প্রথম স্তর
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। নাটকের নাম পরগাছা।
পরগাছার প্রতি আমার খেয়ালি প্রকৃতিবিদ বন্ধুর আসক্তিকে প্রায় পাগলামি বলা চলে। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিরল প্রজাতির পরগাছার খোঁজে দুর্গম বনজঙ্গল পাহাড়ে হন্যে হয়ে ঘোরা ওঁর স্বভাব। কিন্তু এক্ষেত্রে ওঁর সেই প্রিয় উদ্ভিদটি তো নিছক একটি নাটকের নাম! নামটিই কি ওঁকে টেনেছিল?
প্রশ্নটি অবশ্য নাটক দেখে বেরিয়ে আসার পর তুলেছিলাম। তবে তার আগে নাটকটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বলা উচিত।
মঞ্চের মাঝখানে একটি ক্ষয়াখর্বুটে গাছ, যার অল্প কিছু বিবর্ণ পাতা বোঁটায় টিকে আছে মাত্র। গাছটার তলায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে একটা আধপাগলা লোক। সে মাঝে মাঝে বেসুরো গলায় অদ্ভুত কী সব গান গায়। মঞ্চের ডানদিকে কয়েকটি কুঁড়েঘরের অংশ দেখে বোঝা যায় একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের লোকের জীবনের সঙ্গে গাছটার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কাজকর্মের শেষে তারা গাছটার তলায় এসে ভিড় জমায়। আড্ডা দেয়। রসিকতা করে। আধপাগলা লোকটাকে নিয়েও তাদের হাসি-তামাশা চলে।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। হঠাৎ একদিন গ্রামের লোকের তুমুল কৌতুক আর হাসিতে অতিষ্ঠ সেই আধপাগলা বুড়ো চেরা গলায় ঘোষণা করে, সাবধান! এ গাছই তোদের জীবন। এর একটি করে পাতা তোদের একেক জনের জীবনের পরমায়ু। একটি করে পাতা ঝরবে। তোরা একজন করে মারা পড়বি।
অবিশ্বাসের হা হা হা হা অট্টহাসির মধ্যে দেখা যায় একটা পাতা খসে পড়ল এবং আচম্বিতে একটা লোক বুক চেপে ধরে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
এবার নাটকের গতি হয়ে উঠল জোরালো। প্রথমে সন্দেহ এবং দ্বিধা, তারপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড আতঙ্ক। আবার একটা পাতা খসে পড়ে। একটা মৃত্যু আসে। বিভীষিকার প্রতীক হতে থাকে জীর্ণ প্রাচীন সেই গাছ। একটার পর একটা পাতা ঝরে যায়। একের পর এক জীবনের পতন ঘটে। আধপাগলী লোকটা বারবার গলায় ঘোষণা করে, সাবধান! সাবধান!
রাগী যুবকরা কুড়ুল হাতে ছুটে আসে। আধপাগলা লোকটা বলে, খবর্দার! গাছটা কেটে ফেললে একসঙ্গে তোরা সবাই মারা পড়বি।
যুবতীরা ঘটে জল নিয়ে এস বলে, তাহলে আমরা একে বাঁচিয়ে তুলি। তারা গাছের গোড়ায় জল ঢালে। গাছটিকে ঘিরে তারা নেচেনেচে গান গায়। আধপাগলা লোকটা বলে, ভুল! ভুল! তোদের জলে গাছটায় নতুন পাতা গজাবে, আর তোদের। গর্ভে আসবে সন্তান। কিন্তু তারাও বাঁচবে না। পাতা ঝরবে। তারা মরবে।
তা হলে উপায়?
এবার নাটকের ক্লাইম্যাক্স। লোকটা আঙুল তুলে বলে, ওই দ্যাখ সবাই। গাছের ডালে একটা বিষাক্ত পরগাছা গজিয়ে আছে। গাছের সব রস শুষে নিয়ে ডাগর হয়ে ফুল ফোঁটাচ্ছে। ওই পরগাছা ওপড়াতে হবে। তবেই তোরা বাঁচবি।
যাই হোক, আরও কয়েকটি মৃত্যু এবং প্রবল হাঙ্গামার পর পরগাছাটা ওপড়ানো হলো। হাততালির মধ্যে নাটকও শেষ হলো। পাশের এক দর্শককে বলতে শুনলাম, সর্বহারা শোষিতশ্রেণী এবং পরগাছারূপী শোষক শ্রেণীর সংগ্রাম হে কালীপদ! বুঝলে তো?
কালীপদ কী বলল শুনতে পেলাম না। কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে ভিড় ঠেলে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। ওঁর মুখটা রীতিমতো গম্ভীর।
অক্টোবর মাসের রাত সাড়ে আটটায় টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সবে। গাড়িতে উঠে কর্নেল চুরুট ধরালেন। স্টার্ট দিয়ে বললাম, বোগাস! একেবারে প্রচারধর্মী। তবে নাচগান অভিনয় দিয়ে জমিয়েছে বেশ।
কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, হঁ, নাটক মানে তো তাই। কিন্তু আমার অবাক লাগছে। পরগাছা আপনার প্রিয়, তা জানি। তাই বলে পরগাছা নামের রদ্দি তত্ত্বে ঠাসা নাটক দেখতে আপনার এত উৎসাহ রহস্যময়।
কর্নেল তেমনই গম্ভীরমুখে বললেন, রহস্যময় বলতেও পারো। তবে বিষয়টি সত্যি সিরিয়াস।
অবাক হয়ে বললাম, তার মানে?
নাটকটার অন্য একটা মাত্রা আছে। আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ওই মাত্রাটা অত্যন্ত বাস্তব এবং সত্যি ভয়ঙ্কর। বিষাক্ত পরগাছা! হ্যাঁ, জয়ন্ত। কোনও কোনও পরগাছায় লাক্ষা জাতীয় কীটের জীবাণু থাকে। আমি দেখেছি, লাক্ষার লোভে ওই অর্কিড জাতীয় পরগাছা এনে বিশাল গাছের ডালে আটকে দেওয়া হয়। কালক্রমে গাছটা শুকিয়ে মারা পড়ে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমশ পাশের গাছগুলোতেও সেই বিষাক্ত অর্কিড় ছড়িয়ে পড়ে। কী ভাবে বলি। একটা অর্কিডের ফুলের রেণু থেকে প্রায় ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা বাতাসে ছড়িয়ে যায়। গাছ থেকে গাছে এভাবে অর্কিড ছড়ায়। তো আমি দেখেছি, এক অসাধু লাক্ষা ব্যবসায়ী লাক্ষার লোভে একটা রাস্তার ধারে অসংখ্য গাছ ওই বিষাক্ত অর্কিডের সাহায্যে মেরে ফেলেছে। লাক্ষাটা তার লাভ। শুকনো গাছগুলো কাঠের ব্যবসায়ীর লাভ। তুমি যদি তোমার খবরের কাগজের কাজে কখনও মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে সড়ক ধরে কান্দি যাও, লক্ষ্য কোরো সারবন্দি গাছের কঙ্কাল …
এক্সকিউজ মি।
চমকে উঠে বাঁদিকে তাকালাম। আমাদের গাড়ি থিয়েটার রোডে পৌঁছে একটা রাস্তার মোড়ে ঈষৎ জ্যামের দরুন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টিটা বেড়ে গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এক সিক্তবসনা যুবতী কর্নেলের কাছে ঝুঁকে কথাটি উচ্চারণ করেছিল। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য।
একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না। ভিজে যাচ্ছি কিন্তু সেজন্যও না। যুবতীর কণ্ঠস্বরে ছটফটানি ছিল এবং সে বারবার ভয়-পাওয়া চোখে ফুটপাতের দিকে তাকাচ্ছিল। প্লিজ যদি আমাকে একটু লিফট দেন। দুটো মস্তান মতো লোক আমার পিছু নিয়েছে।
কর্নেল ঘুরে পেছনকার দরজার লক খুলে দিলেন। যুবতীটি তক্ষুণি গাড়িতে ঢুকে পড়ল। বুঝলাম, কর্নেলের সৌম্যকান্তি এবং ঋষিসুলভ দাড়িই তাকে সাহায্যপ্রার্থিনী করেছে। না হলে এমন অবস্থায় কোনও অচেনা লোকের গাড়িতে কোনও একলা যুবতী এভাবে ঢুকে পড়ত না।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যেতে চান?
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।
অসুবিধে হবে না। আমরা এলিয়ট রোডে যাচ্ছি। জয়ন্ত, সামনের মোড়ে ঘুরে পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে যাওয়া যাবে। কী বলো?
মনে মনে বিরক্ত হলেও বললাম, ঠিক আছে।
জ্যাম ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। কর্নেল আবার অর্কিড নিয়ে পড়লেন। আমার মন ব্যাকসিটে। মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে এবং কথাবার্তাও যেটুকু শুনলাম, মার্জিত উচ্চারণ–ভদ্ৰপরিবারের বলেই মনে হচ্ছে। স্বভাবত আগ্রহ ছিল, কী তার নাম, কোথায় একা গিয়েছিল এবং কী ভাবে দুটো লোক তার পিছু নিল। কিন্তু আমার বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটি কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দিলেন না। পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকে বললাম, কোথায় নামবেন বলবেন।
বেশি দূরে নয়। বলে সে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল। কিন্তু ফ্রি স্কুল স্ট্রিট প্রায় অন্ধকার। বড় দোকানপাট আজ রবিবারে বন্ধ। শুধু পান-সিগারেটের দোকানে মোম জ্বলছে। লোডশেডিং এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
কিছুক্ষণ পরে সে বলে উঠল, এখানে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে শুধু অসংখ্য ধন্যবাদ বলে অন্ধকারে বাঁদিকের ফুটপাতে অদৃশ্য হলো।
কর্নেল বললেন, তা হলে দেখ জয়ন্ত, যা বলছিলাম–
ঠিকই বলছিলেন। জীবনের সর্বত্র নাটক। রাস্তাঘাটেও নাটক। হাসতে হাসতে এলাম। জানি না এটা একই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক কিনা বলে গাড়ি ডাইনে ঘুরিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকলাম। দূরে আলোকিত বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছিল।
ডার্লিং?
ঝটপট বললাম, প্লিজ কর্নেল। আর কখনও ডার্লিং বলবেন না। আপনার ডার্লিং শুনে আমাদের কাগজের জনৈক সমালোচক বেজায় খাপ্পা হয়ে গেছেন। তা ছাড়া আপনি কথায় কথায় বড্ড বেশি ইংরেজি বলেন। এও নাকি ওঁর পক্ষে বিরক্তিকর।
কর্নেল কান করলেন না আমার কথায়। বললেন, ডার্লিং! অর্কিড বা পরগাছা গাছপালার জগতে যেমন, মানুষের জীবনেও তেমনই স্বাভাবিক একটা জিনিস। আসলে মানুষের সভ্যতার একটা অদ্ভুত লক্ষণও কিন্তু এই অর্কিড জাতীয় পরজীবী সম্প্রদায়। হয়তো বা আমরা প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও সময় অর্কিডের ভূমিকা নিয়ে বেঁচে থাকি।
আহ্ কর্নেল! দার্শনিক তত্ত্ব থাক। ওই মেয়েটি সম্পর্কে কী মনে হলো, বলুন।
ওকেও তুমি অর্কিড বলতে পারে।
কী মুশকিল! আপনার মাথায় অর্কিডের ভূত ঢুকে গেছে দেখছি।
জয়ন্ত! মেয়েটি পরজীবী শ্রেণীর।
তার মানে?
আমরা একজন কলগার্লকে লিফট দিলাম।
গাড়ির গতি কমিয়ে বললাম, বলেন কী!
যে বাড়িতে ও ঢুকে গেল, সেই বাড়িতে কিছুদিন আগেই পুলিশ হানা দিয়েছিল। তুমি সাংবাদিক। তোমার মনে পড়া উচিত, এক ডজন কলগার্লকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল। ওদের কেউ কেউ নার্কোটিকসের কারবার করত। সেদিনকার খবর।
একটু হেসে বললাম, বাড়িটা আপনার চেনা দেখছি।
কর্নেল এতক্ষণে হাসলেন। শুধু বাড়িটা নয়, মালিকও আমার চেনা। ভদ্রলোক একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। হ্যারি ওলসন নাম। গোবেচারা নিরীহ মানুষ। বয়স প্রায় আশির ওপরে। আসলে কলগার্ল বা নার্কোটিকসের ব্যাপারটা ওঁর এক্তিয়ারের বাইরে। তো যা বলছিলাম–সেই অর্কিড, বিষাক্ত অর্কিড শরীরে গজিয়েছে হ্যারি ওলসনেরও। ফলে তার অবস্থা কল্পনা করো।
কল্পনা করছি এখন সবখানে সবকিছুই অর্কিডে ঢাকা। আমার ভয় হচ্ছে কর্নেল, শেষে আপনি না আপনার প্রিয় ষষ্ঠীচরণকেও অর্কিড ভেবে বসেন। তা হলে কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে কফির আশা বৃথা।
কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। লক্ষ্য করলাম, আবার চোখ বুজে হেলান দিয়েছেন। দাঁতে কামড়ানো জ্বলন্ত চুরুট।
কিছুক্ষণ পরে এলিয়ট রোডে কর্নেলের সানি ভিলার প্রাঙ্গণে ঢুকে গাড়ি পোর্টিকোর তলায় দাঁড় করালাম। আমার আর সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় ওঠার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কর্নেল আমাকে যেতে দিলেন না। অগত্যা গাড়ি পার্ক করে রেখে ওঁর সঙ্গ ধরতে হলো।
ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে চাপাস্বরে বলল, এক বুড়োবাবু এয়েছেন। বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। ফিরতে রাত্তির হবে। উনি বললেন, যত রাত্তির হোক, রোয়েট করব। তা–
তিনি কি রোয়েট করছেন?
আজ্ঞে। ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, জোর করে ঢুকে বললেন, আমি তোমার বাবামশাইয়ের বন্ধু।
কর্নেল তার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, শীগগির কফি।
ছোট্ট ওয়েটিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমের পর্দা তুলে ঢুকে উনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাল্লো রায়সায়েব?
ঢুকে দেখি, প্রায় কর্নেলের বয়সী এবং তাঁর মতোই দশাসই চেহারার এক ভদ্রলোক সোফায় বসে আছেন। কিন্তু তাকে কেন কর্নেল রায়সায়েব বলে সম্ভাষণ করলেন বোঝা গেল না। ভদ্রলোকের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। পাশে একটা কাপড়ের ব্যাগ। চেহারায় অবশ্য বনেদী আভিজাত্যের ছাপ আছে। দেখনসই পাকা গোঁফ এবং চুলও সাদা। তবে কর্নেলের মতো টাক নেই।
ভদ্রলোক বললেন, বিকেলে হাওড়া পৌঁছেছি। স্টেশন থেকে ফোনে লাইন পেলাম না। তার ওপর আজকাল আপনাদের কলকাতার কী অবস্থা হয়েছে! ট্যাক্সি, পেতে সে এক হাঙ্গামা। সারা রাস্তা জ্যাম। ব্যস। তারপর শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। অবশেষে যদি বা এসে পৌঁছুলাম, শুনি আপনি নেই।
কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। ইনি অমরেন্দ্র সিংহরায়। জয়ন্ত, তুমি কি কখনও রাঙাটুলি গেছ? ধানবাদ খনি এরিয়া থেকে সামান্য দূরে এক অসাধারণ জায়গা। শহর বলতে পারো, আবার গ্রামও বলতে পারো। টিলাপাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা আর নদী–তো রায়সায়েব! এর নাম আমার কাছে শুনে থাকবেন। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
আমরা নমস্কার বিনিময় করলাম। অমরেন্দ্র বললেন, নামটা শুনে থাকব। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল জয়ন্তবাবু। আপনি কাগজের লোক! নিশ্চয় বটুক চোধুরীকে চিনতেন। আমাদের এলাকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বটুক চৌধুরী। হঠাৎ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিয়ে কত তোলপাড়। পরে ওর বডি পাওয়া যায় ড্যামের জলে।
বললাম, নাহ্। চিনি না তাকে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, চৌধুরীসায়েবের ভূত কি এখনও রায়সায়েবের পিছু ছাড়েনি?
অমরেন্দ্র অমনই গম্ভীর হয়ে গেলেন। চাপাস্বরে বললেন, এবারকার ব্যাপারটা একবারে অন্যরকম। গত বছর তো আপনি গিয়ে রহস্যটা ফাঁস করলেন। যোগেনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এবার উড়ো চিঠি নয়। আপনি ভূত বললেন–কতকটা তা-ই।
যেমন?
প্রায় প্রতি রাত্রেই এটা হচ্ছে। অদ্ভুত সব শব্দ। বুঝলেন? হলঘরের কাঠের সিঁড়িতে, কখনও ছাদে, আবার কখনও দোতলায় আমার ঘরের বারান্দায় হাঁটাচলার শব্দ। ফিসফিস কথাবার্তা। অমরেন্দ্র সিংহরায়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। অথচ দেখুন, আলশেসিয়ানটা ছাড়া থাকে। সে-হারামজাদার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। তাই প্রথমে ভেবেছিলাম, যোগেনের মতো বেচুও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। বেচুকে রাত্রে ঘরে তালা আটকে রাখলাম। কিন্তু তবু সেই ভুতুড়ে কারবার। টর্চ বন্দুক নিয়ে বেরোই। সুনন্দা, সতু আমার সঙ্গে থাকে। ছাদে উঠে দেখি কেউ নেই। তারপর গত পরশু রাত্রে নিচের হলঘরে আর্তনাদ শুনলাম। সুনন্দা, সতু, বেচু সবাই। শুনেছিল। আলো জ্বালাই থাকে সারারাত্রি। কিন্ত সেরাত্রে তখন লোডশেডিং ছিল। হলঘরে সবাই দেখলাম কেউ নেই, কিন্তু কার্পেটে খানিকটা রক্ত পড়ে আছে।
কুকুরটা তখন কোথায় ছিল।
বাইরে। সতু হলঘরের দরজা খুলতেই লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকল।
অবাক হয়ে শুনছিলাম। বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু কর্নেল তুষো মুখে শুনছেন এবং গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে পারলাম না, রক্ত না রঙ, পরীক্ষা করা হয়েছে?
অমরেন্দ্র সিংহরায় হাসবার চেষ্টা করে বললেন, জয়ন্তবাবু! রক্ত আর রঙের তফাত বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। তা ছাড়া সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হলো, কুকুরটাকে আবার বাইরে বের করে দিয়ে হলঘরের দরজা আটকে আমরা সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছি, বেচু মানে আমাদের বাড়ির সারভ্যান্ট চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ} ও নিচের একটা ঘরে থাকে। সতু টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। বেচু বলল, ওই দেখুন। একটা কালো বেড়াল রক্ত খাচ্ছে। সত্যি তা-ই! তাড়া করতেই বেড়ালটা বেচুর ঘরে ঢুকল। সেখানে তাড়া খেয়ে খোলা জানালা গলিয়ে পালাল।
বললাম, তবু কুকুরটার কোনও সাড়া পেলেন না?
নাহ।
ষষ্ঠী ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল এতক্ষণে। বাইরে বৃষ্টিটা সমানে ঝরছে। ভূতের গল্প শোনার মতো পরিবেশ বলা চলে। ভদ্রলোকের মুখ দেখে বুঝতেই পারছিলাম না উনি বানিয়ে বলছেন কিংবা তিলকে তাল করছেন, নাকি সত্যিই এই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্য আমার এই প্রখ্যাত রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধুর কাছে ছুটে এসেছেন?
কর্নেল বললেন, কফি খান রায়সায়েব। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
কফিতে চুমুক দিয়ে অমরেন্দ্র বললেন, গতরাত্রে তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু ভোরবেলা আমার ঘরের দরজা খুলে দেখি, একটা দলাপাকানো কাগজ পড়ে আছে। যা অবস্থা চলেছে, স্বভাবত কৌতূহল জাগল। কাগজটার ভাঁজ ঠিকঠাক করে দেখলাম কী সব ইংরেজিতে লেখা আছে। একবর্ণ বুঝলাম না সুনন্দা আর সতুকে দেখালাম। ওরাও বুঝতে পারল না। তখন তিনজনে মিলে ঠিক করলাম, আবার আপনার শরণাপন্ন হওয়া দরকার। এই দেখুন।
অমরেন্দ্র পাঞ্জাবির ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। কাগজটার অবস্থা দেখে বোঝা গেল, ওটা সত্যি দলপাকানো ছিল। টেনে ঠিকঠাক করা হয়েছে। কর্নেল ভাঁজ খুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতশ কাচ বের করলেন। পড়ার পর শুধু বললেন, হুঁ। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
অমরেন্দ্র বললেন, যোগেনের হাতের লেখা নয়, এটুকু আমি বুঝতে পেরেছি। আপনিই সেবার যোগেনের হাতের লেখা সনাক্ত করেছিলেন।
কর্নেল সায় দিলেন। বললাম, দেখতে পারি? কর্নেল কাগজটা আমাকে দিলেন। লাল ডটপেনে লেখা আছে :
CHAICHICHINGFANK
বার কতক পড়ার পর বললাম, দেখুন, আমার মনে হচ্ছে এতে লেখা আছে চাই চিচিং ফাঁক।
কর্নেল হাসলেন। হুঁ, ঠিক ধরেছ। চাই চিচিং ফাঁক।
অমরেন্দ্র হাসলেন না। রুষ্ট মুখে বললেন, সেটাই তো অদ্ভুত। আমার বোনপো সতুও তা-ই পড়ল। কিন্তু মানেটা কী এর? আরব্য উপন্যাসের আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পে চিচিং ফাঁক বললে নাকি লুঠের মালরাখা ঘরের দরজা খুলে যেত। আমি আলিবাবা না চোরদের সর্দার?
কর্নেল সকৌতুকে বললেন, তা ছাড়া আপনি আলিবাবার ভাই কাশেমও নন। কক্ষনো নই। সমস্তটাই দুর্বোধ্য আমার কাছে। অমরেন্দ্র কফিতে চুমুক দিয়ে ফের বললেন, আপনি বলছিলেন বটুক চৌধুরীর ভূত আমার পিছু ছাড়েনি। আপনি জ্ঞানী মানুষ। ঠিক ধরেছেন। বটুকের লাশ সন্দেহ করে ড্যামের জলে পাওয়া বডিটা পুলিশ ওর চেলাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘটা করে দাহও করেছিল ওরা। কিন্তু আমার সন্দেহ, বটুক মারা পড়েনি। কোনও কারণে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। গতবার আমার কর্মচারী যোগেনকে দিয়ে সে-ই আড়াল থেকে অদ্ভুত সব উড়ো চিঠি লিখত। এখন নিশ্চয় কোনও তান্ত্রিক সাধুর সাহায্যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। কেন তা আপনিই বিশদ জানেন।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, এ যুগে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাপারটাই হয়তো এমন যে পরস্পরের প্রতি রাগ মরে গিয়েও পড়ে না।
হাসি চেপে বললাম, আমাদের নিউজ ব্যুরোর চিফ নগেনদা রাজনৈতিক রাগ বলে একটা টার্ম ব্যবহার করেন।
অমরেন্দ্র কফির পেয়ালা শেষ করে বললেন, কিন্তু আমি তো কবে রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। গত ভোটে আমি তো বটুকের সুবিধে করে দিতেই শেষ মুহূর্তে নমিনেশন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আমার পোষাল না। বটুকের অবশ্য অন্য ব্যাপার। এরিয়ার মাফিয়া ডন ওর হাতে ছিল। যাইহোক, কর্নেল! প্লিজ বটুকের ভূতের হাত থেকে আমাকে বাঁচান।
বলে রায়সায়েব উঠে দাঁড়ালেন। একটা ফোন করব। অলরেডি আপনার অসাক্ষাতে একটা করেছি–আপনার ওই লোকটিকে বলেই করেছি অবশ্য। হেমেনকে খবর দিয়ে গাড়ি পাঠাতে বলেছিলাম। দশটা বাজতে চলল। এখনও গাড়ি এল না। অদ্ভুত ছেলে তো।
কর্নেল বললেন, রাস্তায় জল জমে গেছে হয়তো। আপনি ফোন করুন।
অমরেন্দ্র রিং করে সাড়া পেলেন। বউমা নাকি? আমি বলছি–হ্যাঁ। হেমেন– আচ্ছা। ঠিক আছে। ফোন রেখে বললেন, বেরিয়েছে এক ঘণ্টা আগে। আপনি ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় জল জমে নিশ্চয় কোথাও আটকে গেছে। বৃষ্টি থেমেছে মনে হচ্ছে। আমি বরং আর অপেক্ষা না করে বাসে বা মিনিবাসে চলে যাই। আপনাকে সব জানালাম। আমি কালই দুপুরের ট্রেনে ফিরে যাব। আপনি কবে যাচ্ছেন বলুন?
কর্নেল বললেন, চেষ্টা করব শীগগির যেতে। রাঙাটুলির ওদিকে জঙ্গলে একরকম অর্কিড দেখেছিলাম। তখন তত মনোযোগ দিইনি। সম্প্রতি একটা বইয়ে ওই অর্কিডের ছবি দেখলাম। আশ্চর্য ব্যাপার। এই অর্কিড–
প্লিজ কর্নেল! অর্কিড পরে হবে। সঙ্গে তোক দেব। যত খুশি কালেক্ট করবেন। আগে বটুকের ভূতটাকে শায়েস্তা করুন। অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার দিকে ঘুরে নমস্কার করলেন। জয়ন্তবাবুকেও আমন্ত্রণ রইল। আচ্ছা, চলি।
ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন কর্নেলের রায়সাহেব। কর্নেল সেই কাগজটা আর আতশ কাচ টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। এতক্ষণে হাসির সুযোগ পেলাম। হাসতে হাসতে বলালম, আপনার বরাতে সব অদ্ভুত মক্কেল জোটে। এই রহস্যটাও কম অদ্ভুত নয়। চিচিং ফাঁক রহস্য।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ব্যাপারটা সম্ভবত হাস্যকর নয়, ডার্লিং। রাঙাটুলিতে গেলে তুমি খানিকটা আঁচ করতে পারবে। বটুক চৌধুরী রায়সায়েবের শ্যালক। হেমেনের কথা শুনলে একটু আগে। হেমেন্দ্র ওঁর একমাত্র ছেলে এবং একজন মস্ত ব্যবসায়ী। আমদানী রফতানির কারবার আছে। যতটা জানি, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। রায়সায়েবের কাছে থাকেন ওঁর একমাত্র মেয়ে সুনন্দা। ভদ্রমহিলা বিধবা। সতুর কথা শুনেছসত্যকাম। সুনন্দা দেবীর ছেলে। মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। দাদামশাই তাকে মানুষ করেছেন। যাইহোক, রাত বাড়ছে। তোমাকে সল্ট লেকে ফিরতে হবে। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যাও।
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, হেমেনবাবু কোথায় থাকেন?
বেহালায়। কাজেই তোমাকে কখনই বলা যেত না রায়সায়েবকে একটা লিফট দাও।
হাসলাম। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মেয়েটির মতো কোনও মেয়ে হলে আমি বেহালা কেন, কাকদ্বীপে পৌঁছে দিয়ে আসতে রাজী।
কর্নেল জিভ কেটে বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত তুমি একজন কলগার্লকে ভুলতে পারোনি দেখছি।
আমার কিন্তু ওকে মোটেই কলগার্ল বলে মনে হয়নি। আপনি সম্ভবত ভুল করছেন। মেয়েটি সত্যি ভয় পেয়ে আমাদের গাড়ির কাছে ছুটে এসেছিল। ওর কথাবার্তা, তা ছাড়া চুপচাপ বসে থাকা–সব মিলিয়ে একজন বিপন্ন মেয়েরই হাবভাব লক্ষ্য করেছি।
কথাগুলো জোর দিয়ে বললাম। শোনার পর কর্নেল একটু হাসলেন। বিপন্ন হতেই পারে। কলগার্লদের জীবন তো সবসময় বিপন্ন।….
.
কর্নেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্ক সার্কাস হয়ে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যেতে যেতে সারাপথ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মেয়েটির কথাই ভাবছিলাম। এ যাবৎ কখনও রাস্তাঘাটে দিনে বা রাতে কোনও একলা, মেয়েকে গাড়িতে লিফট দেওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি, যদিও গপ্পে এসব অনেক পড়েছি। সৌভাগ্য মানে, গল্পে এসব ক্ষেত্রে প্রেমের সুযোগ এসে যায়। দুর্ভাগ্য মানে, অনেক সময় নাকি লিফট দিতে গিয়ে সাংঘাতিক ব্ল্যাকমেলের পাল্লায় পড়তে হয়।
কিন্তু মেয়েটিকে কর্নেল কলগার্ল বলে সনাক্ত করেছে, এমন কি বাড়িটাও চেনেন। এজন্যই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। গাড়ির আলোয় কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওর যে মুখ দেখেছি সেই মুখে সৌন্দর্য ও বিপন্নতার ছাপ ছিল। সুন্দরী মেয়েরা কেন নষ্ট হয়ে যায়, এ ধরনের সামাজিক-নৈতিক প্রশ্নও আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল।
গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে পেছনের জানালার কাচ তুলছিলাম। সেই সময় গ্যারাজের আলোর ছটায় চোখে পড়ল ব্যাকসিটে একটা ছোট্ট পার্স পড়ে আছে। একটু চমকে উঠেছিলাম দেখামাত্র। পার্সটা তুলে নিলাম। আমার হাত কাঁপছিল এ কথা অস্বীকার করছি না। পার্সটা নিশ্চয়ই সে ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি। মানসিক চাঞ্চল্য, আর বৃষ্টিও এই ভুলের কারণ হতে পারে।
বাদামি রঙের হাল্কা পার্সটা নিয়ে আমার দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকলাম, তখন আমার অন্য প্রচণ্ড উত্তেজনা টগবগ করছিল। মেয়েদের পার্স আমার কাছে সবসময় কৌতূহলের বস্তু। সেই কৌতূহলে রোমান্টিকতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে উত্তেজনাই আমাকে ক্রমশ নার্ভাস করল।
পার্স খুলতেই প্রথমে চোখে পড়ল একটা নেমকার্ড। তারপর তিনটে চাবির একটা রিং। কিছু খুচরো পয়সা। পার্সের ভেতরে একপাশের খোঁদলে, শ দেড়েক টাকার নোট। অন্যপাশের খোঁদলে খুদে আয়না, লিপস্টিক, এইসব টুকিটাকি প্রসাধনী।
জিনিসগুলো টেবিলে রাখছিলাম। আমার এই কাজটা অশালীন বলা চলে। কিন্তু অস্বস্তিকর উত্তেজনাটা আমাকে ভূতগ্রস্ত করেছিল। আরও খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তলার দিকে ইঞ্চি তিনেক লম্বা জিপ। জিপ টেনে খুলে দেখি, ভেতরে একটা পুরনো হলদেটে কাগজের চিরকুট। তাতে লেখা আছে :
TL-2. R-3. L-1. R-4
পরপর কয়েকটা সিগারেট টানার পর প্রথমেই মাথায় এল, পার্সে চাবি থাকায় মেয়েটি তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারছে না।
এত রাতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে গিয়ে পার্স ফেরত দিতে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু কর্নেলের মুখে ওই বাড়ির কথা শোনার পর সেটা সম্ভব নয়।
নেমকার্ডটা তুলে নিলাম। পুরনো কার্ড। ওতে একজন অ্যাডভোকেটের নামঠিকানা ছাপানো আছে। অলক সেনগুপ্ত। ঠিকানা শ্যামবাজার এলাকারই কোনও গলির। মেয়েটি কি কখনও কোনও মামলায় ফেঁসেছিল? কর্নেল বলছিলেন, সম্প্রতি ওই বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়ে কলগার্লদের গ্রেফতার করেছিল। এই মেয়েটি যদি কলগার্ল হয়, সে গ্রেফতার হয়ে থাকলেও ছাড়া পেয়েছে। তার আইনজীবীর কার্ড হতেও পারে। কার্ডটা জরাজীর্ণ হওয়ায় অনেক ব্যাখ্যা সম্ভব। তবে এ নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর মানে হয় না।
রাঙাটুলির রায়সায়েবের সেই চিচিং ফাঁক চিরকুটের মতো এই অদ্ভুত চিরকুটটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দায় বরং বৃদ্ধ রহস্যভেদীর ওপর চাপানো যেতে পারে। আপাতত আমার দুশ্চিন্তা, মেয়েটি তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারছে না। আমার এখন কী করা উচিত।
অতএব অগতির গতি আমার ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইডকেই রিং করলাম। কয়েকবার চেষ্টার পর সাড়া পেলাম। সংক্ষেপে ব্যাপারটা বললাম। কর্নেল বললেন, ওর ফ্ল্যাট খুলে দেওয়ার লোক ওবাড়িতে আছে। তুমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম না এলে পালের ভেড়া গুনতে শুরু করবে। পুরনো এবং অব্যর্থ ওষুধ। আর শোনো, তুমি পার্স ফেরত দিতে যেও না। আমাকে সকালে দিয়ে যেও। আমিই দিয়ে আসব। তোমারও আমার সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করবে। ঠিক আছে। যাবে। গুড নাইট!…
পালের ভেড়া গোনার চেষ্টা করিনি। ঘুম না এলে আমার অভ্যাস দুর্বোধ্য বিষয়ের বই পড়া এবং বোঝবার চেষ্টা করা। এই চেষ্টা থেকেই ঘুম অনিবার্যভাবে এসে যায়। তবে এদিন ঘুম ভেঙেছিল প্রায় নটায়। তাড়াহুড়ো করে ব্রেকফাস্ট সেরে কর্নেলের বাড়ি পৌঁছুতে সাড়ে নটা বেজে গেল।
আকাশ ঝকঝকে নীল। রাস্তাঘাট শুকনো। বৃষ্টির পর বাতাসে শেষ শরতের স্বাভাবিক স্নিগ্ধতা ফিরে এসেছে। কর্নেল পার্সটা হাতে নিয়ে ঠিক এভাবেই মার্জিত ভাষায় কিছুক্ষণ ঋতুবন্দনা করে গেলেন। কলকাতায় যদিও সঠিক ঋতু পরিবর্তন টের পেতে সময় লাগে, কর্নেলের ছাদের বাগানে দাঁড়ালে নাকি কিছু লক্ষণ থেকে অবস্থা আঁচ করা যায়। কাজেই রাঙাটুলি আজ ভোরবেলা থেকেই তাঁকে খুব টানছে।
চুপচাপ সিগারেট টানছিলাম। বিরক্ত হয়ে বললাম, পার্সটা খুলে দেখবেন না কি?
কর্নেল হঠাৎ চাপাস্বরে বলে উঠলেন, চেপে যাও ডার্লিং! ভুলে যাও গতরাতে কোনও মেয়েকে লিফট দিয়েছ। এক মিনিট। পার্সটা আমি লুকিয়ে রেখে আসি।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কর্নেল পার্সটা সত্যি পাশের ঘরে কোথাও রেখে এলেন। ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর বলছি।
কিছু বুঝছি না। আপনার সবসময় শুধু হেঁয়ালি।
এই সময় ফোন বাজল। কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন, হালদারমশাই নাকি?…. বলেন কী! আপনার কাছে গিয়েছিল? আপনি সিওর? ….. বুঝেছি। …হাঁ চলে আসুন। জয়ন্ত এখানে আছে। …… হ্যাঁ, ঠিক আছে। রাখছি। চলে আসুন।
বললাম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভদ্রলোক নিশ্চয় কোনও কেস হাতে পেয়েছেন? কর্নেল হাসলেন। পেয়েছিলেন। কিন্তু পা বাড়িয়ে পুলিশের ধমক খেয়ে হটে আসেন। এখন সেই পুলিশই ওঁকে সাধছে। একটু অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রিয় গোয়েন্দা ভদ্রলোক পুলিশের গাড়িতেই এসে পড়বেন।
প্লিজ কর্নেল। আর হেঁয়ালি করবেন না।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, গত রাতে সেই কলগার্ল চন্দ্রিকা রায় খুন হয়েছে।
প্রচণ্ড চমকে উঠলাম। সে কী! কোথায়? কী ভাবে?
নিজের ফ্ল্যাটের ভেতরে। কর্নেল নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন। ভোর ছটায় হ্যারি ওলসন ফোন করে আমাকে জানান, চারতলার ফ্ল্যাটে একটি মেয়ে খুন হয়েছে। সেজন্য পুলিশ তাঁর ওপর ঝামেলা করছে। আমি যেন ওঁকে সাহায্য করতে ছুটে যাই।
আপনি গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। আমার জানার ইচ্ছে ছিল গতরাতের সেই মেয়েটিই কিনা। যদি সে না হয়, তা হলে আমার কিছু করার নেই। তো গিয়ে দেখি, সে-ই। মুখটা মনে ছিল। তুমি তো জানো, মানুষের মুখ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু তত্ত্ব আছে। চন্দ্রিকা রায়ের মুখে বিপন্নতা লেখা ছিল। কিন্তু সেটা এতদুর গড়াবে ভাবতে পারিনি।
ওর ফ্ল্যাটের চাবি তো পার্সে।
নো পার্স। চেপে যাও।
ফ্ল্যাটে ঢুকল কী করে চন্দ্রিকা?
যে ভাবেই হোক, ঢুকেছিল। তারপর খুনী ওকে জবাই করেছে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই জবাই। কর্নেল তেমনই নির্বিকার মুখে বললেন। তোমাকে বলেছিলাম, কলগার্লদের জীবন সবসময়ই বিপন্ন। কেন বিপন্ন সেটা একটু চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশের বক্তব্য অবশ্য একটু অন্যরকম। চন্দ্রিকাকে খুন করা হয়েছে ডাকাতির উদ্দেশ্যে। আজকাল নাকি ফ্ল্যাটে ডাকাতি এবং খুন যে ভাবে হচ্ছে, সেভাবেই। কারণ ওলসনের বাড়ির কলগার্লদের গার্জেন ডিস্কোর কাছে চন্দ্রিকা ছিল এক দুর্মূল্য সম্পদ।
ডিস্কো কে?
এখনও তাকে দেখিনি। জানি না কে সে। জানতেও চাই না। ডিস্কো ইজ ডিস্কো। দ্যাটস অল।
চন্দ্রিকার পার্সের ভেতর শেই কাগজটা—
নো পার্স! কর্নেলের চোখে ভর্ৎসনা ফুটে উঠল। কথাটা বলে উঠে গেলেন জানালার কাছে। পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে নিচের রাস্তা দেখতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পরে সরে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন কর্নেল। সহাস্যে বললেন, পুলিশের জিপে হালদারমশাই আসছেন। ভাবা যায়? চিন্তা করো ডার্লিং! ভদ্রলোক নিজেই চৌত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। রিটায়ার করে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। অথচ পুলিশ ওঁকে সহ্য করতে পারে না এবং উনিও পুলিশকে সহ্য করতে পারেন না। সম্পর্কটা প্রায় সাপে-নেউলে বলা চলে। অথচ এতদিন পরে এই একটা ঘটনায় সাপ-নেউলের চমৎকার গলাগলি। দেখা যাক, এই গলাগালি থেকে চন্দ্রিকা হত্যার কোনও সূত্র বেরিয়ে আসে নাকি!
ঘণ্টা বাজলে ষষ্ঠীচরণ গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার নস্যির কৌটো হাতে হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পিছনে এক পুলিশ অফিসার। হালদারমশাই ধপাস করে বসে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, গুপ্তসায়েবরে জিগান, কী কইছিলাম?
পুলিশ অফিসার গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেলসায়েব কি ডি সি ডি ডি লাহিড়িসায়েবের ফোন পেয়েছেন?
কর্নেল বললেন, অরিজিৎ বলছিল, আপনি যোগাযোগ করবেন। জয়ন্ত, আলাপ করিয়ে দিই। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ অশোক গুপ্ত। আমার স্নেহভাজন বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসবেক পত্রিকার সাংবাদিক।
অশোক গুপ্ত নমস্কার করে বললেন, কাগজে নামটা দেখেছি। একটা অনুরোধ জয়ন্তবাবু। যদি কাগজে কিছু লেখেন, এমন কিছু লিখবেন না যাতে আমাদের তদন্তে ব্যাঘাত ঘটে।
বললাম, কিছুই লিখব না। আমাদের কাগজের ক্রাইম-রিপোর্টার আছে। সে আপনাদের ভার্সানই লেখে। কাজেই যা লেখার সে-ই লিখবে। …
আবার একদফা কফি এল। হালদারমশাইয়ের জন্য তিন ভাগ দুধ মেশানো কফি আনতে ষষ্ঠী ভোলেনি। চুমুক দিয়ে হালদারমশাই সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস! এবার অশোকবাবু কইবেন, নাকি আমি স্টার্ট করব? কর্নেলস্যার কী কন?
কর্নেল বললেন, আপনারটা আগে শুনে নিই।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিশ্র ভাষায় যা শুরু করলেন, তার সারমর্ম এই :
হালদারমশাই মাঝে মাঝে কাগজে তাঁর এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেন। গত সপ্তাহে দিয়েছিলেন। কদিন আগে চন্দ্রিকা রায় তাঁর অফিসে গিয়েছিল। তাকে নাকি প্রায়ই একটা অচেনা লোক টেলিফোন করে জ্বালাতন করছে। কী একটা অদ্ভুত কথা বলছে, যার মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। আগের দিন চন্দ্রিকা নিউ মার্কেটে গিয়েছিল। ভিড়ের ভেতরে কেউ তাকে ফিসফিস করে একই কথা বলে ওঠে। কে বলল, চন্দ্রিকা খুঁজে পায়নি। কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে চলে আসে। হালদারমশাই চন্দ্রিকার কেসটি যথারীতি গুরুত্বসহকারে হাতে নেন। চন্দ্রিকার বাসস্থানের কাছে অর্থাৎ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই বাড়ির সামনে ফুটপাতে পুরো একটা দিন ওত পেতে থাকেন এবং নিজস্ব গোয়েন্দা-পদ্ধতিতে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, বাড়িটা কলগার্লদের খাঁটি। চন্দ্রিকাও একজন কলগার্ল। তবে সেটা কোনও ব্যাপার নয়। চন্দ্রিকা তাঁর ক্লায়েন্ট।
উল্লেখ করা দরকার, হালদারমশাই কেস পেলে যা করেন, অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধরেই ওত পাততে গিয়েছিলেন। ভবঘুরে ফুটপাতবাসীর ছদ্মবেশ। গত পরশু শুক্রবার বিকেলে ফের যান উনি। সেই সময় সেজেগুঁজে চন্দ্রিকা বেরুচ্ছিল। তার পিছু নেন। চন্দ্রিকা পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। হালদারমশাই ভেবেছিলেন, সে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা সাদা গাড়ি এসে থামে এবং চন্দ্রিকা তাতে চাপে। ভবঘুরে টাইপ নোংরা পোশাকপরা লোককে কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারই নেবে না। কাজেই গাড়ির নাম্বার টুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় গোয়েন্দাকে। পরদিন শনিবার মোটর ভেহিকলস ডিপার্টমেন্টে চেনা লোকের সাহায্যে গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা যোগাড় করেন। তারপর সেই ঠিকানায় চলে যান। গিয়েই একটু অবাক হন।
এ পর্যন্ত শুনেই কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বাড়ি?
হালদারমশাই চমকানো গলায় বললেন, অ্যাঁ? আপনি জানেন?
সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি। গতকাল সন্ধ্যায় তাঁরই নাটক পরগাছা দেখতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে জয়ন্তকে নিয়ে গিয়েছিলাম? চন্দ্রিকা গ্রাম্য যুবতীদের দলে অভিনয় করছিল।
আমি কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমিও হালদারমশাইয়ের মতো বলে উঠলাম, অ্যাঁ!
কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। যাই হোক, তারপর কী হলো বলুন হালদারমশাই?
ঝটপট বললাম, কিন্তু থিয়েটার শেষ হওয়ার পর আমরা আসছিলাম গাড়িতে। অতদুরে থিয়েটার রোডের ওই মোড়ে মেয়েটি কী করে অত শীগগির এসে পড়ল?
কর্নেল একই ভঙ্গিতে বললেন, তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত! তোমার পেশার লোকেদের জন্য একটা জিনিস খুব জরুরি। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ–সবসময়, সবকিছুর প্রতি। তুমি লক্ষ্য করোনি, নাটকে নাচতে নাচতে একটি মেয়ের চুলে গাছের একটা পাতা পড়ল আর সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে বেরিয়ে গেল। নাটকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম একটি মেয়ের মৃত্যু। তার মুখটা মনে ছিল। কাজেই তার আগেই চলে আসায় অস্বাভাবিক কিছু নেই।
তা হলে আপনি ওকে চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু গাড়িতে আসার সময় চুপচাপ রইলেন। পরে আমাকে বললেন না কিছু। কেন?
বলেছিলাম।
কলগার্ল মনে হচ্ছে বলেছিলেন শুধু।
পুলিশের গোয়েন্দা বললেন, হাতে সময় কম কর্নেলসায়েব! আমাকে উঠতে হবে। ডি সি ডি ডি সায়েব আমাকে বলেছে–
তাঁকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, জাস্ট আ মিনিট! হালদারমশাইয়ের কথা আগে শুনে নিই।
হালদারমশাই দুঃখিত মুখে বললেন, অহন আর কী কমু কর্নেলস্যার? ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি কইলেন, কী চাই? যেই ওনারে কইছি, কাইল আপনি কলগার্লেরে গাড়িতে উঠাইয়া লইয়া কই গেলেন জানতে চাই–আই অ্যাম এ প্রাইভেট ডিটেকটিভ, অমনি উনি দরজা আটকাইয়া পুলিশে ফোন করলেন। পুলিশ আইয়া আমারে ধমক দিয়া–ওঃ! ক্কী কারবার! কিছুতেই বুঝবে না। যত কই, কেসটা শোনেন–তত ধমক দেয়, শাট আপ! আর কক্ষনো ঝামেলা করবেন না।
অশোকবাবু একটু হেসে বললেন, আসলে মিঃ হালদারের অ্যাপ্রোচে গণ্ডগোল ছিল। তাই থেকে একটু ভুল বোঝাবুঝি আর কী! চন্দ্রিকা মার্ডারের পর ওর ফ্ল্যাটে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে মিঃ হালদারের কার্ড পেয়ে আমরা অবাক হয়েছিলাম। তারপর ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
হালদারমশাই বললেন, হঃ! একখান কার্ড দিছিলাম অরে। ভেরি স্যাড!
কর্নেল বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুকে কি জানানো হয়েছে খবরটা?
অশোকবাবু বললেন, ফোনে আমরা জানিয়েছি। মিঃ হালদারের কাছে ব্যাপারটা শোনার পর জানাতে হলো। তারপর লাহিড়িসায়েব আমাদের থানায় রিং করে খোঁজ নিলেন। তখন বুঝলাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে ওঁর জানাশোনা আছে। আমাদের ফোন পেয়েই ভদ্রলোক ডি সি ডি ড-কে অ্যাপোচ করেছেন সম্ভবত। যাই হোক, ডি সি ডি ডি আপনার কাছে আসতে বললেন। এখন মনে হচ্ছে, আপনি ব্যাকগ্রাউন্ডটা মোটামুটি জানেন।
শুধু এটুকু জানি, ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিছুদিন আগে কেউ ফোনে হুমকি দিয়েছিল, ঐ স্কুল স্ট্রিটের ওলসন হাউসের ছায়া মাড়ালে তাঁর বিপদ ঘটবে। স্বভাবত উনি অরিজিৎ লাহিড়িকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। তখন অরিজিৎ ওঁকে আমার নাম ঠিকানা দেন।
শুনলাম আপনি গিয়েছিলেন ওবাড়িতে। ডেডবডি দেখে এসেছেন।
হ্যাঁ। আপনাদের অফিসারদের ধারণা স্রেফ ডাকাতি এবং খুন।
ঠিক তা-ই মনে হয়েছিল আপাতদৃষ্টে। অশোকবাবু হাসলেন। কিন্তু এবার আর তা মনে হচ্ছে না। ডি সি ডি ডি সায়েব বললেন, আপনার সঙ্গে যেন যোগাযোগ রেখে চলি।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, কতকগুলো ঘটনা এ মুহূর্তে আমাদের নানা আছে, যেগুলোর মধ্যে কোনও স্পষ্ট যোগসূত্র নেই। ঠিক আছে মিঃ গুপ্ত! আপনি প্রয়োজন হলে পরে যোগাযোগ করবেন। আমার ফোন নাম্বার আপনার নিশ্চয় জানা?
হ্যাঁ। লাহিড়িসায়েব দিয়েছেন।
একটা কথা। ডিস্কো কে আপনি জানেন?
অশোকবাবু গুম হয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, লোকটি কে আমি অন্তত জানি না। তবে কানাঘুষো শুনেছি, হি ইজ আ বিগ গাই। ওপরতলায় প্রচণ্ড প্রভাব আছে, এটুকু বুঝতে পারি।
কিন্তু সম্প্রতি ওলসন হাউসে আপনারা হানা দিয়েছিলেন?
পুলিশের গোয়েন্দা মুচকি হেসে বললেন, জাস্ট আ শো বিজনেস বলতে পারেন। এগুলো আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের মাঝে মাঝে করতে হয়। আচ্ছা, আমি চলি।….
অশোক গুপ্ত চলে যাওয়ার পর হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, সব ফ্যাক্ট আমি পুলিশেরে দেই নাই কর্নেলস্যার। আপনারে দিমু। আগে দিলেই ভাল করতাম। মাইয়াডা তা হলে হয়তো মারা পড়ত না। ব্যাড লাক।
কর্নেল বললেন, আপনি এখনও খুব উত্তেজিত হালদারমশাই! আমার মনে, আগে উত্তেজনাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার।
ক্যান? প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
কর্নেল হাসলেন। আপনার ভাষা। লক্ষ্য করেছি, উত্তেজনার সময় আপনি স্টান্ডার্ড বাংলায় কথা বলেন না।
হালদারমশাই বিব্রতভাবে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, হঃ। ঠিক কইছেন—সরি। ইউ আর রাইট কর্নেলস্যার। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলাম না। অশোকবাবুকে অত করে বললাম, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওই বাড়িটা হয়েই কর্নেল স্যারের কাছে যাওয়া যাক। উনি বললেন, ও-বাড়িতে গিয়ে আর লাভ নেই। বডি চালান গেছে। তবে বর্ণনা শুনলাম, হরিবল! গলা কাটছে। ওঃ!
হালদারমশাই চোখ বুঝে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করলেন। কর্নেল বললেন, কী ফ্যাক্ট দিতে চেয়েছেন বলছিলেন হালদারমশাই।
হঃ! চোখ খুলে কে কে হালদার চাপা স্বরে বললেন, চন্দ্রিকা রায় কইছিল, যে লোকটা তারে টেলিফোন করে, সম্ভবত সে একজন চীনাম্যান। নিউ মার্কেটে ভিড়ের মধ্যেও চন্দ্রিকার মনে হয়েছিল লোকটা চীনাম্যান। না কর্নেল স্যার। চন্দ্রিকা তারে দ্যাখে নাই। কথা শুনিয়াই–
কর্নেল ওঁর কথার ওপর বলে উঠলেন,! তার মানে, লোকটার যে সব কথা অদ্ভুত মনে হয়েছিল চন্দ্রিকার, সেটা কী চীনা ভাষার মতো?
হঃ! হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন। কতকটা তা-ই মনে হয়েছিল চন্দ্রিকার।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, চাই চিচিং ফাঁক নয় তো?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ নড়ে উঠলেন। কী কইলেন? কী কইলেন?
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললাম, চাই চিচিং ফাঁক কথাটা কেউ আচমকা বলে উঠলে চীনে ভাষা মনে হতেও পারে, কর্নেল!
হালদারমশাই বারকতক বিড়বিড় করে কথাটা আওড়ে খি-খি করে একচোট হাসলেন। তারপর একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, চন্দ্রিকা কইছিল চ্যাংচুংচিংচাঁ করে কী যেন বলে লোকটা। তো জয়ন্তবাবু কী কইলেন য্যান? চিচিং ফাঁক? ফের খি খি করে হাসতে লাগলেন উনি।
কর্নেল হাসছিলেন না। গম্ভীরমুখে বললেন, আর কোনও ফ্যাক্ট আছে কি আপনার হাতে?
হালদারমশাই গম্ভীর হয়ে চাপাস্বরে বললেন, চন্দ্রিকা কইছিল, সে একটা অফিসে চাকরি করে। পরে জানলাম, এটা মিথ্যা কথা। তবে আমারে একটা অ্যাড্রেস দিছিল। যদি হঠাৎ তার কোনও বিপদ হয় হয়, সেই অ্যাড্রেসে আমারে যোগাযোগ করতে হইব। করুম এবার। তার আগে অ্যাড্রেসটা দেখাই।
প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট নোটবই বের করে উনি পাতাটা খুঁজে বের করলেন। তারপর কর্নেলকে দিলেন নোটবইটা। আমি কর্নেলের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঠিকানাটা দেখে খুব অবাক হয়ে গেলাম।
ঠিকানাটা রাঙাটুলির!
নামটা আমার অপরিচিত। হরনাথ সিংহ। তবে ঠিকানা দেখেই আমি উত্তেজিতভাবে বলে উঠলাম, কর্নেল! চিচিং ফাঁক রহস্যের সঙ্গে চন্দ্রিকার খুনের একটা লিংক পাওয়া যাচ্ছে যেন?
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। হালদারমশাইকে নোটবইটা ফেরত দিয়ে বললেন, আপনি রাঙাটুলি যাবেন তাহলে?
হালদারমশাই বললেন, হঃ! আই মাস্ট গো। আমার ক্লায়েন্ট। টাকা খাইছি তার থনে। দিস ইজ মাই মর্যাল ডিউটি কর্নেলস্যার!
ফি দিয়েছিল চন্দ্রিকা? কত?
ফাইভ হান্ড্রেড।
বলেন কী!
হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ক্যান? আমার মিনিমাম ফি কর্নেলস্যার। তবে আমি অরে ইনসিস্ট করি নাই। নিজেই জিগাইল ফিয়ের কথা। দিয়াও দিল।
আপনার হাতে আর কোনও ফ্যাক্ট আছে হালদারমশাই?
মাথা জোরে নেড়ে হালদারমশাই বললেন, নাহ। কিন্তু একটা কথা। আপনি অশোকবাবুরে ডিস্কোর কথা জিগাইলেন। হু ইজ দ্যাট ম্যান কর্নেল স্যার?
জানি না। তার নাম শুনেছি। সে-ই নাকি ওলসন হাউসের কলগার্লদের গার্জেন।
ডিস্কো। গোয়েন্দা ভদ্রলোক আবার একচোট হাসলেন। তারপর আর একটিপ নস্যি নিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, আমার নেক্সট আইটেম ডিস্কো।
কর্নেল বললেন, সাবধান হালদারমশাই! ডিস্কোকে আপনার লিস্টে রাখবেন না। বরং আপাতত আপনি রাঙাটুলির কোনও হরনাথ সিংহকে নিয়েই থাকুন।
হালদারমশাই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অভ্যাসমতো যাই গিয়া বলে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন।
বললাম, একটা কথা মাথায় ঢুকছে না। ডিস্কোর মতো লোক যার গার্ডেন, সে কেন প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য নিতে গিয়েছিল?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সেটা আমারও মাথায় ঢুকছে না জয়ন্ত!
বলে উনি পাশের ঘরে চলে গেলেন। একটু পরে পোশাক বদলে কাঁধে একটা কিটব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন। চলো জয়ন্ত! হালদারমশাইয়ের কথা শোনার পর আবার একবার ওলসন হাউসে যাওয়ার দরকার বোধ করছি। এক মিনিট! ইন্দ্রজিৎবাবুকে ফোনে পাই নাকি দেখি।
কর্নেল ফোন ডায়াল করে সাড়া পেয়ে বললেন, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলতে চাই।…বেরিয়েছেন? কখন? … কিছু বলে যাননি? …ঠিক আছে। ফিরলে বলবেন কর্নেল সরকার ফোন করেছিলেন….
.
গাড়িতে যেতে যেতে বললাম, চন্দ্রিকার পার্সটা আপনি খুলে দেখলেন না। ওর ভেতর একটুকরো কাগজে কোড ল্যাংগুয়েজে কী সব লেখা আছে। ফোনে আপনাকে বলেছিলাম।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, পার্সটা নিয়েই যাচ্ছি।
সে কি?
ও নিয়ে চিন্তা কোরো না ডার্লিং। মেয়েদের পার্স সম্পর্কে বেশি চিন্তা করা ঠিক নয়।
বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পরে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে একটা বাড়ির সামনে কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি থামালাম। বাড়ির সামনে একটা পুলিশভ্যান দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির দরজাটা পাশের একটা সংকীর্ণ গলির দিকে। সামনের অংশটায় কয়েকটা দোকান। সেগুলো এখন খুলে গেছে। টিভি ইলেকট্রনিক গ্যাজেট এবং পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান, টেলারিং শপ ইত্যাদি।
গলিতে ঢুকলে বাড়ির দরজা থেকে এক পুলিশ অফিসার এসে কর্নেলকে অভ্যর্থনা জানালেন। সহাস্যে বললেন, আপনি চলে যাওয়ার পরই বডি মর্গে চলে গেছে।
কর্নেল বললেন, আর একবার চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটটা আমি দেখতে চাই মিঃ দাশ।
অবশ্যই। আসুন। পুলিশ অফিসার বাড়ি ঢুকে সামনে সিঁড়ির মুখে একটু থেমে চাপাস্বরে ফের বললেন, লাহিড়িসায়েব রেডিও মেসেজে জানতে চাইছিলেন, ওঁকে আপনি আবার আসবেন বলছেন, এসেছিলেন নাকি।
বাড়ির সামনে একটুখানি লন মতো। সেখানে যথেচ্ছ দিশি-বিদেশি ফুলের গাছ এবং পাতাবাহার জঙ্গল করে ফেলেছে। বাঁদিকে নিচের তলার ঘরের জানালা থেকে একজন বুড়োসায়েব ফিসফিসিয়ে ডাকলেন, কর্নেল সরকার।
কর্নেল তাকে বললেন, প্লিজ ওয়েট আ বিট মিঃ ওলসন।
বাট দিস ইজ আর্জেন্ট, য়ু নো?
ওক্যে! ওকে! জাস্ট ওয়েট আ বিট।
বাড়ির বাইরের চেহারা জীর্ণ। কিন্তু সিঁড়িতে উঠতে উঠতে টের পাচ্ছিলাম ভেতরটা সুন্দর সাজানো-গোছানো। নেহাত কলগার্লদের ডেরা বলা হলেও এটা যে আসলে অভিজাত পতিতালয় তাতে কোনও ভুল নেই। তবে এ-ও ঠিক, সব ফ্লোরের ফ্ল্যাটগুলোর দরজা বন্ধ। সুনসান স্তব্ধতা ঘিরে আছে। চারতলায় দুটো ফ্ল্যাট এবং একপাশে ফাঁকা ছাদ অজস্র ফুলের টবে সাজানো।
দুজন কনস্টেবল বেতের চেয়ারে বসেছিল। উঠে দাঁড়াল আমাদের দেখে। পুলিশ অফিসার পকেট থেকে চাবি বের করে একটা ফ্ল্যাটের তালা খুলে দিলেন। লক্ষ্য করলাম, হাঁসকলে আরেকটা তালা ঝুলছে। ওটাই তাহলে ফ্ল্যাটের নিজস্ব তালা। এই বাড়তি তালাটা নিশ্চয় পুলিশের।
পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি আবার আসবেন বলে ফ্ল্যাটের সবকিছু অ্যাজ ইট ইজ রাখা হয়েছে।
থ্যাংস্। বলে কর্নেল ঢুকলেন।
এটা ড্রয়িং রুম বলা চলে। কিন্তু আসবাবপত্র ওলটপালট ছত্রখান। কারা যেন প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি মারামারি করেছে এ ঘরে। ওল্টানো সেন্টার টেবিলের পাশে কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। একটা মদের বোতল কার্পেটের ওপর গড়াগড়ি খেতে খেতে দেয়ালের কোণায় আটকে গেছে।
বেডরুমের পর্দা ফর্দাফাই। কর্নেলের সঙ্গে ঢুকে শিউরে উঠলাম। মেঝের কাপের্ট এবং বিছানা রক্তে মাখামাখি। তবে এ ঘরেও একই ধস্তাধস্তি ওলটপালট হয়েছে।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, কী বুঝছ বলো?
ধস্তাধস্তি মারামারির পর খুনটা হয়েছে?
হা চন্দ্রিকা যথাসাধ্য লড়েছিল এটুকু বলা চলে। বসার ঘরের কার্পেটে রক্তের ছিটে আছে। সেটা সম্ভবত খুনীর হাতের রক্ত। সে কিছু তন্নতন্ন খুঁজেছে খুন করার পরে।
পার্সের—
কর্নেল দ্রুত বললেন, এ ঘরে কোনও পার্স পাওয়া যায়নি জয়ন্ত।
ওঁর চোখের ভঙ্গিতে বুঝলাম, পার্স সম্পর্কে আমাকে চুপচাপ থাকতেই হবে। বললাম, পাশের ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না? তার তো টের পাওয়া উচিত।
পুলিশ অফিসার বললেন, কেটি বলে একজন অ্যাংলো মেয়ে থাকত। সে কদিন আগে বোম্বেতে তার মায়ের কাছে চলে গেছে। আমরা চেক করেছি। একটা টেলিগ্রাম পাওয়া গেছে, মায়ের অসুখ। চাবি দিয়ে গেছে ওঁর কাছে।
কর্নেল ঘরের ভেতর এখানে ওখানে হুমড়ি খেয়ে বসে, কখনও দাঁড়িয়ে কী সব পরীক্ষা করছিলেন, তা উনিই জানেম। বললাম, কিন্তু ধস্তাধস্তির শব্দ নিচের ফ্ল্যাটের লোকেদের টের পাওয়া উচিত।
পুলিশ অফিসার মুচকি হেসে বললেন, এ বাড়িতে কোন ঘরে কী হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বুঝতেই পারছেন, বাড়িতে কারা থাকে। সারাদিন মদের ফোয়ারা ছোটে। আর হুল্লোড়।
কর্নেল বললেন, বেরুনো যাক এবার। নতুন কিছু দেখার মতো নেই মিঃ দাশ। আপনি দরজায় তালা এঁটে দিন। আমরা মিঃ ওলসনের ঘরে একটু আড্ডা দিয়ে চলে যাব। আপনি আপনার ডিউটি করুন।
নীচে ওলসন কর্নেলের অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওলসন আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর জানালায় উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে গদিআঁটা পুরনো একটা চেয়ারে ধপাস করে বসলেন। ওঁর চোখে উত্তেজনা জ্বলজ্বল করছিল। ফিসফিসিয়ে ইংরেজিতে বললেন, কর্নেল সরকার! আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগে মনে পড়ল কথাটা। তবে ফোনে বলতেও ভরসা পাইনি। বলা যায় না, আমার ফোন ট্যাপ করা আছে কি না।
এবার স্বচ্ছন্দে বলুন মিঃ ওলসন।
আপনাকে বলেছি, চন্দ্রিকা ওর পার্স কোথায় হারিয়ে আমার কাছে ওর ফ্ল্যাটের তালা খোলার জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিল। আমি ওকে বললাম, তুমি ডিস্কোসায়েবকে ফোন করো। তার কাছে সব ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। বলেছিলাম তো?
বলেছিলেন।
তখন আমার এখান থেকে চন্দ্রিকা ডিস্কো শয়তানটাকে ফোন করেছিল।
এ-ও বলেছে আমাকে।
ওলসন ঝুঁকে এলেন কর্নেলের দিকে। যেটা বলতে ভুলেছি, বলছি। ডিস্কোর ফোন নাম্বার আমি এতকাল জানতাম না। আমার বাড়ির কোনও খানকিই আমাকে সেটা জানাতে চায় না। চন্দ্রিকাও না। কিন্তু চন্দ্রিকা যখন ফোনে ডায়াল করছিল, নাম্বারগুলো– আমি দেখে নিয়েছিলাম। ভুলে যাব বলে একটু পরেই তা লিখে রেখেছিলাম। এখন নাম্বারটা আপনাকে দিতে পারি।
বলে হ্যারি ওলসন পকেট থেকে একটা চিরকুট দিলেন কর্নেলকে। কর্নেল সেটা দেখে পকেটে ভরলেন। তারপর বললেন, ডিস্কোকে আপনি কখনও দেখেননি বলছিলেন। তো–
হ্যাঁ। ওর লোকেদের দেখেছি। নচ্ছার গুণ্ডা তারা।
তো তারপর চন্দ্রিকা ওপরে চলে যায়, বলেছিলেন।
ঠিক। তারপর আর কিছু জানি না। ওলসন বিমর্ষ মুখে বললেন। কিন্তু ডিস্কো হারামজাদা চন্দ্রিকাকে যার হাত দিয়ে চাবি পাঠিয়েছিল, সেই খুন করেনি তো?
খুনের কী মোটিভ থাকতে পারে তার?
ওলসন একটু ভেবে বললেন, এমনও হতে পারে ডিস্কোশয়তানটার হুকুমেই সে চন্দ্রিকাকে খুন করে গেছে। সম্ভবত চন্দ্রিকা ওকে ব্ল্যাকমেল শুরু করেছিল।
এ কথা কেন আপনার মনে হচ্ছে মিঃ ওলসন?
ওলসন আবার একটু ভেবে নিয়ে বললেন, চন্দ্রিকা শুধু নয়, অন্য মেয়েরাও আমার ঘরে ফোন করতে আসে। অনেক সময় তারা ফোনে ডিস্কোর সঙ্গেও কথা বলেছে। আবার কখনও ডিস্কো আমাকে ফোন করে বলেছে, আমি ডিস্কো বলছি। অমুককে ডেকে দাও। লোকটার গলা আমার চেনা হয়ে গেছে। খুব ভদ্র, মার্জিত কণ্ঠস্বর। মনে হবে যেন কোনো অমায়িক সজ্জন ভদ্রলোক।
আপনি এসব কথা আগেও বলেছেন আমাকে।
হ্যাঁ। ওলসন ভারি শ্বাস ছাড়লেন। ইদানিং চন্দ্রিকা যে কণ্ঠস্বরে ডিস্কোর সঙ্গে কথা বলত, আমার মনে হতো মেয়েটা ওকে হুমকি দিচ্ছে। গতকাল রাত্রেও যে ভাবে চাবি হারানোর কথা বলে শীগগির ডুপ্লিকেট চাবি পাঠাতে বলছিল, আমার মনে হচ্ছিল যেন ধমকাচ্ছে। আমার এটা কিন্তু অবাক লেগেছে। চন্দ্রিকার আগের কণ্ঠস্বর এবং ইদানিংকার কণ্ঠস্বর এক ছিল না কর্নেল সরকার।
কর্নেল একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, সম্ভবত আপনার কথা ঠিক। কিন্তু ডিস্কো কী এতই বোকা যে সে চন্দ্রিকাকে তার ঘরে খুন করতে লোক পাঠাবে? ইচ্ছে করলে সে বাইরে যে-কোনও জায়গায় চন্দ্রিকাকে খতম করতে পারত।
ওলসন শুধু বললেন, তা ঠিক।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলি মিঃ ওলসন। আশা করি, আর পুলিশ আপনাকে জেরা করছে না?
ওলসন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, নাহ্। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কে
উ ফোন করে চন্দ্রিকা সম্পর্কে খবর নিয়েছিল কি মিঃ ওলসন?
ওলসন নড়ে উঠলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটু আগে কে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিল, চন্দ্রিকা খুন হয়েছে সত্যি কি না?
নাম বলেনি?
নাহ। ওর কোনও প্রেমিক হবে। এ বাড়ির খানকিদের প্রেমিকরাও এই ফোনে ওদের খবর নেয়। নরকে পড়ে আছি কর্নেল সরকার। আমার মৃত্যু যত শীগগির হয়, বেঁচে যাই। এ বয়সে যাবই বা কোথায়?
কর্নেল হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, দুঃখিত মিঃ ওলসন। ভুলে গিয়েছিলাম। কোনও প্রশ্ন করবেন না এখন। চন্দ্রিকার হারানো পার্সটা আমি উদ্ধার করেছি। এটা আপনি রাখুন। ডিস্কো ফোন করলে তাকে এটার কথা জানাবেন। এটা ফেরত নিতে বলবেন। তারপর ওর লোকের হাতে দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমার কথা বলবেন না যেন।
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে পার্সটা বের করে ওলসনের হাতে গুঁজে দিলেন। চাপাস্বরে ফের বললেন, পুলিশকেও জানাবেন না যেন। আপনার নিরাপত্তার জন্যই বলছি।…..
.
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, পার্সটার ভেতরে সেই অদ্ভুত চিরকুটটা–
কর্নেল হাসলেন। ওটা আমি বের করে রেখেছি, ডার্লিং! এই দেখ।
চিরকুটটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল আমার। বললাম, এটা কিসের কোড বলে মনে হচ্ছে আপনার?
এখনও কিছু ভাবিনি এ সম্পর্কে।
চন্দ্রিকা রায়ের সঙ্গে রাঙাটুলির সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারে কী ভাবছেন বলতে আপত্তি আছে?
কর্নেল বললেন, শুরুতেই রহস্য এত বেশি জট পাকালেই সমস্যা। বোধবুদ্ধি ঘুলিয়ে যাবে। কাজেই একটা করে সূত্র ধরে এগোনোই ভাল। হুঁ, তুমি সঠিক রাস্তা দিয়েই চলেছ। আমার ঘরে না বসলে আমার মাথা খোলে না।
সানি ভিলার তিনতলার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই কর্নেল টেলিফোন তুললেন। ডায়াল করে সাড়া এলে বললেন, মিঃ ডিস্কো?….সে কী! রং নাম্বার?…জাস্ট আ মিনিট। জাস্ট আ মিনিট! রাঙাটুলির হরনাথ সিংহ এই নাম্বারটা আমাকে দিয়ে বলেছেন… বলেছেন, চন্দ্রিকা রায়ের কলকাতার গার্জেনকে এই নাম্বারে পাওয়া যাবে।…বুঝতে পারছেন না? আপনার নামটা প্লিজ…সরি মিঃ ডিস্কো…ডিস্কো নন আপনি? কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিও তো…না, না। আমি পুলিশ নই।…রং নাম্বার? সত্যি বলছেন? ঠিক আছে। তা হলে ছাড়ছি। কিন্তু হরনাথবাবু, ইন্দ্রজিৎবাবু দুজনেই তো…হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভুল হতেই পারে। ধন্যবাদ। রাখছি। তবে আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখুন প্লিজ।…।
কর্নেল নাম্বার বলে ফোন রেখে হাসতে হাসতে বললেন, ডিস্কোই বটে। কথাগুলো শুনতেও চায়। কিন্তু রং নাম্বার বলতে ছাড়ছে না। যাক্ গে, বোতাম টিপে দিলাম। খেলাটা শুরু হয়ে যাক।
বললাম, একটা ব্যাপার ভাবতে আমার খারাপ লাগছে।
কী সেটা?
চন্দ্রিকা আমাদের গাড়িতে পার্সটা ফেলে না গেলে হয়তো খুন হতো না। নিশ্চয় বাইরের লোককে দরজা খুলত না। কিংবা ডিস্কোর লোকের পাল্লায় পড়ত না।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, সে কী করত বলা কঠিন জয়ন্ত! কিন্তু আপাতদৃষ্টে ওলসনের ধারণার ফেসভ্যালু আছে। তার মানে, ডিস্কো ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় পাঠিয়েছিল। যার হাতে পাঠিয়েছিল, তার খোঁজ যতক্ষণ না পাচ্ছি কীভাবে চন্দ্রিকা খুন হয়েছে বলা যাবে না। শুধু একটা বিষয় স্পষ্ট। খুনী চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে ঢুকে চন্দ্রিকার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেছে। এটা চন্দ্রিকার আত্মরক্ষার লড়াই ছাড়া কিছু নয়। তবে খুন করার পর সে চন্দ্রিকার আসবাবপত্র তন্নতন্ন খুঁজেছে। সবখানে রক্তের ছাপ সেটা বলে দিচ্ছে।
এই চিরকুটটাই খুঁজেছে সম্ভবত।
সম্ভবত। বলে কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন।
কর্নেল! একটা ভাইটাল প্রশ্নে আপনি মন দিচ্ছেন না এখনও।
বলো!
কী এমন ঘটেছিল যে আমাদের গাড়িতে পার্স ফেলে গিয়েছিল চন্দ্রিকা? এমন একটা ভুল কী করে হতে পারে? হ্যাঁ, মানসিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত আপনি দিয়েছেন। কাজেই–
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, সে বলছিল, পথে দুটো মস্তান ওর পেছনে লেগেছে।
তারা যারাই হোক, নিশ্চয় জানত চন্দ্রিকার পার্সে ওই চিরকুটটা আছে।
কর্নেল হাসলেন। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে লাভ নেই, ডার্লিং। আপাতত আমি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি এবং ডিস্কোর দিকে তাকিয়ে আছি। সূত্র তাদেরই কাছে আছে। ওয়েট অ্যান্ড সি।…
এ বেলা কর্নেল আমাকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না। তাঁর সঙ্গেই লাঞ্চ খেতে হলো। তার কথামতো আমার কাগজের অফিসে জানিয়ে দিতে হলো, একটা মার্ডারকেসের রোমাঞ্চকর এবং এক্সক্লসিভ স্টোরির পেছনে লড়ে যাচ্ছি। কাজেই অফিসে যেতে দেরি হতে পারে।
লাঞ্চের পর সোফায় লম্বা হয়ে গড়াচ্ছিলাম। কর্নেল একটা অর্কিডসংক্রান্ত বইয়ে বুঁদ হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী এসে বলল, বাবামশাই! এক ভদ্রলোক এয়েছেন।
কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বললেন, নিয়ে আয়।
যিনি এলেন, তাঁর বয়স চল্লিশের মধ্যেই। পরনে আলিগড়ি চুস্ত পাঞ্জাবি। একমাথা ঝাকড়া চুল। সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারায় বিপর্যস্ত ভাব। তাকে দেখে কর্নেল বলে উঠলেন, আসুন ইন্দ্রজিৎবাবু! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সাড়ে তিনটে অব্দি দেখে বেরোতাম এক জায়গায়।
ইনিই সেই ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি? পরগাছা নাটকের পরিচালক? তারপরই মনে পড়ে গেল, মঞ্চের গাছের তলায় আধপাগলা লোকটির চরিত্রে এঁকেই তো দেখেছিলাম।
কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একটু চুপ করে থাকার পর ইন্দ্রজিৎবাবুআস্তে বললেন, আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে কর্নেল সরকার। খালি মনে হচ্ছে, আমারই বুদ্ধির দোষে চন্দ্রিকা মারা পড়ল। আপনাকে আমি আগে যদি সব কথা খুলে বলতাম।
কী কথা ইন্দ্রজিৎবাবু?
গতকাল সন্ধ্যায় আপনাকে আমার নাটক দেখার আমন্ত্রণ করেছিলাম। এর উদ্দেশ্য ছিল। চন্দ্রিকা বলেছিল, আমার দলে শয়তান ডিস্কোর চর ঢুকেছে। কিন্তু চন্দ্রিকা জানত না কে সেই চর। তাই ওকে আপনার কথা বলেছিলাম। আপনার চেহারার বিবরণও দিয়েছিলাম। তখন ও বলল, ওদের বাড়িতে ওলসনসায়েবের কাছে আপনি যান। তার মানে, আপনাকে সে চেনে। তবে আপনাকে শুধু কর্নেলসায়েব বলেই চেনে। যাই হোক, গতরাতে ভাবলাম, থিয়েটার শেষ হলে আপনি গ্রিনরুমে আসবেন। কিন্তু এলেন না।
যাইনি আপনার স্বার্থে। আপনিও বলেছিলেন, প্রকাশ্যে আপনার সঙ্গে যেন না মিশি।
হ্যাঁ। তবু ভেবেছিলাম, আরও সব আমন্ত্রিত মানুষের ভিড়ে আপনিও আসবেন।
ঠিক আছে। তারপর কী হয়েছিল বলুন। সেটাই আমার জানা দরকার।
আশ্চর্য ব্যাপার। থিয়েটার শেষ হওয়ার পর চন্দ্রিকাকে আর খুঁজে পেলাম না। গেস্টদের সঙ্গে গ্রিনরুমে কথাবার্তা না বলে তখনই বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, চন্দ্রিকা সবে একটা ট্যাক্সিতে চাপছে। দৌড়ে গিয়ে বললাম, কী ব্যাপার? চলে যাচ্ছ যে? চন্দ্রিকা বলল, কর্নেলসায়েবের গাড়ি ফলো করছি। তুমি চিন্তা করো না। ওঁকে আমার এখনই মিট করা দরকার। বুঝলাম, প্রকাশ্যে আপনার সঙ্গে মিট করতে সেও যায়নি।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, এখন বুঝতে পারছি, সে ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের গাড়ির পেছনে আসছিল। তারপর থিয়েটার রোডের একটা মোড়ে সম্ভবত যামে আমাদের গাড়ি হারিয়ে ফেলে। তখন ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে আমাদের খুঁজতে শুরু করে। হ্যাঁ ইন্দ্রজিৎবাবু! সে আমাকে খুঁজেও পেয়েছিল। সে লিফট চাইল। তখন বৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া তার পেছনে নাকি দুটো মস্তান লেগেছে।
মস্তান লাগার ব্যাপারটা হয়তো ঠিক নয়। আসলে সে আপনার সঙ্গে কথা বলতেই চেয়েছিল।
কিন্তু কিছুই বলেনি চন্দ্রিকা। আলাপ করার কোনও হাবভাব তার মধ্যে লক্ষ্য করিনি। বরং তাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল।
ইন্দ্রজিৎবাবু অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য তো!
আরও আশ্চর্য, সে তার পার্স গাড়িতে ফেলে ওলসন হাউসে ঢুকে গিয়েছিল। তখনও অবশ্য জোর বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু পার্সটা–কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু পরে ফের বললেন, হ্যাঁ। আসলে সে আমার জিম্মায় পার্সটা রাখতে চেয়েছিল।
পার্স? ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি চমকে উঠে আবার বললেন, পার্স?
হ্যাঁ। ছোট্ট একটা পার্স। পার্সে ওর ফ্ল্যাটের চাবি ছিল। আরও চাবি ছিল দুটো। ফ্ল্যাটের চাবির ডুপ্লিকেট সে ডিস্কোর কাছে পাবে জানত। অন্য চাবি দুটোর ডুপ্লিকেট তার ফ্ল্যাটে থাকা উচিত। কাজেই চাবি খোয়া গেলেও তার অসুবিধা ছিল না।
তা হলে পার্সে এমন কী ছিল যে সেটা আপনার জিম্মায় রাখতে চেয়েছিল?
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, আপনি বুদ্ধিমান ইন্দ্রজিৎবাবু।
পার্সটা আপনি হাতড়ে দেখেছেন নিশ্চয়?
দেখেছি।
কিছু সন্দেহজনক জিনিস নেই ওটার মধ্যে?
কর্নেল হাসলেন। সন্দেহজনক? নাহ্। কিছু টাকা, একজন, উঁকিলের একটা কার্ড, আর–
আর কী?
চাবি।
প্লিজ পার্সটা একটু দেখাবেন?
ওটা ওলসনসায়েবকে দিয়েছি। ডিস্কোকে উনি ফেরত দেবেন।
ইন্দ্রজিৎবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। একটু পরে বললেন, পার্সটা হাতছাড়া করা ঠিক হয়নি আপনার।
কেন বলুন তো?
ওটার মধ্যে এমন কিছু সন্দেহজনক জিনিস থাকতে পারে, যা আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। কারণ আপনারই মতে, পার্সটা আপনার জিম্মায় রাখাই চন্দ্রিকার উদ্দেশ্য ছিল। তার ওই একটাই অর্থ হয়।
আবার বলছি, আপনি বুদ্ধিমান ইন্দ্রজিৎবাবু।
আমি বললাম, কিন্তু স্টেজে অভিনয়ের সময় চন্দ্রিকা পার্স কারুর কাছে রেখেছিল নিশ্চয়?
কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, ছোট্ট একটা পার্স সে পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেও অভিনয় করতে পারে স্টেজে। তা-ই না ইন্দ্রজিৎবাবু?
ইন্দ্রজিৎবাবুসায় দিলেন। তারপর লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার দ্বিতীয় ভুল, ডিস্কো ফোনে আমাকে চন্দ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতেই হুমকি দিত, সেই কথাটা খুলে আপনাকে বলিনি। শুধু বলেছিলাম, ওলসন হাউসে যেতে কেউ মকি দিচ্ছে। আমার জানানো উচিত ছিল, চন্দ্রিকার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। জনাইনি।
আপনার গ্রুপে অভিনয় করে একজন কলগার্ল। আপনি এটুকু অবশ্য বলেছিলেন।
ইন্দ্রজিৎবাবু আস্তে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু বলিনি–আসলে লজ্জাবশতই বলতে পারিনি, চন্দ্রিকা অভিজাত ঘরের মেয়ে। নিজের স্বামীকে খুন করে প্রাণ বাঁচানোর জন্যই শয়তান ডিস্কোর আশ্রয় নিয়েছিল। কর্নেল সরকার! চন্দ্রিকা লাংঘাতিক মেয়ে ছিল, এটা যেমন সত্য, তেমনি এ-ও সত্য, তার স্বামী রথীন চৌধুরীও ছিল একজন নরপিশাচ। হৃদয়হীন, স্বার্থপর, বর্বর। চন্দ্রিকাকে রথীনই প্রথম পাপের পথে ঠেলে দেয়। তার জীবনের এই শোচনীয় পরিণতির জন্য সে-ই দায়ী।
ডিস্কো কে?
ইন্দ্রজিৎবাবু তাকালেন। দৃষ্টিটা ক্রুর মনে হলো। বললেন, জানি না। আপনি এবার তাকে খুঁজে বের করুন। আমি নিজের হাতে তাকে শাস্তি দেব।
চন্দ্রিকা তার কোনও পরিচয় দেয়নি?
না। কারণ চন্দ্রিকা কখনও তাকে দেখেনি। ডিস্কো আড়ালে থেকে সব চালায়।
আপনি হরনাথ সিংহকে চেনেন?
হ-র-না-থ সিংহ? ইন্দ্রজিৎবাবু আস্তে উচ্চারণ করলেন কথাটা।
হ্যাঁ। রাঙাটুলির হরনাথ সিংহ।
মাই গুডনেস! নড়ে বসলেন ইন্দ্রজিৎবাবু। চন্দ্রিকার স্বামী ছিল রাঙাটুলির লোক। চন্দ্রিকাঁদের বাড়িও তো সেখানে। চন্দ্রিকা আমাকে বলেছিল।
চন্দ্রিকার সঙ্গে কোথায় কী করে আপনার পরিচয় হয়েছিল?
পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে। মুনলাইট বার। বারের একজন অ্যাংলো ওয়েটার চ্যাংকো আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই বারে কলগার্লরা যায়। তো প্রথম আলাপেই চন্দ্রিকা থিয়েটারে অভিনয়ের সুযোগ দিতে অনুরোধ করেছিল।
কর্নেল ষষ্ঠীচরণকে ডেকে কফি আনতে বললেন। তারপর বললেন, হরনাথ সিংহের কথা চন্দ্রিকা আপনাকে বলেনি কখনও। মনে করে দেখুন।
নাহ। মনে পড়ছে না।
একটু পরে কর্নেল বললেন, চন্দ্রিকার পার্সে অ্যাডভোকেটের কার্ড পাওয়ার অর্থ বোঝা গেল সম্ভবত। মার্ডার চার্জ ছিল চন্দ্রিকার নামে।
হ্যাঁ। সে প্রায় বছর সাত-আট আগের কেস। তবে ডিস্কো প্রভাবশালী লোক। কেস থেকে তাকে বাঁচায়।
ডিস্কোর সঙ্গে চন্দ্রিকার কীভাবে পরিচয় হয় আপনি জানেন?
জানি না। চন্দ্রিকা খুলে কিছু বলেনি।
আপনি কি জানেন, চন্দ্রিকা ইদানিং ডিস্কোকে ব্ল্যাকমেল করত কি না?
বলেনি আমাকে। ওই যে বললাম, ওর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল।
এই সময় ফোন বাজল। কর্নেলের ইশারায় ফোন তুলে সাড়া দিলাম। কোনও মেয়ে জানতে চাইছে, ফোনের নাম্বার এই কি না। বললাম, হ্যাঁ। বলুন, কাকে চাই?
জবাব এল, এখানে কথা বলুন। তারপর পুরুষকণ্ঠে কেউ বলল, হ্যালো!
কাকে চাই বলুন?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে।
কে বলছেন আপনি?
ডিস্কো।
ঝটপট ফোনের মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে কর্নেলকে বললাম, ডিস্কো।
কর্নেল ফোন নিয়ে বললেন, বলুন মিঃ ডিস্কো! …আমাকে চেনেন তাহলে? কিন্তু দুপুরে তখন তো…ও। পরে খোঁজ নিয়ে পরিচয় পেলেন? ধন্যবাদ।.বলেন কী! ওলসনসায়েব…ঠিক আছে। প্রাণের ভয়ে বুড়োমানুষ আমার নাম করেছেন। পার্স পেয়েছেন তো?..না, না। ধন্যবাদ দেওয়ার কী আছে?…..হ্যাঁ মিঃ ডিস্কো! চন্দ্রিকার খুনী আপনি নন।… নিশ্চয়! আই মাস্ট ফাইন্ড আউট…..জাস্ট আ মিনিট! কালরাত্রে আপনি কার হাত দিয়ে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি……ও মাই গড! সে কী! কোথায়?…ঠিক আছে। …হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
বুঝলাম, লাইন কেটে গেল। কর্নেল ফোন রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, যাই হোক, ডিস্কোর সঙ্গে এতক্ষণে যোগাযোগ হলো। তখন ফোনে ওর ডামি নাকি কথা বলেছিল। বুঝলে জয়ন্ত? অবশ্য এ-ও ডিস্কোর ডামি কি না বলা কঠিন। তবে অদ্ভুত ঘটনা, যে লোকটিকে দিয়ে ডিস্কো ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল, তার ডেডবডি পাওয়া গেছে বেলেঘাটার কাছে ক্যানেলে। শট ডেড।
চমকে উঠে বললাম, তা হলে ওলসনসায়েবের ধারণাই পরোক্ষে সত্যি। যে চাবি এনেছিল, সেই…
ইন্দ্রজিৎবাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, ফোনটা আমাকে দেওয়া উচিত ছিল কর্নেল সরকার।
ষষ্ঠী কফি নিয়ে এল। কর্নেল বললেন, কফি খান ইন্দ্রজিৎবাবু! উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই।
কফি খেতে খেতে ইন্দ্রজিৎবাবু বললেন, চন্দ্রিকার পার্সটা শয়তান ডিস্কোকে ফেরত দেওয়া ঠিক হয়নি। তারপর ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ ঘরে স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল। কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়েছিলেন। ওই অবস্থায় কফিতে দিব্যি চুমুক দিচ্ছিলেন। ইন্দ্রজিৎবাবু কফি শেষ করে ঘড়ি দেখে বললেন, উঠি। আবার যোগাযোগ করব। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কর্নেল সরকার! আপনি ডিস্কোকে আমার মুখোমুখি দাঁড় লাতে পারলে আমি খুশি হব।
কর্নেল শুধু বললেন, দেখা যাক।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমার কেন যেন মনে হলো, ভদ্রলোক নিছক নাটকের লোক নন।…
দ্বিতীয় স্তর
এ যাবৎ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে থেকে অনেক জটিল রহস্যের উন্মোচন দেখেছি। কিন্তু কখনও নিজেকে জড়িয়ে ফেলিনি। আমি থেকেছি নিছক দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু এবার নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমার গাড়িতে পার্স ফেলে গিয়ে চন্দ্রিকাই আমাকে যেন জড়িয়ে গেছে তার শোচনীয় মৃত্যুর সঙ্গে।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ডার্লিং! আমার ধারণা, তোমার মগজে প্রচুর পরগাছা গজাতে শুরু করেছে। উপড়ে ফেলো।
হাসবার চেষ্টা করে বললাম, ওপড়ানো শক্ত। মাথা ঝিমঝিম করছে।
বরং ছাদে গিয়ে বসবে চলো। আমার ছাদের বাগানটিকে হালদারমশাই শুন্যোদ্যান নাম দিয়েছে। শুন্যোদ্যানে কিছুক্ষণ কাটালে মগজ শূন্য হবে। ওপরে বিশাল আকাশ। ওঠো!
বাড়িতে থাকলে কর্নেল তার ছাদের বাগানে দুবেলা কাটান। অদ্ভুত কিম্ভুত সব উদ্ভিদের পরিচর্যা করেন। উনি যখন থাকেন না, তখন কাজটা ষষ্ঠী চমৎকারভাবে করে। সে বলে, আমি গাঁ-গেরামের মানুষ দাদাবাবু। শউরে হওয়া আমার উচিত নয়। ভাগ্যিস বাবামশাই ছাদে বাগানখানা বাইনেছিলেন। পেরানটা শান্ত হয় সেখানে ঢুকলে। ষষ্ঠী গ্রামের মানুষ বলেই গাছপালার প্রতি ওর হয়তো নাড়ির টান।
সে কফির পেয়ালা নিতে এসে বলল, আপনারা বেরুবেন নাকি?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বেরুব।
তাইলে আপনাদের শীগগির বেরুলেই ভাল হয়। সাড়ে চারটে বাজে। বাগানে জল দিতে হবে। নেট হয়ে যাচ্ছে।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, নেট হলেও ক্ষতি নেই। গতরাত্রে খুব বৃষ্টি হয়েছে।
তবু–
ওরে হতভাগা! আমরা বাগানের দিকেই বেরুচ্ছি। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, ঘণ্টাখানেক পরে আবার কফি চাই কিন্তু।
ওপরে গিয়ে শেডের তলা থেকে খুরপি আর কিসের একটা প্যাকেট নিলেন কর্নেল। আমি একটা বেতের চেয়ার নিয়ে গিয়ে ভোলা জায়গায় বসলাম। চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের পাশে ছাদের বাগানটার কথা মনে পড়ে গেল। ওলসন হাউসের ছাদে ওই বাগানটা কি চন্দ্রিকাই করেছিল? প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
কর্নেল একটা বিদঘুঁটে গড়নের ক্যাকটাসের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। বললেন, চন্দ্রিকা এখনও তোমার পিছু ছাড়েনি দেখছি।
একটু চটে গিয়ে বললাম, কী আশ্চর্য! আপনার ছাদের বাগানে এসে ওই বাগানটার মনে পড়া কি স্বাভাবিক নয়?
স্বাভাবিক। কর্নেল গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন, তাই বলে আমার বাগানের সঙ্গে তুলনা কোরো না! জয়ন্ত! এখানে পৃথিবীর কত দুর্গম অঞ্চল থেকে আনা বিচিত্র সব প্ল্যান্ট আছে তুমি তো ভালই জানো। যাই হোক, কলকাতার একটা সুন্দর বিকেলকে খুনখারাপির ভাবনা দিয়ে নোংরা কোরো না।
সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকলাম। কিন্তু বারবার গতরাতের দৃশ্যটা ভেসে উঠে আমাকে উত্তেজিত করছিল। কলগার্ল হোক, মানুষ তো! কে তাকে অমন নৃশংসভাবে খুন করল? এ খুনের উদ্দেশ্য কী?
আগাগোড়া কাহিনীর আকারে ঘটনাগুলো পর-পর সাজানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বারবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কোনও পূর্ণাবয়ব পারম্পর্যময় কাহিনী গড়ে তোলা অসম্ভব মনে হচ্ছিল। শুধু একটা ব্যাপার স্পষ্ট, চন্দ্রিকার পার্সে লুকোনো চিরকুটে লেখা কথাগুলো যদি কোনও রহস্যময় কোড হয়, সেটাই তার মৃত্যুর একমাত্র কারণ। ডিস্কোর পাঠানো লোকটাকে গুলি করে মেরে খুনী চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের চাবি হাতিয়েছিল। তারপর চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে এসে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছে। চন্দ্রিকা চিৎকার করে কারও সাহায্য চায়নি কেন? খুনী তার চেনা লোক কি না, এ-ও একটা পয়েন্ট। তবে এখন মনে হচ্ছে, ওই চিরকুটটা হাতানোই তার উদ্দেশ্য ছিল।
ষষ্ঠী কফি এনেছিল।-কফি খেতে খেতে আবার চিন্তাগুলো ফিরে এসেছিল। আবার এলোমেলো ঘটনার ঝড় আমাকে অস্থির করে ফেলল। হঠাৎ একটা পয়েন্ট মাথায় এসে গেল। খুনী থিয়েটার থেকে চন্দ্রিকাকে বৃষ্টির মধ্যে অনুসরণ করে এসে বাড়ির কাছাকাছি অপেক্ষা করছিল কি? তা হলে আমার গাড়ির পিছনে তার গাড়ি ছিল। তারপর সম্ভবত আড়ি পেতে সে সব শোনে এবং ডিস্কোর পাঠানো লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। লোডশেডিং এবং বৃষ্টি তার সুযোগ করে দিয়েছিল। স্পষ্ট দেখা যায়, বর্ষাতিপরা একটা লোক। তার গাড়ি আছে।
প্রশ্নটা কর্নেলের কাছে তুললাম। উনি সেই কাগজের প্যাকেট থেকে একটা ফুলগাছের গোড়ায় কিছু ছড়াচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে আবাক চোখে তাকালেন। কি সর্বনাশ! তুমি মারা পড়বে দেখছি। না–তার মানে, তুমি পাগল হয়ে যাবে বলতে চাইছি। সাবধান ডার্লিং! কক্ষনো রহস্য নিয়ে ছেলেখেলা করতে নাই।
ছেলেখেলা কেন বলছেন?
হ্যাঁ। রহস্য নিয়ে অহেতুক চিন্তাভাবনা করাটাই ছেলেখেলা। রহস্য ফর্দাফাঁই করতে হলে অবশ্য একটা থিওরি গড়ে তোলা দরকার। তারপর তথ্য হাতড়াতে হয়। তথ্য থিওরির সঙ্গে না মিললে নতুন থিওরি গড়ো। কিন্তু তোমার কোনও থিওরিই নেই। আছে শুধু বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্যকে কেন্দ্র করে গড়া নিছক একটুকরো ধারনা। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমাদের সামনে একটা বিশাল কালো পর্দা টাঙানো। পর্দার আড়ালে অনেক কিছু ঘটছে। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কর্নেল খুরপি রাখতে গেলেন শেডে। আপাতত কোনও থিওরি গড়ে তোলা অসম্ভব, জয়ন্ত। তাই এই কেসে আমি শুধু তথ্য আর ঘটনার দিকে লক্ষ্য খছি। যাই হোক, একটু পরে আমরা বাইরে বেরুব। আরও তথ্য পেতে চাই বলেই প্রচুর ছোটাছুটি করতে হবে। তোমার মতিগতিথেকে বুঝেছি, তুমি তাতে পিছপা নও।
কর্নেল তাঁর জোরালো অট্টহাসিটি হাসলেন।
সাড়ে ছটা বাজে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, কোথায় যাবেন বলুন?
শ্যামবাজার এরিয়ায়।
চন্দ্রিকার সেই অ্যাডভোকেটের কাছে নাকি?
হ্যাঁ।
ওর কার্ডটা আপনি রেখে দিয়েছেন তা হলে?
নাহ। টুকে রেখেছি ঠিকানাটা। সার্কুলার রোডে পৌঁছলে কর্নেল ফের বললেন, ঠিকানাটা ডিস্কোরও দরকার হয় কি না জানতে চেয়েছি। তাই কার্ডটা পার্সেই রেখেছিলাম।
সারা পথ ট্রাফিক জ্যাম। কর্নেলের কাছে কলকাতার অলিগলি প্রায় যাকে বলা চলে নখদর্পণে। পাঁচমাথার মোড় পেরিয়ে বাগবাজারে, তারপর কর্নেলের নির্দেশে একটা গলি-রাস্তায় ঢুকলাম। তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। গলিটায় কোনওক্রমে দুটো গাড়ি পরস্পরকে পেরিয়ে যেতে পারে। একটা লোক অলক সেনগুপ্তের বাড়ি দেখিয়ে দিল। এমন এঁদো গলিতে বিশাল বনেদি বাড়ি দেখে তাক লেগে গেল। গেটের অবস্থা অবশ্য ভাঙাচোরা। নামেই গেট। কোনও কপাট বা গরাদ দেওয়া আগড় নেই। সামনে একটুকরো খোলা জায়গা। সেখানে গাড়ি দাঁড় করলাম।
গাড়ি থেকে বেরুতেই সামনের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেদ্ধাকা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। পরনে ফতুয়া আর ধুতি। উনিশ শতকের প্রতীক বলা যায়। সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। হাতে একটা ছড়ি দেখতে পেলাম। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন মনে হলো। কর্নেল নমস্কার করলে উনি বিনীতভাবে নমস্কার করে বললেন, কোত্থেকে আসা হচ্ছে মশাইদের?
আমরা অলকবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনিই কি—
আজ্ঞে, ঠিকই ধরেছেন। আসুন! ভেতরে আসুন।
ঘরের ভিতরে একধারে তক্তপোশের ওপর ধবধবে সাদা চাঁদরে ঢাকা গদি আর কয়েকটা তাকিয়া। কয়েকটা আলমারিতে আইনের বইপত্র ঠাসা। ঘরের অন্য অংশে অফিস ধরনের টেবিল চেয়ার পাতা। আমাদের গদি দেখিয়ে বসতে বললেন অলকবাবু। নিজে একটা চেয়ার টেনে সামনে বসলেন। মুখে অমায়িক হাসি। কর্নেল তাঁর নেমকার্ড দিলে চশমার কাছে ধরে খুঁটিয়ে পড়ে বললেন, কর্নেল নিলাদ্রি সরকার? আপনি কর্নেল?
রিটায়ার্ড।
হুঁ, তা নেচারিস্ট মানে?
প্রকৃতিচর্চা করি।
অলকবাবু সকৌতুকে হাসলেন। কিন্তু আমি তো আইনচর্চা করি কর্নেলসায়েব। প্রকৃতির সঙ্গে আইনের সম্পর্ক তো থাকার কথা নয়।
এক্ষেত্রে আছে। কর্নেলও কৌতুকের ভঙ্গিতে বললেন। রাঙাটুলি প্রকৃতির স্বর্গ। কাজেই–
অলকবাবু চমকে উঠলেন। রাঙাটুলি? রাঙাটুলির চৌধুরীবাড়িতে আমার জানাশোনা ছিল। বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন। ওঁদের ফ্যামিলির অনেক কেস আমি লড়েছি। বটুকবাবুর ছেলে রথীন খুন হয়েছিল। খামোকা রথীনের বউকে অ্যারেস্ট করল পুলিশ। রথীনের বউ আবার আমার আরেক মক্কেল হরনাথ সিংহের মাসতুতো ভাই অজয়ের মেয়ে।
চন্দ্রিকা রায়?
চেনেন নাকি? অলকবাবু আরও অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা খুলে বললে, ভাল হয়।
বটুকবাবুর ভগ্নীপতি অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার বন্ধু। সেই সূত্রে চন্দ্রিকাকে চিনি।
অ। কিন্তু চন্দ্রিকা তো নিখোঁজ হয়ে গেছে কবছর আগে।
জানি। আমি ওর বাবা অজয়বাবুর সম্পর্কে জানতে চাই।
অজয় তো কবে মরে গেছে। অজয়ের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে হরনাথের কাছে উঠেছিল। হরনাথই ভুলটা করেছিল। রথীন হারামজাদার হারামজাদা। জেনেশুনে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। তো আপনি অজয় সম্পর্কে জানতে চান। অমরেন্দ্রর কাছে আমার চেয়ে ভাল জানতে পারবেন।
আপনি বলুন, প্লিজ!
অলকবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝেছি। আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। কাজেই অজয় সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কোনও কারণ আছে। কিন্তু সে তো সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্যাপার। নতুন করে এতবছর পরে ফাঁইল ধুলল কে?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, সি বি আই।
হুঁ, । তা-ই বলুন। আপনারা সি বি আই অফিসার। দেখুন কর্নেলসায়েব, আমি একজন লইয়ার। কাজেই আই মাস্ট কোঅপারেট উইদ ইউ। অজয় সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, তা আমার মক্কেল হরনাথের সূত্রেই জানি। অজয় রাঙাটুলির মিলিটারি বেসে কন্ট্রাক্টর ছিল। পরে কী কারণে নাকি কন্ট্রাক্টারি যায়। জেল খাটতেও হয়েছিল। শুনেছি জেলে থাকা অবস্থাতেই সে মারা পড়ে।
অজয়বাবুর স্ত্রী বেঁচে আছেন কি?
নাহ্। সে কবেকার কথা। চন্দ্রিকা তখন বাচ্চা মেয়ে। এখন চন্দ্রিকার বয়স বোধ করি পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশিও হতে পারে।
হ্যাঁ। বেবিফেস যাকে বলে। বয়স বোঝা যায় না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার হয়ে আপনি কলকাতায় মামলা লড়েছিলেন। তার মানে রথীনবাবু খুন হয়েছিলেন কলকাতায়?
ঠিক বলেছেন। বেহালায় রথীন থাকত। শুনেছি, অমরবাবুর ছেলেও বেহালায় থাকত। পাশাপাশি বাড়িতে থাকত ওরা। তো সি বি আইয়ের কেসটা কিসের কর্নেল সায়েব?
অজয়বাবুকে ব্রিটিশ সরকার কী অপরাধে ফাঁসিয়েছিলেন, তা নিয়ে তদন্ত উঠেছে।
কার তদ্বিরে? বটুকবাবু তো শুনেছি বেঁচে নেই। কে গভর্মেন্টকে চাপ দিল এতদিন পরে?
আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু অজয়বাবু সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বুঝেছি। চিন্তিত মুখে অলকবাবু বললেন, চন্দ্রিকাকে খুঁজে বের করুন। বাবার কথা সে-ই আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবে। রথীনকে খুনের দায়ে তাকে খামোকা পুলিশ ফাঁসিয়েছিল। তারপর মেয়েটা রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে গেল।
আপনি সম্ভবত আর প্র্যাকটিস করেন না?
করি না। আমার ছেলে করে। আমি অবশ্য কনসাল্ট্যান্টের কাজকর্ম করি আজকাল। কোর্টে ছোটাছুটি আর এ বয়সে সম্ভব নয়। আপনাদের জন্য চা বলি?
থ্যাংকস। কর্নেল হাত তুলে নিষেধ করলেন। বাই এনি চান্স, আজ কেউ চন্দ্রিকা প্রসঙ্গে আপনার কাছে কথা বলতে এসেছিল কি?
অলকবাবু মাথা নাড়ালেন। না তো! কেন?
যদি কেউ আসে, পাত্তা দেবেন না–আমার অনুরোধ। আই মিন, সি বি আইয়ের পক্ষ থেকে এটা রিকোয়েস্ট।
না, না! কী বলছেন? অলকবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, পাত্তাই দেব না।
আমাদের কথাও যেন বলবেন না প্লিজ!
কক্ষনো না। নেভার! আই অ্যাম আ ল-অ্যাবাইডিং সিটিজেন অব দিস কান্ট্রি। তাছাড়া আমি লইয়ার। আই অ্যাসিওর ইউ কর্নেলসাহেব!…
.
ফেরার পথে বললাম, বড় অদ্ভুত ব্যাপার। মনে হচ্ছে, এবার আপনি একটা মহাভারত রহস্যে হাবুডুবু খাবেন। অসংখ্য এপিসোড!। অসংখ্য ট্র্যাজেডি। কোনটার সঙ্গে কোনটার সম্পর্ক আছে, খুঁজে বের করাই কঠিন। কিন্তু শুরু সামান্য একটা পরগাছা থেকে।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তুমি ঠিক ধরেছ। তোমাকে গতরাত্রে বলেছিলাম অর্কিডের একটা ফুল থেকে ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা ছড়িয়ে যাওয়ার কথা।
বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়াসহ।
য়ু আর ড্যাম রাইট, ডার্লিং।
সত্যি বস্! আমি কোনও খেই পাচ্ছি না।
কর্নেল চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ। দাঁতে কামড়ানো চুরুট। সারা পথ আর মুখ খুললেন না। আমি মহাভারতরহস্য থেকে এবার দুরে সরে থাকার চেষ্টা করছিলাম।
ভেবেছিলাম, কর্নেলকে বাড়ি পোঁছে দিয়ে কেটে পড়ব। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু কর্নেল আসতে দিলেন না। তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে ডোরবেলের সুইচ টিপলে ষষ্ঠী দরজা খুলে দিল। তারপর চাপাস্বরে বলল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েব এসে বসে আছেন বাবামশাই!
বসে আছে! বলিস কী রে?
আজ্ঞে। কোফি করে দিয়েছি। খাচ্ছেন।
কর্নেল ড্রয়িংরুমে ঢুকে বললেন, তোমাকে আশা করছিলাম অরিজিৎ। বিশেষ করে তোমার বন্ধু ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে জানার পর।
ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ি হাসলেন। হাতে প্রচুর সময় ছিল। তাই অন্তত ষষ্ঠীর সুস্বাদু কফিটা খেয়ে যাই ভেবেছিলাম। এই যে জয়ন্তবাবু! কেমন আছেন মশাই? অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই।
বললাম, কর্নেলের পাল্লায় পড়লেই আমার সঙ্গে রেগুলার দেখা হবে মিঃ লাহিড়ি!
কর্নেল বসে বললেন, বেলেঘাটার ওখানে ক্যানেলে একটা বডি পাওয়া গেছে তো?
হ্যাঁ। আমাদের অফিসাররা বলছেন, ডিস্কোসাহেবের লোক কিন্তু আপনি জেনে গেছেন–
কী নাম?
স্বপন দাশ। ইয়ং ম্যান। নিউমার্কেটে একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকান আছে। বাড়ি তালতলা এরিয়ায়। ক্রিমিন্যাল তো বটেই। অরিজিৎ কফিতে চুমুক দিয়ে ফের বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার! পকেটে একটা দিশি পিস্তল পাওয়া গেছে। তার মানে, নিরস্ত্র ছিল না। অথচ নিজেই মাথার পিছনে গুলি খেয়ে মারা পড়েছে। পয়েন্ট টোয়েন্টি টু রিভলভারের গুলি। রাত্রে বৃষ্টি পড়েছিল খুব। তাই খালের ধারে গাড়ির টায়ারের দাগ পাওয়া গেছে। দরজা খুলে গড়িয়ে বডি খালে ফেলেছে।
তাহলে বলা যায়, ওলসন হাউসের কাছেই কেউ ওত পেতে ছিল!
তাই মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, ঠিক এই কথাটাই কর্নেলকে বলছিলাম। কর্নেল বললেন, এটা নাকি আমার নিছক ধারণা?
অরিজিৎ গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদেরও নিছক ধারণাই। উই আর নট শিওর।
ইন্দ্রজিৎবাবু ডিস্কোর সঙ্গে ডুয়েল লড়তে চান। কর্নেল টুপি খুলে টাকে হাত মুলোতে বুলোতে বললেন। ডিস্কোর পরিচয় তুমিও সম্ভবত জানো না অরিজৎ!
নাহ্। দ্যাটস্ ওনলি নেম টু মি।
কোনও হিন্ট পাওনি তার সম্পর্কে?
শুধু এটুকু জানি, তার নাকি অনেক ডামি আছে। কোনটা রিয়্যাল ডিস্কো, তা নাকি কেউ-ই জানে না। অরিজিৎ হাসলেন। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, নামটাই একটা গুজব। ভূতের মতো। হয়তো অত্যন্ত সাধারণ কিংবা চেনা কেউ এই নাম নিয়ে অদ্ভুত খেলা খেলছে। যাই হক, ডিস্কো ইজ আ মিস্ট্রি। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন বডি পাওয়ার খবর?
ডিস্কো জানিয়েছে।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ ডার্লিং! ডিস্কোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তবে জানি না সেটা
অমি কি না।
অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, জয়ন্তবাবুদের কাগজে এক ভদ্রলোক আপনার ডার্লিং বলা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
আমি বললাম, পড়েছেন? কর্নেলের ইংরেজি বলাতেও ওঁর আপত্তি!
ভিন্নরুচির্হি জনাঃ! অরিজিৎ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আমার মতে, ডার্লিং বলাটা কর্নেলের একটা টিপিক্যাল ফিচার। এটাই ওঁর বৈশিষ্ট্য। ডার্লিং বলছেন না কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, এটা অকল্পনীয়। তাছাড়া ঐতিহাসিক কারণে তো বটেই, আরও নানা কারণে ইংরেজি বলাটা আমাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। ভারতের মতো একটা বহুভাষী দেশে ইংরেজি ছাড়া চলে না। তাছাড়া-ফর এক্সজাম্পল, এমকিউজ মি কথাটা বাংলা করলে কী অদ্ভুত শোনাবে ভাবুন।
অরিজিৎ ইংরেজি নিয়ে কিছুক্ষণ বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। ষষ্ঠী আমাদের জন্য কফি আনল। অরিজিৎ বললেন, এই যে ষষ্ঠীর কফি!। এছাড়া কর্নেলকে কল্পনা করাই তো অসম্ভব। সেই সমালোচকের অবস্থা সত্যি অনাথের মতো। আই ফিল– পিটি ফর হিম।
কর্নেল বললেন, অনাথ? অনাথ কেন?
প্রেসিডেন্সিতে আমার এক বন্ধু ছিল অনাথ নামে। ইন্দ্রজিৎও তাকে চিনত। ইংরেজি শুনলে চটে যেত। কিন্তু উত্তেজনার সময় সে কী সাংঘাতিক ইংরেজি বলত ভাবা যায় না।
অরিজিৎ! অনাথরা অনেক সময় পরগাছা হয়ে ওঠে।
অরিজিৎ একচোট হেসে বললেন, ইন্দ্রজিৎ পরগাছা নামে একটা নাটক করেছে। আমাকে দেখতে যেতে বলেছিল। শুনলাম, আপনি দেখে এসেছেন। নাটকে কি অনাথ নামে কোনও চরিত্র আছে?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, নাহ্। তবে অনাথ–অনাথ.. বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। জাদুঘরসদৃশ এই ড্রইংরুমের কোণার দিকে গিয়ে ওঁর ছোট্ট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। একটা নোটবই বের করতে দেখলাম। পাতা উল্টে কিছু দেখে নিয়ে ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, হ্যাঁ। অনাথবন্ধু রায়। অরিজিৎ তোমাদের সেই বন্ধুর নাম কি অনাথবন্ধু রায় ছিল?
অরিজিৎ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, পদবি মনে নেই। তবে অনাথবন্ধু বটে। খুব খেয়ালি ধরনের ছেলে ছিল মনে পড়ছে। ওকে আমরা সবসময় উত্ত্যক্ত করতাম।
রাঙাটুলিতে গিয়ে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ইনিও খেয়ালি। পরিবেশদূষণ নিয়ে আন্দোলন করে বেড়ান নানা জায়গায়। জানি না ইন্দ্রজিৎবাবুর নাটকের আইডিয়া ইনিই যুগিয়েছিলেন কি না।
অরিজৎ ঘড়ি দেখে বললেন, যাক্, ওসব কথা। যেজন্য এসেছিলাম, বলি। প্রথমত, বেলেঘাটার ক্যানেলে ডিস্কোর লোক স্বপনের ডেডবডি পাওয়ার কথা তো আপনি জেনেছেন। স্বয়ং ডিস্কোই জানিয়েছে। তবে দ্বিতীয় ঘটনা হলো, বেলা দুটোর পর ওলসন হাউস থেকে আমরা পুলিশ তুলে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ হ্যারি ওলসন থানায় ফোন করে জানান, দোতলার একটা মেয়ে ওঁকে এইমাত্র বলে গেল, চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকেছে। তখনই অশোক গুপ্ত গিয়ে এনকোয়ারি করেন। কিন্তু চন্দ্রিকার ঘর আগের মতোই তালাটা আছে। দোতলার সেই মেয়েটি ওঁকে অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, লোডশেডিংয়ের সময় নাকি লোকটাকে ওপরে উঠতে দেখেছিল। অশোকবাবুর মতে, চন্দ্রিকার কোনও পুরনো খদ্দের। কারণ লোকটা ডিস্কোর চেলা হলে দোতলার মেয়েটি চিনতে পারত।
আর কিছু?
নাহ্। তবে অশোকবাবু আমাকে ঘটনাটা জানানোর পর আমার মনে হচ্ছে, চন্দ্রিকার এমন কোনও ডকুমেন্ট আছে, যা খুনী এখনও হাতাতে পারেনি। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। আপনার চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। হয়তো আপনিই সেটা আবিষ্কার করতে পারবেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার খুনী ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওর ঘরে যেটা খুঁজছে, সেটা বেহাত হয়ে গেছে। চন্দ্রিকা বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল।
কিন্তু ডকুমেন্টটা কী হতে পারে?
একটা সাংকেতিক সূত্র লেখা কাগজ।
অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনার হাতের তাস আপনি আগে দেখাতে চান না জানি। কাজেই আর কোনও প্রশ্ন করব না। শুধু একটা রিকোয়েস্ট, ডিস্কোকে বলুন, ইন্দ্রজিৎকে আর যেন উত্ত্যক্ত না করে। সৌরভ নাট্যগোষ্ঠী নিয়েই বেচারার যা কিছু উচ্চাকাঙক্ষা। সব সময় প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকলে ওর নাটক করা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ইতিমধ্যে ওর দলে নাকি ডিস্কোর চর ঢুকেছে।
চন্দ্রিকা বেঁচে নেই। কাজেই ডিস্কো আর ইন্দ্রজিৎবাবুর পেছনে লাগবে কেন? কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে নিয়ে বললেন, তোমাকে জানানো উচিত, ইন্দ্রজিৎবাবুই বরং ডিস্কোর পেছনে লেগেছেন।
অরিজিৎ হেসে উঠলেন। আসলে চন্দ্রিকার সঙ্গে ওর এমোশনাল অ্যাফেয়ার ছিল বলে আমার ধারণা। তাই ডিস্কো বা তার লোক চন্দ্রিকাকে মেরেছে ভেবেই ইন্দ্রজিৎ খাপ্পা। আমি ইন্দ্রজিৎকে বলেছি, তুমি নির্ভয়ে নাটক চালিয়ে যাও। আর যেন কলগার্লদের ছায়া মাড়িও না। দলের কাকেও ডিস্কোর চর সন্দেহ হলে তাড়িয়ে দাও। ব্যস! ফুরিয়ে গেল।
একটা কথা, অরিজিৎ!
বলুন।
কিছুদিন আগে ওলসন হাউসে পুলিশ হানা দিয়েছিল। সত্যিই কি নার্কোটিকস পাওয়া গিয়েছিল কলগার্লদের কাছে?
অরিজিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, নাহ্। ওটা পাবলিক খাওয়ানো খবর। জাস্ট আ শো বিজনেস।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির অনুরোধে তুমিই হানার ব্যবস্থা করেছিলে কি?
হুঁ! অরিজিৎ সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, ইন্দ্রজিতের ধারণা, ডিস্কো ওকেই ওয়ার্নিং দিতে চন্দ্রিকাকে ওর প্রেমিকা এবং চর ভেবে খুন করেছে। ইন্দ্রজিৎ আজ বলছিল, হানা দেওয়াটা ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যা ঘটল, দেখা যাচ্ছে চন্দ্রিকাকে খুনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কাজেই এখন ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, হচ্ছে ডিস্কো বনাম ইন্দ্রজিতের দ্বন্দ্বের সঙ্গে চন্দ্রিকার মার্ডারের কোনও সম্পর্ক নেই দেয়ার ইজ আ থার্ড ম্যান।
দ্যাটস রাইট। কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন।
আমি চলি কর্নেল! আমরা থার্ড ম্যানকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আপনিও করুন। তবে ডিস্কোকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেবেন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ওর শত্রুতার আর কারণ নেই। আমি ইন্দ্রজিৎকে একই কথা বলেছি।
অরিজিৎ লাহিড়ি চলে যাওয়ার পর বললাম, ডিস্কোকে ফোন করবেন না?
কেন? লাহিড়িসায়েব ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে মিটমাট করিয়ে দিতে বলে গেলেন।
সমস্যা হলো জয়ন্ত, ডিস্কোর ডামি আছে অনেকগুলো। যতক্ষণ না আসল ডিস্কোকে পাচ্ছি, ততক্ষণ ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তার মিটমাট করানোর চেষ্টা বৃথা। কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। ফের বললেন, মানুষের ছায়ার সঙ্গে তো আর রক্তমাংসের মানুষের মিটমাট করিয়ে দেওয়া যায় না। ডিস্কো এখনও ছায়া। ছায়াটা কার এটাই প্রশ্ন।
ফোনে ডাকুন ডিস্কোকে। বলুন সশরীরে হাজির হতে।
সে আসবে না। পাঠাবে তার ডামিকে।
আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?
আমি নিশ্চিত। ভুলে যেও না, স্বয়ং অরিজিও স্বীকার করে গেল, ডিস্কো তার কাছে একটা নাম মাত্র।
তাহলে এবার তৃতীয় লোকটিকে খুঁজে বের করাই আপনার প্ল্যান নিশ্চয়?
হ্যাঁ। কর্নেল চোখ বুজে বললেন। তাকে চিনতে পারলেই কে প্রকৃত ডিস্কো জানা যাবে সম্ভবত।
আমি উঠি কর্নেল।
যাবে? আচ্ছা। কর্নেল অন্যমনস্কভাবে কথাটা বললেন।….
.
কোথায় যেন পড়েছিলাম, Beware of those thoughts come in night! রাতের চিন্তা সম্পর্কে সাবধান! বিছানায় শোয়ার পর চিন্তা এসে আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল। কোনও রহস্য নিয়ে চিন্তা আমার কাছে নতুন কিছু নয়–অন্তত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সান্নিধ্যে আসার পর থেকে। কিন্তু সেই সব চিন্তা আলতো ছুঁয়ে গেছে মাত্র। আজ রাতের চিন্তা মাছির ঝাঁকের মতো মগজে ভনভন করছিল। অবশেষে মরিয়া হয়ে একটা বোঝাঁপড়ার জন্য আমার জানা তথ্যগুলো কাগজে লিখে ফেললাম।
পটভূমি ১: রাঙাটুলির জনৈক অজয় রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক ঘাঁটিতে কন্ট্রাক্টর ছিলেন। কোনও অপরাধে তাঁর জেল হয়। জেলেই তিনি মারা যান। তাঁ স্ত্রী শিশুকন্যা চন্দ্রিকাকে নিয়ে স্বামীর মাসতুতো দাদা হরনাথ সিংহের কাছে আশ্রয় নেন। হরনাথ চন্দ্রিকার বিয়ে দিয়েছিলেন এম এল এ বটুক চৌধুরীর ছেলে রথীনের সঙ্গে। রথীন কলকাতায় থাকার সময় খুন হয়ে যায়। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চন্দ্রিকা জড়িয়ে পড়ে। আইনজীবী অলকবাবুর দ্বারস্থ হয়। তারপর সে কোনও ঘটনাচক্রে ডিস্কোর পাল্লায় পড়ে। মামলা থেকে বেঁচে গেলেও কলগার্লের ভূমিকায় তাকে নামতে হয়েছিল। তারপর তার নাট্য পরিচালক ইন্দ্রজিতের সঙ্গে চেনাজানা হয় এবং নাটকে নামার সুযোগ পায়। কিন্তু ডিস্কো নাকি এটা চায়নি। ইন্দ্রজিৎকে হুমকি দেয়। ইন্দ্রজিৎ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের দ্বারস্থ হন তাঁর বন্ধু ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির পরামর্শে। বোঝা যায়, বহ্মপী ডিস্কোর পরিচয় জানতেই ইন্দ্রজিৎ কর্নেলের দ্বারস্থ হন। ইন্দ্রজিৎ বলছিলেন, নিজের হাতে ডিস্কোকে শাস্তি দেবেন।
পটভূমি ২ : চন্দ্রিকাকে সম্প্রতি কেউ অদ্ভুত ভাষায় উত্ত্যক্ত করছিল। চাই চিচিং ফাঁক বলত কি সে? যাইহোক, ইন্দ্রজিতের মুখে কর্নেলের পরিচয় পেয়ে চন্দ্রিকা গতরাতে কর্নেলকে অনুসরণ করে আসে এবং ইচ্ছে করেই (?) পার্সটা আমাদের গাড়িতে ফেলে যায়। পার্সের ভেতর অদ্ভুত কোড লেখা একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। এর পর চন্দ্রিকা তার ফ্ল্যাটে খুন হয়েছে। ডিস্কো যার হাতে ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল, তার নাম স্বপন। সে-ও খুন হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চন্দ্রিকা প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে, কে হালদারের দ্বারস্থ হয়েছিল। তাঁকে বলেছিল, তার কোনো বিপদ (খুন) হলে রাঙাটুলির হরনাথকে খবরটা জানাতে হবে।
পটভূমি ৩ : রাজনীতি করা লোক রাঙাটুলির বটুক চৌধুরীর ভগ্নিপতি অমরেন্দ্র সিংহরায়কে সম্প্রতি কে বা কারা অদ্ভুতভাবে উত্ত্যক্ত করছে। চাই চিচিং ফাঁক (?) লেখা চিরকুট ফেলেছে অমরেন্দ্রর ঘরের দরজায়। অমরেন্দ্র এবং বটুক চৌধুরীর মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। বটুকবাবুও সম্ভবত (?) খুন হয়েছিলেন। এদিকে বটুকবাবুর ছেলে রথীন থাকত কলকাতায়। অমরেন্দ্রর ছেলে হেমেন্দ্রর বাড়ির পাশেই সে থাকত। হেমেন্দ্রর সঙ্গে তার বাবা অমরেন্দ্রর নাকি ভাল সম্পর্ক নেই (কর্নেলের বক্তব্য)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বটুকবাবুর নাম করে উড়োচিঠি লিখে অমরেন্দ্রর এক কর্মচারী যোগেন অমরেন্দ্রকে ভয় দেখাত। গত বছর কর্নেল তাকে ধরিয়ে দেন অর্থাৎ উড়োচিঠির রহস্য ফাঁস হয়। কেন যোগেন এ কাজ করত? কর্নেল জানাননি আমাকে।
এই সময় ফোন বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে অভ্যাসমতো বললাম, রং নাম্বার।
রাইট নাম্বার ডার্লিং!
কর্নেল! কী ব্যাপার? রাত বারোটা বাজে।
তুমি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকে চারবার কেউ ফোন করে আমাকে বলেছে, চাই চিচিং ফাঁক। দারুণ ইন্টারেস্টিং নয়?
আমিই কিন্তু বলেছিলাম কথাটা চাই চিচিং ফাঁক।
তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি।
কিন্তু শুধু এই কথাটা জানাবার জন্য এত রাতে নিশ্চয় ফোন করছেন না?
তুমি বুদ্ধিমান জয়ন্ত! ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। বিকেলে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিলেন। তখন তুমি ছিলে। কিন্তু উনি এখনও বাড়ি ফেরেননি।
বলেন কী? কে জানাল আপনাকে?
ওর স্ত্রী অরিজিৎকে ফোন করেছিলেন। অরিজিৎ ওঁর খোঁজে পুলিশ লড়িয়ে দিয়েছে। একটু আগে আমাকে অরিজিৎ ফোনে জানাল, এত রাতে ডিসটার্ব করার জন্য দুঃখিত। যা-ই হোক, ইন্দ্রজিৎবাবুর নিখোঁজ হওয়ার চেয়ে অদ্ভুত ঘটনা, অরিজিৎই বলল যে, ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী মৃদুলা রাঙাটুলির মেয়ে। কথায় কথায় অরিজিৎকে সেটা জানিয়েছেন মৃদুলা। অরিজিৎ যেহেতু আমার কাছে তখন রাঙাটুলির ইকোলজিস্ট অনাথবন্ধু রায়ের কথা শুনেছিল, তাই রাঙাটুলি কথাটা ওর মনে ছিল। তবে কথাটা অরিজিৎ নেহাত ক্যাজুয়ালি আমাকে জানাল। অরিজিৎকে আমি অমরেন্দ্র সিংহরায়ের কথা জানালাম না।
ব্যস্! এ যে তাহলে রাঙাটুলি রহস্য হয়ে উঠল।
নাহ্। পরগাছা রহস্য।
তার মানে?
মানে জানতে হলে সকাল আটটার মধ্যে আমার কাছে চলে এসো। ছাড়ছি। গুড নাইট। হ্যাঁভ আ নাইস স্লিপ, ডার্লিং!
ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানছিলাম। উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছিলাম, ইন্দ্রজিৎবাবুকে ডিস্কো খতম করে ফেলেনি তো? কিন্তু তার চেয়ে ভয়ের কথা, এবার কর্নেলকেই ভুতুড়ে ফোনে চাই চিচিং ফাঁক বলে কেউ উত্ত্যক্ত করছে। ডিস্কো নয় বলেই মনে হচ্ছে। সে হলে সোজাসুজি চার্জ করে বসত কর্নেলকে, আমার এই জিনিসটা চাই। চিচিং ফাঁক এই সাংকেতিক কথা বলার পাত্র নয় সে। তাছাড়া সে কর্নেলকে উত্ত্যক্ত করবেই বা কেন? কী লাভ হবে তাতে? এ নিশ্চয় অরিজিৎ লাহিড়ি যে তৃতীয় লোকের কথা বলছিলেন, তারই কাজ।….
.
সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড বই খুলে বসে আছেন। বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললেন, আজ সব কাগজে কলগার্ল খুন হেডিংয়ে চন্দ্রিকার খবর বেরিয়েছে।
বললাম, চোখ বুলিয়েছি। খুঁটিয়ে পড়িনি। ছাঁচে ফেলা খবর। কিন্তু আপনি এই সক্কালবেলা রহস্য ছেড়ে বইয়ে ডুব দিতে গেলেন দেখে অবাক লাগছে।
কর্নেল বইটা রেখে একটু হেসে বললেন, এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ আর্মিবেসের রেকর্ড। কোথায়-কোথায় সামরিক ঘাঁটি করা হয়েছিল, সেই সব ঘাঁটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বুঝলাম, রাঙাটুলি আর্মিবেসের তথ্য খুঁজছেন। কিন্তু কেন?
নিছক কৌতূহল। বলে কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। একটু পর ফের বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী মৃদুলা একটু আগে ফোন করেছিলেন।
ইন্দ্রজিৎবাবু বাড়ি ফিরেছেন কি?
নাহ্। মৃদুলা কাগজে চন্দ্রিকার খবর পড়ে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। চন্দ্রিকাকে উনি চিনতেন। কিন্তু চন্দ্রিকা কলগার্ল হয়েছে জানতেন না। বললেন যে, ওঁর স্বামীর সঙ্গে চন্দ্রিকা মাঝেমাঝে ওঁদের বাড়িতে যেত। সেই নিয়ে কোনও সন্দেহ জাগার কথা নয়। কারণ সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর আরও মেয়ে ওঁর স্বামীর সঙ্গে যেত। রিহার্সাল হতো ওঁদের বাড়িতেই।
ষষ্ঠী আমার জন্য কফি আনল। কফি খেতে খেতে বললাম, মৃদুলা তো রাঙাটুলির মেয়ে! চন্দ্রিকা সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পেরেছে ওঁর কাছে?
ফোনে বেশি কথা বলা যায় না। কর্নেল আস্তে বললেন, কফি খেয়ে নাও। বেরুব। মৃদুলা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বাড়ি লেকের কাছাকাছি। ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, দোতলা বনেদী বাড়ি। গেটে লেখা আছে সৌরভ। একজন তাগড়াই গড়নের যুবককে সম্ভবত আমাদের জন্যই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন মৃদুলা। তার পরনে জিনস। ফিল্মহিবোর কেতা আছে হাবভাবে। নমস্কার করে বলল, আসুন স্যার! ভেতরে গাড়ি রাখার জায়গা আছে।
সে গেট খুলে দিল। ছোট্ট লনের পর পোর্টিকো। সেখানে গাড়ি রেখে আমরা নামলাম। কর্নেল বললেন, আপনি কি সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেতা?
যুবকটি হাসল। হ্যাঁ, স্যার! পরগাছা নাটকে আপনি গাবুর রোলে ছিলেন?
যুবকটি একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি ঠিকই চিনেছেন স্যার। আমার নাম, সুশান্ত সেন। আপনার সব কথা স্যার, মৃদুলাদি বলেছেন আমাকে।
কর্নেল ঘরে ঢুকে বললেন, কী সব কথা? এই মানে–আপনি ডিটেকটিভ অফিসার …
কর্নেল জিভ কেটে বললেন, ছি, ছি! আমি ডিটেকটিভ নই। কথাটা একটা গালাগাল। কারণ টিকটিকি কথাটা ডিটেকটিভ থেকে এসেছে। যাই হোক, মিসেস
ব্যানার্জিকে খবর দিন।
সুশান্ত আরও অবাক হয়ে ভেতরে গেল। ঘরটা আধুনিক ছাঁদে সাজানো। রুচির ছাপ আছে। একটু পরে সুশান্ত ফিরে এসে বলল, মৃদুলাদি আসছেন। ফোনে কথা বলছেন কার সঙ্গে।
সুশান্তবাবু, আপনি কিন্তু অসাধারণ অভিনয় করেন। আপনার অভিনয় দেখে
আমি মুগ্ধ। তো আপনি থাকেন কোথায়?
সুশান্ত একটু ইতস্তত করে বলল, আমি এ বাড়িতেই থাকি স্যার। ইন্দ্রদা আমাকে অনেক কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। ধরুন, রিহার্সালের ব্যবস্থা করা হলো, বুকিং, নানা জায়গায় কন্ট্যাক্ট করা। ম্যানেজার বলতে পারেন।
চন্দ্রিকা রায় তো আপনাদের দলেই অভিনয় করত?
সুশান্ত চমকে উঠল। হ্যাঁ কাগজে দেখলাম মার্ডার হয়েছে। কিন্তু–
চন্দ্রিকা কলগার্ল ছিল, জানতেন না?
আজ্ঞে। তবে স্যার, আমার বরাবর কেমন একটা সন্দেহ হতো। চন্দ্রিকার হাবভাব দেখেই কেমন লাগত। তবে ফেবোসাস টাইপের মেয়ে ছিল।
সে থেমে গেল। মৃদুলা এসে নমস্কার করে বসলেন। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ প্রকট। ঠোঁট কামড়ে ধরে আত্মসম্বরণ করে আস্তে বললেন, মিঃ লাহিড়ির সঙ্গে কথা বলছিলাম। সুশান্ত আপনার আসার খবর দিল। মিঃ লাহিড়িকে জানালাম আপনি এসেছেন। উনি বললেন, ফ্র্যাংকলি সব কথা যেন আপনাকে বলি। উনি সুশান্তর দিকে ঘুরে বললেন, চা করতে বলে এসেছি। গিয়ে দেখ তুমি।
সুশান্ত চলে গেলে মৃদুলা চাপা স্বরে বললেন, আমার হাজব্যান্ডকে কিডন্যাপ করেছে। এই দেখুন, কিছুক্ষণ আগে লেটার বক্সে সুশান্ত চিঠিটা পেয়েছে।
খামে ভরা চিঠিটা ওঁর মুঠোয় দুমড়ে গিয়েছিল। কর্নেল বের করে ভাঁজ সোজা করলেন। ঝুঁকে গেলাম ওঁর দিকে। দেখলাম, লেখা আছে :
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি আমাদের হাতে বন্দি। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে এক লক্ষ নগদ টাকা পৌঁছে দিলে তাকে ছেড়ে দেব। পুলিশকে জানালে আমরা জেনে যাব এবং সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্বামীকে গুলি করে মারব। রাঙাটুলির ভবানী মন্দির কোথায় আপনি জানেন।
ডিস্কো।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে বললেন, আপনি কি লাহিড়িসায়েবকে এই চিঠির কথা জানালেন?
মৃদুলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, না।
সুশান্তবুকে নিশ্চয় জানিয়েছেন?
হ্যাঁ। সুশান্ত এই ফ্যামিলিরই একজন।
কী করবেন ভেবেছেন?
সুশান্তর সঙ্গে পরামর্শ করেছি। সুশান্ত আজই টাকা নিয়ে যাবে। আমিও সঙ্গে যাব। কারণ ভবানীমন্দির সুশান্ত চেনে না।
এত নগদ টাকা যোগাড়-করতে পারবেন?
কর্নেলের কথার ওপর মৃদুলা দ্রুত বললেন, আমি ম্যানেজ করতে পারব।
ডিস্কো কে আপনি জানেন?
না। তবে সুশান্ত বলছিল, ইন্দ্রজিতের কাছে নামটা শুনেছে। বলে একটু দ্বিধার পর মৃদুলা ফের বললেন, সুশান্ত ওর বডিগার্ড। কিন্তু গতকাল ও সুশান্তকে নিয়ে বেরোয়নি। সেই ভুলের জন্যই এ অবস্থা। আমি ওকে একা বেরুতে বারণ করেছিলাম।
আপনি তো রাঙাটুলির মেয়ে। চন্দ্রিকা রায়কে চিনতেন নিশ্চয়?
সুন্দরী মহিলার চেহারায় মুহূর্তের জন্য বিকৃতি ফুটে উঠল। বিকৃত মুখে বললেন, ডেঞ্জারাস মেয়ে। ইন্দ্রজিৎ? আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। নিজের স্বামীকে যে মেয়ে তোক দিয়ে মার্ডার করাতে পারে, তার চরিত্র কেমন ভেবে দেখুন।
চন্দ্রিকার স্বামীকে আপনি চিনতেন?
মুখোমুখি আলাপ ছিল না। শুনেছি, নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে ছিল। তবে ভীষণ মদ খেত–হয়তো ফ্রাস্ট্রেশনের জন্য। তাছাড়া ওর বাবা ছিলেন এম এল এ। সেই জন্য খারাপ লোকেরা ওকে খুব এক্সপ্লয়েট করত। বটুকবাবুকেও রথীনের বোকামির জন্য বিব্রত হতে হতো।
আপনি নিশ্চয় বটুকবাবুর ভাগ্নে হেমেন্দ্রকে চেনেন?
মৃদুলার চোখ জ্বলে উঠল। আমার সন্দেহ, হেমেনদাই ডিস্কো।
কেন সন্দেহ?
চন্দ্রিকার সঙ্গে হেমেনদার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রথীনকে মার্ডারের পেছনে তারও হাত ছিল। ইন্দ্রজিৎ আমাকে বলেছিল এ সব কথা খুলে বলাই উচিত আপনাকে। আমার স্বামীভদ্রলোক এই যে বিপদে পড়েছে, সেটা অকারণ নয়। মৃদুলার মুখে আবার বিকৃতি ফুটে উঠল। চন্দ্রিকাকে নিয়ে হেমেনদার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের রেষারেষি চলছিল। ইন্দ্রজিৎ আমাকে বলত চন্দ্রিকার জীবন হেমেনই নষ্ট করেছে। এদিকে হেমেনদা একদিন আমাকে টেলিফোনে বলছিল, ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রিকার জন্য বিপদে পড়বে। ওকে যেন সাবধান করে দিই।
আপনি ইন্দ্রজিৎবাবুকে বলেছিলেন সেকথা?
মৃদুলা মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন, হ্যাঁ। শুনে ও খেপে গেল। ভীষণ ঝগড়াঝাঁটি হলো আমার সঙ্গে। ইন্দ্রজিতের যুক্তি হলো, চন্দ্রিকার অভিনয় ক্ষমতা নাকি অসাধারণ। সে তার সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অ্যাসেট হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে। আমি বুঝতে পারি না কিছু।
সুশান্ত এল। বাড়ির পরিচারিকার হাতে ট্রে। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি এক চুমুক খাব মাত্র–আপনার অনারে। জয়ন্ত পুরো কাপ খাও।
মৃদুলা সুশান্তকে বললেন, তুমি এখনই পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে দেখতো ইসমাইল এখনও কেন এল না গাড়ি নিয়ে। লাহিড়িসায়েব বললেন, বলে দিয়েছেন ওদের। যাবে আর আসবে কিন্তু। সাড়ে বারোটায় ট্রেন। ভুলে যেও না।
সুশান্ত বেরিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর গাড়ি?
মৃদুলা বললেন, হ্যাঁ। গতরাতে ওর গাড়িটা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে পাওয়া গিয়েছিল। তখন টেলিফোনে আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে পাওয়া গেছে? গত রাতে?
হ্যাঁ। লাহিড়িসায়েব খবর দিয়েছিলেন। লোক পাঠিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি যখন ডিস্কোকে টাকা দিয়ে ইন্দ্রজিৎবাবুর মুক্তি চেয়েছেন, তখন আর আমার কিছু করার নেই। তো–
মৃদুলা ওঁর কথার ওপর বললেন, আমি রিস্ক নিতে চাই না। টাকার চেয়ে প্রাণের দাম বেশি। ওঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। হাতের চেটোয় মুছে ফের বললেন, যদি ভালয়-ভালয় ওকে ফিরিয়ে আনতে পারি, আর নাটক করতে দেব না। কত অচেনা মেয়ে ওর গ্রুপে নাটক করতে আসে। হয়তো আবার কারও জন্য ও বিপদে পড়বে।
কর্নেল বললেন, একটা প্রশ্ন। আপনার বাবার নাম কী?
আমার বাবা একজন সায়েন্টিস্ট। একসময় অধ্যাপনা করতেন। ছেড়ে দিয়ে কী সব রিসার্চ করেন। আমার বাবা ভীষণ খেয়ালি মানুষ। আসলে আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা কেমন যেন হয়ে গেছেন। কোথায় কোথায় বনজঙ্গল পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান।
বাই এনি চান্স, আপনার বাবার নাম কি অনাথবন্ধু রায়?
মৃদুলা আস্তে বললেন, হ্যাঁ। আপনি চেনেন?
কাগজে ওঁর লেখা পড়েছি। ইকোলজিস্ট উনি।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলা বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম। সকাল অব্দি জানতাম না টাকার জন্য ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করেছে। তা হলে আপনাকে আসতে নিষেধ করতাম।
কর্নেল পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, শুধু একটা চিঠির ওপর ভরসা করে আপনি অত টাকা নিয়ে যাবেন? ধরুন যদি কোনও থার্ড পার্টি এই ঘটনার সুযোগে টাকাটা হাতাতে চায়?
মৃদুলা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। শান্তভাবে বললেন, আমি বোকামি করছি না কর্নেল সায়েব! চিঠিটা পাওয়ার পরে টেলিফোনে কিডন্যাপার ইন্দ্রজিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছে, টাকা না দিলে ওরা ওকে মেরে ফেলবে। আমার স্বামীর গলার স্বর আমি চিনি। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছি।
আই সি। কর্নেল একটু হাসলেন। ঠিক আছে চলি! বলে জোরে পা ফেলে বেরিয়ে এলেন।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেটের কাছে গেলে এবার সুশান্তের বয়সী অন্য একটি যুবক গেট খুলে দিল। আর একজনকে গেটের পাশে বসে থাকতে দেখলাম। রাস্তায় পৌঁছে বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর থিয়েটারের লোকেরা সবাই ওঁর বাড়িতে থাকে। নাকি?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, সেটা অস্বাভাবিক কিছুনয়। তবে ইন্দ্রজিত্যাবুর এই বিপদের দিনে ওঁর কাছের মানুষ যারা, তারা ছুটে আসতেই পারে। যাক গে, মহিলাকে কেমন মনে হলো?
শক্ত মনের মানুষ। স্ট্রং নার্ভ। ভেঙে পড়েননি।
ওঁর বাবা অনাথবাবু একেবারে বিপরীত। রাঙাটুলিতে আলাপ হয়েছিল।
কাল রাত্রে আপনি বলছিলেন। কিন্তু উনিই যে ইন্দ্রজিৎবাবুর শ্বশুর, এটা আমাকে চমক দেবার জন্যই কি আপনি গোপন রেখেছিলেন?
কর্নেল সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, ভদ্রলোক পরিবেশদূষণ এবং মানুষের ন্যাচারাল হ্যাঁবিটাট নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন করছেন খনি অঞ্চলে। তবে আমাকে একটা অর্কিড প্রজাতির খোঁজ দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কর্নেল হঠাৎ বললেন, বাঁদিকের রাস্তায় চলো। শর্টকাট হবে।
ওদিকে কোথায় শর্টকাট হবে?
আমরা সোজা চৌরঙ্গি এলাকায় যাব। জয়া ট্রেডিং এজেন্সির অফিসে।
সেখানে কী?
অমরেন্দ্রবাবুর ছেলে হেমেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে চাই।…
.
একটা বহুতল বাড়ির দশতলার পুরোটা নিয়ে জয়া ট্রেডিং এজেন্সি। বিশাল কারবার না থাকলে এমন সাজানোগোছানো অফিস করা যায় না। প্রচুর কর্মচারী আর উর্দিপরা বেয়ারা নিয়ে কর্মব্যস্ত একটা আধুনিক প্রতিষ্ঠান। রিসেপশনের কাউন্টারে সুন্দরী যুবতী মোতায়েন। মিঠে হাসিতে মিশিয়ে ফুরফুরে ইংরেজি বলছে। উচ্চারণে মার্কিনি ঢং। অর্থাৎ আনুনাসিক স্বর।
এক মিনিট পরেই একজন বেয়ারা এসে আমাদের নিয়ে গেল মালিকের চোরে।
হেমেন্দ্রবাবুর বয়স আন্দাজ করলাম চল্লিশ বিয়াল্লিশের বেশি নয়। সপ্রতিভ ঝকঝকে চেহারা। চিবুকে দাড়ি। মুখে পাইপ। কর্নেলকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়ালেন।
করমর্দনের পর কর্নেল আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। হেমেন্দ্র একটু হেসে বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম কর্নেলসায়েব এতক্ষণ রাঙাটুলিতে মামাবাবুর ভূতের পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন।
কর্নেল বললেন, যেতাম। একটু বাধা পড়ে গেল। তো পরশু রাতে তোমার বাবা কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন?
সে এক কেলেংকারি! হেমেন্দ্র হাসলেন। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে জলে আটকে গেলাম। ইঞ্জিনে জল ঢুকে গাড়ি বিগড়ে গেল। ওই অবস্থায় গাড়ি ফেলে রেখে কাছাকাছি একটা গ্যারাজে গিয়ে লোক ডেকে–সে এক বিশ্রি ঝামেলা। বাড়ি ফিরলাম গ্যারাজের একটা গাড়ি নিয়ে। তখন রাত প্রায় একটা। ফিরে দেখি, শালা ঘুমোচ্ছন। জানতাম, আমার অপেক্ষা করবেন না। কিন্তু এই ট্রাজেডির মধ্যে একটা কমেডিও আছে। আমার গাড়ি জলে ডুবেছিল আপনার বাড়ির কাছাকাছি। আসলে শর্টকাটে আসতে গিয়েই পড়লাম অগাধ জলে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে নাকি?
হ্যাঁ। সি দা ফান। তার ওপর লোডশেডিং সারা এলাকায়।
এই রাস্তাটায় আজকাল এক কোমর জল জমে যায়। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ললেন, তুমি কি ওলসন হাউস চেনো? ওই রাস্তায় বাড়িটা পড়ে।
হেমেন্দ্র একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। ওলসন হাউস! নামটা চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ–আজই কাগজে পড়েছি। একটা মার্ডার হয়েছে ওই বাড়িতে। আপনি–
হ্যাঁ। আমি ইন্টাররেস্টেড। চন্দ্রিকাকে তুমি চিনতে।
হেমেন্দ্র একটু চুপ করে থেকে আস্তে বললেন, চিনতাম। দ্যাটস আ লং স্টোরি। কিন্তু আমি আজ কাগজ পড়েই জানলাম চন্দ্রিকা ওই বাড়িতে থাকত এবং কলগার্ল হয়ে উঠেছিল। আশ্চর্য লাগছে, চন্দ্রিকা মাঝে মাঝে আমার অফিসেও আসত। চাকরির জন্য বলত। কিন্তু আমি জানতাম, ওর নামে ওর স্বামীকে মার্ডারের চার্জ আছে। তাছাড়া ওকে তো ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর স্বামী রথীন আমার মামাতো ভাই ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে ওর জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না।
তুমি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে ওকে মিশতে বারণ করতে শুনেছি।
কে বলল? হেমেন্দ্রর চোখ জ্বলে উঠল। ইন্দ্রজিৎ বলল আপনাকে?
ইন্দ্রজিৎকে ডিস্কো নামে কোন মাফিয়া ডন কিডন্যাপ করে এক লাখ টাকা চেয়েছে।
হেমেন্দ্র চমকে উঠলেন। বলেন কী! কে ডিস্কো?
বললাম তো, মাফিয়া ডন। ওলসন হাউসের কলগার্লদের মালিক।
হেমেন্দ্র আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে মনে হচ্ছে। সে বলেছে আমি চন্দ্রিকাকে ওর সঙ্গে মিশতে বারণ করতাম?
না। ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী।
মৃদুলা? মৃদুলা–আশ্চর্য তো!
উত্তেজিত হয়ো না প্লিজ। কর্নেল একটু হেসে বললেন, মৃদুলা ভুল বুঝতেই পারেন। কিন্তু ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল, তোমার মুখেই জানতে চাই।
কফি খান, বলছি।
হেমেন্দ্র সুইচ টিপে ঘণ্টা বাজালেন। একজন বেয়ারা এলে তাকে কফি আনতে বললেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হাসবার চেষ্টা করলেন। মৃদুলাকে নিশ্চয় ইন্দ্রজিৎ ভুল বুঝিয়েছে। ইন্দ্রজিৎ নাটক করে। নিজেকে শিল্পী বলে। কিন্তু এটা ওর চরিত্রের অন্য দিক। মুখোশ বলতে পারেন। আপনি কি জানেন ইন্দ্রজিৎ এক সময় ট্রেড ইউনিয়ন করত ধানবাদ এরিয়ায়? ও ধানবাদেরই ছেলে। আমার মামাবাবু বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন আপনি তো জানেন। মামাবাবুও ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। সেই সূত্রে ইন্দ্রজিৎ রাঙাটুলিতে মামাবাবুর বাড়ি যাতায়াত করত। তারপর মৃদুলার সঙ্গে কী ভাবে প্রেম-টেম করে ফেলে। মৃদুলার বাবা তখন পাটনা য়ুনিভার্সিটির অধ্যাপক। ইন্দ্রজিৎ মৃদুলাকে নিয়ে কলকাতা চলে আসে। বিয়ে করে। ট্রেড ইউনিয়ন করেই ইন্দ্রজিৎ প্রচুর পয়সা কামিয়েছিল। মামাবাবু জানতেন ইন্দ্রজিৎ রাজনীতিতে তাঁকে ডোবাবে। তাই তার সংশ্রব এড়িয়ে চলতেন। আমি নিজের কানে শুনেছি, মামাবাবু জনসভায় চিৎকার করে ইন্দ্রজিতের দুর্নীতির মুখোশ খুলে দিচ্ছেন। এ জন্যই আমার সন্দেহ, ইন্দ্রজিৎ মামাবাবুর বিরুদ্ধে কলকাতায় বসে কলকাঠি নেড়েছে। গত বছর মামাবাবু নিখোঁজ হয়ে যান। তারপর ড্যামের জলে ওর বডি পাওয়া যায়। ইন্দ্রজিৎ পুরনো রাগ ঝাড়তেই ওর একসময়কার চেলাদের দিয়ে মামাবাবুকে মার্ডার করিয়েছিল। এবার বুঝুন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ধরনের ছিল।
কফি এল। হেমেন্দ্র বললেন, কফি খান। আরও বলছি।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, কিন্তু কলকাতায় তোমার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের যোগাযোগ ছিল। প্লিজ এক্সপ্লেন ইট।
যোগাযোগের প্রশ্নই ওঠে না। আমার বাড়ির পাশেই রথীন একটা বাড়ি করেছিল। আমি আমার ঘর থেকে দেখতে পেতাম ইন্দ্রজিৎ রথীনের সঙ্গে মদ খাচ্ছে। চন্দ্রিকাও ওদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। কাজেই রথীনকে আড়ালে সাবধান করে দিতাম ইন্দ্রজিৎ সম্পর্কে। কিন্তু রথীনের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ পড়ে এসেছিল। ইন্দ্রজিৎ ওকে মদ যোগাত। আমি চন্দ্রিকাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। চন্দ্রিকাও আমার ওপর খাপ্পা হয়েছিল। চন্দ্রিকা ছিল যাকে বলে স্পয়েল্ড চাইল্ড। এক রাত্রে দেখি, রথীন মাতাল হয়ে লনে পড়ে আছে। আর চন্দ্রিকা ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ….. সরি। আমার খারাপ কথাবার্তা বলা অভ্যাস নয়।
তুমি ইন্টারভেন করেছিলে কি?
হ্যাঁ। আফটার অল রথীন আমার মামাতো ভাই।
তুমি মৃদুলাকে ফোন করে বলেছিলে—
হ্যাঁ। মৃদুলাকে বলেছিলাম, ওর স্বামী চন্দ্রিকাকে যেন অ্যাভয়েড করে। আসলে চন্দ্রিকার বদনাম দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলাম মৃদুলাকে।
রথীন খুন হয়েছিল কীভাবে?
বাড়িতেই ওর গলাকাটা ডেডবডি পাওয়া যায়। চন্দ্রিকা উধাও। বডি পচে গন্ধ ছুটছে। তখন ব্যাপারটা জানা যায়। কাজেই স্বভাবত চন্দ্রিকাকে পুলিশের সন্দেহ হয়।
তুমি বলছিলে, চন্দ্রিকা তোমার কাছে চাকরির জন্য আসত।
ইদানিং আসত। রথীন খুন হয়েছে ছ-সাত বছর আগে।
কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার ভেতর বললনে, রথীনের খুন হওয়া সম্পর্কে তার বক্তব্য জানতে চাওনি?
হেমেন্দ্র উত্তেজিত ভাবে বললেন, কেন চাইব না? হঠাৎ যেদিন প্রথম এল, আমি সেইদিনই চার্জ করেছিলাম ওকে। কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, সে-রাতে এর সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিল। রথীন ওকে মেরেছিল। চন্দ্রিকা নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। রথীন তখন মাতাল অবস্থায় ছিল। গালাগালি দিয়ে দরজা ভেতর থেকে এঁটে দেয়। তারপর কী হয়েছে, চন্দ্রিকা জানত না।
চন্দ্রিকা কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল তারপর?
চন্দ্রিকার কথা আমি বিশ্বাস করিনি। বলেছিল, ও নাকি ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল–বিডন স্ট্রিটের ওদিকে কোথায় যেন। ওর জ্যাঠামশাই হরনাথবাবুর অ্যাডভোকেটকে ওর সেই আত্মীয় নাকি অ্যাপ্রোচ করেছিলেন। কারণ চন্দ্রিকার নামে তখন হুলিয়া করেছে পুলিশ। দ্যাটস আ লং স্টোরি। চন্দ্রিকার কথার সত্যি মিথ্যে বোঝা কঠিন ছিল আমার পক্ষে।
চন্দ্রিকা এরপর ইন্দ্রজিতের পাল্লায় পড়েছে তুমি কী ভাবে জেনেছিলে?
চন্দ্রিকা একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে আবার। আমি চাকরির ব্যবস্থা না করে দিলে সে ওর নাটকের দলে ঢুকবে। চন্দ্রিকাকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। কাজেই আমি বলেছিলাম, চান্স পেলে ছেড়ো না। আসলে আমি ওকে এড়াতে চেয়েছিলাম।
কর্নেল হাসলেন। গত পরশু রবিবার সন্ধ্যায় ইন্দ্রজিতের নাটক দেখতে গিয়েছিলে তুমি। আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু নাটক শেষ হওয়ার পর ভিড়ে আর দেখিনি।
হেমেন্দ্র চমকে উঠলেন। তারপর শুকনো হেসে বললেন, হ্যাঁ। আপনাকেও দেখেছি। সামনে গেস্টের সিটে ছিলেন। তবে নাটক শেষ হওয়ার পর আমিও ভিড়ে আপনাকে আর খুঁজে পাইনি। বৃষ্টি পড়ছিল বলে বাড়ি চলে গেলাম। গিয়ে শুনি, বাবা আপনার বাড়িতে এসেছেন। গাড়ি পাঠাতে বলেছেন। তখন–
তুমি ডানদিকে দ্বিতীয় সারিতে ছিলে।
হেমেন্দ্র ব্যস্তভাবে বললেন, চন্দ্রিকা শনিবার অফিসে ফোন করেছিল। ও সত্যিই ইন্দ্রজিতের নাটকে চান্স পেয়েছে। আমি নাটকটা দেখলেও খুশি হবে। কিছুক্ষণ পরে একটা লোক এসে গেস্টকার্ড দিয়ে গেল। কাজেই নিছক কৌতূহলে আমি নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।
একা গিয়েছিলে!
হেমেন্দ্র আবার শুকনো হাসলেন। চন্দ্রিকা আমার স্ত্রীর পরিচিত। কাজেই দুটো কার্ড পাঠালেও আমি একা যাওয়া উচিত মনে করেছিলাম। বলে উনি ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি ডিটেকটিভ কথাটা শুনলে চটে যান। কাজেই কথাটা বলছি না। কে চন্দ্রিকার মার্ডার-মিস্ট্রি সলভ করার জন্য আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেছে? ইন্দ্রজিৎ?
নাহ্। চন্দ্রিকা।
হেমেন্দ্র টেবিলের ওপর ঝুঁকে এলেন। চন্দ্রিকা বুঝতে পেরেছিল তাকে মার্ডার করা হবে?
চন্দ্রিকার কাছে একটা মূল্যবান কাগজ ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, ওটা কেড়ে নেওয়ার জন্য তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কর্নেল একটু হেসে ফের বললেন, বাই এনি চান্স, তুমি রবিবার রাতে নাটক শেষ হওয়ার পর ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলে?
হেমেন্দ্র আস্তে বললেন, হ্যাঁ। ওকে গ্রিনরুমে না পেয়ে চলে এসেছিলাম। গেটের কাছে দেখি, চন্দ্রিকা একটা ট্যাক্সিতে চাপছে। ইন্দ্রজিৎ দৌড়ে গেল ওর কাছে। তারপর দেখলাম, ট্যাক্সি চলে গেল। ইন্দ্রজিতের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। তাই আমি আমার গাড়ির কাছে চলে গেলাম। দ্যাটস অল। কিন্তু চন্দ্রিকার মূল্যবান কাগজটা কী?
জানি না।
চন্দ্রিকাকে কেউ মার্ডার করে সেটা হাতিয়েছে?
তা-ও জানি না। আর তোমার সময় নষ্ট করব না। এবার তোমার বাবার কথায় আসা যাক। শুধু একটা প্রশ্ন। তোমার বাবার ঘরের সামনে কে একটা কাগজ ফেলে গেছে। তাতে লেখা আছে চাই চিচিং ফাঁক।
বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সাইকিক পেশ্যান্ট হয়ে পড়েছেন।
চাই চিচিং ফাঁক কথাটা তুমি শুনেছ এর আগে?
নেভার। সব বাবার পাগলামি।
আচ্ছা, উঠি। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার খুনীকে ধরার জন্য তোমার সহযোগিতা ভবিষ্যতেও দরকার হতে পারে, হেমেন। আশা করি, পাব।
সিওর। উঠে দাঁড়ালেন হেমেন্দ্র। তারপর বিদায় অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন আমাদের….
.
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, হেমেনবাবুর বক্তব্য শুনে খটকা লেগেছে আমার।
কর্নেল বললেন, কী খটকা?
পরশু রাতে উনিই চন্দ্রিকাকে ফলো করেছিলেন এবং ওঁর ভয়েই চন্দ্রিকা আমাদের গাড়িতে লিফট নিয়েছিল বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
আর কিছু?
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চন্দ্রিকা খুন হওয়ার সময় হেমেন্দ্র কাছাকাছি ছিলেন। গাড়ি জলে আটকে গিয়েছিল।
কর্নেল একটু পরে বললেন, ডিস্কোর পরিচয় না জানা পর্যন্ত হেমেনকে আমি ক্লিন সার্টিফিকেট দিচ্ছি।
ফিল্মে দেখেছি এই ধরনের বিগ বিজনেসম্যান আড়ালে মাফিয়া ডন হয়। তাদের অনেক ডামি থাকে।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, এ বেলাও আমার বাড়ি তোমার লাখের নেমন্তন্ন। না ডার্লিং। রহস্যের পাঁকে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি সঙ্গে থাকলে ভরসা পাই। মাঝে মাঝে আমাকে তুমি জেরায় জেরবার করবে কিন্তু। কোনও খটকা লাগলে বলবে। তাতে আমার দৃষ্টি পরিষ্কার হবে।
কর্নেলের বাড়ি পৌঁছে গাড়ি পার্কিং জোনে রাখলাম। কর্নেল বললেন, ভেবো আমার অম্নে ভাগ বসাবে। ষষ্ঠীকে বলা আছে।
তেতলায় ডোরবেলের সুইচ টিপলে ষষ্ঠী দরজা খুলে দিল। বলল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েব ফোং করেছিলেন। আপনাকে ফোং করতে বলেছেন।
কর্নেল বললেন, করছি ফোং। তুই খাবার রেডি কর। আজ আমি স্নান করব না। জয়ন্ত, তুমিও কোরো না। বাইরে থেকে ঘেমে তেতে এসে সে-বেলা আর স্নান করা উচিত নয়। নাকি করবে?
বললাম, আমি স্নান করেই বেরিয়েছি আজ।
ফাইন। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। এনগেজড টোন নিশ্চয়। কিছুক্ষণ পরে আবার ডায়াল করলেন। এবার সাড়া পেয়ে বললেন, অরিজিৎ? ….কী? …হ্যাঁ। তারপর? ….বলো কী? …হ্যাঁ। লোক রাখার ব্যবস্থা করাই ঠিক। …অবশ্য। রাতেও থাকবে।….থ্যাংকস। ছাড়ছি।
ফোন রেখে কর্নেল বললেন, হ্যারি ওলসনের কাজের লোকটাকে ডিস্কোর এক চেলা এসে হুমকি দিয়েছে। সে প্রাণ নিয়ে কেটে পড়েছে। ওলসনকেও শাসিয়ে গেছে, পুলিশের কাছে বেফাঁস কিছু বললে খতম করে ফেলবে। এমনকি আমার নাম করে বলেছে, ওই বুড়ো ঘুঘুকেও কিছু বললে বডি ফেলে দেবে। ভয়ে ওলসনসায়েব কাঠ। ভাগ্যিস, আজ ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোকবাবু ওলসন হাউসে আবার গিয়েছিলেন। ওলসন তাঁকে জানিয়েছেন। তারপর এখন সারাক্ষণ পুলিশ থাকছে ওলসন হাউসে।
রাগ হলো। বললাম, ডিস্কোর ফোন নাম্বার তো আপনার জানা। পুলিশকে বলছেন না কেন? ওই নাম্বার কার, সেটা টেলিফোন দফতর থেকে জেনে নিক। পুলিশকে সব গোপন নাম্বার জানাতে ওঁরা বাধ্য।
সময় হলে বলব। ডিস্কোর সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দরকার এখনও শেষ হয়নি। যাক্ গে। বাথরুমে গিয়ে আগে একটু জলস্পর্শ করি।….
খেতে বসে বললাম, একটা পয়েন্ট আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
কর্নেল তাকালেন।
ওলসনসায়েব বলছিলেন, চন্দ্রিকা ডিস্কোকে হুমকি দিয়ে কথা বলত।
হুঁ। বলত। তাতে কী?
চন্দ্রিকা ব্ল্যাকমেল করত না তো ডিস্কোকে?
হয়তো করত। কিন্তু ব্ল্যাকমেল কিসের ভিত্তিতে করত, সেটা যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে ততক্ষণ ব্ল্যাকমেল কথাটা মাথায় রাখা উচিত নয়।
ধরুন, পুলিশকে তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দেব বলে হুমকি দিত।
কর্নেল মুর্গির ঠ্যাং কামড়ে ধরে বললেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ডিস্কো নাকি গভর্নমেন্টের ওপরমহলে প্রভাবশালী লোক।
তাহলে হেমেনবাবুর ডিস্কো হওয়ার চান্স আছে।
কেন?
তার মামা বটুক চৌধুরী ছিলেন এম এল এ। এদিকে হেমেনবাবুর বাবার সঙ্গে তাঁর শ্যালকের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এবং হেমেনবাবুর সঙ্গে তাঁর বাবার সম্পর্ক নাকি ভাল নয়–আপনিই বলছিলেন। সম্পর্ক খারাপের কারণ হেমেনবাবুর সঙ্গে বটুকবাবুর ঘনিষ্ঠতা। এই হলো আমার থিওরি। অর্থাৎ হেমেনবাবু মামার সাপোর্টার ছিলেন। এতে তাঁর বাবা ক্ষুব্ধ হতেই পারেন।
সম্পর্ক খারাপ বলতে এমন কিছু খারাপ নয়– কর্নেল ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে বললেন, তত খারাপ হলে ছেলের বাড়িতে উঠবেন কেন? আসলে অমরেন্দ্রর সঙ্গে হেমেন্দ্রর সম্ভবত পারিবারিক কোনও বিষয়ে মতান্তর আছে। এটা আমি আঁচ করেছিলাম, হেমেনবাবুর দিদি সুনন্দার কথায়। সুনন্দা বলেছিল, হেমেনের সন্দেহ, বাবা সব প্রপার্টি আমাকে এবং সত্যকামকে উইল করে দিয়েছেন। হেমেনের টাকার অভাব নেই। কিন্তু টাকার ওপর ভীষণ লোভ আছে। সুনন্দার ভার্সান এটা। এদিকে অমরেন্দ্রর বক্তব্য হলো, হেমেন সুনন্দাকে দেখতে পারে না। পারিবারিক দ্বন্দ্ব বলা চলে। এমনটা হয়েই থাকে। ও! তোমাকে বলতে ভুলেছি, সুনন্দা এবং হেমেন এক মায়ের সন্তান নন। সুনন্দার মা মারা যাওয়ার পর অমরেন্দ্র দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বটুক চৌধুরীর বোন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং হেমেনের মা।
কর্নেল বরাবর বলেন, খাওয়ার সময় কথা বলা উচিত নয়। কিন্তু আজ তাঁর নিয়মের ব্যতিক্রম দেখে বুঝতে পারছিলাম, সত্যিই তিনি রহস্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। রাঙাটুলির সিংহরায় পরিবারের পুরনো কাহিনী শোনাচ্ছিলেন। আমি শুনছিলাম না। ডিস্কোর মূর্তি হেমেন্দ্রের চেহারায় আরোপ করছিলাম। চমৎকার খাপ খাচ্ছিল। এমনকি, চন্দ্রিকার ডিস্কোকে ব্ল্যাকমেল করার থিওরিও মানিয়ে যাচ্ছিল। কারণ হেমেন্দ্রের আমদানি রফতানির কারবার আছে। এই সুযোগে নিষিদ্ধ ড্রাগের কারবার চালানো অসম্ভব নয়। চন্দ্রিকা কি ব্ল্যাকমেল করার ব্যাপারে ইন্দ্রজিতের সাহায্য নিয়েছিল?
ইন্দ্রজিতের তদ্বিরেই কিন্তু ওলসন হাউসে পুলিশ হানা দিয়েছিল। অরিজিৎ লাহিড়ি অবশ্য বলছিলেন, নার্কোটিকস পাওয়া যায়নি এবং ওটা পাবিলকখাওয়ানো উড়ো খবর। তার মানে, ডিস্কো এত প্রভাবশালী যে ডি সি ডি ডি রও কিছু করার ক্ষমতা নেই।
তাছাড়া হেমেন্দ্র সিংহরায়ের মতো বড় ব্যবসায়ীরাই তো রাজনৈতিক দলের ফান্ডে মোটা চাঁদা জোগান। অতএব হেমেন্দ্রর ডিস্কো হওয়ার চান্স উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আরও একটা পয়েন্ট। কর্নেলের কাছে জানা গেল, সুনন্দা বলেছিলেন, হেমন্দ্রের টাকার ওপর ভীষণ লোভ। অর্থাৎ ভদ্রলোক অর্থলোলুপ। কাজেই নগদ এক লক্ষ টাকার জন্য ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করার ঘটনা থেকে সন্দেহের কাঁটা হেমেন্দ্রের দিকেই ঘুরে যাচ্ছে। আবার ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করে বুঝিয়ে দেওয়াও হলো, সাবধান! আমার পিছনে লাগতে এসো না। …
খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে গিয়ে কর্নেল চুরুট টানছিলেন এবং আমি সোফায় লম্বা হয়েছিলাম। আমার থিওরি ওঁকে গেলানোর চেষ্টা করছিলাম। কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে শুনছিলেন এবং মাঝে মাঝে হুঁ দিচ্ছিলেন।
সেই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। ফোন ধরো।
ফোন তুলে সাড়া দিলাম। মহিলা কন্ঠে কেউ বলল, এটা কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফোন?
হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?
আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছেন?
নাহ্। আপনি কে?
কর্নেলসায়েব কি নেই?
আছেন। কিন্তু আপনি কে বলছেন?
প্লিজ! কর্নেলসায়েবকে দিন না! আমি তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে চাই।
মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে কর্নেলকে বললাম, কোনও মহিলা। নাম বলছেন না। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ক্রমাগত হ্যাঁ, হুঁ করে গেলেন। শেষে বললেন, থ্যাংক। রাখছি। তারপর ফোন রেখে দিলেন।
বললাম, ডিস্কোর কোনও মেয়ে চেলা নিশ্চয়?
কর্নেল হাসলেন। ভদ্রভাষায় বলা চলে, ডিস্কোচক্রের প্রাক্তন সদস্যা। এই একটা ব্যাপার আমি বরাবর দেখে আসছি, জয়ন্ত, আমি কোনও রহস্যসমাধানে নামলে জানা-অজানা অনেক লোক আড়াল থেকে আমাকে ক্ল যোগাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সুযোগটা আমার প্রতিপক্ষও নিতে ছাড়ে না এবং ভূল পথে ছোটাতে চায়। চেজিং আফটার আ রেড হেরিং টার্মটা আমার মুখে বহুবার শুনেছ। সোজা বাংলায় বলা চলে আলেয়ার পিছনে দৌড়ানো। কেউ কেউ আলেয়া তৈরি করে রহস্যের অন্ধকারে।
এই মহিলাও কি আলেয়ার দিকে ছোটাতে চাইছেন আপনাকে?
কর্নেল মাথা নাড়ালেন গম্ভীর মুখে। জানি না।
কী বলল, বলতে আপত্তি আছে?
বলল, সে একসময় ওলসন হাউসে থাকত। চন্দ্রিকাকে চিনত। চন্দ্রিকা নাকি ডিস্কোর খুব বিশ্বস্ত ছিল। নার্কোটিকসের কারবার আছে ডিস্কোর। চন্দ্রিকাকে ডিস্কো ওই কারবারেই নাকি ব্যবহার করত। কমাস আগে নার্কোটিকসের একটা পেটি চন্দ্রিকার ঘরে ডিস্কোর লোক এসে দিয়ে যায়। চন্দ্রিকার ঘর থেকে সেটা আশ্চর্যভাবে হারিয়ে যায়। আসলে চন্দ্রিকাই নাকি সেটা হাপিজ করেছিল। সেই নিয়ে ডিস্কোর সঙ্গে চন্দ্রিকার বিবাদ বাধে। কিন্তু ডিস্কো চন্দ্রিকাকে ঘাঁটাতে সাহস করেনি, পাছে চন্দ্রিকা সব ফাঁস করে দেয়। তাছাড়া ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে চন্দ্রিকার চেনাজানা ছিল। ইন্দ্রজিৎবাবুরও নাকি গভর্নমেন্টের ওপরমহলে যোগাযোগ আছে। পুলিশে তো আছেই, তাছাড়া কোন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও নাকি ওঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাই ডিস্কো সাবধানে চন্দ্রিকাকে ট্যাল্ করত। তারপর ডিস্কো মরিয়া হয়ে চন্দ্রিকাকে খতম করেছে বলে মেয়েটির ধারণা।
নাম কী মেয়েটির? নাম বলল না। চন্দ্রিকার সুত্রে ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। জিৎবাবু তাকে ওলসন হাউসের পাপপুরী থেকে–, পাপপুরী শব্দটাই বলল মেয়েটি–
উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম শুনতে শুনতে। দ্রুত বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবু ওকে পাপপুরী থেকে উদ্ধার করেছিলেন। এই তো?
হ্যাঁ। এখন সে সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেত্রী। ভদ্র জীবনযাপন করছে। ইন্দ্রজিৎবাবুর প্রতি সে কৃতজ্ঞ।
আপনার নাম ঠিকানা পেল কোথায় বলল না?
ওলসনসায়েব তার চেনা। তাই ওঁকে ফোন করে সব কথা বলেছে। উনি তাকে আমার ফোন নাম্বার এবং নাম ঠিকানা দিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তা হলে ব্যাপারটা আলেয়া নয় কর্নেল।
কেন নয়?
ওলসন বলছিলেন, তাঁর সন্দেহ, তাঁর ফোন ডিস্কো ট্যাপ করেছে। কাজেই আজ তাঁর কাজের লোক এবং তাঁকে ডিস্কোর চেলাদের হুমকি দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, এই মেয়েটির কথা ডিস্কো জেনে গেছে। আমার ভয় হচ্ছে, মেয়েটির কোনও বিপদ না হয়। ইন্দ্রজিৎবাবু এখন ডিস্কোর কবলে।
কর্নেল চোখ বুজে আস্তে বললেন, আমি সে-কথা ভাবছি না। ভাবছি, চন্দ্রিকার সঙ্গে আলাপের ব্যাপারটা কেন ইন্দ্রজিৎবাবু বানিয়ে বলেছে আমাকে? জয়ন্ত, আমি অসত্যভাষীদের পছন্দ করি না। বিশেষ করে আমার সাহায্য যারা চায়, তারা আমাকে কিছু গোপন করলে আমি আর তাদের পাত্তা দিই না। …
তৃতীয় স্তর
কিন্তু পরদিন কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি উষ্ক খুষ্ক পোড়খাওয়া চেহারায়, কতকটা ঝড়ে বিধ্বস্ত কাকতাড়ুয়ার মতো বসে আছেন এবং রহস্যভেদী বৃদ্ধ তাঁকে একটু আধটু নয়, বেশি রকমেরই পাত্তা দিচ্ছেন। হাসিখুশি মুখে তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন। সমবেদনাসূচক ভঙ্গি করছেন। আমি থমকে দাঁড়িয়েছি দেখে বললেন, জয়ন্ত। আমারই ভুল। ডিস্কো ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিডন্যাপ করতে পারে, এটা কেন আমার মাথায় এল না বুঝতে পারছি না। আসলে বয়স–আমার এই বয়সে বাহাত্তুরে ধরা বলে একটা কথা আছে। স্বীকার করছি, আমাকে বাহাত্ত্বরে ধরেছে।
বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবু! আপনাকে কীভাবে কিডন্যাপ করেছিল ডিস্কো?
ইন্দ্রজিৎবাবু ক্লান্তভাবে একটু হাসলেন। ওলসনের বাড়িতে ডিস্কোকে মিট করতে গিয়েছিলাম। শয়তানটা ফোনে আমাকে ডেকেছিল বোঝাঁপড়া করার জন্য। আমার জেদ চেপেছিল মাথায়। গাড়ি পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে রেখে পায়ে হেঁটে যাব ভাবছিলাম। গাড়ি থেকে নামছি, একটা লোক হাতে চাঁপাফুল নিয়ে এসে বলল, ফুল কিনবেন স্যার? এঁকে দেখুন, দারুণ সেন্ট। সে ফুল নাকের কাছে আনতেই মাথাটা কেমন করে উঠল। তারপর দেখি, আমি একটা ঘরে শুয়ে আছি। খাটের সঙ্গে আমার হাত-পা বাঁধা। মুখে টেপ বাঁধা। মুখোশ পরা দুজন লোক আমাকে পাহারা দিচ্ছে।
কর্নেল বললেন, যাক। আপনি আর বেশি কথাবার্তা বলবেন না। আপনার বিশ্রাম করা দরকার। এভাবে চলে আসাও ঠিক হয়নি।
ইন্দ্রজিৎবাবুর চোখের তলায় কালো ছোপ। ক্রোধের ছটা চোখের তারায় ঠিকরে পড়ল। এক লাখ টাকা কম কথা নয়, কর্নেলসায়েব। মৃদুলা তার গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে ধারদেনা করে অতগুলো টাকা যোগাড় করেছিল। কিন্তু ডিস্কোর জাল কতদূর ছড়ানো দেখুন। কোথায় রাঙাটুলিতে জঙ্গলের ভেতর পুরনো একটি মন্দির। তার মানে, ডিস্কোর লোক সেখানেও আছে।
সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, যাই হোক, আপনি আবার ফোন করে জেনে নিন, আপনার স্ত্রী রাঙাটুলি থেকে ফিরলেন কি না।
ইন্দ্রজিৎ উঠে গিয়ে ফোন তুলে ডায়াল করলেন। বোঝা গেল এনগেজড টোন। আবার ডায়াল করলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, বোঝা যাচ্ছে না। তখন থেকে খালি এনগেজড টোন। ডিস্কোর লোক গিয়ে ফোনের লাইন কেটে রেখেছে কি না কে জানে। আমি চলি, কর্নেল।
ইন্দ্রজিৎবাবু বেরিয়ে গেলে বললাম, আবার ওঁকে ডিস্কোর লোকেরা রাস্তায় কিডন্যাপ করতে পারে। পুলিশকে আপনি বলে দিলেও পারতেন।
কর্নেল হাসলেন। শেষরাতে ইন্দ্রজিৎবাবুকে ওরা তাঁর বাড়ির গেটে রেখে গিয়েছিল। বাড়িতে সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর ছেলেরা পাহারায় ছিল। কোনও অসুবিধে হয়নি। সাতটা নাগাদ উনি সঙ্গে দুজন ছেলেকে নিয়ে সোজা আমার বাড়িতে হাজির। গাড়িতে ওরা আছে। কাজেই ডিস্কো দ্বিতীয়বার কিডন্যাপ করতে চাইলেও পারবে না। ডিস্কো অত বোকা নয়।
বললাম, রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে টাকা পেয়েই তা হলে ডিস্কোর লোক ট্রাঙ্ককলে ডিস্কোকে জানিয়েছিল। তাই ইন্দ্রজিৎবাবুকে ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ। ডিস্কো কথা রেখেছে। গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত দেয়নি। অথচ নাকি ইন্দ্রজিৎবাবু তাঁর ঘোর শত্রু! ডিস্কোকে ভদ্রলোক বলা উচিত।
আপনি চন্দ্রিকার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎবাবুর আলাপের ব্যাপারটা তোলেননি?
নাহ্। তুমিও তো দেখলে কী অবস্থা! এই অবস্থায় ওসব কথা তোলা কি উচিত? কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে দুষ্টমির হাসি হাসলেন। এবার ডিস্কোর রিঅ্যাকশন দেখা যাক। এক লাখ টাকা হাতিয়ে শত্রুকে জব্দ করা নয় শুধু, হাতে মাতে বুঝিয়ে দিয়েছে, সাবধান! আমার সঙ্গে লড়তে এসো না।
কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, এনগেজড?
নাহ্। রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।
আজকাল টেলিফোনের ওই এক রোগ। আবার ডায়াল করুন বরং।
কর্নেল আবার ডায়াল করলেন। তারপর বললেন, রিং হচ্ছে। সাড়া নেই। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর টেলিফোন রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। ষষ্ঠী আমার জন্য কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, আমার কথাটা আপনি শুনছেন না। আমি বলছি, লাহিড়িসায়েবের সাহায্যে টেলিফোন দফতর থেকে এই গোপন নাম্বারের নাম ঠিকানা যোগাড় করার অসুবিধে কী? নামঠিকানা পেয়ে গেলেই তো ডিস্কোকে পাকড়াও করা যাবে।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে শুললেন, তুমি ঠিক বলেছ।
নাম্বার থেকেই তো এলাকা বোঝা যাবে। কোন এলাকার নাম্বার?
টু ফোর।
উৎসাহে নড়ে বসলাম। ধৰ্ম্মতলা স্ট্রিট, তালতলা এলাকা। আমাকে নাম্বারটা দিন না।
কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, ডিস্কোর টেলিফোন নাম্বার ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত আমার মাথাব্যথা নেই। আমি চিন্তিত হালদারমশাই সম্পর্কে। উনি রাঙাটুলি থেকে ফেরেননি। ট্রাঙ্ককলও করছেন না সেখান থেকে। কোনও বিপদে পড়েননি তো?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদারের কথা ঘটনার পর ঘটনার ধাক্কায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কর্নেলের কথায় টনক নড়ল। এযাবৎ গোয়েন্দা ভদ্রলোকের ক্রিয়াকলাপের প্রবণতা যা লক্ষ্য করে আসছি, তাতে ওঁর এমন চুপচাপ উধাও হয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক। চন্দ্রিকা ছিল ওঁর ক্লায়েন্ট। তার নির্দেশ মতো রাঙাটুলিতে হরনাথবাবুকে বিপদের খবর দিতে ছুটে যাওয়া হালদারমশাইয়ের পেশাগত নীতি অনুযায়ী স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর ওঁর পক্ষে আরও স্বাভাবিক ছিল ক্লায়েন্টের হত্যারহস্য উদঘাটনে আদাজল খেয়ে নেমে পড়া। অর্থাৎ খবর দিয়েই কলকাতা ফেরা এবং গোয়েন্দাগিরিতে নেমে পড়া–যা কি না অনেকসময় রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সামিল। তবে এ-ও ঠিক, অভিজ্ঞতায় জানি যে উনি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে প্রায়ই ফেঁসে যান। এমন সাংঘাতিক বিপদে পড়েন যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়। অবশ্য শেষ মুহূর্তে কর্নেলস্যার গিয়ে ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা-ই তো! হালদারমশাইয়ের পাত্তা নেই কেন? কর্নেল। রাঙাটুলিতে আপনার জানাশোনা লোক আছে। আপনিই ট্রাঙ্ককলে খবর নিন।
কর্নেল তুষোমুখে বললেন, কার কাছে নেব?
রাঙাটুলি থানায় যোগাযোগ করুন। কিংবা কলকাতায় পুলিশের মিসিং স্কোয়াডে জানান।
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ভাঁজকরা দোমড়ানো কাগজ বের করলেন। ভাঁজ খুললে দেখলাম অমরেন্দ্রবাবুর দেওয়া সেই চিচিং ফাঁক।
কাগজটা টেবিলের ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখে উনি পাশের ঘরে গেলেন। আবছা কানে এল আলমারি খোলার শব্দ। ফিরে এলেন আরেকটা কাগজের চিরকুট নিয়ে। দেখলাম, এটা চন্দ্রিকার পার্সে আমার খুঁজে পাওয়া সেই কোড নম্বর লেখা কাগজটা।
দুটো চিরকুট পাশাপাশি রেখে আতশ কাচ দিয়ে কী পরীক্ষায় বসলেন কর্নেল। একটু পরে স্বগতোক্তি করলেন, হুঁ!
জিজ্ঞেস করলাম, কিছু উদ্ধার করলেন নাকি?
কর্নেল দুটো কাগজই ভাঁজ করে টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বললেন, এই নিয়ে প্রায় পনের বার পরীক্ষা করলাম জয়ন্ত। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে দুটোর মধ্যে প্রশ্নোত্তরের সম্পর্ক আছে। রায়সায়েবেরটা যদি প্রশ্ন হয়, চন্দ্রিকারটা তার উত্তর।
আপনাকে কেউ চাই চিচিং ফাঁক বলে টেলিফোন করছে বলেছিলেন।
গতরাতেও বার দুই করেছিল। অগত্যা বলেছি, চিচিং ফাঁক দেব। তবে একটা শর্তে। ডিস্কো কে আমাকে জানাতে হবে।
কী বলল?
কর্নেল হাসলেন। বলল, আমিই ডিস্কো। তখন বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার আসল নাম এবং ঠিকানা জানান। আমি আপনাকে চিচিং ফাঁক পৌঁছে দেব।
তারপর? তারপর?
রাজী হলো না। বলল, রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে রাত্রিবেলা রেখে আসতে হবে। তার বদলে আমার রাহাখরচ বাবদ পাঁচশো টাকা যে কোনও ভাবে আমাকে পৌঁছে দেবে।
অবাক হয়ে বললাম, আবার সেই রাঙাটুলির ভবানীমন্দির?
হ্যাঁ। জায়গাটা গোপন লেনদেনের উপযোগী।
আপনি রাজী হলেন না কেন? ভবানীমন্দিরে পুলিশের ফাঁদ পেতে ডিস্কোকে পাকড়াও করা যেত।
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, কিন্তু যে ফোনে কথা বলছে, সে-ই যে ডিস্কো তার প্রমাণ কী? আমি রিং করে যখন ডিস্কো বা তার কোনও ডামির সঙ্গে কথা বলেছি, তখন কিন্তু চিচিং ফাঁক প্রসঙ্গ সে তোলেনি। কাজেই একজন তৃতীয় ব্যক্তির কথা এসে যাচ্ছে। অরিজিৎও এই তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলছিল, মনে পড়ছে না তোমার?
একটু ভেবে বললাম, তা-ও তো বটে। ডিস্কো চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল স্বপন দাশের হাতে। স্বপনকে খুন করে চাবিটা হাতিয়ে চন্দ্রিকাকে খুন করেছে কেউ এবং সেই খুনের উদ্দেশ্য চন্দ্রিকার পার্সে লুকিয়ে রাখা ওই অদ্ভুত চিরকুট হাতানো। কাজেই তৃতীয় একজনের কথা এসে পড়ছে। সে-ই দেখা যাচ্ছে নাটের গুরু।
কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দিলেন, তোমার বুদ্ধি খুলেছে ডার্লিং।
উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে বললাম, এর সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বনাম ডিস্কোর বিরোধ সম্পর্কহীন। তার মানে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ডিস্কোর লড়াই নেহাত প্রেসটিজের লড়াই।
এই সময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী এসে বলল, একটা মেয়েছেলে এয়েছেন বাবামশাই। বললেন, খুব দরকার। আমি বললাম, একটু রোয়েট করুন–
রোয়েট না করিয়ে নিয়ে আয়।
ষষ্ঠী কর্নেলের ভেংচিকাটা বুঝতে পারে। বেজায় গম্ভীর হয়ে চলে গেল। তারপর এক যুবতী ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বলল, আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কর্নেল বললেন, বসুন।
একটু দ্বিধার সঙ্গে সে বলল, কথাগুলো কনফিডেনশিয়্যাল।
স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী। আপনি?
আমার নাম দীপ্তি রাহা। লিন্টন স্ট্রিটে থাকি।
যা বলতে চান, জয়ন্তের সামনে বলতে পারেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনার কোনও গোপন কথাই আমি আমার এই তরুণ বন্ধুর কাছে গোপন রাখতে পারব না।
দীপ্তি রাহাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সাদামাটা গড় বাঙালি মেয়ের মতো চেহারা। আস্তে বলল, আমার বাবা গোপেন্দ্রনাথ রাহার নাম শুনেছেন কি না জানি না। এক সময় ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর ছিলেন। ধর্মতলায় ওঁর অফিসটা এখনও আছে। ডিস্ট্রিবিউশন কারবার বন্ধ হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে কোনও দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যাঅব্দি অফিসে গিয়ে বসে থাকেন। ওঁর চেনাজানা লোকেরা আড্ডা দিতে আসেন। কিন্তু কিছুদিন থেকে বাবা লক্ষ্য করছেন, ওঁর অফিসের মেঝেয় দামি বিদেশি সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে থাকে। অ্যাশট্রে পোড়া সিগারেটের টুকরোয় ভর্তি। দুদিন আগে মেঝেয় মদের খালি বোতল পড়ে আছে দেখে বাবা ভীষণ রেগে যান। বাড়ির কেয়ারটেকার চাঁদুবাবুকে খুব বকাবকি করেন। চাঁদুবাবু বলেছিলেন, কিছুই জানেন না। রাতবিরেতে এরিয়ার মস্তানরা হয়তো ও-ঘরে এসে আড্ডা দেয়। ডুপ্লিকেট চাবি যোগাড় করা তো সহজ। অত বড় তিনতলা বাড়ি। ডাক্তারের চেম্বার এবং অনেকগুলো ছোটখাটো কোম্পানির অফিস আছে। কখন কে কী কাজে বাড়িতে যাতায়াত করছে, চাঁদুবাবুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
কর্নেল অভ্যাসমতো চোখ বুজে হেলান দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, আপনার বাবার ওই অফিসে টেলিফোন আছে?
দীপ্তি বলল, আছে। বাবা ওখান থেকে টেলিফোন খুব কদাচিৎ ব্যবহার করেন। অথচ এ মাসের বিলে চারশোর বেশি কল উঠেছে। মস্তানরা নিশ্চয় টেলিফোনও ব্যবহার করে। কিন্তু এসব তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য বাবা আমাকে আপনার কাছে। পাঠাননি। কাল বিকেলে র্যাকে পুরনো ফাঁইলগুলো থেকে ময়লা ঝুলকালি সাফ করছিলেন। হঠাৎ দেখেন ফাঁইলের তলায় একটা ড্যাগার লুকোনো আছে। রক্তমাখা ড্যাগার।
টাটকা রক্ত নয় নিশ্চয়?
না।
গোপেনবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন কিছু?
দীপ্তি বিমর্ষমুখে মাথা নাড়ল। বলল, পুলিশে জানানো মানেই ঝামেলা। বাবা তাঁর বন্ধুদের নিষেধ করেছেন। ড্যাগারটা যেমন ছিল, তেমনই রেখে দিয়েছেন। বাবার এক বন্ধু প্রণব চ্যাটার্জি আপনার নাম ঠিকানা জানেন। তাঁর পরামর্শেই বাবা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
প্রণব চ্যাটার্জি? হ্যাঁ–একসময়কার বিখ্যাত ইমপ্রেসারিও। আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বটে। তো আপনার বাবা এলেন না কেন?
বাবা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। ওঁর ধারণা, উনি নিজে আপনার কাছে এলে ওঁকে ফলো করবে মস্তানরা। আসলে বাবা প্রচণ্ড ভীতু মানুষ। তাছাড়া আজকাল মস্তানদেরই রাজত্ব। ওরা যা খুশি করতে পারে। দীপ্তি পাংশুমুখে হাসবার চেষ্টা করে ফের বলল, আমি বাবার পরামর্শে অনেকটা ঘুরে আপনার এখানে এসেছি। প্রথমে গেলাম শ্যামবাজারে পিসিমার বাড়ি। সেখান থেকে এসপ্ল্যানেড। তারপর ট্রামে চেপে এখানে।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলাম। এবার বললাম, কর্নেল! সম্ভকত ওটাই চন্দ্রিকাকে মার্ডারের উইপন। এবার ডিস্কোর ফোন নাম্বারের সঙ্গে গোপেনবাবুর অফিসের ফোন নাম্বার মিলিয়ে নিন।
দীপ্তি তখনই তার বাবার অফিসের ফোন নাম্বার বলল।
কর্নেল বললেন, আমি আপনার বাবার অফিসে যেতে চাই। অফিসের চাবি দরকার হবে।
দীপ্তি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে রিঙে ঝোলানো একটা চাবি বের করল। চাবিটা কর্নেলকে দিয়ে সে বলল, বাবা চাবিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। কিন্তু– সে কুণ্ঠার সঙ্গে আস্তে বলল ফের, আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে নিষেধ করেছেন। চাবিটা আপনার কাছে থাক। পরে আমি এসে নিয়ে যাবখন।
অফিসের ঠিকানা চাই যে। কর্নেল টেবিল থেকে ছোট্ট একটা প্যাড আর ডটপেন দিলেন। দীপ্তি ঠিকানা লিখতে ব্যস্ত হলো। কর্নেল বললেন, আপনাদের বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নাম্বারও লিখুন। দরকার হলে আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলব।
দীপ্তি প্যাড এবং কলম কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বলল, আমাদের বাড়ির ফোনটা অনেকদিন থেকে ডেড। একটা কথা কর্নেলসায়েব। বাবা তো ভীষণ ভীতু মানুষ, তাই বলছি, বাবার সঙ্গে যদি দেখা করার দরকার হয়, বরং প্রণবকাকুর বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা যায়। প্রণবকাকুর ঠিকানা আমি জানি না। আপনি হয় তো জানেন?
নাহ্। কর্নেল প্যাড থেকে ঠিকানা লেখা পাতাটা ছিঁড়ে নিলেন। আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের বছর আগে আলাপ হয়েছিল। উনি যে আমার কথা মনে রেখেছেন, এতেই আমি খুশি। আপনি ঠিকানা যোগাড় করে আমাকে জানিয়ে দেবেন।
দীপ্তি রাহা চলে যাওয়ার পর বললাম, ডিস্কোর ফোন নাম্বারের সঙ্গে মিলল তো?
মিলবে বৈকি। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন। তবে মনে হচ্ছে, ডিস্কো আর ওই ফোন ব্যবহার করছে না কিংবা করবে না।
কেন?
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই চিরকুট দুটো বের করলেন। তারপর পাশের ঘরে চলে গেলেন। আলমারি খোলা ও বন্ধ করার আবছা শব্দ হলো। কর্নেল ফিরে এসে বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ। গোপেনবাবুর পোড়ো অফিসে ফাঁইলের তলায় যে ড্যাগারটা আছে, ওটা দিয়েই চন্দ্রিকাকে খুন করা হয়েছিল।
ব্যস্তভাবে বললাম, এখনই ওটা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। বলা যায়, ইতিমধ্যে ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে কি না!
হয়নি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
কর্নেল ফোনের কাছে গেলেন। ডায়াল করে কার সঙ্গে চাপা স্বরে কী সব কথাবার্তা বলার পর ফোন রেখে চুরুট ধরালেন। বললাম, রহস্য কিন্তু আরও জট পাকিয়ে গেল। কারণ ডিস্কো যার হাতে চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের চাবি পাঠিয়েছিল, সেই স্বপন দাশকে গুলি মেরে চাবিটা হাতিয়ে অন্য কেউ চন্দ্রিকার ঘরে ঢুকেছে এবং তাকে খুন করেছে। কিন্তু মার্ডারউইপন ডিস্কো পেল কী করে? চন্দ্রিকা খুন হওয়ার পর নিশ্চয় সে-ও ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। নাহ! কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কী বোঝা যাচ্ছে না?
ডিস্কো বা তার ডামি বলুন, কী চেলা বলুন–গোপেনবাবুর অফিসের ফোন ব্যবহার করেছে। কাজেই গোপেনবাবুর অফিস ডিস্কোর একটা ডেরা। সেখানে মার্ডারউইপন লুকিয়ে রাখল কে? কেনই বা রাখল? যদি ডিস্কো ওটা চন্দ্রিকার ঘরে পেয়ে থাকে, সে তার ওই ডেরায় রাখতে গেল কেন?
একটু অপেক্ষা করো। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোক গুপ্ত আসছেন সদলবলে। তাঁদের নিয়েই আমরা মার্ডারউইপন উদ্ধার করতে যাব। আশা করি, তারপর ডিস্কোর এই খেলার উদ্দেশ্য বোঝা যাবে…
.
ধর্মতলা স্ট্রিটে একটা গলির পাশে বিশাল পুরনো বাড়িটা হঠাৎ চোখে পড়লে দিনদুপুরে কেমন গা ছমছম করে। গলি দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। সিঁড়ির পাশে অগুনতি লেটার বক্স। অনেক কোম্পানি এবং লোকের নাম লেখা প্ল্যাস্টিক বা কাঠের ফলকও আছে। কোনও আলোর বালাই নেই। পুলিশের গাড়ি খানিকটা দূরে একটা চার্চের কাছে উল্টোদিকে পার্ক করা হয়েছিল। লক্ষ্য করলাম, সাদা পোশাকের পুলিশ একজন-দুজন করে বেরিয়ে আনাচে-কানাচে এসে দাঁড়াচ্ছে।
অশোকবাবু, কর্নেল এবং আমি তিনতলায় পৌঁছে করিডরে কাউকে দেখতে পেলাম না। করিডরে ঘুরে গিয়ে বাড়ির কোণার দিকে শেষ হয়েছে। একটা ঘরের দরজায় বেরঙা এক টুকরো ফলকে লেখা আছে পরমা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার্স লিঃ। কর্নেল তালা খুললেন। ঘরের ভেতর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে এল। কর্নেল ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। দক্ষিণের একটা জানালা খুলে দিলেন।
ঘরটা বেশ বড়। কয়েকটা টেবিল এবং অনেকগুলো চেয়ারে সাজানো অফিস। টেবিলগুলো খালি। একপাশে একটা বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং চারদিকে গদিআটা চেয়ার সাজানো আছে দেখে বোঝা গেল, এটাই গোপেনবাবুর আড্ডাস্থল। টেবিলে ফোনও আছে। কর্নেল প্রথমে ফোন তুলে পরীক্ষা করে বললেন, ফোনটা চালু আছে।
অশোকবাবু র্যাকের কাছে গিয়ে বললেন, ফাইলের পাহাড় দেখছি! সব নামাতে হলে আমার লোকজনকে ডাকতে হবে।
কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন, নাহ্। চোখে পড়ার মতো জায়গায় ভ্যাগারটা রাখা হয়েছে।
কৈ? কোথায়?
কর্নেল একটা থাকের মাঝখান থেকে কাগজের একটা মোড়ক টেনে বের করে বলেন, এই নিন। খুলে দেখুন।
অশোকবাবু মোড়কটা টেবিলে রাখলেন। তারপর সাবধানে খুললেন। রক্তের কালচে ছোপমাখা একটা ছোরা দেখা গেল। আমি আঁতকে উঠেছিলাম ছোরাটা দেখে। বললাম, ছোরার বাঁটে খুনীর আঙুলের ছাপ থাকতে পারে।
কর্নেল হাসলেন। পুলিশের গোয়েন্দারা সেটা জানেন। তবে তুমি একটু ভুল করছ জয়ন্ত। খুনীর আঙুলের ছাপ সম্ভবত এতে পাওয়া যাবে না। ডিস্কো বা তার আমি কিংবা তার চেলাদের আঙুলের ছাপও পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কারণ ছোরার বাঁটে গোপেনবাবু হাত দিয়ে থাকতে পারেন।
অশোকবাবু বললেন, যাই হোক। ফরেনসিক ল্যাবে এটা পাঠাতেই হবে।
অবশ্যই পাঠাবেন। বলে কর্নেল আঙুল দিয়ে মোড়কের ভেতর একটা জায়গা দেখালেন। তবে অশোকবাবু, মার্ডার উইপনটা আমাকেই উপহার দিয়েছে ডিস্কো। দেখুন, লেখা আছে : কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে উপহার। ইতি–ডিস্কো।
অশোকবাবু পড়ে দেখে বললেন, আশ্চর্য স্পর্ধা এই লোকটার।
কর্নেল বললেন, স্পর্ধা কি না বলতে পারছি না। তবে সে নিজের অস্তিত্ব বোষণা করেছে।
অশোকবাবু অবাক হয়ে বললেন, ডিস্কো বলে তো কেউ আছেই। পুলিশমহলেও সবাই জানে। নতুন করে তাকে অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হবে কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিন্তু আমার কাছে তাকে বারবার নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হচ্ছে। সম্ভবত সে আঁচ করেছে, তার প্রকৃত পরিচয় জানার কোনও নয় আমার হাতে এসে গেছে।
কী সূত্র?
এটাই সমস্যা অশোকবাবু। মানুষ অনেক সময় জানে না যে সে কী জানে। আমি নিজেই এখনও জানি না যে আমি এমন কী জানি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ডিস্কোর প্রকৃত পরিচয়।
অশোকবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার হেঁয়ালি বোঝার সাধ্য আমার মেই।
কর্নেল মেঝেয় দৃষ্টি রেখে ঘরের ভেতর চক্কর দিতে শুরু করলেন। এই সময় হঠাৎ আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে টেলিফোনটা বেজে উঠল। অশোকবাবু ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেল। আপনাকে চাইছে কেউ।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। সে লক্ষ্য রেখেছে আমি এখানে এসেছি। এগিয়ে এসে উনি টেলিফোন নিলেন অশোকবাবুর হাত থেকে। বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ ডিস্কো নাকি? ধন্যবাদ। আপনার উপহার পেয়ে খুশি হয়েছি।…না, না। গোপেনবাবুকে ঝামেলায় ফেলব না। কেন এ কথা ভাবছেন?… নাহ্। আপনার সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও চাইব। আশা করি পাব। …. ধন্যবাদ, ছাড়ছি।
অশোকবাবু আরও গম্ভীর মুখে বললেন, ডিস্কোর অনেক ডামি আছে শুনেছি। আপনি যদি ভাবেন ডিস্কো নিজে কথা বলল আপনার সঙ্গে, তা হলে ভুল করবেন।
হ্যারি ওলসন ডিস্কোর যে কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, তাঁর সঙ্গে মিলে গেল এবার। এর আগে তার ডামির গলা শুনেছি। ওলসন বলেছিলেন, খুব মিঠে অমায়িক স্বরে কথা বলে ডিস্কো। বলে কর্নেল আবার ঘরের মেঝে পরীক্ষায় ব্যস্ত হলেন।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর কাগজেমোড়া ছোরাটা একটা কিটব্যাগে ঢোকালেন। বললেন, আপনি কি কিছু খুঁজছে কর্নেল?
কর্নেল সহাস্যে বললেন, জানি না কী খুঁজছি। তবে বলা যায় না, ওই যে পদ্যে আছে : যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন। স্বভাব অশোকবাবু! আমার এই বিদঘুঁটে স্বভাব কিছুতেই ছাড়তে পারি না।
ঠিক আছে। আপনি ছাই উড়িয়ে দেখুন অমূল্য রতন পান কি না। আমি এটা এখনই গিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।
অশোকবাবু বেরিয়ে গেলেন। দরজার ওধারে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা অশোকবাবুর সঙ্গে চলে গেল।
আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। কর্নেল এবার হাঁটু গেড়ে আতশ কাচ দিয়ে মেঝেয় কী দেখছিলেন। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা হয়েছে। তবু লাল সুরকি জিনিসটা এমন যে, মেঝেয় এঁটে যায়।
লাল সুরকি খুঁজছিলেন নাকি?
হ্যাঁ। ওলসন হাউসের গলিতে উল্টোদিকে একটা বাড়ি হচ্ছে। গলিতে বৃষ্টিধোয়া লাল সুরকি পড়ে আছে। কাজেই চন্দ্রিকাকে খুনের রাতে যে ওই ছোরা এখানে এনে রেখেছিল, তার জুতোয় সুরকির ছাপ আছে। কাজেই ডিস্কো সত্যিই সহযোগিতা করছে।
কর্নেল দরজার দিকে ঘুরেছেন এবং আমি চেয়ার থেকে উঠেছি, একজন কালো রোগাগড়নের লোকের আবির্ভাব হলো। বড়বাবু নাকি? বলে উনি উঁকি দিলেন ঘরের ভেতর। তারপর কর্নেলকে বললেন, বড়বাবু কোথায় গেলেন স্যার?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, একটু বেরিয়েছেন। কিছু বলতে হবে?
আজ্ঞে না স্যার। শুনলাম, বড়বাবুর ঘরে কারা কথাবার্তা বলছে। তাই—
আপনিই কি এ বাড়ির কেয়ারটেকার চাঁদুবাবু?
হ্যাঁ স্যার! চাঁদুবাবু বিনীতভাবে বললেন। বড়বাবু তো আজকাল বিশেষ আসেন না। এলেও বিকেলের দিকে। সেইজন্যে খোঁজ নিতে এলাম, যদি কিছু দরকার-টরকার হয়।
গোপেনবাবুকে আপনি বুঝি বড়বাবু বলেন?
আজ্ঞে। এই কোম্পানির দুই পার্টনার। গেপেনবাবু আর রথীনবাবু। রথীনবাবুকে বলতাম ছোটবাবু। কবছর আগে রথীনবাবু মারা যাওয়ার পর থেকে কারবার বন্ধ হয়ে গেল। ছোটবাবু ভেতর ভেতর কোম্পানিকে ফাঁসিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন। বড়বাবু সরল লোক। রথীনবাবুকে বিশ্বাস করেই সর্বস্বান্ত হওয়ার দাখিল।
রথীন চৌধুরী? বেহালায় থাকতেন শুনেছি?
আজ্ঞে! আপনি চিনতেন? চাঁদুবাবু প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিলেন, চিনবেন বৈকি স্যার। বড়বাবুর চেনা যখন, তখন নিশ্চয় সব শুনেছেনও বটে।
আমি চমকে উঠেই সামলে নিয়েছিলাম। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসা একেই বলে। তবে বরাবর দেখে আসছি, যে-কোনও রহস্যেরই জাল বহু বহু দূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। গোপেনবাবু গেলেন তো গেলেন।
চাঁদুবাবু বললেন, এসে পড়বেন। একটু অপেক্ষা করুন। চা-ফা খেতে চাইলে বলুন, এনে দিচ্ছি।
কর্নেল একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, নাহ্। চা খাব না। আপনার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাই। আপনি তো বহু বছর এ বাড়িতে আছেন।
তা কুড়ি একুশ বছর হবে স্যার।
বাড়ির মালিক কে?
পুরনো মালিক ছিলেন মোহনপুরের মহারাজা। তাঁর কাছ থেকে কিনেছিলেন আগরওয়ালবাবু। মারোয়াড়ি বিজনেসম্যান স্যার। তাঁরই ছেলে এখন মালিক। শুনেছি, বাড়িটা ভেঙে মাল্টিস্টেরিড বিলডিং হবে। কিন্তু হবে কী করে কে জানে! এতগুলো কোম্পানি ভাড়াটে হয়ে আছে। তাদের ওঠাবেন কী করে। ঝামেলা আছে। অনেক ঝামেলা!
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, বড়বাবু বলছিলেন, রাতবিরেতে নাকি এই ঘরে পাড়ার মস্তানরা এসে আড্ডা দেয়।
চাঁদুবাবুর চোখ গুলিগুলি হয়ে উঠল। ফিসফিস করে বললেন,আমি ঠেকাব কী করে। জেনেশুনেও চুপ করে থাকি স্যার। ওরা যখন আসে, বুঝতে পারি। কিন্তু যদি বলি, কে? অমনই বলবে, তোর বাপ। শাসাবে। কী করব বলুন স্যার?
আপনি ওদের দেখলে চিনতে পারবেন?
চাঁদুবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ওরে বাবা! আমার বডি ফেলে দেবে।
না। এমনি কথার কথা বলছি। চেহারা নিশ্চয় মনে আছে? চাঁ
দুবাবু করজোড়ে বললেন, না স্যার! ওসব কথা আলোচনা করবেন না। বড়বাবুও আমাকে নিষেধ করেছেন।
আপনি ডিস্কোর নাম শুনেছেন?
ডিস্কো?
হ্যাঁ, ডিস্কো।
চাঁদুবাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, একটু-একটু মনে পড়ছে। একদিন রাত নটা নাগাদ ছোটবাবুর সঙ্গে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। ছোটবাবু তাঁকে ডিস্কো বলছিলেন। তখন বড়বাবু ছিলেন না। ছোটবাবু আমাকে মদ এনে দিতে হুকুম করলেন। অত রাত্রে কি উৎপাত দেখুন স্যার! তা–
সেই ভদ্রলোকের চেহারা মনে আছে?
ফর্সা সুন্দর মতো– চাঁদুবাবু আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই স্যারের বয়সী হবেন। একেবারে সায়েবি চালচলন। তা ছ-সাত বছর আগের কথা। স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে আপনি ডিস্কো বললেন–ওই কথাটা আজকাল খুব চালু কি না! তাই মনে পড়ে গেল।
বলে চাঁদুবাবু পা বাড়ালেন। যাই স্যার! রান্নার যোগাড় করতে হবে। একা মানুষ। বড়বাবুকে বলবেন যেন স্যার, আমি এসেছিলাম।
চাঁদুবাবু চলে যাওয়ার পর বললাম, ব্যস! অনেক সূত্র পেয়ে গেলেন।
কর্নেল একটু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। চলো! কেটে পড়া যাক। তবে খুব আস্তে হাঁটবে। চাঁদবাবুর মুখোমুখি পড়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
যদি নিচে দেখা হয়ে যায়?
হওয়ার চান্স নেই। তবে নেহাত দেখা হয়ে গেলে চুপচাপ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাব।
.
পাড়ি স্টার্ট দিতেই কর্নেল বললেন, সোজা মৌলালি সি আই টি রোড হয়ে গিন্টন স্ট্রিট। গোপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার।
বারোটা পনের বাজে। এখনই না গেলে নয়!
ডার্লিং। আজও আমার বাড়ি তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।
তারপর বলবেন, আজও অফিস কামাই করো।
কর্নেল হাসলেন। অফিস কামাই করছ কোথায়? তুমি অফিসে জানিয়ে দাওনি একটা এক্সক্লসিভ ক্রাইম স্টোরির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ? না জানিয়ে থাকলে
দ্রুত বললাম, জানিয়েছি। কিন্তু এখনও তো স্টোরির লেজটুকু ধরে আছি!
লেজ ধরলেই মাথা দেখতে পাবে।
মৌলালির ট্রাফিক জট ছাড়িয়ে যেতেই আধঘণ্টা লেগে গেল। লিন্টন স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে কর্নেল বললেন, চাঁদুবাবু সম্পর্কে মুখ বুজে থাকবে কিন্তু।
বললাম, আমি সবসময় মুখ বুজে থাকব।
সংকীর্ণ রাস্তাটাকে গলি বলাই চলে। এঁকেবেঁকে কিছুদূর এগিয়ে কর্নেল বললেন, পেয়ে গেছি।
একপাশে গাড়ি রেখে আমরা বেরোলাম। একটা বাড়ির দরজায় বেল টিপলেন কর্নেল। একটি কমবয়সী মেয়ে দরজা খুলে কর্নেলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, কাকে চাই?
গোপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
দাদু তো নেই। ঠাকুমা দাদু পুরী বেড়াতে গেছেন।
তোমার দীপ্তিপিসিকে ডাকো!
মেয়েটি ঘুরে প্রায় চিৎকার করে ডাকল, ছোটপিসি! ছোটপিসি! তোমাকে ডাকছে।
বছর কুড়িবাইশ বয়সী এক তরুণী এসে বলল, আপনারা কোত্থেকে আসছে?
কর্নেল বললেন, দীপ্তি রাহার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
তরুণী অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার নাম দীপ্তি। আপনারা—
জাস্ট আ মিনিট! আপনার বাবা-মা পুরী গেছেন কবে?
এক সপ্তাহ আগে। সামনের মাসে ফিরবেন। কিন্তু আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি তোমার বাবার একজন বন্ধু। তুমি নিশ্চয় প্রণব চ্যাটার্জিকে চেনো? তোমার বাবার কাছে আসতেন। ওঁর ধর্মতলার অফিসেও যেতেন।
প্রণবকাকু-ফাংশন-টাংশন করতেন, তাঁর কথা বলছেন?
হ্যাঁ। বিখ্যাত ইমপ্রেসারিও প্রণব চ্যাটার্জি।
প্রণবকাকু এখন বোম্বেতে থাকেন শুনেছি।
তুমিই তা হলে আদি-অকৃত্রিম দীপ্তি রাহা?
তার মানে?
কিছু না। আমার এই কার্ডটা রাখো। দরকার বুঝলে রিং কোরো।
কর্নেল তার হাতে কার্ডটা দিয়ে হন্তদন্ত গাড়িতে উঠে পড়লেন। আমিও দেরি করলাম না। স্টার্ট দিয়ে বললাম, সোজা বেরিয়ে যাই? বেনেপুকুর রোড হয়ে ট্রামডিপোর পাশ দিয়ে এলিয়ট রোড।
কর্নেল সায় দিলেন। একটু পরে বললেন, ডিস্কো বারবার আমাকে বোঝাতে চাইছে, হি ইজ জাস্ট নট আ নেম, হি রিয়্যালি এজিস্টস। হ–সে আছে।
আশ্চর্য! কিন্তু দীপ্তি সেজে যে-মেয়েটা চাবি দিয়ে এল, সে কে?
ডিস্কোর দলে মেয়েও আছে বোঝা গেল।
কিন্তু তারা তো কলগার্ল! ওই মেয়েটিকে কলগার্ল বলে মনে হয়নি।
কিছু বলা যায় না।
কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন। বাকি পথ একেবারে চুপ। সানিভিলার লনে গাড়ি ঢুকলে চোখ খুলে আপন মনে শুধু বললেন, ডিস্কো অসাধারণ ভাল খেলছে!
ষষ্ঠী দরজা খুলে মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলল, হালদারমশাই এয়েছেন!
কর্নেল বললেন, বাঃ! খাসা খবর!
ড্রয়িং রুমের সোফায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্রায় লম্বা হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। কর্নেল হালদারমশাই বলে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে সোজা হলেন। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বললেন, রাত্রে ঘুম হয় নাই। তারপর লং ট্রেনজার্নি! স্টেশন থিক্যা সোজা আপনার হাউসে-ওঃ! হেভি রহস্য কর্নেলস্যার! আপনাগো আশীর্বাদে প্রাণ লইয়া ফিরছি, এই যথেষ্ট।
কর্নেল বললেন, খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম আপনার জন্য। আজ সকালেই জয়ন্তর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, আপনার কোনও বিপদ হলো নাকি। ট্রাঙ্ককলও করছেন না আপনি।
হালদারমশাইয়ের মুঠোয় নস্যির কৌটো ছিল। এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, বিপদ কইলেন! হেভি বিপদ। হরনাথবাবুর ফার্ম আছে জঙ্গলের কাছে। এগ্রিকালচারাল ফার্ম। তারপর রাত্রিকালে আমারে কিডন্যাপ করল–কী য্যান কয়? হঃ! ডিস্কো।
ডিস্কো! বলেন কী!
আমারে বাঁধতাছে, তহন জিগাইলাম, হু আর ইউ? বান্ধো ক্যান? কয় কী, ডিস্কোর হুকুমে তোমারে বাঁধছি। এবারে মা ভবানীর মন্দিরে তোমারে বলি দিমু।
কর্নেল বললেন, এক মিনিট! কফি খেয়েছেন তো?
হঃ!
তাহলে নিশ্চয় আপনার নার্ভ চাঙ্গা হয়েছে। এবার গোড়া থেকে বলুন, শোনা যাক।
এবার গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাঁর অনবদ্য মিশ্রভাষায় যে বিবরণ দিলেন, তা মোটামুটি এই : রাঙাটুলি পৌঁছুতে সেদিন হালদারমশাইয়ের রাত দশটা বেজে যায়। ট্রেন লেট করেছিল। অত রাতে খোঁজখবর নিয়ে উনি জানতে পারেন, মাইল তিনেক দূরে জঙ্গলের কাছে নদীর ধারে হরনাথ সিংহের কৃষিখামার আছে। হরনাথবাবু রাতে সেখানেই থাকেন। অনেক চেষ্টা করে হালদারমশাই একটা এক্কাগাড়ি যোগাড় করেন। ফার্মে গিয়ে হরনাথবাবুকে চন্দ্রিকা রায়ের শোচনীয় মৃত্যুর খবর দেন। হরনাথবাবু প্রথমে কেঁদে ফেলেন। বলেন, হতভাগিনী নিজেই নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া কী বলব? তবে হালদারমশাইয়ের মতে, হরনাথবাবু শক্ত মনের মানুষ। হালদারমশাইয়ের খাওয়াদাওয়ার। ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর ফার্মের একটা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থাও করেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, চন্দ্রিকা হালদারমশাইকে কোনও জিনিস রাখতে দিয়েছিল কি না। দেয়নি শুনে গম্ভীর হয়ে চলে যান।
অচেনা জায়গায় হালদারমশাইয়ের ঘুম আসতে চায় না। ফার্মে বিদ্যুৎ আছে। ফ্যানও আছে। জানালার বাইরে আবছা আলোয় একটা ফুলবাগান দেখা যাচ্ছিল। তার একধারে উঁচু কয়েকটা গাছ। হঠাৎ হালদারমশাই দেখতে পান, গাছে ফাঁকে টর্চের আলো ফেলে কে চলাফেরা করছে।
গোয়েন্দাগিরি যাঁর পেশা, তাঁর কাছে এটা সন্দেহজনক মনে হওয়া স্বাভাবিক। উনি চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে যান। ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে হালদারমশাই দেখেন, ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কে এগিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা পুঁড়ি মেরে তাকে অনুসরণ করেন। একটু পরে লোকটা গাছের ডগার দিকে টর্চের আলো ফেলে। তখন অবাক হয়ে যান হালদারমশাই। লোকটা স্বয়ং হরনাথ সিংহ।
এত রাতে হরনাথবাবু একটা ঝাঁকড়া গাছের ডগায় আলো ফেলে কী দেখছেন, এটা রীতিমতো রহস্য। একটু পরে উনি এদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে এলে হালদারমশাই চুপিসাড়ে চলে এসে ঘরে ঢোকেন এবং দরজা আটকে শুয়ে পড়েন।
রহস্যটা জানার জন্য হালদারমশাই পরদিন রাঙাটুলিতে থেকে যাওয়াই ঠিক করেন। সকালে চা খেয়ে হরনাথবাবুর সঙ্গে ফার্মের চাষবাস দেখতে বেরোন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে আছে সেই গাছগুলোতে। ফার্মের উত্তর প্রান্তে ওটা একটুকরো জঙ্গল বলা চলে। জঙ্গলটা কেন কাটা হয়নি জিজ্ঞেস করলে হরনাথবাবু বলেন, অর্কিডের চাষ করার জন্য গাছগুলো রেখেছে।
হরনাথবাবু তাঁকে অর্কিড দেখাতে নিয়ে যান। প্রত্যেকটি গাছে প্রচুর অর্কিড রঙবেরঙের পাতায় ঝলমল করছে। হালদারমশাই কর্নেলের কথা তোলেন। কারণ কর্নেলের অর্কিডের হবি আছে। হরনাথবাবু বলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। অমরেন্দ্র সিংহরাযের বাড়ি এসেছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়। (কর্নেলের মন্তব্য : হুঃ) পরে কর্নেল সায়েব তাঁর ফার্মে এসে অর্কিড দেখে গেছেন। যাইহোক, হালদারমশাই কথায় কথায় বলেন, জায়গাটা তাঁর ভাল লেগেছে। একটা দিন কাটিয়ে যেতে চান। হরনাথবাবু কোন মুখে না বলেন তাঁকে?
(ইতিমধ্যে চন্দ্রিকার জীবনকাহিনী হালদারমশাই জেনে নেন। আমরা যতটা জানি, তার বেশি কোনও তথ্য নেই।)
হালদারমশাই সেই বিশেষ গাছটা দিনের বেলায় চিনতে পারেননি, যেটার ডগায় হরনাথবাবু আলো ফেলে কী খুঁজছিলেন। বিকেলে হরনাথবাবু হালদারমশাইকে রাঙাটুলির বিখ্যাত ভবানীমন্দির দেখাতে নিয়ে যান। ফার্মের পশ্চিমে নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের ভেতর প্রাচীন ঐতিহাসিক একটা মন্দির। চারপাশে অজস্র ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরও ভেঙে পড়েছে। শুধু সামনের উঁচু চত্বরটি পাথরের বলে অটুট আছে। তার নিচে হাড়িকাঠ পোঁতা। বৈশাখী পূর্ণিমায় পুজোর সময় বলিদান হয়।
মন্দিরে প্রণাম করে সবে দুজনে উঠেছে, ফার্মের একটা লোক হন্তদন্ত এসে হরনাথবাবুকে একান্তে ডেকে চুপিচুপি কী বলে। অমনই আশ্চর্য ব্যাপার, হরনাথবাবু এক্ষুণি আসছি বলে লোকটার সঙ্গে চলে যান।
হালদারমশাই ভেবেছিলেন, ফার্মে চুরি-টুরি হয়েছে। কারণ প্রায় নাকি ফার্মে চোর পড়ে। গুদামঘরে প্রচুর ফসল মজুত আছে। হালদারমশাই অ্যালসেসিয়ান কুকুর পোষার পরামর্শও দিয়েছিলেন।
মন্দিরচত্বরে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও হরনাথবাবু ফেরেননি। তখন হালদারমশাই নদীর দিকে হাঁটতে থাকেন। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে দুটো মস্তানমার্কা লোক চুপিচুপি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে। তাঁকে দেখেই তারা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
গোয়েন্দার চোখে এ-ও খুব রহস্যময় ঘটনা। কাজেই হালদারমশাই হনহন করে নদীর দিকে যাচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়েন। সেখান থেকে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছিল। লোক দুটো মন্দিরের কাছে যায়। তারপর মন্দিরের পেছনে গিয়ে বসে পড়ে।
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্যদিক থেকে টর্চের আলো ফেলে কারা আসছে দেখে হালদারমশাই ভেবেছিলেন হরনাথবাবু। কিন্তু না–এক ভদ্রমহিলা এবং একজন যুবক আলো ফেলে কথা বলতে বলতে আসছে।
হালদারমশাই ভেবেছিলেন পুজো দিতে আসছে ওরা। কিন্তু চত্বরের সামনে প্রণাম করে ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই রইল টাকা। আমার স্বামীকে তোমরা ফিরে দাও।
মন্দিরের পেছন থেকে সম্ভবত সেই লোক দুটোর একজন হেঁড়ে গলায় বলে, কত আছে?
ভদ্রমহিলা বলেন, গুনে দেখ। পুরো টাকা আছে।
হেঁড়ে গলায় আওয়াজ আসে, ঠিক আছে, চলে যান। আপনার হাজব্যান্ডকে বাড়িতে পেয়ে যাবেন।
ভদ্রমহিলা এবং যুবকটি চলে যায়। ততক্ষণে হালদারমশাই গুঁড়ি মেরে মন্দিরের চত্বরের কাছে পৌঁছেছেন। তোক দুটো টাকাভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটার দিকে এগিয়ে আসতেই হালদারমশাই উঠে দাঁড়ান। হাঁক ছাড়েন, ডোন্ট টাচ!
সঙ্গে টর্চ ছিল না, রিভলভার ছিল। কিন্তু রিভলভার বের করার আগেই ব্যাগ তুলে নিয়ে ওরা উধাও হয়ে যায়। অন্ধকারে আর কী করা যাবে? টর্চ নিতে ভুল হয়েছে। মনমরা হয়ে হালদারমশাই ফিরে আসছিলেন। নদীর ধারে পৌঁছতেই কাঠের ব্রিজে দুজন লোককে কথা বলতে শোনেন। কাছাকাছি হওয়ামাত্র লোক, দুটো হালদারমশাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, এমন লোকেরা যে একই দলের, সেটা কেমন করে বুঝবেন হালদারমশাই? তারা ওঁকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। (হালদারমশাইয়ের ভাষায় আমারে বান্ধো ক্যান?) তারপর তারা ওঁকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর সেই মন্দিরের সামনে। তারা হাড়িকাঠে হালদারমশাইয়ের মাথা গলিয়েছে, সেই সময় টর্চের আলো এসে পড়ে এবং হরনাথবাবুর চিৎকার শোনা যায়, এই ব্যাটাচ্ছেলেরা! লোক দুটো হালদারমশাইকে ফেলে পালিয়ে যায়।
হরনাথবাবু তাঁকে মুক্ত করে ফার্মে নিয়ে যান। সব ঘটনা শুনে উনি খুব গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনি শিগগির চলে যান রাঙাটুলি থেকে। রাত বারোটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে। আপনি আর এখানে থাকলে আমিই এবার বিপদে পড়ব।
কথা শেষ করে হালদারমশাই আবার নস্যি নিয়ে বললেন, হেভি রহস্য। আর হরনাথবাবুর বিহেভিয়ারও মিসটিরিয়াস। কী কন জয়ন্তবাবু?
হালদারমশাইয়ের ভঙ্গিতে বললাম, হঃ!….
.
সে-বেলা হালদারমশাইকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না কর্নেল।
হালদারমশাই স্নান করে ধাতস্থ হয়েছিলেন। ব্যাগ থেকে প্যান্টশার্ট বের করে নোংরা পোশাক বদলে ফিটফাট হয়ে চুল আঁচড়ে খাওয়ার টেবিলে বসেছিলেন। খেতে খেতে তাঁর রাঙাটুলি-অ্যাডভেঞ্চার আবার একদফা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল কোনও প্রশ্ন বা মন্তব্য করেননি। কর্নেলকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে এলাম আমরা। হালদারমশাই সোফায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বললেন, কর্নেলস্যারের রাঙাটুলি যাওয়া উচিত। আমিও যামু। বাট ইন ডিসগাইজ।
হাসতে হাসতে বললাম, আপনার তো সাধুবাবার ছদ্মবেশ ধরার অভ্যাস আছে। ভবানীমন্দিরে গিয়ে ধুনি জ্বেলে বসবেন।
তা কর্নেলস্যার কইলে আপত্তি নাই।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বললেন, হালদারমশাই কি হরনাথবাবুকে চাই চিচিং ফাঁক কথাটা বলেছিলেন?
হালদারমশাই সোজা হয়ে বসে বললেন, ইয়েস। রিঅ্যাকশন বুঝতে চাইছিলাম।
কী বললেন হরনাথবাবু?
শুধু কইলেন, বুঝছি ক্যান চন্দ্রিকারে মারছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেলস্যার। বলে হালদারমশাই হঠাৎ গুম হয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন, কী আশ্চর্য ব্যাপার?
ডিস্কোর লোকেরা আমারে কিডন্যাপ করছিল শুনিয়াই হরনাথবাবু কইছিলেন, সেই ডিস্কো হারামি আবার রাঙাটুলিতে ফিরছে? অরে গুলি করিয়া কুত্তার মতন মারব। জিগাইলাম, ডিস্কো কেডা। শুধু কইলেন, অরে চিনবেন না।
আপনি অমরেন্দ্র সিংহরায়ের কথা শুনেছেন বলছিলেন। হরনাথবাবুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন বুঝলেন?
ভাল। হরনাথবাবু কইলেন ওনার বেস্ট ফ্রেন্ড। আলাপ করতে চাইছিলাম। কিন্তু চান্স পাইলাম না।
হরনাথবাবুকে আপনি চন্দ্রিকা এবং ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সম্পর্কের কথা বলেছিলেন?
হঃ। ডিটেলস সবকিছু কইছি ওনারে। কী বুঝলেন? মানে ইন্দ্রজিৎবাবুকে উনি চেনেন?
চেনেন। রাঙাটুলি ইন্দ্রজিৎবাবুর শ্বশুরবাড়ি। আর কী কইছিলেন য্যান? হালদারমশাই স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। একটিপ নস্যি নিয়েই মনে পড়ল। বললেন, হঃ! ধানবাদের লোক ইন্দ্রজিৎবাবু। পলিটিকস করতেন। নাটকও করতেন। লোকাল এম এল এর রাইটহ্যান্ড ছিলেন। হরনাথবাবু চন্দ্রিকার সঙ্গে ম্যারেজের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু চন্দ্রিকা এম এল এর পোলার লগে পলাইয়া গেছিল।
কিন্তু ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে চন্দ্রিকার মেলামেশা সম্পর্কে হরনাথবাবুর কী রিঅ্যাকশন?
হালদারমশাই মাথা নেড়ে বললেন, ভাল না। কইলেন, হতভাগিনী বুদ্ধির দোষে মারা পড়েছে। এক্সপ্লেন করলেন না। শুধু বুঝলাম, একসময় ইন্দ্রজিৎবাবুরে লাইক করতেন। এখন আর করেন না। আপনি রাঙাটুলি যান কর্নেলস্যার! হেভি মিস্ট্রি। তাছাড়া কোন ভদ্রমহিলার হাজব্যান্ডরে কিডন্যাপ করল কেডা, বুঝি না। মন্দিরে টাকার ব্যাগ রাখল। তারপর তারে ছাড়ল কি না– শ্বাস ছেড়ে চুপ করে গেলেন হালদারমশাই।
কর্নেল বললেন, ডিস্কো ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিডন্যাপ করেছিল। এক লাখ টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
অ্যাঁ? কন কী?
ভবানীমন্দিরে যে ভদ্রমহিলাকে দেখেছেন, তিনি ইন্দ্রজিত্যাবুর স্ত্রী মৃদুলা দেবী।
খাইছে। হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন। গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপতে লাগল।
কর্নেল হাসলেন। আপনি রাঙাটুলি যাওয়ার পর অনেক ঘটনা ঘটেছে। সময়মতো বলব।
টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। বলছি। …হা মিঃ ডিস্কো! বুঝতে পারছি আপনার প্রবলেম।…..শুনুন। চিচিং ফাঁক আমার কাছে আছে তা তো জানেন। আমি আপনার কথায় রাজী।… হ্যাঁ। রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরেই ফেরত দেব। শুধু একটা শর্ত।…না। আপনার প্রকৃত পরিচয় জেনে আমার কোনো লাভ আছে বলে এখন মনে করছি না। তবে শর্তটা হলো, আপনাকে আমি নিজের হাতে চিচিং ফাঁক তুলে দেব। … নাহ্। আমি একা যাব এবং আপনিও একা আসবেন। ভদ্রলোকের চুক্তি।– ঠিক আছে। আগামী শুক্রবার রাত দশটা?…. তা-ই হবে। রাখছি।
হালদারমশাই শুনছিলেন। বললেন, ডিস্কো?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ।
অরে চিচিং ফাঁক দেবেন কইলেন। হোয়াট ইজ দ্যাট থিং?
একটা কোড নাম্বার।
কিসের কোড নাম্বার।
জানি না। তবে ওটা ডিস্কোর দরকার। ওটার জন্যই চন্দ্রিকাকে খুন হতে হয়েছে।
হেভি রহস্য। বলে গুম হয়ে গেলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে হালদার।
কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, অরিজিৎ! …. হ্যাঁ অশোকবাবুকে …… জাস্ট আ মিনিট! স্বপন দাশের ব্যাকগ্রাউন্ড…ঠিক আছে। ওর দোকানের ঠিকানাটা চাই। …হ্যাঁ, বলো। … কর্নেল প্যাড টেনে ঠিকানা লিখে নিলেন। তারপর বললেন, হালদারমশাই বহাল তবিয়তে ফিরেছেন। বলছেন, হেভি মিস্ট্রি। … সন্ধ্যার পর এস বরং। ডিটেলস আলোচনা হবে। ছাড়ছি।
হালদারমশাই বেজার মুখে বললেন, ডি সি ডি ডি সায়েব আমারে পাত্তা দিতে চান না। ওনারে আমার সাংঘাতিক এক্সপিরিয়েন্সের কথা বললে জোক করবেন।
নাহ্। তবে আপনি এবার বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। সকাল সকাল শুয়ে পড়বেন। আপনার লম্বা একটা ঘুম দরকার।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যথারীতি যাই গিয়া বলে বেরিয়ে গেলেন।
বললাম, আপনি ডিস্কোকে চন্দ্রিকার রাখা কাগজটা সত্যি দেবেন?
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, দেব। ভদ্রলোকের চুক্তি, ডার্লিং।
কিন্তু তার আগে ওটা কিসের কোড জানা দরকার নয় কি? ফোনে একটি মেয়ে বলছিল, চন্দ্রিকা নার্কোটিকসের একটা পেটি আত্মসাৎ করেছিল। সেটার সঙ্গে এই কোডের সম্পর্ক থাকতে পারে।
তা পারে।
তাহলে আগে–
আমাকে বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, কিছুক্ষণ জিরিয়ে নাও। আবার বেরুতে হবে।
কোথায়?
স্বপন দাশের নিউমার্কেটের দোকানে।
নিউমার্কেটের ভেতর ভিড় ঠেলে অনেক গলিঘুঁজি ঘুরে একটা ছোট্ট দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। টেপরেকর্ডার বিক্রি হয় দোকানটাতে। ভিডিও ক্যাসেট ভাড়ায় পাওয়ার কথা খুদে ফলকে লেখা আছে। সাইনবোর্ডে দোকানের নাম জয় মা কালী ইলেকট্রনিকস। কাউন্টারে ব্যাগি প্যান্ট আর আই লাভ ইউ লেখা ফতুয়াগোছের গেঞ্জি পরা তাগড়াই এক যুবক ক্যাসেট গোছাচ্ছিল। কর্নেলকে বলল, বলুন স্যার।
কর্নেল বললেন, স্বপনবাবুকে দেখছি না? বেরিয়েছেন কোথাও?
যুবকটি ক্যাসেটগুলো র্যাকে রেখে এসে বলল, স্বপনদা নেই।
কর্নেল হাসলেন। নেই তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আসেননি, নাকি—
স্বপনদা মারা গেছে।
সে কী! এই তো কদিন আগে দেখলাম। হঠাৎ কী অসুখ হয়েছিল?
ফুড পয়েজন।
ভেরি স্যাড। কর্নেল মুখে প্রচণ্ড দুঃখের ছাপ ফুটিয়ে বললেন, আহা! অত ভাল ছেলেটা অকালে ঝরে গেল। আমার সঙ্গে কতদিনের চেনাজানা ছিল। আপনি কি স্বপনের আত্মীয়?
হ্যাঁ।
স্বপন আমাকে একটা ভিডিও ক্যাসেট যোগাড় করে দেবে বলেছিল।
আপনি মেম্বার?
না। স্বপনের সঙ্গে আমার অন্য সম্পর্ক ছিল। আপনার নাম কী ভাই?
তরুণ, সে ব্যবসাদারী ভঙ্গিতে বলল, আমি তো আপনাকে চিনি না। মেম্বার হতে হবে। দুশো টাকা ডিপোজিট। স্বপনদাকে যে ক্যাসেট চেয়েছিলেন, পেয়ে যাবেন।
পারবেন দিতে?
চেষ্টা করব। কী ক্যাসেট বলুন?
চিচিং ফাঁক।
মুহূর্তে তরুণের মুখের ভাব বদলে গেল। ভুরু কুঁচকে বিকৃত মুখে বলল, কী ফালতু কথা বলছেন স্যার। ওই নামে কোনও ক্যাসেট নেই।
কর্নেল অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, সে কী! স্বপন বলেছিল–
স্বপনদার চালাকি। আপনাকে ভুল বলেছে।
ভুল নয়। আসলে ওটা একটা থিয়েটারের নাটকের ক্যাসেট। স্বপন ওতে অভিনয় করেছিল। আপনি নিশ্চয় জানেন স্বপন থিয়েটারে অভিনয় করত?
তরুণ একটু দ্বিধায় পড়ে গেল যেন। স্বপনদা বলেছিল চিচিং ফাঁক নামে নাটক করেছে?
হ্যাঁ। দারুণ নাটক নাকি।
বোগাস। স্বপনদা স্টেজের কাজকর্ম করত।
তা-ই বুঝি? কিন্তু স্বপন বলেছিল, কী যেন নাটকের দলটার নাম—হুঁ, সৌরভ, নাট্যগোষ্ঠী।
হবে। আমি জানি না। স্বপনদার মুখে শুনেছি, নাটকে নামার ইচ্ছে ছিল। একটা দলের সঙ্গে ভিড়েছে। স্টেজ ম্যানেজ করে-টরে।
আপনি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকে চেনেন?
নাহ্।
ডিস্কোকে?
তরুণের মুখের ভঙ্গি আবার পলকে বদলে গেল। গলার ভেতর বলল, নাহ্। তারপর সে নার্ভাস মুখে একটু হাসবার চেষ্টা করল। তাই বলুন! আপনি সি আই ডি অফিসার। দেখুন স্যার, দফায় দফায় এসে আমাকে আপনারা জ্বালাতন করছেন। এতে আমার বিজনেসের লস হচ্ছে। স্বপনদা আমার পার্টনার ছিল। সে কী কাজ করে ফেঁসে গেছে-মার্ডার পর্যন্ত হয়ে গেছে, আমি তার কিছুই জানি না। মিছিমিছি আমাকে হ্যাঁরাস করছেন।
কাউন্টারে ইতিমধ্যে কয়েকজন খদ্দের এসেছিল, তারা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তরুণ তাদের দিকে ঘুরল। কর্নেল মুখে সেই অবাক ভঙ্গিটি রেখেই শ্বাস ছেড়ে বললেন, ভুল করছে তরুণবাবু!
তরুণ হাত নেড়ে বলল, থানায় গিয়ে দেখা করব। বড়বাবু আমার চেনা। আপনি এখন আসুন স্যার।
কর্নেল ভিড় ঠেলে হাঁটতে থাকলেন। রাস্তায় গিয়ে মুচকি হেসে বললেন, অনেক সময় অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে দেখেছি, ঠিক জায়গায় লেগেছে। কী বুঝলে বলো এবার?
বললাম, স্বপন দাশ ইন্দ্রজিৎবাবুর দলে ছিল। আর এই তরুণচন্দ্র ডিস্কোর এক চেলা।
কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন, আর কিছু বুঝলে?
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে ডিস্কোর তো শত্রুতা আছে। ইন্দ্রজিৎবাবুর নাটকের দলে স্বপন দাশ সম্ভবত ডিস্কোর চর হয়ে ঢুকেছিল। ইন্দ্রজিৎবাবুই তো বলছিলেন, তাঁর দলে ডিস্কোর চর আছে।
স্বপনকে কে খুন করল বলে মনে হয় তাহলে?
ইন্দ্রজিৎবাবুকে সন্দেহ করা চলে।
কর্নেল হাসলেন। তা হলে তোমার ধারণা অনুসারে চন্দ্রিকার খুনী ইন্দ্রজিৎবাবু?
হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, চন্দ্রিকাকে উনি খুন করবেন কেন? মোটিভ কী? চন্দ্রিকার লুকিয়ে রাখা ওই কাগজটা তো আপনাকে ডিস্কোই চাইছে। ডিস্কোই ইন্দ্রজিৎবাবুকে কিডন্যাপ করে এক লক্ষ টাকা আদায় করল। কাজেই অরিজিৎবাবুর থিওরি অনুসারে একজন তৃতীয় ব্যক্তি এই রহস্যের পিছনে আছে। সে ডিস্কোকে টেক্কা মেরে ওই কাগজটা অর্থাৎ চিচিং ফাঁকের কোড নাম্বার হাতাতে স্বপনকে দিয়ে চন্দ্রিকাকে মেরেছে। চন্দ্রিকা টের পেয়েছিল থিয়েটার থেকে সে তার পিছু নিয়েছে। এবং আপনার থিওরি অনুসারে চন্দ্রিকা তাই তার পার্স আপনার জিম্মায় পৌঁছে। দিয়েছিল। তাই না?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে শুধু বললেন, হুঃ!
হেমেন্দ্র সে রাতে ওলসন হাউসের কাছে ছিলেন। কাজেই তৃতীয় ব্যক্তি হেমেন্দ্র।
তুমি বলেছিলে হেমেন্দ্রের ডিস্কো হওয়ার চান্স আছে।
নাহ্। ডিস্কো অন্য কেউ। হি ইজ আ বিগ গাই। পুলিশের কথা এটা।
কর্নেল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছে মুখ খুললেন। ওলসন হাউসে ঢুকব। একটু দরকার আছে।
বাড়িটার কাছে একটা পুলিশ ভ্যান দেখে বুঝলাম, কড়া পুলিশ পাহারা বহাল আছে। সাদা পোশাকের পুলিশ দেখলে আমি চিনতে পারি। তারা দুদিকের ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ খৈনিওয়ালার কাছে বসে গল্প করছে আর খৈনি ডলছে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মুখে একজন সাদা পোশাকের অফিসার কর্নেলকে দেখে হাসলেন। কর্নেল তাঁর পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। দেখলাম, ছোট্ট লনের ওপাশে বেঞ্চে কজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসে আছে।
বারান্দায় হ্যারি ওলসন বেতের চেয়ারে বিমর্ষমুখে বসেছিলেন। কর্নেলকে দেখে হাত তুলে অভিনন্দন জানালেন। আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, আশা করি কোনও অসুবিধে হচ্ছে না মিঃ ওলসন?
ওলসন বললেন, হচ্ছে। তাছাড়া পুলিশ আমার বাকি জীবনকাল পর্যন্ত আমাকে পাহারা দেবে না। তখন ডিস্কো আমাকে খতম করবে। কাজেই ঠিক করেছি, বাড়ি বেচে দেব। বোম্বে চলে যাব, আমার এক আত্মীয়ের কাছে।
আপনার ভাড়াটেদের খবর কী?
ওরা আছে। বাইরে শিকার ধরতে যাচ্ছে আগের মতো। তবে কাউকে সঙ্গে আনতে পারছে না। ওলসন ফিসফিস করে বললেন ফের, একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন, ডিস্কো ওপরতলায় খুব চাপ দিচ্ছে পুলিশ তুলে নিতে। কাজেই আপনি যতই চেষ্টা করুন, পুলিশ চলে যাবে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, বাড়ি যে বেচবেন বলছেন, কিনবে কে ভেবেছেন?
মেয়েগুলোকে বলেছি, ডিস্কোকে বলো, সে কিনে নিক। কিন্তু ওরা বলছে, ডিস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। আমিও ফোন করেছিলাম। রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।
ডিস্কো যদি বাড়ি না চায়?
ওলসন একটু চুপ করে থেকে বললেন, পড়ে থাকবে। আমি চলে যাব।
কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন মিঃ ওলসন।
ওলসন হাসবার চেষ্টা করে বললেন, অপেক্ষা করে লাভ কী?
ডিস্কোকে আমি ঢিট করে ফেলব। সে যে-ই হোক।
ওলসন মাথা নাড়লেন। বিশ্বাস করি না। রাজনীতিওলারা তার মুরুব্বি।
আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। ঠিকঠাক জবাব পেলে আমার সুবিধে হবে।
বলুন। আপনাকে আমি কিছু গোপন করিনি। করব না।
আপনি তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তো–
ওলসন কর্নেলের কথার ওপর বললেন, ওঃ! সে এক সুখের দিন গেছে। এ নিয়ে আপনার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছি। স্মৃতি সুখের। আপনার সঙ্গে ডিগবয়ে আলাপ হয়েছিল। যাই হোক, এখন আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। স্মৃতি সুখের বটে, তবে এ মুহূর্তে কষ্টের।
মিঃ ওলসন! আপনি বর্মাফ্রন্টে থারটিনথ ডিভিসনে ছিলেন।
সাধারণ সৈনিক মাত্র।
রিট্রিটের পর ডিভিসন ভেঙে দিয়ে যে দলটাকে রাঁচি ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়, আপনি সেই দলে ছিলেন।
হ্যাঁ। আপনাকে তো কতবার সে-সব কথা বলেছি।
আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি এতদিন, আপনার কি অপারেশন অর্কিডের কথা স্মরণে আছে?
ওলসন একটু নড়ে বসলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। অপারেশন অর্কিড! বিহারে তখন রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল। প্রচণ্ড অন্তর্ঘাত শুরু করেছিল ওরা। ট্রেনের লাইন ওপড়ানো। অস্ত্র লুঠ। আর্মি কনভয়ের ওপর পর্যন্ত হামলা।
১৯৪২সালের আগস্ট আন্দোলন বলা হয়। বিহারে সেই আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ আর্মি অপারেশন অর্কিড শুরু করে। যাই হোক, আপনি কি রাঙাটুলি সেনাঘাঁটি–
ওলসন দ্রুত বললেন, হ্যাঁ। মনে আছে। ওখান থেকে যে সেনাদল অপারেশন অর্কিডে যোগ দেয়, তাতে আমিও ছিলাম।
সামরিক রেকর্ডের একটা বইয়ে পড়েছি, একটা পরিত্যক্ত খনির ভেতর প্রচুর সোনাদানা মজুত রেখেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। খনির মুখ পাথর দিয়ে সিল করে স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল। সেই জায়গার একটা ম্যাপ তৈরি করেন লেফটন্যান্ট জেনারেল হেনরি প্যাটার্সন। ম্যাপটা তাঁর ক্যাম্প থেকে পরে কীভাবে চুরি যায়।
ওলসন মাথা নাড়লেন। আমি জানি না। শুনিনি। কিন্তু অপারেশন অর্কিডের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল জায়গাটা খুঁজে বের করা। কারণ ম্যাপ চুরির পর হেনরি প্যাটার্ন আত্মহত্যা করেছিলেন।
ওলসন একটু অবাক হয়ে বললেন, আমাদের যেখানে সেখানে নিয়ে মাটি খোঁড়ানো হতো। মনে পড়ছে। কেন খোঁড়ানো হতো, ভেবেই পেতাম না। আমাদের প্রশ্ন করা নিষেধ ছিল।
কর্নেল আস্তে বললেন, রাঙাটুলির আর্মিবেসের কন্ট্রাক্টর অজয় রায়কে আপনি চিনতেন। ম্যাপ চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহেই তাঁর জেল হয়েছিল। তাই না?
ওলসন তাকয়ে রইলেন কর্নেলের দিকে।
কর্নেল পকেট থেকে পুরনো একটা খাম বের করে বললেন, পুলিশ চন্দ্রিকার ফ্ল্যাট সার্চ করে এই চিঠিটা পেয়েছে। এটা আপনি চন্দ্রিকার মা স্নেহলতা রায়কে লিখেছিলেন।
ওলসন জড়ানো গলায় বললেন, কনডোলেন্স লেটার।
এ হ্যাঁ। অজয়বাবুর মৃত্যুর পর সান্ত্বনা দিয়ে লেখা চিঠি। কিন্তু এতে প্রমাণ হচ্ছে, আপনি অজয়বাবুকে ভাল চিনতেন। তিনি আপনার বন্ধু ছিলেন। এবার আমার প্রশ্ন, ডিস্কো বা তার লোকের চাপে, নাকি চন্দ্রিকা এই চিঠি আপনাকে দেখিয়ে পরিচয় দেওয়ায় আপনি তাকে চার তলার ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়েছিলেন? আশা করি, সঠিক জবাব দেবেন।
ওলসন আস্তে বললেন, চন্দ্রিকা আমাকে চিঠি দেখিয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, এখানে তুমি থাকতে পারবে না। এখানে খারাপ মেয়েরা থাকে। কিন্তু চন্দ্রিকা বলেছিল, তার আশ্রয় নেই। সে কান্নাকাটি করছিল। তাই তাকে ফ্ল্যাটটাতে থাকতে দিয়েছিলাম। পরে বোকা মেয়েটা ডিস্কোর পাল্লায় পড়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে ওলসন আবার বললেন, কথাটা অপ্রাসঙ্গিক ভেবেই আপনাকে বলিনি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, মিঃ ওলসন! অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কী জানি! এটাই সমস্যা আপনি কি জানেন, অজয়বাবু সত্যিই সেই গোপন নকশা চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন?
ওলসন গম্ভীর মুখে বললেন, আমার সন্দেহ, নকশা উনিই চুরি করেছিলেন। লেফটন্যান্ট জেনারেল প্যাটা জয়ন্তবাবুকে পছন্দ করতেন। বিশ্বাস করতেন খুব। এ কথা অজয়বাবুই আমাকে বলতেন। আমি তো ছিলাম সাধারণ সৈনিক মাত্র।
অজয়বাবুর সঙ্গে কথাবার্তায় তেমন কিছু নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন আপনি?
সম্ভবত। এত কাল পরে কিছু মনে নেই।
ধন্যবাদ! উঠি মিঃ ওলসন।
হ্যারি ওলসন গম্ভীর মুখে রইলেন। গেটের কাছে সেই পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিলেন। চাপা স্বরে বললেন, কী বলছে বুড়ো?
কর্নেল বললেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।
অফিসার হাসলেন। গেলে আমরাও ঝামেলা থেকে বেঁচে যাই।
গাড়িতে আসতে আসতে বললাম, অপারেশন অর্কিড! আপনি সেইজন্যই পরগাছারহস্য বলছিলেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা গুপ্তধনরহস্য হয়ে দাঁড়াল যে! ছ্যাঃ! যত সব চাইল্ডিশ ব্যাপার!
কর্নেল বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু আড়ালের রহস্যময় ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হয় না। কথাটা ঠিকই। বিশাল একটা সাম্রাজ্য। অসাধারণ তার ভৌগোলিক বিস্তার। যুদ্ধের সময় ব্যাঙ্ক এবং ট্রেজারি থেকে কত কোটি কোটি টাকার সোনাদানা শত্রুপক্ষের হাতে পড়ার ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারকে, কল্পনা করতে পারবে না। শত্রুপক্ষের বোমায় কত জায়গায় কত সোনাদানার গুপ্তভাণ্ডার চাপা পড়ে গেছে। পরে আর তা খুঁজে বের করা যায়নি। এখনও মাটির ভেতর সেগুলো রয়ে গেছে। যক্ষের দল সেগুলো পাহারা দিচ্ছে।
মাই গুডনেস! চিচিং ফাঁকের সঙ্গে সেই যখের ধনের সম্পর্ক আছে? চুপ! চুপ! কর্নেল সকৌতুকে অট্টহাসি হাসলেন।
যষ্ঠী দরজা খুলে দিলে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কেউ এসেছিল?
আজ্ঞে না তো।
কেউ ফোন করেছিল?
দুবার ফোং করেছিল। বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। এখনও ফেরেননি।
নাম জিজ্ঞেস করেছিলি?
আপনি বেইরেছে শুনেই ফোং কেটে দিল। হ্যালো হ্যালো করলাম—
হ্যালো হ্যালো করেছিস। এবার শিগগির কফি কর।
যেতে যেতে হঠাৎ ষষ্ঠী বলে গেল, একই নোক বাবামশাই। গলা শুনেই বুঝেছি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টুপি খুলে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠী কফি নিয়ে এল। কফিতে চুমুক দিয়েছি, সেইসময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! ফোনটা ধরো!
ফোন তুলে সাড়া দিলাম। কেউ বলল, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?
আপনি কে বলছেন?
আপনার লেটার বক্সে একটা জরুরি চিঠি আছে।
লাইন কেটে গেল। হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ লোকটার কণ্ঠস্বর কেমন ভারী এবং কর্কশ। তাছাড়া লেটার বক্সে চিঠি থাকার কথা টেলিফোনে বলাও অদ্ভুত।
কর্নেল তাকিয়েছিলেন। একটু হেসে বললেন, ডিস্কো?
কে জানে? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কি না জিজ্ঞেস করেই বলল, আপনার লেটার বক্সে একটা জরুরি চিঠি আছে। কেমন বিশ্রী কণ্ঠস্বর।
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে উঁকি মারল। বললেন, লেটার বক্সে এটা চিঠি আছে। নিয়ে আয়। ষষ্ঠী হন্তদন্ত চলে গেল।
বললাম, লোকটা যে-ই হোক, আপনার গলার স্বর ওর কাছে অপরিচিত। আমাকেই আপনি বলে ধরে নিল। এটা একটা পয়েন্ট। নিশ্চয় ডিস্কোর কোনও বোকাসোকা ডামি।
কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ!
একটু পরে ষষ্ঠী ফিরে এল একটা খাম নিয়ে। কর্নেল খামটা টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দেখে নিয়ে খুললেন। ভাঁজকরা ছোট্ট একটি চিঠি বের করলেন। তারপর চোখ বুলিয়েই আমাকে দিলেন। দেখলাম, ইংরেজিতে টাইপকরা চিঠি। বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় :
ভদ্রলোকের চুক্তি। ঠিক আছে। কিন্তু কোনও চুক্তিই শূন্যে হয় না। একটা ভিত্তি থাকা উচিত। তাই চন্দ্রিকার জ্যাঠামশাই রাঙাটুলির হরনাথ সিংহকে অপহরণ করেছি। কথামতো সময়ে জিনিসটি আপনি যথাস্থানে আমার হাতে দিলেই তাঁকে ছেড়ে দেব। ফাঁদ পাতবেন না। তা হলে একটি প্রাণ যাবে।–ডিস্কো
পড়ার পর রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল। বলালম, শয়তানটার কী স্পর্ধা আপনাকে এভাবে চিঠি লিখতে সাহস পেয়েছে?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, ডিস্কো দুঃসাহসী তো বটেই।
উত্তেজিতভাবে বললাম, একটা কথা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। ইন্দ্রজিৎবাবু ডিস্কোর হুমকিতে ভয় পেয়ে আপনার সাহায্য চেয়েছিলেন। অথচ ওঁকে ডিস্কো কিডন্যাপ করে এক লাখ টাকা দিব্যি আদায় করল। আপনি চুপচাপ থাকলেন। আবার শয়তানটা চন্দ্রিকার জ্যাঠামশাইকে–
হাত তুলে আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, খামোকা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই জয়ন্ত। তোমার কফি হয় তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা হবে।
কিছুক্ষণ পরে কলিং বেল বাজল। কর্নেল বললেন, অরিজিৎ এল হয়তো। তুমি কিন্তু মুখ বুজে থাকবে।
কিন্তু ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির বদলে হন্তদন্ত আবির্ভূত হলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে হালদার। ধপাস করে সোফায় বসে হাঁসফাঁস করে বললেন, হরনাথবাবু কিডন্যান্ড। ওনার ওয়াইফ আমারে ট্রাংকলে খবর দিলেন। হরনাথবাবু ওনারে আমার নেমকার্ড দিয়া কইছিলেন, আমার কোনও বিপদ বাধলে জানাই। বলেই তড়াক করে সোজা হলেন। চাপা স্বরে বললেন, রাত্রি সওয়া নয়টার ট্রেনে রওনা দিমু। কর্নেলস্যার। জয়ন্তবাবু। কাইন্ডলি ফলো মি।
তারপর ঘড়ি দেখে সটান উঠে দাঁড়ালেন এবং জোরে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল তুন্বেমুখে বললেন, জয়ন্ত। এবার আর হালদারমশাইকে ফলো করা ছাড়া উপায় নেই।…
চতুর্থ স্তর
আমরা রাঙাটুলি পৌঁছেছিলাম পরদিন বেলা দুটো নাগাদ। কর্নেলের হাবভাবে কোনও উদ্বেগ বা তাড়াহুড়ো ছিল না। স্টেশনটা মাঝারি ধরনের। অটোরিকশো, সাইকেলরিকশো, ঘোড়ার গাড়ি, এমনকি প্রাইভেট কারও ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা ঘোড়ার গাড়িই ভাড়া করেছিলাম।
অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ি শহরের শেষ প্রান্তে। রাস্তা থেকে বাড়িটা বেশ উঁচুতে। বাউণ্ডারি ওয়ালে ঘেরা পুরনো আমলের দোতলা বিশাল বাড়ি। চারদিকে গাছপালা জঙ্গল হয়ে আছে। নিরিবিলি সুনসান পরিবেশ। গেট থেকে বাড়িটাকে হানাবাড়ি দেখাচ্ছিল। বললাম, এমন ভূতের পুরীতে ভূতেদের কালো বেড়াল সাজার দরকারটা কী? নিজমূর্তিতেই দেখা দিতে পারে।
কর্নেল হাসলেন। ভূতের স্বভাব হালদারমশাইয়ের মতো। ছদ্মবেশ না ধরলে পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ কীভাবে দেবে?
ঠিক বলেছেন। আমার ধারণা, এবার হালদারমশাইও তাঁর পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে নিশ্চয় ছদ্মবেশে এসেছেন।
কথাটা বলেই চমকে উঠলাম। পাঁচিলের ওপর সত্যিই একটা কালো বেড়াল গুটিসুটি হেঁটে চলেছে। সেই রক্তখেকো কালো বেড়ালটা নিশ্চয়। ব্যস্তভাবে বললাম, কর্নেল! সেই বেড়ালটা।
হ্যাঁ। দেখেছি। কিন্তু গেটে ভেতর থেকে তালা আটকে বাড়ির লোকেরা দুপুরবেলার ভাতঘুম দিচ্ছে নাকি? কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে ফের বললেন, রায়সায়েবের ঘরের জানালা বন্ধ। সুনন্দার ঘরটা দেখা যায় না এখান থেকে। সত্যকামের ঘরের জানালা বন্ধ থাকা স্বাভাবিক। এখন সে অফিসে। কিন্তু বেচু-মাই গুডনেস। কালো বেড়ালটা বেচুর ঘরের জানালা গলে ঢুকে গেল।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। অমরেন্দ্রর মুখে রক্তখেকো কালো বেড়ালটার কথা শুনেছিলেন। দিনদুপুরে তার এই গতিবিধি ভৌতিক রহস্যকে জমজমাট করে ফেলল দেখছি। নাহ্। চিচিং ফাঁক-রহস্যের সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক থাকতেই পারে না। বাড়িতে নির্ঘাৎ ভূতপ্রেত আছে। কর্নেল কথাটা বলব ভাবছি, সেই সময় দেখলাম, মধ্যবয়সী একটা রোগাপটকা লোক লাঠি উঁচিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কালো বেড়ালটাকে দেখা যাচ্ছিল না বটে, বোঝা গেল লোকটা বীরবিক্রমে তর্জনগর্জন করে তাকেই তাড়া করেছে।
একটু পরে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং আমাদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, কী বেচু? দিনদুপুরে ভূত ঢুকেছিল ঘরে?
বেচু সেলাম ঠুকে ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলে দিল গেটের। কাঁচুমাচু মুখে বলল, কর্তামশাই দিদিকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছেন। বলে গেছেন, আপনি যে-কোনও সময় এসে যাবেন, লক্ষ্য রাখিস। কিন্তু স্যার, এদিকে এক বিচ্ছিরি উৎপাত।
কালো বেড়াল?
আমরা ভেতরে ঢুকলে বেচু গেটে আবার তালা আটকে দিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার। সবে এত ক্ষণে খেয়েদেয়ে উঠেছি, ব্যাটাছেলে কোত্থেকে এসে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। রোজ যখন-তখন এসে জ্বালাচ্ছে। কার বেড়াল কে জানে! তবে সাংঘাতিক বেড়াল স্যার। রক্ত খায়।
প্রাঙ্গণ পেরিয়ে বেচু আমাদের হলঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর বলল, গতবার এসে যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরেই আপনাদের থাকবার ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু আমারও ভুল, দিদিমণিরও ভুল। চাবি দিদিমণির কাছে। এখানেই একটু জিরিয়ে নিন বরং। আমি খাওয়াদাওয়ার যোগাড় করি। দেরি হবে না।
সে সুইচ টিপে ফ্যান চালিয়ে দিল। কর্নেল বললেন, আমরা ট্রেনেই খেয়ে নিয়েছি বেচু। তুমি বসো। রায়সায়েব ফেরা না পর্যন্ত গল্প করা যাক।
বেচু মেঝেয় বসল। কর্তামশাই হরনাথবাবুর বাড়ি গেলেন। আপনি তো স্যার চেনেন হরনাথবাবুকে। ওঁকে কাল থেকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনছি, মাঠের ফার্ম থেকে ডাকাতরা ফল নিয়ে গেছে। আজকাল রাঙাটুলিতে ডাকাতদেরই রাজত্ব।
কর্নেল বললেন, কালো বেড়ালটার গল্প শোনা যাক বেচু! বেড়ালটা নাকি রাত্রিবেলা এসে এই ঘরে রক্ত খাচ্ছিল? এ ঘরে রক্ত এলো কোথা থেকে?
বেচু বিবর্ণ কার্পেটের একটা কোণার দিকে আঙুল তুলল। ওইখানে একটুখানি রক্ত পড়ে ছিল। কিসের রক্ত, কী করে ওখানে এল–আর কালো বেড়ালটাই বা কোত্থেকে এসে সেই রক্ত চাটছিল, কিছুই বোঝা যায় না। তবে স্যার, কিছুদিন থেকে বাড়িতে ভূতপেরেতের উৎপাত হচ্ছে, তা-ও ঠিক। সে জন্যেই দিদিমণি কর্তামশাইকে কলকাতা যেতে বলেছিল। আপনি গতবার এসে উড়ো চিঠি লিখে ভয় দেখানোর জন্য যোগেনবাবুকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন। এবার কিন্তু উড়োচিঠি নয় স্যার। রাতবিরেতে নানারকম শব্দ। তারপর ওই বেড়ালটা। এবার স্যার ভূতপেরেতের কাণ্ড।
রোজ রাতেই কি ভূতপ্রেতে জ্বালাচ্ছে? গত রাতে জ্বালিয়েছিল?
বেচু বলল, কদিন থেকে একটু কমেছে। তবে উৎপাত একেবারে বন্ধ হয়নি। কিন্তু ওই কালো বেড়ালটার সাহস খুব বেড়ে গেছে। অবাক লাগে স্যার! চোখের পলকে নিপাত্তা হয়ে যায় ব্যাটাছেলে।
কিন্তু তোমাদের অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা কী করে? তাকে তা দেখতে পাচ্ছি না।
বেচু বিমর্ষ মুখে বলল, কুকুরটা গতকাল মারা গেছে স্যার।
সে কী! কী ভাবে মারা গেল?
ভেতর ভেতর অনেকদিন থেকে অসুখে ভুগছিল। আমরা বুঝতেই পারিনি। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল কদিন থেকে। তারপর কাল রাত্তিরে কখন মারা পড়েছে, লক্ষ্য করা হয়নি। বাড়ির পেছনদিকে মরে পড়ে ছিল। ভোরবেলা ওপর থেকে দিদিমণি দেখতে পেয়েছিলেন। কর্তামশাইয়ের আদরের কুকুর। উনি তো কেঁদে কেটে অস্থির। এদিকে ওঁর বন্ধু হরনাথবাবু নিপাত্তা। কর্তামশাই পাগল হতে বাকি। সেজন্যেই দিদিমণি ওঁর সঙ্গ ছাড়ছেন না।
বেচু উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। জিভ কেটে বলল, ভুল হয়ে গেছে। কর্তামশাই আপনার জন্য কফি এনে রেখেছেন। আপনি কফি খেতে ভালবাসেন। আগে কফি করে আনি।
সে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। হলঘরের ভেতরটা লক্ষ্য করছিলাম এতক্ষণ। সেকেলে আসবাবে সাজানো। দেশের বিখ্যাত নেতাদের অয়েল পেইনটিং চারদিকের দেয়ালকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সিলিঙের লোহার কড়িবরগায় মরচে ধরে গেছে। বাড়িটা খুবই পুরনো তাতে সন্দেহ নেই। প্রকাণ্ড দুটো টিকটিকি লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে। দেয়াল থেকে বরগা, বরগা থেকে দেয়ালের ছবির আড়ালে তারা ছুটোছুটি করছে। ঘুলঘুলিতে চড়ুইয়ের বাসাও দেখা যাচ্ছিল। এক পাশে তিনটে বইয়ের আলমারি। কারুকার্যখচিত লম্বাচওড়া একটা পেতলের ফুলদানিতে কবেকার ফুলের গোছা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। সবখানেই অযত্নের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। পর্দাগুলোও বিবর্ণ এবং জীর্ণ। অমরেন্দ্রবাবুর মেয়ে সুনন্দা কি কিছুতে নজর রাখেন না? মেয়েদেরই নাকি ঘরদোর সাজানোগোছানোর স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। সুনন্দা হয়তো অন্যরকম।
বরগার খাঁজ বেয়ে একটা টিকটিকি আরশোলাকে তাড়া করেছে। আরশোলাটা ফরফর করে উড়ে নেহেরুজির ছবির ফ্রেমে বসল। ছবির পাশেই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেই সিঁড়ি এবং দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় ছাদ থেকে ভেঁড়া বিদ্যুতের একটা কলো তার ঝুলছে। লক্ষ্য করলাম তারটা নেমেছে বরগার খাঁজ থেকে। অথচ আলোপাখার ওয়্যারিং দেয়ালের শীর্ষে আলাদা হয়ে সাঁটা আছে। কালো তারটার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ওটা কিসের জন্য টাঙানো হয়েছিল, এমন সময় কর্নেল আস্তে বললেন, ভূতের কারবার জয়ন্ত।
চমকে উঠে বললাম, কৈ ভূত?
তুমি যাকে মন দিয়ে দেখছ।
হেসে ফেললাম। ছেঁড়া কালো তারটা কি ভূতেরই ছদ্মবেশ?
সম্ভবত। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ভূতেরা বহুরূপী। ইচ্ছে করলেই যে কোনও রূপ ধরতে পারে। বিশেষ করে কালো রঙ ভূতেদের খুব পছন্দ। কারণ তারা অন্ধকারের প্রাণী।
একটা ছেঁড়া কালো তার নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। কর্নেলের কৌতুকে কান দিলাম না। বললাম, বাড়িতে মানুষ বাস করে বলে মনে হয় না। এত অযত্নের ছাপ কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললনে, আগের বার এসে বসকিছু ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন এবং সাজানোগোছানো দেখেছিলাম। এবার দেখছি অন্যরকম। এর কারণ হয়তো ভূত তার মানে, রায়সায়েবের বাড়িকে ভূতে ধরেছে।
বেচু ট্রেতে কফির পেয়ালা সাজিয়ে ঘরে ঢুকছিল। কর্নেলের কথা শুনে বলল, যা বলেছেন স্যার! কতবার কর্তামশাইকে বলেছি, ওঝা ডেকে এর বিহিত করুন। কিংবা বামুন ডেকে শান্তিস্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করুন। কর্তামশাই কান করছেন না। নিচের ওই কোণার ঘরটাতে একা থাকি। ওঁরা তো ওপরতলায় থাকেন। সারা রাত ঘুমুতে পারিনে। আর কিছুদিন দেখেই আমি কেটে পড়ব স্যার।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি ভূতের মন্ত্র জানি। দেখ না, আজ রাতেই ভূত জব্দ করে ফেলব।
বেচু হাসল। কিন্তু আগে কালো বেড়ালটাকে জব্দ করা দরকার স্যার!
করব। তুমি ততক্ষণ এক কাজ করো। এখনই হরনাথবাবুর বাড়ি গিয়ে তোমার কর্তামশাইকে খবর দাও। আমাকে একবার বেরুতে হবে। রায়সায়েবের সঙ্গে দেখা না করে বেরুতে পারছি না।
বেচু বলল, গেটের দিকে একটু নজর রাখবেন যেন। আমি খবর দিয়ে আসি।
সে চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে। কর্নেল বললেন, গেটের দিকে নজর তুমিই রাখো অন্ত। কাকেও আসতে দেখলে আমাকে ডাকবে।
উনি উঠে দাঁড়ালে বললাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ওপরে গিয়ে বাইনোকুলারে বাড়ির চারপাশটা একবার দেখে নিই।
কিন্তু কফি পড়ে রইল যে।
থাক, এখনই আসছি।
কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উধাও হয়ে গেলেন। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। রক্তখেকো কালো বেড়ালটা এসে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর? এমন একটা পোভড়া বাড়ির মতো পরিবেশে সবই সম্ভব।
কর্নেলের ফিরতে দেরি হচ্ছিল। আমার অস্বস্তিটাও তত বেড়ে যাচ্ছিল। কতক্ষণ পরে কর্নেল নেমে এলেন। বললাম, কালো বেড়ালটাকে দেখতে পেলেন নাকি?
নাহ্। তবে দুটো ভূত আমি পকেটে পুরে এনেছি।
তার মানে?
কর্নেল সকৌতুকে প্যান্টের একটা পকেটে হাতের চাপ দিয়ে বললনে, মন্ত্রপূত রুমালের ভেতর দু-দুটো ভূত জব্দ হয়ে চুপ করে আছে। বলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন।
বললাম, হেঁয়ালি না করে বলবেন কি?
কর্নেল বললেন, চুপ! ওই দেখ, কালো বেড়ালটা আবার পাঁচিলে উঠেছে।
জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, পাঁচিলের ওপর ঝুঁকেপড়া গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে কালো বেড়ালটা আবার গুটিসুটি হেঁটে আসছে। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন। বললেন, ওর লক্ষ্য হলো কিচেন। অবশ্য বেড়াল মাত্রেরই লক্ষ্য হলো কিচেন। চুপচাপ বসে থাকো। দেখা যাক, ও কী করে।
কিছুক্ষণ পরেই পাশের কোনও ঘরে থালা-বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ হলো। নিঝুম নিরিবিলি বাড়িতে শব্দটা চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কর্নেল উঠে গিয়ে একটা ঘরের পর্দা তুললেন। ওই ঘর থেকেই বেচুকে কফি আনতে দেখেছিলাম।
কর্নেলকে বলতে শুনলাম, না, না! ভয় কোরো না। কী খুঁজছ, বুঝতে পেরেছি। এক মিনিট।
উনি ঘরে ঢুকে গেলে ব্যাপারটা দেখার জন্য উঠে পড়লাম। পর্দা তুলে দেখি, কর্নেল ফ্রিজ খুলে একটা ছোট্ট বোতল বের করছেন। বেড়ালটা জানালার গরাদের ফাঁকে বসে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। কর্নেল বোতলের ছিপি খুলে ডাইনিং টেবিলের ওপর কিছু ঢালছিলেন। বললাম, কী খেতে দিচ্ছেন ওকে?
টমাটো সস। বলে কর্নেল ফ্রিজে বোতলটা ঢুকিয়ে রাখলেন। মুচকি হেসে বললেন, চলল! শ্রীমান কালো ভূত খাওয়াদাওয়া করুক। সামনে থাকলে লজ্জা পাবে।
হলঘরে ফিরে এসে সোফায় বসে বললাম, বেড়াল টমাটো সস খায় কস্মিনকালে শুনিনি। তাছাড়া আপনি কেমন করে জানলেন ও টমাটো সস খুঁজছে?
ডাইনিং টেবিলের এঁটো থালায় টমাটো সসের চিহ্ন দেখলাম। চাটতে গিয়েই থালাটা নিচে পড়েছে। আবার থাবায় থালাটা আঁকড়ে ধরে চাটতে যাচ্ছে, সেই সময় আমি গিয়ে পড়েছি। দেখামাত্র বুঝলাম টমাটো সস ওর প্রিয়।
নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস! তা হলে সে রাত্রে এই কার্পেটের ওপর–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, টমাটো সসই খাচ্ছিল। রাত্রিবেলা দেখলে রক্ত চাটছে বলে ভুল হতেই পারে। তাতে বেড়ালটার রঙ কালো এবং সে-রাত্রে একটু আগেই ভুতের উৎপাত যখন শোনা গেছে।
তাহলে কার্পেট ধুয়ে সাফ করার সময় বেচুর সেটা টের পাওয়া উচিত ছিল।
ছিল বৈকি।
কিন্তু বেচু এখনও বলছে রক্ত।
ভূত ওকে বলতে বাধ্য করেছে। বেঁচুকে ভূতের চেলা বলতেও পারো।
কে ভূত?
যে রাতবিরেতে ভয় দেখায় রায়সায়েবকে।
কেন ভয় দেখায়?
ডিস্কোর হুকুমে?
চমকে উঠে বললাম, ডিস্কো।
হ্যাঁ! ডিস্কো। ডিস্কোর লোক কলকাতায় যেমন, তেমনই রাঙাটুলিতেও আছে। ভুলে যাচ্ছ কেন হালদারমশাইয়ের কথা। তাঁকে ডিস্কোর লোকেরাই বেঁধে বলি দিতে যাচ্ছিল না?
এ বাড়িতে ডিস্কোর লোক আছে তাহলে–যাকে আপনি ভূত বলছেন। কিন্তু কে সে?
কর্নেল চুরুট ধরাচ্ছিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আর ও সব কথা নয়। ওই দেখ, রায়সায়েব এসে পড়েছেন।
আস্তে বলালম, একটা কথার জবাব দিন। বেড়ালটার সঙ্গে তাহলে বেচুর ভাব থাকারই কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম, সে লাঠি নিয়ে ওকে তাড়া করেছে।
ভাব থাকলেও সব সময় এসে টমাটো সসের জন্য ম্যাঁও করবে, এটা বেচু বরদাস্ত করবে কেন? তাছাড়া কালো বেড়ালকে অপয়া মনে করা হয়। কর্নেল উঠে বারান্দায় গেলেন। যেন নিজের বাড়িতে বাইরের লোককে অভ্যর্থনা করছেন, এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যালো রায়সায়েব! সুনন্দা কেমন আছ? আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। হাজারটা ঝামেলা নিয়ে থাকি।
অমরেন্দ্র কর্নেলের করমর্দন করলেন। সুনন্দা কর্নেলের পায়ে প্রণাম করলেন। প্রৌঢ়া মহিলা। এখনও আঁচ করা যায়, যৌবনে লাবণ্যময়ী ছিলেন। কিন্তু মুখে কী যেন যন্ত্রণার স্থায়ী ছাপ পড়ে আছে।
অমরেন্দ্র বললেন, ওদিকে এক সর্বনাশ! হরনাথকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কাল সকাল থেকে। ওর বউ কাল সন্ধ্যায় হরনাথের লেখা চিঠি পেয়েছে। চিঠিটা–কী বলব? বোকা মেয়ে। ভোরে কি এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ এসেছে কলকাতা থেকে। তাকে দিয়েছে বলল। বুঝুন অবস্থা।
কী লেখা ছিল চিঠিতে?
সুনন্দা কর্নেলের পাশ কাটিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়েই হলঘরে ঢুকে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, উনি সোফার দিকের একটা ঘরের দরজার তালা খুলছেন।
অমরেন্দ্র চাপা স্বরে বললেন, হরনাথের বউ বরাবর বোকা। বোকা আর ছিচকাঁদুনি। আসলে সন্তানাদি নেই। বাড়িতে একা থাকে। এদিকে হরনাথ পড়ে থাকে নদীর ধারে ফার্মে। তো চিঠির সব কথা গুছিয়ে বলবে কী, কেঁদেই অস্থির। যেটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হলো, হরনাথ লিখেছে, তার জন্য চিন্তার কারণ নেই। আজ রাত্রেই বাড়ি ফিরবে। তবে ওর ফার্মের একটা গাছের ডগায় নাকি মস্ত বড় একটা পরগাছা আছে, সেটা ডাল থেকে উপড়ে থলেয় ভরে সন্ধ্যার পর ভবানীমন্দিরে রেখে আসতে হবে। আমি তো এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।
কথা বলতে বলতে অমরেন্দ্র হলঘরে ঢুকলেন। সুনন্দা সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, কর্নেলসায়েবের ঘর খুলে দিয়েছি।
বলে উনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন। অমরেন্দ্র বললেন, চলুন। ঘরে বসে আলোচনা করা যাক। আসুন জয়ন্তবাবু।
.
ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। জানালার পর্দা সরানো। বাইরে ঘাস আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রাঙ্গণ। তার ওধারে জরাজীর্ণ পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে বিশাল উঁচু গাছ। ঘরটা বেশ সাজানোগোছানো দেখে ভাল লাগল। পেছনের দিকে দরজা এবং একটুকরো খোলা বারান্দা আছে।
কর্নেল বললেন, হরনাথবাবু লেখেননি কেউ ওঁকে আটকে রেখেছে?
অমরেন্দ্র বললেন, লিখেছে। সেটাই তো আমার অবাক লাগছে। কে ওকে আটকে রাখবে? একটা পরগাছা কেনই বা ভবানীমন্দিরে পৌঁছে দিতে হবে? পুলিশে খবর দিলে নাকি ওর বাড়ি ফেরা হবে না। এই সব কথা লিখেছে। আমার কিন্তু খুব রাগ হলো শুনে। আমার সঙ্গে কনসাল্ট করা উচিত ছিল। কাল বিকেলে খবর নিতে গিয়েছিলাম। হরনাথ, তখনও ফেরেনি শুনে বলে এসেছিলাম, সন্ধ্যার পরও খোঁজ না পেলে খবর দিও? দেয়নি। আজ সকালেও দেয়নি। দুপুরে হরনাথের ফার্মের মদনবাবুর সঙ্গে দেখা হলো রাস্তায়। জিজ্ঞেস করলে বলল, বাবু এখনও বাড়ি ফেরেনি। তাই সুনন্দাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম। গিয়েই এইসব কথা শুনে অবাক।
কর্নেল বললেন, বেচুকে কোথায় পাঠালেন?
কোথাও পাঠাইনি। আমরা রিকশোয় এলাম। ও হেঁটে আসছে। অমরেন্দ্র একটু হাসলেন। কফি চাই তো? সুনন্দা আছে, ভাববেন না।
কফি বেচু খাইয়েছে। এখন আর দরকার হবে না।
অমরেন্দ্র আবার চাপাস্বরে বললেন, পরগাছার ব্যাপারটা সন্দেহজনক। আপনার মনে আছে অনাথবন্ধুর কথা? সেই যে পাগলা প্রফেসর–
হ্যাঁ। অনাথবন্ধু রায়। ওর মেয়ে মৃদুলার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বিয়ে হয়েছে না?
চেনেন নাকি ওদের? চিনি।
নাটকের দল আছে ইন্দ্রজিৎবাবুর।
অমরেন্দ্র বাঁকা মুখে বললেন, ধানবাদের ছেলে। বটুকের একনম্বর চেলা ছিল। তা হলেই বুঝুন কী জিনিস। আজকাল পলিটিক্স ছেড়ে নাটক করছে বুঝি? খুব ভাল। তো যা বলছিলাম, অনাথবন্ধুর কিন্তু পরগাছার ওপর খুব লোভ আছে দেখেছি। পাগলার কাণ্ড। হরনাথের ফার্মে কোনও ভাল পরগাছা দেখে তারই লোভে ওকে আটকে রাখেনি তো?
কর্নেল হাসলেন। পরগাছার নেশা তো আমারও আছে। তাই বলে—
অমরেন্দ্র বাধা নিয়ে বললেন, আহা! আপনি তো অনাথবন্ধুর মতো উন্মাদ নন।
ভদ্রলোক এখন কোথায় আছেন?
জানি না। রাঙাটুলির বাড়িটাতে মৃদুলার মেলোমশাই আর মাসি থাকেন। নবাদেও নাকি একটা বাড়ি আছে। অমরেন্দ্র সন্দিগ্ধভাবে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, এ অনাথবন্ধুরই কীর্তি। বুঝলেন না? সায়েন্টিস্ট লোক। হয়তো সায়েন্সের কোনও গবেষণার জন্য পরগাছাটা দরকার। এমনও হতে পারে, হরনাথের কাছে চেয়েছিল। হরনাথ দেয়নি। তাই ওকে কৌশলে কোথাও আটকে রেখেছে।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, একটা কথা। হরনাথবাবু তো আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
ঘনিষ্ঠ মানে? একেবারে হাফ পেন্টুল পরা বয়স থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। কেউ কারও কোনও কথা গোপন রাখি না। আপনি স্বচক্ষে দেখেও গেছেন দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক।
সম্প্রতি হরনাথ কি কোনও জিনিস আপনাকে রাখতে দিয়েছিলেন?
অমরেন্দ্র একটু চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, জিনিস, মানে একটা ভিডিও ক্যাসেট। ওই যে সব বিলিতি অশ্লীল ক্যাসেট পাওয়া যায়–
ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট?
তা-ই বলেছিল হরনাথ। ওর বাড়িতে ভি সি পি-টিভি এ সব আছে। বউ বুড়ি হলে কি হবে? হরনাথের আবার একটু-আধটু… হাসলেন অমরেন্দ্র। বলছিলাম না? সন্তানাদি নেই। ওর বউ ওইসব দেখে সময় কাটায়। তো হরনাথ বলেছিল, ভুল করে এই অশ্লীল ক্যাসেটটা কিনে ফেলেছে। পুলিশ নাকি এই সব ক্যাসেট দেখলেই অ্যারেস্ট করবে। আমার বাড়িতে টিভি আছে। সতুর ঘরেই থাকে। আমার ওসব দেখতে ভাল লাগে না। তবে নাহ্। ভি সি পি নেই। সতু বলছিল, শীগগির একটা কিনবে।
সত্যকাম?
হ্যাঁ। অমরেন্দ্র গম্ভীর হলেন। যাইহোক, হরনাথ প্যাকেটে ভরে চুপিচুপি আমাকে রাতে দিয়েছিল।
কতদিন আগে?
এই তো–গত মাসের শেষাশেষি।
এখন সেটা আছে?
না। আজ শুক্করবার। গত শুক্কুরবার সন্ধ্যায় হরনাথ এসে ফেরত নিয়ে গেল। বলল, খদ্দের পেয়েছে। বেচে দেবে।
বাইরে বেচুর সাড়া পাওয়া গেল। অমরেন্দ্র হাঁকলেন, বেচু।
বেচু পর্দা তুলে বলল, দিদিমণি বাজারে যেতে বলছেন। এদিকে সাইকেলের চাকায় লিক। আবার হেঁটে যেতে হবে। বলুন, আপনার কিছু আনতে হবে নাকি।
অমরেন্দ্র পকেট থেকে একটা প্রেসক্রিপশন বের করে দিয়ে বললেন, নবীন বলেছিল–ঢ্যারা দেওয়া আছে দেখবি, ওই ওষুধটা এবেলা আসবে। নিয়ে আসবি যেন।
বেচু চলে গেল। অমরেন্দ্র হাসলেন। ঘুমের ওষুধ যে! সেটা কোনও দোকানে পাওয়া যায় না।
কর্নেল বললেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়।
ডাক্তার বলল, ঠিক ঘুমের ওষুধ নয়। ট্রাংকুলাইজার। আসলে রাতবিরেতে ওই সব ভুতুড়ে কাণ্ডের জন্য শরীরের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। এদিকে আপনিও আসছেন না।
ভৌতিক উৎপাত বন্ধ হয়েছে আশা করি।
অমরেন্দ্র জোরালো হাসলেন। আপনি আসছেন শুনেই হয়তো পালিয়েছে। কদিন থেকে আর কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।
কালো বেড়ালটা?
বেড়ালটাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাই। তবে আমার ধারণা, ওটা বেড়ালই বটে। বলে অমরেন্দ্র আবার গম্ভীর হলেন। সেই কাগজটার রহস্য উদ্ধার করতে পারলেন?
রহস্যের ঘাঁটি তো এখানে। দেখা যাক্। কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি আপনার শ্যালকের ছেলে রথীনবাবুর স্ত্রীকে কি চিনতেন?
অমরেন্দ্র বাঁকা মুখে বললেন, খারাপ মেয়ে। হরনাথের দোষ ছিল না। হরনাথ এতটুকু থেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছিল। কিন্তু খারাপকে ভাল করে সাধ্য কার? রথীনকে নিয়ে ভেগে গেল। আর বটুকও এমন লোক, পলিটিক্সই ওকে খেয়েছিল। রথীনকে কলকাতায় ব্যবসা করতে টাকা যোগাত। কিন্তু খবরও নিত না ছেলে সত্যি ব্যবসা করছে, না ফুর্তি মেরে টাকা ওড়াচ্ছে। শেষে হারামজাদি মেয়েটাই রথীনকে লোক দিয়ে মার্ডার করিয়েছিল। বটুক এমন পাপিষ্ঠ যে খবর শুনেও চুপ করে রইল। সাধে কি আমি ওঁকে ঘেন্না করতাম।
চন্দ্রিকাকে রাঙাটুলিতে শেষ কবে দেখেছেন?
অমরেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, চন্দ্রিকা–আপনি চন্দ্রিকাকে চিনতেন নাকি?
একটু-আধটু।
পরশু হরনাথ এসেছিল। বলছিল, চন্দ্রিকা নাকি মার্ডার হয়েছে। হতোই। জীবন নিয়ে জুয়োখেলা–মেয়ে হয়ে! পাপের শাস্তি। কী বলেন?
কনেল বললেন, চন্দ্রিকা হরনাথবাবুর কাছে সম্প্রতি এসেছিল কি না জানেন? এলে হরনাথবাবু আপনার কাছে নিশ্চয় গোপন কবেন না?
অমরেন্দ্র চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন, মাসখানেক আগে রাত্রে এসে রাত্রেই কলকাতা চলে গিয়েছিল। হরনাথ বলেছিল, বাবা-মায়ের জিনিসপত্র নিতে এসেছিল চন্দ্রিকা।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, এক চক্কর ঘুরে আসি।
অমরেন্দ্র ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিছু খাওয়া-দাওয়া না করে বেরোবেন কী! সুনন্দা হয়তো আপনাদের জন্য খাবার তৈরি করছে। এক মিনিট!
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, পৌনে পাঁচটা বাজে। এখনই না বেরোলে ময়। আপনি সুনন্দাকে বলুন, ফিরে এসে একেবারে ডিনারে বসব। জয়ন্ত, উঠে পড়ো। ….
নিচের রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, তা হলে চিচিং ফাঁক রহস্য ফাঁস হলো।
অবাক হয়ে বললাম, কৈ ফাঁস হলো?
ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট।
তার মানে?
তার মানে চিচিং ফাঁক রহস্য। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন। একটা রিকশো পেলে ভাল হতো। হরনাথবাবুর ফার্ম প্রায় দেড় কিমি দূরে।
কিন্তু ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট–
ব্রিটিশ আর্মির গুপ্তধনের নকশা ওটার মধ্যেই আছে। ওটা ক্যাসেট নয়। কোনও শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি একই গড়নের আধার।
কী সর্বনাশ। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়, ডার্লিং! চটপট হাঁটো!
বেলা পড়ে এসেছে। রোদের রঙ ঝিমধরা। এখনই গাছপালা আর উঁচু-নিচু টিলার মাথায় আবছা কুয়াশা ঘনিয়ে এসেছে। কিছুটা পথ দুধারে ঘন জঙ্গল। তারপর বাঁ দিকে সামান্য দূরে কয়েকটা একতলা ঘর এবং কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ফসলের খেত দেখা গেল। বেড়াটা রাস্তার সমাালে এগিয়ে গেছে। আরও কিছুটা নার পর একটা ছোট্ট নদী দেখতে পেলাম। রাস্তাটা বাঁক নিয়ে কাঠের পোল পেরিয়ে গেছে। কাঠের পোলে দাঁড়িয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে ফার্মটা দেখতে থাকলেন। কোথাও জনমানুষ নেই। ফার্মের জমিতেও কোনও লোক নেই। থাকলেও খালি চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটু হেসে বললেন, হালদারমশাই শেষ রক্ষা করতে পারেন কি না দেখা যাক।
কৈ হালদারমশাই?
ফার্ম হাউসের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন আর এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে হাতমুখ নেড়ে গল্প করছেন। হরনাথবাবুর স্ত্রী ছাড়া আর কে হতে পারেন?
দেখি। বাইনোকুলারটা দিন।
কর্নেল বাইনোকুলার দিলেন না। বললেন, ডিস্কোর চেলাদের চোখে পড়ে যাব। চলল, নদীর ধারে নেমে যাই। ফার্মের একটা গেট আছে নদীর ধারে। ভেতরে ঢোকা যায় কি না চেষ্টা করা যাবে।
নিচে বড় বড় পাথর এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। মাঝেমাঝে কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। কিছুদূর চলার পর ফার্মের কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেল। তারপর লোহার গরাদ দেওয়া ছোট একটা গেট চোখে পড়ল। গেটের দুপাশে ঘন ঝোপঝাড়। কর্নেল ইশারায় গুঁড়ি মেরে বসতে বললেন। নিজেও বসলেন। তারপর বাইনোকুলারে চোখ রেখে ফার্মের ভেতরটা দেখতে থাকলেন।
একটু পরে বললেন, হালদারমশাই মই যোগাড় করেছেন। হয়তো ফার্ম হাউসেই মইটা ছিল। কিন্তু উনি সঠিক গাছ এবং সঠিক অর্কিড চিনতে পারবেন কি?
পিঠের কিটব্যাগটি নামিয়ে কর্নেল চেন খুলে একগোছা চাবি বের করলেন। গেটের ওপাশে লটকানো লাটার মধ্যে কয়েকটা চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করে বললেন, নাহ্। বেয়াড়া তালা। বরং কাঁটাতার কেটেই ঢোকা যাক।
কিটব্যাগ থেকে বেঁটে এবং চ্যাপ্টা একটা সাঁড়াশির মতো জিনিস বের করে পাশের কয়েকসারি তার কেটে ফেললেন। তারপর তারগুলো দুমড়ে সরিয়ে বললেন, কুইক! গুঁড়ি মেরে এস। বাঁদিকের ঝোঁপের আড়ালে এগোতে হবে।
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, এই বিশ্রী অ্যাডভেঞ্চার না করে সোজা ফার্ম হাউসের বড় গেট দিয়ে ঢুকলে কী ক্ষতি হতো?
ডিস্কোর লোকেরা ওখানেই নজর রেখেছে। কারণ অর্কিডটা কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না, তারা নিশ্চয় দেখতে চাইবে। সেখানে আমার এই মার্কামারা চেহারা হরনাথবাবুর পক্ষে ক্ষতিকর। ভুলে যেও না, ডিস্কো আমাকে জানিয়ে রেখেছে। হরনাথবাবুকে কেন সে কিডন্যাপ করল। কর্নেল দাড়ি থেকে একটা পোকা বের করে একটু হাসলেন। দাড়ির এই সমস্যা! পোকামাকড় নিয়ে একটুআধটু চৰ্চা করি বলেই কি না জানি না, ওরা আমার দাড়িতে ঢুকে থাকতে ভালবাসে।
আলে দ্রুত কমে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে সাপের ভয়ে চমকে উঠছি। কিন্তু এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। আমার বৃদ্ধ বন্ধু নাকি সাপের গন্ধ টের পান। ব্যাপারটা সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক, এ পর্যন্ত কখনো এধরনের অ্যাডভেঞ্চারে সাপের পাল্লায় পড়িনি।
এদিকটায় পাথর পড়ে আছে জায়গায় জায়গায়। পাথরের ফাঁকে ঝোপ গজিয়েছে। পাথরের জন্যই এ দিকটায় চাষবাস করা হয়নি। ক্রমশ একটা দুটো করে গাছ দেখা গেল। তারপর ঘন গাছের জঙ্গল। তবে তলাটা পরিষ্কার। কোনও ঝোপঝাড় নেই। অসমতল মাটি। বড় বড় পাথর। হালদারমশাই ফার্মের এই জঙ্গলটার কথাই বলেছিলেন।
গাছপালায় পাখিরা তুমুল হল্লা জুড়েছে। আবছা আঁধারে গুঁড়ি মেরে এগোতে এগোতে পায়ে আর পিঠে ব্যথা ধরে যাচ্ছিল। অবশেষে কর্নেল থামলেন। চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই কাছাকাছি কোথাও আছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন। ফার্মের লোকেদের মধ্যে ডিস্কোর চর আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। না থাকলে ডিস্কো মুক্তিপণ হিসেবে পরগাছা দাবি করত না। সে জেনে ফেলেছে, কোথায় জিনিসটা লুকোনো আছে। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। গাছের গুঁড়ির আড়ালে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম।
এতক্ষণে হালদারমশাইয়ের কথা কানে এল। ভাইটি! দ্যাখবেন য্যান পাও হড়কাইয়া না যায়। ওঠেন! টাইম নষ্ট করবেন না।
কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, হালদারমশাই করছেন কী! নিজে মইয়ে উঠছেন না। লোকটা যদি ডিস্কোর চর হয়, তা হলে কেলেংকারি!
হালদারমশাইয়ের কথা শোনা গেল। ডগায় ওঠেন। এক্কেরে পিকে। কাটারি দিয়া গোড়ায় কোপ মারবেন। নিচে ফ্যালাইবেন। হেভি পরগাছা।
সামনে কোথাও কোনও গাছের ডগায় কাটারির কোপ মারার শব্দ শোনা গেল। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, জিনিসটা ছিটকে পড়ে যেতে পারে। খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। করছেন কী হালদারমশাই? এস তো, দেখি।
আমরা কয়েক পা এগিয়েছি, সামনে গাছের ডালপালার ভেতর সড়সড় শব্দ হলো। তারপর টর্চের আলো জ্বলে উঠল। হালদারমশাই বললেন, যাঃ! আটকাইয়া গেল যে ভাইটি। এক কাম করেন। সিঁড়ি থাক। ডালে পাও দিয়া-হঃ। আমি আলো দেখাইতাছি।
টর্চের আলোয় উঁচু ডালে আটকেপড়া প্রকাণ্ড একটা ফুলন্ত অর্কিডের ঝাড় দেখা যাচ্ছিল। হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরা একটা লোক কাটারি হাতে মই থেকে ডালে পা। রাখার চেষ্টা করছিল। অনেক কসরত করে সে পা রাখল। তারপর কাটারি দিয়ে ঠেলে অর্কিডটা ফেলে দিল। দেখলাম, টর্চ জ্বেলে লম্বা পায়ে হালদারমশাই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। গাছ থেকে লোকটা প্রায় চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল, আলো দেখান! আলো দেখান। নামব কী করে?
হালদারমশাই আলো ফেললেন গাছের ডগায়। তাঁর এক গ্রতে টর্চ, অন্য হাতে অর্কিডের প্রকাণ্ড ঝাড়টা উল্টো হয়ে ঝুলছিল। সেটা একটা বস্তায় ভরলেন। তারপর আলো দেখালেন। লোকটা অনেক চেষ্টার পর মই বেয়ে নেমে এল। হালদারমশাই বললেন, সিঁড়িখান লইয়া যান। মাঠানেরে কইবেন, চিন্তার কারণ নাই। আমি যাই গিয়া।
লোকটা মই নামিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল। অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল মইটার। হালদারমশাই টর্চের আলো জ্বেলে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই বুদ্ধিমান। ওঁর টর্চের আলোয় দেখলাম, গাছটার গায়ে একটা স্বস্তিকাচিহ্ন খোদাই করা আছে। কাজেই সঠিক গাছ এবং সঠিক অর্কিড।
কর্নেল সাবধানে পায়ের কাছে টর্চ ফেলে এগিয়ে গেলেন সেই গাছটার দিকে। তারপর যেখানে অর্কিডটা পড়েছিল, সেখানে আলো ফেললেন। ভেঁড়াখোঁড়া ফুল আর কিছু পাতা পড়ে আছে। কর্নেল মাটির ওপর আলো ফেলে ডানদিকে এগিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কর্নেল এদিকে-ওদিকে আলো ফেলতে ফেলতে একজায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, কানের ভুল হতেও পারে। কী একটা শব্দ শুনেছিলাম-শব্দটা অন্যরকম।
বললাম, আমি শুধু অর্কিড পড়ার শব্দ শুনেছি।
নাহ্। আমি আরও একটা শব্দ শুনেছি। কর্নেল একটু এগিয়ে গেলেন। তারপর সামনে ঝুঁকে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, পাওয়া গেল। কিন্তু এবার হালদারমশাই বিপদের মুখে পড়লেন। হরনাথবাবুর অবস্থাও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। জয়ন্ত! কুইক!…
.
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখলাম, দিনের আলো তখনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তবে ফার্মের মাঠে আলো জুগজুগ করছে কাছে ও দূরে। যেখানে বড় বড় পাথর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেখানে পৌঁছে কর্নেল হাঁটু দুমড়ে বসলেন। আমিও বসে পড়লাম। কর্নেলের হাতে ফিকে হলুদ রঙের একটা মোড়ক। ভিডিও। ক্যাসেটের সাইজ মোড়কটার এক দিকে টেপ সাঁটা। কর্নেল টেপ ছিঁড়ে মোড়কটা খুললেন। কালো রঙের চৌকো একটা জিনিস বেরুল। ওটার একদিকে গোল চাকতি বসানো। কর্নেল প্যাকেটের ভেতরপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। দেখামাত্র চিনতে পারলাম। এই চিরকুটটাই চন্দ্রিকার পার্সে লুকোনো ছিল।
কর্নেল চিরকুটটা দেখে নিয়ে গোল চাকতিটা ঘোরাতে থাকলেন। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, তালা খোলার কোড নাম্বার। তাই না?
হ্যাঁ T.L-2. R-3. L-l. R-4, ব্যাপারটা সোজা। কর্নেল শেষবার চাকতিটা ঘোরানোর পর ওপরের ডালাটা খুলে গেল। ভেতরে আবার একটা প্যাকেট দেখতে পেলাম। কর্নেল সেটা তুলে জ্যাকেটের ভেতরপকেটে চালান করে ডালা বন্ধ করে দিলেন। খুট করে শব্দ হলো। কর্নেল বললেন, T হলো Turn. অর্থাৎ ঘোরাও। L হলো Left এবং R হলো Right. তার মানে প্রথমে চাকতিটা বাঁদিকে ২নম্বর পর্যন্ত ঘোরাও। তারপর ডানদিকে ফের ঘোরাও ৩নম্বর পর্যন্ত। আবার বাঁদিকে ১ নম্বর পর্যন্ত ঘুরিয়ে ডানদিকে ৪ নম্বর পর্যন্ত ঘোরালেই তালা খুলে যাবে। মন্দিরে পৌঁছুবার আগেই হালদারমশাইকে ধরতে হবে।
নদীর ধারের ছোট গেটটা এবার ভেজানো দেখতে পেলাম। বোঝা গেল, হালদারমশাই চাবি নিয়ে এসেছেন ফার্ম হাউস থেকে। গেট দিয়ে বেরিয়ে কর্নেল হালদারমশাইকে খুঁজছিলেন। একটু পরে বললেন, ব্রিজের ওধারে দাঁড়িয়ে আছেন দেখছি। কোনও মতলব ভঁজছেন সম্ভবত।
আমরা নদীর ধারে ধারে ঝোপজঙ্গলের আড়ালে হন্তদন্ত এগিয়ে কাঠের ব্রিজে পৌঁছুলাম। ব্রিজের ওপারে একটা প্রকাণ্ড পাথরের কাছে হালদারমশাইয়ের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল। কাছাকাছি গিয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই।
গোয়েন্দা ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন। আইয়া পড়ছেন? ভেরি গুড। বলে সেই পরগাছার ঝাড়টা তুলে ধরলেন। পরগাছা চায় কিডন্যাপার। হরনাথবাবুরে দিয়া চিঠি লিখছে–
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পরগাছার ভেতর এই জিনিসটা ঢুকিয়ে নিয়ে যান।
অ্যাঁ? ক্কী কইলেন?
কর্নেল সেই চৌকো কৗটোটা ওঁর হাতের পরগাছার ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর কিটব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি বের করে বেঁধে ফেললেন ওটা। হালদারমশাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, সময় হয়ে গেছে। এবার শীগগির ভবানীমন্দিরে চলে যান। পরগাছাটা রেখেই চলে আসবেন কিন্তু।
বাট হোয়াট ইজ দ্যাট থিং কর্নেলস্যার?
টাইমোমা।
অ্যাঁ? খাইছে! খি-খি করে হেসে উঠলেন গোয়ন্দাপ্রবর।
কুইক! রেখেই চলে আসবেন।
পথে বার্স্ট করবে না তো?
নাহ্।
হালদারমশাই আবছা আঁধারে গাছপালার ভেতর দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল বললেন, চিলোফেরা যাক।
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, গুপ্তধনের নকশা দিলেন না। কিন্তু রাত দশটায় চিচিং ফাঁক অর্থাৎ ওই কোড নাম্বারটা ডিস্কোকে দেবেন। আমার মনে হয় না ডিস্কো এত বোকা যে কোড নাম্বারের সাহায্যে কৌটো খুলেই যখন দেখবে কিছু নেই, তখন ক্ষেপে গিয়ে হরনাথবাবুকে নির্ঘাৎ খুন করে ফেলবে।
কর্নেল বললেন, চুপচাপ এস। ও সব কথা পরে হবে।
অমরেন্দ্র সিংহরায়ের বাড়ির কাছে পৌঁছে কর্নেল বললেন, তুমি গিয়ে রায়সায়েবের সঙ্গে গল্প করো। বলবে, আমার চুরুট ফুরিয়ে গেছে বাজারে আনতে গেছি।
উনি হন হন করে এগিয়ে গেলেন। গেটে উঠে দেখলাম, বাড়ির চারদিকে আলো জ্বলছে। বারান্দায় চেয়ারে একা বসে আছেন রায়সায়েব। আমি সাড়া দেবার আগেই দেখতে পেয়ে হাঁকলেন, বেচু! তালা খুলে দে।
গেটটা সবসময় তালাবন্ধ থাকে দেখছি। বাড়ির চারদিকে আলোর ব্যবস্থা করার কারণ সম্ভবত ভৌতিক উৎপাত। কিন্তু কর্নেল যে বললেন দুটো ভূতকে পকেটস্থ করেছেন, তার মানে কী?
বেচু তালা খুলে বলল, কর্নেলসায়েব কোথায় গেলেন?
বললাম, চুরুট কিনতে।
বেচু বলল, আমাকে বললেই তো এনে দিতাম।
অমরেন্দ্র শুনতে পেয়ে বললেন, কর্নেলসায়েবের চুরুট তুই আনতিস? চিনিস উনি কী চুরুট খান? খালি সবতাতেই ফেঁপরদালালি। যা! জয়ন্তবাবুর জন্য খাবার নিয়ে আয়। খিদে পেয়েছে ওঁর।
বারান্দায় উঠে বললাম, নাহ্। খিদে পায়নি। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
কতদূর ঘুরলেন?
চেয়ারে বসে বললাম, নদীর ব্রিজ অব্দি। কর্নেলের বাতিক তো জানেন। পাখি প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ালেন। তারপর হঠাৎ খেয়াল হলল, চুরুট ফুরিয়ে গেছে।
বেচু দাঁড়িয়ে গাল চুলকোচ্ছিল। অমরেন্দ্র বললেন, কী রে? দাঁড়িয়ে থাকবি না এঁর জন্য চা-কফি কিছু আনবি?
বেচু বলল, চা খাবেন, না কফি খাবেন স্যার?
বললাম, বরং কড়া করে এক কাপ চা আনো।
বেচু চলে গেল। অমরেন্দ্র হাসলেন। হ্যাঁ। বাইরে বেড়িয়ে এসে কড়া চা আমারও খুব পছন্দ। কর্নেলসায়েব কেন যে শুধু কফি খেতে ভালবাসেন, বুঝি না।
ওঁর মতে, কফি নাকি নার্ভকে চাঙ্গা করে।
অমরেন্দ্র খুব হাসলেন। কে জানে। যার যাতে অভিরুচি। গম্ভীর মুখে চাপা স্বরে ফের বললনে, কর্নেলসায়েব হরনাথের ফার্মে যাননি।
না তো।
ভবানীমন্দিরে?
নাহ। উনি বলছিলেন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ যখন এসে গেছে, তিনিই হরনাথবাবুকে উদ্ধার করে ফেলবেন।
অমরেন্দ্র একটু চুপ করে থেকে বললেন, হরনাথ সেদিন কলকাতার এক ভদ্রলোককে আমার বাড়িতে এনেছিল। লম্বা গড়ন। পেল্লার গোঁফ আছে। ইস্টবেঙ্গলের লোক। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, তিনিই কি ডিটেকটিভ? কিন্তু হরনাথ কেন ডিটেকটিভ ভাড়া করবে? কোনও বিপদ আঁচ করেছিল নাকি? অথচ আমাকে কিছু জানাল না, এটাই আশ্চর্য!
বেচু ঝটপট চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনার অ্যালসেসিয়ানটা মারা গেছে শুনলাম। বেচু বলছিল।
হ্যাঁ। বিমর্ষ মুখে অমরেন্দ্র বললেন, ভুলটা আমারই। কিছুদিন থেকে কেমন ঝিম ধরে বসে থাকত। রাত্রে অত অদ্ভুত কাণ্ড হতো। সাড়া দিত না। তখন বুঝিনি জনি অসুস্থ। আসলে ওর দিকে ইদানিং তত লক্ষ্য ছিল না। ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা নিয়েই মাথা ঘামাতাম।
অমরেন্দ্র এবার তার প্রিয় কুকুরের জীবনী এবং তার পরিবারের ইতিহাস শোনাতে শুরু করলেন। শেষে নিজের রাজনৈতিক কীর্তিকলাপের কাহিনীর পাতা খুললেন। বটুক চৌধুরী ছিলেন তার বন্ধু। হঠাৎ বটুকবাবু দল বদলে তার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। শালা-ভগ্নিপতির এই লড়াই নিয়ে লোকে ঠাট্টা তামাশা করত। তাই রাজনীতি ছেড়ে দেন অমরেন্দ্র।
বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। কর্নেল ফিরলেন প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে। ফিরেই বললেন, রায়সায়েব, ডিনার খাব কিন্তু রাত নটায়। তারপর আবার বেরুতে হবে।
অমরেন্দ্র বেচুকে ডেকে তাড়া দিলেন। তারপর আমাদের সেই ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, সুনন্দার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। এদিকে সতুর মতিগতিও ভাল ঠেকছে না।
কর্নেল বললেন, কেন?
অমরেন্দ্র চাপা স্বরে বললেন, কোনওদিন বাড়ি ফেরে, কোনওদিন ধানবাদে থেকে যায়। আজ বলে গেছে বাড়ি ফিরবে না। চেহারা দেখে মনে হয়, নেশা-ভাং ধরেছে। কোনদিক সামলাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি আসছি। কফি বলব নাকি?
থাক। বাজারে একটা কাফে সেন্টার দেখলাম। সেখানেই কফি খেয়ে নিয়েছি।
অমরেন্দ্র হাসলেন। ভিডিও সেন্টার বলুন! আজকাল এই এরিয়ায় কাফে সেন্টার, কফি হাউস অনেক হয়েছে। সব কিন্তু বুঝলেন তো? ব্লু ফিল্মের বদমাইশি।
.
কর্নেল ঘরের দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসলেন। আমি বাথরুমে গিয়ে মুখহাত রগড়ে লাম। ক্লান্তি চলে গেল। একটু পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, কর্নেল একটা খুদে ক্যাসেট এবং একটা গোল ছোট্ট কী যন্ত্র টেবিলে রেখে খুঁটিয়ে দেখছে। এলাম, কী ওগুলো?
কর্নেল হাসলেন। সেই ভূত দুটো।
ভূত দুটো তার মানে?
তুমি হলঘরে কালো ঘেঁড়া তারটা দেখেছিলে। বরগার খাঁজে গোল দাগটা লক্ষ্য রোনি। এটা একটা খুদে মাইক্রোফোন। আর এটা একটা টেপ। টেপরেকর্ডারে ঢুকিয়ে সুইচ অন করলে নানারকম ভৌতিক শব্দ শোনা যাবে। একটা বিদেশি সাউণ্ডরেকর্ড। আমেরিকায় দেখেছি, হ্যালোউইন পরবের রাত্রে ছোট ছেলেমেয়েরা এটা বাজিয়ে বড়দের ভয় দেখায়।
কোথায় পেলেন ও দুটো?
কালো তারটা সত্যকামের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে দেখে মাস্টার কী দিয়ে ওর ঘরের তালা খুলেছিলাম। বিছানার তলায় পেয়ে গেলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ? আমি আসব শুনেই সত্যকাম খুদে মাইক্রোফোনটা খুলে নিয়েছিল। তাই আর ভূতের উপদ্রব হচ্ছিল না।
শুনে চমকে উঠেছিলাম। বললাম, সত্যকাম ডিস্কোর চেলা হয়েছে?
টাকার লোভে হয়েছে। তাছাড়া ডিস্কো ওর চেনা লোক। একটা চিঠিও উদ্ধার করেছি বিছানার তলা থেকে। ডিস্কো খবর পেয়েছিল নক্সাটা হরনাথ রায়সায়েবের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ডিস্কো একটা ভুল করেছিল। চিচিং ফাঁক কথাটা হরনাথ জানেন এবং তার বন্ধুকেও জানিয়েছেন ভেবেছিল ডিস্কো। আমার ধারণা, চন্দ্রিকা নকশাটা জ্যাঠার কাছে গোপনে রেখে গেলেও ওটার সাংকেতিক নাম যে চিচিং ফাঁক, তা বলেনি।
চিঠিটা দেখি।
কর্নেল বললেন, যথাসময়ে দেখাব। ব্যস্ত হয়ো না। বলে চুরুট ধরিয়ে কিটব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজ বের করলেন। সেই কাগজে খুদে টেপ এবং মাইক্রোফোনটা প্যাকেটবন্দি করে সুতো দিয়ে পরিপাটি করে বাঁধলেন। তারপর ডটপেনে বড় বড় হরফে প্যাকেটের ওপর লিখলেন, সত্যকামকে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের উপহার।
বললাম, এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, কুকুরটাকে সত্যকামই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
হ্যাঁ। সম্ভবত কালো বেড়ালটা এ বাড়িতে আনাগোনা যাতে নির্বিবাদে করতে পারে, সেজন্যই কুকুরটাকে মেরে ফেলার দরকার ছিল। কালো বেড়ালের রক্ত খাওয়া এবং যাতায়াত ভৌতিক রহস্যকে জমজমাট করে ফেলেছিল। অসহায় রোগা কুকুরটা চুপচাপ দেখত। দৃশ্যটা কল্পনা করা যায়! কর্নেল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। থাক ও সব কথা। এবার শেষরক্ষা কীভাবে হয়, সেই চিন্তা। হালদারমশাই কোনও বিভ্রাট বাধালেই সমস্যায় পড়ব।
কতক্ষণ পরে হলঘরের দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে নটা বাজল। বেচু দরজার কড়া নেড়ে ডাকল, খাবার রেডি স্যার!
কর্নেল কিটব্যাগ হাতে নিয়ে দরজা খুললেন। ইশারায় আমাকেও আমার কিটব্যাগটা নিতে বললেন। আমরা ডাইনিং রুমে ঢুকলে বেচু বললু, দিদিমণির হঠাৎ শরীর খারাপ। কর্তামশাই ওনার ঘরে বসে আছেন। বললেন, একটু পরে আসবেন। আপনারা খেয়ে নিন।
কর্নেল বললেন, বেচু! এই প্যাকেটটা তুমি সত্যকামকে, দেবে। খুলো না যেন। মন্ত্র ভরা আছে। বিগড়ে যাবে। অনেক দাম।
বেচু সেই প্যাকেটটা ফ্রিজের মাথায় যত্ন করে রেখে দিল।
খাওয়া সেরে কর্নেল বললেন, কর্তামশাইকে বোলো, বেরুচ্ছি। যদি রাত্রে আর না ফিরি, যেন চিন্তা না করেন।
বেচু গম্ভীর মুখে বলল, এত রাত্তিরে কোথায় যাবেন স্যার?
কলকাতায় যাত্রা শুনতে।
বেচু হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দরজার পাশ থেকে একটা লাঠি নিয়ে হাঁক ছাড়ল, তবে রে! ভারি মজা পেয়ে গেছ। তাই না? সে তাড়া করে গেল।
সেই কালো বেড়ালটাকে জানালা গলিয়ে পালাতে দেখলাম। …
.
জানতাম, কর্নেলের গন্তব্য ভবানীমন্দির। তাই কোনও প্রশ্ন করিনি। নদীর ব্রিজ পৈরিয়ে রাস্তা ডানদিকে মোড় নিয়েছে। কর্নেল বাঁদিকে খোলামেলা মাঠে হাঁটতে থাকলেন। অন্ধকারে উনি নাকি দিব্যি দেখতে পান। আমি পাই না। সাবধানে পা ফেলে ওঁকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছিলাম।
মাঠটা ঢালু হয়ে নেমেছে। বারকয়েক হোঁচট খেলাম। তারপর অন্ধকারে জমাট কালো একটা জঙ্গলে ঢুকলাম। কর্নেল আস্তে বললেন, আমাকে ছুঁয়ে এস। নইলে হারিয়ে ফেলবে।
বললাম, আর কতদূর?
কাছেই।
জঙ্গল শেষ হলো। একটা খোলামেলা জায়গায় পৌঁছে কর্নেল আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, সামনে উঁচু চত্বর আছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকব চত্বরের নিচে। তুমি চত্বরের তলায় গুঁড়ি মেরে বসবে। টর্চ রিভলভার তৈরি রেখো।
চত্বরটা নক্ষত্রের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল গিয়ে ধাপের কাছে পড়ালেন। পাশে আমি গুঁড়ি মেরে বসলাম। চারপাশে পোকামাকড়ের ডাক। একটা প্যাঁচা কর্কশ শব্দে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। তারপর দূরে শেয়ালের ডাক শোনা গেল।
কর্নেল লাইটার জ্বেলে চুরুট ধরালেন। তারপর আস্তে ডাকলেন, মিঃ ডিস্কো!
কোনও সাড়া এল না।
আবার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ডাকলেন, মিঃ ডিস্কো! আর য়ু দেয়ার?
এবার চাপা গলায় সাড়া এল, কর্নেল সরকার!
আসুন। ভদ্রলোকের চুক্তি মিঃ ডিস্কো।
আপনি ওটা ওখানেই এক টুকরো পাথরে চাপা দিয়ে রেখে যান।
কিন্তু হরনাথবাবুকে যে ফেরত চাই।
ফার্ম হাউসে গিয়ে অপেক্ষা করুন। পেয়ে যাবেন।
দুঃখিত মিঃ ডিস্কো! ভদ্রলোকের চুক্তি। এমন তো কথা ছিল না।
কী কথা ছিল?
আপনি যা লিখেছিলেন পড়ে শোনাব?
অত সময় নেই। তাড়াতাড়ি করুন।
আপনি লিখেছিলেন, জিনিসটা আপনার হাতে পৌঁছে দিতে। আপনার হাতেই তা তুলে দিতে চাই।
চালাকি ছাড়ুন। আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারবেন না। চারদিকে আমার লোক তৈরি আছে।
আমি চালাকি করছি না। আমি আপনার বুদ্ধির চাতুর্যে মুগ্ধ। তাই আপনার হাতের স্পর্শ পেতে চাই মিঃ ডিস্কো!
দেরি করবেন না। বিপদে পড়বেন তা হলে।
আপনি টর্চের আলোয় দেখুন, আমি নিরস্ত্র। আমার হাতে সেই কোড নাম্বার লেখা কাগজ। আপনার দেখা উচিত, কাগজটা জাল, কি না। আপনি ওটা দেখলেই চিনতে পারবেন। কারণ চন্দ্রিকা আপনাকে নিশ্চয়ই ওটা দেখিয়াছিল!
দেখায়নি।
আই রিপিট মিঃ ডিস্কো, দেখিয়েছিল। কিন্তু তখন আপনি বুঝতে পারেননি ওটা কী।
একটু পরে ডিস্কোর কথা শোনা গেল, কে বলল আপনাকে?
আপনিই বলেছিলেন আমাকে। তবে পরোক্ষ।
ননসেন্স! দেরি করবেন না।
মিঃ ডিস্কো! আপনি কি জিজ্ঞেস করেননি আমাকে চন্দ্রিকার পার্সের কথা?
ড্যাম ইট! এক মিনিট সময় দিচ্ছি।
ঠিক আছে। আপনার কথামতো পাথর চাপা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। কর্নেল টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে এক টুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলেন। তারপর উঁচু চত্বরের ওপর হতে বাড়িয়ে সেই চিরকুটটা রেখে পাথর চাপা দিলেন। উত্তেজনায় আমি ততক্ষণে একটু উঠে দাঁড়িয়ে চত্বরের কিনারায় উঁকি দিয়েছিলাম। দেখে নিয়েই বসে পড়লাম।
আলো নিভিয়ে কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে চত্বর থেকে দূরে গেলেন, যেন ফিরে চলেছেন। চত্বরের পিছন থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে পড়ল। তারপরই আলোটা নিভে গেল। চাপা শব্দ শুনতে পেলাম চত্বরের ওপর। পাথরটা গড়িয়ে ফেলে দিয়ে কেউ কাগজটা তুলে নিল।
সেই সময় কর্নেলের চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ঠিক সেই কাগজটা তো মিঃ ডিস্কো?
ইউ ব্লাডি ওল্ড হ্যাগার্ড! এখনও চলে যাওনি তুমি?
টর্চের আলো পড়তে থাকল চারদিকে। কিন্তু কোথাও কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম পাথরের আড়ালে বা ধ্বংসস্তূপের পিছনে কোথাও আছেন। আমি চত্বরের নিচে গুটিসুটি বসে আছি। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না।
হঠাৎ আমাকে স্তম্ভিত করে কর্নেল বলে উঠলেন, ইন্দ্রজিৎবাবু! দা গেম ইজ ওভার। ফায়ার আর্মস্ ফেলে দিন। পুলিশ আপনাকে ঘিরে ফেলেছে।
চারদিক থেকে ঝলকে ঝলকে টর্চের আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। চত্বরে কেউ নেই। কর্নেলকে ছুটে আসতে দেখলাম। এদিক ওদিক থেকে পুলিশও এগিয়ে আসছিল বন্দুক তাক করে। তারপরই মন্দিরের পেছনদিকে হালদারমশাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। কর্নেলস্যার! কর্নেলস্যার! হালারে ধরছি।
কয়েকটা উজ্জ্বল সার্চলাইট জ্বলে উঠল। চত্বরের ধাপ বেয়ে উঠে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। বিধ্বস্ত বিশাল মন্দিরের গা ঘেঁষে একটা বটগাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার তলায় হালদারমশাই ডিস্কো-কে মাটিতে পেড়ে ফেলে বুকের ওপর বসে আছেন। তাঁর দুটো পা ধরাশায়ী ডিস্কোর দুই হাতের ওপর।
ডিস্কোরর মুখে মুখোশ আঁটা। কর্নেল কাছে গিয়ে বললেন, অশোকবাবু, রথীন চৌধুরী, স্বপন দাশ এবং চন্দ্রিকা রায়ের খুনী ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকে গ্রেফতার করুন। সাবধান! আগে হ্যাণ্ডক্যাপ পরিয়ে দিন।
কলকাতা থেকে পুলিশের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোক গুপ্ত সদলবলে এসে পড়েছেন, এটা কর্নেলেরই পরিকল্পনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। সৌরভ-নাট্যগোষ্ঠীর নাট্যকার পরিচালক-অভিনেতা এবং প্রাক্তন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিই যে স্বয়ং ডিস্কো, এটা আমার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য। একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? মুখোশের আড়ালে নিশ্চয় অন্য কোনও মুখ আছে।
হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তাগড়াই পুলিশেরা হাতকড়া পরিয়ে ডিস্কোকে টেনে ওঠাল। তখন কর্নেল ডিস্কোর মুখোশটা এক টানে খুলে নিলেন। এবার স্পষ্ট ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিকেই দেখলাম। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ইন্দ্রজিৎবাবুর চোখমুখ ফাঁদে পড়া শ্বাপদের মতো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ছেন।
হালদারমশাই খি-খি করে হেসে বললনে, পরগাছা হেই চত্বরে রাইখ্যা চিন্তা করলাম, কোন হালা আইয়া পরগাছা লয় দেখা উচিত। টাইমবোমা ফাটব কইছিলেন। তাই ঘুর পথে বনবাদাড় দিয়া ফিরিয়া আইলাম। হেই গাছে চড়লাম, কিছুক্ষণ পরে চত্বরে আলো পড়ল। দুইজন আইছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার দুটো লম্বা আঙুল দেখালেন। একজন কইল, তুমি গাড়ির কাছে যাও। বুড়া রাত্র দশটায় আইব। আমি ওয়েট করি। হঃ। এই হালা! বলে প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন হালদারমশাই। ফের চিন্তিতমুখে বললেন, টাইম যোমা ক্যান ফাটল না?
কর্নেল বললেন, বিগড়ে গেছে হালদারমশাই।
অশোকবাবু বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবু! হাইওয়েতে আপনার গাড়িটা আমরা অলরেডি সিজ করেছি। আপনার দুই চেলা ছিল। তারা এতক্ষণ থানার হাজতে। আপনার আরও তিনজন লোককে রাত আটটায় নদীর ব্রিজেই পাকড়াও করেছি। আপনাকে ডি সি ডি. ডি লাহিড়িসায়েব জানাতে বলেছেন, তিনি আর আপনার বন্ধু নন।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির পোশাক হাতড়ে কর্নেল কালো কৌটোটা খুঁজে বের করে ঝটপট তালা খুলে ভেতরটা দেখালেন। বললেন, দেখছেন তো ইন্দ্রজিত্বাবু! এতে কোনও নকশা নেই! কাজেই অযথা হরনাথবাবুকে আটকে রেখে লাভ নেই। বলুন, তাঁকে কোথায় রেখেছেন?
অশোকবাবু একটু হেসে বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর গাড়িতেই হরনাথবাবুকে আমরা উদ্ধার করেছি। হাত-পা বাঁধা এবং মুখে টেপসাঁটা অবস্থায় গাড়ির ভেতরে ওঁকে ফেলে রেখে পাহারা দিচ্ছিল দুই চেলা। ডিস্কোসায়েব গিয়ে এবার নিশ্চয় হরনাথবাবুকে মুক্তি দিতেন। চলুন, থানায় ফেরা যাক।
কর্নেল বললেন, আপনারা তো হাইওয়ের দিকে যাবেন। আমি আর ওদিকে যাচ্ছি না। ফরেস্ট বাংলো বুক করা আছে। সেখানেই উঠব। কলকাতা ফিরে দেখা হবে।
অশোকবাবু সদলবলে আসামীকে নিয়ে সার্চ লাইটের আলোয় জঙ্গল প্রায় জ্বালিয়ে দিতে দিতে চলে গেলেন।
.
ব্রিজের কাছে এসে হালদারমশাই বললেন, আমি আমার ক্লায়েন্টের ফার্মে যাই গিয়া। ওনার ওয়াইফেরে দিদি কইছি। বোঝলেন না? নিজের হাতে রান্না কইরা খাওয়াইবেন কইছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার অনবদ্য খি-খি খুশির হাসি হেসে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলেন। দেখতে দেখতে টর্চের আলো মিলিয়ে গেল।
কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম, ফরেস্ট বাংলো কত দূর? আমার ঠ্যাং দুটোয় জ্যাম ধরে গেছে।
কর্নেল বললেন, কাছেই। ওই দেখ, আলো জ্বলছে। নদীর ধারে টিলার ওপর অসাধারণ একটা রিসর্ট।
চড়াই ভেঙে বাংলোয় পৌঁছুতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। চৌকিদার প্রতীক্ষা করছিল কর্নেলের। আমরা বারান্দায় বসার পর সে শীগগির কফি করে আনল। কর্নেলের সঙ্গে তার কতাবার্তা শুনে বুঝলাম আজ রাত্রে যে কোনও সময়ে কর্নেল পৌঁছুবেন বলে খবর পেয়েছিল সে। তাই বাড়ি চলে যায়নি। এ-ও বুঝলাম, কর্নেল তার সুপরিচিত।
কফি খাওয়ার পর চাঙ্গা হয়ে বললাম, ডিস্কো নামের আড়ালে যে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জিই আছেন, কী করে বুঝলেন?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, প্রথম খটকা বাধে, চন্দ্রিকা খুন হওয়ার পর তার পার্স সম্পর্কে ইন্দ্রজিতের আগ্রহ দেখে। কিন্তু কী অসাধারণ ধূর্ত আর নিষ্ঠুর লোক এই ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি। চিন্তা করে দেখ। ডিস্কোর অস্তিত্ব আমার কাছে সত্য বলে প্রমাণের জন্য সে কত কাণ্ড করে বসল। চন্দ্রিকাকে খুনের অস্ত্র উদ্ধার করে দিল। নিজের এক চেলা স্বপনকেও খুন করল। শেষে নিজেকে নিজেই কিডন্যাপ করল। এক লক্ষ টাকা নিজের স্ত্রীর হাত দিয়ে নিজেই নিল। মৃদুলার অবশ্য এটা জানার কথা নয়। তবে মৃদুলার কথায় আভাস পেয়েছিলাম, অত নগদ টাকা নিশ্চয়ই ঘরে আছে। আসলে ইন্দ্রজিৎ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রেখেছিল। ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে চেক করে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসলে ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রিকার কাছে কোড নাম্বারটা হাতাতে না পেরে একটা বড় রকমের প্ল্যান ফেঁদেছিল। আমার হাত দিয়ে সে ওটা হাতানোর উদ্দেশ্যেই ডিস্কোর হুমকির কাল্পনিক ধুয়ো তুলে অরিজিতের মাধ্যমে আমার দ্বারস্থ হয়। সত্যকামই তাকে আমার পরিচয় দিয়ে থাকবে। এবার পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ওর প্ল্যানটা লক্ষ্য করো। পরগাছা নাটক মঞ্চস্থ করার রাত থেকে ইন্দ্রজিতের অভিযান শুরু। দিন ধরে ডিস্কোর ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি করার পর সে গত রবিবার অ্যাকশনে নেমেছিল।
বললাম, অপারেশন ডিস্কো বলুন।
কর্নেল হাসলেন। বলতে পারো। কিন্তু তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আমারই সাহায্যে কোড নাম্বারটা হাতানো। এই লক্ষ্য নিয়ে সে ছকটা সাজিয়েছিল। কিন্তু নকশার আধার যে ধাতুতে তৈরি, তা ভেঙে ফেলা কঠিন। তাছাড়া তাতে নকশার ক্ষতি হবে। কাজেই কোড নাম্বারের সাহায্যে ওটা খোলা একান্ত দরকার।
নকশাটা কী করবেন?
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের হতে তুলে দেব। এবার দ্বিতীয় অপারেশন অর্কিড শুরু হবে।…