ফাঁস – ১০

দশ

কলকাতার লাল আলোর এলাকার একটি কুঠি। তার তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে খোকন বসে আছে খাটে। একগাল দাড়ি। বিধ্বস্ত চেহারা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে একটি মেয়ে পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ঘন কালো চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে, যেন ঝাউয়ের পাতায় বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। মেয়েটি সুন্দরী। দেহের খাঁজে খাঁজে, ভাঁজে ভাঁজে পাগল করা আকর্ষণ। মেয়েটির সঠিক নাম হারিয়ে গেছে। এ পাড়ায় তার নাম ডলি। খোকন আয়নার প্রতিচ্ছবির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। খোকনের জ্বর হয়েছে। ডলি আয়নায় খোকনের মুখ দেখতে পাচ্ছে। ডলি বলছে,

—তোমাকে দূর করে দিইনি এই তোমার বাপের ভাগ্যি। কবে কোন জন্মে চুটকি মারতে এসেছিল সেই অধিকারে ঠাঠা দুপুরে ফুর্তি করতে চলে এলে। দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্দরঘরের ছেলে। একেবারে নাদান। মুখটা দেখে মায়াই হচ্ছে। রাতের বাবুরা সকাল হলেই আমাদের মেয়েমানুষ বলে। তা বলুক—আসলে তো আমরা মায়ের জাত। শয়তানরা টেনে বের করে এনে মাকে মাগি বানায়। গর্ভে ছেলে এলে বাংলায় বলবে জারজ, ইংরেজিতে বাস্টার্ড, হিন্দিতে বলবে হারামি। বউয়ের পেটের ছেলে—সন্তান, আমার পেটে সেই একই বাপের ছেলে—হারামি! কী বিচার মাইরি তোমাদের!

ডলি আয়নার সামনে থেকে উঠে এসে বেশ আয়েস করে খোকনের পাশে বিছানায় আধশোয়া হল। কথা শেষ হয়নি। খোকনের ঊরুতে হাত রেখে বললে—দেখে মনে হচ্ছে, কিছু একটা বাধিয়ে এসেছ। খুনখারাপি করার সাহস তোমার হবে না, তবে এমন একটা কিছু দেখে ফেলেছ যাতে তুমি নিজেই খুন হয়ে যাবে।

—কী করে বুঝলে বলো তো! খোকন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ডলির শিক্ষিত হাত যেখানে সেখানে ভ্রমণ করছে। খোকনের সারা শরীর শিরশির করছে।

ডলি বললে—এই বয়েসেই হাজারখানেক লোক চরিয়েছি। মানুষের ভেতরটা দেখতে পাই। এখানে এসেছ কেন?

খোকন অসহায়ের মতো বললে—জানি না, কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে এল। সেই কবে একবার দুর্গাপুজোর রাতে তোমার কাছে এসেছিলুম। সিদ্ধির ঘোরে মনে হয়েছিল, তুমিই মা দুর্গা। কিছু করতে পারিনি বলে আমাকে ক্যাঁত ক্যাঁত করে লাথি মেরেছিলে।

—খুব তেল মারতে পারো মাইরি! কী মতলবে এসেছ বলো তো। ঘাপটি মেরে থাকবে কিছু দিন। এই একটা জায়গা। আমরা যেন পাপের আড়তদার! আমার রেট জানো। পকেটে কত টাকা আছে গুরু?

—একটা টাকাও নেই।

——ওরে আমার ফোতো কাপতেন রে। এসব জায়গায় আসতে গেলে ট্যাঁকের জোর থাকা চাই।

—তাহলে আমি চলেই যাই।

খোকন উঠে দরজার দিকে এগোচ্ছে। বাইরে ঝাঁ—ঝাঁ রোদের কলকাতা। ডলি খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মজা দেখতে। ভীরু একটা ছেলে উদভ্রান্তের মতো চলে যাচ্ছে। কোথায় কী করে এসেছে কে জানে। ডলি বললে, এই যে দাঁড়াও, তোমাদের তো আবার নাম থাকে না, আমাদেরও অবশ্য থাকে না। এটা নামহীনদের পাড়া।

খোকন ছাতে বেরিয়ে এসেছিল। দাঁড়াও—আদেশ শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছে স্ট্যাচুর মতো। ডলি খোকনের সামনে মুখোমুখি। ঝাঁঝালো গলায় বললে—যেতে বলতেই সুড়সুড় করে চলে যাচ্ছ যে! আগের জন্মে ট্রেনিং নেওয়া বিলিতি কুকুর ছিলে বুঝি।

খোকন কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে।

ডলি আঙুল উঁচিয়ে কড়া গলায় বললে—ভেতরে চলো। ক’দিন খাওনি। মুখটা তো শুকনো আমের মতো হয়ে গেছে।

খোকন ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল আবার। মেয়েটা পাকা মাছুড়ের মতো খোকনকে খেলাচ্ছে। কতই বা বয়েস! খোকনের বয়সিই হবে। খোকনের মায়ের কথা, বোনের কথা মনে পড়ছে। তুলনা আসছে। এও মেয়ে তারাও মেয়ে। কত তফাত। ডলি কোলে একটা তাকিয়া নিয়ে খাটের ওপর বাবু হয়ে বসল। খোকন ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো সামনে দাঁড়িয়ে। কী করবে বুঝতে পারছে না।

ডলি পান চিবোতে চিবোতে বললে—সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসো। দরজাটা বন্ধ করতেই ঘরের ঝনঝনে আলো বেশ নরম হল। খোকন দাঁড়িয়ে আছে খাড়া।

ডলি মুচকি হেসে বললে—এইবার কী হবে বলো তো!

—কী হবে?

—পয়সাকড়ি নেই তো?

—না। গোটা কুড়ি টাকা আছে।

—ওতে কী হবে। আমি রাত বিক্রি করি, দু’হাজার তিন হাজারে। দিন বিক্রি করি ঘণ্টা—মিটারে। পাঁচশো, হাজার। আমি এখন শোবো, তুমি আমার পা টিপবে। বিলিতি সাবান মেখে চান করেছি। চুলে করেছি এলো খোঁপা। পেটে পড়েছে বিরিয়ানি, চাঁপ। মুখে ঠুসেছি জর্দা পান। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি উপোসী। তোমার কেসটা এবার শোনা যাক। বেশ মজা লাগছে। তোমার সেই হরিদাসের গুপ্তকথা। নিশ্চয় একটা মেয়ে আছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে—পৃথিবীর যত গল্পের শুরু।

ডলি সুর পালটে এক ধমক লাগাল—চাকরের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে বলতে পারছ না। মেড়া কোথাকার।

খোকন বসতে গিয়ে খাট আর নিজের পেছনের দূরত্ব অনুমান করতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিল। ডলি খিল খিল করে হাসতে হাসতে বললে—ভয় পেয়ে মানুষ কীরকম ভেড়া হয়ে যায় মাইরি।

কথা শেষ করেই ডলি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। পা দুটো তুলে দিল খোকনের কোলে— পা দুটো আগে দ্যাখো। এর নাম শ্রীচরণ। কেষ্টঠাকুর শ্রীরাধিকার শ্রীচরণ সেবার পর শ্রীফল পেতেন। এইরকম পা দেখেছ? কী, এইতেই মরে গেলে, গলা শুকিয়ে কাঠ। এখনও যে অনেক বাকি মিঞা। কুঞ্জকানন অনেক দূর। আমার মুখের পান চিবনো খাবে? বেশ রসেছে। বহুত প্রেম। ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসো। পান খাও, পান করো। কত সুধা পৃথিবীতে। বোতল সুধা, অধর সুধা, দেহ সুধা। কত সুধা!

খোকন অবাক হয়ে পা দুটো দেখছে। মানবীর পা এত সুন্দর হয়! হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বস্ত্রের অন্তরালে আরও বিস্ময়। হিসেব করে, শাস্ত্র মেনে বাঁচতে গেলে জীবনের কিছুই দর্শন হয় না। সব বিসর্জন দিলে তবেই অর্জন হয়।

 এগারো

ফুটবল খেলার মাঠ। মাঝমাঠে বল। দু’দিকে দুই স্কুল টিম। সবই ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে। হাত—পা নাড়ছে। গজর গজর কথা হচ্ছে। দুজন প্রবীণ মানুষ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। কোনো একটা সমস্যা। যার সমাধান এই দুজন প্রবীণ মানুষের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। এমন সময় দেখা গেল, মোটর সাইকেলে চেপে মোহন আসছে। সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার একেবারে টিপটপ।

দুই প্রবীণ একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন—মোহন, মোহন!

মোটর বাইক কান্নিক মেরে রাস্তার বাঁ পাশে মাঠের ধারে চলে এল। মোহনের একটা পা মাটিতে। বাইকের চাপা গর্জন। মোহন গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল—কী হল স্যার!

প্রবীণদের একজন বললেন—একবার এসো না বাবা।

মোহন বাইকটাকে রাস্তার পাশে রেখে একলাফে মাঠে পড়ে ছুটতে ছুটতে দূর থেকে বললে—শরীরটা এখনও ফিট আছে, বলুন স্যার?

মোহনের পায়ের কাছেই ফুটবল। সটান লাথি মারার লোভনীয় একটা জিনিস। মাঠের ঘাসে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোহনের শৈশব ফিরে আসছিল। বলটা দেখার পর সেই অনুভূতি আরও তীব্র হল। ধাঁই করে এক শট। বলটা উড়ে গেল গোলের দিকে। সেখানে কেউ নেই, অথচ অদৃশ্য কোনো গোলকিপার বলটাকে যেন পাঞ্চ করে ফিরিয়ে দিল।

মোহনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—যাস শালা।

সঙ্গে সঙ্গে বললে—সরি স্যার। তাজ্জব ব্যাপার।

মাস্টারমশাইদের একজন বললেন—সেইজন্যেই তোমাকে ডেকেছি বাবা। তখন থেকে এইরকমই হচ্ছে। কী ব্যাপার বলো তো!

মোহন বললে—আজকে খেলাটা বন্ধ রাখলেই পারতেন। সকালে এতবড়ো একটা কেলোর কীর্তি হয়ে গেল।

—কী করব! আমাদের টুর্নামেন্ট চলছে যে!

রেফারি কিছুক্ষণ চিন্তা করে রায় দিলেন—খেলা আজ বন্ধ থাক স্যার। যে—কোনো কারণেই হোক, মাঠের আবহাওয়া আজ ভালো নয়। মনে হয়, হাওয়ার জন্যেই আজ এইরকম হচ্ছে। বল ঠেলে বের করে দিচ্ছে।

শিক্ষকমশাই বললেন—কী যে বলো! হাওয়াই নেই তো হাওয়া! গাছের একটা পাতাও কি নড়ছে!

রেফারি বললেন—এ হাওয়া সে হাওয়া নয়। এই যে বলে, আবহাওয়া বার্তা, তাতে হাওয়া আছে?

—ঝোড়ো হাওয়া আছে।

—যে হাওয়ায় গাছে পাতা নড়ে সে হাওয়া আছে কি? নেই। সে হাওয়ায় আমাদের শ্বাস—প্রশ্বাসের হাওয়াও নেই।

কিছুক্ষণ ভ্যাজোর ভ্যাজোর করে মাঠ ফাঁকা করে সবাই চলে গেল। দাঁড়িয়ে রইল একা মোহন। মোহন গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে গেল আবার। প্রশ্নটা থেকেই গেল। ঘটনাটা লৌকিক না অলৌকিক। বিজ্ঞানের যুগে ভূতের অস্তিত্ব কেউ বিশ্বাস করবে! গোল—পোস্ট। পেছনে ঝোপঝাড়। ঝোপঝাড় সামান্য বিধ্বস্ত। কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। তাহলে?

মোহন আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেল বাইকের কাছে। স্টার্ট নিয়ে চলে গেল যেদিকে যাচ্ছিল সেই দিকে। পড়ন্ত বেলার রোদ। মোহনের বাইক দূর থেকে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাঠটা পড়ে রইল শুনশান।

বারো

সুচন্দ্রা লাল পাড়ার এখন টপ বারবধূ। পাঁচ হাজারের কমে কথা বলে না। নামি—দামি লোক আসে, বসে, ফুর্তি করে, চলে যায়। আর আসে সবচেয়ে কুখ্যাত মানুষরা। যারা হাসতে হাসতে খুন করে। ভীষণ সাজানো—গোছানো একটি ঘর দোতলায়। যমদূতের মতো বসে আছে দুটো লোক। মদের বোতল, গেলাস, সোডা ওয়াটারের খালি বোতল। তিনটে প্লেটে মাংসের হাড়। সুচন্দ্রা প্রায় আউট। লোক দুটো নেশায় টান টান। পাপের জগতে এদের একজনের নাম পীরু, আর একজনের নাম জগা।

জগা পীরুকে বলছে—ব্যাটা ষণ্ড। মাথামোটা। তোকে বললে চমকে দিতে, আর তুই পাঠিয়ে দিলি মায়ের ভোগে।

পীরু— আরে, বুরবাকের মতো কথা বলিস না তো! খুন তো করিসনি কোনোদিন। কারও গলা টিপে ধরলে আরও টিপতে ইচ্ছে করে। তা দম বন্ধ হয়ে গেলে আমি কি করব। শালা নেতিয়ে পড়ল।

জগা— তা লাশটা পাড়ায় না ফেলে বেপাড়ায় ফেলতে পারতিস তো!

পীরু— তোর দয়ামায়া কিস্যু নেই। মাল খেয়ে খেয়ে সব লোপাট চৌপাট হয়ে গেছে। পাড়ার জিনিস পাড়াতেই রইল। শালার বাড়ির লোকের লেবার কমে গেল। একছুটে এসে মড়া দেখে মরাকান্না জুড়ে দেবে।

জগা— ভালোই করেছিস মাথামোটা। এইবার দু’সাইডের ধোলাই খাবে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচলেও মোহন শালা কি ছাড়বে? ব্যাটা যমদূত।

পীরু— ছাড়বে ছাড়বে। দুই আর দুইয়ে চার হয় সোনা। গব্বর সিং—এর মতো গতরটাই বাগিয়েছিস। মাথায় আছে ছাই। গোবর থাকলে তবু সার হত। হিসেবটা বোঝার চেষ্টা কর।

জগা— এর মধ্যে আবার হিসেব কী! তোর হাফ আমার হাফ।

পীরু— ওরে আমার মানিক রে! পুরো কেসটা নামালুম আমি, অপারেশন আমার। এক কোপে খতম। ঘ্যাঁক করে গলাটা চেপে ধরে তিনটে ঝটকা। আর তুমি মেরে দেবে হাফ। শোন নেপো, এই দইয়ের এক ছিটেও তুমি মারতে পারবে না।

জগা— যাঃ, তুই আমায় এত পেয়ার করিস, প্রসাদ না দিলে তোর দিলে লাগবে রে। তোকে তো আমি জানি। মানুষের চেহারা হলে কী হয়, আসলে একটা হাতি। যাকে ভালোবাসিস তাকে শুঁড়ে তুলে পিঠে চড়াস। আর যার ওপর রেগে যাস তাকে থেঁতো করিস। তুই আর ব্যাংক তো এক রে। যতদিন থাকবে মাল সুদে বাড়বে। এইবার তোর সেই হিসেবটা বল মাইরি।

পীরু এক চুমুকে আধ গেলাস সাবড়ে জগাকে হিসেব বোঝাচ্ছে—

—শোন, মোহন খোকনকে ভালোবাসে। খোকনকে কেন ভালোবাসে। বল, কেন বাসে! দেখি তোর নেশা হয়েছে কী হয়নি।

জগা একটু ভেবে বললে— খোকনের বোন পূর্ণা।

পীরু— ইয়া, মার দিয়া কেল্লা। ধরেছিস ঠিক। ষাঁড়ের কালিয়া। হুইস্কি খেলে সায়েবদের মতো বুদ্ধি হয়, কী বলো বেগম সাহেবা। তুমি যে বাবা এরই মধ্যে চেত্তা খেয়ে গেলে।

জগা— ওকে ছাড় এখন। তুই আটকে গেছিস, আগে বাড়ো।

পীরু— কী যেন হচ্ছিল?

জগা— হিসেব।

পীরু— হিসেব করে কী হবে! ওসব করবে ওই কেরানিরা। আমাদের হল জিয়ো, পিয়ো। কেউ মনে রাখবে না আমাদের। একদিন আদর করে নিজের মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছি, চিৎকার—বাপ হয়ে মেয়েকে রেপ করতে চাইছ! আমাদের ক্যারেকটার বলে আর কিছু নেই রে জগু।

জগা—লে হালুয়া! শেষ পর্যন্ত তোরই নেশা হয়ে গেল। আরে ব্যাটাচ্ছেলে ওই হিসেব—মোহন ভালোবাসে খোকনকে, আসলে ভালোবাসে পূর্ণাকে, তাহলে? তাহলে কী?

পীরু—অ, তুই ওই হিসেবটা বলছিস? খোকনের দু’লাখ টাকা চোট হয়েছে, তাহলে সমীরকে খতম করার কথা ছিল মোহনের, তার আগে আমরাই ওকে শুইয়ে দিয়েছি। সমীর অনেকের টাকা মেরেছে। ব্যাটা পাপী। পাপীরা কোথায় যায়?

জগা—নরকে।

পীরু—উসকো হাম নরকমে ভেজ দিয়া। হামার কোতো, কোতো পুণ্য হল। সো লোকের ভি কোতো আনন্দ হল। এইবার বাজি পোড়াবে, পটকা ফাটাবে। আভি তুমহার হিসাব ছোড়ো দোস্ত, এক রাউন্ড নাচা—গানা হো যায়। পীরু কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে নাচার চেষ্টা করল। পিয়া ঘর আয়া, আহা, আহা। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে টলে পড়ে গেল। সেন্টার টেবল, মোড়া সব ছিটকে উলটে একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড। পীরুর নাচ দেখে জগা খাটের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে। পীরুকে বলছে—ব্যাটার লিভারে কিছু নেই, ছিবড়ে হয়ে গেছে। এই দ্যাখ, আমি স্টেজে দাঁড়িয়ে কেমন নাচি।

জগা, পীরুর কাণ্ড দেখে সুচন্দ্রা দু’হাত তুলে আতঙ্কের গলায় বলছে—উতার যাও, উতার যাও, খাট ভাঙ যায়েগা।

তেরো

ওই পাড়ারই ডলির ঘরে তখন অন্য দৃশ্য। খোকন দাড়ি কামিয়েছে, চান করেছে। নীচের, নীচের ফ্ল্যাটে গুলজার। খদ্দের ঢুকছে, বেরোচ্ছে। ঘরে ঘরে প্রেম উপচে পড়ছে। কচি কলাপাতায় মোড়া বেলফুলের মালা। কারও কারও খোঁপায় জুঁইফুলের গোড়ের মালা। ফুল আর মদের গন্ধে বাতাস ভারী। ডলির ঘর সেই তুলনায় শান্ত। ছাদের নিরালায় এক টেরে। খোকনের সামনে একটা টেবিল। তার ওপর বড়ো প্লেটে কচুরি আর আলুর দম।

ডলি—তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমি মাসিকে বলে আসি ঘরে লোক আছে। একটাই সমস্যা আজ আর কামাই হবে না। টাকাটা আমার গ্যাঁট থেকে যাবে।

খোকন—কত টাকা?

ডলি—তা ধরো পাঁচশো।

খোকন—তুমি আমার জন্যে এতটা করবে স্বপ্নেও ভাবিনি। ভগবান দিন দিলে পাঁচশো কেন, তোমাকে আমি পাঁচ লাখ দেবো।

ডলি—গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। আগে নিজে বাঁচো। আমার যদ্দিন যৌবন আছে তদ্দিন রোজগার আছে। তোমার তো কিছুই নেই।

খোকন—খুনটা দেখে ফেলেই বিপদ করেছি। আমার মোহনদাকে একবার ধরতে পারলে এখুনি একটা রাস্তা বেরোয়। ওরা আমাকে মারবেই, কারণ এই খুনের আমিই তো একমাত্র সাক্ষী।

ডলি—ওই ছোট্ট মাথায় অত দুশ্চিন্তা আর ঢুকিয়ো না। রাতটা আমার খাটের তলায় কাটিয়ে দাও; কারণ মাঝরাতে আমার এক বাঁধা খদ্দের আছে। চুর হয়ে ঢোকে, একটু হাতটাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল হলে তোমাকে পাচার করে দোবো।

খোকন—কোথায় পাচার করবে?

ডলি—আরে দেশে কী জায়গার অভাব আছে? আমি যেভাবে পাচার হয়েছি, তুমিও সেইভাবেই পাচার হবে।

খোকন—তুমি আমার জন্য এত করছ কেন?

ডলি—ন্যাকামি করো না। কেন—র কোনো জবাব নেই। ঝপ করে মেরে দাও, আমি বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে দিয়ে যাচ্ছি।

চোদ্দ

কালীবাড়ি। মা খুবই জাগ্রত। প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন মন্দির। আরতি হচ্ছে মহা সমারোহে। মালিনী আর পূর্ণা বসে আছে হাতজোড় করে। এধারে, ওধারে আরও দু’চারজন ভক্ত। আরতি শেষ হল। সৌম্যদর্শন পূজারি হাতে হাতে চরণামৃত দিচ্ছেন।

মালিনী চাপা স্বরে বললে— ঠাকুরমশাই! আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

ঠাকুরমশাই—দাঁড়াও মা, একটু ব্যস্ত আছি। একটু পরে সব শুনব।

ঠাকুরমশাই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে উচ্চকণ্ঠে এক সুবেশ তরুণকে ডাকছেন, শোনো বাপি, শোনো বাপি।

যুবকটি ডাক শুনে মন্দিরের সামনের জমিতে উঠে এল রাস্তা থেকে। পূজারিকে প্রণাম করে বললে,

—ভালো আছেন জ্যাঠামশাই? বাবা আজ সকালেই আপনার কথাই বলছিলেন। আপনি কিন্তু অনেকদিন আমাদের বাড়িতে যাননি। একদিন আসুন না। একটু জ্যোতিষ—টোতিস হবে।

—যাবো, যাবো, তোমার বাবার সঙ্গে আমার খুব দরকার।

—আমাকে বলতে পারেন।

—না, না, সে—কথা তোমাকে বলা যায় না। আমি রবিবার সকাল নটায় যাব। বাবাকে বলে রেখো।

ছেলেটি মন্দিরে মাকে প্রণাম করে চলে গেল। পূজারি সিল্কের উত্তরীয় সামলাতে সামলাতে মন্দিরের দালানে উঠে বিশ্বত্রাতার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। ঢুলু ঢুলু চোখে মালিনীকে বললেন,

—বলো মা, তুমি যা বলবে সব আমি জানি। এই পনেরো তারিখ পর্যন্ত গ্রহগুলো সব তেড়েবেঁকে আছে। সে তোমরা বুঝবে না, মহাকাশে এক মহাচক্রান্ত। এখন কেউ ভালো নেই, কেউ ভালো থাকতে পারে না। এই দ্যাখো না, চোদ্দো বছর পর আমার বাত আবার ফিরে এসেছে। বসলে উঠতে পারি না, উঠলে বসতে পারি না। অথচ এই পা দুটো এই শরীরটাকে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা কম ঘোরান ঘুরিয়েছে। তীর্থ থেকে তীর্থে। গোমুখ, গঙ্গোত্রী একসময় আমার কাছে ছিল এপাড়া—ওপাড়া। সব ওই বেটির খেলা, হাসছে দ্যাখো। খিল খিল করে হাসছে। আমি মাঝে মাঝে জিভটা টেনে নিই। আদর, বুঝলে আদর। যা চাইবার ওই বেটির কাছে চাও, মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই। তোমাদের ধোয়া কাপড়?

মালিনী—আজ্ঞে হ্যাঁ।

ঠাকুরমশাই—তাহলে যাও, ভেতরে যাও। মায়ের পা দুটো জড়িয়ে তিনবার কপাল ঠোকো। এই কথার পিঠে বাইরে থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল— কপাল লিখিতং ধাতা কোন শালা কিং করিষ্যতি।

ঠাকুরমশাই—কে, কোন অর্বাচীন?

—আজ্ঞে, অর্বাচীন মোহন।

—তুই বাপি, এই সময় কোথা থেকে জ্বালাতে এলি। তোর তো এখন অন্য জায়গায় থাকার কথা বাপি!

—আজ্ঞে, শক্তিসাধনার পীঠস্থানেই তো এসেছি। শক্তির তো দুটো রূপ ঠাকুরমশাই, একটা সলিড, একটা লিকুইড। আচ্ছা, বলুন তো কত রকমের লবণ আছে?

—এ আবার কী অর্বাচীন প্রশ্ন বাপি! এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়!

—এত শাস্ত্র পড়লেন, এত যজমানকে খলখলে করলেন, এই উত্তরটা জানেন না? এ হচ্ছে গোলাপি রেউড়ির মতো গোলাপি ধাঁধা। শুনুন তাহলে, লবণ, সৈন্ধব লবণ, ভাস্কর লবণ। একই লবণ, প্রথমটা সংসারীর ভোগে লাগে, দ্বিতীয়টা দেবভোগে, তৃতীয়টা অম্বলের রোগীর হজমে। শক্তিও সেইরকম ঠাকুরমশাই।

—শোন বাপি। সাড়ে তিনশো বছরের এই কালীমন্দিরে এসে আজেবাজে কথা নাই বা বললি।

—ঠাকুরমশাই, সবই মায়ের ইচ্ছা। ছিল সিমেন্টের খরখরে মেঝে, হয়ে গেল পাথরের। দেয়ালে পিঁপড়ে পিছলে যাচ্ছে, আর পিঠ লাগলে নুনছাল উঠে যেত। আর নিজে হয়েছেন ফ্রিজ থেকে সদ্য বের করা একটি কুলফিমালাই।

—বাপি, হাত জোড় করছি।

—আমার দিকে নয়, ওই মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ান। বলুন, মা ভবতারিণী, আমাকে চৈতন্য দাও মা, আমার অহংকার কিঞ্চিৎ ছেঁটে দাও মা। আজ আছি কাল নেই মা, মরে গেলে কোনো নাম নেই মা।

মন্দিরের পেছন দিক থেকে পাজামা—পাঞ্জাবি পরা ঝুমকো চুলো একটা ছেলে সিঁড়ি দিয়ে দু’ধাপ নেমেছে কি নামেনি মোহন বাঘের মতো তার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাঞ্জাবির সামনেটা খামচে ধরে দু’বার ঝাঁকানি মেরে মোহন গর্জে উঠল,

—শুয়োরের বাচ্চা, হারামি, তোকে এইবার কোন জগদম্বা বাঁচাবে। মায়ের পায়ের লাল জবা এক ঝুড়ি চিবিয়ে খেলেও এই হাঁড়িকাঠেই তোর শেষ গতি।

ছেলেটির নাম পরেশ। ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। তোতলাতে তোতলাতে বলছে,

—মোহনদা আমি কী করেছি?

ঠাকুরমশাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলছেন—বাপি, এটা মায়ের মন্দির। এখানে এসব করে না বাপি।

মোহনের হাতের মুঠো এতটুকু আলগা হল না। পরেশের পাঞ্জাবি সেই একই কায়দায় ধরে আছে। আর একটা ঝাঁকানি মেরে বললে— ঠাকুরমশাই, সাড়ে তিনশো বছর আগে এখানে নরবলি হত। সাড়ে তিনশো বছর পরে এই নরছাগলটাকে পাওয়া গেছে। আপনি শুধু এর গলাটা আর খাঁড়াটাকে একটু পুজো করে দিন। এক কোপে নামিয়ে দি।

মোহনের এবার অন্য চেহারা, কেশর ফোলানো সিংহের মতো। একটা হুঙ্কার ছেড়ে বললে—মা, অনেকদিন নিরামিষ খেয়ে আছিস মা, আজ তোর আমিষ ভোগ।

পূর্ণা এতক্ষণ থম মেরে বসেছিল। সে তরতর করে নেমে এসে মোহনের হাত ধরল,

—কী করছ মোহনদা?

—এই শুয়োরটা একটু আগে মাধুরীকে বলে এসেছে, ইজ্জত যখন একবার গেছেই তখন শরীরটাকে কাজে লাগিয়ে দু’পয়সা ইনকাম কর না। আমার হাতে ভালো ভালো খদ্দের আছে।

মোহন পরেশকে সপাটে একটা থাপ্পড় হাঁকাল। পরেশ ঠিকরে হাঁড়িকাঠের ওপর। মোহন দু’কোমরে হাত রেখে বললে—খাঁড়াটাকে আর অপবিত্র করব না ঠাকুরমশাই। এই পায়রাটার জন্যে ছোটো একটা দানাই যথেষ্ট। আমার কোমরের খাপে এই মেশিনটা অনেক দিন উপোস করে আছে।

পরেশ—গুরু, বুঝতে পারিনি, সেমসাইড হয়ে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে মোহনের এক লাথি। পরেশ কোঁক করে উঠল।

মোহন—আমার পায়ে ধরে কী হবে। আমার এলাকায় মেয়েদের অসম্মান চলবে না। তোকে সবার সামনে মাধুরীর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।

পরেশ—বেইজ্জত তো আগেই হয়ে গেছে মোহনদা।

মোহনের মার শুরু হল। ঠাকুরমশাই ভয়ে মন্দিরের ঝোলা ঘণ্টাটাকে জোরে জোরে বাজাতে লাগলেন। আর গাঁক গাঁক করে চিৎকার করতে লাগলেন—জয় মা জয় মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *