পাদটীকা

পাদটীকা

নিষিদ্ধ তালেবান সাম্রাজ্যের বন্দিদশা থেকে অবিশ্বাস্য উপায়ে রিডলি মুক্তি পান দশ দিন পর। মুক্তির পর পরই তিনি হয়ে উঠেন পশ্চিমাসহ সমগ্র বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন আফগানিস্তান সফর রিডলির চোখে তুলে ধরে নতুন এক দিগন্ত। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমের অর্কেস্ট্রার সুরের মত সমন্বিত প্রচারের বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। তৎকালীন বিশ্বের জনপ্রিয় স্লোগান ও পরাশক্তিদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কারকে তিনি আখ্যায়িত করেন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে। তবে নিরীহ মানবতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের কালো থাবা তখনো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে রূপ নেয়নি।

তালেবানদের কথা দিয়েছিলেন, মুক্তি পেলে ইসলামের সংবিধান পবিত্র কোরআন পড়ে দেখবেন। নিছক অধ্যয়নের মত করেই তিনি পড়তে শুরু করলেন পবিত্র কোরানের অনুবাদ। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এ কোন আশ্চর্য গ্রন্থ? পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ইসলামের নামে তাবত দুনিয়াতে চলমান অসামঞ্জস্যতা, অত্যাচার আর নিগ্রহ শুধুই স্থানভিত্তিক সংস্কৃতি আর পুরুষবাদের প্রতিচ্ছবি। খোদ তালেবানদের পাশবিক অত্যাচার আর নারীকে দমিয়ে রাখার প্রথারও ঘোর সমালোচনা করেন তিনি। সন্ধ্যার আগে মেয়েরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারবে না কিংবা মেয়েশিশুদের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন নেই-এসব ধারণা তাঁর মতে কেবলই তালেবানদের ধর্মান্ধতা ও মূর্খতা। তবে তালেবান পরবর্তী স্বাধীন যুগে আফগানিস্তানে যখন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার খবর নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় বাহবা অনুনাদিত হয়, রিডলি তখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। এক রচনায় তিনি উল্লেখ করেন, আফগান মেয়েরা বোরকা খুলে ফেলার বদলে তাদের স্বামীদের কর্মসংস্থান, সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে বেশি চিন্তিত। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রদত্ত নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা অধিকাংশ আফগান নারীর নিকট অর্থবহ নয়।

রিডলি পবিত্র কোরআন পাঠের পরে বুঝতে পারেন ইসলামের মর্মার্থ। তুখোড় মদ্যপায়ী রিডলি এক বছর মদ্যপান থেকে দূরে থাকেন। তার বেড়ে উঠার সময় থেকেই জেরির ক্লাব ছিল তার সব থেকে প্রিয় জায়গা। মদ্যপানের এ ক্লাব ছিল তাঁর সুখ দুঃখের নীরব সাক্ষী। কিন্তু সবার অগোচরেই তিনি দূরে থাকেন মদের বোতল থেকে।

অবশেষে তিন বছর পর ২০০৩ সালে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন। আরেকবার মিডিয়ায় বিপ্লবী রিডলিকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। রিডলি স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে সুর তোলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এটি এক ধরনের মানসিক ব্যাধি যেখানে বন্দিশালায় আটক ব্যক্তি তার আটককারীদের জন্য মায়া অনুভব করতে থাকেন। তবে রিডলি এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তাঁর মতে, বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাবার তিন বছর পরে কেউ এ ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে না। তবে এও জানিয়ে দেন, তালেবানদের মহানুভবতা নয়, ইসলামের বক্তব্য, শান্তির বাণী আর নারীদের প্রদত্ত সুমহান মর্যাদাই তাঁকে টেনে নিয়েছে আলোর পথে।

এক সময়ের প্রবল সংগ্রামী নারীবাদী রিডলি ইসলাম গ্রহণ করে নিজেকে আপাদমস্তক বোরকায় জড়িয়ে নেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওয়াল স্ট্রিটের একজন সফল ব্যবসায়ী ঠিক যেমন স্যুটের বাইরে শুধু গেঞ্জি পরে অফিসে যেতে পারেন না ঠিক তেমনি বোরকাও মুসলমান নারীদের আলাদা পরিচয় বহন করে। বোরকা পরিহিত একজন মুসলিম নারীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, পুরনো সহকর্মীরাই এখন তাঁকে দেখে তখন সম্মান করে কথা বলেন। আগের মত হাসি ঠাট্টা বা অশ্লীল কথা শুনতে হয় এখন আর। তাঁর মতে এটি এক অসাধারণ অনুভূতি।

মুসলিম নারীদের নির্যাতনের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, নারী নির্যাতন কোনো মতবাদ নয়, এটি নির্যাতনকারী পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র। ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে বিশ্বের সব স্থানেই নারী নির্যাতনের নমুনার খোঁজ মেলে। এটি শুধু ইসলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি আমেরিকা-ইংল্যান্ডেও মেয়েরা স্বামীদের হাতে নিগৃহীত হন। অফিস আদালতে এখনো নারীদের বেতন ভাতা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। তবে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী শাসিত বিভিন্ন এলাকায় পরিবারের সম্মান রক্ষায় মেয়েসন্তান হত্যা ও মেয়েশিশুদের বর্বর ও অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে খতনা করার নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই উচ্চকণ্ঠ। ইসলামের কোথাও এসবের স্থান নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব প্রথা মূর্খ লোকদের ধর্মীয় নেতাগিরি আর লোকরঞ্জনবাদের অপ্রয়োজনীয় আস্ফালন।

মুক্তি পাবার কিছুদিন পর রিডলি সানডে এক্সপ্রেসের চাকরিটা ছেড়ে দেন। পরে তিনি দোহাভিত্তিক আল-জাজিরা চ্যানেলে যোগ দেন। প্রবল অহংকারী, রাগী আর স্পষ্টভাষী অতিকথনের অভ্যস্ত রিডলি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও বদলে যাননি এতটুকু। একসময় আলজাজিরার সাংবাদিকতা নীতির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ফলে চাকরিটা হারাতে হয় তাঁকে। তবে একরোখা রিডলি মামলা করে বসেন চ্যানেলটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ আনেন লিঙ্গ বৈষম্যের। ১৪ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের মামলাটি জিতেন তিনি ২০০৮ সালে। পরে আরো একবার অপর এক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাতেও তিনি ২৬ হাজার পাউন্ড জিতেন। ইরান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত প্রেস টিভিতেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ২০০৮ সালে সাইপ্রাসভিত্তিক গাজা মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি কোনো প্রকার বাধা বিঘ্ন ছাড়াই গাজায় প্রবেশ করেন। সেখানে তকালীন প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়ার সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেন তিনি। পরের বছর এক বিশাল ত্রান সামগ্রী বহরের সাথে তিনি পুনরায় গাজায় প্রবেশ করেন।

রাজনীতি রিডলি একসময় ইংল্যান্ডের চতুর্থ বৃহত্তম দল রেসপেক্ট পার্টিতে যোগ দেন। সেখান থেকে নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু দুই দুইবার নির্বাচনে চতুর্থ হয়ে রাজনীতির মঞ্চে আর খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।

পাকিস্তান, তিউনিসিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা হিসেবে সফর করেন তিনি। একবার তিনি ইউরোপিয়ান মুসলিম মহিলাদের সর্বোচ্চ সংস্থার সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে।

এক দশকের অস্থির বিশ্বে রিডলির অবস্থান

সন্ত্রাস আর প্রতিসন্ত্রাসের পেশী প্রদর্শনের হিংস্র রঙ্গমঞ্চে যখন বিশ্বব্যাপী নিরীহ মুসলমানেরা বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছিল, তখন রিডলি পশ্চিমা নীতিকে একরকম ধুয়ে দেন। একই সাথে অসংলগ্ন কথাবার্তার জন্য নিন্দিত হন তিনি। যেমন, এক ঘটনায় ব্রিটিশ মুসলিমদের পুলিশকে কোনো সাহায্য না করতে অনুরোধ জানান তিনি, যা ব্রিটিশ মুসলমানেরাও পছন্দ করেননি।

তার বন্দিত্বের সময় তালেবানদের দিকে অসংখ্যবার থুতু নিক্ষেপ, ঘৃণা প্রদর্শন আর গালি গালাজ করলেও মুক্তি পাবার পরে তিনি কিছুটা সমব্যথী হয়ে উঠেন। তিনি মনে করেন, সাংবাদিকেরা সবসময় একপেশে বক্তব্য তুলে ধরেন এসব ব্যাপারে। তবে বর্তমান সময়ের জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের ঘোরবিরোধী তিনি। তিনি বলেন, আইএস বিশ্বের তাবত মুসলিমশক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা কোনোকালেই গ্রহণযোগ্য নয়। একসময় লিবিয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে কথা বললেও ২০১২ সালে লিবিয়া সফর করে এসে তিনি মত পাল্টান। তিনি মনে করনে, সরকারি গোষ্ঠীর নির্যাতনে মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিরুদ্ধ দাবানল জ্বলে উঠা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার বক্তব্যে লিবিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি জনপ্রিয় জঙ্গিবাদের আত্মঘাতী হামলার ঘোরবিরোধী। এ সমস্যা সমাধানে পশ্চিমা বিশের প্রচেষ্টাও কুটিপূর্ণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, মুসলিম বিশ্বে চলমান অস্থিরতা আর নির্যাতনের প্রভাবেই জঙ্গিবাদ শিকড় গজিয়ে উঠে। তাই মুসলিম বিশ্বের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান জঙ্গিবাদ দমনে সহায়ক হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

ইসরায়েল ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে রিডলি অন্তরে ভীষণ ঘৃণা পোষণ করেন। ২০০৬ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের এক সম্মেলনে তিনি ইসরায়েলকে আমেরিকার প্রশিক্ষিত কুকুর বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি তাঁর নিজস্ব রেসপেক্ট পার্টি থেকে ইহুদি সমর্থকদের ঝেটিয়ে বের করবারও হুমকি দেন তিনি।

বিভিন্ন দেশে আমেরিকার ড্রোন হামলায় বেসামরিক লোকজন নিহত হবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন তিনি। সমমনা মহিলাদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘শান্তি বাহিনী। পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব মহিলারা প্রতিনিয়ত ড্রোন হামলার ভয়ে থাকে তাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে এই শান্তি বাহিনী।

ব্যক্তিগত সাফল্য

তিনি মুসলিম মহিলা সংঘের ইউরোপীয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে। লন্ডনভিত্তিক বহু বিখ্যাত সংবাদপত্রের সাথে কাজ করেছেন।

একই সাথে তিনি একজন অহিংস আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী, নাগরিক অধিকার রক্ষা ও মহিলাদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছেন।

২০১০ সালে মিলানে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপিয়ান মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে সংগঠনটির সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।

২০১১ সালে তিনি আরব আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন। বছর কয়েক আগে সুদানের দারফুরে যে জাতিগত সংঘাত দেখা দেয় তা মিটাতে মুসলমানদের এক উদ্যোগের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বিশ্ব সাংবাদিক সংস্থা, ইউরোপিয়ান সাংবাদিক সংস্থা ও মহিলা সাংবাদিক সংস্থার সদস্য।

২০০৮ সালে গাজা অভিমুখে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে একটি জাহাজ নৌপথে যাত্রা শুরু করে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অহিংসবাদী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও দক্ষিন আফ্রিকার বিখ্যাত আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু। সে সময় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ উদ্যোগের প্রশংসা করে একে গান্ধির অহিংস আন্দোলনের সাথে তুলনা করা হয়। সেই জাহাজে রিডলি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। পরে জাহাজটিতে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে পড়ে।

বিশ্বের প্রতিটা দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা রিডলি সবসময় বলে থাকেন।

রিডলি লেখালেখির পাশাপাশি ফিল্ম ক্যামেরার পিছনেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

তার নির্মিত একাধিক প্রামাণ্যচিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে।

 
[সমাপ্ত]