প্রথম অধ্যায় – দেবতারা মানুষের লক্ষণাক্রান্ত
॥ ১ ॥
কবি যে বলেছিলেন, ‘দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা’— সে তো রীতিমত তত্ত্বের কথা। ‘হিউম্যানাইজেশন অব গড্স্’ কিংবা ‘ডিইফিকেশন্ অব হিউম্যান বিয়িংস’ অথবা নিদেনপক্ষে ‘অ্যাপোথিওসিস্’— এসব তো মিথলজিস্টদের পরিসর। আমি অত দূর যাচ্ছি না। আমার বক্তব্য সাদামাটা। আমি বলতে চাই— দেবতারা, বিশেষ করে বৈদিকোত্তর যুগের দেবতারা, আমাদের এত কাছাকাছি চলে এসেছেন যে, তাঁরা শুধু ঘরের গোপালটি কিংবা লক্ষ্মণভাইটি হয়েই রেহাই পাননি। তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা যেমন হয়েছে, তেমনি তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিতান্ত লৌকিক স্তরের প্রবাদও গাঁথা হয়ে গেছে। রঙ্গ-রসিকতা তো এমন মাত্রাছাড়া পর্যায়ে চলে গেছে যে, তাতে দেবত্বের লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। যা থাকে— তা শুধু সাধারণ মনুষ্যসমাজের দৈনন্দিন চালচিত্রে আঁটা দেবতা নামক মনুষ্যটির বিচিত্র কাণ্ডকারখানা। সে সব কাণ্ডকারখানাকে আর যাই হোক, কোন ক্রমেই অলৌকিক মর্যাদাসম্পন্ন বলা যায় না। অন্যদিকে সংস্কৃতের কবিরাও বড়ই চতুর। তাঁদের দোষ দেওয়ার মতো কিচ্ছুটি নেই। তাঁরা রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ বেশ করে পড়ে নিয়ে ভারতবর্ষের তাবড় তাবড় দেবকুলের স্খলন, পতন, ত্রুটিগুলি ভাল করে লক্ষ করেছেন এবং সেগুলি মনেও রেখে দিয়েছেন। দেবতাদের এই স্খলন, তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অথবা ক্রিয়াকলাপই পরবর্তী কবিদের ভয়ঙ্কর রঙ্গ-রসিকতার ইন্ধন যুগিয়েছে। অপিচ শুধু রসিকতাই নয়, আরও পরবর্তী সময়ে ওই রসিকতার অংশগুলিই আরও জমাটভাবে মর্মচ্ছেদী প্রবাদমালার জন্ম দিয়েছে— যা শুনলে, দেবতারা যদি জীবিত থাকতেন, আঁতকে উঠতেন, অথবা তুর্কি নাচন লাগিয়ে দিতেন।
এই তো দেখুন না, যে চৈতন্যদেব এই পাঁচশ বৎসর মাত্র আগে এত লীলা করে গেলেন, তাঁকে কিনা লোকে মেনিমুখো লোকের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলে— ন্যাকা চৈতন্য! চৈতন্যের দোষ কি? না, তিনি কিশোরীভাবে রাধার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করে আজীবন ‘হা কৃষ্ণ’, ‘কোথা কৃষ্ণ’ করে গেছেন। অথবা এটাও বুঝি সবচেয়ে বড় কারণ নয়, যেটা ন্যাকামি বলে গণ্য হতে পারে। কারণটা বোধহয় তাঁর অন্ত্যলীলার পাগলপারা সেই দিব্যোম্মাদগ্রস্ত অবস্থা, যাতে লোকব্যবহার ক্ষুণ্ণ হত হয়তো। এই অবস্থায় ভাবের আতিশয্যে তাঁর কৃষ্ণ শব্দটি পুরো উচ্চারণ করার ক্ষমতা ছিল না। তিনি কৃষ্ণ বলতে ‘ক’ বলতেন, রাধা বলতে উচ্চারণ করতেন ‘রা’। মগ্নচৈতন্যের এই অলৌকিক আবেশ সজ্জন ভক্ত সাধুদের কাছে যতই উচ্চকোটির সাত্বিক বিকার বলে গণ্য হোক না কেন, সাধারণে তাঁকে অবশ্যই ভুল বুঝত এবং তাঁর চরিত্রের অপব্যাখ্যাও করত। সম্ভবত সেই সময় থেকেই যে সব পুরুষ মানুষ একটু মেয়েলি স্বভাবের অথবা এক বলতে আরেক বলে, তার ওপরেই চৈতন্যচরিত্রের ওই আবেশটুকু চাপিয়ে দিয়ে লোকে বলে— ন্যাকা চৈতন্য। আমরা লক্ষ করে দেখেছি— চৈতন্যের আরও একটি সাংঘাতিক অভ্যাস ছিল। কেউ হয়তো অত্যন্ত কঠিন কোনও সমস্যায় পড়েছে এবং তা গিয়ে নিবেদনও করছে স্বয়ং মহাপ্রভুর কাছে। প্রভু কিন্তু সেই সমস্যার স্বাভাবিক সমাধানের পথ বাদ দিয়ে হয়তো বললেন— কৃষ্ণই তোমাদের রক্ষা করবেন, তিনিই পথ দেখাবেন। হয়তো মহাপ্রভু এবং কৃষ্ণের ইচ্ছায় সেই সব সমস্যার সুন্দর সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু আজ যদি কারও গুরুতর সমস্যার সঠিক সমাধানের চেষ্টা না করে গোটা সমস্যাটাই আমরা সার্বিকভাবে লঘু করে দিই, তাহলে অবধারিতভাবে সমস্যা-বিধুর মানুষটির কাছে গালাগালি শুনতে হবে— ন্যাকাচৈতন্য ! কিচ্ছুটি যেন বোঝ না।
অথচ চৈতন্যসংক্রান্ত সমস্ত মধ্যযুগীয় সাহিত্য ঘেঁটে কখনও প্রমাণ করা যাবে না যে, চৈতন্যদেব কোন সমস্যা বুঝতেন না কিংবা তিনি ন্যাকা ছিলেন। শুধু কি এই গালাগালি? তাঁকে ভ্যাঙানোই কি কম হয়েছে? কেউ মাথার ওপরে হাত দুটি তুললেই হল— তাঁকে গৌরাঙ্গের ভঙ্গিতে হাত তোলা বলেছি, পুনরপি যে মানুষ টিকি রাখেন তাঁর টিকিটার নামই হয়ে গেল ‘চৈতন’। হেতু কি? না, চৈতন্য ন্যাড়া মাথায় ধর্মীয় কারণে টিকি রাখতেন। কিন্তু তাই বলে এই শাস্তি ? টিকিকে চৈতন বলে ডাকতে হবে? সাধারণ মানুষ থেকে রবীন্দ্রনাথের মত কবিকেও গাইতে হবে— যাও ঠাকুর চৈতন-চুটকি নিয়া। এস দাড়ি নাড়ি কলিমুদ্দি মিয়া।
আসলে এই হল ঘটনা। ঠাকুর দেবতার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এমনই যে, দরকার মত তাঁদের পুজোর আসনে বসিয়ে ভক্তি-গদগদচিত্তে ফুলনৈবেদ্য উপহার দিই, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি, আবার ঠাট্টা-মশকরাও করি। আপনারা জোরালো যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন যে, এসব প্রবাদ ধর্মীয় মতবাদে বিরোধী গোষ্ঠীর তৈরী। কথাটা যে একেবারে উড়িয়ে দেবার মত— তা আমি বলছি না। তবে ধর্মীয় নেতা কিংবা বিশিষ্ট অবতারের সম্পূর্ণ বিরোধী গোষ্ঠীরা যে প্রবাদ তৈরী করেন, সেগুলির মধ্যে সেই সেই নেতা কিংবা অবতারের চরিত্রহননই থাকে বেশি। যেমন আবার সেই চৈতন্যের উদাহরণই দেব— কেননা তাঁর ঐতিহাসিকতা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমাকে এক সময় কর্মব্যপদেশে চৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপে যেতে হত। প্রথম দিন যেদিন কৃষ্ণনগর থেকে স্বরূপগঞ্জের ঘাটে নৌকো ধরে ওপারে খেয়াঘাটে পৌঁছোলাম, তখন আমার ভ্রমণসঙ্গী বন্ধু— ‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি’র ভঙ্গিতে বললেন— ‘নবদ্বীপের বাঁধাঘাটে/ নিত্যানন্দ পাঁঠা কাটে/ নিমাই চাপিয়া ধরে ঠ্যাং।’ এ গানের সুর ছিল সকালবেলার টহল-কীর্তন— ভজ গৌরাঙ্গ/কহ গৌরাঙ্গের নকলে।
আজন্ম নিরামিষাশী চৈতন্যের সম্বন্ধে এই মর্মন্তুদ গান শুনে আমি একেবারে ধন্দে পড়ে গেলাম। পরে বুঝেছি— এ গানের মধ্যে চৈতন্য-ধর্মের বিরোধিতার সুর আছে, যে বিরোধিতা আরম্ভ হয়েছিল তাঁর আপন কাল থেকেই। পাঠকের স্মরণে থাকবে, বৃন্দাবন দাসের লেখা চৈতন্যভাগবতের কথা। চৈতন্য যখন নবীন ভাবাবেশে শ্রীবাসের বাড়িতে ঘরের দরজা বন্ধ করে কীর্তন-যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন, সেদিন এইরকমই কিছু লোক শ্রীবাসের বাড়ির বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে নিজেরা নিজেরা বলেছিল— এই বৈষ্ণবগুলো আসলে মদ-মাংস সব খায়, এসব না খেলে দিনরাত এমন গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে কীর্তন করে কি করে ? বৃন্দাবন দাসের জবানীতে—
কেহো বোলে, “এগুলা সকল নাকি খায়।
চিনিলে পাইবে লাজ— দ্বার না ঘুচায় ॥”
কেহো বোলে— “সত্য সত্য এই সে উত্তর।
নহিলে কেমতে ডাকে এ অষ্টপ্রহর ॥”
কেহো বোলে— “আরে ভাই মদিরা আনিয়া।
সভে রাত্রি করি খায় লোক লুকাইয়া ॥”১
নবদ্বীপের বাঁধাঘাটে আমি যে গান শুনেছি, তার সঙ্গে বৃন্দাবন দাসের জবানীর তফাত নেই কোনও। বস্তুত বিরোধীরা যে প্রবাদ তৈরী করে তা মর্মভেদী, কিন্তু সাধারণের মধ্যে যে প্রবাদ তৈরী হয়েছে তার মধ্যে নির্ভেজাল বদামি ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি প্রধানত চৈতন্যের কথা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, তিনি এই পাঁচশ বছর আগেও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু আমাদের পরিমণ্ডলে যাঁরা দু’হাজার আড়াই হাজার বছরের বনেদী দেবতা— তাঁদের সম্বন্ধে যে প্রবাদগুলি তৈরী হয়েছে তার মধ্যেও এই একই প্যাটার্ন থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। অর্থাৎ কিনা এমন প্রবাদ, দেবতার চারিত্রিক আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এমন কিছু রসিকতা, যা দেবতার গায়ে হুল ফোটায় না, অথচ তাঁকে ঠেলা দেয় নাড়া দেয়, বিরোধী গোষ্ঠীর তৈরি-করা প্রবাদ কিন্তু সেক্ষেত্রে দেবতাকে একেবারে অপদেবের মতো করে তুলবে।
আমার কলেজ-জীবনের শিক্ষক সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য মশাই একসময় আমাকে বলেছিলেন যে, মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে দেবতায় দেবতায় ঝগড়া, বিদ্বেষ এবং গালাগালি অত্যন্ত লৌকিক পর্যায়ে চলে গেছে, এবং এই লৌকিকতার প্রভাব পরবর্তী প্রবাদবাক্যগুলির ওপর পড়ে থাকতে পারে। উল্লেখ্য, মাষ্টারমশাই মঙ্গলকাব্যগুলি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তবে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত না হয়েও আমার একটা আর্জি পেশ করতে পারি। বস্তুত বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলি আমার কাছে প্রাচীন পুরাণগুলির বাংলা সংস্করণ বলে মনে হয়। দেবতাদের লোকায়ন শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই সংস্কৃত পুরাণগুলির যুগ থেকেই। দেবতায় দেবতায় ঝগড়া শুধু নয়, দেবতাদের চারিত্রিক এবং আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলিও পুরাণগুলির মধ্যে এমন লোকায়তভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, প্রবাদের জমি তৈরী হয়েছে সেখান থেকেই। আবার সভ্য সমাজের সাধারণ মানুষেরাও যে বিশিষ্ট দেবতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানা কথা বলেন, নানা কবিতা তৈরী করেন, নানা রঙ্গ-রসিকতা করেন— তারও উৎসভূমি এই পুরাণগুলিই, যার প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে বিভিন্ন কবির জবানীতে।
বাঙালীর ঘরে ঘরে যে সব দেবতা অধিষ্ঠিত এবং প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের প্রতি অচলা ভক্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মশকরা কোনওদিনই বন্ধ থাকেনি। অনেক ক্ষেত্রে সে ইঙ্গিত অতি হীন, কখনও বা অতি কুরুচিপূর্ণও বটে। কিন্তু দেখেছি— তাতে ভক্তের ভক্তিতেও ভাঁটা পড়ে না, দেবতার ঐশ্বর্য সম্বন্ধেও কোনও মালিন্য তৈরী হয় না। বরঞ্চ ওই সব রঙ্গ-রসিকতা ক্ষেত্রবিশেষে ভক্তের হৃদয়ে রীতিমত রসসঞ্চার করে। তাতে আপন আপন দেবতার, ক্রিয়াকর্ম এমনকি বিক্রিয়াগুলিও লীলা-বিলাসের রূপ ধারণ করে। বিশ্বাস না হয়, বাঙালি ঘরের প্রাচীন এবং আধুনিক মায়েদের কথা স্মরণ করুন। তাঁরা যুবক-বয়সের অতিপক্ক পুরুষটিকেও নিছক ‘গোপাল’ বলে ভাবেন এবং তার অনেক অন্যায় কর্মকেও গোপাল-সুলভ মনে করে প্রশ্রয় দেন। কিন্তু এই প্রশ্রয় শুরু হয়েছে কবে থেকে জানেন ? সেই দেবতার সময় থেকেই, যাকে আমরা গোপাল বলে সেবা করি। যশোমতীর চিরন্তন মাতৃহৃদয় গোপালের পরস্ত্রীবিষয়ক ক্রিয়াকলাপে একটুও সন্দিগ্ধ কিংবা উৎকণ্ঠাগ্রস্ত ছিল না, বরঞ্চ এ রকম কথা শুনলে তিনি সাতবাহন হালের গাথা সপ্তশতীর পদ্ধতিতে বলতেন— আমার দামোদর এখনও ছেলে মানুষ—অজ্জাবি বালো দামোদরেত্তি— বাছা আমার ওসব বোঝেই না। পুত্রের অপকর্মগুলি যে সব মায়েরা এইভাবে আবরণ করেন, তাঁদের নিয়ে আমরা কি করি? সামনে ঝগড়ার ভয়ে কিছু বলি না, পেছনে হাসি। তার ওপরে এই দুরন্ত প্রশ্রয় যদি ছেলের বন্ধু-বান্ধব বা বান্ধবীর সামনের প্রদর্শিত হয়, তাহলে বন্ধুরা কি করে ? হাসে। হাল দেখিয়েছেন — যশোমতীর মুখে এই প্রশ্রয়মাখা কথা শুনে ব্রজের যুবতীরা নাকি কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে তেরছা করে হেসেছিল।২ ব্যঞ্জনাটা পরিষ্কার।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়/তৃতীয় শতাব্দীতে হালের মত ভোগী কবি যা বলেছিলেন, ষোড়শ শতাব্দীতে এসে আপাত যৌবনবিরাগী রূপ গোস্বামী একই কথা বলেছেন। বিদগ্ধমাধব নাটকে দেখছি— কৃষ্ণের পিতা নন্দ মহারাজ যশোমতীকে বলছেন— কৃষ্ণের বিয়ের জন্য গোপীকুলে একটি মেয়ে দেখতে। উত্তরে যশোদা বললেন— ছেলে আমার এখনো ‘দুগ্ধমুখ’ বালক, তার আবার এখনই বিয়ে কি? বলা বাহুল্য, স্নেহময়ী যশোদা গোপরমণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের রসবিলাসের কথা শুনেও শুনতেন না, জেনেও জানতেন না। কিন্তু যারা জানত, যেমন এক্ষেত্রে কৃষ্ণেরই এক বয়স্য বন্ধু— মধুমঙ্গল, সে এ কথা শুনেই চুপিচুপি কৃষ্ণের কানে কানে বলল— তুমি বুঝি সত্যিই দুগ্ধমুখ— যে দুধের লোভে সহস্র গোপকিশোরীরা তোমার মুখে মুখ দিয়ে দুধ চাখে।৩
সহৃদয় পাঠক! কৃষ্ণের বন্ধুর এই তির্যক রসিকতা ভক্তের কাছে কিন্তু লীলাপুরুষোত্তম কৃষ্ণের বিলাস-বৈদগ্ধ্যের অঙ্গ। অভক্তজনে এসব কথার অপব্যাখ্যা করতে পারে বলে এই সব লীলা গ্রন্থে অভক্তজনের প্রবেশও নিষেধ। সেই রসের রসিক মানুষই এই রসিকতার অধিকারী এবং তিনিই এর বোদ্ধা। ভক্তের কাছে কৃষ্ণ শুধু নবনীত-চোর নন, তিনি অনেকই কিছুরই চোর। ঘটে-পটে ছিন্নভিন্ন রুক্ষ নৈয়ায়িক পর্যন্ত সরসে তাঁকে প্রণাম করেন— কাঁচা-বয়সী গোপবধূর বসন-চোরা বলে— গোপবধূটিদুকূলচৌরায়।৪ আর সামগ্রিক ভক্তের কাছে তিনি শুধু ননীচোরা, গোপীর বসন-চোরা, ভক্তের মনোচোরাই নন, তিনি জগতের সবচেয়ে বড় চোর— চৌরাগ্রগণ্যং পুরুষং নমামি।৫ ধ্যানগম্য বিরাট পুরুষকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় চোর বলে প্রতিষ্ঠিত করে ভক্ত যে পরম মাধুর্য আস্বাদন করেন— তারই পথ ধরে অন্য কবিরা কিন্তু এমন জায়গায় এসে পৌঁছোন, যাতে মর্ত্ত্যলিঙ্গ পরম পুরুষটিকে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্’ বলতে ভয় হয়।
॥ ২ ॥
বস্তুত রসিকতাই হোক কিংবা কটুক্তিই হোক— এই প্যাটার্নটা নতুন কিছু নয়, এমনকি এটা যে নিতান্ত ভারতবর্ষীয় কোন উদ্ভাবন— তাও বলা যাবে না। কারণ অন্যান্য দেশের দেবচরিত্রেও নানান কালিমা-কলঙ্ক আছে, আছে ক্রোধ, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা। পরম ঈশ্বরের রূপকল্পনা যেখানে কার্যত নিষিদ্ধ, সেখানে হোমারের মত কালজয়ী কবি মহাকাব্যের গ্রন্থিসূত্রে দেবতাদের নানান পাকে জড়িয়ে দিয়েছেন, এমনকি অনেক হীন কাজও তাঁদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। থিওগনির বিখ্যাত লেখক হেসিয়ড— তিনিও দেবতাদের কার্যকলাপ একেবারে নিঃসঙ্কোচে তুলে ধরার ফলে তাত্ত্বিকেরা পড়েছেন মহা ফাঁপরে। আমাদের দেশে ব্যাস-বাল্মিকীদের হোমার-হেসিয়ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কিন্তু হোমার-হেসিয়ড যা করেছেন তাতে তাঁদের আপন দেশেই কোথাও কোথাও নিন্দা-মন্দ শুনতে হয়েছে। গ্রীস দেশের এক প্রখ্যাত দার্শনিক, হেরাক্লিটাস তো হোমার অথবা তাঁর সমগোত্রীয় আর্চিলোকাসকে চাবকে সোজা করার প্রস্তাব দিয়েছেন— Homer should be whipped and Archilochus likewise।৬ হোমার-হেসিয়ডের মানসিক গঠন দেখে হেরাক্লিটাস্ মোটেই সুখী নন, এবং তাঁর ধারণা— অনেক কিছু জানলেই যে একজনের সব বোঝা হয়ে যাবে তার কোনও মানে নেই। যদি তাই হত, তাহলে হেসিয়ড কিংবা পিথাগোরাস, জেনোফেনিস কিংবা হেকাটেলাসও অনেক কিছু শিখে ফেলত— The learning of many things does not teach understanding, otherwise it would have taught Hesiod and Pythagorus and again Xenophanes and Hecataleus.৭
সত্যি কথা বলতে কি— আমাদের দেশের তাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা কেউই ব্যাস-বাল্মীকির ওপর এতটা মারমুখো নন। ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী বৌদ্ধ দার্শনিকেরা পর্যন্ত কেউ বেত মারার ভয় দেখাননি ব্যাস-বাল্মিকীকে। বরঞ্চ আমরা ব্যাস-বাল্মীকির সূত্র ধরে যেটা রপ্ত করেছি— তা হল, দেবতাদের চরিত্রব্যাখ্যা, দেবতাদের ক্রোধ, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা, কামনা, এমনকি ভক্তের ওপর পক্ষপাত— এই সব কিছুরই একটা যুতসই কারণ খুঁজে বার করে তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা করি আমরা। অপিচ এসব প্রশ্ন-ব্যাখ্যা আমরা নয়, আমাদের পূর্ববর্তী ব্যাসেরাই করেছেন।
আপনারা জানেন যে, দেবতারা—সে ভারতীয়ই দেবতাই হোন কিংবা গ্রীক—ছল, জুয়োচুরিতে দারুণ অভ্যস্ত। কিন্তু এসব দৈবদোষ দেখে আমরা হেরাক্লিটাসের মতো মোটেই মারমুখো হইনি, বরঞ্চ রাজার মতো সশ্রদ্ধে দেবীভাগবত পুরাণের ব্যাসকে জিজ্ঞাসা করেছি কি ব্যাপার, কেন এমন হল ? ঘটনা হল— দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতি একবার অসুরগুরু শুক্রাচার্যের অনুপস্থিতিতে অসুরদের ছলনা করেছিলেন। তিনি শুক্রাচার্যের রূপ ধরে এসে অসুরদের প্রবঞ্চনা করে বলেছিলেন— আমিই তোদের গুরু। অসুরেরা বিশ্বাস করেছিল এবং এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে দেবগুরু তাঁদের অহিংসা শেখাচ্ছিলেন যাতে আততায়ী দেবতাদের তারা না মারে— অহিংসা পরমো ধর্মোহন্তব্যা হ্যাততায়িনঃ।৮
খবর শুনে শ্রোতার আসনে-বসা রাজা জনমেজয় হুম হুম করে উঠলেন। ব্যাসকে বললেন— এটা কি রকম কথা হল, মুনিবর ? দেবতাদের গুরু হয়ে, প্রাতঃস্মরণীয় অঙ্গিরার ছেলে হয়ে বৃহস্পতি কিনা শেষে এমন নিপাট মিথ্যা কথা বলতে পারলেন ? ধর্মশাস্ত্রে কুলীন , বিদ্যাবাগীশ মুনি হয়েও যদি তিনি এমন মিথ্যাবাদী হন, তাহলে সংসারী লোকেরা আর সত্য কথা বলার উপদেশ শুনবে কেন— কঃ সত্যবক্তা সংসারে ভবিষ্যতি গৃহাশ্রমী ?৯ রাজা এইটুকু বলেই থামলেন না। বললেন— শাস্ত্রের বচনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হলে, মনুষ্যব্যবহারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হলে আপনারাই না বলেন যে, ঋষিদের বাক্যই হল সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। তা বৃহস্পতির এই ছলনায় তো’ শব্দ-প্রমাণের বারোটা বেজে গেল। আপনারা বলেছেন— দেবতাদের জন্য নাকি সত্ত্বগুণ থেকে আর মানুষের জন্ম রজোগুণ থেকে। তা দেবতাদের গুরু সত্ত্বগুণী বৃহস্পতিই যদি এত মিথ্যাচারী হন, তা হলে রজোগুণী মানুষের মধ্যে আর সত্য কথা কইবে কে ? দেবগুরুর ওপর থেকে অভিযোগ সরিয়ে রাজা এবারে ধরলেন দেবতাদের। রাজা বললেন— দেখুন, মুনিবর ! ভগবান শ্রীহরি থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মা, ইন্দ্র— সকলেই ছল-জুয়োচুরিতে বেশ সিদ্ধহস্ত দেখছি, মানুষের কথা নাই বা বললাম—
হরি র্ব্রহ্মা শচীকান্ত স্তথান্যে সুরসত্তমাঃ।
সর্বে ছলবিধৌ দক্ষা মনুষ্যাণাঞ্চ কা কথা ॥১০
চিরটা কাল মানুষকে কেবল ধর্ম শেখানো হয়, শেখানো হয় দেবতা-মুনিদের দ্বারেই। আজকে উপযুক্ত মওকা বুঝে মানুষ রাজা ব্যাসকে বললেন— দেবতাদের কাম-ক্রোধ কোনওটাই তো কম নয়, লোভও দারুণ। এখন দেখছি— সত্ত্বগুণী দেবতা আর তপোধন মুনিরা ছল-চাতুরীও বেশ ভাল রকম জানেন। এই যে বশিষ্ঠ, বামদেব, বিশ্বামিত্র— এত সব বড় বড় মুনিদের নাম। এঁরা তো প্রত্যেকে পাপী— তাহলে আর ধর্মের গতি কি হবে? আর দেবতারাই কি কম ? ইন্দ্র, অগ্নি, চন্দ্র, মায় বিধাতাপুরুষ পর্যন্ত ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন, প্রত্যেকেই পরের বউ দেখলে হামলে পড়েন। কিন্তু তবু লোকে এঁদেরই ভদ্রলোক বলে, আর্য বলে, কেমন করে এমনটি হয় বলুন তো— আর্যত্বং ভুবনেন্বেষু স্থিতং কুত্র মুনে বদ।
দেবতা-মুনিদের স্বভাব-চরিত্রে হাজার রকমের স্থলন পতনের কথা স্মরণ করে রাজা শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিমনা হয়ে মন্তব্য করলেন— ঋষি, মুনি দেবতা— সবাই লোভে কাতর, এখন কার কথাই বা শুনব, কার কথাই বা মানব— বচনং কস্য মন্তব্যম্ ?১১
দেবীভাগবতের স্রষ্টা ব্যাসদেব কিন্তু সোজাসুজি দেবতা কিংবা মুনিদের স্বভাব-চরিত্রের কোন সাফাই গাইতে পারলেন না। কিংবা শ্রীমদ্ভাগবতের কায়দায়— তেজী লোকের কোনও দোষ হয় না বাপু—তেজীয়সং ন দোষায়১২— এইরকম একটা বাহানা দিয়ে দৈব চ্যুতিগুলির দার্শনিক প্রতিপত্তি ঘটানোরও কোনও চেষ্টা করলেন না। উত্তরে ব্যাস যা বললেন, তা আমাদের মত মানুষের ভারি ভাল লেগেছে। ব্যাস দেবতাদের সম্পূর্ণ মানুষ বানিয়ে দিয়েছেন, এবং মন্তব্য করেছেন— দেহধারী জীবমাত্রেরই এইরকম ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে। ব্যাস কোন ভণিতা না করে জবাব দিলেন— কি বিষ্ণু, কি শিব, কি ইন্দ্র কি বৃহস্পতি— দেহবান পুরুষ মাত্রেই এসব বিকার থাকবে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর সবারই কামনা-বাসনা যথেষ্ট আছে বাপু— রাগী বিষ্ণুঃ শিবো রাগী ব্রহ্মাপি রাগসংযুতঃ।১৩ আর কামপর মানুষ মাত্রেই সমস্ত অন্যায়ই করতে পারে। দেবতাদের তুমি ত্রিগুণাতীত ভেবে বসে আছ— এইখানেই তোমার গণ্ডগোল। সত্ত্ব, রজ এবং তম— এই তিন গুণের বশেই এঁরা ভাল-মন্দ সবই করেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের যেমন জন্ম-মরণ আছে, এঁদেরও তাই— কালে মরণধর্মশ্চ সন্দেহঃ কো’ত্র তে নৃপ।১৪ পরিশেষে ব্যাস আমাদের মতই মন্তব্য করেছেন— অন্যকে উপদেশ দেওয়ার সময় সবাই খুব সাধু সাজতে পারে—
পরোপদেশে বিস্পষ্টং শিষ্টাঃ সর্বে ভবন্তি চ।
বিপ্লুতি র্হ্যবিশেষেণ স্বকার্যে সমুপস্থিতে ॥১৫
সেরকম সেরকম পরিস্থিতিতে পড়লে যে ভয়ান দেওয়া বেরিয়ে যাবে, সেটা অনেকেই বোঝে না। ব্যাস বুঝি দেবতা-মুনিদের জ্ঞান দেওয়ার প্রবৃত্তি এবং কার্যক্ষেত্রে নিজেদের অন্যায় আচরণের নিরিখেই এত বড় কথাটা বললেন।
যাঁরা কৃষ্ণভক্ত, ভাগবত পুরাণকে যাঁরা সবচেয়ে প্রামাণিক বলে মনে করেন, তাঁরা দেবীভাগবতের মন্তব্যে খুবই ক্রুদ্ধ হবেন মনে করি ; বিশেষত ভগবান বিষ্ণুকে যেহেতু এখানে জন্ম-মরণশীল মনুষ্য বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই এ ক্ষেত্রে তাঁদের ক্রোধ উদ্ৰিক্ত হওয়ারই কথা। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে দেখতে গেলে তাঁদের রাগ হওয়ার কোন কারণ নেই, যেহেতু তাঁদের ঘরের ভাগবত পুরাণে একমাত্র বিষ্ণু ছাড়া শিব, ব্রহ্মা তথা ইন্দ্রাদি দেবতার অবস্থা খুবই খারাপ। ভগবদ্গীতা তো একেবারে দিনক্ষণ মেপে ব্ৰহ্মার আয়ু নির্ধারণ করে দিয়েছেন।১৬ আর ভাগবত পুরাণের একনিষ্ঠ অনুগামী চৈতন্যচরিতামৃত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে নিয়ে কি কাণ্ড করিয়েছে ভাবতেই পারবেন না। আসলে কৃষ্ণের সঙ্গে ব্রহ্মার দেখা করার সময়টি পূর্বে নির্ধারিত ছিল না। তিনি এক শুভ মুহূর্তে দ্বারকায় কৃষ্ণকে দেখতে এসেছিলেন। কৃষ্ণের দারোয়ানকে তিনি আর্জি জানালেন এবং দারোয়ান যথারীতি কৃষ্ণকে জানাল। আর্জি শুনে কৃষ্ণ বললেন, “কোন ব্রহ্মা, কি নাম তাহার ?” দারোয়ান ঘুরে এসে ব্রহ্মাকে কৃষ্ণের প্রশ্ন শুনিয়ে দিল। ব্রহ্মা বললেন— “কহ গিয়া, সনকপিতা চতুর্মুখ আইলা।”১৭ পরিচয়, পাবার পর ব্রহ্মার ডাক পড়ল বটে, কৃষ্ণও তাঁকে অনেক খাতির যত্ন করে আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন বটে, কিন্তু ব্রহ্মার কিছুতেই স্বস্তি হচ্ছিল না। সব ফেলে তিনি কৃষ্ণকে বললেন— একটা সন্দেহের নিরসন করতে হবে আগে—
‘কোন ব্রহ্মা পুছিলে তুমি কোন অভিপ্রায়ে।
আমা বই জগতে আর কোন ব্রহ্মা হয়ে?’১৮
এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান কৃষ্ণ নাকি শতমুখ ব্ৰহ্মা থেকে আরম্ভ করে কোটি-মুখ ব্রহ্মার লাইন লাগিয়ে দিয়েছিলেন দ্বারকায়। হাজারো রুদ্র আর হাজারো ইন্দ্রদেরও চতুর্মুখ ব্রহ্মার চোখের সামনে ফেলে দিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, ব্রহ্মাটা কিছুই নয়।
আমি বেশ বুঝতে পারছি— আমার বক্তব্য অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে। আমরা বলতে চেয়েছিলাম— দেবতারা সবাই জন্ম-মরণশীল মনুষ্যের মতই। রাগ, দ্বেষ, লোভ, তৃষ্ণা কারুরই কম নয়। তবে হ্যাঁ, এই কথাটা এমনি করে দেবতাদের বলাটা একটু কঠিন। মানুষ তো ভাবী ভবিষ্যতের জন্য দেবতাদের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাদের পক্ষে এ সব কথা বলা মানে ইহকাল পরকাল ঝরঝরে করা। আমরা তাই কথাটা অসুরদের জবানীতে বলব। আর দেখুন, আমরা গণতন্ত্রের যুগে বাস করি। বিরোধী গোষ্ঠীর মতামত যাই হোক— আমরা মূল্য দিয়ে থাকি, কারণ সরকার গোষ্ঠীরা সব সময়ই বিরোধীদের সমালোচনার মূল্য দেন। আপনারা তো এটা জানেন যে, স্বর্গে সরকারি দল হলেন দেবতারা ; কিন্তু মাঝে মাঝে বিরোধী গোষ্ঠী অসুরেরাও ক্ষমতা দখল করে নেন। তখনই লাগে গণ্ডগোল, একবার বিষ্ণুর ডাক পড়ে, একবার শিবের ডাক পড়ে— তারপর কোনওমতে অসুরদের সামলানো হয়। কিন্তু কেন এই অবিচার ? স্বয়ং বিষ্ণুর কাছেও কিছু বলে লাভ নেই, কারণ তিনি দেবতাদের অনুকূলে কাজ করেন। কাজেই এমন একটা জায়গা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে, যেখানে অসুরেরা নির্ভয়ে দেবতাদের সমালোচনা করছে। তবে এর জন্য আবার আমাদের দেবীপুরাণ খুলতে হবে। সেখানে দেখা যাবে অসুরেরা সম্পূর্ণ দশ বছর স্বর্গসুখ ভোগ করেছে। দৈত্যদের রাজা তখন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ। তিনি তখন পূর্বে উল্লিখিত বৃহস্পতির বঞ্চনায় খানিকটা মুষড়ে পড়েছেন। ওদিকে দেবরাজ ইন্দ্রও কোমর কষে তপস্যা করে দেবী মহামায়াকে তুষ্ট করেছেন। তিনি এখন উপস্থিত হয়েছেন প্রহ্লাদের সামনে। দৈত্য-দানবেরা সবাই ভয় পাচ্ছে একটু-আধটু। প্রহ্লাদও তখন দেবীর উদ্দেশে দারুণ ভাব দিয়ে একটা স্তুতি-পাঠ করলেন। এর পরেই প্রহ্লাদ এত সুন্দর কতকগুলি কথা বললেন, যাতে আত্ম-সমালোচনাও যেমন আছে, তেমনি আছে দেবতাদের সমালোচনা। বিশ্বজননী মায়ের সামনেই এমন কথা বলা যায় বলে, দেবীভাগবতের ব্যাস নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সে সব কথা নিজের মমতা মাখিয়ে নিজের জবানীতেই ধরে রেখেছেন।
প্রহ্লাদ বললেন— তুমি বিশ্বজননী, তোমার কাছেই বলি। দেবতারাও স্বার্থপর, আমরাও স্বার্থপর। তাহলে আমাদের সঙ্গে দেবতাদের পার্থক্যটা কোথায়? আমরাও টাকাপয়সা চাই, ভোগ করার জন্য স্ত্রীলোক কামনা করি, দেবতারাও তাই চায়— সেখানে সুরাসুরে ভেদ কিসের? ওদের জন্ম কশ্যপ মুনির ঔরসে, আমাদের জন্মও তাই, তাহলে কোথা থেকে এল এই জন্ম-জন্মান্তরের বৈরিতা। মাগো ! তোমার নিশ্চয়ই যুদ্ধ দেখতে ভাল লাগে, নইলে তুমিও তো আমাদের মধ্যে একটা সমতা আনার চেষ্টা করতে পার !১৯ প্রহ্লাদ এতক্ষণ ভণিতা করে এবার আসল অভিযোগ পেশ করলেন, পেশ করলেন দেবতাদের বঞ্চনার কথা। প্রহ্লাদ বললেন— তুমিই বিচার করে দেখ, মা ! দেবতারা এবং অসুরেরা সমবেতভাবে সমুদ্রমন্থন করল। কিন্তু সমুদ্র থেকে যা যা রত্ন উঠল, যে অমৃত উঠল— সব গিয়ে পড়ল দেবতাদের ভাগে। স্বয়ং বিষ্ণুই তখন দেবাসুরে ভেদ তৈরী করলেন। তিনি জগতের পালক বলে পরিচিত, অথচ লোভে পড়ে তিনি কি কাণ্ডটাই না করলেন ! সমুদ্র থেকে ওঠা মাত্র তিনি, স্বর্গসুন্দরী লক্ষ্মীকে হাতিয়ে নিলেন— তেন লক্ষ্মীঃ স্বয়ং লোভাদ্ গৃহীতামরসুন্দরী।২০ সমুদ্র থেকে ঐরাবত হাতী উঠল, উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া উঠল, পারিজাত ফুল উঠল— সব মেরে দিল দেবরাজ ইন্দ্র এবং এর মধ্যে স্বয়ং বিষ্ণুর হাত ছিল— সুরৈঃ সর্বং গৃহীতং বৈষ্ণবেচ্ছয়া।২১
প্রহ্লাদ এবার — তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ— এমন একটা ভঙ্গিতে সিদ্ধান্ত করলেন— এইরকম সব জঘন্য অন্যায় করেও দেবতারা আজ সাধু হয়ে গেলেন— জাতা দেবাস্তু সাধবঃ।২২ কিন্তু আপনাদের ধর্মের লক্ষণে কি বলে ? এত অন্যায় করা সত্ত্বেও ভগবান বিষ্ণু সেই দেবতাদের রক্ষা করে যাচ্ছেন, আর আমাদের মেরে ঠাণ্ডা করছেন, এই কি আপনাদের ধর্মের লক্ষণ ! প্রহ্লাদ এবার রেগে উঠলেন— কোথায় ধর্ম, কিসের ধর্ম, ঔচিত্য কোথায়, সাধুতাই বা কোথায় ? কার কাছে গিয়েই বা এই অন্যায়, এই অবিচারের কথা জানাব ? আপনারা তো এক কথা বলেন না। একেক শাস্ত্রে একেক রকম, এক বেদজ্ঞ এক কথা বললে, আরেক বেদজ্ঞ তা মানে না— নৈকবাক্যং বচস্তেষামপি বেদবিদাং পুনঃ।২৩ আর কেনই বা বলবে— সবাই যে স্বার্থপর— যতঃ স্বার্থপরং সর্বং জগৎ স্থাবরজঙ্গমম্।২৪ সংসারে কামনা ছাড়া মানুষ নেই। এই যে চন্দ্র ! তিনি গুরু বৃহস্পতির বউকে নিয়ে পালালেন। দেবরাজ ইন্দ্র— রাজা বটে— তিনি গৌতমগুরুর সাধ্বী পত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করলেন। গুরু বৃহস্পতি, তার নিজের বউ কোথায় পালাল ঠিক নেই, তিনি তাঁর ছোটভাইয়ের বউকে গর্ভবতী অবস্থায় বলাৎকার করে অন্ধ ছেলে হওয়ার অভিশাপ দিলেন। ভগবান বিষ্ণু বিনা অপরাধে রাহুর গলা কাটলেন। শুধু কি তাই ! আমার দৈত্যঘরের নাতি বলি স্বর্গ অধিকার করেছিল, তাকে বেঁটে বামুনের বেশে ছলনা করে রাজ্য কেড়ে নিলেন বিষ্ণু। অথচ এঁরাই নাকি দেবতা, লোকে তাঁদের ধর্মজ্ঞ বলে জানে। আর জনগণেরও বলিহারি যাই— এইসব দেবতার পেছনে তেল দিয়ে, চাটুকারিতা করে, ধম্মোভাব খুইয়ে দিলে— জয়ন্তি চাটুবাদাশ্চ ধর্মবাদাঃ ক্ষয়ং গতাঃ।২৫
প্রহ্লাদের মুখে হক কথা শুনে বিশ্বজননী বিচলিত বোধ করেছেন নিশ্চয়ই ; কিন্তু তাই বলে তিনি কোনও অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে পারেননি। তিনি ঝামেলা-ঝক্কি এড়ানোর জন্য অসুরদের পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু নীতিগতভাবে এ কথাটা মেনে নিয়েছিলেন যে, দেবতারা লোভী। ত্রৈলোক্য রাজ্যে রাজত্ব করেও সেই লোভীদের যে সুখ নেই— সে কথাও তিনি কবুল করেছেন— ত্রৈলোক্যস্য চ রাজ্যে’ পি ন সুখং লোভচেতসাম্।২৬
পৌরাণিক ব্যাসেরা দেবতাদের লোভ-তৃষ্ণা যেভাবে চিত্রিত করেছেন—তার একটা প্যাটার্ন আছে, কিন্তু তাঁদের পথ ধরে আমাদের সাধারণ কবিরা পরম পূজ্য দেবতাদের ওপর এমন রঙ চাপিয়েছেন, যাতে মনে হবে— তাঁরা যেন বড় কোম্পানীর ‘একজিকিউটিভ’ চাকুরে। পয়সায়, সম্মানে কে কাকে ফেলে আগে যাবে— সেই চিন্তাতেই যেন তাঁরা বিভোর। কবি বলেছেন— যে ব্যাটা গরীব, সে একশ টাকার কাঙাল, যার একশ আছে, সে চায় দশ হাজার, দশ-হাজারী চায় কবে সে লাখপতি হবে, আর লাখপতি ভাবে কবে আমি একটা গোটা রাজ্য পাব। রাজ্য পেয়ে এবং রাজ্য বৃদ্ধি করে যখন একজন চক্রবর্তী রাজা হয়, তখন সে স্বর্গের আধিপত্য চায়। আর একবার স্বর্গাধিপতি দেবরাজ হলে সে চায় কবে ব্রহ্মা হবে। এইভাবে ব্রহ্মা বিষ্ণুর পদ চায়, বিষ্ণু শিবের পদ চায়— হায় ! দেবতাদেরই যখন এই অবস্থা, লোভ-তৃষ্ণার শেষ পারে কেই বা গেছে তাহলে— ব্রহ্মা বিষ্ণুপদং হরি র্হরপদং তৃষ্ণাবধিং কো গতঃ ?২৭
॥ ৩ ॥
গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের সঙ্গে পার্থক্যটা লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই। আমাদের পুরাণকারেরা, ইতিহাসকারেরা, কবিরা মানুষের আদলেই দেবতাদের গড়েছেন। লোভ, হিংসা, কামনা— এই সব মশলা যে শুধুমাত্র মনুষ্য-জীবনেরই উপযোগী নয়— এটা তাঁরা জানতেন এবং জানতেন বলেই মৎস্যপুরাণে স্বয়ং ব্রহ্মার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে যে, জরামরণহীন নিস্তরঙ্গ সৃষ্টি, যা নাকি শুধু সিদ্ধ পুরুষের জন্ম দেবে— তেমন সৃষ্টি কোন কাজের কথাই নয়— নৈবংবিধা ভবেৎ সৃষ্টিৰ্জরামরণবর্জিত।২৮ সৃষ্টি হবে এমন, যার মধ্যে শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ দুইই থাকবে। ফলত দেবতা, মানুষ, ঋষি, মুনি কেউই লোভ-মোহ, হিংসা-দ্বেষ, স্বার্থ-নীচতা বাদ দিয়ে তৈরী হলেন না। মজা হল— এ সব সত্ত্বেও পৌরাণিকেরা, ব্যাসেরা আমাদের দেবতাদের শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছেন। কেন শিখিয়েছেন— তার কারণও আছে। পৌরাণিকদের মতে— মানুষে আর দেবতায় তফাৎ কিছুই নেই, শুধু বুদ্ধির প্রাধান্য ছাড়া। মানুষের বুদ্ধি কম, দেবতার বুদ্ধি বেশি— বুদ্ধ্যতিশয়যুক্ত দেবানাং কায়মুচ্যতে।২৯ আমরা এ কথা অস্বীকার করি না, কারণ পৌরণিকদের মত করেই আমরাও জানি যে, বুদ্ধি, ক্ষমতা কিংবা গুণাতিশয্যেই মানুষ দেবতা হয়ে যায়, যেমন কৃষ্ণ, রাম, বুদ্ধ, চৈতন্য মহাপ্রভু। আধুনিক সমাজেও যাঁদের বুদ্ধি বেশি, ক্ষমতা বেশি, তাঁরাই যেমন সমাজের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে যান, কিংবা যাঁদের সর্বাতিশায়ী গুণ আছে বিদ্যা আছে, তাঁরাই যেমন পূজ্যপদে বৃত হন, ঠিক তেমনি সেকালের সমাজেও যাঁদের ক্ষমতা বেশি ছিল—, বুদ্ধি বেশি ছিল—তাঁরাই দেবতা হয়ে গেছেন। তাঁরা দেবতা, কারণ আমাদের ভাল-মন্দ দুইই তাঁরা স্বেচ্ছায় করতে পারেন। ইচ্ছে করলে ভালটাও তাঁরা বেশি করতে পারেন, না ইচ্ছে করলে মন্দটাও বেশিই করতে পারেন।
হোমার হেসিয়ড এই নিরিখেই তাঁদের কাব্যে দেবতার চরিত্র এঁকেছেন—ব্যাস-বাল্মীকিও তাই। দ্বিতীয় জন তো রামায়ণের প্রারম্ভ থেকেই সেই আদর্শ মানুষটিকে খুঁজছিলেন, যাঁকে উত্তরকাণ্ডে গিয়ে অবধারিত ভাবে দেবতা বানাতে হয়েছে। কিন্তু গ্রীসদেশের হেরাক্লিটাসের থেকে আমাদের বাস্তব বোধটা এইজন্য একটু বেশি যে, দেবতাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাঁদের আমরা ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু গ্রীক দার্শনিকেরা হোমার হেসিয়ডের ওপরে রেগেই গেলেন। শুধু হেরাক্লিটাস নয়, আরও একজনকে আমাদের এ বিষয়ে স্মরণ করতে হবে। তিনি হলেন জেনোফেনিস— সক্রেতিসের পূর্বসূরিদের অন্যতম। জেনোফেনিস নিজে সুন্দর কবিতা লিখতেন, অথচ মহাকাব্যের কবি হোমারের ওপর তিনি একেবারেই প্রসন্ন ছিলেন না। হোমার এবং হেসিয়ডের বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে তিনি যা বলেছেন, তা অবশ্য আমাদের প্রবন্ধের পক্ষে খুব জরুরী।
জেনোফেনিস লিখেছেন— হোমার এবং হেসিয়ড দেবতাদের ওপর চুরি, লাম্পট্য, প্রবঞ্চনা ইত্যাদি সমস্ত কলুষিত আচরণগুলিই আরোপ করেছেন, যা মানব সমাজে লজ্জাকর কিংবা খারাপ বলে পরিচিত।৩০ গ্রীস দেশের পরিপ্রেক্ষিতে জেনোফেনিস যা লিখেছেন, আমাদের দেশের রামায়ণ মহাভারত বিশেষত পুরাণের কবিরাও আমাদের দেবতাদের সম্বন্ধে একই কাজ করেছেন। সেই বেদের আমল থেকে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের মধ্যে যেমন এই চুরি প্রবঞ্চনা এবং লাম্পট্যের সমস্ত উদাহরণ দেখেছি, ঠিক তেমনটিই আমরা দেখেছি ইতিহাস-পুরাণের অবিসংবাদিত নায়ক কৃষ্ণের মধ্যে এবং কি আশ্চর্য, এঁদের সঙ্গে গ্রীস-দেশীয় জিউসের চরিত্রের কোন তফাৎ নেই। হোমার-হেসিয়ড জিউস কিংবা অ্যাপোলোর ওপর যে সব মানবিক কলুষ বা কলংকের আরোপ করেছেন, আমাদের দেশে বাল্মীকি-ব্যাস, বিশেষত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, আমাদের প্রধান প্রধান দেবতাদের ওপর একইভাবে সমস্ত মানবিক স্বভাবই আরোপ করেছেন।
হোমার-হেসিয়ডের ভাব দেখে দার্শনিক জেনোফেনিস মন্তব্য করেছেন— সাধারণ মর্ত্ত্য মানুষেরা ভাবে যে, দেবতাদের জন্ম হয়, তাঁরা মানুষের মতই জামা-কাপড় পরেন, মানুষের ভাষায় কথা বলেন এবং তাঁদের মতই দেবতাদের দেহ-অবয়ব আছে।৩১
হায়! জেনোফেনিস আমার পিতৃদেবকে দেখেননি ; দেখলে বুঝতেন, জামাকাপড় পরা কি! রাগানুগা ভক্তির কারণে তিনি মহাভারতের ধুরন্ধর নায়ক কৃষ্ণকে এবং বিশ্বমোহিনী রাধাকে শীতকালে সোয়েটার পরিয়ে রাখতেন এবং সদা গরম জলে স্নান করাতেন, পাছে ওই অতি-অভিসারপ্রিয় যুবক-যুবতীর ঠান্ডা লাগে। তবে এর জন্য রাগানুগা ভক্তি পর্যন্ত যেতে হবে কেন ? স্ত্রী দেবতার নাকে নথ পরানো থেকে আরম্ভ করে ঠাকুর দেবতাকে নানা সাজে সাজানো আমাদের চিরকালের অভ্যাস। কুঙ্কুম, চন্দন না পেলে আমরা শেষ পর্যন্ত সখার প্রেমে সখীকে সাজিয়েছি। জেনোফেনিস সেসব রোমান্স বুঝবেন কি করে ?
বস্তুত জেনোফেনিসের ধারণা ছিল প্রায় ঔপনিষদিক। তিনি কোন সময়েই দেবতাকে মর্ত্ত্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাননি এবং ব্যঙ্গ করে লিখেছেন— গরু, ঘোড়া অথবা সিংহের যদি মানুষের মত হাত থাকত এবং সেই হাত দিয়ে তারা যদি আঁকতে পারত, তাহলে ঘোড়ারা দেবতাদের চেহারা আঁকত ঘোড়ার মত, গরুরা আঁকত গরুর মত এবং সিংহেরা সিংহের মত। তা ছাড়া, তারা দেবতাদের দেহের আকার তৈরী করত নিজেদের আদল অনুযায়ী, অর্থাৎ গরুরা গরুর মত, ঘোড়ারা ঘোড়ার মত এবং সিংহ সিংহের মত। জেনোফেনিস লিখেছেন— এই যে ইথিওপিয়ানরা বলে— তাদের দেবতারা নাকখাঁদা আর কালোকোলো, কিংবা থ্রোসিয়ানরা বলে— তাদের দেবতাদের চোখ নীল, চুল লাল— এসব কিছুই তাদের নিজস্ব চেহারা আর প্রকৃতি অনুযায়ী। অর্থাৎ ইথিওপিয়ানরা নিজেরা নাকখাঁদা আর কালো বলেই তাদের দেবতাদেরও তারা নাকখাঁদা আর কালো ভাবে, ঠিক যেমন থ্রোসিয়ানরা নিজেরা নীল চোখ আর লাল চুলের অধিকারী বলেই দেবতাদেরও তারা সেইরকম ভাবে।৩২
প্রাক-সক্রেতিস যুগে মহামতি জেনোফেনিস যা বলেছেন— আমরা তা জেনোফেনিসের অনেক আগে অনুভব করেছি। ঋক্সংহিতার যুগেই বৈদিক ঋষি তর্জনী তুলে শাসন করেছেন— যিনি এই সৃষ্টি করেছেন- তাঁকে তোমরা কিচ্ছুটি বুঝতে পার না, তোমাদের অন্তঃকরণ সেটা বোঝবার ক্ষমতাই পায়নি। ঘন কুয়াসায় আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা রকম প্রচার করে অর্থাৎ তারা বলে— তিনি এইরকম, তিনি ওইরকম। তারা নিজের প্রাণের তৃপ্তির জন্য আহারাদি করে এবং নিজের প্রাণের তৃপ্তির জন্যই স্তবস্তুতি করে— নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা চাসুতৃপ উথশাসশ্চরন্তি।৩৩ এ কথাটা খুব কম কথা নয়, অন্তত সেই যুগে। ঋষির শাসন থেকে বোঝা যায়— সে কালেও সাধারণ মানুষেরা নিজেদের বিচার অনুসারেই দেবতার বিচার করত। কল্পলোকের সেই বিচার সহজেই ঢুকে পড়ত স্তবস্তুতির শব্দ-রাশির মধ্যে, অর্থের মধ্যে, ছন্দ এবং মন্ত্রের মধ্যে। অবশ্য, বিশেষ মানুষের আদলে এই যে দেবতার গড়ন, যা সক্রেতিসের পূর্বসূরি জেনোফেনিস ভ্রান্ত বলে ভেবেছেন, তাকে আমাদের দেশের দার্শনিকেরা অনেকে ভ্রান্ত জেনেও স্বীকার করেছেন। এমনকি আমাদের দার্শনিকেরা অনেকক্ষেত্রে দেবতার রূপের সত্যতাও স্বীকার করেছেন। খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতে জেনোফেনিসের যে ধারনা ছিল, কিংবা যেসব দার্শনিক কথা তিনি ক্ষীণ স্বরে বলতে পেরেছিলেন, সে সব কথা আমরা অত্যন্ত জোরদারভাবে বলে এসেছি খ্রীষ্টপূর্ব নবম/ অষ্টম শতাব্দীতে।
খোদ ঋক্সংহিতার মধ্যেই আমরা বৈদিক দেবতামন্ডলীর সম্বন্ধে এত মত ব্যক্ত করেছি যে, আসলে পরম দেবতা একজনই, কিন্তু ঋষিরা তাঁকে কেউ অগ্নি, কেউ যম, আবার কেউ বা ইন্দ্র, বরুণ, বায়ু বলে ডেকেছেন— একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি/অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।৩৪ বেদের ভাষাবিদ নিরাক্তকার যাস্ক এই সব একেশ্বরবাদী কথাবার্ত্তা তাঁর তত্ত্বসমীক্ষায় প্রথমেই উচ্চারণ করে নিয়েছেন। কিন্তু তার পরেই মানুষের মধ্যে দেবচিন্তার ধারা বুঝে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিকল্পের ব্যবস্থা দিয়েছেন। বলেছেন— এবার দেবতাদের আকার সম্বন্ধে চিন্তা করা হচ্ছে— অথ আকার-চিন্তনং দেবানাম্।৩৫
যাস্কের মতস্থিতি বোঝাতে গিয়ে প্রাচীন টীকাকার বলেছেন যে, আত্মবিৎ ব্রহ্মবাদী জানেন— পরমেশ্বর এক এবং নিত্য। তাঁর কোন আকারও নেই। কিন্তু যাজ্ঞিক বৈদিকের কাছে দেবতার একটা আকার নিশ্চয় আছে। যাজ্ঞিকেরা বলেছেন— সূর্য, অগ্নি ইত্যাদি বৈদিক দেবতার চেহারা আমরা দেখতেই পাই। কিন্তু ইন্দ্র, রুদ্র— এ সব দেবতাদের তো আমরা প্রত্যক্ষ দেখিনি, তাই তাঁদের চেহারাটা ভেবে নিয়েছি দুভাবে। প্রথমত এঁদের আমরা মনুষ্যোচিত কতগুলি শব্দ দিয়ে নামকরণ করেছি— যেহেতু মন্ত্রবর্ণের মধ্যে সেই রকমের মনুষ্যকল্প ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত ভেবেছি— বায়ু আকাশ ইত্যাদি শব্দ যেমন এক একটা অনাকার অর্থবিশেষের পরিচায়ক, রুদ্র, ইন্দ্র প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ দেবতার রূপকল্পও হয়তো ওই রকম অনাকার অথচ অর্থবহ। এত সব কূট চিন্তায় বিমূঢ় যাজ্ঞিকেরা শেষ পর্যন্ত বলেছেন— ইন্দ্র, রুদ্র, অশ্বিন, পর্জন্য— এই সব দেবতাদের রূপ বুঝি বা পুরুষ মানুষের মতই হবে—পুরুষবিধাঃ স্যুঃ।৩৬
এইখানটা হয়তো যাজ্ঞিক দার্শনিকের ভাবনাটা গ্রীক দার্শনিক জেনোফেনিসের অভিযোগের শিকার হল। কারণ পুরুষশাসিত সমাজে দেবতারা বেশির ভাগ যে পুরুষ মানুষের মতই হবেন, তাতে আশ্চর্য কি! অবশ্য পুরুষ কথাটা এখানে অত আক্ষরিক অর্থে না ধরাই ভাল। পুরুষ বলতে যাস্ক মানুষই বুঝিয়েছেন, নইলে এর পর man is mortal বললে স্ত্রীলোকের অন্তর্ভুক্তির জন্য woman is mortal বলে আলাদা প্রবাদ তৈরী করতে হবে। যাই হোক, আমার বক্তব্য দেবতাদের আকার নিয়ে একটা চিন্তা চলেছে পাণিনিরও পূর্বযুগে, কিন্তু অপরপক্ষে একথাও ঠিক যে, খোদ ঝক্সংহিতার যুগেও আমরা এরকম ভ্রান্ত ছিলাম না যে একক পরমেশ্বরের কথা আমরা জানতাম না। বরঞ্চ আমাদের তত্ত্বটা জেনোফেনিসের চেয়েও গভীরে। আমরা যা করেছি, জেনেশুনেই করেছি। আমাদের ঈশ্বর যেহেতু সর্বক্ষম ঈশ্বর, তাই তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছি। যাজ্ঞিকেরা খোদ বেদের মধ্যে দেবতাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, কেলি-কলা-কুতূহল— সবই ব্যক্ত করেছেন। পুরাণ ইতিহাসের আমলে তো দেবতারা যা-ইচ্ছে-তাই শুধু নয়, একেবারে যাচ্ছেতাই কান্ডকারখানা করেছেন, এবং সাধারণ মানুষেরাও যে তাঁদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করেছেন, তার কারণ— মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা নিজেরাই দেবতাদের দিয়ে মানুষের ইচ্ছাপূরক ব্যবহার করিয়েছেন। এর ফল হয়েছে অনেক রকম।
প্রথম ফল— বৈদিক দেবতাদের কাছে শত শত চাহিদা এবং তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপনিষদের যুগে আমরা ভয়ংকর জ্ঞানকান্ডী হয়ে উঠেছি। বৈদিক দেবতাদের প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমরা একান্ত আত্মবিৎ হয়ে উঠেছি। দ্বিতীয় ফল—উপনিষদের সর্ব-ব্রহ্মবাদী প্রতিক্রিয়ায় আমরা আমাদের অভীষ্টদায়ী দেবতাদের প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। উপনিষদের মুনিরা প্রায় সবাই ব্ৰহ্মকে স্ত্রী-পুরুষের চিহ্নরহিত এক জোতিঃস্বরূপে মেনে নিয়েছিলেন। তবু এরই মধ্যে দু-একটি তত্ত্বদর্শী আরণ্যক মুনি ছিলেন যাঁরা ব্রহ্মকে এখানে সেখানে একটি মানুষের আদলে কল্পনা করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মকে নির্বিশেষ, নিরাকার না ভেবে সাকার, সবিশেষ কল্পনা করেছেন। এমনকি রসস্বরূপ ব্রহ্মের কল্পনায় তাঁরা এতদূর ভেবেছেন যে, তাঁর একা একা ভাল লাগে না— একাকী ন রমতে—তাঁর দ্বিতীয় একজনের সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছায় নাকি শেষ পর্যন্ত একাকী ব্ৰহ্মকে নারী-পুরুষ হয়ে জন্মাতে হয়েছে।৩৭
এই সাকার ইচ্ছাময় ব্রহ্মের সূত্র ধরে পুরাণ-ইতিহাসের যুগে আমরা আবার এক শ্রেণীর দেবতা পেলাম— যাঁদের মধ্যে বৈদিক দেবতাকুলের মনুষ্যধর্মিতাও আছে, আবার উপনিষদের চরম তাত্ত্বিক মাহাত্ম্যও আছে— অথচ তাঁরা মানুষের দেহ এবং মনের খুব কাছাকাছি। আরও পরিস্কার করে বলা যায়— এই দেবতাদের মন পেতে যাজ্ঞিকদের কঠিন ক্রিয়াকলাপ, বিচিত্র মন্ত্রবিধি লাগে না, আবার উপনিষদের চরম তাত্ত্বিক জ্ঞান, সূক্ষ্ম ভাবনাবৃত্তিও লাগে না। এ এক এমন ঈশ্বর, যাঁর সম্বন্ধে প্যাসকাল লিখেছেন— God of Abraham, Issac and Jacob, not of the philosophers and scholars.৩৮ এতে আমাদের সুবিধে এই যে, যখন তখন একজন নামী দেবতার মাথায় ব্রহ্মের টোপর পরিয়ে দেওয়া যায়, যদিও মনুষ্যলোকের ভক্তির টানে এঁরা একেবারেই মানুষের আদলে মানুষের মধ্যেই দেখা দেন। মানুষের মতই একটা স্বয়ং ভগবান প্রাপ্তি হওয়ার ফলে সিদ্ধ মহাপুরুকেরা বৃন্দাবনের নন্দরাজার ঘরের দুয়োরে পরমব্রহ্মকে দেখতে পেয়েছেন— অহমিহ নন্দং বন্দে যস্যালিন্দে পরং ব্রহ্ম৩৯, — অথবা এই পরব্রহ্মকে যমুনার কুঞ্জবনে অল্পবয়সী মেয়েদের পেছনেও লাগতে দেখা গেছে— গোপবধূটিবিটং ব্রহ্ম।
॥ ৪ ॥
সত্যি কথা বলতে কি, বিপদটা শুরু হয়েছে সেই বেদের আমল থেকেই। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা ইষ্ট দেবতাদের মধ্যে মানুষের প্রাত্যহিক আবেশ দেখতে পেয়েছেন এবং সেই কারণেই পিতামহের প্রশ্রয়ে দেবতাদের দিয়ে যা ইচ্ছে করিয়ে নিয়েছেন। জগতের চৈতন্যস্বরূপ সূর্যকে তাঁরা লাল চেলি-পরা সুন্দরী উষার পেছন পেছন ঘুরতে দিয়েছেন, ঠিক যেমন যুবক পুরুষটি যুবতী মেয়ের পেছন পেছন ঘোরে— মর্যো ন যোষাম্ অভি এতি পশ্চাৎ।৪০ ঋষিরা দশ জালা সোমরসের টোপ সামনে রেখে বায়ু দেবতা আর ইন্দ্রকে দিয়ে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত একজনকে জয়ী ঘোষণা করে সোমরসের বিশাল পানপাত্রখানি উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছেন বায়ু দেবতার হাতে। এই সোমরসের ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন দেবতার মধ্যে কলহেরও সূত্রপাত ঘটিয়েছেন বৈদিক ঋষিরা। আপন কার্য সাধনের জন্য মন্ত্রবর্ণের মধ্যে আগাম পানপাত্রের ব্যবস্থা করে ঋষিরা একেবারে আধুনিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন— অভি ত্বা পূর্বপীতয়ে সৃজামি সৌমং মধু৪১— তুমি যাতে সন্তুষ্ট হও, তার জন্য আগেভাগেই এই সোমরসের মধু বানিয়ে রেখেছি আমি। (তা, এসব জিনিস তো একা একা ভাল লাগে না), তুমি তোমার দেবতা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গেই এস— মরুদ্ভিঃ অগ্ন আগহি। রাজার রাজা ইন্দ্রকে দিয়ে যাজ্ঞিকেরা যেমন অসাধারণ সব যোদ্ধৃকৰ্ম করিয়েছেন, তেমনি তাঁকে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার উপযুক্ত উপভোগ থেকেও বঞ্চিত করেননি। পৌনঃপুনিক সোমপান থেকে আরম্ভ করে নারীহরণ, পরনারীসম্ভোগ পর্যন্ত সমস্ত উপচার আর অধিকার ইন্দ্রেরই দখলে।
অন্তরীক্ষলোকের এই দেবতাদের ওপর বৈদিক ঋষিদের এমনই এক অকৃত্রিম স্নেহ ছিল যে তাদের জন্ম-কর্ম, সাহস, প্রেম এমনকি অসভ্যতাগুলিও তাঁরা পিতামহের প্রশ্রয়ে দর্শন করেছেন। গৃহস্থের অনেকগুলি সন্তান থাকলে তাদের মধ্যে যেমন বড় ছোট মেজোর ভাগ তৈরি করা হয়, দেবতাদের মধ্যেও সে ভাগ আছে। বৈদিকেরা নিশ্চয়ই বলবেন যে, —বাপু হে ! ওসব ভাগ সৃষ্টি হয়েছে দেবতাদের ক্ষমতা, ওজস্বিতা এবং যজ্ঞভাগ নিশ্চয়ের কারণে। আমরা বলি—তা হোক। কিন্তু ভাগটি তো তৈরি হয়েছে গেরস্থের আদলেই। এমনকি অনেকগুলি ছেলের মধ্যে যার সম্বন্ধে আমরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলি—এমন ছেলে আর হয় না, জন্মের সময় থেকেই ওর বুদ্ধি একেবারে পাকা, তেমনই আমরা ইন্দ্রের সম্বন্ধে বলেছি—জন্মমাত্রেই যিনি সবার চাইতে বুদ্ধিমান অথবা জন্মমাত্রেই যিনি দেবতাদের প্রধান, তিনিই ইন্দ্র—যো জাত এব প্রথমো মনস্বান্।৪২
দেবতার পরিবারে ইন্দ্র একেবারে প্রশ্রয়-পাওয়া জ্যেষ্ঠ পুত্রটির মত। যেমন তাঁর শারীরিক শক্তি তেমনই মানসিক ক্ষমতা, তেমনই তাঁর ভোগবিলাস। একদিকে তিনি যেমন “ওজিষ্ঠো বলিষ্ঠঃ সহিষ্ঠঃ সত্তমঃ পারয়িষ্ণুতমঃ”,৪৩ অন্যদিকে তাঁর জন্য বৈদিক ঋষিরা যে পরিমাণ সোমরস এবং স্ত্রীসঙ্গের ব্যবস্থা করেছেন, তাকে লায়েক ছেলের ওপর প্রশ্রয় ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ভাবুন একবার—বৈদিক ঋষিরা এমন বিপুল পরিমাণ সোমরস ইন্দ্রের উদ্দেশে সমন্ত্র নিবেদন করেছেন যে, ইন্দ্রের পেটটি সমুদ্রের মত ফুলে উঠেছে। শত বা সহস্র সোমলতার নির্যাস অন্যান্য বস্তুর মিশ্রণে ইন্দ্রের আনন্দের জন্য প্রস্তুত করা হয়, আর তাতেই তাঁর পেট ফুলে ওঠে জয়ঢাকের মত—সং যন্মদায় শুষ্মিণ এনা হ্যস্যোদরে। সমুদ্ৰো ন ব্যচো দধে ॥৪৪
সমাজের উচ্ছন্ন যুবকটি মদ খেয়ে পেট ফোলালে আমরা বলি জয়-ঢাক, আর ঋষিরা বলেন সমুদ্র। তা হোক, বড় ছেলে, কৃতী ছেলে, কত দাস-দস্যু, অহি-বৃত্র-শম্বর মেরে সপ্ত সিন্ধুর ধারা মুক্ত করেছেন, আকাশ-পর্বত ফাটিয়ে জল এনেছেন বসুন্ধরায়, সেই দেবতাকে তো একটু ভোজ্য-পান দিতেই হবে। তার ওপরে ইন্দ্র হলেন গিয়ে দেবতাদের সেনানী এবং রাজা, মেজাজটাও তাঁর ‘মিলিটারি’। ফলে মনুষ্যলোকের ঋষিরা একদিকে যেমন তাঁর উদ্দেশ্য সবচেয়ে বেশি স্তুতিপাঠ করেছেন, তেমনই সোমরসেরও ব্যবস্থা করেছেন।
তবে মজা হল, মনুষ্যলোকে যেমন একটি লোভনীয় বস্তু সামনে রেখে দুটি অপরিণত বালককে প্রলোভিত করে তাদের দিয়ে আমরা রীতিমত দৌড় করাতে পারি, ঠিক তেমনই ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এক জায়গায় দেখতে পাচ্ছি—সোমরসের পাত্র সামনে রেখে দেবতাদের দৌড়-প্রতিযোগিতা হচ্ছে। মনে রাখবেন—এই ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে সোমাহুতির জন্য যে যুগল-দেবতার হোমগুলি নির্দিষ্ট হয়েছে, তার মধ্যে ঐন্দ্ৰবায়ব—মানে ইন্দ্র এবং বায়ুর উদ্দেশ্যে যে হোমটি হবে, তার জন্যই এই সোম-প্রতিযোগিতার গল্প বলেছেন ঋষিরা। ব্রাহ্মণ-গ্রন্থের প্রামাণ্য বেদের মতই, কারণ বৈদিকদের মতে বেদ বলতে বেদও বোঝায় ব্রাহ্মণ-গ্রন্থগুলিতেও বোঝায়—মন্ত্র-ব্রাহ্মণয়ো বেদনামধেয়ম্।
তো ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেখা যাচ্ছে—সোমপানের জন্য দেবতারা সব এক জায়গায় জড়ো হয়েছেন। ইনি বলছেন—আমি আগে খাব, উনি বলছেন—আরে তুই নয় আমি। শেষ পর্যন্ত কিছুতেই ঠিক করা গেল না যে কে আগে সোম পান করবেন। তারপর দেবতারা সবাই মিলে ঠিক করলেন—বেশ, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরা যাক, আমরা সবাই সেই লক্ষ্যের দিকে দৌড়োব, যে জিতবে, সেই প্রথম সোমপানের অধিকার পাবে।৪৫
দেব-দৌড় শুরু হল ; কিন্তু প্রতিযোগিতায় যা হয়, সব হিসেব-নিকেষ উল্টো-পাল্টা হয়ে যায়। এমন যে সেনানায়ক তথা অশেষ সমর-বিজয়ী ইন্দ্র, তিনি বায়ু দেবতার কাছে হেরে গেলেন। প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে প্রথম পৌঁছোলেন বায়ু, তারপর ইন্দ্র, তারপর মিত্র ও বরুণ এবং তারও পরে অশ্বিনীকুমারদ্বয়।
যে ইন্দ্র তিন ভুবনের রাজা—ইন্দ্রো রাজা জগতশ্চর্ষণীনাম্, ঋষিরা যাঁকে স্তব করে বলেন—শক্তি বা বল থেকেই তোমার জন্ম—ত্বমিন্দ্র বলাদধি—সেই ইন্দ্র কিনা বায়ুর কাছে দৌড়-প্রতিযোগিতায় হেরে গেলেন ! তাও কি, এ তো যে সে প্রতিযোগিতা নয়, সোমপানের জন্য প্রতিযোগিতা !
সোমরস দেখলে পরে দৌড়ে যাওয়াটা ইন্দ্রের অভ্যাসের মধ্যে ছিল। নিরুক্তকার যাস্ক, যিনি খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে বৈদিক কোষ লিখে নিরুক্তকে বেদাঙ্গের মধ্যে স্থান করে দিতে পেরেছিলেন, সেই যাস্ক ইন্দ্র শব্দের মূল খুঁজতে গিয়ে অনেক বিকল্পের মধ্যে একবার বলছেন—‘ইন্দবে দ্রবতীতি বা’।৪৬ অর্থাৎ ইন্দু বা সোমরস দেখলে পরে যিনি দৌড়ে যান, তিনি ইন্দ্র। কাজেই সারা জীবন সোমরসের জন্য দৌড় করেও যে ইন্দ্র বায়ুর কাছে হেরে গেলেন, সেই ইন্দ্রের আর মান-সম্মান রইল না দেবসমাজে।
কিন্তু মজাটা কি জানেন—ইন্দ্র হলেন দেবতাদের রাজা, তিনি ভাঙেন তবু মচকান না। সেকালে ফোটো-ফিনিশে প্রতিযোগিতার শেষ মুহূর্তটি ধরে রাখার প্রশ্ন ছিল না ঠিকই, তবে ইন্দ্র বোধহয় বায়ুর পরপরই লক্ষ্যস্থানে পৌঁছেছিলেন। ইন্দ্র যখন বুঝলেন বায়ুই সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন, তখন ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেখা যাচ্ছে ইন্দ্র বায়ুর পেছনে পেছনে গিয়ে বললেন—এই প্রতিযোগিতায় আমরা যুগ্ম-জয়ী, তাই না? তমনুপরাপতৎ সহনাবখোজ্জয়াবেতি।৪৭
বায়ু বললেন—কেন বাপু ! আমি একা যেখানে জয়ী হয়েছি, সেখানে আবার তুমি ঢুকে পড়ছ কেন ? ইন্দ্র দেখলেন বায়ুর মন গলছে না। তিনি বললেন—ঠিক আছে, ঠিক আছে, যুগ্ম-জয়ী নাই হলাম, জয়ের এক তৃতীয়াংশটা অন্তত আমার হোক, তাহলেও তো বলা যাবে—আমাদের একসঙ্গে জয় হয়েছে।৪৮
বায়ু তাতেও রাজি হলেন না। বললেন—আমি প্রথমে লক্ষ্যে উপস্থিত হয়েছি, আমি একাই জয়ী। ইন্দ্র বললেন—আচ্ছা বেশ, জয়ের এক চতুর্থাংশ না হয় আমার নামে চিহ্নিত হোক। তাতেও অন্তত আমাদের একসঙ্গে জয় লাভ করা হবে।
বায়ু এবার রাজি হলেন। হাজার হোক, ইন্দ্র যখন দেবতাদের রাজা, সেনানী এবং প্রধান। প্রতিযোগিতার সম্মান-বন্টনে তাঁকে একেবারে মুছে ফেলা যায় না। ফলে ঋষিরা যখন ভোরবেলায় সোমাহুতির পর ইন্দ্র-বায়ব নামে দুই দেবতার হোম করেন, তখন ঐন্দ্র-বায়ব গ্রহ থেকে অর্ধেক সোমরস নিয়ে প্রথমে বায়ুর উদ্দেশে দেন। পরে অন্য অর্ধাংশ থেকে বায়ু এবং ইন্দ্র—দুজনের উদ্দেশেই হোম করেন। ইন্দ্রের ভাগ এখানে এক-চতুর্থাংশমাত্র।৪৯
তাহলে দেখুন, তুচ্ছ সোমপানের জন্য এই যে দেবতাদের দিয়ে দৌড় করিয়েছেন ঋষিরা অথবা সেবসমাজে ইন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব বারবার ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও প্রতিযোগিতার বাস্তব মুহূর্তে তাঁকে যে হেরে যেতে হল অথবা হেরে যাবার পরেও বহুকীর্তিত যশস্বী ব্যক্তি যে তাঁর হেরে যাওয়াটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেন না—এগুলি একেবারে মনুষ্যসমাজের আদলেই বৈদিক মন্ত্রের মধ্যে প্রতিচ্ছায়ার মত নেমে এসেছে। তা যদি না হত, তাহলে জগতের আদিভূত জ্যোতিঃস্বরূপ সূর্যকে একটি রোমাঞ্চিত মনুষ্যযুবকের মত লাল-চেলি-পরা সুন্দরী ঊষার পেছন পেছন ঘুরতে দেখতাম না—সূর্যো দেবীমুষসং রোচমানাং মর্যো ন যোষাম্ অভ্যেতি পশ্চাৎ। ঋষিরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রভাতের রক্তিম ঊষা যেমন অভিসারিকার সত্তায় চিহ্নিত, তেমনই তমঃশেষের আদিত্যবর্ণ দেব-পুরুষটিও প্রেমে-পড়া মনুষ্যযুবকের রসাপ্লুতিতে অঙ্কিত। ঋষি পিতামহের প্রশ্রয়ে ঊষাকে সম্বোধন করে বলেছেন—দেবি ! তুমি কুমারী কন্যার মত শারীরিক সৌন্দর্য বিকাশ করে দীপ্তিমান সূর্যের কাছে যাও। যুবতীর মত দীপ্তিমতী হয়ে স্মিতহাস্যে তুমি তোমার বক্ষোদেশ অনাবৃত কর তার সামনে—সংস্ময়মানা যুবতিঃ পুরস্তাদাবি বাংসি কৃণুষে বিভাতী।৫০
বেদ থেকে এইরকম শৃঙ্গারসিক্ত মন্ত্র আমি আরও উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু তার দরকার কি ? আমার বক্তব্য দেবতারা মানুষের আদলেই ঋষির দর্শনে ধরা দিয়েছেন। মানুষের শক্তি, মানুষের অবয়ব, মানুষের ভালবাসা, এমনকি মানুষের অভব্যতা বর্ণনা করার জন্য আমরা যে সব শব্দরাশি ব্যবহার করি, ঋষিরাও সেই ভাবেই মন্ত্র দর্শন করেছেন, সেইভাবেই দেবতাদের চরিত্র নির্ণয় করেছেন। একদিকে যেমন চরম স্থূলভাবে আমরা দেবতাদের জিভ দিয়ে চেটে চেটে সোমরসের আস্বাদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেছি—গৃভায় জিহ্বয়া মধু, তেমনই পরম সূক্ষ্মভাবে সেই দেবতাদের মধ্যে চরাচর ব্যাপ্ত পরম উপলব্ধি করেছি। মাতাল পানশৌন্ড ব্যক্তি হা-হা করে হেসে বলে— আমার জন্মের সময় আমার মা মুখে মধু না দিয়ে মদ দিয়েছিলেন, ঋষিরা এই সাবলীল রসিকতা জানতেন। তাঁরা বলেছেন—ইন্দ্র ! তুমি জন্মেই পাহাড়ী সোমলতার রস চেখেছিলে, কেননা তোমার মা যুবতী অদিতি তোমাকে স্তন্যদানের আগেই তোমার মুখে সোমরস সিঞ্চন করেছিলেন—তং তে মাতা পরি যোষা জনিত্রী মহঃ পিতু দর্ম আসিঞ্চদগ্রে।৫১
এই রসিকতার সঙ্গে এও জানি যে, আমরা এই দেবতাকে আমাদের একান্ত স্বার্থসাধনের জন্য, অন্নপানের জন্য, আমাদের শত্রুপাতনের জন্য বারবার স্তুতি করি। বারবার ব্যবহার করি। নিজেদের অফুরন্ত স্বার্থের মধ্যে সেই দেবতার জন্য আমাদের মায়াও আছে। মাঝে মাঝে তাকে বলি—এইটুকু খেয়ে বাড়ি যাও ভাই, বাড়িতে তোমার কল্যাণী বধূটি আছেন, নৃত্যগীতের আয়াসটুকু আছে, তুমি রথে করে বাড়ি যাও ভাই—অপাঃ সোমমস্তামিন্দ্র প্র যাহি কল্যাণীজায়া সুরণং গৃহে তে।৫২
এমন করে মানুষের মায়া, মানুষের ভালবাসা, মানুষের রসিকতায় যে দেবতাদের আমরা অহরহ বেঁধে ফেলেছি, পরম তত্ত্ব এবং দর্শনের ভাবনায় হঠাৎ করে তাঁদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিয়ে—তুমি আমাদের পরম উপাস্য দেব, অতএব পরম গম্ভীর, অতএব সমস্ত লঘুতা রসিকতার তুমি ঊর্ধ্বে—এমন ভাব পোষণ করা কোন কালেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বস্তুত বেদের সাহিত্যে যে সমস্ত দেবতাদের কাছ থেকে গৃহ-জায়া-ভৃত্য-ধন—এত শত পেয়েছি, সেই পাওয়ার জন্যই তাঁদের হাজারবার পিতা, দাতা, আশ্রয় বলে স্তুতি করেছি নিশ্চয়, কিন্তু পাওনা-গণ্ডা মিটে যাবার পর লঘু অবসরে কতবার যে তাঁদের ‘সখা’ বলে ডেকেছি, কতবার যে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছি—রসিকতার পূর্বে সেই সম্বন্ধটুকুও স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
একই বৈদিক সূক্তের মধ্যে যেখানে দেবতার মহাশক্তিসূচক সম্বোধন অথবা স্তুতিবাচক শব্দ আটটা-নটা আছে, সেই একই সূক্তের শেষে সেই উদগ্র-বীর দেবতার সখ্য-সম্বন্ধটি পাকা করে নিতে কিন্তু ঋষিরা ভোলেননি। বলেছেন আমাদের সঙ্গে তোমার সখ্যভাব যেন মঙ্গলকর হয়—অস্মে তে সন্তু সখ্যা শিবানি। আর সেই সখ্য শুধু একদিক থেকে নয়—অর্থাৎ আপনি বলতে পারবে না—এত দিচ্ছে, তাই আমরা দেবতার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে চাই, এই সখ্য-সম্বন্ধ দুই দিক থেকেই আছে।
একটি বৈদিক সূক্তের মধ্যে দেখা যাচ্ছে অগস্ত্য ঋষি আর ইন্দ্র দুজনেই কথা বলছেন। অগস্ত্য বলছেন—ইন্দ্র ! তুমি কি আমাদের মেরে ফেলতে চাইছ ? অন্য দেবতাদের সঙ্গে তুমি তোমার যজ্ঞভাগ নাও। উত্তরে ইন্দ্র বলছেন— আরে ভাই অগস্ত্য ! তুমি আমাদের বন্ধুলোক হয়ে আমাদের টপকে যাবার চেষ্টা করছে কেন বাপু—কিং নো ভ্রাতরগস্ত্য সখা সন্নতি মন্যসে।৫৩ এই ঋক্-মন্ত্রগুলির আগে কিম্বা পরে অগস্ত্যের দিক থেকে শরণাগতির কথা যেমন আছে, তেমনই দেবতার দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি—উপাস্য এবং উপাসক একই অমৃত-যজ্ঞের প্রস্তুতিতে অংশ নিয়েছেন—তত্রামৃতস্য চেতনং যজ্ঞং তে তনবাবহৈ।৫৪
উপাস্য আর এই উপাসকের মধ্যে এই সখ্য-সম্বন্ধ—এই সম্বন্ধ উপনিষদের পরম সূক্ষ্ম জ্ঞান-সাধনার পথ বাহিত হয়ে অন্য এক ধারায় ইতিহাস-পুরানের মধ্যে এসে পৌঁছেছে। এই সাধনার চরম বিন্দু হল গৌড়ীয় বৈষ্ণবের দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মধুর রস।
বৈদিক দেবতাদের সমস্ত ক্রিয়া-কলাপেরই জের এসে পড়েছে ইতিহাসে, পুরাণে। মহাভারত, রামায়ণ এবং অন্যান্য প্রাচীন পুরাণগুলিতে দেবতারা বারবার নেমে এসেছেন মানুষের কর্মভূমিতে। এই সময় থেকে মর্ত্ত্য রাজা-মহারাজা কিংবা ঋষিদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক, চলাফেরা বেড়ে গেছে। তাঁদের যে কোন আপদ-বিপদে, আনন্দে দেবতারা যে প্রত্যক্ষভাবে শুধু অংশ নিচ্ছেন- তাই নয়, মর্ত্ত্যভূমির সুন্দরী রমণীদের দেখে তাঁরা স্বর্গসুন্দরীদের মোহ পর্যন্ত ত্যাগ করছেন। এমনকি পৃথিবীর পরিসরে মনুষ্য-রমণীদের গর্ভে তাঁদের দু-একটি ছেলেপুলে থাকবে— এই ভাবনাও তাঁদের রোমাঞ্চিত করত। সোজাসুজি মানুষের ঘর থেকে পুলকিত প্রেমের আহ্বান আর কটা আসত ? এক কুন্তী ছাড়া এরকম আহ্বান দু-চারটি বৈ নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেবতারা নিজেরাই মনুষ্যরমণীর রূপে এতই মোহিত ছিলেন যে, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের হিতাহিত জ্ঞানের পরিচয় থাকত না। বিশেষত স্বর্গের রাজা ইন্দ্ৰ গৌতমপত্নী অহল্যা এবং আরও কয়েকটি মনুষ্যরমণীকে এমন কৌশলে ধর্ষণ করেছেন যে, মর্ত্ত্যের ঐতিহাসিক বেদব্যাস মহাভারতে তাঁর উপাধি দিয়েছেন— ইন্দ্ৰস্তু রতিলম্পটঃ। শুধু ইন্দ্ৰ কেন, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অহল্যাকে মনুষ্য-ঋষি গৌতমের হাতে সঁপে দেওয়ায় সমস্ত দেবকুলেই যে হতাশার ছায়া নেমে এসেছিল, সেকথা রামায়ণের কবি বাল্মীকিও লক্ষ করেছেন আসন্নিরাশা দেবাস্তু গৌতমে দওয়া তয়া। অন্যদিকে বায়ুদেবতা বানরী রমণী অঞ্জনার বুকের কাপড় এমনভাবে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন যে, তাতে বিদগ্ধ বাল্মীকি পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করেছেন। বেদের দেবতা এবং মহাভারত-রামায়ণের দেবতাদের কীর্তিকলাপ দেখে পুরাণগুলি পরিস্কার বুঝতে পেরেছে যে, স্বর্গের দেবতারা যতই চতুর্বাহু, সহস্রবাহু আর সহস্রলোচন বলে কীৰ্তিত হোন না কেন, তাঁদের আসল চেহারা মানুষের মতই। বায়ুপুরাণ তো পরিস্কার বলেই দিল যে, দেবতাদের সমস্ত লক্ষণ মানুষেরই মত এবং এ হিসেব সাধারণের মনগড়া হিসেব নয়, তত্ত্বদর্শী ঋষিমুনিরাই তাঁদের এইভাবে দেখেছেন। বায়ুপুরাণ বলেছে— মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অবয়বসংস্থান ঠিক যেমনটি, দেবতাদের শরীর, অবয়বসংস্থানও ঠিক তেমনটিই এবং এটাই ঋষিদের তত্ত্ববোধ এবং দার্শনিক সিদ্ধান্তে প্রতিভাত—
মানুষস্য শরীরস্য সন্নিবেশস্তু যাদৃশঃ।
তল্লক্ষণং তু দেবানাং দৃশ্যতে তত্ত্বদর্শনাৎ।৫৫
দেবতাদের সমস্ত লক্ষণ যেখানে মানুষের মত, সেখানে ভগবানকে শুধু মানুষের মত দেখতে হবে— এইটুকুই নয়, তাঁদের আচার-ব্যবহারও মানুষের মত হবে— এটাই স্বাভাবিক। বিপদের শুরু কিন্তু এইখান থেকেই। কবিরা, দার্শনিকেরা ব্যক্তি ভগবানের সমস্ত মাহাত্ম্য তত্ত্বগতভাবে স্বীকার করে নিয়েও ভগবানের ওপর চাপিয়ে দিলেন মনুষ্য ব্যবহারের নানান দিক— মানুষের শৈশব, তার বাল্যচপল ভঙ্গী, তার যৌবন এমনকি লাম্পট্যও। পুরাণকারেরা যেখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ইন্দ্র, বায়ু-কাউকেই বাদ দিলেন না, সেখানে কবিরা রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলির মধ্যে বর্ণিত দেবচরিত্রের সূত্র ধরে দেবতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অতি মধুর তথা চটুল কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন। কোথাও কোথাও সে কবিতা রসসৃষ্টির চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে, মূলত তার মধ্যে রসিকতার অংশই বেশি।
রসিকতা জিনিসটা এমনই যে, রসিকতা করতে করতে তার সীমা ছাড়িয়ে যায়। যে কবি শিব কিংবা কৃষ্ণজীবনের ব্যক্তিগত ঘটনা নিয়ে সুন্দর রসসৃষ্টি করলেন, অন্য কবি তারই জের টেনে এমন রসিকতা করলেন যে, তাকে রস না বলে রসোদগার বলাই ভাল। এইসব রস, ঠাট্টা-মস্করার শেষ পরিণতি হল আঞ্চলিক প্রবাদ, যা কোন কোন মহান দেবতা কুলের মান একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য এই যে, তবু দেবতারা স্বমাহাত্ম্যে, সগর্বে মানুষের উপাসনা-মঞ্চে সমাসীন এবং অত্যন্ত লীলায়িত ভঙ্গিতে সমাসীন। পাশাপাশি সরস রঙ্গ এবং কুরস ঠাট্টা-তামাশা তাঁদের ওপরে সমানভাবে বর্ষিত হলেও তাঁরা অবিচল, এবং নিজেদের কিছু দোষ আছে বলেই হোক অথবা অত্যন্ত রসিক বলেই হোক— এই সব ঠাট্টা-তামাশায় হিন্দুকুলের দেবতারা কিছু মনে করেন না, অথবা সাধারণ মনুষ্যকুলের কোন ক্ষতিও করেন না। স্বয়ং রাজশেখর বসু তাই সাহস করে লিখেছেন— ব্রহ্মা গড় ও আল্লা— এঁদের মেজাজ একরকম নয়। ঠাট্টা তামাশায় কোন হিন্দু দেবতা চটেন না। ব্রহ্মার তো কথাই নেই, তিনি সম্পর্কে সকলেরই ঠাকুরদাদা। (তিন বিধাতা)
কবিদের রঙ্গ-রসিকতা বোঝার জন্য আপনার প্রধান কর্তব্য। রামায়ণ, মহাভারত কিংবা পুরাণগুলির বিভিন্ন স্থলে দেবতাদের যে সব কীর্ত্তীকলাপ আছে সেগুলি আপনাকে অনুপুঙ্খ জানতে হবে, জানতে হবে দেবতাজীবনের রতি-বিলাস, কলহ, ঈর্ষা, ক্রোধ, মমতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সব কিছুই— কেননা এইগুলিই পরবর্তী কবিদের ইন্ধন।
সূত্র
১ বৃন্দাবন দাস, ‘চৈতন্যভাগবত’, ২ ৮ ২৩৫-২৩৭
২ হাল, ‘গাথা-সপ্তশতী’, ২ ১২
৩ যশোদা—অজ্জ দুদ্ধমুহস্স বৎস্স কো ক্খু দাণীং উব্বাহে ওসরো।
মধুমঙ্গলঃ—(অপবার্য্য) বয়স্স সচ্চং দুদ্ধমুহোসি জং দুদ্ধলুব্ধাইং গোবকিশোরীসহস্সাইং তুজ্ঝ মুহং পিঅন্তি।
রূপ গোস্বামী, বিদগ্ধমাধব, ১• ৩৯, পৃ ৩৯.
৪ বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন, ‘ভাষাপরিচ্ছেদ’, কারিকা ১, আরম্ভ-শ্লোক, পৃ. ৪.
৫ শ্ৰীচৌরাগ্রগণ্য-পুরুষাষ্টকম্’, ভক্তিগীতি, পৃ. ৩১৩-৩১৫
৬ Fredrick Copleston, A History of Philosophy, Vol. I: Pt. IP. 54
৭ তদেব, পৃ, ৫৪
৮ ‘দেবীভাগবত পুরাণ’ ৪. ১৩. ৫৫
৯ তদেব, ৪. ১৩, ৪
১০ তদেব, ৪, ১৩ ১০
১১ তদেব, ৪ ১৩ ১৪
১২ ‘শ্রীমদ্ভাগবতম্’, ১০, ৩৩, ২৯
১৩ ‘দেবীভাগবত পুরাণ’ ৪. ১৩ ১৬
১৪ তদেব, ৪ ১৩ ১৯
১৫ তদেব, ৪, ১৩, ১৯-২০
১৬ ‘ভগবদগীতা’, ৮, ১৮-১৯
আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনো’র্জুনঃ।
সহস্ৰযুগপর্যন্তমহর্যদ ব্ৰহ্মণো বিদুঃ।
রাত্রিং যুগসহস্রান্তাং…
এই হিসাবে সত্য-ত্রেতা ইত্যাদি চতুগ সহস্রবার গত হলে ব্রহ্মার এক দিন হয়। এই পরিমাণে একশ বৎসর ব্রহ্মার পরমায়ু।
১৭ কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, ২. ২১. ৬১
১৮ তদেব, ২. ২১. ৬৫
১৯ ‘দেবীভাগবত পুরাণ’, ৪. ১৫. ৪৫
২০ তদেব, ৪. ১৫. ৫০
২১ তদেব, ৪. ১৫. ৫১
২২ তদেব, ৪. ১৫. ৫২
২৩ তদেব, ৪. ১৫. ৫৭
২৪ তদেব, ৪. ১৫. ৫৮
২৫ তদেব, ৪. ১৫. ৬৪
২৬ তদেব, ৪. ১৫. ৬৮
২৭ ‘সুভাষিত-রত্নভাণ্ডাগার’, ৭৭.৫০
২৮ ‘মৎস্য-পুরাণ’, ৪. ৩১
২৯ ‘বায়ু-পুরাণ’, ৫৯. ১৪
৩০ G. S. Kirk & J. E. Raven, Pre-socratic Philosophers, P. 168, Fn. 169.
৩১ তদেব, P. 168, Fn. 170
৩২ তদেব, P. 168, Fn. 171
৩৩ ‘ঋগ্-বেদ সংহিতা’, ১০. ৮২. ৭
৩৪ ‘ঋগ্-বেদ সংহিতা’, ১. ১৬৪. ৪৬
৩৫ যাস্ক, ‘নিরুক্তম্’, দৈবতকাণ্ড, পৃ. ৩৫৩
৩৬ তদেব, পৃ. ৩৫৪
৩৭ “স বৈ নৈব রেমে, তম্মাদেকাকী ন রমতে, স দ্বিতীয়মৈচ্ছৎ। …স ইমমেবাত্মানং দ্বেধাপাতয়ৎ ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবকাম…।”
‘বৃহদারণ্যক উপনিষৎ’, পৃ. ১৯১
৩৮ Hugo Rahner, The Christian mysteries and Pagan mysteries, p. 359. In ‘The Mysteries’.
৩৯ ‘সুভাষিতরত্নভাণ্ডাগারম্’, পৃ. ২২.
৪০ ‘ঋগ্-বেদসংহিতা’, ১.১১৫. ২
৪১ তদেব, ১, ১৯, ৯
৪২ তদেব, ২.১২.১
৪৩ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’, ৩, ১
৪৪ তদব, ১, ৩০, ৩
৪৫ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’, পৃ. ২৩ খ
৪৬ যাস্ক, ‘নিরুক্তম্’, পৃ. ৪৩৬
৪৭ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’, পৃ. ২৩খ
৪৮ তদেব, পৃ. ২৩ খ
৪৯ “তত্ তুরীয়ভাগ্ ইন্দ্রো’ভবত্, ত্রিভাগ্ বায়ু স্তৌ সহৈবেন্দ্ৰবায়ু উদজয়তাং …।”
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, পৃ. ২৩ খ
৫০ ‘ঋগ্-বেদসংহিতা’, ১, ১২৩, ১০
৫১ ‘তদেব, ৩. ৪৮. ২
৫২ তদেব, ৩. ৫৩. ৬
৫৩ তদেব, ১০. ১৭০. ৩
৫৪ তদেব, ১. ১৭০. ৪
৫৫ ‘বায়ুপুরাণম্’, ৫৯. ১৩