বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – ২৫

পঁচিশ

মনে হয় জাতিগতভাবে ইংরেজরা আবেগহীন। ভাব-বিহ্বলতা বোধ হয় ওদের চরিত্রে নেই। দয়াময়া স্নেহ-মমতা প্রায় মানুষের আছে, সুতরাং ইংরেজদেরও আছে। কিন্তু ইংরেজদের মধ্যে তার প্রকাশ খুব সংযত। কিন্তু জাতিগতভাবে ইংরেজদের একটা সংযত আবেগ বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার Queue-তে। ইংরেজরা আগেও কিউ করতো কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে সে কিউ যতো ব্যাপক সুশাখল হয়েছে, আগে তেমন ছিল না। ইউরোপে এমন কিউ আর কোথাও দেখিনি।

প্যারিসে দেখলাম সিনেমা কি থিয়েটার হলে কিউ, ঢাকবার জন্যে কিউতে দাঁড়ালেও দরজায় ঢুকবার সময় সে কিউ আর থাকে না, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। বাসের জন্যে লোক অপেক্ষা করছে। মনে হচ্ছে যেন কিউতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তা নয়, কিউতেও আছে। তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে ঘোরাফেরা করছে এমন লোকও আছে। বাস এলো। কিউর লোকেরা উঠতে পারলো না। আশেপাশের লোক ঝটপট বাসে উঠে পড়লো। কিন্তু ইংলণ্ডে তা হবার নয়। সেখানকার ‘কিউ তো ‘কিউই। এমনও সময় আসে যখন একটা কিউ দু’তিন মাইল লম্বা হয়। একদিন স্থির করলাম ‘ফেষ্টিভ্যাল অব ব্রিটেন উপলক্ষে টেসের পাশে Pleasure Garden-এর যে মেলা বসেছে, কয়েক বন্ধুতে মিলে তা দেখে আসবো। কেনসিংটন গার্ডেন স্টেশন থেকে বাস ধরতে হবে। দেখলাম বাসের প্রতীক্ষায় কিউতে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত নরনারী। বাস ধরতে হলে আমাদেরও কিউতে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য উপায় দেখি না। কিউতে দাঁড়ানোর জন্যেই হাঁটতে শুরু করলাম। কেনসিংটন স্টেশন থেকে প্লেজার গার্ডেনের দূরত্ব মোটামুটি মাইল পাঁচেক। হাঁটতে হাঁটতে আমরা কিউটির শেষ প্রান্তে এসে যখন পৌঁছলাম, তখন দেখি প্লেজার গার্ডেনে পৌঁছাতে আর মাইল দুই পথ। বাকী। মহা সমস্যায় পড়লাম। বাকী দু’মাইল পথ হেঁটে যাবো, না বাস ধরার জন্যে কিউতে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে আরও তিন মাইল হাঁটবো? কিউতে দাঁড়ালে অবশ্য হাঁটার কষ্টটা বুঝবো না। সারিতে পিঁপড়ে যেমন সুড় সুড় করে চলে, তেমনি নরনারীর সারি সুড় সুড় করে নিজেদের অভন্নাতে এগুচ্ছে। হাঁটার কষ্ট বুঝা না গেলেও কিউ অভ্যস্ত আমাদের তো আর একটা বড়ো কষ্ট আছে। তা সমস্ত দেহের ভারটা বেচারী পা দুটোকে দিয়ে বইয়ে নেওয়া। ওরা কতক্ষণই বা ত পারবে? ক্লান্তি অবশ্য দূর হয় যদি কিউতে দাঁড়ানোর ভার থেকে মন মুক্তি পায়। তেমন ভাগ্যবান ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিউতে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সকলের ভাগ্যেই যে এমন ঘটবে তার নিশ্চয়তা কি? সুতরাং বুদ্ধিমানের মতো বাকী পথ আমরা পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম।

অধিকাংশ ইংরেজই কিউতে দাঁড়িয়ে সময়ের সদ্ব্যবহার করে। কিউতেই পড়ছে, কিউতেই চিন্তা করছে, কিউতে নতুন সৃষ্টির খোরাক পাচ্ছে। কিউতে খাচ্ছে, আবার কিউতে দাঁড়িয়ে রসিকতাও করছে, এমনকি টুকিটাকি লেখার কাজও করছে কিউতে দাঁড়িয়েই। কেননা কিউ ছাড়া এদের পথ নেই, মুক্তিও নেই। জীবনের সব যে কিউতে ভর্তি। সিনেমা দেখতে যাও লেখা আছে, সাড়ে চার শিলিং-এর টিকিটের জন্যে এখানে কিউ কর, এখানে কিউ কর সওয়া নয় শিলিং-এর, এখানে সাড়ে ষোল শিলিং-এর। সিনেমা, থিয়েটার, আমোদ প্রমোদ ভবনের সবেতেই কিউ। বাস ট্রেন ইত্যাদিতে উঠতে গেলেও সর্বত্রই কিউ। এ কিউ প্রকট হয়ে উঠে উইকএণ্ডে যেদিন ইংরেজরা দলে দলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোয়। তাই বাস স্টপে কিউ করে, নৌকা বাইচ খেলার জন্যে কিউ করে, চা-এর জন্যে কিউ করে, লায়ন্স-এ খেতে ঢুকে কিউ করে। কিউ করে আইসক্রিমের জন্যেও। কোথাও কিছুর জন্যেও কিউ করার না থাকলে কিউতে দাঁড়ানোর আনন্দের জন্য কিউ করে। সঙ্গী না পেলেও সুশৃঙ্খল ভাবে একাই কিউ করে দাঁড়ায়। সপ্তাহ শেষে যারা ঘরের বাইরে যেতে পারলো না, তারা বাইরে কিউতে দাঁড়াতে না পারার ব্যথা ভোলে কিছুক্ষণের জন্যে ঘরের মধ্যে পরিবার পরিজনদের নিয়ে কিউ করে। সব শেষে মজা হয় তখনই, যখন রাতের বেলা মা বাবাদের ছেড়ে ছোট ছেলেমেয়েরা বিছানায় যাবার জন্যে কিউ করে দাঁড়ায়।

ছাব্বিশ

খাওয়াতে যে তৃপ্তি আছে, বিলাতে এসে অবধি তা ভুলেই গেছি। বিলেতে রওয়ানা হবার আগে দিনকয় ধরে কি পোলাও কোরমাই না খেলাম। দেশে থাকতে ও সব খাবারের জন্যে আগ্রহ থাকলেও লালায়িত হইনি। আমাদের মোগলাই খানা সত্যি সে এক এলাহি ব্যাপার। পাঠান ও মোগলেরা মিলে এদেশে এ সব খানা আমদানি করেছিলেন। মোরগ পোলাও, বিরইয়ানি, কোরমা-কাব, কোফত-কালিয়া, পাক হতে থাকলেই দূর থেকে তার ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে এসে জিবের পানি ঝরায়। ক্ষুধা না থাকলে ও পেটের মধ্যে ক্ষুধার রস ক্ষরণ হতে থাকে। মন প্রফুল্ল হয়। আর খেতে বসে মনে হয় খোদার দেওয়া নেয়ামত মুখ দিয়ে কোথায় যেন নেমে যাচ্ছে। খেয়ে তা পেট ভরছেই, সঙ্গে সঙ্গে মনও ভরছে। আত্মাও হচ্ছে তপ্ত। পরিতৃপ্ত মন তার অজ্ঞাতসারে আপনা থেকেই অন্নদাতার প্রতি সম্ভ্রমে নুয়ে আসছে। একেই বলে খাওয়ার মতো খাওয়া একেবারে বনেদী। বাঁচার জন্যে খাওয়া নয়, খাওয়ার জন্যেই বাঁচা। এ খাওয়ার জন্যে বাঁচতে গিয়েই ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে মোগলেরা ভারত সাম্রাজ্য হারালো। সে যাক গে। পর্ব পার্বণের কথা নাইবা তুললাম। অতিথি অভ্যাগতের সমাদরেও আমাদের দেশের সাধারণ মুসলমানের বাড়ীতে খাওয়ার যে আয়োজন হয়, তাও কি কম। দিনকাল তো বদলে গেলো। এখন পেটের ক্ষুধা মেটানো দায় হয়ে উঠেছে। তবু বিরইয়ানি, মোরগ পোলাও, টিকিয়া, শিককাবাব আর জরদা ফিরনি, রংবেরঙের মোরব্বা আর হালুয়া আমাদের সাধারণ বাড়ীতে এখনও বিশেষ দিনে খাবার রূপে শোভা পায়।

এখানে এসে অবধি খাওয়ার টেবিলে বসে ইংরেজদের খাবার দেখে নাকি-কান্না কাদি। সঙ্গে সঙ্গে আট হাজার মাইল দূর থেকে কল্পনায় আমাদের খাবারের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে, তার গন্ধ কি। সে খাবার পাবার জন্যে মন আঁকুপাকু করে, আর সে কারণে যাও-বা এদের খাবার পেটে যেতো তাও যায় না। মুখে তুলে দিলেও নীচে নামতে চায় না। নাড়ীভুড়িগুলো বিদ্রোহ করে সব ঠেলে ফেলতে চায়।

ইংরেজদের খাবার শুধু সিদ্ধই। সকালের ব্রেকফাষ্টটা তবু ভালো, ভরপেট খাবার পাওয়া যায়। খাওয়াও যায়। দুধ, কর্ণফ্লেকস, কি পোরিজ, মাখন টোষ্ট, ডিম আর সময়ে “স্মোকড় ফিশ’। সিদ্ধ না করে আধ পোড়া লালচে ধরনের করে একটা ধোয়াটে গন্ধ তৈরী করা হয় বলে তবু আমাদের কেউ কেউ মাছের এ পাকটাই খেতে পারে।

লাঞ্চ আর ডিনারের কথা কি বলবো। আমাদের যেমন ভাত, সিদ্ধ করা গুঁড়িয়ে নেওয়া আলু (Mashed Potato) এদেরও তেমন প্রধান খাবার। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটর সুটি, ছিনা কি ছিমের বিচি, মিষ্টি কুমড়া, বর্বটি ইত্যাদি যাবতীয় শাকসজীই এরা পানি দিয়ে পুরো কি আধ সিদ্ধ করে নিয়ে গোল মরিচের গুড়ো আর নুন দিয়ে শুধু গিলে। ইংলিশ হোটেল রেস্তোরাঁয়, কি স্কুল কলেজের রিফেক্টারীগুলোতে খেতে যাই। সব রকমের সিদ্ধই তো ধীরে ধীরে সহ্য হয়ে আসছে, কিন্তু আস্ত জড় শুদ্ধ সিদ্ধ করা বাধাকপি যখন পাতে ধরে দেয়, তখন ঐ আলুনি, আর তার ফ্যাকাসে দৃশ্য দেখে মনটা এমন বিষিয়ে উঠে যে, ক্ষুধা থাকলেও খেতে ইচ্ছে করে না। এতোকাল ধ’রে যে শুনে আসছি ক্ষুধার বড় নাকি চাটনি নেই, প্লেটভর্তি সিদ্ধ বাঁধাকপির এ দৃশ্য দেখলেই প্রবাদ বাক্যটির অসারতা ধরা পড়ে। ক্ষুধা যেন আপনা থেকেই উবে যেতে চায়। গরুর বাচ্চা হবার পর দুধ দোয়া শুরু করার ক’দিন আগে আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে দেখেছি লাউ, কলাই, বাঁধাকপি ইত্যাদি সিদ্ধ করে গরুকে খাওয়ানো হয়। এখানে খেতে বসে পাতের এ দৃশ্য দেখলেই আমার কাছে ইংরেজ জাতির কি যে একটা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এতে সভ্য জাত, ভানে বিজ্ঞানে এতো উন্নত, এত বছর ধরে জগৎ জোড়া সাম্রাজ্য চালালে অথচ খাওয়ার ব্যাপারে এদের রুচি কেন মার্জিত হলো না।

আলু শাকসজী সিদ্ধতে তবু খাওয়া যায়। কিছুদিন পরে অভ্যাস হয়ে গেলে মাখন কি দুধ মিশিয়ে একট সুস্বাদ করার চেষ্টা করলে মন্দ লাগে না। কিন্তু মাছ সিদ্ধ? তা আবার কি রকম? কল্পনা করুন তো বাংলা দেশের রুই, কাতল, মৃগেল, ইলিশ, চিতল, পাঙাস আর কই মাগুর সিং প্রভৃতি নামকরা স্বাদ-গন্ধ-ভরা মাছগুলো শুধু পানি-সিদ্ধ করে কৎ কৎ করে গিলছেন। তা হলে কেমন লাগতে পারে? এখানে তাজা মাছ কি টাটকা মাংস অমিল। একেতো শুকনো মাছ তার ওপরে তার এই দশা। নইলে এখানকার ও হেরিং প্রভৃতি মাছগুলো মন্দ লাগে না। এখানকার দু’একটি বাড়ীতে এ মাছই তো খেয়ে দেখলাম। শুকনো বরফ-সিটা মাছ, কিন্তু আশ্চর্য স্বাদ তো।

তারপর গোশতের কথা। বীফ হ্যাম, প মাটন সবই কাটা অবস্থায় একেবারে তৈরী হয়ে আসে ইংলণ্ডের বাইরে থেকে। এতো ভালো গোশত আমাদের দেশে কোথায় পাবো আমরা? এ মাংসও এরা পাকি করে না, পাকের নামে করে সিদ্ধ। সময়ে সময়ে রোষ্ট। হায়রে আমাদের দেশের রোষ্ট মুরগী আর রোষ্ট মাট। চোখে দেখছি থালায় কি সুন্দর করে সাজানো। সদ্য ভেজে এনে পরিবেশন করা হচ্ছে। মনে মোহ জাগছে। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে মুখে পুরতে। কিন্তু যা বলছিলাম। একদিন সেল্ফরীজে খেতে ঢুকলাম। মেনু দেখে উৎসাহিত হয়ে রোষ্ট বীফ’-এর অর্ডার দিলাম। মধ্যবয়সী এক ওয়েট্রস আমার খাবার দিয়ে গেলো। কাঁটা দিয়ে ধরে টুটার ওপরে যেই ছুরির টান দিয়েছি আর অমনি দেখি কি রকম এক পঁচা রক্তের দাগ ফুটে বেরুচ্ছে। তবু কিছু মনে করিনি। উৎসাহ তখনও দমেনি। মুখে তুলে দিলাম আর একটা ভাপসা গন্ধ আমার নাকে মুখে ঢুকে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিলো। পেটের ভেতরে ঢোকাতো দূরের কথা, পেটে যা ছিল তাও বমি হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। অথচ এতো লোকজনের মধ্যে বমিই বা করি কি করে? ইংরেজের আবার ম্যানারসের প্রশ্ন আছে। এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ওয়াশিং রুমে ছুটে গেলাম। ফিরে এসে বসলাম খাবার টেবিলে। ওয়েট্রেসকে বললাম আমার বিল দিতে। সে বেচারী আমার অবস্থা দেখছিল। বললে এদেশে নতুন এসেছো বুঝি?

আমি ছোট একটি উত্তর দিলাম ‘হ্যাঁ’।

বললে সে, কিছুতো খেতে পারলে না, আচ্ছা পয়সা কিছু কম দাও না হয়। আমি বললাম, দোকাল তোমার নয়, তোমার মালিকের। তা ছাড়া এ জিনিস তো খারাপ নয়। তোমাদের লোকজন তো বেশ খাচ্ছে। আমি খেতে পারছি না। দোষ তোমার জিনিসের নয়, আমারই। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’ পুরো আড়াই শিলিং মিটিয়ে দিয়ে ক্ষুধায় ও ঘেন্নায় কাতর হয়ে হাঁটা দিলাম।

এখানকার হোটেল রেস্তোরাঁয় স্পাগেটি পাওয়া যায়। লণ্ঠনের ফিতার মতো চওড়া আর কেঁচোর মতো মোটা ধবধবে এ সাদা জিনিসগুলো পাতে নিয়ে লোকজনকে বড় আরামে খেতে দেখি। লোভে পড়ে তাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। লবণ ঝাল দিয়ে পাক করলে কেমন লাগতো বলা যায় না। কিন্তু ময়দার তৈরী এ জিনিসগুলো মুখের ভেতরে তুলে দিলেই দেখছি ল্যাল প্যাল ল্যাল প্যাল করছে। এও এক কি রকমের অনুভূতি।

অক্সফোর্ড স্ক্রীটের কোণের বিরাট লায়ন্স কর্ণার-এ স্কুল পালিয়ে মাঝে মাঝে লাঞ্চ খেতে আসি। লাঞ্চ যা খাই, তাতো জানি। পয়সাও এখানে অন্যান্যগুলোর তুলনায় মন্দ দিইনে, তবু আসি এখানে লাঞ্চের সময় কনসার্টের লোভে। উইক এণ্ডে এ হোটেলটিতে ইংরেজ নরনারীর ভিড় দেখি অন্য কিছুর জন্যে নয়, স্যালাড় খাবার জন্যে। শাকসজী সিদ্ধ করলে তাতে ভিটামিন তবু কিছু নষ্ট হয়। তাই সাত দিন পরে আস্ত ভিটামিন গিলে খাবার আয়োজন। স্যালাড পাতা, গাজর ফুলকপির টুকরী জাতীয় কিছু টক–এ সব মিলিয়েজুলিয়ে স্যালাড খাবার ব্যবস্থা। সবই কাঁচা। ইংরেজদের প্রতি উইক্ এণ্ডে সোল্লাসে আর সাগ্রহে স্যালাড খাবার উৎসাহ দেখে একদিন আমি, সাজ্জাদ সাহেব, আর সিদ্দিকী সাহেব (চট্টগ্রামের ধনী ব্যবসায়ী, এ, কে, খানের জামাই) এখানে স্যালাড খেতে এলাম। কিউতে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে পছন্দসই লতা পাতা তুলে নিয়ে তো বসবার জায়গায় বসলাম। তারপর আগ্রহের সঙ্গে খাওয়া শুরু হলো। লালচে ধরনের কুচি কুচি পদার্থগুলো আমার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করায় ওদের তুলনায় আমি ওগুলো কিছু বেশী নিলাম। সাজ্জাদ সাহেব গম্ভীর লোক। অসুবিধা হলেও চুপচাপ থাকেন। এতো ইংরেজী খাবার ভক্ত মানুষ তিনি, তবু মুখে দিয়ে যে নিরুৎসাহ হয়েছেন, তা প্রকাশ না করলেও তার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি। সিদ্দিকী সাহেব মিটিমিটি হাসছেন আর মুখে দিচ্ছেন। সিদ্দিকী সাহেব। আমার প্রকৃতি জানতেন, আমি টক্ খেতে পারি না। আমি যেই মুখে দিয়েছি আর অমনি মুখ বিগড়ে লাফিয়ে ওঠার যোগাড়। এতোগুলো ইংরেজদের সামনে নাটুকাভিনয় হয়ে যায় নাকি তাই ভয়ে ভয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ ভার করে বসলাম। আমাদের পাশে এক ইংরেজ যুগলকে দেখছি কি তৃপ্তির আর ভরসার সঙ্গে না আস্ত ভিটামিন গিলছে। আমি ভাবছি আমাদের দেশের কোন আস্ত গেঁয়ো মানুষ এতোগুলো লোককে এক সঙ্গে এমনি করে শুধু কাঁচা তরিতরকারী আর লতাপাতা খেতে দেখলে কি ঠাওরাবে? গরু ছাগলের খাবার বদলে দিয়ে হঠাৎ মানুষের খাবারে পরিণত হলো নাকি। প্রথম দৃষ্টিতে যে তার মনে এ খটকা লাগবে, একথা হলপ করে বলতে পারি।

ভালো লাগে এদের ক্রিসমাস ডিনারগুলো। বিশেষ করে ক্রিসমাস ডিনারের রোষ্ট টার্কি। টার্কি এক রকম মুগীই। আমাদের মতো করে রোষ্ট করলে আরও যে কত ভাল লাগতো, তা আঁচ করতে পারি।

খাওয়ার পরে মিষ্টি খাওয়া মুসলমানদের কাছে সুন্নত। ইংরেজরা এ সুন্নত নিয়ম বেঁধে পালন করে। এখানে ভাত তো তেমন পাইনে। স্কুলের রিফেক্টারীগুলোতে সিদ্ধ তরিতরকারীর সঙ্গে চা চামচের দুই চামচ ভাত মাঝে মাঝে পাই। খাবারের পরে কিন্তু রাইস পুডিং পাওয়া যায় তার যা ছিরি। দুধের মধ্যে চাল ফেলে সেদ্ধ করে দেওয়া হয়। ইংরেজরা তাই খায় বড়ো তৃপ্তির সঙ্গে।

ইংরেজরা মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। চা কফি এক রকম চিনি ছাড়াই দেশ জোড়া লোক খাচ্ছে। কিন্তু পুডিং, আইসক্রিম, ফুট স্যালাড সবই এতো মিষ্টি যে, কোন দিন মনে হয় না, চিনি বলে কোন পদার্থের কোনো কালের জন্যে এদের অভাব ছিল।

ইংরেজদের কোনো খাবারের যদি সত্যিকার প্রশংসা করতে হয় তাহলে তাদের কেকের। এরা সত্যিই উৎকৃষ্ট কেক, পেষ্ট্রি আর বিস্কটু তৈরী করতে পারে। ক্রিসমাস কেক, বার্থডে কেক, ওয়েডিং কেক এবং এ ধরনের আরও বিশেষ কোন দিন বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে যে সব কেক তৈরী করা হয়, সত্যি তার তুলনা হয় না। তার অর্থ, ওরা এ আর্টটিতে সিদ্ধহস্ত আর এটা খেতে জানে। তার স্বাদ বোঝে।

খেতে বসে ইংরেজদের প্রতি অপ্রসন্ন হই, কিন্তু জীবনের প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গী বিচার করলে খাওয়া সম্পর্কে ওদের উদাসীনতাকে ক্ষমা না করে পারা যায় না। খাওয়াটা এদের বিলাস নয়, ইউটিলিটি বা বাস্তব দর্শনের দিক থেকে নিতান্ত প্রয়োজন। তাই খেতে গিয়ে তার আয়োজন করতে গিয়ে এতো সময় নষ্ট করে না। আমাদের দেশের হিন্দু বাড়ীতে জামাই বরণ করবার জন্যে শুনি বত্রিশ ব্যঞ্জনের আয়োজন হয়। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মধ্যবিত্ত পরিবারেও একটা ভাজাভুজি, একটা মাছ-মাংসের তরকারী আর ডাল সাধারণ ভাবে হয়েই থাকে। এর আয়োজন করতে গিয়ে গৃহিণীকে সেই যে সকালে পাকের ঘরে ঢুকতে হয়, আর তার বোরোনোর সময় হয় না। যখন বের হন তখন দেখা যায়, বিকেল আর রাতের খাবারের আয়োজনের সময় হয়ে গেছে। আমাদের দেশের গৃহকত্রীদের রান্না ঘরে এমনিভাবে বন্দী করে আমরা খাওয়া-দাওয়ার যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছি, ইংরেজ তা করতে নারাজ। একেতো এখানে অধিকাংশ লোকই খাওয়ার কাজটা সারে হোটেলে রেস্তোায়, তার ওপরে কর্মব্যস্ত জীবনে খাওয়ার জন্যে এত ব্যয় করার মত সময় তাদের হাতে কোথায়? তাই চটপট করে সিদ্ধ করে কোন রকমে গলাধঃকরণ করে ও কাজটা শেষ করে দেবার ব্যবস্থা। ওদের খাওয়ায় সে জন্যে পেটও পারে না, মনও ভরে না। আর খাওয়ার পরে পেটও ভার হলো বলে ঝিমুতেও হয় না। খেতে পারে না বলে পরিমাণে কম খায়, আর ঘুরে ফিরেই খায়। বাকী ক্ষুধাটা মিটায় চা খেয়ে। ভোরে চা, লাঞ্চের পরে চা, চায়ের সময়ে চা, সাপারের পরে চা, শোবার সময়ে চা, আর তা ছাড়াও এর ফাঁকে-ফাঁকে চা।

এতো দুঃখের মধ্যেও ইংলণ্ডের হোটেল রেস্তোরাঁয় খেয়ে সুখ আছে। খাওয়ার জন্যে নয়, তরুণী পরিবেশনকারিণীদের মধুর ব্যবহারে। নানা কারণে পিকাডিলীর সোহ অঞ্চলটির খ্যাতি আছে। পৃথিবীর নামকরা দেশ খুব কমই আছে যাদের বড়ো রেস্তোরাঁ এখানে নেই। ভালো ডিনারের লোভে বিকেলের দিকে এধারে এলেই নানাদেশী খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়। ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, চাইনিজ, টার্কিশ আর ইন্দো-পাকিস্তানী রেস্তোরাঁতে এ অঞ্চলটি সমৃদ্ধ। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাতেও তাই এলাহি কারখানা। মুখের স্বাদ বদল করতে আর ভিন্ন দেশী খাবারের প্রকৃতি নিরূপণ করতে এখানে বিদেশীদের, আর বিশেষ করে ভারত-ফেরত ইংরেজদের ভিড়ের তুলনা নেই। কন্টিনেন্টের মধ্যে খাবারের চর্চায় ফরাসীদের জুড়ি নেই। পাক-ভারতের মোগলাই খানাও ওদের খাবারের রকমফের, প্রণালী আর স্বাদের কাছে হার মানে। এক মিশর আর আরব জগতের রেস্তোরাঁই বিলেতে তেমন চোখে পড়েনি। অন্যত্র ওদের খাবার যে পেটে যায়নি তা নয়। কিন্তু আরবী মিশরী হোক, কি ইস্তাম্বুলী খাবারই হোক, আমাদের শাহী খাবারের কাছে দাঁড়ায় না। কলা হিসেবে খাবারের চর্চা করেছে ইউরোপে ফ্রান্স, প্রাচ্যে পাক ভারতীয় মুসলমানেরা আর দূর-প্রাচ্যে চীনারা। হংকং রেস্তোরাঁয় চীনাদের খাবার খেতে সেজন্যে ঘুরে-ফিরে আসি। ইংরেজদের ছুরি কাঁটা আয়ত্ত করেছি, কিন্তু ওদের চপষ্টিক নামক কাঠির ব্যবহার আয়ত্তে এলো না। না আসুক, ওদের তেলাপোকা, সাপ, ব্যাং অবশ্য খাইনি, কিন্তু অন্যান্য খাবারের মধ্যে যে স্বাদ আছে তা অস্বীকার করি কি করে?

সাতাশ

লণ্ডনের একটি মাত্র জায়গায় আমাদের দেশী বাজারগুলোর নমুনা দেখা যায়। লণ্ডনের কোন দোকানেই দরদস্তুর করবার রেওয়াজ নেই। ছোট বড়ো যে দোকানেই হোক না কেন এবং যা-ই কেনা যাক না কেন, সব কিছুরই দাম নির্দিষ্ট রয়েছে। যেখানে নেই সেখানেও সেলসম্যান কি সেলগার্লেরা যা বলবে, দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে কিনবার হলে সে দামটি ফেলে দিয়েই জিনিস কিনতে হবে। একে ঠকা জেতা নেই। এটাই এখানকার নিয়ম। বাজার করতে গিয়ে আমাদের দেশে পাঁচ দোকান ঘুরে ফিরে দরদস্তুর করে সুবিধা দামে জিনিসপত্র কেনা যাদের অভ্যাস লণ্ডনে এসে হঠাৎ এ রকম ভাবে জিনিস কিনে তাদের মনটা খুঁৎ খুঁৎ করে।

এ রকম লোক জিনিসপত্র কিনতে যেন পেটিকোট লেনে আসে। দক্ষিণ-পূর্ব লণ্ডনে এ বাজারটি। আল্ডগেট ইষ্ট টিউব স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগুলেই এ বাজার শুরু হতে দেখা যায়। এ অঞ্চলটি কলকাতার চীনা বাজারের মতো। একে অপরিষ্কার তার ওপরে মানুষ ও দোকান-পাটগুলো যেন গায়ে গায়ে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের দরদালান যে নেই তা নয়, তবু দোকানের সামনে ফুটপাথের ওপর হয় চাল খাঁটিয়ে নয়তো চাদোয়া টাঙিয়ে নানারকম হাট বাজার বসানো হয়েছে। এখানে সাধারণতঃ শ্ৰমিক ও গরীব লোকদেরই নমুনা থেকে দারিদ্র্যের চিত্ন ফুটে বেরুচ্ছে। এদের অমার্জিত আচার-আচরণ, ককনি ইংরেজি, ছেঁড়া ফাটা পোশাক, আর অগোছালো পরিবেশ সব মিলেমিশে এমনই এক আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে, যে অঞ্চলটিকে লণ্ডনের অংশবিশেষ বলে কিছুতেই মনে হয়। না। এক জায়গায় দেখছি পুরানো ও ছেঁড়া কাপড়-চোপড় নীলাম হচ্ছে নীলমের জন্যে তার আনুষঙ্গিক হাঁকডাক শুরু হয়েছে। লোকও ভিড় করেছে কম নয়। ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং রীতিমতো দর কষাকষি শুরু হয়ে গেছে। আর এক জায়গায়। দেখছি আমাদের দেশের মুদিখানার মতো বেশ কিছু ছোট ছোট দোকান। তেল নুন ইত্যাদি যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে।

লণ্ডন শহরের এ পেটিকোট লেনটি যে সব কারণে বিশিষ্ট, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এখানকার জীবন্ত হাঁস মুরগী। যারা জীবন ভরে তাজা জীব জানোয়ারের টাটকা গোশত খেয়ে অভ্যস্ত, বেশ কিছুদিন লণ্ডনে থেকে বাসি, আধশুকনো ও আধপচা গোশত খেয়ে তাদের মন যখন বিষিয়ে ওঠে আর গা বমি বমি করে, তখন চোখের সামনে পেটিকোট লেনের ভাজা এবং মোটা এ হাস মুরগীগুলো দেখে তাদের মন যে প্রফুল্ল হয়, তা বেশ আচ করা যায়।

খাঁচায় বদ্ধ মোটা মোটা মুরগী ও টার্কি দেখে আমরা এক ইহুদীর দোকানে ঢুকে পড়লাম। দরদস্তুর করে আঠারো শিলিঙে সের তিনেক ওজনের একটি মুরগী নিলাম। দোকানদার তার কক্‌নি ইংরেজীতে আমাদের জিজ্ঞেস করলো, কোন ধর্ম অনুসারে এটা হালাল করে নিতে চাও? খ্রীষ্ট, ইহুদী, না ইসলাম?

ডা. মল্লিক (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলার) বললেন, ইসলাম ধর্ম মতেই আমরা ওটাকে জবাই করে নিতে চাই। কিন্তু সে জন্য তোমাকে কষ্ট করতে হবে না, আমরাই পারবো।

বন্ধুরা মুরগীটা জবাইয়ের ভার দিলেন আমার ওপর। বিলেতে বসে মুরগী হালালের কথা কোনোদিন চিন্তাও করিনি। কিন্তু ভার যখন পড়লোই, তখন আমতা আমতা না করে বীরপুরুষের মতো বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবর বলে মুরগীটির গলায় ছুরি চালিয়ে দিলাম। বাকী কাজটা করলো ইহুদী দোকানদার। কেটে কুটে ঠিক করে দিলো। ওটা নিয়ে আমরা দ্রুত রওয়ানা হয়ে গেলাম।

আটাশ

লণ্ডনের হাইড পার্ক নানা কারণে দুনিয়া বিখ্যাত। বা চর্চা আর বাক স্বাধীনতার চূড়ান্ত নিদর্শন, দুনিয়াতে যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই। কোন রসিক যে এ পার্কের কতকগুলো জায়গাকে ‘ম্যাড়ম্যানস কর্ণার’ বলে অভিহিত করেছে, তা জানিনে। তবে এ পার্কের নানা ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে ছোট বড়ো মাঝারি, ভালো মন্দ সব রকম লোকের বক্তৃতার বহর দেখে মনে হয় এ বিশেষণ এ পার্কটির জন্যে অতি ভাষণ নয়, এর ন্যায্য পাওনা।

আবহাওয়া ভালো থাকলে সারা বছর ধরে বিকেল হতে না হতে এ পার্কটির বিশেষ বিশেষ কোণগুলো সব বয়সের আর সব দেশের নরনারীতে ছেয়ে যায়। কেউ আসে তার শোভা দেখতে। কেউ আসে ভিড় ঠেলতে। কেউ আসে বক্তৃতা শুনতে। কেউ আসে মন জুড়াতে। আর কেউবা কৌতুক করতে। ম্যাড়ম্যান্স কর্ণারগুলো দল উপদলের বক্তৃতার জন্যে বিশেষভাবে খ্যাত। আপন আপন বক্তৃতা মঞ্চ নিয়ে এসে বক্তারা নিজের দলের মুখপাত্র হিসেবে বক্তৃতা শুরু করতে না করতেই শ্রোতারা তাদের চার পাশ ঘিরে ভিড় জমায়। কেউ বক্তৃতা করছে রাজনীতি সম্পর্কে, কেউ সমাজ সংস্কার সম্পর্কে। কেউবা ধর্ম আর কেউবা অন্যকিছু সম্পর্কে। যে সব বিষয়ে বক্তৃতা করে সাধারণ লোকের মন জয় করা যায় আর তাদের জ্ঞান বাড়ানো যায় হাইড পার্কে সাধারণতঃ সে ধরনের জনপ্রিয় বিষয়ের ওপরেই বেশী বক্তৃতা হয়; বক্তার বিষয়বস্তু মুখরোচক হলে এবং বলবার ভঙ্গী ভালো হলে সেখানে শ্রোতারও ভিড় জমে বেশী। রাজবংশ এবং বিশেষ করে রাজরাণী ছাড়া প্রধান মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ পদাতিক পর্যন্ত যে কাউকে গালাগালি করার যদি কারুর প্রয়োজন থাকে, তবে হাইড পার্কের এ জায়গাই তার জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রশস্ত। এক বক্তা একদিন ইংলণ্ডের পররাষ্ট্র নীতি এবং মন্ত্রিসভাকে গালিগালাজ করে খুব জোর গলায় বক্তৃতা করছে। তার অভিযোগ ইংলণ্ডকে এরা আমেরিকার ‘ফটিনাইনথ ষ্টেইট’ করে তুললো।

সে যা হোক, বক্তা এবং শ্রোতা যখন উভয়েই উভয়ের অপরিচিত হয় তখন শ্রোতার চেয়ে বক্তার লাভ হয় বেশী। তার কোন দায়িত্ব থাকে না। মন্দ, কি ভুলচুকভরা যেমনই হোক না কেন গলাবাজি করে বক্তৃতা দিয়ে বক্তা আত্মপ্রসাদ পেতে পারে এবং বক্তৃতা দেওয়ার শিক্ষানবিসিও সে করতে পারে। এমনি করে এই হাইড পার্ক থেকে বহু খ্যাতনামা বক্তার উদ্ভব হয়েছে। শোনা যায় ভারতের কৃষ্ণ মেননও ছাত্রজীবনে হাইড পার্কের ম্যাড়ম্যান্স কর্ণারে এককালে বক্তৃতা করে হাত পাকিয়েছিলেন।

ঊনত্রিশ

১৯৫২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী স্যানড্রিংহাম ক্যাসলে সকাল সাড়ে সাতটায় রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা যান। পৌনে এগারোটায় তার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা হয়। রাজকন্যা এলিজাবেথ তার স্বামী ডিউক অব এডিনবরার সঙ্গে কেনিয়া ভ্রমণ করছিলেন। তাঁর আর অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যাণ্ড যাওয়া হলো না। সেদিনই বিকেলে জেট বিমানে তিনি দেশে ফিরলেন। পরদিন সকালে পিতৃশোকার্তা নারীকে রাণী হবার মহড়া দিতে হলো। রাজা মরে, কিন্তু নিয়মের এমনি শাসন যে, সিংহাসন শূন্য থাকতে পারে না। ঘোষক বাহিনী ঐতিহাসিক সাজপোশাক পরে লণ্ডনের অঞ্চলবিশেষ ঘুরে ঘুরে এলিজাবেথের রাণী হবার সংবাদ ঘোষণা করে গেলো। চেয়ারিংক্রসে গিয়ে রাস্তার দুপাশে অগণিত নর-নারীর ভিড়ের মধে, দাঁড়িয়ে এ ঘোষক বাহিনীকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। ইংলণ্ডের ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় সংযোজিত হচ্ছে। দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আমি তা দেখতে পচ্ছি।

একদিন পরে স্যানড্রিংহাম থেকে রাজার মৃতদেহ লণ্ডনে আনা হয়। তারপর তিন দিন ধরে সজ্জিত শবাধারে করে তার মৃতদেহকে ওয়েষ্ট মিনিষ্টার হলে শুইয়ে রাখা হয়। এটাই Lying in-State Ceremony. তিন দিন তিন রাত ধরে লাখ তিন চার লোক তার শবাধারের পাশ দিয়ে অতি ধীরে ধীরে চলে তাকে শেষ সম্মান দেখিয়ে গেলো। তাদের প্রিয় রাজার মৃত্যুতে ইংরেজরা যে ব্যথিত হয়নি তা নয় কিন্তু দেখে শুনে মনে হচ্ছে ব্যথা প্রকাশ না করে তারা যেন শোক উৎসব করছে। এ মধ্যে কতোটা আছে কর্তব্যবোধ আর কতোটাই বা বেদনার প্রকাশ, বলা শক্ত। এ শোকোৎসব দেখার জন্য ল্যাম্বেথ ব্রিজের কাছে কিউতে গিয়ে দাঁড়ালাম। দশবারো জন করে চওড়া এক একটা কিউ। একটু পথ অতিক্রম করে ওয়েষ্টমিনিষ্টার হলে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টা চারেক লেগে গেলো। ঘরের ভিতরে ঢুকতেই দেখি ঘরের এক পাশ ঘিরে কমনওয়েলথ, ইংলণ্ডের অধীনস্থ দেশ এবং অন্যান্য মিত্র দেশের পতাকা টাঙানো রয়েছে। ইংরেজরা তো আছেই, তাছাড়া আমার মতো অগণিত বিদেশীও রাজার শবাধারের পাশ দিয়ে সম্মান দেখিয়ে যাচ্ছে। দেখলাম শবাধারের ওপরে রাণীর দেওয়া একটি ফুলের মালাই শোভা পাচ্ছে, আর চারকোণে চারজন সশস্ত্র প্রহরী পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

১৫ই ফেব্রুয়ারী উইনর ক্যাসলে রাজাকে কবর দেওয়া হ’ল ওয়েষ্টমিনিষ্টার হল থেকে শব যাত্রার শোভা দেখলাম। প্যাডিংটন ষ্টেশনে উইণ্ডসরের পথে শবদেহ ট্রেনে তুলে দেওয়া হলো। ওয়েষ্টমিনিষ্টার হল থেকে প্যাডিংটন ষ্টেশনের এটুকু পথ আসতে শবযাত্রার লাগলো পুরো তিন ঘণ্টা। খ্যাতির দিক থেকে লণ্ডন-পেজেন্ট্রির দুনিয়াজোড়া নাম আছে। এ কালেও এ প্রাচীন ইংরেজ জাতের সাজসজ্জায় এবং শোভাযাত্রার ঐশ্বর্যের সমারোহ দেখলাম। শবাধারের আগে আগে চলেছে মাইল খানিক লম্বা সৈন্যসামন্তের বাছাই করা নানা শাখাবাহিনী। প্রথমেই গেলো শোকবাদ্য বাজিয়ে ব্যাপার্টি। তারপর ঘোড়সওয়ারেরা, তারপর নানাদেশের সৈন্যবাহিনীর প্রতিনিধিদল। এরপরে এলো মাথায় লম্বা টুপি পরিহিত রাজার খাস দেহরক্ষীরা। তারপর আবার ব্যাপার্টি, অশ্বারোহী, পদাতিক বাহিনী, এয়ার ফোর্সের লোকেরা, আর সব শেষে নৌবহরের ব্যাণ্ড। এরই পরে রাজকীয় নৌবহরের একটি শাখা একটি গান ক্যারেজে করে রাজার শোভনীয় শবাধার টেনে নিয়ে গেলো। রাজার শবাধারের পরের গাড়ীগুলোতে গেলেন রাণী, রাণীমা, রাজকুমারী মার্গারেট ও রাজার বান। রাজ মহিলাদের পরে শুরু হলো দেশের ডিউক থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের রাজপুরুষদের শোভাযাত্রা।

রাস্তার দু’ধারে অগণিত নরনারী দাঁড়িয়ে রাজার প্রতি তাদের শেষ সম্মান জানাচ্ছে। মাইলব্যাপী এ দীর্ঘ শোভাযাত্রাটি ঘিরে বিরাজ করছে ঐশ্বর্যের গম্ভীর ও পবিত্র দীপ্তি। মৃত্যুতেও রাজার মহিমা রয়েছে অক্ষুণ্ণ। সমগ্র শব-শোভাযাত্রার পরিবেশ ঘিরেই বিষাদের রাজসিকতা এবং মৌন মহিমা লক্ষণীয়। এ শব-শোভাযাত্রায় দেখলাম ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ঐশ্বর্যের অপরূপ সমন্বয়। আর দেখলাম এর উপযোগী পরিবেশ-মৌন, মধুর, গম্ভীর। ইংরেজদের মতো এমন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অথচ এমন রাজভক্ত জাত একালের পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *