দেবতা এবং স্বর্গের ঠিকানা

দ্বিতীয় অধ্যায় – দেবতা এবং স্বর্গের ঠিকানা

॥ ১ ॥

বস্তুত ছলনা, বঞ্চনা, হিংসা, ধর্ষণ—এগুলি ন্যায়, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, ভালবাসার বিপরীত কোটিতে অবস্থান করলেও এই সমস্ত বৃত্তিগুলিকেই আমি সুস্থ সমাজের লক্ষণ বলে মনে করি। অবশ্য আমার কথাগুলি একটু বিশদ অর্থে বোঝা দরকার। আদর্শ যে সমাজটি আমাদের একান্ত কাম্য, তাতে লোভ, হিংসা-দ্বেষ, তঞ্চকতা—এগুলি থাকবে না এটা অস্বাভাবিক। অর্থাৎ এই অসদ্‌বৃত্তিগুলি পরিহার্য হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পরিহার্য এক কথা, আর শুন্যতা আরেক কথা। সমাজে এই জঘন্যবৃত্তিগুলি যদি একটুও না থাকে, সেই সমাজে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিকেরা যতই আবাস-কল্পনা করুন, আমি সেই সমাজে থাকতে চাই না। আমাদের বাপ-পিতামহ ব্রাহ্মণ-ঋষি, ক্ষত্রিয়-রাজা এবং দেবতারাও কেউ সেই সমাজের বাসিন্দা হতে চান না।

আমাকে আধুনিকমনা অনেকে—অনেকে যাঁরা প্রাচীন দেবতা, ঋষি বা ব্রাহ্মণমাত্রকেই শুদ্ধ ধর্মপুরুষ বলে মনে করেন, তাঁরা অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন—ছি ছি কী সব জিনিস নিয়েই আপনার কারবার! যাঁদের আমরা দেবতা বলে পুজো করছি, যে ব্রাহ্মণ-ঋষিদের আমরা শম-দম-তপস্যার প্রতিমূর্তি ভাবছি, তাঁরা কিনা বঞ্চনা করছেন, নারীর রূপ দেখা মাত্রই মোহিত হচ্ছেন, অন্যের সম্পত্তির লোভ করছেন, এমনকি রেগে গেলে ভীষণভীষণ সব শাপ দিচ্ছেন। এই কি তপস্যার ফল ? এই কি ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ? ছিঃ, এরা আবার ঋষি, এঁরা আবার দেবতা !

এই সব অপভাষণে আমি ক্রুদ্ধ হই না, দুঃখিতও হই না। বরঞ্চ এই বন্ধুদের আপাত অজ্ঞতার জন্য খানিকটা কৌতুকও বোধ করি। কেউ যদি ভেবে নেন—আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয় বা গান্ধী—আমি এঁদেরও ঋষি বা দেবতার মতই মনে করি—এঁরা অতি উচ্চমার্গের লোক বলেই এঁদের কোন কাম, লোভ বা ক্রোধ-বেগ ছিল না, তাহলে ভুল ভাবা হবে। হয়তো এঁরা নারীধর্ষণ বা কারও সঙ্গে প্রত্যক্ষ বঞ্চনা করেননি, —করেননি যে, তার কারণ এরা উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে জন্মেছেন। সভ্যতার অগ্রগতিতে হৃদয়ের দুর্বৃত্তিগুলি চেপে রাখা যায় বলেই সেটা সভ্যতা। কিন্তু সমাজ যখন বেশি এগোয়নি, মানুষ যখন নাগর-বৃত্তিতে অভ্যস্ত হয়নি, তখনও যে সমাজটা অসভ্য ছিল, তা নয়। যথেষ্ট শম-দম এবং তপস্যার মধ্যেও দেবতা কিংবা ঋষি-মুনিরা যে অসংযমের পরিচয় দিতেন, তার কারণ সেই সমাজে এই দুবৃত্তিগুলি না চাপলেও চলত।

তা ছাড়া সমাজের তৎকালীন অবস্থার কথাটাও আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথাও। তবে আর্থ-সামাজিকতার কথা যখন ভাববেন, তখন যেন আমাদের আধুনিক সমাজের পরিশীলিত মনন সেই সমাজের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। তাহলে অবিচার হবে। আমি আগে দু-একটি গুরুগৃহবাসী শিষ্যের গুরুপত্নীগমনের কথা ইঙ্গিত করেছি। উল্লেখ করেছি—ব্রাহ্মণ কিংবা দেবতার বঞ্চনার কথাও। কিন্তু তার সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা বলিনি। এবারে তাও একটু বলব।

যাঁরা ভাবেন—সে যুগে ব্রাহ্মণেরা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ভোগ করতেন এবং ব্রাহ্মণ হলেই তাঁদের আর কোন অভাব অভিযোগ থাকত না তাঁরা অংশত ভুল ভাবেন। এটা অতিসরলীকরণ অথবা সাধারণীকরণ। সন্দেহ নেই আপন শিক্ষার গুণে অথবা তাত্ত্বিকতার গুণে ব্রাহ্মণেরাই সে যুগের ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। ঠিক যেমন রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ-দখল করে, রাজারাও সুবিধাভোগী দেবতারাও তাই। কিন্তু তাই বলে সমাজে অভাবী ব্রাহ্মণ ছিলেন না, তাঁদের কোন কষ্টও ছিল না—এ ধারণা স্পষ্টতই ভুল।

আমি এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের সেই বিখ্যাত ঘটনাটি উল্লেখ করতে চাই। বৈদেহ জনক ব্রহ্মসভার আয়োজন করে সমবেত মুনি-ঋষিদের বলেছিলেন—আপনাদের মধ্যে যিনি নিজেকে ব্রহ্মিষ্ঠ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বেদবিৎ বলে মনে করেন, তিনি আমার উপহারস্বরূপ এই গরুগুলি নিয়ে যান। কোন ঋষি কোন কথা বললেন না, তর্কে-বিতর্কে ব্ৰহ্ম-বিষয়ের চরম মীমাংসা হওয়ার আগেই যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর শিষ্যকে বললেন—সৌম্য সামশ্রব! তুমি গরুগুলি নিয়ে চল। সমবেত ঋষি-ব্রাহ্মণরা রে-রে করে উঠলেন। রাজর্ষি জনকের ঋত্বিক যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন—তুমি কি নিজেকে আমাদের সবার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন—আরে! সর্বশ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মর্ষির চরণে নমস্কার। আমার মশাই গরু দরকার, গরু নিয়ে যাচ্ছি—নমো বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্ম্মো গোকামা এব বয়ং স্ম ইতি।

এই সভায় ব্রহ্ম-বিষয়ণী চর্চা অনেক হয়েছিল, যাজ্ঞবল্ক্যও শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমার বক্তব্য হল, এই সামান্য ঘটনার মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যর কৌতুকপ্রিয়তা যতই থাক, গরুগুলি তাঁর দরকার ছিল। রাজা-রাজড়ারা মুনি-ঋষিদের দান-ধ্যান কম করতেন না। কিন্তু সব সময় তাঁদের সেই দানেই সংসার চলত, এ কথা ঠিক নয়। উপরন্তু ব্রাহ্মণ নিজেও দান করতেন। তার ওপরে শিষ্য-সামন্ত যাঁরা গুরুগৃহে থাকতেন, তাঁদেরও ভরণ-পোষণের ব্যাপার ছিল। সব কিছু মিলে ব্রাহ্মণের পক্ষে অপরের দান গ্রহণ বা প্রতিগ্রহ করাটা নিয়মের পর্যায়ে পড়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত অভাবের তাড়নায় অন্যের যাগ-যজ্ঞ সম্পাদন করে তাঁদের সে দক্ষিণার দিকে তাকিয়ে থাকতে হত, তার কারণ ব্রাহ্মণ নিজেই। তিনি অন্যের চাকরি করবেন না, অন্যের গোলামি করবেন না—শুধু যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা এবং দান-প্রতিগ্রহ—এই নিয়েই তাঁরা থাকবেন, এই তাঁদের ধর্ম। কিন্তু ওই যে বলেছি আদর্শ এক জিনিস, আর বাস্তব আরেক জিনিস। যাঁরা অযাচিতবৃত্তি হতে চাইতেন, তাঁদেরও আর্থ-সামাজিক চাপে লোভী হয়ে পড়তে হত। তার উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি।

মহাভারতে পাণ্ডব-কৌরবের সন্তান-বীজ মহারাজ পরীক্ষিৎ তৃষ্ণাকুল হয়ে নিরুত্তর ধ্যানস্থ শমীক মুনির গলায় মরা সাপ জড়িয়ে দিয়ে তাঁর ছেলের অভিশাপ লাভ করলেন—তক্ষকের দংশনে রাজার মৃত্যু হবে। রাজা পরীক্ষিৎ উপায়ন্তর না দেখে মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সাপ এবং সাপের বিষ থেকে রক্ষা পাওয়ার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ওদিকে তক্ষকও তার পথ খুঁজছিল পরীক্ষিৎকে দংশন করার। সে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে রাজবাড়ির অন্ধিসন্ধি দেখে নিচ্ছিল। এমন সময় সে মহর্ষি কাশ্যপকে দেখতে পেল। কাশ্যপ সর্প-চিকিৎসা জানেন এবং সাপের বিষ নির্মূল করে সাপে-কাটা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। তিনি পরীক্ষিতের কাছে এসেছেন, কারণ দেশের রাজাকে বাঁচালে তাঁর ধর্মও হবে এবং তিনি টাকাও পাবেন প্রচুর—তত্র মে’র্থশ্চ ধর্মশ্চ ভবিতেতি বিচিন্তয়ন।

ঠিক এই অবস্থায় ব্রাহ্মণবেশী তক্ষকের সঙ্গে কাশ্যপের দেখা। তক্ষক বলল—মশাই! আপনি এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছেন? কাশ্যপ উত্তর দিলেন যে, সর্পদষ্ট রাজাকে তিনি বাঁচিয়ে তুলবেন। তক্ষক কাশ্যপকে উপযুক্ত পরীক্ষা করেও দেখল যে, তিনি কতটা ক্ষমতা রাখেন। তক্ষক দেখল—কাশ্যপের ক্ষমতা যথেষ্টই। সে তখন নিজের পরিচয় দিয়ে পরীক্ষিতের অন্যায় আচরণের কথা তুলল। তক্ষক বলল—কিসের আশায়, কোন লাভের জন্য আপনি পরীক্ষিৎকে বাঁচাতে চাইছেন। আপনি যা চান, তা যদি দুষ্প্রাপ্যও হয়, তবু আমিই সেটা আপনাকে দেওয়ার চেষ্টা করব। আপনি পরীক্ষিতের কাছে যাবেন না। তক্ষক বলল—পরীক্ষিৎ ব্রাহ্মণকে অপমান করেছে। আপনি তাঁকে বাঁচিয়ে তুললে, সেটা আপনার মর্যাদা বাড়াবে ? অর্থাৎ তক্ষক এবার কাশ্যপের ব্রাহ্মণত্বে তথা জাতিসাম্যে সুড়সুড়ি দিলেন। কাশ্যপ কিন্তু সব ভুলে গিয়েও বললেন—তবু আমি সেখানে যাব, কারণ আমার টাকার দরকার । তুমি সেই টাকা দাও আমি এখুনি চলে যাচ্ছি—ধনার্থী যাম্যহং তত্র তন্মে দেহি ভুজঙ্গম। তক্ষক বলল—আপনি রাজার কাছে যত টাকা চাইবেন, আমি তার চাইতে বেশি দেব আপনাকে, আপনি ফিরে যান—যাবদ্ধনং প্রার্থয়সে তস্মাদ্‌ রাজ্ঞ স্ততো’ধিকম্‌। অহমেব প্রদাস্যামি…।

কাশ্যপ তক্ষকের কাছ থেকে অভিলষিত ধন নিয়ে ফিরে গেলেন ; রাজার বাড়ি আর গেলেন না। আপনারা বলতেই পারেন—ব্রাহ্মণ লোভী, স্বার্থপর, টাকার মূল্যে সব দেখে। যে রাজা-রাজরাড়া ব্রাহ্মণদের জন্য এত করেছেন, ব্রাহ্মণ সেই রাজাকে দেখল না, তাঁর জীবনের কথা চিন্তা করল না ! এ কেমন ব্রাহ্মণ্য, এ কেমন ব্যবহার? উত্তরে আমি আবারও সেই কথা বলি—আর্থিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিস্থিতি। এগুলির জন্যই আদর্শ ব্রাহ্মণ-ঋষি তাঁর ত্যাগব্রত তপস্যার আদর্শ ধর্ম থেকে চ্যুত হন। এই চ্যুতির উপকার একটাই—দেবতা, ঋষি, রাজা—সবাইকেই মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং মানুষের মহত্ত্বেই সামান্যীকরণের সুযোগ পাওয়া যায়।

সময় আসবে, যখন আমি দেবতাদের রাজার জাত বলতে বাধ্য হব। বেদেও অনেক দেবতাই রাজ-সম্বোধনে সম্মানিত, অন্যদিকে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রমতে মর্ত্যের রাজারাও সব দেবতার অংশে বলীয়ান-যস্মাদেষাং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রা নির্হূত্য শাশ্বতীঃ—অতএব দেবতার চরিত্রে সেই স্বেচ্ছাচারিতার বীজ আছে, যা প্রাচীন রাজাদের মধ্যে দেখতে পাই। নইলে ইন্দ্র যেভাবে গুরুর চেহারা নকল করে গুরুপত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করেছেন এবং চন্দ্র যে মেজাজে বৃহস্পতির স্ত্রীকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁর গর্ভে পুত্ৰ উৎপাদন করলেন, তা একান্তই রাজকীয়। অন্যদিকে সমাজের গরীব-গুর্বো ব্রাহ্মণেরা অর্থের অস্বচ্ছলতায় যে অন্যায় করতেন, তার থেকে অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলতেন তাঁরা, যাঁরা রাজার আশ্রিত অথবা রাজার সঙ্গে যাঁদের ওঠা-বসা। রাজাদের সঙ্গে মিলে মিশে, তাঁদের মধ্যেও অনেক স্বেচ্ছাচারিতা প্রবেশ করেছে। শাস্ত্রের বিধান যেহেতু তাঁদের হাতেই ছিল, অতএব অনেক ক্ষেত্রে শাস্ত্র-নিয়মও এমনভাবেই তাঁরা তৈরি করেছেন যাতে তাঁদের অথবা রাজাদের অসুবিধে হয়। অন্যদিকে দেবতাদের কাম-ক্রোধ-লোভের মত হাজার ত্রুটি থাকলেও তাঁরা কিন্তু দেবতার চরিত্র এমনভাবেই বর্ণনা করেছেন, যাতে দোষ-সমম্বিত হলেও তাঁদের আরাধ্যতা নষ্ট না হয়। এই দৃষ্টি অবশ্যই বাস্তব-সম্মত এবং অত্যন্ত মানবিকও বটে। অন্যকে ছলনা করা, বঞ্চনা করা, অথবা আপন স্বার্থ সাধন করা—এগুলি ব্রাহ্মণোচিত গুণ না হলেও অনেক ঋষি-মুনি-ব্রাহ্মণই এই আচরণ করেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি এই আচরণকে সুস্থ সমাজের অঙ্গ বলেই মনে করি।

মুনি-ঋষি এবং মান্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে চরিত্রের কলুষ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যে সমস্ত সমাজের মূর্ধণ্য-ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তার কারণ সমস্ত রকমের উচ্চ শিক্ষা, ত্যাগ এবং বহুজনহিতের মাহাত্ম্য তাঁদের মধ্যে বেশি ছিল। লক্ষ্য করে দেখুন, মানুষের ভাগ্য-বিধান এবং আরাধ্যত্বের নিরিখে যে দেবতাদের আমরা হয়তো পরে ‘উত্তমোত্তম’ মানুষ বলব, তাঁদেরও কিন্তু এই মুনি-ঋষিদের কাছেই একটা ‘এ্যাকাউন্টেবিলিটি’র ব্যাপার ছিল। অর্থাৎ রাজকীয় স্বেচ্ছাচারিতার বশে দেবতা যদি কোন অন্যায় করে বসতেন, তাহলে তিনি রেহাই পেয়ে বেরিয়ে যেতে পারতেন না। মনুষ্য-সমাজে রাজারা যদি অন্যায় করতেন, তাহলে ব্রাহ্মণ ঋষিদের মুখে সাবধান-বাণী শোনা ছাড়াও তাঁদের যেমন অভিশাপ লাভ করতে হত, তেমনই মানুষের আরাধ্য দেবতারা মানুষের ভাগ্য-নিয়ন্তার সিংহাসনে বসেও নিজকৃত অন্যায়ের জন্য মনুষ্য ঋষি-মুনির তর্জন-গর্জন অভিশাপ লাভ করতেন। অথাৎ মুনি-ঋষিদের কাছে মনুষ্য-রাজার যে ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ ছিল, দেবতা অথবা দেবরাজেরও সেই ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ ছিল।

এই যে জবাবদিহির একটা ব্যাপার সর্বত্র থেকে যাচ্ছে, এইটাই দেবতা, ঋষি, রাজা বা অসুরেরা না হয় মুনি-ঋষিদের কাছে জবাবদিহি করে নিজেদের শুধরে নেবার সুযোগ পেতেন অথবা জবাবদিহি না করে অভিশাপ লাভ করে অন্যায়ের ফল ভোগ করতেন, কিন্তু মুনি-ঋষিরা? তাঁরা তো কারও কাছেই জবাবদিহি করছেন না। তাঁদের অন্যায় শুধরাবে কে? উত্তরে জানাই—তাঁদের জন্য অন্য ব্যবস্থা ছিল। যে ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ যে পরম পদের জন্য তাঁদের শিক্ষা, দীক্ষা, তপস্যা, তাঁদের সেই তপস্যার সিদ্ধি নষ্ট হয়ে যেত হঠাৎ আপতিত কোন অসংযমের কারণে অথবা অন্যায় আচরণের ফলে।

আমি এই প্রসঙ্গে আরও একবার পরীক্ষিৎ মহারাজের কথাই তুলব। তিনি তৃষ্ণাকুল হয়ে মৌনব্রতধারী তপস্যামান শমীর ঋষির গলায় মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে এলেন। এতে কিন্তু শমীক এতটুকু রাগ করলেন না, পরীক্ষিৎকে তিনি কোন অভিশাপও দিলেন না। কিন্তু শমীকের ছেলে যুবক মুনি শৃঙ্গী রাজার এই আচরণ সহ্য করতে পারলেন না এবং তিনি পরীক্ষিৎকে তক্ষক-দংশনে মৃত্যুর অভিশাপ দিলেন। ‘পুত্র শৃঙ্গীর এই হঠাৎ ক্রোধ এবং উদ্ধত আচরণে শমীক, কিন্তু মোটেই খুশি হলেন না। তিনি পুত্রকে ডেকে শাসন করলেন অত্যন্ত কর্কশভাবে এবং তির্যকভাবে তাঁর তপস্যার শক্তি যে অপব্যবহৃত হয়েছে—তাও বলে দিলেন।

শমীক বললেন—পুত্র! তোমার তপস্যার শক্তি বড় উগ্র—জানাম্যুগ্রপ্রভাবং ত্বাম্‌। তুমি সত্যবাদী, জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলেনি, অতএব এখন যা বলেছ, তাও নিশ্চয়ই ঘটবে। কিন্তু বাবারা যে বয়স্ক ছেলেকেও শাসন করেন, তার কারণ তাঁরা চান তাঁদের ছেলে গুণবান হোক, ছেলের যশ বাড়ুক, এই তো? তপস্যার ফলে তোমার প্রভাব বেড়েছে বটে, কিন্তু এখনও তুমি ছেলেমানুষ, তোমাকে আমার বলার কিছু থাকতেই পারে—সো’হং পশ্যামি বক্তব্যং ত্বয়ি ধর্মভৃতাং বর।

শমীক এই ভণিতাটুকু শেষ করেই আসল কথায় এলেন। বললেন—যে সমস্ত মহাত্মা পুরুষেরা তপস্যার বলে বলীয়ান হন, তাঁদের রাগ বড় বেড়ে যায়—বর্ধতে চ প্রভবতাং কোপো’তীব মহাত্মানাম্‌। তুমি বাপু বনের ফলমূল খেয়ে আরও সংযমের মাধ্যমে এই ক্রোধটাকে সংযত করার চেষ্টা কর। স্বৰ্গলিপ্সু লোকেরা অনেক কষ্টে যে ধর্ম সঞ্চয় করেন, এই ক্রোধ তা নষ্ট করে দেয়। শমগুণ বা সংযমই জিতেন্দ্রিয় লোকের অভীষ্ট সিদ্ধি ঘটায়। তুমিও ইন্দ্রিয়কে শাসন কর, ক্ষমাশীল হও।

শমীক আরও বললেন—তুমি যা করেছ, আমি কিন্তু তা মেনে নিতে পারছি না। আমি অন্তত শিষ্যমুখে সেই রাজাকে সংবাদ পাঠাব যে, আমার অশিক্ষিতবুদ্ধি বালক পুত্র আপনাকে এই অভিশাপ দিয়েছে—মম পুত্রেণ শপ্তো’সি বালেনাকৃতবুদ্ধিনা।

শমীক একটা মাত্র অসংযমের কথা বলেছেন, সেটা ক্রোধ। একইভাবে কাম-মৈথুন, লোভ এগুলিও যে মুনি-ঋষিদের তপস্যার প্রভাব নষ্ট করেছে, তারও উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। পুরাণে ইতিহাসে কত মুনি-ঋষিকে শেষ পর্যন্ত হাহাকার করতে দেখেছি, তাঁরা তাঁদের অন্তস্থিত কামবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে অথবা লোভী হয়ে পড়েছেন বলে। কাজেই মানুষ, অসুর বা দেবতাদের ওপর যেভাবে অভিশাপ নেমে আসত, ঋষি-মুনিদের ওপরেও সেই অভিশাপ নেমে আসত কাম-ক্রোধের ছদ্মবেশ ধরে। অর্থাৎ দেবতা বা রাজাদের মত তাঁদেরও এক জায়গায় ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ আছে। তাঁরাও সর্বেসর্বা নন।

অন্যায়, অসংযম এবং অভিশাপের সূত্র ধরে আমি যেটা বোঝাতে চাইছি, তা হল—সমাজ যেখানে আছে, সেখানে মনুষ্যধর্মের নিয়ম অনুযায়ী দেবতা-অসুর, ঋষি বা রাজা কেউই নির্ভেজাল ভালর মহিমা দিয়েই তৈরি হতে পারেন না। ভাল-মন্দ মিশিয়ে যেমন মানুষ, তেমনই ভাল-মন্দ মিশিয়েই দেবতা, ঋষি এবং বৃহত্তর মনুষ্যসমাজ। সুস্থ সমাজের নিয়মে ভাল-মন্দেই সবার প্রবহমানতা, নইলে হিন্দুর দেবতা হতেন নিপ্রাণ, ধূসর এবং শুধুই আরাধ্যতম। তাঁরা আমাদের জীবনের অংশীদার হতেন না। দেবতারা যেখানে সব দিক দিয়েই মনুষ্যধর্মের অঙ্গীভূত, অতএব এই রকম একটা জায়গা থেকেই আমরা দেবতা, ঋষি অথবা দেবকল্প রাজাদের মনুষ্যোচিত কামনা বাসনা, রতি, ক্রোধ একেবারে মানুষের দৃষ্টিতেই লক্ষ্য করতে থাকব। দেখবেন, এই চরম মনুষ্যায়ণের শেষ বিন্দুতেই দেবতা, ঋষি বা আমাদের প্রাচীন পিতামহদের নিয়ে রঙ্গ-রসিকতাও খুব অন্যায় বলে গণ্য হবে না।

॥ ২ ॥

দেবতাদের সম্মানার্থে পুরাণকারেরা পৃথিবীতে তাঁদের বাসস্থান নির্ণয় করতে পারেননি ; করেছেন স্বর্গ নামক এক কাল্পনিক লোকে। তবে কি জানেন, ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলে বুঝবেন, স্বর্গ জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে কোন কাল্পনিক জায়গা নয়। ওটা পৃথিবীতেই ছিল। স্বর্গের সম্বন্ধে যে সব রোমাঞ্চকর বিলাসের খবর পাওয়া যায়, সে সবও মিথ্যে নাও হতে পারে। হ্যাঁ, আপনি মরবার পরে স্বর্গে গিয়ে উর্বশী-রম্ভার কাঁধে হাত রেখে আঙুর ফল খেতে পারবেন কিনা, সে সম্বন্ধে সন্দেহ রাখাটাই শ্রেয় মনে করি। কিন্তু আপনি এখনকার ভারতের মুঘল গার্ডেনে বিশ্বাস করবেন, অথচ নন্দন-কাননে বিশ্বাস করবেন না—তা হবে না। ভারী সুন্দর একটা ফুল-ফলের বাগান যে স্বর্গের দেশে ছিল, তাতে অসম্ভব কি আছে? পারিজাত ফুলও কিছু অসম্ভব নয়। রেয়ার কোয়ালিটির গোলাপে বিশ্বাস করবেন, নাগচম্পায় বিশ্বাস করবেন, অথচ পারিজাতের মোহন গন্ধে বিশ্বাস করবেন না, তা হবে না।

এই সেদিনের রাজা-রাজড়ারা সুন্দরী নতর্ককীদের নৃত্য উপভোগ করতেন। জমিদার বাড়িতে মেহফিল বসত। আলোর রোশনাই আর সুরার হিল্লোলে রাত দিন হয়ে যেত—সেটা আপনি বিশ্বাস করবেন। তাহলে পানীয় হাতে দেবরাজ ইন্দ্রের সামনে উর্বশী-মেনকার মত স্বর্গসুন্দরীরা একটু নাচ দেখালেই সেটা কল্পলোকের বিলাস-ব্যাভার হবে কেন? বস্তুত নন্দকানন, পারিজাত ফুল অথবা উর্বশী-রম্ভারা স্বর্গের বিশ্বাসে একেবারেই গৌণ ব্যাপার। আসল ব্যাপার হল, স্বর্গ নামক জায়গাটি কোথায়? সেটা যদি পাওয়া যায় তবে নাচ-গান আর ফুলের বাহারটা মোটেই কাল্পনিক হবে না।

আপনারা মৎস্যপুরাণ খুলুন। দেখবেন, মহাশক্তিশালী তারকাসুর ত্রিপুর বলে একটা দুর্গ বানিয়েছেন। এই দুর্গ দেবতারা শত চেষ্টা করেও ভাঙতে পারেননি এবং এই দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করা তাঁদের পক্ষে একরকম অসম্ভব। দেবতারা এই অবাধ্য অসুরকে বধ করার জন্য দেবদেব মহাদেবের শরণ নিয়েছেন। দেবতাদের অভয় দিতে মহাদেব এসে পৌঁছেছেন দেবসভায়। সে সভার নাম অমরাবতী। আমাদের যেমন দেওয়ান-ই-আম্‌, দেওয়ান-ই-খাস্‌ অথবা মিটিং রুম, তেমনই ইন্দ্রের অমরাবতী। এই অমরাবতীর মধ্যেও আবার ইন্দ্রের একটা ‘পারসোন্যাল’ প্রমোদ-প্রাসাদ আছে যার নাম বৈজয়ন্ত-প্রাসাদ। এই প্রাসাদের যা বর্ণনা আছে, তাতে এটাকে আক্ষরিক অর্থে ‘ক্রিস্টাল প্যালেস’ বলা যায়, কারণ প্রাসাদটি স্ফটিক-নির্মিত।

এখন ইন্দ্রের যা অবস্থা, তাতে তাঁর পক্ষে ওই প্রাসাদে বসে উর্বশীর নৃত্যকলা দেখা সম্ভব ছিল না। তিনি দেবসভায় এসে মিলিত হয়েছেন উপস্থিত দেবগণের সঙ্গে। সেখানে নারদও এসে উপস্থিত হয়েছেন ত্রিপুর দুর্গের খবরাখবর নিয়ে। সকলেই অবশ্য এখন মহাদেবের আপ্যায়নে ব্যস্ত। কিন্তু মহাদেব নিজের জায়গা ছেড়ে কোথায় এসেছেন এবং দেবসভাই বা কোথায় বসেছে—তার একটা হিসেব কষলেই বুঝতে পারবেন আমাদের সেই কল্পিত স্বর্গভূমি কোথায়।

পুরাণের কথক ঠাকুর বললেন—নারদ মুনি ত্রিপুর থেকে এসে দেবসভায় উপস্থিত হলেন। জায়গাটার নাম কি? জায়গাটার নাম ইলাবৃত বর্ষ। বর্ষ মানে ভৌগোলিক সীমাযুক্ত একেকটা জায়গা, যেমন ভারতবর্ষ। তা এই ইলাবৃতের বর্ষের আর কোন পরিচয় আছে কি? পুরাণকার চিনিয়ে দিচ্ছেন—আছে! যেখানে দৈত্যরাজ বলি বড় যত্ন করে সেই বিশাল যজ্ঞ করেছিলেন। যে যজ্ঞে বিষ্ণুকে বামন হয়ে ভিক্ষা চাইতে হয়েছিল, যে যজ্ঞে বামনকে ত্রিপাদ ভূমি দান করতে গিয়ে তিনি সর্ব খুইয়েছিলেন এবং যে যজ্ঞের দানমহিমায় স্বয়ং বিষ্ণুকে বলির দ্বারপাল নিযুক্ত হতে হয়েছিল, সেই যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছিল এই ইলাবৃত বর্ষে—যত্র যজ্ঞো বলের্বৃত্তো বলিৰ্যত্র চ সংযতঃ। আর কি কোন ইতিহাস আছে এই ইলাবৃত বর্ষের? পুরাণকার বললেন—আছে। এই সেই পবিত্র স্থান, যেখানে দেবতাদের জন্ম হয়েছিল। দেবতাদের যাগ-যজ্ঞ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন, বিবাহ এমনকি কন্যা সম্প্রদান করতে হলেও এই জায়গাতে আসতে হয়—

দেবানাং জন্মভূমি র্যা ত্ৰিষু লোকে বিশ্রুতা।
বিবাহাঃ ক্ৰতবশ্চৈব জাতকর্মাদিকাঃ ক্রিয়াঃ ॥
দেবানাং যত্র বৃত্তানি কন্যাদানানি যানি চ।

তাহলে দেখুন —বলি দৈত্যদের রাজা, তিনিও যজ্ঞ করেছিলেন এইখানে ; আবার দেবতাদের জন্ম-কর্ম, বিয়ে-সাদিও এইখানে। অর্থাৎ দেবতা এবং দৈত্য দুই পক্ষেরই পছন্দের জায়গাটা হল এই ইলাবৃত বর্ষ। মহাদেব ত্রিপুর দুর্গের অধিকারীকে শায়েস্তা করার আগে এই ইলাবৃতবর্ষে দাঁড়িয়েই ইন্দ্রকে বলেছেন—দেখ ইন্দ্র ! ত্রিপুর দুর্গে শত্রুদের পতাকাগুলো কেমন পত্‌পত্‌ করে উড়ছে দেখ। বিমানগুলি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে, অট্টালিকার মধ্যে কেমন সুন্দর সব ঘরগুলো। এই দুর্গ যেন আগুনের মত তাপ দিচ্ছে, অসুররা সব অস্ত্র-শস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছে।

আসলে অট্টালিকা কি দুর্গ বানানোতে অসুর-দৈত্যরা খুবই অভ্যস্ত ছিলেন। ওঁদের মধ্যে যত ভাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, দেবতাদের মধ্যে তেমন ছিলেন না। ত্রিপুর দুর্গ যেমন তার প্রমাণ, রাবণের স্বর্ণলংকাও তার প্রমাণ। অর্জুনকে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপ্রাসাদ বানাতে হয়েছিল ময়দানবকে দিয়ে এবং ত্রিপুর দুর্গের অন্যতম রূপকারও ওই ময়দানব। কিন্তু সে কথা যাক। মোদ্দা ব্যাপার হল—দেবতাদের জন্মভূমি আর সমস্ত কাজ-কারবারের জায়গা যেটা, সেইখানেই কিন্তু এই ত্রিপুর দুর্গ এবং জায়গাটা হল ইলাবৃত বর্ষ।

এই ইলাবৃতবর্ষের অন্য নাম হল স্বর্গ। পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষের উত্তর সীমায় হিমালয় পর্বতের অবস্থান। হিমালয়ের উত্তরে এবং হেমকূট পর্বতমালার দক্ষিণে হল কিম্পূরুষ বর্ষ। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের সীমা নিষধ পর্বত পর্যন্ত এবং নিষধের উত্তরেই হল আমাদের ইলাবৃতবর্ষ-হরিবর্ষাৎ পরঞ্চাপি মেরোস্তু তদিলাবৃতম্। পুরাণের এক জায়গায় যেমন বলা হল—ইলাবৃতবর্ষ দেবতাদের জন্মভূমি, অন্যত্র কিন্তু আবার বলা হচ্ছে যে, সেখানকার মানুষের গায়ের রঙ পদ্মের মত, আর তাদের চোখগুলো সব পদ্মের পাঁপড়ির মত, গা দিয়েও যেন পদ্মের গন্ধ বেরুচ্ছে—পদ্মগন্ধাশ্চ জায়ন্তে তত্র সর্বে চ মানবাঃ। আমার মতে এই মানুষেরাই দেবতা। পুরাণও একই সঙ্গে বলছে—দেবলোকচ্যুতাঃ সর্বে মহারাজতবাসসঃ।

পণ্ডিতেরা বলেছেন—এই ইলাবৃতবর্ষ মোটামুটি “মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। সম্ভবত আধুনিক পামির বা পূর্ব-তুর্কীস্থান ইলাবৃতবর্ষের অন্তর্গত।” পণ্ডিতদের অনুমান—এই জায়গার নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই ইলাবৃত বর্ষের সভ্যতা লুপ্ত হয় এবং নিতান্ত জলাভাবের জন্যই ইলাবৃত বর্ষ থেকে তাঁরা ভারতের দিকে ক্রমশ আসতে থাকেন। গিরীন্দ্রশেখর বসু লিখেছেন—ইলাবৃতবাসীগণ আর্য ছিলেন। কালবশে তাঁহারা দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়েন। একদল নিজেদের দেব এবং অপর দল নিজেদের অসুর বলিতেন। অসুরগণ দেবগণের জ্ঞাতি ও বন্ধু ছিলেন।

এটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কথা। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে দেখা যাবে—দেবতাদেরও নানা দল ছিল। একেকটা দলের একেকটা গোষ্ঠী-পরিচয়ও ছিল। দেব, শুক্র, ত্বিষিমান্‌—এইগুলি হল দলের নাম। ইন্দ্র ছিলেন এঁদের প্রধান এবং বলা বাহুল্য, ইন্দ্র একটা উপাধিমাত্র, দল-প্রধানের উপাধি। আর অসুররা এই দেবতাদেরই জ্ঞাতিবন্ধু—অসুরা যে তদা তেষামাসন্‌ দায়াদবান্ধবাঃ। ঠিক এইখানটায় গিরীন্দ্রশেখরের সুচিন্তিত বক্তব্য আমি আবার চলিত ভাষায় অনুবাদ করে দিচ্ছি—

“অনুমান হয় দেবগণ তুর্কীস্থান থেকে কাশ্মীরের পথে প্রথমে ভারতে আসেন। তাঁরা কাশ্মীর থেকে পঞ্জাব ও পঞ্জাব থেকে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর প্রদেশ পর্যক্ত ক্রমে অধিকার করেন। তারপর বিন্ধ্যের দক্ষিণেও আর্যরা রাজ্যবিস্তার করেন। পুরাণ আলোচনায় দেখা যায় যে, দক্ষিণাপথে আর্যরাজ্য বেশ প্রাচীন। ইলাবৃতবর্ষ, কাশ্মীর-বিন্ধ্যাত্তর ভারত এবং দক্ষিণাপথ পর্যায়ক্রমে স্বর্গ, অন্তরীক্ষ, মর্ত্য এবং পাতাল নামে পুরাণে পরিচিত। ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে কাশ্মীর বা অন্তরীক্ষে এসে বসবাস করেন বলেই অন্তরীক্ষের অন্য নাম পিতৃলোক। অন্তরীক্ষ মানে মধ্যবর্তী দেশ। দেবলোক, পিতৃলোক এবং মর্তলোক অর্থাৎ ইলাবৃতবর্ষ, কাশ্মীর ও উত্তরভারত প্রাচীনকালে আরও তিনটি নামে পরিচিত ছিল—যেমন, ইলা, সরস্বতী ও ভারতী। একাধিক ঋক্‌সূক্তে এই তিনটি নাম পাওয়া যায়। এই তিন প্রদেশেরই অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ঋগ্‌বেদে বাগ্‌দেবতা নামে পরিচিত।

যখন দেবতারা প্রথমে ভারতে আসেন, তখন প্রথমে তাঁরা ইন্দ্রের অধীন ছিলেন। স্বর্গ বা ইলাবৃতবর্ষের অধিপতির সাধারণ নাম ইন্দ্র। ভারতে তখন রাজা বলে কেউ ছিলেন না। ভারতে নেমে আসার পর দেবতারা মানব নামে পরিচিত হন। ইন্দ্রের প্রতিভূর নামই মনু বা প্রজাপতি। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী ভারতে বেণরাজাই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইন্দ্রের বশ্যতা অস্বীকার করেন। ইলাবৃত-বর্ষ ভারতীয়দের আদি বাসস্থান বলেই অতি পবিত্র তীর্থভূমি বলে মনে করা হত। যুধিষ্ঠিরের সময়েও লোকে স্বর্গে তীর্থ করতে যেত। স্বর্গের পথ ক্রমে দুর্গম হয়ে পড়ে। কাশ্মীর থেকৈ তুর্কীস্থান যাবার যে বণিকপথ এখনও আছে, সেটাই স্বর্গে যাবার আদিপথ বা দেবযান-পথ বলে মনে হয়। উত্তরদেশের উচ্চ ভূমি এবং পর্বতও পরবর্তী কালে স্বর্গ নাম লাভ করেছিল।

ইলাবৃত-বর্ষ যে দেবতাদের বাসভূমি পুরাণে তা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। ইলাবৃত-বর্ষের মধ্যে যে মেরুপৰ্বত (এই মেরু পৃথিবীর অক্ষপ্রান্ত মেরু নয়), সেইখানেই দেবতাদের বাস ছিল। বায়পুরাণে আছে—বেদ-বেদাঙ্গ জানা পণ্ডিতেরা নাকপৃষ্ঠ, দিব, স্বর্গ ইত্যাদি পর্যায়বাচক শব্দে মেরুমহিমা কীর্তন করেন। এই গিরিতেই দেবলোক বিরাজিত বলে সমস্ত শ্রুতি বা বেদে বলা আছে—দেবলোকে গিরৌ তস্মিন্ সর্বশ্রুতিষু গীয়তে।

দিবি আরোহণ বা স্বর্গারোহণের কথাটা এখন এমনই শুনতে লাগে যে, স্বর্গ বুঝি মৃত পূণ্যাত্মাদের মরণোত্তর আশ্রয়ভূমি। আমাদের দেশে এই সেদিনও লোকে বুড়ো হয়ে গেলে জীবনের শেষ কদিন ভগবান বিশ্বেশ্বরের সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য কাশী যেতেন। আমরা পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদীকেও মৃত্যুর ঠিক আগে মহাপ্রস্থানিক পর্বে নিজের জায়গা ছেড়ে স্বর্গে আরোহণ করতে দেখেছি। যদিও যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ এবং তাঁরও পূর্বে ইলাবৃত বর্ষের স্বর্গ একেবারেই আলাদা। কেন তা বলছি পরে। কিন্তু এই যে মাঝে মাঝে পুরাণে-ইতিহাসে সশরীরে স্বর্গে যাবার কথাটা শোনেন, সেটা ছিল অনেকটাই মৃত্যুর পূর্বে সশরীরে কাশী যাবার মত।

বস্তুত স্বর্গ বলে একটা জায়গা নির্দিষ্টই ছিল এবং সেখানে যেতে হলে যেহেতু পাহাড়-নদী পেরিয়ে বন্ধুর পথে ওপরের দিকেই উঠতে হত, তাই স্বর্গে যাওয়াটা আমাদের কাছে যাত্রা মাত্র ছিল না, সেটা ছিল আরোহণ। ঠিক সেইজন্যই উত্তর আরও উত্তর দেশের উচ্চ ভূমি বা পর্বতই স্বর্গ বলে কল্পিত হয়েছিল। পণ্ডিতেরা মৎস্যপুরাণের প্রমাণ দিয়ে বলেছেন—পুরাকালে কোন এক ইন্দ্র সামরিক উদ্দেশ্যে দেবযান নামের বণিক্‌পথটি পাহাড় ফেলে ফেলে দুর্গম করে দেন। পুরাণ এই ইন্দ্রকে হীনচেতা অথবা ক্ষুদ্রাত্মা বলতে দ্বিধা বোধ করেনি। পুরাণ বলে—যখন থেকে ইন্দ্র আপন সংকীর্ণতায় বজ্র দিয়ে স্বর্গপথ রোধ করেন, তখন থেকেই মানুষের কাছে স্বর্গদ্বার রুদ্ধ হয়ে গেছে—তদা প্রভৃতি লোকানাং স্বৰ্গমার্গো নিবারিতঃ।”১০

লক্ষণীয় বিষয় হল, এক স্বর্গ রুদ্ধ হলেও আরেক স্বর্গ তৈরি হতে দেরি হয়নি আর্যরা যতদিন ইলাবৃত বর্ষের কাছাকাছি ছিলেন, তখন সেটাই স্বর্গ ছিল। কিন্তু কাশ্মীর থেকে আরও নীচে নেমে এসে ভারতের উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর ইলাবৃত স্বর্গের পথ তাঁদের কাছে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যুধিষ্ঠিরকে তাই বদরীনারায়ণ এবং মানস সরোবরের পথে স্বর্গে যেতে হয়েছে। স্বর্গের উর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করে ইন্দ্রসভা থেকে ফিরে এসে অর্জুন যেখানে ভাইদের সঙ্গে মিলেছিলেন, সেটা হিমালয়ের কোলঘেঁষা একটা জায়গা। অর্জুনের স্বর্গ থেকে সে জায়গা বড় দূরে নয়।

আমি যে তখন থেকে আপনাদের স্বর্গ চিনিয়ে দেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি, তার কারণ একটাই। আমার প্রস্তাবে দেবতারা উন্নত শ্রেণীর মানুষ এবং তাঁদের আবাসভূমি যে স্বর্গরাজ্য, সেও পৃথিবীর বাইরে কোন স্থান নয় ; মানুষের ভৌগোলিক জ্ঞানের সীমানার মধ্যেই সেই স্বর্গরাজ্যের ঠিকানা আছে। দূরে ফেলে আসা সেই ঠিকানার জন্য তাঁদের মনে ব্যাকুলতাও আছে। স্বর্গবাসী দেবতাদেরও পরলোকের চিন্তা সাধারণ মানুষের মতই। জীবনের সময় ফুরোলে পরলোকের ভাবনা এবং বিষাদ দুইই তাঁদের পেয়ে বসে—ইত্যৌৎসুক্যবিষাদেন। অন্যদিকে সংসারে থাকলে মায়ায় মমতায় যেমন আমাদের এই নশ্বর ভূমিখণ্ডটি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না, দেবতারাও তেমনই এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে পরপারে যেতে চান না। পুরাণকার বলেছেন—তাঁরা হলেন ‘ইহস্থানাভিমানিনঃ’, অর্থাৎ এই স্থান সম্বন্ধে তাঁদের মায়া জন্মে যায়।১১ তাহলে মানুষের মতই ভাবনা, বিষাদ আর মায়া নিয়ে যে দেবতারা মানুষের মনের উর্ধ্বলোকে বসে আছেন, তাঁদের আমার মতে মানুষই বলা ভাল।

সূত্র

‘বৃহদারণ্যক-উপনিষদ্‌’ পৃ. ৭০৬

‘মহাভারত’ ১.৩৭. ৩৫

৩ তদেব, ১ ৩৮. ১৭

‘মনুসংহিতা’, ৭. ৫

‘মহাভারত’, ১ ৩৭. ৫

তদেব, ১ ৩৭. ১২

‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ১৩৫, ৩-৪

‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৩৪. ২৯

‘মৎস্য-পুরাণম্‌’, ১১৪. ৭২

১০ গিরীন্দ্রশেখর বসু, ‘পুরাণপ্রবেশ’, পৃ. ২৩২-২৩৩ দ্রঃ মৎস্য-পুরাণম্‌, ১৯১ ১০-১১

১১ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৭. ২৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *