আমি নিশার আতঙ্ক – রণেন ঘোষ
ঘরে ঢুকতেই প্রথমে নজর পড়ল টেবিলের উপর সুন্দর একটা খাম। চট করে তুলে নিলাম। সত্যি, অদ্ভুত মনোগ্রাম করা খাম। গভীর নীল সমুদ্র। লাল প্রবালের স্তূপ এবড়োখেবড়ো। কিন্তু কী বিশ্রী। লাল প্রবালস্তূপের পাশে রয়েছে একটা বড় ইল বা বান মাছ। চোখ দুটো চুনি। মুখটা চ্যাপটা জোঁকের মতো সাকার লাগানো। কী জীবন্ত ছবি, মনে হয় এক্ষুনি যেন নড়ে উঠবে ইলটা। আর তারপরেই রক্তলাল চোখ দুটো মেলে ধেয়ে আসবে… ভাবতেই কেমন যেন শিরশির করে উঠল গা-টা।
তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে ফেললাম খামটা। পুরু দামি অ্যান্টিক কাগজের প্যাডে ছোট্ট একটা চিঠি।
বন্ধুবরেষু,
১৬-০৬-৭৫ তারিখের চিঠি পেলাম। আটলান্টিক সাগরে ভেসে থাকার জন্যে উত্তর দিতে দেরি হল। বাইরের কোনও লোক বা সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা না করা আমার স্বভাব। কিন্তু যেহেতু আপনি সাংবাদিক নন এবং সাগরের গভীর রহস্য আপনাকে অভিভূত করে, শুধু সেই জন্যেই আপনার সঙ্গে দেখা করব ঠিক করলাম। আগামী ০৩-০৩-৭৬ তারিখে গ্রেট নিকোবর দ্বীপে আসুন। আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে আমার ছোট বোট থাকবে।
এম.বালসুব্রমনিয়াম
(বালম
)
বালম! আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। অদ্ভুত দাম্ভিক মিঃ বালম। সাংবাদিক তো দূরের কথা, কারও সঙ্গেই দেখা করা পছন্দ করেন না। অথচ ইকথিয়োলজি বা মৎস্যবিজ্ঞান এবং সমুদ্রবিজ্ঞানে একরকম অদ্বিতীয় পুরুষ মিঃ বালম। সারা পৃথিবীজোড়া খ্যাতি। একেবারে অসামাজিক লোক। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, আমি তো দেখা করার অনুমতি পেয়েছি।
বালমকে ঘিরে কেমন যেন এক রহস্যের জাল আছে। গ্রেট নিকোবর দ্বীপে বিরাট বাড়ি। এক ছেলে আর চারটি আদিবাসী সঙ্গী ওর। বছরে একবার বা দুবার বৈজ্ঞানিক অভিযান চালান সমুদ্রের বুকে! খরচ-খরচা সব নিজের। পৈতৃক সূত্রে প্রচুর অর্থের অধিকারী মিঃ বালম। অভিযান চালানোর জন্যে অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম, এমনকী আধুনিক মডেলের জাহাজ ‘হাঙর’ পর্যন্ত রয়েছে ওঁর হেপাজতে।
প্রফেসর এম.বালসুব্রমনিয়ামের জন্ম ১৯২৫ সালে কেরালায়। পড়াশোনা যাবতীয় কলকাতায়। মৎস্য আর সমুদ্র বিজ্ঞান নিয়ে বহু বছর গবেষণা করেছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলবর্তী দেশে। আটলান্টিক, ভারত আর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে কেটেছে অনেক বছর। তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন হারিয়ে যাওয়া কোনও এক সূত্রকে। থ্রন আইল্যান্ডের একটু দূরে লুজন দ্বীপের গভীরে প্রথম অভিযান চালিয়ে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন পৃথিবীকে। সাত হাজার ফ্যাদম গভীরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় তিনি প্রথম আবিষ্কার করেন ‘বালম ট্রেঞ্চ’ বা বিরাট লম্বা এক সুড়ঙ্গ। আর তার পরের বছর সেই সুড়ঙ্গের পঁচিশ হাজার ফ্যাদম গভীরে একক অভিযান চালান বালম। প্রায় শ-চারেক নতুন সামুদ্রিক প্রাণীর হদিশ পাওয়া যায় সুড়ঙ্গের মধ্যে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ডুবন্ত এক পাহাড়ের বুকে প্রথম জীবন্ত সিলাকান্থ মাছ দেখতে পান বালম। জীবন্ত তুলেও আনেন প্রাগৈতিহাসিক সিলাকান্থকে। এ ছাড়াও আরও অনেক অনেক দুঃসাহসিক অভিযানের নায়ক ছিলেন মিঃ বালম।
দুবার বিয়ে করেছেন। প্রথম বউ রহস্যজনকভাবে সমুদ্রের মাঝখানে জাহাজ থেকে উধাও হয়ে যান। দ্বিতীয়জন কোনও অজ্ঞাত ক্ষয়জনিত রোগে প্রাণ হারান বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়। তিন বছরের ফুটফুটে এক ছেলে তখন ওঁদের। নাম তার মহাদেব।
তিন তারিখের ভোরবেলা বোট ছাড়ল পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। ভোরবেলায় সমুদ্র যে কী ভালো লাগে তা বলবার নয়। ঠান্ডা হাওয়ায় জুড়িয়ে যায় সমস্ত শরীর। তীরের কাছে অগভীর সমুদ্রের উপর কয়েক ঝাঁক গাঙচিল উড়ছে। ওদের কর্কশ চিৎকারও কেমন যেন মধুর শোনায়। শান্ত সমুদ্র। দূরে কী একটা যেন ভুস করে উঠেই আবার তলিয়ে গেল সমুদ্রের তলায়। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল মোটর বোট।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম গ্রেট নিকোবর দ্বীপে। বন্দরে ভেড়ার আগেই চোখে পড়ল বিরাট সাদা এক বাড়ি। ঠিক যেন বিশাল এক রাজপ্রাসাদ। সামনে বেশ ঘন পাম গাছ।
মিঃ বালমের নিভৃত আবাস। নির্জনাবাসও বলা চলে। প্রায় কুড়ি বছর এই দ্বীপে বাস করছেন বালম।
ছোট জেটি দিয়ে গ্রেট নিকোবরে পা দেবার আগেই চোখে পড়ল, দীর্ঘ লম্বা চেহারার এক ভদ্রলোক ধীরগতিতে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। মাথাজোড়া টাক। বেশ কালো গায়ের রং। বুঝলাম ইনিই মিঃ বালসুব্রমনিয়াম।
আমাকে সাদর আলিঙ্গন করলেন বালম। আসতে পথে কোনও কষ্ট হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর ওঁর পিছুপিছু বাড়ির কাছে এসে পড়লাম। একটা ব্যাপারে বেশ আশ্চর্য হলাম। কী অদ্ভুত খসখসে গায়ের চামড়া। খরখর করে কেমন যেন লাগে হাতে। আর চোখের রোগে বোধহয় ভুগছেন বালম। সারাক্ষণই দরদর ধারায় জল পড়ছে দু-চোখ দিয়ে। বাঁ হাতে সবসময়ে একটা মোটা রুমাল। তা-ই দিয়ে বারে বারে চোখের জল মুছছেন। দু-চোখ বড় কালো গগল্সে ঢাকা। মনে মনে বললাম, এ নিশ্চয় জয় বাংলা রোগ। এত দূরেও অভিযান চালিয়েছে চোখ লাল হওয়া রোগ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর-একটা ব্যাপারও আশ্চর্য মনে হল। আমার হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠান্ডা মনে হল ওঁর হাত। স্যাঁতসেঁতে, ঘামে মনে হয় জবজব করছে।
অবশ্য বোটে থাকতেই চোখে পড়েছিল, বেশ কয়েকটা মোটা মোটা পাইপ সোজা সমুদ্রের মধ্যে থেকে উঠে গেছে বাড়ির মধ্যে। কাছে এসে দেখলাম, পাইপের সঙ্গে বেশ বড় বড় কয়েকটা পাম্পও রয়েছে বাড়ির একপাশে। পাম্পের চাপা এক আওয়াজ শোনা গেল বেশ দূর থেকে। সমুদ্রের জল পাম্প করে ঢোকানো হচ্ছে বাড়ির মধ্যে। তার মানে বাড়ির মধ্যে নিশ্চয় রয়েছে সমুদ্রের নোনা জলের এক বা একাধিক আধার। অর্থাৎ ভদ্রলোক সমুদ্রযাত্রা ছাড়াও সাগরের পরিবেশে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। সত্যি আশ্চর্য সমুদ্রের প্রতি টান। বিশাল বিশাল এই অ্যাকোয়ারিয়ামের মাঝেই বোধহয় জীবন কাটান বালম।
বর্ণে বর্ণে সত্যি আমার অনুমান। প্রকাণ্ড মোটা কাচের অ্যাকোয়ারিয়াম (অ্যাকোয়ারিয়াম না বলে কাচের চৌবাচ্চা বলা উচিত), কোনও কোনওটা আবার সারা ঘরজোড়া সিলিং পর্যন্ত উঁচু। দেওয়ালের গায়ে বড় বড় গোলাকার গর্ত। অবাধে দিনের আলো আসতে পারে ভেতরে। অ্যাকোয়ারিয়ামের সমুদ্রের জল আর জলের মধ্যে আমাজন, সোনাফেন, ভেলিসিনেরা প্রভৃতি গাছের প্রতিফলনে সমস্ত ঘরটা আবছা আবছা নীল, ঠিক যেন সমুদ্রের ভেতরের পরিবেশ। কেমন যেন গা-ছমছমে নীরবতা।
অ্যাকোয়ারিয়ামের গায়ে কোনও প্ল্যাকার্ড নেই। ফলে সব মাছের পরিচয় জানতে পারলাম না। ছোটবড় হরেক জাতের মাছ পাখনা মেলে সদর্পে ভেসে বেড়াচ্ছে জলের মধ্যে। একটার পর একটা ঘরে ঘুরলাম। সঙ্গে রয়েছেন বালম। প্রতিটি মাছের নিখুঁত বর্ণনা, বংশপরিচিতি, চালচলন সব বলে চললেন। মাঝে মাঝে স্তম্ভিত হলাম ওঁর অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে। সামুদ্রিক জীব ওঁর কাছে একান্ত পরিচিত। তবুও সাগরের অতল গহ্বরের অজানা জীবের আকর্ষণে সদা অস্থির। নতুন নতুন জ্ঞানের জন্যে ছটফট করছেন মধ্যবয়সি এই প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক।
একের পর এক জেলিফিশের মতো সব জীবন্ত প্রাণী। এদের তিন হাজার ফুট সমুদ্রের গভীরে পাওয়া গিয়েছিল। এটা একরকম অস্বাভাবিক। এদের coelenterate বলি আমরা। এখানে বাঁচিয়ে রাখা খুবই শক্ত। বুঝতে পারছি যে জলের চাপ, আলোর স্বল্পতা প্রভৃতি অনেক কিছুর প্রয়োজন। হ্যাঁ, এর একটা শুঁড় গায়ে লাগলেই আর দেখতে হবে না। নির্ঘাত মৃত্যু—একটা সবজে রঙের বিরাট থলথলে মাংসপিণ্ডকে দেখিয়ে বললেন বালম। লম্বা শুঁড়গুলো শেওলার মতো ভাসছে জলের মধ্যে। পাশের ট্যাংক থেকে ছোট একটা মাছ তুলে ওই অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে ছেড়ে দিলেন বালম। ছটফট করে মাছটা সোজা নেমে গেল সবজে মাংসপিণ্ডটার কাছে। কী আশ্চর্য! স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তে পাথর হয়ে গেল মাছটা। পরমুহূর্তে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জেলিফিশটা।
বুঝলে ঘোষ, সময়-সুযোগ পেলে আমাদেরও ছেড়ে কথা বলবে না জেলিফিশ। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন বালম।
প্রকাণ্ড এক হলঘরে ঢুকলাম এবার। প্রায় সমস্ত ঘর জুড়ে রয়েছে এক বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম। মোটা মোটা লোহার চ্যানেল দিয়ে ধরে রাখা হয়েছে ভারী মোটা কাচগুলোকে। ভেতরে জলের মধ্যে বিচিত্র আকারে অনেকরকম মাছ। অবিকল সমুদ্রের অভ্যন্তরের ছবি। অল্প অল্প করে দুলছে জলজ মাছ-গুলো। টকটকে লাল অনেকগুলো শামুক স্বচ্ছন্দে হামাগুড়ি দিচ্ছে গাছের উপরে। ঠিক মাঝখানে কাচের এক পার্টিশন। প্রায় দু-মিটার লম্বা হাতুড়ি-মাথা কয়েকটা হাঙর নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করছে অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে। এক ধাপ সিঁড়ি মেঝে থেকে উঠে নেমে গেছে জলের মধ্যে। জলের মধ্যে সিঁড়ির ধারে ধারে শেওলা জমেছে। স্থায়ী সিঁড়ি দেখে চোখে-মুখে বোধহয় বিস্ময়ের ভাব ফুটেছিল আমার। তা-ই দেখে বালম বলে উঠলেন, কিছু বলবে ঘোষ? তোমার বলার আগেই বলছি। সত্যি, প্রয়োজনে তৈরি করিয়েছি সিঁড়িগুলোকে। ল্যাম্প্রিগুলোকে খাওয়াবার জন্যে দরকার পড়ে এগুলো। খুব যত্ন করে খাওয়াতে হয় তো। তবে অবশ্য বর্তমানে তেমন কোনও ল্যাম্প্রি নেই আমার। প্রায় তিন বছর আগে আমার শেষ ল্যাম্প্রিকে সমুদ্রে ছেড়ে দিয়েছি।
ল্যাম্প্রি। ল্যাম্প্রি। খুব চেনা চেনা কথা। কোথায় শুনেছি বা পড়েছি, মনে করার চেষ্টা করলাম। প্যারাসাইট… পরজীবী বা পরভুক… আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন বালম।
—কী ঘোষ, বুঝতে পারছ না? অবশ্য সাধারণের কাছে হগফিশ বা ল্যাম্প্রি জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী একেবারেই অপরিচিত। ল্যাম্প্রি একজাতীয় সামুদ্রিক পরভুক মাছ বা জীব। আমি খুব দুঃখিত ঘোষ যে তোমাদের দেখাতে পারলাম না। তিন বছর আগে এলে…
তিন বছর। কথাটা কেমন যেন শোনাল আমার কাছে। অ্যাকোয়ারিয়ামের আরও কাছে সরে এলাম। একেবারে কাচের কাছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা হাঙর। মসৃণ পেটটা সাদা চকচকে। কানকো থেকে পেটের তলা পর্যন্ত অনেকগুলো লাল চাকা চাকা দাগ। ঠিক যেন গোলাকার রক্তরেখা। কয়েকটা দাগ খুবই নতুন বলে মনে হল। কেননা ছোট আঁশগুলো সদ্য উঠে গেছে। বেশ বুঝতে পারলাম, ল্যাম্প্রি বা পরভুক মাছেদের সাকার বা চোষক চেপে বসেছিল ওখানে। আর তারপর রক্তরস পান করেছে ল্যাম্প্রিগুলো। না না, তিন-বছর নয়, আজ-কালকের দাগ। বালম বলতে নিশ্চয় ভুল করেছেন। তিন দিন বলতে বোধহয় তিন বছর বলেছেন। শুধু একটা হাঙর নয়, পরপর কয়েকটার দেহেই চাকা চাকা লাল ঘা। দগদগ করছে।
বালমের পিছুপিছু পাশের ঘরে ঢুকলাম। কী অপূর্ব! সমস্ত অ্যাকোয়ারিয়াম জুড়ে নানা দেশের নানান জাতের শেলফিশ বা শাঁখজাতীয় জীবন্ত প্রাণীরা বিচিত্র ছন্দে চলাফেরা করছে। যে কোনও শেলফিশ বিশারদ দেখলে বোধহয় লাফিয়ে উঠত আনন্দে। এত সুন্দরভাবে সাজানো এ ট্যাংকগুলো, ঠিক যেন সামুদ্রিক পরিবেশ। সাগর সত্যিই রত্নগর্ভা। এইসব জীবন্ত মণিমুক্তো যে কোনও সাগরের গর্বের বস্তু। বিরাট শাঁখগুলো দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের সুন্দর ছোট ছোট Haliotis Exacavata এবং সুরেক্স মনোডোম। এমন শত শত শাঁখ রয়েছে এখানে। আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম বালমের মূল্যবান সংগ্রহের দিকে।
ঘরের মধ্যে ঢুকল নারায়ণ রাও। বালমের সেক্রেটারি। দেশীয় ভাষায় কী যেন বলল বালমকে। বেশ প্রয়োজনীয় বলে মনে হল। বালম সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই প্রায় জনা বিশেক কর্মচারী ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। প্রত্যেকের সঙ্গে দু-একটা করে কথা বললেন বালম। সবাই চলে গেল একে একে। আবার দুজনে একা হয়ে গেলাম আমরা।
—এরা আমার কর্মচারী। অনেকে বছর কুড়ির বেশি থেকেছে আমার সঙ্গে। কিন্তু এখন আর ওদের দরকার হবে না আমার। শেষ পাইপয়সা মিটিয়ে দিয়েছি। বুক ফেটে যাচ্ছে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কী করব ওদের আটকে রেখে। রাও ওদের পৌঁছে দেবে পোট ব্লেয়ারে। তারপর শুধু তোমার জন্যে থাকবে বোটটা।
আর ইতিমধ্যে আমার সব কথা বলে নিতে হবে তোমাকে। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন বালম।
—ঠিক বুঝতে পারলাম না, মিঃ বালম। এখানে কি নির্জনে বাস করবেন আপনি? কথা শুনে তো আমার তা-ই মনে হল।
—নির্জন বাস! এখানে? না না ঘোষ, তবে সিদ্ধান্ত আমার চূড়ান্ত। সাগর সম্বন্ধে প্রায় সব জানা শেষ আমার। শুধু একটাই জানতে বাকি আছে। আর সেই জানার জন্যে কোনও বাইরের বিশেষজ্ঞর দরকার হবে না। কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন বালম।
আমার হতচকিত মুখ দেখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল ওঁর মুখে।
—বুঝতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে, তা-ই না? অবশ্য অবাক হবারই কথা। মাত্র গুটিকয়েক লোক জানে, কী পরিস্থিতিতে আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবার পরই তোমার চিঠি পেলাম। মনে হল, সব এবার বলব তোমাকে। সেদিক দিয়ে ভাগ্যবান বলতে হবে তোমাকে। আজ পর্যন্ত বাইরের কারও কাছে মুখ খুলিনি কোনও দিনও। এ বিষয়ে তোমরা আমাকে দাম্ভিকও বলতে পার। তবে শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম, বলাই ভালো। অজানা সেই ভয়ংকর সম্বন্ধে অন্তত জানুক সকলে। শুধু জানলেই হবে না, সাবধান হতে হবে সকলকে। আমি জানি, সব দেশেই আমার মতো সাগর-পাগল লোক আছে। তাদের কপালে কী আছে জানি না। আমার গল্পটা গল্প বলে উড়িয়ে দিয়ো না ঘোষ। অনেক কিছুই নির্ভর করছে এর উপরে।
—না না, বলুন আপনি। সব শোনার পর বিচার করে দেখব আমি। আপনার সারাজীবনের অভিজ্ঞতায় অনেক অজানাকে জানতে পারবে পৃথিবী। প্রয়োজন হলে…
—প্রয়োজন হবে কি হবে না—জানি না আমি। আগামীকাল গ্রেট নিকোবর দ্বীপ আবার নির্জন হয়ে যাবে। রাও তোমাকে নিয়ে চলে যাবে পোট ব্লেয়ারে। আর কোনও দিনও ফিরবে না। ট্যাংকের সমস্ত জীবকে ছেড়ে দেব সাগরে। ওই হাতুড়িমুখো হাঙরগুলোও ফিরে যাবে আপন স্থানে। আর আমি…আমি চলে যাব…
—কোথায়… কোথায় যাবেন আপনি? যাবেনই বা কেন? অনেকগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার মুখ দিয়ে। এই দ্বীপ তো আপনার। আপনার সারাজীবনের সাধনার স্থান। দুর্মূল্য সব জীবের নমুনা রয়েছে এখানে। আর এখানে বসেই তো লিখেছেন আপনি সেই অদ্ভুত যুগান্তকারী বইগুলো…
—ঠিক… ঠিক বলেছ ঘোষ। সারাজীবন গবেষণা করেছি এখানে। জানা, না-জানা কত ভয়ংকরের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এখানকার ইট-কাঠ-পাথর মাটিতে। অমূল্য সব দুষ্প্রাপ্য সামুদ্রিক প্রাণী জোগাড় করে রেখেছি এখানে। সব সত্যি… কিন্তু আমার বাড়ি… আপন জায়গা? না না, এখানে নয়—ওই যে ওখানেই আমার আসল বাড়ি। নীল সমুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালেন বালম। বঙ্গোপসাগরের বড় ঢেউগুলো রুপোর মুকুট পরে নাচছে। প্রখর সূর্যের আলোয় বঙ্গোপসাগর যেন গলন্ত রুপোর স্রোত।
গগল্সে ঢাকা দু-চোখ বেয়ে দরদরিয়ে জল গড়াচ্ছে। বাঁ হাতে রুমাল দিয়ে বারবার করে মুছছেন বালম। সমস্ত মুখ-হাত কেমন জলে ভরা। টাক মাথায় কানের কাছে কয়েকটা পাকা চুল হাওয়ায় উড়ছে ফুরফুর করে। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশের মধ্যে এসে পড়েছি আমি। কী বলব, কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।
—তোমার ইন্টারভিউ শেষ হবার পর আমি ওই পাহাড়ের উপর একবার উঠব। প্রাণভরে দেখে নেব আমার সারাজীবনের সঙ্গী এই দ্বীপকে। দূরের পোট ব্লেয়ার আর আন্দামান দ্বীপগুলোকে। তারপর আমার ছোট্ট পাওয়ার বোট ‘গাল্পি’-তে উঠে বসব। বঙ্গোপসাগরের দূর নির্জনে চালিয়ে নিয়ে যাব গাল্পিকে। একসময়ে গাল্পির পেট্রোল ফুরিয়ে যাবে। ইচ্ছে করলেও আর ফেরার উপায় থাকবে না গভীর সমুদ্রের মাঝখান থেকে। বিশাল সাগরের অতল গভীরে… কী অন্ধকার… অজানা সেই পরিচিত জীব… কী ঠান্ডা… জুড়িয়ে যাবে আমার সর্বাঙ্গ… আঃ, ভাবলেও জুড়িয়ে যায় মনপ্রাণ সব। মধুর আমেজে ফ্যাঁসফেঁসে গলার স্বর মোটা আর ভারী হয়ে এল বালমের।
হঠাৎ জলে ভেজা মুখে ঘুরে দাঁড়ালেন আমার দিকে। … কী… কী ভাবছ ঘোষ… মাথার গোলমাল হয়নি আমার। খুব ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি আমি। গাল্পির শেষ জায়গা হবে বঙ্গোপসাগরের অতল গভীরে। আর গাল্পির সঙ্গে আমি—আমিও যাব অতল অন্ধকারের বুকে।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। এক বড় বিজ্ঞানীর এ কী মর্মান্তিক পরিণতি! নিজের অজান্তে বলে উঠলাম, আত্মহত্যা? আপনি… আত্মহত্যা করবেন সাগরের বুকে?
খিকখিক করে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন বালম। দু-গাল বেয়ে জলের ধারা নামল আরও বেশি করে। হাসতে হাসতে কাশতে শুরু করলেন।
—নিজেকে ডুবিয়ে মারব? ডুবে মরা কি যায়? এই যে… এই যে শাঁখটা ঘুরে বেড়াচ্ছে ট্যাংকের ভেতরে, তাকে কি ডুবিয়ে মারতে পার সাগরজলে? ওই যে হাতুড়িমুখো হাঙরগুলো… ওগুলো কি জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে পারে?
বাক্যহারা হয়ে গেলাম আমি। স্থান-কাল-পাত্র বুঝি সব ভুলিয়ে দিতে পারে মানুষকে। সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ওঁর দিকে।
বেশ অনুভব করতে পারলাম, কালো চশমায় ঢাকা চোখ দুটো নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কালো কাচ দুটো বুঝি কৌতুকে ঝিকিয়ে উঠবে এখুনি।
—আমি দুঃখিত ঘোষ। তুমি দুঃখ পাবে জানলে বলতাম না কথাগুলো। যাক… এস আমার সঙ্গে, আমার লাইব্রেরি দেখে যাও একবার।
ঘরটা বেশি বড় নয়। সিলিং পর্যন্ত র্যাক করা। থরে থরে সাজানো বই আর বই। কিছু বইয়ের নাম পড়ার চেষ্টা করলাম। H. P. Lovecraft-এর সমস্ত বই রয়েছে এখানে। শুধু একটা করে বই নয়—এক-একটা বইয়ের বেশ কয়েকটা এডিশন।
Cthulhu Mythos রয়েছে সবচেয়ে বেশি। লাভক্র্যাফটের বিস্ময়কর ভয়াবহ সৃষ্টি সাগরদানব থুলহুর বিরাট বড় বড় ছবি টাঙানো রয়েছে ঘরের চারপাশে। বীভৎস সেইসব ছবি। আতঙ্কে শিউরে ওঠে সমস্ত শরীর। সমস্ত বইই নানান জানা-অজানা সাগরদানবের।
ফিরে তাকালাম বালমের মুখের দিকে। আকুল আগ্রহ নিয়ে চশমার কালো কাচগুলো তাকিয়ে আছে বইগুলোর দিকে।
—লাভক্র্যাফট কি আপনার বিশেষ প্রিয়?
—শুধু প্রিয় বললে ভুল হবে। লাভক্র্যাফটকে গুরু বলতে পার। থুলহু মিথস আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
—আপনি… আপনি কি বলতে চাইছেন যে থুলহু সত্যি! মানে বাস্তবে সম্ভব?
—হ্যাঁ, ঘোষ, ঠিক এটাই আমি বলতে চাই। আমার, তোমার আর সকলের মতো বাস্তব থুলহু। সাগরের গভীরে আমি দেখা পেয়েছি তার।
আমি শুধু অবাক নয়, বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এত বড় বিজ্ঞানীর মুখে এ কী কথা! লাভক্র্যাফটের অস্বাভাবিক ভয়াল ভয়ংকর কল্পনা বাস্তবে সত্যি?
—শোন ঘোষ, আমার সমস্ত বই কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে দান করে গেছি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সব নিয়ে যাবে ওরা। শুধু তা-ই নয়, আমার একমাত্র ছেলে মহাদেবের জন্যে সামান্য কিছু অর্থের সঞ্চয় রেখে বাকি সব টাকা দান করেছি থুলহু নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্যে।
বালমের সঙ্গে সামনের লনে বেরিয়ে এলাম। কয়েকটা চেয়ার আর একটা গোল টেবিল পাতা। সামনাসামনি দুটো চেয়ারে বসলাম আমরা। দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করে কী যেন বললেন বালম।
একজন দেশি চাকর ছুটে এল ওঁর কাছে। দুজনে কী যেন বলাবলি করল। তারপর চাকরটা দৌড়ে বাড়ি থেকে ট্রে-র উপরে দুটো গ্লাস নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা হাতে বালম একটা গ্লাস তুলে দিলেন আমার হাতে। উনি নিজে বড় গ্লাসটা রাখলেন টেবিলের উপর। থকথকে সবজে কোনও তরল পদার্থে ভরতি গ্লাসটা।
আমি চুমুক দিলাম শরবতে। বালমও এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন অনেকটা। চিনেমাটির বড় একটা জার টেবিলের পাশে নামিয়ে রাখল সেই চাকরটা।
সমস্ত গা দিয়ে যেন দরদরিয়ে জল পড়ছে বালমের। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চলেছেন ক্রমাগত। কী আশ্চর্য, একবারও তো গগল্স খুললেন না বালম। কেন? সাংঘাতিকভাবে কি আক্রমণ করেছে জয় বাংলা? ঘরের মধ্যে তো রোদ ছিল না। এখনও তো এখানে ছায়া। তবে কি অন্য কোনও রোগ? শুধু চোখ নয়… সমস্ত চালচলন যেন কেমন বিস্ময়কর লাগছে আমার কাছে। এত ঘামতে তো কাউকে দেখিনি? ঠিক যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে।
—কিছু মনে করো না ঘোষ। আজকাল একটু বেশি খেতে হচ্ছে এই সিরাপটা। এই পর্যায়ে এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
পর্যায়! কী বলতে চাইছেন বালম। আমার জিজ্ঞাসা করার আগেই ওই চাকরটাই জারটাকে আবার ভরতি করে দিয়ে গেল। ভাবলাম, দেখাই যাক না। সবই তো বলছেন।
—আচ্ছা ঘোষ, এত কী দেখছ আমাকে? এতই কি পরিবর্তন হয়েছে আমার? তবে একটা কথা বলা দরকার। কোনও কিছু দেখে ভয় পেয়ো না তুমি।
—ভয়? ভয় পাব কেন?
—অবশ্য ভয় পাবার কিছু নেই। যা স্বাভাবিক তা-ই হয়েছে। তবে কী জান, আমার কাহিনি এক ভয়ংকরের কাহিনি।
—যতই ভয়ংকর হোক না কেন, আমি শুনব মিঃ বালম। দেখুন না—আমি ভয় পাই কি না।
কেমন যেন বাচ্চা ছেলেদের মতো ভয়ের কথা বলছেন বালম।
—বেশ। তা-ই হোক! আমার কাহিনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাগল ভেব না যেন আমাকে। সম্পূর্ণ সুস্থ আমি। গল্পের শেষে প্রমাণ নিশ্চয় দেব। একটা নয়, বেশ কয়েকটা।
ঢকঢক করে দু-গ্লাস সবুজ পানীয় খেয়ে ফেললেন বালম। বারবার রুমাল দিয়ে মুছে নিলেন জলের ধারাকে।
দুই
—জন্মেছিলাম বিরাট বড়লোকের ঘরে। বাবা আমার জমিদার। কিন্তু আমি জন্মাবার ঠিক তিন বছরের মাথায় মারা যান মা, আমার মামার কাছে মানুষ হয়েছি। সকাল-বিকেল-সন্ধে আমার কেটেছে সাগরবেলায়। দূর থেকে হাত- ছানি দিয়ে ডাকত আমাকে। কেরালা, তামিলনাডু আর কলকাতায় শেষ করেছি আমার পড়াশোনা। তারপর গেলাম বাইরে। সাগরের অতল রহস্যে পাগল আমি। কত যে রহস্য, তার হদিশ কে দেবে! এমন সময় পেলাম থুলহু মিথস। আমার ধ্যানধারণা সব পালটে গেল। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল অন্বেষণ। পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রে ঘুরেছি আমি। তখন থেকে সাগর আমার ধ্যানজ্ঞান।
—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গ্রেট নিকোবরে বাসা বাঁধলাম। একে একে গড়ে তুললাম আমার অমূল্য সব সমুদ্রসম্পদ। আমার দুটো বই লিখেছি এখানে। ‘সাগরের ডাক’ আর ‘মানুষের বন্ধু—সাগর’। আর এই ‘মানুষের বন্ধু—সাগর’ই আমাকে বিখ্যাত করেছিল। তারপর লিখেছি আমার শেষ বই ‘থুলহু—সাগরের আদিমতম দেবতা’। জান ঘোষ, আমি বিশ্বাস করি যে থুলহু রহস্যের মীমাংসা হলেই মানুষের সৃষ্টিরহস্যের সহজ সমাধান হবে। বারবার লেখা পালটাচ্ছি। প্রতিবারেই অনেক নতুন নতুন তথ্য যোগ করছি। তবুও কেমন যেন তৃপ্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, থুলহু সম্বন্ধে কিছুই লেখা হল না।
—এই বইয়ের একটা অধ্যায়ে লিখেছি সাইরেনিয়ামদের সম্বন্ধে। সাইরে- নিয়াম বলতে আমরা সাধারণত ডুগং ম্যানাটি এবং সি-কাউদেরই বুঝে থাকি। সকলেই এরা স্তন্যপায়ী জীব। সাগরের বিশেষ বিশেষ স্থানে পাওয়া যায় এদের। এরা সকলে নিরামিষাশী। এদের মধ্যে ম্যানাটি এক আশ্চর্য জীব। মৎস্যকুমারী বা রূপকথার অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছের জলকন্যাদের সঙ্গে ম্যানাটির আশ্চর্যরকম মিল আছে। শুধু রূপকথা বলি কেন, গভীর সমুদ্রের বহু লক্ষ নাবিক দেখেছে জলকন্যাদের। এদের দুনিবার আকর্ষণে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে সাগরজলে। থুলহু-ম্যানাটি-জলকন্যা আমাকে রীতি- মতো ভাবিয়ে তুলেছিল। তার ফলে পরপর কয়েকটা অভিযান চালিয়েছি আমি। নাম দিয়েছি ‘মৎস্যকুমারী বা ম্যানাটির খোঁজে’। আর এই অভিযান আমার জীবনে এক নতুন দিক খুলে দিল। আমার ভবিষ্যৎ মুহূর্তের মধ্যে ঠিক হয়ে গেল। ভবিষ্যৎ বলি কেন, আমার জীবনের শেষ এবং চরম পরিণতি তো এই অভিযানের ফলেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।
একটানা এত কথা বলে হাঁপাতে শুরু করলেন বালম। দরদর করে জল পড়ছে দু-চোখ দিয়ে। মাছের মতো কেমন যেন লীলায়িত ভঙ্গি ওঁর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে।
—চরম পরিণতি? ঠিক বুঝতে পারলাম না। এই পরিণতি কি বৈজ্ঞানিক সত্য?
—বৈজ্ঞানিক সত্য-মিথ্যা কিছুই বুঝি না এখন। তবে চরম পরিণতি বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেটাই বোঝাতে চেয়েছি।
আর কিছু বলার নেই। শুধু বসে রইলাম বালমের কালো চশমা ঢাকা চোখের দিকে চেয়ে। কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। অনেক বিদঘুটে পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করেছি জীবনে। সমুদ্র আমাকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে। শুধু সমুদ্র কেন, যে কোনও জল আমার ভালো লাগে। সাগরের অতল গভীরে অনন্ত রহস্য আমাকেও হাতছানি দেয়। জীবনের শুরু সাগরজলে। সমুদ্র আমাদের প্রাণ দিয়েছে। তাই সমুদ্রই জানে, কেমন করে এলাম আমরা। ছোটখাটো কয়েকটা সাগর অভিযানে গেছি আমি। আমিও বিশ্বাস করি, সাগরের গভীরে অনেক বিস্ময়কর রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু বালমের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
—আজকে বলতে বসে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ঘোষ। এক গ্লাস তরল পানীয় খেয়ে আবার বলতে শুরু করলেন বালম, কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট বা ‘মহাদেশ ভ্রমণ’ সম্বন্ধে অনেক তথ্য নিশ্চয় শুনেছ তুমি। সর্বপ্রথম ওয়েগনার এবং লিন্টজ এই মতবাদ প্রচার করেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই মহাদেশগুলো ক্রমশ ভাসতে ভাসতে দূরে সরে যাচ্ছে। এই মহাদেশগুলো একে অপরের সঙ্গে জুড়ে ছিল। এই তত্ত্ব কিন্তু আজ অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। শুধু তা-ই নয়, মানুষের জন্মের বহু পূর্বে বিশাল এক মহাদেশের অস্তিত্ব যে ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণও পেয়েছি আমি।
—যা-ই হোক, ওয়েগনার ও অন্যান্যদের অনুসরণ করে আমি শুরু করে দিলাম ‘মৎস্যকন্যার খোঁজে’ অভিযান। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হল লাইবেরিয়া, সেনেগাল আর গাল্ফ অব গিনির সঙ্গে ক্যারিবিয়ান আর গাল্ফ অব মেক্সিকোর ম্যানাটিকের তুলনা করা। ঘোষ, তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে যে, পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র উপকূলের মধ্যে একমাত্র এই দুই উপকূলেই ম্যানাটিদের স্বাভাবিক পরিবেশ দেখা যায়। কে জানে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে এই দু-জায়গা হয়তো পরস্পর সংযুক্ত ছিল। কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্টসের জীববিজ্ঞানের মতো এমন প্রমাণ কি আর দুটো পাওয়া যাবে।
—এই আবিষ্কারের পর আমি দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে মেতে গেলাম। আরও অকাট্য প্রমাণ খুঁজে বার করার জন্যে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলাম। এই প্রমাণের খোঁজে উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে জ্যাকসনভাইলে উপস্থিত হলাম একদিন। উত্তরে এটাই শেষ জায়গা, যেখানে বহুল পরিমাণে ম্যানাটিদের দেখা যায়। এইখানে… এইখানেই শুনলাম এক ভয়ংকর কথা। শুনলাম, অদ্ভুত কিছু পাথর পাওয়া গেছে সমুদ্রের মধ্য থেকে। পাথরের গায়ে হাইরোগ্লাইফস ছবিতে আঁকা কোনও অতিপ্রাচীন বর্ণমালা খোদাই করা আছে। কালের প্রভাবে বেশির ভাগই অবশ্য বিবর্ণ, অস্পষ্ট। কেন জানি না, ওই পাথরগুলো ভীষণভাবে আকর্ষণ করল আমাকে। মনে হল ম্যানাটি আর পাথরের রহস্য একসূত্রে গাঁথা। তুমি তো জান ঘোষ, আটলান্টিস, মু প্রভৃতি সাগরে তলিয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক শহরগুলোর রহস্যময় অস্তিত্বের কথা। মনে মনে ঠিক করলাম, মৎস্যকন্যার খোঁজের পরিবর্তে এইসব শহরের রহস্য ভেদ করব। একটা রহস্য ভেদ করতে পারলেই সব রহস্যের মীমাংসা হবে। তাই ওখান থেকে সোজা বোস্টন শহরে চলে এলাম। এখানে খোঁজ পেলাম, এইরকম আরও অনেক অতিপ্রাচীন পাথরের ব্যক্তিগত মিউজিয়াম আছে এক ভদ্রলোকের। পরে অবশ্য দেখলাম আমার মতো সে-ও সমুদ্র-পাগল। জানা-অজানা অনেক রহস্যময় পাথর ছিল ওর মিউজিয়ামে। বিশেষত উত্তরে আটলান্টিক সাগর থেকে পাওয়া এই ধরনের পাথর ছিল সবচেয়ে বেশি। শুধু তা-ই নয়, ভদ্রলোক আটলান্টিকের পূর্ব উপকূলে সামুদ্রিক প্রাণী বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞও বটে। নিউ ইংল্যান্ডে উপকূল সম্বন্ধে অনেক বিস্ময়কর গল্পও শুনিয়ে দিল আমাকে। ওর কাছ থেকেই শুনলাম যে, নিউ ইংল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলেও এই ধরনের প্রাচীন পাথর পাওয়া গেছে। প্রাগৈতিহাসিক রহস্যময় এক বুদ্ধিমত্তার সাক্ষ্য দেয় এই পাথরগুলো। হঠাৎ সমস্ত আনন্দ এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল মন থেকে। মনে পড়ল, ঠিক একই ধরনের পাথর তো আমিও পেয়েছি পলিনেশিয়ার দ্বীপগুলোর আশপাশে। আইভরি কোস্টের উপকূলে। অথচ এই জায়গা দুটোর দূরত্ব তো সামান্য নয়। তাহলে… তাহলে আমার অনুমান তো…
বলতে বলতে কোনও এক অজানা উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠলেন বালম। বেশ বুঝতে পারলাম, কালো কাচে ঢাকা চোখ দুটোও উত্তেজনায় চকচক করছে। চেয়ারের হাতলটি ক্রমাগত রগড়াতে শুরু করলেন।
—ঘোষ, এটা কি বিরাট আবিষ্কার নয়? আমেরিকার পাথরগুলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম ওদের। পাথরগুলো ছোট হলেও ছবিগুলো কিন্তু হুবহু এক এবং অদ্বিতীয়। লাইবেরিয়ার জঙ্গলে আশ্চর্য পাথরের স্তম্ভগুলোর গায়েও এক ছবি আঁকা। চাঁদনি রাতে স্থানীয় আদিবাসীরা কিম্ভূত এই স্তম্ভগুলোকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। পূজা করার মন্ত্রগুলো এক বিচিত্র অজ্ঞাত ভাষায় গাঁথা। সবচেয়ে আশ্চর্য কী জান, নিজেরাও কেউ এই মন্ত্রের মানে বোঝে না। তবে এই মন্ত্রের এক অদ্ভুত শক্তি আছে আর আছে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ংকরের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ। অনেক চেষ্টা করে আয়ত্ত করেছি। মন্ত্রের প্রথম লাইন—
Ph”nglini Mglw”nafh Cthlhu R’lyeh Wgah”ngl fhtagn!
বিচিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লেন বালম। হাঁটু মুড়ে সামনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বারবার তিনবার প্রণাম জানালেন। তারপর হঠাৎ আমার মুখের দিকে নজর পড়তেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। চেয়ারে বসে পড়লেন ধপ করে। চেয়ারের দুপাশে অসহায়ের মতো ঝুলে পড়ল হাত দুটো। গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ল কোলের উপর।
—কিছু… কিছু মনে করো না ঘোষ। খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। থুলহু… থুলহু শব্দ মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন হয়ে যাই আমি। মনে হয় সৃষ্টির আদিমতম ধ্বনি থুলহু।
চকচক করে পরপর দু-গ্লাস সবুজ পানীয় পান করলেন বালম। তারপর সোজা হয়ে বসে আবার বলতে শুরু করলেন।
—অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে এলাম আমি। অতি প্রাচীনকালে আমেরিকা আর আফ্রিকা ছিল যমজ ভাইবোনের মতো। বিস্তীর্ণ এক নিচু জায়গা দিয়ে এই দুই মহাদেশ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এইসব নিচু জায়গায় ছিল প্রাগৈতিহাসিক আটলান্টিস, মু প্রভৃতি শহরগুলো। কালক্রমে মহাদেশ ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জলমগ্ন হয়ে গেল শহরগুলো। ঠিক একই জায়গায় শহরগুলো রয়েছে অতল সাগরগহ্বরে। পলিনেশিয়ার প্রাগৈতিহাসিক যুগের গোড়ার কথা। ওরাই বসবাস করেছিল এইসব শহর সমেত আরও কয়েকটা বড় বড় শহরে। সমস্ত পৃথিবী ছিল ওদের পদানত। সাগরের ভয়াল ভয়ংকর থুলহু ছিল বোধহয় ওদের কোনও সমগোত্রীয়। কালক্রমে অজ্ঞাত কারণে নভশ্চররা চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। ঠাকুর-দেবতা, শয়তান, অপদেবতার পূজার মধ্যে রয়ে গেল ওদের স্মৃতি। রেখে গেল সারা পৃথিবী জুড়ে অদ্ভুত অবিশ্বাস্য আচার-আচরণ। অতিপ্রাচীন বিবর্ণ কালো পাথরে খোদাই করা দুর্বোধ্য ছবির বর্ণমালা ওদেরই সৃষ্টি। সাগরের ভয়ংকর থুলহুর ছবি আঁকা রয়েছে কয়েকটা কালো পাথরে। হয়তো বা ছবির বর্ণমালাগুলো থুলহু এবং সাগর গভীরে আরও অনেক অজানা ভয়ংকরকে সন্তুষ্ট রাখার মন্ত্র। বিভিন্ন সাগর উপকূলে একের পর এক কালো পাথরের আবির্ভাব হয়তো বিশেষ কোনও উদ্দেশে পাঠানো হচ্ছে আমাদের কাছে। বল ঘোষ, বল তুমি, আমাদের কি উচিত নয় ওইসব পাথরের প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করা?
—এবার আমার বংশগত কয়েকটি বৈশিষ্ট্যর কথা বলতে চাই তোমাকে। মূল ঘটনার সঙ্গে যোগ না থাকলেও মনে হয়, কোথাও যেন এক যোগসূত্র রয়েছে। আমার বাবার সম্পর্কে বলার কিছু নেই। ঊর্ধ্বতন দশ পুরুষের নামধাম প্রভৃতি সমস্ত কিছুই জানতে পারা যায়। কিন্তু আমার বাবা দাদুর সঙ্গে খুব ছোটবেলা থেকেই ম্যানিলায় মানুষ। দাদুর ব্যাবসা ছিল ম্যানিলায়। বাবার যখন বছর পনেরো বয়স, তখন বছর দু-আড়াইয়ের এক ফরসা টুকটুকে মেয়েকে কুড়িয়ে পায় আমার ঠাকুমা। ভোরবেলা সমুদ্রতীরে বেড়ানো ঠাকুমার বহু দিনের স্বভাব। সে দিনও বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। আগের দিন সারারাত ঝড়-জল হয়ে গেছে। ঠাকুমার হঠাৎ নজর পড়ল, ঠিক সাগরজলের শেষ সীমায় কী যেন একটা পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখেন ফুটফুটে এক মেয়ে। পরনে কিছু নেই। কিছু সামুদ্রিক শেওলা জড়িয়ে রয়েছে সারা গায়ে। সেই মেয়েটিকে মানুষ করেন ঠাকুমা। সেই মেয়েটি আমার মা লক্ষ্মী সুব্রমনিয়াম। মায়ের অদ্ভুত কতকগুলো দৈহিক বৈশিষ্ট্য ছিল। মাছের চোখের মতো প্রায় গোলাকার স্বচ্ছ ছিল মা-র চোখ দুখানি। প্রায় জল গড়াত দু-চোখ বেয়ে। সামান্য গরমে ঘামে জবজব করত হাত-পা সব। ঘুমের ঘোরে দুর্বোধ্য অজানা ভাষায় কথা বলত মা। একটা-দুটো কথা এখনও কানে ভাসছে আমার— থুলহু, সোমোথ… আরও কত কী। তবে বড় আশ্চর্য মায়ের মৃত্যু। ঠিক মৃত্যু কি না জানি না তবে ঘোর দুর্যোগের রাতে সাগরপারে বেরিয়েছিল মা। ঝড়ের সাহায্য নিয়ে সমুদ্র তখন হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর দুর্নিবার। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল পৃথিবীকে। সেই আকাশ-ছোঁয়া প্রবল ঢেউয়ের টানে ভেসে গিয়েছিল মা আমার গভীর সমুদ্রে। অবশ্য মায়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। জান ঘোষ, দুজন আদিবাসী জেলে কিন্তু বলে অন্য কথা। ঝড়ের তাণ্ডবে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল সে দিন। দূর সমুদ্রের মধ্যে ভাসতে ভাসতে বিদ্যুতের আলোয় ওরা দেখে, পাড়ে কে যেন দাঁড়িয়ে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল তখন। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চুলগুলো উড়ছিল মায়ের। হঠাৎ অস্বাভাবিক গুমগুম শব্দ ওঠে সমুদ্রের মধ্যে থেকে। অজস্র শুঁড়ওয়ালা প্রাগৈতিহাসিক কোনও দানব যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সমুদ্রের তীরের দিকে। দু-হাত বাড়িয়ে মা-ও ছুটে আসে সমুদ্রের মধ্যে সেই দানবের দিকে। পরমুহূর্তে বিশাল ঢেউয়ের মধ্যে ঢাকা পড়ে যায় দুজন। ব্যাস, তারপর আবার যে কে সেই। তখন অবশ্য কেউ বিশ্বাস করেনি ওদের কথা। আজ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জেলে দুটো ঠিকই দেখে -ছিল সেই দুর্যোগের রাতে।
—যা-ই হোক, আমার এখনকার অবস্থা ঠিক মায়ের মতো। বংশগত কারণ হয়তো এর জন্য দায়ী।
ঢকঢক করে আর-এক গ্লাস শেষ করলেন বালম।
—বুঝলে ঘোষ, পলিনেশিয়ায় কাটিয়েছি অনেকদিন। বহু বিচিত্র গল্প শুনেছি তখন। পরে অবশ্য বোস্টন শহরের সেই বন্ধুর কাছ থেকেও একই
রকম গল্প শুনেছিলাম।
—সেইসব গল্পের বিষয়বস্তু মোটামুটি এক। কোনও এক শুভ বা অশুভ মুহূর্তে সাগরের অজানা জীব উঠে আসে লোকালয়ে। সাগরের গভীরে টেনে নিয়ে যায় সুন্দর ছেলেমেয়েদের। তারপর নতুন এক বংশের সৃষ্টি হয়। অবশেষে বংশধররা একদিন ফিরে যায় সৃষ্টিকর্তার কাছে… গভীর সমুদ্রের মধ্যে।
বলতে বলতে আবার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন বালম। দাঁড়িয়ে, মাথা নুইয়ে কাউকে যেন প্রণতি জানালেন বারবার। বেশ জোরে জোরে উচ্চারণ করলেন, l-a R’Lyeh! বল তো বল তো… ঘোষ, সাগরের গভীর অতলে কী না জানি ভয়াল আশঙ্কা ওত পেতে বসে আছে সেই অনাদিকাল থেকে। আশ্চর্য, প্রাণের প্রথম বিকাশও হয়েছে এই সাগরেই।
ছমছম করে উঠল আমার সমস্ত দেহ। অজানা আতঙ্কে বারে বারে শিউরে উঠল আমার মন। পালাবার সহজ কোনও উপায় থাকলে নিশ্চয় পালাতাম আমি। কোনওমতেই শুনতাম না বালমের ভয়ংকর জীবনকথা।
—যাক সে কথা। এবার আসল জায়গায় ফিরে আসি। তুমি কি বিরক্ত হচ্ছ ঘোষ? বিরক্ত হয়ো না—একটু মন দিয়ে শোন। অনেক—অনেক কথা জমে আছে বুকের মধ্যে। আমার শেষ বইটার কয়েকটা চ্যাপটার তখন কেবলই লিখছি আর কাটছি। কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছিল না আমার। আদ্যিকালের খোদাই করা পাথর আর ম্যানটির নেশা একটু কমতেই আবার বই লেখায় মন দিলাম। বিশেষ করে সামুদ্রিক প্যারাসাইট বা পরভোজীদের চ্যাপটারটা। এখানে ডাঙার নানান প্যারাসাইটের সঙ্গে সমুদ্রের প্যারাসাইটের তুলনা করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন দেশের সাগর-প্রাণীদের নিয়ে নানান রূপকথা-উপকথার বিশদ আলোচনাও করেছি ওখানে।
—এবার তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ ঘোষ যে, ডাঙার মতো এত অজস্র প্যারাসাইট সমুদ্রের জলে নেই। ডাঙায় চরে বেড়ানো প্রতিটি প্রাণীর শরীরেই আছে প্যারাসাইট। প্যারাসাইটদের আক্রমণ থেকে পাখি বা পোকামাকড়রাও ছাড় পায় না। এদের জীবনধারণ পদ্ধতিও বিস্ময়কর। সমুদ্রের হ্যাগফিশ, ল্যাম্প্রি প্রভৃতি পরজীবী মাছদের নিয়ে বেশ কিছু লিখেছি। এ ছাড়া কয়েক ধরনের মাছের জোঁক, তিমির উকুন, ফাঙ্গাস প্রভৃতি নিয়েও লেখা আছে ওখানে। শুনে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে ঘোষ, প্রতিটি প্যারাসাইট যেন এক-একটি বিস্ময়। কত তফাত ডাঙার প্যারাসাইটদের সঙ্গে জলের। অথচ প্রাণের সৃষ্টি তো হয়েছিল সাগরজলেই।
—ভ্যাম্পায়ারের কথা নিশ্চয় তোমার মনে আছে। সব দেশেই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের নানান গল্প আছে। দিনের বেলায় ঠিক থাকে তারা, অথচ রাতের অন্ধকারে চেহারার দ্রুত পরিবর্তন হয় ওদের। সুযোগ বুঝে অসহায় প্রাণীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্ত চুষতে আরম্ভ করে। শেষকালে মৃত্যু ঘটে প্রাণীদের। কিন্তু মরেও বুঝি মরে না মৃত প্রাণী। সে-ও পরিণত হয় বীভৎস আর-এক ভ্যাম্পায়ারে। এমন করে ছড়িয়ে পড়ে ভ্যাম্পায়াররা। আজ আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি ঘোষ, যে ভ্যাম্পায়ার আর অলীক কল্পনা নয়। আর শুধু ভ্যাম্পায়ার নয়, এইসব প্যারাসাইটও ভিকটিমদের শরীরে পরিবর্তন আনতে পারে। শুধু আনতে পারে কেন… আমি তো…
—মানে… মানে কী বলতে চাইছেন আপনি? ভ্যাম্পায়ার বাস্তব? প্যারাসাইট -রাও শরীরের পরিবর্তন আনতে পারে? উঃ কী ভয়ংকর। আপনি নিজে তো একজন বিজ্ঞানী? বিজ্ঞান কি স্বীকার করে এগুলো?
—বিজ্ঞান! বিজ্ঞান! জগতের সব বিস্ময় কি জানতে পেরেছে বিজ্ঞান? যত দিন যাচ্ছে, ততই বিজ্ঞানের শাখাপ্রশাখা পুষ্ট হচ্ছে নানান আবিষ্কারে। নিজে বিজ্ঞানী হয়ে বলছি, এ বিষয়ে ভালোভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করা দরকার। তবে আমিও কম পরীক্ষা করিনি। কিন্তু এখন দেখছি আমাদের জ্ঞানের সীমা একান্তই সীমাবদ্ধ। বিশ্বের কতটুকু জানি আমরা? প্রাণ কী? প্রাণের উৎস কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব কি দিতে পেরেছে বিজ্ঞান?
আর বলার কিছু নেই। শুধু অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম বালমের মুখের দিকে। কালো মুখ উত্তেজনায় আরও কালো হয়ে উঠেছে। থমথম করছে সমস্ত মুখখানা। দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবিশ্রান্ত জলের ধারা। থরথর করে কাঁপছে হাত দুটো। কাঁপা কাঁপা হাতে আর-এক গ্লাস পানীয় শেষ করলেন বালম।
—এখন আর এসব প্রশ্ন করো না ঘোষ। কোনওরকম তর্ক করতে ভালো লাগে না আমার। আমি শুধু বিশ্বাস করতে চাই। বিশ্বাসে মনের শান্তি আসে। আর বিশ্বাস ছাড়া তো কোনও পথ নেই। আমার প্রথম জীবনে অবিশ্বাস করেছি থুলহুকে… আর আজ থুলহু আমার উপাস্য। থাক, নানান কথায় চাপা পড়ে যাচ্ছে আসল কথা।
—যত দূর মনে পড়ছে, সেটা ১৯৫০ সাল। সলোমন আইল্যান্ডের চার- পাশের সমুদ্রে অভিযান চালাচ্ছি। সঙ্গী আমার ছোট একটা স্পিড বোট আর পাঁচজন সহকর্মী। সন্ধে হয়ে এসেছে। রাতের মতো নোঙর করলাম লোকবসতিশূন্য ছোট্ট একটা দ্বীপে। চাঁদের আলোয় ভরে গেল চারপাশের সমুদ্র। কেমন যেন আবছা রোমাঞ্চকর সেই চাঁদনি রাত। আমার বাড়ি তো কেরালায়। চাঁদনি রাতে সমুদ্রতীর নতুন নয় আমার কাছে। তা সত্ত্বেও সে দিন যেন কেমন হয়ে পড়লাম আমি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে রইলাম উঁচু এক পাথরের ওপর। সামনে সমুদ্র। মনে হল, এই বুঝি সময় হল। সেই পরম মুহূর্ত। অনাদিকালের অনন্ত সাগরের পরম বিস্ময় বুঝি দেখা দেবে এক্ষুনি। থুলহুকে আজ দেখব স্বচক্ষে। সারারাত বসে রইলাম। সঙ্গী আমার অশান্ত সমুদ্র। মন আমার কানায় কানায় ভরপুর। হঠাৎ চমক ভাঙল সঙ্গীর ডাকে। চেয়ে দেখি, পুব আকাশে সূর্য উঠছে। তাঁবু গুটিয়ে যাত্রার আয়োজন করছে সঙ্গীরা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে নোঙর তোলা হবে।
—উঠে পড়লাম পাথর ছেড়ে। সমুদ্রতীরে পায়চারি শুরু করলাম। যদি কোনও জীবন্ত শাঁখ পাওয়া যায় এখানে। সামনেই একটু নিচু জায়গা। জোয়ারজলে ভরতি। ছোটখাটো একটা পুকুর যেন। একটা বিরাট হাঙর আটকা পড়ে গেছে এখানে। বুঝতে পারলাম, রাতে জোয়ারের স্রোতে ভেসে এসেছে। অর্ধেক দেহটা জলের উপরে। কানকোর মধ্যে দিয়ে লাল লাল ফুলকা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছটফট করে উঠছে। ওইটুকু জলে ডুবছে না সমস্ত দেহটা। ওর কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। নীল সাগরের গভীরে যার দোর্দণ্ডপ্রতাপ, আজ তার কী মর্মান্তিক দুর্দশা! একবার মনে হল, দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে ছেড়ে দিই সমুদ্রে। কিন্তু ওই বিরাট দেহ আমাদের কয়জনের পক্ষে টানা অসম্ভব। আর-একবার যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল হাঙরটা। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে এল এক ভয়াবহ দৃশ্য। প্রকাণ্ড এক ল্যাম্প্রিজাতীয়
পরভুক সামুদ্রিক জীব জাপটে রয়েছে ওর বিশাল সাদা পেটের তলায়। এত বিশাল ল্যাম্প্রি আমার চোখে পড়েনি আর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। শুধু বড় নয়, বীভৎসও বটে। চ্যাপটা বিশাল সাকার বা চোষক মুখটা চেপে বসেছে ওর নরম পেটের উপর। রক্ত চুষছে প্যারাসাইটটা। সব নিয়ে বোধহয় ফুট চারেক লম্বা হবে ওটা।
—আমার নিজের কষ্ট হতে লাগল। রাইফেল দিয়ে ওর যন্ত্রণার অবসান ঘটালাম। হাঙরটা মরে যাবার পরও জাপটে ধরে রইল ল্যাম্প্রি। ভাবলাম, আর কতক্ষণ চুষবে ও দেহরস। একসময় তো গলে খসে পড়বে দেহটা। একে একে ঝরে যাবে হাড়গুলো। তারপর…
—না, ঠিক করলাম, এ হতে পারে না। ল্যাম্প্রি বা হ্যাগফিশটা আমার সঙ্গেই যাবে। বোটে অনেক বড় বড় ট্যাংক আছে। অনেক ছোটবড় মাছও আছে। ভাবলাম, প্যারাসাইটটাকে নিয়ে যেতে পারলে আমার পরীক্ষানিরীক্ষায় অনেক সুবিধে হবে। দরকার পড়লে আর-এক চ্যাপটার না হয় বাড়িয়ে দেব বইতে।
—জাল দিয়ে প্যারাসাইটটাকে ধরে ফেলা হল। কিন্তু ট্যাংকের মধ্যে ছাড়তে বেশ বেগ দিতে শুরু করল। অসুবিধে হচ্ছে দেখে আমিও হাত লাগালাম। তাড়াতাড়ি না করলে হয়তো মরে যাবে ওটা। জাল থেকে ছাড়িয়ে ট্যাংকের মধ্যে ফেলে দিতে চেষ্টা করলাম বারবার। হঠাৎ জাল ছাড়িয়ে আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিদঘুটে ল্যাম্প্রিটা। আমিও টাল সামলাতে না পেরে প্যারাসাইট -সুদ্ধ পড়ে গেলাম জল ভরতি ট্যাংকের মধ্যে।
—হো হো করে হেসে উঠল আমার সঙ্গীরা। হয়তো আমিও হেসে উঠতাম। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আমার গায়ে জাপটে ধরল প্যারাসাইটটা। বুকের উপরে সজোরে চেপে বসল চ্যাপটা সাকার লাগানো মুখটা। দপদপে চোখ দুটো একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। উঃ কী ভয়ংকর বীভৎস সেই চাউনি। সঙ্গে সঙ্গে বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম।
তিন
—ট্যাংকের মধ্যে থেকে টেনে তোলার পর পুরো চার হপ্তা ভুল বকেছি আমি। শক না বিষ—ঠিক করে কিছুই বুঝতে পারিনি তখন। মনে হয়েছিল শকই দায়ী এর জন্যে। কিন্তু আজ বুঝেছি, কী হয়েছিল আমার। কিন্তু বুঝতে বড় বেশি দেরি হয়ে গেল।
—আমার সঙ্গীদের সঙ্গে সেই সময় আমার স্ত্রী-ও ছিল বোটে। পুরো চার সপ্তাহ একনাগাড়ে আমার পাশে বসে ছিল। ইতিমধ্যে হ্যাগফিশটাকে সবাই সেই ট্যাংকে রেখেছিল। ট্যাংকের মধ্যে বেশ কয়েকটা ছানা হাঙর আর মাছও ছেড়ে দিয়েছিল ওরা। সুতরাং খাবারের অভাব হয়নি ওর। ওরকম হ্যাগফিশ কেউ কোনও দিনও দেখেনি আগে। Myxinoidea জাতির সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজাতি বলে মনে হল আমার।
—আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলাম। কিন্তু নতুন এক উপসর্গ দেখা দিল। বিচিত্র অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। চোখ বুজলেই একের পর এক ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। অতলান্ত সাগরতলায় বিরাট বড় শহর। সম্পূর্ণ কালো পাথরের তৈরি। অদ্ভুত ভয়ংকর সব প্রাণী ঘুরে বেড়ায় সেখানে। বিচিত্র সব বাড়িঘরদোর। মৎস্যকন্যারা ভিড় করে আসে। হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়। ল্যাম্প্রি, হ্যাগফিশ, জানা-অজানা সব প্যারাসাইটরা বিকট আকার ধারণ করে ঘুরে বেড়ায় আমার চারপাশে। রূপকথা-উপকথার সমস্ত সাগর- দানব জীবন্ত হয়ে নড়াচড়া করে আমার সামনে। কী বিশাল অনন্ত সমুদ্র। কী বিরাট সামুদ্রিক সাপ! ভয়াল ভয়ংকর থুলহু বারে বারে দেখা দেয় আমাকে। সাদর অভ্যর্থনা জানায় অতলান্ত সাগরের গভীরে নামার জন্যে। ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠি। ঘেমে-নেয়ে যেত সর্বাঙ্গ।
—দিনের বেলায় ট্যাংকের পাশে চলে আসি। ট্যাংকের কাচের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় ল্যাম্প্রিকে। খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করি ওকে। সত্যি বীভৎস ভয়ংকর দেখতে ল্যাম্প্রিদের। ইলের মতো লম্বা শরীর। মুখ- জোড়া সাকার। খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। কোনও কিছু চোষার জন্যে কেবলই চঞ্চল সাকারটা।
—প্রায় দু-মাস কেটে গেছে। অভিযানও শেষ হবার মুখে। এমন সময় ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটল। ইতিমধ্যে ঘা-টা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। কিন্তু ওর প্রথম আক্রমণের স্মৃতি কিছুতেই মুছতে পারলাম না মন থেকে।
—প্রথম আক্রমণ? নিজের অজান্তে প্রশ্ন করলাম।
—হ্যাঁ, প্রথম আক্রমণ। পরে আরও আক্রমণ বা আক্রমণ না বলে যোগাযোগ হয়েছে বলতে পার।
ক্রমাগত রুমাল দিয়ে জলের ধারা মুছছেন বালম। গ্লাসের পর গ্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে তরল পানীয়। অদ্ভুত ঝোঁকের মাথায় জীবনকাহিনি বলে চলেছেন বিজ্ঞানী।
—বারবার আক্রমণ করেও কিন্তু আমাকে শেষ করতে পারেনি ল্যাম্প্রি। তবে শেষ করে ফেলা বোধহয় এর চেয়ে ভালো ছিল। যত দিন যেতে লাগল, ততই আমার অদ্ভুত এক আকর্ষণ জন্মাতে শুরু করল ল্যাম্প্রিটার উপর। প্রচণ্ড এক নেশার মতো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবলই ছুটে আসি ট্যাংকের পাশে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি ইল মাছের মতো প্যারাসাইটটার দিকে। ল্যাম্প্রিটাও বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমার মনের কথা। ড্যাবড্যাব করে সে-ও তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ছানা হাঙরগুলোর গায়ে কেবলই নিত্যনতুন দগদগে ঘা। নতুন রক্ত চোষার দাগ সুস্পষ্ট।
—বুঝলে ঘোষ, এই সময়ে একটা নতুন তত্ত্ব জানতে পারলাম। বুঝলাম, একেবারে প্রাণে মারার চেষ্টা করে না প্যারাসাইটরা। যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিনই রক্ত চুষবে ল্যাম্প্রি! এ এক অদ্ভুত বন্ধন।
—শুধু কি একটা কথাই জেনেছি? না, না ঘোষ, আরও এক বিস্ময়কর ব্যাপারও আমার নজরে এসেছে। সাগরজলেও ভ্যাম্পায়ার আছে। কী ভয়ংকর বীভৎস ওর আক্রমণ। যাকে আক্রমণ করে, সে-ও ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে যায় ভ্যাম্পায়ারে। এ ভ্যাম্পায়ার কারা জান ঘোষ? যাক, পরে আসছি এ কথায়। মাঝে মাঝে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলি।
—সাইপ্রাসের একটু দূরে লিমাসলে নোঙর করল আমার বোট। অভিযানের শেষ পর্যায়। ওখান থেকে ফিরে আসব গ্রেট নিকোবর দ্বীপে। একে একে সকলে নেমে গেল লিমাসলে। এমনকী আমার স্ত্রী-ও দেখা করতে গেল কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে। বোটে কেবল আমি একা। সারাদিন বেশ খাটনি হয়েছে। অবসাদে আচ্ছন্ন সর্বাঙ্গ। এ ভাবটা বেশ কয়েকদিন ধরেই দেখছি। কেমন যেন পরিশ্রান্ত মনে হয় সর্বক্ষণ। সে দিন সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম কেবিনে। দূরে শহরের আলোগুলো মালার মতো জ্বলজ্বল করছে। ছলছলাৎ করে ঢেউগুলো ধাক্কা মারছে বোটের গায়ে। বোটের চারপাশ তরল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বুজে এল আমার।
—আমার জ্ঞান হল পুরো তিন সপ্তাহ পরে। আমি তখন গ্রেট নিকোবর দ্বীপে—আমার বাড়িতে শুয়ে। আবার ল্যাম্প্রির আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম আমি। ধীরে ধীরে সব শুনলাম। ঝপাং করে জলের আওয়াজ হতেই ছুটে আসে নারায়ণ রাও। আমি তখন ল্যাম্প্রির ট্যাংকের মধ্যে পড়ে গেছি। অনেক কষ্ট করে রাও তুলে আনে আমাকে। আমার শরীর তখন ল্যাম্প্রির দখলে। সাকার চেপে ধরে কেবলই রক্ত চুষছে। অনেক জোরজবরদস্তি-কসরত করে ছাড়াতে হয়েছিল প্যারাসাইটটাকে। দেখবে, দেখবে ওর কামড়ের দাগ।
—সার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে ফেললেন বালম। বুকের উপর বেশ বড় চাকা এক দাগ। আরও কয়েক জায়গায় সাদা দাগের মতন। হাতুড়িমাথা হাঙর ছানার গায়ের মতো গোলাকার ক্ষতচিহ্ন। আরও বোতাম খোলার সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন বেরিয়ে পড়ল। একটার উপর আর-একটা। মাংস-চামড়া গুটিয়ে সব এবড়ো-খেবড়ো। কোনওটা আবার দগদগ করছে।
—হায় ভগবান, কী ভয়ানক! সমস্ত শরীর তো ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। আমার স্বরে আতঙ্কের রেশ।
—কী… কী বললে? ভগবান? এ কোন ভগবান? কার কথা বলছ তুমি? সৃষ্টির অনাদি পুরুষ। সেই কি তোমাদের ভগবান? কিন্তু আমার কাছে এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই তোমাদের আদিপুরুষ সেই ভগবানের। সারা বিশ্ব জুড়ে চলেছে থুলহুর লীলাখেলা, প্রাণের সৃষ্টিসাগরে আর সেই সাগর চলছে থুলহুর আদেশে। সঙ্গে রয়েছে ড্যাগন। বলতে বলতে উন্মাদের মতো হয়ে উঠলেন বালম। সামনের দিকে ঝুঁকে উঠে দাঁড়ালেন। থরথর করে কাঁপছে সর্বাঙ্গ। বুকের বোতাম খোলা। দগদগে ঘাগুলোর চারপাশে খুব ছোট ছোট মাছের আঁশের মতো কী যেন উঁকি মারছে। অবোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করে কী সব মন্ত্র আওড়ে চলেছেন বালম। একটা কথা থেকে থেকে কেবল শোনা যাচ্ছে… থুলহু, ড্যাগন… কেন জানি না, কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা হিমেল স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে। সামনের বিশাল সমুদ্র যেন দুর্জ্ঞেয় অপার্থিব বলে মনে হয়। সাগরের অতল গভীরে রহস্যময় ডাক যেন ভেসে আসে হাওয়ায় ভর করে।
বালমের কথায় সংবিৎ ফিরে এল। আবার বলতে শুরু করেছেন—এবার আসল কথায় আসি। ঘুমের ঘোরে ট্যাংকের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। এ কথাটাই বলল সকলে। আমিও বিশ্বাস করেছিলাম! তা নয়তো ট্যাংকের মধ্যে পড়ার তো কোনও কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম, কী হয়েছিল তখন। নিজের অজান্তেই ট্যাংকের জলে নেমেছিলাম আমি। অবিশ্বাস্য ওই ল্যাম্প্রির আকর্ষণ। কেউ বুঝবে না… বুঝতে চাইবেও না।
—আমি তো জানি কী দুর্নিবার ওর টান। সবাই বলে ল্যাম্প্রিদের চোখ নেই। বইতেও বলে এক কথা। কিন্তু আমার ল্যাম্প্রির চোখ আছে। ড্যাবড্যাবে দুটো চোখে চেয়ে থাকে আমার দিকে। কয়েকদিন যাবার পর হঠাৎ একদিন মনে হল, ল্যাম্প্রিটা চিনে ফেলেছে আমাকে। দিনে-রাতে দু-বেলা পরীক্ষা করেছি ওকে। আশপাশে দাঁড়িয়েও দেখেছি। চোখ ঘুরিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ল্যাম্প্রি। গোল গোল চোখে অমোঘ এক সাদর আহ্বান। শিরশির করে উঠত আমার শরীর। ওই যে, বড় হাতুড়িমাথা হাঙরটা যে বড় অ্যাকোয়ারিয়ামে আছে, ঠিক ওইখানে ছিল আমার ল্যাম্প্রি। কাউকে ঢুকতে দিতাম না… সে শুধু ছিল আমার। আমার উপাস্য থুলহুর দূত। ওর বীভৎস দেহের মাঝেই আমি দেখতে পেতাম জলের দেবতা ভয়ংকর সেই থুলহুর রূপ। ওর প্রতিটি দংশনে অনুভব করতাম থুলহুর অকল্পনীয় স্পর্শ। সে যে কেমন নেশা, কেমন করে বোঝাব তোমায়। নানান কাজের ভিড়ে কেটে যেত দিনের বেলা। মন কিন্তু ঘোরাফেরা করত অ্যাকোয়ারিয়ামের চারপাশে। সন্ধে ঘনিয়ে ক্রমে রাত ঘনিয়ে আসত। নেশার ঘোরের মতো ছটফট করতাম আমি। অবশেষে গভীর রাতে চলে আসি ট্যাংকের পাশে। ঠিক কাচের গায়ে ভাসতে থাকে আমার ল্যাম্প্রি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আমার জন্যে। সাকার লাগানো চ্যাপটা মুখটা ঘন ঘন কাঁচের গায়ে চেপে ধরে ছেড়ে দেয়। বেশ বুঝতে পারি, চঞ্চল হয়ে উঠেছে ল্যাম্প্রি। কোনও কিছু পাবার আশায় চকচক করে গোল গোল দুটো চোখ। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ি। সে-ও ভেসে ওঠে জলের উপর। উত্তেজনায় ছটফট করে। আমার জন্যে অপেক্ষায় অধীর হয়ে উঠেছে ল্যাম্প্রি। বল, বল ঘোষ… আর কি কষ্ট দেওয়া যায় ওকে? অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে নেমে যাই একসময়ে। পরনে আমার ডুবুরির পোশাক। আমার নিজের হাতে তৈরি। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কোনও অসুবিধা হয় না। ল্যাম্প্রি আর আমার খেলা শুরু হয়ে যায়। চরম খেলা। তারপর আসে পরম মুহূর্ত। যখন থুলহুর…
থরথর করে কেঁপে উঠল বালমের সমস্ত শরীর। সেই মুহূর্ত স্মরণ করে রোমাঞ্চে অধীর হয়ে উঠল ওঁর দেহমন! ঘন ঘন মুছতে লাগলেন জলের ধারা। রীতিমতো কাঁপছে হাত দুটো। ভয়ে শিউরে উঠল আমার মন! অজানা কোনও আতঙ্কে বাক্যহারা হয়ে গেলাম আমি। এরপর কী বলব ওঁকে? বালমই বা কী বলবেন আমাকে? ঢকঢক করে বড় এক গ্লাস পানীয় শেষ করলেন বালম। ইতিমধ্যে আরও বড় দুটো জার টেবিলের উপর নামিয়ে রেখেছে চাকরটা।
—হ্যাঁ, যা বলছিলাম ঘোষ, আমার নিজের মন কিন্তু সায় দিল না এসবে। নেশার ঘোর সব কিছু ভুলিয়ে দিত আমাকে। বিশ্বাস কর, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ল্যাম্প্রির সঙ্গে মিলন চলত আমার। হাঙরের দেহের মতো আমার শরীরও জাপটে ধরে ল্যাম্প্রি। সাকার চেপে রক্ত চুষত থুলহুর দূত। ওঃ, কী আরাম যে হত। রক্ত চোষার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন মদের নেশা ধরত আমার। ঠিক যেন তোমাদের কোনও ট্র্যাঙ্কুলাইজারের নেশা। খেতেই হবে প্রতিদিন। তবে এই নেশার ফলে রাতের ভুল বকা বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হত, আমার শরীরের সমস্ত শক্তিসামর্থ্য বুঝি চুষে নিচ্ছে ল্যাম্প্রিটা। সবাই মনে করত অসুস্থ আমি। ধীরে ধীরে আরও খারাপ হয়ে গেল স্বাস্থ্য। রাতারাতি বয়সও বেড়ে গেল যেন অনেক বছর। বুঝতে পারলাম… আর দেরি নেই… দিন আমার গোনাগুনতি।
—১৯৭২-এর গোড়ার দিক। জানি মৃত্যু আমার সুনিশ্চিত। ঠিক করলাম, আরও একবার বেরুব অভিযানে। স্ত্রী-ও মত দিল সঙ্গে সঙ্গে। ভাবল বোধহয় সমুদ্রযাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠবে আমার শরীর। শুধু বুঝতে পেরেছিল একজন। সে নারায়ণ রাও। ল্যাম্প্রির ঘরে একদিন দেখতে পেয়েছিলাম ওকে। অথচ কারও ঢোকার পারমিশন ছিল না সেখানে। ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সে প্যারাসাইটটার দিকে। রাগে-উত্তেজনায় ফুলে ফুলে উঠেছিল ওর শরীর। যা-ই হোক, সন্দেহ ওর বদ্ধমূল হল আমার এক সিদ্ধান্তে। ল্যাম্প্রিটাও আমাদের সঙ্গে যাবে বলে ঠিক করলাম। বাধা দিল রাও। আমার স্ত্রীকেও বোঝাল অনেক। শেষে আমাকেও। আমি বললাম যে, প্যারাসাইট নিয়ে রিসার্চ শেষ হয়নি এখনও। তাই ওকে নিতে হচ্ছে সঙ্গে। কাজ শেষ হলে সাগরে ছেড়ে দেব। ঘোষ, তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ, ওটা আমার মনের কথা ছিল না কখনও। থুলহুকে যে চিনেছে-জেনেছে, সে কি কখনও ছাড়তে পারে তার দূতকে? ল্যাম্প্রি… ল্যাম্প্রিই তো বলে দেবে আমাকে, কোথায় পাব থুলহুর দেখা। যা-ই হোক, অভিযান যে শেষ করতে পারব এ জীবনে এমন আশা ছিল না আমার। অভিযানের মাঝেই হয়তো মরে যাব আমি। পঁচাত্তর কেজি থেকে পঞ্চাশ কেজিতে নেমেছিল আমার ওজন তখন।
—বঙ্গোপসাগরের বুকে ঘুরলাম অনেকদিন। দূর বঙ্গোপসাগরের বুকে অনেকগুলো ল্যাম্প্রি দেখতে পেলাম একবার। ঠিক আমার ল্যাম্প্রির মতো। দুটো ডলফিনের গায়ে জাপটে ধরেছিল ওরা। কিন্তু ধরতে পারলাম না একটাকেও। এত বড় বড় ল্যাম্প্রি একসঙ্গে দেখিনি কখনও। মনে হল, এখানেই বোধহয় দেখা পাব আদিপুরুষ থুলহুর। কিন্তু আশা আমার পূরণ হল না। অবশেষে নানান সমুদ্র পেরিয়ে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের কাছে নোঙর করলাম সে রাতে। আর ঠিক সে রাতেই ল্যাম্প্রির সঙ্গে আমাকে একসঙ্গে দেখতে পায় আমার স্ত্রী। সকলে তখন ঘুমে অচেতন। সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে বলেই নিশ্চিন্ত মনে খেলায় মেতেছিলাম আমি। কিন্তু আমার স্ত্রী যে ঘুমোয়নি, সে কথাটা খেয়াল ছিল না সে দিন। জলের ভেতর থেকে হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ল স্ত্রীর উপর। ট্যাংকের পাশে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। চোখে-মুখে ভয়-আতঙ্ক-ঘেন্নার ছাপ। চোখে ওর পলক পড়ছিল না। কোনও দিন… কোনও দিনও ভুলব না সেই হিমশীতল দৃষ্টি। কী আতঙ্ক ওর দু-চোখে। পরমুহূর্তে তীক্ষ্ণ এক আর্তনাদে ফালাফালা হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধ সমুদ্র।
—ততক্ষণে আমি উঠে পড়েছি ট্যাংক থেকে। ছুটে ঘরের বাইরে চলে গেল ও। ঝপাং করে আওয়াজ উঠল সাগরজলে। নিজে লাফিয়ে ছিল না, হঠাৎ পড়ে গেল—কেউ বলতে পারল না সে কথা। ওর আর্ত চিৎকারে জেগে উঠেছিল সকলে। রাও ছুটে এল প্রথমে। লোকজন নিয়ে স্ত্রীর মৃতদেহ বার করলাম সমুদ্রের মধ্যে থেকে। কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে দেহটা। একেই তো ক্ষয়জনিত রোগে ভুগছিল। তারপর এত বড় শক আর সামলাতে পারেনি। বোটে ফিরে আসার আগেই রাও তার কাজ করে ফেলেছিল। টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছিল ল্যাম্প্রির নরম বীভৎস দেহটা। থেঁতলে ছোট মাথাটা রক্তাক্ত একতাল মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল। গোলাকার সাকারটা তখনও কীসের আশায় খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল। তীব্র যন্ত্রণায় পাথর হয়ে গেলাম আমি। পাঁজরের মধ্যে থেকে কেউ যেন সজোরে বের করে নিয়ে আসছে আমার হৃৎপিণ্ডটাকে। স্ত্রীর মৃতদেহ দেখেও এত কষ্ট হয়নি। সাগরদেবতা থুলহুর দূতকে হত্যা করেছি আমরা! চোখের সামনে ভেসে উঠল ক্রোধে-প্রতিহিংসায় ভয়ংকর আমার দেবতার ছবিটা। মনে মনে বললাম, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর আমায়! নিজের জীবন দিয়েও প্রায়শ্চিত্ত করব এ পাপের।
একটা বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস এল ওঁর বুক থেকে। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী। দু-গাল বেয়ে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়ল কোলের উপর।
—গল্প আমার শেষ হয়ে আসছে ঘোষ। প্রথম চ্যাপটার এখানেই শেষ। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। পুরানো স্বাস্থ্য ফিরে পেলাম আবার। তবে একটা পরিবর্তন হল। চুল সব উঠে গেল। টাক পড়ে গেল মাথায়। স্ত্রীর শোক ভুললাম মহাদেবকে নিয়ে। ভুললাম না কিন্তু ল্যাম্প্রির স্মৃতি। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মনে পড়ে যায় ওর কথা। সারা শরীর জুড়ে ওর ভালোবাসার দাগ দগদগ করছে। তা ছাড়া ভুলতেও চাই না ওর কথা। ও-ই তো আমায় নিয়ে যাবে থুলহুর কাছে।
—বই লেখা শেষ করলাম পরের বছর। ম্যানাটি, ডুগং-এর আশ্চর্য কাহিনি শোনালাম পৃথিবীর লোককে। তবে ল্যাম্প্রি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু লিখলাম না। আর লিখলাম না ল্যাম্প্রির সঙ্গে আমরা অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা। এ কথা কি লেখা যায়? যা একান্ত নিজের তা কি ঢাক পিটিয়ে বলা যায় সকলকে? মাঝে মাঝে নির্জনে বসে রোমন্থন করতাম সমস্ত ঘটনা। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতাম আমি।
—হঠাৎ সমস্ত শরীরে ব্যথা হতে শুরু হল প্রচণ্ড ব্যথা। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতাম। ধীরে ধীরে যন্ত্রণা সব কেন্দ্রীভূত হল নাভির কাছে। যন্ত্রণায় টনটন করে উঠত সমস্ত পেট। ডাক্তার দেখালাম, চিকিৎসাও হল অনেক। কিন্তু ভালো হল না একেবারে। তারপর… তারপর ঘটল ভয়ংকর আশ্চর্য ঘটনা।
—ঘোষ… ঘোষ… আর-একটা নতুন অঙ্গ গজিয়ে উঠতে শুরু করল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে নতুন অঙ্গ… বা উপাঙ্গও বলতে পার… জন্ম নিল। ঠিক আমার নাভির মধ্যে থেকে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল সেটা। নতুন উপাঙ্গের মাথায় দেখা দিল ছোট্ট এক ফুটো। ঠিক যেন আমার দ্বিতীয় নাভি। আবার ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। কিন্তু সব ডাক্তারই শোনাল এক ভয়ংকর কথা। উপাঙ্গটা কোনও মতেই বাদ দেওয়া সম্ভব নয় আমার দেহ থেকে। হাত-পা-চোখের মতো উপাঙ্গটাও এক স্থায়ী অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আর্টারি, ভেন, নার্ভাস সিস্টেম প্রভৃতি নিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে আমার বাড়তি অঙ্গ। আমার স্টমাক আর হার্টের মধ্যে গিয়ে মিশেছে উপাঙ্গটার প্রধান এক আর্টারি। একে একে অনেক পরীক্ষা হল, কিন্তু সুরাহা হল না কিছু। তবে অদ্ভুত আর-এক পরিবর্তন ধরা পড়ল ডাক্তারদের চোখে। দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে রক্তে। এ এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। নুনের ভাগ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে আমার রক্তে। ঠিক সাগরজলের মতো।
—না, এখানেই শেষ নয় ঘোষ—আরও আছে। ক্রমে ক্রমে আরও পরিবর্তন হল শরীরে। উপাঙ্গটাও বড় হয়ে উঠল। লম্বা মোটা ইল বা সাপের মতো। ঠিক যেন ল্যাম্প্রি। ওর মাথার ছোট ফুটো ক্রমেই বড় হল। ঠিক মুখের মতো। আপনা থেকেই খপখপ করে খোলে আর বন্ধ হয়। মাঝে মাঝে ফোড়ার মতো ব্যথা হয় সারা দেহে। হঠাৎ একদিন চোখ জ্বালা করতে আরম্ভ করল। উঃ কী প্রচণ্ড জ্বালা!
আবার চুপ করে গেলেন বালম। হাঁপাতে লাগলেন। ঠিক যেন জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো। থরথর করে কাঁপতে শুরু করল সমস্ত শরীর। দু-গাল বেয়ে একনাগাড়ে ঝরে পড়ছে জলের ধারা। সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক মনে হল বালমকে। কী বলব আমি? সান্ত্বনা দেব না আরও কিছু জিজ্ঞাসা করব? কথা বলার শক্তিও বোধহয় নেই আমার। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল বলতে পারব না। হঠাৎ বালমের কথায় চমক ভাঙল।
—দেখবে… দেখবে তুমি ঘোষ। দেখবে তোমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানী বালমের পরিবর্তন। দেখ… দেখ একবার…
ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বালম। প্যান্টের ভেতর থেকে টেনে বের করলেন জামাটা। সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলাম ওঁর দিকে। জামার তলায় সমস্ত পেট জুড়ে মোটা এক ব্যান্ডেজ। সারা বুক জুড়ে এ কী? আবের মতো উঁচু উঁচু হয়ে উঠেছে অনেকগুলো। কোনওটা ছোট, কোনওটা বড়! এরকম আব তো লেপ্রসির লক্ষণ। তবে কি শেষ পর্যন্ত কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন বালম! প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে লেপ্রসিও তো সেরে যায়!
পেটের ব্যান্ডেজটা খুলতে শুরু করলেন এবার। একে একে খসে পড়ল ব্যান্ডেজের পাতলা কাপড়। চোখের সামনে বেরিয়ে এল ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন। সম্পূর্ণ উপাঙ্গটা দেখতে পেলাম ঠিক নাভির উপর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফুটখানেক লম্বা মোটা সাপের মতো। ল্যাম্প্রি কি এমন দেখতে? না না, উপাঙ্গ নয় ওটা। উঃ কী ভয়ংকর, কী বীভৎস।
উপাঙ্গের মাথায় ছোট এক মুখ। মুখের চারপাশে গোলাকার সাকার বা চোষক। খাবি খাচ্ছে মুখটা। টকটকে লাল মুখের ভেতর মুখের চারপাশে অজস্র ছোট ছোট দাঁত। দুটো কানকো রয়েছে মাথার দুপাশে। খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল বালমের বুক ভরতি আবগুলোর কথা। না না… এ আমি চিন্তা করতে চাই না, ভাবতে চাই না… ভাবলেও আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ি। এক-একটা আব… মানে এক-একটা ভয়াল ভয়ংকর উপাঙ্গ তৈরি হবে আবগুলো থেকে? সারা বুক-পেট… সমস্ত দেহ জুড়ে একে একে বেরিয়ে আসবে নিশার আতঙ্ক ল্যাম্প্রিগুলো। কিলবিল করবে সমস্ত দেহ জুড়ে অজস্র কুৎসিত সাকার। সাকারগুলো আবার নিজের দেহের উপর চেপে বসবে রক্তের আশায়। না না না… এ কী অবিশ্বাস্য, অসম্ভব…
আবার তাকালাম উপাঙ্গটার দিকে। কাঁপতে কাঁপতে ক্রমেই এগিয়ে আসছে জীবন্ত সাকার। খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে লাল মুখটা। ভয়ে-আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে এল আমার চোখ। চিৎকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। ক্রমেই এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আরও… আরও কাছে। এক টানে কালো চশমাটা খুলে ফেললেন বালম। এই প্রথম… প্রথমবার দেখলাম বালমের চোখ দুটো। না না… মানুষের চোখ নয় ও দুটো! পলকমাত্র দেখলেও কেউ বলবে না এ কথা। ঠিক যেন মাছ বা জলজ কোনও প্রাণীর চোখ। গোল গোল চোখ দুটো অনেকটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। কাঁকড়ার চোখ দেখেছেন? ছোট একটা কাঠির আগায় থাকে চোখ দুটো। গর্ত থেকে বাইরে বেরিয়ে থাকে চোখ দুটো। প্রয়োজনে আবার ঢুকে যায় ওগুলো ভেতরে। চোখের কালো মণি দুটো ঠিক যেন লেগে আছে ইঞ্চি দুই লম্বা সরু এক মাংসপিণ্ডের উপর। ইচ্ছেমতো নড়ছে চোখের মণি দুটো। চোখের পাতার অস্তিত্ব নেই কোনওখানে। দরদর ধারায় জল গড়াচ্ছে কাঁকড়ার মতো বাইরে ঠেলে বেরুনো চোখ দিয়ে। কালো মণি দুটোর মধ্যে কেমন যেন গভীর সমুদ্রের আহ্বান। না না… ও চোখ তো কোনও মানুষের নয়। ও যে অতলান্ত সাগরের গহন গভীরের অজানা কোনও প্রাণীর চোখ! ড্যাবড্যাব করছে! থুলহু… থুলহুর চোখ কি এমন?
সংবিৎ ফিরতে দেখি বালম নেই আমার সামনে। সাগরের গর্জন ভেসে আসছে। বিশাল সমুদ্র রুষে রুষে ফুলে ফুলে উঠছে। প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে শক্ত মাটির উপর। সাগরও কি খেপে উঠল পৃথিবীর উপর? ভয়ংকর বীভৎস সেই সাগরদেবতা থুলহু কি প্রতিহিংসায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে? একটা কালো মেঘ ঢেকে ফেলেছে সমস্ত আকাশ। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। তাল তাল কালো মেঘ হুড়মুড় করে ধেয়ে আসছে! কড়কড় করে বাজ পড়ল কোথায়। কোথা থেকে বিদ্যুতের আলোয় ভয়াবহ পরিবেশ গড়ে উঠল চারপাশে। ঝোড়ো হাওয়ায় বঙ্গোপসাগর মাতাল হয়ে উঠেছে। আকাশপ্রমাণ ঢেউগুলো হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে আসছে গ্রেট নিকোবর দ্বীপের দিকে। বালমের কাহিনির সঙ্গে প্রকৃতির ঘোর ঘনঘটার কি কোনও মিল আছে? তা নয় তো সুনীল আকাশ কেন ঢেকে যাবে নিকষকালো মেঘে? বেশ বুঝতে পারলাম, ঝড় আসছে… বড় ঝড়। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে গাঙচিল। অন্ধকার মেঘে প্রলয়ের আভাস! অন্ধকার নেমে আসছে গ্রেট নিকোবরে।
এমন সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন বালম। ফুটফুটে এক ছেলের হাত ধরে। এই কি মহাদেব… মহাদেব বালম?
—আমার জন্যে দুঃখ করো না ঘোষ! এই পরিবর্তনটাই বোধহয় আমার কাম্য। থুলহুর উপাসনা করি। থুলহুর ইচ্ছায় এই বিস্ময়কর পরিবর্তন। আগামীকাল পর্যন্ত সময় দিতে নারাজ সাগরদেবতা। আকাশে-বাতাসে তারই ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। দেখেছ… দেখেছ ঘোষ কেমন করে কালো মেঘে ঢেকে গেল নীল আকাশ। থুলহুর আদেশে সাগরও উঠেছে খেপে। এই বুঝি পরম মুহূর্ত! শোন ঘোষ, একটা উপকার করতে হবে তোমায়। মহাদেবের ভার নিতে হবে তোমাকে। আমার যাবতীয় সম্পত্তির ট্রাস্টি করে দিয়েছি তোমার নামে। তুমি নেবে তো ভার আমার মহাদেবের? সাগর ভালোবাসতাম আমি। দুর্নিবার সাগরের টান! সাগর রহস্যের কতটুকু জেনেছি আমি! সাগরের অতল গভীরের অনেক রহস্য ভেসে উঠবে এবার আমার চোখের সামনে। সাগরদেবতা থুলহু ডাকছে আমায়! দেখ, দেখ, বড় বড় ঢেউ কী অধীর হয়ে উঠেছে। আর দেরি করতে পারব না। ছটফট করছে আমার উপাঙ্গ… আমার ল্যাম্প্রি… হয়তো আর দেখা হবে না তোমাদের সঙ্গে। জানি না মহাদেবকে না দেখে কেমন করে থাকব আমি। তবে কোনও দিনও যদি যেতে পার সাগরের সেই অতল গভীরে, সেখানে হয়তো দেখা হবে আবার আমার সঙ্গে। তখন কি তোমার সঙ্গে থাকবে আমার মহাদেব? না না… আর পারছি না… সারা দেহ অধীর হয়ে উঠেছে আমার… থুলহু ডাকছে… ডাকছে আমায়…
চশমা ছাড়া বালমের কোটর থেকে বেরিয়ে আসা কালো মণি দুটো ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। কাঁকড়ার চোখের মতো চোখ দুটো কী ভয়াল ভয়ংকর দেখাচ্ছে চারপাশের দুর্যোগময় পরিবেশের মধ্যে! কী ভয়ংকর অলৌকিক পরিবর্তন!! বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছেন… না না, শেষ পর্যন্ত কী হবেন বালম তা আমি জানি না… কল্পনাও করতে চাই না… ঝড় উঠেছে। তীরের গাছগুলো নুয়ে পড়ে প্রণাম জানাচ্ছে সাগরদেবতা থুলহুকে। গুমগুম করে অপার্থিব এক আওয়াজ উঠছে সাগরের মধ্যে থেকে। আমার হাত-পা শক্ত করে ধরে আছে মহাদেব। আকাশ বুঝি ভেঙে পড়বে ছোট এই দ্বীপের উপর। বিদ্যুতের আলোয় কেটে কেটে যাচ্ছে অন্ধকার। বাজ পড়ছে কড়কড় করে। দুরন্ত উন্মাদ ঢেউগুলো বারে বারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বালমের দিকে। মোচার খোলার মতো ভাসছে বোধহয় ছোট্ট দ্বীপটি।
ধীরে ধীরে সাগরের দিকে এগিয়ে গেলেন বালম। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জেগে উঠল বিচিত্র সেই অপার্থিব শব্দ…
la R’Lyeh! Cthulhu fhtagn!
লেখক পরিচিতি – রণেন ঘোষ
বাংলা সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি সাহিত্যের স্বর্ণযুগের অন্যতম নাম। লেখার পাশাপাশি সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন ‘বিস্ময়!’ এবং ‘ফ্যানট্যাসটিক’ এর অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে প্রতিশ্রুতি প্রকাশনের কর্ণধার।