প্রথম অধ্যায়
সেকালের এক কবিওয়ালাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল—কোন সময়ে ময়ূরের মাথায় সাপ নেচেছিল? আমরা জানি ‘সাপের মাথায় ব্যাঙ-নাচুনি’ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ময়ূরেব মাথায় সাপ-নাচুনিও সম্ভব নয়। ব্যাঙ যেমন সাপ দেখলে ডরায়, সাপও তেমনি ময়ূর দেখলে ডরায়। কিন্তু সমস্যাটা ধরে ফেললেন কবিওয়ালা। তিনি বললেন—একবার এমনটি হয়েছিল। সেই যখন রাম-রাবণের ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল, পৃথিবী হয়ে উঠেছিল অস্থির, অচল পর্বতগুলো পর্যন্ত কাঁপছিল থরথর করে, তখন শিবের ছেলে কার্তিক ভয়ে হঠাৎ তার বাহনসুদ্ধুই শিবের কোলে চেপে বসেছিল—ভবাঙ্কভাক্ সবাহনঃ। ওদিকে ঠিক তখনই শিবের গলায় দোল-খাওয়া সাপটি নাকি ময়ূরের মাথার ওপর গর্জে গর্জে উঠছিল—তদা ময়ূর-মস্তকে জগৰ্জ পন্নগঃ স্বয়ম্। কবিওয়ালা সমস্যা সমাধান করে দিলেন। রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় এবং তার আগে এমনি অসম্ভব ঘটনা অনেক ঘটেছিল, বানরে গান গেয়েছে; জলে শিলা ভেসেছে। আর সত্যি কথা বলতে কি সম্পূর্ণ রামায়ণটিকে যদি কেউ এককথায় প্রকাশ করতে বলে তা হলেও বলতে হবে সেই রাম-রাবণের যুদ্ধ। এক হিন্দী কবি তাঁর এক চৌপাইতে লিখেছেন-বানে বাকী ত্রিয়া চুরাই। বানে বাসে করী লড়াঈ—সে অন্যের স্ত্রীকে চুরি করেছিল এবং অন্যজন তখন তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, একজন রাম, আরেকজন রাবণ। এই একটি ঘটনার জন্য তুলসীদাসকে অত বড় একখানা বই লিখতে হয়েছিল—তুলসীনে রচা দও পোথন্না। আমরা বলি, শুধু তুলসী কেন, ভারতবর্ষে যত প্রদেশ আছে, প্রায় সব প্রদেশেরই একখানা করে প্রাদেশিক রামায়ণ আছে, আর আছেন শতেক যুগের কবিদল, যাঁরা আদি কবির রচনাকে পুঁজি করে তাঁদের আপন কবিত্ব প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বছরের পর বছর কাজ করতে করতে গৃহভৃত্যেরও যেমন কিছু কিছু স্বাধীনতা জন্মায়, তেমনি বাল্মীকির অনুষঙ্গে অনুগামী কবিদের কবিতায় এসেছে নতুন আঙ্গিক, অভিনব রস। তাতে লাভ হয়েছে এই যে, কখনও মূল রামায়ণের থেকেও প্রাদেশিক কবিই হয়ে গেছেন প্রিয়তর। বাঙালিরা রামায়ণ বলতে যেমন কৃত্তিবাসকেই চেনে, হিন্দী বলয়ে তেমনি তুলসীদাসের প্রতিপত্তি। দখিন দেশে আবার কম্বনের রামায়ণ, তেলেগুদেশমে রঙ্গনাথনের রামায়ণ, কাশ্মীরে দিবাকর ভট্টের রামায়ণ। ওড়িশ্যা, আসাম, নেপাল, তিব্বত—সবারই নিজের মত করে একখানা রামায়ণ আছে। তবে মজা হল বিশেষ বিশেষ প্রদেশের শত কবির রূপটানে রামায়ণের ঘটনাপ্রবাহে যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন এসেছে তা কখনও চমৎকার কখনও বা অদ্ভুত কখনও অর্থহীনও বটে। এমনকি মূল বাল্মীকি রামায়ণখানাই যখন বিভিন্ন প্রদেশের প্রাদেশিক লিপিকরদের হাতে পড়ল, তখন সেখানকার সমাজ এবং ধর্মবোধ অনুযায়ী কখনও বা দু-চারটে শ্লোক বর্জিত হয়েছে, কখনও বা সংযোজিত। তার মধ্যেও আছে মহাকালের দুরভিসন্ধি। সময় যত গেছে পরিবর্তনে, পরিবর্ধনে মূল রামায়ণকে করে তোলা হয়েছে যুগোপযোগী। তাতে শুধু শ্লোকসংখ্যা নয়, শুনি নাকি পাঁচ কাণ্ডের জায়গায় রামায়ণ একেবারে সাত কাণ্ড হয়ে গেছে। আবার বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে আরও এক দঙ্গল সংস্কৃত রামায়ণও তৈরি হয়ে গেল। সেখানে মহাৱামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে আরম্ভ করে অদ্ভুত রামায়ণ, মোল্লা রামায়ণ, এমনকি দুরন্ত রামায়ণও আছে। এর ওপরে দেশ, বিদেশ, প্রদেশ, লোকগাথা এবং হাজারো কবিওয়ালাদের টানাটানিতে কেউ যদি সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসী বলে আমি তাতেও আশ্চর্য হই না, কারণ সীতা রামের বোন কি না এই নিয়ে তো এই সেদিনই হইচই হল।
অনেক পণ্ডিতই মনে করেন প্রথম স্তরে বাল্মীকি রামায়ণ রচনা আরম্ভ হয়েছিল অতি সুসংবদ্ধভাবে। রাম যে অবতার কিংবা ভগবান তার বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না, তিনি নেহাতই মনুষ্য। লেখার দিক দিয়ে কোনরকম শিথিলতা কিংবা ধর্মনীতির জয়ঘোষ কোনটাই নাকি ছিল না রামায়ণ রচনার আদিস্তরে। ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছিল রাজবাড়ির অন্তঃকলহে, ঈষার্য়, সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে; শেষ হয়েছিল রাবণ-বধে। বালকাণ্ডে রামরূপী বিষ্ণুর জন্মলীলা আর উত্তরকাণ্ডের প্রসিদ্ধ লব-কুশ উপাখ্যানের সঙ্গে রাক্ষসরাজ রাবণ আর বানরপ্রধানদের পূর্ব জীবনের কাহিনী—এ সবই নাকি পরবর্তীকালের সংযোজন। আবার মূল পাঁচ কাণ্ডের মধ্যেও রামের বিষ্ণুকল্প সাধনের জন্য খুচরো কতগুলি শ্লোক আছে যেগুলি অতি সহজেই পৃথক করে ফেলা যায়। আমাদের বিপদ হল এই যে, কালে কালে যে সংযোজনগুলি ঘটেছে তার বয়সও কম নয়, অর্থাৎ কিনা অনেক ক্ষেত্রে এই সংযোজন এবং প্রক্ষেপ ঘটেছে খ্রীস্টপূর্ব সময়ে। অপিচ ভাস, কালিদাস কিংবা ভবভূতির মত মহাকবি খ্রীস্টজন্মের এদিক-ওদিক সময়ের মধ্যেই তাঁদের প্রকৃষ্ট কাব্য-নাটকগুলি লিখেছেন এই প্রক্ষিপ্ত কাণ্ডগুলিকে অবলম্বন করেই। কাজেই কাহিনীর দিক দিয়ে অতি বৃদ্ধ এই প্রক্ষেপগুলিকে, একেবারে কিছুই নয়, বলে উড়িয়ে দিই কি করে। তবে মনে রাখতে হবে ভগবত্তা, অলৌকিকত্ব এবং ঐশ্বর্যই রামায়ণের বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড জুড়ে বসে আছে। এই ভগবত্তা বিষয়ক প্রস্তাবগুলিই কিন্তু সাত কাণ্ডে ব্যাপ্ত এক অভিনব রূপ ধরেছে প্রাদেশিক কবিদের হাতে। রামের এই ভগবত্তাই কিন্তু মূল পার্থক্যরেখা, যেটি রামায়ণের আদিস্তরকে তার বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড থেকে আলাদা করে রেখেছে, ঠিক যেমনটি আলাদা করে রেখেছে প্রাদেশিক রামায়ণগুলিকে।
সবাই জানেন, বাল্মীকির প্রধান বিশেষণ হল—তিনি ক্রৌঞ্চবিরহী কবি। তবে ক্রৌঞ্চমিথুনের মধ্যে যেটি ব্যাধের হাতে মারা পড়ল সেটি ক্রৌঞ্চী না ক্রৌঞ্চ, তা নিয়েও বিবাদ আছে। বনবাসে রাম-সীতার মধ্যে যে বিরহের ব্যবধান ঘটেছিল, সেই ঘটনার প্রতীক হিসেবেই নাকি ব্যাধের হাতে একজনের মৃত্যু। সালর্ট ভদভিল্ সাহেব থেকে আরম্ভ করে বরোদা থেকে যাঁরা রামায়ণের পরিশুদ্ধ সংস্করণ বার করেছেন, তাঁরা সবাই এই ক্রৌঞ্চবিরহ এবং প্রথম শ্লোকের উৎপত্তি কাহিনীটি বাল্মীকির জীবন থেকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্ত ক্রৌঞ্চবধের প্রসঙ্গে ‘মা নিষাদ’ বলে যে শ্লোকটি বাল্মীকির মুখ দিয়ে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল, তা বোধহয় রামায়ণের অনেক বিখ্যাত ঘটনার থেকেও বিখ্যাত। কোমলপ্রাণ কৃত্তিবাসের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু চতুর্থ খ্রীস্টাব্দের কালিদাস, ধ্বনিকার আনন্দবর্ধনের মত আলঙ্কারিক কিম্বা রাজশেখরের মত কবি মনীষীও গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে, ক্রৌঞ্চবিরহী কবির গভীর শোকই শেষ পর্যন্ত শ্লোকের আকার ধারণ করেছিল। কবিদের এই দৃঢ়মূল বিশ্বাস আমরা একেবারে হেলা করি কি করে ? তবে হ্যাঁ, কৃত্তিবাস যে দস্যু রত্নাকরকে ভক্তিরত্নাকর বানিয়ে দিয়েছেন, তার পেছনে চৈতন্যপূর্বযুগের ভক্তি আন্দোলনের হাওয়া ছিল। মূল রামায়ণে বাল্মীকির এই মন পরিবর্তনের কাহিনীটি কোথাও নেই। তা ছাড়া ‘মড়া, মড়া’ অথবা ‘মরা মরা বারংবার আবৃত্তিতে না হয় রাম হল কিন্তু সংস্কৃতে ‘মরা’ বলে যেহেতু মৃত্যুর কোন প্রতি শব্দও নেই, তাই সংস্কৃত রসনায় রাম নাম উচ্চারণ অত সহজে হবে না। দীনেশ সেনমশায় আবার বলেছেন যে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে নিজামুদ্দিন আউলিয়া বা নিজাম ডাকাতের মন পরিবর্তনের কাহিনীই কৃত্তিবাসের রত্নাকর দস্যুকে ভক্তিরত্নাকর বানিয়েছে। সে না হয় দস্যুবৃত্তির কথা নিয়ে গল্পগাথা বানানো হয়েছে, কিন্তু কৃত্তিবাস যে লিখেছিলেন ‘চ্যবনমুনির পুত্র নাম রত্নাকর। দস্যুবৃত্তি করে সেই বনের ভিতর’—এই কথাটা বড় দামি। তাছাড়া, বামুন ওঝা কৃত্তিবাস! মুসলমান ডাকাতের রূপকল্প ব্যবহার করতে যাবেন কেন? তাঁর তো বামুনপনা কম ছিল না। স্কন্দ পুরাণে বাল্মীকি এক জায়গায় বলেছেন যে, তাঁর শৈশব এবং যৌবন কেটেছিল বনবাসী কিরাত আর অনার্যদের সঙ্গে। আর্যদের পরিশীলিত শিক্ষা তাঁর জীবনে ছিল না, ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় তাঁর মত পরিবর্তন হয়েছে অনেক পরে। কৃত্তিবাস যখন তাঁর রামায়ণ লিখেছেন, তখনকার বিদ্বৎসমাজে পুরাণগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কৃত্তিবাস তাই স্কন্দ পুরাণের তথ্যটি মূলত অবহেলা করতে পারেননি। তাছাড়া খোদ রামায়ণের মধ্যেই একদিকে নিষাদরাজ গুহক, বানর এবং রাক্ষসদের সঙ্গে রামের গভীর মেলামেশা এবং অন্যদিকে পরবর্তী উত্তরকাণ্ডে শূদ্র শম্বুকের তপশ্চরণে রামের ক্রোধ—এ সব কিছু বাল্মীকির আপন জীবনেরই প্রতিফলন নয় তো ? আরেক কথা। প্রাদেশিক ভাষার অন্য রামায়ণগুলি একবারের তরেও বাল্মীকিকে ‘চ্যবনমুনির পুত্র’ বলেনি। অথচ রামায়ণ রচনার ব্যাপারে মহর্ষি চ্যবনের প্রসঙ্গ এসেই পড়ে। একেবারে প্রথম খ্রীস্টাব্দের কবি অশ্বঘোষ তাঁর ‘বুদ্ধচরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন—চ্যবনমুনিই নাকি রামায়ণ রচনা আরম্ভ করেছিলেন কিন্তু এ কাজ তাঁর পক্ষে শেষ করা সম্ভব হয়নি। কাজটি সুসম্পন্ন করেন বাল্মীকি—বাল্মীকিরাদৌ চ সসৰ্জ পদ্যং জগ্রন্থ যন্ন চ্যবননা মহর্ষিঃ ॥ পণ্ডিতেরা আবার বলেন যে, উইঢিবির গপ্পোটা চ্যবনের ব্যাপারেই প্রথম উল্লিখিত হয়েছে মহাভারতে। কাজেই একই ভার্গববংশের চ্যবন আর বাল্মীকির মধ্যে যে একটা সম্পর্ক কৃত্তিবাস বার করেছেন, সেটা খুব ফেলনা নয়।
যাই হোক আমরা রামলীলার আসরে বসে কবিওয়ালাদের জীবনচর্যা আরম্ভ করেছি; তবে তার প্রয়োজন এইটুকুই যে, এঁদের পথ ধরেই আমাদের রামলীলার আসরে প্রবেশ করতে হবে। রামের জন্মকথা দিয়েই যদি রামকাহিনী আরম্ভ করি তবে তারও পূর্বকথা আছে। আছেন মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ, যার অমৃতপরশে ‘পতিতারা’ পর্যন্ত নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করেছে। মজা হল, কার্যসিদ্ধি করার জন্য গণিকা নিয়োগ করে কাওকে ভুলানো—এই অতি আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার ইতিহাসে বোধহয় প্রথম করেছেন বাল্মীকি। রাজকার্য সিদ্ধির জন্য তিনিই প্রথম বারাঙ্গনাদের পাঠিয়েছিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে ভোলাতে। রামায়ণ সমাজের নীতিবাগীশ লোকেরা বাল্মীকির এই আচরণে অখুশি হননি, অখুশি হইনি আমরাও। বাল্মীকির বারাঙ্গনারা নারী-পুরুষের ভেদ-জ্ঞানহীন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে ভোলাতে ফলের বদলে মিষ্টি খাইয়েছিল আর দিয়েছিল কোমল বাহুর আলিঙ্গন—ততস্তা স্তং সমালিঙ্গ্য সব হর্ষসমন্বিতাঃ। মোদকান্ প্রদদুস্তস্মৈ⋯। কৃত্তিবাস কিন্ত বারাঙ্গনার বিষয় পেয়ে অল্পেতে খুশি হননি। বেশ্যাদের মধ্যে যেমন বয়স্কা ‘মাসি’ থাকে তেমনি এক বুড়ির আমদানি করেছেন। ঘটনা এগিয়েছে তারই ব্যবস্থাপনায়। ঋষ্যশৃঙ্গের পালকপিতা বিভাণ্ডক ফিরে এলে শৃঙ্গী মুনির মুখ দিয়ে বারাঙ্গনাদের অঙ্গবর্ণনার একটা বাতুল চেষ্টাও কৃত্তিবাস দেখিয়েছেন। অবোধ মুনির ভাষায় বারাঙ্গনাদের পয়োধর—‘বেলের মতন দুটা মাংসপিণ্ড বুকে’ এবং তাতে যদি হস্তটি করাই পশন। স্বর্গবাস হাতে পাই হেন লয় মন’।। এতে বুঝি কৃত্তিবাস অবোধর মনেও কেমন একটা বোধ আনতে চেয়েছেন। ভক্তিতে গদ্গদ তুলসীদাস কিন্তু বারাঙ্গনার প্রসঙ্গে ভীষণ সঙ্কুচিত। ঋষ্যশৃঙ্গের সমস্ত গল্প উহ্য রেখে তিনি তাকে সোজাসুজি দশরথের রাজসভায় নিয়ে এসেছেন একটিমাত্র পঙ্ক্তিতে—সৃঙ্গী রিষিহি বসিষ্ঠ বোলাবা। পুত্রকাম সুভ জজ্ঞ করাবা ॥ ঠিক একই কায়দা কম্ব রামায়ণেও, যদিও রঙ্গনাথের তেলেগু রামায়ণে গল্পটি ঠিক আছে। ঋষ্যশৃঙ্গের আসল পরিচয় কিন্তু তিনি দশরথের জামাই। চার ছেলের অনেক আগে দশরথের মেয়ে হয়েছিল, তার নাম শান্তা। দশরথের কোন স্ত্রীর গর্ভ থেকে তার জন্ম, কন্যা-জন্মের অবহেলায় তা উপেক্ষা করেছেন বাল্মীকি এবং দশরথও তাকে দত্তক দিয়েছিলেন বন্ধু লোমপাদের হাতে। তিনিই তাকে মানুষ করেছেন এবং বিয়েও দিয়ে দিয়েছেন ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে। ‘বংশকর’ পুত্রের জন্য শেষ পর্যন্ত এই অবহেলিত কন্যার বরকেই প্রণাম করে যজ্ঞের কাজে বরণ করতে হল দশরথকে—ততঃ প্রণম্য শিরসা তং বিপ্রং দেববর্ণিনম্। যজ্ঞায় বরয়ামাস সন্তানার্থং কুলস্য চ॥
বাল্মীকিতে দেখি শৃঙ্গী মুনির যজ্ঞ থেকে যজ্ঞপুরুষ আবির্ভূত হয়ে দশরথের হাতে দিব্য পায়স প্রদান করলেন। এই যজ্ঞপুরুষকে কৃত্তিবাস বলেছেন বিষ্ণু বলে, তুলসী একে ভেবেছেন অগ্নি আর কম্ব রামায়ণে পায়সের পাত্র হাতে যে উঠে এল সে নাকি একটা ‘ভূত’। ‘অমৃতপিণ্ড’টি রেখেই সে মিলিয়ে গেছে আগুনে। এরপর পায়েসের ভাগাভাগি নিয়েও নানা মুনির নানা মত। প্রথমেই মনে রাখা দরকার মহারাজ দশরথের পত্নীক্রমে কৈকেয়ী যে মেজোরানী, সে ধারণাও আমাদের হয়েছে কৃত্তিবাসের কল্যাণে। মূল রামায়ণ অনুযায়ী কৈকেয়ী দশরথের ছোটরানী, রাম তাঁকে বলেছেন ‘জননী মে যবীয়সী’। কৈকেয়ী কেকয়দেশের পাঞ্জাবী মেয়ে এবং রাজার বুড়ো বয়েসের বউ বলেই রাজার প্রাণের থেকেও প্রিয়তবা—স বৃদ্ধ স্তরুণীং ভার্যাং প্রাণেভ্যো’পি গরীয়সীম্।
দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞের পর রানীদের চরু খাওয়ানোর সময়ে দেখি দশরথ কৌশল্যাকে সমস্ত চরুর অর্ধেকটা দিয়েছেন। যে অর্ধেক থাকল তারও অর্ধেকটা আগেই দিলেন সুমিত্রাকে—অর্ধাদর্ধং দদৌ চাপি সুমিত্রায়ৈ নরাধিপঃ। এতেও বুঝি তিনিই মেজোরানী। এবার যে অর্ধেক থাকল, তাও পুরোটাই দশরথ কৈকেয়ীকে দেননি। দিয়েছেন তারও অর্ধেক। যেটুকু হাতে রেখেছিলেন, সেটুকু বেশ চিন্তাভাবনা করে শেষ পর্যন্ত সুমিত্রাকেই দিলেন—অনুচিন্ত্য সুমিত্রায়ৈ পুনরেব মহামতিঃ। আমাদের ধারণা দশরথ কনিষ্ঠা কৈকেয়ীর প্রতি অত্যাসক্ত ছিলেন বলেই মনে মনে হয়তো কিছু পাপবোধ ছিল, কিন্তু পুত্রজন্মের ব্যাপারে সুমিত্রাকে তিনি ধর্মত এড়িয়ে যেতে চাননি। আর এই যে সুমিত্রাকে দুবার চরু দেওয়া হল তারই সূত্র ধরে প্রাদেশিক রামায়ণকারেরা গপ্পোটাকে তাঁদের ছাঁচে সাজিয়ে নিলেন। কৃত্তিবাসের বর্ণনায় দশরথ কিন্তু চরুহাতে মধ্যযুগীয় বাঙালি বাড়ির বড়ঠাকুরের মত ভেতর-ঘরে এসেছেন এবং সামনে কৌশল্যা এবং কৈকেয়ীকে দেখে অর্ধেক অর্ধেক পায়েস দিয়েই ফিরে গেছেন বড়বাবুর মত। মজা হল দিবাকর ভট্টের কাশ্মীরী রামায়ণেও দশরথের ব্যবহারটা বাঙালি বড় কতার্র মতই। রুচিশীল তুলসীদাস আবার বাল্মীকির ভাগাভাগিটা ঠিক রেখেছেন কিন্তু দশরথ পায়েসটা কৌশল্যা আর কৈকেয়ীর হাতে দিয়ে তাঁদের দিয়েই। সুমিত্রার হাতে দেওয়ালেন—কৌসল্যা কৈকঈ হাথ ধরি। দীনহ্ সুমিত্রহি প্রসন্ন করি। আমাদের কৃত্তিবাস কিন্তু সুমিত্রাকে একেবারেই এলেবেলে করে দিয়েছেন। তাঁকে রাজা একফোঁটাও পায়েস দেননি। কোথা থেকে ‘ঊর্ধ্বশ্বাসে’ ছুটে এসে তিনি দেখলেন পায়েসের ভাগাভাগি শেষ। শেষ পর্যন্ত দয়াবতী কৌশল্যা অর্ধেকটা পায়েস দিলেন এই আশ্বাসে যে সুমিত্রার ছেলে তাঁর ছেলের সঙ্গী হবে। আর কৈকেয়ীর ওপর কৃত্তিবাসের যেন জন্মরাগ। কৌশল্যার কায়দা দেখেই যেন ‘ক্রূরমতি’ কৈকেয়ী সুমিত্রাকে আধভাগ চরু দিয়ে তাঁর ছেলের জন্য একজন দেহরক্ষী ঠিক করে রাখলেন। সুমিত্রাও প্রতিজ্ঞা করলেন—‘তোমার পুত্রের দাস আমার নন্দন’।
আসলে প্রাদেশিক কবিদের মুশকিল হল, বাল্মীকি রামায়ণের ভবিষ্যৎ তাঁদের আগে থেকেই জানা। অতএব তাঁদের রামায়ণের আবহ তৈরি হয়েছে সেইভাবেই। একই কারণে এমন কোন কথা তাঁরা বলতে চাননি যাতে প্রসিদ্ধ চরিত্রের গায়ে কলঙ্কের লেশমাত্র লাগে কিম্বা সুকুমারমতি পাঠকের ভক্তিভাবনায় আঘাত লাগে কোন। সুমিত্রার দুই ছেলে অন্য দুই রানীর পুত্রদের চিরসঙ্গী। সুমিত্রার এই দুর্ভাগ্যের পূর্ব কারণ হিসেবে কৃত্তিবাস যা বলেছেন তা কিন্তু সেই মধ্যযুগীয় বাঙালির চিরন্তন বিশ্বাসের কথা। দশরথ নাকি কৌশল্যা আর কৈকেয়ীকে লুকিয়ে লুকিয়ে সুমিত্রাকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন সিংহল দেশে। মূল রামায়ণে কিন্তু সুমিত্রার পিতৃপরিচয় জানাই যায় না। শুধু কালিদাস বলেছেন যে সুমিত্রা মগধের মেয়ে। যাই হোক কৃত্তিবাসকল্পিত সেই সিংহলে গিয়ে দশরথ আপন কুলের বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ, শুভদৃষ্টি, শয্যাতোলানি, বাসি বিয়ে—সব একেবারে বাঙালিমতে করেছেন। কিন্তু সুমিত্রাকে নিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসবার পথে রাজা সুমিত্রার রূপ দেখে আর থাকতে পারলেন না—বিলম্ব না সহে রাজা করে ইচ্ছাচার। রথের উপরে রাজা করেন শৃঙ্গার ॥ কৃত্তিবাসের মতে, সেদিন ছিল বাসিবিয়ের দিন এবং কালরাত্রি; এইদিনে এত সব কাণ্ড করার ফলেই নাকি সুমিত্রা দুভাগা হয়েছেন, তাঁর ছেলেগুলোও তাই খালি বাইরে বাইরে থাকে। এই একটিবার মাত্র কৃত্তিবাস দশরথের ধৈর্যচ্যুতির বর্ণনা দিয়েছেন এবং তাও সে দোষে দশরথের কিছু হয়নি, দুর্ভাগা হয়েছেন সুমিত্রা।
যা হোক দুর্ভাগা সুমিত্রারও ছেলে হয়েছে বাল্মীকি রামায়ণে, সে ছেলে দুটি রাম আর ভরতের পেছন পেছন ঘোরে এবং তাতে সুমিত্রারও কোন কষ্ট নেই। সব ছেলেরই নামকরণ, চূড়াকরণ বেদবিধি অনুসারে ক্রমে ক্রমে যেমন চলতে থাকল, তেমনি প্রাদেশিক কবিরাও থেমে থাকলেন না। যে কবির কাছে যৌবনকালটাই বেশি রসঘন, তিনি রামের যৌবনটি তুলে রাখলেন অনুকূল সময়ের জন্য, আর সেই অবসরে তুলসীদাস রামের বাল্যলীলায় মিশিয়ে দিলেন গোপালকৃষ্ণের শৈশব-লীলার মায়া। নিঃসন্দেহে তুলসীদাসের উৎসমুখ ছিল অধ্যাত্ম-রামায়ণ, যে রামায়ণ ভাগবত-পুরাণের কায়দায় রামের জন্মকালে কৌশল্যার মুখে দেবকীর বিষ্ণু-স্তুতি বসিয়ে দিয়েছেন, যে রামায়ণ রামের বাল্যলীলা বর্ণনা করেছে যশোদাদুলালের ছাঁচে ফেলে। তুলসীদাসের কৌশল্যা যখন রামের নাম ধরে ডাকেন, রাম তখন নেচে নেচে পালান—কৌসল্যা জব বোলন জাই। ঠুমুকি ঠুমুকি প্রভু চলহি পরাঈ ॥ এ থেকেই রাগপ্রধানীরাও গান ধরলেন—ঠুমক চলত রামচন্দ্র⋯। আগম, নিগম, শিব যাঁকে তন্ন তন্ন করে খোঁজে তাঁকে রাম-জননী ধরতে যান দৌড়ে। ভাগবতে দামবন্ধনের আগে ঠিক একই রকমভাবে কৃষ্ণের পেছনে দৌড়েছিলেন যশোদা—গোপী অন্বধাবন্ ন যমাপ যোগিনাং/ক্ষমং প্রবেষ্টুং তপসেরিতং মনঃ। তুলসীর রামায়ণে ধুলায় ধূসর রামকিশোরকে দেখতে পাই পরম প্রশ্রয়ী দশরথের কোলে; ক্ষণে ক্ষণে বাল্যচপল রামচন্দ্র দই-ভাত-জ্যাবড়ানো মুখেই খল খল করে হেসে ছুটে পালায়—ভাজি চলে কিলকত মুখ/দধি-ওদন লপটাই।
ক্ষত্রিয় শিশুর এই দুধেভাতে ল্যাপটানো মুখের ছবি মহাকবি বাল্মীকির কল্পনাতেও ছিল না, যার জন্য পুত্রজন্মের উৎসব মিটতে না মিটতেই মহাতেজা বিশ্বামিত্রের আগমন ঘটেছে বাল্মীকির রামায়ণে। ক্ষত্রিয়পুত্রের বীরত্ব-পরীক্ষার সময় এসে গেছে পুত্রজন্মের পরের সর্গেই। বিশ্বামিত্র দশ দিনের জন্য নিয়ে যেতে চাইলেন রামকে। পনের বছরের ছেলেকে যুদ্ধ জয় করার জন্য পাঠাতে বৃদ্ধ পিতার মনে যে আশঙ্কা থাকে বাল্মীকির দশরথের মনেও সেই ব্যাকুলতা জেগেছিল। মহর্ষি বশিষ্ঠের পরামর্শে সে ব্যাকুলতা রাজোচিত ঔদার্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কৃত্তিবাসের দশরথ বিশ্বামিত্রের ভয়ে রামলক্ষ্মণের নাম ভাঁড়িয়ে পরিবর্তে ভরত-শত্রুগ্নকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের কাছে, ভরত-শত্রুঘ্নের ক্ষাত্রবীর্য যে তাতে লঘু হল, সে চিন্তা কৃত্তিবাসের নেই। তুলসীদাস কম্বন কি রঙ্গনাথ—এঁরা সবাই যদিও এক্ষেত্রে বাল্মীকির অনুযায়ী, কিন্তু তাড়কা বধের ঘটনাটি,তাঁরা অল্পকথায় সেরে দিয়েছেন, তাড়কাবধও করেছেন এক নিমেষে। কৃত্তিবাস বিশ্বামিত্রের পূর্বাশ্রমের ক্ষাত্ৰতেজ এবং উত্তরকালের ব্রাহ্মণ্যের মাথায় জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে তাড়কার ভয়ে ভীতু এক ব্রাহ্মণ-বটু তৈরি করেছেন। তাড়কাকে একবারের তরে দেখিয়ে দিয়েই তিনি দৌড়ে পালান, যদিও মূল রামায়ণে তিনি শেষ পর্যন্ত রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে থাকেন এবং উপদেশ দেন।
রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে পথে যেতে যেতে বিশ্বামিত্র পৌঁছোলেন গৌতম মুনির আশ্রমে, যেখানে পাষাণী হয়ে আছেন অহল্যা। অহল্যার কাহিনীটি বাল্মীকি যেমন মুক্তকণ্ঠে বর্ণনা করেছেন, সেই রকম বর্ণনা করার সাহসই পাননি কোন কবি। সমস্ত প্রাদেশিক কবিরাই তামাম দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন ইন্দ্রের ঘাড়ে, যিনি অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন। অন্যদিকে অহল্যা হয়ে গেছেন সরলা সতীলক্ষ্মীর প্রতীক, ‘মহাপাতকনাশিনী’ পঞ্চকন্যার মধ্যে যাঁর নাম স্মরণ করতে হয় প্রথমে—অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা। পঞ্চকন্যাং স্মরেন্নিত্যং মহাপাতকনাশিনীম্ ॥ মূল রামায়ণে অহল্যা গৌতমের শাপে পাষাণী হননি, মুনির কোপাগ্নিতে এবং অনুতাপে তিনি হয়েছিলেন ভস্মশায়িনী, সকলের অদৃশ্যা—বাতভক্ষ্যা নিরাহারা তপন্তী ভস্মশায়িনী। অদৃশ্যা সর্বভূতানাং আশ্রমে’স্মিন্ বসিষ্যসি। রাম আশ্রমে আসামাত্রই অদৃশ্যা অহল্যা তপঃপ্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন অথচ প্রাদেশিক রামায়ণগুলির সর্বত্রই অহল্যা হয়ে গেছেন পাষাণী, এবং এর উৎস বোধহয় মহাকবি কালিদাস, যিনি প্রথম বলেছিলেন, ‘গৌতমবধূঃ শিলাময়ী’। অহল্যার কাহিনী নিয়েও মূল রামায়ণের সঙ্গে দেশজ রামায়ণগুলির পার্থক্য বিস্তর। বাল্মীকির মতে, অহল্যা তিন ভুবনের সেরা সুন্দরী। বিধাতা তাঁকে সৃষ্টি করে এমন বিপদে-পড়েছিলেন তাঁকে রাখবার জায়গা পর্যন্ত পাচ্ছিলেন না। শেষে জিতেন্দ্রিয় গৌতম মুনির কাছে তাঁকে রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দেন। বাল্মীকি লিখেছেন—অহল্যার এমন রূপ যে আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে ‘মায়াময়ী’ বলে মনে হত—দিব্যাং মায়াময়ীমিব। বিবাহিতা অহল্যা যখন ঘোমটার আড়ালে চলে গেছেন, ঠিক এই সময়েই গৌতমের ছাত্র ইন্দ্রের প্রবেশ। ইন্দ্র অহল্যার রূপে মোহগ্রস্ত কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পান না গুরুপত্নীর সঙ্গে নির্জনে সঙ্গত হবার। রঙ্গনাথ রামায়ণ লিখেছে—ইন্দ্র নাকি গৌতম মুনির তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য তার পত্নীকে কলুষিত করেছেন; বাল্মীকি রামায়ণে দেবসভায় আপন লজ্জা ঢাকার জন্য এইরকম একটা কথা প্রচার করেছিলেন মাত্র। রঙ্গনাথের রামায়ণে ইন্দ্র মুরগীর রূপ ধরে কোঁকর-কোঁ ডেকে গৌতম-গুরুকে ভোরবেলার সঙ্কেত দিচ্ছিলেন। মুরগীর ডাক শুনে মুনি ব্যস্তপদে সন্ধ্যাআহ্ণিক করার জন্য বেরোলেন। সুযোগ বুঝে মনের বাসনা মেটাতে ইন্দ্ৰ গৌতম মুনি সেজে অহল্যার সঙ্গে মিলিত হলেন। মজা হল, অহল্যা কিন্তু ইন্দ্রকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং এ-তথ্যটি বাল্মীকি রামায়ণেও আছে। তামিলভাষী কম্বনও মূল থেকে বেশি সরে আসেননি, যদিও আশ্রম থেকে পালাবার সময় ইন্দ্র এখানে পালিয়ে গেছেন বেড়ালের রূপ ধরে। আমাদের কৃত্তিবাসে কিন্তু এসব মুরগী কিম্বা বেড়ালের উৎপাত নেই, সমস্ত দোষই এখানে ইন্দ্রের। মধ্যযুগের সতীধর্মের বিড়ম্বনায় ইন্দ্ররূপী নকল গৌতমের শৃঙ্গারেচ্ছামাত্র অহল্যা ‘তখনি শয়নগৃহে করিল গমন’। আসল গৌতম এসে অসময়ে আপন স্ত্রীর এলোথেলো চুল উতলা আঁচল দেখে সন্দেহ প্রকাশ করতেই অহল্যা সরলভাবে জবাব দেয়—‘আপনি করিয়া কর্ম দোষহ আমারে।’ প্রিয় শিষ্যের ‘গুরুদক্ষিণা’ দেবার ঢঙ দেখে গৌতম তাকে শাপ দিলেন। তার সমস্ত শরীর স্ত্রী-চিহ্নে ভর্তি হয়ে গেল। মুনির শাপে অহল্যাও হলেন পাষাণী। মুনির লজ্জাই যেন প্রস্তরের রূপ নিল।
বাল্মীকি রামায়ণে কিন্তু অহল্যার ঘটনাটি অনেক বেশি বাস্তবানুগ, অনেক বেশি সত্যি। আধুনিক বাগধারায় ‘বিছানায় শোয়া’ শব্দটি অত্যন্ত খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হলেও ওই একই অর্থে ‘গুরুতল্পগ’, কিম্বা ‘গুরুতল্পগামী’ শব্দগুলি সেকালেও লক্ষ করার মত। ‘তল্প’ মানে বিছানা; ‘গুরুতল্পগামী’ বলতে বোঝায় তাকেই, যে গুরুর বিছানায় গুরুপত্নীর সঙ্গে সঙ্গত হয়। একটা সাধারণ কথা আগে বলে নেওয়া ভাল। সেটা হল, সেকালের দিনে গুরু-শুশ্রূষা যতই চালু থাক, গুরুপত্নীর শুশ্রূষা একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। স্বয়ং মনুর মতে গুরুপত্নীকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করতে হবে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গুরুপত্নীর পা-ছোঁয়া পর্যন্ত বারণ, খুব বেশি হলে তাঁর পায়ের কাছে মাটি খামচে ধরে নিজের নাম বলে প্রণাম করা যায়। মনু আরও অনেক কথা বলেছেন, তবে গুরুপত্নীর ব্যাপারে এত যে কড়াক্কড়ি, তাতে আমাদের এই বিশ্বাস জন্মেছে যে সেকালের অনেক দুবার শিষ্যেরা গুরুসেবার সঙ্গে সঙ্গে গুরুপত্নীদেরও কিছু সেবা করার চেষ্টা করত। এই সেবার চরম পরিণতি ছিল ‘গুরুতল্পগমন’ অথাৎ গুরুর বিছানায় উঠে পড়া। আসল কথা সেকালের দিনে ঐহিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষাতে ব্রাহ্মণেরাই গুরু হতেন এবং বিদ্যার গৌরবে শুষ্ক রুক্ষ বয়স্ক মুনিদেরও সরসা তরুণী বউ জুটে যেত। কখনও বা রুদ্ধযৌবন মুনিদের দৃষ্টি পড়ে যেত রাজা-রাজড়ার সুন্দরী কন্যাদের দিকেও। অভিশাপের ভয়ে রাজারাও বাধা দিতেন না, এমন দৃষ্টান্তও আছে অনেক। অতএব বিয়েও হত, পুত্ৰাদিও হত, কিন্তু বয়স্ক গুরুর যুবতী স্ত্রীদের মন বলে যে জিনিসটা থাকত, সেটার গতিবিধি সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ গুরুরা অনেক সময়ই খেয়াল করতেন না। কিন্তু যুবতী স্ত্রীদেরই সমানবয়সী যুবা ছাত্র-শিষ্যেরা সেই মনের ব্যাপারে অনবহিত থাকবেন কেন। মনু বারবার তাই যুবা শিষ্য এবং যুবতী গুরুপত্নী সম্বন্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। বাস্তবে কিন্তু, এই সব যুবা-শিষ্যদের সন্ধানী দৃষ্টি প্রায়ই অন্তরালবর্তিনী গুরুপত্নীকে অভিষিক্ত করত এবং কুত্রাপি প্রতিদানও মিলত।
আমাদের ধারণা, ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে বাল্মীকি রামায়ণের অহল্যার কাহিনীতে। সময়টা সকালবেলাই বটে। মহর্ষি গৌতম স্নানে গেছেন। কিন্তু সেই সাত সকালেই অহল্যার মনে কেমন রঙিন নেশা লেগেছিল। সেই সকালেই তিনি শৃঙ্গারোচিত সাজসজ্জায় শিঙার করে বসেছিলেন, অন্তত রামায়ণের তিলকটীকা তাই লিখেছে—‘সঙ্গমোচিতরূপ-প্রসাধনবতি’। সময় বুঝে ইন্দ্র মুনির বেশে প্রবেশ করলেন পর্ণশালায়। বললেন—শৃঙ্গারী ব্যক্তির সময়-অসময় নেই—সঙ্গমং তু অহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে। বাল্মীকি লুকোননি; অহল্যা মুনিবেশী ইন্দ্রকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন, বহুকাল ধরে ইন্দ্র তাঁকে মনে মনে চান—বহুকালম্ অভিলাষশ্রবণাৎ (টীকা গোবিন্দরাজ)। তা হলে ধরা দেবেন বলেই কি তিনি সেজেগুজে বসেছিলেন ? নিজের অলোকসামান্য রূপ এবং দেবতাদের রাজা সেই রূপের ভিখারি—এমন একটা আপ্লুতিই তাঁকে পেয়ে বসল, আর্ষরতির চেয়ে শৃঙ্গার কুশল দেবরাজের রমণেচ্ছাই তাঁর কাছে প্রিয়তরা মনে হল—দিব্যরতিকৌতুকাৎ। “এতকাল গুণের সেবা করিয়াছি, এখন কিছু রূপের সেবা করিব”— এই ভাবনায় শুধুমাত্র দেবরাজের রসরতি আস্বাদনের জন্যই অহল্যার ধৈর্য নষ্ট হল, তিনি মিলিত হলেন ইন্দ্রের সঙ্গে—মতিং চকার দুর্মেধা দেবরাজকুতূহলাৎ। স্ত্রীলোকের ব্যাপারে ইন্দ্র চিরকালই দুর্বল, বহুবাসনায় প্রাণপণে যা চেয়েছিলেন, আজ তাই তৃপ্ত হল। তিনি আজ কৃতার্থ। আর অহল্যা! কালিদাস লিখেছেন, ক্ষণকালের জন্য হলেও তিনি যেন ইন্দ্রের পত্নীপদ লাভ করেছিলেন—বাসবক্ষণকুলত্রতাং যযৌ। ব্যঞ্জনা-মুখর কবির শব্দচয়নেই বোঝা যায় যে ব্যাপারটা অহল্যার অমতে হয়নি। কিন্তু কম্বন, কৃত্তিবাস কি রঙ্গনাথ যে অহল্যার কথা লিখেছেন, সেই অহল্যা বাল্মীকি রামায়ণে কি করল জানেন ? রতিমুক্তির প্রবল উচ্ছ্বাসে আনন্দে দেবরাজকে আপ্লুত করে অহল্যা বললেন—আমি আজ কৃতার্থ হয়েছি, সুরশ্রেষ্ঠ। এখন আমি এবং আপনি দুজনেই যাতে এই নিন্দাপঙ্ক থেকে উদ্ধার পাই, সেইজন্য এই মুহূর্তে আপনি পালান—কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গুচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো। গোপন প্রণয়ীকে পার করে দেওয়ার অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হল না। মহর্ষি গৌতমবেশী ইন্দ্রকে ধরে ফেললেন এবং শাপ দিলেন যে, এই অপকর্মের ফলে ইন্দ্রের অণ্ডকোষই খসে পড়বে—বিফলঃ ত্বং ভবিষ্যসি। হলও তাই। সাবধানী প্রাদেশিক কবিরা ইন্দ্রের সারা গায়ে সহস্র স্ত্রী-চিহ্ন এঁকে দিয়ে আবার তাঁকে দিয়েই অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়ে সহস্র স্ত্রী-চিহ্নের পরিবর্তে ইন্দ্রের সহস্রলোচনের ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু বাল্মীকিতে ইন্দ্রকে ‘সফল’ করার জন্য মেষের অণ্ডকোষ জুড়ে দিতে হয়েছে, যার জন্য তাঁর নাম হয়ে গেছে ‘মেষবৃষণ’।
গৌতম মুনির পর্ণশালায় পায়ের ধুলো পড়তেই ভস্মশয্যা ছেড়ে আলোর মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন অহল্যা, এবং বাল্মীকি রামায়ণে অহল্যা উদ্ধারের পরেই রাম-লক্ষ্মণ-বিশ্বামিত্র তিনজনেই রওনা দিয়েছেন মিথিলার রাজসভার উদ্দেশে। মাঝখানে পাটনী-মাঝির নৌকোখানা যে রামের পায়ের জাদুস্পর্শে সোনা হয়ে গেল,সে গল্প কৃত্তিবাসেই আছে, বাল্মীকিতে নেই। মিথিলায় জনকনন্দিনী সীতার বিবাহ, ধনুর্ভঙ্গ পণ। বাল্মীকি রামায়ণে এই রাজসভাতেই কথিত হয়েছে বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠের বিবাদ-বিসংবাদের কথা এবং বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণ্যপ্রাপ্তির কথাও। এই দুটি গল্পই পণ্ডিতেরা প্রক্ষিপ্তবাদের গহ্বরে ঠেলে দিয়েছেন বটে, তবে এর মধ্যে যে ঐতিহাসিকতার পুঁজি লুকানো আছে তা ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ প্রবন্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। আমরা অবশ্য এখন সোজাসুজি জনকের বিবাহসভায় উপস্থিত হব। কৃষিক্ষেত্রে লাঙলের ফলকে ওঠা সীতার জন্ম নিয়ে কৃষিবিস্তারের রূপক সিদ্ধ হয়েছে অনেক দিনই এবং হলের মুখে সীতার জন্ম নিয়ে প্রাদেশিক রামায়ণগুলির মধ্যেও সম্পূর্ণ ঐকমত্য আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম দিবাকর ভট্টের কাশ্মীরী রামায়ণ। এই রামায়ণের মতে সীতা হলেন রাবণ-পত্নী মন্দোদরীর মেয়ে। পূর্বে মন্দোদরী ছিলেন স্বর্গের হুরি এবং তিনি রাবণের বিনাশের জন্যই রাবণের বউ হয়ে জন্মান। রাবণ তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন বটে, তবে রাবণের অবর্তমানে, এমনকি অজান্তেই মন্দোদরীর এক মেয়ে হয়। মেয়ের ঠিকুজি-কুষ্ঠি বিচার করে জানা যায় যে, সে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং এই মেয়েকে যদি বিয়ে করার সুযোগ দেওয়া হয় তা হলে সে বিয়ে করবে এক বনবাসীকে। কিন্তু সেই বন থেকেই সে আবার লঙ্কায় আসবে লঙ্কার ধ্বংস সাধন করতে। এ সব কথা শুনে মন্দোদরী মেয়ের গলায় পাথর বেঁধে ফেলে দেন নদীতে। কিন্তু এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়। ভাসতে ভাসতে সে মিথিলার চাষের জমিতে এসে ঠেকল। সেখান থেকেই জনক সীতাকে তুলে নিয়ে আসেন। এর পরের ঘটনা অন্যান্য রামায়ণের মতোই। মন্দোদরী কোনদিন রাবণকে নিজের পেটের মেয়ের কথা বলতে পারেননি এবং যেদিন রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে এলেন, সেদিন আর কেউ না হোক মন্দোদরী কিন্তু মেয়েকে চিনেছিলেন। রাবণের কাছে অবশ্য এ সব প্রসঙ্গ তিনি তোলেননি, কিন্তু তাঁকে সাধারণভাবে যথেষ্ট সাবধান করেন। সীতা যে মন্দোদরীর মেয়ে এ কথা বাল্মীকি রামায়ণ একবারও বলেনি তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বিশেষ খেয়াল করা দরকার। বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অগস্ত্য রামকে রাবণের পূর্বজীবনের কাহিনী শোনাচ্ছিলেন। তিনি বললেন—পুরাকালে বেদবতী নামে এক অতি সুন্দরী তপস্বিনী বিষ্ণুকে বর হিসেবে পাওয়ার জন্য হিমালয় পর্বতের কাছে এক জায়গায় তপস্যা করছিল। ভুবনবিজয়ী রাবণ ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে তাঁর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাঁকে বলাৎকার করতে উদ্যত হন। বেদবতী সক্রোধে বললেন—সামনের জন্ম তোকে বধ করার জন্য আবার আমি জন্মাব—তস্মাৎ তব বধার্থং হি সমুৎপশ্যাম্যহং পুনঃ। বেদবতী তখনকার মত অনলপ্রবেশ করলেন বটে তবে তিনি পরজন্মে এক পদ্মফুল থেকে সুন্দরী মেয়ে হয়ে জন্মালেন। সেই সুন্দরীকে দেখে রাবণ তাকে নিয়ে গেলেন লঙ্কায়। ভবিষ্যদ্বক্তা মন্ত্রীরা রাবণকে বললেন—এই মেয়ে ঘরে থাকলে ভীষণ বিপদ হবে। রাবণ তখন সেই সুন্দরীকে ভাসিয়ে দিলেন সাগরজলে। সেই মেয়েটিই জনকের যজ্ঞভূমির মাঝে এসে স্থান নিল—সা চৈব ক্ষিতিমাসাদ্য যজ্ঞায়তনমধ্যগা। জনকের হলের মুখে সে আবার পুনঃপ্রকটিত হল।
দেখা যাচ্ছে সীতার জন্ম যে ভাবেই হোক না কেন, লঙ্কা এবং রাবণের সঙ্গে তাঁর একটা পূর্বসম্বন্ধ বাল্মীকি রামায়ণও অস্বীকার করে না। অদ্ভুত রামায়ণ বলে যে রামায়ণটি পাওয়া যায় এবং যে রামায়ণ থেকে কৃত্তিবাস তাঁর অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেই রামায়ণেও কিন্তু সীতা মন্দোদরীরই মেয়ে। এখানকার ঘটনা অবশ্য আরও কৌতুকজনক এবং এই কন্যাজন্মের ব্যাপারে রাবণ পরোক্ষভাবে জড়িত। এখানে যেরকম অলৌকিকভাবে মন্দোদরীর গর্ভসঞ্চার হল সেই কথাটা সংক্ষেপে বলি। সেই রাবণ যখন অমরত্বের জন্য তপস্যা করছিলেন তখন ব্রহ্মা এসে তাঁকে ‘অমরত্ব’ ছাড়া আর যে কোন বর চাইতে বললেন। রাবণ মানুষকে শুধু ‘খাবার’ ভেবে অবহেলা করে অন্য সবার হাতে যাতে মরণ না হয় সেই বর চেয়ে নিলেন। অতি কামুক রাবণ নিজেকে চিনতেন বলে আরও একটি বর চাইলেন ব্রহ্মার কাছে। তিনি বললেন—আমি যদি কোনদিন নিজের মেয়েকে কামসাধনের জন্য প্রার্থনা করি এবং সে কন্যার যদি তাতে মত না থাকে, তা হলে সেই পাপেই যেন আমার মৃত্যু হয়—আত্মনো দুহিতা মোহাদ রত্যর্থং প্রার্থিতা ভবেৎ। তদা মৃত্যুর্মর্ম ভবেৎ যদি কন্যা ন কঙক্ষতি। ব্রহ্মা ‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন। রাবণ বাহুবলে তিন ভুবন জয় করে দণ্ডকারণ্যে উপস্থিত হলেন। সেখানে অগ্নিতেজী ঋষিদের দেখে ভাবলেন—এঁদেরও আমি জয় করব। কিন্তু খামোকা ঋষিবধে কোনই বীরত্ব নেই দেখে তিনি প্রত্যেক মুনির গায়ে বাণের খোঁচা মেরে একটু একটু করে রক্ত সংগ্রহ করে একটি কলসীর মধ্যে রাখলেন। এদিকে শতপুত্রের পিতা গৃৎসমদ ঋষি স্বয়ং লক্ষ্মীকে কন্যা হিসেবে লাভ করার জন্য প্রতিদিন মন্ত্রপূত দুগ্ধ সংগ্রহ করে রাখছিলেন সেই কলসীতেই, যেটিতে রাবণ মুনিরক্ত ভরে নিয়ে গেলেন লঙ্কায়। সেখানে গিয়ে মন্দোদরীকে হেঁকে বললেন—খুব সাবধান, এই কলসীর মধ্যে মুনিদের রক্ত আছে, বিষের থেকেও এর ক্ষমতা বেশি—বিষাদপ্যধিকং বিদ্ধি শোণিতং কলসে স্থিতম্—এ জিনিস কাওকে দিও না, নিজেও যেন খেও না। এদিকে ত্রৈলোক্য বিজয় সমাপন করে রাবণ হাজারো সুন্দরীদের নিয়ে আমোদ করতে গেলেন ভারতবর্ষের সমস্ত হিল-স্টেশনগুলিতে—আহৃতা রময়ামাস মন্দরে সহ্যপর্বতে। হিমবন্ মেরুবিন্ধ্যাদৌ⋯। মন্দোদরীর বড়ো কষ্ট হল। এতদিন পরে স্বামী ফিরলেন আর তাঁর এই ব্যবহার। তিনি বিষের থেকেও শক্তিশালী সেই দুধ-মেশানো রক্ত পান করলেন। এতে তাঁর মৃত্যু তো হলই না, বরঞ্চ তার জায়গায় আগুন-হেন অদ্ভুত এক গর্ভসঞ্চার হল—গর্ভো জ্বলনসন্নিভঃ। লজ্জায়, ঘৃণায় শেষ পর্যন্ত তীর্থদর্শনের অছিলায় তিনি বেরিয়ে। পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে কুরুক্ষেত্রে এসে তাঁর গর্ভ মুক্ত হল, সীতা জন্মালেন। তিনি সেখানেই তাকে মাটি চাপা দিয়ে সরস্বতীর জলে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ফিরে গেলেন লঙ্কায়। কাউকে কিছু বললেন না। মহারাজ জনক হলকর্ষণ উৎসব সম্পন্ন করার জন্য উপস্থিত হলেন কুরুক্ষেত্রে—কুরুক্ষেত্রং সমাসাদ্য লাঙ্গলং যজ্ঞমাবহৎ। সোনার লাঙলের ফলায় মাটির ওপরে উঠে এল শিশুকন্যা। তাকে মহিষীদের হাতে দিয়ে নাম রাখলেন সীতা।
আমি অদ্ভুত রামায়ণের ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এই জন্যে যে শুধু কাশ্মীরী রামায়ণ নয়, বিদেশে প্রচলিত অনেক রামায়ণেই সীতা মন্দোদরীর কন্যা এবং সেখানে সে কন্যাজন্মের ব্যাপারে রামপিতা দশরথেরও দায়িত্ব এসে যায়। আমি এত সব ঝামেলায় যাব না, কারণ এই নিয়ে বাদ-বিসংবাদ অনেক হয়ে গেছে এবং এখনও তার অবকাশ আছে। আমরা মূল রামায়ণের সীতা জন্মকথা ধরেই মিথিলার রাজসভায় হরধনুভঙ্গে যোগ দেব। এরই মধ্যে প্রাদেশিক কবিরা আবার সুযোগ বুঝে রামসীতার পূর্বরাগ সেরে নিয়েছেন। বাল্মীকি যার আভাস পর্যন্ত দেননি সেই পূর্বাগের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন তামিলভাষী কম্বন। রাজবাড়ির জানলায় দাঁড়ানো সীতাকে দেখে রামের মনে দোলা লাগল আর রামকে দেখে সীতার এমন অবস্থা হল যে কম্বন কবি অন্তত চল্লিশটি পয়ার খরচা করে বসলেন তাঁর হৃদয়রাগ বোঝানোর জন্য। এ ব্যাপারে গোস্বামী তুলসীদাসও কম যান না। বাল্মীকির তোয়াক্কা না করে তিনি রামকে এনে ফেলেছেন এক ফুলের বাগানে আর সীতাকে সেইখানেই নিয়ে এসেছেন গৌরীপূজার ছলে। তারপর শুধুই বর্ণনা—যার সার কথা অবশ্যই—ইনি দেখেন এঁকে আর উনি দেখেন তাঁকে—সরদসসিহি জগু চিতব চকোরী। তুলসীদাসের বর্ণনা স্তব্ধ করার কোন উপায় ছিল না, ভাগ্যিস এক সেয়ানা সখী সীতার চোখের পলকটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন—দীন্হে পলক-কপাট সয়ানী। ভাগ্যিস আর এক চতুরা সখী সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন—এই পাখীই কাল ফিরে আসবে আবার—পুনি আউব এহি চিরিয়াঁ কালী। আমাদের কৃত্তিবাস কিন্তু এসব পূর্বরাগের ব্যাপারে বাঙালি বাপের মতই সংরক্ষণশীল। হরধনুভঙ্গের মত একটা সংকুল সময়ে সীতাকে একবারমাত্র রাজবাড়ির ছাদে উঠতে দিয়েছেন তিনি আর কনে হয়ে বসা বাঙালি মেয়ের আশংকা নিয়ে সীতা সেখানে আকুল প্রার্থনা করেছে—‘পাছে বা বিরিঞ্চি করে বঞ্চিত এ ধনে।’
মজা হল, চতুর্দশ শতাব্দীর কৃত্তিবাসী রামায়ণে দৈববাণী হয়েছে—‘পাবে রাম, গৃহে যাও জনকনন্দিনী’ আর যোড়ষ শতাব্দীর তুলসীদাসের বাগানে গৌরীমাতা সীতাকে আশীর্বাদ করেছেন—সো বর মিলিহি জাহি মনু রাচা—যাকে তোমার মনে ধরেছে সেই বরই তুমি পাবে। হায় পুরাণ মুনি বাল্মীকি! পূর্বরাগের কথা কি তুমি ভাল করে জানতে না, কারণ সত্যিই তো, তোমার রচিত রামায়ণে পূর্বরাগের কাহিনী তো প্রায় কোথাওই নেই; তুমি জানতে শুধু বেদবিধি আর ঘটক-ঠাকুরদের মত বংশ-কীর্তন। দুই বৃহৎ রাজবংশের ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নামকীর্তন করেই তুমি সীতা, ঊর্মিলা, মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তির সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণ আর ভরত-শত্রুঘ্নের পাণি-গ্রহণ সম্পন্ন করেছ—পাণীন্ পাণিভিরস্পৃশন্। অগ্নিপ্রদক্ষিণ, বেদি আর ঋষি প্রদক্ষিণ করেই তোমার বরবধূরা রেহাই পেয়েছে, সেখানে আমাদের প্রাদেশিক কবিরা তাঁদের তাঁদের রাজ্যের সমস্ত স্ত্রী-আচার, দেশাচার, যা সাধারণে মনে করে সবই বেদে আছে, সে সমস্তই চারভাইকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন।
চারভায়ের বধূযোগের রাগিনীতেই মূল রামায়ণের আদিকাণ্ড শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু শেষের দিনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ভরতের মামা যুধাজিৎ ভরতকে মামাবাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য প্রথমে গিয়েছিলেন অযোধ্যায়। সেখানে গিয়ে তিনি শোনেন, সবাই বিয়ে করতে গেছে মিথিলায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মিথিলায় চলে আসেন এবং দশরথকে তাঁর মনোবাসনা জানান। বিয়ে-থা হয়ে গেলে বরযাত্রীদের সঙ্গে অযোধ্যায় প্রবেশের পর পরই যুধাজিতের সংকল্প জানিয়ে মহারাজ দশরথ ভরতকে বললেন—তোমার মামা এসেছেন তোমাকে তাঁদের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য—ত্বাং নেতুমাগতো বীরো যুধাজিন্ মাতুলস্তব। মামাবাড়ি যাবার নাম শুনেই ভরত এক পায়ে খাড়া; সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শত্ৰুগ্নকে সঙ্গে নিয়ে গমনের উদ্যোগ করলেন—গমনায়াভিচক্রাম শত্ৰুঘ্নসহিতস্তদা।
এই ঘটনাটার বিশেষ মূল্য উল্লেখ করলাম এই জন্যে যে, এ ঘটনা পরবর্তী সমস্ত রামায়ণ বিভাগকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। অযোধ্যাকাণ্ডের প্রথমেই দেখা যাচ্ছে দশরথ তাঁর সমস্ত মন্ত্রিমণ্ডলীকে ডেকে বলছেন—আমি বুড়ো হয়েছি, এবার সর্বগুণে গুণান্বিত রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাই—নিশ্চিত্য সচিবৈঃ সার্ধং যৌবরাজ্যমমন্যত। বলার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ, অভিষেকের তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে গেল; কিন্তু দশরথ যেন সব কিছুই একটু তাড়াতাড়ি করতে চান। এর আগে তিনি বলেছেন—আমি বুড়ো হয়েছি বটে, তবে অনেকদিন এখনও বাঁচব—বৃদ্ধস্য চিরজীবিনঃ। ‘অনেকদিন বাঁচব’ এই বোধ যাঁর আছে, তার এত তাড়াতাড়ি তড়িঘড়ি কিসের? রাজ্যাভিষেকের সময়ও ঠিক হল যেমন তাড়াতাড়ি তেমনি তাড়াহুড়ো করে আনুষঙ্গিক কাজ, জোগাড়যন্ত্রও সারা হল—ত্বরিতবান নৃপঃ। এই তাড়াহুড়োটা বাল্মীকিরও চোখে পড়েছে। তিনি লিখেছেন, নানা দেশের নানান জনপদের সমস্ত নরপতিকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন, কিন্তু কেকয়রাজ, যিনি কৈকেয়ীর সম্বন্ধে তাঁরই শ্বশুর, সেই কেকয়রাজ অশ্বপতিকে তিনি নেমন্তন্ন করলেন না, নেমন্তন্ন করলেন না স্বয়ং রামের শ্বশুর জনককেও—ন তু কেকয়রাজানং জনকং বা নরাধিপঃ। আর এই যে তিনি দুজনকেই কিছু জানাননি, তার কারণ নাকি—খুব তাড়াহুড়ো ছিল তো, তাই; তাঁরা বরং পরে খবর পেয়ে চমকে যাবেন—ন তু কেকয়রাজানং জনকং বা নরাধিপঃ। ত্ববয়া চানয়ামাস পশ্চাত্ তৌ শ্রোষ্যতঃ প্রিয়ম্॥ আশ্চর্য হল, দুনিয়ার সমস্ত প্রধান প্রধান রাজাদের তিনি তাড়াহুড়ো করেও জানানের সময় পেলেন—সমানিনায় মেদিন্যাঃ প্রধানান, পৃথিবীপতিঃ, কিন্তু এই সেদিন ভরত মামার বাড়ি চলে গেল, তাঁকে দিয়েও তো তিনি কেকয়রাজ অশ্বপতিকে এই রাজ্যাভিষেকের খবর দিতে পারতেন। আবার অতি প্রিয় পুত্রের শ্বশুর রাজর্ষি জনক, যার কন্যা দুদিন পরে সমস্ত পৃথিবীর রানী হবে, তাঁকেও তিনি ডাকলেন না। ভাবে বুঝি, এর মধ্যে শুধু রহস্য নয়, ঘরোয়া ‘পলিটিকস’ও আছে; তবে এই ‘পলিটিকসে’র মূল জানতে হলে আমাদের আরও একটু এগিয়ে যেতে হবে অযোধ্যাকাণ্ডের আগের দিকে।
রামের বনবাসের কথা শুনে ভরত যখন তাঁকে ফিরিয়ে আনতে গেছেন ত্রিকূটে, তখন রাম সানুবন্ধে ভরতকে বললেন, তুমি যে আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছ, এ তোমারই উপযুক্ত কথা। কিন্তু ভাই, আমাদের বাবা দশরথ যখন তোমার মা কৈকেয়ীকে বিয়ে করতে চান, তখন তোমার দাদু কেকয়রাজ অশ্বপতির কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, কৈকেয়ীর গর্ভে যে সন্তান হবে, তাকেই তিনি রাজ্য দেবেন—পুরা ভ্রাতঃ পিতা নঃ স মাতরং তে সমুদ্বহন্। মাতামহে সমাশ্ৰেীষীদ্ রাজ্যশুল্কম্ অনুত্তমম্॥ বিষ্ণুকল্প রামের পিতার চরিত্রে নিন্দারোপণ হবে বলে কৃত্তিবাস, তুলসীদাস কেউ এই পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু দশরথ নিজে এই প্রতিজ্ঞা কখনও ভোলেননি এবং এইজন্যেই তিনি কেকয়রাজ অশ্বপতিকে ইচ্ছাকৃতভাবে নেমন্তন্ন করার সময় পাননি। আবার রামের শ্বশুর জনককে নেমন্তন্ন না করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যেন, তাড়াহুড়োয় কেকয়রাজকে তো ডাকা হল না, আরে! যে রাজা হবে সেই সদ্য বিবাহিত রামের শ্বশুর জনককেই ডাকতে পারলুম না, তো আমার শ্বশুর বৃদ্ধ অশ্বপতির কথা আর কি বলব, থাক থাক ওসব কথা, ওঁরা পরে শুনে আনন্দ করবেন—পশ্চাত্ তৌ শ্রোষ্যতঃ প্রিয়ম্। আমরা জানি, যাঁর মেয়ে দুদিন পরে রাজরানী হবে, তিনি আগে জানলেই কি আর পরে জানলেই কি! কিন্তু যার নাতি রাজা হবে বলে, যিনি আগে থেকেই জানতেন, সেই কেকয়রাজ অশ্বপতি যদি এসে দেখেন দশরথের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা, তাহলে তিনি জনসমক্ষে ‘সত্যপ্রতিজ্ঞ’ বলে পরিচিত দশরথকে গায়ের জোরে না হোক, বাক্যবেগে কলঙ্কিত করতে পারেন। অতএব সমাগত রাজা-মুনি-ঋষিদের সামনে একটা বিচিত্র অবস্থায় অপদস্থ হওয়ার থেকে শ্বশুরকে না ডাকাই তিনি শ্রেয় মনে করলেন।
কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ভরতমাতা কৈকেয়ী জানতেন, কেকয় দেশে বিয়ের সময় কোনকালে পিতার কাছে দশরথ তাঁরই ছেলেকে রাজ্য দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সে কথা এতকাল পরে অযোধ্যার রাজবাড়িতে তুলে কোন লাভ নেই। অযোধ্যায় বড় ছেলেই রাজা হয় এই নিয়ম। তাছাড়া যখন রাজা কৈকেয়ীকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন তখন পর্যন্ত কোন রানীর ছেলেও হয়নি, তাই হয়তো এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দশরথ। কৈকেয়ী নিজের বাবার অনুপস্থিতিতে সে প্রতিজ্ঞার কথা ভাবলেনই না, বরঞ্চ কুটিলা মন্থরার কথাই তাঁর মনে ধরল, যে-মন্থরার কথা কৃত্তিবাস বলেছেন—পৃষ্ঠে ভার কুঁজের নাড়িতে নারে চেড়ী। কুঁজ নহে তাহার সে বুদ্ধির চুপড়ি। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে যে শম্বরবধের প্রসঙ্গ এসেছে, কৃত্তিবাস সে কথা সেরে দিয়েছেন আদিকাণ্ডে। সেখানে রাজার কাছে বর চাইবার ব্যাপারে মন্থরার সঙ্গে কৈকেয়ীর রীতিমত একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়ে গেছে। মন্থরার কথাতেই কৈকেয়ী রাজাকে বললেন যে, সময়মত তিনি বর চেয়ে নেবেন। কুচুটে সতীনটির মত কৃত্তিবাসের কৈকেয়ী রাজা দশরথকে একেবারে কড়ার করিয়ে নিয়েছে—আমার সত্যেতে বন্দী রহিলা গোসাঁই। প্রয়োজন অনুসারে বর যেন পাই ॥ বাল্মীকি রামায়ণে দুটি বরই শরবধের পারিতোষিক, কিন্তু কৃত্তিবাসে দ্বিতীয় বরের জন্য রাজার আঙুলহাড়া রোগ হয়েছে। বৈদ্য এসে বিধান দিয়েছে—‘হয় শামুক আর গুগলির ঝোল খাও’ ‘নহে নখদ্বারে চুম্ব দিক একজনা’। কৈকেয়ী ঘেন্নার মুখে জলাঞ্জলি দিয়ে আঙুল থেকে পুঁজ-রক্ত শুষে বার করে দিয়েছেন, ফলে আবার বর, এবং দুটি বরই থাকল ভবিষ্যতের আশঙ্কা গর্ভে নিয়ে। আসলে কৃত্তিবাস দশরথকে খুব সরল সাদামাটা ধার্মিক রাজা হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন আর যত দোষ ঢেলে দিয়েছেন কৈকেয়ীর ওপর; কিন্তু মূল রামায়ণের গতি-প্রকৃতি থেকে বেশ বোঝা যায় দশরথ ছিলেন কৈকেয়ীর ব্যাপারে একেবারে অন্ধ মোহান্ধ। তুলসীদাস, কম্বন কি রঙ্গনাথনের ভাব দেখে মনে হবে দশরথের যেন তিনটি বৈ বৌ ছিল না। বাল্মীকিতে কিন্তু সম্পূর্ণ অন্তঃপুর জুড়ে দশরথের স্ত্রী ছিল তিনশ-পঞ্চাশটি। রাম বনে যাবার সময় বাল্মীকি একবার তাঁদের রাজসভায় বার করেছিলেন—অর্ধসপ্তশতাস্তত্র প্রমদাস্তাম্ৰলোচনাঃ (কৃত্তিবাস আবার ‘অর্ধ’ কথাটি বাদ দিয়ে মাঝে মাঝেই পরিচারিকার মত ‘সাত শত রানী’র উল্লেখ করেছেন।) বাল্মীকিতে রামের বনপ্রস্থানের সময় রাজা দশরথ সুমন্ত্রকে আদেশ করেছেন—আমার সবগুলি বৌকে ডেকে নিয়ে এস, আমি স্ত্রীপরিবৃত হয়ে প্রাণারাম রামকে দেখতে চাই—দারৈঃ পরিবৃতঃ সর্বৈঃ দ্রষ্টুমিচ্ছামি রাঘবম্। এ আবার কেমন-ধারা সখ জানি না, তবে রাজা দশরথ যে পত্নীসংগ্রহের ব্যাপারে রীতিমত শিল্পী ছিলেন, সে কথা বাল্মীকি পড়ে বেশ বোঝা যায়। ক্ষত্রিয়া ছাড়াও বৈশ্য এবং শূদ্ৰজাতীয়া সুন্দরী রমণীরাও যে দশরথের অন্তঃপুরের শোভা বর্ধন করেছিলেন, তার খবর পাওয়া যাবে দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়। অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষভাগে যজ্ঞীয় অশ্ব ফিরে এলে তার সঙ্গে প্রধানা মহিষীকে রাত কাটাতে হয়। কাজেই রাত কাটালেন প্রধানা কৌশল্যা। কিন্তু তারপর যজ্ঞের পুরোহিতেরা সেই যজ্ঞীয় অশ্বের সঙ্গে দশরথের অন্য ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা এবং শূদ্রা রমণীদেরও সংযোগ করলেন। বিধির অঙ্গ হিসেবে ‘সংযোগ’ কথাটার অর্থ না হয় গোপনই থাকল, কিন্তু এই যে বৈশ্যা, শূদ্রা রমণীদের কথা এল, তাও বাল্মীকি উল্লেখ করেছেন এমন ভাষায় যাতে সাধারণে বুঝতেই পারবেন না—মহিষ্যা পরিবৃত্ত্যার্থ বাবাতামপরাং তথা। রামায়ণের তিলকটীকা ঐতরেয়ব্রাহ্মণের প্রমাণ উদ্ধার করে বলেছে—মহিষী বলতে রাজার ক্ষত্রিয়া স্ত্রীদেরই বোঝায়। বৈশ্যা স্ত্রীদের পারিভাষিক নাম হল ‘বাবাতা’ আর শূদ্রা রমণীদের নাম হল ‘পরিবৃত্তি’। কৃত্তিবাস অথবা তুলসীদাস, কম্ব অথবা রঙ্গনাথন, কেউই দশরথের এই বৈশ্যা এবং শূদ্রা রমণীদের উল্লেখ করেননি, তাঁদের ধারণায় মহারাজ দশরথের মত শুদ্ধসত্ত্ব মানুষ বোধহয় আর ছিলেন না।
মূল রামায়ণে যদিও দশরথের বিবাহসম্বন্ধের বর্ণনা কিচ্ছুটি নেই, তবে নানা জায়গায় যা তথ্য আছে তাতে স্ত্রীলোকের ব্যাপারে যে দশরথের ধৈর্য কম ছিল, তার প্রমাণ যথেষ্ট আছে। সুমিত্রাকে দুর্ভাগা করার জন্য যে অধৈর্যের কথা কৃত্তিবাস বলেছেন, যা আমরা আগেই কৃত্তিবাসের জবানীতে উল্লেখ করেছি, সে অধৈর্য যে কৈকেয়ীর ব্যাপারে দশরথের আরও বেশি ছিল, সেটা বাল্মীকিই স্পষ্ট করে বলে গেছেন। সারা দিন-রাত দশরথ কৈকেয়ীর ঘরে পড়ে থাকতেন, এবং তার সময়সীমা এতটাই যে তাঁর ধাড়ি ধাড়ি ছেলেদের চোখেও পড়েছে। রামের বনগমন এবং দশরথের মৃত্যুর পর ভরত যখন মামাবাড়ি থেকে ফিরে এলেন তখন দশরথের নিজের ঘরে তাঁকে না দেখেই কৈকেয়ীর ঘরে ঢুকেছেন এবং সেখানেও তাকে না পেয়ে প্রায় আশ্চর্য হয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করেছেন—কি ব্যাপার বলুন তো মা! বাবা তো বলতে গেলে প্রায় সবসময়ই আপনার এখানেই থাকেন—রাজা ভবতি ভূয়িষ্ঠমিহাম্বায়া নিবেশনে। তাঁকে এখানে পেয়ে যাব ভেবেই আপনার এখানে এসেছি। কিন্তু কই তাঁকে তো দেখতে পাচ্ছি না—তমহং নাদ্য পশ্যামি দ্রষ্টুমিচ্ছন্নিহাগতঃ।
কৈকেয়ীর ব্যাপারে রাজার পক্ষপাত যেমন বয়স্ক ছেলেদের দৃষ্টি এড়ায়নি, তেমনি স্ত্রীলোকের ব্যাপারে তাঁর অল্প-স্বল্প চিত্তচাঞ্চল্যের কথা তাঁর পুত্রবধূদেরও চোখ এড়ায়নি। অত্রিমুনির স্ত্রী অনসূয়া সীতার পাতিব্ৰত্য ধর্মের খুব প্রশংসা করছিলেন। সীতা তখন যেন একটু কটাক্ষ করেই বলতে চাইলেন যে স্ত্রীলোকের পতিব্রতা হওয়ার সাধনায় তখনই মধু থাকে যখন স্বামী পুরুষটিও একপত্নীব্রত হন। এ ব্যাপারে পতি-মাহাত্ম্য খ্যাপন করতে গিয়ে যে উদাহরণটি দিলেন সীতা সেটিই মোক্ষম। সীতা বললেন—যে সব মেয়েমানুষের দিকে মহারাজ দশরথ নিজের ‘ভোগ্যাত্ববোধে’ একবারের তরেও দৃষ্টি দিয়েছেন, আমার স্বামী রামচন্দ্র সমস্ত অভিমান ভুলে সেইসব মেয়েদেরও মায়ের মত দেখেন—সকৃদ্ দৃষ্টাস্বপি স্ত্রীষু নৃপেন নৃপবৎসলঃ। মাতৃবৎ বর্ত্ততে বীরো মানমুৎসৃজ্য ধর্মবিৎ॥ এই কথাগুলি রামচরিত্রের গৌরব না দশরথচরিত্রের লাঘব সে কথা আদিকবি না বললেও আমরা এইটুকু বুঝি—যে বয়সে রামচন্দ্র তাঁরই বয়সী রমণীকে মাতৃবৎ দেখতে পারতেন সেই বয়সেই দশরথ এইসব মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকালে সীতার কিছু বলার থাকত না। কিন্তু কৈকেয়ী যেখানে বৃদ্ধ দশরথের তরুণী ভার্যা সেখানে বৃদ্ধতর বয়সে রামের যোগ্য তরুণীদের প্রতি ‘ভোগ্যা’ বোধে শুভদৃষ্টি দিলে মেয়েমানুষ সীতার নজর এড়াবে কেন? দশরথ নিজেও যে নিজেকে চিনতেন না, তা নয়। মনের অগোচর পাপ নেই। তাই কৈকেয়ী যখন রামের বনবাস বর চাইলেন রাজার কাছে, তখন লোকের কাছে কি করে মুখ দেখাব—এইটেই ছিল রাজার প্রথম প্রতিক্রিয়া। কৈকেয়ীর কাছে তিনি বারবার বলেছেন—রাম বনে গেলে লোকেরা তাকে যা তা বলবে। বলবে—বোকা রাজা, কামুক রাজা, বউয়ের কথায় ছেলেকে বনে পাঠাল—বালিশো বত কামাত্মা রাজা দশরথো ভৃশম্। স্ত্রীকৃতে যঃ প্রিয়ং পুত্রং বনং প্রস্থাপয়িষ্যতি।
তরুণী কৈকেয়ীর ওপরে দশরথের এত মোহ ছিল যে, তাঁর জন্য তিনি কৌশল্যা এবং সুমিত্রাকে পাত্তাই দিতেন না। নিজ মুখেই সে কথা স্বীকার করে কৈকেয়ীকে তিনি বলেছেন—রাম বনে গেলে কৌশল্যা আমাকে কি বলবে? যখন যেমন দরকার পড়েছে কৌশল্যা আমাকে সেইভাবেই সেবা করেছে। কখনও দাসীর মত, কখনও সখীর মত, প্রিয়পত্নীর মত তো বটেই কখনও ভগিনী কিংবা মায়ের মতও। আর সেই কৌশল্যার সঙ্গে আমি শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমারই জন্য একটু ভাল ব্যবহার পর্যন্ত করিনি, যা আমার করা একান্ত উচিত ছিল—ন ময়া সৎকৃতা দেবী সৎকারার্হা কৃতে তব। একা কৈকেয়ীকে তুষ্ট করার জন্য দশরথ স্বয়ং বড় রানী কৌশল্যাকে কতখানি অবহেলা করতেন তা মিলিয়ে নেওয়া যায় কৌশল্যার জবানী থেকেই। কৌশল্যা তখন রামের বনবাসের কথা সবেমাত্র শুনেছেন, কিন্তু পুত্রের বনবাসের থেকেও তাঁর আপন করুণ অবস্থাটি যেন তাঁর প্রথম মনে এল। বড় এবং উপযুক্ত ছেলে বাড়িতে না থাকলে তাকে আরও কত নাকানি-চোবানি খেতে হবে, এই চিন্তাতেই তিনি তখন বিভ্রান্ত। তিনি রামকে বললেন—বাবা, তুই কাছে কাছে থাকতেই তোর বাবা আমার এই দশা করলেন, সেখানে তুই বনে গেলে আমার কপালে মরণ লেখা আছে—ত্বয়ি সন্নিহিতে’ প্যেবাহমাসং নিরাকৃতা। কিং পুনঃ প্রোষিতে তাত ধ্রুবং মরণমেব মে।। তুই জানিসনে, বাবা, আমি কত সহ্য করেছি, কত অত্যাচার মাথা পেতে নিয়েছি, আসলে তোর বাবা আমায় দেখতেই পারে না—অত্যন্তং নিগৃহীতাস্মি ভর্ত্তু র্নিত্যমসম্মতা। এই যে ছোটবৌ কৈকেয়ী, তার দাসীর চেয়েও অধম করে আমাকে রেখেছে—পরিবারেণ কৈকেয্যাঃ সমা বাপ্যথবাবরা। তুই এত সব কথা জানবিই বা কি করে। এই যে ঝি-চাকরগুলো পর্যন্ত, যারা আমার সেবা করে, আমার কথায় চলে, তারাও যদি একবার ভরতকে দেখে তাহলে তার সামনে আমার সঙ্গে কথা কয় না, পাছে কৈকেয়ী রাজাকে লাগায় যে আমার খুব সেবা হচ্ছে—যো হি মাং সেবতে কশ্চিদপি বাপ্যনুবৰ্ত্ততে। কৈকেয্যাঃ পুত্রমন্বীক্ষ্য স জনো নাভিভাষতে॥ এখন বুড়ো হয়ে গেছি এই বয়েসে আর সতীনের মুখঝামটা সহ্য করতে পারব না, আমাকে তুই সঙ্গে নিয়ে চল বাবা—তদক্ষয়ং মহদ্ দুঃখং নোৎসহে সহিতুং চিরম্। বিপ্রকারং সপত্নীনামেবং জীর্ণাপি রাঘব॥
কৌশল্যার বিলাপ শোনানো আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু এই বিলাপে সত্য আছে, যে সত্য স্বয়ং দশরথ কর্তৃক সমর্থিত। গোস্বামী তুলসীদাস লিখেছেন—দশরথ রামকে দেখেই বেঁচেছিলেন, রাম বনে যেতেই তিনি মরে গেলেন—জিয়ত রাম বিধু-বদন নিহারা। রাম-বিরহ করি মরনু সবাঁরা॥ বাল্মীকিমতে দশরথ কৈকেয়ীকামিতার জন্যই বেশি প্রসিদ্ধ, কৈকেয়ী-কামুকত্বেই তাঁর জীবন শেষ হয়েছে—কারণ রামের বনবাস সেই কামুকতারই ফল। দশরথের তৃতীয় পুত্র লক্ষ্মণ, যিনি প্রায়ই উচিতক্তা বলে বাল্মীকিতে প্রসিদ্ধ, তিনি দশরথের এই কৈকেয়ীপ্রীতি একটুও ভাল চোখে দেখেননি। কৌশল্যাকে তিনি বলেছেন—এই নাকি আবার বাবা, বুড়ো বয়সে খোকা সেজেছেন—পুনর্বাল্যমুপেয়ুষঃ। ওঁর ভীমরতি ধরেছে—বিপরীতশ্চ বৃদ্ধশ্চ স্ত্রিয়ো বাক্যবশং গতঃ—মেনিমুখো পুরুষ, যিনি মেয়েছেলের কথায় ছেলেকে বনে পাঠান। এই বয়েসে এত কামুক হলে তিনি কিই না বলতে পারেন—নৃপঃ কিমিব ন ব্ৰূয়াচ্চোদ্যমানঃ সমন্মথঃ। কৈকেয়ীর ওপরে গদগদ হয়ে তিনি যদি আমাদের সঙ্গেও শত্রুতা করেন, তবে তাকে মেরে ফেলাই উচিত—বধ্যতাং বধ্যতামপি। এতক্ষণ ধরে ভাববাচ্যে কথা বলে শেষে লক্ষ্মণ আর থাকতে পারলেন না, একেবারে পরিষ্কার স্পষ্টভাষায় যে কথাটা বললেন সেটা কৃত্তিবাস, তুলসীদাসেরা শুনেও শুনতে পাননি, কেন না শুনলে সাধারণের ধর্মবোধে আঘাত লাগত। লক্ষ্মণ বললেন—আমি মেরেই ফেলব; আমাদের ওপর যার একটুও মায়া নেই আর কৈকেয়ীর ওপর যার এত মোহ, সেই কুচুটে কুৎসিত বুড়ো বয়েসের রামখোকাটিকে আমি মেরেই ফেলব—হনিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকয্যাসক্তমানসম। কৃপণঞ্চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধভাবেন গর্হিতম্।।
দশরথ সম্বন্ধে আর কটূক্তি শোনাতে চাই না। পুরুষ মানুষ স্ত্রীর মুখের দিকে সব সময় চেয়ে থাকলে লোকে যা বলে, তা সবই বাল্মীকি বলেছেন। পুরবাসী থেকে বশিষ্ঠমুনি, পুরনারী থেকে মহামন্ত্রী সুমন্ত্র কেউ কৈকেয়ী কিংবা দশরথকে কথা শোনাতে ছাড়েননি। ভক্ত তুলসীদাস তো পাঁচ কথায় দশরথ-কৈকেয়ীর সংলাপ সেরে দিয়েছেন। তুলসীর কৌশল্যা পুত্রের বনগমনের কথা শুনেও ‘ধীরজ’ রেখে স্বামীর অধর্মের ভয়ে কবিত্ব করে বলেন—তুমি ঠিকই করেছ বাপ, পিতার আজ্ঞাই সব ধর্মের সার—পিতু আয়সু সব ধরমকো টীকা। আমাদের কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কবিত্বও এখানে স্তব্ধ। মধ্যযুগীয় স্বামীর মত তিনি ভেবেছেন, কৌশল্যা ঠিকমত স্বামী-সেবা করেননি বলেই আজকে তাঁর ছেলে রাজা হল না, যদিও বাল্মীকিতে খোদ দশরথের মুখেই তার উল্টো কথা শুনি। কৃত্তিবাস পুত্র রামকে দিয়ে মা-কে শিক্ষা দিয়েছেন—স্বামী বিনা স্ত্রীলোকের নাহি অন্য গতি। বিমাতার সেবায় পিতার প্রতি অতি। তুমি যদি সেবা মাতা করিতে পিতার। তবে কেন তাপ ঘটিবে তোমার ॥
এসব কথা শুনলে মনে হবে তুলসীদাস, কৃত্তিবাস মূল রামায়ণের স্বাভাবিকতা এবং মনস্তত্ত্ব সহ্য করতেই পারেননি। বাল্মীকিতে দশরথের মুখ দিয়েই রীতিমত গ্রাম্যভাষা বেরিয়েছে। তিনি কৈকেয়ীকে বলছেন— বদমাশ মেয়েছেলে, এসব কথা বলতে তোর দাঁতগুলো কেন খসে খসে পড়ছে না— ন নাম তে কেন মুখাৎ পতত্যধো বিশীৰ্য্যমানা দশনা সহস্রধাঃ। শুধু দশরথ কেন, নিজের ঘরে ঝামেলা হলে রাস্তার লোকেও উপদেশ দেয়। সুমন্ত্র সারথি পর্যন্ত রাজার ঘরোয়া বিবাদে অংশ নিয়েছেন, সর্বসমক্ষে কৈকেয়ীকে বাপ-মা তুলে গালাগালি দিতেও তাঁর বাধেনি। তিনি কৈকেয়ীর মার সম্বন্ধে একটি গপ্পোও শুনিয়েছেন। সুমন্ত্র বললেন— তোমার মা যেমন তুমিও তেমনি, আমড়া গাছে আম হয় না, নিমগাছে মধু হয় না— ন হি নিম্বাদ্ স্রবেৎ ক্ষৌদ্রং লোকে নিগদিতং বচঃ। কৈকেয়ীর বাবা নাকি এক ব্রাহ্মণের বরে পাখির ভাষা বুঝতে পারতেন। একদিন এক পাখির রসালাপ শুনে তিনি হেসে উঠলেন এবং কৈকেয়ীর মা তাঁকে বললেন— কি কারণে হাসছ তুমি, বলতেই হবে। বরদাতা ব্রাহ্মণের নিষেধ থাকায় কেকয়রাজ বললেন— কারণ বললে এখনই যে আমার মৃত্যু হবে। কৈকেয়ীর মা বললেন— ও সব ঠাট্টা চলবে না, তুমি বাঁচ আর মর, তোমাকে বলতেই হবে—শংস বা জীব মা বা ন মাং ত্বং প্রহসিষ্যসি। এবার দশরথের দিকেই ইঙ্গিত করেই যেন সুমন্ত্র বললেন— সেই বরদ ব্রাহ্মণের নিষেধ থাকায় কেকয়রাজ কিন্তু কিছুতেই তাঁর হাসির রহস্য স্ত্রীকে বললেন না। কিন্তু কৈকেয়ীর বায়নাক্কাটি ঠিক তাঁর মায়ের মতনই। কথায় বলে, ছেলেরা হয় তাদের বাপের মত, আর মেয়েরা হয় তার মায়ের মত— —পিতৃণ সমনুজায়ন্তে নরা মাতরমঙ্গনাঃ। স্বামী মরুন আর বাঁচুন সেদিকে চিন্তা নেই, কৈকেয়ী তাঁর মতই জেদ বজায় রাখতে ব্যস্ত।
কোন কিছুতেই কৈকেয়ীর কিছু হল না, তাঁর ক্রূরতা এবং কুটিলতা ক্ষণে ক্ষণে আরও বাড়তেই থাকল। দুখানি বর চাওয়ার পর থেকে একবারও তিনি দশরথের পাশটি থেকে নড়েননি। কারও কথায় তিনি গলেও গেলেন না, মন্দ বললে সেকথা হজম করে নিজের জিদ থেকে একটুও সরে গেলেন না। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা বাকল পরে বনে চলে গেলেন আর সেই প্রথম এবং সম্ভবত সেই শেষবারের মত দশরথ কৈকেয়ীকে বললেন— ছুঁয়ো না আমাকে ছুঁয়ো না—মা স্প্রীক্ষীঃ পাপনিশ্চয়ে, আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী নও, বান্ধবীও নও— ন হি ত্বাং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ন ভার্যা ন চ বান্ধবী। এতকাল ধরে ‘রতিপুত্রফলা’ স্ত্রীর মধ্যে যিনি প্রাণের বান্ধবীকে খুঁজে পেয়েছিলেন, আজ তাঁকেই তিনি বললেন—সখ মিটেছে তো, এবার বিধবা হয়ে রাজ্য ভোগ কর—সকামা ভব কৈকেয়ি বিধবা রাজ্যমাবস। এতকাল একমাত্র কৈকেয়ীর প্রেমাস্পদ দশরথ এই প্রথমবার বোধ হয় শান্তি পাওয়ার জন্য বার্ধক্যের বারাণসী কৌশল্যার ঘরে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু সে কি সত্যি সত্যি শান্তির জন্য, নাকি পুত্রহারা কৌশল্যার স্বাভাবিক রোষের মুখোমুখি হয়ে অনুতাপে পুড়ে মরবার জন্য। রাজাকে নিজের ঘরে দেখে পুত্রহারা জননীর যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা বাল্মীকি তাই লিখেছেন যদিও কৃত্তিবাস, তুলসীদাস দশরথের সম্বন্ধে এসব কথা বলতেই চাননি। রাম বনে চলে যাবার পর রাজা দশরথ যে কৈকেয়ীর নাম পর্যন্ত শুনতে চাইছিলেন না, এতদিন পর নিজের ঘরে সেই কৈকেয়ী-সোহাগী রাজাকে দেখে প্রথমেই কৌশল্যা কৈকেয়ীর নাম ধরেই আরম্ভ করলেন— রামের ওপর বিষ ঝেড়ে এখন তোমার কৈকেয়ী খোলসছাড়া সাপের মত ঘুরে বেড়াবে— নির্মুক্তেব পন্নগী। তোমার ভালবাসাতেই সে ভাগ্যবতী, নিজের আখের সে ভালই বোঝে; এখন ঘরের মধ্যে কালসাপ আমাকে শুধু ভয়ই দেখাবে—ত্রাসইয়িষ্যতি মাংভুয়ো দুষ্টাহিরিব বেশ্মনি। কৌশল্যার বিলাপ চলল, ওদিকে সুমন্ত্র সারথি তিনজনকে বনে রেখে ফিরে এলেন অযোধ্যায়। দশরথ পুত্রশোকে কোন কথাই বলতে পারছিলেন না, তো কুশল প্রশ্ন করবেন কি! কৌশল্যা কিন্তু আবার তেতে উঠে চিমটি কেটে রাজাকে বললেন—কি গো সুমন্ত্রকে যে তুমি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছ না। আগে রামের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এখন অনুতাপ দেখাচ্ছ— অদ্যেমমনয়ং কৃত্বা ব্যপত্রপসি রাঘবে। তুমি যার ভয়ে রামের কুশল প্রশ্ন পর্যন্ত করতে পারছ না, সেই কৈকেয়ী এখানে নেই, তুমি নির্ভয়ে কথা বল— নেহ তিষ্ঠতি কৈকেয়ী বিশ্রদ্ধং প্রতিভায্যতাম্।
আস্তে আস্তে সুমন্ত্র সব জানালেন। বনবাসী ছেলের খবর শুনে কৌশল্যা আবার স্বামী দশরথকে মর্মাঘাত করে বললেন— চোদ্দ বছর পরে রাম যদি ফেরেও তবু ভরত তাকে রাজ্য, রাজকোষ কিছুই দেবে বলে মনে হয় না—জহ্যাদ্ রাজ্যঞ্চ কোষঞ্চ ভরতো নোপলক্ষ্যতে। আর যদি দেয়ও তো, কনিষ্ঠের উপভুক্ত এঁটো সেই রাজ্য রাম আমার নেবে কেন, বাঘ কি কখনো এঁটো খায়! যে মদের সারভাগ খেয়ে নেওয়া হয়েছে, যে যজ্ঞে সোমরসটাই নষ্ট হয়ে গেছে, সেই রকম রাজ্য নিয়ে সে কি করবে— তথাহ্যাত্তমিমং রাজ্যং হৃতসারাং সুরামিব। নাভিমন্তুমলং রামো নষ্টসোমমিবাধ্বরম্। রাম হল গিয়ে আমার সিংহ ছেলে, কিন্তু হলে হবে কি, মাছ যেমন নিজের পোনাগুলো ধরে ধরে খায়, তেমনি তুমিও তোমার ছেলেকে গিলেছ—স্বয়মেব হতঃ পিত্রা জলজেনাত্মজো যথা। আর আমার কথা আর কি বলব! স্ত্রীলোকের প্রথম গতি হল স্বামী, সেই তুমিই আমার নও, কৈকেয়ীর; দ্বিতীয় গতি যে পুত্র, তাকেও তুমি পাঠিয়েছ বনে—তত্র ত্বং মম নৈবাসি রামশ্চ বনমাহিতঃ, তুমি সব নষ্ট করেছ, ছেলে, আমি, রাজ্য, মন্ত্রী, প্রজা সব নষ্ট করেছ, এতগুলি লোকের মূল্যে তুমি যাকে সুখী করেছ সে হল শুধু ভরত আর তোমার প্রিয়তমা কৈকেয়ী।
দশরথ মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছেন, কৌশল্যার পায়ে ধরার চেষ্টা করেছেন, কারণ অন্যায়টা প্রধানত সেইখানেই। পুত্রশোক, প্রিয়তমা পত্নীর আঘাত, কৌশল্যার বাক্যবাণ— সব কিছুতে জর্জরিত হয়ে মহারাজ দশরথ যেদিন মারা গেলেন সেদিন তাঁর মুখে শেষ জলটুকু দেবার জন্যও কেউ ছিল না। পরিচারক, চারণেরা যখন রাজার দেখা পেল না, তখন কাছের ঘরের সাধারণ রানীরা, কেউ গায়ে হাত দিয়ে, কেউ নাড়ি টিপে বুঝতে পারলেন— রাজা রাত থেকেই মরে পড়ে রয়েছেন। পুত্র শোকাতুরা কৌশল্যা এবং সুমিত্রাও অন্য ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন —তে চ দৃষ্ট্বা তদা সুপ্তে উভে দেবৌ চ তং নৃপম্। সুপ্তমেব উদগতপ্রাণম্ অন্তঃপুরমদৃশ্যত ॥ পুত্রশোকের ওপর স্বামী শোকে উদ্ভ্রান্ত কৌশল্যা মৃত দশরথের মাথাটি কোলের ওপর রেখে কৈকেয়ীকে বললেন— তোর পথের কাঁটা সবাই সরে গেছে, এবার মনের সুখে রাজ্য ভোগ কর— সকামা ভব কৈকেয়ী ভুঙ্ক্ষ রাজ্যমকণ্টকম্।
রাজবাড়ির পলিটিক্সটা ছিল এই রকম। কেউ দশরথকে ছাড়েনি। বাল্মীকির মতে, রাম বনে যাবার পর পাঁচটি রাত দশরথ বেঁচে ছিলেন। ষষ্ঠ রাত্রির অর্ধেকটা ধরে তিনি কৌশল্যা আর সুমিত্রার কাছে কৈকেয়ী-কামুকতার জন্য অনুতাপ করেছেন আর অন্ধমুনির শাপ স্মরণ করেছেন। তারপর সকাল হওয়ার আগেই স্ত্রী-পুত্রহীন একাকী রাজা সবার অলক্ষ্যে প্রাণত্যাগ করে আপন কামুকতার প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। আসলে দশরথের সময় থেকেই বিখ্যাত রঘুবংশের ধ্বংস আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। বিষয়ে অনাসক্তিই যেখানে রঘুকুলের আভূষণ ছিল, সেই বিষয়াসক্তিই দশরথকে যেন পেয়ে বসেছিল। এ কথাটি বাল্মীকি যেমন নিজের বক্তব্য একটুও না বলে কেবল ঘটনা পরম্পরায় দেখাবার চেষ্টা করেছেন, তেমনি অন্য কোন প্রাদেশিক কবি এসব কথা উচ্চারণ করবারই সাহস পাননি। একমাত্র কালিদাস তাঁর পরিশীলিত গোপন ইঙ্গিতে প্রকাশ করে দিয়েছেন দশরথের কুলবিষম চরিত্রটি। তিনি বলেছেন— অন্ধমুনির পুত্রবধের আগে দশরথ যথেচ্ছ মৃগয়া করে বেড়াতেন, তাতে ভুল হয়ে গেছিল তাঁর ইতিকর্তব্যতা জ্ঞান—ইতি বিস্মৃতকরণীয়মাত্মনঃ। সমস্ত রাজ্যের ভার তিনি সঁপে দিয়েছিলেন মন্ত্রীদের ওপর এবং ভোগ যেহেতু উপভোগের দ্বারা শান্ত হয় না তাই চতুরা কামিনীটির মতই চপলচরণ মৃগয়ার হরিণই তাঁর হৃদয় হরণ করেছিল— মৃগয়া জহার চতুরেব কামিনী। ঘরে ফিরে আসলে মৃগয়ার বদলে চতুরা কামিনীই যে দশরথের বিবেকবুদ্ধি নষ্ট করে দিয়েছিল, সে কথা আর উল্টো করে ব্যঞ্জনামুখর কবি স্বকণ্ঠে বলেননি, যদিও বাল্মীকি রামায়ণে মুনি, ঋষি, সারথি, প্রজা— সবাই সে কথা সোচ্চার ধিক্কারে বার বার বলেছে।
রাজবাড়ির ষড়যন্ত্র দশরথ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। মৃত্যুর পরের সূর্যোদয়েই মন্ত্রীরা নতুন রাজা খোঁজার জন্য মন্ত্রণাসভা বসালেন। লক্ষ করার বিষয়, মন্ত্রণার জন্য যাঁরা রাজসভায় মিলিত হলেন তাঁরা বেশির ভাগই ব্রাহ্মণ। বোঝা যাচ্ছে, রামায়ণ-সমাজের ব্রাহ্মণেরা ব্রত, উপবাস কিংবা ‘নবমীতে লাউ খাইতে আছে কিনা’, সে বিষয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। ব্রাহ্মণদের নাম করে বাল্মীকি বলেছেন তাঁরা নাকি ‘রাজকতারঃ’ অথাৎ ‘কিংমেকার্স’। সেকালের সাতজন বিশিষ্ট মুনির নাম করে আদি কবি একেবারে সাধারণভাবে মন্ত্রীদের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে, তাঁরা সবাই বশিষ্ঠকে ‘চেয়ারম্যান’ করে অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যুক্তি কষতে বসলেন— এতে দ্বিজাঃ সহামাত্যৈঃ পৃথগবাচম্ উদীরয়ন্। ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্রীরা কিন্তু অরাজক রাজ্যে বিভিন্ন বাস্তব অসুবিধের কথা উল্লেখ করে অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে— ‘ইক্ষ্বাকুবংশের যে কোন একজনকে রাজা করা হোক’— এই রকম একটা অভিমত দিলেন —ইক্ষ্বাকৃণামিহৈবাদ্য কশ্চিদ্ রাজা বিধীয়তাম্। এতে বোঝা যায় কৈকেয়ীর কথার পাকে পড়ে দশরথ অনিচ্ছাকৃতভাবে যে রাজপ্রতিনিধি ঠিক করেছিলেন তাঁর প্রতি এই মন্ত্রীদের আস্থা ছিল না। কিন্তু এ যুগেও যেমন ভক্ত মন্ত্রীরা অনভিজ্ঞ হলেও পূর্বতন প্রধানের আত্ম বংশকেই মর্যাদা দেন, তেমনি সব কথার শেষে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করলেন সূর্যবংশের একাধিক রাজার নুন-খাওয়া রাজমুনি বশিষ্ঠ। প্রধানত তাঁর কথাতেই ভরতকে মামাবাড়ি থেকে ডেকে আনার প্রস্তাব সর্ব-সম্মতিক্রমে গৃহীত হল। যাঁকে ডেকে এনে রাজ্য দেওয়ার কথা হল তিনি বোকা ছিলেন না বলেই রামায়ণ মহাকাব্যের নাটকীয়তা বেড়েছে, হয়তো বশিষ্ঠও ভরতকে ভালই চিনতেন। ভরত রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তার কথা সবিশেষ জানতেন এবং সেই কারণেই তিনি আপন জননীর মত অযোধ্যার রাজলক্ষ্মীর ওপরেও বিরক্ত হলেন। ভরত জানতেন— যে রাজ্যের জন্য রামচন্দ্রের বনবাস, সেই রাজ্যের ‘দখলী-সত্ত্ব’ তাঁর নিজের হাতে থাকলেও রাম-ভজা প্রজাদের মুখের ওপর সেই রাজ্য প্রেমানন্দে ভোগ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। নিতান্তই যদি ভোগ করতে হয় তা হলে রামের থেকেও বেশি জনপ্রিয়তা তাঁর দরকার ছিল, এবং সারাজীবন মামাবাড়িতে কাটানো ভরত খুব বাস্তবভাবেই জানতেন যে, সে জনপ্রিয়তা তাঁর নেই। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড আরম্ভ হচ্ছে রামের প্রবাদোপম জনপ্রিয়তা দিয়ে। কৈকেয়ীকে কুমন্ত্রণা দেবার সময় মন্থরা একবার অনুযোগ করেছে— তুমি এমনই মাথামোটা যে ছেলেবেলা থেকেই ভরতকে ফেলে রেখেছ মামাবাড়িতে। আরে! কাছাকাছি চোখের সামনে থাকলে নিরেট পদার্থের ওপরেও লোকের মমতা হয়, সেখানে এমন কাজ কেউ করে— বাল এব তু মাতুল্যং ভরতো নায়িতত্ত্বয়া। সন্নিকর্ষাচ্চ সৌহার্দ্যং জায়তে স্থাবরেষ্বপি।
আমাদের ধারণা, আধুনিক অনেক মায়ের মত কৈকেয়ী রানীর বাপ-ভাইয়ের ওপর টান ছিল একটু বেশি এবং এ কারণে দশরথও বোধ হয় কিঞ্চিৎ শঙ্কিত ছিলেন। কেননা তিনি ভরতকে রাজ্য দিয়ে প্রতিজ্ঞা পূরণ করলেন বটে কিন্তু মরার আগে কৈকেয়ীকে তিনি বলে গেলেন— তোমাকে অগ্নি প্রদক্ষিণ করে বিয়ে করেছি, কাজেই ইহলোক এবং পরলোকে তোমাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করতে আমি ধৰ্মত বাধ্য, কিন্তু তুমি যেহেতু ধর্মত্যাগ করেছ তাই আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম— ত্যক্তধর্মাং ত্যজাম্যহম্। আর তোমার ছেলে ভরত যদি এই রাজ্য পেয়ে সুখী হয় হোক, কিন্তু তার প্রেতকৃত্যের দান যেন আমার ভোগে না আসে— যন্ মে স দদ্যাৎ পিত্ৰৰ্থং মা মাং তদ্ দত্তমাগমৎ। আরও স্পষ্ট করে দশরথ আগেই বলেছেন যে, ভরত যেন তাঁর শ্রাদ্ধতৰ্পণাদি কিচ্ছু না করে— মাস্ম মে ভরতঃ কার্ষীৎ প্রেতকৃত্যং গতায়ুষঃ। সপুত্রয়া তয়া নৈব কর্ত্তব্যা সলিলক্রিয়া। শুধু কি এই, রাগের মাথায় দশরথ তাঁর মেজছেলেকেও ‘ত্যাজ্যপুত্তুর’ করে বসলেন— সন্ত্যজামি স্বজঞ্চৈব তব পুত্রং ত্বয়া সহ—তোমার সঙ্গে তোমার ছেলেকেও আমি ত্যাগ করলাম। ভরত কি এসব কথা কিছুই শোনেননি, তিনি রাজার ছেলে বটে এবং কচি খোকাও নন, তিনি ভালই বুঝতেন পিতার এই বিরুদ্ধতার মুখে তাঁর পক্ষে প্রজারঞ্জন করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে রাজা দশরথ জানতেন, রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তার স্রোতে ভরত কুটো গাছটির মত ভেসে যাবে, কেননা তার সঙ্গে প্রজাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। কৈকেয়ীকে বোঝানোর সময় দশরথ ভদ্রভাবে একটু ইঙ্গিতও করেছেন এ বিষয়ে, বলেছেন— রাম ছাড়া ভরত কখনও রাজা হবে না, কেননা সে রামের থেকেও ধার্মিকন কথঞ্চিৎ ঝতে রামাদ্ ভরতো রাজ্যমাবহেৎ। বেশি ধার্মিক বলে কিনা জানি না, ভরত রাজ্য নিলেন না এবং আমরা মনে করি এটিই তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং লোকদর্শিতার ফল। লঙ্কাকাণ্ডের শেষে রাম যখন সীতা উদ্ধার করে ফিরে এসেছেন তখন ভরত রামচন্দ্রকে বলেছিলেন— বলবান একটি ষাঁড় যে ভার বইতে পারে, একটা বাচ্চা ষাঁড় তো সে ভার বইতে পারে না, কাজেই এ রাজ্যের ভার কি আমার সয়— কিশোরবদ্ গুরু ভারং ন বোঢুমুৎসহে। তা ছাড়া রাজ্যের ছিদ্র অনেক, জলপ্রবাহে যেমন বাঁধ ভেঙে যায় তেমনি এ রাজ্যের ফুটো বন্ধ করাও আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। তা ছাড়া গাধা যেমন ঘোড়ার তেজে ছুটতে পারে না, কাক যেমন হাঁসের গতিতে ছুটতে পারে না, তেমনি আপনার ক্ষমতা কি আমার আছে— নান্বেতুমুৎসহে বীর তব মার্গমরিন্দম।
হতে পারে এসব বিনয়ের কথা, কারণ ভরত ভালই রাজ্য চালিয়েছিলেন। কিন্তু কথা হল ভরত রামের নামেই রাজ্য চালিয়েছিলেন কিন্তু রাজগৃহের প্রথম ভাঙনের মুখে ভরতের লোকদর্শিতাই বেশি কার্যকর হয়েছে। আরও একটা এখানেই বলে রাখি। বাল্মীকি রামায়ণে দশরথ যে পুত্রকে বারংবার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত করতে বারণ করে গেছেন, তাঁর পক্ষে সোজাসুজি রাজা হওয়া কঠিন ছিল। সূর্যবংশের বশংবদ রাজপুরোহিত দশরথের এই রাগের কথা মনে রাখেননি। বাস্তব পরিস্থিতি খেয়াল করে তিনি ভরতকে দিয়েই দশরথের অগ্নিকার্য এবং প্রেতকৃত্য সবই করিয়েছেন। প্রাদেশিক রামায়ণগুলির মধ্যে একমাত্র কম্ব রামায়ণ ছাড়া আর কেউই বাল্মীকির ওপরে টেক্কা দেননি এবং ভরতকে শ্রাদ্ধাধিকার থেকেও বঞ্চিত করেননি। আমরা অবশ্য অযোধ্যাকাণ্ডে শ্রাদ্ধ নিয়ে আর সময় নষ্ট করব না, কেননা স্বয়ং রামচন্দ্র বনে আছেন, তাঁর কথাও আমাদের ভাবতে হবে।
প্রথম কথা, আমাদের দেশজ রামায়ণগুলির আদি থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত পড়লে মনে হবে, রাম যেন চিরকালই খুব নির্বিকার, ভালোমন্দে সমযোগী। ফলমূল-খাওয়া ঝুঁটিবাঁধা এক তপস্বী যেন আমাদের রাম-কল্পনা জুড়ে বসে আছে। বাল্মীকির বাস্তবে কিন্তু রামের জীবনটি এত নিরামিষ ছিল না। রাজধানীতে থাকাকালীন রামচন্দ্রের ভোগবিলাসের কথা রাজা দশরথ তো বার বার বিলাপ করে বলেছেন। রাজবেশ, হাতি-ঘোড়া— এসব তো ছিলই, খাবার ব্যাপারেও রাম ছিলেন রীতিমত সুরসিক। ভাল ভাল রাঁধিয়েরা রামের কাছে রান্নার তারিফ শোনার জন্য ‘আমি রাঁধব, আমি রাঁধব’ বলে সুস্বাদু পান-ভোজন প্রস্তুত করতেন— অহংপূর্বাঃ পচন্তি স্ম প্রশস্তং পান-ভোজনম্। রামের পানীয়ের মধ্যে যে শুধু দুধ আর ঘোলই ছিল এমন ধারণা যেন পাঠক মনেও না আনেন। একে রাজপুত্র বলে কথা, তাছাড়া অযোধ্যার পথেঘাটে ছিল সুরা-মদের ছড়াছড়ি। ভরত রামকে ফিরিয়ে আনতে না পেরে দুঃখ করে বলেছেন— রামবিহীন অযোধ্যায় থাকবই না। যে রাম অযোধ্যায় থাকতে কত রমরমা ছিল, অযোধ্যার রাস্তাঘাট যেখানে বারুণী মদ আর ফুল-মালা-চন্দনের গন্ধে ম-ম করত, সে গন্ধ তো পাচ্ছি না— বারুণী মদ গন্ধশ্চ⋯ন প্রবাতি সমন্ততঃ। অযোধ্যার রাস্তাঘাটের যখন এই নমুনা সেখানে ক্ষত্রিয়কুমার মদ্যস্পর্শ করতেন না, এটা বিশ্বাসের কথা নয়। আরও কথা, গুহকের রাজ্য ছেড়ে প্রথমে গঙ্গা এবং পরে যমুনা পার হবার সময় সীতাদেবী এই দুই পুণ্যা নদীর কাছে মানত করেছেন—রাম যদি ভালোয় ভালোয় অযোধ্যা ফিরে আসেন তা হলে তোমার প্রীতির জন্য ব্রাহ্মণদের প্রচুর খাওয়াব আর তোমাকে পুজো দেব মা, হাজার কলসী মদ আর পোলাও দিয়ে— সুরা-ঘট সহস্রেণ মাংসভূতৌদনেন চ।⋯সুরা-ঘট শতেন চ। গঙ্গা-যমুনার ভোগ্যা এই সুরার প্রসাদ কি রাজমহিষীরাও পেতেন না। বিশেষত সুরা বিষয়ে রাজমহিষীদের অন্তরঙ্গ জ্ঞানও ভালই ছিল। ‘মণ্ড’ বলে একটা জিনিস ছিল, সেটাই ছিল মদের সার ভাগ। মদিরার মণ্ডভাগটি পান করার পর যেটা জলের মত পড়ে থাকত সেটার কোন কদর ছিল না মদ্যপায়ীদের কাছে। কৌশল্যা বিলাপ করে দশরথকে বলেছিলেন—ভরত এ রাজ্যে বাজা হলে সার শুষে নেওয়া সুরার মত এ রাজ্য আমার ছেলে নেবেই না—হৃতসারাং সুরামিব। আবার বনগমনের সময় দশরথ যখন নানা ধনরত্ন রামের সঙ্গে দিতে চাইলেন, তখন কৈকেয়ী রাজাকে বললেন—‘মণ্ড’ শুষে নেওয়া মদিরার মত এ রাজ্য ভরত নেবেই না—পীতমণ্ডাং সুরামিব। মদিরার মণ্ডভাগটির প্রস্তুত-প্রণালী আমার জানা নেই, তবে এর সঙ্গে যে রাজমহিষীদেরও ব্যক্তিগত নিবিড় পরিচয় ছিল, সে কথা বোধকরি আর বলে দিতে হবে না। ঠিক এই অবস্থায় আমরা কি এখনও বিশ্বাস করব যে, রাম মদ্যপানের সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন। যদিও রাম বসে বসে গেলাসের পর গেলাস মদ খাচ্ছেন এ রকম কোন পরিষ্কার বর্ণনা বাল্মীকিতে নেই, তবে ইঙ্গিত আছে যথেষ্টই। বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে যখন সীতার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ হয়েছে। তার বহু বছর আগে রামচন্দ্র স্বয়ং সীতাকে বাম বাহুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে টলটলে মৈরেয় মার্কা মদ্যপান তুলে দিয়েছেন সীতার হাতে—ঠিক যেমন দেবরাজ স্বর্গীয় সুরা তুলে দেন ইন্দ্রাণীর হাতে—সীতামাদায় হস্তেন মধু মৈরেয়কং শুচি। পায়য়ামাস কাকুৎস্থঃ শচীমেব পুরন্দরঃ। ‘মৈরেয়’ কিন্তু বেশ কড়া মদ, কিন্তু এর পরেও কি আমরা বলব রামচন্দ্র মদ ছুঁতেন না! স্বাধীনভাবে রামচন্দ্রের মদ খাওয়ার ঘটনা পরিস্কার করে বাল্মীকি না জানালেই কি ? তাঁর মদ্যপানের পরিবেশ তো বাল্মীকিই তৈরী করেছেন। যেদিন রামচন্দ্র সীতার হাতে মৈরেয় মদের পানপাত্রখানি এগিয়ে দিয়েছিলেন, সেদিন তিনি অযোধ্যার নবনির্মিত ক্রীড়াকানন অশোকবনে ফুলের আসনে বসেছিলেন। মাংসের চাট এবং বহু মিষ্ট ফলও তাঁর অলস-হাতের নাগারে মধ্যেই ছিল— মাংসানি চ সুমৃষ্টানি ফলানি বিবিধানি চ। সুন্দর অপ্সরা-কিন্নরীরা তাঁর সামনে নাচ দেখাচ্ছিল এবং তারা মদ খেয়েই নাচছিল— দক্ষিণা রূপবত্যশ্চ স্ক্রিয়ঃ পানবশং গতাঃ। রাম সেই সুন্দরী ললনাদের সন্তুষ্টও করলেন। অবশ্য কিভাবে— তা বাল্মীকি লেখেননি। কিন্তু এমনি এক নাচের আসরে, যেখানে নাচিয়ে, বাজিয়ে এমনকি সীতা পর্যন্ত মদ্যপানে মত্ত, সেখানে রামচন্দ্র বসে বসে আপন অঙ্গুলি-লেহন করছিলেন বলে মনে হয় না। বিশেষত বাল্মীকি লিখেছেন— দেবকন্যাদের সঙ্গে দেবতারা যেভাবে কামক্রীড়া করে, রামচন্দ্র বৈদেহীর সঙ্গে সেই রকমভাবেই প্রতিদিন ক্রীড়া করছিলেন— রময়ামাস বৈদেহীম্ অহন্যহনি দেবযৎ। দেবতাদের তো অমৃতে অরুচি নেই বলেই জানি এবং এই রকম দেবভোগ্য ব্যবহারে বিলাসে-বিহারে রাম-সীতার দিন কেটেছে বহু বছর, যেটাকে বাল্মীকি বাড়িয়ে বলেছেন— দশবর্ষ-সহস্রানি গতানি সুমহাত্মনোঃ। মদের ব্যাপারে সীতা যে একেবারেই বিমুখ ছিলেন না, তা যেমন তাঁর গঙ্গা-যমুনার কাছে মানত করা থেকে বোঝা যায়, তেমনি বোঝা যায় তাঁর সাধারণ সংলাপ থেকে। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি তপস্বী বনবাসী রামকে হেয় করে তাঁকেই সপ্রেমে বরণ করে নিতে বলেন। প্রত্যুত্তরে সীতা রাম-রাবণের তুলনা করে এমন কতকগুলি উপমার কথা বলেন যার মধ্যে একটিতে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ভাল কিসিমের মদ স্বয়ং সীতাদেবী কি রকম চিনতেন। সীতা বললেন— সিংহে আর শেয়ালে যে তফাত, খাড়ি আর সমুদ্রে যে তফাত, উত্তম সুরা আর সুবীর দেশের ধেনো মদে যে তফাত— সুরাগ্র্য-সৌবীরকয়ো যর্দন্তরং— রামে আর তোতে সেই তফাত। পাঠক মহাশয় নিশ্চয় জানুন, সীতা, কৌশল্যা, কৈকেয়ী— সবাই মদ খেতেন আর লঙ্কার অশোকবনে সীতাকে হনুমান রামের খবর দিয়ে বলেছে— তিনি আপনার বিরহে মদ-মাংস সব ছেড়ে দিয়েছেন— ন মাংসং রাঘবো ভুঙ্ক্তে ন চৈবং মধু সেবতে। তার মানে, সীতাবিরহ না থাকলে মদ এবং মাংস দুই-ই যে রামের চলত, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মদ্যপান ছাড়া, খাবারের মধ্যে যে জিনিসটি রামের অতি প্রিয় ছিল সেটি হল মাংস, বিশেষ করে হরিণের মাংস। দশরথ আর কৈকেয়ীর কাছে বনবাসের আদেশ পেয়ে রাম যখন কৌশল্যাকে সে কথা জানালেন, তখন তিনি বলেছিলেন—আমাকে এখন চোদ্দ বছর ফল-মূল খেয়ে ঋষি-মুনির মত বনেই কাটাতে হবে, আমিষ আমার চলবে না— কন্দমূলফলৈ জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্। আবার অশোকবনে হনুমানের ‘রিপোর্টে দেখছি তিনি সীতা বিরহে মদ-মাংস দুই-ই ছেড়েছেন। তা হলে মদ-মাংস ধরার প্রশ্নও থেকে যায়। আসলে অতিরিক্ত মনঃকষ্টে বনবাসের শেষের দিকটায় রামচন্দ্র হয়তো মদ-মাংস সবই ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু বনবাসের প্রথমদিকে অরণ্য-প্রকৃতির মাধুর্য তাঁকে রাজভোগ ভুলিয়ে দিলেও মাংস খাওয়া ভোলাতে পারেনি। বনবাসের প্রথম দু-তিনদিনের রাত্রি রামচন্দ্র শুধু জল খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন— অভিমানবশত, না অন্য কোন কারণে— বাল্মীকি তা স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু বনবাসের তৃতীয় দিনে সুমন্ত্র সারথি আর গুহককে বিদায় দিয়ে যেই না রামচন্দ্র গঙ্গাপারের অরণ্যসঙ্কুল ভূমিখণ্ডে পৌঁছেছেন, তখনই ক্ষিদের চোটে আগে তিন রকমের হরিণ আর একটি শুয়োর মেরে নিলেন— তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্ বরাহমৃষ্যং পৃষতং মহারুরুম্। আদায় মেধ্যং ত্বরিতং বুভুক্ষিতৌ। ক্ষিধে বেশি লাগলে খাবারের জোগাড় কম থাকলে ভাল লাগে না— এই মনস্তত্ত্ব থেকেই হয়তো তিন জনের জন্যে চারটে গোটা পশু মেরে নিয়েছিলেন দুই ভাই, কিন্তু পুরোটা তাঁরা খেতে পেরেছিলেন কিনা সে খবর আমরা বাল্মীকির কাছে পাইনি। বনবাসের চতুর্থ দিনে এবং রাতে রামচন্দ্র ছিলেন ভরদ্বাজ মুনির অতিথি, কাজেই খাওয়া-দাওয়া ভালই হয়েছিল, যদিও তাঁর ‘মেনু’তে আমিষ ছিল না। কিন্তু ভরদ্বাজের নির্দেশে দু ভাই সীতাকে নিয়ে যেদিন চিত্রকুটে বাল্মীকির আশ্রমে পৌঁছলেন সেদিনটা ছিল বনবাসের পঞ্চম দিন। জায়গাটাও রামের ভারি পছন্দ হল এবং তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মণকে তিনি বললেন কাঠ-পাতা দিয়ে একটি পর্ণকুটির তৈরি করতে। পর্ণকুটির তৈরি হলে, সেই বনবাসের মধ্যেও রামের ইচ্ছে হল সামান্য একটি গৃহ-প্রবেশের অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের প্রথম অঙ্গ হিসেবে রাম ছোট ভাইকে বললেন— একটা হরিণ মেরে আন আগে— মৃগং হত্বানয় শীঘ্রম্, কেননা হরিণের মাংস দিয়েই আজ আমাদের বাস্তুপূজা সারতে হবে— ঐণেয়ং মাংসমাহৃত্য শালাং যক্ষ্যামহে বয়ম্। বাস্তবে আমরা দেখেছি যে, দেবভক্ত মানুষেরা নিজেরা যে জিনিসটি খেতে পছন্দ করেন, সেই জিনিসটি ইষ্টদেবতার পছন্দ বলে নিবেদন করেন। এখানে বাস্তুযাগের উদ্দেশ্যে হরিণ মারা হল, না হরিণের মাংস খাওয়ার জন্যই বাস্তুপূজা করা হল— সে তর্ক নিষ্প্রয়োজন, তবে রামচন্দ্র আপন গৃহিণীকে মাংস রান্না করতে বললেন না। ছেলেরা বোধ হয় মাংস ভাল রাঁধে, তাই লক্ষ্মণকেই তিনি বললেন— ধ্রুব নক্ষত্র পার হয়ে যাচ্ছে, ভাই লক্ষ্মণ, তাড়াতাড়ি মাংস রান্নার ব্যবস্থা কর— ঐণেয়ং স্রপয়স্বেতৎ⋯ত্বর সৌম্য। লক্ষ্মণ খাবার যোগ্য একটি কালো হরিণ মেরে আনলেন এবং তার বিশুদ্ধ পাক-প্রণালীটি হল এই রকম—প্রথমেই তিনি আগুন জ্বালিয়ে হরিণটাকে ঝলসে নিলেন— অথ চিক্ষেপ সৌমিত্রিঃ সমিদ্ধে জাতবেদসি। তারপর যখন দেখলেন সমস্ত মাংসটি একেবারে গরম হয়ে গেছে, রক্তধারাগুলি গেছে সম্পূর্ণ শুকিয়ে তখন বুঝলেন হরিণের মাংস একেবারে সুসিদ্ধ হয়ে গেছে— তত্তু পক্কং সমাজ্ঞায় নিষ্টপ্তং ছিন্নশোণিতম্। রামকে গিয়ে বললেন— আমি একেবারে গোটা হরিণটাই ‘রোস্ট’ করে এনেছি— অয়ং সর্বঃ সমস্তাঙ্গঃ শৃতো কৃষ্ণমৃগো ময়া। এরপর সবাইকে দিয়ে থুয়ে মাংস খেয়ে গৃহপ্রবেশ করার পর বাল্মীকি মন্তব্য করেছেন— রাম যেন অযযাধ্যার বিয়োগব্যথাই ভুলে গেছেন— জহৌ চ দুঃখং পুরবিপ্রবাসাৎ। হরিণের মাংস রামের কাছে এমনই জিনিস। আপনারা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু চিত্রকূটে রাম অনেকদিন ছিলেন এবং হরিণের মাংসের ‘রোস্ট’ মাঝে মাঝেই তাঁর প্রবাস-দুঃখ হরণ করেছে। এমনকি যেদিন ভরত সদলবলে রামকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এলেন, সেদিনও লক্ষ্মণ হরিণের মাংস ঝলসাচ্ছিলেন, কেননা সেই আগুনের ধোঁয়া দেখেই ভরত রামের বাসস্থানটি চিনতে পারেন— ভরতো যত্র ধূমাগ্রং তত্র দৃষ্টিং সমাদধৎ। ভরত আসার আগেই রান্না হয়ে গেছে এবং লক্ষ্মণ তা দাদার হাতে তুলে দিয়েছেন। চিত্রকূট পাহাড়ের এক জায়গায় বসে পাহাড়-ছোঁয়া মন্দাকিনীর তরঙ্গশোভা দেখাতে দেখাতে রামচন্দ্র যে বিষয়ে সীতাকে প্রলোভিত করে তুলতে চাইছিলেন, সেটা কিন্তু সেই হরিণের মাংস— সীতাং মাংসেন ছন্দয়ন্। সীতা বোধ হয় আর খেতে চাইছিলেন না। রাম বললেন— একটু খেয়েই দেখ না, খুব স্বাদ; ঘেন্না কিসের ? খুব পরিষ্কার, খুব স্বাদের মাংস—ইদং মেধ্যম্ ইদং স্বাদু, আগুনে ঝলসে কিরকম তুকতুক করছে দেখ না—নিষ্টপ্তমিদম্ অগ্নিনা।
হরিণমাংসের স্বাদু গন্ধে সীয়াবর রামচন্দ্র অরণ্যের মধ্যে কালক্ষেপ করতে থাকলেন বটে কিন্তু কৌশল্যার কাছে রামের যে নিরামিষ খাওয়ার প্রতিজ্ঞা ছিল, সে প্রতিজ্ঞার কথা বনবাসের আতুর অবস্থায় অতি সঙ্গত কারণেই বাল্মীকি মনে রাখেননি। আমাদের প্রাদেশিক রামায়ণগুলি কিন্তু একান্ত ভ্রমবশত অথবা প্রভু রামের প্রতি অতি সম্ভ্রমবশত, রামকে মদ্য-মাংসের ধারে কাছে যেতে দেননি। কৃত্তিবাস, তুলসীদাস—এঁরা সবাই ব্রাহ্মণ্য এবং বৈষ্ণবী হাওয়ায় মানুষ; এঁরা কোন অবস্থাতেই ক্ষত্রিয়কুমারের স্বাভাবিক খাদ্য রাম-লক্ষ্মণকে খেতে দেননি। তুলসীদাস তো শুধু চিত্রকূট পাহাড়ের আনাচেকানাচে লক্ষ্মণ আর সীতাকে দিয়ে প্রচুর তুলসীগাছ লাগিয়ে দিয়েছেন— তুলসী তরুবর বিবিধ সুহায়ে। কঁহু কঁহু সিয় কঁহু লষণ লগায়ে ॥ এই বৃন্দাবিপিনে রাম-সীতা হরিণের মাংস খাবেন কি, তাঁরা বটের ছায়ায় বেদি বাঁধিয়ে শুধু বেদ-পুরাণের কাহিনী শোনেন। আমাদের কৃত্তিবাস আবার আরেক কাঠি। তিনি এসব কথা বলতে না পেরে কোথাও সীতাকে দিয়ে দশরথের উদ্দেশে বালির পিণ্ড দিইয়েছেন, কোথাও ব্রাহ্মণ, তুলসী আর ফন্ধুনদীকে মিথ্যা সাক্ষ্যের অপরাধে অভিশাপ দিইয়েছেন, কোথাও বা রামসীতাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গয়াধামে দশরথের সাংবৎসরিক পিণ্ডি দেবার জন্য, যদিও মূল রামায়ণে এসব কিছুই নেই। চরিত্রের দিক দিয়েও এই সব রামায়ণগুলিতে রামচন্দ্রেকে এমন এক আদর্শের পদ্মাসনে বসানো হয়েছে যে স্বয়ং বাল্মীকিও তাঁর আপন হাতে-গড়া চরিত্রগুলিকে চিনতে পারবেন না। কৃত্তিবাসে বনে যাবার কথা শুনে রাম সহাস্যবদনে কৈকেয়ীকে বলেন— ‘তোমার আজ্ঞায় মাতা এই যাই বনে’ এবং বনে গিয়েও কৈকেয়ী সম্বন্ধে তাঁর মনে কোন বিক্রিয়া হয়নি, পিতা দশরথ সম্বন্ধে তো নয়ই। বরঞ্চ ‘যেখানে শুনেন রাম পিতার নিন্দন। করেন সে স্থান হতে ত্বরিতে গমন।।’ কিন্তু বাল্মীকির রাম যে মানুষ। বনে যাবার সময় আদর্শবাদের ঠেলায় তিনি যত বড় বড় কথাই বলুন না কেন, বনবাসের তৃতীয় রাত্রিতে যখন সুমন্ত্র কিংবা গুহক কেউই আর কাছে নেই, তখন নীল আকাশের তলায় রামের বোধহয় বড়ো একা লাগল। লক্ষ্মণকে তিনি বললেন— মনুষ্য বসতির বাইরে একেবারে অরণ্যের মধ্যে এই আমাদের প্রথম রাত্রি— অদ্যেয়ং প্রথমা রাত্রি যাতা জনপদাদ্ বহিঃ। কিছুক্ষণ আগে বন্য শুয়োর আর মৃগমাংস খেয়ে বিশাল বনস্পতির তলায় শুয়ে রাম একেবারে মানুষের মতই বললেন— ভাই লক্ষ্মণ! এতদিনে ভরত অযোধ্যায় এসে গেছে, তাকে দেখে জোর পেয়ে কৈকেয়ী আবার দশরথকে প্রাণে না মেরে ফেলেন— অপি ন চ্যাবয়েৎ প্রাণান্ দৃষ্ট্বা ভরতমাগতম্। এর আগে রামের মুখ দিয়ে বাল্মীকি রামায়ণেও দশরথ সম্বন্ধে কোন তিক্ত মন্তব্য শোনা যায়নি। কিন্তু আজ যেন তাঁর সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, রামের মুখ যেন খুলে গেল। তিনি বললেন— একে আমি কাছে নেই, তায় বুড়ো আবার কামুক, কৈকেয়ীর হাতের পুতুল, কি যে করবে— কিং করিষ্যতি কামাত্মা কৈকেয্যা বশমাগতঃ ? পিতার বুদ্ধির পরাকাষ্ঠা দেখে আজ মনে হচ্ছে ভাই ধর্ম-অর্থ— এগুলোর থেকে কামই বড়, নইলে কোন্ মূর্খ বৌ-এর কানভাঙানি খেয়ে একান্ত বশংবদ পুত্রকে তাড়িয়ে দিতে পারে— কো হ্যবিদ্বানপি পুমান্ প্রমদায়াঃ কৃতে ত্যজেৎ। আর ভরত আর তার বৌ-এর ভাগ্য দেখ! আজ বাদে কাল বুড়ো রাজা মারা যাবে, আর আমিও বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আজকে অযোধ্যার রাজ্য পেয়ে তারাই সবচেয়ে সুখী হল। যে মানুষ ধর্ম অর্থ বাদ দিয়ে শুধু কামনার সেবা করে সে হয়তো দশরথের মত বিপদে পড়ে। তা পড়ুক, লক্ষ্মণ ভাই, তুমি বরং বাড়ি যাও, নইলে কৈকেয়ী আমার মা কিংবা তোমার মা-কে বিষ খাইয়ে মারতে পারে— ক্ষুদ্রকর্মা হি কৈকেয়ী দ্বেষাদ্ অন্যায়মাচরেৎ। পরিদদ্যাদ্ হি ধর্মজ্ঞ গরং তে মম মাতরম্ ॥
মানুষের মত রামচন্দ্রের এই সব স্বাভাবিক সন্দেহের কথা, মনের কথা প্রাদেশিক রামায়ণগুলি ভুলেও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু কোন্ মুনিকে রাম কতবার প্রণাম করেছেন, উল্টে কত মুনি রামচন্দ্রকে ‘নারায়ণ’ বলে চিনতে পেরেছেন— এই সব চিন্তাতে তুলসীদাস, কৃত্তিবাস, কম্ব এবং রঙ্গনাথ পদে পদে বাল্মীকিকে ছাপিয়ে গেছেন। এই যে নিষাদরাজ গুহ তাঁর সঙ্গে রামচন্দ্রের মাখামাখি বেশি দেখানইনি প্রাদেশিক রামায়ণকারেরা। কম্ব তো তাঁকে প্রথম থেকেই পুরো রামভক্ত সাজিয়ে দিয়েছেন। অথচ বাল্মীকিতে নিষাদরাজ গুহক রামের ‘আত্মসমঃ সখা’। সে গুণী লোক, বড় একজন স্থপতি বলে সে বিখ্যাত— স্থপতিরিতি বিশ্রুতঃ। রাম তাঁকে দেখলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ করেন, আর দেখামাত্র জড়িয়ে ধরেন। আসলে রামের সমাজে যে অস্পৃশ্যতার অত বালাই ছিল না, এ কথাটা চেপে যাবার জন্যই প্রাদেশিক রামায়ণকারেরা গুহককে সখ্যরসের ভক্ত সাজিয়ে দিয়েছেন। গুহ রামকে তুই-তোকারি করলে কৃত্তিবাস ভয় পেয়ে বলেন— ভক্তিমাত্র লন রাম, নাহি লন দোষ। অথচ বাল্মীকিতে নিষাদরাজ হেঁটে এসে রামের সঙ্গে দেখা করতেই রাম কৃতার্থ বোধ করেন— পদ্ভ্যাম্ অভিগমাচ্চৈব স্নেহসন্দর্শনেন চ। তফাতটা এইখানেই।
স্পৃশ্যতা অস্পৃশ্যতা ছেড়ে আবার মূল প্রসঙ্গে আসি। অরণ্যবাসে রামের দিন ভালই কাটছিল, তবে কৃত্তিবাসী কায়দায় ‘ফুলধনু হাতে রাম বেড়ান কাননে’— এমন কায়দায় তাঁর দিন চলছিল না। যত গভীর অরণ্যে প্রবেশ করছিলেন, রাক্ষসের ভয় তত বাড়ছিল। কত তপস্বী মহামুনির আশ্রম দেখে, এ বন থেকে সে বনে ঘুরে রামের দশ বছ্ছর কেটে গেল— রমতশ্চানুকূল্যেন যযুঃ সংবৎসরা দশ। অগস্ত্যমুনি, পিতৃবন্ধু জটায়ুর সঙ্গে পরিচয় হল, রাম দণ্ডকারণ্যে এসে পৌছোলেন। ঠিক এই সময়টা সীতা রামচন্দ্রকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন— ঋষিরা বললেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তুমি প্রতিজ্ঞা করে বসলে— ‘আমি দণ্ডকবনের সমস্ত রাক্ষস বধ করব’। কেন ? রাক্ষসেরা তোমার কি শত্রুতা করেছে যে, বিনা কারণে তাদের ধরে ধরে তুমি মারবে— ন কথঞ্চন সা কার্যা⋯বুদ্ধির্বৈবং বিনা হন্তুং রাক্ষসান্ দণ্ডকাশ্রিতান্। রাম সীতার কথার খুব একটা মূল্য দিলেন না এবং ক্ষত্রিয়ধর্মকে সাক্ষী মেনে সীতাকে বুঝিয়েও দিলেন। ঠিক এই রকম একটা সময়েই সব কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। রাবণের বোন শূর্পণখার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কির শেষরক্ষা করতে পারলেন না রাম লক্ষ্মণ। শূর্পণখার নাক-কান কাটা গেল, দণ্ডকারণ্যের ‘কেয়ারটেকার’ খব এবং তার সেনাপতি দূষণও রামের হাতে মারা গেল। রাক্ষসদের সঙ্গে বৈরিতার এই সূত্রপাত।
দণ্ডকারণ্য রাবণের বাগানবাড়ির মত। আর্য ভূখণ্ডের এত কাছে রাবণের বাগান, ব্যক্তিগত জনস্থান— এসব রাবণের প্রতিপত্তির পরিচয় দেয়। বাল্মীকি রামায়ণে রাবণের কাছে প্রথম যে শূর্পণখার নাক-কান কাটার খবর দেয় সে হল অকম্পন, শূর্পণখা নয়, যা কৃত্তিবাস-তুলসীদাসে আছে। বাল্মীকিতে রাবণের কাছে খবর দেবার সময় শূর্পণখা রামের প্রতি তার নিজের আসক্তির কথা চেপে গিয়ে বলেছিল— সুন্দরী সীতা, সে শুধু তোমারই যোগ্য। তোমার জন্য আমিই তাকে তুলে আনছিলাম, কিন্তু বাদ সাধল লক্ষ্মণ —ভার্যার্থে তু তবানেতুমুদ্যতাহং বরাননাম্। বিরূপিতাস্মি ক্রুরেণ লক্ষ্মণেন মহাভুজ।। সব শুনে রাবণ সমুদ্র পার হয়ে মায়াবী মারীচকে সহায় করে সীতা হরণ করতে এলেন। মায়াবী রাক্ষসের মনোহরণ সোনার রূপে যিনি একটুও বিচলিত হননি, তিনি হলেন লক্ষ্মণ, তিনি মারীচকে পরিষ্কার চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু মায়ামৃগের অলোকসামান্য রূপ দেখে সীতা যেমন রামকে প্ররোচিত করেছেন, রামেরও তেমনি লোভ হয়েছিল— লোভিতস্তেন রূপেন সীতয়া চ প্রচোদিতঃ। মহাভারতকার ব্যাসদেবও তাই লিখেছেন— সোনার হরিণ অসম্ভব জেনেও রামের লোভ হল—অসম্ভবং হেমমৃগস্য জন্ম তথাপি রামো লুলুভে মৃগায়। যা হোক রাম গেলেন কিন্তু মারীচের মায়াস্বরের আকুতি অনুধাবন করে সীতার যতটুকু অনুতাপ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি তিনি সতী হয়ে উঠলেন। চির হিতাকাঙক্ষী লক্ষ্মণকে তিনি তখন যে ভাষায় গালাগালি দিয়েছেন তাতে ধারণা হয় সীতা রামের জন্য যতখানি দুশ্চিন্তা ভোগ করছিলেন, তার চেয়েও তিনি নিজের রূপ সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন। বহু জায়গায় এই সচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে আড়ে-ঠারে, কোথাও বা একটু নগ্নভাবেই। পরবর্তী লঙ্কাকাণ্ডে ইন্দ্রজিৎ যখন রাম-লক্ষ্মণকে রণক্ষেত্রে নাগপাশে বন্ধ করে রেখে গেলেন, তখন রাবণ আদেশ দিলেন সীতাকে পুষ্পক বিমানে চড়িয়ে নিহত রাম-লক্ষ্মণকে দেখিয়ে আনতে। ভূমিশায়িত রাম-লক্ষ্মণকে দেখেই সীতা বিলাপ করতে থাকলেন। সেই বিলাপে আপাত শোকের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সীতার আপন রূপ-গুণের সচেতনতা। সীতা বললেন— জ্যোতিষীগুলো কি সব মিথ্যা বলেছে। যে সমস্ত দুর্লক্ষণ থাকলে মেয়েরা দুর্ভাগা হয়, তার একটা লক্ষণও তো আমার মধ্যে নেই। আমার চুলগুলো কিরকম সরু, সমান এবং ভীষণ কালো, ভুরু দুটোও তো জোড়া নয়। জঙ্ঘা দুটো সুগোল, এমনকি একফোঁটা লোম নেই তাতে। ঝকঝকে দাঁতের মধ্যে কোথাও একটু ফাঁক নেই। অপাঙ্গ, চোখ, হাতের আঙুল— কোথাও কোন খুঁত নেই। ঊরু দুটি আমার পরম্পর সংযুক্ত, স্তনযুগল পীন, উন্নত এবং সে দুটির মধ্যে অভাব আছে একমাত্র স্থানের, চূচুকদুটি আপনাতে আপনি নিমগ্ন— স্তনৌ চাবিরলৌ পীনৌ মামকৌ মগ্নচূচুকৌ। আমার স্তনের পাশটা এবং বক্ষোদেশ বিশাল, নাভির পাশটা উন্নত কিন্তু নাভিটি সুগভীর। আমার গায়ের রঙ মণির মত উজ্জ্বল। হায়! যেসব কারণে কন্যালক্ষণজ্ঞ পণ্ডিতেরা আমাকে সুলক্ষণা বলেছে, তাঁরা কি সব মিথ্যে বলেছে— তৎ সর্বং বিথীকৃতম।
অতিশোকের মধ্যেও যে মহিলা আপন মুখে নিজের উন্নত দেহলক্ষণ বর্ণনা করতে পারেন, তিনি নিজের রূপ সম্বন্ধে সজাগ নয়তো কি! কেননা এর মধ্যে গুণের বর্ণনা কিছুই নেই, আছে শুধু আত্মরূপের স্তুতি যা কিনা ক্ষেত্র-বিশেষে বিকারের রূপ নিয়েছে, যার বলি হয়েছেন লক্ষ্মণ। এই বিকারবশেই সীতা লক্ষ্মণকে বললেন—বন্ধুর ছলে আসলে তুমি রামের শত্রু। তুমি ভাবছ রাম মরবে আর তুমি আমাকে বিয়ে করবে— ইচ্ছসি ত্বং বিনশ্যন্তং রামং লক্ষ্মণ মৎকৃতে। আমাকে পাবার লোভেই তুমি আসলে রামের ডাক শুনতে পাচ্ছ না— লোভাত্তু মৎকৃতে নূনং রাঘবং নানুগচ্ছসি। লক্ষ্মণ অনেক বোঝালেন, কিন্তু সীতা যে কথা বিনয়-মধুর বাক্যে লক্ষ্মণকে বলতে পারতেন, তার ধারেকাছে না গিয়ে অত্যন্ত অপমানসূচকভাবে লক্ষ্মণকে বললেন— দুরাচার, নৃশংস। কুলপাংসন, রামের বিপদই তোর কাম্য, তুই চিরকালই নিজের আসল স্বভাবটি চেপে রেখেছিস— নিত্যং প্রচ্ছন্নচারিষু। হয় ভরতের কথামত, নয়তো নিজেই আমাকে হাত করবার জন্য নিজের অভিপ্রায় গোপন রেখে একা রামের সঙ্গে এসেছিস—মম হেতোঃ প্রতিচ্ছন্নঃ প্রযুক্তো ভরতেন বা। কিন্তু ভরত কিংবা তোর, কারও ইচ্ছেই পূরণ হবে না, রাম ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচব না— তন্ন সিধ্যতি সৌমিত্রে তবাপি ভরতস্য বা।
চিরকালের সঙ্গী, ভৃত্যের মত বিশ্বস্ত লক্ষ্মণকে এ সব কথা বলার পেছনে। রামের জন্য সীতার উদ্বেগ এবং সতীত্বই বড় ছিল, কিন্তু সেইটেই সব নয়। সময়কালে দেবী সীতা বড়ই মুখরা ছিলেন। চরম সতীত্বের অন্তরালে সীতার আত্মসচেতনতাও কম ছিল না। বনে আসবার সময় রাম সীতাকে বলেছিলেন— বনে বড়ো বিপদ সীতা, তুমি অযোধ্যাতেই থাক। এখানে তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন, তাঁদের সেবা করে দিন কাটিয়ে দাও। প্রাণের ভাই ভরত এখন রাজা হয়েছে, তুমি তার অনুবর্তিনী হয়ে অযোধ্যাতেই থাক— স ত্বং বসেহ কল্যাণি রাজ্ঞঃ সমনুবর্তিনী। কিন্তু জননী কৌশল্যা অযোধ্যায় থাকতে পারলেও, লক্ষ্মণ-পত্নী উর্মিলা অযোধ্যায় থাকতে পারলেও সীতা কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা ভরতের অধিকারে থাকতে পছন্দ করেননি। তিনি বলেছেন— বাপ, ভাই, মা, বন্ধু— এঁরা আমার আশ্রয় নন— ন পিতা নাত্মজো নাত্মা ন মাতা ন সখীজনঃ। স্বামীই আমার আশ্রয়। তোমার কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে, আমাকে এত ছোট ভাব বলেই তুমি এ কথা বলতে পারলে— কিমিদং ভাষষে রাম বাক্যং লঘুতয়া ধ্রুবম্। এরপর সীতা অবশ্য অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কিন্তু ভরতের কাছে থাকার ব্যাপারে তাঁর ক্ষোভটা প্রকাশ করলেন রাম যখন আবার বনবাসের বিপদ শোনাতে আরম্ভ করলেন। সীতা বললেন— আমার পিতা জনক কি করে জানবেন যে তাঁর জামাই আসলে পুরুষের চেহারায় একটা মেয়েমানুষ— স্ত্রিয়ং পুরুষবিগ্রহম্। চরিত্র শক্তিহীন রঙ্গমঞ্চের অভিনেতারা যেমন কুমারী অবস্থায় পরিণীতা বহুকালের সহবাসিনী স্ত্রীকে অন্যের ভোগে দেয়, আমাকেও তুমি তেমনি পরের কাছে রেখে যেতে চাইছ— শৈলূষ ইব মাং রাম পরেভ্যো দাতুমিচ্ছসি। যে ভরত মহারাজের হিতসাধনে অনুবর্তিনী হওয়ার জন্য আমায় এত উপদেশ দিচ্ছ, সেই ভরতের অধীন হয়ে তুমি থাকগে যাও— ত্বং তস্য ভব বশ্যশ্চ বিধেয়শ্চ সদানঘ।
হয়তো বনে পর্যন্ত স্বামী-সহবাসে থাকার জন্যই এত সব কটু কথা বলেছেন, হয়তো রামের জন্য দুশ্চিন্তা হেতুই লক্ষ্মণকে তিনি যা-তা বলেছেন। কিন্তু রাম যে বলেছিলেন, ‘ভরতের কাছে থাক’—তার মানে কি ভরতের ভোগ্যা হয়ে থাকা, অথচ সীতা এইরকমই একটা অর্থবিকার কল্পনা করেছেন, যে বিকার আবার ঘটেছে লক্ষ্মণকে যা নয় তাই বলার মধ্যে। এমন হতে পারে, রেগে গেলে সীতাদেবীর কথার মাত্রাই ছিল এমনিধারা, আর তা না হলে সীতার মনের কোণে কি এমন কোনও ধারণা ছিল যে, ভরত লক্ষ্মণ সবাই তাঁকে পাবার জন্য একেবারে ছোঁক ছোঁক করছেন। বাল্মীকি রামায়ণে সীতার কথা অসহ্য বোধ। করেই লক্ষ্মণ শেষ পর্যন্ত ঘর ছাড়লেন। যাবার আগে বলে গেলেন—আমার সম্বন্ধে যখন এইসব সন্দেহ করছ, তখন মর তুমি, মেয়েছেলে তো আরও কত হবে—ধিক্ ত্বম্ অদ্য বিন্যশ্যম্ভীং যন্মামেবং বিশঙ্কসে। স্ত্রীত্বাদ্ দুষ্টস্বভাবেন⋯।
আসলে লক্ষ্মণের কপালটাই খারাপ। বনবাসে আসা অবধি তাঁর কাজকর্মের কামাই নেই। বাড়ি বানানো, হরিণ শিকার, রান্না করা—সবই তাঁর ঘাড়ে। আমাদের কৃত্তিবাস এবং রঙ্গনাথ আবার সম্পূর্ণ বনবাসকালে লক্ষ্মণের খাওয়া এবং ঘুম দুই-ই কেড়ে নিয়েছেন, তাতে লক্ষ্মণ হয়ে উঠেছেন আরও মহনীয়। কৃত্তিবাসে তো এই ঘুম এবং খাওয়া বন্ধের ফলেই লক্ষ্মণের পক্ষে ইন্দ্রজিৎ বধ সম্ভব হয়েছিল। বাল্মীকি রামায়ণে এসব অবাস্তব কল্পনা নেই, লক্ষ্মণের ঘুম এবং খাওয়ার ওপর তিনি কোনও হস্তক্ষেপ করেননি। বনবাসের তিন-চার দিনের মধ্যেই রাম-লক্ষ্মণ যখন চিত্রকূটে এসে পৌঁছেছেন, সেদিন রাতটা লক্ষ্মণ এমন ঘুমিয়েছিলেন যে, সকালবেলাও তাঁর ঘুম ভাঙেনি, তাঁকে আস্তে আস্তে ডেকে তুললেন রাম—অথ রাত্র্যাং ব্যতীতায়ামবসুপ্তমনন্তরম্। প্রবোধয়ামাস শনৈ লক্ষ্মণং রঘুপুঙ্গবঃ ॥ লক্ষ্মণের খাওয়া এবং ঘুম নিয়ে অবশ্য আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই, আমাদের বক্তব্য—সীতা না হয় বেবুঝ, কিন্তু লক্ষ্মণ সীতার কটু বাক্যগুলি আনুপূর্বিক রামের কাছে উদগিরণ করা সত্ত্বেও, রাম উল্টে লক্ষ্মণকেই বকাবকি করলেন। অবলা স্ত্রীলোকের কথায় ক্রোধের বশীভূত হওয়া নাকি লক্ষ্মণের ঠিক হয়নি। কিন্তু অবলা স্ত্রীলোকের বায়নাক্কা শুনে সোনার হরিণের বশীভূত হয়েছিলেন যিনি—মায়ামৃগং দয়িতয়েপ্সিতম্ অন্বধাবৎ—তাঁর কথা কে বলবে ? লক্ষ্মণ তো বারণও করেছিলেন। যা হোক সীতার কথায় লক্ষ্মণ ঘর ছাড়লেন, যদিও পঞ্চবটীর পর্ণশালার সামনে গণ্ডি কেটে দেওয়ার ব্যাপারটা শুধুমাত্র কৃত্তিবাসী এবং রঙ্গনাথী রামায়ণেই আছে, বাল্মীকি রামায়ণেও নেই, কম্ব রামায়ণেও নেই। বাল্মীকির লক্ষ্মণ শুধু স্বস্তিবাচন করে সীতাকে রেখে গেছেন বনদেবতাদের ভরসায়—স্বস্তি তে’স্তু বরাননে। রক্ষন্তু ত্বাং বিশালাক্ষি সমগ্রা। বনদেবতাঃ ॥.
সীতা নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। সুযোগ বুঝে ভিখারি-বেশী রাবণ সীতাকে হরণ করলেন, রাস্তায় মারা পড়লেন বৃদ্ধ জটায়ু। রাম যখন পঞ্চবটীতে এলেন তখন এই গৃধ্ররাজ বৃদ্ধ জটায়ু নিজেই রামকে বলেছিলেন—আমি তোমার পঞ্চবটী বাসের সহায় হব। বাড়িতে যখন তুমিও থাকবে না, লক্ষ্মণও থাকবে না, আমি তখন সীতার রক্ষাবিধান করব—সীতাঞ্চ তাত রক্ষিয্যে ত্বয়ি যাতে সলক্ষ্মণে। কম্ব রামায়ণে তাই দেখি, লক্ষ্মণ সীতার কথার জ্বালায় বেরিয়ে পড়ার পর বৃদ্ধ জটায়ুকেই স্মরণ করেছেন সীতাকে রক্ষা করার জন্য। অরণ্যকাণ্ডের মাঝামাঝি জায়গায় ঋষ্যমূক পর্বতের ওপর আমরা পাঁচজন বানরকে দেখতে পাই, যাদের লক্ষ করে সীতা তার গায়ের গয়না আর সোনার বরন ওড়নাখানি খুলে ফেলে দেন রাবণের রথের ওপর থেকে। সীতাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এই বানরেরা বিশেষভাবে লক্ষ করল।
আশ্চর্যের কথা হল একটি বুড়ো পাখি রাম-লক্ষ্মণের অবর্তমানে সীতাকে রক্ষার ভার নিয়েছে এবং কতকগুলি বানর সীতাকে জোর করে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা বিশেষভাবে খেয়াল করেছে—এসব কি তা হলে রূপকথার গল্প ? বাল্মীকি রামায়ণ যদি আর্যদের সঙ্গে অনার্য রাক্ষসদের যুদ্ধবিগ্রহের প্রতিরূপ হয়, তা হলে পণ্ডিতদের মত করে বলতেই হবে যে, রামচন্দ্র একটি উন্নত। অনার্যগোষ্ঠীকে প্রতিহত করার জন্য আরও একটি অনার্যগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এই হাত মেলানো আরম্ভ হয়েছে সেই শৃঙ্গবেরপুরে নিষাদ রাজা গুহকের রাজ্য থেকে। নিষাদ রাজা যদি রামচন্দ্রেব অভিন্নহৃদয় বন্ধু হন, তো গৃধ্ররাজ জটায়ু ছিলেন রামপিতা দশরথের বয়স্য। আসলে গৃধ্রেরা এমন একটি জাতি যাদের ডাকা হত গৃধ্র কিংবা সুপর্ণ নামে (উপাধি হিসেবে পক্ষী শব্দটি তো। এই সেদিনও চলেছে)। এঁরা অরণ্যচারী ছিলেন এবং যাযাবরবৃত্তি। ভারতের পশ্চিমঘাট এবং পশ্চিম সমুদ্র তীরে গৃধ্রদের হয়তো কিছু ক্ষমতাও ছিল, যে ক্ষমতার অবসান ঘটে জটায়ু এবং তাঁর ভাই সম্পাতি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে। জটায়ু রামকে সীতাহরণের সংবাদ দিয়েছিল আর তার ভাই সম্পাতি সমুদ্র তীরে ভগ্নহৃদয় বানরগোষ্ঠীকে রাবণের স্পষ্ট সংবাদ দিয়েছিল কাজেই যাযাবরবৃত্তি। গৃধ্রদের ক্ষেত্রে সংবাদদাতার ভূমিকাটি বিশেষত লক্ষণীয়।
বাল্মীকি রামায়ণের বানরেরা, আমি বাঁদর না বলে এদের বানরই বলব—এরা মোটেই আমাদের দৃষ্ট-শ্রুত বানরদের মত ছিল না। তাদের বুদ্ধি, হৃদয় ক্ষমতা এবং চেহারার যে পরিচয় খোদ রামায়ণ থেকেই মেলে তাতে বোঝা যায়, এরা মানুষই ছিল, তবে অবশ্যই অনার্য সম্প্রদায়ভুক্ত। প্রথম কথা, প্রাচীন সংস্কৃতে ‘বা’ শব্দটি উপমার্থে ব্যবহৃত হত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে বা-নর মানে দাঁড়ায় নরের মত, মানুষের মত। মূল রামায়ণে বানরদের চেহারাও মোটেই বানরোচিত নয়। কিষ্কিন্ধ্যারাজ বালির মুখটি যেন ঊষার আলোয় ধোয়া সূর্যের মত—তরুণার্কনিভাননম্ আর গায়ের রঙ ঠিক সোনার মত—বালী স কনকপ্রভঃ। বালির ভাই সুগ্রীবও তাই—‘বরহেমবর্ণঃ’ অথবা ‘সুগ্রীবো হেমপিঙ্গলঃ’। বানরদের মধ্যে হনুমান, অঙ্গদ—এদের চেহারা ফর্সা বলেই সর্বত্র বলেছেন বাল্মীকি। তবে রঙচাপা বানরও যে ছিল না, তা নয়। সুগ্রীব, বালি, হনুমান এরা সবাই আর্যসমাজের প্রতিভূ সূর্য, ইন্দ্র, বায়ুর পুত্র হওয়ায় এঁদের রঙ কাঁচা সোনার মত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ব্রহ্মার অশ্রুবিন্দু থেকে ত্রিভুবনের সেরা সুন্দরীটি জন্মেছিল, নাম তার ঋক্ষরজা। তার রূপ দেখে ইন্দ্র এবং সূর্য কেউই আত্মসংবরণ করতে পারেননি। ঋক্ষরজার চুলের মধ্যে ইন্দ্রের তেজ পতিত হওয়ায় কিষ্কিন্ধ্যার বানররাজার জন্ম, নাম হয় বালি—বালেষু পতিতং বীজং বালি নাম বভূব সঃ। আর গ্রীবার ওপরে পতিত সূর্যতেজ থেকে জন্মালেন সুগ্রীব। হনুমানের জন্মও এমনিধারা অলৌকিক। এ-ক্ষেত্রে সুন্দরী অঞ্জনা ধর্ষিতা হয়েছেন বায়ুদেবতার দ্বারা। দেবতাদের ঔরসে এইসব বানরদের জন্ম দিয়ে বাল্মীকি নিজের জন্য অদ্ভুত এক বৈজ্ঞানিক ফাঁপর তৈরি করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় এঁরা কেউই আক্ষরিক অর্থে বানর ছিলেন না। যদি লেজের কথা বলেন, তা হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে—বালির বৌ তারা, সুগ্রীবের বৌ রুমা কিংবা অন্য কোন বানরীর লেজের কথা বাল্মীকি ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তবে হ্যাঁ, বালি, সুগ্রীব, হনুমান অথবা কাপড়চোপড়-পরা রামায়ণের সব বানরেরাই একটা করে লেজ নিজের দেহে লাগিয়ে নিতেন। সুন্দরকাণ্ড হনুমান যখন সমুদ্র পার হওয়ার জন্য বিরাট এক লম্ফ দিলেন, তখন তাঁর পশ্চাৎদেশে লাগানো লেজটি গরুড়ের মুখে লটকানো সাপের মত লাগছিল—তস্য লাঙ্গুলম্ আবিদ্ধম্ অতিবেগস্য পৃষ্ঠতঃ। দদৃশে গরুড়েনের হ্রিয়মানো মহোরগঃ ॥
‘আবিদ্ধ’, ‘সমাবিদ্ধ’—এইসব শব্দগুলি তো ‘আটকানো’, ‘লাগানো অর্থেই সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয়। যদি বা পণ্ডিতেরা শব্দের নানার্থ ভাবনায় ‘আবিদ্ধ’ শব্দের অন্য মানে করেন, তা হলে বলি বাল্মীকি রাবণের মুখ দিয়েই পরিষ্কার জানিয়েছেন যে রামায়ণী বানরদের লেজটা হল সম্মান এবং সৌন্দর্যের প্রতীক। সীতার খবর নেওয়ার পর রাবণকে দেখার ইচ্ছায় হনুমান রাবণের নন্দনকানন ভেঙে দিলেন এবং ইন্দ্রজিতের হাতে ধরা দিলেন। সবাই অবধ্য দূতকে বধ করবার উপদেশ দিলেও বিভীষণের কথামত রাবণ বললেন —বাপু হে, লেজ। জিনিসটা বানরদের অত্যন্ত আদরের জিনিস এবং এটাই তাদের অলঙ্কার, সম্মানের প্রতীক—কপীনাং কিল লাঙ্গুলমিষ্টং ভবতি ভূষণম্। সাধারণভাবে বানরদের সম্বন্ধে এ কথা বলেই রাবণ বললেন—দাও ব্যাটার লেজগাছি পুড়িয়ে। পোড়া লেজ নিয়ে চলে যাক ও নিজের বানরসমাজে—তদস্য দীপ্যতাং শীঘ্রং তেন দগ্ধেন গচ্ছতু। আমাদের কৃত্তিবাস তো আমাদের চোখে দেখা হনুমানগুলির সঙ্গে বাল্মীকির হনুমানের স্বাজাত্য প্রণয়ন করার জন্য হনুমানের লেজের আগুন সাগরের জলেও নিভতে দেননি এবং প্রতিকারের জন্য হনুমানকে আবার সীতার কাছে নিয়ে এসেছেন। সীতা হনুমানকে বললেন লেজটা মুখের ভেতর পুরে দিতে। “তবে হনূ হয়ে অতি জ্বালায় কাতর। জ্বলন্ত লাঙ্গুল পুরে মুখের ভিতর ॥” জ্বালা নির্বাণ হল বটে কিন্তু সেই অবধি সে মুখপোড়া হনুমান। সাগর-জলের আয়নায় মুখ দেখে বিষণ্ণ হনুমান আবার ফিরে এসেছে সীতার কাছে। সীতা অভয় দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছেন—সমুদ্রের ওপারে গিয়ে দেখবি তোর আত্মীয় বন্ধু, সবারই মুখ-পোড়া—মম বাক্যে সকলেই হবে মুখ পোড়া। বাল্মীকির রামায়ণে লেজের আগুনে হনুমানের কোন কষ্টই বর্ণিত হয়নি এবং সে আগুন সাগরের জলেই নিভে গেছে, কাজেই লেজটা যে বানরদের কোন উপাঙ্গ ছিল না, সে কথা পরিষ্কার। তা ছাড়া বাল্মীকি রামায়ণের বানরেরা অনেকেই বেদ-বেদান্ত অর্থশাস্ত্র এবং আয়ুর্বেদ ভাল জানত। কিন্তু অনেক বিচক্ষণতা সত্ত্বেও এই বানরেরা মাঝে মাঝেই উল্টোপাল্টা কাজ করে ফেলত এবং এই চাঞ্চল্যই ছিল এদের স্বভাবদোষ। কিন্তু কৃতকর্মের জন্য যখন তারা লজ্জিত হত, তখন নিজেই বলে উঠত—এটা একেবারে বাঁদরামি করে ফেলেছি—কপিত্বঞ্চ প্রদর্শিতম্। বাঁদর বাঁদরামি করছে—এ কথা আমরা বলি না আমরা মানুষের উদ্দেশেও বলি বাঁদরামি কোর না। কিন্তু লঙ্কাদাহের পর হনুমান ভাবলেন লঙ্কার আগুন যদি অশোকবনেও বিস্তৃত হয় তা হলে তো সীতাও মারা পড়বেন—ইস্ ছি ছি, এই চাঞ্চল্যের জন্যই বাঁদরামি ব্যাপারটা বিখ্যাত হয়ে গেছে—প্রথিতং ত্ৰিষু লোকেষু কপিত্বমনবস্থিতম্। আবার বালিবধের পর সুগ্রীব অনুতাপে আত্মসমালোচনা করে বলছেন—বালিই নিজের মান রক্ষা করেছেন, তিনি কখনও আমাকে মেরে ফেলবার কথা ভাবেননি, কিন্তু আমি! আমি তার সঙ্গে ক্রোধ ব্যবহার এবং বাঁদরামি সবই করেছি—ময়া ক্রোধশ্চ কামশ্চ কপিত্বঞ্চ প্রদর্শিতম্।
বাঁদরামি বলতে ‘কপিত্ব’ কথাটির ব্যবহার অবশ্যই বাল্মীকির যোজনা, কিন্তু বাল্মীকির বক্তব্যেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে তাঁর রামায়ণের বানরদের জাত আলাদা এবং রাজনীতি জিনিসটা এই বানরেরা ভালই বুঝতেন। একটু পরেই আমরা সে কথায় আসব। রামের সঙ্গে ঋষ্যমূক পর্বতে সুগ্রীবের সঙ্গে দেখা হবার আগে রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই শবরীর আশ্রমে যান। শবরী অবশ্যই শবর জাতির মেয়ে, মতঙ্গ মুনির কথায় তিনি রামদর্শনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুড়ো হয়ে গেছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণের ভাষ্যমত, শবরী পম্পা সরোবরের তীরে জন্মানো। বন্য ফল সংগ্রহ করে রেখেছিলেন রামের জন্য—ময়া তু সঞ্চিতং বন্যং—পম্পায়াস্তীরসম্ভবম্। একমাত্র কম্ব রামায়ণেই দেখি, ভক্তি এবং অনুরাগের আতিশয্যে সেই বন্য ফলগুলি মিষ্টি কি না আগে চেখে দেখে তার পর সেগুলি রামের জন্যে রেখে দিয়েছেন শবরী। রঙ্গনাথী রামায়ণে এই খবরটি সোজাসুজি না থাকলেও, তেলেগুভাষীরা শবরীর কথা উঠলেই এই ফল চাখার অনুরাগটুকু না জানিয়ে পারেন না।
শবরীর আশ্রম ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে ঢুকে পড়ব। রাম যখন এখানে এলেন তখন বসন্তকাল এসে গেছে। সীতার অভাবে তিনি যতখানি মর্মাহত তার থেকেও বেশি মদনাহত। পম্পা সরোবরের তীরে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে রাম যে বিরহোক্তি করেছেন, তা খুব পরিস্রুত নয়, ধীরোদাত্ত নায়কের উপযুক্ত তো নয়ই। এগুলি যতখানি বিরহোক্তি তার থেকেও বেশি। কামুকোক্তি। এটা অস্বাভাবিক তা আমি বলছি না,কিন্তু এই উক্তিগুলি সারা পথ, সমস্ত অধ্যায় ধরে শুনতে হয়েছে লক্ষ্মণকে।
বাল্মীকি তাঁর রামচন্দ্রকে কামগন্ধশূন্য কোন অতিদেব বানাতে চাননি। মহিমান্বিত প্রেমের মৃদু প্রলেপ গায়ে মেখে রামচন্দ্র এখানে শুধু বিরহোক্তি করেননি, বরঞ্চ বসন্তোদয়ে মৃগ-পক্ষীর রতিক্রীড়া দেখে তিনি নিতান্ত অলজ্জভাবে মানুষের মতই কামাসক্ত বোধ করেন। হাঁস-কোকিলের পারস্পরিক কামনার ডাক শুনে রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বলেন—ইস্, এখন সীতা থাকলে আমাকেও এইভাবে আকুল-ডাকে ডেকে নিয়ে আনন্দিত করত। এই দেখ না, ময়ূরী ময়ূরের সঙ্গে যে কামার্ত্ত ব্যবহার করছে, আমার সীতা অপহৃত না হলে ঠিক একইরকম সকাম ব্যবহার করত—মদনেনাভিবৰ্ত্তেত যদি নপেহৃতা ভবেৎ।
পম্পা সরোবরের তীরে মনোহর অরণ্যের মধ্যে রামচন্দ্র যত তিৰ্য্যপ্রাণীর কামক্রীড়া দেখেছেন, তাঁর কামবেগ তত বেড়েছে। বারবার তিনি বলেছেন—এরা কেমন রমন করছে, আর আমার কামোদ্দীপনা হচ্ছে—রমতে কাস্তয়া সার্ধং কামম্ উদ্দীপয়ন্নিব।
সখেদে লক্ষণকে বলেন, যদি এখন শুধু সীতার সঙ্গে থাকতে পেতাম তা হ’লে ইন্দ্রপুরী কি অযোধ্যায়ও আমি ফিরে যেতাম না। বাল্মীকির রাম এই রকমই রক্তমাংসের মানুষ। অনেক ধীরোদাও গুণের সঙ্গে তাঁর কামনা-বাসনাও বড় স্বাভাবিক করে দেখিয়েছেন বাল্মীকি।
এর পরেই সুগ্রীবের সঙ্গে রামের দেখা। সুগ্রীব যদিও রামকে বালির চর ভেবে হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন যথাযথ খবর নিতে। কিন্তু হনুমানের ব্যাকরণসম্মত সংস্কৃত উচ্চারণ আর বাগ্মিতায় রাম এত অভিভূত হয়ে গেছিলেন যে অন্তত ন’টা শ্লোকে হনুমানের বাক্যবিন্যাসের প্রশংসা করেছেন। শেষে আপন বংশমর্যাদার কথা বারবার বলে তিনি সুগ্রীবের শরণ নিয়েছেন—সুগ্রীবং শরণং গতঃ। রাম এবং সুগ্রীব যে অগ্নিসাক্ষী করে পরস্পরের বন্ধু হলেন—সুগ্রীবো রাঘবশ্চৈব বয়স্যত্বমুপাগতৌ—এইখানেই রাজনীতির আরম্ভ, দু’জনের প্রয়োজন ছিল দু’জনকেই। পাঠক মনে রাখবেন, রাম জন্মানোর অনেক আগে রাবণ এক সময় বালির সঙ্গে লড়তে এসেছিলেন। বালির সন্ধ্যা বন্দনার সময়ে রাবণ উপস্থিত হওয়ায় বালি তাঁকে বগলদাবা করে চার সমুদ্রে সন্ধ্যা করে এলেন। বালির শক্তি দেখে রাবণ তাঁকে বললেন—তোমার সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করতে চাই অগ্নিসাক্ষী করে—ত্বয়া সহ চিরং সখ্যং সুস্নিগ্ধং পাবকাগ্রতঃ। বাল্মীকিতে বালি আর রাবণের সখ্যবন্ধনে যে আলিঙ্গন আর ভাতৃভাবের ছবি ফুটে ওঠে, ঠিক একই ছবি আছে সুগ্রীব আর রামের বন্ধুত্বে।
মনে রাখতে হবে রামায়ণের যুগটা আর্যায়ণের যুগ। উত্তর ভারতে আর্যদের ঘাঁটি যখন সুরক্ষিত, তখন আস্তে আস্তে তাঁরা হাত বাড়িয়েছেন বিন্ধ্য পর্বতের ওপারটায়। আযয়ণের এই সম্ভাব্যতার কথা অনার্যদের অজানা ছিল না এবং ঠিক এই কারণেই অনার্য রাবণের সঙ্গে আরও এক ক্ষমতাশালী অনার্য প্রধানের বন্ধুত্ব রাজনীতির দিক থেকে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আবার দেখুন বালি আর সুগ্রীব যমজ ভাই, একটু বড়-ছোট। বড় ভাই রাজা হওয়ায় আরেক ভাইয়ের রাজ্যভোগের আশা জীবনের নত ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। রাজ্যের লোভেই সে ‘ডিফেক্ট’ করে বেরিয়ে গিয়ে হাত মেলাচ্ছে আর্যগোষ্ঠীর প্রধান। পুরুষ রামচন্দ্রের সঙ্গে। একই গোষ্ঠীর মধ্যে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ভ্রাতৃবিরোধের সুযোগ নিতে রামচন্দ্র ছাড়েননি এবং ছাড়েননি এই জন্যেই যে বালির সঙ্গে রাবণের মৈত্রী চুক্তি অগ্নিশিখায় লিখিত হয়েছিল অনেক আগেই। দুই বিরোধী গোষ্ঠীর দুটি আলাদা আলাদা মৈত্রী চুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই আমরা দেখব সুগ্রীব বারবার রামকে বলছেন যে, বিনা কারণে বালি তাঁকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছে এবং তাঁর স্ত্রী রুমাকেও নিজের অঙ্কশায়িনী করেছে—‘এবং বিনিকৃতো রাম⋯হতভার্যো বনে এস্তঃ’। সুগ্রীব ‘হতভার্য’, রাম হৃতভার্য। রামও বিনা কারণে রাজ্য থেকে বনে নির্বাসিত, সুগ্রীবও তাই। একই ভাব, একই সুর। রাম প্রতিজ্ঞা করলেন—আজ থেকে আমাদের এক দুঃখ, এক সুখ—একং দুঃখং সুখঞ্চ নৌ। মারব সেই বালিকে, যে তোমার পত্নীকে হরণ করেছে—বালিনং তং বধিষ্যামি তব ভার্যাপহারিণম্। হৃতপত্নীক রামের কাছে তখন যে কোন ভার্যা-হরণকারীই বধযোগ্য। সুগ্রীব কিন্তু রামের কাছে তাঁর নিজের অন্যায়ের কথা পুরোপুরি চেপে গেছেন। বালির স্ত্রী তারাবৌদির ওপরে সুগ্রীবের যে ভীষণ আসক্তি ছিল, সে কথা সুগ্রীব একবারও রামকে বলেননি। মায়াবী দুন্দুভিকে বধ করার জন্য বালি গুহায় ঢুকলে প্রহররত সুগ্রীব যে গুহার মুখে পাথর চাপা দিয়ে, বালির শ্রাদ্ধ পর্যন্ত করে ফিরে এসেছিলেন—তার একটা বড় কারণ ছিল সুন্দরী তারা। বালির অনুপস্থিতিতে তারাকে আপন অঙ্কশায়িনী করতে তাঁর একটুও বাধেনি। আর বালি যে সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে অধিকার করেছিলেন সে শুধু প্রতিহিংসাবশতই। কিন্তু রামের কাছে রুমা হরণের গপ্লোটি সুগ্রীব ফলাও করে বলেছেন কিন্তু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীকে লঙ্ঘন করার কথা সুগ্রীব পুরোপুরিই চেপে গেছেন। রামও কি আর এসব কিছুই জানতেন না, কিন্তু নিজের অবস্থা বুঝে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এসব কথায় কান দেননি বরঞ্চ অন্যায়ভাবে বালিবধ করে বসলেন। বালিবধের পর সাময়িক শ্মশানবৈরাগ্য এবং কুম্ভীরাশুবর্ষণের পর সুগ্রীব আবার যাকে নিয়ে দিন-রাত মত্ত হয়ে উঠলেন সে কিন্তু তাঁর নিজের স্ত্রী রুমা নন, বালির স্ত্রী তারা—তারয়া সহিতঃ কামী সক্তঃ কপিবৃষস্তদা। রসে-রমণে, রামের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞার কথাও সুগ্রীব ভুলে গেছেন। কিন্তু সুগ্রীবের এই কামোন্মত্ত অবস্থায় সীতার অন্বেষণ-কার্য বিলম্বিত হওয়ায় রাম যে সুগ্রীবের ওপর খুব চটে গেলেন তার পেছনে কারণ কিন্তু রামও সীতার জন্য একধরনের কামনা বোধ করছিলেন। দিন যত যাচ্ছিল সীতার জন্য তাঁর কামনা, আকাঙক্ষা বেড়েই চলছিল। বিশেষত তিনি জানতেন সুগ্রীব কাম-ক্রীড়া করতেই বালিপত্নী তারা এবং রুমার সঙ্গে অন্তঃপুরে ঢুকেছেন অথচ সীতা-বিহনে রামের সে উপায় নেই—কামবৃত্তঞ্চ সুগ্রীবং নষ্টাঞ্চ জনকাত্মজাম্। এর ওপরে শরৎকালের নিসর্গ সৌন্দর্য তাঁর কামবেগ দ্বিগুণিত করছিল। তিনি ভাবলেন—সুদূরবাসিনী সীতাও হয়তো তাঁরই মত কাম-পীড়িত বোধ করছেন—সুদূরং পীড়য়েৎ কামঃ শরদ্গুণনিরন্তরঃ! এমনই রামচন্দ্রের বিপর্যস্ত অবস্থা যে, ফল-মূল কুড়িয়ে ফিরে এসে লক্ষ্মণ তাঁর দাদার কাম-প্রলাপ শুনে তাঁকে এক বকা লাগিয়েছেন। তিনি বললেন—এ কি! আর্যপুত্র, এত কামাবেশ। হলে চলে, এরকম করলে তো আপনার পৌরুষ ধুলোয় মিশে যাবে—কিমার্য কামস্য বশংগতেন, কিমাত্ম-পৌরুষ-পরাভবেন। রামচন্দ্র অবশ্য লক্ষ্মণের বকায় খানিকটা আত্মস্থ হলেন এবং তাঁকেই বললেন সুগ্রীবকে সতর্ক করে দিতে। অবশ্য রাম যা বললেন তাতে বোঝা গেল তাঁর রাগটা কোথায়। তিনি বললেন—আমরা শোকে-তাপে মড়ছি, আর সুগ্রীব বসে বসে কামক্রীড়া করছে আর মদ খাচ্ছে—সামাত্য-পরিষৎ ক্রীড়ন্ পানমেবোপসেবতে। রামের কথার শেষে লক্ষ্মণ স্বয়ং কিষ্কিন্ধ্যায় এসে সুগ্রীবকে রীতিমত হুমকি দিয়ে বললেন—বালির মরার পথটি এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি—ন স সংকুচিতঃ পন্থা যেন বালি হতো গতঃ। সর্বত্র কামোন্মত্ততার ছড়াছড়ি দেখে লক্ষ্মণের রাগ আর কিছুতেই কমে না। সুগ্রীব ভাবলেন তারার মত বুদ্ধিমতী মেয়ে যদি লক্ষ্মণের কাছে যায়, তবে নিঘাত কাজ হবে, তার রাগও থাকবে না—ত্বদ্ দর্শনে বিশুদ্ধাত্মা মাস্ম কোপং করিষ্যাতি।
তারা চললেন। মদের ঘোরে টালমাটাল পায়ে মদবিহ্বলাক্ষি তারা গেলেন লক্ষ্মণের কাছে, আর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মণের মাথাটি নিচু হল—অবাঙ্মুখো’ভূৎ। তাঁর দৃষ্টিও প্রসন্ন হল। লক্ষ্মণ বললেন—সুগ্রীব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন। বসে বসে শুধু মদ খেয়ে আর স্ত্রী বিহার করে সীতাকে খোঁজার সময়ই পার করে দিয়েছেন—ব্যতীতাংস্তান্ মদোদগ্রো বিহরন্ নাবলুধ্যতে। এবারে তারা লক্ষ্মণকে একটু চিমটি কেটেই বললেন—কুমার! সবই বুঝি কিন্তু কাম জিনিসটা যে কি তা বোধ হয় তুমি জান না—ন কামতন্ত্রে তব বুদ্ধিরস্তি। এতকাল পরে সুগ্রীব আমাকে পেয়েছেন তো, তাই কামবশত নিয়ত আমার আঁচল-ধরা সুগ্রীবকে। আপনি ক্ষমা করুন—তং কামবৃত্তং মম সন্নিকৃষ্টং/ কামাভিভোগাচ্চ বিমুক্তলজ্জং/ক্ষমস্ব⋯। বেচারা আগে বহু কষ্ট পেয়েছে, এত দিনে একটু সুখের মুখ দেখেছে—সুদুঃখশায়িতং পূর্বং প্রাপ্যেদং সুখমুত্তমম্—তাই তাঁর বিশ্বামিত্র মুনির মত একটু বেসামাল অবস্থা। বিশ্বামিত্রের কথা আপনার মনে আছে তো? সেই যে সেই ঘৃতাচী অপ্সরার সঙ্গে দশ বছর রতিক্রীড়া করার পর, তপঃক্লিষ্ট মুনির মনে হয়েছিল, বুঝি এক দিন কেটেছে। সুগ্রীবেরও সেই অবস্থা, আপনি ক্ষমা করুন—জহি কোপ অরিন্দম। হয়তো লক্ষ্মণের রাগ কমে যেত, হয়তো ক্ষমা হয়ে যেত। কিন্তু তারার সঙ্গে লক্ষ্মণ যখন সুগ্রীবের অন্তঃপুরে পৌছোলেন, তখন যে তিনি তাঁকে চিন্তাকুল বিব্রত দেখবেন, তা নয়। তারা বাইরে গেছেন, অতএব তাঁর ফাঁকটুকু পুরিয়ে দিচ্ছিলেন রুমা। বিশেষত অন্তঃপুরে এসে রুমাকে সুগ্রীবের শীতল বক্ষে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখেই লক্ষ্মণ আবার রাগে ফেটে পড়লেন। তাতে কাজও হল অবশ্য, বানর-রাজ্যে সীতা অন্বেষণের সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যার বহির্দ্ধারে এবং অন্তঃপুরে সমস্ত পরিস্থিতিটি যিনি সামাল দেন, তিনি সুগ্রীব নন, তারাই। মূলত এই রুচিরা রমণীর জন্যই লক্ষ্মণ শান্ত হন এবং তাঁর কথাও শোনেন—প্রতিজগ্রাহ তদ্বচঃ।
লক্ষ্মণ-তারা-সুগ্রীব—এঁদের ঘটনা-পরম্পরা, যেমনটি আমরা বাল্মীকি রামায়ণে দেখলাম, তার মূল সুরটি কৃত্তিবাসী এবং রঙ্গনাথী রামায়ণেও ধরা আছে। তবে কৃত্তিবাস সুগ্রীবপত্নীর রুমা নামটি আধুনিকগন্ধী মনে করে তার নাম দিয়েছেন উমা। তুলসীদাসে এসব বর্ণনা ভক্তিরসে আপ্লুত। বাল্মীকিতে যা আছে তা সেখানে থাকা সম্ভবই নয়। কম্ব রামায়ণে কিন্তু লক্ষ্মণকে দেখে অঙ্গদ প্রথম ছুটে যায় তারার কাছে এবং তারা সেখানে অঙ্গদ আর হনুমানকে রামের কার্যে বিলম্ব করার জন্য খুব একচোট বকাবকি করেন। শেষে তিনি লক্ষ্মণের কাছে পৌঁছোলেন, তখন তাঁকে দেখেই লক্ষ্মণের মনে পড়ল বিধবা মায়েদের কথা। বালিপত্নী তারা বিধবার বেশে সাদা থান কাপড় পরে লক্ষ্মণের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কম্বের বর্ণনামত তাঁর গলায় নেই মঙ্গলসূত্র, কপালে নেই কুমকুম। তারার এ চেহারা অবশ্যই সতীর তেজে অঙ্কিত কেন না প্রাতঃস্মরণীয়া মহাপাতকনাশিনী পঞ্চকন্যার মধ্যে বালি-সুগ্রীবের অন্তরঙ্গা পত্নী তারাও আছেন। মূল রামায়ণে অবশ্য তারার এই সতীলক্ষ্মী বর্ণনা নেই এবং সে বিষয়ে তাঁর কোন লজ্জাও নেই।
প্রকৃত কথায় আসি। বস্তুত লক্ষ্মণের হুঙ্কারেই সুগ্রীব আত্মস্থ হলেন, রামের কাছে প্রতিপালনের ধর্মভয়ে নয়। অন্তত বালিপুত্র কুমার অঙ্গদেরও সেই ধারণা। তিনি বলেছেন সুগ্রীবের আবার ধর্ম! তিনি সীতাকে খোঁজবার আদেশ দিয়েছেন লক্ষ্মণের ভয়ে, ধর্মের ভয়ে নয়—লক্ষ্মণস্য ভয়েনেহ নাধর্মভয়ভীরুণা। আদিষ্টা মার্গিতুং সীতাং ধর্মস্তস্মিন্ কথং ভবেৎ ॥ বালি মারা গেছে, রাজ্যও পাওয়া গেছে, মন্ত্রীরা বশ্যতাপন্ন, সুন্দরী তারাও হাতের মুঠোয়, এ অবস্থায় কেই বা পরের বৌ হারিয়ে গেছে বলে অত মাথা ঘামায়। প্রথম দিকে সমস্ত রাজ্যের ভার মন্ত্রীদের ওপর দিয়ে সুগ্রীব ইচ্ছেমত কামক্রীড়া করে বেড়াচ্ছিলেন। হনুমানের উপদেশে ত্রস্ত হয়ে একদিন খুব গরমভাবে তিনি আদেশ দিলেন—সমস্ত ভারতবর্ষের বানরকে আমি পনের দিনের মধ্যে কিষ্কিন্ধ্যায় দেখতে চাই, না আসলে মৃত্যুস্তস্য প্রাণান্তিকো দণ্ডো না কালবিচারণা। কিন্তু এও লোক-দেখানো আদেশ। তিনি তারারানীর সঙ্গে মত্ত হয়েই রইলেন এবং সত্যি কথা বলতে কি লক্ষ্মণের হুমকি না এলে তিনি মত্ত হয়েই থাকতেন। লক্ষ্মণের কথায় সুগ্রীবের ঘুম ভেঙেছে, তিনি সমস্ত বানরসেনাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চারদিকে পাঠিয়ে দিলেন। শত অন্বেষণেও সীতাকে পাওয়া গেল না। যে পথে সবচেয়ে বিচক্ষণ দলটি গেছিল অর্থাৎ যে দলের দলপতি ছিলেন যুবরাজ অঙ্গদ, যে দলে হনুমান জাম্ববানের মত বুদ্ধিমান শাস্ত্রজ্ঞ লোকেরা ছিলেন, সে দলটি পর্যন্ত সমুদ্রের তীরে এসে হতাশ্বাস হয়ে বসে রইল, কেন না সীতা অন্বেষণের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে যুবরাজ অঙ্গদের মুখ দিয়ে কতকগুলি সত্য কথা বেরিয়ে পড়ে; হতাশা থেকেই হোক কিংবা সন্দেহ থেকেই হোক, অঙ্গদের কথাগুলি যথেষ্ট অনুধাবনযোগ্য। অঙ্গদ সমস্ত বানরদের উদ্দেশ করে বক্তৃতা করে বললেন—আমি আর বাড়ি ফিরব না। আপনারা জানেন সুগ্রীব এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং তার শাসনটাও বড়ো কড়া—তীক্ষঃপ্রকৃত্যা সুগ্রীবঃ স্বামিভাবে ব্যবস্থিতঃ। সময় পেরিয়ে গেছে, এখন ফিরে গেলেই প্রাণদণ্ড। মনে রাখবেন, আমি যুবরাজ বলে রেহাই পাব না, কেন না সুগ্রীব আমাকে যুবরাজ করেননি, করেছেন রাম—ন চাহং যৌবরাজ্যেন সুগ্রীবেনাভিষেচিতঃ। আমি বালির ছেলে বলে আগে থেকেই সুগ্রীব আমায় দেখতে পারেন না—স পূর্বং বদ্ধবৈরঃ—তার মধ্যে সীতার খবর পাইনি, আমাকে অবশ্যই মেরে ফেলবে। অতএব মরলে এখানেই মরব, সম্মান খুইয়ে মরতে চাই না। অঙ্গদের বক্তৃতা শুনে অনেক বানরই সুগ্রীবের ওপর ক্ষেপে গেল। আমাদের ধারণা, এরা ছিল সব অঙ্গ-পক্ষীয় বানরের দল। কেন না যুবরাজ অঙ্গদের কিছু সাকরেদ ছিল এবং তাদের আমরা একবার দেখেছি বালিবধের সময়ে। বালিবধের খবর পেয়ে অঙ্গদপক্ষীয় বানরেরা এদিক-ওদিক পালাচ্ছিল—যে তু অঙ্গদপরীবারা বানরা হি মহাবলাঃ। এখন অঙ্গদের কথা শুনে তারাই ক্ষেপে উঠল মনে হয়, কিন্তু ক্ষেপার মুখে যে কথাটি তারা বলল, সেই কথাটি খুব খাঁটি। বানরেরা বলল—সত্যিই তো; সুগ্রীব ভীষণ নিষ্ঠুর, আর রামের কথাই বা কি বলি, তিনি প্রিয়ার প্রেমে বড়ো বেশি পাগল—তীক্ষঃপ্রকৃত্যা সুগ্রীব: প্রিয়ারক্তশ্চ রাঘবঃ।
যে রামের কাছে মিথ্যে কান ভাঙানি দিয়ে ভাইকে মারে সেই সুগ্রীবের কথা হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু রামের প্রেমে দুনাম—এ তো বড় সাংঘাতিক কথা। সন্দেহ নেই, রাম বড় প্রেমিক ছিলেন, কিন্তু বানরদের দিক থেকে জিনিসটা লক্ষ করুন। সীতা উদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র এক ফোঁটা আর্যরক্ত খরচ করেননি, যা গেছে সব এই বানরদের ওপর দিয়ে। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে খবর পাচ্ছি—সীতাহরণের কথা শুনে ভরত তিনশ সামন্ত রাজাকে সমরসজ্জায় সজ্জিত করে অযোধ্যায় মজুত রেখেছিলেন সময়মত রামের সাহায্যে পাঠাবার জন্য। রাম না হয় অভিমানে তাঁদের ডেকে পাঠাননি, কিন্তু যে ভরত রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য বন পর্যন্ত দৌড়েছিলেন, তিনি কেন সেই তিনশ নরপতিকে—ত্রিংশতং পৃথিবীপতীন্—পাঠালেন না রামের সাহায্যার্থে। তা হলে কি ধরে নিতে হবে রামের আমলে আর্যেতর-মনুষ্যেরাই ভাল যুদ্ধ জানতেন, বালি কিংবা রাবণ। কিন্তু তাও তো নয়। বানরেরা তো যুদ্ধ করতেন গাছ পাথর আর বাহুবলের ক্ষমতায়। রাক্ষসেরাও বহু তপস্যায় যেসব অস্ত্র সংগ্রহ করতেন সেগুলিও তো আর্যদের চিরাভ্যস্ত ব্রহ্মাস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র প্রভৃতি। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, উন্নততর অস্ত্রবিদ্যাই ভারতবর্ষে আর্যদের প্রতিপত্তি দিয়েছে এবং এই উন্নততর অস্ত্রকৌশল রাম-লক্ষ্মণের অবশ্যই জানা ছিল। এই কৌশলেই বানরগোষ্ঠী বিজিত হয়েছে এবং বিজিত রাজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে রামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বানরগোষ্ঠীর পরিশ্রমেই সীতার খোঁজ মিলেছে, তাদের রক্তের মূল্যেই লঙ্কার যুদ্ধে রামচন্দ্রের জয়। সমুদ্রতীরে যে বানর সৈন্যেরা এসেছিল তাদের পরিশ্রম ব্যর্থ হয়েছে, আবার ঘরে ফিরলেও প্রাণদণ্ড। এই অবস্থায় তাদের এই স্বাভাবিক খেদোক্তি এসেছে যে রাম তাদের পরিশ্রম এবং প্রাণের মূল্যে প্রিয়া-প্রেমের প্রমাণ দিচ্ছেন—প্রিয়ারক্তশ্চ রাঘবঃ। লক্ষ্মণ যে কিষ্কিন্ধ্যায় সুগ্রীবকে হুমকি দিয়েছিলেন, সেই হুমকির প্রথম চেহারাটা দেখেছিলেন অঙ্গদ; তাই অঙ্গদের বক্তৃতার পর হনুমান অঙ্গদকে বারবার লক্ষ্মণের সেই শাণিত শরগুলির ভয়ই দেখিয়েছিলেন—অত্যুগ্রবেগা নিশিতা ঘোরা লক্ষ্মণসায়কাঃ। তার মানে, সুগ্রীব যেমন লক্ষ্মণের ভয়ে বানরদলকে সীতার অন্বেষণে লাগিয়েছিলেন, তেমনি এদের মধ্যেও লক্ষ্মণের ভয় ছিল। হনুমান অঙ্গদকে সুগ্রীবের গুণের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অঙ্গদের যেন আজকে মুখ খুলে গেছে। প্রিয় পিতার মৃত্যু, আপন জননীর প্রতি সুগ্রীবের লোভ, অবশেষে সেই সুগ্রীবের সঙ্গেই জননীর মাখামাখি দেখে অঙ্গদ আর স্থির থাকতে পারেননি। তিনি হনুমানকে সর্বসমক্ষে অভিযোগ করে বললেন—আপনি যে সুগ্রীবের স্থিরতা, শুচিতা—এইসব গুণ দেখতে পাচ্ছেন, এগুলি সুগ্রীবের মধ্যে একটুও নেই। বড় ভাই বেঁচে থাকতেই যে মায়ের সমান বড় ভায়ের বৌকে—ভ্রাতুর্জ্যেষ্ঠস্য যো ভার্যাং জীবিতাং মহিষীং প্রিয়াম্—নিজের অঙ্কশায়িনী করে, তার আবার শুচিতা, তার আবার ধর্ম—কথং স ধর্মং জানীতে! যে অগ্নিসাক্ষী করে রামের হাত ধরে বলেছিল, ‘সীতাকে খুঁজে দেব’, সে দু’দিনেই তা ভুলে গেছে। এই কি উপকার স্মরণে রাখার শ্রদ্ধা? আপনি যাই। বলুন, অধর্মের ভয়ে নয়, লক্ষ্মণের বাণের ভয়েই তিনি আমাদের সীতার অন্বেষণে। পাঠিয়েছেন—লক্ষ্মণস্য ভয়েনেহ নাধর্মভয়ভীরুণা।
আমরাও তাই মনে করি। রাম সোজাসুজি প্রবল পরাক্রান্ত বালির সঙ্গে যুদ্ধ করেননি; সুগ্রীবের গলায় গজপুষ্পীর মালা দুলিয়ে একটি বাণেই তিনি বালিকে সাবাড় করেছেন, যা বালি রামের সম্বন্ধে ভাবতেও পারেননি। বালি রামকে অজস্র গালাগালি দিয়েছেন এবং বলেছেন—সামনাসামনি যুদ্ধ করলে আজকে তোমায় যমের মুখ দেখিয়ে ছাড়তাম—অদ্য বৈবস্বতং দেবং পশ্যেং নিহতো ময়া। বালি বললেন—আমার মত বানরের সঙ্গে যুদ্ধ করার কি কারণ থাকতে পারে তোমার? অরণ্যজাত বস্তু, ফলমূল—এই তো আমাদের সম্পদ; তোমরা নিশ্চয়ই এই বন্য ফলের লোভে যুদ্ধ কর না। তোমরা যুদ্ধ কর জমি-জায়গা কিংবা সোনা রুপোর জন্য—ভূমি হিরণ্যং রূপাঞ্চ নিগ্রহে কারণানি চ। তত্র কস্তে বনে লোভ মদীয়েষু ফলেষু বা॥
বস্তুত ভারতীয় ইতিহাসের পটভূমিকায় এ কথা অনস্বীকার্য যে, বন্য ফল কিংবা বন্যসম্পদে রামেরও লোভ ছিল না, তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বর্ণলঙ্কা জয় করা, সেই ফাঁকে যদি সুন্দরী অরণ্যভূমিও হাতে আসে তো মন্দ কি? বিশেষত পরাক্রান্ত বালিকে অন্যায়ভাবে বধ করে দুর্বলতর সুগ্রীবকে তিনি হাতের পুতুল বানিয়ে নিয়েছেন। আর স্বর্ণলঙ্কা জয় করাই যে রামের আসল উদ্দেশ্য ছিল, এমন কি সীতা উদ্ধারও নয়, সে কথা রাম নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন সীতা উদ্ধারের পর, সেই লঙ্কাকাণ্ডে। সীতার মনে দুঃখ দিয়েও তিনি তখন বলেছেন—তোমাকে রাক্ষসেরা যে অপমান করেছে, তা ক্ষালন করা আমার কর্তব্য। আমি নিজের মানরক্ষার জন্যে তাই রাবণকে মেরেছি—তৎকৃতং রাবণং হত্বা ময়েদং মানকাঙিক্ষনা। মনে রেখো সীতা, বন্ধুদের সাহায্যে যে রণপরিশ্রম আমি করেছি তা মোটেই তোমার জন্যে নয়—ন ত্বদর্থং ময়া কৃতঃ। তোমাকে হরণ করা হয়েছিল—এই অপবাদ খণ্ডন করে আমি আমার প্রখ্যাত বংশের মর্যাদা রক্ষা করেছি—প্রখ্যাতস্য আত্মবংশস্য ন্যঞ্চ পরিমার্জিতা। রাম আরও একটা কথা বলেছেন—অগস্ত্য ঋষি যেমন এই দুর্জয় দক্ষিণ দিক জয় করেছিলেন, তেমনি রাবণকে মেরে আমি তোমাকে জয় করেছি—অগস্ত্যেন দুরাধার্ষা মুনিনা দক্ষিণের দিক্।
উপমাটা খেয়াল করুন। অগস্ত্যের সঙ্গে রামের তুলনা আর দুর্জয় রাবণকে মেরে সীতা উদ্ধারের সঙ্গে দক্ষিণ দিকের তুলনা। আমরা জানি এই দক্ষিণ দিকটা পুরো জয় করাই ছিল রামের উদ্দেশ্য, যেটা বালি সাধারণভাবে। বলেছেন—ভূমি র্হিরণ্যং রূপ্যঞ্চ। কিন্তু স্বর্ণলঙ্কা জয়ের আগে, বানরদের কাছে তিনি সীতা উদ্ধারের জিগির তুলেছেন এবং এতে বানরেরা ভেবেছে—একটিমাত্র স্ত্রীলোকের জন্য রামের এই বিশাল আয়োজন বড়ো বাড়াবাড়ি, তাই ছোট্ট করে তারা অনুযোগ করেছে—প্রিয়ারক্তশ্চ রাঘবঃ। অন্য দিকে সীতা উদ্ধারের পর সেই রামচন্দ্রই বলছেন-সীতা নয়, রাবণকে জয় করে বংশমর্যাদা রক্ষা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বালি আর রাবণই যেহেতু ছিলেন দক্ষিণ জয়ের বাধা, তাই সে দু’জনকে মেরে ফেলায় অগস্ত্যের মত সম্পূর্ণ দক্ষিণ দিকটাও এসে গেল রামচন্দ্রের হাতে।
আপাতত এই বিশ্লেষণটা মনে রেখেই আমরা সমুদ্রতীরে বানরদের কাছে ফিরে যাব। অঙ্গদের কথা শুনে সবাই খুব করে সুগ্রীবের নিন্দা করতে থাকল এবং মৃত বালির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। এই সময়ে জটায়ুর ভাই সম্পাতির কথায় সীতার ঠিকানা মিলে গেল, সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আবার চলে গেল রাম এবং সুগ্রীবের অনুকূলে। সীতার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বানর সৈন্যদের মধ্যে উন্মাদনা ফিরে এসেছিল। সুগ্রীব এবং রাম সেইটাকেই কাজে লাগিয়েছেন সেতুবন্ধে এবং লঙ্কা জয়ে। সেতুবন্ধনের সময় কাঠবেড়ালীরা যে বানরদের সাহায্য করেছিল, এ খবর মূল রামায়ণে নেই কিন্তু কৃত্তিবাসে আছে, আর আছে রঙ্গনাথের রামায়ণে। রামের কোমল অঙ্গুলিস্পর্শে কাঠবেড়ালীর পিঠের ওপর যে লম্বা লম্বা আঁচড় পড়ল, তার খবর আছে শুধু রঙ্গনাথের রামায়ণে। কৃত্তিবাসের কোনও কোনও সংস্করণে এই ঘটনাটা আছে বটে, তবে সব সংস্করণে নেই। সেতুবন্ধে রামেশ্বর শিবের প্রতিষ্ঠার কাহিনীও শুধু কৃত্তিবাসেই আছে, বাল্মীকিতে নেই। কিন্তু এ ঘটনা এতই প্রসিদ্ধ যে আর্য দেবতা রামচন্দ্র এবং অনার্যদের দেবতা শিবকে একেবারে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে পণ্ডিতেরা রামেশ্বর শব্দটির সমাস ভেঙে বলেছেন—‘রামের ঈশ্বর’ রামেশ্বর শিব, ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস অথবা ‘রাম যাঁর ঈশ্বর’ এমন শিব বহুব্রীহি সমাস। সমুদ্রের পারে রাম আর শিবের মুচকি হাসির সুধাবৃষ্টি এবং পরস্পর-প্রশংসা বাল্মীকির কল্পনাতে আসেনি। যা হোক আমরা আপাতত রামকে বানরবৃন্দসহ সমুদ্রের পারে রেখে অল্পক্ষণের জন্য রাক্ষসরাজ রাবণের লঙ্কাপুরীতে ঢুকব।
কি করে বোঝাই, রামায়ণের বানরেরা যেমন বাস্তবের বানর নয়, রামায়ণের রাক্ষসেরাও তেমনি আসলে রাক্ষস নয়। রাবণ তো ব্রাহ্মণদের মত হোম করতেন রীতিমত। বেদান্ত শাস্ত্রে তিনি সুপণ্ডিত, বৈদিক কর্মকাণ্ডেও অগ্রণী পুরুষ—এষ আহিতাগ্নিশ্চ মহাতপাশ্চ বেদান্তগঃ কর্মসু চাগ্র্যশূরঃ। রাবণের আপন গৃহের গার্হপত্য অগ্নি থেকেই রাবণের শবদেহে অগ্নিসংস্কার করা হয়েছে ব্রাহ্মণেরা সেখানে চোখের জলে মন্ত্র পড়েছে—রাবণং রাক্ষসাধীশং অশ্রুপূর্ণমুখা দ্বিজাঃ। রাবণকে চিতাতেও তোলা হয়েছে রীতিমত বেদবিধি অনুসারে—ব্রাহ্ম্যা সংবৰ্ত্তয়ামাসুঃ, যদিও তান্ত্রিক আচারও ছিল যথেষ্ট। যদি বলেন রামের সংস্পর্শে আসার পর রাক্ষসেরা এইসব আর্য আচার গ্রহণ করেছেন, তা তো মোটেই নয়, আহিতাগ্নি, ‘বেদবিদ্যাবিধিস্নাত’ বেদান্তবিৎ—এইসব বিশেষণ তো রাবণের চিরকালের। এতেও যদি বিশ্বাস না হয়, তা হলে আমাদের হনুমানের সঙ্গে রাবণের অন্তঃপুরে ঢুকতে হবে। সেই যখন হনুমান একা সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে রাবণের অন্তঃপুরে ঢুকে পড়েছিলেন। লঙ্কা-গৃহের নান্দনিক স্থাপত্য দেখে হনুমান ভেবেছিলেন—এ কি স্বর্গপুরী না দেবলোক, নাকি ইন্দ্রপুরী—স্বগোহিয়ং দেবলোকোহয় ইন্দ্রস্যাপি পুরী ভবেৎ। লঙ্কার মধ্যে ঢুকে হনুমান যেমন মদনবিদ্ধা রমণীদের শিঞ্জিনীধ্বনি শুনেছিলেন তেমনি বেদ্যাধায়ী রাক্ষসদের মন্ত্রধ্বনি স্তবস্তুতিও শুনতে পেলেন—শুশ্রাব জপতাং তত্র মন্ত্রান্ রক্ষাগৃহেযু বৈ। স্বাধ্যায়-নিরতাংশ্চৈব যাতুধানান দদর্শ সঃ। হনুমান যেমন খারাপ চেহারার রাক্ষস দেখেছেন, তেমনি আবার সুন্দর সুন্দর রাক্ষসও দেখেছেন বুদ্ধিদীপ্ত চারুভাষী রাক্ষসও দেখেছেন—ননন্দ দৃষ্ট্বা চ স তা সুরূপান্, নানাগুণান্ আত্মগুণানুরূপান্। কিন্তু হনুমানের সবচেয়ে ভাল লাগল লঙ্কা-সুন্দরীদের দেখে। বানর-রাজ্যে বালিপত্নী তারার চেয়ে বেশি সুন্দরী হনুমান দেখেননি, তেমন মনস্বিনী বুদ্ধিমতীও দেখেননি। কিন্তু লঙ্কার সব সুন্দরীদের বালিপত্নী তারার মতই লাগল হনুমানের—তেযাং স্ত্রিয়স্তত্র মহানুভাবা, দদর্শ তারা ইব সুস্বভাবাঃ। এর পরে রাবণের অন্তঃপুরের যে মনোগ্রাহী বর্ণনা বাল্মীকি দিয়েছেন, তা শত রসশাস্ত্রের সাগর-ছেঁচা ধন, অযোধ্যা, কিষ্কিন্ধ্যার সৌন্দর্য সেখানে ম্লান হয়ে গেছে। তা এতই নিপুণ, এতই স্নিগ্ধ আবার এতই প্রকট যে হনুমান ছাড়া আর কেউ দেখলে বিব্রত বোধ করবে। রাবণের স্ত্রীরত্নগুলি দেখে হনুমান মন্তব্য করেছে যে, একমাত্র সীতা ছাড়া আর সব মহিলাই রাবণের গুণে কিংবা বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আপনি এসে রাবণের বাহুর ডডারে ধরা দিয়েছে, কাউকে হরণ করে আনতে হয়নি—ন তত্র কাশ্চিৎ প্রমদা প্রসহ্য, বীর্যোপপন্নেন গুণেন লব্ধা। এঁদের মধ্যে দৈত্য, রাক্ষস কিংবা গন্ধর্বদের মেয়েরা তো আছেনই, রাজা, ঋষি এবং ব্রাহ্মণের মেয়েরাও আছেন—রাজর্ষি-বিপ্র-দৈত্যানাং গন্ধবানাঞ্চ যোষিতঃ। সে যুগে রাজা, ব্রাহ্মণ এমন কি ঋষিকন্যারাও যাঁকে মোহবশত স্বেচ্ছায় স্বামিত্বে বরণ করেছে, সে লোকটিকে শুধু রাক্ষস বললেই হল! সবচেয়ে বড় কথা রাবণের প্রধানা পত্নী মন্দোদরীর রূপ দেখে হনুমান ভেবেছিলেন যে তিনিই সীতা। মন্দোদরী সীতার চেয়ে কোনও অংশে কম সুন্দরী ছিলেন না; তাঁর হাব-ভাব, রূপ এবং আভিজাত্য দেখে হনুমানের মনে হল, এই সীতা—তর্কয়ামাস সীতেতি রূপ-যৌবনসম্পদা। মুহূর্তের জন্য কপিবর একেবারে আত্মবিস্মৃত হলেন। আবিষ্কারের আনন্দে, অকারণে লাফিয়ে লাফিয়ে নিজের লেজেই চুমু খেতে লাগলেন। মুহূর্তেই হনুমানের ভুল ভাঙল, তিনি ভাবলেন—সীতা কি রাম-বিহনে সেজেগুজে মদ খেয়ে রাবণের পাশে শুয়ে থাকবেন—ন ভোক্তুং নাপ্যলংকৰ্ত্ত ন পানমুপসেবিতুম্।
কিন্তু এ তো একটা ধারণামাত্র। একটা আরোপিত আদর্শবোধ। সীতাও তো মদ খেতেন। তবে হয়তো রাম-বিহনে খেতেন না, যেমন রাম খেতেন না সীতা-বিহনে। কিন্তু ‘রাজর্ষি বিপ্র’দের অভিজাত কন্যারাই যেখানে স্বেচ্ছায় রাবণের কণ্ঠলগ্না হতেন সেখানে সীতার পক্ষেও এই ব্যবহার আশ্চর্য ছিল না। আসলে বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা মহিলাদের মধ্যে অনেকেরই রাবণের ব্যাপারে মোহ থাকলেও, সীতার যে সে মোহ ছিল না, বা সে মোহ যে কোনওদিন হয়নি—এইটে দেখানোই তো বাল্মীকি-মহাকাব্যের অভিপ্রায় এবং মহাকাব্য বিস্তারের সম্বলও বটে। কিন্তু তবু বলব হনুমানের যুক্তিটা বাল্মীকির মতই জোলো, বরঞ্চ তাঁর পূর্বতন শঙ্কাটি ছিল ঠিক। হনুমান ভেবেছিলেন যে, রামের স্ত্রী যদি এই হাজারো স্ত্রীলোকের মত রাবণ কর্তৃক উপভুক্তা হয়েই থাকেন—যদি ঈদৃশী রাঘবধর্মপত্নী, তবে অবশ্য রাবণের পক্ষেই মঙ্গল—সুজাতমস্যতি হি সাধুবুদ্ধে, কেন না আমার মুখে শুধু এই খবরটি শুনলেই রাম আর যুদ্ধ করতে আসবেন না। বাল্মীকির কাব্য আর তা হলে মহাকাব্য হত না, লঘুকাব্যের নটেগাছেই মুড়িয়ে যেত। আপাতত অবশ্য মহাকাব্যের সম্প্রসারণ নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। আমাদের বক্তব্য রাবণ রাক্ষস হয়ে গেছেন শুধু তাঁর আপন স্বভাবে; মদ মাংস এবং স্ত্রীলোকের ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতাই রাবণকে রাক্ষস বানিয়েছে। রাবণ বলেছিলেন—এ আমাদের ধর্ম—‘স্বধর্মে রক্ষসাং ভীরু’, জোর করে পরস্ত্রীগমনে কি হরণে আমাদের রাক্ষসজাতির কোন দোষ নেই—গমনং বা পরস্ত্রীনাং হরণং সংপ্রমথ্য বা। আমরা জানি, রাক্ষস-বিবাহেও তো কন্যাহরণ অনুমোদিত। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই যে মাত্রাজ্ঞানের প্রয়োজন আছে, এই মাত্রাটা মন্দোদরীর কপালদোয়ে এবং রাক্ষসজাতির স্বভাবদোষে রাবণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই মাত্রাই ছিল আর্যসমাজের সঙ্গে রাক্ষসদের পার্থক্যরেখা, নইলে তাঁরা শুধুই রাক্ষস নন।
আসলে সীতার ব্যাপারে রাবণের রোখ চেপে গেছিল। রাবণ নিজে এতটাই বড় ছিলেন যে, কোন স্ত্রীলোক তাঁকে ‘না’ বলবে, এ তিনি ভাবতেই পারতেন না। সীতার ব্যাপারে রাবণের কামনা বাসনা যতখানি ছিল, তার চেয়েও বেশি ঘা খেয়েছে তাঁর অহংবোধ। নইলে মন্দোদরী ঠিক কথাই বলেছিলেন। অপরূপা সম্পূর্ণ আত্মসচেতন এই মহিলা রাবণ মারা যাবার পর বলেছিলেন—সীতার চেয়ে হাজার গুণে সুন্দরী মহিলা তো তোমার অন্তঃপুরেই ছিল কিন্তু সীতার মোহবশে সে কথা তুমি বুঝলে না—সন্ত্যন্যা প্রমদাস্তুভ্যং রূপেনাভ্যধিকাস্ততঃ। অনঙ্গবশমাপন্ন স্তবং তু মোহান্ন বুধ্যসে। আর মৈথেলী সীতা! রূপে, আভিজাত্যে। দয়া-দাক্ষিণ্য কিংবা কোনও গুণে, সে আমার চেয়ে বড় হওয়া দূরে থাকুক আমার ধারে কাছেও আসতে পারবে না—ন কুলেন ন রূপেন ন দাক্ষিণ্যেন মৈথেলী। ময়াধিকা বা তুলা বা তত্ত্ব মোহান্ন বুধ্যসে॥ কথাটা মন্দোদরী মিথ্যে বলেননি, সীতার চেয়ে রূপে-গুণে হয়তো তিনি বেশিই ছিলেন, কিন্তু মোহবশে নয়, রাবণ তা বুঝতে পারেননি আপন অহংবোধে। অতএব রাম এবং তাঁর বানরবাহিনী যে সময়ে সমুদ্রের পরপারে সমুদ্র লঙ্ঘনের চিন্তায় ব্যস্ত, সেই সময় রাবণ তাঁর মন্ত্রী এবং অমাত্যদের নিয়ে একটি বিশেষ সভা ডাকলেন। ভাগ্যবশত সেদিনটি ছিল রাবণের অপরাজেয় ভাই কুম্ভকর্ণের জেগে থাকার দিন। সভায় তিনিও উপস্থিত। সবার সামনে রাবণ মুক্তকণ্ঠে বললেন—দেখ, রামের প্রিয়া মহিষী সীতাকে আমি দণ্ডকারণ্য থেকে ধরে এনেছি। অনেক দিন হয়ে গেল, তাকে বশ করবারও চেষ্টা নিয়েছি অনেক। কিন্তু এ পর্যন্ত সে কিছুতেই আমার সঙ্গে বিছানায় শুতে চাইছে না—সা মে ন শয্যামারোঢুম্ ইচ্ছত্যলসগামিনী। তোমরা আলোচনা করে দেখ, কিভাবে সীতাকেও ফিরিয়ে দিতে না হয়, এবং দশরথের ছেলে দুটোকেও মেরে ফেলা যায়—অদেয়া চ যথা সীতা বধ্যেী দশরথাত্মজৌ।
‘অলসগামিনী’ সীতা রাবণের শয্যায় ওঠার ব্যাপারেও কেন ‘অলসগামিনী’, সে তর্কের মধ্যে যতটুকু কামনা আছে তার চেয়েও বেশি আছে অহংবোধ। এই কামনা এবং অহংবোধ-এর কোনওটাই অনুমোদন করলেন না মহামতি কুম্ভকর্ণ। তিনি বললেন—সীতাকে অন্যায়ভাবে হরণ করার সময় তো তুমি আমাদের কারও সঙ্গে মন্ত্রণা করনি, কাজেই তুমি একা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তার ফলাফল নিয়ে তুমি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছ, তাতে কোনও লাভ নেই। সীতাকে ছলে বলে হরণ করে তুমি খুবই অন্যায় করেছ। রাম যে তখুনি তোমাকে জানেপ্রাণে মারেনি, এই তোমার ভাগ্য—দিষ্টা ত্বাং নাবধীদ্ রামো বিষমিশ্রমিবামিষম্। তবে হ্যাঁ, যুদ্ধ-বিগ্রহের ব্যাপারে তুমি আমার সাহায্য চাও, সে আমি করব। রাম, লক্ষ্মণ এবং বানরদের আমি একে একে গিলে খেয়ে ফেলব। তুমি মজাসে থাক, ভাল-মন্দ মদ খাও—রমস্ব কামং পিব চাগ্রাবারুণীং, যুদ্ধের ব্যাপারে তুমি কোনও চিন্তা কোর না। কুম্ভকর্ণ যতই সাহস দিন, তাঁর পূর্ব কথাগুলি শুনে রাবণ যে মর্মাহত হবেন সে কথা রাবণের মোসাহেব মন্ত্রীরা বুঝেছিল। সেনাপতি মহাপার্শ্ব তাই মোসাহেবির সুরেই বললেন—সীতাকে ছিনিয়ে এনে আপনি বেশ করেছেন। ঘোর অরণ্যে ঢুকে মধু পেয়েও মধু খাব না—এ আবার কি মূর্খামি—ন পিবেৎ মধু সংপ্রাপ্য স-নরো বালিশো ভবেৎ। শত্রুর মুখে লাথি মেরে আপনি নিশ্চিন্তে সীতাকে ভোগ করুন। সীতা যদি স্বেচ্ছায় ধরা না দেয়, বাধা দেয়, তা হলে মোরগের মত মাঝে মাঝে বল প্রয়োগ করে তাকে ভোগ করুন—আক্রম্যাক্রম্য সীতাং বৈ তাং ভুঙ্ক্ষব চ রমস্ব চ।
কথাগুলি রাবণের বেশ পছন্দ হল কিন্তু বিভীষণের সতীমার্কা বক্তৃতায় ইন্দ্রজিৎ এবং রাবণ দু’জনেই খেপে গেলেন। রাবণ বললেন—জ্ঞাতির বিপদ হলে জ্ঞাতিরা খুশি হয়—হৃষ্যন্তি ব্যসনেদেতে জ্ঞাতীনাং জ্ঞাতয়ঃ সদা। বরং শত্রু এবং সাপের সঙ্গেও আমি ঘর করব কিন্তু নামেমাত্র বন্ধু এই শত্রুসেবী বিভীষণের সঙ্গে থাকব না—ন তু মিত্রপ্রবাদেন সংবসেং শত্রুসেবিনা। রাবণ বিনা কারণে সর্বসমক্ষে অপমানজনকভাবে বিভীষণকে ভৎসনা করায় বিভীষণ চারজন বন্ধুর সঙ্গে রাবণের রাজসভা ছেড়ে আকাশপথে বেরিয়ে এসে রামের সঙ্গে যোগ দিলেন। বাল্মীকি রামায়ণে বিভীষণকে রাবণের পদাঘাতে সভার মধ্যে শুইয়ে ফেলা হয়নি, খঙ্গ হাতে রাবণ তাঁকে মেরে ফেলতেও ওঠেননি অথচ এসব ঘটনাই কৃত্তিবাসে আছে, রঙ্গনাথেও আছে। এই দুই জায়গাতেই অপমানিত বিভীষণ মাতা কৈকসীর কাছে গেছেন, রামের কাছে যাবার অনুমতিও লাভ করেছেন তাঁরই কাছ থেকে। কৃত্তিবাস আবার এই সুযোগে বিভীষণকে নিয়ে গেছেন কৈলাস পর্বতের অধিবাসী বড়দাদা কুবেরের কাছে। সেখানে কুবের এবং শিবের কাছে রামপক্ষে যোগ দেওয়ার সুপারিশ পেয়েই বিভীষণ এসেছেন রামের কাছে। কৃত্তিবাস বলেছেন, রাম বরঞ্চ নিজের অপমান সহ্য করবেন কিন্তু ভক্ত বিভীষণের অপমান তিনি সহ্য করবেন না। কৃত্তিবাসের শিব বিভীষণকে বলেছেন—রামের পক্ষে যোগ দিলে, বিভীষণের ঘরভেদী ভূমিকা নিয়ে কেউই সমালোচনা করতে পারবে না কারণ বিভীষণ তো আর রাজ্যের জন্য রামের পক্ষে যোগ দিচ্ছেন না—‘যেহেতু রাজ্যের আশা নাহিক তোমার’।
কিন্তু আদিকবি বাল্মীকির এ ব্যাপারে কিছু বক্তব্য আছে। শত্রুপক্ষীয় বিভীষণকে যখন সুগ্রীব, জাম্ববান সবাই সন্দেহ করতে আরম্ভ করল, তখন সকলের যুক্তি খণ্ডন-মণ্ডন করে একেবারে শেষে হনুমান বললেন—বিভীষণ বুদ্ধিমান মানুষ। রাম বালি বধ করে সুগ্রীবকে রাজা করেছেন বলেই বিভীষণও ভেবেছেন রাবণ মারা গেলে বিভীষণকে রাজা করা হবে—এবং এই আশাতেই বিভীষণ রামের কাছে আশ্রয় নিতে এসেছেন—বালিনং তু হতং শ্ৰুত্বা সুগ্রীবঞ্চাভিষেতিম্। রাজ্যং প্রার্থয়মানস্তু বুদ্ধিপূর্বমিহাগতঃ॥ রামও কিন্তু সবার সাবধানবাণী শুনেও প্রকারান্তরে হনুমানকেই অনুমোদন করেই বললেন যে, বিভীষণ জ্ঞাতিভেদ সৃষ্টি করে রাজ্যলাভের আশাতেই তাঁর কাছে এসেছেন—‘রাজ্যাকাঙক্ষী চ রাক্ষসঃ’। রাম বললেন, যত দিন রাজ্যপ্রাপ্তির আশা না থাকে তত দিন ভাইয়েরা সব একসঙ্গে সন্তুষ্টচিত্তেই দিন কাটায়, কিন্তু কোনও কারণে রাজ্যভোগের ইচ্ছা হলেই একের থেকে অন্যের ভয় আসে। বিভীষণ সেই কারণেই রাবণকে ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছেন—ইতি ভেদং গমিষ্যন্তি. তস্মাৎ প্রাপ্ত বিভীষণঃ।
সবার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রাম বিভীষণকে আশ্রয় দিলেন এবং প্রথম আলাপেই বিভীষণ রামকে বললেন—আমি অপমানিত হয়ে ধন, জন, বন্ধু-বান্ধব এমন কি লঙ্কা ত্যাগ করে আপনার শরণ নিয়েছি। এখন আমার রাজ্যলাভ, জীবন এবং সুখ সবই আপনার ওপর—ভবদ্গতং হি মে রাজ্যং জীবিতঞ্চ সুখানি চ। পাঠক লক্ষ করবেন, প্রথমেই এখানে রাজ্যলাভের প্রসঙ্গ। রামের কাছে বিভীষণের প্রথম টোপ ছিল—আমি আপনার সৈন্যের মধ্যে থেকে, যখন যেমন দরকার সেইভাবে রাক্ষসদের বধে সাহায্য করব, সাহায্য করব লঙ্কার অধিকারে—রাক্ষসানাং বধে সাহং লঙ্কায়াশ্চ প্ৰধর্ষণে। এইবারে রামের রাজনৈতিক বুদ্ধি লক্ষ করুন, তিনি বিভীষণের টোপ গিললেন এবং এই কথা তাঁর মুখ দিয়ে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে রামচন্দ্র সেই উন্মুক্ত সমুদ্রতীরেই বিভীষণের রাজ্যাভিষেকের নির্দেশ দিলেন, বললেন—সমুদ্ৰাৎ জলম্ আনয়। অভিষেক হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে, যাতে বিভীষণ বিশ্বাস করেন যে, রাবণের সিংহাসনে বিভীষণকে বসাতে রামচন্দ্রের কোনও দ্বিধা নেই। তবে হ্যাঁ, রাক্ষসবধ এবং লঙ্কাজয়ে তাঁকে নির্লজ্জভাবে সাহায্য করতে হয়েছিল। দুর্জয় রাক্ষসবধের অন্ধিসন্ধি ঘরের গোপন খবর সবই তিনি সময়ে সময়ে রামচন্দ্রকে জানিয়েছেন; তাতে তাঁর আপন ঘরের লোকেরা তাঁকে সামনাসামনি দুর্নামের ভাগী করেছে। কিন্তু তাই বলে রাজা হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অভিলাষ যে কমে গেছে তা মনে হয় না। রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই যখন ইন্দ্রজিতের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছেন, তখন বিভীষণ কেঁদে উঠে বলেন, যাদের ওপর ভরসা করে, যাদের ক্ষমতার জোরে আমি লঙ্কার রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হব ভেবেছিলাম,—যয়োর্বীর্যমুপাশ্ৰিত্য প্রতিষ্ঠা কাঙিক্ষতা ময়া—তারাই এখন যুদ্ধভূমিতে ঘুমিয়ে পড়েছে যেন। বিভীষণের এই আকুল আর্তিতে যিনি প্রথম সাড়া দিলেন তিনি রাজ্যলাভের মর্ম বোঝেন, তিনি সুগ্রীব। তিনি তাঁর আপন অভিজ্ঞতায় বিভীষণকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—তুমি ঠিকই রাজ্য পাবে দেখো, লঙ্কায় রাজা হবে তুমিই—রাজ্যং প্রান্স্যসি ধর্মজ্ঞ লঙ্কায়াং নেহ সংশয়ঃ। বিভীষণ অবশ্য সারা লঙ্কাকাণ্ড জুড়ে যেরকম বিনীতভাবে, যেরকম অনুবর্তিতায় রামকে সাহায্য করেছেন তাতে পরবর্তী রামায়ণকারেরা তাঁকে ভক্তভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন সর্বত্র। কিন্তু বাল্মীকির চোখে তিনি যেমন রামের বশংবদ আবার তেমনি ঘরভেদীও বটে। বিভীষণের দিক থেকে রাবণকে ত্যাগ করার পেছনে যে যুক্তিগুলি ছিল, যা পরবর্তী রামায়ণকারদের অবলম্বনও বটে, সেগুলি বিশুদ্ধ ধর্মবোধে পরিব্যাপ্ত হলেও বিভীষণের গৃহভেদী ভূমিকার অপযশ ঘোচাতে পারেনি।
সম্পূর্ণ লঙ্কাকাণ্ডে বাল্মীকির রামচন্দ্র খুব একটা বিপদে কিছু পড়েননি। তাঁর আধিপত্য এবং প্রভাব এত গভীর ছিল যে রাবণ কিছুতেই আপনা থেকে রামকে আক্রমণ করছিলেন না। শেষে অঙ্গদকে দূত করে পাঠিয়ে রাবণকে খুব খানিকটা গালাগালি বর্ষণ করে তাঁর যুদ্ধোন্মাদনা উসকে দিতে হয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণে অঙ্গদের দৌত্যে কোনও বাড়াবাড়ি নেই। তবে সমস্ত প্রাদেশিক কবিরাই অঙ্গদের দূতকর্মের সুযোগে নিজেদের কবিত্ব প্রকাশ করেছেন, সে কবিত্ব তুলসীদাসেও চমৎকার, কৃত্তিবাসেও তেমনি। কৃত্তিবাসে ‘অঙ্গদের রায়বার’ অংশটি পাঁচালীকারদের প্রক্ষেপ বলে অনেকে মনে করেন, কেউ বলেন তা কবিচন্দ্রের রামায়ণের ধারায় লেখা। এই অংশটি গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট হলেও অসাধারণ। রাবণের সভায় আসন না পেয়ে লেজের ‘কুশন’ বানিয়ে অঙ্গদের আত্মসম্মান বাঁচানোর আভাসমাত্রও বাল্মীকি রামায়ণে নেই, যেমনটি নেই রাবণের মুকুট ছিনিয়ে নিয়ে আসার কাহিনী, যা কৃত্তিবাসে আছে।
অঙ্গদের দৌত্যকর্মের পরেই বাল্মীকি রামায়ণে দু’পক্ষের যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। রাবণের কয়েকজন পুত্র-সেনাপতি মারা যাবার পর রামের প্রথম বিপদ এল ইন্দ্রজিতের নাগপাশে। বাল্মীকিতে রাম-লক্ষ্মণকে নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে নারদ, ব্রহ্মা, পবন এবং হনুমান কাউকে কোনও কষ্ট করতে হয়নি। জটায়ু-সম্পাতি যেমন রামের হিতকার্য সাধন করেছিল, তেমনি গরুড় নাগপাশের বৃত্তান্ত শুনেই সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকে এসে নাগপাশ মুক্ত করে বন্ধুকার্য করে গেছেন—ইমং শ্রুত্বা তু বৃত্তান্তং ত্বরমাণোহমাগতঃ। সহসৈবাবয়োঃ স্নেহাৎ সখিত্বম্ অনুপালয়ন্। রঙ্গনাথন রামায়ণে নারদ এসে রামকে তাঁর আপন বিষ্ণু-স্বরূপ স্মরণ করে গরুড়কে আহ্বান করার নির্দেশ দেন, তাতেই নাগপাশ থেকে মুক্তি আসে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে পবনে আর রামে কানাকানি কথা হয়েছে এবং গরুড় এসে নাগপাশ মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁর আবদারে রামকে ধনুক ছেড়ে বাঁশি হাতে নিতে হয়েছে। ভক্তপ্রাণের টানে গরুড়ের পাখার আড়ালে ত্রিভঙ্গ-ভঙ্গিম ঠামে, মোহন বাঁশি হাতে দাঁড়াতেও হয়েছে। উপায় কি, এইসব রামায়ণগুলিতে রাম যে অবতার হয়ে গেছেন এবং অবতার হলে ভক্তের জন্যে এসব ল্যাঠা পোয়াতেই হয়।
রঙ্গনাথী কিংবা কম্ব রামায়ণে কুম্ভকর্ণের চরিত্রটি আঁকা হয়েছে কবিহৃদয়ের সমস্ত আকুতি দিয়ে। একদিকে সে যেমন রাজা রাবণের আদেশ মান্য করে যুদ্ধে প্রাণ দিতে আসে অন্যদিকে ছোটভাই বিভীষণকে সে আকুল পরামর্শ দেয় রামচন্দ্রকে জীবনের আশ্রয় করে নিতে। নীতিগত প্রশ্নে বাল্মীকি রামায়ণে পরস্ত্রীর প্রতি রাবণের মোহকে সে যথোচিত নিন্দা করেছে, অন্যদিকে রাজা রাবণকে সে অস্বীকার করে না তাঁরই আদেশ মেনে সে যুদ্ধে এসেছে। বাল্মীকি রামায়ণের এই সামান্য পটভূমিকাই কম্ব রামায়ণে রাবণ-কুম্ভকর্ণ এবং কুম্ভকর্ণ-বিভীষণের সংলাপে চরম নাটকীয়তার রূপ নিয়েছে। তবে কুম্ভকর্ণকে তাঁর মহানিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য সমস্ত কবিই অপূর্ব রসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কোনও কিছুই যখন কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ করতে পারল না, তখন আমাদের কৃত্তিবাস বাঙালির খাদ্যমন্ত্র উচ্চারণ করে আদেশ দিয়েছেন—‘মদিরা মাংসের দেহ খুলিয়া ঢাকনি’। মনোহর সেই খাদ্যগন্ধেই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে। বাল্মীকিতে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙার কাহিনীতে শুদ্ধ হাস্যরস মিশে গেছে কুম্ভকর্ণের আতঙ্কের সঙ্গে। হাজারো হাতি যখন কুম্ভকর্ণের শরীর দলাই-মলাই করতে থাকল, তখন সেই সুখম্পর্শে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙল বাল্মীকি রামায়ণে—কুম্ভকর্ণস্তদা প্রাপ্য স্পর্শং পরমবুধ্যত।
অবশ্য কাঁচা ঘুম ভাঙা, মদ-মাংসে মাতাল কুম্ভকর্ণের বিশাল বপু থেকে রামের কোনও বিপদ আসেনি। আসলে কুম্ভকর্ণের চেহারাটাই ছিল উৎকট, বিখ্যাত বানর বীরেরাও তাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছিল। রাম বললেন, কুম্ভকর্ণকে দেখেই বানরদের এই অবস্থা, যুদ্ধ লাগলে কি হবে—কথমেনং রণে ক্রুদ্ধং বারয়িষ্যন্তি বানরাঃ। বিভীষণ নির্দেশ দিলেন—সেনাপতি নীল যেন বানরদের মধ্যে প্রচার করে দেন যে, এই কুম্ভকর্ণ আসলে হল একটা দৈত্যাকার ‘রোবট’—যন্ত্ৰমেতৎ সমুচ্ছিতম্। কিন্তু এ নির্দেশ জারি করার আগেই রণক্ষেত্রে কুম্ভকর্ণ এসে গেছেন এবং তাঁকে দেখে প্রথম যে পালানো শুরু করল সে হল সেনাপতি নীল। সাহসী অঙ্গদ তখন ঘোষণা করল যে, এটা যুদ্ধ করতে আসেনি, এটা হল রাবণের বিভীষিকা-যন্ত্রনায়ং যুদ্ধায় বৈ রক্ষো মহতীয়ং বিভীষিকা। কিন্তু এই যন্ত্র-রাক্ষসের প্রতাপ বুঝতে কারোরই দেরি হয়নি, যদিও রামের পক্ষে বিরাট অনিষ্ট কিছু হয়নি। অনিষ্ট ঘটল আবার ইন্দ্রজিতের হাতেই। কুম্ভকর্ণ এবং আর চার-পাঁচজন রাক্ষস সেনাপতি মারা যেতেই ইন্দ্রজিৎ আবার এসে সমস্ত প্রধান বানরদের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণকেও রণক্ষেত্রে শুইয়ে রেখে গেলেন। একমাত্র সুস্থ ছিলেন হনুমান আর বিভীষণ। দু’জনে রাতের অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে মৃত, অর্ধমত মুখ্য সেনানীদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন—উল্কাহস্তৌ তদা রাত্রৌ রণশীর্ষে বিচেরতুঃ। বিস্তীর্ণ রণাঙ্গনে যখন প্রায় নিহত জাম্ববানকে পাওয়া গেল, তখন তিনিই হনুমানকে বললেন, হিমালয়ের কৈলাস-শিখর থেকে মৃতসঞ্জীবনী নিয়ে আসতে। হনুমান পাহাড় উপড়ে নিয়ে এলেন। মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী—ইত্যাদি চার রকমের ওষুধের গন্ধে বাই বেঁচে উঠল। মজা হল, হনুমানকে ওষুধ আনতে দু’বার হিমালয়ে যেতে হয়েছিল, একবার তো এই জাম্ববানের কথায় আরেকবার যখন খোদ ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর পর রাবণ লক্ষ্মণকে শক্তিশেল মেরে গেলেন। বানরদের বৈদ্য ছিলেন সুষেণ, যাকে গোস্বামী তুলসীদাসের কল্যাণে আজকাল আমরা রাক্ষসরাজ রাবণের গৃহচিকিৎসক বলে মনে করি। হনুমান যখন পাহাড়-পর্বত উপড়াতে পারেন-তখন ক্ষুদ্ররূপে লঙ্কায় গিয়ে রাবণের গৃহবৈদ্যকে গৃহসমেত তুলে আনা, এ আর এমন কি কঠিন কাজ। অতএব তুলসী লিখলেন—জামবন্ত কহ বৈদ সুষেনা। লঙ্কা রহ কোই পঠইয় লেনা। ধরি লঘু রূপ গয়উ হনুমন্ত। আনেউ ভবন-সমেত তুরন্তা। কিন্তু বাল্মীকিতে, সুষেণ হলেন বানররাজ বালি এবং সুগ্রীবের শ্বশুর, তারা এবং রুমা দু’জনেই তাঁর কন্যা! ধন্বন্তরির মত তাঁর চিকিৎসা-প্রতিভা, এবং প্রথম থেকেই তিনি বানরদলের সঙ্গে কিষ্কিন্ধ্যা থেকে এসেছেন, ঠিক যেমনটি সেনাদলের সঙ্গে চিকিৎসক থাকে সেইভাবেই। বানর-বৈদ্য সুষেণ হনুমানকে জাম্ববানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন—কৈলাস-শিখর থেকে আবার সেই ওষুধগুলিই নিয়ে এস—পূর্বন্তু কথিতো যোহসৌ বীর জাম্ববতা তব। দক্ষিণে শিখরে জাতাং মহৌষধিমিহানয় ॥ হনুমা আবার পাহাড় উপড়ে নিয়ে এলেন, বানর-বৈদ্যের চিকিৎসায় লক্ষ্মণ আবার বেঁচে উঠলেন।
দোষের মধ্যে বাল্মীকি বলেছিলেন, পাহাড়-চুড়োয় ওষুধ চিনতে না পেরে হনুমান ভাবলেন—দেরি করলে মহাবিপদ হয়ে যেতে পারে, লক্ষ্মণ মারা যেতে পারেন—কালাত্যয়েন দোষঃ স্যাদ্ বৈক্লব্যঞ্চ মহদ্ ভবেৎ—অতএব পাহাড়-চুড়োটাই উপড়ে নিয়ে যাওয়া ভাল—গৃহীত্বা হরি-শার্দুলঃ হস্ত্যাভ্যাং সমোলয়ৎ। কিন্তু এই ‘কালাত্যয়ের দোষ’, মানে দেরি করলে লক্ষ্মণের বিপদ হবে—এই সূত্র ধরেই পরবর্তী রামায়ণকারেরা বহুতর ‘সাসপেন্স্’ তৈরি করেছেন; বিশেষত উৎকণ্ঠার পর উৎকণ্ঠা তৈরি করে যদি শেষ পর্যন্ত প্রায় মৃতরোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, তাহলে কাহিনীতে নাটকীয়তা আসে আরও বেশি। অতএব কৃত্তিবাস পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত লক্ষ্মণের জীবন-সময় বেঁধে দিয়েছেন, গন্ধমাদন পর্বতের কাছের সরোবরে কুমিরের রূপ-ধরা গন্ধকালীকে স্থাপন করেছেন হনুমানের পায়ে কামড় দেওয়ার জন্য, কালনেমিকে পাঠিয়েছেন তপস্বী-বেশে হনুমানকে প্রবঞ্চনা করে তাঁর সময় নষ্ট করার জন্য, অযোধ্যায় ভারতের হাত দিয়ে আশি লক্ষ মণের খেলার ‘বাঁটুল’ মেরে হনুমানকে অজ্ঞান করে দিয়েছেন, এমনকি আর একটু হলে সূর্যকেও উঠিয়ে দিচ্ছিলেন কৃত্তিবাস, নেহাত হনুমান তাকে বগলদাবা করে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন বলে শেষ রক্ষে হয়েছে।
অবশ্য আমরা শুধু কৃত্তিবাসের কবিত্ব-বিস্তারে মুগ্ধ হচ্ছি কেন, ‘কালাত্যয়’ দোষের সুযোগ নিয়ে একই রকমভাবে রঙ্গনাথ এবং তুলসীদাসও কালনেমি, কুমির (রঙ্গনাতে ধন্যমালিনী, তুলসীদাসে অপ্সরা) এবং ভরতের প্রসঙ্গে বিলম্বিত করেছেন হনুমানের অমূল্য সময়। বাল্মীকি রামায়ণে এসব কিছুই নেই। বাল্মীকিতে ইন্দ্রজিৎ বধের সূত্র ধরেই রাবণের শক্তিশেল নিক্ষেপ এবং হনুমৎ-প্রসাদে লক্ষ্মণ খুব তাড়াতাড়ি রোগমুক্ত হওয়ায়, সঙ্গে সঙ্গে রাম-রাবণের যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। আসলে বাল্মীকি যে রসের কবি, তাতে বেশি অলৌকিকতারমধ্যে কবিত্ব ফলাতে তিনি ভালোবাসেন না। ভক্তি জিনিসটাও বোধহয় তাঁর হৃদয়ে কম ছিল। সমুদ্রের ওপর অলৌকিক সেতু-টেন্তু বেঁধেই বোধহয় তাঁর সংকোচ হয়েছিল মনে, কাজেই কোন বীরচুড়ামণি বীরবাহু বা তরণীসেনের কাটা মুণ্ড দিয়ে তিনি রামনাম নিষ্কাশন করতে পারেননি। সীতাকে পাতালে পাঠিয়ে যিনি করুণরসের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, তিনিও পাতালে কোন অহিরাবণ-মহীরাবণের সন্ধান পাননি রাম-লক্ষ্মণের মরণ-ফাঁদ তৈরি করতে। এমনকি এই যে রাম-রাবণের যুদ্ধ, সেটা বাল্মীকি রামরাবণের যুদ্ধের মত করেই দেখিয়েছেন, যার জন্য কবিরা লিখেছেন রাম-রাবণের যুদ্ধ রাম-রাবণের যুদ্ধের মতই—রামরাবণয়ে যুদ্ধং রাম-রাবণয়োরিব। যুদ্ধটা বড়োই সোজাসুজি হয়েছে। শুধু ‘আদিত্যহৃদয়’ মন্ত্র জপ করা ছাড়া ক্ষত্রিয়বীর রামচন্দ্রের আর কিছুই পূজা-উপচার ছিল না। অথচ কৃত্তিবাসে রাবণবধের জন্য রামচন্দ্রকে দুর্গাপূজার অকালবোধন করতে হয়েছে। কালিকাপুরাণের ঘটনা সাজিয়ে কৃত্তিবাসের রামচন্দ্রকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ থেকে আরম্ভ করে বন্য ফলের নৈবেদ্য—সব সাজাতে হয়েছে। এর ওপরে আছে একশ আটটি নীলপদ্ম সংগ্রহ্নে যন্ত্রণা। তা এসব যন্ত্রণা যথারীতি হনুমানই পোহান, কিন্তু শেষে একখনি নীলপদ্ম হারিয়ে যে চরম করুণ রসের সঞ্চার হয়েছিল বাঙালির মনে, সে খবর বাল্মীকি একটুও রাখতেন না। আর একটা কথা, কৃত্তিবাসে হনুমানের কাজ এবং দায়িত্বও বড়ো বেশি যেন। বাল্মীকি তাঁকে দিয়ে সাগর লঙ্ঘন কিংবা পর্বত উৎপাটন পর্যন্ত করিয়েছেন, কিন্তু কৃত্তিবাস! হেন অসম্ভব কাজ নেই যা তিনি হনুমানকে দিয়ে করাননি। রাবণবধের জন্যও তাকে একবার মাছির রূপ ধরে রাবণের ঘরে গিয়ে চণ্ডী-মাহাত্মের শ্লোক চেটে মুছে দিতে হয়, আবার জ্যোতিষীর রূপ ধরে মন্দোদরীকে ভুলিয়ে তাঁরই সাহায্যে রাবণের গোপন মৃত্যুবাণ জোগাড় করে আনতে হয়। কিন্তু বাল্মীকি হনুমানকে এত ক্ষমতা দেননি।
বাল্মীকিতে রাবণ রামের শত্রু এবং সে মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সঙ্গে রামের শত্রুতা শেষ হয়ে গেছে—মরণাস্তানি বৈরাণি নিবৃত্তং নঃ প্রয়োজনম্। সঙ্গে সঙ্গেই রাবণের শ্রাদ্ধকৃত্য করার জন্য আদেশ দিয়েছেন রামচন্দ্র। কিন্তু তুলসীদাসে অন্যান্য বিষ্ণুভক্তের সঙ্গে সমতা রক্ষার জন্য রাবণের প্রাণজ্যোতি প্রবেশ করেছে রামচন্দ্রের মুখে—‘তাসু তেজ সমান প্রভু আনন’, আর কৃত্তিবাসে তো রামচন্দ্র প্রিয়শিষ্যের মত রাবণের কাছে বসে রাজনীতির উপদেশ শুনেছেন। বাল্মীকি রামায়ণে এসব কিছুই নেই।
বাল্মীকি রামায়ণে রাবণের মৃত্যুর পর সমস্ত মুখ্য চরিত্রগুলির মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। এদের মধ্যে প্রথম হলেন বিভীষণ। রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর অসাধারণ গুণগুলি স্মরণ করে বিভীষণ বেশ খানিকটা ভেউ-ভেউ করে কেঁদে নিলেন—শোকবেগপরীতাত্মা বিললাপ বিভীষণঃ। খুব খানিকটা কেঁদে-কেটে তিনি রামকে বললেন—এখন আপনি আদেশ দিলেই আমি এই মহাত্মার প্রেতকার্য করতে পারি। এরপর যখন রাবণের পুরনারীরা এবং মন্দোদরী রাবণের জন্য হৃদয়ের অবরুদ্ধ আবেগ মুক্ত করে দিলেন, তখন রাম যেন আর সে বিলাপ সহ্যই করতে পারছিলেন না। তিনি বিভীষণকে বললেন—রাবণের স্ত্রীদের আপনি সান্ত্বনা দিন, ভাইয়ের সৎকার করুন—সৎকারঃ ক্রিয়তাং ভ্রাতুঃ স্ত্রীগণঃ পরিসান্ত্ব্যতাম্। কিন্তু বিভীষণ যত শোকগ্রস্তই হোন, যত ধার্মিকই হোন, শক্তিমত্তের পক্ষকে কিঞ্চিৎ লেহন করার অভ্যাস তাঁর ছিল এবং সে জিনিস বাল্মীকির চোখ এড়ায়নি। যিনি নিজেই রাবণের প্রেতকার্য করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তিনি হঠাৎই বলে উঠলেন—আমি এই ধর্মহীন, পরস্ত্রীহারী রাবণের সৎকার করতে চাই না—নাহমহামি সংস্কর্ত্তুং পরদারাভিমর্শিনম্। এমন কথা, এমনি করে বলে ফেলাটাই বড় কথা নয়, এই কথার পেছনে উদ্দেশ্যটাই বড় কথা। বিভীষণ ভাবলেন—এই কথাটা বললে বোধহয় রামের খুব ভাল লাগবে, তিনি তাতে বিভীষণের ওপর খুশি হবেন—বিমৃশ্য বুদ্ধ্যা প্রশ্রিতং—তাই বিভীষণ এই কথাটা বললেন। রাম আবার তাঁর উদাত্তকণ্ঠে বললেন—শত্রুর মরণ পর্যন্তই তার সঙেগ শত্রুতা। তাছাড়া রাবণ অধার্মিক হতে পারেন, কিন্তু তেজস্বিতা এবং বলবত্তায় তাঁর সমতুল্য ব্যক্তি কোথায় আছে—মহাত্মা বলসম্পন্নো রাবণে লোকরাবণঃ। আর এখন তো রাবণ মারা গেছে; এই সময়ে তোমারই মত আমারও সে বন্ধুই বটে—মমাপ্যেষ যথা তব। তবে বিভীষণের তোষণেচ্ছা বুঝতে রামের দেরি হয়নি, তিনি সীতাকে দেখার আগেই বিভীষণের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করেছেন।
অবশেষে সীতা। যার জন্য রামায়ণ সাতকাণ্ড হল, সেই সীতা। বালিবধ, সুগ্রীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সমুদ্র লঙ্ঘন এবং বন্ধন সব এই সীতার জন্য। এত যুদ্ধের কারণও সীতা—অন্তত লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত বাল্মীকি আমাদের সেই ধারণাই দিয়েছেন। কিন্তু ওই যে বললাম বাল্মীকি রামায়ণে রাবণবধের পর সবারই মনোলোকে কেমন যেন এক পরিবর্তন এসেছে। সীতাকে চতুদোলায় চড়িয়ে অশোকবনের গাছতলা থেকে রামের কাছে নিয়ে আসা হচ্ছিল। কিন্তু এই খবর শুনেই রামের মনে কেমন রাগও হল, আনন্দও হল আবার শোকও হল—রোষং হর্ষষ্ণ দৈন্যঞ্চ রাঘব প্রাপ শত্রুহা। চোদ্দ বছর পরে প্রিয়ার চাঁদ-চুয়ানো মুখ দেখতে পেলে এই ধরনের সাত্ত্বিক বিকার হয় কিনা, তার একটা রসশাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারতাম, কিন্তু তার আগেই দেখছি রাম উত্তরোত্তর রেগেই যাচ্ছেন, রেগেই যাচ্ছেন। সীতা আসছেন, তাঁকে দেখার জন্য প্রচণ্ড ভিড়-ভাট্টা হচ্ছে কিন্তু রাম তাঁর এতকালের বিনীত স্বভাব লঙ্ঘন করে আগুন-চোখে বিভীষণকেই খানিকটা বকে নিলেন—সংরম্ভাচ্চাব্ৰবীদ্ রামশ্চক্ষুধা প্রদহন্নিব। বিভীষণং মহাপ্রাজ্ঞাং সোপালম্ভমিদং বচঃ ॥ তিনি বললেন—আমাকে অবজ্ঞা করে কেন লোকগুলোকে কষ্ট দিচ্ছ, এরা সবাই সীতাকে দেখতে চায়। বিপদে পড়লে সেই স্ত্রীলোককে দেখায় কোন দোষও নেই। বাড়ির পর্দা, লজ্জাবস্ত্র এগুলো স্ত্রীলোকের আবরণ নয়। তুমি সীতাকে নামাও চতুদোলা থেকে, সে আসুক আমার কাছে পায়ে হেঁটে—বিসৃজ্য শিবিকাং তস্মাৎ পড্যামেবাত্র গচ্ছতু।
নিশ্চয়ই রামের ব্যবহার এখানে ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করেছিল, কেননা, তাঁর কথা শুনে বিভীষণ, সুগ্রীব, লক্ষ্মণ, হনুমান—সবাই কষ্ট পেয়েছেন। তুলসীদাস কৃত্তিবাস এসব জায়গায় ‘প্রভুর লীলা’ বলে অন্য সবার বিষম প্রতিক্রিয়াগুলি একেবারেই চেপে গেছেন। কিন্তু বাল্মীকি মহাকাব্যের কবি, তিনি জানেন যে, তিনি ধর্মশাস্ত্র লিখতে বসেননি, কিংবা লিখতে বসেননি দুজনে দুদিক থেকে এসে জড়িয়ে-ধরা কোন মিলনান্তক চলচ্চিত্রের মহড়া। বাল্মীকি রামের কথার স্ববিরোধগুলি অদ্ভুতভাবে পরিবেশন করে নিজের অন্তরদাহ মিশিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্মণ, সুগ্রীব কিংবা হনুমানের প্রতিক্রিয়ায়। একটু আগেই মৃত রাবণের বুকের ওপর আছড়ে-পড়া মন্দাদরীর মুখ দিয়ে বাল্মীকি বলিয়েছেন—আমি অবগুণ্ঠন মোচন করে নগরের দ্বার দিয়ে প্রশস্ত রাজপথে পায়ে হেঁটে এসেছি তোমার কাছে; তবু যে তুমি রাগ করছ না—দৃষ্ট্বা ন খল্বসি সংক্রুদ্ধে মাম্ ইহানবগুণ্ঠিতাম্। নির্গতং নগরদ্বারাৎ পদ্ভামেবাগতাং প্রভো॥ তোমার অন্য রমণীরাও তো লজ্জাবস্ত্রের ঘোমটা খুলে সবার সামনে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে—ভ্রষ্টলজ্জাবগুণ্ঠনান্, তবু যে তুমি রাগ করছ না?
তার মানে, বিবাহিতা স্ত্রীর পক্ষে লজ্জাবস্ত্রের অবগুণ্ঠন ত্যাগ করে পায়ে হেঁটে সবার সামনে আসাটা যেখানে অনার্য রাক্ষসদের মধ্যেও শিষ্টাচার বলে গণ্য হত না, সেখানে রামের ব্যবহার বিসদৃশ। সীতাকে সোজাসুজি অপমান করার জন্যই তিনি এই অভদ্র ভাষাগুলি ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া সীতা তো কোন বিপদে পড়েননি, বরঞ্চ তিনি বিপদ্-মুক্ত, কাজেই রামের যুক্তি এখানে খাটেই না। শুধু এটুকু হলেও হত, এরপর রামচন্দ্র বললেন—সমুদ্র-বন্ধন, রাবণবধ, এত যে সব দুষ্কর কর্ম করেছি, তা তোমার জন্য নয়, সীতা! সে শুধু আপন কুলের মর্যাদা রক্ষার জন্য। তোমাকে উদ্ধার করেছি। তুমি এখন যেখানে খুশি যেতে পার—যথেষ্টং গম্যতামিতি, যাকে মনে ধরে তাকেই বিয়ে করতে পার—বিভীষণ সুগ্রীব, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন যাকে মনে ধরে—নিবেশয় মনঃ সীতে যথা বা সুখমাত্মনঃ। বাস্তবিক তোমার চরিত্রেই আমার সন্দেহ হয়। চোখ-খারাপ লোকের সামনে আলো রাখলে যেমন তার কষ্ট হয়, তেমনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তুমি আমায় কষ্টই দিচ্ছ—দীপো নেত্রাতুরস্যেব প্রতিকূলাসি মে দৃঢ়ম্। এই একটিমাত্র উপমা দিয়েই বাল্মীকি বুঝিয়ে দিয়েছেন বাল্মীকি রামের দলে নন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, আসলে রামের চোখেই সন্দেহের রোগ ধরেছে, সীতা আলোকবর্তিকার মত পবিত্র।
যাঁরা আজকের দিনের আর্থ-সামাজিক ভাবনায় বাল্মীকির প্রেমচেতনা নিয়ে আলোচনা করে রামচন্দ্রকে অপ্রেমের যূপকাষ্ঠে বলি দেন, তাঁরা বোঝবার চেষ্টা করবেন যে বাল্মীকির বক্তব্যে এবং রামের বক্তব্যে একটা বিরাট তফাত আছে। আমরা বলি, ব্যাপারটা রামের দিক থেকেও দেখা দরকার। নিজের স্ত্রী, সে যদি আবার পরমা সুন্দরী হয় এবং তাকে যদি রাবণের মত কামুক পুরুষ হরণ করে নিয়ে গিয়ে এক বছর নিজের কাছে রাখে, তাহলে যত উদারই হোন না কেন, তবু মনের মধ্যে খচখচানি থাকে বৈকি! রামের কেবলই মনে হতে লাগল যে, এই রূপ দেখে রাবণ সীতাকে শঙ্খ-ঘণ্টা নেড়ে আরতি করে পূজার বেদীতে বসিয়ে রাখেননি নিশ্চয়ই। রাম বললেন—তোমার এই রূপ দেখে রাবণ তোমায় ছেড়ে দিয়েছে বলে মনে হয় না—ন হি ত্বাং রাবণো দৃষ্ট্বা দিব্যরূপাং মনোরমাম্। মর্ষয়ত্যচিরং সীতে স্বগৃহে পর্যবস্থিতাম্।
রামচন্দ্র অনেক কটুকথা বললেন বটে, তবে বাল্মীকিও তাঁকে ছেড়ে দেননি। সীতার মুখ দিয়ে তাঁকে চাবুক কষিয়ে বলেছেন—অসভ্য ছোটলোকেরা অসভ্য মেয়েদের সঙ্গে যেমন করে কথা বলে, তুমি সেই রকম বলছ—প্রাকৃতঃ প্রাকৃতামিব। অসভ্য মেয়েরা যা করে সেই কথা ভেবেই তুমি সমস্ত স্ত্রী-জাতিকে এই রকম করে সন্দেহ করছ—পৃথক্স্ত্ৰীণাং প্রচারেণ জাতিং ত্বং পরিশঙ্কসে। এতকাল একসঙ্গে থেকে আমাদের মধ্যে যে প্রেমের মধু জমা হয়েছিল, সেই তুমিও যদি আমাকে না বোঝ, তাহলে আমার মরণ ছাড়া আর কি গতি আছে—যদি তে’হং ন বিজ্ঞাতা হতা তেনাস্মি শাশ্বতম্। লজ্জায় ঘৃণায় নিজের গায়ের মধ্যেই যেন সিঁটিয়ে যাচ্ছিলেন সীতা, লক্ষ্মণকে তিনি সেই মুহূর্তে চিতা প্রস্তুত করতে বললেন।
রাবণ মরিয়াও প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই। এই রাবণের জন্যই সীতাকে দুঃখ সইতে হয়েছে অজস্র। শুধু রাম কেন, সীতাকে সন্দেহ করেন অনেকেই। একমাত্র ব্যতিক্রম বাল্মীকি। বহ্নিবিশুদ্ধা সীতাকে আবার অপবাদ সইতে হয়েছে অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে। দু-একজনে তাঁর কোলের ছেলেকেও রাবণের ছেলে বলে সন্দেহ করেন, যদিও এসব সন্দেহের কোন পোষণা সপ্তকাণ্ড রামায়ণের কোথাও করেননি বাল্মীকি। পণ্ডিত সুখময় ভট্টাচার্য মশাই রাশি নক্ষত্র ধরে রাবণের ঘরে সীতার বন্দিনী দশার কাল নির্ণয় করেছেন এবং তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে, সীতার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে অযোধ্যায় ফিরে আসার অনেক পরে। আমরা বলি, রামকে তো লোকে ‘একপত্নী ব্রত’ বলে জানে, কিন্তু হেমচন্দ্র আচার্যের জৈন রামায়ণ মতে তো তাঁর আরও তিনটে বৌ ছিল এবং তারাই নাকি সীতার নামে কুৎসা করেছিল রামের কাছে। বাংলাদেশে যাঁরা রামায়ণ লিখেছেন কৃত্তিবাস, চন্দ্রাবতী দেবী, তাঁরা কেউই এই জৈন রামায়ণের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তবে রামের অন্য বৌদের সরাসরি কাব্যে স্থান দিতে তাঁদের ভয় ছিল, তাই সে কাজটা তাঁরা করেছেন অন্যভাবে। বাল্মীকি কিন্তু এসব কিছুই দেখাননি।
আসলে পাঠক যদি সপ্তকাণ্ড রামায়ণের সমস্ত ঘটনাগুলি যথাযথ খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন রামচন্দ্র কম প্রেমিক ছিলেন না। আধুনিক গবেষকেরা বলেন, রামচন্দ্র প্রেমের মর্যাদা বুঝতেন না। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় সোনার সীতা বানিয়েই তাঁর কাজ চলেছে, আসল সীতার কোন প্রয়োজনই তাঁর নেই। আমরা বলি, সীতাকে ছেড়ে অন্য রাজা-রাজড়াদের মত তিনি আরও একটা বিয়ে করেননি, সোনার সীতা গড়ে তিনি বুঝিয়েছেন, সীতা ছাড়া আর কাউকে দিয়েই তাঁর পত্নীব্রত চলে না। আর ভালবাসা! পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে কষ্ট করতে এসে রাম-সীতার প্রেম যেন আরও বেড়ে গেল। সংসারের সমস্ত জটিলতার বাইরে উন্মুক্ত অরণ্যরাজ্য তাঁদের প্রেমকে আরও বিপুল প্রশ্রয়ে বাড়িয়ে তুলছিল যেন। হিতকারী লক্ষ্মণ সঙ্গে থাকায় ক্ষুধার অন্ন কিংবা বাসস্থান নিয়েও তাঁদের চিন্তা করতে হয়নি। প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যে মোহিত রাম বারবার সীতাকে বলেছেন—রাজ্যনাশ কিংবা অযোধ্যার স্বজন হারানোর কষ্ট কিছুই তাঁর মনে লাগে না—ন রাজ্যভ্রংশনং ভদ্রে ন সুহৃদ্ভির্বিনাভবঃ। রাম সীতাকে কখনও পর্বতের শোভা দেখান, কখনও নদীর শোভা। সীতার ভাল লাগলে, সেই বনেই তিনি বেশিদিন থাকেন—বৈদেহ্যাঃ প্রিয়মাকাঙক্ষন্ স্বঞ্চ চিত্তং বিলোভয়ন্। যে সীতার একটুখানি হরিণের বায়না রাখার জন্য তিনি অসম্ভবের পেছনে দৌড়েছিলেন, সেই সীতার প্রতি তাঁর প্রেম ছিল না, একথা অবাস্তব। যে সীতা হরণের পরে সমস্ত কাল ধরে তিনি শুধু কেঁদেছেন, যে-সীতার জন্যে বানরেরা পর্যন্ত রামচন্দ্রের উপর বিরক্ত হয়ে গেছিল, সে সীতার ওপরে রামের ভালবাসা ছিল না? অথচ অনেক দিনের পর যখন পরানবধূর সঙ্গে নবীন মিলনের কুঞ্জ প্রস্তুত, তখন সন্দেহ, ভয়, লোকলাজ সবই একসঙ্গে তাঁর হৃদয়ের আবেগ রুদ্ধ করে দিল।
আসলে ওই যে বলেছি রাবণবধের পর থেকেই রাম যেন এক অন্য মানুষ। সুগ্রীব, লক্ষ্মণ কাউকে তিনি তোয়াক্কাই করছেন না। সদ্য রাজা হওয়া বিভীষণকে তিনি স্বভাববিরুদ্ধভাবে গালাগালি দিচ্ছেন। তাঁর এইসব ব্যবহার যে তাঁর একান্ত স্বভাব-বিরুদ্ধ তা বুঝিয়ে দিতেও বাল্মীকি কসুর করেননি। সীতার অগ্নিশুদ্ধির প্রস্তাবে লক্ষ্মণ রাগে কটমট করে রামের দিকে তাকাচ্ছিলেন—এবমুক্তস্তু বৈদেহ্যা লক্ষ্মণঃ পরবীরহা। অমর্ষবশমাপন্ন রাঘবং সমুদৈক্ষত॥ দীর্ঘ সময় ধরে রাক্ষস এবং বানরেরা যে রামচন্দ্রকে জানত একমাত্র ‘সীয়াবর রামচন্দ্র’ বলে, সেই রামচন্দ্রের মনেই কেমন ‘রাজা-রাজা’ ভাব হল একটা। তিনি এখন ‘রঘুপতিরাঘব রাজা রাম’—আর কিছু নন।
আমাদের দুঃখ হল রামকে সবাই, এমনকি আমরাও এইভাবেই বুঝলাম,তাঁর সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্বের কথা কেউ বুঝলাম না। তুলসীদাস, কৃত্তিবাস তো প্রথম থেকেই রামকে ‘যজ্ঞেশ-নারায়ণ-কৃষ্ণ-বিষ্ণু’ বলেই জানেন এবং তাঁদের দোষ দেব কি, খোদ বাল্মীকির মধ্যেই আরেক কোন বাল্মীকি সম্পূর্ণ উত্তরকাণ্ড ধরে রামকে ভগবান বানিয়ে ছাড়লেন। পণ্ডিতেরা প্রক্ষেপবাদের ওজর এখানে তুলবেনই এবং আমরাও তাতে আপত্তি দেখি না। তুলসীদাসের রাম তো আবার অরণ্যকাণ্ড থেকেই নিজেকে বিষ্ণুর প্রতিরূপ বলে জানেন, কাজেই এক সীতাকে অগ্নির কাছে রেখে মায়া সীতাকে রাবণের হাতে ছেড়ে দিতে তাঁর বাধেনি এবং সীতা রাবণের ঘর থেকে এলে তাঁর মনে কোন দ্বন্দ্ব সন্দেহ কিছুই হয় না। কিন্তু বাল্মীকির রামচন্দ্র অগ্নিশুদ্ধির পর অগ্নিকেই বললেন—জানকী পবিত্র, সে ধারণা আমার ছিল, কিন্তু বহুদিন তিনি রাক্ষসের ঘরে ছিলেন, একটু পরীক্ষা করে না নিলে লোকে বলত—দশরথের ছেলে রাম! সে তো একটা বোকা পাঁঠা; অত্যন্ত কামুক লোক—বালিশো বত কামাত্মা রামো দশরথাত্মজঃ।
ঠিক এই পংক্তির মধ্যেই রাজা রামচন্দ্রের মনস্তত্ত্ব লুকিয়ে আছে। ঠিক একই রকম কোন কথা, পূর্বে উচ্চারিত অনুরূপ কোন উক্তি পাঠক কি স্মরণ করতে পারেন? মনে পড়ে কি, ছোটরানী কৈকেয়ীকে দশরথ একবার বলেছিলেন—আজকে রামকে তোমার কথায় বনবাস দিলে, লোকে বলবে—বোকা রাজা, কামুক রাজা, স্ত্রীর কথায় সে প্রিয় পুত্রকে বনবাস দিয়েছে—বালিশো বত কামাত্মা রাজা দশরথো ভৃশম্। দশরথের এই কথাটি উপলব্ধি করলেই পাঠক রামের মনোজগতে প্রবেশ করতে পারবেন সহজে। রাবণবধের পর রাম বিভীষণকে রাজা করেছেন এবং তিনি বুঝেছেন তাঁরও রাজা হবার সময় আসছে। স্ত্রীর বশবর্তী হয়ে যে দশরথ নিজের পুত্র বিসর্জন দিয়েছিলেন, অরণ্যযাত্রার সময় ভাই বন্ধু, রাস্তাঘাটের লোকেরা পর্যন্ত যার সম্বন্ধে বলেছে ‘কামাত্মা’, ‘কামবেগবশানুগ’, সেই দশরথের কাছ থেকে রাম যেন এক শিক্ষা নিয়েছিলেন। রাজা হওয়ার সময় আসতেই এবং সম্পূর্ণ রামরাজ্যের সময়েও তাঁর মনে কেবল এই চেষ্টা ছিল যে, কেউ যেন তাঁকে ‘কামাত্মা’ না বলে। রাবণের ঘর থেকে আসা ভালবাসার স্ত্রীকেও তাই তিনি বিনা বাক্যে গ্রহণ করতে পারেননি। এই একই লোকাপবাদের কারণে ‘কামাত্মা’ না হওয়ার বিষম চেষ্টায় রাম আবার সীতাকে বিসর্জন দিয়েছেন উত্তরকাণ্ডে। সেখানেও এই একই ভাব, লোকে তাঁকে স্ত্রীর বশবর্তী বলে জানে না তো?
আসলে রামায়ণে দুটি বিসর্জন নাটক আছে। এক জায়গায় তরুণী রমণীর প্রেমে পাগল দশরথ রমণীর জন্য পুত্রকে বিসর্জন দিচ্ছেন, আরেকজন ভাল রাজা হবার জন্য, প্রজানুরঞ্জনের জন্য, দ্বিতীয় দশরথ না হবার জন্য তরুণী রমণীকে বিসর্জন দিচ্ছেন। রামের প্রেম নিয়ে হাজারো কাব্য লেখা হয়েছে, কিন্তু দশরথ-কৈকেয়ীর প্রেম নিয়ে কেউ তো কাব্য লিখলেন না। কেন? প্রেমিক হিসেবে তিনিই তো আদর্শ! কাজেই কামাত্মা দশরথের ব্যক্তিজীবনের ভূত রামের মনে এক বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। সারা জীবন তিনি এই ভূতই বহন করে শুধু পিতৃসত্য পালন করেছেন, প্রেম থাকলেও তিনি প্রেমের কথা আর বলতে সাহস পাননি। অযোধ্যাকাণ্ডে এক রাজাকে যেমন রমণীই অধিকার করেছিল, উত্তরকাণ্ডের অযোধ্যাপর্বে আরেক রাজা রমণীকে একবার বিশুদ্ধ করেও আবার বিসর্জন দিয়ে পিতার কলঙ্কের প্রায়শ্চিত্ত করল। রাবণবধের পর প্রেমিক রামচন্দ্রকে গ্রাস করল রাজা রামচন্দ্র। ক্রৌঞ্চবিরহী কবি তাই অলংকারশাস্ত্রসম্মত কোন মিলনান্তক মহাকাব্য লিখতে পারলেন না, যা লিখলেন তা হল, মানুষের একান্তভাবেই মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বময় মনোলোকের ইতিহাস, বিরহ-ব্যথায় বিধুর এক ‘ট্রাজিডি’।