তালেবানের বন্দিনী

তালেবানের বন্দিনী

গাড়িটা পাকিস্তান সীমান্ত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ভয়ে শরীর অসাড় হয়ে এল। হৃৎস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সম্ভবত শরীরের একটা প্রতিরোধক ব্যবস্থা। কিন্তু আমি বাইরে একদম শান্ত ভাব দেখাই। ভেতরে তখন অ্যাড্রেনালিন পাম্প ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ আমি নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছিলাম। সবচেয়ে ভালো কী করা যায়, তা-ই ভাবছিলাম।

সেমি অটোমেটিকের গুলির শব্দে আমার চিন্তার বহর থেমে যায়। বাতাসে বারুদের গন্ধ। একটা গাড়ির বহরে আমাদের গাড়িটাও ঢুকে পড়ে। চারপাশে তখন তরুণ সৈন্যরা বিজয়ের ভঙ্গিতে শ্লোগান দিচ্ছিল। আমেরিকান গোয়েন্দা কী ভয়ংকর! ওরা ভাবছে আমি একজন বদমাশ আমেরিকান। মাথায় একটা গুলি প্রবেশ করতে আর কোনো বাধা রইল বুঝি।

এমন সময় কনুইয়ের তা খেলাম। আফগান গাইড। ও দ্রুত হাত নেড়ে মুখ চাপা দিয়ে ইশারা করল। আমি বুঝে গেলাম সব। এখন মুখ খুললেই বিপদ। তালিবরা যদি বুঝতে পারে, আমি ওদের প্রথম থেকেই চিনি, তাহলে সর্বনাশ। এ কারণেই আসার আগেই আমি পাশাকে বলেছিলাম কারও নাম জানতে চাই না আমি। একে অপরকে যতই কম চিনব, ধরা পড়লে ততই মঙ্গল।

আবার গুলির শব্দ। একসঙ্গে অনেকগুলো। উচ্ছঙ্খল জনতা মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতে লাগল। শ্লোগানটা আমার পরিচিত। পেশোয়ারের মিছিলেও একই শ্লোগান শুনেছি। উসামা জিন্দাবাদ উসামা জিন্দাবাদ, অর্থাৎ উসামা দীর্ঘজীবী হোক। আর আমার জীবনের আয়ুর কী হবে? দীর্ঘায়িত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

গাড়িটা এক জায়গায় থেমে গেলে জানকে ওরা সরিয়ে নেয়। তখন ভাবিনি যে ওর সঙ্গে আবার দেখা হবে। একজন লোক উঠে আমার পাশেই বসে পড়ে। লোকটাকে তালেবান সৈন্য মনে হচ্ছিল না। তার মাথায় বিশাল ভারী পাগড়িও ছিল না। এমন পাগড়ির নকশার পোশাক ২০০২ সালে ইউরোপ ফ্যাশন সপ্তাহে মডেলরা পরিধান করেছিল।

ফ্যাশনের চিন্তা বাদ। এক পাশে আফগান গাইড, অন্য পাশে এই অদ্ভুত তৈলাক্ত প্রাণী। আফগান লোকটা আমাকে চিমটি মেরেই যাচ্ছিল। আমার চামড়া ছিড়েই ফেলবে মনে হচ্ছে। ওর ইশারা আমি এতক্ষণে বুঝে গেছি। ব্যাটা এমন করতে থাকলে নির্ঘাত ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব, যদি এটাই আমার জীবনের শেষ কাজ হয় তবুও।

গাড়িটা আবার থেমে গেলে জান আবার আমাদের গাড়িতে এসে বসে। ওকে কেমন শান্ত দেখাচ্ছিল। আমি খুব অবাক হলাম ওর পুনরায় ফিরে আসায়।

জানের ফিরে আসার মানে হলো অপরিচিত লোকটা এবার আমার গাঁ ঘেষে বসবে। প্রথম প্রথম কিছু মনে না হলেও পরে বুঝতে পারি লোকটা আমার গায়ে হাত দিতে চাইছে। আশায় ছিলাম, বদমাশ লোকটা নিবৃত্ত হবে। তবে এই মুহূর্তে এটা বড়সড় কোনো সমস্যা নয়।

আফগান লোকটা আবার জোরে চিমটি কাটল। প্রচণ্ড জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। আর চুপ থাকতে পারলাম না। এখানে কেউ কি ইংরেজি ভাষা বোঝেন? আমি কুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করি। কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি আবার প্রশ্ন করি, কী ঘটছে আমি জানতে চাই? আমি জানি না এই দুজন কারা। কিন্তু আমি একজন ব্রিটিশ। যদি আমার ক্যামেরা ফেরত না পাই, তাহলে বড়সড় সমস্যা হবে।

আমি আশা করছিলাম জান অন্তত আফগান লোকটাকে কিছু বলবে, যাতে ও আমাকে চিমটি কাটা বন্ধ করে। আমার ডান দিকের বিরক্তিকর লোকটা আমার বোরকার ঢাকনা খুলে ফেলে। কালো-স্বর্ণালি রং মিশ্রিত বাদামি চুলগুলো খুলে যায়। একদম কোনো সাজপোশাক ছাড়াই বসে আছি। আমার গায়ের রং একটু হলদে সাদা আর চোখটা নীল রঙের।

লোকটা আমাকে একটা চিরুনি দেয়। আমি দুই দিন ধরে বোরকার নিচে আটকে থাকা অগোছালো চুলগুলো আঁচড়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করি।

অবশেষে চুলগুলো ছেড়ে দিতে পারলাম। বিরাট শান্তি। এমনকি পলিএ্যানাও এমন মুহূর্তে এ রকম ছোট ছোট ইতিবাচক চিন্তা করত।

আমার পরনে হালকা কমলা রঙের পাজামা আর একটা ফুলেল ছাপের কমলা জামা। সামনে তিনটা বড় ফুলের ছাপ। জামাটা কোমরের দিকে একটু চাপা। এরপর নিচের দিকে তা স্কার্টের মতো ছড়ানো। দেখতে কিম্ভুতকিমাকার লাগছিল আমায়। হোয়াট হ্যাপেন্ড টু বেবি জেন সিনেমার বেট ডেভিসের মতো। সামনের সিটে বসা সোনালি চুলের লোকটা বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। অশ্লীল চাহনি ওঠানামা করছে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। হায় যিশু, সম্ভবত আমি ধর্ষণ অথবা গণধর্ষণের শিকার হতে যাচ্ছি।

হঠাৎ চালককে গাড়ি থামাতে বলা হয়। তালিব লোকটা আমাকে বের করে নিয়ে একটা উঁচু জায়গায় দাঁড় করায়। পরক্ষণেই লোকটা চলে যায়। খানিক বাদেই একদঙ্গল লোকসহ ফিরে আসে। সবাই কেমন আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। সবাই উত্তেজিত ভঙ্গিতে তারস্বরে চিৎকার করছে। কেউ কেউ কুদ্ধ স্বরে গলা ফাটিয়ে চিল্লাচ্ছে। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে একটা হাস্যকর বিনোদনের পাত্র মনে হলো, যাকে এসব মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য ধরে আনা হয়েছে। ভয়ে আমার শরীর নীল হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কার্পেটের মতো শক্ত হয়ে আছে।

নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের নখে রক্তলাল নেল পলিশ চোখে পড়ল। পায়ে জুতা বা মোজা কোনোটাই নেই। কখন এসব খুলে গেছে, মনে পড়ছিল না। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, রঙিন পায়ের দিকে কারও যেন নজর না পড়ে। এই তল্লাটে গায়ে রং বা প্রসাধনী মাখাও নিষিদ্ধ।

এখানেই তাহলে সব শেষ। উত্তেজিত জনতার পাথরের আঘাতে আমাকে হত্যা করা হবে। হায় খোদা, যেন প্রথম আঘাতেই আমি অচেতন হয়ে পড়ি। কিছু যেন টের পেতে না হয়। অনুনয় করে জীবন ভিক্ষা চাইতে না হয়।

ভাবতে থাকি, কতখানি ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা আছে আমার? অবিরত প্রার্থনা করছি, যেন আমি দ্রুত মারা যাই । চিন্তা করলাম, মেরে ফেলার পর আমার মৃতদেহটার কপালে কী পরিণতি জুটবে? দেশে পাঠানো হবে? মা বাবা কি আমাকে দেখে চিনতে পারবে? ডেইজি কি কোনো দিন জানতে পারবে আমাকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদৌ কেউ কোনো দিন জানবে?

আরও কাছে চলে এল জনতার ঢল। ভাবলাম, চোখ বন্ধ করে ফেলি। আবার মনে হলো, এদের দিকে তাকিয়ে থাকি। যদি কারও দয়া হয়, কেউ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করতে নিষেধ করুক। মাটির দিকে চোখ পড়লে দেখি থরে থরে অস্ত্র সাজানো। এত বিপুল গোলাবারুদ, আরেকটা ইন্তিফাদা এক দশক জিইয়ে রাখা যাবে। ইন্তিফাদা হচ্ছে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রাম।

রাস্তার দিকে চোখ পড়লে তাকিয়ে দেখি, তালেবান সৈন্যটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা চলন্ত গাড়িকে থামতে ইশারা দিচ্ছে। বোরকা পরিহিত একজন নারী গাড়ি থেকে নেমে এলে ওনাকে আমার অবস্থান দেখিয়ে দেওয়া হয়। দুজনই হেঁটে আমার দিকে আসতে থাকে। ততক্ষণে জনতা সমবেত কণ্ঠে গান গাইতে শুরু করেছে। অথচ আমি জানতাম সমবেত সংগীত নিষিদ্ধ।

নারীটি আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে শরীর হাতড়াচ্ছিল। কী মজা, তারা হয়তো ভেবেছে আমি অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছি। পরমুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল।

আমি তুরিত গতিতে উন্মত্ত জনতার দিকে ঘুরে গায়ের কাপড় ওঠাতে উদ্যত হলাম। ভালো করে দেখে নে, ডায়নামাইটের একটা কাঠিও নেই। ভঙ্গিমাটা সেখানে ক্রোধ, ক্ষোভ আর হতাশার উদ্রেক করল। বিরাশি শিক্কার যে থাপ্পড় খেলাম, তা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল।

এই সাহসী অশ্লীল পদক্ষেপে উপস্থিত জনতার দম আটকে গেল। এক মুহূর্ত পর সবাই উল্টো দিকে ঘুরে একরকম পালিয়ে গেল। দৃশ্যটা ছিল অদ্ভুত। ঠিক যেন সিনেমার একটা চিত্রনাট্যের মতো, যেখানে মেয়ে সৈনিকেরা স্থানীয়দের ভয় পাইয়ে দিতে স্কার্ট খুলে ফেলে। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ফলাফল, মহিলা হাত তুলে আমাকে জোরে আঘাত করলেন। কে বেশি ব্যথাতুর-আমি, এই মহিলা নাকি সঙ্গের সোনালি বাদামি চুলের লোকটা। বোধগম্য হলো না।

আমাদের নরকযাত্রা জালালাবাদের দিকে এগিয়ে চলল। অসভ্য লোকটা বারবার গায়ে হাত দিচ্ছিল। একসময় আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে আমি চিকার করি, থাম ব্যাটা শয়তান। লোকটার পাঁজরের হাড্ডিতে কনুই দিয়ে জোরে চাপ দিলে সে ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। সামনের আসনের লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘটনার অর্ধেক অংশ চাক্ষুষ করল ও নির্দেশ দিল গাড়ি থামাতে।

দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। একপর্যায়ে বদমাশটাকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হয়। পরের যাত্রাটা গুলি ছোড়ার শব্দ আর সমবেত সংগীত শুনতে শুনতে পার হয়। ততক্ষণে আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি।

জালালাবাদ পৌছে আমাকে শহরের প্রতিটা মোড়ে প্রদর্শন করা হয়, যেন আমি কোনো বিজয়ের স্মারক। আমি গাড়ির জানালা সরিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকি, কেউ ইংরেজি জানে কি না। উত্তরটা ছিল সব সময় -বোধক। একটা ছোট ছেলে ভাবলেশহীনভাবে জানালা দিয়ে তাকাচ্ছিল আমার দিকে।

ছেলেটার মুখটা জলপাই রঙের। চুলগুলো অপরিষ্কার আর কোঁকড়ানো। রাজ্যের বিষাদ তার চোখে-মুখে। বাচ্চাটার চেহারা খুব মায়া মায়া। তাকিয়ে একটা সুন্দর হাসি দিই। সে-ও প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়ায়। একটা ছোট আঙুল তুলে ঘাড়ের চারদিকে ঘুরিয়ে ইশারা করে। কী দারুণ, ছোট ছেলেদের আমার কখনোই ভালো লাগে না। কিন্তু এই ছেলেটা কী পাকনা!

পরের চেক পয়েন্টে পৌছানোর আগেই গাড়ির চালক জোরে একটা কাশি দিল। মুখের চিবুনো খাট পাতা লালাসহ বাইরে নিক্ষেপ করে। থুতুটা আমার মুখে এসে লাগে।

বোরকা দিয়ে মুখটা পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রায় বমি করে দিয়েছিলাম। এক চৌরাস্তার মোড়ে এক লোক আমাকে কয়েকটা কাগজ আর কলম দিলে আমি দ্রুত জিমের নাম্বারটা লিখে ওকে একটা ফোন করতে অনুরোধ করি। লোকটা এক শব্দ ইংরেজি জানে না। সম্ভবত আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল। মনে হলো, সম্ভবত শেষবারের মতো আমি কাগজে-কলমে কিছু লিখলাম।

বিস্ময়ের ঘোর আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। ভাগ্য অমানিশার ঘোর আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। ভয় জেঁকে বসছে মনে। লোকটা গাড়ির দরজায় হাত বাড়িয়ে জোরে কিন্তু সহজভাবে আমার কবজিটা চেপে ধরে শুধু ওকে শব্দটা উচ্চারণ করে। লক্ষ করলাম, চোখ ভিজে আসছে। মনে হচ্ছিল, লোকটা আমাকে অভয় দিচ্ছে। কথা বলতে না পারলেও আমরা হাসি বিনিময় করলাম।

পেছনে তাকিয়ে মনে হলো, আজ জালালাবাদের পুরুষ গোষ্ঠীর জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। লোকগুলো শুধু মা, স্ত্রী ও বোনদের চেহারা দেখে অভ্যস্ত। গাড়ির পেছনের আসনে সোনালি চুল, নীল নয়না এক পশ্চিমা নারী বোরকা ছাড়া বসে আছে। যদি বোরাটা না খুলতাম, তাহলে হয়তো কেউই আমাকে ঘাটাত না।

গাড়ির ইঞ্জিন চালু হয় আরেকবার। তালেবান গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করছি বোধ করি। আমাদের তিনজন ও ছোট মেয়েটাকে একটা পরিষ্কার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিয়ে বসানো হয়। এখানে টয়লেটের সুবিধাও রয়েছে। আমাদের একা বসিয়ে রেখে দরজাটা বাইরে দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। আমি জানের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোনো কথা বলতে নিষেধ করি। রুমে গোপন শব্দধারণ যন্ত্র থাকতে পারে। আফগান লোকটা অবশেষে কথাটা বুঝতে পারে। ওদের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কিছুই বলব না।

আধা ঘণ্টা পরে আমাদের পাহারা দিয়ে আরেকটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকটা হাসপাতালের মতো। এখানে ছোট একটা বিছানাও আছে। আমি পাহারার দায়িত্বে থাকা লোকটাকে বলি দুজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে একই কক্ষে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। এটা তালেবানদের রাজত্বে পুরোপুরি নিষিদ্ধ একটা ব্যাপার। অবস্থাকে আমার অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকি। কৌশলটা কাজে দেয়। আমাকে আগের ঘরটাতে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমার পাহারাদার, যে এক শব্দ ইংরেজি বুঝতে অক্ষম, আমাকে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় দরজায় তালা দেওয়া থাকবে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমি যেন দরজায় আঘাত করি। অধিকাংশ তালেবান সৈন্যের মতো এই লোকটার চেহারার দিকে তাকালেও ভয় করে। ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল বাদামি ভারী পাগড়ি দিয়ে আড়াল করা। পাগড়িটা একটা বিশাল উপজাতীয় টুপির চারদিকে পঁাচানো। টুপিটা দেখে বুঝতে পারি, লোকটার বাড়ি উত্তর-পূর্বের কুন্দুজ অঞ্চলে। এতে সম্ভবত দুই হাজারের বেশি রং রয়েছে।

বিছানো লাল কার্পেটে বসে পড়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতখানি? তবে আমি নিজেই বেঁচে থাকা নিয়ে আশাবাদী হতে পারছিলাম না। এখন কয়টা বাজে? জিম বোধ হয় টেবিলের পাশে বসে আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে।

খুব অসুস্থবোধ করছিলাম। অনেক ভয় লাগছে। পৃথিবী কি কোনো দিন জানতে পারবে আমি তালেবানদের হাতে আটক? আমার ক্যামেরার ভাগ্যেই বা কী জুটেছে? নিকনের মালিকদের নিজস্ব ক্লাবে যে ছাড় পেতাম, সে সুযোগ বোধ হয় হাতছাড়া হয়ে গেল।

মাঝেমধ্যে কঠিন পরিস্থিতিতেও দু-একটা চুটকি মনে পড়ে যায়। হাস্যকর। ক্যামেরার ফিল্মে কাদের ছবি তোলা আছে, কামা গ্রামের কোনো অধিবাসীর চেহারা কি চিহ্নিত করা যাবে? আশঙ্কার মেঘ বারবার উঁকি দিল। কত সব উদ্ভট চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল হলো, বোরকায় হাত পেঁচিয়ে আছে।

তখনই কানে একটা পরিচিত শব্দ শুনতে পেলাম। তালা মোচড়ানো আর চাবি ঘোরানোর শব্দ। গোয়েন্দা প্রধান, ঠান্ডা নির্মোহ চেহারার একজন মানুষ, যার চেহারায় আবেগের কোনো ছাপ নেই। লোকটার চোখে একটা শীতল চাহনি। আমার কল্পনা ভয়ের অতলে নামছে। লোকটা নিজেই কি অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাবে নাকি উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রথম পাথরটা লোকটার পাষণ্ড হাত দিয়ে নিক্ষেপিত হবে?

লোকটার চরিত্রে একটা রহস্যময় দিক আছে। আমাকে ব্যক্তিগত কিছু তথ্য লিখতে বললে জবাব দিই আমি একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক। চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় কমতি ছিল না। কিন্তু এতে গোয়েন্দা প্রধানের চেহারায় কোনো ভাবান্তর দেখা দিল না। যদি বলতাম আমি ইংল্যান্ডের মহামান্য রানির বিশেষ দূত, তাহলেও সম্ভবত লোকটার পাথুরে মুখে কোনো পরিবর্তন আসত না।

লোকটা চলে যাওয়ার পর মনে কিছুক্ষণের জন্য শান্তি ফিরে এল। কায়দা করে একটা কলম লুকিয়ে রেখে দিয়েছি। এখন কয়েক পাতা কাগজ পেলেই পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে যাব।

দিনটা ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। আমার পক্ষে এই দিনের স্মৃতি কখনো ভোলা সম্ভব নয়। আমার পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা সহকর্মীদের অনেকের কাছেই দিনটা বিশেষ অর্থবহ। আমি ভাবছিলাম জিম কখন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবে। মা অথবা বাবার কাছে জিম এই সংবাদটা পৌছে দিক, তা মোটেও চাইছিলাম না। মায়ের মতে জিম একজন পাষণ্ড পুরুষ যে তার আদরের মেয়েকে ইসলামাবাদে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ আমার মনে হচ্ছে, যৌক্তিক জায়গাতেই রয়েছি। অন্তত হাসি-ঠাট্টা করার শক্তি এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

রুমের চারদিকে পর্যবেক্ষণ করলাম। দেয়ালে একটা এসি লাগানো। এক প্রান্তে টেবিলের ওপর একটা ছোেট বই রাখা। মনে হয়, কাউকে দেওয়া হয়েছিল উপহার হিসেবে। ভেতরের পাতায় অসংখ্য স্বাক্ষর আর শুভেচ্ছাবাণী। কেন জানি মনে হলো, এই বইয়ের মালিক বা যাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, তিনি আদতে একজন ব্রিটিশ অথবা আমেরিকান।

আফগানিস্তানে তিনি জীবনের নতুন ইনিংস শুরু করেছেন।

বইটার নাম তাতারিদের কাফেলা। লেখকদ্বয় ফ্রান্সের অধিবাসী রোলান্ড ও সার্বিয়া মিখাদ।

বইটা প্রথম ১৯৭৮ সালে লেখা হয় এবং মিখাদ পরিবারের উপজীব্যের বর্ণনা আছে এতে। এই দম্পতি আফগানিস্তান ঘুরে গেছেন এবং এখানের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কিছু অসাধারণ ছবি তুলেছেন। ভাবতে থাকি বইয়ের মালিক কে? কেনই-বা এটা ফেলে রাখা হলো। কারণ যা-ই হোক, বইটা পেয়ে মনটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে রাখতে পেরেছি।

বইয়ে মন না দিলে তালেবানদের নির্মম পাথর নিক্ষেপ অথবা শিরচ্ছেদের শাস্তির কথা বারবার চোখে ভেসে উঠত। সায়রা শাহের প্রামাণ্যচিত্র ‘ববারকার আড়ালে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা অনুধাবন করতে পারবেন এই অঞ্চলের নিষ্ঠুরতা কী নির্মম হতে পারে।

মেয়েটা বোরকার নিচে একটা ক্যামেরা লুকিয়ে চুপিসারে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল মেয়েদের ওপর তালেবানদের বর্বরতা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরতে।

গোপনে কয়েকটি ফুটবল মাঠে শিরচ্ছেদের ভিডিও ধারণ করেছিল।

ইশ, যদি আমার শিরচ্ছেদও তার ক্যামেরায় ধরা পড়ত।

বসে বসে বুড়ো আঙুল নাচাচ্ছিলাম। নাকে এসে একটা তীর লাগল। পরখ করে দেখলাম, গন্ধটা আমার শরীর থেকে আসছে। গত দুই দিনে একবারও গোসল করিনি। পরনের ট্রাউজার আর জামাটা নাইলন আর কৃত্রিম তন্তুতে বোনা। ঘর্মাক্ত শরীর থেকে ভুরভুর করে গন্ধ বের হচ্ছিল। চুলগুলো আঠার মতো মাথায় লেপ্টে ছিল।

পাহারাদার আব্দুল্লাহ মৌনির কিছু খাবার নিয়ে প্রবেশ করলে আমি খেতে অস্বীকৃতি জানাই। গত দুই দিনে পেটে একটা দানাপানিও পড়েনি। কিম্ভ রাগ, ভয়, উত্তেজনা আর শিহরণে পাহাড় চাপা দিয়ে মুখে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল না। আব্দুল্লাহ ইংরেজি জানে না। ইশারায় বোঝালাম, মায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ পর্যন্ত আমি কিছুই খাব না।

গোয়েন্দা প্রধান অল্প কিছু ইংরেজি জানেন। তিনি জানতে চাইলেন আমি কেন খাচ্ছি না। এবার তার সঙ্গে আরও তিনজন তালেবান। হামিদ নামের একজন দোভাষীর কাজ করছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কণ্ঠস্বর দৃঢ় রেখে জবাব দিলাম, মায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ পর্যন্ত আমি কিছুই খাব না। আর বন্দিনী অবস্থায় আমার কিছু খাওয়ার ইচ্ছা নেই। শুধু মেহমান হিসেবেই আমি আহার করতে পারি।

তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে নিজের কাছেই নিজের মনে হচ্ছিল, এ রকম আত্মম্ভরী বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা বলার সাহস কোথায় পেলে? তারাও একই রকম ভেবেছে হয়তো। দরজা বন্ধ করে খাবার নিয়ে ও ফোনের ব্যবস্থা না করে চলে যায় তারা। আমি তারজালি দিয়ে ঢাকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আর কেউ আমাকে দেখতে এল না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম অথবা চেষ্টা করছিলাম। ভোরের দিকে কারও পায়ের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘাড়ের পেছন দিকে চুলকানি অনুভূত হলেও আমি নড়াচড়া করিনি। কুঁজো হয়ে জড়সড় ভঙ্গিতে বাচ্চাদের মতো শুয়ে ছিলাম এবং উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম কেউ একজন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলে সবকিছু আগের মতো অন্ধকার হয়ে যায়। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বুঝতে পারি লোকটা ঘরের ভেতরেই অবস্থান করছে। বলতে পারব না, আমার কি চিৎকার করা উচিত ছিল কি না। তবে চেষ্টা করলেও গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোত না। বালুর মতো শুকিয়ে ছিল কণ্ঠনালি। লোকটা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বোঝার চেষ্টা করছিল আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কি না। আমি চোখ বন্ধ করলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না লোকটা ঠিক আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এরপর লোকটা মাটিতে আমার পাশে বসে পড়ে আলতোভাবে আমাকে নাড়া দেয়। আমি ধড়াম করে উঠে বসি। চোখ দিয়ে দড়দড় করে পানি ঝরছিল।

আমার চোখ এই নিকষ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। শুধু একজন তালিবের অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ে। কিন্তু সে ঠিকই বিপরীত দিক থেকে আসা চাঁদের আলোয় আমাকে দেখতে পাচ্ছিল। লোকটা তার হাত ওপরে ওঠালে আমি ভয়ে পিছিয়ে যাই। হাতের পেছন দিক দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে। খুবই নরম স্বরে পশতু ও উর্দুতে কিছু একটা বলে।

পরদিন সকালে নাশতার সময়ের আগেই সরকারি অনুবাদক হামিদ চলে এল। সে বলতে থাকে, রাতের বেলা তোমার ঘুমের সমস্যা হয়েছিল দেখে একজন খুব চিন্তিত। আমার ঘুমের কোনো সমস্যা হয়নি এবং কী বলছে তা ও বোধগম্য নয়। এ কথা হামিদকে জানিয়ে দিলে ও আবারও বলে বসে, একজন তোমাকে নিয়ে সত্যিই অনেক উদ্বিগ্ন। তোমার ঘুম হয়নি এবং তোমাকে হতাশ লাগছিল।

আমি বুঝতে শুরু করি, রাতে যে-ই এসে থাকুক না কেন, সে ভীষণ বিপদে ছিল এবং জানতে চেয়েছিল আমি কোনো অভিযোগ করব কি না। আমার কোনো অভিযোগ নেই বলে পাল্টা জানিয়ে দিই। রাতে হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখে থাকলেও এখন সব ভুলে গেছি।

লোকটা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রাতে যে এসেছিল, তার কাছে সংবাদটা জানাতে চলে যায়। আমার বুঝে এল না আমি কেন অভিযোগ করতে যাব। উদ্ভট আইনের তালেবান রাজত্বে হয়তো প্রথম অপরাধটা আমি করেছি বলে অভিযুক্ত হব।

লোকটা দেখতেই পারছে আমি কী দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি এবং কোনো কিছু অস্বীকার করার কতটুকু ক্ষমতা আমার মধ্যে আছে। অনেক চিল্কার চেঁচামেচির পরে না উত্তর মেনে নেবে এমন খুব কম পশ্চিমা লোকের কথাই আমি মনে করতে পারি।

একটু পরে আব্দুল্লাহ ফিরে এসে ইশারায় দরজার ভেতর দিকে লাগানো একটা তালা দেখিয়ে দেয়। সে বলতে চাইছে, রাতের বেলায় অনাকাক্ষিত কোনো অতিথিকে এড়ানোর জন্য আমার দরজা তালাবদ্ধ করে রাখা উচিত।

আরও একবার হামিদ যে ইংরেজি শিখেছে পাকিস্তানে বসবাসের সময়, তার যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করে জানাল, আমার কোনো কিছু না খাওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই আতঙ্কে আছে। গোয়েন্দা প্রধান এসে উপস্থিত হলেন। যদিও আমার সন্দেহ হচ্ছিল, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর দোভাষীর দরকার নেই, তবুও তিনি হামিদের মাধ্যমেই কথোপকথন চালিয়ে নিতে উৎসাহী। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, এখান থেকে ফোন করা সম্ভব নয়, কারণ যোগাযোগব্যবস্থা এতই করুণ যে স্যাটেলাইট ফোন ছাড়া যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।

আমাকে একটা টেলিফোন ব্যবহারের সুযোগ দিলে আমি একটা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিতে পারতাম। কামা গ্রামের আন্তরিক মানুষেরা যারা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে তাদের কথা, জালালাবাদ বাজারের আশপাশে গতিময় জীবনের গল্প তুলে ধরা সম্ভব হতো। আজ শনিবার এবং এই দিনটা আমার জন্য মহা ব্যস্ততায় ঠাসা। এখনো কি ওরা জানতে পেরেছে যে আমি তালেবানদের হাতে বন্দী? দুজন তালেবান গোয়েন্দা আমার সাক্ষাৎকার নিতে চলে এলেন। আরও একবার আমার গ্রেপ্তার তাঁদের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, সে কারণে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আমার কথায় তারা প্রভাবিত হলেন। তবে তাঁদের মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না, সবাই যখন আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে উন্মুখ হয়ে আছে, তখন কেন একজন সাংবাদিক এই জ্বলন্ত উনুনে পড়তে এসেছে।

হামিদের সহায়তায় আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার উদ্দেশ্য। এ ও জানালাম পাকিস্তানে বসে রেডিও, টিভি ও সংবাদমাধ্যমের তিন হাজার সীমান্ত অতিক্রমের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, তাঁরা আমার কথা বোঝেননি অথবা গণমাধ্যমের উপস্থিতি তাঁদের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। আরও একবার আমি টেলিফোন ব্যবহার করতে চাইলাম। আবারও তারা অস্বীকৃতি জানালে আমি রাগে ফুসতে শুরু করি।

আমাকে একটা ফোন ব্যবহার করতে না দিলে আমার মা ভেঙে পড়বেন। আমি তাঁকে বলতে চাই এখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের নিচে আধুনিক টয়লেট আর গোসলখানার সুবিধাযুক্ত একটা কক্ষে অবস্থান করছি। জানাতে চাই তোমরা আমাকে কীভাবে আতিথেয়তা দিচ্ছ।

তিনি মনে হয় এখনো বুঝতে পারেননি আমি এখানে। তাঁকে বলতে হবে, আমি একটা ছোটখাটো সমস্যায় পড়েছি এবং সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছি। অন্যথায় বড় বড় সংবাদমাধ্যমে তোমাদের নিয়ে বৃহৎ শিরোনামে খবর ছাপা হবে। তোমাদের কোনো ধারণা আছে বাইরে পশ্চিমারা তোমাদের নিয়ে কী ধারণা পোষণ করে?

হামিদের ভাষান্তরিত কথাগুলো তারা খুব মনোেযোগ দিয়ে শুনলেন। আমি বলতে থাকলাম, মা ভাববেন, আমি এই ছাদ থেকে পায়ের গোড়ালিতে বাঁধা রশি দিয়ে ঝুলে আছি। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আর তোমরা আমাকে চাবুকপেটা করছ। হামিদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অনেক কষ্টে আমার শেষ বাক্যটা অনুবাদ করল। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দ্রু কুঁচকালেন এবং উঠে চলে গেলেন।

হ্যাঁ, আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম, এবার আমাকে একটা ফোন দেওয়া হবে। কী বোকা আমি আমার অনশন চলতে থাকলেও আমার জন্য বারবার খাবার আনা হচ্ছিল। আমি একের পর এক তাঁদের দেওয়া সিগারেট ফুঁকছিলাম। সবুজ চা-ও পান করি। এটা বেশ সতেজকর

অনুভূতি বয়ে আনে।

হঠাৎ বাতাসের বুক চিরে একটা বিকট শব্দের বিস্ফোরণ শোনা গেল। যদিও আমি হাঁটু মুড়ে বসে ছিলাম, তারপরও বিস্ফোরণের তীব্রতায় তিন ফুট দূরে ছিটকে পড়ি। হামিদের মুখে চাপা হাসি। আব্দুল্লাহ অতি কষ্টে হাসি সংবরণ করে। তখন বিকেল পাঁচটা। আব্দুল্লাহ নিজের বন্দুকটা হাতে তুলে নেয়। আফ্রিকা-আম্রিকা বলে মুখ ভেংচায়। পরমুহূর্তেই ও চলে গেল। আমি নিজেকে দৃঢ়তার সঙ্গে সংবরণ করার চেষ্টা করি। কারণ, আমেরিকা প্রতিশোধপর্ব শুরু হয়েছে বোধ হয়।

১৫ মিনিট পরে আব্দুল্লাহ ফিরে এল। ওকে দেখে হতাশ মনে হচ্ছে। আব্দুল্লাহ জানায়, কেউ একজন ভূমি মাইনের ওপর পা ফেলায় বিস্ফোরণ ঘটে। আমি জানতে চাইলাম, হতভাগ্য লোকটার ভাগ্যে কী ঘটেছে? জবাবে আব্দুল্লাহ রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকাল। ঘাড় নাচিয়ে চলে গেল।

দুই ঘণ্টা পরে দ্রুত ছুটে যাওয়া মেশিনগানের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু সব গুলি একই দিকে ছুটছিল। কোনো একটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নিকট আছি বোধ হয়।

সেই রাতে আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করি। রাতে কোনো পুরুষ মানুষ এসে বিরক্ত করল না। আব্দুল্লাহর দেওয়া উপদেশ মেনে দরজাটা ভেতর দিয়ে লক করে রাখি। আমি তখনো বুঝতে পারিনি, ঠিক কোথায় আমার অবস্থান, তবে ধারেকাছেই কোথাও একটা হাসপাতাল আছে। কয়েকজন আহত মানুষকে হাঁটতে দেখেছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, এটা একটা বন্দিশালা। এবং আমার সন্দেহ বাড়িয়ে দিতে এখানে গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি ছিল আরেক গোলকধাধা।

রোববার, ৩০ সেপ্টেম্বর, সকাল সাড়ে নয়টায় দুজন আফগান লোককে আমার কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আমাকে বলা হয়, তারা দুজন কাবুলের সাংবাদিক। আমার আগ্রহ বেড়ে যায়, কারণ, আমি যত দূর জানতাম, কাবুল থেকে সব সাংবাদিককে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাদের স্বাগত জানিয়ে অনুরোধ করি আসন গ্রহণ করতে। সাক্ষাতের মুহূর্তটা ছিল উত্তেজনাময়। কারণ, দুনিয়ার যে প্রান্তেই কাজ করুক না কেন, সাংবাদিকদের মাঝে একটা বিশেষ বন্ধন থাকে। আশা করছিলাম, এই দুজনের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীতে দু-একটা বার্তা পাঠাতে পারব। আমাকে বলা হলো তাদের সামনে আমার বক্তব্য তুলে ধরতে। এরাই আবার হামিদকে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দেবে।

এর মধ্যে তিন-চার মিনিট কথা বলে ফেলেছি। খেয়াল করলাম, তারা কেউই আমার বক্তব্য লিখছে না অথবা রেকর্ড করছে না। সন্দেহের গন্ধ পাই। হয়তো এই দুজন কোনো গোপন অনুচর। আমি তাদের ছদ্মবেশী বলে অভিযুক্ত করি। অথবা তার চেয়েও খারাপ, পালিত সাংবাদিক। তালেবানদের কথার বাইরে যাদের এক অক্ষর লেখার সক্ষমতা নেই।

মনে পড়ে, আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। নিশ্চিত ছিলাম এরা অনুচর। এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। এরা আমার আতিথেয়তার সম্মান রাখেনি। তাই তখনই বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিই। হামিদ জানায়, এই লোক দুজন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওর কথা কানেই তুললাম না। বরং দুই হাত বগলদাবা করে উঠে পায়চারি করতে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। একটা সুন্দর ফুলের বাগান চোখে পড়ছে। আমাকে অমিদ কী চরিত্রের ভেবেছিল, তা জানি না। তবে খেয়াল করি, আমার রাগান্বিত অবস্থা অথবা মন খারাপের মুহূর্তে ও কেমন ভড়কে যেত। সাবলীলভাবে অনুবাদ করতে পারত না।

সেদিন দুপুরবেলা অভুক্ত লাঞ্চের পর তিনজনের একটা তদন্ত দল আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসে। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এদের একজন গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সহকারী। লোকটার চেহারায় প্রভাবিত করার ক্ষমতা বিদ্যমান। ঘন কালো লম্বা দাড়ি গোলাপি গালটার অধিকাংশকেই ঢেকে দিয়েছে।

দাড়িওয়ালা অধিকাংশ পুরুষলোক হাড্ডিসার হলেও এই লোকটা বেশ গাঁট্টাগোট্টা। লোকটার চোখের মণি ঘন কালো এবং হাঙরের মতন অনেকটা। ভয়ার্ত একটা ছাপ চেহারায়। বাজি ধরে বলতে পারি, তিনি সেদিন অবশ্যই ভয় পেয়েছিলেন।

হামিদের মাধ্যমে তারা জানতে চাইল কীভাবে আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছি। আমার সাহায্যকারী কারা। ওই দুজন লোকই-বা কারা, যাদের আমার সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া গতদিনের প্রশ্নগুলোও উঠে আসে।

এত প্রশ্নের জবাবে ওই দুজন লোকের কোনো ভূমিকাই নেই বলে জানাই। আমার গুরুত্বপূর্ণ জীবনে এদের উপস্থিতি ক্ষণিকের মাছির মতো। উল্টো আমি জানতে চাই, তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হলো? তালেবানদের গোয়েন্দাগিরির সক্ষমতাকে সরাসরি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিই। তিন গোয়েন্দা এতে খুব বিরক্ত হয়। কালো শশ্রুমণ্ডিত লোকটা শত চেষ্টা করেও মুখের বিরক্তিভাব আড়াল করতে পারেনি। হয়তো, প্রত্যুত্তরে এখনই কোনো নখ টেনে তোলার অথবা শারীরিক নির্যাতন করার কোনো যন্ত্র এসে হাজির করা হবে।  সাংবাদিকতার কিছু নৈতিকতা রয়েছে। কোন
ো তথ্য সরবরাহকারী অথবা সাহায্যকারীর পরিচয় ফাঁস করতে অপারগ। ওদেরকে বলি, বিষয়টা সবারই সহজে বুঝে আসবে। একজন সম্মানিত মেহমানকে রক্ষা করাটাও যেমন তোমাদের কর্তব্য।

উসামার মেহমান হিসেবে অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করলেও তারা বিষয়টা এড়িয়ে গেল। কেউ আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে কোনো কথা বলছিল না। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অথবা সরাসরি ছাদের দিকে তাকাতে থাকে। পরে জানতে পারি, আফগান সংস্কৃতিতে সম্মানিত কারও দিকে তাকিয়ে সরাসরি কথা বলার প্রথা নেই। হামিদ মাঝেমধ্যে চিকার করছিল, এই মেয়ে, যখন কথা বলছি তখন সরাসরি আমার দিকে তাকাও। ব্যাটা রাগান্বিত অথবা বিরক্ত ভাব নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ক্রমেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে দেখে একপর্যায়ে আমি হেসে দিই।

বিকেলের দিকে একজন চিকিৎসক আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে আসেন। আমার মস্তিষ্ক তখনো ভালোভাবেই সচল ছিল। বুঝতে পারি, অত্যাচার শুরু করার আগে শেষবারের মতো আমাকে সুস্থ রাখার মতলব। যা-ই হোক, ছোটখাটো গড়নের চিকিৎসকের চেহারায় প্রজ্ঞার ছাপ। তিনি আমার রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন এবং কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলেন। উচ্চ রক্তচাপ আছে, ব্যাপারটা আমার জানা।

হামিদ এ কথাটা চিকিৎসককে অনুবাদ করলেও তিনি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি জানান, আমার রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে। কয়েক বছর আগে আমি উচ্চ রক্তচাপে ভুগেছি। নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে উত্তর দিই।

ব্যস্ত ডাক্তার আবার আমার রক্তচাপ মাপতে শুরু করলেন। হায় খোদা, এবার আমার নিজেকেই দেখতে হলো। হ্যা, স্বাভাবিক। তিন দিন ধরে তালেবানদের হাতে বন্দী। অথচ এখনো আমার সবকিছুই স্বাভাবিক। বুঝতেই পারছেন ডাক্তার সাহেব, আমি কতটা সুখে, আরামে আছি। এরপর তিনি হামিদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলেন। হামিদ জানায়, ডাক্তার বলে গেছেন, না খেলে আমি মারা যাব।

আব্দুল্লাহ একটা রেডিও নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। হামিদ বলল, ‘বিবিসিতে তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তুমি তো বিখ্যাত হয়ে গেছ। সবাই শুধু তোমাকে নিয়েই কথা বলছে। আমি চ্যানেল ঘোরাতে থাকলে তারা দুজন উৎসুক ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে। একটা চ্যানেলে খেলার খবর বলছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তিন গোলে টটেনহামের কাছে ধরাশায়ী। ইংরেজি বাক্য শুনতে পেয়ে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়েছিলাম যে রেডিওটা হাত থেকে পড়ে যায়। চ্যানেলটাও ধাক্কা লেগে সরে যায়। আরও কিছু খাবারের বাটি আমার রুমে আনা হয়। আমি সাফ সাফ হামিদকে জানিয়ে দিই, মায়ের সঙ্গে কথা বলার আগে আমি কিছুই মুখে তুলছি না।

বন্দিত্বের দিনগুলোয় আমি তারিখ উল্লেখ করে কিছু হাবিজাবি কথাবার্তা লিখে রেখেছিলাম। পাণ্ডুলিপি হিসেবে একটা টুথপেস্টের কার্টন ব্যবহার করেছি। কার্টনের গায়ে চোখ মেললেই সেই দিনগুলোতে আমার অভিজ্ঞতার কথা কল্পনায় ভেসে ওঠে।

ঠিক রোববার দিন লিখেছিলাম, বিবিসি শোনার জন্য আমাকে একটা রেডিও দেওয়া হয়েছে। ওরা জানতে চেয়েছে আমার আর কী প্রয়োজন।

সেদিন আরও লিখেছি, হামিদ জানায় আমার অনাহারী অনশন নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। খাবারে কোনো সমস্যা আছে কি না। অথবা বিশেষ কিছু কিংবা হোটেলে রান্না করা খাবার খেতে চাই কি না।

তারা আমাকে প্রতিনিয়ত তাদের মেহমান বলে সোধন করছে। আমার দুঃখে তারাও দুঃখিত। আমার এসব বিশ্বাস হচ্ছে না। দয়া প্রদর্শন করে তারা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে।

এই জাতিটা অনেকটা গোর্খাদের মতো। এরা খুব শান্ত, ভদ্র ও বিবেচক। কিন্তু রণাঙ্গনে এদের মতো নির্ভীক যোদ্ধাবাহিনী আর একটাও নেই। আমার ইচ্ছে হলো, সবাই যদি জানত আমার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করা হচ্ছে, তাহলে একটু স্বস্তি পেতাম। সমগ্র বিশ্বের ধারণা, আমার ওপর কঠিন অত্যাচার চলছে, যৌন নিগ্রহ আর প্রহারে প্রায় আধমরা। অথচ এখন পর্যন্ত আমার প্রতি দয়া আর সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে। অবিশ্বাস্য!

ধুত্তোরি, কীভাবে যেন রেডিওটা ভেঙে ফেলেছি। দুনিয়াবাসী আমার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত কি না, তা জানতে পারছি না। কয়েক দিন আগে একটা প্রতিবেদন শুনেছি, কাবুলে আটজন যাজককে আটক করা হয়েছে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগে।

আরও অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। সম্ভবত খণ্ড খণ্ড রোজনামচাগুলোতেই সেই দিনগুলো ভালো ধরা পড়বে।

সোমবার, পয়লা অক্টোবর।

প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছেই। একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক। আমার মাঝেমধ্যে অসহায় লাগে। আজকে জেরা করার দায়িত্বে ছিলেন শুকনা, লম্বা হ্যাংলা গড়নের বিজ্ঞ চেহারার এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লাল দাড়ির মোটাসোটা একজন। উভয়ের চেহারায় কেমন ভয় দেখানোর নিরন্তর চেষ্টা। আরেকবার ব্যাখ্যা দিই কেন সীমান্ত অতিক্রম করেছিলাম। কিন্তু তাদের চেহারার কঠোর ভাব দূর হলো না। হামিদ আমার কথা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্বাস করতে না পারলেও আমার বক্তব্য তাদের বোধগম্য হয়েছে।

একবার মনে হলো, আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে। আমার ব্যাখ্যা তারা গ্রহণ করেছেন। ঠিক এমন সময় হামিদ আবার জিজ্ঞেস করল, কীভাবে আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছি, যেন তার ঠিক ঠিক বর্ণনা দিই।

আমি ক্রোধ আর হতাশায় বাতাসে হাত ছুড়ে বলি, তালেবানে যোগ দেওয়ার খায়েশ মনে জাগায় আফগানিস্তানে এসেছি। সম্ভবত এটা একটা বাজে মন্তব্য। এমন আচরণের জন্য বুকে একটা গুলি এসে বিধতে পারে। মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই বিপদের চিন্তা মাথায় এল।

এতক্ষণ পর্যন্ত তদন্তকারীরা পেছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হামিদ উদ্বিগ্ন হয়ে আমার কথা পশতুতে ভাষান্তর শুরু করতেই তাঁরা দুজন একসঙ্গে কেঁপে উঠলেন। কাঁধ নাড়িয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। এ রকম রসবোধ নিষ্ঠুর তালেবানদের কাছ থেকে একদমই অপ্রত্যাশিত।

যাক, ভালোই লাগছে, আমার অনুসন্ধানকারীরা অল্প হলেও রসিক মানুষ। পাঁচ মিনিট পরে আমিও হেসে দিলাম। তাঁদের দাবি, আমি আমেরিকার গোপন এজেন্ট। সমুচিত জবাব দিলাম, আমেরিকার গোপন অস্ত্র হয়ে যদি এত সহজে ধরা পড়ে যাই, খোদা যেন সে ক্ষেত্রে আমেরিকাকে সাহায্য করেন। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করি, আমেরিকার গোয়েন্দা হলে আমার ব্যাগভর্তি জেমস বন্ডের গোপন যন্ত্রপাতি থাকত। পরিবর্তে কেবল একটা নাইকন ক্যামেরাই আমার গোয়েন্দাগিরির সম্বল।

আমি কী কী ছবি তুলেছি, তাঁরা জানতে চাইলেন। ক্যামেরার ফিল্মে অল্প কয়েকটা ছবি তোলাই সম্ভব হয়েছে জানিয়ে অনুরোধ করি ছবিগুলো প্রিন্ট করে দেখে নিতে।

সন্দেহ জাগল, হয়তো কেউ একজন আমার ক্যামেরা অথবা ফিল্মটা নষ্ট করে দিয়েছে। ছবি তোলা নিষিদ্ধ হওয়ায় এখানে প্রিন্ট করার ব্যবস্থাও হয়তো নেই।

একই প্রশ্নে বারবার জেরা করতে থাকায় আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। আমি সোজাসাপটা জানিয়ে দিই, একই প্রশ্নের উত্তর বারবার দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তাদের অসুবিধার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এ সময় তাদের অন্য কোথাও মনোনিবেশ করার কথা। কিন্তু আমি মাঝখানে বিরাট ঝামেলা হিসেবে উদয় হয়েছি।

আমি স্বীকার করছি, আমি পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই এখানে এসেছি। কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। আমার কথায় তারা অসন্তুষ্ট হলেও মনে হচ্ছে, বৈঠকগুলো সুন্দর সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে। আমাকে এক-দুই দিনের মধ্যেই বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে বলে তারা জানালেন। আমি ডায়েরিতে লিখেছিলাম, আমি খুশি। যদিও এ রকম এক-দুই দিনের প্রতিশ্রুতি এর আগেও কয়েকবার দেওয়া হয়েছিল।

লাল বিছানাগুলোর একটাতে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময় বাইরে গন্ডগোল শুনতে পাই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। সেই আফগান সাংবাদিককে এদিকে আসতে দেখি। হাতে একটা স্যাটেলাইট ফোন। আমার জন্য সে সারা রাত অপেক্ষা করেছে এবং সত্যি সত্যি আমাকে সাহায্য করতে চায়। লোকটা আমার মায়ের ফোন নম্বর চাইল। আমার কোনো কথা থাকলে তা মায়ের কাছে পৌছে দেবে। আমি যোগাযোগের নাম্বার দিতে অস্বীকৃতি জানাই। একজন অপরিচিত লোকের কাছ থেকে আমার খবর শুনতে পারলে মা চিন্তায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই আমি এ প্রস্তাবে না বলি।  আমি ল
োকটাকে আমার হাতে টেলিফোনটা দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করি। হঠাৎ আব্দুল্লাকে আসতে দেখে পর্দাটা টেনে দিই। আমার কিছু প্রয়োজন আছে কি না জানতে এদিকেই আসছিল সে। আবারও দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ রাখার কথা মনে করিয়ে দেয়। রাতের বেলা বাথরুমে যাওয়ার দরকার হতে পারে জানানোয় আব্দুল্লাহ বাইরে থেকে দরজা আটকে

রাখতে রাজি হয়েছিল। চলে গেলে আমি দ্রুত একটা কাগজে মায়ের উদ্দেশে লিখি, আমি ভালো আছি মা, নানি আকাশ থেকে আমার দেখাশোনা করছেন।

সবাইকে আমার ভালোবাসা জানাতে বলি। বাবাকে বলবে, আমি তার সাহসী মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করছি। আমি আরও লিখি, ডেইজি যেন বোর্ডিং স্কুলেই থাকে। ওর জীবন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। খুব সাধারণ কয়েকটা বাক্য। কিন্তু এটা পেলে মায়ের কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। আমি জানালার কাছে ফিরে গিয়ে ছোট একটা ছিদ্র দিয়ে কাগজটা স্যাটেলাইট ফোনধারী আফগান সাংবাদিকের হাতে তুলে দিই। লোকটা খুশিমনে কাগজটা হাতে নেয়। ইঙ্গিত দিই, এই চিঠিটা ঠিকঠাক ঠিকানায় পৌছে দিলে আমার জীবনের দারুণ একটা গল্প শোনাব।

ডায়েরিতে লিখেছি —

লোকটাকে সৎ, অমায়িক মনে হচ্ছে। কিন্তু তার মনের প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব নয়। খুব করে চাচ্ছিলাম, মায়ের কাছে একটা খবর পৌছাক। ডেইজি কেমন আছে জানতে মনটা অস্থির হয়ে ছিল। সামনের বুধবার তার জন্মদিন। একটা কার্ড আর উপহারের আশায় ও অপেক্ষায় থাকবে। বাইরের দুনিয়ার কোনো খবরই আমার কাছে নেই। বোমা নিক্ষেপ কি আদৌ শুরু হয়েছে? এই দিনগুলোতে নিজেকে বড় একা মনে হচ্ছে। পরিবার ছাড়া আর কেউ কি আমার কথা ভাবছে?

মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। হাত, পা আর মুখের সর্বত্র কামড়ের দাগ। চুলকাতে চুলকাতে চামড়ার দাগ উঠে গেছে। ওপরে বা নিচে মশা মারার চেষ্টা করেছি বহুবার। বিরক্তি চেপে বসেছে। আমার কক্ষটা সাত ফুট দীর্ঘ আর পাঁচ ফুট প্রশস্ত। গতকাল মাথার ওপর একটা ফ্যান ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাখাগুলো মিনিটে সাতবার ঘুরে, ঘণ্টায় ৪২০ বার।

ইভন, স্বাভাবিক থাক। আচ্ছা, আমি কি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়ছি? আমার কাছে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা কখনোই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অফিসের কী খবর? এখনো কি চাকরিতে বহাল আছি? তাদের অবশ্যই এত দিনে জানার কথা আমার দুঃসাহসিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এই বন্দিদশা শেষ হবে।

জানালা দিয়ে বাইরের সুন্দর মনোমুগ্ধকর ফুলবাগান চোখে পড়ে। ফুলের পাপড়ি দেখতে দেখতে আমার সময় চলে যায়। এটা কোনো পুলিশ স্টেশন নয়। আবার সামরিক ঘাঁটি হওয়ার কথাও নয়। বাগানের চারদিকে একটা ছোট ঝরনা আছে।

আলো পড়ে পাথরগুলো ঝকমক করে ওঠে। ব্রিটিশ বিশেষ গোয়েন্দা দল যদি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেত! আমার বিবেচনা বলছে, তারা এই দেশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাদের কাছে কি আমার বন্দিত্বের খবর পৌঁছেছে? হয়তো গোপনে আমাকে উদ্ধারের পরিকল্পনা চলছে।

মাঝেমধ্যে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা হয়। বোরকাটা এখনো আমার কাছেই আছে। গভীর রাতে বোরকা পরে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়লে কেমন হয়? বড্ড বিপজ্জনক, কিন্তু এটা ছাড়া আমার আর কী করার আছে!

কী শাখের করাতে আটকা পড়লাম!

পরদিন হঠাৎ করেই প্রশ্নোত্তর পর্বের মোড় ঘুরে গেল। হঠাৎ করেই আমার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নিয়ে তালেবানদের আগ্রহ বেড়ে গেল।

তারা আমার বাবা ও দাদার নাম জানতে চাইল, যা আমার পক্ষে বলা সম্ভব হলো না। সবাই এতে খুব অবাক হয়ে গেল। বিষয়টা হয়তো অসম্মানজনক। কিন্তু প্রপিতামহ আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছেন, আমিও প্রতিবাদ করি।

প্রশ্নের গতিধারার রং বদলাতে থাকে। তারা কিছু নথিপত্র ঘেঁটে দেখছিল এবং সেখান থেকে আমাকে প্রশ্ন করছিল। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। হয়তো তারা আমার ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। কিন্তু কী কী তথ্য তাদের হস্তগত, তা আমি জানতে পারছি না। গত সপ্তাহের আগ পর্যন্ত আমি কখনোই এই দেশে পা মাড়াইনি।

কখনো ইরান গিয়েছি কি না জানতে চাইলে আমি না জবাব দিই। কী অদ্ভুত প্রশ্ন, আমি ইরান যেতে চেয়ছিলাম এবং গত বছর ডেইজির সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার সব পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছিলাম। জানতে পারলাম, ইরানের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে একক মায়েদের সহ্য করা হয় না। এমনকি ইসলামি মৌলবাদীদের পাথরের আঘাতে আমার মৃত্যুও হতে পারে।

মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর।

তিন থেকে চারজন লোক জেরা করার দায়িত্ব নেয়। বিক্ষিপ্তভাবে প্রশ্ন আসতে থাকে। ওদের চলে যাওয়ার পর হামিদ ফিরে আসে। আমার সন্দেহ হয়, হামিদ নিজেও একজন গোয়েন্দা অফিসার। ও পাগড়ি পরিহিত নয়, মুখের দাড়িও অল্প। তারপরও মাঝেমধ্যে ওকে আমার ভয় হয়।

আমি ভীষণ বিপদে আছি। হামিদ বলতে থাকে, তোমার একটা মেয়ে আছে, যার নাম ডেইজি। তোমার জীবনের অনেক কিছুই তুমি তালেবানদের বলোনি। তুমি বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছ। অনেক কিছুই তুমি তালেবানদের বলোনি।’

হামিদ থামল না, এখনো সময় আছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু তুমি কোনো সুযোগ দিচ্ছ না। এখনো সময় আছে, সঙ্গের দুজন লোকের পরিচয় দিয়ে দাও। ওদের ওপর অত্যাচার চলছে এবং মারধর করা হচ্ছে ।

আমার মাথাটা ঘোরাচ্ছিল। আমি হামিদকে বিশ্বাস করতে পারি না। ওর ওপর আস্থা রাখাটাও বোকামির লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে। মনে পড়ে, আমি বলেছিলাম, তুমি ডেইজির কথা জানতে চাওনি। মনে করে দেখো, আমি একলা থাকি, এটা বলার পর তুমি আর কিছু জানতে চাওনি। ডেইজির বাবার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আলাদা থাকার অর্থ কী, তোমরা বোঝো না?

আমি আবার বলতে থাকি। ডেইজির বাবা একজন সুন্নি মুসলিম। তাঁর নাম আবুল হাকিম অথবা দাউদ জারোরা। জাতে ফিলিস্তিনি। তোমাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখো তিনি কী অসাধারণ মহান যোদ্ধা ছিলেন।

নির্লজ্জের মতো আমি ডেইজির বাবার নাম বলছিলাম, এখান থেকে মুক্তির আশায়। ভেবেছিলাম এর ফলে আমার মুক্তির পথ সুগম হবে। কিন্তু ডেভিডের কথা শুনেও হামিদের চেহারায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিছু একটা ঘটেছে এবং এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। সে আবার বাকি দুজন লোকের কথা জানতে চাইল এবং তাদের অত্যাচার ও প্রহার করা হচ্ছে বলে পুনরাবৃত্তি করল।

তোমাদের যা ইচ্ছা করো। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। নিরপরাধ লোকদের অত্যাচার করে যদি তোমাদের পাশবিক আত্মা শান্তি পায়, তবে করতে থাকো। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে একটা সুন্দর গল্প লিখতে পারব। তোমার তালেবান বন্ধুদের কথাটা বলে দিয়ে।

আমার কথায় সে বেশ আঘাত পেল, মনে হয়। দিনের বাকি অংশে আর কেউই আমার কাছে এল না। তদন্তের মুখে পড়ার চেয়েও একাকী বসে থাকাটা বিরক্তিকর ঠেকছিল। সম্ভবত, তালেবান ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করেছি। নির্যাতন পর্ব শুরু হলো বলে। অনেকটা সাপ লুডু খেলার মতো কাণ্ডকারখানা হচ্ছে। এক পয়েন্ট অর্জন করার সঙ্গেই কয়েক পয়েন্ট পিছিয়ে যাচ্ছি।

২ অক্টোবর ডায়েরির শব্দগাথায় মনের অব্যক্ত হতাশাগুলো গভীরভাবে ফুটে উঠেছিল না।

এখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বলতে গেলে পুরো দিনটাই অনর্থক নষ্ট হয়েছে। কেমন একটা উদ্বেগের পাহাড় গড়ে উঠছে। আমি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পথে। খাবার নিয়ে আসা ও যাওয়ার সময় কেউই আমার মুখের দিকে তাকাতে সাহস পায় না। আমি বিভ্রান্ত, ভ্রষ্ট এবং ভয়ংকরভাবে ভীত।

বাতাসে একটা চাপা উত্তেজনা। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছিল, আমার পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তারা হয়তো শিগগিরই আমাকে মেরে ফেলবে। কিছু একটা করতে হবে। ভয়ে আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি। বাথরুমে জং ধরা একটা পুরোনো ব্লেড আছে। সাবানের ভেতর লুকিয়ে ফেলব? মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে আমি নিজেই নিজের মারা যাওয়ার পথ বেছে নেব। কিন্তু মেরে ফেলতে চাইলে অদ্ভুতভাবে আমার সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার কেন করা হচ্ছে? আজ সারা দিন আব্দুল্লাহ আর হামিদ কোথায় ছিল?

আমি রুম থেকে বেরিয়ে পরিচালকের কক্ষে টোকা দিই। একটা বদমেজাজি লোক ঘুমাচ্ছে। আমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত নেড়ে বেরিয়ে যেতে বলল। তাকে বললাম, পরিচালকের সঙ্গে দেখা করা দরকার।

লোকটাকে আগে কখনোই দেখিনি।

কী একটা দুঃসহ রাত ছিল এটা। আমি পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করার পর আব্দুল্লাহ ও হামিদ দৌড়ে এল। আমার নাকি একজন ডাক্তার প্রয়োজন। তাদের চেহারায় ছিলো উদ্বেগের ছাপ। কিন্তু আমি একদম স্বাভাবিক আছি। পরিচালক বা ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করতে চাই, ডক্টর নয়। হামিদকে বলি, স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারছি আমি, আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমার শেষ ইচ্ছা ও বক্তব্য লিখে রাখার জন্য একজন আইনজীবীকে দরকার।

ও আমার দিকে বোকার মতো একটা দৃষ্টি দিয়ে চলে গেল। আধা ঘণ্টা পরে পরিচালক এলেন এবং জানতে চাইলেন আমার কী প্রয়োজন। আমি তাঁকেও একজন আইনজীবীকে উপস্থিত করার জন্য অনুরোধ করি। একই সঙ্গে বলে দিই, এটা একটা ন্যূনতম মানবিক অধিকার। অস্বীকার করার জো নেই।

প্রতিদিন বারান্দা পার হওয়ার সময় গলায় দম আটকে আসত। বাথরুমের বিপরীত দিকে রেজর ব্লেডটা রাখা। প্রতিদিন আমি এটাকে দেখি। কিন্তু আজ ব্লেডটা তুলে নিই। পাকিস্তানের তৈরি ভিজয়া ব্লেড। আমি ব্লেডটাকে নিজের কাছে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এতে করে অশান্ত মন কিছুটা হলেও শান্ত হবে। তা ছাড়া যদি সময় এসে হাজির হয়, তাহলে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব কখন আমার জীবনাবসান হবে।

আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানুষ নই। কিন্তু পাথরের আঘাতে অথবা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুবরণের চেয়ে আত্মহত্যা ঢের ভালো। এখন আমি নিরাপদে বাসায় বসে আছি। ঠান্ডা মস্তিষ্কে এসব ভাবনাকে অপরিণত মস্তিষ্কের বলে প্রতীয়মান হবে। অথচ ১১ তারিখের দিনগুলোর কথা বিবেচনায় আনলে এমন চিন্তা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

তুলনাটা হয়তো যুক্তিযুক্ত হবে না। কিন্তু সেদিন বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের অনেক কর্মী আগুনে পুড়ে মরে যাওয়ার চাইতে লাফ দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে সেদিন শান্ত নীল আকাশের নিচে আগুনের আবির্ভাব হয়েছিল। আমারও এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসতে পারে। তাই ভিজয়া ব্লেডটাকে অতি সন্তর্পণে তুর্কি সাবানের নিচে লুকিয়ে রাখি। সাবানটা পেয়েছিলাম একদম প্রথম দিন।

পরের দিন ছিল অন্য রকম ঝক্কিঝামেলা পূর্ণ । দিনের শুরুটা ছিল মন সতেজকারী। আমাকে নতুন পোশাক দেওয়া হলো। কমলা রঙের জামাটা আমি প্রায় সাত দিন ধরে পরে আছি। দুর্গন্ধ আর ঘামে নাক চেপে রাখতে হতো। আব্দুল্লাহ এসে নতুন পোশাকগুলো দিয়ে যায়। সাংস্কৃতিক আর ধর্মীয় ব্যবধান ভুলে গিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। আব্দুল্লাহ ফিক করে হেসে দেয়। তবে এমন অপ্রত্যাশিত অভিবাদনে খানিক চমকে গিয়েছিল। একটা পোশাক ছিল হালকা বাদামি রঙের সঙ্গে দুধেল মিশেল। কিন্তু অন্য পোশাকটা একজন বন্দিনীর জন্য একটু বেশি অভিজাত। এটাকে একটা বিয়ের পোশাক বলে মনে হলো। পরে আমার ধারণাই সত্যি হয়েছিল।

দিনটা বিষাদময় কাটে। আজ ডেইজির নবম জন্মদিন। আমি মেয়ের উদ্দেশে গান গাইলাম। চোখ বন্ধ করে মনের ভেতর ডেইজির চেহারা স্মরণ করি। নিজের চারদিকে হাত জড়িয়ে কল্পনায় ওকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখি। ওর কথা খুব বেশি মনে পড়তে থাকে। ভাবতে থাকি, আবার কি কন্যার মুখখানি দেখতে পাব? একই সঙ্গে চিন্তা এল মাথায়, আমার কথা কতটুকু ওর মনে থাকবে। ও কি মনে রাখবে আমাদের শেষ কথোপকথন?

আসার আগে ডেইজিকে বলে এসেছি, যখনই আমার কথা মনে পড়বে ও যেন দুই চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে আমার কথা। উপস্থিত হয়ে সাহস জোগাব মনে মনে। এসব ভাবতে ভাবতে চোখটা ভিজে এল। মনটা দুঃখ ভারাক্রান্ত। কোনো কিছুই এখন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। অনশন আর রেজর ব্রেড মানসিক শক্তি নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অক্টোবরের তৃতীয় দিনের বিশেষ ঘটনা সুন্দরভাবে তোলা আছে ডায়েরির পাতায় উসখুস লাগছিল খুব। কিছু করার নেই। অবচেতন মনে একটা ক্রিমের কৌটা নিয়ে খেলতে শুরু করি। আটককারীরা কদিন আগে একটা নতুন জামা দিয়ে গেছে। জামাটা থেকে সুতা এদিক-সেদিক খুঁটে বের করতে গেলে হঠাৎ হাতে তিনটা গুটি আটকে যায়। মনে পড়ে গেল তিন স্রষ্টার অস্তিত্বের কথা। মহান পিতা খোদা, পুত্র খোদা ও খোদার ছায়ার অস্তিত্ব। ঠিক কী কারণে মন ধাবিত হলো জানি না, তবে আমি প্রার্থনা করতে বসে যাই।

চোখ বুজে খোদার কাছে শক্তি প্রার্থনা করি। মনে হলো, শরীর থেকে সব জড়তা ও ক্লান্তি ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে শক্তি এসে ভর করল। সময়টা ছিল খুব আন্তরিক। গভীর প্রার্থনায় যেন স্রষ্টার নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিলাম। পরিচিতজনেরা অবশ্য এসব আধ্যাত্মিক কথা শুনে চোখ উল্টে ফেলবে, বিশ্বাস করতে পারবে না।

তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, একদম মুখে-কানে তালা লাগানো বন্দী হয়ে যাব। আজ থেকে আর কোনো প্রশ্নের উত্তর নয়। সেদিনই সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমাকে জানানো হলো, কাল বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। একদল খ্রিষ্টান যাজক, যাদের ইতিমধ্যে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল, তারা হবেন আমার যাত্রাসঙ্গী।

আমার মানসিক শক্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। আমার প্রার্থনায় মন দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমার ঘুম ভাঙে। হামিদের ঘড়িটা ও আমাকে দিয়েছিল। উত্তেজনায় সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। খোদা এত দ্রুত আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন। প্রার্থনার শেষ অংশটা ঠিকমতো শেষ করিনি। সমস্ত অশুভ শক্তি থেকে রেহাই চাওয়ার দরকার ছিল। সারা জীবন অশুভ মুহূর্তের উপস্থিতির জন্য আমাকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

হামিদ ও আব্দুল্লাহ এসে সানন্দের সঙ্গে একটা পশতু ভাষার পত্রিকা চোখের সামনে মেলে ধরে। সম্ভবত তালেবান বুগল। প্রথম পাতায় আমার বড় ড় দুটো ছবি। একটা ছবি সানডে এক্সপ্রেস-এ ছাপা হয়েছিল আমার আটক হওয়ার খবরের সঙ্গে। আরেকটা ছবি খাইবার পাসে তোলা। বিদেশিদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ লেখা সাইনবোর্ডের সামনে দাড়িয়ে তুলেছিলাম। তালেবানদের আইনে পত্রিকায় মেয়েদের ছবি ছাপানো বা তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অবশ্য আমি ছিলাম নিয়মের ব্যতিক্রম।

বোঝাই যাচ্ছে, বিখ্যাতদের তালিকায় নাম লিখিয়েছি। হামিদের মতে, জালালাবাদের সবাই আমাকে চেনে। জানতে চাইলাম, শিরোনামে কী লেখা? একনজর দেখে হামিদ হাসতে থাকে।

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে হামিদ শিরোনামটা পড়ে শোনায়। ইভন রিডলি ভালো আছেন। শিরোনাম শুনে আমিও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। একাধিকবার আমার রক্তচাপ মাপা ডাক্তার অথবা তার পরিচিত কেউ গণমাধ্যমে আমার সুস্থতার কথা ছড়িয়েছে। অথবা নিজেদের আতিথেয়তার কথা জাহির করে মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়ার তালেবানি চেষ্টাও হতে পারে। কে জানে সত্যিটা!

কাবুল বিমানবন্দর পর্যন্ত আব্দুল্লাহ আমাকে পৌছে দিয়ে আসবে। হামিদ সঙ্গে আসবে কি না জানতে চাইলে ও যেতে পারবে না বলে জানায়। আমি শেষমেশ অনশন ভেঙে একটা রুটি খেতে রাজি হলাম। আমার খাওয়া দেখে দুই হতভাগা বন্ধু যারপরনাই আনন্দিত হলো। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তখনই আমার পায়ের দিকে হামিদের চোখ পড়ে এবং জুতাবিহীন আমার নগ্ন পা দেখে হামিদের একটু মনে হয় মায়া হলো।

ব্যাপার না, জুতার দরকার নেই। বিষয়টা শেষ করে দিতে চাইলেও হামিদ এক জোড়া জুতা খুঁজতে বেরিয়ে গেল। বুঝতে পারি, এক জোড়া জুতা খুঁজে না পেলে কাবুল বিমানবন্দরের উদ্দেশে আমার যাত্রা পিছিয়ে যেতে পারে। ও আবার ফিরে এসে পায়ের মাপ নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। আধা ঘণ্টা বসে রইলাম। অপেক্ষা করতে অসহ্য লাগছিল। মনের ভেতর অজানা আশঙ্কা উকি দিতে লাগল।

চতুর লোকগুলো আমার ভঙ্গুর মন নিয়ে খুব সফলভাবে খেলতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই আমাকে বাড়ি যাওয়ার কথা শোনানো হতো। ফাঁদে পা দিয়েছিলাম, পরে বুঝতে পারি। ওদের ভাষ্য ছিল, আমি একজন গোয়েন্দা। তার মানে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। আমার বিরুদ্ধে ওরা তদন্ত করছিল কিন্তু যার কোনো যৌক্তিক সমাপ্তি ছিল না।

শেষমেশ তারা কিছুই খুঁজে পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। আমি শুরু থেকে শেষ দিন অবধি একজন সাংবাদিক এমনকি এক্সপ্রেস-এর পক্ষ থেকে আলোচনার জন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এসেছিলেন বলে তারা আমাকে জানিয়েছিল। কী এক গোলকধাধার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। অথচ তত দিনে বাড়ি যেতে পারব বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।

একজোড়া হাওয়াই চপ্পল নিয়ে ফিরে এল হামিদ। ওপরের দিকে বড় করে লেখা লন্ডন। চপ্পল জোড়া পায়ে গলিয়ে হামিদকে এক গাল হেসে ধন্যবাদ জানাই। সে জবাব দিল, ধন্যবাদ। এরপর আমাকে বসতে বলে হামিদ আবার কোথায় যেন চলে গেল।

অপেক্ষার পালা শেষ হলো রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্ত দিয়ে। আরেকবার ফিরে যাই সেদিনের ডায়েরির লেখনীতে।

দরজায় টোকা দিয়ে হামিদ জানাল, কেউ একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি ছিলেন সম্ভবত একজন মাওলানা (আরবি ও উর্দু ভাষায় উচচতর শিক্ষা অর্জনকারী)। হামিদের মুখে উদ্বেগের ছাপ। লম্বা, শুকনা গড়নের একজন লোক। তাঁর চোখা বাদামি চোখে একটা বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। ভদ্রলোক কপাল কুঁচকে ঘরে প্রবেশ করলেন।

আঁচড়ানো দাড়িতে ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে হাত বোলাতে বোলাতে কথা শুরু করলেন মাওলানা। তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল আমার ধর্ম প্রসঙ্গে। একই সঙ্গে ইসলাম নিয়ে আমার ভাবনা জানতে চাইলেন।

শুকনো মুখে ভয়ে ভয়ে জানালাম, আমি একজন খ্রিষ্টান। কিন্তু তিনি খুব সহজ ভঙ্গিতে আমি খ্রিষ্টানদের কোন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, তা জানতে চান। জবাব দিই, প্রটোস্ট্যান্ট। মাওলানার চেহারায় একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। মনে হচ্ছিল, আমি কোনো পাতা ফাঁদে পা দিয়েছি। আমি বলতে থাকি, ইসলাম একটা চমৎকার ধর্ম। ইসলামের অনুসারীরা যেভাবে তাঁদের বিশ্বাস ও আচার-কর্ম পালন করেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি জানাই, লন্ডনে ফিরে যাওয়ার পর ইসলাম নিয়ে আরও গভীর পড়াশোনা করব। আরেকবার বাঁকা একটা হাসি দিয়ে তিনি আচমকাই আমাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।

আশঙ্কায় কাঁপতে কাঁপতে চিন্তা হলো, যদি এখন হঁ্যা বলে দিই, তাহলে আমাকে ভীত ভেবে নিয়ে পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হবে। অন্যদিকে এই প্রস্তাব অস্বীকার করলেও আমাকে মেরে ফেলার আশঙ্কা শতভাগ।

খুব ঠান্ডা মাথায় দ্রলোককে তার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ দিই। সঙ্গে এ-ও জানাই, এই মুহূর্তে দুশ্চিন্তা আর প্রতিকূল পরিবেশে জীবন পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। মাওলানাকে আরও একবার ধন্যবাদ জানিয়ে পরবর্তী প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তিনি এবার একটা সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বিদায় নিলেন।

তখনো আমার হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করছিল। হামিদ ফিরে এলে জানতে চাইলাম বাইরের পরিস্থিতি কী রকম। হামিদ জানাল, আমি যেতে পারি, কিন্তু বের হওয়ার আগে যেন বোরকাটা পরে নিই।

এই প্রস্তাবে আমার চোখে পানি চলে এল। আমি বোরকা পরতে অস্বীকৃতি জানালে হামিদ একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতামত নিতে চলে যায়। গোয়েন্দা এ প্রস্তাবে রাজি হলেন না।

হামিদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ও আমার দিকে একটা চাদর ছুড়ে মারে। চিল্কার করে চাদরটা আমার গায়ে জড়িয়ে নিতে বলে। বুঝতে পারছিলাম না ও হঠাৎ এত আগ্রাসী হয়ে উঠল কেন। তবে তখন এসব কথায় খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিলাম না। মনের মধ্যে শুধু একটাই ভাবনা, আমি বাড়ি যাচ্ছি।

পিকআপ ট্রাকের সামনে ৪০ জন তালেবান আমাকে অভিবাদন জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। সামনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় ওরা মিষ্টি হাসি দিয়ে বিদায় জানালে আমিও প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানাই। যে দুজন লোককে আমার সঙ্গে বন্দী করা হয়েছিল, তাদের দেখতে পেলেও সুকৌশলে তাদের এড়িয়ে গেলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। লোক দুজনকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাচ্চামেয়েটাও তাদের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে।

উঠে পিকআপের সামনের আসনে বসে পড়ি। দুজন সশস্ত্র তালেবান আমার সঙ্গী হলো। সঙ্গে যোগ দিলেন জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারার সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। মুহূর্তটা ছিল আবেগঘন। অতি কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখি। আব্দুল্লাহও দেখি তার প্রথম ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করে বসল। বিদায়।

আব্দুল্লাহ আগে থেকেই ইংরেজি জানত বলে আমার সন্দেহ হলো। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে রহস্যময় জাদুর ঘরটা, যেখানে আমি বন্দী ছিলাম, একনজর দেখে নিই। গাড়ি চলতে শুরু করলে অঝোর ধারায় গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরতে শুরু করল।

মা, আমি বাড়ি আসছি।

কাবুল পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা ধরে যাত্রাটা ছিল নরক যন্ত্রণার। তবে রাস্তার দুই পাশে ছিল চোখ জুড়ানো সবুজ মাইলের পর মাইল সবুজ ফসলের খেত। মাঝেমধ্যে সুন্দর নদী অতিক্রম করে আমাদের গাড়িটা ছুটে চলল। পুরো রাস্তায়ই অসাধারণ সব নৈসর্গিক দৃশ্য, পানির আধার, সুউচ্চ পাহাড়। চোখে পড়ল অজস্র শিয়ালের গর্ত আর পাহাড়ের অভ্যন্তরের সুড়ঙ্গ। ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে লাগলাম, প্রেসিডেন্ট বুশের আফগানদের শিকড় সমূলে উৎপাটনের হুংকার ছিল ফাঁকা বুলি।

একসময় চারপাশের পরিবেশ হঠাৎ বদলে যায়। পাথরে ভরা প্রান্তর আর ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠের পর মাঠ। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর শেষ প্রান্ত অতিক্রম করছি। পথিমধ্যে সঙ্গের লোকজনের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ও নামাজ আদায় করার জন্য গাড়ি থামানো হলো। কেউ একবারও জানতে চাইল না আমার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। অবশ্য আফগানিস্তানের নারীদের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। নিজেকে বোঝালাম, এই মেয়ে এখনো সন্ধ্যা নামেনি, সুতরাং তোমার প্রস্রাব চাপার প্রশ্নই ওঠে না।

তবে আমি ধূমপান করার অনুমতি পেয়েছিলাম। ধন্যবাদ ওদের। আমাকে কয়েক প্যাকেট আফগান সিগারেট দেওয়া হয়েছিল। এখানকার সিগারেটগুলোতে নিকোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি। যাত্রাপথে গাড়ির চালক একবার নেমে এক বান্ডিল আখ খরিদ করে।

আখগুলো ছিল সতেজ। অতি দ্রুত তা শেষ হয়ে যায়। পরে একটা ছিলে রসভরা অংশটুকু একটা কাগজের ব্যাগে ভরে আমাকে দেওয়া হলো। ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। তবে আফগান নিয়মে ফল খাওয়ার ধরনটাও মজাদার। ফলটার নাম উচ্চারণ করতেই সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। নামটা মোটেই হাস্যকর নয়। মনে করার চেষ্টা করলাম, কোথা থেকে নামটার উৎপত্তি। গাড়িচালক কয়েকটা চুইংগাম বাড়িয়ে দিলে খুশিমনে তা গ্রহণ করি।

আবারও নিকোটিন ধোয়া টানছি এবং চুইংগাম চিবুচ্ছি। মা থাকলে নির্ঘাত বকুনি জুটত কপালে। যাত্রার মাঝপথে গাড়িচালক মুখ থেকে চুইংগামের দলা বের করে সামনের উত্তপ্ত ড্যাশ বোর্ডে লাগিয়ে রাখে। এরপর একগাদা ফল মুখে পুরে নেয়। আধা ঘণ্টা পরে চুইংগামের দলাটা আবার মুখে ভরার চেষ্টা করতেই আঠালো চুইংগামটার একটা অংশ স্টিয়ারিং হুইলে আর একটা অংশ চালকের দাড়িতে আটকে যায়। দুই মিনিটের মধ্যে লোকটার মুখ, চোখ, দাড়ি আর হাতে চুইংগামে মাখামাখি হতে দেখে আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি।

বেচারা গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়। শরীর থেকে চুইংগাম ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা দেখে সবাই হাসতে লাগল। যমিদের দেওয়া চাদরটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরি। চাদরটার অন্তত পক্ষে আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার কাছে। কারণ, বাড়ি চলে যাচ্ছি একেবারে। ওই মুহূর্তে এমনই মনে হয়েছিল।

চুইংগাম ছাড়ানো হলে আমরা কাবুলের দিকে পুনরায় চলতে থাকলাম। রাস্তার প্রতি মিটারে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে যেতে থাকে। পুরো সড়ক পাথর আর অসংখ্য খানাখন্দে ভরা। বোমাবর্ষণের ইতিহাস থাকায় সড়কের অধিকাংশ স্থানেই বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। এর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় কোমরের হাড়িতে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। ধুলাময় রাস্তার পাশে উদোম গায়ে আর অবহেলার শরীর নিয়ে ছোট ছোট বাচ্চারা দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট ছোট রুক্ষ হাতে এসব খানাখন্দ ভরাট করে দুটো পয়সা পাওয়ার চেষ্টা। এসব বাচ্চার বাড়ি কোথায়, এ সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা পেলাম না।

যেতে যেতে বেশ কয়েকটা গ্রামও অতিক্রম করতে হলো। গ্রামের ঘরগুলো মাটির তৈরি একতলা। দৃশ্যটা অনেকটা ছোটদের চিত্রিত বাইবেলে আঁকা ঘরগুলোর মতো। তবে বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত অনেকগুলো গ্রামও চোখে পড়ে, যেন প্রস্তর যুগের ভুতুড়ে কোনো দৃশ্য। মনে হলো, প্রাচীন যুগে ফিরে গেছি। মনে পড়ল, কেউ একবার বলেছিল, তালেবানদের লক্ষ্য হলো পৃথিবীর প্রথম বসতি স্থাপনের যুগে ফেরত যাওয়া।

তালেবানদের প্রকৃত মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নির্মম ও একরোখা প্রচেষ্টা আমার কাছে শুধুই অবুঝ পাগলামি। আমার বেড়ে ওঠা টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে, টেলিফোনে কান পেতে। গরম-ঠান্ডা জলে গোসল করে সতেজ হই। নাচ-গানের আনন্দ তো আছেই।

ভাঙা রাস্তায় এক ঘন্টা অতিক্রম করার পর জানের হাতকড়া খুলে নিয়ে ওকে গাড়ির পেছনের আসনে জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারার গোয়েন্দা অফিসারের পাশে বসানো হলো। আমার গায়ে আলতো আঘাত করে জান আস্তে আস্তে জানাল, চিন্তার কিছু নেই। ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি আমার।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ধমকের সুরে বলি, তোমাকে আমি চিনি না। আমার সঙ্গে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টার ফল ভালো হবে না। এক মিনিট পরে বাঁকা চাহনিতে দেখতে পেলাম, গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানকে ইশারা করছেন। জান আবার বলতে থাকে, তোমার মেয়ে কেমন আছে? ওর কোনো ছবি আছে তোমার কাছে? জানকে ডেইজির একটা ছবি দেখিয়েছিলাম। কিন্তু সেসব তো পাকিস্তানে পাশার কাছে রেখে এসেছি। সন্দেহের গন্ধ পেয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে উত্তর দিলাম, তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। বিরক্ত করা বন্ধ করো।

আমরা এরপর নীরবতার মধ্য দিয়ে চলতে থাকি। জানকে আরও কয়েকবার ইশারা করা হয়। আমার কানে একটা কথাই শুনতে পেলাম, তোমার ভয়ের কিছু নেই। আমরা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

ব্যস, এ পর্যন্তই। আমি হাত উঁচু করে চিৎকার করতে থাকি, ট্রাক থামাও। প্রয়োজনে আমি কাবুল পর্যন্ত হেঁটে যাব।

আধা ঘণ্টা পর গাড়ি থামিয়ে জানকে পেছনে নিয়ে পুনরায় বেঁধে রাখা হলো। কষ্ট হলেও কিছুই করার নেই। যে গল্পটা শুরু থেকে বলে এসেছি, সেই গল্পের দৃশ্যপট বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। যতটুক জেনেছি, তারা সবকিছু স্বীকার করেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।

আফগানিস্তানের প্রকৃতি এখানকার অধিবাসীদের মতোই ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। পাথুরে মাটি পেরিয়ে আমরা আবার সবুজের মহাসমুদ্রে গিয়ে পড়লাম। আফগানিরা অসাধারণ দয়ালু ও মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। কিন্তু এদের মন নিষ্ঠুরতা ও কাঠিন্যে রূপ নিতে এক মিনিটও সময় লাগে না।

কাবুল যখন পৌঁছাই, তখন সন্ধ্যা নামছে। অন্ধকারে কিছুই আলাদা করে চেনার জো নেই। এটা নিশ্চয়ই কোনো রাজধানী নয়। আমি হন্যে হয়ে বিমানবন্দর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ি গিয়ে থামল একটা বিশাল অট্টালিকার পাশে। কোনো সরকারি অফিস হবে হয়তো। গোয়েন্দা অফিসার ভেতরে প্রবেশ করলেন। ১০ মিনিট পর ফিরে এসে গাড়িচালককে কিছু একটা বললেন।

গাড়ি পুনরায় আরও পাঁচ মিনিট চলার পর একটা দুর্গসমেত অবকাঠামোর সামনে এসে দাঁড়াল। কাবুল জেলখানার সন্ত্রাসী সেল। তালেবানদের হাতে বন্দী থাকাকালে বিভিন্ন সময় আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। এই মুহূর্তটা সেসবের মধ্যে অন্যতম।

আমাকে একটা ভাঙাচোরা গেট দিয়ে একটা চত্বরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে একটা অন্ধকার করিডোর ধরে হেঁটে শেষ প্রান্তে আরেকটা করিডোরের মাথায় গিয়ে পৌছাই। একটা দেড় মিটার উঁচু ভারী ধাতব দরজা ঠেলে কালো পাগড়ি মাথায় একজন ভেতরে ঢুকলেন। তিনি ছিলেন কারা পরিচালক।

কৌতূহলবশত আমি ভেতরে উঁকি দিলাম। দুজন নারী হাঁটু ভেঙে বসে আছে। একটা শীর্ণকায় বাচ্চা তারস্বরে কেঁদেই যাচ্ছে। আমি কারা পরিদর্শক ও গোয়েন্দা অফিসারের দিকে ফিরে তাকাতেই তাঁরা আমাকে ভেতরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন।

তোমরা নিশ্চয় তামাশা করছ। আমি ভেতরে যাচ্ছি না। বরং রেড ক্রিসেন্টের বিমানে করে বাড়ি যাব। আমি একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং আমার সঙ্গে এহেন আচরণ কাম্য নয়। বাড়ি গিয়ে আমি তোমার এবং তোমার সম্পর্কে লেখালেখি করব। এই বলে আমি আঙুল তুলে তাদের দুজনের দিকেই নির্দেশ করলাম।

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে লাগল। আমি বলেই চললাম, আমাকে কোনো আবাসিক হোটেলে রেখে আসো। আমার পত্রিকা অফিস থেকে এর ব্যয় সরবরাহ করা হবে। মোটেই অস্বাভাবিক কোনো কথা বলছি না। তোমরা জারজ মিথ্যাবাদীর দল। বলেছিলে আমাকে বাড়ি পাঠানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছ।

যে দুজন লোক এত দিন ধরে ইংরেজি না বোঝার ভান করেছিল, তারা এবার খুব সুন্দর করেই আমার আকৃতি বুঝতে সক্ষম হয়। অনেকবার আমাকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার অপচেষ্টা কিছুটা সফল হচ্ছে দেখে গোয়েন্দা অফিসার পৈশাচিক খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সুন্দর অনর্গল ইংরেজিতে বলে চলল, এটা আফগানিস্তান। তুমি নিয়ম ভেঙে অবৈধভাব প্রবেশ করেছ। এটাই তোমার ঠিকানা।

আমি একই সঙ্গে ভয় পেয়ে যাই ও রাগান্বিত ভাব দেখাতে শুরু করি। এমন পরিস্থিতিতে একসঙ্গে রাগ আর ক্রোধের সম্মিলনে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কণ্ঠস্বর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম, এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমরা বুঝতে পারছ না কেন? আমি একজন সভ্য দেশের বাসিন্দা। আমি ব্রিটিশ নাগরিক। তোমরা আমার সঙ্গে এমন করতে পারো না।

এমন সময় পাশের একটা কারাঘর খুলে ছয়জন নারী বাইরে কী ঘটছে, তা দেখতে উঁকি দিল। ঘন কালো চুল ও চশমা পরিহিত একজন জিজ্ঞেস করে বসে, আমি কি রেডক্রস থেকে এসেছি?

তখনো আমি ক্রোধে ফুঁসছিলাম। ঘুরে গিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকি, অবশ্যই আমি রেডক্রস নই, বরং ক্রস পরিহিত। কিন্তু তুমি কি ইংরেজিতে কথা বলতে পারো এবং…? আমি বাক্যটা শেষ করতে পারিনি। অবাক না হয়ে পারছিলাম না।

মেয়েটা বিস্ময়ের পর বিস্ময় উপহার দিয়ে জবাব দেয়, হ্যা, আমি অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। এই তিনজন জার্মান নাগরিক। বাকি দুজন। আমেরিকার অধিবাসী। হঠাৎ করে তালেবানদের উপস্থিতি ভুলে বসি। মনে পড়ে গেল, এরাই সেই খ্রিষ্টান দল। কিন্তু আমি তো জানতাম, তাদের সবাইকে হোটেলকক্ষে রাখা হয়েছে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস সজ্জিত।

কথা শেষ হলে চারদিকে একটা হাসির রোল পড়ে গেল। মেয়েটা বলতে থাকে, তারা সবাই জার্মানভিত্তিক দাতব্য সংস্থা শেলটারের কর্মী। সংস্থাটি তখন আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা নামে কার্যক্রম চালাচ্ছিল। এদের আরও দুজন পুরুষ সহকর্মীসহ গ্রেপ্তার করা হয় মুসলমানদের খ্রিষ্টান বানানোর অভিযোগে। আমি জানতে চাইলাম, তারা পশতু ভাষা জানে কি না। মোটামুটি সবাই পশতু ভাষা বুঝতে সক্ষম। অবাক করা ব্যাপার। আমি ওদের অনুরোধ করি, যেন এই তালেবানদের বুঝিয়ে বলে, এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে যেন একটা হোটেলকক্ষে রেখে আসা হয়। অথবা কপালে ঝুলে থাকা শাস্তি দিয়ে দেয়।

কেথি নামের জার্মান একটা মেয়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও খুব সম্ভব আমার কথাই ধীর গলায় নিচু স্বরে তালেবান দুজনকে শোনাল। তালেবান দুজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ডায়ানা নামের অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটা আমাকে তাদের সঙ্গে থাকার জন্য প্রস্তাব দেয়। সকালবেলা নতুন কিছু একটা করার চেষ্টা করা হবে। মেয়েগুলো আমাকে দুশ্চিন্তা না করতে বলে।

আমি মনের সাধ মিটিয়ে দুজন তালেবানকে গালি দিয়ে মেয়েগুলোর কক্ষে প্রবেশ করলাম। কক্ষটা ছিল ৭ মিটার দীর্ঘ ও ৫ মিটার প্রস্থ। বসে বসে কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করলাম। একটা সিগারেট ধরাতে চাইলে ওরা সবাই নিষেধ করল। হায়রে খ্রিষ্টান বন্ধুত্বের কী অসাধারণ প্রতিফলন! ওরা যা-ই ভাবুক, কিছুক্ষণ পরে ধূমপান করব বলে জানিয়ে কথা বলতে লাগলাম ওদের সঙ্গে।

সাত দিন ধরে আমি কোনো নারীর সাক্ষাৎ পাইনি। এবং কারও সঙ্গে অনর্গল কথা বলার সুযোগ পাইনি। এতগুলো মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল আনন্দঘন একটা ব্যাপার। মনের দুশ্চিন্তা কমানোর উপশম। আমি ওদের জানাই যে, বোকার মতো রাগ দেখিয়ে আমি ওদের সামনে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েছি এবং সবকিছু বলে দিয়েছি।

আমার টানা সাত দিন অনশনের কথা শুনে ওরা জানায়, ২০ দিন পর্যন্ত অনশন করতে হয়েছে তাদের।

মেয়েটার মুখে অনশন ও ২০ দিন শব্দটা শুনে আমার নিজেকে অক্ষম মনে হতে লাগল। তাই ঠিক করলাম, শুরু করব নোংরা আন্দোলন। মুক্তি দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি গোসল করব না।

‘ননা, তুমি এমন করবে না।’ ডায়ানা আমার কথায় হেসে দিল। এই রকম আবদ্ধ ঘরে একজন দুর্গন্ধযুক্ত মানুষই যথেষ্ট। কথায় ছিল স্পষ্ট নির্দেশ কিন্তু একটা আন্তরিক ভঙ্গি। বলতে বলতে ডায়ানা হেনরির দিকে দেখিয়ে দিল। মেয়েটা আমেরিকার অধিবাসী। বুঝতে পারলাম, ও এই ছোট দলের নেতা।

মেয়েগুলো তাদের সন্ধ্যাকালীন বিশেষ আলোচনা শুরু করলে আমিও একটু নিকোটিন পোড়াতে পাশের চত্বরটায় চলে আসি। আকাশে অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে। নাহ্, স্যাটেলাইটটা আর দেখা যাচ্ছে না।

আমার কাছে অবশিষ্ট থাকা তিনটা সিগারেটই একের পর এক জ্বালিয়ে জালালাবাদের লোকটাকে অভিশাপ দিতে লাগলাম। লোকটা পুরো পথেই আমার সঙ্গে বোনের মতো ব্যবহার করেছে। অথচ, এরা নিশ্চয়ই জানত, আমাকে এখানে নিয়ে আসা হবে শেষমেশ।

তারা মিথ্যার পর মিথ্যা বলেই চলছিল। আমি যখন তাদের দেওয়া মুক্তির আশ্বাস বিশ্বাস করতে শুরু করেছি মাত্র, তখনই বদমাশের দল আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। এমন সময় কারাঘর থেকে খুব সুন্দর সংগীত ভেসে এল। কী আশ্চর্য, মেয়েগুলো গান গাইছে। কাবুল জেলখানায় মুহূর্তটা তখন অন্য রকম লাগছিল। অপার্থিব একটা সময়।

ঘরটাতে ফিরে গিয়ে তাদের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সময় কাটাই। মেয়েটাকে জানাই, আমার পরিকল্পনা ছিল একজন নরকবন্দি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। যতটা খারাপ ব্যবহার করা যায়, ওদের সঙ্গে আমি তা-ই করব। কিন্তু মেয়েগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর আগের ভাবনা থেকে সরে আসি। মেয়েগুলোর সঙ্গ ভালো লাগতে শুরু করেছিল। আমি আলাদা একটা ঘরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই মেয়েগুলোর ওপর আমার খারাপ আচরণের কোনো প্রভাব পড়তে দেওয়া যাবে না।

তারা আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। রাগ একটু পর এমনিতেই কমে যাবে। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব নয় রাগ প্রশমিত করা। এর ফলে তালেবানরা আমার কঠিন মানসিকতা ভেঙে পড়ছে বলে মনে করবে। একজন মানসিকভাবে দুর্বল মানুষ খুব সহজেই নিয়তিকে মেনে নেয়, যা আমি হতে দিতে পারি না। আমার ব্যাখ্যাটা হয়তো সম্পূর্ণ পাগলের প্রলাপের মতো শোনাল।

ডায়ানা আমার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। হয়তো সে-ও একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে এর আগে অথবা শুনেছে কোথাও। ও আমার জন্মস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে নিউক্যাসলের কথা উল্লেখ করি। ডায়ানার এক বান্ধবীও ডারহাম কাউন্টির অধিবাসী।

চিন্তা কোরো না। বাড়ি যাওয়ার পরে ওর বান্ধবীকে খুঁজে বের করে তোমার কাছে চিঠি পাঠাতে বলব। আমি বলতে থাকি, বাহ্, কী প্রশান্তিময় চিন্তা! আমি তাহলে বাড়ি যাচ্ছি।

বাথরুমে যেতে চাইলে ওরা একটা সরু জায়গা দেখিয়ে দিল।

সাবধানে পানি ঢালতে হবে। ডায়ানা জানাল, মাঝেমধ্যেই ড্রেনের পাইপ আটকে যায়। এখানে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ব্যবহৃত টিস্যু রাখতে হয়। বাহ্, কী ভাগ্য আমার। ফ্ল্যাশ টয়লেট নেই। তবু এই জায়গাটা অনেক পরিষ্কার। ভাবতে লাগলাম, ভাগ্যে কি এর থেকেও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে কি না, কে জানে।

ঘরে ফিরে এসে একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ি। এখানে রাতের বেলা পরার জন্য আলাদা কোনো পোশাক নেই। সারা দিন যে পোশাক পরতে হয়, তা পরেই বিছানায় গা এলিয়ে দাও, এই ভালো। বন্দী হওয়ার পর থেকে তোয়ালে দিয়ে গা মোছার সুযোগ মেলেনি। জালালাবাদে থাকাকালে একটা চাদর দিয়ে গা মুছতাম।

আব্দুল্লাহ বাথরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত, যতক্ষণ না আমার গোসল শেষ হচ্ছে। ব্যাপারটা বিরক্তিকর হলেও লোকটার ধৈর্য ছিল। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো বাথরুমটা একটু পরিষ্কার করি। তবে ব্লিচিং পাউডার বা এ-জাতীয় কোনো পরিষ্কারক চোখে দেখিনি কখনো। মনে মনে ভাবতাম, তারা কি চায় না মেয়েরা কাজ করুক? একবার সুযোগ পেলে হাঁটু গেড়ে বাথরুম ঘষে মেজে পরিষ্কার করে ওদের দেখিয়ে দিতাম কাজ কাকে বলে!

সেদিন ঘুমের মধ্যে নিশূপে অঝোর ধারায় কেঁদেছি। জালালাবাদের লোকগুলো আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। যখন গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, তখন হতচ্ছাড়ার দল নিশ্চয় আমার পেছন পেছন হাসছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম খারাবির একটা শেষ দেখিয়ে ছাড়ব ওদের। তালেবানদের আস্পর্ধা বেড়েছে বহুগুণ।

মনে পড়ে, তখন ভেবেছিলাম, একটা বিপজ্জনক পরিকল্পনা ধরে এগোতে চাচ্ছি। কিন্তু একবার যদি বর্তমান পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করি, তাহলে এই নোংরা গর্তে আরও কয়েক বছর কাটাতে হবে।

কাবুল কারাগারের সকালটা শুরু হলো খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে। চোখ খুলে দেখি, কাঠের ছাদের নিচে শুয়ে আছি। ক্ষণিকের জন্য মতিভ্রম হলো, যেন অবকাশ যাপনে স্কি লজে এসেছি। এতটাই খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল ডেইজির সঙ্গে কোথাও ছুটি কাটাতে এসেছি। বর্তমান পরিস্থিতিকে মনে হচ্ছিল নির্ঘাত রাতের বেলা দেখা একটা দুঃস্বপ্ন।

উঠে বসতেই পিঠটা মট করে উঠল। জার্মান মেয়ে তিনটা মেঝেতে তোশকের ওপর তখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাকি মেয়ে তিনটা আমার পেছনে অপ্রশস্ত একটা খাটে শোয়া। না, এটা কল্পনা নয়, বরং একটা জীবন্ত দুঃস্বপ্ন।

আমি এখন কাবুল জেলের একজন বন্দিনী।

বসে বসে বিগত দিনের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করি। শুক্রবার, ৫ অক্টোবর। আমার দুর্ভাগ্যের গাধার পিঠে যাত্রার এক সপ্তাহ পার হলো। কেথি নামের জার্মান মেয়েটাই প্রথম নড়েচড়ে বসল। ওর একটা ডাকনামও ছিল। জেলিনেক, পরে জেনেছিলাম অবশ্য। গোসল করার ইচ্ছা আছে কি জানতে চাইল জেলিনেক। বাহ্, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে। আমার চোখে-মুখে অবিশ্বাস দেখে ও মুচকি হেসে আমাকে টেনে নিয়ে গেল গোসল বিলাসিতার উদ্দেশ্যে।

চত্বরে একটা পুরোনো জং ধরা জিঙ্কের পানির আধার। সেখান থেকে বালতিতে পানি সংগ্রহ করতে হয়। আমি সরলভাবে জানতে চাই, গরম পানির ব্যবস্থা আছে তো? জবাবে কেথির মুখ বাঁকানো হাসিতে উত্তরটা পেয়ে যাই।

ঠান্ডা পানির বালতিটা টেনে নিয়ে গেলাম করিডোর ধরে। খোলা জায়গাটার এক কোনায় একটা ছাউনির মতো আছে। সেখানেই একটা রড বৈদ্যুতিক লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত। বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গায় এই ব্যবস্থাটা বিপজ্জনক বলে গণ্য হবে।

আধা ঘন্টা পরে পানি গরম হলে পুনরায় বালতিটা টেনে বাথরুমে নিয়ে যাই। ব্যাগ থেকে সাবান আর টুথব্রাশটাও বের করে আনি। চায়নিজ একটা টুথপেস্ট আমাকে প্রথম দিন দেওয়া হয়েছিল। সেটাও টেনে বের করি।।

গায়ের সব পোশাক খুলে স্যান্ডেল পায়ে শরীরের প্রতিটি অংশে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে শুরু করি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আরে সাবানের মধ্যেই রেজর ব্লেডটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। কী ভয়ংকর!

আরেকটু হলেই নিজের কত বড় ক্ষতি করে ফেলতাম, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ব্লেডটা টেনে বের করতেই মনে হলো, তালেবানদের চাইতেও আমি নিজেই নিজের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারি।

মেয়েদের দেওয়া একটা নীল তোয়ালে দিয়ে শরীরের সব পানি মুছে ফেলি।

ততক্ষণে আমেরিকান হেথার মার্সার, ডায়ানা কারি, পাগলা অস্ট্রেলিয়ান ডায়ানা যার ডাকনাম থমাস ও বাকি দুজন জার্মান স্লাইক ডার্ক এবং মারহিট স্টেবনারের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে। আমি জিনিসপত্র বের করতেই ওদের একজন জানতে চাইল, আমাকে বিয়ের ড্রেস কিনে দেওয়া হয়েছে কোন দুঃখে? আমি সাদা শিফন আর সোনালির কারুকাজে মিশ্রিত পোশাকটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিই। এক ইমাম সাহেব যে আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে গল্প শোনাই ওদের। সম্ভবত, আমার জন্য একজন স্বামীও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। যদি সত্যিই এমন হয়ে থাকে, তাহলে নির্ঘাত এই দেশের কোনো এক হতভাগা পুরুষের কপাল পুড়েছে।

আমার তিনটি বিয়ের কথা শুনে মেয়েগুলো ভিরমি খেল। খোদা জানে, চতুর্থ জনের জন্য কি অপেক্ষা করছে। এই রকম দুরবস্থার মধ্যেই কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে মজা হলো। জালালাবাদেও আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। মাঝেমধ্যে বন্দিত্বের দুঃসহ পরিস্থিতি এমন মুহূর্ত ক্ষণিকের জন্য হলেও মনটাকে সতেজ করে তুলত।

আমি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বন্দী হওয়ার পরিকল্পনার কথা ওদের জানালে ওরা আমাকে আরও সাবধান হতে অনুরোধ করে।

ডায়ানা একজন প্রশিক্ষিত সেবিকা। আমি ওকে হাতে ওঠা কিছু ফুসকুড়ি দেখাই। বন্দী হওয়ার পর এগুলো দেখা দিয়েছে। ও জানাল, চর্মরোগ অথবা ছারপোকার কামড় অথবা তীব্র গরমে এদের উৎপত্তি।

বেচারা কেথি মাথায় করে আগের জেলখানা থেকে উকুন নিয়ে এসেছে। বিষয়টা কিছুটা ভয়ংকর। এখানে সবারই কমবেশি চুলকানি হচ্ছে। আছে ইঁদুরের উৎপাত, সেই সঙ্গে বিষাক্ত বৃশ্চিকের কামড় খাওয়ার ভয়। বৃশ্চিকের কথা শুনে আমার আত্মারামা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়।

আমার আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল, যখন জানলাম মেয়েগুলোকে নিয়মিত বৈদ্যুতিক তার দিয়ে চাবকানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত কারও ওপর ব্যক্তিগত নির্যাতন করা হয়নি।

এখানকার জেলকর্মীদের আচার-ব্যবহার যথেষ্ট আন্তরিক এবং এখন পর্যন্ত কারও কোনো ক্ষতি করেনি তারা।

আরেকটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ডায়ানা জানাল, দীর্ঘদিন অন্তর্বাস পরে থাকার দরুন গরমে চুলকানি সৃষ্টি হয়েছে। আফগানিস্তান আসার পর থেকে কোনো দিনই শান্তিমতো বাথরুম করার সুযোগ মেলেনি। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর কোনো ওষুধ আছে কি না জানতে চাইলাম। একটা কাবার্ডে ওরা জমিয়ে রেখেছিল কিছু কিছু ওষুধ।

ও জানাল, দীর্ঘদিন ধরে অনশন করার কারণে আমার খাদ্যনালিতে কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

যা-ই হোক, আফগানিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর আগে হোটেলে বুফেতে ইচ্ছেমতো খেয়েছিলাম। মনে পড়ে, মজা করে হোটেল ম্যানেজারকে বলেছিলাম, পরবর্তী খাবার কোথায় বসে খাব জানি না। তখন সেটা নিছক মজা হলেও এখন কী কঠিন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে ডায়ানা আমাকে আমেরিকান দূতাবাস থেকে দেওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণের একটা পানীয় অথবা মল্লারে সাপোজিটরি ব্যবহারের প্রস্তাব করে। জেলখানায় বসে কী অদ্ভুত একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শেষমেশ সাপোজিটরি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, এটা আমার নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু রেচক তরল, বাপরে বাপ, কে জানে আবার যদি দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় এবং তখনই বাথরুম পেয়ে বসে।

মারগ্রিট বলল, বউ সেজে সারাক্ষণ হাঁটাচলা করার কোনো মানে হয় । একটা নেভি ব্লু রঙের পাজামা আর রং মিলিয়ে জামা পেলাম ওর কাছ থেকে। বেশ ভালোমতোই এটা সেঁটে গেল গায়ে। কাপড়টা বদলে নেওয়ার পর গায়ের সব পোশাক ও বাদামি রঙের ড্রেসটা ধধায়ার জন্য জিঙ্কের বালতির কাছে চলে যাই। অনেক দিন পর একঘেয়েমি কাটানোর জন্য কিছু একটা কাজ পেলাম। প্রথম দিকে এতে নতুনত্ব থাকলেও কয়েক দিন এভাবে চললে নিশ্চিত আমি বিরক্ত হয়ে পড়ব।

পোশাকগুলো চত্বরে টানানো তারে ঝুলিয়ে দিলাম। ডায়ানা অন্তর্বাসগুলো ঢেকে নাড়ার জন্য সতর্ক করে দিল। তালেবানরা এই চত্বরে সর্বদা কড়া নজরদারি করে। এবং মেয়েদের কেউ সেখানে গেলে তাদের গতিবিধি সুচারুরূপে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। তাই খোলা হাওয়ায় তারে ঝোলানো অন্তর্বাস তালবানদের মেজাজ বিগড়ে দিতে পারে। তবে তা-ই হোক, আমিও জবাব দিলাম। এবং ঘাড় ত্যাড়ামির যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সেই অনুসারে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করলাম।

সেদিন মেয়েগুলোর সঙ্গে একজন আইনজীবীর দেখা হওয়ার কথা ছিল। সবাই বাইরের পৃথিবী দেখার আকুতি জানিয়ে তার উদ্দেশে চিঠি লিখতে শুরু করল। ব্যথাতুর হৃদয়ে আমার কর্মক্ষেত্রের সম্পাদক জিম মুরের উদ্দেশে একটা চিঠি লিখলাম পাকিস্তানি আইনজীবী তা পৌঁছে দেবে এই আশায়। শেষ বাক্যটা ছিল এ রকম, জিম, এখানে নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিনাতিপাত করছি। সাহায্য করো।

হতাশা থেকে বেপরোয়া ভাব দেখাতে আমি মোটেই পছন্দ করি না। আমার সহকর্মীদের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোেগানোর কোনো ইচ্ছাও ছিল না আমার। কিন্তু আমি মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি, যেন নরকের চোরা গর্তে আটকা পড়ে গেছি। বড় বড় অক্ষরে কল্পনায় হিজিবিজি করে বারবার লিখছি, এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাও।

দুর্ভাগ্যবশত লোকটা ছিল গোড়া আইনজীবী। আমার চিঠিটা পৌছে দিতে অস্বীকৃতি জানাল। আইন নিয়ে সতর্ক লোকটা জানাল, কাবুলে আমাকে দেখতে পেয়ে সে যারপরনাই খুশি হয়েছে। সবাই নাকি জানে আমি জালালাবাদেই অবস্থান করছি। আমাকে দেখতে অচিরেই নাকি অনেকে আসবে। একই আশ্বাস আবার শুনতে পেয়ে আমি রাগে গড়গড় করতে লাগলাম। লন্ডনের একজন ভালো আইনজীবীর খুব দরকার এখন। আইনের ফাঁকা বুলি কপচানো কেউ নয়।

আমার বক্তব্যে একটু অসন্তুষ্ট হলেও লোকটা নিশ্চিত আমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। ততক্ষণে ছয়টা মেয়ে আর তাদের দুজন পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলার জন্য লোকটা একটা গারদের ভেতর প্রবেশ করেছে। পুরুষ সহকর্মী দুজন হলেন জর্জ টাবম্যান ও পিটার মাঞ্চ। যথাক্রমে জার্মান ও আমেরিকান নাগরিক। এই দুজনকে আলাদা কক্ষে আটক রাখা হলেও আইনজীবীর সঙ্গে বৈঠকের সময় তাদের একত্র হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো।

ওরা বৈঠকে বসলে আমি চত্বরে হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বোঝার চেষ্টা করি মনে মনে। দেয়ালের চারদিকে ঘুরে লুকিয়ে লুকিয়ে লাথি মেরে চেষ্টা করি এর স্থায়িত্ব বোঝার। কোনো ফাঁকা স্থান বা দুর্বল অংশ তো থাকতেই পারে। এমন মুহূর্তে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়ে হিথার হন্তদন্ত হয়ে চত্বরে ছুটে এল। ওর চেহারায় রাজ্যের মেঘ। ২৪ বছরের মেয়েটা দুম করে কাঁদতে শুরু করে দিল।

আমি কিছু না বলে চুপ করে সরে আসি সেখান থেকে। কান্নাকাটির সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ একা থাকতে চায়। পিটারকে দেখলাম এদিকে এগিয়ে আসতে। এসেই মেয়েটাকে কঠোর ভাষায় সংযত হতে বলে ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। হায়রে পুরুষ মানুষ, কবে তোমরা বুঝবে কাঁদতে থাকলে মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে হয় না।

এহেন পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আমি বললাম, মেয়েটাকে কাঁদতে দেওয়া হোক। এর ফলে কিছুটা হলেও ওর কষ্ট লাঘব হবে। পিটার পাকিস্তান ফিরে যাচ্ছে শুনে মেয়েটা সাংঘাতিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল। সে চাইছিল সবার সঙ্গে পিটার কাবুলেই থাকুক। তার ধারণা, ছেলেটা নিশ্চয় এখানে হামলা হবে ভেবে ভয় পেয়ে গেছে।

অসি লোকটা জানাল, সবকিছুই ফাকা বুলি মাত্র। কোনো হামলা-টামলা হবে না। আমি বলতে থাকি, হামলা শুরু হয়ে গেলে তখন যদি বলে কোনো উপায় থাকবে না। অবশ্যই এখানকার মাটিতে বোমা পড়বে এবং সবার উচিত নিজেদের প্রস্তুত করে নেওয়া। সীমান্তের বাইরে পাকিস্তানে তিন হাজার সাংবাদিক অপেক্ষা করছে। কিন্তু সম্পাদকেরা তাদের আহত হওয়ার ভয়ে সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দিচ্ছে না।

ছেলেটার তাকানো দেখে মনে হলো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলতে থাকি, মাত্র এক সপ্তাহ আগেও আমি বাইরের দুনিয়ায় বিচরণ করে এসেছি। অন্যদিকে তোমরা আড়াই মাস ধরে অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বন্দী। সামরিক সাজসজ্জা আমি নিজ চোখেই দেখেছি। মোটেও আমার অলক্ষুনে কথা বলার ইচ্ছে নেই। তবে বাস্তব ধারণা থেকেই বলছি, বোমা হামলা হতে যাচ্ছে এবং এ বিষয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।

ছেলেটা স্বভাবতই আমার কথা মানতে পারল না। মেজাজ বিগড়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। আমি হিথারকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে শুনিয়ে দিলাম, গত রাতে আমার নিঃশব্দে কান্নার ঘটনাও। চোখে পানি আসাটাই স্বাভাবিক ঘটনা।

পরে কারা পরিচালক এসে তাদের আইনি বৈঠকে যোগ দেন। পরে জানতে পেরেছিলাম, আমার কথা উল্লেখ করে কোনো চিঠি লেখা হয়ে থাকলে তা পুনরায় নতুন করে লিখতে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কোনো লিখিত কাগজে আমার উপস্থিতির দলিল থাকতে পারবে না। ব্যাপারটা বিভ্রান্তিকর। আমাকে লুকিয়ে রাখতে চাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য কী?

আমি ভেতরে প্রবেশ করে জানতে চাই, সবকিছু ঠিক আছে কি না? কিন্তু সবাইকে কেমন ঠান্ডা আবেগহীন বলে মনে হলো। জার্মান জর্জ টাউবম্যান, যিনি কিনা আফগানিস্তানের ত্রাণ কমিটির প্রধান ছিলেন, আমাকে সবকিছু সহজভাবে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁর মতে, আমার কাঠিন্য আর গোয়ার্তুমি দিয়ে কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না।

আমি সঙ্গে সঙ্গেই এ কথার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। মনে হচ্ছিল, লোকটা তালেবানদের দয়া-দাক্ষিণ্য পাচ্ছে। আর তাকে চিনিও না। আমি বললাম, তুমি নিজের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুশি থাকলেও আমি নই। এই বন্দিত্বের বিরুদ্ধে আমি লড়াই করেই যাব। এখানে যদি বন্দী থাকতেই হয়, তাহলে প্রতিদিন আমি ওদের নরক যন্ত্রণা দিয়ে ছাড়ব। সতর্ক না থাকলে তুমিও একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। একসময় বন্দিকারীদের প্রতি তোমার মায়া জন্মে যাবে। অচিরেই তোমার মতো অবিবেচক লোকজন স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত হবে।

দেখলাম, আমার কথা বলার ধরন মোটেই পছন্দ হয়নি মেয়েদের। লোকটা হয়তো ভালো মানুষ। কিন্তু আমার সঙ্গে ভুল বিষয়ে তর্ক করেছে, যেমন করেছিল অসি ছেলেটা।

হিথার চতুরে এল। ওর হাতে একটা পাকিস্তানি কাগজ। এতে লেখা। হয়েছে, তালেবানদের মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, আমি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য। ব্যাপারটা যতই মারাত্মক হোক না কেন, হাসি পেল আমার। মেয়েগুলো উঠে চলে যেতেই পাকিস্তানি আইনজীবী আমার দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তা করতে না করল। আমি শুধু বললাম, দ্রুত আমার অফিসকে জানানোর ব্যবস্থা করো। একজন শক্তপোক্ত আইনজীবী প্রয়োজন আমার। লোকটা একবার আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। আমি আবার চিৎকার করে বললাম, যা-ই হোক, আমি দুশ্চিন্তা করছি না! কেন করব? আমি তো এখান থেকে বের হয়ে যাচ্ছিই।

সেদিন ছিল শুক্রবার। তাই আমার পক্ষে সেদিন কাবুল ছাড়ার সম্ভাবনা ছিল না। মেয়েরা জানিয়েছিল, শুক্রবার মুসলমানদের পবিত্র ছুটির দিন।

এদিন সবকিছুই বন্ধ থাকে।

পরের দিন থেকে চত্বরে গিয়ে ইয়োগা অনুশীলন করতে শুরু করি। ভাঙা গেটটা খুলে দিয়ে জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারার সেই গোয়েন্দা অফিসার প্রবেশ। করলেন। এই লোকটা জালালাবাদ থেকে আমার যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছিলেন। আমাকে দেখেই তিনি দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। খুব শিগগির আমার মুক্তির ফরমান ঘোষণা হতে যাচ্ছে। আমি শুধু একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। এই বদমাশদের ওপর আমার আর একটুও বিশ্বাস নেই। অন্তত আমার সঙ্গে যে ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে, তারপর বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। কাবুলের বন্দিশালায় প্রথম রাতের প্রহরে নিঃশব্দে আমার চোখ দিয়ে যে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরেছে, তার জন্যও এরাই দায়ী। তবে সেটাই শেষ। আমার মূল্যবান অশ্রু ঝরানোর পরবর্তী সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।

পায়চারি করতে করতে কারা পরিচালক এলেন এবং আমার নাম জিজ্ঞেস করে হাতে একটা নিবন্ধন ফরম ধরিয়ে দিতে চাইলেন। আমি সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে নিজ কক্ষে ঢুকে পড়ি। পরিচালক মেয়েদের জানালেন, নিবন্ধন ফরম পূরণ না করলে আমার জন্য কোনো খাবার বরাদ্দ করা সম্ভব হবে না। জবাবে আমি মেয়েগুলোকে পশতুতে বুঝিয়ে বলতে বলি, খাবারের কোনো দরকার নেই। আমি অনশন করছি। আর উনি যদি আমার নাম জেনে না থাকেন, তাহলে সেটা তাঁর ভুল, আমার নয়। এখন তিনি বিদায় নিলেই আমি খুশি হই। কারণ, তাঁর প্রতিটা প্রশ্নই আমাকে বিরক্ত করছে।

মেয়েগুলো কথা বলার সময় আমি লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, তার চেহারা ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। চলে যাওয়ার আগে ব্যাটা চিৎকার করে কিছু একটা বলে গেল। মেয়েগুলো ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইল। জানতে চাইলাম, কী বলেছে লোকটা? কিছুক্ষণ পরে ডায়ানা কানে কানে বলল, লোকটা আমার মৃত্যু কামনা করেছে। আমি এক গাল হেসে দিয়ে সবাইকে আমার ব্যাপারে একদম নিশ্চিত থাকতে বলি। তবে অনুভব করলাম, গলার কাছে কিছু একটা এসে আটকে আছে। মনটাকে শান্ত করতে একটা সিগারেতে আগুন ধরাই।

পরে আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা নিয়ে কমবেশি কথা হতে লাগল। হিথার জানাল, এক কানাডিয়ান স্বেচ্ছাসেবক তার সঙ্গে জায়গা অদলবদল করতে চেয়েছিল। লোকটাকে হিথার চেনে না, তবে কত সুন্দর মানসিকতা আমারও মনে পড়ে গেল, জালালাবাদে থাকাকালে তালেবানরাও লন্ডনে বন্দী কারও সঙ্গে আমাকে বন্দিবিনিময় করতে চেয়েছিল।

গত সপ্তাহে জেরা চলাকালে কোনো এক সময় আমাকে এ কথা জানানো হয়েছিল। দিনটা ছিল অদ্ভুত এবং এত এত স্মৃতিতে ভরা যে আমি টুথপেস্টের বক্সের অপর পৃষ্ঠায় সব কথা লেখার সুযোগই পাইনি।

জেরা চলাকালে একজন লোক প্রবেশ করলে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। ভদ্রলোেক এসে সবার সঙ্গে হাত মেলালেন। পরে শুনেছি, তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর কমান্ডার। যা-ই হোক, সেদিন কিছুক্ষণ পরে আমিই জিজ্ঞেস করি, তোমরা নাকি আমাকে দিয়ে বন্দিবিনিময় করাতে চাও। প্রশ্নটা শুনে উপস্থিত সবাই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমি বলতে থাকি, মার্গারেট থ্যাচারের পর থেকে ব্রিটিশ সরকার কোনো দিন বন্দিবিনিময়ের চুক্তি করেনি। এ ধরনের দাবি তুললে তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে। কস্মিনকালেও বন্দিবিনিময়ের চিন্তা মাথায় এনো না।

একজন জানতে চাইল, তোমার সরকার বর্তমানে কী ভাবছে?

আমি শুধু চোখ কচলে বললাম, তোমরা জানো না আমি আটক হওয়ায় টনি ব্লেয়ার কী খুশি হয়েছে? তার দুঃখ একটাই, কেন আরও অধিক সাংবাদিককে তোমরা গ্রেপ্তার করোনি।

আমার কথায় তারা একেবারে চমকে গিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। হয়তো আমি তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছি বলে, অথবা তারা ইতিমধ্যেই হতাশ হয়ে গিয়েছে বা যে কারণেই হোক, আমি তা জানতে পারিনি এবং কোনো দিন পারবও না।

হিথারের হাসির শব্দে আমার কল্পনায় ছেদ পড়ে। ওর কাছে এখানে এক দিন বেশি বন্দী থাকার চাইতে বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়াই কাম্য। স্বীকার করতেই হবে, মেয়েগুলোর মানসিক শক্তি ছিল প্রবল এবং তারা সব সময়ই নিজেদের সংযত রাখার চেষ্টা করেছে। ভেঙে পড়েনি।

পরদিন সকালে প্রস্তুত হতে বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। দুই ঘণ্টা লেগে গেল শুধু ময়লা কাপড় পরিষ্কার করতেই। কেথি ও সিল্কে চত্বরের এক প্রান্তে বসে কিছু একটা পড়ছিল এবং ডায়ান অপর প্রান্তে চুপচাপ বসে ছিল। মার্গারিট শুয়ে ছিল। হিথার সম্ভবত প্রধান কারারক্ষীর সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় কানে ভেসে এল বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের কান-ফাটানো গর্জন। আমি বিছানা থেকে এক লাফে উঠে বসি। চারদিকে গোলাবারুদ ফাটার বিকট শব্দ। এত শব্দে হিথার খেই হারিয়ে ফেললে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। ও শুধু চিকার করে ডাকছিল কারারক্ষী ও ওদের দুই পুরুষ সহকর্মীকে।

কী ঘটছে কিছুই বোঝার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু মেয়েটা যেভাবে পাগলামি করছে, তাতে করে সবার মধ্যেই এর প্রভাব পড়তে পারে। এখনই হয়তো আমাদের একটা কক্ষে আটকে রাখা হবে। আমি হিথারের হাত ধরে ওকে শান্ত হয়ে বসতে ধমক দিই। হিথার, এমন করে কোনো লাভই হবে না। বরং উভ্রান্ত নীল প্রজাপতির মতো তোমার দিগ্বিদিক জ্ঞান হারানোর দৌড়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। মনটাকে একটু শান্ত করো। আমি তোমার সঙ্গে আছি। কিন্তু ও আমাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে দৌড়াতে থাকে।

আমি ডায়ানার কাছে গিয়ে ওকে কিছু একটা করতে বলি। কারণ, এখন আমাদের উচিত সবাইকে একসঙ্গে থাকা। এমনও হতে পারে, বিশেষ বাহিনী তাদের অপারেশন শুরু করেছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে ওদের হাতে ২০ সেকেন্ড সময়ও নেই। ডায়ানা বলল, হিথার মানসিকভাবে একটু দুর্বল। অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ওকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ততক্ষণে কারা পরিচালক এসে হাজির হয়েছেন। ডাকা হয়েছে পুরুষ দুজনকে। অসি লোকটা হিথারকে শান্ত হতে অনুরোধ করে। কিন্তু বাংকারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে কিছুতেই শান্ত হবে না। শেষমেশ এই ঘটনা ঘটাই বাকি ছিল। পিটার ওকে বারবার আশ্বস্ত করে, বিমান হামলা প্রতিরোধের মহড়া চলছে। ভয়ের কিছু নেই। সবাইকে শান্ত করার জন্য এবার আমাকেও চেষ্টায় নামতে হলো। অমার্জিত মিথ্যা কথা একদম পছন্দ করি না। হিথারকে উদ্দেশ করে বলি, পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটেনি, যার জন্য ভূমি থেকে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইলের আঘাতে মরতে হবে। না, আমরা এভাবে অসহায়ের মতো প্রাণ দিতে পারি না। পরে জানা গেল, আমেরিকার সরকার দুটি ড্রোন বা চালকবিহীন উড়োযান কাবুলের আকাশ প্রদক্ষিণে পাঠিয়েছে।

সৌভাগ্যবশত একসময় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এল। আমি হিথারকে পুনরায় এমন উল্টাপাল্টা আচরণ করতে কড়া ভাষায় নিষেধ করি। এর প্রভাব পড়ে সবার ওপর। আমাদের কেউই বাংকারে যেতে রাজি নয়। হিথার শান্ত হলো বটে, কিন্তু মনে একটা উদ্বেগ রয়েই গেল।

আমি বিশ্বাস করতে শুরু করছিলাম, বিশেষ কমান্ডো বাহিনী আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। এই ধারণার কথা বলতেই সবাই একে ভয়ংকর পরিকল্পনা বলে অভিহিত করল। হিথারকে বোঝালাম, সত্যি সত্যি যদি বিমান হামলা শুরু হয়, তাহলে বাংকারে লুকানোর চেষ্টা ছাদসমেত চাপা পড়তে পারে। আমার কথায় ও ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো। বয়স মাত্র ২৪। এইটুকুন বয়সে এত নির্মম বাস্তবতার মোকাবিলা করা সহজ কাজ নয়। আমিও খুব সাহসী বালিকা নই। তবে কারও পাগলামির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করার কোনো ইচ্ছা নেই।

এর মধ্যে হিথার ও ডায়ানার নামে আসা চিঠি হাতে এসে পৌছালে চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বিজয়ীর বেশে হিথার বলতে থাকে, চিঠিতে বাবা তাকে দুশ্চিন্তা করতে একদম নিষেধ করেছেন। নিরাপদে হিথারের বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত আমেরিকার সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে।

এহেন ফাঁকা কথায় আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। জবাবে হিথার বেশ রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে জানায়, তার বাবা আমেরিকার দূতাবাসের একজন কর্মচারী। তিনি কখনো হিথারের সঙ্গে মিথ্যা বলেন না। আমি বললাম, অবশ্যই তোমার বাবা মিথ্যা বলেন না, আর বলতেও চান না। কিন্তু কলিন পাওয়েল কি তোমার বাবাকে জানিয়ে বিমান হামলা শুরু করবে? বিশেষ করে, যখন তিনি কাবুলের জেলে তাঁর মেয়ের কাছে চিঠি লিখছেন।

খারাপ সংবাদ বলে বেড়ানোর জন্য আমি দুঃখিত হলেও এখন আবেগ সরিয়ে রেখে বাস্তববাদী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। জেলখানা কোনো আকাশকুসুম কল্পনার বাড়ি নয়। যা-ই হোক, চিঠির আনন্দে হিথার আর ডায়ানার সময়গুলো ভালোই কাটতে লাগল। ক্যাথির নামে সচরাচর কোনো চিঠি আসত না। একদিন দেখি ও চোখে-মুখে উত্তেজনা নিয়ে কিছু একটা পড়ছে। মনে হয়, দূর থেকে কেউ ওকে মনে করেছে। এসব চিঠির প্রতিটিই ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাতে হতো। এত ঝামেলা পোহানোর ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই তালেবানদের ছিল না।

হতভাগিনী সিল্কের নামে কোনো চিঠিই আসেনি। মেয়েটার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। একদিন দেখি মেয়েটার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বিষয়টা অস্বাভাবিক। কারণ, সিল্কে কান্নাকাটি করার মতো মেয়ে নয়। চত্বরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে মেয়েটা নিজেকে সামলে নেয়। দুঃখের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল কোনো কারণে হয়তো। মেয়েটার কান্না কারা পরিচালকের মন ছুঁয়ে গেল বোধ হয়। উনিই এখানে অস্থায়ী ডাকপিয়নের কাজ করেন। লোকটা নরমসরম নিরীহ গোছের একজন বৃদ্ধ। কিন্তু এ জন্য আমার কাছ থেকে করুণা লাভের কোনো সুযোগ নেই।

পরের দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দুজন কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করতে আসেন। সঙ্গে ছিলেন কঠোর দর্শনের কারা মহাপরিচালক। তাঁরা জানালেন, আজ থেকে আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেহমান। অর্থাৎ আমার ওপর গোয়েন্দা বিভাগের কোনো কর্তৃত্ব রইল না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এত দিনের তদন্ত, গোয়েন্দাগিরি আর জেরার দিন ফুরিয়ে এল তাহলে!

সেদিন মধ্যদুপুরে আমি ইয়োগার দ্বিতীয় সেশনে অনুশীলন করি। বিকেল চারটা পর্যন্ত অনুশীলন চালিয়ে যাই। ইচ্ছে করেই এ সময়টা বেছে নিয়েছিলাম। তালেবানরা দেখুক আমি কতটা শক্তসমর্থ নারী অথবা ঘেউ ঘেউ করা কুত্তা। যা ইচ্ছা তা-ই মনে করুক। আমার খোলা চত্বরে অনুশীলনের দৃশ্যটা তালেবানদের কাছে দৃষ্টিকটু প্রতীয়মান হয়েছিল। চোখ খুলে অনুশীলন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা জড়সড় হয়ে বসে ছিল এক কোনায়।

সুসংবাদ দেওয়ার পরে কর্মকর্তারা জানান, আমাকে কিছু প্রশ্ন করা হবে। বেশি সময় লাগবে না। কথা শুনে যুদ্ধংদেহী রূপে আবির্ভূত হই। তাঁদের সহযোগিতা করতে অস্বীকার করি। দ্বিতীয়বারের মতো যখন রণরঙ্গিনী রূপ দেখাই, আমি রীতিমতো কাঁপছিলাম। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মাটিতে পা দিয়ে মৃদু স্বরে আঘাত করতে থাকি। তাঁদের মধ্যে একজন, যাকে আমি হাসিমুখের খুনি বলে অভিহিত করতাম, আমাকে জালালাবাদের সেই পুরোনো জ্ঞানগর্ভ কথাগুলোই আবার শোনাতে থাকেন। আমি তাঁদের মেহমান এবং তারা সব সময় আমাকে খুশি দেখতে চান ইত্যাদি।

আমি চিল্কার করে বললাম, আমি কোনো মেহমান নই। এখান থেকে আমার নড়াচড়ার কোনো জো নেই। আমি একজন বন্দী। একটা দেশের উন্নতির মাত্রা কখনো কখনো জেলখানার মানের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়। এই জায়গাটা একদম জঘন্য নরকের মতো। তোমরা হলে আদিম যুগের নিষ্ঠুর জগতের লোক।

লোকটার সহকারী প্রতিবাদ জানাল আমার কথায়। ২২ বছর ধরে এখানে প্রতিদিন যুদ্ধ হচ্ছে। বিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে আর কী আশা করা সম্ভব? জেলখানার উন্নতি সাধনের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য। বরং তুমিই আমাদের না জানিয়ে এ দেশে প্রবেশ করেছ।

আমি হাত নেড়ে লোকটার কথাকে পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গি করি। তোমরা নরকে যেতে পারো, এই কথা বলে তাদের চলে যেতে বলি আমার চোখের সামনে থেকে। পরমুহূর্তে নিজেই উঠে দাঁড়াই, থুতু ফেলি ওদের পায়ের কাছে আর হাটতে হাটতে চলে আসি কারাঘরে। মেয়েগুলো আমার কাণ্ড দেখে আতঙ্কে নীল হয়ে যায়। আমাকে আরও সাবধান থাকতে নির্দেশ দেয়। এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এল আমারও। উঠে দাঁড়াতেই আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। মনে হলো যেন অসুস্থ হয়ে পড়ে যাব। হাজার হাজার প্রজাপতি যেন কিলবিল করছে পেটে।

পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে এল হিথার। কারার লোকজনের সঙ্গে ওর ভালোই খাতির। একজন নারী কারারক্ষী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সঙ্গে এমন আচরণ করলে আমাকে যেন চাবুক দিয়ে প্রহার করা হয়। আমার দায়িত্ব শুধু তোমাকে সতর্ক করে দেওয়া। ঠিক এই জায়গায় এসে নিশ্চয়ই যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোেক চুপ হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন মাথায় ভূত চেপেছিল। আমি একটুও দমে না গিয়ে উত্তর দিলাম, প্রহারের সময় যদি ব্যথা পাই, তাহলে খুশিই হব আমি। বুঝতে পারব বেঁচে আছি।

খুব শক্ত ও সাহসী বাক্য। কোনো সিনেমায় দেখেছিলাম? মনে করার চেষ্টা করলাম। বাস্তবতা ছিল একেবারে অন্য রকম। বাইরে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও ভেতরে ভেতরে আমি তখনো ভয়ে কাঁপছিলাম। আশঙ্কা জাগছিল মনে, এক্ষুনি হয়তো আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাইপ দিয়া চাবকানো হবে। জেলে বন্দী স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করা হয়।

২০ মিনিট পরে ভাঙা গেটটা খুলে যায়। পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। হিথার কাঁপতে কাঁপতে রুমের এক কোণে বসে পড়ে। হাসিমুখের খুনি একজন লোককে সঙ্গে করে পুনরায় ফিরে এসেছে। আমার পা দুটো কাঁপছিল। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। ওদের কণ্ঠস্বর আমাদের কক্ষের দিকেই এগিয়ে আসছিল।

ওদের মধ্য থেকে তিনজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে খোদার কাছে প্রার্থনা করতে লেগে গেল। খোদা, রিডলিকে শক্তি দাও। অত্যাচার-নির্যাতনের সময় ও যেন কোনো ব্যথা অনুভব না করে। আমার মঙ্গল কামনা করাই ছিল ওর উদ্দেশ্য। এ যেন ঠিক মন্টি পাইথনের লাইফ অব ব্রায়ান সিনেমার দৃশ্য। জালালাবাদে থাকাকালে খোদা আমায় অনেক শক্তি জুগিয়েছিলেন। জানি না, ঈশ্বর এখানে এসেও উপস্থিত হয়েছেন কি না! সবাইকে অবাক করে দিয়ে আফগান সাহেব উপস্থিত হলেন হাতে একটা স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে। না, আমাকে প্রহার করার জন্য কোনো বৈদ্যুতিক তার নয়। সবাইকে তাদের বাড়িতে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো। মেয়েগুলো আনন্দে ফেটে পড়ে। একের পর এক গল্প চলতেই থাকে। জার্মান মেয়েটা ও ডায়ানার জন্য এটা ছিল বিশেষ আবেগঘন মুহূর্ত। বন্দী হওয়ার পর থেকে কারও সঙ্গেই কথা

বলার সুযোেগ হয়নি ওদের। হতাশায় ভেঙে পড়া সিঙ্কে হয়তো অপেক্ষা করছিল এমন একটা মুহূর্তের জন্যই।

তবে এই আলাপচারিতা থেকে স্বাভাবিকভাবেই আমি বাদ পড়ি। কেথি, মেয়েটার মঙ্গল হোক, আমার জন্য এগিয়ে এল। আমিও যেন বাড়িতে কথা বলতে পারি, আফগান লোকটাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করল। না, আমার জন্য কোনো অনুমতি নেই। এই মহিলা আমাদের কোনো সহযোগিতাই করছে না এবং খারাপ ব্যবহার করছে। তোমরা জানো, সে আমাদের দিকে থুতু নিক্ষেপ করেছে? বাড়িতে কথা বলতে পারার এত বড় সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় স্বভাবতই আমার মন খারাপ হলো। তবে মেয়েগুলোর জন্য এ রকম একটা মুহূর্তের দরকার ছিল খুব।

আফগানিস্তানে খারাপ খবর ও খারাপ ব্যবহারের খবর বাতাসের আগে ছড়ায়। পরদিন দেখতে ছোটখাটো গড়নের সদা হাস্যময় সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। খুব দ্রুতই আমাকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়ে গেলেন। এ সংবাদ শোনার পরও আমি ওনাকে অগ্রাহ্য করে গেলাম। তিনি আমাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। জবাব দিলাম, দুশ্চিন্তা করছি না, কিন্তু প্রচণ্ড রেগে আছি। তোমাদের কথার কোনো মূল্যই আমি দিচ্ছি না। বিশেষ করে, কাবুল নিয়ে আসার কথা বলে তোমরা আমাকে যেভাবে ধোকা দিয়েছ। গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন অনর্গল মিথ্যার পর মিথ্যা বলে গেছে। এখন আবার আমাকে এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করেছ তোমরা। শেষ দিকে আমি চিৎকার করতে থাকি। তোমরা কী ধরনের লোক?

আমরা কথা বলছিলাম চত্বরে দাঁড়িয়ে। কারারক্ষী আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। হোড়াই কেয়ার করে আমি নিজ কক্ষে ফিরে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে যাই। ইয়োগা অনুশীলন চলল কিছুক্ষণ। সূর্য তখন ঠিক মাথার ওপরে এবং গরমে গায়ে ফোসকা পড়ার উপক্রম। মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে তাঁকে চলে যেতে বললাম।

মানসিকভাবে আমি খুব বিপর্যস্ত ও বিভ্রান্ত ছিলাম তখন। মনে হচ্ছিল, আমি যতই ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না কেন, বিনিময়ে ওরা শুধু একগাল হাসি আর মেহমানের প্রতি চিরাচরিত সম্মান দেখিয়েই যাচ্ছিল। আবার সব সময় অগ্নিমূর্তি ধারণ করে থাকাটাও বিরক্তিকর। কত দিন এমন রাগ দেখিয়ে যেতে পারব, ঠিক নেই। এমনিতেই আমি মোটেও কঠিন প্রকৃতি ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গির মানুষ নই। সহজাত প্রকৃতির বাইরে অন্য কোনো চরিত্রে অভিনয় করাটা মোটেও স্বাভাবিক আচরণ নয়।

হিথার একটা উপন্যাস পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। কেন ফলেটের লেখা কোড টু জিরো। ওদের সবাই ইতিমধ্যেই এটা পড়া শেষ করেছে। মেয়েটা আমাকে উৎসাহ জোগায়, চমৎকার উপন্যাস। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতেই পারবে না। তবে ওর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। এত বড় একটা উপন্যাস পড়তে শুরু করার অর্থ হচ্ছে, আমি কয়েদখানার দীর্ঘদিনের বন্দিত্ব মেনে নিয়েছি।

মার্গারিট ওর কাছে থাকা ছোট ছোট গল্পের একটা বই দিতে চাইল। গল্পগুলো বেশি দীর্ঘ নয়, তাই মন ভালো থাকলে খুব অল্প সময়েই একটা একটা করে পড়ে শেষ করা যাবে। বইটার দিকে একনজর দেখে হাসি পেল আমার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কুখ্যাত ধান্দাবাজ, প্রতারক রাজনীতিবিদ জেফরি আচারের লেখা গল্পের সংকলন। ওই বদলোক বর্তমানে কারাগারে বন্দী। মেয়েগুলোকে বলি, তবে তাকেও মনে হয় না প্রতিদিন নিজের হাতে পানি টেনে তুলতে হয়।

লোকটা কি আমার আগেই কারাগার থেকে মুক্তি পাবে? বৈরুতে আটক পশ্চিমা বন্দীদের ভাগ্য নিয়ে আমরা কথা বলতে শুরু করি। টেরি ওয়েট, টেরি অ্যান্ডারসন ও জন ম্যাকার্থি-এই তিন হতভাগা দীর্ঘদিন ধরে বৈরুতে বন্দী ছিলেন। তাঁদের বন্দিত্বের কথা মনে করে আমার মনেও হতাশা চেপে বসল। তবে তাঁদের চেয়ে কাবুলে আমরা অনেক ভালো আছি। হিথারকে বলি এই কথা। অন্ততপক্ষে সারাক্ষণ বন্দী হয়ে থাকতে হয় না। চত্বরে হাঁটাহাঁটি করা যায়।

তবে কারাগারের জীবন একঘেঁয়েমিপূর্ণ ও নিয়মমাফিক। খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে বাকি সময় খুব বিরক্তিকর কাটে। কারাগারের নিয়মিত সকালের নাশতা রুটি ও ভাতের বদলে তাজা ফলমূল ও সবজি খেতে পারলে ভালো হতো। মেয়েগুলো একটা বাজারের ফর্দ তৈরি করে এক নারী কারারক্ষীর হাতে তুলে দেয়। অধিকাংশ কারাগারেই হাতে টাকা থাকলে বাইরে থেকে খাবারদাবার কিনে আনার সুযোগ থাকে। ডায়ানার হাতে কিছু টাকা ছিল, মেয়েরা সবাই তখন রান্না করার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে। তত দিনে আমার ক্ষুধার জ্বালা উবে গেছে। খাবারের চিন্তায় মুখ থেকে এখন আর পানিও ঝরে না। তবু মনে আছে, একদিন সিঙ্কে কিছু একটা রান্না করছিল আর চারদিকে রান্নার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিল। কাটা ধনে পাতার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই সুবাস আমার নাকে এসে লাগে।

সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বারান্দার শেষ মাথার ঘরের বাচ্চাটা সারা রাত কেঁদেই যাচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওই ঘরে দুজন আফগান নারীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাঁদের অপরাধ, কার্পেট কিনতে আসা দুজন অপরিচিত লোককে তারা বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিলেন।

তালেবান রাজত্বে আফগানিস্তানের নারীদের কোনো অধিকার নেই। তবে এর আগেও যে নারীদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল, এমনও নয়। ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক, নারীরা চরম মাত্রায় বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত। বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্র ব্যতীত তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই।

মধ্য নভেম্বরের মাঝামাঝি তালেবান রাজত্বে ফাটল ধরলে দুঃসাহসী অনেক নারী প্রকাশ্যে চেহারা দেখিয়ে চলাফেরা করেছেন। তবে দীর্ঘাত্রায় তাঁদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, তা দেখার জন্য আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকটা সেদিন আরেকবার দেখা করতে আসেন। আমাকে খুব শিগগির আলাদা কক্ষ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। আপনি আমাদের মেহমান এবং আমরা আপনাকে খুশি রাখতে চাই।

আমি কিছু একটা বলতে চাইছিলাম কিন্তু লোকটা দ্রুত বলতে শুরু করে, আমরা জানি, আপনি ইরানেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই শুধু কেন আমাদেরই আদিম যুগের মানুষ বলছেন, বুঝতে পারছি না।’ এই কথা বলে লোকটা এমনভাবে তাকাল, যেন এই মাত্র সে খুব গোপন কিছু উদ্ধার করে ফেলেছে।

খোদাই জানেন, সে কী নিয়ে কথা বলছে কিন্তু আমি কোনো দিন ইরানেই যাইনি।

কাবুল জেলের বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে আছি। শুধু জানতাম, আমার পত্রিকা অফিসের লোকজন ইসলামাবাদে তালেবান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করেই যাচ্ছেন। এক্সপ্রেস-এর চেয়ারম্যান আবার আমাকে নিয়ে ‘বিন লাদেনের ডেরায় বা এ ধরনের কোনো গল্প লিখছেন কি না কে জানে! ওকে ম্যাগাজিনে আমাকে নিয়ে কী প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে, আমি একদমই জানি না।

কারা পরিচালক মেয়েগুলোর সঙ্গে কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বলে বসেন, ‘তোমাদের জন্য জর্জ বুশ প্রতিনিয়ত আমাকে চাপ দিচ্ছে। এখন আবার যোগ দিয়েছেন টনি ব্লেয়ার এই ইংরেজ নারীর জন্য।’

আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। নিজেকে আমার কখনোই এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি যে আমাকে মুক্ত করার জন্য এত প্রচেষ্টা চলবে। একটা পাকিস্তানি পত্রিকা হাতে এল, যেখানে লেখা হয়েছে আমি বিশেষ বাহিনীর একজন সদস্য। হ্যা মেয়েরা, জেনে রাখো আমি বিশেষ বাহিনীর একজন কমান্ডো। আজ রাতেই চত্বরে লুকিয়ে রাখা অদৃশ্য হেলিকপ্টারে করে তোমাদের মুক্ত করে নিয়ে যাব।

এটা ছিল একটা ছোটখাটো চুটকি। বন্দিজীবনের এসব হাসি-তামাশাই মনে শক্তি জোগায়। কিন্তু ওই প্রতিবেদন পড়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। ইচ্ছা করছিল প্রতিবেদকের টুটি চেপে ধরি। সে প্রায় আমার মৃত্যু পরোয়ানা লিখেই ফেলেছে। কোনো না কোনোভাবে এসব গুজবের রাশ টেনে ধরতে হবে।

আমার জীবনের দুটি গোপন ঘটনার জন্য জীবন দেওয়া লাগতে পারে। তালেবানরা কখনোই বুঝতে চাইবে না কেন আমি একজন ইসরায়েলিকে বিয়ে করেছিলাম। আমার তৃতীয় স্বামীর কথা বলছি। এই বিয়েটা যে কেন করেছিলাম, সেটা ঠিক আমিও জানি না। এ জন্য আমাকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হতে পারে। আরেকটা গোপনীয়তা হলো, আমি আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর একজন সদস্য ছিলাম।

আমাদের নিজেদের কক্ষে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হলো। কয়েকজন পুরুষ মানুষ আসবে একটা নতুন কক্ষ পরিষ্কার করতে এবং আমাদের তাদের থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে। এসব অভিজ্ঞতা ছিল খুবই বিরক্তিকর। যদিও বেশি দিন হয়নি এখানে এসেছি, তবে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় নিজেকে একজন তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে মনে হচ্ছিল।

পরে আমার জন্য বরাদ্দ কক্ষটা দেখতে যাই। মোটেও ভালো কিছু নয়। এক প্রান্তে একটা বিশাল গর্ত। উঁকি দিতেই ইঁদুর-জাতীয় কিছু একটা সরে গেল। দেয়ালে আরবিতে অনেক কিছু লেখালেখি করা। জানালা দিয়ে পুরুষদের কারাগার চোখে পড়ে।

দরজার দিকে তাকাই। ধাতব দরজা। মনে মনে ভয় হতে লাগল, মাঝেমধ্যে গালিগালাজ করলে আবার না আমাকে দরজায় তালা দিয়ে বন্দী করে রাখা হয় টানা ২৪ ঘন্টা। দরজার লকটা নষ্ট করতে মেয়েদের কাছে আঠাজাতীয় কিছু চাইলাম। পরে অবশ্য একটা পাথর দিয়ে বাড়ি মেরে দরজার লকটা ভেঙে ফেলি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদা হাস্যময় লোকটা কারা পরিচালকের সঙ্গে দেখতে এলেন নতুন কক্ষটা আমার পছন্দ হয়েছে কি না। কক্ষটা অপ্রশস্ত এবং এমনকি খোদ আফগানিস্তানেও মানুষ কেন একটা প্রাণীকেও এখানে রাখা সম্ভব নয়। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমার কথায় সম্মতি জানালেন। এ রকম নোংরা কষ্টকর জায়গায় আমাকে থাকতে বাধ্য করার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন।

তিনি আমাকে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের তালেবানদের আবাসিক এলাকায় নিয়ে যেতে চান। তাই বললেন, কাপড়চোপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। তাদের এমন ভদ্র ও নরম ব্যবহারে আমার সন্দেহ হতে লাগল। ভয় লাগছিল নির্ঘাত কোথাও নিয়ে আমাকে অত্যাচার করা হবে। তিনি বলতে থাকলেন, আগামীকাল সকালে মুক্তি দেওয়া হবে আমাকে। আমিও বলতে থাকি, হা হা, বহুবার শুনেছি এই ম্যাড়মেড়ে সংলাপ। আগামীকাল, ইনশাল্লাহ (যদি আল্লাহ চান)।

আমি প্রথমে কক্ষটা দেখতে চাইলে আমাকে চত্বর পেরিয়ে একটা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা বেশ বড়সড় কক্ষ। ওখান থেকে কাবুলের পাহাড় চোখে পড়ে। স্বীকার করি, যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। তবে তা প্রকাশ হতে দিলাম না। মুখে একটা কঠিন ভাব ধরে রাখলাম।।

আমি পুরোনো কক্ষে ফিরে গিয়ে মেয়েগুলোকে জানালাম, হঠাৎ করেই ওরা বেশ ভালো ব্যবহার করছে। জানি না এর রহস্য কী। তবে তোমাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। খোদা মঙ্গল করুক। একটা মেয়ে আমার হাতে উপন্যাসটা গুজে দিল। আমাকে দ্রুত সরে আসতে হলো সেখান থেকে।

সেদিন ছিল রোববার। সন্ধ্যা নামতেই আঁধার ঘনিয়ে এল। রুমের আলো জ্বালিয়ে দিলাম। মাঝখানে ঐতিহ্যবাহী আফগান শতরঞ্জি ও চারদিকে বালিশ সাজিয়ে রাখা। এক প্রান্তে পুরোনো জীর্ণশীর্ণ একটা খাট। একবার মনে হলো, কক্ষে অনর্থক বসে না থেকে উপন্যাসটা পড়তে শুরু করি। গল্পটা বেশ ভালোই এবং অল্প সময়ের মধ্যেই গল্পের ভেতরে ঢুকে গেলাম।

রাতের নীরবতা চিরে প্রকট শব্দে আকাশটা আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠল। উজ্জ্বল আলো, বিমানবিধ্বংসী মিসাইল আর ক্রুজ মিসাইলের লক্ষ্যভেদী কান-ফাটানো শব্দ। ২০ মাইল দূরে থেকেই মিসাইলের শব্দ শোনা যায়। কিন্তু এই মিসাইলগুলো কারাগারের আধা মাইলের মধ্যে আঘাত হানছিল। ঘরের জানালাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছিল প্রচণ্ড শক ওয়েভে।

তড়াক গতিতে বিছানা থেকে নেমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। দূরে পাহাড়ের ওপর বাড়িঘরের বাতিগুলো জ্বলজ্বল করছিল। উঁচু উঁচু পাহাড়ের ওপর বিন্দু বিন্দু মৃদু আলো সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব শোভা, যেন ক্রিসমাসের রজনী। হঠাৎ করে কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই আলো নিভে গেল। অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত হলো এ আটজন তালেবান সৈন্য হন্তদন্ত হয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করল। ওদের তাড়া দেখে ভয়ে চমকে উঠলাম। কারণ, সাধারণত কক্ষে ঢোকার আগে ওরা দরজায় আঘাত করে।

আমার খাটের নিচ থেকে বের হলো রকেটচালিত গ্রেনেড। হায় খোদা, ক্ষুদ্র অ্যাশ লির মতো অসহায় হয়ে ছিলাম এতক্ষণ। এক মিটারেরও কম দূরত্বে রক্তখেকো অস্ত্রের মজুত। আমি একরকম বেপরোয়া হয়েই জানতে চাইলাম, তারা কী করতে যাচ্ছে?

ওদের মধ্যে একজন ছাড়া কেউই উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করল না। ওই হতচ্ছাড়াও খিলখিল করে হাসছিল। আকাশের দিকে নির্দেশ করে চিৎকার করে ওঠে, আফ্রিকা, আফ্রিকা, আম্রিকা, অ্যাচ, অ্যাচ, অ্যাচ, অ্যাচ। নির্বোধ ধর্মান্ধ লোকটার অঙ্গভঙ্গিতে বিরক্তির উদ্রেক হলো। আমিও বলে ফেললাম, সামান্য কালাশনিকভ আর আরপিজি দিয়ে আকাশে উড্ডীয়মান বি-৫২ বোমারু বিমানের পাখার নাগালও পাওয়া যাবে না। ওদের অস্ত্র ফুরিয়ে আসতে থাকলে আমি খোঁচা দিয়ে বলি, তির-ধনুক দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারো।

এমন সময় কারা পরিচালক এসে হাতের ইশারায় শান্ত হতে বললেন। অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি আমার জন্য মোটেও চিন্তিত ছিলাম না। তবে নিচের মেয়েগুলোর জন্য অজানা আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠছিল। বিশেষ করে, হিথারের জন্য বেশি মায়া লাগছিল। দুই দিন আগে চালকবিহীন বিমানের সামান্য শব্দেই ও কী পরিমাণ আতঙ্কে পাগলামি করেছে! তাহলে আজ ওর অবস্থা হবে কী ভয়ংকর, এসব ভাবতে ভাবতে আমি নিচে যাওয়ার অনুমতি চাইলে আমাকে বাধা দেওয়া হলো।

তিনি চলে গেলেন একটু পরই। চাইলে লুকিয়ে নিচে নেমে যেতে পারতাম। কিন্তু শকুনি দৃষ্টিসম্পন্ন একদল তালেবান যারা হন্যে হয়ে শিকার খুঁজছে, তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। যুদ্ধের ডামাডোলের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই চিলেকোঠাতে ফিরে এসে তাকিয়ে তাকিয়ে বোমাবর্ষণ দেখতে লাগলাম। ৪০ মিনিট ধরে যুদ্ধবিমানের পেট থেকে বোমা পড়ল। দুটি লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে হামলা হচ্ছে। একটা হলো সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র, যেটা বিমানবন্দরের খুব কাছে অবস্থিত। আরেকটা তার বিপরীত দিকে মাইলখানেক দূরে হবে হয়তো।

অদ্ভুত যেটা ছিল, তা হলো আকাশের অবস্থা। শুধু রুপালি, সাদা আর ধূসর রঙের মিশেল চোখে ভাসছিল, যেন একরঙা আকাশ। সবচেয়ে বেশি হতাশার ছিল বোধ হয় এটাই। একমাত্র পশ্চিমা সাংবাদিক কাবুলে বসে বসে বোমা হামলার শুরুটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সংবাদ প্রচারের কোনো উপায় নেই।

পাখির চোখে সবকিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম। শুধু বার্তাকক্ষে ফোন দিয়ে বলতে বা জানাতে পারছিলাম না, এটা কী অপূর্ব দৃশ্য। কোনো দিন কি একের পর এক বোমারু বিমানের আগুনের ফুলকি কীভাবে ছুটে যাচ্ছিল, এ দৃশ্যের বর্ণনা কাউকে শোনাতে পারব? আমি তখনো জানতাম না।

হামলার প্রথম দিকে মনে শান্তি লাগছিল। মনে পড়ে, কিছুক্ষণ পরই বিরক্তিকর আফগান বাহাদুর ওরফে হাসিমুখের খুনির উল্লাসধ্বনি শুনতে পেলাম। তালেবানরা একটা গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত করেছে শুনে লোকটা। শূন্যে ঘুষি মেরে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। তাই তার সম্মানার্থে সর্বোচ্চ স্বরে ‘রুল ব্রিটানিয়া গানটা গাইতে শুরু করি।

টের পেলাম আনন্দ লাগছে খুব। দেহে অ্যাড্রেনালিনের গতি বাড়ছে দ্রুত। যাক, অবশেষে বোমা হামলা শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা হয়তো খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপরের মতো শোনাবে, তবে কয়েদখানা মানুষকে এসব ভাবতে বাধ্য করে। একটু খুঁতখুঁতেও লাগছিল। ভেবেছিলাম, আমার ও সাহায্যকর্মীদের কথা চিন্তা করে হয়তো বোমা হামলা শুরুর আগে কিছুটা কালক্ষেপণ করা হবে।

হঠাৎ আমার পরিবারের কথা মাথায় এল। জর্জ বুশের বোমা হামলার কথা ঘোষণার পর তাদের কী কষ্টটাই না লাগছে।

দরজায় আঘাতের শব্দ কানে এল। তালেবান সৈন্যরা ফিরে এসেছে। কেমন বিপর্যস্ত লাগছে সবাইকে। বিছানার নিচে আরপিজি রাখতে ফিরে এসেছে ওরা।