বিদ্যালয়-চরিত।
ইংরাজী ১৮২৯ সালের জুন মাসের প্রথম দিবসেই পিতৃদেব, অগ্রজ মহাশয়কে কলিকাতাস্থ পটলডাঙ্গা গবর্ণমেণ্ট সংস্কৃত-কলেজে ব্যাকরণের ৩য় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলেন। তৎকালে তাঁহার বয়স নয় বৎসর মাত্র। ইহার পূর্ব্বে তাঁহার সংস্কৃত শিক্ষা আরম্ভ হয় নাই। হালিসহরের নিকটস্থ কুমারহট্টনিবাসী গঙ্গাধর তর্কবাগীশ ঐ শ্রেণীর পণ্ডিত ছিলেন। ইনি শিশুগণকে শিক্ষা দিবার ভালরূপ রীতি-নীতি জানিতেন। বিশেষতঃ অল্পবয়স্ক বালকদিগকে শিক্ষা দিবার জন্য তর্কবাগীশ মহাশয় বিলক্ষণ পরিশ্রম করিতেন; একারণ, কলেজের মধ্যে ব্যাকরণের অন্যান্য শিক্ষক অপেক্ষা তর্কবাগীশ মহাশয় বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। অনেকেরই সংস্কার ছিল যে, তর্কবাগীশের নিকট অধ্যয়ন করিলে, ছাত্রগণের ব্যাকরণে বুৎপত্তি জন্মে। পিতৃদেব প্রত্যহ প্রাতে নয়টার মধ্যে দাদাকে ভোজন করাইয়া, পটলডাঙ্গার কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে বসাইয়া, তর্কবাগীশ মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎপূর্ব্বক পুনর্ব্বার প্রায় দুই মাইল অন্তরস্থিত বড়বাজারের বাসায় যাইয়া ভোজনান্তে আফিসে যাইতেন। পুনর্ব্বার বৈকালে চারিটার সময় আফিস হইতে কলেজে যাইয়া, অগ্রজকে সঙ্গে করিয়া বাসায় রাখিয়া তৎপরে আপনার কার্য্যে যাইতেন। এইরূপে ছয় মাস গত হইলে পর, জ্যেষ্ঠ মহাশয় পথ চিনিতে পারিলেন ও ক্রমশঃ সাহসী হইল। তৎপরে আর পিতৃদেব সঙ্গে যাইতেন না। কলেজে প্রবিষ্ট হইবার ছয় মাস পরে পরীক্ষোর্ত্তীর্ণ হইয়া, মাসিক ৫৲ টাকা বৃত্তি পাইলেন। মধুসূদন বাচস্পতি মহাশয়, শৈশবকালে পঠদ্দশায় সর্ব্বদা দাদার তত্ত্বাবধান করিতেন; একারণ তিনি বাচস্পতিকে কখন বিস্মৃত হন নাই; অদ্যাপি, তাঁহার পুত্র সুরেন্দ্রকে প্রতিপালন করিয়া থাকেন। বড়বাজার হইতে পটলডাঙ্গার কলেজে অধ্যয়ন করিতে যাইবার সময় যখন পথে ছাতা মাথায় দিয়া যাইতেন, তখন লোকে মনে করিত যে, একটা ছাতা চলিয়া যাইতেছে। দাদা বাল্যকালে অত্যন্ত খর্ব্ব ছিলেন। অন্যান্য লোকের মস্তক অপেক্ষা জ্যেষ্ঠের মস্তক অপেক্ষাকৃত স্থূল ছিল; তদ্রুপ প্রায় দৃষ্টিগোচর হইত না। একারণ, বাল্যকালে উহাঁকে কলেজের অনেকে “যশোরে কৈ”* বলিত এবং কেহ কেহ যশোরে কৈ না বলিয়া, “কসুরে জৈ” বলিত। ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় রাগ করিতেন। ক্রোধোদয় হইলে, তখন তিনি সহসা কথা কহিতে পারিতেন না; যেহেতু, বাল্যকালে তিনি তোত্লা ছিলেন।
[* যশোহর জেলার কৈ-মাছ ৮/১০ দিন নৌকায় আসিয়া, কলিকাতায় গামলায় কিছুদিন থাকিত; এজন্য ঐ মাছের মাথা মোটা, এবং অপর অংশ সরু হইত।]
অগ্রজ, কলেজে ব্যাকরণের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়া, তর্কবাগীশ মহাশয়ের নিকট প্রত্যহ যাহা পড়িয়া আসিতেন, প্রত্যহ রাত্রিতে তাঁহাকে পিতার নিকট তাহা বলিতে হইত। পিতা, পুত্রের প্রমুখাৎ প্রত্যহ ব্যাকরণের পাঠ শ্রবণ করিতেন। ১০/১৫ দিন পরে তিনি যাহা বিস্মৃত হইতেন, তাহা পিতা অক্লেশে অবিকল বলিয়া দিতেন। পুত্রের নিকট প্রত্যহ শ্রবণ করিয়া, পিতার বিলক্ষণ ব্যাকরণে জ্ঞান জন্মিয়াছিল। দাদা মনে করিতেন যে, পিতৃদেব ব্যাকরণ ভালরূপ জানেন। কারণ, কলেজে তর্কবাগীশ মহাশয় যেরূপ বলিয়া দিতেন, পিতাও সেইরূপ বলিয়া দেন। বস্তুতঃ পিতৃদেব সংস্কৃত-ব্যাকরণ পূর্ব্বে কিছুমাত্র অবগত ছিলেন না। পিতা, প্রত্যহ রাত্রি নয়টার পর কর্ম্মস্থান হইতে বাসায় আসিতেন। যে দিবস রাত্রিতে পড়িতে দেখিতেন, সে দিন পরম আহ্লাদিত হইতেন; যে দিন আসিয়া দেখিতেন যে, প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর তিনি নিদ্রা যাইতেছেন, সেই দিন ক্রোধান্ধ হইয়া তাঁহাকে অত্যন্ত প্রহার করিতেন। মধ্যে মধ্যে এরূপ প্রহার করায়, জগদ্দুর্লভ সিংহের ভগিনী ও তাঁহার পত্নী বলিতেন, এরূপ ছোট ছেলেকে যদি অতঃপর এরূপ অন্যায়রূপে প্রহার করেন, তাহা হইলে আপনার এ বাটীতে অবস্থিতি করা হইবে না। কোন্ দিন প্রহারে ছেলেটা মরিয়া যাইবে; আমাদের সকলকেই বিপদে পড়িতে হইবে। গৃহস্থ এইরূপ ধমক দেওয়ায়, প্রহারের কথঞ্চিৎ লাঘব হইয়াছিল। রাত্রিতে পড়িবার সময় নিদ্রাকর্ষণ হইলে, তিনি প্রদীপের সর্ষপতৈল চক্ষে লাগাইতেন। চক্ষে তৈল লাগিলে চক্ষু জ্বালা করিত; সুতরাং নিদ্রাকর্ষণ হইত না। পিতা, রাত্রি নয়টার সময় বাসায় আসিয়া পাক করিয়া, উভয়ে ভোজন করিয়া শয়ন করিতেন। শেষ রাত্রিতে পিতার নিদ্রাভঙ্গ হইলে, প্রত্যহ দাদাকে উদ্ভট-কবিতা মুখে মুখে শিখাইতেন। এইরূপে তিনি, পিতার নিকট প্রায় দুই শত সংস্কৃত-শ্লোক শিক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন; সুতরাং অন্যান্য বালক অপেক্ষা ভাল পাঠ বলিতে, শব্দ রূপ করিতে, সন্ধি বলিতে ও ধাতু রূপ করিতে পারিতেন; একারণ, অধ্যাপক তর্কবাগীশ মহাশয় সকল ছাত্র অপেক্ষা তাঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন। তর্কবাগীশ মহাশয় তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া, প্রত্যহ একটি করিয়া উদ্ভট-কবিতা শিখাইতেন এবং ঐ কবিতার অন্বয় ও অর্থ বলিয়া দিতেন। তর্কবাগীশ মহাশয়ের নিকটেও দাদা প্রায় দুই শত সংস্কৃত শ্লোক শিক্ষা করিয়াছিলেন। ব্যাকরণ-শ্রেণীতে তিন বৎসরের মধ্যে দুই বৎসর পরীক্ষায় উত্তমরূপে পারিতোষিক পাইয়াছিলেন। এক বৎসর অপর একটিী মন্দ বালক ভাল প্রাইজ পাইল দেখিয়া, তাহার মনে এত ক্ষোভ জন্মিয়াছিল যে, “কলেজে আর অধ্যয়ন করিব না, দেশে যাইয়া দণ্ডিপুরে বিশ্বনাথ সার্ব্বভৌম পিসা মহাশয়ের টোলে অধ্যয়ন করিব,” এই স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু পিতৃদেব, তর্কবাগীশ মহাশয় ও মধুসূদন বাচস্পতির অনুরোধের বশবর্ত্তা হইয়া, কলেজ পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। ঐ বৎসর ভালরূপ প্রাইজ না পাইবার কারণ এই যে, ঐ বৎসর প্রাইস্ সাহেব পরীক্ষক ছিলেন। সাহেব ভাল বুঝিতে পারিতেন না। দাদা যাহা উত্তর করিতেন, তাহা ভালরূপ বিবেচনাপূর্ব্বক করিতেন, তাহা নির্ভুল হইত। যে বালক বিবেচনা না করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়াছিল, তাহা ভালই হউক আর মন্দই হউক, সাহেব তাহাকে বুদ্ধিমান্ জানিয়া প্রাইজ দিয়াছিলেন।
দাদা, বাল্যকালে অত্যন্ত একগুঁয়ে ছিলেন। নিজে যাহা ভাল বোধ করিতেন, তাহাই করিতেন; অপরের উপদেশ গ্রাহ্য করিতেন না। গুরুতর লোক উপদেশ দিলেও ঘাড় বাঁকাইয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতেন। তজ্জন্য পিতা প্রহার করিলেও শুনিতেন না। আপনার জিদ বজায় রাখিবার জন্য শৈশবকাল হইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ঘাড় সোজা করিতেন না বলিয়া, পিতা বলিতেন, “আমার পিতা তোমাকে যে, ঘাড়াবাঁকা এঁড়ে গরুর সহিত তুলনা করিয়াছিলেন, তাহা সত্য।” পিতা তাঁহার স্বভাব বুঝিয়া চলিতেন। যে দিন সাদা বস্ত্র না থাকিত, সে দিন বলিতেন, আজ ভাল কাপড় পরিয়া কলেজে যাইতে হইবে। তিনি হঠাৎ বলিতেন, না, আজ ময়লা কাপড় পরিয়া যাইব। যে দিন বলিতেন আজ স্নান করিতে হইবে, শ্রবণমাত্র দাদা বলিতেন যে, আজ স্নান করিব না; পিতা প্রহার করিয়াও স্নান করাইতে পারিতেন না। সঙ্গে করিয়া টাঁকশালের ঘাটে নামাইয়া দিলেও দাঁড়াইয়া থাকিতেন। পিতা, চড় চাপড় মারিয়া জোর করিয়া স্নান করাইতেন। অগ্রজের যাহা ইচ্ছা হইত, শৈশবকাল হইতে একাল পর্য্যন্ত তাহাই করিয়াছেন। তিনি বাল্যকাল হইতে এ পর্য্যন্ত নিজের প্রতিজ্ঞা বজায় রাখিয়াছেন এবং অসাধারণ উন্নতি লাভ করিয়াছেন। পিতা ইহাকে ঘাড় কেঁদো নাম দিয়াছিলেন, অর্থাৎ ঘাড় বাঁকাইলে সোজা হইবার নহে।
আমা হইতে ক্লাসে আর কেহ ভাল শিক্ষা করিতে না পারে, এরূপ জিদের উপর লেখাপড়া শিখিতে দাদা চিরকাল আন্তরিক যত্ন পাইয়াছিলেন। এমন কি, শৈশবকালেও প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া অভ্যাস করিতেন। প্রায়ই রাত্রি বারটা বাজিলে আমায় তুলিয়া দিবেন, নচেৎ আমার পাঠাভ্যাস হইবে না।” পিতা, আহারের পর দুই ঘণ্টা বসিয়া থাকিতেন, নিকট আরমাণি গির্জার ঘণ্টারব শুনিয়া, তাঁহার নিদ্রা ভাঙ্গাইয়া দিতেন; তিনি উঠিয়া সমস্ত রাত্রি পাঠাভ্যাস করিতেন। এইরূপ অত্যধিক পরিশ্রম করিয়া, মধ্যে মধ্যে তিনি অত্যন্ত কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হইতেন। ব্যাকরণশ্রেণীতে তিন বৎসর ছয় মাস ছিলেন; কিন্তু তিন বৎসরের মধ্যেই ব্যাকরণ সমাপ্ত করেন। শেষ ছয় মাস কাল অমরকোষের মনুষ্যবৰ্গ ও ভট্টিকাব্যের পঞ্চম সৰ্গ পর্য্যন্ত পাঠ করিয়াছিলেন।
একাদশবর্ষ বয়ঃক্রমকালে অগ্রজ মহাশয়ের উপনয়ন সংস্কার হয়। দ্বাদশবর্ষ বয়ঃক্রমসময়ে অগ্রজ মহাশয় সাহিত্যশ্রেণীতে প্রবিষ্ট হন। তৎকালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয় সাহিত্যশাস্ত্রের শ্রেণীতে অধ্যাপক ছিলেন। শুনিয়াছি, তর্কালঙ্কার মহাশয় ঁকাশীধামে বাল্যকাল হইতে সাহিত্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া, বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। গদ্য-পদ্য-রচনা-বিষয়ে তাঁহার তুল্য লোক প্রায় কেহ তৎকালে জন্মগ্রহণ করেন নাই। একারণ সংস্কৃত-কলেজ স্থাপনসময়ে উইলসন সাহেব, তাঁহাকে কাশীধাম হইতে আনাইয়া এই পদে নিযুক্ত করেন। উইলসন সাহেব প্রথমতুঃ বেনারসের টাঁকশালে কর্ম্ম করিতেন। তদনুন্তর কলিকাতায় সংস্কৃত-কলেজে অধ্যাক্ষের পদে নিযুক্ত হন। কাশীধামে সাহেবের সহিত তর্কালঙ্কার মহাশয়ের বিশেষরূপ আলাপ হইয়াছিল; এজন্য সংস্কৃত-কলেজের সাহিত্যশ্রেণীর শিক্ষকতাপদে নিযুক্ত করিবার জন্য তাঁহাকে আনয়ন করিয়াছিলেন। বাঙ্গালাদেশে কাব্যশাস্ত্রে ইহার তুল্য পণ্ডিত আর কেহই ছিলেন না। দাদার সাহিত্যশ্রেণীতে প্রবেশকালে মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতি অনেক বিদ্যার্থী এই সাহিত্যশ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। তন্মধ্যে তিনি সকল ছাত্র অপেক্ষা অল্পবয়স্ক ছিলেন; এজন্য প্রথমতঃ তর্কালঙ্কার মহাশয় বুলেন যে, “ঈশ্বর এত ছোট ছেলে, কাব্য বুঝিতে পরিবে কি?” এজন্য তিনি ভট্টির কয়েকটি কবিতার অর্থ করিতে বলেন। অগ্রজ যেরূপ অর্থ ও অন্বয় করিলেন, অন্য কোন ছাত্র সেরূপ অন্বয়ার্থ করিতে পারিলেন না, তজ্জন্য তর্কালঙ্কার মহাশয় তাঁহার প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। তর্কালঙ্কার মহাশয়, বাঙ্গালা দেশের সকল পণ্ডিত অপেক্ষা কাব্য-শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন সত্য বটে; কিন্তু ছাত্রগণকে পড়াইবার সময়, যে কবিতার অন্বয় করিতেন, তাহার অর্থ বলিতেন না, যাহার অর্থ ও ভাব বলিতেন, তাহার অন্বয় করিতেন না; সুতরাং যে সকল ছাত্র ব্যাকরণে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিতে পারে নাই, তাঁহাদের পক্ষে তর্কালঙ্কার মহাশয়ের নিকট অধ্যয়ন করিয়া কিছুমাত্র ফলোদয় হইত না। অগ্রজ মহাশয়ের ব্যাকরণে বিশিষ্টরূপ বুৎপত্তি জন্মিয়াছিল। বিশেষতঃ ভট্টিকাব্যের প্রথম হইতে পঞ্চম সৰ্গ ও প্রায় ৫০০ শত উদ্ভটকবিতা ভালরূপ কণ্ঠস্থ ছিল; এজন্য তাঁহার নিকট শিক্ষা-বিষয়ে ইহার কোন অসুবিধা ঘটে নাই। প্রথম বৎসর রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, রাঘবপাণ্ডবীয় প্রভৃতি সাহিত্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করিয়া, বার্ষিক-পরীক্ষায় সর্বোৎকৃষ্ট হইয়া প্রধান পারিতোষিক প্রাপ্ত হন। তৎকালে পুস্তক-পারিতোষিকেরই ব্যবস্থা ছিল। দ্বিতীয় বৎসরে মাঘ, ভারবি, মেঘদূত, শকুন্তলা, উত্তরচরিত, বিক্রমোর্বিশী, মুদ্রারাক্ষস, কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি মুখস্থ করিয়া, সাহিত্যশাস্ত্রে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তৎকালে রবিবারে কলেজ বন্ধ হইত না। অষ্টমী ও প্রতিপদে সংস্কৃত অনুশীলন নিষেধ ছিল; এজন্য উক্ত দিবসদ্বয় কলেজ বন্ধ থাকিত। দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দ্দশী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় নূতন পাঠ বন্ধ থাকিত; একারণ ঐ কয়েক দিবস সংস্কৃত-রচনা-শিক্ষার অনুশীলন হইত। কোন দিন সংস্কৃত হইতে বাঙ্গালা অনুবাদ, কোন দিন বাঙ্গালা হইতে সংস্কৃত অনুবাদ হইত। অগ্রজ মহাশয়, সকল ছাত্র অপেক্ষা ভাল অনুবাদ করিতে পারিতেন। বিশেষতঃ তাঁহার ব্যাকরণভুল বা বর্ণাশুদ্ধি আদৌ হইত না। একারণ অধ্যাপক তর্কালঙ্কার মহাশয়, তাঁহাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। তিনি কাব্য বা নাটক যাহা অধ্যয়ন করিতেন, তাহাই প্রায় কণ্ঠস্থ করিতেন। তাঁহার ন্যায় স্মরণশক্তি কোন ছাত্রেরই ছিল না। নাটকের প্রাকৃত-ভাষা প্রায় তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। একারণ, যেমন সংস্কৃত কথা কহিতে সমর্থ ছিলেন, সেইরূপ অনর্গল প্রাকৃত-ভাষাও কহিতে পারিতেন। এই অসাধারণ ক্ষমতা দেখিয়া, তৎকালের পণ্ডিতব্যক্তিরা বলিতেন যে, ঈশ্বর শ্রুতিধর; এই বালক দীর্ঘজীবী হইলে অদ্বিতীয় লোক হইবে। সাহিত্যশ্রেণীতে দ্বিতীয় বৎসরের পরীক্ষায় সর্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়া, অগ্রজ সর্ব্বপ্রধান পারিতোষিক পাইয়াছিলেন। তৎকালে নিয়ম ছিল, যে ছাত্রের হস্তাক্ষর ভাল হইত, সে লেখার জন্য স্বতন্ত্র একটি পারিতোষিক পাইত। ক্লাসের মধ্যে দাদার হস্তাক্ষর ভাল ছিল; এজন্য তিনি প্রতি বৎসরেই লেখার প্রাইজ পাইতেন। সেই সময়ে অনেক সংস্কৃত-পুস্তক মুদ্রিত ছিল না; অগ্রজ মহাশয় সুবিধা অনুসারে অনেক সংস্কৃত-পুস্তক স্বহস্তে লিখিয়াছিলেন।
এই সময় পিতৃদেব তাঁহার মধ্যমপুত্র অষ্টমবর্ষীয় দীনবন্ধুকে লেখাপড়া শিক্ষার মানসে কলিকাতায় আনয়ন করিলেন। ঐ সময় হইতে অগ্রজকে দুই বেলা সকলের পাকাদি-কার্য্য সম্পন্ন করিতে হইত। বাসায় কোন দাসদাসী ছিল না। প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, কিয়ৎক্ষণ পুস্তক আবৃত্তি করিয়া, বড়বাজার টাঁকশালের গঙ্গার ঘাটে স্নান করিয়া আসিবার সময়, বড়বাজার কাশীনাথ বাবুর বাজারে যাইতেন। তথা হইতে মৎস্য ও আলু-পটল প্রভৃতি তারকারী ক্রয় করিয়া আনিতেন। বাসায় পঁহুছিয়া, প্রথমতঃ হরিদ্রাদি ঝালমশলা বাটিয়া, উনন ধরাইয়া মুগের দাউল পাক করিয়া, মৎস্যের ঝোল রন্ধন করিতেন। তখন বাসায় চারিজন লোক ভোজন করিতেন। ভোজনের পর সমুদয় উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার ও বাসনাদি ধৌত করিতে হইত। হাঁড়ি মাজিয়া, বাসন ধৌত করিয়া ও স্থান পরিষ্কার করিয়া দাদার অঙ্গুলির অগ্রভাগ ও নখগুলি ক্ষয় হইয়া যাইত। হরিদ্র বাটার জন্য হন্তে হরিদ্রার চিহ্ন থাকিত। ভোজন করিতে করিতে যদি একটা ভাত ছড়ান হইত বা পাতে কিছু উচ্ছিষ্ট পড়িয়া থাকিত, তাহা হইলে পিতৃদেব তৎক্ষণাৎ চড় মারিতেন; তজ্জন্য ভোজনের সময় পাত পরিষ্কার করিয়া খাইতে হইত। তিনি বাল্যকালে পিতার নিকট এই সকল রীতি শিক্ষা পাইয়াছিলেন এবং বরাবর ভোজনের পাত্র পরিষ্কার করিয়া আহার করিতেন। একারণ তাঁহার উচ্ছিষ্টপাত্রে অনেকে শ্রদ্ধাপূর্বক ভোজন করিতে ইচ্ছা করিত। অগ্রজ মহাশয়, মধ্যম সোদর দীনবন্ধুকে সংস্কৃত-কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট করাইয়া দেন। তৎকালে হরিপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন উক্ত শ্রেণীর অধ্যাপক ছিলেন। দীনবন্ধু, বাল্যকালে লেখাপড়া শিক্ষা বিষয়ে ঔদাস্য অবলম্বন করিতেন বটে, কিন্তু অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান ছিলেন। অনেকে দীনবন্ধুকে শ্রুতিধর বলিত। অধিক কি, সংস্কৃত-কবিতা একবারমাত্র শ্রবণ করিলেই দীনবন্ধুর কণ্ঠস্থ হইত। পিতৃদেব স্বীয় কার্য্য সমাধা করিয়া, রাত্রি নয়টার সময় বাসায় আসিতেন। জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম পুত্র উভয়ে মনোযোগপূর্ব্বক পাঠাভ্যাস করিতেছেন দেখিলে, তিনি পরমাহ্লাদিত হইতেন। প্রদীপ জ্বলিতেছে, পুস্তক খোলা রহিয়াছে, অথচ উভয়েই নিদ্রা যাইতেছে দেখিবামাত্র, ক্রোধান্ধ হইয়া অত্যন্ত প্রহার করিতেন। প্রহারে উভয়ে অত্যন্ত চীৎকার করিয়া রোদন করিতেন; ইহাঁদের রোদন শুনিয়া গৃহস্বামী সিংহ মহাশয়ের পরিবারগণ অত্যন্ত দুঃখিত হইতেন এবং তাহাঁরা স্পষ্টাক্ষরে বলিতেন, ছোট ছোট প্রাণসম সন্তানগণকে এরূপ প্রহার করা উচিত নহে। এইরূপ প্রহারে কোন দিন মরিয়া যাইতে পারে; তজ্জন্য আপনাকে আমরা পুনঃপুনঃ বলিয়া থাকি যে, ছোট ছোট ছেলেকে এরূপ নির্দ্দয়ভাবে যদি প্রহার করেন, তাহা হইলে আপনার এখানে থাকা হইবে না। ইহাতে প্রহারের অনেকটা লাঘব হইয়াছিল। পিতৃদেব রাত্রি নয় ঘটিকার সময় বাসায় আগমন করিয়া পাকারম্ভ করিতেন; পাক ও আহার করিয়া রাত্রি একাদশ ঘটিকার পর সকলে শয়ন করিতেন। পুনর্ব্বার শেষ রাত্রিতে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, পিতার নিকট যে সকল উদ্ভট-কবিতা শিক্ষা করিয়াছিলেন, সেই গুলি আবৃত্তি করিতেন। সূর্য্যোদয় হইলে পর, কলেজের পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করিতেন; তৎপরে গঙ্গাস্নান করিয়া প্রাতঃসন্ধ্যা করিতেন এবং পাকাদিকার্য্য সমাধানান্তে ভোজন করিয়া বিদ্যালয়ে যাইতেন। অগ্রজ মহাশয় সন্ধ্যার ক্রমগুলি প্রকাশ্যরূপে দেখাইতেন। লোকে জানিত যে, অগ্রজ মহাশয়ের সন্ধ্যাভ্যাস আছে; কিন্তু সন্ধ্যা সমস্তই বিস্মৃত হইয়াছিলেন। সন্দেহপ্রযুক্ত একদিবস কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পিতৃব্য মহাশয় তাহাকে বলিলেন, “আমরা সন্ধ্যা ভুলিয়া গিয়াছি, বিশেষতঃ আমরা বিষয়ী লোক, তুমি সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়াছ, তোমার শুদ্ধ হইবে, অতএব একবার সন্ধ্যাটি তুমি আবৃত্তি কর, আমি শুনিতে ইচ্ছা করি।” তিনি সন্ধা ভুলিয়া গিয়া, ছিলেন, কিছুই বলিতে পারিলেন না। পিতৃব্য, পিতৃদেবকে বলিলেন যে, “ঈশ্বর সন্ধ্যা সমস্ত ভুলিয়া গিয়াছে; মিথ্যা কেবল হাতনাড়াদি কার্য্য করিয়া থাকে।” পিতৃদেব তাহা শুনিয়া বিলক্ষণ প্রহার করেন। সন্ধ্যা শিক্ষা না হইলে জল খাইতে দিব না বলায়, অগ্রজ মহাশয় সন্ধ্যার পুঁথি দেখিয়া পুনর্ব্বার সন্ধ্যা মুখস্থ করেন।
বীরসিংহ হইতে জননীদেবী চরখায় সুতা কাটিয়া, উভয় পুত্রের জন্য বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া কলিকাতায় পাঠাইতেন। উভয় ভ্রাতা সেই মোটা বস্ত্র পরিয়া, অধ্যয়নার্থ পটলডাঙ্গার কলেজে যাইতেন। এক্ষণে সেইরূপ চরখাকাটা সুতায় প্রস্তুত মোটা বস্ত্র উড়িষ্যাদেশীয় বেহার বা জঙ্গলবাসী ধাঙ্গড়গণকে পরিধান করিতে দেখা যায়। অগ্রজ মহাশয়কে বরাবর মোটা বস্ত্র পরিধান করিতে দেখা গিয়াছে, তিনি কখনই সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করেন নাই। অগ্রজ মহাশয়, কলেজে মাসিক বৃত্তি যাহা পাইতেন, তাহা পিতাকে দিতেন।
এইরূপে তাঁহার উন্নতি হওয়াতে পিতৃদেব বলেন যে, “তোমার এই টাকায় জমি ক্রয় করিব; কলেজের অধ্যয়ন শেষ হইলে, দেশে টোল করিয়া দিব। দেশস্থ লোক যাহাতে লেখাপড়া শিক্ষা করিতে পারে, তাহা তুমি করবে। তোমার বৃত্তির টাকায় যে জমি ক্রয় করা হইবে, তাহার উপস্বত্বের দ্বারা বিদেশীয় ছাত্রগণের ব্যয়নির্ব্বাহের কিছু সাহায্য হইতে পরিবে।” ইহা স্থির করিয়া, কাঁচিয়া গ্রাম প্রভৃতিতে কয়েক বিঘা জমি ক্রয় করিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে বলেন, “তোমার টাকায় তোমার আবশ্যক পুস্তকাদি ক্রয় করিবে।” তাহাতে দাদা অনেকগুলি হস্তাক্ষরিত পুঁথি ক্রয় করিয়াছিলেন। সেই সমস্ত পুঁথি অদ্যপি তাঁহার প্রসিদ্ধ লাইব্রেরীতে দেদীপ্যমান রহিয়াছে। অগ্রজ মহাশয়, ব্যাকরণ ও কাব্য-শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইয়াছিলেন। যখন দেশে (বীরসিংহায়) আসিতেন, তৎকালে কাহারও বাটীতে আদ্যশ্রাদ্ধ হইলে, কৃতী, নিমন্ত্রণার্থ অগ্রজের নিকট কবিতা রচনা করাইতেন; সমাগত সভাস্থ পণ্ডিতগণ ঐ কবিতা দেখিয়া বলিতেন যে, “এ কবিতা কাহার রচনা?” তাহা শুনিয়া কৃতী বলিতেন, এই বালক রচনা করিয়াছে। সমাগত পণ্ডিতগণ তাঁহার সহিত ব্যাকরণের বিচার করিতেন; বিচারসময়ে তিনি সংস্কৃত-ভাষায় কথা কহিতেন। তজ্জন্য দেশস্থ পণ্ডিতগণ আশ্চর্য্য হইতেন। ক্রমশঃ দেশে প্রচার হইল যে, বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইয়াছেন; যেহেতু তিনি বিচারসময়ে সংস্কৃতভাষা অবলম্বন করিয়া কথা কহিয়া থাকেন। তৎকালে দেশীয় পণ্ডিতগণ সংস্কৃতভাষায় কথা কহিতে সম্পূর্ণরূপ সক্ষম ছিলেন না।
দেশে অনেকে অগ্রজকে কন্যাদান করিবার জন্য বিশিষ্টরূপ যত্ন পাইয়াছিলেন। প্রথমতঃ রামজীবনপুরের আনন্দচন্দ্র অধিকারী সম্বন্ধ স্থির করিয়া যান। তাঁহাদের যাত্রার সম্প্রদায় ছিল; একারণ তাঁহাদিগকে অধিকারী বলিত; তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয় তাহদের বাটীতে বিবাহ করিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন; এবং তাঁহারা ধনশালী লোক ছিলেন, আমাদের ইষ্টকনির্ম্মিত বাটী নয় দেখিয়া, তাঁহারাও সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া দেন। পরে জগন্নাথপুরে চৌধুরীদের বাটীতে সম্বন্ধ স্থির হইয়াছিল। নানা কারণে সেই স্থানেও বিবাহ ঘটিল না। অবশেষে ক্ষীরপাইনিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয় আসিয়া বলিলেন, “ঈশ্বর বিদ্বান্ হইয়াছেন; সৎপাত্রে কন্যাদান করিতে আমি বাসনা করিয়াছি।” এ প্রদেশের মধ্যে তৎকালে ক্ষীরপাই সর্ব্বপ্রধান গ্রাম ছিল। তখন কলের কাপড় ছিল না। উক্ত গ্রামে নানা দেশের লোক আসিয়া, কাপড়ের ব্যবসা করিত। পশ্চিম হইতে হিন্দুস্থানী মহাজনেরা আসিয়া, তথায় রেশম ও কাপড়ের ব্যবসার জন্য কুঠী প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ভট্টাচার্য্য মহাশয়, ক্ষীরপাই গ্রামের মধ্যে ক্ষমতায়, মান্যে ও সদ্ব্যয়ে সর্বপ্রধান লোক ছিলেন। বিশেষতঃ কন্যাটি অতি সুলক্ষণা ও দর্শনীয়া ছিলেন এবং কোষ্ঠীর ফলও ভাল ছিল। ভট্টাচার্য্য মহাশয় বলিলেন, “আমার এই কন্যা পাদুকা। কোষ্ঠী-গণনার ফলে জানিবেন যে, এই কন্যা যাহাকে দান করা যাইবে, সর্ব্বপ্রকারে তাঁহার অচলা লক্ষ্মী হইবে।” পুনরায় ভট্টাচার্য্য মহাশয় পিতৃদেবকে বলিলেন, “বন্দ্যোপাধ্যায়! তোমার ধন নাই, কেবল তোমার পুত্র বিদ্বান্ হইয়াছেন; এই কারণে আমার প্রাণসম তনয়া দিনময়ীকে তোমার পুত্রের করে সমর্পণ করিলাম।” বিবাহ করিতে অগ্রজের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। যাবজ্জীবন লেখাপড়া শিখিব, সাধ্যানুসারে দেশের উপকার করিব, তাঁহার এই আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। কেবল পিতার ভয়ে অগত্যা বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। ক্ষীরপাইনিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের দিনময়ী নামী অষ্টমবর্ষীয়া সুলক্ষণা ও দর্শনীয়া দুহিতার সহিত অগ্রজের পাণিগ্রহণ-বিধি সমাধা হইল।
পঞ্চদশবর্ষ বয়ঃক্রমকালে অগ্রজ মহাশয় অলঙ্কারশাস্ত্রের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইলেন। তৎকালে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ মহাশয় অলঙ্কারের অধ্যাপক ছিলেন। তর্কবাগীশ মহাশয় ব্যাকরণ, সাহিত্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে বিশিষ্টরূপ বুৎপন্ন ছিলেন। সংস্কৃত গদ্য-পদ্য-রচনাবিষয়ে তাঁহার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। অলঙ্কার শ্রেণীতে প্রবিষ্ট ছাত্রগণ, তাঁহার নিকট অধ্যয়ন করিয়া, সংস্কৃতভাষায় সম্যক বুৎপত্তি লাভ করিত। ইনি পরিশ্রমশালী ছিলেন, এজন্য সকলে ইহাঁর প্রশংসা করিত। তৎকালে অগ্রজই অলঙ্কার-শ্রেণীতে সকল বালক অপেক্ষা অল্পবয়স্ক ও খর্বাকৃতি ছিলেন। অলঙ্কার-শ্রেণীতে এরূপ ছোট বালক অধ্যয়ন করিতেছে দেখিয়া, অন্যান্য লোক আশ্চর্য্যান্বিত হইত। ইনি এক বৎসরের মধ্যে সাহিত্যদর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলঙ্কার গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন, এবং বাৎসরিক পরীক্ষায় সর্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়া, সর্ব্বপ্রধান পারিতোষিক প্রাপ্ত হন। তর্কবাগীশ মহাশয় অন্যধ্যায়-দিবসে, ছাত্রগণকে গদ্য-পদ্য-রচনা ও কবিতার টীকা প্রস্তুত করিতে উপদেশ দিতেন।
সংস্কৃত-রচনায় অগ্রজের বিশিষ্টরূপ ক্ষমতা জন্মিয়াছিল; একারণ, তর্কবাগীশ মহাশয় সকল ছাত্র অপেক্ষা তাহাকে আন্তরিক ভালবাসিতেন। এই সময়ে তাঁহাকে প্রত্যহ দুই বেলা পাকাদিকার্য্য সমাধা করিতে হইত। পাক করিতে করিতে ইনি নিজের পাঠ্য-পুস্তক লইয়া পাঠানুশীলন করিতেন। অগ্রজ মহাশয় ও মধ্যমাগ্রজ মহাশয়, বেলা দশটার সময় বড়বাজার হইতে পটলডাঙ্গাস্থ কলেজে যাইবার সময়ে, পথে বহি দেখিতে দেখিতে গমন করিতেন। বাসায় প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া অধ্যয়ন করিতেন। জ্যেষ্ঠাগ্রজ অত্যধিক পরিশ্রম করিয়া, উৎকট রোগে আক্রান্ত হইলেন; প্রত্যহ রক্তভেদ হইতে লাগিল। কলিকাতায় থাকিয়া ঔষধাদি দ্বারা রোগ হইতে অব্যাহতি পাইলেন না, অগত্যা দেশে আসিতে হইল। দেশে আসিয়াও নানাবিধ ঔষধ সেবনে রোগের উপশম হইল না। অবশেষে প্রতিবাসী কাশীনাথ পালের অভীষ্টদেব, তক্রমিশ্রিত করিয়া সিদ্ধ ওল ভোজন করিবার ব্যবস্থা করেন। এই ঔষধ কতিপয় দিবস ব্যবহার করায়, সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভ করিয়াছিলেন।
অনন্তর পুনর্ব্বার কলিকাতায় যাইয়া রীতিমত অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং পূর্ব্বের ন্যায় স্বয়ং পাকাদিকার্য্য সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। একদিন মধ্যম সহোদর দীনবন্ধুকে সন্ধ্যার সময় বাজার করিতে পাঠাইয়াছিলেন। রাত্রি একাদশ ঘটিকা অতীত হইল, তথাপি দীনবন্ধু বাসায় উপস্থিত না হওয়াতে, তাঁহার অত্যন্ত দুর্ভাবনা হইল। ভ্রাতার জন্য উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। অবশেষে অন্যান্য লোকের উপদেশানুসারে প্রথমতঃ বড়বাজারে কাশীনাথ বাবুর বাজারে অনুসন্ধান করিলেন। তথায় অনুসন্ধান না পাওয়ায়, পরিশেষে যোড়াসাঁকো নূতন বাজারে অনুসন্ধান করিতে করিতে দেখিলেন, দীনবন্ধু বাজারে দেওয়াল ঠেস দিয়া নিদ্রা যাইতেছেন। তখন নিদ্রা ভাঙ্গাইয়া তাঁহাকে বাসায় লইয়া গেলেন। অগ্রজ মহাশয় ছোট ছোট ভাই ও ভগিনীদিগকে আন্তরিক স্নেহ করিতেন। এরূপ ভ্রাতৃস্নেহ অপর কাহারও দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
অগ্রজ মহাশয় শৈশবকাল হইতে কাল্পনিক দেবতার প্রতি কখনই ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিতেন না। জগতের মধ্যে কেবল হিন্দুগণ দেবদেবী প্রতিমার প্রতি যেরূপ হৃদয়ের সহিত ভক্তি প্রকাশ করেন, তিনি জনক-জননীকে বাল্যকাল হইতে তদ্রুপ আন্তরিক শ্রদ্ধা ও দেবতাস্বরূপ জ্ঞান করিতেন। অগ্রজ মহাশয় দেশে আগমন করিলে, আদিশিক্ষক কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে আন্তরিক ভক্তি-সহকারে, প্রণাম করিবার নিমিত্ত তাঁহার বাটীতে যাইতেন। চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ও তাঁহাকে সন্তানসদৃশ স্নেহ করিতেন। অগ্রজ মহাশয়, দেশের কি ইতর কি ভদ্র সকল সম্প্রদায়ের লোকের প্রতি সৌজন্যপ্রকাশ করিতেন। ছোট ছোট ছেলের সহিত তিনি কপাটী খেলিতেন, এতদ্ব্যতীত কখন তাস, শতরঞ্জি প্রভৃতি ক্রীড়া করিতেন না ও জানিতেন না।
অলঙ্কার-শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে অপরাহ্ন চারি ঘটিকার সময় বিদ্যালয়ের ছুটি হইলে, ঠন্ঠনিয়ার চৌরাস্তার কিয়দীর পূর্বে তারাকান্ত বিস্তাসাগর, তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও মধুসূদন বাচস্পতি মহাশয়দের বাসায় যাইতেন। ঐ সময় তাঁহাদের কলেজের অধ্যয়ন শেষ হইয়াছিল। উহাঁরা অগ্রজকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন; একারণ, তিনি প্রত্যহ ছুটির পর তাঁহাদের বাসায় যাইতেন। সন্ধ্যা পর্য্যন্ত তথায় অবস্থিতি করিয়া, সাহিত্যদর্পণ দেখিতেন। একদিবস বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রবেত্তা জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয়, জজ পণ্ডিতের পদ প্রাপ্ত্যভিলাষে ল-কমিটির পরীক্ষা দিবেন বলিয়া, তারানাথ তর্কবাচস্পতির সহিত যুক্তি করিতে আসিয়াছিলেন। তিনি তথায় অগ্রজ মহাশয়কে সাহিত্যদৰ্পণ আবৃত্তি করিতেছেন দেখিয়া চমৎকৃত হইলেন, এবং বাচস্পতিকে জিজ্ঞাসা। করিলেন, “এরূপ অল্পবয়স্ক বালক সাহিত্যদর্পণ বুঝিতে পারে কি?” ইহা শ্রবণ করিয়া বাচস্পতি মহাশয় বলিলেন, “কেমন শিখিয়াছে ও সংস্কৃতে ইহার কীদৃশী বুৎপত্তি জন্মিয়াছে, প্রশ্ন করিয়া অবগত হউন।” সাহিত্যদর্পণের রসের বিচারস্থল জিজ্ঞাসা করিলে, অগ্রজ মহাশয় যেরূপ ব্যাখ্যা করিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া তর্কপঞ্চানন মহাশয় আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “এই বালকের বয়োবৃদ্ধি হইলে, বাঙ্গালা দেশের মধ্যে অদ্বিতীয় লোক হইবে। এত অল্পবয়সে এরূপ সংস্কৃত-ভাষায় বুৎপন্ন লোক আমার কখন দৃষ্টিগোচর হয় নাই।” ইহা শুনিয়া তারানাথ তর্কবাচস্পতি বলিলেন, “আমরা এই বালককে কলেজের মহামূল্য অলঙ্কারস্বরূপ জ্ঞান করিয়া থাকি।”
তর্কপঞ্চানন মহাশয় শেষাবস্থায় কাশীবাস করিয়াছিলেন। তথায় সোণারপুর মহল্লাতে বহুসংখ্যক হিন্দুস্থানী, বাঙ্গালী, মহারাষ্ট্রীয়, দণ্ডী, পরমহংস ও ব্রহ্মচারীকে ন্যায়, বৈশেষিক, সাঙ্খ্য, পাতঞ্জল, বেদান্ত, মীমাংসা এই ষড়দর্শন ও অন্যান্য দর্শনশাস্ত্রের গ্রন্থ সকল অধ্যয়ন করাইতেন। তর্কপঞ্চানন মহাশয় মধ্যে মধ্যে ঐ সকল দণ্ডী প্রভৃতি ছাত্রগণের নিকট অগ্রজের বিষয় গল্প করিতেন। আমি কাশীতে তর্কপঞ্চাননের প্রমুখাৎ জ্যেষ্ঠের বাল্যকালের বহুতর গল্প শ্রবণ করিয়াছি।
এই সময় দাদা কলেজে মাসিক ৮৲ টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হন। তৎকালীন কলেজের নিয়মানুসারে অলঙ্কার, ন্যায়, বেদান্ত ও তৎপরে স্মৃতিশাস্ত্র পর্য্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ছাত্রগণ প্রথমে ন্যায়-দৰ্শন-শাস্ত্রের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়া অধ্যয়ন করিত; তাহার পর বেদান্ত-শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়া, বেদান্ত অধ্যয়ন করিত; তদনন্তর স্মৃতির শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়া মনুসংহিতা, মিতাক্ষরা, জীমূতবাহন-কৃত দায়ভাগ প্রভৃতি অধ্যয়ন করিয়া, জজ-পণ্ডিতের পদ-প্রার্থনায় ল-কমিটির পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইত। অগ্রজ মহাশয়, কলেজের অধ্যক্ষ মহাশয়ের নিকট আবেদন করিয়া, অলঙ্কার-শ্রেণী হইতে অগ্রে স্মৃতিশ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইলেন। ঐ সময় রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ প্রভৃতি স্মৃতি-শাস্ত্রের উপযুক্ত অধ্যাপকগণ, নানা কারণে পদচ্যুত হইয়াছিলেন। তৎকালীন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষগণ, দৰ্শন-শাস্ত্রজ্ঞ হরনাথ তর্কভূষণ মহাশয়কে স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তর্কভূষণ মহাশয়, দর্শনশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন বটে; কিন্তু প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রে তাঁহার তৎপূর্বে বিশেষ দৃষ্টি ছিল না; সুতরাং স্মৃতির ব্যবহারাধ্যায়ে ভালরূপ ব্যবস্থা স্থির করিতে অক্ষম ছিলেন। যদিও অগ্রজ স্মৃতির শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, তথাপি ঐ পণ্ডিতের নিকট অধ্যয়ন করিয়া মনের তৃপ্তি জন্মাইত না; একারণ, অদ্বিতীয় ধীশক্তিসম্পন্ন, হরচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের নিকট যাইয়া স্মৃতি অধ্যয়ন করিতেন। সাধারণ পণ্ডিতগণ দুই তিন বৎসরে যে সমস্ত প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্র শিক্ষা করিয়া পরীক্ষা দিতেন, তিনি স্মৃতির সেই সকল গ্রন্থ ছয় মাসে মুখস্থ করিয়া, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার মানসে পিতৃদেবকে বলিলেন, “আমি ছয় মাস পাকাদিকার্য্য সম্পাদন করিতে পারিব না।” সুতরাং তাঁহার অনুজ দীনবন্ধুকে দুইবেলা পাকাদিকার্য সমাধা করিতে হইত। তখন মধ্যমাগ্রজ দীনবন্ধুর বয়ঃক্রম দশ বৎসর মাত্র। জ্যেষ্ঠাগ্রজ প্রাতঃকাল হইতে বেলা নয় ঘটিকা পর্য্যন্ত অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া, সমগ্র মনুসংহিতা, মিতাক্ষরা প্রভৃতি স্মৃতিগ্রন্থ আবৃত্তি করিতেন এবং ভোজনান্তে বড়বাজার হইতে পটলডাঙ্গাস্থ বিদ্যালয়ে যাইবার সময়, পথে আবৃত্তি করিতে করিতে গমন করিতেন। কলেজে উপস্থিত হইয়া পড়া বন্ধ করিতেন। পুনরায় চারিটার পর বাসায় আসিবার সময়, পথে আবৃত্তি করিতে করিতে বাসায় আসিতেন। রাত্রি দশটার সময় ভোজন করিয়া, দুই ঘণ্টা নিদ্রা যাইতেন। নিকটস্থ আরমাণি গির্জ্জার ঘড়িতে রাত্রি বারটা বাজিলে, পুনর্ব্বার নিদ্রা হইতে উঠিয়া, সমস্ত রাত্রি স্মৃতি আবৃত্তি করিতেন। এইরূপ অনবরত ছয় মাস কাল সমস্ত রাত্রি পরিশ্রম করিয়া, ল-কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন।
অদ্যপি যাহার শ্মশ্রূরেখারও উদয় হয় নাই, সেই ১৭/১৮ বৎসরের বালক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, ল-কমিটির সার্টিফিকেট পাইলেন। এত অল্পবয়সে, ছয় মাসের মধ্যে তিনি সমগ্র প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থ কণ্ঠস্থ করিয়াছিলেন; ইহাতে অধ্যাপক মহাশয়েরা তাঁহার অলৌকিক-ক্ষমতা-দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলেন। ল-কমিটির সার্টিফিকেট-প্রাপ্তির কিয়দ্দিবস পরে, ত্রিপুরাজেলার জজ্-পণ্ডিতের পদ শূন্য হইলে, অগ্রজ মহাশয় ঐ পদ-প্রাপ্তির প্রার্থনায় আবেদন করেন। অগ্রজকে ঐ কার্য্যে নিযুক্ত করিবার জন্য গবর্ণমেণ্ট এই নিয়োগ-পত্র দেন যে, তুমি ত্বরায় ত্রিপুরায় আসিয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হও। কিন্তু পিতৃদেবের অসম্মতি-নিবন্ধন তাঁহার ঐ কার্য্যে যাওয়া ঘটিল না।
এখনকার মত তৎকালে থিয়েটার বা হাপ্ আখড়াই প্রভৃতি ছিল না। তৎকালে কলিকাতায় কবি ও কৃষ্ণযাত্রা হইত। দাদার কবি শুনিবার অত্যন্ত সখ ছিল; কোথাও কবি হইলে তিনি শুনিতে যাইতেন। যখন দেশে যাইতেন, তখন সমবয়স্ক ভাই বন্ধু লইয়া কবি গান করিতেন।
আত্মীয় লোকের পীড়া হইলে, মাতৃদেবীর অনুকরণে তিনিও তাঁহাদের বাটীতে যাইয়া, শুশ্রূষাদি-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন; এরূপ কার্য্যে তাঁহার কিছুমাত্র ঘৃণা ছিল না। নিঃসম্পৰ্কীয় অর্থাৎ কোনরূপ সংস্রব না থাকিলেও, পীড়িত-লোকের মলমূত্র স্বহস্তে পরিষ্কার করিতেন। পীড়িত-লোকের শুশ্রষাদি-কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিয়া, সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিতেন। যে সকল সংক্রামক-রোগাক্রান্ত রোগীকে অপরে স্পর্শ করিতেও ভীত হইত, তিনি নির্ভয়ে ও অসঙ্কুচিতচিত্তে সেই সকল রোগীর শুশ্রূষাদিকার্য্যে লিপ্ত থাকিতেন। তিনি বাল্যকাল হইতেই পরম দয়ালু ছিলেন। তাঁহার এবম্বিধ গুণ থাকায়, তৎকালে তিনি কলেজের সকল শিক্ষক ও ছাত্রবৃন্দের পরম প্রিয়পাত্র ছিলেন।
বৈকালে, কলেজের নিকট ঠন্ঠনিয়ার চৌমাথার কিছু পূর্বে, বিপ্রদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিঠাইয়ের দোকান ছিল। তথায় কলেজের ছুটির পর জল খাইতেন। কলেজের যে কোন ছাত্র সম্মুখে থাকিত, সকলকেই মিষ্টান্ন খাওয়াইতেন। তিনি মাসিক যে ৮৲ টাকা বৃত্তি পাইতেন, তাহা অপরাপর বালককে বৈকালে জল খাওয়ানতেই খরচ হইত। এতদ্ভিন্ন কলেজের দ্বারবান্দের নিকটও যথেষ্ট টাকা ধার করিতেন। যে সকল বালকের বস্ত্র জীণ দেখিতেন, ঐ ধার করা টাকায় সেই সকল বালকের বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিতেন। বড়বাজারের বাসায় যে সকল সহাধ্যায়ী যাইতেন, তাহাদিগকে জল খাওয়াইতেন; একারণ, অনেকে মনে করিতেন যে, ঈশ্বর ধনশালী লোক। পূজার অবকাশে দেশে আগমন করিলে, ষে যে প্রতিবাসিগণ পীড়িত হইয়াছেন শুনিতেন, তাহাদের বাটীতে সর্ব্বদা যাইতেন এবং তাহাদের শুশ্রূষাদিকার্যো স্বতঃপ্রবৃত্ত হইতেন। অপর লোকে রোগীর শুশ্রূষাদিকার্য্যে নিযুক্ত থাকিতে ঘৃণা প্রকাশ বা ক্লেশ বোধ করিত, কিন্তু অগ্রজ মহাশয় যে কোন জাতীয় লোকের পীড়া হইলে, সন্তুষ্ট-চিত্তে তাহাদের সেবা করিতে অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করিতেন। একারণ, তৎকালে দেশস্থ লোকগণ দাদাকে দয়াময় বলিত। অনেকেই দেখিয়াছেন যে, সামান্য বিড়াল বা কুকুর মরিলেও তাহা দেখিয়া দাদার চক্ষে জল আসিত; কোন লোক রোদন করিলে, তিনিও তাহাদের সহিত রোদনে প্রবৃত্ত হইতেন।
পূজার অবকাশে গ্রামের গদাধর পাল, ব্রজমোহন চক্রবর্ত্তী ও ছোট ছোট ভ্রাতৃগণের সহিত কপাটী খেলিতেন। অন্য কোনরূপ ক্রীড়ায় কখন তাঁহাকে আসক্ত হইতে দেখি নাই। কপাটী খেলিলে অত্যন্ত শ্রম হয়, তাহাতে উদরাময় প্রভৃতি রোগ আরোগ্য হয়, এতদভিপ্রায়ে কপাটী খেলায় প্রবৃত্ত হইতেন। এতদ্ব্যতীত কখন কখন মদনমোহন মণ্ডলের সহিত লাঠী খেলিতেন।
দেশস্থ যে সকল লোকের দিনপাত হওয়া দুষ্কর দেখিতেন, তাহাদিগকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে ক্ষান্ত থাকিতেন না। অন্যান্য লোকের পরিধেয় বস্ত্র না থাকিলে, গামছা পরিধান করিয়া, নিজের বস্ত্রগুলি তাহাদিগকে বিতরণ করিতেন। বাল্যকালে দেশে যাইয়া, কৃষকগণের সহিত মাঠে কাস্তিয়া লইয়া ধান্য কাটতেন। ভ্রাতৃগণকে বলিতেন, সকলে মাঠে চল্, মাঠ হইতে ধান বহিয়া আনিতে হইবে। মজুরদের সহিত ধান বহিয়া তিনি পরম আহ্লাদিত হইতেন।
অগ্রজ মহাশয় উনিশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে, বেদান্ত-শাস্ত্রের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইলেন। পূজ্যপাদ শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি মহাশয়, ঐ সময় বেদান্ত-শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি দাদাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। বাচস্পতি মহাশয়ের যাহা কিছু যুক্তি বা পরামর্শ, তৎসমস্তই দাদার সহিত হইত। বেদান্ত, পাতঞ্জল কি সাঙ্খ্য গ্রন্থের যে যে স্থলে পাঠের সন্দেহ হইত বা অসংলগ্ন বোধ হইত, তদ্বিষয়ের সন্দেহ-ভঞ্জনার্থ তাঁহার সহিত বাদানুবাদ করিতেন। তাহাতে তিনি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া বলিতেন যে, তুমি ঈশ্বর। ঐ সময়ে পিতৃদেব, অষ্টমবর্ষবয়ঃক্রমকালে বিদ্যাশিক্ষার মানসে আমায় কলিকাতায় লইয়া আইসেন। কয়েকদিন পরে, দাদা আমাকে সংস্কৃত-কলেজের ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন। তৎকালে ঐ শ্রেণীতে গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশয় অধ্যাপক ছিলেন। আমি ঈশ্বরের তৃতীয় সহোদর, একারণ তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করিতেন। তিন ভ্রাতা ও পিতা এবং দয়ালচাঁদ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি সকলের দুই বেলার পাকাদিকার্য্য অগ্রজ মহাশয়ই সম্পন্ন করিতেন। যে গৃহে পাক করিতেন, তাহার অতি সন্নিহিত স্থানে অপরের পাইখানা ছিল; সুতরাং পাকশালায় বসিলেই অত্যন্ত দুৰ্গন্ধ বোধ হইত। এক্ষণে মিউনিসিপালিটির বন্দোবস্তে পাইখানায় আর সেরূপ দুৰ্গন্ধ থাকে না। তৎকালে কলিকাতায় মিউনিসিপালিটী ছিল না, পথে ময়লা ফেলিলেও কেহ কোন কথা বলিতেন না। পাকগৃহটী অত্যন্ত অন্ধকার ছিল; একটী মাত্র দ্বার ব্যতীত জানালা ছিল না। পাকশালা অত্যন্ত ছোট ছিল এবং উহা তৈলপায়ী অর্থাৎ আরসুলায় পরিপূর্ণ থাকিত। প্রায় মধ্যে মধ্যে দুই চারিটা আরসুলা ব্যঞ্জনে পতিত হইত। দৈবাৎ একদিন অগ্রজের ব্যঞ্জনে একটা আরসুলা পড়িয়াছিল। প্রকাশ করিলে বা পাতের নিকট ফেলিয়া রাখিলে, ভ্রাতৃগণ বা পিতা মহাশয় ঘৃণাপ্রযুক্ত আর ভোজন করিবে না, এই আশঙ্কায় তিনি সমস্ত আরাসুলা, ব্যঞ্জনসহিত উদরস্থ করিলেন। ভোজনের কিয়ৎক্ষণ পরে, আরসুলা খাইবার কথা ব্যক্ত করিলেন। তাহা শুনিয়া উপস্থিত সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন।
যে স্থানে আহার করিতে বসিতেন, তাহার নিকটস্থ নর্দ্দামা হইতে কেঁচো ও অন্যান্য কৃমি উঠিয়া ভোজনপত্রের নিকটে আসিত; এজন্য তিনি এক ঘটী জল ঢালিয়া দিয়া, কৃমিগুলিকে সরাইয়া দিতেন। ঐ সময় জগদ্দুর্লভ সিংহের বাটীর সম্মুখে তিলকচন্দ্র ঘোষের সোণারূপার খোদাইখানার গৃহ ছিল। তিলকচন্দ্র ঘোষ ও উহার পুত্র রামকুমার ঘোষ অতি ভদ্র লোক ছিলেন। তাঁহারা দাদাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। ঐ বাটীর উপরের গৃহে পিতৃব্য কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় রাত্রিতে শয়ন করিতেন; উহার নিম্নস্থ গৃহে অগ্রজ মহাশয় রাত্রিতে পাঠ্যপুস্তক পাঠ করিয়া, অধিক রাত্রিতে শয়ন করিতেন। সন্ধ্যার সময় হইতে তাঁহার শয্যায় আমিও শয়ন করিতাম। এক দিবস আমার উদরাময় হওয়ায়, সন্ধ্যার সময় অসাবধানতাপ্রযুক্ত বস্ত্রেই মলত্যাগ করিয়াছিলাম; তজ্জন্য যদি ভোজন করিতে না দেন, এই আশঙ্কায় উহা প্রকাশ করি নাই। অগ্রজ মহাশয় অধিক রাত্রিতে শয়ন করিয়া, তৎক্ষণাৎ নিদ্রাভিভূত হইলেন। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলেন যে, তাহার পীঠ, বুক ও হস্ত প্রভৃতিতে বিষ্ঠা লাগিয়া রহিয়াছে। আমায় কোন কথা না বলিয়া, গাত্র ধৌত করিয়া সমস্ত শয্যা স্বহস্তে কূপোদক দ্বারা প্রক্ষালিত করিলেন। তিনি বাল্যকাল হইতেই পিতামাতার প্রতি ভক্তি এবং ভ্রাতা ও ভগিনীদিগকে যথেষ্ট স্নেহ করিয়া আসিতেছেন। এরূপ পিতৃমাতৃভক্তি ও ভ্রাতৃস্নেহ অন্য কেহ করিতে পারেন না। জননীরও সকল পুত্র অপেক্ষা অগ্রজ মহাশয়ের প্রতি আন্তরিক স্নেহ ছিল।
বেদান্তের শ্রেণীতে যখন অধ্যয়ন করিতেন, তখন প্রত্যহ ক্লাসের পড়া শেষ করিয়া, শেষবেলায় আমাকে ও মধ্যমাগ্রজ দীনবন্ধুকে ব্যাকরণের শ্রেণী হইতে আনিয়া, নিজের নিকটে বসাইয়া রাখিতেন। একদিন বাচস্পতি মহাশয় আমাকে বলিলেন, “শম্ভু, তুমি আমার নামটী চুরি করিয়াছ কেন?” তাহা শুনিয়া আমি উত্তর করিলাম, “মহাশয়! আমি চুরি করি নাই, বাবা চুরি করিয়াছেন।” ইহা শ্রবণ করিয়া বাচস্পতি মহাশয় পরম আহ্লাদিত হইয়াছিলেন, এবং তদবধি প্রত্যহ শেষবেলায় ব্যাকরণ-শ্রেণী হইতে আমায় আহ্বান করিতেন। বাচস্পতি মহাশয়, অগ্রজকে আন্তরিক ভাল বাসিতেন ও অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান্ ছাত্র বলিয়া শ্রদ্ধা করিতেন। তিনি সন্তুষ্ট হইবেন বলিয়া, বাচস্পতি মহাশয়, আমাদিগকে প্রত্যহ কাছে বসাইয়া সন্ধি জিজ্ঞাসা করিতেন। বাচস্পতি মহাশয়ের পত্নী কালগ্রাসে নিপতিত হইলে, কিয়দিবস পরে তিনি বৃদ্ধ-বয়সে পুনর্ব্বার বিবাহ করিবার জন্য বিলক্ষণ যত্ন পাইতে লাগিলেন। বিবাহ করা উচিত কি না, এই বিষয়ে একদিন নির্জ্জনে অগ্রজের সহিত পরামর্শ করেন। তিনি বলিলেন, “এরূপ বয়সে মহাশয়ের বিবাহ করা পরামর্শসিদ্ধ নয়।” বাচস্পতি মহাশয় তাঁহার পরামর্শ কোনরূপে শুনিলেন না। একারণ তিনি রাগ করিয়া, বাচস্পতি মহাশয়ের বাটী যাইতেন না। বাচস্পতি মহাশয়, তৎকালে কলিকাতার অদ্বিতীয় ধনশালী ও সন্ত্রান্ত রামদুলাল সরকারের পুত্র ছাতু বাবু ও লাটু বাবুর দলের সভাপণ্ডিত ছিলেন। নড়ালের রামরতন বাবুও বাচস্পতি মহাশয়কে অতিশয় মান্য করিতেন। ইহাঁরা উভয়ে ঐক্য হইয়া সম্বন্ধ স্থির করিয়া, এক পরমাসুন্দরী কন্যার সতিত বাচস্পতি মহাশয়ের বিবাহ কার্য্য সমাধা করান। বাচস্পতি মহাশয়, অগ্রজকে সুতনির্ব্বিশেষে স্নেহ করিতেন; এজন্য এক দিবস বলেন, “ঈশ্বর! তোমার মাকে এক দিনও দেখিতে গেলে না।” ইহা শুনিয়া তিনি রোদন করিতে লাগিলেন। পরে এক দিন জোর করিয়া, দাদাকে তাঁহার বাটীতে লইয়া যান। বাচস্পতি মহাশয়ের নূতন বিবাহিতা পত্নীকে দেখিবামাত্র অগ্রজ রোদন করিতে লাগিলেন। বাচস্পতি মহাশয় তাঁহাকে অনেক উপদেশ দিয়া সান্ত্বনা করেন। ইহার কিছু দিন পরেই বাচস্পতি মহাশয় পরলোকগমন করেন। অগ্রজ, শম্ভুনাথ বাচস্পতির দেশস্থ কোন লোককে দেখিলেই তাহাকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন।
১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে এই নিয়ম হইয়াছিল যে, স্মৃতি, ন্যায়, বেদান্ত এই তিন প্রধান শ্রেণীর ছাত্রদিগকে বাৎসরিক পরীক্ষার সময়ে সংস্কৃত গদ্য ও পদ্য রচনা করিতে হইবে। যাহার রচনা সর্ব্বাপেক্ষা ভাল হইবে, সে গদ্য-রচনায় একশত টাকা ও কবিতা-রচনায় একশত টাকা পারিতোষিক পাইবে। এক দিনেই উভয় প্রকার রচনার সময় নিৰ্দ্ধারিত হয়। দশটা হইতে একটা পর্য্যন্ত গদ্য রচনা, এবং একটা হইতে চারিটা পর্য্যন্ত কবিতা-রচনার সময় ছিল। গদ্যপদ্য-পরীক্ষার দিবসে, বেলা দশটার সময়ে, সকল ছাত্র পরীক্ষাস্থলে উপস্থিত হইয়া লিখিতে আরম্ভ করিল। অলঙ্কার-শাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র, তর্কবাগীশ মহাশয়, অগ্রজকে পরীক্ষাস্থলে অনুপস্থিত দেখিয়া, বিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব মহোদয়কে বলিয়া, অগ্রজকে বলপূর্ব্বক তথায় লইয়া গিয়া একস্থানে বসাইয়া দিলেন। অগ্রজ বলিলেন, “মহাশয়! আমার রচনা ভাল হইবে না, আমি লিখিতে পারিব না।” তর্কবাগীশ মহাশয় তাহা শুনিয়া অত্যন্ত রাগান্বিত হইয়া বলিলেন, “যা পার লিখ, নচেৎ অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব রাগ করিবেন।” অগ্রজ বলিলেন, “কি লিখিব?” তিনি বলিলেন, “সতং হি নাম আরম্ভ করিয়া লিখা।” তদনুসারে তিনি লিখিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সত্য-কথনের মহিমা, গদ্য-রচনার বিষয় ছিল। তিনি উক্ত বিষয় যেরূপ লিখিয়াছিলেন, তাহা সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। তিনি ভাবিয়াছিলেন যে, আমার লেখা বোধ হয় ভাল হয় নাই; কিন্তু পরীক্ষক মহাশয়েরা সকল ছাত্রের রচনা অপেক্ষা তাহার রচনাকে সর্ব্বোৎকৃষ্ট স্থির করিয়াছিলেন। সুতরাং তিনি গদ্য-রচনার পারিতোষিক ১০০৲ এক་ শত টাকা প্রাপ্ত হইলেন।
ইহার অব্যবহিত পরে পিতৃদেব, মধ্যমাগ্রাজের বিবাহ কার্য্য সমাধা করেন; এতদুপলক্ষে পিতৃদেবের বিলক্ষণ ঋণ হইয়াছিল। বীরসিংহাস্থ ভবনের ব্যয়ের কিছুমাত্র লাঘব করিতে পারিলেন না, সুতরাং অগত্যা কলিকাতাস্থ বাসার ব্যয়ের হ্রাস করেন। দুগ্ধ, মৎস্যাদি কিছুকালের জন্য রহিত হয়। বৈকালে জল খাইবার জন্য আধ্য পয়সার ছোলা আনিয়া ভিজান হইত। আধা পয়সার বাতাসা আসিত; ইহাই বৈকালে সকলের জলখাবার ব্যবস্থা ছিল। ঐ আর্দ্র ছোলার কিয়দংশ আবার রাত্রে কুমড়ার ব্যঞ্জনের সহিত পাক হইত। ঐ সময় কষ্টের পরিসীমা ছিল না। প্রাতে ও রাত্রিতে ছোলা-মিশ্রিত কুমড়ার ডাল্না ও পোস্তভাজা ব্যঞ্জন হইত। তৎকালে এরূপ কষ্ট স্বীকার করিয়া, স্বহস্তে পাকাদি সম্পন্ন করিয়া, অগ্রজ যেরূপ লেখাপড়া শিক্ষা করিয়াছিলেন, এক্ষণকার ছেলেরা ভাল ভাল দ্রব্য খাইয়া এবং উত্তম বসন পরিধান করিয়াও সেরূপ যত্নপূর্বক লেখাপড়া শিক্ষা করে না।
এই বৎসর কার্ত্তিক মাসে কলিকাতা বড়বাজারের বাবু জগদ্দুর্লভ সিংহের যে বাটীতে বাসা ছিল, অগত্যা ঐ বাটী প্রায় ৩/৪ মাসের জন্য পরিত্যাগ করিতে হয়। ইহার কারণ এই যে, উক্ত সিংহ ভ্রমক্রমে চোরাই কোম্পানির কাগজ ক্রয় করিয়া, রাজদ্বারে দণ্ডার্হ হন। তাঁহার বাটী কিছু দিনের জন্য পুলিশকর্ম্মচারী দ্বারা বেষ্টিত হয়। সুতরাং অগ্রজ মহাশয়ের সহিত আমরা দুই মাসকাল পাতুলগ্রামনিবাসী গুরুপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পিসা মহাশয়ের বাসায় অবস্থিতি করিয়া, কলেজে অধ্যয়ন করি। ঐ সময় অগ্রজ, কলেজের সকল ছাত্র অপেক্ষা পদ্যে অত্যুৎকৃষ্ট সংস্কৃত-কবিতা রচনা করেন; তজ্জন্য শিক্ষা-সমাজ তাঁহাকে ৫০৲ টাকা পুরস্কার প্রদান করেন। উপরি উক্ত জগদ্দুর্লভ সিংহ মোকদ্দমা করিয়া ঋণগ্রস্ত হন। আমরা তাঁহার বাটীতে ভাড়া না দিয়া, দীর্ঘকাল অবস্থিতি করিতাম। তিনি অত্যন্ত দুরবস্থা-প্রযুক্ত তেতালায় যে গৃহে আমাদের বাসা ছিল, তাহা তনসুকদাস নামক হিন্দুস্থানীকে ভাড়ায় বিলি করেন। ঐ ভাড়ার টাকায় ঐ সিংহের সংসার চলিতে লাগিল। সুতরাং আমাদিগকে ঐ বাটীর নিমগৃহে অগত্যা বাস করিতে হইল।
বড়বাজারের নিম্নতলস্থ গৃহ অত্যন্ত আৰ্দ্র; তাহাতে শয়ন করিয়া অগ্রজ মহাশয় বিষম রোগাক্রান্ত হইয়া, অনেক কষ্টভোগ করেন। সর্ব্বদা আমবাতের মত হইত। অনেক প্রতিকার দ্বারা পরে প্রকৃতিস্থ হন। ঐ সময়ে অগ্রজ মহাশয়, বেদান্তের শ্রেণী হইতে ন্যায়শাস্ত্রের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হন। তৎকালে নিমচাঁদ শিরোমণি মহাশয় কলেজের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। সে সময়ে তিনি বঙ্গদেশের মধ্যে অদ্বিতীয় দর্শনশাস্ত্রবেত্তা ছিলেন। তাঁহার সহিত বিচারে সকল দর্শনবেত্তাদিগকে পরাস্ত হইতে হইয়াছিল। তাঁহার নিকট দাদা এক বৎসর ভাষাপরিচ্ছেদ, সিদ্ধান্তমুক্তাবলী, কুসুমাঞ্জলি, শব্দশক্তিপ্রকাশিকা প্রভৃতি প্রাচীন ন্যায়গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। দ্বিতীয় বাৰ্ষিক পরীক্ষার সময় দর্শনশাস্ত্রে সকল ছাত্র অপেক্ষা সর্বোৎকৃষ্ট হন; একারণ দর্শনের প্রাইজ ১০০৲ টাকা পান, এবং সংস্কৃত কবিতা-রচনায় সর্ব্বাপেক্ষা ভাল কবিতা লিখিয়া ১০০৲ টাকা পুরস্কার প্রাপ্ত হন।
নিমচাঁদ শিরোমণি মহাশয়, ঐ সময় ইহজগৎ পরিত্যাগ করেন। ইহাঁর মৃত্যুতে অগ্রজ মহাশয়, কিছু দিন দুর্ভাবনায় ম্লান হইয়াছিলেন। কয়েক মাস সর্ব্বানন্দ ন্যায়বাগীশ দর্শনশ্রেণীর ছাত্রগণকে শিক্ষা দেন; কিন্তু তিনি ভালরূপ ন্যায় পড়াইতে পারিতেন না। অগ্রজ মহাশয় উদ্যোগী হইয়া অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব মহোদয়ের নিকট এই বিষয়ে আবেদন করেন। তজ্জন্য বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি সাহেবের আদেশ হয় যে, কর্ম্মপ্রার্থী দর্শনশাস্ত্রবেত্তা পণ্ডিতগণ আবেদন করুন। পরীক্ষায় যিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ হইবেন, তিনিই দর্শনশ্রেণীর অধ্যাপক হইবেন। নানাস্থানের পণ্ডিতগণ এই পদপ্রার্থনায় দরখাস্ত করেন। কিন্তু জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন প্রথমতঃ আবেদন করেন নাই। অগ্রজ মহাশয়, শালিকায় তর্কপঞ্চাননের টোলে কয়েকবার যাইয়া, তাঁহার স্বাক্ষর করাইয়া, আবেদনপত্র স্বয়ং অধ্যক্ষ সাহেবের হস্তে অৰ্পণ করেন। তর্কপঞ্চানন মহাশয়ের প্রতি তাঁহার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছিল। বিশেষতঃ যৎকালে অলঙ্কারশ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন, ঐ সময়ে তাহার সহিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বাসায় শাস্ত্রালাপ হইয়া, পরস্পরের প্রতি হৃদ্যতা জন্মিয়াছিল। আর যে বৎসর তিনি ল-কমিটির পরীক্ষা দেন, সেই বৎসর তর্কপঞ্চানন মহাশয়ও ঐ পরীক্ষা দিয়াছিলেন। কর্ম্ম-প্রাথী দর্শনশাস্ত্রবেত্তাগণের মধ্যে জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয় পরীক্ষায় উৎকৃষ্ট হইয়াছিলেন। তজ্জন্য পরীক্ষক মহাশয়েরা জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননকে কলেজের দর্শনশাস্ত্রের যোগ্য অধ্যাপক স্থির করিয়াছিলেন। কর্ত্তৃপক্ষেরা তাঁহাকে ঐ পদে নিযুক্ত করিলেন। অগ্রজ ইহাঁর নিকট তিন বৎসর, এবং নিমচাঁদ শিরোমণির নিকট এক বৎসর এই চারি বৎসর রীতিমত পরিশ্রম করিয়া, প্রায় সমগ্র দৰ্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ইহাতে অন্যান্য পণ্ডিতগণ অবাক হইয়াছিলেন। কারণ, অপরে ১০।১২ বৎসরে যে শাস্ত্র শেষ করিতে পারে না, ঈশ্বর এত স্বল্প সময়ের মধ্যে কেমন করিয়া তাহা শেষ করিল।
যৎকালে দৰ্শন-শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন, তখন দেশে যাইলে অনেকের সহিত তাঁহার বিচার হইত। সকলেই তাঁহার সহিত বিচারে সন্তুষ্ট হইয়া, তাঁহাকে আশীৰ্বাদ করিতেন। একদা বীরসিংহ গ্রামের কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাস সমারোহপূর্বক মাতৃশ্রাদ্ধ করেন। তিনি দাদার নিকট শ্রাদ্ধে ভট্টাচার্য্যনিমন্ত্রণ-জন্য সংস্কৃত-কবিতা প্রস্তুত করাইয়া লন। শ্রাদ্ধের দিন নানাস্থান হইতে পণ্ডিতমণ্ডলী আসিয়াছিলেন। কে এরূপ কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহা জানিবার জন্য পণ্ডিতগণ ব্যগ্র হইলেন। পরে অগ্রজকে ঐ কবিতারচয়িতা জানিয়া, সকলে তাঁহার সহিত বিচারে প্রবৃত্ত হইয়া পরাস্ত হন। অবশেষে কুরাণগ্রামনিবাসী সুবিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রবেত্তা রামমোহন তর্কসিদ্ধান্তের সাহিত প্রাচীন ন্যায় গ্রন্থের বিচার হয়; বিচারে তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের পরাজয় হয় শুনিয়া, পিতৃদেব, তর্কসিদ্ধান্তের পদরজঃ লইয়া দাদার মস্তকে দেন। পিতৃদেব অনেক স্তবস্তুতি করিয়া তর্কসিদ্ধান্তকে সান্ত্বনা করেন। তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় বিচারে পরাজিত হইয়া, পিতৃদেবকে বলেন যে, “তোমার পুত্র ঈশ্বর যেরূপ কাব্য, অলঙ্কার, স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছে, এরূপ বঙ্গদেশের মধ্যে কেহই শিক্ষা করিতে পারেন না; উত্তরকালেও যে, অপর কেহ শিক্ষা করিতে পরিবেন, এরূপ আশা করা যাইতে পারে না। ঈশ্বরের প্রতি সরস্বতীর কৃপাদৃষ্টি হইয়াছে, নচেৎ এই অল্পবয়সে এত শাস্ত্র কেমন করিয়া শিক্ষা করিয়াছে।” কোন কোন পণ্ডিত সর্ব্বসমক্ষে ব্যক্ত করিলেন যে, “ঈশ্বরের পিতামহ বহুকাল তীর্থক্ষেত্রে তপস্যা করিতেছিলেন; স্বপ্ন দেখিয়া দেশে আসিয়া ঈশ্বর ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র, জিহ্বায় কি মন্ত্র লিখিয়া দিয়াছিলেন; তজ্জন্য দৈবশক্তিবলে সমস্ত শাস্ত্রে পারদর্শী হইয়াছে।” কোন কোন পণ্ডিত বলিতেন যে, “ঈশ্বরের মাতামহ শবসাধন করেন, তাঁহারই আশীর্ব্বাদ-প্রভাবে এত অল্প বয়সে এরূপ পণ্ডিত হইয়াছে।”
যৎকালে অগ্রজ, ন্যায়শাস্ত্রের শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন, তৎকালে ব্যাকরণের দ্বিতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক হরিপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন পীড়িত হইয়াছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ মহাশয়, অগ্রজকে উপযুক্ত পণ্ডিত বিবেচনা করিয়া, দুই মাসের জন্য প্রতিনিধিপদে নিযুক্ত করেন। তিনি প্রতিনিধি পদে নিযুক্ত থাকিয়া ৪০৲ টাকা প্রাপ্ত হন, এবং সেই টাকা পিতৃদেবের হস্তে অৰ্পণ করিয়া বলেন, “এই টাকায় পিতৃকৃত্য-সম্পাদনার্থ গয়াধাম প্রভৃতি তীর্থ-পর্যটনে যাত্রা করুন।” ছেলেমানুষ, পিতাকে তীর্থক্ষেত্রে যাইতে উপদেশ দিতেছেন, এই কথায় আত্মীয় বন্ধুবান্ধব সকলেই পরম আহ্লাদিত হইলেন।
পিতৃদেব তৎকালে কলিকাতা যোড়াশাঁকোনিবাসী বাবু রামসুন্দর মল্লিকের আফিসে চাকরি করিতেন। রামসুন্দর মল্লিক যদিও অতি ধার্ম্মিক লোক ছিলেন, তথাপি তিনি পিতৃদেবকে ঐ সময় তীর্থ পর্য্যটনে যাইতে নিষেধ করেন; সেই জন্য পিতা, তাঁহার অবাধ্য হইয়া যাইতে সাহস করেন নাই। এজন্য দাদা, বাবু রামসুন্দর মল্লিকের বাটীতে যাইয়া, যাহাতে পিতা গয়া যাইতে পারেন, রামসুন্দর বাবুকে এরূপ ধর্ম্মবিষয়ক উপদেশ প্রদান করেন। বৃদ্ধ রামসুন্দর বাবু, ছেলেমানুষের প্রমুখাৎ নানাপ্রকার হিতগর্ভ উপদেশ শুনিয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন, এবং পিতৃদেবের গয়াযাত্রার বিষয়ে আর নিবারণ করিতে পারিলেন না। তখন রেলের পথ হয় নাই; তজ্জন্য পিতৃদেব পদব্রজেই প্রস্থান করেন।
ঐ সময় মার্শেল সাহেব, সংস্কৃত-কলেজের সেক্রেটারির পদ পরিত্যাগ করিলেন। ঐ পদে কলিকাতার ছোট আদালতের জজ বাবু রসময় দত্ত মহাশয় নিযুক্ত হইলেন। তৎকালে বাঙ্গালীর মধ্যে ইহাঁর তুল্য আর কাহারও অধিক বেতন ছিল না। দত্তবাবু যদিও সংস্কৃত-ভাষায় অনভিজ্ঞ, তথাপি রাজকীয় ব্যক্তিগণ ইহাঁর হস্তেই সংস্কৃত-বিদ্যালয়ের গুরুতর ভার ন্যস্ত করিয়াছিলেন। মধুসূদন তর্কালঙ্কার ইহাঁর আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি ছিলেন। কলেজের তৃতীয় বার্ষিক পরীক্ষার সময়, দত্ত মহাশয়, অগ্নীধ্র রাজার তপস্যাসংক্রান্ত কতিপয় কথা লিখিয়া, পরীক্ষার্থী ছাত্রগণকে এই বিষয়ের শ্লোক রচনা করিতে বলেন। অগ্রজের উক্ত বিষয়ের রচনা উদ্ধৃত করিলাম না। যেহেতু তাহার সংস্কৃত-রচনা-নামক পুস্তকে সেই সমস্ত মুদ্রিত হইয়াছে।
ঐ সময়ে কলেজে নিম্ন-শ্রেণীর বালকগণকে একঘণ্টা কাল ভূগোল ও অঙ্ক শিক্ষা দেওয়া হইত, আর উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রগণকেও একঘণ্টা কাল আইন শিক্ষা দেওয়া হইত। ঐ বিষয় শিক্ষা দিবার জন্য বাবু নবগোপাল চক্রবর্তী মহাশয় নিযুক্ত হইয়াছিলেন। দাদা, তৃতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় দর্শনশাস্ত্রে সর্ব্বপ্রধান হইয়াছিলেন, তজ্জন্য ন্যায়ে ১০০৲ টাকা, কবিতা-রচনায় ১০০৲ টাকা, ক্লাসের মধ্যে হস্তাক্ষর সর্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়াছিল বলিয়া লেখার পুরস্কার ৮৲ টাকা, আইনের পরীক্ষায় সর্ব্বপ্রধান হইয়াছিলেন বলিয়া ২৫৲ টাকা, একুনে ২৩৩৲ টাকা পারিতোষিক পাইয়াছিলেন। পরে পিতৃদেব তীর্থপর্য্যটন করিয়া জলপথে কলিকাতায় সমুপস্থিত হইলে, পুরস্কারের সমস্ত টাকা পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন।
কাব্যশাস্ত্রে অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়, ন্যায় ও স্মৃতির শ্রেণীর ছাত্রদিগকে মধ্যে মধ্যে কবিতা রচনা করিতে দিতেন। অনেকেই তাহার সমক্ষে বসিয়া কবিতা রচনা করিতেন; কিন্তু অগ্রজ মহাশয় তদনুসারে কবিতা-রচনায় কদাচ প্রবৃত্ত হইতেন না। বার্ষিক পরীক্ষায় রচনার পারিতোষিক পাইবার পর, জয়গোপাল তর্কালঙ্কার বলিলেন, “আর আমি তোমার কোন ওজর শুনিব না। অদ্য তোমায় কবিতা-রচনা করিতেই হইবে।” এই বলিয়া, তিনি পীড়াপীড়ি করাতে, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হইলেন।
“গোপালায় নমোহস্ত মে”, এই চতুর্থ চরণ নির্দ্দিষ্ট করিয়া তর্কালঙ্কার মহাশয়, সকলকে শ্লোক-রচনায় নিযুক্ত করিলেন। দাদা, পরিহাস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! কোন গোপালের বিষয় বর্ণনা করিব? এক গোপাল আমাদের সম্মুখে উপস্থিত রহিয়াছেন; আর এক গোপাল বহুকাল পূর্ব্বে বৃন্দাবনে লীলা করিয়া অন্তৰ্হিত হইয়াছেন। এ উভয়ের মধ্যে কাহার বর্ণনা আপনকার অভিপ্রেত, স্পষ্ট করিয়া বলুন।” পূজ্যপাদ তর্কালঙ্কারমহাশয়, অগ্রজ মহাশয়ের এই কৌতুক-কার জিজ্ঞাসা-বাক্য শ্রবণ করিয়া বলিলেন, “বৃন্দাবনের গোপালের বর্ণনা কর।” অগ্রজ মহাশয় ঐ বিষয়ে পাচটি শ্লোক লিখিয়াছিলেন। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার শ্লোক পাচটি দেখিয়া পরম আহ্লাদিত হইয়াছিলেন। সেই পাঁচটি শ্লোক এই—
“যশোদানন্দকন্দায় নীলোৎপলদলশ্রিয়ে।
নন্দগোপালাবালায় গোপালায় নমোহস্তু মে॥ ১॥
ধেনুরক্ষণদীক্ষায় কালিন্দীকূলচারিণে।
বেণুবাদনশীলায় গোপালায় নমোহস্তু মে॥ ২॥
ধৃতপীতদুকূলায় বনমালাবিলাসিনে।
গোপস্ত্রীপ্রেমলোলায় গোপালায় নমোহস্ত মে॥ ৩॥
বৃষ্ণিবংশাবতংসায় কংসধ্বংসবিধায়িনে।
দৈতেয়কুলকালায় গোপালায় নমোহস্তু মে॥ ৪॥
নবনীতৈকচৌরায় চতুৰ্বর্গৈকদায়িনে।
জগদ্ভাণ্ডকুলালায় গোপালায় নমোহস্তু মে॥ ৫॥
অগ্রজ চারি বৎসর দর্শনশাস্ত্রের শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিয়া ষড়দর্শনে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয়, মধ্যে মধ্যে বলিতেন, “ঈশ্বরের ন্যায় বুদ্ধিমান ছাত্র আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই। ইহাকে পড়াইবার জন্য দর্শনশাস্ত্রে আমায় বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিতে হইয়াছিল; তজ্জন্য দর্শনশাস্ত্রে যে আমার বিশেষরূপ অধিকার জন্মিয়াছিল, তাঁহার সন্দেহ নাই। পড়াইবার সময় এরূপ বোধ হইত, যেন কতকাল পূর্ব্বে ঈশ্বরের ঐ সকল শাস্ত্রে বিশিষ্টরূপ অধিকার ছিল। নচেৎ চারি বৎসরের মধ্যে দর্শনশাস্ত্রে এরূপ কাহারও অধিকার হইতে পারে না।”
ঐ সময় বড়বাজারের বাবু জগদ্দুর্লভ সিংহের যে বাটীতে আমাদের বাসা ছিল, তাঁহার অবস্থা অত্যন্ত হীন হওয়ায়, ঐ বাটীর সদরের সমস্ত গৃহ তনসুকদাস হিন্দুস্থানীকে ভাড়া বিলি করা হইয়াছিল। অন্তঃপুরস্থ নিম্ন-গৃহে, সিংহবাবু আমাদের বাসা অবধারিত করিয়া দেন। নিম্ন-গৃহে অবস্থিতি-প্রযুক্ত অগ্রজ মহাশয় পীড়িত হইলেন। চিকিৎসকগণ পিতৃদেবকে বলিলেন, “কলিকাতায় নিম্ন-গৃহে—বিশেষতঃ বড়বাজারে অবস্থিতি করা রোগীর পক্ষে কদাপি উচিত হয় না। নিম্ন-গৃহে শয়ন-প্রযুক্ত ইতঃপূর্ব্বে ইনি একবার বিষম রোগাক্রান্ত হইয়া, অনেক কষ্টে আরোগ্যলাভ করেন। তথাপি আপনারা ওরূপ গৃহ পরিত্যাগ করেন না। ওরূপ গৃহে শয়ন করিলে, নিশ্চয়ই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইবেন। রাত্রিতে সমস্ত শয্যা যেন জলসিক্ত বোধ হইয়া থাকে; অতএর যত শীঘ্র পারেন, আপনারা এই গৃহ পরিত্যাগ করুন।” এই সকল নানা কারণে বড়বাজারের বাসা পরিত্যাগপূর্ব্বক, বহুবাজারের পঞ্চাননতলায় আনন্দচন্দ্র সেনের বাটীতে বাসা স্থির হইল। সেই বাটীর মধ্যে স্বতন্ত্র গৃহে দেশস্থ বিশ্বম্ভর ঘোষ ও যশোদানন্দন ঘোষ প্রভৃতি অবস্থিতি করিতেন। দেশস্থ লোকসহ একত্র এক বাটীতে অবস্থিতি করায়, বিশেষ সুবিধা বোধ হইয়াছিল।
ইহার কিয়দ্দিবস পরে, আশ্বিন মাসে, অগ্রজ মহাশয় অসুস্থতা-নিবন্ধন দেশে প্রস্থান করেন। মধুসূদন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজের এসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি ও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সেরেস্তাদায় পণ্ডিত অর্থাৎ প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন। কার্ত্তিক মাসে তর্কালঙ্কারের মৃত্যু হইলে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ঐ পদ প্রাপ্ত্যভিলাষে অনেকেই মার্শেল সাহেবের নিকট আবেদন করিতে লাগিলেন। বহুবাজারের মলঙ্গা-নিবাসী বাবু কালিদাস দত্ত মহাশয়, অপর এক পণ্ডিতকে ঐ পদ দেওয়াইবার আশয়ে, মার্শেল সাহেবকে অনুরোধ করিতে যান। সাহেব বলেন, “ঈশ্বরচন্দ্র নামে সংস্কৃত-কলেজের এক ছাত্র আছে, তাহাকে এই কর্ম্ম দিবার মানস করিয়াছি। আমি যৎকালে সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষতা-কার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম, সেই সময় হইতে বিশিষ্টরূপ অবগত আছি যে, ঈশ্বর অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষরূপ বুৎপন্ন।” সাহেবের প্রমুখাৎ ইহা শ্রবণ করিয়া, কালিদাস বাৰু বলেন, “তিনিও আমার আত্মীয় লোক, তিনি এ পদ পাইলে, আমি পরম আহ্লাদিত হইব।” এই বলিয়া কালিদাস বাবু প্রস্থান করেন। অনন্তর, মার্শেল সাহেব, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননকে ডাকাইয়া বলেন, “তোমার ক্লাসের ছাত্র ঈশ্বর কোথায়? আমি তাহাকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের কর্ম্ম দিব মানস করিয়াছি। কিন্তু ঈশ্বর নিতান্ত ছেলেমানুষ। গবর্ণমেণ্ট ছেলেমানুষ দেখিলে, এ পদ তাহাকে দেন কি না সন্দেহ।” ইহা শুনিয়া তর্কপঞ্চানন মহাশয় বলেন, “ঈশ্বর, ২২ বৎসর বয়সে সংস্কৃত-কলেজের ল-কমিটির পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হইবার পর, এক বৎসর বেদান্ত-শাস্ত্রের শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিয়াছে, তৎপরে দর্শন-শ্রেণীতে প্রায় চারি বৎসর সমগ্র দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছে। অতএব ঈশ্বরের বয়স এক্ষণে ২৭ বৎসর অতীত হইয়াছে।” সুতরাং সাহেব আর কম বয়সের আপত্তি করিতে পারিলেন না। নচেৎ কম বয়সে এ পদ পাইবার কোন আশা ছিল না। সাহেব, যৎকালে সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষ-পদে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় হইতেই অগ্রজের প্রতি তাঁহার বিশেষ লক্ষ্য ছিল। তজ্জন্য তিনি বহুবাজার মলঙ্গা-নিবাসী বাবু রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয় দ্বারা আমাদের বাসায় ঐ সংবাদ পাঠাইয়াছিলেন। ঐ সময়ে অগ্রজ দেশে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পিতৃদেব, রাজেন্দ্রবাবুর প্রমুখাৎ এ সংবাদ-প্রাপ্তিমাত্রেই দেশে গমনপূর্ব্বক অগ্রজকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় পঁহুছিলেন। পরদিন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদপ্রাপ্ত্যভিলাষে, মার্শেল সাহেবের নিকট আবেদন-পত্র প্রেরিত হইল এবং গবর্ণমেণ্ট, মার্শেল সাহেবের রিপোটে সম্মতি দান করিলেন।