চাকরি।
ইং ১৮৪১ খৃঃ অব্দের ডিসেম্বর মাসে অগ্রজ মহাশয়, মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হইলেন। সিবিলিয়ানগণ বিলাত হইতে কলিকাতায় আসিয়া, প্রথমতঃ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাঙ্গালা, হিন্দী প্রভৃতি শিক্ষা করিয়া পরীক্ষোত্তীর্ণ হইলে, জেলায় জেলায় বিচার-কার্য্যে নিযুক্ত হইতেন। যিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে না পারিতেন, তিনি পুনর্ব্বার পরীক্ষা দিতেন, তাহাতেও উত্তীর্ণ হইতে না পারিলে, স্বদেশে ফিরিয়া যাইতে হইত। সিবিলিয়ানদের মাসিক পরীক্ষার কাগজ অগ্রজকেই সংশোধন করিতে হইত। অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব, যখন সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, সেই সময়ে দাদাকে অসাধারণ-ধীশক্তি-সম্পন্ন এবং ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার-শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত বলিয়া বিশিষ্টরূপ পরিচয় পাইয়াছিলেন; তজ্জন্য অগ্রজের নিকট মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ, রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, শকুন্তলা, উত্তরচরিত, বিক্রমোর্ব্বশী প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ সকল অধ্যয়ন করিতে প্রবৃত্ত হন। তৎকালে অগ্রজ সামান্যরূপ ইংরাজী জানিতেন। একারণ, মার্শেল সাহেব বলেন, “ঈশ্বরচন্দ্র! তোমাকে রীতিমত ইংরাজী ও হিন্দীভাষা শিখিতে হইবে। যেহেতু, মাসে মাসে সিবিলিয়ান-বিদ্যার্থী ছাত্রদের পরীক্ষার কাগজ দেখিয়া, দোষগুণ বিবেচনা করিতে হইবে।” সুতরাং অগ্রজ মহাশয় কয়েক মাস প্রাতে নয়টা পর্য্যন্ত, এক হিন্দুস্থানী পণ্ডিতকে মাসিক ১০৲ টাকা বেতন দিয়া, হিন্দীভাষা শিক্ষা করেন। তাহাতে হিন্দী পরীক্ষার কার্য্য তাঁহার দ্বারা সুচারুরূপে নির্ব্বাহ হইতে লাগিল।
তৎকালে তালতলানিবাসী বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় হেয়ার সাহেবের স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রায়ই বৈকালে ২/৩ ঘণ্টা আমাদের বাসায় অবস্থিতি করিয়া, নানা বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক ও হিতগর্ব্ভ গল্প করিতেন। ঐ সময় দুর্গাচরণ বাবুর মত সুবিজ্ঞ লোক আতি বিরল ছিল। তিনি অগ্রজের পরম বন্ধু ছিলেন। প্রথমতঃ দুর্গাচরণ বাবুই স্বয়ং দাদাকে ইংরাজী-ভাষা শিখাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিছু দিন পরে, তাঁহার ছাত্র বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের উপর ইংরাজী পড়াইবার ভারার্পণ করেন। নীলমাধব বাবু সামান্য দিন শিক্ষা দেন। অনন্তর তৎকালীন হিন্দু-কলেজের ছাত্র, বাবু রাজনারায়ণ গুপ্তকে মাসিক ১৫৲ টাকা বেতন দিয়া, অগ্রজ মহাশয় প্রত্যহ প্রাতঃকাল হইতে বেলা নয়টা পর্য্যন্ত ইংরাজী-ভাষা অধ্যয়ন করিতেন। এইরূপে কিছু দিন অতীত হইলে, সিবিলিয়ানগণের পরীক্ষার কাগজ দেখিতে যেরূপ ইংরাজী ভাষা অবগত হওয়া আবশ্যক, সেইরূপ শিক্ষা হইল।
পিতৃদেব তৎকাল পর্য্যন্ত সামান্য বেতনের কর্ম্ম করিতেন। অগ্রজ মহাশয় অনেক অনুনয় ও বিনয় করিয়া, পিতৃদেবকে কর্ম্ম হইতে অবসর লইয়া দেশে অবস্থিতি করিবার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু, পিতৃদেব কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া পুত্রের অধীনে থাকিয়া সংসারের ও অপর পুত্রগণের লেখাপড়ার ব্যয় নির্ব্বাহ করায়, অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন। অনেক বাদানুবাদের পর জ্যেষ্ঠাগ্রাজের সবিশেষ অনুরোধে সন্মত হইলেন। কর্ম্ম-পরিত্যাগ-সময়ে তাঁহার প্রভু, পিতৃদেবকে উপদেশ দেন যে, “ছেলেমানুষের কথায় উপস্থিত কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া, পরাধীন হওয়া উচিত নয়। যখন অসমর্থ হইবে, তখন ঐ ছেলে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া যদি তোমার সাহায্য না করে, তখন কি পুনরায় চাকরি করিতে আসিবে?” পিতৃদেব তাঁহাকে বলেন যে, “আমার পুত্র সাক্ষাৎ যুধিষ্ঠিরের মত ধর্ম্মশীল এবং আমায় দেবতুল্য-জ্ঞানে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। তাহার কথা অবহেলন করিতে পারিব না। যদি তাহাকে অধার্ম্মিক ও দুশ্চরিত্র জানিতাম, তাহা হইলে কখনই কর্ম্ম ত্যাগ করিতাম না।” তদবধি অগ্রজ মাসিক-ব্যয়-নির্ব্বাহার্থ, পিতৃদেবকে প্রতি মাসের প্রথমেই ২০৲ টাকা প্রেরণ করিতেন। অবশিষ্ট ৩০৲ টাকায় কষ্টেসৃষ্টে বাসার ব্যয় নির্ব্বাহ করিতেন। তৎকালে বাসায় আমরা তিন সহোদর, দুই জন পিতৃব্যপুত্র, দুই জন পিতৃস্বস্রেয়, এক জন মাতৃস্বশ্রেয় ও পৈত্রিক অনুগত ভূত্য শ্রীরাম নাপিত, এই নয় জন অবস্থিতি করিতাম। বাসায় পাচক-ব্রাহ্মণ ছিল না, সকলকেই পর্য্যায়ক্রমে পাকাদিকার্য্য সম্পন্ন করিতে হইত। অগ্রজও পর্য্যায়ক্রমে পাকাদিকার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। যে বাটীতে বাসা ছিল, তাহাতে সকলের স্থান সংকুলান না হওয়ায়, বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়দের পঞ্চাননতলাস্থ বৈঠকখানা-বাটীতে বাসা হইল।
ঐ বৎসর ভাদ্রমাসে মার্শেল সাহেব, সংস্কৃত-কলেজের জুনিয়র ও সিনিয়র ডিপার্টমেণ্টের এস্কলার্শিপের পরীক্ষক নিযুক্ত হন। এই বৎসর হইতে এই নূতন পরীক্ষায় এডুকেশন কোউন্সেল হইতে নূতন প্রথার আদেশ হয়। সাহেব, স্বয়ং ভালরূপ সংস্কৃত জানিতেন না; সুতরাং তাঁহার পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রকেই সমস্ত প্রশ্ন প্রস্তুত করিতে হইত। কাব্য ও অলঙ্কারের ক্লাস জুনিয়র ছিল; ঐ দুই ক্লাসের জন্য কাব্য, বাঙ্গালা হইতে সংস্কৃত ও সংস্কৃত হইতে বাঙ্গালা অনুবাদ, ব্যাকরণ ও লীলাবতীর প্রশ্ন প্রস্তুত করিতেন। সিনিয়ার ক্লাসের জন্য দর্শন, বেদান্ত, স্মৃতি, সংস্কৃত গদ্য ও পদ্য রচনা, বীজগণিতের অঙ্ক প্রভৃতির প্রশ্ন প্রস্তুত করিয়া, গোপনে মুদ্রিত করাইতেন; তদ্ভিন্ন কোন কোন বিষয়ের প্রশ্ন স্বহস্তেও লিখিয়া দিতেন। পরীক্ষার কার্য্যপ্রণালী দেখিয়া, সকলেই মার্শেল সাহেব ও অগ্রজের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন। ইহার পূর্ব্ববৎসর উপযুক্ত পরীক্ষকের অভাবে সকলই অসঙ্গত প্রশ্ন হইয়াছিল; তজ্জন্য কোন ছাত্রই এস্কলার্শিপ প্রাপ্ত হন নাই।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে নিযুক্ত হইবার পর, ইংরাজী-ভাষায় কৃতবিদ্য অনেক লোক অর্থাৎ বাবু শ্যামাচরণ সরকার, বাবু রামরতন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি অগ্রজের নিকট সংস্কৃত অধ্যয়ন-মানসে বাসায় আসিতেন। তৎকালে উপক্রমণিকা ব্যাকরণের সৃষ্টি হয় নাই। সংস্কৃত-ভাষা শিখিতে হইলে, অগ্রে মুগ্ধবোধ বা অন্য কোন ব্যাকরণ পড়িতে হইত; সুতরাং অগ্রেই মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পড়াইতেন। ব্যাকরণ শিখাইবার এমন কৌশল জানিতেন যে, এক বৎসরের মধ্যেই অনেকে ব্যাকরণ সমাপ্ত করিয়া, কাব্য অধ্যয়ন করিতে সক্ষম হইতেন। একারণ, ক্রমশঃ প্রাতে ও সায়ংকালে অনেক বিষয়ী-লোক, সংস্কৃত শিখিবার মানসে আমাদের বাসায় উপস্থিত হইয়া, প্রত্যহ সংস্কৃত শিক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। ক্রমশঃ বাসায় ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। নিজে ইংরাজী পড়িতেন, তথাপি অপর যে সমস্ত লোক সংস্কৃত শিক্ষা করিতে আসিতেন, তাহদের প্রতি কখনও ক্ষণকালের জন্য বিরক্তিভাব প্রকাশ করিতেন না। তিনি বাল্যকাল হইতে জ্ঞানদানকার্য্যে কখন পরামুখ ছিলেন না। যে সকল লোক সর্ব্বদা বাসায় আসিতেন, তাঁহারা পরস্পর মনে করিতেন যে, ঈশ্বরের আমরাই পরম বন্ধু ও আত্মীয়। কিন্তু আমরা দেখিতাম, কি আত্মীয় কি শক্র সকলের প্রতি তিনি সমভাব প্রকাশ করিতেন।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে নিযুক্ত হইবার অব্যবহিত পরে, তত্ত্ববোধিনী সভার বিখ্যাত লেখক বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত, প্রত্যহ সন্ধ্যার পুর উক্ত সভায় যে সকল প্রবন্ধ প্রচার হইবে, তাহা অগ্রজ মহাশয়ের নিকট পাঠ করিয়া শুনাইতেন। অগ্রজ মহাশয়ের অভিপ্রায় অনুসারে অনেক স্থল পরিবর্ত্তিত ও পরিত্যক্ত হইত। তাঁহার রচিত বাহ্য-বস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ-বিচার নামক পুস্তক যৎকালে ইংরাজী হইতে বঙ্গভাষায় অনুবাদিত হয়, তৎকালে তিনি ঐ পুস্তক অগ্রজ মহাশয়ের নিকট আদ্যোপান্ত দেখাইয়া লইয়াছিলেন, এবং যে সকল দুরূহ শব্দ বাঙ্গালায় লিখিতে অক্ষম হইয়াছিলেন, তাহা নূতন প্রণালীতে তাঁহার দ্বারা রচনা করাইয়া লইয়াছিলেন। ফলতঃ বাহ-বস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ-বিচার পুস্তক যে, সকলের আদরের বস্তু হইয়াছে, তাহা অগ্রজ মহাশয়ের সংশোধন-প্রণালীর ফল, ইহা সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। তিনি আদ্যোপান্ত সংশোধন করিয়া না দিলে, অক্ষয়বাবুর ঐ পুস্তক সহজে সাধারণের বোধগম্য হইত না। এতদ্ব্যতীত অক্ষয়বাবুর অন্যান্য কয়েকখানি পুস্তকও তিনি দেখিয়া দিয়াছিলেন। অগ্রজ মহাশয়, সর্ব্বাগ্রে তত্ত্ববোধিনীতে মহাভারতের বাঙ্গালা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তৎকালে তত্ত্ববোধিনীর সভ্যগণের অনুরোধবশবর্ত্তী হইয়া, তিনি তথাকার তত্ত্বাবধায়ক হইয়াছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পরেই কোন বিশেষ কারণে, তত্ত্ববোধিনীর সংস্রব একবারে পরিত্যাগ করেন।
আমাদের তৎকালীন বাসার সম্মুখে ঁহৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটী ছিল। ইহাঁর পৌত্র বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। তিনি অল্পবয়সেই ইংরাজী পড়া পরিত্যাগপূর্ব্বক নিরর্থক বাটীতে বসিয়া থাকিতেন। তিনি নিত্যই দেখিতেন যে, অনেকে ইংরাজী শিক্ষা করিয়া, বিষয়-কর্ম্মে লিপ্ত থাকিয়াও, অগ্রজের নিকট সংস্কৃত শিক্ষা করিতেছেন; এজন্য তিনিও, তাঁহার নিকট মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ শিক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হন। ইতিপূর্ব্বে রাজকৃষ্ণ বাবু কিছুমাত্র ব্যাকরণ অবগত ছিলেন না। তিনি দিবারাত্র পরিশ্রম-সহকারে অগ্রজের নিকট অধ্যয়ন করিয়া, ছয় মাসের মধ্যে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ সমাপ্ত করেন। এজন্য সংস্কৃত-কলেজের পণ্ডিত ও ছাত্রগণ আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিয়াছিলেন যে, ঈশ্বর কি প্রণালী অবলম্বন করিয়া, এত শীঘ্র ব্যাকরণ সমাপ্ত করাইলেন। পণ্ডিত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, কলেজের অধ্যয়ন সমাপ্ত করিয়া চাকরী না হওয়া প্রযুক্ত, অগ্রজ মহাশয়ের বাসায় মধ্যে মধ্যে অবস্থিতি করিতেন। দাদাও তাঁহাকে সহোদরের ন্যায় স্নেহ করিতেন। ঐ সময়ে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সিবিল পড়াইবার জন্য ৪০৲ টাকা বেতনের একটী পণ্ডিতের পদ শূন্য হইলে, অগ্রজ মহাশয় মার্শেল সাহেবকে বলিয়া, তাঁহার বাল্যকালের পরমবন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিয়া দেন। ইতিপূর্ব্বে মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কলিকাতায় বাঙ্গালা পাঠশালায় মাসিক ১৫৲ টাকা বেতনের শিক্ষকতা-কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন; তৎপরে বারাসতে মাসিক ২০৲ টাকা বেতনের কর্ম্ম করিতেন। ইহার কিছু দিন পরে মাদ্রাসা কলেজের ৪০৲ টাকা বেতনের একটী পণ্ডিতের পদ শূন্য হইলে, অগ্রজ মহাশয়, সাহেবকে অনুরোধ করিয়া, তাঁহার সহাধ্যায়ী মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশকে ঐ পদে নিযুক্ত করিয়া দেন।
এই সময়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ বাহাদুর ভারতবর্ষের গবর্ণর জেনেরেলের পদ প্রাপ্ত হইয়া এদেশে আইসেন। উক্ত মহাত্মা এক সময় কলেজ পরিদর্শন-জন্য আগমন করিয়া, কথা-প্রসঙ্গে অবগত হইলেন যে, সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রগণ ইংরাজী অধ্যয়ন করে না; একারণ তাহারা ভাল কর্ম্ম পায় না। প্রতি জেলায় যে একজন করিয়া জজপণ্ডিত ছিল, তাহাও সম্প্রতি উঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে; তজ্জন্য সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রসংখ্যা অতি অল্প হইয়াছে। সাহেব, সংস্কৃত কলেজের বিদ্যার্থিগণের উৎসাহ-বৰ্দ্ধনার্থ বঙ্গদেশে একশত একটী বাঙ্গালা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। গবর্ণমেণ্ট, সকল বিদ্যালয়ের পণ্ডিতের পরীক্ষার ভার, মার্শেল সাহেবের প্রতি অৰ্পণ করেন। অগ্রজ মহাশয় উক্ত সাহেবের পণ্ডিত ছিলেন; সাহেব, বাঙ্গালা ভাষা ভাল জানিতেন না, তজ্জন্য দাদাই উহাঁদের পরীক্ষা করিয়া, পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত করিয়া দিতেন। তৎকালে অন্য কোন বাঙ্গালা পুস্তক ছিল না। পুরুষ-পরীক্ষা, জ্ঞান-প্রদীপ, হিতোপদেশের বাঙ্গালা, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি পুস্তকের পরীক্ষা হইত। লীলাবতীর অঙ্ক ও ভূগোল পরীক্ষায় যাহারা উত্তীর্ণ হইবে, সেই সকল পণ্ডিতকেই নিযুক্ত করা আবশ্যক; একারণ, তিনি তৎকালে ভাল ভাল পণ্ডিত নির্ব্বাচন করিয়া দিতেন। তজ্জন্য কত পণ্ডিত যে বাসায় আসিতেন, তাহা বলা বাহুল্য। সংস্কৃত-কলেজে অনেক মহামান্য পণ্ডিত থাকাতেও, সাহেব তাঁহাকে যে পরীক্ষক নির্বাচন করিয়াছিলেন, ইহাতে সাধারণ লোকে সাহেবের যথেষ্ট প্রশংসা করিয়াছিলেন। কিন্তু পণ্ডিতগণের মধ্যে অনেকে মনে মনে ঈর্ষ্যা করিয়া বলিতেন যে, আমরা বিদ্যমান থাকিতে, সাহেব, ঈশ্বরকে বহুসংখ্যক পণ্ডিতের পরীক্ষক নিযুক্ত করিলেন। অগ্রজ মহাশয় নিরপেক্ষভাবে লোক-নির্ব্বাচন করায়, তাঁহার বিশিষ্টরূপ সুখ্যাতি হইয়াছিল। অদ্যাপি হার্ডিঞ্জ বাহাদুরের কীর্ত্তিস্তম্ভস্বরূপ বাঙ্গালা স্কুল, কোন কোন স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়।
সংস্কৃত-কলেজের ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশয়, তাঁহার পুত্র গোবিন্দচন্দ্র শিরোমণি অপেক্ষা অগ্রজ মহাশয়কে ভাল বাসিতেন। যখন যাহা আবশ্যক হইত, তিনি তাহা দাদাকেই বলিতেন। দাদা শ্রবণমাত্রেই তাঁহার আজ্ঞানুবর্ত্তী হইয়া, সে কার্য্য সম্পন্ন করিতেন। অনুমান ইং ১৮৪৩ সালে জ্যৈষ্ঠমাসের শেষে, গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশয় বিষম বিসূচিকারোগাক্রান্ত হইলেন এবং অবিলম্বে তাঁহার শৌচ-প্রস্রাব বন্ধ হইয়া অত্যন্ত যাতনা হইতে লাগিল। অগত্যা তাঁহার প্রিয়ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্রকে আহ্বান করিলেন। দাদা, শ্রবণমাত্রই অত্যন্ত বিষন্নবদনে দ্রুতবেগে তৎকালীয় বিখ্যাত ডাক্তার বাবু নবীনচন্দ্র মিত্র ও তালতলানিবাসী ডাক্তার বাবু, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়দের বাটী যাইয়া, তাঁহাদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া, তর্কবাগীশ মহাশয়ের বাটীতে গমন করিলেন। তিন দিবস অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া, তিনি পীড়িত পণ্ডিতের চিকিৎসা করাইলেন। তাহাতে তর্কবাগীশ প্রথমতঃ আরোগ্যলাভ করেন, কিন্তু পরে হঠাৎ এক দিবস তাঁহার প্রাণত্যাগ হয়। কয়েক দিবস অগ্রজ মহাশয় স্বহস্তে তাঁহার মলমূত্রাদি পরিষ্কার করেন। চিকিৎসকগণ, কয়েক দিবসের ভিজিটের টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করেন নাই। উক্ত কয়েক দিবসের ঔষধের মূল্যও অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং প্রদান করিয়াছিলেন। বাল্যকালের শিক্ষকের প্রতি তাঁহার এরূপ শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখিয়া, সংস্কৃত-কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্রগণ তাঁহার যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিলেন এবং সকলে একবাক্যে বলিলেন যে, “তর্কবাগীশের পুত্র ও কন্যা এ সময়ে নিকটে উপস্থিত নাই; অনেক ছাত্র বিদ্যমান রহিয়াছে বটে, কিন্তু কেহই ঈশ্বরের মত ভক্তিপূর্ব্বক স্বহস্তে বিষ্ঠা পরিষ্কার করিতে পারে নাই।” অতঃপর অপর যে কোন আত্মীয় বন্ধুর পীড়া হইত, তিনি বিনা ভিজিটে ডাক্তার পাইবার জন্য অগ্রজকে জানাইতেন। তিনিও কি আত্মীয় কি অনাত্মীয় কাহারও পীড়ার সংবাদ পাইলে, ডাক্তার দুর্গাচরণ বাবুকে লইয়া, সেই রোগীর ভবনে যাইতেন। যে রোগীর কোন অভিভাবক নাই জানিতে পারিতেন, তাহার বাটীতে যাইয়া সকল অভাব পূরণ করিতেন। তিনি তৎকালে বাসাস্থিত ভ্রাতা এবং অন্যান্য আত্মীয়াদিগকেও ঐ সকল রোগীর শুশ্রূষার জন্য পাঠাইতেন; একারণ, অনেকেই বলিত, ঈশ্বরের মত দয়ালু ও ধর্ম্মশীল লোক সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
ইহার কিছু দিন পরে, দর্শনশাস্ত্রাধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের নারিকেলডাঙ্গাস্থ ভবনে, তাঁহার ভাগিনেয় ঈশানচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ওলাউঠা হয়। তর্কপঞ্চানন মহাশয়, ভয়ে ভাগিনেয়কে বাটীর বাহিরে সামান্য একস্থানে রাখিয়াছিলেন, চিকিৎসা করান হয় নাই, মৃত্যুর আশঙ্কায় শয্যা পর্য্যন্ত দেন নাই; রোগীকে দরমার উপর শয়ান রাখা হইয়াছিল। অগ্রজ মহাশয়, এই সংবাদ পাইয়া, ডাক্তার বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, নারিকেলডাঙ্গায় তর্কপঞ্চাননের ভবনে উপস্থিত হইয়া, চিকিৎসা করাইতে প্রবৃত্ত হন। ঐ রাত্রিতেই মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে বহুবাজারে পাঠাইয়া, বালিশ, তোষক, মাদুর প্রভৃতি আনাইয়াছিলেন। নিশীথসময়ে মুটে না পাওয়ায়, মধ্যনাগ্রজ দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন স্বয়ং প্রায় দেড়ক্রোশ পথ উক্ত শয্যাদি মাথায় করিয়া লইয়া যান। অতঃপর রোগীকে ভাল শয্যায় শয়ন করান হইল, এবং রোগীর গাত্রের মলমূত্র অগ্রজ মহাশয় স্বহস্তে পরিষ্কার করিয়া দিলেন। তৎপরে রোগী সম্পূর্ণরূপ আরোগ্য লাভ করিলে, তিনি বাসায় গমন করিলেন। তর্কপঞ্চাননের ভাগিনেয় বিষম বিসূচিকা-রোগাক্রান্ত হইলেন; কিন্তু তর্কপঞ্চানন, তাঁহার শিশুসন্তানদিগকে ভয়ে রোগীর ত্রিসীমায় আগমন করিতে দেন নাই। অগ্রজ মহাশয়, বহুবাজার হইতে ডাক্তার, ঔষধ ও শয্যা-সাহিত তথায় যাইয়া, চিকিৎসা করাইলেন। তদ্দর্শনে অনেকেই আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন। ইহার কিছুদিন পরে সংস্কৃত-কলেজের তৎকালীন সর্বপ্রধান ছাত্র প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্যের মধ্যম ও কনিষ্ঠ সহোদর বিসূচিকারোগগ্রস্ত হন। অগ্রজ মহাশয়, এই সংবাদ-প্রাপ্তিমাত্র দুর্গাচরণ বাবু প্রভৃতি ডাক্তারগণকে লইয়া চিকিৎসা করান। সুচিকিৎসায় প্রিয়নাথের মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু আরোগ্যলাভ করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত তাঁহার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়।
ঐ সময় বহুবাজারস্থ বাসাবাটীর পার্শ্বে মোক্তার বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের এক ভৃত্যের ওলাউঠা হয়। মোক্তার বাবু, চাকরের হাত ধরিয়া উপর হইতে নামাইয়া পথে শোয়াইয়া রাখেন। অগ্রজ, তাহাকে ভূমিতে পতিত দেখিয়া, অনেক দুঃখ-প্রকাশ-পূর্ব্বক নিজ বাসায় লইয়া গিয়া, আপন শয্যায় শয়ন করাইলেন, এবং অবিলম্বে ডাক্তার আনাইয়া চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন। পাঁচ সাত দিন চিকিৎসা ও শুশ্রূষায় রোগী সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভ করিল।
ঐ সময় অগ্রজ মহাশয়, অনেক অনাথ ও পীড়িত লোকের চিকিৎসাদিকার্য্যে বিস্তর অর্থব্যয় করিয়াছিলেন। অগ্রজের এরূপ দিয়া দেখিয়া সকলেই বলিত, ইনি মানুষ নহেন, সাক্ষাৎ দেবতা। এইরূপ কত রোগীর প্রতি যে অগ্রজ দয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন, বিস্তৃতিভয়ে তাহা লিখিতে ক্ষান্ত রহিলাম।
এই সময় সংস্কৃত-কলেজের ব্যাকরণের প্রথম-শ্রেণীর পণ্ডিত হরনাথ তর্কভূষণ মাসিক ৯০৲ টাকা ও তৃতীয় শ্রেণীর পণ্ডিত গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে কর্ম্ম করিতেন। ইহাঁদের উভয়ের মৃত্যু হইলে, এডুকেশন কৌনসেলের সেক্রেটারি ডাক্তার ময়েট্ সাহেব, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেবের নিকট যাইয়া বলেন যে, উক্ত কার্য্য নির্ব্বাহের জন্য উপযুক্ত, দুইজন পণ্ডিত মনোনীত করিয়া দেন। তাহাতে মার্শেল সাহেব অগ্রজকে ব্যাকরণের প্রথম শ্রেণীর কর্ম্মে নিযুক্ত হইবার এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নিমিত্ত একটী লোক মনোনীত করিয়া দিবার জন্য আদেশ করেন।
ইহা শ্রবণ করিয়া অগ্রজ উত্তর করিলেন, “মহাশয়! আমি টাকার প্রত্যাশা করি না আপনার অনুগ্রহ থাকিলেই আমি কৃতার্থ হইব। আর আপনার নিকট থাকিলে, আমি অনেক নূতন নূতন উপদেশ পাইব। আমি দুইটী উপযুক্ত শিক্ষক মনোনীত করিয়া আপনাকে দিব।” এই কথা বলিয়া তারানাথ তর্কবাচস্পতির নাম ব্যক্ত করিলেন। সাহেব বলিলেন, “তারানাথ এখন কোথায় অবস্থিতি করেন?” অগ্রজ বলিলেন যে, “তিনি পূর্ব্বে সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন করিয়া, সর্ব্বোৎকৃষ্ট প্রশংসাপত্র পাইয়া, কয়েক বৎসর কাশীধামে অব-স্থানপূর্ব্বক, পাণিনি ব্যাকরণ ও বেদান্ত প্রভৃতি অধ্যয়ন করেন। সম্প্রতি অম্বিকাকালনায় চতুম্পাঠী স্থাপন করিয়া, বহুসংখ্যক ছাত্রকে শিক্ষা দিতেছেন।” এই কথা শুনিয়া; সাহেব বলেন, “তাহার চাকরি করিতে ইচ্ছা আছে কি না, অগ্রে জানা আবশ্যক।” ঐ দিবস অগ্রজ বাসায় আসিয়া, মাতৃঘসার পুত্র সর্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, হাটখোলার ঘাটে গঙ্গা পার হইয়া, পদব্রজে কানা অভিমুখে যাত্রা, করিলেন। পরদিন বৈকালে তথায় উপস্থিত হইলে, বাচস্পতি ও তাঁহার পিতা অকস্মাৎ অগ্রজকে অবলোকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। অনন্তর বাচস্পতি মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “এরূপ বেশে পদব্রজে এত পথ আসিবার কারণ কি?” অগ্রজ বলিলেন, “আপনি কলেজে অধ্যয়ন করিয়া যে প্রশংসাপত্র পাইয়াছেন, তাহা আমায় প্রদান করুন। আমি আপনার সার্টিফিকেট ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেবকে দেখাইব। তিনি আপনাকে মাসিক ৯০ টাকা বেতনে সংস্কৃত-কলেজে ব্যাকরণের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষকতাকার্যের জন্য গবর্ণমেণ্টে লিখিবেন।” ইহা শুনিয়া বাচস্পতি মহাশয় ও তাঁহার পিতা পরম আলাদিত হইলেন, এবং প্রশংসাপত্রগুলি অগ্রজের হন্তে সমৰ্পণ করিলেন। প্রায় ত্রিশ ক্রোশ পথ পদব্রজে গমন করিয়া, সৰ্বেশ্বরের চরণদ্বয় স্ফীত ও তাহাতে বেদনা হইয়াছিল; অতঃপর আর চলিতে পারিবেন না বিবেচনায়, নৌকাররাহণে কলিকাতা যাত্রা করিলেন। পর দিবস কলিকাতায় উপস্থিত হইয়া, সমস্ত বিবরণ বলিয়া, বাচস্পতির সার্টিফিকেট ও আবেদনপত্র সাহেবকে প্রদান করিলেন।
মার্শেল সাহেব রিপোর্ট করিলে পর, গবর্ণমেণ্ট, বাচস্পতি মহাশয়কে ৯০ টাকা বেতনের পদে নিযুক্ত করিলেন, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যাকরণের পণ্ডিতের পদ ও পুস্তকাধ্যক্ষের কর্ম্ম খালি হওয়াতে, সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয়, মফঃস্বলের চতুস্পাঠীর পণ্ডিতগণকে ঐ কর্ম্ম দিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। কিন্তু ময়েট সাহেবকে জিজ্ঞাসা করাতে, মার্শেল সাহেব তাঁহার পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের পরামর্শানুসারে ময়েটু সাহেবকে বলিলেন, “মফঃস্বলস্থ টোলের পণ্ডিতের দ্বারা কলেজের ছাত্রদিগের অধ্যাপনাকার্য্য উত্তমরূপে নির্ব্বাহ হইবে না। অতএব কলেজেরই পরীক্ষাত্তীর্ণ পূর্ব্বতন ছাত্রদিগকে ঐ কর্ম্ম দিলে, অধ্যাপনা-কার্য্য ভালরূপে সম্পন্ন হইবে।” তদনুসারে সেক্রেটারি মহাশয়, দুই কর্ম্মে লোক নিযুক্ত করিবার জন্য, ব্যাকরণ-বিষয়ে নূতন পরীক্ষার ব্যবস্থা করিলেন। মফঃস্বলের পণ্ডিত প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর প্রভৃতি এবং সংস্কৃত-কলেজের কয়েকজন প্রসিদ্ধ ছাত্র পরীক্ষা প্রদান করিলেন। পরীক্ষায় দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রথম ও গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন দ্বিতীয় হইলেন। তদনুসারে বিদ্যাভূষণকে ৫০ টাকা ও বিদ্যারত্নকে ৩০ টাকা বেতনে, উক্ত দুই পদে নিযুক্ত করা হইল। গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন সংস্কৃত কলেজে ফার্ষ্টগ্রেটের সিনিয়ার এসকলার্শিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। তিনি অতি উপযুক্ত লোক ছিলেন। সাহিত্য ও অলঙ্কার-শাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ অধিকার ছিল। তর্ক- বাচস্পতি মহাশয়, সংস্কৃত ভাষায় অদ্বিতীয় ‘লোক বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সভায় বিচার করিবার ইহার বিশিষ্টরূপ ক্ষমতা ছিল। একারণ, বাচস্পতি মহাশয় বাঙ্গালাদেশে বিশেষ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তর্কবাচস্পতি, বিদ্যাভূষণ ও বিদ্যারত্ন এই তিনজন উপযুক্ত লোক সংস্কৃত- কলেজে নিযুক্ত হইলেন। দাদা, সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন; একারণ কৌশল ও অনুরোধ করিয়া, তিন জন উপযুক্ত লোককে কলেজে প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়া, পরম আহলাদিত হইয়াছিলেন। মার্শেল সাহেব, মাসিক ৯০ টাকা বেতনের উক্ত পদ অগ্রজকে দিবার মানস করিয়াছিলেন; কিন্তুতিনি তাহাতে স্বীকার না পাইয়া, বাচস্পতি মহাশয়ের দেশে গিয়া, তাঁহাকে অনুরোধ করিয়া আনাইয়া, কর্মে প্রবিষ্ট করাইয়া দেন, ইহাতে বিষয়ী লোকমাত্রেই আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন। একারণ, বাচস্পতি মহাশয়ের সহিত অগ্রজের অত্যন্ত সদ্ভাব ছিল।
১৮৪২ খৃষ্টাব্দে রবার্ট কষ্ট নামক একজন সন্ত্রান্ত-বংশোদ্ভব সিবিলিয়ান, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। অগ্রজ মহাশয় সেই সময়ে ঐ কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহার সহিত আলাপ, হইলে, তিনি মধ্যে মধ্যে কলেজে আসিয়া, অগ্রজের সহিত নানা বিষয়ের আলোচনা করিতেন। তিনি বিলক্ষণ বুদ্ধিমান্ ও বিদ্বান্ ছিলেন। অগ্রজের সহিত আলাপ করিয়া, তিনি সাতিশয় সুখী হইতেন। একদিন তিনি আগ্রহ-সহকারে সবিশেষ অনুরোধ করিয়া অগ্রজকে বলিলেন, “যদি তুমি, আমার বিষয়ে সংস্কৃত-ভাষায় কবিতা রচনা করিয়া দাও, তাহা হইলে আমি অত্যন্ত আহলাদিত হইব।” তাঁহার অনুরোধের বশবর্তী হইয়া, ক্ষণকাল অপেক্ষা করিতে বলিয়া, নিম্নলিখিত শ্লোকদ্বয় তাঁহার হস্তে প্রদান করিলেন। সাহেব শ্লোক লইয়া প্রীতমনে প্রস্থান করিলেন। শ্লোকদ্বয় এই—
শ্রীমান্ রবর্টকষ্টোহদ্য বিদ্যালয়মুপাগতঃ।
সৌজন্যপূর্ণৈরালাপৈর্নিতরাং মামতোষয়ৎ॥ ১॥
স হি সদ্গুণসম্পন্ন সদাচাররতঃ সদা।
প্রসন্নবদনো নিত্যং জীবত্বব্দশতং সুখী। ২॥
কষ্ট, সাহেব সন্তুষ্ট হইয়া, অগ্রজ মহাশয়কে ২০০ শত টাকা দিতে মানস করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি তাহা না লইয়া, সাহেবকে উপদেশ দেন যে, এই টাকা কলেজে জমা করিয়া দেন; সংস্কৃত-কলেজের যে ছাত্র সংস্কৃত রচনায় ভাল পরীক্ষা দিবেন, তিনি ৫০ টাকা পারিতোষিক পাইবেন। এইরূপ ব্যবস্থা হইলে, বৎসর বৎসর পরীক্ষায় একজন করিয়া ছাত্র, কবিতা-রচনার পুরস্কার ৫০ টাকা পাইবেন। সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রেরা চারি বৎসর কষ্ট, সাহেবের পুরস্কার পাইয়াছিলেন; তৎকালে এই পুরস্কারকে কষ্ট, সাহেবের পুরস্কার বলিত। কষ্ট, সাহেব, অগ্রজকে, নির্লোভ ও উদার-হৃদয় দেখিয়া, সাহেব, যার-পর-নাই সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। কষ্ট, সাহেবের পুরস্কারপ্রাপ্তির পরীক্ষায়, অগ্রজ মহাশয় প্রথম বৎসর এই প্রশ্ন দেন যে, বিদ্যা, বুদ্ধি, সুশীলতা এই তিনের গুণবর্ণনা করিয়া এই গুণত্রয়ের মধ্যে কোনটী প্রধান, তাহা সংস্কৃত- গদ্যে লিখ। তৎকালে ঐ পরীক্ষা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সমাধা হইত। সংস্কৃত-কলেজে সিনিয়র ছাত্রবর্গের মধ্যে নীলমাধব ভট্টাচার্য্য সর্ব্বাপেক্ষা উত্তম রচনা করিয়াছিলেন; সুতরাং তিনিই ঐ কষ্ট সাহেবের ৫০ টাকা প্রাপ্ত হন। দ্বিতীয় বৎসরে সংস্কৃত পদ্য লিখিবার প্রশ্ন হয়; তাহাতে দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এই দুইজন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট হন। শ্রীশের ব্যাকরণ ভুল হইয়াছিল, কিন্তু দীনবন্ধুর ব্যাকরণ ভুল হয় নাই। দীনবন্ধু সহোদর, এজন্য লোকে যদি দুর্নাম করে, এই আশঙ্কায় শ্রীশকেই ঐ পারি-তোষিক প্রদান করিতে বাধ্য হন।
এই সময়ে, রবার্ট কষ্ট পরীক্ষোত্তীর্ণ হইয়া পঞ্জাবপ্রদেশে নিযুক্ত হন, এবং অনেক দিন কর্ম্ম করিয়া স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করেন। প্রস্থানের পূর্ব্বে একদিন অগ্রজের সহিত দেখা করিয়া, তিনি বলিলেন, “আমি স্বদেশে যাইতেছি, আর ভারতবর্ষে আসিব না, তোমার সহিত এই আমার শেষ দেখা।” কিয়ৎক্ষণ কথোপকথনের পর তিনি বলিলেন, “যদি পূর্ব্বের মত তোমার কবিতা-রচনার অভ্যাস থাকে, তাহা হইলে কল্য আমার বিষয়ে কিছু শ্লোক রচনা করিয়া পাঠাইলে, পরম আলাদিত হইব।” তদনুসারে অগ্রজ মহাশয় নিম্নলিখিত কয়েকটা কবিতা লিখিয়া, তাঁহার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন।
“দোযৈর্বিনাকৃতঃ সর্ব্বৈঃ সর্ব্বৈরাসেবিতে গুণৈঃ।
কৃতী সর্ব্বাসু বিদ্যাসু জীয়াৎ কষ্টো মহামতিঃ॥১॥
দয়াদাক্ষিণমাধুর্য্যগাভীর্য্যপ্রমুখা গুণাঃ।
নয়বর্ত্ম রতে নূনং রমন্তেহস্মিন্ নিরন্তরম্॥ ২॥
সদা সদালাপরতেনিত্যং সৎপথবর্ত্তিনঃ।
সর্ব্বলোকপ্রিয়ন্যান্য সম্পদস্ত সদা স্থির॥ ৩॥
অস্য প্রশান্তচিত্তস্য সর্ব্বত্র সমশিনঃ।
সর্ব্বধর্ম্মপ্রবীণস্য কীর্ত্তিরায়ুশ্চ বর্দ্ধতাম্॥৪॥
বিদ্যাবিবেকবিনয়াদিগুণৈরুদারৈঃ
নিঃশেষলোকপরিতোষকরশ্চিরায়।
দূরং নিরস্তখলদুর্ব্বচনাবকাশঃ
শ্রীমান্ সদা বিজয়তাং নু রবর্টকষ্টঃ॥ ৫॥”
পূর্ব্বপ্রদর্শিতরূপে সংস্কৃত-রচনা-বিষয়ে সাহস ও উৎসাহ জন্মিলে, অগ্রজ মহাশয় সময়ে সময়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, কোন কোন বিষয়ে শ্লোক রচনা করিতেন। মেঘবিষয়ে যে শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে কয়েকটী নিয়ে প্রকাশ করা গেল।
“প্রায়ঃ সহায়যোগাৎ সম্পদমধিকর্ত্তু মীশতে সর্ব্বে।
জলদাঃ প্রাবৃড়পায়ে পরিহীয়ন্তে শ্রিয়া নিতরাম্॥ ১॥
কিং নিম্নগা জলদমণ্ডলবর্জ্জিতেন
তোয়েন বৃদ্ধিমুপগন্তুমধীশতে তাম্।
ন স্যাদজগলিতং যদি পান্থযুনাং
সাহায়কায় কিল নির্ম্মলমশ্রুবর্ধম॥ ২॥
কান্তাভিসাররসলোলুপমানসানাম্।
আতঙ্ককম্পিতদৃশামভিসারিকাণাম্।
যদ্বিঘ্নকৃদ্ দুরিতমর্জ্জিতবানজস্রং
কেনাধুনা ঘন তরিষ্যসি তন্ন বিঘ্ন॥৩॥
ক্ষীণং প্রিয়াবিরহকাতরমানসং মাং
নো নির্দ্দয়ং ব্যথয় বারিদ নাত্মবেদিন্।
ক্ষীণো ভবিষ্যসি হি কালবশং গতঃ সন্
আস্তে তবাপি নিয়তস্তড়িতা বিয়োগঃ॥৪॥
সর্ব্বত্র স্ননমৃতদস্তটিনীশরীর-
সংবর্দ্ধকস্তনুভৃতাং শমিতোপতাপঃ।
যচ্চাতকেষু করুণাবিমুখোহসি নিত্যং
নায়ং মতো জলদ কিং বত পক্ষপাতঃ॥৫||
বিদ্যাসাগর মহাশয়, জন মিয়র নামক এক সিবিলিয়ানের প্রস্তাব-অনুসারে পুরাণ, সূর্য্য়সিদ্ধান্ত ও ইয়ুরোপীয় মতানুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ক কতকগুলি শ্লোক রচনা করিয়া, ১০০৲ এক শত টাকা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সেই কবিতাগুলি মুদ্রিত করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি বাল্যকালে সংস্কৃত গদ্য-পদ্যে দেশ-ভ্রমণ, সন্তোষ, ক্রোধ প্রভৃতি নানাবিষয় রচনা করিয়াছিলেন। ঐ সকল কাগজ আমার নিকট ছিল। আমি যৎকালে বালক-বালিকা বিদ্যালয় বসাইবার জন্য দেশে গিয়া তাহার আদেশানুসারে কার্য্য করি, তৎকালে ঐ সকল কাগজপত্র মধ্যমাগ্রজের নিকট রাখি, তিনি উহা যদুনাথ মুখোপাধ্যায় ভগিনীপতিকে দেন। যদুনাথ তৎকালে সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন করিতেন; ঐ সকল লেখা দেখিয়া, তৎকালের সংস্কৃত-কলেজের অনেক ছাত্র সংস্কৃত-রচনা শিখিয়াছিলেন। দীনবন্ধু ও যদুনাথ কালকবলে নিপতিত হইয়াছেন, তজ্জন্য উক্ত রচনার কাগজ সকল পাওয়া যায় নাই। যাহা উপস্থিত ছিল, তাহাই ১২৯৬ সালে ১লা অগ্রহায়ণ প্রকাশ করিয়াছেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে কর্ম্ম করিবার সময়ে সীটিনকার, কষ্ট্, চ্যাপ্ম্যান, সিসিল বীডন, গ্রে, গ্রাণ্ড, হেলিডে, লর্ড ব্রাউন, ইডেন প্রভৃতি বহুসংখ্যক সম্ভ্রান্ত সিবিলিয়ানের সহিত অগ্রজের বিশেষরূপ ঘনিষ্ঠতা ও আত্মীয়তা ছিল। সিবিলিয়ানগণ তাঁহাকে বিশেষ সম্মান করিতেন। কোন কোন সম্ভ্রান্ত সিবিলিয়ানকে পরীক্ষায় পাশ না হইলে, দেশে ফিরিয়া যাইতে হইত। একারণ, মার্শেল সাহেব দয়া করিয়া ঐ সকল সিবিলিয়ানদের পরীক্ষার কাগজে নম্বর বাড়াইয়া দিতে বলিতেন। অধ্যক্ষেরও কথা না শুনিয়া, অগ্রজ ন্যায়ানুসারে কার্য্য করিতেন। উপরোধ করিলে ঘাড় বাঁকাইয়া . বলিতেন, “অন্যায় দেখিলে কার্য্য পরিত্যাগ করিব।” একারণ, সিবিলিয়ান ছাত্রগণ ও অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব, তাঁহাকে আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতেন। ঐ বৎসর গবর্ণমেণ্ট, সংস্কৃত-কলেজের দ্বিতীয় এসকলার্শিপের পরীক্ষাগ্রহণের ভার, মার্শেল সাহেবের প্রতি অর্পণ করেন। অগ্রজ মহাশয়, উক্ত সাহেবের জুনিয়ার ও সিনিয়ার উভয় ডিপার্টমেণ্টের প্রশ্ন প্রস্তুত ও মুদ্রিত করিয়া দেন। পরীক্ষাস্থলে প্রশ্ন দেখিয়া, কলেজের শিক্ষক মহাশয়গণ অগ্রজের পাণ্ডিত্য ও কৌশলের ভূরি ভূরি প্রশংসা করিতে লাগিলেন। এই বৎসর মধ্যম সহোদর, সংস্কৃত-কলেজের পরীক্ষায় সিনিয়র ডিপার্টমেণ্টের সর্বপ্রধান হইলেন। মধ্যম দীনবন্ধু, অগ্রজ মহাশয়ের তুল্য বুদ্ধিমান্ ছিলেন। ইতিপূর্ব্বে বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধায় মহাশয়ের নাম উল্লেখ হইয়াছে, তিনি অগ্রজ মহাশয়ের নিকট ছয় মাসের মধ্যে ব্যাকরণ শেষ করিয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মাঘ, ভারবি, মেঘদূত, শকুন্তলা, উত্তরচরিত প্রভৃতি সাহিত্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করিয়া অলঙ্কার, সাহিত্যদর্পণ, কাব্যপ্রকাশ অধ্যয়ন করেন; তৎপরে প্রাচীন স্মৃতি, মনু, মিতাক্ষরা অধ্যয়ন করিয়া, সংস্কৃত-কলেজের সিনিয়ার ডিপার্টমেণ্টের ছাত্রগণের সহিত পরীক্ষা দিয়া, সেকেণ্ড গ্রেটের এসকলার্শিপ প্রাপ্ত হন। তৎপরে রাজকৃষ্ণ বাবু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, দুই বৎসর কুড়ি টাকা করিয়া ফাষ্টগ্রেটের এসকলার্শিপ প্রাপ্ত হন। আউট ষ্টুডেণ্ট অর্থাৎ বাহিরের কোন বিদ্যার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, এসকলার্শিপ পাইবারও নিয়ম ছিল; তদনুসারে রাজকৃষ্ণ বাবু পরীক্ষা দিয়া বৃত্তি লাভ করেন। ইনি অতিশয় ধীশক্তিসম্পন্ন ছিলেন এবং অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া নিরন্তর অধ্যয়ন করিতেন। সুতরাং রাজকৃষ্ণ বাবু ছয় মাসে ব্যাকরণ ও দুই বৎসরে সাহিত্য, অলঙ্কার ও স্মৃতি অধ্যয়ন করিয়া, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই সংবাদ- শ্রবণে সংস্কৃত-কলেজের শিক্ষকগণ ও অপরাপর সকলে বিস্ময়ান্বিত হন। ইহার কারণ এই যে, যিনি সাহিত্যের পণ্ডিত, তিনি স্মৃতি বা অলঙ্কার পড়াইতে অক্ষম; যিনি যে বিষয়ের পণ্ডিত, তিনি তাহাই শিক্ষা দিতে পারিতেন, অপর বিষয়ে সম্পূর্ণ অসমর্থ ছিলেন। অগ্রজ, সকল বিষয়েই শিক্ষা দিতে দক্ষ ছিলেন। অনেকে রাজকৃষ্ণ বাবুকে দেখিবার জন্য অগ্রজের বাসায় সমাগত হইতেন। তৎকালের কলেজের শিক্ষকগণ দাদার অলৌকিক ক্ষমতাদর্শনে মুগ্ধ হইয়া- ছিলেন। সংস্কৃত-কলেজের নিয়ম ছিল যে, তিন বৎসর ব্যাকরণ অধ্যয়ন এবং তৎপরে দুই বৎসর সাহিত্য শিক্ষা করিতে হইত। অনন্তর এক বৎসর অলঙ্কার- শ্রেণীতে শিক্ষা লাভ করিয়া ব্যুৎপত্তি জন্মিলে, ছাত্রগণ দর্শন বা স্মৃতির শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিত। পরে টেষ্ট একজামিনে উত্তীর্ণ হইলে পর, সিনিয়ার ডিপার্টমেণ্টে পরীক্ষা দিতে পাইত। এরূপ স্থলে, অগ্রজ আড়াই বৎসর শিক্ষা দিয়া, রাজকৃষ্ণ বাবুকে সিনিয়রের পরীক্ষাপ্রদানে, চতুর্দিক হইতে তাহাকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল। কিরূপ প্রণালী অবলম্বনে শিক্ষা দিয়াছিলেন, তাহা পরিজ্ঞাত হইবার জন্য অনেকে অগ্রজ মহাশয়ের বাসায় সমুপস্থিত হইতেন। কলিকাতা তালতলা-নিবাসী ডাক্তার বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অগ্রজ মহাশয়ের পরমবন্ধু ছিলেন। পুর্ব্বে তিনি হেয়ার সাহেবের স্কুলের শিক্ষকের পদ পরিত্যাগপূর্ব্বক, মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করেন। তিনি অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন ও চিকিৎসাবিদ্যায় সম্পূর্ণরূপ পারদর্শী ছিলেন। অগ্রজ মহাশয় কিছুদিন তাহার নিকট ইংরাজী শিক্ষা করিয়াছিলেন। উক্ত কৃতবিদ্য চিকিৎসক কলিকাতায় স্থায়ী হইলে, আত্মীয়বর্গের ও অন্যান্য সাধারণ লোকের সবিশেষ উপকার হইবে, এই মানসে, তাঁহাকে কলিকাতায় স্থায়ী করিবার নিমিত্ত অগ্রজের ঐকান্তিক ইচ্ছা হইয়াছিল। ইত্যবসরে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে অশীতিমুদ্রা বেতনের একটী হেড, রাইটারের পদ শূন্য হইলে, উক্ত ডাক্তারবাবুকে ঐ পদে নিযুক্ত করাইবার জন্য কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেবকে অনুরোধ করেন। সাহেব, তদীয় অনুরোধের বশবর্তী হইয়া, দুর্গাচরণবাবুকে ঐ পদে নিযুক্ত করিয়া দেন।
সংস্কৃত-কলেজের আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কার মহাশয় পরলোক-যাত্রা করিলে পর, শিক্ষাসমাজের সেক্রেটারি ডাক্তার ময়েট সাহেব, ঐ পদে উপযুক্ত লোক অর্থাৎ ইংরাজী ও সংস্কৃতভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিত নিযুক্ত করিবার মানসে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেবের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া বলিলেন, “একটী কার্যদক্ষ লোক নিযুক্ত না করিলে, সংস্কৃত কলেজের বিশেষ উন্নতির আশা নাই। দেখুন, প্রাচীন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ঐ পদে কয়েক বৎসর ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর অবধি রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কার ঐ কার্য্য করিয়া আসিতেছিলেন। উল্লিখিত পণ্ডিতদ্বয় দ্বারা কলেজের কোন উন্নতি হইতে দেখি নাই। এক্ষণে আপনার পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ঐ পদে নিযুক্ত করা সর্ব্বততভাবে কর্ত্তব্য।” মার্শেল সাহেব, অগ্রজ মহাশয়কে সংস্কৃত-কলেজের ঐ পদে নিযুক্ত হইবার কথা ব্যক্ত করিলে পর, তিনি বলিলেন, “ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রবিষ্ট হইবার পূর্ব্বে, আমারও ঐ পদগ্রহণে আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এক্ষণে মহাশয়ের নিকট হইতে কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া আমার যাইতে ইচ্ছা নাই।” ইহা শুনিয়া সাহেব, সংস্কৃত-কলেজে নিযুক্ত হইবার জন্য আগ্রহাতিশয় প্রকাশ করাতে বলিলেন, “মহাশয়! যদি আমার মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে এই পদে নিযুক্ত করেন, তাহা হইলে সংস্কৃত-কলেজের ঐ পদে নিযুক্ত হইবার আমার কোন আপত্তি নাই। ইহার কারণ এই যে, তথায় যাইয়া আমি যেরূপ বন্দোবস্ত করিব, তাহাতে যদি সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয়ের সহিত মনান্তর ঘটে, কিম্বা আমার বন্দোবস্ত বা কথা রক্ষা না পায়, তাহা হইলে নিশ্চয় পদ পরিত্যাগ করিব। সহসা কার্য্য পরিত্যাগ করিলে, অর্থাভাবে আমার পরিবারবর্গের বিশেষ কষ্ট হইবে; কিন্তু এখানে আপনার নিকট দীনবন্ধুর কর্ম্ম থাকিলে, অন্নকষ্ট হইবে না। আর আমার মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন। অল্প- বয়সেই সংস্কৃত-কলেজে উচ্চ-শ্রেণীর পরীক্ষায় সর্ব্বপ্রধান হইয়া, কয়েক বৎসর সর্বোৎকৃষ্ট এসকলাশিপ পাইয়াছে।” সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমাকে যেরূপ ব্যাকরণ, সাহিত্য ও নাটকাদি পড়াইয়া থাক, যদি দীনবন্ধু সেইরূপ পড়াইতে পারেন, তাহা হইলে তাহাকে এখানে তোমার পদে নিযুক্ত করিতে আমার কোন আপত্তি নাই, ফলতঃ আমাকে রীতিমত পড়াইতে পারিলেই আমি সম্মত আছি।” ইহা শ্রবণ করিয়া তিনি উত্তর করেন, “ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত ও দর্শনশাস্ত্র এবং লীলাবতী ও বীজ। গণিতে দীনবন্ধুর বিশিষ্টরূপ বুৎপত্তি ও অধিকার আছে, অধিক আর কি বলিব, আমা অপেক্ষা দীনবন্ধু কোন বিষয়ে’ ন্যূন নহে, বরং অঙ্কশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন।” ইহা শুনিয়া মার্শেল সাহেব গবর্ণমেণ্টে রিপোর্ট করিয়া, মধ্যম সহোদর মহাশয়কে অগ্রজ মহাশয়ের পদে নিযুক্ত করিলেন।
এই সময় তিনি দুগ্ধ ও তদ্বারা যে সকল খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত হয়, তৎসমস্ত ভোজন করিতেন না। ইহার কারণ এই যে, গাভীদোহনসময়ে বৎসকে আবদ্ধ রাখায়, সেই বৎস স্তন্য-পানার্থে ছটফট্ করে; কিন্তু মনুষ্য এমন নৃশংস ও স্বার্থপর যে, তাহার মাতৃদুগ্ধ তাহাকে পান করিতে দেয় না; এইরূপ গাভী দোহন দেখিয়া তাহার অত্যন্ত মানসিক কষ্ট হইত; কখন কখন চক্ষের জলে বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যাইত। প্রায় পাঁচ বৎসর কাল তিনি দুগ্ধ ও ঘৃতের দ্বারা প্রস্তুত মিষ্টান্নাদি ভোজন করিতেন না, এবং তৎকালে মৎস্যও পরিত্যাগ করিয়া নিরামিষ ভোজন করিতেন। কিছু কাল এই নিয়মে দিনপাত করেন, পরে জননীদেবীর অনুরোধের বশবর্তী হইয়া, মৎস্য খাইতে বাধ্য হইলেন; কিন্তু তদবধি দুগ্ধ অসহ্য হইল, অর্থাৎ দুগ্ধ পান করিলে ভেদ ও বমি হইত।
১৮৪৬ খৃঃ অব্দের এপ্রেল মাসে অগ্রজ মহাশয় মাসিক ৫০ টাকা বেতনে সংস্কৃত-কলেজের আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হইলেন। অনন্তর তিনি ব্যাকরণের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যয়নের নূতন প্রণালী প্রচলিত করিলেন। তদনুসারে অধ্যাপকগণ ছাত্রদিগকে শিক্ষা দিতে প্রবৃত্ত হন। বিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক চেয়ারে উপবিষ্ট হইয়া নিদ্রা যাইতেন; ছাত্র- গণের মধ্যে কেহ পাখা লইয়া অধ্যাপককে বাতাস করিত। তিনি এই কুপ্রথা: উঠাইয়া দিলেন। সাড়ে দশটার মধ্যেই অধ্যাপক ও ছাত্রগণকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইতে হইবে, এইরূপ নিয়ম করিয়া দিলেন। অতঃপর সেক্রেটারির বিনা অনুমতিতে কি শিক্ষক কি ছাত্র কেহই ইচ্ছামত বিদ্যালয় হইতে বাটী যাইতে পারিবেন না। ছাত্রগণ ইচ্ছানুসারে একবারেই সকলে ক্লাশ হইতে বাহিরে মালীর গৃহে যাইতে পরিবে না; এক এক জন করিয়া যাইবে, কিন্তু তাহাও কাষ্ঠের পাশ গ্রহণ করিয়া যাইতে হইবে। অধ্যাপক ও বিদ্যার্থিগণ আবেদন ব্যতিরেকে অনুপস্থিত হইতে পরিবেন না। সাহিত্য-শ্রেণীতে যে সকল পুস্তক অধ্যয়ন করান হইত, তন্মধ্য হইতে অশ্লীল কবিতা-সমূহ রহিত করিয়া, অধ্যাপককে অধ্যয়ন করাইতে হইত। কলেজ, জুনিয়র ও সিনিয়র এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হইল। তন্মধ্যে সাহিত্য ও অলঙ্কারের শ্রেণী জুনিয়র, এবং দর্শন, বেদান্ত ও স্মৃতির শ্রেণী সিনিয়র। জুনিয়ারের পরীক্ষায় ছাত্রবৰ্গকে পাঁচ দিন পাঁচ বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হইত। ব্যাকরণের প্রশ্ন হইত; কিন্তু ছাত্রগণ নীরস বলিয়া প্রায় ব্যাকরণ দেখিতে আলস্য করিত; সুতরাং ব্যাকরণে অনেক ছাত্র ফেলা হইত। একারণ, অগ্রজ মহাশয় মাসে মাসে ব্যাকরণের পরীক্ষা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ব্যাকরণের প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়, যথানিয়মে উক্ত জুনিয়র ডিপার্টমেণ্টের ছাত্রগণকে উপদেশ দিতেন। সাহিত্য ও অলঙ্কারের অধ্যাপক, নিয়মানুসারে বাঙ্গালা-ভাষা হইতে সংস্কৃত অনুবাদ, সংস্কৃত-ভাষা হইতে বাঙ্গালা অনুবাদ ও শ্লোকের টীকা করাইতেন। তৎকালে নিয়ম ছিল, অলঙ্কারের শ্রেণী হইতে ছাত্রগণ লীলাবতী ও বীজগণিতের অঙ্ক শিক্ষা করিত; কিন্তু সাহিত্য-শ্রেণীর ছাত্রগণের মধ্যে কেহ অঙ্ক শিক্ষা করিবার জন্য জ্যোতিষের শ্রেণীতে যাইত না, এতদ্বিষয়েও কর্তৃপক্ষের কোন বন্দোবস্ত ছিল না; সুতরাং সাহিত্য-শ্রেণীর ছাত্রগণ অঙ্কে প্রায় ফেলা হইত। এজন্য অগ্রজ মহাশয়, যোগধ্যান শাস্ত্রীর শ্রেণীতে সাহিত্যশ্রেণীর ছাত্রগণের অঙ্ক শিক্ষা করিবার জন্য নূতন ব্যবস্থা করিয়া দেন। ঐ রূপে দর্শন ও স্মৃতির ছাত্রগণের, অলঙ্কার-শ্রেণীতে গিয়া নিয়মানুসারে অলঙ্কারগ্রন্থ শিখিবার ব্যবস্থা করিয়া দেন। অলঙ্কারের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ মহাশয়, ছাত্রবৰ্গকে রীতিমত সংস্কৃত গদ্য-পদ্য-রচনা ও বাঙ্গালা রচনা শিক্ষা দিতেন। দর্শন ও স্মৃতির শিক্ষক মহাশয়, প্রশ্নের উত্তর লিখিবার অনুশীলনে বিশিষ্টরূপ যত্নবান্ হইতেন। এরূপ নিয়ম করিয়া দেওয়ায়, ছাত্রগণের লিখিবার অধিকার জন্মিল। অগ্রজের এই অভিনব বন্দোবস্তে, শিক্ষক ও বিদ্যার্থিগণ পরম সন্তোষলাভ করিয়াছিলেন।
অগ্রজ মহাশয়, একসময় সংস্কৃত-কলেজের বিশেষ কার্যোপলক্ষে হিন্দুকলেজের প্রিন্সিপাল কার্ সাহেবের নিকট গমন করিয়াছিলেন। সাহেব, টেবিলের উপর চর্মপাদুকাসহিত চরণদ্বয় উত্তোলন করিয়া, অগ্রজের সহিত কথোপকথন করেন। তাঁহার সেই অসৌজন্যে, অগ্রজ, মনে মনে অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। কিছুদিন পরে ঐ কার সাহেব, হিন্দু-কলেজের কোন কার্য্যানুরোধে, সংস্কৃত-কলেজে অগ্রজের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আইসেন। কার্ সাহেব, ইতিপূর্বে যেরূপ শিষ্টাচার দেখাইয়া আপ্যায়িত করিয়াছিলেন, অদ্যাপি তিনি তাহা বিস্মৃত হন নাই। সাহেব দেখা করিতে আসিতেছেন শুনিয়া, অগ্রজ, চটী-চর্মপাদুকাসহিত চরণযুগল টেবিলের উপর রাখিয়া, সাহেবকে বসিবার জন্য কোনরূপ সম্ভাষণ বা অভ্যর্থনা করিলেন না। সাহেব দণ্ডায়মান হইয়া, তাঁহার সহিত কথা কহিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণপরে সাহেব লজ্জিত ও অবমানিত হইয়া প্রস্থান করিলেন। তৎপরে শিক্ষাসমাজের সেক্রেটারি ময়েট্ সাহেবের নিকট রিপোর্ট করেন যে, হিন্দু-কলেজের কোন কার্যানুবোধে, সংস্কৃত-কলেজের আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির সমীপে গিয়াছিলাম। তিনি আমার প্রতি যেরূপ অভদ্রতা করিয়াছেন, তাহাতে আমার বিশেষরূপ অপমান হইয়াছে। অন্য কোন ইউরোপীয়ান হইলে, এরূপ অপমান সহ্য করিতেন না। শিক্ষাসমাজ, অগ্রজ মহাশয়ের কৈফিয়ৎ তলপ করেন। তিনিও তাহার উত্তর লেখেন যে, ইতিপূর্বে ঐ সাহেব আমার প্রতি ঐরূপ অসৌজন্য প্রকাশ করিয়াছিলেন, অর্থাৎ আমাকে বসিতে না বলিয়া, টেবিলের উপর চর্ম্ম-পাদুকা সহিত চরণদ্বয় অৰ্পণ করিয়া, আমার সহিত কথাবার্তা, কহিয়াছিলেন। তাহাতে শিক্ষা-সমাজের সেক্রেটারি পরম সন্তোষ লাভ করিয়া, হাস্যপূর্ণ-বদনে কহিলেন, বাঙ্গালার মধ্যে পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের মত তেজস্বী লোক আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই; এই কারণেই আমরা, সকল বাঙ্গালী অপেক্ষা পণ্ডিতকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিয়া থাকি। বাঙ্গালায় বিদ্যাসাগরের সদৃশ আর দ্বিতীয় লোক নাই। ময়েট্ সাহেব যতদিন শিক্ষা-সমাজের অধ্যক্ষ ছিলেন, ততদিন বিদ্যাসাগরের সহিত পরামর্শ না করিয়া কোন কার্য্য করিতেন না।
ইং ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয় মানবলীলা সংবরণ করিলে, সংস্কৃত-কলেজের সাহিত্য-শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। সংস্কৃত-কলেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয়, অগ্রজ মহাশয়কে ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। এই সময়ে অগ্রজ, সংস্কৃত-কলেজে আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত ছিলেন। কোনও বিশেষ কারণবশতঃ তিনি অধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ অনুরোধ করেন। তৎকালে মদনমোহন তর্কালঙ্কার মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে কৃষ্ণনগর কলেজে প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন। অগ্রজের যত্নে মদনমোহন তর্কালঙ্কার উক্ত পদে নিযুক্ত হন। জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই, সর্ব্বানন্দ ন্যায়বাগীশ সাহিত্যশ্রেণীর প্রতিনিধিরূপে কার্য্য করিতেছিলেন। ন্যায়বাগীশ মহাশয়, পূর্ব্বের ন্যায় প্রত্যহ বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইয়া চেয়ারে বসিয়া নিদ্রা যাইতেন, অনবরত নস্য লাইতেন, তথাপি নিদ্রা উহাকে পরিত্যাগ করিত না। এই কারণে ছাত্রেরা এই কবিতাটিী পাঠ করিতেন-“সর্ব্বানন্দন্যায়বাগীশো ভায়া নিত্যং নিদ্রাং যাতি কলেজমধ্যে। ধীরে নাম্না ধ্যাপনা নাস্তি তস্য চত্বারিংশম্মুদ্রিকাণাং গতেহপি।” তিনি ছাত্রগণকে পড়াইবার সময় কেবল মল্লিনাথের টীকাগুলি আবৃত্তি করিয়া দিতেন। কবিতার ভাব, অর্থ কি অন্বয় বলিয়া দিতেন না; তজ্জন্য ছাত্রগণের মনস্তুষ্টি হইত না।. তিনি শিক্ষক থাকিলে, আগামী বর্ষে বাৎসরিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হইবার আশা নাই, এই বিবেচনায়, সাহিত্যশ্রেণীর ছাত্রগণ আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারিকে সমস্ত বিবরণ অবগত করাইয়াছিল এবং শিক্ষাসমাজের অধ্যক্ষ ময়েট্ সাহেবের নিকট এই আবেদন করিয়াছিল যে, ত্বরায় উপযুক্ত শিক্ষক নিযুক্ত না হইলে, আমাদের পাঠের অনেক ক্ষতি হইতেছে। তৎকালে অনেকের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যে, সর্ব্বানন্দ বহুকাল হইতে কলেজের সকল শ্রেণীতে প্রতিনিধির কার্য্য করিয়া থাকেন, অতএব উপস্থিত সাহিত্যশ্রেণীর কার্য্যটী ইহাঁরই হওয়া উচিত। সেই সময়ে অনেকে বলিয়াছিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে তাড়াইয়া আপনার বন্ধু মদনকে আনাইবার জন্য ছাত্রগণকে খেপাইয়াছে।” অনন্তর, বিদ্যাসাগরের কৌশলে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ঐ পদে নিযুক্ত হইবার আদেশ পাইয়াছে শুনিয়া, ন্যায়বাগীশ মহাশয় প্রস্থান করেন। কৃষ্ণনগরের কার্য্য ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিতে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিলম্ব হওয়ায়, অগ্রজ মহাশয় কয়েকদিন সাহিত্যশ্রেণীতে কিরাতার্জ্জুনীয় অর্থাৎ ভারবি পড়াইতে প্রবৃত্ত হইলেন। ছাত্রগণ তাঁহার অধ্যাপনার পাণ্ডিত্য-দর্শনে পরমহলাদিত হইয়াছিল। তদনন্তর মদনমোহন তর্কালঙ্কার কলিকাতায় আগমনপূর্ব্বক কয়েকদিবস বিদ্যাসাগরের বাসায় অবস্থিতি করিয়া, তাঁহার নিকট ভারবির যে যে অংশ ছাত্রগণকে পড়াইতে হইবে, সেই সেই স্থলের সন্দেহ ভঞ্জন করিয়া লইতেন। ক্রমশঃ অধ্যাপনাকার্য্য করিয়া, তর্কালঙ্কার সাহিত্য-শাস্ত্রে অসাধারণ লোক তইয়া উঠিলেন। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, অগ্রজের বাল্যবন্ধু ও সহাধ্যায়ী ছিলেন। এই কারণেই যে উহাঁকে ঐ পদে নিযুক্ত করাইয়াছিলেন, এরূপ নহে; সহাধ্যয়নকালে উক্ত মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে কাব্যশাস্ত্রে বিশেষরূপ বুৎপন্ন জানিতেন বলিয়াই, উহাকে ঐ পদে নিযুক্ত করিবার জন্য প্রয়াস পাইয়াছিলেন। অগ্রজের আন্তরিক আগ্রহাতিশয় না থাকিলে, ঐরূপ উপযুক্ত তর্কালঙ্কার মহাশয় উক্ত পদে নিযুক্ত হইতেন না।
তৎকালে ভাল বাঙ্গালা পুস্তক ছিল না। জ্ঞানপ্রদীপ, প্রবোধচন্দ্রোদয়, পুরুষপরীক্ষা ও হিতোপদেশের বাঙ্গালা প্রভৃতি যে তিন চারি খানি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক ছিল, তৎপাঠে কোনও ফলোদয় হইত না। সিবিলিয়ানদের অধ্যয়নের অত্যন্ত গোলযোগ হইত। একারণ, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব মহোদয়, অগ্রজ মহাশয়কে একদিন বলেন যে, “ঈশ্বরচন্দ্র! তুমি কতকগুলি ভাল বাঙ্গালা পুস্তক ভাষান্তর হইতে অনুবাদ বা নূতন রচনা করিয়া মুদ্রিত ও প্রকাশিত কর, নচেৎ এখানকার ছাত্রগণের বাঙ্গালা-শিক্ষার অত্যন্ত অসুবিধা দেখিতেছি।” সাহেবের অনুরোধ শ্রবণে, অগ্রজ বলিলেন, “মহাশয়! আমি কি লিখিব, আদেশ করুন।” সাহেব বলিলেন, “তুমি ত হিন্দী বেতালপঞ্চবিংশতি রীতিমত অধ্যয়ন করিয়াছ। ঐ পুস্তক অবলম্বন করিয়া, হিন্দীভাষা হইতে বিশুদ্ধ বাঙ্গালায় অনুবাদ করা। আর সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনাধিরোহণ হইতে, ইংরাজদের বাঙ্গালা অধিকার পর্য্যন্ত মার্শমান সাহেবের রচিত ইংরাজি পুস্তক অবলম্বন করিয়া, সরল বাঙ্গালা-ভাষায় অনুবাদ কর। বেতালপঞ্চবিংশতির বাঙ্গালা ছাপাইতে যেমন অধিক বায় হইবে, তেমন গবর্ণমেণ্ট এখানকার লাইব্রেরীর জন্য একশত পুস্তক ৩০০৲ তিন শত টাকা মূল্যে গ্রহণ করিবেন। তাহাতে তোমার ছাপানর ব্যয় নির্ব্বাহ হইবে। অবশিষ্ট পুস্তক বিক্রয় করিয়া তুমি যথেষ্ট লাভ করিতে পরিবে। প্রথমতঃ মার্শেল সাহেবের উত্তেজনায় উৎসাহান্বিত হইয়া, তিনি হিন্দী বেতালের অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হইলেন। অল্পদিনের মধ্যে লেখা শেষ হইলে, ঐ পুস্তক লালবাজারস্থ রোজারীয় কোম্পানীর মুদ্রাযন্ত্রে মুদ্রিত হইয়াছিল।
তিনি আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া, সংস্কৃত-কলেজের বন্দোবস্ত করায়, কলেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় ও এডুকেশন কৌন্সেলের সেক্রেটারি ডাক্তার ময়েট্ সাহেব, পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার বন্দোবস্তে অন্যান্য বৎসর অপেক্ষা এই বৎসরের এসকিলার্শিপ। পরীক্ষার ফল অনেক অংশে উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। ঐ বৎসর ফাল্গুনমাসে পারিতোষিক-বিতরণ-কার্য্য সমাধার পর, অগ্রজ, ছোট ছোট ভাইগুলিকে কলিকাতায় রাখিয়া বাটী গমন করেন; ইহার কয়েক দিন পরে, দ্বাদশবৰ্ষীয় হরচন্দ্র নামক চতুর্থ সহোদর, বিস্তুচিকারোগে আক্রান্ত হইয়া, অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয়। অনুগত, অসাধারণ বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন ভ্রাতার মৃত্যুসংবাদে অগ্রজ মহাশয় অত্যন্ত শোকাতুর হইয়াছিলেন। লেখাপড়ার চৰ্চা একেবারে পরিত্যাগ করিয়া, দিবারাত্র কয়েক মাস রোদনেই সময়াতিপাত করিতেন। পাঁচ ছয় মাস রীতিমত আহার না করায়, অতিশয় দুর্বল হইয়াছিলেন। ভ্রাতৃবর্গের মধ্যে হরচন্দ্র অত্যন্ত বুদ্ধিমান্ ছিল। তাহার উপর জ্যেষ্ঠের এরূপ আশা ছিল যে, (নিজে পরিবার, প্রতিপালনের জন্য চাকরি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, ইচ্ছামত্ ভালরূপ লেখাপড়া শিখিতে পারিলাম না; যাহা জানি, তাহাতে দেশের কোন উপকার হইবে না।)হরচন্দ্রকে মনের মত লেখাপড়া শিখাইব, তাহার দেশস্থ লোকের উপকার হইবে। জননীদেবী, পুত্রশোকে আহার-নিন্দ্রা-পরিত্যাগ-পূর্বক নিরন্তর রোদন করিয়া থাকেন, একারণ তাঁহার সান্ত্বানার জন্য অন্যান্য ভ্রাতৃবর্গকে কলিকাতা হইতে দেশে পাঠাইয়া দেন। মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের কার্য্যে ছয় মাস প্রতিনিধি রাখিয়া, অন্যান্য ভ্রাতৃবৰ্গসমভিব্যাহারে দেশে অবস্থিতি করেন। কিয়দ্দিবস পরে জননীদেবীর শোকের কিছু লাঘব হইলে পর, অগ্রজ মহাশয় আমাদিগকে পুনর্বার কলিকাতা যাইবার আদেশ করেন।
ঐ সময় অগ্রজ মহাশয়, সংস্কৃত-কলেজের কোন বন্দোবস্ত উপলক্ষে কথা রক্ষা না হওয়ায়, হঠাৎ কর্ম্ম ত্যাগ করেন। রিজাইনপত্র প্রাপ্ত হইয়া, কলেজের অধ্যক্ষ বাবু রসময় দত্ত ও শিক্ষাসমাজের সেক্রেটারি ডাক্তার ময়েট্ সাহেব, অগ্রজকে অনেক প্রকার উপদেশ প্রদান করিয়া, কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে নিবারণ করেন, এবং অন্যান্য আত্মীয় বন্ধুবান্ধবও বিশিষ্টরূপ হিতগর্ভ উপদেশ দেন; কিন্তু কাহারও কথা শ্রবণ করেন নাই। একারণ, অনেক আত্মীয় তৎকালে বলেন, “বিদ্যাসাগর! অতঃপর তুমি কি করিয়া দিনপাত করিবে?” তাহা শ্রবণ করিয়া তাঁহাদিগকে উত্তর করিলেন, “আলু, পটল বিক্রয় বা মুদীর দোকান করিয়া জীবিকা-নির্বাহ করিব।” এরূপ সন্মানের কার্য্য অক্লেশে পরিত্যাগ করায়, অনেকে আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। কেহ কেহ বলিলেন যে, বিদ্যাসাগরের মতিভ্রম হইয়াছে, নচেৎ এরূপ সম্মানের পদ পরিত্যাগ করেন কেন? কিন্তু কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া অগ্রজের কিছুমাত্র মানসিক কষ্ট হইল না। তৎকালে বাসায় নিরুপায় আত্মীয় ও স্বসম্পৰ্কীয় প্রায় ২০টী বালককে অন্নবস্ত্র দিয়া বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করাইতেছিলেন। তন্মধ্যে কাহাকেও বাসা হইতে যাইবার কথা এক দিনের জন্যও বলেন নাই। বাল্যকাল হইতে অগ্রজ মহাশয় পরম দয়ালু ছিলেন। কিসে পরের উপকার হইবে, সতত এই চিন্তাতেই মগ্ন থাকিতেন। ভালরূপ ইংরাজী-ভাষা শিক্ষার জন্য, প্রত্যহ প্রাতে বহুবাজারের পঞ্চাননতলার বাসা হইতে, সভাবাজারস্থ রাজা রাধাকান্ত দেবের বাটীতে, রাজার জামাতা বাবু অমৃতলাল মিত্র ও অপর জামাতা বাবু শ্রীনাথচন্দ্র বসুর নিকট যাইতেন এবং আগ্রহাতিশয়-সহকারে ইংরাজী-ভাষার অনুশীলনে প্রবৃত্ত ছিলেন। মধ্যম সহোদর, ফোটউইলিয়ম কলেজের প্রধান পদে নিযুক্ত থাকিয়া মাসিক যে ৫০৲ টাকা বেতন পাইতেন, তদ্দ্বরা কলিকাতার বাসাখরচ অতিকষ্টে নির্ব্বাহ হইতে লাগিল। অগ্রজ মহাশয়, দেশস্থ বাটীর মাসিক ব্যয়-নির্ব্বাহের জন্য মাসে মাসে ৫০৲ টাকা ঋণ করিয়া প্রেরণ করিতে লাগিলেন।
১৯০৩ সংবতে, হিন্দী বেতালপঞ্চবিংশতির বাঙ্গালা অনুবাদ প্রকাশিত করিলেন। ফোটউইলিয়ম কলেজের কর্ম্মাধ্যক্ষ, সিবিলিয়ানদের পাঠের উদ্দেশে, একশত বেতালপঞ্চবিংশতি তথাকার লাইব্রেরীতে রাখিলেন; গবর্ণমেণ্ট উহার মূল্য ৩০০৲ টাকা প্রদান করিলেন। এতদ্বারা ছাপাময় ব্যয় নির্ব্বহ হইল। অবশিষ্ট চারিশত পুস্তকের মধ্যে প্রায় দুই শত পুস্তক আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবকে বিনামূল্যে বিতরণ করিলেন। বেতালপঞ্চবিংশতি মুদ্রিত হইবার পূর্ব্বে, অপর আর কেহ কখন এরূপ উৎকৃষ্ট বাঙ্গালাভাষায় পুস্তক লিখিতে পারেন নাই। এজন্য দেশবিদেশে অগ্রজ মহাশয়ের প্রশংসা হইতে লাগিল। এক বেতালপঞ্চবিংশতি লিখিয়া, বাঙ্গালাদেশের মধ্যে তাঁহার অদ্বিতীয় নাম প্রকাশিত হইল। বেতালপঞ্চবিংশতি পুস্তকে অতি সুমধুর পদবিন্যাস হইয়াছিল। তৎকালে বেতালপঞ্চবিংশতির বাঙ্গালা পাঠ করিবার জন্য, সকল সম্প্রদায়ের লোকের আন্তরিক ইচ্ছা হইয়াছিল। এই পুস্তকের বাঙ্গালা পাঠ করিয়া, তৎকালীন সংস্কৃত-কলেজের ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের বালকবৃন্দ বাঙ্গালা লিখিতে শিক্ষা করিতেন। অগ্রজ মহাশয়, বাঙ্গালা-ভাষা শিক্ষার আদি-পথপ্রদর্শক, ইহা সকলকেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে। তিনিই প্রচলিত বাঙ্গালা-ভাষা লিখিবার ও শিক্ষা করিবার আদি-গুরুস্বরূপ। ঐ সময়ে কি সংস্কৃত, কি ইংরাজী, সকল বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ, অনেকেই বেতালপঞ্চবিংশতি পুনঃ পুনঃ অধ্যয়ন করিয়া কণ্ঠস্থ করিয়াছিল; ইহার কারণ এই যে, বাঙ্গালা রচনা বা অনুবাদ করিবার সময়, বেতালপঞ্চবিংশতির কোন কোন স্থলের অবিকল পঙক্তি লিখিয়া দিত।
ইহার কিয়দিবস পরে, সিরাজদ্দৌলার সিংহাসনাধিরোহণ হইতে ইংরাজদের অধিকার পর্য্যন্ত, মার্শমান সাহেবের হিষ্টিরি অব বেঙ্গল, অর্থাৎ বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রাঞ্জল দেশীয় ভাষায় অনুবাদ করিয়া মুদ্রিত করেন। তৎকালে বাঙ্গালার ইতিহাস সকলেই সমাদরপূর্বক গ্রহণ করিয়াছিল। স্বল্পদিনের মধ্যেই সমুদয় পুস্তক নিঃশেষ হইয়া যায়। ইহার কয়েক মাস পরে অর্থাৎ সন ১২৫৬ সালের ২৬শে ভাদ্র জীবনচরিত নামক পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন। রবার্ট উইলিয়ম চেম্বর্স, বহুসংখ্যক সুপ্রসিদ্ধ মহানুভবদিগের বৃত্তান্ত সঙ্কলন করিয়া, ইংরাজি-ভাষায় যে জীবনচরিত পুস্তক প্রচার করিয়াছেন, তন্মধ্য হইতে কেবল কোপর্নিকস, গ্যালিলিয়, নিউটন, হর্শেল প্রভৃতি কয়েকটা মহানুভবের চরিত, ইংরাজী ভাষা হইতে বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদ করিয়া, এই ‘পুস্তক প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইতিপূর্বে এতদ্দেশীয় কেহ কখন এরূপ জীবনচরিত সঙ্কলন বা অনুবাদ করেন। নাই। বিশেষতঃ এতদ্দেশে এরূপ জীবনচরিত লিখিবার প্রথা পুর্ব্বে প্রচলিত ছিল না। ইউরোপীয়দের ন্যায় জীবনচরিত লিখিবার প্রথা প্রচলিত থাকিলে, এতদ্দেশেরও অনেক মহানুভবের নাম প্রকাশ হইত। দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত এরূপ প্রথা না থাকাতে, ভারতবর্ষের পূর্বতন অসংখ্য মহানুভব মহামহোপাধ্যায়ের নাম কালসহকারে বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছে। বাঙ্গালাদেশের বিদ্যার্থী বালকবৃন্দের বিশিষ্টরূপ উপকার দর্শিতে পারে, এই আশায়, অগ্রজ মহাশয় ঐ পুস্তকের অনুবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। “সামান্য কৃষকের পুত্র নিউটন, নিজের যত্ন ও পরিশ্রমে লেখাপড়া শিক্ষা করিয়া জগদ্বিখ্যাত হইয়াছিলেন। নিউটন অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান্ ও বিদ্বান্ হইয়াও স্বভাবতঃ বিনীত ছিলেন; তিনি আপন বিদ্যার কিঞ্চিম্মাত্র অভিমান করিতেন না। নিউটনের এই এক সুপ্রসিদ্ধ কথা ধরাতলে জাগরূক রহিয়াছে, “আমি বালকের ন্যায় বেলাভূমি হইতে উপলখণ্ড সঙ্কলন করিতেছি, কিন্তু জ্ঞানমহার্ণব পুরোভাগে অক্ষুন্ন রহিয়াছে।” ইত্যাদি রূপ বিদ্যাশিক্ষার উত্তেজক জীবনচরিত পাঠে, এতদ্দেশীয় লোক নানাপ্রকার উপদেশ প্রাপ্ত হইবে, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে তত্তদ্দেশের তত্তৎকালীন রীতি, নীতি, ইতিহাস, আচার, ব্যবহার পরিজ্ঞাত হইবে। জীবনচরিত পুস্তক মুদ্রিত করিবার স্বল্পদিনের মধ্যেই লোকের আগ্রহাতিশয়ে সমস্ত পুস্তক নিঃশেষিত হইল। তৎকালীন বিদ্যার্থামাত্রেই এই পুস্তক সমাদরপূর্ব্বক পাঠ করিতেন। অগ্রজ মহাশয়ের সুন্দর অনুবাদ ও ললিত, রচনা-প্রণালী দর্শনে, সকলে অপরিসীম আনন্দলাভ করিয়াছিলেন। সুতরাং তিনি সাধারণের নিকট অদ্বিতীয় লেখক বলিয়া প্রশংসাভাজন হইয়াছিলেন। ইতিপূর্বে সাধুভাষায় ইংরাজী পুস্তকের এরূপ অনুবাদ করিতে কেহ সক্ষম হন নাই।
কাপ্তেন ব্যাঙ্ক সাহেব, সংস্কৃত, বাঙ্গালা ও হিন্দী শিক্ষার মানসে, শিক্ষা— সমাজের অধ্যক্ষ ডাক্তার ময়েট্ সাহেবকে এই অনুরোধ করেন যে, ইংরাজী ও সংস্কৃত-ভাষায় বিলক্ষণ অভিজ্ঞ একটী পণ্ডিত নির্বাচন করিয়া দেন। সংস্কৃতকলেজের সেক্রেটারির কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া নিরর্থক বসিয়া আছেন মনে করিয়া, ময়েট্ সাহেব, কাপ্তেন ব্যাঙ্ককৈ শিক্ষা দিবার জন্য অগ্রজ মহাশয়কে অনুরোধ করেন। অগ্রজ মহাশয়, ময়েট্ সাহেবের অনুরোধপরতন্ত্র হইয়া, ব্যাঙ্ক সাহেবকে কয়েক মাস প্রত্যহ শিক্ষা দিতে যাইতেন। সাহেব, স্বল্পদিনের মধ্যেই বাঙ্গালা ও হিন্দী ভাষা ভালরূপ শিক্ষা করিলেন। কয়েক মাস পরে, ব্যাঙ্ক সাহেব মাসিক ৫০৲ টাকার হিসাবে একবারে কয়েক মাসের টাকা তাঁহাকে প্রদান করিতে উদ্যত হইলে, তিনি ঐ টাকা গ্রহণ করেন নাই। সাহেব, টাকা না লইবার কারণ জিজ্ঞাসা করায়, অগ্রজ বলেন, “আপনি বলিয়াছিলেন যে, আপনি ময়েট্ সাহেবের পরম আত্মীয়, আমিও তাঁহার আত্মীয়, এমত স্থলে আমি কি প্রকারে আপনার নিকট বেতন লইতে পারি?” চাকরি না থাকায় ক্রমশঃ ঋণগ্রস্ত হইতেছিলেন, তথাপি সাহেবের নির্ব্বন্ধাতিশয়েও, শ্রমলব্ধ টাকা গ্রহণ করিলেন না। অন্য লোক এরূপ অবস্থায় কদাচ উপস্থিত প্রচুর টাকা পরিত্যাগ করিতে পারিতেন না। বাল্যকাল হইতেই তাঁহার অর্থের প্রতি দৃষ্টি কম ছিল।
এই সময়ে অগ্রজ, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহিত পরামর্শ করিয়া, সংস্কৃত-যন্ত্র নাম দিয়া একটি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেন। ৬০০৲ টাকায় একটি প্রেস ক্রয় করিতে হইবে; টাকা না থাকাতে তাঁহার পরমবন্ধু বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নিকট ঐ টাকা ঋণ করিয়া, তর্কালঙ্কারের হস্তে দিলে, তর্কালঙ্কার প্রেস ক্রয় করেন। ঐ টাকা ত্বরায় নীলমাধব মুখোপাধ্যায়কে প্রত্যাৰ্পণ করিবার কথা ছিল। এক দিবস কথাপ্রসঙ্গে অগ্রজ, মার্শেল সাহেবকে বলেন যে, “আমরা একটি ছাপাখানা করিয়াছি, যদি কিছু ছাপাইবার আবশ্যক হয়, বলিবেন।” ইহা শুনিয়া সাহেব বলিলেন, “বিদ্যার্থী সিবিলিয়ানগণকে যে ভারতচন্দ্রকৃত অন্নদামঙ্গল পড়াইতে হয়, তাহা অত্যন্ত জঘন্য কাগজে ও জঘন্য অক্ষরে মুদ্রিত; বিশেষতঃ অনেক বর্ণাশুদ্ধি আছে। অতএব যদি কৃষ্ণনগরের রাজবাটী হইতে আদি অন্নদামঙ্গল পুস্তক আনাইয়া শুদ্ধ করিয়া ত্বরায় ছাপাইতে পার, তাহা হইলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য আমি একশত পুস্তক লইব এবং ঐ এক শতের মূল্য ৬০০৲ শত টাকা দিব। অবশিষ্ট যত পুস্তক বিক্রয় করিবে, তাহাতে তুমি যথেষ্ট লাভ করিতে পরিবে, তাহা হইলে যে টাকা ঋণ করিয়া ছাপাখানা করিয়াছ, তৎসমস্তই পরিশোধ হইবে।” সুতরাং কৃষ্ণনগরের রাজবাটী হইতে অন্নদামঙ্গল পুস্তক আনাইয়া, মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন। একশত পুস্তক ফোট উইলিয়ম কলেজে দিয়া ৬০০৲ ছয় শত টাকা প্রাপ্ত হন; ঐ টাকায় নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের ঋণ পরিশোধ হয়। ইহার পর যে সকল সাহিত্য, ন্যায়, দর্শন পুস্তক মুদ্রিত ছিল না, তৎসমস্ত গ্রন্থ ক্রমশঃ মুদ্রিত করিতে লাগিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ও সংস্কৃত-কলেজের লাইব্রেরীর জন্য যে পরিমাণে নূতন নূতন পুস্তক লইতে লাগিল, তদ্দ্বরা ছাপানর ব্যয় নির্ব্বহ হইয়াছিল। অন্যান্য লোকে যাহা ক্রয় করিতে লাগিলেন, তাহা লাভ হইতে লাগিল। ঐ টাকায় ক্রমশঃ ছাপাখানার ইষ্টেট বা কলেবর বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। অনন্তর, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড়্ রাইটারের পদ শূন্য হইলে, ঐ পদে অগ্রজ মহাশয় মাসিক ৮০৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত হইলেন। তিনি যেরূপ পরিশ্রম করিয়া ইংরাজী শিক্ষা করিতেছিলেন, এক্ষণেও ঠিক সেইরূপভাবে শিক্ষা করিতে লাগিলেন। ইংরাজীতে যে সকল রিপোট গবর্ণমেণ্টে পাঠাইতে হইত, তৎসমুদয় স্বয়ং রচনা করিতেন; অন্য কাহারও সাহায্য লইতে হইত না। তাঁহার ইংরাজী রচনা অতি উৎকৃষ্ট হইত। একারণ, কৃতবিদ্য ইংরাজী লেখকগণ, তাঁহার ইংরাজী রচনা দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইতেন। সর্ব্বদা অনেক রিপোর্ট প্রস্তুত করিয়া রচনা যেমন উৎকৃষ্ট হইয়াছিল, ইংরাজী হস্তাক্ষরও তদনুরূপ অতি উত্তম হইয়াছিল। পণ্ডিত-লোকের অধিক বয়সে নিজের যত্ন ও পরিশ্রমে এরূপ ইংরাজী শিক্ষা করা, অতি আশ্চর্য্যের বিষয় বলিতে হইবে।
এই সময় সংস্কৃত-কলেজের গণিতশাস্ত্রাধ্যাপক যোগধ্যান পণ্ডিত মানবলীলা সংবরণ করেন। তিনি সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রগণকে লীলাবতী ও বীজগণিতের অঙ্ক শিক্ষা দিতেন। তৎকালে তিনি বঙ্গদেশের মধ্যে অঙ্কশাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। কলেজের কর্ম্মাধ্যক্ষ বাবু রসময় দত্ত, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হইতে, গণিতশাস্ত্রের অঙ্ক শিক্ষা দিবার জন্য লোক নির্ব্বচন করিয়া আনিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন; কিন্তু অগ্রজের অভিপ্রায় ছিল যে, সংস্কৃত-কলেজের মধ্যে যিনি অঙ্কে প্রতিবৎসর পরীক্ষায় সর্বশ্রেষ্ঠ হইয়া থাকেন, ন্যায়বিচারে তাঁহারই এই পদ পাওয়া সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। অতএব তিনি মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, শিক্ষা-সমাজের প্রেসিডেণ্ট ও সেক্রেটারিকে অনুরোধ করিয়া বলেন যে, সংস্কৃত-কলেজের সকল ছাত্র অপেক্ষা প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্য প্রতিবৎসর অঙ্কের পরীক্ষায় সর্বোৎকৃষ্ট হইয়া থাকেন এবং কলেজের সকল ছাত্র অপেক্ষা তাহার অঙ্কে বুৎপত্তি জন্মিয়াছে। অন্যান্য বিষয়েও পরীক্ষায় গত বৎসর সর্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়া প্রধান এসকিলাশিপ প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব উক্ত পদ তাঁহারই পাওয়া উচিত। ইহা শ্রবণ করিয়া, শিক্ষাসমাজ, প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্যকে উক্ত পদে নিযুক্ত করেন। প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্য, কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, আন্তরিক যত্নের রহিত বালকগণকে শিক্ষা দিতেন। এজন্য পূর্ববৎসর অপেক্ষা ঐ বৎসর পরীক্ষায় ছাত্রগণ অঙ্কে উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। পরীক্ষায় পূর্ব্ব-বৎসর অপেক্ষা ফল ভাল হওয়াতে, অগ্রজ মহাশয়, প্রিয়নাথের প্রতি পরম সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন।
এই বৎসর শিক্ষাসমাজ, সংস্কৃত-কলেজের জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় ডিপার্টমেণ্টের বাৎসরিক পরীক্ষার ভার অগ্রজ মহাশয় ও ডাক্তার রোয়ারের প্রতি অৰ্পণ করেন। কিন্তু অগ্রজ মহাশয়ই স্বয়ং উভয় ডিপার্টমেণ্টের প্রশ্ন প্রস্তুত করেন। কলেজের অধ্যাপকগণ প্রশ্ন দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। পাঁচ দিবস পরীক্ষার স্থলে উপস্থিত থাকায়, প্রশ্ন প্রস্তুত করায় ও পরীক্ষার কাগজ দেখায়, তাঁহার যথেষ্ট পরিশ্রম হইয়াছিল; তজ্জন্য গবর্ণমেণ্ট হইতে উভয় পরীক্ষকই পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সিনিয়র ডিপার্টমেণ্টের পরীক্ষায় রামকমল ভট্টাচার্য্য, কাব্য ও অলঙ্কারের প্রশ্নের সর্বাপেক্ষা ভাল উত্তর লিখিয়াছিলেন; একারণ, অগ্রজ মহাশয় রামকমল ভট্টাচার্য্যকে ঐ পুরস্কারের টাকা হইতে সমগ্র সংস্কৃত মহাভারত পুস্তক ক্রয় করিয়া দিয়াছিলেন। অবশিষ্ট টাকা হইতে দরিদ্র লোকদিগকে বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিয়াছিলেন। তৎকালে কোন পরীক্ষক নিজ হইতে ছাত্রকে পারিতোষিক প্রদান করেন নাই; বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এ বিষয়ের প্রথম পথ-প্রদৰ্শক বলিতে হইবে। কিছুদিন পরে, রামকমল ভট্টাচার্য্য কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া কষ্ট পাইতেছেন শুনিয়া, তিনি, বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ডাক্তার মহাশয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, রামকমল ভট্টাচার্য্যের বাটী যাইয়া চিকিৎসা করাইতে প্রবৃত্ত হন। যতদিন তিনি সম্পূর্ণরূপ আরোগ্য লাভ করিতে না পারিয়াছিলেন, ততদিন অগ্রজ মহাশয়, বহুবাজারের বাসা হইতে সিমুলিয়ায় তাঁহাদের বাটী যাইতে আলস্যা করিতেন না। তাঁহার অনুরোধে দুর্গাচরণ বাবু ভিজিট্ গ্রহণ করেন নাই। ঐ সময়ে রামকমল ভট্টাচার্য্যের বাটীতে দেবনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সহিত দাদার প্রথম আলাপ হয়। তিনি উক্ত মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে সম্মান করিতেন। তৎকালে নীলাম্বর বাবুর শৈশবাবস্থা। নীলাম্বর বাবু ঐ সময়ে বহুকাল হইতে রোগে আক্রান্ত হইয়া কষ্ট পাইতেছিলেন। অগ্রজ, নীলাম্বর বাবুর মস্তক দেখিয়া ব্যক্ত করেন যে, এই বালক অসাধারণ ধী-শক্তিসম্পন্ন। তিনি তাঁহাকে সংস্কৃত-কলেজে ভর্ত্তি করিয়া, লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করিয়া দেন।
সন ১২৫৬ সালের ৩০শে কার্ত্তিক নিশাযোগে অগ্রজ মহাশয়ের পত্নী এক সন্তান প্রসব করেন। তিনি, অধিক বয়স পর্য্যন্ত পুত্রলাভে বঞ্চিত ছিলেন; একারণ, পিতৃদেব তাঁহাকে নারায়ণের ঔষধ সেবন করান, তন্নিমিত্ত ঐ শিশুর নাম নারায়ণ রাখেন। ইহার কয়েক দিন পরে, অষ্টমবর্ষীয় পঞ্চম সহোদর হরিশ্চন্দ্র, লেখাপড়া শিক্ষার জন্য কলিকাতায় গিয়াছিল। কলিকাতায় উপস্থিতির কয়েক দিন পরে, সে বিষম বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হইয়া, অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয়। তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয়, কয়েক মাস শোকে অভিভূত হইয়াছিলেন। তিনি যথাসময়ে রীতিমত ভোজন করিতেন না এবং লেখাপড়ায় বিরত হইয়াছিলেন। আমরা সাত ভাই; এজন্য জ্যেষ্ঠাগ্রজ সর্ব্বদা বলিতেন যে, যদ্যপি সকলে জীবিত থাকি, তবে দেশের অনেক উপকার করিতে পারিব। তিনি মনে মনে সংকল্প করিয়াছিলেন, নিজে উপাৰ্জ্জ ন করিয়া সংসারযাত্রা নিৰ্বাহ করিব; অন্যান্য ভ্রাতৃবৰ্গকে দেশে রাখিয়া, বিদ্যালয় স্থাপন-পূর্ব্বক, দেশের দরিদ্র লোকের সন্তানগণকে লেখাপড়া শিখাইব। কিন্তু উপর্য্যুপরি দুই বৎসরে দুইটি ভ্রাতার মৃত্যুতে তিনি হতাশ হইয়াছিলেন। হরিশ্চন্দ্র ইতিপূর্ব্বে বলিয়াছিল যে, “দাদা! আমার বিবাহে বাজনা করিতে হইবে।” এজন্য অদ্যাপি অগ্রজ, অপর লোকের বিবাহে বাদ্যের শব্দ শুনিলে, দীর্ঘ-নিশ্বাস-পরিত্যাগপূর্বক অশ্রুবিসর্জন করিতেন। লোকপরম্পরায় শুনিলেন যে, জননী-দেবী পুত্রদ্বয়ের মৃত্যুতে সর্ব্বদা রোদন করিয়া থাকেন; এজন্য জননীদেবীকে দেশ হইতে কলিকাতায় লইয়া আইসেন এবং পাচ মাস কাল নিকটে রাখিয়া সান্ত্বনা করেন। জননী, দেশে থাকিয়া স্বয়ং পাকাদিকার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া, অপরাপর আগন্তুক ব্যক্তিগণকে বা দরিদ্র নিরুপায় লোকদিগকে ভোজন করাইতে ভাল বাসিতেন। তাঁহাকে অন্যমনস্ক করিয়া রাখিবার জন্য, তিনি সর্বদা আত্মীয় ও বন্ধুগণকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতেন। জননী, স্বয়ং পাকাদি কার্য্য নির্বাহ করিয়া, উপস্থিত নিমন্ত্রিতদিগকে খাওয়াইতেন। রন্ধন-পরিবেশনাদি-কার্য্যে ব্যাপৃত থাকায়, তাঁহার শোকের অনেক লাঘব হইতে লাগিল। জননীকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য তিনি পাঁচ মাস কাল অকাতরে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করিয়াছিলেন। কিয়ৎপরিমাণে শোকের হ্রাস হইলে পর, বৈশাখ মাসে অন্যান্য ভ্রাতৃবৰ্গসহিত জননীকে দেশে পাঠাইয়া দেন। ঐ সময়ে অগ্রজের পুত্র নারায়ণের বয়ঃক্রম ছয় মাস; তাহার অন্নপ্রাশন উপলক্ষে পিতৃদেব সমারোহ করিয়া, আত্মীয়গণকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়াছিলেন। অগ্রজ, তৎকাল পর্য্যন্ত মৃত হরিশ্চন্দ্র ভ্রাতার শোক সংবরণ করিতে পারেন নাই; কেবল পিতার অনুরোধে দেশে গমন করেন। দেশে অবস্থিতির সময় মনে মনে চিন্তা করিলেন যে, অল্পবয়স্ক বালকবালিকাগণ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ শিশুশিক্ষা পড়িয়া, তৎপরে কি পুস্তক অধ্যয়ন করিবে? অনন্তর রুডিমেণ্টস্ অফ নলেজ নামক পুস্তক বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিয়া, ১২৫৭ সালে বোধোদয় নামে একখানি পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন। নিম্নশ্রেণীস্থ বালকগণের পাঠোপযোগী এরূপ কোনও পুস্তক একাল পর্য্যন্ত কেহ প্রকাশ করিতে পারেন নাই।
বাল্যকাল হইতেই অগ্রজ মহাশয় মনে মনে চিন্তা করিতেন যে, স্ত্রীলোকেরা কেন লেখাপড়া শিক্ষা করিতে পায় না? কেনই বা ইহারা যাবজ্জীবন জ্ঞানোপার্জনে অসমর্থা থাকে? কুলীনদিগের বহুবিবাহ কি উপায়ে রহিত হয়? ইহা শাস্ত্রসম্মত নয়; এই কুপ্রথা যতদিন না দেশ হইতে নির্ব্বাসিত হয়, ততদিন বঙ্গদেশবাসী হিন্দুগণের মঙ্গল নাই।
বিধবা বালিকা দৃষ্টিপথে পতিত হইলে, তিনি আন্তরিক দুঃখানুভব করিতেন। এক দিবস, কোন আত্মীয়ের দ্বাদশবর্ষীয়া দুহিতা বিধবা হইলে, তদ্দর্শনে জননী-দেবী শোকে অভিভূত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। অগ্রজ, জননীকে সান্ত্বনা করিলে পর, জননী ও পিতৃদেব বলিলেন যে, “বিধবাবালিকার পুনর্ব্বার বিবাহবিধি কি ধর্ম্মশাস্ত্রের কোনও স্থলে কিছু লেখা নাই? শাস্ত্রকারেরা কি এতই নিৰ্দয় ছিলেন?” জনক-জননীর মুখনিঃসৃত এই বাক্য তাঁহার হৃদয়ে প্রোথিত হইয়া রহিল।
হিন্দু কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেণ্টের ছাত্রগণ ঐক্য হইয়া, সর্ব্ব-শুভকরী নামক মাসিক সংবাদপত্রিকা প্রকাশ করেন। উক্ত সংবাদপত্রের অধ্যক্ষ বাবু রাজকৃষ্ণ মিত্র প্রভৃতি অনুরোধ করিয়া, অগ্রজকে বলেন যে, “আমাদের এই নূতন কাগজে প্রথম কি লেখা উচিত, তাহা আপনি স্বয়ং লিখিয়া দিন। প্রথম কাগজে আপনার রচনা প্রকাশ হইলে, কাগজের গৌরব হইবে এবং সকলে সমাদরপূর্ব্বক কাগজ দেখিবে।” উহাঁদের অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া, তিনি প্রথমতঃ বাল্যবিবাহের দোষ কি, তাহা রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার লিখিত বলিয়া, তৎকালীন কৃতবিদ্য লোকমাত্রেই সমাদরপূর্বক সর্ব্ব-শুভকরী পত্রিকা পাঠ করিতেন। পর মাসে, মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়, স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেন। ইহার পর, চৈত্রসংক্রান্তির সময় লোকে যে জিহবা বিদ্ধ করে ও পীঠ ফুড়িয়া চড়ক করিয়া থাকে, এবং মৃত্যুর পূর্ব্বে যে গঙ্গায় অন্তর্জলি করে, এই দ্বিবিধ কুপ্রথার নিবারণার্থে প্রবন্ধ লিখিবার জন্য দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও তৎকালীন সংস্কৃত-কলেজের সুলেখক ছাত্র মাধবচন্দ্র গোস্বামীর প্রতি ভার দেন।
এই বৎসর অগ্রজ মহাশয়, শিক্ষাসমাজ কর্তৃক হিন্দু-কলেজ, হুগলি-কলেজ, কৃষ্ণনগর-কলেজ ও ঢাকা-কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেণ্টের ছাত্রগণের বাঙ্গালা-রচনার পরীক্ষক নিযুক্ত হন। ভারতবর্ষের স্ত্রীলোকগণকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়া উচিত কি না? এই বিষয়ে তিনি প্রশ্ন দেন। সকল ছাত্র অপেক্ষা কৃষ্ণনগর কলেজের নীলকমল ভাদুড়ী, উক্ত প্রশ্নের সর্বোৎকৃষ্ট উত্তর লিখিয়াছিলেন। তজ্জন্য গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে একটি স্বর্ণমেডেল প্রদান করেন। উক্ত কয়েকটি বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণকালে, প্রেসিডেণ্ট মহামতি ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন উপস্থিত থাকিয়া, ঐ সকল বিদ্যালয়ে স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ের সুদীর্ঘ বক্ততা করিয়া, সাধারণের মনোহরণ করিতেন এবং ঐ সকল বিদ্যালয়ের যে সকল ছাত্র ভাল পরীক্ষা দিয়াছিলেন, পারিতোষিক প্রদানসময়ে, তাঁহাদের রচনাও সর্ব্বসমক্ষে পাঠ করা হইয়াছিল। তদবধি সভাস্থ শ্রোতাগণের মধ্যে অনেক কৃতবিদ্য লোক, যাহাতে দেশে স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলিত হয়, তদ্বিষয়ে আন্তরিক যত্ন করিতে লাগিলেন।
সংস্কৃত-কলেজের সাহিত্যশাস্ত্রাধ্যাপক মদনমোহন তর্কালঙ্কার, সংস্কৃতকলেজ পরিত্যাগ করিয়া, মুরশিদাবাদের জজপণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হইলে পর, কাব্যশাস্ত্রের শিক্ষকের পদ শূন্য হয়। তৎকালীন এডুকেশন কৌন্সিলের সেক্রেটারি ডাক্তার ময়েট্ সাহেব, অগ্রজ মহাশয়কে ঐ পদে নিযুক্ত করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, অগ্রজ মহাশয় নানা কারণ দর্শাইয়া প্রথমতঃ অস্বীকার করেন; পরে, ময়েট্ সাহেব সবিশেষ যত্ন ও আগ্রহ প্রকাশ করাতে তিনি বলিয়াছিলেন, “যদি শিক্ষাসমাজ আমাকে অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করেন, তাহা হইলে আপাততঃ এই পদ গ্রহণ করিতে পারি।” অনন্তর তিনি খৃঃ ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে ৯০৲ টাকা বেতনে সংস্কৃত-কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাক্ষের পদে নিযুক্ত হইলেন। তাঁহার পরমবন্ধু বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, তৎকালে জার্ডিন কোম্পানির হৌসে কেসিয়ারি পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়কে অনুরোধ করিয়া, রাজকৃষ্ণ বাবুকে ঐ কলেজের হেড্ রাইটারের পদে নিযুক্ত করাইয়া দেন। অগ্রজ মহাশয় কিছুদিন সাহিত্যশ্রেণীর অধ্যাপনার কার্য্য সম্পন্ন করিতেছেন, ইত্যবসরে বাবু রসময় দত্ত মহাশয় সংস্কৃত-কলেজের সেক্রেটারীর পদ পরিত্যাগ করিলেন। সেই সময়ে, কিরূপ ব্যবস্থা করিলে, সংস্কৃত-কলেজের উন্নতি হইতে পারে, তদ্বিষয়ের রিপোর্ট প্রদান করিবার জন্য আদেশ হইল। তদনুসারে অগ্রজ মহাশয় রিপোর্ট প্রদান করিলে, ঐ রিপোর্ট দর্শনে সন্তুষ্ট হইয়া, শিক্ষাসমাজ তাঁহাকে সংস্কৃত-কলেজের অধ্যাক্ষের পদে নিযুক্ত করিলেন। এতদিন সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষতা কর্ম্ম, সেক্রেটারি ও আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি, এই দুই ব্যক্তি দ্বারা নির্ব্বাহিত হইয়া আসিতেছিল; এক্ষণে ঐ দুই পদ রহিত করিয়া, শিক্ষা-সমাজ অগ্রজকে ১৫০৲ টাকা বেতনে সংস্কৃত-কলেজের প্রিন্সিপালি পদে নিযুক্ত করিলেন। তখন তিনি কিরূপ বন্দোবস্ত করিলে কলেজের সম্যক্ উন্নতি হইবে, নিরন্তর এই চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে সাহিত্য-শ্রেণীর অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত করিলেন। তৎকালে সাহিত্যশ্রেণীর যে সকল পাঠ্যপুস্তক অবধারিত ছিল, তন্মধ্যে যে কয়েক প্রকারের পুস্তক দুষ্প্রাপ্য হইয়াছিল, তৎসমূহ পুনর্মুদ্রিত করাইয়া বিদ্যার্থিগণের বিশিষ্টরূপ সুবিধা করিয়া দিয়াছিলেন। ভরতমল্লিক, জয়মঙ্গল, নাথুরাম শাস্ত্রী ও প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের টীকাসম্বলিত রঘুবংশ মুদ্রিত ছিল; কিন্তু উহার টিকাগুলি সর্ব্বাঙ্গসুন্দর না থাকায়, মল্লিনাথের টীকাসম্বলিত রঘুবংশ ও কুমারসম্ভব মুদ্রিত করিয়া সাধারণের বিশেষ উপকার করিয়াছিলেন। ইহার পূর্ব্বে কুমারসম্ভব মুদ্রিত হয় নাই; সুতরাং কলেজের ছাত্রগণ হস্তলিখিত পুস্তকদর্শনে অধ্যয়ন করিত। এইরূপ দর্শনশ্রেণীর বিদ্যার্থিগণের যে সকল পাঠ্যপুস্তক মুদ্রিত ছিল না, তৎসমুদয় ত্বরায় মুদ্রিত করাইয়া, ঐ অভাব মোচন করেন। ইহাতে কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্রবর্গের এবং অন্যান্য টোলের ছাত্রবর্গেরও বিশেষ সুবিধা হইয়াছিল।
প্রিন্সিপালের পদে নিযুক্ত হইবার ৬|৭ মাস পরে, অগ্রজ মহাশয় অত্যন্ত পীড়িত হন। কিছু সুস্থ হইবার পর শিরঃপীড়া ও দন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া অতিশয় যন্ত্রণা ভোগ করেন; অনেক চেষ্টা করিয়া কিছু সুস্থ হন। কিন্তু শিরঃপীড়া হইতে একবারে নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারেন নাই, বহু দিবস ব্যাপিয়া শিরঃপীড়ার সূত্র ছিল। প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হইবার কয়েক মাস পরে, এক ভয়ানক দুর্ঘটনা উপস্থিত হইল। অগ্রজ মহাশয়ের প্রধান সহায় লেজিস্লেটিভ কৌন্সিলের মেম্বর ও শিক্ষাসমাজের প্রেসিডেণ্ট ভারতহিতৈষী, বিদ্যোৎসাহী, মহামতি বেথুন সাহেব মহোদয় কালগ্রাসে নিপতিত হইলেন।
অগ্রজ মহাশয়, সংস্কৃত-কলেজের ও অন্যান্য কলেজের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য এবং ভারতবর্ষের জেলায় জেলায় বিদ্যালয় স্থাপন জন্য বিদ্যোৎসাহী বেথুন সাহেবের ভবনে নিরন্তর গমন করিতেন। মহামতি ভারতহিতৈষী বেথুন সাহেব, ভারতবর্ষের অবলাগণের বিদ্যা-শিক্ষার জন্য সর্বপ্রথমে কলিকাতা মহানগরীতে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রথমতঃ কলিকাতাস্থ হিন্দুদলপতিগণ স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ে নানাবিধ অমূলক আপত্তি উত্থাপন করেন; তথাপি বেথুন সাহেব ভগ্নোৎসাহ হন নাই। সর্ব্বাগ্রে কলিকাতা সুকিয়াষ্ট্রীটের বাবু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বৈঠকখানায় অভিনব বালিকাবিদ্যালয়ের কার্য্য় আরম্ভ হয়। সাহেব, প্রতিদিন বালিকাবিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধান করিতে আসিতেন; কিরূপে বিদ্যালয়ের উন্নতি হয়, সতত এই চিন্তায় মগ্ন থাকিতেন। কিছু দিন পরে, পটলডাঙ্গার গোলদিঘীর দক্ষিণপূর্ব্ব-কোণে, পূর্ব্বে যে গৃহে হেয়ার সাহেবের স্কুল ছিল, সেই বাটীতে ঐ বিদ্যালয়ের কার্য্য় নির্বাহ হইত। বালিকাগণকে উৎসাহ দিবার জন্য মধ্যে মধ্যে তৎকালীন গবর্নর জেনারলের পত্নী লেডী ডালহৌসী, বেথুন-সংস্থাপিত এই বিদ্যালয়ে আসিয়া কার্য্য পরিদর্শন করিতেন এবং ত্বরায় যাহাতে বিদ্যালয়ের উন্নতি হয়, তদ্বিষয়ে বিশিষ্টরূপ মনোযোগ দিয়াছিলেন।
কলিকাতাস্থ দলপতিদের নিবারণে প্রথমতঃ কেহ কেহ স্বীয় দুহিতাগণকে শিক্ষার জন্য এই নবপ্রতিষ্ঠিত বালিকাবিদ্যালয়ে পাঠাইতে সাহস করেন নাই। অগ্রজ মহাশয়ের অনুরোধে বহুবাজারনিবাসী বাবু নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, বাবু হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু ঈশানচন্দ্র বসু, তৎকালের সদর দেওয়ানী আদালতের প্রধান উকীল বাবু শম্ভুনাথ পণ্ডিত, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতি কয়েকজন কৃতবিদ্য ও সম্রান্ত লোক স্বীয় স্বীয় কন্যাগণকে শিক্ষার্থে বেথুনবালিকাবিদ্যালয়ে প্রেরণ করিতেন। উক্ত মহোদয়গণ দলপতিদের নিবারণেও ক্ষান্ত হইলেন না। এজন্য কলিকাতা ও পল্লিগ্রামস্থ সম্রান্ত দলপতিরা ঐক্য হইয়া, উহাঁদের সহিত সামাজিক ব্যবহার বন্ধ করিয়া দেন, এবং সংবাদপত্রেও তাঁহাদের যথোচিত দুর্নাম ঘোষণা করিয়াছিলেন। তাহাতেও তাঁহারা স্ব স্ব প্রাণসম দুহিতাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইতে ক্ষান্ত হয়েন নাই। তৎকালে অগ্রজ মহাশয়ের কন্যা হয় নাই; তজ্জন্য অনেকে বলিত, “বিদ্যাসাগরের কন্যা থাকিলে, কখন তিনি ইহাঁদের মত গাড়ী করিয়া বেথুনস্কুলে পাঠাইতেন না। অপরকে উত্তেজিত করিয়া দিয়া নিজে বাহিরে থাকিয়া, সাহেবদের সুখ্যাতিভাজন হইতেছেন।” ‘ যে গাড়ীতে বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠান হইত, ঐ গাড়ীতে ধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতার এই বচনটা স্পষ্টাক্ষরে লেখা ছিল—
“কন্যাপ্যেয়ং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নতঃ।”
সমাজের ভয়ে অন্যান্য কৃতবিদ্য অনেক লোক স্ব স্ব দুহিতা, ভগিনী ও ভাগিনেয়ী প্রভৃতিকে বেথুনস্কুলে পাঠাইতে সাহস করিতেন না। বালিকা ঐ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নার্থে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কোন কোন বালিকার পাণিগ্রহণ-সময়ে বিপক্ষপক্ষ প্রতিবেশী সকল অনেক আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেন। অগ্রজ মহাশয়, পরিশ্রম স্বীকার করিয়া, গতিবিধি ও উপবোধ অনুবোধ দ্বারা ঐ সকল আপত্তি খণ্ডন করিয়া দিতে ক্ষান্ত থাকিতেন না। তৎকালে বেথুন ফিমেল-স্কুলের চিরস্থায়িতার কোন আশাই ছিল না। পরিশেষে বেথুন সাহেব মহোদয়, অগ্রজ মহাশয়কে ঐ বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত করিলেন। তিনি সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হইয়া, ইহার উন্নতির জন্য কায়মনোবাক্যে বিলক্ষণ যত্নবান্ হইয়াছিলেন। বেথুন সাহেব, ফিমেল-স্কুলের বাটী-নির্ম্মাণার্থে স্বীয় প্রচুর অর্থের দ্বারা সিমুলিয়ায় স্বতন্ত্র স্থান ক্রয় করেন। বনিয়াদ্ খোঁড়া হইল, ক্রমশঃ ভিত্তি হইতে আরম্ভ হইল; ইত্যবসরে বেথুন সাহেব, কলিকাতার সন্নিহিত প্রায় দশ মাইল পশ্চিম জনাইগ্রামবাসী লোকদিগের অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া, তথাকার স্কুল পরিদর্শনে গমন করেন। বর্ষাকাল, সুতরাং পথ অতিশয় কর্দ্দমময় হইয়াছিল; তজ্জন্য গাড়ী না চলাতে, শকট হইতে অবরোহণ করিয়া, পদব্রজেই কর্দ্দমোপরি গমন করিয়া বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। ইহার অব্যবহিত পরেই ভয়ানক জ্বরে আক্রান্ত হইয়া, কালের করাল-কবলে নিপতিত হন। ভারতের অদ্বিতীয় বন্ধু, বিদ্যোৎসাহী, সদ্গুণবিভূষিত, পরম দয়ালু বেথুন সাহেব মহানুভবের মৃত্যু-সংবাদে দেশীয় কৃতবিদ্য লোক ও বিদ্যালয়ের ছাত্রসমূহ বিষগ্ন-মনে মৃত মহাত্মার সদনে উপস্থিত হইয়া, শোক ও দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।
অগ্রজ মহাশয়, সর্ব্বসমক্ষে রোদন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার বদনমণ্ডল অশ্রুজলে প্লাবিত হইল, অন্যান্য লোকের উপদেশেও নিবৃত্ত হইলেন না। তিনি বাঙ্গালাদেশের বিদ্যালয়সমূহের উন্নতির জন্য নিরন্তর বেথুনের ভবনে যাইতেন। নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, যথার্থ দেশহিতৈষী বেথুন সাহেব, তাহার প্রতি আন্তরিক স্নেহ ও মমতা প্রদর্শন করিতেন। বিশেষতঃ ভারতবর্ষের জেলাসমূহের মফঃস্বলে প্রায়ই বিদ্যালোচনার অভাব ছিল; অধিকাংশ প্রজাপুঞ্জ কৃষিবৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিত। তাহাদের সন্তানগণ বাল্যকালে পাঠশালায় সামান্য শিক্ষা করিত; তাহার পর অর্থের অসদ্ভাবপ্রযুক্ত কলিকাতায় লেখাপড়া শিক্ষার জন্য যাইতে সম্পূর্ণরূপ অক্ষম হইত। তজ্জন্য যাহাতে গবর্ণমেণ্টের দ্বারা দেশে দেশে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তদ্বিষয়ের উপায় নির্দ্ধারণের জন্য সাহেবের সহিত প্রায়ই আন্দোলন হইত। সাহেব, মফঃস্বলের স্থানে স্থানে বিদ্যালয় স্থাপনজন্য গবর্ণমেণ্টকে উত্তেজিত করিতেন। তাঁহার কথাতেই তৎকালীন গবর্ণর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি কর্ণপাত করিয়াছিলেন। তাহাতেই যে দেশের এরূপ উন্নতি হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই। তিনি আর কিছুদিন জীবিত থাকিলে, না জানি দেশের কতই উন্নতিলাভ হইত। ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য-প্রযুক্ত, বেথুন মহোদয় ইহজগৎ পরিত্যাগ করিলেন। অনন্তর মৃতদেহ সমাধিস্থানে নীত হইল; হেলিডে সাহেব ও অগ্রজ মহাশয়, উভয়ে এক শকটে আরোহণ করিলেন, বিদ্যালয় সমূহের প্রায় সহস্রাধিক ছাত্রগণ সমবেত হইয়া, সমাধিস্থানে সমুপস্থিত হইলেন।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপনান্তে সকলে ম্লানবদনে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। অনন্তর গবর্নর জেনারেল বাহাদুর, বেথুন-ফিমেল-স্কুলের ভার স্বহস্তে লইয়া, তৎকালীন হোমডিপার্টমেণ্টের সেক্রেটারি সিসিল বীডন সাহেব মহোদয়কে এই বিদ্যালয়ে প্রেসিডেণ্ট এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পূর্ব্বের মত অবৈতমিক সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত করিলেন। তাঁহার আন্তরিক যত্ন ও অধ্যবসায়ে, ক্রমশঃ বালিকাবিদ্যালয়ের উন্নতি হইতে লাগিল। যাঁহারা উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান বিদ্বেষ্টা ছিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় ক্রমশঃ তাঁহাদিগকে কমিটী করিয়া উপদেশ দিয়া, তাঁহাদের বাটীর (অর্থাৎ সভাবাজারস্থ রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর প্রভৃতির বাটীর) বালিকাগণকেও বেথুনফিমেল-স্কুলে প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন। সর্বপ্রথমে ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষা-প্রচারবিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ই বেথুন সাহেবকে প্রবৃত্ত করেন। ফলতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয় আন্তরিক যত্ন না করিলে, তৎকালে এতদ্দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত হওয়া দুষ্কর হইত। তাঁহার যত্নের শৈথিল্য থাকিলে, কোন্কালে বেথুন-ফিমেল-স্কুল উঠিয়া যাইত।
চেম্বর্স, ইংরাজী-ভাষায় মর্যাল ক্লাসবুক নামে যে পুস্তক প্রচারিত করিয়াছেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় সন ১২৫৭ সালে, এতদ্দেশীয় বালকবালিকাগণের নীতিজ্ঞানার্থ নীতিবোধ নাম দিয়া, বাঙ্গালাভাষায় ঐ পুস্তকখানি অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হন। প্রথমতঃ, পশুগণের, প্রতি ব্যবহার, পরিবারের প্রতি ব্যবহার, প্রধান ও নিকৃষ্টের প্রতি ব্যবহার, পরিশ্রম, স্বচিন্তা ও স্বাবলম্বন, প্রত্যুৎপন্ন-মতিত্ব, বিনয়, এই কয়েকটি প্রস্তাব অনুবাদ করিয়াছিলেন এবং প্রত্যেক প্রস্তাবের উদাহরণস্বরূপ যে সকল বৃত্তান্ত লিখিত হইয়াছে, তন্মধ্যে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথাও তাঁহার অনুবাদিত; কিন্তু প্রিন্সিপাল-পদে নিযুক্ত হওয়ায় ও অন্যান্যরূপ কার্য্য়ে নিরন্তর ব্যাপৃত থাকায়, অনবকাশ-প্রযুক্ত তিনি তাহার পরমবন্ধু বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রতি নীতিবোধ প্রস্তুত করিবার ভারার্পণ করেন। তিনি অবশিষ্ট অংশ লিখিয়া, সন ১২৫৮ সালের ৪ঠা শ্রাবণ মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন।
ঐ সালে মার্শেল সাহেব, সংস্কৃত-কলেজের জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় ডিপার্টমেণ্টের পরীক্ষক নিযুক্ত হন। অন্যান্য বৎসর অপেক্ষা এ বৎসরের পরীক্ষার ফল উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সুনিয়মই ইহার কারণ। ঐ বৎসরের আশ্বিন মাসে পূজার অবকাশে অগ্রজ মহাশয়, বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারিকে সঙ্গে লইয়া বাটী যান। তথায় উভয়েই পুস্তক লইয়া শচীসরোবরের এক অশ্বথবৃক্ষের মুলে বসিয়া, পুস্তক-পাঠ ও কথোপকথন করিতেন। যে কয়েক দিবস বাটীতে অবস্থিতি করিতেন, সেই কয়েক দিন দরিদ্র লোকের বিলক্ষণ সুবিধা হইত; কারণ, তিনি তাহাদিগকে গোপনে কিছু কিছু দান করিতেন।
গ্রামবাসীদের বাটীতে যাইয়া ও সবিশেষ অনুসন্ধান লইয়া, যাহার যেরূপ অভাব থাকিত, সাধ্যানুসারে তিনি তাহার সেই অভাব মোচন করিতেন। ইহা জানিয়া অন্যান্য ধনশালী লোকেরা আশ্চর্য্য়ান্বিত হইতেন যে, যিনি এতাদৃশ প্রচুর অর্থ দান করেন, তাঁহার গোপনে দান করিবার কারণ কি? আমরা যাহা দান করি, তাহা সকলকেই প্রকাশ করিয়া থাকি। একদিবস একটি ভদ্রলোক, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, “মহাশয়! গোপনে দান করিবার তাৎপর্য কি?” তিনি উত্তর করেন যে, “লোকের সমক্ষে দিলে লইতে যদি লজ্জিত হয়, এজন্য গোপনভাবে দেওয়া হয়। যাহারা প্রকাশ্যে দান করেন, তাঁহারা লোকের নিকট প্রতিষ্ঠালাভের অভিপ্রায়ে করিয়া থাকেন। আমি সর্ব্বসমক্ষে কাহাকেও দান করি না; লোকের কষ্ট দেখিলেই দিয়া থাকি। নামে আমার আবশ্যক নাই।”
ঐ বৎসর আশ্বিন মাসে অগ্রজ মহাশয় বাটীতে থাকিয়া দেখিলেন, কনিষ্ঠ সহোদর ঈশান ও তাঁহার পুত্র নারায়ণকে পিতৃদেব অত্যন্ত আদর করেন; তদ্দর্শনে পরিহাসপূর্ব্বক পিতৃদেবকে বলিলেন, “আপনি ঈশানের ও নারায়ণের মাথা খাইতেছেন, তথাপি আপনি লোকের নিকট আপনাকে কিরূপে নিরামিষাশী বলিয়া পরিচয় দেন?”
তৎকালে সংস্কৃত-কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যজাতীয় সন্তানগণ অধ্যয়ন করিত। ব্রাহ্মণের সন্তানেরা সকল শ্রেণীতেই অধ্যয়ন করিত; বৈদ্যজাতীয় বালকেরা দর্শন-শাস্ত্র পর্য্য়ন্ত অধ্যয়ন করিতে পাইত, বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে পাইত না। শূদ্র-বালকের পক্ষে সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন নিষেধ ছিল। অগ্রজ মহাশয়, প্রিন্সিপাল হইয়া, শিক্ষাসমাজে রিপোর্ট করিলেন যে, হিন্দুমাত্রেই সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন করিতে পারিবে। শিক্ষাসমাজ রিপোর্টে সন্তুষ্ট হইয়া, তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। ইহা শ্রবণ করিয়া, ব্রাহ্মণের আপত্তি করিলেন যে, “শূদ্রের সন্তানেরা সংস্কৃত-ভাষা কদাচ শিক্ষা করিতে পাইবে না।” তাহাতে অগ্রজ মহাশয় বলিয়াছিলেন যে, “পণ্ডিতেরা” তবে কেমন করিয়া সাহেবদিগকে সংস্কৃত শিক্ষা দিয়া থাকেন? আর সভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব শূদ্রবংশোদ্ভব, তবে তাঁহাকে কি কারণে সংস্কৃত-শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল?” এইরূপে অগ্রজ মহাশয়ের দ্বারা সকল আপত্তি খণ্ডিত হইয়াছিল। তাঁহার মত এই যে, শূদ্রসন্তানেরা ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে পারিবেন, শাস্ত্রের কোনও স্থানে ইহার বাধা নাই। কেবল ধর্মশাস্ত্র স্মৃতি অধ্যয়ন করিতে পারিবেন না। তজ্জন্য শূদ্রগণের স্মৃতির শ্রেণীতে অধ্যয়ন রহিত হইয়াছে। তদবধি শূদ্রজাতীয় সন্তানগণ সংস্কৃতকলেজে প্রবিষ্ট হইয়া, সংস্কৃত ভাষা অবাধে শিক্ষা করিয়া আসিতেছেন। শূদ্রেরা যে সংস্কৃত অধ্যয়ন করিতেছেন, কেবল বিদ্যাসাগর মহাশয়ই ইহার প্রধান উদ্যোগী; ইঁহার যত্নে ও আগ্রহাতিশয়েই শূদ্রগণের সংস্কৃতশিক্ষা প্রচলিত হইয়াছে এবং ইহাতে দেশের বিশেষ উপকার সাধিত হইতেছে।
তৎকালে সংস্কৃত-কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যজাতির সন্তানেরা বিনা বেতনে অধ্যয়ন করিত। বেতন না লইয়া শিক্ষা দেওয়ায়, সাহেবদের নিকট বিদ্যালয়ের গৌরব থাকে না। একারণ, তিনি, অতঃপর ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও শূদ্রের যে সকল নূতন বালক অধ্যয়নার্থ আসিত, তাহাদের নিকট হইতে মাসিক বেতন আদায়ের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
সাহিত্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে হইলে, অগ্রে সংস্কৃত-ব্যাকরণ শিক্ষা করা অত্যাবশ্যক, নচেৎ সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি লাভ হয় না। অনেক কৃতবিদ্য বিচক্ষণ বিষয়ী লোক, সংস্কৃত-ভাষা শিখিতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন; কিন্তু ব্যাকরণে অজ্ঞতাপ্রযুক্ত সংস্কৃত অধ্যয়নে বঞ্চিত হইয়াছেন। অধ্যাপকগণ সুকুমারমতি শিশুগণকে ব্যাকরণের যাহা উপদেশ প্রদান করিতেন, বালকগণ তাহা কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিত, কোন বালকই ভালরূপ বুঝিতে পারিত না। শুকপক্ষীকে লোকে যেমন রাধাকৃষ্ণ পাঠ শিক্ষা দেয়, অনেকবার শিক্ষা দেওয়ায় বনের পক্ষীও যেমন ঐ নাম বলিতে পারে; কিন্তু রাধাকৃষ্ণ যে কি পদার্থ তাহা তাহার কখনই বোধগম্য হয় না; ব্যাকরণেও তাহাদের সেইরূপ বুৎপত্তি জন্মিত।
সন ১২৫৮ সালের ১লা অগ্রহায়ণ অগ্রজ মহাশয়, অল্পবয়স্ক বালকগণের আশু সংস্কৃত-ভাষার অধ্যয়নের সৌকর্য্যার্থে ব্যাকরণের উপক্রমণিকা নামক পুস্তক রচনা করিয়া মুদ্রিত ও প্রকাশিত করিলেন। ইহার মধ্যে সন্ধি, শব্দ, ধাতু, কৃদন্ত, কারক, সমাস, তদ্ধিত আছে। সংস্কৃত-ভাষায় অধিকাংশ পুস্তক দেবনাগর অক্ষরে লিখিত থাকে; একারণ, উপক্রমণিকার শেষভাগে দেবনাগর অক্ষরের বর্ণপরিচয়ও মুদ্রিত হইয়াছে। উপক্রমণিকা শেষ করিয়া সাহিত্য বুঝিতে পারিবে না, এই জন্য শেষে সরল-ভাষায় সংস্কৃত গদ্য-রচনাও সন্নিবেশিত হইয়াছে। বিদ্যার্থী বালকগণ ছয় মাসের মধ্যে উপক্রমণিকা পাঠ করিয়া, সংস্কৃত-ভাষা শিখিতে সক্ষম হয় দেখিয়া, সর্ব্বসাধারণ লোকে অগ্রজের এই লোকাতীত ক্ষমতায় আশ্চর্য্য়ান্বিত হইয়াছিলেন।
উপক্রমণিকা অধ্যয়ন করিয়াই রঘুবংশ প্রভৃতি অধ্যয়ন করা শিশুগণের পক্ষে দুরূহ বিবেচনা করিয়া, পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থ হইতে কতিপয় সরল গল্প উদ্ধৃত করিয়া, সন ১২৫৮ সালের ১লা অগ্রহায়ণ, সংস্কৃত ঋজুপাঠ নামক পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন। সন ১২৫৮ সালের ২২শে ফাল্গুন রামায়ণের কতিপয় শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া, ২য় ভাগ ঋজুপাঠ মুদ্রিত করেন। তৎপরে হিতোপদেশের সরল গদ্য ও পদ্য এবং মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, ঋতুসংহার, বেণীসংহার ও ভট্টিকাব্য এই সকল গ্রন্থের কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া, তৃতীয় ভাগ ঋজুপাঠ মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেন। বালকেরা এক বৎসরের মধ্যে ঋজুপাঠ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ অধ্যয়ন করিয়া, অনায়াসে সাহিত্য-শাস্ত্র অধ্যয়ন করিবার অধিকার পাইয়া থাকে এবং সংস্কৃত রচনা করিবারও যে সামান্যরূপ ক্ষমতালাভ করিয়া থাকে, তাহা বিলক্ষণরূপে প্রকাশ পাইয়াছে। ব্যাকরণের উপক্রমণিকা প্রচার না হইলে, বিষয়ী লোক প্রভৃতি কখনই সংস্কৃত অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হইতে সক্ষম হইতেন না। ফলতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয়ই সংস্কৃত-ভাষা শিখিবার সহজপথপ্রদর্শক।
কলিকাতায়, গ্রীষ্মের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব, ঐ সময় কলিকাতায় থাকিরা পাঠ করা একান্ত কষ্টকর; একারণ, ঐ সময়ে অবকাশের আবশ্যক বিবেচনা করিয়া বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ দুই মাস অবকাশের জন্য শিক্ষাসমাজে আবেদন করিয়া কৃতকার্য্য হন। তদবধি বাঙ্গালাদেশে ঐ দৃষ্টান্তে ক্রমশঃ গ্রীষ্মবকাশ প্রবর্তিত হইয়াছে।
অগ্রজ মহাশয় ১২৫৯ সালের গ্রীষ্মবকাশে কলিকাতা হইতে যাত্রা করিয়া, পদব্রজে ৬ ক্রোশ অন্তর চণ্ডীতলা গ্রামের এক পান্থনিবাসে রাত্রিযাপনপূর্ব্বক, পরদিবস পদব্রজেই তথা হইতে ২০ ক্রোশ অন্তর বীরসিংহায় নিজ বাটীতে পঁহুছিয়াই, পিতা মাতা ভাই ভগিনী ও প্রতিবেশী বন্ধুবর্গের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
পর দিবস হইতে গ্রামস্থ নিরুপায়দিগকে বিবেচনামত কিছু কিছু দিয়া সাহায্য করিতে লাগিলেন; ইহা দেখিয়া গ্রামের ও পার্শ্ববর্ত্তী গ্রামের অনেকে ইঁহাকে ধনশালী বলিয়া স্থির করিলেন। বোধ হয়, এই কারণেই গ্রামস্থ ব্যক্তিদের যোগে ৩০শে বৈশাখ আমাদের বাটীতে ডাকাইতি হয়। ঐ দিবস আমরা রাত্রি নয়টার পর ভোজনান্তে অন্তঃপুরে শয়ন করিয়াছি, সদর-বাটীতে প্রায় ৩০ জন পুরুষ নিদ্রা যাইতেছিলেন, এতদ্ব্যতীত দুই জন গ্রাম্য-চৌকিদারও জাগরিত ছিল। নিশীথসময়ে বাটীর সম্মুখে প্রায় ৪০ জন লোক ভয়ানক চীৎকার করিয়া উঠিল; ঐ চীৎকার-শ্রবণে আমাদের সকলেরই নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন, ডাকাইতগণ মশাল জ্বলিয়া মধ্যদ্বার ভাঙ্গিতেছিল, তদ্দর্শনে দাদা অত্যন্ত ভীত হইলেন। আমরা অলক্ষিতভাবে খিড়কির দ্বার দিয়া, তাঁহাকে লইয়া বাটী হইতে প্রস্থান করি। দস্যুগণ, অগ্রজকে ধরিতে পারিলে, টাকার জন্য বিলক্ষণ যাতনা দিত। অনন্তর দস্যুগণ যথাসর্বস্ব লুঠিয়া লইয়া প্রস্থান করিল। রাত্রিতেই ঘাঁটাল-থানার দারোগাকে সংবাদ দেওয়ায়, তিনি পরদিন প্রাতে পঁহুছিয়া, পুলিশকর্মচারিদের প্রথানুসারে গোলমাল করায়, পিতৃদেব বলিলেন, “আপনি কুলীন-ব্রাহ্মণের ছেলে বলিয়া আপনার মর্য্য়াদা রাখিতে পারি, কিন্তু এ সম্বন্ধে আপনাকে কিছু দিতে পারি না।” অনন্তর পিতৃদেব, পরিবারবর্গের কাহারও দ্বিতীয় বস্ত্র না থাকায় ও ঘটী, বাটী, থালা ইত্যাদি কিছুমাত্র না থাকায়, ঐ সকল দ্রব্য ক্রয় করিবার জন্য উদয়গঞ্জ ও খড়ার গ্রামে গমন করিলেন। ইত্যবসরে অগ্রজ মহাশয় বাটীর সম্মুখে ভ্রাতা ও বন্ধুবর্গ লইয়া কপাটী খেলা আরম্ভ করিলেন। দারোগাবাবু, ফাঁড়ীদারকে বলিলেন, “এ বামুনের (ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের) এত কি জোর যে, আমি দারোগা, আমার মুখের উপর জবাব দেয় যে, এক পয়সাও দিব না; এবং ইহাও অতি আশ্চর্য্য়ের বিষয় যে, (অঙ্গুলি দ্বারা দাদাকে দেখাইয়া) ঐ ছোঁড়াটা কি রকমের লোক; কল্য ডাকাইতি হইয়াছে, আজ সকালেই বাটীর সম্মুখে কপাটী খেলিতেছে।” ফাঁড়ীদার বলিল, “হুজুর, ইনি সামান্য লোক নহেন। ইনি দেশে আসিলে, জাহানাবাদের ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট্ বাবু ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল, বন্ধুভাবে এখানে আসিয়া ইঁহার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া, আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন, এবং শুনা যায় যে, বড় লাট ও ছোট লাট সাহেবের সহিত ইঁহার বন্ধুত্ব আছে, ইঁহার মত লইয়া জজ মাজিষ্ট্রেট্ বাহাল হয়।” ইহা শুনিয়া দারোগা স্তব্ধ হইল, এবং শান্তভাবে কার্য্য করিল; ডাকাইতির কোন কিনারা হইল না। গ্রীষ্মকালের শেষে কলিকাতায় আসিবার পর, এক দিবস ছোট লাট হেলিডের সহিত দাদার সাক্ষাৎ হইলে, কথাপ্রসঙ্গে হেলিডে সাহেব বলিলেন, “তুমি অতি কাপুরুষ, বাটীতে ডাকাইত পড়িল, আর তুমি বিষয় রক্ষা না করিয়া ও তাহাদিগকে না ধরিয়া, কাপুরুষের মত পলায়ন করিলে; ইহা অপেক্ষা তোমার পক্ষে আর কি লজ্জার বিষয় হইতে পারে।”
ঐ সময়ে দেশহিতৈষী হেলিডে সাহেব, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের পদে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। ঐ পদ ভারতবর্ষে এই নুতন স্থাপিত হইল। ঐ সময়ে এডুকেশন কৌন্সেল কার্য্য়দক্ষ সেক্রেটারি ডাক্তার ময়েট্ সাহেব, কিছু দিনের জন্য অবকাশ গ্রহণ করিয়া, স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করেন। হেলিডে সাহেব বাহাদুর নুতন লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর হইয়া, সাবেক শিক্ষাসমাজের পরিবর্তন করেন। এডুকেশন কৌন্সেল নামের পরিবর্তে এক্ষণে পব্লিক্ ইন্ষ্টিটিউসন্ এই নামকরণ করিলেন। সেক্রেটারি নাম না রাখিয়া, ডিরেক্টরের পদ স্থাপন করেন ও ঐ পদে গর্ডন্ ইয়ঙ্ সাহেবকে নিযুক্ত করেন। তৎকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়, হেলিডে সাহেবকে বলেন যে, “আপনি অল্পবয়স্ক সিবিলিয়ান্ বালককে এতবড় গুরুতর ভার দিয়া ভাল করেন নাই; তিনি এ প্রদেশের রীতি-নীতি আচারব্যবহার কিছুমাত্র পরিজ্ঞাত নন; যেহেতু ঐ সাহেব সিবিলিয়ান্, অহঙ্কৃত ও বালক, বিশেষতঃ উনি অল্পদিন হইল ভারতবর্ষে সমাগত হইয়াছেন; এ প্রদেশের রীতি-নীতি কিছুই পরিজ্ঞাত নহেন, শিখিতে আরও কিছুকাল লাগিবে। ইনি কিরূপে এই গুরুতর ভার বহন করিবেন, বুঝিতে পারি না। ডাক্তার ময়েট্, বহুকাল হইতে শিক্ষাসমাজের কর্ম্মধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁহার প্রতি এ ভার সমর্পণ করিলে, সর্ব্বোতোভাবে ভাল হইত।” ইহা শ্রবণ করিয়া, হেলিডে সাহেব বলিলেন, “আমার নিজের এ বিষয় পরিদর্শনে বিলক্ষণ ইচ্ছা আছে। আমি নিজেই সকল কাজ দেখিব, ইয়ঙ্ সাহেব উপলক্ষমাত্র; তুমি দুই মাস ইয়ঙ্ সাহেবকে কার্য্যশিক্ষা দাও। ইয়ং বুদ্ধিমান্, ত্বরায় কার্য্য়দক্ষ হইবার সম্ভাবনা।” হেলিডের আদেশে, বিদ্যাসাগর মহাশয় কয়েক মাস, মধ্যে মধ্যে ডিরেক্টার আফিসে যাইয়া, ঐ সাহেবকে উপদেশ প্রদান করিয়া কার্য্য়ক্ষম করিয়া দেন। যে কয়েক মাস ইয়ঙ্ সাহেব কার্য্য শিক্ষা করেন, সেই কয়েক মাস অগ্রজকে বিশেষ সম্মান করিতেন।
অগ্রজ মহাশয়, জন্মভূমি বীরসিংহ ও তৎসন্নিহিত গ্রামবাসী লোগণের ও বালকবৃন্দের মোহান্ধকার নিবারণমানসে বিদ্যালয় স্থাপন করিবেন, শৈশবকাল হইতে এ বিষয় মনে মনে আন্দোলন করিতেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবপ্রযুক্ত, বিদ্যালয় স্থাপন করিব এই কথা, এতাবৎকাল পর্যন্ত ব্যক্ত করিতে পারেন নাই। এক্ষণে মাসিক ৩০০৲ তিন শত টাকা বেতন পাইতেন ও বেতালপঞ্চবিংশতি, জীবনচরিত, বাঙ্গালার ইতিহাস, উপক্রমণিকা, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তক বিক্রয়ের লাভও যথেষ্ট হইত; একারণ, ভ্রাতৃচতুষ্টয়সহ ফাল্গুনমাসে জলপথে উলুবেড়ে, গেঁয়োখালি, তমোলুক, কোলা, বাক্সী, গোপীগঞ্জ হইয়া তৃতীয় দিবসে ঘাঁটালে নৌকা হইতে অবতরণ করিয়া বাটী যান, এবং বাটীতে সমুপস্থিত হইয়া, পিতৃদেব মহাশয়কে বলেন যে, “আপনি দেশে টোল করিয়া দেশস্থ লোককে বিদ্যাদান করিবেন, ইহা বহুদিন পূর্ব্বে মধ্যে মধ্যে প্রায় ব্যক্ত করিতেন; এক্ষণে মহাশয়ের আশীর্বাদপ্রভাবে অবস্থা ভাল হইয়াছে, অতএব আমি বীরসিংহায় একটী বিদ্যালয় স্থাপন করিতে মানস করিয়াছি।” ইহা শ্রবণ করিয়া, জননী-দেবী ও পিতৃদেব মহাশয় পরম আহ্লাদিত হইয়া, দাদার মুখচুম্বন করিয়া আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন। পরদিন বিদ্যালয়ের স্থান নিরূপণ হইল। ভূস্বামী রামধনচক্রবর্তী প্রভৃতিকে মূল্য দিয়া ভূমিবিক্রয়ের কোবালাপত্র লিখাইয়া লইলেন। ইহার পরদিবস মঞ্জুর পাওয়া যায় নাই দেখিয়া, দাদা স্বয়ং কোদালগ্রহণপূর্ব্বক ভ্রাতৃবর্গসহ মাটী খনন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পরে বিদ্যালয়গৃহ শীঘ্র নির্ম্মাণজন্য, পিতৃদেবকে সহস্রাধিক মুদ্রা দিয়া কলিকাতায় গমন করিলেন।
১৮৫৩ খৃঃ অব্দে গ্রীষ্মবকাশের পূর্বে চৈত্রমাসে, মধ্যম ও তৃতীয় সহোদর ও তৎকালীন বাসার যে যে আত্মীয় সংস্কৃত-কলেজের উচ্চ-শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিত, তাহাদিগকে দেশস্থ বালকগণের শিক্ষাকার্য্য় সম্পাদনার্থে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। বিদ্যাভবন প্রস্তুত হইতে আরও চারি মাস সময় অতিবাহিত হইবে, একারণ, দেশস্থ স্বীয় বাসভবনে ও সন্নিহিত প্রতিবেশীলোকের ভবনে, ফাঙ্কনমাসে বীরসিংহগ্রামে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ইতিপূর্বে এ প্রদেশে কোনও স্কুল স্থাপিত হয় নাই। স্থানীয় অনেকের সংস্কার ছিল, স্কুলে অধ্যয়ন করিলে খৃষ্টান হইয়া থাকে। কেহ কেহ বলিতেন, ছেলেরা নাস্তিক হইবে। কোন কোন ভট্টাচার্য্য়ের সংস্কার ছিল, জাতিভ্রংশ হইবে; ইত্যাদি কত লোকে কত কথাই প্রকাশ করিতে লাগিল। তৎকালে বীরসিংহবাসী লোকদিগের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ ছিল। সদ্গোপেরা কৃষিকর্ম্ম করিয়া দিনপাত করিত। ইহাদের সন্তানগণ গরু চরাইত; কেহ কেহ অন্যের ক্ষেত্রে মজুরি করিয়া দিনপাত করিত। অনেকের দিনান্তে অন্ন জুটা দুষ্কর হইত। যাহা হউক, বিদ্যালয় স্থাপন করিবামাত্র ৫|৭ দিনের মধ্যেই প্রায় শতাধিক বালক অধ্যয়নার্থ প্রবিষ্ট হইল। ক্রমশঃ সন্নিহিত গ্রাম পাথরা, উদয়গঞ্জ, কুরাণ, গোপীনাথপুর, যদুপুর, দণ্ডীপুর, ঈড়পালা, দীর্ঘগ্রাম, সাততেঁতুল, আমড়াপাট, পুড়শুড়ী, মাম্রুল, আকপপুর, আগর, রাধানগর ক্ষীরপাই প্রভৃতি গ্রাম হইতে যথেষ্ট বালক বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। পাঠ্যপুস্তক ক্রয় করে, অনেকেরই এমন সঙ্গতি ছিল না। বিদ্যালয় অবৈতনিক হইল। অগ্রজ মহাশয়, কলিকাতা হইতে প্রায় ৩০০ তিন শতের অধিক বালকের জন্য পাঠ্যপুস্তক এবং কাগজ, শ্লেট প্রভৃতি অকাতরে প্রেরণ করিতেন। স্বগ্রামের যে যে ছাত্রের বস্তাভাব ছিল, তাহাদিগকে বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিবার জন্য, আমাকে আদেশ দেন। ঐ সময়ে বিদেশস্থ অনেক অধ্যাপকের পুত্র, অধ্যয়ন-মানসে সমাগত হন।
যাহারা অন্যের বাটীতে বেতন গ্রহণ করিয়া দিবসে গরু চরাইত, বা যাহারা দিবসে কৃষিকর্ম্ম করিত, তাহাদের লেখাপড়া শিক্ষার জন্য নাইট্-স্কুল স্থাপন করিলেন। ঐ স্কুলে সন্ধ্যার পর রাত্রি দুই প্রহর পর্যন্ত দুইজন শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন; বিনামূল্যে পুস্তক দিতে হইত, এই সকল বিষয়ে যা ব্যয় হইত, তাহা অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং নির্ব্বাহ করিতেন। ঐ সময়ে এ প্রদেশে ডাক্তারি চিকিৎসার প্রচলন ছিল না। অগ্রজ মহাশয়, দেশস্থ লোকের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়া, দাতব্যচিকিৎসালয় স্থাপন করেন। সকলেই বিনামূল্যে ঔষধ পাইত। বীরসিংহা, বোয়ালিয়া, পাথরা, মামুদপুর প্রভৃতি সন্নিহিত গ্রামে কাহারও বাটীতে চিকিৎসা করিতে হইলে, পদব্রজে যাইয়া বিনা ভিজিটে চিকিৎসা করিবার ব্যবস্থা ছিল। এতদ্ব্যতীত দুঃস্থ লোকের পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি দেওয়া হইত।
তৎকালে এ প্রদেশের স্ত্রীলোকেরা লেখাপড়া শিক্ষা করিত না। বীরসিংহায় সর্ব্বাগ্রে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সকল বালিকাই বিনামূল্যে পুস্তক পাইত। যৎকালে কলিকাতায় প্রথম বেথুন-ফিমেল-স্কুল স্থাপিত হয়, তৎকালে কলিকাতাবাসী সন্ত্রান্ত দলপতিগণ ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত লোকেরা নানারূপ গোলযোগ করিয়াছিলেন; কিন্তু বীরসিংহায় বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হইলে, প্রতিবেশিবর্গ সন্তুষ্টচিত্তে স্বীয় স্বীয় দুহিতাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। তজ্জন্য, সন্নিহিত অপরাপর গ্রামস্থিতলোক সকল কোনও প্রকার আপত্তি উত্থাপন করেন নাই। বালকবিদ্যালয়ে প্রথমতঃ বাঙ্গালা এবং সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কারাদির শিক্ষা দেওয়া হইত; কিছুদিন পরে, অধিক সংস্কৃত সাহিত্যাদি অধ্যয়ন না করাইয়া, রীতিমত ইংরাজী ও সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হইত। অগ্রজ মহাশয়, উক্ত বিদ্যালয়ে মাষ্টার ও পণ্ডিতের বেতন মাসিক ৩০০৲ টাকা প্রদান করিতেন; এতদ্ব্যতীত পুস্তকাদির জন্য মাসিক অন্ততঃ ১০০৲ টাকা ব্যয় হইত। অগ্রজের পরম আত্মীয় বাবু প্যারিচরণ সরকার তাহার ফার্ষ্টবুক, সেকেণ্ড বুক, থার্ডবুক প্রভৃতি পুস্তকগুলি বালকদিগের পাঠার্থ বিনামূল্যে দান করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, বীরসিংহার বালিকাবিদ্যালয়ে মাসে মাসে ৩০৲ টাকা ব্যয় করিতেন। ডাক্তারখানায়, ডাক্তার ও কম্পাউণ্ডারের বেতন এবং বাজে খরচ ও ঔষধাদির মূল্য প্রভৃতিতে মাসে মাসে ১০০৲ টাকা প্রদান করিতেন। নাইট্স্কুলে প্রতিমাসে ১৫৲ টাকা প্রদান করিতেন।
ইতিপূর্ব্বে গ্রামে কয়েকটী পাঠশালা ছিল; অবৈতনিক স্কুল হওয়াতে তাহ উঠিয়া গেল। পাঠশালার শিক্ষকগণের দিনপাতের অন্য কোন উপায় না থাকায়, পাঠশালার গুরুমহাশয়ের অগ্রজের নিকট দুঃখ জানাইতে লাগিলেন। একারণ, তিনি তাঁহাদের প্রতি দয়া করিয়া, আমায় আদেশ করেন যে, ঈশ্বরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরচন্দ্র আচার্য্য, উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও মধুসূদন ভট্টাচার্য্য এই কয়েক জনকে তুমি প্রাতে ও রাত্রিতে পরিশ্রমসহকারে বাঙ্গালা পুস্তক ও উপক্রমণিকা, পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ প্রভৃতি ত্বরায় শিখাইয়া দাও। অদ্য হইতে ইঁহারা নিম্ন-শ্রেণীর শিক্ষক নিযুক্ত হইলেন। পাঠশালায় ইহাদের যেরূপ প্রাপ্য ছিল, তদপেক্ষায় কিছু অধিক বেতন পাইবে; ভাল করিয়া শিখিতে পারিলে, রীতিমত বেতন দেওয়া যাইবে। তাহার বাল্যকালের গুরুমহাশয় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে নিম্নশ্রেণীর ছোট ছোট ছেলেদিগের বর্ণপরিচয় শিক্ষা দিবার নিমিত্ত নিযুক্ত করেন।
খৃঃ ১৮৫৫ সালে সংস্কৃত-কলেজের অধ্যক্ষতাস্বত্বেও মহানুভব লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর হেলিডে সাহেব বাহাদুর, ইঁহাকে হুগলি, বর্দ্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর, এই জেলাচতুষ্টয়ের স্থানে স্থানে বিদ্যালয় সংস্থাপন ও পরিদর্শন জন্য মাসিক ২০০৲, দুই শত টাকা বেতনে স্পেসিয়্যাল ইস্পেক্টার নিযুক্ত করেন।
ঐ সময়ে, অগ্রজের সংস্কৃত-কলেজের প্রিন্সিপালের বেতন ৩০০৲ তিন শত টাকা, উপরি উক্ত কার্যের বেতন ২০০৲, দুই শত টাকা, এতদ্ব্যতীত জেলায় জেলায় পরিভ্রমণের ব্যয় স্বতন্ত্র নির্দিষ্ট ছিল।
তৎকালে প্রাট্ সাহেব এবং আরও দুই জন ইংরাজ, স্কুল ইনস্পেক্টারের পদে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ইংলণ্ডের রাজপুরুষদের সহিত শিক্ষা-বিষয়ে পরস্পর পত্র লেখা চলিতেছিল। ত্বরায় স্কুল বসাইবার জন্য ইংলণ্ড হইতে আদেশপত্র আসায়, অগ্রজ মহাশয়, সত্বর স্থানে স্থানে স্কুল বসাইতে লাগিলেন। কিন্তু ডিরেক্টর ইয়ং সাহেব, আদেশ-পত্রের বিপরীত অর্থ করিয়া ক্ষান্ত থাকিলেন।অপর তিন জন স্কুল ইন্স্পেক্টার সাহেব এবং লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর হেলিডে সাহেবও বিপরীত বুঝিয়া, অগ্রজকে কিছুদিনের জন্য স্কুল বসাইতে ক্ষান্ত থাকিতে বলিলেন। তিনি ক্ষান্ত না হওয়ায়, ডাইরেক্টার এ বিষয়ে লেপ্টেনেণ্ট গবর্নরকে জানাইলেন। লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর, অগ্রজ মহাশয়কে ডাকাইয়া, অনেক বাদানুবাদের পর ঐ বিষয় বিলাতে রাজপুরুষদিগের গোচর করিলেন। রাজপুরুষগণ এই সংবাদ পাইয়া, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুরকে ত্বরায় বিদ্যালয় স্থাপনের আদেশ পাঠান এবং ঐ পত্রে অগ্রজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই সূত্রে তাঁহার সহিত ডাইরেক্টার ইয়ং সাহেবের অপ্রণয় বদ্ধমূল হয়। এই অপ্রণয়ই তাহার ভাবী পদ-পরিত্যাগের মূল-কারণ।
আদর্শ-বিদ্যালয়ে বা ইংরাজী বিদ্যালয়ে যাঁহারা শিক্ষকতার কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবেন, তাঁহাদের শিক্ষার জন্য অগ্রজ, গবর্ণমেণ্টকে অনুরোধ করিয়া, কলিকাতায় নর্ম্যালে স্কুল স্থাপন করেন। প্রথমতঃ বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত, পণ্ডিত মধুসূদন বাচস্পতি ও রাজকৃষ্ণ গুপ্ত, নর্ম্যাল স্কুলের শিক্ষকতাপদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পরে অক্ষয়বাবু শিরঃপীড়া প্রভৃতি নানা রোগে আক্রান্ত হইয়া কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে, তৎকালের সংস্কৃত-কলেজের সর্ব্বপ্রধান ছাত্র বাবু রামকমল ভট্টাচার্য্যকে নর্ম্যালে স্কুলের প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত করেন। রামকমল বাবু সংস্কৃত ও ইংরাজীতে অদ্বিতীয় লোক ও অসাধারণ ধী-শক্তিসম্পন্ন; তাঁহার ন্যায় বুদ্ধিমান্ লোক সম্প্রতি দৃষ্টিগোচর হয় নাই। একারণ, বিদ্যাসাগর মহাশয়, রামকমলকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; তাঁহার আশা ছিল, রামকমলের দ্বারা দেশের অনেক উপকার হইবে। তৎকালে মফঃস্বলের টোল হইতে অনেক ব্রাহ্মণপণ্ডিত ও অপরাপর লোক, বিদ্যালয়ের পণ্ডিতের কর্ম্ম প্রাপ্ত্যভিলাষে নর্ম্যালে প্রবিষ্ট হইয়া, শিক্ষাজন্য পরীক্ষা দিতে লজ্জিত হইতেন না। যাঁহারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতেন, তাঁহারাই নর্ম্যালে প্রবিষ্ট হইতে পারিতেন। ঐ সময় সংস্কৃত-কলেজের অনেক কৃতবিদ্য ছাত্র, কর্ম্মপ্রার্থনায় নর্ম্যালে প্রবিষ্ট হইয়া অঙ্ক, ভূগোল ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হন। কয়েক মাস পরে, যাঁহারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন, অগ্রজ মহাশয় তাঁহাদের মধ্যে কাহাকেও আদর্শ-বিদ্যালয়ে, কাহাকেও ইংরাজী বিদ্যালয়ের প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন।
রামকমল বাবু মধ্যে মধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিতেন, “কত টাকা হইলে আপনার খ্যাতি কিনিতে পারিব।” বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলেন, উড্রো সাহেব নর্ম্যাল বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হইয়াছিলেন। রামকমল বাবুর সহিত উড্রো সাহেবের সদ্ভাব ছিল না; মধ্যে মধ্যে বিলক্ষণ বাদানুবাদ হইত। একদিবস উড্রো সাহেব কোন অন্যায় কথা বলায়, অসহ্য বোধ হইলে, অথবা অন্য কোন কারণে রামকমল বাবু সেইদিনই উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেন। এই সংবাদে অগ্রজ শোকাভিভূত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। সংবাদদাতা তাঁহাকে বলেন, ৭|৮ জন ব্রাহ্মণ প্রেরণ করুন, তাঁহারা শবকে মেডিকেল কলেজে লইয়া যাইবেক। তথায় পরীক্ষাকার্য্য সমাধা হইলে পর, সেই মৃত-দেহ নিমতলার ঘাটে দাহ-কারণ লইয়া যাইতে হইবে। উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিয়াছে বলিয়া, আমাদের পাড়ার কোন ব্রাহ্মণ দাহ করিতে যাইতে স্বীকার পাইতেছেন না; আর মুদ্দফরাসের দ্বারা বহন করিয়া লইয়া গেলে, দুর্নাম ও জাতিনাশ হইবে। বিদ্যাসাগর মহাশয়, উক্ত শব-বহন-কারণ অনেককে অনুরোধ করেন, কিন্তু কেহই সম্মত হয় নাই; পরিশেষে ভ্রাতা ঈশানচন্দ্র, পিতৃব্যপুত্র পীতাম্বর, মাতুলপুত্র ঈশ্বর ঘোষাল, ভগিনীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি আট জনকে প্রেরণ করেন। উঁহারা তাঁহার বাটী হইতে শব বহন করিয়া, মেডিকেল কলেজে লইয়া যান; তথায় পোষ্টমর্টন অর্থাৎ পরীক্ষার পর, পুনরায় নিমতলার ঘাটে লইয়া গিয়া, দাহাদিকার্য্য সম্পন্ন করেন।
ঐ সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রতি সপ্তাহের মধ্যে একদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবারে ছোট লাট হেলিডে সাহেব বাহাদুরের বাটী যাইতে হইত। তিনি তাঁহাকে চটি জুতা, থানের ধুতি ও ধানের চাদর এই তিনের পরিবর্ত্তে পেণ্টুলন, চাপকান, পাগড়ি, মোজা ও বুটজুতা পরিধান করিবার আদেশ দেন। অগ্রজ মহাশয়, অগত্যা কয়েকবার গোপনে সাহেবের কথিতমত পোষাক পরিধান করেন; কিন্তু উক্ত বেশ-ধারণে লজ্জিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধের ন্যায় ক্লেশ অনুভব করিয়া, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের সমক্ষে বলেন, “আপনার সহিত আমার এই শেষ-দেখা, আমি এই বেশ ধারণ করিতে বা সং সাজিতে পারিব না, ইহাতে আমার চাকরি থাক্ বা যাক্।” ইহা শ্রবণ করিয়া লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর, দাদাকে তাঁহার,অভিলষিতবেশে আসিবার আদেশ দিলেন। তাঁহার আজীবনে এই কয়েকবার ভিন্ন চটিজুতা, থান ধুতি, ধানের চাদর পরিত্যাগ করেন নাই। পরে রোগ ও বার্ধক্য-নিবন্ধন চিকিৎসকের উপদেশে সময়ে সময়ে ফ্লানেলের জামা ও উড়ানি ব্যবহার করিতে দেখা গিয়াছে।
বাবু শ্যামাচরণ বিশ্বাস ও বিমলাচরণ বিশ্বাস, অগ্রজের পরম বন্ধু ছিলেন। কলিকাতা হইতে নয় ক্রোশ অন্তরে তাঁহাদের পৈতৃক বাস। তাহারা সংস্কৃতকলেজের সম্মুখে বাটী নির্ম্মাণ করিয়া বাস করিতেন। সময়ে সময়ে তাঁহারা পৈতৃক বাসভূমি পাঁইতেল গ্রামে যাইতেন। এক বৎসর, জগদ্ধাত্রীপূজা উপলক্ষে অগ্রজ, উক্ত শ্যামাচরণ বিশ্বাসের সহিত পাঁইতেল গ্রামে গমন করেন। তথায় রাত্রিজাগরণে ও হিম লাগায় কলিকাতায় প্রত্যাগত হইবার পর, তাঁহার জ্বর হইল, পরে নাসারোগ দৃষ্ট হইলে পর, তৎকালীন বহুবাজারস্থ বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। ভাল হইলেও নাসারোগের নিবৃত্তি না হওয়ায়, কয়েক বৎসর নস্য ব্যবহার করিয়াছিলেন।
ইহার কিয়দ্দিবস পরে উদরাময় ও শরীরের দুর্বলতা-নিবারণ-মানসে, জনৈক ব্যায়ামশিক্ষক (হিন্দুস্থানী পালোয়ান) রাখিয়া, কয়েক মাস ব্যায়াম শিক্ষা করেন।
এই সময়ে অগ্রজ মহাশয়, বৈঁছি গ্রামে যাইয়া, বাবু গবিনচাঁদ বসুর ভবনে গমন করেন এবং তাঁহার বাটীতেই একটি বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করেন। তৎকালে তথাকার সম্ভান্ত ও ধনশালী বাবু রাখালদাস মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সাহায্যে বৈঁছিতে একটি ইংরাজী-বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। বাঙ্গালা মডেলস্কুলের স্থান নির্দিষ্ট-করণ-জন্য, প্রথমে হুগলি-জেলার অন্তঃপাতী শ্যাখালা গ্রামে পণ্ডিত প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের বাটীতে উপস্থিত হন। উক্ত গ্রামে বহুসংখ্যক ভদ্রলোকের বাসস্থান অবলোকন করিয়া, তথায় বাঙ্গালা আদর্শবিদ্যালয় সংস্থাপনের উপযুক্ত স্থান স্থির করিলেন। তৎপরে খানাকুল কৃষ্ণনগর গ্রামে বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয়ের সদনে অবস্থিতি করিয়া দেখিলেন, ঐ গ্রাম অতি সমাজস্থান, অনেক ব্রাহ্মণ কায়স্থের আবাসভূমি, একারণ কৃষ্ণনগরে বিদ্যালয়স্থাপনের অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তদনন্তর হারোপ, বাঙ্গালপুর, কামারপুকুর, ক্ষীরপাই প্রভৃতি গ্রামে যাইয়া আদর্শবিদ্যালয় স্থাপনের উৎকৃষ্ট স্থান নিরূপণ করেন। পরে মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত রাণীগোপালনগর, বাসুদেবপুর, মালঞ্চ, বদনগঞ্জ প্রভৃতি গ্রামে এবং ঐ জেলাস্থ অন্যান্য গ্রামে যাইয়া, বিদ্যালয়ের স্থান নিরূপণ করেন। তদনন্তর জেলা বর্ধমান জৌগ্রাম, মানকর প্রভৃতি গ্রামে যাইয়া এবং নদীয়া জেলায় মফঃস্বলের নানাগ্রামে যাইয়া, বিদ্যালয়ের স্থান মনোনীত করেন।
উক্ত চারি জেলায় পরিভ্রমণকালে, পথে কেহ শারীরিক অসুস্থতাপ্রযুক্ত চলিতে অক্ষম হইয়া ভূমে পতিত আছে দেখিতে পাইলে, তিনি পাল্কী হইতে নামিয়া, ঐ পীড়িত অপরিচিত পথিককে নিজের পাল্কীতে তুলিয়া দিয়া, স্বয়ং পদব্রজে গমনপূর্ব্বক উহাকে তাহার বাটীতে অথবা বাটীর নিকটস্থ কোন বিপণীতে পঁহুছাইয়া দিতেন এবং পান্থনিবাসের অধিকারীকে তাহার আবশ্যক ব্যয়ের টাকা প্রদান করিতেন। এইরূপ বিপদাপন্ন যে সকল লোক তাঁহার দৃষ্টিপথে পড়িয়াছিল, তাহারা পরে আসিয়া অগ্রজকে পরিচয় দিত, এবং সেই সকল লোক তাঁহার পরম বন্ধু বলিয়া গণ্য হইত।
মফঃস্বল পরিভ্রমণকালে, সমভিব্যাহারে চক্চকিয়া টাকা, আধুলী, সিকি, দুয়ানি, পয়সা, যথেষ্ট রাখিতেন। পথে দরিদ্র লোক নয়নগোচর হইলে, উহা দিগকে অকাতরে দান করিতেন। পরিভ্রমণসময়ে অর্থব্যয় করিতে কখনই কুষ্ঠিত হইতেন না। একারণ, অনেকে তাঁহাকে বলিত যে, আপনাকে আমরা বিদ্যাসাগর না বলিয়া, দয়ার সাগর বলিব। মফঃস্বল-পরিভ্রমণসময়ে অনেক নিরুপায় বালক পুস্তক, বস্ত্র ও স্কুলের বেতনের জন্য তাঁহাকে ধরিত, তিনিও সকলেরই আশা পূর্ণ করিতেন। প্রতিমাসেই উক্ত নিরাশ্রয় বালকদিগের সাহায্য করিতেন, কখনই বিস্মৃত হইতেন না। একদিন তিনি নিবদো দত্তপুকুরনিবাসী বাবু কালীকৃষ্ণ দত্তের বাটীতে গিয়াছিলেন; তথায় ক্ষেত্রনামক এক ব্রাহ্মণবালক অধ্যয়ন করিতে পান না শ্রবণ করিয়া, উহাকে সমভিব্যাহারে আনয়ন করেন এবং কলিকাতার বাসায় অন্ন-বস্ত্র দিয়া সংস্কৃত-কলেজে প্রবিষ্ট করিয়া দেন। অন্ততঃ ১২ বৎসর কাল তাহাকে বাসায় রাখিয়া বিদ্যাশিক্ষা করান। সম্প্রতি ঐ ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন। বারাসতনিবাসী তাঁহার পরমবন্ধু ডাক্তার নবীনচন্দ্র মিত্রের বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাইতেন; তথাকার কয়েকজন বালক তাঁহার সঙ্গে আসিয়া, বাসায় অবস্থান করিয়া অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হন। ঐরূপ বর্দ্ধমান জেলার অন্তঃপাতী যৌগ্রাম হইতে নিমাইচরণ সিংহ বাসায় অবস্থিতি করিয়া সংস্কৃত-কলেজে শিক্ষা করেন। খাঁটুরা গোবরডাঙ্গার কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক বালক তাঁহার নিকট ক্রন্দন করায়, কয়েক বৎসর অন্নবস্ত্র দিয়া সংস্কৃত-কলেজে প্রবিষ্ট করাইয়া দেন।
এই সময়ে বর্দ্ধমান, নদীয়া, হুগলি ও মেদিনীপুর এই জেলাচতুষ্টয়ের বিদ্যালয়সমূহের তত্ত্বাবধানের জন্য তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য্য, মাধবচন্দ্র গোস্বামী, দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও হরিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেপুটী ইন্স্পেক্টার নিযুক্ত করেন। ইঁহারা চারিজনে প্রত্যেকে এক এক জেলায় নিযুক্ত হন।
মধ্যে মধ্যে দেশে গিয়া বীরসিংহ বিদ্যালয়ের ও নাইট্-স্কুলের বা রাখালস্কুলের অনেক দরিদ্র বালক বাটীতে ভোজন করিয়া অধ্যয়ন করিবে, এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত বিদেশস্থ অনেক ব্রাহ্মণতনয়কে নিজ বাটীতে অন্ন দিয়া, বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করাইতেন। এস্থলে উঁহাদের মধ্যে কয়েকটির নাম প্রদত্ত হইল—জেলা মেদিনীপুরের কুঙাপুরগ্রামনিবাসী পণ্ডিত অন্নদাপ্রসাদ ন্যায়ালঙ্কারের পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ও ঈশানচন্দ্র ভট্টাচার্য্য়, নারাজোলনিবাসী দর্পনারায়ণ বিদ্যাভূষণের পুত্র দিগম্বর চক্রবর্তী, শ্রীবরা গ্রামের ভট্টাচার্য্য়মহাশয়দের বাটীর দৌহিত্রসন্তান বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রামেড়নিবাসী রামার্চ্চন বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা হুগলির ঝিংকরানিবাসী দুর্গাপ্রসাদ চূড়ামণির পুত্র বরদাপ্রসাদ ও সারদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য়, ঐ গ্রামবাসী রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি ন্যুনাধিক ৬০ জন বালক বাটীতে ভোজন করিয়া, লেখাপড়া শিক্ষা করিত। মধ্যে মধ্যে পিতৃদেব বলিতেন যে, আমি বাল্যকালে বিলক্ষণ অম্নকষ্ট পাইয়াছি, অতএব অন্নব্যয় করা সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান কর্ম্ম। পিতৃদেব স্বয়ং কুমারগঞ্জের হাটে যাইয়া, দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আনিতেন; ছাত্র সকলকে এবং পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্রদিগকে একত্র বসাইয়া আহার করাইতেন। জননীদেবী সন্তুষ্টা হইয়া, নিজেই রন্ধন-পরিবেশনাদি কার্য্য়ে সমভাবে পাচক ও পাচিকাদিগের সাহায্য করিতেন। ঐ সময় অগ্রজ মহাশয়, প্রতিবৎসর বীরসিংহবিদ্যালয়ের ৭|৮ জন দরিদ্র বালককে কলিকাতায় লইয়া যাইতেন এবং উহাদিগকে বাসায় অন্ন-বস্ত্র দিয়া, কাহাকেও সংস্কৃত-কলেজে, কাহাকেও মেডিকেল কলেজে এবং কাহাকেও বা ইংরাজী স্কুলে অধ্যয়ন করাইতেন। কয়েক বৎসরের মধ্যে বীরসিংহবিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্র মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করে। এইরূপ প্রতি বৎসর ৮|১০ জন ছাত্র কলিকাতার বাসায় ভোজন করিয়া, নরম্যালস্কুলে অধ্যয়ন-পূর্ব্বক অন্যান্য মফঃস্বল-বিদ্যালয়ের শিক্ষক হইয়াছিলেন।
তৎকালের শিক্ষাসমাজের অধ্যক্ষ ডাক্তার ময়েট্ মহোদয়, বেথুন সাহেবের স্মরণার্থ বীটনসোসাইটি নামক সমাজ স্থাপন করেন। ঐ সমাজে বিদ্যাসাগররচিত সংস্কৃত-সাহিত্য-বিষয়ক প্রস্তাব পঠিত হয়। অনেকের অনুরোধে অগ্রজ মহাশয়, সভাপতির অনুমতি লইয়া, উক্ত প্রস্তাব পুস্তকাকারে মুদ্রিত করেন।
বাল্যকাল হইতে ৩০ বৎসর বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত অগ্রজ মহাশয়কে কখনও তামাক খাইতে দেখি নাই; পরে তামাক খাইতে আরম্ভ করেন। প্রথমতঃ বাসায় কাহারও নিকট খাইতেন না, গোপনে অপরের বাটীতে খাইতেন। তামাক খাইবার বিশেষ কারণ এই যে, রাত্রিজাগরণ করিয়া লেখাপড়ার অনুশীলন করিতেন, তজ্জন্য দাঁতের গোড়া ফুলিত। তৎকারণেই বাবু দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায় ডাক্তার মহাশয়, সর্ব্বদা উপদেশ দিতেন যে, তামাকের ধূমে দন্তমূলের যাতনার অনেক লাঘব হইবে। একারণ, অগত্যা ডাক্তারের উপদেশানুসারে তামাক খাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কিন্তু তৎকালে বাটী আগমন করিয়া ১৫ দিবস অবস্থিতি করিলেও আমরা কখনও তাঁহাকে তামাক খাইতে দেখি নাই। ছোট ঘোট ভ্রাতৃবর্গ প্রভৃতি কেহই না দেখিতে পায়, এরূপ গোপনভাবে তিনি তামাক খাইতেন।
বাল্যকালে বড়বাজারের দোয়েহাটানিবাসী জগদ্দুর্লভ সিংহের ভবনে বাসা ছিল। বাল্যকালে উক্ত সিংহের পরিবারবর্গ, অগ্রজ মহাশয়কে যথেষ্ট স্নেহ করিতেন। উক্ত সিংহের মৃত্যুর পর, তাঁহার পুত্র ভুবনমোহন সিংহের দুরবস্থা হইলে, উহাকে সাংসারিক-ব্যয়-নির্ব্বাহার্থে মাসে মাসে ৩০৲ টাকা প্রদান করিতেন। উক্ত ভুবনমোহন সিংহের মৃত্যুর পর, উহাঁর পত্নীকেও ঐ টাকা প্রদান করিয়া আসিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত উহাঁর কন্যার বিবাহের সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়াছিলেন এবং উহাঁর অভিনব জামাতার কর্ম্ম করিয়া দিয়াছিলেন।
ঐ সময়ে জননীদেবীর মাতৃষ্বসার পুত্র শ্যামাচরণ ঘোষাল, কলিকাতায় লৌহসিন্দুকের ও তাওয়া চাটু প্রস্তুতের ব্যবসা করিতেন। আমরা দুই ভ্রাতা পঠদ্দশায় তাঁহার বাসায় তিন মাস ছিলাম। নানা কারণে ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া, তিনি অত্যন্ত কষ্টে পড়িয়াছেন এবং পীড়ায় আক্রান্ত হইয়া মৃতকল্প ও শীর্ণকায় আছেন শুনিয়া, দাদা আমার দ্বারা উক্ত শ্যামাচরণ ঘোষাল মাতুল মহাশয়কে ডাকাইয়া বলেন যে, “আপনি মাসিক কয় টাকা পাইলে, দেশে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকিতে পারেন?” তাহাতে তিনি বলেন, “যদি যাবজ্জীবন মাসে মাসে ১০৲ টাকা করিয়া দিতে পার, তাহা হইলে নিশ্চিন্ত হইয়া দেশে অবস্থিতি করিতে পারি। আমার দ্বিতীয় কথা এই যে, তিনটি ভ্রাতুপুত্রকে বীরসিংহায় তোমার বাটীতে রাখিয়া, অন্নবস্ত্র দিয়া লেখাপড়া শিক্ষা দিতে হইবে।” অগ্রজ, তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, মাসে মাসে ঐ দশ টাকা প্রদান করেন। আর উহাঁর তিনটী ভ্রাতুস্পুত্রকে বাটীতে রাখিয়া লেখাপড়া শিক্ষা দিয়া, বিষয়কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়া দেন ও পরে তাঁহার পুত্রকেও লেখাপড়া শিখাইয়া বিষয়কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়া দেন।
বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয়, হিন্দুকলেজে শিক্ষালাভ করিয়া, সর্ব্বোৎকৃষ্ট এস্কলার্শিপ মাসিক ৪০৲ টাকা ও স্বর্ণ-মেডেল প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তৎকালে বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী। ভালরূপ ইংরাজী শিক্ষা করিয়াছিলেন, তাহা প্রকাশ পাইয়াছিল। কোন কারণবশতঃ তাঁহাকে ঢাকাকলেজে সামান্য-বেতনে শিক্ষকতাকার্য্য়ে নিযুক্ত হইতে হয়। দুরদেশে, স্বল্পবেতনে কয়েক বৎসর অবস্থিতি করিয়া, পরিশেষে বিনা অনুমতিতে ঢাকা- কলেজ হইতে প্রস্থান করেন; এজন্য শিক্ষাসমাজ প্রসন্নবাবুকে আর কোন কর্ম্ম না দেওয়ায়, অগত্যা প্রসন্নবাবু, অগ্রজ মহাশয়ের শরণ লইলেন। পরম- দয়ালু অগ্রজ মহাশয়, প্রসন্নবাবু এবং উহাঁর ভ্রাতৃবর্গ ও তাঁহার কনিষ্ঠ পিতৃব্যকে প্রায় দুই বৎসর কাল বহুবাজারের পঞ্চাননতলায় নিজ বাসায় রাখিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা নিজব্যয়ে আহারাদি করিতেন। অগ্রজ মহাশয়, এডুকেসন কৌন্সেলের সেক্রেটারি ময়েট্ সাহেব মহাশয়কে অনুরোধ করিয়া, প্রসন্নবাবুকে প্রথমতঃ হিন্দুকলেজের নিম্নশ্রেণীর শিক্ষক নিযুক্ত করান। প্রসন্নবাবু স্বল্প-বেতনে কর্ম্ম করিতে প্রথমতঃ অসম্মত হইয়াছিলেন; কারণ, এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াই মাসিক ৪০৲ টাকা বৃত্তি পাইয়াছিলেন; এক্ষণে ঐ বিদ্যালয়ে স্বল্প-বেতনে নিম্ন-শ্রেণীর কর্ম্ম করিতে লজ্জা বোধ হইল। ইহা প্রকাশ করিলে পর, অগ্রজ তাঁহাকে উপদেশ দিলেন যে, তুমি না বলিয়া ঢাকা কলেজ হইতে আসায়, শিক্ষাসমাজ তোমার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছেন। এক্ষণে এই কর্ম্ম করিতে স্বীকার না পাইলে, অপরাধী বলিয়া তোমাকে কোন ভাল কর্ম্মে নিযুক্ত করিবেন না। এইরূপ উপদেশ দেওয়ায়, তিনি উক্ত কার্য্য়-গ্রহণে স্বীকৃত হইয়া ত্বরায় ঐ কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেন।
প্রসন্নবাবু, অগ্রজের অনুরোধে চারিটার ছুটীর পর, কয়েক মাস সংস্কৃত- কলেজে তৎকালের প্রধান ছাত্র রামকমল, তারাশঙ্কর, সোমনাথ, সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতিকে ইংরাজী শিক্ষা দিতেন, এবং স্বয়ং প্রতিদিন প্রাতঃকালে অগ্রজ মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত বিষ্ণুপুরাণ, রঘুবংশ প্রভৃতি অধ্যয়ন করিতেন। দাদাও সময়ে সময়ে প্রসন্নবাবুর নিকট ইংরাজী পুস্তক দেখিতেন। প্রসন্নবাবু অতিশয় বুদ্ধিমান্ ও কার্য্য়দক্ষ লোক ছিলেন। একমাত্র অগ্রজ মহাশয়ের চেষ্টাই ইহাঁর ভবিষ্যৎ উন্নতির মূল। তাঁহার অনুগ্রহেই প্রসন্নবাবু ক্রমশঃ উচ্চপদে অধিরূঢ় হইয়াছিলেন। প্রথমতঃ সংস্কৃত-কলেজে ১০০৲ টাকা বেতনে হেড্ মাষ্টারের পদে নিযুক্ত হইয়া, ক্রমশঃ সংস্কৃত-কলেজের প্রিন্সিপাল হন। প্রিন্সিপাল-পদে থাকিয়া গ্রেডে উঠিয়া, মাসিক হাজার টাকার অধিক বেতন পাইয়াছিলেন। তিনি সংস্কৃত-কলেজ হইতে বহরমপুর কলেজের প্রিন্সিপাল এবং তৎপরে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসার হইয়াছিলেন।
ইতিপুর্ব্বে সংস্কৃত-কলেজে রাবু রসিকলাল সেন ও বাবু বিশ্বনাথ সিংহ ইংরাজীর শিক্ষক ছিলেন। যে যে ছাত্রের ইংরাজী শিখিতে ইচ্ছা হইত, তাহারাই দুই ঘণ্টা করিয়া ইংরাজী-ভাষা অধ্যয়ন করিত। সকল বালক ইংরাজী অধ্যয়ন করিত না; তাহাতে সাধারণের কোনও ফলোদয় হইবার আশা ছিল না। অগ্রজ মহাশয়, শিক্ষাসমাজকে অনুরোধ করিয়া, বাবু রসিকলাল সেন ও বিশ্বনাথ সিংহকে সংস্কৃত-কলেজ ত্যাগ করাইয়া, অপর স্থানে অধিক বেতনে হেড্ মাষ্টারের পদে নিযুক্ত করিয়া দেন এবং সংস্কৃতকলেজের লীলাবতী ও বীজগণিতের অধ্যাপক প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্য় মহাশয়কে সিবিল গাইড্ আইন পাঠ করিতে বলেন। অনন্তর তৎকালীন শিক্ষাসমাজের প্রেসিডেণ্ট, সার্ জেমস্ কল্বিন্ ন্সাহেব মহোদয়কে অনুরোধ করেন যে, সংস্কৃতকলেজে ইংরাজীতে অঙ্ক শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা করিয়া বিপোষ্ট করিব। সংস্কৃত-অঙ্কের অধ্যাপক প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্য় অনেক দিন হইতে মাসিক ৯০৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত আছেন; ইনি সিরিল গাইড্ আইন শিক্ষা করিয়াছেন; এস্পিসিয়াল্ আদেশ হইলে, ইনি আইন-পরীক্ষায় কৃতকার্য্য় হইবেন। ইহাঁঁকে মুন্সেফের পদে নিয়োগ করিবার আদেশ হইলে, সংস্কৃত-কলেজে ইহাঁঁর পরিবর্ত্তে ইংরাজীতে অঙ্ক শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা স্থির করা হইয়াছে। অনন্তর প্রিয়নাথ ভট্টাচার্য্য় পরীক্ষা দিয়া মুন্সেফী পদে নিযুক্ত হইলেন। সাধারণ লোক অগ্রজের এরূপ অলৌকিক ক্ষমতাদর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলেন।
ইহার কিছুদিন পরে সংস্কৃত-কলেজে ইংরাজী শিক্ষার জন্য, বাবু প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী, বাবু শ্রীনাথ দাস, রাবু কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, বাবু তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায় ও বাবু প্রসন্নকুমার রায় প্রভৃতি ইংরাজী শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হইলেন। সিনিয়ার ও জুনিয়ার ডিপার্টমেণ্টে এস্কলাশিপ্ পরীক্ষায়, সংস্কৃতের ও অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষায় ছাত্রগণকে যেরূপ নম্বর রাখিতে হইত, সেইরূপ একদিন ইংরাজীর নম্বর রাখিতে হইবে, নচেৎ এস্কলাশিপ্ পাইবে না। এই নিয়ম করায়, অগত্যা সকলকেই রীতিমত ইংরাজী শিখিতে হইয়াছিল। ক্রমশঃ সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রগণ ইংরাজী-বিদ্যালয়ের ন্যায় ইংরাজী শিখিতে প্রবৃত্ত হইল। পরবৎসর হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রথা নূতন সৃষ্টি হইয়াছিল। সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রগণের মধ্যে অনেকেই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায়, অন্যান্য ইংরাজী-বিদ্যালয়ের ছাত্র গণের মত কৃতকার্য্য় হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ই সংস্কৃত-কলেজে ইংরাজী শিক্ষা দিবার আদি-কারণ। তাঁহারই আন্তরিক যত্ন ও আগ্রহাভিশয়েই সংস্কৃতকলেজের উন্নতি হইয়াছে, ইহা সকলকেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে। উত্তরকালে যিনিই অধ্যক্ষ হউন না কেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম কোনকালেই বিলুপ্ত হইবার আশঙ্কা নাই।
ভারতবর্ষের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান কবি কালিদাসের প্রণীত শকুন্তলা, সংস্কৃতভাষায় সর্ষোৎকৃষ্ট নাটক। অগ্রজ মহাশয়, ঐ পুস্তক বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিয়া ১২৬১ সালে ২৫শে অগ্রহায়ণ মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন। পাঠকবর্গ বিদ্যাসাগরের অনুবাদিত শকুন্তলা পাঠ করিয়া যে পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছিলেন, ইহা এস্থলে উল্লেখ করা বাহুল্য। দেশবিদেশস্থ কি বিদ্যার্থী, কি পণ্ডিতমণ্ডলী, কি বিষয়ীলোক সকলেই অতিশয় আগ্রহের সহিত ইহা পাঠ করিতেন।
রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়ের সহিত অগ্রঞ্জ মহাশয়ের অত্যন্ত প্রণয়-ছিল। রমাপ্রসাদ বাবু, বর্দ্ধমানের রাজবাটী হইতে নৈহাটিনিবাসী নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চু নামক স্বল্পবয়স্ক, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন, ন্যায়-শাস্ত্রে অদ্বিতীয় এক পণ্ডিতকে আনয়ন করিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অর্পণ করেন। ঐ নন্দকুমারের পিতৃকুল ও মাতৃকুল, বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্যাবর্তার কারণ বঙ্গদেশে সুপ্রসিদ্ধ; এই কারণে অগ্রজ মহাশয়, নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুকে পরম সমাদরে গ্রহণ করিয়া, কোন উচ্চপদ শূন্য না থাকায়, অগত্যা একটি ৩০৲ টাকা বেতনের পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত করিলেন। ইনি সংস্কৃত-কলেজের ছাত্র ছিলেন না; একারণ, শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টার ইয়ং সাহেবের নানা আপত্তি খণ্ডন করিয়া, আপাততঃ কিছুকালের জন্য ঐ পদে রাখিলেন। কিন্তু সংস্কৃত-বিদ্যালয়ে পূজ্যপাদ জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয়ের সহিত বিচার হওয়ায়, নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চু উৎকৃষ্ট সাব্যস্ত হন। পরে পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপনারায়ণ সিংহ ও রাজা ঈশ্বরনারায়ণ সিংহের কান্দীগ্রামে তাঁহাদের স্থাপিত বিদ্যালয়ে ৮০৲ টাকা বেতনে ন্যায়চঞ্চুকে নিযুক্ত করিয়া পাঠান। কয়েক বৎসর পরে তিনি জ্বরকাশ-রোগে আক্রান্ত হইলে, অগ্রজ মহাশয় তাঁহাকে কলিকাতায় আনাইয়া, তৎকালের বিখ্যাত ডাক্তার গুডিড্ সাহেব প্রভৃতি চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করান। ঐ রোগেই তাঁহার মৃত্যু হইলে পর, তাহার জননী-দেবীর, পত্নীর এবং নাবালক সহোদরগণের ভরণপোষণ ও তাহাদের বিদ্যানুশীলনাদির সমুদয় ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়াছিলেন ও আবশ্যকমত সময়ে সময়ে নিজে তত্ত্বাবধান করিতেন। এমন কি, তাহার ভ্রাতৃবর্গকে সহোদর-নির্ব্বিশেষে তত্ত্বাবধান করিয়া আসিয়াছেন। এক্ষণে, রঘুনাথ ভট্টাচার্য্য, যদুনাথ ভট্টাচার্য্য়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও মেঘনাদ ভট্টাচার্য্য, নন্দকুমার ন্যায়চক্ষুর এই চারি সহোদর, পৈতৃক পদমর্য্যাদা বজায় রাখিয়া, সাংসারিক কার্য্য সমাধ করিতেছেন।