প্রেম, হত্যা এবং কর্নেল
বারান্দা থেকে কয়েক একর পাথুরে জমির ওধারে কয়েকটা শালগাছ আছে। দুটো কুকুর ভোরবেলা থেকে শালগাছ ঘিরে খুব খেলা জমিয়েছিল। তারপর একটা মাটি শুঁকতে শুঁকতে স্টেশনের দিকে চলে গেছে। অন্যটা মদ্দা, একটা কিছু আঁচ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে মুখ তুলে–যেন গন্ধ শুঁকেছে কিছু। তারপর দু-পা সামনে ছড়িয়ে থাবায় চিবুক রেখে টানটান বসে আছে। ওর গায়ে আস্তে আস্তে একটা ছায়া সেঁটে যায়। সাদা কুকুরটা ধূসর হয়ে বস্তুজগতের সঙ্গে ওতোগোতভাবে সংলগ্ন হয় এবং স্তব্ধতায় গুপ্ত থাকে।
মেঘেন–বরমডিহি স্টেশনের রেলবাবু মেঘে লাল বোস, তার লাল কোয়ার্টার থেকে সকালের অবসরে সবুজ বনের খেলা দেখছিল। সাদা কুকুরটা শুলে সে বারান্দা থেকে নামল। খানিক দূরে গিয়ে একটুকরো পাথর ছুঁড়ল। কুকুরটা মুখ ঘুরিয়ে দাঁত বের করল। দ্বিতীয়বার মেঘেন পাথর তুললে সে গরগর করে তেড়ে এল। মেঘেন পিছিয়ে আসে।
বারান্দা থেকে মন্দিরা চেঁচায় কী হচ্ছে ওখানে? ওর পিছনে লাগলে কেন?
মেঘেনও ঘুরে দাঁত বের করে–অর্থাৎ হাসে।
–পাগলা কুকুর ওটা। শীগগির চলে এস।
স্ত্রীলোকের ইনটুইশান। মেঘেন ভাবে। কিন্তু পাগলা কুকুর কি সঙ্গিনী নিয়ে। খেলে? কে জানে! পৃথিবীর অনেক ব্যাপারের অনেকটাই মানুষের জানা হয় না। জানা যায় না। প্রাণীজগতটা তো মনে হয় একেকটি দুরুহ কোডে ভরা জিনপুঞ্জসমন্বিত দুয়ে ক্রোমোসোম নিয়ে তৈরি। তার মধ্যে মানুষ বিশেষত স্ত্রীলোক, যাদের রামকৃষ্ণদেব বলতেন, প্রকৃতির অংশ। অংশ কেন–হাতের পুতুল। কী করে কী বলে নিজেরাও বোঝে না। যেমন মন্দিরা। কেন সে সারারাত মেঘেনের পিঠ আঁকড়ে শুয়ে থেকেছে, কে বলবে? পিঠটা আয়নায় দেখেছে সে, নখের চেরা লাল দাগ পড়ে গেছে। কারও কারও নখে নাকি বিষ থাকে। মন্দিরার নেই তো?
জামার ভেতর হাত চালিয়ে পিঠের দাগটা ছুঁতে-ছুঁতে মেঘেন বারান্দার সামনে রোদ্দুরেই দাঁড়িয়ে যায়। চৈত্রের আকাশ এই এলাকায় এত নীল কখনও সে দেখেনি। ঈশানকোণে কয়েকটা পাখি বিন্দুর মতো নড়ছে। শকুন নাকি? মেঘেনের চোখ নিস্পলক হয়ে ওঠে।
মন্দিরা সকালের স্নান সেরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কী ভাবছে সে হয়তো নিজেও জানে না। খুব পবিত্রতা দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে, এমনি শান্ত অবস্থিতি। মেঘেনের মনে মন্দিরা, চোখে দূরের কয়েকটা সাংঘাতিক বিন্দু অবশেষে সে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
–রোদ্দুরে কী করছ? চলে এস।
মন্দিরার গলাটাও এখন পবিত্র, স্নেহে ভিজে, শান্ত। মেঘেনের ভাল লাগে ডাকটা। অনেকদিন এমন করে সে যেন ডাকেইনি।
একটু পরে মেঘেন বারান্দায় বসে যখন চা খাচ্ছে, ফাদার খ্রিস্টমাস চেহারার বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক এলেন। বয়স মেঘেনের বাবার সমান মনে হয়। কিন্তু টাক পড়েছে মাথায়। খাড়া নাক, চাপ চাপ সাদা দাড়ি, বড় বড় কান, চওড়া কপালে তিনটে ভঁজ! মেঘেন ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
কোয়ার্টারের পিছনদিক এটা। বেড়ায় ঘেরা একটুকরো সবজিক্ষেত বা বাগিচার জন্য জমি আছে। এদিকে কারও আসার কথা নয়।
-নমস্কার। আপনি কি মেঘেনবাবু?
মেঘেন পাল্টা নমস্কার করে বাঁ হাতে, কারণ ডানহাতে চায়ের পেয়ালা।
–আমি মোহনপুর জংশন থেকে আসছি।
বলুন?
বৃদ্ধ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হাসেন।বসব। না বসে তো বলা যায় না।
মেঘেন হন্তদন্ত হয়ে ওঠে। আসুন, আসুন! খালি মোড়াটার দিকে আঙুল বাড়ায় সে। বেড়ার গেট দিয়ে লোকটা ঢোকে। মোড়ায় বসে পড়ে। হাসিমুখে তাকিয়ে বলে–কাল ইভনিং-এ কখন থেকে কখন অব্দি ডিউটি ছিল আপনার?
-কেন বলুন তো? বিকেল পাঁচ থেকে রাত বারোটা।
বরমডিহি তো খুব বড় স্টেশন নয়।
নয়। কেন বলুন তো?
–আপনার দেশ কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গ। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। কেন ব…..
এখানে ছমাস এসেছেন?
–হ্যাঁ কিন্তু কেন……..
এর আগে মোহনপুরে ছিলেন?
–ছিলুম। কে…….
–মোহনপুরের ডিভিসনাল সুপারিন্টেন্টে রথীনবাবুও তো বহরমপুরের লোক?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু…..
রথীনবাবুর মেয়ে তিথিকে তো চেনেন?
–চিনি। কী ব্যা…….
–গতকাল সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশের ডাউন ঠিক ক’টায় ইন্ করেছিল মেঘেনবাবু?
-সাতটা সাঁইত্রিশে। আগের স্টেশনে মেল পাস ক…
–তিথি নেমেছিল স্টেশনে?
এ্যাঁ? তি… … …।
দরজায় মন্দিরা এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমে চোখ দুটো বড় ছিল। তারপর ছোট হয়েছে, ভুরু কুঁচকে গেছে, ঠোঁটের নিচে ভাজ ফুটেছে–যা তাকে সুন্দর করে। সে মুখ খোলে।
আপনি কে?
বৃদ্ধ অমনি নমস্কার করেন তাকে। আপনি মিসেস মন্দিরা বোস?
–হ্যাঁ! আপনি কে?
–আপনি ভাগলপুরের মেয়ে?
–সবই তো জানেন দেখছি? আমার বলা কেন? কে আপনি শুনি?
–গত মাসের এগারো তারিখে আপনি নারায়ণগড় মন্দিরে যাচ্ছি বলে মোহনপুরে গিয়েছিলেন?
মন্দিরা লাল মুখে প্রায় গর্জায়। হ্যাঁ, গিছলুম। কিন্তু তাতে আপনার এত মাথাব্যথার কী আছে? আগে বলুন তো, কে আপনি–নয়তো…রাগে সে কথা হারিয়ে ফেলে।
বৃদ্ধ মিটিমিটি হাসেনা হাত তুলে বলেন–প্লীজ! প্লীজ! আচ্ছা, মন্দিরাদেবী, আপনি সেদিন তিথিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ কিংবা না বলুন, প্লীজ!
বলব না।
–প্লীজ!
না! চলে, যান আপনি! এখুনি চলে যান। নয়তো লোক ডাকব!..মন্দিরা হাঁফাতে হাঁফাতে কথা বলে। তারপর মেঘেনের দিকে ঘোরে। তুমি চুপচাপ এই অপমান হজম করছ? একটা কোথাকার কে এসে যা খুশি জিগ্যেস করবে বাড়ি চড়াও হয়ে, তার জবাব দিতে হবে? কী–ভেবেছে কী? মগের মুলুক?
মেঘেন গম্ভীর ও অপ্রস্তুত হয়ে থাকে। বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বলেন–ভীষণ রেগে গেলেন দেখছি! প্লীজ, শান্ত হোন। আচ্ছা মেঘেনবাবু!
–উ?
–আপনার স্ত্রী গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে বাসায় ছিলেন? নাকি বেরিয়েছিলেন–আপনার কী ধারণা?
–ওকে জিগ্যেস করুন!
–আপনার ধারণাটাই আমি জানতে চাই।
হয়তো….
বলুন! বলুন!
–হয়তো ছিল, হয়তো বেরিয়েছিল। জানি না।
–তিথির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনি মাঠের দিকে গিয়েছিলেন তাই না?
মন্দিরা চেঁচাল। –কোনও কথা না! চুপ করে থাকো!
–মেঘেনবাবু!
–উ? হুঁ। তিথি আমাকে জরুরি কিছু কথা আছে বলে ডেকে নিয়ে গেল।
তারপর?
–কিন্তু তেমন কিছু বলল না। শুধু…
–! বলুন!
রাতকাটানোর আশ্রয় চাইল। বলল বাড়ি থেকে চলে এসেছে! আর ফিরবে না।
–আপনি কী করলেন তখন?
–আমি বললুম– আমার বাসায় তো অসম্ভব! তবে রামু সিগন্যালম্যানের কোয়ার্টার এখন খালি আছে। তিথি আপত্তি করল। তখন আমি ওই যে দেখছেন জঙ্গলের ওপাশে লাইনের ওপর খালি একটা ওয়াগনের সঙ্গে গার্ডের কামরা রয়েছে–ওইযে!
–হ্যাঁ। দেখতে পাচ্ছি।
ওটাই সিলেক্ট করলুম। রামুকে কিছু খাবার তৈরি করে দিতে বলেছিলুম। তিথি তা খায়নি। বিছানার তেমন ব্যবস্থা হলো না। একটা মাত্র শতরঞ্জি দিল রামু। একটা বাড়তি লণ্ঠন দিল।…মেঘেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বাসায় ফিরেছিলেন ঠিক কটায়?
–একটা প্রায়।
–তখন আপনার স্ত্রী ছিলেন?
মেঘেন মন্দিরার দিকে তাকাল। মন্দিরা মুখ ঘুরিয়ে মাঠ দেখছে। নাকের ফুটো কাঁপছে। চোখ দুটো লাল। চাপা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছে।
মেঘেন বলেনা। তারপরই মাথাটা কয়েকবার দোলায়।
আপনার নিশ্চয়ই বাকি রাত ঘুম হয়নি?
হয়নি। জেগেই ছিলুম। কারণ রাত তিনটে চল্লিশের ডাউনে…
–থামবেন না, প্লীজ।
রাত ৩-৪০-এর ডাউনে কলকাতা যাবার কথা ছিল! তিথির সঙ্গে।
মন্দিরা চকিতে মেঘেনকে দেখে নিয়ে আবার মাঠের দিকে ঘুরল। বিশাল ঢেউ খেলানো মাঠ–শস্যহীন, বেশির ভাগই অনুর্বর রুক্ষ মাটি, দুরে টিলার সার এবং খড়কুটো উড়িয়ে ছোটখাট ঘূর্ণি হাওয়া চলেছে কোনাকুনি। কাছাকাছি ফণিমনসার ঝোপের গায়ে একটা সাপের খোলস উড়ছে, এক ফালি পতাকা যেন।
–কিন্তু শেষঅব্দি যাওয়া হলো না?
না। হলো না। মন্দিরা–আমার স্ত্রী আমাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছিল।
একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরা সাঁৎ করে ভেতরে চলে গেল। তারপর কয়েকটা সেকেণ্ড বারান্দায় স্তব্ধতা। পাখির ডাকও স্তব্ধতা বলে ভুল হয়। তারপর মাঠ থেকে ঘূর্ণি নিয়ে একটা বাতাস এসে বারান্দায় উঠল। দরজার পর্দা দুলিয়ে ঢুকে গেল ঘরে।
কখন উঠলেন মেঘেনবাবু?
–সাতটার কাছাকাছি।
–সেই গার্ডের কামরায় গেলেন না?
না।
–কোথাও গেলেন না?
গেলুম। ওই শালবনটায়। রোজ ভোরে ওখানে বেড়ানো অভ্যাস আছে। এক মিনিট স্তব্ধতা। তারপর…–তিথি কোথায় মেঘেনবাবু?
জানি না। মেঘেন মাথা দোলায়।
–গার্ডের কামরার মেঝেতে রক্ত পাওয়া গেছে মেঘেনবাবু।
মেঘেন সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে ওঠেনা না না! তিথি… না না!
–প্লীজ, আস্তে।
–গেট আউট! গেট আউট! চলে যান আপনি বেরিয়ে যান!….মেঘেন হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়ায়! গলা আরও চড়িয়ে চেঁচায়–গেট আউট!
-আমার আরও প্রশ্ন আছে মেঘেনবাবু!
শাট আপ। আপনাকে আমি খুন করে ফেলব। গেট আউট ইউ ওল্ড ফুল!
বৃদ্ধ হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ান। তারপর অমায়িকভাবে নমস্কার করে চলে যান।
তিনি বাঁদিকে স্টেশনের রাস্তায় ওঠেন। থমকে দাঁড়ান হঠাৎ। তারপর ফিরে আসেন বাঁজা জমিটার ওপর এবং মেঘেনের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে পশ্চিমের সেই শালবনে এগিয়ে যান।
বনের ভেতরে ঢুকে ছায়ায় সেই বৃদ্ধ দু’পকেটে হাত ভরে দাঁড়িয়ে আছেন। কুকুরটা তেমনি চুপচাপ শুয়ে আছে একই জায়গায়। মেঘেন তাকিয়ে দেখে। মাথার ভিতরটা খালি, দৃষ্টিতে ক্রমশ একটা নীল চওড়া কিছু এসে আটকে থাকে। একটু পরে তিনি নেমে আসেন। তারপর বাঁদিকে ঘুরে স্টেশনে চলে যান। মেঘেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
.
পরদিন মেঘেন স্টেশনে সকালের ডিউটিতে আছে, সেই বৃদ্ধ এলেন। স্টেশনের ভেতরে আর কেউ নেই। পশ্চিমের জানলার বাইরে কুয়োয় পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা জল তুলছে, কাপড় কাঁচছে, স্নান করছে। তার ওপাশে বেড়া, বেড়ার ওধারে কয়লার স্তূপ, দুটো কাক বসে আছে।
নমস্কার মেঘেনবাবু!
–আবার কী চান?
—অনেক কিছু।
কিছু বলার নেই আর।
–আছে। এক মিনিট। ..বলে তিনি পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে পাতা ওল্টান। তারপর একটা খালি চেয়ারে বসে পড়েন। মেঘেন টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
–মেঘেনবাবু, আপনি-সরি, আপনার সঙ্গে তিথি যতক্ষণ ছিল, এমন কোনও কথা বলেছিল কি যাতে আপনার স্ত্রীর উল্লেখ ছিল?
মেঘেন তেতো মুখে বলে খুবই থাকা উচিত।
–আমি পজিটিভ উত্তর চাই, মেঘেনবাবু।
–তাহলে ছিল।
–তিথি কি মন্দিরাদেবীর দ্বারা কোনও বিপদের আশঙ্কা করেছিল?
–তাই স্বাভাবিক।
–ঠিক কী ধরনের আশঙ্কা?
–আমি অন্তর্যামী নই।
–আপনি তিথিকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কী কিছু স্পষ্ট নির্দেশ ছিল?
তার মানে?
তার মানে-ধরুন, আপনি গিয়ে গার্ডের কামরার দরজায় নক করবেন, অথবা ডাকবেন–এমন কিছু?
–ডাকা নিরাপদ মনে করিনি! তিনবার নক করার কথা ছিল।
–দেখুন তিথির লাশ আমরা পেয়েছি।
–পেয়েছেন? মেঘেন প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।
–হাওড়া এক্সপ্রেসের কামরায়। কিন্তু মাথাটা পাইনি।
–আমি লুকিয়ে রাখিনি। না, না!
বলছি না। মেঘেনবাবু, আপনার স্ত্রী তিথিকে খুন করেছে বলে মনে করেন?
–আমি কিছুই মনে করি না।
–কিন্তু আপনি সিওর যে আপনি নিজে তিথিকে খুন করেননি। কেমন?
না। সিওর নই। মেঘেন দৃঢ়কণ্ঠস্বরে জবাব দেয়!
–সিওর নন?
না।
বৃদ্ধ হাসেন। কয়েক সেকেণ্ড পরে বলেনতিথির পেটে বাচ্চা ছিল।
মেঘেন তাকায়। ঠোঁটে ফাঁক করে কিছু বলার জন্যে কিন্তু বলে না।
–ফোরেনসিক এক্সপার্টদের মতে তিথির মৃত্যু হয়েছে সে রাতে ঠিক বারোটা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে কোনও একসময়ে। আর…আর তার দেহে সেক্সয়াল ইন্টারকোর্সের লক্ষণ স্পষ্ট পাওয়া গেছে। সেও ওইসময়ের মধ্যে ঘটেছে। মনে হয়, তিথি বাধা দিয়েছিল–পারেনি। এইতে সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যে কোনও পুরুষমানুষই খুনী। কিন্তু রেপ–হ্যাঁ, রেপই বলছি আপাতত-রেপ এবং খুন দুটো আলাদা ঘটনা হওয়া সম্ভব, অর্থাৎ যে খুন করেছে–সেই রেপ করেছে–এটা ঠিক হতেও পারে।
মেঘেন আবার ঠোঁট ফাঁক করে। কিন্তু কিছু বলে না।
গতকাল অন্তত দুপুরের মধ্যে এসব জানা গেলে আপনাকে আমরা নিয়ে যেতুম এবং মেডিক্যাল একজামিন করা হতো। কিন্তু টু লেট!
–আমি তিথির সঙ্গে শুইনি। সে প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমরা চলে যেতে চেয়েছিলুম। তারও কারণ তিথি রথীনবাবুর নির্বাচিত বিগ অফিসারকে ফেলে সামান্য একজন এ. এস. এমের ঘর করবে–যার একটি বিবাহিতা স্ত্রীও রয়েছে, এটা রথীনবাবু বরদাস্ত করতেন না। আর মন্দিরা……
বলুন। মন্দিরা….
–মন্দিরাও তা বরদাস্ত করত না। তাছাড়া আইনও সইত না।
–তাই নিরুদ্দিষ্ট হতে চেয়েছিলেন দুজনে?
হুঁ।
–মেঘেনবাবু, আমাদের ধারণা, তিথির মুণ্ডুটা সম্ভবত বাক্সে ধরাতে পারেনি খুনী। তিথির মাথায় নাকি প্রচুর চুল ছিল। ওঁর মা বলছিলেন-বংশের ধারা।
-হ্যাঁ। খুব ঘন আর সুন্দর চুল ছিল ওর। ওতেই ওকে সুন্দর লাগত। নয়তো স্বাস্থ্য বা দেহের দিক থেকে মন্দিরার চেয়ে অনেক কুৎসিত ছিল তিথি।
–আপনি স্বাভাবিক হয়েছেন দেখে খুশি হলুম।
–তিথির আর এক সৌন্দর্য ছিল ওর অস্ফুট কণ্ঠস্বর। অর্ধেক বলা অর্ধেক না বলা কথা ওকে রহস্যময়ী করে রাখত। ওর শরীরে শরীর রাখলে ও ছটফট করতবারবার না না না বলত, কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত না, বারবার বলত– এ তুমি কী করছকী করছ তুমি–কেন এমন করছ….
–মেঘেনবাবু, আবার ধন্যবাদ যে আপনি এখন এত স্বাভাবিক।
হঠাৎ মেঘেন পকেটে হাত ভরে একটা মোড়ক বের করে। ব্যগ্রস্বরে বলে– খুলে দেখুন। এর মধ্যে তিথির কয়েক গোছা চুল আছে।
সে ব্যস্ত হয়ে মোড়ক খোলে। বৃদ্ধ শান্ত মুখে বলেন আই সি! কোথায় এ চুল পেলেন মেঘেনবাবু?
কাল ভোরে ওই শালবনের তলায়। শুকনো ঘাসে। তারপর….
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।
–আমি একখানে মাটির চাবড়া দেখলুম। কী খেয়াল হলো, সরালুম–দেখি তিথির মাথা! মাথাটা তুলে নিয়ে একদৌড়ে জঙ্গলে ঢুকলুম। ওদিকে একটা জলনিকাশী ন্যাচারাল ড্রেন আছে–রেল ব্রিজ আছে না? তার ষাট-সত্তর মিটার পুব-দক্ষিণে শুকনো বালির তলায় পুঁতে ছিলুম। তারপর ফিরে এসে শালবনের সেই গর্তটা বুজিয়ে দিলুম। কাঠকুটো কুড়িয়ে ছড়ালুম। খুব স্বাভাবিক দেখাল জায়গাটা।
বলে যান, প্লীজ।
কাল বিকেলে গিয়ে দেখি, তিথির মাথাটা জন্তুজানোয়ারে তুলে কোথায় নিয়ে গেছে। কিছু চিহ্ন পড়ে ছিল। আবার বালিতে ঢেলে দিলুম।
–কেন এমন করলেন?
মন্দিরার স্বার্থে।
–তাহলে মন্দিরাদেবীই খুন করেছেন–আপনার মতে?
কী? ও-হ্যাঁ। তাই মনে হয়।
–আপনার স্টেটমেন্ট অনুসারে মন্দিরাদেবীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে।
–ও! তাই বুঝি? কিন্তু…..আপনি কে? কে আপনি?
–মেঘেনবাবু, মন্দিরাদেবীকে এইমাত্র বিরক্ত করে এসেছি। তিনি অনেক কিছু বলেছেন।
-অ্যাঁ?
হ্যাঁ। উনি সব জানতে পেরেছিলেন। আপনাদের ফলো করে সেই গার্ডের কামরায় গিয়েছিলেন। রাত বারোটার পর আপনি কোয়ার্টারে আসার একটু আগেও উনি ওখানে লুকিয়ে ছিলেন। আপনি চলে এলে কিছুক্ষণ পরে উনি তিথির দরজায় তিনবার নক করেন। দরজা খোলে তিথি। পরস্পর তীব্র বচসা হয়। কিন্তু মন্দিরার কথামতো–সেটা কান্নায় শেষ হয়। শেষে নাকি মন্দিরা আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে চলে আসেন। আসার পথে রামুর সঙ্গে ওঁর দেখা হয়। রামু ওখানে নাকি পায়খানায় গিয়েছিল। রামুকে ডাকুন না, প্লীজ।
রামু কাল বিকেলে ছুটি নিয়ে জংশনে গেছে। এখনও ফেরেনি। অথচ গতরাতেই ফেরার কথা ছিল। মোহনপুর বলছে, রামুকে কেউ দেখেনি সেখানে।
রামুর কথা আপাতত তাহলে থাক। আপনি নিজের কথা বলুন।
সবই তো বললুম—
–একটা ভাইটাল কথা এখনও বলেননি।
কী?
-রাত এগারোটা পাঁচের ডাউনে মোহনপুর জংশন থেকে একজন নামেন সে রাতে। তার কথা এড়িয়ে গেছেন।
অ্যাঁ! হ্যাঁ–তিথির বাবা নেমেছিলেন।
–আপনি তখন…..
–আমি তখন তিথির শতরঞ্জি বিছানা হাতে রামুর কোয়ার্টার থেকে বেরচ্ছি সবে–পিছনে তিথি আছে, প্ল্যাটফর্মে দেখতে পেলুম রথীনবাবুকে; তক্ষুনি আমরা চলে গেলুম মাঠের দিকে। ফিরে আসার পর রথীনবাবুকে আর দেখতে পাইনি।
–মিথ্যা বলছেন মেঘেনবাবু! গিরিধারী খালাসি আপনাকে ও রথীনবাবুকে কথা বলতে দেখেছিল।
–ও, হ্যাঁ। মনে পড়ছে।
-রাত একটায় রথীনবাবু আপ-সিগনালের দিকে যান। হাতে টর্চ ছিল! গিরিধারী যেতে চেয়েছিল সঙ্গে। ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর গিরিধারী দেখেছে, রামু হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসে তার কোয়ার্টারে ঢুকল। তার আগে গিরিধারী মেয়েলি গলায় একটা চিৎকার শুনেছিল দূরে।
রামু কি…..
আমার সিদ্ধান্ত, রামুই রেপ করে তিথিকে।
–স্কাউড্রেল!
-চুপ! আস্তে। গিরিধারী তার একঘণ্টা পরে রথীনবাবুকে ফিরতে দেখে। রথীনবাবু তাকে একটা জিনিস আনতে বলেন।
-ওঃ! একটা বাক্স।
–গিরিধারী সব কবুল করেছে, মেঘেনবাবু।
–কে খুন করেছে তিথিকে?
–ওর বাবা।
–ওঃ তিথি!
–আমার কাজ আপাতত শেষ! শুধু ভয় হচ্ছে, হয়তো রামুকেও…।
–ঠিক এসময় দুজন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত ঢোকেনকর্নেল! লাশটা পাওয়া গেছে। ওই মাঠের নালায় পোঁতা ছিল। স্ট্যাবড বডি। ধস্তাধস্তি হয়েছিল সম্ভবত।
মেঘেন ভারি গলায় বলে রামুর লাশ!
দাড়িওলা বৃদ্ধ একটু হাসেন।-হ্যাঁ, রামুর। রথীনবাবু মেয়েকে খুন করলেন। আর আপনি–মেঘেনবাবু, আপনি করলেন রামুকে। মিঃ ভদ্র, হেয়ার ইজ দা সেকেণ্ড মার্ডারার।
মেঘেনের সামনে পুলিশ অফিসার এসে দাঁড়ায়।