বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা 

আমাদের দেশে চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে এ কথা বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রুপগুলির পক্ষ থেকে সাধারণভাবে বলা হচ্ছে। আমাদের বর্তমান আলোচনার সূত্রপাত এখান থেকেই করা যেতে পারে। 

প্রথমেই এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের কয়েকটি পরস্পর সম্পর্কিত বক্তব্য উদ্ধৃত করা দরকার। 

“বিপ্লবের মূলসূত্র যা সমস্ত বিপ্লবের দ্বারা, বিশেষতঃ বিশ শতকের তিনটি রুশ বিপ্লবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো এই : পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন অসম্ভব—শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের এই উপলব্ধি এবং তাকে পরিবর্তনের দাবীই বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। শোষকেরা যাতে পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন ও শাসন করতে না পারে, বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্যে সেটা অবশ্য প্রয়োজনীয়। একমাত্র সেই পরিস্থিতিতেই বিপ্লব জয়লাভ করতে পারে যখন “নিম্ন শ্রেণীরা” পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন করতে চায় না, এবং “উচ্চ শ্রেণীরা” পুরাতন কায়দায় আর চালাতে পারে না। এই সত্যটিকে অন্যভাবেও প্রকাশ করা যায় : একটা জাতীয় সংকট (যা শোষক ও শোষিত উভয়কেই স্পর্শ করে) ব্যতিরেকে বিপ্লব অসম্ভব। এর থেকে এটাই দাঁড়ায় যে, বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য যা অবশ্য প্রয়োজনীয় প্রথমতঃ তা হলো এই যে, মজুরদের মধ্যে অধিকাংশ (বা অন্ততপক্ষে শ্রেণী সচেতন, চিন্তাশীল এবং রাজনীতিগতভাবে সক্রিয় মজুরদের অধিকাংশকে) বিপ্লবের প্রয়োজন পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং তার জন্যে প্রাণ দিতে তাঁদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ শাসক শ্রেণীসমূহকে এমন একটি সরকারী সংকটের মধ্যে পড়তে হবে যা জনগণের সব থেকে পশ্চাৎপদ অংশকেও রাজনীতিতে টেনে আনবে (একটি সত্যিকার বিপ্লবের লক্ষণ হলো এই যে, সে সময়ে এতদিন পর্যন্ত দূরে সরে থাকা সেই মজুর ও নিপীড়িত জনগণের সংখ্যা দ্রুতগতিতে দশ গুণ এমনকি শত গুণ বাড়িয়ে তোলে যারা একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে সক্ষম), সরকারকে দুর্বল করবে এবং বিপ্লবীদের দ্বারা তার দ্রুত উচ্ছেদকে সম্ভব করবে।”[১] 

“শুধুমাত্র অগ্রবাহিনীর দ্বারা বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সমগ্র শ্রেণী, ব্যাপক জনগণ অগ্রবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করার মত অবস্থায় উপনীত হওয়ার পূর্বে অথবা অন্ততপক্ষে তাঁদের প্রতি নিরপেক্ষতা অবলম্বন করার ও শত্রুকে সমর্থন দেওয়ার মত অবস্থায় পৌঁছানোর পূর্বে কেবলমাত্র অগ্রবাহিনীকে চূড়ান্ত সংগ্রামে নিক্ষেপ করাটা যে শুধু বোকামী হবে তাই নয়, তা হবে একটা অপরাধ। সামগ্রিকভাবে কোন শ্রেণীকে, ব্যাপক মেহনতী জনগণকে, পুঁজির দ্বারা যারা নিপীড়িত তাঁদেরকে, সে ধরনের একটা ভূমিকা গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে শুধু প্রচারণা ও বিক্ষোভ সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়। তার জন্য প্রয়োজন জনগণের নিজেদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। … 

“আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের শ্রেণী সচেতন অগ্রবাহিনী অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ, গ্রুপসমূহ ও ধারাসমূহের আশু লক্ষ্য হচ্ছে ব্যাপক জনগণকে (যারা এখনো মোটমুটিভাবে উদাসীন, নিষ্ক্রিয়, সুপ্ত এবং ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ) তাদের নোতুন অবস্থানের দিকে এগিয়ে নেওয়া, অথবা শুধুমাত্র তাদের নিজেদের পার্টিকে নয়, এই জনগণকেও তাদের অগ্রযাত্রা ও নোতুন অবস্থানের দিকে উত্তরণের ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া। প্রথম ঐতিহাসিক লক্ষ্য (সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণীসচেতন অগ্রবাহিনীকে সোভিয়েত শক্তি ও শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের সপক্ষে জয় করা) অর্জন করা সুবিধাবাদ ও সামাজিক-উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ আদর্শগত ও রাজনৈতিক বিজয় ব্যতীত যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি বিপ্লবের অগ্রবাহিনীর বিজয়কে নিশ্চিত করার জন্য নোতুন অবস্থানের দিকে জনগণকে এগিয়ে নেওয়া—এই দ্বিতীয় এবং আশু লক্ষ্য অর্জন বামপন্থী তত্ত্ববাগীশতার উচ্ছেদ ব্যতীত ও তার ভুলভ্রান্তিসমূহ সম্পূর্ণ দূরীকরণ ব্যতীত সম্ভব নয়। 

“যে পর্যন্ত সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রবাহিনীকে কমিউনিজমের সপক্ষে নিয়ে আসার একটি প্রশ্ন ছিল (এবং যা এখনো পর্যন্ত আছে) সে পর্যন্ত প্রচার কার্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে। এই অবস্থায় প্রচার কেন্দ্রগুলির সকল সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁদের একটা প্রয়োজনীয়তা থাকে এবং তার থেকে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু যখন এটা হয়ে দাঁড়ায় জনগণের ব্যবহারিক কাজের প্রশ্ন, একটি বিশেষ সমাজে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক লড়াইয়ের জন্য যাকে বলা যেতে পারে বিরাট বাহিনীসমূহের বিন্যাস এবং সকল শ্রেণীশক্তির শ্রেণীবদ্ধতার প্রশ্ন, তখন শুধুমাত্র প্রচারমূলক পদ্ধতি, “বিশুদ্ধ” কমিউনিজমের সত্যগুলির কেবল পুনরাবৃত্তির দ্বারা কোন কাজই হয় না। এই পরিস্থিতিতে যারা এখনো পর্যন্ত জনগণকে কোন নেতৃত্ব দেয়নি এমন একটি ছোট গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত প্রচারকের মতো হাজার হিসেবে গণনা করলে চলবে না। এই পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি হিসেবে গণনা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে আমাদের নিশ্চয় জিজ্ঞেস করা উচিত যে, আমরা শুধু বিপ্লবী শ্রেণীর অগ্রবাহিনীর মধ্যে একটা দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছি, না তার সাথে সকল শ্রেণীর ব্যতিক্রমহীনভাবে ও নিশ্চিতভাবে যে কোন বিশেষ সমাজের সকল শ্রেণীর ঐতিহাসিকভাবে কার্যকর শক্তিসমূহকে এমনভাবে সুবিন্যস্ত করেছি যাতে চূড়ান্ত লড়াই হাতের কাছে এসে গেছে, এমনভাবে এসে গেছে যাতে করে : (১) আমাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত শ্রেণীশক্তি আছে সেগুলি যথেষ্টভাবে নিজেদের মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলেছে, পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছে এবং নিজেদেরকে যথেষ্টভাবে দুর্বল করে দিয়েছে এমন এক সংগ্রামের ক্ষেত্রে, যার মোকাবেলা করা তাদের ক্ষমতার বাইরে; (২) বুর্জোয়াজীর থেকে স্বতন্ত্র পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মতো সকল দোদুল্যমান এবং অদৃঢ় মধ্যবর্তী লোকজনেরা নিজেদের চেহারা জনগণের কাছে যথেষ্ট অনাবৃত করেছে, বাস্তব কর্মক্ষেত্রে দেউলিয়াপনার মাধ্যমে নিজেদের যথেষ্ট মর্যাদাহানী ঘটিয়েছে; এবং (৩) সর্বহারাদের মধ্যে বুর্জোয়াজীর বিরুদ্ধে কঠিন সংকল্পবদ্ধ, সাহসী ও একনিষ্ঠ বিপ্লবী সংগ্রামের সপক্ষে জনগণের একটা সেন্টিমেন্ট দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। তখন সত্যিসত্যিই বিপ্লব একটা পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, সত্যিসত্যি তখন যদি আমরা উপরে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত শর্তগুলি সঠিকভাবে পরিমাপ করে থাকি এবং যদি আমরা সঠিক মুহূর্তটিকে নির্ধারণ করতে পারি তাহলে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।”[২]

বিপ্লব ও বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিন এখানে যে সব কথা বলছেন, যে সব শর্তের কথা তিনি উল্লেখ করছেন, সেগুলি যে শুধুমাত্র রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল তাই নয়। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলছেন যে, এই সমস্ত শর্তগুলি যে কোন সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই শর্তগুলি পূরণ না হলে কোন সমাজেই বিপ্লব একটা পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় না, এগুলি পূরণ না হলে কোন সমাজের ক্ষেত্রেই একথা বলা চলে না যে, সেখানে চরম বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে অথবা বিপ্লব হাতের কাছে এসে গেছে। 

কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে এই ধরনের বিভ্রান্তি আজ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। শুধুই আজই নয়। এই বিভ্রান্তি ১৯৪৮ সাল থেকেই বস্তুতঃপক্ষে কোন না কোন প্রকারে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঘাড়ে চেপে আছে। দেশীয় পরিস্থিতির মার্কসবাদসম্মত বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার মধ্যে না গিয়ে, শ্রেণীসমূহের বিন্যাসের দিকে না তাকিয়ে এবং শ্রমিক কৃষকের রাজনৈতিক চেতনা ও সংঘশক্তির উপযুক্ত হিসেব না করে, বছরের পর বছর শুধু তোতা পাখির মতো আবৃত্তি করা হচ্ছে যে, এদেশে চরম বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজমান। এই ভ্রান্তিপূর্ণ বক্তব্য যে প্রকৃতপক্ষে এদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা দুস্তর বাধা একথা বলাই বাহুল্য। কারণ এই বক্তব্যের দ্বারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে আবহাওয়ায় বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য লেনিন কর্তৃক বর্ণিত উপরোক্ত শর্তগুলি পূরণের জন্যে কোন চেষ্টা বাদ দিয়ে শ্রেণী শত্রুদের বিরুদ্ধে ‘চরম আঘাত’ হানার চিন্তাতেই সকলে মশগুল হয়ে আছে। এই ধরনের চিন্তা যারা করেন তাঁদের সম্পর্কে এঙ্গেলসের বক্তব্য : “নিজেদের অধৈর্যকে একটি তত্ত্বগত যুক্তি হিসেবে উপস্থিত করার কী এক শিশুসুলভ সরলতা।”৩ 

লেনিনের বক্তব্য অনুযায়ী বিপ্লবী পরিস্থিতির জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি হলো : 

ক. ‘নিম্ন শ্রেণীভুক্ত নিপীড়িত জনগণ আর পুরাতন কায়দায় জীবন-যাপন অসম্ভব মনে করবে। 

খ. ‘উচ্চ শ্রেণীভুক্ত’ শোষকেরা আর পুরাতন কায়দায় তাদের শাসন চালাতে সক্ষম হবে না।

গ. সুবিধাবাদ ও সামাজিক-উগ্রস্বাদেশিকতাকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি, গ্রুপ এবং ধারাসমূহকে আদর্শগতভাবে প্রস্তুত হতে হবে। 

ঘ. শ্রমিক শ্রেণীর এই অগ্রবাহিনীর সমর্থনে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী ও ব্যাপক জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। 

ঙ. জনগণকে এই নোতুন অবস্থানে টেনে আনার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বামপন্থী তত্ত্ববাগীশতা এবং তার ভুলত্রুটিসমূহকে নির্মূল ও দূরীভূত করতে হবে। 

চ. তোতা পাখির মতো করে আবৃত্তি ও পুনরাবৃত্তি করা ‘বিশুদ্ধ’ কমিউনিজমের সত্যসমূহকে শুনে শুধু নয়, নিজেদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে বিপ্লব প্রয়োজন কেন এবং কেন তাঁরা বিপ্লবের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনীকে সমর্থন করবেন। 

ছ. বিপ্লবের বিরুদ্ধে যে সামাজিক শক্তিসমূহ আছে সেই প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের নিজেদের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে যা কোন মীমাংসার পথ থাকবে না এবং যার ফলে তারা নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়বে। 

জ. বুর্জোয়াজী ছাড়াও সমস্ত দোদুল্যমান এবং অদৃঢ় পেটি-বুর্জোয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহ নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার মাধ্যমে জনগণের চোখে যথেষ্ট পরিমাণে উলঙ্গ, খেলো এবং মর্যাদাহীন হয়ে পড়বে। 

ঝ. ব্যাপক সর্বহারা শ্রেণীর মধ্যে দৃঢ় সাহসী এবং একনিষ্ঠ বিপ্লবী সংগ্রামের একটা চেতনার দ্রুত বিকাশ ও বৃদ্ধি ঘটবে। 

উপরোক্ত উপাদানগুলি বিদ্যমান থাকলেই লেনিনের মতানুযায়ী বলা যাবে যে, কোন একটি বিশেষ সমাজে বিপ্লবী পরিস্থিতি পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়েছে অর্থাৎ সেই সমাজে ‘চরম বিপ্লবী পরিস্থিতি’ বিরাজ করছে। 

কিন্তু বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এখানেও শেষ হয় নাই। তিনি বলছেন যে, উপরোক্ত শর্তগুলি পূরণ হওয়ার ফলে যে বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে সেই পরিস্থিতিতে সামগ্রিক অবস্থাকে যথাযথভাবে পরিমাপ করে চূড়ান্ত সংগ্রামের সঠিক মুহূর্তটি যদি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় একমাত্র তাহলেই সাফল্য অর্জিত হবে, অর্থাৎ বিপ্লব ঘটবে, অন্যথায় নয়। বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের এই বক্তব্যসমূহের প্রতি, তাঁর নির্দেশিত শর্তসমূহের প্রতি যদি আমরা লক্ষ্যপাত করি এবং সেই বক্তব্য ও শর্তসমূহের আলোকে বাঙলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে যাচাই করি তাহলে আমরা কী দেখবো? যা দেখবো তা হচ্ছে এই যে, বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী শর্তগুলির মধ্যে কয়েকটি কিছু পরিমাণে উপস্থিত থাকলেও অনেকগুলি শর্ত পূরণ হতে বাকী থাকছে এবং কোন শর্তটিই পরিপূর্ণভাবে পূরণ হচ্ছে না। 

বাঙলাদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু এই কথাই বলা চলে যে (ক), (খ), (ছ) এবং (জ) আংশিকভাবে বিদ্যমান আছে। অর্থাৎ নিপীড়িত জনগণ পুরাতন কায়দায় জীবনযাপন সম্পূর্ণ অসম্ভব মনে না করলেও সেই কায়দা যে ক্রমশঃ অচল হয়ে উঠছে তা কিছু পরিমাণ উপলব্ধি করছেন; বাঙলাদেশের শোষক শ্রেণীসমূহ তাদের পরিচিত ও পুরাতন কায়দায় শাসন করতে একেবারে অক্ষম না হলেও সেই কায়দার অকার্যকারিতা দ্রুত উপলব্ধি করছে এবং দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নানা ভুলভ্রান্তির ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদেরকে ক্রমশঃ দুর্বল করছে; শোষক শ্রেণীভুক্ত প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের অন্তর্দ্বন্দ্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে; এবং পেটি-বুর্জোয়া শক্তিসমূহ নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার মাধ্যমে জনগণের সামনে নিজেদেরকে যথেষ্ট না হলেও ক্রমশঃ খেলো এবং মর্যাদাহীন করে ফেলছে। 

এই উপাদানগুলি আংশিকভাবে বিদ্যমান থাকলেও অন্যগুলির অস্তিত্ব এত ক্ষ.1 অথবা সেগুলি এমনভাবে অনুপস্থিত যে তার ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির চরিত্র সত্য অর্থে বিপ্লবী না হয়ে অন্য রকম দাঁড়ায়। এবং যা দাঁড়ায় তাকে বিপ্লবী পরিস্থিতি না বলে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি বলা অধিকতর সঠিক ও সঙ্গত। 

এর কারণ বাঙলাদেশে এখন এমন কোন কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না যারা সুবিধাবাদ ও সামাজিক-উগ্র স্বাদেশিকতাকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী হিসেবে আদর্শগতভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছে; শ্রমিক শ্রেণীর এই অগ্রবাহিনীর সমর্থনে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী ও ব্যাপক জনগণ মোটেই এগিয়ে আসেনি; জনগণকে এইভাবে টেনে আনার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টি অথবা গ্রুপগুলির মধ্যে বামপন্থী তত্ত্ববাগীশতা এবং ভুলত্রুটিগুলি নির্মূল ও সংশোধিত হয়নি; নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনগণ এখনো পর্যন্ত যথাযথভাবে উপলব্ধি করছেন না বিপ্লব প্রয়োজন কেন এবং কেন তারা বিপ্লবের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনীকে সমর্থন করবেন; এবং ব্যাপক সর্বহারা শ্রেণীর মধ্যে এখনো পর্যন্ত দৃঢ়, সাহসী ও একনিষ্ঠ বিপ্লবী সংগ্রামের কোন চেতনা দ্রুত বিকাশ লাভ করছে না, যদিও শ্রমিক শ্রেণীর একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে এই চেতনার কিছুটা বিকাশ ইতিমধ্যে ঘটেছে। 

৪ 

বিপ্লবী পরিস্থিতি, বিশেষত ‘চরম’ অথবা ‘চমৎকার’ বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের দ্বারা উল্লিখিত শর্তগুলি পূর্ণ না হলে সে ধরনের কোন পরিস্থিতি আদৌ সৃষ্টি হয় না। কারণ বিপ্লব হচ্ছে সমাজের একটা গুণগত পরিবর্তন। এই গুণগত পরিবর্তন দ্বন্দ্ববাদের অমোঘ নিয়মানুযায়ী সমাজ দেহে ঘটে থাকে। 

কিন্তু এই গুণগত পরিবর্তন বলতে কি বোঝায় এবং তা ঘটে কীভাবে? এর জবাব হচ্ছে : পরিমাণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে। মূল্যের পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়ে কীভাবে পুঁজির সৃষ্টি করে সে কথা বলতে গিয়ে মার্কস ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডে বলেছেন, ‘একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে উত্তীর্ণ হয়ে শুধু পরিমাণগত পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়—হেগেলের দ্বারা (তার লজিকে) আবিষ্কৃত এই সূত্রের সত্যতা প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতো এখানেও প্রমাণিত হচ্ছে।’ 

দ্বন্দ্ববাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস Anti-Duhring-এ পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হওয়ার অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। তার এই উদাহরণসমূহ প্রকৃতি ও ইতিহাস দুই ক্ষেত্র থেকেই নেওয়া। 

হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশ্রিত হয়ে নির্দিষ্ট চাপ ও তাপের সমন্বয়ে পানিতে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে সৃষ্ট নোতুন রাসায়নিক বস্তুটির অর্থাৎ পানির মধ্যে এমন কতকগুলি বিশেষ ও নোতুন গুণের আবির্ভাব হয় যা তার মৌলিক উপাদান হাইড্রোজেন অথবা অক্সিজেনের মধ্যে থাকে না। এ জন্যে এই পরিবর্তনকে বলা হয় গুণগত পরিবর্তন। 

কিন্তু এখানে যে জিনিসটি মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে এই যে, এই গুণগত পরিবর্তন ঘটে একমাত্র তখনই যখন মৌলিক উপাদানগুলি (এ ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন) একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ চাপ ও তাপের মধ্যে মিশ্রিত হয়। প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির প্রত্যেকটি যদি নির্দিষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান না থাকে তাহলে তার দ্বারা কোনো গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি হয় না। পানির উদাহরণটিকেই যদি ধরা হয় তাহলে বলা যাবে যে, হাইড্রোজেন অথবা অক্সিজেনের যে কোনটির পরিমাণ যদি সঠিক না হয় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ চাপ ও তাপের মধ্যে যে কোন একটিও যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে পানির সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ পানি সৃষ্টি হয় তখনই যখন নির্দিষ্ট পরিমাণ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, চাপ ও তাপের সমন্বয়ে পানি সৃষ্টির উপযোগী একটা সামগ্রিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। 

পূর্বেই বলেছি যে, সমাজের ইতিহাসে বিপ্লব একটি গুণগত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনও পরিমাণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘটে থাকে। বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেমন ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তেমনি। প্রয়োজনীয় শর্তগুলির প্রত্যেকটি যদি বিদ্যমান না থাকে অর্থাৎ সেগুলি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যমান থেকে সামগ্রিকভাবে একটা বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি যদি না করে তাহলে বিপ্লবী পরিস্থিতির উদ্ভব হয় না এবং বিপ্লবও ঘটে না। 

এতক্ষণ আমরা বিপ্লবী পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ শর্তসমূহ আলোচনা করলাম। কিন্তু এই পর্যায়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। এবং সে বিষয়টি হলো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। স্ট্যালিন তার ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’ নামক পুস্তকে লেনিনের বিপ্লবতত্ত্ব সম্পর্কে বলছেন, ‘পূর্বে কোন একটি বিশেষ দেশের সর্বহারা বিপ্লবকে সেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিকাশের ফল হিসাবে মনে করা হতো। এখন এই দৃষ্টিভঙ্গি আর যথেষ্ট নয়। এখন সর্বহারা বিপ্লবকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার দ্বন্দ্বসমূহের বিকাশের পরিণতি হিসেবে, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ফ্রন্টের শৃঙ্খল এক অথবা অন্য দেশে চূর্ণ হওয়ার পরিণতি হিসেবেই, মূলত বিচার করতে হবে।” স্ট্যালিন কর্তৃক বর্ণিত লেনিনের এই বক্তব্যের অর্থ কি? 

এর অর্থ আমাদেরকে ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কারণ এই বোঝার ক্ষেত্রে যদি কোন অসাবধনতা অথবা গাফিলতি থাকে তাহলে সর্বহারা বিপ্লব অথবা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব যাই হোক, তার সাফল্যের ক্ষেত্রে তা হয়ে দাঁড়াবে এক দূরতিক্রম্য প্রতিবন্ধক। 

প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল চূর্ণ হওয়া সংক্রান্ত লেনিনের এই বক্তব্য ভালভাবে না বোঝার ফলে অনেকের মধ্যেই তা এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। সে বিভ্রান্তিটি হলো এই যে, দেশীয় পরিস্থিতির তুলনায় বিশ্ব পরিস্থিতির ওপরই আমাদের বেশি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াব্যাপী যে শোষণ চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে একটা সাধারণ সংগ্রাম করা উচিত, কারণ তার ফলেই দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল একের পর এক চূর্ণ হবে এবং বিপ্লব ঘটবে। 

এই চিন্তা মারাত্মক। এবং লেনিন অথবা স্ট্যালিন কেউই বিপ্লব তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে এ ধরনের কথা বলেননি। তাঁরা যা বলেছেন তার মূল অর্থ হলো কোন একটি দেশের বিপ্লবকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের সামগ্রিক শোষণব্যবস্থা এবং তার আওতা বহির্ভূত বিষয় বলে বিবেচনা করা চলবে না। যে কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক অথবা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার না হওয়ার ফলেই তা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের ওপর আঘাত স্বরূপ এবং সেই হিসেবে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ কোন বিপ্লবের ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা আর পালন করতে পারে না। তাঁরা বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহকে সাহায্য করতে এবং এমনকি সরাসরি এক একটি বিশেষ দেশের বিপ্লবের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দ্বিধাবোধ করে না, যেমনটি তাঁরা করেনি কোরিয়া অথবা ইন্দোচীনের দেশগুলির বিরুদ্ধে। কিন্তু এক্ষেত্রে যা মনে রাখা দরকার তা হলো এই যে, সাম্রাজ্যবাদকে কোন একটি দেশের শ্রমিক শ্রেণী, তাদের অগ্রবাহিনী এবং ব্যাপক জনগণ যদি আঘাত হানতে চান, তাহলে সে আঘাত মূলতঃ তাদেরকে নিজেদের দেশের মাটিতেই হানতে হবে যেভাবে রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের জনগণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছেন। এই আঘাত হানার জন্যে তারা ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তাদের সাথে লড়াই করেননি, তাদের আকাশসীমা লংঘন করে তাদের কলকারখানা, শস্য ক্ষেত্রে ও বাণিজ্য- প্রতিষ্ঠানের উপর বোমা নিক্ষেপ করেননি। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল যেখানে দুর্বলতম সেখানেই বিপ্লব ঘটবে এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, সেখানে বিপ্লব আপনা থেকেই ঘটে যাবে। মোটেই তা নয়। উপরন্তু এর উল্টোটাই সত্য। সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলকে কোন দেশে দুর্বল করে দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব সেই বিশেষ দেশের শ্রমিক শ্রেণীর, তাদের অগ্রবাহিনীর অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির এবং কৃষক ও মধ্যবিত্ত ব্যাপক শোষিত জনগণের। এই দায়িত্ব তারা পালন করতে পারেন একমাত্র একটি পথে; এবং সে পথটি হলো লেনিন কর্তৃক বর্ণিত উপরোল্লিখিত শর্তগুলি পূরণ করে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান অবস্থানের জন্যে, যে কোন দেশে বিপ্লবের ওপর তার ঝাঁপিয়ে পড়ার বাস্তব সম্ভাবনার জন্যে, বিপ্লবী পরিস্থিতিকে তৈরী করার ক্ষেত্রে বিপ্লবীদের দায়িত্ব অপরিসীম। এই দায়িত্ব পালন করতে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে না গিয়ে কেউ যদি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল আপনা আপনি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের দেশে চূর্ণ হওয়ার সুখস্বপ্ন দেখেন তাহলে তাঁকে খুব নাবালক কমিউনিস্টই বলতে হবে। 

১৯১৫ সালে চিরস্থায়ী বিপ্লবের তাত্ত্বিক ‘চিরস্থায়ীবাদীদেরকে’ ব্যঙ্গ করে লেনিন বলেছিলেন, “চিন্তা কর, দশ বছর ধরে এই চমৎকার তত্ত্ব কেন জীবনকে পাশ কাটিয়ে গেছে।’৫ আমাদের দেশের বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে যারা মন্ত্র উচ্চারণের মতো বুলি আউড়িয়ে বলেন, “বিপ্লবী পরিস্থিতি চমৎকার’ অথবা ‘চরম বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজমান” তাঁদেরকে লেনিনের ভাষাতেই বলা উচিত, “আপনারা চিন্তা করুন, কেন ১৯৪৮ সাল থেকে বিগত ২৪ বছর ধরে চমৎকার ও চরম বিপ্লবী পরিস্থিতির এই তত্ত্ব এদেশের জীবনকে পাশ কাটিয়ে গেছে।” 

আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতার কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় বলা হয় যে, আমাদের দেশে বিপ্লবের অবজেকটিভ শর্তগুলি পূর্ণ হয়েছে কিন্তু সাবজেকটিভ শর্তগুলি পূর্ণ হয়নি, এজন্যেই বিপ্লব এদেশে এখনো ঘটছে না। এইভাবে প্রশ্নটিকে উত্থাপন ও বিচার করা ঠিক নয়। 

তত্ত্বগত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ শর্তগুলিকে এইভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা বিজ্ঞান ও দ্বন্দ্ববাদ এই দুইয়েরই বিরোধী। কারণ যে কোন বিশেষ সমাজে এই দুই ধরনের শর্তসমূহ একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিকাশ লাভ করে না। অবজেকটিভ শর্তগুলিও পূরণ হওয়া যথাযথভাবে সম্ভব হয় না। অর্থাৎ সমগ্র সমাজের দ্বান্দ্বিক বিকাশ এই দুই ধরনের শর্তগুলির কোন একটির বিকাশকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। 

শ্রমিক শ্রেণীর চেতনার বিকাশ ও সচেতনভাবে বিপ্লব করার আদর্শগত প্রস্তুতি এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনগণের সচেতন সমর্থনকে যদি একটা সাবজেকটিভ শর্ত হিসেবে ধরা যায় এবং জনগণ থেকে শোষক শ্রেণীর বিচ্ছিন্নতা ও পুরানো কায়দায় শাসন চালানোর ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাকে যদি একটা অবজেকটিভ শর্ত হিসাবে ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, প্রথম ধরনের শর্ত পূরণের ওপর দ্বিতীয় ধরনের শর্ত পূরণ নির্ভরশীল থাকছে। কারণ শ্রমিক শ্রেণী, তাদের অগ্রবাহিনী ও ব্যাপক জনগণের চেতনা যদি উপযুক্তভাবে বিকশিত না হয়, তাহলে শোষক শ্রেণীর সংকট যত তীব্রই হোক না কেন, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব যত প্রবলই হোক না কেন, এবং পুরাতন কায়দায় শাসন চালাতে তাদের যত অসুবিধাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা সঙ্কট উত্তীর্ণ হবে, অন্তর্দ্বন্দ্বের একটা সাময়িক মীমাংসা করতে তারা সমর্থ হবে এবং হাজার অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও তাঁরা নিজেদের শাসনকে কায়েম রাখবে। কাজেই সেক্ষেত্রে সাবজেকটিভ শর্তগুলির অবর্তমানে অবজেকটিভ শর্তসমূহ পূরণ হয়েছে একথা বলা ঠিক হবে না, তা বললে বিপ্লবের ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল করা হবে। 

সাবজেকটিভ এবং অবজেকটিভ শর্ত যে পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, এমনকি একের থেকে আর একটির উদ্ভব, তার একটা নির্দিষ্ট উদাহরণ হচ্ছে যে কোন সমাজে একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব। শ্রমিক শ্রেণীর, বিশেষতঃ তার অগ্রবাহিনীর চেতনা বিশেষভাবে বিকশিত না হলে এবং আদর্শগত বিজয়ের মাধ্যমে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ ও বিচ্যুতি এবং বামপন্থী তত্ত্ববাগীশতা, হঠকারিতা ইত্যাদিকে পরাজিত না করলে কোন সঠিক পার্টির জন্ম ও বিকাশ কোন বিশেষ সমাজে হতে পারে না। কিন্তু এইভাবে সৃষ্ট ও গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি আবার অবজেকটিভ শর্তেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এবং এই শর্ত পূরণ যে কোন বিপ্লবের সাফল্যের ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এক অনিবার্য শর্ত। 

কাজেই কোন বিশেষ সমাজের বিকাশ যেমন সামগ্রিকভাবে হয়, তেমনি সামগ্রিকভাবেই পরিস্থিতিকে বিচার ও বিশ্লেষণ করতে হবে। এভাবে পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ তত্ত্বগতভাবে না করলে রণনীতি, কৌশল ও কর্মসূচীর ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি অবধারিত। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এই ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির উদাহরণে পরিপূর্ণ এবং প্লাবিত। 

আমাদের দেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি, অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনীর নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্তের ক্ষমতা দখলের মতো পরিস্থিতি সম্পর্কে ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এদেশের বিপ্লবী পরিস্থিতি এখনো পর্যন্ত পরিণত ও পরিপক্ক হয়নি। শুধু তাই নয়। যে কোন বিশেষ সমাজে বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতার জন্যে যে শর্তসমূহ নিশ্চিতভাবে পূরণ হওয়া দরকার সেগুলি পূরণ হতে এখনো অনেক বাকী। বস্তুতপক্ষে আদর্শগত ও সংগঠনগত দিক দিয়ে বাঙলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী, তাদের অগ্রবাহিনী এবং ব্যাপক জনগণ এখনো পর্যন্ত যে স্তরে অবস্থান করছেন সে স্তরে তারা অবস্থান করা পর্যন্ত এ দেশে ‘চমৎকার’ বিপ্লবী পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে এ কথা বলা চলে না। 

এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে (যাকে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে বিচার করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অথবা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আখ্যা দেওয়া চলে) বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অতীতে কি ছিলো, বর্তমানে কি রয়েছে এবং বিপ্লবের সাফল্যের জন্যে তা কীরূপ হওয়া উচিত, সেটা নির্ণয় ও নির্ধারণ করা দরকার। 

‘বিপুল সংখ্যায় বুদ্ধিজীবীদেরকে দলভুক্ত কর’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মাও সেতুঙ বিপ্লবী আদর্শের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে ঔপনিবেশিক এবং আধা- ঔপনিবেশিক দেশগুলির বুদ্ধিজীবী ও পুঁজিবাদী দেশগুলির বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এই পার্থক্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলে বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব উপলব্ধি এবং তাঁদের সম্পর্কে সঠিক নীতিনির্ধারণও যে সম্ভব নয়, তা বলছেন। একথা বলাই বাহুল্য যে, ইংরেজ শাসিত ভারত অথবা বিপ্লব-পূর্ব চীনের মতো ঔপনিবেশিক এবং আধা-ঔপনিবেশিক দেশের ক্ষেত্রেই যে শুধু মাও-এর এই বক্তব্য প্রযোজ্য তাই নয়। এই বক্তব্য বর্তমান এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নয়া- ঔপনিবেশিক দেশগুলির ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ এই সব দেশের বিপ্লবের ক্ষেত্রেও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বিপ্লবের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র এবং অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বের অর্থ কি? 

পুঁজিবাদী দেশের বুদ্ধিজীবীদের থেকে ঔপনিবেশিক, আধা-ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশগুলির বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র অনেকাংশে স্বতন্ত্র, তার কারণ এ ধরনের দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদীরা নানাভাবে, নানা কৌশলের মাধ্যমে, জাতীয় নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায় এবং তার আঘাত বুদ্ধিজীবীদের ওপরও এসে পড়ে। এই ধরনের জাতীয় নিপীড়ন যে বিশেষ সমাজে থাকে সেখানে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী অর্থনীতি এবং ঐতিহ্য-জর্জরিত সংস্কৃতিকে সাম্রাজ্যবাদীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও তার সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা রপ্তানীকৃত এক ধরনের দুষ্ট অপসংস্কৃতি যুক্ত হয়ে জনগণের এবং সেই সাথে বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে বন্ধ্যাত্ব এবং পঙ্কিলতার গহ্বরে নিক্ষেপ করে। একথা ঠিক যে, এই ধরনের সমাজে বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ দেশীয় শোষক শ্রেণী ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে আপোস করে তাদের শোষণলব্ধ মুনাফা ও ফায়দার ছিটেফোঁটার অংশীদার হয়। কিন্তু একথাও আবার সত্যি যে, বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ শেষ পর্যন্ত এই ভূমিকা পালন করে না, উপরন্তু তারা নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থকে শ্রমিক কৃষকদের স্বার্থের সাথে অনেক বেশী একাত্ম করে দেখে অথবা দেখার জন্যে প্রস্তুত থাকে। পুঁজিবাদী দেশগুলির বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক অবস্থান ঔপনিবেশিক আধা- ঔপনিবেশিক অথবা নয়া ঔপনিবেশিক দেশসমূহের বুদ্ধিজীবীদের একটা স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্য ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হয়। এজন্যে সামগ্রিকভাবে প্রথমোক্ত দেশগুলির বুদ্ধিজীবীরা বুর্জোয়া স্বার্থের যতখানি পায়রবী করে ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের যতখানি বিরোধিতা করে, শেষোক্ত দেশের বুদ্ধিজীবীরা মোটেই ততখানি করে না। সামগ্রিকভাবে এই শেষোক্ত বুদ্ধিজীবীরা অনেক বেশী দোটানার মধ্যে থাকেন এবং সেই জন্যেই তাদেরকে জয় করার জন্যে ঔপনিবেশিক, আধা- ঔপনিবেশিক এবং নয়া-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীসমূহের একটা রেষারেষি ও টানাটানি বিপ্লবের মুহূর্ত পর্যন্ত, এমন কি বিপ্লবের বিজয়ের পরও অব্যাহত থাকে। 

চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে ১৯৩৯ সালে ‘৪ঠা মে আন্দোলন’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মাও সেতুঙ বলছেন, 

“চীনা গণতান্ত্রিক বৈপ্লবিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই সর্বপ্রথম জাগরণ আসে। ১৯১১- এর বিপ্লব ও ৪ঠা মে আন্দোলন উভয় ক্ষেত্রেই এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এবং ১৯১১-এর বিপ্লবের থেকে ৪ঠা মে আন্দোলনের দিনগুলিতে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সংখ্যায় অনেক বেশী সচেতন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা কিছু অর্জন করতে সক্ষম হবেন না, যদি তাঁরা শ্রমিক ও কৃষকদের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করতে ব্যর্থ হন। তাঁরা শ্রমিক ও কৃষকদের সাথে একাত্ম হতে চান কি না এবং বাস্তব ক্ষেত্রে হন কি না, সেটাই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের এবং অবিপ্লবী অথবা প্রতিবিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যের একটা সীমারেখা। শেষ পর্যন্ত একমাত্র এটাই একের থেকে অন্যের পার্থক্য নির্দেশ করে, তিনটি জনগণের নীতি অথবা মার্কসবাদের উপর বিশ্বাস ঘোষণা নয়, একজন সত্যিকার বিপ্লবী হচ্ছেন তিনি যিনি শ্রমিক ও কৃষকদের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে চান এবং বাস্তব ক্ষেত্রে তা করেন।” 

ঐ একই প্রবন্ধে তিনি আরও বলছেন, 

“গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও প্রতিরোধ যুদ্ধে সারাদেশের যুবসমাজ ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলির গুরুতর দায়িত্ব আছে। আমি আশা করি তাঁরা চীনা বিপ্লবের চরিত্র এবং চালিকা শক্তিসমূহ উপলব্ধি করবেন, নিজেদের কাজকে শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থে নিয়োজিত রাখবেন, তাঁদের মধ্যে যাবেন এবং গিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রচারক ও সংগঠক হিসেবে কাজ করবেন।” 

মাও-এর এই বক্তব্য এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তার এই আহ্বান থেকে এবং পরবর্তী পর্যায়ের চীনা বিপ্লবের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবীদের পালিত ভূমিকা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় সামন্তবাদের অবশেষসমূহ, মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত চীনের মতো একটি দেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা প্রকৃতপক্ষে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এদিক দিয়ে চীন যে একটি ব্যতিক্রম নয় বা হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। 

১০ 

পুঁজিবাদী দেশের বুদ্ধিজীবীদের সাথে নয়া-ঔপনিবেশিক দেশের বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য তাদের উভয়ের ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবস্থানের মধ্যে নিহিত থাকলেও বিপ্লবের ক্ষেত্রে শেষোক্ত বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীসমূহের প্রতিও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে এই সমস্ত শ্রেণীর বিশেষ অবস্থান, তাদের সংস্কৃতি, শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক মান ইত্যাদি বিবেচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। 

উন্নত পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে শ্রমিক শ্রেণী নিরক্ষর তো থাকেই না, উপরন্তু সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে তারা অনেকখানি এগিয়ে থাকে। তাছাড়া ইংল্যাণ্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানী ইত্যাদির মতো দেশগুলিতে কৃষক সমাজ বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। কাজেই বিপুলসংখ্যক অশিক্ষিত শ্রমিক অথবা পুরোপুরি অশিক্ষিত একটা কৃষক সমাজের অস্তিত্ব এই ধরনের পুঁজিবাদী দেশে নেই। শিল্প ও কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকেরা সেখানে শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় তুলনায় অনেক অগ্রসর। এ কারণে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা সেখানে অন্য রকম। সাধারণতঃ সেখানে সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্গত এই বুদ্ধিজীবীরা বিপ্লবের সহায়ক শক্তি হিসেবে অবস্থান করে না। উপরন্তু তাদের অধিকাংশই থাকে প্রতিবিপ্লবী শিবিরে; বিপ্লবকে তারা ভয় করে, এবং খুবই অল্পসংখ্যক ব্যতিরেকে প্রায় সামগ্রিকভাবেই তারা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ ও সর্বহারা বিপ্লবের বিরোধিতার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সক্রিয় থাকে। 

ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ কবলিত দেশগুলির অবস্থা এদিক দিয়ে অনেক স্বতন্ত্র। সেখানে শিল্প শ্রমিকদের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম থাকে এবং শিক্ষাদীক্ষায়ও তারা থাকে অনেক পশ্চাৎপদ। শুধু তাই নয়। তাদের মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তির অক্ষর পরিচয় পর্যন্ত থাকে না। এই শ্রমিক শ্রেণী ছাড়া সেখানে থাকে এক বিশাল কৃষকসমাজ। এই কৃষকদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনের অক্ষর পরিচয় থাকলেও তাঁরা প্রায় সকলেই নিরক্ষর। তাদের সাংস্কৃতিক মান যে শুধু নিম্ন তাই নয়, তারা সামন্ত ঐতিহ্যজাত কুসংস্কারের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এই কারণে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শিল্প ও কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের দেখা পাওয়া গেলেও এই ধরনের দেশে শিল্প, বিশেষত কৃষিকার্যে রত মেহনতী মানুষদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীর দেখা পাওয়ার তেমন প্রশ্ন ওঠে না। 

এ কারণেই ‘বিপুল সংখ্যায় বুদ্ধিজীবীদেরকে দলভুক্ত কর’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে মাও বলছেন, “উপস্থিত যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন তাঁদের সাহায্য ব্যতিরেকে সর্বহারা শ্রেণী বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি করতে পারে না।’ এই বিশেষ ধরনের সমাজে বুদ্ধিজীবীদের এই ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্যেই তিনি ঐ প্রবন্ধেই বলছেন, ‘আমাদের সকল পার্টি কমরেডদের বুঝতে হবে যে, বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে একটা সঠিক নীতি বিপ্লবী বিজয় অর্জনের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব-শর্ত।’ 

১১

বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে কি বুদ্ধিজীবীরা আসেননি? তাঁরা কি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি? তাঁরা কি শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজ করেননি? 

এখানে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হলো এই যে, শুধু বাঙলাদেশের নয়, সারা ভারতীয় উপমহাদেশের (দক্ষিণ এশিয়ার) কমিউনিস্ট আন্দোলনে এ পর্যন্ত প্রধানতঃ বুদ্ধিজীবীরাই এসেছেন, তাঁরাই কমিউনিস্ট পার্টিতে সব থেকে বেশী সংখ্যায় যোগ দিয়েছেন এবং শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজও তাঁরা করেছেন। অর্থাৎ সংখ্যানুপাতের দিক থেকে এই সমগ্ৰ অঞ্চলের কমিউনিস্ট আন্দোলনে অন্যান্য শ্রেণীর তুলনায় বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বুদ্ধিজীবীদের পাল্লাই বরাবর ভারী থেকেছে এবং এখনো আছে। 

প্রাথমিক পর্যায়ে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনার যুগে, শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের বাইরে থেকে আগত বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্য যে কোন সমাজে এবং যে কোন দেশের বিপ্লবের ইতিহাসে দেখা যায়। এদিক দিয়ে রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস ইত্যাদি কোন দেশই ব্যতিক্রম নয়। এই সার্বজনীন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার কারণ শ্রমিক শ্ৰেণী ও কৃষক সমাজ বিপ্লবের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পূর্বে যে সাংস্কৃতিক স্তরে থাকে সেই স্তরে অবস্থান করে তারা নিজেরা বুদ্ধিজীবীদের জন্মদান করতে পারে না, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাতের জন্যে যে আদর্শগত প্রস্তুতি দরকার সে প্রস্তুতির পর্যায়ে উপস্থিত হওয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না। তার জন্যে প্রয়োজন হয় অন্যান্য শ্রেণী থেকে আগত সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের যারা শিক্ষা সংস্কৃতির দিক দিয়ে অগ্রসর এবং বিপ্লবী অর্থাৎ নিজেদের শ্রেণীস্বার্থকে উপেক্ষা করে ও তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চান। 

 এদিক দিয়ে বাঙলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের অথবা রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদির কোন তফাৎ নেই। অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়মে প্রত্যেকটি দেশেই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। 

রাশিয়া তো বটেই, এমনকি চীন ভিয়েতনামের মতো যে সমস্ত দেশে ভারতের প্রায় সমসাময়িক সময়েই কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছে সেই সমস্ত দেশের অবস্থার সাথে আমাদের এই সমগ্র অঞ্চলের অবস্থার তফাৎটা তাহলে আসলে কোথায়? তফাৎটা হচ্ছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশের ক্ষেত্রে, শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের বাইরে থেকে আগত বুদ্ধিজীবীরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে এসে তার মধ্যে যে ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং এখনো পালন করছেন তার মধ্যে। 

১২ 

বুদ্ধিজীবী মাত্রই কমিউনিস্ট নন, কিন্তু কমিউনিস্ট মাত্রই বুদ্ধিজীবী। কোন ব্যক্তি কমিউনিস্ট অথচ তিনি বুদ্ধিজীবী নন, এ চিন্তা উদ্ভট ও পরস্পর বিরোধী। কারণ কোন ব্যক্তির মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির একটা নির্দিষ্ট বিকাশ যদি না ঘটে, তাহলে কমিউনিস্ট হওয়ার মতো মানসিক পর্যায়ে তিনি উন্নত হতে পারেন না। বুদ্ধিবৃত্তির এই বিকাশকেও আবার নির্ভরশীল থাকতে হয় শিক্ষা সংস্কৃতির একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অনুশীলন ও চর্চার উপর। 

কিন্তু কমিউনিস্টদের শিক্ষা সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ শুধু বই-পুস্তক ও দলিলপত্র পঠন- পাঠনের উপরই নির্ভরশীল নয়। তা যদি হতো তাহলে কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীর সাথে অকমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের কোন তফাৎ থাকতো না। কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরা এক দিকে যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞান সংস্কৃতির অনুশীলন করেন, অন্যদিকে তেমনি তাঁরা শ্রমিক কৃষকদের স্বার্থের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকে তাঁদের সাথে একাত্মবোধ করেন এবং বিপ্লবী আন্দোলনের মূল স্রোতের মধ্যে নিমজ্জিত থাকেন। বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে এইভাবে নিমজ্জিত থাকাকালে তারা শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজ করেন। এই কাজের দুটি দিক। প্রথমতঃ, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার করা এবং শিক্ষা সংস্কৃতির অনুশীলনের মাধ্যমে সেই চেতনাকে দৃঢ় ও বৈজ্ঞানিক চরিত্র দান করা। দ্বিতীয়তঃ, সাংগঠনিক দিক দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক ও মধ্য- শ্রেণীভুক্ত জনগণকে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে চালনা করা। 

এই আন্দোলনের ফলে একদিকে যেমন শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের বাইরে থেকে আগত বুদ্ধিজীবীরা পরিণত হন মেহনতী জনগণের অংশে, অন্য দিকে তেমনি শ্রমিক কৃষকেরা ক্রমশঃ বর্ধিত সংখ্যায় পরিণত হন বুদ্ধিজীবীতে। 

আমাদের দেশে এই প্রক্রিয়া কিভাবে কার্যকর হয়েছে এবং তার দ্বারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশ কতখানি ঘটেছে সেটাই এবার দেখা দরকার। বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বুদ্ধিজীবীরা এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে কী ভূমিকা পালন করে এসেছেন এবং কী ভূমিকা ভবিষ্যতে তাঁদের পালন করা উচিত সে বিষয়ে আমাদের ধারণা এই পর্যালোচনার মাধ্যমেই পরিষ্কার হবে। 

১৩ 

কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আলোচনা করতে গেলে প্রধানতঃ তিনটি ক্ষেত্রে তাঁদের বাস্তব কাজের পর্যালোচনা করতে হবে। এই তিনটি ক্ষেত্র হলো,

(ক) মার্কসবাদের সাধারণ প্রচার এবং সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতা; (খ) শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক কাজ এবং 

(গ) রাজনৈতিক কাজের সাথে সাথে শ্রমিক কৃষক ক্যাডারদের আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন ও তাদেরকে নেতৃত্বের উপযোগী করে তোলা। 

(i) মাকর্সবাদের তত্ত্বকে সাধারণভাবে প্রচারের ক্ষেত্রে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা ভূমিকা আগেও ছিলো এবং এখনো আছে। কিছু কিছু বই পুস্তক রচনা থেকে শুরু করে বক্তৃতা ও বৈঠকী আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা মার্কসবাদ প্রচার করেছেন। কিন্তু এখানে যে মূল ত্রুটিটি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, মার্কসবাদী তত্ত্বকে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তাঁদের পুরোপুরি না হলেও বিরাট ব্যর্থতা। এ জন্যেই এই প্রচার মোটামুটিভাবে মার্কসবাদের ‘বিশুদ্ধ তত্ত্ব’ প্রচারেই পর্যবসিত হয়েছে। 

একথা বলার অর্থ এই নয় যে, মার্কসবাদের বিশুদ্ধ তত্ত্বের প্রচারের কোন প্রয়োজন নেই অথবা সে প্রচার ব্যতীত প্রকৃত মার্কসবাদী শিক্ষার বিস্তার সম্ভব। না, তা নয়। তার অর্থ হলো এই যে মার্কসবাদ সম্পর্কে শিক্ষা যদি এমন হয়, অথবা তার পরিণতি যদি এমন দাঁড়ায় যে, সেই শিক্ষা থেকে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত নির্দেশ পাওয়া যায় না, এবং সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাকে দেশীয় পরিস্থিতির উপযোগী করে কাজে লাগাতে পারা যায় না. তাহলে তাকে সাফল্য আখ্যা দেওয়া চলে না। এই সাফল্য যে আমাদের দেশের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রচারের ক্ষেত্রে তেমন অর্জন করতে পারেননি, সেটা এখানকার রাজনৈতিক ও বিশেষতঃ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার মধ্যেই পাওয়া যাবে। 

মার্কস এঙ্গেলস বলেছেন যে, তাঁদের তত্ত্ব একটা বিশ্বাসের বস্তু (dogma) নয়, তা হলো একটা কর্মের দিশারী (guide to action)।[৬] মার্কসবাদকে এ দেশে যেভাবে অধ্যয়ন করা হয়েছে এবং তার প্রচার যেভাবে আজ পর্যন্ত মোটামুটি করা হয়েছে তাতে মার্কসবাদকে (মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সকলের রচনার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য) বাস্তবকর্মের দিশারী হিসেবে না দেখে তাকে সাধারণভাবে একটা বিশ্বাসের বস্তু হিসেবেই এদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে মার্কসবাদের কোন সৃষ্টিশীল প্রয়োগ এখানে সম্ভব হয়নি। একথা শুধু বাঙলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। 

(ii) বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা এদেশের শ্রমিক কৃষকের মধ্যে কাজ করেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক প্রচার কার্য চালিয়েছেন এবং সংগঠনের কাজও করেছেন। এইভাবে কাজ করার ফলে শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলন এ দুইই এদেশে অনেকখানি সংগঠিত হয়েছে এবং সময়ে সময়ে সেইসব আন্দোলন অনেক জোরদারও হয়েছে। কিন্তু এইভাবে কাজ করার সময় তাঁদের কাজের ধারা ও পদ্ধতির মধ্যে অনেক রকম মারাত্মক ত্রুটি থাকার জন্যে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে সেই শ্রমিক কৃষক আন্দোলন একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ক্রমশঃ উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এই ব্যর্থতার কারণ তাঁদের মধ্যে কাজ করা সত্ত্বেও শ্রমিক কৃষকদের থেকে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের একটা বিচ্ছিন্নতা। এই বক্তব্য আরও পরিষ্কার হবে যদি আমরা শ্রমিক কৃষকদের আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করি।

(iii) বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজ করলেও তাঁরা শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের মধ্যে থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতাসম্পন্ন ক্যাডার সৃষ্টি করতে এতকাল ধরে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ উপস্থিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে থেকে আদর্শগতভাবে উন্নত ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মতো উপযুক্ত ও শিক্ষিত ক্যাডার সৃষ্টি করতে তাঁরা পারেননি। এর অর্থ একটি আধা-সামন্তবাদী এবং আধা-ঔপনিবেশিক সমাজের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে তাঁদের উপর যে মূল দায়িত্ব ন্যস্ত আছে সে দায়িত্ব পালন করতে তাঁরা সক্ষম হননি। 

বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা কলকারখানা ও গ্রামাঞ্চলে শ্রমিক কৃষকের মধ্যে যখন কাজ করতে গেছেন তখন তাঁদের মধ্যে সততা, একনিষ্ঠতা, ঐকান্তিকতা ইত্যাদির অভাব অনেক ক্ষেত্রে না থাকলেও কতকগুলি ঐতিহাসিক কারণে শ্রমিক কৃষক ব্যাপক মেহনতী জনগণের সাথে তাঁদের একটি মানসিক বিচ্ছিন্নতা বজায় থেকেছে এবং এখনো বিদ্যমান আছে। এই বিচ্ছিন্নতার বিবিধ বহিঃপ্রকাশের মধ্যে একটি হলো, আদর্শগতভাবে শ্রমিক কৃষক ক্যাডারদেরকে যথার্থ গড়ে তোলার এবং ক্যাডার নয়, এমন সহানুভূতিশীল মেহনতী জনগণের মধ্যে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটা বিপরীত স্রোত সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে পর্বত প্রমাণ গাফলতি।[৭] 

এই গাফলতির ফলে অতীতে দেখা গেছে এবং এখনো দেখা যাচ্ছে যে, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা শহরে গ্রামাঞ্চলে মেহনতী জনগণের মধ্যে কাজ করছেন, অশেষ দুঃখকষ্ট নিজেরা স্বীকার করছেন, নিজেদের জীবনকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত করছেন এবং অকাতরে অনেকে জীবনও দিচ্ছেন, কিন্তু এত সত্ত্বেও যে কৃতিত্ব অর্জন করতে তাঁরা কিছুতেই সক্ষম হচ্ছেন না, সেটি হচ্ছে শ্রমিক কৃষক ক্যাডারদেরকে আদর্শগতভাবে দৃঢ় করা এবং তাদের সাংস্কৃতিক মানকে এতখানি উন্নত করা যাতে তারা বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্বে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। 

এই ব্যর্থতার পরিমাণ নির্ণয় করা সহজ হবে যদি আমরা একটি বিষয় বিবেচনা করি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অতীতে দেখা গেছে এবং এখনো দেখা যাচ্ছে যে, বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা মাসের পর মাস বছরের পর বছর শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজ করছেন, বৈঠক করে তাঁদের মধ্যে মার্কসবাদ কিছুটা প্রচার করছেন, এবং তাঁদের মধ্যে সংগঠনের কাজও করছেন, কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে যে সেই সব এলাকার শ্রমিক কৃষক ক্যাডাররা নিরক্ষর থেকে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ক্যাডারদেরকে মার্কসবাদের সাথে পরিচিত করার জন্য তাঁরা বৈঠক করলেও তাঁদের অক্ষর পরিচয় ঘটানোর কোন চেষ্টা অথবা উদ্যোগ তাঁদের থাকছে না। এর ফলে শ্রমিক কৃষক ক্যাডাররা প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হতে পারছেন না এবং বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হতে না পারার জন্যে তাঁরা কমিউনিস্টও হতে পারছেন না। 

একথা পূর্বেই বলেছি যে, কোন ব্যক্তিকে কমিউনিস্ট হতে হলে তাকে বুদ্ধিজীবী হতেই হবে। কারণ মার্কসবাদ কোন বিশ্বাসের বস্তু নয়, তা একটা বিজ্ঞান। কোন বিশেষ সূরা বা মন্ত্র আবৃত্তি করে যেমন ধর্মে দীক্ষিত হওয়া যায়, তেমনভাবে মার্কসবাদে দীক্ষিত হওয়া চলে না। তার জন্য প্রয়োজন হয় একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মার্কসবাদের মূল তত্ত্বগুলির সাথে একটা সন্তোষজনক পরিচয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিচয় যে অক্ষর পরিচয় ব্যতীত সম্ভব নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। 

আত্মনির্ভরশীল হয়ে তত্ত্বজ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়া এবং মার্কসবাদ ও অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুশীলন করার জন্যে অক্ষর পরিচয় একটা অপরিহার্য শর্ত। এ জন্যে যে ক্যাডারের অক্ষর পরিচয় নেই, সে পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের উপর তত্ত্বগতভাবে তো বটেই, এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও একান্তভাবে নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য। এই ধরনের নির্ভরশীলতা কোনো নেতৃত্বের জন্মদান করতে পারে না এবং এতে তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এত বৎসরকালব্যাপী এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন সত্ত্বেও শ্রমিক কৃষক শ্রেণী থেকে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব আজ পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়েতেও এদেশে সৃষ্টি হয়নি। 

১৪

এই পরিস্থিতির পরিণতিতে যা ঘটেছে তা হলো এই যে, কমিউনিস্ট আন্দোলন কোন ক্ষেত্রেই প্রকৃতপক্ষে মূল বিস্তার করতে পারেনি। আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে হাজার হাজার বিপ্লবী কর্মী কমিউনিস্ট আন্দোলনে এসেছেন, তাঁরা নিষ্ঠা ও সততার সাথে শ্রমিক ও কৃষক এলাকায় অনেক কষ্ট স্বীকার করে কাজ করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে বিপুল অধিকাংশই আর রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারেননি। তাঁরা বিপ্লবী রাজনীতি পরিত্যাগ করে পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীতেই ফিরে গেছেন এবং মামুলী জীবনযাত্রায় নিমগ্ন হয়েছেন। শুধু তাই নয়। তাঁদের মধ্যে একটা অংশ পরবর্তীকালে শ্রমিক কৃষকদের শ্রেণীশত্রুতে পরিণত হয়ে সচেতনভাবে বিপ্লবের বিরোধিতা করতে সক্রিয় হয়েছেন। 

এইভাবে এক একটি এলাকা থেকে মাঝে মাঝে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ক্যাডাররা নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে সেই সমস্ত এলাকায় নেতৃত্বের অভাবে রাজনৈতিক কাজে ভাটা পড়েছে, অথবা কিছুকালের জন্যে রাজনৈতিক কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে একটা হতাশার ভাব বিশেষ বিশেষ এলাকায় শ্রমিক কৃষকদেরকে আচ্ছন্ন করেছে। 

শ্রেণী হিসেবে বিপ্লবে যাদের ভূমিকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেই শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া সৃষ্টি না হওয়া ও স্থায়ী না থাকাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যার জন্যে এদেশের মেহনতী জনগণের মধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলন বাস্তবতঃ কোন মূল বিস্তার করতে পারেনি। বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া শ্ৰেণী থেকে আগত বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের চরিত্র সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার জন্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টরা এখনো পর্যন্ত এদেশে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বদান করতে পারেননি, তার যোগ্যতা অর্জন করতে তাঁরা সমর্থ হননি। 

১৫ 

১৯৩৯ সালে লিখিত ‘৪ঠা মে আন্দোলন’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে মাও সেতুঙ বলছেন যে, চীনে প্রায় একশো বছর ধরে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছিলো এবং অহিফেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিপ্লবের বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েরই কতকগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিলো। কিন্তু তারা কমিউনিস্ট পার্টির আবির্ভাবের পূর্বে এসেছে না পরে এসেছে এটাই হলো তাদের পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। 

এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি কি? এ বৈশিষ্ট্য বলতে কি বোঝায়? চীনের ‘নয়া গণতন্ত্র’ সম্পর্কে তাঁর রচনাটিতে মাও সেতুঙ এই বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে বলছেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি আবির্ভাবের পর থেকে চীনের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে পুরাতন সামন্ত-বুর্জোয়া সংস্কৃতির পশ্চাৎপদতা খুব পরিষ্কার হয়ে পড়ে এবং কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক, কৃষক ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যাপক জনগণের মধ্যে এক নোতুন সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয় এবং সেই ঐক্যফ্রন্ট নেতৃত্বের দায়িত্ব বর্তায় সর্বহারা সংস্কৃতি এবং আদর্শের ওপর। এর ফলে চীনে উদ্বোধন হয় নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির, যা হলো মূলতঃ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী ব্যাপক জনগণের সংস্কৃতি। 

১৬ 

ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পর থেকে এদেশের ব্যাপক জনগণের জীবনে সাংস্কৃ তিক বিপ্লবের সূচনা ও সূত্রপাতের জন্যেও কোন ব্যাপক প্রচেষ্টা যে হয়েছে তা বলা চলে না। গণনাট্য সংঘের মাধ্যমে যে প্রচেষ্টা হয়েছিলো তাকেও যদি মার্কসবাদের আলোকে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, সে প্রচেষ্টাও ছিলো বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর একটা প্রগতিশীল অংশ কর্তৃক একটা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সর্বহারা সংস্কৃতির একটা ক্ষীণ ও দুর্বল প্রভাব যে ছিলো না তা নয়, কিন্তু গণনাট্য আন্দোলন মূলতঃ একনিষ্ঠ মার্কসবাদী বিপ্লবীদের দ্বারা পরিচালিত না হওয়া এবং সেই আন্দোলনকে গভীর ও ব্যাপক করা অর্থাৎ মধ্যশ্রেণীর শহুরে জনগণের মধ্যে তাকে মোটামুটি সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক শ্রমিক কৃষকের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার কোন নীতি ও কর্মসূচী কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক গৃহীত না হওয়ায় সে আন্দোলন ভারতীয় জনগণের সংস্কৃতিতে কোন নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা অবলম্বন করতে পারেনি। উপরন্তু পরবর্তী পর্যায়ে বুর্জোয়া রাজনীতি ও সংস্কৃতির অভিঘাতে চূর্ণ- বিচূর্ণ হয়ে সেই আন্দোলনের নায়কেরা প্রায় সকলেই পরিণত হয়েছিলেন ভারতীয় মুৎসুদ্দী ও সমাজ্যবাদের সহায়ক সংস্কৃতির সেবাদাসে। 

এদিক দিয়ে ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাঙলাদেশের পরিস্থিতি আরও নিদারুণ পশ্চাৎপদ। এখানে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ব্যাপক জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার কোন সুষ্ঠু চিন্তা বাস্তব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ বিপ্লবের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তার কোন উল্লেখযোগ্য চেতনা এবং উপলব্ধিই কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে থাকেনি। এজন্য জনগণের চেতনার মান উন্নয়নের জন্যে এ পর্যন্ত তাঁরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য সম্বলিত কিছু কিছু ইস্তাহার ও পুস্তিকার প্রকাশ ও বণ্টন এবং কিছু কিছু বৈঠকী আলাপ ব্যতীত আর কিছুই করেননি। এজন্যে জনগণের আদর্শগত মান উন্নয়নের জন্যে তাঁদের তথাকথিত প্রচেষ্টাকে বড় জোর তুলনা করা চলে কতকগুলি পাঠচক্রের প্রচেষ্টার সাথে। ব্যাপক মেহনতী জনগণের মধ্যে সর্বহারা সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়া, শ্রমিক কৃষকদের সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে এদেশে সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতিকে আঘাত হেনে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গভীর ও ব্যাপক করার কোন চিন্তা অথবা কিছুমাত্র প্রচেষ্টা এখানে ছিলো না এবং এখনো নেই। বর্তমান বাঙলাদেশের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে ব্যাপক, গভীর এবং অদৃষ্টপূর্ব নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে সে নৈরাজ্য কিছুতেই সম্ভব হতো না যদি এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মসূচী থাকতো। বর্তমানের সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যই তাই এ যাবৎকাল এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার, বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের ত্রুটিপূর্ণ ভূমিকার সব থেকে সিদ্ধান্তসূচক প্রমাণ 

১৭ 

বাংলাদেশের বর্তমান কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রায় সামগ্রিকভাবেই মধ্য শ্রেণী থেকে আগত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গঠিত এবং পরিচালিত। এই শতকের বিশের দশকে এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হলেও কমিউনিস্ট আন্দোলন যে এদেশে যথাযথভাবে মূল বিস্তার করেনি, অর্থাৎ শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে এই আন্দোলন যে গভীর ও ব্যাপক হয়নি, কমিউনিস্ট আন্দোলনে বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বুদ্ধিজীবীদের এই অসামান্য প্রতাপ ও প্রাধান্য তার প্রমাণ। 

কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের থেকে এই বুদ্ধিজীবীদেরকে বাদ দিতে হবে অথবা বুদ্ধিজীবীদেরকে আরও বিপুল সংখ্যায় কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করতে আহ্বান জানাতে এবং উৎসাহ দিতে হবে না। মোটেই তা নয়। বরং তার উল্টোটাই দরকার। 

বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন এখন যে অবস্থায় আছে তাতে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদেরকেই এর ভুলত্রুটি চিহ্নিত করতে হবে, সেগুলিকে উপযুক্তভাবে সংশোধন করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবেই সে দায়িত্ব এখনো পর্যন্ত তাঁদেরই উপর ন্যস্ত আছে। 

এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব তাঁদেরকে আজ পালন করতে হলে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে ভূমিকা তাঁরা এতদিন পালন করে এসেছেন সেই ভূমিকার বিস্তৃত ও গভীর বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে তার ভিত্তিতে তাঁদেরকে নোতুনভাবে বিপ্লবী আন্দোলন এদেশে সংগঠিত করতে হবে। 

১৮ 

দাবা খেলার সময় রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে এক পক্ষ অপর পক্ষকে পরাজিত করে। সেখানে হিসেব-নিকেশ বুদ্ধি-বিবেচনা এবং সামগ্রিক অবস্থার একটা সঠিক পরিমাপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাপ লুডু খেলায় এ ধরনের কোন নীতি, কৌশল, হিসেব- নিকেশ, বুদ্ধি-বিবেচনা এবং সামগ্রিক অবস্থার পরিমাপের প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে, শুধু বাঙলাদেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় বা ভারতীয় উপমহাদেশে এ যাবৎকাল পর্যন্ত যে কমিউনিস্ট আন্দোলন চলে এসেছে দাবা খেলার সাথে তার তুলনা করা চলে না। তুলনা করা চলে সাপলুডু লেখার সাথে। 

একদিকে নিপীড়িত জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের একটা প্রবল তাড়না এবং বিপ্লবের একটা ক্ষীণ চেতনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি মাঝে মাঝে অসহ্য হয়। কিন্তু যথার্থ বিপ্লবী নেতৃত্ব দেখা দেয় না। এর ফলে উপযুক্ত বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। যা হয় তা হলো, সাময়িক বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ। এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের মই অবলম্বন করে মাঝে মাঝে কমিউনিস্ট আন্দোলন হঠাৎ এক উচ্চমার্গে ওঠে। কিন্তু ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিবিপ্লবী সাপের মুখে পড়ে আবার নিম্নগামী হয়, অনেকখানি নেমে আসে। এই চড়াই উত্তাই-ই হলো এদেশের এযাবৎকালের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কৃতিত্বের ইতিহাস! 

১৯ 

এদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি এখনো পর্যন্ত পরিপক্ক অথবা চমৎকার হয়নি এ কথার অর্থ এই নয় যে, কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এদেশে সম্পন্ন হওয়ার প্রশ্ন সুদূরপরাহত। মোটেই তা নয়। বাঙলাদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী উপাদানগুলি এখনো যে অবস্থায় আছে তাতে কতকগুলি প্রয়োজনীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলে বিপ্লবী পরিস্থিতিও যে অতি দ্রুত পরিপক্ক হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজগুলি, যার কিছু কিছু উল্লেখ ইতিপূর্বে করা হয়েছে, করতে হলে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের কর্মপদ্ধতি কৌশল ও সামগ্রিক ভূমিকাকে আমূলভাবে পরিবর্তিত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন আনতে হলে সমগ্র শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত নিপীড়িত জনগণের মধ্যে একটা নোতুন সাংস্কৃতিক চেতনার ব্যাপক উন্মেষ ঘটাতে হবে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং সেই আন্দোলনের অন্তর্গত শ্রমিক কৃষকদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক মানকে উন্নত করতে হবে, রাজনীতি ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ, উগ্রজাতীয়তাবাদ, বামপন্থী তত্তবাগীশতা ও সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠন করে সেই ঐক্যজোটকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সংহত এবং দৃঢ় করতে হবে। 

এই কাজগুলি সম্পন্ন করা বর্তমান পরিস্থিতিতে মূলতঃ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদেরই দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথার্থভাবে যতদিন না তাঁরা পালন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন, এবং তাতে সফল হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত ও সম্পন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি পরিপক্ক হবে না। 

তথ্যসূত্র 

১. Lenin : “Left-Wing “ Communism – An Infantile Disoreder, Collected Works vol. 31, P. ৪4-৪5 Progress Publishers, Moscow 

২. Ibid., 92-94 

৩. F. Engles; Programme of the Blanquist Communards. Ibid., 92-94 

৪. J. V. Stalin : Fundations of Leninism. P. 29 Foreign Languages Press, Peking. 1965 

৫. উদ্ধৃত : Stalin : Foundations of Leninism, P-37 

৬. লেনিন কর্তৃক উদ্ধৃত : Collected works, vol 31. P. 71 এবং 549 

৭. দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ। 

৮. Mao Tse-Tung: Selected Works. vol. 2, P. 372-73 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *