বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – ১০

দশ

লণ্ডনের টিউব রেলওয়ের নাম দুনিয়া জোড়া। টিউব মানে সুড়ঙ্গ। শোনা যায় ঢাকার লালবাগ কেল্লার নীচে মোগল শাসনের সময় সুড়ঙ্গ পথ ছিল। মাটির নীচে দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত এ পথ এগিয়ে গিয়েছিলো। আমরা যখন ঢাকায় এলাম তখন ইসলাম খাঁর সময়কার এ সুড়ঙ্গ পথের কথা শুনে ভারী কৌতূহল বোধ করলাম। পরী বিবির কবর আর লালবাগ। কেল্লার সুড়ঙ্গ পথ দেখবার জন্যে সদলবলে সেখানে হাজির হয়ে মুসলিম শাসনের সমাধি দেখেছিলাম।

এককালে মুসলমানদের যা ছিল বিলেতে এসে দেখেছি পুরো মাত্রায় তার বিকাশ করেছে ইংরেজরা। পরিধিতে দুনিয়ার সব চাইতে বুড়ো শহর লণ্ডন। আয়তনে ৬৯৩ বর্গমাইল। দালানকোঠা ঘরবাড়ীতে বোঝাই এ শহরটি। এক ঘরে গাদাগাদি করে এখানে বহু লোক বাস করে না। প্রত্যেক লোকের জন্য ঘর চাই স্বতন্ত্র। তাই দোকানপাট, ঘরবাড়ী আর দালানে দালানে লণ্ডনের বুক ভরে আছে। এখানকার মানুষেরা কাজ বোঝে। কাজের জন্যে এক রকম ছুটেই চলে। তাই শহরের ওপর দিয়ে রেলপথ তৈরী করে ঢাকার মতো। লেভেলক্রসিং-এ পথে বেরিয়ে অত্যাচারে আটকে পড়তে এ জাতটা নারাজ। প্রতি ইঞ্চি মাটির সদ্ব্যবহার জানে এরা। মাটি এদের কম বলেও কিছুটা এমন হবে হয়তো। তাই সারা লণ্ডন শহর জুড়ে মাটির নীচ দিয়ে পাতালপুরীতে আর একটা শহর এরা গড়ে তুলেছে। অধিকাংশ বাড়ীতেই যেমন বেসমেন্ট অর্থাৎ মাটির নীচে দু’একটা ঘর তেমনি লণ্ডন শহরের। অধিকাংশ জায়গা জুড়ে মাটির তলায় এখানকার সুড়ঙ্গ-রেলপথ।

উপর থেকে কিছু বোঝা যায় না। মাটির নীচে এমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। রাস্তার পাশ দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ পথের মাঝখানে চারিদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা সুড়ঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। ওপরে হয়তো লেখা থাকবে ষ্টেশনের নাম। কোথাও বা আণ্ডারগ্রাউণ্ড ট্রান্সপোর্ট বা রেলওয়ে। আবার কোথাও দেখা যায় ঘরের একটি দরজার মতো। সেখান দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ নীচে নেমে গেলে পাওয়া যাবে বিরাট স্টেশন। আমাদের দেশের মাটির উপর বড়ো বড়ো স্টেশনগুলো যেমন এদেশের মাটির নীচের স্টেশনগুলোও তেমনি। সেখানে টিকিটঘর। প্লাটফম। সেখানেই সব। তার আবার তলা শুধু একটা নয়। মাটির ওপর থেকে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নীচে নেমে এসে যেমন এ ধরনের একটা বিরাট স্টেশন দেখা যায় তেমনি আবার এর নীচেও কয়েক তলা থরে থরে সাজানো আছে। অতো নীচে নামা যদিও বা সহজ হয়, সেখান থেকে ওঠা তো আর তেমন সহজ নয়। তাই এরা Escalator বা চলন্ত সিঁড়ির বন্দোবস্ত করে রেখেছে। মাটির ওপর থেকে সাধারণ সিঁড়ি বেয়ে প্রথম তলায় এলে তারপরের তলাগুলোতে যেতে এই এস্কেলেটরের সাহায্য নিতে হয়। তল্লাবাশের কতকগুলো চওড়া বাতা এক জায়গায় ক’রে সুতো দিয়ে একত্রে গেঁথে সিঁড়ির মতো বিছিয়ে দিলে যেমন হয়, এস্কেলেটরের একটা ধাপও তেমনি। মাটির নীচের প্রথম তলাগুলো থেকে তার নীচের তলাগুলোতে যেতে এ জীবন্ত সিঁড়ির প্রয়োজন। ওপর থেকে এসে এর একটাতে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই সাত আটটা ধাপ ফিতার মতো গড় গড় করে চলার পর একেবারে সিঁড়ি হয়ে যাবে। তখন হয় তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকি কিংবা নীচে ওঠানামা করি, ঠিকমতো গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যাবে। নামার জন্য যে ব্যবস্থা ওঠার জন্যেও তাই। নিজের কোন পরিশ্রম নেই। ইলেকট্রিসিটির চলন্ত সিঁড়ি ক্রমেই যেমন পাতালপুরীতে নেমে যাচ্ছে তেমনি সেখান থেকে উঠিয়েও নিয়ে আসছে। এমনি করে একটার পর একটা প্লাটফরম পাওয়া যায়। এখানে দুতিন মিনিট পরই গাড়ী আসছে। এক একটা ট্রেন প্রকাণ্ড। আমাদের ঢাকা কি চাটগা মেইলের সমান, কি তারও বড়ো বই ছোট হবে না। প্ল্যাটফরমে গাড়ী এসে দাঁড়ালে যারা নামার তারা নেমে যাচ্ছে, যারা উঠবার তারা উঠে যাচ্ছে মাত্র দু’এক মিনিট সময়ের মধ্যে। তারপর সুড় সুড় করে বিরাট দৈত্যের মতো গাড়ীটি সুড়ঙ্গ পথের মধ্যে ঢুকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সুড়ঙ্গ পথের স্টেশনগুলো মাটির তলায় বলে দিনরাত সেখানে সমানে আলো জ্বলছে। আলোয় আলোয় দিন বরাবর সেই পাতালপুরীর রাজ্য। হাজার হাজার মানুষ রাস্তা দিয়ে পথ বেয়ে চলতে চলতে ইঁদুরের মত সুড়ঙ্গ পথের গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ছে আবার সুড়ঙ্গ দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে যে যার কাজে শহরের বুকে ছিটিয়ে পড়ছে। হ্যামষ্টেড বলে একটি স্টেশন আছে মাটির নীচে। সেটি আঠর তলা (১৯৫ ফুট)। টেমস নদীর নীচ দিয়ে মাটির তলা দিয়ে ট্রেনে বা পায়ে হেঁটে কি করে মানুষ চলাচল করে নিজের চোখে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো ছেলেবেলায় পড়া সে লাইনটি “উপরে জাহাজ চলে নীচে চলে নর, অপরূপ আর কি আছে এরপর। লণ্ডন শহরের টিউব রেলওয়ে আমার কাছে ভারী আশ্চর্য লাগে। এর ভেতরে স্টেশন আছে। ইচ্ছে হলে সেখান থেকে টিকিট করা যায়। নইলে পাশে মেশিন আছে, সেখানে পয়সা ফেললে টিকটিও বেরিয়ে আসবে, আবার টাকাটা সিকিটা দিলে টিকিটের দামটা রেখে মেশিনই বাকী পয়সা ফিরিয়ে দেবে।

এগারো

লণ্ডনে পৌঁছার দু’দিন পরেই আমরা বরাঈদের নামাজ পড়তে গেলাম লণ্ডন থেকে মাইল তিরিশেক দূরে ওকিং মসজিদে। লণ্ডনে মুসলমানদের আরও কয়েকটি মসজিদ আছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রবাসী জাহাজীদের কলোনী অঞ্চল পূর্ব লণ্ডন আল্ডগেটে একটি। আর পাটুনীতে কাদিয়ানীদের মসজিদ। বেকার স্ট্রীটের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারেও ঈদের দিনে নামাজ হয়। লণ্ডনে ওকিং-ই সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদ।

বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হবে। মসজিদ কমিটির সৌজন্যে অন্তত একটি বেলার জন্যে সিদ্ধ খাবারের দেশে মুফতে রসনা পরিতৃপ্তিকর পাকিস্তানী খানা খাওয়া যাবে। আরও দেখা যাবে দুনিয়ার নানা জাতির মুসলমানকে। এক ঢিলে এতগুলো পাখী মারা যাবে দেখে লণ্ডন প্রবাসীরা তো বটেই, এমনকি ইংলণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলের অবস্থানকারী মুসলমানরাও ঈদের দিনটিতে ওকিং-এ নামাজ পড়তে আসে।

এ মসজিদের পাশে নানা জাতীয় ফল ফুলের গাছের ছায়ায় নামাজের জন্যে তাঁবু খাটানো হয়েছে। মসজিদের গেট সাজানো হয়েছে পাকিস্তানী-মিশরী আল-হেলাল আর আরবীয় তরবারী খচিত ঝাণ্ডা দিয়ে। পতাকার শোভা দেখলাম তাঁবুর উপরের চারপাশ দিয়ে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়, কেদা (মালয়ের একটা ষ্টেট), পাকিস্তান, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, তুর্কী, মিশর, ইরাক, সিরিয়া, আরব ও মরক্কো প্রভৃতি মুসলিম দেশের নানা রঙের পতাকা জড়াজড়ি করে উড়ে জয় ঘোষণা করছে ‘আল্লাহ ছাড়া দোসরা আর মাবুদ কেহই নাই আমার।

মুসলমানদের ঈদের নামাজে ধর্মানুভূতি ও ধর্মানুষ্ঠান ছাড়াও একটা বড়ো দিক আছে। সেটা হলো তার সামাজিকতা আর উৎসবের দিক। এর মাধুর্য ও সৌন্দর্য কম নয়। এতোগুলো জাতের এতো রকমের পাতাকা তলে এক আল্লাহ ও রসূলকে কেন্দ্র করে এক ধর্ম বিশ্বাস বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশকে কি করে একত্র করেছে ছোট্ট এই ওকিং মসজিদের প্রাঙ্গণে তার অপরূপ রূপ দেখে অমুসলিমের মনও চমৎকৃত হয়। ঈদের দিনে ওকিং-এ এসে নানাজাতের মুসলমানের মিলনে এক জামাত ও মিল্লাতের এদিকটা এত করে চোখে পড়ে যে, অতি সাধারণ মানুষও তাতে আকৃষ্ট না হয়ে পারে না।

এখানে এসে আর একটা নতুন জিনিস চোখে পড়লো। ইসলাম ধর্ম যে জগতের নানা দেশে ছড়িয়ে আছে, তার চাক্ষুস পরিচয় পেলাম। মিশর, আরব, সিরিয়া, ইরাক, পারস্য, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, চীন এবং আফ্রিকার বহু মুসলমান এসেছে। ভারত ও পাকিস্তানের আমরা তো অনেকেই ছিলাম এখানে। এক এক দেশের লোক দেখতে এক এক রকম। ভিন্ন ভিন্ন রকমের চেহারা ও শরীর অথচ ঈদের নামাজ পড়তে এসে সব দেশের মুসলমানই এক ধর্মের বাঁধনে ভাই ভাই হয়ে গেছে। নামাজ শেষে চেনা-অচেনা নানা দেশের মুসলমানের কোলাকুলি দেখে কি যে আনন্দ পাওয়া গেল তা বুঝানো কঠিন। এ কোলাকুলি এক দিকে যেমন মুসলমানে মুসলমানে অন্য দিকে তেমনি জাতিতে জাতিতে। সবচেয়ে বড়ো কোলাকুলি সাম্যের, মৈত্রীর এবং মানবতাবাদের। এর জোরেই ইসলাম একদিন বিশ্বের আচার-পীড়িত মজলুম মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এ সাম্যের বাণী এবং তার বাস্তব রূপ দুনিয়ার অমুসলমানকেও কম মোহিত করে না। ইউরোপে আমেরিকায় ইসলামের তেমন তবলিগ হয় নি। হলে আজ সেখানে আরও অনেক মুসলমান দেখা যেতো।

নামাজ হলো আরবীতে। একজন মিশরীয় মুসলমান অপূর্ব সুন্দর সুরে কোরআন শরীফ থেকে আবৃত্তি করলেন। আরবীর ‘আ’ স্বরধ্বনিটি বাংলার মতো করে আমরা মুখের পেছনের দিক অর্থাৎ জিবের গোড়ার কাছাকাছি জায়গা থেকে উচ্চারণ করি। মিশরীয়দের এ স্বরধ্বনি জিবের সামানের ভাগ থেকে তির্যকভাবে বেরিয়ে আসে। ভদ্রলোকের গায়ের রং গমের রং-এর মতো লালচে ফর্সা। তাঁকে দেখতে লাগছিলো ইংরেজের মতো। পারস্য, মিশর ও তুরস্ক প্রভৃতি দেশের লোক অবশ্য দেখতে অনেকটা ইউরোপ ও আমেরিকার লোকের মতো।

ইমাম সাহেব খোতবা পড়লেন সকলের বোধগম্য ভাষা ইংরেজীতে। যাদের কাছে খোতবা পড়া হয়, তাদেরকে ইসলামের সার কথা বোঝানোই খোতবার অর্থ। বহুদেশে অজ্ঞ ও অশিক্ষিত মোল্লাদের হাতে পড়ে ইসলাম বিকৃত হয়ে গেলো। ইংলণ্ডে দেখছি এখানকার চার্চের পুরোহিতেরা রীতিমতো শিক্ষিত। অশিক্ষিত কি অর্ধ-শিক্ষিত পুরোহিত ইংলণ্ডের কোন চার্চে নেই। ফলে এদের ধর্মব্যাখ্যা শুনলে জনসাধারণ তৃপ্ত হয়ে ঘরে ফিরে যায়। আমাদের দেশে অধিকাংশ ইমামই আরবী ভাষায় পারদর্শী নন! শুধু তোতাপাখীর মতো আরবী খোতবা প’ড়ে দিয়ে রুটিন বজায় রাখতে পারলেই এদের চ’লে যায়। ইংলণ্ডের মতো আমাদের রাষ্ট্রের এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশে যদি মাতৃভাষায় খোতবাটা পড়া হতো তাহলে অনেক মঙ্গল হতো আমাদের সাধারণ মুসলমানের। ওখানে নানান দেশের নানান লোক এসেছিল। ইংরেজদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। তাছাড়া এরা মোটামুটি সকলেই ইংরেজী বোঝে। খোতবায় ইমাম সাহেব যা বোঝাচ্ছিলেন সকলের শোনার ধরন দেখে মনে হলো সকলেই তা বুঝছে।

নানান দেশের মেয়েরাও ওকিং-এ এসেছে নানা বেশভূষায়। কেউ নামাজ পড়তে, কেউ দেখতে আর কেউ বন্ধুদের নেমন্তন্ন খেতে। ইংরেজরা সিদ্ধ ছাড়া তো আর কিছু খেতে জানেনা। জানলেও তা খায়না। এ সুযোগে তাই এখানকার প্রবাসী মুসলমানেরা তাদের বন্ধুবান্ধবদের আমাদের দেশী খাবার খাইয়ে বন্ধুত্ব গাঢ় করে। আর পাশ্চাত্যের লোকদের কাছে আমাদের দেশের মোগলাই খানার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে আত্মপ্রসাদ লাভ

নামাজের পর নামাজের তাঁবুতেই মসজিদ কমিটির তরফ থেকে কয়েকবারে হাজার দেড়েক লোক খাওয়ানো হল। সেই সঙ্গে আমরাও খেলাম দেশী পোলাও আর কালিয়া। ওকিং-এর এ খাওয়ার মধ্যে আর একটু বৈশিষ্ট্য আছে। মুসলমানদের হাতে হালাল করা টাটকা গোশত ঈদের নামাজ উপলক্ষে একটি দিনের জন্য এখানেই পাওয়া যায়। ইংলণ্ডের গোশতের মোটা ভাগ আসে আরজেনটিনা থেকে। বিদেশ থেকে যে গোশত ইংলণ্ডে আসে জবাই হবার পর থেকে মানুষের পেটে গিয়ে পৌঁছতে তার তিন চারটে মাস লেগে যায়। ঠাণ্ডা দেশ বলে গোশত নষ্ট হয় না। এর ওপরে আছে রেফ্রিজারেটার আর বরফ। দোকানে দিনের পর দিন এ গোশ্বত ঝুলতে দেখা যায়। ঈদের দিনে সাধারণ মুসলমান টাকা গোশত খাবার আনন্দ মেটায়। আর ধর্মভীরুরা বহুদিন ফাঁকা থাকার পর হালাল গোশত খাবার সুযোগ পেয়ে আল্লার কাছে এখানে শোকর গোজার করে।

ওকিং-এ নামাজ উপলক্ষে আমার কয়েকজন বিদেশী বন্ধুকে নেমন্তন্ন করে এনেছিলাম। ইংরেজ চাউন, ডেরিক ও মাইকেল, ইরাণী নিপে, তুকী জিহনী, আরজেনটিনীয় বাণ্ডক আর ত্রিনিদাদের রামশরণ। আমাদের পাকিস্তানী খাবার ভালো লাগে দেখে এরা প্রত্যেকেই দেখলাম বেশ পেট ভরে খেলেন আর আমাকে জানালেন হাজারো শুকরিয়া।

পৃথিবীর জনসমুদ্রের সঙ্গে মিশবার ও বিচিত্র শোভা দেখবার সুযোগ পাই লণ্ডনে। আজকের দিনে আরও শোভা দেখলাম মুসলিম জগতের। লণ্ডন দুনিয়ার কসমোপলিটন শহরগুলোর অন্যতম। ইংরেজ রাজত্বের সমৃদ্ধির সঙ্গে লণ্ডন শহর দুনিয়ার নানাদেশেরই স্নায় কেন্দ্র এবং তীর্থক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। এখানে নানা দেশ থেকে নানা লোক আসে। নানা কিছু শিখতে ও দেখতে। পৃথিবীতে মুসলমানদের রাজ্য যেখানে নেই এমন অনেক দেশেও মুসলমান বাস করে। মধ্য এশিয়ার তো কথাই নেই। এখানকার অধিকাংশ দেশই। মুসলমানদের। ইংলণ্ড ভরে আছে নানান দেশের মুসলমানে। ওকিং মসিজদে নামাজ পড়তে গিয়ে দুনিয়ার নানান দেশের মুসলমান ও সার্বজনীন রূপের চাক্ষুস পরিচয় পাওয়া যায়। ওকিং মসজিদকে কেন্দ্র করে এখানে একটা মুসলিম মিশন কাজ করে। পত্রিকা বের করে, বক্তৃতা দিয়ে, সভাসমিতির আয়োজন করে ইসলামকে এরা ব্যাখ্যা করছে এখানে। ইসলাম সম্বন্ধে খৃষ্টানদের যে ধারণা তা মোটেই সুবিধাজনক নয়। এদেশের সাধারণ খৃষ্টান মুসলমানদের সম্বন্ধে জানে যে, মুসলমানেরা ক্রুসেডার। খৃষ্টজগতের সঙ্গে মধ্যযুগে ইসলামের যে সংঘর্ষ হয় সেটাকেই আজ পর্যন্ত সাধারণ খৃষ্টানরা বড়ো করে দেখছে এবং মুসলমানদেরকে যোদ্ধা ও আক্রমণকারী জাত হিসেবে ভেবে আসছে। ওকিং-এ মুসলমানদের মিশন সব রকমে যত্ন নিচ্ছে মুসলমানদের সম্বন্ধে এদের ভুল ধারণা ভেঙে ইসলামকে যথারীতি ব্যাখ্যা করবার।

ইসলাম বিশেষ কোন একটি জাতির ধর্ম নয়। নানাজাতি, নানাদেশ এ ধর্মের বাঁধনে কি অদ্ভুত ভাবে বাঁধা পড়েছে–এখানকার ঈদের দিনে ওকিং তার অপূর্ব দৃষ্টান্ত তুলে ধরে অমুসলমানদের কাছে। ওকিং মসজিদের সামনে বিরাট সামিয়ানা খাটানো হয়। তার চারধার ঘিরে এক একটা মুসলিম দেশের পতাকা টাঙানো হয়। পতাকাগুলোর দিকে একবার চোখ বুলোলেই সে দেশের জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, সউদি আরব, স্যামন, লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, কেদা, মিশর, জর্দান, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মরক্কো- একের পর এক ইসলামী নিশান উড়ছে। আর মাটির দিকে তাকালে এক এক দেশের অপূর্ব পোশাক পরিচ্ছদ ভূষিত এক এক রকম চেহারা দেখা যাচ্ছে সেখানকার নরনারীর। তার মধ্যে আফ্রিকার নিগ্রো মুসলমানের পোশাক পরিচ্ছদই অদ্ভুত ধরনের। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা চীন জাপানের পীত জাতের মধ্যে যেমন রঙের সুষমা রক্ষা করেছে তেমনই মরক্কোর মুসলমানেরা ইউরোপের শ্বেতজাতির সবচেয়ে নিকটবর্তী বলে দেহের রং-এর দিক থেকে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। মাঝখানে আমরা না কালো না ফরসা। কিন্তু আফ্রিকার নিগ্রোরা জাম কালো। ওকিং-এ দেখলাম নানাজতির ফ্ল্যাগ, পোশাক আর নানান জাতির নানা রং। এতো বৈষম্য অপূর্ব সুন্দর বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। সে বাঁধন হচ্ছে এক আল্লাহ এবং তার রসূলে বিশ্বাস। নামাজের পরে সকলে জাতীয় পোশাক আচার ও রং নির্বিচারে যখন কোলাকুলি করে তখন সে দৃশ্যে মুগ্ধ হতে হয়। ইসলামের এ সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের রূপ দেখেই ওকিং মসজিদের ইমামের হাতে হাত রেখে কয়েকজন ইংরেজ মহিলা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। এর পরে। প্রায় হাজার বারো শ লোক বিরাট ঈদের ভোজে আপ্যায়িত হলো। দেখলাম রান্না বান্নার আয়োজন থেকে বিতরণ ও খাওয়ানোর দাবী মেটানো পর্যন্ত কাজ পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ছেলেরা দেশের সুনাম বজায় রেখে সম্পন্ন করলো। এতোগুলো দেশের মধ্যে পাকিস্তানের প্রধান অংশ গ্রহণ ধনজন ও মানের দিক দিয়ে বিদেশে আমাদের গর্বের কারণ বটে।

বারো

অধিকাংশ মানুষের জীবন কাটে স্বদেশে এবং স্বজাতির মধ্যে। নিতান্ত ভাবুক এবং চিন্তাশীল না হলে নিজের দেশে এবং জাতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যও সহজে কারুর চোখে ধরা পড়ে না। জীবন যখন সহজ ভাবে চলে তখন জীবন সম্বন্ধে ভাববার প্রয়োজন হয় না। অবশ্য চিন্তাশীল লোকের সংখ্যা দুনিয়ার সব দেশেই কম। তবু যখন জীবনের চলার পথে কোন কিছুর অভাব ঘটে তখন সাধারণ মানুষও সে বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে।

নিজের দেশের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থেকে স্বজাতির ও স্বদেশের যতোটা জানা যায় বিদেশে নানা মানুষ এবং নানা বস্তুর সংস্পর্শে এসে স্বদেশকে লোকে আরও ভালো করে চিনে। কারণ তখন তাদের দৃষ্টি প্রসারিত হয়। প্রত্যেকটি জিনিসকে সে বিচার করতে শেখে।

দেড় বছর অবধি ইংলণ্ডে বাস করে ইংরেজ জাতকে দেখছি। এদের জীবনের অনেকগুলো দিক আছে যা দুনিয়ার অন্যান্য জাতির সঙ্গে মিলে না। বিদেশীরা চোখ দিয়ে এদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা যায়। কোন্ গুণে এরা বড়ো হয়েছে, কি বৈশিষ্ট্যে এতোকাল দুনিয়াকে শাসন করেছে, এদের অপসৃয়মান অতীত গৌরব অস্তমিত হতে গিয়েও কোন্ মাহাত্মে এদেশের ‘টোয়াইলাইটের মতো লম্বমান রেখা টেনে দিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয় ভাবলে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না।

এদেরকে যতো দেখছি ততোই মনে মনে প্রশ্ন করি একটি জাত কিসে বড়ো হয়? এক কথায় অবশ্য এর উত্তর দেওয়া যায়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে শিক্ষিত করে তোলা। তাহ’লে এক পুরুষে না হয় দুই পুরুষে জাতি অগ্রসর না হয়ে পারবে না। শিক্ষা পেলেই নিজের দায়িত্বজ্ঞান বাড়বে এবং সকলেই নিজের কাজটা ঠিক মতো করবে। জাতির প্রত্যেকেই যদি নিজ কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং নিজের বিবেক ও বুদ্ধির কাছে নিজেকে দায়ী করে, নিজের কাছে তৎপর হয়ে উঠে, তাহলে প্রত্যেকের সংঘবদ্ধ ও সমবেত চেষ্টায় জাতি দিনে দিনে বড়ো হয়ে উঠবে।

কথা উঠতে পারে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ইংলণ্ডের সব লোকই কি শিক্ষিত? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সাত বছরেরও কিছু বেশী সময় ধরে ইংলণ্ডের শাসন ব্যবস্থা লেবার পার্টির হাতে থাকায় এখান থেকে অশিক্ষা এক রকম দুর হয়ে গেছে বললেই চলে। বৃটিশ জার্ণাল অব এডুকেশনাল সাইকোলজি পত্রিকায় স্যার সিরিল টাটের The Education of Illiterate Adults নামক একটি লেখা সেদিন পড়ছিলাম। তাতে তিনি ইংলণ্ডের অশিক্ষিত এবং অর্ধ শিক্ষিত লোকের একটি তালিকা দিয়েছেন। তার মতে ইংলণ্ডের মোট লোক সংখ্যার শতকরা দেড় থেকে দু’জন অশিক্ষিত এবং পর থেকে বিশ জন অর্ধশিক্ষিত। অশিক্ষা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন দৈনন্দিন জীবনে যারা লেখাপড়ার কোন কাজই করতে পারে না। আর অর্ধশিক্ষা বলতে বুঝিয়েছেন লেখা এবং পড়ার ব্যাপারে যারা তেমন অংশ। গ্রহণ করতে পারে না। যারা বিগত জেনারেশনের লোক তাদের সম্বন্ধেই সার সিরিলের এ মন্তব্য প্রযোজ্য। Adult Education প্রথম প্রবর্তনের ফলে এদের সংখ্যাও দিনে দিনে কমে আসছে। কিন্তু যারা জেনারেশনের কনিষ্ঠতম তাদের কারুরই প্রাথমিক শিক্ষালাভ না করে গত্যন্তর নেই।

যে শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে বৃটেনের এতো গৌরব ও মান তা আজকের নয়। বরং একথাই বলা যেতে পারে যে যখন তার জাতীয় শিক্ষার মান ও শিক্ষিতের সংখ্যার দিক থেকে সর্বোচ্চ শিখরে তখন দু’দুটো মহাসমরের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠত্ব লোপ পেয়ে গেছে। তবু বৃটেন আজও যে রাজনৈতিক দিক দিয়ে জাতিসংঘে তার কর্তৃত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে, তা তার নিজের দেশের নরনারী নির্বিশেষের দায়িত্ববোধ, কর্মতৎপরতা, জাতীয় চেতনা, নিজের কাজে নিজেকে ফাঁকি না দেওয়া এবং সর্বোপরি জাতীয় কল্যাণ সাধনায় অসাধারণ কষ্ট-সহিষ্ণুতার গুণে। কেবলমাত্র শিক্ষার গুণেই যে একটা জাত এতোগুলো গুণের অধিকারী হয় এমন কুথী কি করে বলবো? শিক্ষাই অবশ্য এর মূলে। তবু এর পেছনে রয়েছে বৃটেনের জাতীয় ট্রডিশন। ইংরেজ জাত ট্রডিশন ও কনভেনশন, ঐতিহ্য ও প্রথাকে জীবনের নানাক্ষেত্রে বড়ো স্থান দিয়েছে। পুরুষ পরম্পরায় যে ট্র্যাডিশন গড়ে উঠে তাকে এদের প্রত্যেক নারনারীই প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতে প্রয়াস পায়। আর নতুন ট্র্যাডিশন গড়ে তোলবার জন্যে পথ খুঁজে ফেরে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অপিস, আদালত, ব্যাঙ্ক, রেস্তোরাঁ ও দোকানপাটে যারা কাজ করে তারা তারতম্য ভেদে সকলেই শিক্ষিত। নানাকাজে দোকানপাটে, ব্যাঙ্কে, স্কুলে, কলেজে, অফিসে যেখানেই গেছি সেখানে কাজের সময়ে কাউকে দেখলাম না যে পরের চাকরী করছে বলে মুনিবের অদর্শনে কিছু সময় বিশ্রামে, আলস্যে কি সহকর্মীর সঙ্গে মিষ্টি আলোচনায় কাটালো। এদের কর্মতৎপরতা দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। কোন কাজের জন্যে কোথাও গিয়ে একটুখানি দাঁড়িয়েছেন কি সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ এসে মধুর ভাষায় প্রশ্ন করবে, আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি? কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনার কাজ উদ্ধার হয়ে গেলো। আপনার সময়ের অপচয় হলো না। প্রত্যেকের সময়ের মূল্য প্রত্যেকে বোঝে বলেই প্রয়োজনীয় কাজ স্বল্পতম সময়ে শেষ হয়ে যায়। প্রত্যেকের সময় এমনিভাবে বাঁচে দেখে দেশের আর্থিক জীবনের তাতে উন্নতি হয়।

পথে দেখছি কলি-মজুর কাজ করছে। কৌতূহলী হয়ে ওদের সঙ্গে আমি মিশি। এটা সেটা নিয়ে অনেক সময় আলোচনা করি। ওদের অধিকাংশ লোকই তেমন বুদ্ধিমান নয়। লেখাপড়ার চর্চা ওদের তেমন নেই। সকল দেশের মজুর শ্ৰেণীর মতো মার্জিত রুচি ও সংস্কৃতির স্বাদ থেকে ওরাও বঞ্চিত। কথা অপরিষ্কার। বুলি কিনি। দক্ষিণ ইংলণ্ডের স্কুল কলেজের শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকের মতো কিংবা বি. বি. সি. থেকে প্রচারিত ইংরেজীর স্বচ্ছ সুন্দর উচ্চারণ ওদের নেই। ওদের ইংরেজী, উচ্চারণের স্বরধ্বনিগুলো ‘ডিপথঙ্গাল’ এবং দুই স্বরধ্বনির সঙ্গমস্থলে প্রথমটি লক্ষযোগ্যভাবে দীর্ঘ। কারুর বা দ্বৈত স্বরের সংযোগস্থলে হচির মতো ধ্বনি।

মনে পড়ছে তখন আমি ওয়েস্ট লণ্ডনের ২৯ নটিংহাম প্লেসে থাকতাম। একদিন এক আঠারো ঊনিশ বছরের ছোকরাকে দেখলাম আমার ঘরের জানালা পরিষ্কার করছে। ল্যাণ্ডলর্ড বেজমেন্ট থেকে একবার বেরোলেনও না। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি মন দিয়ে সুন্দর করে কাজ করছো। তোমার নিয়োগকর্তা তো একবার দেখলেন না? সে বললো, না দেখলে কি হবে স্যার? আমার কাজের জন্যে আমি পারিশ্রমিক নেব। সময়ের কাজ সময়ের মধ্যে ভালো করে করা আমার কর্তব্য। আমার সাধ্যমত তাই আমি ভালোভাবে কাজ করছি। মজুর শ্রেণীর এই ছেলেটির দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞান দেখে মুগ্ধ হলাম। শুধু এর কথা কেন বলি! এ নিয়ে এদের যারই সঙ্গে আলোচনা করেছি তারই মুখে দেখেছি হাসি এবং আপন কর্তব্য সম্বন্ধে টনটনে জ্ঞান।

ইংলণ্ডের প্রায় প্রতিটি মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে তার দায়িত্বজ্ঞান লাভ করেছে। সেজন্যে তারা যক্ষের ধনের মতো জাতীয় চরিত্রের এ শ্রেষ্ঠ গুণটিকে বংশ পরম্পরায় আগলে রেখেছে। ইংলণ্ড এজন্যে আজও পৃথিবীতে এতো বড়ো। যতদিন তার জাতীয় চরিত্রের ও গুণ অক্ষুণ্ণ থাকে ততোদিন সে যে বড়ো হয়ে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভাবছি ইংরেজ জাত কর্তব্যপরায়ণ হবার এতো শক্তি পেলো কোথায়? ব্যক্তি বা জাতি বিশেষ শুধু যদি মেশিনের মতো কাজ করে যায় তাহলে মানুষে আর মেশিনে পার্থক্য থাকলো কোথায়? অথচ এও জানি যে, মানুষ মেশিন নয়। সুইচ টিপলেই মেশিন চলে, সুইচ বিকল হ’লে শত টিপলেও আর চলে না। এদিক থেকে মানুষও মেশিনের মতো। মেশিনের চলার এবং চালানোর যতো উৎস আছে, বিদ্যুৎই তার মধ্যে প্রধানতম। মানুষ মেশিনের চলার জন্যে চাই ক্ষুধার নিবৃত্তি এবং অফুরন্ত উৎসাহ আর প্রেরণা।

কোন ইংরেজ পেটের জ্বালায় মরেছে কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসে এমন নজীর ইংলণ্ডে নেই। এরা কষ্টসহিষ্ণু। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে এদের অভিধানে বিলাসিতা বলে কোন শব্দ থেকে থাকলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে এদের জাতীয় জীবন থেকে সে শব্দটি একেবারে উধাও হয়ে গেছে, ডায়েট এদের ব্যালান্সড়। বড়লোক থেকে শ্রমিক সকলেই শরীর গঠন ও শরীর ধারণোপযোগী আহার পায়। এদের দীনতম ব্যক্তিটির আয়ও সপ্তাহে পাকিস্তানী টাকার হিসেবে তিরিশ টাকার নীচে নেই। সে জন্য আমাদের দেশের তুলনায় ক্ষুধার জ্বালায় মরার মতো কিংবা মাসিক তিরিশ টাকার চাকুরিজীবী পিতার পুত্রকন্যাসহ চিন্তা ও জরাভারগ্রস্ত হবার মতো কাউকে এখানে তেমন সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতি দেশের মতো ধনী ও নির্ধন এখানেও আছে। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম এখানকার গরীবদেরও করতে হয়। তবু মানুষের জীবনে অপরূপ বিলাসের অবসর আর দুর্ভিক্ষজনিত অন্তিম হাহাকার এখানকার মাটিতে পাশাপাশি ঠাই পায়নি।

বড়োলোকদের কথা না হয় বাদই নিলাম, জীবনের মান উঁচু বলে গরীবরাও তাই এখানে জীবন সম্বন্ধে প্ল্যান করতে পারে। এদের কাজের সপ্তাহ সাত দিনের নয়। সাড়ে পাঁচ দিনের। যদি কেহ এর অতিরিক্ত সময় কাজ করতে চায় তার জন্যে সে অতিরিক্ত মজুরী পায়। এদের শ্রমিক, কি চাকুরিজীবীর জীবন কর্তৃপক্ষের মরজির ওপরে চলে না। গোলামীর দাসখতেও তা বাধা নয়। বড়োসাহেবের মরজির কৃপার দিকে সভয় ও সলজ্জা দৃষ্টি রেখে এখানে কোনো মানুষকে চলতে হয় না। এখানে প্রত্যেকেই ইনডিভিজুয়াল। সে জন্যে প্রত্যেকের কাজেরই মূল্য রয়েছে। কর্তপক্ষ আপন সীমারেখার মর্যাদা রক্ষা করে চলে। অতিরিক্ত সময় খাটলে বা খাটালে তার জন্যে কেউ কারও প্রতি রুষ্ট হয় না। এ কারণে কাজ এবং অকাজের সময় সম্বন্ধে এদের প্রত্যেকেই আগে থেকে ওয়াকেফহাল হতে পারে। অবসর ক্ষণকে এরা ধনী নির্ধন নির্বিশেষে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করার সুযোগও তাই পেয়ে থাকে।

বলেছি এরা চাকরির অর্থাৎ দেশের জন্যে কাজ করে খুব বেশী হ’লে সাড়ে পাঁচদিন। সোমবার থেকে শনিবারের দুপুর পর্যন্ত। আর কেউ কেউ বা সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত। পরীক্ষার পড়া তৈরী করবার ভয় না থাকলে কিংবা অত্যন্ত সহিষ্ণু না হলে এদেশী অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ঐ নিয়ম লঙ্ঘন করে না। শনি রবিবার সেজন্যেই এখানকার ব্যক্তি বিশেষের নিজের আর সপ্তাহের অন্য দিনগুলো কাজের। উইক এণ্ড’ কথাটি ইংরেজের জাতিগত। ইংলণ্ড থেকেই উইক এণ্ডের প্রথা এবং শব্দটিও কন্টিনেন্টের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে।

কাজের দিনগুলোতে এখানকার নরনারীরা যেমন কাজের মধ্যে ডুবে থাকে, অবসরের দেড় দিনে সপ্তাহান্তে তেমনি প্রাণ ভরে নিজের জীবন উপভোগ করে। উইক এণ্ড ও ছুটির দিনগুলোতে নিজেকে লঘু ছন্দে ভাসিয়ে দিয়ে যে শক্তি তারা সঞ্চয় করে, সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে সে শক্তিই আবার দুহাতে ব্যয় করে। ইংরেজ জীবনের প্রেরণা এবং উৎসাহের উৎস তার ছুটি উপভোগ করার ক্ষমতায় আর তার অবসর ক্ষণকে সুন্দর করে রচনা করার তাগিদে।

অবসর ক্ষণ রচনা করা ও ভোগ করার কতো পদ্ধতি যে ইংলণ্ডে রয়েছে। এ সম্বন্ধে ধীরভাবে চিন্তা করলে ইংরেজের জাতীয় ও সমাজ জীবনের বৈশিষ্ট্য পরতে পরতে আলগা হয়ে যায়। ইংরেজের বলডান্স, ড্রিঙ্ক, তার জুয়ো, পেশাদারী গ্যাম্বলিং, খেলাধূলা, মুক্ত, সমাজ ব্যবস্থায় নরনারীর সম্বন্ধ ও অবাধ মেলামেশা, সিনেমা, থিয়েটার, তার বেতার জগৎ, পড়াশোনার অভ্যাস ও ধর্মব্যবস্থা প্রভৃতি এক একটি বিষয় সম্বন্ধে নানা কথাই বলা যায়। ইংরেজ জীবনের অবসর ক্ষণ এ সবের উপভোগ ও আলোচনায় ভরে থাকে। উইক এণ্ডের সন্ধ্যাগুলো অনেক তরুণ-তরুণীরই নাচের ঘরে কাটে। সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে যথারীতি কাজ করায় শরীর ও মন শ্রান্ত হয়ে আসে। সপ্তাহ শেষে নাচের ঘরে গিয়ে নাচের ছন্দের তালে তালে দেহমনের সে ক্লান্তি এরা দূর করে নেয়। সপ্তাহ শেষে নাচ এবং গানে এরা এদের কর্মের ক্লান্তি ভোলে বলেই সপ্তাহের শুরুতে দ্বিগুণ শক্তি ও উৎসাহে আবার কাজ আরম্ভ করতে পারে।

আমাদের দেশের মতো দিনের পর দিন মাসের পর মাস একটানা রোদ ইংলণ্ডে বড়ো বেশী দেখা যায় না। যার যেখানে অভাব তার সম্বন্ধেই সে চকিত হয় বেশী। আর সে অভাব যদি তার মেটে তাহলে তার মনের তৃপ্তির মাত্রাও হয় বেশী। সকাল বেলাতেই যেদিন রোদ ওঠে সেদিন মানুষে মানুষে কথা শুরু হয়, How Lovely! Lovely morning isn’t it? যাকে লক্ষ্য করে কথা বলা হয় তাকেও এ ধরনের উত্তরই দিতে হয়। আর সেদিনটি যদি ছুটির দিন থাকে, যদি উইক এও হয় তবে তো কথাই নেই। পরিবারের সকল লোকই সদল বলে কোনো প্ল্যান না থাকলেও পার্কে রোদ পোয়াতে বেরোলে। দম্পতি যুগল নিজেরাই কিংবা সন্তান সন্ততি নিয়ে স্যাণ্ডউইচ কি সে ধরনের হাল্কা লাঞ্চ নিয়ে দিনের মতো এসে বসলো পার্কে। রোদে গা মেলে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় জামা কাপড় খুলে মিষ্টি রোদে নিজেকে এলিয়ে দিলো। ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করলো। করলো খেলাধূলা আর লুটোপুটি। বড়োরা কাগজ কিংবা সময় কাটাবার মতোই বই পড়লো কিংবা চোখ বন্ধ করে রোদের মিষ্টতাই করলো উপভোগ। আগে থেকে একটু প্ল্যান করা থাকলে স্বামী হলে স্ত্রীকে নিয়ে, কিংবা আপন আপন বন্ধু নিয়ে গ্রামে কি সমুদ্রতীর থেকে একটি দিনের জন্যে হলেও বেড়িয়ে এলো।

জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করবার উপায় এদের জানা আছে। গতানুগতিকতা জীবনকে ক্লান্ত করে তোলে। গণ্ডীবদ্ধ সংসার জীবন বৈচিত্র্যের উদ্রেক করতে না পারলে জীবন দুর্বিষহ ও দুর্বল হয়ে ওঠে। নানা আকর্ষণ ও চাঞ্চল্যে জীবনকে ভরে তুলতে না পারলে জীবনের মাধুর্য কি ক’রে আহরণ করা যায়? জীবনকে শতভাবে উপভোেগ না করলে জীবনের উদ্দেশ্য লঘু ও ফিকে হয়ে আসবে নাকি? জীবন যে পরিমিত! এতো বিচিত্র সুরে কোথা থেকে মানুষ ভরে তুলবে? নতুবা উপায় আর কতোই বা উদ্ভাবিত হবে। পৃথিবীতে মানুষের রচনা করা শত উপায় নিঃশেষিত হয়ে এলো না কি? ইংরেজদের অবসর ক্ষণ উপভোগ করার মধ্যে বড়ো কিংবা আশ্চর্য কিছু দেখি না। ছোটখাট জিনিসের মধ্যে তুচ্ছতম প্রক্রিয়া ও প্রণালীর মধ্যে বহু মুহূর্তের বিচিত্রতম মিল এদেরকে সৃষ্টি করতে দেখি।

লণ্ডনের বুক ভেদ করা টেমস নদীর পাশের ঘননীল ও শ্যামশোভাময় পত্র-পুষ্প পল্লবিত রিচমণ্ড। এটি এখানকার রাজ-রাণীদের অনেকেরই গ্রীষ্মকালীন বিশ্রামাগার। জুন মাসের এক রবিবারে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সেখানকার প্রকৃতির শ্যামশোভা প্রাণ ভরে উপভোগ করে এলাম। স্বর্গীয় মাধুরীতে ভরা ইংলণ্ডের গ্রীষ্মকাল। টেমসের পার্শ্ববর্তী তরুচ্ছায়াঘন রিচমণ্ডের নানা স্থানে বেঞ্চ পাতা রয়েছে। তাতে আর মসৃণ সবুজ ঘাসের পাতায় অগণিত তরুণ তরুণীকে দেখছি সহজ ছন্দে গা মেলে দিয়ে বন্ধু প্রেমের ও মিষ্টি সূর্যের অমিয় ধারা পান করতে। নদীর বুকে ছোট ছোট নৌকায় যুগলের দলকে ভেসে যেতে দেখেছি। দাড়ের পানির ছিটায় উত্থিত হচ্ছে তাদের মধুর কণ্ঠে উচ্ছ্বসিত কল-লহরী। নদীর মৃদু তরঙ্গে কম্পিত হচ্ছে তাদের জীবন। জেগে উঠছে জীবনে রোমাঞ্চ জীবনের গতানুগতিকতার মাধ্যেম অতি পুরাতন প্রণালীর মধ্যে সামান্যতম পুলক শিহরণের সঞ্চার করে জীবনকে এমন ভাবে উপভোগ করে জীবনের নতুনত্বের স্বাদ সৃষ্টি করতে পারাতেই তো আনন্দ। নইলে চলার পথে শক্তি ক্ষয় করার এতো প্রেরণা পাওয়া যাবে কোথা থেকে?

ইংরেজের মতো এতো ছুটি এবং বিশ্রাম উপভোগ-প্রিয় জাত বোধ হয় খুব কমই আছে। ছুটির জন্য প্ল্যান করে এরা ছমাস আগে থেকে। গ্রামের ও সমুদ্রতীরবর্তী হোটেলগুলোর সব কয়টাই হলিডের ছয় থেকে তিন মাস আগে ভাড়া হয়ে যায়। ইষ্টারের ছুটি শেষ না হতেই গরমের ছুটি কাটানোর জন্যে হোটেলের সিটগুলো ভাড়া হয়ে যাচ্ছে। পথে বেরিয়ে আমাদের দেশের মতো শোওয়া ও থাকার ভাবনায় এখানে বিছানাপত্র বাঁধতে হয় না বলেই পথের বোঝার ভারে বিশ্রাম ও অবকাশের আনন্দ এদেশে ফিকে হয়ে যায় না। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঠাই কানট্রি ও সমুদ্র তীরবর্তী হোটেলগুলো। ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সবাই প্ল্যান্ড কি প্ল্যানহীন হলিডে করে আসতে পারে সেখানে গিয়ে।

ইংলণ্ডে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে ইংলিশ চ্যানেল। ইংলিশ চ্যানেলের উপকূলবর্তী ইষ্টবোর্ণ, ব্রাইটন, হোভ, হেষ্টিংস্ ওয়েমাথ, বোর্ণমাথ, টর্কি, প্লিমাথ প্রভৃতি শহরগুলোর প্রত্যেকটিই অবকাশ ও বিশ্রাম ভোগ করবার জন্যে ভূস্বর্গের মতো। সমুদ্র তীরের ছোট ছোট শহর এগুলো। প্রত্যেকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যেন ঝকঝক করছে। দিনের বেলায় এগুলোর পরিচ্ছন্নতা ও মার্জিত পরিকল্পনা নজরে পড়ে। সন্ধ্যার সময় বাতি জ্বলে উঠলেই এরা অপরূপ রমণীয় শোভা ধারণ করে।

লণ্ডন থেকে ব্রাইটন। মাঝখানে মাত্র মাইল পঞ্চাশেকের ব্যবধান। লণ্ডন থেকে ট্রেনে। করে আধ ঘণ্টাখানের মধ্যেই যাওয়া যায় সেখানে। সমুদ্রের কুলঘেষে একটানা পথ সারা শহরকে বেষ্টন করে রেখেছে। মাঝে মাঝে সবুজ মসৃণ ঘাসের আকর্ষণীয় বিছানা। পথের পাশেই বিশ্রামকারীদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঘাসের উপর বসতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ঘুমুতে। তার মাঝে মাবো ফুলের বাগান। মানুষের হাতের রচনা কতো সুন্দর ও মনোহর হতে পারে, না দেখলে তা বলা এবং বোঝান শক্ত। শহর থেকে পথ বেয়ে। সমুদ্রতীরে এগোবার পথের পাশে মাঝে মাঝে বাগান! নীচে ফুলের সারি ও শোভা। ওপরে তরুশ্রেণীর নানা শাখা পল্লব। আলো জ্বালানোর জন্যে ডালপালার ফাঁকে নানা প্রকার বাল্ব। আলো যখন জ্বলে উঠে তখনকার নানা রঙের আভা শহরটিকে বিচিত্র ও রমণীয় করে তোলে। দেখতে দেখতে চোখে যেন নেশা ধরে যায়। মনে হয় হলিডের উপযুক্ত স্থানই বটে। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে নানা রেস্তোরাঁ আর সমুদ্র স্নানার্থিনীদের পোশাক ভাড়া করার আর বদল করার ঘর।

সমুদ্রের তীর থেকে পানির মধ্যে প্রায় কোয়াটার মাইল লম্বা পিয়ার (pier) গ’ড়ে তোলা হয়েছে। তার ওপরে খাবার ঘর। রেস্তোরাঁ। আনন্দ মেলা (Fun fair)। নিত্যকার উৎসব লেগেই আছে। এখানে নানাভাবে এটা সেটার পয়সা পকেট থেকে বেরিয়ে যায় সত্য কিন্তু নিজের কাজের ক্লান্তি, সংসারের ঝামেলা, মানসিক ও ব্যক্তিগত অশান্তি এবং যাতনা থেকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও যে মুক্তি পাওয়া যায় তাও কম সত্য নয়।

সারা ইষ্টারের ছুটিটায় ওয়েদার অবিশ্বাস্যভাবে ভালো গেলো। গত তিন বছরের মধ্যে নাকি এপ্রিল মাসে এতো রোদ ইংলণ্ডে দেখা যায়নি। শীত নেই। দিনের বেলায় তাপের মাত্রা পঁচাত্তর থেকে আশী ডিগ্রীর মধ্যে ঘোরাফেরা করলো। ইংলণ্ডে একটা ওয়ার্ম ওয়েভ বয়ে গেলো। আমরা গরম দেশের লোক। শীতের দেশের মধুর উষ্ণ হাওয়া আমাদের কাছে স্বর্গসুখ বলে বোধ হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু এদেশের লোকও দেখছি অবকাশকালে এতো ভালো ওয়েদার পাওয়াতে ওয়েদার ফোরকাষ্টের ওপরে নির্ভর করে দলে দলে ঘরের বাইরে থেকে হলিডে করে এলো। হলিডে উপলক্ষে লণ্ডনের নিয়মিত ট্রেনের ওপরে অতিরিক্ত দু’হাজার ট্রেন এ কদিনের জন্য দেওয়া হয়েছিল। প্রতি চার মিনিটে ভিক্টোরিয়া, ওয়াটারলু প্রভৃতি স্টেশন থেকে একটি করে ট্রেন এবং প্রতিদিন আট হাজার অতিরিক্ত বাস বিশ্রামভোগীদের নিয়ে সমুদ্রতীরে কি গ্রামে পৌঁছে দিল। ছোট ছোট কাগজগুলোতে হলিডে সংক্রান্ত হালকা লোভনীয় ও মুখরোচক সংবাদ বড়ো বড়ো অক্ষরে ক’দিন ধরে ছেপে বের করা হলো। রাস্তাপথে বেরোলেই মনে হতো এরা যেন জাতীয় জীবনের একটা মহোৎসব। পালন করছে। নরনারীর মুখে চোখে একটা লীলাচঞ্চল ভাব সহজেই যেন চোখে পড়ছে। এতো যোগাড়, এতো আয়োজন ও উপকরণ সত্ত্বেও গ্রেট বৃটেনের অর্ধেক লোক হলিডে করতে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে পারলো দেখে খবরের কাগজগুলো আনন্দের প্রাবনের মধ্যে এক সুরে জাতীয় বেদনার গান গাইলো।

হলিডে বা ছুটি উপভোগ করা কথাটি আমাদের দেশে নেই। ভাষার অভিধানে নেই। আমরা কাজের মধ্যে প্রতি মিনিটে ছুটি নেই। আর ছুটির দিনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য না করে হয়তো কাজ করি। আমাদের পক্ষে তাই জীবনকে উপভোগ করাটা আর হয়ে ওঠে না। তাই কাজের মতো কাজও সেজন্যে আমরা করে উঠতে পারি না। ছুটির দিনটা যে আমাদের নিজের ও স্ত্রী-পুত্রকন্যার আনন্দ বিধানে কাটাবো এ ধারণা আমাদের হলো কৈ? যদি হতো তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন অনেকের সুখের হতো। দেহের বিশ্রাম ও মনের স্বস্তির জন্যে যদি একটি নিশ্চিন্ত অবসর ক্ষণ আমরা রচনা করতে জানতাম তাহলে কাজের দিনগুলোতে নিজের দেশের কাজে হয়তো বেশী করে আমাদের নিয়োগ করা সম্ভব হ’ত। বহু দুঃখ থেকেই আমরা বাঁচতাম। আমাদের দেশেরও তাতে বৃহত্তম কল্যাণ হতো।

ইষ্টারে এদের ছুটি উভোগের পালা দেখে লণ্ডন-প্রবাসী দেশী বন্ধুদের মধ্যে যারা আমার ঘনিষ্ঠ তাদের বললাম, এ কদিন তো লাইব্রেরী পর্যন্ত বন্ধ। কোনো কব্জিই হবে না। সুতরাং চলো আমরাও হলিডে করে আসি।’ কিন্তু অভ্যাস কোথায়? প্ল্যান করিনি ব’লে রোজ রোজ নিজেদের মধ্যে সম্ভাব্য নানা যুক্তি তর্কের ছুতোয় ছুটি ফুরিয়ে ফেলতে লাগলাম। শেষটায় প্ল্যানহীন অবস্থায় একদিল ওয়াটারলু থেকে ট্রেনে চেপে বোর্ণমাথের পথে বেরিয়ে পড়লাম। লণ্ডন থেকে বোর্ণমাথ একশো দশ মাইল। দুটোয় বেরিয়ে পাঁচটায় গিয়ে উঠলাম। হোটেলের দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম। কিন্তু প্রত্যেক জায়গা থেকে উত্তর পেলাম Full up sir, no rooIn অজানা নতুন জায়গা! একা আমি। কোথাও জায়গা পাচ্ছিনে। দেখে মনটা যেন কেমন হয়ে উঠলো। Y. M. C. A-তে গেলাম। সেখানেও এ কথা ‘Sorry, full up’, যে তরুণীটি তখন সেখানে কাজ করছিলো আমাকে প্রবাসী বুঝে বোধ। হয় কিছুটা দয়াপরবশ হয়ে সে কয়েকটা বোর্ডিং ও প্রাইভেট হাউসে ফোন করে এক জায়গায় আমার ঠাই করে দিল। তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে আমি মিষ্টার ও মিসেস ইকাপসের বাসায় গিয়ে উঠলাম।

হলিডের সময় বলে নয়, বছরের অধিকাংশ সময়ই বার্ণমাথ হলিডের বেশ পরে থাকে। সমুদ্রের পারে একটি Pavilion তৈরী করা হয়েছে। এ Pavilion-টিতে ধর্মচর্চা থেকে শুরু করে ধর্মের গণ্ডী ভাঙার সব রকম আয়োজনই দেখলাম। কোনো দিকে কনসার্ট, কোনো দিকে সিনেমা কিংবা অপেরা। কোনো দিকে প্রমোদ ও পানীয়ের ব্যবস্থা আর কোনো দিকে চলেছে সময় মত বলড্যান্স। আবার কোনো দিকে ধর্মের আলোচনা। হচ্ছে। একরাত্রে বক্তৃতা শুনতে গেলাম Pavilion-এ। বক্ততা হচ্ছিল চার্চ সংলগ্ন স্কুলগুলোর প্রভাব ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে কি ভাবে পড়েছে সে সম্বন্ধে। লোকে যেন বেশী করে তাদের ছেলে মেয়েদের চার্চে পাঠায় তার জন্যে সাধারণের কাছে কৌশলে আবেদন করা হচ্ছে। মনে হলো চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। সেজন্যে আমোদ প্রমোদের আড়ালে এ হেন সুন্দর ও সদুপদেশমূলক কথা বলে মুক্তো ছড়ানোর ব্যবস্থা। যে যা হোক, এ প্রকাণ্ড Pavilion-টি মুসাফির ও স্থানীয় নরনারীদেরও সমান আকর্ষণ ও প্রলোভনের স্থান বটে। এর সামনেই একটি বাগান। মনোরম ফুলে ফুলময়। বাগানের মধ্যে বসবার ও দাঁড়াবার নানা আসন পাতা। বিকেল থেকে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত সারা গ্রীষ্মকালে সপ্তাহের কয়েক দিন ধরে এখানে Open air কনসার্ট চলে এবং কনসার্টের তালে Open air dance-ও হয়। অসংখ্য নরনারীর ভীড় দেখলাম সেখানে। নাচছে। পান করছে। গান গাইছে। লঘু ছন্দের তালে মনে হচ্ছে যেন ভেসে যাচ্ছে এরা! দুনিয়া ভোলবার জন্যেই বোধ হয় এখানে আসে আর এমনি করে আনন্দে গা ভাসিয়ে দেয়।

দিনের বেলাতে এরকম তাকে বোর্ণমাথ, কিন্তু নিরুপম শোভা ধারণ করে সন্ধ্যার পর। আলোয় অপরূপ আলোময় হয়ে যায়। আলোর বিচিত্র রং চোখে মায়াপ্রলেপ লাগিয়ে। দিয়ে যায়, আলোর সঙ্গে রঙের আর রঙের সঙ্গে মনের যে কি মিল, এখানে তার কিছুটা স্বাদ পাওয়া যায়। বিশেষ করে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে পাড়ের নীচ দিয়ে একে বেকে যে রাস্তাটি বহুদূর বিস্তৃত হয়ে সান্ধ্য ভ্রমণ বিলাসী নরনারীর পায়ের ছোঁয়া পাবার আশায় নিরীহ ভাবে বুক পেতে দিয়েছে, তার ওপরে প্রতি রশির ব্যবধানে গায়ে গায়ে বিচিত্রমত আলোর মালা দেখলে বিস্মিত না হয়ে থাকা যায় না। সে আলোর সাজ অপরূপ অনুপম। প্রতি থাকে বালব সাজানোর পদ্ধতি কি পরিমিত ও পরিকল্পিত। কোনোটায় পান পাতা। কোনোটায় জিজ্ঞাসা চিহ্ন দু;দিক থেকে এসে গলাগলি করে মিশছে। কোনোটায় স্বস্তিকা আঁকা। কোনোটায় লতা। কোনোটায় তারের ফুল। তার ভেতরে হলুদ, বেগুনে, লাল, নীল, জরদ, জাফরাণি, ধূসর ও আসমান রঙের বাল্ব জ্বলে জ্বলে কি শোভা যে বিকীর্ণ করেছে! এরা বড়ড কল্পনাপ্রবণ জাত। এদের রুচি আছে। আকাশের তারার ফুলকে আলোর মেলায় এরা সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে হীরের দুলের মতো সাজিয়ে দিয়েছে। দূর বা কাছে যেখান থেকেই দেখিনা কেন বোর্ণমাথের আলোয় আলোময় এ রূপ দেখে স্বর্গীয় মায়াপুরী বলে মনে হয়। আলোর প্রভাবে সারা শহরেই fairy town-এর রূপ ধরেছে।

জীবনে এমন পরিপূর্ণ বিশ্রাম কতো বছর যে নিইনি এবং পাইওনি, তা খোদাই জানেন। ক’দিন ধরে বোর্ণমাথ শহরের শোভা দেখছি। সমুদ্র তীরের স্নিগ্ধ রোদ পোয়াচ্ছি। আর প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ বাতাস খাচ্ছি। দিনের বেলাটায় প্রয়াগের গঙ্গাস্নানের মেলার মতো ইংরেজদের রৌদ্রস্নানের মেলা বসে। এ রোদ পোয়ানোতে পুরুষের চেয়ে নারীর উৎসাহ বেশী বলে মনে হয়। ঘণ্টা হিসেবে আরাম চেয়ার ভাড়া করে কতো যে নরনারী গা ছেড়ে পড়ে রয়েছে, তা কে গুণবে? শুধু দেখা যায় মুনুষ আর মানুষ। কতো অগণিত অলস অবশ ক্ষণ মানুষের কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যেন জিরিয়ে নিচ্ছে।

অনেকে আবার নেমেছে সমুদ্রে স্নান করতে। কোনো দল ছোট নৌকা ভাড়া করে চলে গেছে পাড় থেকে বহু দূরে। ইংরেজরা বিশ্রাম ক্ষণের এই শোভা সৃষ্টি করতে এবং তা দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতে বোধ হয় আরাম পায়। দলে দলে ক্যামেরাম্যান আসে এ দৃশ্যের ছবি তুলতে। ফিল্মের জন্যে ছবি তোলে। পিকচার পোষ্টকার্ড এ দৃশ্য ধরে রাখে ছুটির দিনগুলোকে লোভনীয় করার জন্যে। এ ছবির আবার বাজার আছে। খবরের কাগজগুলো এ সব দৃশ্যের ছবি ছাপে সামনের কিংবা পিছনের পৃষ্ঠাতে। আমাদের কাছে যা তুচ্ছ ওদের কাছে মনে হয় তাই উচ্চ। ছোটকে বড় করার, অনাবশ্যককে ফলাও করে জীবনে ঠাই দেবার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি এরা জানে। এরা জাত হিসাবে হুজুগপ্রিয় বটে। তবে হুজুগ থেকে মনে হয় জীবনের পাথেয় ও প্রেরণা এরা আহরণ করে নেয়।

বোর্ণমাথ ‘সি-বিচে’ আমার মতো রঙীন চামড়ার লোক খুব কমই দেখলাম। লণ্ডন কসমোপলিটন শহর বলে দুনিয়ার সকল দেশের লোক লণ্ডনের প্রতি ঘরেই দেখা যায়। কিন্তু মফস্বল শহরগুলোতে বিচিত্র রঙের লোকের সমাবেশ কম; তাই ভিন্ন রঙের লোকেরা হঠাৎ এখানে এসে সহজেই স্থানীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বুঝতে পারছি আমাদের দিকে কতো লোক যে কৌতূহলী দৃষ্টিতুলে ধরেছে আর কতো লোক যে মনের প্রশ্ন মুখের কাছে নিয়ে এসে জোর করে চেপে যাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। যেখানে বসেছিলাম তার পাশেই এক প্রৌঢ়া ইংরেজ মহিলার আগ্রহ দেখে তার সঙ্গে নিজেই কথা শুরু করলাম। তার একটি বছর-ছয়েকের মেয়ে বালুর মধ্যে ঘর তৈরী করে খেলছে। তাকে কেন্দ্র করেই আলাপের শুরু। ভদ্র মহিলা বেশ মিশুক। আমি বিদেশী। এখানে আত্মীয়হীনও। সেজন্য আমার ওপরে তার কিছুটা মায়া হওয়া স্বাভাবিক। নিতান্ত ঘরোয়া স্বরে তিনি নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আমি আকৃষ্ট হলাম তার অইংরেজোচিত ব্যবহার দেখে। তাতে তিনি খুশী হয়ে একেবারে গলে গেলেন। ভাল হলো, পরের দিন তার বাসায় চায়ের নেমন্তন্ন। তাঁর সঙ্গে এক তরুণীকে দেখলাম তার মেয়েটির আয়া হিসেবে। ওর নাম মাফতা, ডাকা হয় মাফি বলে। সুইজারল্যাণ্ড থেকে এসেছে নিজের চেষ্টায় ইংরেজী শিখতে। ইউরোপের ছেলেমেয়েদের এ রকম আত্মনির্ভরতায় পরিচয় ইংলণ্ডের যে কোন জায়গাতেই পাওয়া যায়। ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে। ছোটখাট একটি চাকুরি যোগাড় করে নেয়। তাতে পেটও চলে পকেট খরচও জোটে। এমনি করে মাস ছয়েক কি বছর খানিকের মধ্যে একটি দেশ দেখা ও ভাষা শেখা দু’ই হয়ে যায়। মাফির মাতৃভাষা ফরাসী। এখনও ইংরেজী ভালো করে শিখে উঠতে পারেনি। মেয়েটির মুখের কমনীয়তা ও লাবণ্য অসাধারণ। তাকে ঘিরে যেন একটা স্নিগ্ধ সারল্য বিরাজ করছে। ওকে বললাম, “মাফি, তোমার ইংলও কেমন লাগে। তোমার দেশ ভাল না ইংলণ্ড?” ও বললে, “তোমার কেমন লাগে এ দেশ আগে বলো তবে আমি বলবো।” আমি বললাম, “ইংলণ্ডের গ্রীষ্ম ও বসন্তকাল আমার খুব পছন্দ হয়, মনে হয় যেন ভূ-স্বর্গ।” ইংলণ্ডের প্রশংসা করাতে বেচারী আহত হলো নাকি বুঝলাম না। সে বললেন, “তোমার দেশে ফেরার আগে একবার সুইজারল্যাণ্ড দেখে যেও। তা হলে ইংলণ্ডের গ্রীষ্মকাল ও তোমার ফিকে মনে হবে।” আমি বললাম, “মাফি, তুমি হোমসিকনেসে ভুগছো নাতো?” আমি মাফির রোগ ধরে ফেলেছি দেখে আমার এ প্রশ্নে তারা উভয়েই হো হো করে হেসে উঠলেন।

ঘর ছেড়ে যারা বাইরে আসে, ডানপিটে বেপরোয়া হলেও কিছুদিনের জন্যে হোমসিকনেস যে কি, তার ব্যথা তাদের সকলকেই ভোগ করতে হয়। কিছুদিন পরে সয়ে গেলেও মাঝে মাঝে ধিক্ ধিক করে জ্বলে উঠতে চায়। আমি এর বেদনা জানি বলেই মাফিকে সহানুভূতি জানালাম।

আমার সমবেদনার সুর দেখে ভদ্রমহিলা বোর্ণমাথের শোভা ও সৌন্দর্যের দিকে। আমাদের উভয়ের মন আকর্ষণ করলেন। ইংলণ্ডের দক্ষিণ উপকূলে সুন্দর এ শহরটি। তারপরে ইংলিশ চ্যানেল। অপর পারে ‘দুরাদয়শ্চা” ফ্রান্সের নীল বনরাজির আবছা ও অস্পষ্ট রেখা দেখা যাচ্ছে আতিবেলা লবণম্বুরাশেদ্ধারানিবন্ধের কলঙ্করেখার মতো। দূর দিগন্তে ইংলিশ চ্যানেলের মুখ রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য পাটে বসতে যাচ্ছে। সোনালী আভায় পার্শ্ববর্তী অগণিত নরনারীর ধব ধবে গণ্ডদেশ রক্তিম আভাময় হয়ে উঠেছে। সব সুন্দর। দেশ, ক্ষণ, পরিবেশে জুড়ে পাত্রপাত্রীদের ঘিরে সৌন্দর্য উপচে পড়ছে! এ সন্ধ্যায় স্নিগ্ধ করুণ প্রবাহ আমার চোখে মুখে এক ঝলক আনন্দ দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেলো। মনে মনে। গুন্ গুন্ করে উঠলাম–

“তোমার ঐ অনন্ত মাঝে এমন সন্ধ্যা
হয়নি কোনো কালে
আর হবে না কভু,
এমনি করেই, প্রভু,
এক নিমেষের পত্রপুটে ভরি
চিরকালের ধনটি তোমার ক্ষণকালে
লও যে নূতন করি।”

ভদ্রমহিলাকে বললাম, তোমাদের শহরের বিশেষ করে তোমাদের সঙ্গে একটি মধুর সন্ধ্যা কাটানোর আনন্দ আমার সারা জীবন মনে থাকবে। কিন্তু ‘হোমের কথা মনে করে দিলে দেখে এত আনন্দের মধ্যেও মনটা আমার বেদনায় ভরে উঠলো। তুমি যদি বুঝতে তাহলে আমার দেশের শ্রেষ্ঠ কবির কথা তোমাকে শোনাতাম–

‘যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে
সুন্দর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরণীর
প্রজাপতিটির পাখা।’

মাফিকে লক্ষ্য করে বললাম, “এ তুমিও বুঝবে, কেননা আমার মতো তুমিও প্রবাসী

“Amid pleasures and palaces
Though we may roam.
Be it ever so humble.
There’s no place like home’

মাফির ইংরেজী জ্ঞান টনটনে না হলেও তার মনের কথাটি সুন্দর করে প্রকাশ করে দিলাম দেখে সুইজারল্যাণ্ডের এই লাবণ্যময়ীর চোখে অশ্রুর রেখা টলমল করে উঠলো।

তের

বিদেশের সঙ্গে যার একবার পরিচয় হয় দেশ দেখবার মোহ তাকে পেয়ে বসে। ইউরোপে এলে তো কথাই নেই, ইংলণ্ডে এসে সারা কন্টিনেন্ট যে না দেখে গেলো তার অবস্থা ঢাকা কি কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশের বাইরে না যাওয়ার মতো। যাদের এ সৌভাগ্য পুরোপুরি হয় না তারা কমপক্ষে পারী নগরীটি দেখে যেতে ভোলে না।

বিদেশে যারা পড়াশোনা করতে আসে বাড়ী বলে তাদের কিছু নেই। সুতরাং ছুটিতে স্থান বদল করতে বেগ পেতে হলেও মায়ার কোনো বন্ধন না থাকার জন্যে পথে বোরোতেই তাদের আনন্দ বেশী। সাজ্জাদ সাহেব আমি ও আলী আশরাফ সাহেব তিন সঙ্গী মিলে সত্যি একদিন পারীর পথে বেরিয়ে পড়লাম।

ইংলণ্ডের পোর্টে ইউহ্যাভেন থেকে আমাদের জাহাজ ছাড়লো দীয়েপের দিকে। এই পোর্ট দুটির মধ্যে ইংলণ্ডের ও ফ্রান্সের ব্যবধান সবচেয়ে বেশী। ডোভার ও ক্যালের মাঝখানে দু’দেশে ব্যবধান কম বলে (৬০ মাইল) সাধারণতঃ এ বন্দর দুটো দিয়ে জাহাজে লোক পারাপার হয়। ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে পারীতে হচ্ছিল ওদের বাইমিলেনারী (দ্বিসহস্রতম) উৎসব। এ উৎসব উপলক্ষে দুনিয়ার নানা জায়গা থেকে এতো বেশী লোক পারীতে যাচ্ছিলো যে, সময় মতো সচেতন হইনি বলে ডোবার-ক্যালের পথ আমাদের ভাগ্যে জুটলো না।

ঘণ্টা তিন ধ’রে ভাসলাম ইংলিশ চ্যানেলের অথৈ নীল পানির ওপরে। অশান্ত বলে ইংলিশ চ্যানেলের কুখ্যাতি আছে। আমাদের ভাগ্য ভালো। আবহাওয়া সেদিন ভালো ছিল। শান্ত সমুদ্রের বুকের ওপর দিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজ নিতান্ত নিরাপদে আমাদের পার করে দিল। কিছুকালের জন্যে দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয় নরনারীর সঙ্গে আমরা তিন পাকিস্তানী আমাদের দেশের অস্তিত্ব ঘোষণা করলাম।।

ফ্রান্সের উপকূলে দীয়েপ বন্দরে নামতেই যেন চোখে পড়লো আমাদের দেশের নারায়ণগঞ্জের রূপ। সেই ময়লা। সেই নোংরা। মানুষের চেহারাতেও কেমন যেন দারিদ্র্যের ছাপ। ইংলণ্ড থেকে ফ্রান্স। ইংলিশ চ্যানেলের সামান্য ব্যবধান। অথচ এ দু’দেশের মধ্যে যে তফাৎ তা ফ্রান্সের মাটিতে পা দিতে না দিতে বিদেশীদের চোখেও স্পষ্ট হয়ে উঠে। একমাত্র গায়ের সাদা রং ছাড়া আর কিছুতেই মিল নেই। এরা সাদা হলেও যে ইংরেজ নয় তা এদের চেহারা থেকেই ধরা যায়। ভাষা আর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কথা নাই বা বললাম।

দীয়েপে কিছু কুলি দেখলাম। এরা ইংলণ্ডের পোর্টারের মতো নয়। সাদা চামড়া বাদ দিয়ে ওদের পোশাক আর পেশা আমাদের দেশের কুলিদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই ব’লে গোয়ালন্দ, চাঁদপুর কি শিয়ালদহের কুলিদের মতো নয়। গোয়ালন্দের কুলি ওদের নিজেদের বৈশিষ্ট্যেই বিখ্যাত। মোটা মালের গাদা নিয়ে যে একবার গোয়ালন্দের কুলির পাল্লায় পড়েছে সে আজীবন মনে রাখবে তার দুর্ভোগের কথা। এরা ভুদ্র ও নম্র। ঠকানোর প্রবৃত্তি এদের নেই। ফ্রাঙ্কও যা দাবী করে তা পরিশ্রমের পারিশ্রমিক। তার Service-এর দাম।।

দীয়েপ থেকে ট্রেন চললো পারীর দিকে। উদার উঁচু নীচু মাটির পাহাড়ের চূড়া। আর তরুছায়া ঘন জনবিরল গ্রাম। তার ভেতর দিয়ে রেল লাইন। ফ্রান্স আর ইংলণ্ডের যেখানে মিল তা তাদের প্রাকৃতিক গঠনে সেই উঁচু মাঠ। সেই নীচু সমতল ভূমি। দুয়ে মিলে চারণ এবং চাষের ক্ষেত। মাঠ যেখানে নীচু থেকে ক্রমেই মসৃণভাবে উঁচু হয়ে গেছে সে উচ্চতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ঘন বন। তাতেও যেন মানুষের হাত লাগানো। প্রাকৃতিক রাঁধুনিতেও দুই দেশ এক। তবে ইংলণ্ডের মতো ফ্রান্সের প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের অপরূপ ফাগ ছড়ানো নেই। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইংলণ্ডের সবুজ পেকে যেভাবে গাঢ় হয়ে ওঠে তার এক অদ্ভুত অপরূপ সৌন্দর্য আছে। ফ্রান্সের প্রকৃতিতে সবুজের ছাপ আছে। সে সবুজ গাছ নয়। ফিকে আর নীলের মাঝখানে তার বসতি।

ইংলণ্ডের গ্রাম, শহর, পোর্ট কি স্টেশন, যাই দেখি না কেন, তাতে শালীনতার ও আভিজাত্যের ছাপ। কতো কালের আর্থিক ভারসাম্য এবং সচ্ছলতা ইংলণ্ডকে তার রূপপ্লবী প্রবৃদ্ধ ছন্দ দিয়েছে ইংলণ্ডের ইতিহাস যাদের জানা আছে তারাই ইংলণ্ডের এরূপ দেখে একটা জবাব ও সান্ত্বনা পায়। এ রকমটা না হলেই যেন অস্বাভাবিক ঠেকতো। দুনিয়া শোষণ কম্বরে সারা ইংলণ্ডকেই ইংরেজরা স্বর্গে পরিণত করেছে। সারা ইংলও স্বর্গের একটি বাগানের মতো। ফ্রান্স ইংরেজদের মতো এমন করে দুনিয়াকে লুটতে পারেনি। তাই শুধু পারীই সৌন্দর্যে ইউরোপে সেরা হয়ে রয়েছে, সারা ফ্রান্স নয়। ইংলণ্ডের ছোট বড়ো শহরের তো বটেই, তার গ্রামগুলোতেও লণ্ডনের সভ্যতা, ঐশ্বর্য ও সজ্জার ছাপ পাওয়া যায়। সুতরাং সারা ইংলণ্ডই এক হিসাবে লণ্ডন। ফ্রান্সের প্রভিন্সিয়াল শহর থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্স এক শহরের দেশ। সৌন্দর্যে শুধু ইউরোপে নয়, পৃথিবীতেই পারীর জুড়ি মেলা ভার। তাইতো সারা দুনিয়ার ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে পারী পারীই। পারীকে এমনভাবে সাজানোর জন্যে ফ্রান্সের গ্রামবাসীরা মাঝে মাঝে আপত্তি করে। তাদের আপত্তির কারণ বুঝি। পেটে না জুটলে পিঠে সওয়া কি মাথায় বোঝা বওয়া যায়! ইংলণ্ডের আর্থিক সচ্ছলতার জন্যে বন গ্রাম থেকে শুরু করে তার লণ্ডন পর্যন্ত সব কিছুকেই নানা পরিকল্পনায় সমৃদ্ধ সুসজ্জিত করতে তার বাধেনি। ফ্রান্সের সম্বন্ধে সে কথা খাটে না। ট্রেনে চলতে চলতে গ্রামের ভাঙাচোরা বাড়ীঘর প্রচুর চোখে পড়ছে। আমাদের দেশের মতো করগেট টিনের আর অ্যাজবেস্টোজের ছাদ দেওয়া বাড়ীও রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সেও সেগুলো দিয়ে দারিদ্র্যের চিহ্ন ফুটে বেরোচ্ছে। ইংলণ্ডে এ কল্পনাতীত। ফ্রান্সের গ্রামের মানুষ ছাড়াও গ্রামের ঘোড়া গরু যা দেখছি ইংলণ্ডের ঘোড়া ও গরুর তুলনায় তারা অনেকটা রোগা। ঐশ্বর্য ও দারিদ্র্যের ছাপ এই দুই দেশের মানুষ ও প্রকৃতিতে স্পষ্ট ধরা পরেছে।

পারীতে পৌঁছলাম বিকেলে। নতুন এ বড়ো শহরে হঠাৎ এসে পড়ার চকিত বিস্ময় লণ্ডন আমাদের ঘুচিয়ে দিয়েছে। এর বৃহত্ব ও নতুনত্ব আমাদের তেমন আশ্চর্য করলো না। লণ্ডনের ভাষা জানা ছিলো। শৈশব যৌবনের প্রতীক্ষা নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম নগরীতে এসে বিস্ময়রস ভাঙতে সেখানে ভাষার সাহায্য নিতে কষ্ট হয়নি। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে বুক দুরু দুরু করলেও মুখে কথা ফুটেছিলো। দ্বিধাজড়িত হাতে তার অবগুণ্ঠন অপসারণ করতে মুখের মধু রসই হয়েছিল প্রধান সহায়। পারীতে সাজাৰ্মা স্টেশনে পা দিতেই অদ্ভুত কাকলি শোনা গেলো। লণ্ডনে মাদাম দুপের কাছে ফ্রেঞ্চ পড়তাম। লণ্ডনে দু’চারজন লোককে ফরাসী ভাষা যে বলতে শুনিনি, তাও নয়। তাদের ফরাসী ভাষা বলা আর আমাদের শোনার মধ্যে একটা সচেতনতা ছিলো। সেজন্যেই খুব সম্ভব তার বৈচিত্র্য ও মাধুর্য আমাদের মনে। ধরেনি। ভাষা না-জানা দেশে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হলে কেমনটি যে লাগে এ অদ্ভুত অভিজ্ঞতা যার হয়েছে সে-ই এর অসহায়তা এবং অনির্বচনীয়তা ভালো করে উপলব্ধি করবে। চারদিক থেকে একই শৃঙ্খলার বহু বিচিত্র ধ্বনি কানে এসে হরদম বাজছে। আর সে বিচিত্র ধ্বনির প্রভাবে মানুষগুলো যে যার তেমন ভাবে ছুটোছুটি করছে। সে ধ্বনির সঙ্গে তার নিজের না আছে কোন যোগ না সে পারছে তাদের একজন হয়ে তাদের মতোই চলাফেরা করতে। তখনকার মতো আমরা যতটুকু ফ্রেঞ্চ জানতাম তা কাজে এলো না। পারীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে বেচারী পারী তার সমস্ত আকুলতা নিয়ে এগিয়ে এলেও আমাদের সামলে নিতে হলো। শুধু মনে মনে বললাম, “সে ভাষা ভুলিয়া গেছি ……।’

“ও-ভাটনগর”-হঠাৎ কানে বেজে উঠলো অতি পরিচিত বাঙালী হিন্দু ঢং-এর ডাক। পারীর রাস্তায় এ ধরনের ডাক শুনে বিস্মিত হবারই কথা। সচকিত হয়ে পাশ ফিরতেই দেখি আমাদের কমন বন্ধু ডাঃ ভাটনগর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আওয়াজকারী ভদ্রলোক আর তার সঙ্গে আর একজন দু’জনই এসেছে বর্ধমানের দিক থেকে। ওরা সকলেই লণ্ডনে হোমিওপ্যাথি কলেজের ছাত্র। দেশে ফেরার পথে কন্টিনেন্ট ভ্রমণে বের হয়েছে। আশ্চর্য এ ভাটনগর ছেলেটি। দিল্লীর সেরা হোমিওপ্যাথের একমাত্র ছেলে। ছেলেবেলায় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে তার ডানহাতটা অবশ হয়ে যায়। ওর বাবার বিশ্বাস, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতেই তার হাত সেরে উঠবে। হোমিওপ্যাথি পড়া আর চিকিৎসা করানো এক ঢিলে দুই পাখী মারার জন্যে তার বিলেতে আসা। ধর্মাধর্মের কোন বালাই নেই। মুখে সব সময় হাসি লেগে আছে। অতি সহজেই মিশতে পারে। চট করে বন্ধুত্ব করতে পারে। ছবি তোলার বাতিক খুব। তাতে পয়সা নষ্ট করে বেশ। কিন্তু খাবার সময়ে খুব হিসেবী! আমাদের ক’দিন আগে পারীতে আসে। কথা ছিল ষ্টেশনে সে আমাদের রিসিভ করবে। আমাদের যখন বোবার দশা তখনই শুনলাম অভাবিতপূর্ব এ ডাক। ভাটনগর এরই মধ্যে ভুল ফরাসী ভাষা বেশ আয়ত্ব করে ফেলেছে। সে গেলো আমাদের জন্যে ট্যাক্সি আনতে। এমন সময় আমাদেরকে বিদেশী মনে করে একজন ফরাসী পোর্টার আমাদের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো। এতে বর্ধমানের এক ভদ্রলোক ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজী মিলিয়ে বোঝাতে চাইলো “মন আমি (আমার বন্ধু) গন ফর ট্যাক্সি”-হাত দিয়ে দূরে দেখালো ভাটনগরকে। লোকটা কি বুঝলো খোদাই জানেন, কিন্তু আমরা না হেসে পারলাম না।

ভাটনগরের সাহায্যে রুদ-ত্রভিজের একটি হোটেলে এসে উঠলাম। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে চারতলার উপরে উঠতে হলো। আমাদের থাকবার জন্যে ওয়েট্রেস আমাদের কামরা ঠিক করে দিয়ে গেলো। পারীর হোটেলগুলোর বেশ বৈশিষ্ট্য আছে। বাথ নেবার ব্যবস্থা থাক বা না থাক না থাকাটাই অবশ্য স্বাভাবিক) কামরায় কিংবা কামরা সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঘরে মুখ হাত ধোয়ার ‘ওয়াস বেশীন আর তার পাশে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার জন্যে মেঝেতে বেশ নীচু আর একটা বেশীন আছে।

পারীতে এমন হোটেলও যে থাকতে পারে তখনকার মতো হোটেলের মধ্যে দাঁড়িয়েও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাদের কামরার পাশে ছিলো টয়লেট রুম। নামে নিশানায় বুঝা যাচ্ছে ফ্লাশ সিষ্টেমেরই হবে। টয়লেট পেপারের অভাব আছে বলে মনে হলো। খবরের কাগজের ছেঁড়া টুকরোয় সবটা ভর্তি হয়ে আছে। কতোকাল যে পরিষ্কার হয়নি খোদাই জানেন।

পারীতে তিন রকমের হোটেল আছে। যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বিলাস ও আরামের প্রথম শ্রেণীর হোটেল। মাঝারি রকমের হোটেল আর সাধারণ হোটেল। হোটেলের ক্লাশ ভাগ করা হয়েছে বিলাসের উপকরণ ও পরিচ্ছন্নতার তারতম্যের হার দিয়ে। সাধারণ হোটেলগুলো বড্ডো নোংরা। একটি দুটি নয়। অধিকাংশ হোটেলই পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অসহনীয়। পারী দু’হাজার বছরের পুরাতন শহর বলেই এতে চূড়ান্ত ভালো ও মন্দের আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায়। পারীর তুলনায় লণ্ডনের বয়স কম। সেজন্যই হোক, কিংবা ওসব দিকে ইংরেজ জাত অত্যন্ত সতর্ক বলেই হোক, অপরিচ্ছন্নতা ইংরেজ হোটেলে সাধারণত চোখে পড়ে না।

একদিন যেতে না যেতেই বাধ্য হলাম হোটেলটি ছাড়তে। বেশ খোঁজাখুজির পরে রুলাফায়েতের পাশে রু’বুফোর হোটেল লাফোতে এসে উঠলাম। হোটেলটি মাঝারী রকমের। বেশ পরিষ্কার। আমরা তিনজনে মিলে পাশাপাশি দুটো কামরা নিলাম। কামরা সংলগ্ন ‘সাল দ ব্যা’, বা বাথরুম পাওয়া গেলো। ভালোভাবে গোসল করা যাবে এ আনন্দে সাজ্জাদ সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আশরাফ সাহেবেরও অজিফা পড়ার জায়গা হলো। পারীর বুকে এ রকম কামরার (শুধু থাকার জন্যে অবশ্য)-দৈনিক বার শ ফ্রাঙ্ক ভাড়া। আমাদের হিসেবে মোটামুটি বার টাকা। এক রকম সস্তাই বলতে হবে। হোটেলের অধিকারিণী মাদাম মারী। অমায়িক ভদ্র মহিলা। কিছু ইংরেজী শিখেছেন হোটেল চালানোর জন্যে। তার স্বামী এবং নিজে মিলে হোটেলটি চালাচ্ছেন। আট দশ বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে আন্ মারীকে কেন্দ্র করে এদের দাম্পত্য জীবন সুন্দর বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। মাদাম মারীর আশ্রমে আমাদের পারী প্রবাসের কটা দিন সুধায় ভরে উঠলো।

****

পায়ে হেঁটে পারী দেখছি। নগর পরিকল্পনার দিক থেকে পারীর বেশিষ্ট্য আছে। রাস্তার সাহায্যে এক একটি ত্রিভুজ তৈরী করা। তারই মধ্যে দালানের পর দালানের সমারোহ। রাস্তাগুলো সবই সরল রেখাকৃতি। সমান্তরাল ভঙ্গীতে সাজানো। কোথাও আঁকাবাকা বা ঘুরপাক নেই। রাস্তার একপ্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্ত বেশ নজরে পড়ে। সমস্তপারী নগরীকে ছবির মতো সাজানো গুছানো লাগে।

পারীর ছোট রাস্তাগুলোর নাম রু। আর বড়গুলোর নাম বুলেভার্ড। বুলেভার্ডগুলো এক একটি বাগানের মতো। মাঝখান দিয়ে সরল রেখার পার্ক। তাতে সমান মাপের ছোট বড়ো গাছপালা। বসবার বেঞ্চ পাতা। আর তার দুপাশ দিয়ে প্রকাণ্ড চওড়া রাস্তা। একটা আসবার। একটা যাবার। পারীর এমন (এমন কি দুনিয়ারও) সুন্দর রাস্তাটির নাম স-জে লি-জে। কবিতার ছন্দভরা নামটি। আর পারীজেনরা এর স্বরধ্বনিগুলোকে টেনে রীতিমতো খেলিয়ে দিয়ে যখন উচ্চারণ করে তখন মনে হয় যেন নৈশ সৌন্দর্যের প্রবাহের উপরে স্বর তরঙ্গের একটা মৃদু কম্পন এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি জুড়ে বিস্তৃত হয়ে গেলো। সাঁজেলিজের এক প্রান্তে গগনচুম্বী আলোকস্তম্ভ। আর অন্য প্রান্তে নেপোলিয়ানের যুদ্ধ জয়ের স্মৃতিস্তম্ভ আর্ক দু’ত্রয়াম। মাঝে মাঝে পানির ফোয়ারা। পানির গুঁড়ো গুড়ো সফেন বিন্দু বাতাসের সঙ্গে মিশে উড়ে উড়ে একটি মিষ্টি কোমল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মাঝে মাঝে রং বেরঙের আলোর ফুলঝুরি। আর তার দু’পাশ দিয়ে বিছানো রয়েছে নানা রকম ফুলের বাগান। প্রথম প্রান্ত থেকে এমনিভাবে আর্ক দু’ত্রয়াফের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে পর ক্ল্যাসিকেল ভঙ্গীর আর এর সম্পূর্ণ সুচারু কারুকার্যের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দালান। তাতে হোটেল রেস্তোরাঁ আর কাফে। মনে হয় যেন একেবারে পরীর রাজ্য। ইউরোপের মধ্যে লাবণ্য, কোমলতায় ও নিটোল দেহসৌন্দর্যে পারী যেন মিস্ য়ুনিভার্স। আর তার আনারদানা রঙীন গালের উপর আঁকা সজেলিজে যেন একটি মিষ্টি তিলক ফোঁটা। শেষে আর্ক দু’ত্রয়াম। আট দিক থেকে আটটি রাস্তা এসে এর পায়ে কুর্নিশ করেছে। পারীর রূপ দেখতে আসে বিশ্বের সব রস পিপাসুরা। সেজন্যেই পারীর সেরা রূপোপজীবিনীরাও এখানে তাদের রূপের বেসাতি মেলে ধরে।

দিন ও রাতের পারীতে আকাশ পাতাল তফাৎ। দিনের বেলা সারা পারী নগরীই যেন ৯ ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু চাঙা হয়ে উঠে সাঁঝের কিছু আগে দিয়ে। পারীর কাফেগুলোই পারীর জীবন। রাস্তার পাশের এই কাফেগুলো ঘরে বাইরে টেবিল চেয়ার ফেলে দিয়ে সন্ধ্যার পরে যেন হাত পা ছড়িয়ে বসে। রসিক জনেরা এখানে আসে রসপান করতে। মাদামোয়াজেলরা চা, কফি অন্যান্য কোমল মধুর পানীয় পরিবেশন করতে। মধুলোভী রসিক জন সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। হৈ চৈ গোলমাল, আলাপ আলোচনা, গান বাজনা, সবই চলছে। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক প্রভৃতি ললিতকলাবিদরা এখানেই বসে বসে ভাবের আদান প্রদান করেন। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, এমন কি রাজনীতি–যা নিয়ে পারীর খ্যাতি ও অখ্যাতি সব কিছুরই সূতিকাগার পারীর এই কাফেগুলো।

শুনি প্রিয়জনের শরীরের ঘ্রাণ (body odour) নাকি নরনারীর মনে মোহ জাগায়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ইউরোপের অধিকাংশ লোক গোসল করে না বলে তাদের শরীর দিয়ে বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধের মতো যে গন্ধ বেরোয় তাতে অনভ্যস্ত আমাদের অনেক সময়। বমি বমি করে, মাথাও ঘুরে যায়। পারীতে গোসল না করাটা আবার ফ্যাসান এবং আভিজাত্যের লক্ষণ। সে জন্যে পারীতেই ইউরোপের সেরা সুগন্ধি ইভ নিং ইন প্যারিসের জনা, আর তার বহুল ব্যবহার।

পারীতে দেখবার জিনিসের অভাব নেই। যা-ই দেখি সবই বিশ্ববিখ্যাত। বিশ্ব নিয়ে কারবারী এমন দেশ আর কোথাও দেখলাম না। দৃষ্টিভঙ্গীতে এরা যে সত্যই আন্তর্জাতিক তার পরিচয় প্রতি পদে পদে। জর্জ ওয়াশিংটন, রুজভেল্ট, ফ্রাঙ্কলিন, লেনিন, ষ্ট্যালিন সকলের নামেই এরা এদের পথ ঘাটের নামকরণ করেছে।

বৃহত্ত্বে আর ঐশ্বর্যে বিশ্বে পারীর লুভর মিউজিয়ামের জুড়ি নেই। লণ্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখে মনে হয়েছিলো কি জানি কি দেখলাম। লুভারে এসে স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে গেলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রাচীন সভ্যতার সমস্ত নিদর্শন আছে লুভারে। প্রাচীন গ্রীক, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশের ভাস্কর্যের নমুনা তো আছেই, তাছাড়া মধ্যযুগীয় ইউরোপের ললিতকলার নিদর্শনেরও প্রচুর চিহ্ন এখানে বিদ্যমান। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিরন্তন নারীর অপূর্ব রহস্যময়তার প্রতীক মোনালিসার মূল ছবিটি আর ভেনাস দি মিলোকেও দেখলাম এখানে। চিত্রের তো তুলনাই নেই। ইতিহাস ও পুরাণের নানা কাহিনী চিত্র ও ভাস্কর্যে ধরা পড়ে এখানে চির বিরাজ করছে। মন দিয়ে আর বিশেষজ্ঞের দৃষ্টি নিয়ে লুভারে দেখতে গেলে কতোদিন যে লাগবে, বিশেষজ্ঞরাই তার হিসেব দিতে পারেন। সাধারণ দর্শকের হাতে এতো সময় কই?

পারীর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম। যেমনি বৃহৎ, তেমনি গম্ভীর। সামনেই বিখ্যাত দার্শনিক অগাস্ত কোতের মূর্তি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সরবোনই বিশ্বের ছাত্র ও সুধী সমাজকে আকৃষ্ট করেছে। এই সেদিন পর্যন্ত পারীই ছিলো ইউরোপের শিক্ষাদীক্ষায়, দর্শনে, শিল্প-সাহিত্যে, চিত্রে-ভাস্কর্যে–এক কথায় সাংস্কৃতিক জীবন-নির্মাণে ইউরোপের গুরু। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিলো সেই জ্ঞান ও সংস্কৃতির সূতিকাগার।

নেপোলিয়ানের মাজার আঁভালিদকে ঘিরে নেপোলিয়ান সংক্রান্ত এক পরিদর্শনগার গড়ে উঠেছে। তার জীবনের কীর্তি আর মৃত্যুর পথকে এখানে যেন থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি যুদ্ধে কি পোশাক পরেছেন, সেন্ট হেলনা দ্বীপে বন্দী হয়ে কি ভাবে তাঁর সময় কেটেছে, কোন বিছানায় ঘুমিয়েছেন, কোন মশারি খাঁটিয়েছিলেন সবই দর্শকদের চোখের সামনে ধরে রাখা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবার-পরিজনদের ইতিহাসও রয়েছে।

পারীর মুসলমানদের মসজিদটি আমার ভালো লাগলো। মরক্কোর সুলতানেরাই উদ্যোগী হয়ে এ মসজিদটি এখানে নির্মাণ করেন। মসজিদটির কারুকার্য আশ্চর্য রকম সূক্ষ্ম। মনের ওপরে তা কোমলতার একটা স্পর্শ ছড়িয়ে দেয়। আগ্রার স্মৃতিসৌধ এমাদুদ্দৌলার সঙ্গে এর সূক্ষ্ম কলা-কৌশলের আর বাইরের সৌন্দর্যের কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম স্থাপত্যের একটি প্রবাহ দেখা যায়। তার বৈশিষ্ট্য আর পারীজেনদের রুচি ও রসবোধের সমন্বয়ে এ মসজিদটি গড়ে উঠেছে। তাই বোধ হয় এ মসজিদটি এতো মাধুরীময়।

নরনারীর দেহ সম্বন্ধে এদের অহেতুক কুণ্ঠা কিংবা কৌতূহল নেই। প্রকৃতির অন্যান্য জিনিসের মতো মানব দেহকেও এরা সহজ দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্রহণ করেছে। পারীতে আর ভার্সাই এ নামকরা পথ খুব কমই আছে যেখানে দু’চার পা যেতে মানবদেহের ঐশ্বর্য এরা পাথরে প্রতিফলিত করেনি। ফরাসীরা যে লাবণ্য আর সুষমার চর্চায় অদ্বিতীয় তার চিহ্ন দেখা যায় পারীর গায়ে গায়ে। ফরাসীদের লাবণ্য-প্রীতি উছলে উঠেছে ওদের নগর পরিকল্পনায়, মেয়েদের অঙ্গসজ্জায়, রূপচর্চায়। ফরাসী মেয়েরা সত্যিই সুন্দরী। সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতের’। বড়ো মিষ্টি। বড় স্নিগ্ধ। আর ওদের সেই মধু মুখ দিয়ে অনুনাসিক সুরপ্রধান স্বরধ্বনি-ইদায়িত ফরাসী ভাষা যখন বারে পড়ে তখন সত্যিই মনে হয় যেন ওরা কথা বলছে না, কপোত কূজন করছে।

চৌদ্দ

লণ্ডনের পথ ঘাট আর দালান কোঠার দিকে চেয়ে সময়ে সময়ে এক রকম উল্টো ভাবনা আমাকে পেয়ে বসে। কোনো ব্যক্তিবিশেষ কিংবা জাতিবিশেষের যদি কোনো অতীত না থাকে, যদি সে ব্যক্তি বা জাতি কোনো একটি জায়গায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠে, তাহলে কেমন হয়? তার ইতিহাস নেই। অতীত নেই। কোনো মানুষ বা জাতিবিশেষের সঙ্গে তার কোন সম্পর্কও নেই। আপনাতে আপনিই স্বয়ম্ভ হয়ে একদিন এমনি কাউকে গজিয়ে উঠতে দেখা গেলো। তখন আর পেছনে কি আশেপাশে পরিচিত কাউকে না পেয়ে তার কি দশা হয় তা অনুভব করার এবং চিন্তা করার মতো। কোনো সুস্থ মানুষ বা জাতির জীবনে স্বভাবতই এমন অবস্থা দেখা যায় না, এই যা ভরসা। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করার জন্য ব্যক্তি বা জাতিবিশেষ কতো না আয়োজন করছে। তার সে আয়োজনের ভেতর দিয়ে তার স্বাতন্ত্র্য ও অগ্রগতির ইতিহাস সূচিত হচ্ছে।

চীনাদের সম্পর্কে একটি গল্প আছে। তারা জাতীয় ইতিহাস জানবার আগে নাকি পিতৃপুরুষের ইতিহাস আয়ত্ত করে। এ সত্যিই কৌতুকপ্রদ। ইতিহাসে দেশের যুগ যুগান্তরের কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়। যে বর্তমান প্রতিদিন নিজেকে রচনা করে দিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায় তা অতীতের গায়ে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়। স্বচ্ছ পানির ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করলে তাতে যেমন নিজের মুখ প্রতিবিম্বিত হয় তেমনি ইতিহাসে মানুষ তার পিতৃপিতামহের কীর্তিকথা প্রতিফলিত দেখে। এ কারণেই বোধ হয় চীনারা দেশের ইতিহাস জানবার আগে নিজের পিতা, তস্য পিতা, তস্য পিতা করতে করতে তার চৌদ্দ কি আটাশ পুরুষের ইতিহাস করতলগত করে। জানে তাদের নাম। তারা কি কারণে খ্যাত কি অখ্যাত তার বিবরণ ঘটনা ও কাহিনী। ভাবছি সত্যিই তো এ না হলে ইতিহাসের প্রতি আকর্ষণ কি করে জমবে? আমাদের দেশে এমন ক’টা লোক পাবো যারা তাদের বাবা থেকে ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষের নাম অবাধে ব’লে যেতে পারে। মা থেকে ওপরের দিকে আর পাঁচজনের নাম করতেপারে।

এক একটি মানুষের মধ্যে দেখা যায় এ ভাবে তার মাতৃ কি পিতকূলের উধ্বর্তন বহু পুরুষের নাম জানার স্পৃহা! যার এ স্পৃহা প্রবল তার আত্মসচেতনতাও উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রশংসনীয়।

ইংরেজদের প্রত্যেককে বিচারের সমান মাপকাঠিতে ফেলে যাচাই করা যায় না। তবু সত্য, ইংরেজরা জাতি হিসেবে আত্মসচেতন। তার পরিচয় পাই ইংলণ্ডের পথে ঘাটে। পথ চলতে গিয়ে রং বেরঙের ছোট বড়ো নানা আকারের মূর্তি দেখি। এ মূর্তিগুলোর কতকটা পৌরাণিক, অধিকাংশই ঐতিহাসিক। গ্রীক কি রোমকদের মতো কিংবা ভারতীয় হিন্দুদের মতো ইংরেজরা এতো বেশী পুরাণপ্রিয় নয়। কিন্তু ইতিহাসপ্রিয় তাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশী। খাস লণ্ডনে পৌরাণিক মূর্তি যা দেখি তা আর সংখ্যায় কয়টি? পিকাডিলীর এরোস বা কামদেবতা কিউপিডের আর কেনসিংটন গার্ডেনের পিটার প্যানের মূর্তি। এ ধরনের আরও দু’চারটি মূর্তি বাদ দিলে লণ্ডনের প্রায় প্রতি প্রধান পথের আশেপাশে এক রকম দু’চার কদম আগে পরেই জাতীয় ইতিহাস রচনাকারী এমন ছোট বড়ো লোকের পাথরের বহু মূর্তি শোভা পাচ্ছে। যে সব মূর্তির গায়ে তাদের নাম ধাম, তাদের কীর্তি খ্যাতি খোদাই করা আছে। এদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজ রাজত্ব বিস্তারের জন্যে যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। যুদ্ধ বিজয়ী কিংবা যুদ্ধে শহীদদের মূর্তি কি স্মৃতিস্তম্ভই এসবের মধ্যে সংখ্যায় বেশী। চলতে চলতে দেখবো কোন মা এদের স্মৃতির পূজোয় কখন ফুল দিয়ে গেছেন। কোন স্ত্রী ফুলের সঙ্গে স্মৃতির বেদীতে হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করে গেছেন। জাতীয় জীবনে এর মূল্য কি কম? আগের যুগের ইংরেজদের বীরত্ব ও জীবনদানের এসব কীর্তি ও স্মৃতিস্তম্ভ দেখে বর্তমানের ইংরেজরা প্রেরণা পাবে। তাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির করবে। সামনে চলার পথে উদ্দীপ্ত হবে। অতীতের পথ ধরে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য করে বর্তমানে ইতিহাস রচনা করে যাবে। ইংরেজদের নগর পরিকল্পনা আর পথে মূর্তির বহর দেখে আমার এ কথাই মনে পড়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য হই ট্রাফালগার স্কোয়ারের নেলসনের কলাম দেখে। ট্রাফালগার যুদ্ধবিজয়ী নৌসেনাপতি নেলসনের মূর্তি সুউচ্চ স্তম্ভের উপর স্থাপন করা হয়েছে। মুখে তার বিজয়ীর গৌরব। বুকে অপরিসীম সাহসের উদ্দীপনা। নীচে স্তম্ভের পার্শ্বদেশে বৃটিশ সিংহের দুই বিরাট প্রতিমূর্তি। আভাসে ইংগিতে বলা হচ্ছে, কোথাও যেন এদের পরাজয় নেই শুধু বিজয়দৃপ্ত অভিযানের এ ইতিহাস।

ইংরেজের ইতিহাস-প্রীতির কথা বলতে গেলে শুধু মূর্তি কিংবা ভাস্কর্যেই তার পরিচয় শেষ হয় না। যে সব মূর্তির কথা বলছি তা তো জন ও যান চলার পথের বহিরাবরণ হিসাবে বিরাজ করে। ইংরেজ ও তাদের অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সরবে আপন মহিমা ঘোষণা করে। এছাড়া স্থান বিশেষে ইতিহাসকে জীবন্ত ও জাগ্রত করে রাখবার প্রয়াসও এদের কম নয়। তার দৃষ্টান্ত দেখি এদের মিউজিয়াম বা যাদুঘরগুলোতে। সাম্রাজ্যলিপ্সা ইংরেজদের জাতীয় চরিত্রের প্রধান লক্ষণগুলোর অন্যতম। পথের পার্শ্ববর্তী মুর্তিগুলোতে তার কিছুটা পরিচয় পাই। কিন্তু তারও চেয়ে বেশী করে পাওয়া যায় প্রাচীন অস্ত্র প্রদর্শনীর আগারগুলোতে। টাওয়ার অব লণ্ডন এমনি এক স্থায়ী অস্ত্র প্রদর্শনী। প্রাচীন কাল থেকে একাল পর্যন্ত এক এক যুগের সৈন্যরা কি সাজে সেজেছে, কি অস্ত্র ব্যবহার করেছে, কি অসুবিধায় পড়েছে, সে অসুবিধা থেকে বাঁচবার জন্য পরবর্তী যুগে কি উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে- বই-এর পাতায় তাকে নিবদ্ধ না রেখে এখানে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবসর মতো ছেলে বুড়ো সকলে তা দেখছে। শিক্ষিতদের স্মৃতির এতে হচ্ছে কালাই অরি বই-এর পাতা থেকে মুখই না করে শিশুদের হচ্ছে এ থেকে চাক্ষুস শিক্ষা। যুগ যুগান্তের ইতিহাস এমনি করে মানুষের চোখের সামনে আপনাকে আপনিই যেন মেলে ধরেছে। মানুষ না শিখে যাবে কোথা দিয়ে? আর দেখে শিখে ভুলবেই বা সে কি করে? ইতিহাসের পুরানো পাতা চোখের সামনে যখন এমনি করে ভেসে ওঠে তখন মানুষের অজ্ঞাতসারেই নতুন ইতিহাস আপনা থেকেই রচিত হয়ে যায়। জাতি কোনোদিন আত্ম বিস্মৃত হয় না। জাতির মর্মমূলে অতীত অলক্ষে দানা বেঁধে বেঁধে ভবিষ্যতের পথে আপনাকে রচিত করে যায়। জাতীয় জীবনে এর প্রেরণা কি কম?

এর মূল্য কি টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায়? সমগ্র জাতির আত্মচেতনাকে বিদ্ধ করে তাকে জীবন্ত রাখার এ এক অপরূপ আয়োজন।

***

একটি মানুষের জীবনে যা সত্য, একটি জাতীয় জীবনেও বোধ হয় তাই সত্য। যে যায় সে আর ফিরে আসে না। যাকে বর্তমান থেকে ঝরিয়ে অতীতের খাঁচায় বন্দী করা গেল, সে অতীত এমনি করুণ, এমনি নিষ্ঠুর যে, তার স্বমূর্তিতে সে কোনদিন আর তাকে ফিরিয়ে এনে দেবে না। বর্তমান ও অতীতের সম্পর্ক বড় ঠুনকো। প্রতিমুহর্তের বর্তমান অতীতের অতল গহ্বরে যাচ্ছে তলিয়ে। কেউ কারও পাশে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে একটু যে মিষ্টি সম্পর্ক পাবে তার অবসর নেই। হয়তো বা মহাকালের নিষ্ঠুর নিয়মে তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু মানুষ মানুষ। সে জড় পদার্থ নয়। সে মহাকালের অমোঘ নিয়মের মতো অমন নির্মমও নয়। তাই সে কল্পনা করে–যেদিনটি হারিয়ে গেলো তাকে ধরে রাখবার স্বপ্ন দেখে। যে মানুষ তার জীবন থেকে ঝরে গেলো তার স্মৃতি বুকে পুষে অবসর মুহূর্তে অঝোরে ব্যথা বারিধি রচনা করে। তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের স্পন্দনে’– যদি আবার তাকে ফিরে পাওয়া যায়। তার অতীতের কীর্তি ও তাপকীর্তি, গল্প ও রচনা, ‘চাওয়া ও পাওয়া, সার্থকতা ও ব্যর্থতার সকল ইতিহাস একত্র করে তাই এক জায়গায় গুছিয়ে রাখতে স্বতঃই সে ভালবাসে। সে-আগ্রহের বশেই সে রচনা করে বিরাট গ্রন্থাগার। গগনচুম্বী স্মৃতিস্তম্ভ। সুদৃশ্য কুতুবমিনার। ‘সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জ প্রশান্ত পাষাণের তাজমহল’ সুবৃহৎ মিউজিয়াম। মুল অতীতকে মুখর করার জন্যে কতো না তার প্রয়াস।

লওনে এসে সুযোগ পেলেই একট-না একটা মিউজিয়াম দেখে আসি। এখানে। মিউজিয়াম কি একটা দুটো? না একই ধরনের? ছোট খাটো মিউজিয়াম তো বেশুমার। বড়ো মিউজিয়ামের সংখ্যাও কম নয়। এর মধ্যে ভিক্টোরিয়া এ্যালবার্ট মিউজিয়াম, সাইন্স মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্টরী মিউজিয়াম আর বৃটিশ মিউজিয়াম দেখবার মতো। বৃহতের দিক দিয়ে সারা ইংলণ্ডে বৃটিশ মিউজিয়ামের জুড়ি নেই। জায়গার অভাবে এখানকার প্রদর্শনীয় জিনিসপত্রের কিছুটা ভিক্টোরিয়া এ্যালবার্ট মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বৃটিশ মিউজিয়ামের নানা ভাগ উপভাগ রয়েছে; ভারতীয়, চৈনিক, মিশরীয় ও সিরিয়াকে সভ্যতার নিদর্শনযোগ্য ভাগগুলোই এ মিউজিয়ামে সুরক্ষিত। প্রাচীনত্বে মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শনগুলো এ মিউজিয়ামের অন্যান্য সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি এ বিভাগের মানব সভ্যতার চার হাজার বছর আগেকার নিদর্শন। সেকালের চেয়ার। কাঠ কুঠোর তৈরী জিনিস। ছোট ছেলের পায়ের জুতো আর সবার ওপরে মিশরের মমি। মমি অর্থাৎ সেকালের মিশরীয় রাজরাজড়া, রাজ-কন্যা ও রাজ-রাণীদের সুরক্ষিত মৃতদেহ। সেকালেরই কাপড় চোপড়ে জড়ানো। এমনভাবে ভাঁজে ভাঁজে কাপড়-চোপড় জড়িয়ে রাখা হয়েছে যে, দেখে মনে হবে যেন জীবন্ত মানুষই সটান হাত পা ছড়িয়ে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে আমি অনাদি অতীতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছি মনে নেই। দেখলাম সেই অনাদি কালের মানব সভ্যতার ধারা যুগে যুগে এক জাতির মানুষের ভেতর দিয়ে আপনাকে রচনা করে দিয়ে যাচ্ছে। বিস্তারিত করে দিচ্ছে। বতর্মানের মানুষ আমরা অতীত মানুষেরই বংশধর। তাদের সাধনার আর আরাধনার পথ ধরে আমরা এগোচ্ছি সামনের দিকে। কিন্তু তাদের থেকে আমরা কতটুকু ভিন্নত্ব লাভ করেছি? ঐ যে চেয়ারটি দেখছি। ঐ চেয়ারই তো এখন আমার বসবার উপকরণ। তার তুলনায় অধিক আরামপ্রদ আমি এমন কি আবিষ্কার করেছি? সেই যে ছোট্ট জুতো জোড়া রাজকন্যা কি রাজপুত্রের শোভা বৃদ্ধি করেছিলো আজও তাদেরই বংশধর এ বনি-আদমেরা সেই চামড়ার তৈরী জুতো দিয়েই তাদের পদযুগল শীতাতপ ও কাদামাটি থেকে রক্ষা করছে। এখানে এসে বুঝতে পারছি মূক অতীত পাষাণ কারায় বন্দী হয়ে অব্যক্তবেদনায় আমার সঙ্গে মিতালী পাতাতে চাচ্ছে। অতীত আর বর্তমানের আমি যেন একই মানবীয় অনুভূতিতে একাকার হয়ে গেছি। অতীত যেন মানুষের ফেলে আসা দিন ও বহু জীবনের স্মৃতি বুকে নিয়ে মনে মনে নীরব আবেদন জানাচ্ছে।

‘কথা কও কথা কও।
কোনো কথা কভু হারাওনি তুমি সব তুমি তুলে লও।
কথা কও কথা কও
যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই
তুমি তাহাদের কিছু ভালো নাই
বিস্মৃত যতো নীরব কাহিনী স্তম্ভিত হয়ে বও
ভাষা দাও তারে হে মুনি অতীত, কথা কও কথা কও।

***

বৃটিশ মিউজিয়ামের পরে নাম করতে হয় ‘মাদাম তুসো’র (Madam Tussud) বিভিন্ন দেশের অতীত সভ্যতাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে বৃটিশ মিউজিয়ামে। যে হারানো অতীত এখানকার মানুষের চোখে পড়বার নয় তাকেই চোখে চোখে রেখে প্রেরণা পাবার অপরূপ আধার হলো বৃটিশ মিউজিয়াম। এখানে ঢুকলেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর দিকে চেয়ে’ যেন কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুনি ‘নয়ন তোমাদের পায়না দেখিতে, রয়েছে। নয়নে নয়নে।’

মাদাম তুসোর ভাবখানা অনেকটা সে রকমই। তবে তফাৎ এই যে, অন্যান্য মিউজিয়ামের যেখানে সুদূর অতীতই প্রাধান্য লাভ করেছে, মাদাম তুসোতে সেখানে অদূর অতীতই আর পলায়নপর বর্তমান নিয়ে কারবার। মাদাম তুসোর সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এখানে চিত্রের বা ভাস্কর্যের ঠাই নেই। আছে শুধু মোমের। মাদাম তুসো নাম্নী এক ফরাসী ভদ্রমহিলা এ কারুশিল্পের গোড়া পত্তন করেন। তারই নাম অনুসারে এ প্রদর্শনীটির নামকরণ করা হয়েছে।

এখানে বর্তমান ও অদূর অতীতের ঐতিহাসিকই নায়ক নায়িকাদের মোমের মূর্তি তৈরী করে রাখা হয়েছে। বিস্মিত হতে হয় শিল্পীমনের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখে। দৈনন্দিন জীবনে যে ভঙ্গী যার সবচেয়ে স্বাভাবিক এবং বহুল পরিচিত তাকে তার বিশিষ্ট ভংগীতে মোমের মাধ্যমে ধ’রে দেওয়া হয়েছে। মাথার চুল, চোখের চাউনি, মুখের ভঙ্গী, পোশাকের বিশিষ্টতা, সব নিয়ে বিশিষ্ট মানুষ স্বয়ং সম্পূর্ণভাবে শিল্পীর মনোজগতে ধরা পড়ে এখানে বন্দী হয়ে গেছেন। অনেক জানা মানুষকে এখানে মোমের মূর্তিতে স্বরূপে রূপায়িত হতে দেখে হঠাৎ বিস্মিত হতে হয়। মাদাম তুসোর মূর্তিগুলোতে জীবনের লক্ষণ এমনভাবে ফুটে উঠেছে যে, যাকে দেখেছি তিনি যে একটি মূর্তিতে বন্দী হয়ে আছেন সে কথা কিছুতেই মনে পড়ে না। তাদের দেখে মনে হয় যেন তারা তাদের কাজ কর্ম করার জন্যে নিজ নিজ জীবনের মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। কথা বলতে বলতে যেন হঠাৎ থেমে গিয়ে আবার কি কথা বলতে উদ্যত হয়েছেন। ঠোঁটের কোণে সে কথা যেন ফুটি ফুটি করছে।

একালের বিশ্ববিখ্যাত নেতাদের সকলেই আছেন। ইংলণ্ডের রাজপরিবারের সকলেরই থাকবার কথা। সে জন্যে তারা তো আছেনই। শুধু অষ্টম এডোয়ার্ড (বর্তমানে ডিউক অব উইণ্ডসর) আর তাঁর স্ত্রী (ভূতপূর্ব মিসেস সিম্পসন) রাজপরিবারের বাইরে স্বতন্ত্র স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রাজা পঞ্চম জর্জ। রাণী মেরী। রাজা ষষ্ঠ জর্জ। তাঁর রাণী। রাজকন্যা মার্গারেট। একালের রাণী এলিজাবেথ এবং রাজপরিবারের গণ্যমান্য সকলেই স্ব-মহিমায় আসন পেয়েছেন। হিটলার, মুসোলিনী প্রমুখ নেতাও বাদ যান নি। গান্ধীজিকে দেখছি তার সেই চিরাচরিত–Naked Fakir of India র পোশাকে। নেহেরুও বাদ যান নি। দেখলাম আমাদের কায়েদে আযমকে, সেরওয়ানী পরিহিত পাকিস্তানী পোশাকে। তার চেহারায় চিন্তাশীলতার স্বকীয়তা পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে।।

এই জায়গায় এসে দেখছি রূপকথার নিদ্রিতা সুন্দরী সেই ‘Sleeping Beauty’ কে। তনু দেহ মেলে দিয়ে কতকাল ধরে ঘুমিয়ে আছেন তিনি, স্বপন পুরীর কোন রাজপুত্রের প্রতীক্ষায়। তার ক্ষীণ শরীর ছেয়ে স্নিগ্ধ কোমলতা যেন পুষ্পিত হয়ে উঠেছে। মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম সরু কাপড়ে তার দেহলতা সুশোভিত। তাকে নিশ্বাস নিতে দেখা যাচ্ছে। তার হৃদয়ের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে, স্বাস-প্রশ্বাস সুচারু যান্ত্রিক আয়োজনের ভিতর দিয়ে। মনে হচ্ছে তার নিশ্বাসে একটা সুমধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে নিষেধ আছে। চোখ দিয়ে দেখে হৃদয়ে তৃপ্তি পেতে পেতে তাই মন দিয়ে তাঁর চরণ ছুঁয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

মাদাম তুসো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। দরজার সামনে পুলিশের পোশাক-পরা প্রহরী দেখছি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। সে কি সত্যিকার মানুষ না মোমের তৈরী বুঝতে পারছি না। দেখতে দেখতে আমি নিশ্চুপ হয়ে গেছি। এমন সময় দশ বারো বছরের গোটা দুই ইংরেজ মেয়েকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। তারা কিম্ভূতকিমাকার আধাকালো এই আমাকে দেখে মূর্তি ঠাওরে যেই না আমাকে স্পর্শ করছে, অমনি আমি সচকিত হয়ে ফিরে দাঁড়িয়েছি। বেচারীদের ভুল ভাঙতেই তারা হতচকিত হয়ে ছুট দিয়েছে। আমি মনে মনে হেসে উঠলাম। সামনে পাহারারত মোমের পুলিশটিকে নিয়ে আমার যে দশা, আমাকে নিয়ে ওদেরও সে দশা হয়েছিল। ওদের ভুল ভাঙলো আমাকে নড়ে উঠতে দেখে। আর পুলিশটিকে স্পর্শ করে আমার ভুল ভাঙলে যে, সে মূর্তিই, মানুষ নয়।

লণ্ডনের Natural History Museum সত্যি মানুষকে মুগ্ধ করে দেবার মতো। প্রাকৃতিক বিবর্তনের ইতিহাস যেন এ মিউজিয়ামে, জীবন্ত রূপ ধরেছে। জীব-জানোয়ার পশুপাখী তার আদিমতম অবস্থা থেকে কিভাবে বর্তমান রূপে এসে দাঁড়িয়েছে, এখানে এক দৃষ্টিতে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। প্রত্যেক জীব-জানোয়ারকেই রাখা হয়েছে তার জীবনের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, সেই পরিবেশকে যথাযথ সৃষ্টি করে। মানুষ তার বুদ্ধি এবং মনের চর্চায় প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় কি করে বন্দী করতে পারে তার আর একটি বাস্তব নিদর্শন পেলাম এ প্রাকৃতিক ইতিহাস প্রদর্শনীতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জলবায়ুর বিভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী জন্মায়। তারা এখানে স্থান পেয়েছে তাদের স্বদেশের পরিবেশে। ছোট ছোট প্রাণী থেকে বৃহৎ প্রাণীর কেউ বাদ যায়নি। এক এক রকম “স্পিশিস’ (Species) বা গোত্রভুক্ত প্রাণীর হাড়গোড় তো আছেই, তারপর তাদের মৃতদেহকে স্বকীয় পরিবেশে জীবন্ত করা হয়েছে। তারা যে মূত, প্রথম দৃষ্টিতে তা সহজে বুঝা যায় না। দেখছি হাতী ঘোড়া হরিণ জিরাফ বাঘ সিংহ শেয়াল বেবুন সবই আছে। জীবজগতের ইতিহাসের বিবর্তন কিভাবে বর্তমান রূপ পেলো, তা বই পড়ে শিখবার চাইতে এখানে এসে একবার দেখে ভালো করে জানা যায়। তাতে পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়।

আশ্চর্য হচ্ছি ঘুঘু, পায়রা প্রভৃতি পেয়ারা পাখীগুলোকে দেখে। আপন আপন পরিবেষ্টনীতে যেমন করে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে বসে থাকে, এখানেও তেমনি গাছের শুকনো কি সবুজ পাতায়-ভারা ডালে তাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় দেখছি কপোত কপোতী পরস্পর চঞ্চু সংলগ্ন হয়ে প্রণয়সম্ভাষণে লিপ্ত হয়েছে। কোন কোনোটার পাখায় গতির লক্ষণ। যেমন উড়ি উড়ি করছে।

এলামি কুকুরের আস্তানায়। কুকুরের জাতের এতে যে বিভিন্নতা আছে, এখানে এদের একত্রে দেখলে তা যেমন বিশ্বাস হয়, বইয়ে পড়ে কি শোনা কথায় মন যেন তাতে তেমন করে সায় দিতে চায় না। ইংরেজরা ইতিহাস প্রিয় তা তো জানি, কিন্তু তারা যে এমন কুকুরভক্ত জাত তা এবারে ভালো করে বুঝতে পারছি। ছোট থেকে বড়ো পর্যন্ত কত জাতের যে কুকুর আছে, তা প্রথম দেখলাম। এক একটা দেখতে এক এক রকম। ছোট বেড়ালের সমান থেকে শুরু করে সিংহের মতো কুকুরও দেখলাম। ইংরেজরা শুধু যে কুকুরভক্ত তাই নয়, কুকুরের ‘রেস’ ভক্তও বটে। কোন্ কুকুর কবে কোন্ রে জিতেছে, তার পিতা ছিল কে, তার সন্তান কে হলো এমনি করে তার আগের ও পরের কয়েক পুরুষের রক্তের অবিমিশ্রণ যেভাবে রক্ষা পেয়েছে, তাও সযত্নে দেখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

Science Museunটি কিন্তু ভিন্ন ধাচের। এখানে ইতিহাস ও ভূগোল প্রীতি নেই। আছে বিজ্ঞান সাধনার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত। এ যুগটাই বিজ্ঞানের যুগ। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। তাতে ইংরেজদের অবদান কম নয়। এ যুগে দুনিয়াতে চলতে গেলে প্রত্যেক মানুষেরই যাতে বিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান হ্য, এ মিউজিয়ামটি মূলত সেই প্রেরণার সৃষ্টি। আমাদের দেশের মানুষ তো দূরের কথা, যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তাদেরও অনেকে বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকেফহাল নয়। দোষ দিইনে তাদের। কারণ বই পড়ে শিখতে গিয়ে কোনোটা দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, কোনোটা বা মাষ্টারের হাত থেকে ফসকে গেছে। ফলে বিদ্যা হয়েছে কেতাবী, প্রত্যক্ষ জ্ঞানগোচর নয়। প্রাথমিক জ্ঞানে যে প্রত্যেক মানুষেরই একটা সাধারণ অধিকার রয়েছে, তার একটা সুরাহা হয়েছে এখানে। কিসের থেকে কি আবিষ্কার হলো, কোন্ যন্ত্রে কি হয়, যন্ত্রপাতি কি করে ব্যবহার করতে হয়, এখানকার ছোট ছোট ছেলেপুলেরা পর্যন্ত অবসর বিনোদনের জন্য এখানে এতে নেড়ে চেড়ে তা শিখতে পারছে। একজায়গায় দেখছি ছাদ থেকে একটা বিরাট পেণ্ডুলাম ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার নীচে মেঝেতে একে রাখা হয়েছে একটি বিরাট ঘড়ি। সকালে এসে দেখা যায় পেণ্ডুলামটি হয়তো আটটা বরাবর ঝুলছে। দুপুরে এসে এই পেণ্ডুলামটিকেই ঝুলিতে দেখছি বারোটার দাগ বরাবর। পৃথিবী যে অনবরত ঘুরছে, এর চেয়ে চাক্ষুষ প্রমাণ সাধারণের কাছে আর কি হতে পারে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *