বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – ৩০

তিরিশ

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা দেশ ইংলণ্ডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এসে যে ভাবে মুগ্ধ হলো, তার দৃষ্টান্ত বড়ো বেশী খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের এ আকর্ষণের হেতু ছিল ইংলণ্ডের সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরা। শেকসপীয়ার, মিল্টন, শেলী, কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ এ নামগুলো। বাঙালী যুবক সম্প্রদায়ের প্রাতঃস্মরণীয় শুধু নয়, নিত্যস্মরণীয় হয়ে উঠেছিল। মধুসূদন মাইকেল হলেন মিল্টনকে ভালোবেসে, খ্রীষ্টধর্মকে ভালোবেসে নয়। যাদের সাহিত্য তার চিত্তকে আলোকিত করেছিল এবং মনের কাঠামো গড়ে তুলেছিলো, তাদেরই দেশে তীর্থযাত্রা করার জন্যে তিনি উতলা হয়ে ফিরেছিলেন।

যে ইংলণ্ড আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষিত লোকের কাছে এখনও অপরিচিত এবং এখনও তাদের মনে মোহে, জাগায়, আর যে দেশে যেতে না পারার জন্যে বসে বসে তারা দিবাস্বপ্ন দেখে, আর যাবার জন্যে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে, সে ইংলণ্ড হচ্ছে তার সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্যজগৎকে ঘিরে। ইংলণ্ডের অপরিবর্তনীয় মর্মবাণী আবহমান কাল ধরে এরাই জগৎ সভায় বিতরণ করে গেলেন। একদিন ইংলণ্ডের সবই যদি চলে যায়, সেদিনও দেখা যাবে এ অমর শব্দশিল্পী ও কৃথাকুশলীরা এ মর জগতে মানুষের গভীর অনুভূতি ও সাধনালব্ধ অমৃতময় বাণীর অপূর্ব সম্পদ নিয়ে তেমনিই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

কেউ তাদের খোঁজ করুন বা না করুন, এ মনীষীরা এমনিতেই অমর। তবুও কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ ইংরেজরা এদের মর্ত্য জীবনের দিনগুলোকে নানাভাবে স্মরণীয় করে রাখবার ব্যবস্থা করেছে।

সত্য ও সুন্দরের পূজারী কবি কীটস্ বাস করতেন প্রকৃতির লীলা-নিকেতন হ্যামষ্টেড হীথে। যে বাড়ীতে তিনি বাস করতেন, সেখানে তাঁর স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার নিজের আসবাবপত্র, বই পুস্তক তেমনি আছে আজও সুরক্ষিত। ফ্যানী ব্রাউন নামক একটি মেয়ের তিনি প্রেমে পড়েছিলেন। কবি আর তার প্রেমিকা ফ্যানীর দু’গুচ্ছ চুল সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে। কীটসও নেই, ফ্যানীও নেই, কিন্তু যে অলকগুচ্ছ মর্ত-জীবনে কবি কটিসের চোখে মুখে পড়ে তার চিত্তকে মোহিত করেছিল, প্রেরণা জাগিয়েছিল তাঁর সৃষ্টির, আশা ও আনন্দে তাকে করে তুলেছিল বিহ্বল। ইংরেজ জাত কবিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় এ চুলের অধিকারিণীর কথাও ভুলতে পারেনি। এসব দেখে শুনে মনে হচ্ছে মানুষ মানুষই, যুগে যুগে আর দেশে দেশে তার অনুভূতি আর উপলব্ধির পথ এক বই দুই নয়।

রাসেল স্কোয়ার টিউব ষ্টেশনের কাছেই ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের বাড়ী। একটা চুলও এখান থেকে আজও সরানো হয়নি। ডিকেন্স যে চেয়ারটিতে বসে লিখতেন, এতোদিন পরেও সেটা তাঁর সময়ে যেমন ছিল আজও আছে তেমনি। তার পছন্দসই জিনিসপত্র, ছবি, বই পুস্তক যেখানে যেমন করে রেখে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি আছে এবং তেমনিভাবে রাখার জন্যে লোকও রয়েছে। একটা ঘরে ঢুকলাম। দেওয়ালে নানা রকম ছবি আর ড্রইং ঝুলানো রয়েছে। একটিতে দেখছি ডিকেন্স নিজে একটি আরাম কেদারায় তন্ময় হয়ে বসে আছেন আর তাঁর উপন্যাস সৃষ্ট চরিত্রগুলো তার মাথা থেকে বেরিয়ে তারই সামনে যেন কিলবিল করে বেড়াচ্ছে।

নটিংহাম শহর থেকে মাইল কয়েক দূরে হটিংহাম সায়ারের নিউষ্টেড এ্যাবিতে কবি বাইরণের বাড়ী। নিউস্টেড এ্যাবির চারিদিক ঘেরা। প্রবেশ পথ থেকে এ্যাবির দূরত্ব আধ মাই।। পাশাপাশি মোটর আর পায়ে চলার পথ। গেট দিয়ে ঢুকে এ পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলে এখানকার রোমান্টিক পরিবেশে মন আবিষ্ট হয়। এ্যাবিটির এক পাশে ইংলিশ ফ্যাসানে আর পেছনে ক্ল্যাসিকাল প্যাটার্নের বাগান। বাইরণকে ঘিরে বহু মুখরোচক গল্প গড়ে উঠেছে। এ বাগান দুটোতে বিচরণ করলে মনে হয় কবির স্মৃতির প্রতি তার পরবর্তী বংশধরেরা যোগ্য সম্মানই দেখিয়ে ছিলেন। ক্ল্যাসিকাল ঢংয়ের বাগানটিতে ঢুকলে মনে হয় যেন এখানকার আবেশমাখানো পরিবেশ আবেগপ্রিয় মানুষদেরকে হাতছানি দিচ্ছে। এ বাগানটির মধ্যে বাইরণের প্রিয় ককর বোসয়েন (Boatswain) এর কবর রয়েছে। কবরের ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ, তাতে খোদিত রয়েছে কুকুরটির নাম। বাইরণ যে ঘরে থাকতেন, সেটি পরিণত হয়েছে জাতীয় পরিদর্শনাগারে। তার পড়ার টেবিল, বসবার চেয়ার রয়েছে যথাস্থানেই। এখানে তার কোনো কোনো বই-এর পাণ্ডুলিপি আছে, আর এখনও সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে তাঁর ব্যবহৃত কিছু কাপড়-চোপড়। রুচিবান এবং সুদর্শন পুরুষ হিসেবে বাইরণের যে খাতি ছিল, এ থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়।

জগদ্বিখ্যাত নাট্যকার শেকসপীয়ারের বাসাবাড়ী স্ট্রাটফোর্ড অন এ্যাভনে। লণ্ডন থেকে যাইল সত্তর দূরে অরিকশায়ার কাউন্টিতে এ শহরটি। ইংলণ্ডের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী ইডেনের বাড়ী এ কাউন্টিতে। এভিন শহর শুদ্ধ সমগ্র কাউন্টিটাই অত্যন্ত সুন্দর। অদ্বিতীয় মানব চরিত্র শিল্পী শেকসপীয়ারের বসতি-স্থান স্ট্রাটফোর্ড অন এ্যাভন আজ জগতের তীর্থক্ষেত্র স্বরূপ। তার স্বদেশীরা তো বটেই, বিদেশীরাও একবার শেকস্পীয়ারের আবাসস্থানে আসতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করে। শেকসপীয়ারকে কেন্দ্র করে এ্যাভন নদীর ওপরেই শেকসপীয়ার মেমোরিয়াল থিয়েটার’ গড়ে তোলা হয়েছে। লণ্ডনের ওল্ডভিকের মতো এ রঙ্গমঞ্চে শেক্সপীয়ারেরই নাটক অভিনয় করা হয়। তাঁর ও তাঁর নাট্যসাহিত্য সম্পর্কে শেকসপীয়ারীআনা নামক এক বিরাট সাহিত্যজগতেই গড়ে উঠেছে। ইংরেজজাত যে ফুলভক্ত, তার একটা পরিচয় পাই এখানে এসে। শেকসপীয়ার তার সমগ্র নাট্যসাহিত্যে যত রকম ফুলের উল্লেখ করেছেন, এখানে সে সব ফুলের বাগান করে রাখা হয়েছে।

বৃটিশ মিউজিয়ামে শেলী, কীটস, বাইরণ, ব্রাউনিং, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ প্রায় সকলেরই হাতের লেখার নিদর্শন আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাতের লেখায় মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। একথা যে অনেকাংশে সত্য, তার আর একটা দৃষ্টান্ত দেখলাম কবি শেলীর একটি বই-এর পাণ্ডুলিপিতে। চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গীতে শেলী দিলেন বিপ্লবী। চিত্তে অস্থির। তার অস্থিরমতিতুের ছাপ পড়েছে হাতের লেখায়। দ্রত হিজিবিজি কি যেন টেনে গেছেন। মিল্টনের হস্তাক্ষর দেখলাম স্বচ্ছ ও বলিষ্ঠ। তাতে দৃঢ়চেতা মিল্টনের ব্যক্তিত্বের চিহ্ন যেন ধরা পড়েছে।

ওয়েষ্ট মিনিষ্টার এ্যাবিতে আছে একটি পোয়েটস কর্ণার। কবিদের অনন্ত বিশ্রামের জায়গা। সত্য, সুন্দর ও শান্তির পূজারী কবিদের জন্যে অপরূপ এ পরিবেশটি। মনে হচ্ছে অনন্ত শান্ত সভায় সকলে একত্র মিলিত হয়ে যেন এক মনোরম মধুচক্র রচনা করেছেন।

১৯৫০ সালের দোসরা নভেম্বর তার আয়োটসেন্ট লরেন্সের গ্রামের বাড়ীতে বার্ণার্ড শ মারা যান। মাস তিনেক পরে তার বাড়ীটি জাতীয় পরিদর্শনাগারে পরিণত হয়। ৩১ মার্চ আমরা আয়োটসেন্ট লরেন্স গিয়েছিলাম এই মনীষীর বাসগৃহ দেখতে। তাঁর সেক্রেটারী মিস প্যাঁচ আমাদের গাইডের কাজ করলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যুবতী বয়েসে তিনি শর সেক্রেটারী হয়ে আসেন। তারপর থেকে বছর তিরিশ কেটে গেছে। বার্ধক্যের চিহ্ন তার চোখে মুখে। শ’র মত্যুর পরেও তাকে তার সেক্রেটারীর কাজ করে যেতে হচ্ছে। খুঁটিয়ে। খুঁটিয়ে তিনি আমাদের সব দেখাচ্ছেন। শর কথা বলতে বলতে গলা উঁার ধরে আসছে, চোখ সজল হয়ে উঠছে।

শ’র পড়বার কামরাটি সুন্দরভাবে সাজানো। টেবিলে টাইপরাইটার চিঠি লেখার সাজসরঞ্জাম, দোয়াত কলম সব যেন শ’র হাতের স্পর্শ পাবার আশায় আছে। একটা খামে ষ্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে শুধু পাঠানো হয়নি। কেমব্রিজ এক্সাইক্লোপেডিয়ার সেট সবে আনিয়েছিলেন। মৃত্যুর দিন পনর আগে ওগুলো ষ্টাডিতে এসেছে। উনি ব্যবহার করতে পারেন নি।

তার রিসেপসান রুমেও সুন্দরভাবে বই সাজানো আছে। শেকসপীয়ারের গ্রন্থাবলী রয়েছে এ ঘরটিতে। আর রয়েছে তার স্ত্রীর ছবি এবং নোবেল প্রাইজের সার্টিফিকেট। তার এক বন্ধু তাকে একটা চাইনিজ গাউন দিয়েছিলেন–গাঢ় নীল সিল্কের গাউনটি। সেটিও আছে এখানে। এ ঘরেই তিনি সিনেমা থিয়েটারে কন্ট্রাক্ট সই করতেন। এইখানেই বড়ো বড়ো অভিনেতা অভিনেত্রীদের শুভাগমন হতো আর নাটকের কিছু কিছু মহড়াও দিতেন।

ডাইনিং রুমটিও সুন্দর সাজানো। বেডরুম ছিল দোতলায়। মৃত্যুর ক’দিন পূর্বে এতো কাতর হয়ে পড়েন যে, আর দোতলায় উঠে যেতে পারেন নি। সাময়িক ভাবে তার ডাইনিং রুমটিকে বেডরুমে পরিণত করা হয়। এখানে ম্যান্টেলপিসের ওপরে গান্ধীর, আইনষ্টাইনের আর ষ্ট্যালিনের ছবি রয়েছে।

ছবিতে ফুটে ওঠার মতো চেহারা ছিল শ’র। তিনি নিজেও ছিলেন ভালো ফটোগ্রাফার। তার স্টাডিতে চার চারটি ভালো ক্যামেরা রয়েছে। শ’র বাড়ীটা মনে হয় যেন একটি টিলার ওপরে। সব উঁচুতে মূল ঘরগুলো। সামনে ফুলের বাগান আর বাড়ীর পেছনে একটি ছোট খোলা সবুজ মাঠ। ঢালু হয়ে তার নীচে নেমে গেছে পাইন জাতীয় গাছের সারি। সেই ঢালু জায়গায় খানিকটা সমান করে তাতেই একটা ছোট ঘর তৈরী করা হয়েছে। সেখানেও শোবার খাট, পড়াশোনা করার মত টেবিল চেয়ার, লেখার সাজসরঞ্জাম, টেলিফোন ও আগুনের ব্যবস্থা। শান্তি নিকেতনের ছায়াঘন আম্রকুঞ্জের মতো জায়গাটি বড়ো নিরিবিলি। দিনের বেলায় অধিকাংশ সময়েই শ’ এখানে থাকতেন। এ ঘরটিতে নামবার জন্যে ঢালু পথে পা বাড়িয়েছিলেন। ঝিপ বিপি বৃষ্টিতে পা পিছলে পড়ে যান তিনি। পেছনে ছিল ক্যামেরা ঝুলানো। তাতে ঠেস লেগে তার পেছনের হাড় ভেঙ্গে যায়। তাতেই শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হলো।

নীরবতাপ্রিয়, নিরামিষাশী, জড়বাদী সভ্যতার নির্ভীক সমালোচক ও আত্মাভিমানী মানুষটি নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে জগৎকে সমালোচনা করতেন। সেজন্যই বোধ হয় জনবহুল লণ্ডন নগরী এবং কৃত্রিম সভ্যতার আবেষ্টনী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে শান্ত নীরব পল্লীতে এসে বাসা বেঁধেছিলেন। ইংলণ্ডের গ্রাম বলেই আয়োটসেন্ট লরেন্সও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শহরের সুখ-সুবিধা অন্যান্য গ্রামের মতো এখানে পাওয়া যায়, নইলে আমাদের দেশের পাড়াগাঁয়ের চেয়ে বেশী কিছু নয় এ জায়গাটি। তবু শ’ এ জায়গাটিকে ভালোবেসেছিলেন। এর উঁচু নীচু উদার মাঠ, আঁকাবাকা পথ, ছায়াঘেরা পল্লীকুঞ্জ, মধ্যযুগীয় সভ্যতার নিদর্শন, ভাঙাচোরা সরাইখানা, বর্তমান যুগের কৃত্রিমতার আওতার বাইরে এর নীরব নিথর রূপ–সব মিলে শ’র মনে মোহ জাগিয়েছিল।

শ’র বাড়ীর অনতিদূরে আমাদের দেশের নওয়াব নাজিরদের গোরস্থানের মতো এ অঞ্চলের বড়লোকদের একটা গোরস্থান দেখলাম। পাশেই মধ্যযুগের ভাঙাচোরা ঘরবাড়ী। সেকালের সভ্যতার নিদর্শন। এ সবই স্কটের লে অব দি লাষ্ট মিনিষ্ট্রেল এর উপকরণ হবার যোগ্য। বহু চারণ কবি হয়তো এগুলোর স্মৃতি গানে গানে মুখরিত করে তুলেছেন। পাশেই একটা আধো-ভাঙা বাড়ী দেখলাম অনেকটা গ্রামের হোটেলের মতো। শীত আর ক্ষুধায়। কাতর হয়ে এ বাড়ীতে ঢুকতেই গৃহস্বামী বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা করে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। অত্যন্ত দরিদ্র এ পরিবারটি। শীতের কাপড়-চোপড়ও এদের তেমন নেই। ছেঁড়া কাপড়-চোপড় গায়ে দিয়ে শীত নিবারণ করছে। আগুন জ্বালানোর চুল্লী সেও মধ্যযুগীয়। আমাদেরকে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে কিছু কাঠ আর কয়লা টেনে দয়াময়ী গৃহকত্রী চুল্লীতে ফেললেন। কিছুক্ষণ পরে বছর চৌদ্দ বয়সের একটি কচি মেয়ে চা নিয়ে এসে আমাদের পরিবেশন করলো। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো ওয়ার্ডসওয়ার্থের বেচারী’ সুসান যেন এ জন্মে এ ঘরে এসে ঠাই নিয়েছে। কি ভাসা ভাসা চোখ আর স্নিগ্ধ মধুর সরল দৃষ্টি। তার মুখ থেকে কথা ফুটি ফুটি করেও যেন সলজ্জ কুণ্ঠায় ফুটতে চাইছে না। কি জানি যদি তাদের দারিদ্র আর গ্রাম্যতা ধরা পড়ে যায়। তার মুখের ঝরে-পড়া কথার চেয়ে গুমরে-মরা না-বলতে-পারা বাণীটুকু চোখে মুখে অপরূপ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। সে যেন স্বর্গীয় পবিত্রতার একটি জীবন্ত প্রতিরূপ। এ গ্রামের এ নির্দোষ সরলতাই কি শ’র জীবনে তার মনে রং ধরিয়েছিল, তার মন ভুলিয়েছিল।

একত্রিশ

বিলেতের মাটিতে যে দিন পা দিলাম, সেদিন সামনের দিকে চেয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়েছিলাম। এ আতঙ্কের সবটুকুই ছিলো প্রিয়জনের বিচ্ছেদজনিত। তাই সামনের দিকে চেয়ে চেয়ে যখন ভাবতাম, দু’বছর অচেনা অজানা প্রবাসে কি করে কাটাবো, তখন মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠতাম। অথৈ পানিতে ডুববার সময় মানুষ যেমন আকুপাকু করে, আমারও তখন ঠিক তেমন অবস্থা। কিন্তু সময় বসে থাকে না। এক এক করে দিন কেটে যায় আর বিদায় মুহূর্তও একদিন ঘনিয়ে আসে। তখন পেছনের দিকে ফিরে চাইলে কি করে এতটা সময় কেটে গেলো সেটাই আশ্চর্য মনে হয়। চোখের সামনে অতীতের দিনগুলি ভেসে ওঠে, আর কি পেয়েছি কি পাইনি, মনের আনাচ কানাচ ঘিরে তার একটা খসড়া তৈরী হতে থাকে। ভবিষ্যতের দুয়েতা মনের ওপর ভার হয়ে দাঁড়ায় না; এক সময়ের ভবিষ্যৎ অতীতের রূপ ধরে তার সমূহ সার্থকতা আর ব্যর্থতার ডালা সাজিয়ে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তখন পিছনে ফিরে তাকালে শুধুই মনে হয় এতো সেদিনের কথা। মাঝখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অথবা বছরের পর বছর কাটেনি, কালস্রোতে ভেসে গেছে শুধু ক’টি অমূল্য মুহূর্ত।

আগামীকাল ১৯৫৩ সনের ১৯শে জানুয়ারী। এ দেশ ছেড়ে যাবো। মনে পড়ে দেশের কথা। কচি ছেলে মেয়েদের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অদ্ভুত মানুষের জীবন। এক পায় তো আর চায়, যা পায় তা চায় না। এর জন্যেই বোধ হয় বাংলার কবি এত সুন্দর করে বলেছিলেন–

যারে বাঁধি ধ’রে তার মাঝে আর
রাগিণী খুঁজিয়া পাই না,
যাহা চাই তাহা ভুল ক’রে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।

আমার ত্রিশ বছরের জীবনের পেছনে ফিরে চাইতে আজ যেন স্বতঃই ইচ্ছে করছে। একটি বছর বর্তমান থেকে অতীতে গেলো মিলিয়ে রেখে দিয়ে গেলো গ্রীবনের পাতায় তার স্বর্ণাক্ষর। ভুলিতে চাইলেও তা ভোলা যায় না। জীবনের কতো বড়ো আকর্ষণ ফিকে হয়ে গেছে। কতো ছোট শূন্য মুহূর্তগুলো সূক্ষ্ম স্বপ্নের জাল বুনে দিয়ে গেছে চোখের সামনে। দূর বিস্তৃত পেছনের ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি চোখ মেলে যতোই চাইছি, ততোই এ জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-ব্যথায় মন আমার অভিভুত হয়ে পড়ছে। সবটা মিলিয়ে কি সুন্দর লাগছে পেছনে ফিরে যেতে। সুন্দর বলেই বিস্ময়ের অন্ত পাচ্ছিনে।

ছোটবেলা থেকে বিলেতের গল্প শুনতাম। মাটিও নাকি সোনা দিয়ে মোড়া ছিল এখানকার। ইংলণ্ড প্রায় দুই শতাব্দী আমাদের শাসন করলো। তার সম্বন্ধে আমাদের ছেলেমেয়েরা কচি বয়সে, যা শোনে, তারও চেয়ে বেশী তার চারপাশে রঙীন করে স্বপ্ন কল্পনা মাখিয়ে তাকে রাঙা করে তোলে। তাই ইংলণ্ড আর ইংরেজ জাত–এক কথায় বিলেত আমাদের মনের চারপাশ ঘিরে এমন একটা মায়াজাল রচনা করে যে, তাতেই আমাদের অনেকেরই বিলেতের সঙ্গে হয় অলক্ষে প্রণয়। এর উপর মোহ ছড়ায় আমাদের দেশ থেকে এর হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান। সুদূরের আকর্ষণ কল্পনাপ্রবণ মানুষের কাছে কম নয়। দূরের মোহ তাই আমাদেরকে কম অশান্ত করেনি।

আমাদের দেশের কবিই ত গেয়েছেন–

‘ওগো সুদূর বিপুল সুদূর-তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি—’

তাই দূরের দেশকে ঘিরে আমাদের মনের আনাচে কানাচে কতো অসম্ভব কথা, কতো আজগুবি কল্পনা যে রাজত্ব করেছে, কেই বা তার ইয়ত্তা করে।

এমনি করেই শিশু বয়সে বিলেতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তারপর কেমন। ক’রে জানিনা সাহিত্যের ছাত্র হলাম। রবীন্দ্রনাথ যোগালেন কল্পনা। শেলীর কাছ থেকে পেলাম জীবনস্বপ্ন। কীটস্ যোগালেন সৌন্দর্যপিপাসা। মাইকেল আনলেন শান্ত গাম্ভীর্যের মধ্যে অশান্ত চঞ্চলতা। জীবনকে দেখতে শিখলাম রয়ে সুয়ে নয় শুধু ছেড়ে যাবার ফেলে যাবার তাগিদে। নইলে আমার মতো বিত্তহীন মানুষের প্রিয় পরিজন ও কচি ছেলেমেয়ে ফেলে সাত সাগরের দেশ বিলেতে আসা যে সুবিবেচনার হয়নি, তা আমি নিজেও বুঝি। কিন্তু হঠাৎ একদিন ভাগ্য যেন সুপ্রসন্ন হয়ে উঠেলো। সুযোগ এলো স্বপনপুরীর রাজকন্যার ঘোমটা খোলবার। সংশয় ছিল অনিশ্চয়তাও ছিল। তবু তার মধ্যেই মনে মনে তৈরী হয়ে উঠলাম। বিলেতে আসবে বলে জাগ্রত চেতনায় কতোদিন কতো কল্পনার জাল বুনেছি। সুরের খেই কখনও হারিয়ে গেছে, কখনও বা আবার ফিরে এসেছে। কতো রৌদ্রদীপ্ত দিনে, কতো বর্ষণমুখর শ্রাবণে, কতো বাসন্তী চাদিমায়, কতো গভীর অমারজনীতে কল্পনার জাল ছিন্ন হয়ে গেছে, আবার কখন অজ্ঞাতে জোড়া লেগেছে। সকল আয়োজন শেষ করে অবশেষে সেই সাগরপারের বিলেতের পথে বেরোবার সময় আমারই জীবনে একদিন ঘনিয়ে এলো। গৃহিণীর কাছ থেকে, কচি কচি বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায়ের লগ্ন ঘন দুর্যোগের ভিতর দিয়ে নামলো।

তারপর?

বিলেতের পথে বিমান উড়লো আকাশে। দেশের ছবি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। পেছনে পড়ে রইলো আমার কর্মক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় আর কর্মমুখর ঢাকা নগরী। সবার উপর আমাদের সোনার শ্যামল পূর্ব-বাংলা। আমার দেশ আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। তবু মা এবং মাতৃভূমির স্নেহের তোর ছিড়লাম। পেছনে ফেলে এলাম এতো বছরের জীবনে নিবিড় করে পাওয়া এতোগুলো মুহূর্তকে। কে বলবে আমার অতীত ও তখনকার মুহর্তগুলো এক সুরে গাথা ছিলো? আমারই জীবনের সকল মাধুরী আহরণ করে একে একে যে দিনগুলো আমারই অতীতকে সমৃদ্ধ করলো, তারা তখন আর আমার ছিল কি?

আর আজ?

সুখে-দুঃখে প্রবাসের এ দিনগুলো কেমন করে যে এখানে কেটে গেলো তাই ভাবছি। প্রথম প্রথম মনে হতো কোনো রকমে যদি পালাতে পারতাম। আমাদের দলের অনেকেই দেশে স্ত্রী-পুত্র ফেলে এসেছিলেন। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? যার সঙ্গে দেখা হতো তারই মুখ দেখতাম ইংলণ্ডের আকাশের চেয়েও গম্ভীর আর বিষণ্ণ। দলের মধ্যে হাসির কথা যদিই বা কিছু হতো, সবার কাছ থেকে আড়াল হয়ে গেলে সব হাসি আর সুখস্মৃতি বেদনার রূপ ধরে বুকের উপরে পাষাণের মতো চেপে বসততা। সুখের সময় দেশী বন্ধুদের সঙ্গ কম ভালো লাগতো না। দুঃখের সময় তাদের কাম্য হলেও সকলে এক জায়গায় জুটলে তিল তিল করে সকলের বেদনা যেন জগদ্দল পাথরের মতো ভার হয়ে উঠতো। এখানে এসে প্রথমে যে বাড়ীতে উঠেছিলাম, সেখানে আমার রুমে থাকতেন আমারই এক স্বদেশী এবং সহকর্মী বন্ধু (মিঃ স–বর্তমানে তিনি করাচীতে পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী)। সবে বিয়ে করে বৌয়ের গায়ের হলুদ বাসি না হতেই প্রবাসের পথে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি। তার হৃদয়ের ক্ষত ছিল টাটকা। বেদনা ছিল গাঢ়। আশা, হতাশা, আনন্দ ও উদ্বেগ মিলে মিশে তার চোখের সামনে কি যেন এক মায়ার জগৎ রচিত হয়েছিল; তাকে দেখে মনে হতো বিরহী যক্ষের কথা। চাতক পাখীর মতন তিনি ডাকের দিকে চেয়ে থাকতেন। তাঁর সদ্য-পরিণীতা বিরহ-বিধুর স্ত্রীর কাছ থেকে দশ-পনের পৃষ্ঠার চিঠি আসততা তার কাছে। তাঁকে দেখতাম অন্তহীন পিপাসা নিয়ে তাঁর নববধূর পত্র থেকে আকণ্ঠ প্রেমের মাধুরী পান করতে।

দিন যতো এগিয়ে যেতে লাগলো, ধীরে ধীরে বেদনা-বাণ বিদ্ধ দেশী বন্ধুদের আওতা থেকে ততোই দূরে সরে যেতে লাগলাম। জীবন হরণ করা এক শীত কাটিয়ে এখানে। প্রকৃতিতে জীবনের জয়গান মুখরিত বসন্তের আবির্ভাব আর লীলা দেখলাম। প্রকৃতির আধার দূর হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের কুহেলীও ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে গেল। এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশলাম। মানুষের মন দিয়েই মানুষকে বুঝবার আর জানবার সুযোগ খুঁজে ফিরতে লাগলাম।

আমি থাকতাম লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে। বহুদেশ এবং বহু জাতের মানুষই এখানে বাস করতো। তাদের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পেয়ে তাদের মন এবং প্রকৃতি বুঝবার অবকাশ পেলাম। এ হোষ্টেলটিই আমার কাছে ছিল মিনিয়েচার লন– লণ্ডনের এ কেন্দ্রবিন্দুটিতে মানব-মহাসিন্ধুকে জানবার সুযোগ পেলাম।

লণ্ডন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো শহর আর সবচেয়ে জনবহুল। অধিকারের দিক থেকে এ শহর ইংরেজদেরই, কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে এটি দুনিয়ার নার্ভ সেন্টার ব’লে দুনিয়াতে এমন আন্তর্জাতিক শহর খুব কমই পাওয়া যায়। এখানে মানব-মহাসমুদ্রের মহাসঙ্গম সাধিত হয়েছে। হেন দেশ নেই যেখানকার মানুষ এ শহরে দেখা যায় না। বিশ্বের প্রাণধারা শত ভঙ্গিমায় এ শহরে প্রবাহিত হয়ে গেছে। ধর্ম বর্ণ জাতি তার আশ্চর্য জটিলতা এবং বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মানুষ যে মানুষই তা দেখবার সুযোগ এবং সৌভাগ্য হলো এখানেই। পুরুষ এবং স্ত্রী নিয়েই এ মানব মহাজগৎ। সে জগৎ এখানে এসে মিশেছে আশ্চর্য রকমের সহজ স্বাভাবিক ছন্দে। পরস্পরের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই, অনাবশ্যক কোন ব্রীড়া বোধ নেই, সলজ্জ সন্ত্রস্ত ভাব নেই। আমাদের দেশে স্ত্রী-পুরুষের মাঝখানকার সমাজ-বিধান শাসিত অবরোধের কোন দেয়াল নেই। নারী ও পুরুষ-মানব জগতের এই দুই শাখা এখানে মুক্ত জীবনানন্দেই যেন বিকশিত হয়েছে।

দুনিয়াতে মানুষের মন বোধ হয় সবচেয়ে দুর্গম ও দুয়ে। একটি মানুষের মন জানাই কম দুরূহ ব্যাপার নয়। আমরা নিজেরাই বা নিজের মন কতটুকু জানি। সুতরাং বহু লোকের মন জানতে পেরেছি এ অহঙ্কার কেমন করে বা করি। কিন্তু মন জানাতো পরের কথা, মন জানবার আগে মানুষকে দেখবার সৌভাগ্যও তো কম নয়। তাই বা কার কপালে জোটে? সে জন্যে নিজের ভাগ্যের কথা নিয়ে যখন চিন্তা করি–কোথাকার মানুষ কোথায় এসেছি যখন এ কথা ভাবি, তখন নিজের ভাগ্যকে আর ধিক্কার দেই না। এ জীবনে কি পাইনি তা নিয়ে তর্ক তুলি না। যা পেয়েছি তাকে সৌভাগ্য বলে মানি। শত দুঃখ-বেদনার মধ্যেও প্রবাসের এ দু’টি বছরে আমি যে মরজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছি, সেজন্যে গর্ববোধ করি। আমি মিশে গেছি মানুষের মহৎ মেলার মধ্যে। এ মানুষের কতো জাত, বর্ণ ও ধর্মের লোকের সঙ্গে যে মিলেছি, কতো নরনারীর সঙ্গে কতো কথা বলার যে সুযোগ পেয়েছি, কতো ভাবে যে তাদের অন্তরের মহত্ত্বের পরিচয় পেয়েছি, পেয়েছি তাদের মনের উদারতার কতো যে স্পর্শ! লণ্ডন আমাকে এ সুযোগ দিয়েছে। তাই লণ্ডন ছেড়ে যাবার আগে লণ্ডনের প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা জানিয়ে যাই। কৈশোর ও যৌবনের কতো প্রতীক্ষা নিয়েই যে এখানে এসেছিলাম! প্রথম মিলনে আমার ভীরু হিয়া গুরু ত্রাসে দুরু দুরু করে উঠেছিল, কিন্তু দু’বছর সুখ-দুঃখের পরিচয়ের পরে আজ যখন একে ছেড়ে যাবার প্রশ্ন মনকে জিজ্ঞেস করছি, তখন দেখি আমার অজ্ঞাতে মন বলছে

‘এসেছিনু প্রাণ হরিতে মহা পারাবার পারায়ে।
ধরিব কি ধরা দিবে সে ‘গেনু’ আপনারে হারায়ে।’

টেবেরি পোর্ট থেকে আগামীকাল আমার জাহাজ ছাড়বে। প্রিয়জনের সঙ্গে মিলনের আনন্দে মন অধীর হয়ে উঠেছে। সে আনন্দ কি কম? কিন্তু যখন ভাবি স্বদেশে আমরা কোথায় পড়ে আছি, দেশ আছে অন্ধকারে, দেশের মানুষের মন আছে মধ্যযুগে, ক্ষুদ্র স্বার্থের তাড়নায় মানুষে মানুষে দেশে এতো বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত কারণে এত রেষারেষি, এতো পেছুলাগা আর এতো হানা-হানি, আত্মীয় বন্ধুতে বিচ্ছেদ, ভাইয়ে ভাইয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তখন দেশে ফেরার কথা মনে করে ভেতরের সমস্ত উৎসাহ স্তিমিত হয়ে আসে। দেশে পৌঁছার পর এখানে কি কোন দিন আর আসতে পারবো? আবার কি জোটাতে পারবো রাহা খরচ? যদি জীবনে আর এ সুযোগ না আসে, আর কোনোদিন ইউরোপের পথে যদি পা বাড়াতে না পারি, তবে মানুষের এ মহাজীবনের, তার সঙ্গে এ মহামিলনের আর মনের এ মহামুক্তির স্বাদ কোথায় পাবো?

পরিশিষ্ট

(ক) পত্র পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত অংশ

১. বিলেতের পথে। মাহেনও, শ্রাবণ (১৯৫১)

২. ইংরেজ জীবন ও চরিত্র। দৈনিক মিল্লাত, ১,৮ ও ১৫ জুন (১৯৫২)

৩. পথ চলতে। দৈনিক সংবাদ, ১৪ আগষ্ট (১৯৫৩)

৪. রিজেন্ট পার্কের চিড়িয়াখানায়। দৈনিক সংবাদ, অগ্রহায়ণ (১৯৫৩)

৫. ওকিং মসজিদে। দৈনিক-সংবাদ, নভেম্বর (১৯৫৩)

৬. বিলেতে বড় দিন। দৈনিক আজাদ, ২৬ ডিসেম্বর (১৯৫৩)।

৭. বিলেতের শিশু দৈনিক আজাদ, ১০ জানুয়ারি (১৯৫৪)

৮. শিশুজগৎ ও বিলেত দৈনিক আজাদ, ২৬ জানুয়ারি (১৯৫৪)

৯. প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিলেত। দৈনিক আজাদ, ৩১ জানুয়ারি (১৯৫৪)

১০. ব্যোমযানে বিলেত। স্পন্দন, চৈত্র (১৯৫৪)

১১. বিলেতের শীত। দৈনিক আজাদ, ১১ এপ্রিল (১৯৫৪)

১২. বিলেতের বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল। দৈনিক আজাদ, এপ্রিল-মে (১৯৫৪)

১৩. বিলেত ও বিলেতের মানুষ। দৈনিক আজাদ, মে (১৯৫৪)

(খ) পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি অভিমত :

১। জামিল চৌধুরী :

মুহম্মদ আবদুল হাই রচিত ‘বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন’—বইটি গতানুগতিক ভ্রমণ। কাহিনী নয়। আবার নিছক রম্য রচনাও নয়। এ বইটির মধ্যে তথ্যাশ্রিত গল্প আর গল্পাশিত তথ্যের যে অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং এই দুয়ের স্বাদ-ব্যঞ্জনায় বিলেত ও বিলেতবাসীর যে যথার্থ রূপ প্রতিফলিত হয়েছে, তা লেখকের কৃতিতু, পাণ্ডিত্য এবং সূক্ষ্মদর্শী মনোভাবের পরিচায়ক। বিলেতের পরিচয় তিনি রাজরাজড়া, লর্ড বা ব্যারনদের জমকালো জীবন, প্রাসাদ, দুর্গ, মিউজিয়ম বা ঐশ্বর্য থেকে গ্রহণ করেন নি, করেছেন মধ্যবিত্ত জীবনের বঞ্চিত বাসনা থেকে, বৃটিশদের কূটনৈতিক শঠতা ও বঞ্চনা থেকে, তাদের সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক এমন কি পারিবারিক জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিভাস থেকে। তাই বিলেত দেশটি এবং তার মানুষ এত অকৃত্রিমভাবে তার চোখে ধরা পড়েছে এবং অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়েই তিনি তা পরিবেশন করেছেন তাঁর পাঠকদের কাছে।

মুহম্মদ আবদুল হাই পণ্ডিত ব্যক্তি এবং একজন প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক। দেশ চেনা ও জানায় তার এই পাণ্ডিত্য ও ধ্বনিজ্ঞানও যথেষ্ট সাহায্য করেছে। …সঙ্গীতের ব্যঞ্জনার মত তার এই কাহিনীর ভাষা।

(সওগাত, মাঘ ১৩৬৫ : ৫৪-৫৫ পৃ.)

২। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :

মুহম্মদ আবদুল হাই সাহেবের সাম্প্রতিক বই ‘বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন’ লেখকের বিদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে লেখা। লেখক বলেছেন বিলেত সম্পর্কে তার ঔসুক্য ছেলেবেলার।…একটা আনন্দিত মনের ছাপ এই বইএর প্রধান বৈশিষ্ট্য। …সে আনন্দ শুধু যে নতুনের দেখার তা নয়, তা বিশেষ করে নতুনের আলোকে পুরাতনকে দেখার। …নতুন অভিজ্ঞতাকে তিনি প্রধানত প্রাক্তন ও দেশজ অভিজ্ঞতার আলোকেই বিচার করেছেন। ওদেশের গাইফকসের উৎসবের পাশে আমাদের শবে বরাতের পটকা ফোঁটানো, ওদেশের পুলিশের পাশে আমাদের পুলিশ, ওদেশের শীতের পাশে আমাদের দেশের শীত, ওদেশের সবুজের পাশে আমাদের সবুজ প্রায় সমান্তরাল রেখার মত উপস্থিত রয়েছে। মেয়েদের স্বাস্থ্য, দু’দেশের ছড়া, খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি অনেক ব্যাপারে তুলনামূলক আলোচনাও আছে।…ঐ সমান্তরাল বৃত্তির কারণটা বোঝা কঠিন নয়। আবদুল হাই মূলতঃ শিক্ষাবিদ ও প্রবন্ধকার, আনন্দের মুহূর্তেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তার মনে থাকে। থাকে হয়তো এই জন্যেই যে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তার উপলব্ধিটা আন্তরিক।

এ-কারণে এই বইয়ে… লেখকের উদ্দেশ্য যতটা না ভ্রমণের কাহিনী বলা, তার চেয়ে বেশী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করা। লেখকের নিজের কৌতূহলের ছাপ এ বইতে আছে, কিন্তু পাঠকের কৌতূহলকে উৎসাহিত করার চাইতে তার বুদ্ধিবৃত্তির কাছে আবেদন করাকেই তিনি সঙ্গত মনে করেছেন।…আলডাস হাকলীর একটি ভ্রমণ কাহিনী Beyond the Maxique Bay.. বইতে তত্ত্বকথার প্রাচুর্য চোখে পড়ছে। কিন্তু তত্ত্বকথা এখানে প্রবন্ধধর্মী নয়–একান্তই রম্য-রচনাধর্মী। …তত্তমূলে প্রায় সমান মূল্যবান। কথা হাই সাহেবের বইতে আছে।…এবং হাই সাহেবের বইতেও অবশ্যি এমন জায়গা আছে যেখানে প্রবন্ধের গাম্ভীর্য রম্যরচনার মেজাজে পরিণত হয়েছে। …এই লেখকের আনন্দবোধ সৌন্দর্যের প্রশংসায় সঙ্কুচিত নয়। সাহিত্য প্রীতির সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্য-প্রীতিও বইতে লক্ষণীয়। আমার ত’ মনে হয় সৌন্দর্যের বর্ণনাতেই তার ভাষা অধিকতর স্ফূর্তি পেয়েছে।

লেখকের ভাষা সুখপাঠ্য।

(উত্তরণ, কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৩৬৫: ১৩২-৩৫ পৃ.)

৩। আবদুল গাফফার চৌধুরী :

সমারসেট মমের অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘Of Human Bondage’ সম্পর্কে বলা হয়, ‘It’s a happy memory, a song, a benediction…’ দুটি বইয়েরই চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। তবু মাফি, ভাটনগর, মাদাম মারী, মিস হার্ড ও ভেরিঙ্কহার্ড, বিশর, পিটার ও গে’বনেলের গল্প পড়তে পড়তে ‘বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন’ এই নামটি ভুলে যেতে হয়। মনে হয়, নেপথ্যে লেখক ও তার লেখা। আসলে এই চরিত্রগুলিই জীবন্ত ও সত্য। কিন্তু সংক্ষিপ্ততম ও অপরিণত আভাসে মনে অতৃপ্তি থেকে যায়। অথচ আর একটু বললেই এদের প্রায় সমাপ্তিটুকু পাঠক অনায়াসে নিজের কল্পনায় উপভোগ করতে পারতো। বিশেষ করে পিটারের গল্পটি।…তবে পাঠকের উপর অবিচার করনে নি লেখক। ভ্রমণ নয় স্মৃতিকথা, স্মৃতিকথা নয়–ভ্রমণ, এ দুয়ের সংমিশ্রণে এক আশ্চর্য রস সৃষ্টি করেছেন তিনি; তাতে সঙ্গীতের সম্মোহ সৃষ্টি করেছে ভাষা।…

‘আর তার আশার দানা-রঙীন গানের উপর আঁকা সাঁজেলিজে যেন একটি
মিষ্টি তিলক ফোঁটা। শেষে আর্ক দু’ত্রয়াম। আট দিক থেকে আটটি রাস্তা
এসে পায়ে কুর্নিশ করছে।’

‘বিলেতে সাড়ে সাত শ দিনের ভাষা আশ্চর্য সঙ্গীতমুখর। অনুভব ও হৃদয় সংবেদনার মদিরতা মাখা তা স্বীকার করতেই হবে।…লেখক মুহম্মদ আবদুল হাই একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। তিনি পণ্ডিত এবং সব চাইতে উল্লেখযোগ্য–একজন ভাষাবিজ্ঞানীও। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তার এই পাণ্ডিত্য, তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞান বইয়ের কোথাও সাহিত্যরস বা ভাষার মাধুর্যের পথে অন্তরায় হয় নি..। বরং মাঝে মাঝে প্রসঙ্গক্রমে দু’একটি কথায় যেখানে তিনি পাঠককে তত্ত্ব বা তথ্য দান করেছেন তা বর্ণনার রসে ভেততে ঠেকে নি। আশ্চর্য সমমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তার। কখনো সাহিত্য-রসিক, কখনো শিল্প-রসিক, কখনো ভাষাতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ, কখনো কবি বা দার্শনিকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি সমগ্র বইটিতে বিচরণ করেছেন; কিন্তু নেপথ্যে সর্বক্ষণ বিরাজ করেছে একটি গভীর সংবেদনশীল স্রষ্টা-মন।

…বইটি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, তিনি বিদেশের ভূ-চরিত্র ও জাতীয় জীবন সম্পর্কে বেশী উচ্ছ্বাসপ্রবণ; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার কঠোর বিচারক-সুলভ মন্তব্য এ ধারণা দূর করে দেয়। আর এ জন্যেই বইটিকে ইংরেজের সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য বই হিসেবে গ্রহণ করা চলে।…অর্থাৎ ভালোমন্দ, আলোয় আঁধারে মিশে যে সত্যিকারের ইংল্যান্ড তারই চিত্র এঁকেছেন তিনি সমস্ত অনুভুতি দিয়ে। ইংরেজদের জাতীয় জীবন সম্পর্কেও এই একই কথা। ভলোটুকু বলেছেন অকৃত্রিম দরদ দিয়ে, মন্দটুকুও তুলে ধরেছেন বিচারকের নিরাসক্তি নিয়ে।…অহেতুক জাতিবিদ্বেষ তার দৃষ্টির ঐতিহাসিকতাকে আচ্ছন্ন করে নি।

এমনি সব বর্ণনা, বিবরণ, (বিস্ময়কর) উপমা ও গল্পের মধ্য দিয়ে মুহম্মদ আবদুল হাই ইংরেজদের সমাজ, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান এমন কি ব্যক্তিচরিত্র তুলে ধরেছেন। …বিচিত্র গল্পরসে সমৃদ্ধ সে সব বিবরণ নিয়ে আলোচনা চলে না। তা পাঠকের একান্তভাবে জানা ও উপভোগের বিষয়।..

(দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ মাঘ ১৩৬৫/২৫ জানুয়ারি ১৯৫৯; ৪ এবং ৩ পৃ.)।

৪। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান :

ব্যক্তিক প্রবন্ধ পর্যায়ে ভ্রমণ বা প্রবাসের অভিজ্ঞতা রচনা সাম্প্রতিক বাংলাসাহিত্যের এক বিশিষ্ট লক্ষণ।…আধুনা প্রকাশিত “বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন’ এ শ্রেণীর রচনায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

..ধ্বনি বিজ্ঞান সম্পর্কে অধ্যয়ন ব্যাপদেশে তিনি (লেখক) ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ১৯৫৩ সালের জানুয়ারীর মাঝামাঝি পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন এবং বিভিন্ন অবকাশে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থান ও পারী ভ্রমণ করেন। এই প্রবাস জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্পদেই গ্রন্থটি পরিপূর্ণ। ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক-ছাত্রের তীক্ষ্ণ সচেতন বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি সর্বদাই অভিজ্ঞতাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করে নিতে প্ররোচিত করেছে বলে গ্রন্থটি অপূর্ব তথ্য সমৃদ্ধ।

অপরিচিত আবেষ্টনীকে মনের অভ্যাসের সাথে মিলিয়ে নেবার কালে তার শ্রেষ্ঠত্বের দিকেই দৃষ্টি পড়ে প্রথমে। লেখক তাই বিলেতের নগর ও নাগরিকতা, আচার ও আচরণ, কর্মব্যস্ততা ও অবসর, কর্তব্য ও আনন্দ, শিক্ষা ব্যবস্থা, যানবাহন, পত্র পত্রিকা, মিউজিয়াম, জু, আর্ট একজিবিশন ইত্যাদির তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা দিয়েছেন জাগ্রত কৌতূহলে। খ্রিস্টমাসের উৎসব মুখর পরিবেশের, এমন কি খ্রিস্টমাস-কার্ড প্রেরণের আনন্দের সঙ্গে বহুজনের জীবিকার সম্পর্কও যে জড়িত তা তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি।

অথচ এই তীক্ষ্ণ বিচারশীল দৃষ্টির সঙ্গে আছে এক আশ্চর্য সংবেদনশীল মন, যার ফলে তথ্যের গুরুভার কখনো যথার্থ ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে না। বরং ছোট ছোট ঘটনার হৃদয়াবেগ ও ভাবোচ্ছ্বাসের স্নিগ্ধ চড়াই-উত্রাই পাঠকের কৌতূহলকে জাগ্রত করে রাখে। সঙ্গীহারা শ্যামদেহী যুগলের অসহায় তরুণীটির বিবর্ণ-হাসি, সুইজারল্যান্ড থেকে আগতা বোর্ণমাথের মাফির হোমসিকনেস বা নটিংহামের পিটার সত্যিই মনকে ছুঁয়ে যায়।…

গ্রন্থকারের ভাষায় বাহুল্য বর্জিত চিত্তাকর্ষক সুন্দর সুষ্ঠু ও মোহনীয় আবেশ রয়েছে।…

(দৈনিক মিল্লাত, ১৪ ভাদ্র ১৩৬৫/৩১ আগস্ট ১৯৫৮:৪ পৃ:)

(গ) বাংলা একাডেমী প্রকাশিত মুহম্মদ আবদুল হাই রচনাবলী’ (১৯৯৪)-তে ড. হুমায়ুন আজাদ গ্রথিত ‘বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন’-এর গ্রন্থপরিচয়’ (অংশ বিশেষ) :

‘প্রথম সংস্করণ ১৯৫৮; নওরোজ কিতাবিস্তান, ৪৬ বাংলাবাজার, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৪+১৭৬; দাম- তিন টাকা। কলেজ সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪; নওরোজ কিতাবিস্তান, ৪৬ বাংলাবাজার, ঢাকা ১। পৃষ্ঠা ৪+২০৮; মুল্য-৩,০০। উৎসর্গ : আমার স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের হাতে। কলেজ সংস্করণ ষষ্ঠ মুদ্রণ আগষ্ট ১৯৬৯: হাসিন জাহান, ২ সেক্রেটারিয়্যাট রোড, ঢাকা। পৃ. ৪+২০৮; মূল্য-৩.০০। কলেজ সংস্করণ সপ্তম মুদ্রণ আগস্ট ১৯৭০; হাসিন জাহান, ২ সেক্রেটারিয়া রোড, ঢাকা। পৃ. ৪+২০৮; মূল্য তিনটাকা পঞ্চাশ পয়সা মাত্র। উৎসর্গ: আমার পুত্র ও কন্যাদের হাতে। বইটির নাম প্রথম স্থির করেছিলেন বিলেতের কথা। সাহিত্য ও সংস্কৃতি [প্রেস ১৯৫৪] বইয়ের পেছনের মলাটে এ-নামে ঘোষণাও দেয়া হয়েছিলো। বইটি প্রকাশের পর বইটির একটি কর্কশ অশোভন আলোচনা লিখেছিলেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ (সমকাল ১৩৬৫.২:৩, ১৯৮-২০৩]। তিনি লেখককে তিরস্কার করেছিলেন নানাভাবে, এবং একুশ অধ্যায়ে বিভিন্ন পত্রিকার প্রচারের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে, তার ভুল ধরেছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও (উত্তরণ ১৩৬৫, ১:২, ১৩২-১৩৫] একটি আলোচনা লিখেছিলেন বইটির, লেখককে কিছুটা প্রশংসা করে সুখী করার জন্যেই অনেকটা; তবে তিনিও কয়েকটি আপত্তি তুলেছিলেন। বইটির নামই তার কাছে মনে হয়েছে আপত্তিকর, যদিও আমরা আপত্তির কোনো কারণ দেখি না। মুহম্মদ আবদুল হাই বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন-এর প্রথম সংস্করণের একটি কপিতে নিজের হাতে বইটিকে নানাভাবে সংশোধন করে লিখেছিলেন ‘Corrected copy for future editions… M.A Hai. ৩০/৮/১৯৬০’। পরবর্তী সংস্করণগুলো তার এ সংশোধন অনুসারেই ছাপা হয়, তবে তার সব সংশোধন অনুসরণ করা হয় নি। সম্ভবতঃ ছাপার সময় তিনি নিজের সংশোধন পুরোটা মানেন নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *