বহ্ন্শোয়াইগা অ্যাল্পট্হম – সৌম্যজিৎ দেবনাথ
গতকাল জিনিসটা মোটা টাকার বিনিময়ে তুলে দিয়েছি মিঃ রঘুনাথানের হাতে। সেটি কী জিনিস তা সমঝদার কেউ শুনলে হয় আমাকে পাগল ভাববে নতুবা শুধুই এক শখের কালেক্টর ভেবে নেবে, যে কিনা এরকম একটি দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য জিনিসের কদর করতে শেখেনি। ভালো দাম পেয়েছি কি বেচে দিয়েছি! আসলে এরকম একটি ‘অ্যান্টিক আইটেম’ নিজের সংগ্রহে রাখার আগে সে সম্বন্ধে যে বেশ খানিকটা পড়াশোনার প্রয়োজন হয় তা কমবেশি সকলেই মানবেন। তারপর অনেক তত্ত্ব-তালাশ করে, বিভিন্ন নামী- দামি অকশন হাউসের চক্কর কেটে, প্রয়োজন পড়লে ভিন দেশে পাড়ি জমিয়ে অর্থের বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাত করা সম্ভব হয়। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটে। অনেক সময়ই দুর্ঘটনাবশত কিছু মহামূল্য জিনিস কারও কারও হাতে চলে আসে। তার জন্য না লাগে পড়াশোনা, না সেটি ব্যবহার করার যোগ্যতা। আবার পুরানো জিনিস পেলে অনেক অর্থবান ব্যক্তিই ঘর সাজাতে অনেক কিছু কিনে রাখেন। আমি স্বভাবত এই ব্যতিক্রমীদের দলে পড়ি না। আবার জ্ঞানগম্ভীর এক দুঁদে কালেক্টরও যে আমি নই–এ কথা সত্য। কিন্তু আজ আমি আমার যথেষ্ট সময় ও অর্থব্যয়ে অর্জিত ‘এহল্লাই কে ওয়ান মডেল সিক্সটেন’-কে হাতছাড়া করতে একপ্রকার বাধ্যই হলাম।
ঘটনাটা খুলে বলি। একজন ফিল্ম স্টাডিজ মেজর কোর্সের ছাত্র হিসেবে চলচ্চিত্রের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক; এমনটা প্রথমেই ভেবে নেবেন না। স্থিরচিত্র এবং চলচ্চিত্র–এই দুইয়ের প্রতি আমার গভীর আকর্ষণ একেবারে ছোট বয়স থেকে। আমার বাবা একজন প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার ছিলেন। এক নামকরা বাংলা পত্রিকার হয়ে অনেকদিন এডিটরিয়াল ফোটো- গ্রাফারের চাকরি করেছেন। তাঁর দৌলতে ছোট থাকতেই আমি নানা প্রকারের ক্যামেরা নেড়েঘেঁটে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাবা ধৈর্য সহকারে আমাকে সেগুলির ‘কনভার্জিং লেন্স টাইপ’ কিংবা ‘শাটার মেকানিজ্ম্’ বুঝিয়ে দিতেন। পুরানো ক্যামেরার প্রদর্শনীতেও আমাকে নিয়ে গিয়েছেন অনেকবার। কাজেই এই ‘ক্যামরা অবস্কিউরা’-র প্রতি আমার একাত্মতা বহু দিনের।
মাসখানেক হল আমি দেশে ফিরেছি। তার আগে অ্যাকাডেমি অব আর্ট ইউনিভার্সিটির ফিল্ম স্কুলের পক্ষ থেকে একটা আট মাসব্যাপী ওয়ার্কশপের কাজে প্রথমে হ্যানোভার ও তারপর উল্ভ্স্বুর্গে আমাদের থাকতে হয়েছিল। নিডাজাক্সেন (Niedersachsen) উত্তর জার্মানির বুন্দেসল্যান্ড। ইংরেজরা এই ডিস্ট্রিক্টকে লোয়ার স্যাক্সনি বলে থাকে। হ্যানোভার আর উল্ভ্স্বুর্গ এই ডিস্ট্রিক্টেরই দুটি নামকরা শহর। আমরা হ্যানোভারে বেশি দিন থাকিনি। তিনটে ছোট ডকুমেন্টারি শুট করে সোজা চলে এসেছিলাম উল্ভ্স্বুর্গে। এখানে এপ্রিল মাসের আবহাওয়া দারুণ মনোরম। ঝকঝকে রোদের সঙ্গে নিরন্তর মৃদুমন্দ বাতাসের আনাগোনা, খুব বেশি হলেও তাপমাত্রা বারো-তেরো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের অধিক নয়। এই শহরে জার্মানির সব থেকে বড় অটো- মোবাইল হাব অবস্থিত। সেই আওতোস্টাটের এঞ্জিনিয়ার আর মেকানিকদের কর্মজীবন নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি শুট করা হবে, এমন স্থির হয়েছিল।
চারটি আলাদা দল তৈরি করে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। রেচেল, ব্যাল্ড্রিক, ভন আর আমি–এই অন্তরঙ্গ চার বন্ধু মিলে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ এবং গল্পের ন্যারেশন লেখার কাজ জোর কদমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বিকেলটা ঘুরতে বেরই এদিক-ওদিক, সন্ধ্যায় বিয়ার পাব থেকে বিয়ার পান করে হোটেলে ফিরি। ফ্যাকাল্টি বিদ্বজ্জনরা ক্যালিফোর্নিয়ান এবং ভীষণ ভালো মনের মানুষ, ইংরেজদের মতো ছোটখাটো ব্যাপারে ডিসিপ্লিন নিয়ে বজ্র আঁটুনির ফাঁস লাগিয়ে দেননি। তা ছাড়া ব্যাল্ড্রিক জার্মান ছেলে, ও থাকলে স্থানীয় লোকজন, দোকানদার বা পাবের বারটেন্ডারদের সঙ্গে কথোপকথনের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি সুবিধে পাওয়া যাচ্ছিল। যদিও ইংরেজিটা এখানে অনেকেই ভালো বোঝে, কারণ প্রায় সারা বছরই ট্যুরিস্টদের ভিড় লেগে থাকে উল্ভ্স্বুর্গে। একদিন ঠিক হল, কুন্স্টমুজিয়মে যাওয়া হবে। এখানকার নামকরা আর্ট গ্যালারি। ফোক্সভাগেনের তরফ থেকে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে টেক্সটাইল আর্টের ওপর।
বিকেল সাড়ে ছ-টা নাগাদ আমরা চার বন্ধু বেরিয়ে পড়লাম কুন্স্টমু- জিয়মের উদ্দেশে। এখানে বছরের এই সময়টায় প্রায় আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত সূর্য থাকে। কাজেই আমরা দিব্যি আলোতে হোটেল থেকে বেরিয়ে তিনশো তিরাশি নম্বর বাসে চড়ে বসলাম। তারপর মসৃণ ব্যের্লিনার রিং ধরে এগিয়ে আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে লিওনার্দো হোটেলের সামনে এসে নামলাম। সেখান থেকে খানিকটা হেঁটে গেলেই আর্ট গ্যালারি। ভন আমাদের মধ্যে সব থেকে বেশি লম্বা। হাঁটতে হাঁটতে ও কিঞ্চিৎ এগিয়ে গিয়েছিল আমাদের থেকে। আমি রেচেলের সঙ্গে আমার নতুন-কেনা ‘নাইকন ডিএইট-টেন এফএক্স’-এর
কিছু ফিচার নিয়ে আলোচনা করতে করতে এগচ্ছিলাম। ব্যাল্ড্রিক ধূমপায়ী, সিগারেট জ্বেলে আমাদের পাশে পাশে চলেছে। আর্ট গ্যালারির সামনে এসে পড়তে দেখলাম, ভন এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। কাছে এসে বলল, “ইট’স গনা বি কুল। আই গট দ্য টিকেটস্, হিয়ার…”
তারপর সময়মতো ঢুকে পড়লাম প্রদর্শনীর হলঘরে। নানারকম রংবাহারি কাপড় ও কাপড়ের টুকরো দিয়ে বানানো জিনিসের সম্ভার রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। ফোটোগ্রাফির শখেই ছবি তুলতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে। হঠাৎ ভন আমায় ডেকে ফিসফিস করে বলল, “লুক দেয়ার জ্যামি বয়, হি গট আ রিয়্যাল বিউটি, ডাজ্ন্ট হি…!!”
আমি ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য কিছু খুঁজে পেলাম না। কিন্তু তারপরই জিনিসটাতে চোখ পড়তে একেবারে থ হয়ে গেলাম। এক বৃদ্ধ আর্টপ্রেমীর গলায় ঝুলে থাকা ব্রাউন ক্যাম্বিসের কভারের মধ্যে থেকে যে যন্ত্রটির কেবলমাত্র সামনের অংশটুকু উঁকি দিচ্ছে, সেটি কি আসল না আসলের মতো দেখতে–এই ধন্দে মনটা তোলপাড় করে উঠল। মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে এগিয়ে যেতে লাগলাম বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে। দু-পা এগতেই স্পষ্ট চোখে পড়ল, যন্ত্রটির গায়ে রোমান হরফে লেখা রয়েছে ‘Rolleiflex’। একপ্রকার ধেয়ে এসে ওঁকে পাকড়াও করলাম।
“এক্সকিউজ মি স্যার, ইজ ইট দি অরিজিনাল এহল্লাই?”
আমার সটান প্রশ্নটি শুনে বৃদ্ধ বিস্মিত হয়ে তাকালেন আমার দিকে। আর তাঁর সেই তাকানোর ভঙ্গি দেখে আমার মনেও সন্দেহের উদ্রেক হল যে, ইনি আদৌ ইংরেজি বোঝেন তো? আমি দেরি না করে ইশারায় ব্যাল্ড্রিককে কাছে আসতে বললাম। ওদিকে রেচেল আর ভনও সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল আমার ওপর। ব্যাল্ড্রিকের সঙ্গে ওরাও এগিয়ে এল। আমি ব্যাল্ড্রিককে বললাম, “আস্ক হিম অ্যাবাউট হিজ ক্যামরা। ইজ ইট দি অরিজিনাল ওয়ান?”
ব্যাল্ড্রিক ক্যামেরাটা ভালো করে দেখে বেশ উৎসাহিত হয়ে বৃদ্ধকে জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করলে, “ইস্ট এস উশপুয়ম্লিএখ্ এহল্লাই?”
বৃদ্ধের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটিকে একবার হাতের দোলায় নাচিয়ে আমাকে ও বোধ করি বাকিদেরকেও অবাক করে দিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, “অ্যাম অ্যাফ্রেইড ইট’স নট মাই ডিয়ার।”
হতাশ হলাম শুনে। আসল এহল্লাই নয় তবে এটা! কিন্তু দেখতে হুবহু এক- রকম। যদিও এ জিনিস স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার আগে কখনওই হয়নি। তবুও ছবিতে যতটুকু খুঁটিয়ে দেখেছিলাম, অবিকল সেরকম দেখতে। বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড স্যার, উড ইউ প্লিজ শো ইট টু আস? অ্যাকচুয়্যালি উই আর ভেরি ফন্ড অব ভিনটেজ ক্যামরাস অ্যান্ড উই আর দ্য স্টুডেন্টস অফ এএইউ।”
বলেই সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ইউনিভার্সিটির আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখালাম। এরপর বৃদ্ধ চকিতে আমাদের চারজনের ওপর একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাসিমুখে আমায় বললেন, “শিয়োর আই উইল সান। বাট নট টুডে। টুমরো ফাইভ পিএম অ্যাট মাই প্লেস। হিয়ার, টেক মাই কার্ড।”
কার্ডটা হাতে নিতেই বৃদ্ধ ‘সো লং’ বলে অন্য ঘরে চলে গেলেন। দেখলাম কার্ডে নাম লেখা ব্যেয়ানহাড ক্র্যিমা (Bernhard Krämer)। পেশায় আর্টিস্ট। কিন্তু ঠিকানাটা উল্ভ্স্বুর্গের কোনও জায়গার নয়। ফালাস্লিবা স্তাশা, বহ্ন্শো- য়াইগ। মনটা দমে গেল।
হোটেলে ফেরার পথে আজ আর মদ্যপান করলাম না। মাথায় নানারকম চিন্তার স্রোত বইছে। একবার মনে হচ্ছে কাজ ফেলে বহ্ন্শোয়াইগ যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আবার পরক্ষণেই ওরকম একটা ক্লাসিক ক্যামেরা স্বচক্ষে দেখার লোভ আমাকে গ্রাস করে ফেলছে। আমাকে অন্যমনস্ক দেখে রেচেল আমার মানসিক অবস্থাটা আন্দাজ করে কাছে এসে বলল যে, এটা নিয়ে এখনই এত কিছু ভাবার দরকার নেই, ঠিকানা যখন রয়েছে, তখন পরেও খোঁজ করে দেখা যেতে পারে। আর এই ক্যামেরাটি নিয়ে তার আগ্রহও কিছু কম নয়। কিন্তু এতেও আমার মানসিক অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হল বলে অনুভব করতে পারলাম না।
রাতে বেশিক্ষণ লেখালেখি করলাম না। ল্যাপটপে ইন্টারনেট ঘেঁটে অরিজিনাল এহল্লাই সম্বন্ধে নানা তথ্য খুঁজে পড়লাম। এর ছবি আমি আগেও দেখেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেগুলোও অরিজিনাল এহল্লাই নয়। কারণ এই ক্যামেরা প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘ফাঙ্কে উন্ট হাইডেকা’ ১৯২৮ সালে অল্প কিছু প্রোটোটাইপ তৈরি করার পর মাত্র চার বছর অরিজিনাল এহল্লাই তৈরি করে, ১৯২৯-১৯৩২ পর্যন্ত। ‘ওয়ার ফোটোগ্রাফি’ বা যুদ্ধের ছবি তোলার আলাদা দিক খুলে দিয়েছিল এই ক্যামেরা। আর এখন এ জিনিস যে কতটা দুর্লভ, সেটা আলাদা করে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না। মনের গভীরে যে দ্বন্দ্বের ঝড় উঠেছিল, সেটা মনে হল যেন শান্ত হয়েছে। নৈশভোজ সেরে শোয়ার আগে ওয়ালেট থেকে কার্ডটা বের করে নাইটল্যাম্পের নিচে ধরে ফিসফিস করে বললাম, “সি ইউ টুমরো মিঃ ক্র্যিমা।”
পরের দিন সকাল থেকে দৈনিক রুটিন মেনেই সব চলছে। আওতোস্টাটে যাওয়ার কথা উঠলে আউটডোর শুটের কাজ ভনের ওপর চাপিয়ে আমি ন্যারেশন লেখা শেষ করার ভার নিয়ে নিলাম। শুটে গেলে আর দেখতে হবে না, বিকেল গড়িয়ে যাবে। আজ বিকেল পাঁচটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কোনওক্রমে সেটা বিঘ্নিত হয়, সে ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। রেচেলকেই প্রথম জানালাম যে, আজ বহ্ন্শোয়াইগ যাওয়া হচ্ছে। অনুরোধ করে বললাম, সে যেন ভনকে একটু বুঝিয়ে বলে। কারণ আজ অন্তত ওর পক্ষে আমাদের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রেচেল আমায় অবাক করে হাসিমুখে আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে জানাল তার পক্ষেও আজ কাজ ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে বেশ ফাঁপরে পড়ে গেলাম। সঙ্গী না পেলে তো মুশকিল! একা অতদূরের অজানা-অপরিচিত একজনের বাড়ি ধাওয়া করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে!
সকাল দশটা নাগাদ কিছু দরকারি জিনিস গুছিয়ে ব্যাকপ্যাকে ভরে নিচ্ছিলাম। মনকে পুরোপুরি তৈরি করেছি, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। এমন সময়ে দেখলাম, ব্যাল্ড্রিক হাতে একটা ট্রিপড নিয়ে তাড়াতাড়ি কোথায় বেরচ্ছে। ওকে আটকালাম। তারপর খুব কম সময়ের মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা ওকে বললাম। সব শুনে ও এককথায় আমার সঙ্গে যেতে রাজি হল। আমার এই আকস্মিক পাগলপনায় দোসর হিসেবে ব্যাল্ড্রিকের মতো একজনকে পাওয়াই স্বাভাবিক। খাঁটি জার্মান রক্ত কিনা! ইতিহাস সাক্ষী এই রক্তের নির্ভীকতা ও কাঠিন্যের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তবে ওকে আপাতত ভনের সঙ্গে যেতে হবে। কাজ সেরে ঠিক সময়মতো সে ফিরে আসবে। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে আমার কাজে মন দিলাম।
সময় যত এগিয়ে আসছে, আমার উত্তেজনাও ক্রমে বেড়ে চলেছে। খোঁজ করে জানলাম, গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সওয়া ঘণ্টামতো সময় লাগবে। লাঞ্চ সেরে ভনকে ফোন করলাম। ও-ই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিল ক্যামেরা- টির দিকে। এভাবে ওকে না বলে যাওয়াটা খুবই অন্যায় হবে মনে হল। তাই ফোন করে ওকে সব বললাম আর এ-ও বুঝলাম, ব্যাল্ড্রিকের কাছে ও কিছুটা শুনেছে। খুব আনন্দের সঙ্গেই আমাকে উৎসাহিত করল ভন। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি না বলে যে আমার কুণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই, সে আশ্বাস দিয়ে ও জোর গলায় বলল, “ওহ্ কাম অন বাডি, গো অ্যান্ড বাই দ্যাট ব্লাডি ক্যামরা, উইল ইয়া… ইট’স আ হেল অব অ্যান্ আইটেম টু কালেক্ট।” ঈষৎ হেসে আমি মনে মনে বললাম, অরিজিনাল মডেলটা পেলে কেনার চেষ্টা করতাম বইকি! কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেল কিনতে যাওয়ার এখনই কোনও ইচ্ছে আমার নেই। তবে হ্যাঁ, অনুমতি পেলে ভালো করে নেড়েঘেঁটে দেখে আসব আর সেই সঙ্গে বেশ কিছু ছবিও তুলে আনব। খুব রেয়ার না হলেও এই মডেলও যে যার-তার গলায় ঝোলে না তা বলাই বাহুল্য।
দুপুর তিনটে বেজে দশ মিনিটে ব্যাল্ড্রিক ফোন করে জানাল সে হোটেলের বাইরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ব্যাকপ্যাকটা পিঠে চড়িয়ে বেরতে গিয়েও হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্যে কী যে ভাবলাম, পরিষ্কার করে আমি নিজেও বুঝে উঠলাম না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কারচুপি বোধহয় একেই বলে। ধাঁ করে আবার ঘরে ঢুকে আমার লকার থেকে একতাড়া ইউরো বের করে সযত্নে সেটা ব্যাগে পুরলাম। কত নিলাম গোনার প্রয়োজন বা সময় কোনওটাই ছিল না। ভনের দেখানো সেই প্রলোভন যে এড়িয়ে যেতে পারিনি তা স্পষ্ট হল। যথেষ্ট পাথেয় থাকা সত্ত্বেও বাড়তি অর্থ সঙ্গে নেওয়া তারই প্রমাণ বটে। যদিও মস্তিষ্ক বলছে, বৃদ্ধ সেই জিনিস হয়তো বিক্রি করবেন না, তবু অফার করে দেখা যেতেই পারে। ক্যামেরাটি কমপক্ষে সত্তর-পঁচাত্তর বছরের পুরানো তো হবেই।
দুই
আজ আর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধরার ইচ্ছে ছিল না। তাই দুই বন্ধু মিলে একটা ভাড়ার গাড়িতে চেপে বসলাম। ব্যাল্ড্রিক আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। কৌতূহলবশত, কী ব্যাপার জানতে চাইতে অবশ্য হোঁচট খেয়ে কোনওরকমে বলল যে, সে এই আকস্মিক অ্যাডভেঞ্চারের জন্য আমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই সাফাই আমার ঠিক হজম হল না। এক হুজুগে ভারতীয়র কাণ্ডকারখানায় যে সে বেশ কৌতুকান্বিত হয়েছে তা ওর মুখাভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। তবু দমে না গিয়ে এটাকে নিজের অসামান্য প্রগল্ভতা গণ্য করে মনে মনে উচ্ছ্বসিত হয়েই রইলাম। ইচ্ছাপূরণের উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়ানো যে মোটেই পাগলামি নয়, সেটা ব্যাল্ড্রিক নিজেও জানে বলে আমার বিশ্বাস।
হেমস্টেটা হাইওয়ে ধরে বহ্ন্শোয়াইগে ঢুকে বেলা ঠিক সাড়ে চারটের সময় ফালাস্লিবা সড়কে এসে নামলাম। বেশ জনবসতিপূর্ণ স্থান এটি। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও অনেক বেশি। ব্যাল্ড্রিক আমাকে নিয়ে চলল নির্দিষ্ট ঠিকানার উদ্দেশে। কিছুটা হেঁটে একটা হেয়ার ড্রেসিং পার্লারকে টপকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম। সুন্দর কাঠের গেটের ওপারে ছোট্ট একটা বাগান। আর তারপরেই দোতলা টালি বসানো ছাই রঙের বাড়ি। বাড়ির দেওয়াল, জানালা-দরজা–এসব দেখে তার বয়স আন্দাজ করার মতো অভিজ্ঞ আমি মোটেই নই, তাই সে ব্যাপারে দুজনে আর আলোচনায় গেলাম না। গেটের পাশে আটকানো রয়েছে একটি ডাকবাক্স এবং এই বস্তুটি যে খুব একটা নতুন নয়, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। দেখলাম তাতে লেখা W. Krämer। তখনও পাঁচটা বাজতে মিনিট কুড়ি বাকি। দুজনেই এদিক-ওদিক দেখতে লাগলাম। এই লেনটা বেশ ফাঁকা। তবে কোথাও বসবার মতো ব্যবস্থা নেই। রাস্তার দুপাশে পরপর বাড়িগুলির কয়েকটির সামনে গাড়ি দাঁড় করানো রয়েছে। আমরা মিঃ ক্র্যিমার বাড়ির সামনে দাঁড়ানো গাড়িটা বেশ পুরানো দেখে তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। আশানুরূপভাবে সে গাড়িতে টাচ সেন্সিং অ্যালার্ম না থাকায় বিকট কোনও শব্দ বেজে উঠল না।
তারপর যখন পাঁচটা বাজতে মিনিট তিনেক বাকি, সেই সময় গেট খুলে ভিতরে ঢুকে সবুজ লন পেরিয়ে সদর দরজার সামনে এসে ‘ডোর নকার’ ঠুকে দিলাম বার দুয়েক। মুহূর্তকাল পরে নীলবর্ণ ডিয়েন্ডে (Dirndl) পরিহিতা এক বৃদ্ধা দরজা খুলে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ও ব্যাল্ড্রিক সহাস্যে একবার মাথা নেড়ে অভিবাদন করে একেবারে দেশীয় কায়দায় একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলাম বৃদ্ধার হাতে। কাগজটিতে একবার চোখ বুলিয়ে স্মিত হাসিমুখে তিনি আমাদের ভিতরে আসতে বললেন। আমরা একসঙ্গে প্রবেশ করলাম। তারপর বড় হলঘরটির এদিক-সেদিক চোখ ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম, ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম, তেমনই। বৃদ্ধ নিজেও যেমন আর্টিস্ট, তাঁর আর্ট কালেকশনও প্রচুর। নানারকম ছবি, ছোটবড় মূর্তি, ঘড়ি, ফুলদানি এবং আরও কত কী রয়েছে এই একটি ঘরে! তবে সেগুলির দাম বা তাদের প্রাচীনত্বের খুব একটা সঠিক ধারণা যে আমার নেই–এ কথা স্বীকার করে নিতে আমি লজ্জাবোধ করি না। বাড়ির একতলায় দেখলাম কোনও ঘর নেই। পুরোটাই বৈঠকখানা, যা বেশ কিছু দামি আসবাবপত্রে সজ্জিত। বৃদ্ধা আমাদের দুজনকে বসতে বলে দোতলায় উঠে গেলেন। আমরা ঘরটির মাঝামাঝি রাখা একটি ডিম্বাকৃতি সোফাসেটে বসে রইলাম মিনিট পাঁচেক।
তারপর দোতলার একটা ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আমরা দুজনই উঠে দাঁড়ালাম আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ক্র্যিমা বেরিয়ে এসে হাসিমুখে দু-হাত ছড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন ও সেই সঙ্গে আমাদের ওপরে চলে আসতে বললেন। আমরা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতেই তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন বাঁ দিকের একটি ঘরে। এটিকে স্টাডি বা লাইব্রেরিও বলা চলে। চারপাশে দেওয়াল জুড়ে বইপত্র বোঝাই আলমারির সারি। মাঝে চতুষ্কোণ একটি টেবিল ও গোটা চারেক গদি লাগানো আর্মচেয়ার। আমাদের সেখানে বসতে বললেন মিঃ ক্র্যিমা। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “ইউ আর ইন্ডিয়ান, রাইট?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে করতে নিজের নাম বললাম। ব্যাল্ড্রিক ওদের মাতৃভাষায় বেশ কিছু কথা বলল বৃদ্ধের সঙ্গে। আমার একটু অধৈর্য লাগছিল। যে উদ্দেশে আসা, সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি বললাম, “ওয়েল স্যার, উই আর হিয়ার টু টেক আ গুড লুক অ্যাট দ্যাট প্রেশাস ওয়ান উই স ইয়েস্টারডে।”
বৃদ্ধ হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “অব কোর্স মাই ফাইন ফেলো… বাট বিফোর দ্যাট, উড ইউ লাইক টু হ্যাভ সামথিং?”
আমরা দুজনই মানা করলাম। খানাপিনা কী জিনিস তখন ভুলে গিয়েছি আমি। বৃদ্ধ আর সময় নষ্ট না করে আমাদের নিয়ে গেলেন আরেকটি ঘরে। এই ঘরটি এ বাড়ির বাকি যে দু-তিনটি ঘর আমরা দেখলাম, তার থেকে একদম আলাদা। ঘরের এক কোণে একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে একটি কাঠের চৌপায়া রাখা এবং সেটি একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। সারাটা ঘর ধুলোর আস্তরণে আবৃত আর ঘরের চারদিকের দেওয়ালে দেখলাম একরকম কালচে অমসৃণ কাগজ সাঁটানো। এরকম অদ্ভুত ওয়ালপেপার আমি আগে কোথাও দেখিনি। বৃদ্ধ আমাদের সেখানে দাঁড়াতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা ঘরটির ওই এক জায়গায় দাঁড়িয়েই এদিক-ওদিক দেখছিলাম। একটা স্কাইলাইট রয়েছে ঘরের উত্তর দিকের ছাদে, সেখান থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ছে। ভদ্রলোক বড্ড দেরি করিয়ে দিচ্ছেন ভেবে মনে মনে একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম। আসল জিনিসের দেখা নেই, এ ঘর-সে ঘর ঘোরাচ্ছেন কেবল। দেখলাম ব্যাল্ড্রিকেরও মুখ বেজার হয়ে আছে, ধুলোবালিতে কার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে না রাগ হয়! এমন সময় বৃদ্ধ আমাদের পেছনে এসে দাঁড়াতেই আমরা ফিরে তাকালাম। আরিব্বাস! এই তো বৃদ্ধের গলায় ঝুলছে সেই এক ঝলক দেখা বাদামি রঙের ক্যাম্বিসের কভারে ঢাকা আমার সাধের ও স্বপ্নের ভিনটেজ এহল্লাই। এটি বাইরে থেকেই যদি নিয়ে এলেন, তবে এমন অপরিষ্কার ধুলোয় আচ্ছন্ন ঘরে ডেকে এনে সেটা দেখাবার কী প্রয়োজন ছিল, সেসব ভাবনা তখনও আমার মাথায় আসেনি। কতক্ষণে জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখব, সে চিন্তায় তখন আমার মন ব্যাকুল।
এরপর বৃদ্ধ ক্যাম্বিসের কভার থেকে সন্তর্পণে ক্যামেরাটি বের করে এনে আমার দিকে তুলে ধরলেন। ব্যাল্ড্রিকের মুখ থেকে বিস্ময়জনক একটা শব্দ বেরিয়ে এল। সত্যিই ভনের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার তারিফ করতে হয়। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি থেকে ছয় ইঞ্চি, ডুয়াল জাইস টেসার লেন্স ও কম্পুর র্যাপিড শাটার বসানো আক্ষরিকভাবেই ‘আ রিয়্যাল বিউটি’। বৃদ্ধ দেখিয়ে দিলেন যে, এই ক্যামেরার ডান দিকে একটা ‘উইন্ডিং ক্র্যাঙ্ক’ লাগানো রয়েছে, যা কিনা দ্রুত শাটার কক করে ছবির ‘ডাব্ল এক্সপোজার’ হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। ঠিক তা-ই, এটাই বৈশিষ্ট্য এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলটির। অরিজিনাল মডেলে এই উইন্ডিং লিভার নেই। পরবর্তীকালে মডিফাই করা হয়েছে। উন্নত আরও বেশ কিছু ফিচার আছে এতে। ক্যামেরাটির ফোকাস টেকনোলজিও বৃদ্ধ আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। এরপর ক্যামেরাটি হাতে নিলাম। ব্যাল্ড্রিক আমার কানে ফিসফিস করে বলল, ‘স্টলজ্ এর ডয়েটসেন’, যার অর্থ জার্মানদের গর্ব। আলবাত!
ক্যামেরাটি হাতে পাওয়ার পর মনে হল, এবার একটু কোথাও বসতে পারলে হয়। কারণ ভালো করে নাড়াচাড়া করার জন্যে একটা নিরাপদ জায়গা প্রয়োজন। হাতে করে দেখতে গিয়ে ক্যামেরাটি থেকে কিছু খুলে মেঝেতে পড়ুক তা আমি চাই না। ব্যাল্ড্রিকের হাতে ক্যামেরাটি দিয়ে আমি আমার নিজের ক্যামেরা বের করলাম। কিছুক্ষণের জন্য বৃদ্ধকে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। ব্যাল্ড্রিকের হাতে ধরা অবস্থায় ছবি তুলে নিতে হবে। হঠাৎ মাথায় এল ছবি তোলার অনুমতিটা নিয়ে নেওয়া দরকার। এটি যার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তাঁর মতামতই আসল। কিন্তু আমার কিছু বলার আগেই বৃদ্ধ ঘরের যে কোণে কাঠের চৌপায়াটি রাখা সেখান থেকে বলে উঠলেন, “দিস ওয়ান ইজ মোর প্রেশাস।”
তাকিয়ে দেখি বৃদ্ধ কালো কাপড়ের ঢাকনাটি সরিয়েছেন। সেই চৌপায়াটি একটি পুরানো পিয়ানো। এটি যে ব্যবহার হয় না, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। তা না হলে কি আর এমন অভাগার মতো তালাবন্ধ ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে! কিন্তু চমক এই পুরানো পিয়ানোটি নয়। আসলটি হল পিয়ানোর ওপরে একটি কাচের বাক্সের মধ্যে রাখা আরেকটি ভিনটেজ এহল্লাই। এর কোনও কভার বা বেল্ট কিছুই নেই। শুধু ক্যামেরাটি কাচের বাক্সের মধ্যে বসানো রয়েছে।
আমি দ্রুতপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, এটিতে কোনও উইন্ডিং লিভার নেই। অ্যাপেচার নবটার একদিক খানিকটা চেপটে গেছে আর এটি দেখতে আগের ক্যামেরাটি থেকেও বেশ পুরানো। আনন্দের আতিশয্যে প্রায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তবু সম্পূর্ণ- ভাবে নিশ্চিত হতেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইজ ইট দি অরিজিনাল ওয়ান?”
“ইয়েস, ইট ইজ।”
আমার মনে এক অনাবিল প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। ওঃ! বহ্ন্শোয়াইগে আসা এরকম অকল্পনীয়ভাবে সার্থক হবে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এর জন্যে আমি এই ধুলোময়লার মধ্যে সারারাত কাটাতেও রাজি আছি। আমি আমার ক্যামেরাটা পুনরায় ব্যাগে পুরে অনুরোধ করে বৃদ্ধকে বললাম যেন একটিবার এই ক্যামেরাটি কাচের বাক্সের বাইরে বের করে এনে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি আমার কথায় আমল দিলেন বলে মনে হল না। উলটে আমাকে একটি প্রশ্ন করলেন, “হোয়াট ডু ইউ নো অ্যাবাউট অরিজিনাল এহল্লাই?”
আমি মোটামুটি যা জানি বললাম। ১৯২৮ সালের প্রোটোটাইপ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত তৈরি এহল্লাই অরিজিনাল মডেল, যা এখন বেশ দুর্লভ ক্লাসিক ক্যামেরা বলেই গণ্য হয়। কিন্তু সব শুনেও বৃদ্ধ খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে আমার মনে হল না। আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না, উনি আর কী তথ্য জানতে চাইছেন। যা হোক, বার দুয়েক মাথা নেড়ে মিঃ ক্র্যিমা আরেকটি উদ্ভট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “হ্যাভ ইউ এভার হার্ড অ্যাবাউট বহ্ন্শোয়াইগা অ্যাল্পট্হম?”
আমার মুখ তির্যকভাবে বেঁকে গেল। এটা আবার কী? ঘাড় নেড়ে জানালাম, শুনিনি। তৎক্ষণাৎ ব্যাল্ড্রিক পাশ থেকে বলল যে এটি জার্মান কথা, যার অর্থ বহ্ন্শোয়াইগের দুঃস্বপ্ন। নাঃ, তা-ও শুনিনি। বৃদ্ধ একবার ক্ষমার চোখে আমার দিকে তাকালেন আর তারপরই আমাদের অদ্ভুত একটা গল্প শোনালেন।
মিঃ ক্র্যিমার পিতা ওয়াইল্টা ক্র্যিমা (Walter Krämer) ছিলেন একজন জার্মান নাৎজি চিত্রসাংবাদিক। ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর অ্যাডল্ফ্ হিটলার নাৎজি পার্টির ব্যের্লিন শাখার ‘গাউলাইটা’ হওয়ার পরই ডাক পড়ে সিনিয়র ক্র্যিমার। হের হুগো ইয়েগা ব্যক্তিগতভাবে হিটলারের কাছে ক্র্যিমার প্রশংসা করেছিলেন আর সেই জন্যেই তাঁকে একটি বড় মাপের দায়িত্ব সঁপা হয় পার্টির তরফ থেকে। তা ছিল তৎকালীন শ্রেষ্ঠ জার্মান প্রযুক্তিসম্পন্ন কিছু নতুন ধরনের ক্যামেরার খোঁজ করা। হিটলার তখন থেকেই প্রযুক্তিকে নিজের সব থেকে বড় হাতিয়ার করে ফেলেছিল। তা ছাড়া একজন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে কাজটি বেশ পছন্দও হয়েছিল সিনিয়র ক্র্যিমার। এরপর নানা জায়গা ঘুরে বেশ কিছু আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরা জোগাড় করে তিনি হিটলারের প্রিয়পাত্র হলেন। তবে খোঁজ করা তিনি সেখানেই বন্ধ করেননি, চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একদিন তাঁর এক বন্ধুর মারফত খবর পেলেন, এই বহ্ন্শোয়া- ইগে পাউল ফাঙ্কে ও হাইনহোল্ট হাইডেকা নামের দুই ব্যক্তি এক বিশেষ প্রকার ক্যামেরা বাজারে আনতে চলেছেন, যার ফোকাসিং মেকানিজ্ম্ বেশ আলাদারকম ডিজাইনে করা হয়েছে। তারপর ১৯২৮ সালের অগাস্ট মাসে হিটলারের ব্যক্তিগত সুপারিশে ক্র্যিমা এসে দেখা করেন হাইডেকার সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে একটি বিশেষ চুক্তি হয় সেই মোলাকাতে, যার ফলস্বরূপ ওই বছরেরই নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে হাইনহোল্ট হাইডেকা তাদের প্রথম ‘ফাংশনাল প্রোটোটাইপ’ মডেলটি দুশো হাইসমাকের (Reichsmark) বিনিময়ে বিক্রি করেন ক্র্যিমার কাছে।
আমরা দুজনে বোকার মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। বৃদ্ধ ক্র্যিমা যা শোনালেন তা কি বিশ্বাসযোগ্য, নাকি অনভিজ্ঞ অল্পবয়সি দুজনকে পেয়ে স্রেফ গল্প ফেঁদে শুনিয়ে দিলেন তা নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই কাহিনি যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে এই ক্যামেরার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক হওয়ার কথা। এভাবে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকার কারণ কী? ব্যাল্ড্রিক বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইল এটিই সেই প্রথম প্রোটোটাইপ মডেলটি কি না। তাতে সহাস্যে উত্তর এল, “ইয়েস, দ্য ফার্স্ট কে ওয়ান মডেল সিক্সটেন।”
হঠাৎ করেই যেন বৃদ্ধের সব কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল। আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম যে, আমার মনকে এসব বিশ্বাস করাতে পারলে আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। তবুও কেন জানি না বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। কটাক্ষ করে এরকম একটি ঐতিহাসিক জিনিসকে এভাবে অনাদরে ফেলে রাখার কারণ জানতে চাইলাম। তার উত্তরে বৃদ্ধ ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বললেন, “বিকজ ইট ইজ হন্টেড অ্যান্ড ইট’স নেম ইজ বহ্ন্শোয়াইগা অ্যাল্পট্হম।”
হন্টেড! অর্থাৎ ভূতুড়ে ব্যাপার! বেশ লাগল কথাটা শুনে। ভূতেরা এখন মানুষজন ছেড়ে পুরানো ক্যামেরার ওপর ভর করছে–এটা বেশ মজাদার ঘটনা। তা কীরকম সে ব্যাপার, একটু খুলে জানতে চাইলাম। কিন্তু কিছু বলার আগে বৃদ্ধ কালো কাপড়ে আবার ক্যামেরাসহ পিয়ানোটা ঢেকে দিয়ে আমাদের সেই আগের ঘরে গিয়ে বসতে বললেন। আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে লাইব্রেরিতে চলে এলাম। ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম বিকেল পৌনে ছ-টা। এ ঘরে এসে বসার মিনিট দুয়েকের মধ্যে সেই বৃদ্ধা আমাদের জন্যে কেক আর চা নিয়ে এল ট্রে-তে করে। মিঃ ক্র্যিমাও এসে বসলেন একটি আর্মচেয়ারে। তারপর নিজে থেকেই বললেন ক্যামেরাটির গোপন রহস্যের কথা।
বৃদ্ধের পিতা মারা যান ১৯৭২ সালে। তার আগে পর্যন্ত ওই ক্যামেরাটিতে তিনি নাকি আর কাউকে হাত দিতে দেননি। এমনকী নিজের একমাত্র ছেলেকে পর্যন্ত নয়। তিনিই এর নামকরণ করেছিলেন বহ্ন্শোয়াইগা অ্যাল্পট্হম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পর কাগজে একটা প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল এই নাম দিয়ে। দিনকয়েকের জন্য ক্যামেরাটি নিয়ে শোরগোল হলেও তারপর একেবারে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। শেষ বয়সে যখন নিদ্রাহীনতার কারণে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তিনি ছেলেকে অর্থাৎ বৃদ্ধকে ডেকে বলে যান, এই ক্যামেরাটি যেন আর কোনওভাবেই ছবি তোলার কাজে কখনও ব্যবহার না করা হয়। ওই কাচের বাক্সটিও পাঁচের দশকে বানিয়ে এনেছিলেন সিনিয়র ক্র্যিমা। সেই থেকে ক্যামেরাটি বন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পরে তাঁর ঘরে রাখা একটি স্বস্তিক চিহ্ন সংবলিত ট্রাংক থেকে বেশ কয়েকটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যাতে তাঁর সারাজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুচারু বর্ণনা লেখা আছে। সেগুলি বৃদ্ধ বেশ ভালোভাবেই পড়েছেন এবং তিনিও তাঁর পিতার আদেশমতো ক্যামেরাটি কখনও ব্যবহার করেননি।
মোটের ওপর দাঁড়াল এই যে, ক্যামেরাটির সঙ্গে বৃদ্ধের নিজস্ব কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। সবটাই তাঁর পিতার গল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অন্ধবিশ্বাস। আশ্চর্য! এরকম মূল্যবান ও একই সঙ্গে দুষ্প্রাপ্য একটি জিনিস ধুলোয় পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কেবলমাত্র এক উদ্ভট পারিবারিক ফ্যান্টাসির জন্য। আমি তবু শান্তভাবে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম এই ক্যামেরাটির ভবিষ্যতের কথা। আগামী দিনে কী হবে, কোথায় যাবে, কে নেবে এর দায়িত্ব! উত্তরে তিনি ক্ষুন্নচিত্তে বললেন, “আই উইল বারি ইট বিফোর আই ডাই।”
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “হোয়াই? ইয়োর সান অর ডটার…”
আমার প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে বৃদ্ধ বেশ ধমকের সুরে বলে উঠলেন, “ডোন্ট হ্যাভ এনি। হ্যাড আ সান। হি ডায়েড ইন দ্য ক্যানাডিয়ান রকিস।”
আন্তরিকভাবে দুঃখ জ্ঞাপন করলাম। বৃদ্ধ সুন্দর এক ভঙ্গিমায় হাত নাড়িয়ে দিলেন। এরপর আমার মনোবাঞ্ছা ব্যক্ত করতে আর দেরি করলাম না। তাঁকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বললাম এই অমূল্য সম্পদটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে আমি কতটা আগ্রহী এবং এর জন্য আমি আটশো ইউরো পর্যন্ত দাম দিতে রাজি আছি।
বৃদ্ধ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। তারপর বললেন যে তাঁর মূল্যের প্রয়োজন নেই। আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। ব্যাল্ড্রিকের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে-ও বেশ অবাক চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ বললেন তাঁর বয়স তিয়াত্তর বছর, তাই খুব বেশি আয়ু অবশিষ্ট নেই। এর মধ্যে যদি তিনি তাঁর এই ক্যামেরাটির দায়িত্ব সঠিক কাউকে অর্পণ করে যেতে পারেন, তবে এর থেকে বেশি কিছু চাহিদা তাঁর নেই। নতুবা তিনি যেমন ঠিক করেছিলেন, তেমনটিই করবে। বছর পনেরো আগে একজন এ বাড়িতে এসে ক্যামেরাটি দেখে কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর রহস্যের ইতিহাস জানতে পেরে শেষমেশ আর কেনেননি। ইতিহাসের পাতায় ও গল্পে লেখা জার্মানদের বীরত্বের কাহিনি বাস্তবের সঙ্গে ঠিক মিলছে না দেখে বেশ অবাক হচ্ছিলাম। হিটলার যুগের পর থেকে জার্মানদের সহজাত সাহসী মনোভাবে কোনও ত্রুটি এসে পড়েছে কি না, সে ভাবনাও একবার মাথায় এল।
যা-ই হোক, আমাকে আর বেশি জোরাজুরি করতে হল না। বৃদ্ধ রাজি হয়ে গেলেন। আচমকা ব্যাল্ড্রিক আমার কানের কাছে মুখ এনে নিচুস্বরে বলল, বৃদ্ধ না নিতে চাইলেও একটা কিছু দাম অন্তত সম্মানের খাতিরে যেন তাঁকে দিয়ে যাই আমি। সর্বান্তঃকরণে সহমত হলাম ব্যাল্ড্রিকের সঙ্গে। বৃদ্ধ অন্য ঘরে গিয়েছিলেন, কিছুক্ষণ পর এলেন। এসেই আমার পাশে বসে কাঁধের ওপর হাত রেখে বললেন, “প্রমিস মি ওয়ান থিং ডিয়ার, ইউ ওন্ট ইউজ ইট!”
খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। আমি কীভাবে ওঁকে বোঝাব যে, তাঁর পিতার বলে যাওয়া গল্পে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস জন্মায়নি, বরং এর জন্য ক্যামেরাটির দুর্দশা দেখে বিরক্তই হয়েছি! আমার মাথায় এল না। ভেবে দেখলাম, এখানে আমাকে মিথ্যের আশ্রয় নিতেই হবে। নচেৎ বৃদ্ধ একবার বেঁকে বসলেই সর্বনাশ।
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম যে, ক্যামেরাটি ঠিক যে অবস্থায় আছে, সেভাবেই আমি রাখব, কেবল মাঝেমধ্যে ধুলো ঝাড়ার জন্যে বাক্স থেকে বের করতে হতে পারে। বৃদ্ধ সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমি তাঁকে অসীম কৃতজ্ঞতা জানালাম। বৃদ্ধ আমাকে ফ্রেমবন্দি একটা পুরানো জার্মান কাগজের কাটিং এনে দেখালেন, যার হেডলাইন মোটা হরফে লেখা ‘Braunschweiger Alptraum’, বাকিটা পড়তে পারলাম না। ব্যাল্ড্রিক হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিল পড়ার জন্য। আমি ব্যাগ থেকে পাঁচশো ইউরো বের করে বৃদ্ধকে অনুরোধ করে বললাম, তিনি যেন লিখিতভাবে ক্যামেরাটির মালিকানা আমার নামে করে দেন। বৃদ্ধ তাঁর নিজস্ব লেটারহেডে ইংরেজিতে লিখে দিলেন, যদিও এর আইনি গুরুত্ব তেমন কিছু নেই, তবুও একটা প্রমাণপত্র সঙ্গে রাখা ভালো। এরপর আমি তাঁকে জোর করে সামান্য কিছু মূল্য নিতে রাজি করালাম, যা আক্ষরিক অর্থেই ‘ফ্লক্সিনসিনিহিলিপিলিফিকেশন’ (floccinaucinihilipilificationn)।
তার পরের ব্যাপার সংক্ষিপ্ত। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে বিদায় জানিয়ে আমরা দুজনে একটা পিচবোর্ডের বাক্সে ক্যামেরাটিকে কাচের বাক্স সমেত ভরে সাড়ে ছ-টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম উল্ভ্স্বুর্গের উদ্দেশে। গাড়িতে বসে ব্যাল্ড্রিকের কাছে জানতে চাইলাম জার্মান কাগজের লেখাটির ব্যাপারে। মোটামুটি ভূতুড়ে ক্যামেরা বলেই যে এর উল্লেখ রয়েছে, সেটা জানাল ব্যাল্ড্রিক। কেন ভূতুড়ে বা কীভাবে হল এটি হন্টেড, তার কোনও উল্লেখ নেই। তবে এতে ছবি তুললে ভূতের ছবি ওঠে, এমনটা লেখা রয়েছে। দুজনে একচোট হাসাহাসি করে নিলাম। এরপর ভনকে ফোন করে জানানো হল সুসংবাদ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা হোটেলে এসে পড়লাম।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই এএইউ-এর সকলে এসে ভিড় করে ক্যামেরাটি দেখে গেল। আমি অবশ্য এর ইতিহাস কাউকে বললাম না, ফ্যান্টাসি গল্পটি তো না-ই। সাফল্যের গৌরবে রাতের দিকে আমরা চার বন্ধু মিলে ছোটখাটো একটা পার্টি অ্যারেঞ্জ করে ফেললাম। খানাপিনা করতে করতে আমাদের চারজনের মধ্যে আলোচনা হল। সবটা শুনে ভন হাস্যকরভাবে বেশ কিছু ইংরেজি গালাগালি ছুড়ে দিল, তবে সেগুলি সিনিয়র না জুনিয়রের উদ্দেশে ছিল তা ঠিক বোঝা গেল না। রেচেল খুব বেশি কিছু বলল না। ও আগাগোড়া শান্ত স্বভাবের মেয়ে।
তিন
এরপর দিন দশেক ব্যস্তভাবে কেটে গেল। প্রতিদিনই ক্যামেরাটা ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখি। এখনও এর কার্যকারিতা বজায় আছে কি না তা নিয়ে অবশ্য একটা আশঙ্কা রয়ে গেছে মনে। তবু এটিই আমার কাছে পরম প্রাপ্তি যে পৃথিবীর প্রথম এহল্লাই এখন শুধুই আমার সম্পত্তি। এর ঐতিহাসিক গৌরব চির অমলিন। মগ্নতার মধ্যেই ধীরে ধীরে ইচ্ছে জাগতে লাগল ফিল্ম কিনে ক্যামেরাটি পরীক্ষা করার। ক্যামেরার পেছন দিকের কালো রং করা প্লেটটির জায়গায় জায়গায় রং চটে গিয়েছে। কিন্তু এর গঠন রীতিমতো সম্ভ্রম জাগায়। যে কাচের বাক্সে ক্যামেরাটি রয়েছে, সেটিও বেশ দামি মনে হল। নিচের অংশটা মোটা কাঠের তৈরি। কাঠের বেসের ওপর কাচ আঁটা। একেবারে ওপরের কাচটি দুটি ছোট হিঞ্জ বা কবজা দিয়ে আটকানো। প্রয়োজনমতো খোলা-বন্ধ করা যায়। এই সপ্তাহে কাজের চাপ বেশি থাকায় দরকারি জিনিসগুলি কিনে আনা হয়নি। ১১৭ রোল ফিল্ম এখন আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যা সে সময় এহল্লাইতে ব্যবহার করা হত। আমি ১১০ বা ১২০ রোল ফিল্ম দিয়ে কাজ চালাব ঠিক করলাম।
তারপর এক ছুটির দিনে আমি আর রেচেল বেরিয়ে পড়লাম কেনাকাটা করতে। সঙ্গে ক্যামেরাটিও নিয়ে নিলাম। শিলার প্যাসেজের ফোটো-আটেলিয়ে হাকলেন্ডা এখানকার নামকরা স্টুডিয়ো। সেখানে ক্যামেরাটি দেখিয়ে ফুজি ১২০ রোল ফিল্ম লাগানোর পরামর্শ পাওয়া গেল। তিনটি ফিল্ম রোল কিনে নিলাম। পুরানো ক্যামেরা যাঁরা ঘেঁটে দেখেছেন, তাঁরা জানবেন, পুরানো ক্যামেরাতে অনেক সময় ময়লা জমে ফিল্ম রোটেটিং কগহুইল জ্যাম হয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত, ক্যামেরাটির সেরকম কোনও সমস্যা নেই, দিব্য সব ক-টি ঘুরছে। এরপর লাঞ্চ বাইরে সেরে আমরা ফিরে এলাম।
হোটেলে ফিরেই ক্যামেরাটি নিয়ে বসে পড়লাম। আজ এর শাপমুক্তি ঘটতে চলেছে, এত বছরের উপেক্ষা ও অবহেলার অবসান হতে চলেছে আমার জন্যে। ভাবতে ভাবতে বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ চোখে পড়ল ক্যামেরার লেন্সের ওপর, যেখানে রোমান হরফে ‘Rolleiflex’ লেখা, তার ঠিক নিচেই ছোট করে লেখা ‘K1 610’ এবং তারও নিচে লেখা প্রস্তুতকারক সংস্থার নাম। বিশ্বাস আরও বদ্ধমূল হল যে, বৃদ্ধের বলা ইতিহাস যদি বানানো গল্পও হয়ে থাকে, তবুও এই ক্যামেরা মাত্র চোদ্দোটি প্রোটো- টাইপের মধ্যে একটি। অর্থাৎ এর গৌরব মোটেও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত আমার কাছে তো নয়ই। তারপর খুব সাবধানে একে একে ফিল্ম লাগালাম, ফোকাস মিরর ঠিকমতো সাজিয়ে শেষে লেন্সক্যাপ খুলে পরীক্ষা করে দেখলাম যে সব ঠিকঠাক আছে।
মিনিট পনেরো পরে আমরা চারজন হোটেলের বাগানে এসে জড়ো হলাম। ব্যাল্ড্রিক বলল, ক্যামেরাটিতে প্রথম তোলা ছবি আমারই হওয়া উচিত, কারণ একটিবার স্বচক্ষে দেখার জন্যে যেভাবে আমি অচেনা একজনের পেছনে ছুটেছি, তাতে ভাগ্যদেবতাও আমার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমি আগাগোড়া ভনকেই সমস্ত কৃতিত্ব দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওদের জবরদস্তির সামনে আমাকে হার মানতে হল। রাজি হলাম ব্যাল্ড্রিকের প্রস্তাবে। এরপর আমাকে একটি পাতাবাহার গাছের পাশে দাঁড়াতে বলে হাত দশেক দূর থেকে প্রথম ছবিটি তুলে নিল ব্যাল্ড্রিক। আমরা সকলে উল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠলাম। চারপাশে খুব বেশি লোকজন না থাকলেও যে কজন ছিল, তারা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে আবার যে যার মতো চলে গেল। এরপর আমরা তিনজন করে দাঁড়িয়ে গোটা দশেক ছবি তুললাম।
হোটেলে ডার্করুম নেই, থাকার কথাও নয়। তা ছাড়া আমাদের কাছেও এনলার্জার, ফোটোগ্রাফিক পেপার কিছুই না থাকায় ফিল্ম নেগেটিভ থেকে ছবি করতে সেগুলি স্টুডিয়োতে দিয়ে আসা হল। সে দিন রাত পর্যন্ত ক্যামেরাটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। যতই দেখছি, ততই যেন আসক্ত হয়ে পড়ছি। রাতে নৈশভোজ সেরে আর কাজে বসতে ইচ্ছে করল না। সারাদিন অনেক হইচই করে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার ওপর আজ মদ্যপানের মাত্রাও কিঞ্চিৎ বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই আর দেরি না করে ঘরে এসে ক্যামেরাটি কাচের বাক্সে ঢুকিয়ে রেখে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সারা ঘরে ঝকঝকে এলইডি আলো জ্বলছে। ক্লান্ত নেশাতুর চোখের ওপর উজ্জ্বল আলো বড্ড বিরক্তিকর হয়। আমি ঘরের আলো নিবিয়ে ব্ল্যাঙ্কেট চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
খুব বেশিক্ষণ জেগে ছিলাম বলে মনে হয় না। শরীর এতটা অবসন্ন হয়েছিল তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন আটটা বেজে দশ মিনিট। বিছানায় উঠে বসতেই বুঝতে পারলাম, গতকালের মদ্যপানের ঘোর তখনও পুরোপুরি কাটেনি। মাথা ভার হয়ে আছে, সারা গায়ে ব্যথা। এমনটা সচরাচর হয় না আমার সঙ্গে। যদিও অতিরিক্ত পরিমাণে হুইস্কি পান করাও আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তবু গতকাল সেরকমই কিছু হয়ে গিয়েছে। অনুতাপের আঁচে ছেঁকা খেয়ে মুখ বেজার করে বিছানা ছাড়লাম। রুম সার্ভিস বয় যে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসে ফিরে গেছে, সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। তাই আরেকটিবার কল দিয়ে দিলাম। এমন সময় চোখ পড়ল ঘরের দেওয়ালের দিকে। ঘরের মাঝামাঝি একটি সিঙ্গল খাটে বিছানা পাতা, তার বাঁ দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটি ওয়ার্ডরোব রয়েছে আর একটি লকারওয়ালা টেবিল। দেওয়ালের এই বাঁ দিকের অংশটি ও ছাদের অর্ধেক অংশ জুড়ে সর্বত্র কালো একপ্রকার পদার্থ লেপে রয়েছে। রংজাতীয় কিছু নয় বলেই মনে হচ্ছে, কতকটা কয়লার গুঁড়োর মতো জিনিস এলোপাথাড়ি লেপে দেওয়া হয়েছে যেন।
ব্যাপারটায় বেশ ভড়কে গেলাম। গতকাল শোবার আগেও এরকম কিছু চোখে পড়েনি। অথচ একরাতের মধ্যে এরকম অনিষ্ট কীভাবে হল, তার কোনও সদুত্তর মাথায় এল না। ব্রাশ করতে করতে দেওয়ালের অবস্থা দেখছিলাম, এমন সময় ব্রেকফাস্ট এল। আমি প্রথমে ছেলেটিকে দেখালাম সব। তারপর গতকাল রাতে মাস্টার চাবির সাহায্যে দরজা খুলে কেউ ঘরে ঢুকেছিল কি না জানতে চাইলাম। প্রশ্নটি শুনে ছেলেটি একেবারে হাঁ হয়ে গেল। তারপর আশ্বাস দিয়ে বলল, এই হোটেলে গ্রাহকের অনুমতি বিনা মাস্টার চাবি ব্যবহার করা হয় না। আমি ছেলেটির আত্মবিশ্বাস দেখে মনে মনে কথাটা বিশ্বাস করে নিলাম। তারপর দেওয়ালটি পরিষ্কার করে দেওয়ার কথা জানিয়ে দিলাম।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট খেয়ে অন্য দুজন বন্ধুর সঙ্গে দরকারি কাজে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। আমার অনুমতিতে আমার অবর্তমানে রুম সার্ভিসের কেউ ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে পুনরায় দরজা লক করে দিয়ে যাবে, সেরকম কথা হয়ে গেল। টাকাকড়ি যা আছে সব লকারে রাখা আর ওয়ার্ডরোবের ভিতরের একটি তাকে রাখা আছে আমার এহল্লাই। দুটোরই চাবি আমার পকেটে, কাজেই চিন্তার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া প্রথম বিশ্বের দেশে ছিঁচকে চুরির সম্ভাবনা যথেষ্ট কম।
যখন ফিরলাম, তখন বেলা দেড়টা। ঘরের দেওয়াল ও ছাদ যথাসম্ভব পরিষ্কৃত হয়েছে। লাঞ্চ সেরে ক্যামেরাটা বের করতে গিয়ে দেখি, কাচের বাক্সটা ফেটে চৌচির হয়ে রয়েছে। মারাত্মক রাগ হল! একী কাণ্ড! খুব সাবধানে আলতো করে এনে বাক্সটা টেবিলের ওপর রাখলাম। প্রত্যেকটা কাচে অজস্র ফাটল, তবু যেরকম থাকার, সেরকমই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ যেন সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেল! রাগে উন্মাদ হয়ে গিয়ে হোটেলের আধিকারিকের সঙ্গে তুমুল বচসা বাধিয়ে বসলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল না হোটেলের কর্মচারীদের দিক থেকে। ওটি বন্ধ ওয়ার্ডরোব থেকে বের করে কে আছড়ে ভাঙল, তার কোনও হদিশ পাওয়া গেল না।
মাথা ঠান্ডা হতে ভেবে দেখলাম, এভাবে চৌচির হয়েও ঠিক যেরকম থাকার, সেভাবে রয়ে যাওয়াটা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! আছাড় মারলে বা হাত থেকে পড়ে গেলেও তো কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ার কথা। যা-ই হোক, রেচেল আর ভন দুজনেই সান্ত্বনা দিয়ে জানাল যে, তারা আমাকে আরেকটি বাক্স এনে দেবে। আমি বাক্সটি থেকে ক্যামেরাটা বের করে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলাম। সৌভাগ্যবশত ক্যামেরাটির কোনও ক্ষতি হয়নি। সে দিন রাতে ক্যামেরাটি বেডসাইড টেবিলের ওপরই রেখে দিলাম। তারপর রাত দুটো পর্যন্ত কাজ করে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলেই শুয়ে পড়লাম। আজ স্নায়ু বড়ই সজাগ, সহসা ঘুম এল না।
পরের দিন সকালের ঘটনা অত্যন্ত অপ্রীতিকর। গতকালের মতো আজও দেওয়াল জুড়ে কালির আঁকিবুকি। পার্থক্য এই যে, গতকাল সেটি ঘরের বাঁ দিকের অংশে ছিল, আর আজ গোটা ঘর জুড়ে করা হয়েছে। বন্ধুরা সকলেই ঘর বদলের উপদেশ দিল। আমিও কয়েকবার ভেবে দেখলাম কথাটা, কিন্তু কেন জানি না, মন সায় দিল না। ব্রেকফাস্ট করতে করতে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে রেচেলকে ফোন করলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়াও আর ঠিক কী সম্পর্ক আছে তা আমরা নিজেরাই ভালোভাবে জানি না। তবে বন্ধুত্বের চেয়েও যে বেশি কিছু আছে তা অনুভব করি মাঝে মাঝে। মনের সব কথা ওকে জানিয়ে একটা আলাদা স্বস্তি পাই। সে দিনও এর ব্যতিক্রম হল না। ব্রেকফাস্ট করতে করতে সেই রাতেই দেখা একটা স্বপ্নের কথা মনে পড়েছিল। রেচেলকে সেটা জানাতেই আগ্রহের সঙ্গে সে গোটা বিষয়টা জানতে চাইল।
ঘন কুয়াশায় ঢাকা এক সকালে একটি লম্বা কাঠের তৈরি বাড়ির মধ্যে একদল মহিলা সেলাইয়ের কাজ করছে। সমস্ত ঘর জুড়ে সেলাই মেশিনের আওয়াজে যেন ছন্দ উঠেছে। হঠাৎই এক লহমায় সবাই উধাও হয়ে গেল। প্রতিটা ডেস্ক মানবশূন্য, কেউ কোথাও নেই। আমি হেঁটে বেড়ালাম ঘরটির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা প্রশস্ত অঞ্চলটিও একেবারে জনমানবশূন্য। হঠাৎ চোখে পড়ল খোলা মাঠের ওপর কাতারে কাতারে নবজাত শিশুর ঢল। এরকম কনকনে ঠান্ডায় তারা উলঙ্গ অবস্থায় মাঠের ওপর পড়ে রয়েছে। আমি ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। একদম কাছে আসতে দেখি প্রতিটা শিশুর গলা থেকে নাভি পর্যন্ত চেরা, যেন কেউ ফালি করে কেটে রেখেছে। চমকে উঠে হাঁটু মুড়ে বসে দেখতে লাগলাম। যত দূর দৃষ্টি গেল, প্রতিটা মৃতদেহেরই একরকম অবস্থা। হাতের সামনে পড়ে থাকা একটি শিশুর মুখের দিকে তাকালাম। ভারী মিষ্টি মুখটা, যেন এরকম নিষ্ঠুরভাবে মরেও মুখ থেকে হাসিটা যায়নি। বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। তারপর চোখ ফেরাতেই দেখি, মাঠের ওপর বাকি সব মৃতদেহ উঠে বসেছে আর বীভৎস ঠিকরে বেরনো চোখে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
সব শুনে রেচেল গম্ভীর হয়ে বলল কয়েকদিন ‘ভায়োলেন্ট’ কিছু চিন্তাভাবনা না করতে। মানুষ মাঝেসাঝে এরকম দুঃস্বপ্ন দেখে থাকে, আপাতত চিন্তা করার মতো কিছু নেই। আমিও এরপর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সারাদিন আউটডোর শুটের কাজ করে সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে একটা বিয়ার পাবে গেলাম। ব্যাল্ড্রিকের আজ জন্মদিন, সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তারিখ জিনিসটা বড্ড এঁড়ে, মোটেও কবজা করতে পারি না। যা হোক, ওর অনারেই আজ ডিনার অর্ডার করা হল। কেক খেতে খেতে সকলেই বিয়ারে চুমুক লাগাচ্ছে। কিন্তু আমার একদম ইচ্ছে করল না। গত পরশু মাত্রাতিরিক্ত নেশা করে শরীরটা বেশ বিগড়ে ছিল, বিয়ারের গন্ধটা নাকে যেতেই গা গুলিয়ে উঠল। তাই আর ঝুঁকি নিলাম না।
সে দিন রাতেও অদ্ভুত আরেকটি স্বপ্ন দেখলাম। সেই সুন্দর মুখওয়ালা শিশুটি বসে রয়েছে ঘন কুয়াশার মধ্যে। চারপাশ ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। কেউ ধারেকাছে নেই। একা আমি একটা চতুষ্কোণ কাঠের ফ্রেমে বাঁধা দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছি। চারদিক অস্বাভাবিকরকম নিস্তব্ধ, কেবল একটিমাত্র রক্ত জল করা আওয়াজ ভেসে আসছে। সেটি মোটা ফাঁসির দড়িতে দেহ এদিক-ওদিক দুললে যেরকম শব্দ হয়, সেই ভয়ংকর মড়মড় শব্দ। আমি ঝুলতে ঝুলতেই দেখছি, শিশুটি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ধীরে ধীরে একসময়ে আমার দম আটকে চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
সকালে উঠে আজ আর স্বপ্নের কথা কাউকে জানালাম না। মনে চিন্তার কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছে। স্বপ্ন মানুষ দেখে, দুঃস্বপ্নও দেখে। কিন্তু পরপর দু-রাত একই রকম বিষয়ে এক অজানা চরিত্রকে নিয়ে স্বপ্ন আসে কি? আমি মনস্তাত্ত্বিক নই, তাই এর সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। হয়তো এর মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব নেই, তবু মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কাজের ফাঁকে ব্যাল্ড্রিককে জিজ্ঞেস করলাম, রাতে সে-ও কোনও স্বপ্ন দেখেছে কি না। কিন্তু গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোনও স্বপ্নের কথা ও মনে করতে পারল না। ভালো কথা, এরকমটা কেবল আমার সঙ্গেই ঘটেছে। ঘরের চার দেওয়াল ও ছাদ কালো ধুলোয় আবৃত। আজ ইচ্ছে করেই সেটি পরিষ্কার করালাম না। রাতে শোবার আগে নিজেই একটি ডাস্টার নিয়ে ঘরের একদিকের দেওয়ালের খানিকটা মুছে পরিষ্কার করলাম। কারণ আজ একটি ব্যাপার নিশ্চিত করতেই হবে আর সে জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
সারারাত জেগে বসে থাকার ব্যবস্থা করেছি। ঘরের সব আলো জ্বেলে বিছানার ওপর ক্যামেরাটা আর ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। ফ্লাস্কে করে কড়া কফি আনিয়ে নিয়েছি। ঘুম পেলে কফিটা কাজে আসবে আশা করি। এরপর আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। ঠিক রাত দুটোয় সিনেমার আওয়াজের মধ্যেই মচমচ করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে এল। দেওয়ালের যে অংশটুকু পরিষ্কার করেছিলাম, দেখলাম সেই জায়গাটা আবার বাকি দেওয়ালের মতো কালো হয়ে যাচ্ছে। হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম। এরকম অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করব, কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। আর আজ বাস্তবটাই যেন কেমন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে!
মিনিট দশেক পর একসঙ্গে ঘরের সব ক-টি আলো নিবে গেল। এমনকী ব্যাটারিতে চলা ল্যাপটপটিও। যেন কোনও গুপ্ত শত্রু অকস্মাৎ ইএমপি অ্যাটাক করে বসেছে। একবার চিৎকার করে উঠে ভয়ে আমি চোখ বুজে বালিশে মুখ গুঁজে দিলাম। যদিও বেশিক্ষণ সেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে থাকতে পারলাম না। একটা চাপা কোলাহলের শব্দে মুখ তুলে চেয়ে দেখি, ঘরের সমস্ত দেওয়াল ও ছাদে পুরানো দিনের সাদাকালো সিনেমার মতো ছবি কেঁপে কেঁপে নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছে। আর আমার সাধের ক্যামেরাটির লেন্স থেকে ক্যাপটি খসে পড়েছে। সেই লেন্স থেকেই ছবিগুলির প্রজেকশন হয়ে চলেছে।
ছবিগুলির প্রত্যেকটি, অন্তত আমি যে ক-টি সাহস করে তাকিয়ে দেখতে পারলাম, নাৎজি পাশবিকতার চূড়ান্ত নমুনা বলা চলে। কোনও ছবিতে অস্থিচর্মসার লাশের পাহাড়, কোনওটায় গ্যাস চেম্বারের ভিতরে বমি-পায়খানায় মাখামাখি হয়ে থাকা হরিদবর্ণ উলঙ্গ নারীশরীর, কোনওটায় ফার্নেসের ভিতরে স্তূপীকৃত মানুষের হাড়। হলোকাস্টের এরকম দৃশ্য যে আগে দেখিনি তা নয়, তবু ঘৃণা ও ভয়ে আমার শরীর ক্রমে অচেতন হয়ে আসছিল। একভাবে বসে থেকেই একবার হাত বাড়িয়ে ক্যামেরাটা কাছে আনার চেষ্টা করলাম। তারপর লেন্স ক্যাপটা তুলে নিয়ে লেন্সের ওপর চেপে বসিয়ে দিতেই চারদিকের ছবিগুলি গায়েব হয়ে গেল।
মনে মনে তীব্র অনুশোচনা হতে লাগল। বৃদ্ধ আমাকে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও আমি ওঁর কথা গ্রাহ্য করিনি। তার ফলাফল হল বড়ই ভয়ানক। পরের দিন সকালে ভন, রেচেল আর ব্যাল্ড্রিককে ডেকে সব ঘটনা বললাম। ওরা চুপ করে সব শুনল। আমি জানি, ওরা কেউই আমাকে চট করে অবিশ্বাস করার মানুষ নয়। সে দিন বিকেলে স্টুডিয়ো থেকে ছবিগুলি আনা হল। সেখানেও এক অদ্ভুত ব্যাপার! আমাদের সকলেরই ছবি উঠেছে, সেই হোটেলের বাগান, সেই আমাদের পোশাক-পরিধান, কিন্তু আমাদের কারও মুখ আমাদের মতো আসেনি। বিশ্রী টাক-মাথা ফ্যাকাশে কোঁচকানো তিনটে মুখ ওদের তিনজনের মুখের ওপর বসানো। অবশ্য আমার ঘাড়ে যে মুখটি বসানো, সেটি আমার পরিচিত। গত দু-রাতে যে শিশুটিকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, অবিকল সেই মুখটি আমার মুখের জায়গায় বসানো। কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না। যে যার মতো চলে গেলাম। ব্যাল্ড্রিক সন্ধ্যায় এসে জানাল যে, সব ক-টি ছবিই সে পুড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাতে কোনও সমস্যার সমাধান হবে কি? মনে মনে বললাম, “ইট’স গেটিং হরিব্ল।”
চার
এই ঘটনার পর থেকে মানসিকভাবে রীতিমতো দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। রোজ রাতে আমি ভয়ানক সব স্বপ্ন দেখতে লাগলাম সেই মরা শিশুটিকে নিয়ে। এভাবে প্রায় দিন দশেক কাটল। তবে আমি ছাড়া আর কাউকেই স্বপ্নের বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। আরও একটা জিনিস লক্ষ করলাম, যে দিন জোর করে রাত জেগে থাকি, সে দিন রাত দ্বিপ্রহরের পর ক্যামেরাটি থেকে ভয়ংকর সব শব্দের সঙ্গে নাৎজি এসএস অফিসারদের পাশবিক অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার নানা ছবির প্রজেকশন হয়ে চলে। ভবিতব্যের দোহাই দিয়ে আর নিজের ওপরই সমস্ত দোষ চাপিয়ে আমি ব্যাপারটা নিজের ভিতরেই চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অভিশপ্ত ক্যামেরাটি থেকে আমার মুক্তি কীভাবে হবে তা নিয়ে রেচেলের সঙ্গে আলোচনা করি মাঝেমধ্যে। স্থানীয় একটি চার্চেও গেলাম বারকয়েক। কিন্তু রাতে ঘুমের মধ্যে সেই বীভৎস দৃশ্যগুলি দেখা কোনওভাবেই বন্ধ হল না।
একদিন সকালে জামাকাপড় ধোয়ানোর জন্যে হোটেলের লন্ড্রির একটি ছেলেকে ঘরে ডেকেছিলাম। ওয়ার্ডরোব থেকে জামা, স্যুট, প্যান্ট বের করে দিচ্ছি, এমন সময় ছেলেটি বলে উঠল, “এক্সকিউজ মি স্যার, ইফ ইউ নিড অ্যানাদার গ্লাসবক্স দেন ইউ ক্যান আস্ক মি এনিটাইম।”
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আস্ক ইউ ফর হোয়াট? ইউ সেল দিজ কাইন্ড অব বক্সেস?”
“নট মি অ্যাকচুয়্যালি, স্যার, বাট মাই ফাদার মেকস দিজ কাইন্ড অব গ্লাসবক্সেস উইদ উড্ন সারফেস।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে বাক্সটা কাছে এনে দেখালাম। তাতে ছেলেটি ঘাড় নেড়ে জানাল, একেবারে এরকম বাক্সই বানায় তার বাবা। আমি তৎক্ষণাৎ ছেলেটিকে কথা দিলাম, আমি অবশ্যই একটি বাক্স কিনব তার থেকে। আর সেইমতো দিন দুয়েক বাদে ছেলেটির সঙ্গে গেলাম ওর বাবার ক্র্যাফ্ট স্টোরে। মিষ্টভাষী ভদ্রলোক আমাকে বেশ কয়েকরকম কাচের বাক্স দেখালেন। তারপর একটি বাক্স এনে দেখিয়ে বললেন, এরকম বাক্স পোল্যান্ডে একসময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল, যার নিচের ওই কাঠের বেসটি একটি স্লাইডিং পাল্লার সাহায্যে খোলা-বন্ধ করা যায়। ভালো করে দেখলাম, সত্যিই অসাধারণ ব্যবস্থা। একটা ছোট কাঠের নবকে ধরে খানিকটা স্লাইড করে নিচে নামিয়ে তারপর পাল্লার মতো ওপরের দিকে টেনে খুললেই কাঠের বেসটির ভিতরে একটা চোরাকুঠুরি বেরিয়ে পড়ে। ইহুদিরা সোনা, রুপো বা অন্য দামি কিছু লুকিয়ে রাখতে এরকম বাক্স ব্যবহার করত এককালে। আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। বাপ-ছেলেকে ধন্যবাদ জানিয়ে, বাক্সটি কিনে, সোজা হোটেলে চলে এলাম। উত্তেজনার পারদ যে ক্রমেই চড়ছে তা বুঝতে পারলাম।
এসেই এহল্লাই-এর সঙ্গে থাকা কাচের বাক্সটি বের করে টেবিলে নিয়ে বসলাম। তারপর কাচের পাল্লা খুলে কাঠের বেসটির মধ্যে হাত বোলাতেই ছোট একটা নব আঙুলে ঠেকল। একই কায়দায় নিমেষের মধ্যে টেনে খুলে ফেললাম চোরাকুঠুরির পাল্লা। ভিতরে লালচে কাপড়ে মোড়া কিছু একটা এতকাল চেপে রাখা ছিল। টেনেহিঁচড়ে কোনওরকমে বের করে আনলাম। এরপর কাপড়ের মোড়ক খুলতেই দেখি তাতে সোনাদানা, মণি-জহরত কিছুই নেই। রয়েছে কেবলমাত্র একটি চামড়ার মলাট দেওয়া পাঁচ ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি সাইজের পুরাতন ডায়েরি।
সন্ধ্যার পর ঘরে এসে অতি সন্তর্পণে ডায়েরিটা নিয়ে পড়তে বসলাম। মলাট ওলটাতেই দেখি, প্রায় প্রথম পাতা জুড়ে নাৎজি পার্টির ‘পাহ্টাইয়াড্লা’ (Parteiadler) চিহ্ন আর তার নিচে ছোট করে নীল কালিতে লেখা ওয়াইল্টা এইচ ক্র্যিমা। ডায়েরির প্রতি পাতার গাঢ় হলুদ রং প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। ফাউন্টেন পেনে সুন্দর হাতের লেখায় প্রায় গোটা ডায়েরি ভরতি। কিন্তু পুরোটাই জার্মান ভাষায় লেখা বলে আমার বোঝার উপায় নেই। তাহলে ব্যাল্ড্রিক ছাড়া কি আর গতি নেই, এমন ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, অনলাইন ট্রান্সলেটর-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই ব্যাপারটা আপাতত আমার মধ্যেই থাক, এমনটাই মন চাইল।
সে দিন আর কোথাও বেরলাম না। এমনকী রাতে ভারী কোনও খাবারও খেলাম না। গুগ্ল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে যথাসম্ভব সুষ্ঠুভাবে অনুবাদ করে পড়তে লাগলাম ডায়েরির লেখা। শুরুর বেশ কয়েক পাতা পড়েই মনে হল, এই ডায়েরি সিনিয়র ক্র্যিমার কর্মজীবনের অনেককাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি দিয়েই শুরু হয়েছে লেখা। হায়েনহিখ হিমলা, হায়েনহাড হায়েডিখ, হ্যারমান গহিং, ইয়োসেফ মাংগিলি এবং আরও নানান কুখ্যাত নাৎজি নেতার সঙ্গে ক্র্যিমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা লেখা রয়েছে। নিজে কখনও হত্যা করেননি বটে, তবে ইহুদিদের প্রতি ক্র্যিমার অটুট ঘৃণার কথাও সাফ লেখা রয়েছে ডায়েরিতে প্রথম পর্বে।
একটা জাতি সেই হিবরু বাইবেলের যুগে মিশরীয়দের দাসত্ব করার সময় থেকে কালের প্রতি পদে নানাভাবে নানা স্থানে চরম নিষ্পেষিত ও অত্যাচারিত হয়ে এসেছে। আজ যদি তারা উদ্বাস্তু দশা কাটিয়ে নিজেদের ক্ষমতাবলে মাথা তুলে সম্মানের সঙ্গে দাঁড়াতে পেরেছে, পরিবার নিয়ে একত্র হতে পেরেছে, সম্পত্তি অর্জন করতে পেরেছে, তা ভোগ করার অধিকার স্রেফ গায়ের জোরে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল। তবু জার্মানদের চোখে সেটা মোটেই অন্যায় ছিল না। ফ্যাসিবাদী হিংসা ও বিদ্বেষের বিষে গোটা দেশ তখন জর্জরিত। ডায়েরির প্রতি পাতায় লেখা মানবিকতার চরম পরিহাসের
এরকমই নানা কাহিনি পড়ে যেতে লাগলাম।
১৯৩৮ সালের পর থেকে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে ‘কনসেনন্ট্রেশন ক্যাম্প’ তথা ‘এক্সটারমিনেশন ক্যাম্প’-গুলিতে ঘুরে ঘুরে ক্র্যিমা ছবি তুলে বেড়িয়ে- ছেন। সেই ছবি ও চলচ্চিত্রের নিয়মিত প্রদর্শনী হত বিভিন্ন নাৎজি রিক্রিয়েশন ক্লাবে। সেখানে উপস্থিত এসএস কমান্ড্যান্ট, সেনার অন্য অফিসাররা ও নাৎজি পার্টির অন্য সদস্যরা সে ছবির বীভৎসতাকে কমেডি সিনেমার মতো উপভোগ করত। এ ছাড়াও ‘ফিউহা’ (Führer) হিটলারের নির্দেশে হিমলা ও হায়েডিখ কীভাবে গণনিধন যজ্ঞ চালিয়েছে, তার বিশদ বিবরণ পড়তে পড়তে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।
যখন ল্যাপটপের চার্জ প্রায় শেষের পথে, তখন সংবিৎ হল, এবার আজকের মতো এখানেই শেষ করা যেতে পারে। আবার আগামীকাল বসা যাবে। যে পৃষ্ঠাটি খোলা ছিল, ভাবলাম, সেটি শেষ করে তুলে রাখব সব। কিন্তু তা আর হল না। ট্রান্সলেটরে শেষ প্যারা লিখে অনুবাদের দিকে তাকাতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। হ্যাঁ এই তো, এহল্লাই ক্যামেরা নিয়ে প্রথম কোনও লেখা চোখে পড়ল। এক লাফে উঠে গিয়ে ল্যাপটপের চার্জার নিয়ে এলাম। এই লেখা এখনই ছাড়া কীভাবে সম্ভব! ক্যামেরার সঙ্গেই যখন ডায়েরিটা গোপনে রাখা, তখন এর ভয়াবহতা সম্বন্ধেও কিছু লেখা থাকবে আশা করি। কে বলতে পারে, যদি এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তির কোনও পথের হদিশ থেকে থাকে? এরপর ধৈর্য সহকারে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ পাতা একবারে অনুবাদ করে মন দিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
সময়টা ১৯৪৪ সালের প্রথম দিক। নানা জায়গা থেকে জার্মানদের পরাজয়ের খবর আসতে শুরু করেছে। সোভিয়েত রেড আর্মি ও ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েড ফোর্সের সাঁড়াশি চাপে তখন জার্মানরা পিছু হঠছে। এমত অবস্থায় ফেব্রুয়ারি মাসে নাৎজি পার্টির ও এসএস বাহিনীর উচ্চপদস্থ নেতাদের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক হল হিটলারের। এসএস বাহিনীর চিফ হায়েনহিখ হিমলা সে বৈঠকে এক সোজাসাপটা বক্তব্য পেশ করল সকলের সামনে। হিটলারের সব থেকে বিশ্বস্ত ও কাজের লোক ছিল এই হিমলা। তাই জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের প্রতিটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের যত শীঘ্র সম্ভব মেরে ফেলার প্রস্তাবে হিটলার এককথায় তার অনুমতিও দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে সোভিয়েত বাহিনী পূর্ব পোল্যান্ডের কয়েকটি ক্যাম্পে কবজা করে নিয়েছে ও সেখানকার জীবিত বন্দিদের উদ্ধার করেছে। বিদ্বেষের আগুনে জ্বলতে থাকা নাৎজিদের কাছে এটা যুদ্ধে পরাজয়ের থেকেও খারাপ খবর। তারপর মে মাসের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি জার্মানদের জন্যে আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠতেই বন্দিদের হত্যার বেগ অকল্পনীয় হারে বৃদ্ধি পেল। ক্র্যিমা তখন আওসউইতজ্ (Auschwitz) ‘ডেথ ক্যাম্পে’ ছবি তুলছেন। গ্যাস চেম্বারের ভিতরে হাইড্রো- জেন সায়ানাইড গ্যাসের বিষক্রিয়ায় প্রায় হাজারজন নারী-পুরুষকে এক-একবারে মেরে ফেলা হচ্ছে। তারপর মৃতদেহগুলি টাল করে রেখে তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন সময়ে ইয়েগার পত্র পেলেন ক্র্যিমা। তাঁকে অবিলম্বে নিডাজাক্সেন চলে আসতে বলা হয়েছে। মনে মনে একপ্রকার খুশিই হলেন তিনি। প্রায় অনেকদিন হল পড়ে রয়েছেন পোল্যান্ডে। পরের দিন জিনিসপত্র গোছগাছ করে তিনি তৈরি হয়ে নিলেন। এহল্লাইয়ের দুটি ক্যামেরা তখন তাঁর সঙ্গী। এর মধ্যে প্রোটোটাইপটি তিনি আর ছবি তোলার কাজে ব্যবহার করেন না। আধুনিক মডেলটি ব্যবহারের সুবিধে অনেক বেশি, তাই সেটিই এখন ব্যবহৃত হয়। সে রাতে একজন নাইটগার্ডের কাছ থেকে ক্র্যিমা খবর পেলেন, মধ্যরাতে ক্রাকাউ থেকে একটি ট্রেন আসবে, যাতে করে ওই অঞ্চলের কিছু জার্মান ব্যক্তি আওসউইতজ্-এ আসবে। তারা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আগামী কিছুদিন এই ক্যাম্পে থাকবে। ক্র্যিমা ভেবে দেখলেন, আগামীকাল ভোরেই হয়তো ট্রেনে চেপে তাঁকে ফিরতে হবে, তাই আজ রাতে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে নেওয়া যেতে পারে। ক্র্যিমা অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঠিক রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ একটি ট্রেন এসে থামল ক্যাম্পের প্ল্যাটফর্মে। ক্র্যিমা তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকেই দেখলেন, প্রথমে তিনজন লোক ট্রেন থেকে একে একে নেমে এল ও তারপর কিছু সেনা বড়সড়ো কয়েকটি ট্রাংক নিয়ে নামল। আর দেরি না করে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ক্র্যিমা। সময়মতো আলাপ-পরিচয়ও সেরে নেওয়া গেল। আমন গুট একজন এসএস হাউফস্টোমফিউহা (Hauptsturmführer) এবং তার ব্যবসায়ী বন্ধু অস্কার শিন্ডলা একজন হাসিখুশি মানুষ। ক্র্যিমার পরিচয় পেয়ে তারাও উচ্ছ্বসিত। হওয়ারই কথা, হিটলারের যথেষ্ট কাছের লোক হিসেবে ক্র্যিমার নাম তখন ঘনিষ্ঠ মহলে বেশ পরিচিত। কথা আলোচনায় রাত আরও বাড়লে ক্যাম্প ঘুরে দেখার ইচ্ছা জানাল মদ্যপ আমন গুট। কেউ তাতে আপত্তি জানাল না, আওসউইতজ্-এর কমান্ড্যান্ট উডল্ফ হাস নিজে ঘুরিয়ে সব দেখাতে শুরু করল অতিথিদের। সে দিন বিকেলেই কিছু সোভিয়েত যুদ্ধবন্দিকে তড়িৎস্পৃষ্ট করে মারা হয়েছিল। তাদের মরদেহ- গুলি তখনও একটা কাঠের ঠেলাগাড়ির ওপর রাখা ছিল। গুট হঠাৎ সেটি সমেত সকলের একটি ছবি তুলে দিতে ক্র্যিমাকে অনুরোধ করল। ক্র্যিমা বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের ছবি তুলে দিলেন। তারপর সকলে মিলে আবার মদ্যপান করতে বসতেই অস্কার শিন্ডলা ক্র্যিমার কাছে তাঁর ক্যামেরাটি দেখতে চাইল ও যথোপযোগী বিশেষণে অনেক প্রশংসাও করল। ফিউহা ও পার্টির প্রতি ক্র্যিমার আনুগত্য ও তাঁর এই কঠোর পরিশ্রম যে নিঃসন্দেহে তুলনাহীন, সেটা শিন্ডলা অনেক নাৎজি অফিসারের কাছেই শুনেছে বলে জানাল। ঘণ্টাখানেক পর ক্র্যিমা নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলেন এবং বাকি রাতটুকু ঘুমিয়ে কাটালেন। পরের দিন ভোরে জার্মানির উদ্দেশে ট্রেনে চাপতে হল তাঁকে। দুবার ট্রেন বদল করে পৌঁছাতে হবে বহ্ন্শোয়াইগ। তারপর বহ্ন্শোয়াইগ প্রেসে গিয়ে হুগো ইয়েগার সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরবর্তী করণীয় সেখান থেকেই জানা যাবে। কিন্তু যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছে ক্র্যিমা প্রথমেই তাঁর নিজের বাড়িতে এসে পড়লেন। দুটি ক্যামেরার ফিল্ম ও বেশ কিছু ডকুমেন্ট সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে প্রেসে। একটু বিশ্রাম করে ক্যামেরা থেকে ফিল্ম খুলে নিতে গিয়ে চমকে গেলেন তিনি। নতুন মডেলটির ফিল্মের জায়গায় একটা সাদা কাগজের টুকরো গোঁজা, আর ফিল্মটি উধাও হয়েছে। কাগজটি বের করে হাতে নিতেই একটা লেখা চোখে পড়ল ক্র্যিমার। জার্মান ভাষায় তাতে যা লেখা রয়েছে, তার মানে করলে এই দাঁড়ায় যে, অস্কার শিন্ডলা সুন্দরীদের সঙ্গে ছবি তোলে, মৃতদেহের সঙ্গে নয়। কাজেই তিনি একজন খাঁটি পুরুষ। এ ঘটনায় বেজায় চটে গেলেন ক্র্যিমার। ইচ্ছে না থাকলে তো সটান মানা করে দিতে পারতেন, গোটা ফিল্ম রোলটাই চুরি করে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বেশ কিছু দরকারি ছবি ছিল রোলটিতে। রাগে গজগজ করলেও সময়মতো প্রেসে এসে পৌঁছালেন ক্র্যিমা। তারপর কিছু দরকারি কাজ সেরে হুগো ইয়েগার কাছে ব্যাপারটা বললেন। ইয়েগা সব শুনে বলল লোকটা জার্মানদের নামে কলঙ্ক, তা না হলে কি কেউ ইহুদি মেয়েকে চুমু খায়! তবু বড় ব্যবসায়ী বলে লোকজন খাতির করে। তা ছাড়া পার্টির অর্থনীতিকে সরাসরি সাহায্যও করে। যা-ই হোক, ক্র্যিমাকে কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে এখানেই কাজে লেগে পড়তে হবে। বহ্ন্শোয়াইগ লেবর ক্যাম্পে- র চেহারা তখন প্রায় কঙ্কালসার। বন্দিদের খাবারের জোগান প্রায় আসে না বললেই চলে। এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার রোমানি জিপসি ও ইহুদি বন্দিকে নতুন করে আনা হয়েছে ক্যাম্পে। এদের মধ্যে পনেরোজন মহিলা গর্ভবতী। কিছু মহিলাকে বহ্ন্শোয়াইগের হাসপাতালে সাময়িকভাবে ভরতি করে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের মধ্যে প্রায় সত্তরজন মহিলা এমন রয়েছে, যাদের কোলে নবজাত শিশু রয়েছে। জার্মানির বিভিন্ন স্থান থেকে এদের একত্র করে বহ্ন্শোয়াইগ নিয়ে আসা হয়েছে। যুদ্ধে সেনাদের ব্যবহারের ব্যাগ বানানো চলছে লেবর ক্যাম্পে। মহিলারাই মূলত এই কাজ করে। এদের কারও কর্ম- ক্ষমতা হারিয়ে গেলে বা কর্মদক্ষতা হ্রাস পেলে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলাই একমাত্র নিয়ম। পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে সপ্তাহখানেক পর ক্র্যিমা ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গী পুরানো সেই প্রোটোটাইপ ক্যামেরাটি। গতকাল রাতে তিনি আবিষ্কার করেছেন, নতুন মডেলটির কেবলমাত্র ফিল্মই খোয়া যায়নি, ব্যাক কভারটি এমনভাবে বলপূর্বক খোলা হয়েছে যে, এর ফোকাস রিফ্লেক্টিং মিররটিও ভেঙেছে। তাই ওটি আরও কিছুদিন বিশ্রাম নেবে। অগাস্ট মাসের শুরুর দিক। হঠাৎ একরাতে ক্যাম্পের শান্ত পরিবেশ ভারী বুটের আওয়াজে মুখরিত হয়ে গেল। হিমলা এই অঞ্চল থেকে খুব বেশি কাজ পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। আজ তার নির্দেশে পুনরায় রাতের অন্ধকারে শিশু ও নাবালক নিধন করা হবে বলে খবর পাওয়া গেল। ক্র্যিমা তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এরপর কমান্ড্যান্টের আদেশে ক্যাম্পের সকল বন্দিকে সারবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হল খোলা মাঠে। জন পাঁচেক সেনা তাদের মধ্যে থেকে যাদের কোলে বাচ্চা রয়েছে, তাদের আলাদা করে দিল। আরও কিছু সেনা তিনটি শ্রমিক ছাউনিতে ঢুকে প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটি নবজাত শিশুকে চ্যাংদোলা করে বের করে আনল। অমনি মুহূর্তের মধ্যে এক তুমুল কাণ্ড শুরু হল। বন্দিদের মধ্যে থেকে শিশুগুলির মায়েরা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসতে চাইল তাদের সন্তানদের কাছে। কিন্তু পাগল কুকুরের মতো আর্মির সেনারা তাদের কাউকে মেরে, কাউকে বন্দুকের বাঁটের গুঁতোয় অজ্ঞান করে ও কাউকে স্রেফ ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে কিছুতেই সেদিকে অগ্রসর হতে দিল না। ক্র্যিমা ছবি তুলে নিচ্ছেন সুযোগমতো। যত নাটকীয় দৃশ্য হবে, তত তাঁর নাম হবে। যত নারকীয় দৃশ্য হবে, ততই তাঁর যশ বাড়বে। এ এক আশ্চর্য জীবিকা! এমন সময় কিছু রোমানি মহিলা দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করে কমান্ড্যান্টকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে শুরু করল। প্রথম দিকে ক্র্যিমা কিছু বুঝতে না পারলেও পরে অন্তত এটুকু বুঝলেন যে, সেটি নাৎজি বিরোধী কোনও কথা বা গালাগালই হবে। কারণ নিমেষের মধ্যে কমান্ড্যান্ট খিঁচিয়ে উঠে আদেশ দিল প্রত্যেকটা শিশুকে উলঙ্গ করে মাঠের ওপর শুইয়ে দিতে। তারপর তিনজন সেনাকে সঙ্গে নিয়ে সে নিজে সেদিকে এগিয়ে গেল। ক্র্যিমা এতকাল যাবৎ নানাবিধ পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যালীলা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন, তবু এ দৃশ্য যেন সকল প্রকার ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গেল। মাঠের ওপর পড়ে থাকা বাচ্চাগুলি এক সুরে কেঁদে চলেছিল। কমান্ড্যান্ট তার ভারী বুটের চাপে এক-এক করে শিশুগুলিকে চেপটে পিষে মারতে শুরু করল। কোনও শিশুর খুলি থেঁতলে গেল, কারও বুকের পাঁজর চ্যাপটা হয়ে গেল, কোনওটির পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এল। সে এক বীভৎস সাংঘাতিক দৃশ্য, যা কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা সম্ভব নয়। ক্র্যিমার হাত থেকে ক্যামেরা খসে পড়ল মাটিতে। তাঁর নিজের একটি সন্তান হয়েছে বছরখানেক হল। বারবার তাঁর মনে পড়ে যেতে লাগল ছেলের মুখটা। জীবনে প্রথমবার বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে ক্র্যিমা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এদিকে গুনে গুনে চৌষট্টিটি শিশুর কান্না থামিয়ে ফিরে এসে কমান্ড্যান্ট ক্র্যিমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল এবং তারপরই বলিষ্ঠ হাতে ক্র্যিমাকে জাপটে ধরে জবরদস্তি একটি ঘরে টেনে নিয়ে গেল। সেখানে তাঁকে বোঝানো হল যে, এরকম ব্যবহার ইহুদিদের ও বন্দিদের প্রতি দেখানোটা ঘোরতর অন্যায়। কোনওরকম সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্যই নয় তারা। এরপর তাঁকে মাঠে পড়ে থাকা শিশুদের মৃতদেহের ছবি তুলে আনার কথা বলা হল। ক্র্যিমা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন চারপাশে কিছু মৃতদেহ ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। কিছুটা এগিয়ে যেতে মাটিতে পড়ে থাকা ক্যামেরাটা চোখে পড়ল ক্র্যিমার। তিনি সেটি তুলে নিয়ে শিশুগুলির লাশের সামনে এলেন। এখানে আলো বড্ড কম। ছবি ঠিকঠাক আসবে না মনে হতে লাগল ক্র্যিমার। ঝুঁকে দেখতে দেখতে লক্ষ করলেন, একটি শিশুর মুখ যেন অবিকল তাঁর ছেলে ব্যেয়ানহাডের মতো। চমকে উঠলেন! এভাবে মানসিক শক পাবেন, ভাবতেই পারেননি তিনি। যা-ই হোক, কাজটুকু সেরে ফেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ জায়গা ছেড়ে যাওয়া যাবে ততই ভালো, এমন ভেবে যেই ছবি তুলতে যাবেন, ঠিক সে সময়ে পেছনে কার যেন ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। চমকে উঠে পিছনে ফিরে দেখলেন, হাঁটু মুড়ে এক মাঝবয়সি মহিলা রক্তাক্ত অবস্থায় বসে রয়েছে। ক্র্যিমা মুহূর্তের জন্যে ভেবে পেলেন না কী করবেন। তারপর সাহস করে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন তার কী চাই। মহিলা জানাল, সে নাকি ক্র্যিমাকে আগে বেশ কয়েকবার দেখেছে, অন্য কোনও ক্যাম্পে। তার মনে হয়েছে, নাৎজি আর্মির থেকেও বেশি নিষ্ঠুর কাজ করে চলেছেন ক্র্যিমা। এটুকু বলবার পরই সে অন্য কোনও ভাষায় কী সব বলতে শুরু করে তা আর ক্র্যিমা বুঝতে পারেননি। তার কিছু সময় পর সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এরপর ক্র্যিমা একটিমাত্র ছবি তুলে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলেন এবং পরের দিনই বিশেষ অনুমতি নিয়ে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন। ভেবেছিলেন, আর এ কাজ করবেন না, ইয়েগাকে জানিয়ে অবসর নিয়ে নেবেন। কিন্তু রাত্রি ঘনাতেই অদ্ভুত কিছু ব্যাপার টের পেলেন ক্র্যিমা। সুন্দর করে সাজানো তাঁর ঘরটি দেখতে দেখতে পোড়ো বাড়ির মতো চেহারা নিল, চারপাশ থেকে অপার্থিব নানারকম শব্দ শোনা যেতে লাগল এবং রাতে ঘুমের মধ্যে সেই জিপসি মহিলা বারবার দেখা দিতে লাগল। দিন তিনেক এভাবে কাটার পর ক্র্যিমা দোতলায় আলাদা ঘরে নিজের জায়গা করে নিলেন। পরিবারের বাকিদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে গেল। দিনকয়েক পর, ১৪ অগাস্ট মধ্যরাতে গোটা বহ্ন্শোয়াইগ জুড়ে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের (RAF) চল্লিশটি বোমারু বিমান কার্পেট বম্বিং করে শহরের প্রেস, ক্যাম্প, কারখানা ও প্রায় আশি শতাংশ বাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে দিল। তবু আশ্চর্যরকমভাবে ক্র্যিমার বাড়ির কোনও বড় রকমের ক্ষতি হল না। এরপর অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করে নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার, কিন্তু সে সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার বেশ কিছু বছর পরে তিনি খোঁজ করে একটি জিপসি পরিবারের হদিশ পেলেন, যারা ভাগ্যগণনা ও ভূতপ্রেত চর্চা করে থাকে। পোল্যান্ডের সেই পরিবারের কাছে এসে সব বলে ও ক্যামেরাটি দেখিয়ে ক্র্যিমা জানতে পারলেন, ক্যাম্পের সেই জিপসি মহিলা ক্যামেরাটিকে ও সেই সঙ্গে তাঁকেও কালান্তক অভিশাপে বেধে দিয়েছে।
সন্তানের বাসনা এক চরম বাসনা। অতৃপ্ত আবিজু প্রতিনিয়ত ক্যামেরায় তোলা শেষ ছবির ছায়াতে তার সন্তানের খোঁজ করে। এরপর সেই জিপসি স্বামী-স্ত্রী মিলে যথাসম্ভব প্রচেষ্টায় ক্র্যিমার মানসিক পীড়া কমানোর চেষ্টা করল। তাঁকে একটি হিবরু ভাষায় লেখা মন্ত্র দিল, যেটা রোজ রাতে একবার করে পড়ে ঘুমালে সকালে উঠে দুঃস্বপ্নের কথা প্রায় মনে থাকবে না। ক্র্যিমা বাকি জীবনটা সেরকমই করে গেছেন, কিন্তু মুক্তি পাননি।
মনটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল। তবে কি এই অভিশাপের থেকে আমৃত্যু উদ্ধার পাওয়া যাবে না? এতকাল বাদে আমার ছবিই প্রথম তোলা হল বলে কি আমাকে এই দুর্দশা ভোগ করতে হচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে এল। সব গুছিয়ে রেখে সে রাত্রে প্রচুর হুইস্কি পান করলাম। একেবারে যখন চোখ ঝাপসা হয়ে এল, তখন বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙল। আবার সেই মাথা ভার। তারপর ফ্রেশ হয়ে, ব্রেকফাস্ট করে স্টুডেন্টস’ মিটিং-এ গেলাম। সেখানে হঠাৎ মাথায় এল কাল রাতে কোনও স্বপ্ন আমি দেখিনি। বেশ ভালোভাবে মনে করে দেখলাম, নাঃ, কোনও স্বপ্নই আমি দেখিনি। মিটিং শেষে নিজের ঘরে এসে দেখলাম, চারপাশের দেওয়াল থেকে কালো ধুলোর আবরণ যেন কিছুটা হালকা হয়ে গিয়েছে। মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তবে কি কোনও আশ্চর্য ক্ষমতাবলে জিপসি মহিলার অভিশাপ আমার ওপর থেকে কেটে যাচ্ছে!
লাঞ্চের সময়ে রেচেলের সঙ্গে দেখা হল। সে নিজে থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করল রাতের স্বপ্নের কথা। আমি আজকের ঘটনাটা ওকে বললাম। শুনে রেচেল আমাকে জানাল, আজ সন্ধ্যায় সে আমাকে একজন পণ্ডিতের কাছে নিয়ে যাবে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে কী ব্যাপার জানতে চাইলাম। কিন্তু রেচেল খুলে কিছু বলল না আমাকে। আমি তবু কথামতো তৈরি হয়ে নিলাম সন্ধের আগে। তারপর চার বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম। সবাই চুপচাপ, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না। জায়গামতো আসতে দেখলাম এটি একটি সুন্দর সাজানো বাগানবাড়ি। রেচেল গৃহকর্তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। গত পরশু রেচেলের সঙ্গে এঁর আলাপ হয় উল্ভ্স্বুর্গের একটি প্যারানর্ম্যাল সোসাইটির ক্লাবে।
পাঁচ
ভদ্রলোকের নাম ইভান মুলার। তাঁকে আমি প্রথম থেকে সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি সব শুনে ক্যামেরাটি দেখতে চাইলেন। আমি তাঁকে কাচের বাক্সটি সমেত ক্যামেরাটি দেখালাম। সব দেখে-শুনে বললেন, আগামী পূর্ণিমায় তিনি আমার সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। সেই দিন আমাকে ক্যামেরা, গ্লাসবক্স, ডায়েরি সব নিয়ে এখানে আসতে হবে ও একরাত এ বাড়িতে কাটাতে হবে। রাজি হলাম, আর কোনও উপায়ও নেই। যত শীঘ্র সম্ভব এই জঘন্য অবস্থা থেকে রেহাই পেতে চাই। অনেকদিন হল কাজেও বিশেষ মন দিতে পারছি না।
ফেরার পথে আমি রেচেলের কাছে সব ঘটনা জানতে চাইলাম। রেচেল জানাল, সে আর ব্যাল্ড্রিক স্থানীয় লোকদের সাহায্য নিয়ে ওই প্যারানর্ম্যাল সোসাইটির খোঁজ পায়। সেখানকার প্রেসিডেন্ট ইভান মুলার। একসময়ে হাইডেলব্যাগ ইউনিভার্সিটির ইন্দোলজি ডিপার্টমেন্টের সংস্কৃত অধ্যাপক ছিলেন। তারপর ভূততাত্ত্বিক গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। রেচেল সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে তাঁকে ঘটনাগুলি জানায়। মিঃ মুলার আজ সবাইকে তাঁর বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। এই বাড়িই এখন তাঁর গবেষণাগার। মনে মনে খুব খুশি হলাম রেচেলের এই পদক্ষেপে। আমি ডায়েরির ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছিলাম সবার কাছে। তার জন্যে ক্ষমা চাইলাম।
মন থেকে ক্যামেরাটির প্রতি প্রেম প্রায় ঘুচে গিয়েছিল, বরং নাৎজি বর্বরতার প্রতীক হিসেবে এটির ওপর যথেষ্ট ঘৃণা জন্মাল। শুধুই জন্মের ইতিহাস জেনে আনন্দ পেয়ে আসছিলাম এতদিন, কর্মের ইতিহাস জানার পর সেই ভক্তিভাব চিরতরে বিলুপ্ত হল। এদিকে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। খুব ভালো করে ভেবে দেখলাম, যে ক-দিন আমি মাত্রাতিরিক্ত নেশা করেছি, সে রাতে স্বপ্ন দেখিনি আমি। অথবা দেখলেও পরের দিন সকালে কিছু মনে পড়েনি। যাক, সংস্কৃত পণ্ডিতের আশ্বাসবাণীতে আত্মবিশ্বাস উছলে পড়তে দেখেছি সে দিন। হয়তো কোনও একটা উপায় তিনি ঠিকই বের করবেন।
তারপর পূর্ণিমার রাতে ডাক পড়ল আমাদের। চারজন মিলে সেখানে যাওয়া হল। ভন, রেচেল আর ব্যাল্ড্রিক ফিরে আসবে হোটেলে আর আমি থেকে যাব। মিঃ মুলার আমাদের স্বাগত জানিয়ে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। চারদিকে লম্বা কাচের পাত্রে প্যারাফিন জ্বলছে আর তার সুগন্ধে সারা ঘর ভরে আছে। আমরা সবাই একটি টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসলাম। ভদ্রলোক প্রথমেই আমাদের প্রত্যেকের সামনে একটি করে পাত্রে পানীয় রাখলেন। তারপর বাইবেল থেকে কিছু পড়তে পড়তে হাতের ইশারায় আমাদের সেটি পান করে ফেলতে বললেন। আমরা তা-ই করলাম। এরপর তিনি বাকিদের চলে যেতে অনুমতি দিলেন। ওরা সবাই থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও একপ্রকার জোর করেই ভদ্রলোক ওদের চলে যেতে বললেন। অগত্যা সকলে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ একাকী ঘরটিতে বসে রইলাম।
কিছু সময় পর ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর গায়ে প্রাচীন রোমান পুরোহিতদের মতো পোশাক। খানিকটা আলখাল্লার মতো, মাথার ওপর এক- ফালি কাপড় চাদরের মতো জড়ানো। তারপর তিনি আমার সোজাসুজি টেবিলের অপর প্রান্তে বসে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করে গেলেন। সেটি শেষ হলে আমার কাছ থেকে ক্যামেরাটি চাইলেন। আমি ক্যামেরাটি বের করলাম, ভাঙা গ্লাসবক্সটিও টেবিলের ওপর রাখলাম। তিনি ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন। ঘরের জানালা থেকে সরু আলোর রেখা এসে পড়েছিল টেবিলের ওপর। সেই ক্ষীণ আলোতে ক্যামেরাটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কী যে দেখলেন, আমার বোধগম্য হল না। এরপর তিনি ক্যামেরাটিকে ভাঙা গ্লাসবক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে ছড়ানো একটি পাত্রের ওপর তুলে নিলেন। এরপর আমাকে কাগজে ইংরেজি অক্ষরে উদ্ভট উচ্চারণের কিছু শ্লোকজাতীয় মন্ত্র লিখে দিলেন এবং বললেন, যখন আমাকে বলা হবে, ঠিক তখনই যেন আমি এই মন্ত্রগুলি পড়তে শুরু করি।
এরপর ভদ্রলোক আমার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। আমি যেমন বসে ছিলাম, তেমনই রইলাম। সামনে টেবিলের ওপর বাক্স সমেত ক্যামেরাটি রাখা। উনি দু-হাতে আমার দুই কান চেপে ধরলেন, আর বললেন পড়া শুরু করতে। আমি সাবধানে পড়তে শুরু করলাম। অজানা ভাষার উচ্চারণ চেনা অক্ষরেও পড়ে যাওয়া যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। তবু একটা ব্যাপার ভালো, শ্লোকগুলির কোনও শব্দই অত্যধিক বড় নয়। জার্মান ভাষায় যেমন এক-একটি শব্দ আছে বিরাট লম্বা, এটি সেরকম নয়। দেখে-শুনে পড়ে যেতে লাগলাম।
পড়তে পড়তে হঠাৎ আমার গালে ও নাকে হালকা সুড়সুড়ির মতো অনুভূতি হল। দেখতে দেখতেই আমার হাতে ধরা পৃষ্ঠার ওপর মাঝারি সাইজের কালো কালো চুল পড়তে শুরু করল। ভয় পেয়ে বোধহয় মুহূর্তের জন্যে থেমে গিয়েছিলাম, মিঃ মুলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সতর্ক করে দিলেন। আমি পুনরায় পড়ে যেতে লাগলাম। শেষ করে যখন থামলাম, তখন আমার সামনে টেবিলের ওপর গোছা গোছা চুলের রাশি পড়ে রয়েছে। ভদ্রলোক আরেকটি জিনিসের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। ক্যামেরাটির গ্লাসবক্সের দিকে চেয়ে দেখলাম, সেটি সম্পূর্ণভাবে আগের মতো হয়ে গিয়েছে। একটিও ফাটল বা চিড় ধরার দাগ নেই তাতে।
রাত্রি দ্বিপ্রহর পার হল। বুকের ভিতরে ধুকপুকুনি চলছেই। ভদ্রলোক বললেন যে, আজ রাতে যদি অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা না ঘটে, তবে বোঝা যাবে, আমি এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছি। একইভাবে আরও আধ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হল। অলৌকিক কিছু ঘটল না। এরপর ভদ্রলোক আমাকে আরেকটি পানীয় এনে দিলেন। সেটি পান করে ভীষণ ঘুম পেল। সেই ঘরেই একটি সোফার ওপর তিনি আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই তিনি আমার সামনে এক পেয়ালা কফি এনে রাখলেন। সুপ্রভাত জানিয়ে আমি রাতের বাকি ঘটনা জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে আগে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে বললেন। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। আমার মাথায় একটিও চুল নেই, মাথাজোড়া টাক চকচক করছে। বেরিয়ে এসে দেখি, মিঃ মুলার হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি চুপ করে সোফার ওপর বসে কফিতে চুমুক লাগালাম।
ভদ্রলোক আমাকে বললেন, এই ক্যামেরাটি যেন আর কখনও ছবি তোলার কাজে ব্যবহার না করা হয়। ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে দিয়েই সেই রোমানি জিপসি মহিলার অভিশাপ আমাকে গ্রাস করে। আমি জানতে চাইলাম, যদি কোনওভাবে প্রথমবারই একাধিক মানুষের ছবি তোলা হত তবে কি সকলেই ‘পজেস্ড্’ হত? তিনি বললেন, এই মহিলার আত্মা যার ওপর ভর করে, তার শারীরিক কোনও ক্ষতি করে না। এই আত্মাটি কেবল মানুষের অবচেতন মনকে বশ করে। এককথায় বোঝাতে গেলে একে ভূত বা প্রেত না বলে স্রেফ দুঃস্বপ্ন বলাই ভালো। ‘ফন অ্যাল্পট্হম ব্যসেসেন’ বা ইংরেজিতে বললে ‘Possessed by Nightmare’। সে ক্ষেত্রে হয়তো সকলেই দুঃস্বপ্নের কবলে পড়ত।
আমার চুল পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বললেন সেটি সাময়িক প্রভাব। ধীরে ধীরে আবার চুল উঠবে। বুঝলাম সব। কিন্তু ক্যামেরাটি নিয়ে এখন আর কী করতে হবে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, এটি নির্দ্বিধায় ঘরে রাখা চলতে পারে, কেবল ব্যবহার না করলেই হল। তা-ও ভালো! কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম রেচেল আর ভন এসে হাজির। সব শুনে ওরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আমি ক্যামেরাটি সঙ্গে নিয়ে ফেরার আগে ভদ্রলোককে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম। রেচেল খুব সম্ভবত ওঁকে কিছু ইউরো দিল গবেষণার ডোনেশন হিসেবে।
এরপর থেকে আর রাত্রিকালীন ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি হয়নি। দিনকয়েক বাদে অনলাইন সেলিং ওয়েবসাইটে ক্যামেরাটি বিক্রির বিজ্ঞাপন ছেড়ে দিলাম। ডিসেম্বরে ওয়ার্কশপের কাজ শেষ হয়ে গেলে আমরা সান ফ্রানসিস্কো ফেরার তোড়জোড় শুরু করলাম। এমন সময় আমার বাড়ি থেকে খবর এল আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই দেশে ফেরা জরুরি। সেইমতো ব্যবস্থাও করে ফেললাম। ক্যামেরাটি সঙ্গে নিয়ে ক্রিসমাসের আগেই ইন্ডিয়াতে চলে এলাম, একেবারে আমার শহর কলকাতায়। এখানে এসে পুরানো কিছু বন্ধুর মারফত রাসেল স্ট্রিটের এক অকশন এজেন্টের সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি আমাকে খরিদ্দার জোগাড় করে দেবেন কথা দিলেন। সেই সূত্রে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে একজন তামিল কালেক্টরের সঙ্গে আমার আলাপ হল। সে লিখিতভাবে আমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হল যে, এই ক্যামেরা সে ছবি তোলার কাজে কখনওই ব্যবহার করবে না, এবং এর ব্যতিক্রম ঘটলে কোনওভাবেই আমি দায়ী থাকব না। সে আরও জানাল যে, জিনিসপত্র ব্যবহার করার থেকে সেগুলি সাজিয়ে রাখতেই সে বেশি পছন্দ করে। তারপর পেপারওয়ার্ক শেষে ক্যামেরাটি গ্লাস- বক্স সমেত তুলে দিলাম তার হাতে। চিরতরে বিদায় সাধের এহল্লাই!
ক্যামেরাটি বিক্রির পর কিছু সময় বেশ মন খারাপ লাগল। তবু মনে হল, এ জিনিস বাড়িতে রাখাও যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। আমার পক্ষে এটিকে কাছে রাখা একদমই ঠিক নয়। ঐতিহাসিক মূল্য তো সেই কবেই অভিশাপের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে, তাই দুঃখ পেয়ে লাভ নেই। খানিক আগে রেচেলকে ফোন করেছিলাম। সে এখন আমেরিকার ওয়েস্ট কোস্টে ছুটি কাটাচ্ছে। বিক্রির খবর শুনে খুশি হয়ে আমার কাছে ডায়েরিটার কথা জানতে চাইল। আমি যে সেটি বিক্রি না করে আমার কাছেই রেখেছি, তা ওকে জানালাম না। শুধু বললাম, “ইউ নো, দ্যাট ব্লাডি ক্র্যিমা পার্সোনালি মেট অস্কার শিন্ডলা। বাট দ্য বাস্টার্ড ডিডন্ট রেকগনাইজ হিম।”
লেখক পরিচিতি – সৌম্যজিৎ দেবনাথ
কলকাতা নিবাসী, মাইক্রোবায়োলজি স্নাতক ও অ্যানিমেটর সৌম্যজিৎ দেবনাথ লেখার জগতে নতুন। পেশায় ব্যবসায়ী। এ ছাড়া আঁকা ও নানা ধরনের বই পড়ার শখ রয়েছে। বহুমুখী পূজাবার্ষিকীতে প্রথম বড়গল্প প্রকাশ। মূলত ভৌতিক, আধিভৌতিক ও কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক লেখালিখিতে ঝোঁক।