দুই নারী
সব লেখকই পাঠকপাঠিকাদের চিঠি পান। কোনও লেখা ভাল লাগলে লেখককে তা না জানাতে পারলে স্বস্তি পান না অনেকে। তবে অনেক চিঠিতে কড়া সমালোচনাও থাকে। কেউ কেউ নিখাদ গালিগালাজও খামে পুরে পাঠিয়ে দেন। এ ধরনের চিঠি আমি অনেক পেয়েছি। আবার কোনও কোনও পাঠিকা এমন চিঠি লিখেছেন, যা বটতলার সচিত্র প্রেমপত্র থেকে নিখুঁত কপি করা। এমন কি অপটু হাতে আঁকা ফুল ও ভোমরা ইত্যাদি সমেত।
কিন্তু রাখী মিত্র নামে মফস্বলের এক পাঠিকার চিঠি পেয়ে সত্যি অভিভূত হয়েছিলুম। এই বুদ্ধিমতী পাঠিকা সরাসরি প্রেম নিবেদন করেননি বটে; কিন্তু যা লিখেছিলেন, তাতে আমার কোনও নিজ্ঞান ইচ্ছার ওপর মিষ্টি একটা ছোঁওয়া লেগেছিল এবং তার জবাবও দিয়েছিলুম পুরো চার স্লিপ!
এমনি করে রাখীর সঙ্গে আমার দূর থেকে প্রেম হয়ে যায় এবং পরস্পরকে না পেলে জীবন ব্যর্থ হবে, এই ধারণা গড়ে ওঠে। অথচ তখনও আমরা কেউ কাউকে চোখের দেখাও দেখিনি অর্থাৎ রক্তমাংসের শরীর নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াইনি। অবশ্য দুজনেই নিজের নিজের ফোটো পাঠিয়েছিলুম। বলাই বাহুল্য, একটু আগের ভরাট চেহারার ফোটোই পাঠিয়েছিলুম। রাখীও তাই করেছিল, পরে তা বুঝলুম।
ফোটোর রাখীকে দেখেই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তারপর যখন হাওড়া স্টেশনে কথামতো সে এল, তখন ঘুরে যাওয়া মাথার ঘিলু গলে গেল। ফোটোর। কথা ভুলেই গেলুম। এত আশ্চর্য সুন্দর আর সেক্সি চেহারা সচরাচর দেখা যায় না। হাল্কা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছিল সে, হাতাকাটা ব্লাউজ ছিল গায়ে, বেণী বাঁধা ঘন কালো চুল ঝুলছিল কোমর অব্দি–এবং তার উদ্ধত বুকের ওপর একটা শঙ্খের মালা ঝুলছিল। আমি মনে মনে পাগল হয়ে গেলুম। বললুম–একটা কবিতা মনে পড়ছে। জীবনানন্দ দাশের শঙ্খমালা নামে এক নারীর কথা আছে তাতে।
কথা ছিল আমরা ওখান থেকেই সোজা বাইরে এক জায়গায় চলে যায়। সেই জায়গাটা পছন্দ করেছিল রাখীই। আমার অমত করার কী আছে? চন্দনপুর অন-সীর মতোন সুন্দর সমুদ্রতীর সারা ভারতে আর একটিও নেই। হিলক শ্রেণীর পাহাড়, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, তার নিচে সমুদ্র–মাত্র একবার গিয়েছিলুম কবছর আগে। খুবই ভাল লেগেছিল।
ট্রেনে আমরা কোনও প্রেমাত্মক কথাবার্তা বললুম– না। খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করলুম। শুধু একবার আস্তে বলেছিলুম-আমাকে দেখে তোমার ইমেজ নিশ্চয় নষ্ট হয়ে গেছে, রাখী!
রাখীও আস্তে জবাব দিয়েছিল–পাগল! কী যে ভাল লাগছে!
চন্দনপুর অন-সী পৌঁছতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গিয়েছিল। সময়টা বর্ষার। ভাগ্যিস আমরা পৌঁছানোর সময় বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। ভাল হোটেল কয়েকটা। আছে ওখানে। কিন্তু রাখীর পছন্দ মিসেস জেভিয়ারের হোটেল। লোকে বলে মিসেস জেভিয়ারস্ লজ। প্রাইভেট বাড়ির মতো ব্যবস্থা। সমুদ্রের এক খাড়ির কাছে পাথুরে জমির ওপর বাড়িটা বানিয়েছিলেন ব্রিটিশ আর্মির লেফটন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড জেভিয়ার–সে ১৯৩০ সালের কথা। মিসেস আর দেশে ফিরে যাননি। একা এখানেই থেকে গেলেন। বয়স প্রায় সত্তর। কিন্তু শক্ত সমর্থ মহিলা। আমাদের দেখেই সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। কারণ, এখন অফ সিজন। খুব কম লোকই এই বর্ষায় এখানে বেড়াতে আসে। একটা ডাবল বেড ঘর খালি ছিল দোতালার পুবদক্ষিণ কোণে। পুবে সমুদ্র, দক্ষিণে কিছু ছোটো পাহাড় আর বাংলো বাড়ি। বসতি এলাকা গোটা পশ্চিম-উত্তর জুড়ে।
ঘরটা খুবই ভাল লাগল। সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা আছে। রাখীর প্রতি সপ্রশংস তাকিয়ে বললুম– নিশ্চয় তুমি এখানে কখনও এসেছিলে?
রাখী জবাব দিল–মোটেও না। এই প্রথম।
–তবে মিসেস জেভিয়ারের লজে আসতে বললে যে?
আমার বিস্ময় কাটিয়ে দিল রাখী। বলল–আমার এক আত্মীয় এখানে আসেন। তাঁর কাছেই শুনেছিলুম।
ইচ্ছে ছিল, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সব কিছুর আগে ওকে বুকে চেপে ধরব। ওকে দুহাতে তুলে নিয়ে তুমুল চিৎকার করে বলব-রাখী, তুমি আমার! কিন্তু কে জানে কেন, সেসব কিছু করলুম না। খুব শান্ত ও ভদ্র হয়ে গেলুম। সেও যেন বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। সোজা বাথরুমে চলে গেল আগে।
মিসেসের লোক এসে সব দেখিয়ে শুনিয়ে চলে গিয়েছিল। একটু পরে উনি নিজে এলেন। বিরক্ত করার জন্য বারবার ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন–কোনও অসুবিধে হলে যেন তক্ষুনি জানাই। এ বাড়িতে যাঁরাই আসেন, তারাই ওর কাছে পুত্রকন্যাবৎ। নো কোয়েশ্চেন অফ মানি। প্রবাসের আনন্দটুকু, পুরোপুরি সবাই যাতে উপভোগ করতে পারে, সেটা দেখা ওঁর কর্তব্য।
রাখী কিন্তু খুব ভাব জমাবার চেষ্টা করল। যত শীগগির উনি চলে যান, তাই ভাল কারণ, আমি একা হতে চাই রাখীর কাছে। অথচ রাখী এটা ওটা নানা প্রশ্ন করল। অবশেষে আন্টি পাতিয়ে বসল। মিসেস জেভিয়ারও দেখলুম রাখীকে পছন্দ করেছেন। এমন কি, যাবার সময় ওর গালে সস্নেহ চুমুও দিয়ে বসলেন।
চলে গেলে দরজা বন্ধ করে রাখী বলল–কেমন ম্যানেজ করলুম দেখলে? বুড়িটা অবশ্য খুব ভাল মানুষ। দেখবে, একটুও অসুবিধে ঘটতে দেবেন না।
রাখী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মাঝে মাঝে পাশের খোলা জানলায় উঁকি দিয়ে সমুদ্র দেখছিল। দেখা যায় না–সব অন্ধকার। শুধু নিচের দিকে অবিশ্রান্ত গর্জন শোনা যায়। বর্ষার সমুদ্র এমনিতেই উত্তাল থাকে। তাতে এ বাড়ির নিচে খাড়ি আছে। পাথরের ওপর ঠেউ এসে দারুণ গর্জনে ভেঙে যাচ্ছে। মিসেস বলছিলেন–ঝোড়ো হাওয়া বইলে জানলা খোলা যেন না থাকে। লোনা জল এত উঁচুতে ছিটকে এসে ঘর ভিজিয়ে দেবে।
আমি বিছানার দিকে তাকিয়ে একটা কিছু ভাবছিলুম। পাশাপাশি দুট নিচু খাট আছে। ডানলোপিলো গদি আছে। মধ্যে একহাত ব্যবধান ওই ব্যবধান রেখেই কি শুতে হবে?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মুখের সেই লোভ, অসহায়তা ও কাকুতির দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করল রাখী–প্রতিবিম্বে। সে ঘুরে একটু হেসে বলল–যে মেয়ে সোজা এভাবে চলে আসতে পেরেছে সে তোমার কোনও সমস্যাই সৃষ্টি করবে না। সাহিত্যিক হয়ে এটুকুও তুমি বুঝতে পারছ না গৌতম?
অপ্রস্তুত হয়ে বললুম–কী বলছ! যাঃ!
রাখী তার খোলাচুলের ঝাপি নিয়ে আমার পাশে এসে বসে পড়ল হঠাৎ! তারপর আমার চিবুক ধরে সোজা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল বলো তো, আমাকে তুমি বাজারের মেয়ের মতো ভেবেছ কি না?
আবেগ সংযত করে বললুম–তুমি এসব কেন ভাবছ রাখী? বাজারের মেয়ে আমি জানি না। জানলেও তোমাকে তা ভাবব কেন? আমি তো তোমাকে দেখে তোমার প্রেমে পড়িনি! সে প্রশ্নও ওঠে না।…
রাখী আমার মুখে হাত চাপা দিল। ওর চিরোল সাদা আঙুলগুলো আমার ঠোঁটের খিদে জাগিয় তুলল। কিন্তু এখনই হুট করে কিছু করে বসলে রাখীর মনে আমার সাহিত্যিক ইমেজে আঘাত লাগতে পারে। তাই সংযমী হলুম।
রাখী বলল–চলো না গো, ওই ব্যালকনিতে গিয়ে বসে সমুদ্র দেখি!
এই ডাকে সহজ সম্পর্কের তীব্র মাধুর্য ছিল। তখুনি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম আমরা। তারপর রাখী কেমন চুপ করে গেল। তার মৌন নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না। অথচ আমার চুপচাপ থাকতে ভাল লাগছিল না। এই অসাধারণ সৌন্দর্য পাশে নিয়ে কেউ চুপ থাকতে পারে না।
একটু পরেই আবার বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ছাঁটে পুবের ব্যালকনি ভিজতে থাকল। সেইসঙ্গে সমুদ্রের দিক থেকে জোর একটা বাতাস এল! তখন আমরা উঠে এসে দরজা বন্ধ করলুম। শুধু জানালা খোলা রইল। সমুদ্রের গর্জন বেড়ে গেল। অস্বস্তি জাগছিল যদি সমুদ্রের ঝাপটায় নিচের পাথর ধসে যায়। এই বাড়িটাও তো তখুনি সমুদ্রের তলায় চলে যাবে।
সেই সময় রাখী বলে উঠল–ভীষণ খিদে পেয়েছে। তোমার পায়নি?
নিশ্চয় পেয়েছে। কিন্তু ওদের যে খাবার এখানে আনতে বলা হয়নি।
চলো না, নিচে ডাইনিং হলে গিয়ে খেয়ে আসি।
একটু হেসে বসলুম–চেনাজানা কারো চোখে পড়লে কী বলবে বলোত? তুমিই বা কী বলবে–যদি তোমার চেনা কেউ থাকেন?
রাখী তাচ্ছিল্য করে জবাব দিল–আমি বলব, বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে এসেছি। তুমি বলতে পারবে না?
খুব পারব। ওর সাহস আমার সাহস বাড়াল। উঠে দাঁড়ালুম।
রাখী বলল–এক মিনিট। তুমি নিচে গিয়ে বসো। আমি যাচ্ছি। কাপড়টা বদলে নিতে যেটুকু সময় লাগবে!
ওর কথা মেনে নিয়ে সুড়সুড় করে নিচে চলে এলুম। ডাইনিং হলটা মোটামুটি প্রশস্ত। মৃদু আলো জ্বলছে সেখানে। বেশ রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ্য করলুম কোণার দিকে একজন বুড়ো কাপ্তেন গোছের ভদ্রলোক একা বসে রয়েছেন। মাথায় টাক, মুখে সাদা গোঁফ আর দাড়ি, কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। ওঁর কোলে একটা বর্ষাতি রয়েছে। মনে হলো, এইমাত্র বাইরে থেকে এসেছেন। ভদ্রলোকের উদ্দেশে কাউন্টার থেকে মিসেস জেভিয়ার চাপা গলায় কিছু বললেন। উনি অমায়িক হেসে মাথা নেড়ে পাল্টা কিছু বললেন। কথাগুলো শোনা গেল না।
অন্যদিকের কোণে এক দম্পতি বসে রয়েছেন। অবাঙালী মনে হলো। চল্লিশ বেয়াল্লিশ বয়স পুরুষটির, মহিলাটির পঁয়ত্রিশ-সাঁইত্রিশের কম নয়। আলো কম থাকলেও এটা আঁচ করা গেল। আমার ডাইনে দুটো টেবিল পরে বসে আছে একটি মেয়ে। হাল্কা ছিপছিপে গড়ন। ডিমালো মুখ। বেণীবাঁধা চুল। পরনে ফিকে নীল রঙের শাড়ি আর গায়ে সাদা লম্বাহাতা ব্লাউস। স্কুলমিসট্রেসের আদল যেন।
টেবিলে একটা কালো ব্যাগ রয়েছে। আমি নেমে আসার সময় মুখটা একবার। ঘুরিয়েছিল মেয়েটি, কেমন চোখে তাকিয়েছিল যেন। যতক্ষণ আমি এই টেবিলে না এলুম, সে তাকিয়েই ছিল। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিলো, তারপর আর তাকায়নি। কেন যেন মনে হলো, তার দুই চোখে ঘৃণা বা ব্যঙ্গ ছিল।
কিন্তু ও যে বাঙালী মেয়ে, তা চিনতে আমার অসুবিধে হয়নি। শুধু ভাবছিলুম, আজকাল বাঙালী যুবতীরাও একা এতদূর সমুদ্রতীরে বেড়াতে আসার সাহস রাখে! ওকে সাহসী মেয়ে বলেই মনে হলো। চেহারা খুব সুশ্রী বলব না। কিন্তু মুখে ব্যক্তিত্ব কিংবা এমন একটা কিছু আছে–যা ওকে আর পাঁচজন থেকে আলাদা করে দেখাতে বাধ্য। কিন্তু একটু পরে হঠাৎ মনে হলো ওকে কোথায় যেন দেখেছি।
আমার ডাইনের দিকের একটা টেবিল বাদে বসেছেন একজন রুক্ষ কঠোর চেহারার ভদ্রলোক–একা। গোঁফ আর বড়বড় চুল আছে মাথায়। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। হাতে একটা বালা রয়েছে। খাড়া নাক, চোখদুটো কেমন হিংস্র যেন। এইসব চেহারায় হানাদারের আদল থাকে এবং অকারণে অস্বস্তি জাগায়।
বসে থাকতে থাকতে উনি হঠাৎ উঠে গেলেনে। সিঁড়িতে ওঁর পা দুটো মিলিয়ে গেল। মিসেস জেভিয়ার ওঁকে কী যেন বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, কিন্তু বললেন না। ঘরে প্রায় স্তব্ধতা। শুধু অবাঙালী দম্পতি চাপা গলায় কথা বলছেন। বাইরে চাপা বৃষ্টি ও সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে। ওপরে সম্ভবত কেউ ঘরের জানালায় হুক লাগায়নি–মাঝে মাঝে জানালার কপাটই হয়তো শব্দ করছে। ঘড়ি দেখলুম, আটটা বারো। এখনও ডিনার সার্ভ করছেন না কেন মিসেস জেভিয়ার? কিচেনের কাউন্টারের পাশে তিনজন উর্দিপরা বয় পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ আমার কেমন অস্বস্তি জাগল। ওই বেয়াড়া রুক্ষ চেহারার লোকটা ওপরে গেল। ওপরে রাখী একা আছে।
কিন্তু রাখীই বা এত দেরি করছে কেন? সিঁড়ির দিকে বারবার ঘুরে তার আশা করতে থাকলুম। এসময় মিসেস জেভিয়ার কাউন্টার থেকে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। এসে সস্নেহে চাপা স্বরে বললেন মাফ করবেন। আর আট মিনিট পরে ডিনার সার্ভ করা হবে, মাই ডিয়ার ইয়াং ম্যান। একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে কিচেনে। তাই ইলেকট্রিক চুলোয় সব রান্না হচ্ছে। একটা হিটার জ্বলে গিয়ে এই সামান্য দেরি। খুব কষ্ট হচ্ছে না তো?
শশব্যস্ত বললুম–না, না!
মিসেস জেভিয়ার বললেন–যা অবস্থা হচ্ছে দিনে দিনে বলার নয়। জিনিসপত্র আগুনের দর। মিলছে না সবকিছু। গ্যাস প্রায় মেলে না। ইলেকট্রিসিটি–তাও প্রায় লোডশেডিং হচ্ছে ঘন ঘন। তোমাদের ভাগ্য ভাল যে আজ প্রায় সারাটা দিনই ভাল। গেছে। এখন অব্দিও ভাল যাচ্ছে। পরে কী হয় বলা যায় না। তোমাদের টেবিলের ওপর মোম রাখা আছে। আশা করি লক্ষ্য করেছ?
দেখিনি–তবু মাথা দোলালুম। ভদ্রমহিলার আচরণ মায়ের মতো। সহজে হৃদয় গলে যায়।
আরও কিছু কথা বলে উনি চলে গেলেন। তখন লক্ষ্য করলুম, সেই একলা বাঙালী মেয়েটি নেই। কখন হয়তো ওপরে উঠে গেছে।
কিন্তু আট মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট হলো, তখনও ডিনার এল না, রাখীও না, অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। মিসেস জেভিয়ার কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করলেন আবার–কিন্তু বললেন না। আমি সিঁড়িতে কয়েক ধাপ সবে উঠেছি, হঠাৎ রাখীর চিৎকার শুনলুম যেন চিৎকারটা হঠাৎ বেখাপ্পাভাবে থেমে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর কার সঙ্গে ধাক্কা লাগল আমার। উঠেই চেঁচিয়ে ডাকলুম রাখী! রাখী!
মাত্র কয়েকটি সেকেণ্ডের মধ্যে এসব ঘটল। আমার সঙ্গে যার ধাক্কা লেগেছিল, সে যেন নীচে নেমে গেল। নীচে মিসেস জেভিয়ারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনলুম হীরা সিং! মোম জ্বালাও। জলদি মোম জ্বালাও।
ওপরের করিডোরে ঘন অন্ধকার। আবার ডাকলুম রাখী! রাখী! আমার গলা শুকিয়ে গেছে–অজানা ভয়ে প্রচণ্ড কাঁপছি। দেশলাই আছে, তাও ভুলে বসেছি। কেবল বেমক্কা ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকছি রাখীকে। নিজেদের ঘরও চিনতে পারছিনে।
সেইসময় করিডরের শেষদিকে দরজা খুলে কে বেরোল। তার হাতে টর্চ জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দেখলুম, আমার ঘরের দরজার সামনে রাখী অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। লাফিয়ে গিয়ে রাখীর মাথাটা তুলে বোকার মতো চেঁচালুম-ডাক্তার! ডাক্তার!
টর্চের আলোটা কাছে এসে গেল। কে বলে উঠল–ও কী! হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি? কী ব্যাপার?
মনে হলো, সেই রুক্ষ চেহারার ফো লোকটিই। রুদ্ধশ্বাসে বললুম–প্লীজ একটু জল আনুন না দাদা! আমাদের রুমেই পেয়ে যাবেন।
ততক্ষণে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তুলে কারা সব উঠে আসছে। তারপর মোমের আলো হাতে বেয়ারা, মিসেস জেভিয়ার আর কারা এসে পড়লেন। ভিড় জমে গেল। রাখীকে আমি আর কে যেন ধরল। তুলে নিয়ে ঘরে ঢোকালুম। ঘরে ঢুকে দেখি, সেই ফো ভদ্রলোক দেশলাই জ্বেলে টেবিলের মোমটা ধরাচ্ছেন।
ঘরে স্বভাবত ভিড় হলো। রাখীর মুখে জল ছিটিয়ে দিতেই সে জ্ঞান ফিরে পেল। চোখ খুলে শশব্যস্তে উঠে বসতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু মিসেস জেভিয়ার… বাধা দিলেন–চুপ করে শুয়ে থাকো ডার্লিং। প্লীজ। অন্তত মিনিট দশেক। তারপর কোনও কথা।
এবার দেখলুম, টেকো মাথা দাড়িওলা বুড়ো ভদ্রলোকটিও আমাদের রুমে এসেছেন। ভুরু কুঁচকে রাখীর দিকে তাকিয়ে আছেন। মিসেস জেভিয়ার ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন–চলুন কর্নেল, আমরা একে সুস্থ হতে সময় দিই। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন–থাক বাছা, তোমাদের আর কষ্ট করে নীচে যেতে হবে না। এখানেই ডিনার খাবে। আর, দেখো–একে বেশি নাড়াচাড়া করতে দিও না। মনে হচ্ছে, হঠাৎ লোডশেডিং হওয়ায় ভয় পেয়েছিল। এ খুবই স্বাভাবিক। কর্নেল, আপনার মনে পড়ছে, সেবার এক ভদ্রমহিলা তো প্রতিরাত্রে সমুদ্রে ভূত দেখে চেঁচামেচি করতেন!
বুড়ো লোকটি তাহলে কোনও কর্নেল–তবে পোশাক ও বয়স দেখে মনে হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। উনি চাপা হাসলেন। হাসিটা খুবই ভদ্র আর অমায়িক। মুহূর্তে ভালো লেগে গেল আমার।
মিসেস জেভিয়ার ফের হেসে বললেন–ও নো নো! অফ কোর্স এটা কোনও ভূতের বাড়ি নয়। সবাই তা জানে। তোমরা মিছিমিছি ভয় পেয়ো না–আসলে অনেকের নার্ভের অসুখ থাকে-হ্যালুসিনেশা দেখে তারা।
উনি বেরোলেন প্রথমে। তারপর গুফো লোকটি গেল। তার পেছনে অবাঙালী দম্পতি। বেয়ারা পিছনে মোমের আলো হাতে এগোল।
কর্নেল ভদ্রলোক তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললুম–বসুন স্যার!
কর্নেল হাত তুলে মিঠে গলায় বললেন–ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। থাকি কলকাতায়। আর ইয়ে…
চমকে উঠে বললুম–কী কাণ্ড! আপনি কি সেই প্রখ্যাত কর্নেল সরকার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার? এই তো সেদিন খবরের কাগজে আপনার আরেক কীর্তির কথা পড়লুম! কী সর্বনাশ! রাখী, আমাদের কী সৌভাগ্য। পরিচয় করিয়ে দিই।
রাখী ক্লান্তভাবে চোখ বুজল! তখন নিজের পরিচয় দিলুম–আমি গৌতম চৌধুরী। সামান্য সাহিত্যচর্চা করে থাকি।
কর্নেল ব্যস্ত হয়ে বললেন-সামান্য কী অসামান্য আমি জানি। গৌতম চৌধুরী! মাই গুডনেস! আপনি তো আমার প্রিয় লেখক গৌতমবাবু। আপনার লেখায় প্রকৃতি থাকে অনেকটা জায়গা নিয়ে। আর আমি সত্যি বলতে কী– একজন প্রকৃতি-প্রেমিক। এই দেখুন না, এখনও গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। দিনমান টোটো করে ঘুরি। বিরলজাতের পাখি প্রজাপতি পোকামাকড় আর অর্কিড দেখার বাতিক আছে প্রচণ্ড। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব প্রীত হলুম।
রাখী চোখ খুলছে না দেখে অস্বস্তি জাগল। আস্তে বললুম– রাখী তোমার কি কষ্ট হচ্ছে এখনও?
চোখ বুজে ও জবাব দিল-হ্যাঁ।
তখন কর্নেল একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন–এখন তাহলে আসি গৌতমবাবু। পরে আলাপ করা যাবে। ওঁকে একটু সাবধানে রাখবেন। আর নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার জন্যে আমার কাছে একরকম ট্যাবলেট আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি। দুটো খাইয়ে দেবেন নির্ভয়ে। দেখবেন, সকালে ফ্রেশ হয়ে উঠেছেন আবার!
কর্নেল চলে গেলেন। এমন একজন প্রখ্যাত ধুরন্ধর গোয়েন্দার সঙ্গে আলাপ : হওয়া এখন আমার পক্ষে যতটা খুশির–ততটা অস্বস্তিরও। কারণ, রাখীর ব্যাপারে আমি নার্ভাস বোধ করছিলুম। নিশ্চয় ওই ঘুঘু ভদ্রলোক আঁচ করে নিয়েছেন ইতিমধ্যে যে এই মেয়েটিকে নিয়ে আমি বেড়াতে অর্থাৎ ফুর্তি করতেই এসেছি। আবার মনে হলো, ভদ্রলোক নিশ্চয় আধুনিক মনের মানুষ। যুগোপযোগী উদারতা। কি ওঁর থাকতে নেই? আজকাল বান্ধবী নিয়ে ছেলেদের বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে তেমন খারাপ কী থাকতে পারে?
দরজায় কেউ নক করল। অমনি রাখী চোখ খুলে উঠে বসল। ব্যস্তভাবে বললনা, না। দরজা খুলল না। আমার ভয় করছে!
বাইরে থেকে সাড় এল–খানা সাব!
তখন দরজা খুলে দিলুম। বেয়ারা ট্রেতে রাতের খাবার রেখে গেল। কোণের টুলে জলের কুঁজো আর গ্লাস দেখিয়ে দিয়েও গেল।
এবার রাখীকে প্রশ্ন করলুমকী হয়েছিল বলো তো? হঠাৎ কী দেখে ভয় পেয়েছিলে?
রাখী আমার কাছ ঘেঁষে এসে চাপা গলায় বলল–তুমি যাবার পর শাড়ি বদলে নিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, হঠাৎ দরজায় কে নক করল! বললুম– কে? সাড়া নেই। একটু ভয় পেলুম! কিন্তু ভাবলুম হয়তো তুমিই দুষ্টুমি করছ। দ্বিতীয়বার নক করার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললুম। কিন্তু করিডোর ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। অমনি ভীষণ ভয় হলো। কিছুতেই একা ওই পথটুকু পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে যাবার সাহস হলো না। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ভাবলুম–চুপচাপ বসে থাকি। দেরি দেখলে তুমি নিশ্চয় আসবে। তখন দুজনে একসঙ্গে বেরোব। কিছুক্ষণ পরে আবার দরজায় কে নক করল। এবার ভাবলুম, নিশ্চয় তুমি আমার দেরি দেখে চলে এসেছ। তবু জিজ্ঞেস করলুম-কে? যে নক করছিল, সে বলল–আমি!
কী আশ্চর্য!
হ্যাঁ! শুধু আমি বলল। মনে হলো তোমার গলা। তখন গিয়ে দরজা খুলে দিলুম। কিন্তু দরজা খুলেই আমি আবার অবাক। কেউ কোথাও নেই। আর সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভে গেল। তখন….
রাখী প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে। ফের বলল–তখন, বিশ্বাস করো–মনে হলো, কী একটা ঠাণ্ডা শরীর তামাকে চেপে ধরেছে হঠাৎ। অমনি চেঁচিয়ে উঠলুম। তারপর কী হলো কিছু মনে নেই!
ওর কথার মধ্যে সরলতা এত বেশি যে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। ভয়ে। আড়ষ্ট হলুম। তাহলে কি সত্যি ভূতপ্রেত বলতে কিছু আছে? পরক্ষণে মনে। হলো-রাখীর মনের ভুলও হতে পারে।
হাসতে হাসতে বললুম–তুমি বড্ড অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে তো! তাই বৃষ্টির রাতে সমুদ্র তীরের বাড়িতে এটা ঘটেছে। আসলে বাতাস বইছে জোরে। তাই দরজায় শব্দ হয়েছে। আর বৃষ্টির বাতাস তো বেশ ঠাণ্ডাই। আচমকা একটা ঝাপটানি এসে গায়ে লাগতেই ভেবেছ, কেউ চেপে ধরল।
রাখী বলল–তা নয়। আমি স্পষ্ট নক করতে শুনেছি। আর ওই আমি বলাটা? নিশ্চয় কেউ বদমাইশির তালে ছিল। সাহস পায়নি। পাশের ঘরে ঢুকে পড়েছিল।
তাও আশ্বস্ত হওয়া গেল, রাখীর ভয়টা ভূতের নয় তাহলে কোনও লম্পট বদমাইশের। বললুম–আমার সামনে শাড়ি বদলালে এসব হতো না!
রাখীর মুখ লজ্জায় রাঙা হলো–যাঃ! আমি তা পারি না।
ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এবার চুমু খেলুম। ও ছাড়িয়ে নিয়ে বলল–এস, খাওয়াটা সেরে নিই আগে….
.
সে রাতে যখন শুতে যাচ্ছি, তখন ঘড়িতে নটা তিরিশ। এত সকালে ঘুমানো সম্ভব নয়। তাই দাখীর সঙ্গে প্রেমিকসুলভ কথা বলছি আর সিগারেটের পর সিগারেট খাচ্ছি। এই সময় মনে হলো, বাইরে কারা সব ব্যস্তভাবে চলাফেরা করছে! তখন বৃষ্টি অনেকটা কমেছে, কিন্তু লোডশেডিং চলছে। আমাদের টেবিলে মোমের আলো জ্বলছে। বাইরের চাপা শব্দে কৌতূহলী হলুম। উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছি, রাখী বাধা দিয়ে বলল–যে যা করছে করুক। দরজা খুলল না।
সরে এসে আবার বসলুম। কিন্তু নাবাইরের চলাফেরা ও কথা বলার চাপা আওয়াজ থামল না। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে।
কয়েকমিনিট পরে রাখীর নিষেধ না মেমে দরজা খুললুম। উঁকি মারতেই দেখি, করিডরে মিসেস জেভিয়ার শশব্যস্তে ওদিকে কোথায় চলেছেন। তার সঙ্গে আলো হাতে দুজন বেয়ারা দৌড়ে চলেছে। তারপর সিঁড়ির মুখ থেকে কর্নেলের ভারি গলার আওয়াজ পেলুম–আপনি তাহলে ওকে করিডোরে দেখেছিলেন মিঃ সেন?
ঠাহর করে দেখি সেই গুফো লোকটি টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেলের সামনে। কী ব্যাপার? দরজা খুলে বেরিয়ে গেলুম ওঁদের দিকে।
আমাকে দেখে কর্নেল বললেন-এই যে গৌতমবাবু। আসুন, আসুন। আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি। ইয়ে–একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।
চমকে উঠলাম। অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল মাথার চুল। ব্যস্তভাবে বললুম– কী হয়েছে কর্নেল?
কর্নেল গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন মিস রমা রায় নামে একটি মেয়ে আজ সন্ধ্যায় এই লজে আসে। রাত আটটা দশ অব্দি মেয়েটিকে ডাইনিং হলে দেখেছি আমরা। তার রুম নাম্বার আঠারো। কিন্তু আশ্চর্য, তার পাত্তা নেই। আর…
বাধা দিয়ে বললুম–হা, হ্যাঁ। আমার ডাইনের দুটো টেবিলের ওদিকে একা বসেছিল–সেই তো! রোগা ছিপছিপে চেহারা ফিকে নীল শাড়ি?
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। সেই। তবে তার চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা হচ্ছে তিন তলায় মিসেস জেভিয়ারের ঘর থেকে একটা দামী জিনিস হারিয়েছে। যার দাম অন্তত লাখ তিনেক হবে।
–সে কী! সর্বনাশ!
-হ্যাঁ, একটা জুয়েল নেকসেল। ওপরের ঘরে মিসেস জেভিয়ার আজকাল থাকেন না। ওঁর জিনিসপত্র থাকে। উনি ভেবেছিলেন, যেহেতু অত দামী জিনিস, তাই ওঘরে আর সব অকেজো জিনিসের মধ্যে এটা রাখলে চোরডাকাতের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হবে না। সচরাচর দামী জিনিস লোকে নিজের শোবার ঘরেই রাখে। অথচ, কী আশ্চর্য ব্যাপার–চোর কীভাবে তা টের পেয়েছিল এবং সুযোগমতো হাতিয়েছে!
গুঁফো লোকটি বলল–এবং হাতিয়ে কেটেও পড়েছে।
আমি বললুম–এর সঙ্গে মিস রমা রায়ের বেপাত্তা হওয়াটা খুব অদ্ভুত লাগছে কিন্তু!
কর্নেল বললেন–ঠিকই বলেছেন গৌতমবাবু। হঠাৎ সে বেপাত্তা হলো কেন? যাক গে–এসব পুলিসের ব্যাপার। পুলিশ এসে যা হয় করুক।
বললুম–মিসেস জেভিয়ার হঠাৎ কীভাবে টের পেলেন যে ওঁর নেকলেস খোয়া গেছে?
–ভদ্রমহিলা যেমন কর্মঠ, তেমনি অভিজ্ঞ। বুদ্ধি ওঁর প্রখর। ডিনার টেবিলে রমা নেই–অথচ আপনার ঘরের দরজায় ওই কাণ্ড হলো, তবু ওকে দেখা যায়নি। তাছাড়া বোর্ডারদের সম্পর্কে খোঁজখবর তো মিসেস জেভিয়ারকে রাখতেই হয়। বেয়ারা দিয়ে খাবার পাঠালেন ঘরে। বেয়ারা ফিরে এসে জানাল–দরজা খোলা কিন্তু ঘরে কেউ নেই। এমনকি কোনও জিনিসপত্রও নেই ওর। অমনি স্বভাবত মিসেস জেভিয়ারের মনে সন্দেহ হলো। তারপর…
-কিন্তু আশ্চর্য! রমা পালাল কোন পথে?
–সেটাই বুঝতে পারছি না। যেতে হলে এই সিঁড়ি দিয়েই ওঁকে যেতে হবে।
গুঁফো লোকটি বলল–তখন আমরা সবাই এই ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত। এঁর ঘরে ঢুকে গেছি। তখন সে কেটে পড়েছে।
কর্নেল বললেন–এও একটা পয়েন্ট বটে। কিন্তু নীচে নামলে বেয়ারা আর দারোয়ানের চোখে না পড়েই পারে না। তারা বলছে, কেউ বেরিয়ে যায়নি।
দারোয়ানদের কথা ছাড়ুন স্যার! ব্যাটারা গাঁজাখোর। তখন তো লোডশেডিং –অন্ধকার। ওরা কি টের পাবে নাকি? তার ওপর বৃষ্টি। ঘরে ঢুকে বসেছিল সব।
হাতে টর্চ ছিল। হেরিকেনও জ্বেলে নিয়েছিল লোডশেডিং শুরু হতেই। অবশ্য, তাতেও রমার পালাবার সন্স থাকে। রাউট রাইট মিঃ সেন। আপনার যুক্তি অগ্রাহ্য করা কঠিন। কিন্তু..
–কোনও কিন্তুর ব্যাপার নেই। পুলিসে খবর গেছে। দেখবেন, স্টেশনেই ধরা পড়ে যাবে!
আরও একটা আলোচনার পর আমি নিজের ঘরে ফিরে এলুম। রাখী আমার প্রতীক্ষায় উত্তেজিত মুখে বসেছিল। বলল–কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
সব বললুম–! শুনে রাখী আরও ভয় পেয়ে গেল। রুদ্ধশ্বাসে বলল–আমার ইনটুইশান বলছিল কিছু সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটছে। ওগো, তুমি খাটটা সরিয়ে নিয়ে এস। আমরা পাশাপাশি শোব…
.
বেড-টি দিয়ে গেল ভোর সাড়ে ছটায়। রাখী তখনও ঘুমোচ্ছে। ওকে জাগালুম না। কর্নেল দুট ট্যাবলেট দিয়েছিলেন খেতে। তাই অত ঘুম। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম।আমার চোখ জ্বালা করছিল। একটুও ঘুম হয়নি। রাখী জেগে থাকলে নিশ্চয়ই ওর শরীরের সঙ্গে কিছু একটা শারীরিক ব্যাপার ঘটে যেত কিন্তু বিবেক আর শালীনতা অথবা চিরকালের ভীরুতা আমাকে সংযত রেখেছিল। রাখীকে মনে হচ্ছিল, ঝড়ে ক্লান্ত এক ছোট্ট সুন্দর পাখি। সে আকাতরে ঘুমোচ্ছে যখন–ঘুমোক। ওকে বিরক্ত করব না। বিরক্ত করিনি। বরং সাবধানে দূরত্ব নিয়ে শুয়েছিলুম–যাতে আমার মনের অন্ধ কামনা বাসনা ওই অবস্থাতেই হঠকারী কোনও ঘটনা না। ঘটিয়ে ফেলে।
আকাশ আজ পরিষ্কার। সূর্যোদয় দেখলুম। রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়াতেই নিচে বাঁদিকে চোখ পড়ল। চমকে উঠলুম। দেখি, খাকি উর্দি পরা পুলিসদল, আর কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন একটা পাথরের ওপর। পিছনে আরও একটা ভিড় রয়েছে। এবং কজন জেলে ধরনের আধন্যাংটা লোক জাল দিয়ে নীচে থেকে কী যেন টেনে ওপরে তোলার চেষ্টা করছে।
তক্ষুনি ভেতরে এসে দরজা আস্তে খুলে বেরিয়ে গেলুম।
ডাইনিং হলে দুজন কনস্টেবল বসে রয়েছে। মিসেস জেভিয়ারকে দেখতে পেলুম না।
বাইরে রাস্তায় গিয়ে একজনকে পেলুম। তাকে জিগ্যেস করলুম–ওদিকে পুলিশ কেন অত?
লোকটা নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল–যাকে দেখিয়ে না। কুছ অ্যাকসিডেন হুয়া জুরুর। যাইয়ে–দেখিয়ে! কই বড়া মছলি পাকড়া, মালুম।
বাড়ির উত্তর ঘুরে পাথুরে সরু পথ ধরে কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল, জালটা টেনে ওপরে ভোলা হয়েছে। ভিড় ঘিরে ধরেছে।
কাছে গিয়ে আমার চোখ দুট নিষ্পলক হয়ে উঠল। জালে যা তুলেছে, তা একটি বডি। এবং ডেডবডিলাশ!!
সেই লাশটার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট চিৎকার করে উঠলুম–কে ও?
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন রমা রায়। দ্য পুওর গার্ল!
রমা! সেই মেয়েটি! কীভাবে সমুদ্রে পড়ল?
কর্নেল জবাব দিলেন–ওর ঘরের ব্যালকনি থেকে।
–অ্যাকসিডেন্ট?
–কে জানে! কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিতেও পারে।
আঁতকে উঠলুম। ফিকে নীল শাড়িটা জড়িয়ে আছে গায়ে-রমার মুখে আতঙ্কের চিহ্ন নোনা জলেও মুছে যায়নি। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে পালিয়ে এলুম।…
সিঁড়িতে ওঠার সময় অন্যমনস্ক হয়ে ছিলুম। শেষ ধাপে উঠলে আমাদের ঘরটা ডাইনে সামনে পড়ে এবং কোনও বাধা না থাকায় দরজাটা স্পষ্ট দেখা যায়। আমার অন্যমনস্কতা কেটে গেল। সেই গ্রুফো ভদ্রলোক যেন এইমাত্র আমাদের দরজা থেকে সরে আসছে, এমন কি পর্দাটাও স্পষ্ট নড়ে ওঠা দেখেছি। প্রথম মুহূর্তের চমক কাটলে ব্যাপারটা চোরে ভুল বলে সন্দেহ করলুম।
এই লোকটাকে কর্নেল সাহেব মিঃ সেন বলে সম্বোধন করছিলেন। আমার সামনে এসে সে একটু হাসল। হাসিটা অপ্রস্তুত ও হতচকিত মানুষের যেন।–এই যে মিঃ চৌধুরী। দেখে এলেন নাকি?
গম্ভীর হয়ে পড়েছিলুম নিজের অজান্তে। বললুম–হ্যাঁ।
সে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করল যেন। বলল–কিন্তু কী মারাত্মক ঘটনা বলুন তো! আমি তো গত পাঁচ-ছ বছর ধরে জেভিয়াস লজে আছি। এমন বীভৎস কাণ্ড কখনও ঘটতে দেখিনি! আচ্ছা, আপনারা সাহিত্যিকরা তো খুব পাওয়ার অব অবজার্ভেশনের অধিকারী। দেখে কী মনে হলো বলুন তো?
উত্তেজনা দমন করে বললুম–কী মনে হবে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সেন চাপা গলায় বলল, বোঝার সমস্যা নিশ্চয়। প্রথম ধরুন, এটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলেও মনে হতে পারে। রমার ব্যালকনির নিচেই খাড়ি এবং গভীর জল। আনমনে রেলিং-এ পা ঝুলিয়ে বসলে পড়ে যাবার চান্স আছে! সম্প্রতি বোম্বেতে ফিল্ম প্রডিউসার ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে এভাবেই তো এক অভিনেত্রী শাবানা সমুদ্রে পড়ে গেছেন। খবরের কাগজে দেখেননি?
–দেখেছি। কিন্তু রমা হঠাৎ ডাইনিং থেকে উঠে এসে ওভাবে বসতে যাবে কেন রেলিং-এ?…অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই প্রশ্নটা তুললুম। কারণ, আমি ঘটনাটায় গুরুত্ব চাপিয়ে ওকে আঁচ করাতে চাইছিলুম যে যত সহজে ভাবছ উড়িয়ে দেওয়া যাবে, তত সহজ এটা নয়। অবশ্য ওকেই আমি অপরাধী ভেবেছি, তাও নিঃসংশয় নই। শুধু কেমন-কেমন লাগছে মাত্র।
আমার প্রশ্ন শুনে গুঁফো সেন সায় দিয়ে বলল–ঠিক, ঠিক। ওটাই ভাইটাল কথা! তবে এমনও হতে পারে, খাবার দেরি দেখে বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছিল রমা এবং রেলিং-এ বসেছিল!
সবই সম্ভব! তবে খুব জোরাল যুক্তি এতে নেই!
–তা তো নেই-ই। কিন্তু ওকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে কেন?
আমরা তো পিছনের ঘটনা কিছু জানি না। ওর শত্রু থাকতে পারে।
নিশ্চয় পারে। কিন্তু যার শত্রু আছে, সে দরজা খোলা রেখে একা এইভাবে অন্ধকারে ব্যালকনিতে গিয়ে শত্রুকে সুযোগ দিল?
লোকটি যে ধুরন্ধর, তাতে সন্দেহ রইল না! ওর প্রশ্নে যুক্তি আছে। বললুম– হ্যাঁ, সেও একটা পয়েন্ট। দ্বিতীয়ত মিসেস্ জেভিয়ারের হার চুরির ঘটনা।….
কথা কেড়ে সেন বলল–হ্যাঁ, হার চুরি। দুটো প্রায় একই সময়ে ঘটেছে। আপনি কি মনে করেন দুটোর মধ্যে কোনও লিঙ্ক আছে?
থাকতে পারে। হয়তো রমা চোরকে মুখোমুখি দেখেছিল এবং তার ফলে তাকে মরতে হয়েছে।
সেন সোসাহে বলল–চমৎকার যুক্তি! জানেন, ওই কর্নেল ভদ্রলোকও তাই মনে করেন। পুলিসও তাই ধরে নিয়েছে। হাজার হলেও আপনারা সাহিত্যিকরা অর্ডিনারি ব্রেন তো নন!
সে সপ্রশংস তাকাল আমার দিকে। কিন্তু ওর চাউনিটা পছন্দ করছিলুম না। গায়ে পড়ে এমন ভাব করতে চায় কেন সে? তাছাড়া আমাদের ঘরের দরজায় ওকে দেখলুম, যদি চোখের ভুল না হয় তার কারণটাই বা কী? সেই সময় চকিতে মনে পড়ল, গতরাতে রাখীর মুছা যাবার সময় সে আমাদের ঘরে ঢুকেছিল–মোম জ্বেলে দিয়েছিল। তখন আবছা ভাবে মনে হয়েছিল, নোকটা যেন আমাদের ঘরের প্রতি কোনও অজানা কারণে আগ্রহী। কেন এই ধারণা মাথায় এসেছিল তখন? এটা ইনটুইশানের মতো।
সেন আরও দু-একটা কথা বলে চলে গেল। আমি ঘরের দরজা ঠেললুম। যেমন ভেজিয়ে রেখে বেরিয়েছিলুম, তেমনি রয়েছে। কিন্তু খাটে রাখী নেই। বাথরুমে জলের সব্দে তার সাড়া পেলুম। কী বোকা মেয়ে! দরজাটা বন্ধ আছে কী নেই দেখেনি! এবার আমাদেরই কিছু চুরি গেল না তো? প্রেমিকারা এমনি সরল গোবেচারা হয়!
প্রথমে চোখ পড়ল রাখীর ভ্যানিটি ব্যাগটার দিকে। সেটা গতরাত থেকে ওর বালিশের পাশে রয়েছে। সেই মুহূর্তে চমকে উঠলুম। ব্যাগের মুখটা খোলা একটা ভাঁজকরা কাগজ উঁকি মেরে রয়েছে। ব্যস্ত হয়ে ব্যাগটা ফাঁক করলুম। সর্বনাশ! নির্ঘাৎ কিছু, চুরি গেছে। রাখী শোবার সময় হাতের সোনার কাকন দুটো খুলে ওতে ঢুকিয়ে রেখেছিল মনে পড়ছে।
কাগজটা কিন্তু আমারই লেখা চিঠি। রাখী সঙ্গে এনেছে তাহলে! ওর কাকন খুঁজতে–যদিও ওর ব্যাগে হাত ভরা উচিত নয়–এই অনধিকার চর্চা করতে হলো, কারণ আমিই তো এখন ওর গার্জেন।
টুকিটাকি কাগজপত্র, প্রসাধনী, রুমাল কিন্তু কাকন জোড়া কই? রুমালটা তুলতেই বুকে জোর এল। এই যে রয়েছে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার চোখ ঝলসে গেল। মাথা ঘুরে উঠল। কয়েকটা সেকেণ্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। রুমালের তলা থেকে একটা নেকলেস যন্ত্রের মতো টেনে তুললুম। হা-হীরেরই নেকলেস।তা না হলে এত উজ্জ্বল সাদা হতে পারে না। সাদাসিদে নেকলেস নয় রীতিমতো জড়োয়া হার!
কোথায় পেল এ হার রাখী? এটাই সেই চুরি যাওয়া নেকলেস ম্যাডাম জেভিয়ারের? থরথর করে কাঁপতে থাকলুম। রাখীই কি….কিন্তু না–তা তো অসম্ভব। রাখীর মতো একজন সাদাসিধে নিরীহ মেয়ে সুশিক্ষিতা, সংস্কৃতিমতী, মার্জিত রুচির মেয়ে–যে শুধু ভালবাসা ছাড়া, সৌন্দর্য ও শিল্প ছাড়া জীবনে কিছু শ্রেয় ও প্রেয় মনে করে না–সে হার চুরি করবে কেন? গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত এই তেইশটি ঘন্টায় ওর যা পরিচয় পেয়েছি, তাতে ওকে কিছুতেই ক্রিমিনাল চরিত্রের মেয়ে বলে ভাবা যায় না। তাহলে যা চোখের ভুল ভেবেছি, তাই ঠিক। ওই সেন ব্যাটাই খুনে ডাকাত। সে রাখীর ব্যাগে হারটা পাচার করে গেল এইমাত্র। হয়তো হজম করতে পারল না–তাই।
হারটা হাতে নিয়ে অবশ হয়ে বসে আছি, এমন সময় রাখী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল হাসিমুখে ক্ষণে সে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল–ও কী? ওটা কী?
আড়ষ্টস্বরে বললুম–হীরের নেকলেস।
রাখী আমার পাশে লাফিয়ে এসে বসল। রুদ্ধশ্বাসে ভয়ার্ত গলায় বলল হীরের নেকলেস! এ কোথায় পেলে তুমি? কার নেকলেস?
–সম্ভবত মিসেস জেভিয়ারের সেই চুরি যাওয়া নেকলেস। তোমার ব্যাগের মুখ ভোলা দেখে সন্দেহ হয়েছিল, তারপর দেখি ওতে ভরা আছে।
রাখী কেঁদে ফেলল তখুনি। সে কী! কে রাখল ওখানে? হা গো, আমার গায়ে হাত দিয়ে তুমি বলোতুমি বলো আমার গা ছুঁয়ে–তুমি…
অবাক হয়ে বললুম–রাখী! কী বলতে চাও তুমি? আমি হার চুরি করেছি?
রাখী আমার বুকে ভেঙে পড়ল! না, না, না। তুমি সাহিত্যিক, তুমি শিল্পী তুমি কেন তা করবে? ছি ছি ছি! আমার মনে এখনও পাপ আছে গো? আমায় ক্ষমা করো, ক্ষমা করো তুমি। বলল, ক্ষমা করেছ? বলো!
তার মাথাটা এবার আমার পায়ে পড়ার উপক্রম হলো। ব্যস্ত হয়ে ওকে দুহাতে চেপে ধরে সামলে নিলুম। বললুম–না, রাখী। তোমার স্বাভাবিক সংশয় তুমি প্রকাশ করেছ মাত্র। কিন্তু আমি ভাবছি, অন্য একটা কথা। দরজাটা ভেতর থেকে লক না করে তুমি বোকার মতো বাথরুমে ঢুকেছিলে, আর চোর সেই সুযোগে ঘরে ঢুকে এটা পাচার করে গেছে।
রাখী চমকে উঠে বলল–সে কী! দরজা ভেজানো ছিল?
-হ্যাঁ।
রাখী ভুরু কুঁচকে কিছু ভেবে বলল–আমারই ভুল। ট্যাবলেট দুটোর ঘোর এখনও চোখ থেকে যায়নি। টলতে টলতে সোজা বাথরুমে ঢুকেছি। ভেবেছিলুম তুমি হয়তো ব্যালকনিতে বসে আছ।
কিন্তু যা হবার হয়েছে। এখন এটা নিয়ে কী করা যায়, দেখি। বরং কর্নেলের সঙ্গে পরামর্শ করে… ।
বাধা দিল রাখী!–উঁহু। ঠাণ্ডা মাথায় এটা ভাবা দরকার। আমার মনে হচ্ছে, এখন কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। পুলিস জানলেই আমাদের জড়াবে। তার ফলে একটা ভীষণ ক্ষতি হবে অন্তত আমার। কারণ, আমি মেয়ে–এবং একটা স্কুলের শিক্ষিকা। আমার চাকরি যাবে। কেলেঙ্কারি রটবে–এমনি করে, তোমার সঙ্গে বাইরে এসেছি বলে! রাখী বুদ্ধিমতী। ঠিকই তো। আমরা দুজনে গোপনে বেড়াতে এসেছি স্বামী স্ত্রী সেজে। রটলে রাখীর শুধু নয়, আমারও কি কম বদনাম হবে? তার ওপর সবচেয়ে সর্বনাশ হবে আমার বাড়িতে। সত্যিকার স্ত্রী ভদ্রমহিলা হিস্টেরিক মেয়ে। নির্ঘাৎ আত্মহত্যা করে বসবে। এ ব্যাপার ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেও কতটুকু কাজ হবে? কারণ, সাহিত্যিক হিসাবে আমার খ্যাতি আছে। খ্যাতিমান লোকেদের কোন কিছু চাপা থাকে না। এক সময় ফঁস হয়ে যায়। খবরের কাগজের রিপোর্টাররা এ নিয়ে যা শুরু করবে, তা ভাবতেই আমার গা হিম হয়ে গেল।
বললুম–হা, ঠিকই বলেছ রাখী। আমরা এখন অজ্ঞাতবাসে এসেছি। কর্নেলকে জানানো মানেই পুলিসকে জানানো। ব্যাপারটা সহজে হয়তো মেটার বা চেপে দেওয়ার একটা চান্স ছিল কিন্তু তা আর নেই। কারণ সেই বেপাত্তা রমা রায়ের লাশ পুলিস খুঁজে পেয়েছে!
অমনি রাখীর মুখটা আবার আতঙ্কে ছাই হয়ে গেল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল–সে কী! সেই মেয়েটি খুন হয়েছে?
–হ্যাঁ। ব্যালকনিতে গেলেই দেখতে পাবে। ওর ঘরের নীচের খাড়ি থেকে লাশটা তোলা হয়েছে।
রাখী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কোনও কথা বলতে পারল না।
বললুম–কাজেই এই হারটা খুব সহজ হার নয়। খুনের সঙ্গে তার বাস্তব যোগাযোগ থাক বা নাই থাক, এখন আপাতত দুটো একসুত্রে জড়িয়ে গেছে। তুমি ঠিকই বলেছ, হারটা আমরা দিতে গেলেই জড়িয়ে যাব!
রাখী অস্ফুটস্বরে বলল–এ কী বিপদে পড়লুম আমরা।
ওকে আশ্বস্ত করার ক্ষমতা নেই। তবু বললুম–আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। তাহলে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে। তুমিও ভাব, কী করলে ভাল হয়।
একটু পরে রাখী বলে উঠল–এক কাজ করা যেতে পারে। হারটা যে কোনও ভাবে পাচার করা। বরং ওটা ব্যালকনি থেকে এক্ষুণি সমুদ্রের জলে ফেলে দাও।
-এখন চারদিকে পুলিসের চোখ, রাখী!
রাখী ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে বলল–তাহলে…তাহলে ওটা এবাড়ির মধ্যে কোথাও ফেলে রেখে এস।
–তা সম্ভব। কিন্তু কয়েক লাখ টাকা দামের জিনিস এটা। যদি অন্য কেউ হজম করে দেয়? আমাদের বিবেক তত আছে, রাখী! মিসেস জেভিয়ারের এই সম্পদ তো শুধু টাকার জিনিষ নয়!
–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ! আহা বেচারা!
–একটা কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটায় রিস্ক আছে।
কী, কী?
–হারটা ম্যাডামের হাতের নাগালে রেখে দেওয়া।
–কোথায় রাখবে?
–ভাবছি।
-শোনো, এক কাজ করা কিন্তু অনেকটা সহজ। ওপরে ওঁর যে ঘর থেকে এটা চুরি গিয়েছিল, সেখানেই রেখে আসা।
–কিন্তু সেখানে তো তালা আটকানো।
কপাট বা অন্য কোথাও ফোকর থাকা সম্ভব। গলিয়ে দিলেই তো ঝামেলা চুকে গেল। তাই না? ম্যাডাম ভাববেন, চোর ভয়ে ফেরত দিয়েছে। হজম করতে পারেনি।
ঘামতে ঘামতে বললুম–তাহলে তা এখনই করতে হয়। তুমি সিঁড়ির মুখে দাঁড়াও। ম্যাডাম এখন নীচে আছেন! আমি কোনও কায়দায় তিনতলায় ঝটপট গিয়ে এটা পাচার করে আসি।
রাখী হঠাৎ একটু হাসল–হাসিটা অবশ্য খুবই করুণ। বলল–হ্যায় সাহিত্যিক। তোমার প্রেমের মূল্য হয়তো এভাবে শোধ দিতে হচ্ছে!
ওর একথায় আপ্লুত হলুম। উঠে দাঁড়ালুম। আমার পা থরথর করে অবশ্য কাঁপছে। মাথা টলমল করছে।
পা বাড়াতেই রাখী উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে একটা দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল। ফিসফিস করে বলে উঠল সেনা, না! তোমাকে অমন ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। আমি তা প্রাণ থাকতে হতে দিতে পারব না। তুমি দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তোমার মর্যাদার দাম কে দিতে পারে! ওগো, তুমি যেওনা। জীবনে তোমার এখনও কত কী দেবার আছে মানুষকে? তার চেয়ে আমি তো সামান্য অজ্ঞাতকুলশীল মেয়ে–আমার কিছু ঘটলেও কিছু যায় আসে না। শোনো, আমার কথা শোনো তুমি!
রাখীকে আবেগে উচ্ছসিতা দেখলুম। এই সেই সত্যিকার রাখী, ঠিক কণ্ঠস্বর তার চিঠিতে পেয়ে এসেছি বরাবর। আবেগময়ী প্রেমিকা মেয়ে সে। আমি ওর চিবুক ধরে চুমু খেলুম। বললুম–না। তুমি অসামান্যা, রাখী। তুমি মেয়ে বলেই তোমার মর্যাদা আমার চেয়ে বেশি।
না, না! ওগো, তা নয়। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যেও না!
তবে কে যাবে?
রাখীর নাসারন্ধ্র কাঁপছিল। তার মুখে ফুটে উঠেছে এক দৃপ্ত দৃঢ়তা। এদেশের মেয়েরা হয়তো এমনি করেই প্রেমিকের সম্মানে আত্মদান করতে যায়। সে বলল আমি যাব। আমিই রেখে আসব। ভেবো না–মেয়েরা এমন অনেক কিছু পারে, যা পুরুষেরা কল্পনাও করতে পারে না। তুমিই তো একথা কত উপন্যাসে লিখেছ?
তুমি যাবে?
হ্যাঁ। তার আগে তুমি বাইরেটা ভাল করে দেখে এস। তারপর তুমি কাশলে আমি বেরোব। তুমি বাঁদিকে নীচে যাবার সিঁড়ির মুখে দাঁড়াবে। কেউ এলে খুব জোরে কাশবে। আমি করিডরে ডাইনে তেতলার সিঁড়িতে উঠব। তোমার দ্বিতীয়বার কাশি শুনলে নেমে আসব। কেমন? আর কেউ না এলে তুমি চুপচাপ থাকবে। মনে রেখ।
বেরিয়ে এলুম অগত্যা। ওর দৃঢ়তার কাছে নতি স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই। করিডর ফাঁকা। সব দেখে শুনে বাঁদিকে এগিয়ে নিচে যাবার সিঁড়ির মুখে কথামতো দাঁড়ালুম এবং কাশলুম অর্থাৎ পথ পরিষ্কার।
আমাদের ঘর থেকে রাখী বেরোল। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় চলে গেল সে করিডর পেরিয়ে তেতলার সিঁড়ির দিকে। অবশ গায়ে ও দুরুদুরু বুকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এতদিন পরে দেবতাকে খুব ডাকাডাকি করছি মনে মনে। মানত মানছি। সেকেণ্ডগুলো কাটতেই চায় না।
আর কাশবার দরকার হলো না। রাখীকে নেমে আসতে দেখলুম। সে চোখ নামিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকলে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা ভাল করে লক করলুম। তারপর রুদ্ধশ্বাসে বললুম–কোথায় রেখে এলে?
রাখী জবাব দিল–ভেবো না। ঠিক জায়গায় রেখেছি।
এই সময় বাইরে ভারী পায়ের শব্দ হলো। পুলিস নাকি? শব্দ অন্য দিকে সরে গেল। ইস্ আর একটু দেরি করলে কী যে ঘটত! …
.
তারপর যা সব হলো, বিস্তারিত বলার দরকার নেই। পুলিস আমাদের নীচে ডাইনিং হলে ডেকেছিল। জিজ্ঞাসাবাদ যা হলো, তা চূড়ান্ত। এরপর সার্চের পালা পড়ল। প্রত্যেকটি ঘর এবং প্রত্যেককে সার্চ করা হবে। মেয়েদের বডিসার্চ করবে এক মহিলা পুলিস। সবাইকে নিয়ে ওপরে আসা হচ্ছে, এমন সময় দেখা গেল মিসেস জেভিয়ার তেতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে নামছেন। কর্নেল সাহেবই দৌড়ে গিয়ে বুড়িকে ধরলেন। বুড়ির হাতে সেই চোখ ধাঁধানো জড়োয়া নেকলেস! সবাই তাজ্জব।
বুড়ি হেসে কেঁদে বাঁচেন না! তারপর সকলের কাছে ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন। বোঝা গেল, হারটা মোটেও খোওয়া যায়নি। ওটা ওঁর স্মৃতির ভুল। লকারের অন্য তাকে রেখেছিলেন। এই স্মৃতিভ্রংশের জন্য উনি ভীষণ লজ্জিত।
সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কর্নেল ওঁর হাত থেকে হারটা নিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বুড়ি তখন প্রায় পাগল-হারানিধি ফিরে পেয়েছেন। পাত্তাই দিলেন না।
আমরা আবার ডাইনিং হল-এ নেমে এলুম। বেলা বারোটা তখন। লাঞ্চের এক ঘণ্টা দেরি। এখন মিসেস জেভিয়ারের আন্তরিক কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে কফি খেতে হবে বিনা দামে। বলা বাহুল্য, সবাই খুশি মনে কফি খেতে বসলেন।
কিন্তু আমার মন খারাপ করছিল। বেচারা রমার কথা ভাবছিলুম। কীভাবে পড়ে গেল সে রেলিং থেকে? রাখী আমার মনমরা ভাবটা টের পেয়ে বলল তুমি কিন্তু এখনও নার্ভাস হয়ে রয়েছ গৌতম?
-না, না। এমনি!
–এমনি নয়। কী ভাবছ, বলব?
বলো না?
রমার কথা।
হাসলুম। হয়তো ভাবছি। বেচারা ওভাবে মারা পড়ল!
দুঃখ নিশ্চয় হওয়া স্বাভাবিক। হ্যাঁ গো, যদি রমা না পড়ে আমি ওভাবে পড়ে যেতুম…
না, না! কী বলছ অলক্ষুণে কথা!
–আচ্ছা, হ্যাঁ গো, যদি রমা হতে রাখী–তাহলে এমন করে ভালবাসতে নিশ্চয়? বলল না!
-যাঃ! কী বলছ!
–আহা, বলোই না বাবা! যদি আমি অন্য কোনও মেয়ে হতুম, আর রমা হতো তোমার ভক্ত সেবিকা এবং প্রেমিকা!
যা হয়নি, তা নিয়ে ভাবি না, রাখী।
ভাবতে দোষ কী? তুমি তো সাহিত্যিক মানুষ। কত সব কল্পনা করতে পারো। এটা কল্পনা করে দেখ না কেন একবারটি।
–তুমি সামনে না থাকলে পারতুম রাখী।
–তাহলে রমাকে আমার মতোই আদর করতে? কাছে নিয়ে শুতে– চুমু খেতে?
যাঃ! শুনবে ওরা!
আচমকা আমার বাঁ দিক থেকে কর্নেলের সাড়া পেলুম-হ্যালো গৌতমবাবু! এই যে মিসেস চৌধুরী! এতক্ষণ কথা বলার ফুরসতই পাইনি। ট্যাবলেট খেয়ে ভাল ঘুম হয়েছিল তো?
বলতে বলতে কর্নেল এসে আমাদের পাশে বসে পড়লেন। রাখী সলজ্জ মুখে বলল–বসুন, বসুন কর্নেল। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। খুব ঘুমিয়েছি।
কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–সবই সুরাহা হলো। শুধু বেচারা রমা! ভেরি স্যাড রিয়্যালি!
রাখী বলল-হা, বেচারার জন্য কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা কর্নেল, আপনার কি মনে হয় সত্যি ওটা অ্যাকসিডেন্ট?
তাই বলছে পুলিস। রেলিং-এর ফাঁকে ওর শাড়ির একটা টুকরো আটকে রয়েছে। আর–ওর হাতের ব্যাগটাও ছিটকে পড়েছে-অবশ্য জলে পড়েনি, পাথরের ওপর পাওয়া গেছে ওটা। এসব দেখে পুলিস বলছে, অ্যাকসিডেন্ট। বৃষ্টিতে রেলিং ভীষণ পিছল ছিল। বসতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেছে।
আমি বললুম–আপনার ধারণা কী বলুন কর্নেল?
কর্নেল হাসলেন। আমার আর কী আলাদা ধারণা থাকবে?
-এটা খুন নয় তো?
–তেমন ক্লু তো পাওয়া যায়নি এখনও। অবশ্য মেয়েটির সত্যিকার পরিচয়। পুলিস উদ্ধার করতে পারলে সব বোঝা যেত।
রাখী ভুরু কুঁচকে বলল–সত্যিকার পরিচয়? তার মানে-ও কি রমা নয়, অন্য কেউ?
কর্নেল জবাব দিলেন–আমি ডেফিনিট নই। কিন্তু…
বললুম–কিন্তু?
–কিন্তু ওর মধ্যে কেমন একটা অপ্রকৃতিস্থ ভাব লক্ষ করেছিলুম। আমার স্বভাব, মানুষকে লক্ষ করা। অবশ্য আমার চোখের ভুল হতেও পারে। তাছাড়া ও আসে গত রাত্রে সাতটা দশের ট্রেনে।
–আমরাও তো ওই ট্রেনে এসেছি।
-তাই বুঝি? তা ও যখন নাম রেজিস্ট্রি করাচ্ছিল মিসেস জেভিয়ারের খাতায়, আমি কাছাকাছি ছিলুম। লক্ষ করলুম, নাম লেখবার সময় একটু ইতস্তত করল। আমার ওই এক কুঅভ্যাস। একটু পরে পাশে গিয়ে একটা অজুহাতে দাঁড়ালুম। দেখলুম আর লিখে ও হরফটা দুবার বুলিয়েছে–যেন অন্য কী হরফ লিখতে যাচ্ছিল–হয়তো অভ্যাসে।…অবশ্য সবই আমার ভাসা ভাসা ধারণা। এর পিছনে কোনও বাস্তব তথ্য নাও থাকতে পারে।
রাখী কৌতূহলী হয়ে বলল ঠিকানা কোথাকার?
-বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
–সে কী! আমিও তো…বলে চুপ করে গেল রাখী।
–আপনি কি বহরমপুরের মেয়ে?
রাখীর বিব্রত অবস্থা টের পেয়ে আমি বললুম–হা কর্নেল। আমার শ্বশুরালয় বহরমপুর। কিন্তু সবাইকে চেনা তো রাখীর পক্ষে সম্ভব নয়। কী বলল রাখী?
রাখী বলল–নামটা…নামটা কেমন চেনা লাগল। বহরমপুরে রমা বলতে সে ভুরু কুঁচকে ভাবতে থাকল।
কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে খারাপ লাগল। রাখীর সিঁথিতে অবশ্য সরু সিঁদুরের রেখা রয়েছে। হাতে শাঁখাটাখা নেই–আমরা তো মডার্ন দম্পতি! বললুম–একটা শহরে অনেক রমা থাকা সম্ভব!
কর্নেল বললেন–রাইট, রাইট। সে তো সম্ভবই।
রাখী হঠাৎ বলল–ও, মনে পড়েছে! রমা রায়! কিন্তু তাকে তো আমি চিনতুম!
–কে সে?
রাখী হেসে ফেলল।–এক দাগী ডাকাতের বউ। পরে ওর স্বামীর জেল হয়। জেল থেকে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা পড়ে। বউটি বহরমপুরে মার্কামারা মেয়ে ছিল। সবাই চিনত। পুলিসের সঙ্গে খাতির ছিল প্রচণ্ড। তারপর কোথায় যেন চাকরি-টাকরি নিয়েছিল। ও হ্যাঁ–স্কুলে।
–স্কুলে ডাকাতের বউকে চাকরি দিল?
বুঝতেই পারছেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খাতির করে নিয়েছিল। ওর মতো মেয়ের পক্ষে অসম্ভব তো কিছু ছিল না!
আমি রাখীকে সমর্থন করে বললুম–আজকাল তো সব জায়গায় এরকম হচ্ছে। মরালিটি নিয়ে কজনই বা মাথা ঘামায়? অবশ্য, সাহিত্যিক হিসেবে আমি বলব–এতে ইম্মরালও কিছু নেই। স্বামী দাগী ডাকাত হলেই যে বউ ভাল মেয়ে হবে না, তার মানে নেই। তাছাড়া স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে বাঁচতে হবে তো!
কর্নেল বললেন–সে রমা নিশ্চয় দেখতে খুব সুন্দরী ছিল?
কর্নেলের বেমক্কা প্রশ্নে অবাক হলুম। রাখী কিন্তু হাসল।-কেমন করে বুঝলেন?
হিউম্যান সাইকলজি এরকমই, মিসেস চৌধুরী। রূপের বেলা সাতখুন মাফ। অবশ্য এটা জেনারেল ল।
রমা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল। গরীব ঘরের মেয়ে তো? বি এ পাশ করার আগেই বাবা ওর বিয়ে দেন–অবশ্য রমা প্রেম করেই বিয়ে করে। আর করল করল, এক মাস্তানের সঙ্গে। তার ফলটা ভালই ভুগল।
–তাহলে বলছেন, সে রমা এই রমা নয়?
–মোটেও না।
আমি হঠাৎ বলে উঠলুম কিন্তু তুমি তো এই রমাকে দেখইনি, রাখী?
রাখী ভুরু কুঁচকে বলল–দেখিনি? পরক্ষণে হেসে ফেলল। কী কাণ্ড! সত্যি তো! আমি ওকে এখানে দেখিইনি। অথচ কেবলই মনে হচ্ছে–দেখেছি! আসলে ওই নামটার জন্যে এমন হচ্ছে!
কর্নেল মাথা নেড়ে সায় দিলেন। রাইট, রাইট। যাকে বলে উইশফুল থিংকিং। তবে ও বডিটা আপনার একবার দেখা দরকার। অবশ্যই দরকার। আপনি সনাক্ত করলে পুলিসের খুবই সুবিধে হয়। দায়িত্ববান নাগরিকের পক্ষে এটা কর্তব্যও বটে।
এই বলে কর্নেল খুব ব্যস্তভাবে উঠলেন এবং রাখী অসহায় মুখে আমার দিকে তাকাল। বিব্রত বোধ করছিলুম। রাখীকে এভাবে মড়ার সামনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তাই শেষ রক্ষার জন্যে, বললুম–ইয়ে দেখুন কর্নেল, ওর নার্ভ খুব শক্ত নয়। একসময় নার্ভের অসুখেও ভুগেছে। তার প্রমাণ তো গতরাতে পেয়েছেন। তাই বলছিলুম, মড়াটড়া দেখে ও হয়তো ভীষণ ভয় পাবে এবং হিতে বিপরীত ঘটে যাবে।
কর্নেল মানুষটি দেখলুম খুবই সহানুভূতিশীল। ব্যাপারটা বুঝতে ওঁর দেরি হলো না। আবার বসে পড়লেন। বললেন–হ্যাঁ, সেও ঠিক। ওঁর নার্ভ তেমন শক্ত নয়। আচ্ছা মিসেস চৌধুরী, তাহলে যদি ওর ডেডবডির একটা ফোটো আপনাকে দেখানো হয়, কোনও আপত্তি হবে?
রাখী নিশ্চয় মনে মনে বিরক্ত হলো। পুলিসে যা করবার করুক, তুমি কে বাপু যে এত উৎসাহ দেখাচ্ছ–এরকম ভাব রাখীর মুখে ফুটে উঠল। কিন্তু সে আস্তে ঘাড় নেড়ে ছোট্ট করে শুধু বললেউ।
কর্নেল বললেন–ছবি তোলা হয়েছে। লাশও এতক্ষণ মর্গে চলে গেছে। ছবিটা পেতে ঘণ্টা চার-পাঁচ দেরি হবে। যাই হোক, অপেক্ষা করা যাক।
রাখী বলল-চার-পাঁচ ঘণ্টা! আমরা যে এগারোটা ছত্রিশের ট্রেনে চলে যাব ঠিক করেছি কর্নেল!
আমি অবাক হয়ে তাকালুম ওর দিকে। কখন ঠিক করলুম রে বাবা! চলে যাওয়া মানেই তো রাখীর সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া! আর এক্ষুণি চলে যাব বলে তো এতদূরে বেড়াতে আসিনি।
রাখী আমার দিকে চোখের ইশারা করল। তখন বুঝলুম, আসলে ও ডেডবডির ছবিও দেখতে চায় না। এড়িয়ে যাবার মতলব এঁটেছে! অতএব ওকে সায় দিয়ে বললুম–হা কর্নেল। যে বীভৎস কাণ্ড হলো–এরপর এখানে ওকে নিয়ে থাকা খুব রিস্কি! আবার ভয়টয় পেয়ে সিন ক্রিয়েট করে বসবে। তাছাড়া রমা ঠিক পাশের ঘরেই উঠেছিল!
হাসতে হাসতে বললুম– কথাটা। কর্নেল গম্ভীর হয়ে মাথাটা কয়েকবার দোলালেন মাত্র। কিছু বললেন না। অবশ্য এও জানি যে, পুলিস আইনত আমাদের আটকাতে পারে। বুক কেঁপে উঠল–আমাদের নিয়ে পুলিস টানাটানি করলেই বিপদ। রাখী ও আমার গোপন সম্পর্ক ফাঁস হয়ে যায় যদি! পুলিসের চোখে ফাঁকি দেওয়া কি সহজ হবে যে আমরা আসলে স্বামী-স্ত্রী নই?
অবশ্য এটা পশ্চিমবঙ্গ হলে নিজের কিছু প্রভাব খাটাতে হয়তো পারতুম। কিন্তু এটা ওড়িশা। ভিন ভাষার রাজ্য। এখানে কারো কাছে গৌতম চৌধুরী সাহিত্যিক বলে কোনও আলাদা গুরুত্ব নেই।
হঠাৎ কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন–এক্সকিউজ মি। আবার দেখা হবে। কেমন?
উনি চলে গেলে রাখী ফিসফিস করে রাগ দেখিয়ে বলল–ভদ্রলোক বড্ড কুচুটে মানুষ! যেন সব দায় ওঁর! এই, আর এখানে থাকব না আমরা। বরং অন্য কোনও জায়গায় চলে যাই। এই বিশ্রী ঘটনার পর তোমার ইচ্ছে করবে ফ্রিলি চলাফেরা করতে?
ঠিকই বলেছে রাখী। এই পরিবেশে প্রেমের বারোটা বেজে যাবে। মোটেও জমবে না। ওকে সায় দিলুম। বললুম–তাই হবে। লাঞ্চ খেয়ে আর দরকার নেই। চলল, গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিই। মিসেস জেভিয়ারকে আমি বলে আসছি তুমি এগোও।
রাখী তখুনি ওপরে চলে গেল। আমি মিসেস জেভিয়ারকে কথাটা বলতেই উনি দুঃখিত মুখে বারবার ক্ষমা চাইলেন। বললেন কী করব বাছা, আমারই দুর্ভাগ্য! আবার কিন্তু আসবে তোমরা।
সিঁড়ির মুখে সেই গুঁফো সেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল–হ্যাল্লো মিঃ চৌধুরী, আর কিছু শুনলেন?
-কিসের বলুন তো?
–আবার কিসের? যা ঘটে গেল!
বিরক্ত হয়ে বললুম–কিচ্ছু শুনিনি। স্রেফ সুইসাইড। কেন? আর বেশি কী শোনার আছে?
হঠাৎ লোকটা অভদ্রভাবে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে মুচকি হেসে চাপা গলায় বলে উঠল–ওই ভদ্রমহিলা কি সত্যি আপনার স্ত্রী?
রাগে সারা শরীর বি রি করে উঠল। হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললুম–কী বলছেন মশাই যা-তা! একটু ভদ্রতাও শেখেননি!
গুঁফো সেন হাসতে লাগল।
আরও রেগে বললুম–আপনি অত্যন্ত অভদ্র! আপনি জানেন কার সঙ্গে ইতর রসিকতা করছেন? তেমন শিক্ষা-সংস্কৃতি থাকলে গৌতম চৌধুরীর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে লজ্জা পেতেন!
গুঁফো একটুও না দমে বলল–আমি মশাই এখানকার ভেটারেন ট্যুরিস্ট। আপনার সঙ্গিনীকে অনেকবার দেখেছি এখানে। এই লজেই–অন্য ভদ্রলোকের প্লঙ্গে। মিসেস জেভিয়ার বুড়ি মানুষ–চোখেও কম দেখেন। নয়তো চেনা মুখকে। অচেনা ভাবতেন না। এবেলার চেনা মানুষ উনি ওবেলায় চিনতে পারেন না। কিন্তু আমি পারি!…..
বলেই গুঁফো সেন আচমকা চলে গেল। আর দুটো চড়া কথা বলার সুযোগ দিল না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরের দিকে পা বাড়ালুম।
রাখী তাহলে অন্য কারও সঙ্গে অনেকবার এখানে এসেছে? কার সঙ্গে এসেছে? অন্য প্রেমিক? নাকি ওই মাস্তান লোকটা আমাকে নিয়ে মজা করল? রাখীকে কথাটা বলার সাহস পেলুম না। ও দুঃখ পাবে। আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা নড়ে ওঠারও আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে রাখী যা ভাবপ্রবণ মেয়ে! অত আবেগ। যার মনে–তাকে এসব প্রশ্ন করা মানেই বারুদে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে দেওয়া! আর এযুগে অত সংকীর্ণচেতা হওয়া সাজে না।
মনের অস্থিরতা মনেই চেপে রাখলুম। কিন্তু গোছগাছ করতে করতে বুদ্ধিমতি রাখী তা যেন টের পেল। বলল–তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন বল তো? মাথা ধরেনি তো?
বললুম–হ্যাঁ?
ট্যাবলেট আছে। খেয়ে নাও না! দেব?
থাক। বেরুলে ছেড়ে যাবে।
সব গোছানো হয়ে গেলে রাখী একবার ব্যালকনিতে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে ডাকল–এই! শুনে যাও না!
তার ডাকের কোনও তুলনা নেই। খুব ঝটপট যেটুকু সেজে নিয়েছে, তাতে, ওর চেহারা আশ্চর্য লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। ওর কোমর, নিতম্ব ও পেটের কিছু নগ্ন অংশ, এবং ওর ঠোঁট চিবুক গলা ঘাড় চুল–আমার চোখে অলৌকিক আর মায়াময় হয়ে উঠেছিল। প্রায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে তার পাশে গেলুম। সে তার চাপা অভ্যস্ত আবেগময় স্বরে বলল–চলে যাবার আগে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে বলে যাবে না যে, আমরা এসেছিলুম–তুমি সাক্ষী রইলে?
-হ্যাঁ। বলব। বলব যে আবার আসব, আমাদের মনে রেখ।
–গৌতম!
উঁ?
–এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে আমাকে তুমি একটা চুমু দাও না লক্ষ্মীটি।
বলার দরকার ছিল না। পাগলের মতো ওকে দুহাতে বুকে টেনে ওঁর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলুম–দীর্ঘ একটা মিনিট। তারপর ও সরিয়ে দিল। ঠোঁট মুছল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল–আরও কিছু তোমাকে দেবার ছিল এই সমুদ্রের সামনে। তুমি আরও কিছু চেয়েছিলে–তাই না গৌতম?
–হ্যাঁ। আরও কিছু বাকি থেকে গেল, রাখী।
রাখী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ ঘরে চলে এল। আমি ওর পিছন পিছন এসে ওকে গভীর আবেগে আকর্ষণ করে বললুম–রাখী! আমার আত্মা! আমার প্রাণ!
রাখী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল–এবার আমরা কোথায় যাব গৌতম? আমার ছুটি কিন্ত আরও তিনদিন আছে।
–চলো তো, আগে স্টেশনে যাই। তারপর ঠিক করে নেব।
কাছাকাছি আর কোথাও সি-বিচ নেই ভাল?
–আছে। সে অনেক দূর। প্রায় ছ-সাত ঘণ্টার জার্নি। তার চেয়ে তিন ঘণ্টার ট্রেনে ও বাসে আমরা কোনারক পৌঁছাতে পারি।
–কোনারক! রাখী নেচে উঠল। ওগো, তাহলে তাই চলো! …
একটু পরে নির্বিবাদে আমরা বেরোলুম। ফো সেন বা কর্নেল কাউকেও দেখতে পেলুম না। অনেকটা স্বস্তি এল। রিকশায় আমরা স্টেশনের দিকেই চললুম। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার আজ। অবশ্য এখানে ওখানে কিছু সাদা মেঘ আছে। বাতাসও বইছে প্রচণ্ড জোরে। পিছন থেকে বইছে বলে রিকশা প্রায় পক্ষীরাজের মতো উড়ে চলল।
চন্দনপুর অন-সী জংশন স্টেশন। খুব ভিড়ও ছিল। কোনারকের দিকে যাবার ট্রেন আসতে দেড় ঘণ্টা দেরি। ফার্স্ট ক্লাশ ওয়েটিং রুমে রাখীকে বসিয়ে রেখে এনকোয়ারিতে দাঁড়িয়ে ছিলুম। ভাবছিলুম, দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সেরে নিই। কারণ ট্রেন থেকে নেমে কোনারকের পথে বাসে যেতে হবে। কখন পৌঁছব কিছু ঠিক নেই।
হঠাৎ চমকে দেখি সেই গুফো সেন সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে খবরের কাগজ পড়ছে। আপদটা এখানে কেন? অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলুম। ওর চোখ এড়িয়ে তক্ষুনি সরে গেলুম। ক্যান্টিনটা খুঁজে বের করতে হবে!
ক্যান্টিন থেকে অবস্থা দেখে বেরিয়ে রাখীকে ডাকতে আসছি, চোখে পড়ল প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা জায়গায় কিছুটা দূরে একটা পিপুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই ধুরন্ধর গোয়েন্দা ঘুঘু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার বুকে রক্ত ছলকে উঠল।
দ্রুত ওয়েটিং রুমে গিয়ে ঢুকলুম। কিন্তু রাখী কোথায়? প্রায় দৌড়ে গিয়ে দেখি শুধু আমার সুটকেসটা পড়ে আছে–আমার মগজ খালি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মাথা ঘুরতে লাগল। পাশের টেবিল ধরে সামলে নিলুম। তারপর চারদিকে ঘুরে ঘটনাটা বাস্তব কি না টের পেতে চাইলুম।
সেই সময় দরজায় দেখা গেল কর্নেলকে। মুখে স্বভাবসিদ্ধ হাসি বুডোর। গা জ্বলে যাচ্ছিল। কাছে এসে বাও করে বললেন–গুডমর্নিং মাই ডিয়ার চৌধুরী। তাহলে সত্যি সত্যি চন্দনপুর ছেড়ে চললেন? আপনার স্ত্রী কোথায়?
হঠাৎ আমার সব উত্তেজনা ঝিমিয়ে গেল। বললুম– কর্নেল, আমি হয়তো ভুল করেছিলুম কোথাও কিছু সাংঘাতিক একটা ভুল ঘটেছে। আমার ইনটুইশন বলছে একথা! রিয়্যালি কর্নেল–আমি যেন বড্ড ঠকে গেছি।
কর্নেল আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলে বললেন–নেভার মাইণ্ড গৌতমবাবু! আপনারা সাহিত্যিকরা বড্ড আবেগপ্রবণ এবং বেহিসেবী মানুষ। তাই এটা স্বাভাবিক। তবে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই–পস্তেও ফল হবে না। স্টেশনটা পুলিস ঘিরে ফেলেছে। আপনার জাল প্রেমিকা পালাতে পারবে না।
চমকে উঠে বললুম–জাল প্রেমিকা মানে?
-মানে রমা রায়!
–কিন্তু রমা রায় তো মৃত!
না গৌতমবাবু, যে সমুদ্রের জলে পড়ে মারা গেছে সেই হচ্ছে খাঁটি রাখী–আপনার সত্যিকার প্রেমিকা–মানে, সরি। পাঠিকা–গুণমুগ্ধা পাঠিকা।
–আমি কিছু বুঝতে পারছি না কর্নেল।
–খুবই সহজ। বহরমপুর গার্লস স্কুলের দুই শিক্ষিকা–একজন রমা রায়– কুখ্যাত ডাকাতের উইডো, অন্যজন রাখী মিত্র-সরলমনা কালচার্ড মেয়ে। কিন্তু যেভাবে হোক, দুজনের মধ্যে ভাব ছিল। এমন কি বিশ্বাস করে রাখী রমাকে আপনার সব চিঠিই দেখিয়ে থাকবে। এসব কিন্তু হাইপথিসিস। এখনও বাস্তবে প্রমাণিত হয়নি। তবে আমার সিদ্ধান্ত প্রায়ই ভুল হয় না। যাই হোক, রমার লক্ষ ছিল মিসেস জেভিয়ারের নেকলেসটার প্রতি। একদা এখানে এসে, হয়তো তার স্বামীও সঙ্গে ছিল-ওটার খবর পেয়ে যায়। কিন্তু কোনও সুযোগ পায়নি। অথচ ওটার কথা ভোলেনি রমা। এবার সে একটা চান্স নিল। রাখীকে সেই সম্ভবত প্ররোচনা দিল চন্দনপুরে বেড়াতে যেতে-সাজতে হবে গৌতম চৌধুরীর স্ত্রী। তাই পুলিস বা কেউ ভুলেও সন্দেহ করবে না। এবার একটা প্রশ্ন করি। আপনি রাখীকে বহরমপুরে কোন ট্রেন ধরতে বলেছিলেন?
-পাঁচটা পাঁচের। ভোরে। পরের ট্রেন ছটা তেইশে। ওটাতেও হাওড়া এসে চন্দনপুরের ট্রেন ধরা যায়–তবে লেট করলে যায় না। তাই প্রথম ট্রেনেই আসতে বলেছিলুম।
–হুঁম্! রেডিও মেসেজে বহরমপুর পুলিসের পাওয়া তথ্য শুনুন। স্কুলে দুজনেই ছুটি নেয়। ওইদিন সাড়ে পাঁচটায় হোস্টেলে রমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনে অন্য ঘরের একটি মেয়ে দেখে ভিতরে রাখী বন্দী। বাইরে কেউ শেকল তুলে দিয়েছে। ঘরে রমা ছিল না। রাখী তখন সেজেগুজে বেরিয়ে যায়। বলে– কলকাতা যাচ্ছে কথামতো। রাখী তাহলে বোধহয় ছটা তেইশের ট্রেন ধরেছিল। ট্রেনটা হয়তো লেট করেনি। ফলে আপনাদের দেখে থাকবে। অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। সে চন্দনপুরের ট্রেনে চেপে বসেছিল। কোনও এক সুযোগে ব্যাপারটা ফাঁস করে দেবার ইচ্ছে নিশ্চয় ছিল–আপনার সঙ্গে গোপনে দেখা করত হয়ত। এবার বাকিটা সহজ। রমা এখানে এসে কোনও ভাবে ওকে আবিষ্কার করুক, কিংবা রাখী নিজেই রমাকে একা পেয়ে মুখোমুখি চার্জ করার সুযোগ নিক কিছু একটা ঘটেছিল।
–ঠিক বলেছেন কর্নেল। আমার মনে পড়ছে যখন জাল রাখীকে ঘরে রেখে আমি নীচে এসেছি, হঠাৎ ওই মেয়েটি কখন ওপরে চলে গিয়েছিল।
–তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাখীই গিয়েছিল রমার কাছে। রমা কোনও অজুহাতে তাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে যায় এবং ব্যালকনিতে গিয়ে বোঝাপড়া করার অছিলায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সমুদ্রে।
ইস্! কী সাংঘাতিক মেয়ে।
ব্যাপারটা প্রথমে টের পাই, রাখীর পড়ে যাওয়া ব্যাগে আপনার কিছু চিঠি দেখে। মুহূর্তে অনেকটা বুঝতে পারি কী ঘটেছে। দ্বিতীয় আবিষ্কার–মিসেস জেভিয়ারের ফিরে পাওয়া নেকলেস–যা নকল!
নকল!
–হ্যাঁ! ওটা নকলই। আসলটা রমা মেরে দিয়েছিল এবং নকলটা …
বলছি। সে আমাকে ভুল বুঝিয়ে সিঁড়ির মুখে পাহারা দিতে বলল, এবং নেকলেসটা রাখতে গেল। আঃ, তখনই সন্দেহ করা আমার উচিত ছিল। কারণ। তেতলার ঘরের চাবি…
–চাবি কোনও প্রশ্ন নয় ওর কাছে। দেখবেন, কবে ওই তালার ছাঁচ নিয়ে গিয়ে চাবি তৈরি করিয়ে নিয়েছিল। ধরা পড়ে যাবে। আর কয়েকটা মিনিট পর দেখতে পারবেন আপনার জাল প্রেমিকাকে!
কর্নেল হাসতে লাগলেন। আমার মন দুঃখে ভেঙে পড়ছিল। হায় রাখী! চিঠিতে অত গভীর প্রেম আর সৌন্দর্যময় ব্যক্তিত্বের প্রমাণ দিয়েছিলে–বাস্তবে তুমি যাই হও, তোমাকে মনেপ্রাণে বরণ করে নিতে এতটুকু বাধত না!
কর্নেল বললেন–দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক গৌতমবাবু। আপনারা সাহিত্যিকরা অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। কিন্তু তত চালাকচতুর নন। প্র্যাকটিকাল হওয়া আপনাদের ধাতে নেই।
এমন সময় সেই গুঁফো সেন দৌড়ে এল–কর্নেল! আসামী ধরা পড়েছে। আসল নেকলেস আর একগোছ চাবি পাওয়া গেছে। পিস্তল ছোঁড়ার চেষ্টা করেছিল কী সাংঘাতিক মেয়ে!
কর্নেল বললেন–এই যে আলাপ করিয়ে দিই–বহরমপুরের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর রমেন সেন। ইনিই রমাকে সারা পথ ফলো করে এসেছিলেন!
যন্ত্রের মতো গুঁফো সেনকে নমস্কারের জবাব দিলুম। সে বলল–আপনি হাওড়ায় আমাকে জিগ্যেস করলেন চন্দনপুর এক্সপ্রেস কোন প্লাটফর্মে? মনে পড়ছে?
না তো।
গুঁফো সেন হাসল–তখন অত লক্ষ করার মুড ছিল না আপনার।
কর্নেল বললেন–তাহলে এগোনো যাক্। আসুন গৌতমবাবু, আপনার কিছুক্ষণের সঙ্গিনীকে এবার অন্যরূপে দেখবেন আসুন।
আমি করজোড়ে বললুম–ক্ষমা করবেন কর্নেল।
–কিন্তু আপনাকে এখন পুলিশের দরকার হবে স্যার। গুঁফো সবিনয়ে বলল।–এবার আপনাকে আগাগোড়া একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে যে।
–ঠিক আছে, দেব। চলুন–। কিন্তু ওই শয়তানীর সামনে নয়–নেভার।
ওঁরা দুজনে হেসে উঠলেন। সুটকেসটা তুলে নিয়ে ভারি পা দুটো কোনও ভাবে টেনে নিয়ে চললুম। যেতে যেতে গুঁফো সেন বলল–গত রাত্রে আর এক মিনিট আগে ওপরে গেলে হতভাগিনী রাখীকে বাঁচাতে পারতুম। আমি ব্যাপারটা এভাবে দেখিনিজানেন? অর্থাৎ রাখীই যে আপনার সত্যিকার প্রেমিকা এবং সে এতদূর চলে এসেছে, জানতুম না। কীভাবে জানব বলুন? শুধু নির্দেশ আছে রমা যেখানে যাচ্ছে ওকে ফলো করতে হবে। এটা কর্তাদের স্ট্যাণ্ডিং নির্দেশ। তাই বরাবর হোস্টেলের দিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা। হাওড়া স্টেশনে এসে আপনার সঙ্গে রমাকে দেখে ভাবলুম নিশ্চয় বড় শিকারে যাওয়া হচ্ছে। আপনাকেও ভাবলুম কোনও বড় মাল। সাহিত্যিক গৌতম চৌধুরী যে আপনি, কেমন করে জানব? পরে জেভিয়ার্স লজে এসে জানলুম। তখন আরও শিউরে উঠলুম। সর্বনাশ, নিরীহ শিল্পী ভদ্রলোককে শয়তানী ফাঁদে ফেলেছে যে। সাবধান করার স্কোপ পেলুম না।
গুঁফো সেন অনর্গল বকবক করতে করতে একটা জিপের সামনে দাঁড়াল। দেখলুম পুলিশের জিপ। উঠে বসলুম তিনজনে। জিপটা স্টার্ট দিল।
আমাদের আগে-আগে একটা কালো প্রিজনভ্যান যাচ্ছিল। জানি, ওর মধ্যে সেই রহস্যময়ী যুবতীটি খাঁচায় বন্দী বাঘিনীর মতো ছটফট করছে। এখন তো আমি ওর কেউ নই। সামনে গেলে মাংস ছিঁড়ে খাবে। এখন আমি ওর ঘোর শত্রু।
বাঁকের মুখে সমুদ্র দেখা দিল। সেই সমুদ্রবর্ষার দুরন্ত উচ্ছ্বাসে বিক্ষুব্ধ। এখন তাকে মনে হলো না প্রেমের আবেগে চঞ্চল হয়েছে। মনে হলো প্রচণ্ড দুঃখে ক্রোধে কান্নায় ফেটে পড়ছে। চোখে জল এসে গেল। রুমাল চাপলুম।