দ্বিতীয় অধ্যায়
রাম বলতে বাল্মীকি যে কোন অতিদেব, লোকোত্তর মানুষের স্বপ্ন দেখেননি তা আমি অল্প হলেও দেখানোর চেষ্টা করেছি। দেখিয়েছি শুধু ঝুঁটিবাঁধা তাপস বালক নন, তাঁর ক্রোধ, কাম, স্বার্থবোধ—সবই ছিল। আপনারা বলতে পারেন বাল্মীকি রামায়ণের মোক্ষম অংশগুলি খামচা খামচা করে তুলে এনে আমি রামচরিত্রকে একেবারে সাধারণ করে ফেলেছি। তাহলে বলতে হবে, অন্যেরা এতদিন যে রামচরিত্র বর্ণনা করছিলেন, তাও কিন্তু রামচরিত্রের মহীয়ান অংশগুলি খামচা খামচা তুলে এনেই। সত্যটা আছে মাঝখানে দাঁড়িয়ে, রামচরিত্রের ভাল এবং মন্দ একসঙ্গে আত্মসাৎ করে। রামচন্দ্র আদর্শ পুত্র কিংবা আদর্শ ভ্রাতা। এমনকি রামরাজ্যের প্রবাদে তিনি যে আদর্শ রাজাও—সে কথাও সব সময়ই শুনি। কিন্তু তাঁর আদর্শ পতিত্ব অথবা আদর্শ পিতৃত্বের ছন্দে যে কিছু ভুল ছিল, সে কথা কালিদাস এবং ভবভূতির আমল থেকেই নানাভাবে প্রচারিত। অস্বীকার করি না, আদর্শবান মানুষের ভাগটিই রামচন্দ্রের মধ্যে বেশি ছিল, কিন্তু তাঁর রাগ-দুঃখ, কাম-ক্রোধ অথবা কোন দোষই ছিল না—এমন কথা তো কই বাল্মীকি বলেননি। রাম লিখতে বসে আমি যে রামায়ণ লিখেছি তাও এই কারণেই। আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি, রামায়ণের কোন চরিত্রই বাল্মীকি অবাস্তব কিংবা উদ্ভট আদর্শে বর্ণনা করেননি। রামায়ণের প্রত্যেক চরিত্রের মধ্যেই যেখানে গুণগুলি দোষের সঙ্গে মিশে আছে, যেখানে আপাতশুদ্ধ আদর্শের গর্ভে আছে অশুদ্ধতার ভ্রূণ কিংবা ন্যায়নীতির প্রকোষ্ঠে অন্যায় এবং নীতিভ্রষ্টতা, সেখানে আলাদা করে শুধু রামচরিত্রটি যে একেবারে অলৌকিক হয়ে উঠবে, এ ধারণা ভুল। রামায়ণের অনেক চরিত্রই আমি এখানে এইজন্যে হাজির করেছি যে তাতে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে রামচরিত্রও সর্বৈব প্রকাশ হয়ে পড়বে। কেননা অযযাধ্যায় যেমন দশরথ, কৌশল্যা, কৈকেয়ী, ভরত সবাইকে নিয়েই রামের সংসার তেমনি তাঁর বনবাসের সংসারে আছেন বালি, সুগ্রীব, হনুমান, তারা, অঙ্গদ—সবাই। আবার অযোধ্যা, কিষ্কিন্ধ্যা ছেড়ে লংকাপুরীতে গেলে দেখব রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, ইন্দ্রজিৎ—এরাও সবাই রামের জীবনধারার অনেকখানি অংশ অধিকার করে নিয়েছেন। এঁদের সবাইকে নিয়েই রামের বিরাট সংসার। কাজেই এঁদের সবার কথা বললে রামচরিত্রই যে, মূলতঃ পরিষ্কার হবে—তাতে সন্দেহ কি।
এর ওপরেও একটা কথা মনে রাখা দরকার। যিনি মহাকাব্য লেখেন এবং যে বিশাল প্যানোরমায় তাঁকে মহাকাব্য লিখতে হয়, তাতে ফাঁক-ফোকর, সমালোচনার রসদ কিছু থেকেই যায়। কিন্তু পাঠক! সে ফাঁক বাল্মীকি স্বয়ং রেখেছিলেন বলেই তো আপনি সমালোচনা করতে পারছেন। তিনি তো কিছুই লুকোননি। প্রজারঞ্জনের জন্য গর্ভবতী সীতাকে বনবাস দিয়ে বসলেন রামচন্দ্র। আমরা বললাম—একটুও কি প্রেম ছিল না রামচন্দ্রের হৃদয়ে! তিনি কি প্রেম বুঝতেনও না! কিন্তু ঠিক এইখানেই বাল্মীকির ক্ষমতা, প্রেমের ব্যাপারে তিনি অন্ততঃ রামচন্দ্রের মত বেরসিক নন। রাবণবধের পরে রামচন্দ্রের যে উন্নাসিক আচরণ কিংবা সীতা-পরিত্যাগ-এ সবপরিস্থিতি তো বাল্মীকিই তৈরি করেছেন। হাজারো আদর্শের চূড়ায় উঠিয়ে মহাকাব্যের এক উদাত্ত নায়ককে এইভাবে যখন কবি স্থানভ্রষ্ট করেন, তখনই বোঝা যায় তিনি তাঁকে লোকোত্তর কোন পুরুষাতীত আদর্শের অলংকারে সাজাতে চান না। মানুষ বলেই এক জায়গায় সব ভাল তাঁর মধ্যে বাসা বাঁধেনি। মহাকবির প্রেম চেতনাও এইখানেই।
পরবর্তী কবিরা রামের এবং একই সঙ্গে ক্রৌঞ্চবিরহী কবির এই বিসদৃশ আচরণ অতি নিপুণভাবে লক্ষ্য করেছেন, আর করেছেন বলেই কালিদাস তাঁর রঘুবংশে বনবাসিনী সীতাকে দিয়ে রাজা রামকে, মনে রাখবেন রাজা রামকে, গালাগালি দিইয়েছিলেন। কিন্তু কালিদাসের কবিত্ব শৈলীর এই ইন্ধনটুকু তো জুগিয়েছেন বাল্মীকিই। মহাকাব্যে কবি নিজে কিছু বলেন না শুধু পরিস্থিতি তৈরী করেন, মুখে ন্যায় অন্যায় বলা তাঁর স্বভাব নয়, তিনি শুধু সাক্ষী থাকেন। আদর্শ মহত্ত্বের মধ্যে মহাকবি স্থানভ্রষ্টতার ফোঁকর তৈরী করে দেন বলেই বজ্র-সমুৎকীর্ণ মণির ভেতর সূচের মত ঢুকে ফাল হয়ে বেরোন পরবর্তী অন্য কবিরা। কালিদাসের সীতা অভিমানে বলেছেন—লক্ষ্মণ! তোমাদের রাজা রামকে বোল, আমাকে অগ্নিশুদ্ধ জেনেও শুধুমাত্র লোকনিন্দার ভয়ে যে আমাকে তিনি ত্যাগ করলেন—এ কি তাঁর কীৰ্ত্তি কিংবা বংশের অনুরূপ হল! তবু কালিদাস বলেছেন, সীতাকে ছেড়ে রামচন্দ্র অনেক কেঁদেছেন, যেন তুষারবর্ষী পৌষমাসের চাঁদ এবং তিনি যে সীতাকে ত্যাগ করেছেন সে শুধু বাইরের লোকের জ্বালায়, মন থেকে নয়—কৌলীনভীতেন গৃহান্নিরস্তা, ন তেন বৈদেহসুতা মনস্তঃ। সীতাকে রামচন্দ্র মন থেকে নির্বাসন দেবেন কি করে, তিনি যে ‘বৈদেহিবন্ধু’—বৈদেহীর প্রেমে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। একবার কালদোষে নির্বাসিতা, যার জন্য রামচন্দ্রকে লংকাকাণ্ড পর্যন্ত কাঁদতে হয়েছিল, তাঁকে আবার আপন হাতে নিবার্সন—তাঁর হৃদয় যেন ফেটে গেল—‘বৈদেহিবন্ধো র্হৃদয়ং বিদদ্রে’। ঠিক এইখানটাতেই এক মহাকবির লেখনীতে আরেক মহাকবির সমালোচনা ধ্বনিত হয়। কিন্তু এই যে সমালোচনা, তা কালিদাস এই স্পর্ধাতেই করতে পেরেছেন, যে স্বয়ং মহাকবি আছেন তাঁর পক্ষে। বাল্মীকি যে স্বয়ং এইখানে রামচন্দ্রকে প্রেমচেতনার সিংহাসন থেকে নামিয়ে এনে প্রজা পালকের আদর্শ সিংহাসনে বসিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন—হয় প্রেম, নয় রাজত্ব—দুটো একসঙ্গে হবে না বাপু! রামচন্দ্র যদি সরল সাহসে বলতে পারতেন রাজত্বে সুখ নেই—‘নাহি সুখ যশে’—তাহলে সীতাকে পাওয়া তাঁর কঠিন ছিল না। কিন্তু লজ্জা! পিতার কৈকেয়ী প্রেমের দৃষ্টান্তে রঘুকুলের যশ বাড়াতে, তিনি সীতাকেই সব ভাবতে লজ্জা পেয়েছেন। প্রজা পালনের বৃহত্তর স্বার্থই তিনি বেছে নিলেন, প্রিয়া পত্নীকেই দিলেন বিসর্জন।
অন্যদিকে দেখুন, কালিদাসের অতিসংবেদনশীল মনের মাধুরী। তাঁর আদর্শে সীতা কিন্তু রামচন্দ্রের মন থেকে কিছুতেই ছাড়া পান না—ন তেন বৈদেহসুতা মনস্তঃ। বিরাট রঘুবংশের পরিসরে কালিদাস যতটুকু বলতে পেরেছেন, কিংবা শেষ করেছেন যেখানে, ঠিক সেখানেই ভবভূতি আরম্ভ করেছেন তাঁর উত্তররামচরিত। যা নিয়ে রামের সমালোচনা ঠিক সেখানটাতেই ধরলেন ভবভূতি। যে লোকটি সীতার অপবাদ রামচন্দ্রের কাছে বয়ে নিয়ে এল, ভবভূতি তার নাম দিয়েছেন দুর্মুখ। প্রেমের নির্মল জ্যোৎস্নায় যখনই লোকনিন্দার রাহুচ্ছায়া দেখা দেয়, ভবভূতি বোধহয় তখনই সেই লোকগুলির দিকে আঙুল তুলে বলেন—‘অয়ি কঃ’। উত্তর আসে—আপনারই একান্ত পরিচারক দুর্মুখ। সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় ভবভূতি সিদ্ধান্ত করেছেন যে, স্ত্রীলোক আর কবির কাব্য—এই দুয়েরই শুদ্ধতায় বিশ্বাস করে না দুর্জনেরা। ভবভূতির এই কথায় তাঁর সহচর নাটকের মধ্যেই টিপ্পনী কেটেছে—অতি দুর্জন বলুন, এই দেখুন না—অগ্নিশুদ্ধা যে বৈদেহী, তাঁর চরিত্রেও নিন্দা রোপন করে কুপুরুষেরা। সন্দেহ হয়, ভবভূতি দুর্জন বলতে একেবারে রামচন্দ্রের দিকেই অঙ্গুলি সংকেত করেননি তো? কেননা পরে দেখি সীতার কলঙ্ক শুনে রাম নিজেকেই দুষছেন। বাবা-মা, শ্বশুর, বিভীষণ, সুগ্রীব—এঁদের সবাইকে তিনি হা হতো’স্মি করে ডাকছিলেন আর বলছিলেন—আমার মত কৃতঘ্নের মুখে এই ভাল-মানুষদের নাম-গ্রহণও পরোক্ষে এঁদেরই দূষিত করছে। ভবভূতি অপবাদভীত রামচন্দ্রকে মানসিক যন্ত্রণার চরমে নিয়ে গেছেন। সীতা শুয়েছিলেন রামচন্দ্রেরই হাতে মাথা রেখে আর সেই অবস্থায় মনে মনে সীতাকে বিসর্জনের সংকল্পে রাম নিজেকে একটুও ক্ষমা করতে পারছেন না। ভাবছেন—আমি কি নৃশংস, অতি বীভৎস এক কাজে হাত দিয়েছি—আশৈশব যে প্রিয়াকে লালন করেছি, সৌহার্দ্যে যার সঙ্গে আমি অভিন্ন-হৃদয়, সেই প্রিয়াকে ছলনা করে সঁপে দিচ্ছি মৃত্যুর হাতে, ঠিক যেন গৃহপালিত পাখিটিকে নিয়ে চলল কসাই—ছদ্মনা পরিদদামি মৃত্যবে শৌনিকো গৃহশকুস্তিকামিব। সীতার প্রেম রামের মনে এতটাই উজ্জ্বল যে, তিনি মনে করেছেন সীতাকে স্পর্শ করারই যোগ্য নন তিনি—আমি অস্পৃশ্য পাতকী, দেবী সীতাকে স্পর্শ করে দূষিত করছি। আস্তে আস্তে তিনি সীতার মাথার তলা থেকে নিজের দূষিত হাতখানি সরিয়ে নেন, মুখে বলেন—আমি দুষ্কর্মপটু চণ্ডাল হয়ে গেছি সীতা, শুদ্ধ প্রেমে মুগ্ধ বধূটি আমার, ত্যাগ কর আমাকে। মনের ভুলে আমাকে তুমি চন্দনের গাছ বলে ভেবেছ, কিন্তু আসলে আমি বিষবৃক্ষ—শ্ৰিতাম্মি চন্দনভ্রান্ত্যা দুর্বিপাকং বিষদ্রুমম্।
শুধু রামচন্দ্রকে আত্মদহনে দগ্ধ করেই ক্ষান্ত হননি ভবভূতি, প্রেমের রাজ্যে এই যে চরম অন্যায়টি ঘটে গেছে ক্রৌঞ্চবিরহী কবির হাতে, তার প্রায়শ্চিত্ত করেছেন সারা নাটকে বিভিন্ন জায়গায় রামচন্দ্রকে ধিক্কার দিয়ে। কিন্তু এই যে ধিক্কার—এ ধিক্কারের পথ তো করে দিয়েছেন স্বয়ং বাল্মীকি। রামচন্দ্রের আত্মদূষণে আর কবির ধিক্কারে যেটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে সেটি তো বাল্মীকিরই প্রেমচেতনা, যে চেতনা মোটেই হাল আমলের ব্যাপার নয়, কিংবা নয় এমন কিছু যাতে মনে হবে রামচন্দ্র শুধু শয্যামিলনের প্রস্তুতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। যদি তাই হোত, তাহলে সীতাকে অল্প-স্বল্প খোঁজার চেষ্টা করার পরই রামচন্দ্রকে আরেকবার ছাতনাতলায় বসিয়ে দিতে পারতেন বাল্মীকি, যা সে যুগে অচলও ছিল না। কিন্তু বাল্মীকি তাও করেননি, আবার তিনি রামচন্দ্রকে প্রেমের আদর্শ আসন থেকে ঠেলেও ফেলে দিয়েছেন। এই যে প্রেম থাকতেও আপাত প্রেমহীনতা—এইখানেই মহাকবি রামচন্দ্রকে একেবারে মানুষ করে ফেলেছেন, তাঁর গুণ-দোষ কিছুই কবি লুকোননি, যা তিনি লুকোননি দশরথের বেলায়, কৌশল্যা-কৈকেয়ীর বেলায়,লক্ষ্মণের বেলায় এমনকি সীতার বেলাতেও এবং সে সবই আমি পূর্বে দেখিয়েছি এইজন্যে যে, রামচরিত্রও এঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
বাল্মীকি কিছু লুকোননি বলেই আরও কিছু কথা বলার সাহস পাচ্ছি। যেমন আজকাল কেউ কেউ বলছেন যে, দশরথের ছেলে চারটি তার নিজের ছেলে নয়, ওগুলি সব আসলে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির পুত্র। (দ্রঃ জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘কবি তব মনোভূমি রামের জনম স্থান’, দেশ, ৮ অক্টোবর, ১৯৮৮, পৃঃ ১৯-২৫) সৌভাগ্যের বিষয় এই সব বক্তারা প্রাচীন নিয়োগ প্রথার কথা শুনেছেন এবং যেহেতু শুনেছেন অতএব তাঁদের মনে হয়েছে যে রাম-লক্ষ্মণ সবাই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির নিয়োগজাত পুত্র, ঠিক যেমনটি মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর ব্যাসদেবের পুত্র।
মজা হল, এই পণ্ডিতেরা একবার বলছেন রামায়ণের আদিকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত, অথচ অন্যদিকে আদিকাণ্ডের ঋষ্যশৃঙ্গকে দিয়েই চারটি ছেলের জন্ম না দেওয়ালে তাঁদের ‘লিবিডো’ প্রসন্ন হচ্ছে না। এঁদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা—আপনাদের মতে মূল কাণ্ডপঞ্চকের মধ্যে তো কোথাও ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির উল্লেখমাত্র নেই এবং সেখানে সব জায়গাতেই তো রাম-লক্ষ্মণেরা ‘দশরথাত্মজ’ বলেই পরিচিত। কাজেই সেখানে আবার আদিকাণ্ডের ঋষি-মুনির শৃঙ্গ ধরে টানাটানি কেন? দ্বিতীয়তঃ যদি আদিকাণ্ডকেও কথঞ্চিৎ প্রামাণিক ধরে কথা বলেন, তাহলে আমি বলব সেটা আরও হাসির ব্যাপার হবে। কেননা দশরথের কোন্ অনামা স্ত্রীর গর্ভে শান্তার জন্ম হয়েছিল সেটা জানা না গেলেও, শান্তা যে দশরথের কন্যা সে কথা সর্বজন স্বীকৃত। ভবভূতির মত কবি, যিনি পণ্ডিত বলেও সমধিক পরিচিত, তিনিও তো সাড়ম্বরে শান্তার কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর বিয়ে হয়েছিল ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গেই। কাজেই দশরথের পুত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা ছিল না—এ কথাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বরঞ্চ বলতে পারি পুত্র উৎপাদনের আগে পর্যন্ত দশরথের পুত্র নিশ্চয়ই হয়নি কিন্তু তাঁর উৎপাদন ক্ষমতাই ছিল না—শান্তা কি তাই প্রমাণ করে? তৃতীয়তঃ সেকালের দিনে নিয়োগ প্রথা যতই চালু থাকুক, তারও কিছু রীতিনীতি ছিল। গম্যা এবং অগম্যার বোধও ছিল যথেষ্ট। সেক্ষেত্রে দশরথ হেন রাজা আপন জামাইকে দিয়ে নিজের পত্নীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে খুব যে উৎসাহ বোধ করবেন, তা মনে হয় না। নিয়োগের এমন অদ্ভুত উদাহরণ ইতিহাস-পুরাণে আর একটা পেলেও হত, তাও পাইনি। চতুর্থতঃ সেই পুরানো কথা। কোন চরিত্রের সামান্যতম ত্রুটিও যেখানে মহাকবি লুকোননি, সেখানে সম্পূর্ণ সমাজ-সচল নিয়োগপ্রথাই বা লুকোতে যাবেন কেন? রামায়ণ-মহাভারতে বাল্মীকি কিংবা ব্যাস যা বলেছেন, তা সব সময় দাপটেই বলেছেন এবং সাড়ম্বরেই বলেছেন, কোথাও তো তাঁরা ঢাক-ঢাক, গুড়-গুড় করেননি, এখানেই বা তাঁরা এমন অদ্ভুত আচরণ করবেন কেন! আমার ধারণা, স্বক্ষেত্র ছাড়া যাঁরা পরক্ষেত্রে প্রবন্ধ লিখতে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদেরকে যে ভিত্তিহীন নতুন কথা কিছু বলতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে! পুরানো আলোচনা, সমালোচনাই এত আছে যে তার সুসামঞ্জস্য করাই বেশ কঠিন, সেখানে যদি আবার নবতম সমালোচকের উর্বর ক্ষেত্র থেকে এমন হঠ-কল্পনা নিঃসারিত হতে থাকে তাহলে হতভাগা বাল্মীকি যাবেন কোথা?
আমি রামায়ণের সাধারণ কিছু ঘটনা এবং চরিত্র নিয়ে দুচার কথা আগে বলেছি কিন্তু এই মহাকাব্যের সামগ্রিক গঠন নিয়ে কিছু বলিনি। এ নিয়ে ঝগড়া আছে অনেক, আছে পণ্ডিতে পণ্ডিতে লড়াই। সব ঝগড়া এখানে মেটানো সম্ভব নয়, কিন্তু এই সব ঝগড়া সম্বন্ধে কিছুই না বলাটাও বোধহয় সমীচীন হবে না। প্রথম কথা, বরোদা থেকে বাল্মীকি রামায়ণের যে পরিশুদ্ধ সংস্করণ বেরিয়েছে, তার সুবাদে এবং অনেক বাঘা বাঘা ইঙ্গ-ইউরোপীয় পণ্ডিত যেহেতু ‘মনে করেছেন’, তার সুবাদে অনেক অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বাল্মীকি রামায়ণের অগ্র এবং পশ্চাৎ অর্থাৎ আদিকাণ্ড এবং উত্তর কাণ্ড ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এর সব চেয়ে বড় কারণ হল—রামকে যে একেবারে ভগবান বিষ্ণুর অবতার করে ফেলা হয়েছে তা নাকি প্রধানতঃ এই কাণ্ড দুটিতেই। অযোধ্যা কাণ্ড থেকে লংকা কাণ্ড পর্যন্ত রামের এই ভগবদ্ উপাধি জোটেনি। ব্যাপারটা প্রথম বোধহয় পণ্ডিতদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন হারমান জ্যাকোবি। তাঁর মতে—
রামের দেবায়ন এবং ক্রমশঃ বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁর একাত্মতা—এই পুরো ব্যাপারটাই ছিল সেই কবির হৃদয়ে যিনি রামায়ণের আদি এবং উত্তরকাণ্ডটি লিখেছিলেন। মূল কাণ্ডপঞ্চকেও প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলিকে বাদ দিলে রামচন্দ্রের দেবায়নী ভূমিকা নেই কোন, বরঞ্চ তিনি সেখানে অনেক মানুষোচিত।
রামের চরিত্র-ধারায় এই পরিবর্তন ঘটেছে অনেক কাল ধরে। সংশয়ী পণ্ডিতেরা প্রশ্ন তুলেছেন যে তথাকথিত মূল কাণ্ডগুলিতেও ধর্মীয় ভাবনা-চিন্তা অনুস্যুত ছিল না। এ কথা কি সর্বতোভাবে প্রমাণ করা যাবে? আর আমাদের জিজ্ঞাসা হয়—‘মূল কাণ্ড-পঞ্চকেও প্রক্ষিপ্ত অংশগুলি বাদ দিলে’—জ্যাকোবির এই কথাটার মানে কি? তার মানে কি এই দাঁড়ায় না যে, যেখানে যেখানে, অর্থাৎ মূল কাণ্ড-পঞ্চকের কতগুলি শ্লোকে এবং আদিকাণ্ড তথা উত্তরকাণ্ডে তো বটেই, যেখানেই রামকে ভগবানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেই অংশটাই প্রক্ষিপ্ত। এই নিরিখে এমন কথা অবশ্যই বলা যায় যে, পণ্ডিতেরা যদি তাঁদের প্রতিপাদ্য সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সংকল্পিত থাকেন তাহলে তাঁদের যুক্তিও সেই মতেই চলবে এবং সত্যি কথা বলতে কি, তাই চলেছে। যেখানেই পণ্ডিতদের অসুবিধে হয়েছে সেখানেই শ্লোকের পর শ্লোক বাদ পড়ে গেছে। ‘কনটেক্সট্’ মিলছে না, শ্লোক বাদ দাও; ‘স্টাইল’ মিলছে না শ্লোক বাদ দাও; ছন্দ-অলংকার একটু অন্যরকম, শ্লোক বাদ দাও; অবতারবাদ আছে—সব বাদ দাও।
আজকের দিনে এ প্রশ্ন অবশ্যই আসবে যে, পণ্ডিতেরা প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে এমন গ্রন্থ উদ্ধার করে আনতে পারবেন কি যা সেই কালের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন; কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাৎসায়নের কামসূত্র-কিংবা এহেন বিশিষ্ট বিষয়ক গুটি কতক গ্রন্থ ছাড়া এমন গ্রন্থ দেখাতে পারবেন কি যা সেকালের সমাজের রন্ধ্র-পূরিত ধর্মভাব থেকে বিচ্ছিন্ন। আর অবতারবাদ জিনিসটাকে ভারতীয় ধর্মভাবনায় এমন নয়া আমদানী ভাবার কোন কারণ নেই যে, খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর আগে তা কেউ জানত না। বেদের ইঙ্গিত না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র কিংবা অতি পুরাতন পঞ্চরাত্র গ্রন্থগুলিতে অবতারবাদের কথা ভূরি ভূরি আছে। উপনিষদ্-নির্ভর ব্রহ্মবাদীদের পক্ষে অবতারবাদ ব্যাখ্যা করাও অতি সহজ। তাছাড়া যদি লৌকিক দৃষ্টিতেও বিচার করি তাহলেও স্বীকার করতে হবে ভারতবর্ষে অবতার হওয়ার একটা বিশিষ্ট পদ্ধতি আছে, যাতে বিশিষ্ট মানুষের দেবায়ন ঘটা তাঁর জীবৎকালেই সম্ভব।
আমি সাধারণ একটি উদাহরণ দেব। যাঁরা বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত অথবা কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত পড়েছেন, তাঁরা জানেন চৈতন্যদেব একটি মানুষই ছিলেন। চৈতন্য জীবনীকারেরা সকলেই যেমন চৈতন্যের মানবিক আচার-ব্যবহারগুলি বর্ণনা করেছেন, তেমনি সে বর্ণনায় মাঝে মাঝেই তাঁর জীবনধারায় এসেছে অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরের আবেশ। আপনি পাঠক হিসেবে চৈতন্যের ঈশ্বরলীলা অবিশ্বাস করতে পারেন কিন্তু আপনি কি চৈতন্যভাগবত কিংবা চৈতন্যচরিতামৃত থেকে এই অংশগুলি ছেঁটে ফেলে, যেখানে যেখানে শুধু চৈতন্যকে মানুষের মত বর্ণিত হতে দেখা যাচ্ছে, সেই অংশগুলিকে বৃন্দাবন দাস কিংবা কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা—এমন বলতে পারবেন! পারবেন না। আমরা জানি গৌতম বুদ্ধ ঐতিহাসিক ব্যক্তি, কিন্তু যে সমস্ত গ্রন্থকার বুদ্ধকে শেষ পর্যন্ত ভগবান বানিয়ে ফেললেন, তাঁদের বিশ্বাসে আপনি অবিশ্বাস করতে পারেন কিন্তু তাঁদের লেখা থেকে দৈব উচ্ছ্বাসটুকু ছেঁটে দেবার অধিকার কি আমার আপনার আছে?
যিনি রামায়ণ রচনা করেছিলেন, তিনি সাধারণ সমাজ-বিশ্বাসের বাইরের কোন ব্যক্তি নন। মূল কাণ্ডপঞ্চকে তিনি মূল রাম-কাহিনী ধরে রাখলেও, সময়ে সময়ে তাই তাঁকে সমাজ-বিশ্বাসের কথা, রামচন্দ্রর সম্বন্ধে সাধারণের অনুভূতির কথা মাঝেই মাঝেই ঢুকিয়ে দিতে হয়েছে, তা আপাততঃ শুনতে ‘অ্যাব্রাপ্ট’ লাগে, প্রসঙ্গের বাইরে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়। এই সাধারণ্যের কথা মনে রেখেই তাঁকে আদিকাণ্ডে রামকথার প্রস্তাবনা করতে হয়েছে এবং উত্তরকাণ্ডে তাঁর দেবায়ন সম্পূর্ণ করতে হয়েছে—এও তো হতে পারে। বিশেষতঃ তথাকথিত মূল কাণ্ড পঞ্চকের মধ্যেও আদর্শ পুরুষ হিসেবে রামের কল্পনা, ধর্মের তত্ত্ব এবং তথ্য, দৈব সংবাদ এমন কিছু কম নয়, যা অন্ততঃ একজন অবতার পুরুষের থেকে কম বলে মনে হয়। ভারতবর্ষের ধর্মীয় এবং দার্শনিক বিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে পরে এমন দু-চারজন পুরুষকে আমরা অবশ্যই দেখতে পাব যাঁদের মনুষ্যজীবন মহত্ত্ব এবং অতিপ্রাকৃত মাহাত্ম্য আকীর্ণ। কিন্তু যাঁরা এই সব ঐশ জীবনের রূপকার তাঁদের কি এই বলে দূষতে পারি যে, তাঁদের লেখার মধ্যে যখনই এই সব মানুষের দেবায়ন ঘটেছে সেই অংশগুলি তাঁদের লেখা নয়, অন্য কোন পরবর্তী কবির লেখা। আমাদের ধারণা রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন গ্রন্থাংশ ছেঁটে ফেলে তাদের একটা ‘কম্প্যাক্ট’ রূপ দেওয়ার তাগিদ যদি থাকে, তাহলে আরও বড় কোন মাপকাঠি দরকার। পণ্ডিতেরা অবশ্য আরও অনেক রকম যুক্তিজাল বিস্তার করে রামায়ণের দুটি কাণ্ড ছেঁটে ফেলেছেন এবং দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, মহাভারতের মধ্যে যে রামোপাখ্যান আছে তার একটা বড় অবদান আছে বর্তমান রামায়ণের পরিকল্পনায়। মহাভারতের মধ্যে রামকে প্রথমেই বিষ্ণুর অবতার বলে স্বীকার করা হয়েছে—বিষ্ণু মানুষরূপেণ—এবং আরও কতক জায়গায় রামচন্দ্রকে বিষ্ণুই বলা হয়েছে। পণ্ডিতদের ধারণা অতএব রামায়ণের অবতারবাদ মহাভারত থেকে ধার করা। কিন্তু তাঁরা এটা বলবেন না যে, রামায়ণের আদি কাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ডেই যেহেতু রামের বিষ্ণু বলে প্রতিষ্ঠা, তাই মহাভারতকারও তো সেই তথ্যে প্ররোচিত হতে পারেন যার জন্যে রামকে বিষ্ণু বলেই তিনি কথারম্ভ করেছেন এবং রামচরিত্রের অবশিষ্ট বর্ণনা করেছেন মানুষের মতই, যা রামায়ণেরও বৈশিষ্ট্য। আমি পণ্ডিতদের সঙ্গে বেশি তর্কাতর্কি করব না, কেননা তার শেষ নেই। কিন্তু কি কি ভিত্তিতে তাঁরা বাল্মীকি রামায়ণকে ছেঁটেছুঁটে মনের মত করে তৈরী করেছেন তার একটু দিক্ নির্দেশ করব। এই অংশে আমরা প্রধানতঃ মহাপণ্ডিত কালীকুমার দত্তের আপত্তিগুলি নথিভুক্ত করব, কেননা তিনি দেশীবিদেশী সমস্ত পণ্ডিতদের মতই একত্র সংকলিত করেছেন।
প্রথম কথা, রামায়ণ মহাকাব্যে সূচীপত্র গোছের দুটি জিনিস আছে। একটি আছে সেই যখন নারদ মুনি বাল্মীকির কাছে রামের জীবনী সংক্ষেপে বলেছিলেন, যাকে ‘সংক্ষেপ রামায়ণ’ বলা হয়। আরেকটি সূচীপত্র আছে আদিকাণ্ডেরই তৃতীয় সর্গে। নারদের বলা সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বালকাণ্ডের কোন ঘটনার উল্লেখ নেই এবং দোষ কাটাবার জন্যই দ্বিতীয় সূচীপত্র জোড়া হয়েছে বলে পণ্ডিতদের ধারণা।
দ্বিতীয়তঃ বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ডের বাচনশৈলীতে অনেক মিল আছে যা রামায়ণের অন্য কাণ্ডগুলির সঙ্গে মেলে না। অতএব এই কাণ্ডদুটিকে পরবর্তী বলতে হবে।
তৃতীয়তঃ বালকাণ্ডে বর্ণিত অনেক ঘটনার সঙ্গেই মূল কাণ্ডপঞ্চকের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। অতএব বালকাণ্ড পরে লেখা। সগর রাজার কাহিনী, সমুদ্র-মন্থন, বিশ্বামিত্রের জীবনকথা এসব রামায়ণে থাকা চলবে না, কাঁরণ এগুলি পৌরাণিক কায়দায় রামায়ণের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। এটা নাকি মহাভারতের প্রভাবও হতে পারে। কিন্তু উল্টোটা নৈব নৈব।
চতুর্থতঃ কবি বাল্মীকির কবি হওয়ার অনর্থও আছে। তিনি বালকাণ্ডে লক্ষ্মণের সঙ্গে উর্মিলা সুন্দরীর বিয়ে দিয়েছেন, অথচ অরণ্যকাণ্ডে তিনি সামান্য রসিক হয়ে ওঠার ফলে রামের মুখ দিয়ে কামার্ত শূর্পনখাকে শুনিয়েছেন—দেখ বাপু আমি বিয়ে করে ফেলেছি, সামনেই এই ভার্যাও উপস্থিত। কিন্তু আমার অনুজ লক্ষ্মণ ইনি বিয়ে করেননি—শ্রীমান্ অকৃতদারশ্চ লক্ষ্মণো নাম বীর্যবান্। আমার ভাই বিয়েও করতে চান অতএব—এনং ভজ বিশালাক্ষি—তোমাদের দুজনে মানাবেও ভাল।
বাল্মীকির অন্যায় হল, তিনি কবি। যত ইচ্ছে কবিত্ব করুন, আবার রসিকতা কেন? তাঁর বোঝা উচিত ছিল, তিনি যে এই সর্গের আরম্ভেই রামকে খানিকটা হাসিয়ে নিয়ে কথা বলাতে আরম্ভ করেছেন—স্মিতপূর্বম্ অথাব্রবীৎ—এই স্মিতহাস্যের তাৎপর্য গবেষকের কঠিন মনোভূমিতে রসিকতা হিসেবে ধরা দেয় না, ভুল হিসেবে ধরা দেয়।
বাল্মীকির উত্তরকাণ্ড নিয়েও কতগুলি মোটা দাগের প্রশ্ন গবেষক মহলে আলোড়ন তোলে। ভারতবর্ষে রামায়ণ সম্বন্ধে তিন ধরনের বিশিষ্ট পাঠ পাওয়া যায়—বঙ্গীয়, দক্ষিণী এবং উত্তুরে। পণ্ডিতেরা পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, তথাকথিত মূল কাণ্ডগুলির মধ্যে যে শ্লোকগুলি পাওয়া যায়, রামায়ণের উত্তুরে এবং দক্ষিণী সংস্করণে তা নিয়ে বিস্তর পার্থক্য আছে—পাঠভেদ, ক্রমভেদ সব ব্যাপারেই। কিন্তু উত্তরকাণ্ড নিয়ে উত্তর এবং দক্ষিণে প্রায় বিবাদ নেই। অতএব পণ্ডিতদের ধারণা, উত্তরকাণ্ড লেখা হয়েছিল অনেক পরে এবং তা প্রায় অবিকৃতভাবেই উত্তর এবং দক্ষিণের পাণ্ডুলিপিগুলিতে সংযোজিত হয়ে গিয়েছিল। মজা হল, লিপিতে লিপিতে গরমিল যেমন সিদ্ধান্তের প্রতিকূলতা তৈরী করে, তেমনি লিপিতে লিপিতে মিলও অনেক সময় অনর্থ ঘটায় এবং এক্ষেত্রে সেই অনর্থই ঘটেছে।
দ্বিতীয়তঃ মহাভারতকার তাঁর রামোপাখ্যানে উত্তরকাণ্ডের ঘটনাগুলি নাকি প্রায় একটুও উল্লেখ করেননি। অতএব উত্তরকাণ্ড মহাভারতের রামোপাখ্যানের থেকেও অর্বাচীন। আমরা বলি মহাভারতে উল্লিখিত হলেই কি প্রাচীনতা স্বীকার করি আমরা—অন্ততঃ মহাভারতের থেকে প্রাচীনতা? তাহলে বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র—এ কথাটি রামায়ণের অন্য কাণ্ডগুলির মত প্রাচীনতার দাবী করতে পারবে? নাকি সেখানে যুক্তি নিশ্চয়ই হবে অন্যকিছু? কিন্তু মহাভারতের রামোপাখ্যানের মধ্যে তো রাবণের বংশ পরিচয়, তাঁর পুষ্পক রথ অধিগ্রহণ—এসব তো আছে, যা একান্তভাবেই রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের পরিসর। আর উত্তরকাণ্ডের সব ঘটনা তো আর ওইটুকু রামোপাখ্যানের মধ্যে আমূলান্ত বলা সম্ভব নয়, কেননা আখ্যানটি মূল রামায়ণের সংক্ষিপ্তসার। তাছাড়া তথাকথিত মূল পাঁচ কাণ্ডের কাছে যে বিষয় অত্যন্ত অপেক্ষিত ছিল, সেই রাবণ কুম্ভকর্ণ ইত্যাদির বংশ পরিচয়, তাঁদের তপস্যা, বরলাভ—এই সব কিছুই কিন্তু মহাভারতের রামোপাখ্যানে একেবারে প্রথমেই অবতারণা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত হলেও এর তাৎপর্য পণ্ডিতদের চোখ এড়িয়ে যাবার কথা নয় এবং সেই সুবাদে এমন কথাও চলে না যে উত্তরকাণ্ডের কোন কথাই মহাভারতকারের জানা ছিল না। হ্যাঁ, রামোপাখ্যানে অযোধ্যায় সীতার চরিত্রে কলঙ্ক নেই, তাঁর বিসর্জনও নেই, পাতাল প্রবেশও নেই। কিন্তু মহাভারতকারের বিপদটাও চিন্তা করুন। একে তাঁকে গল্পের মধ্যে গল্প বলতে হয়, তাতে প্রসঙ্গ কেবলই যায় হারিয়ে; তার মধ্যেও ‘টু দ্য পয়েন্ট অ্যানসার’ ব্যাপারটা তাঁর জানা ছিল, যার জন্যে রাম-সীতার মিলন দেখিয়েই তিনি ক্ষান্ত হয়েছেন। মহাভারতে রামের উপাখ্যান বলেছেন মার্কণ্ডেয় মুনি এবং যে প্রসঙ্গে এই গল্প এসেছে তা হল—বনের মধ্যে যখন দুর্যোধনের জামাইবাবু জয়দ্রথ মহাশয় দ্রৌপদীকে হরণ করেছিল; পাণ্ডবেরা জয়দ্রথকে রাস্তার মধ্যে প্রায় ধরে ফেলেন এবং ভয়ে দুষ্কৃতকারী পালিয়ে যায়। এই অবস্থায় যুধিষ্ঠির ভূত-ভবিষ্যৎ-জানা মার্কণ্ডেয় মুনিকে প্রশ্ন করেন যে, তাঁর মত হতভাগ্য আর দ্বিতীয় কে আছে, বনবাসকালে যার স্ত্রীকেও অবিতর্কিতভাবে শত্রুপক্ষ হরণ করে! এই প্রশ্নের পেছনে তাঁর একটা সংশয়ও ছিল। মার্কণ্ডেয়কে প্রশ্ন করার সময় যুধিষ্ঠির সোজাসুজি বলেন—কৃষ্ণা দ্রুপদ রাজার মেয়ে, যজ্ঞের বেদি থেকে তার জন্ম। সে অযোনি সম্ভবা এবং পাণ্ডবদের সহধর্মিণী। ধর্ম কাকে বলে দ্রৌপদী তা জানেন এবং ধর্মের আচরণও করেন। এইরকম যে আমাদের পত্নী, তাকেও অন্যলোকে চুরি করতে গিয়ে স্পর্শ করল! দ্রৌপদী কোন পাপ তো করেনি কোন গর্হিত কাজও তো করেনি, ব্রাহ্মণদের প্রতিও সে চিরকাল ধর্ম ব্যবহার করেছে। তবু কেন এমন হল?
দ্রুপদস্য সুতা হ্যেষা বেদিমধ্যাৎ সমুত্থিতা।
অযোনিজা মহাভাগা স্নুষা পাণ্ডো র্মহাত্মনঃ॥
ইমাং হি পত্নীমস্মাকং ধর্মজ্ঞাং ধর্মচারিণীম্॥
সংস্পৃশেদীদৃশো ভাবঃ শুচিং স্তৈন্যমিবানৃতম্॥
ন হি পাপং কৃতং কিঞ্চিৎ কর্ম বা নিন্দিতং ক্কচিৎ।
দ্রৌপদ্যা ব্রাহ্মণেদেব ধর্মঃ সুচরিতো মহান্॥
তা জহার বলাদ্ রাজা⋯
প্রশ্ন যতটুকু তার জবাবও ততটুকু। যুধিষ্ঠিরের মনে দ্রৌপদীর সম্বন্ধে পাপ এবং নিন্দার সংশয় জেগেছে, মার্কণ্ডেয় তাঁর জবাবে রামের সংশয় উল্লেখ করেছেন। পরগৃহবাসিনী সীতাকে রামের মনে হয়েছে কুকুরে-চাটা ঘিয়ের মত। তিনি তাঁকে নিঃসংশয়ে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। তারপর বায়ু, অগ্নি, বরুণ, ব্রহ্মা, সবাই মিলে সীতার স্বপক্ষে সাক্ষী দিলেন। রাম সন্দেহ মুক্ত হলেন। দুজনের মিলন হল। এর বেশি তো এই প্রসঙ্গে বলার দরকার নেই। অযোধ্যায় গিয়ে কি হল না হল, সেই ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও নেই, তার জবাবও নেই। কিন্তু যারা বলেন মহাভারতকার বালকাণ্ড, উত্তরকাণ্ডের কথা কিছুই জানতেন না তাঁরা আরও কথা মনে রাখতে পারেন। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে ‘অযোনিজা’, ‘বেদিমধ্যাৎ সমুত্থিতা’—এত সব বিশেষণ লাগিয়েই কথারম্ভ করেছিলেন। উত্তরে এইটাই অপেক্ষিত যে, মার্কণ্ডেয় এমন বধূ হরণের কথাই বলবেন যে বধূ অযোনিজা কিংবা অলৌকিক উপায়ে যার জন্ম হয়েছে। হ্যাঁ সীতা যোনিজা, না অযোনিজা সেই নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মহাভারতকার সব কিছু অতি সংক্ষেপে বললেও রামায়ণের বালকাণ্ডে সীতার অলৌকিক উৎপত্তি-কথা যে মাথায় রেখেছিলেন তার প্রমাণ তো আছে। একে তো যুধিষ্ঠিরের স্বগত সংবাদেই এই বিষয়ের পরোক্ষ সমর্থন আছে, তার ওপরে সীতার সঙ্গে রামের বিবাহ সংবাদে মার্কণ্ডেয় বললেন—সীতা বিদেহরাজ জনকের মেয়ে কিন্তু স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁকে রামের প্রিয়া মহিষী করে দেন—বিদেহরাজো জনকঃ সীতা তস্যাত্মজা বিভো। যং চকার স্বয়ং ত্বষ্টা রামস্য মহিষীং প্রিয়াম্॥
ত্বষ্টা ব্রহ্মা। কেন, তিনি কেন? বললেই হত রামের সঙ্গে সীতার বিয়ে হয়েছিল। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ লিখলেন—ত্বষ্টা প্রজাপতি স্বয়ং এই বিবাহের সংকল্প করেছিলেন, সীতা তাই মৈথুনজাতা কোন কন্যা নন, তিনি অযোনিজা—ত্বষ্টা প্রজাপতিঃ স্বয়মেব সঙ্কল্পেন চকার, ন তু মৈথুনদ্বারা, অযোনিজাম্ ইত্যর্থ।
ধরে নিলাম নীলকণ্ঠ অনেক পরের লোক, তিনি বাল্মীকি রামায়ণের বালকাণ্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকবেন, তাই সীতাকে ‘অযোনিজা’ বলেছেন। কিন্তু মহাভারতকার স্পষ্টতঃই যুধিষ্ঠিরের দ্রৌপদী ভাবনার অনুরূপ উদাহরণ দিতে গিয়েই যে সীতাকে ত্বষ্টা প্রজাপতির সঙ্কল্পিতা বধূটি বানিয়েছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
যাঁরা বলেন মহাভারতকার বাল্মীকি রামায়ণে অযোধ্যার রাজধানীতে রামের হাতে সীতা-বিসর্জন কিংবা পাতাল প্রবেশের কথা জানতেন না, তাঁরা যেন রামোপাখ্যানের শেষ অধ্যায়টিই খেয়াল করেন। না, মহাভারতকার এ সব বর্ণনা করেননি, তার প্রসঙ্গও ছিল না, শুধুমাত্র লঙ্কাযুদ্ধের পর বাল্মীকি রামায়ণে যেমনটি সীতা-প্রত্যাখ্যান আছে, মহাভারতেও তাই আছে। রামচন্দ্র এতকাল রাবণের গৃহে-থাকা সীতাকে সহজে স্বীকার করলেন না কিন্তু এই অস্বীকার, অসম্মানের পর সীতা যে ভাষায় কথা বলে উঠলেন, সেই ভাষা, সেই শৈলী কিন্তু মহাভারতের কবির বড় চেনা, এই বিলাপ তিনি আগেও যেন শুনেছেন। বাল্মীকি রামায়ণে প্রত্যাখ্যাতা সীতা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু মহাভারতে তিনি তা নন। ভাষা-শৈলীকে আমি সাহিত্যবিচারের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি মনে করি না, কেন করি না তা পরে বলব, কিন্তু মহাভারতে অতি সংক্ষিপ্ত রামোপাখ্যানের মধ্যে অন্ততঃ এই জায়গাটায় ভাষা-শৈলীকে একবারের মত প্রণিধান করতেই হবে। রামায়ণ মহাকাব্যে সীতার পাতাল-প্রবেশের সময় সীতারই জবানীতে কতগুলি মর্মস্পর্শী বিলাপোক্তি আছে। এই শ্লোকগুলির মধ্যে রামের প্রতি সীতা কতখানি একনিষ্ঠ তার দৃঢ় প্রত্যয় যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি সীতার কথা যদি রাম স্নুযা বিশ্বাস না করেন, তাহলে ‘ধরণী দ্বিধা হও’—এই ধ্রুপদে বাঁধা পড়েছে চরম করুণ এই শ্লোকগুলি। সীতা একবার তাঁর পতি-নিষ্ঠতার কথা বলেন, আর দ্বিতীয় চরণে নিজেকে অভিশাপ দেন—তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি—যদি এই নিষ্ঠা সত্যি না হয় তাহলে সর্বংসহা ধরিত্রীও যেন বিদীর্ণ হয়। তাই হয়েছে, অবিশ্বাসীর প্রত্যয় হওয়ার আগেই ধরিত্রী তাঁকে শান্ত আশ্রয় দিয়েছেন।
সাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ এই শ্লোকগুলি যে অবশ্যই ব্যাসের অন্তর্হৃদয়ে ক্রিয়া করেছে সে বিষয়ে একটা ছোট্ট প্রমাণ উপস্থিত করা যেতে পারে। ব্যাস জানতেন—তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গহীনভাবে সীতার পাতাল প্রবেশের কথা উল্লেখ করা সম্ভব হবে না। অথচ এইখানে বাল্মীকির সীতার বিলাপোক্তিগুলির মর্মভাব যদি অপ্রকাশিতই থেকে যায় তাহলে স্বয়ং ব্যাসের পাঠককুল হবেন বঞ্চিত। ব্যাসদেব তাই বাল্মীকির পরের লেখার ভাবটুকু আগে নিয়ে এসেছেন। মহাভারতের রামোপাখ্যানে সীতার পক্ষে তাঁর রাম-নিষ্ঠা জানানোর সময় এসেছে—রাবণবধের পর। তিনি যখন প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন সেই তখন। মহাভারতকার কিন্তু এই সুযোগ ছাড়েননি। বাল্মীকির ধ্রুবপদ তিনি ব্যবহার করেননি, কিন্তু একই ভাবে দ্বিতীয় চরণে একবার পবন-দেবতা, একবার অগ্নি, একবার ভূলোক-দ্যুলোককে সাক্ষী মেনে তিনিও সীতা-বিলাপের নতুন ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছেন—স মে বিমুঞ্চতু প্রাণান্ যদি পাপং চরাম্যহম্—যদি আমি কোন পাপ করে থাকি তবে অগ্নি, বায়ু, আকাশ, জল অথবা পৃথিবীই আমার প্রাণ-বিয়োগ করুন। এই ধ্রুবপদের থেকেও যে পংক্তিটা ব্যাসের হৃদয়ে বাল্মীকির ছায়া ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে, তা হল সীতার সেই প্রতিজ্ঞা। রামায়ণে সীতা বলেছিলেন—‘রাম ছাড়া যদি অন্য কারও কথা মনে মনেও না ভেবে থাকি—যথাহং রাঘবাদ্ অন্যং মনসাপি ন চিন্তয়ে—তাহলে দ্বিধা হোক ধরণী। মহাভারতকার বাল্মীকির শব্দ একটু আধটু ওলট পালট করে লিখেছেন—বীর! তোমার ছাড়া যদি অন্য কারও কথা স্বপ্নেও না ভেবে থাকি—যথাহং তদ্ঋতে বীর নান্যং স্বপ্নেপ্যচিন্তয়ম্—তাহলে তুমিই আমার চিরনিরূপিত পতি হও। বাল্মীকির পংক্তি আর ব্যাসের পংক্তিতে ভাবগত পার্থক্য তো নেইই, এমনকি শব্দ-ব্যবহারেও আশ্চর্য মিল আছে। তবুও কি আমরা বলব রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি ব্যাস, নাকি উত্তরকাণ্ডের খবরও তাঁর জানা ছিল না।
যাঁরা উত্তরকাণ্ডের ভাষার আঁটোসাঁটো বাঁধুনি দেখে ‘অরনেট্ স্টাইল’-এর যুক্তিতে বাল্মীকির রচনার এই সব অংশে পরবর্তিতার আভাস দেখতে পান, তাঁদেরকে জানাই এইরকম পুনরাবৃত্ত পংক্তি-ব্যবহার, এইরকম ‘অরনেট স্টাইল’ বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যা-কাণ্ড, সুন্দর-কাণ্ড এবং লঙ্কা-কাণ্ডেও যথেষ্ট আছে। ভাষা-শৈলীর যুক্তিতে সেগুলির মধ্যেও যদি আবার স্থূল-হস্তাবলেপ দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে বাল্মীকি রামায়ণ শূন্যে পর্যবসিত হবে। কাজেই ভাষা-যুক্তির কথা আমার আপাততঃ পরিহার্য বলেই মনে হয়।
পণ্ডিতেরা বলেছেন—উত্তরকাণ্ডের বর্ণনভঙ্গী নাকি পৌরাণিক। তার ওপরে উত্তরকাণ্ডে আছে সেই সব কথা-কাহিনী যার কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগই নেই মূল কাণ্ড-পঞ্চকের সঙ্গে। নিমি, শ্বেত কিংবা যযাতির কাহিনীগুলি এই পর্যায়ে পড়ে। উত্তরকাণ্ডে আছে বেদবতীর কাহিনী এবং সীতার জন্ম প্রসঙ্গেও সে কাহিনীর উল্লেখ নেই বলে পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণ উত্তর-কাণ্ডকেই অভিযুক্ত করেছেন পরবর্তিতার দায়ে। এসব খুচরো অভিযোগ আমরা না হয় স্বীকার করেই নিলাম, কিন্তু তাই বলে সম্পূর্ণ উত্তরকাণ্ডই যে ভিন্ন মস্তিষ্কের স্থূল কল্পনা, সে কথা মানতে আমাদের আপত্তি আছে। এর ওপরেও কিছু উটকো বিপদ আছে। হেবার আর প্রিনজ্ সাহেব বলেছেন সীতার অগ্নি-পরীক্ষা ব্যাপারটা যদিও লঙ্কা-কাণ্ডেই আছে, তবুও ওটি নাকি রামায়ণ-রচনার প্রথম কিংবা মূল স্তরে ছিল না।
এ কথার যুক্তি কি? না, উত্তরকাণ্ডে সীতার পাতাল-প্রবেশের পূর্বে বাল্মীকি যখন লব-কুশের হাত ধরে সীতাকে নিয়ে রামের সভায় উপস্থিত হলেন, তখন রাম তাঁকে বলেছিলেন—মুনিবর! ইনি পূর্বেও দেবতাদের সামনে শপথ করে আমার প্রত্যয় উৎপাদন করেছিলেন বলেই, আমি এঁকে ঘরে তুলেছি—শপথশ্চ কৃতস্ত্রত্র তেন বেশ্ম প্রবেশিতা। রাম তো এই সময়ে মুনির কাছে সীতার অগ্নি পরীক্ষার কথা তোলেননি, অতএব অগ্নি-পরীক্ষার ব্যাপার মূল রামায়ণে ছিল না।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি যে, এই সব পণ্ডিতেরা বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের যুক্তিবাদী মানুষের ওপর এই খেজো যুক্তিগুলি চাপিয়ে দিলেন কি উপায়ে! এই সব পঞ্চানন পণ্ডিতেরা একমুখে উত্তরকাণ্ডকে বলবেন প্রক্ষিপ্ত, আবার আর এক মুখে তাঁদেরই বলা মূল কাণ্ডের একটি ঘটনা নস্যাৎ করার জন্য উত্তরকাণ্ডেরও একেবারে শেষ পর্যায়ের একটি অধ্যায়কে সাক্ষী মানবেন। নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য যেরকম সুবিধে, সেইরকম যুক্তি প্রয়োগ করেও যে পার পাওয়া যায়, তার কারণ তাঁরা এদেশী নন। এ সেই হ্বেবার, যিনি বলেছিলেন রামায়ণের শম্বুক-কাহিনীর মূলে আছে করোমণ্ডল অঞ্চলে ক্রীশ্চান মিশনারীদের অভিবাসনের ঘটনা। এতটা বাড়াবাড়ি তাঁর জাতভাই প্রিনজ্ সাহেবই সহ্য করতে পারেননি। তিনি মহাভারত, পদ্মপুরাণ, রঘুবংশ, উত্তররামচরিত এবং অধ্যাত্ম-রামায়ণের প্রমাণে হ্বেবারের কথাগুলি উড়িয়ে দিয়েছেন।
বাদ-প্রতিবাদ, উদ্ভট মত উদ্ভাবন এবং আরও অনেক কিছুই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে হয়েছে, কিন্তু আজ বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে দাঁড়িয়ে স্বাধীন দেশে বড় হয়েও যাঁরা এইসব উদ্ভট কথা বলেন এবং তথা ‘হ্বেবার-হ্বেবার’ বলে ধন্যধ্বনি দেন, তাঁদের শোধরানোর উপায় কি?
বিশেষতঃ অনভিজ্ঞ ব্যক্তি যখন অভিজ্ঞের মত করে কথা বলেন, তখন বিপদ আরও বাড়ে। অনভিজ্ঞ ব্যক্তি জার্মান পণ্ডিতের মত উদ্ধার করে সাধারণ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন—দেখ বাপু ডঃ হ্বেবার সাহেবের মত পণ্ডিত বলেছেন—যে, আমাদের রামায়ণ কাহিনীর সঙ্গে হোমারের ইলিয়াডের বড় মিল আছে। দুই মহাকাব্যেই এক দেশের রাজার স্ত্রীকে আরেক দেশের রাজা হরণ করেছে। যদিও হোমারের হেলেন হৃত হয়েছেন স্বেচ্ছায় আর সীতা বলযোগে। মিলল না। সমুদ্র পার হয়ে শত্রু রাজার রাজধানী অবরোধেও আছে মিল, যদিও একজন গেছেন জাহাজে, অন্যজন সেতুবন্ধন করে। লঙ্কার প্রকারের বাইরে এবং ট্রয়ের প্রাকারের বাইরের যুদ্ধ আছে দুই মহাকাব্যেই। অতএব “রামায়ণ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় পরিবেশে ইলিয়াডের ছায়া অবলম্বনে রচিত, হয়ত-বা কিছুটা ওডিসির ছায়াও পড়ে থাকতে পারে।” এবং ভুলিও না, “জার্মানীর বিশিষ্ট রামায়ণ-বিশেষজ্ঞ ডঃ অ্যালব্রেক্ট ওয়েবার এই মত পোষণ করতেন।” (দ্রঃ জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বে উল্লিখিত প্রবন্ধ)
হ্বেবারের এই মত পণ্ডিত মহলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এবং যিনি তাঁদের অন্যতম সেই কে. টি. তেলাং নাকি ‘স্বদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ’ হয়ে এই কাজ করেছেন। আমাদের বক্তব্য—‘স্বদেশিকতা’ কোন পাপ নয়, সভাগৃহে সমাজতান্ত্রিকতাও পাপ নয়, পাপ হল বিষয়ানভিজ্ঞতা, সাহেব বললেই ঠিক মনে হয় এবং সাহেবের মত প্রত্যাখ্যাত হলেই ‘স্বদেশিকতা’ মনে হয়। অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে প্রামাণ্য হল মাল্লাদী ভেঙ্কটরত্নম, যাঁর দুখণ্ড বই পড়লে মনে হয় ‘রাম ছিলেন প্রকৃতপক্ষে মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্যারাও দ্বিতীয় র্যামেসিস, সীতা ছিলেন ইখনাতেনের ভগ্নী সীতামন, আর রাবণ ছিলেন একজন হিটাইট রাজা।” অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে প্রামাণ্য হন নীরদ চৌধুরী, যিনি কয়-লাইনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আদিতে পশ্চিম এশিয়ার কোন যুদ্ধকাহিনী পরবর্তীকালে আর্যদের রামায়ণী কথার রূপ ধারণ করেছে। আর নীরদ চৌধুরীমশাই বললে অনভিজ্ঞের সংকল্প জন্মায়—‘এরকম কোন কারণ থাকা অসম্ভব নয়।’
পাঠকমশাই! আমাকে যদি মিল দেখাতে বলেন, তাহলে ওদেশের কাব্য-মহাকাব্যের সঙ্গে এদেশের কাব্য-মহাকাব্যের-এমন মিল দেখাতে পারি, যাতে মনে হবে কালিদাস সেকস্পীয়র থেকে টুকেছেন, কীটস্-ব্রাউনিং রবীন্দ্রনাথ থেকে টুকেছেন, পাণিনি-ভর্ত্তৃহরি চমস্কির তত্ত্ব মেরে দিয়েছেন আর অভিনবগুপ্ত আই এ রিচার্ডসের যোগ্য উত্তরাধিকারী। বলা বাহুল্য আমি আপাততঃ এই উল্টোরথে টান দেব না, তার থেকে রামায়ণ-গবেষণার কিছু মূল্যবান তথ্য এ প্রসঙ্গে অবতারণা করার চেষ্টা করব।
অধিকাংশ পণ্ডিতের মত মানতে গেলে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে রামায়ণের আদিকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড দুটিই প্রক্ষিপ্ত। কিন্তু প্রক্ষিপ্ত হলে হবে কি, পরবর্তী কালের ধর্ম-ধারণায় এবং সাহিত্য-কৃষ্টিতে—এই দুই কাণ্ডেরই এক উত্তরাধিকার আছে, যে উত্তরাধিকার একেবারেই ফেলনা নয়। ফেলনা না হওয়ার আরও একটি বড় কারণ আছে। এন. জে. শেণ্ডে লিখেছিলেন যে, রামায়ণ কাহিনীতে ভৃগু-অঙ্গিরস নামক ব্রাহ্মণ পরিবারের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে এবং এই ভৃগু-অঙ্গিরস-গোত্রীয় ব্রাহ্মণেরা, যাঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পোষক ছিলেন, এঁরাই মূল পঞ্চ-কাণ্ড রামায়ণকে সপ্তকাণ্ডে ব্রাহ্মণায়িত করেন। অবতারবাদ, চাতুর্বর্ণ্য-বিধানের কড়াক্কড়ি—যা নাকি রামায়ণের মূল কাণ্ড-পঞ্চকের মধ্যে খুন বেশি লক্ষ্যণীয় নয়, এ সব কিছুই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে রামায়ণের বালকাণ্ডে এবং উত্তরকাণ্ডে। আর্যসমাজের প্রাথমিক অবস্থায় যজ্ঞ, হোম, তপশ্চর্যা—এগুলিই ছিল ব্রাহ্মণ্যের অভিব্যক্তি। সে সমাজে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়, উভয়েই পশুমাংসের রসাস্বাদ ভাল করেই জানত। বানররাজ বালিকে মারার পর তিনি রামকে বলেছিলেন—আমাকে মেরে তোমার কি লাভ হল বল। আমার মাংসও তোমার খাওয়া চলবে না। কারণ, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়েরা একযোগে যে পাঁচনখওয়ালা প্রাণীর মাংসগুলো খায়, তা হল শজারু, গণ্ডার, গোসাপ, খরগোশ আর কচ্ছপের মাংস—পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘব। শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশঃ কূর্মশ্চ পঞ্চমঃ॥
পরবর্তীকালে ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নে আমিষ মেনুতে অনেক মাংসই বাদ পড়ে গেছে, আর পুরাণে ইতিহাসে ব্রাহ্মণেরা, ঋষিরা প্রায়ই পরিচিত হয়েছেন ফলমূলাহারী বলে। কিন্তু রামায়ণসমাজের প্রথম বিকাশে এমন ব্যাপার আদৌ ছিল না। ভরদ্বাজ মুনির তো শুচি-বাই বলতে কিছু ছিল না। বনের পথে ভরত এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীর জন্য মদ-মাংসের এমন বিপুল সম্ভার তিনি রচনা করেছিলেন যে একমাত্র ভরত ছাড়া তাঁর সমস্ত সৈন্যই বলতে থাকল—সুখে থাকুন ভরত, কিন্তু অযোধ্যায় আর ফিরে যাচ্ছি না, সুখে থাকুন আমাদের রামচন্দ্র, কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা দণ্ডক বনেও যাব না—নৈবাযোধ্যাং গমিষ্যামো ন গমিষ্যামো দণ্ডকান্। ভাবুন তো কি পরিবেশ—মুনির আশ্রম। আর স্বয়ং মুনিই পরিবেশন করছেন—সুরাদীনি চ পেয়ানি মাংসানি বিবিধানি চ। আপনি ভাবতে পারেন—এই খরগোশ, গোসাপ—এ সব কি খাওয়া যায়! মুনির মেনুতে কি আজকের দিনের মত কিছুই নেই! ঋষি ভরদ্বাজকে ভুল বুঝবেন না। ব্রাহ্মণের পক্ষে খরগোশ, কচ্ছপ—এ সবের বাইরে হয়তো মাংস খাওয়া চালু ছিল না, কিন্তু পাবলিক ক্ষত্রিয়ের জন্যে ভরদ্বাজের যথেষ্ট চিন্তা ছিল। পাঁঠা তো ছিলই। ছিল মাটন এবং হ্যাম, এবং তা আবার গন্ধরস সমন্বিত—আজৈশ্চাবিকবারাহৈঃ/সূপৈ র্গন্ধরসান্বিতৈঃ। আবার পিঠর-পাকে উত্তপ্ত হরিণ, ময়ুর আর মুর্গীর রোষ্ট—এমন উপাদেয় ব্যবস্থা ভরদ্বাজ করেছিলেন তপোবলে—প্রতপ্তপৈঠরৈশ্চাপি মার্গমায়ূরকৌক্কুটৈঃ। নিজে না খেলে কি হয়, জনগণের ‘টেস্ট’ তিনি জানতেন এবং এই সব মদ্য-মাংস্যের ব্যবস্থা করার জন্য তপোবল খাটালেও সেটা তাঁর কাছে অপব্যবহার বলে মনে হয়নি। আসল কথা জনগণের ‘টেস্ট’ তিনি জানবেন না কেন? মুনি হলেও রাজবাড়িতে কি হচ্ছে, সে খবর তাঁরা সবসময়ই রাখতেন। রামচন্দ্র যখন যে মুনির আশ্রমে গেছেন, সেইখানেই শুনেছেন যে, মুনি তাঁর বনবাসের খবর পূর্বাহ্নেই জানেন। এর কারণ যতখানি তপোবল, তার থেকেও বেশি জনসংযোগ। রাজাদের সঙ্গে মেশামিশিও তাঁদের কম ছিল না। অনেক ব্রাহ্মণ-মুনিই তপস্যা এবং চতুর্বেদের সঙ্গে ধনুর্বেদের চর্চাও ভালই রপ্ত করতেন। মহর্ষি অগস্ত্যের আশ্রমে রাক্ষসেরা উৎপাত করার কোন সাহস পেত না। কারণ এ মুনি মাংস-খাওয়া শক্তিধর মুনি। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণেও যে মাংস খাওয়া তাঁর অভ্যাস ছিল, সে প্রমাণও তো আছে। কিন্তু মাংস-খাওয়ার থেকেও আরও বড় পরিচয়ই অনেক মুনির ছিল এবং তা হল দরকারে অস্ত্রধারণ। আমি মহাভারতের দ্রোণাচার্যের মত গৃহস্থ ব্রাহ্মণ বীরের কথা বলছি না। কিংবা বলছি না রামায়ণের পরশুরামের কথা, কেননা পরশুরামের কথা উঠলেই পণ্ডিতেরা বলবেন—এ হল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের স্বাধিকার-দ্বন্দ্বের প্রতিফলন, যাতে ব্রাহ্মণ পরশুরামকে ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এও তো বালকাণ্ডের কথা—এবং তার মানেই প্রক্ষিপ্ত, পরবর্তী। ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণত্ব-লাভও একই বিশ্লেষণের পরিসর, এবং তাও বালকাণ্ডেই। মূল কাণ্ড-পঞ্চকের মধ্যে কিন্তু ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের ব্যবহারে আপাত কোন বিরোধ নেই। বরঞ্চ যা আছে, তা হল শাস্ত্র এবং অস্ত্রের তুল্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মহাভারতের ব্রাহ্মণ গুরু দ্রোণাচার্যের প্রতিরূপ রামায়ণেও আছে। অস্ত্র-শাস্ত্রের পারদর্শিতা তাঁর এমনই যে, সেই ব্রাহ্মণগুরুর নামই ছিল সুধম্বা। বনবাসের মাঝখানে হঠাৎ যখন রাম ভরতকে দেখলেন, তখন প্রায় চমকে উঠে অযোধ্যা রাজ্যের নানা বিষয়ে অমঙ্গলাশঙ্কী হয়ে ভরতকে নানা প্রশ্নে উদ্বেল করে তুললেন। দশরথ, গুরু বশিষ্ঠ, জননী কৌশল্যা—এঁদের কুশল জিজ্ঞাসা করেই, ভরতকে কোন উত্তর দেবার অবসর না দিয়েই রামচন্দ্র ভেবে বসলেন—ভরত কোন পূজ্য স্থানে অন্যায় করে ফেলেছেন হয়তো। কাজেই পুরোহিতের কথা জিজ্ঞাসা করলেন রাম, জিজ্ঞাসা করলেন যিনি অগ্নিহোত্র নিষ্পাদন করেন তাঁর কথাও। কিন্তু এর পরেই যাঁর প্রসঙ্গ এল, তিনি সেই সুধম্বা। রাম বললেন—ভরত! যিনি মন্ত্র সহযোগে এবং মন্ত্র না পড়ে—দুভাবেই বাণপ্রয়োগে নিপুণ, যিনি রাজনীতি এবং আমাদের ধনুর্বেদের আচার্য, সেই সুধম্বাকে তুমি মান্য-গণ্য কর তো?—ইষ্বস্ত্রবরসম্পন্নম্ অর্থশাস্ত্রবিশারদম্। সুধন্বানমুপাধ্যায়ং কচ্চিৎ ত্বং তাত মন্যসে॥
রামায়ণে অবশ্য ভাল করে বলা নেই ইনি ব্রাহ্মণই কিনা, কিন্তু ব্রাহ্মণ-সম্বন্ধীয় প্রশ্নভাগেই সুধার নাম পড়ায় পণ্ডিতেরা তাঁকে ক্ষত্রিয়বৃত্তি ব্রাহ্মণ বলেই মনে করেন। তাছাড়া আরও একটি কথা আছে। ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে সরাসরি অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় ব্রাহ্মণেরা হয়তো সামিল ছিলেন না, কিন্তু আজকের দিনের মত তাঁদের আরণ্য পর্ণ কুটিরে পুলিশী তল্লাসী চললে তাজা কার্ত্তুজের বদলে তাজা বাণ অবশ্যই পাওয়া যেত। নইলে মুনির আশ্রমে গেছেন রামচন্দ্র, ঋষিরা কোথায় আতিথেয়তা করবেন ফল-মূল দিয়ে, নইলে নিদেন পক্ষে শাস্ত্রবাণীর সুনৃত উপদেশে—সেখানে মহামুনি সুতীক্ষ্ণ রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাইকে দিলেন দুখানি উত্তম তূণ, দুটি ধনুক এবং দুটি খড়্গ, যাতে মরচে দাগ পর্যন্ত নেই, নির্মল। অস্ত্রগুলি তিনি দিলেন সীতার হাত দিয়ে—ততঃ শুভতরে তূণী ধনুষী চায়তেক্ষণা। দদৌ সীতা তয়োর্ভ্রাত্রোঃ খড়্গৌ চ বিমলৌ ততঃ॥ মুনির আজ্ঞায়—অনুজ্ঞাতৌ মহর্ষিণা—রাম লক্ষ্মণ দুজনেই ধনুক-বাণ আর খড়্গ সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন দণ্ডকারণ্যের পথে। আমাদের জিজ্ঞাসা, মুনির আশ্রমে এ সব অস্ত্র-শস্ত্র কেন? সুতীক্ষ্ণ মুনি নিজেই কবুল করেছেন যে, তাঁর আশ্রমে রাক্ষসেরা হামলা করে না। শুধুমাত্র শত শত নির্ভয় হরিণের উপদ্রব ছাড়া তাঁর আশ্রম চত্বরে আর কোন উপদ্ৰবই নেই। তবু এসব অস্ত্র তাঁর ঘর থেকে বেরোল কেন? নিশ্চয় তিনি এর ব্যবহার ভালই জানতেন, অথবা পূর্বে এসব ব্যবহার করেছেন, এবং সেই কারণেই হয়তো তাঁর আশ্রমে রাক্ষসেরা পা রাখার সাহস করত না। অথচ অন্যান্য মুনিরা, এই সুতীক্ষ্ণের আশ্রমে আসার একটুখানি আগেই তো রামের কাছে আর্জি পেশ করছিলেন যাতে তিনি রাক্ষসদের উৎপীড়ন থেকে মুনিদের রক্ষা করেন—পরিপালয় নঃ সর্বান্ রাক্ষসেভ্যো নৃপাত্মজ। অগস্ত্য ঋষি অরণ্যজাত দ্রব্যগুলি রামকে নিবেদন করার পর যে অমূল্য উপহার রামকে দিয়েছিলেন তা হল বিশ্বকর্মার তৈরী সোনায় মোড়া আর বজ্ৰমণি খোদাই করা একখানি ধনুক, একটি সোনার হাতলওয়ালা তলোয়ার আর আগুন-পানা বাণে ভর্ত্তি দুখানি অক্ষয় তূণ, যে তূণ সেই রাবণবধ পর্যন্ত কাজে লেগেছে। ঋষি বলেছেন এগুলি নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া, এগুলি বিষ্ণু পূর্বে অসুর মারবার জন্যেই ব্যবহার করে সফল হয়েছেন। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, চিরকাল রাবণের ভয়-ভীত ইন্দ্র নিজে কেন এগুলি রাবণবধের জন্যে ব্যবহার করেননি, এবং কেনই বা তিনি এগুলি মুনিবর অগস্ত্যের কাছে জমা রেখেছেন? অনাদিকাল থেকে বিশ্বকর্মা-মার্কা যেসব অস্ত্র-শস্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে বুঝি বিশ্বকর্মারা এক বিশেষ কামার গোষ্ঠী—যাদের শিল্পের কদর মুনিরাও বুঝতেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র আবার রামচন্দ্রকে যে সব অস্ত্র-শস্ত্র দিয়েছিলেন তাড়কাবধের পর, সেগুলি সবই এসেছিল বিশ্বামিত্রের তপোবলে। রামায়ণের আদিকাণ্ডে বিশ্বামিত্রর দেওয়া অস্ত্রগুলির বিচিত্র সব নাম আছে আর সেগুলি সংখ্যায়ও অনেক। বিশ্বামিত্র নিজে ক্ষত্রিয় ছিলেন কাজেই তাঁর পূর্বাশ্রমের অস্ত্র-শস্ত্র যে সংখ্যায় অনেক হবে তাতে আর আশ্চর্য কি। বিশ্বামিত্রের অস্ত্রপ্রসঙ্গ রামায়ণের আদিকাণ্ডের পরিসর, কিন্তু সুতীক্ষ্ণ-অগস্ত্যের অস্ত্রগুলি তো সব অরণ্যকাণ্ডের দান—সেগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলারও কোন উপায় নেই।
একদিকে যেমন মুনিদের ঘরে নানারকম অমোঘ অস্ত্রের সন্ধান পাচ্ছি, অন্যদিকে ক্ষত্রিয়দের দেখতে পাচ্ছি ব্রাহ্মণ্য অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। ঘরে কিংবা বনে রামচন্দ্রের মন্ত্রোচ্চারণ কিংবা সন্ধ্যা বন্দনার কথা ছেড়েই দিলাম, কেননা ক্ষত্রিয়কুমারদের ব্রাহ্মসংস্কার অনেকগুলোই পালন করতে হত। কিন্তু রামায়ণের মেয়েদের লক্ষ্য করেছেন কি? রামচন্দ্রের ওপর যখন বনবাসের খাঁড়া নেমে এল, তখন তিনি সেই দুঃসহ সংবাদ দেবার জন্য উপস্থিত হলেন জননী কৌশল্যার কাছে। দেখলেন তিনি পূজোর কাপড় পরে বিষ্ণুপূজা করছেন। কিন্তু এই বিষ্ণুপূজার পদ্ধতি এতটাই বৈদিক যে পরবর্তী কালের রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা তা মেনে নিতে পারেননি। কৌশল্যা মন্ত্র উচ্চারণ সহযোগে অগ্নিতে আহুতি দিচ্ছিলেন—অগ্নিং জুহোতি স্ম তদা মন্ত্রবৎ কৃতমঙ্গলা। রামও সেই অবস্থাতেই জননীকে দেখলেন—হাবয়ন্তীং হুতাশম্। টীকাকার বলেছেন কৌশল্যা দশরথের জ্যেষ্ঠা পত্নী, তাই তাঁকে দিয়ে অগ্নিহোত্র করাচ্ছিলেন ঋত্বিক্। সত্যি কথা বলতে কি, বাল্মীকির কথাগুলি এতই স্পষ্ট যে টীকাকারেরা আর অন্যরকম বোঝাতে পারেননি। নইলে তাঁরা বলতেন, কৌশল্যা যজ্ঞ করছিলেন, ঋত্বিক তাঁকে যজ্ঞ করাচ্ছিলেন এবং মহারাজা দশরথ আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছিলেন— কেননা, স্বামী ছাড়া স্ত্রীলোক একা একা যজ্ঞ করতে পারেন না—এই তাঁদের কালের নিয়ম। কিন্তু বাল্মীকির কৌশল্যা অগ্নিহোত্র করতেন, এমনকি পরবাসে রাবণের ঘরে সীতার কাছেও প্রায় একই জিনিস আশা করা হয়েছে। হনুমান লংকাপুরীতে সীতাকে খুঁজে খুঁজে যখন একেবারে অধৈর্য হয়ে পড়লেন তখন তিনি রাত কাটাতে উঠে পড়লেন অশোকবনের মধ্যস্থিত এক শিংশপা গাছে। তখনও তিনি সীতাকে দেখেননি। অশোকবনের মধ্যেই ছিল এক স্বচ্ছ-সলিল সরোবর। নানা জল্পনা-কল্পনার অবসরে হনুমান এবার যা ভাবলেন তার মধ্যেই পাব ক্ষত্রিয় ললনার ব্রাহ্মণ্য আচার। হনুমান ভাবলেন—সেই সুন্দরী সীতা যদি জানতে পারেন যে প্রাতঃসন্ধ্যার সময় হয়ে এসেছে, তাহলে এই নির্মল জলে সন্ধ্যা করার জন্য সীতা নিশ্চয়ই এই সরোবরে আসবেন—সন্ধ্যাকালমনাঃ শ্যামা ধ্রুবমেষ্যতি জানকী। নদীঞ্চেমাং শুভজলাং সন্ধ্যার্থে বরবর্ণিনী॥ স্ত্রীলোকের পক্ষে এই সন্ধ্যা-বন্দনার ব্যাপারটা কিন্তু অদ্ভুত শোনাচ্ছে, এবং এই সন্ধ্যা শুধু ব্রত-নিয়ম নয়, একেবারেই সন্ধ্যাই। টীকাকার ভয় পেয়ে লিখেছেন, জানকীর সন্ধ্যা মানে ভগবানের ধ্যান, কারণ সেইটাই মাত্র স্ত্রীলোকের অধিকার। এই সন্ধ্যা বলতে ব্রাহ্মণদের গায়ত্ৰীমন্ত্র স্মরণ বোঝায় না—কিঞ্চ সম্যগ্ ভগবদ্ধ্যানস্যৈব সন্ধ্যাপদাৰ্থত্বেন অস্ত্যেব তত্র স্ক্রিয়া অধিকারঃ। গায়ত্রীমন্ত্রেণ তদর্থস্মরণপূর্বকধ্যানে তু দ্বিজস্যৈবাধিকার ইত্যন্যৎ।
আসলে সংরক্ষণশীল টীকাকারের যা ভয়, তাই ঘটেছে। পাছে আমরা ‘সন্ধ্যা’ শব্দের চিরপ্রচলিত অর্থটিই বুঝে ফেলি, তাই টীকাকার ‘সং’ মানে ‘সম্যক’, ‘ধ্যা’ মানে ‘ধ্যান’—এইভাবে শব্দের স্বাভাবিক অর্থ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু যিনি হাজার হাজার শ্লোক লিখে রামায়ণী কথা গ্রন্থনা করেছেন, যাঁর হাজার হাজার শব্দ-ব্যবহার অমোঘ বলে কবি-পণ্ডিতের বিস্ময় উৎপাদন করে তিনি কি না ব্রাহ্মণোচিত একটি শব্দ ব্যবহার করলেন স্ত্রীলোকের ব্রত-নিয়ম বোঝানোর জন্য! কেন, তাঁর শব্দকোষে কি শব্দের অভাব ছিল? অতএব বাল্মীকি যা বোঝাতে চেয়েছেন তাই বলেছেন শব্দমন্ত্রে। স্বাভাবিক অর্থের বদলে যেখানে দুরূহ অর্থ কল্পনা করতে হয়, সেখানে যিনি সেই অর্থ কল্পনা করেন তাঁরই সামাজিক ভূমিকা সম্বন্ধে আলোচনার অবসর থেকে যায়। পুরাকল্পে স্ত্রীলোকের বেদপাঠ, ‘মৌঞ্জীবন্ধন’ যে প্রচলিত ছিল, সে সম্বন্ধে প্রমাণ আছেই। কিন্তু টীকাকারের মত আমরাও জানি—স্ত্রী-শূদ্রেরা কেউই বেদ-কিংবা গায়ত্ৰীতে অধিকারী নয়। যে রামায়ণে কৌশল্যার অগ্নিহোত্র, সীতার সন্ধ্যা বন্দনার কথা বলা হয়েছে, সেই রামায়ণেই শূদ্র শম্বুকের তপশ্চর্যায় কোন অন্যায় হত না। আর যে রাম জায়া এবং জননীর বৈদিক আচারে অভ্যস্ত, সেই রামই শূদ্র শম্বুকের ব্রাহ্মণোচিত ব্যবহারে তাঁকে মেরেই বসলেন, এই বা কেমন কথা! কাজেই রামায়ণের উত্তরকাণ্ড এবং বালকাণ্ডের পরিবেশের সঙ্গে অন্য কাণ্ড-পঞ্চকের পরিবেশে যে মৌলিক পার্থক্য আছে সে কথা অস্বীকার করার মানে হয় না। অস্বীকার করছিও না। কিন্তু তাই বলে হ্বেবার সাহেব আর গুটিকতক বাঙালি সাহেব যা বলবেন, তাই ধ্রুব সত্যি—একথা মানতেও আমাদের আপত্তি আছে, এবং তার কারণটাও খুব পরিষ্কার।
হ্বেবার সাহেবের বড় যুক্তি হল, বাল্মীকি রামায়ণের আগে লেখা হয়েছিল সেই বৌদ্ধ গ্রন্থটি, যার নাম দশরথ জাতক। দশরথ জাতকে সীতা হরণের বৃত্তান্ত নেই; অতএব হ্বেবার সাহেবের ধারণা—রামায়ণের এই পর্ব সংযোজিত হয়েছে অনেক পরে, মানে সেই যখন আলেকজাণ্ডার ভারত আক্রমণ করলেন এবং সেই সুবাদে ভারতের অধিবাসীরা ইলিয়াডের বৃত্তান্ত জানতে পারল, তারপর।
এ সেই রোগ, যাতে প্রতিপদে মনে হয়—সব ব্যাপারেই উত্তমর্ণের ভূমিকাটি আছে ইউরোপের। সাহেব একবার ভাবলেন না যে, তাঁর যে সব জাতভায়েরা রামায়ণ-মহাভারতকে এক একটা বড় ধরনের ঢাকাই পরোটা কিংবা নিমকি গোছের মনে করেন, তাঁরা পর্যন্ত রামায়ণের বিভিন্ন পরতের কথা বলতে গিয়ে রামায়ণের আদিস্তর থেকে সীতাহরণের বৃত্তান্ত মুছে দিতে পারেননি। খুব বেশি হলে এইটুকু স্বীকার করা যায় যে, সীতাদেবীর বায়না-ধরা সেই সোনার হরিণের গপ্পোটা পরবর্তী কোন বাল্মীকির রচনা। মূল রামায়ণের এই অংশটি যদি একটু অভিনিবেশ সহকারে দেখেন, তাহলে দেখবেন ব্যাপারটা নিতান্তই সোজাসুজি ঘটেছে। একটা কথা প্রথমে লক্ষ্য করুন।
আগেই জানিয়েছি, দণ্ডকারণ্যে রামের হাতে খর-দূষণের লাঞ্ছনার কথা প্রথমে রাবণের গোচরে আনে অকম্পন, এবং সে-ই প্রথম সীতার অলৌকিক রূপ বর্ণনা করে তাঁকে হরণের প্রস্তাব দেয়। রাবণ সিদ্ধান্ত করেন যে, তিনি সীতাকে হরণ করবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মারীচের ঘরে আসেন। এ ঘটনা অরণ্যকাণ্ডের একত্রিশ সর্গে। আবার দেখা যাচ্ছে শূর্পনখার কাছে খবর পাওয়ার পর রাবণ পুনশ্চ মারীচের আশ্রমে এসেছেন এবং সেটি পঁয়ত্রিশ সর্গে। দুই জায়গাতেই রাবণকে দেখার পর মারীচ যে কথাগুলি বলেছে, তাকে দ্বিরুক্তি বললেও কোন অসুবিধে হয় না—
মারীচেনার্চ্চিতো রাজা ভক্ষ্য-ভোজ্যৈরমানুষৈঃ॥
তং স্বয়ং পূজয়িত্বা তু আসনেনোদকেন চ।
অর্থোপহিতয়া বাচা মারীচো বাক্যমব্রবীৎ॥
কচ্চিৎ সুকুশলং রাজন্ লোকানাং রাক্ষসাধিপ।
আশঙ্কে নাধিজানে ত্বং যতস্তূর্ণমিহাগতঃ॥
এবমুক্তো মহাতেজা মারীচেন স রাবণঃ।
ততঃ পশ্চাদিদং বাক্যমব্রবীদ্ বাক্যকোবিদঃ॥
এই শ্লোকগুলির মধ্যে কতগুলি শ্লোক পঁয়ত্রিশ অধ্যায়েও একেবারে অবিকৃত। অন্য শ্লোকগুলির মধ্যে শব্দের কিছু তরতম আছে বটে, কিন্তু অর্থ একেবারে একই। তার মানে হল এই অন্তর্বর্তী সর্গগুলির মধ্যেই পরবর্তী সময়ের কবি মায়ামৃগের পরিকল্পনা ছকে নিয়েছেন এবং সেটি তিনি বিস্তার করেছেন পঁয়ত্রিশ সর্গের পর থেকে। কেননা উল্লিখিত শ্লোকগুলির মধ্যে শেষ শ্লোকটি, যার মানে হল—মারীচের প্রশ্ন শুনে মহাতেজস্বী, বক্তৃতাকুশল রাবণ বলতে আরম্ভ করলেন—এই শ্লোকটি অরণ্যকাণ্ডের একত্রিশ সর্গের মাঝামাঝি আছে, কিন্তু অরণ্যকাণ্ডের পঁয়ত্রিশ সর্গে এইটিই শেষ শ্লোক। পরবর্তী ছত্রিশ সর্গ থেকেই রাবণ মারীচকে মায়ামৃগের রূপ ধারণ করার জন্য চাপ দিতে থাকেন এবং মারীচ এবং রাবণের উতোর-চাপান চলতে থাকে সেই একচল্লিশ সর্গ পর্যন্ত। অতঃপর রাবণের পরামর্শমত কাজ চলতে থাকে। মৃগরূপী মারীচ প্রলুব্ধ রামকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে লক্ষ্মণের নাম ধরে চেঁচাতে থাকল। রাবণও ঢুকে পড়লেন ভিখারী বেশে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল—রাবণের বেশ তপস্বীর মত, অথচ তিনি সামনা-সামনি সীতার স্তন-জঘনের প্রশংসা করতে থাকলেন—তবু সীতার কোন সন্দেহ হল না। মারীচের ডাক শুনে যাবার আগে লক্ষ্মণের সঙ্গে সীতার বচসা হয়। রাম মায়ামৃগের সন্ধানে যাবার পূর্ববর্তী কালে লক্ষ্মণ মৃগের ছলনা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং মারীচের ডাক শুনে সীতাকেও তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, বনের মধ্যে রাক্ষসেরা এরকমধারা শব্দ করেই থাকে—রাক্ষসা বিবিধা বাচো ব্যাহরন্তি মহাবনে। লক্ষ্মণের এত সন্দেহ, এত বচসা সত্ত্বেও, তপস্বীর মুখে কুলবতীর অঙ্গ-সংস্থানের বর্ণনা শুনেও সীতার কোন সন্দেহ হল না কেন? তাতেই বুঝি এই স্বর্ণমৃগের অংশ মূল রামায়ণে ছিল না। যা ছিল, তা সরলা কুলবতীর আত্মকথা—সীতা নিশ্চিন্ত মনে রাবণকে দশরথের কথা, তাঁর কৈকেয়ী-কামিতার কথা সবিস্তারে শুনিয়েছেন। রামের বনবাস, পিতৃসত্য রক্ষায় দৃঢ়-প্রতিজ্ঞতা সবই তাঁকে বলেছেন। সবার শেষে রাবণকে যে কথাটা বলে তিনি একটু সবুর করতে বললেন সেই কথাটাই আমাদের সবচেয়ে বিস্মিত করে। যেখানে এত বলশালী রাম মহাবিপদে পড়েছেন বলে দেওরের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করে তাঁকে সাহায্যের জন্য পাঠাতে হল, সেখানে কোন দুশ্চিন্তার ছায়ামাত্র সীতার ভাষায় ফুটে উঠল না! বরঞ্চ তিনি বললেন—এই আর একটুখানি বসুন—সমাশ্বস মুহূর্তং তু, এই আমার স্বামী এলেন বলে। আমার স্বামী এখনই অনেক বনজাত খাদ্যদ্রব্য, অনেক রুরু-মৃগ, গোসাপ, শুয়োর—সব মেরে প্রচুর মাংস নিয়ে আসবেন, আপনি এই একটুখানি বসুন—আগমিষ্যতি মে ভর্ত্তা বন্যমাদায় পুষ্কলম্। রুরূন্ গোধান্ বরাহাংশ্চ হত্বাদায়ামিষং বহু॥ এর পরেই রাবণ নিজের পরিচয় দিলেন।
রামায়ণের সামগ্রিক সীতা-চরিত্রে কোথাও কোন কূটবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আপন দুশ্চিন্তা চেপে রেখে তিনি যে রাবণের সঙ্গে খোশগল্প করে যাবেন তা মনে হয় না। আর্ত্ত রামের মুখে ‘হা সীতে লক্ষ্মণেতি চ’ শব্দ শুনেও তার প্রসঙ্গ একটুও উল্লেখ না করে—এই আমার স্বামী বন্য পশুর মাংস নিয়ে এলেন বলে—এমনতর নিশ্চিন্ততা দেখাবেন—এই কি সরলা কুলবতীর স্বভাব হতে পারে! বেশ বোঝা যায়, রাম-লক্ষ্মণ দুজনেই বন্য পশু শিকার করার জন্য এমনিই বেরিয়েছিলেন। সীতার খবর শুনেও তাই বোঝা যায়। আবার মায়ামৃগ বধ করার পর রাক্ষসরূপী মারীচের মুখ দিয়ে মায়াস্বরে ‘হা সীতা হা লক্ষ্মণ’ ডাক শুনে রাম যেখানে সীতার কথা চিন্তা করে ভীষণ শংকিত হয়ে উঠলেন, সেখানে তিনি অন্য একটা মৃগ বধ করে, তার মাংস কাঁধে করে ঘরের দিকে ছুটতে থাকলেন—এও কি কোন স্বাভাবিক কথা—নিহত্য পৃষতঞ্চান্যং মাংসমাদায় রাঘবঃ। ত্বরমাণো জনস্থানং সসারাভিমুখং তদা॥ এই ঘটনা থেকেও মনে হয় শিকারে বেরিয়ে একটা হরিণ মেরে এবং তারপরে আরও একটা হরিণ মেরে রাম ছুটলেন ঘরের পানে, কারণ সীতা একা আছেন। এইরকম একটা অসংরক্ষিত অবস্থাতেই সীতা-হরণ সম্পন্ন হয়েছে—এর মধ্যে মায়ামৃগ-কল্পনার অবসর নেই। অবশ্য প্রক্ষিপ্ত হলেও মায়ামৃগের কল্পনা অভিনব এবং মূল রামায়ণে সেটি সংযোজিত হতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু তাই বলে সীতা-হরণের ব্যাপারটাই মূল রামায়ণে ছিল না—একথা শুধু সাহেবী নয়, বেহিসেবি কথা। হ্বেবার সাহেব ভুলে গেছেন যে, ছোট ছোট লোকায়ত কথা-কাহিনী যেমন কবিদের হাতে বৃহদাকার ধারণ করে, তেমনি অনেক বৃহৎকথাও পরবর্তী কবি সাহিত্যিকদের হাতে সংক্ষিপ্ত হয়। আবার অনেক কাহিনীই ধর্মীয় সংগঠকেরা আপন স্বার্থে নিজেদের মত করে ব্যবহার করেছেন। বৌদ্ধদের মধ্যে এই ব্যাপারটাই ঘটেছিল।
সেইকালে রামকথা এবং কৃষ্ণকথা এত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যে বৌদ্ধরা সে কাহিনী ব্যবহার না করে পারেননি। নেপথ্যে ছিল অবতারবাদের হাতছানি, কারণ বুদ্ধও ততদিনে প্রায় অবতার হিসেবেই গণ্য হতে চলেছেন আর সেইজন্যেই দশরথ জাতকের শেষে ভগবান বুদ্ধকে বলতে হচ্ছে— ‘সেই সময়ে মহারাজ, শুদ্ধোদন ছিলেন দশরথ’, কৌশল্যা ছিলেন মহামায়া, রাহুলজননী ছিলেন সীতা, ভরত ছিলেন আনন্দ, সারিপুত্ত ছিলেন লক্ষ্মণ আর স্বয়ং রাম-পণ্ডিত ছিলাম আমি’। কৃষ্ণ-কাহিনীর বেলাতেও বুদ্ধের কৃষ্ণে পর্যবসান। কিন্তু কোন অবস্থাতেই কি এই সব বৌদ্ধ জাতক রাম কিংবা কৃষ্ণ কাহিনীর পূর্ববর্ত্তী হতে পারে? তাছাড়া দশরথ জাতকের কাহিনী শুনলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে সে কাহিনী রামায়ণী কথারই বিকৃত সংস্করণ।
দশরথ জাতকের পটভূমি অযোধ্যা নয়, বারাণসী; যে বারাণসী অন্যান্য বৌদ্ধ কাহিনীতেও পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত। সেখানে দশরথ রাজার পাটরানীর গর্ভে দুটি ছেলে, রাম আর লক্ষ্মণ আর এক মেয়ে, তাঁর নাম সীতা। পাটরাণী হঠাৎ মারা যান এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অন্য রানী, যে ক্রমশঃই রাজার প্রিয়তমা হয়ে ওঠে। এই রানীর ছেলের নাম ভরত। (বাল্মীকিতে তরুণী কৈকেয়ীর প্রতি রাজার অত্যধিক আসক্তিই কৌশল্যার ভালবাসার মৃত্য ঘটিয়েছে। সেই ভালবাসার মৃত্যুই কিন্তু বৌদ্ধ জাতকে কৌশল্যার দৈহিক মৃত্যুতে পরিণত।) ভরতের প্রতি মমতার জন্য দশরথ একসময় তাঁর মাকে বর দিতে চান এবং মূল রামায়ণ কাহিনীর মতই বর সেখানে তোলা রইল। ভরতের আট বছর বয়স হতেই ভরতমাতা দশরথের কাছে বর চাইলেন এবং ভরতকে রাজ্য দিতে বললেন। দশরথ রেগে দিশাহারা হয়ে বললেন, দুষ্টবুদ্ধি স্ত্রীলোক কোথাকার, আমার দুই আগুনপানা ছেলে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। আর সেই দুটিকে, মেরে তোমার ছেলেকে রাজ্য দিতে বলছ তুমি! রানী সাময়িকভাবে একটু ভয় পেলেন বটে কিন্তু মাঝে মাঝেই তিনি তাঁর পুরানো আর্জি জানাতে থাকলেন। রাজা ভাবলেন—মেয়েরা এমনিতেই বিশ্বাসঘাতিনী। রানী নিশ্চয়ই উল্টোপাল্টা চিঠি লিখে নয়তো বা অন্য কাউকে ঘুষ-ঘাষ দিয়ে তাঁর ছেলে দুটিকে মেরে ফেলতে পারে। এমনি সাত-পাঁচ ভেবে দশরথ রাম-লক্ষ্মণকে ডেকে বললেন—বাপু হে, এখানে থাকলে তোমাদের বিপদ হতে পারে। তাই হয় তোমরা কিছুদিন পাশের কোন রাজ্যে গিয়ে থাক নয়তো বা বনের দিকে চলে যাও। কিন্তু আমি মারা গেলে তোমরা ফিরে আসবে এবং পিতৃরাজ্য দখল করবে। এরপরেই তিনি ডেকে পাঠালেন দৈবজ্ঞ জ্যোতিষীদের এবং তাঁর নিজের আয়ুষ্কাল সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন। জ্যোতিষীরা গুণে-গেঁথে বললেন যে, দশরথ আর বার বছর বাঁচবেন। দশরথ আবার ডাকলেন দুই ছেলেকে এবং বললেন—বার বছর পরে ফিরে এস তোমরা। রাম পণ্ডিত এবং লক্ষ্মণ পিতৃবাক্য স্বীকার করলেন এবং সীতা বললেন— ‘আমিও যাব ভাইদের সঙ্গে’। শেষ পর্যন্ত তিন জনেই রাজ্যের জনসাধারণকে বিদায় জানিয়ে হিমালয়ে গিয়ে কুটির বানিয়ে থাকতে আরম্ভ করলেন (পাঠক মনে রাখবেন হিমালয় কিন্তু বৌদ্ধদের বড় প্রিয় এবং বৌদ্ধ কাহিনীতে বড় পরিচিত জায়গা)। লক্ষ্মণ আর সীতা রাম পণ্ডিতকে প্রায় পিতার যত্নে সেবা করতে থাকলেন। এর মধ্যে রাম, লক্ষ্মণ এবং সীতার বনবাসের মেয়াদ না ফুরাতেই নয় বছরের মাথায় দশরথ মারা গেলেন। শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটতেই রাজরানী বললেন—এবার আমার ছেলের মাথার ওপর রাজছত্র শোভা পাক। কিন্তু মন্ত্রীরা এতে রাজি হলেন না এবং ভরতও বললেন—আমি রাম-পণ্ডিতকে ফিরিয়ে আনব বন থেকে। চতুরঙ্গ সেনাবাহিনী নিয়ে ভরত রামের বাসস্থলে পৌঁছোলেন এবং সৈন্য-সামন্ত দূরে রেখে রামের আশ্রমে প্রবেশ করলেন এমন সময়, যখন লক্ষ্মণ এবং সীতা ফল-মূলের সন্ধানে অন্যত্র গেছেন। ভারত দেখলেন রাম পণ্ডিতকে, প্রশান্তি এবং নির্বিন্নতার প্রতিমূর্ত্তি যেন। ভরত প্রণাম করে রামকে পিতার মৃত্যু-সংবাদ দিলেন। রাম-পণ্ডিত দুঃখও পেলেন না, কোন কান্নাকাটিও করলেন না। মনের মধ্যে তাঁর বিকারও হল না একটু; যেমন স্থির ছিলেন, তেমনি স্থির। পাঠক, এইখানেই বাল্মীকির মানুষ রাম একেবারে বুদ্ধ বনে গেছেন। দুঃখে দুঃখিত সুখে সুখিত কবিকল্পনার বিষয়কে এখানে বৌদ্ধ স্থবির করে ফেলা হয়েছে। পাঠক নিজেই বুঝুন, যেখানে বাল্মীকিতে একাধিক ক্ষেত্রে মৃত্যু-বিরহের করুণ রস উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, সেখানে এক উদ্বেল রসনিষ্পত্তি এখানে স্তব্ধ করে দেওয়া হল, নাকি স্তব্ধ স্থবির মূক রামপণ্ডিতকে বাল্মীকিই শোক-মুখর করে তুলেছেন? কার কাছে কে ঋণী? এ প্রশ্নের সমাধান খুব সহজ। বৌদ্ধ জাতকের গল্পকার আপন সুবিধার্থে রামায়ণের এই জায়গাটি বেছে নিয়েছেন মাত্র। লক্ষ্মণ এবং সীতা পিতার মৃত্যুসংবাদে অধৈর্যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিতুলনায় রাম পণ্ডিত, যিনি বুদ্ধেরই জন্মান্তর-প্রতিকল্প, তিনি কত স্থির, এইটা দেখানোই তো জাতকের উদ্দেশ্য। দশরথ জাতকের আরম্ভকালীন প্রতিজ্ঞাও তো তাই। এক গৃহস্থের পিতৃবিয়োগ হলে, তিনি যখন শোকে আপ্লুত হয়ে জেতবনে বুদ্ধের কাছে এলেন, তখন বুদ্ধ এই গল্প বললেন।
পিতার সংবাদ দিতে গিয়ে ভরতও কাঁদছেন এবং এই সময়েই লক্ষ্মণ এবং সীতাও ফল-মূল কুড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। রাম পণ্ডিত ভাবলেন—“এদের বয়স কম এবং আমার মত বিবেকবুদ্ধিও এদের নেই। পিতার বিয়োগ ব্যাথায় এরা একেবারেই ভেঙে পড়বে। তাই এদের জলের মধ্যে দাঁড় করিয়ে এই খবর দেব।” যে কথা সেই কাজ। রাম পণ্ডিত যেন লক্ষ্মণ এবং সীতাকে একটা শাস্তি দিচ্ছেন এমন একটা ভাব দেখিয়ে তাঁদের জলে নামালেন এবং ভরতের কাছ থেকে পাওয়া দশরথের মৃত্যুসংবাদও জানালেন। লক্ষ্মণ, সীতা সংজ্ঞা হারালেন। সংজ্ঞা লাভ করলে আবার তিনি একই কথা বললেন। তাঁরা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এইরকম করে তৃতীয়বার সংজ্ঞা হারানোর পর অন্য লোকেরা তাঁদের জল থেকে ডাঙায় নিয়ে এল। ভরত বললেন—রাম! এমন স্থৈর্য তোমার কি করে হল, যাতে আমরা নিজেদের সংবরণ করতে পারছি না, অথচ তুমি অটল, স্থিতধী। রাম বললেন, যা মানুষ হাজার দুঃখ-শোকের বদলেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে না, তার জন্য দুঃখ পেয়ে লাভ কি? পাকা ফলকে যেমন মাটির টান সহ্য করতেই হয়, মানুষকে তেমনি মৃত্যুর যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে।
এ সবই জ্ঞানের কথা, এবং এ জ্ঞানের কথা বাল্মীকির রামও জানতেন। তবু বাল্মীকির রাম সুখে-দুঃখে যতখানি স্থিতধী ততখানিই সলীল। নির্বিকার থেকে কি বিকারের কল্পনা জন্ম নিতে পারে? রসঘন মনুষ্যসত্তাকে নিজধর্ম প্রচার করার জন্য নীরস করে ব্যবহার করা যত সহজ, নীরস থেকে রসের জন্ম দেওয়া ততখানিই কঠিন। অতএব কে কার কাছে ঋণী তা সহজেই বোধগম্য। অবশ্য দশরথ জাতকের রামকে যখন ভরত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন তখন তিনি কিন্তু বাল্মীকির রামের মতই পিতৃসত্যের দোহাই দিলেন। বললেন—ন’ বছর কেটেছে, আর তিন বছর পরে দেশে ফিরব। অথাৎ সেই বার বচ্ছর পর। কিন্তু মজা হল দশরথ জাতকে তো পিতৃ-সত্য পালনের কোন ব্যাপার ছিল না। রাজা বলেছিলেন—আমি মারা গেলেই তোমরা এসে সিংহাসন দখল করবে। দশরথ জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর বেশি নির্ভর করে ছেলেদের বার বচ্ছর পরে ফিরতে বলেছিলেন এবং মনে রাখতে হবে সেটাও ছিল মৃত্যু সম্পর্কিত ভবিষ্যৎ বাণী। ‘মারা গেলে ফিরে আসবে’— এইটাই ছিল পিতৃবচন। কিন্তু এই যে রাম পিতৃসত্য পালনের গোঁ ধরলেন, এটি কিসের অনুসরণে। অবশ্যই বাল্মীকির রামের অনুকরণে; কারণ বাল্মীকিতে পিতৃসত্য পালনের জন্য তিনি যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছেন, অতএব এই মহনীয় কাজটি বুদ্ধের রামকল্পে মিলিয়ে দিতে জাতককারের ভাল লেগেছে। দশরথ জাতকের ভরত রামের সত্যপ্রতিজ্ঞতার সীমা জানতেন না। বাল্মীকির ভরত তা জানতেন এবং জানতেন বলেই দুখানি সোনার পাদুকা রাজধানী থেকেই গড়ে নিয়ে এসেছিলেন। সময়মত সেটি ঝুলি থেকে বার করে রামকে তিনি বলেছেন—এই সোনার পাদুকা দুটিতে একবার পাদার্পণ করুন আর্য। এই খড়ম-জোড়াই জনগণের হিতসাধন করবে—অধিরোহ আর্য পাদাভ্যাং পাদুকে হেমভূষিতে। রাম সেই খড়ম-জোড়ায় একবার পা গলিয়ে ভরতকে দিয়ে দিলেন। দশরথ জাতকে ভরত পাদুকা চাননি। রাম আপনা থেকেই খড়-কুটোয় তৈরী পাদুকা দুখানি ভরতকে দিয়েছেন এবং সে পাদুকা ‘ম্যাজিক’ জানে। রাজ্যের মধ্যে কোন রকম অন্যায় হলেই জুতো-জোড়া পরম্পর আটকে যেত। তিন বছর আরও গেল এবং তারপর রাম পণ্ডিত সাঙ্গোপাঙ্গে ফিরে এলেন বারাণসীতে।
মোটামুটি এই হল সংক্ষেপে দশরথ জাতক। গল্পটা আমি দ্বিতীয়বার উল্লেখ করলাম এইজন্যে যে আজকাল অনেক পণ্ডিতমানী ব্যক্তি এই জাতকের উল্লেখমাত্র কাজে লাগিয়ে কিছু হঠ-সিদ্ধান্ত করে বসেন। কিন্তু জাতকের কাহিনীটিই হয়তো তাঁদের জানা নেই। তারও ওপরের কথা হল, ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে হ্বেবার যে মত প্রচার করেছেন, ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দেই আর এক জাঁদরেল জার্মানি পণ্ডিত হারমান জ্যাকোবি তার প্রতিবাদ করেছেন। শুধু দশরথ জাতক নয়, হেরের বক্তব্য ছিল যে, মহাভারতের ‘রামোপাখ্যান’ নামক অংশটিও নাকি মূল রামায়ণের পূর্ববর্তী। অর্থাৎ কিনা বাল্মীকি দশরথ জাতক আর মহাভারতের ‘রামোপাখ্যান’কে উপজীব্য করেই তাঁর রামায়ণী কথা তৈরী করেছেন। আবার এমন ইঙ্গিতও আছে যে, এই মূল রামায়ণ ছাড়াও এমন কোন রাম-কথা অতি প্রাচীন কালে চালু ছিল, তার সারাৎসার হল মহাভারতের ‘রামোপাখ্যান’। জ্যাকোবি এই মতের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এবং দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, মহাভারতের রামোপাখ্যানে যেটুকু পরিবর্তন দেখা যায়, তা করেছেন স্বয়ং মহাভারতের কবিই, সে তিনি ব্যাসই হোন কিংবা অন্য কেউ। রামায়ণী কথা যে রামায়ণ লেখার আগেই লোকস্তরে চালু ছিল সে কথা কেউ অস্বীকার করে না। এমনকি বাল্মীকির আগে চ্যবন মুনি যে একবার রামায়ণ লিখতে আরম্ভ করেছেন, সে কথা তো অশ্বঘোষই প্রথম খ্রীষ্টাব্দে জানিয়েছেন। আধুনিক গবেষকেরা তো একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন যে, মূল রামায়ণ, যেমনটি উত্তর ভারতে চালু ছিল, সেইটাই ছিল রামোপাখ্যানের প্রধান উপজীব্য। তাছাড়া অবতার-বাদের মত বৈষ্ণব সংযোজন, যা নাকি রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশের বৈশিষ্ট্য, সেটি তো মহাভারতের রামোপাখ্যানের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। কাজেই এটি মূল রামায়ণের পূর্ববর্তী হতেই পারে না। দশরথ জাতক সম্বন্ধে আজকের গবেষকরা আরও বেশি নিষ্ঠুর মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে দশরথ জাতকের গদ্যাংশগুলি পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দের সিংহলী রামকথার পালি অনুবাদমাত্র। লুডার্সের মত উল্লেখ করে ব্রকিংটন দেখিয়েছেন, রামায়ণের যে গাথাটিতে রাম মৃত দশরথের উদ্দেশ্যে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, দশরথ জাতকের লেখক সেটিকে এতই ভুল বুঝেছেন যে, লক্ষ্মণ এবং সীতাকে মৃত্যু সংবাদ দেবার আগেই তাঁদের জলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। রামায়ণে আছে রাম ভাইদের সঙ্গে নিয়ে মন্দাকিনীর জলে নেমে ‘জলপুরিত’ অঞ্জলি—‘বিমলং তোয়ম্ অক্ষয়ম্—দশরথের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন। এই পুরো ব্যাপারটাকেই জাতককার ভুল বুঝে ভাইবোনকে জলে নামিয়ে দশরথের মৃত্যু-সংবাদ পরিবেশন করেছেন। বিকৃতি আছে আরও। দশরথ জাতকে সীতা রামের বোন। রাম তাকে বিয়ে করেছেন বনবাস থেকে ফেরার পর। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, এইটাই প্রাচীন বৌদ্ধ ঘরানার কথা। বৌদ্ধ ঘরানায় ভাই-বোনের বিয়ে অন্যত্রও দেখানো হয়েছে এবং তার প্রাচীনতাও কম নয়। বৌদ্ধগ্রন্থ দীঘ নিকায়ে ওক্কাক (হয়তো ইনি ইক্ষ্বাকু) নামের নৃপতিটি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং কন্যাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। নির্বাসনে গিয়ে তারা ভাবল যে, তারা যদি অন্য কোথাও বিবাহাদি করে তাহলে বুঝি তাদের রক্তের শুদ্ধতা নষ্ট হবে। এই ভয়ে তারা ভাই-বোনেই বিয়ে করে বসল এবং তাদের থেকেই শাক্য-বংশের উৎপত্তি। এই ইক্ষ্বাকু বলতে যে দশরথকেই বোঝানো হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, এমনকি ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থগুলিতেও দশরথ কিংবা রামকে ইক্ষ্বাকু বলেও ডাকা হয়েছে অনেক সময়। বৌদ্ধ ঘরানায় ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের উল্লেখ অন্যান্য কিছু গ্রন্থেও আছে; কাজেই রাম-সীতার কাহিনী সেইভাবেই বিকৃত হয়েছে। বৌদ্ধ জাতক কিংবা রামোপাখ্যানের উত্তমর্ণ-ভূমিকা নিয়ে পণ্ডিত গবেষকেরা অনেক প্রত্যাখ্যান সূত্র রচনা করেছেন এবং সেসব সূত্র প্রায় গৃহীত। বরঞ্চ একাধিক প্রশ্ন আসে রামায়ণের বাল এবং উত্তরকাণ্ড নিয়ে, যেগুলিকে আমরা প্রক্ষিপ্ত বলেই জানি।
একালে ব্রকিংটন সাহেব রামায়ণ কাহিনীর প্রায় সমস্ত জটিলতা নিয়েই আলোচনা করেছেন, এবং তাঁর আলোচনাগুলি ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকসুলভ হওয়ায় সেগুলি আপাততঃ অনবদ্য, তথা প্রত্যাখ্যানের অযোগ্য বলেই মনে হয়। তবু প্রশ্ন কিছু থেকেই যায়। প্রশ্ন আরও এইজন্য যে, ভাষার বিশ্লেষণ, সে বিশ্লেষণ যত সূক্ষ্ম এবং বুদ্ধিদীপ্তই হোক না কেন, তারও সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষতঃ ভাষার এবং কাব্যশৈলীর ভিত্তিতে ব্রকিংটন সাহেব রামায়ণ মহাকাব্যের এতরকম স্তরবিভাগ করেছেন যে তাতে পাণ্ডিত্যের মহিমা যতই বেড়ে উঠতে থাকে, ততই মনে হয় ব্রকিংটন সাহেবকে তো আর মহাকাব্যের কবির হৃদয়খানি উপহার দেওয়া যায় না! অবশ্য তাঁরই বা দোষ কি? এই স্তর বিভাগের খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে সেই হ্বেবার, জ্যাকোবি, বঙ্কিমচন্দ্রের আমল থেকে। ব্রকিংটন পর্যন্ত নামলে পরে দেখা যাবে যে নানা মুনির মত বিন্যাসে রামায়ণের স্তর-ভেদ ঘটেছে প্রায় পাঁচ-সাতটি। অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা এবং প্রতি-তুলনা করে ব্রকিংটন যেভাবে রামায়ণের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তর-ভেদ নির্ণয় করেছেন এবং সেই স্তর-ভেদ যেভাবে রামায়ণের কাহিনী-গঠনের স্তর-ভেদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন, তাতে অনেকের মতই আমাদেরও সন্দেহ হতে থাকে যে, রামায়ণ বুঝি কোন বাল্মীকির একক কবিতা নয়। অন্যদিকে তেমনি গর্বও হতে থাকে যে, বাল্মীকি-প্রতিভার মত সমমানের প্রতিভা আমাদের দেশে তাহলে আরও অনেক ছিল।
ব্রকিংটন বলেছেন, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য—সেই হল রামায়ণ বিশ্লেষণের ‘best starting point’ এবং তাঁর এই শুভারম্ভের পরিসরে সংস্কৃত ব্যাকরণের পদশ্রেণীর চুলচেরা বিচার আছে। তাতে ক্রিয়া থেকে আরম্ভ করে কাল, সমাস থেকে আরম্ভ করে আত্মনেপদ পরস্মৈপদ—সবকিছুরই পূর্বকালিক এবং উত্তরকালিক ব্যবহার বিশ্লেষণ করে রামায়ণ মহাকাব্যের স্তর বিভাগ করা হয়েছে। কিন্তু সেই ভিত্তিতে—বড় বড় সমাসবদ্ধ পদ অযোধ্যা-কাণ্ডে যতখানি ব্যবহৃত, সুন্দর কাণ্ডে তার চেয়ে বেশি এবং যুদ্ধকাণ্ডে আরও বেশি; অতএব এটি এই স্তরের মধ্যে পড়ে, আর ওটি অন্য স্তরে—এই যুক্তি কি মহাকাব্যের কবির হৃদয় ব্যাখ্যানে একটুও সাহায্য করে। কিংবা যদি রামায়ণে ব্যবহৃত ফল-ফুল, নদী-পর্বত, মানুষ-জন, মুনি রাক্ষস—এ সবারই নানা নাম থেকে, অন্য সাহিত্যে তাদের ব্যবহার থেকে রামায়ণের স্তর-বিভাগ করতে চাই তাহলে সে যুক্তি যতই কুট এবং মনোহারী হোক, তা সব সময়ই ধোপে টিকবে কি? অথচ ব্রকিংটন তাই করেছেন। সমস্ত বই জুড়ে শুধু অমুক শব্দটি প্রথম স্তরে বেশি দেখা যায়, অমুকটি পঞ্চম স্তরে। দেবতার মধ্যে ইন্দ্রের সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে বেশি, পশুর মধ্যে হাতীর সঙ্গে, অবশ্য তার পরেই সিংহের উপমা… লক্ষ্মণঃ শুভলক্ষ্মণঃ—এখানে লাটানুপ্রাসের ঝোঁক যতখানি, তার থেকে বেশি কাজ করছে oral tradition, কারণ, পাদপূরণের সমস্যা সেখানে কম…‘পুরা দেবাসুরে যুদ্ধে’, ‘রাক্ষসাঃ কামরূপিনঃ’, ‘রাক্ষসা পিশিতাশনাঃ’—এগুলি যেহেতু common stock usage অতএব Proverbial stock material বেশ কিছু ছিলই, যা বাল্মীকি বারবার ব্যবহার করেছেন—
হায়! মহাকাব্যের কবির কাব্য বিচারের এই মাপকাঠিতে আমরা তৎকালীন এবং রামায়ণের বিভিন্ন স্তরকালীন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, প্রকৃতি, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার সব কিছু কত নিখুঁত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে পেরেছি, কিন্তু মহাকাব্যের কবির যে বিশাল, ব্যাপ্ত মনোভূমি থাকে, সেটির বিচিত্র গঠন সম্বন্ধে তো কিছুই শুনলাম না। লেখকের মনোভূমির বিচিত্র আলোচনা বাদ দিয়ে যদি শুধুই স্তর-ভেদে মন দিই তাহলে যে কিরকম বিপদ ঘটে, তার একটা অপূর্ব বিশ্লেষণ করেছেন মহামতি এইচ, জে. পেটন, যদিও এ বিশ্লেষণ এক জগদ্বিখ্যাত দার্শনিককে নিয়ে, এবং তাঁর নাম ইমানুয়েল কান্ট। তবে পেটনের প্রতিক্রিয়ারও কিছু পূর্ব ইতিহাস আছে এবং সেজন্যে আমাকে আপাততঃ প্রসঙ্গ থেকে একটু দূরে সরে যেতে হচ্ছে। পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন এইজন্যে যে, পেটনের যুক্তিগুলি মাথায় থাকলে রামায়ণ বিশ্লেষণেও বাড়তি সুবিধে আসবে, তাই।
প্রথম কথা হল, কান্টের অনেক সুচিন্তিত গ্রন্থের মধ্যে তাঁর ‘ক্রিটিক্ অব পিওর রিজন’ একটি, এবং এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, কান্টের জীবদ্-দশাতেই তাঁর এই গ্রন্থটির দুটি সংস্করণ বেরিয়ে যায়। ধরে নেওয়া যায় তিনি যা লিখেছেন এবং দ্বিতীয় সংস্করণ পর্যন্ত যা বেরিয়েছে, তা তাঁর মত মতই হয়েছে।
এবারে ১৯০২ সালে এক খ্যাতকীৰ্ত্তি জার্মান পণ্ডিত, হানস্ ফাইহিন্গার কান্টের গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের গ্রন্থ নিয়ে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলেন এবং তা প্রধানতঃ ‘ট্রান্সেন্ডেন্টাল্ ডিডাক্সন্’ নামক গ্রন্থাংশ সম্বন্ধে। উল্লেখ্য, কান্ট গ্রন্থ লেখার আগে প্রায় সব কিছুই ‘ড্রাফ্ট’ বা ‘নোট করে নিতেন, তাই ফাইহিন্গারের ধারণা, এবং সে ধারণা আপাততঃ অমূলক নয়, যে কান্টের ‘ট্রান্সেন্ডেন্টাল্ ডিডাক্সন্’-এর সবটাই হল জোড়াতালি দিয়ে লেখা—‘ফ্রাগ্মেন্টস্ এবং তা এক সময়ে লিখিত নয়, বিভিন্ন সময়ে লেখা। জোড়াতালির এই অংশগুলি কখন কিভাবে লেখা হয়েছে সেইটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করাই ছিল ফাইহিন্গারের কাজ। এই কাজের জন্য তিনি কান্টের লেখা গ্রন্থটির গোটা চারেক স্তর খুঁজে বার করেন। কান্টের সারা জীবনের ছোট্ট ছোট্ট ‘ড্রাফ্ট’, ‘নোট’ কিংবা বি. আর্ডমান এবং রিকের সম্পাদিত কান্টের সংস্করণগুলির পৃষ্ঠাগুলিতে পার্শ্ব-মন্তব্য দেখে দেখে এই স্তর খুঁজে বার করার কাজ ছিল অত্যন্ত পরিশ্রম সাধ্য, যা ফাইহিন্গারের মত সুযোগ্য পণ্ডিতের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব। এই স্তর বিভাজনের ব্যাপারে তিনি কতগুলি মাপকাঠিও (criterion) ঠিক করে দেন, যা কান্টের দার্শনিক বিবর্ত্তনের নিরিখে আপাত-অমূলক ছিল না; কেননা কান্টের ‘ট্রান্সেন্ডেন্টাল্ ডিডাক্সনের’ মধ্যে ‘কাঠিন্য, অবোধ্যতা, আপাত-বিরোধ এমনকি ভুলও আছে।’
১৯২৯-৩০ সালে এইচ. জে. পেটন, ফাইহিন্গারের পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধটির কথা মনে রেখেও প্রধানতঃ তাঁর মতের বিরোধিতা করে একটি কালজয়ী প্রবন্ধ লেখেন, যার নাম—ইজ দ্য ট্রান্সেন্ডেন্টাল ডিডাক্সন্ আ প্যাচ্ওয়র্ক। পেটন লিখেছেন কান্টের বিষয়ে যাঁরা পণ্ডিত তাঁদের মধ্যে ফাইহিন্গারই বোধহয় সবচেয়ে বড়—perhaps the most distinguished of all Kantian Scholars. পেটন স্বীকার করেছেন যে, কান্টের ওপর লেখা হাজারো টীকা-টিপ্পনী এবং প্রবন্ধ পড়ে তিনি যতটুকু কাণ্ট বুঝেছেন, তার থেকে অনেক বেশি বুঝেছেন ফাইহিন্গারের ক্ষুদ্র প্রবন্ধটি পড়ে। এত সম্মান দিয়েও পেটন কিন্তু ফাইহিন্গারের প্রবন্ধটির অনেকগুলি ত্রুটি বার করেছেন, তার মধ্যে প্রধান হল—সেই স্তর খুঁজে বার করার পদ্ধতি। পেটনের মতে কান্ট যেহেতু বোকাও ছিলেন না এবং অসৎও ছিলেন না— neither unintelligent nor dishonest—তাই ফাইহিন্গারের অনুসৃত পদ্ধতি তাঁর লেখার পরিসরে খাটে না। কেন খাটে না—তা পেটন বহু যুক্তি জাল বিস্তার করে দেখিয়েছেন এবং প্রায় সফলও হয়েছেন। এক্ষেত্রে পেটনের বিরোধিতার মূল বিষয় ছিল কিন্তু সেই মাপকাঠিগুলি (criterion), যেগুলির দ্বারা ফাইহিন্গার কান্টের গ্রন্থটিকে বলে বসেন—cast out, thrown together; and in part they cross one another. ফাইহিন্গার মনে করেন— কাণ্ট হঠাৎ এবং তাড়াতাড়ি করেই তাঁর এই কঠিন অধ্যায়খানি (ট্রান্সেন্ডেন্টাল্ ডিডাক্সন্) শেষ করে দেন এবং তা করেন এই আশায় যে দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি সংশোধনের সুযোগ পাবেন। ফলে কি হল? পূর্বাহ্নে লেখা প্রথম স্তরের ভাবনা-চিন্তাকে কান্ট জুড়ে দিলেন তাঁর পরবর্তী এবং পরিণত ভাবনার সঙ্গে—the earliest and the latest levels are brought together here….ফাইহিন্গার বলেছেন, এই অবস্থায় কেউ যদি ভূতাত্ত্বিকের মত কান্টের মিশ্রশৈলীর স্তরগুলি খুঁজে বার করে তাঁর লেখাগুলিকে সঠিক ভাবে সাজানোর চেষ্টা করেন, সে চেষ্টাকে তো স্বাগত জানাতেই হবে।
হ্যাঁ স্বাগত। পেটন বলেছেন—একশবার স্বাগত। কিন্তু স্তর (যাকে ফাইহিন্গার বলেছেন level আর পেটন বলেছেন Layer) বিভাজন শৈলীতে কেউ যদি ভুল প্রণালী অবলম্বন করেন, তাহলে সে প্রণালী ভুল ফল দিতে আরম্ভ করবে। কাণ্টের অনেক টীকা-টিপ্পনীরই দিনক্ষণ জানা যায় না, আবার অনেকগুলির দিনক্ষণ জানাও যায়। যেগুলির দিনক্ষণ জানা গেছে, সেগুলির ব্যাপারে ফাইহিন্গারের স্তরবিভাজন নীতি প্রয়োগ করলে অনেক ক্ষেত্রেই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে বলে পেটন প্রমাণ করেছেন। সেক্ষেত্রে কান্টের যে সব লেখার দিনক্ষণ মেলে না, সেখানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি— if the criterion gives us such false results when applied to arguments whose date we know, how can we have any confidence in its application to arguments whose date we do not know?
পেটন লক্ষ্য করেছেন, যে, শুধুমাত্র কাণ্টের অমূল্য গ্রন্থখানির ক্ষেত্রেই নয়, এই ‘লেভেল’ বা ‘লেয়ার’ খুঁজে বার করবার পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রচেষ্টা আরও অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে। এই চেষ্টা হয়েছে বাইবেলের ‘ওল্ড’ এবং ‘নিউ টেস্টামেন্টে’-এর বিশ্লেষণে, হোমারের মহাকাব্যে, রোলাণ্ডের কবিতায় এবং প্লেটোর ডায়ালোগে। বোধ করি রামায়ণ-মহাভারতের কথা তাঁর জানা থাকলেও—এই দুই মহাকাব্যের স্তর-নির্ণয়ের বিচিত্র পদ্ধতির কথা তাঁর জানা ছিল না। ফাইহিন্গার যে পদ্ধতিতে কান্টের ছেঁড়া-পাতার (lose Blatter) বিচার করেছেন, সে পদ্ধতি আপাত অমূলক মনে না হলেও, পেটন বলেছেন, কান্টের সামগ্রিক তত্ত্ব-বিচারে সে পদ্ধতি অপ্রতুল এবং লঘু— seldom indeed can so slight an instrument have been applied to so heavy a task.
আমরাও একই কথা বলি। রামায়ণ মহাকাব্যের ভাষা বিশ্লেষণ হয়তো ব্রকিংটনের best starting point কিন্তু সেইটাই সব নয়। কোন পণ্ডিত আবার ‘প্রসঙ্গ উল্লেখ পূর্বক’ নানারকম ব্যাখ্যা করে—এই প্রসঙ্গ এখানে খাটে না, অতএব এটি প্রক্ষিপ্ত… এটি মূল কাহিনীর সঙ্গে বেখাপ্পা, অতএব এটি প্রক্ষিপ্ত— এমনি হাজারো বিচার-কণ্টকে রামায়ণকে ছেঁটে-ছুঁটে একেবারে পাতি পেপার-ব্যাকে হাজির করে দেবেন। পেটন যে রকম ফাইহিন্গারকে কান্টের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তেমনি আমরা কিন্তু এই মহাপণ্ডিতদের মহাকাব্যের পরিসরের কথাই স্মরণ করিয়ে দেব। কান্ট বলেছিলেন,
In every writing, above all when it proceeds as a free discussion, it is possible to ferret out apparent contradictions by comparing together isolated passages torn from their context. Such apparent contradictions cast a prejudicial light upon it in the eyes of those who depend upon critism at second hand, but they can be easily solved by any one who has mastered the idea as a whole.
বাল্মীকির রামায়ণ বিচারের ক্ষেত্রে কাণ্টের এই বক্তব্যকে আমি সবচেয়ে দামী বলে মনে করি, কেননা রামায়ণ-মহাভারতকে দেশী বিদেশী পণ্ডিতেরা ব্যবহার করেছেন ঠিক গণিকার মত। পুরাতনেরা কেউ এগুলিকে দেখেছেন ধর্মগ্রন্থ বলে, কেউ বা কাব্য বলে। আর আজকাল যে প্রবৃত্তি বড় বেড়েছে, তা হল প্রসঙ্গ থেকে ছিঁড়ে এনে তৎকালীন সাধারণ মানুষের প্রতিকূল এক বিশেষ ধরনের আর্থ-সামাজিক ‘প্যাটার্ন খুঁজে বার করা। এবং তাতে এই স্তর-বিভাজনের প্রক্রিয়াটি বড় বেশি কাজে লাগে বলে, অনেক পণ্ডিতেরাই এখন বিস্ময়-মুকুলিত নেত্রে এই স্তর-বিভাজনের সাফাই গান। আমরা হ্বেবার সাহেবকে বেশি আমল দিতে চাই না, তার কারণ এই নয় যে, রামায়ণের স্তর-নির্ণয়ে তাঁর অনুসৃত পদ্ধতি অমূলক এবং সমূলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে; কারণ এই যে, এ দেশের অনেক কিছুই তাঁর ভিনদেশী নীলচোখে বিকৃত এবং নেতিবাচক লেগেছে। তার ওপরে হ্বেবার সাহেবের টোকাটুকির অভ্যাস ছিল এতই বেশি যে তাতে এক বস্তু আরেক বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বাস না হয় দীনেশ ভট্টাচার্য মহাশয়ের ‘বঙ্গে নব্যন্যায়চর্চা’ (পৃ: ১৮) দেখুন।
ব্রকিংটনকে নিয়ে আবার অন্য জ্বালা। রামায়ণের ভাষার ওপর তিনি এতই বেশি নির্ভরশীল এবং তাঁর সমস্ত বিশ্লেষণই, সে রামায়ণের সমাজই হোক কিংবা রাজনীতি, এত বেশি ভাষামুখীন যে, যে কোন সময়ই অন্যতর যুক্তিতর্কের কাছে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। ব্রকিংটনের আদর্শে রামায়ণ মহাকাব্যের প্রতিস্তরের ভাষা শুধুমাত্র সমান্তরাল শব্দ-ব্যবহারের নিকষে পরীক্ষিত হওয়া মাত্রই স্তর ভেদ সূচনা করে। আমাদের ধারনায় সেখানে যুক্তি বড়ই একপেশে হয়ে পড়ে। পেটনের মত আবার তখন সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে হয়—দেখ বাপু! One criterion is not enough—তুমি মহাকাব্যের বিচার করছ, যে মহাকাব্য ভারতবর্ষীয় ধর্মনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি এবং স্বয়ং নীতিশাস্ত্রের সঙ্গেও জড়িত। যে মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিসির পাঁচগুণ বড় এবং যে মহাকাব্যের কবির হৃদয় ক্রৌঞ্চ-পক্ষীর ক্রন্দন সুরে বাঁধা। কবির মমতা যেমন তাঁর মুখ্য নায়ক রামচন্দ্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তেমনি তাঁর প্রতিনায়ক রাবণের ওপরেও কবির মমতা কম নয়। এমন মহাকাব্যের আনাচে-কানাচে শুধুমাত্র গবেষকের শ্যেন ভাষাদৃষ্টি পৌঁছানোই যথেষ্ট নয়, দরকার সেই সমান-হৃদয় যা স্বয়ং সেই মহাকবির ছিল। কারয়িত্রী প্রতিভার বিচারের জন্য ভাবয়িত্রী প্রতিভার প্রয়োজন, যা কালিদাসের ছিল, রাজশেখরের ছিল, ভাসের ছিল অথবা ছিল মাইকেলের, রবীন্দ্রনাথের। উৎসাহের আতিশয্যে আমি এ কথা বলছি না যে, আমারও সেই সমান হৃদয়তা আছে, কিন্তু এ কথা একশবার বলছি যে মহাকাব্যের বিচারে মহাকবির সামগ্রিক শৈলীর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা দরকার, যা অনেক দুর্বোধ্যতা, বিরোধিতা বা ‘inconsistency’ কাটিয়ে দেবে।
হ্যাঁ, পণ্ডিতদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এমন কথা আমার বলার সাধ্য নেই যে, রামায়ণকে যেমনটি আজকের দিনে পাই, বাল্মীকির আমলেও তেমনটি ছিল। অথাৎ কিনা রামায়ণ একেবারে প্রক্ষেপের অবলেপ মুক্ত, এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু আপনি যদি বলেন, রামায়ণের বালকান্ড এবং উত্তর কাণ্ড—দুটোই সম্পূর্ণ প্রক্ষিপ্ত তাতে আমাদের আপত্তি আছে। গবেষককুল ব্রকিংটনের মত প্রমাণ দেখিয়ে বলবেন—দেখ বাপু! এই ধর না কবির কথার সাধারণ মাত্রাগুলি। কবি বালকাণ্ডে পাঁচবার বলেছেন—এতস্মিন্ এব কালেতু—মানে বাংলায় গল্প করতে গেলে যেমন বলি—এমন সময় হল কি…। তা দুঃখের মধ্যে কবি পাঁচবার এই বাক্যধারা বালকাণ্ডে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু অযোধ্যাকাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত একবারও ব্যবহার করেননি। কিন্তু এই গল্প বলার ধরনটি যেহেতু মহাভারতের রামোপাখ্যানে একান্ন বার ব্যবহার হয়েছে অতএব বালকাণ্ড লেখা হয়েছে মহাভারতের পরে। আবার বাংলা তর্জমায় ঠিক একই কথা—এতস্মিন্ অন্তরে—অর্থাৎ ‘এর মধ্যে হল কি… এই কথাটি বালকাণ্ডে এসেছে একবার, অযোধ্যা থেকে যুদ্ধ কাণ্ড পর্যন্ত যোল বার, এবং এক উত্তর কাণ্ডেই ব্যবহার হয়েছে সতের বার। তফাৎ শুধু—উত্তর কাণ্ডে আছে এতস্মিনন্তরে সুরাঃ’… ‘এই সময়ে দেবতা করলেন কি…’ এই করলেন, সেই করলেন। আর ব্রকিংটনের মতে মূল কাণ্ড-পঞ্চকের মধ্যে আছে ‘এতস্মিন্নন্তরে বীরা’…‘এই সময়ে বীরপুরুষেরা করলেন কি…’ এই করলেন, সেই করলেন। মহাভারতে এই বাগধারা আছে ছাব্বিশ বার। অতএব ব্রকিংটনের ধারণা, যদিও স্পষ্ট করে তিনি এখানে আর কিছু বলেননি, তবে তফাৎটা দেখিয়ে বলতে চাইলেন—উত্তরকাণ্ডের কবির এই বাগ্ধারাটি বেশ পছন্দ হয়েছে, তাই মূল কাণ্ড-পঞ্চকে যেটি বোল বার মাত্র ব্যবহার হয়েছে, সেটির একটি পদ পরিবর্তন করে এক উত্তরকাণ্ডই ব্যবহার করেছেন সতেরবার। অতএব উত্তরকাণ্ড পরে লেখা হয়েছে।
হায়! রামায়ণ মহাকাব্যের কবি যদি জানতেন যে, কলিকালের এক সাহেব তাঁকে সংস্কৃত বাগ্ধারার দাওয়াই দিয়ে তাঁর মহাকাব্যখানি একেবারে ওলট-পালট করে দেবেন, তাহলে তিনি একটু ভাবনা-চিন্তা করতেন বই কি? তবু শত ভাবনা করলেও তাঁর এই বদভ্যাস যেত বলে মনে হয় না। কেননা তিনি যে মহাকাব্যের কবি, তিনি তো আজকের ধারণা অনুযায়ী ছোটগল্প লিখতে বসেননি যে মেপে মেপে শব্দ ব্যবহার করবেন। তাছাড়া এইগুলো কোন যুক্তি হল! বাল্মীকির মত মহাকবি, যিনি দু-আড়াই হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র শব্দমন্ত্রেই সংসার জয় করে এসেছেন, তাঁকে যদি সরল ভাষাশিক্ষা দিয়ে বলি—অমুক শব্দ অমুক কাণ্ডে এতবার আর অমুক কাণ্ডে অতবার, ব্যবহার করলে বা না করলে আমরা মনে করব এইটা আগে লেখা, আর ওইটা পরে লেখা, তাহলে সেটা কতখানি হাস্যকর হয়, সেটা শৈলসার গবেষকের হৃদয়ে মালুম হবার জো নেই। আরও হাস্যকর, এরকম ছেঁদো ভাষাযুক্তি ব্রকিংটন আরও দিয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ভাষাযুক্তি যথেষ্ট জোরালো সন্দেহ নেই, কিন্তু এইরকম যুক্তির ভিত্তিতে তিনি যদি বলেন—অযোধ্যাকাণ্ডে রামায়ণ আরম্ভ হলে কোনই ক্ষতি নেই, তাহলে আমরা বলব—ক্ষতি আছে। কি ক্ষতি, তা সাহেবকে বোঝানো মুস্কিল। তবে এটুকু তো বলতেই পারি যে, অযোধ্যাকাণ্ডে রামায়ণ আরম্ভ হতে পারে না। সাহেব বলবেন—অযোধ্যাকাণ্ডে রামায়ণ আরম্ভ হলেও there is ample dramatic justification, কিন্তু আমরা বলব—বাল্মীকি তো নাটক লিখতে বসেননি যে তাঁকে ‘সাসপেন্স’ দিয়ে লেখা আরম্ভ করতে হবে এবং ভারতবর্ষীয় সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা বলে যে, ‘সাসপেন্স’ কিংবা নাটুকে কায়দায় মহাকাব্য আরম্ভ হয় না। অযোধ্যাকাণ্ডের প্রথমেই ভরত মাতুলালয়ে যাচ্ছেন, রামের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে এবং দশরথ সভা ডেকে রামকে যুবরাজ করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। পরিষ্কার জানাই, রামায়ণ মহাকাব্যের মহানায়ক রামকে দিয়ে কথা আরম্ভ না করে, ভরত-শত্রুঘ্নকে দিয়ে রামকথা আরম্ভ করা বাল্মীকির পক্ষে সম্ভবই নয়—মহাকাব্যে এ জিনিস হয় না। স্বয়ং যে কালিদাস যিনি বাল্মীকিকে অবলম্বন করেই রঘুবংশ লিখেছেন তাঁকে পর্যন্ত রামকথা আরম্ভ করতে হয়েছে রামের চার পুরুষ আগে থেকে। আগে দিলীপ, তারপর রঘু, অজ, দশরথ, সবার কথা তাঁকে সবিস্তারে বলতে হয়েছে। কালিদাস তাঁর মত করেই রাম কথা লিখেছেন। কিন্তু রামের কোন পূর্ব প্রসঙ্গ নেই, তাঁর বাপ-ঠাকুর্দার পরিচয় নেই, তাঁর জন্ম নেই, অস্ত্রশিক্ষা নেই, ভাইদের পরিচয় নেই, বিবাহ নেই; হুট করে বললাম— ভরত শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়ে মামাবাড়ি চললেন— আর মহাকাব্য আরম্ভ হয়ে গেল, এই কি হয় নাকি? বরঞ্চ জ্যাকোবি অনেক ভাল কথা বলেছিলেন। তিনি অন্ততঃ স্বীকার করেছিলেন যে অযোধ্যাকাণ্ডের প্রস্তাবনা হিসেবে বর্তমান বালকাণ্ডের কিছু অংশকে স্বীকার করে নিতেই হবে, যদিও সে অংশটুকু অযোধ্যাকাণ্ডের সঙ্গেই নাকি পূর্বকালে সংযুক্ত ছিল। এসব খবর পণ্ডিতদের কানে কানে বাল্মীকির ভূত এসে বলে যায়নি, তাঁরা আপন আপন পাণ্ডিত্যের ভূয়োদর্শন ক্ষমতায় এসব কথা প্রমাণ করেছেন মাত্র।
স্বীকার করে নিলাম—রামের জন্মকথায় ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির গপ্পোটা বাড়াবাড়ি; কিন্তু অশ্বমেধ যজ্ঞটিকে বাদ দেবেন কি করে? মহাকাব্যের গল্পাংশে—এক রাজা ছিল। তাঁর নাম দশরথ। তাঁর সব সুখ ছিল, কিন্তু বংশকর পুত্র ছিল না—এ কি কোন বাড়তি কথা? তার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করা—এই তো সেকালের রীতি। বিশেষতঃ পুত্র প্রাপ্তির জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা তো দশরথই প্রথম ভেবেছিলেন—সুতার্থং বাজিমেধেন কিমর্থং ন যজাম্যহম্। অশ্বমেধ যজ্ঞ করার এই ইচ্ছা দশরথ প্রকাশ করলেন কুল-পুরোহিত বশিষ্ঠের কাছে, অন্যান্য ব্রাহ্মণ মন্ত্রীরাও তখন সভায় উপস্থিত। তাঁরা সবাই একবাক্যে বললেন, আপনি অবশ্যই পুত্র লাভ করবেন—যজ্ঞের আয়োজন করুন, যজ্ঞের ঘোড়া ছেড়ে দিন এবং সরযু নদীর উত্তর তীরে যজ্ঞভূমি বানিয়ে ফেলুন—সম্ভারাঃ সংভ্রিয়ন্তান্তে তুরগশ্চ বিমুচ্যতাম্। সরায্বাশ্চোত্তরে তীরে যজ্ঞভূমি র্বিধীয়তাম্॥
এই শ্লোকটি খেয়াল করুন। বশিষ্ঠ্যের এই অনুমতির পরেই রাজা রানীদের সঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞে দীক্ষিত হয়েছেন। কিন্তু তার পরের সর্গেই দেখা যাবে সুমন্ত্র দশরথকে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কাহিনী শোনাচ্ছেন এবং দুই-তিন সর্গে সে কাহিনী শুনিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসাও হল। তারপর সে কাহিনী খাপ খাওয়ানো হল ঠিক যেমন মুনিরা বলেছিলেন—যজ্ঞের আয়োজন করুন, যজ্ঞের ঘোড়া ছেড়ে দিন… সম্ভারা সংভ্রিয়ন্তান্তে তুরগশ্চ বিমুচ্যতাম্—এই শ্লোকের সঙ্গে। শ্লোকটিও আরও দু-তিনটি পূর্বকথিত শ্লোকের সঙ্গে পুনরুচ্চারিত হল। মুনিরা এখানে আরও পরিস্কার আশ্বাস দিয়েছেন—আপনার চারটি পুত্র হবে। বেশ বোঝা যায় ঋষ্যশৃঙ্গের কাহিনীটি অবশ্যই পরে সংযোজিত হয়েছে। তা ছাড়া অশ্বমেধ যজ্ঞের পরেও ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মুখ দিয়ে বেরিয়েছে—মহারাজ! আপনার চারটি পুত্র হবে। কাজেই এর পরেও ঋষ্যশৃঙ্গের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ বৃথা, কারণ পুত্রকাম দশরথের পুত্র জন্মের সম্ভাবনা করে দিয়েছে অশ্বমেধ যজ্ঞই, ঘোড়া তিনবার খড়্গঘাতে স্বয়ং কৌশল্যাই ছেদন করেছেন। কিন্তু অশ্বমেধ যজ্ঞে একজন স্ত্রী, মনে রাখবেন স্ত্রীলোক, কোন পুরোহিত নয় কিংবা তাঁর যজমান পুরুষও নয়, একজন স্ত্রীলোক বৈদিক কর্মে এমন সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন—এ ঘটনাও তো স্ত্রীলোকের সন্ধ্যা-বন্দনার মতই প্রাচীন। কাজেই অশ্বমেধ যজ্ঞটিকে বোধ হয় মূল রামায়ণ থেকে বাদ দেওয়া চলবে না, এবং বাদ না দিলে রাম-লক্ষ্মণ, ভরত-শত্রুঘ্নের জন্ম-সম্ভবও ভাগ্যক্রমে হয়ে যাবে।
রাম বিষ্ণুর অবতার, সুগ্রীব সূর্যের অবতার—এ সব বৈষ্ণবীয় ভাবনা নিঃসন্দেহে বালকাণ্ডের ভার বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু বালকাণ্ডে তাড়কা রাক্ষসীকে না মেরে, রাম-সীতার বিয়ে না দিয়ে আমরা অযোধ্যা কাণ্ডে যাই কি করে? আর দুটি কাজই যদি রামকেই করে থাকতে হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই বিশ্বামিত্র মুনির হাত ধরে তাড়কা রাক্ষসীকে মারবার জন্য বনে পাঠাতেই হবে। সাহেব ভাষা-ছন্দ মিলিয়ে বলে দিলেন—The whole of Visvamitra episode (1. 31-64) lacks direct relevance to the main story of Rama and could be omitted. সাহেব জানেন না যে, ভারতবর্ষীয় মহাকাব্যের রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষা দিতে হয়, এবং রামায়ণ মহাকাব্যের যে দুই নায়ক রাম-লক্ষ্মণ পরে এত যুদ্ধ করবেন, তাদের পনের বচ্ছর বয়স হয়ে গেল, অথচ তাদের কোন অস্ত্রপরীক্ষা হবে না—এটা হয় না। বাল্মীকি মূলতঃ কবি, তাই তিনি দুই রাজপুত্রকে অযোধ্যার মাঠে হাজির করেননি, তিনি সুকৌশলে বিশ্বামিত্রকে নিয়ে এসেছেন রাজসভায়। দশরথ যখন কিছুতেই রাম-লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ছেড়ে দিতে রাজী হচ্ছিলেন না, তখন বশিষ্ঠ বলেছেন—মহারাজ! আপনার ধারণা অনুযায়ী রাম অস্ত্ৰকুশলই হোন বা অকুশল হোন—কৃতাস্ত্রম্ অকৃতাস্ত্রং বা নৈনং শক্ষ্যন্তি রাক্ষসাঃ—রাক্ষসেরা এর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। তার ওপরে বিশ্বামিত্র এদের সব সময় রক্ষা করবেন, কারণ বিশ্বামিত্র যেমন ধার্মিক তেমনি বীর পুরুষ, ইনি তপশ্চর্যায় যেরকম, অস্ত্রবিদ্যাতেও সেইরকম—এষো’স্ত্রান্ বিবিধান্ বেত্তি ত্রৈলোক্যে সচরাচরে। নৈনম্ অন্যঃ পুমান্ বেত্তি ন চ বেৎস্যন্তি কেচন ॥ ইনি যেমন অস্ত্রবিদ্যা জানেন তেমনটি কেউ জানে না, কারও পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। এর পরে বিশ্বামিত্র কত-শত অস্ত্রচালনা জানেন এবং কত অস্ত্র তাঁর আছে—সেসবের একটা বিবরণ দিয়ে বশিষ্ঠ বললেন—মহারাজ! বিশ্বামিত্র একাই সব রাক্ষস মেরে ফেলতে পারেন, তবু যে তিনি এখানে এসেছেন সে শুধু আপনার পুত্রের ভাল চান বলে, নইলে তাঁর দায় কি! এর পর মহারাজ দুই ছেলেকেই বিশ্বামিত্রের সঙ্গে যেতে দিলেন।
আমাদের মত বশিষ্ঠও বোধ করি জানতেন যে বিশ্বামিত্র আগে ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজা, পরে ব্রাহ্মণ। মহাভারতের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য জাতে ব্রাহ্মণ, কাজে ক্ষত্রিয়। এই দো-আঁশলা লোকগুলিই অস্ত্রশিক্ষার সবচেয়ে বড় গুরু বলে মহাকাব্যগুলিতে চিহ্নিত। বিশ্বামিত্রের পূর্বজীবনের ক্ষাত্র-শিক্ষা, যা তিনি ব্রাহ্মণ্য-আচারের মধ্যেও ত্যাগ করেছিলেন কিনা সন্দেহ, সেই শিক্ষা যে রাম-লক্ষ্মণের কাজে লাগবে—একথা বশিষ্ঠ বুঝেছিলেন বলেই উপযুক্ত আধারকে আধান কর্ত্তার সঙ্গে যোগ করে দিয়েছিলেন। হলও তাই, পথে যেতে যেতে এই মন্ত্র, সেই মন্ত্র, নানা উপদেশ বিশ্বামিত্রের মুখ থেকে শোনা গেল বটে, কিন্তু ঝুনো বুড়ো ভুলেও তাঁর অস্ত্রশস্ত্রের একখানাও রাম-লক্ষ্মণকে দেননি। যেদিন তাড়কা-বধ হল এবং বিশ্বামিত্র বুঝলেন—হ্যাঁ বাহাদুর ছেলে বটে—পাত্রভূতো’ সি রাঘব—তখন একগাদা অস্ত্রশস্ত্র দিলেন, এবং তার প্রয়োগবিধিও রামের কাছে বাতলে দিলেন। অস্ত্ৰ-পরীক্ষা এবং শিক্ষার এই রীতি বাল্মীকির মত কবির পক্ষেই এমনভাবে কাব্যশরীরে ন্যস্ত করা সম্ভব। কাজেই আমাদের ধারণা—রামায়ণী কথা থেকে বিশ্বামিত্রকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া বেরসিকের মত কাজ হবে। কারণ আমরা জানি—স্নেহান্ধ রাজা দশরথ ক্ষত্রিয় ছেলেদের অস্ত্রশস্ত্রের পারদর্শিতা না জেনে আগেই তাদের বিয়ের জন্য চিন্তিত ছিলেন। বিশ্বামিত্র, আসবার আগেই দশরথকে দেখছি, তিনি গুরু এবং আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ছেলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছেন—অথ রাজা দশরথস্তেষাং দারক্রিয়াং প্রতি। চিন্তয়ামাস ধর্মাত্মা সোপাধ্যায়ঃ সবান্ধবঃ ॥ এই সময়েই বিশ্বামিত্র উপস্থিত হন।
বিশ্বামিত্রের হাত ধরেই রাম-লক্ষ্মণ মিথিলায় উপস্থিত হন এবং সেইখানেই চার ভায়ের বিয়ের ব্যবস্থা হয়। এর মধ্যে বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের ঝগড়ার ব্যক্তিগত কাহিনী, রামের পূর্ব পুরুষ সগর রাজার কাহিনী কিংবা ভগীরথের গঙ্গা আনার কাহিনী, অহল্যার কাহিনী—এগুলি হয়তো সবই পরবর্তী কালের সংযোজন। কিন্তু বালকাণ্ডেই বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণকে জনকের রাজসভায় হরধনু ভাঙবার জন্য না পাঠালে বাল্মীকির চলবে কি? অযযাধ্যাকাণ্ড থেকে কাহিনী আরম্ভ করে সেই কাণ্ডের মাঝখানে আমরা জানতে পারব রামের বৌয়ের নাম সীতা—এমন প্রস্তাব বাল্মীকির সইবে না। তার চেয়ে পরশুরামের কাহিনী বাদ দিন, অহল্যা বাদ দিন, এটা সেটা যা বলেছি আরও কিছু বাদ দিন, কিন্তু বিশ্বামিত্রকে বাদ দেবেন না, সীতার বিয়ে বাদ দেবেন না, রামের জন্ম বাদ দেবেন না। সাবধানীরা বলেছে—সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ। যে অর্ধেক থাকবে তাতেই বাল্মীকি তাঁর পরবর্তী কাণ্ডগুলির পরিকল্পনা করে নিতে পারবেন।
এবারে উত্তর কাণ্ডের কথা বলি। উত্তর কাণ্ডের প্রধান দোষ, এবং যে দোষের জন্য পণ্ডিতেরা একে বাল্মীকির লেখা বলতে রাজী নন, তা হল—এই কাণ্ডের প্রথমেই সমস্ত ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণেরা অযোধ্যায় এসে রাজা রামচন্দ্রকে রাবণ-বধের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। শুধু কৃতজ্ঞতা হলেও হত। মুনি-প্রবর অগস্ত্য এইখানে রাবণ এবং অন্যান্য লংকা-নায়কদের পূর্ব জীবনের কাহিনী বলতে আরম্ভ করেন। এই কাহিনীর মধ্যে বালি-সুগ্রীবের জীবন বৃত্তান্তও আছে। পণ্ডিতদের ধারণা, যে সব ঘটনা বা ঘটনা-পরম্পরা বাল্মীকি মহাকাব্যের বিষয়বস্তু তার সঙ্গে উত্তর কাণ্ডের এই জীবন কাহিনী বলার কায়দাটি মেলে না। রাম প্রশ্ন করছেন আর অগস্ত্যমুনি এক কাহিনী থেকে আরেক কাহিনীতে চলে যাচ্ছেন, এ সব যেন অনেকটা মহাভারতীয় বাচনভঙ্গী, যে ভঙ্গী বালকাণ্ডেও দু/এক জায়গায় আছে। আমার বক্তব্যেও বালকাণ্ডের সে সব জায়গা আমি বাদ দিয়েছি, উত্তর কাণ্ডেও না হয় বাদ দেব। কিন্তু কোন্ অংশ একেবারেই বাদ দেওয়া যাবে না, তারও একটা মীমাংসা হওয়া দরকার বৈ কি!
রাম-রাবণের যুদ্ধকাণ্ড যেভাবে শেষ হল, মহাকাব্য সেভাবে শেষ হয় না। ইলিয়াডের কবিকেও তো ওডিসি লিখতে হয়েছিল। বাল্মীকি রাবণের কথা বলেছেন, বালি-সুগ্রীবের কথাও বলেছেন, বলেছেন হনুমানের কথাও। অরণ্য কাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত এদের সবারই একটা ছবি পাই বটে, তবে তা ছেঁড়া-ছেঁড়া, কাটা কাটা। মনে রাখা দরকার—আমাদের দেশে যেমন দুর্গা-পূজা হয়, তেমনি মহিষাসুরেরও পূজা হয়। মহাকাব্যের কবির কাছে উদাত্ত নায়কের বল বীর্য বিভূতি বর্ণনা যতখানি অভীষ্ট, তাঁর কাছে প্রতিনায়কের ভূমিকাও ততখানি গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে প্রতিতুলনায় নায়ক রামচন্দ্রের শৌর্য-বীর্য বর্ণনার অর্থ থাকে না। বস্তুতঃ অরণ্যকাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত যতখানি রাবণের ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্য বর্ণনা আছে, তা সামগ্রিক না হলেও বাল্মীকির মমতা সেখানে যথেষ্ট স্পষ্ট চেহারায় ধরা দিয়েছে; না হলে বাংলার কবি মাইকেলের পক্ষেও রাবণের পক্ষ নেওয়া সম্ভব ছিল না। যে কোন বুদ্ধিমান লোকই রামায়ণ পড়লে বুঝতে পারবেন যে, রাবণের ভাব-ভঙ্গী এবং ঐশ্বর্যের কাছে রাম চরিত্র প্রায় ম্লান, এমনকি লঙ্কাপুরীর কাছে অযোধ্যার ঐশ্বর্যও একেবারে হতশ্রী। রাম রাজত্ব হারিয়ে বনে গেছেন, সৈন্যসামন্তহীন জটাধারী তপস্বীর বেশে বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তার মধ্যেও হাজারটা বিপদ এসেছে, তাঁর স্ত্রী পর্যন্ত চুরি গেছে—এই করুণ অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়েও সততা এবং নীতিবোধের যে জয় হল, মহাকাব্যের কবি জানেন যে, সততা ও নীতিবোধের সুবাদেই তা করা যায়। কিন্তু তার মধ্যে রাজকীয়তা নেই, ঐশ্বর্য নেই, আড়ম্বরও নেই। এই সমস্ত কিছুর জন্যেই তাঁকে তিলে তিলে রাবণচরিত্র গড়তে হয়েছে। এ হেন যে প্রতিনায়ক, তার কি পূর্ব জীবন বলে কিছুই থাকবে না! কিংবা যে বানরবাহিনীকে সহায় করে রাম ভীষণ যুদ্ধে জিতে গেলেন সেই বানর বীরদের পূর্বজীবন বলে কি কিছুই থাকবে না! মহাকাব্যের পাকা বাঁধুনীর মধ্যে এসব কাহিনী লেখার অসুবিধে ছিল, কাজেই তার অবসর খুঁজতে হয়েছে পরে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি—অগস্ত্যের মুখে কাহিনীগুলি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবে বাল্মীকি নাও লিখে থাকতে পারেন। কিন্তু বাল্মীকি যে সেগুলির আভাস মাত্র দেননি, কিংবা সেসব কাহিনীর স্থিরাংশগুলি একটুও রেখাঙ্কিত করেননি—একথা কি জোর দিয়ে বলা যায় ? পণ্ডিতেরা বলেছেন, রামায়ণের উত্তরকাণ্ড নাকি ‘ব্রাহ্মণাইজেশনে’র ব্যাপার, অথাৎ কিনা রাম মানুষ ছিলেন, দেবতা হইয়াছেন। রাবণের সঙ্গে দেবতারাও যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারছেন না, অতএব বিষ্ণু বলেছেন, সময় আসুক রাবণকে মারব—তা এই বিষ্ণুর অবতার গ্রহণের সংকল্পটা না হয় রামায়ণ থেকে ছেঁটেই ফেলুন। ছেঁটে ফেলুন সেই সব অংশ যেখানে মুনিরা রামচন্দ্রকে নারায়ণ, কিংবা বিষ্ণু বলে সম্বোধন করেছেন। সবই না হয় গেল, কিন্তু একথা কি করে অস্বীকার করতে পারবেন যে, মূল রামায়ণ অর্থাৎ সেই অযোধ্যাকাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত যাকে পণ্ডিতেরা মূল রামায়ণ বলছেন, সেখানে তো অজস্রবার রাবণকে দেবজয়ী, স্বৰ্গক্ষয়ী, সুরত্রাস এসব বিশেষণে অনবরত ভূষিত করা হয়েছে। অথচ পণ্ডিতেরা ভাবলেন—মূল কাণ্ডপঞ্চকে রাবণের এই সব বিশেষণ থাকে থাকুক কিন্তু তার স্বর্গজয়ের ইতিহাস না থাকলেই হল। কিন্তু এইভাবে কি ইতিহাসকে স্তব্ধ করা যায় ?
আরও একটা কথা বলি। ভারতবর্ষীয় সামাজিক গঠনের নিরিখে একান্তভাবে দেবত্ববর্জিত নরচন্দ্রমার বর্ণনা বড়ই কঠিন। যে কবি মানুষভাবে মনুষ্যচরিত্র বর্ণনা আরম্ভ করেছেন, সেই মনুষ্য নায়কের চরিত্রের মধ্যেই যদি অতিদেবের কল্পনা থাকে তবে উত্তরপর্বে একই কবির পক্ষে তার মধ্যে দেবত্ব আরোপন একেবারে অসম্ভব নয়। তা পণ্ডিতদের কলমের আঁচড়ে উত্তর রামায়ণে রামের দৈবী কল্পনা না হয় বাদই গেল। কিন্তু তারপর ? তারপর তো আর পণ্ডিতের কথা মানতে পারছি না। মনে রাখা দরকার, যে মহাকবি কাব্য রচনা করেন, সে কবির আপন নায়ক-নায়িকার ওপর যেমন মমতা থাকে, তেমন পাঠকের ওপরেও তাঁর কিছু মমতা থাকে। যেখানে রূপকথার কাহিনীতেও অন্তিম মুহূর্তে শুনতে পাই—অতঃপর তাহারা রাজপুরীতে সুখে কাল কাটাইতে লাগিল—সেখানে মহাকাব্যের পাঠককুলের কোন প্রত্যাশা থাকবে না, তারা জানতে চাইবে না মহাকবির নায়ক-নায়িকার অন্তিম জীবনের পরিণতি কি? রামচন্দ্র রাজা হবার মুখেই বনে নির্বাসিত। নায়িকা রাজরানী হবার মুহূর্ত্তেই অরণ্যচারিণী। শুধু তাই নয়, প্রতিনায়ক তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। এহেন দুর্ভাগ্যপীড়িত নায়ক-নায়িকার কি হল, এ বিষয়ে পাঠকের কোন চাহিদা থাকবে না ? লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত নায়ক আর প্রতিনায়কের যোঝাযুঝি, বোঝাবুঝি; কিন্তু নায়িকার সঙ্গে মিলন মুহূর্তেই মহাকাব্য শেষ ? হায়, এ কি সমাপন!
ভবভূতি সীতার অপবাদ সইতে না পেরে বলেছিলেন যে, দুর্জনেরা কবিত্বে আর স্ত্রীলোকের সাধুত্বে চিরকালই সন্দেহ প্রকাশ করে—যথা স্ত্রীণাং তথা বাচাং সাধুত্বে দুর্জনো জনঃ। স্ত্রীলোকের সাধুত্বের কথা না হয় পরে আসবে, কিন্তু উত্তরকাণ্ডে প্রক্ষেপের অছিলায় যারা সীতা-পরিত্যাগের মত মধুর কাব্যখানি রামায়ণের বুক থেকে কেটে বাদ দিয়ে দেন, তাদেরকে ‘দুর্জন’ বলা ছাড়া আমার আর গতি নেই। এর মধ্যে যাঁরা আবার পঞ্চকাণ্ড থেকে উত্তর কাণ্ডের মধ্যে কাব্যলেখার ‘স্টাইলে’র অন্তর দেখতে পান তাঁরা অন্ততঃ সংস্কৃত কাব্যশৈলীর কিছুই বোঝেন না এটুকু জোর দিয়েই বলতে পারি। প্রজাতোষণের জন্য রামচন্দ্র সীতা পরিত্যাগ করলেন—এ কথা আমরা আগেই দেখেছি, এ বিষয়ে রাজা রামচন্দ্রের মনস্তত্ত্বও আমরা কথঞ্চিৎ লক্ষ্য করেছি। কিন্তু লক্ষ্য করিনি কবিকে। যে কবি স্বয়ং ক্রৌঞ্চবিরহী বলে রামায়ণের মুখবন্ধেই খ্যাত, তিনি যে সর্বংসহা চিরবিরহাতুরা এক রমণীকে তাঁর নায়িকা হিসেবে বেছে নেবেন, এই তো স্বাভাবিক। ধনুর্ভঙ্গ পণে যার বিয়ে হল, সেই সুদুর্লভা রমণীকে কামুক শ্বশুরের মুখের কথায় বনে চলে যেতে হয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে অরণ্যবাসের পর তাঁকে আরও এক কামুকের হাতে গিয়ে পড়তে হয়েছে, এবং যে ভাবেই হোক, তাঁকে নিজেকে রক্ষাও করতে হয়েছে। কবি তাঁকে রক্ষা করার জন্য স্বয়ং চিন্তিত ছিলেন, যার জন্য রাবণ যাতে তাকে স্পর্শ করতে না পারেন তার জন্য রাবণের ওপর নানা অভিশাপের কাহিনী তাঁকে অবতারণা করতে হয়েছে। পণ্ডিতদের কথা আবার এসে যায়, কারণ তাঁরা উত্তরকাণ্ডের রম্ভার অভিশাপ আর লংকাকাণ্ডে পুঞ্জিকস্থলী নামে এক অপ্সরার অভিশাপের মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পাননি। বলা বাহুল্য, পণ্ডিত বলেই পাননি। বোধ করি পাঠকের স্মরণ আছে যে, সীতাকে বিছানায় তুলতে পারছেন না বলে রাবণ একসময়ে তাঁর মন্ত্রী-মণ্ডলীর পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি সেখানে কুম্ভকর্ণের সৎপরামর্শ এবং মহাপার্শ্বের সেই মোসাহেবি কথাটির কথাও উল্লেখ করেছি। মহাপার্শ্ব রাবণকে সীতাভোগের ব্যাপারে মোরগের অনুকরণ করতে বলেছিলেন। রাবণ মহাপার্শ্ব মহোদয়ের তারিফ করে বলেছিলেন—বলপ্রয়োগের উপায় থাকলে কি আর আমি তা বাকী রাখি, আসলে আমার একটা গোপন ঘটনা আছে। রাবণ বললেন—সে অনেককাল আগের কথা। পুঞ্জিকস্থলী নামে এক আগুনপানা সুন্দরী অপ্সরা আকাশপথে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্রহ্মার কাছে যাচ্ছিল। আমি জোর করে তার পরিধেয় বসন খুলে নিয়ে উপভোগ করি—সা প্রসহ্য ময়া ভুক্তা কৃতা বিবসনা ততঃ। তারপর সেই অপ্সরা বিস্রস্তবাসে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে উপস্থিত হল এবং ব্রহ্মাও সব জানতে পেরে আমাকে অভিশাপ দিলেন যে, আমি যদি জোর করে কোন রমণীকে উপভোগ করি তাহলে সেই মুহূর্তে আমার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। উত্তরকাণ্ডে রম্ভার ঘটনাও প্রায় একই রকম। সে কুবেরের ছেলে নলকূবরের কাছে বাগ্দত্তা, সম্বন্ধে তাই রাবণের পূত্রবধূ। সে নলকূবরের কাছেই যাচ্ছিল—মাঝখানে রাবণের উৎপাত। শেষে নলকূবরের অভিশাপ, যার ফলশ্রুতি একই।
কিন্তু এতে অসামঞ্জস্যের কি হল। রাবণের যা চরিত্র, তাতে তিনি তো একটিমাত্র রমণীর শ্লীলতা হানি করেই ক্ষান্ত হবার লোক নন। রাবণ যে বিবাহিতা অবিবাহিতা কত শত স্ত্রীলোকের সর্বনাশ করেছেন, তার কথা বলতে বলতেই তো উত্তর কাণ্ডে রম্ভার কাহিনী এসেছে। স্ত্রীলোকের অভিশাপবাণী অথবা তাদের স্বামীদের শত সহস্র অভিশাপ-বাণীও তার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হয়ে থাকবে। রাবণ তার একটি মাত্র মহাপার্শ্বের কাছে বলে ফেলেছেন। অন্যগুলি অনুচ্চারিত থেকে গেছে। উত্তরকাণ্ডে ঋষিদের গল্পে এই অভিশাপ আরও একবার শোনা গেল, তাতে অসামঞ্জস্য কি হল ?
হ্যাঁ, অসামঞ্জস্যের কথা আসতে পারে যদি আপনি অভিশাপ জিনিসটাকে একেবারে ধর্মীয় অক্ষরে গ্রহণ করেন। একথা ঠিক যে এই দুই রমণীর ওপর রাবণের অত্যাচার এবং বলাৎকার একই সঙ্গে হয়নি। অবশ্যই এদের যে কোন একটি ঘটনা পূর্ববর্ত্তী এবং অপরটি পরবর্ত্তী। অন্যদিকে ব্রহ্মার দেওয়া অভিশাপ এবং নলকূবরের অভিশাপ—এই দুয়ের ভেতরেও কোন পারম্পর্য নেই। তার ওপরে প্রথম অভিশাপের কথা সত্যি হলে দ্বিতীয়বার দুষ্কর্ম করার সময়েই রাবণের মাথা চৌচির হবার কথা ছিল, সীতা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না। কাজেই দুবার অভিশাপের ব্যাপারটা কিছু অসামঞ্জস্য নিয়ে আসে বৈকি। কিন্তু আমরা বলি, ব্যাপারটা অন্যভাবেও দেখা যায়। পুঞ্জিকস্থলী এবং রম্ভা দু-জনেই অপ্সরা। দুজনের ওপরেই রাবণের অত্যাচারের ধরন-ধারণও এক, অভিশাপও এক। কাজেই রাবণের গল্পে যিনি অপ্সরা পুঞ্জিকস্থলী, ঋষিদের গল্পে তিনিই রম্ভা হয়ে গেছেন। অসংগতি এইটুকুই। কিংবা রাবণের গল্পে অভিশাপের বিধাতা ব্রহ্মা, ঋষিদের গল্পে নলকূবর হয়ে গেছেন। অসংগতি এইটুকুই। কিন্তু এরকম ঘটনা একটা ঘটেই ছিল এবং অনুরূপ অভিশাপও একটি ছিল যার জন্য সীতার বেলায় রাবণকে সংযত থাকতে হয়েছে। আধুনিককালে যাঁরা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখেন তাঁদের ক্ষেত্রেও দেখি উপন্যাসের প্রথমাংশের একটি নাম পরবর্ত্তীকালে আরেক হয়ে গেছে; কোথাও বা মৃত চরিত্র পরবর্তী অংশে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে হাজার হাজার বছর আগে, যখন লেখার ব্যবস্থাও ভাল করে ছিল না, সেই তখনকার দিনে গায়েনদের কণ্ঠে যদি অপ্সরার নাম কিংবা অভিশাপদাতার নাম পালটে গিয়ে থাকে, তাতে দোষ দেখি না কোন। বাল্মীকির রামায়ণ কোন ধর্মগ্রন্থ নয় যে, শুধুমাত্র অভিশাপ জিনিসটাকে ‘ইসু’ করে, বাল্মীকির কল্পনায় মুষ্ট্যাঘাত করতে হবে। বাল্মীকি মূলতঃ কবি এবং পৌরাণিক কবিদের এককথা দুবার, তিনবার বলার অভ্যাস আছে এবং তাতে ক্কচিৎ কখনও নামের পরিবর্তন ঘটে, সময়ের পরিবর্তন ঘটে, অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে।
বিশেষতঃ আমি তো আগেই বলেছি যে, মহাকাব্যের কবি তো আর ছোটগল্প লিখতে বসেননি। তাই সমমর্মের কাহিনী দুবারও শোনানো যায়, এবং লঙ্কাকাণ্ডই নায়ক-নায়িকা শেষ হয়ে না হইল শেষের ভাব দেখাবে, এমনটিও নয়। আমি তো মনে করি রাবণের ওপর যে অভিশাপ-বাণীর কথা বলা হয়েছে সে প্রয়োজন ছিল স্বয়ং ক্রৌঞ্চবিরহী কবির। কারণ পরে তাকে দেখাতে হবে যে রাক্ষসগৃহে দীর্ঘকাল বাস করেও, কোনওভাবে কলুষিতা না হয়েও তাঁর নায়িকাকে একবার সন্দেহের আগুনের ওপর পা ফেলে হাঁটতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে পরিত্যক্তাও হতে হয়েছে। কবিহৃদয়ের সমস্ত আকৃতি দিয়ে সীতাকে রক্ষা করলেও বাল্মীকি তাঁকে বাঁচাতে পারেননি, জনাপবাদ তাঁকে কলংকিত করেছে, যার জন্যে তাঁর আপন মানসপুত্রীর শেষ আশ্রয় হয়েছেন বাল্মীকি নিজে। রাজা রামচন্দ্রের আদেশের অছিলায় কবি তাঁর কল্পলোকের নায়িকাকে নিজের কাছেই নিয়ে এসেছেন। কবি জানেন, সীতাকে ধরে রাখবার বা বোঝার ক্ষমতা তাঁর ঘরের লোকেরও নেই, কাজেই তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছেন। বাল্মীকির আশ্রমে আসার পর পরিত্যক্তা সীতাকে বাল্মীকি বলেছেন—বিস্রদ্ধা ভব বৈদেহি সাম্প্রতং ময়ি বত্তসে—এখন তুমি আশ্বস্ত হও সীতা, এখন তুমি আমার কাছে এসেছ। পণ নেই, কৈকেয়ীর মুখে ঝাল খাওয়া মহারাজ নেই, বনবাস নেই, রাবণ নেই এমনকি রাজা রামচন্দ্রও নেই—তুমি আমার কাছে এসেছ, এই তোমার আপন ঘর—যথা স্বগৃহম্ অভ্যেত্য বিষাদঞ্চৈব মা কৃথাঃ— তুমি আর দুঃখ কর না। এখানে সীতা নির্বিঘ্ন, সংসারের মালিন্য এখানে পৌঁছায় না, অন্ততঃ সুখ-প্রসবের জন্যও তো আপন মানসকন্যাকে বাপের বাড়ি নিয়ে আসা যায়। রামায়ণ মহাকাব্যের জনক বাল্মীকি তাঁর হৃদয়বাসিনী কন্যার কাছে এইভাবেই পিতৃকৃত্য সম্পাদন করেছেন।
আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না বা করতে চাই না সীতার সম্পর্কে অপবাদ, সীতা পরিত্যাগ এবং শেষে সীতার পাতালপ্রবেশ—এই উত্তরাংশ বাল্মীকির হাতে লেখা নয়। একদিকে পরিত্যক্তা সীতাকে বাল্মীকি যেমন আশ্রয় দিয়েছেন, অন্যদিকে রাজা রামচন্দ্রের অসহায় অবস্থার প্রতিও তিনি উদাসীন নন। কলঙ্কিতা স্ত্রীকে বাপের বাড়ি ফেলে আসার মত, রাম তাকে ত্যাগ করতে পারেননি। রাম বলতে পারেননি—মহাকাব্যের কবি! এই তোমার লালিতা কন্যা! এ কি চরিত্রহীনা রমণী যাকে তুমি চিরকালের আদর্শ রামচন্দ্রের পাশে জায়গা দিয়েছ! সীতাকে ত্যাগ করার মুহূর্তে রাম আর কথা বাড়াতে চাননি। ভাইদের তিনি বলেছিলেন—আমি কোন কথা শুনতে চাই না, যদি কথা বল, যুক্তি দেখাও তাহলে তা আমার অহিত আচরণ বলে গণ্য হবে—অহিতা নাম তে নিত্যং মদভীষ্টবিঘাতনাৎ। কেউই কথা বলেননি, লক্ষ্মণের ওপর সেই নির্মম কর্ত্তব্যের ভার দেওয়া হল, লক্ষ্মণও কোন প্রত্যুত্তর করেননি। কিন্তু সীতাকেও তো কিছু জানানো হল না। রাজা রামেরও তো সেই সাহস নেই। বাল্মীকি তাহলে কি বোঝাতে চাইছেন ? যেদিন সীতাকে লক্ষ্মণ বাল্মীকির তপোবনে রেখে এলেন, সেদিন তিনি অঝোরে কাঁদলেন। যিনি পূর্বে সীতার অগ্নি-পরীক্ষার কথায় দাঁত কড়মড় করেছিলেন, তিনি যে সারা রাস্তা অঝোরে কাঁদলেন সে কি শুধু সীতার জন্য দুঃখে, রামের ওপর রাগে নয় ? বাল্মীকি কি বোঝাতে চাইছেন ? একটু পরেই তো লক্ষ্মণ বলবেন—লোকের কথা শুনে রাম সীতাকে ত্যাগ করলেন, এ তো একেবারে নৃশংস কাজ—পৌরাণাং বচনং শ্রুত্বা নৃশংসং প্রতিভাতি মে।
লক্ষ্মণ কিন্তু সীতা পরিত্যাগ করেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত করে চলে যেতে পারেননি। তমসার অপর পার থেকে লক্ষ্মণ বার বার সীতাকে দেখছিলেন—মুহুর্মুহুঃ পরাবৃত্য দৃষ্ট্বা সীতামনাথবৎ। লক্ষ্মণ দেখলেন, বাল্মীকি তাঁর করুণার আশ্রয় বাড়িয়ে দিয়েছেন সীতাকে। লক্ষ্মণ দেখলেন, সীতা শান্তপদে বাল্মীকির আশ্রমপদে প্রবেশ করেছেন— দৃষ্ট্বা তু মৈথিলীং সীতামাশ্রমে সম্প্রবেশিতাম্—লক্ষ্মণ তখন রওনা দিয়েছেন। তমসার তীরে লক্ষ্মণ রথে উঠেই বললেন—রামের অবস্থা কি হবে ? সীতার এই বিরহ-দুঃখের থেকে রামের কাছে আর কোন দুঃখ বড় হতে পারে—ততো দুঃখতরং কিন্নু রাঘবস্য ভবিষ্যতি। সহৃদয় পাঠককুল! মহাকাব্যের কবি যা দেখানর তা এইভাবেই দেখান। রামের মুখ দিয়ে সহস্রবার আমি তোমাকে ভালবাসি বলানো মহাকাব্যের কবির কাজ নয়। তাঁর কাজ চলে আড়ালে আবডালে সন্তর্পণে। আর যদি বলেন—রামের মনের কথা আমরা তাঁর আজন্ম-সঙ্গী লক্ষ্মণের থেকেও ভাল জানি, তাহলে অবশ্য এক কথায় সীতা-পরিত্যাগের উদাহরণ দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—রাম পুরুষ মানুষ, পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের দাম ছিল না, প্রেম বলে কোন জিনিস তারা বুঝত না—অতএব রাম সীতাকে পরিত্যাগ করেছেন।
কিন্তু এ কেমন প্রেম যার জন্য সুমন্ত্র বলেছেন—রামের কপালই এমন যে তিনি কোনদিন সুখী হতে পারবেন না—দুঃখপ্রায়ো বিসৌখ্যভাক্। ভবভূতি টিপ্পনী কেটেছেন—রামের জীবনটাই করুণ রসে ভরা, তুষের আগুনের মত তাঁর হৃদয় শুধু দুঃখেই জ্বলছে—পুটপাকপ্রতীকাশশা রামস্য করুণো রসঃ। রাম রাজা হয়েছিলেন বটে, কিন্তু আদর্শ রাজা হয়ে তিনি যে সুখী হয়েছিলেন তা কে বলেছে ? মজা হল, লক্ষ্মণ যাঁকে বাল্মীকির পিতৃহৃদয়ে আলিঙ্গিতা দেখে গেলেন, সেই সীতার ঘরে রামের আরেক ভাই শত্রুঘ্ন এসে পৌছালেন। কবে? না, সীতার প্রসবের রাত্রিতে। শত্রুঘ্ন নাকি লবণাসুর বধ করার জন্য রওনা হয়েছিলেন। দুই দিন পথশ্রমের পর তিনদিনের দিন তিনি বিশ্রামের জন্য বাল্মীকির তপোবনে আশ্রয় নিলেন এবং যে রাত্রিতে তিনি এলেন সেই রাত্রিতেই সীতার দুটি ছেলে হল—যামেব রাত্রিং শত্রুঘ্নঃ পর্ণশালাং সমাবিশৎ। তামেব রাত্রিং সীতাপি প্রসূতা দারকদ্বয়ম্।
এ কি ‘কয়েনসিডেন্স’ ? আমি বলব—মোটই নয়। আর যদি ‘কয়েন্সিডেন্স’ হয়ও, তাহলে বলব—কবি স্বকার্য সাধনের জন্যই এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। পুত্রজন্মের খবর পেয়ে বাল্মীকি সানন্দে পুত্রদের নামকরণ করলেন। রাতদুপুরে বৃদ্ধারা বারবার রামের নাম বলতে থাকল, সীতার সুখপ্রসবের কথা বলতে থাকল—সংকীৰ্ত্তনঞ্চ রামস্য সীতায়াঃ প্রসবৌ শুভৌ। পর্ণকুটীরের পাতার শয্যায় শুয়ে শত্ৰুগ্ন সব শুনতে থাকলেন। মনে মনে বললেন—মা! কত সৌভাগ্যে আজ তুমি সুখপ্রসবা হলে—মাতর্দিষ্ট্যেতি চাব্রবীৎ। রামের পুত্রজন্মের আনন্দে শাওনের দীর্ঘরাত্রি একটুকু সময়ের মধ্যেই যেন কেটে গেল শত্রুঘ্নের—ব্যতীতা বার্ষিকী রাত্রিঃ শ্রাবণী লঘুবিক্রমা।
সংস্কৃত সাহিত্যের হৃদয়ে যাঁদের প্রবেশ আছে, সেই সব সহৃদয়েরা বলুন, বাল্মীকির মত মহাকবি ছাড়া এই শ্লোকের জন্ম দেওয়া সম্ভব কিনা ? একমাত্র বাল্মীকির মত কবিই এই শৈলীতে জানাতে পারেন—রামের হৃদয়ে সীতার জন্যে কোন জায়গা ছিল কিনা! নইলে, ঠিক পুত্র-জন্মের শুভক্ষণেই শত্রুঘ্ন এসে পৌছালেন বাল্মীকির পর্ণশালায়—এর মধ্যে পূজার পুষ্পে দিন গোনার ব্যাপার কি ছিল না একটুও; অন্ততঃ রামের দিক থেকে—শত্রুঘ্নের রওনা হওয়ার দিন-ক্ষণ তো তিনিই ঠিক করে দেন। তবু স্বীকার করে নিলাম, আসন্নপ্রসবা সীতাকে বনে পাঠিয়ে তিনি সামগ্রিক প্রিয়াপ্রেমের দৃষ্টান্ত বা আদর্শ কোনটাই রাখতে পারেননি। তার কারণও বলেছি—রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে জেতা ইস্তক তিনি রঘুপতি রাঘব রাজা রাম। শূদ্র শম্বুকের তপশ্চরণে রামের যে ক্রোধ, তাও এই রাজা রামের মনস্তত্ত্বের আলোকে দেখা যেতে পারে। ব্রাহ্মণ-প্রধান মন্ত্রিসভায়, ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবিত সমাজে রাজা নাম কিনতে গেলে দু-একটা শম্বুক-টম্বুক না মারলে চলছিল না। আর যাঁরা বলেন যে, উত্তর রামায়ণ লেখার এই সময়টাতেই সমাজে ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব বাড়ছিল, মূল কাণ্ড-পঞ্চকের মধ্যে এই প্রভাব তত নেই, তাঁদের এও বোঝা উচিত যে রাম তখন রাজা ছিলেন না। তারও ওপরের কথা হল যে, রামায়ণের পূর্ব যুগেও সমাজে যথেষ্ট ব্রাহ্মণ্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, হাজারো গ্রন্থ থেকে সে প্রভাব যথেষ্ট স্পষ্ট করে দেখানোও যায়। রামায়ণের উত্তর যুগ সম্বন্ধেও সেই একই কথা। আর ঠিক ওই সময়টুকুতেই, মানে রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য একেবারে প্রভাবহীন হয়ে পড়ল—এ কথা কি খুব যুক্তিসহ ? বস্তুতঃ ভারতবর্ষের ইতিহাস বৈদিক যুগ থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত—কোন স্তরেই সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণ্য অহংকার মুক্ত ছিল না। এই সামাজিক পটভূমিকা কোন কবির পক্ষে, এমনকি বাল্মীকির মত মহাকবির পক্ষেও তাঁর কাব্য থেকে হেঁটে ফেলা সম্ভব ছিল না, এবং সে কথা রামায়ণের তথাকথিত মূল কাণ্ডপঞ্চকের মধ্যে থেকে যেমন প্রমাণ করা যায়, অন্য দুটি কাণ্ড থেকে তা প্রমাণ করা যায় আরও বেশি—এইমাত্র। কিন্তু এই অছিলায় রামায়ণের কাব্যশরীর থেকে একটু একটু করে যদি ব্রাহ্মণ্য অঙ্গগুলি ছেদ করতে থাকি, তাহলে কাব্যের ঈপ্সিততম অংশগুলিও একেবারে ব্যবচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তার ফল হবে এই যে, উত্তরকাণ্ড থেকে সীতা পরিত্যাগ বাদ যাবে। বাদ যাবে রামের পুত্র জন্ম, যা সেকালের সামাজিক নিরিখে একান্ত অপেক্ষিত বলেই মনে হয়। এবং বাদ যাবে সীতার পাতাল প্রবেশ, যেখানে বাল্মীকি-প্রতিভার চরম উত্তরণ। বাল্মীকি দেখিয়েছেন, সীতাকে একবার জনসমক্ষে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে, দ্বিতীয়বার বহ্নি-বিশুদ্ধ সীতাকে লোকাপবাদের গুরুত্বে পরিত্যাগ করা হয়েছে, কিন্তু তার পরেও—ছেলেপিলে বড় হয়ে গেছে—এই অবস্থাতেও যদি রামচন্দ্র পুনরায় সীতার শুদ্ধতা এবং সতীত্বের প্রমাণ চান, তো সেটি হবে আবদার। বিশেষতঃ দুঃখে দুঃখেই যে রমণীর জীবন কাটল, তাঁর ওপরে রাজা রামচন্দ্রের এই অহেতুক অত্যাচার কতক্ষণ কিংবা কতবার সহ্য করবেন সেই মহাকবি, যিনি করুণ রস সৃষ্টির জন্যই বিখ্যাত। ঠিক একই কারণে রামায়ণ কাব্যের এই অংশ বাদ দিয়ে দেওয়াও আবদার বলেই গণ্য হবে, কেননা যে সব পণ্ডিতেরা শুধু মাত্র ‘ornate style’ এর অছিলায় পাতাল প্রবেশের মুহূর্তে সীতার শপথোক্তিগুলি তথা ধরিত্রীর কাছে তাঁর আত্মনিবেদনের অংশটি বাদ দিতে চান, তাঁদের সাহিত্য বিচার শক্তির ওপর খুব একটা আস্থা নেই আমার। কেননা করুণ রসের চরম অভিব্যক্তিতে এখানে কতগুলি শব্দ প্রতি শ্লোকে পুনরুচ্চারিত হয়েছে। এই পুনরুচ্চারণের অলংকরণ বাল্মীকির লেখা আর পাঁচ কাণ্ডের মধ্যেও আছে, যদিও পাণ্ডিত্যের হলুদ চোখে সে অংশগুলিও প্রক্ষেপ বলে গণ্য হতে পারে। প্রশ্ন হল, পণ্ডিতদের কথা শুনে বাল কিংবা উত্তরকাণ্ডের অলংকৃত শৈলীর নিরিখে মূল কাণ্ড-পঞ্চকের অলংকার দুষ্ট অংশগুলি আমরা পরিত্যাগ করব, নাকি পাঁচ কাণ্ডের স্থল বিশেষে অলংকৃত শৈলীর নিরিখে বাল কিংবা উত্তরকাণ্ডের অংশগুলিও আমরা গ্রহণ করব। আমার ধারণা—গ্রহণ করাই ভাল, কেননা তাতে মহাকাব্যশরীরের হানি হয় না। তাছাড়া কবি কোথায় অলংকৃত ভাষা ব্যবহার করবেন, কোথায় করবেন না, কোথায় তিনি বড় বড় সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করবেন এবং কোথায় লঘু সমাস, কোথায় উপমার মালা তৈরী করবেন, কোথায় রূপক—এসব তো আর তিনি ভবিষ্যৎ ভাষ্যতাত্ত্বিকের গবেষণার ফর্মুলা বুঝে করবেন না। কবির ভাবনা-মুকুরে যখন যে ভাব, যে শব্দ, যে সমাস কিংবা যে ভঙ্গীর ছায়াপাত ঘটবে, তিনি সেই ভাবেই লিখবেন, ভাষাতত্ত্বের জারিজুরি সেখানে খাটবে না। ব্রকিংটন সাহেবের মত অনুযায়ী যদি বাণভট্টের কাব্যশৈলীর বিচার করি, তাহলে বলা যাবে—কাদম্বরী কাব্যে যেখানে অলংকার বহুল ভাব অথবা সমাস বহুল পদ ব্যবহৃত হয়েছে সেটা বাণভট্টের লেখা। আর কাদম্বরীর যে সব অংশে একটি সামান্য অলংকার কিংবা একটি সমাসও নেই, সেই সব অংশগুলি পরবর্তী কোন সজ্জনের লেখা, অথবা একেবারেই নিরলংকার সমাসহীন বলে একথাও ভাবা যেতে পারে যে, সেগুলি অগ্রবর্ত্তী কোন গদ্যকারের লেখা। কিন্তু এর কোনটাই তো ঠিক কথা নয়। আর ‘স্টাইল’-এর ফারাক যদি কবির ফারাক নির্দেশ করে, তাহলে সেদিনের রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে প্রভাত সংগীত সন্ধ্যাসংগীত বাদ দিতে হবে; বাদ দিতে হবে তাঁর আধুনিকগন্ধী অতি পরিণত কবিতাগুলিও।
পণ্ডিতদের ভাষাতত্ত্ব আর গবেষণার বিচিত্র ধারা থেকে আরও একটি কথাও মনে হয়। বিশেষতঃ বাল্মীকি ছাড়া যদি অন্য কোন মহাকবি, যাঁর মান যশ অহংকার—সবই বাল্মীকির সঙ্গে মিশে গেছে, সেই মহাকবি যদি রামায়ণ মহাকাব্যের মধ্যে তাঁর আপন প্রতিভা স্ফুরিত করেন, সেই প্রতিভাকে আপনি আলাদা করবেন কোন নিয়মে ? সব নিয়মই যে সেখানে বড় লঘু হয়ে পড়বে। বিস্তীর্ণ আকাশে ক্ষণিকের তরে সহস্রবার স্ফুরিত ক্ষণপ্রভার কি ক্ষণ-নির্ণয় সম্ভব! আমরা তাই ষড়্দর্শনকেশরী বাচস্পতি মিশ্রের কথাটি বেশি মনে রাখি। বাচস্পতি ব্রহ্মসূত্রের ওপরে লেখা শংকরাচার্যের শারীরিক ভাষ্যের ওপর ‘ভামতী’ টীকা লিখেছিলেন। সে টীকা এমনই যে, তার জন্য নতুন বেদান্ত-সম্প্রদায় তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু টীকা রচনা করবার সময় বাচস্পতির বক্তব্যটি লক্ষ করার মত। তিনি তাঁর পূর্বতন আচার্যদের, বিশেষতঃ শংকরাচার্যকেই স্মরণ করে বলেছেন—আমি প্রাতঃস্মরণীয় আচার্যদের লেখার মধ্যে টিপ্পনী কাটতে বসেছি, আমাদের কথা যত হেয় কিংবা লঘুই হোক না কেন, আচার্যদের লেখার সঙ্গে তা মিশে যাবে, অর্থাৎ কিনা রাস্তার জল গঙ্গার বিরাট প্রবাহে মিশে যাবে। যখন গঙ্গাজলের পবিত্রতা কিংবা শুদ্ধির কথা উঠবে, তখন কি কেউ এমন প্রশ্ন করবে যে—এই গঙ্গার জলে রাস্তার জলের ভেজাল কতখানি আছে ?
আমার বক্তব্য ঠিক এইরকম। বাল্মীকির রামায়ণ, এক বিশাল জলপ্রবাহ। সেই প্রবাহে যদি কবিযশের কামনাহীন কোন কবির অমন্দ কবিতাংশ মিশে যায়, তো তাকে মশাই আলাদা করবেন কি করে ? বাল্মীকির কাব্য সমুদ্রে খামচা দিয়ে যদি বলেন এই কবিতার অঞ্জলিটুকু অন্য কোন অর্বাচীন কবির, তা মানব কি করে ? ‘স্টাইল’, ভাষা আর শব্দ ব্যবচ্ছেদ করে রামায়ণের নানারকম স্তর এবং কাল বিভাজন করতে গেলে সে যুক্তি যে হবে ভীষণ জোলো, এবং তা যে কত জোলো সে কথা এই সেদিনের লেখা ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজিনে’র স্তর ব্যবচ্ছেদেই বোঝা গেছে, যা মহামতি পেটন ভাল করেই দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে আর কথা বাড়াব না। আজ বেঁচে থাকলে বাল্মীকি হয়তো কান্টের মতই বলতেন যে রামায়ণ মহাকাব্যের সমস্যা—‘Can be easily solved by any one who has mastered the idea as a whole.’