পুরাণের সচল সমাজে দেবতাদের লোকব্যবহার

তৃতীয় অধ্যায় – পুরাণের সচল সমাজে দেবতাদের লোকব্যবহার

॥ ১ ॥

আচ্ছা, মনুষ্য-ব্যবহারের বিচারে আমরা যদি দেবতাদের উত্তমোত্তম মানুষ বলি, তাহলে ক্ষতি কি! এখনও সমাজে উত্তমোত্তম তাঁরাই, যাঁরা সাধারণের ভাগ্য বিধান করেন কিংবা যাঁদের হাতে দণ্ড। পৌরাণিক দৃষ্টিতে আধুনিক প্রলেপ দিয়ে আমরা কি দেবতাদের রাজা বলতে পারি? বৈদিক ঋষিরা তো অনেককেই রাজা বলেছেন। আরও একটা জিনিস পুরাণ ইতিহাসে লক্ষ করার মতো। সেটি হল, স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গে পৃথিবীর রাজাদের সর্বক্ষণের যোগাযোগ। একই ভৌগোলিক সীমার মধ্যে না হলে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এত মেশামেশি কি সম্ভব? মনুষ্যলোকে যখনই কোন শক্তিশালী রাজা অসুবিধেয় পড়েছেন, দেবতারা অনেকেই তখন নেমে এসেছেন যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত ভূমিতে, তাঁরই সাহায্যকল্পে। দেবতাদের রাজার প্রতীক ইন্দ্রকেই তো কতবার দেখা গেছে, মনুষ্য রাজার ধ্বজ-পতাকার অন্তরালে। মর্ত্যলোকে গুণী রাজার উপাধিই তো ইন্দ্র-রাজেন্দ্র, ক্ষিতীন্দ্র। আবার উল্টোদিকে, স্বর্গের দেবতারা যখন শত্রুপক্ষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না, তখনই দেখি মানুষ রাজা ছুটছেন স্বর্গের দিকে, স্বয়ং দেবরাজের রথ আসছে তাঁকে নিতে। দশরথ স্বর্গে গেছেন যুদ্ধ করতে, মুচুকুন্দ গেছেন, খট্বাঙ্গ গেছেন, দুষ্যন্ত গেছেন। আরও কত রাজা স্বর্গক্ষেত্রে যুদ্ধজয়ের পর দেবস্থানের ধন্যধ্বনি শুনতে শুনতে স্বর্গের মন্দারমঞ্জরী এনে গুঁজে দিয়েছেন রাজ-রানীর খোঁপায়! আবার দেখুন, যখনই পুরাণকাহিনীতে বিষ্ণুর অবতার নেমে এসেছেন ভূঁয়ে, তখনই তাঁর সাহায্যকল্পে স্বর্গের দেবতারা এসে জন্মেছেন মনুষ্যলোকে রাজরানীদের গর্ভে। মনে রাখা দরকার, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজরানীর গর্ভে, ঋষিপত্নীর গর্ভে নয়।

কি পশ্চিমী পুরাণকাহিনীর মধ্যে, কি প্রাচ্য পুরাণকথায়, এটা প্রায় দেবলোকের বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে যে, তাঁরা মনুষ্য রমণীর গর্ভে পুত্র উৎপাদনে বড়োই দক্ষ। আমাদের ঘরের দেবতারাও সোজাসুজি এসে মনুষ্য রমণীর গর্ভাধান করেছেন নির্দ্বিধায়। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, কর্ণের কথা ছেড়েই দিলাম, ভারতবর্ষের বানরীরাও বাদ যায়নি দেবতার রতিগ্রাস থেকে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাও বানর ঘরের রানী। পুরাণে, ইতিহাসে আবার এ-ও দেখা যাবে যে, ইন্দ্র, চন্দ্র, যম, বরুণ—এই সমস্ত শক্তিশালী দেবতার অংশেই রাজার জন্ম। যে কোন রাজাই তাই। আমরা তাই পৌরাণিক দেবতাদের যেমন রাজার জাত বলব, তেমনি মর্ত্যভূমির রাজাদেরও দেবতার জাত বলব। তাহলে আমাদের আগেকার সিদ্ধান্তটা একটু ঘসামাজা করে দেবতা এবং রাজাদেরই আমরা উত্তমোত্তম মানুষ বলব। উত্তমোত্তম এইজন্যে যে, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির নিরিখে মুনি-ঋষিদের ‘উত্তম’ উপাধি দিতেই হবে। মধ্যম বলব সাধারণ ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের—যাঁরা সমাজের সাধারণ সুবিধেগুলি সব সময়ই পেতেন এবং যাঁদের একাংশ সাধনা, তপস্যার মাধ্যমে ঋষি-মুনির পর্যায়ে চলে যেতেন এবং অন্যাংশ ক্ষমতা এবং বুদ্ধির জোরে রাজপদবী লাভ করতেন। আর সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ যে ‘পাবলিক’, তারা যেমন গণতন্ত্রের যুগেও কার্যত অধম অবস্থায় আছে, পৌরাণিক রাজতন্ত্রের যুগেও তাই ছিল। কাজেই ‘পাবলিক’কে অধম বলতে কোন অসুবিধে নেই।

এ-কথা অবশ্য মানতেই হবে পৌরাণিকেরা আমাদের মত কুটিল ছিলেন না। এখনকার দিনে সমাজের অধম সাধারণ মানুষকে মৌখিকভাবে গণতান্ত্রিক মূল্য দিয়ে দিয়ে মনে মনে তাদের পাঁঠা ভাবা হয়, পুরাণের যুগে কিন্তু এমন ছিল না। যাদের তাঁরা অধম ভাবতেন, তাদের তাঁরা সামনাসামনিই অধম বলতেন। শূদ্রদের তাঁরা অধম ভাবতেন এবং সামনাসামনিই অধম বলতেন। স্ত্রীকে পছন্দ হচ্ছে না, ত্যাগ কর তাকে। আবার যাকে পছন্দ হল, তার সঙ্গফল অবধারিত রতিক্রিয়া। এই সোজাসুজি দৃষ্টি থাকার ফলে তাঁরা এ-ও বুঝেছিলেন যে, সমাজের উচ্চকোটির মানুষ যাঁরা, তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি, ক্ষমতা এবং মানসিক বলের সঙ্গে দোষও কিছু থাকে। এই সহজ কথাটা সহজে বুঝেছিলেন বলেই পৌরাণিকেরা দেবতা, মুনি কিংবা রাজাদেরও চারিত্রিক ত্রুটিবিচ্যুতি দেখাতে লজ্জাবোধ করেননি।

প্রায় প্রত্যেকটি পুরাণেই যে বিষয়টি আরম্ভ-সর্গগুলি অধিকার করে আছে, তা হল সৃষ্টি। আমরা জানি যে-কোন সৃষ্টির মূলে আছে কাম। মৎস্যপুরাণ জানিয়েছে—ব্রহ্মা যখন বেদাভ্যাসে রত ছিলেন, সেই অবস্থায় তাঁর দশটি মানস পুত্র জন্মায়। এঁরা সবাই মাতৃহীন, অযোনিজ এবং স্থিতধী মুনি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মজা হল, এই সম্ভ্রান্ত মুনিকুল সৃষ্টির পরেই ব্রহ্মা তাঁর বুক থেকে ধর্ম সৃষ্টি করলেন, হৃদয় থেকে কাম এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে লোভ, মোহ, অহঙ্কার। তার মানে কি সৃষ্টিকারী ব্রহ্মা বুঝতে পেরেছিলেন যে, জীবনে ধর্ম যেমন প্রয়োজন, কামও তেমন প্রয়োজন? সময় বিশেষে লোভ, মোহ, অহঙ্কারও যে জীবনের শক্তি জোগায়, এটা বোঝানোর জন্যই বোধহয় এরা ব্রহ্মার পুত্র বলে স্বীকৃত। পৌরাণিক বলেছেন—এই পুত্রগুলির সঙ্গে একটি কন্যাও আছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই কন্যা জন্মের প্রসঙ্গেই পৌরাণিকেরা এমন একটি জীবন-সত্য স্বীকার করে নিয়েছেন, যা তাঁরা চিরকাল প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন।

প্রজা সৃষ্টির সময় ব্রহ্মা নাকি চতুর্বেদের সার সাবিত্রী-মন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে জপে বসেছিলেন। হঠাৎ তাঁর পবিত্র দেহ ভেদ করে অর্ধেক পুরুষ এবং অর্ধেক স্ত্রী জন্মাল। অর্ধেক মানে এই নয় যে, এরা একটি পুরুষেরও অর্ধেক কিংবা একটি নারীরও অর্ধেক। স্বরূপত, যে কোন একটি পুরুষ কিংবা যে কোন একটি নারী সৃষ্টি রহস্যের অধাংশমাত্র। এরা মিলিত হলে তবেই না সম্পূর্ণ মানুষটা। আমার বক্তব্য কিন্তু এখানে নয়। পৌরাণিকেরা বলেছিলেন—ব্রহ্মার ভাবটা ছিল যেন, সব তাঁর মন থেকেই তৈরি হচ্ছে—মানসপুত্র—তার মধ্যে কামগন্ধের ছিটেফোঁটাও নেই যেন। তাঁর শরীর ভেদ করে এইমাত্র যে কন্যাটি জন্মাল, তাঁকে তিনি ‘আত্মজা’ বলে ডেকেছেন, তাঁর নামকরণ করেছেন সাবিত্রী বলে, সরস্বতী বলে, শতরূপা বলে। ঠিক যেমন সুন্দরী রমণীকে প্রথম দেখে আমরা ভাবি—এ আমার হৃদয়ের ধন, মানসরূপিণী, এর সঙ্গে আমার কাম-সম্বন্ধ নেই কোন ; সোচ্ছাসে তার নামকরণ করি প্রিয়া বলে, প্রণয়িণী বলে, মানসী বলে। কিন্তু হঠাৎ করে হৃদয়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে কীট আর ঠিক ব্রহ্মার মতোই তখন বলে উঠি—আহা কি রূপ, কি রূপ—অহো রূপম্ অহো রূপমিতি চাহ প্রজাপতিঃ। কন্যার রূপ দেখে বিভু ব্ৰহ্মা কামনায় পীড়িত হলেন।

ব্ৰহ্মার মন থেকে আগে যে সব মুনিরা জন্মেছিলেন সেই বশিষ্ঠ প্রমুখ মানসপত্রেরা পিতার অঙ্গজাত কন্যাকে ‘বোন, বোন’ বলে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু ব্রহ্মা খালি কন্যার মুখটি দেখেন আর বলেন—‘অহো রূপম্‌ অহো রূপম্‌’। প্রণাম-নম্রা সেই কন্যা ব্রহ্মার চারদিক ঘুরে প্রদক্ষিণ করল, কিন্তু ব্রহ্মার কেবলই ইচ্ছে হতে লাগল নারীরূপ দেখার। লজ্জা! লজ্জা! মানসজাত পুত্রদের সামনে এ কি হল, লজ্জা—পুত্রেভ্যো লজ্জিতস্য—অতএব ব্রহ্মার তপোরুক্ষ মাথার দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয় একটি হলদে রঙের মুখ বেরোল-ভাল করে রূপ দেখার জন্য। পশ্চিম দিক থেকে যে মুখটি বেরোল, সেটি তো কন্যার রূপ দেখে বিস্ময়ে স্ফূরিতাধর। বাঁদিক থেকে চতুর্থ মুখ যেটি বেরোল, সেটি একেবারে ‘কামশরাতুরম্‌’। ঠিক এমন অবস্থাতেও আরও একটি মুখ দেখা গেল ব্ৰহ্মার এবং সেটিও নাকি তাঁর নাকি কামাতুর অবস্থার জন্যই। কথাটা কেমন হল? একটি কামাতুর মুখ, আবার কামাতুরতার জন্য আরও একটি মুখ। আসলে মানুষ রূপ দেখে, বিস্মিত হয়, কামনাও জাগে। কিন্তু কামনা জাগার পরে মানুষের যে মুখটি প্রকট হয়ে ওঠে, সে মুখটি তো আর মানুষের মতো থাকে না। কাজেই ব্রহ্মার কামদিগ্ধ মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও একটি মুখ—যার লজ্জা নেই, ভাবনা নেই, শুধুই সে নগ্নতার কুতূহলী—আলোকন-কুতূহলাৎ। সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করার জন্য ব্রহ্মার এতদিনের তপস্যা নিজের কন্যার সম্ভোগ বাসনায় সম্পূর্ণ বৃথা হয়ে গেল। ব্রহ্মা তাঁর মানসপুত্রদের প্রজা সৃষ্টির আজ্ঞা দিয়ে নিজে শতরূপাকে বিয়েই করে ফেললেন। তারপর! তারপর কমলকেলির মুখ বন্ধ হয়ে গেল। শতরূপার সঙ্গে একশ বছর কেটে গেল—সলজ্জাং চকমে দেবঃ কমলোদরমন্দিরে।

এই গল্পটার মধ্যে নাকি রূপক আছে। চতুরানন ব্রহ্মার চারটে মুখ থেকে চতুর্বেদের জন্ম। বেদসার গায়ত্রী অথবা সাবিত্রী তাই ব্রহ্মার অঙ্গজা। বেদের সঙ্গে গায়ত্রীর সম্পর্ক মিথুনের মতো, বেদস্বরূপ ব্রহ্মার সঙ্গেও তাই—বিরিঞ্চি যর্ত্র ভগবাংস্তত্র দেবী সরস্বতী। কিন্তু ব্রহ্মা এবং সরস্বতীর রূপকের সম্পর্ক যাই হোক আমরা শুধু পৌরাণিকের বাস্তব দৃষ্টিটুকু বোঝাতে চাই। কামনার সূত্রই যে জীবনের প্রথম ইন্ধন—এ কথাটা পিতামহের ব্যবহারে প্রমাণ দিয়েই পৌরাণিক যেন আধুনিক উপন্যাস সমালোচনার প্রথম কথাটি বললেন। তাঁদের এই বাস্তববোধ ছিল যে, সংঘাত ছাড়া, ‘টেনশন’ ছাড়া মানুষের জীবন চলে না। এ বোধ যে কত বড় বোধ তা বলে বোঝাতে পারব না। ব্রহ্মার আদেশমতো তাঁর মানসপুত্রেরা যখন জরা-মরণ-হীন সিদ্ধদের জন্ম দিচ্ছিলেন, তখন ব্রহ্মা বললেন—দেখ বাপু! এই জরা-মৃত্যুবর্জিত কতকগুলি স্থাণু সৃষ্টির মধ্যে কোন রহস্য নেই—নৈবংবিধা ভবেৎ সৃষ্টিৰ্জরামরণবর্জিতা। জীবনের মধ্যে শুধু নিরঙ্কুশ শুভই থাকবে—তাহলে জীবনের কোন অর্থ থাকে না। শুভের সঙ্গে অশুভের সংঘাত হবে বারবার, তবেই না সৃষ্টির মজা—শুভাশুভাত্মিকা যা তু সৈব সৃষ্টিঃ প্রশস্যতে। এই শুভ এবং অশুভের গতি অনুসারেই পৌরাণিক সমাজ-জীবনের ধারা নিরন্তর বয়ে চলেছে। দেবতা, ঋষি, রাজা, দানব, রাক্ষস এবং মানুষ—সকলের জীবনেই কাজ করছে এই শুভাশুভের সংঘাত। অন্যদিকে এই শুভাশুভের ইতরবিশেষই কিন্তু দেবতা, দৈত্য-রাক্ষস, মুনি-ঋষি অথবা মানুষের জন্ম।

একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, এখনকার সমাজের সূক্ষ্ম অনুভূতির নিরিখে পৌরাণিক সমাজের নীতি-নিয়ম বিচার করা যায় না। কারণ তখনকার সমাজ ছিল শিথিল, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণাও নির্ভর করত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ওপর, ইচ্ছার তীব্রতার ওপর। ধরুন আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না, আপনি ঘুমোনার আগেই সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, আপনি সরস চুম্বন করলে সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চুম্বিত স্থানটি পুঁছে দেয়—চুম্বিতা মার্ষ্টি বদনং—আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলে এমন ভাব করে, যেন পাড়ার মুদি মিন্‌সে আসছে—এ রকম বউকে আপনি কি করবেন? আজকের দিনের সামাজিক নীতিবোধে আপনি তো তাকে ত্যাগ করতে পারেন না। আপনি তাকে অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু একেবারে ফেলে তো দিতে পারেন না, দায়িত্বও অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু এই রকম স্ত্রীর ব্যাপারে আপনি যদি পুরাণজ্ঞ ঋষির পরামর্শ চান, তিনি সহজভাবে বলবেন—ওটাকে বাদ দিয়ে আর একটা বিয়ে কর বৎস, যে তোমাকে ভালবাসবে—তাং ত্যক্‌ত্বা সানুরাগাং স্ক্রিয়ং ভজেৎ।

পুরাণের কালে সেই সানুরাগা রমণীটি স্বামীর সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে জানেন? স্বামীকে দেখা মাত্রই সে খুশি-খুশি হয়ে উঠত, কিন্তু স্বামী তার দিকে সানুরাগে তাকালেই তার মুখে ফুটে উঠত লজ্জা-লজ্জা ভাব—দৃষ্‌ট্রৈব হৃষ্টা ভবতি বীক্ষিতে চ পরাংমুখী। লজ্জা-লজ্জা ভাব থাকলেও সে রমণী কিন্তু ফালুক-ফুলুক করে তাকাবে। ওদিকে বুকের আঁচল সরে গেলে একটু-আধটু খুলেও রাখবে আবার কুৎসিত দেখা গেলে গোপন অঙ্গ ঢাকা দেবে। স্বামীকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাচ্চা ছেলের গালে চুমো খাবে—তদ্দর্শনে চ কুরুতে বালালিঙ্গনচুম্বনম্‌। এই ছেলেখেলার ফলাফলে উত্তেজিত স্বামী যদি সেই রমণীকে একবার স্পর্শ করে, তাহলেই তিনি পুলকে, আবেগে একেবারে ভেঙে ভেঙে পড়বেন—স্পৃষ্টা পূলকিতৈরঙ্গৈঃ স্বেদেনৈব চ ভজ্যতে।

পুরাণের এই বর্ণনা মিলিয়ে সেই মনোহরা রমণীটি আপনি পাবেন না, যদি বা পান দেখবেন বিয়ে করার উপায় নেই তাকে। কিন্তু পৌরাণিককালে স্ত্রী বর্তমান থাকতেও দেবতা, ঋষি-মুনি, রাজা বা যে কোন মানুষই পুরাণোক্ত সুলক্ষণা রমণীটিকে ঘরে আনতে পারতেন। কারণ, আগেই বলেছি, নীতি-নিয়মের বোধটা ছিল অন্য রকম। পুরাণে ঋষিরা অবশ্য তাঁদের কালের সমস্ত দুষ্কর্ম কিংবা অন্যায়গুলির দায় চাপিয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যৎকালের ওপর।

ঠিক এই কারণেই প্রায় প্রত্যেকটি প্রাচীন পুরাণেই কলিকালে কি ঘটবে তার একটা বর্ণনা আছে। অথচ কলিকালে যা ঘটবে বা যা এখন ঘটছে, তার অনেক কিছুই ঘটত সেই দেবতা, ঋষি বা রাজাদের যুগে। পৌরাণিকেরা একদিকে তত্ত্বগতভাবে এক আদর্শ সমাজের কথা বলছেন, অন্য দিকে আখ্যান এবং উপাখ্যানের মাধ্যমে তাঁরা যা জানাচ্ছেন, তাতে ফুটে উঠছে আদর্শচ্যুতির সম্ভাবনা। সেই আদর্শচ্যুতি একেবারে মানুষের মত করেই ঘটছে, কিন্তু সেই চ্যুতি ঘটাচ্ছেন দেবতারা ঋষিরা এবং মহান রাজারা। বিভিন্ন উপাখ্যানের সঙ্গে সেখানে উপদেশের মিল থাকছে না। বস্তুত পৌরাণিক ঋষিদের যুগে যা ঘটেছিল এবং যা তাঁরা ঘটুক বলে চাইছিলেন না, তারই ছায়া পড়েছে তাঁদের কলিকালের ভবিষ্যৎবাণীতে। অনীস্পিত এই কলিযুগ আসলে তাঁদেরই কালের ত্রুটিবিচ্যুতির প্রতিবিম্ব। পৌরাণিক যুগের কথা বলতে গিয়ে পুরাণ বিশেষজ্ঞ রাজেন্দ্রচন্দ্র হাজরা তাই লিখেছেন—The Puranic chapters on the Kali age are the records of the state of society during the period with which we are concerned here. প্রধান তথা পুরনো পুরাণগুলির মধ্যে বায়ু, মৎস্য, কূর্ম, ব্ৰহ্মাণ্ড এবং ভাগবত পুরাণের মধ্যে কলিকালের ধর্ম, আচার, আচরণ ব্যাখ্যা করা আছে। ভারত ইতিহাসের অন্যান্য পুঁজি এবং উপাদানগুলি নিপুণভাবে পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাব সমাজের যে ছন্দোভঙ্গ এই কলিধর্মে বর্ণনা করা হয়েছে, তা অনেকটাই দেবতা বা ঋষিদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। দেবতার একান্ত মানবায়নের প্রসঙ্গে তাই এই কলিকালকে বাদ দিলে মোটেই চলবে না।

আশি বছরের বুড়ি ঠাকুমা যদি নাতনিকে মিনি-ম্যাক্সি পরতে দেখেন তাহলে প্রথমে চমকে যান, তারপর অনুযোগের সুরে বলেন—কালে কালে কত কি দেখছি, আর কত কিই বা দেখতে হবে। ঠিক একইভাবে পুরাণ-যুগের কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হয়তো সেকালের কোন আধুনিকা নাতনিকে চুলের কায়দা করতে দেখেছিলেন। ফলে অবধারিত মন্তব্য শোনা গেছে—কলিকালের মেয়েরা শুধু চুলের কায়দা দেখাবে—কলৌ স্ত্রিয়ো ভবিষ্যন্তি তদা কেশৈলংকৃতাঃ। সেই যুগে হয়তো সেই প্রথম মেয়েদের চুলে কাঁটা গুজে, খোঁপা করার চল উঠেছিল। ব্যাস্‌, বৃদ্ধা নাক সিঁটকে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছেন—কলিকালের মেয়েগুলো সব মাথায় লোহার কাঁটা দিয়ে ঘুরে বেড়াবে, ঢঙ কত—প্রমদাঃ কেশশূলাশ্চ ভবিষ্যন্তি কলৌ যুগে। নইলে ভগবান বলে চিহ্নিত পুরুষোত্তম কৃষ্ণের প্রিয়তমা আদরিণী সত্যভামা কী চুল নিয়ে কম ঝামেলা করেছিলেন নাকি। স্বর্গে দেখা পারিজাত ফুল খোঁপায় গুঁজে সতীনদের মধ্যে ডাঁটসে ঘুরে বেড়াবেন বলে সত্যভামা যে বায়না করেছিলেন কৃষ্ণের কাছে, তার জন্য কৃষ্ণকে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নন্দনের গন্ধমাতাল সেই পারিজাত স্বর্গ থেকে উপড়ে এনে কৃষ্ণকে তা পুঁতে দিতে হয়েছিল দ্বারকায়। অতএব কলিকালে গৃহিণীকে তুষ্ট করতে আমরাই যে শুধু ব্যস্ত, তা নয়। এ বাবদে মানুষের সঙ্গে ভগবানের কোন তফাৎ নেই। আসলে বৃদ্ধ স্থবিরের কাছে তাঁদের কালের আধুনিকতাই আশঙ্কার রূপ ধরে কলিকালের ধর্মে ঢুকে পড়েছে। পুরাণে বর্ণিত কলিকাল অতএব তাঁদেরই কলি।

॥ ২ ॥

ধর্মের ষাঁড় বলে যে কথাটা সাধারণ্যে চালু আছে, সে কথাটার একটা সময়োপযোগী মানে থাকতে পারে বটে, তবে সাধারণের জ্ঞাতার্থে জানাই—পৌরাণিক ঋষিরা ধর্মের চেহারাটাই কল্পনা করেছেন চতুষ্পদ ষাঁড়ের মতো। বৃষ শব্দের অর্থ নাকি জ্ঞান এবং দেবাদিদেব মহাদেব আসলে বৃষরূপী জ্ঞানবাহন। কথায় বলে, ‘জ্ঞানঞ্চ শংকরাদিচ্ছেৎ’। ধর্মকে তাই বৃষের চেহারায় কল্পনা করতে কোন অসুবিধে নেই। এক একটি যুগের শেষে এই চতুষ্পদী প্রাণীর এক একটি পা ভেঙে দিতে পুরাণকারদের বাধেনি। সত্যযুগে ধর্ম একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ, ষাঁড়ের চার পা-ও ঠিকঠাক। কিন্তু সত্যযুগ গিয়ে যেই ত্রেতা এল, অমনি ষাঁড়ের একখানি পা ভেঙে গেল, ধর্ম হল ত্রিপাদ। দ্বাপর যুগে পেছনের দু পায়ে ভর করে ধর্মের ষাঁড় কোনও রকমে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু কলিকাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার তিনখানা পা-ই ভেঙে গেল। এ অবস্থায় সমস্ত চাপ নিয়ে একখানা পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা খুব কষ্টকর, তবু ঠিক এই অবস্থাতেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বালক-বীর পরীক্ষিতের। পরীক্ষিৎ দেখলেন—কে একটা লোক, রাজা-রাজা চেহারা বটে, সে ধর্মের ষাঁড়কে একটা ঠ্যাঙা দিয়ে মারে আর কি। তাড়নার ভয়ে ষাঁড়টি ঠক-ঠক করে কাঁপছে এবং প্রস্রাব করে ফেলেছে—ভয়াৎ মূত্রয়ন্নিব। পরীক্ষিৎ বললেন, খুব সাবধান।

তিন পা-ভাঙা ষাঁড়। তার ওপরে তাড়নার ভয়। পরীক্ষিৎ ষাঁড়কে দেখে করুণাগ্রস্ত হলেন, আর রেগে উঠলেন রাজা-পানা লোকটাকে দেখে। দুজনকেই পরিচয় জিজ্ঞেস করতে ষাঁড় বলল—আমি ধর্ম। রাজা-পানা লোকটি বলল—আমি কলিকাল। দ্বাপর যুগ শেষ, তাই জায়গা নিতে এসেছি। পরীক্ষিৎ তাঁর বাপ-পিতামহ এবং স্বনামধন্য কৃষ্ণের পুরাকীর্তি স্মরণ করে বললেন—এত বড় কথা। এই সমগ্র ব্ৰহ্মাবর্ত, যেখানে নানা যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণেরা বিষ্ণুর উপাসনা করছেন—যজ্ঞেশ্বরং যজ্ঞবিতানবিজ্ঞাঃ—সেখানে তোমার ঠাঁই হবে না জেনো। কলি বলল—তাহলে আমি থাকব কোথায়? যুগের টান তো আর উল্টো হতে পারে না। পরীক্ষিৎ বললেন—তাও তো বটে। তাহলে এক কাজ কর। তুমি থাক, যেখানে তাস-পাশা খেলা হয়, যেখানে মদ, যেখানে মেয়েছেলে, আর যেখানে মানুষে মানুষে হানাহানি—এই চার জায়গায় থাক তুমি। কলি বলল—আর একটু জায়গা দেবেন না ? করুণাবশত পরীক্ষিৎ কলিকে সোনাচাঁদির জায়গাটাও ছেড়ে দিলেন—পুনশ্চ যাচমানায় জাতরূপমদাৎ প্রভু। পাঁচ নম্বর এই সোনাচাঁদির জায়গাটার ছেড়ে দেওয়ার ফলে—তাস-পাশা, মদ-মেয়েছেলে এবং মারামারি—এই সবগুলির সঙ্গে যোগ হল টাকাপয়সার।

কলির সর্বগ্রাসী হাঁ-মুখটাকে মাত্র পাঁচ জায়গায় সীমায়িত করতে পেরে এবং একপেয়ে ধর্মকে আপাতত বাঁচাতে পেরে পরীক্ষিৎ খুব খুশি হলেন বটে কিন্তু অনভিজ্ঞ পরীক্ষিৎ ‘কলির সন্ধ্যা’ কথাটির অর্থ বোঝেননি। তিনি বোঝেননি সকালবেলায় রাত্রিদিনের সন্ধিক্ষণে দিনের ভাগ যতটুকু থাকে, রাতের ভাগও ততটুকুই থাকে। তিনি বোঝেননি যে কলি-মহারাজকে চাক্ষুষ দেখাটাই কলির আরম্ভ নয়—গোলমালটা আরম্ভ হয়েছে দ্বাপর যুগ থেকেই। এমনকি তিনি এ-ও বোঝেননি যে, তাঁর বাপ-পিতামহেরাও ছিলেন কলির পোষ্য। একটা কথা জনসমাজে চালু আছে যে, কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের লোক। মোটেই নয়। কৃষ্ণ আমাদের মতোই কলিযুগের মানুষ, একেবারে আক্ষরিক অর্থে ‘কলির কেষ্ট’। হরিবংশে লক্ষ করবেন—দানবরাজ কালযবনকে হত্যা করার জন্য কৃষ্ণ তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মুচুকুন্দের সামনে নিয়ে এসেছেন। কালবন মথুরাবাসীর অবধ্য ছিল এবং মুচুকুন্দের ওপর দেবতাদের আশীর্বাদ ছিল যে, তাঁর ঘুম ভাঙলেই তাঁর চোখের সামনে যে আসবে, সেই পুড়ে যাবে। কৃষ্ণ ঘুমন্ত মুচুকুন্দের আলো-আঁধারি গুহায় প্রবেশ করলেন, পেছন পেছন কালযবন। কৃষ্ণ মুচুকুন্দের চোখ এড়িয়ে দূরে দাঁড়ালেন। এদিকে কালযবন মুচুকুন্দকে কৃষ্ণ মনে করে তাঁর ঘুম ভাঙালেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভস্মসাৎ। কিন্তু এবারেই হল আসল মজা। ঘুম ভেঙে মুচুকুন্দ কৃষ্ণকে দেখে ভাবলেন—ব্যাপারটা কি? এরকম একটা খুদে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে—বাসুদেবমুপালক্ষ্য রাজা হ্রস্বং প্রমাণতঃ। মুচুকুন্দ বললেন—আপনি কে? আপনি কি বলতে পারেন ঘুমন্ত অবস্থায় আমার কতদিন কেটেছে? কৃষ্ণ বললেন, আজ্ঞে, আমি যদুবংশের ছেলে, আমার নাম কৃষ্ণ বাসুদেব। আপনি সেই ত্রেতা যুগ থেকে ঘুমোচ্ছেন—এখন কলিযুগ চলছে, এবারে বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি—ইদং কলিযুগং বিদ্ধি কিমন্যৎ করবাণি তে।১০

ব্যাখ্যাটা মানবেন কিনা জানিনা, তবে মুচুকুন্দের এই দীর্ঘ নিদ্রার একটা ব্যঞ্জনা আছে। আসলে কালের পরিবর্তন যখন দ্রুত ঘটতে থাকে, তখন প্রাচীন রক্ষণশীল বৃদ্ধরা চোখ বুঁজে সেই পরিবর্তনকে মনে-প্রাণে অস্বীকার করতে থাকেন। রক্ষণশীলতা এবং পরিবর্তন—এই দুয়ের দ্বৈরথে তাদের মধ্যে এক বিরূপ অন্তঃক্রিয়া চলতে থাকে। যাঁরা পরিবর্তনকে শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারেন না, তাঁরা অক্ষম অনুযোগে কখনও একেবারে চুপ হয়ে যান, কখনও বা পুরাতনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। অর্থাৎ আমাদের কালে কী দেখেছি, আর এখন কী হল? বাস্তবে কিন্তু সাভিমানে চুপ করে যাওয়া বা নতুনকে অস্বীকার—দুটোই আমার মতে ঘুমের শামিল। এই ঘুম যখন ভাঙে অথবা যদি কখনও কৃষ্ণের মত অসাধারণ কেউ নূতনের মহত্ত্ব নিয়ে পুরাতনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘোষণা করেন, তখনও তাঁর একমাত্র প্রতিক্রিয়া—সবাইকে ছোট করে দেখা। অর্থাৎ তিনি সবাইকে আপন যুগের তুলনায় ছোট দেখেন, খাট করে দেখেন।

ঘুমচোখ ঘষে মুচকুন্দ গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন কলিযুগের প্রকৃতি দেখবার জন্য। দেখলেন পৃথিবী বেঁটে আর ক্ষুদে মানুষে ভরে গেছে—ততো দদর্শ পৃথিবীম্‌ আবৃতাং হ্রস্বকৈ নরৈঃ। তাদের উৎসাহ, শক্তি, পরাক্রম সবই কেমন কম কম। তিনি আর এই স্বল্পবল পৃথিবীকে বাসযোগ্য মনে করলেন না, চলে গেলেন হিমালয়ে। অবতারবাদী সংরক্ষণশীলেরা মনে করেন এই যে কৃষ্ণের মুখে পষ্টাপষ্টি কলিযুগের কথা শোনা গেল, এটা নাকি দ্বাপর-কলির সন্ধিলগ্ন। আমরা বলি ‘ইদং কলিযুগং’ বললে কি কোন সন্ধিলগ্ন বোঝায়? তাছাড়া প্রমাণ তো আরও রয়ে গেছে। স্বনামধন্য পরশুরাম বিষ্ণুপুরাণের যে অংশ অবলম্বনে ‘রেবতীর পতিলাভ’ গল্পটি লিখেছিলেন, সেখানেও রেবতীর বাবা ব্রহ্মার আসরে নাচ-গান শুনে এসে দেখেন পৃথিবীতে কলিকাল এসে গেছে—আসন্নো হি তৎ কলিঃ। তাঁর অবস্থাও হয়েছিল মুচুকুন্দের মতোই। বেশ কিছুদিন ‘স্পেসে’ কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে রৈবত ককুদ্মী দেখলেন তিনি একেবারে একা হয়ে গেছেন আর পৃথিবী অল্পশক্তি ক্ষুদে মানুষে ভরে গেছে—দদর্শ হ্রস্বান্ পুরুষআন্‌ অশেষান্‌/অল্পোজসঃ স্বল্পবিবেকবীর্যন্।১১

তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি কৃষ্ণ, বলরাম, পাণ্ডব, কৌরব—এরা সবাই আমাদের মতো বেঁটে-খাটো কলিযুগের মানুষ এবং পুরাণের ইতিহাস মানে প্রায় কলিযুগেরই ইতিহাস। নৃতাত্ত্বিকেরা কি বলবেন জানি না, তবে পুরাণজ্ঞ ঋষিদের ধারণা ছিল—মানুষের চেহারা ক্রমেই বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। তবে বেঁটে-খাটো হলে হবে কি, এদের বুদ্ধি কম ছিল না। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি—এই চতুর্যুগের ভাবনা ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যত্র কোথাও নেই—অন্যত্র ন ক্কচিৎ। তবে নিবিষ্ট মনে পুরাণগুলি দেখলে বোঝা যায় যে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি—আসলে মনুষ্যত্বের ক্রম-ক্ষীয়মান ইতিহাস অথবা উল্টোদিক দিয়ে জটিলতার ক্রমবর্ধমান ইতিহাস। আমাদের কালের প্রাচীনদের কাছে প্রায়ই শুনি যে, তাঁদের যুগটা ছিল অন্য রকম। লোকের ধর্মভীতি ছিল, শৌচ, আচার ছিল, আর মেয়েরা ছিল সব দারুণ ভাল। আমাদের পৌরাণিকেরা ঠিক একইভাবে বলেছেন যে, সত্যযুগে যেমন সুদিন ছিল, ত্রেতাযুগে তা ছিল না, দ্বাপরের অবস্থা বেশ খারাপ আর কলিকালের তো কথাই নেই।

পুরাণকাহিনীতে সত্যযুগের কল্পনায় যে অনন্ত মাহাত্ম্য আছে তাতে মনে হয় সে সমাজটা ছিল একেবারে বিকারহীন, একেবারে নিরেট। মানুষ ভাল, মন ভাল, আচার আচরণ সব ভাল। শোক-তাপ, দুঃখকষ্ট, লোভ-মাৎসর্য, ধর্মাধর্ম কিছুই নেই। এই কাল্পনিক সমাজ খুব ভাল হতে পারে, তবে বিকারহীনতা জড়তারই নামান্তর। সত্যযুগের এত মাহাত্ম্যের মধ্যেও কূর্মপুরাণ লক্ষ করেছে যে, সে যুগের মানুষেরা ছিল নির্জনতাপ্রিয় এবং তাদের বাসস্থান বলে সঠিক কিছু ছিল না—অনিকেতাঃ। সমুদ্রতীর আর পর্বতের গুহাই ছিল তাদের থাকবার জায়গা—পর্বতেদধিবাসিন্যঃ। পুরাণের মতে, সমস্ত জটিলতার সূত্রপাত ঘটে ত্রেতা যুগে। এই জটিলতার সঙ্গে যে অর্থনৈতিক কারণের যোগ ছিল, সেটাও কূর্মপুরাণ লক্ষ করেছে। আগে হাজার হাজার গাছই মানুষকে জীবন ধারণে সাহায্য করত, কিন্তু হঠাৎ তাদের মধ্যে কামনা আর লোভ দেখা গেল —কামলোভাত্মকো ভাব স্তদা হ্যাকস্মিকো’ ভবৎ।১২ কূর্মপুরাণ বলেছে, এই কামনা আর লোভের ফলেই মানুষের সমস্ত বৃক্ষাবাসগুলি নষ্ট হয়ে গেল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, এ হল সেই যুগ, যখন বিভিন্ন আর্যগোষ্ঠীরা এক বনের খাবার শেষ করে আরেক বনে পৌছচ্ছিলেন। কারণ পুরাণের বার্তামতো মানুষের অনুতাপে আবার বনবৃক্ষেরা তাদের ঘরবাড়ি দিয়েছে, খাবার ফল দিয়েছে, দিয়েছে লজ্জাবস্ত্র—বল্কলবাস। গাছের ‘পুটকে পুটকে মধু’—ভালই ছিল প্রজারা। কিন্তু পুরাণ বলেছে—কালক্রমে আবার মানুষের মধ্যে লোভ দেখা গেল। মানুষেরা জোর করে যে গাছ থেকে যত মধু পাবার নয়, তার চেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা আরম্ভ করল—বৃক্ষাংস্তান্‌ পর্যগৃহ্নন্ত মধু চামাক্ষিকং বলাৎ।১৩

যতটুকু ব্যবহারে গাছ জীর্ণ হয় না, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করার ফলেই বনগুলির মরণদশা উপস্থিত হচ্ছিল। আর এই যে বার বার গাছেরা জন্মাচ্ছে, লুপ্ত হচ্ছে, আবার জন্মাচ্ছে—এই বর্ণনা পশুপাখি যাযাবর আর্যজাতির আরণ্যক স্মৃতিমাত্র। কূর্মপুরাণ বুঝিয়ে দিয়েছে—শুধুমাত্র গাছের ছায়া আর বনের ফলের অপ্রতুলতার জন্যই মানুষ পাকাপাকিভাবে বাড়িঘর বানানোর প্রেরণা পেল ; শীত, বর্ষা আর রোদের কবল থেকে বাঁচতে এবার তারা বাড়ি তৈরির কায়দা শিখেছে। গাছের ডাল যেমন একটা সামনে, একটা পেছনে, একটা এপাশে, একটা ওপাশে বেড়ে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেই বুদ্ধিতেই মানুষ বাড়ি বানানো শিখেছে। গাছের শাখার শিক্ষা থেকে বাড়ি তৈরি হয় বলেই বাড়ির নাম ‘শালা’—বুধ্বাম্বিষ্যংস্তথা ন্যায়ো বৃক্ষশাখা যথা গতাঃ। তথা কৃতাস্তু তৈঃ শাখাঃ…। গাছগুলি একের পর এক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—এই বিনাশের আশঙ্কার মধ্যেই জন্ম নিল কৃষিকর্মের সুপরিকল্পিত ভাবনা, পশুপালনের চিন্তা—বার্ত্তোপায়মচিন্তয়ন্‌। তবে ত্রেতা যুগের প্রথম কৃষিকর্মে নাকি লাঙল লাগত না, বীজও লাগত না—অফালকৃষ্টাশ্চানুপ্তা। আসলে পৌরাণিকের রূপকথায় লাঙল ব্যবহারের চেষ্টা, অপচেষ্টা এবং অবশেষে সার্থকতার ইতিহাসটুকু বেমানান। তাই লাঙল আর বীজ ছাড়াই সেখানে কৃষিকর্ম সম্পন্ন হয়।১৪

ঠিক এইরকম একটা সময়েই মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সম্পত্তির চেতনা জন্মাল। কেননা পুরাণ বলেছে—ত্রেতাযুগের কালধর্মে মানুষের মধ্যে আবার লোভ জন্মাল এবং তারা জোর করে নদী, পাহাড়, জমি, গাছপালা, ওষধি—একের পর এক দখল করতে লাগল—ততস্তে পর্যগৃহুন্ত…প্রসহ্য তু যথাৰলম্‌।১৫ ঠিক এই গোষ্ঠীগত অধিকারের পালা যখন চরম আকার ধারণ করল, তখনই বোধহয় সেই মানুষটা জন্মালেন, যাঁর নাম পৃথু। এঁর নাম থেকেই এই মর্ত্যভূমির নাম পৃথ্বী অথবা পৃথিবী। বস্তুত পৃথুই ভারতবর্ষের প্রথম রাজা, যিনি সাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা নিয়ে আসেন এবং পৃথিবীর গর্ভ থেকে শস্য বার করে নিয়ে আসেন।

ত্রেতাযুগের যে সময়টাতে মানুষ ভীষণ লোভী হয়ে উঠেছিল এবং যে সময়ে তারা ঘরবাড়ি তৈরি করতে শস্য উৎপাদন করতে শিখে গেল, এই সময়টার সঙ্গে পৃথু মহারাজের অবশ্যই একটা যোগ আছে। একটা কথা বোঝা দরকার, পৃথুর কথা সমস্ত নামী পুরাণগুলিতে পাওয়া যাবে। কেননা তিনিই স্বেচ্ছাচালিত দখলদারির মধ্যে প্রথম শৃঙ্খলা এবং সভ্যতা নিয়ে আসেন। আরও লক্ষ করার বিষয় হল—পুরাণগুলি যেখানে পৃথুকে ভগবানের অবতার বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি—সেই অবতারপুরুষ আদি ধর্মরাজের জন্ম কিন্তু প্রায় জীবন্ত এক অধর্মপুরুষের দেহ থেকে। পৃথুর বাবার নাম বেণ, যাঁর প্রথম পরিচয় ছিল—তিনি ধর্ম মানতেন না। সেচ্ছাচার এবং লোভই ছিল তাঁর একমাত্র বিলাস—স ধর্মং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা কামাল্লোভে ব্যবর্ত্তত।১৬ ঠিক এই ব্যবহার আমরা সম্পত্তিগ্রাসী মানুষগুলির মধ্যেও পেয়েছি। নদী, পাহাড়, জমির দখলদারি নিয়ে যে চরম অবস্থা হয়েছিল তার একটা প্রতীকী আচরণ আছে এই বেণের মধ্যে। বেণ নাকি বলতেন—আমার চেয়ে বড় আবার কে আছে, আমি ছাড়া আর কেই বা আছে যাকে আরাধনা করা যায়—মত্তঃ কো’ভ্যুধিকো’ন্যো’স্তি যশ্চারাপধ্যো মমাপরঃ।১৭ সমস্ত যজ্ঞে পুজো করতে হবে আমাকেই—অহমিজ্যশ্চ পূজ্যশ্চ। এটা বুঝতে হবে যে, সভ্যতার প্রথম লগ্নে বিশৃঙ্খল জনতার মধ্যে যিনি সবচেয়ে বলশালী তাঁর কাছে এই ব্যবহার অপ্রত্যাশিত নয়। দু-একটি পুরাণ বলেছে প্রথম রাজা হওয়ার কৃতিত্ব নাকি বেণেরই, পৃথুর নয়। তবে সব পুরাণই এ ব্যাপারে এককাট্টা যে, বেণের স্বেচ্ছাচার চরমে উঠলে ঋষিরা সব একজোট হলেন। আমরা অবশ্য ঋষিদের কথা বলি না, বলি, শুভকামী মানুষেরা সংঘবদ্ধ হলেন। একথা বলি এইজন্যে যে, সব পুরাণের মতেই পৃথুর পূর্ববর্তী সময়ে কোন সভ্যতা ছিল না। এমনকি পৃথিবীর মাটি পর্যন্ত ছিল অসমান—বিষমাসীদ্‌ বসুন্ধরা। পৃথুর আগে গ্রাম-শহরের কোন বিভাগই ছিল না, ছিল না কৃষিকর্ম। শস্য কিংবা পশুপালন। ব্যবসাবাণিজ্যের তো কথাই নেই—ন শস্যানি ন গোরক্ষা ন কৃষির্ন বণিকি্‌পথঃ১৮। ঠিক এই অবস্থায় কোথায় বা যজ্ঞ, কোথায় বা ঋষি! তাই বলেছি শুভকামী মানুষেরা একজোট হলেন। পৌরাণিকেরা বলেছেন ঋষিরা বেণ-রাজাকে শাপদগ্ধ করে জীবন্ত অবস্থাতেই তাঁর বাহু দুটি মন্থন করতে থাকলেন। বাঁ হাতটি মন্থনের ফলে জন্মাল নিষাদেরা, আর ডান হাত মন্থনের ফল হলেন পৃথু।

আমরা আবার একটু আগের কথায় চলে যাই। আসলে আমাদের সেই ইলাবৃতবর্ষের স্বৰ্গছেড়া দেবতারা ভারতের মর্ত্যভূমিকে কিছুতেই বশে আনতে পারছিলেন না। বেণই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইন্দ্রের ইন্দ্ৰত্ব অস্বীকার করে বসেন। ঋষিরা কথায় কথায় ইন্দ্র-বিষ্ণু ইত্যাদি দেবতাকে যজ্ঞে আহ্বান করবেন—এ তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। তিনি দেবতার অধিকার অস্বীকার করে বললেন—আমিই সব—ঘোষায়মাস স তদা পৃথিব্যাং পৃথিবীপতিঃ। বেণের বক্তব্য—যজ্ঞ করতে হয় আমার উদ্দেশ্যেই যজ্ঞ কর, আহুতি দিতে হয় তো আমাকেই দাও, আর দান করতে হলেও সেই দানের শ্রেষ্ঠ পাত্র আমি। যজ্ঞাধিপতি কখনই ইন্দ্র বা বিষ্ণু নন, যজ্ঞাধিপতি হলাম আমি স্বয়ং—অহং যজ্ঞপতি প্রভুঃ। বেণের এই বিদ্রোহের জন্য দেবসমাজকে কিছু করতে হয়নি। তাঁদের প্রতিভূ ঋষিরাই তাঁদের ঈপ্সিত কাজটি করে দিয়েছেন। বেণের দুই বাহু মন্থন করার মধ্যে যে রূপকই থাক না কেন, ঋষিরা বেণের পর এমন একজনকে সিংহাসনে বসাতে পেরেছেন, যিনি আর্যায়নের তাগিদ মেনে নিয়েছেন এবং যিনি দেবতা-ঋষির কর্তৃত্ব এবং প্রাধান্য মেনে নিয়েছেন। এই মেনে নেওয়ার ফলেই পৃথুও পরবর্তী কালে ভগবানের অন্যতম অবতার বলে চিহ্নিত হয়েছেন। অন্যদিকে বেণের অন্য বাহু থেকে বেরিয়ে আসা নিষাদদের অস্তিত্ব স্বীকার করে ঋষিরা বুঝিয়ে দিলেন ভারতবর্ষে অতি-দাক্ষিণ্যযুক্ত দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বামস্বভাব নিষাদ-মানুষও রইল। তবে এ সব হল ত্রেতা যুগের কথা অর্থাৎ আমার মতে কলির দ্বিতীয় ‘ফেজে’র কথা।

জনসাধারণ বিপ্রতীপ স্বার্থপর আচরণের প্রতীক বেণ তো ধ্বংস হলেন। পৃথুও ব্ৰহ্মার আদেশে গোরূপা পৃথিবী দোহন করে তাকে শস্যশালিনী করে তুললেন। কিন্তু মুশকিল হল, এতে সবার অন্ন-পানের ব্যবস্থা হলেও জমি নিয়ে ঝগড়াটা বোধহয় চলছিলই। কূর্মপুরাণের পরবর্তী বচন থেকে সেটা বোঝাও যায়। সম্পদ এবং তার মালিকানা নিয়ে যে অর্থনৈতিক অভিসন্ধির কথা পণ্ডিতেরা ব্যাখ্যা করেন তার মূল বোধটা এসেছিল বোধহয় জমি আর স্ত্রীলোক নিয়েই। পুরাণের অন্যত্র সমস্ত স্ত্রীলোকেরাই অবশ্য এক ধরনের জমি বলেই স্বীকৃত। পৃথু মহারাজের জমানায় পৃথিবী দোহন করে অন্ন-বস্ত্র পাওয়া গেলেও স্ত্রীলোক আর ধনসম্পত্তি নিয়ে লড়াই চলছিল। এমনকি যাদের স্ত্রী এবং ধনসম্পত্তি দুই-ই ছিল, তারাও ছিল এই লড়াইতে সমান অংশীদার। তারা পরস্পরের, জমি এবং বউ নিয়ে কাড়াকাড়ি আরম্ভ করেছিল—ততস্তা জগৃহুঃ সর্বা হ্যন্যোন্যং ক্রোধমূর্চ্ছিতাঃ। আপ্তদারধনাদ্যাস্তু বলাৎ কালবলেন চ॥১৮ পুরাণ লিখেছে—ঝগড়াটা হচ্ছিল কালবশে, গা-জোয়ারি করে। কিন্তু আমরা বলব—ঝগড়ার মূলটা মহাকালের গভীর নয়, মালিকানার তত্ত্ববোধে। ঠিক এই কারণেই দুটো নিয়ম করতে হল, এবং তা করতে হল স্বয়ং ব্রহ্মাকে।

প্রথম বিধান অবশ্যই স্ত্রীসংক্রান্ত। সৃষ্টির আরম্ভেই প্রজাপতি ব্রহ্মার কন্যাগমনের সংবাদে যদি কোন রূপকই থাকে, তবুও সভ্যতার আদিতে সাধারণের মধ্যে যে মৈথুন সংক্রান্ত কোন বিধি-বিধান ছিল না, বরঞ্চ দারুণ শিথিলতা ছিল, এটা ভাবাই স্বাভাবিক। পৌরাণিকেরা বলেছেন ব্রহ্মার দেহটি দুভাগ হয়ে একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রীরূপ তৈরি হল। ঠিক এই অবস্থায় দ্বিধাভিন্ন অর্ধেক মানুষ হয়ে জন্মাবার ফলে এদের পারম্পরিক মিলনের টান তাই রয়েই গেল, রয়ে গেল সম্পূর্ণ হওয়ার ইচ্ছে। দুইয়ের এই পারস্পরিক মিমীলিষা বা মিলনের ইচ্ছেই হল কাম, যে কামনা রূপ ধারণ করেছে শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিকলায়।

পুরাকালে বিবাহ বলে কোন সামাজিক বন্ধন ছিল না। যা ছিল তা অথর্ববেদের কায়দায়—এ মেয়েমানুষ, এ পুরুষ মানুষ, একজন যুবক, অন্যজন যুবতী—এও যৌন মিলন করেনি, অন্যজনও নয়—ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী। দুজনে মিলনের জোড় বাঁধলেই মিথুন এবং তাদের মিলনকর্ম মৈথুন। ব্রহ্মা নিজকন্যা সরস্বতীর সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করে—হ্যাঁ মিলন সম্পূর্ণ করেই—মিলনের দেবতাকে শাপ দিয়ে বললেন—তুমি শিবের চোখের আগুনে ভস্ম হবে। কাম বললে—সে কি কথা! আপনিই না আমাকে এরকম করে স্ত্রী-পুরুষের ইন্দ্রিয় ক্ষোভ জন্মাতে বলেছেন। আপনি আমাকে বলেননি—পুরুষ আর রমণী হলেই হল—স্ত্রীপুংসোরবিকারেণ—দুজনের মন একেবারে উথাল-পাথাল করে দেবে—ক্ষোভ্যং মনঃ প্রযত্নেন ত্বয়ৈবোক্তং পুরা বিভো! এখন আপনিই আমাকে দুষছেন? সত্যিই তো সৃষ্টির আদিতে কামনার দেবতা কি করে মনুষ্য সম্পর্কের কথা বুঝবে! মাতা, কন্যা, পিতা, পুত্র—এ সব সামাজিক সম্পর্ক অনেক পরের ব্যাপার। পৌরাণিকদের বিশ্বাস ছিল পুরাকালে ব্রহ্মা নাকি জোড়ায় জোড়ায় নারী পুরুষ তৈরি করেছিলেন। তাদের মনে নাকি অদ্ভুত এক আনন্দ হওয়ায়—ততে বৈ হর্ষমানাস্তে—তারা কামনায় পরস্পর মৈথুনে প্রবৃত্ত হল—অন্যোন্যা হৃচ্ছয়াবিষ্টা মৈথুনায়োপচক্রমে।১৯ তাদের সুবিধে ছিল বিরাট। তারা যত মৈথুনই করুক, তাদের ছেলেপুলে হত না, কারণ তখন নাকি রমণীদের মাসে মাসে ঋতুকাল ছিল না। কাজেই প্রচুর মৈথুনের পরেও—সবিতৈরপি মৈথুনঃ—রমণীরা পুত্র-কন্যা প্রসব করত না। সেই মিথুনজাত মানুষেরা নাকি আয়ুশেষে একেবারে আরও একটি যুগল ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়ে স্বর্গত হত।

তবে এ সব সত্য যুগের কথা। ত্রেতা যুগেই লোকজন প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় পৌরাণিকেরা বুঝতে পেরেছেন—মাসে মাসেই স্ত্রীলোকের ঋতুকাল ঘুরে আসে আর মাসে মাসে মিলনের ফলেই—মাসি মাস্যপগচ্ছতাম্‌—গর্ভোৎপত্তিও হয়। কিন্তু এই গর্ভোৎপত্তির মধ্যে শৃঙ্খলা আসেনি তখনও। সমাজে বিবাহ বস্তুটা কি অথবা নিদেনপক্ষে মৈথুন-বদ্ধ পুরুষ কিংবা নারী পরস্পরের কাছে দায়বদ্ধ কিনা—সেই সামাজিক সমস্যা তখনও তৈরি হয়নি। পুরাণকারেরাও প্রায় কোথাও নির্দিষ্ট করে বলেননি, যে, স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক মিলনে শৃঙ্খলা ব্যাপারটা কি করে এল। তবে হ্যাঁ, খোদ মহাভারতের মধ্যে পৌরাণিক কথাবার্তা কিছু আছে। আমরা যদি সেখান থেকে স্ত্রী-পুরুষের প্রাথমিক ব্যবহারের একটা হদিশ পাই, তাতে পুরাণের মর্যাদা কিছু কমে না।

মহাভারতে মহারাজ পাণ্ডু যখন ‘ছেলে হল না, ছেলে চাই’ বলে পাগল-পারা হয়ে উঠলেন, তখন কুন্তী অনেক ধর্মকথা শোনালেন। দোষের মধ্যে পাণ্ডু বলেছিলেন—একজন উপযুক্ত ব্রাহ্মণের সঙ্গে সঙ্গত হয়ে একটি পুত্র জন্মের সাধন কর, কুন্তী! কুন্তী বড়ো দুঃখিত হয়ে এক পতিব্রতার কাহিনী শোনালেন বটে তবে ভুলেও তাঁর কুমারীকালের সূর্য-সম্ভোগ বর্ণনা করলেন না। পাণ্ডু তখন ভালো মানুষের মেয়ে কুন্তীকে বললেন—দেখ বাপু, তুমি কি জান যে, এককালে মেয়েদের দুয়োর ছিল সবার জন্য খোলা—অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন্‌ বরাননে। তারা ছিল স্বতন্ত্র, স্বেচ্ছাবিহারী। তারা যে কোন পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারত এবং তাতে কোন অধর্ম ছিল না, বরঞ্চ সেইটাই ছিল ধর্ম—স হি ধর্মঃ পুরাভবৎ। পাণ্ডু বললেন—কুন্তী। তুমি হয়তো আমার কথা মানতে চাইবে না, কিন্তু প্রমাণ দিলে তো তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখ—এখনও উত্তরকুরু দেশে এমনি প্রথাই চালু আছে—উত্তরেষু চ রম্ভোরু কুরুষু অদ্যাপি পূজ্যতে।২০

উত্তর-কুরু দেশটা কোথায় জানেন? পণ্ডিতের বলেন—মধ্য এশিয়ার পামির বা পূর্ব তুর্কীস্থান যদি ইলাবৃত-বর্ষ হয় এবং সেটা যদি স্বর্গ হয় তবে তারও উত্তরে হল ‘উত্তর কুরু’। গিরীন্দ্রশেখর লিখেছেন—ওটাই ব্ৰহ্মলোক এবং বিষ্ণুলোক। ঋগ্‌বেদে আছে বিষ্ণু ‘উন্নত’ অর্থাৎ উত্তরদেশবাসী এবং তাঁর রাজ্যে প্রচুর শৃঙ্গী হরিণ পাওয়া যায়—ভূরিশৃঙ্গাঃ গাবঃ। গিরীন্দ্রশেখর আরও লিখেছেন—“পৌরাণিক নির্দেশ অনুসারে মনে হয় বিষ্ণুর রাজ্য ক্যাসপিয়ন সাগরের উত্তরে ছিল। হিন্দু তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী ক্যাসপিয়ন সাগরের তীরে যাইতেন তাহার প্রমাণ আছে। (দ্রষ্টব্য : ‘বাকুতে হিন্দুমন্দির’ নামক প্রবন্ধ : নূতন পত্রিকা, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)। উত্তর কুরু সাইবিরিয়া বা রাশিয়ার কোন স্থান বলিয়া মনে হয়। উপনিষদে ব্ৰহ্মলোক যাইবার পথে ‘আর’ হ্রদ ও বিজরা নদীর উল্লেখ আছে। আর হ্রদ ও Lake Aral বোধ হয় একই। বিজরা ও আধুনিক Pechora একই বলিয়া মনে হয়।২১

উত্তর-কুরু ব্রহ্মলোক কি বিষ্ণুলোক সে কথা স্পষ্ট করে জানি না বটে, কিন্তু পাণ্ডু যে উত্তরকুরুর সমাজ-সচল একটি প্রথার উল্লেখ করেছেন, সে যে দেব-সমাজেরই নিয়ম-কানুন, তা স্বীকার করে নিতে দোষ নেই বোধহয়। এখন পাণ্ডুর কথার সূত্র ধরে আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি—কবে থেকে এসব নিয়ম চালু হল যে, মেয়েরা স্বামীর ঘরেই থাকবে?

পাণ্ডু বলতে থাকলেন। পাণ্ডু যা বললেন, তা তাঁর কালের পুরাণ কথা। অবশ্য পাণ্ডু যে সময়ের কথা বললেন তাতে দেখা যাচ্ছে তখন স্ত্রীলোক একটি পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধা আরম্ভ করেছে। পাণ্ডু বললেন—মহর্ষি উদ্দালকের ছেলে হলেন শ্বেতকেতু। পাঠক। এই দুজনেই উপনিষদের নাম-করা মুনি, কাজেই পাণ্ডু হয়তো উপনিষদের যুগের বৃত্তান্ত বলছেন, তাও হতে পারে। পাণ্ডু বললেন—পুত্র শ্বেতকেতু একদিন দেখলেন, তাঁর মাকে তাঁর বাবার সামনেই আরেক বামুন এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বামুন এসে তাঁর মার হাত ধরে বলল—চল, আর মাও চললেন। জোর করে নয়, এমনিই। কিন্তু পুত্র শ্বেতকেতুর মনে হল যেন জোর করেই তাঁর মাকে নিয়ে গেল ওই বিটলে বামুনটা—নীয়মানাং বলাদিব। কিন্তু জোর করে যে নয় তার প্রমাণ দিলেন স্বয়ং তার বাবা। ক্রুদ্ধ শ্বেতকেতুকে দেখে তাঁর বাবা বললেন—এত রাগের কি হয়েছে বাছা! এই তো চিরকালের ধর্ম—মা তাত কোপং কার্ষীঃ ত্বমেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।২২ তুমি কি জান না বাবা, মেয়েরা হল সব ছাড়া-গরুর মত—যথা গাবঃ স্থিতাস্তাত। যখন যে ইচ্ছে, যে কোন বর্ণের পুরুষ-পুঙ্গব যে কোন স্ত্রীলোককে ভোগ করতে পারে—অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণানাম অঙ্গনা ভুবি। শ্বেতকেতুর বাবা উদ্দালক যে যৌন ব্যাপারে খুব উদার ছিলেন সেটা বোঝা যায়। কেননা এই উদ্দালক উপায় থাকা সত্ত্বেও শিষ্যকে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সুযোগ দিয়ে শ্বেতকেতুর জন্ম দিয়েছিলেন—উদ্দালকঃ শ্বেতকেতুং জনয়ামাস শিষ্যতঃ।

শ্বেতকেতু সব শুনলেন বটে কিন্তু সেদিন থেকেই তিনি এই নিয়ম বেঁধে দিলেন যে, কোন মেয়েই তার স্বামীকে অতিক্রম করে অন্য পুরুষের সঙ্গ করতে পারবে না। পাণ্ডু বললেন—শ্বেতকেতুর এই বচনের পর থেকেই সমাজে এটা পাপ বলে গণ্য হচ্ছে—অদ্য প্রভৃতি পাতকম্। নচেৎ পাণ্ডুর ভাবটা এই যে, অন্য পুরুষের সঙ্গ কিছু দোষের নয়। বিশেষত পুত্রার্থে। বিশেষত স্বামীই যখন এই নিয়োগে অনুমতি দিচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে কি, পাণ্ডু যেখানে কুন্তীকে উত্তরকুরু দেশের রমণীকুলের দৃষ্টান্ত দিয়ে আপন স্ত্রীর পতিব্রতা-বাতিক ভাঙার চেষ্টা করছেন, তাতে বেশ বুঝি তাঁর কালে এই ধরনের সামাজিক শিথিলতা ছিল।

আমাদের আলোচ্য প্রধান পুরাণগুলির মৌলাংশও যেহেতু মহাভারতের যুগের বেশি পরে লেখা নয়, তাতে এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই করা যেতে পারে যে, পুরাণের যুগেও সামাজিক শিথিলতা ছিল যথেষ্ট, যদিও সাধারণ মেয়েমানুষকে পতিব্রতার দীক্ষা দিতে পৌরাণিকেরা ছিলেন শুধুমাত্র মৌখিকভাবে দায়বদ্ধ। পুরুষ মানুষেরা স্ত্রীসংক্রান্ত বিষয়ে নিজেরা দায়হীন, আচরণহীন, অথচ স্ত্রীলোকের কর্তব্য বিষয়ে তাঁদের এই যে মৌখিকতা—এ মৌখিকতার একমাত্র কারণ হল—তাঁরা নিজেরা বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁদের নিজেদের স্ত্রীরা অন্য পুরুষের মোহগ্রস্ত হলে মানসিক স্থিরতা নষ্ট হয় বটেই। তবু বলব এই যে শিথিলতা—এর বেশির ভাগটাই দেবতা, ঋষি বা পৌরাণিক রাজাদের নিজের কালের নয়, এ তাঁদের পূর্বকালের। মৎস্যপুরাণ থেকে একটি কাহিনী উদ্ধার করলেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

মৎস্যপুরাণের এই ঘটনা মহাভারতে আছে, এমনকি ঋগ্‌বেদেও আছে। কাজেই এই শিথিলতা পৌরাণিকদের পূর্বকালের, যা তাঁরা তাঁদের কালেই পুরাণো ঘটনা বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। আমরা একই বংশে পর পর দুটি শিথিলতার উদাহরণ দেব। তবে সামজ এখন সেই পর্যায়ে নেই যেখানে রমণীরা গাভীর মত উন্মুক্ত। সমাজে এখন বিবাহাদি চালু হয়ে গেছে এবং পরপুরুষের আনাগোনায় নারীরাও বিব্রত বোধ করতে আরম্ভ করেছে। দেবতা, মুনি এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা সকলেই এখন বিবাহ ব্যাপারটা বোঝেন, কিন্তু সময় বুঝে মানুষ দেখে রমণীরা হৃদয় বা শরীর লাভের জন্য তাঁরা এখনও সাধারণ মানুষের মতই নিয়ন্ত্রণহীন। ঘটনাটা বলি।

উশিজ মুনির স্ত্রীর নাম মমতা আর উশিজের ছোট ভাই স্বনামধন্য বৃহস্পতি। বিবাহিত মহিলা হলেও মমতার চেহারা ভারী সুন্দর—মমতা বরবর্ণিনী। একদিন বড়দাদা উশিজের অনুপস্থিতিতে উতলা বাতাস আর যৌবনের অভিসন্ধিতে বৃহস্পতি মমতার মিলন কামনা করলেন—মমতামেত্য কামতঃ। মমতা-বৌদি বললেন—সে কি কথা ঠাকুর পো, আমি তোমার বড় ভায়ের বৌ না! তার ওপরে এখন আমি গর্ভবতী, এখন তুমি ক্ষ্যামা দাও—অন্তর্বর্ত্যুস্মি তে ভ্রাতুর্জেষ্ঠস্য তু বিরম্যতাম্‌। যতখানি অনভিলাষে তার থেকেও অনেক বেশি গর্ভপাতের ভয়ে মমতা ভাবী ছেলের গুণরাশি কীর্তন করে বললেন—জান! ছেলে আমার গর্ভে থেকেই সাঙ্গ বেদ উচ্চারণ করছে। ঠিক এই অবস্থায়, না, না, তোমার শক্তিও যে অমোঘ বৃহম্পতি। এই সময়টা তুমি পার হতে দাও, তার পরে আমার যা ইচ্ছে কোর তুমি—অস্মিন্নেব গতে কালে যথা বা মন্যসে বিভো।২৩

মহাতেজা বৃহস্পতি শুনলেন না মমতার অনুনয়, কারণ মহাত্মা হলেও সেই মুহুর্তে তিনি কামাত্মা হয়ে পড়েছেন কামাত্মা সা মহাত্মাপি। মনকে দমন করতে না পেরে তিনি মমতার তাৎক্ষণিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। চরম মুহুর্ত যখন এগিয়ে এল তখন বাধা দিল স্বয়ং মমতার গর্ভস্থ সন্তান। গর্ভেই যে বেদ উচ্চারণ করেছে, সে গর্ভ থেকেই বলে উঠল—ওগো বাক্যে বৃহস্পতি—বাচামধিপ—এই গর্ভে দুজনের স্থান হবে না। আপনার শক্তিক্ষয় বৃথা হবে না নিশ্চয়, কিন্তু আমি যে এখানে পূর্বের অতিথি—পূর্বঞ্চাহমাগতঃ। বড় ভায়ের ছেলের ছোট মুখে বড় কথা শুনে ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি যা বললেন তা পঞ্চানন তর্করত্ন মশায়ের বঙ্গানুবাদে শুনুন। বৃহস্পতি বললেন, “তুই গর্ভে থাকিয়া যখন আমার ঈদৃশকালে বীর্যপাত করিতে নিষেধ করিতেছিস ; তখন তুই দীর্ঘ তমোরাশির মধ্যে প্রবেশ করিবি।”২৪ মৎস্যপুরাণ বলেছে বৃহস্পতির এই শাপে মমতার ছেলেটি দীর্ঘতমা নামে জন্ম নিল। শাপের ফলে ঋষির নাম দীর্ঘতমা হল—শুধু এইমাত্র হতে পারে না। আমরা বেদ, মহাভারত ইত্যাদির প্রমাণে জানি—এই ঋষি অন্ধ হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জীবনে অন্ধকার ছাড়া কিছু ছিল না বলেই তিনি দীর্ঘতমা।

দীর্ঘতমা বড় হয়ে বৃহস্পতির মতই হয়ে উঠলেন। তবে গর্ভাবস্থাতেই যিনি বেদমন্ত্রের সঙ্গে কামপ্রবৃত্তিও দেখেছেন তাঁর পরবর্তী জীবনে কিছু বিকার ঘটবে এইটেই স্বাভাবিক। পুরাণকার অবশ্য এই বিকারের জন্য একটি গল্প বলেছেন। দীর্ঘতমা তখন ছোট ভায়ের আশ্রমে থাকেন। হঠাৎ সেখানে একদিন একটি ষাঁড় এসে উপস্থিত হল এবং যজ্ঞের কুশ-টুশ মাড়িয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিল। দীর্ঘতমা ষাঁড়ের শিংদুটো ধরে টানতে থাকলেন এবং যাঁড় যখন আর কোনক্রমেই এঁটে উঠতে পারল না তখন সে বলল—আমি তোমায় বর দেব। দীর্ঘতমা বললেন—নচ্ছার কোথাকার, পরের বাড়িতে খাওয়া ষাঁড়, তোকে কিছুতেই ছাড়ব না। যাঁড় বলল—আমাদের কোন পাপ নেই, চুরির দোষও আমাদের গায়ে লাগে না। ধর্ম জিনিসটা তোমাদের ব্যাপার, যারা দু’পেয়ে প্রাণী। চতুষ্পদ জন্তুর ধর্ম অধর্ম, খাওয়া-দাওয়ার বিধিনিষেধ মৈথুনের, বিচার কিছুই নেই। দীর্ঘতমা তখন সেই ষাঁড়ের কাছে আচ্ছা করে গো-ধর্ম শিখে নিলেন। গো-ধর্ম মানে যাঁড় বা গরু যেভাবে জীবন-যাপন করে, সেই ধর্ম শিখে নিলেন এবং এই বিদ্যা তাঁর বেশ পছন্দ হল।

গোধর্ম-শিক্ষার প্রথম প্রয়োগের জন্য দীর্ঘতমা বেছে নিলেন তাঁর ছোট ভাইগের বৌকে, যিনি মহর্ষি গৌতমের পত্নী। ভ্রাতৃবধুর মিলন কামনা করলে সে তো ভারী ক্ষুব্ধ হল। সে কোনমতে ভাসুর-ঠাকুরকে প্রত্যাখ্যান করল বটে কিন্তু যে দীর্ঘতমা যাঁড়ের ব্যবহার শিখেছেন, তিনি করলেন কি, যেখানেই ভাই-বৌ যায়, সেখানেই ষাঁড়ের কায়দায় উপস্থিত হতে লাগলেন—সো’নড্বানিব।২৫ গৌতমের বৌ তখন তাঁকে খুব একচোট গালাগালি দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁর হাত দুটো ধরলেন চেপে। বললেন—তুমি এ রকম উল্টো ব্যাভার করছ কেন, আমি যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই আমার পেছন পেছন ধাওয়া করছ ষাঁড়ের মত—অনড্বানিব বর্ত্তসে। তোমার কি গম্যাগমের ভেদবুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে যে, মেয়ের সমান ভাইবৌয়ের সঙ্গ কামনা করছ—গোধর্মাৎ প্রার্থয়ন্‌ সুতাম্‌। উত্ত্যক্ত, বিরক্ত গৌতমপত্নী শেষ পর্যন্ত রেগে বললেন—দাঁড়াও তোমায় দেখাচ্ছি মজা, বদমাশ! তোকে আজকে ঘরছাড়া করব—দুবৃত্তং ত্বাং ত্যজাম্যদ্য। বেটা কানা, বুড়ো! দুরবস্থায় ঘরে বসে খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি—যস্মাৎ ত্বমন্ধো বৃদ্ধশ্চ ভর্ত্তব্যো দুরধিষ্ঠিতঃ—তার এই ব্যাভার! গৌতমপত্নী এবার গোধর্মী দীর্ঘতমাকে ধরে একটা প্যাঁটরার মধ্যে পুরে ফেলে দিলেন গঙ্গায়। দীর্ঘতমা ভাসতে ভাসতে চললেন।

এই পুরাকাহিনীতে একটা ঘটনা বেশ প্রমাণ হল। প্রমাণ হল—যে সমাজে রমণীরা ছাড়া-গরুর মত বলে পুলকিত বোধ করছিলেন উদ্দালক ঋষি, সেই সমাজে পুরুষেরাও অনেকে ছিলেন ষাঁড়ের মত। বোঝা যাচ্ছে রমণীরা কেউ বিব্রত বোধ করছে, কেউ বা সাংঘাতিকভাবে বাধা দিচ্ছে তবু ষাঁড়ের মত পুরুষ মানুষও সমাজে থাকেই। দেবতা হোন আর ধর্মপ্রাণ তপোধনই হোন, কারোরই এই ষণ্ড-স্বভাব যায় না। দেবতা-মুনির মনুষ্যায়ণে আপনাদের আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু যণ্ডায়ণে আপত্তি করবেন কি করে? ঋষি-মুনিদের মধ্যেও অন্তত দু-একজন যে কতখানি ষাঁড়ের মত ব্যবহার করতে পারেন, তার প্রমাণ মিলবে ওই দীর্ঘতমারই পরবর্তী আচরণে। গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে দীর্ঘতমা কোথাও তীরে এসে ঠেকলেন। তাঁকে তুলে নিলেন প্রহ্লাদের নাতি দৈত্যরাজ বলি।

এইবার লক্ষ্য করে দেখবেন—ঋষি-মুনির দৈত্য-দানব-রাক্ষসদের কী সুন্দর ইন্ট্যার‍্যাক্‌শন হচ্ছে। দৈত্যরাজ বলির স্ত্রী সুদেষ্ণা, তাঁর ছেলে হয় না। তখনকার দিনে ছেলে না হলে, যেন তেন প্রকারেণ ছেলে অবশ্যই চাই। আর কে না জানে নিয়োগ প্রথায় ছেলে জন্মাবার ব্যাপারে ব্রাহ্মণ বড়োই উপাদেয়। বলি ভাবলেন, ব্রাহ্মণ উপস্থিত, এই সুযোগ। আমরা বলি, প্রবলপ্রতাপ দৈত্যরাজের রাজ্যের ভেতরে বাইরে আর কি কোন ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তবে এ কথা ঠিক, যে কোন কালের যে কোন পুরুষ মানুষই স্ত্রীকে অন্য পুরুষের কাছে পুত্রার্থে নিয়োগ করুন না কেন, তাঁর মনে কিঞ্চিৎ বিকার হবেই। এ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ কানা বলে রাজা হয়তো ভেবেছিলেন যৌবনবতী স্ত্রীর রূপই সে দেখতে পাবে না, উপরন্তু যে বৃদ্ধ তাঁকে দিয়েই কর্তব্য-নিষেকটুকু করা ভাল। কিন্তু গোধর্মী দীর্ঘতমা অত বোকা নন। চোখ না থাকলে তার অন্য ইন্দ্রিয় বেশি সজাগ থাকে, বিশেষত সে অনুভবে সব পেতে চায়—রূপ, রস, যৌবন—সব।

নিয়োগ প্রথার নিয়ম হল—যে পুরুষ গর্ভাধান করবেন তিনি রাতের আঁধারে এই কাজ করবেন, দিনে নয়। তার ওপর তিনি নিজের গায়ে বেশ খানিকটা ঘি মেখে নেবেন এবং মৌনী থাকবেন—ঘৃতাক্তো বাগ্‌যতো নিশি।২৬ এ সব নিয়মের কোন ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা বুঝি যে, ঘিয়ে জ্যাবজ্যাবে পুরুষের সঙ্গে রতিতে কোন স্ত্রীই যাতে আনন্দ না পায় সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। তার ওপরে তার সঙ্গে প্রেম সম্ভাষণও যাতে সম্ভব না হয় তার জন্যই বোধহয় পুরুষটির মৌনী থাকার ব্যবস্থা। যাতে তার রূপ দেখে ভাল না লাগে সেই জন্য রাত্রের ব্যবস্থা। কিন্তু এত নিয়ম সত্ত্বেও স্ত্রীরা পুরুষের চেহারা বুঝে ফেলত, কথাও যে হত না, তা নয়।

রাজমহিষী সুদেষ্ণা কানা-বুড়ো দীর্ঘতমাকে দেখেই আর তাঁর কাছে ঘেঁসলেন না—অন্ধং চ বৃদ্ধং তং জ্ঞাত্বা ন সা দেবী জগাম হ।২৭ তিনি দীর্ঘতমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন শূদ্রা ধাত্রীকে। ঋষি শূদ্রা-সঙ্গে বেশ কয়েকটি পুত্র উৎপাদন করলেন যাঁরা পরবর্তীকালে ব্রহ্মবাদী মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলে পরিচিত। রাজা বলি ঋষিধর্মে প্রবীণ এতগুলি ছেলেপুলে দেখে পরম পুলকিত হয়ে দীর্ঘতমাকে বললেন—বাঃ! তাহলে এইগুলিই আমার ছেলে! দীর্ঘতমা বললেন—মোটেই নয়, এগুলি আমারই ছেলে। রাজমহিষী সুদেষ্ণাকে পাননি বলে দীর্ঘতমার মনে বা কিছু ক্ষোভও ছিল। রাজাকে তিনি তাই দগ্ধ হৃদয়ে বললেন—তোমার স্ত্রী আমাকে অন্ধ-বুড়ো জেনে অপমান করেছে, তোমার নিয়োগমত রানী সেখানে আসেননি, এসেছিল তার শূদ্রা ধাত্রী। এগুলি তাই আমারই ছেলে।

দানব রাজা তো মুনির কথা শুনে সুদেষ্ণাকে খুব বকলেন—ভার্যাং ভর্ৎ সয়ামাস দানবঃ। রাজা আবার তাঁকে সালংকারে মনোমমাহিনী সাজে সাজিয়ে ঋষির কাছে পাঠালেন। সজ্জিতা রমণীকে অনুভবে কাছে পেলেন ঋষি। নিয়োগের প্রথামত মুনির দেহ কিন্তু ঘিয়ে ভেজানো দেখছি না ; তাঁর দেহে লেপন করা হয়েছে দই, একটু লবণ এবং মধু দিয়ে—দধ্লা লবণমিশ্রেণ ত্বভ্যক্তং মধুকেন তু। অর্থাৎ পঞ্চামৃতের দুই অমৃতে একটু নুন পড়েছে। গোধর্মে শিক্ষিত ঋষি চোখে দেখতে পান না বটে তবে প্রতি অঙ্গে রানীকে অনুভব করবার জন্য সুদেষ্ণাকে তিনি কি বললেন জানেন? মুনি বললেন—আমার এই দই-লবণ আর মধুমাখা দেহখানি একটুও ঘেন্না না করে সব জায়গায় চাটতে থাক দেখি—লিহ মাম্ অজুগুপ্সন্তী আপাদতলমস্তকম্।২৭ক যদি এইভাবে লেহন করতে পার তবেই পুত্র পাবে তুমি।

পুত্র জন্মানোর নিয়োগে বৃত হয়েছেন বলে এত ঘৃণিত আচরণ আর কেউ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এটা অবিশ্বাস্য নয় এই জন্যে যে, ঋষি অন্ধ এবং গোধর্মী বলেই এত বিকার সম্ভব হয়েছে। তখনকার সামাজিক কাঠামোয় যে স্ত্রীলোককে নিয়োগের ঢেঁকি গিলতে হচ্ছে, তিনি রাজরানী হলেও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না বিকৃত রুচির এই ঋষিকে বারণ করার। অতএব সুদেষ্ণা মুনির দেহ চাটতে থাকলেন। চাটতে চাটতে সুদেষ্ণা কোন অঙ্গই বাদ দিলেন না, বাদ দিলেন শুধু মুনির উপস্থদেশ—লজ্জায় অথবা ঘেন্নায়। মুনি বললেন—তুমি যখন এই অঙ্গ বাদ দিলে, তখন তুমি গুহ্যদেশহীন এক পুত্র পাবে।

সুদেষ্ণা বললেন—আপনি এ কি বললেন মুনিবর! আমি যথাসাধ্য যথাশক্তি আপনাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি, আপনি প্রসন্ন হোন। রানীর অনুনয়ে মুনি প্রসন্ন হলেন। হবেনই বা না কেন, ভাইবৌয়ের সঙ্গে গোধর্ম করতে গিয়ে লাথি-ঝাঁটা খেয়েছেন, সেই মানুষের গা চেটে আনন্দ দিয়েছেন রাজারানী। মুনি বললেন—ঠিক আছে আমার কথাটা তোমার ছেলের ব্যাপারে না লেগে তোমার নাতির ক্ষেত্রে লাগবে এবং গুহ্যহীন হলেও তার কোন অসুবিধে হবে না। এবারে পুলকিত হয়ে বললেন—তুমি যখন আমার লিঙ্গটি ছাড়া আর সব অঙ্গই লেহন করেছ—প্রাশিতং যৎ সমগ্ৰেষু ন সোপস্থং শুচিস্মিতে—অতএব তুমি দেবতাদের মত পাঁচ ছেলে পাবে—ধার্মিক সুচরিত্র।২৮ এই ছেলেরাই নাকি অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, কলিঙ্গ এবং পুন্ড্র।

বাংলাদেশ এবং তার চারপাশের ভাগ্য মূল থেকেই এই বিকৃতরুচি মুনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, থাকুক। কিন্তু এই বিকৃতি এসেছিল সেই দিন থেকে, যেদিন শ্বেতকেতুর দাম্পত্য আইন চালু হয়েছিল। পুরাণে এবং মহাভারতে নিয়োগ ব্যবস্থার অন্ত নেই, কিন্তু মনুর সময়েই দেখছি ধর্মশাস্ত্ৰকারেরা আর নিয়োগের পক্ষপাতী নন। একেবারে নিরুপায় অবস্থায় মনু নিয়োগের কার্যকারিতা স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু সব সময় মনু মহারাজ এই প্রথার বিপক্ষে। হয়তো মনুর সময়ে এর প্রয়োজনও ছিল না। আর্যায়নের প্রথম পর্যায়ে পুরুষ-বৃদ্ধির প্রয়োজন যত ছিল, পরবর্তী সময়ে তা ছিল না। এই কারণেই সমাজে শৃঙ্খলা, বিশেষত নারী-পুরুষের দাম্পত্য শৃঙ্খলা, বাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক শিথিলতা নিন্দিত হতে আরম্ভ করে।

অবশ্য পুরাণকারদের মৌখিক উপদেশে শৃঙ্খলার কথা যথেষ্ট আছে, কিন্তু তাঁদের সমাজের বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। তাঁরা তত্ত্বগতভাবে যে জিনিসটা হওয়া উচিত বলে মনে করতেন তার সঙ্গে মিল ছিল না, যা ঘটত তার। অবশ্য সেজন্য পৌরাণিকের মিথ্যাবাদিতার দায় নেই, কেননা যে কোন সমাজেই এটা হয়। এমনকি আজকের দিনেও যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাস আমাদের ঈপ্সিত, যে সব সংস্কারের জন্য আমরা আন্দোলন করি, লেখালেখি করি, বক্তৃতা দিই, সেগুলির সঙ্গে প্রায়ই যোগ থাকে না, যা বাস্তবে ঘটে, বা ঘটে চলেছে—তার। পুরাণকারদের সমাজ ব্যবস্থা বুঝতে গেলেও এই বাস্তববোধটুকু থাকা দরকার।

এ কথাটা প্রথমে বোঝা প্রয়োজন যে, সমাজ বলে যে কথাটা প্রচলিত, সেটা সব সময়েই একটা সচল ব্যাপার। এই সচলতার কারণেই সমাজকে ধরে রাখার জন্য যে নিয়মগুলি করা হয়, তার বিপর্যয়ও ঘটে। নিয়ম এবং তার বিপর্যয়—এইটাই সুস্থ এবং সচল সমাজের লক্ষণ। যাঁরা মনে করেন এই কলিযুগে সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে, ত্রেতা যুগে কিংবা দ্বাপর যুগে বড়ো ভাল সময় ছিল, তাঁরা ভুল ভাবেন। যাঁরা ভাবেন দ্বাপর-ত্রেতায় বর্ণাশ্রম ধর্ম একেবারে নিখুঁতভাবে মানা হত, পুরুষেরা সব সদাচার পালন করত আর মেয়েরা ছিল সব সতী-সাধ্বী, কোন অনাচার কু-আচার কিচ্ছু ছিল না—তাঁরাও ভুল ভাবেন।

সত্যি কথা বলতে কি—এই অনাচারহীন সদাচার-পরায়ণ যুগকল্পনা একটা ‘উটোপিয়া’ মাত্র, সুস্থ সমাজ কখনও কাল্পনিক সমাজের কায়দায় চলে না। বস্তুত যে ত্রেতাযুগে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রচলন হয়, সেই ত্রেতাযুগেই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বারোটা বেজে গিয়েছিল। বায়ুপুরাণ সাক্ষী দিয়ে বলবে—ব্রহ্মা লোকহিতার্থে ত্রেতাযুগে বর্ণাশ্রমের নিয়ম তৈরি করলেন বটে কিন্তু জনসাধারণ তা মোটেই মানল না—এবং বর্ণশ্রমাণাং বৈ প্রবিভাগে কৃতে তদা। যদাস্য ন ব্যবর্ত্তন্ত প্রজা বর্ণাশ্রমাত্মিকাঃ।২৯

কাজেই যাঁরা ভাবছেন, ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র শূদ্র শম্বুকের তপস্যায় বর্ণবিধির লঙ্ঘন দেখে তাঁকে হত্যা করলেন আর বর্ণ এবং আশ্রম সব একেবারে ঠিকঠাক হয়ে গেল—তাঁরাও ভুল ভাবছেন। পুরাণের মধ্যে দেখবেন বার বার ব্রহ্মা মানসী প্রজা সৃষ্টি করছেন। এই মানসী প্রজা সৃষ্টি কাল্পনিক বর্ণাশ্রম বিভাগের তাগিদে। বাস্তবে সব সময় বর্ণবিপর্যয়, বর্ণসংকর ঘটেছে। একটা জিনিস লক্ষ করবেন। পৌরাণিকেরা বার বার বলছেন সত্যযুগে যে মানুষেরা ছিলেন, ত্রেতাতেও তাঁরাই আছেন, দ্বাপরেও তাঁরাই থাকেন এবং কলিতেও তাঁরাই থাকবেন। পুরাণের ভাষায় প্রলয়কাল পরিপক্ক হলে প্রজাপতি ব্রহ্মা আবার বসেন তাঁর তপস্যায়। সেই তপস্যা থেকেই উত্তম আর অধম কর্মের ফল পাবার জন্য কেউ দেবতা, কেউ অসুর, কেউ বা কীট হয়ে জন্মায়। পূর্বকল্পে যাঁরা জনলোকে ছিলেন, তাঁরাই আবার অন্যকল্পে দেবতা ইত্যাদি হয়ে জন্মান। এরা সবাই প্রজা, সবাই মানুষ—দেবাদ্যাস্তু প্রজা ইহ। কি প্রথম কি শেষ, সমস্ত মন্বন্তরেই মানুষের সুকর্ম কুকর্ম, সুখ দুঃখ, খ্যাতি প্রতিপত্তি এমনকি রূপ-গুণও একই রকম থাকে—কুশলাকুশলপ্রায়ৈঃ কর্মভিস্তৈঃ সদা প্রজাঃ। ৩০ অতএব মহাশয়! সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরে যে দেবতারা ছিলেন, যে ঋষিরা ছিলেন, যে রাজারা ছিলেন, যে রাক্ষসেরা ছিলেন, অথবা আরও স্পষ্ট করে বলি—যে মানুষেরা ছিলেন, তাঁরা সবাই অন্য নামে আছেন মর্ত্যলোকে।

॥ ৩ ॥

সাধারণ তত্ত্বগুলিকে এই নিরিখে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে যে, মুনি, অথবা দেবতা বলে পরিচিত মানুষরা যে অপকর্মগুলি করছেন সেগুলি সচল সমাজের অঙ্গ। অর্থাৎ এখন যেমন আছে, তখনও তেমনি। আর এই তো স্বাভাবিক। ব্রাহ্মণকুলের চূড়ামণি কোন ঋষি হলেই শূদ্র বর্ণের পরমা সুন্দরী কন্যাকে তাঁর পছন্দ হবে না, কিংবা সাময়িক ধৈর্যচ্যুতিতে তাকে বলাৎকার করবেন না—এ তো সচল সমাজের মনুষ্যধর্মের লক্ষণ নয়। ঠিক এই কারণেই পরাশর-সত্যবতী কিংবা বশিষ্ঠ-অক্ষমালাকে আমরা ক্ষমা করব। কারণ সেক্ষেত্রে তাঁরা বেশি তেজী বলে তাঁদের দোষকে ‘জাস্টিফাই’ করার কোন প্রয়োজন থাকবে না।

লোভ, হিংসা, লোকঠকানো, মেয়ে মানুষের রূপে মজা, পরস্ত্রী ধর্ষণ—এ সব যেমন এখনও চলছে, তখনও চলত। তাই বলে কি ভাল কিছুই ছিল না? হ্যাঁ তাও ছিল। বার বার যে পুরাণের ঋষিরা আচরণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ করেছেন—সেও তো বৃথা নয়। বেশির ভাগ মানুষই সে কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করে গেছেন—আবার মনুষ্য ধর্ম অনুসারে তার থেকে চ্যুতিও ঘটেছে। কাজেই আদর্শ এবং বিচ্যুতি—এই দুইয়ে মিলে সে কালের সমাজটা এখনকার মতই সজীব, এখনকার মতই কৌতূহল-জনক। এই অল্প পরিসরে পৌরাণিকের সব টুকিটাকি, মানুষের সব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, কাজ-অকাজ, রস-রসাভাস—সব এক জায়গায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবু যাগ-যজ্ঞ, দেবতা, ব্রাহ্মণ্য ছাড়াও সেকালের সমাজে আরও যা কিছু ছিল, তার সামান্য স্বাদ-গন্ধ আমরা পেতেই পারি। এই স্বাদ-গন্ধ সামান্য পেলেই এটা বোঝা সহজ হবে যে, দেবতা, রাক্ষস, মুনি অথবা রাজা—এঁরা কেউই অলৌকিক বা অবাস্তব কোন জগতের বাসিন্দা নন। আঁধার-আলোয়, ভাল-মন্দে তাঁরা এই জগতেরই মানুষ।

ধরুন আপনি যদি পুরাণের কালে জন্মাতেন, তাহলে সকালে উঠেই আপনাকে কিছু পূজার্চনা করতে হত। হ্যাঁ, পুরাণকারেরা হোম-যজ্ঞ ইত্যাদির কথা অনেক শোনাবেন বটে, তবে ওসব ঝামেলা তাঁদের যুগে অত ছিল না। পুরাণ মানেই এক এক দেবতার মাহাত্ম্য এবং ব্রত, উপবাস। শিব, কৃষ্ণ কিংবা দেবী দুর্গার কথা যখন পুরাণে শুনি তখন দেখা যাবে এঁদের এক একজনের নাম করলেই শত যাগ-যজ্ঞের পুণ্য হত। কাজেই একটু পূজার্চনা এবং হরির নাম স্মরণ করেই পৌরাণিক গৃহস্থ কিন্তু দিনের কাজে নেমে পড়তে পারতেন।

পুরোনো দিনের মানুষ হলে কি হবে, পৌরাণিক গৃহস্থ কিন্তু সৌখিন কম ছিলেন না। স্বয়ং বিষ্ণুপুরাণ তাকে উপদেশ দিয়েছে ছেঁড়া কাপড় না পরতে—সদানুপহতে বস্ত্রে চ। উত্তমাঙ্গে একটি উত্তরীয় এবং অধমাঙ্গে একটি কাপড়—এই দুই খণ্ড বস্ত্রের জন্য পুরাণের দেবতা ব্রহ্মাকে কাপাস তুলো তৈরি করতে হয়েছে, যেন কাপাস গাছও ছিল না আমাদের দেশে। অবশ্য কাপাস তুলো নাকি প্রথম সৃষ্টি করতে হয়েছিল ব্রাহ্মণের পৈতে বানানোর জন্য—কার্পাসমুপবীত্যর্থং নির্মিতং ব্ৰহ্মণা পুরা।

কূর্মপুরাণ বড় আশা করে বলেছে—ব্রহ্মচারী যুবক যেন রঙে না ছুপিয়ে, সাদা কাপড় পরে; আর কাঁধে যেন জড়ায় কৃষ্ণসার হরিণ-চামড়ার চাদর। কিন্তু এতে কি ব্রহ্মচারীর মন মানে? গুরুগৃহের হাজারো কাজকর্মের ফাঁকে সে যদি কোনদিন একটি নীল কাপড় পরে ফেলে তাহলেই পুরাণের গুরু ঠাকুর আদেশ দেবেন—দেখ বাপু মেয়েদের গায়ে ছোঁয়া লাগলে অথবা নীল কাপড় পরলে—স্ত্রীণামথাত্মনঃ স্পর্শে নীলীং বা পরিধায় চ—জল কিংবা ভূমি স্পর্শ করে শুদ্ধ হবে। ৩১ নিয়ম ভেঙে কোনদিন নীল-কাপড় পরলেই রঙিন কোন আকর্ষণে রসবতী রমণীর স্পর্শদোষ ঘটত কিনা—এসব বাজে খবরে আমাদের দরকার নেই, কেননা পুরাণ-গুরু গুরুগৃহে-থাকা যুবককে বলছেন—বৎস, মেয়েদের দেখে কটাক্ষ করা, কিংবা তাদের জড়িয়ে ধরা—স্ত্রীপ্রেক্ষালম্ভনং তথা—খবরদার, খবরদার, এসব যেন কখনো কোর না—প্রযত্নেন বিবর্জয়েৎ।

আমাদের দেশের পৌরাণিক গৃহস্থ জীবনে সব ‘ডোজ’গুলিই অত্যন্ত বেমানানভাবে কড়া। কোন অবস্থাতেই উশুম-কুশুমভাবে মানিয়ে নেবার ব্যবস্থা নেই। এই তুমি ব্রহ্মচারী আছ, তো অমুক করবে না, তমুক করবে না অর্থাৎ ব্রহ্মচারী যুবকের যা যা ভাল লাগবে, তা করবে না। গান-বাজনা নয়, নাচ নয়, তাস-পাশা নয়, এমনকি যুবকের যা কিছু সহজ ধর্ম তা সব করা বারণ। রমণীর সঙ্গে কথা বলা বারণ, কটাক্ষ বারণ। এমনকি গুরুপত্নী যুবতী হলে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা পর্যন্ত বারণ—গুরুপত্নী যুবতী নাভিবাদ্যেহ পাদয়োঃ। ৩২ অথচ একই বাড়িতে, যেখানে ছাত্র-শিষ্য প্রায় পশুর মত খাটবে, সেখানে গুরু থাকবেন রাজার মত। তাঁর আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, তাঁর আচার ব্যবহার, ক্ষমতা সবই রাজোচিত।

বেশির ভাগ পুরাণ-প্রমাণে বোঝা যায় যে, ব্রাহ্মণ গুরুর স্ত্রী থাকত একাধিক। ধর্মরক্ষার জন্য তিনি একটি সবর্ণা ব্রাহ্মণী বিবাহ করতেন বটে কিন্তু কামপূর্তির জন্য অন্য জাতের সুন্দরী রমণী বিয়ে করে আনা ছিল তাঁদের অভ্যাস। স্বয়ং মনু এ ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু গুরুর সংসারে এই অসবর্ণা রমণীদের দিয়ে তাঁর কামপূর্তি হলেও, তাঁদের সম্মান বলে কিছু ছিল না। ব্রাহ্মণ শিষ্য পর্যন্ত তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত না, গুরুর স্ত্রী বলেই তাঁরা শুধু অভিবাদন লাভ করতেন মাত্র—অসবর্ণাস্তু সম্পূজ্যাঃ প্রত্যুত্থানাভিবাদনৈঃ। ৩৩

এই যে একই গুরুগৃহের মধ্যে ভিন্নধর্মী চরম আচরণ—গুরু সব করতে পারতেন, শিষ্য স্বেচ্ছায় কিছুই পাবে না—এই আচরণ বহু জায়গায় বহু জটিলতার সৃষ্টি করেছে। বিশেষত রমণী বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধানতা অনেকক্ষেত্রেই শিষ্যদের রসান্বিত করে তুলত গুরুপত্নীর সঙ্গ লাভ করতে। ইন্দ্র তাই অহল্যার সর্বনাশ করেছিলেন, চন্দ্র গুরু বৃহস্পতির স্ত্রীকে হরণ করেছিলেন—এ সব উদাহরণ পুরাণেই সবিস্তারে লেখা আছে। সমাজের বড়মানুষ এবং তেজী লোকের যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধিকার থাকায় সাধারণের মানসিকতা কি হত, তার একটা উদাহরণ আছে পদ্মপুরাণের ভূমিখণ্ডে।

পূর্বকালে যমের মেয়ে সুনীথা অরণ্যবাসী এক গন্ধর্ব-তপস্বীর তপস্যায় বিঘ্ন করেছিল। তপস্যা করার সময় গন্ধর্ব সুশঙ্খকে সুনীথা মাঝে মাঝেই গিয়ে খোঁচাত। এতে রেগে গিয়ে সুশঙ্খ শাপ দেন যে, সুনীথার ছেলে হবে দস্যি, পাপাচারী। সুনীথা ভয় পেলেন এবং বাবা যমকে গিয়ে সব নিবেদন করলেন। যম বললেন, তুমি খুব অন্যায় করেছ, একমাত্র পরম সত্যের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই তোমার।

সুনীথা সব শুনে নির্জন বনে তপস্বিনী হলেন। নবীন তপস্বিনী দেখে সুনীথার অল্পবয়েসী বন্ধুরা মনে বড়ো দুঃখ পেল। সখীরা খেলতে এসে তাকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বনেই তার সঙ্গে দেখা করতে গেল। তারা বলল—কি হয়েছে তোর, এত চিন্তা কিসের? কি হয়েছে, আমাদের খুলে বল্। সুনীথা সুশঙ্খের অভিশাপের কথা বললেন। বললেন—তবুও আমার বাবা সব চেপেচুপে দেবতা, মুনি সবাইকে অনেক সাধ্যসাধনা করেছেন আমার বিয়ের জন্য। কিন্তু মুনির শাপ মাথায় রেখে কেউই আমাকে বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ পাপচারী পুত্রের জন্ম হলে সমস্ত কুল মজবে—এই ভয়ে তাঁরা সবাই আমার বাবাকে বলেছেন—অন্য কোথাও এর বর খুঁজনগে, যান—অন্যস্মৈ দীয়তাং গচ্ছ দেবৈরুক্তঃ পিতা মম। ৩৪ সুনীথা বললেন—আমার আর কোন উপায় নেই, তপস্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া।

সব শুনে সুনীথার সখীরা এবার যে কথাটি বলল, সেইটেই হল তৎকালীন বাক্যবাগীশ সমাজের প্রতি যুবক-যুবতীর আসল মনোভাব। সখীরা বলল—বংশ, কুল—এসব বড় বড় কথা রাখ্ তো। কার বংশে দোষ নেই একটু বলবি—দেবতারাও কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নয়—নাস্তি কস্য কুলে দোষো দেবৈঃ পাপং সমাশ্রিতম্‌। তুই কি জানিস না, স্বয়ং ব্রহ্মা একবার ভগবান শ্রীহরির সামনে ফালতু মিথ্যে কথা বলেছিল, তাতে কি সমস্ত দেবতারা তাকে ত্যাগ করেছে, নাকি দেব-সমাজে তার পরম পূজ্য স্থানটি চলে গেছে—দেবৈশ্চাপি ন হি ত্যক্তো ব্রহ্মা পূজ্যতমো’ভবৎ? সুনীথার সখীরা এবার বলল—স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের কথাটাই ধর না। ব্রহ্মহত্যার পাপ করেও দিব্যি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল শাসন করে যাচ্ছে। তাছাড়া গুরু গৌতমের প্রিয়া পত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করেও সেই পরস্ত্রীকামী ইন্দ্র দিব্যি দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত, সবাই তাকে এখনও দেবরাজ বলেই জানে। পরস্ত্রীগমন করে তার কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়েছে কি—পরদারাভিগামী স দেবত্বে পরি বৰ্ত্ততে? স্বয়ং মহেশ্বর শিব ব্রহ্মহত্যার মত পাপ করে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন—দেবতারাও তাঁকে নমস্কার করেন, ঋষিরাও করেন—দেবা নমন্তি তং দেবম্ ঋষয়ো বেদপারগাঃ। ৩৫

সুনীথার বন্ধুরা কাউকেই ছাড়লে না। তারা বলল—অন্যায় করে সূর্য দেবতার তো কুষ্ঠ রোগ ধরেছিল, তাতে কি তার সম্মান কমেছে? জগতে কার দোষ নেই বল তো? এই তো কৃষ্ণ ঠাকুর ভার্গব ঋষির শাপ ভোগ করে চলেছে। জগতের এত আহ্লাদ জন্মায় যে চাঁদ, সেও গুরুপত্নীর বিছানায় উঠে পড়েছিল। তার জন্যেই নাকি তার রাজ-যক্ষ্মা হয়ে কলাক্ষয় আরম্ভ হয়, কিন্তু তাতে কি আসে যায়? আবার তো সে পূর্ণিমায় জ্বল জ্বল করে তেজী হয়ে ওঠে। অত বড় মানুষ যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, সেও গুরুকে মারবার জন্য মিথ্যে কথা বলেছিল। কাজেই বড় মানুষদের কথা আর বলিস না, সুনীথা! দোষ ছাড়া মানুষ নেই, দেখাতে পারবি না এমন বড় মানুষ, যার গায়ে নোংরার দাগ লাগেনি একটুও—বৈগুণ্যং কস্য বৈ নাস্তি কস্য নাস্তি চ লাঞ্ছনম্। ৩৬ সুনীথার সখীরা এবারে স্ত্রীলোকের গোপন রহস্যটি বলল। বলল—সুনীথা! যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের দোষ তো অনেক বেশি। সে আন্দাজে তোর দোষ তো এইটুকুনি। আর ছাড় তো ওসব বড় বড় কথা, মেয়েছেলের গতর আছে, তো সব আছে। রূপ আছে তো সব আছে—রূপমেব গুণঃ স্ত্রীণাং প্রথমং ভূষণং শুভে।

সুনীথার সখীরা বলল—তোকে পুরুষের মন-মজানো একটা বিদ্যা দেব। এতে দেবতা থেকে আরম্ভ করে সবাইকেই তুই মোহিত করে দিতে পারবি। সুনীথা কি বিদ্যা পেলেন জানি না, তবে যে-বিদ্যায় তাঁর কাজ হয়েছিল, সে তার রূপ। তাঁর বীণার গান শুনে আর রূপে মজে তপস্যা ছেড়ে উঠে এলেন সূর্যের মত রূপবান ব্রাহ্মণ অঙ্গ। তিনি কাম-ক্রোধ ত্যাগ করে ভগবান জনার্দনকে ধ্যান করছিলেন: সেই অবস্থায় সুনীথার রূপ-লাবণ্য দেখে তাঁর এমন মোহ হল যে, ধ্যান-জপ মাথায় উঠল। ঘেমে, কেঁপে, হাই তুলে ঋষিপুত্র অঙ্গ কেবলই সুনীথাকে কাছে পেতে চাইলেন, বিয়ে করতে চাইলেন। শুধু তাই নয়, অঙ্গ বললেন—কন্যে, তুমি যা চাও তাই দেব, তোমার সঙ্গে সঙ্গমের প্রতিদান হিসেবে যা মানুষকে দেওয়া যায় না—তাও দিতে রাজি আছি—দেয়ং বাদেয়মেবাপি তস্যাঃ সঙ্গম-কারণাৎ। ৩৭

পুরাণের রাজ্যে এই এক অদ্ভুত জিনিস। আমরা বলেছিলাম—গুরুগৃহের অতিরিক্ত কড়াক্বড়ি অনেক সময় ব্রহ্মচারী শিষ্যের মনে নানা জটিলতা তৈরি করত। ফলে অনেক সময়ে তাঁরা স্বয়ং গুরু-মার ওপরেই আসক্ত হয়ে পড়তেন এবং রুক্ষ গুরুর সংসার-ঠেলা উপবাসিনী গুরুপত্নীরাও যে স্বেচ্ছায় শিষ্যের বাহু-বন্ধনে ধরা দিতেন, তার প্রমাণও আমরা অন্য প্রবন্ধে দিয়েছি। বস্তুত পুরাণ-প্রবন্ধের সমাজটি কিন্তু এক অদ্ভুত উপদেশ এবং ততোধিক বিপ্রতীপ বাস্তবতার সূত্রে বাঁধা। তাঁরা যা উপদেশ দেন, তা ঘটে না। বরঞ্চ যা ঘটে, তা থেকে কেবল আরও একটি মৌখিক উপদেশ তৈরি হয়—এমনটি কিন্তু কোর না। বিপদে পড়লেই তাঁদের ব্রহ্মশাপ আছে, প্রারব্ধ কর্ম আছে, আছে দেব-দ্বিজের কাছে অন্যায়।

এই যে সুনীথা ঋষিপুত্র অঙ্গকে রূপে মজাল, পুরাণে এমনিতর কাহিনী তো হাজারো আছে। অথচ পুরাণজ্ঞ ঋষিরা সব সময়েই স্ত্রীলোকের রূপে মজতে বারণ করেছেন। আবার দেখুন ওই যে সুনীথা আর অঙ্গের মিলনে একটি ছেলে জন্মাল আমরা প্রাচীন পুরাণ থেকে আগেই তার পরিচয় দিয়েছি—তার নাম বেণ। বেণ এমনিতেই দুষ্টপ্রকৃতির ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালের পুরাণ পদ্মপুরাণে বেণকে দুষ্ট প্রমাণ করার জন্য প্রথমে তো সুশঙ্খ ঋষির শাপ লেগেছে। কিন্তু সে শাপ সত্ত্বেও বেণ নাকি ভালই ছিলেন, এমনকি বেশ ধর্মপ্রাণ। কিন্তু এইবার বেণের গায়ে লাগল পদ্মপুরাণের নিজের কালের হাওয়া। সে আমলে জৈনধর্মের প্রকোপ বেড়েছিল অতএব পদ্মপুরাণে ঋষির শাপে এবং কালবশে জৈনরা এসে উপস্থিত হল ধর্মানুরাগী বেণের রাজসভায়। বেণ মহারাজ তাঁদের ধর্ম এবং দার্শনিক প্রস্তাব শুনে পাপাচারী হলেন। দেব-দ্বিজে ভক্তি উচ্ছন্নে গেল।

ব্যাপারটা এইরকমই। পৌরাণিকেরা নিজের কালের হাওয়া সব সব সময় লেগেছে তাঁর কালের পুরোনো গল্পে। ফলে পুরোনো, আরও পুরোনো কালের বৃত্তান্ত বিভিন্ন পুরাণকারের কালের গন্ধে নতুনভাবে সঞ্জীবিত হয়েছে। তবে একটি ব্যাপারে সর্বত্র বড়ো মিল, সে রমণী। আমার এক নতুন পরিচিত বন্ধু আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিলেন—তোমরা যে সব সময় প্রাচীন ভারতের তাবৎ রমণী-কুলের ওপর পুরুষ মানুষের অত্যাচার দেখতে পাও, তাই নিয়ে আবার প্রবন্ধ লেখ—এ ভারী অন্যায়। আমি বললুম—কেন, কেন, এই তো গবেষণা লব্ধ জ্ঞান, তুমি বললে তো হবে না। প্রাচীন ঋষি, মুনি, নাগরিকেরা স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে কিই না বলেছেন—নরকের দ্বার থেকে আরম্ভ করে ছলা-কলার সবচেয়ে বড় যন্ত্র। বন্ধুবর বললেন—রাখো তোমার গবেষণা! প্রাচীন ভারতের পুরাণ-ইতিহাসের বৃত্তান্ত থেকে এইটেই প্রমাণ হবে যে, মেয়েরাই ছিল বেশি শক্তিশালী, তারাই ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত এবং প্রচুর রজ্জু-ভ্রমণের পর ছেলেরা বলত—মাগী ছলাকলায় আমাকে ভুলিয়ে এতকাল ঘুরিয়েছে; আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু রূপের নেশায় আমি ছিলাম নাচার। অতএব শুন ভাই সাধু, তোমরা মেয়েছেলে দেখে ভুলো না, নারী নরকের দ্বার। পুরুষ শুনত, আবার ভুলত।

বন্ধুর কথা শুনে আমি ভাগবত পুরাণের কলিকালের বর্ণনা স্মরণ করলাম। আমি বললাম—ধুর, আপনি যা বলছেন, স সব ঘটবে কলিকালে। ঋষিরা বলেছেন—কলিকালে পুরুষেরা হবে সব মেনিমুখো স্ত্রৈণ—দীনাঃ স্ত্রৈণাঃ কলৌ নরাঃ। ৩৮ কলির পুরুষেরা সব বাপ-ভাই ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে—পিতৃ-ভ্রাতৃ-সুহৃদ্-জ্ঞাতীন্ হিত্বা—বৌয়ের আঁচল ধরে শুধু শালা-শালীর খোঁজ নিয়ে বেড়াবে—ননান্দৃ-শ্যালসংবাদা দীনাঃ স্ত্রৈণাঃ কলৌ নরাঃ। বন্ধু বললেন—বেড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন আপনার ঋষি। কেন, দ্বাপর-ত্রেতার চেহারাটা কি অন্যরকম ছিল! খোঁজ নিয়ে দেখুন তো দ্বাপর যুগের পুরুষেরা কি শালা-শালীর খবরই রাখতেন না। মনে করতে পারেন কি—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহামতি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সেনা-বাহিনীর প্রথম এবং প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন? গাণ্ডীবধারী ভাই অর্জুনও নয়, গদাধারী ভাই ভীমও নয়। সেনাপতি ছিলেন পাঁচ ভায়ের এক শালা ধৃষ্টদ্যুম্ন। তাছাড়া বিরাট-রাজার শালা কীচকের প্রতি বিরাট রাজার কিরকম প্রীতি ছিল, অর্জুনের শালা কৃষ্ণের ওপর অর্জুনের কিরকম গদগদ ভাব ছিল, সেটাও কি বলে দিতে হবে! আর কথা বাড়াবেন না। এত বড় মানুষ, অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুটা পর্যন্ত বাবার বাড়িতে মানুষ হয়নি, হয়েছে তার মামা-বাড়িতে। কেন হস্তিনাপুরে কি আর পাঁচটা ছেলে মানুষ হয়নি, তার বাপেরা মানুষ হয়নি। যাই বলুন, এও শালা-প্রীতি। আর কথা বাড়াবেন না।

আমি আর কথা বাড়াইনি। ভাবলাম শালা-শালীর কথাটা ও যুগেও সত্যি হতে পারে। কিন্তু স্ত্রৈণতা? কিংবা ভাগবত পুরাণ যে বলেছে—কলিকালে শুধু কামনার কারণেই মেয়েদের সঙ্গে মিশবে পুরুষেরা—সৌরতসৌহৃদাঃ—এ ব্যাপারটা? মনে মনে ভেবে প্রমাদ গণলাম। বিভিন্ন পুরাণের পাতায় পাতায় অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন দেবতা এবং কাম-লোভ বর্জিত মুনিদের স্ত্রীসঙ্গ পাবার জন্য যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে, তা ভাবতে ভয় করে। আর তাঁদের কামনা জানাবার যে ভাষা, সে ভাষার মধ্যে ভালবাসার কোন ব্যঞ্জনা নেই, আছে শুধু রমণীর প্রত্যঙ্গ-স্তুতির সঙ্গে দুর্বার সঙ্গমেচ্ছা—সে ভাষা আর উচ্চারণ করে কলিকালের কচি-কাঁচাদের পাকিয়ে তুলতে চাই না। কবিবর যে লিখেছিলেন—’মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল, তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবন-চঞ্চল’—এ শুধু উর্বশীর একার ক্ষমতা নয়, পুরাণ কাহিনীতে যে কোন রমণীর রূপ দেখে কাম-গন্ধহীন দেবতা-মহাপুরুষেরাও মুহূর্তে কামোন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। কাজেই শুধুমাত্র যৌন সম্বন্ধের ইচ্ছাতেই স্ত্রীলোকের সঙ্গে মেশামেশি—এ কিন্তু যতখানি পৌরাণিক যুগের বৈশিষ্ট্য, কলিকালের ততটা নয়। পুরাণকারেরা তাঁদের কালের দুস্কর্মগুলি চাপিয়ে দিয়েছেন কলিকালের কাঁধে। চাপিয়ে দিতে পেরেছেন শুধু মানুষ বলেই, ঠিক যেমন বৃদ্ধ স্থবির বলেন—আমাদের কালে কী ছিল আর এখন কী হল?

এই যে উর্বশীর কথা বললাম, সে তো স্বর্গের বেশ্যা বলে পরিচিত। স্বর্গের বেশ্যা মানেই কিন্তু তার রূপ, যৌবন, ক্ষমতা—কোনটাই সাধারণ বেশ্যার মত নয়। বিশেষত ‘কালচার’, বিদগ্ধতা, শিক্ষা—এ সব গুণ তখন শুধু গণিকাদেরই থাকত। তার ওপরে উর্বশী হলেন স্বর্গের বেশ্যা, তাঁর খানদানই আলাদা। পুরাণগুলির মধ্যে উর্বশীকে একাধিকবার পাঠানো হচ্ছে শুধু ইন্দ্রিয় সংযত সিদ্ধবর্গের সুপ্ত কামনায় সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য। আর কি আশ্চর্য, তিনি সব সময়ই সফল। এই যে সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশ, যে বংশের অধস্তন কৌরব-পাণ্ডবেরা কত পুরাকীর্তি স্থাপন করে গেলেন, ভাবতে পারেন, সে বংশের মূলেও বংশ বংশ ধরে রমণী-দর্শনমাত্রে কাম-সম্বন্ধ ঘটেছে। ভাবতে পারেন সে বংশের এক মহদ্ গ্রন্থিতেও জড়িয়ে আছেন স্বর্গ-বেশ্যা উর্বশী। চন্দ্রবংশের প্রথম পুরুষ চন্দ্র শুধু গুরুপত্নীকেই ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি। গুরুপত্নীর গর্ভে তাঁর একটি পুত্র হয়েছিল এবং সে পুত্র সুস্থ সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। যদিও ধর্ষণজাত এই পুত্রটির সামাজিক স্বীকৃতি পুরাণগুলিতে লেখা হয়েছে নক্ষত্র-জন্মের প্রতীকে, তবু গুরু বৃহস্পতির সামনেই তাঁর স্বেচ্ছায় ধর্ষিতা স্ত্রী একটুও বলতে লজ্জা বোধ করেননি যে, তাঁর পুত্র বুধ ধর্ষণকারী চন্দ্রের জাতক। আবার পরবর্তী সময়ে বুধ যখন এক রমণীকে প্রলুব্ধ করার জন্য ব্রাহ্মণ বেশ ধারণ করেছেন, তখন তিনি নিজের কুল পরিচয় দিচ্ছেন বৃহস্পতির ছেলে বলে—পিতা মে ব্রাহ্মণাধিপঃ। ৩৯

কাজেই দেখুন ভাগবত পুরাণ যে বলেছিল—সঙ্গম বাসনাতেই কলিকালে স্ত্রীলোকের সঙ্গে মেলামেশি করবে লোকেরা, সে ‘ট্র্যাডিশন’ বহু কালের। চন্দ্র তো গুরুপত্নীর গর্ভে বুধের জন্ম দিলেন, কিন্তু বুধ কি করলেন? তিনি মোহিত হয়েছিলেন এমন এক মহিলা দেখে, যে মহিলা পূর্বে পুরুষ ছিলেন। পুরাকালে ‘সেক্স-চেঞ্জ’ করার কোন শৈলী বা শৈল চিকিৎসা চালু ছিল কিনা জানি না, কিন্তু মনুর ছেলে ইল রাজা মহাদেব আর পার্বতীর ক্রীড়াকানন শরবনে ঢুকে স্ত্রীলোক হয়ে গেলেন। মহাদেব নাকি এই নিয়ম করেছিলেন যে, পুরুষ মানুষ তাঁর বিহারস্থানে ঢুকলেই মেয়ে হয়ে যাবে। মহারাজ তাই মেয়ে হয়ে গেলেন, তাঁর নাম হল ইলা। পাঠক! এই ইলার নাম থেকেই আমাদের সেই ইলাবৃতবর্ষ, যে দেবতাদের আবাসভূমি, মহাত্মা বলির যজ্ঞস্থান। মৎস্য পুরাণ লিখেছে, মেয়ে হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্তন যুগল হয়ে উঠল পীনোন্নত, জঘনদেশও তাই—সাভবারী পীনোন্নতঘনস্তনী। ৪০ চাঁদের মত মুখে এল বিলোল কটাক্ষ; ইলার দেহে এল আরও সব অস্ত্র, যা রমণীর দেহ-তৃণে থাকে। রমণী হবার সঙ্গে সঙ্গে ইলার মনে হল—কেই বা আমার বাবা, কেই বা মা, কোন স্বামীর হাতেই বা আমি পড়ব? এত সব চিন্তা করতে করতে মোহময়ী রমণী যখন নির্জন বনপথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকল, তখনই সে চন্দ্রপুত্র বুধের চোখে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে মৎস্যপুরাণের ভাষা হল—রমণীকে দেখামাত্র বুধের মন জর্জরিত হয়ে উঠল এবং তিনি কামপীড়িত হয়ে, কি করে এই রমণীকে লাভ করা যায় সেই উপায়ে মন দিলেন—বুধঃ তদাপ্তয়ে যত্নম্ অকরোৎ কামপীড়িতঃ। ৪১ এর পরেই বুধের ব্রাহ্মণবেশ। ইলার হঠাৎ স্ত্রীত্ব প্রাপ্তিতে থতমত ভাবটা তিনি জানতেন বলে, কৌশল করে আচমকা তাকে বললেন—আমার অগ্রিহোত্রের কাজকর্ম ফেলে কোথায় পালিয়েছিলে, সুন্দরী! এখন সন্ধে হল, এই তো রমণীয় বিহারের সময়—ইয়ং সায়ন্তনী বেলা বিহারস্যেহ বৰ্ত্ততে। তুমি ঘরদোর মুক্ত করে ফুল-সজ্জা কর আমার ঘরে। আর কি, ইলা বুধের মায়া-ভবনে ঢুকলেন। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল রসে, রমণে—রেমে চ সা তেন সমম্ অতিকালম্ ইলা ততঃ।

তাহলে ভাগবত পুরাণের কলিকালের ভবিষ্যদভাণী খাটল গিয়ে অতীত কালে। চন্দ্র গেল, বুধ গেল, তার ছেলে পুরূরবাও মুগ্ধ হলেন স্বর্গ-সুন্দরী উর্বশীকে দেখে। ভাগবত পুরাণের মন্তব্য বিরুদ্ধভাবে সপ্রমাণ করার জন্য আমরা বিষ্ণুপুরাণের টিপ্পনীটা বজায় রাখব। বলব—দুজনে দুজনকে দেখা মাত্রই মোহিত হলেন। বিশেষত রাজা, যাঁর পক্ষে অন্য দরকারী কাজ ফেলে রাখা চলে না, তিনি সব বাদ দিয়ে প্রগল্চতায় ভরপুর উর্বশীকে বললেন—সুভ্রূ , আমি কামনা করি তোমাকে—ত্বামভিকামো’স্মি। তাই আশা করব তুমিও অনুরাগ উপহার দেবে আমাকে! পুরূরবা এবং এই স্বর্গবেশ্যা উর্বশীর ব্যাপারে পারস্পরিক কামনার ব্যাপার যাই থাকুক, একথা কিন্তু মানতেই হবে যে, ভারতবর্ষের উপন্যাস, নাটক, বা রোমান্টিক প্রেমের আরম্ভবিন্দু হল এই পুরূরবা-উর্বশীর মিলন কাহিনী, যে কাহিনীর আরম্ভ ঋগ্বেদে এবং পরিণতি কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে আমি অল্পক্ষণের জন্য মৎস্যপুরাণ স্মরণ করব, কারণ অন্যান্য পুরাণের চেয়ে মৎস্যপুরাণের কাহিনীতেই রোমান্টিকতার সুবাস লেগেছে বেশি। সেই সঙ্গে আবারও দেখুন—দেবতা, দানব আর মানুষের ঘনিষ্ঠতা, ‘ইনটার‍্যাকশন’। এর পরেও কী দেবতা, অসুর আর মানুষকে একাত্মতার নিরিখে দেখা যাবে না।

দানবরাজ কেশী স্বর্গ আক্রমণ করে স্বর্গের শোভা উর্বশীকে হরণ করে নিয়ে যাবার সময় পুরূরবার চোখে পড়েন। বহুবার স্বর্গে যাতায়াত করার ফলে পুরূরবা উর্বশীকে চিনতেন এবং উর্বশীকে হারালে স্বর্গের কি ক্ষতি হবে, দেবরাজের মন কতটা ভেঙে পড়বে তাও তিনি বুঝতেন। পুরূরবা মাঝপথে কেশীকে আক্রমণ করে উর্বশীকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেন দেবরাজের কাছে। কৃতজ্ঞ দেবরাজের সঙ্গে পুরূরবার বন্ধুত্ব আরও বেড়ে যায়। উর্বশী উদ্ধারে সমস্ত দেবতারও দারুণ খুশি। এমন একটা ঘটনা ‘সেলিব্রেট’ করার জন্য স্বর্গমঞ্চে একটি নাটক করার কথা হল যার নাম লক্ষ্মীস্বয়ংবর, পরিচালক স্বনামধন্য নাট্যশাস্ত্রকার ভরতমুনি। বহু নাটকের নায়িকা উর্বশী লক্ষ্মীর ভূমিকায় অভিনয় করছিল। প্রথম থেকেই নাটকের যেখানে সেখানে সে পুরূরবার কীর্তিকথা গান করতে থাকে, এবং স্বয়ং পুরূরবা তখন দর্শকাসনে উপবিষ্ট। পরিচালক ভরতমুনি তবুও কিছু বলেননি। পুরূরবাকে দেখে নৃত্যপরা উর্বশী ভরতমুনির শেখানো লক্ষ্মীস্বয়ংবরের পার্ট ভুলে গেল। নেমে আসল অভিশাপ, বিজন বনে লতা হয়ে থাকার অভিশাপ।

কালিদাস এই অভিশাপকে কাজে লাগিয়েছিলেন কবিকল্পে, উর্বশীর জন্য বিরহী পুরূরবার বিলাপে। কিন্তু আমরা জানি উর্বশীর ওপর আরও একটা অভিশাপ ছিল, যা তাকে সাহায্য করেছিল পুরূরবাকে পেতে। মিত্র আর বরুণ—এই যমজ দেবতা বদরিকাশ্রমে বসে তপস্যা করছিলেন। সেই অবস্থায় আশ্রমের বাগান থেকে নানা ভঙ্গিতে ফুল তোলা আরম্ভ করুল উর্বশী। প্ররোচনার জন্য যথেষ্ট ছিল উর্বশীর অঙ্গে জড়ানো রাঙা বসনখানি। বসনের সূক্ষ্মতায় উর্বশীর দেহ-সৌষ্ঠব এমন এক স্ফুটাস্ফুট সীমারেখায় এসে পৌঁছেছিল যে তপস্যারত দুই দেবতা আর তাকে না দেখে পারছিলেন না—সুসূক্ষ্মরক্তবসনা তয়োদৃষ্টিপথং গতা। ফলে ভাগবত পুরাণের কলিকাল মিথ্যা করে দুই দেবতা মোহিত হলেন, এবং তাঁদের তেজ পতিত হল ত্রেতা কিংবা দ্বাপরযুগের তপস্যার আসনে—তপস্যতো স্তয়োবীর্যম্ অঙ্খলচ্চ মৃগাসনে। ৪৩ মৎস্যপুরাণ লিখেছে—দুই দেবতাই পরস্পরের শাপভয়ে নিজেদের সামলালেন বটে কিন্তু উর্বশীর ওপরে শাপের কথাটা এখানে পুরাণ বলেনি। বিষ্ণুপুরাণ কিংবা বায়ুপুরাণে দেখছি মিত্রাবরুণের শাপের কথা উর্বশীর মনে আছে এবং বিদগ্ধা রমণী ভাবছে—শাপের ফলে যখন মর্ত্যলোকেই বাস করতে হবে, তবে সেই মর্ত্যরাজা পুরূরবার সঙ্গেই থাকব। বিষ্ণুপুরাণ লিখেছে পুরূরবাকে দেখেই উর্বশী তার স্বর্গের অহংকারে জলাঞ্জলি দিয়ে সমস্ত স্বর্গসুখ পায়ে ঠেলে—অপহায় মানম্, অপাস্য স্বর্গসুখাভিলাষং—উর্বশী আত্মনিবেদন করল রাজার কাছে। আর পুরূরবা! তিন ভুবনের সেরা স্বর্গসুন্দরীর রূপ, বিলাস আর হাসি দেখে মুগ্ধ পুরূরবা বললেন—আমি তোমাকেই চাই—ত্বাম্ অভিকামো’স্মি। লজ্জায় যেন নুয়ে পড়ে স্বর্গের গণিকা জবাব দিল—থাকতে পারি তোমার সঙ্গে, কিন্তু শর্ত আছে! মোহিত রাজা তখন যে কোন শর্তেই রাজি। উর্বশী বলল—আমার বিছানার কাছে দুটি মেষ-শাবক থাকবে, যাদের আমি ভালবেসে পালন করি; ও দুটিকে কখনও সরানো চলবে না। দ্বিতীয় শর্তে উর্বশী বলল—মহারাজ! আমি যেন আপনাকে কখনও উলঙ্গ না দেখি—ভবাংশ্চ ময়া নগ্নো ন দ্রষ্টব্যঃ। স্বর্গের সংস্কৃতিতে এই হয়তো বিদগ্ধা নায়িকার রুচি কিন্তু বায়ু-পুরাণ বিপদ বুঝে উর্বশীকে শুধরে দিয়ে বলেছে—মহারাজ! মৈথুনের সময় ছাড়া অন্য সময় যেন আপনাকে নগ্ন না দেখি—অনগ্নদর্শনঞ্চৈব অকামাৎ সহ মৈথুনম। ৪৪ উর্বশীর তৃতীয় শর্ত ছিল, যতদিন সে রাজার কাছে থাকবে, ততদিন তার আহার হবে শুধু ঘি—ঘৃতমাত্ৰং তথাহারঃ।

শুধুমাত্র ঘি খেয়ে জীবনধারণ! এ আমরা কলিকালের লোকেরা হয়তো ভাবতে পারব না, কিন্তু পুরাণের অঙ্কে রাজা নাকি ভোগে, সুখে উর্বশীর সঙ্গে ষাট হাজার বছর কাটিয়েছিলেন। আর মাটির রাজার রতিসুখে উর্বশী, স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশী নাকি ভেবেছিল—ছাই অমন স্বর্গের মুখে, আর স্বর্গে ফিরে যাব না—প্রতিদিন-প্রবর্ধমানানুরাগা অমরলোকবাসে’পি ন স্পৃহাং চকার। এর পরের সব ঘটনা আর ব্যক্ত করতে চাই না। মোট কথা স্বর্গের চাতুরিতে উর্বশী রাজাকে উলঙ্গ দেখতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এর পরেও রাজার প্রেমের টানে উর্বশীকে প্রতি বছর একরাত অন্তত পুরূরবার বাহুবন্ধনে ধরা দিতে হত।

আমি অবশ্য এখানে পুরূরবা-উর্বশীর প্রেমকাহিনী শোনাতে বসিনি। আমি চন্দ্রবংশের তিন মূল পুরুষের কাহিনী উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, সুন্দরী রমণীর দর্শনমাত্রেই পুরুষের যে বাঁধ-ভাঙা উন্মাদনা, সে যদি কলিকালেও সত্যি হয়, তবে তা দ্বাপর-ত্ৰেতাতের আরও বেশি সত্যি। সে দেবতার ক্ষেত্রেও সত্যি দানবের ক্ষেত্রেও সত্যি এবং মানুষের ক্ষেত্রেও সত্যি। তবু কলিকালের ভদ্রলোকেরা যা করে, রয়ে সয়ে করে, কিন্তু পৌরাণিক কাহিনীতে হঠাৎ করেই, অথবা যাচ্ছেতাইভাবে সবই করা যেত। দেখামাত্রই সেখানে স্পৃহা এবং স্পৃহামাত্রই চ্যুতি, ধৈর্যচ্যুতি থেকে আরম্ভ করে সর্বচ্যুতি। আসল কথা মানুষের মূল চরিত্র কখনও বেশি পরিবর্তিত হয় না। পুরাণকারেরা ঘোর কলি বলে যা যা বলেছেন, তা সব তাঁদের কালেও একভাবে ছিল। অন্যদেশীয় চালে কথাবার্তা বলা আধুনিক বিনোদিনীকে নাই বা দেখলেন তাঁরা, কিন্তু হালকা কাপড়-পরা উর্বশী-রম্ভাই বা কম কিসে? বড় ঘরের অতিযৌবনা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে শীর্ণকায় সাধারণ মানুষের প্রেম দেখলে, আমরা যেমন সদুপদেশ দিই—দেখ্ ভাই, এ সব বস্তু আমাদের জন্যে নয়, এদের জন্যে তৈরি বরপুরুষ আছে অন্য জায়গায়, আমাদের মত সাধারণ ঘরে নয়, তেমনি সে যুগের কবিরাও রব তুলেছেন—আরে, রম্ভার মত স্বর্গসুন্দরীর সঙ্গে সম্ভোগ করতে কত ক্ষমতা লাগে, সে জানেন শুধু দেবরাজ। যারা সব সময় ছোঁক ছোঁক করছে, চেড়ির মত মেয়েদের পছন্দ করে যে সব বিট্লে পুরুষেরা, তারা কি ক্ষমতায় বুঝবে স্বর্গসুন্দরীর স্বাদ—ঘটচেটীবিটঃ কিংস্বিদ্‌ জানাত্যমরকামিনীম্‌? ৪৫ মিত্রাবরুণের মত দেবতা, দানবরাজ কেশী আর তথাকথিত মানুষ পুরূরবার কাণ্ড দেখে কলিকালের মানুষ এটুকু রসিকতা করবেই।

আমাদের বলা পুরাণকাহিনীর এই সব নমুনা থেকে এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, সেকালে কোন সজ্জন পুরুষ ছিলেন না, ছিলেন না সতী-সাধ্বী মহিলারা। বরঞ্চ তাঁরা এতই ছিলেন এবং এতকালের সমস্ত আলোচনায় তাঁরা এত বিপুলভাবেই সম্বর্ধিত হয়েছেন যে, আলাদা করে এই মুহূর্তে তাঁদের স্মরণ করার প্রয়োজন বুঝি না। আমি শুধু বলতে চেয়েছি যে সেকালের দুনিয়াটা যদি শুধু সাধু, সজ্জন আর সাধ্বী মহিলায় ভরে থাকত, তাহলে সমাজটা স্থাণু হয়ে যেত। আমি বলতে চেয়েছি কলিকালের সব দোষই কোন না কোনভাবে পৌরাণিক সমাজেও ছিল এবং সে সমাজটাও ছিল ভাল-মন্দে সচল। শুধু বড় ঘরের মেয়ে সম্বন্ধে কৌতূহলই নয়, শুধু পছন্দসই মেয়ে দেখামাত্র স্পৃহালুতা নয়, বিদগ্ধা সুন্দরীর হালকা প্ররোচনামূলক পরিধানই নয়, সে কালের অনেক কিছুর মধ্যেই পাব কলিকালের আধুনিক চলন-বলনের ভঙ্গি, যদিও সে ভঙ্গি পুরাতন সরল সমাজে অবশ্যই অন্যরকম। কিন্তু তাঁরা জানতেন, সবই জানতেন। প্রাক্বিবাহ পর্বে প্রেম করাও জানতেন, লুকিয়ে দেখা করাও জানতেন, আবার বিয়ের পর ‘হনিমুনে’ যাওয়ার কথাটাও জানতেন। তবে হ্যাঁ বিয়ের আগে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁদের সুবিধে ছিল অনেক বেশি। শত শত কুঞ্জ বন আর রেবা-নর্মদার তীরভূমি ছেড়েই দিলাম, ছেড়েই দিলাম ভাঙা দেউল আর হাজারো নির্জন স্থান। স্বয়ং কৃষ্ণ ঠাকুর যে জায়গাটি দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রেম করার জন্য, সে জায়গার হদিশ পেলে আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রমাদ গণবেন। নররূপী ভগবান কৃষ্ণ সহস্র প্রেমিকাকে সুখী করার জন্য শ্মশানে নিয়ে গেছেন নির্জনে রসাস্বাদন করতে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের এই পৌরাণিক ক্ষেত্রটি আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকারা স্মরণে রাখতে পারেন, কেননা আধুনিক জনসংকুল শহরগুলিতে শ্মশান জায়গাটিতে অন্যলোকের ভিড় থাকলেও নেহাত আপনার আত্মীয়-গুরুজন গতায়ু না হলে ধরা পড়ার কোন ভয় নেই। বিয়ের পরে যে ‘হনিমুন’, তারও কিছু নমুনা পাওয়া যাবে পুরাণে। সেই যে পুরূরবা, তিনি উর্বশীকে বিয়ে করে কত জায়গায় ঘুরেছিলেন জানেন? কখনও চৈত্ররথ বনের মত ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’, কখনও মন্দাকিনীর তীরে, কখনও কামনার মোক্ষধাম অলকায় কখনও ঐতিহাসিক নগরী বিশালায়—অলকায়াং বিশালায়াং নন্দনে চ বনোত্তমে। ৪৬ রাজার ভ্রমণসূচিতে গন্ধমাদন পাহাড়ের নিম্নভূমি কিংবা নাম করা ‘হিল-স্টেশন’ মেরুশৃঙ্গও বাদ যায়নি। অর্থাৎ স্বর্গলোক। বাদ যায়নি দূরপাল্লার দেশ উত্তর কুরু অর্থাৎ বিষ্ণুলোক। কিংবা ছায়া-সুনিবিড় কলাপ গ্রাম। এই সব জায়গায় রাজা উর্বশীকে নিয়ে পরম সুখে রমণ করেছেন—উর্বশ্যা সহিতো রাজা রেমে পরময়া মুদা।

॥ ৪ ॥

পরাশর বলেছিলেন— কলিকালের বিয়ে-করা বউরা যদি একটুও অনাদর পায় তাহলে নাকি তারা মাথা চুলকোতে চুলকোতে অনায়াসে স্বামীদের কথা উড়িয়ে দেবে— উভাভ্যামেব পাণিভ্যাং শিরঃ কণ্ডূয়নং স্ত্রীয়ঃ। ৪৭ কুর্বন্ত্যো গুরুভর্ত্তৃণামাজ্ঞাং ভেৎস্যন্ত্যনাদৃতাঃ ॥ আহা, পরাশর-ব্যাসের যুগে বোধ হয় অনাদর পেলে মেয়েরা যেন সব স্বামীদের মাথায় চুমো খেত। সেই যযাতি রাজা ক্ষণিকের কামনায় ভুলে শর্মিষ্ঠার একটু গর্ভ উৎপাদন করেছিলেন বলে (যা সে যুগের এমন কিছু অপকর্ম নয়) তাঁর নিজের স্ত্রী দেবযানী বাবাকে বলে তাঁর দেহে হাজার বছরের বার্ধক্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। বোকা যযাতি জানতেন না যে, সমস্ত পুরাণগুলি একযোগে ব্যবস্থা দিয়েছে যে শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতার মত, গুরু-গুরুপত্নীর মত সম্মান করবে। তাও আবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মত ক্ষমতাবান শ্বশুর। যযাতি শ্বশুরের কথা শোনেননি, তার ফলও ভোগ করেছেন।

তবে এও মানতে হবে এই শুক্রাচার্য পুরাণগুলির মধ্যে এক বিচিত্র চরিত্র। আমাদের বিশ্বাস সেকালের ব্রাহ্মণ-সমাজে শুক্রাচার্যের ব্রাহ্মণ আরও অনেকেই ছিলেন, যদিও তাঁর চরিত্রটি পুরাণ-কথিত ব্রাহ্মণ-সমাজের আচরণীয় চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। যেমন ধরুন ব্রাহ্মণের পক্ষে সুরা পান এক্কেবারে বারণ। এমনকি যে ব্রাহ্মণ সুরা পান করে ফেলেছেন তাকে শাস্ত্রমতে দৈহিক কৃচ্ছৃসাধন করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। শাস্ত্রীয় শাস্তির বহর থেকেই বুঝি মদ্যপানের অপরাধ তখনকার ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকেই করতেন। আমাদের শুক্রাচার্য কিন্তু ভালরকম মদ্যপান অভ্যাস করেছিলেন। স্বয়ং ভগবান বিভূতিযোগে নিজেকে শুক্রাচার্যের মত পণ্ডিত বলে কল্পনা করেছেন, অথচ অসুরগুরু হওয়ার সুবাদে প্রতিদিনই সেই পণ্ডিতের মদ না চলে চলত না। এই অভ্যাস ছিল বলেই অসুরেরা একদিন বৃহস্পতি-পুত্ৰ কচকে পুড়িয়ে গুঁড়ো করে তাঁর পানপাত্রে মদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল এবং শুক্রাচার্য প্রমানন্দে সেই মদ পান করে কচকে গলাধঃকরণ করেছিলেন। কচ সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে গুরুর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আবার শুক্রাচার্যকে বাঁচালেন বটে, কিন্তু মদ খেয়ে তাঁর কি অবস্থা হয়েছিল সে অবস্থাটার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন পুরাণকার। মৎস্যপুরাণ লিখেছে তিনি অসুরদের প্রবঞ্চনায় মদ খেয়ে একেবারে মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন— সুরাপানাদ্ প্রবঞ্চনং প্রাপয়িত্বা, সংজ্ঞানাশং চেতসশ্যাপি ঘোরম্। ৪৮ পুরাণকার শেষ পর্যন্ত এক কৌশল করেছেন। ব্রাক্ষণদের যেহেতু মদ খাওয়া বারণ এবং শুক্রাচার্য যেহেতু মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়েছেন, অতএব পরবর্তী সমস্ত ব্রাহ্মণ-সমাজকে বাঁচানোর জন্য মৎস্যপুরাণ বলেছে যে শুক্রাচার্যই রেগে-মেগে নিয়ম করলেন যে, ব্রাহ্মণের পক্ষে এর পর থেকে সুরাপান নিষিদ্ধ হল। যেন তার পরে আর কোন ব্রাহ্মণ সুরাপান করেনি।

পুরাণগুলিতে আপ্ত মুনি-ঋষিদের উপদেশাবলী শুনলে মনে হবে যে, সেকালের দেবতা এবং আর্যপুরুষেরা মানুষের ছল, জুয়েচুরি, রাহাজানি এসব কিছুই যেন জানতেন না। কিন্তু এক এই শুক্রাচার্যের কাহিনীতেই এই সমস্ত অপরাধের অনেকগুলি উদাহরণ পাব। এমনকি শ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত দেবসমাজ, বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণও এই ছলনায় এমনভাবে অংশ নিয়েছিলেন যে, আজকাল হিন্দি সিনেমার অনেক চিত্রাংশ এই কাহিনীর কাছে ঋণী থাকবে। দেবতা আর তাঁদের সৎভাই দৈত্যদের যুদ্ধ-বিগ্রহ তখন প্রায়ই লেগে ছিল। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য আরও সিদ্ধাই পাওয়ার জন্য ধুমব্রত পালন করে মহাদেবের তপস্যা করছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র স্বভাবতই প্রমাদ গণলেন। কিন্তু বিপদ-মুক্তির জন্য বড় ঘরের ব্যবসাদারের মত কাজে লাগালেন নিজের মেয়ে জয়ন্তীকে। জয়ন্তীর উদ্দেশে পিতার উপদেশ ছিল—শুক্রাচার্যকে হাত করতে হবে তোমায়— গ্র্রচ্ছ সংসাধয়স্বৈনম্‌। তার মনে যেমনটি চায় সেই সমস্ত স্ত্রীলোকের উপচারে সেবা করতে হবে তোমায়। জয়ন্তী গেলেন। প্রথমে মধুর কথা, সেবার ইচ্ছে দিয়ে কাজ আরম্ভ হল, পরে তপঃক্লান্ত মুনির গা-হাত-পা টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শসুখও দিতে থাকলেন জয়ন্তী—গাত্রসংবাহনৈঃ কালে সেবমানা ত্বচঃ সুখৈঃ। ৪৯ শুক্র কিন্তু তপস্যা ছাড়েননি, মহাদেবের বরলাভও সম্ভব হল তার ফলে। জয়ন্তী ততদিনে শুক্রাচার্যের প্রেমে পড়ে গেছেন। বরলাভও করার সঙ্গে সঙ্গেই শুক্র ফিরে তাকিয়েছেন জয়ন্তীর দিকে। বললেন—তুমি কে, কি চাও, কেনই বা এত কষ্ট করছ আমার জন্যে, তোমার ভালবাসায় আমি খুশি, বল কি চাই—স্নেহেন চৈব সুশ্রাণি প্রীতো’স্মি বরবার্ণিনি। ৫০ শুক্রের কথা শুনে সলজ্জে জয়ন্তী বললেন—আমার মনে কি আছে, তা তুমি ধ্যানযোগেই জেনে নাও, মুনি— তপসা জ্ঞাতুমর্হসি। আমি বলতে পারব না।

জয়ন্তী পুরো দশ বছর শুক্রাচার্যের সঙ্গে বিহার করতে চেয়েছিলেন। এতকাল তপস্যার পরিশ্রমের পর এমন মধুর নিবেদন শুনে শুক্র সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন। বললেন— ‘এবমন্তু’ সুন্দুরী, আমাদের ঘরে চল। পুরাণকার লিখেছেন—তারপর শুক্রাচার্য জয়ন্তীকে বিয়ে করে দশ বচ্ছর ধরে মায়াবৃত হয়ে সকলের অদৃশ্য হয়ে থাকলেন—অদৃশ্যঃ সর্ব ভূতানাম্। আমরা জানি— নিয়মব্রতে এতকাল উপবাসী শুক্রাচার্য প্রায়ই আর ঘরের দরজা খোলেননি। তবে এই দশ বচ্ছর অদৃশ্য থাকার ফল হল পুরাণের অন্যতম নায়িকা দেবযানীর জন্ম— সময়ান্তে দেবযানী তদোৎপন্না ইতি শ্রুতিঃ। ৫১

কিন্তু আসল মাথাব্যাথাটা দেবযানীর জন্ম নিয়ে নয়। অসুরেরা শুনেছিল, তাদের গুরু তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছেন, কিন্তু বাড়ি গিয়ে তারা তাঁকে পেল না। মায়া-ফায়ার ব্যাপার যে কিছু ছিল না তা কিন্তু পুরাণের একটা খবর শুনেই বোঝা যায়। পুরাণ লিখেছে, মায়াবৃত গুরুকে দেখতে না পেয়ে তাঁর ভাবগতিক বুঝে—লক্ষণং তস্য তদ্ বুধ্ব—অসুরেরা ফিরে এল। এই যে ‘ভাবগতিকের’ ব্যাপারটা—এটা শুক্রাচার্যের ক্ষেত্রে বড়ো বেশি সত্যি। তিনি বড্ড মেজাজী মানুষ; তিনি ইচ্ছে করেছেন দশ বছর ফুর্তিতে কাটাবেন, অতএব কারও সাধ্য হবে না, তাঁকে ফেরাবে। তিনি ইচ্ছে করেছিলেন শত্রুপক্ষের ছেলে কচকে বিদ্যা শেখাবেন, সেখানে অসুরদের হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি টলেননি। অসুর গুরু শুক্রাচার্যের মধ্যে এই খাঁটি ব্যাপারটা ছিল, তাঁর পাঠশালাতে এখনকার ছাত্রদের নিয়মে পাঁঠার ইচ্ছেয় কালীপুজো হত না, যা দেবসমাজে হত। যেমন অসুর গুরুর দশ বছরের নেশা বুঝেই ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতিকে পাঠালেন কার্যসিদ্ধি করতে। দেবগুরু নির্দ্বিধায় চলে এলেন অসুরদের ছলনা করার জন্য। পুরাণকারও পরমানন্দে জানালেন—বোকা অসুরেরা কিভাবে ছলিত হল। কিন্তু আমাদের ধারণা দেবসমাজের বিরুদ্ধপক্ষে থাকতে হত বলেই যা কিছুই অসুরদের আয়ত্ত করতে হয়েছে, তা নিষ্ঠাভরেই আয়ত্ত করতে হয়েছে। ছলনা ব্যাপারটা তাদের শুক্রাচার্যের পাঠ্যক্রমে ছিল না বলেই তারা দেবগুরুর ছলনা বুঝতে পারল না। দেবগুরু বৃহস্পতি শুক্রাচার্যের বেশ ধরে এলেন এবং অসুরদের পটিয়ে পাটিয়ে উল্টো বিদ্যা শেখাতে থাকলেন।

এদিকে দশ বছর শেষ হয়েছে। স্ত্রী জয়ন্তীকে বিদায় জানিয়ে শুক্রাচার্য উপস্থিত হলেন তাঁর যজমান, ভক্ত অসুরদের কাছে। শুক্রাচার্য এসে দেখলেন দেবগুরু তাঁর অনুপস্থিতিতে আসর জমিয়ে নিয়েছেন এবং অসুরেরা কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু প্রতারিত হচ্ছে। দৈত্যগুরু হাঁক দিয়ে বললেন— তোরা করেছিস কি? আমি হলাম শুক্রাচার্য, আমিই তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করে এসেছি। অসুরেরা একবার এদিক তাকায় ওদিক তাকায়, কিন্তু কিছুতেই বোঝে না, কোনটা আসল শুক্রাচার্য। শুক্র বললেন— ওরে আমিই তোদের গুরু, কবির কবি শুক্রাচার্য। আর এই যাকে দেখছিস, ইনি দেবগুরু বৃহস্পতি। তোরা আমার পথে আয়; বঞ্চিত না হতে চাস তো বৃহম্পতিকে ত্যাগ কর।

অসুরেরা আবার তাকিতুকি শুরু করল, কিন্তু আসল শুক্র আর নকল শুক্রের মধ্যে কোন তফাত বুঝতে পারল না। ঠিক এই সময়ে দেবগুরু বৃহস্পতি কি করলেন জানেন! তিনি শুক্রাচার্যের মেজাজ নিয়ে বললেন— ভাই সব, আমিই তোমাদের গুরু শুক্রাচার্য। আর এই যে আজকে যিনি উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছেন—ইনিই আসলে দেবগুরু বৃহস্পতি, শুক্রাচার্যের রূপে আমাদের সবাইকে প্রতারণা করতে চাইছেন। বৃহস্পতির প্রত্যয়-মাখানো কথা শুনে অসুরেরা পুরো দেহাতি কায়দায় বৃহস্পতির দিকে আঙুল দেখিয়ে শুক্রকে বলল— ইনিই দশ বছর ধরে শিক্ষা দিচ্ছেন, ইনিই আমাদের অন্তরের গুরু। অসুরেরা এবার চোখ লাল করে শুক্রাচার্যকে বলল—ভাগুন আপনি এখান থেকে, আপনি মোটেই আমাদের গুরু নন—গচ্ছ ত্বং নাসি নো গুরুঃ। ৫২ ইনি বৃহস্পতিই হোন আর শুক্রই হোন, ইনিই আমাদের গুরু, আপনি মানে মানে কেটে পড়ুন এখান থেকে—সাধু ত্বং গচ্ছ মাচিরম্।

দেবতা, দেবগুরু এবং ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ বৃহস্পতি প্রবঞ্চনা অবশ্য শেষ পর্যন্ত টেকেনি, মহামতি প্রহ্লাদের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা মিটে যায়; কিন্তু অসুরদের প্রতারণা করে দেবগুরু যে আপনার কৌশলে মুগ্ধ হয়েছিলেন—কৃতাৰ্থঃ স দা হৃষ্টঃ— এই ছলনা বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়েছে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে ছলনাও যদি বৃহস্পতির মত সোজাসুজি হত, তা হলেও আমাদের বলার কিছু ছিল না, কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজের নিজের ওপর আস্থা যত কমেছে, ত্যাগের আসন থেকে ব্রাহ্মণ যখনই নামতে আরম্ভ করেছে, এই কৌশলে ছলনা বেড়েছে তত বেশি। পরবর্তীকালে এই ছলনার কৌশল বড়ো অদ্ভুত। অশিক্ষিত জনসাধারণকে শুধু পরলোকের ভয় দেখিয়ে, শাস্ত্রের নামে অদ্ভুত অদ্ভুত নিয়ম করে এমন কতগুলো ব্ৰত-উপবাস লোকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ভাবলে ভয় করে।

ক্রমাগত সামাজিক মূল্য পেতে পেতে ব্রাহ্মণেরা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যখন সভ্যতার চোখে ব্রাহ্মণের মূল্য কমতে আরম্ভ করেছিল। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তৈরি হয়ে গিয়েছিল এমন এক বিভাগ যাতে এক ভাগ তাঁদের শিক্ষা, দীক্ষা, উদারতা এবং কর্মগুণে সবার সম্মান পেতেন। আরেকভাগ, বেদ-উপনিষদ, ব্রহ্মভাবনা সব ভুলে শুধু ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছি বলে গর্ব করতেন। আর তেজোহীন ব্ৰহ্মণ্যের নির্বিষ খোলসখানি গলায় ঝুলিয়ে শুধু সম্মান পেতে চাইতেন দানসামগ্রীর স্বার্থে।

একটা গল্প বলি বিষ্ণুপুরাণ থেকে। এক সময়ে ঋষিরা এক জায়গায় এসে একটা সমাজ কিংবা এখনকার ভাষায় একটা ‘ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করলেন। ইউনিয়নের নাম ‘মহামেরু’ ইউনিয়ন। ব্রাহ্মণেরা সিদ্ধান্ত করলেন— যে ঋষি এই মহামেরু সমাজে আসবেন না, তিনি সাত রাতের পর ব্রহ্মহত্যার পাতকে পাতকী হবেন। ইউনিয়নের ভয় কার না থাকে! সমস্ত ঋষিরাই কোন কোন সময়ে মহামেরু সমাজে তাঁদের নাম লিখিয়ে গেছেন। শুধু মহর্ষি বৈশম্পায়ন এই ইউনিয়নের ধার ধারেন না, তিনি আসেনও না। ফল, মেরুসমাজের ঋষিদের শাপ এবং তারও ফলে তিনি তাঁর বাচ্চা-বয়েসী ভাগনেকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলেন এবং সে মারা গেল। কিন্তু বালক হলে কি হবে সেও তো ব্রাহ্মণ বটে, অতএব ব্রহ্মহত্যার পাপ লাগল। বৈশম্পায়ন তখন শিষ্যদের ডেকে বললেন— বাপু হে, আমার ব্রহ্মহত্যার পাপ যাতে নষ্ট হয়, তার জন্য নির্দিষ্ট ব্রত উদ্‌যাপন করো। মজা হল এই শিষ্যদের মধ্যে ঠোঁটকাটা যাজ্ঞবল্ক্যও ছিলেন। তিনি বললেন—গুরুমশাই! খুব তো বললেন ব্রত কর, কিন্তু এই ফালতু বামনগুলোকে দিয়ে ব্রত করিয়ে কি হবে—কিম্ এভি র্ভগবন্ দ্বিজৈঃ। এদের ক্ষমতা খুব কম, একটু আধটু ব্ৰত-নিয়ম করলেই এরা মুষড়ে পড়ে— ক্লেশিতৈ রল্পতেজোভিঃ… কিমেভি র্ভগবন্ দ্বিজৈঃ। ৫৩ তার চেয়ে আমি একাই এই ব্রত পালন করছি। বৈশম্পায়ন নিশ্চয় ভাবলেন—একবার মেরুসমাজের ব্রাহ্মণদের চটিয়ে ভাগনে মারা পড়েছে, আবার শিষ্য ব্রাহ্মণ, চটানো! তিনি রেগে যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন— শিষ্য হয়ে তোর এত বড় কথা! তুই এত সব ব্রাহ্মণদের নিস্তেজ বলছিস। দে, আমায় ফিরিয়ে দে, এতকাল ধরে তোকে যা পড়িয়েছি, বেদবিদ্যা সব ফিরিয়ে দে, এতকাল ধরে তোকে যা পড়িয়েছি, বেদবিদ্যা সব ফিরিয়ে দে। যাজ্ঞবল্ক্য গুরু বৈশম্পায়নকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন, কেননা পুরাণ তাঁর আখ্যা দিয়েছে—শিষ্যঃ পরমধর্মজ্ঞঃ গুরুবৃত্তিপরঃ সদা। সেই যাজ্ঞবল্ক্য যখন দেখলেন যে তাঁর গুরু কতগুলি ফালতু ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণপুঙ্গব বলে ঘোষণা করেছেন— নিস্তেজসো বদস্যেতান্ যস্ত্বং ব্রাহ্মণপুঙ্গবান্‌, তখন যাজ্ঞবল্ক্যও ভীষণ রেগে বললেন—দেখ ঠাকুর! যা বলেছি, তোমার ওপর যথেষ্ট ভক্তি ছিল বলেই বলেছি—ভক্ত্যৈতত্তে ময়োদিতম্। এখন তুমি যদি বিদ্যে ফিরিয়ে নিতে চাও, তাহলে বলছি— তোমার মত গুরুতেও আমার প্রয়োজন নেই, যা এতকাল শিখেছি এখনই নাও ফিরিয়ে—মমাপ্যলং ত্বয়াধীতং যন্ময়া তদিদং দ্বিজ। এই বলে সাঙ্গ যজুর্বেদ তিনি রক্তবমি করে উগরে দিয়ে সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন— ছৰ্দয়িত্বা দদৌ তস্মৈ যযৌ চ স্বেচ্ছয়া, মুনিঃ। ৫৪ বেদের মত জিনিস উগরোনোর জন্যই যাজ্ঞবল্ক্যের বমির সঙ্গে একটু রক্ত পড়েছিল হয়তো। কিন্তু এই ঘটনাটা হল অল্পবীর্য নিষ্কমা, নিস্তেজ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যাজ্ঞবন্ধ্যের প্রতিবাদ। প্রতিবাদ যে ঠিক ছিল, তার প্রমাণ তিনি সেখান থেকে চলে গিয়ে সূর্যোপাসনা করে যজুর্বেদের পাঠ এতটাই রপ্ত করেছিলেন, যা তাঁর গুরুও জানতেন না—যানি বেত্তি ন তদ্ গুরুঃ। ৫৫ বস্তুত বামুনের কোন গুণ না থাকা সত্ত্বেও বৈশম্পায়ন যেন তাঁদের মাথায় তুলে দিয়েছেন।

এই মাথায় তোলার ব্যাপারটা পুরাণকার এবং ধর্মশাস্ত্রকারদের যুগেই ঘটেছে বেশি। ব্রাহ্মণদের গুণ এবং বিশিষ্ট কর্ম না থাকা সত্ত্বেও জন্মসূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মণ্যকে সম্মান দিতে হবে—এই তাগিদ থেকেই ব্রাহ্মণকে বউনির খদ্দের হতে হয়েছে বেশ্যাব্রতে, আবার একই তাগিদে ব্রাহ্মণ ঠাট্টা-মস্করার পাত্র হয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। মনে রাখবেন গো-ব্রাহ্মণের চরম পৃষ্ঠপোষক কৃষ্ণের ঘরেই ব্রাহ্মণদের নিয়ে মস্করা হয়েছিল। যদুকুলের কুমারেরা শাম্বকে গর্ভবতী মেয়ে সাজিয়ে ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা করেছিল— বলুন তো ঠাকুর, এর ছেলে হবে না মেয়ে? ব্রাহ্মণেরা মুষল প্রসবের শাপ দিয়েছিলেন। আমরা বলি— ইয়ার্কি-ঠাট্টা কি লোকে করে না। ব্রাহ্মণেরা সব কথাতেই বাণী দিতেন, প্রচুর ভবিষ্যৎ ঘোষণা করতেন, সেই নিরিখে ফাজিল ছেলেরা হয়তো একটু ঠাট্টাই করেছে, তাতেই বংশধ্বংসের অভিশাপ! আমরাও তো জ্যোতিষীকে পরীক্ষা করার জন্য কত মিথ্যে মস্করা করি। কিন্তু বংশধ্বংসের অভিশাপেও স্বয়ং কৃষ্ণের মতামত কি বলুন তো! প্রথমত ভাগবত পুরাণকার লিখেছেন—ঈশ্বর হওয়ার কারণে তিনি ইচ্ছে করলে কিছু করতেও পারতেন অথবা অন্যথাও করতে পারতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের অভিশাপ সত্য করার জন্যই তিনি নাকি এক্ষেত্রে চুপচাপ রয়ে গেলেন। কারণ তাঁর মত হল—বামুনেরা যদি রেগে যায়, রেগে গিয়ে যদি শাপও দেয়, এমনকি হত্যাও করে তবু তাঁকে নমস্কার করে যেতে হবে ঘ্নন্তং বহুশপন্তং বা নমস্কুরুত নিত্যশঃ। ৫৬ এই নমস্কারের ফল হয়েছে এই যে পদ্মপুরাণে দেখি—মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক পরমহংস ব্রাহ্মণ যখন সন্ধ্যাকালে অভিসারিণী পতিব্রতা যুবতীকে দেখে কামার্ত হয়ে ওঠেন, পুরাণকার তখনও সেই ব্রাহ্মণের বিশেষণ দেন— ভগবান্ বিপ্রঃ। যদিও শ্লোকের অন্য অর্ধে পৌরাণিককে বলতেই হয়—এই ভগবান বিপ্র এক যুবতীকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়লেন— দৃষ্টবা তাং ভগবান্ বিপ্র্রো মন্মথস্য ভয়ার্দিতঃ। পরে যে ঘরে ওই রমণী আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই অর্গলরুদ্ধ ঘরের গবাক্ষপথে ঢুকতে গিয়ে ব্রাহ্মণ পরমহংস মারা যান—প্রবিষ্টং ন পুনশ্চৈতি পঞ্চত্বমগমত্তা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার জলবৎ।

আজ থেকে একশ বছর আগে যখন ব্রাহ্মধর্মের রমরমা চলছে, তখন আমরা বলেছি— বেদ ব্রাহ্মণ সব গেল। পঞ্চদশ-ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে যখন চৈতন্যদেব বৈষ্ণব-ধর্মের জোয়ার এনেছিলেন তখনও আমরা শ্লোক বেঁধে বলেছি— কলির প্রকোপ ভীষণ বেড়ে গেছে— বলী কলিপরাক্রমঃ। নিত্যানন্দের কীর্তনরসে বেদ-ব্রাহ্মণ সব গেল—বিগতবেদবাদো’ধুনা। ৫৭ আবার দেখুন দশম-একাদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত প্রাচীন নৈয়ায়িক উদয়ানাচার্য লিখেছেন— ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা এখন কামনা-বাসনা আর ক্রোধ-লোভের শত কাঁটায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে—কোমক্রোধাদি কন্টকশতজর্জরঃ। সর্বত্রই আচার্য নৈয়ায়িক কেবলই স্খলন দেখতে পাচ্ছেন— ইতস্ততঃ স্খলান্নিব উপলভ্যতে।৫৮ অর্থাৎ তিনিও বলছেন—বেদ-ব্রাহ্মণ সব গেল। আমরা তিন যুগের সন্ধিতে এই যে গেল গেল রব শুনলাম, এই রব পুরাণগুলির মধ্যেই বহুবার শোনা গেছে। যে দ্বাপরযুগের শেষ অংশে পুরুষোত্তম কৃষ্ণ জন্মেছিলেন বলে, লোকে বলে সেই দ্বাপর যুগের আদিতেই নাকি ‘সব গেল গেল’ হয়েছিল। বেদ এক ছিল তাকে চারভাগ করতে হয়েছে দ্বাপরযুগে, কেননা ব্রাহ্মণেরা আর বেদ ধরে রাখতে পারছিলেন না। বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা দ্বাপরযুগে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে—দ্বাপরেষু প্রবর্তন্তে ভিন্নবৃত্তাশ্ৰমা দ্বিজা। ৫৯ ধর্ম হয়ে পড়েছে ব্যাকুল তার ওপর বেদের ওপর এত ব্যাখ্যা, এত টীকা-টিপ্লীন চালু হয়ে গেছে যে, মানুষ ধর্ম বলে কোনটা মানবে, তা ভেবেই পাচ্ছে না—মতিভেদাস্তথা নৃণাম্। ভেদ, প্রভেদ, আর বিকল্পে মানুষ দ্বাপরেই জর্জর। ফলে বর্ণাশ্রম ধ্বংস হয়ে গেছে—বর্ণাশ্র্রমপরিধ্বংসাঃ। ৬০ কামনা, লোভ, অধৈর্য, যুদ্ধ এমন কি ধর্মের মধ্যে পর্যন্ত সংকর এসে গেছে। আমাদের বক্তব্য দ্বাপর যুগের অবস্থাই যখন এই রকম, তখন আর কলিযুগে বেশি কি হবে।

ইতিহাস-পুরাণে যেমনটি দেখেছি বা শুনেছি, তাতে দ্বাপর-ত্রেতায় দেবতারা আর ঋষিরা মর্ত্যভূমির মানুষের সঙ্গে দিন-রাত ওঠা-বসা করতেন। সেই সময়েই মানুষ যখন দেবকল্প ঋষি-ব্রাহ্মণ এবং বৃহত্তর মনুষ্যসমাজের স্বলন নিয়ে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তখন আজকের এই ঘোর কলির অস্থিরতার মধ্যে দেবতা, ঋষি বা রাজাদের আর নতুন করে বিপর্যস্ত করতে চাই না। বরঞ্চ আমাদের চেয়ে তাঁদের সরলতা অনেক বেশি; যেহেতু নিজেদের স্বলন পতন-ত্রুটিগুলি তাঁরা অসীম সৎসাহসে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তাঁরা কিছুই লুকোননি।

আমরা সম্পূর্ণ অবহিত আছি যে ব্রাহ্মণেরাই এককালে তাঁদের ত্যাগ এবং শৌচাচারের নিরিখে সমাজের মূর্ধণ্যভূমিতে প্রতিষ্ঠি ছিলেন। আমরা অবহিত আছি ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক ছিলেন ব্রাহ্মণেরা। আমরা এও জানি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা না থাকলে ভারতের দার্শনিক, মানবিক এবং সাহিত্যিক চিন্তাধারা অন্যরকম হত। মহামতি কৃষ্ণ এই ব্যাপারটা বুঝেছিলেন এবন বুঝেছিলেন বলেই তাঁর কথাটাই আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। হাজার দোষ থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণ যে বলেছেন ব্রাহ্মণদের হেয় কোর না, তার একটা কারণ আছে। কারণ, কৃষ্ণ বুঝেছিলেন— কাম, ক্রোধ, লোভ— এই সব মানবিক দুর্বৃত্তি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা এবং ত্যাগের মাহাত্মে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁদের এত সহজে নস্যাৎ করে দেওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে আমরা এটাও মনে রাখব যে, চরম মাহাত্ম্য থাকা সত্ত্বেও স্বয়ং কৃষ্ণের পুত্রেরাই যেখানে তৎকালীন ভূদেব ব্রাহ্মণঋষিদের সঙ্গে নিতান্ত রসিকতায় মেতে উঠছেন, সেখানে আমরা কলিকালের লোকেরা পিতামহোপম দেবতা ঋষি বা রাজার সঙ্গে যে প্রশ্রয়যুক্ত হয়েই কথা বলব— তাতে আশ্চর্য কি?

সুত্র

‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ৩. ৩৩

তদেব, ৩. ৪৩

তদেব, ৪. ৩১

R. C. Hazra, Stdies in the Puramic Records on the Hindu Rites and Customs, p. 207

‘বিষ্ণু-পুরাণম্‌’, ৬. ১. ১৭

‘কর্ম-পুরাণম্‌’, পূর্বভাগ, ২৯.১২

‘শ্রীমদ্ভাগবতম্’, ১.১৭. ২

‘বৃষং মৃণাল-ধবলং মেহন্তমিব বিভ্যতম্‌।’

(এই শ্লোকের শ্রীধরস্বামী-কৃত টীকা দ্রষ্টব্য)।

তদেব, ১.১৭. ৩৯

‘হরিবংশ’, বিষ্ণুপর্ব, ৫৭. ৫৮

১০ তদেব, ৫৭. ৬২

১১ ‘বিষ্ণু-পুরাণম্‌’, ৪. ১. ৩৬

১২ ‘কূম-পুরাণম্‌’, পূর্বভাগ, ২৮, ৩০; ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৮. ৮৩

১৩ তদেব, পূর্বভাগ, ২৮. ৩৫, ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৮. ৯৩

১৪ তদেব, পূর্বভাগ, ২৮. ৪২

১৫ তদেব, পূর্বভাগ, ২৮. ৪৪

১৬ এ ছাড়াও অন্য একটি পাঠ পাওয়া যায় “স্বধর্মং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা কামাল্লোভেম্ববর্তত।” হরিবংশে হরিবংশ-পর্ব, ৫.৩

১৭ ‘বিষ্ণুপুরাণম্‌’, ১. ১৩. ২০

১৮ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৬২. ১৭২

১৮ক ‘কূর্ম-পুরাণম্‌’ পূর্বভাগ, ২৮. ৪৬

১৯ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’ ৮. ৪১. ৪৩

২০ ‘মহাভারত’, ১. ১২২. ৭

২১ গিরীন্দ্রশেখর বসু ‘পুরাণ-প্রবেশ’, পৃ. ২৩৪

২২ ‘মহাভারত’, ১.১২২. ১৪

২৩ ‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ৪৮. ৩৬

২৪ তদেব, বঙ্গানুবাদ ৪৮. ৪১

২৫ তদেব, ৪৮. ৫৩

২৬ ‘মনুসংহিতা’ ৯. ৬০

২৭ ‘মৎস্য-পুরাণম্’, ৪৮. ৬২

২৭ক তদেব, ৪৮. ৬৯

২৮ তদেব, ৪৮, ৭৫

২৯ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৮. ১৯৯

৩০ তদেব, ৮. ২০৭

৩১ ‘কূর্ম-পুরাণ’, উপরিভাগ, ১৩. ৭

৩২ ‘মনুসংহিতা’, ২.২১২

৩৩ তদেব, ২. ২১০

৩৪ ‘পদ্ম-পুরাণ’, ভূমিখণ্ড, ৩৪, ১১

৩৫ তদেব, ৩৪. ২২

৩৬ তদেব, ৩৪. ২৬

৩৭ তদেব, ৩৬. ৩২

৩৮ ‘শ্রীমদ্ভাগবতম্‌’, ১২. ৩. ৩৭

৩৯ ‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ১১. ৬১

৪০ তদেব, ১১. ৪৮

৪১ তদেব ১১. ৫৪

৪২ তদেব, ১১. ৬০

৪৩ তদেব, ২০১. ২৭

৪৪ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৯১. ১০

৪৫ ‘সুভাষিতরত্নভাণ্ডাগারম্’ পৃ. ২৪৫. ১০

৪৬ ‘বায়ু-পুরাণ’, ৯১. ৬-৮

৪৭ ‘বিষ্ণু-পুরাণ’, ৬. ১. ২৯

৪৮ ‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ২৫. ৫৯

৪৯ তদেব, ৪৭. ১২১

৫০ তদেব, ৪৭. ১৭৩

৫১ তদেব, ৪৭. ১৮৬

৫২ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৯৮. ৩৩; ‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ৪৭. ১৯৯

৫৩ ‘বিষ্ণুপুরাণম্’, ৩. ৫. ৭

৫৪ তদেব, ৩. ৫. ১১

৫৫ তদেব, ৩. ৫. ২৭

৫৬ ‘শ্রীমদ্ভাগবতম্‌’, ১০. ৬৪. ৪১

৫৭ ‘বঙ্গে নব্য-ন্যায়চর্চা’, পৃ ১০৩

৫৮ উদয়নকৃত ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’, ২.৩. ৩. পৃ. ৩১৭

৫৯ ‘বায়ু-পুরাণম্’, ৫৮. ১৫

৬০ তদেব, ৫৮. ২৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *