অবশেষে মুক্তি

অবশেষে মুক্তি

পরদিন সকালে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মান দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা আমার সঙ্গে সদলবলে সাক্ষাৎ করতে আসেন। জার্মানিভিত্তিক দাতব্য সংস্থার আটক হওয়া আটজন সাহায্যকর্মীর ব্যাপারে তাঁরা সবাই উদ্বিগ্ন। আমার কাছে জানতে চাইলেন কী অবস্থায় তাদের রাখা হয়েছে? কেমন আছে সবাই?

ওদের কাছে সংবাদ পৌছাতে পেরে আমার খুব আনন্দ অনুভূত হলো। জার্মান টিমের সদস্য জর্জ টম্যান, ক্যাথি জেলিনেক, মার্গারিট স্টেবনার ও সিল্কে ডাকোফ সবাই খুব ভালো আছে। আমার ভাষ্যমতে, খোদার প্রতি তাদের চরম আস্থা রয়েছে। খোদার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও মনের শক্তির জোরেই তারা এখনো টিকে আছে। আমার কথা শুনে তাঁরা কৃতজ্ঞচিত্তে ফিরে গেলেন।

এবার আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে জানালাম ডায়ানা বেশ ভালো ও সুস্থ আছে। তবে ওদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যাকে নিয়ে একটু আশঙ্কা রয়েছে। হিথার মার্সার, বিপদের মুখে ও সহজেই ভেঙে পড়ে। আমি ওদের সঙ্গে খুব অল্প সময় কাটিয়েছি। এই সময়ের মধ্যেই আমার কাছে হিথারকে খুব প্রাণোচ্ছল, বুদ্ধিমতী ও বন্ধুবৎসল মনে হয়েছে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর শোনার পর ওর অস্থিরতা আমিসহ সবাইকেই চিন্তিত করেছিল।

আমি অনুরোধ করলাম, তোমরা দ্রুত ওদের বের করে আনার ব্যবস্থা করো। ওদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আর কত দিন ওরা, বিশেষ করে হিথার আর কত দিন টিকতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে।

পরে কারাগারের একটা নকশা এঁকে ফেলি। সবগুলো ঢাকার ও বের হওয়ার পথ চিহ্নিত করে দিই। পাহারাদারদের কাজের রুটিন উল্লেখ করি। চারপাশের দেয়ালের অবস্থা ও ভেতরের গর্তগুলো চিহ্নিত করে দিই। যে চত্বরে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করেছি সেটার আয়তন অনেক আগেই মনে মনে মেপে নিয়েছিলাম। তা-ও উল্লেখ করতে ভুলি না।

আমেরিকান কনস্যুলের প্রধান কর্মকর্তা ডেভিড ডৌহাউ গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শোনেন। আমার কথা শেষ হওয়ার পর তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ডায়ানার মা ন্যান্সি ক্যাসেলের ফোন নম্বর ধরিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা খুব দুশ্চিন্তা করছেন এবং আন্তরিকভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।

আমার প্রদত্ত তথ্যগুলো কী কাজে লাগত, তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমি মনে মনে আশা করছিলাম, বিশেষ বাহিনীর একটা দল ঝটিকা আক্রমণ করে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। সাহায্য সংস্থাটির পরিচালক জর্জ ও পিটারকে মেয়েগুলো থেকে দূরে ও আলাদা একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। সপ্তাহে মাত্র একবার তাদের দেখা হতো। এটাই ছিল উদ্ধার অভিযানের প্রধান বাধা। মেয়েগুলোকে মুক্ত করার সময় যদি ওদেরও বের করে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে তালেবানরা নির্ঘাত ওদের মেরে ফেলবে। যদিও জর্জ তালেবানদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। পরিস্থিতিটা সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটা উভয়সংকটে ফেলে দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইরানে বন্দী আমেরিকান নাগরিকদের মুক্ত করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা শেষ হয়েছিল রক্তপাতের মাধ্যমে। অতএব, শক্ত ও কঠিন মানসিকতার একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষেই কেবল এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ একটা পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

যা-ই হোক, আমার সাধ্যে যতটুকু কুলায় তা আমি করেছি। এখন শুধুই ওদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। আমি শয়নকক্ষে ফিরে যাই এরপর। এই কক্ষের পাশের ঘরেই টনি ব্লেয়ার সর্বশেষ ইসলামাবাদ ভ্রমণের সময় অবস্থান করেছিলেন। শরীরে ঘামাচির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। ওদের ঘরে মাছি বা পোকাজাতীয় কিছু নিয়ে এসেছি কি না এ ভয়ে অ্যানির কাছে আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিই।

এই মহিলা কখনোই বিচলিত হন না। অন্য কোনো গৃহিণী হলে হয়তো এতক্ষণে আমাকে ঘাড় ধরে বাইরে বের করে দিতেন। অথচ অ্যানি একটুও বিরক্ত হলেন না। একজন স্বাস্থ্য পরিদর্শককে দিয়ে পরে ঘর পরীক্ষা করে দেখবেন, শুধু এতটুকু বলেই ক্ষ্যান্ত দিলেন। অ্যানি খুব ভালো মানসিক পরামর্শ দিতে পারেন। মাথা থেকে যদি কোনো দুশ্চিন্তা দূর করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে যেন তাকে জানাই। মনে হলো, আমাকে সাহায্য করতে পারলে তিনি বেশ খুশিই হবেন।

পল অ্যাশফোর্ড ও সালেহা এসে পৌছালে অনেকক্ষণ আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করি। সালেহা একটা সুন্দর সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। মেয়েটাকে দেখতে দারুণ লাগছে। আমরা ওপরে গিয়ে গল্প করতে লাগলাম। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী সব ধরনের ক্রিম, লোশন বোঝাই ব্যাগ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি শরীরের ঘামাচির দাগগুলো দেখাই। না, যা ভেবেছি তা নয়। তীব্র গরমেই এমন হয়েছে বলে তিনি জানালেন। এর পরই তিনি জানতে চাইলেন, আমি যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছি কি না। আমার কাছ থেকে না-বোধক উত্তর শুনেই তিনি চলে গেলেন।

পরদিন মনে হলো, ডায়ানার মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। কিন্তু খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল। নিজেকে এতটাই ভিতু আর কাপুরুষ মনে হচ্ছিল যে কী করে ফোন করব তাই বুঝে আসছিল না। এই অবর্ণনীয় মানসিক চাপ কমাতে অবশেষে অ্যানির দ্বারস্থ হলাম। আমি আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলাম অবৈধভাবে। পরে আটক হই, তালেবানদের সঙ্গে মারাত্মক খারাপ ব্যবহার করি এবং ১০ দিন পর মুক্তি পেয়ে চলে আসি। ব্যস, এতটুকুই করেছি আমি। অন্যদিকে ডায়ানা মেয়েটা আফগানিস্তানের গরিব অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় নিজের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছে। এবং বর্তমানে বিভিন্ন অভিযোগে বন্দিনী হয়ে ধুকছে। এখানে ন্যায়বিচার কোথায়? ডায়ানার মা হলে আমি নিজেকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। কখনোই কথা বলতে চাইতাম না নিজের সঙ্গে।

নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আমি এতটা ভিতু কাপুরুষ না-ও হতে পারি। ডায়ানা বেশ সাহসী মেয়ে। ওর মাকে না জানালে বড্ড অপরাধ হবে।

আমরা বিষয়টা নিয়ে বেশ সময় ধরে কথা বললাম। অবশেষে আমি ফোন করার জন্য মানসিক শক্তি ফিরে পেলাম। ন্যান্সি একজন চমৎকার নারী। আমি তাঁকে জানাই, আপনি এক বিরল সাহসী ও সুন্দর মেয়েকে পেটে ধরেছেন। ওর মানসিক শক্তি এতই বেশি যে, বন্দিদশাতেও সে রূপচর্চা করত। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করত। যদিও সেখানে তাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো কেউ ছিল না। জেলের জীবন ছিল বড় একঘেয়েমিপূর্ণ।

ডায়ানা ছিল আমার জন্য বিশেষ একজন। অসম্ভব ভালো ও দয়ালু মনের অধিকারী। মনে আছে, একদিন ওর হাতে চোখের পাপড়ি সাজানোর কার্লার দেখি। জেলখানার ভেতরে কার্লার? মানুষের মন কতটা ইতিবাচক হলে জেলখানার ভেতর চোখের পাপড়ি সাজাতে বসে? সেদিন আমরা বেশ মজা করেছিলাম।

ন্যান্সিকে আমি যা যা বলছিলাম, তার সবই তিনি জানতেন। তবু আমার মুখ থেকে শুনে তিনি বেশ শান্তি পাচ্ছিলেন বুঝতে পারি। ওনাকে এতটুকু সাহায্য করতে পেরে আমার মনটাও ভালো হয়ে গেল। অ্যানির জ্ঞানী জ্ঞানী কথা আমার অন্তরে রেখাপাত করেছে।

ইংলিশ ফুটবল টিমের একটা গেঞ্জি পরেছিলাম। ওই অবস্থাতেই গ্যারি ট্রটার আমার ছবি তোলে। সেন্ট জেমস পার্ক স্টেডিয়ামে যেদিন ইংল্যান্ড ফুটবল দল আলবেনিয়াকে হারিয়ে দিল, সেদিনই এই গেঞ্জিটা কিনেছিলাম। ওই দিন গ্যারি আরও একবার আমাকে দেখতে আসে। ও জানায়, লন্ডন বিশেষ করে ডেইলি এক্সপ্রেস-এর পক্ষ থেকে ফুলের ছাপযুক্ত কোনো পোশাক পরিধান করতে অনুরোধ করা হয়েছে আমাকে।

কিন্তু আমার এ রকম কোনো পোশাক নেই। কোনো দিন ছিলও না। এখন কারও অনুরোধে ফুলের ছাপওয়ালা পোশাক পরিধান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ওকে জানালাম, এই মুহূর্তে আমার সংগ্রহে এর চেয়ে ভালো কিছু নেই। তবে গ্যারির পরনের টি-শার্টটা পরে আমি ছবি তুলতে পারি। এরপর ওর গায়ের টি-শার্ট পরে আরেক দফা ছবির জন্য পোজ দিই। এসব ছবি কোনো দিন ছাপা হয়েছিল কি না জানি না।

রানি ভিক্টোরিয়ার একটা পুরোনো মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আগের কোনো একজন রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের কোনো এক গ্রাম থেকে এটি উদ্ধার করে এনেছিলেন। মূর্তিটা দেখতে সুন্দর লাগে, যতক্ষণ না নিচের দিকে লক্ষ করা হয়। বেচারা ভিক্টোরিয়ার কোনো হাত ছিল না। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন একজন কর্মকর্তা। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তিনিও মজা করতে ছাড়লেন না। হ্যা, ভিক্টোরিয়ার ছোটখাটো চুরির অভ্যাস ছিল। এ অপরাধে তালেবানরা ওর হাত কেটে দিয়েছে।

দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানালেন, দুবাই হয়ে লন্ডনগামী ফ্লাইটে আসনের ব্যবস্থা করা যাবে। তাই আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। কোথাও যেতেও পারছি না। আমার চেহারা এখানে সবাই চিনে ফেলেছে। তাই সুযোগসন্ধানী যে কারও হেনস্থার শিকার হতে পারি।

আমিরাতের ফ্লাইটে ওঠার পর পল, সালেহা ও আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। সম্ভবত বিমান উড্ডয়নের আগেই আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। আমি ছিলাম শারীরিকভাবে বিপর্যন্ত। আর ওরা দুজন শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল।

নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে আমরা দুবাইয়ের মাটিতে পা রাখি। এখানে এসে আমাদের পরবর্তী ফ্লাইটের সময় পিছিয়েছে বলে শুনতে পেলাম। আমি আর সালেহা তাই বিমানবন্দরের দোকানগুলো ঘুরে কেনাকাটা করতে চলে যাই। গভীর একটা ঘুম হয়ে যাওয়ায় পরের ফ্লাইটে ওঠার পর শরীর বেশ হালকা লাগছিল। এই ফাঁকে পল ও সালেহা শশানাতে থাকেন আমার মুক্তির জন্য ওঁদের সংগ্রামের গল্প।

আমার সাংবাদিক পরিচয় প্রমাণের জন্য তারা শুধু কাঠখড়টাই পোড়ননি। গত ২৫ বছরের আমার সাংবাদিকতা জীবনের ইতিহাস, বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদকের চিঠি, বেতনের বই, আমার লেখা সংবাদ ইত্যাদি সবকিছু তাঁরা সংগ্রহ করেন। এরপর সমস্ত কাগজপত্র পশতুতে অনুবাদ করে তালেবানদের সহকারী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন পল।

পরপর অনেকবার তারা তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্দেশ্যে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকের খবর কাবুলে থাকা অবস্থাতেই আমার কানে পৌছেছিল। শান্ত ও ভদ্র ব্যবহার না করলে আমাকে কোনো দিনও মুক্তি দেওয়া হবে না, তালেবানরা এ কথাও বলেছিল পলকে।

পল বললেন, ‘আমরা তোমাকে ছাড়িয়ে আনার একদম কাছে পৌছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এমন খারাপ ব্যবহার করছিলে যে মনে হচ্ছিল আমি নিজেই কাবুল গিয়ে তোমাকে চুপ থাকতে নির্দেশ দিই।’ তবে পল স্বীকার করেন, এই দোদুল্যমান অবস্থা অনিশ্চয়তার চরমে গিয়ে পৌছায়, যখন আমাকে ছেড়ে দেওয়ার আগের রাতেই বিমান হামলা শুরু হয়। সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে, এমনটাই ভেবেছিল সবাই।

এরপর পল আমার সঙ্গে তালেবানদের মোলাকাতের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলেন। এটা একটা বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন, প্রত্যুত্তরে জানাই আমি। যদিও তালেবানদের নিষ্ঠুরতার কথা সর্বজনবিদিত, তবু ওরা আমার সঙ্গে সম্মানসূচক ব্যবহার করেছে। এই কথা হয়তো অনেকেরই পছন্দ হবে না, তবে অপ্রিয় হলেও সত্যটা আমাকে বলতেই হবে।

পলও দেখি আমার কথায় সম্মতি দিলেন। তিনি বলেন, অনেকের পছন্দ না হলেও ওরা আমাকে খুবই সৌজন্যবোধ দেখায় ও খাতিরদারী করে। একটা সময় ওরা তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার ওয়াদা করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা কথা রেখেছে। তারা সর্বদাই নিজস্বতাবোধ বজায় রাখত। রিচার্ড এখানে আসার দিন আমাকে একটা চেক দিয়ে দেয়। কিন্তু টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করলে শুধু শুধু আমরা বিপদ ডেকে আনতাম।

আরও একজন প্রতিবেদক তালেবানদের হাতে আটক হয়েছেন বলে পল জানান। তিনি হলেন মাইকেল পেরার্ড। বোরকা পরিহিত অবস্থায় জালালাবাদ থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে আটক করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে মাইকেলের কর্মস্থল প্যারিস ম্যাচের পক্ষ থেকে পলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মাইকেলের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ আনা হয়। ওঁর কর্তৃপক্ষ পলের কাছে আমার মুক্তির উপায় জানতে চেয়েছিল। এমনকি মাইকেলকে উদ্ধারের জন্য সাহায্য করার অনুরোধও জানায় ওরা।

আহ কী উত্তেজনায় দিনগুলো কেটেছে, একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। অফিসে গিয়ে আবার সেই খবরের কাগজ উল্টানোর একঘেয়েমিপূর্ণ জীবন। জীবনে কি আর এমন রক্ত হিম করা মুহূর্ত ফিরে পাব?

আমাদের বহনকারী বিমান হিথরোতে নামার প্রস্তুতি নিলে উৎকণ্ঠায় ভুগতে শুরু করি। যাক, আপন ভুবনের মাটি শেষ পর্যন্ত, আমার গায়ে তখন একটা চামড়ার জ্যাকেট জড়াননা। মাথায় একটা বেসবল ক্যাপ খুব শক্ত করে চাপিয়ে দেওয়া। উষ্কখুষ্ক জট লাগা চুল ঢাকতেই এই ব্যবস্থা। আফগানিস্তানে যাওয়ার আগে চুলের রং করেছিলাম। সেই রং নষ্ট হয়ে বিশ্রী খড়ের মতো দেখাচ্ছে চুল। পুরোটাই কেটে ফেলতে হবে বোধ হয়, মনে মনে ভাবতে থাকি। দীর্ঘদিন চোখের কোনো যত্ন নিইনি। মেকআপও দেওয়া নেই। দ্রুত একটা সানগ্লাস চোখে লাগাই।

নামার সময় এত বিপুল পরিমাণ গণমাধ্যমকর্মীর সমাগম হবে, তা আমি ভাবতেও পারিনি। কিন্তু এ যেন মানুষের সমুদ্র। অগত্যা অধিকাংশ প্রশ্ন এড়িয়ে দ্রুত কেটে পড়ার চেষ্টা করি। এক কোণ থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ কানে এসে লাগে। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে- ইভন রিডলি! জেন ড্রিপার। নিউক্যাসলে খুব নাছোড়বান্দা প্রতিবেদক হিসেবে সুনাম ছিল তার। এখন একটা টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী। মেয়েটাকে দারুণ দেখাচ্ছিল। মন চাচ্ছিল ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু না থাক, নিরাপদ কোথাও পৌছানোর আগে এমন কিছু করা ঠিক হবে না।

ওয়েটিং রুমের ভেতর আমার বোন ভিভ বসে ছিল। দেখা হতেই দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমার মাথায় টোকা দিয়ে ভিভ অনুযোগের সুরে বলতে থাকে, এত দিন ধরে আমাদের ঘুম হারাম করে রাখার জন্য এই শাস্তি। আরও অনেকেই তোমাকে শাস্তি দিতে বাইরে অপেক্ষা করছে। আরে, ওই তো জিম মুরে, আমার সম্পাদক। ওকে কেমন হতভম্ব দেখাচ্ছে। ইশ, বেচারাকে কী নরক যন্ত্রণাই না দিয়েছি এত দিন।

যেতে যেতে জিম শুক্রবারে আমার আটক হওয়ার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ শুনাতে থাকে। সেদিন ও বসে ছিল বার্তা কক্ষে। তখনো কারও সন্দেহ হয়নি। অন্য সহকর্মীদের জিম বলেছিল, রিডলির সঙ্গে এখনো যোগাযোগ হয়নি। তবে ও খুব দ্রুতই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে এল বলে। সেই সপ্তাহে ঘড়ির কাঁটা খুব ধীরে চলছিল। প্রথম সাত পৃষ্ঠার খবর বাছাই করতে গলদঘর্ম সবাই।

বার্তাকক্ষে পায়চারি করার সময় কেউ একজন একটা সংবাদের প্রতি জিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিদেশি সংবাদ সংস্থার পাঠানো সংবাদে লেখা ছিল, আফগানিস্তানে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তালেবানদের হাতে আটক হয়েছেন। অসমর্থিত সূত্রগুলো থেকে আটক সাংবাদিক হিসেবে আমার নাম আসছিল। জিম সোজা সংবাদকক্ষে গিয়ে সবাইকে সংবাদটা জানিয়ে দেয়।

সেই রাতে প্রতিবেদক ডিক ডিসমুরে বিচলিত না হয়ে এই সংবাদটা সব জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। দ্রুত এ-কান ও-কান হয়ে খবরটা জেনে যায় সবাই। হতবিহ্বল কর্মীরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। ডিক খুব

পেশাদার লোক। আবেগহীনভাবে বেশ সাবলীলভাবেই এ কথাটা বলেছে ও। কিন্তু নিশ্চয়ই আশা করছিল এটা যেন একটা গুজব হয়।

তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় নির্ধারণ করতে পল অ্যাশফোর্ডকে ডাকা হয়। তিনি সরাসরি বলে ফেলেন, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে রিডলি বেঁচে ফিরে আসতে পারে। এ কথা আমাকে জানিয়ে পল নিজেই হেসে ফেলেন। এই জগষ্টাতে চুটকি বলা লোকের অভাব নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে জীবন এমন সংকীর্ণ গলিতে গিয়ে আটকে যায় যে সব ফেলে রেখে নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য ছুটতে হয়।

আমাদের গাড়ি লেক ডিস্ট্রিক্টের দিকে যেতে থাকে, যেখানে আমার মেয়ে ডেইজির আবাসিক স্কুল। পথে যেতে যেতে বিগত ১০ দিনের সব অজানা গল্প পল বলে যান।

‘ইভন, বিভিন্ন তথ্য ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে তোমার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছু অজান্তেই জেনে ফেলেছি। এখন তোমার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমাদের কল্পনাতেও ছিল না যে তুমি এতবার বিয়ে করেছ। তা-ও আবার একজন ফিলিস্তিনির পরে আবার একজন ইসরায়েলি ব্যক্তির সঙ্গেও।

আসলে আমার অনেক স্বজন ও বন্ধুর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে তাঁকে। তখনই ফাঁস হয়ে যায় সব গুমর। এমনকি সামরিক বাহিনীতে থাকা কয়কজনের সঙ্গেও কথা হয়েছে ওঁর।

ম্যালকম এক্সের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলে জানান। ও বিশেষ বাহিনীর একজন সদস্য। আমার বন্ধুদের তালিকায় ওর মতো দুর্ধর্ষ আরও অনেকেরই অস্তিত্ব রয়েছে।

জিম বলে, ম্যালকম এক্স খুব দুশ্চিন্তা করছিল আমার জন্য, আফগানিস্তানে একটা বিশেষ দল পাঠানোর জন্য ও প্রস্তাব দিয়েছিল। ম্যালকম ছাড়াও জিমকে আরও অনেকেই কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে আমাকে মুক্ত করতে পরামর্শ চেয়েছিল।

বাহু, পল আমার জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছেন। ভাবতেই ভালো লাগছে। এই লম্বা দাড়িওয়ালা মানুষটা যে ভেতরে ভেতরে এত যত্নবান, তা কে জানত! তবে যদি একদল বেপরোয়া বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা ঝটিকা অভিযান চালিয়ে আমাকে উদ্ধার করত, তাহলে বোধ হয় আরও উত্তেজনা অনুভব হতো। এমনকি অন্ধকার জগতের অনেক অপরাধীও আমার জন্য ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল। এটা একটু বেশি হয়ে যেত একদল গাঁট্টাগোট্টা লোক দুর্ধর্ষ তালেবানদের সঙ্গে লড়াই করে আমাকে ছিনিয়ে আনছে।

আমার বন্দিত্বের সময়টায় লন্ডনে একরকম ঝড় বয়ে গেছে। যাত্রাপথের এসব গল্পের সঙ্গে হাসিঠাট্টাও জমে ওঠে। আমার বন্দিজীবনের প্রথম দিনটা ছিল রোববার। সেদিন জিমের কাছে একটা ফোন আসে। কেউ একজন জানায়, আগামী মঙ্গলবার প্রকাশ্য দিবালোকে আমার গর্দান নেওয়া হবে।

এমনিতে ফোনের ওপাশের লোকটা নির্ভরযোগ্য। ওর মাথায় খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আরেক শুভাকাঙ্ক্ষী জিমকে মেইল করেছিল। মেইলের ভাষ্যটা ছিল এ রকম- কাবুল থেকে যে তদন্ত দল রিডলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছে, তা আদতে একটা নির্যাতন টিম। এদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের কবল থেকে বেঁচে ফিরে আসা অসম্ভব। খুব কম বন্দীই এদের হাত থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে বাঁচতে পেরেছে। তাই এদের নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষীও খুব বেশি নেই।

আমার পুরো বন্দিত্বের সময়টাতে জিম সম্পাদকের কাজ বাদ দিয়ে আলাদা ডেস্কে জরুরি বিপদ মোকাবিলা বিভাগ খুলে বসেছিল। আমার ব্যাপারে বাইরের দুনিয়ায় যত তথ্যের আদান-প্রদান হচ্ছিল, তার সবকিছুর ওপরই নজর রাখা হতো। অন্তত আমার দুটি ব্যক্তিগত তথ্য আমার জীবননাশের জন্য যথেষ্ট ছিল। এক, আমি ব্রিটিশ আঞ্চলিক বাহিনীর একজন সাবেক সদস্য। আর দুই, আমার সাবেক স্বামীদের একজন স্বয়ং ইসরায়েলের নাগরিক। এ তথ্যগুলো কিছুতেই গণমাধ্যমে ছাপা না হয়, তার জন্য জিমদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।

এসব সংবেদনশীল তথ্য গোপন রাখতে জিম দায়িত্ব দেয় রেবেকা ওয়েডকে। ভদ্রমহিলাও আমার মতো ইংল্যান্ডের বিখ্যাত হাতে গোনা কয়েকজন নারী সাংবাদিকের অন্যতম। রেবেকা নিজ দায়িত্বেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলে গোপন তথ্য গোপন রাখার ব্যবস্থা করেন। অবজারভার-এর সহকর্মী বারবারা গানেল ও ট্রেসি ম্যাকভি এবং গার্ডিয়ান-এর হেলেন কার্টার আমার সমর্থনে প্রথম ডাউন স্ট্রিটে মোমবাতির আয়োজন করে। নারী সাংবাদিকদের পুরো দল তাতে যোগ দেয়।

বান্ধবী জুলিয়া হার্টলে ব্রিওয়ার লেবার পার্টির প্রভাবশালী নেতাদের কাছে ধরনা দিয়েছে। জিমের একজন চাচা পরিবহন ও সাধারণ শ্রমিকদের সংগঠনের প্রাক্তন প্রধান। জিম তার চাচাকে দিয়েও আমার সমর্থনে সমাবেশের আয়োজন করে। বেশ কয়েকজন সাংসদ তালেবানদের কাছে আমার নিরাপত্তা ও মুক্তি দাবি করে লেখা এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। শ্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়েছেন সাধারণ ও ব্রিটিশ সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারাও। জিম যখন এসব বলছিল, আবেগে আমার গলা ধরে আসে। টের পাই চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল জমা হয়েছে। এত এত শুভাকাক্ষী আর বন্ধুবান্ধবের ঐকান্তিক আর নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা। সত্যি, এমন ভাগ্য আর কজনের হয়। কৃতজ্ঞতা জানানোর কোনো ভাষা নেই।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিলিস্তিনের জঙ্গি নেতা আহমেদ জিব্রিল ও কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েভ তালেবানদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। নুরসুলতান ছিলেন আমার বন্ধু জন ম্যাপিনের পরিচিত। জনের বউ কাজাখস্তানের বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পী ইরিনা। ইভান লিঞ্চ আরও এক ধাপ এগিয়ে একটা ওয়েবসাইট খুলে বসে। ইভন রিডলির মুক্তির জন্য টনি ব্লেয়ারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে এবং আরও অধিক ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে হবে-এই দাবিতে ই-মেইলে গণস্বাক্ষর গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দাবিনামায় আরও লেখা হয়, ইভন শুধু পেশাগত প্রয়োজনে আফগানিস্তান গিয়েছে এবং সেখানকার মানবাধিকার লনের করুণ দশা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

ইভান আরও অনেককেই রাজপথে নামিয়ে আনে। কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ওকে বিরত থাকতে নিষেধ করা হয়। এত বিপুল প্রতিবাদ কর্মসূচি আর জনগণের দাবি তালেবানদের কাছে ভুল বার্তা প্রেরণ করতে পারে। আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেউ, এমন সন্দেহে ওরা আমাকে পণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, এমন সম্ভাবনাও ছিল যথেষ্ট।

এদিকে আমার গর্ভধারিণী মা প্রতিদিন কাউন্টি ডারহামের ওয়েস্ট পেলটনের বাড়ি থেকে বিশ্ব মিডিয়ার কাছে বক্তব্য পেশ করতেন। মায়ের অবাক বাকপ্রতিভার খবর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে মাকে চুপ থাকার জন্য যতই অনুরোধ করা হতো, মা থোড়াই কেয়ার করতেন। ফলাফল, লেবার পার্টির সম্মেলন চলাকালেও ১০ দিন ধরে সংবাদপত্রের মূল পাতার শিরোনাম ছিলেন তিনি।

টনি ব্লেয়ারের রাজনৈতিক মুখপাত্র অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল নিশ্চয় মনে মনে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। কোথাকার ডারহামের কোনো বৃদ্ধ নারী প্রেসিডেন্ট টনি ব্লেয়ারের গণমাধ্যমে উপস্থিতিতে বাগড়া দিচ্ছিলেন।

ব্লেয়ারের জন্য ছিলেন ক্যাম্পবেল। অন্যদিকে আমার মা জয়েস রিডলির জন্য বিরামহীনভাবে কাজ করে গেছেন টেড হাইন্ডস ও জেমস হান্ট। দুজন সহৃদয়বান ডাক্তার। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও টেলিভিশনে তাঁরা দুজন রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। রিডলি শুধুই একজন নিরীহ সাংবাদিক। ওর দ্বারা ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে তারা তালেবানদের এটা বোঝাতে সক্ষম হন। একদিকে মহৎ হৃদয়ের এ দুজন বিশ্ব মিডিয়ার প্রধান শিরোনামে ও কাগজের মূল পাতায় আমার নাম মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, অন্যদিকে তালেবানদের হৃদয় জয়ের কাজেও ব্যস্ত ছিলেন। এসব কাজ তালেবানদের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছিল, আমি জানি না। তবে সত্যই আমি ক্ষতিকর কিছু করিনি।

টেড হাইন্ডস এর আগে ফ্লিট স্ট্রিটে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। যেকোনো কাজ সমাধায় ছিলেন একেবারে সিদ্ধহস্ত। অপরদিকে জেমস জান্ট একজন দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ। অনেক বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা ও সফল ব্যবসায়ীদের প্রচারণা অভিযানের দায়িত্ব পালন। করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। আমার পুরোনো বন্ধুদ্বয় আমার মুক্তি পাওয়ার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন নায়কের ভূমিকায়।

আমার গ্রেপ্তারের সংবাদ চাউর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে। মায়ের মতে, একটা নিরীহ টেলিফোন আলাপেই মাকে সব পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলা হয়। আলাপের পর থেকেই আমাকে মুক্ত করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল। জেমসের সঙ্গে এ নিয়ে মায়ের আলাপ হওয়ার পরই তিনি নীরব অপেক্ষার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেন। জেমসের মতে এটা ছিল রাজনৈতিক ইচ্ছা আর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার মুখোমুখি সংঘর্ষ। জেমস ও টেড মনেপ্রাণে তালেবানদের পরাজয় চাইছিল। ওদের চতুর কৌশলের সঙ্গে তাল মেলাননা আমার সহজ-সরল মায়ের জন্য কঠিন ছিল বটে।

তারা ঠিক করেন, মা যা-ই বলুন না কেন, তাতে তালেবানদের ধর্ম ও মানবতাবোধকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। কিছুটা হলেও যদি ওদের মানবতাবোধ থেকে থাকে, তাহলে তালেবানরা আমাকে মুক্তি দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে, এটাই ছিল তাদের ভাবনা। কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ফকল্যান্ডের অধিবাসীদের বিজয়ের ইতিহাস, বোমা হামলার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন রণসজ্জার কথা ভুলেও মুখে আনা যাবে না। এমনকি কোনো উসকানিমূলক শব্দ আছে কি না, তা-ও যাচাই করা হতো। টেড ও জেমস মায়ের বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সব সময়। এত কঠোর বেড়াজাল আর নিষেধাজ্ঞার মাঝেও মা সাহসী ভঙ্গিতে দাড়িয়ে যেতেন। ৭৪ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জয়েস রিডলি আমার মুক্তি আন্দোলনের সঞ্জীবনী তারকা হয়ে ওঠেন অল্প সময়ের মধ্যেই। এই ১০ দিনের অপেক্ষার অসহ্য যন্ত্রণার পুরোটা সময় আমার বোন মায়ের পাশে ছিলেন। জেমস পরে আমাকে জানায়, তার সহজ-সরল বক্তব্য আর সততা পুরো জাতির হৃদয় জয় করেছিল। মুক্তি পাওয়ার দিন কয়েক পরই স্যার ডেভিড ফ্রস্ট আমাকে তাঁর বিখ্যাত টিভি অনুষ্ঠান ব্রেকফাস্ট উইথ ফ্রস্টে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে। তিনি বলেছিলেন, মায়ের জন্য আমার সত্যিই গর্ব করা উচিত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুখপাত্র।

মায়ের মতে- আমি ছিলাম স্নেহশীল মা ও আদুরে কন্যা। তিনি বলতেন, ইভন রিডলি একজন পুরোদস্তুর পেশাদার সাংবাদিক। হ্যা, কিছুটা দুঃসাহসীও বটে। ও শুধু সাধারণ আফগানদের দুর্দশার কথাই বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছে। খুব একঘেয়ে মামুলি কথা। কিন্তু মাঝেমধ্যে সোজাসাপ্টা কথাই অনেক কঠিন কাজ সমাধা করতে পারে।

আমার মেয়ে ডেইজি গণমাধ্যমে মায়ের মুক্তি দাবি করে কথা বলেছে, তালেবানদের মুখে এ কথা শুনে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। আমি কখনোই ভাবিনি মা এতটাই নিরাশ হয়ে যাবেন যে ডেইজিকে দিয়ে তালেবানদের মনে দয়ার উদ্রেক ঘটানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু পরে জেমস আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয় ডেইজির উপস্থিতির দরকার ছিল।

প্রথম দিকে গণমাধ্যমে ডেইজির নবম জন্মদিনের কথা প্রাধান্য পায়। ওর জন্মদিনের দিন আমি সুদূর কাবুলের কয়েদখানায় বন্দী। গণমাধ্যমে প্রচারাভিযানে ডেইজি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটা বাচ্চামেয়ের মাকে কাছে পাওয়ার আকুতি বিশ্ববিবেককে অচিরেই নাড়া দিতে সক্ষম হয়। ‘আমি মাকে ফেরত চাই’-ব্যস, এই শিরোনামেই প্রায় ২৮০টি সংবাদমাধ্যমে ডেইজির গল্প লেখা হয়।

রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখতে জেমস আয়োজন করেন বেশ কয়েকটি সম্মেলনের। এদিকে টনি ব্লেয়ারের কাছে মায়ের মুক্তির দাবিতে চিঠি লেখে ডেইজি। দ্রুতই ডেইজির চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর আগেও টনিকে ও দুবার লিখেছে, এ খবরটা জানাজানি হলে সংবাদমাধ্যমে ওর চিঠি লেখার খবর শিরোনাম হয়। সাত বছর বয়সে কসোভোতে বোমা হামলা বন্ধের দাবিতে ডেইজি প্রথম চিঠি লেখে। সে সময় ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রত্যুত্তরে ওর চিঠির জবাব পাঠানো হয় বেশ গুরুত্ব দিয়ে। তিন দিন পরই বন্ধ হয় বোমা হামলা। নিজের মতামতের গুরুত্ব দেখে ডেইজি অবাক হয়ে পড়ে। এর পরের চিঠিটা ও লিখে ড্রোন পরিদর্শনের পরে। এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা চলছিল তখন। অবাক করা ব্যাপার, গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় খুব গুরুত্ব দিয়েই ছাপানো হয় ডেইজির চিঠির সংবাদ। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন আলোচনা ছিল মানুষের মুখে মুখে।

আগেও বলেছি, তাদের পরিকল্পনায় মা ছিলেন প্রধান খেলোয়াড়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ যেন তালেবানদের খেপিয়ে না দেয়, সে জন্য জোর প্রচেষ্টা ছিল। জেমস ও টেড মাকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে সাবধানতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এমনকি ধারাবাহিক রেডিও ও টেলিভিশনের দেওয়া সাক্ষাত্তারেও মায়ের উচ্চারিত বাক্যগুলো ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। তালেবানদের অসম্মান করে বা ওদের ব্যঙ্গ করে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি।

এভাবেই আট দিন ধরে গণমাধ্যমকে সামলানো হয়। প্রতিদিন সকালে জেমস ও টেড মায়ের সঙ্গে বসে সেদিনের কৌশল ঠিক করতেন। দুপুর পর্যন্ত বসে বসে সাজানো হতো মায়ের বক্তব্য। বিকেল হতেই বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে ফোন করে বক্তব্য পৌছে দেওয়া হতো। মায়ের মতে, ইভন রিডলির মুক্তির প্রচারাভিযান থেকে জেমস এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেনি। সারা দিন ধরে চলত বক্তব্য গোছানো ও তাতে শাণ দেওয়ার কাজ। কথা বলার সময় মা টেলিফোন সেটের পাশে তিনটা খাতা রাখতেন। টেলিফোনের প্রতিটা কথোপকথন রেকর্ড করা হতো।

যাঁরাই বাড়িতে ফোন করতেন, তিনটা খাতায় আলাদা করে টেলিভিশন চ্যানেল, খবরের কাগজ ও রেডিও স্টেশনের নাম ধাম লিখে রাখা হতো।

সাধারণত যেকোনো খবরে মূল ব্যক্তি বা বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। কিন্তু এদিকের চিত্র ছিল ভিন্ন। জেমস ও টেড তাদের গণমাধ্যম প্রচারণা অভিযানে একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তালেবানদের প্রলুব্ধ করা।

অন্যদিকে মায়ের বাড়ির বাইরে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁরাও প্রতিদিন মায়ের বক্তব্য সংগ্রহের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। জেমস ও টেড খুব সতর্ক ছিল, যাতে করে মায়ের বক্তব্য কোথাও ভুলভাবে উপস্থাপিত না হয়। প্রথম দিকে আমার দ্রুত মুক্তির একটা ক্ষীণ আশা জেগে ওঠে। কিন্তু তালেবানরা হঠাৎ করেই আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ তুললে সে আশার আগুন নিভে যায়।

টেড জানায়, শুরু থেকেই পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রচেষ্টা নিয়ে আমার পরিবার সন্দিহান ছিল। এতে করে তালেবানদের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন সহজ হয়ে যায়। জেমস সুচারু কৌশলে সরকারের প্রতি আমার পরিবারের অবিশ্বাস ও সন্দেহকে গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। তালেবানদের সদিচ্ছার দিকেই আমার পরিবার চেয়ে আছে, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এটা বোঝাতে সক্ষম হয় তারা। তবে সব চেষ্টাই বিফলে যেত, যদি না আমার মা দক্ষ হাতে গণমাধ্যম সামলাতে ব্যর্থ হতেন।

জিম মুরে আমার কাছে জানতে চাইল জেমস হান্টের ব্যাপারে। আমি হেসে জবাব দিই, উনি হলেন ছায়ার পেছনের নায়ক। তার দেখা পাওয়া সম্ভব নয়।

লেক ডিস্ট্রিক্টের কাছাকাছি আসতেই ডেইজির সঙ্গে নিরিবিলি আলাপ করার সুযোগ দিতে জিমকে অনুরোধ করি। কারণ, অনেক হয়েছে, ডেইজির আবার গণমাধ্যমের সামনে আসার প্রয়োজন নেই। আমি ওর স্কুলে ফোন দিয়ে এক ঘন্টা সময় ডেইজির সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নিয়ে নিই আগেই।

মুহূর্তটাকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। লেক উইভামায়ারের ধারে ডেইজির আবাসিক স্কুল ভবন অবস্থিত। প্রধান ফটকের কাছাকাছি হতেই ভেতর থেকে বাচ্চাদের হইহুল্লোড় আর চেঁচামেচির শব্দ কানে ভেসে এল। একজন শিক্ষক আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ডেইজি তখন মাত্র টয়লেট থেকে বেরিয়েছে। ওর কোঁকড়ানো চুলগুলো তখনো ভেজা ছিল। গোলাপি গাল দুটো রোদে চকচক করছে। আমাকে দেখেই ও দৌড় দিয়ে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। হাত-পা দিয়ে আমাকে আটকে ফেলার চেষ্টা। টানতে টানতে ওর বিছানার ধারে নিয়ে যাই। কিছুটা সময় জড়িয়ে রাখি ওকে।

মেয়েটা হেঁচকি দিয়ে কাঁদছিল। আমি জানতে চাইলাম, মায়ের সঙ্গে ও রাগ করেছে কি না? ওর উত্তরটা ছিল এমন, ‘মা, আমি জানি এটাই তোমার কাজ। কিন্তু তুমি এতই বেখেয়াল ছিলে যে পাসপোর্ট নিতে ভুলে গেলে?

জন্মদিনের দিন আমি থাকতে পারিনি। তাই ওর কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু মা, আমি কিন্তু তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ঠিকই গান গেয়েছিলাম। বন্দিশালায় আমার রুম থেকেই তোমার উদ্দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে গান গেয়েছি। মেয়েটা ছোট ছোট বাদামি চোখে আমার দিকে তাকাল, ‘মা, আমি তোমাকে শুনতে পেয়েছি মা। এই কদিনে দস্যি মেয়ে আবার কয়েকটা কবিতাও লিখেছে। আমাকে পড়ে শোনায় ও।

ওর ঘরের চারপাশে জন্মদিনের উপহার ছড়ানো-ছিটানো। তাহলে জন্মদিন কেমন কেটেছে? অসাধারণ, ওর চটপট জবাব। জানোনা মা, সেদিন সবাই না আমার পাশে বসার জন্য কেমন হুড়োহুড়ি করেছে। তুমি ছিলে না দেখে বোধ হয়।

এক ঘন্টা মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম। বের হওয়ার আগে আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হলো, এখন থেকে বিদেশে যাওয়ার আগে অবশ্যই ওকে জানিয়ে যাব।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন আবার দেখা হবে। ও একগাল হেসে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে দৌড় দেয়।

গাড়ি ফিরে এলে তাতে চড়ে বসি। গন্তব্য এবার কনিস্টনের এক প্রত্যন্ত গ্রাম লিটল ল্যাঙ্গডেলের ছায়াঘেরা এক খামারবাড়ি। জিমের মতে, রিডলি পরিবারের সবাই ওখানে আমার অপেক্ষায় থাকবে। আমি আঁতকে উঠি, আমাদের পরিবারের সদস্যরা ঝগড়াঝাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি না করে ১০ মিনিটও চুপ করে বসে থাকতে পারি না। কিছুটা মজা আর কিছুটা সত্য বলছিলাম।

মা আর বাবার সঙ্গে পুনরায় মিলিত হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার মুক্তির দিন সহকর্মী গ্যারেথ ক্রিকমার বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিক দলের অগোচরে বেরিয়ে আসতে মা-বাবাকে সাহায্য করে। একটা খালি বাড়িতে ১২ ঘণ্টার নিষ্ফল অপেক্ষার পরে ডজনখানেক সাংবাদিক টের পান, খামারবাড়ির সংবাদ সম্মেলন চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।

ভাতিজি বিয়েনকার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলো। বোন জিল ও তার জীবনসঙ্গী পল বেইলিও আমাকে একনজর দেখতে উপস্থিত হয়েছে। ভিভ আর আমি মিলে মোট সাতজন। কনিস্টনের এক রেস্তোরায় আমরা আনন্দ সহকারে খাওয়ার পর্ব সেরে নিই। বিশ্রাম নিতে ফিরে যাই আমাদের দূরের খামারবাড়িতে।

একসময় সবাই ঘুমিয়ে গেলে শুধু আমরা বোনেরাই জেগে থাকি। ফলাফল, হাসিঠাট্টা আর এত দিনের জমে থাকা গল্প কি আর ঘুমাতে দেয়? আনন্দের মুহূর্তটা হঠাৎ থমকে যায় জিলের প্রশ্নে। ও জানতে চায়, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, এটা জানার পর আমার কেমন লাগছিল? কী কায়দায় ওরা তোমাকে মারবে বলে মনে হচ্ছিল? মেয়ের কী সাহস আর ঔদ্ধত্য? সবচেয়ে নাছোড়বান্দা প্রতিবেদকও আমাকে এই প্রশ্ন করেনি।

পরদিন সকালে লাল চোখ কচলাতে কচলাতে আমার আর ভিভের ঘুম ভাঙে। আমরা দুজনই একসঙ্গে রান্নাঘরে যাই। বাবা বেকন স্যান্ডউইচ বানাচ্ছিলেন। বাবা এটা খুব ভালো বানান। আমি জানি না, এমন সাধারণ খাওয়ার জিনিস কীভাবে ওনার হাতে এত সুস্বাদু হয়ে ওঠে?

আমি, বাবা আর মা খোলা মাঠে পায়চারি করছিলাম। ম্যানচেস্টার এক্সপ্রেস-এর চিত্রগ্রাহক স্টুয়ার্ট ম্যাসন দ্রুত আমাদের পুনর্মিলনী হাঁটার কিছু ছবি তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু এসব কী হচ্ছে? পরিকল্পনা ছিল সংবাদমাধ্যমের আড়ালে কয়েক দিন অবস্থান করব। শুধু রোববারের পত্রিকার জন্য আমার গোপন দিনলিপি পড়তে জিম রয়ে যাবে এখানে।

তালেবানদের বলে এসেছি, নোংরামি আমার ভীষণ অপছন্দ। তবে আমি খামারবাড়ির ব্যক্তিগত জীবনটাও সবার সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাক, এটাও চাই না। ম্যাসন স্পষ্টভাবেই দেখতে পারছিল, সবুজ খোলা প্রান্তরে আমি মোটেও ছবির জন্য পোজ দিচ্ছি না। ছবি তুলতে চাইলে না হয় আমরা শহরের কোথাও গিয়ে পোজ দিই।

মা-বাবাকে বিদায় জানিয়ে সদলবলে ছুটে চললাম ম্যানচেস্টারের উদ্দেশে। চমক্কার হোটেলের সবচেয়ে দামি কক্ষটাই আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়। একটা কম্পিউটার বসানো হলে বৃহস্পতিবার থেকে পুরোদমে গোপন দিনলিপিটার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ থেকে বিস্তারিত লিখতে শুরু করি।

আগেই বলেছি, জালালাবাদে লেখার জন্য কোনো উপকরণ দেওয়া হয়নি আমাকে। তাই টুথপেস্টের একটা কাগজের বাক্সে তারিখ ও দিনক্ষণ লিখে ছোট ছোট সাংকেতিক শব্দে ঘটনাগুলো তুলে রাখতাম। কাবুল জেলে আসার পর সাহায্যকর্মী মেয়েরা আমাকে কিছু কাগজ দিয়েছিল। সেখানে আমি দিন-তারিখ আর বিভিন্ন শব্দ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করতাম।

আমাকে স্থানান্তরিত করার সময় অতি সন্তর্পণে কাগজগুলো লুকিয়ে রাখতাম। আর যখন আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়, তখন জুতার তলায় এই কাগজগুলো আর ক্যাথির একটা চিঠি লুকিয়ে নিয়ে আসি। ক্যাথির চিঠিটা হ্যানোভারে ওর ভাই অ্যাড্রেসের কাছে পাঠাতে হবে। টুথপেস্ট বাক্সসমেত আরও কিছু কাগজ অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে নিয়ে আসি।

শুক্রবারের মধ্যে আমি ১২ হাজার শব্দ লিখে ফেলি। সানডে এক্সপ্রেস এ কয়েক দিন ধরে আমার দিনলিপি ছাপা হয়। এ ছাড়া ৪০টি দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে অনূদিত হয়ে ছাপা হয় এটি।

ডেইজি ওর চাচা বিলের সঙ্গে দেখা করতে আসে। মজাদার ও পছন্দের কিছু খাবার দিয়ে দুপুরের ভোজ সারি। হোটেলকক্ষে ফিরে আসার সময় ডেইজি খুব উত্তেজিত ছিল। ও হোটেলে থাকতে খুব পছন্দ করে। সাধারণত কোথাও বেড়াতে গিয়ে হোটেলে থাকলে আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখি। সেদিন আমরা এতই ক্লান্ত ছিলাম যে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি গভীর ঘুমে। বিছানাটা ছিল অনেক প্রশস্ত। কিন্তু তারপরও ডেইজি গড়াতে গড়াতে কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার খুব স্বর্গীয় অনুভূতি হচ্ছিল। এত দিন মেয়েটা মায়ের কোলে ওঠার জন্য না জানি কতই কান্নাকাটি করেছে।

পরের দিন বেলা করে আমাদের ঘুম ভাঙে। সকালবেলার হুড়োহুড়ি আমি ঘৃণা করি। ডেইজি বিছানার ওপর লাফাচ্ছিল। ও খুব উত্তেজিত। বিল চাচা ওকে ব্ল্যাকপুলের মজার মজার রাইড চড়াতে নিয়ে যাবে। ব্ল্যাকপুলে কখনো যাওয়া হয়নি আমার। যেতে পারলে ভালোই হতো। নানা রকম মজার রাইডে চড়া যেত।

ওদের বিদায় দিয়ে আমি আর ভিভ লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। আমাদের গাড়িটা যখন ব্ল্যাকফ্রায়ার সেতুর ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, পুরোনো স্মৃতিগুলো ফিরে আসতে শুরু করে। নস্টালজিক হয়ে যাই আমি। চোখের কোণে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু জমা হতেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিই। ভিভ আমাকে কড়া ধমক লাগায়। আজ থেকেই কাজ শুরু করার কোনো দরকার নেই। সেই চিরাচরিত পুরোনো সেতু, ধূসর লুবায়েনকা বিশালত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো, হয়তো আর কোনো দিন এসব জায়গায় আসা হবে না।

বার্তাকক্ষে সেই পুরোনো মুখগুলো আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অনেকের চেহারা ভাষা বলছে আমাকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার আশা তারা একরকম ছেড়েই দিয়েছিল।

মার্টিন টাউনসেন্ড সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না। হঠাৎ করেই ও শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। মার্টিন আমার দিকে তাকিয়ে শুধু এক টুকরা হাসি উপহার দিল। আমরা নরকের দরজায় টোকা দিয়ে ফেরত এসেছি।

ওরেব্বাস চার শর মতো ই-মেইল জমা। অধিকাংশ মেইল এসেছে পরিচিতজনদের কাছ থেকে। তিনটা ফালতু ই-মেইলও পেলাম। একের পর এক মেইলের জবাব দিয়ে গেলাম।

আমার ভয়েস মেইলের বাক্সখানাও ভরে আছে ভয়েস বার্তায়। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনেরা শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ফ্যাসিবাদী দল আন্তর্জাতিক তৃতীয় পক্ষের লোকজন নোংরা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছে।

এই নব্য নাৎসিবাদীদের মুখোশ উন্মোচনের সময় হয়েছে এবার।

পানশালার সেই রাতটা ছিল আনন্দ আর হাস্যরসে ভরপুর। এমনকি পানশালার ম্যানেজার মেড হাটারও সবার উদ্দেশে এক চুমুক পান করার জন্য খোঁচাতে লাগল। আমার কয়েকজন দুই সহকর্মীও তাল দিল সঙ্গে। খাস লন্ডনি স্টু কারশ চিল্কার করে বলতে লাগল, আফগানিস্তানে দুই সপ্তাহের আনন্দ ভ্রমণ শেষ হয়েছে। মুফতে মদ্যপানের এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।

ওই সপ্তাহে আমাকে নিয়ে লেখা সংবাদপত্রের খবরগুলো পড়তে শুরু করি। কজনের ভাগ্যে আর নিজের শোকবার্তা পড়ার সুযোগ হয়? আমার প্রাক্তন সহকর্মীদের যারা আমার বেঁচে ফিরে আসার আশা ছেড়েই দিয়েছিল প্রায়, তাদের অনেকেই আমাকে স্মরণ করে দু-চার কথা লিখেছে। সবচেয়ে ভালো লেখাটা বোধ হয় ওয়েলস অন সানডের প্রধান প্রতিবেদক মার্টিন শিপটনের কলম দিয়েই বেরিয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিক জন সুউনিও একটা লিখেছে, যেটা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। আজ সেটা পড়া যাক। তবে প্রথমে শিপটনের লেখাটায় চোখ বুলিয়ে আসি।

‘শুক্রবার আমি সংবাদটা পাই। ইভন রিডলিকে আফগানিস্তান থেকে আটক করা হয়েছে। খবরটা পেয়ে আমি খুব একটা অবাক হয়নি। দুই যুগ ধরে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডে তখন আমরা শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতাম। মেয়েটা তখন থেকেই বিপদ হাতে নিয়ে ছুটে বেড়াত। প্রায়ই সে দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।

‘আমি মন থেকে প্রার্থনা করি, এই প্রতিকূল পরিবেশ থেকেও সে ঠিকই বেরিয়ে আসবে। সত্তরের দশকে কাজ শুরু করা সাংবাদিকদের মধ্যে ও নিজের আলাদা একটা স্থান তৈরি করে নিয়েছে।

‘আমাদের অধিকাংশই তখন ব্রিটেনের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছি। মাথায় তখন ‘সাংবাদিকতা হচ্ছে ব্যাখ্যা করা তত্ত্ব ঘোরাঘুরি করত রাত-দিন।

‘অথচ ইভন উঠে এসেছিল খুব সাধারণ জায়গা থেকে। আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পা রাখেনি। সংবাদজগতে প্রচলিত কল্পিত তত্ত্ব আর নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করতে দেখিনি ওকে। ও শুধুই একজন সাংবাদিক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, যাতে করে অনুসন্ধান করে সে লিখতে পারে। এটা ছিল ওর জন্য আনন্দদায়ক একটা অভিজ্ঞতা।

‘মেয়েটা একদম বুনো স্বভাবের। আমোদ-ফুর্তি করার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো কাজে মনপ্রাণ দিয়ে খাটার শক্তি ছিল ওর ভেতরে। সারা রাত জেগে থেকে পুরুষদের মতো করে ঢকঢক করে মদ গিলতে তার কোনো সমস্যাই হতো না। ভোরবেলা সবাই যখন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখনো ওর মধ্যে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও দেখা যেত না। হাঁকডাক করে সবাইকে নিয়ে গলির কোনো দোকানে নাশতা করতে যেত।

‘পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে ও উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের অনেক পত্রিকায় কাজ করেছে। স্ট্যানলি নিউজ, নর্দার্ন ইকো, জার্নাল ও সানডে সান। আশির দশকে ও নিউক্যাসলে ঘাঁটি গাড়ে। এখানে এসে ওর শকুনি দৃষ্টি পড়ে মাটির গভীরে। অন্ধকার জগতের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে তুলে আনে মাদক ব্যবসায়ী বিভিন্ন দলের রক্ত হিম করা খবর।

মাঝেমধ্যে আমারও ওর সঙ্গে নিষিদ্ধ জগতে যাওয়ার সুযোগ হতো। স্থানীয় বিভিন্ন ডাকুদলের সর্দারদের সঙ্গে ছিল ওর ওঠাবসা। দেখতাম ওরা তাকে খুব শ্রদ্ধা আর স্নেহ করত। সম্ভবত ও নিজস্ব প্রাণোচ্ছলতা দিয়ে ওদের মনের ভয় দূর করতে পেরেছিল।

‘আশির দশকের শেষ দিকে ও এমন একটা গল্পের পেছনে দৌড়াতে শুরু করে, যা ওর ভাগ্যকে বদলে দেয়। বছর কয়েক আগে উত্তর-পূর্ব এলাকার একজন বিদ্রোহী এভান ডেভিসন ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংঘ পিএলওতে যোগ দেয় ও গোপন মিশনে সাইপ্রাসে যায়। সেখানে আরও কয়েকজন পিএলও সদস্যের সঙ্গে একটা বিলাসবহুল প্রমোদতরিতে হামলা চালিয়ে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য সন্দেহে তিনজন ইহুদিকে হত্যা করে।

‘বিচারে ডেভিসনের কারাদণ্ড হয় ও সাইপ্রাসের জেলে শাস্তি ভোগ করতে থাকে। ইভন ওর একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য উঠেপড়ে লাগে। ডেভিসনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ও নিকোশিয়ার তথাকথিত পিএলও দূতাবাসে যাতায়াত করতে শুরু করে। আবারও নিজস্ব বাচনভঙ্গি আর হাসিখুশি মন দিয়ে ওদের ঘায়েল করে ডেভিসনের সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পিএলও কর্নেল দাউদ জারোরার সঙ্গে ওর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দাউদ সাইপ্রাস ছেড়ে ইভনের সঙ্গে নিউক্যাসলে এসে ওঠে। ওদের কোলজুড়ে আসে ডেইজি, যে আগামী বুধবার নয় বছরে পা দেবে। দাউদ কিছুদিন ডেভিড নামেও পরিচিত ছিল। ‘দাউদের সঙ্গে সম্পর্কের আগে ইভনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অশান্ত সমুদ্রের মতো। এর আগে ওর দু-দুটো বিয়ে ভেঙে গেছে। আরও অনেক সম্পর্কই পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। কাজই ছিল ওর নিত্যসঙ্গী।

‘দাউদ এলে ওর জীবনে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। নিউক্যাসলে ইভনের সঙ্গেই থাকত। বর্তমানে দাউদ উত্তর ইংল্যান্ড শরণার্থী সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

‘দাউদ ছিলেন একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান ও সাংস্কৃতিক মানুষ। একসময় পিএলওর দখলকৃত লেবাননের অংশবিশেষ দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করেছেন তিনি। ইভনের মতো দাউদের জীবনের ঘটনাপ্রবাহও কখনো সরলরেখায় চলেনি। তাই দুজনের মধ্যে মিলটাও হলো ভালো।

‘দাউদের সূত্রেই ও ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংঘের প্রধান আহমেদ জিব্রিলের সাক্ষাঙ্কার নেওয়ার সুযোগ পায়। চিন্তা করা যায়, সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় ও লকারবি বিমান হামলার সঙ্গে দাউদের বের করতে দামেস্কে উড়াল দেয়।

১৯৯৩ সালে ইভন ওয়েলস অন সানডের যুগ্ম প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিতে কার্ডিফে চলে যায়। তখন থেকেই নানা কারণে ওর আর দাউদের সম্পর্কে ঝামেলা শুরু হয়। কার্ডিফে যাওয়ার পরপরই ওয়েলস-এর প্রধান প্রতিবেদকের দেহে ক্যানসার ধরা পড়ে এবং তিনি দীর্ঘদিনের ছুটিতে চলে যান।

‘ইভনকেই পত্রিকার পুরো দায়িত্ব মাথায় নিতে হয়। রোববারের পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর ইভন নিউক্যাসলে ফিরে আসত, যেখানে দাউদ ও ডেইজি থাকত। সোমবার বিকেলে তাকে আবার পরিবার ছেড়ে চলে যেতে হতো।

১৯৯৫ সালের আগস্টে ইভনের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের যাত্রা শুরু হয় সংবাদপত্রের জন্য বিখ্যাত ক্লিট স্ট্রিটে। এখানে ও বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পায়। প্রথম দিকে পুরুষতান্ত্রিক কটচালের কারণে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হয় ওর। আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে অনেক অবিবেচক সাংবাদিক তাকে বয়কট করতে থাকে।

সিয়েরা লিওনে অবৈধ অস্ত্র বিক্রি-সংক্রান্ত একটা প্রতিবেদন ছাপতে চায়নি এক সম্পাদক। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ওর মধ্যে হতাশা বিরাজ করেছে। কয়েক সপ্তাহ পরে ওর একজন সহকর্মী নিজেই ওর করা সংবাদ ছিনতাই করে। এই সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে।

‘পরের কয়েক বছর সানডে এক্সপ্রেস-এ ও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই কাজ করে। এ সময় ভালো ভালো কিছু সংবাদ করে প্রধান প্রতিবেদকের পদে পদোন্নতি পায় সে। এ সময় দুঃখজনকভাবে দাউদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভেঙে যায়। বর্তমানে ও একাকীই জীবন যাপন করছে।

‘জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, ব্যক্তিগত জীবন বা নিরাপত্তার চিন্তায় কাজ করতে গিয়ে বরাবরই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখত সে। এর আগেও অনেকবার ও বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, তবে এবারের মতো বিপদ কোনোটাই নয়।

‘জীবনে অনেকবার ইভন নিজের মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আমি আশা করব, খুব শিগগির ও জীবনের সবচেয়ে বিখ্যাত আরও বড় গল্পটা লিখে ফেলবে।

পরে মার্টিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। আমাকে আর কোনো দিন দেখার আশা নাকি ও ছেড়েই দিয়েছিল।

জেন সুইনি লিখেছিল–

‘ব্যস্ত গাড়ি-ঘোড়া, রাই স্ট্রিটের ব্যস্ততা, ফারিংটনে খবরের লোকজনের দৌড়াদৌড়ি-এসব কিছুই এখন কাবুল জালালাবাদ থেকে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, এখন কিছু ভালো কথাই বলতে যাচ্ছি।

কাগজের জগতের একজন সেরা গল্পকথক বর্তমানে অন্ধকার রৌদ্রহীন মাটির নিচের কারাগারে বন্দী। তালেবানদের বন্দিখানার মেহমান অবজারভার-এর একজন বিখ্যাত সাংবাদিক।

‘ইভন রিডলি একজন পুরোদস্তুর সাংবাদিক। সে শুধু তার দায়িত্ব পালন করেছিল। নিজের কাজ করতে গিয়েই ধরা পড়েছে তালেবানদের হাতে। ও বিশেষ বাহিনীর সদস্য, এই অভিযোেগ যদি সত্য হয়, তাহলে আমি একটা বোকা হাঁস।

‘দুই সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ হয়ে আছে ইভন রিডলি। সানডে এক্সপ্রেস এর হয়ে কাজ করতে গিয়ে আটক হয়েছে ও। তার নয় বছরের মেয়ে ডেইজি এখন মায়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তালেবানদের ডেরায় গিয়ে সব ঝুঁকি নিয়ে হানা দেওয়া নিতান্তই সাধারণ মানুষের কাজ নয়। অনেকেই একে স্রেফ বদ্ধ পাগল বলে ডাকতে পারেন।

‘কিন্তু একটা নিযোগ্য খবর সংগ্রহে আগ্রহী সাংবাদিকেরা প্রায়ই ঘোলা জলে সাঁতার কেটেছেন। বিবিসির আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক জন সিম্পসন, আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে বের হওয়ার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে। নিজেকে ঢেকে ফেলে মুসলমান নারীদের পরিধেয় বোরকায়। বোরকা পরিহিত সিম্পসন, অতিসাধারণ আফগান নারী হিসেবে ওকে ঠিক মানিয়ে নেওয়া যায় না। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় প্রতি মুহূর্তে। তবু ও ঝুঁকিটা নিয়েছিল, কারণ গল্পটা তৈরির জন্য এর দরকার ছিল।

‘আমার পেশাজীবনে বহুবার ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে। কখনো লর্ড সুইনি, কখনো একজন চেচেন, একজন প্রকৌশলী কিংবা চিড়িয়াখানার রক্ষক। এমনকি একবার তো বটসোয়ানার প্রেসিডেন্ট হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলাম। তালিকাটা আরও দীর্ঘ।

‘ক্রোয়েশিয়ার দুভনিক শহরে অবরোধের হাত থেকে বাঁচতে একটা ফেরির মহিলা টয়লেটে লুকিয়ে ছিলাম। তীব্র দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে অনেক কষ্টে নাক-মুখ চেপে ছিলাম। একবার যদি সার্বদের হাতে ধরা পড়তাম, তাহলে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতাম, তা এখন আর জানতে চাই না।

‘আরেকবার আমাদের বন্ধু গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদক ম্যাগি ও কেন সাধারণ গৃহবধূ সেজে পাবলিক বাসে করেই বসনিয়ায় ঢুকে পড়ে। ও বসেছিল একদম পেছনের আসনে। এত পেছনে এসে সেনাবাহিনী ওর পাসপোর্ট দেখতে চাইবে না নিশ্চয়।

১৯৯০ সালের এক বিকেলে স্টালিনের অনুসারী আলবেনিয়ার সীমান্তে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের একটা দল গবেষণার কাজে যায়। তাদের সঙ্গে ছিলেন একজন নাট্যকর্মী, একজন স্থপতি ও একজন বাদাম বিক্রেতা। আদতে ছদ্মবেশে আমি, ম্যাগি আর স্কাই নিউজের একজন ক্যামেরাম্যান উপস্থিত হয়েছিলাম সেখানে।

‘ভালো প্রতিবেদক হতে হলে ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ইভন বেচারা ধরা পড়ে গেছে। অবজারভার-এ কাজ করতে গিয়েই ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ১৭৯১ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এই কাগজ জীবনের উপাখ্যান বলে যাচ্ছে। আর রিডলি ছিল একজন চমৎকার গল্পকথক।

মাঝেমধ্যে আমরা ওকে ঘিরে ধরতাম। সোফায় আরাম করে বসে ও হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনাকে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার সঙ্গে উপস্থাপন করছে। অথবা বসের সঙ্গে তার ঝগড়ার বিষয় কিংবা দারুণ উপমা দিয়ে নিজের প্রেমকাহিনি বলে যেত।

‘উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে জন্ম ওর। মেয়েটা সবার মতে জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কোনো নাক উঁচু কিংবা অযথা আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগতে দেখিনি। মাঝেমধ্যে ওকে বোকা বানানোর চেষ্টা সফল হতো না। অবজারভার-এর কম্পিউটারে কোটকোট নামে একটা ফাইল ছিল। আড়ি পেতে শোনা বিভিন্ন বিব্রতকর বা হাস্যরসাত্মক কথা লিখে রাখা হতো সেখানে। কেউ বোকার মতো কোনো কথা বললেই সেটা কোটকোটে রেকর্ড করা হতো। ইভনকে নিয়ে লেখা কৌতুকগুলোর মধ্যে একটা আমার ভীষণ প্রিয়। ইভন কখনোই অবজারভার-এর বিনোদন পাতা

পড়ত না। এবং এই অংশটা না পড়ার সুবিধা ও উল্লেখ করত এভাবে, অদ্ভুত নেশাবিহীন মদের বোতলে চুমুক দেওয়া বিপজ্জনক। ‘তবে কোটকোট পড়ে শুধু বিব্রতকর বিষয়গুলোই জানা সম্ভব। ইভনের বুদ্ধি ছিল সরষের তেলের মতো ঝাঁজযুক্ত। খুব দ্রুত যেকোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ফেলত। চটপটে মেয়েটার হৃদয়টা ছিল বিশাল, স্বর্ণের মতো খাটি।

‘মনে পড়ছে, মাঝেমধ্যেই ওর গল্প শুনে আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়তাম। কর্মজীবনের নিষ্ঠুর প্রতিকূলতাকে পাশ কাটাতে ওর জুড়ি মেলা ভার।

‘অবজারভার-এর সহকর্মীরা একটু হামবড়া স্বভাবের। একবার আমাদের এক সহকর্মীর বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ইভন কাকে নিয়ে এল, ইংল্যান্ডের তৎকালীন সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষের হাত ধরে হাজির ও।

‘ফলাফল, সেদিন ইভনকে নিয়েই বেশি মাতামাতি হলো। আন্তর্জাতিক চরিত্র। ইভনের আটক হওয়ার খবর শুনে প্রথমে খুব ব্যথিত হই। তবে তালেবানরা ওর কিছুই করতে পারবে না। আমি অবজারভার-এর একজন আইনজীবীকে সেদিন রাতেই ই-মেইল পাঠাই, তালেবানরা জানে না ওরা কাকে ধরেছে। ওদের কপালে দুঃখ আছে।

‘আশা করি, দ্রুতই ওরা ভুল বুঝতে পারবে এবং ইভনকে ছেড়ে দেবে। একটু বলে নেওয়া ভালো, সাংবাদিকেরা মাঝেমধ্যে কেন বোকার মতো ঝুঁকি নিতে যায়। আমাদের সবচেয়ে ভালো অবিশ্বাস্য গল্পটা বলতে হয়। আর এ রকম কাহিনির নায়কদের অধিকাংশই হচ্ছে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যারা চায় না নিজেদের অন্ধকার গল্পটা প্রকাশিত হোক।

‘ইভন, আফগানিস্তানের কারাগার থেকে যদি কোনো জাদুবলে তুমি আমাদের কথা শুনে থাকো, তাহলে মনে রেখো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি। তোমার প্রতিটা বন্ধুবান্ধব, স্বজনেরা জানে তুমি কোনো ভুল করোনি, যা করেছ ঠিকই করেছ।

‘আবার সেই পুরোনো গাড়িতে বসে তোমার রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।

শোকবার্তা দুটি মর্মস্পর্শী। এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এটা ভেবেই আমি আনন্দিত যে কঠিন সময়টা পার করে এসেছি। আজ নিজের মুখেই শোনাতে পারছি দুঃসময়ের দিননামচা। আমার গল্পটা হয়তো এখানেই সমাপ্ত হতো। বইয়ের শেষ বাক্যটা লিখে দাঁড়ি টেনে দিতাম। কিন্তু কিছু ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ব্যথিত ও বিভ্রান্ত করেছে।

স্বাভাবিক জীবনের সংজ্ঞাটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে আমার। আমার বন্দিত্বের খবর ছড়িয়ে পড়লে খবরের জগতের ঘড়ির কাঁটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। এবং আফগানিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সেই ঘড়ির কাঁটা দ্রুত চলতে শুরু করে। পাকিস্তান থেকেও খুব দ্রুত চলে আসি। এমনকি পাশাকে একবার বিদায় বলার সুযোগও পাইনি।

পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা একটু কঠিন হয়ে পড়ে আমার জন্য। কারণ, যখন সবাই জানত দুনিয়াতে কী ঘটছে ঘটতে যাচ্ছে, তখননা আমি তাবৎ দুনিয়া থেকে ১০ দিন পেছনে ছিলাম। তাল রাখতে চেষ্টা অব্যাহত ছিল।

১০ দিনের ঘটনাপ্রবাহের কিছু কিছু বিচ্ছিন্নতা ছিল হাস্যকর। একটা গুজব রটেছিল, আমি বিশেষ বাহিনীর সদস্য। আমাকে গোয়েন্দা বানানোর কাহিনি পড়ে নিজেরই হাসি পাচ্ছিল। তালেবানরা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে, আমি ব্রিটিশ বিশেষ বাহিনীর একজন সদস্য। কিন্তু আমার কার্যকলাপ কোনোভাবেই একজন গোয়েন্দার মতো দক্ষ ও চটপটে নয়। প্রতিদিন যে কটা সিগারেট পোড়াতাম, তা কোনোভাবেই একজন বিশেষ বাহিনীর কমান্ডোর কাজ নয়।

আমার বিরুদ্ধে তালেবানদের অভিযোগ আফগানিস্তানের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, যা একসময় আমার মৃত্যুশঙ্কা পর্যন্ত তৈরি করে।

খবরের কাগজের অফিসে গুজব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় এবং ডেইলি এক্সপ্রেস-এর অফিসে অবাস্তব গুজব ছড়ানোর কাজটা দায়িত্বের সঙ্গে পালন করে অ্যান্থনি মিশেল। একবার বার্তাকক্ষে অ্যান্থের গোপন বিয়ের খবর রটে যায়। গ্রেগ সুইফট রসিয়ে রসিয়ে ওর পালিয়ে বিয়ের গল্পটা আমাকে শুনিয়েছে, এটা জেনে ও প্রচণ্ড রেগে যায়। মজার ব্যাপার হলো, আমরা ওর বিয়ের পুরোহিতকে ফোন করে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করি। কিন্তু বিষয়টা মোটেও ওর পছন্দ হয়নি। আমি যখন আফগানিস্তানে বন্দী, গ্রেগ তখন তালেবানবিরোধী জোট নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের খবর সংগ্রহে ব্যস্ত।

খবর পেয়ে অ্যান্থনি খুব খুশি খুশি ভাব দেখায়। সবার সামনেই প্রকাশ্যে ও গ্রেগের মৃত্যু কামনা করে। আমার ও গ্রেগের করুণ পরিণতি দেখতে ও মুখিয়ে আছে, এ কথা বলতেই বার্তাকক্ষে হাসির রোল ওঠে।

এসব রসাল গালগপ্পের বিপরীতে তালেবানরা ১০ দিন আমাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন ও সৌজন্যবোধ দেখিয়েছে। এরপর যেদিন লন্ডনের এক ক্যাচালক আমাকে চিনতে পারল, ওর কথা শুনে আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই।

কালো ট্যাক্সিতে চড়তেই চালক আমাকে চিনতে পেরে প্রশ্ন করে, “তুমিই তো তালেবানদের হাতে বন্দী হয়েছিলে, তাই না? আমি হুঁ-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ি। ও পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, ওরা কি তোমাকে ধর্ষণ করেছে? আমার উত্তর শুনে ও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকাল একবার। সুযোগ পেলে নাকি চালক নিজেই এর সদ্ব্যবহার করত।

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। মনে হলো, ও আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেকে সংযত রাখি। মনে মনে বললাম, ইভন, বাস্তব সভ্য জগতে তোমাকে সুস্বাগত।

রহস্যের কিছু অংশ আমি আর কখনোই মেলাতে পারব না। জটিল ধাধার কয়েকটা অংশ চিরতরে হারিয়ে গেছে। যেমন ক্রাউন প্লাজায় কারা আমার কক্ষে প্রবেশ করেছিল? কেনই-বা আমার দামি সুগন্ধির বোতলটা হারিয়ে গেল?

ডেইলি এক্সপ্রেস-এর ডেনিস রাইসের কাছ থেকে জানতে পারি, ডেভিড স্মিথ আসার আগেই ইতালির একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হোটেলে আমার কক্ষে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু তবু হিসাব মেলাতে পারি না। সম্ভবত, ইতালিয়ানের আগেও কেউ একজন সেখানে হানা দিয়েছিল।

হয়তো পাকিস্তানে অবস্থানরত কোনো তালেবান গোয়েন্দা অথবা অন্য কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক। আমি তালেবানদের আমার রুম নাম্বারটাও বলে দিয়েছিলাম, কারণ আমার লুকানোর কিছুই ছিল না। আমার টাকাপয়সা, ক্রেডিট কার্ড কিছুই খোয়া যায়নি। এমনকি আমার পাসপোর্টটাও পড়ে ছিল যথাস্থানে। তবে আমার ফোনবইটা উল্টেপাল্টে দেখা হয়েছিল। আরও কিছু কাগজপত্রও ঘাটাঘাটি করেছিল অজ্ঞাত হানাদাররা। বের হওয়ার সময় আমি বিছানাটা পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সেটাও উল্টেপাল্টে কিছু খোঁজা হয়েছিল। আগেই বলেছি, কারা এসেছিল এবং তাদের উদ্দেশ্যই-বা কী ছিল, তা আমার পক্ষে আর কোনো দিন জানা সম্ভব হবে না।

লন্ডনের সোহোর ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পর দেখি ভিভ আগেই আমার ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে। অবশ্য এর দরকার ছিল, কারণ, কত দিন ধরে বন্দী থাকব কেউ জানত না তখন। একটা লক বদলে দিতে ৭০ পাউন্ড খরচ হয়। কিন্তু আমার দরজায় তখন পাঁচটা লক ঝুলছিল। ভেতরে ঢুকতে ওদের খরচ হয়েছিল পাঁচ গুণ টাকা।

ভিভের মন্তব্য, এমন কিছু ও আগে কখনোই দেখেনি। লক সারানোর কারিগর যেন রীতিমতো অপারেশন চালিয়েছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও আয়না ব্যবহার করে সূক্ষ্মভাবে খুলতে হয়েছিল সিঁড়ির লকটা। এবং ঘরের প্রবেশ দরজার লকটাকেও একইভাবে নানান কায়দা-কীর্তি করে ফেলা হয়। কারিগর লোকটার মতে আমরা নিশ্চয়ই চাবি হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, তার আগেও কেউ একজন এসে একই কায়দায় লক খোলার চেষ্টা করেছে।

কথার এই পর্যায়ে এসে ওকে থামিয়ে দিয়ে পুরো গল্পটা পুনরায় শোনাতে বলি। আমি বললাম, কিন্তু ভিভ, এক বছর আগে এই ফ্ল্যাটটাতে ওঠার সময় শুধু লকটা বদল করেছি মাত্র। কখনোই চাবি হারিয়ে লক ভাঙার মতো কিছু করিনি।

বিষয়টা শুনে কেমন খুঁতখুঁতে লাগল আমার। আমি নিজে গিয়েই কারিগরের সঙ্গে কথা বললাম কিন্তু উনি সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারলেন না।

ডেনিস আরও জানায়, ইতালির ওই টেলিভিশনে আমার, ডেইজি ও হার্মসের একটা ছবি দেখিয়ে দাবি করা হয়, ওটা ইরানে তোলা। কথাটা শুনে আমি প্রথমে হাসতে চাইলেও পরক্ষণেই মনে হলো, তালেবানরা নিশ্চয় এই সংবাদটা দেখেছিল। তখন আল-জাজিরা উসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল, যার ফলে ওদের দর্শকসংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। সংঘর্ষ চলাকালে লাখ লাখ মুসলমান ও অন্য অনেক দর্শক আল-জাজিরার সংবাদ প্রচার প্রত্যক্ষ করত। আফগানিস্তানে টেলিভিশন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও তালেবান শাসকগোষ্ঠী কিন্তু টিভি পর্দায় ঠিকই খবর দেখত।

আমি খুব ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম আল-জাজিরার ওপর। ওদের কারণে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হতো। আমি গোয়েন্দা, এটা বিশ্বাস করতে শুরু করলে তালেবানরা আর দেরি করত না। ট্যাঙ্কের মাথা থেকে আমার নিথর দেহটা ঝুলিয়ে অন্যদের সতর্ক করা হতো।

এসব বিষয় জানতে আমি চ্যানেলটির কাতারে অবস্থিত সদর দপ্তরে প্রধান নির্বাহীকে ফোন করি। আমার প্রশ্ন ছিল, কেন ওরা আমাকে মেরে। ফেলার ষড়যন্ত্র করছিল? ঢালাওভাবে কেন আমাকে নিয়ে দু-দুটি প্রতিবেদন করেছিল ওরা? আর রহস্যজনক কারণে কেন প্রতিবেদন দুটো প্রচার বন্ধ করে দেয় ওরা?

প্রত্যুত্তরে আল-জাজিরার নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে জানান, তাঁদের হাতে এমন কিছু দলিল প্রমাণাদি ছিল, যার মাধ্যমে নির্দ্বিধায় আমাকে গোয়েন্দা বলে অভিযুক্ত করা যেত। তাই ওরা এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। একই সঙ্গে ওদের লন্ডনের টিম আরও তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চালাচ্ছিল। তিনি আমাকে একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রস্তাব দিলে আমি রাজি হই। কারণ, এসব ধোঁয়াশা পরিষ্কারের দরকার ছিল তখন। পাশাপাশি ওদের হাতে থাকা দলিলগুলোতেও একবার চোখ বুলানো দরকার।

দিন কয়েক পরই লন্ডনের কার্নেবি সড়কে অবস্থিত আল-জাজিরার কার্যালয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। সেখানে নাসির আল বাদরির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আমার। আমরা কথা বলছিলাম। মনে হলো, সে আমাকে যথেষ্ট সন্দেহ করছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আমি হাঁপাতে থাকি। নাসিরকে বললাম, দেখো, আমার দমের শক্তি। এতটুকু উঠতেই হাঁপিয়ে পড়েছি। বিশেষ বাহিনীর সদস্য বা গোয়েন্দা হওয়ার যোগ্যতা আমার কতখানি? কথাটা শুনে নাসির মুচকি হাসল। বুঝতে পারলাম, ওকে বোঝাতে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

আমরা বসে কথা বলছিলাম। নাসির আমাকে ওদের হাতে থাকা কাগজগুলোর ফটোকপি দেখাল। এসব দলিলে উল্লেখিত আমার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সঠিক ছিল একটা মাত্রা পর্যন্ত। আমার আয়কর বিবরণী একদম নির্ভুল। কিন্তু একটা দলিলে আমার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। ডকল্যান্ডে আমার পুরোনো বাড়ি বিক্রির দলিল আল-জাজিরার হস্তগত হয়েছিল। দলিলমতে আমার বাড়িটা পাঁচ লাখ পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে। অথচ বাস্তবে বিক্রয়মূল্য ছিল ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড। নাসির আমাকে আমার তৃতীয় স্বামী, যিনি ইসরায়েলি ছিলেন, তার পাসপোর্টের একটা অনুলিপি দেখায়, যেটা সঠিক ছিল। এরপর ও আমাকে মোসাদের একটা শনাক্তকরণ নাম্বার ও পরিচয়পত্র দেখিয়ে দাবি করে, এসব আমার তৃতীয় স্বামীর। এবং তাদের দাবি আটক হওয়ার সময় এসব কাগজপত্র আমার সঙ্গে পাওয়া গেছে।

কী উদ্ভট প্রগলভতা, আমি আমার নিজের পাসপোের্টই আফগানিস্তানে নিয়ে যাইনি। তাহলে কী কারণে আমি ইসরায়েলি কাগজপত্র সঙ্গে রাখব?

নাসির হাসল। বিজয়ের ভঙ্গিতে একটা ছবি বের করে আনল, যেটাতে আমি ডেইজি ও হার্মস (এখনো ওর নামের প্রথম অংশ ধরে সম্বোধন করতে ঘেন্না করে) একটা প্রমোদতরিতে দাঁড়িয়ে আছি। এই যে, নাসির বলতে থাকে, অবৈধভাবে ইরানে যাওয়ার পথে এই ছবিটা তোলা হয়। অবিশ্বাস আর সন্দেহে আমার গলার দম যেন আটকে যাচ্ছে। মনে পড়ল, জেরার সময় আফগান তদন্ত দল বেশ কয়েকবার কথাটা আমাকে বলেছিল। আমি অবৈধভাবে ইরানে প্রবেশ করেছি, তাদের কাছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।

আমাকে হত্যা করতে এ রকম উঠেপড়ে লেগেছিল কে? ছবিটার দিকে ভালোমতো লক্ষ করে হাসি পেল আমার। এই ছবিটা ১৯৯৮ সালে স্ট্রাটফোর্ড অ্যাভনে তোলা হয়েছিল। হচ্ছেটা কী? পেটটা কেমন গুলিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এখনই বমি করে দেব। মনে পড়ে গেল ছবিটা আমি শেষ কোথায় দেখেছি। সোহোতে আমার ফ্ল্যাটের একটা আলমারিতে রাখা ছিল এটা।

এই ছবিটা তোলার দিন কয়েক পরেই আমার তৃতীয় স্বামীকে ভাগিয়ে দিই। ও চলে যাওয়ার পর এসব ছবির নিগেটিভ আর কোনো দিনই ওয়াশ করা হয়নি। তাহলে চুরি করে আমার ফ্ল্যাটে কে প্রবেশ করেছিল? লক সারানোর কারিগর কিন্তু ভিতকে বলেছিল যে এর আগেও কেউ একজন আমার ফ্ল্যাটে ঢোকার চেষ্টা করেছে। বড় অস্বস্তি লাগছিল আমার।

নাসির খুব চতুর শিকারি। ও বুঝতে পারছিল, আমি ভয় পাচ্ছি। বিষয়টা ও ধরে ফেলে। আমরা জানি, কোনো গোয়েন্দা সংস্থার হাত থেকে ফাঁস হয়েছে এসব। কিন্তু ধরতে কষ্ট হচ্ছিল কোনটা আসল আর কোনটা নকল। এসব কাগজ প্রথমে কাতারে আমাদের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আমাকে ই-মেইল করে কর্তৃপক্ষ। জানায় নাসির।

খুব সংবেদনশীল একটা ব্যাপার। তালেবান গোয়েন্দাদের হাতেই এসব দলিল পৌছেছিল। খুব জটিল একটা মুহূর্ত। তোমার বন্দিত্বের সুযোগ অথবা অভিযুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল নিশ্চয়। দুভাবেই এর খুব খারাপ পরিণতি হতে পারত।

খারাপ? আমি চিন্তা করলাম। রক্তাক্ত সমাপ্তি হতো এই নাটকের। এক কোপে গর্দান চলে যেত আমার। আমি রহস্যময় গোয়েন্দা জগতের পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব তথ্য জানাই।

হোয়াইট হলের সূত্রের দাবি, পুরো ঘটনার পেছনে রয়েছে আমেরিকার হাত। একটা কফিনে করে যদি আমার মরদেহ পৌছাত, তাহলে ওই আদিম যুগীয় বর্বরদের সমূলে ধ্বংস করে দিতে বোমা হামলার সমর্থনে জনমত তৈরি হতো। তবে নাসির ব্যক্তিগতভাবে এসব বিশ্বাস করেনি। আসলেই কি তাই? তখন আমার মনে হচ্ছিল, এই নোংরা কাজের পেছনে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা অন্য কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে।

চেস্টারফিল্ডে লেবার পার্টির সাবেক এমপি টনি বেনের সঙ্গে কথা হয়েছিল ব্রেকফাস্ট উইথ ফ্রস্টে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরই। সানডে এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত আমার বন্দিজীবনের কাহিনি তিনি পুরোটা পড়েছেন। তাঁর মতে, এটা ছিল সাহসী সাংবাদিকতার উদাহরণ। তুমি আফগানদের একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছ। অন্যদিকে পশ্চিমারা কয়েক সপ্তাহ ধরে বোমা হামলা করার লক্ষ্যে ওদের মুখোশ উন্মোচন করার চেষ্টা করছে। একটা শয়তানের দেশে বোমা হামলা করা খুব সহজ কাজ। তাঁর মতে, আমি খুব ভালো সাংবাদিকতা করেছি।

দ্রলোকের কথা শুনে মন ভরে গেল। বেন আমাদের সময়ের একজন অন্যতম শান্তিবাদী লোক। খুব বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও অনলবর্ষী বক্তা।

অবশ্য যদি সত্যিই বর্বর তালেবানরা আমার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালাত অথবা আমার ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ একটা বাক্সে ভরে পাঠিয়ে দিত কিংবা আল-জাজিরা যদি সরাসরি আমার শিরচ্ছেদের দৃশ্য প্রচার করত, সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে বোমা হামলা করার জন্য পশ্চিমাদের আর কোনো অজুহাতের দরকার পড়ত না।

একজন ইসলামিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আমার এ ব্যাপারে কথা হয়েছিল। তাঁর মতে, তালেবানরা যদি সত্যি সত্যি গোপন দলিলের কথা বিশ্বাস করত, তাহলে আমাকে নিয়ে দর-কষাকষি করত। তিনি বলেন, তোমাকে হয়তো আফগানিস্তানের পাহাড়ে উধাও করে দেওয়া হতো। গোয়েন্দা হিসেবে তোমার কাছ থেকে গোপন তথ্য আদায় করার জন্য তার সব চেষ্টাই করত।

ভাগ্য ভালো, তালেবান গোয়েন্দারা কিছুটা হলেও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এখন আমি সহজেই বলতে পারি, কেন আমাকে মুক্তি দেওয়া হলো। সম্ভবত তালেবান গোয়েন্দারা বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিমা শক্তি তাঁদের বিরুদ্ধে কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। ব্যাপারটা তাদের মনঃপূত হয়নি। তাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে যেদিন ইঙ্গ মার্কিন বাহিনী কাবুলে ৫০টি ক্রুজ মিসাইল দিয়ে আঘাত হানে, ঠিক তার পরদিনই মোল্লা ওমর মানবতার খাতিরে আমাকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিল পশ্চিমা নেতাদের প্রতি একচোখা আধ্যাত্মিক এই নেতার ব্যঙ্গাত্মক সম্মান প্রদর্শন।

আমি নিজেও কিন্তু অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসিনি। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে তালেবানরা আমাকে রুক্ষ, বদমেজাজি বলে উল্লেখ করে এবং প্রচুর গালিগালাজ করেছি বলে অভিযোগ জানায়। আমি সীমান্ত অতিক্রম করার পর তারাও হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

যা-ই হোক, আমার কর্মস্থল থেকে আমার সাংবাদিক পেশার সপক্ষে তালেবানদের নিকট যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণাদি সরবরাহ করা হয়। আমি কোনো বিশেষ বাহিনীর সদস্য নই, নিতান্তই একজন সাংবাদিক, এটা প্রমাণ করতে পারলে তালেবানরা আমাকে নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দেবে, পল অ্যাশফোর্ডের কাছে এ রকম ইসলামিক ওয়াদা করেছিল ওরা।

আমিও ওদের একটা কথা দিয়েছিলাম, যেটা না রাখলে আমি নিজেকেই অসম্মানিত করব। তালেবানদের যে ধর্মীয় নেতা বা ইমাম আমাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমি তাকে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করব বলে কথা দিই। ওরা আমাকে মুক্তি দিয়ে ওদের কথা রেখেছে। এবার আমার পালা।

ড. জাকি বাদাভির সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি। উনি লন্ডনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান মুসলিম কলেজ অব লন্ডনের প্রধান। তিনি আমাকে ইসলাম নিয়ে আরও গভীর পড়াশোনা করতে সাহায্য করছেন। এ জন্য আমি ওনার কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। এটা প্রকৃতপক্ষেই একটা চমক্কার ধর্ম। অন্যান্য ধর্মের মতো এই ধর্মেও মহৎ অনেক বিষয় রয়েছে।

আমি গত কয়েক দিনে যদি কোনো শিক্ষা অর্জন করে থাকি তা হলো, অন্যদের অবহেলার সময় ধৈর্য ধারণ করা। ইংল্যান্ড ফিরে আসার পর অনেক গণমাধ্যম আমার ব্যাপারে সত্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। এদের অনেকেই আমার বিরুদ্ধে বিষোদার ও বিমাতাসুলভ আচরণ করে। নারী কলামিস্টরা আইভরি টাওয়ারের ছায়ায় বসে নখের সৌন্দর্য রক্ষায় ব্যস্ত ছিল। আমাকে একজন মা, একজন নারী ও একজন সাংবাদিক হিসেবে উপদেশ দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। কাবুলের বাজারে একদিন শুক্রবারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে তাদের এই পাগলের মতো গলাবাজি কোথায় উড়ে যেত! বাইরে বেশি সাহস দেখালেও ওদের রক্ত ছিল পানির মতন।

অবিশ্বাস্যভাবে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড, প্রতিটা জায়গা থেকে আমার বিরুদ্ধে দম্ভভরে কটুক্তি করা হচ্ছিল। তবে এর ব্যতিক্রমও ছিলেন কয়েকজন। যারা আমার ঘনিষ্ঠ, তাঁরা আমাকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। এমনকি কাগজের জগতে বদমেজাজি বলে পরিচিত, যারা মাঝেমধ্যে নিষ্ঠুর হতেও দ্বিধা করে না, সেই প্রাইভেট আইয়ের সহকর্মীরা আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে যান।

সে বছর আমি নারী সাংবাদিকদের সম্মেলনে যোগ দিই। সেখানে বেরসিক মেয়েদের অনেকেই আমাকে কাগজে-কলমে শাপশাপান্ত করাকে স্বাভাবিক বলে মতও দেয়। তখনই ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে, কোনো কোনো নারী মনেপ্রাণে চাইছিল আমাকে ধর্ষণ করা হোক কিংবা অত্যাচার করে মেরে ফেলে আমার নিথর দেহটা পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

সেখানে আমি বলি, তালেবানরা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ওরা চাইলে আমার নখ উপড়ে ফেলতে পারত, বৈদ্যুতিক শক দিতে পারত, ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে মারতে পারত কিংবা করতে পারত যৌন নিপীড়ন। এসব করলে হয়তো অনেক নারীর মনের আশা পূরণ হতো।

আমি জানি, তালেবানদের কাছে নারীজাতির কোনো মূল্য নেই। তারা আফগান নারীদের সঙ্গে অমানুষের মতো ভয়ংকর ব্যবহার করে। এমনকি নর্দার্ন অ্যালায়েন্স, যাদের মানবাধিকার-বিষয়ক ইতিহাসও খুব একটা আলাদা কিছু নয়, তাদের কাছ থেকেও নারীরা ভালো কোনো ব্যবহার পান না। কিন্তু আফগানিস্তানের নারীরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন, তার জন্য আমি একা আর দায়ী হতে পারি না।

একদিন রাতে আমার প্রতি ঘৃণাসূচক বিদ্বেষের বাষ্পে আর শ্বাস নিতে পারিনি। আমি গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও মিরর পত্রিকার সাবেক সম্পাদক রয় প্রিন্সল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করি। আমার প্রতি উসকানিমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চাইলাম। জিজ্ঞাসা করি, কত দিন ধরে এসব চলবে?

তিনি বলেন, “তুমি এক্সপ্রেস-এর হয়ে কাজ করো। এসবের অধিকাংশই তোমার প্রতি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ। তাই এদের এড়িয়ে চলো।

দিন কয়েক বাদে এক রাতে বিবিসির বুশ হাউসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ এক আফগান নারী এসে বললেন, ইভন, তোমার লেখনীর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন আমি কোনো লজ্জা ছাড়াই নিজের দেশের পরিচয় দিতে পারি। তুমি আমাদের আবার মানুষ বানিয়েছ।

এই সামান্য কয়টা শব্দ আমার মনে উৎসাহ জোগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। গুটি কয়েক লোকের খারাপ কথার জন্য মন খারাপ করে বসে থাকা

অথবা অযথা রাগ দেখানোর কোনো মানে হয় না।

খেয়াল করে দেখলাম, আমার বিরোধিতাকারীরা সংখ্যায় খুব নগণ্য। মুক্তি পাওয়ার সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যেই বেলফাস্টে সম্পাদক সংঘের সাধারণ সম্মেলনে অংশ নিতে যাই। সেখানে সংগঠনটির প্রধান কনস্টেবল স্যার রনি ফ্ল্যানাগান আমাকে রীতিমতো বীরের মর্যাদা দিলেন। তিনি আমাকে সাহসী ও নির্ভীক সত্তা হিসেবে উল্লেখ করলে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। উৎসাহমূলক ও আবেগপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আমাকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান।

আমার বক্তব্যে আমি সেসব সাহসী সাংবাদিকের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা ভয়ংকর সব মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধী চক্রের কুকীর্তি ফাঁস করে প্রতিনিয়ত নাশতার টেবিলে অবিশ্বাস্য আর গা শিউরে ওঠা সংবাদ সরবরাহ করছেন। আইরিশ সাংবাদিক, যিনি প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে বের হন, তাঁর প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

বিশেষ করে, মার্টিন ও হ্যাগেনের কথা উল্লেখ করি। এই বীর সাংবাদিককে তাঁর স্ত্রীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ভয়ংকর একদল অপরাধীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ফাঁস করে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন, এই ছিল তাঁর অপরাধ।

আমার গ্রেপ্তারের দিনেই মার্টিনকে গুলি করা হয়। অথচ সেদিন আমি গণমাধ্যমের শিরোনামজুড়ে থাকলেও এই সৎ ও নির্ভীক লোকটার মৃত্যুসংবাদ কেউই গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি। আরেকটা সাধারণ খুন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

আমার বক্তব্য শেষ হলে মার্টিনের পত্রিকা সানডে ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক জিম ম্যাকডয়েল আমার বক্তব্যে, বিশেষ করে মার্টিনের কথা উল্লেখ করায় কৃতজ্ঞতা জানান। মার্টিন ও হ্যাগেনের মতো সাংবাদিকদের শতবার সালাম জানাই। দুষ্টচক্রের মুখোশ উন্মোচন আর সত্য প্রকাশে অকুণ্ঠ সাহস দেখানোর জন্য এ ধরনের সাংবাদিককে যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধা জানানো উচিত।

বেলফাস্টের রাস্তায় মানুষজন আমাকে ঘিরে ধরে শুভেচ্ছা জানাল। তারা সহাস্যে আমার সঙ্গে করমর্দন করতে লাগল। ইউরোপা হোটেলে একজন মাল বহনকারী কর্মী আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বলল, “ব্রিটেন তোমার জন্য গর্ব করে। দুজন মধ্যবয়সী নারী আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার রুম পর্যন্ত চলে এলেন।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বেলফাস্ট টেলিগ্রাফ-এর সম্পাদক এড করেন। তিনি আমাকে বলেন, “ইভন, জীবন তোমার জন্য কখনোই আগের মতো হবে না। আগের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করে খবর সংগ্রহ করা তোমার পক্ষে আর কোনো দিনই সম্ভব হবে না। তোমাকে নতুন কোনো কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।

এডের কথায় আমার মন খারাপ হয়ে গেল। ও অনেকটাই সত্যি কথা বলছে। সাংবাদিকতা আমার রক্তে মিশে আছে এবং আমি সানডে এক্সপ্রেস এর প্রধান প্রতিবেদক। ভবিষ্যতে আমি কীভাবে কাজ করব, তা আমি এখনো বলতে পারছি না। তবে আমার সমালোচক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি আমার কিছু বলার আছে।

আমি হাস্যরস পছন্দ করি এবং বাকি দিনগুলো হেসেখেলে কাটাতে চাই। মদ্যপান আমার অতীব পছন্দের কাজ এবং ঢকঢক করে শ্যাম্পেন গিলতে চাই আরও অনেক দিন। অবশিষ্ট জীবনটাকে আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চাই। তার মানে এই নয় যে, আমি উদাসীন বা উজ্জ্বল।

তালেবানদের হাতে ধরা পড়ার অভিজ্ঞতা আমার অন্তরে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

কারও কারও মতে, সাহায্য সংস্থা শেল্টার ইন্টারন্যাশনালের কর্মীরা কাবুল জেলে খোদাকে একমনে ডেকে গেছে, তাদের প্রার্থনাতেই খ্রিষ্টানদের খোদা সাড়া দিয়েছেন। এরা প্রায় তিন মাসের বেশি বন্দী ছিল কাবুলে । তাদের বিরুদ্ধে তালেবানদের অভিযোগ ছিল, তারা মুসলমানদের গোপনে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ওদের গ্রেপ্তার করা ছিল তালেবান ধর্মীয় পুলিশের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। একই সঙ্গে খোদার প্রতি ওদের অগাধ বিশ্বাসই ওদের এই প্রতিকূল সময়টা পাড়ি দিতে সহায়তা করেছে।

পাঁচ সপ্তাহের বোমা হামলার পর নর্দার্ন অ্যালায়েন্স রণাঙ্গনে তালেবানদের পিছু হটিয়ে দেয়। আমেরিকার নির্বিচার শক্তিশালী বোমা হামলা তালেবানদের কোমর ভেঙে দেয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তারা। কাবুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা ওই আটজন সাহায্যকর্মীকেও তাদের সঙ্গে করে নিয়ে কান্দাহারের দিকে চলে যায়। তখনো ওখানে তালেবানদের বেশ শক্ত ঘাঁটি ছিল।

জর্জ টাবম্যান জানান, যখন তারা জানতে পারেন যে তাঁদের কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন তারা খুব ভয় পেয়ে যান। কারণ, ওখানেই তাদের সলিলসমাধি ঘটার আশঙ্কা ছিল। জর্জ প্রায় ১৬ বছর আফগানিস্তানে কাজ করেছেন।

তাঁদের বহনকারী গাড়ি রাতের বেলা ওয়ারদাক প্রদেশের পার্শ্ববর্তী এলাকায় থেমে যায়। আটজনকে বেঁধে একটা আবদ্ধ কনটেইনারে ঢোকানো হয়। পরদিন সকালে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় কাবুল থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে গজনির একটা কারাগারে। গজনি কারাগারে তারা যখন বন্দী ছিলেন, তখন সেখানে আমেরিকান বাহিনী বোমা হামলা চালায়। বোমা হামলা থেমে গেলে ঘট করে তাঁদের আটকে রাখা কারাকক্ষের দরজা খুলে যায়। একজন তালেবান সৈন্য রাইফেল হাতে প্রবেশ করে।

টম্যান বলেন, আমরা ভেবেছিলাম এখানেই আমাদের জীবনের ইতি টানা হবে। কিন্তু অস্ত্রধারী সৈন্য শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করে। আজাদি (স্বাধীনতা)।

গজনিতে আরেকটা রাত কাটানোর পরদিন তিনটা আমেরিকান হেলিকপ্টার আমার সাবেক কারাসঙ্গীদের উদ্ধার করে। বিশেষ বাহিনী খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ওদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আমিও বিশেষ বাহিনীর একটা ঝটিকা অভিযানের জন্য অপেক্ষা করতাম। তবে এত দ্রুত আর সফল অভিযানের কথা ভাবতেও পারিনি। পাগলি হিথার এত বড় ধাক্কা সামলাতে পেরেছে, এটা জেনে আমি খুব আনন্দিত হই। ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে ও বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে, এমন একটা ছবি দেখার পর আমার চোখ ভিজে যায়। হিথারের বাবা সারা রাত জাগ্রত অবস্থায় ইসলামাবাদে অস্থির সময় কাটিয়েছেন।

সেদিন রাতে আমি কাকতালীয়ভাবে জার্মান শহর কোলোগনেতে অবস্থান করছিলাম। সঙ্গে ছিলেন শেল্টারের প্রধান উদো স্টল, কেথির ভাই অ্যান্দ্রেস জেলিনেক ও তাঁর স্ত্রী ক্যাজা। আমরা স্টার্ন টিভিতে সাক্ষাৎকার দিই। একই সঙ্গে ওদের মুক্তির আশা ও বিপদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করি। তখন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছিল ওদের সম্ভাব্য মুক্তির কথা। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার পরে এসব কেউ আর সহজে বিশ্বাস করেন না। আফগানিস্তান থেকে আসা গুজব ওখানকার প্রকৃতির মতোই রহস্যময়।

আমরা একটা ট্যাক্সিতে করে হোটেলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় উদোর কাছে একটা ফোন আসে। ওরা মুক্ত, ওই সময় জাদুকরি আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিল। আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা বাক্যই বের হলো, যেটা আমার বন্ধুবান্ধব বহুবার শুনেছে। আজ রাতে আরেক ঢোঁক শ্যাম্পেন গিলতে হবে অবশ্যই।

হোটেলে ফিরেই আমরা সবাই পিয়ানো বারে বসলাম। সাংবাদিক ও অনুষ্ঠান প্রযোজক থিও হেইনকে আমাদের সঙ্গে আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিতে আমন্ত্রণ জানাই। ওর কাছে এসবের বিস্তারিত খবর রয়েছে। কয়েক দিন ধরে সাহায্যকর্মীর বন্দিত্ব, মুক্তি ইত্যাদি ব্যাপারে যেসব খবর রটেছে, তা থিও থেকে কেউ ভালো বলতে পারবে না। পুরো সময়ই ও এই সংবাদের পিছু ছুটেছে। সংবাদগুলোর সঙ্গে যদি, সম্ভবত, কিন্তু শব্দগুলো জুড়ে দেওয়া হচ্ছিল। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছিল না, আফগানিস্তান থেকে আসা খবরগুলো ভালো না খারাপ।

আমি অনুপস্থিত বন্ধু ও উদোর সম্মানে এক পেয়ালা পান করি। উদোর কাছে বারবার বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে ফোন আসছিল। একটু পরপর কথা বলতে উঠে যাচ্ছিল ও। এত ব্যস্ততার মধ্যেও ও আটজনের কথা স্মরণ করতে ভুলল না। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানালাম আমরা সবাই। আজকের মতো শ্যাম্পেন আগে কখনো এত সুস্বাদু লাগেনি। তাই স্বাদটাকে উপভোগ করার জন্য আরও তিন বোতল খালি করে ফেলি।

পরে জানতে পারি, নর্দার্ন অ্যালায়েন্স মঙ্গলবার কাবুলে প্রবেশ করে সাহায্য সংস্থা শেল্টার ইন্টারন্যাশনালের ১৬ জন আফগান কর্মীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছে। আমি উদোকে বললাম, আটজন বিদেশি কর্মীকে জানানো হয়েছিল তাদের আফগান সহকর্মীদের শিরচ্ছেদ করা হয়েছে। খবরটার সত্যতা নিয়ে ওরা সন্দিহান ছিল। প্রতিদিনের প্রার্থনায় ওরা তাদের সহকর্মীদের জন্য শুভকামনা করত।

তড়িৎ গতিতে আমার দুই গাইড জান আলী ও নাকিবুল্লাহর কথা মনে পড়ে যায়। ওদের সঙ্গে আমার কাবুল কারাগারেই শেষ দেখা হয়েছিল। আমাকে জানানো হয়েছিল, ওদেরও ফাঁসির রশি গলায় ঝোলাতে হয়েছে। খবরটা শুনে আমি তখন মুষড়ে পড়ি। তবে ওরা আটজন মুক্ত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমার সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে। পাশাই প্রথম আমাকে সংবাদটা দেয় যে ওদেরও মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

সে জানায়, ‘ম্যাডাম, গাইড দুজনকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তালেবানরা ওদের কাবুল কারাগার থেকে জালালাবাদে নিয়ে যায়। ওই সময় সবাইকে নিজ নিজ জীবন নিয়ে চিন্তা করতে বলা হয়। শত্রুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলে তোমরা সবাই মুক্ত। কথাগুলো সবার কানে মধুবর্ষণ করে।’

আমি ও আমার পত্রিকা অফিস থেকে আমরা নীরবে ওদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। বিষয়টা ছিল আমার জন্য ব্রিতকর। কারণ, ১০ দিনের বন্দিজীবনের পুরোটা সময় আমি তালেবানদের কাছে ওদের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এসেছি। তাই মুক্ত হওয়ার পুরো গল্পটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনের সাহস হয়নি আমার। আমার ভয়টা অমূলক ছিল না। কারণ, আমাকে নিয়ে করা কিছু প্রতিবেদন ছিল চরম প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষে ভরপুর। তার থেকেও ভয়ের কারণ ছিল, এসব প্রতিবেদনের জন্য ওদের জীবননাশের শঙ্কা ছিল।

তারা খুব নিরাপদেই তাদের পরিবারের সঙ্গে আনন্দঘন মুহূর্তে মিলিত হয়। আমিও লিখতে পারলাম, ওদের হত্যা করে ফেলার খবরগুলো ছিল অতিরঞ্জিত। পাশা জানায়, তালেবানরা ওদের সঙ্গে সদাচরণ করেছে। সঙ্গে এ-ও বলেছে, আমি গোয়েন্দা, এটা প্রমাণিত হলে ওদের গর্দান যাবে।

সবাই খুব সুখেই আছে মনে হচ্ছে।

কিন্তু না, পাশার সঙ্গে আমার কথোপকথনের পুরোটাই আমার জন্য আনন্দদায়ক ছিল না। আমার মুক্তির তিন সপ্তাহেরও কম সময়ে আমেরিকান বোমারু বিমান কামা গ্রামে হামলা চালায়। সেই কামা, যেটাকে আমি পৃথিবীর মুখ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলাম। খবরটা শোনার পর আমার কী পরিমাণ কষ্ট লেগেছে, তা বর্ণনাতীত। ম্যাডাম, দুঃখের সংবাদ। আপনার গ্রামে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। যাদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ এই হামলায় নিহত হয়েছে।

যেসব বোমা হামলায় নিরপরাধ লোকেরা মারা গেছে, নিশ্চয় সেগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। খুব সরলভাবেই আমি কথাটা বলি পাশাকে। কিন্তু ও আমার কথায় প্রতিবাদ জানাল। তাহলে তিন দিন ধরে ভুল করে কামায় বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।

আমি ফোনটা রেখে দিই। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। কাবুলে বোমাবর্ষণের প্রথম দিন যেই নারী বিজয়োল্লাসে বন্দিদশায় চিৎকার করে ‘রুল ব্রিটানিয়া গান গেয়েছিল, সে-ই এখন যুদ্ধটাকে অভিশাপ দিচ্ছে। আমি কামায় গিয়েছিলাম কিন্তু এটা ছিল একটা সাধারণ গ্রাম। এর কোনো ভৌগোলিক বা সামরিক কলাকৌশলগত গুরুত্ব ছিল না।

আমি মাকে ফোন করে কাঁদতে থাকি। ওরা আমার কামা গ্রামে বোমা ফেলেছে। ছোট ছিমছাম গ্রামটার কোনো অস্তিত্ব নেই এখন আর। আমি আমার বার্তা সম্পাদক জিম ও আরও অনেককেই ফোন করে এই দুঃখজনক খবরটা দিয়ে কাঁদতে থাকি। আমার মনটা ছিল দুঃখ ভারাক্রান্ত।

আমি এরপর অ্যালান সিম্পসনের সঙ্গে কথা বলি। তিনি ছিলেন লেবার পার্টির একজন সদস্য এবং যুদ্ধের বিরোধিতাকারী লেবার দলের সদস্যদের নেতা। আমি তাকে সুন্দর কামা গ্রামের বর্ণনা শোনাই। তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনেন এবং ক্ষোভে ফেটে পড়েন। আমাকে এ প্রসঙ্গে লিখতে পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য জনমনে প্রভাবে ফেলতে সক্ষম হবে। কারণ, আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই এবং যুদ্ধের সমর্থনকারীদের কেউই আমার মুখ বন্ধ রাখতে চাপ প্রয়োগ করছে না।

আমি ছিলাম চাক্ষুষ প্রত্যক্ষকারী। বোমা হামলার সময় আফগান মাটিতে অবস্থান করছিলাম। একজন সাংবাদিক যে প্রমাণ করতে পারবে আমেরিকানরা বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা করছে। মানুষের কাছে একটা সুন্দর বার্তা পৌছে দেওয়া দরকার ছিল আমার জন্য। এর পর থেকেই আমি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যুদ্ধ ও সামরিক সাজসজ্জা নিয়ে আমার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

অনেক কাজ তখনো বাকি রয়ে গেছে। আমাকে পুনরায় আফগানিস্তানে যেতে হবে। কামায় যাঁরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রার্থনা করি, তাঁদের সবাই নিরাপদে সুস্থ আছেন। যে মা নিজেকে ১৫ বাচ্চার মা বলে অভিহিত করেছেন, আমি পুনরায় তাঁর সঙ্গে হাসিঠাট্টার অংশ নিতে চাই। সেই মেয়েটা, যে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখত, আমি একনজর তাকে দেখতে চাই। দেখতে চাই সেই তরুণ ছেলেটাকেও, যার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করার। আমাকে জানতে হবে, তারা এখনো বেঁচে আছে কি না। এরা অনেক দিন আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। দুই দশক ধরে যুদ্ধের ক্ষত বয়ে চলা দেশটাকে গড়ে তুলতে এমন স্বপ্নবাজ তরুণের দরকার হবে না।

ভ্রমণ করতে গিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ আর শহরের প্রেমে পড়েছি। নিউ ইয়র্ক শহর কখনো ঘুমায় না। সর্বদাই একটা উত্তেজনা বিরাজ করে। রোমের রসুইঘরের সুগন্ধের লোভ সামলানো বড় কঠিন। ভেনিসের সৌন্দর্য হাঁ হয়ে দেখতে হয় আর প্যারিস পরিচ্ছন্ন ও সাজানো-গোছানো।

কিন্তু বুননা প্রাকৃতিক আর দুর্ধর্ষ আফগানিস্তান হৃদয় চুরি করেছে আমার। এই দেশের ঝা-বিক্ষুব্ধ ইতিহাস, টলায়মান রাজনীতি আর ভৌগোলিক বন্ধুরতার প্রভাবে এখানকার মানুষগুলোর আচরণেও এক আশ্চর্য বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। লেখক আহমদ রশিদ তাঁর বই তালেবান : আফগান যোদ্ধা জাতিতে খুব সাবলীল ও সুন্দর করে গুছিয়েছেন আফগানের রহস্যলীলা।

অনেক বছর আগে এক বৃদ্ধ বিজ্ঞ আফগান মুজাহিদ আমাকে আফগানিস্তান সৃষ্টির রহস্যময় গল্পটা শোনান। তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, তখন এখানে-সেখানে অনেক আবর্জনা, পাথর আর জঞ্জাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। পৃথিবীর কোথাও এসব রাখা যাচ্ছিল না। তাই এসব একত্র করে এক জায়গায় ফেলা হয় আর সেটাই আফগানিস্তান।

আফগানিস্তানের আকর্ষণ লজ্জন করা দুঃসাধ্য কাজ। আবার যেতে হবে আমাকে। আমি সম্পাদক মার্টিন টাউনসেন্ড ও মা জয়েসকে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি, তারা আরেকবার আমাকে এই বিচিত্র দেশে ভ্রমণের সুযোগ দেবেন। এবার কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই চষে বেড়াব ধু ধু প্রান্তর।

রুক্ষ দেশটার সঙ্গে প্রথম খণ্ডযুদ্ধে আমি হেরে গেছি, কিন্তু যুদ্ধ এখনো বাকি আছে।