পাতিহাঁস

পাতিহাঁস

ডোন্ট টিচ মি ট্রেড ইউনিয়ন। চাপা গর্জনের মতো, নিচু শক্ত স্বরে কথাগুলো উচ্চারণ করল দেবনাথ। কারোর উদ্দেশে না। কারণ ঘরে কেউ নেই। ডাইস মেশিন টেবিলের ওপর থেকে সে ড্রিল মেশিনটা শক্ত হাতে তুলে নিল। চোয়াল শক্ত করে ড্রিল মেশিনে চাপ দিল। উত্তরের খোলা জানালা। দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। তামাটে চওড়া মুখটা যেন আরও চওড়া হল। উঁচু, কিন্তু মোটা নাকটা মোটা হল আরও। বড় বড় শুয়োপোকার মতো ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল। কালো বড় চোখের দৃষ্টিতে ক্রুরতা, অথচ মোটা ঠোঁট জোড়ায় যেন ব্যঙ্গের হাসি। তামাটে মুখ যথেষ্ট চওড়া হলেও, শরীরটা চওড়া না। মেদ নেই, রোগাও বলা যায় না। লম্বা, শক্ত শরীর, দু হাতের শিরাগুলো একটু বেশি স্পষ্ট। মুখে দুদিনের আকাটা গোঁফ দাড়ি, লাল মাটিতে অভ্রের কুচির মতো দেখাচ্ছে। চওড়া কপালে, নাকের পাশে। গাঢ় রেখা। মাথার পাতলা চুলে পাক ধরেছে। কপালের ওপর এসে পড়েছে এক গুচ্ছ চুল। নীল জিন এর কাউবয় ট্রাউজার। কোমরে চওড়া বেল্ট। গায়ের হাত কাটা গেঞ্জি, ট্রাউজারের কোমরে গোঁজা। গলায় একটা রুপোর সঙ্গে, চৌকো চ্যাপটা লকেট। আসলে মাদুলি। দেখে মনে হয় অন্য রকম। বাঁ হাতের কবজিতে স্টিল ব্যান্ডের বড় ঘড়ি। পায়ে হাওয়াই চপ্পল।

দেবনাথদেবনাথ দত্ত। দত্ত ম্যানুফ্যাকচারার্স প্রাঃ লিঃ-এর মালিক। ঘরের উত্তর দিকে দেওয়ালের খোলা জানালা দিয়ে সে ওদের দেখল। চারজন বসে ছিল একটা গাছের ছায়ায়। চারজনই বিড়ি টানছিল। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল, আর হাসছিল। ফাল্গনের বেলা প্রায় এগারোটা। বাতাসে যেন একটা ঝোড়ো বেগ। গাছের ডালপালায় ঝর ঝর শব্দ, মাতালের মতো টলছে। মাঝে মাঝে পাতা ঝরছে। কোকিলের পক্ষে যথেষ্ট কারণ থাকলেও, আপাতত যেন অর্থহীন ভাবে ডেকে চলেছে। বুনো কুল ঝোপে প্রমত্ত চড়ুইয়ের ঝক। তাদের কিচিরমিচিরের সঙ্গে দোয়েলের শিস। উত্তরের দিকে, জমির অনেকটা অংশে ছড়িয়ে আছে পেপার মিলের নীলচে রাবিশ। ঘেঁস আর ছাই। ধুলো উড়ছে। রাবিশ ঘেঁস ছাই ভরা জমির পরেই জল। কোথাও বেশি, কোথাও নয়ানজুলির মতো ফালি রেখা, ভাঙা আয়নার মতো। পুবে রেল লাইন। পশ্চিমে বড় রাস্তা। জলের ধারে ধারে, জলজ গুল্ম, বিষকাটারির ঝাড়, নানা রকম আবর্জনা ছড়ানো। পশ্চিম ঘেঁষে, শিমুল গাছটার অনেকখানি চোখে পড়ে। নিষ্পত্র, আর কাটা ডালপালায় লাল ফুলগুলো বাতাসে মেতে ঝাপটাচ্ছে। সাবারবান লাইনে, আপ আর ডাউনে প্রায়ই ইলেকট্রিক কোচ ট্রেন যাতায়াত করছে। ঘর ঝাঁপিয়ে শব্দ ভেসে আসছে। ঘর মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, বড় রাস্তার মালবাহী ভারী ট্রাকের যাতায়াতে। সাইকেল রিকশার পাতিহাঁস প্যাক প্যাক কখনও থামে না।

টালির চাল, পাঁচ ইঞ্চি দেওয়াল বড় ঘরটার মধ্যে মেশিন অয়েলের গন্ধ ছাপিয়েও, কমজলের পাক আর জলজ গুল্মের গন্ধ ছড়াচ্ছে। দক্ষিণ থেকে মাঝে মাঝে ডালের সম্বরা বা তেল-ঝালের ঝাঁজালো ব্যঞ্জনের গন্ধও ভেসে আসছে। পুব দিকের দুটো বড় দরজাই খোলা। গোটানো রয়েছে কোলাপসিবল গেট। অনেকখানি জায়গা টিনের শেড দিয়ে ঢাকা। দুটো টুল, কয়েক টুকরো পুরনো ওয়াটার প্রুফ। সাইকেল রিকশার টায়ার গোটা দুয়েক ছড়ানো। সাধারণ সাইকেলের টায়ার না, রিকশার টায়ার। ভারী শক্ত, সিক্স প্লাই টায়ার। টিনের শেড ঢাকা জমির পরেও কিছুটা খোলা জমির ওপরে বাগান করার একটা চেষ্টা চোখে পড়ে। শীতের গাঁদার শুকনো ঝাড় এখনও বর্তমান। কিছু বেলফুল গাছ, যাদের বাড়। থমকে গিয়েছে। পানাগুলোর গায়ে ধুলো। জল পায় না, চর‍্যা নেই দেখলে বোঝা যায়। লতানে উঁইয়ের ঝাড় শুকনো। কাঠিসার, শীর্ণ। কিন্তু এই ফাল্গুনেও চালকুমড়োর মাচা সবুজ নধর ডগায় পল্লবিত। এবং কাছাকাছি পুঁইমাচায় পুঁইয়ের কচি ডগা লতিয়ে উঠেছে। কয়েকটা মানকচুর গাছ। তবে ধুলোর আস্তরণ সবকিছুতেই। এক দিকে রেল লাইন। আর এক দিকে যান চলাচলের রাস্তা। ধুলো নিবারণ অসম্ভব।

সমস্ত জায়গাটিকে ঘিরে আছে বাখারির বেড়া। বেড়ার পুবে ঢালু জমির বুকে বনগাঁদার ঝাড়। নীচে কচুরিপানা, দু-এক জায়গায় টুকরো আয়নার মতো জল। রেল কোম্পানির জমি। তারপরে অনেকটা উঁচুতে, রেল লাইন। দুটো আপ আর ডাউন, মেন লাইন। দুটো সাবারবান লাইন। ইলেকট্রিক পোস্ট, আর তারের হিজিবিজি আকাশ জুড়ে।

দেবনাথ ডাইস মেশিনের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। ড্রিল মেশিনটা ডান হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। যেন লোহার ডাণ্ডা ধরে আছে, চোয়াল শক্ত করে। বড় কালো দু চোখে ক্রুর দৃষ্টি। শুয়োপোকা ভুরু জোড়া কোঁচকানো। অথচ মোটা ঠোঁট জোড়ায় ব্যঙ্গের হাসি। আসলে ব্যঙ্গ না, জ্বলুনি। ওর চোখে যতটা রাগ, ততটাই অস্থিরতা। শক্ত মুঠিতে চেপে ধরা ড্রিল মেশিনটা লোহার না হলে, ভেঙে যেত। মুঠি কাঁপছে। জানে, ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, উত্তরের গাছতলার ওরা ওকে দেখতে পাচ্ছে না। ওরা বিড়ি টানছে, কথা বলছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ওরা হাসছে যেন কোনও পরোয়া নেই। নিশ্চয়ই দেবনাথকে নিয়েই কিছু বলছে আর হাসছে। ও দাতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করল, বেইমান। বেইমানের দল। আমাকে ট্রেড ইউনিয়ন করা দেখাচ্ছে। দেবনাথ দত্তকে, অ্যাঁ? শ্রমিক আন্দোলন? রেভলিশন? কিন্তু রিমেমবার, ইউ বেগারস-ননা, ইউ আর নট প্রোলেটারিয়েট। তোরা ভিখিরির দল, ভিখিরি কখনও রিয়্যাল শ্রমিক আন্দোলন করে না। আই অ্যাম দেবনাথ দত্ত, ডি. ডি, ডোন্ট ফরগেট, আই ওয়াজ এ কমিউনিস্ট। স্বাধীন ভারতে জেল খেটেছি। আমি শ্রমিক আন্দোলন করেছি–আন্দোলন আর বিপ্লব কাকে বলে, আমি জানি। তোরা জানিস না। তোরা ভিখিরি, উঞ্ছ, আর মস্তান। তোরা রাজনীতি জানিস না। লড়াই করার কায়দা কৌশল জানিস না, সংগঠন করতে জানিস না। লাই পাওয়া কুকুর তোরা, আমাকে আন্দোলন দেখাচ্ছিস?

দেবনাথ ড্রিল মেশিনটা টেবিলের এক দিকে ছুঁড়ে দিল। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে পুবের দেওয়ালের দিকে তাকাল। লেনিনের রঙিন ছবি, কাঁচে বাঁধানো ঝুলছে। সেই গোঁফ দাড়ি, মাথায় টাক, খোঁচা ভুরু আর তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল চোখ। গলার সাদা কারে লাল নেকটাই, কালো কোট। ব্যাকগ্রাউন্ডে রেডফ্ল্যাগ। দেবনাথের মনে হল, লেনিন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ দেখলেই বোঝ যায়, হাসছেন। দেবনাথও হাসল। ওর তামাটে মুখে লাল ঝলক দেখা দিল। মনে মনে বলল, গাড়লগুলো ভুলে গেছে, লেনিনের ছবিটা আমি টাঙিয়েছি। আমিই ওদের লেনিনের কথা বলেছি– লেনিনের সর্বহারা বিপ্লবের কথা, আমিই বলেছি। ওরা হাঁ করে শুনেছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি কিছুই। আমি যেন ওদের রূপকথা শুনিয়েছি। রূপকথা, অ্যাঁ? বিপ্লব রূপকথা? কিছুই বুঝিসনি, হাঁ করে শুনেছিস। শ্রমিক কৃষক, কমিউনিজম, সংগঠন–রূপকথা? উনি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন–ইয়েস–এই আমার মতোই আর সর্বহারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমি কি বলেছি, আমি সর্বহারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দেব? বলিনি, কিন্তু অল গাড়ল, আমার ক্লাস ক্যারেকটার বুঝতে পারেনি। আমি আসলে বিপ্লবীদেরই সঙ্গী, আই অ্যাম এ ন্যাশনাল বুর্জোয়া শেষপর্যন্ত আমি বিপ্লবীদেরই সঙ্গী থাকব–এটা আমার ক্লাস ক্যারেকটার। বাট অ্যাট দ্য সেম টাইম–আই ওয়াজ এ কমিউনিস্ট। নেই, মেম্বারশিপ নেই, সো? আমার একটা পাস্ট আছে, ডোন্ট ফরগেট। আই লিভ, মিনস ইউ লিভ, এটাই আমাদের সম্পর্ক। আমি বিগ বুর্জোয়া নই। আমি ওয়ার্কার্সদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলি। আমি তোদের নিয়ে বাঁচি, তোরা আমাকে নিয়ে বাঁচিস। তবু আমি মালিক, কিন্তু একজন পুরনো কমিউনিস্ট দিস ইজ এ কোয়ালিটিটিভ চেঞ্জগুণগত পরিবর্তন। আমি একটা চশমখোর অর্ডিনারি বিজনেসম্যান নই। আমি টাকা ঢেলেছি, কাজ জানি, কাজ বুঝি। তোরা কাজ করছিস, মজুরি পাচ্ছিস। আমি না থাকলে, তোরা কোথায় আছিস। হ্যাঁ, তোরাও আছিস আমার জন্যে, মাল বানাচ্ছিস, ঠিক যা পাওনা, তাই পাচ্ছিস। তোরা জানিস, মুনাফা কত হয়। এটা তো সহজ কথা, আমি মাল জোগাচ্ছি, তা দিয়ে তোরা আর এক মাল তৈরি করছিস, বাজারে বিকোচ্ছে। মুনাফার টাকা তো আমার–আর সেই টাকা দিয়ে, দত্ত ম্যানুফ্যাকচারার্সকে আরও বড় করে তুলতে হবে, বেকার সমস্যার সমাধান করতে হবে–এটা হচ্ছে ন্যাশনাল বুর্জোয়ার কাজ। বাট য়ু অল গাড়লস। তোরা আমাকে টাইট দিতে চাইছিস, লোভী কুকুরের মতো, আরও বেশি টাকা চাইছিস। মজুরি বাড়াবার একটা নিয়ম আছে–তোরা জানিস না। মালের দাম আর বিক্রির সঙ্গেই সেটা বাঁধা, তার এক চুল এদিক ওদিক হবে না। কিন্তু তোরা কী ভেবেছিস। ভেবেছিস, যত খুশি তাংড়ে নিবি। আর আজকাল যারা ট্রেড ইউনিয়নের নামে, আখের গোছাবার জন্য মামদোবাজি করছে, তাদের কাছে ছুটছিস। সবাই মিলে একটা সংস্থাকে ধ্বংস করতে চাইছিস। কিন্তু পারবি না। আমি ডি ডি, আমার একটা পাস্ট আছে। লোকাল লিডারদের সঙ্গে আমার আঁতাত বেশি। তারা জানে, আমি কী। তারা বোঝে, আমার বিজনেসের কী অবস্থা, তারা আমার সঙ্গেই থাকবে। আর তোদের বদলে, আমি নতুন লোক কাজে লাগাব। তবু, আমি তোদের বোঝাব বোঝাবার চেষ্টা করব। না যদি বুঝিস–

দেবনাথ স্বগতোক্তি থামিয়ে, লেনিনের চোখের দিকে তাকিয়ে, হেসে মাথা ঝাঁকাল। সোজা হয়ে দাঁড়াল, অনেকটা সামরিক ভঙ্গিতে। উচ্চারণ করল, কমরেড! ওরা বোঝে না।’….

এ সময়ে মেয়েলি স্বরের খিলখিল হাসি ভেসে এল। দেবনাথের হাসিমুখ আবার শক্ত হয়ে উঠল। ফুলে উঠল নাকের পাটা। ভুরু কুঁচকে তাকাল পুবের খোলা দরজা দিয়ে। সেখানে কেউ নেই। ওর চোখে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। উত্তরে খোলা জানালার দিকে তাকাল। চার জন বসে আছে। একই রকম ভাবে কথা বলছে, আর হাসছে। দেবনাথ দক্ষিণ দিকে তাকাল। ওই দিকে আর একটা ঘর। অফিস ঘর। হাসিটা ভেসে এল দক্ষিণ দিক থেকেই। চেনা হাসি। কার সঙ্গে রঙ্গ, আর এই রঙ্গিণী হাসি? দেবনাথ দাতে দাঁত পিষে অস্ফুটে উচ্চারণ করল, উইচ!

পুবের খোলা দরজা দিয়ে বাতাস আসছে। দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো, এক হাসকুটি রূপসী মেয়ের মুখের ছবি ক্যালেন্ডার উড়ছে। একটা না, দেওয়ালের তিনটে ক্যালেন্ডারেই তিনটি মেয়ের ছবি। তার মধ্যে এক জনের আবার বুকে কোনও আবরণ নেই। সবগুলোই বাতাসের ঝাপটায় ওলটপালট খাচ্ছে। দু-চার জায়গায় ছিঁড়েও গিয়েছে। ওই শয়তানগুলোই ক্যালেন্ডারের ছবিগুলো টাঙিয়েছে। ক্যালেন্ডার দেখার দরকার হয় না। মেয়েদের ছবিগুলো দেখে, আর নিজেদের মধ্যে রসিয়ে মশকরা করে। দেবনাথ অনেক দিন দেখেছে। এই ওদের রুচি। আর এ ঘরে দেবনাথ লেনিনের ছবি টাঙিয়েছে। যে ছবিটার দিকে ওরা কখনও তাকায় না। কিন্তু হঠাৎ ওরা সংগ্রামী হয়ে উঠেছে। মেটিরিয়েলের দাম যখন হু হু করে চড়ছে, খরচা বাড়ছে, তখনই বায়না তুলেছে, মজুরি বাড়াতে হবে। ছেলের হাতের মোয়া! শয়তান ভর করেছে ওদের মাথায়। আর সেই শয়তানটা কে, দেবনাথ ভালই জানে।

খিলখিল হাসি শুনে দেবনাথ পুবের খোলা দরজার দিকে পা বাড়াল। কয়েক পা গিয়ে থমকে দাঁড়াল। সবুজ রঙের বিজলি ট্রেন, দরজায় দরজায় উপছে পড়া যাত্রী নিয়ে খট খট শব্দে বেরিয়ে গেল। দেবনাথ চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, লেট দ্য উইচ লাফ। আর কত দিন? বিয়ে? সে-গুড়ে বালি। দিনকে দিন ছেনালিপনা যে রকম বাড়ছে, কোন দিন পেট খসাতেই পালিয়ে যেতে হবে।’… কথাটা শেষ করেই, হঠাৎ যেন সামনে কারোকে দেখে থমকে গেল। আসলে কেউ-ই সামনে এসে দাঁড়ায়নি। দেবনাথের চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়েই ও থমকে গেল। বিব্রত দেখাল ওকে। একটা ঢোক গিলে মুখ নিচু করল। কল্পিত সেই মুখের দিকে যেন তাকিয়ে থাকতে পারল না। বিড়বিড় করে বলল, তা-তো আমি কী করব? আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমার ভাল লাগে –ওইরকম ধিঙ্গিপনা, তাও ওই ইতরগুলোর সঙ্গে।

দেবনাথের চোখ পড়ল স্বস্তিক চিহ্নের ওপরে। পুবের দেওয়ালে, সিমেন্ট বাঁধানো মেঝে থেকে কয়েক ফুট ওপরে, মেটে সিঁদুরে আঁকা স্বস্তিক চিহ্ন। গত বিশ্বকর্মা পুজোর সময় আঁকা হয়েছিল। ওখানেই পুজো হয়েছিল। প্রত্যেক বছরই হয়। বিশ্বকর্মা পুজোয় দেবনাথ দরাজ হাতে খরচ করে। আর ওই একটা দিন শয়তানগুলো যদি বেইমান না হত, অন্তত ওই দিনের একটা কারণেই দেবনাথের কাছে ওদের মুণ্ডু নামিয়ে রাখা উচিত। ওই দিন, ও সকলের সঙ্গে রাত্রে মদ খায়। দিশি টিশি না, বিলিতি মদ। নিজের খরচে খাওয়ায়, নিজেও ওদের সঙ্গে বসে বসে খায়। কোনও কারখানার মালিক তা করে? করে না। দেবনাথ করে কেন? না, সে হতে পারে মালিক। কিন্তু সে একজন পুরনো দিনের। লড়াকু ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, সংগ্রামী কমিউনিস্ট। সে জেল খেটেছে। সে কি তোদের খালি সামান্য মজুর মনে করে? তা হলে তো দেবনাথ তোদের কাছে, সাহেব স্যার বা বাবু হত। দেবনাথদা বা দেবুদা হত না। ওই রমেশ মিত্তিরের মতো কারখানার মালিক হত যে তার কাজের লোকেদের কুকুর বেড়ালের মতো দেখে। খিস্তি আর গালাগালি করে। তবু সবাই রমেশ মিত্তিরকে ভয় পায়। ওইরকম লোক ওদের দরকার। কিন্তু দেবনাথ তা হতে পারে না। ওর একটা পাস্ট আছে। ও কখনও চাকরি করেনি। কলেজে পড়তে পড়তেই, পার্টিতে ঢুকেছিল। মজুরদের সংগঠিত করেছে। বস্তিতে বস্তিতে ঘুরেছে। আন্দোলন করেছে। কেন? ওর কি কোনও অভাব ছিল? ও কি গরিবের বাড়ির ছেলে ছিল? মোটেই না। ও আদর্শের জন্য লড়েছে। পার্টি যখন বেআইনি ছিল, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল, আর সেখান থেকে লড়াই করেছে। হতে পারে, আজ ও একটা কারখানা করেছে। কিন্তু বিপ্লবী মনটা তো রয়েছে। সে জন্যই ও কোনও দিন রমেশ মিত্তির হতে পারেনি। কারখানার মজুরদের সঙ্গে ওর দাদা-ভাই সম্পর্ক। আর, কাল কা যোগী–ওই ওঁচার দল, ওকে মজুরি বাড়াবার আন্দোলন দেখাতে এসেছে।

দেবনাথ ট্রাউজারের পকেট থেকে স্যাঁকা তামাকের সিগারেটের প্যাকেট বের করল। হিপ পকেট থেকে গ্যাসলাইটার বের করে সিগারেট জ্বালল। পশ্চিমের দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো কোরা বডি দুটোর দিকে তাকাল। কোরা কাপড় বলতে যে রকম বোঝায়, সেই রকম। নতুন। কোরা বডি হল, সাইকেল রিকশার কাঠের আসল বডি। তুন–আসলে যার নাম ঘোড়া নিমের কাঠ। কাঠ চেরাইয়ের কারখানা থেকে তৈরি হয়ে আসে এই কোরা বডি। কোরা বডি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে মোড়া হয়। দুটো কোরা বডির কাছেই পড়ে আছে, চটের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের ডাই করা শিট। রয়েছে টিনের পাতও। টিনের পাত দিয়ে মুড়লে খরচ কম। তবে কোরা বডি অ্যালুমিনিয়ামের পাত দিয়েই মুড়তে হয়। না হলে, টিনে জং ধরে চেহারা খারাপ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। পা রাখবার জায়গাটা অবিশ্যি বেশির ভাগ টিনের পাত দিয়েই মোড়া হয়। সে রকম অর্ডার পেলে, অ্যালুমিনিয়ামেও মোড়া যায়। ফ্যানসি রিকশার অর্ডার পেলে তো কথাই নেই। রবার ক্লথও পেতে দিতে হয়। সব ভঁই হয়ে পড়ে আছে। দুটো কোরা বডি ছাড়াও রয়েছে, একটা মাল-টানা রিকশার কাঠের পাটাতন। আর একটা কাঠের পাটাতন রয়েছে, স্কুলের রিকশা ভ্যানের জন্য। কলকাতার বাইরে আজকাল বিস্তর ইংলিশ মিডিয়ামের কে জি স্কুলের ছড়াছড়ি। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাবার জন্য পালকির মতো রিকশা ভ্যান চালু হয়েছে। পুরোপুরি চারটি মালের অর্ডার রয়েছে। দুটো রিকশা। তার মধ্যে একটা ফ্যানসি। যাবে সোনারপুর, এক বিড়ির কারখানার মালিকের কাছে।

দেবনাথ সিগারেট টানতে টানতে, দেওয়ালে আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পাতলা পিতলের পাতগুলো সোনার মতো ঝকঝক করছে। একটা পাতের ওপর পেখম খোলা ময়ুর আঁকা। আর কয়েকটা ফুল। রঙিন রেকসিনের টুকরো। লাল নীল পুঁতি। এ সবই রিকশার গায়ে ডেকরেশানের জন্য। ফ্যানসি রিকশা যাকে বলে। মাথার ওপরে হুডের ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ের সঙ্গে, লটকে দেওয়া হয় রঙিন কাপড়ের ঝালর। রঙিন কার্পেট দিয়ে মোড়া হয় বসবার সিট। পিতলের পাত কেটে রিকশা মালিকের নামও লিখে দেবার অর্ডার থাকে। কাতান পড়ে আছে এক পাশে। পিতলের পাত কাটার ধারালো কাতান।

দেবনাথ সরে এসে তাকাল বাখারিগুলোর দিকে। সবে মাত্র আলকাতরা মাখানো হয়েছে। বাঁশের বাখারি দিয়েই তৈরি হয় হুডের খোল। তৈরি করে গ্রামের বিশেষ এক শ্রেণীর কারিগর। বাখারির ওপরে ওয়াটারপ্রুফ কাপড় পেরেক মেরে লাগানো হয়। দুটো রিকশার বাখারি সেট, চারটে চেসিস, সব জায়গায় জায়গায় পাকার হয়ে পড়ে আছে। দু রকমের চেসিস। অর্ডিনারি রিকশার এক রকম। মাল ভ্যান আর ইস্কুল ভ্যানের আর এক রকম। এগুলো একটু বেশি ভারী, চওড়া।

কী নেই? যাবতীয় মাল পড়ে আছে। সাত দিন আগে দেবনাথ কলকাতা থেকে এই সব মাল কিনে এনেছে। বেন্টিংক স্ট্রিট আর বাগরি মার্কেট চষে বেড়িয়ে, টেম্পোতে করে নগদ দামে মাল কিনে এনেছে। রেট পাইকেরি। কারবার নগদ ছাড়া নেই। রেকসিন, ফোম, কার্পেট। সিটের চট, ছোবড়া, স্পঞ্জ। স্পঞ্জের দরকার হয় গোঁজা দিতে। চটের ভিতর ছোবড়া ভরে, স্পঞ্জের গোঁজা দিয়ে সেলাই। তার ওপরে খরিদ্দারের অর্ডার মাফিক রেকসিন, ফোম কিংবা প্লাস্টিক। অবিশ্যি আজকাল প্লাস্টিক অচল হয়ে যাচ্ছে। পাতলা রেকসিনে মোড়া সিক্স প্লাই টায়ার টিউব একপাশে জড়ো করা। স্পোক লাগানো রিম। নতুন, ঝকঝক করছে। অ্যাকসেল, হেভি ডিউটি চেন। সাধারণ সাইকেলের চেন না। রঙের কৌটো, ব্ল্যাক জাপান, আর সিলভার। বাখারিতে রুপোলি ডোরা আঁকা হবে। আর রকমারি হাতল। অনেক তার নাম। বাবু বডি, ডিম বডি, মধুমতী, গঙ্গা-যমুনা। গঙ্গা-যমুনা সবথেকে বড়। হেভি স্প্রিং, যার ওপর গোটা বডি দাঁড়িয়ে থাকে।

দেবনাথ সিগারেট টানতে টানতে, ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগল। নিকেল আর পিতলের মাডগার্ড, হ্যাঁন্ডেল, চালকের সিট, ওয়াশার, ল্যাম্প ব্রাকেট, ব্রেক সেট, গিয়ার, প্যাডেল, জাম নাট, সব থরে থরে সাজানো পড়ে আছে। ধুলো জমছে। গত সাত দিন কাজ বন্ধ। ইতিমধ্যে আরও একটা রিকশার অর্ডার এসেছিল। দেবনাথ নিতে সাহস পায়নি। চারটে মালের অর্ডার, গলার কাঁটা হয়ে বিধে আছে। মেটেরিয়েল পড়ে আছে, কাজ হচ্ছে না। আজ পর্যন্ত খদ্দেরদের কাছ থেকে কখনও আগাম টাকা নেয়নি। সেটা একটা ভাগ্য। ও ঠিক চালিয়ে নিয়েছে। আগাম নেওয়া মানেই, নিজেকে বাঁধা রাখা। মাল পুরোপুরি রেডি করব। চালিয়ে দেখে নাও। পুরো পেমেন্ট কর। ক্যাশ দাও, চেনাশোনা পার্টি হলে, চেকও চলতে পারে। কিন্তু ধারে কারবার নেই। অথচ এই স্তৃপাকার মাল পড়ে আছে। পড়ে থাকা মানে, মরে থাকা। অল ডেড’–দেবনাথের ভাষায়। প্রত্যেকটি পার্টস অ্যাসেমবলড হবে, গাড়ি তৈরি হয়ে যাবে। তখন একটা সচল জিনিস গড়ে উঠবে। প্রাণ পাবে। এই সব ছোট বড় সব মেটেরিয়েল, মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো। জুড়ে দাও, গেঁথে দাও, পোশাক জড়াও। ফিনিশড মাল, জীবন্ত আর চলমান একটা প্রাণীর মতো।

দেবনাথ ঘরে দক্ষিণের কোণে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের দৃষ্টি অন্যমনস্ক। ও প্রথম প্রথম ফুরনে কাজ করাত। সব কাজেই, আলাদা আলাদা মিস্তিরি, মজুর। রোজ কাজ, রোজ টাকা। ফুরনের চুক্তি মতো কাজ শেষ করো। টাকা নিয়ে চলে যাও। কোনও উদ্বেগ নেই, অস্বস্তি নেই, ঝামেলা নেই। দত্ত ম্যানুফ্যাকচারার্সের হাতে অর্ডার নেই। কাজও নেই। তুমি মিস্তিরি হও, বেকার বসে থাক। দেবনাথের সঙ্গে কোনও দেওয়া নেওয়া নেই। ঝাড়া হাত পা।

এককালে–শুরুতে, এইভাবেই কাজ করে দেবনাথ ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিল। কাজে ফাঁকি ছিল না। কাজে ফাঁকি এখনও নেই। যার যেমন অর্ডার, ঠিক সেই রকম ডেলিভারি। খদ্দের খুশি। বাজারে সুনাম এমনি হয়নি। কিন্তু কবে এক সময় থেকে মাথায় ভূত চাপল ফুরনে আর কাজ নয়। রোজের হিসাব যোগ করে, মাস মাইনে চালু করেছিল। স্বপ্নও দেখেছিল, রিকশা তৈরির কারখানা ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে মোটর মেরামতের কারখানা। রিকশা যত বাড়ছিল, কলকাতার বাইরে এইসব শিল্পাঞ্চলে মোটর গাড়িও তত বাড়ছিল। এক দিকে রিকশা আর রিকশা ভ্যান তৈরি হবে। আর এক দিকে মোটর মেরামতি কারখানা। নামও ভেবে রেখেছিল। ডাট অটোমোবিলস অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স। রোজের টাকা, হপ্তার টাকা, কেমন যেন ছোটখাটো, শোনাত। বড় কারখানার মতো, মাস মাইনে চালু করতে না পারলে কেমন যেন ছোটখাটো, পাতি ব্যবসার মতো মনে হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, মাস মাইনে মানেই রোজের তুলনায় কিছু কম হবেই। কাজ না থাকলেও মাইনে গুনতে হবে। হপ্তায় এক দিন ছুটি দিতে হবে। পূজা পালপার্বণেও ছুটি। রোজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায় না। রমেশ মিত্তির চালাক লোক। সে কখনও ফুরনে ছাড়া কাজ করে না। একটা বডি করতে যা রেট তাই পাবে। আট ঘণ্টার জায়গায় দশ ঘণ্টা খাটো। বারো ঘণ্টা খাটো। চার ঘণ্টাই খাটো না। কাজ পাওয়া নিয়ে কথা। কাজ শেষ, বাজিয়ে দেখে নেয়। টাকা নিয়ে চলে যাও।

দেবনাথ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে, মেঝেয় ফেলল। চপ্পল দিয়ে চেপে দিল। দু হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠল। শিরাগুলো ফুলে উঠল। স্বপ্ন–অ্য, স্বপ্ন দেখেছিল ও বড় কারখানার মতো সব ব্যবস্থা চালু করবে? তার সঙ্গে আবার মোটর মেরামতির কারখানা। কলকাতার বড় বড় কোম্পানির মতো গ্যারাজ। কোম্পানি অ্যাক্ট মাফিক বিজনেস করবে। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড দেবে, গ্র্যাচুয়িটি দেবে। স্বপ্ন, অ্যাঁ? ওই সব বিশ্বাসঘাতকদের দল নিয়ে।

আবার সেই খিলখিল হাসি ভেসে এল। দেবনাথ পুবের খোলা দরজার দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সরে গিয়ে, উত্তরের খোলা জানালার দিকে তাকাল। গাছতলায় সেই চার জন বসে আছে। কথা বলছে, হাসছে। বাকি চার জন কাছে পিঠেই কোথাও আছে নিশ্চয়। পাহারা দিচ্ছে। যেন ফুরনের মিস্তিরি-মজুরদের ডেকে কাজ চালু করা না যায়।

একটা আপ ট্রেন ঝম ঝম শব্দে বেরিয়ে গেল। দেবনাথ আবার একটা সিগারেট ধরাল। কার সঙ্গে এই রঙ্গ আর রঙ্গিণী হাসি হচ্ছে? বাঘের মতো চাপা গরগর শব্দে উচ্চারণ করল, ওই বুক পাছা নাচানো গতর একদিন কুকুরেরা ছিঁড়ে খাবে। হ্যাঁ, কতগুলো ঘেয়ো উপোসি কুকুর। তার আগে, আমি…।

দেবনাথের স্বর ডুবে গেল। যেন সামনে কারোকে দেখে, আচমকা ভয়ে আর লজ্জায় থতিয়ে গেল। অথচ সামনে কেউ নেই। ও নিজেই মার খাওয়া কুকুরের মতো, ডাইস মেশিন টেবিলটার কাছে সরে গেল। ফিসফিস করে বলল, আমার মাথার ঠিক নেই। রাগের চোটে মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে পড়েছে। সত্যি, মাইরি’…ও কাপুরুষের মতো চাটুকারের হাসি হাসল।

পুবের খোলা দরজা দিয়ে জোড়া প্রজাপতি ঢুকল ঘরের মধ্যে। একটার পিছনে আর একটা যেন জুড়ে গিয়েছে। দেবনাথ দেখল। জাম রং ঢাকাই জামদানির আঁচলের নকশার মতো পতঙ্গ দুটোর রং। কী চায় ওরা এখানে? বাতাসের ঝাপটায় ঢুকে পড়েছে। প্রায়ই এ রকম ঢোকে। ও দেখল, প্রজাপতি দুটো অস্থির পাখায় উড়ে, পিতলের মাডগার্ডের ওপরে চকিতের জন্য বসল। আবার উড়ল। সিক্স প্লাই টায়ারগুলোর গায়ে পাখা ছুঁইয়ে, উড়ে গেল ব্ল্যাক জাপানি রঙের কৌটোর মুখে। আবার উড়ল। স্তূপাকার সব মেটেরিয়াল পার্টসের গায়ে পাখা ছুঁইয়ে, উড়ে গেল উত্তরের জানালার কাছে। বেরিয়ে গেল জানালার বাইরে। রাস্তা দিয়ে গর্জন করে বাস চলে যাচ্ছে। সহিসের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এ ঘরটা কাঁপছে, দেবনাথের চোখে আবার অন্যমনস্কতা নেমে এল। ঠোঁটে চেপে ধরা সিগারেট কাঁপছে। ও ডাইস মেশিন টেবিলের কাছ থেকে সরে এসে, ঘরের চারদিকে পাকার মেটেরিয়াল পার্টসগুলোর দিকে দেখতে লাগল। ডেড’! মনে মনে বলল। মুখটা আবার শক্ত হল। এখন নিজের আঙুলগুলো চিবিয়ে ছিঁড়ে খেলেও, শোধরাবার উপায় নেই। ফুরনের মিস্তিরি মজুরদের ডেকে এনে, কাজ করানো যাবে না। অথচ শুরুতে, ফুরনের কাজ করিয়েই, ও ভাল লাভ করেছে। আরও সাত কাঠা জমি কিনেছে। নিজের আলাদা বাড়ি করেছে।

এখান থেকে, পশ্চিমে, মাইলখানেক দূরে দেবনাথের পৈতৃক বাড়ি। বাড়ি বাগান পুকুর, সব মিলিয়ে বিঘে খানেক জমি। ওর দাদাদের ধারণা ছিল, ও চিরকাল রাজনীতি করবে। ধারণার কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল, দেবনাথ একটা বোকা উল্লুক। অবিশ্যি পার্টিও তাই ভাবত। জেল থেকে বেরিয়ে ও লোকাল কমিটির মেম্বার হতে পারবে ভেবেছিল। লোকাল কমিটি থেকে এক দিন জেলা কমিটিতে যাবে, কল্পনা করত। তারপর পার্টির নমিমেশন পেয়ে এম. এল. এ। ক্ষমতায় যেতে পারলে অন্তত রাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু লোকাল কমিটিতেই যেতে পারেনি। বরং পার্টি চেয়েছিল, ও একজন সাধারণ সদস্যই থাকবে। শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করবে। পার্টি সংগঠন বাড়িয়ে তুলবে। উনপঞ্চাশের যত ভুলের আবর্জনা সাফ করে, নতুন নীতি আর কৌশলে পার্টিকে চাঙা করে তুলতে হবে। অথচ ভিতরে ভিতরে পার্টির নীতি আর কৌশল নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেবনাথ দেখছিল, ওর বয়স পেরিয়ে গিয়েছে তিরিশ। পাটি ওকে মোটেই তেমন আমল দিচ্ছিল না। দেবার কোনও কারণও ছিল না। ওর সে যোগ্যতা ছিল না। থাকলে, ও নিজেই নিজের আসন পাকা করে নিতে পারত। উলটে, ওকে সবাই কেমন ঠাণ্ডা-কঁধ ধাক্কা দিচ্ছিল। বিশেষ করে, যখন লোকাল কমিটিতে দাঁড়াতে চেয়েছিল। ও ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছিল। পার্টি থেকে সরে এসেছিল আস্তে আস্তে। জেলে থাকতেই বাবা মারা। গিয়েছিলেন। দাদা বউদিরা করুণা করত। রোজগার ছিল না। বিয়ে করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, করতে পারছিল না। কিন্তু প্রেম করছিল।

পূর্ববঙ্গের দেশ ছাড়া মেয়ে সুমতি। দেবনাথের পাড়ায়, একটা বিশাল পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল গোটা কয়েক মধ্যবিত্ত পরিবার। জবর দখল বাড়ি। তার মধ্যে এক পরিবার, হরমোহন চক্রবর্তী। এক ছেলে চটকলে মিস্তিরির চাকরি জোগাড় করতে পেরেছিল। আর এক ছেলে রেলের ওয়াগান লুটে হাত পাকিয়েছিল। সংসারেও কিছু টাকাপয়সা দিত। বৃদ্ধ হরমোহন সারা দিন ঘরে বসে থাকতেন। আর স্ত্রীর গঞ্জনায় ভুগতেন। দুই ছেলের পর দুই মেয়ে। বড় সুমতি। ছোট মিনতি। দেবনাথ সুমতিকে প্রথম যখন দেখেছিল, তখন ওর বয়স কুড়ি-একুশ। মিনতি অনেক ছোট, দশ-বাবোর বেশি। ছিল না।

সুমতির রং ফরসা, একটু দোহারা গড়ন। ডাগর কালো চোখ, নাকটিও নেহাত বোঁচা ছিল না। পুষ্ট ঠোঁট দুটিতে কেমন মিটমিটে হাসি লেগেই থাকত। এক মাথা চুল, স্বাস্থ্যটি উজ্জ্বল। একটু বা উদ্ধতই। এমন মেয়ের প্রেমিকের অভাব ছিল না। অনেক ছেলেই ঘুরঘুর করত। দেবনাথও ঘুরঘুর করত। সুমতি দেখেশুনে, দেবনাথকেই প্রশ্রয় দিয়েছিল বেশি। সুমতির মাও দেবনাথকে বেশি খাতির করতেন। সুমতিই প্রথম দেবনাথকে জীবন আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন করেছিল। দেবনাথ কি চিরকাল দাদাদের ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকবে নাকি? ও সব রাজনীতি করার কথা চিন্তা করে কী লাভ? চাকরি জুটছে না? ব্যবসা তো করা যায়। টাকা? দেবনাথ যদি কোনও ব্যবসার কথা ভাবে, তা হলে বাড়ির। নিজের অংশ বিক্রি করে দিয়ে টাকা জোগাড় করতে পারে।

সুমতিই প্রথম মন্ত্রণা দিয়েছিল। বাড়ির অংশ বিক্রি করে দিলে, তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছাড়তে হবে? ছাড়বে। সুমতিদের সঙ্গেই কোনও রকমে মাথা গুঁজে থাকবে। না থাকতে চাইলে, একটা এক ঘরের ছোট বাসা ভাড়া নিলেই হবে। ব্যবসা করে দাঁড়াতে পারলে, ভবিষ্যতে সবকিছুই মিলবে। দেবনাথ রমেশ মিত্তিরের রিকশা তৈরির কারখানা দেখেছিল। কাজ কারবারের ধাঁচ, লাভ-লোকসান, সব খতিয়ে দেখেছিল। সুমতিকে বলেছিল। সুমতি এক কথায় সায় দিয়েছিল, লেগে পড়ো।’

দেবনাথ লেগে পড়েছিল। শহরে চেনাশোনা কারবারি বন্ধুর অভাব ছিল না। রমেশ মিত্তিরের শত্রুরও অভাব ছিল না। ভাল কারবার। লাগাতে পারলে, জমে যাবে। একলা রমেশ মিত্তির কেন রিকশা ম্যানুফ্যাকচার করবে। সিদ্ধান্ত নিয়েই, আগে বড় রাস্তা আর রেল লাইনের ধারে এ জায়গা দেখা হয়েছিল। দেবনাথ বাড়ির অংশ বিক্রি করবে শুনে দাদারা ফাঁপরে পড়েছিল। ভেবেছিল, বোকাটার মাথায় এ পোকা কে ঢোকাল? নিশ্চয়ই ওই বাঙাল বামুনদের মেয়েটা? দেখতে শুনতে ভাল, চালাক চতুর বুদ্ধিমতী মেয়ে। মেয়ের মন্ত্রণা, বড় সাংঘাতিক মন্ত্রণা। দাদারা ঝটিতি সিদ্ধান্ত নিয়ে, নিজেরাই দেবনাথের অংশ কিনে নিয়েছিল। মূল্য দিয়েছিল তিরিশ হাজার টাকা। টাকা পেয়েই প্রথম একটি বাসা ভাড়া। তারপরে সুমতিকে বিয়ে। বিয়ের পরেই জমি কিনে, প্রথম এই ঘর তোলা হয়েছিল। বছর না। ঘুরতেই, ব্যবসার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখা দিয়েছিল। দু বছরে, লাগোয়া দক্ষিণের ঘরটা তুলেছিল। এখন যেটা অফিস। আসলে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে, সুমতিকে নিয়ে ওই দক্ষিণের ঘরেই উঠেছিল। একটা ঘর, একটা স্যানিটারি প্রিভি, লাগোয়া চানের ঘর।

বারো বছরের মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। দেবনাথ আরও জমি কিনেছে। দক্ষিণে আলাদা। বাড়ি করেছে। কারখানার সঙ্গে দু কাঠা ফারাক রেখে। ইতিমধ্যে সুমতির বাবা মার স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে গিয়েছে। দাদারা যে যার মতো। মিনতিকে সুমতি নিজের কাছে এনে রেখেছে। সব দিকেই উন্নতি হয়েছে। ফাঁক থেকে গিয়েছে একটা জায়গা। সুমতির কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। ওকে দেখলে, এখনও সেই কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ের মতোই মনে হয়। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে সমীহ করার মতো ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধি দিয়েছে। কেবল সংসারের দায়িত্বই তুলে নেয়নি। দেবনাথের ব্যবসারও সে উপদেষ্টা। টাকা পয়সার চুলচেরা হিসাব তার কাছে। গহনাগাঁটি পরার শখ নেই। কিন্তু গড়িয়ে জমা করার ঝোঁক আছে। সাজগোজের ঠাটবাট নেই। জীবনে কোনও দিন কুঁচিয়ে শাড়ি পরেনি। তা সে যত দামের শাড়িই হোক, আটপৌরে ধরনের সজ্জা বজায় রেখেছে। বই পড়ার বাতিক আছে। মাঝে মধ্যে সিনেমা থিয়েটার দেখতে যায়। তাও খুব কম। তার ব্যক্তিত্বের কাছে, দেবনাথ খাটো মাপের মানুষ। সুমতিকে ও মান্য করে। মনে মনে ভয়ও পায়। একমাত্র মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে, মেজাজ খারাপ থাকলে, যা মুখে আসে, সুমতিকে তা-ই বলে। সুমতি তখন একটা কথাও বলে না। তারপরেও বলে না। কারণ দেবনাথই খোয়ারি কাটবার পরে, সুমতির কাছে মাথা নিচু করে যায়। ল্যাজ নাড়ার ভঙ্গিতে, চাটুবাক্যে মান ভাঙাবার চেষ্টা করে। সুমতি ছেলে ভোলানোর মতো হেসে বলে, ন্যাকামি যথেষ্ট হয়েছে। যাও, অনেক কাজ পড়ে আছে, কাজ করোগে। এখন থেকে বেশি ওই ছাইপাঁশ গিললে, বোতলগুলো সব ভেঙেচুরে দেব, তারপরে যে দিকে দুচোখ যায়, চলে যাব।

চলে যাবার কথাটা সুমতি অনেক বারই বলেছে। যায়নি। কিন্তু দেবনাথ মোটেই সুমতির কথাটাকে কথা মনে করে না। মনে ভয় থেকেই যায়, সুমতি যদি সত্যি চলে যাবে বলে স্থির করে ওকে আটকানো কঠিন হবে। সে জন্য ও মাথা নত করে জোড় হাতে বলে, আর যাই কর, আমাকে ফেলে চলে যেয়ো না। আমি ধনে প্রাণে মারা যাব।

সুমতি ছেলেমানুষকে আদর করার মতো, দেবনাথের গালে ঠোনা মারে, এত যদি ভয় মদ খেয়ে বীরত্ব কেন? যাও, কাজ করো গে।

দেবনাথ বুকে ভরসা আর বল পায়। মিনতি সুমতির বিপরীত। রংটা তেমন ফরসা না। লজ্জা একটু বেশি। দেখতেও সুমতির থেকে রূপসী। কথায় কথায় হাসি, যাকে বলে ঢলানি। যত সাজগোজের বহর, তত বাইরের হাতছানি। পারলে বোধ হয় রোজই সিনেমা দেখে। মিনতির বেলায় সুমতি সবসময় দরাজ। সুমতির মতো দিদি কী করে মিনতিকে প্রশ্রয় দেয়, দেবনাথের মাথায় ঢোকে না। কারখানার মিস্তিরি মজুরদের ও বউদি। সবাই ওকে সমীহ করে। কেউ কোনও রকম বেচাল করে না। সুমতিও সকলের সঙ্গে, আপনজনের মতো হেসে কথা বলে। মাঝে মাঝেই এটাসেটা করে খাওয়ায়। যেন একটা বড় পরিবারের নিপুণা গৃহকত্রী। ওর আচরণে কোথাও বিন্দুমাত্র বেচাল নেই। বরং দেবনাথের সামনে ওরা যেটুকু বা হাসি ঠাট্টা করে, সুমতিকে দেখলে মুখে একেবারে কুলুপকাটি। আর সুমতি একটু হাসলে, ওরা গলে যায়। অথচ বেচালই যার চাল, সেই মিনতিকে সুমতি একটা কড়া কথা বলে না। কোনও বিষয়ে বাধা দেয় না। বরং প্রশ্রয়টাই চোখে পড়ে। দেবনাথ নিজেও কি মিনতির প্রতি একটু দুর্বল না? আসলে পুরুষ হিসাবে, ও মানুষটাই দুর্বল। মনে করে, মিনতির ওপর ওর একটা অধিকার আছে। মিনতি যখন অন্য পুরুষের সঙ্গে হেসে ঢলে কথা বলে, ওর বুকে জ্বালা ধরে। ওর সঙ্গে বললে, খুশি হয়। মিনতি তো ওরই আশ্রিতা। ওরটাই খায় পরে। অতএব, মিনতির ওপর এক এক সময় ওর আকর্ষণ যখন দুর্নিবার হয়ে ওঠে, একটা অন্ধ আবেগে বুকে চেপে পিষ্ট করতে ইচ্ছা করে। আর সেটা গোপন করার ক্ষমতাও ওর থাকে না। এবং আশ্চর্য, সুমতি সেইসব মুহূর্তে, একটা অলৌকিক দৈবের মতো আবির্ভূত হয়। সুমতি মুখে কিছুই বলে না। কেবল কঠিন অপলক চোখে দেবনাথের চোখের দিকে তাকায়। দেবনাথ কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। আরও আশ্চর্য, সুমতি পরে, কোনও সময়েই ওকে সেই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না। বলেও না। ওর ভিতরে থাকে একটা আড়ষ্ট হীনম্মন্যতা। মিশে থাকে ভয়। যে কারণে, মিনতির বিরুদ্ধে সুমতিকে কোনও নালিশ জানাতে পারে না। অন্য আর এক চিন্তা, মিনতি কোনও দিন এ সংসার ছেড়ে চলে যাবে, দেবনাথ মনে প্রাণে তা চায় না।

সাত দিন আগে, সকালবেলা মজুরি বাড়ানোর কথা উঠেছিল। দেবনাথ তার আগের দিন রাত্রেও জানতে পারেনি, শয়তানগুলো এ রকম একটা মতলব ফেঁদেছে। প্রথমে কথাটা শুনে ও অবাক হয়েছিল। তারপরে ভেবেছিল, দেবনাথের সঙ্গে ওরা মজা করছে। দেবনাথ হেসে বলেছিল, কাজের সময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না। অনেক কাজ জমে আছে, কাজে লেগে পড়ো।

আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি করি না, দেবুদা। পালের গোদাটা মুখ গম্ভীর করে বলেছিল, এটা ইয়ার্কির কথাও না। দু-তিন মাস ধরেই ভাবছি কথাটা বলব। ফুরনের হিসেব করেও দেখেছি, আমাদের মাস মাইনে অনেক কম। একটা বডি করলে, একজন মিস্তিরি পায় পনেরো টাকা। আমরা যারা বডি মিস্তিরি, মাস মাইনের হিসেবে একটা বডির জন্য আট-ন’ টাকার বেশি পাই না। অথচ কাজ করি কম করে দশ ঘণ্টা। এভাবে চলতে পারে না। আপনি হিসেব নিয়ে বসুন। মাসে কটা মাল ফিনিশ হয়, আর তার মজুরির পড়তা কী পড়ে, দেখুন।

দেবনাথ শুনছিল, আর ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিল। তারপরে চিৎকার করে উঠেছিল, কিছু দেখব না। ও সব হিসেব টিসেব আমাকে শোনাতে আসিস না। মাইনে বাড়ানো? ছেলের হাতের মোয়া? মামদোবাজি? কী জন্যে মাইনে বাড়াব? আমার লাভ বেড়েছে? কোনও পার্টসের দাম কমেছে?

সবই জানি দেবুদা। পালের গোদাটা বলেছিল, আপনার মাল পিছু লাভ বাড়েনি, কিন্তু কাজ বেড়েছে। মাসে আজকাল কম করে ষোলো-সতেরোটা ফিনিশ মাল তৈরি হচ্ছে। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে আপনার আয় বেড়েছে। একটু আমাদের মুখের দিকেও দেখুন। আমরা আপনার কাছে চেয়ে নিচ্ছি।

দেবনাথ হুংকার দিয়েছিল, চাইলেই দুনিয়ায় সব পাওয়া যায় না। কারোর মুখ দেখবার দরকার নেই। আমার। যা মাইনে পাচ্ছিস, তাতে পোয় কাজ কর, নয় তো চলে যা। মিস্তিরি মজুরের অভাব নেই। আমি ফুরনে কাজ করাব।

তা আমরা করতে দেব না। পালের গোদাটা বেশ শক্ত গলায় বলেছিল, কোনও মিস্তিরি মজুরকে আমরা এ কারখানায় ঢুকতে দেব না। আমাদের কাজ আমরাই করব, মজুরিও বাড়াতে হবে।

দেবনাথের তামাটে মুখ, বড় চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছিল। খানিকটা অবাক সুরেই বলেছিল, ও! আন্দোলন ফলানো হচ্ছে? সংগ্রাম? মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন? দেবনাথ দত্তকে শ্রমিক আন্দোলন দেখানো হচ্ছে? যে শ্রমিক আন্দোলন করে স্বাধীন ভারতে জেল খেটে এসেছে!

সে আপনি কী করেছেন না করেছেন, আপনি জানেন!’ পালের গোদাটা একই কথা বলে যাচ্ছিল, ও সব কথা অনেক বার শুনিয়েছেন। তাতে আমাদের পেট ভরে না। আমরাও মজুর মিস্তিরি মানুষ। চার বছরের মধ্যে আপনি আমাদের একটা পয়সাও মাইনে বাড়াননি। সব জিনিসের দাম বেড়েছে। আমাদের খেয়ে পরে বাঁচতে হবে তো। এই নিন, আমাদের দরখাস্ত। ওতেই লেখা আছে, কার কী হারে মাইনে বাড়াতে হবে।

দেবনাথ ছোঁ মেরে কাগজটা নিয়ে, দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল ঘরের এক কোণে, নিকুচি করেছে। দরখাস্তের। বেরিয়ে যা সব আমার সামনে থেকে। বেরো।

সবথেকে বয়স যার বেশি, মিস্তিরি হারু ফেসো গলায় হেসে উঠেছিল, বেরিয়ে তো যাব গো বাবু। তবে তুমি মজুর আন্দোলন করে জেলে গিছলে, এ বারফটটাই আর কোরো না।

মানে? আমি জেলে যাইনি?’ দেবনাথ ক্ষেপে উঠেছিল।

হারু বলেছিল, গিছলে, কিন্তু তুমি আসলে ও সব কিছু নও বাবু। মজুর আন্দোলন করলে, কেউ এ রকম কথা বলে না। তোমার জেলে যাবার গপপোটা এখন বারফটটাই বলে মনে হয়। তুমি যে কী মাল, সরকার জানলে, তোমাকে জেলে বসিয়ে খাওয়াত না। আমাদের বের করে দিচ্ছ দাও, কিন্তু তোমার দত্ত কোম্পানির কারখানা চলবে না।

দেবনাথ কিছু বলার আগেই, সবাই বেরিয়ে গিয়েছিল। ও দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, বেইমানের দল। ট্রেটারস। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? আমাকে মজুর আন্দোলন দেখাতে এসেছে?’ …ও দরজা জানালাগুলো ধাই ধাই শব্দে বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষেপে উঠলেও ওর চোখে মুখে কেমন একটা বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ছিল। কারণ সমস্ত ব্যাপারটাই ওর কাছে অভূতপূর্ব, অপ্রত্যাশিত ছিল। ভাবতেও। পারেনি, ওরা মাইনে বাড়াবার দাবি করতে পারে। কারখানা অচল করে দেবার ভয় দেখাতে পারে। দরজা জানালা বন্ধ ঘরটার মধ্যে ও খাঁচায় পোরা বাঘের মতো পায়চারি করেছিল। তারপরে হঠাৎ মনে পড়তেই, দলামোচড়া দরখাস্তটা ঘরের কোণ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল। খুলে পড়েছিল। দাবিপত্র না, আবেদন, সকলেরই পঁচিশ ভাগ করে মাইনে বাড়ানো হোক। পঁচিশ ভাগ! মামদোবাজি? ও আবার কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সুমতির কাছে গিয়েছিল। সুমতি তখন গ্যাসের উনোনে সকালের জলখাবার তৈরি করছিল। দেবনাথ বলেছিল, তুমি কিছু শুনেছ, ওই হারামজাদাদের কথা?

কোন হারামজাদা?’ সুমতি অবাক চোখে তাকিয়েছিল।

দেবনাথ কারখানার দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলেছিল, ওই মিস্তিরি মজুরদের কথা?

এরা আবার হারামজাদা হল কবে থেকে? সুমতি গ্যাস উনোনের কড়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হাসি রাগ বিস্ময়, কিছুই ছিল না ওর মুখে। এমনকী জিজ্ঞাসাও। তবু জিজ্ঞেস করেছিল, কী করেছে ওরা?’

দেবনাথ বলেছিল, ওরা পঁচিশ পারসেন্ট মাইনে বেশি দাবি করছে। আর ভয় দেখিয়েছে, কারখানা অচল করে দেবে, কোনও ফুরনের মজুরি মিস্তিরিদের ঢুকতে দেবে না। এত সাহস ওদের?

তা তুমি কী বললে? সুমতি মুখ না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল।

দেবনাথ কঠিন স্বরে বলেছিল, কী আবার? বলে দিয়েছি, এক পয়সাও মাইনে বাড়াব না।’

হাত ধুয়ে খেতে বসো।সুমতি বলেছিল, জলখাবার হয়ে গেছে।

 রান্নাঘরের পাশেই খাবার ঘর। দেবনাথ খাবার ঘরের বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলেছিল, আমি ঠিক বলিনি?

সুমতি খাবার টেবিলে গরম পরোটা আর আলুর হেঁচকি বেড়ে দিয়েছিল। হেসে বলেছিল, আমি কি এ সবের ঠিক বেঠিক কিছু বুঝি নাকি? তুমি যা ঠিক ভেবেছ, বলেছ।

দেবনাথও হেসেছিল। ধরেই নিয়েছিল, সুমতি ওর কথাই ঠিক বলে মেনে নিয়েছিল। খাবার খেতে খেতে বলেছিল, আমার জেল খাটা নিয়ে, ওই বুড়ো হারুটা কী বলছিল, জানো? বলছিল, ও কথা বলে নাকি আমি বারফটটাই করি। কত বড় সাহস! আমাকে মজুর আন্দোলন দেখাতে এসেছে?

 মিনু খেতে আয়। সুমতি মিনতিকে ডেকেছিল। ওই প্রসঙ্গে আর কোনও কথা বলেনি।

.

দেবনাথ আবার খিলখিল হাসি শুনতে পেল। ওর চোয়াল শক্ত হল। পুবের দরজা দুটো বন্ধ করে, অফিস ঘরে গেল। একটা বড় টেবিল। গোটা কয়েক চেয়ার। ওর নিজের চেয়ারটা গদি আঁটা। টেবিলের ওপর কিছু কাগজ ফাইল। রবার কোম্পানির ছাইদানি। একটা প্লাস্টিকের বাটিতে কিছু নাট বল্ট, একটা ব্লেড। পূর্ব দিকের বন্ধ দরজার মাথার ওপরে মাটির গণেশের মূর্তি। পশ্চিম দিকে, বড় রাস্তায় যাবার দরজাটাও বন্ধ। দক্ষিণের দরজা খোলা। দরজার কাছ থেকে চার ফুট ইট বাঁধানো রাস্তা, বসত বাড়ির পিছনের বারান্দা পর্যন্ত গিয়েছে। প্রায় দুকাঠা খোলা জমির ওপরে আসল বাগান। সুমতির হাতে তৈরি বাগান। চার ফুট ইটের রাস্তার দুপাশে, কলা গাছ থেকে নারকেল গাছের চারা। লেবু জবা শিউলি। বেল টগর জুই অপরাজিতা। পশ্চিমের বড় রাস্তার দিকে উঁচু পাঁচিল। পুব দিকেও পাঁচিল আছে, বসত বাড়ির আবরু রক্ষার জন্য।

দেবনাথ দক্ষিণের দরজা দিয়ে বাইরে গেল। একতলা বাড়ির তিন দিকেই ছাদ ঢাকা বারান্দা। গ্রিল দিয়ে বারান্দা ঘেরা। বসত বাড়িতে ঢোকবার রাস্তা দক্ষিণ দিকে। এ বাড়ির সীমানা পেরিয়ে, দক্ষিণ দিকে অন্য একজনের পাঁচিল ঘেরা বড় বাগান।

দেবনাথ বাড়ির দিকে তাকাল। বাড়ির পিছন দিকে বাথরুম, রান্নাঘর। সেপটিক ট্যাঙ্কও পিছন দিকে। সুমতি বোধ হয় রান্নাঘরে। দেবনাথ বাগানের পুব দিকে গেল। দক্ষিণ দিকে দেখল। যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। বাড়ির দক্ষিণে, পুব দিকে পাঁচিলের ধারে বড় একটা আমগাছ। আমগাছ সহই জমিটা কেনা হয়েছিল। আম গাছের নীচে বসে ছিল হারু আর ফটিক। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে মিনতি। মাথার চুল খোলা, বাতাসে উড়ছে। শাড়ির আঁচল গাছকোমরে জড়ানো। ও রকম জড়ানোর অর্থ একটাই। সরু কটি, চওড়া নিতম্ব, মেদহীন পেটের ওপরে বুক জোড়া আরও স্পষ্ট আর উদ্ধত করে তোলা। দেবনাথের এটাই বিশ্বাস। আর ওই ফটিক, কারখানার পালের গোদা। খুব সাধারণ মোটা কাপড়ের কালো ট্রাউজার। আর বুক খোলা, বগল ঘেঁড়া একটা নীল রঙের হাওয়াই শার্ট গায়ে। লম্বা প্রায় ছ ফুটের মতো। রোগা কিন্তু শক্ত চেহারা। এক মাথা রুক্ষ চুল। কালো চোখ দুটো ঝকঝকে। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হলেও, আর এক জোড়া মোটা গোঁফ থাকা সত্ত্বেও, মুখে এখনও একটা কোমল ভাব আছে। মেয়েদের মতো টিকোলো নাক। চিবুকে একটা সরু খাঁজ।

শুয়োরের বাচ্ছা! দেবনাথ চোয়াল শক্ত করে মনে মনে বলল। এই ফটিক পাঁচ বছর আগে, ওর রিকশা চালাত। হ্যাঁ, দেবনাথের চারটি রিকশা ভাড়া খাটে। আজকাল প্রত্যেক রিকশার জন্য, মালিকের রোজ পাওনা চার টাকা। পাঁচ বছর আগে ছিল আড়াই টাকা। ফটিক চাকি ভদ্রলোকের বাড়ির গরিব ছেলে। থার্ড ডিভিশনে স্কুল ফাইনাল পাস করেছিল। পাঁচ বছর আগে, দেবনাথের রিকশা চালাতে এসেছিল। রোজের টাকা পাবার জন্য ছেলেটার পিছনে পিছনে ঘুরতে হত না। অন্য রিকশাওয়ালাদের পিছনে যেমন ঘুরতে হয়। অধিকাংশই জুয়াড়ি আর মদখোর হয় রিকশাটানারা। ফটিকের সে সব দোষ ছিল না। আজকাল অবিশ্যি মাঝে মধ্যে খায়, তবে লুকিয়ে। কেবল বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, দেবনাথ নিজেই খাওয়ায়। তখন ফটিকের চেহারা ছিল আরও রোগা। চোখের কোলে কালি। গোটা চেহারায় আর মুখে অনাহারের ছাপ। ছেলেটার ওপর দেবনাথের মায়া পড়ে গিয়েছিল। মাস দুয়েক রিকশা চালাবার পর, ও নিজেই ফটিককে বলেছিল, রিকশা না টেনে, রিকশা বানাবার কাজ শেখো। মজুরিও বেশি পাবে, রিকশা টানার ধকলও সইতে হবে না। আফটার অল, তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, লেখাপড়াও শিখেছ।’…সেই থেকে ফটিক রিকশা তৈরিতে লেগেছিল। হাত পাকিয়েছিল বডি মিস্তিরি হিসাবে। এখন ওর মত ভাল বডি মিস্তিরি এ তল্লাটে নেই। ফটিককে কারখানার কাজে লাগানোয়, সুমতিও খুশি হয়েছিল। ফটিককে সে স্নেহ করে। রমেশ মিত্তির ফটিককে অনেক টোপ দিয়েছে, নিজের কারখানায় নিয়ে যাবার জন্য। ফটিক যায়নি। ফটিক কেবল বডি মিস্তিরি না। বারো ঘণ্টার মধ্যে একটা পুরো রিকশা তৈরি করতে পারে একাই। ফ্যানসি রিকশার বডিতে, পিতলের নকশা আঁকতে, কাটতে, জুড়তেও ওর জুড়ি নেই। হারুও ভাল বডি মিস্তিরি। ডাইস থেকে ড্রিল মেশিনের সব কাজ করতে জানে।

ফটিক কিছু বলছিল। হারু বিড়ি টানতে টানতে হাসছিল। মিনতি ফটিকের কথা শুনেই, খিলখিল করে হেসে উঠছিল। ছেনালি। তা ছাড়া আর কী? মিস্তিরি মজুরদের সঙ্গে ওভাবে হেসে কথা বলার মানে কী? বিশেষ করে, যারা ওর ভগ্নিপতির সঙ্গে শত্রুতা করছে, তাদের সঙ্গে এখনও ওইভাবে হাসি-গল্প? দেবনাথের মোটেই পছন্দ না, ফটিকরা বসতবাড়ির সীমানার মধ্যে আসে। বরাবরই আসে, উঠোনে বসে। প্রয়োজনে, ঘরের ভিতরেও যায়। বিশেষ করে ফটিক। অনেকটা বাড়ির ছেলের মতোই, তা বলে এখনও আসবে? মাইনে বাড়াবার জন্য যারা দেবনাথের বিরুদ্ধে লড়ছে, কাজ বন্ধ। করে সর্বনাশ করছে, খরিদ্দারদের কাছে ওকে অপদস্থ করছে, তারা বাড়ির উঠোনে বসে গল্প করবে? ওর শালির সঙ্গে মজাকি করবে? আর শালিও ওই রকম ঢলানিপনা চালাবে? সুমতির কি কিছু মনে হয় না? বোনকে কিছু বলতে পারে না। ওই শুয়োরগুলোকে বাড়ির সীমানা থেকে তাড়িতে দিতে পারে না?

দেবনাথ দাতে দাঁত পেষে, আর মনে মনে অবাক হয়। সুমতি ওদের কিছু বলে না। বরং যে রকম হেসে কথা বলে, সে রকমই বলে। যেন কারখানায় ধর্মঘটের ব্যাপারটা সুমতির কাছে কোনও ঘটনাই না। এ বিষয়ে একটা কথাও দেবনাথের সঙ্গে বলে না। দেবনাথ বললে, চুপচাপ কেবল শুনে যায়। ও কি বুঝতে পারছে না, দেবনাথের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে? সাত দিন হয়ে গেল, একটাও মাল তৈরি হয়নি। নতুন অর্ডার নিতে পারছে না। যে সব খরিদ্দার অর্ডার দিয়েছে, তারা কদিন চুপ করে থাকবে? দেবনাথ অ্যাডভান্স নেয় না বটে। খরিদ্দাররা মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। কিন্তু সরে পড়লে, তাদের আর আটকানো যাবে না। আর এই সর্বনেশে হারামজাদাগুলো বাড়ির উঠোনে বসে হাসি মশকরা করছে। সুমতি তেলেভাজা মুড়ি চা করে খাওয়ায়নি তো? যে রকম মাঝে-মধ্যে খাইয়ে থাকে? স্বামীর শত্রুদের এতটা খাতির নিশ্চয়ই করবে না।

দেবনাথকে দেখামাত্রই, মিনতি হাসি থামিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। ফটিক আর হারুও কথা হাসি থামিয়ে চুপ করে গেল। মিনতি পিছন ফিরে প্রায় ছুটেই চলে গেল বাড়ির মধ্যে। দেবনাথ শক্ত মুখে, শুয়োলোকা ভুরু কুঁচকে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এগিয়ে গেল পাঁচিলের ধারে আমগাছের দিকে। বাতাসে গাছের ডালপালায় ঝরঝর শব্দ। ধুলো উড়ছে। কোকিলটা কোথায় কোন গাছ থেকে। ডেকেই চলেছে। দেবনাথ গাছতলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘৃণা মেশানো রাগী চোখে তাকাল ফটিক। আর হারুর দিকে। হারু বিড়িটা ফেলে দিল। ফটিক দেবনাথের দিকে তাকাল। দেবনাথ ডান হাতের তর্জনী তুলে দুজনকে দেখিয়ে বলল, ইউ টু-মাই এনিমি।’

বাংলায় বলুন না।’ ফটিক নির্বিকার মুখে বলল।

দেবনাথের মুখ রাগে আরও চওড়া হয়ে উঠল, জানি, মূর্খেরা ইংরেজি বোঝে না। আমি চাইনে, আমার শত্রুরা আমার বাড়ির উঠোনে এসে বসবে। গেট আউট, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। আমার বাড়ি আর কারখানার ত্রিসীমানায় আমি তোদের মুখ দেখতে চাইনে।

খুব তো তড়পাচ্ছেন, আর তাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফটিক ঝেঝে বলল, তাড়িয়ে দিচ্ছেন, চলে যাচ্ছি। আমাদের বকেয়া মাইনেটা মিটিয়ে দিন।

দেবনাথের চোখে একটু আশার আলো ফুটল। কিন্তু সেটা ওদের জানতে দিতে চাইল না। বলল, তা মিটিয়ে দিচ্ছি, আজ এখনই দিচ্ছি। কারখানার সঙ্গে তোরা আর সম্পর্ক রাখবি না তো? একেবারে ছেড়ে চলে যাবি তো?

তাই কখনও যাই নাকি?’ ফটিক হাসল, আপনি ভাবছেন, আমরা একেবারে ছেড়ে চলে যাব, আর আপনি অন্য লোক এনে ফুরনে কাজ করাবেন? তা আমরা হতে দেব না।

দেবনাথ পা তুলে মাটিতে লাথি মারল, কারখানা কি তোদের বাপের সম্পত্তি না কি?

বাপ তুলে গাল দিচ্ছেন?’ ফটিক হাসল, কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টি কঠিন, না, কারখানা আমাদের বাপের নয়, আপনারই। কিন্তু কাজ তো করি আমরাই। মাল বানাই আমরা। কাল তো শাসিয়েছিলেন, পুলিশ ডেকে ফুরনে কাজ করাবেন। তা পুলিশ ডাকলেন না কেন? ফুরনে কাজ করালেন না কেন?

দেবনাথ হুমকে উঠল, সে কৈফিয়ত তোদের দিতে হবে নাকি?

দরকার নেই।’ ফটিক বলল, শাসিয়েছিলেন, তাই বললাম। তবে কোনও মিস্তিরি মজুরই আপনার কারখানায় কাজ করতে আসবে না। মনে রাখবেন, তাঁরা আমাদের বন্ধু, আপনার নয়। যাক গে, বকেয়া মাইনেটা কি আজই মিটিয়ে দেবেন?

দেবনাথ সজোরে ঘাড় নাড়ল, না, দেব না। কাজ বন্ধ রেখে, বকেয়া মাইনে চাইছিস? ইউ অল বেইমানের দল! একটা পয়সাও দেব না। নাউ গেট আউট।

চলো হারুদা। ফটিক উত্তরের দিকে পা বাড়াল। দেবনাথের দিকে তাকাল, আমাদের না খাইয়ে মারছেন। এখনও বলছি, কাজটা ভাল করছেন না। আমরা অন্যায্য কিছু চাইনি। কারখানা লাটে উঠে যাবে, বলে রাখছি।

দেবনাথ মুঠি পাকিয়ে ফটিকের দিকে দু পা এগিয়ে গেল, বেরো এখান থেকে। কারখানা লাটে তুলবি? তোর বাপের কারখানা পেয়েছিস, লাটে তুলবি? মগের মুলুক? বেশি কথা বললে মুখ ভেঙে দেব।

না, ওটা পারবে না বাবু। হারু মিস্তিরি ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, সত্যি তো এটা মগের মুলুক নয়? তুমিই বললে। এত সহজে মুখ ভাঙা যায় নাকি? সত্যি একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ঘরে বসে ভাবো। মিছিমিছি গালাগাল দিয়ো না।’

ফটিক আর হারু, দুজনেই উত্তর দিকে চলে গেল। দেবনাথ ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। বাতাসে যেন কেমন একটা ঝোড়ো বেগ। দক্ষিণের পাঁচিল ঘেরা বাগান থেকে শুকনো পাতা উড়ে আসছে। তার সঙ্গে ধুলো। দেবনাথ ঘুরে, বারান্দার দিকে গেল। কাজের মেয়েটি বেরিয়ে এল এক গোছা সাবান-কাঁচা জামাকাপড় নিয়ে। দেবনাথকে দেখে যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কোনও রকমে পাশ কাটিয়ে উঠোনে নেমে গেল। দেবনাথ সামনের ঘরে ঢুকল। বসবার ঘর। বাঁ দিকে, দুটো শোবার ঘর। বসবার ঘরের পাশে খাবার ঘর। ও সে দিকে গেল। সুমতি রান্নাঘরের ভিতরে রান্না করছে। মিনতিকে দেখা যাচ্ছে না। দেবনাথ রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুমতি পিছন ফিরে বসে রান্না করছে।

আমি ওদের আজ বলে দিয়েছি, ওরা যেন আর আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে। দেবনাথ সুমতির ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল।

সুমতি মুখ না ফিরিয়ে, গ্যাস উনোন থেকে কড়া নামাল। চাবি ঘুরিয়ে, উনোন নিবিয়ে দিল, ও। সে তুমি যা ভাল বুঝেছ করেছ। মিনুর একটা ব্যাপার হয়েছে।’

কী ব্যাপার?’ দেবনাথের ভ্রুকুটি চোখে অনুসন্ধিৎসু কৌতূহল।

 সুমতি দেবনাথের দিকে তাকাল। তার পান খাওয়া ঠোঁটে মৃদু হাসি, ও নাকি ফটিককে ভালবাসে। ফটিকও। ওরা বিয়ে করবে।

হোয়াট?’ দেবনাথ ঘর কাঁপিয়ে গর্জে উঠল, ওই লোচ্চা আমার কারখানার ধর্মঘটী মিস্তিরি, যে একসময় রিকশা চালাত, তোমার বোন তাকে বিয়ে করবে?

সুমতি সামনের ঘটি কাত করে, হাতে ঢালল। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল, তা ওদের যদি ইচ্ছে হয়, তুমি আমি কী করতে পারি?’ সুমতি শান্ত স্বরে বলল, ওরা নিজেদের মতো নিজেরা বিয়ে করবে। আমরা কিছু দিতে যাচ্ছি নে।’

তা বলে, ও রকম একটা লোজ্জা লাফাঙাকে?’ দেবনাথের গলার স্বরে উগ্র ক্রোধ আর বিস্ময়।

সুমতির ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল, লোচ্চা লাফাঙা কি না জানি নে, তবে গরিব। তা মিনু যদি ও রকম গরিব ছেলেকে বিয়ে করতে চায়, আমাদের বলার কী আছে? আমার কোনও আপত্তি নেই।

কিন্তু ও আমাদের শত্রু।’

সেটা তো তোমার কারখানার ব্যাপার। সুমতি আবার একটু হাসল, বিয়ের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? মিনু তো বিয়ে করে এ বাড়িতে থাকবে না।

দেবনাথ সুমতির মুখের দিকে অবাক চোখে তাকাল। কোথায় যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ফটিকের সঙ্গে মিনতির বিয়ে, আর সুমতির কোনও আপত্তি নেই। ভাবা যায়? অথচ সুমতি অনায়াসেই রাজি। দেবনাথ পিছন ফিরতে উদ্যত হল। সুমতি বলল, আর একটা কথা। আমি তো কোথাও কোনও দিন বাইরে যাইনি। ভাবছি, কিছুদিনের জন্য একটু পুরী বেড়াতে যাব। তোমার তো এখন কোনও অসুবিধে নেই। কারখানা বন্ধ।

দেবনাথ অধিকতর অবাক চোখে সুমতির দিকে ফিরে তাকাল, এখন পুরী বেড়াতে যাবে? এই দুঃসময়ে? কারখানা বন্ধ মানে কী? ওরাই তো কারখানা বন্ধ করে রেখেছে, কাজ করছে না। এ সময়ে আমি যাব কেমন করে?’

তা হলে তুমি থাকো।’ সুমতি বলল, মিনুর বিয়ের এখনও দেরি আছে। ওরা রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করবে। আমি আর মিনুই বেড়িয়ে আসি। তুমি ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে পারবে তো?

দেবনাথের মনে হচ্ছিল, ওর মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। ভিতরটা শূন্য। সুমতির শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা দুজন মেয়েছেলে পুরী যাবে? কোনও দিন যাওনি। কোথায় উঠবে, থাকবে।

সে আমরা ঠিক ব্যবস্থা করে নেব।’ সুমতি খুব সহজেই বলল, মেয়েছেলে তো কী? মেয়েরা আজকাল কত কী করছে। ট্রেনে উঠলে, সোজা পুরী গিয়ে নামব। একটা হোটেল দেখে উঠব। তুমি যদি টিকিট কেটে না দিতে পারো, আমি দাদার ছেলেকে বলে ব্যবস্থা করতে পারি।’

দেবনাথ নির্বাক অপলক অবাক চোখে সুমতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল, ওর ভারী মাথাটার মধ্যে, যেন ঢাক বাজছে। এ কি সব অভাবিত কথা। মিনতি বিয়ে করবে ফটিককে। সুমতি এ সময়ে পুরী বেড়াতে যেতে চাইছে। সুমতিও ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেবনাথ কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। সুমতি আবার বলল, বেলা কম হয়নি। চান করতে যাও। আমার রান্না শেষ।

কিন্তু সুমি, তুমি তুমি–মানে টিকিট কেটে দিতে পারি আমি, কিন্তু দেবনাথের চোখে অস্থির অসহায়তা ফুটে উঠল, আমি একটু ভাবি, কেমন?

সুমতি লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘাড় কাত করল, ভাবো। আজকের দিনটা ভাবো।’

দেবনাথ খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে চারদিকে তাকাল। কেউ কোথাও নেই। বাতাসের বেগে ধুলো উড়ছে। পাতা ঝরছে। কোকিলটা ডেকেই চলেছে। দেবনাথ সোজা ওর অফিস ঘরে গেল। পকেট থেকে চাবি বের করে, বড় দেরাজ খুলে রা=এর বোতল বের করল। মুখ খুলে নির্জলা বেশ খানিকটা গলায় ঢেলে দিল। মুখ বিকৃত করে, বোতল রাখল টেবিলের ওপর। সিগারেট ধরাল একটা। গণেশের মূর্তির দিকে এক বার দেখল। আর মনে পড়ল ওর কুষ্টির ছকটার কথা। মনে করতে পারছে না, জ্যোতিষী এ সময়ের কোনও ভবিষ্যৎবাণী করেছিল কি না। ও আবার বোতল তুলে গলায় ঢালল। বিড়বিড় করে বলল, এ সবের মানে কী? আমাকে সবাই ছেড়ে যেতে চাইছে?’ ও ঘন ঘন বোতল তুলে গলায় ঢালতে লাগল, আর খানিকক্ষণের মধ্যেই মাথাটা টেবিলের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

দেবনাথ জানে না, কতক্ষণ টেবিলে মাথা পেতে পড়ে ছিল। মাথায় গায়ে স্পর্শ পেতেই, মুখ তুলে তাকাল সুমতি। সুমতি বলল, এ সময়ে এ সব খেয়েছ কেন? চান করতে যাও।’

দেবনাথ সুমতির নির্বিকার শান্ত মুখের দিকে তাকাল। ওর দু চোখ আর তামাটে মুখ লাল। কিন্তু ক্ষিপ্ততা নেই। প্রায় কোলা ব্যাঙের মতো গলায় বলল, সুমি, পুরী যদি যেতেই হয়, আমিও যাব। তার আগে, আমি একটা হিসেব করে ফেলতে চাই।’

কীসের হিসেব? সুমতির চোখে কুটি জিজ্ঞাসা।

দেবনাথ একই রকম স্বরে বলল, ওদের ওই টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্ট বাড়তি মাইনের হিসেব। কারখানা বন্ধ রেখে আমি, কোথাও যেতে পারব না। তোমাকেও ছাড়তে পারব না।’

ও হিসেব আমি করে রেখেছি। সুমতি শাড়ির আঁচল দিয়ে দেবনাথের ঠোঁটের কষের গাঁজলা মুছিয়ে দিল, মাসে তোমার বাড়তি মাইনে দিতে, আট জনের হিসেবে লাগবে একশো সত্তর টাকার মতো।’

দেবনাথের লাল চোখে অবাক দৃষ্টি, তুমি হিসেব করে ফেলেছ? আমাকে বলনি তো?

তুমি তো জিজ্ঞেস করোনি। সুমতি হাসল।

দেবনাথ সুমতির কোমরে হাত রাখল, এবং হাসল, একশো সত্তরের মতো। সুমি আই উইল পে দ্যাট মানি–আমি তো আর কমিউনিস্ট নেই কিন্তু আমি একজন উদার ন্যাশনাল বুর্জোয়া। লেনিন বলেছেন, ন্যাশনাল বুর্জোয়াদেরও বিপ্লবে একটা অংশ আছে, বুঝলে?

না। সুমতি দেবনাথের মাথার চুলে বিলি কেটে দিল, আমি ও সব বুঝিনে। আমি বুঝি, নিজেদের ক্ষতি না করে, কাজ কারবার শান্তিতে চলুক। ওরাও খুশি থাক, তোমারও যেন লোকসান না হয়। আমি হিসেব করে দেখেছি, একশো সত্তর টাকা মাসে বেশি খরচ করলেও, তোমার লোকসান তেমন কিছু নেই। ফুরনে কাজ করালে, তোমাকে মাসে ষোলোটা মাল তৈরি করতে, চারশো টাকা বেশি খরচ। করতে হত।

দেবনাথ সুমতির কোমর জড়িয়ে, মুখের কাছে টেনে আনল, গড! তুমি এতটাও হিসেব করেছ। ওক্কে, সুমি আমি দেব। দো আই অ্যাম নো মোর এ কমিউনিস্ট, বাট-ইয়ে, মানে দেশের প্রগতিতে আমারও অংশ নিতে হবে। ওদের এখনই।

না, এখন তুমি চান করতে যাবে।’ সুমতির স্বরে স্নেহ মিশ্রিত আদেশ, ওঠো, চলো।

দেবনাথ সুমতিকে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়াল। বলল, কিন্তু সুমি, মিনু যদি ওই ফটিককে বিয়ে করে, আমি ওকে ভায়রাভাই মনে করতে পারব না।

আচ্ছা কোরো না।’ সুমতি হাসল।

দেবনাথ আবার বলল, তা হলে পুরী যাওয়ার দিনটা

ওটা পরে ভাবা যাবে। সুমতি ঘাড়ের ওপর ঢলে পড়া দেবনাথকে নিয়ে দরজার দিকে এগোল। ফাল্গুনের বাতাসে ঝোড়ো বেগ যেন আরও বাড়ছে। ধুলো উড়ছে, পাতা ঝরছে। পাখিটা ডেকেই চলেছে।