পান
সে বহু যুগ আগের কথা! রাজার নির্দেশে ধনপতিকে যেতে হবে সিংহলে। বহুদিন ওদেশ থেকে কোনও সওদাগর আসেনি। দেশে তাই গুয়ারের বড়ো অভাব! রাজা চিন্তিত! কীসে সাজা হবে তম্বুল, কী দিয়ে রাখবেন অতিথিদের মান? কাজেই, রাজ-নির্দেশে ধনপতি নৌকা ভাসালেন নোনাজলে। হাত পেতে নিতে হল রাজার দেওয়া তাম্বুল। সেইসঙ্গে শালবস্ত্র, লক্ষ মুদ্রা, তুরঙ্গ, বর্ম ও ফলা কাটারি। যথাসময়ে যাত্রা শুরু হল। পিছনে পরে রইল উজানিনগর, দুই স্ত্রী লহনা আর খুল্লনা।
তা হলেই ভাবুন, কেমন ছিল পানের কদর! আজও কিছু কমেনি! চব্য, চষ্য, লেহ্য, পেয় যতই উদরস্থ হোক, যতক্ষণ না মুখে পানটি পড়ছে, মন খুশ হয় না! বাঙালির বড়ো প্রিয় বন্ধু এই পান! বাঙালিরা মনে করেন, ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাবেদ চুনে। পানের খিলিতেই বাস করেন এই তিন দেবতা।
কিন্তু কোথা থেকে এল পান? পণ্ডিতদের মতে, পান অস্ট্রো-এশিয়াটিক। ইন্দো-আরিয়ান নয়। আদি ঠিকানা ফিলিপাইনস, সেবিস কিংবা জাভা, বোর্নি। তবে, ভারতীয়দের ধারণা, পান একান্ত স্বদেশি। যদিও আদিকালে পৃথিবীতে পান ছিল না! মহাভারতে পানের উৎপত্তির এক দিক নির্দেশ করা হয়েছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পানের জন্য দুনিয়া তোলপাড় করেন পঞ্চপাণ্ডব। হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে নানাদিকে খোঁজ পড়ে যায়। কিন্তু কোথাও পান নেই! খুঁজতে খুঁজতে সন্ধানীরা পৌঁছোন পাতালপুরীতে। সাপের রানির ঘরে। তখন বাসুকী তাঁদের খোঁজে সন্তুষ্ট হয়ে উপহার দেন হাতের কনিষ্ঠ আঙুল। সেই আঙুল মাটিতে পুঁতলে জন্মায় পানের বল্লরী। সে গাছের ফুল নেই, ফল নেই। কেবল কচি সবুজ পাতা। সংস্কৃতে তাই পানের আর-এক নাম ‘নাগবল্লরী’।
এখানেই শেষ নয়! অন্য গল্পও আছে। পুরাণে রয়েছে, সমুদ্রমন্থনে উঠেছিল হলাহল। সেই বিষের ভাণ্ড নিয়ে মহাবিপদে পড়েন দেবকুল! অবশেষে সেই বিষ গলায় ধারণ করে দেবাদিদেব হলেন নীলকণ্ঠ। বিষের জ্বালায় কিছুক্ষণের জন্য তিনি মূর্ছা যান। তখন তাঁর কপালের ঘাম আর শরীরের ময়লা জমানো হল তামার পাত্রে। সেই মিশ্রণ থেকে জন্মায় এক সুদর্শন পুরুষ। নারায়ণ তাঁর নাম রাখেন তাম্বুলপুত্র। জন্মানোর পর সে যায় নাগলোক। তার রূপে মুগ্ধ হয় নাগকন্যা। বিয়ে হয় দুজনের। জন্মায়, পানরূপী নাগবল্লরী। অনেকে আবার মনে করেন, অর্জুন স্বর্গ থেকে চুরি করে এনেছিলেন পানের চারা। পুঁতেছিলেন রাজবাড়ির বাগানে। সেখান থেকেই মর্তে পানের প্রচলন। কে জানে বাবা! কিন্তু ইতিহাস বলছে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা ভিয়েতনামি বই ‘লাইফ স্টোরি অব ট্যান অ্যান্ড ল্যাং’-এও পানের কথা লেখা আছে। সে তো মহাভারতেরও আগের লেখা।
পান এককালে ছিল খুবই দামি। মনসামঙ্গলে রয়েছে এমনই এক গল্প। চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য করতে গিয়ে উপস্থিত হন আজব এক দেশে। সপ্তডিঙা নোঙর হয়। সওদাগরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কোতোয়াল। সওদাগর তখন পান খেতে ব্যস্ত। সোনার বাটা থেকে পান-সুপারি-চুন দিলেন অতিথিকে। কোতোয়াল চুনকে দই ভেবে চেটে খেলেন, পান দিলেন ফেলে। চাঁদ বুঝলেন, এদেশের লোক পানের ব্যবহার জানেন না। ব্যবসায়ী বুদ্ধি উসকে উঠল। পানপাতার বদলে দেশে নিয়ে ফিরলেন হিরে-মানিক।
এ তো গেল পুরাণের গল্পকথা! বাস্তবেও রয়েছে পানের ঝুড়ি ঝুড়ি কিসসা ! আরবি হেকিম আতা ইবন আহামদ বলেছিলেন, পানের অনেক গুণ। দোষ একটাই, আরব মুলুকে আনতে না আনতেই পান শুকিয়ে যায়। উপায়? ইয়েমেন-এর লোকজন তাই এদেশ থেকে ওদেশ খাঁটি মধুতে ভিজিয়ে নিয়ে যেত পানপাতা। এতে পাতা শুকিয়ে তো যেতই না, উলটে হল আরও মিঠে। ১২৯৫ সালে মার্কো পোলো গুজরাতে আসেন। সেখানকার বাসিন্দাদের দাঁতের হাল দেখে অবাক হয়ে যান! লিখেছিলেন, এটা একধরনের পাতা চিবানোর ফল। সেই পাতা চিবোলে চেহারা খোলতাই হয়। পঞ্চদশ শতকে বিজয়নগর আসেন আবদুর রজ্জাক। রাজদরবারে পৌঁছোতেই রাজা তাঁর হাতে তুলে দেন সুগন্ধী পান। সিংহাসনের পাশে সবসময় থাকত মজুত তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী। হাতে নিয়ে তাম্বুল-সম্পুট। তাঁর ধারণা হয় : পান খুবই বলবর্ধক, আর ৭০০ মহিলাকে অন্তঃপুরে রেখেও রাজা যে এরকম ক্লান্তিহীন, তা এই পানের মহিমা। ১৫৪৮ সালে এদেশে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা। পান নিয়ে তিনি বলেন, ‘চিবুলে মুখ লাল হয়, দাঁত কালো। তা ছাড়া পান তৃষ্ণা হরে, মাথা ঠান্ডা রাখে।’ কিন্তু শেষে সাবধান করে দেন, কর্পূরের সঙ্গে পান খেলে পুরুষত্বের হানি হয়! সপ্তদশ শতাব্দীর ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চির অভিজ্ঞতা আবার একদম অন্য ঘরানার। পান খেয়ে মুখ রাঙানো লোকদের দেখে ওঁর দৃঢ় ধারণা হয় এদের ভয়ানক কোনও অসুখ করেছে। এরপর আবার এক মেমসাহেবের অনুরোধে প্রথম বার পান খেয়ে দাঁত ছিরকুট দিয়ে ভিরমি খেয়েছিলেন! একই শতকে আসেন গার্সিয়া ওরটা। পান সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতীয়রা সব সময়ই পান চিবুচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েরা। পানের সঙ্গে থাকে সুপারি, চুন, খয়ের, কর্পূর। লক্ষ করলে দেখবে, ওদেশের মানুষের বুড়ো আঙুলের নখ বড়ো। কেন-না, তাতে পানের শিরা ছিঁড়তে সুবিধা হয়। পান খুবই উপকারী। পানে মাথা সাফ, পেট সাফ, দাঁত ও মাড়ি অটুট।’ তবে পান খেয়ে মেয়েদের ঠোঁট রাঙানোর যে প্রথা, তা শুরু মুঘল রাজদরবার থেকে। শুরু করেন স্বয়ং নূরজাহান।
ইংরেজ ভারত ছাড়ল! দেশভাগ হল। চারদিকে হাহাকার, রক্তারক্তি! সেই দুঃসময়েও পাকিস্তান কিন্তু পানের কথা ভোলেনি। পান ছাড়া নাকি তাঁদের খাবার হজম হবে না! কাজেই, ভারত থেকে ওদেশে গেল পান! পান তৈরির সময় নখ বা বোঁটা দিয়ে পানের মাঝবরাবর ছিঁড়ে ফেলা হয়। খাওয়ার সময় দাঁত দিয়ে কেটে ফেলা হয় খিলির আগা। কিন্তু কেন? ফের দ্বারস্থ পুরাণের। মার্কণ্ডেয় পুরাণে রয়েছে, ‘পানের অগ্রভাগে পরমায়ু, মূলভাগে যশ এবং মধ্যে লক্ষ্মীর অবস্থান। সেইজন্যই এই তিন ভাগ ফেলে পান খেতে হয়। না হলেই গণ্ডগোল। মূলভাগ খেলে কঠিন রোগ, অগ্রভাগ খেলে হবেন পাপের ভাগী, কমবে আয়ু আর পানের বোঁটা খেলে নষ্ট হবে বুদ্ধি। পিকও ফেলতে হবে নিয়ম মেনে। পান-সুপারি-মশলায় তৈরি প্রথম রস বিষের মতো। দ্বিতীয় রস রেচন। তৃতীয় রসই হল অমৃত। সেজন্যই প্রথম দুবারের রস খাওয়া চলবে না।’
বাংলার লোককবিতা বা ছড়ায় বারবার এসেছে পানের অনুষঙ্গ—
আয় রঙ্গ হাটে যাই।
এক খিলি পান কিনে খাই।।
পানের ভিতর ফোঁপরা।
মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া। ।
বা
বাবু বলেছেন যেতে
পান সুপারি খেতে।
পানের ভিতর মৌরী বাটা
ইস্কাপনের ছবি আঁটা।
কিংবা
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?
ধান ফুরোল, পান ফুরোল, খাজনার উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।
শুধু পানই নয়, রয়েছে পানমশলা খাওয়ার নিয়মও। সকালের পানে থাকবে বেশি সুপারি, দুপুরের পানে খয়ের এবং রাতে চুন। সুপারি ছাড়া পান খেলে রেহাই নেই। দোষ কাটাতে যেতে হবে গঙ্গাস্নানে। না হলে পরের জন্মে জন্ম হবে চণ্ডালের ঘরে!
মেনুকার্ড এল কীভাবে?
১৯১১ সালের ৭ই মে। অতিথি-অভ্যাগতদের ভিড় উপচে পড়ছে ঠাকুরবাড়িতে, কারণ সেদিন কবিগুরুর ৫০তম জন্মদিন বলে কথা! খাওয়াদাওয়াটাও সেদিন হওয়া উচিত বেশ জম্পেশ! তাই হেমেন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে প্রজ্ঞা দেবী কবিগুরুর জন্য বানালেন একটা বিশেষ ধরনের বরফি, যার নাম দিলেন ‘কবিসম্বর্ধনা বরফি।’ যেমন নাম, তেমনই স্বাদ। খেয়ে তারিফ করেছিলেন সবাই। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও নাকি বুঝতে পারেননি, বরফির মূল উপাদান ছিল ফুলকপি!!! রেঁধেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজো মেয়ে, প্রজ্ঞা দেবী। রান্না নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট করে, দারুণ সব রান্না করে ফেলা, আর তাদের শ্রুতিমধুর সব নাম রাখা… এই ব্যাপারে দক্ষতার অধিকারিণী ছিলেন তিনি। আমরা আজকে কোনও ভোজসভায় যে মেনুকার্ড দেখি, বাংলার ভোজসভায় সেই মেনুকার্ড বা ‘ক্রমণী’ চালু করার পুরো কৃতিত্ব প্রজ্ঞার। লেখাটা সম্পূর্ণ তাঁর নিজের ভাষায়। ইংল্যান্ডের ভোজসভায় মেনুকার্ডের চল দেখে প্রজ্ঞা ঠিক করেছিলেন, বাংলার ধাঁচেও মেনুকার্ড বানাবেন। না ছাপালেও, হাতে সুন্দর করে লিখে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। এইরকম একটা ক্রমণী নিচে দিলাম–
‘জাফরানি ভুনি খিচুড়ি
ধুঁধুল পোড়া
শিম বরবটি ভাতে
পাকা আম ভাতে
পটলের নোনা মালপোয়া
পাকা কাঁঠালের ভূতি ভাজা
কাঁকরোল ভাজা
ভাত
অড়হর ডালের খাজা
লাউয়ের ডালনা
বেগুন ও বড়ির সুরুয়া
ছোলার ডালের ধোঁকা
বেগুনের দোল্মা
আলুবখরা বা আমচুর দিয়ে মুগের ডাল
পাকা পটলের ঝুরঝুরে অম্বল
ঘোলের কাঁঢ়ি
রামমোহন দোলমা পোলাও
নীচুর পায়স
নারিকেলের বরফি।’
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই, শোভাবাজার রাজবাড়ির কেশবেন্দ্র দেবের বিয়ের মেনুকার্ডে ৩৬ রকম মেনুর সন্ধান পাই। কিন্তু এই মেনুকার্ড এল কোথা থেকে? ইতিহাস বলছে চিন দেশে সং রাজবংশের সময় দিনের শেষে ব্যবসায়ীরা এসে হাজির হতেন রেস্তোরাঁতে। তাঁদের ইচ্ছেমতো খাবার বানানোর সময় থাকত না। তাই কিছু জনপ্রিয় খাবার বানিয়ে একটা লিস্টি বানিয়ে রাখা হত। সেখান থেকেই তাঁরা পছন্দের খাবারের অর্ডার দিতেন। ফরাসি শব্দ মেনুর উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন মিনিটুস থেকে, মানে ছোটো আকারে দেখা। ফরাসি রান্নার জটিলতা বেশি, তাই সহজ মেনুদের লিস্টি থাকে আ-লা-কার্ত-এ। এখানে দায়দায়িত্ব সব খদ্দেরের। আর রেস্তোরাঁর সেরা রেসিপি নিয়ে একেবারে শুরুর স্যুপ থেকে শেষের ডেসার্ট অবধি ফুল কোর্স ডিনারের নাম তাবল দ্যোৎ। এই অবধি বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু ১৯২২ সালে উইলিয়াল ক্রিস্টাল সাহেব ১১৮৬-এ মমি হওয়া সেতনাখত-এর মমির সমগে বেশ কিছু হায়রোগ্লিফের টুকরো খুঁজে পান। তা দেখে চিনারা একেবারে ব্যাকফুটে। কারণ সেগুলো আর কিছুই না, ভিন্ন খাবারের নাম লেখা মেনুকার্ড মাত্র।
ঠাকুরবাড়ির খাওয়াদাওয়া
ঠাকুরবাড়ির লোকেরা যথার্থ ভোজনরসিক ছিলেন। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হতেন না। ঠাকুরবাড়িতে পাকা আম ভাতে, পাকা পটলের টক, কাঁচা ও কচি তেঁতুলের ঝোল, বেগুন ও কাঁচাকুলের টক, তিল বাটা দিয়ে কচি আমড়ার অম্বল রান্না হত। রবি ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী পাকা আমের মিঠাই বানাতেন। শেষ পাতে দই ও সন্দেশ অপরিহার্য ছিল। মিষ্টির নানারকম নামও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একবার একটি মিষ্টি খেয়ে নাম দেন ‘এলোঝেলো’, পরে বদলে রাখেন ‘পরিবন্ধ।’
১৯১৩ সালে কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্যতালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে। এই খাবারের তালিকায় ছিল : গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস অ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম। বাইরে এই ধরনের খাবার খেলেও বাড়িতে তিনি কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেতেন। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তাঁর হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জানো সবরকম কলার মতো রন্ধনকলাতেও আমার নৈপুণ্য ছিল। একদা মোড়া নিয়ে রান্নাঘরে বসতাম এবং স্ত্রীকে নানাবিধ রান্না শেখাতাম।’ এভাবেই তৈরি হয়েছিল মানকচুর জিলিপি। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় তিনি স্ত্রীকে মানকচুর জিলিপি তৈরি করতে বললেন। মৃণালিনী প্রথমে হেসে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু খেয়ে দেখা গেল সেটা জিলিপির চেয়ে ভালো হয়েছে। কবি বললেন, ‘দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন শিখিয়ে দিলুম।’ কবিপত্নী হেসে বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে পারবে কে? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।’
স্বাস্থ্যসচেতন কবি নিজের খাদ্যাভাস নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। একবার এক বিদেশি বন্ধু এসে বললেন, ডিম হচ্ছে আসল খাদ্য। ওতে সব রকমের গুণ আছে। এরপর কী হল? রানী চন্দ লিখেছেন, ‘গুরুদেব কাঁচা ডিম ভেঙে পেয়ালায় ঢালেন, একটু নুন-গোলমরিচ দেন, দিয়ে চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলেন। রাতের খাবার, দিনের খাবার এই একভাবে চলে।’ একবার এক আয়ুর্বেদজ্ঞ বললেন নিমপাতার রস সর্বরোগনাশক। ব্যস, শুরু হয়ে গেল নিমপাতার রস খাওয়া। রানী চন্দকে বললেন, ‘বেশি ডিম খাওয়া ভালো নয়। বেশি কেন, ডিম একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। বরং নিমপাতার রস খাবি রোজ কিছুটা করে।’ ঠাকুরবাড়িতে প্রায়শই খামখেয়ালি সভা বসত। সেই সভায় কবি থাকতেন মধ্যমণি। সেই খামখেয়ালিপনা থেকেই হয়তো তিনি রাত দুটোর সময় মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন। শোনা যায় এই ঘটনা প্রায়শই ঘটত আর মাঝরাতে মৃণালিনী দেবী রান্না করে রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতেন। কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। এ ছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি। এখানেই শেষ নয়, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তাঁর নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালনী তাঁকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠাকুরবাড়িতে রক্ষিত আছে। ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হত। রান্নার তালিকায় প্রতিদিনই দীর্ঘ পদ থাকত। আর তাতে নিয়মিত অবশ্যই থাকত শুক্তো আর দইমাছ।
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী নিজে রান্না না করলেও রন্ধন বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ভালো কিছু খেলেই তার রেসিপি লিখে রাখতেন লাল একটা খাতায়। পরে পুর্ণিমা ঠাকুর সেই খাতাটি উপহার পেলে, খাতার রেসিপি আর তাঁর মা নলিনী দেবীর রেসিপি মিলিয়ে ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ নামে দারুণ একটা বই লেখেন। এখানে স্যালাড, চাটনি আর মিষ্টি তৈরির নানা অভিনব পদ্ধতির কথা বলা আছে। রেণুকা দেবী চৌধুরানীও ‘রকমারি আমিষ রান্না’ ও ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ নামে দুটি উচ্চমানের কুকবুক লিখেছেন, যা আজও গৃহিণীদের একান্ত উপযোগী। এই বইতে চাং পাঁঠা রান্নার কথা আছে। মায়ের দুধ ছাড়িয়েই তাকে মাচার উপর বেঁধে প্রচুর ছোলা ঘাস ইত্যাদি দেওয়া হয়। নড়াচড়া না করার জন্য তার মাংসের আঁশ শক্ত হয় না। খাবার উপযুক্ত হলে তাকে মাচা থেকে নামিয়ে খাওয়া হয়। উনষাট রকম ভাজা কিংবা দইভাত খাইয়ে হাঁসকে রন্ধন-উপযোগী করে তোলার কথা রেণুকা দেবীই প্রথম বলেন।
বাঙালির কুকবুকের উপাখ্যান
মুজতবা আলী সাহেব ঠিক বলেছিলেন। এমন কেউ নেই যে খেতে ভালোবাসে না। শুধু এখানেই থামেননি। এটাও বলেছিলেন, ‘খাদ্যের হাজারো প্রকার থাকলেও খাদক মূলত দুই প্রকারের। ভোজনপটু ও ভোজনবিলাসী। ভোজনবিলাসীরা হরেকরকমের খাবার সামনে থাকলেও বেছে বেছে খায়। আর ভোজনপটু যারা তাদের কোনো বাছ-বিচার নেই। আহার উপযোগী হাতের কাছে যা পায় তাই টপাটপ হজম করে। ভরা পেটেও খাওয়া শুরু করে।’ এখানে অবশ্যি আলী সাহেবের ফরাসি জ্ঞান কিঞ্চিৎ কাজে এসেছে। ফরাসিতে খুব কাছাকাছি দুটো শব্দ আছে— গুরমাঁ আর গুর্মে। গুরমাঁ হলেন তাঁরা, যাঁরা খাবার জন্য বাঁচেন। স্বাদ গন্ধের সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁদের প্রায় নেই বললেই চলে। যা পান, গোপাল অতি সুবোধ বালকের মতো তাই চেটেপুটে খান। যতদিন বেঁচে থাকেন, নিজের (এবং অন্যের ক্ষতি করে) প্রবলভাবে খেয়ে যান। গুর্মেরা একেবারেই উলটো। পরিমাণ নয়, খাবার গুণাগুণই তাঁদের কাছে একমাত্র বিচার্য। তবে অনেকদিন অবধি খাওয়া ব্যাপারটা একেবারেই ঘরোয়া ছিল। নবাবদের খাস বাবুর্চি থাকতেন পাকশালায়। তবে শুরুতেই ব্যাপারটা এমন ছিল না। এই যে মোগলাই খানা নিয়ে এত নাচানাচি, সেই মোগলদের প্রথম সম্রাট বাবর তিনবেলা মাংস ঝলসে খেতেন। কাঠি গাঁথা সেইসব ভেড়ার মাংস খুলে খুলে খেতে হত। তবে সেই সময়ের এক পর্যটক এই মাংস খেয়ে ‘অতিরিক্ত তৈলাক্ত আর বিস্বাদ’ বলেছিলেন, সে কথাও ভুললে চলবে না। মসলা জারিয়ে পরের সম্রাটরা যে রাজকীয় খানা খেতেন, তা বাবরের কপালে জোটেনি, বোঝাই যাচ্ছে। হিন্দু রাজারাও যে শুধু শাক লতাপাতা খেয়ে থাকতেন তা নয়। দ্বাদশ শতকে চালুক্য রাজা সোমেশ্বর খাসা একটা বই লিখেছিলেন, নাম ‘মানসোল্লাস’। সেই বইতে ঝাল ঝাল দই দিয়ে ডালের বড়া, এলাচ দিয়ে ভাজা শূকরের মাংস, ঝলসানো লেজ, কচ্ছপের মাংসের চিপস (তা নাকি ভাজা কলার মতো খেতে লাগত)-এর কথা বলা আছে। তবে রাজার ফেভারিট ছিল কাঁচা আম আর লবণ সহযোগে ঝলসে রাঁধা ধেড়ে ইঁদুরের মাংস। রাজা নিজে এই খাবারের কী প্রশংসা করেছেন কী বলব! এ যেন মনের শান্তি, প্রাণের আরাম।
জৈন আর বৌদ্ধরা এসে ভারতীয়দের মাংস খাবার বাই বেশ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল এক ঝটকায়। যত নিরামিষ রান্না, সব কিছুর শুরু ওই সময় থেকে। বাবর যখন এলেন, ততদিনে অর্ধেক ভারত স্ট্রিক্টলি ভেজ হয়ে গেছে। যত দিন গেছে মোগলাই খাবারের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। এর পরে পরে পর্তুগিজরা এলে ভারতীয় খাওয়াতে অনেক নতুন নতুন জিনিস আমদানি হল। তারা ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক ফলমূল ও শুকনো খাবার এদেশে নিয়ে এসেছিল। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল গোল আলু। পর্তুগিজদের নিয়ে আসা আর-একটি জিনিস, যা ভারতবর্ষের লোকেরা লুফে নিয়েছিল, তা হল লংকা। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই অদ্ভুত ফলটি। এর আগে কি বাঙালি ঝাল খেত না? খেত। তবে সেটা লবঙ্গের ঝাল। অনেকে বলেন লংকা ভারতের হেঁশেলে ঢুকতে পেরেছিল তার একমাত্র কারণই হচ্ছে লবঙ্গের সঙ্গে তার চেহারার মিল।
রান্না নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট চলছিল চারদিকে। কিন্তু যাকে বলে কুকবুক বা রান্নার বই, তেমনটি একটিও ছিল না। বিলেতে প্রথম ঠিকঠাক কুকবুক বানান এক কবি। কারা যেন বলে, “কবিরা আমাদের পেট ভরান না। তা বলে কি কবিতা পড়ব না!” ডাহা মিথ্যে কথা। আমরা যে এখন দুবেলা দুটি ভালোমন্দ খেয়ে বেঁচে আছি, সেও এক কবির জন্যেই। এক মহিলা কবি। নাম এলিজা অ্যাকটন। ভদ্রমহিলা কেন্টে থাকতেন। কবিতা মন্দ লিখতেন না। কিন্তু যা হয়, কবিতার বইয়ের বিককিরি নেই। প্রকাশক বলল, “ম্যাডাম, কিছু বাজারি বিষয় চেষ্টা করুন না।” এলিজা খেয়াল করলেন বাজারে অনেক রান্নার বই আছে। কিন্তু কোনোটাই ঠিক বিজ্ঞানসম্মত না। উপাদান ও পরিমাণের জায়গায় “পরিমাণ মতো ময়দা” বা “বেশ খানিক দুধ” বলে দায়সারা কাজ চলছে। তিনি এবার উঠে পড়ে লাগলেন। প্রতি উপাদানের ওজন, রান্নার সময় বেঁধে দিলেন কাঁটায় কাঁটায়। নিক্তি মেপে। যেভাবে গবেষণাগারে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। আর দাবি করলেন তাঁর পদ্ধতি মানলে “anybody can cook”। ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ক্লাসিক বই ‘MODERN COOKERY FOR PRIVATE FAMILIES’। প্রকাশমাত্রে বেস্টসেলার। রান্নাঘরে কিচেন স্কেল চালু করল এই বইটিই। পরে প্রজ্ঞাসুন্দরী থেকে লীলা মজুমদার হয়ে বেলা দে… রান্নার বই লিখতে গিয়ে জেনে না-জেনে সবাই এলিজার দেখানো পথেই হেঁটেছেন। এরপরেও কে বলে যে কবিরা পেট ভরাতে পারে না? বাংলা তথা ভারতের প্রথম কুকবুক অবশ্য এর কিছু আগে লেখা। বর্ধমানের রাজা মহতাবচাঁদ, বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্য নামে এক ব্রাহ্মণকে দিয়ে ‘পাকরাজেশ্বর’ নামে এক রান্নার বই লেখান। কেমন ছিল সেই বই? এই বই নিয়ে পত্রিকায় বেশ খটমট বাংলায় লেখা হয়েছিল—
( ১ অক্টোবর ১৮৩১ । ১৬ আশ্বিন ১২৩৮ ) নূতন গ্রন্থ। পাক রাজেশ্বর .এই দেহধারণের মূলাধার আহার অতএব সৰ্ব্বোপভোগযোগ্য মানবের নিমিত্ত অন্নপূর্ণ রূপ ধারণপূর্বক অম তিক্ত মধুর লবণ কটু কষায় ষড্রসযুক্ত চৰ্ব্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় ভক্ষ্য ভোজ্য দ্রব্যসকল সাত্বিক রাজসিক তামসিক ত্রিবিধ প্রকার বিভাগ করিষা অন্নদাস্থপনামক শাস্ত্র প্রকাশ করিলেন । ঐ শাস্ত্ৰ সৰ্ব্বসাধারণ বোধের কঠিনতাপ্রযুক্ত তৎকৰ্ম্ম স্বনিম্পন্নাভাবে প্রচণ্ড প্রতাপবান সকল গুণ নিধান শ্ৰীমান মহারাজ নল মহাশয় এবং পাগুৰীয় ভীমসেন ও দ্ৰৌপদীপ্রভৃতি স্বস্বনামে স্থপশাস্ত্র প্রকাশ করিয়াছেন এবং উত্তরোত্তর সুগমোপায় নিমিত্ত অনেকশনেক মহামহোপাধ্যায় মহাশয়েরা নানাবিধ কুতুহলনামে স্থপশাস্ত্র প্রকাশে স্থলভাধিক্য করিয়াছেন। তৎপরে জবনাধিকারে ঐ সকল স্থপশাস্ত্রহইতে প্রয়োজনমতে কিঞ্চিৎ২ সংগৃহীত হইয়া পারসীয় ভাষাতে গ্রন্থ প্রস্তুত হইয়াছে। এইক্ষণে হিন্দুরাজ্য বহুকালাবধি ভ্ৰষ্ট হওয়াতে ঐ সকল সংস্কৃত স্থপশাস্ত্র এতদ্দেশে প্রায় লোপ পাইয়াছে । অতএব মহানুভব শ্ৰীযুত বিক্রমাদিত্য মহারাজাধিকারে সংস্কৃত স্থপশাস্ত্র সংক্ষেপ সংগ্ৰহকৰ্ত্ত শ্ৰীযুত ক্ষেম শৰ্ম্মকৃত ক্ষেমকুতুহলনামক গ্রন্থ হইতে ও শ্ৰীযুত শাহজহান বাদশাহের নিত্য ভোজনের নেয়ামৎখাননামক পারসীয় পাকবিধি ও নওয়াব মহাবতজঙ্গের নিত্য ভোজনের পাক বিধিহইতে সাধারণের দুষ্কর পাক পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক স্থলভ পাক যাহা অনায়াসে সম্পন্ন হয় তাহ গ্রহণ করিয়া এবং বর্তমান অনেকানেক স্থপকুশল ব্যক্তিদিগের নিকট জ্ঞাত হইয়। বিষয়ি ব্যক্তিসকলের সুগমবোধার্থ পরিমাণ সহ পাকবিধি এবং ভক্ষণজন্য অজীর্ণ হইলে দ্রব্যাস্তর ভক্ষণে আশুপ্রতিকারক জীর্ণমঞ্জরী গ্রন্থ এবং তদৰ্থ সংস্কৃত মূল সহ গদ্য পদ্য রচনাতে পাক রাজেশ্বর নাম প্রদানপূর্বক গৌড়ীয় সাধুভাষাতে গ্রন্থ । প্রস্তুত করিলাম ইতি –সং চং ।
১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয় গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘ব্যঞ্জনরত্নাকর।’ এই দুই পণ্ডিতের লেখায় মাংসের কথা উঠে এসেছে বারবার। ‘পাকরাজেশ্বর’-এ প্রলেহ অর্থাৎ কোর্মা তৈরির প্রণালী রয়েছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে নানাবিধ মাংসের কথা। যেমন মেষ, কচ্ছপ, হরিণ, খরগোশ। তারপর তিলের তেল সহযোগে ছাগলের মাথা ও নাড়ির রান্নাকৌশলের কথা বলা হয়েছে।
গৌরীশঙ্করের ‘ব্যঞ্জনরত্নাকর’-এ পাবেন মাংস পরিষ্কারের কথা— ‘লোমসহ চর্ম্ম দূর করণের পর উদরসহ মূত্র পুরীষ ও পিত্তস্থলী এবং নাড়ি ইত্যাদি ত্যাগ করিবে, পরে ওষ্ঠ দণ্ড চক্ষূ কর্ণ ক্ষুর ও চরণ আদি ত্যাগ করিবে।’ নাড়ি রন্ধনে নিজেকে আরও পটু করে তুলতে চাইলে তাতে যোগ করুন ঘি, গরম মশলা, আদা, পেঁয়াজের ফোড়ন। রয়েছে করলা বা বেগুনের শুক্ত প্রলেহ, মাংস দিয়ে লাউ অথবা ঝিঙে। শসা বা কাঁকুড়ের শাঁস বের করে তাতে মাংসের পুর ভরে যে কাবাবটির কথা বলা হয়েছে, সেটাও অত্যন্ত সুস্বাদু।
এই দুই বইয়ের পরেই ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক প্রণালী’ আর ১৯০২-তে ‘মিষ্টান্ন পাক।’ আর কী অদ্ভুত সব পাক!! ‘রুটি টুকরা টুকরা আকারে কাটিয়া, এক একখানি টুকরা কোন পাত্রে সাজাইয়া রাখ। অনন্তর, সর কিংবা গাঢ় দুগ্ধ প্রত্যেক টুকরার উপর এক এক চামচ বা ঝিনুক ঢালিয়া দাও। এক ঘণ্টা পরে, এই রুটির টুকরাগুলি পূৰ্ব্বোক্ত নিয়মে খাঁটি মাখনে ভাজিয়া লও, এবং গরম গরম অবস্থায় পরিবেষণ কর। চিনির সহিত এই টুকরা খাইতে অতি সুখাদ্য।’ হিন্দু, অহিন্দু, আমিষভোজী, নিরামিশাষী সবার জন্যেই এই বই লেখা হয়েছে। শুধু ধনী নয়, সাধারণ মানুষও যাতে এই বই মেনে রান্না করতে পারে, তার সন্ধান লেখক দিয়েছেন। তাঁর মতে রান্না তিনরকম, ‘সহজ, উৎকৃষ্ট এবং রোগীর উপযুক্ত রন্ধন। তবে সর্বাগ্রে উচিত ভোক্তার জীবনের প্রতি মমতা।’ অন্ন প্রস্তুতেরই সাতরকম প্রণালী আছে এই বইতে, যার মধ্যে বড়ি ভাতে আর বেতের ডগা ভাতে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ষোলো রকমের খিচুড়ি, ছিয়াত্তর রকমের পোলাও, একুশ রকম ঘণ্ট, এগারো রকমের চচ্চড়ির কথা নেহাত বাদই দিলাম। তবে রসগোল্লার কোর্মা কীভাবে রাঁধতে হবে, জানতে গেলে এই বই আপনার অবশ্যপাঠ্য।
এর পরপরই প্রকাশ পায় প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ম্যাগনাম ওপাস ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার।’ তাঁর বাবা হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন রসায়নবিদ। রন্ধনকে তিনি বিজ্ঞান হিসেবে দেখতেন। মূলত বাবার ইচ্ছেকে রূপ দিতেই তিনি এই বইটি লেখেন। পরে অসামিয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ‘পুণ্য’ পত্রিকার সম্পাদিকা প্রজ্ঞাসুন্দরী, নানা কাজের ফাঁকে রান্না চালিয়ে যেতেন, আর তাঁর স্বামী সেগুলো পরখ করে দেখতেন। মূলত তাঁর উৎসাহেই ১৯০০ সালে বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশ পেল। মোট তিন খণ্ডের বইটিতে প্রায় আড়াই হাজার বিভিন্ন পদের প্রস্তুত প্রণালী লিপিবদ্ধ রয়েছে। শুধু রান্নাই না, রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন রাখা, দাস দাসী নির্বাচনে সতর্কতা, উনুন তৈরি, বঁটির ব্যবহার, সব বিষয়েই নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বারবার বলেছেন যাতে কোনও কিছু নষ্ট না হয় সেদিকে নজর দিতে, ‘অল্প ব্যয়ে যিনি সুশৃঙ্খলায় সংসার চালাইতে পারেন, তিনিই সুগৃহিণী।’ শুধু এখানেই শেষ নয়, রান্না বিষয়ে একটি পরিভাষার তালিকাও প্রস্তুত করেন তিনি। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক—
১। কাঁটা মারা— লেবু ইত্যাদির ভিতরে নুন ঢুকিবার জন্য একটা কাঁটা দিয়া বিধান
২। গাঁধর চর্বি— কাঁচা মাংসের ভিতরে ফ্যাকাশে লাল রঙের চর্বি
৩। চমকান— শুকনো খোলায় অল্প ভাজা
হেমেন্দ্রনাথের অন্য মেয়ে সুনৃতাও ‘পুণ্য’ পত্রিকায় বিভিন্ন রকম আচারের প্রণালী প্রস্তুত করতেন। একই সময় প্রকাশ পেয়েছিল কিরণলেখা রায়ের ‘বরেন্দ্র রন্ধন ও জলখাবার’, নীহারমালা দেবীর ‘আদর্শ রন্ধন শিক্ষা’ আর বনলতা দেবীর ‘লক্ষীশ্রী’। একই ধারায় লেখা লীলা মজুমদারের ‘রান্নার বই’ আমাদের মন জয় করেছে। ইদানীং কালে রান্নার যে কটা বই লেখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমার ঠাকুমা দিদিমার রান্না’ বা এসো বসো আহারে’ বই দুটি বেশ অন্যরকম। এখানে কমলালেবু দিয়ে কই মাছ, আনারস দিয়ে ইলিশ মাছ, আম দিয়ে মুরগি বা বিনা দুধের পায়েস, লিচুর পায়েসের রেসিপি বলা আছে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে রান্নার বইকে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন একজনই। তিনি বেলা দে। ট্রেন থেকে শুরু করে পাড়ার ছোটো বইয়ের দোকান… সব জায়গায় তাঁর উপস্থিতি। এমন কোনও বাঙালি পরিবার আছে কি, যেখানে বেলা দে-র লেখা অন্তত একটা কুকবুক নেই!
খাওয়াদাওয়া বা খাদ্যসংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর বইও লেখা হয়েছে। এখুনি আমার মনে পড়ছে সমীর দাশগুপ্তের ‘সুখাদ্যের সন্ধানে’, শংকরের ‘রসবতী’, দেবী ঘোষের ‘বাঙালির রসনাবিলাস’ কিংবা প্রতাপকুমার রায়ের ‘সুখাদ্য সুবচন’ আর ‘মহাভোজ রাজভোজ’-এর কথা। শেষ বইটি একটি মহাগ্রন্থ বিশেষ। তাঁর ভাষার গুণে সাবিরের রেজালা, উজ্জলার চানাচুর, চাং-ওয়ার চাউমিন কিংবা উদিপির দোসার স্বাদ যেন মুখে এসে লাগে। বুদ্ধদেব বসুও তাঁর লেখায় রান্নার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও গুণাগুণ নিয়ে লিখে গেছেন। অতি সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ফুড ব্লগার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর ‘ফুড কাহিনি’। একেবারে আটপৌরে ঢঙে, যেন গল্প করছেন এইভাবে, তিনি আমাদের এক আশ্চর্য যাত্রায় নিয়ে চলেন। যে যাত্রা খাদ্যের ইতিহাস ভূগোলের (কিছুটা বিজ্ঞানেরও)। আজ অবধি বাংলায় খাবারদাবার নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ আলোচনা করেছেন কী খাব না খাব নিয়ে, কেউ খাবারের ইতিহাস নিয়ে, কেউ কোন খাবার কোথায় ভালো তাতে ফোকাস করেছেন, আর অধিকাংশ নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন রেসিপিতে। লাহিড়ী মশাই বাংলার নানা চেনা অচেনা খাবার আর সেই খাবারের সুলুকসন্ধান দিয়ে এই বই লিখেছেন। কী নেই তাতে! চৈনিক, মোগলাই, ভাজাভুজি, বিরিয়ানি, আম, পাইস হোটেল, বড়োবাজারের গোপন ঠেক, দিঘা আর পুরীতে।
ব্যাস! আর কী চাই? জোগাড় করে ফেলুন এর যে-কোনো একটা ( আমি তো বলব সব কটা) বই। আর ঘরেই রাঁধুন কিংবা বইতে বলা জায়গায় গিয়ে কবজি ডুবিয়ে খান, সেটা নিতান্ত আপনার ব্যাপার।
ফুড ইজ নাও রেডি টু সার্ভ….
.
এডওয়ার্ড লিয়রের আজব রেসিপি
১৮৭০ সালের ননসেন্স গেজেটে এডওয়ার্ড লিয়র কাল্পনিক এক অধ্যাপক ভোসের তিনখানি রন্ধনপ্রণালী প্রকাশ করেন। নাম ছিল ননসেন্স কুকারি। শুরুতে গ্রাম্ভারি একখানা ভুমিকাও ছিল-
“আমাদের পাঠকরা বিশ্ববিখ্যাত উদ্ভিদবিদ অধ্যাপক ভোসের নিম্নলিখিত তথ্যপূর্ণ রচনাবলীতে আগ্রহ বোধ করিতে পারেন। প্রাথম তিনটি প্রবন্ধেই তিনি রন্ধন বিষয়ে নানা উপাদেয় কথা যাহা লিখিয়াছেন, উহা প্রতিটি পরিবারের রন্ধনের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়। সেই কারণে ডাক্তার ভোসের নবতম আবিস্কারসমূহের সচিত্র বিবরণ তাঁহারই সৌজন্যে প্রকাশ করা হইল”।
পড়লেই লিয়রের ফাজলামোটা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিশ্বসাহিত্যে রেসিপি নিয়ে এমন লেখা বিরলতম। তাই নোলার পাঠকদের এমন লেখার সঙ্গে পরিচয় না করিয়ে দিয়ে পারলাম না।
গার্হস্থ্য রন্ধনের তিনখানি উপায়
লম্ব- হংস পিঠা তৈরি
ঠিক চার পাউন্ড (মানে ওই সাড়ে চার পাউন্ড মত) খুব টাটকা দেখে একখানা লম্ব হংস নাও, আর ছোট্ট দেখে একটা মাটির পাত্রে রাখ। এবারে জল ঢেলে সেটাকে ডোবাও আর আট ঘন্টা ধরে ক্রমাগতঃ ফুটিয়ে যাও আর ফুটিয়ে যাও। চার ঘন্টা ফোটানোর পরে যখন মনে হবে হংসটা বেশ নরম সরম হয়েছে, তা নামিয়ে বড় একখানা পাত্রে রাখ। আর হ্যাঁ, ভালো করে খেয়াল রেখ যেন সেটা ঠিকঠাক ঝাঁকানো হয়।
এবার কটা জায়ফল গুঁড়ো করে তাঁর ওপরে ছড়িয়ে দাও, তারপর লাগাও তাতে আদাপিঠে, কারি পাউডার আর গোলমরিচের পুরু প্রলেপ। এবার পাত্তরটা ধরে মেঝেতে ঠকাস করে নামিয়ে রাখো। দেখবে ঠকাস যেন একেবারে নির্ভুল হয়। ফের ওটাকে আগের ঘরে নিয়ে এসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সিদ্ধ হতে দাও। এবারে পাত্তরটা ধরে জোরে জোরে নাড়া দাও, যতক্ষণ না লম্ব-হংসের রঙ হালকা বেগুনি না হয়।
পুরো জিনিসটা কাদার মত নরম হয়ে গেলে তাতে একটা ছোট্ট পায়রা, দুইপিস গোমাংস, চার পিস ফুলকপি আর যতগুলো পার শামুক ধীরে ধীরে একসঙ্গে মিলিয়ে দাও। ভাল করে দেখ রাখ ওপরের পর্দা পড়তে শুরু করেছে, তারপর মাঝেমাঝেই একটিপ করে নুন ছিটিয়ে দাও।
এবারে তৈরি হয়ে গেল লম্ব- হংস পিঠা। পরিস্কার পিরিচে সাজিয়ে সকলকে পরিবেশন কর। এমন মজাদার খাবার একেবারে চেটেপুটে- না, মুখে দেবার আগে যত তাড়াতাড়ি পার, পিরিচশুদ্ধু খাবারটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বাঁচো। বাপস্ রে!!
বিচূর্নিত কাটলেট তৈরি
কটা লম্বা লম্বা ফালির মাংস জোগাড় কর। এরপর যতদূর সম্ভব ছোট ছোট করে সেগুলোকে টুকরো টুকরো কর। সেই টুকরোগুলোকেই এরপর আট নয় ভাগে কাট। এগুলো যখন পাওয়া গেল, তখন কাপড়ের তৈরি একটা ব্রাস দিয়ে চটপট ঝেড়ে নাও। তারপর একটা নুনের চামচ কিংবা ঝোলের হাতা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চারিদিকে ঘাঁটতে থাক।
পুরোটাকে একটা সসপ্যানে ঢেলে রোদ্দুরে রাখ। (ছাদে যদি চড়াই বা ওই জাতীয় অন্য কোন পাখির উৎপাত না থাকে তাহলে ছাদেই মেলে দেওয়া ভাল।) ওই অবস্থায় হপ্তাখানেক রেখে দাও।
হপ্তা কেটে গেলে একটু ল্যাভেন্ডার, কিছুটা বাদাম তেল, হেরিং মাছের কয়েকটা কাঁটা ভাল করে মিশিয়ে নিয়ে চার গ্যালন পরিশ্রুত ব্রাস্কোবোলিয়াসের চাটনিতে চুবিয়ে রাখ। ব্যাস! জিনিসটা তৈরি!! বাকি শুধু কেটেকুটে কাটলেটের ছাঁচে আনা।
এখন পরিস্কার টেবিল ক্লথ কিংবা ডিনার ন্যাপকিনে সাজিয়ে সকলকে পরিবেশন কর।
মাংসের প্যাটিস তৈরি
তিন চার বছরের একটা বাচ্চা শুয়োর নাও; তাঁর পেছনের পা একটা খুঁটিতে শক্ত করে বাঁধ। এখন তাঁর নাগালের মধ্যে রাখ পাঁচ পাউন্ড কিশমিশ, তিন পাউন্ড চিনি, দুই ঝুড়ি কড়াইশুঁটি, আঠেরোটা পোড়া আখরোট, একটা মোমবাতি আর ছয় টুকরো পালং শাক। যদি দেখ যে শুয়োরটা এগুলো আরামসে খাচ্ছে, তবে ক্রমাগত এর জোগান দিয়ে যাও।
এবার একটু ননী, কয়েক টুকরো পনির, চার দিস্তে ফুলস ক্যাপ কাগজ আর কালো পিনের একটা প্যাকেট জোগাড় কর। এগুলো একত্রে লেই বানাও, আর একটা পরিস্কার সুতির কাপড়ে মেলে শুকোতে দাও। যতক্ষনে লেইটা পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে, ততক্ষন অবধি একটা মস্ত ঝাড়নের হাতল দিয়ে শুয়োরটাকে বেধড়ক পেটাও। যদি সে ব্যাথায় চিৎকার করে, তবে তাঁকে আরও পেটাও।
লেইটাকে একবার দেখে এস, আবার শুয়োরটাকে পেটাও। এইভাবে চলুক কয়েকদিন। ওই সময়ের শেষে দেখ সবটাই রগরগে প্যাটিসে পরিনত হয়েছে কি না। যদি ততক্ষণও তা না হয়, তবে যেন আর কোনকালেই হবে না। তবে আর কি! শুয়োরটাকে ছেড়ে দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটাই খতম হল বলে ধরে নিতে পার।
.
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
বাংলা বই
ঘোষ, দেবী, বাঙালির রসনাবিলাস (বেস্টবুকস, ২০০৬)
ঠাকুর, পূর্ণিমা, ঠাকুরবাড়ির রান্না (আনন্দ, ২০১৪)
তর্কালঙ্কার, বিশ্বেশ্বর, তর্কবাগীশ গৌরীশঙ্কর, পাকরাজেশ্বরঃ ও ব্যাঞ্জনরত্নাকর (সুবর্ণরেখা, ১৯৯৯)
দাশগুপ্ত, সমীর, সুখাদ্যের সন্ধানে (সুবর্ণরেখা, ২০০১)
দে, বেলা, রান্নাবান্না (পাত্রজ, ২০১২)
দেবী, প্রজ্ঞাসুন্দরী, আমিষ ও নিরামিষ আহার (১ ও ২) (আনন্দ, ১৯৯০)
ভট্টাচার্য সান্যাল, রামকৃষ্ণ, এবং তাপস, অনার্য (সম্পা), নুনেতে ভাতেতে, খাদ্য সংস্কৃতি বিষয়ক সংকলন (দি ক্যাফে টেবল, ২০১৬)
নুনেতে ভাতেতে ২, হারিয়ে যাওয়া খাবারের গল্প (২০১৭)
ভট্টাচার্য, পিনাকী, খানাতল্লাশি (আনন্দ, ২০১৮)
ভৌমিক, হরিপদ, রসগোল্লা, বাংলার জগত মাতানো আবিষ্কার (গাংচিল, ২০১৫)
মুখোপাধ্যায়, দামু, পাহাড়ে আহারে (৯ঋকাল, ২০১৯)
মুখোপাধ্যায়, বিপ্রদাস, পাক প্রণালী (আনন্দ, ১৯৯৮)
-মিষ্টান্ন পাক (প্রকাশক অজ্ঞাত)
মজুমদার, লীলা, এবং চট্টোপাধ্যায়, কমলা, রান্নার বই (আনন্দ, ২০১০)
বন্দ্যোপাধ্যায়, শতরূপা, আমার ঠাকুমা-দিদিমার রান্না (আনন্দ, ২০১২)
রায়, প্রতাপকুমার, মহাভোজ রাজভোজ (আনন্দ, ২০০২)
সুখাদ্য সুবচন (নবপত্র, ২০০১)
লাহিড়ী, ইন্দ্রজিৎ, ফুড কাহিনি (বুকফার্ম, ২০১৯)
শংকর, রসবতী (দেজ, ২০০০)
ইংরাজি বই-
Blake, Anthony, and Crewe, Quentin, Great Chefs of France, (H. N. Abrams, 1978)
Burrow, John, A History of Histories (Allen Lane, 2007) Chapman, Pat, Curry Club Balti Curry Cookbook (Piatkus Books, 1997)
Collingham, Lizzie, Curry: A Tale of cooks and conquerors (Vintage Books, 2006)
-The Hungry Empire (Vintage Books, 2018)
David, Elizabeth, English Bread and Yeast Cookery (Viking, 1977)
-French Country Cooking (John Lehmann, 1951)
-French Provincial Cooking (Penguin Books, 1960)
-Mediterranean Food (John Lehmann, 1950)
Davidson, Alan, The Penguin Companion to Food (Penguin Books, 2002)
Grigson, Jane, English Food (Macmillan, 1974)
Fish Cookery (David & Charles, 1973)
Vegetable Book (Michael Joseph, 1978)
Jack, Albert, What Caeser Did for My Salad (Penguin Books, 2012)
Kulansky, Mark, Salt: A World History (Penguin Books, 2002)
Lee, Christopher, This Sceptered Isle (Penguin, 1998) Montagne, Prosper, Larousse Gastronomique: The World’s Greatest Cookery Encyclopedia, ed. Jennifer Harvey Lang, third English Edition (Clarkson Potter, 2001)
Odya Krohn, Norman, Menu Mystique: The Diner’s Guide to Fine Food & Drink (Jonathan David, 1983)
Saulnier, Louis, Le Repertoire de la cuisine, tr. E. Brunet, seventeenth edition (Leon Jaeggi & Sons, 1982)
Shaida, Margaret, The Legendary Cuisine of Persia (Interlink Books, 2002)
Smith, Drew, Modern Cooking (Sidgwick & Jackson, 1990) Swinnerton, Jo, The Cook’s Companion (Robson Books, 2004)
Tannahill, Reay, Food in History (Penguin Books, 1973) Wilson, C. Anne, Food and Drink in Britain (Constable, 1974) (ed.), Traditional Food East and West of the Pennines (Edinburgh University Press, 1991)