পেঁয়াজের কথা
বেদ উপনিষদ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পেঁয়াজের নাম পাইনি। এসব বিধর্মী যবন আর ম্লেচ্ছদের খাবার। দাম বাড়ল কি কমল, আপনার কী এসে যায় তাতে? আরও জানিয়ে রাখি পেঁয়াজে নাকি উত্তেজনা বাড়ে, তাই ছাত্র আর বিধবাদের পেঁয়াজ খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফা হিয়েন সারা ভারতে পেঁয়াজ দেখেননি। হিউয়েন সাং দেখেছিলেন, কিন্তু পেঁয়াজ খেলে নাকি শহরের বাইরে বের করে দেওয়া হত। মুখের গন্ধের জন্য কি না কে জানে!)। তাহলে ভারতীয়দের মধ্যে পেঁয়াজ চালু করলেন কে? খুব সম্ভব চরক। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভদ্রলোক, যিনি আয়ুর্বেদের উপর দারুণ একটা সংহিতা লিখেছিলেন। পেঁয়াজ তখন ব্যবহার হত একমাত্র ওষুধ হিসেবে। সেখানে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হৃৎপিণ্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই, কোকাকোলাও প্রথমে মাথা ধরার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হত। তারপর নবাবি আমলে তো পেঁয়াজের পুর দেওয়া শিঙাড়া থেকে মিসরি রুটি, সবেতেই পেঁয়াজের ছড়াছড়ি যেত। মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আর-এক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাত পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত, সেসময় খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করত। পৃথিবীর বহু স্থানে এই পেঁয়াজকেই অনন্ত জীবনের প্রতীক হিসাবে দেখা হত এককালে। পেঁয়াজের গোলাকার আকৃতি আর সমকেন্দ্রিক একটির উপর আর-একটি চক্রাকার রিং থেকে এই ধারণার জন্ম বলে মনে করা হয়। পিরামিডের দেওয়ালে তাই পেঁয়াজের ছবি আঁকা দেখতে পাই। আর হ্যাঁ, মিশরীয়দের কথা উঠল যখন, বলেই ফেলি, তারা মনে করত মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখত। এই ঘটনার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতে। এই সমাধি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষুকোটরে ভরে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ! এ ছাড়াও মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হত। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি স্থানে পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হত। বহু মিশরীয় যাজকদেরও ছবিতে পেঁয়াজ হাতে দেখা গিয়েছে। মিশরীয়দের ধারণা ছিল পেঁয়াজের এই ঝাঁঝালো গন্ধ ও তার জাদুকরী ক্ষমতায় মৃত মানুষ আবার নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করে। সোজা কথা, পেঁয়াজের গন্ধে মড়াও জেগে ওঠে। পেঁয়াজের এই গন্ধের কারণ গন্ধকঘটিত কিছু যৌগ, এটাও এখন অনেকে জানেন। গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেত। এ ছাড়াও নিজেদের পেশি আরও মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্ল্যাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করত। রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানত। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেত। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্ন্যুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ। বাইবেলেও ইজরায়েলিদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
শেষকালে বলি, মধ্যযুগে মানুষ ঠিক মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করত। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এ ছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান, যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিত। চিন্তা নেই। আবার সেই দিন আসতে চলেছে…
আলুর উত্থান পতন
আশা করি এই আলোচনায় পাঠক দোষের কিছু পাবেন না। এখন সবজিতে আলু ছাড়া চিন্তা করা অসম্ভব হলেও কিছুদিন আগেও ইউরোপীয়রা আলুকে বিষাক্ত ভেবে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। যখন আলু চালু হল, তখনও মাপে অতি অল্প, ওষুধ হিসেবে। ১৭৭৮ সালে ফ্রান্স সরকার রীতিমতো আইন করে আলুর চাষ বন্ধ করে দেন। তাঁরা স্থির বিশ্বাস করতেন আলু থেকে কুষ্ঠ সহ নানা বিচিত্র রোগ ছড়ায়। এই বিশ্বাস এতটাই প্রবল ছিল যে ১৭৭০ সালে মহাদুর্ভিক্ষের সময় রাজা ফ্রেডরিখ দ্য গ্রেট টন টন আলুর বস্তা চাষিদের পাঠালেও তাঁরা ফেরত পাঠিয়ে দেন। না খেয়ে মরেন, তবু আলু খেতে অস্বীকার করেন।
নাঃ, শুরু থেকেই শুরু করা যাক বরং। বিজ্ঞানীরা ধারণা করে থাকেন আজ থেকে প্রায় ১৩০০০ বছর আগে আলুর বুনো জাতের উদ্ভব হয়েছিল এবং প্রায় ৭০০০ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রথম আলু চাষ শুরু হয়।
ইনকা সভ্যতা স্মরণীয় হয়ে আছে এই আলুর জন্য। তারা আলুর ভিতরের আর্দ্রতা বের করে এক বিশেষ উপায়ে একে চূর্ণ করে চুচু নামক এক খাবার তৈরি করত। প্রায় দশ বছর সংরক্ষণ করা যেত সেই খাবার। সেটা ছিল তাদের আকালের দিনের রক্ষাকবচ। তারা বিশ্বাস করত যে, গর্ভবতী মায়েরা বেশি আলু খেলে প্রসববেদনা কম হয়। আলু দিয়ে অনেক রোগের চিকিৎসাও করা হত ইনকা সভ্যতায়। সেই ইনকাদের কথা যখন স্প্যানিশরা লিখলেন, তাঁরা এই ফসলকে নাম দেন বাটাটা। আজও ভারতের পশ্চিমে, বিশেষ করে মুম্বাইতে বা গোয়ায়, যেখানে পর্তুগিজরা আস্তানা গেড়েছিলেন, সেখানে আলুকে বাটাটা নামেই ডাকা হয়। ১৫৩২ সালে পেরুতে সোনার খোঁজে এসেছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। তারা জানত যে সোনার খনিতে কাজ করা ইনকারা আলু বা চুচু খেত। যদিও স্প্যানিশরা তখন পর্যন্ত সোনার চেয়েও দামি আলুর মর্ম বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখনই জাহাজে করে তারা বিভিন্ন এলাকায় যেত, সঙ্গে করে খাবার হিসেবে আলু নিয়ে যেত। কিন্তু সেটা ওই জাহাজ পর্যন্তই ছিল, ঘরবাড়িতে আলুর প্রবেশ তখনও হয়নি।
১৫৭০ সালে স্পেনে প্রথম আলুর ছোটোখাটোভাবে চাষ হয়। মজার ব্যাপার হল এই আলু চাষ করা হয়েছিল গোরু ছাগলের খাবারের জন্য। মানুষ তখন আলু খাবে?? কভি নেহি। আলু আস্তে ধীরে ইউরোপে ছড়িয়েছে, কিন্তু ইতিবাচকভাবে না। মানুষ এটাকে অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ভয়ের চোখে দেখত। একেবারে খাওয়ার কিছু না থাকলে একেবারে হতদরিদ্র মানুষ আলু খেত, অন্যথায় ওটা গোরু ছাগলই খেত। নেহাত নতুন ধরনের গাছ বলে উত্তর ইউরোপে কিছু বোটানিকেল গার্ডেনে লাগানো হয়েছিল আলু গাছ। ইউরোপের মানুষের নাকউঁচু স্বভাব ছিল। এমনকি কিছু লোক তো রীতিমতো ভাবতে শুরু করল আলু গাছ ডাইনিদের সৃষ্টি। মানুষকে সম্মোহিত করতে নাকি ডাইনি জাদুকররা আলু বানিয়েছে। এইরকম ভাবা একেবারে অমূলক না। আসলে আলু যে প্রজাতির গাছ, তার নাম ডেডলি নাইটশেড। ঠিক একই প্রজাতির বেশ কিছু বিষাক্ত গাছ আছে। তাই প্রথম দর্শনে আলুর প্রতি সন্দেহ হওয়া কিছু অস্বাভাবিক না। ইউরোপে আলুর একটা কারণেই কদর ছিল। আলুর ফুল। আলুর ফুল দিয়ে ঘর সাজানো ধীরে ধীরে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মজার ব্যাপার, পরে যখন ব্যাপক হারে আলু খাওয়া শুরু হল, তখন আলুর ফুল তার মর্যাদা হারাল। খাবার জিনিস দিয়ে ঘর সাজাতে কে চায়?
আরও প্রায় ১০০ বছর পরেও মাংসপ্রিয় ইউরোপিয়ানদের আলু খাওয়ানো যায়নি। আলু নাকি বিস্বাদ!! ১৬৬২ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি সুপারিশ করে সরকারের প্রতি ও জনগণের প্রতি আলু চাষের জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবশ্য আলুর কপাল খুলতে বেশি দেরিও হয়নি। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে রেভোল্যুশনারি যুদ্ধ শুরু হলে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। জনগণ বাধ্য হয় খাবার টেবিলে আলু রাখতে। তখন ইংল্যান্ডের তৎকালীন বোর্ড অব এগ্রিকালচার আলু চাষের নিয়মকানুন নিয়ে প্রচার শুরু করে। শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের। এই ধরনের ঘটনাগুলো শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সেও ঘটেছিল। সেই সময়ের সৈন্যরা যখন খাবারের খোঁজে কৃষকের মাঠে লুটতরাজ করত, মূলত তারা গম, আঙুর ইত্যাদি ফসল, যেগুলো সহজেই কেটে ফেলা যায়, সেগুলো লুট করে নিয়ে যেত। আলু যেহেতু মাটির নিচে থাকত, মাটি কেটে আলু লুট করার ঝামেলায় তারা যায়নি। এ কারণে কৃষকরাও আলু চাষ করে নিরাপদ থাকত।
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ১৭০০ সালের আগে পর্যন্ত আলু চাষে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। হবে কী করে? জনগণের ধারণা আলু খারাপ, না দেখতে ভালো, না খেতে ভালো! খেলে আবার অসুখবিসুখ হয়! ১৭৭১ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা হয় আলু চাষ করলে ‘লাভ আছে, ক্ষতি নাই।’ তবে মানুষের ভুল ধারণার অবসান ঘটানোর জন্য রাজা ষোড়শ লুই জামার বোতামে আলুর ফুল লাগিয়েছিলেন, রানি মেরি এন্টোনি চুলের খোঁপায় আলুর গোলাপি মুকুল রাখতেন। আলুর কপাল এমনি এমনি খোলেনি। এদিকে প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডেরিকও বেজায় চেষ্টা করেছিলেন তাঁর রাজ্যের লোকদের আলু খাওয়াতে; পারেননি। কারণ? ওই যে, আলু বিষাক্ত। এদিকে রাজ্যে খাদ্যসংকট চলছে, গমের দাম হুহু করে বেড়ে চলছে। লোকজন না খেয়ে মরবে নাকি? রাজা পড়লেন বিপদে। রাজা ফন্দি আঁটলেন। রাজ্যের লোকজনের ওপর উলটো সাইকোলজি প্রয়োগ করলেন। তাঁর রাজকীয় বাগানে তিনি আলু চাষ করলেন, কঠিনভাবে ঘোষণা দিলেন এখান থেকে কোনও আলু চুরি করা যাবে না। কে না জানে নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে? লোকজন ওই বাগান থেকেই আলু চুরি করল। যেটা এত গার্ড দিয়ে রাখা হয়, সেটাই তো চুরির জন্য উপযুক্ত। চুরি করে আলু গাছ নিজেদের বাগানে লাগিয়ে দিল কৃষকরা। রাজা মিটিমিটি হাসলেন। তিনি তো এটাই চেয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদরা বলেন শিল্পবিপ্লব যুগে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ নাকি ছিল আলু। শিল্পবিপ্লব অনেক নতুন কিছুর আবিষ্কারক। তো যেই শিল্পবিপ্লবের পূর্বে ইংল্যান্ডের মানুষের খাবার ছিল রুটি, মাংস, মাখন ইত্যাদি, সেই শিল্পবিপ্লবই বাধ্য করেছে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও ছিল। ওই সময় প্রচুর মানুষ শহরে ভিড় করেছিল কাজের জন্য। এত মানুষ তো বাসাবাড়িতে ফ্রিজ কিংবা ওভেন কিনতে পারত না। তো ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করে কার ইচ্ছে থাকত বাসায় এসে আবার রুটি বানাবে, মাংস পাকাবে! তার চেয়ে দ্যাখো ভালো আলুর এত ঝামেলা নেই। একটা বড়ো সাইজের আলু খেলেই পেট ভরে যায়,এত আয়োজন করে রান্নাও করতে হয় না।
অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল আইরিশরা। তারা ইনকাদের মতোই আলুর মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছিল। আয়ারল্যান্ডের মাটি আর আবহাওয়াও অবশ্য আলু চাষের অনুকূল ছিল। সে কারণে কৃষকরাও একে সহজভাবে নিয়েছে কোনোরকম সন্দেহ ছাড়াই। আয়ারল্যান্ডে আলু প্রধান খাবার হিসেবে পরিগণিত হয় ১৮০০ সালের দিকে। জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে তখন থেকে। তাহলে কি আলুই জনসংখ্যা বাড়িয়েছে? ঐতিহাসিকরা ওইরকমই মত দিয়েছেন। ১৭৮০ সাল এবং ১৮৪০ সালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আলুর ব্যাপক চাষ ছাড়া লক্ষণীয় এমন কোনও বিষয় পাওয়া যায় না, যার কারণে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। আয়ারল্যান্ডের কৃষি ব্যবস্থা তখন এতটা উন্নত ছিল না। কিন্তু ইতিহাস বলে, সেখানকার সবচেয়ে গরিব চাষিটিও অনেক স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে পারত এই আলু চাষের দৌলতে। এতে তেমন বড়ো কোনও বিনিয়োগ লাগত না কিংবা খুব শ্রমও দিতে হত না। এমনকি ছোটো ছোটো শিশুরাও সহজে আলু রোপণ করত, মাঠ থেকে আলু সংগ্রহ করত। কোনও মাড়াইয়ের প্রয়োজন হয়নি কিংবা প্রয়োজন হয়নি ফসল হওয়ার পর শ্রমসাধ্য কোনও কাজের। এই যে আলু এত প্রাচুর্য দিল, তাতে করে শিশুমৃত্যুর হার কমে যায়, বেড়ে যায় বাল্যবিবাহের হার। আর এরপরই তাদের উপর নেমে এল চরম অভিশাপ।
আলুর উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল আইরিশরা যে ৩৩ শতাংশ জনগণের বাঁচা মরা নির্ভর করত আলুর ফলনের উপরে। ১৮৪৫ সালে ডাউনি মিলডিউ বা নাবি ধ্বসা নামে এক ছত্রাকবাহী রোগে খেতের পর খেত শেষ হয়ে গেল। এই ছত্রাকের উপদ্রবে ধ্বংস হয়ে যায় আইরিশদের প্রধান খাদ্য আলুর প্রায় এক-দ্বিতীয়াংশ জমি। এবং সেবছর সহ পরবর্তী ৭ বছরে নষ্ট হয় আরও এক-তৃতীয়াংশ জমি। সেসময় আয়ারল্যান্ডের প্রজা কৃষকেরা গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হত এবং তাদের একমাত্র খাদ্যের নির্ভরশীলতা ছিল আলুর উপর। হঠাৎ এই বিপত্তিতে অসহায় হয়ে পড়ে আইরিশরা। ১৮৫২ সালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই দুর্ভিক্ষের ফলে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ আইরিশ। এর সঙ্গে আরও ১০ লাখ মানুষ হারায় তাদের ঘরবাড়ি এবং শূন্য হাতে দেশ ছেড়ে অধিবাসী হয় অন্যত্র। মাত্র সাত বছরে নয় মিলিয়ান থেকে আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা নেমে আসে চার মিলিয়নে। আর এই সব কিছু হয়েছিল একমাত্র আলুর কারণে।
বাঙালির পাতে আলু এসেছে পর্তুগিজদের হাত ধরে। ১৬ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৭ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত পর্তুগিজরা বাংলার রাষ্ট্রীয় সকল কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। কলকাতা-ঢাকা-মুর্শিদাবাদের কথা যেমনই হোক, বাংলার গ্রামাঞ্চলে আলু পৌঁছেছিল অনেক পরে। বিভূতিভূষণ ‘ইছামতী’ উপন্যাসে আলু পান কলকাতায়, ওখান থেকে গ্রামে আলু নিয়ে এলে হুলুস্থূল পড়ে গিয়েছিল। আলুর চেয়েও আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বা অভূতপূর্ব উপকরণ পর্তুগিজরা আমদানি করে, তা হল মরিচ আর তামাক। যা বাংলাদেশের লোক লুফে নিয়েছিল। এবং দ্রুত তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি— তিনটিও সম্ভবত পর্তুগিজরা এদেশে এনেছিল। তাই খাঁটি বাঙালি রান্নায় শুরুতেই যখন লুচি আর আলুর দম থাকে, কিংবা খিচুড়ি আর বাঁধাকপির তরকারি, তখন মজা লাগে বই কি।
বাঙালি খানায় ডাল ও শাকসবজি
ভাত কার্বোহাইড্রেট আর ডাল প্রোটিন— তাই ডালে ভাতে এক সুষম খাবারের দিশা দেখায়। বাংলায় ডাল খাওয়া খুব সম্ভব মধ্যযুগ থেকে শুরু। ডালের একঘেয়েমি দূর করতে ভিন্ন ভিন্ন ফোড়নের নির্দেশ দিয়েছেন বাঙালি রাঁধুনিরা। কাঁচালংকা, পাঁচফোড়ন, জিরে, কালোজিরে, মেথি, শুকনো লংকা, রাঁধুনি, পেঁয়াজ, রসুন— এক এক ডালে এক এক ফোড়ন। প্রাচীন বাঙালি ডাল খেত কি না তা নিয়ে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে একটি প্রশ্নচিহ্ন তুলেছেন। এক তো কোনও প্রাচীন গ্রন্থে বাঙালির ডাল খাওয়ার কোনও খবর নেই, উপরন্তু এই অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী-কৌম সমাজের খাওয়াদাওয়ার মধ্যেও ডাল খাওয়ার চল দেখতে পাওয়া যায় না। যদিও ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে ডালের উল্লেখ না থাকলেও বড়ির উল্লেখ রয়েছে, আর কে না জানে যে বড়ি তৈরির একটি প্রধান উপাদান ডাল। তবে সে যুগে ডাল ছাড়াও বড়ি তৈরির অন্য কোনও উপকরণ ছিল কি না তা জানা যায় না। সে যাই হোক, সেকালে চল না থাকলেও পরবর্তীকালে বাঙালির রান্নায় ডাল ক্রমে একটি অতি আবশ্যকীয় পদ হয়ে ওঠে সম্ভবত দক্ষিণ থেকে সেন রাজবংশ ও উত্তর-পশ্চিম থেকে ইসলামের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই। তার প্রমাণ পাই ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’ নামক আধুনিক বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম রান্নার বইতে। এই বইতে ডাল রান্নার একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে, যেখানে মুদগ, অড়হর, মসুর ও কলাই ইত্যাদি ডাল রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
ডাল-ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন সবজি খাবার প্রচলন অনেক আগের। তবে পর্তুগিজরা আসার আগে বাঙালি আলুর সঙ্গে পরিচিত ছিল না। মধ্যযুগের নানা লেখা থেকে বোঝা যায়, তরকারি হিসেবে প্রধান ছিল কুমড়ো, বেগুন, ঝিঙে, থোড়, মোচা, কাঁচকলা, পটল, লাউ, ওল, কচু, মুলো, শিম আর নিমপাতা। সেকালে ‘শুক্তা’ রান্না করা হত— বেগুন, কাঁচা কুমড়ো, কাঁচকলা, মোচা এই সবজিগুলি গুঁড়ো বা বাটা মশলা অথবা বেসনের সঙ্গে বেশ ভালো করে মেখে বা নেড়ে নিয়ে ঘন ‘পিঠালি’ মিশিয়ে। পরে হিং, জিরা ও মেথি দিয়ে ঘিয়ে সাঁতলিয়ে নামাতে হত। কিন্তু ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ সুকুতা, শুকুতা বা সুক্তা বলতে একধরনের শুকনো পাতাকে বলা হয়েছে। এটি ছিল আম-নাশক। সম্ভবত এটি ছিল শুকনো তিতো পাটপাতা। রাঘব পণ্ডিত মহাপ্রভুর জন্য নীলাচলে যেসব জিনিস নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে এই দ্রব্যটিও ছিল। আবার ‘সুকুতা’ বলতে সেই সময় শুকনো শাকের ব্যঞ্জনকেও বোঝাত। পদ্মপুরাণে বেহুলার বিয়ের নিরামিষ খাবারের মধ্যে শুক্তোর উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলেও বাইশ রকমের নিরামিষ পদের মধ্যে শুক্তুনিকে পাওয়া যায়।
বাঙালির আনুষ্ঠানিক ভোজে নাকি খাদ্য অপচয়ের চূড়ান্ত হত— এমন কথা লিখে গিয়েছেন চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং। তাঁর দেখা ব্যঞ্জনের তালিকায় রয়েছে দই আর রাই সরষে দিয়ে রান্না করা পদ। যা খেয়ে অতিথিদের মাথা ঝাঁকাতে ও মাথা চাপড়াতে হত তীব্র ঝালের আক্রমণে। একটু অতীতে ফেরা যাক। নবম ও দশম শতকে বাংলা সমৃদ্ধ ছিল হরেক রকমের শস্য-ফলে। এ অঞ্চলের মাটিতেই জন্মেছে ৪০ ধরনের ধান, ৬০ রকমের ফল আর ১২০ প্রজাতির বেশি শাকসবজি। এর মধ্যে ছিল শশা, গাজর, বিভিন্ন ধরনের লাউ, বেগুন, রসুন, মেথি, মুলা, মাশরুম, ইত্যাদি।
শুক্তোর পরেই আসে শাকের কথা। শাক খাবারে স্বাদ বাড়ায়, কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখে, রক্তাল্পতা দূর করে।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ভাতের সাথে আহার্য কিছু খাদ্যের খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন-
‘নটে রাঙা তোলে শাক পালঙ্গ নলিতা
তিক্ত ফল তাঁর শাক কলতা পলতা
সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা
নটুয়া বেথুয়া তোলে ফিরে ক্ষেতে ক্ষেতে
মহুরী শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেটে।’
বিভিন্ন দেশীয় শাকপাতাও ভাতের সাথে খাওয়া হত। কখনও ভর্তা, কখনও বা ঝোল-তরকারি। টক দই খাওয়ারও বেশ প্রচলন ছিল ভাতের সাথে বা আহার শেষে। তবে সবজি ছাড়াও আরও একটা পদ এর সঙ্গেই এসে পড়ে, তা হল ছানা। ছানার ডালনা একটি অতি প্রাচীন বাঙালি পদ, যা বহু যুগ ধরে বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করে আসছে। পনিরের সঙ্গে এর তফাত অনেক। যদিও আজকাল ছানার ডালনা প্রায় উঠেই গেছে। এসেছে শাহি পনির বা চিলি পনির। পনিরের আবিষ্কার অবশ্য নেহাতই দুর্ঘটনা। আজ থেকে আট হাজার বছর আগে পশুপালকরা বাড়তি দুধ রাখত পশুর পাকস্থলী দিয়ে তৈরি থলেতে। পশুর পাকস্থলীতে রেনেট নামে এক এনজাইম থাকে। একবার নাকি এক থলেতে এমন কিছু এনজাইম ছিল, যা দুধকে কেটে পনির বানিয়ে দিয়েছিল। তবে পনির নিতান্তই হালের বাঙালি খানা। বিশ বছর আগেও এর নাম তেমন শোনা যেত না।
স্যালাডের রকমফের
গোল করে কাটা শসা, সঙ্গে টমেটো আর পেঁয়াজের কুচি। ব্যস হয়ে গেল বাঙালির স্যালাড। উঁহুঁ মশাই, ভুল করেন। নুনই তো ছড়ালেন না। আর আলুনি হলে এ জিনিস আর যাই হোক স্যালাড না। স্যালাড শব্দের উৎস ল্যাটিন শব্দ স্যাল, যার মানেই হল নুন। ‘Oxford Dictionary of Food and Drink in America’ জানাচ্ছে বিশ্বকে দেওয়া রোমান সাম্রাজ্যের সেরা দান নাকি এই স্যালাড। কাঁচা শাকপাতাকে নিয়ে তেল আর নুনে জারিয়ে তৈরি হত রোমান স্যালাড। এই স্যালাড ব্রিটিশদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেছিল যে ১৬৯৯ সালে জন এভেলিন ‘Acetaria: A Discourse on Sallets’ বলে স্যালাড নিয়ে গোটা একখানা বইই লিখে ফেলেছিলেন। স্যালাড নিয়ে দারুণ একখানা কবতে ১৮০৮ সালে লিখে ফেলেছিলেন ইংরেজ পুরোহিত সিডনি স্মিথ। গোটাটা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
Recipe for a Salad
To make this condiment your poet begs
The pounded yellow of two hard-boil’d eggs;
Two boiled potatoes, passed through kitchen sieve,
Smoothness and softness to the salad give.
Let onion atoms lurk within the bowl,
And, half-suspected, animate the whole.
Of mordant mustard add a single spoon,
Distrust the condiment that bites so soon;
But deem it not, thou man of herbs, a fault
To add a double quantity of salt;
Four times the spoon with oil of Lucca crown,
And twice with vinegar procur’d from town;
And lastly o’er the flavour’d compound toss
A magic soup on of anchovy sauce.
Oh, green and glorious! Oh, herbaceous treat!
Twould tempt the dying anchorite to eat;
Back to the world he’d turn his fleeting soul,
And plunge his fingers in the salad-bowl!
Serenely full, the epicure would say,
`Fate cannot harm me, I have dined today.
মেরি, কুইন অফ স্কট নাকি খাবারের সঙ্গে সেলেরি পাতা আর ডিমসেদ্ধ মেশানো স্যালাড খেতে বড্ড ভালোবাসতেন। বিভিন্ন বিখ্যাত স্যালাডের জন্য এদিক-ওদিক উঁকি মেরে বেশ কটা নাম আর তাদের ইতিহাস জানা গেল।
সিজার স্যালাড-এর সঙ্গে সম্রাট সিজারের কোনও সম্পর্ক নেই। এই স্যালাডের আবিষ্কর্তা মেক্সিকোর তিজুয়ানা শহরের এক রেস্তোরাঁ মালিক: সিজার কার্দিনি। স্বয়ং সিজারের মেয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, ৪ জুলাই ১৯২৪-এ রেস্তোরাঁতে এত ভিড় হয়েছিল যে রেস্তোরাঁর হেঁশেলে সবজি কম পড়ে গিয়েছিল। বেগতিক দেখে অবস্থা সামাল দিতে হাতের কাছে যা সবজি আর ড্রেসিং ছিল, তাই দিয়ে এক পাঁচমিশেলি স্যালাড বানিয়েছিলেন সিজার সাহেব, আর তাড়াহুড়ো করে বানানো সেই স্যালাড ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল রাতারাতি, আর তার নামকরণ করা হয়েছিল সিজার সাহেবের নামে। আবার সিজারের রেস্তোরাঁর এক অংশীদারের বক্তব্য: রোমেইন, রসুন, পার্মেসান চিজ, সেদ্ধ ডিম, অলিভ তেল, উস্টারশায়ার সস দিয়ে তৈরি সিজার স্যালাডের আসল নাম অ্যাভিয়েটর্স স্যালাড, আর তা বানানো হয়েছিল সান দিয়াগোর এক আমেরিকান পাইলটের সম্মানে। সিজারের রেস্তোরাঁ এই স্যালাডকে জনপ্রিয় করে, আর সময়ের সঙ্গে এর নাম বদলে হয় ‘সিজার স্যালাড।’
কব্ স্যালাড— বব কব্ ১৯২৬ সালে তাঁর লস অ্যাঞ্জেলেসের রেস্তোরাঁয় রান্না করতে করতে বেঁচে যাওয়া অ্যাভোক্যাডো, সেলেরি, টমেটো, সেদ্ধ ডিম, চিকেন, রকফোর্থ চিজ আর বেকন দিয়ে এই স্যালাড বানান। এই রেস্তোরাঁ আজও চালু— এখন এর নাম ব্রাউন ডার্বি।
পটেটো স্যালাড— ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপকে আলুর সঙ্গে পরিচয় করান স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা আমেরিকা থেকে ফিরে, আর পটেটো স্যালাড তাঁরাই বানাতে শেখান। প্রথম জমানায় পটেটো স্যালাড তৈরি হত ওয়াইন-এ আলু সেদ্ধ করে— ভিনিগারে আলু সেদ্ধ করে পটেটো স্যালাড বানানো শুরু হয় অনেক পরে।
গ্রিক স্যালাড— এর নামকরণে কী করে ‘গ্রিক’ শব্দটা প্রবেশ করল, সেটা বেশ রহস্যের। কারণ, কোনোভাবেই গ্রিক স্যালাড খানদানি গ্রিক রান্না-ঘরানার মধ্যে পড়ে না। কারণ গ্রিক স্যালাডের মূল উপাদান ‘টমেটো’, সেটা গ্রিসে প্রবেশই করেছে হালে উনিশ শতকে।
ওয়ালডর্ফ স্যালাড— সেলেরি আর আপেল মেশানো এই স্যালাড ১৮৯৩ সালে ওয়ালডর্ফ হোটেলের রেস্তোরাঁয় প্রথম পরিবেশন করা হয়। ১৮৯৬তে “The Cook Book by ‘Oscar’ of Waldorf” প্রকাশ পেলে আমেরিকার ঘরে ঘরে এই স্যালাড বানানো শুরু হয়। এতটাই বিখ্যাত এই স্যালাড যে কোল পোর্টারের বিখ্যাত গান “You’re the top”-এ গায়ক প্রেমিকাকে দুনিয়ার সেরা সব জিনিসের সঙ্গে তুলনা করছেন— মোনালিসার হাসি, ফ্রেড অ্যাস্টায়ারের নাচ, মিকি মাউস, মহাত্মা গান্ধি এবং… ওয়ালডর্ফ স্যালাড।
রবি ঠাকুরও স্যালাড খেয়েছেন দেখতে পাই। ১৯১৩ সালে কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্যতালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে। এই খাবারের তালিকায় ছিল: গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস অ্যান্ড কিউকাম্বার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম। এ ছাড়া রানী চন্দের লেখাতে দেখি মাঝে কিছুদিন তিনি কাঁচা শাকসবজি শুধু নুন ছড়িয়ে খেতেন। এ স্যালাড নয় তো কী?
এবার কয়েকটা ড্রেসিং-এর কথা বলি। স্যালাডের ড্রেসিং অগুনতি হলেও মূলত দুভাগে তাকে ভাগ করতে পারেন— ভিনিগ্রেত এবং ক্রিমি। ভিনিগ্রেত হল তেল ও ভিনিগারের মিশ্রণ। আর ক্রিমি স্যালাড ড্রেসিংয়ে থাকে বাকি নানা উপকরণের মিশ্রণ। ক্রিমি ড্রেসিংয়ের বেস কিন্তু সাধারণত মেয়োনেজ, দই কিংবা সাওয়ার ক্রিম হয়। গ্রিন গডেস ড্রেসিং বানানো হয়েছিল সানফ্রান্সিসকোর প্যালেস হোটেলে ১৯২০-তে, অভিনেতা জর্জ আর্লিস-এর সম্মানে। তিনি সেখানে থাকতেন ‘দ্য গ্রিন গডেস’ নাটকে অভিনয় করার সময়। সবুজ অলিভ, গোলমরিচ, আচার, পেঁয়াজ,আর সেদ্ধ ডিম দিয়ে তৈরি টকমিষ্টি থাউজেন্ড আইল্যান্ড ড্রেসিং-এর নামকরণ হয়েছিল সেন্ট লরেন্স নদীর থাউজেন্ড আইল্যান্ডসকে মনে রেখে। ডিমের কুসুম আর তেল দিয়ে তৈরি মেয়োনিজ ড্রেসিং তৈরি হয়েছিল ১৭৫৬ সালে ফরাসিদের স্পেনের অধীন মিনর্কা দ্বীপের মেয়ন শহর জয় করার আনন্দ উদ্যাপন করতে। এই যুদ্ধে ফরাসি ফৌজের সেনাপতি ছিলেন রিচেলিউ’র ডিউক। এই ডিউক ছিলেন ভোজনরসিক, খাওয়াতেও ভালবাসতেন। তাঁরই শেফের হাতে প্রথম তৈরি হয়েছিল মেয়নিজ ড্রেসিং। রিচেলিউ’র ডিউকের ভোজের পোশাকবিধি ছিল অনন্য। উলঙ্গ হয়ে সেই ভোজসভায় খেতে যেতে হত!