ফাঁস – ৫

পাঁচ

অনেক রাত, কল্যাণবাবুর বাড়িতে পুরো পরিবার থম মেরে বসে আছে। মোহন বসে আসে একটা টুলে। কল্যাণবাবু খাটে শুয়ে আছেন। কল্যাণবাবু বলছেন—

কল্যাণবাবু।। এ পাড়া তাহলে ছাড়তে হবে মোহন?

মোহন।। কেন?

কল্যাণবাবু।। কলঙ্ক।

মোহন।। ও সেকালের কাঁসার বাসনে পড়ত। একালে সব স্টেনলেস স্টিল।

কল্যাণবাবু।। ব্যাপারটা যে ক্লিন একটা চক্রান্ত সেটা বুঝলে। মাঝখান থেকে মাধুরী হয়ে গেল কলগার্ল।

মোহন।। এই প্রপার্টি নিয়ে খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে মামলাটা কতদিন চলছে?

কল্যাণবাবু।। লাস্ট টেন ইয়ার্স।

মোহন।। কী অবস্থায় আছে?

কল্যাণবাবু।। ওরা নো হোয়্যার হয়ে যাবে।

মোহন।। মাধুরী, তোকে বারান্দা থেকে কে ডেকেছিল?

মাধুরী।। রেবাদি।

মোহন।। তুই রেবার কেচ্ছা শুনিসনি?

মাধুরী।। শুনেছি। বিশ্বাস করিনি। রেবাদির মেয়ে আমার সঙ্গে পড়ত।

মোহন।। রেবার মেয়ে পড়লেই রেবা ধোয়া তুলসীপাতা।

মাধুরী।। আগে কতবারই তো ওদের বাড়ি গেছি।

মোহন।। তখন কি ওর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল?

মাধুরী।। না।

মোহন।। ওর স্বামীকে খুন করেছে। ডেডবডি পাওয়া যায়নি।

মাধুরী।। কোনো কেস হয়নি আজও।

মোহন।। তাতে কী! কানেকশান থাকলে একটা কেন, দশটা মার্ডার করা যায়। মাধুরী, এত সরল হলে এই জটিল যুগে পদে পদে বিপদ। তুই জানিস না, তোদের এক শত্রু আত্মীয় রেবার ব্যাবসার পার্টনার। তোর একটুও সন্দেহ হল না, একটা মেয়েমানুষের এত পয়সা হল কী করে? তোকে ডাকার কারণ?

মাধুরী।। বিউটি পারলার খুলবে। খুব ভালোভাবেই কথা বলছিল। তোদের এই অবস্থা, একটা ইনকাম না থাকলে কী করে চলবে। তখন যে ভেতরের ঘরে ওইসব হচ্ছিল, কী করে জানব।

মোহন।। পুলিশ রেড না হলে তোর কী অবস্থা হত বুঝতে পারছিস? আমাদের ও.সি. অত্যন্ত ভালো লোক। মুখ দেখলে মানুষ চিনতে পারেন।

মাধুরী।। আমার কী হবে মোহনদা। কাল সকালে রাস্তায় বেরোব কী করে?

মোহন।। সেইজন্যেই বসে আছি। ভোর হলেই হাওড়া।

মাধুরী।। হাওড়া কেন?

মোহন।। হাওড়া থেকে হাওয়া।

মাধুরী।। কোথায়?

মোহন।। জামশেদপুরে। আমার পিসেমশাই ডাক্তার। নাম—করা।

মাধুরী।। তারপর?

মোহন মাধুরীর কথাটি শেষ হওয়া মাত্রই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সেই গানের একটি লাইন ‘তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা’ উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠল। মোহন থামামাত্রই কল্যাণবাবু বললেন—আহা, কী গলা। এ ছেলেটা গান গেয়েই মাৎ করে দিতে পারে। কেন যে করে না! মোহনের ক্লাসিক্যাল আমি শুনেছি আসরে। মনে আছে তোমার?

মোহন।। সব মনে আছে কাকাবাবু। এতবড়ো দুঃসাহস, অত বড়ো বড়ো ওস্তাদের সামনে দরবারি কানাড়া গেয়েছিলুম।

কল্যাণবাবু।। সেই গান আজও আমার কানে। জানো তো মোহন, এ বাড়িতেও গানবাজনার যথেষ্ট চর্চা ছিল। আবদুল করিম, ফয়েজ খান, মহিষাদল রাজ এস্টেটের পুলিনবিহারী। বেহাগে সিদ্ধ ছিলেন, আসরে আমাদের বাস্তুসাপ ঢুকে পড়েছিল। গল্পকথা নয়, চোখে দেখা, তখন আমি টেন ক্লাসের ছাত্তর। তারপর, ভাগ্য আর কপাল। জীবনটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারলুম না। লাগামছাড়া ঘোড়া। যতবার চেপে বসি, ছিটকে ফেলে দেয়।

মোহন।। একটা ব্যাবসা তো করেছিলেন। কীসের ব্যাবসা? ম্যানুফ্যাকচারিং?

কল্যাণবাবু।। না সেলিং।

মোহন।। কী সেল করতেন?

কল্যাণবাবু।। পেটারনাল প্রপারটি। বিষয়—সম্পত্তি, স্থাবর, অস্থাবর সব বেচে বেচে বছর কুড়ি খুব লপচপানি। তারপর একে একে নিবিল দেউটি। দিনগুলি মোর রইল না, সোনার খাঁচায় রইল না, নানা রঙের দিনগুলি। দারিদ্র্য, নোনাধরা দেয়াল, ঝুরঝুর বালি। একটা শাস্ত্রবাক্য শোনো মোহনলাল,

বরং বনং ব্যাঘ্রগজেন্দ্রসেবিতং

দ্রুমালয়ঃ পত্রফলাম্বুভোজনম।

তৃণানি শয্যা বসনঞ্চ বল্কলং

ন বন্ধুমধ্যে ধনহীন জীবনম।।

গৃহত্যাগ করে বনে গিয়ে বাঘ—হাতির সঙ্গে বাস করা ভালো। পাতা, ফল, জল খাও। ঘাসের বিছানা। পরনে বল্কল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ধনহীন—দরিদ্র মানুষের জীবন অপমান আর অবহেলায় অসহ্য, দুর্বিষহ। যাও, হাই উঠছে সব। দুটো বাজল, শুয়ে পড়। আবার কাল। লড়াই, লড়াই, এ লড়াই মরার লড়াই, লড়াই করে মরতে হবে।

ছয়

কল্যাণবাবুদের বাড়ির বারান্দায় একটা বেতের আরাম চেয়ারে টান টান হয়ে শুয়ে আছে মোহন। বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলোর একটা ঝলক এসে পড়ছে মোহনের মুখে। ঘুরে ঢুকল মাধুরী। মোহনকে ওইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, একটা কিছু পেতে দি না মোহনদা। তোশক, মশারি সব আছে।

মোহন।। অকারণে কাজ বাড়িয়ো না। আমি কোথায় কোথায় শুয়ে ঘুম পাকিয়েছি জানিস— ইস্টিশানের বিছানায়। সেটা কী? কাঠের বেঞ্চি। মাঠের ঘাস, বাড়ির খড়ের চাল, পার্কের পাঁচিল, কলকাতার ফুটপাথ, গঙ্গার ঘাট, নৌকোর পাটাতন, গাছের মগডাল, শ্মশানের বটতলা, ভাঙা মন্দিরের দালান, চলন্ত ট্রাক, হাসপাতালের খাট, ঝুপড়ির খাটিয়া।

মাধুরী।। আজ না হয় বিছানা।

মোহন।। কেন অমন করছিস মাধু। খাতির আমার অসহ্য লাগে। পথেই জীবন পথেই মরণ আমাদের। ফুটে যা তো। একা একটু ঝিমোতে দে।

মোহন শরীরটাকে আরও একটু এলিয়ে দিল। ঘুমিয়ে পড়েছে মোহন। দূর থেকে ভেসে আসছে হরিধ্বনি। ঘোলাটে অতীত স্বপ্ন হয়ে আসছে। গানের আসর, অজস্র শ্রোতা, মোহন দরবারি কানাড়ায় আলাপ করছে। ভোরের ঘোলাটে অন্ধকার, হাততালির শব্দ। একটা ঝাড়লন্ঠন ঝপ করে নিভে গেল। পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে নীল ধোঁয়া। বেতের চেয়ারে আধশোয়া মোহন হাততালির শব্দে সোজা হয়ে বসল। স্বপ্নের অতীত বর্তমানে এসে মিলিয়ে গেল। মোহন আপন মনেই হা—হা করে হাসছে। মোহনের হাসির শব্দে মাধুরী ছুটে এসেছে।

মাধুরী।। কী হল? হা—হা করে কংসের মতো হাসছ? এখনও ভালো করে ভোরই হল না।

মোহন।। হাসব না কেন! আমার অতীত যদি স্বপ্ন হয়ে আসে তাহলে আমার বর্তমান কেন হাসবে না।

মাধুরী।। এইটুকু সময়ের মধ্যে কী স্বপ্ন আবার দেখলে?

মোহন।। দেখলুম, বিরাট এক আসর। অজস্র শ্রোতা আর ওস্তাদ, আমি মঞ্চে বসে দরবারি কানাড়ায় গান গাইছি। গান শেষ হতেই হাততালি আর হাততালি। আর বড়ে গোলাম আলি আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাচ্ছেন আর বলছেন, কেয়াবাত, কেয়াবাত।

মাধুরী।। একদিন তো তাই হয়েছিল।

মোহন।। একদিন, একদিন, বহুদিন, দিনের পর দিন চলে গেল। পড়ে রইল, মোহন দি অ্যান্টিসোশ্যাল। কথা শেষ করেই মোহন উঠে দাঁড়িয়ে, শরীরের দু’পাশে হাত দুটো টান টান করে ছড়িয়ে দিল।

মাধুরী।। শোন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। তুমি যে বললে, জামশেদপুরে পালাবে, আমাকে তোমার পিসিমার কাছে রেখে আসবে। আমি বলছি, পালাব কেন, কেন পালাব?

অবাক বিস্ময়ে মাধুরীর দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল মোহন। কথা শেষ হওয়া মাত্রই মোহন উত্তেজনায় মাধুরীর দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি মেরে বলল— আমি তো সেই কথাই বলতে চাইছি। মাধুরী, পালাবি কেন? রুখে দাঁড়া, দেখ, লেখাপড়া আমি তেমন করিনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটা আমার বেঁচে থাকার মন্ত্র—

অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

মোহন আর মাধুরী পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই মাধুরী বলল, পালাতেই যদি হয় তবে একজনের সঙ্গেই পালাব।

মোহন।। মানে, এ আবার কী কথা? সে কে?

মাধুরী মোহনের ডান গালে তর্জনী দিয়ে টোকা মারতে মারতে বলল, তুমি, তুমি, তুমি।

ঠিক সেই সময় রাস্তা দিয়ে কর্পোরেশনের সাইলেন্সার ফাটা ময়লার গাড়ি বিকট শব্দ করতে করতে চলে গেল। দূরে একজন লোক বাজখাঁই গলায় ব্রঙ্কাইটিসের কাশি কাশতে নিজেকেই গালাগাল দিচ্ছে—শালার কাশি লাংস দুটো ফেঁড়ে ফেঁড়ে ফেলে দেবে। এই ভদ্রলোকের পল্লিকে কাশি বানিয়ে ছেড়ে দিলে। কাশি আর যেতে হবে না।

মোহন।। নাও, ভোর হতে না হতেই শুরু হল গদাইদার কপচানি। জানিস মাধুরী, আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন এই পাড়ায় ভোরবেলায় সংকীর্তনের দল বেরোত। গাইতে গাইতে যেত—

আর ঘুমায়ো না মন, মায়াঘোরে।

কতদিন আর রবে অচেতন।

তা তুই এ—কথাটা কী বললি?

মাধুরী।। কোন কথাটা?

মোহন।। আমার সঙ্গে পালাবি? আমার মতো একটা র‍্যাজাটে ছেলে যার কোনো চালচুলো নেই।

মাধুরী।। ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছ কেন? এ তো তোমার সঙ্গে আমার কথা। পলিটিক্যাল বক্তৃতা দিতে দিতে তুমি সবকিছুই বলো বক্তৃতার ঢঙে। তা মহাদেবের কী ছিল? দালানকোঠা ছেড়ে দিয়ে শ্মশানে বৈঠকখানা। পার্বতী সেই মহাদেবকে পাবার জন্যই তপস্যা করেছিলেন।

মোহন।। ওইসব সাহিত্যমার্কা ন্যাকান্যাকা কথা বলিসনি তো। লায়লা—মজনু, হীর—রণঝা, শাহজাহান—তাজমহল এসব ইলেকট্রিকের আলো আর স্যাটেলাইটের যুগের আগের কথা। এ যুগ হল কম্পিউটার, এ যুগ হল কেরিয়ারের। এ যুগ হল P3—র।

মাধুরী।। P3?

মোহন।। কিছুই জানিস না। ধেড়ে হয়ে বসে আছিস। শোন তিনটে পি হল, পপুলেশন, পলিউশন, পলিটিক্স।

মাধুরী।। তোমাকে ভালোবাসি। পরিষ্কার সোজা কথা তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমার চোখে দেখেছি আমি আমার সর্বনাশের ইশারা।

মোহন।। শোন, সভ্য মানুষের জীবনে একটা ইংরেজি আছে, সেটাকে বলে গুড মর্নিং। সেটা কী জানিস?

মাধুরী।। কী?

মোহন।। ভাঙা কাপে, কালচে রঙের তিনটে পিঁপড়ে ভাসা এককাপ তেতো চা। সেটার আশা কী আছে? না, আশার আশা ভবের আশা, আশা মাত্র হল সার। কাল সারারাত তোদের বারান্দার ব্লাডব্যাঙ্কে তা প্রায় আধবোতল রক্ত দিয়েছি, এখন একটু পুষ্টিকর চা না হলে এই চাতাল যে ভোরের কা—কা—র বদলে চা চা করবে।

অস্পষ্ট একটা কোলাহলের শব্দ দূর থেকে ভেসে এল। মোহন কান খাড়া করে বললে,

—সাতসকালে কী আবার হল!

মাধুরী।। যাই হোক, তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই।

মোহন।। তুই কি আমাকে রিফর্ম করতে চাস! ফুল ফুটলে ভ্রমর ছুটবেই।

মাধুরী।। আর আমি যদি শ্যামল মিত্রের সেই বিখ্যাত গান গেয়ে বলি, ফুলের বনে মধু নিতে অনেক কাঁটার জ্বালা। ভ্রমরা যাসনে সেখানে।

মোহন।। সে হল তোর বাংলা ফুল। আমি হলুম, ইংরিজি Fool। আমার মাস্টারমশাই বলতেন— Fools tread where angles dare to step in. যেতে আমাকে হবেই। গোলমালটা আসছে খেলার মাঠের দিক থেকে।

সাত

খেলার মাঠে গোলপোস্টের পেছন দিকে কৌতূহলী এক দল মানুষের জটলা। মোহন দ্রুত এগিয়ে গেল সেইদিকে। মোহন দূর থেকেই জিজ্ঞাসা করছে—কী হয়েছে রে, কী হয়েছে?

মোহন এ পাড়ার অভিভাবক। সকলেই আশ্বস্ত হল। নেতা এসে গেছে। আর ভয় নেই। ভিড়ের মধ্যে থেকেই একটি ছেলে বললে, এই দ্যাখো মোহনদা, একটা লাশ পড়ে আছে।

গোলপোস্টের পেছনদিকে ঝোপঝাড় আগাছার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে এক জোড়া পা। এক পায়ে জুতো, আর এক পা খালি। দেহের ঊর্ধ্বভাগ ঝোপের অন্তরালে। যে পারছে সেই একবার করে উঁকি মারছে। ঠোঁটে ঠোঁটে প্রশ্ন ফিরছে—লোকটা কে? মোহন ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। এগোতে এগোতে বলছে, এতে এত হইচই করার কী আছে! মানুষ তো আজকাল কুকুরেরও অধম। মরে গেলেই হল। লাশটা কার?

কে একজন বললে, দেখে মনে হচ্ছে সমীরদার।

—সমীর? কোন সমীর? এ পাড়ায় সাতটা সমীর আছে।

—আরে, শেয়ারের দালাল সমীর। তুমিতো চেনো।

মোহনের গলায় বিস্ময়—সমীর সরকার! যাঃ, ওকে ঝেড়ে দিলে! আমি জানতুম ও হড়কাবে। ধর্মের কল বাতাসেই নড়বে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল পুলিশের ধধধড়ে জিপ। জিপটাকে আসতে দেখেই ভিড় হাওয়া। গোলপোস্টের সামনে গোলকিপারের মতো একা দাঁড়িয়ে মোহন। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বেজারমুখো দু’জন সেপাই। পুলিশের বড়োবাবু আসতে আসতে দূর থেকেই বলছেন,

—কী হে মোহনলাল, আবার একটা নামিয়েছ?

—স্যার! এতকাল ক্রিমিন্যালদের চরিয়ে এ—কথা বললেন কী করে! খুনি কখনো খুনের জায়গায় থাকে? আর বডিটা দেখলেই মালুম হবে, কাঁচা হাতের কাজ।

—খুনি খুনের জায়গায় থাকে না ঠিকই, তবে আমাদের শাস্ত্র কী বলে জানো—খুনি খুনের জায়গায় ফিরে আসবেই।

—জানি স্যার। তবে এত তাড়াতাড়ি নয়।

অফিসার সিপাইদের হুকুম দিলেন, সাবধানে ডেডবডি স্পর্শ না করে ঝোপটাকে একটু পরিষ্কার করতে। সিপাই দুজন সাবধানে কচুঘেঁচুর ঝোপ সরিয়ে মৃতদেহটাকে, দৃশ্যমান করল। অফিসার মোহনকে প্রশ্ন করলেন,

—চেনো?

—চিনি স্যার! সমীর সরকার। লোকে বলে, সমীর শেয়ার।

অফিসার।। এই আর এক উপসর্গ ঢুকেছে শেয়ার। কিছুদিন হল, চিটফান্ড। এখন রসখ্যাপা বাঙালিকে ধরেছে শেয়ারে। শেয়ারের ট্যাক্সি, শেয়ারের অটো, বাকি রয়েছে শেয়ারে বিয়ে করাটা।

মোহন।। বিয়ে জিনিসটা উঠে যাবে স্যার। এখন, এসে গেছে লিভ টুগেদার, ধরো আর ছাড়ো আবার ছাড়ো আর ধরো। (চিৎকার করে) জাগো বাঙালি। ডলার ছাড়াই আমেরিকান। খালি পেটে বুলি ঝেড়ে আর বুলি শুনে স্বাধীনতার ফিফটি ইয়ারস। আমি তাহলে আসি স্যার।

অফিসার।। আসবে মানে?

মোহন।। মানে আমি যাই।

অফিসার।। তুমি তো আমার সঙ্গে যাবে। হাতের কাছে এমন একটা জিনিস থাকতে খুনিকে আমি কোথায় খুঁজে বেড়াব? লাশ আর কিলার একসঙ্গেই পাঠিয়ে দেব।

মোহন।। আগে শনাক্ত করুন, তারপর তো ধরবেন। নাহলে তো এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাব।

অফিসার।। কাজের সময় ইয়ার্কি নয়। আবার তোমাকে দেখলেই দুটো রসের কথা বলতে ইচ্ছা করে। জানো তো পুলিশের সবথেকে বড়ো বন্ধু হচ্ছে ক্রিমিন্যাল। কেসটা কী বলো তো?

মোহন।। কেসটা বললে—আমার খুব একজন স্নেহভাজন ফেঁসে যাবে। সেটা আমি চাই না স্যার।

অফিসার।। এই তো বলেই বিপদ করলে। তুমি যখন জানো তখন না বললে আমাদের বলানোর মেথড তো তোমার জানাই আছে মোহন।

মোহন।। এই আপনাদের দোষ স্যার। থেকে থেকে পালটে যান। পুলিশ কী কখনোই মানুষ হবে না।

অফিসার।। ব্যাপারটা রেসিপ্রোকাল। তোমরা মানুষ হলে পুলিশও মানুষ হয়ে যাবে।

অফিসার মোহনের কাঁধে হাত রাখলেন। অন্তরঙ্গতা দেখলে মনে হবে যেন কতকালের বন্ধু দুজন প্রাণের কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন। এই সময় আর একটা জিপ, বেশ ঝকঝকে, রাশভারী, ঝাঁ করে ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়াল। দুজন অফিসার নামলেন। গটগট করে এগিয়ে গেলেন ঘটনাস্থলের দিকে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞ। এইবার মাপজোকের ফিতে বেরোবে। লেনস, ক্যামেরা। ছাপ তোলা হবে। আরও কত কী! আপাতত স্থানীয় থানার আর কিছু করার নেই।

আট

নিত্যানন্দের ফ্ল্যাটে নিত্যানন্দ, মালিনী, পূর্ণা। চিন্তিত মুখ। রাতে ঘুম নেই কারও চোখে। মোহন বসে আছে একটা মোড়ায়। হাঁটুর ওপর হাত দুটো টানটান। মোহনের বসার ধরনটা যোগীর মতো। কখনো সামনে ঝোঁকে না। মুখ তুলে মোহন প্রশ্ন করল,

—খোকা কোথায়?

নিত্যানন্দ।। কাল থেকে সেই যে হাওয়া হয়ে গেছে, কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

মোহন।। আপনাদের মতো ইডিয়েট…। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে…। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে গেল, ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। থানায় একটা ডায়েরি করতে পারতেন তো!

মালিনী।। না, আমরা ভাবছিলুম, দেখি না, ফিরে আসে কি না!

মোহন একটা আক্ষেপের শব্দ করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললে,

—এ কী বেড়াল যে ফিরে আসবে! মানুষের ছানা! আপনাদের মতো ক্যাবলাদের সংসার করাটাই উচিত হয়নি। এখন কী হবে।

পূর্ণা প্রশ্ন করে উদবেগটা আরও বাড়িয়ে দিল—এখন কী হবে মোহনদা!

মোহন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—কেস খুব সিরিয়াস। সমীরের কাছ থেকে খোকা শেয়ার কিনেছিল, সেই শেয়ার জাল। ট্রান্সফার করাতে গিয়ে ধরা পড়ল জাল সই। খোকার লাখ দুই লাখ টাকা চোট। সমীরের ডেডবডি গোলপোস্টের পেছনে। একটু পরেই পুলিশ কুকুর আনবে। সেই কুকুর যদি শুঁকতে শুঁকতে এই বাড়িতে আসে তাহলে কী হবে?

পূর্ণা।। এই বাড়িতে আসবে কেন?

মোহন।। মাথামোটা! এই খুনের পেছনে খোকা যদি থাকে কিছু অন্যায় হবে।

পূর্ণা।। দাদা থাকবে কেন?

মোহন।। এই কারণে থাকবে, দাদার টাকা চৌপাট হয়ে গেছে। টাকার শোক তো ভোলা যায় না। সেই শোকে খোকা যদি ঝেড়ে দিয়ে থাকে।

পূর্ণা।। দাদা খুনের এবিসি জানে না। ওরকম নরম মনের মানুষ জলজ্যান্ত একটা মানুষকে মেরে ফেলবে?

মোহন।। বাবা, টাকা কী বস্তু জানো না! টাকার জন্য বাপ ছেলেকে, ছেলে বাপকে খুন করতে পারে। এটা স্বর্গ নয়, নরক পৃথিবী। এই সত্যটি ভুলো না কখনও।

নিত্যানন্দ।। আমার প্যালপিটেশান হচ্ছে।

মোহন।। হলেও কিছু করার নেই। শোন পূর্ণা, তোর দাদা খুন না করলেও আর একজন কেউ খুন করে তোর দাদার ঘাড়ে দায়টা চাপিয়ে দিতে পারে। প্রফেশনাল খুনিরা অনেক আটঘাট বেঁধে কাজ করে। পুলিশ যখন জাল ফেলবে তখন সেই জালে রুই, কাতলা, চুনোপুঁটি সব উঠবে। খুন না করলেও হ্যারাসমেন্টটা যাবে কোথায়!

মোহন উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে এদিক—ওদিক তাকিয়ে বললে—যেভাবেই হোক খোকাকে খুঁজে বের করতেই হবে। পূর্ণা, তুই বাবার জিভের তলায় একটা সরব্রিটেট দিয়ে দে।

মোহন একটা গানের দুটো কলি গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেল,

এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় সব সত্যি।

ঘুরিয়ে এই দুনিয়ার লাট্টু, ভগবান,

তুমি হারিয়েছো লেত্তি।

নয়

গুপীর চায়ের দোকানে জোর গুলতানি। পাড়ার সব বিশেষজ্ঞের জমায়েত! যত না চা উড়ছে, তার চেয়ে বেশি ছুটছে কথা। আলাদা করে বক্তাদের চেনার চেষ্টা না করাই ভালো। স্বরক্ষেপের দিকে কান রাখা যাক :

।। কণ্ঠস্বর।।

১। এর পেছনে রাজপরিবারের হাত আছে। ডেফিনিট।

২। ধুস, চার্লস একেবারে ভেঙে পড়েছে। ফ্র্যাকচারড। দশ বছর বয়েস বেড়ে গেছে এক ঝটকায়। বউকে ভালোবাসত। যে যাই বল, প্রেম মরে না। ও হল বটের শেকড়।

৩। ভাই, এই তো জীবন, হেসে নাও দু’দিন বই তো নয়/কার যে কখন সন্ধে হয়। এই তো সমীর! কী লপচপানি। চলে গেল লাশকাটা ঘরে। কাল সেলাইফোঁড়াই হয়ে শ্মশানে, দেড় কেজি ছাই!

৪। আমি দেখছি, অনেকেরই পয়সা সহ্য হয় না। ডায়ানা, ডোডি কম বড়োলোক। হিরের আংটিটার দাম এক লাখ বিশ হাজার পাউন্ড।

৫। শেয়ার সমীর জাস্ট তিন দিন আগে গাড়ি কিনেছে। লে হালুয়া।

৬। কার কাজ বল তো, অমাবস্যার রাতে ঝড়াকসে নামিয়ে দিল মাইরি!

৭। ওই ডায়ানার মার্সিডিজ। ফাস্ট দৌড়লেই ক্র্যাশ। সমীর ফাস্ট রান করছিল। পাঁচ বছর আগেও গুপীদার ধারের খদ্দের। পাঁচ বছর পরে তাজে ডিনার।

৮। বাঙালির এই এক রোগ। কেউ মরলেই হল, অমনি ফিলজফি। আরে বাবা বাঁচতে এসেছিস, যেভাবেই হোক বেঁচে থেকে একদিন ফুটে যা। ইলিশ খা, ঢেঁড়স খা, রোল খা, মোগলাই খা, প্রেম কর, ঝগড়া কর, ভাব কর।

৯। লাও, শুরু হল ভাদ্দরের পচা তাল, ভড়ড় ভড়ড়।

এই কথার গজর বজরে মোহন দমকা বাতাসের মতো দোকানে ঢুকল। ঢোকা মাত্রই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোফিয়ার ঝাঁঝ। চায়ে চিনি গুলছিল। চাপা গলায় মোহনকে বললে,— কবে তুমি ভদ্দরলোক হবে?

—ভদ্দরলোক তো হয়েই আছি।

—যার কথার ঠিক নেই সে আবার ভদ্দরলোক।

—এই লাও, কিছুই জানো না, সাঁই করে একটা কথা বলে বসলে। ভদ্দরলোকের লক্ষণই হল, তার কথার ঠিক থাকবে না। বলবে এক, করবে আর এক। এত ভদ্দরলোক চারপাশে থইথই করছে। দেখলেই তো শেখা যায়। লোনা না হলে সমুদ্রের জল হয়। ঝাল না হলে লংকা হয়!

——এটা দেখি কথার ঝুড়ি।

——ওটাও তোমার ভদ্দরলোকের লক্ষণ।

—যাও, তোমার সঙ্গে কথা বলব না, অসভ্য। তোমার জন্যে কাল রাতে আমার খাওয়াই হল না। কত কী রাঁধলুম।

—রাগ করে না। অবশ্য রাগলে তোমাকে আরও সুন্দর দেখায়।

—থাক থাক, খুব হয়েছে। আমি চা—উলী, চা—উলীই থাকব।

—আমি বেওয়ারিশ মাল বেওয়ারিশই থাকব। মরলে মুখ কেউ জলও দেবে না, শ্রাদ্ধও করবে না।

হঠাৎ সোফিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলে—খোকনকে দেখেছ? কাল থেকে একবারও?

সোফিয়া বললে—না তো!

মোহন নিজের মনেই বলে উঠল—আশ্চর্য! ছেলেটি ভ্যানিশ হয়ে গেল!

সোফিয়া বললে, তাতে তোমার কী?

—এই দ্যাখো, ভদ্দরলোকের মতো কথা বললে। আমি ভদ্দরলোক হলে আমার কিছুই হত না। ছোটোলোক হয়েই বিপদ পড়েছি। ছেলেটার খুব বিপদ। যেভাবেই হোক, ওকে বাঁচাতে হবে।

——ওর আবার কী হল, ম্যালেরিয়া, না জন্ডিস!

—দুটোই। এক গেলাস কড়া ছাড়।

—রাতে কিছু জুটেছিল?

—না।

—সেই কাল দুপুরে খেয়েছিলে, এখন বেলা এগারোটা। আমি যদি তোমার কেউ হতুম, তাহলে তোমার মতো ছেলেকে কীভাবে টাইট দিতে হয় দেখিয়ে দিতুম।

—তুমি যে আমার কে তুমি না জানলেও আমি জানি। কিন্তু সেই জানাটা তোমার অজানাই থেকে যাবে।

মোহন সোফিয়াকে ছেড়ে দোকানের ভেতর গুলতানিতে বেঞ্চের একপাশে বসল। মোহনকে দেখে সবাই সমস্বরে বলে উঠল—গুরু অনেকদিন বাদে মিইয়ে যাওয়া পাড়াটা আবার তেতে উঠল।

সোফিয়া মোহনের হাতে চায়ের গেলাসটা ধরাচ্ছে, মোহন সকলকে শুনিয়ে সোফিয়াকে বললে,

—সোফিয়া শুনলে, এরাই হল ভদ্রলোক। কারওর সর্বনাশ কারওর পোষ মাস।

দোকানের বয় কিশোর। বাইরে বসে কাপডিশ ধুচ্ছিল। হঠাৎ তিন লাফে দোকানে—

—পুলিশ কুকুর ছেড়েছে, শুঁকতে শুঁকতে এইদিকেই আসছে।

দোকানে যারা বসেছিল, পেছনের দরজা দিয়ে নিমেষে সব হাওয়া। ওদিকে আবর্জনা ভরা একফালি পোড়ো জমি। অন্য সময় হলে যেত না। মোহন একটা পা বেঞ্চের ওপর ছড়াতে ছড়াতে বললে,

—যাঃ, সব ব্যাটা হাওয়া!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *