বিধবাবিবাহ।
অগ্রজ মহাশয়, শৈশবকাল হইতে পুরুষ-জাতি অপেক্ষা স্ত্রী-জাতির দুঃখ-দর্শনে অতিশয় দুঃখানুভব করিতেন। তিনি, কি আত্মীয়, কি অনাত্মীয়, কি নিকৃষ্ট জাতি, কি ভদ্রজাতি, নিরুপায় পতিপুত্রবিহীনা স্ত্রীলোকদিগের আনুকুল্য করিতে কখন ত্রুটি করেন নাই। পুরুষ-জাতি অপেক্ষা স্ত্রী-জাতি স্বাভাবিক দুর্ব্বল, এই কারণে তিনি স্ত্রী জাতির সমধিক পক্ষপাতী ছিলেন।
এক দিবস বীরসিংহ-বাটীর চণ্ডীমণ্ডপে উপবিষ্ট হইয়া, অগ্রজ, পিতৃদেবের সহিত বীরসিংহার বিদ্যালয়গুলির সম্বন্ধে কথোপকথন করিতেছিলেন, এমন সময়ে জননী-দেবী রোদন করিতে করিতে চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়া, একটি বালিকার বৈধব্যসংঘটনের উল্লেখকরতঃ দাদাকে বলিলেন, “তুই এত দিন যে শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবাদের কোনও উপায় আছে কি না?” ইহা শুনিয়া পিতৃদেব বলিলেন, “ঈশ্বর! ধর্ম্মশাস্ত্রে বিধবাদের প্রতি শাস্ত্রকারের কি কি ব্যবস্থা করিয়াছেন?” দাদা উত্তর করিলেন, “শাস্ত্রে বিধবাদিগের প্রথমতঃ ব্রহ্মচর্য্য়, ব্রহ্মচর্য্য়ে অপারক হইলে, সহমরণ বা বিবাহ।” ইহা শুনিয়া পিতৃদেব বলিলেন, “রাজা রামমোহন রায়, কালীনারায়ণ চৌধুরী ও দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতির যোগাড়ে ও পরামর্শে, গবর্ণর জেনেরেল লর্ড বেণ্টিঙ্ক সহমরণ-প্রথা নিবারণ করিয়াছেন। আর কলিতে ব্রহ্মচর্য্য়ে অপারক; সুতরাং বিধবাদিগের পক্ষে বিবাহই একমাত্র উপায়।” ইহা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “বেদ, স্মৃতি, পুরাণ পাঠ করিয়া অনেক দিন হইতে আমার ধারণা হইয়াছে যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ; ইহাতে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নাই, এবং ইহা সাধারণের হৃদয়ঙ্গম হইবে। কিন্তু এ বিষয়ের পুস্তক প্রচার করিলে, অনেকে নানাপ্রকার কুৎসা ও কটুকাটব্য প্রয়োগ করিবে। তাহাতে পাছে আপনারা দুঃখিত হন, এই আশঙ্কায় আমি নিবৃত্ত আছি।” এই কথা শুনিয়া তাঁহারা বলিলেন, “আমরা উভয়ে একবাক্যে বলিতেছি, এ বিষয়ে যাহা কিছু সহ্য করিতে হয়, তাহা করিব এবং আমাদিগকে যখন যাহা করিতে হইবে, তাহা সাধ্যমতে ত্রুটি করিব না। কিন্তু তুমি পুস্তক প্রচার করিবার অগ্রে আর একবার ধর্ম্মশাস্ত্র ভাল করিয়া দেখিয়া প্রবৃত্ত হইবে। প্রবৃত্ত হইবার পর কিছুতেই পশ্চাৎপদ হইবে না; এমন কি, আমরা তোমার পিতা মাতা, আমরা নিবারণ করিলেও ক্ষান্ত থাকিবে না।”
বিধবাবিবাহ প্রস্তাবের বহুকাল পূর্ব্ব হইতে, অনেক ধনশালী লোক বালিকাবিধবার বিবাহ দেওয়া সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য, এতদ্বিষয়ে আন্দোলন করিয়া আসিতেছিলেন; কিন্তু অনেক ধনশালী ব্যক্তির (রাজা রাজবল্লভ প্রভৃতির) আন্তরিক যত্ন থাকিলেও, এ বিষয়ে সাহস করিতে পারেন নাই। অগ্রজের উক্ত প্রস্তাবের দশ বৎসর পূর্ব্বে, বহুবাজারনিবাসী বাবু নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, স্বীয় ভবনে কতকগুলি আত্মীয় লোককে ঐক্য করিয়া, বিধবাবিবাহ দিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। এরূপ অপরাপর দেশেও অনেকেই বালবিধবা দেখিয়া, দুঃখানুভব করতঃ তাহাদের বিবাহ দিতে সম্মত ছিলেন; কিন্তু সমাজের ভয়ে অগ্রে প্রবৃত্ত হইতে কাহারও সাহস হয় নাই।
কোন কোন ধনশালী লোকের প্রাণসমা কন্যা বিধবা হইলে প্রচার করিতেন যে, বিধবাবিবাহ যিনি প্রচলিত করিতে পারিবেন, তাঁহাকে ব্যয়-নির্বাহার্থে লক্ষ টাকা পুরস্কার প্রদান করিব। যৎকালে কন্যার বৈধব্য সংঘটন হয়, তৎকালেই দিন-কয়েকের জন্য লোকের মানসিক দুঃখ উপস্থিত হয় যে, একাদশীর দিবস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড দিনকরের উত্তাপে বালিকা কন্যা শুষ্ককণ্ঠ হইয়া জলপান না করিয়া কেমন করিয়া প্রাণধারণ করিবে। কন্যার এরূপ অসহ্য কষ্ট দেখা অপেক্ষা আমাদের মৃত্যু হওয়া শ্রেয়ঃ। কিছু দিন অতীত হইলে, ঐ কন্যার জনক-জননীর আর ঐরূপ দুর্ভাবনা থাকে না। পরে যৌবনাবস্থায় সমুপস্থিতা হইয়া প্রাকৃতিক নিয়মের বশীভূত হইয়া কার্য্য করিলে, পিতামাতা দেখিয়াও দেখেন না। জণহত্যাদিতেও পরাঙ্মুখ হন না। পুরুষজাতির স্ত্রীবিয়োগ হইলে, ঐ মৃতা-স্ত্রীকে শ্মশানে দাহ করিতে করিতেই কর্তৃপক্ষ বলিয়া থাকেন, যথাসর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়াও পুনরায় ত্বরায় বিবাহ দিতে হইবে, নচেৎ চলিবে না। দেখুন, স্পষ্টরূপে শাস্ত্রকারেরা বলিয়াছেন, পুরুষ-জাতি অপেক্ষা স্ত্রীজাতির দুর্জয় রিপুবর্গ অষ্টগুণ প্রবল; এমন স্থলে পতিবিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকদিগের দুর্নিবার কামপ্রবৃত্তি কি অন্তর্হিত হয় যে, পিতামাতা বিধবাকন্যার বিবাহ দিতে ইচ্ছা করেন না! কি আশ্চর্য্য়, কন্যার ভ্রূণহত্যা করিতে এবং স্ত্রীহত্যা করিতেও সম্মত আছেন, কিন্তু শাস্ত্রানুসারে বিবাহ দিতে ইচ্ছা করেন না। অনেক সম্ভ্রান্ত লোককেও কন্যার ভ্রূণহত্যা করিতে শ্রবণ করা যায়, কিন্তু উহাঁরাই সমাজে ভদ্রলোক বলিয়া পরিগণিত হন।
অগ্রজ মহাশয়ের বিধবা-বিবাহের পুস্তক মুদ্রিত হইবার কিছুদিন পূর্ব্বে, কলিকাতার অন্তঃপাতী পটলডাঙ্গানিবাসী বাবু শ্যামাচরণ দাস কর্ম্মকার, স্বীয় দুহিতার বৈধব্য-দর্শনে দুঃখিত হইয়া, মনে মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন, যদি ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দেন, তবে পুনর্ব্বার কন্যার বিবাহ দিব। তদনুসারে তিনি সচেষ্ট হইয়া, বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা-প্রতিপাদক এক ব্যবস্থা-পত্র সংগ্রহ করেন। উহাতে ৩ কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ন, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত, ঠাকুরদাস চূড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রভৃতি কতকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের স্বাক্ষর ছিল। ইহাঁরাই এতদ্দেশে সর্ব্বপ্রধান স্মার্ত ছিলেন। ইহাঁরা সকলেই ঐ ব্যবস্থায় স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আশ্চর্য্য়ের বিষয় এই, কিছুদিন পরে তাঁহারাই আবার বিধবাবিবাহের বিষম বিদ্বেষী হইয়া উঠেন। বাবু শ্যামাচরণ দাসের সংগৃহীত ব্যবস্থা, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশের নিজের রচিত এবং ব্যবস্থাপত্র বিদ্যাবাগীশের স্বহস্ত লিখিত। কিছুদিন পরে যখন ঐ ব্যবস্থাউপলক্ষে রাজা রাধাকান্তদেবের ভবনে বিচার উপস্থিত হয়, তৎকালে ভরতচন্দ্র শিরোমণি মহাশয় প্রভৃতি মধ্যস্থ ছিলেন যে, কে বিচারে জয়ী হন। ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ন, বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা-পক্ষ রক্ষার নিমিত্ত, নবদ্বীপের প্রথম স্মার্ত্ত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের সহিত বিচার করেন এবং বিচারে জয়ী হইয়া, একজোড়া শাল পুরস্কার প্রাপ্ত হন। একজন পরিশ্রম করিয়া ব্যবস্থার সৃষ্টি করিয়াছিলেন, আর একজন বিরোধী-পক্ষের সহিত বিচার করিয়া ঐ ব্যবস্থার প্রামাণ্য রক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, কিয়দ্দিবস অতীত হইলে ইহাঁরা উভয়েই বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয় বলিয়া, সর্ব্বাপেক্ষা অধিক বিদ্বেষ প্রদর্শন করিয়াছিলেন। শ্যামাচরণ দাস বিষয়ী লোক, কিন্তু সংস্কৃত-ভাষায় অনভিজ্ঞ ছিলেন। পণ্ডিত মহাশয়দের কথার স্থিরতা নাই দেখিয়া, স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। বস্তুতঃ উল্লিখিত বিচার দ্বারা উপস্থিত বিষয়ের কিছুমাত্র মীমাংসা হইল না, তথাপি ঐ বিচার দ্বারা এই এক মহৎ ফল দর্শিয়াছিল যে, তদবধি অনেকেই এ বিষয়ের নিগুঢ়-তত্ত্ব জানিবার নিমিত্ত অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়াছিলেন।
জনক-জননীর ঐ সম্বন্ধের কথোপকথনগুলি হৃদয়ে জাগরূক থাকায়, অগ্রজ মহাশয়, সবিশেষ যত্ন সহকারে এ বিষয়ের তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, এবং কয়েক মাস দিবারাত্র পরিশ্রম-সহকারে সমস্ত ধর্ম্মশাস্ত্র আদ্যোপান্ত অবলোকন করিয়া, যথাসাধ্য চেষ্টাকরতঃ সাধারণের গোচরার্থে খৃঃ ১৮৫৫ সালে বা সম্বৎ ১৯১২ সালের কার্ত্তিক মাসে বঙ্গ-ভাষায় অনুবাদসহ বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা-পুস্তক প্রচার করেন। ইহা মুদ্রিত হইবার পর,‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না? সমস্ত ভারতবর্ষে এ বিষয়ের আন্দোলন চলিতে লাগিল; বঙ্গদেশের অনেকেই নানাপ্রকার কুৎসা ও গালি দিতে লাগিল। এই সময়ে পিতৃদেব, কলিকাতায় বহুবাজারস্থ পঞ্চাননতলার বাসায় একদিন ডাক্তার নবীনচন্দ্র মিত্র ও অগ্রজের সহিত কথোপকথনে হাস্য-বদনে বলিলেন, “ঈশ্বর! আর তোমাকে আমার শ্রাদ্ধ করিতে হইবে না।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ সহাস্যমুখে বলিলেন, “খরেদরে এক হাঁটু,” (ইহার অর্থ এই যে, যেমন সামান্য লোকে নানাপ্রকার গালাগালি করিবে, তেমনই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সমস্ত পর্য্যালোচনা করিয়া, মানসিক সন্তোষ লাভ করিবেন এবং বিধবারা বৈধব্য-যন্ত্রণা হইতে মুক্তিলাভ করিয়া, সুখে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে। বিশেষত ভ্রূণহত্যা প্রভৃতি মহাপাপকর ও জাতিনাশকর কার্য্যগুলির হ্রাস হইবে।) পিতৃদেব বলিলেন, “বাবা! ধরিবার পূর্ব্বে ভাবা উচিত, ধ’রেছ ছেড়ে না, প্রাণ পর্য্যন্ত স্বীকার করিও। এই অভিপ্রায়েই পূর্ব্বে বীরসিংহার চণ্ডীমণ্ডপে,আমরা উভয়েই তোমাকে বলিয়াছিলাম।”
বিধবাবিবাহ-পুস্তক প্রচারিত হইবামাত্র, লোকে এরূপ আগ্রহ-প্রদর্শন-পূর্ব্বক গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন যে, এক সপ্তাহের অনধিক কালমধ্যেই প্রথম মুদ্রিত দুই সহস্র পুস্তক নিঃশেষ হইয়া গেল। তদ্দর্শনে উৎসাহান্বিত হইয়া অগ্রজ মহাশয়, আবার তিন সহস্র পুস্তক মুদ্রিত করিয়াছিলেন; তাহাও অনতিবিলম্বে শেষ হইতে দেখিয়া, পুনর্ব্বার দশ সহস্র পুস্তক মুদ্রিত করেন। ঐ পুস্তক এরূপ আগ্রহ-সহকারে সর্ব্বত্র পরিগৃহীত হইতেছে দেখিয়া, তিনি পরম আহ্লাদিত হইলেন। কি বিষয়ী, কি শাস্ত্রব্যবসায়ী, অনেকেই উক্ত প্রস্তাবের উত্তর লিখিয়া, মুদ্রিত করিয়া, সর্ব্বসাধারণের গোচরার্থে প্রচার করিয়াছিলেন। যে বিষয়ে সকলে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিবেন বলিয়া অগ্রজের স্থিরসিদ্ধান্ত ছিল, সেই বিষয়ে অনেকে শ্রম ও ব্যয় স্বীকার করিয়া, উত্তর-পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করিয়া, তাঁহার নিকট প্রেরণ করেন। অগ্রজ মহাশয়, ঐ উত্তর-পুস্তকগুলি দেখিয়া, শাস্ত্রজলধি-মন্থন-পূর্ব্বক প্রত্যেকের হিসাবে প্রত্যেক প্রত্যুত্তর পরিচ্ছেদগুলি লিখিয়া, একত্র সংগ্রহ করিয়া, দ্বিতীয় পুস্তক মুদ্রিত করেন। এই পুস্তক প্রচারিত ও সৃষ্ট হইবামাত্র, সমস্ত ভারতবাসী নিরুত্তর ও মনে মনে সন্তোষলাভ করিয়া, মৌখিক অসন্তোষকর বাক্যসকল প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ভারতবাসী হিন্দুরা সকলেই বিধবা-বিবাহের শাস্ত্রীয়তা স্বীকার করিয়াও দেশাচারের একান্ত অনুগত দাস বলিয়া,বিবাহে পরাঙ্মুখ রহিলেন।
অগ্রজ মহাশয়, ধর্ম্মশাস্ত্রের বিচারে বাঙ্গালা-দেশের প্রধান প্রধান পণ্ডিত সকলকে পরাজয় করিলেন। ইহাতে কি স্ত্রী, কি পুরুষ, কি ভদ্র, কি অভদ্র সকল সম্প্রদায়ের লোকে অগ্রজ মহাশয়ের গুণানুবাদ করিতে লাগিল। কেহ বিলক্ষণ গালি দিতেও লাগিল, কিন্তু তিনি তাহাতে কর্ণপাতও করেন নাই। অনেকেই স্ব স্ব বিধবা দুহিতা বা ভগিনী কিম্বা ভাগিনেয়ীর বিধবাবিবাহ দিবার জন্য সর্ব্বদা অগ্রজ মহাশয়ের নিকট গতি-বিধি করিতে লাগিলেন। বিধবার বিবাহ হইলে, উহার গর্তসম্ভূত সন্ততিগণের রাজকীয় আইনানুসারে মৃত পিতার বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবার জন্য গবর্ণমেণ্টে আবেদন করা কর্তব্য, এই বিষয়ে তৎকালের হোমডিপার্টমেণ্টের সেক্রেটারি সার্ সিসিল বীডন, সুপ্রীম কৌন্সেলের মেম্বরগণ এবং লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর হেলিডে সাহেব প্রভৃতি আইন পাশের অবেদন জন্য, অগ্রজ মহাশয়কে উপদেশ প্রদান করেন। তদনুসারে প্রায় দুই সহস্র লোকের স্বাক্ষর করাইয়া, আবেদন-পত্র গবর্ণমেণ্টে প্রেরিত হয়। গবর্ণমেণ্টের কৌন্সেলের বিচারে, হিন্দুশাস্ত্রানুসারে বিধবার পুনর্ব্বার যখন বিবাহ হইতে পারে, তখন বিধবার গর্তজাত পুত্র ঔরসজাত পুত্র বলিয়া, পৈতৃক-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইবে, এই ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ হইল। ইংরাজী ১৮৫৬ খৃঃ অব্দের ১৩ই জুলাই, এই আইন পাশ হইল। ইহার নাম ১৮৫৬ সালের ১৫ আইন হইল। এই সংবাদে ভারতবর্ষের সকলেই মনে মনে পরম আহ্লাদিত হইলেন। তৎকালে গ্রাণ্ড সাহেব, আইন-পাশ-বিষয়ে আশাতীত সাহায্য করিয়াছিলেন। তজ্জন্য ভারতবাসী হিন্দুমাত্রেই তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা-পাশে বন্ধ আছেন। গ্রাণ্ড সাহেবকে অভিনন্দন-পত্র দিবার সময়ে, অগ্রজ মহাশয়, কৃষ্ণনগরের রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর, বাবু রামগোপাল ঘোষ, পণ্ডিতাগ্রগণ্য তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রভৃতি অনেকেই গ্রাণ্ড সাহেবের বাটীতে গমন করেন। কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রীশচন্দ্র বাহাদুর স্বহন্তে উক্ত সাহেবকে অভিনন্দন-পত্র প্রদান করেন। বিধবাবিবাহ আইনবদ্ধ করিবার জন্য, গবর্ণমেণ্টের নিকট আবেদনপত্র প্রেরিত হইলে পর, তৎকালের কয়েক ব্যক্তি সন্তোষপুর্ব্বক অগ্রজ মহাশয়ের নামে ঐ বিষয়ের কতকগুলি সঙ্গীত রচনা করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে নিম্নলিখিত একটি সঙ্গীত এস্থলে সন্নিবেশিত করা গেল।
বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে,
সদরে ক’রেছো রিপোর্ট, বিধবাদের হবে বিয়ে।
কবে হবে এমন দিন, প্রচার হবে এ আইন,
দেশে দেশে জেলায় জেলায় বেরোবে হুকুম,
বিধবা রমণীর বিয়ের লেগে যাবে ধূম,
সধবাদের সঙ্গে যাবো, বরণডালা মাথায় ল’য়ে।
আর কেন ভাবিস্ লো সই, ঈশ্বর দিয়াছেন সই,
এবার বুঝি ঈশ্বরেচ্ছায় পতি প্রাপ্ত হই,
রাধাকান্ত মনোভ্রান্ত দিলেন না কো সই,
লোকমুখে শুনে আমরা আছি লোক-লাজভয়ে।
একাদশী উপসের জ্বালা, কর্ণেতে লাগিত তালা,
ঘুচে যাবে সে সব জ্বালা, জুড়াবে জীবন,
দুজনাতে পালঙ্কেতে, করিব শয়ন—
বিনাইয়া বাঁধ্বো খোঁপা গুজিকাটি মাথায় দিয়ে।
যেদিন হ’তে মহাপ্রসাদ, শুনেচি ভাই এ সংবাদ,
সে দিন হতে আনন্দেতে হয় না রেতে ঘুম—
পছন্দ করেছি বর, না হ’তে হুকুম,
ঠাকুরপোরে করব বিয়ে, ঠাকুরঝিরে ব’লে ক’য়ে॥
উপরি উক্ত গীতটী কি নগরমধ্যে, কি পল্লীগ্রামে, কি বনমধ্যে, কি স্থলপথে, কি জলপথে, বঙ্গদেশের সর্ব্বত্রই সকলেরই শ্রুতিগোচর হইত। বিধবার বিবাহ হইবে, ইহা শ্রবণে, মনে মনে সকলেই পরম আহ্লাদিত হইয়াছিলেন। এপ্রদেশে ইতরজাতি অর্থাৎ দুলে, হাড়ী, কেওরা প্রভৃতি নীচজাতির বিধবার বিবাহ প্রচলিত আছে; কিন্তু ভদ্রসমাজে এ প্রথা না থাকায়, ইহা এক নূতন কাণ্ড।
ঐ সময়ে শান্তিপুরের তন্তুবায়গণ উপরি উক্ত গীতটি কাপড়ের পাড়ে ঝাঁপে তুলিয়াছিল। ঐ বস্ত্র অনেকেই আগ্রহাতিশয়ের, সহিত অধিক মূল্য দিয়া ক্রয় করিত। অনেকেই বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিতে আসিত। যখন তিনি পদব্রজে পথে যাইতেন, অনেক স্ত্রীলোক একদৃষ্টিতে তাঁহাকে অবলোকন করিত। কারণ, এতাবৎ দীর্ঘকালের মধ্যে ভারতবর্ষে অনেক ধনী ও গুণী লোক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, কিন্তু হতভাগিনী বিধবা স্ত্রীলোেকদের প্রতি কেহ কখন বিদ্যাসাগরের মত দয়া প্রকাশ করেন নাই। যিনি যতই প্রকাশ্যে বিধবাবিবাহের বিদ্বেষ্টা হউন না কেন, কিন্তু মনে মনে বলিতেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা-বিবাহের প্রচলনের ব্যবস্থা করিয়া ভালই করিয়াছেন। তিনি অন্ততঃ একটী বিধবার বিবাহ দিতে পারিলে, অনন্তকালব্যাপিনী কীর্ত্তি রাখিয়া যাইবেন, তাহার সন্দেহ নাই।
এস্থলে কৃষ্ণনগরনিবাসী বাবু বিষ্ণুচন্দ্র বিশ্বাসের অনুরোধে, তাহার বিবরণটি নিম্নে প্রকাশ কর গেল।
বিদ্যাসাগর মহাশয়, কৃষ্ণনগরের লোকদিগকে অতিশয় ভাল বাসিতেন ও অনেকের যথেষ্ট উপকার করিয়াছিলেন। কৃষ্ণনগরনিবাসী বাবু বিষ্ণুচন্দ্র বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর কলেজে অধ্যয়নের মানস করিয়াছিলেন। কিন্তু কলেজের বেতনের অসদ্ভাবপ্রযুক্ত লেখাপড়া শিক্ষা করিতে অক্ষম হইয়া, স্থানীয় অন্যান্য লোকের উপদেশানুসারে কলিকাতায় বাবু রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের ভবনে উপস্থিত হন। উক্ত বাবু কোন সাহায্য না করায়, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া চিন্তাকুল হন। অবশেষে ভোজন করিবার জন্য তাঁহাদের দেশস্থ দ্বারিকানাথ বাবুর বহুবাজারের বাসায় উপস্থিত হন। তথায় আহার করিয়া দেশে গমন করেন। পুনর্ব্বার বন্ধুবর্গের উপদেশানুসারে আট পয়সা পাথেয় লইয়া, দুই দিবস পদব্রজে গমন করিয়া, কলিকাতায় রামগোপাল বাবুর বাটীতে আইসেন। কিন্তু তিনি বলেন যে, “আমার স্কুল নাই যে আমি তোমাকে পড়াইব।” অবশেষে হতাশ হইয়া, ভোজনের জন্য দেশস্থ উক্ত দ্বারিকানাথ বাবুর বাসায় গমন করেন। তথায় যাইয়া দেখিলেন, সেখানে দ্বারিকানাথ বাবুর বাসা নাই, সুতরাং নিরুপায় হইয়া আমাদের বাসায় বসিয়া চিন্তা ও নোদম করিতে লাগিলেন। আমরা তাঁহাকে ভোজন করাইলাম, এবং পরদিন তাঁহাকে উপদেশ দিলাম, তোমার অভিলষিত বিষয় অগ্রজের নিকট বল, তাহা হইলে, তিনি, তোমার উপায় করিয়া দিবেন। তৎকালে অগ্রজ, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে ৮০৲ টাকা বেতনে হেড্ রাইটার ছিলেন। অনন্তর বিষ্ণু বাবু, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পায়ে ধরিয়া রোদন করিলে, তিনিও দয়ার্দ্র হইয়া বলিলেন, “তুমি কেন কাঁদিতেছ?” তাহাতে বিষ্ণুবাবু বলিলেন, “আমি গরীবের ছেলে, কৃষ্ণনগরের কলেজে অধ্যয়ন করিব মানস করিয়াছি, কিন্তু স্কুলের বেতন দিতে অক্ষম। অনেকের পরামর্শে রামগোপাল বাবুর নিকট আসিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি মাসে মাসে একটি টাকাও সাহায্য স্বীকার পাইলেন না। মহাশয় যদি মাসে মাসে একটি করিয়া টাকা দেন, তাহা হইলে আমার স্কুলে পড়া হয়।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ বলিলেন, “তথায় যদি আমার কেহ আত্মীয় থাকেন, তুমি তাহার নাম কর, আমি তাঁহার নিকট টাকা পাঠাইয়া দিব। এক্ষণে তোমার পথখরচ কি চাই বল?” ইহা শুনিয়া বিষ্ণু বাবু বলিলেন, “বাটী হইতে আটটি পয়সা আনিয়াছিলাম, তন্মধ্যে সাতটি খরচ হইয়াছে, একটিমাত্র আছে।” এই কথা শ্রবণ করিয়া দুই দিনের পাথেয়৷৷৵৹ দশ আনা দিলেন। বিষ্ণু বাবু, রামতনু লাহিড়ীর নাম করায়, অগ্রজ তাঁহার নিকটেই উহাঁর স্কুলের বেতন পাঠাইয়া দিতেন। বিষ্ণুবাবু স্কুলের বেতন ব্যতীত অপর কিছুই কখল গ্রহণ করেন নাই; একারণ, অগ্রজ মহাশয় বিষ্ণুবাবুকে বিশেষ স্নেহ করিতেন।
উক্ত বিষ্ণুবাবুর কথায়, কৃষ্ণনগরনিবাসী ভগবানচন্দ্র দত্তকে মাসে মাসে ৮৲ টাকা দিতেন। ইহাঁর মৃত্যুর পর ইহাঁর স্ত্রীকে মাসে মাসে ৫৲ টাকা ও বৎসরে ৮ খানি বস্ত্র দিতেন। ভগবান দত্তের স্ত্রী, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর দুই দিন পূর্ব্বে, মাসহারা ও বস্ত্র লইয়া গিয়াছিলেন।’
খৃঃ ১৮৬৩ সালে নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী কৃষ্ণনগরনিবাসী বাবু লক্ষ্মীনারায়ণ লাহিড়ী, সরবেয়ার জেনের্যাল আফিসে মাসিক ৪০৲ টাকা বেতনে কেরাণীগিরি কর্ম্ম করিয়া দিনপাত করিতেন। অল্পবয়সে তাঁহার কয়েকটি পুত্র ও কন্যা উৎপন্ন হয়; তজ্জন্য ক্রমশঃ আয় অপেক্ষা সাংসারিক ব্যয়-বাহুল্য হইতে লাগিল। অতঃপর মাসিক ৪০৲ টাকায় সংসার নির্ব্বাহ হওয়া দুষ্কর হইবে মনে করিয়া, ভাবী-উন্নতির প্রত্যাশায়, কলিকাতা মেডিকেল কলেজে প্রবিষ্ট হইয়া, চিকিৎসা-বিদ্যা শিক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হন। শেষ-বৎসরে তাঁহার সংসার এরূপ অচল হয় যে, অর্থাভাবে অধ্যয়ন পরিত্যাগ না করিলে, সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ হওয়া দুরূহ। তৎকালে তাঁহার বিখ্যাত ও কার্য্য়দক্ষ পিতৃব্যগণের নিকট কোনরূপ সাহায্য না পাইয়া, পরিশেষে অগত্যা অগ্রজ মহাশয়কে বিনয়পূর্ব্বক আপন অবস্থা অবগত করাইলেন। তিনিও, লক্ষ্মীনারায়ণ বাবুর ঐরূপ কথা শুনিয়া, অনুগ্রহপূর্ব্বক প্রায় দুই বৎসর কাল মাসে মাসে ৫০৲ টাকা করিয়া, উহাঁর সংসারের ব্যয়-নির্ব্বাহার্থে প্রদান করিয়াছিলেন। সময়ে সময়ে এইরূপ কৃষ্ণনগরের অনেক লোকের উপকার করিয়াছিলেন। কথা লিখিলে, হয়ত অনেকের মনে দুঃখ হইবে, এজন্য ক্ষান্ত হইলাম। দুঃখের বিষয় এই, আমাদের দেশের অনেকে বিশেষ উপকার পাইয়াও কৃতজ্ঞতা দেখাইতে লজ্জাবোধ করেন এবং কেহ কেহ সময়ে সময়ে উপকারীর অনেক কুৎসাও করিয়া থাকেন।
সন্ ১২৬২ সালের ১লা বৈশাখ, অগ্রজ, মহাশয়, শিশুগণের শিক্ষার সুবিধার জন্য বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ নূতন-প্রণালীতে প্রচারিত করিলেন। বালকদিগের প্রথমপাঠ্য এরূপ পুস্তক ইতিপুর্ব্বে কেহ প্রকাশ করেন নাই।
সন্, ১২৬২ সালের ১লা আষাঢ় অগ্রজ মহাশয়, বালকবালিকালদিগের সংযুক্ত বর্ণপরিচয় শিক্ষার সৌকর্য্যার্থে, দ্বিতীয় ভাগ বর্ণ-পরিচয় নাম দিয়া, নূতন প্রণালীতে এক পুস্তক, মুদ্রিত, করিলেন। উহা যে প্রণালীতে রচনা করিয়াছিলেন, সেরূপ প্রণালীতে পূর্ব্বে কেহ কখন রচনা করেন নাই। এই দ্বিতীয় ভাগ বর্ণ-পরিচয় ভালরূপ.শিখিলে, বালকবালিকাগণ অপরাপর সকল পুস্তক অক্লেশে আবৃত্তি করিতে সমর্থ হয়। ভারতবর্ষের মধ্যে যাহারা প্রথমে বাঙ্গালা-ভাষা শিক্ষা করিয়া থাকেন, তাহাদের মধ্যে প্রায় সকলকেই অগ্রজের রচিত দ্বিতীয়-ভাগ বর্ণপরিচয় শিক্ষা করিতে হয়।
বালকবালিকাগণের পক্ষে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ বর্ণ-পরিচয় শিক্ষা করিয়া, বোধোদয় ও নীতিবোধ অধ্যয়ন করা কিছু কঠিন বোধ হইবে, একারণ অগ্রজ মহাশয়, শিশুগণের শিক্ষার সুবিধার জন্য, ইংরাজী ঈসপ্রচিত গল্পের সরল বাঙ্গালা-ভাষায় অনুবাদ করিয়া, সন ১২৬২ সালের ফাল্গুন, মাসে কথামালা নাম দিয়া, এক পুস্তক প্রচার করিলেন।
সন ১২৬৩ সালের ১লা শ্রাবণ অগ্রজ মহাশয়, চরিতাবলী মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন। ইহাতে অতি সরল-ভাষায় ডুবাল, উইলিয়ম রস্কো, হীন, জিরমষ্টোন, প্রভৃতি ইউরোপীয় মহানুভবদিগের জীবনচরিত বর্ণিত হইয়াছে। ইহাঁদের জীবনচরিত পাঠ করিলে, এতদ্দেশীয় শিশুগণের লেখাপড়ায় অনুরাগ জন্মিবে ও উৎসাহবৃদ্ধি হইতে পারে; যেহেতু, উপরি উক্ত মহাত্মারা প্রায় সকলেই দরিদ্রের সন্তান। সকলেই নানারূপ ক্লেশ পাইয়া, নিজের যত্নে ও পরিশ্রমে লেখাপড়া শিখিয়া, জগদ্বিখ্যাত হইয়াছিলেন। অগ্রজ মহাশয়, এতদ্দেশীয় দরিদ্র-বালকগণকে লেখাপড়া শিখিতে উৎসাহান্বিত করিয়া দিবার মানসে, আগ্রহপূর্ব্বক পরিশ্রম-সহকারে এই পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন। ইহা বাঙ্গালা-প্রদেশের সকল বঙ্গবিদ্যালয়ের শিশুগণ সমাদরপূর্ব্বক অধ্যয়ন করিয়া থাকেন।
বাবু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিধবাবিবাহের কয়েকদিন পূর্ব্বে, পূজ্যপাদ প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ মহাশয়, অগ্রজের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলেন, “ঈশ্বর! তুমি বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় পুস্তকে যে বিচার করিয়াছ, তাই আমি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া পরম আহ্লাদিত হইয়াছি। বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত, তাহা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। তুমি যে অত্যন্ত পরিশ্রম-সহকারে নানা স্থানে যাইয়া, আবেদন-পত্রে সম্ভ্রান্ত লোকদের স্বাক্ষর করাইয়া, রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছিলে, এবং তাহাতেই বিধবাবিবাহ বিধিবদ্ধ হইয়াছে, ইহা শুনিয়া আমি পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছি। ভবিষ্যতে যে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হইবে, তুমি তাহার পথ পরিষ্কার করিয়া দিয়াছ। পরন্তু, যিনি এ বিষয়ের ব্যবস্থা দিবেন, এবং যিনি ইহা আইনবদ্ধ করাইবেন, তাঁহাকেই যে বিধবাবিবাহ দেওয়াইতে হইবে, এমন কথা নয়। এ সকল বহুব্যয়সাধ্য কর্ম্ম; তোমার টাকা কোথায়? কোনও কারণে কর্ম্মচ্যুত হইলে, কি উপায়ে দিনপাত করিবে? ইহা ধনশালী লোকদের কার্য্য়। বরং, আমার বিবেচনায় কিছুকাল মফঃস্বলে পরিভ্রমণ করিয়া, রাজা ও সম্রান্ত জমিদারদিগকে স্বমতে আনয়ন-পূর্ব্বক এই গুরুতর কার্য্য়ে প্রবৃত্ত হও। অন্যথা, কলিকাতাবাসী অল্পবয়স্ক, অপরিণামদর্শী ও অব্যবস্থিতচিত্ত যুবকবৃন্দের কথায় নির্ভর করিয়া, এই গুরুতর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা উচিত নহে।” পূজ্যপাদ তর্কবাগীশ মহাশয়ের এই কথা শুনিয়া, অগ্রজ বলিলেন, “মহাশয়, উৎসাহ ভঙ্গ করিবেন না। আমি কখনই পশ্চাৎপদ হইব না।” তাঁহার বাক্য-শ্রবণে তর্কবাগীশ মহাশয় বলিলেন, “অগ্রে টাকার যোগাড় ও মফঃস্বলবাসী রাজা ও জমিদারগণকে স্বমতে আনয়ন-পূর্ব্বক একার্য্য়ে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত ছিল; একথা আমি তোমাকে বারম্বার বলিতেছি।” ইহা বলিয়া তর্কবাগীশ মহাশয় প্রস্থান করেন।
এস্থলে নিম্নলিখিত গল্পটি না লিখিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। তর্কবাগীশ মহাশয়ের পূর্ব্বপুরুষের রচিত সাহিত্যদর্পণের হস্তলিখিত টীকাসমেত পুঁথিটী অতি জীর্ণ হইয়াছিল; একারণ, ছাত্রগণকে বলিয়াছিলেন যে, “তোমরা ক্লাশে বসিয়া এই আদর্শ দেখিয়া, অন্য পুস্তক লিখিবে, কেহ বাটী লইয়া যাইও না; যেহেতু জীর্ণপুস্তক, অনায়াসেই নষ্ট হইতে পারে বা দৈবাৎ তৈল পড়িয়া পাতার অক্ষর অস্পষ্ট হইতে পারে।” তজ্জন্য সকলেই ক্লাশে বসিয়া লিখিত। কিন্তু এক দিবস অগ্রজ মনে করিলেন, এখানে লেখায় অনেক সময় নষ্ট হয়। বাটীতে লিখিলে, এক রাত্রেই অনেক লেখা হইবে; এইরূপ মনে করিয়া গোপনে কতকগুলি পাতা লইয়া যাইতেছিলেন। বর্ষাকাল, ছাতা নাই, পথে ভিজিতে ভিজিতে যাইতেছেন; হঠাৎ পড়িয়া গিয়া, পরিধান-বস্ত্রাদি এবং প্রাচীন পুঁথির পাতাগুলি ভিজিয়া গেল। তাহা দেখিয়া, দাদা রোদন করিতে লাগিলেন। পরে মনে মনে ভাবিলেন যে, গুরুর বাক্য অবহেলন করিয়া এই বিপদে পড়িলাম। কোন সদুপায় স্থির করিতে না পারিয়া, রোদনে প্রবৃত্ত হইলেন। অবশেষে এক ব্যক্তি বলিল, “কান্না কেন, সম্মুখে এই ভুনারীর দোকানে পুঁথির পাতাগুলি অগ্নিতে সেক, তাহা হইলে শুকাইরে।” তাহার পরামর্শানুসারে ঐরূপ করিতেছেন, এমন সময়ে, তর্কবাগীশ মহাশয়, ঐ পথ দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি অগ্রজকে ভুনারীর দোকানে ঐরূপ অবস্থাপন্ন দেখিয়া বলিলেন, “ঈশ্বর! এখানে কি করিতেছ?” তর্কবাগীশ মহাশয়কে দেখিয়া, ভয়ে কোন কথা বলিতে না পারিয়া, মাথা চুল্কাইতে লাগিলেন। তাঁহার আর্দ্র বস্তু দেখিয়া, তর্কবাগীশ মহাশয় নিজের উড়ানি পরিধান করিতে দিলেন, এবং বলিলেন, “পুঁথির পাতের জন্য তোমার কোন চিন্তা নাই।” অনন্তর একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া, তাঁহাকে বড়বাজারের বাসায় পঁহুছাইয়া দিলেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় এরূপ শ্রদ্ধাস্পদ পণ্ডিত মহাশয়ের কথা রক্ষা না করিয়া, নিজের জীদ্ বজায় রাখিয়া, শ্রীশবাবুর বিবাহের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
তৎকালে বঙ্গদেশের অনেকেই বলিত যে, বিদ্যাসাগর মহাশ আন্তরিক যত্নের সহিত পরিশ্রমপূর্ব্বক ধর্ম্মশাস্ত্র সকল আদ্যন্ত অবলোকন করিয়া, বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত ইহা প্রমাণ করিয়া বঙ্গদেশের সকল পণ্ডিতকে পরাজয় করিয়াছেন এবং রাজদ্বারে আবেদন করিয়া, বিধবাবিবাহের আইন পাশ করাইয়াছেন; কিন্তু অদ্দ্যাপি একটিও বিধবার বিবাহ দিতে পারিলেন না। অগ্রে একটী বিধবার বিরাহকার্য্য সমাধা হইলে, দেখিয়া শুনিয়া অনেকেই বিধবা-কন্যার বিবাহ দিবেন। কিছু দিন সর্ব্বত্র সকল সময়ে এই কথারই আন্দোলন হইতে লাগিল। সন ১২৬৩ সালের ২৪শে অগ্রহায়ণ সর্ব্বপ্রথমে মহাসমারোহপূর্ব্বক কলিকাতায় (সুকিয়া-স্ট্রীটস্থ অগ্রজের পরমবন্ধু বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবনে) একটি বিধবা-কন্যার বিবাহবিধি সম্পন্ন হইল। বর, বিখ্যাত কথক, সম্রান্ত ও ধনশালী, খাটুয়াগ্রামনিবাসী রামধন তর্কবাগীশের পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। ইনি প্রথমে সংস্কৃত-কলেজের আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত ছিলেন; তৎপরে ঐ বিদ্যালয়ের সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পরে মুরশিদাবাদের জজ-পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। কন্যার নাম শ্রীমতী কালীমতী দেবী, ইহার পিতার নাম ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়, ইহাঁর নিবাস বর্ধমান-জেলার অন্তঃপাতী পলাশডাঙ্গা গ্রাম। কন্যার প্রথম বিবাহ চারি বৎসর বয়সের সময়ে হইয়াছিল, ছয় বৎসরের সময় বিধবা হয়। বিধবাবিবাহের সময় তাহার বয়স দশ বৎসর মাত্র। নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী বহিরগাছি গ্রামনিবাসী হরমোহন ভট্টাচার্য্য়ের সহিত প্রথম পাণিগ্রহণ হইয়াছিল। এই প্রথম বিধবাবিবাহ অতি সমারোহপূর্ব্বক সম্পন্ন হয়। ইহাতে অগ্রজ মহাশয়ের বিস্তর অর্থব্যয় হয়। সংস্কৃত-কলেজের অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, ভরতচন্দ্র শিরোমণি, প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ ও তারানাথ তর্কবাচস্পতি এবং অন্যান্য টোলের অধ্যাপক, অনেকেই বিবাহ-সভায় উপস্থিত ছিলেন। বালিগ্রামনিবাসী বাবু মাধবচন্দ্র গোস্বামী, ঐ গ্রামের বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণসহ সভায় উপস্থিত ছিলেন। তৎকালীন সংস্কৃত-কলেজের পণ্ডিত শিবপুরনিবাসী হরিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এবং উক্ত গ্রামের অনেক ব্রাহ্মণও সমুপস্থিত ছিলেন। কলিকাতানিবাসী সম্রান্ত ও ধনশালী বাবু নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি অনেক লোকও উপস্থিত ছিলেন। এতদ্ব্যতীত নানা স্থানের ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ বিবাহের সভাস্থলে সমুপস্থিত হইয়াছিলেন। বিবাহ-কার্য্য নির্ব্বিঘ্নে সম্পন্ন হইয়াছিল। প্রথমতঃ বিধবা-বিবাহ যাহাতে না হইতে পারে, তদ্বিষয়ে কলিকাতাস্থ ও ভিন্ন ভিন্ন দেশবাসিগণ ঐক্য হইয়া, অনেক বাধা দিয়া কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। বিবাহস্থলে অধিক জনতা হইলে গোলযোগ হইবার আশঙ্কায়, রাজপুরুষেরা শান্তিরক্ষার্থ যথেষ্ট পুলিসকর্ম্মচারীও নিয়োগ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, বিধবার বিবাহ দিয়া, অনন্তকালস্থায়ী কীর্ত্তিস্তম্ভ স্থাপন করিলেন দেখিয়া, তদানীন্তন অনেক কৃতবিদ্য ও ধনশালী লোক মনে মনে এই বিষয় আন্দোলনপূর্ব্বক ঈর্ষ্য়ান্বিত হইয়াছিলেন।
২নং। সন ১২৬৩ সালের ২৫ শে অগ্রহায়ণ, কলিকাতায় একটি কায়স্থজাতীয় বিধবার বিবাহ-কার্য্য সমারোহপূর্ব্বক সমাধা হয়। কন্যার নাম থাকমণি দাসী, পিতার নাম ঈশানচন্দ্র মিত্র, নিবাস কলিকাতা, ঠন্ঠনিয়া। নয় বৎসর বয়সের সময় কন্যার প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয়, বিবাহের তিন মাস পরে বৈধব্য সংঘটন হয়, দ্বিতীয় বার বিবাহসময়ে বয়স বার বৎসর। নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী সাপুরগ্রামনিবাসী কৃষ্ণমোহন বিশ্বাসের সহিত প্রথম বিবাহ হইয়াছিল। দ্বিতীয় বরের নাম মধুসূদন ঘোষ, নিবাস পানিহাটী গ্রাম, জেলা ২৪ পরগণা, পিতার নাম কৃষ্ণকালী ঘোষ। ইহাঁরা কুলীন কায়স্থ। বর, কলিকাতা হাটখোলার দত্তবাবুদের বাটীর দৌহিত্র; ইহাঁর জ্যেষ্ঠতাত বাবু হরকালী ঘোষ, সদরদেওয়ানি আদালতের উকীল, ইনি সভাবাজারের রাজবাটীর জামাতা। বর অতি প্রসিদ্ধ-বংশোদ্ভব; তৎকালে প্রেসিডেন্সি-কলেজে ল-ক্লাশে অধ্যয়ন করিতেন। এই বিবাহেও অগ্রজের যথেষ্ট ব্যয় হইয়াছিল।
৩নং। সন ১২৬৩ সালের ১১ই ফাল্গুন কায়স্থবংশোদ্ভব এক বিধবা-রমণীর বিবাহকার্য মহাসমারোহে সমাধা হইয়াছিল। কন্যার নাম শ্রীমতী গোবিন্দমণি দাসী, নয় বৎসর বয়ঃক্রমকালে প্রথম বিবাহ হয়, দশ বৎসরের সময় বৈধব্য সংঘটন হয়। পুনরায় বিবাহকালে কন্যার বয়স চৌদ্দ বৎসর হইয়াছিল। কন্যার পিতার নাম রামসুন্দর ঘোষ, নিবাস ভবানীপুর, জেলা ২৪ পরগণা। প্রথম বরের নাম প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, নিবাস কলিকাতা, হোগলকুড়িয়া। দ্বিতীয় বরের নাম দুর্গানারায়ণ বসু, নিবাস বোড়াল, জেলা ২৪ পরগণা; পিতার নাম মধুসূদন বসু, ইহাঁরা অতি সম্রান্ত লোক। দুর্গানারায়ণ বসু, মেদিনীপুর গবর্ণমেণ্ট ইংরাজী-স্কুলের শিক্ষক; ইনি বিখ্যাত রাজনারায়ণ বসুর পিতৃব্যপুত্র। এ বিবাহেও অগ্রজ মহাশয়ের বিলক্ষণ ব্যয়াধিক্য হইয়াছিল।
৪নং। সন ১২৬৩ সালের ২৬শে ফান কলিকাতায় আর একটি কায়স্থের বিধবা-কন্যার বিবাহকার্য্য সমাধা হয়। কন্যার নাম শ্রীমতী নৃত্যকালী দাসী। ইহার প্রথম বিবাহ সাত বৎসর বয়ঃক্রমকালে হইয়াছিল; একাদশ বৎসর বয়সের সময় বিধবা হয়, পুনরায় বিবাহ-সময়ে বয়স চৌদ্দ বৎসর হইয়াছিল। ইহার পিতার নাম হরিশ্চন্দ্র বিশ্বাস, নিবাস সুকচর, জেলা ২৪ পরগণা। প্রথম বরের নাম রামকমল সরকার, নিবাস চন্দনপুখুর, জেলা ২৪ পরগণা। দ্বিতীয় বরের নাম মদনমোহন বসু, নিবাস বোড়াল, জেলা ২৪ পরগণা, পিতৃনাম নন্দলাল বসু। এই বর বিখ্যাতবংশোদ্ভব কুলীন কায়স্থ। ইনি পরম ধর্ম্মপরায়ণ বিখ্যাত বাবু রাজনারায়ণ বসু মহাশয়ের মধ্যম সহোদর। দেশহিতৈষী বাবু রাজনারায়ণ বসু মহাশয়, সাধারণের হিতকামনায় আগ্রহপূর্ব্বক মধ্যম সহোদরের ও পিতৃব্য-পুত্র দুর্গানারায়ণ বসুর বিধবাবিবাহ দিয়া, সাধারণ কৃতবিদ্য লোকের নিকট প্রশংসার ভাজন হইয়াছেন। এই সময় সিপাহীবিদ্রোহ উপস্থিত হওয়ায়, বিধবা-বিবাহের কার্য্য় কিছুদিন স্থগিত ছিল।
১৮৫৭ খৃ: অব্দে কলিকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ঐ সময়েই বিদ্যাসাগর মহাশয় ইউনিভারসিটির অন্যতম সভ্য হন।
কিছুদিন পরে গবর্ণমেণ্ট, সংস্কৃত-শিক্ষা রহিত করিবার প্রস্তাব করায়, ইউনিভারসিটির সেনেটে, অন্য সকল মেম্বরই সংস্কৃত-শিক্ষার প্রতিকূলে বদ্ধপরিকর হইলেন; কিন্তু অগ্রজ, সংস্কৃত শিক্ষার অনুকুলে নানা অকাট্য যুক্তি দর্শাইয়া, সংস্কৃত-শিক্ষা রহিত না হইয়া বরং ঐ শিক্ষার বৃদ্ধি করিতে ও প্রবলতা রাখিতে কৃতকার্য্য় হইলেন। সকল মেম্বরের প্রতিকুলে নিজের মত বজায় রাখা, অপর কাহারও সাধ্য নহে; এজন্য তিনি সমস্ত ভারতবাসীর নিকট ভক্তি ও শ্রদ্ধার ভাজন হইলেন।
সিবিলিয়ানগণ ফোর্ট-উইলিয়ম-কলেজে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, মফঃস্বলে আসিষ্টাণ্ট প্রভৃতি পদ পাইয়া থাকেন। এই সময়ে লর্ড ডালহৌসী গবর্ণর জেনেরাল বাহাদুর, সিবিলিয়ানগণের উচ্চপদযোগ্যতার পরীক্ষার জন্য, সেণ্টাল-কমিটি নামে একটী কমিটি স্থাপন করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় উক্ত কমিটির অন্যতম মেম্বর হইলেন, এবং উক্ত কমিটিতে বাঙ্গালা ও হিন্দী পরীক্ষার, ইহার মতই প্রবল ছিল। কিছুকাল পরে নানা কারণে তিনি ঐ পদ পরিত্যাগ করেন।
সন ১২৬৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসে অগ্রজ মহাশয়, সিসিল বীডন মহোদয়কে বলিয়াছিলেন যে, সিপাহি-বিদ্রোহ-নিবন্ধন বিধবাবিবাহ কার্য্য স্থগিত রাখা হইয়াছে। ইহা শ্রবণ করিয়া সিসিল বীডন মহোদয় বলিলেন, “যখন আমাদের তরবারির উপর নির্ভর, তখন ভয় করিয়া বিধবাবিবাহ-কার্য্য স্থগিত রাখা তোমার কর্ত্তব্য নয়।” অনন্তর তাহার কথা শুনিয়া পুনর্ব্বার বিধবাবিবাহ দিতে যত্নবান্ হইলেন।
৫নং। সন ১২৬৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসের শেষে ব্রাহ্মণজাতীয় একটি বিধবা-বালিকার বিবাহ হয়। কন্যার নাম শ্রীমতী লক্ষ্মীমণি দেবী, পিতার নাম স্বরূপচন্দ্র চক্রবর্ত্তী, নিবাস চন্দ্রকোণার অতি সন্নিহিত কেয়াগেড়ে গ্রাম। তৎকালে ঐ গ্রাম, জেলা হুগলির অন্তর্গত ছিল; এক্ষণে জেলা মেদিনীপুরভুক্ত হইয়াছে। কন্যার তিন বৎসর বয়সে প্রথম বিবাহ হয়, ঐ বৎসরেই বৈধব্য সংঘটন হয়; এক্ষণে অর্থাৎ দ্বিতীয়বার বিবাহের সময় বয়স আট বৎসর হইয়াছিল। প্রথম বরের নাম শিশুরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, নিবাস শিরসা, জেলা মেদিনীপুর। দ্বিতীয় বরের নাম যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়। ইনি সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন করিয়া, সংস্কৃত ও ইংরাজী ভাষায় ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন; ইহাঁর নিবাস গৈপুর, জেলা নদীয়া। এই বিবাহেও অগ্রজ মহাশয় প্রচুর অর্থব্যয় করিতে কুষ্ঠিত হন নাই।
ইতিপূর্ব্বে লেখা হইয়াছে যে, তৎকালীন লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর হেলিডে সাহেব মহোদয়, অগ্রজ মহাশয়কে আন্তরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধা করিতেন। তিনি সপ্তাহের মধ্যে বৃহস্পতিবার নানাবিষয়ের যুক্তি ও পরামর্শ করিবার জন্য, অগ্রজকে তাঁহার বাটীতে যাইবার আদেশ করেন। অগ্রজ, তজ্জন্য প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার উহাঁর ভবনে যাইতেন। একদিন সম্ভ্রান্তপদস্থ মান্যগণ্য ও রাজন্য প্রভৃতিতে গৃহ পরিপূর্ণ হইয়াছিল; এমন সময়ে অগ্রজ মহাশয় ঐ গৃহে সমুপস্থিত হইয়া, চাপরাসী দ্বারা টিকিট পাঠাইবামাত্র চাপরাসী আসিয়া বলিল, “পণ্ডিতজীকে লাট সাহেব আসিতে বলিলেন।” তাহা শ্রবণ করিয়া, রায় কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রমুখ ভিজিটারগণ আশ্চর্য্য়ান্বিত হইলেন যে, আমাদের মধ্যে কেহ পুলিশের মাজিষ্ট্রেট, কেহ রাজা, কেহ উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী। আমরা বিদ্যাসাগরের আসিবার অনেক পূর্ব্বে টিকিট পাঠাইয়াছি; তাহাতে আমাদিগকে আহ্বান না করিয়া, আমাদের অনেকক্ষণ পরে আগত, তালতলার চর্ম্মপাদুকা-পরিহিত ও গাত্রে লংক্লাথের চাদরযুক্ত ঐ ভট্টাচার্য্যকে অগ্রে ডাকিলেন। মনে মনে এইরূপ অপমান বোধ হওয়াতে, সকলে ঈর্ষ্য়ান্বিত হইয়া, কোন এক উচ্চপদস্থ সাহেবের দ্বারা লাট সাহেবকে জানাইলেন যে, “তিনি বিদ্যাসাগরকে কি কারণে এত সম্মান করেন?” ইহা শ্রবণ করিয়া, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর উহাঁদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিকে উত্তর দেন যে, “বিদ্যাসাগরের দ্বারা অনেক উপদেশ ও কাজ পাই। কারণ, বিদ্যাসাগর নিঃস্বার্থ ও দেশহিতৈষী এবং সকল বিষয়ে অভিজ্ঞ ও অসাধারণ বুদ্ধিমান্। ইহাঁর নিকট সদুপদেশ গ্রহণ করিলে, দেশের অনেক উপকার সাধিত হইয়া থাকে। যাঁহারা আসিয়াছেন, তাঁহারা কেবল স্বীয় স্বীয় স্বার্থ-সাধনোদ্দেশে আসিয়া থাকেন। বিদ্যাসাগরের সহিত কাহারও তুলনা নহে।”
একদিন ছোট লাট হেলিডে সাহেব, কথাপ্রসঙ্গে অগ্রজ মহাশয়কে বলেন যে, “বঙ্গদেশের মধ্যে কেবল কলিকাতায় একটিমাত্র বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে। কুসংস্কারপরতন্ত্র হইয়া সর্ব্বসাধারণ-লোকে বালিকাগণকে ঐ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নার্থ প্রেরণ করেন না; অতএব আমার ইচ্ছা যে, তুমি মফঃস্বলের স্থানে স্থানে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন না করিলে, সাধারণ বালিকাগণের লেখাপড়া শিক্ষার প্রচলন হওয়া দুষ্কর। অতএব তুমি যেমন হুগলি, বর্দ্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর এই জেলা-চতুষ্টয়ের স্থানে স্থানে মডেল-স্কুল অর্থাৎ আদর্শ-বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করিয়া পরিদর্শন করিতেছ, সেইরূপ মফঃস্বলের স্থানে স্থানে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করিয়া, হিন্দু-স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের জন্য তোমার চেষ্টা করা কর্ত্তব্য।” তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয়, আন্তরিক যত্ন ও পরিশ্রম-সহকারে বর্দ্ধমান, নদীয়া, হুগলী ও মেদিনীপুর এই কয়েক জেলার মফঃস্বলে স্থানে স্থানে প্রায় শতাধিক বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। প্রত্যেক বালিকাবিদ্যালয়ে দুইজন পণ্ডিত ও একটী চাকরাণী নিযুক্ত করিলেন এবং বিনামূল্যে বালিকাগণকে পুস্তকাদি প্রদান করিতে লাগিলেন। কয়েক মাস অতীত হইলে পর, ঐ সকল বালিকাবিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের বেতনাদির বিল করিয়া, ডিরেক্টারের নিকট পাঠাইলেন; কিন্তু ডিরেক্টার ইয়ং সাহেব, ঐ বিল মঞ্জুর করিলেন না।
ইতিপূর্ব্বে কথিত হইয়াছে, আদর্শ-বিদ্যালয় স্থাপন-সময়ে ডিরেক্টার ইয়ং সাহেবের সহিত অগ্রজ মহাশয়ের অপ্রণয় হওয়ায়, ডিরেক্টার ঐ সময় হইতে একাল পর্যন্ত তাঁহার ছিদ্রান্বেষণে তৎপর ছিলেন। এই সময়ে পার্লিয়ামেণ্টে কন্সারভেটিব পার্টি প্রবল হয় এবং তৎকালে লর্ড এলেন্বরা ভারতবর্ষে সাধারণ-শিক্ষার বিরুদ্ধে অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। ডিরেক্টার ইয়ং সাহেবও ঐ মতাবলম্বী ছিলেন; সুতরাং ডিরেক্টার এক্ষণে এই ছিদ্র পাইয়া, বালিকাবিদ্যালয়ের বিলের প্রতিবাদ করেন। এই বিল পাশ করিতে অক্ষম হইয়া, অগ্রজ মহাশয়, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরকে জানাইলেন। তিনি বলিলেন, “লর্ড এলেন্বরা ভারতবর্ষের শিক্ষাসমাজের ব্যয়-লাঘবের নিমিত্ত অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন। বালিকাবিদ্যালয়ে গবর্ণমেণ্ট টাকা দিতে সম্মত নহেন। কিন্তু আমি তোমাকে বিদ্যালয় বসাইবার বাচনিক আদেশ দিয়াছি সত্য বটে অতএব তুমি আমার নামে ঐ সকল বালিকাবিদ্যালয়ের কয়েক মাসের বেতনের টাকা আদায় জন্য অভিযোগ কর; আবেদন করিলেই আমি তোমায় টাকা দিতে বাধ্য হইব।” ইহা শুনিয়া, অগ্রজ বলিলেন, “আমি কখনও কাহারও নামে নালিশ করি নাই, অতএব আপনার নামে কি প্রকারে অভিযোগ করিব? ঐ টাকা আমি নিজে ঋণ করিয়া পরিশোধ করিব। আপনার কথায় বিশ্বাস করিয়া, মফঃস্বলে বালিকাবিদ্যালয় সকল স্থাপন করা হইয়াছে; শিক্ষকগণকে কয়েক মাসের বেতন না দিয়া, কিরূপে জবাব দেওয়া যায়?” এই বলিয়া মর্ম্মান্তিক ক্রোধান্বিত হইয়া প্রস্থান করেন।
দ্বিতীয়তঃ হুগলি, নদীয়া, বর্দ্ধমান, মেদিনীপুর এই জেলা-চতুষ্টয়ের স্কুলসমূহের এম্পিসিয়াল ইন্স্পেক্টারের পদে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। ঐ সকল জেলায় বিদ্যালয় সমূহের যেরূপ উন্নতি পরিদর্শন করেন, তদনুযায়ী রিপোর্ট করিয়া থাকেন; তজ্জন্য ডিরেক্টার অর্থাৎ শিক্ষাসমাজের কর্ম্মাধ্যক্ষ স্পষ্ট প্রকাশ করিয়া বলেন, “এতদপেক্ষা উৎকৃষ্ট অর্থাৎ ভালরূপ সাজাইয়া রিপোর্ট করিবে, নচেৎ সাধারণের নিকট গৌরব হইবে না।” অগ্রজ বলিলেন, “যাহা হইয়াছে আমি তাহাই লিখিব, বাড়াইয়া লেখা আমার কর্ম্ম নহে। যদি ইহাতে সন্তুষ্ট না হন, তাহা হইলে আমি কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি।”
তৃতীয়তঃ যৎকালে গবর্ণমেণ্ট, সংস্কৃত-কলেজের বাটী নির্ম্মাণ করেন, তৎকালে গবর্ণমেণ্টের উদ্দেশ্য ছিল যে, মধ্যস্থলের উন্নত দ্বিতল বাটীতে উক্ত কলেজের অধ্যাপকগণের বাসাবাটী হইবে, আর ঐ বাটীর উভয় পার্শ্বের একতলা ভবনে বিদ্যার্থিগণ বসিয়া অধ্যয়ন করিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত তৎকালের অধ্যাপকবর্গ বলিলেন, “স্নেচ্ছের ভবনে বাসা করা কোনও রূপে হইবে না।” একারণ, মধ্যস্থলের দ্বিতল-ভবনে শিক্ষাকার্য্য় সমাধা হইয়া আসিতেছে। উভয় পার্শ্বের গৃহ খালি পড়িয়া আছে। তৎকালে গবর্ণমেণ্ট, বিদ্যালয়ের উন্নতির অভিপ্রায়ে নিম্নশ্রেণীর ছাত্রগণকে মাসিক ৫৲ টাকা বৃত্তি ও উচ্চশ্রেণীর ছাত্রগণকে মাসিক ৮৲ টাকা বৃত্তি প্রদান করিতেন। কিছু দিন পরে, তৎকালের গবর্ণর জেনেরাল লর্ড বেণ্টিঙ্ক, সংস্কৃত-কলেজ উঠাইয়া দিবার উদ্যোগ পাইলে, কলেজের শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার প্রভৃতি নিরুপায় হইয়া, কলেজের স্থায়িত্বের মানসে বিলাতে উইলসন্ সাহেবকে এই পত্রখানি লিখেন যে—
অস্মিন্ সংস্কৃতপাঠদ্মসসরসি ত্বৎস্থাপিতা যে সুধী-
হংসা কালবশেন পক্ষরহিতা দূরং গতে তে ত্বয়ি।
তত্তীরে নিবসন্তি সংহিতশরা ব্যাধাস্তদুচ্ছিত্তয়ে
তেভ্যত্বং যদি পাসি পালক তদা কীর্ত্তিশ্চিরং স্থা্স্যতি॥
উইলসন্ সাহেব বিলাতে কলেজের প্রফেসার ছিলেন। বিদ্যালয়েই ঐ পত্র পাইয়া, উক্ত কবিতা পাঠ করিয়া নেত্রজলে প্লাবিত হইলেন। সেই বিদ্যালয়ের সম্ভান্তবংশীয় বিদ্যার্থিগণ প্রফেসারের রোদনের কারণ অবগত হইয়া সকলে মুক্তকণ্ঠে বলিল, যে ভাষা পাঠ করিলে এরূপ চক্ষুর জল বিনির্গত হয়, সেই ভাষা একেবারে পরিত্যাগ করা যুক্তিসিদ্ধ নয়। অনন্তর উপস্থিত সকলেই ঐক্য হইয়া কর্ত্তৄপক্ষগণকে অনুরোধ করায়, তাঁহারা সংস্কৃত-কলেজ স্থায়ী করিলেন সত্য বটে; কিন্তু তদবধি ব্যয়ের অনেক লাঘব করিয়া দিলেন এবং বিদ্যালয়ে নুতন প্রবিষ্ট আর কেহ বৃত্তি পাইল না।
ঐ সময়ে লালবাজারের একটী সামান্য বাটীতে হিন্দু-কলেজ ছিল। তথায় নানা অসুবিধাপ্রযুক্ত ঐ বিদ্যালয়ের কর্ম্মাধ্যক্ষগণ, সংস্কৃত-কলেজের পূর্ব্ব ও পশ্চিম উভয় পার্শ্বের শূন্য-ভবনে হিন্দু-কলেজ স্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। গবর্ণমেণ্ট, সংস্কৃত-কলেজের ঐ স্থানে হিন্দু-কলেজ স্থাপনের আদেশ প্রদান করেন। তদবধি ঐ স্থানে হিন্দু-কলেজের শিক্ষাকার্য্য় সমাধা হইয়া আসিতেছে। ক্রমশঃ ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি হইলে পর, সংস্কৃত-কলেজের পশ্চিমাংশের উপরের কয়েকটী গৃহ ও হল অধিকার করিয়াছে। ঐ সময়ে প্রেসিডেন্সিকলেজের স্বতন্ত্র বাটীর বন্দোবস্ত হইয়াছিল। তৎকালে, বিদ্যাসাগর মহাশয়, সংস্কৃত-কলেজে ইংরাজী-শিক্ষার নুতন সুপ্রণালী স্থাপন করেন; সুতরাং অধিক ঘরের আবশ্যক হয়। পশ্চিমাংশের উপরের দুইটি গৃহ হিন্দুকলেজের কোনও ব্যবহারে লাগিত না, কেবল চাবি বন্ধ থাকিত। ঐ দুইটী ঘর লইবার জন্য শিক্ষাসমাজের কর্ম্মাধ্যক্ষকে জানাইলে, তিনি অগ্রজ মহাশয়কে বলেন যে, তুমি নিজে হিন্দু-কলেজের প্রিন্সিপাল সার্টক্লিপ সাহেবকে বলিবে। তাহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন যে, সাটক্লিপের সহিত বিদ্যালয় উপলক্ষে বিলক্ষণ মনান্তর আছে; আমি তাহাকে কোন কথা বলিব না। ইহাতে সাহেব জীদ্ করিয়া বলেন যে, তোমাকে তাঁহার নিকট যাইতে হইবে। তচ্ছ্রবণে অগ্রজ বলেন যে, তুমি যদি একদিন তথায় যাইয়া আমায় ডাকাও, তাহা হইলে অগত্যা আমায় যাইতে হইবে। কয়েক দিন পরে সাহেব, হিন্দুকলেজে গিয়াছিলেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ডাকান নাই। সুতরাং তথায় যাইয়া দেখা না করিয়া, সাহেবের বাটীতে গিয়া, ঘরের কথা উল্লেখ করিলে, তিনি অগ্রজকে সার্টক্লিপের সহিত দেখা করিতে বারম্বার জীদ্ করিলেন। তাহাতে অগ্রজ, তৎক্ষণাৎ সেইখানেই কাগজ লইয়া, রেজাইনপত্র লিখিয়া দিয়া প্রস্থান করেন। পরে রেজাইন-পত্র দেখিয়া লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর, রেজাইন মঞ্জুর করিতে ইচ্ছা করেন নাই। তিনি তাঁহাকে ডাকাইয়া পাঠান, কিন্তু অগ্রজ তাহাতেও দেখা করিতে যান নাই। অবশেষে বেতন বৃদ্ধি করিয়া দিতে স্বীকার পাইলেও বলিয়াছিলেন, আর চাকরি করিব না। অনেকে রেজাইন-পত্র ফিরিয়া লইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু অগ্রজ কাহারও উপদেশ শ্রবণ করেন নাই।
১৮৫৮ খৃঃ অব্দের শেষে বিদ্যাসাগর মহাশয়, সংস্কৃত-কলেজের প্রিন্সিপালের পদ পরিত্যাগ করেন। ঐ সময়ে কলিকাতার সুপ্রিম-কোর্টের চিফ জষ্টিস্ সার জেম্স্ কল্বিন্ সাহেব মহোদয়, তৎকালীন শিক্ষাসমাজের প্রেসিডেণ্ট ছিলেন। ইনি অগ্রজকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন; একারণ, অগ্রজকে বলেন, “তুমি যেরূপ হিন্দু-ল (আইন) অবগত আছ, উকীল হইলে তোমার আরও প্রতিপত্তি হইবে।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ তাঁহাকে বলেন যে, “আমি ইংলাজী আইন জানি না, আর এ বয়সে আইন পরীক্ষা দিতেও ইচ্ছা নাই।” তাহাতে চিফ জষ্টিস্ বলেন যে, “তোমার মত অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান্, দেশহিতৈষী, বিদ্যোৎসাহী, বিচক্ষণ, কার্য্য়দক্ষ ব্যক্তিকে পরীক্ষা দিতে হইবে না। আমার পাশ করিয়া দিবার ক্ষমতা আছে, তোমার মত লোক পাইলে, গবর্ণমেণ্টের ও ভারতবর্ষের অনেক উপকার হইবে। কল্বিন্ সাহেব মহোদয়ের উত্তেজনায়, তৎকালীন সদর-দেওয়ানী আদালতের সর্বপ্রধান উকীল বাবু দ্বারকানাথ মিত্র মহোদয়ের বাটীতে প্রতিদিন প্রাতে ও সায়ংকালে যাইয়া দেখিলেন যে, হিন্দুস্থানী মোক্তারদের সহিত টাকার জন্য অনেক হুড়াহুড়ি করিতে হয়। তাহা দেখিয়া শুনিয়া ওকালতী-কর্ম্মে ঘৃণা জন্মিল এবং কল্বিন্ সাহেবের বাটী যাইয়া বলিলেন, “অধিক টাকা পাইব বলিয়া এরূপ বিসদৃশ ঘৃণিত-কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে আমার প্রবৃত্তি হয় না।” সাহেব নানাপ্রকার উপদেশ দিয়া, অনেক বুঝাইলেন, তথাপি অগ্রজের অর্থকরী ওকালতী-কর্ম্মে প্রবৃত্তি হইল না।