বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে
সংস্কৃতির দ্বিতীয় সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১) আমি ‘বাঙলাদেশে সামন্তবাদী সংস্কৃতি ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ নামক একটি প্রবন্ধে এ দেশের বিপ্লবী পরিস্থিতি চমৎকার’ এই বক্তব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করেছিলাম এবং তৃতীয় সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৮১) বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নামক অপর একটি প্রবন্ধে এ বিষয়ে অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত আলোচনা করেছিলাম।
উপরোক্ত দুটি প্রবন্ধ সংস্কৃতিতে প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন লেনিনবাদী পার্টির সম্পাদক অমল সেন ‘কমিউনিষ্টদের পথ হাতড়ানোর কাল শেষ হতে এখনও অনেক বাকী?’ নামক একটি প্রবন্ধে (সংস্কৃতি ৫ম সংখ্যা) আমার কয়েকটি বক্তব্যের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। সইফ-উদ-দাহার সাহেব ‘বিপ্লব না নৈরাজ্যবাদ’ নামক অপর একটি প্রবন্ধে (সংস্কৃতি ৬ষ্ঠ সংখ্যা) অমলবাবুর বক্তব্যের সমালোচনা করেন। বর্তমান সংখ্যাটিতে (৮ম সংখ্যা) তৎকালীন লেনিনবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং নবগঠিত ইউনাইটেড পিপলস পার্টির অন্যতম নেতা নজরুল ইসলাম সাহেব ‘নৈরাজ্যই – কিন্তু বিপ্লবী সংকট’ নামে একটি রচনায় দাহার সাহেবের সমালোচনামূলক প্রবন্ধটির সমালোচনা করেছেন। এই সব আলোচনার পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমি আমার নিজের বক্তব্যগুলিকে আরও একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
২
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, উপরোক্ত দুটি প্রবন্ধেই আমার মূল উদ্দেশ্য আমাদের দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সংগঠিত, শক্তিশালী ও সফল করার সঠিক পদক্ষেপগুলি চিহ্নিত করা, বিপ্লবী পরিস্থিতি ও তৎসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের কর্মনিরপেক্ষ বিশ্লেষণ নয়। আমার এই উদ্দেশ্যটি আমি যথেষ্ট পরিষ্কারভাবে আমার দুটি প্রবন্ধেই বর্ণনা করেছি।
আমার প্রবন্ধ দুটির নামকরণ থেকে শুরু করে সমগ্র বক্তব্য পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে কোথাও বিপ্লবী পরিস্থিতির অস্তিত্ব আমি অস্বীকার করিনি। সাধারণভাবে বিদ্যমান বিপ্লবী পরিস্থিতির সাথে বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতাকে যাঁরা এক করে দেখেন, বিপ্লবী পরিস্থিতির পর্যায়, অগ্রসরতা ইত্যাদিকে যারা মার্কসবাদী লেনিনবাদী পদ্ধতিতে যথাযথভাবে পরিমাপ না করে বাস্তব কর্মসূচী ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাঁদেরই সমালোচনা করে আমি বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা সামগ্রিক আলোচনার সূত্রপাত করেছি মাত্র।
আমার উদ্দেশ্যের এই সীমাবদ্ধতার জন্য সাধারণভাবে সামাজিক বিপ্লবের যুগ বলতে কি বোঝায়, আমাদের দেশে এই যুগ কখন শুরু হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে কোন আলোচনায় ইচ্ছাকৃতভাবেই পূর্বে আমি প্রবৃত্ত হইনি। আমি সাধারণভাবে এটা ধরে নিয়েছি যে, আমরা এখন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে আছি এবং সেই বিপ্লবকে সফল ও সংগঠিত করার জন্যে যা কিছু করণীয় কর্তব্য সেগুলিকে উপযুক্ত সতর্কতার সাথে আমাদেরকে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সেই বিচার বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করতে হবে আমাদের বিপ্লবের বাস্তব কর্মসূচী।
উদ্দেশ্যকে এইভাবে সীমাবদ্ধ রাখার ফলে আমি আমার সমগ্র আলোচনাকেও সেই গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। লেনিনের যে উদ্ধৃতিগুলি এ ক্ষেত্রে আমি দিয়েছি সেগুলিও কেবলমাত্র যে এদিক দিয়েই প্রাসঙ্গিক সেটা যে কোন সতর্ক পাঠকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
কাজেই যে কথাটি আবার জোরের সাথেই এ ক্ষেত্রে বলতে হয় তা হচ্ছে এই যে, আমরা এখন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে আছি এ কথা বলার অর্থ বিপ্লবী পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা নয়, ঠিক তার উল্টো। সাধারণভাবে বিপ্লবী পরিস্থিতিকে একটা বাস্তব সত্য হিসেবে ধরে না নিলে বিপ্লবী পরিস্থিতিকে চমৎকার, পরিপক্ক ও পরিণত করার প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর, হাস্যকর ও পাগলামীর শামিল।
৩
লেনিনের যে উদ্ধৃতিগুলি আমি দিয়েছি তার দ্বারা লেনিন নিজেই দেখাতে চেয়েছেন একটি সমাজে বিপ্লবী পরিস্থিতি কোন্ কোন্ শর্তসাপেক্ষে একটা পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, পরিপক্ক হয়, বিপ্লব ‘হাতের কাছে এসে যায়।’ ঠিক এ কারণেই বিপ্লবী পরিস্থিতির সামগ্রিক শর্তগুলি উল্লেখ করার পর তিনি নিজেই বলেছেন, “তখন সত্যি সত্যিই বিপ্লব একটা পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, সত্যি সত্যি তখন যদি আমরা উপরে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত শর্তগুলি (বড় হরফ সব আমার—ব. উ.) সঠিকভাবে পরিমাপ করে থাকি এবং যদি আমরা সঠিক মুহূর্তটিকে নির্ধারণ করতে পারি তাহলে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।” বাঙলাদেশের বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার মূল বক্তব্যটিকে আমি যেভাবে উল্লেখ করেছি তা হলো এই : “বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের এই বক্তব্যসমূহের প্রতি, তাঁর নির্দেশিত শর্তসমূহের প্রতি যদি আমরা লক্ষ্যপাত করি এবং সেই বক্তব্য ও শর্তসমূহের আলোকে বাঙলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে যাচাই করি তাহলে আমরা কি দেখবো? যা দেখবো তা হচ্ছে এই যে, বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী শর্তগুলির মধ্যে কয়েকটি কিছু পরিমাণে উপস্থিত থাকলেও অনেকগুলি শর্ত পূরণ হতে বাকী থাকছে এবং কোন শর্তই পরিপূর্ণভাবে পূরণ হচ্ছে না।” (তৃতীয় সংখ্যা, পৃষ্ঠা, ৭৫-৬)
এর পর আমি বলেছি যে, লেনিনের শর্তগুলির মধ্যে (ক), (খ), (ছ) এবং এবং (জ) বাঙলাদেশে আংশিকভাবে বিদ্যমান আছে কিন্তু অন্যগুলির অর্থাৎ (গ), (ঘ), (ঙ), (চ) এবং (ঝ) এর “অস্তিত্ব এত ক্ষুদ্র অথবা সেগুলি এমনভাবে অনুপস্থিত যে তার ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির চরিত্র সত্য অর্থে বিপ্লবী না হয়ে অন্য রকম দাঁড়ায়। এবং যা দাঁড়ায় তাকে বিপ্লবী পরিস্থিতি না বলে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি বলা অধিকতর সঠিক ও সঙ্গত।” (ঐ, পৃ ৭৬)।
এখানে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি বলতে ঠিক কি বোঝানো হয়েছে তা কিছুটা বিশদভাবে বলা দরকার। কারণ এই ‘নৈরাজ্য’ শব্দটিকে নিয়েও খানিকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য এবং পুরানো কায়দায় শাসক শ্রেণীর শাসন করতে উত্তরোত্তর অক্ষমতাজনিত যে নৈরাজ্য তা নিঃসন্দেহে বিপ্লবের পক্ষে খুবই সহায়ক। বস্তুতঃপক্ষে সে রকম নৈরাজ্যেরই অপর নাম বিপ্লবী সংকট এবং সেই হিসেবে তা বিপ্লবেরই একটি পূর্বশর্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি পরিস্থিতির মধ্যে যে নৈরাজ্যের কথা বলেছি তা উৎপাদন ব্যবস্থার নৈরাজ্য ও শাসক শ্রেণীর সংকট উদ্ভুত নৈরাজ্য নয়। তা হলো বিপ্লবের সংগঠিত শক্তিসমূহের মধ্যে বিরাজমান নৈরাজ্য। যে শর্তগুলির ‘ক্ষীণ অস্তিত্ব’ অথবা ‘অনুপস্থিতির’ কথা আমি উপরোক্ত উদ্ধতির মধ্যে উল্লেখ করেছি সেগুলির দিকে তাকালেই এ বিষয়ে আমার মূল বক্তব্যটি পরিষ্কার হবে। কারণ উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেও শাসক শ্রেণীর মধ্যে বিরাজমান নৈরাজ্য যেমন বিপ্লবের একটি অনিবার্য পূর্বশর্ত, তেমনি বিপ্লবের সংগঠিত শক্তিসমূহের মধ্যে নৈরাজ্যের অবসান হলো বিপ্লবের অপর একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এই দ্বিতীয় পূর্বশর্তটির অভাবে সমগ্র পরিস্থিতির মধ্যে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় তার উপস্থিতি বিপ্লবী পরিস্থিতি পরিণত, পরিপক্ক বা চমৎকার হয়ে ওঠা অথবা বিপ্লব হাতের কাছে এসে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নয়। এজন্যেই এই ধরনের নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি যখন বিরাজমান তখন পরিস্থিতিকে ‘চমৎকার,’ ‘পরিপক্ক’ ইত্যাদি বলে বর্ণনা করে হাতের কাছে বিপ্লবকে ধরতে গেলে যা হয় এদেশের ইতিহাসে বারংবার তাই ঘটেছে। এবং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে ঠিক সেই কারণেই আমি বর্তমান বাঙলাদেশের বিপ্লবী পরিস্থিতির একটা সংক্ষিপ্ত সামগ্রিক পর্যালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি, বিপ্লবী পরিস্থিতিকে সামগ্রিকভাবে ‘অস্বীকার’ করতে যাইনি।
৪
এখানে প্রসঙ্গতঃ একটি বিষয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এবং সে বিষয়টি হলো, দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী মহলের পক্ষ থেকে বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ও অন্তর্ঘাতমূলক বক্তব্য ও প্রচারণা, বিপ্লবীরা বিপ্লবী পরিস্থিতিকে যাতে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে না পারেন তার জন্য তাঁদের নানা ধরনের চক্রান্তমূলক প্রচেষ্টা। পূর্বেই বলেছি যে, পরিস্থিতি পরিণত ও পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে বিপ্লবী শক্তিসমূহকে ‘হাতের কাছে বিপ্লব ধরতে’ প্ররোচিত করা বিপ্লবের শত্রুদেরই একটি সুপরিচিত কৌশল। বিপ্লবের কাতারে সুকৌশলে অনুপ্রবিষ্ট নিজেদের গুপ্তচরদের দ্বারাই এ কাজ প্রতিবিপ্লবীরা সব থেকে সার্থকভাবে উদ্ধার করতে পারে এবং তাঁদের সে প্রচেষ্টার বিরাম কখনো ঘটে না। অনেকে বৈজ্ঞানিক ও সুষ্ঠু চিন্তার অনভ্যাসের দরুণ অথবা পেটি বুর্জোয়া সুলভ হঠকারী চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে পরিস্থিতি পরিণত ও চমৎকার হওয়ার পূর্বেই তাকে পরিণত ও চমৎকার বলার প্রবণতা বোধ করেন। এবং এই প্রবণতার জন্যই তাঁরা অনেক সময় খুব সহজেই প্রতিবিপ্লবী গুপ্তচরদের প্রচারণার দ্বারা প্রতারিত হন। এই প্রতিবিপ্লবী কৌশল ও প্রতারণার হাত থেকে শুধু বিপ্লবীদেরকে রক্ষার জন্য নয়, বিপ্লবকেও সফল ও রক্ষার জন্য প্রয়োজন বিপ্লবীদের সদা সতর্কতা, যে সতর্কতা একমাত্র সম্ভব বিপ্লবী পরিস্থিতি ও তার অগ্রসরতা বলতে মার্কসবাদ লেনিনবাদে কি বোঝায় তার সতর্ক অনুশীলন এবং তার ভিত্তিতে বাস্তব পরিস্থিতির অবিরাম ও নিরলস পর্যালোচনা। বলাই বাহুল্য যে, এই উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তার উদ্দেশ্যেই মহামতি লেনিন রচনা করেছিলেন তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ বামপন্থী কমিউনিজম – একটি শিশুসুলভ উচ্ছৃঙ্খলতা।
৫
“মানুষ যে সামাজিক উৎপাদন চালায়, তাহাতে সে পরস্পরের কতকগুলি নির্দিষ্ট সম্পর্ক মানিয়া লয়, যাহার উপর মানুষের ইচ্ছাশক্তির কোন প্রভাব নাই এবং যাহা অপরিহার্য; এই উৎপাদন সম্পর্কগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার বাস্তব শক্তির বিকাশ নির্দিষ্ট স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া গড়িয়া উঠে। এই উৎপাদন সম্পর্কগুলি একত্রিত হইয়া সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সৃষ্টি হয়; এই বুনিয়াদের সঙ্গে নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ চেতনার সামঞ্জস্য আছে, এবং বাস্তব ভিত্তির উপরই আইনগত ও রাজনৈতিক ইমারত খাড়া হয়। সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মননবিষয়ক জীবনধারাকে বাস্তব জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের চেতনা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না মানুষের সামাজিক সত্তাই তাহার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিকাশের একটি বিশিষ্ট স্তরে সমাজ-উৎপাদনের শক্তির সঙ্গে উৎপাদন-ব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্কগুলির বিরোধ ঘটে, কিংবা ঐ একই ব্যাপারকে আইনের ভাষায় বলিতে গেলে যে সম্পত্তি সম্পর্কের গণ্ডীতে উৎপাদনশক্তি সক্রিয় ছিল তাহার সঙ্গেই বিরোধ বাধে। উৎপাদনশক্তির বিকাশের বিভিন্নরূপ হইতে এখন এই সম্পর্কগুলি সে-শক্তির শৃঙ্খলে পরিণত হয়। তখন আরম্ভ হয় সামাজিক বিপ্লবের যুগ। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিরাট ইমারত অল্পাধিক দ্রুতবেগে বদলাইতে থাকে। এই রূপান্তরের কথা আলোচনা করিতে গেলে দুইটি বিষয়ের পার্থক্য লক্ষ করিতে হইবে; একটি হইল উৎপাদনের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তব রূপান্তর, যাহাকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের মতো অনিবার্য নিয়মমাফিক জানা যায়; আর একটি হইল মানুষের চিন্তাধারার স্বরূপ—আইন, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সৌন্দর্যতত্ত্ব, দর্শন – যাহার সাহায্যে মানুষ এই বিরোধ বিষয়ে সচেতন হয় ও বিরোধ নিরসনের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়। কোন মানুষ নিজের সম্বন্ধে কি ভাবে, তাহার উপর নির্ভর করিয়া যেমন তাহার সম্বন্ধে কোন মত স্থির করা চলে না, তেমনি পরিবর্তনের কোন যুগকে তাহার নিজস্ব চেতনা দিয়া বিচার করা যায় না; বরং সে-যুগের চেতনাকে ব্যাখ্যা করিতে হইবে বাস্তবজীবনের স্ববিরোধিতা দ্বারা, সে-যুগের সামাজিক উৎপাদনশক্তির ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে জায়মান সংঘর্ষ দ্বারা। উৎপাদন শক্তির পূর্ণতম বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোন বিশেষ সমাজ-ব্যবস্থার লোপ হইতে পারে না; পুরাতন সমাজ-ব্যবস্থার গর্ভে নূতন ব্যবস্থার অস্তিত্বের উপযোগী অবস্থা যতদিন না পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় ততদিন উৎপাদনের উচ্চতর নূতন সম্পর্কগুলি আবির্ভূত হইতে পারে না। সুতরাং মানুষ সেই কাজেরই ভার গ্রহণ করে, যে-কাজের জটিলতার সমাধান সে করিতে পারে; কারণ একটু মনোযোগের সহিত দেখিলেই আমরা বুঝিতে পারিব যে – কোন একটি কর্তব্য তখনই আমাদের সম্মুখে দেখা দেয়, যখন সে- কর্তব্য সমাধা করার পক্ষে অনুকূল বাস্তব অবস্থা উদ্ভূত হইয়াছে কিংবা হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে।”২ (কার্ল মার্কস্, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, ইংরাজী সংস্করণ, ১৯৪৬, ১ম খণ্ড, পৃ, ৩০০-০১)।
সামাজিক বিপ্লব সম্পর্কে এই হলো মার্কসের সাধারণ সূত্রায়ন।
এই সূত্রায়নের ক্ষেত্রে মার্কসের মূল বক্তব্যগুলির সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় এই যে, (ক) সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক উৎপাদন সম্পর্কসমূহ গড়ে ওঠে সেগুলি মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়, অর্থাৎ ইচ্ছা নিরপেক্ষ। এবং অনিবার্যভাবে সেগুলি গড়ে ওঠে এবং একত্রিতভাবে সৃষ্টি করে সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। (খ) সমাজের এই অর্থনৈতিক বুনিয়াদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এক এক ধরনের নির্দিষ্ট চেতনা গড়ে ওঠে। মানুষের এই চেতনা তার সামাজিক সত্তার দ্বারাই সৃষ্ট এবং সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ সামাজিক সত্তাকে বাদ দিয়ে এই চেতনার কোন অস্তিত্ব নাই। (গ) সামাজিক বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে উৎপাদনের শক্তির সঙ্গে উৎপাদনের পারস্পরিক সম্পর্কগুলির বিরোধ ঘটে, উৎপাদন সম্পর্কগুলি পরিণত হয় উৎপাদন শক্তির শৃঙ্খলে। এবং ঠিক তখনই শুরু হয় সামাজিক বিপ্লবের যুগ, যে যুগে অর্থনৈতিক বুনিয়াদের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের বিরাট উপরিকাঠামোও অল্পাধিক দ্রুতবেগে রূপান্তরিত হতে থাকে। (ঘ) এই রূপান্তরের বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উৎপাদনের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তব রূপান্তর এবং আইন, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি যার সাহায্যে মানুষ এই বিরোধ সম্পর্কে সচেতন হয় ও সেই বিরোধ নিরসনের জন্যে সংগ্রামে লিপ্ত হয় এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করতে হবে। ঙ) কোন সমাজে উৎপাদনী শক্তির পূর্ণতম বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত সে সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস হয় না। (চ) অনুকূল বাস্তব অবস্থার উদ্ভব অথবা সেই উদ্ভবের সম্ভাবনা ব্যতীত মানুষের সামনে কোন কর্তব্য দেখা দেয় না এবং মানুষ সে রকম কোন কর্তব্যের ভারও গ্রহণ করতে পারে না।
প্রথমে যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো এই যে, সামাজিক বিপ্লবের যুগ শুরু হওয়া এবং বিপ্লব চূড়ান্তভাবে সংঘটিত হয়ে সমাজের মধ্যে একটা গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি হওয়া এক জিনিস নয়। সামাজিক বিপ্লবের যুগ শুরু হয় তখনই যখন উৎপাদন সম্পর্কগুলি উৎপাদন শক্তির শৃঙ্খলে পরিণত হয়। সামাজিক বিকাশের যে পর্যায়ে এই অবস্থার উদ্ভব হয় ঠিক সেই পর্যায়েই সেই বিশেষ সমাজে উৎপাদনী শক্তির পূর্ণতম বিকাশ ঘটে না। এক একটি সামাজিক বিপ্লবের যুগ শুরু ও সমাপ্তির মধ্যবর্তী পর্যায়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করে তাকেই সাধারণভাবে বলা হয় বিপ্লবী পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি সামাজিক বিপ্লবের যুগের শুরু থেকে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং তা পরিণতি লাভ করার পরেই সংঘটিত হয় চূড়ান্ত সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লব এক শ্রেণীকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে অনিবার্যভাবে আর এক শ্রেণীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই বিপ্লবী পরিস্থিতির বিকাশের প্রক্রিয়া মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ। এই ইচ্ছা নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া বাস্তব অবস্থার বিকাশের সাথে সাথে অনিবার্যভাবে কতকগুলি নির্দিষ্ট চেতনা ও ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করে। এই চেতনা ও ধ্যান-ধারণাগুলির ঐতিহাসিক ভূমিকা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে কিভাবে নির্ণয় করা হয়েছে এবার স্তালিনের ভাষায় সেটা দেখা যাক :
“নূতন সামাজিক চিন্তাধারা ও মতবাদ তখনই দেখা দেয় যখন জীবনযাত্রা ব্যবস্থার ক্রমোন্নতির ফলে সমাজে নূতন সমস্যা ও কর্তব্য আসিয়া উপস্থিত হয় কিন্তু একবার দেখা দিবার পর এইসব নূতন চিন্তাধারা ও মতবাদ খুবই শক্তিশালী হইয়া উঠে এবং তাহাদের এই শক্তি সেইসব নূতন সামাজিক কর্তব্যসিদ্ধিকে সাহায্য করে, সমাজ প্রগতিকে সাহায্য করে। ঠিক এইখানেই নূতন ধারণা, নুতন মতবাদ, নূতন রাজনৈতিক চিন্তা ও নূতন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যে প্রচণ্ড সংগঠনী সংহতিসাধনী ও রূপান্তরকারী অবদান আছে তাহা সুস্পষ্ট হয়। সমাজের পক্ষে প্রয়োজন বলিয়াই নূতন সামাজিক ধারণা ও মতবাদের আবির্ভাব ঘটে; তাহাদের সংগঠক, সংহতিকারক ও রূপান্তরকারী শক্তি বিনা সমাজের বাস্তবজীবন বিকাশের জন্য অবশ্য প্রয়োজন কর্তব্যপালন অসম্ভব বলিয়াই তাহাদের আবির্ভাব ঘটে; সমাজের বাস্তব জীবনবিকাশ সম্পর্কে কাজের তাগিদ দেখা দিয়া নূতন সামাজিক ধারণা ও মতবাদ সকল বাধা সবলে দূর করিয়া অগ্রসর হয়, জনগণের সম্পদে পরিণত হয়, সমাজের ক্ষয়িষ্ণু শক্তিপুঞ্জের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য জনগণকে সংগঠিত করে, এবং যে সব শক্তি সমাজের বাস্তব প্রগতির পথে বাধা, সেইসব শক্তিকে পরাভূত করার কাজকে সহজ করে।”
“এইভাবে সমাজজীবনের ক্রমবিকাশের ফলে সামাজিক জীবনযাত্রা ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে যে নুতন প্রয়োজন ও দাবী দেখা দেয়, তাহারই উপর ভিত্তি করিয়া সামাজিক চিন্তাধারা মতবাদ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়িয়া উঠে, এবং ইহারাই আবার সমাজজীবন, সামাজিক জীবনযাত্রার ব্যবস্থার উপর সক্রিয় প্রভাব বিস্তার করিতে থাকে এবং তাহার ফলে সমাজ ব্যবস্থার জরুরী দাবী মিটাইবার অনুকূল ব্যবস্থা সৃষ্টি করে এবং সমাজজীবনের প্রগতিকে সম্ভবপর করিয়া তোলে।”
এই প্রসঙ্গে মার্কস বলিয়াছেন :
‘যে মুহূর্তে কোনো মতবাদ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, সেই মুহূর্তেই ঐ মতবাদ বাস্তব শক্তিতে পরিণত হয়।’ (হেগেলের ‘ফিলজফি অফ রাইট সম্বন্ধে সমালোচনা। জার্মান ভাষায়)। “সুতরাং সমাজের বাস্তব জীবন ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য, তাহার অগ্রগতি ও উন্নতির বেগ দ্রুততর করার জন্য, সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির পক্ষে একান্ত প্রয়োজন এমন একটি সামাজিক মতবাদ বা চিন্তাধারা অবলম্বন করা, যাহা সমাজের বাস্তব জীবনব্যবস্থার অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় দাবীকে সঠিকভাবে রূপ দেয়— এমন চিন্তাধারা ও মতবাদ যাহা ঐ কারণে জনগণের ব্যাপক অংশকে সক্রিয় করিয়া তুলিতে পারে, যাহা জনগণকে সর্বহারা পার্টির বিরাট বাহিনীরূপে সংঘবদ্ধ করিতে পারে, পরিচালনা করিতে পারে যে বাহিনী প্রস্তুত হইবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে চূর্ণ করিয়া সমাজের প্রগতিশীল শক্তিগুলির পথ পরিষ্কার করিয়া দিবার জন্য।[৩]
এখানে যে জিনিসটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো এই যে, নোতুন চিন্তাধারা ও মতবাদগুলি একদিকে যেমন মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে সামাজিক সত্তা থেকে জন্মলাভ করছে তেমনি ‘একবার দেখা দিবার পর’ সেগুলি আবার শক্তিশালী হয়ে উঠে পরিণত হচ্ছে বাস্তব শক্তিতে এই রূপান্তর সম্পর্কে বলতে গিয়েই মার্কস্ বলছেন, “যে মুহূর্তে কোন মতবাদ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, সেই মুহূর্তেই ঐ মতবাদ বাস্তব শক্তিতে পরিণত হয়।” এইভাবে বাস্তব শক্তিতে পরিণত হওয়ার ফলে সেগুলি আর সাবজেকটিভ থাকে না, মানুষের ইচ্ছার কোন তোয়াক্কা না করেই সেগুলি সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বিপ্লবী পরিস্থিতির বিকাশ এবং পরিণতি লাভের ক্ষেত্রে নোতুন রাজনৈতিক মতবাদ ও চিন্তা এবং নোতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এই বাস্তব চরিত্রটি যদি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা না যায় তাহলে বিপ্লবী পরিস্থিতির বিকাশ ঘটানো, তাকে পরিপক্কতা দানের ক্ষেত্রে বিপ্লবীদের সামনে যে কাজের ভার, যে কর্তব্য দেখা দেয়, তারও যথার্থ উপলব্ধি কিছুতেই সম্ভব হয় না, সে কাজ ও কর্তব্য সমাধা করা তো দূরের কথা।
এ প্রসঙ্গে মাও সেতুঙ বলেন,
‘সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে দুনিয়াকে জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে রূপান্তরিত করা, এছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই। একটি নির্ভুল জ্ঞান প্রায়শঃই বস্তু থেকে চেতনায়, চেতনা থেকে বস্তুতে, অর্থাৎ অনুশীলন থেকে জ্ঞানে, জ্ঞান থেকে অনুশীলনে অনেকবার পুনরাবৃত্তির পরই সম্পন্ন করা যায়। এই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব অর্থাৎ দ্বন্দ্ববাদী বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব। আমাদের কমরেডদের মধ্যে অনেকেই এখনো এই জ্ঞানতত্ত্বকে বোঝেন না। তাঁদের চিন্তাধারা, মতামত, নীতি পদ্ধতি, পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত, অনর্গল বক্তৃতা এবং প্রবন্ধগুলি কোথা থেকে আসে একথা জিজ্ঞেস করলে তাঁরা এই প্রশ্ন অদ্ভুত বলে মনে করেন এবং উত্তর দিতে পারেন না। বস্তু যে চেতনায় এবং চেতনা যে বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে এইরূপ দ্রুত অতিক্রমণের ঘটনা দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই দেখা গেলেও তাঁরা বুঝতে অক্ষম। সুতরাং আমাদের কমরেডদের দ্বন্দ্ববাদী বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন, যাতে করে তাঁরা নির্ভুলভাবে চিন্তা করতে পারেন, অনুসন্ধান ও পর্যালোচনায় নিপুণ হতে পারেন, অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করতে পারেন,…।[৪[
৬
এ পর্যন্ত বিপ্লবের যুগ, বিপ্লবের প্রক্রিয়া, বিপ্লবী পরিস্থিতি, চেতনা ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রগতিশীল মতবাদ ও চিন্তাধারার সংগঠন ও পরিচালনা শক্তি এবং সৃজন ক্ষমতা সম্পর্কে যে আলোচনা হলো তার পরিপ্রেক্ষিতেই এবার বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার নির্দিষ্ট বক্তব্যগুলিকে আবার উল্লেখ এবং আলোচনা করা দরকার।
প্রথমেই বিপ্লবের সাবজেকটিভ এবং অবজেকটিভ শর্ত বলতে কি বোঝায় সেটা দেখা যাক। উৎপাদনের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তব রূপান্তরকে অবজেকটিভ শর্ত এবং বিপ্লবের সংগঠিত শক্তিগুলিকে সাবজেকটিভ শর্ত হিসেবে সাধারণত চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বিপ্লবের সংগঠিত শক্তিগুলিকে ‘সাবজেকটিভ’ হিসেবে চিহ্নিত করার দ্বারা একথা মোটেই বোঝায় না যে, সেই শক্তিগুলি বাস্তব নয়। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের বিপ্লবী রূপান্তরের প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত নোতুন চিন্তাধারা ও মতবাদ (যে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করার কথা মার্কস্ বলেছেন) এবং তার ভিত্তিতে গঠিত নোতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল সংগঠিত শক্তির বাস্তব চরিত্র সঠিকভাবে অনুধাবন না করলে বিপ্লবী তত্ত্বের উপলব্ধি ও যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব নয়। এই বাস্তব চরিত্রের অর্থ এই যে, নোতুন ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা, মতবাদ ও তার ভিত্তিতে গঠিত সংগঠন ইত্যাদি ‘বাস্তব শক্তি’ হিসেবে ‘জনগণের সম্পদে’ পরিণত হয়ে সামাজিক রূপান্তরের সেই সামগ্রিক প্রক্রিয়ারই অংশে পরিণত হয় যে প্রক্রিয়া মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষ অর্থাৎ অবজেকটিভ। তাই সাধারণভাবে সাবজেকটিভ শর্তগুলিকে অবজেকটিভ শর্তগুলি থেকে বাস্তব কর্মপন্থা নির্ণয়ের সুবিধার জন্যে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হলেও সাবজেকটিভ শর্তগুলি বাস্তব শক্তিতে পরিণত হয়েই সামাজিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, এগিয়ে নিয়ে যায়, এক কথায় সামাজিক রূপান্তরকে সৃজনশীলভাবে পরিচালনা করে।
বিপ্লবী পরিস্থিতির সামগ্রিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা এবং সেই পরিস্থিতিকে পরিণত ও পরিপক্ক করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ শর্তগুলিকে পরস্পর থেকে বিযুক্ত করে রেখে কেউ যদি মনে করেন যে শুধুমাত্র অবজেকটিভ (সাধারণ বিভক্তিকরণের অর্থে) শর্তগুলি পূরণ হলেই বিপ্লবী পরিস্থিতি পরিপক্ক হয়ে উঠবে তাহলে মারাত্মক ভুল হবে। এই ভুল যাঁরা করেন তাঁদেরকেই দ্বন্দ্ববাদী বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে যথার্থভাবে শিক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তার কথাই কমরেড মাও ওপরের উদ্ধৃতিটিতে উল্লেখ করেছেন। বস্তুবাদের যান্ত্রিক উপলব্ধি থেকেই সাবজেকটিভ এবং অবজেকটিভ শর্তগুলির মধ্যে চীনের প্রাচীর খাড়া করা যেতে পারে, এই ধরনের যান্ত্রিক উপলব্ধির ফলেই সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রকৃত অর্থে পরিপক্ক না হওয়ার পূর্বেই অবজেকটিভ শর্ত পূরণ হয়েছে এই ধ্বনি তুলে শ্রমিক শ্রেণী, তার অগ্রবাহিনী ও জনগণকে এক চূড়ান্ত সংগ্রামের মধ্যে নিক্ষেপ করে বিপ্লবকে সাময়িকভাবে ব্যর্থ করা যেতে পারে। লেনিন এ বিষয়ে কি পরিমাণ সতর্ক ছিলেন সেটা বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর আলোচনার মধ্যে আমরা দেখেছি। পরিস্থিতিকে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে বিচার না করে সামগ্রিকভাবেই বিচার করেছেন এবং পরিস্থিতি পরিপক্ক হওয়ার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি বর্ণনার ক্ষেত্রে সেজন্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই সাবজেকটিভ অবজেকটিভ ইত্যাদি প্রশ্নের অবতারণা না করে শর্তগুলিকে সামগ্রিকভাবেই উপস্থিত করেছেন।
৭
সাবজেকটিভ শর্তগুলিকে বাস্তব কর্মপন্থা নির্ণয়ের সুবিধার জন্যে ‘সাবজেকটিভ’ আখ্যা দিলেও তত্ত্বগতভাবে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দিক থেকে তাকে ‘সাবজেকটিভ’ মনে করা এবং সেই হিসেবে সেগুলি সমাজের ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তব প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে না এটা ধরে নেওয়া একটা শিশুসুলভ ব্যাপার ব্যতীত কিছুই নয়। এই শিশুসুলভ ব্যাপারটির প্রতি রাজনৈতিক কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যেই আমি সাবজেকটিভ অবজেকটিভ শর্ত সম্পর্কে আলোচনা উত্থাপন করেছি এবং একটি বিশেষ উদাহরণ দিয়ে বলেছি, “কাজেই সে ক্ষেত্রে সাবজেকটিভ শর্তগুলির অবর্তমানে অবজেকটিভ শর্তসমূহ পূরণ হয়েছে একথা বলা ঠিক হবে না, তা বললে বিপ্লবের ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল হবে” (তৃতীয় সংখ্যা, পৃষ্ঠা : ৮২)। এই প্রসঙ্গেই আমি কমিউনিস্ট পার্টিরও উল্লেখ করেছি। শ্রমিক শ্রেণী ও তার অগ্রবাহিনীর চেতনা বিশেষভাবে বিকশিত হয়ে সেই অগ্রবাহিনীকে তাঁদের নিজেদের পার্টির মাধ্যমে একটি সংগঠিত শক্তিতে পরিণত করা ব্যতীত বিপ্লবের বাস্তব পরিস্থিতির পরিক্কতা ও পরিণতি লাভ সম্ভব নয়, কারণ এইভাবে গঠিত শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তব রূপান্তরের প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, জনগণের সম্পদ এবং বিপ্লবের অপরিহার্য শর্ত, এবং এ সব কারণেই তা প্রকৃতপক্ষে অবজেকটিভ পরিস্থিতিরই অংশ। চেতনার মধ্যে তার উৎপত্তির কারণে এবং বাস্তব কর্মপন্থা নির্ণয়ের সুবিধের জন্য তাকে সাবজেকটিভ শর্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর দ্বারা কেউ যদি মনে করেন যে বাস্তব শক্তিতে পরিণত হওয়ার পরও তা সাবজেকটিভ, মানুষের ইচ্ছার অধীন, অথবা সামাজিক রূপান্তরের বাস্তব প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা তার নেই, তাহলে দারুণ ভুল হবে।
৮
বিপ্লব কখন হবে এই প্রশ্ন কি বিপ্লবী পরিস্থিতি অথবা বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতার প্রশ্নকে বাদ দিয়ে সম্ভব? বিপ্লবী পরিস্থিতি একটা বিশেষ পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পূর্বে কি বিপ্লব সম্ভব? সমাজের কতকগুলি পরিমাণগত পরিবর্তন বিপ্লবী পরিস্থিতির অগ্রগতি ও পরিপক্কতা সাধন করেই কি পরিশেষে একটা গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করে না? এবং সেই গুণগত পরিবর্তনের নামই কি বিপ্লব নয়? বিপ্লবী পরিস্থিতির অগ্রগতি আলোচনাকালে ঠিক কখন তাকে ‘চমৎকার’, ‘পরিপক্ক’, ‘পরিণত’ ইত্যাদি বলা যেতে পারে সে প্রশ্ন কি অবান্তর? তা যদি অবান্তর না হয় তাহলে সঠিক মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, সচেতন শ্রেণী সংগ্রামের সারসংকলন দ্বারা সমৃদ্ধ এবং ব্যাপক জনগণের আস্থাভাজন একটি শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ব্যতীত পরিস্থিতির চমৎকার’ হয়ে ওঠা, তার পরিপক্কতা লাভ অথবা ‘পরিণত হওয়া কি সম্ভব? এ ধরনের পার্টি যে সমাজে বিরাজ করে না সেখানে বিপ্লবী পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে থাকতে পারে কিন্তু সেই পরিস্থিতিকে কি ‘চমৎকার’, ‘পরিপক্ক’ অথবা ‘পরিণত’ বলা চলে? লেনিন বলেছেন, না বলা চলে না। উপরন্তু কোন পরিস্থিতিতে সেটা বলা চলে তার বর্ণনা দিয়ে লেনিন বলছেন, “তখন সত্যি সত্যিই বিপ্লব একটা পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়… অর্থাৎ তখনই তার দ্বারা বর্ণিত শর্তগুলি সঠিকভাবে পরিমাপ করে সঠিক মুহূর্তটিকে নির্ধারণ করতে সক্ষম হলে বিপ্লবের বিজয় সুনিশ্চিত করা যেতে পারে।
৯
বিপ্লবী পরিস্থিতি, তার পরিপক্কতার (এ সবই ইচ্ছানিরপেক্ষ) প্রশ্নকে বাদ দিয়ে যারা বিপ্লবের মূল সূত্রকে স্বতন্ত্রভাবে দেখতে ও দেখাতে চান এবং বিপ্লবী পরিস্থিতিকে সামগ্রিকভাবে বিচার ও পরিমাপ করার ক্ষেত্রে অনীহার পরিচয় দেন তাঁদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে বাধ্য। কারণ তার দ্বারা যে ঝোঁক মানুষকে পেয়ে বসে তা হলো পরিস্থিতি পরিণত হওয়ার পূর্বেই, সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টির পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পূর্বেই শ্রমিক শ্রেণী ও তাঁদের অগ্রবাহিনীকে একটা চূড়ান্ত সংগ্রামে নিক্ষেপ করার প্রবণতা। এই প্রবণতার ফলেই সাময়িক সংঘর্ষের সম্ভাবনাকে, অথবা তার সীমিত সাফল্যকে মনে করা হয় শাসক শ্রেণীর চরম সংকট; এই সংঘর্ষে জনগণের সাময়িক অংশগ্রহণকে মনে করা হয় বিপ্লবপূর্ব মুহূর্তের অথবা বিপ্লবকালীন উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের তরঙ্গ।
আমার মূল আলোচনা যে বিপ্লবী পরিস্থিতির অগ্রসরতা ও পরিপক্কতার পরিমাণ সম্পর্কে এবং বিপ্লবী পরিস্থিতিকে এগিয়ে নেওয়া ও পরিপক্ক করার ক্ষেত্রে বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ সম্পর্কে এ বিষয়ে কোন সতর্ক পাঠকের দ্বিমত থাকতে পারে বলে মনে করি না। আমার এই মূল আলোচনায় দু’তিন জায়গায় বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতা অথবা বিপ্লবী পরিস্থিতি চমৎকারের স্থানে আমি কেবল মাত্র বিপ্লবী পরিস্থিতি বলেই তাকে উল্লেখ করায় আমি বিপ্লবী পরিস্থিতির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ এটাকে কেন্দ্ৰ করে অনেক প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সমালোচনার জাল বুনেছেন। কিন্তু বিপ্লবী পরিস্থিতির বিদ্যমানতা সম্পর্কে আমি যে সমস্ত শর্ত উল্লেখ করেছি সেগুলিকে কোন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি। সমগ্র প্রবন্ধটির আলোচনাকে গুটিয়ে নিতে গিয়ে শেষ দিকেও আমি বলেছি, “এদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি এখনো পর্যন্ত পরিপক্ক অথবা চমৎকার হয়নি, একথার অর্থ এই নয় যে, কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এদেশে সম্পন্ন হওয়ার প্রশ্ন সুদূরপরাহত। মোটেই তা নয়। বাঙলাদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী (অর্থাৎ ক, খ, ছ ও ঝ) উপাদানগুলি এখনো যে অবস্থায় আছে তাতে কতকগুলি প্রয়োজনীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলে বিপ্লবী পরিস্থিতিও যে অতি দ্রুত পরিপক্ক হবে সে কথা বলাই বাহুল্য।”৫ এ ক্ষেত্রে যে প্রয়োজনীয় কাজগুলি করলে, যে কর্তব্যগুলি সমাধা করলে বিপ্লব সত্যি সত্যিই ঘটবে সেগুলির আলোচনাই আমার দুটি আলোচ্য প্রবন্ধেরই মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সমালোচকরা সেই অতি প্রয়োজনীয়, বিপ্লব সাধনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য আলোচনার ধারেকাছেও না গিয়ে, তার কোন উল্লেখও না করে আমার সমগ্র আলোচনার মর্মবস্তুকে এড়িয়ে গিয়ে এমন কতকগুলি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনায় মত্ত হয়েছেন যেগুলি বিপ্লবী কর্তব্য নির্ণয় ও সাধন ক্ষেত্রে সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধকতারই সৃষ্টি করবে। কারণ পরিস্থিতিকে চমৎকার ও পরিপক্ক বলে অসময়োচিত চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া অথবা স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবের প্রতীক্ষায় ঘরে বসে বিপ্লবের ধ্যান করা, এ দুই প্রবণতার বিরুদ্ধে তত্ত্বগত ও বাস্তব কর্মক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই সংগ্রাম করেই বিপ্লবী পরিস্থিতিকে চমৎকার ও পরিপক্ক করার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুদিন যাবৎ যত আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে তার মধ্যে এই সংগ্রাম সংগঠিত করার বিষয়ে কোন কথা যে দেখা গেল না, এটাও বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা মূল সমস্যা। এই সমস্যার চরিত্রটিকে ভালোভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।
১০
এই সাধারণ আলোচনার পর এবার অমল বাবু, সইফ-উদ-দাহার সাহেব ও নজরুল ইসলাম সাহেবের কতকগুলি বক্তব্য সম্পর্কে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে। অমল বাবুর বক্তব্য যে আসলে কি তা মোটেই তাঁর লেখায় পরিষ্কার হয়নি। তিনি যে কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন তার দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বাঙলাদেশে বিপ্লবী অবস্থার পরিপক্কতা, সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ দিকের পরিপক্কতা, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো পেটি-বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের মধ্যে কাজ করা কমিউনিস্টদের পক্ষে সঠিক কিনা, এ ধরনের কোন প্রশ্নেই তিনি কি বলছেন তা মোটেই বোঝা যায় না। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের যুক্তির জালকে এমনভাবে বিস্তার করেছেন যে, তার মধ্য থেকে উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে তার নির্দিষ্ট কোন বক্তব্য খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। অমল বাবুর আলোচনার এই দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দাহার সাহেব সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ দিকের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আগুপিছু হওয়া সম্পর্কে আমার বক্তব্যের বিষয়ে অমল বাবুর স্থূলভাবে স্ববিরোধী বক্তব্যের উল্লেখ করেছিলেন। এই যথার্থ স্ববিরোধিতাটিকে স্বীকার না করে উপরন্তু তার উল্লেখের জন্যে আবার দেখলাম নজরুল ইসলাম সাহেব উল্টো কথা বলে হাসি সংবরণ করতে পারেননি। এই হাস্যরসের গূঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি সত্যিই অসম্ভব!
অমল বাবু নিজের আলোচনায় আমার ঘাড়ে এমন অনেক বক্তব্যই চাপিয়ে দিয়েছেন যেগুলি আমি মোটেই বলিনি। এ ক্ষেত্রে তার কৌশলটিও অভিনব। তিনি আমার নাম উল্লেখ না করে এক এক বার এক এক ধরনের বক্তব্য হাজির করে সেই বক্তব্যকে এমনভাবে তুলে ধরছেন যেন সেগুলি প্রকৃতপক্ষে আমারই বক্তব্য। অবজেকটিভ দিক হাজির না থাকা সম্পর্কে ঝটিতি সিদ্ধান্ত (পৃ ৩৬), ‘জনগণের দুর্দশা আরও বাড়ুক বাড়তে দিন’ ইত্যাদি বক্তব্য (পৃ. ৩৯) এদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। দাহার সাহেব শেষোক্ত উদাহরণটি সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন কিন্তু তার জবাবে নজরুল সাহেব অমল বাবুকেই সমর্থন করে দাহার সাহেবকেই আবার উল্টো ‘উমর সাহেবের অস্বাভাবিক সমর্থক’ বলে গাল পেড়েছেন।
মার্কসবাদী বিতর্কে ‘বকুনি’, ‘গালাগালি’ ইত্যাদি নাজায়েয নয়। কিন্তু তার তো একটা ভিত্তি থাকা দরকার। প্রতিপক্ষের আসল বক্তব্যকে উপস্থিত না করে অন্যের বক্তব্য তার ঘাড়ে সুকৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হবে, অথচ তার উল্লেখ করলে গাল পাড়া হবে এ ধরনের বিতর্ক নীতি মার্কসবাদী বিতর্ক-রীতি নয়। মার্কসবাদী চেতনার একটা বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে আলোচনা ও বক্তব্যের আসল বিষয়বস্তুটিকে আবিষ্কার করা এবং তাকেই বিচার করা।
অমল বাবু তাঁর প্রবন্ধটির নাম দিয়েছেন, “কমিউনিস্টদের পথ হাতড়ানোর কাল শেষ হতে এখনও অনেক বাকী’ এবং তার আলোচনার শেষের দিকে বুর্জোয়া সংগঠনে কমিউনিস্টদের কাজ করা সম্পর্কিত আমার বক্তব্যের (দ্বিতীয় সংখ্যার প্রবন্ধ) সমালোচনা করে বলেছেন যে, আমি শ্রেণী সংগ্রামকে ‘শিকেয় তুলেছি এবং কমিউনিস্টরা যে শ্রেণী সংগ্রামের থেকে বিচ্যুত হয়েছিলো একথার উল্লেখ ‘কোথায়ও’ করিনি। আমার এই ‘অনুল্লেখের জের টেনেই তিনি তার প্রবন্ধের নামকরণের সার্থকতা দেখাতে চেয়েছেন। শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে আমার বক্তব্য বিকৃত করার এ থেকে বড় উদাহরণ আর নেই। এই বিকৃতকরণ কতখানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে বিষয়ের মধ্যে না গিয়ে শুধু এ কথা উল্লেখ করলেই চলবে যে, আলোচ্য প্রবন্ধটিতে আমি সামগ্রিকভাবে শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের ব্যর্থতার এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলির ওপরই আমার আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করেছি। এ ধরনের আলোচনায় ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ বলে চিৎকার করার কোন প্রয়োজন হয় না। এ জন্যে আমি সেটা না করে শ্রেণী সংগ্রামকে অতীতে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কি কি ব্যর্থতা ছিলো সেগুলি উল্লেখ করে শ্রেণী সংগ্রামকে এদেশে কিভাবে নোতুন করে সংগঠিত করা যায়, কিভাবে তাকে শ্রেণী সচেতনতার দ্বারা উদ্দীপ্ত করা যায় সেই সব সমস্যাই আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া পার্টির মধ্যে কমিউনিস্টদের কাজ করার নীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি বলেছি, “এই গণতন্ত্রী দল, আওয়ামী লীগ এবং তারপর ১৯৫৭ সাল থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের অধিকাংশ শক্তিকে নিয়োজিত রেখে পেটি বুর্জোয়া রাজনীতির পুষ্টিসাধন করলো, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি হিসেবে সামন্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং দেশীয় শ্রেণী শত্রুদের বিরুদ্ধে পার্টিগতভাবে নিজেদের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে তাঁরা পারলো না। তাঁদের এই অক্ষমতার কারণে তৎকালীন পার্টির এবং পরবর্তীকালে একাধিক বিভক্ত পার্টির মধ্যে পেটি বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণা ও সংশোধনবাদের প্রায় অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব। এ জন্যেই কমিউনিস্ট পার্টি পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক পার্টিগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে পেটি বুর্জোয়া পার্টিগুলিকে অধিকতর প্রগতিশীল করতে পারেনি, নিজেরাই পরিণত হয়েছে অধিকতর পেটি-বুর্জোয়া পার্টিতে। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি বিভিন্ন ফ্রন্টের মাধ্যমে গণসংযোগ স্থাপন করতে পারে, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারে, কিন্তু অন্য শ্রেণীর একটি রাজনৈতিক পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে যে তার চরিত্র পরিবর্তন করতে পারে না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির অথবা পরবর্তীকালের একাধিক বিভক্ত পার্টির ইতিহাসই তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করবে।’ (দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ ৬০-৬১)।
আমার এই বক্তব্যের মধ্যে অমল বাবু শ্রেণী সংগ্রামের কোন দেখা পেলেন না! শুধু তাই নয়, এই বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বললেন, ‘ব্যর্থতার মূল কারণকে এইভাবে উপস্থিত করাতে এক মারাত্মক বিভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্তে চলে যাওয়ার অবকাশ থাকে। অর্থাৎ এখন কমিউনিস্টরা ঐ ধরনের কোন সংগঠনে না ঢুকলে সংশোধনবাদী বিচ্যুতি ও বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তির ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত থাকবে। বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি ও সংশোধনবাদের উৎস নির্দেশে এই ধরনের উপর বিশ্লেষণ সহায়ক হয় না।’ (৫ম সংখ্যা, পৃ ৪০)।
সংশোধনবাদী বিচ্যুতির ফলেই কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া পার্টির মধ্যে কাজ করার এবং তার দ্বারা নিজেদের বিলুপ্তি ঘটানোর ব্যবস্থা করেছিলো একথার অর্থ বের করতে গিয়ে অমল সেন তার পূর্বোক্ত বিশেষ পদ্ধতিতে আমার ঘাড়ে আবার যে বক্তব্যটি চাপিয়ে দিয়েছেন সেটি হচ্ছে এই যে, বুর্জোয়া সংগঠনে না ঢুকলে কমিউনিস্টরা সংশোধনবাদী বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকবে। সংশোধনবাদী প্রভাব এসে পড়লে তার ফলে অনেক রকম বিচ্যুতিই ঘটতে পারে এবং তার একটি বিশেষ ঐতিহাসিক উদাহরণ আমি দিয়েছি। এ বিষয় নিজের মতামত স্পষ্টভাবে নির্দেশ করার পরিবর্তে তিনি আমার ঘাড়ে উপরোক্ত বক্তব্য বেশ নিশ্চিন্তে চাপিয়ে দিলেন। বুর্জোয়া পার্টিতে কাজ করার ব্যাপারটি আমি উল্লেখ করেছিলাম সংশোধনবাদী বিচ্যুতির একটি উদাহরণ হিসেবে, কিন্তু তার হাতে পড়ে সেই উদহারণটি পরিণত হলো ‘উৎস নির্দেশে’ এবং সেই সিদ্ধান্ত করে তিনি ‘বিভ্রান্তি’, ‘পা পিছলানো’ ইত্যাদি অনেক কথার অবতারণা করলেন। এক্ষেত্রেও যে বিষয়টি সবিশেষ লক্ষণীয় তা হলো এই যে, কমিউনিস্টদের একটি বুর্জোয়া পার্টিতে কাজ করা সঠিক কিনা সে বিষয়ে তিনি নির্দিষ্ট কিছুই বললেন না। নেতৃত্বের প্রশ্ন তুলে কৌশলের সাথে তিনি কীভাবে প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গেলেন সেটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
১১
দাহার সাহেব কর্ম-চেতনা-কর্মের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে যা লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম তার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি একটি সামান্য বিষয় লক্ষ না করার ফলে তার আলোচনাটি কোন কাজেই এলো না। সেই সামান্য বিষয়টি হলো এই যে, দাহার সাহেব কর্ম-চেতনা-কর্ম এই প্রক্রিয়াটিকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবেই উপস্থিত করেছেন, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদে যেভাবে উপস্থিত করা চলে। সামাজিক প্রক্রিয়াই চেতনার স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক একথা যেমন ঠিক, তেমনি এই প্রক্রিয়ায় কর্ম (বস্তুর একটি বিশেষ রূপ) ও চেতনার যে পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা দাহার সাহেব উল্লেখ করেছেন সেটাও ঠিক। প্রত্যেক সামাজিক প্রক্রিয়াই একটি বিশিষ্ট চেতনার জন্মদান করে, আবার চেতনাও সামাজিক প্রক্রিয়া বা কর্মতে রূপান্তরিত হয়। এজন্যেই যেখানেই কর্ম সেখানেই চেতনা, যেখানেই চেতনা সেখানেই কর্ম। কিন্তু বিষয়টিকে বুঝতে না পেরে ‘কোনও না কোন প্রকার চেতনা ছাড়া কর্মের অস্তিত্ব নাই’–দাহার সাহেবের এই বক্তব্যকে ‘ভাববাদী’ প্রমাণের জন্য তিনি কর্মের স্থানে ‘বস্তু’ বসিয়ে দিলেন! এ কাজ করতে গিয়ে সামাজিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে দাহার সাহেব যে বিশেষ ল’ এর উল্লেখ করেছেন সেই ল’কে তিনি বিশ্ব প্রক্রিয়ারও সাধারণ ল’ হিসেবে উপস্থিত করলেন। এ কাজ করার ফলে তিনি বুঝতেই পারলেন না যে, ‘চেতনা ছাড়া কর্ম নেই’ (অর্থাৎ প্রত্যেক কর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি চেতনা আছে) এবং ‘চেতনা ছাড়া বস্তু নেই’ এ দুই বক্তব্য কখনও এক নয়।
কর্ম ও চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ক উপলব্ধির ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম সাহেব যে ‘গভীর’ মার্কসবাদী চেতনার পরিচয় দিয়েছেন তার সর্বোচ্চ বিকাশ তার প্রবন্ধের সেই অংশে যেখানে তিনি বলছেন, “বিপ্লবের চেতনা ছাড়াই বাস্তব অবস্থার পরিপক্কতাই শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে বিপ্লবটাই সমাধা হয়ে যেতে পারে।” তার মতে ইতিপূর্বের বিপ্লবগুলি ফরাসী বিপ্লবসহ ইউরোপীয় বুর্জোয়া বিপ্লবগুলিও নিঃসন্দেহে যার অন্তর্গত – নাকি বিপ্লবী চেতনা ছাড়াই (ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্যায়ে বুর্জোয়াদেরও যে একটা বিপ্লবী চেতনা ছিল সে ধারণা নজরুল ইসলাম সাহেবের নেই বোঝা গেল) ঘটে গেছে! বিপ্লবী চেতনার বিকাশের অবকাশ নাকি তখন ছিলো না! মার্কসবাদের নামে এই শিশুসুলভ আবোল তাবোল (গালাগালির ইচ্ছে থাকলে এখানেই সে সুযোগ ব্যবহারের অতি উত্তম ক্ষেত্র ছিলো) বকনেওয়ালা ব্যক্তি যে এ ক্ষেত্রে ‘কর্মের’ স্থানে ‘বস্তু’ বসিয়ে বিজয় গর্বে বিস্ফারিত হবেন তাতে আর অবাক হওয়ার কি আছে?
১২
চেতনা ছাড়া কর্ম আছে কি নেই, এ বিতর্ককে আপাততঃ স্থগিত রেখে এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ অবশ্যই করা দরকার। সে বিষয়টি হলো, অমল বাবু নজরুল ইসলাম সাহেবদের চেতনা ও কর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক। (অমল বাবু লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক। সেই হিসেবে দাহার সাহেব তাকে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা না করে ‘অমলবাবুরা’ অর্থাৎ লেনিনবাদীরা বলে উল্লেখ করায় কোন অন্যায় নিশ্চয় হয়নি। কারণ একজন পার্টি সম্পাদক স্বনামে যখন লেখেন তখন তিনি পার্টি সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু বলছেন না, এটা মনে করাই সঙ্গত)। শ্রেণী সংগ্রামের কথা না বলে উমর সাহেব সংশোধনবাদী বিচ্যুতির মূল জায়গাটি উল্লেখ করেননি এবং তার ফলে কমিউনিস্টদের পথ হাতড়ানোর কাল শেষ হতে অনেক বাকী; সাবজেকটিভ এবং অবজেকটিভ দিকের মধ্যে দ্বিতীয়টিই যে প্রাইমারী উমর সাহেব তা উল্লেখ করেননি (আমার সমগ্র আলোচনাটিতে অবজেকটিভ দিকটি যে প্রাইমারী সেটাই ভালভাবে বোঝানোর জন্যে আমি কমিউনিস্ট পার্টিও যে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবের বাস্তব প্রক্রিয়ারই অংশ, অবজেকটিভ, সে কথা উল্লেখ করেছি); শ্রেণী সংগ্রামই বুদ্ধিজীবীদের কামারশালা ইত্যাদি অনেক মানানসই কথা অমল বাবু বললেন। আর নজরুল ইসলাম সাহেব অবজেকটিভ বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতা এমনভাবে উপলব্ধি করলেন যে, তিনি তাঁর প্রবন্ধের নামই দিলেন ‘নৈরাজ্যই – কিন্তু বিপ্লবী সংকট’। কিন্তু এত সংগ্রামী ও বিপ্লবী কথাবার্তা সত্ত্বেও আমরা যখন পত্রিকায় দেখলাম অমল বাবু নজরুল সাহেবরা সাংবাদিক সম্মেলন করে লেনিনবাদী পার্টির বিলুপ্তি ঘোষণা করে একটি নোতুন পেটি বুর্জোয়া পার্টি খাড়া করলেন তখন আমরা আশ্চর্য হলাম না। উপরন্তু কর্ম-চেতনা- কর্ম এই বৃত্তের কথাই আমরা স্মরণ করলাম এবং চেতনা ছাড়া যে কর্ম নেই এই বক্তব্যের তাৎপর্য আরও ভালভাবে উপলব্ধি করলাম। সত্যি বলতে কি, যে ‘শ্রেণী সংগ্রামী’ ও ‘বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে অমল বাবু নজরুল ইসলাম সাহেবরা কমিউনিস্ট পার্টি নামে কথিত একটি পার্টিকে খোলা সাংবাদিক সম্মেলনে বিলুপ্ত করে দিয়ে তাকে একটি পেটি-বুর্জোয়া সংগঠনের মধ্যে একাকার করে দিলেন সেই চেতনার স্বাক্ষরই তাঁরা তাঁদের আলোচ্য দুটি প্রবন্ধেই নির্ভুলভাবে রেখেছেন। এ বিষয়টির দিকে লক্ষ রেখেই যে তাঁদের সামগ্রিক বক্তব্য এবং সেই বক্তব্য প্রকাশের পদ্ধতিকে বিচার করতে হবে সেকথা বলাই বাহুল্য।
তথ্যসূত্র
১ এই শর্তগুলির বিস্তৃত বিবরণের জন্য ‘বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি দ্রষ্টব্য।
২ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক নিয়োজিত কমিশন দ্বারা সম্পাদিত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বারা অনুমোদিত (১৯৩৮)। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ পৃ ১৪৯-৫০।
৩ ঐ, পৃ. ১৩৪-৩৫
৪ মাও সেতুঙ, মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে? (মে, ১৯৬৩)। বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং ১৯৬৮
৫ বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।