ছায়াচারিণী

ছায়াচারিণী

আশা চমকে উঠে বাইরের দিকে তাকাল।

কিন্তু রাস্তা খানিকটা দূরে। বাড়ির উঠোন থেকে দেখা যায় না। তবু শব্দটা বাইরের রাস্তার দিক থেকেই এসেছে। রাংচিতের বেড়া তেমনি অগ্রহায়ণের নতুন বাতাসে দুলছে। প্রজাপতিরা উড়ছে। তাদের বর্ণবাহার পাখায় চমকাচ্ছে রৌদ্রচ্ছটা। এই মন্দিরবহুল তীর্থক্ষেত্র, কোম্পানির আমলের সরু ঘিঞ্জি রাস্তা, পুরনো বড় বড় বাড়ি–সেকেলে বেনে শহরটার সাড়া শব্দ তেমনি ভেসে আসছে এই প্রান্তে। কাপড় কলের বয়লারের শোঁ শোঁ শব্দ তেমনি নিরন্তর যন্ত্রপ্রাণের সাড়া জানাচ্ছে। শহরের এই সীমানায়, যেখানে একদা বাগানবাড়িগুলির তলার ভিত থেকে আলসে পর্যন্ত বার্ধক্যে নাড়া খেয়ে গেছে। অনেককাল, গতায়ু যৌবনের ভাঙা কঙ্কালে শুধু ঘুঘু দম্পতিরাই যেখানে চরে ও বংশবৃদ্ধি করে, যেখানে এখনও কিছু বনবাদাড় মাঠ গেছে উত্তরে ঢালুতে, নদীর সীমানায় একটি প্রায় নিখুঁত গ্রামীণ আবহাওয়ায়, নতুন দু-চারটে বাড়ি ঘিঞ্জি শহরটাকে যেখানে হাঁফ ছাড়বার ডাক দিচ্ছে, সেখানে পুরনো সেই নিম্নবিত্তের ভদ্রলোকদের পাড়াটার প্রত্যহের ঘরে বাইরের হাসি কান্না আড্ডার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে একই রকম। শালিকের স্বভাব-কলহ, চড়ুইয়ের স্বভাব-ঝাঁপাইঝোড়ার কোথাও কোনও ব্যতিক্রম নেই। পাড়ার ধারে, চিরপ্রবহমান ছোট নদীটি নিশ্চয় থমকে নেই। জলের নীচে শ্যাওলার জটা হাত স্রোতের বুকে হাত বাড়িয়ে আছে নিশ্চয় তেমনি পাতাল থেকে।

সবই ঠিক রইল। সকালের সোনা রোদ বেলা দশটায় রইল রুপা রুপা-ই। রাস্তার ওই শব্দটা শুনে শুধু আশার টানা টানা কালো দুটি চোখ চকিত হল। যেন ঘুম ভাঙা চমক, থতিয়ে যাওয়া বিভ্রম, অনেক দিনের প্রতীক্ষা করার একটি আশা নিরাশার সহসা সংশয়ে থমকে গেল। বাঘ কিংবা ব্যাধ অথবা ফিরে আসা হরিণের পায়ের শব্দে সংশয় চমকিতা হরিণীর মতো অদৃশ্য রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আশা উঠোনের মাঝখানে। কুয়ো-পাড় থেকে ধুয়ে নিয়ে আসা বাসনের পাঁজা তার হাতে। বাসি বিনুনির তলায় পুরনো কালো ফিতের ফুপরি বাতাসে উড়ছে সাপের চেরা জিভের মতো। কাল বিকেলে পরা ছোট কুমকুমের ফোঁটাটি এখন কুয়াশা ঢাকা তারার মতো অস্পষ্ট। ওর চোখে না লাগা বাড়ন্ত আঠারোর ছিপছিপে শরীরে দশহাত ডুরে শাড়িটি, গাছকোমরের পুরো পাকের আগেই কষিতে মুখ গুঁজেছে। আসলে ওর আড়ষ্ট শরীরে শাড়ির ডোরাগুলিও যেন থমকে রয়েছে। লাল জামার যে সাদা ফুলগুলি নড়াচড়ায় সবসময় ফোটে, দল মেলে, তারাও নিথর। ওর সাধারণ ঠোঁটের চুপিচুপি খোলার অস্পষ্টতায় ঝকঝকে দাঁতের অসাধারণ মুক্তাদ্যুতি। অতি সাধারণ নাক আর গোটা মুখ জুড়ে অতি সুলভ বড় কালো, ছেলেবেলায় কৃমিকীটে খাওয়া শুধু অসাধারণ স্বপ্ন দেখা ভাবিনী দুটি চোখে, আশা তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে।

আর ওকে দেখে অবাক হল শান্তি, বিরক্তও হল ওর ছত্রিশ বছরের মা রান্নাঘরের দরজায় অধৈর্য অপেক্ষায়। জাকুটি করে জিজ্ঞেস করল, কী হল?

মায়ের দিকে ফিরল না আশা। প্রায় চুপিচুপি বলল, মোটরগাড়ির শব্দ।

মোটরগাড়ির শব্দ? অ্যানিমিয়া-আক্রান্ত সাদা চোখে ও সকালের খাওয়া পানের পিক-শুকনো ঠোঁটে বিরক্ত রাগ হয়ে দেখা দিল মায়ের। রুষ্ট সন্দিগ্ধ চোখে মেয়ের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, মোটরগাড়ির শব্দ তো কী হয়েছে?

এতেই আশার সংবিৎ ফেরা উচিত ছিল। কিন্তু ফিরল না। প্রায় তেমনি করেই বলল, এ রাস্তায় তো আর গাড়ি যায় না আজকাল?

ছত্রিশ বছরের শান্তি ছেষট্টির মতো রুক্ষ ঝংকার দিয়ে উঠল, আর যায় না, আজ যাচ্ছে, তাতে হলটা কী, অ্যাঁ?

এ বার আর এক বার চমকাল আশা। এক চমকে সে কয়েক মুহূর্ত আড়ষ্ট হয়েছিল। সে যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। বেমানান হয়েছিল এখানে। আর এক চমকে সে এখানে ফিরে এল। মিশে গেল, সারা শরীর ত্রস্ত সুরে কথা বলে উঠল নিঃশব্দে। গায়ের ডোরাগুলি কিলবিলিয়ে উঠল। এস্তে নড়ে ওঠা সাপের মতো বেণীটা ছিটকে গেল এক দিক থেকে আর এক দিকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে এক ছুট্টে সে রান্নাঘরে।

শান্তি টেনে বলল, ঢং! ছেলেদের ইস্কুলের ভাত নিয়ে বসে আছি, বেড়ে দেবার জায়গা পাচ্ছিনে। বাসনের গোছা হাতে নিয়ে ও মোটরগাড়ির শব্দ শুনছে। যেন একেবারে কী শুনছে! শাঁখ বাজিয়ে টোপর মাথায় দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসছে নাকি কেউ?

মায়ের বিদ্রুপে আশা অপ্রতিভ হল না। কেমন একটি হাসি ওর ঠোঁটের কোণে চুপি চুপি লুটিয়ে পড়ে রইল। বাসনের জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, সত্যি, এমন চমকে গেছি!

ক্লাস সেভেনে পড়া চোদ্দো বছরের ক্ষয়টে ভাই শ্যাম ওর চুলের আলবোটে আলগোছে আঙুল ঠেকিয়ে বলল বুড়োটে গম্ভীর গলায়, তুই ভাবলি তোর বর আসছে, না?

রাগ করল না আশা। ভাইকে ভ্যাংচাল একটু জিভ বার করে একটু বা কপট রাগের ভাব দেখিয়ে।

আর আট বছরের রাম বলল, ফটিকদা, মোটরগাড়ি নিয়ে আসছে তুই ভেবেছিস না?

মুখ গম্ভীর করল আশা। কিন্তু চুপিচুপি হাসিটা চুপিচুপিই বোধ হয় রাগের ছদ্মবেশে ছড়িয়ে রইল ওর কটাসে মুখের চকিত রক্তাভায়। মনে মনে বলল, অসভ্য।

শান্তি ভাত বেড়ে ধমক দিল, এই চুপ করে ভাত খেয়ে ইস্কুলে বেরো শিগগির।

তবু ছেলেদের সামনেই ঠোঁট উলটে শান্তি না বলে পারল না, লোহাকলের মস্ত চাকুরে ফটিক বাঁড়ুজ্জেই এ বার আসবে মোটর হাঁকিয়ে, হুঁ!

লোহাকলের সামান্য চাকুরে বলেই এ বিদ্রূপ, না কি আঠারোর গলার কাঁটাটার যন্ত্রণা মায়ের, বোঝা গেল না। যদিও অনেক অস্বস্তি এবং লজ্জার বিষয় ছিল কথায়, তবু মা এখন রেগে গেছে, এ ছাড়া ভাববার কিছু নেই। আশা উঠে পড়ে বলল, মা আমি চান করতে যাচ্ছি।

শান্তি তীক্ষ্ণ গলায় এক রাশ ঝাঁজ ছুঁড়ে দিল, দশ ঘণ্টা জলে হুড়ে এস না যেন। আর নদীতে যেতে পথেঘাটে বেলেল্লাপনাটাও একটু কম করো।

বাইরে এসে যেন মাকে ক্ষমা করে হাসল একটু আশা। পথেঘাটে বেলেল্লাপনা কিছু করে না সে। আসলে অন্য কথাই বলতে চেয়েছে মা। মুখ ফুটে সেটা বলতে পারে না। যে কথাটি এখন এ পাড়ার চাকের মুখে মধু জুটিয়েছে।

রাম আবার বলল, দিদিটার আজকাল খুব ঢং হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে মায়ের একটি চাটি পড়ল তার মাথায়। বলল, তোকে এ সব পাকা পাকা কথা কে বলতে বলেছে রে হারামজাদা। খেয়ে ইস্কুলে বেরো তাড়াতাড়ি।

এক বিনুনি বুকের ওপর টেনে রাংচিতের বেড়াটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আশা।

.

বিনুনি খুলতে খুলতে তাকাল রাস্তার দিকে। রাস্তাটা দেখা যায় না। শুধু সরু গলি-পথটা কয়েকটি বড় বাড়ির মাঝখান দিয়ে বুকে হাঁটা সাপের মতো চলে গেছে। মোটরগাড়ির শব্দটা আর নেই। তবু আশার মনে হল, শব্দটা তার কানে লেগে রয়েছে।

এমনও হয়। মানুষের মনটা বুঝি এমনি। কত মোটরগাড়ির শব্দ শুনেছে আশা তার জীবনে। কিন্তু আজকের শব্দটা কেমন এক রকম করে যেন তার কানে বাজল। এমন চমকে দিলে! যেন সে কোনও দিন মোটরের শব্দ শোনেনি। ওইটুকু সময়ের মধ্যে, কয়েকটা মুহূর্তে, সে চমকে গেল, থতিয়ে গেল, হাসি পেল, তবু ভয় পেল আবার দুঃখ হতে লাগল। এতগুলি অনুভূতির সমাবেশ যে হয়েছে কয়েক লহমায়, সেটাও তার নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। মা তো বিরক্ত হবেই। অমন করে কেউ চমকায় শুধু শুধু?

হেসে ফেলল আশা। সেলাই মেশিনের দ্রুত ছুঁচের মতো তার আঙুল বেণীর বন্ধনে বন্ধনে ওঠা-পড়া করতে লাগল আর নিটুট বেণীটা খুলে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চুলের গোছা। যেন নিজেকেই ঠাট্টা করে দুষ্টু হেসে রাস্তাটার দিকে তাকাল আশা।

অগ্রহায়ণের রোদে কী মায়া লেগেছে রাংচিতের গাঢ় সবুজ পাতায় পাতায় কে জানে। দু-তিনটে প্রজাপতি অস্থির পাখায় উড়ছে বসছে, উড়ছে। মৌমাছির মতো ওরা ফুলের খোঁজে বেড়ায় না। কিংবা ভোমরার মতো। খালি পাতায় পাতায় ফেরে। যার যাতে টান। কচি পাতা খায় প্রজাপতিরা, ফুলের রেণু খায়। উঠোনের উত্তরে কাঁটাগাছের পাতাগুলি যেন কান খাড়া করে আছে। কৃষ্ণকলির ঝাড়ে কাল সন্ধেয় ফোঁটা ফুলগুলি দিনের আলোয় গেছে শুকিয়ে। সূর্য-পত্নী ছায়ার মতো প্রতীক্ষা বা ওদের, কখন সে পৃথিবী পরিক্রমা করে ফিরে আসবে। অদৃশ্য সূর্য-প্রেয়সী ছায়ার ওরাই বুঝি নিঃশব্দ বহিঃপ্রকাশ।

আড় চোখে রান্নাঘরের দিকে এক বার লক্ষ করে ঠোঁট টিপে তেমনি হাসল আশা। কিন্তু একটু কুটি করে। নিজেকেই যেন কপট সুরে ধমকাল, ও আবার কেমন ভুতুড়ে চমকানো? মাঝখান থেকে বকুনি খেয়ে মরতে হল। না হয় ও রাস্তায় মোটর যায় না। এক সময়ে করাত কলে ছোট লোহার কারখানায় মোটর যেত ওই রাস্তাতেই। তারপর যুদ্ধের সময় থেকে, রেল স্টেশন থেকে নতুন রাস্তা হয়ে ইস্তক, এটা বাতিল হয়ে গেছে। পুরনো সদর এখন অন্দর। দুপাশে ঘন বুনো কুল খেজুর আর বনশিউলির ঝাড়ে ভরে গেছে। রাস্তার ওপরেও ঝাঁপ খেয়ে পড়েছে। পুবে পশ্চিমে রাস্তাটার উত্তরে নদী। এখনও ও রাস্তায় গোরুর গাড়ি যায়। কাছেই নদীর ওপর পুল। ওপারের গ্রাম থেকে পুল পেরিয়ে শহরে ঢোকার এইটিই সংক্ষিপ্ত পথ। সাইকেল রিকশা গোরুর গাড়ি যাওয়া আসা করে। কিন্তু মোটরগাড়ি আর যায় না। এ পাড়ায় আগে ঘন ঘন গাড়ির শব্দ শোনা যেত। এখন আর শোনা যায় না।

না-ই বা গেল। বাড়ি থেকে দু পা বাড়ালেই যে শব্দে কান পাতা দায়, সেই শব্দ শুনে এমন চমকায় কেউ কখনও। এ যেন অলৌকিক, ভয় ধরানো খারাপ বাতাস লাগা থমকানি। জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখার মতো। যে স্বপ্নের কোনও স্মৃতি নেই, অস্পষ্ট, কুহেলিকা। হাসি পায় অস্বস্তিও হয়।

মানুষের এক-একটা ব্যাপার কেমন হয়ে যায়। তার জন্যে অমন বকুনি খেতেই হয়। মাঝখান থেকে শ্যামটা ফোড়ন কাটলে। সেটা এমন কিছু নয়। রামটা আরও পাজি। ফটিকদার নামটা বলে মা’কে আরও রাগিয়ে দিলে। যে নামটা যে কোনও সময় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। রাগাতে পারে, হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রূপ করতে পারে। একটা নাম কত কী করতে পারে। সেই নাম ধরে বাঁশি বাজানোর মতো, গুরুজনের মাঝে বড় ভয়। যে নাম শর হয়ে বেঁধে, শরীরকে বিবশ করে, ধরা পড়িয়ে দেয়।

আশার সারা মুখ জুড়ে যে বিশাল কালো দুটি চোখে অগ্রহায়ণের রোদের মতো কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছিল, সেখানে বুঝি বা রাংচিতে ঝাড়ের ছায়া পড়ল। হাসিটুকু বিষণ্ণ হয়ে উঠল ঠোঁটের কোণে। মনে পড়ল, তিন দিন ফটিকদার সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু মায়ের রাগ নয়; তার মতি-চাপা মনটাকে খুঁচিয়ে দিলে। তিন দিন ফটিকদাকে দেখতে পায়নি আশা। মানুষের মনকে ধিক। আঠারো বছরের চোরা মনকে আরও ধিক। কেন না, এখন আশার মনে পড়ল, এই তিন দিন সে অনেক বার অনেক রকমে চমকেছে। যাকে রোজ দেখতে ইচ্ছে করে, তাকে তিন দিন না দেখলে বোধ হয় এমনি চমকায় মানুষ। সে এরোপ্লেনে আসবে কি মোটরে আসবে, তা কে জানে। মোটরে এরোপ্লেনে আসা সম্ভব কি না, তা-ই বা কে ভাবছে। নিজেকে হারাবার জন্যে যে মেয়ে মনে মনে কান পেতে থাকে, সে শুধু চমকায়। এই চমকানোটা তার সংসারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা! ধরা পড়লে ধমক খেতে হয় বইকী।

বেণী খুলে ঘরে গিয়ে খানিকটা নারকেল তেল মাথায় তালুতে আর খানিকটা গোড়ার গুছিতে মাখিয়ে, গামছা কাঁধে ফেলে আশা নদীর পথ ধরল। নদী ছাড়া গতি নেই। কুয়োর জলে চান করতে ইচ্ছে করে না।

কিন্তু আবার সেই গাড়ির শব্দ। সরু গলিটা পার হয়ে আশা বড় রাস্তায় পড়তেই, দেখতে পেল গাড়িটাকে। এই গাড়িটার শব্দই সে শুনতে পেয়েছিল কি না কে জানে। দেখল, পশ্চিম দিক থেকে নীল রঙের গাড়িটা বনশিউলির ঝড়ে ঝাপটা খেতে খেতে আসছে! এই গাড়িটাই তখন নিশ্চয় এসেছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে। আপদ গাড়ি। শুধু শুধু চমকে দিয়েছিল তাকে। ফটিকদা মোটরে করে আসবে, এ কথা কোনও দিনও আশা ভাবেনি। আশা দাঁড়াল। গাড়িটা চলে গেলে সে রাস্তা পার হবে।

কিন্তু গাড়িটা চলে যেতে যেতেও যেন দাঁড়িয়ে পড়ল তার সামনে। চশমা চোখে একটি মুখ বার হল ভিতর থেকে। আশা পালাবে কি না ভাবছে। আশেপাশে কেউ নেই। লোকটি ডাকল, খুকি।

খুকি? কী অসভ্য! মা আর বাবাই একমাত্র ওই নামে তাকে ডাকে। লোকটা তাকে খুকি ভাবল? সে ফিরে তাকাল সংশয় সন্দেহ জিজ্ঞাসু চোখ তুলে।

লোকটি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এই যে পেছনে, দুটো বাড়ির আগে, একটা দোতলা বাড়ি রয়েছে, ওটা কি খালি?

বুঝতে পারল আশা, বিনোদ ভট্টাচার্যের বাড়ির কথা বলছে লোকটা। যাদের বাস বাড়ি শহরের ঘিঞ্জিতে। পুবে নদীর ধারে যাদের ধানকল আছে। ততক্ষণে সে লোকটার মুখ দেখে নিয়েছে। কালো, চওড়া মুখ আর দামি জামা পরনে। ভিতরে ড্রাইভার ছাড়া আরও একজন রয়েছে। সেও তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।

আশা বলল, হ্যাঁ।

কাদের বাড়ি জান?

–বিনোদ ভটচাযের।

–কোথায় থাকেন?

–বারো মন্দিরের গলিতে।

 লোকটা মুখ ঢুকিয়ে নিল ভিতরে। কী যেন বলাবলি করল নিজেদের মধ্যে। তারপর চলে গেল। আশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে হেসে ফেলল। এই জন্যেই বোধ হয় আশা চমকে উঠেছিল। আগের থেকে জানান দিয়েছিল যেন, তার সঙ্গে গাড়িটার দেখা হবে, কথা হবে। তবুও সে গাড়িটাকে জিভ না ভেংচে পারল না।

রাস্তাটা পার হলেই বাগান। বাঁ দিকে পুরনো একটি দোচালা মন্দির। পাশেই ঝুড়ি নামা বট গাছ। জায়গাটার নাম সতীদাহতলা। লোকে বলে সতীতলা। একমাত্র সেখানেই একটু আশা ছিল আশার। নইলে এ সময়ে চান করতে না এলেও চলত। লোহা কারখানার হাজিরাবাবুর এ সময়েই একটু চা খাওয়ার ছুটি। কিন্তু মন্দিরের দাওয়া শূন্য। বটের ছায়ায় এই মুহূর্তে একটি কাকপক্ষীও নেই। তিন দিন পার হয়ে, চার দিনেও আজ সেই সাইকেলের চেনা বেল ক্রিং ক্রিং করল না।

বাগান পার হয়ে আশা নদীর ধারে এসে পড়ল। বাঁধানো ঘাট কোনও এক কালে ছিল। ভাঙা ঘাট এখন ওপরে উঠে গেছে। অত উঁচুতে আর জল ওঠে না। নদী গহীন কিন্তু ছোট। এপারে ওপারে ডেকে কথা বলা চলে। গহীন আর খরস্রোতা নদী। টলটলে জলের নীচে দেখা যায় সহস্রবাহু শ্যাওলা। স্রোতের টানে হেলে পড়ে কিলবিল করছে। যেন লাখো লাখো ডাকিনীরা ওত পেতে আছে নীচে। তাদের এলো চুলের জটা লকলক করছে জড়িয়ে বাঁধবার জন্যে।

এ ঘাট এখন কলমুখর। ঘোড়ার গাড়িওয়ালারা কেউ কেউ এসেছে ঘোড়া চান করাতে। গোরু মোষও নেমেছে জলে। আর এক দিকে মানুষ। জল থেকে কে যেন ডাকল আশাকে। আশা দেখল পদ্ম। পাড়ার মেয়ে–আশার বন্ধু।

পদ্ম জল ছিটিয়ে দিল আশার গায়ে। আশা শিউরে ডুকরে হেসে জলে পড়ল।

এ সময়ে আশা রোজই জলে ঝাঁপাই-ঝুড়তে আসে। কিন্তু আজ আশার ভাল লাগছে না। যদিও সে সাঁতার কাটল। পদ্মকে জলের ছিটা দিল। ওদের হাসি কলতানে স্রোতস্বিনী নদী আরও খর হল, শিউরোল, হাজার হাজার মুক্তোকণা ছিটিয়ে ছড়িয়ে লোকেদের চিরকালের মনে দ্যুতি হানল, তবু বিরক্ত করল।

তারপরে আশাই আগে উঠে পড়ল জল থেকে। আজ জলে হুড়তে ভাল লাগছে না। আজ দেরি করে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেতেও ভাল লাগবে না। আজ তেমন দিন নয়, এক-একদিন যেমন হাজার শ্লেষ করলে, বকলেও গায়েই লাগে না।

ওর ভেজা শাড়ি ছপছপিয়ে উঠল চলতে গিয়ে। ভেজা শাড়ির দোরাগুলি ওর ভেজা গায়ে জড়িয়ে ধরে, স্পষ্ট রেখায়, অস্পষ্ট বাঁকে কেমন এক রকমের অলংকার হয়ে উঠেছে যেন। ভেজা ডোরারও দ্যুতি আছে। সে দ্যুতি নিংড়ে নিংড়ে পড়ছে যেন। চুল মুছতে মুছতে, অন্যমনস্ক হয়ে চলছিল আশা। এমন সময় শুনতে পেল শব্দটা। কিন্তু মুখ ফেরাল না। আবার শুনতে পেল। আর প্রথমেই ওর শান্ত সুদূর চোখ দুটিতে নিকট হল অভিমান, ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসি বন্ধ করতে গিয়ে বুঝল হাসি নয়, কান্না পাচ্ছে আশার।

সাইকেলের বেল আবার অধৈর্য হয়ে বেজে উঠল, ক্রিং ক্রিং।

এ সব জানত না আশা। দু বছর ধরে জানতে হচ্ছে। খেতে না পাওয়ার দুঃখ কিছু অজানা নয় আশার। বাবা মা ভাইদের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, অকল্যাণের আশঙ্কায় শঙ্কিত হওয়া তার জন্মগত। কিন্তু আর একটি লোক, যাকে জন্ম থেকে দেখেনি, পরিচয় মাত্র কয়েক বছরের, তাকে তিন দিন না দেখতে পেলে, কান্না চাপতে হয়। জীবনে এ সব নতুন পাঠ নিতে হচ্ছে তাকে।

অধৈর্য ক্রিং ক্রিং শব্দ কান্না উড়িয়ে নিল তার। শুধু তার মুখ জুড়ে দিঘি-চোখে, অগ্রহায়ণের রোদের মতোই অভিমানের ঝিলিক দিয়ে রইল। এগিয়ে গেল সে। কারণ মন্দিরের আড়াল ছেড়ে ফটিক সামনে আসতে পারবে না। লোকে দেখবে। যদিও, লোকের দেখার বাকি কিছুই নেই। আর, বন্ধ ঘরের ফুটোয় কিছু আলো দেখেই লোকেরা বুঝতে পারে, ঘরে কত আলো।

দুহাতে সাইকেলের সিট ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ফটিক। অতি সাধারণ চোখমুখ, সাধারণ মাপের কালো ফটিক। মাথার চুলে একটু হাল ফ্যাশানের তৈরি ঢেউ, যদিও বাসি চুলে সেটা খুব সুবিধের হয়নি। মুখে কিছু দৃঢ়তার ছাপ, ঠোঁট দুটিতে যেন একটু দুর্বিনীতের বাঁকা রুক্ষতা। স্বচ্ছ চোখ দুটিতে কোনও কিছু চাপবার মুন্সিয়ানা অনায়ত্ত। শার্টের ওপর সোয়েটারের বুনোন খানে খানে খুলতে আরম্ভ করেছে।

বলল, রাগ হয়েছে বুঝি?

মাথা নিচু রেখেই চোখ তুলে এক বার তাকাল আশা। বলল, না।

আশা ভেজা গায়ে গামছাটা আর একটু ভাল করে টেনে দিল।

 ফটিক বলল, তবে? আসছিলে না যে?

বলে হাত বাড়িয়ে ফটিক চিবুক ধরতে গেল আশার। আশা মুখ সরিয়ে নিল। বলল, রোজই এসেছি।

এ যে অভিযোগ, তা বুঝল ফটিক। বলল, সেদিন তোমার মা এমন ক্যাট ক্যাট করে কথা শুনিয়ে দিল। আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল। তোমাদের বাড়ি তো আর যাবই না। ভেবেছিলাম, এখানেও আর আসব না।

আশার মুখ গম্ভীর হল আরও। বলল, এলে কেন তবে?

ফটিক চঞ্চল। পা ঘষছে, শরীর দোলাচ্ছে, হাত নাড়ছে। যেন নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে বলল, থাকতে পারি না যে! না, সত্যি, কী এমন খারাপ ছেলেটা হয়ে গেছি যে, অত কথা শুনতে হবে।

আশা বলল, সে দোষ বুঝি আমার?

ফটিক বলল, বউদির ভাবখানা যেন কী এক দিগগজ বড়লোকের সঙ্গে মেয়ের বে’ দেবেন।

ফটিক আশার মাকে বলে বউদি আর বাবাকে বলে নরেনদা। পাড়াতুতো দাদা বউদি। ছোটবেলা থেকে বলে এসেছে।

আশা বলল, মা কত কী ভাবে। ভাবলেই বা কী আছে। তা ছাড়া মাকে নানান জনে নানান খানা করে বলে। রাগ হয়ে যায়, তাই বলে। এত কাল পরে তোমার যদি ও সব কথা এত গায়ে লাগে, তা হলে আর এস না।

এক বার চোখ তোলবার চেষ্টা করল আশা। বলল, শীত করছে, যাই।

আশার দিঘি-চোখ যেন আরও বড় হল। যেন বেলা শেষের ছায়ায় নিঝুম নিস্তরঙ্গ, ঝোপে ছাড়ে পাখিডাকা দিঘিটার কূলকিনারা ঠাহর করা যায় না।

আশার কথা কানে না তুলে ফটিক বলল, পাড়ার লোকে তো ক’বছর ধরেই বলছে। কবে কোনদিন একটু সিনেমায় গেছি তোমাকে নিয়ে, একটু নদীর ধারে বেড়িয়েছি। কী এমন বেলেল্লাপনা হয়েছে যে দেখা হলেই ঠারেঠোরে সে কথা শোনাতে হবে। আর প্রেম বুঝি একলা ফটিকই করে পাড়ার মধ্যে? তা নয় আমি যদি বড় চাকুরে হতাম নয়তো বিনোদ ভটচায্যিদের বাড়ির ছেলে হতাম–

ততক্ষণে আশা পা বাড়িয়েছে।

ফটিক বলল, চলে যাচ্ছিস?

এতক্ষণে অকৃত্রিম সম্বোধন বেরুল তার মুখ দিয়ে। বুঝি সংবিৎ ফিরল, আর সাইকেলসহ আশার কাছে এগিয়ে এল!

আশা বলল, ও কথাগুলো আর কতক্ষণ শুনব দাঁড়িয়ে। এ সব কথা তুমি মাকে বলল।

ফটিক হাত বাড়িয়ে আশার ভেজা হাত চেপে ধরল। যদিও আশা শক্ত আড়ষ্ট। ফটিক ঠোঁট বাঁকিয়ে, মাথা ঝাড়া দিয়ে বলল, আমার বয়ে গেছে ও সব বলতে। তোকে নিয়ে সোজা কলকাতা রেজেস্ট্রি অফিসে যাব, ফিরে এসে আর ও বাড়িমুখো নয়।

আশা ফটিকের চোখের দিকে তাকাল। ফটিক আশার শক্ত শরীরটাকে আরও কাছে টেনে বলল, তাকিয়ে রইলি যে?

আশা বলল, ও কথাটা আর কত দিন শুনব?

কোন কথাটা?

–এই রেজিষ্ট্রি অফিসে যাওয়া?

দাঁড়া না সব খোঁজ খবর নিই আগে! শেষটায় বেঘাটে গিয়ে পড়ব?

আশা বললে, তা নয়, তুমি চাও, বাবা মা বেশ তত্ত্ব করে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিক। তা সে রাজপুত্তুর এলেও কোনও দিন হবে না।

ফটিক প্রায় ভেংচে বলল, তোর কানে কানে আমি বলেছি সে কথা, না?

বলে সে আরও কাছে টানল আশাকে। আশার ভেজা শরীর তার শুকনো জামা ভিজিয়ে দিল।

আশা বলল, তাই তো। তা নইলে ও সব ভেবে তিন দিন দেখা না দেবার কারণ কী? সরো, তোমার জামা ভিজছে।

–ভিজুক।

এবার আশাও ভেংচে বলল, ভিজুক। এ তিনদিন সে কথা মনে ছিল না, না?

 ততক্ষণে ফটিক আশার চিবুক তুলে ধরে, তার ঠোঁটের গন্তব্য ও চোখের দৃষ্টি একাগ্র করেছে।

আশা বলল, কী হচ্ছে? কেউ আসে যদি এ দিকে?

 ফটিকের আবার সংবিৎ ফিরল। বিভ্রান্ত চোখে সে এ দিক ও দিক ফিরে তাকাল। যদিও গুটিকয় শালিক ছাড়া আপাতত সাক্ষী কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

আশার চোখে আবার রৌদ্রচ্ছটা ঝিকমিক করে উঠল। সে হেসে বলল, জান, আজ একটা মোটরগাড়ি এসেছিল এ পাড়ায়।

ফটিকও প্রায় আশার মায়ের মতোই অবাক হয়ে বলল, মোটরগাড়ি এসেছিল? তাতে কী হয়েছে?

 আশা বলল, আজকাল এ পাড়া দিয়ে আর মোটরগাড়ি যায় বুঝি?

ফটিক বলল, যায় না। আজকে গেছে, তাতে কী?

এমন চমকে গেছলাম। শব্দ শুনে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠেছিল, সত্যি।

ফটিক অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আশার মুখের দিকে।

আশা ফিসফিস করে বলল, সত্যি, রাগ হোক যাই হোক, তুমি এমন করে গাপ খেয়ে থেকো না।

ফটিক হেসে ফেলল। শালিকগুলি যেন ভয় পেল, সহসা ডাক দিয়ে উড়ে গেল। ডাক ভেসে এল রাস্তার ওপর থেকে, ফটিক, টাইম হয়ে গেছে।

ডাক দিয়েছে ফটিকের বন্ধু কার্তিক। দুজনে একই কারখানায় কাজ করে।

 চা খাওয়ার ছুটির পরে, কার্তিকের ডেকে নিয়ে যাবার কথা।

ফটিক বলল, চলি। বিকেলে পারিস তো পদ্মদের বাড়ি বেড়াতে যাস।

চলে গেল ফটিক। আশার গায়ের কাপড় প্রায় গায়েই শুকোবার দশা। আর এক বার জলে যেতে তার ইচ্ছে করল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাবে। মা রাগ করবে। যদিও ভেজা কাপড় গায়ে এত শুকোল কেমন করে, সেটাও মায়ের চোখে পড়তে পারে। কারণ কতখানি পথে আসতে কাপড়ের জল কতটুকু ঝরে, মায়ের সে হিসেব জানা আছে।

কিন্তু হাঁসের গায়ে জল লেগে থাকে না। তিন দিন পরে, আজ এখন আর কোনও বকুনি আশাকে ছুঁতে পারবে না। মন তার উজানগামিনী এখন। ফটিকের ঠোঁটের ও চোখের একাগ্র গন্তব্যগুলি আশার নিজের রক্তে দপদপ করতে লাগল। বাড়ি গেল সে। মাকে দেখতে পেল না! কাপড় ছেড়ে, মাথায় চিরুনি দিতে দিতে একটা পাখির ডাক শুনে, শিস দিয়ে ভেংচে উঠল আশা। পরমুহূর্তেই ঠোঁট টিপে ধরল। মা শুনলেই ধমক দেবে। মেয়েমানুষের শিস! কিছুতেই মনে থাকে না আশার।

.

কিন্তু দু দিন পরে আবার সেই মোটরগাড়ির শব্দ। যদিও কালকেই ফটিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আশা চমকে দাঁড়াল। শান্তিও আজ রান্নাঘরে যেতে গিয়ে থমকে গেল। একটা নয়, প্রায় কনভয় যাচ্ছে বলে মনে হল। একসঙ্গে কয়েকটি গাড়ির গর্জন এবং বিভিন্ন সুরের হর্ন বেজে উঠল। সেই সঙ্গে অনেক লোকের গুঞ্জন।

আশা স্নান করতে যাবার আগে বেণী খুলছিল। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বলল, দেখে আসব মা?

হ্যাঁ কি না শোনবার আগেই আশা বাড়ির বাইরে। রাস্তায় এসে সে হা করে তাকিয়ে রইল। চারটে গাড়ি রাস্তার ওপরে পর পর দাঁড়িয়ে পড়েছে। পরশুর দেখা সেই গাড়িটা সকলের আগে। তারপরে আর একটা। তার পরে দুটি বড় গাড়ি। একটিতে প্রায় দশ বারোজন মেয়ে পুরুষ। আর একটি গাড়ি ঢাকা, পুলিশের গাড়ির মতো।

ততক্ষণে আশার কানে, প্রায় বাতাসের আগে এসে ঢুকল, ফিল্ম। ফিল্মের লোকেরা এসেছে। ফিল্ম তুলবে। কিন্তু এ ঢাকা গাড়িটা কীসের? ও দাদারা, এ গাড়িটা কীসের মশাই? সাউন্ড ভ্যান?

আশা দেখল, প্রথম গাড়িটা থেকে সেই ভদ্রলোক নেমেছেন। সেই কালো চশমা চোখে ভদ্রলোক। প্রথম দিনের দেখা। আরও কয়েকজন নেমেছে। আশা দেখল, বিনোদ ভটচাযের মেজো ছেলে হরিশ। তাদের কী বলছে, উত্তরের রাস্তাটা দেখিয়ে। গাড়ির ভিতরে মেয়েদের মুখগুলি দেখছিল আশা। ফাঁপা। ফাঁপা চুল, মুখে মোটা করে পাউডার মাখা। ঠোঁটে রং। বড় গাড়িটার তিনটি মেয়ের মধ্যে দুজনেরই চোখে কালো চশমা। আর একজনের চোখে কাজল। ওরা মেয়ে পুরুষ সবাই যেন কী এক উৎসবে মেতে উঠেছে। হাসছে বকবক করছে, এ ওর গায়ে পড়ছে। ওদের যে এত লোক দেখছে সেটা যেন। খেয়ালই নেই। আশার মনে হল ওরা যেন অন্য গ্রহের মানুষ। ওরা তো সেই ছবি। ওরা সেই ছায়া, যারা সেই অন্ধকার ঘরটার পরদায় ভেসে ওঠে। হাসে কাঁদে গায়। ভালবাসে হিংসা করে। লুকিয়ে মন্দিরের। পিছনেও ওরা যায়, মায়ের বকুনি খায়, বাবাকে ভয় পায়, প্রতিবেশীর চোখ ঠারাঠারি, হাসাহাসি, খারাপ কথা সবই শোনে। আশাদের মতোই। তবু আশাদের মতো নয়। এই মাটি, এই গাছ, এই আকাশ, আমাদের এমন রক্ত মাংস মন, অমন সত্যিকারের মা আর কাপড়ের কলের কেরানির ছেলেমেয়ে কিংবা লোহা কারখানার হাজিরাবাবুর মতো ওরা নয়। ওরা ছায়া, ছবি হয়ে শুধু আমাদের হেসে কেঁদে দেখা দেয়। তখনও ওরা আমাদের দেখতে পায় না। এখনও তেমনি দেখতে পাচ্ছে না। ওরা যে কোথায় থাকে, কে জানে! কেমন ভাবে থাকে? কেমন বিচিত্র আর রহস্যময় মনে হয়। ওই তো, ওদের বেশভূষা, কথাবার্তা, হাসি, চাউনি, সব যেন আশার অন্য রকম লাগছে। ওরা যে ছায়ালোক থেকে এসেছে, সেখানকার পরিবেশটুকুও যেন নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। পুরুষেরা সকলেই সে রকম নয়। এ শহরের সেই ছেলেদের মতো, যাদের কোমরের নীচে প্যান্ট, অদ্ভুত জামা আর কপালের কাছে চুড়ো করা চুল। এমনি সাধারণ মানুষের মতোও অনেকে আছে। তবু তারাও যে সেই দুর ছায়ালোকের মানুষ, তা বোঝা যাচ্ছে হাসিতে কথাবার্তায়। সবাই যেন স্বপ্নের ঘোরে রয়েছে। মেয়েরা যে কোনও ছেলের সঙ্গে কথা বলছে, হাসছে, হাত ধরছে। ছেলেরাও তেমনি করছে। সমাজ সামাজিকতা ঘর-সংসারের কোনও ভয়। নেই যেন ওদের। সে সবের ঊর্ধ্বে ওরা।

আর লোক আসছে অনবরত। ঝড়ের বেগে সংবাদ রটেছে। জোয়ারের বেগে আসছে গোটা শহর ভেঙে। আজ যেন এখানে মেলা লেগেছে। গাড়িগুলি ঘিরেছে সবাই। কে কত কাছে যেতে পারে গাড়িগুলির, তার জন্যে ঠেলাঠেলি করছে।

প্রথম গাড়িটার পরে, সবুজ রঙের গাড়িটার চারপাশেও ভিড় জমেছে খুব। অস্পষ্ট হলেও আশা দেখতে পাচ্ছে, সবুজ গাড়িটায় মাথায় সিল্ক-স্কার্ফ বাঁধা একটি মেয়ে রয়েছে। তার ফরসা গাল, রং মাখা ঠোঁট আর কালো চশমার অংশও দেখা যাচ্ছে।

আশার ভয় হল, গাড়ির মানুষগুলির কারুর সঙ্গে যদি ওর চোখাচোখি হয়। তা হলে ওরা নিশ্চয় সব হেসে উঠবে। লজ্জায় মরে যাবে সে। কিন্তু কী ভাগ্যি, ওরা দেখতে পায় না।

আশা দেখল, পাড়ার মেয়ে বউ সবাই এসে ভিড়েছে দূরে দূরে। যে ছেলেরা সারা দিন এখানে ওখানে জটলা করে, তারা তো এসেছেই। বুড়োরাও এসেছেন। আশা আরও অবাক হয়ে দেখল, ফটিকদাও এসেছে কার্তিককে সঙ্গে নিয়ে। আশার দিকে তাদের নজর নেই। হাসি পাচ্ছে আশার ফটিককে দেখে। কেমন হতভম্ব বিস্ময়ে ফটিকদা মানুষগুলিকে দেখছে। যেন, একেবারে ছেলেমানুষ। কার্তিক ঘাড়ে হাত দিয়ে কী যেন বলল। কিন্তু ফটিকদার খেয়াল নেই। অন্যমনস্ক বিরক্তিতে হাতটা সরিয়ে দিল কাঁধ থেকে। একেবারে বিভোর।

তারপরে আশার চোখ পড়ল তার ভাই শ্যাম আর রামের দিকে। কী পাজি দেখ! বই খাতা বগলে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলে যায়নি এখনও।

কিন্তু ওরা সবাই গাড়ির গায়ের কাছে। অত কাছে যেতে সাহস হল না আশার। এমন সময় সেই কালো চশমা চোখে ভদ্রলোক হাত তুলে পিছনের গাড়িগুলিকে ইশারা করলেন। তারপরে গাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। সেইসঙ্গে বিনোদ ভট্টাচার্যের ছেলে, হরিশও। গাড়িগুলি পর পর চলতে আরম্ভ করল বনশিউলির ঝড়ে ঝাপটা খেতে খেতে। রাস্তাটায় এত ধুলো ছিল, কোনও দিন টের পাওয়া যায়নি।

কে একজন চেঁচিয়ে বলল, বিনোদ ভটচার্যের বাড়ির সামনের মাঠটায় গাড়ি দাঁড়াবে।

আশা বুঝল, সেই বাড়িটাতেই ওরা থাকবে। এখানে তা হলে সিনেমা তুলবে। আরও কয়েক বার এই শহরে সিনেমার লোকেরা এসেছে। কিন্তু এ পাড়ায় কখনও আসেনি। আর বাড়ি ভাড়া করে থাকবার কথা শোনেনি কখনও।

কিন্তু ফটিকদা কার্তিক শ্যাম রাম, সবাই ভিড়ের সঙ্গে গাড়ির পিছু পিছু ছুটে গেল। আশারও যেতে ইচ্ছে করল। সাহস হল না। কারণ মেয়েরা কেউই প্রায় যাচ্ছে না। শুধু দু চোখে অসহ্য কৌতূহল নিয়ে, ধুলো ঢাকা বনশিউলির জঙ্গল আর অপসৃয়মাণ ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপরে মায়ের কথা মনে হতেই পিছন ফিরে দেখল পদ্মকে।

আশা বলল, কোথায় সিনেমা তুলবে রে?

পদ্ম বলল, নদীর ধারে নাকি তুলবে! কিন্তু আজ নয়, কাল সকালে। এক মাস থাকবে এখানে।

–এক মাস? রোজ তুলবে?

–হ্যাঁ।

আশার বিস্মিত কৌতূহলিত চোখ দুটি খুশিতে ঝলকে উঠল। বলল, মা’কে বলে আসি।

বলে সে তার আধখোলা বেণী দুলিয়ে ছোট মেয়েটির মতো দৌড় দিল। বাড়িতে এসে দেখল, মা সেলাই নিয়ে বসেছে। আশা ডাক দিতেই শান্তি বলল, শুনেছি। সিনেমা তুলতে এসেছে।

আশা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এক মাস ধরে তুলবে।

সেলাইয়ের দিকে নজর রেখে শান্তি বলল, তা বলে রোজ রোজ ওখানে নেচে নেচে যাওয়া চলবে না বলে রাখলাম।

আহা! মা’র যেমন কথা! ভুরু কোঁচকাতে গিয়ে হাসি পেল আশার। মা ঠিক ভাবছে, ফটিকদার সঙ্গে মেশামিশির বেশি সুযোগ পাবে বলে আশা খুশি হয়েছে। তার মনে পড়ল, শ্যাম আর রামের কথা। কিন্তু সে বলল না। তা হলে মা রেগে উঠবে। ঠিক বলবে, আপদ এসে জুটেছে, ছেলেগুলোর ইস্কুল করা মাথায় উঠবে এ বার।

আবার বেণীতে হাত দিল আশা। আর তার বিশাল কালো দিঘি-চোখের কূলে কূলে ঠোঁটের কোণে একটি বিচিত্র হাসি দেখা দিল। ভাবল, এই জন্যেই বোধ হয় আমি সে দিন অমন চমকে উঠেছিলাম মোটরগাড়ির শব্দ শুনে। আজ শহরসুদ্ধ সবাই চমকে উঠেছে।

ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের ওপর হাত চাপা দিল আশা। আর একটু হলেই শব্দ করে হেসে ফেলত। অমনি মায়ের রুষ্ট সন্দিগ্ধ খর চোখ কুচি কুচি করে কাটত তাকে; কী যে বিশ্রী হাসি পায়। যেন নিজের ওপর বিরক্ত হতে গিয়েই আশার নজরে পড়ে মস্ত বড় প্রজাপতিটাকে। মস্ত বড় প্রজাপতিটা পাখায় রাজ্যের রং মেখে আশার মনের সঙ্গে মিতালি করে হাসছে। কখনও তার রুক্ষ মাথায়, কখনও তার। বাসি কাপড়ের আঁচলে বসতে আসছে। আবার উড়ছে। আশা ঠোঁট টিপে ভুরু কুঁচকে হাত বাড়াল। রঙিন পতঙ্গটা বাতাসের আগে উড়ে চলে গেল দীন মলিনা কৃষ্ণকলির ঝাড়ে।

তারপরে আশা বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, আজ আর ফটিকদা সতীতলার মন্দিরের পিছনে আসবে না। হা করে ফিল্মের লোক দেখতে দেখতেই কারখানার সময় হয়ে যাবে। আর যদি দেখা হয় তা হলে আশা বলবে, গাড়ির শব্দটা শুনে পরশু বোধ হয় এ জন্যই চমকে ছিলাম।

.

কিন্তু আরও চমক বাকি ছিল আশার। সেটা বোঝা গেল তার পরদিন সকালবেলা। পরদিন সকালবেলা রাজ্যের লোক এসেছে নদীর ধারে। পাড়া থেকে খানিকটা দূরে, সেই নাগরা ঘাটে, যেখানে ঘাট নেই, খেয়া পারাপার নেই, উঁচু পাড়ে শুধু বাগান আর জঙ্গল। ফিল্মের লোকেরা গেছে সেখানে। চারটে গাড়িই সেখানে এসেছে, নাগরাঘাটে মেয়ে-পুরুষ সবাই এসেছে। সাউন্ডভ্যান থেকে সাপের মতো কালো রবারের তার এঁকেবেঁকে নেমে গেছে নদীর ধারে। ট্রলিসহ ক্যামেরা কালো কাপড়ে ঢাকা একটি অদ্ভুত ঘাপটিমারা জানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে। ছোট একটি তাঁবু খাটানো হয়ে গেছে এর মধ্যেই। ঘোট ঘোট বেতের মোড়া এসে গেছে অনেকগুলি। ওরা সবাই ব্যস্ত। শুধু কয়েকজন মেয়ে-পুরুষ ছাড়া। সে সব মেয়ে-পুরুষদের চেহারার মধ্যে কী যেন আছে। যদিও এমনিতে কিছুই মনে হয় না। শুধু তাদের রং মাখা ছাড়া। অন্তত আশার তাই মনে হয়।

আশাও এসেছে দেখতে। আর আজও তার তাই মনে হচ্ছে ওদের দেখে। ওরা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ওরা, ওই চার জন মেয়ে আর কয়েক জন পুরুষ, যাদের অধিকাংশেরই চোখে গগলস। ওরা কেউ গাছতলায়, কেউ তাঁবুর সামনে এলিয়ে বসে আছে। হাসছে কথা বলছে তবু যেন ওদের ঘিরে এক নাম-না-জানা দূর রহস্যের ছায়া। সবাই ওদেরই দেখছে। সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরা ভদ্রলোক। তিনি সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন, কী সব বোঝাচ্ছেন। মাঝে মাঝে দেখছেন ফাইল খুলে।

তারপরে হঠাৎ ভদ্রলোক ভিড়ের দিকে ফিরে তাকালেন। যে ভিড়টাকে একটি মোটা দড়ির সীমানার বাইরে রাখা হয়েছে। ভদ্রলোককে সবাই কানুদা বলে ডাকছে।

পদ্ম বলল, এই রে, এ বার বোধ হয় ভাগিয়ে দেবে সবাইকে।

 আশা বলল, কেন?

–দেখছিস না, ওই লোকটা বার বার তাকাচ্ছে। ও তো ডিরেক্টার।

–ওই যাকে সবাই কানুদা বলছে?

–হ্যাঁ।

পাশ থেকে ফটিক বলে উঠল, ভাগালেই হল আর কী। ওদের কেনা জায়গা নাকি?

আশা চমকে পিছন ফিরল। ফটিক তার উপস্থিতি ঘোষণা করবার জন্যেই কথাটা বলেছিল। চোখাচোখি হতেই আশার হাসিটা লজ্জায় বিব্রত হয়ে উঠল। পদ্ম ছাড়াও আরও বন্ধুরা রয়েছে। গীতা বাণী সুষমারা রয়েছে আশেপাশে।

পদ্ম লুকিয়ে চিমটি কাটল আশাকে। ফটিকের দিকে ফিরে বলল, কারখানায় যাননি ফটিকদা?

বাণীর গলা শোনা গেল মেয়েদের দল থেকে, আজ এ কারখানার হাজিরা নেবে ফটিকদা।

 ফটিক বিনা বাক্যে আশার পাশে এসে দাঁড়াল। আশা সভয়ে চারপাশে তাকিয়ে, সন্ত্রস্ত গলায় বলল, ও কী করছ ফটিকদা, ওই দেখ শান্তপিসি এইদিকে তাকিয়ে আছে।

ফটিক ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, থাকতে দে। ওরা চিরকালই ও রকম তাকিয়ে থাকবে। তোর পাশে দাঁড়ালে যদি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় তো যাক।

কথাটা নিশ্চয় ন্যাড়া মাথা বিধবা, থপথপে মোটা, পাড়ার শান্তপিসির কানে যায়নি। গেলে, শান্তপিসি চুপ করে থাকত না।

সন্ত্রস্ত লজ্জার মধ্যেও ভরা কলসির উপচানো জলের মতো খুশি চলকে পড়ছিল আশার চোখে মুখে। যদিও তার হাতে মায়ের দেওয়া সুতো কেনবার পয়সা ঘামছে। সে বলল, কাজে যাবে না আজ?

ফটিক বলল, দু ঘণ্টার বাড়তি ছুটি নিয়ে এসেছি। ও দিকে দেখেছিস, তোদের পাড়ার বিভা সুন্দরীকে। হিরোইনের মতো সেজে কেমন দড়ির ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। আশা দেখল বিভাকে। ড্রেস দিয়ে বোম্বাই সিল্কের শাড়ি পরে চুলের গোছায় হর্সটে করে এসেছে। বিভার সঙ্গে আশার কথা নেই অনেক দিন। বিভা এক বছর কলেজে পড়েছিল। এখন প্রায়ই সেজেগুজে কলকাতায় যায়। কোথায় যায়, কেউ জানে না। এক সময়ে নাকি ফটিকের সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। এখন আর নেই। কেন, তা কে জানে। লোকে যা-ই ভাবুক বিভার ধারণা ও বিশ্বাস, আশার জন্যেই ফটিক ওর কাছ থেকে সরে পড়েছে। তাতেও কথা বন্ধ হবার কারণ ছিল না। বিভা এক দিন আশার সামনে ফটিকের নামে মাতাল, বদমাইশ, বলে গালি দিয়েছিল।

আশা বলল, আমাদের পাড়ার কেন। তোমারই হিরোইন।

 ফটিক বলল, আমার চৌদ্দ পুরুষের হিরোইন।

এমন সময়ে সেই কালো ফ্রেমের চশমা চোখে ভদ্রলোক, কানুদা সদলবলে ভিড়ের দিকে এগিয়ে এলেন। হাত জোড় করে বললেন, আপনারা দেখুন তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু একেবারে চুপচাপ না– থাকলে কাজ করা যাবে না।

ফটিক বলে উঠল, ঠিক আছে, আপনি আরম্ভ করে দিন দাদা, আমরা আছি, কিছু ভাবতে হবে না আপনাদের।

আশার লজ্জা করল ফটিকের এইরকম গায়ে পড়া কথা শুনে। কিন্তু ফটিকদা এ রকমই। সঙ্গে সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে লেগে গেল গোলমাল থামাতে। ফল পাওয়া গেল ঠিকই৷ গোলমাল থেমে এল অনেকখানি।

কানুদা ভিড়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন পাশের ছেলেটিকে। যার গায়ে ম্যারিন শার্ট, গলায় ক্যামেরা, ঠোঁটে সিগারেট। আবার কী যেন বললেন বিনোদ ভটচাযের ছেলে হরিশকে।

হরিশ সঙ্গে সঙ্গে আঙুল দিয়ে, সামনেই বিভাকে দেখিয়ে দিল। কানুদা ঘাড় নাড়লেন। শোনা গেল, বললেন, না, হবে না।

বলে নিজেই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে, যেন কাউকে খুঁজতে লাগলেন।

 হরিশ বলল, এখান থেকেই নেবেন? পরে হলে হবে না।

–দেখি না, পাওয়া যায় কি না কাউকে।

 মেয়েরা সবাই যেন কেমন সংকুচিত হয়ে উঠল। ভদ্রলোক মেয়েদের দিকেই বারবার তাকাচ্ছিলেন। লক্ষ করে দেখছিলেন সবাইকে। তারপরে আশার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, একে চেনেন হরিশবাবু?

হরিশ আশাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, চিনি বইকী। আমাদের পাড়ারই মেয়ে তো।

আশা যেন চমকে ভয় পেয়ে, এক পা পেছিয়ে দাঁড়াল। সবাই তখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু ফটিক গেছে গোলমাল থামাতে। আশার বুকের মধ্যে গুরুগুর করে উঠল।

কানুদা বললেন হরিশকে, এক বার কথা বলে দেখুন না। যদি আপত্তি না থাকে, অবশ্য এর গার্জেনের মতামতও চাই।

হরিশ অবাক হয়ে, আশার প্রায় প্রত্যহ দেখা সাধারণ মুখটি এক বার দেখল। বলল, আশা, ফিল্মে নামবে? একটা ছোট রোলের জন্য মেয়ে দরকার। এখানকারই কাউকে চান ওঁরা।

দিঘির বুকে প্রথম সূর্যের রক্তচ্ছটা দেখা দিল আশার চোখে। মনে হল, কোনও এক অদৃশ্য বায়ু ওকে ঝাপটা মেরে গেল। সলজ্জ হাসিটা ঠিক হাসি নয়, যেন গলা টিপে ধরল ওর। খুশিতে উপচে পড়া নয়, একটি ভীরু রহস্যময় হাতছানি ওকে যেন ডাক দিল সেই দুর ছায়ালোক থেকে। সাধ করে নয়, ছায়াচারিণী হবার এক অসাধ্যসাধনের মাধ্যাকর্ষণ ওকে টেনে নিয়ে গেল। ফটিকদাকে দেখবার জন্য এক বার এ দিক ও দিক তাকিয়ে, ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দিল। তারপরে, প্রায় চুপিচুপি রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল, বাবাকে বলতে হবে।

হরিশ বলল, হরেনবাবুকে তো। উনি তো এখন বাড়ি নেই নিশ্চয়?

আশা বলল, না। সন্ধ্যাবেলায় থাকবেন।

–ঠিক আছে আমি গিয়ে বলব তখন।

কানুদা বললেন, আমিও যাব তোমার বাবার কাছে।

আশা আবার এ দিক ও দিকে দেখল ফটিকদার জন্য। তারপরে বলল, আমি পারব?

কানুদা বললেন, সে ভার আমি নিচ্ছি খুকি, তোমাকে ভাবতে হবে না।

 আবার সেই খুকি। সেই প্রথম দিনের মতো। এই জন্যেই কি আশা চমকেছিল সে দিন?

ক্যামেরা গলায় ছেলেটি, কানুবাবুর অ্যাসিস্টান্ট, বলল, আসুন আপনি আমাদের তাঁবুর ওখানে।

কী করবে আশা? সে এদিক ওদিক তাকাল আবার। পদ্ম তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, যা না, যা।

পদ্ম খুশি হয়েছে। বীণা সুষমারা চুপ করে আছে। যেন কী এক অপরাধ করছে আশা। শান্তপিসির চোখ জোড়া যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। পাড়ার চেনাশোনা ছেলেদের চোখগুলি বাঁকা ছোরার মতো তীক্ষ্ণ খোঁচা হয়ে আছে। বিভা চলে যাচ্ছে নদীর উঁচু পাড়ের দিকে উঠে।

আশা বলল, এখুনি যেতে হবে?

কানুবাবু বললেন, না। তুমি কাল-পরশু থেকে কাজ করবে। এখন সকলের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করে নাও। চলো, একে নিয়ে চলো বিনয়। হ্যাঁ, কী নাম তোমার।

–আশা। আশালতা চক্রবর্তী।

 –বেশ।

গলায় ক্যামেরা ঝোলানো বিনয় বলল, এসো।

সজ্ঞানে নয়, একটি অজ্ঞান ইশারায় যেন আশা চলে গেল। চলে গেল দড়ির বেড়া পেরিয়ে, ছায়াদের সীমানায়। তবুও এখনও ও রক্তমাংসের মানুষের মতো সবই দেখতে পাচ্ছে। তাই আর এক বার পিছনে ফিরল। দেখল, ফটিকদা ছুটে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বেড়ার ওপারে, যেন শিশুর বিস্ময় নিয়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

বুকটা কেমন করে উঠল আশার। ও আবার দড়ির বেড়ার দিকে ফিরতে গেল। ডাকল, ফটিকদা।

 ফটিক হাত তুলে বলল, ওখান থেকে ঘুরে আয়, তারপর কথা হবে।

 আশা ফিরল, কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা আড়ষ্টতা ঠেকে রইল। বিনয় বলল, এক মিনিট।

তারপরেই ক্লিক করল ক্যামেরা। আশা হাসল। আবার ক্লিক করল ক্যামেরা। আশা অবাক হয়ে বলল, কী করছেন?

জবাবে ক্যামেরাটা আর এক বার ক্লিক করল। হেসে বলল বিনয়, তোমার স্টিল নিলাম।

–স্টিল মানে?

ফটো। চলো তো ওই জলের দিকে, আর একটা নিয়ে নিই।

 সহজেই বিনয় তুমি বলল। যেন কত দিনের চেনা। এরা সবাই আশাকে বুঝি খুব ছেলেমানুষ ভেবেছে? আশা হেসে নদীর দিকে গেল। ফটো নিল বিনয়। তারপর তাকে নিয়ে এল তাঁবুর কাছে।

এ বার ছায়ারা নড়ল, যদিও আলস্যে জড়িয়ে। চোখ তুলে তাকাল আশার দিকে। দেখতে পেল এ বার, বোধ হয় আশাও এখন ছায়া হয়ে গেছে, কিংবা হয়ে যাবে তাই।

বিনয় এক জনকে দেখিয়ে বলল, ইনি চঞ্চলাদি, আমাদের হিরোইন।

স্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাসের ছেলেও নামটা জানে এ দেশে। সেই চঞ্চলার সামনে হঠাৎ শীত-ধরা বাতাসে কেবল কুঁকড়ে উঠল আশা। লজ্জা ও উত্তেজনায় করুণ হয়ে উঠল ও।

বিনয় বলেই চলেছে, ইনি আমাদের কনকদি, সরমা চ্যাটার্জি, অনসূয়া মজুমদার। আর এই হল বিজনদা হিরো, প্রাণেশদা, সুলতান…।

চঞ্চলা বলে উঠল, তা হলে লোকেশন থেকেই নেওয়া হল?

বিজন বলল, কানুদা ক্রমেই বেশি রিয়ালিস্টিক হয়ে উঠছে। এসো ভাই, বসো, তোমার নাম কী?

আশাকেই আসতে বলছে, তারই নাম জিজ্ঞেস করছে। যেন পরদার বুকেই সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে ছায়ারা। কিন্তু মানুষিক আড়ষ্টতা কঠিন হাতে এখনও অসহজ করে রেখেছে আশাকে।

অগ্রহায়ণের এ শীত-শীত সকালে ও ঘেমে উঠল। বলল, আশালতা।

চমৎকার নাম। কোন রোলটার জন্যে একে নিয়েছে?

বিনয় বলল, সেই হিরোইনের বালিকা প্রতিবেশিনী।

 একটু বয়োজ্যেষ্ঠ প্রাণেশ বলল, চমৎকার মানাবে।

আশা বিনয়ের দিকে ফিরে বলল, আমি এ বার বাড়ি যাব?

–এখুনি? আচ্ছা দাঁড়াও। কানুদা, শুনুন আশা বাড়ি যেতে চায়।

 কানুদা কাছে এলেন। বললেন, আচ্ছা যাও এখন, সন্ধ্যাবেলা তোমাদের বাড়ি যাব আমি হরিশবাবুকে নিয়ে। তুমি আজ শুটিং দেখবে না?

আশার দৃষ্টি নেমে গেছে। কথা বলতে ঠোঁট শিথিল মনে হচ্ছে। বলল, দুপুরে আসব।

বলে ও ফিরল ভিড়ের দিকে। দড়ির সীমানার ও পারে, যেখান থেকে ও এসেছিল। যদিও মাত্র দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে, সে জায়গাটা যেন তার চরিত্র বদলে ফেলেছে। কিংবা আশা নিজেই বদল হয়ে এসেছে ওই ছবিদের সীমানা থেকে। তাই ওর চোখে সব অন্য রকম ঠেকছে। মুহূর্তে চমক ও বিস্ময়ের ঝলক যেন একটি শূন্যতা এনে দিয়েছে মনের মধ্যে। কী ঘটেছে, সবটা যেন এখনও হৃদয়ঙ্গম করে উঠতে পারেনি।

দেখল, সবাই যেন ওর দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। চেনা অচেনা, সবাই। আশার লজ্জা হল, ভালও লাগল। তবু ভয় হল, কষ্ট হল। ভিতরে ভিতরে যতই একটি হাসি উত্তাল হয়ে উঠল, অতল গভীরে ততই যেন একটি কান্নার ঘূর্ণি আবর্তিত হয়ে উঠতে লাগল। কেন? এ আবার কী?

আশা দেখল পদ্ম হাত বাড়িয়ে ছুটে এল না। কোনও ব্যগ্র কৌতূহলী জিজ্ঞাসা নেই ওদের। ওরা, পদ্ম বাণী সুষমা, সবাই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে হাসছে আশার দিকে চেয়ে। সবাই ওকে পথ করে দিল ভিড়ের মধ্যে।

বড় যেন বাতাস লেগেছে আশার দিঘি কালো চোখে। আলোকালোর দ্রুত ঝড় ওর চোখে। জিজ্ঞেস করল, পদ্ম, ফটিকদা কোথায় গেল।

পদ্ম বলল, কী জানি। মনে হল, ওপরের দিকে উঠে গেল।

চলে গেছে? দু ঘণ্টার ছুটি নিয়ে না এসেছিল? বলেছিল যে, ফিরে এলে কথা হবে। একটা তীক্ষ্ণ কাঁটা, কোথায় খোঁচা দিয়ে যেন চমকে দিতে লাগল আশাকে। ও উঁচু পাহাড়ের দিকে পা বাড়াল।

পদ্ম জিজ্ঞেস করল, চলে যাচ্ছিস যে? ওখানে যাবি নে।

অর্থাৎ দড়ির বেড়ার ওপারে। আশা বলল, পরে যাব।

ওকে তখন সতীতলার মন্দিরের পিছনটা ডাক দিয়েছে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। শুধু পাখিরাই ব্যস্ত হল। ব্যস্ত মেয়েটিকে দেখে উড়ে পালাল। মা’কে বুঝি তাড়াতাড়ি খবর দিতে গেছে ফটিকদা? কিন্তু পয়সাগুলি ততক্ষণে চটচটিয়ে উঠেছে হাতের ঘামে। বিশুকাকার দোকানে যেতে হবে এক বার সেলাইয়ের সুতো কিনতে।

দোকানের দিকে পা বাড়াল আশা। তবু বিস্ময়ে, অজানা এক খুশি ও ভয়ে যেন ওর পা জোড়া আড়ষ্ট, বিপথগামিনী। ছায়ারা ওকে ডাক দিয়েছে। সেই বিচিত্র ছায়ালোকে যাবে ও।

পিছন থেকে শ্যামের চিৎকার শোনা গেল, দিদি, এই দিদি।

দেখল, শ্যাম আর রাম, দুজনেই ছুটতে ছুটতে আসছে। বগলে ওদের বই। আজও স্কুলে যায়নি।

হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ বড় করে বলল শ্যাম, দিদি, তুই নাকি সিনেমায় নামবি?

রাম একেবারে আঁচলে হ্যাঁচকা মেরে জিজ্ঞেস করল, সত্যি নাকি রে?

আশা বলল, কে বললে?

শ্যাম বলল, ওখানে সবাই বলছে।

শ্যাম রাম দুজনেই কয়েকটা পাক খেয়ে নিল। রাম টানাটানি করতে করতে আশার আঁচলটাই খুলে ফেলল গা থেকে।

আশা তাড়াতাড়ি আঁচল টেনে বলল, এই অসভ্য, কাপড় ছাড়।

তারপরেই শ্যাম বলল, দেখিস দিদি, বাবা তোকে নামতে দেবে না।

রাম সঙ্গে সঙ্গেই বলল, আর মা তোকে চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে দেবে।

আশা ভেংচে বলল, তোদের বলেছে। তোরা স্কুলে যাবি নে?

শ্যাম বলল, না। মাকে বলতে যাচ্ছি তোর কথা।

বলেই দুজনে ছুটল বাড়ির দিকে। মায়ের মুখোনি মনে পড়ল আশার। একটু যেন থমকে গেল সে। পরমুহূর্তেই হাসল আবার। সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে চমকে তাকাল সামনে। কিন্তু সে অন্য লোক, অন্য সাইকেল।

.

তাড়াতাড়ি সুতো নিয়ে বাড়ি এল আশা। চুলের কুঁটি ধরে নাড়া না দিক, তার চেয়ে বড় রকমের নাড়া খাবার ভয় রয়েছে আশার। তাই, চুপিচুপি বাড়ি ঢুকল আশা। কিন্তু শান্তি কিছুই বলল না। বাবার মাসিক সাতাশি টাকার আয়ের ওপরে মা তার বাড়তি আয়ের ঠোঙা তৈরি করছিল বসে বসে। শুধু ঠোঙা নয়, পাড়া প্রতিবেশীর ছোটখাটো হাতে-সেলাইয়ের কাজও মায়ে ঝিয়ের ভাগাভাগিতে আছে।

মা এক বার তাকিয়ে দেখল আশাকে। শ্যাম রাম, কেউ নেই। বোধ হয় মা বকে ধমকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে।

আশা বলল, মা সুতো এনেছি।

মা বলল, ঘরে রাখ।

 ঘরে ঢুকে আশা চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী জানি, মা কি ছেলেবেলার মতো ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে মারবে নাকি? শুনেছে তো নিশ্চয়। বেহায়া নির্লজ্জ বলে একটু বকুক না মা।

ভাবতে ভাবতেই আশা মায়ের গলা শুনতে পেল, ওরা নিজেরাই তোকে ডেকে নিলে?

আশা তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ।

–টাকা দেবে?

চমকে গেল আশা। মা রাগ করেনি? শাসন করবে না? অবাক হয়ে ভাবল, টাকার কথা তো জিজ্ঞেস করেনি। তবু বলে ফেলল, তা তো দেবেই, যদি করি। সে সব কথা বাবাকে বলতে আসবে আজ সন্ধেবেলা।

তারপরে চুপচাপ। মা আর কিছুই বলল না। রাজি না অরাজি, বোঝা গেল না কিছুই। যেন খানিকটা সন্ধ্যাবেলা বাবার ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপরে ঠেলে রেখে দিল ব্যাপারটা। কিন্তু মা বকল না। রাগ দেখাল না।

আশা পা টিপে টিপে ওদের সেকেলে ভাঙা বড় আয়নাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হেসে ফেলল ও। সেই রহস্যময়ী ছায়ালোকে সত্যি যাবে ও? আশ্চর্য। কেন? নিজেকে দেখল আশা। সেই তো ডুরে শাড়ির ঘেরাওয়ে, ছিটের জামার বেষ্টনীতে সেই একই রকম। দেখাচ্ছে তাকে। তবু যেন অবাক হয়ে, নিজের প্রতিটি অঙ্গে অনুসন্ধিৎসু হয়ে তাকাল। ওই ছায়াদের। মতো শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তেমন উঁচু নিচুর রুদ্ধশ্বাস ঢেউ কোথায় আশার অঙ্গে সঙ্গে? এ যেন কিছু নম্র, একটু বা বিষণ্ণ তবু ওর নিজের উচ্ছল চাপা হাসির মতোই এক গোপন উচ্ছ্বাসে সারা শরীরটাকে বড় তরাসে ঢাকা ঢাকা রাখতে ইচ্ছে করে। পুরুষের চোখের কাছে যে এতেই নিজেকে পরিস্ফুট মনে হয়। ফটিকদার কাছে এই যে দুরন্ত উচ্ছ্বাস আকুল হয়ে ওঠে।

কিন্তু ওদের? চোখ তোলবার আগে সবটুকু চোখে পড়ে। তবু সে যেন একটা সর্বনাশের মতো ভাল লাগে। তাই নিজেকে সাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল আশার। আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখল আশা, ওর দুপাশে চুল ফাঁপানো, মুখে আর ঠোঁটে রং, চোখে কাজল, ভুরুতে কালো আঁচড়। পেটকাটা ছোট পাতলা জামা, ভিতরে ব্রেসিয়ার, আর তারই উজান টানে দুই শিখর-মধ্যে নীল সিল্ক, বহতা নদীর মতো। সবশেষে ও চোখে দেখল কালো গগলস। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা হাসি ওর বুক ঠেলে উঠে এল। আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরল সেই মুহূর্তেই। সর্বনাশ! মা রয়েছে। কী একটা ভেবে বসত এখুনি হঠাৎ হাসি শুনলে।

কিন্তু ফটিকদা কেন না জানিয়ে চলে গেল? তাড়াতানি বিনুনি খুলতে লেগে গেল আশা। খুলতে খুলতে গেল রাংচিতের বেড়ার কাছে। ভাবল, ফটিকদা নিশ্চয় ওখানেই রয়েছে। যা আত্মভোলা বিভোর মানুষ কোথায় বসে হয়তো হা করে সিনেমা তোলা দেখছে। আশার দিকে নজরও ছিল না হয়তো। এখন বুঝি হা করে দেখছে।

মন খারাপ হয় বইকী একটু। অতটা আত্মভোলা হলে মেয়েদের মনে লাগে! ফটিকদার মনেও কি লাগে না? লাগে, অনেক বার তা টের পেয়েছে আশা।

দু-তিনটে প্রজাপতি মাথার কাছে মুখের কাছে পাখা ঝাপটা দিয়ে গেল। আশা ভুরু কুঁচকে দেখল, কিন্তু মন দিল না। বিনুনি খুলে মাথায় তেল দিয়ে তাড়াতাড়ি মাকে বলে, নদীতে ছুটল।

মা ছুঁড়ে দিল পিছন থেকে, এখন যেন আবার ওখানে রঙ্গ করতে যেয়ো না, সংসারের কাজ আছে।

অর্থাৎ সিনেমার ওখানে যেন এখন না যায়। জবাব না দিয়ে আশা ছুটল। কিন্তু সতীতলার মন্দিরে সেই পাখিদের নির্ভীক জটলা। ঝুরি-নামা বটের ছায়ায় রোদের লুকোচুরি খেলা। বিগ্রহহীন পুরনো মন্দিরটা তেমনি শেষের দিনের নোটিশ-পাওয়া বিমূঢ় স্তব্ধতায় শিরদাঁড়া বাঁকা।

সহসা উদাস হল আশার মন, সব তরঙ্গ থির নিস্তরঙ্গ হল। আর অনেক তলায়, ছোট একটা ঘূর্ণি পাক খেয়ে উঠল অভিমানে। তবু চোখের পাতা নামিয়ে, ভুরু কুঁচকে একটি জিজ্ঞাসা বাঁকা বড়শির মতো বিধে রইল। কোথায় গেল ফটিকদা?

ঘাটে গেল আশা। জলের নীচে শ্যাওলার আলুলায়িত জটা বাঁচিয়ে চান করল। আজ ঘাটে ভিড় কম। দুটি ডুব দিয়ে উঠে পড়ল আশা। ওপরের ধানকাটা-মাঠের দিকে তাকিয়ে মাথা মুছল। তারপর ভেজা কাপড় ছপছপিয়ে এল।

এ বারও সতীতলা তেমনি শূন্য। শুধু রাস্তার ওপর পড়ে একটু থমকে গেল আশা। কয়েকটি অচেনা ছেলে তার দিকে হা করে তাকিয়ে রয়েছে। এ শহরের কলেজের ছেলে। নাগরাঘাটে আশাকে নিয়ে ঘটনাটা দেখেছে।

রাগতে গিয়ে হাসি পেল আশার ওদের রকমসকম দেখে। ওদের পেরিয়ে এসে আশা শুনতে পেল, লাকি গার্ল।

ক্লাস টেন অবধি পড়েছে আশা। ও কথাটার মানে জানে। তাই আরও হাসি পেল তার। সেই সঙ্গে দু চোখের বিস্মৃত কৌতুকচ্ছটায় আবার সেই ছায়ারা ভেসে উঠল। সেই জন্যই ভাগ্যবতী আশা?

বোধ হয়। নইলে এখনও কেন এমন বিস্মিত সংশয়ের ঘোর তার মনে। অবিশ্বাস্য, অথচ দূর-রহস্যের হাতছানির একটি ভয় খুশি খুশি ভাব ওর চেতনাকে এমন ঘিরে রয়েছে কেন? ও কি সত্যি সেই অন্ধকার ঘরটার পরদায় ভেসে উঠবে? তবু কাউকে দেখতে পাবে না?

মায়ের বিরক্ত তীক্ষ্ণ চোখে চোখ পড়তেই সংবিৎ ফিরল আশার। মনে মনে বলল, ছিঃ নিশ্চয় আমি হাসছিলাম। রান্নাঘরের পিছনে, বাঁধানো চত্বরে যেতে যতক্ষণ ওকে দেখা গেল, ততক্ষণ মা ঠায় তাকিয়ে রইল।

তারপর খেয়ে, কাজকর্মে কেটে গেল সারা বেলা। শ্যাম রাম ফেরেনি স্কুল থেকে। বোধ হয়, ছুটির পর চলে গেছে নাগরাঘাটে।

ছুটির বেলা পার হয়ে যাওয়ায় মা-ই প্রথম বলেছে, হারামজাদারা গেছে সেখানে।

কিন্তু আশার বলতে বাধল যে, সে খুঁজে দেখে আসবে কি না। অন্য দিন হলে পারত, আজ আশার ভয় ও লজ্জা হল।

অগ্রহায়ণের ছোট বেলায় ছায়া এল জলদে। কারখানাগুলির ছুটির বাঁশি বেজে উঠল। কেন যেন মনে হয়েছিল আশার, আজ ফটিকদা সোজা এ বাড়ি চলে আসবে। এল না। কৃষ্ণকলির ঝড়ে সারাদিনের বাসি ফুলগুলি আবার সতেজ হয়ে উঠতে লাগল। উত্তর কোণের কাঁঠাল গাছটায় ফিরে এল কাকেরা। বাবা বাড়ি এল।

হরেন চক্রবর্তী স্থানীয়। বাঙালির কাপড় কলের নিম্নশ্রেণীর কেরানি উঁচু করে কাপড় পরা, হাতা গুটোনো মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি, রোগা লম্বা শরীরে ঝলঝল করে। নুয়ে পড়া ভারবাহী, সদ্য জোয়াল নামানো ক্লান্তিতে ধীর ও মন্থর। চল্লিশে চালসে না পড়লেও বার্ধক্যের পদক্ষেপ সর্বাঙ্গে।

আশা পালিয়ে গেল আগেই রান্নাঘরে। তাড়াতাড়ি উনুনে আগুন দিয়ে চা বসালে সে। যদিও কান খাড়া রাখল, মা কী বলে।

কিন্তু মা কিছুই বলল না। বাবার হাত মুখ ধোয়া হয়ে গেল। মা হ্যারিকেনের চিমনি মুছছে ঘরে বসে। এমন সময় হরিশের ডাক শোনা গেল, হরেনদা আছেন নাকি?

–কে?

–আমি হরিশ।

 বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে আশার। উনুনের ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে রইল সে। রান্নাঘরে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু বেরুতে পারল না। শ্যাম-রামেরও গলা শোনা গেল। শ্রীমানেরা ফিরল এখন।

আবার বাবার গলা শোনা গেল, আরে কী খবর ভাই। কোনও চাঁদার্টাদা নাকি।

না, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। বসতে হবে।

 –ও। তা হলে এসো। কই গো, মাদুরটা পেতে দাও তো বারান্দায়।

আশা টের পেল, মাদুর পেতে দিল মা। হরিশের গলা শোনা গেল, ইনি কানাই মজুমদার, নাম শুনেছেন নিশ্চয়, সিনেমা ডিরেক্টর।

বাবার শোনবার কথা নয়। কারণ বাবা সিনেমা দেখে না। শোনা গেল, অ!

হরিশ বলল, আপনি শুনেছেন কিছু?

না তো। এই আসছি। কেন, কী হয়েছে?

–না খারাপ কিছু নয়, বরং শুভ। ওঁরা এসেছেন এখানে ছবির আউটডোরের কাজে। আমাদের এ পাড়ার বাড়িতেই ভাড়া আছেন। নাগরাঘাটে ওদের ছবি তোলার সময় আশা দেখতে গেছল। তা আশাকে দেখে

এ বার কানুবাবুর গলা শোনা গেল, আমরা আপনার মেয়েকে একটি ছোট রোলে নিতে চাই। মানে, ওই মেয়েটিকে পেলেই আমার সুবিধে হয়। আর কাজটাও এখানেই হয়ে যাবে। ওকে কলকাতার স্টুডিওতে যেতে হবে না। এখন আপনার যদি আপত্তি না থাকে।

হরিশ বলল, আপত্তি থাকবে কেন? পয়সা নিয়ে কাজ করবে। এমন কিছু পাপ কাজ নয়। এইতেই হয় তো আশা একদিন ফিল্ম স্টার হয়ে যাবে।

–ফিল্ম স্টার!

 বাবার মোটা মন্থর গলায় যেন রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল। তারপরে বলল, না, মানে আমাদের তো গরিবের ঘর। শুধু শাঁখা সিঁদুর দিয়েই মেয়ে পার করতে হবে তো। তাই আখেরের ভাবনাটা ভাবতে হবে।

আহা! আখেরের ভাবনা আবার কী? ভুরু জোড়া কুঁচকে নিজের মনেই বলল আশা, শাঁখা সিঁদুরের বেশি চাইছেই বা কে? ফটিকদা কিছুই চায় না। আখের তো ঠিক হয়েই আছে। এখন যার ভাবনা, সে-ই ভাববে। তা সে সিনেমায় নামা হোক বা না হোক। বাবার ধন দৌলত নেই, আশারও কিছু নেই, একটি মেয়েজীবন ছাড়া। সেটাও সে নিজের জন্যে রাখেনি, ফটিকদা নিয়ে নিয়েছে। জীবনটা যার সঙ্গে কাটবে।

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল আশা। শুনতে পেল বাবার গলা, একটু চা খেয়ে যান। খুকি, ও খুকি?

আমাকেই ডাকছে বাবা। ও জবাব দিল, কী বলছ বাবা?

–এঁদের জন্যেও একটু চা করিস রে।

কিন্তু কী স্থির হল? একদম শুনতে পায়নি আশা। ও তাড়াতাড়ি অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে আরও জল ঢেলে দিল। দিয়ে বাইরে উঁকি মারতে যাবে, মা ঢুকল। ঢুকে শিল পেতে বসল। নোড়া দিয়ে হলুদ থেঁতো করতে করতে বলল, বাঁধা ঘোড়া-ই দিনরাত্তির লাথি ছুড়ছে, এবার ছাড়া পেয়ে বেলেল্লার। একশেষ হবে।

তার মানে, বাবা রাজি হয়ে গেছে? কিন্তু চুপ করে রইল আশা।

মা আবার বলল, বে’ তো কোনও কালে এমনিতেও হত না, এ বার কান পাতাও দায় হবে। ওই, টাকা আনবে আর স্বাধীন জেনানা হয়ে ব্যাটাছেলের হাত ধরে বেড়াবে।

তা হলে রাজি হয়ে গেছে বাবা। ভিতরে ভিতরে একটা হাসির উচ্ছ্বাসের মধ্যেও মনে মনে অবাক না হয়ে পারল না আশা। মা যে কত রকম কথা বলে। তখন জিজ্ঞেস করল টাকার কথা। যেন টাকা দিলে মায়ের আপত্তি নেই। এখন আবার রাগ করছে। তার কারণ আর কিছুই নয়। ওই ফটিকদার ওপর বিতৃষ্ণা। অর্থাৎ, এখন থেকে আমি ফটিকদার সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেলামেশা করব, আর লুকোচুরির ধার ধারব না। এই মায়ের ভয়।

তা হাত ধরে বেড়াবার মতো অতটা বেহায়া না হলেও, আর কার সঙ্গে আশা স্বাধীনভাবে মেলামেশা করবে।

আশা কোনও কথা বলল না। ওদের ময়লা ছোট ছোট কাপগুলি যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে চা পরিবেশন করল।

কানুবাবু বললেন, কাল তা হলে তুমি যেয়ো। গাড়ি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে সকালে। খাওয়া দাওয়া সব ওখানেই হবে, বুঝলে?

আশা বাবার দিকে এক বার আড়চোখে তাকিয়ে ঘাড় কাত করল। বাবাও যেন এক বার তাকাল একটু অবাক হয়ে। অনেক দিনের মধ্যে বোধ হয় মেয়েকে এ রকম লক্ষ করে দেখবার দরকার হয়নি। শ্যাম-রামও দেখছিল দিদিকে। সবাই দেখছিল। যেন দেখতেই এসেছে আশাকে। এবং সকলের পছন্দ হয়েছে।

আশা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল বাতি জ্বালাতে। সন্ধ্যা দেখাতে হবে। অন্ধকার নামছে একটু একটু করে। মশারা আক্রমণ শুরু করছে।

রাম ছুটে এসে বলল, তুই মোটরগাড়িতে করে যাবি রোজ?

শ্যাম বলল, হ্যাঁ, ও তো এখন ফিল্ম স্টার। কিন্তু দ্যাখ দিদি, আমি কিন্তু আর ওই দড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দেখব না, তোর সঙ্গে ভেতরে যাব।

রাম বলল, আর আমি মোটরে চেপে যাব তোর সঙ্গে।

আশা দুজনকেই বলল, আচ্ছা, হবে সে সব।

কানুবাবুকে নিয়ে হরিশ চলে গেল। আশা দেখল, বাবা রান্নাঘরে যাচ্ছে মায়ের কাছে। এই সুযোগ, আর এক মুহূর্তও দেরি নয়। সে বলল, রাম, শিগগির শাঁখটা বাজিয়ে দে নারে।

বলে সে বাতি নিয়ে চলে গেল রাংচিতের বেড়ার কাছে, তুলসীতলায়। ফিরে এসে ঘরের চৌকাঠে একটু গঙ্গাজল ছিটিয়েই দৌড়। রামের শঙ্খনাদ তখনও চলছে। আশা এক দৌড়ে পদ্মদের বাড়িতে। ফটিকদা নিশ্চয়ই এখানেই অপেক্ষা করছে। পদ্মর দাদা আশু, ফটিকদার খুব বন্ধু। ও বাড়ির সকলেই জানে, ফটিকের সঙ্গেই বিশেষ করে আশা দেখা করতে আসে এ বাড়িতে! শুধু পদ্মর মা জেনেও না জানার ভান করে।

আশা দৌড়ে এসে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল উঠোনের ওপর। দেখল, ফটিকদা, আশুদা আর পদ্ম, তিনজনেই বসে আছে। ওরা যেন কী বলছিল। আশাকে দেখেই থেমে গেল।

আশা দেখল, ফটিকদা মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখেছে কেন? রাগলে ফটিকদার চোখ দুটি কুঁচকে যায়। আর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। এখন সে রকম দেখাচ্ছে। কেন?

পদ্মই প্রথম হেসে বলল, কী হল? দাঁড়িয়ে রইলি যে, আয়।

আশুদা বলল, এসো আশা।

আশার চোখের দিঘিতে গাঢ় অন্ধকার, তবু নক্ষত্রের ঝিকিমিকি। ফটিকদার মুখ থেকে ওর দৃষ্টি সরল না। পরমুহূর্তেই সে চমকাল যখন দেখল ফটিকদা সটান উঠে দাঁড়াল।

ফটিক বলল, আমি চলি।

কাকে বলল, বোঝা গেল না। কিন্তু এগিয়ে এল দরজার দিকে। আশার কাছাকাছি আসতেই সে বলল, চলে যাচ্ছ।

ফটিক দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ।

–আমি এসেছি বলে?

 চাপা কান্নার মতো শোনাল আশার গলা।

-হ্যাঁ।

ফটিকের গলায় সমান ঝাজ। আশা কষ্ট করে ঢোক গিলে বলল, কেন?

-কেন? কেন আবার কী? আমার ইচ্ছে, আমি চলে যাব।

আশুদা বলে উঠল, এই ফটিক, ঝগড়া করিস নে।

 ফটিকদা তার সামনের আলবোটের ঝাড়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঠোঁট উলটে বলল, আমার বয়ে গেছে ঝগড়া করতে। ফটকে বাঁড়ুজ্জে লোহা কলে কাজ করে, তার এখন ফ্লিমস্টারের সংবাদ শোনবার সময় নেই। নিজের ঝাড়ে বাঁশ কাটি বাবা, পরের বাগানে আমি ফুল তুলতে চাইনে।

এমনি অদ্ভুত সব উপমা দিয়ে কথা বলা অভ্যাস ফটিকের। অন্য সময় হলে, আশা হাসত। এখন তার হাসি পেল না। সে শুধু চোখের পাতা তুলে ফটিকদার মুখটা এক বার দেখল।

ফটিক দু পা এগিয়ে, আবার ফিরে দাঁড়াল। বলল, এ বার তোর মা কী বলবে? আমার সঙ্গে কথা বললে তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়, আর এখন টাকার লালচে সিনেমায় নামতে দিলে সব শুদ্ধ হয়ে যায়, না? শালা ঝাটা মারি অমন পটপটানির মুখে।

কথা শেষ করবার আগেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ফটিক। আশা তেমনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ তুলে, পদ্ম আর আশুদার দিকে তাকাতে পারল না। অপমান ও কষ্টে ওর বুকের ভিতর থেকে একটা তীব্র করুণ শব্দ বেরিয়ে আসতে চাইল। উপচে পড়তে চাইল ওর চোখের দিঘি। কিন্তু চুপ করে, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আশা। সদ্য বাঁধা খোঁপায়, নত কাঁধে, কান্না-চাপা স্থির প্রদীপ্ত চোখে, পদ্মদের সাঁঝ-আঁধার উঠোনে কান্নার চেয়ে বেশি শোকাহত দেখাল তাকে।

ফটিকদা অনেক বার রেগেছে। এমন করে রাগেনি। আশা প্রতি বারেই চুপ করে থেকেছে। কিন্তু এবারের নীরবতার মধ্যে, তার ভিতরে ভিতরে এত প্রবল কলরব সে শোনেনি। ওই দূর রহস্যের ছায়ায় যেতে আশার এত যে ভয় ও খুশি তাতে ফটিকদা এতটুকু সাহস, এক ছিটে হাসিও দিলে না। দেবেও না। বরং না গেলেই ফটিকদা খুশি হবে। কেন?

আশা জিজ্ঞেস করবে না। কিন্তু আশা কাঁদবেও না। কারণ, ফটিকদা এটুকু বুঝতে চায় না, আশার ভয়-অভয়, হাসি-কান্না, এ সংসারে শুধু একজনের কাছে তার প্রাপ্য অপ্রাপ্য মিটিয়ে নিতে চায়!

পদ্ম উঠে এল কাছে। বলল, বসবি নে আশা।

আশা বলল, না, দেরি হয়ে যাবে, মা খুঁজবে।

পদ্ম বলল, খুব রেগে গেছে ফটিকদা।

যেন তাতে যুক্তি আছে, এমনি সুর পদ্মর গলায়। মনে মনে তা হলে পদ্মও রুষ্ট। তাই বুঝি সকালে ভিড়ের মধ্যে পদ্ম দাঁড়িয়েছিল, ছুটে আসেনি।

আশা বলল, যাই।

বেরিয়ে এল সে। পথের দু পাশে বাগানে ও বনে অন্ধকার দ্রুত জমা হচ্ছে। ডাক শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝির।

আশার ঠোঁটে এক বিচিত্র ভীত বিস্মিত হাসি দেখা দিল। মনে মনে বলল, এই জন্যেই বুঝি সেই প্রথমদিনের গাড়ির শব্দে চমকে উঠেছিলাম?

.

পরদিন সকালবেলায় সত্যি গাড়ি এল একেবারে গলির মধ্যে। এ গলিতে আর কোনও দিন কেউ গাড়ি ঢুকতে দেখেনি। এ সেই প্রথমদিনের দেখা গাড়িটা। সব বাড়ি থেকে সবাই উঁকি মারল। ছোট ছোট এক দল ছেলেমেয়ে এল গাড়ির পিছনে। শ্যাম রাম ছুটে গেল পড়া ফেলে।

গাড়ি থেকে নেমে এল বিনয়। সেই ম্যারিনশার্ট, গলায় ক্যামেরা, চোখে গগলস।

আশা তার মায়ের কাছে ছিল রান্নাঘরে। সে বেরিয়ে এল।

 বিনয় বলল, একি, তৈরি হওনি?

আশা লজ্জায় হেসে বলল, এত তাড়াতাড়ি?

বাঃ, কখন সবাই লোকেশনে চলে গেছে। নাও চটপট তৈরি হয়ে নাও। তোমার বাবা কোথায়?

কাজে গেছেন।

 –মা?

একটু সংকুচিত হল আশা। বলল, মা রান্না করছেন।

 বিনয় সঙ্গে সঙ্গে সম্বন্ধ পাতিয়ে বলল, মাসিমাকে বলো না একটু চা খাওয়াতে।

বলে সে বারান্দার ওপরে বসে পড়ল। আশা তাড়াতাড়ি বলল, দাঁড়ান, একটা আসন দিই।

–না না, আসন টাসন লাগবে না। তুমি তৈরি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আর হ্যাঁ, তুমি কি চান করেছ নাকি?

না।

করো না তা হলে। জামা কাপড় বাড়তি নিয়ে নাও, ওখানেই করবে। কারণ, মাথায় তেল দেবে কি না, কানুদা বলবেন। আজ হয়তো তোমার কাজ হবে।

আশা বারান্দা দিয়ে রান্নাঘরে গেল। মা তখন লুকিয়ে বিনয়কে দেখছিল। যদিও চায়ের জলটা চাপিয়ে দিয়েছিল আগেই।

মা জিজ্ঞেস করল, ও কে?

আশা বলল, ওদের লোক।

মা এক বার আশার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, ভাল কাপড়ের মধ্যে নীল তাঁতেরই আছে। কী পরে যাবি?

–যা বল।

 মা আর ও বিষয়ে কিছু বলল না। একেবারে অন্য কথা বলল, যাচ্ছ যাও, কিন্তু ওখানেই থেকো। ওখান থেকে আবার অন্য কোথাও টহল দিতে যেয়ো না।

অর্থাৎ ফটিকদার সঙ্গে যেন কোথাও আড্ডা মারতে না যায় আশা। মা জানে না যে, ফটিকদা ওখানে হয়তো যাবেই না কোনও দিন।

শ্যাম আর রাম ছুটে এল রান্নাঘরে। প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হল, দিদি, আমি যাব।

জবাব দিল মা, না কেউ যাবে না। সামনে পরীক্ষা, ইস্কুলে না গিয়ে সব সিনেমা তোলা দেখতে যাবে। শিগগির চান করে খেয়ে ইস্কুলে চলে যা।

আশা বলল, মা, আজ রাম যাক।

 মা এক বার রামের দিকে তাকিয়ে চা তৈরি করতে লাগল। অর্থাৎ আপত্তি নেই। কিন্তু শ্যাম একেবারে রুদ্র। কারণ রামের চেয়ে তার আকর্ষণটা বেশি। সে বড়, এখন সে লুকিয়ে দু-একটা সিনেমাও দেখতে যায়। সিনেমা হলে গিয়ে শুধু ফটোও দেখে আসে। সে প্রায় খেঁকিয়ে উঠে আশাকে বলল, রাক্ষুসি আমি গেলে তোর কী হত?

–তুই কাল যাস।

 –যা, যেতে চাইনে তোদের ওই পেত্নিদের ফিলম দেখতে।

 বলে সে দুপদাপ করে বেরিয়ে গেল। মা বলল, দাঁড়া, তোর পিঠে ঘা কতক দিই।

আশা বিনয়কে চা দিয়ে হাতে মুখে সাবান দিল। ড্রেস দিয়ে নীল শাড়ি পরল সাদা জামার ওপরে। ওর টিনের সুটকেস থেকে সযত্নে রক্ষিত স্নোর কৌটো বার করে মাখল। চোখে কাজল দিল সরু করে। যেমন পুজোর সময় প্রতিমা দেখতে গেলে সাজে, সেই রকম সাজল। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট কামড়ে ধরল সে। ওগুলো লাল করতে পারবে না সে-ওই ছায়াদের মতো। জামাকাপড় তার অতি সাধারণ। তবু মনে হচ্ছে, কত না জানি সেজেছি। লজ্জা করছে, তবু ছায়াদের মতো না হতে পারার একটা দুর্বলতায় তাকে বিষণ্ণ দেখাতে লাগল।

রামকে নিয়ে যাবার আগে, রান্নাঘরে গিয়ে বলল, যাচ্ছি।

মা এক বার মেয়েকে দেখে নিয়ে বলল, এসো। যা বলেছি মনে থাকে যেন।

বিনয় বলল, বাঃ, বেশ হয়েছে। এক মিনিট ওই বেড়ার কাছে দাঁড়াও।

আশা রাংচিতের বেড়ার কাছে দাঁড়াল। বিনয়ের ক্যামেরা ক্লিক করল! চোখ থেকে ক্যামেরা সরিয়ে রাংচিতের ঝাড়ের কাছে এল সে হাসতে হাসতে। সবুজ পাতার ওপরে মস্ত বড় প্রজাপতিটা দেখিয়ে বলল, ছবিতে এসে গেছে এটা। এনলার্জ করলে দারুণ হবে। ঠিক তোমার মুখের পাশেই দেখা যাবে।

আশা বলল, সত্যি?

 বলে ও ফিরে দেখল, মস্তবড় প্রজাপতিটাকে। রাংচিতের ঘোর সবুজ মোটা পাতার ওপরে প্রজাপতিটা যেন ধ্যানমগ্ন, নিথর। একটুও কাঁপুনি নেই পাখায়। ও যেন ফটো তোলার জন্যেই পাখা দুটিকে ঈষৎ নামিয়ে, ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েছে। আশার মনে হল কয়েকদিন আগের সেই বড় প্রজাপতিটা বোধ হয়। রাজ্যের রং মেখে এসেছে সারা গা জুড়ে। তার হাত নিশপিশিয়ে উঠল। সে হাত বাড়াল সন্তর্পণে।

বিনয় বলল, পারবে না ধরতে, পালাবে।

 ঠিক সেই মুহূর্তেই আশার সরু সরু আঙুল যেন পাখির ঠোঁটের মত পতঙ্গটিকে ধরল। ধরে হাসতে হাসতে টান দিতেই একটা পাখা ছিঁড়ে এল। কী হল? থতিয়ে গিয়ে আর একটা পাখায় টান দিতেই দেখা গেল প্রজাপতিটা মরা। পাতার সঙ্গে যেন আঠা দিয়ে জোড়া। গুটিকয় পিঁপড়ে ইতিমধ্যেই, ছিদ্র করে ঢুকে গেছে পেটের মধ্যে।

রাম বলে উঠল, মরে গেছে রে দিদি।

 বিনয় হেসে বলল, সেইজন্যেই শ্রীমান নট নড়নচড়ন। তা হোক গে মরা, ছবিতে দারুণ এফেক্ট আসবে।

–আসবে। আশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

বিনয় বলল, আসবে বইকী। একটা ছবি তো।

আশা হাসল। কিন্তু একটা মরা প্রজাপতি তার মুখের পাশে কেমন করে জ্যান্ত দেখাবে। মনটা যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে রইল আশার।

ড্রাইভার সামনের পোডড়া জায়গাটার মধ্যেই গাড়ি রেখেছিল। ওরা এসে উঠতেই গাড়ি ছাড়ল। পাড়ার সবাই আবার উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল। আশার লজ্জা করতে লাগল। মাথা নিচু করে বসে রইল।

বড় রাস্তায় এসে গাড়ি পড়তেই সতীতলার দিকে দেখল সে। কেউ নেই। পুরনো ভাঙা রাস্তা। গাড়িটা আস্তে আস্তে মোড় ঘুরতে যাবে। কে যেন চিলের মতো শিস দিয়ে উঠল পাশ থেকে। আশা। দেখল, ফটিকদার বন্ধু কার্তিক। সঙ্গে আরও দুটি পাড়ার ছেলে।

আশা ভুরু কুঁচকে মুখ ফেরাল। সেই মুহূর্তেই কানে এল, সতীতলার হিরোইন চললেন।

আশার বুকে খচ করে বাজল কথাটা। সতীতলার হিরোইন? ফটিকদার চেলারা তাকে এ সব বলছে। ব্যাপারটা কোন পর্যায়ে গেছে, ভাবতে ভয় করছে আশার। মনে হল, চিৎকার করে ছুটে বাড়ি গিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে সে।

বিনয় বলল, গম্ভীর হলে যে। তোমাকেই বলেছে বুঝি।

রাম বলে উঠল, হ্যাঁ ওরা ফটিকদার বন্ধু কিনা। সাদা ও কথা বলল রে দিদি।

বিনয়ের সামনে আশা জোর করে হাসতে চাইল। কিন্তু ওর কালো চোখ দুটিতে খর দুপুরের রৌদ্র ঝলকে উঠল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল ফটিকদার মুখোনি। কাল সন্ধ্যার চেয়েও ওর ভিতরটা আরও শক্ত কঠিন হতে লাগল।

বিনয় বলল, এ পাড়াটার নাম সতীতলা বুঝি।

 আশা বলল, না। রাস্তাটার নাম বসন্ত ভট্টাচার্য রোড। তবে সতীতলাই বলে লোকে।

 বিনয় বলল, ও! তা তোমাকে ও সব বলবেই লোকে। ছেলেরা পেছনে লাগবেই, বরাবর দেখলাম তাই।

তা বলে ফটিকদার বন্ধুরা। আর পাড়ার বড় ছেলেরা সবাই ফটিকদার বন্ধু। তবে ফটিকদাই আশার পিছনে লাগছে?

রাগ-ভয় বিস্ময়, ত্রিমুখী সাঁড়াশিটা যেন আশার টুটি টিপে ধরল। তবু আশৈশব ক্ষুধা ও দুঃখের সঙ্গে ঘর করা মেয়েটি যেমন চিরদিনই হেসেছে, তেমনি করেই হাসল আশা। আঠারোয় আটচল্লিশ বছর ধরে দেখা বিচিত্র বিস্ময়কর দুঃখের দহনে বিষণ্ণ নম্রতা, এ সংসারের দায় আশার আয়ত্তে। সে তো স্তব্ধ বিস্ময়ে, অবাক হেসে আজীবন এ সংসারের দিকে তাকিয়েছিল। তবু তার উত্তীর্ণপ্রায় ষোড়শী কৈশোরে যে দিন আজন্ম চেনা ভোমরাটা ঝাঁপ খেয়ে পড়েছিল, সে দিন তার পাপড়ি ঢাকা সমস্ত রেণু শিউরে উঠেছিল। সংসার তাকে মারতে পারেনি। আজ সেই ফটিকদা তাকে, হেলাফেলায় বাঁচা মরা বুনো ঝড়ে ফেলে দিতে চায়। দিক। আশা কাঁদবে না। কারণ, এ সংসার তার জৈবিক সাধের উচ্ছ্বাসে যদি বা আঁতুড়ে প্রথম অভ্যাসবশে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করেছিল আশাকে, আজ শ্মশানের শঙ্খও শত শত আশাকে আমন্ত্রণ করছে। তাই সুখে দুঃখে, মানুষের মন নিয়ে বারে বারে বেঁচে থাকা ছাড়া, জটিল কিছু জানে না আশা। সে কাঁদবে কেন? হাসুক, আশা হাসুক।

নাগরাঘাটের উঁচু পাড়ে, বটের ছায়ায় সাউন্ডভ্যানের পাশে এসে গাড়ি দাঁড়াল। রামকে নিয়ে নেমে এল আশা। দেখল, ভ্যানের কাছেই আজ বিভার পাশে পদ্মরা দাঁড়িয়ে আছে। সুষমা বাণীরাও আছে।

আশার যেতে ইচ্ছে করল ওদের কাছে। কিন্তু দেখল, বিভা খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই সঙ্গে পদ্ম সুষমারাও।

তবু পদ্মকে জিজ্ঞেস করল আশা, কখন এসেছিস।

 জবাব দিল সুষমা, সেই সাতসকালে।

বলে ওরা এমন টিপে টিপে হাসতে লাগল, আশা মুখ না ফিরিয়ে পারল না। বিনয়ের সঙ্গে নেমে গেল নদীর চড়ায়। আশা দেখল, আজকে দড়ির বেড়ার ওপারে লোক এসেছে আরও বেশি। এমনকী বোম্বাই মিঠাই আর চিনেবাদামওয়ালারাও এসেছে। শহরটা বুঝি ফাঁকা হয়ে গেছে আজ।

কানুবাবু আজ প্যান্টের ওপর শুধু গেঞ্জি গায়ে কাজে লেগে গেছেন। ক্যামেরাম্যান তার অ্যাসিস্ট্যান্টদের নিয়ে কাজে ব্যস্ত। হিরোইন চঞ্চলা খালি গায়ে শাড়ি জড়িয়ে, পিঠে চুল ছড়িয়ে দিয়েছে। কাঁখে কলসি। পাড়াগাঁয়ের আইবুড়ো মেয়েদের মতো, তবু ঠিক যেন পাড়াগাঁয়ের নয়! ঠোঁট দুটিতে লাল টুকটুকে রং মাখা, মুখেও রঙের প্রলেপ। চোখে কাজল। চুলগুলি তেলহীন রুক্ষ নয়, যেন সিল্কের মতো মোলায়েম, মসৃণ চকচকে।

দেখল, বিজন মালকোঁচা দিয়ে কাপড় পরে শার্ট পরেছে। কাঁধে ঝুলিয়েছে সাইড ব্যাগ। প্রায় যেন এ শহরের ছেলেদের মতো, তবু ঠিক তা নয়! বিজনেরও মুখে রং। প্রাণেশ গলাবন্ধ কোট পরে প্রস্তুত। হাতে লাঠি, মোটা গোঁফ।

কোথা থেকে একটি ছোট নৌকা আনা হয়েছে। মাঝি যেন চেনা চেনা মনে হয় আশার। আশাকে দেখতে পেয়ে কানুবাবু এগিয়ে এলেন। বললেন, তুমি মেক-আপটা সেরে ফেলো।

বলে বিনয়কে ডাকলেন, বিনয়, একে এর কাপড়টা দাও। জামা খুলে, গাছকোমর বেঁধে শাড়ি পরবে। বিনুনি খুলে চুল এলোখোঁপা করে দেবে। আর…

আশার দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ চোখে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত এমনভাবে দেখলেন আশার লজ্জা করল। যেন আশাকে একটি মেয়ে হিসাবে দেখছেন না। গাছ কিংবা পাথর যাচাই করে দেখা কোনও জিনিস। বললেন, হু, হালকা মেক-আপ দেবে, ঠোঁট আর ভুরু প্রমিনেন্ট হবে, বুঝলে বিনয়। যাও তাঁবুতে নিয়ে যাও আশাকে।

বলে চলে গেলেন। বিনয় বলল, চলো।

 রাম বলল, আমি?

বিনয় বলল, তুমি ওই গাছতলায় কি যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে সব দেখো।

তবু রাম দিদির দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। আশা হাসল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। কষ্ট হল তার। তবু চলে যেতে হল বিনয়ের সঙ্গে। একটু আড়ালে যেতে চাইছিল আশা। সে টের পাচ্ছিল, তার দিকে অনেকে তাকিয়ে আছে ওই দড়ির বেড়াটার ওপার থেকে। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল। বলাবলি করছিল যেন কী। ভাল না মন্দ, বিস্ময় না বিদ্রূপ, কে জানে। শুধু পালাতে ইচ্ছে করছিল। হয়তো, ফটিকদাও আছে ওই ভিড়ের মধ্যে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই আছে। তার বন্ধুরাও আছে।

কিন্তু আশা এখনও কানে শুনতে পায়। চোখ ফেরালে দেখতে পায়। সে বুঝি এখনও পুরোপুরি ছায়া হয়ে উঠতে পারেনি এই চঞ্চলার মতো। যে তার দিকে তাকিয়ে এই মাত্র হাসল। বলল, কই, আমার সঙ্গিনী কোথায়? এখনও যে মেক-আপই হয়নি।

এই তো কনকদি কেমন আপন মনে কমলালেবু খেয়ে চলেছে। অনসূয়া গগলস পরে ক্যামেরাম্যান বিমলের সঙ্গে কী যেন বলছে আর হাসাহাসি করছে। ওদের দুজনের খুব ভাব। তারপরেই থির জলে বাতাসের মতো লজ্জায় একটু কেঁপে উঠল। দেখল বিজন তার কাছে দাঁড়িয়ে, তাকেই দেখছে অপাঙ্গে।

বিনয় বলল, কেমন?

বিজন যেন ছায়ার স্বরে বলল, বেশ। চাপা চাপা একটা গ্ল্যামার আছে আশার।

বিনয় বলল, দেখছ কী? কোনদিন দেখবে, হিরোইন হয়ে গেছে।

–কিন্তু ও যে লজ্জা পাচ্ছে। চঞ্চলা বলে উঠল।

সত্যি, শুধু লজ্জা নয়, আরও কিছু, যার নাম জানে না আশা। তার চোখের পাতা নত হয়ে আসছে। সে তাড়াতাড়ি তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়ল।

এখনও পুরোপুরি ছায়া হয়ে উঠতে পারেনি আশা। কিন্তু আজ তার অভিষেক। আজ সে ছায়া হবে। ছায়াদের রাজ্যে সে এসেছে। ছবির সজ্জা নেবে সে এ বার। তারপর থেকে বাইরের কোনও কিছু ফটিকদাদের কোনও কিছু আর দেখবে না, শুনবে না। দোহাই, দোহাই ভগবান, আশার যেন একটুও ভয় না করে। একটুও কান্না না পায়।

তাঁবুর মধ্যে ঘেরা জায়গায় কাপড় ছাড়ল আশা। কিন্তু ভীষণ লজ্জা করতে লাগল তার। জামা ছাড়া শুধু শাড়ি পরে কোনও দিন বাইরের লোকের সামনে আসেনি সে। আয়নার দিকে চোখ পড়তে মনে হল, নিজের খোলা কাঁধ আর পিঠের অংশ সে নিজেও বুঝি দেখেনি কোনও দিন। কিন্তু দেশবিখ্যাত। চঞ্চলা কত সহজে শুধু শাড়ি পরেছে। নির্বিকার হয়ে ঘুরছে সকলের চোখের সামনে।

ঘুরবেই, চঞ্চলা যে কাউকে দেখতে পায় না।

 বিনয় ডাকল, হল?

 আশা বেরিয়ে এল ডুরে শাড়ি গাছকোমর বেঁধে।

বিনয়, দেখে বলল, অলরাইট। বিনুনি খুলে ফেলো।

এমনভাবে বলল, আশা লজ্জা পাবার অবকাশ পেল না। তারপর সে নিজেই মুখে রং মাখিয়ে দিল আশার। ভুরু এঁকে দিল। ঠোঁটে বুলিয়ে দিল লিপস্টিক। চোখে টেনে দিল কাজল।

সাজতে সাজতে কান দুটি গরম হয়ে উঠছিল আশার। বিনয় তাকে এমন করে ধরছিল, এত ঘন হয়ে ছিল শরীরের সঙ্গে! বিনয়ের যেন খেয়াল নেই। কিন্তু কনকদি দেখছিলেন, আর কমলালেবু খাচ্ছিলেন। মনে হয় আশা অবাক হচ্ছিল, এত তাড়াতাড়ি অতগুলি লেবু ভদ্রমহিলা খেলেন কী করে। তবু লজ্জাই তার বেশি করছিল। উনি যেন হাসছিলেন ঠোঁট টিপে টিপে। সাজা হয়ে যাবার পর বললেন, মেক-আপে দেখছি তোমার হাত আছে বিনয়।

বিনয় আশার দিকে চোখ রেখেই বলল, কেন, খারাপ হয়েছে কনকদি?

না। তাই তো বলছি। তোমার যে এমন হাত আছে, জানতাম না।

কিন্তু কনকদির প্রৌঢ় ঠোঁটের কোণ কি কেন্নোর মতো কুঁকড়ে উঠল একটু?

বিনয় আশাকে ঠেলে দিল আয়নার দিকে, যাও দেখো কেমন হয়েছে। এ বার চুল খোলো। কানুদাকে ডাকি।

বলে সে বেরিয়ে গেল। আশা বিনুনি খুলতে খুলতে আয়নার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত যেন চিনতে অসুবিধে হল নিজেকে। পরমুহূর্তেই তার রং মাখা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। অপলক হল চোখ। নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। তন্ময় হল, আঙুলগুলিতে অন্যমনস্ক জড়তা এল বিনুনি খুলতে। মনে মনে বলল, ছায়ার মতো দেখাচ্ছে আমাকে।

কিন্তু কোথায় একটা অস্বস্তি, খচখচ করছে। যেন দুটি অদৃশ্য চোখ, অনেক দূর থেকে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

কানুদা এলেন। দেখে বললেন, ঠিক আছে। ওই কলসিটা দাও তো বিনয় আশাকে, কাঁখে নিয়ে দাঁড়াক। হ্যাঁ, ঠিক আছে।

তারপর তিনি বোঝাতে লাগলেন, আশা কী করবে। ও যেন একটি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। নদীতে রোজ জল আনতে যায়। ওদের পাড়ার একটি মেয়েকে ও এক দিন দেখল, রোজ নদী পারাপার করে এমনি একটি ছেলের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। রোজই দেখে, ওরা হাসে, কথা বলে। তারপর মেয়েটির ঘাটে আসা বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেটি তখন আশাকেই মেয়েটির সন্ধান জিজ্ঞেস করে। আশা যেন ভয় পায়। তবু সে বলে দিল, চিনিয়েও দিল বাড়িটা। শেষে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে, সংবাদও এনে দিল। মেয়েটির নাকি বিয়ে হয়ে যাবে শিগগির, তাই তার ঘাটে আসা বন্ধ ইত্যাদি। অর্থাৎ নায়ক নায়িকার যোগাযোগ করার ব্যাপারে সাহায্য করবে আশা, শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা ধরা পড়লে, আশাই এক দিন ভয়ে সব কথা বলে ফেলবে মেয়েটির বাবাকে। এইটুকু করলেই হবে আশাকে। অবশ্য, এটুকু করতেই নাকি অনেক দিন লেগে যাবে।

বলে কানুদা চলে গেলে। বিনয় বলল, চলো বাইরে।

আশার পা দুটি যেন জড়িয়ে এল সংকোচে। বলল, এখুনি কিছু করতে হবে নাকি?

না, সময় হলে কানুদা ডাকবেন। কিন্তু তাঁবুর মধ্যে বসে থাকবে কেন শুধু শুধু? আশা তাঁবুর বাইরে এল। কিন্তু সে দড়ির বেড়াটার দিকে তাকাল না। যদিও তার সর্বেন্দ্রিয় উজান ঠেলে ছুটে গেল ওই দিকেই।

প্রাণেশ তার ঝুটো গোঁফের ফাঁকে হেসে বলল, চমৎকার মানিয়েছে। তবে, চঞ্চলার সখী বলে মনে হবে না। ছোট বোন হলে মানাত।

কিন্তু আশা তখন শুনতে পাচ্ছে, কে যেন ফটিকদার নাম ধরে চিৎকার করছে। তার কানে এল আবার, সতীতলার হিরোইন। তারপরেই মিলিত গলার অট্টহাসির গুলি-বৃষ্টি হল যেন। শুধু আশারই কানে যাচ্ছিল এ সব। এখানে, কারুর কোনও মনোযোগ নেই দড়ির বেড়ার ওপারে।

বিনয় তাকে ডেকে নিয়ে গেল গাছতলায়। ফটো নিল আবার। আশা শুনতে পেল কানুদা বলছেন হরিশকে, আজ বড় গণ্ডগোল করছে সবাই।

হরিশ ছুটল দড়ির বেড়ার দিকে। আশার ভয় হল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার ভয়ের বাস্তব শব্দটা সে শুনতে পেল ফটিকদার গলায়, কেন, এ নাগরাঘাটের বাগানও কি বিনোদ ভটচাযের জমিদারি নাকি?

হরিশও চিৎকার করে উঠল, তোমরা গণ্ডগোল থামাবে কি না, জানতে চাই।

 ফটিকদাও চিৎকার করে বলল, তুমি কে হে হরিদাস?

 রাম ছুটে এল আশার কাছে। বলল, দিদি ফটিকদা ঝগড়া করছে।

ততক্ষণে কানুদা বিনয় সবাই ছুটে গেছে সেখানে। রাম আবার বলল, ফটিকদা বেড়া ডিঙিয়ে আসতে চাইছে, না?

আশা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, জানি নে।

 রাম দিদির হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, তুই ফটিকদাকে বারণ কর না ঝগড়া করতে।

 আশা তা পারবে না বলতে। ফটিকদাও আশার কোনও বারণ আর কোনও দিন শুনবে না।

তারপর গণ্ডগোল থেমে এল। কানুদারা ফিরে এলেন। আশা শুনতে পেল ক্যামেরাম্যান বিমল জিজ্ঞেস করছে, মাস্তানটি কে মশায়?

হরিশ বলল, কে আবার। আমাদের শহরে এ রকম অনেক আছে। চিরদিনই এরা এ রকম করে।

কানুদা বললেন, না হরিশবাবু এর চেয়ে সাংঘাতিক ছেলেদের পাল্লায় আমাকে পড়তে হয়েছে। এ ছেলেটি তো তবু আমার কথা শুনল। অনেক জায়গায় ক্যামেরা পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে।

তারপরেই ডাক পড়ল আশার। দুরদুরিয়ে উঠল আশার বুকের মধ্যে। এবার কাজ শুরু। নদীর উঁচু পাড় থেকে ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্য দিয়ে চঞ্চলার পিছু পিছু নেমে আসতে হবে আশাকে। কাঁখে থাকবে কলসি। আশা যেন চঞ্চলার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।

কিন্তু এ তো সত্যি জল আনতে যাওয়া নয়। তাই বারে বারে উঁচু পাড়ে ওঠা-নামা করেও মনের মতো ওঠা-নামা হয় না। এ তো আর সত্যি মিটিমিটি হাসি নয়। তাই হেসেও হাসি ঠিক হতে চায় না। এটাকে সাইলেন্ট শট বলে।

মনের মতো যখন হল, তখন ঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে। তার ঘাটে পা ডুবিয়ে নামা, জল ভরা শেষ হতে হতেই অগ্রহায়ণের দক্ষিণায়ন বেলা ঢল খেয়ে যায়। খাওয়ার ডাক পড়ে।

কিন্তু রাম? আশা বসবে কেমন করে খেতে? সে রামের হাত ধরে, তাঁবুর বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। কানুদা তাবুতে ঢুকতে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার? এটি কে?

–ভাই।

দাঁড়িয়ে কেন? ওকে নিয়ে বসে পড়ো। এসো তো খোকা, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

রাম আর দিদির দিকে ফিরে তাকাল না। আহ্বান মাত্র আজ্ঞা পালন। আশাকে বিনয় ডেকে বসাল তার পাশে। আশা দেখল, চঞ্চলা, অনসূয়া, বিমল আর বিজন নেই। ११५

আশা জিজ্ঞেস করল, চঞ্চলাদিরা খাবেন না?

বিনয় বলল, খাচ্ছে তো। ওরা গাড়িতে বসে খাচ্ছে। তোমার লজ্জা করছে এখানে খেতে?

-না।

বিনয় হাত তুলে হা হা করে উঠে বলল, এখানে, এখানে দাও ওটা, আশার পয়লা দিন আজ।

আশা লজ্জায় কাটা হয়ে দেখল, সামনের এগিয়ে-আসা হাতার মস্ত বড় মুড়োটা তার পাতে পড়ল। সবাই হেসে বলল, হ্যাঁ ঠিক হয়েছে।

আশা সলজ্জ চোখের পাতা এক বার তুলেই দেখল, রাম হা করে তাকিয়ে আছে মুড়োটার দিকে। কারণ, এমনভাবে দিদির পাতে মুড়ো পড়তে কোনও দিন দেখেনি ও। কিন্তু মরে গেলেও আশা এখানে ভাইকে একটু ভেঙে দিতে পারবে না। অথচ ভাইয়ের সামনে খাওয়া যায় কেমন করে তাও সে জানে না। লোকে কিছু বোঝে না। শুধু রুইয়ের ঝোলমাখা গলিত গোল চোখ দুটি অপলক তাকিয়ে রইল তার দিকে। যেন একটা কপিশ বুড়োটে চোখে তীব্র শ্লেষ। আঙুল দিয়ে একটা চোখ গেলে দিল আশা। কানা মুড়োটাকে ভাঙল একটু একটু করে। একটু একটু করে খেতে হল তাকে। সে জানল, কেমন করে খাওয়া যায়।

সারা দিনে আর আশার ডাক পড়ল না আজ। সূর্য অস্ত গেল। কানুবাবুর নির্দেশ শোনা গেল, প্যাক আপ।

আশা তার নিজের জামাকাপড় পরে নিল। ভুরু ঠোঁটের রং মুছতে যাচ্ছিল সে। বিনয় পিছন থেকে বলে উঠল, থাক না। অত ব্যস্ত কেন? বাড়ি গিয়ে তুলল।

কিন্তু মা কী ভাববে? পাড়ার লোকেরা যখন দেখবে, কী বলবে?

হরিশও বলে উঠল, হ্যাঁ থাক না।

আশার নজরে পড়েছে, হরিশ তাকে বারে বারে লক্ষ করছে। ঘন ঘন কাছে আসছে। প্রশংসা করেছে অনেক বার। রাম যেন কী বকবক করে বলছে।

রং মুছল না আশা। সে তাঁবুর বাইরে এল। দেখল ভিড় ভেঙে গেছে। দড়ির বেড়া নেই। অনেকে তাঁবুর চারপাশে এসে ভিড় করেছে।

আশা রামের হাত ধরে উঁচু পাড়ে উঠল। বিনয় তাদের পিছনে। উঠেই, বাঁ দিকের মুচকুন্দ চাপার তলায় দেখল বিভাকে। আর তার পাশে ফটিকদা। পাশাপাশি, প্রায় গায়ে গায়ে। বিভা হাসছে টিপে টিপে। কী যেন বলছে ফিসফিস করে। বিভা আর ফটিকদা পুরনো বন্ধু। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওদের ভাব হয়ে গেছে আবার।

তবু একটা অদৃশ্য প্রেত-বাতাস যেন আশার শিরদাঁড়ায় কষে ঝাপটা দিল। তবু একটি জ্বলন্ত আগুনের গলিত ধারা যেন তার কানের পাশ দিয়ে মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল। তার বুকের মধ্যে কতকগুলি শাণিত অদৃশ্য নখ আঁচড়াতে লাগল।

রাম বলল, দিদি, ফটিকদা।

 আশা নিচু গলায় বলল, থাক আয়।

আশা দেখতে চায় না। শুনতে চায় না। হতে চায়। ছবি হয়ে সবকিছু দেখাশোনার বাইরে থাকতে চায়। সে আপন মনে লীলা করে। যাকে সবাই দেখে সে কাউকে দেখে না।

তবু আশার বুকের মধ্যে একটি রুদ্ধস্বর ফিসফিস করে বলল, ওদের দুজনের মাঝে আমি শুধু জোর করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

তারপর আশার মনে হল, এ জন্যেই বুঝি সে প্রথম দিন গাড়ির শব্দে চমকে উঠেছিল!

বিনয় বলল, বাড়ি যাবে আশা, না বেড়াবে একটু?

আশা বলল, বাড়ি যাব।

–তা হলে চঞ্চলাদির সঙ্গে চলে যাও। তোমাদের গলির মোড়ে নামিয়ে দেবে।

চঞ্চলা ডাকল আশাকে। আশা পুরোপুরি ছায়া হতে চাইল। হেসে, সহজ লাস্যে যেন সে গাড়িতে গিয়ে উঠল। শুধু রামটা এক বারও দিদির মুখ থেকে চোখ সরাল না। ফটিকদাকে দেখেও, দিদি দাঁড়ায় না, কথা বলে না, এমন অভাবিত ব্যাপার সে ভাবতে পারে না।

গাড়ি থেকে নেমে গলিতে যখন পা বাড়াল আশা, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। গলিটা জনশূন্য।

রাম বলল, দিদি ফটিকদার সঙ্গে তোর ঝগড়া হয়ে গেছে?

 আশা বলল, চুপ কর দিকিনি।

 চুপ করল রাম। কিন্তু তারপরেই তার বিচিত্র জিজ্ঞাসা, মাছের মুড়োটা খেয়ে তোর খুব পেট ভরে গেছল, না?

আশা জবাব দিল না। এবং এই সারা দিন পরে, রাম আবার বলল, তোকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল।

 আশা বলল, যাঃ!

সত্যি। ঠিক ওদের মতো।

 অর্থাৎ ছায়াদের মতো। সারা জীবন ছায়া হয়ে থাকতে চায় আশা।

বাড়ি এসে কাপড় ছেড়ে, রং তুলে, মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজে লেগে গেল আশা। মা তাকে লক্ষ করে করে দেখল। ছাড়া ছাড়া দু-একটি কথা জিজ্ঞেস করল। রামে শ্যামে ঝগড়া করল।

একসময়ে বিনয় এল প্রডাকশন ম্যানেজার শঙ্করবাবুকে নিয়ে। বারো টাকা দিয়ে গেল আশার পারিশ্রমিক। তারপর খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে শুতে যাবার আগে মা বলল, কাল তো দেখলাম আনন্দ আর ধরে না। আজ কী হল?

আশা বলল, কিছু নয়, বড্ড ঘুম পাচ্ছে।

কিন্তু ঘুম কোথায়! শ্যাম আর রামের পাশে শুয়ে, তার দুই চোখ আকাশের তারা-গোনা দিঘিটার মতো অতন্দ্র হয়ে রইল। মাত্র দু বছর আগে হলেও, সেই দিনগুলি আবিষ্কারের বিষয় হয়ে উঠল। পদ্মদের বাড়িতে যাওয়া ষোলো বছর বয়সের সেই দিনগুলি। যে দিনগুলির হিসেবের আওতায় শুধু কিশোরীলজ্জা, ভয় অথচ এক কৌতুকোজ্জ্বল খুশির ছড়াছড়ি। দুটি চোখ, যার চাউনিকে অসভ্য বলতে পারলে ভাল হত, কিন্তু বলা যায়নি। সভ্যও বলা যায়নি। সভ্য-অসভ্য নয়, অন্য কিছু, যাতে ভয় করেছে, তবু রক্তে একটা দুরন্ত ঘূর্ণি লেগেছে। যা তাকে প্রত্যহ বিকেলে ডেকে নিয়ে গেছে নিশির মতো। পদ্ম। বুঝত, কিছু বলত না। আশুদা তার বন্ধুর ব্যাপারটা লক্ষ করছিল।

তারপর, সেই দিনটা। যেদিন পদ্ম আশুদা, কেউ ছিল না বাড়িতে। পদ্মর মা ছিলেন পিছনের পুকুরে ব্যস্ত। শুধু দুজন।

ফটিকদা যেন বোকার মতো বলেছিল, পদ্মকে নিয়ে আশু ডাক্তারের কাছে গেছে।

আশা বলেছিল, তা হলে আমি যাই।

 ফটিকদা বলেছিল, বসো না।

 বসতে পারেনি আশা। দাঁড়িয়ে থাকতেও যে কী ভীষণ ভয় করছিল। তবু তৎক্ষণাৎ চলে যেতে পারেনি। কতকগুলি স্তব্ধ মুহূর্ত। গোটা বিকেলটাই রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠেছিল। তারপর ফটিকদার মতো একটা বড় ছেলে, আশুদাদের বন্ধু, কেমন কাঁপা কাঁপা মোটা গলায় বলেছিল, তুমি এলে ভাল লাগে আশা।

আশার মুখটা মুহূর্তে নীচে নেমে এসেছিল। পরমুহূর্তেই সে দেখেছিল, তার চিবুকে ফটিকদার মোটা মোটা আঙুলগুলি কাঁপছে। আশার মনে হয়েছিল তার বুক ফেটে কান্না আসছে। আশ্চর্য! তাকে জোর করে চাপতে গিয়ে আশা দেখল, সে হেসে ফেলেছে। হেসে এস্তে ফিরে এক দৌড়ে সে বাড়ি। সারা রাত সে ঘুমোতে পারেনি। তিন দিন পদ্মদের বাড়ি যেতে পারেনি। অথচ নিশির হাতছানি তাকে অস্থির করেছিল রোজ। শেষে পদ্ম জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। আর তিন দিন বাদে ফটিকদাকে দেখে সে। বুঝেছিল ফটিকদাকে ছাড়া ওই কদিন সে আর কিছু ভাবেনি। সেই ভাবনাটাই তারপর কাজে অকাজে চলায় ফেরায় মিলেমিশে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ, কত সহজে ফটিকদা সরে গেছে, বিভার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

এত দিন তো একটুও বুঝতে পারেনি আশা শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ওরা দুটিতে। তাই বুঝি সে দিন এমনি করে চমকে উঠেছিল আশা? তাই বুঝি ছায়াদের কাছে ডাক পড়ল তার, আর ফটিকদার সময় হল বিভার কাছে যাবার। এত দিনে বিবাদ মেটাবার। না জেনে বিভাকে কষ্ট দিয়ে মেরেছে এত দিন আশা।

অথচ, ফটিকদাকে বিভাই নাকি এক দিন অপমান করেছিল। ফটিকদা কখনও বিভার নাম উচ্চারণ করত না। শুধু একদিন বলেছিল, দ্যাখ আশা, বিভাদের মতো মেয়েরা কখনও একটা অ্যাটেনডেন্স ক্লার্ককে ভালবাসতে পারে না। ও কোনও দিন কাউকে ভালবাসবে না।

সে যে শুধু রাগের কথা, আজ আর তা বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু আগামী পৌষ মাসে আঠারো পেরিয়ে উনিশে পড়বে আশা। তাকে যে কোনও মূল্য দিয়ে আজ সে কথা বুঝতে হবে।

আশা দুহাত দিয়ে চোখ ঢাকতে গেল। না, তার কান্না পায়নি। চোখ বড় জ্বলছে। তার রক্তে রক্তে যেন বিষের জ্বালা। তার ঠোঁটে, তার বুকে, প্রতি অঙ্গে অঙ্গে। কারণ শরীর আজ অনুকূল নয়, নির্জন কঠিন শিলায় আশার এই ঘোট ঘোট নিঝরিণী দেহে সর্বত্র ফটিকদার পদক্ষেপ কঠিন শক্ত গভীর।

সহসা রামের ঘুমন্ত একটি হাত এসে পড়ল আশার গায়ে। দুহাত দিয়ে ভাইয়ের হাতটি জড়িয়ে ধরল সে। ছোট্ট ঠাণ্ডা হাতখানি যেন তার সারা জীবনের প্রতীক হয়ে বুকে এসে পড়ল। তার বাবার হাত, মায়ের হাত, এ সংসারের হাত এর চেয়ে বড় শক্তি ও উত্তাপ নিয়ে কোনও দিনই আসেনি।

আশা কাঁদবে না। কারণ সংসার এমনি। রামের হাতটি সে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। রাম কথাই শিখেছে, বয়স হয়নি। স্পর্শ পেয়ে মা ভেবেই বুঝি ও দিদির কোল ঘেঁষে এল। অন্ধকারে রামের মুখোনি দেখবার চেষ্টা করল আশা। তার চোখে যেন স্নেহময়ী বিষণ্ণ মায়ের হাসি দেখা দিল। সে চোখ বুজল।

.

আশা বুঝি ছায়াই হয়ে গেল। রোজ গাড়ি আসে সকালে। সে নাগরাঘাটে যায়। রোজই কম বেশি কাজ হয়। ফিরে আসে সন্ধ্যায়। গাড়ি এসে তাকে পৌঁছে দিয়ে যায়। শুধু রবিবারটা ছুটি।

এর মধ্যে একটি রবিবার গেছে। সেই দিনটাও ওদের সঙ্গেই কাটিয়েছে আশা। সারা দিন বিনোদ ভটচাযের ভাড়াটে বাড়িতে ওদের সঙ্গে গল্প করেছে। সেখানে প্রত্যহ যজ্ঞিবাড়ির আয়োজন। প্রচুর লোকের রান্না বসে। এক-এক বারে ত্রিশ-চল্লিশ কাপ চা হয়। কোনও দল তাস খেলে, কোনও দল গানের আসর বসায়। কোনও দল শুধু গল্প।

একদিন সন্ধ্যায় চঞ্চলার সঙ্গে তার গাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল আশা। পুল পেরিয়ে নদীর ওপার ফাঁকা পাকা রাস্তা। দুপাশে ধানকাটা মাঠ। যাবার সময় আশা দেখল পুলের ওপর বিভা আর ফটিকদা।

বিনা টিটকারিতে এখন রাস্তা দিয়ে চলতে পারে না আশা। পদ্ম সুষমারা এক দিনও খোঁজ নিতে আসে না আর।

নাগরাঘাটে কিংবা বিনোদ ভটচাযের বাড়ি যাওয়া আসার পথে বুঝি সতীতলার পাখিরাই ডাক দিয়ে ফেরায় তাকে এক বার। চোখ টেনে নেয় চকিতে।

সতীতলায় আর কোনও দিন যাবে না আশা। কেবল বিনয় যখন কারণে অকারণে তার হাত ধরে, তখন তার বুকের মধ্যে চমকে ওঠে! সে আড়ষ্ট হয়ে ওঠে ভিতরে ভিতরে। তবু হাসে। বিনয় যখন গাড়ি নিয়ে কোনও কাজে শহরে যায় আশাও ঘুরে আসে তার সঙ্গে। ফটিকদা বিভারা দেখুক, আশা এখন ছায়া। আশা ছবি হয়ে গেছে। সে আর কোনও দিন কাউকে দেখতে পাবে না।

তবু দেখতে পেল আশা। সেদিন এই শীতের বেলায় যখন আকাশে মেঘ দেখা দিল, কাজ গেল বন্ধ হয়ে। সবাই নৌকো পেরিয়ে বাগানে বাগানে মাঠে ঘাটে বেড়াতে চলল। কানুদাও বাদ গেলেন না। চঞ্চলা বিজন প্রাণেশ সবাই।

একসময়ে আশা নিজেকে আবিষ্কার করল নির্জন ঝোপে বিনয়ের বাহুপাশে।

বিনয় চুপিচুপি বলল, রাগ করছ আশা?

হা করছে। কিন্তু বিনয়ের ওপর নয়, নিজের প্রতি। নিজেকে তার ঘৃণা করছে। তবু সে হাসল যখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ফটিকদা। সে যেন দেখতে পেল ফটিকদা আর বিভাকে। ফটিকদা ভালবাসছে বিভাকে।

আশা হেসে বলল, না।

বিনয়ের নিশ্বাসে পুড়ে গেল আশার মুখ। তার ঠোঁট নেমে এল আশার ঠোঁটের ওপর। আশার বুকের ভিতর থেকে যেন বাঘিনী নখ বিস্তার করে কেউ চিৎকার করে উঠল নিঃশব্দে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল তার। চোখে বুঝি জল আসে।

বিনয় একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল আশা?

 আশা প্রায় ফিসফিস করে বলল, সবাই যেখানে আছে, সেখানে যাই চলুন।

বিনয় সহজ গলায় বলল, চলো যাই।

 ফিরে এল আশা। একেবারে বাড়িতে চলে এল। এসে মুখের রং মুছল। মা দেখল তাকিয়ে তাকিয়ে। মা কি কিছু বুঝতে পারে? কে জানে। মা চিরদিন ধরেই অমনি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে আছে আশার দিকে। থাকতে থাকতে, হঠাৎ একদিন কিছু বলে ওঠে। তখন বোঝা যায়, মা একেবারে অবুঝ নয়। কারণ, এ মায়ের পেটেই আশা জন্মেছে।

রং মুছে আশা পায়ে পায়ে পদ্মদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। কেন যে এল, নিজেও জানে না। এসে দেখল, পদ্মর চুল বেঁধে দিচ্ছে সুষমা।

পদ্ম সুষমা দুজনেই অবাক হল একটু। তারপর পদ্ম জিজ্ঞেস করল, বাবা। এত দিন বাদে আজ এলি যে বড়?

আশা বলল, এলাম। তুই তো আর খোঁজ নিসনে।

–তোর খোঁজ নেওয়া কি এখন চাট্টিখানি কথা?

সুষমা বলল, আসলে আশা ফটিকদার খোঁজ নিতে এসেছে, না রে?

 আশা জবাব দেবার আগেই পদ্ম বলল, ফটিকদা আর বিভা আজ কলকাতা গেছে।

আশা হাসল। বলল, তোরা তোদের কথাই বলছিস। আজ কাজ নেই, তাই এসেছি।

পদ্ম বলল, বস তা হলে।

আশা বসল না। সে যেন একটি সুদীর্ঘ বর্শার খোঁচায় বেঁকে দাঁড়িয়ে রইল। নদীর ওপারের নির্জন ঝোপে, বিনয়ের বাহুপাশ থেকে মুক্ত হয়ে কেন ছুটে এসেছিল আশা? নিজের সঙ্গে মিথ্যাচারের অপরাধ তাকে ডেকে এনেছিল এখানে। মিথ্যে নয়, সে শুধু এক বারটি দেখতে চেয়েছিল ফটিকদাকে।

জেনে শুনেও আশা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, বসব না চলি। তোরা বস।

পিছন থেকে সুষমা ছুঁড়ে দিল, বসেই তো আছি।

 তারপর মিলিত চাপা হাসি।

আশা গেল বিনোদ ভটচাযের সেই বাড়িতে। কেউ বেড়িয়ে ফেরেনি। শুধু বিমল আর অনসূয়া গল্প করছে। ফিরে এল আশা। ফিরে, সতীতলার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল মন্দিরটার কাছে। মেঘ ঢাকা অন্ধকারেরা বিকেলবেলাতেই ভিড় করেছে বটের ঝুরির কোলে কোলে। ঝি ঝি ডাকছে। এখানকার বাসিন্দা পাখিরা অবাক হয়ে তাকাল, তাদের চেনা চেনা মেয়েটির দিকে। দূরে সরে বসল। উড়ে পালাল না। আর আশার বুক কাঁপিয়ে সাইকেলের ঘণ্টা বেজে উঠল, ক্রিং ক্রিং…। ফিরে দেখল আশা, কোনও এক কাজের লোক ঘরে ফিরছে।

আশারও ঘরে অনেক কাজ। সে বাড়ি ফিরে গেল। সতীতলার মন্দিরের কোল আঁধার সন্ধ্যাতারা প্রবীণ-চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

.

 শেষ বারের জন্য প্যাক আপ হয়ে গেল ফিল্ম কোম্পানির মালপত্র। বাইশ দিন বাদে ওরা ফিরে চলল কলকাতায়। কানুদার সঙ্গে সবাই আশাকে নিমন্ত্রণ করল কলকাতায়।

কানুদা বললেন, আশা যেন তাদের অফিসে আসে। এই রইল ঠিকানা। তাকে দরকার পড়লে তোক পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন কানুদা। স্টুডিওতে আসতে পারে আশা। হরিশবাবুর সঙ্গেই আসতে পারে। তা ছাড়া কানুবাবুদেরও দরকার হতে পারে আবার এখানে। তখন যেন আশা প্রস্তুত থাকে।

বিনয় বলল আড়ালে, যদি রাগ না কর তো মাঝে মাঝে বেড়াতে আসব আশা।

আশা বলল, আসবেন।

–তুমি এসো কলকাতায়।

 আশা হাসল। কান্না পেতে লাগল তার। ভয় করতে লাগল। ছায়ারা চলে যাচ্ছে। এ বার আর সত্যি করে কিংবা মিথ্যে করেও কোথাও যাবার থাকল না তার। যদি চলে যেতে পারত আশা।

সে বিনয়কে জিজ্ঞেস করল, কবে বেরুবে ছবি?

বিনয় বলল, মাস দুয়েকের মধ্যেই রিলিজ হবে। সংবাদ পাবে তার আগেই।

যেমন করে এক দিন লাইন বেঁধে গাড়িগুলি এসেছিল তেমনি লাইন বেঁধে চলে গেল। এ বার আর একটা গাড়ি বেশি ছিল। রাস্তার দুপাশে লোকে ভিড় করে আবার ওদের যাওয়া দেখল। আশা বাড়ি ফিরে এসে দেখল, রাংচিতের বেড়াগুলি বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পাতা ঝরে যাচ্ছে রোজ। সে তো অনেক দিন উঠোন ঝাঁট দেয়নি, তাই নজরে পড়েনি। উত্তর দিকের পাঁচিলের কাছে কৃষ্ণকলির ঝাড়েও। পাতা ঝরে যাচ্ছে, রুক্ষ কাঠিসার হয়ে উঠছে। তারপর কুটোকাটির জট হয়ে যাবে। অপেক্ষায় থাকবে বৃষ্টির। এখন আর খই নেই, কৃষ্ণকলির সেই কালো গোলমরিচের মতো বীচি। যার ভিতরে সাদা শিস থাকে খইয়ের মতো দেখতে। আজ লক্ষ করে দেখল আশা, কুকুরের বাচ্চাগুলিকে। মায়ের হাজার বিরক্তি আর রাগ সত্ত্বেও কুকুরটাকে এক বার তাড়িয়েও টের পাওয়া যায়নি কখন এক পাল বাচ্চা বিইয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে এল। শ্যাম রামের গলা শোনা যাচ্ছে সামনের পোডড়া ভিটেয়। ওরা এসে কুকুরবাচ্চাগুলিকে ঘাঁটবে। মায়ের বকুনি শুনে তবে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসবে।

বাবার আসার সময় হল। মা’র বাসন মাজার শব্দ শোনা যাচ্ছে কুয়োর পাড়ের চাতালে। ঘরে গিয়ে হ্যারিকেনের চিমনি মুছতে লাগল আশা। এ সব কাজ আরও আগেই হয়ে যায়। আজ ওরা গেল বলে দেরি হল আশার। তাড়াতাড়ি করেই বা লাভ কী হত। অন্য সময় এ সব কাজ সেরে, আশা পদ্মদের বাড়ি যেত। না হয় সুষমাদের বাড়ি। ফাঁক পেয়ে, রায়েদের বাগানের ভিতর দিয়ে একেবারে নদীর ধারে। যদি আগে থাকতে কথা থাকত সেই রকম। কিংবা সতীতলার মন্দিরের পিছনে। তারপর সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বাড়ি এসে সন্ধেবাতি দেখাত।

এখন আর বিকেলটাকে ফঁক রেখে কী লাভ। ছায়ারা চলে গেল। আশা যদি চলে যেতে পারত। আর কোনও দিন কি ডাক আসবে না। ছায়া হয়ে চলে যেতে চায় আশা। এ শহরে আর থাকতে চায় না।

বাতি জ্বালাল। জ্বালিয়ে এই প্রথম নজরে পড়ল আশার, পুরনো মান্ধাতার আমলের ট্রাঙ্কটায় তালা বন্ধ। কোনও দিনই তালা বন্ধ থাকত না ওটা। এখন থাকে, মা সযত্নে চাবি সরিয়ে রাখে। একদিন শুনেছিল আশা, বাবা বলছিল মাকে, পোস্টঅফিসের একটা খাতা করলে হয়।

মা বলেছিল, দরকার নেই। সই মেলানো নিয়ে নাকি বড় ঝঞ্জাট করে পোস্ট অফিসে। তা ছাড়া, দরকারই বা কী। ও কি আর ধরে রাখা যাবে?

বাবা বলেছিল, তা ঠিক। খুকিকে একটা ভাল শাড়ি কিনে দিলে হয়।

খুকি হল আশার ডাক নাম। যে নামে শুধু বাবা মা তাকে ডাকে। মা বলেছিল, কত রকম যে বলছ, তার ঠিক নেই। সে দিন বললে, ব্রঞ্জের ওপর সোনার পালিশ দিয়ে কয়েক গাছা চুড়ি করে দেবে খুকিকে। তা আনা বারো সোনা কিনতে গেলেই গোটা আশি টাকা বেরিয়ে যাবে, এ দিকে তো রোজই এক আধ টাকা করে খরচ হয়ে যাচ্ছে। বলেছিলে, একটা মিস্তিরি লাগিয়ে ছাদের ফুটোফাটাগুলো বোজাবে ফের বর্ষা আসার আগেই, তার চেয়ে এক কাজ করো না কেন?

কী বলো তো?

–তোমাদের মিলের কো-অপারেটিভের খান কয়েক শেয়ার কিনলে পাঁচশো টাকা ধার পাওয়া যাবে।

বাবা বলেছিল, তা মন্দ বলনি। বে যদি দিতে পারি, তখন তো টাকার দরকার হবেই। চুড়ি-টুড়ি ওই টাকা তুলেই হবে। তবে, পাঁচশো টাকা ধার করলে কুড়ি টাকা মাসে মাসে যখন কাটবে।

তারপর দুজনেই চুপ করে গিয়েছিল, যেন কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তালা বন্ধ ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে সেই কথাগুলি মনে পড়ল আশার। একশো বত্রিশ টাকা পেয়েছে আশা। সেই টাকাটা আছে ট্রাঙ্কের মধ্যে। টাকা না থাকলে কত ভাবনা। থাকলে কত নতুন চিন্তা পেয়ে বসে মানুষকে। তবু একঘেয়ে চিন্তার চেয়ে, নতুন চিন্তা বোধ হয় ভাল, আরও টাকা যদি থাকত! এইরকম ভাবে যদি রোজগার করতে পারত আশা। আর কি কখনও তার ডাক পড়বে না।

বাবার গলা খাঁকারি শুনতে পেল আশা। তাড়াতাড়ি ঘরের চৌকাঠে জলের ছিটে দিয়ে, তুলসীতলায় বাতি দেখিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে দিল, দিয়েই ছুটল রান্নাঘরে। খুঁটে জ্বালিয়ে, চায়ের জল গরম করে, কয়লা। ঢেলে দিতে হবে। তার মধ্যেই বাবা বসে একটা বিড়ি খাবে, তারপর হাতমুখ ধুয়ে নেবে। মা এসে পড়ল বাসন ধুয়ে। শ্যাম রামও এসে পড়েছে।

বাবা ডেকে বলল, হারে খুকি; ওরা আজ গেল বুঝি?

আশা বলল, হ্যাঁ বাবা।

 বাবা বলল, হরিশ বলছিল তাই। বললে, ওদের ছবিটা বেরিয়ে গেলে নাকি তোর নাম হয়ে যেতে পারে, তখন সবাই তোকে ডাকবে, বলে বাবা হাসল। মা বলে উঠল, কিন্তু তোমার ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে। তাতে চুপ করে থাকলে চলবে না।

অর্থাৎ আশার বিয়ের ভাবনা।

বাবা যেন হাসির মধ্যেও একটি দুশ্চিন্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তবু বলল, দেখি ছবিটা বেরোক।

এখন সেই দিনটিরই প্রতীক্ষা, ছায়াদের রাজ্যে, আশার স্থায়ীবাসের পরীক্ষা হবে সেইদিন। চিরদিন পুরোপুরি, কিছু না-দেখা, কিছু না-শোনা ছায়া হয়ে সে থাকতে পারবে কি না, সেইদিন জানা যাবে।

এখন সামনে শুধু একূল ওকূলের সংশয়ে, একলা জীবন কাটানো। একূল ওকূল আর নয়। একটা কূল তো গেছেই। এখন শুধু আর একটি কূলে ভেড়ার সংশয়। যদি নিরসনের সার্থকতা আসে, তবে এখানে আর থাকবে না আশা। এক দণ্ডও নয়, এক মুহূর্ত নয়, তার আঁতুড়ের রক্তে গন্ধে নিশ্বাস মেশানেনা এই দেশ ছেড়ে চলে যাবার ইচ্ছায় সে বড় ব্যাকুল হয়েছে। এ শহরে সে জলের মাছ ছিল। আজ চারপাশে তার কঠিন মাটিতে খাবি খাওয়া মরণের ভয়। আশা চলে যেতে চায়।

বাবাকে চা দিয়ে, উনুনে কয়লা ঢেলে দিল সে, মাকে চা দিল, নিজেরটা নিয়ে গিয়ে বসল শ্যাম রামের পড়ার জায়গায়। দুজনেই কথা জড়িয়ে পড়তে বসেছে। এখন আর শ্যাম রাম রোজ ফিল্ম আর শুটিং নিয়ে আলোচনা করে না। প্রথম প্রথম খেতে, বসতে, পড়তে খালি এক কথা, এখন আর বলে না। সংসারে ওদের এত বিষয় আছে যে একটাতে বেশিদিন মনোযোগ দেবার সময় নেই। রাত্রে বাতি জ্বালিয়ে কারা ব্যাডমিন্টন খেলে, এদের ক্যারাম বোর্ড ভাল, কোন পাড়ায় এঁদো জায়গায় কুকুরের বাচ্চা। জন্মেছে, কিংবা শহরের পাঁচমিশেলি বিষয় ওদের আলোচ্য। এবং সে সব আলোচনা গুরুতর তর্কের বিষয়। তর্কেতে এঁটে উঠতে না পারলেই, আট বছরের সঙ্গে চোদ্দো বছরের রাম রাবণের লড়াই শুরু হয়ে যায়, তথন মাকে এসে সেই লঙ্কাকাণ্ড থামাতে হয়।

এখন কী করবে আশা? মা গেছে রান্নাঘরে, বাবার বাইরে কোথাও আড্ডা নেই। এক বার মার কাছে যাবে রান্নাঘরে। এক বার এখানে আসবে, আবার উঠে চলে যাবে। দোকানপাটে যাবার দরকার হয় না, অভ্যাসমতো সেটা কারখানার ছুটির পরই সেরে আসে। বাবা-মা’র একটা জুটি। দু ভাইয়ে একটা জুটি। আশা মনে মনে একলা ছিল না। অনেক কথা আপনি আপনি মনে জমা হত। সে সব কথা বলার জন্য রাত পোহাবার অধৈর্য প্রতীক্ষায় থাকত। কথা যদি নাও থাকত, তবু শুধু সতীতলায় কিংবা পদ্মদের বাড়ি যাবার ব্যাকুল হাতছানি থাকত।

এখন? পদ্ম কী করে? সুষমা বাণীরা কী করে? ওদের কি আশার মতো অবস্থা? কে জানে, পদ্মকে তো প্রায়ই দেখতে আসে। সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেলেই ও স্বস্তি পায়, সুষমারও তাই। বাণীর সঙ্গে অবশ্য আশুদার খুব ভাব। কিন্তু আশার মতো অবস্থা নয়, ভাসা ভাসা ভাল লাগা ভাব দুজনের। কিন্তু আশা কী করবে। কেন সে এমন করে মিশতে গিয়েছিল, কেন সে পদ্ম সুষমা বাণীদের মতো সাবধান থাকতে পারল না। ওরা কেমন হাসছে, খেলছে, কোথাও কোনও অনাসৃষ্টি নেই, কে আশাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল, অল্প বয়সে সাহস করে এমন আগুনে হাত বাড়াতে? ছি ছি। এজন্যেই বাবা মা শাসন করে। বুঝি এমনি করেই আশা নষ্ট হল ভ্রষ্ট হল, নইলে মন এমন করছে কেন? নইলে বাড়ানো হাত ফিরিয়ে এনে তাকে দগ্ধ ভয়ংকর মনে হচ্ছে কেন?

কেউ দিব্যি দেয়নি। তার মন থেকে স্বভাব উজানে সে গিয়েছিল, তার ভিতরের অচিন পাখিটা দিব্যি দিয়েছিল তাকে, কিন্তু আজ আর কেউ তাকে রক্ষা করবে না। এখন সে যেদিকে তাকায়, তার সব শূন্য মনে হচ্ছে। একটা ভয়ংকর হাহাকার তার বুকের মধ্যে মাথা কুটে মরছে। কিন্তু কাউকে সে কিছু বলতে পারবে না। ইশারায় জানাতে পারবে না। সে সবই করবে। কাজ করবে, নদীতে নাইতে যাবে, বেণী বাঁধবে, হাসবে, কথা বলবে। এ সংসার তাকে কঁদবার দুঃখ করবার অধিকারও দেয়নি। এ অধিকার জোর করে নেবার নয়। এ কোনও প্রকাশ্য কলঙ্কও নয়, এ শুধু যেন খেলতে গিয়ে পোড়ানো হাতের দাগ ও ব্যথা সবাইকে লুকিয়ে বেড়ানো। কিন্তু কেমন করে রাখা যায়? কেমন করে?

উঠে গেল আশা। বাবা মা রান্নাঘরে। অন্ধকারে বারান্দা পেরিয়ে কুয়োতলার অন্ধকার চাতালে, পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল আশা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে। দুহাতে মুখ চেপে রইল।

পৌষের শীতার্ত উত্তরে বাতাস পাঁচিলের গায়ে এসে লাগল। ঝি ঝি ডাকছে একটানা। আকাশ পরিষ্কার, নক্ষত্রেরা স্থির একাগ্র হয়ে তাকিয়ে আছে। কুকুর বাচ্চাগুলি ডাকছে কুঁই কুঁই করে। কারখানার বয়লারের শব্দ আসছে ভেসে।

আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেলে, মুখ থেকে হাত নামাল আশা। সে কাঁদেনি। কাঁদবে না। এ পাড়ায় ও পাড়ায়, গোটা শহরের মানুষের কত কথা শোনা যায়। সেই সব কথা যদি সত্যি হয়, তবু তারা যদি হেসে খেলে কাটাতে পারে, আশা কেন পারবে না। না পারলেই বা শুনছে কে? সংসার এমনি।

মায়ের ডাক শোনা গেল, খুকি।

চট করে জবাব দিতে পারল না আশা। চাতালের অন্ধকার থেকে জবাব দেয় বা কেমন করে। ও চলে আসবার আগেই মা আরও দু বার ডাকলে। তারপর রান্নাঘরের সামনা সামনি দেখা হয়ে গেল। মা এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, দুটো হলুদ বেটে দে।

.

নতুন পাতা দেখা দিতে লাগল গাছে, লাল ফুলগুলি নেশায় পাগল হয়ে ফুটল শিমুলে আর মাদারে। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে থোকা থোকা শক্ত কুঁড়িতে প্রথম রক্তাভা যেন চুঁইয়ে আসছে। কাসা রং বোল আমগাছে। আশাদের বাড়ির কাঁঠাল গাছে লোমশ ইঁদুরের মতো উঁচড় ধরেছে।

নিরালার টইটুম্বুর পরিত্যক্ত দিঘিটির মতো দুটি চোখ আশার। তবু বড় দরিদ্রের মতো, ঘাটে যেতে রোজ না দেখে পারেনি, সতীতলার জটপাকানো, ঝুড়ি নামানো, নাতিপূতি সবংশ ন্যাড়া বটকে। আবার দেখল প্রত্যহ চিকচিকিয়ে ওঠা শ্যাম পাতা। নদীতে জল শুকোল। তবু নদী গহীন। শুধু শ্যাওলাদের জট জলের উপর ভেসে উঠেছে।

আর কোনও দিন সতীতলার রাস্তায় কোনও মোটরগাড়ি আসেনি। ও পথে এখন বড় ধুলো। কত সাইকেলের ঘণ্টা বাজে ক্রিং ক্রিং। এখন শুধু বটতলায় বটতলার পাখিরাই বুঝি চমকায়। নয় তো ওরাও ভুলে গেছে।

সবই তার নিত্য চক্ৰ-প্রবাহে একই রকম ঘুরছে, সবাই তেমন রইল। তবু আশা যেন এপাড়া ওপাড়ায় দুষ্ট ক্ষতের মতো হয়ে রইল। যেখান দিয়ে যায়, সতীতলার হিরোইন’ ক্ষত দগদগিয়ে ওঠে। সেই বিদ্রূপ আর শিস।

শুধু ঘাটে পদ্ম সুষমাদের সঙ্গে দেখা হয়। পদ্ম বাড়িও যেতে বলে। ফটিকদার কথাও বলে। বলে, ফটিকদা আজকাল বড় একটা আসে না। বলে, ঠোঁট টিপে হাসে। তারপরে বলে, প্রত্যেক রোববার কলকাতা যাওয়া চাই ফটিকদার। আর ফটিকদা টাকা পয়সা নিয়ে তার মা’র সঙ্গে ভারী ঝগড়া করে।

সেই গানটির কথা মনে পড়ে আশার। ত্রিবেণীতে বাণ ডাকল ওরে তুই জলে নেমে বাঁধ দে, ডুব সাঁতার দিয়ে সেই মীনকে ধর, কিন্তু তোর গায়ে যেন জলের ছিটে না লাগে। ফটিকদার কথা শুনেও, মুখের ভাব অবিকৃত রাখতে চায় আশা। কথাবার্তায় কিছুই টের পেতে দিতে চায় না। পদ্ম সুষমাদের শুধু নয়। নিজের সঙ্গেও তার একই বোঝাঁপড়া, এ সংসারে সবাই গায়ে জলের ছিটে না লাগিয়ে চলতে চাইছে। নইলে, এ উনিশ বছর ধরেই বা বাঁচা গেল কেমন করে।

কলকাতা থেকে আর কোনও সংবাদ আসেনি, ছায়াদের কাছে ডাক পড়েনি আর। হরিশ এসে মাঝে মাঝে সংবাদ দেয়। জোর কদম কাজ চলছে। খুব শিগগির বেরোবে ছবি, আশা ইচ্ছে করলে ঘুরে আসতে পারে হরিশের সঙ্গে।

কী করবে গিয়ে শুধু শুধু? এদিকে প্রতীক্ষা বাড়ছে। মাঝে মাঝে কাগজে সংবাদ বেরুচ্ছে ছবির। এ শহরের উত্তেজনাও বাড়ছে, এ শহরের সঙ্গে ছবিটার যোগাযোগ আছে। সেই সঙ্গে আশার যোগাযোগের কথা কেউ ভোলে না। সতীতলার হিরোইন কী খেলা দেখিয়েছে, এক বার দেখতে হবে।

শ্যাম রাম সংবাদ আনে, এ শহরে ছবিটা আসবে। এবং তাদের দাবি হচ্ছে, দ্যাখ, দিদি, আগেই বলে রাখছি, ফার্স্ট ক্লাসের পাস নিবি। দু দিন দেখব।

শ্যাম বলে, হ্যাঁ ফার্স্ট ক্লাসে কোনও দিন ছবি দেখিনি। এ বার পর পর দু দিন দেখব।

রাম বলে, আমার দুটো বন্ধু দেখতে চেয়েছে। দিদি, তোকে পাস দিতে হবে।

আশা বুঝতে পারে, বাবা মায়েরও একটি আড়ষ্ট প্রতীক্ষা রয়েছে। আশার নিজেরও প্রতীক্ষা। সে ছায়া হবে, ছায়া হয়ে হাসবে কাঁদবে। সে কিছু ফিরে দেখবে না। তাই সেও কাল গুনছে।

একদিন শ্যাম বাড়ি এল ছুটতে ছুটতে, হাতে কাগজ।

আশা বারান্দায় বসে চুল বাঁধছিল।

 শ্যাম বলল, দিদি, তোর নাম দেয়নি কাগজে।

 আশা বলল, কীসের?

–সিনেমার। এই দ্যাখ; ছবির নাম পারাপার’, ভূমিকায় চঞ্চলা, বিজন, প্রাণেশ, কনক, অনসূয়া, সুলতান প্রভৃতি। তোর নাম বাদ।

চুলের গুছিতে গিট দেওয়া ফিতে তখন আশা দাঁত দিয়ে চেপে ধরেছে। সে বলল, আমার নাম দেবে কেন? যারা নামকরা তাদেরই নাম দেবে।

তবু ফিতেটাকে আরও কষে দাতে চাপল আশা। তার বুকের মধ্যে সেই পুরনো চমকটা কেমন যেন। গুরুগুরু মেঘের স্বরে ডেকে উঠল। দৃষ্টি সে ফিরিয়ে রাখল অন্য দিকে।

শ্যাম বলল, সবাই বলছে, তোকে নাকি একদম পাত্তাই দেবে না ওরা। বলছে, তোকে নাকি দেখতে ভাল নয়, তুই কিছু পারিসনি।

বেণীর বাঁধন যত শক্ত করতে গেল আশা, ততই শিথিল হতে লাগল। বলল, তা সত্যিই তো।

কিন্তু আশার ভয় করতে লাগল মাকে। মা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে। আয়নার কাছে যাবার অছিলায় আশা ঘরে উঠে গেল।

তারপর এক দিন বিকেলে হরিশ এল বৃষ্টি মাথায় করে, এ শহরের সিনেমা হলে পারাপার এসেছে। আশাদের দেখবার জন্য কমপ্লিমেন্টরি পাস পাঠিয়েছে কলকাতা থেকে। দশ-বারো জন যেতে পারে।

আশা নিজের হাতে পাস নিল। নিয়ে তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল হরিশকে, কানুদা, বিনয় তার কথা বলেছে কি না। তার আগেই হরিশ বলল, কানুদা তোমাকে কলকাতায় যেতে বলেছেন। বলেছেন, সিনেমা করাটাই তো বড় কথা নয়। এসে-গেলে একটা রিলেশন থাকে। ওকে আসতে বলবেন।

আশা হেসে বলল, যাব।

হরিশ চলে গেল।

আশা তার বাবার হাতে পাস দিল। শ্যাম পাসের কাগজটা দেখবার জন্য দৌড়ে এল।

বাবা হেসে বলল, তুই যাবি তো দেখতে?

 আশা বললে, তুমি আর মা শ্যাম রামকে নিয়ে দেখে এসো, আমি পরে যাব।

পরদিন বাবা এক ঘন্টা আগে ছুটি নিয়ে এল, এসে তাড়াতাড়ি দাড়ি কামাল। আর হাসতে হাসতে বারবার বলল, কারখানার লোকগুলো পাগল। খালি বলে, ও চক্কোত্তিদা তোমার মেয়ের সিনেমা আমাদেরও দেখাতে হবে।

মা আজ সেই তাঁতের নীল শাড়িটা পরল। কতকাল পরে বুঝি সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছে। রামকে। আশা নিজেই সাজিয়ে দিল।

বাড়িতে কয়েক ঘণ্টা একলা থাকাটা আশার নতুন নয়। সবাই বেরিয়ে যাবার পর, রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল সে, তবু কেমন একটি অস্থিরতা তাকে কাজে আড়ষ্ট করে রাখল। এ শহরের, এ পাড়ার চেনা মানুষের মুখগুলি তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। একটি অন্ধকার ঘরে, সেই মানুষগুলির মুখ ভাসছে।

আকাশে মেঘ করেছে। অন্ধকার রাত্রিটা ঝাপটা খাচ্ছে পুবের বাতাসে, বৃষ্টির জল জমেছে বাড়ির আশেপাশে। ব্যাঙগুলি যেন অষ্টম প্রহরের গানে মেতেছে। ঝিঁঝিদের ডাক আজকাল বদলেছে, কেমন যেন মৃদু অথচ গভীর শোনায়। ৭৮৪

ডাল বসিয়ে আশা বাইরে এসে দাঁড়াল। রাংচিতের বেড়া আবার ঝাকড়ালো হয়েছে, কাঁঠাল গাছের কান-খাড়া পাতাগুলি বাতাসের লাপটায় সাঁই সাঁই করছে, কৃষ্ণকলির গন্ধ পাচ্ছে আশা।

হঠাৎ বাইরে, জলের ওপর কার পায়ের দুপ দুপ শব্দ শোনা গেল। আশা শক্ত হয়ে দাঁড়াল। সহসা শিরদাঁড়া বেয়ে, চেতনাগ্রাসী একটি বিচিত্র ভয় ও কামনায় শিউরে উঠল সে। দুপ দুপ শব্দটা এগিয়ে এল আরও। এ বার শুধু একটি গলার স্বর, চাপা কিন্তু স্পষ্ট বেজে উঠবে। তখন আশা কী করবে?

আরও কাছে এল শব্দটা। কিন্তু থামল না। বাঁক নিয়ে চলে গেল সামনে পোড়োভিটার দিকে। বোধ হয়, পোডভিটের বেওয়ারিস বাসিন্দা সেই বুড়িটা ফিরল ভিক্ষে করে, নইলে এ সময়ে ওদিকে কে যাবে।

আস্তে আস্তে আবার শিরদাঁড়া বেয়েই চেতনা ফিরে এল আশার। আর সেই মুহূর্তেই, ভয়ংকর লজ্জায় নিজেই নিজের কাছে মরমে মরে গেল সে। বড় বেহায়া নির্লজ্জ এ প্রাণ। নইলে, এখনও এমন করে চমকায় কেন আশা।

পুবে বাতাসে কাঁপা অন্ধকার আকাশের তলা থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এল আশা। এ বাড়ি বড় খারাপ। জোনাকিরা কেমন অস্থির হয়ে ঘুরে মরছে, দুপ দুপ পায়ের শব্দ এখানে এল না। যদি দুপ দুপ শব্দে আশা নিজে বেরিয়ে যায়? সে পালিয়ে এল রান্নাঘরে, লম্ফর আলোয়। এসে উনুনের ধারে বসল। মুখ ঢেকে।

একটু পরেই অনেকগুলি পায়ের শব্দ কানে এল আশার।

 তারপরেই শ্যামের গলা, দিদি, তোর নামটা সবশেষে ছোট্ট করে দিয়েছে।

 রাম বলল, তোকে মাত্তর দু বার দেখিয়েছে রে দিদি। এক বার দূর থেকে ঘড়া কাঁখে। আর এক বার তোকে ওই হিরো জিজ্ঞেস করলে, শিবানীদের বাড়ি কোথায়? তুই সঙ্গে গিয়ে বাড়িটা দেখিয়ে দিলি। ব্যস।

শ্যাম বলল, হরিশদা বললে, ছবি অনেক বড় হয়ে যাবে, সেইজন্য তোকে কেটে বাদ দিয়েছে। তবে ছবিটা খুব দারুণ হয়েছে। মা কেঁদে ফেলেছে।

আশা বাইরে এসে হাসল। বাবা বারান্দায় বসে একটা বিড়ি ধরায়। মা কাপড় ছাড়তে গেল ভিতরে। বাবা মা, দু জনের কেউই কোনও কথা বলল না।

আশা স্বাভাবিক গলায় বলল ভাইয়েদের, রান্না হয়ে গেছে। হাত পা ধুয়ে খেতে আয়।

তারপরে রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল। ভাঙা পুরনো ইট বের করা দেয়ালে ধোঁয়া লেগে লেগে কালো হয়ে গেছে। সেখানে আশার ছায়াটা লম্ফর আলোয় এলোমেলো হয়ে কাঁপতে লাগল। মনে হল, হাঁটু মুড়ে বসতে গেলে হঠাৎ কোথায় ভীষণ খোঁচা লেগে লুটিয়ে পড়বে আশা।

কিন্তু আশা আস্তে আস্তে বসল। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত একটু হাসি দেখা গেল ওর। ও ভাবল, মোটরগাড়ির শব্দ শুনে এ জন্যেই বুঝি চমকেছিলাম তখন।

রামের গলা শোনা গেল, দিদি, মা বললে, বাবার ভাতও বাড়িস।

মা রান্নাঘরে এল না। আশা দেখল, মা সকলের ঠাঁই করছে বারান্দায়। আশা সকলের ভাত বেড়ে দিল। মা বসেছিল বাবার কাছেই।

বাবা হঠাৎ মুখ তুলে আশার দিকে তাকাল। কী আশা করে বাবা দেখতে গিয়েছিল, কে জানে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আশার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করল।

মা বলল বাবাকে, তোমাদের কারখানা থেকে কারা মেয়ে দেখতে আসবে বলেছিলে? এ রোববারেই তাদের আসতে বললো।

বাবা মুখ নামিয়ে বলল, বলব।

 আশা রান্নাঘরে চলে গেল।

.

তারপর দেখতে আসার পালা, বিবাহযোগ্য সেই সব পাত্রদের অভিভাবকেরা এলেন গেলেন, তাঁদের ছক বাঁধা সীমায় পা ফেলে ফেলে টাকা চাইনে রূপ চাই শুধু, সেখানে আশা ফেল। টাকা চাই, রূপ চাইনে। সেখানে বাবা ফেল। পাঁচটি শেয়ারের পাঁচশো টাকা ঋণের সাধ্যে সে বাঁধা। আর শুধু দুটি ডাগর চোখ ও ডহর চুলে তো রূপসীর রূপ বেঁধে রাখা যায় না।

তা বলে আশার রূপ কি ছিল না? ছিল। চোখের দেখায় যা প্রকাশ পায়নি, আর একটি হৃদয়ের মন্ত্রে সে যে তিল তিল রূপে তিলোত্তমা হয়। মেয়ে যারা দেখতে আসে, তাদের সে কথা বোঝানো যায় না। কারণ, সে মন্ত্র কেউ চুক্তি আর যুক্তির বীজ দিয়ে বুনে আনে না।

শেষটায়, গান্ধী নারী সমবায় সমিতির সম্বন্ধটাকে আর ছাড়া গেল না। সেখানে মেয়েরাই সুতো কাটে, হাতে তাঁত চালায়। এখন চরকা কাটার কাজ। মাস গেলে বত্রিশ টাকা মাইনে। তার ওপরে, সুতো কাটার ওপরে, হিসেবে কিছু কমিশন পাওয়া যাবে। মাসের শেষে পঞ্চাশে গিয়ে উঠবে। বর্তমানে যেতে হবে অবশ্য কলকাতা পেরিয়ে, আরও একটু দক্ষিণে। গান্ধী নারী সমবায়ের কারখানা সেখানে।

মন স্থির করেও বাবা অস্থিরভাবে আশার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কী যে করব, বুঝতে পারছি না।

 আশা তার টিনের সুটকেসটি নিয়ে বসে বলল, কী আবার করবে বাবা। আমি যাব, তবে আমি তো তোমাদের কখনও ছেড়ে থাকিনি। মাঝে মাঝে আমি বাড়ি পালিয়ে আসব।

বাবা গোঙানোর মতো হেসে বলল, কী যে বলিস।

মা বাবাকে শুধু বলল, তবু যা হোক এক জায়গায় তো পাঠালে মেয়েকে।

বাবা মার দিকে তাকাল। মা’র দুটি জ্বর মাঝে ধিক্কারের একটি তীক্ষ্ণ খোঁচা ফুটে উঠল। মুখ ফিরিয়ে চলে গেল সামনে থেকে।

বাবা চুপ করে রইল।

আশা তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগল কারণ আজ বিকেলেই তাকে চলে যেতে হবে। আজ রবিবার, বাবা তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

শ্যাম বলল, দিদি, তুই খালি আসিসনে। আমরাও যাব, আমাদের বেশ বেড়ানো হবে।

আশা বলল, আচ্ছা।

রাম বলল, আর যখন আসবি, তখন তোর কাছে অনেক পয়সা থাকবে, না?

আশা হেসে বলল, কেন?

রাম বলল, তা হলে খাবার আনবি।

আশা কাঁচকলা দেখিয়ে ভেংচাল রামকে, তারপর হাসল, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল রামের দিক থেকে। বাবা বুঝি কখন মায়ের কাছে চলে গেছে। আশা শুনতে পেল মায়ের ঝংকার, তুমি যাও তো এখন আমার কাছ থেকে, আমার ভাল লাগছে না তোমার কথা শুনতে।

আশার কাজের হাত থেমে এল, মায়ের গলায় যত ঝাঁজ, তত ভেজা ভেজা শোনাচ্ছে। আশা জানে, মা কী চেয়েছিল। আশা জানে, মা তার সঙ্গে আজ আর চোখাচোখিও করবে না। কারণ স্বামী পুত্র কন্যা কারুর সামনেই মা কোনও দিন চোখের জল ফেলতে ভালবাসে না।

আশা সুটকেস গুছিয়ে বেণী খুলতে খুলতে রাংচিতের বেড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ নীলে সাদায় মাখামাখি। এ সময়টায়, একটিও প্রজাপতি নেই। কিন্তু কৃষ্ণকলি প্রচুর, মেজেন্টা রঙের ফুলগুলি রোদের ঘায়ে মূর্ছা গেছে। ছায়ায় আবার ফুটবে। উঠানে এখনও বর্ষার সবুজ শ্যাওলার দাগ।

আশা তাড়াতাড়ি মাথায় তেল দিয়ে বলল, মা নাইতে যাচ্ছি।

নদীতে গেল আশা, আজ শেষ, আবার কবে আসবে, কে জানে। বড় রাস্তার ওপরে পা দিয়ে আশা হেসে ফেলল। মনে মনে বলল, আজকের দিনটার জন্যই বোধ হয় তখন চমকেছিলাম।

সতীতলার দিকে ফিরবে না মনে করেও এক বার ফিরতে হয়। এ বট যেন অক্ষয়, অমর। শুধু মন্দিরটাই যেন সময়ের পায়ে আর একটু মাথা নুইয়েছে। সতীতলার পাখিগুলিও বংশ পরম্পরায় বাস করে কি না কে জানে। নাকি, ওরা নদীর ঘাটে যাবার সময় সব মানুষের দিকে অমন ঘাড় কাত করে তাকায়।

নদীতে এখন অনেক জল, ওপরের ধান ক্ষেতে সবুজের গায়ে পাঁশুটে ছোপ লেগেছে। চান করে ফেরবার সময় সতীতলার দিকে আজ আর তাকাল না আশা।

বাড়ি এসে কাপড় ছাড়ার পর রাম বলল, দিদি, মা তোকে বেড়ে নিয়ে খেতে বলেছে।

আজ মা আর আশার সামনে আসবে না, সে জানে। কিন্তু আশার বড় ইচ্ছে করল, আজ ও মা’র কাছে বসে খাবে। বাবা আর ভাইদের খাওয়া হয়ে গেছে। আশা আর মা খাবে, তারপর অনেকক্ষণ এঁটো হাতে কথা বলবে, ভেবে আশা চুল আঁচড়াতে যাচ্ছিল।

এমন সময় দরজায় ডাক শোনা গেল, হরেনদা।

আশা থমকে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে।

বাবা বারান্দায় ছিল বলল, কে?

–আমি।

 বাবা বলল, ফটিক নাকি? এসো, কী খবর?

 চিরুনির তীক্ষ্ণ দাঁত আশার আঙুলে চেপে বসল। মনে হল, এক অদৃশ্য বাতাস ঝাপটা দিয়ে গেল ওকে। নিজেকে সামলে শক্ত হল সে। দেখল, ফটিকদা বারান্দায় বাবার কাছে এল। এখনও বোধ হয় চান করেনি, তাই রুক্ষু, খাওয়া হয়নি, তাই শুকনো। গলার স্বরটা অনেক দিন বাদে বেশি মোটা লাগছে। বলল, এই অনেকদিন আসব আসব ভাবছি, আসা আর হয় না। খাওয়া হয়ে গেছে নাকি?

বাবা বলল, হ্যাঁ!

আশা পা টিপে টিপে সরে যেতে চাইল, পারল না, একই জায়গায়, প্রাক-ঝড় স্তব্ধতায় সে। প্রস্তরবৎ। সে দেখল, ফটিকদাকে ঠিক সেই রকম বোকা বোকা দেখাচ্ছে, বলল, বউদি কোথায়?

বাবা বলল, চান করতে গেছে।

ফটিকদা এদিক ওদিক তাকাল, বলল, আশা নাকি চাকরি করতে চলে যাচ্ছে শুনলাম।

 বাবা বলল, হ্যাঁ।

 এমন সময়ে মা এসে দাঁড়াল। ফটিকদা বলল, এই যে বউদি, আমি একটু এলাম।

মা বলল, বসো।

ফটিকদা বলল, বসব না। আপনারা দুজনেই রয়েছেন, একটা কথা বলব।

বাবা মা দুজনেই চুপচাপ।

ফটিকদা সারা গায়ে একটা দোলানি দিয়ে এক বার হাসল, আবার গম্ভীর হল। বলল, আশাকে আমার সঙ্গে বে দিতে আপনাদের আপত্তি আছে?

আশার মনে হল, থরথরিয়ে কেঁপে বুঝি মেঝেয় লুটিয়ে পড়বে। ওর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাবে। চোখের দৃষ্টি অন্ধ হয়ে যাবে।

কিন্তু কিছুই হল না। শুধু তার নিশ্বাস সহজ হয়ে পড়ল না। বুকের মধ্যে কে যেন তাকে চাপা দিতে চাইল বারে বারে, দৃষ্টি তার স্বচ্ছ রইল, কিন্তু দিকভ্রান্ত হল।

বাবা যেন হুড়মুড় করে কী বলতে যাচ্ছিল, মা বলে উঠল, দেখো, নিজেরা বে দিতে পারিনি, ভরণপোষণের জন্য তাই মেয়েকে চাকরি খুঁজে নিতে হয়েছে, এখন মেয়ে যা বলে, তাই।

উঃ। মা কী সাংঘাতিক মেয়ে, সত্যের কাছে মা’র কোনও সংস্কার নেই? নইলে এমন করে মেয়েকে কখনও এমন বিষয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেয়? বাস্তবের সামনে মেয়ের সব লজ্জাকে এমনি করে ঘুচিয়ে দিল মা। কী করবে সে?

সে শুনতে পেল ফটিকদার গলা, ও কোথায়?

–ঘরে।

–যাব?

–যাও।

কেমন করে আসে ফটিকদা? মা বাবা না বসে বাইরে? এমন দিনও আসে সংসারে, যখন আর কোনও অন্তরাল কোথাও থাকে না।

ফটিকদার ছায়াটা দেখতে পেল আশা। সে চোখ তুলল। আশার কানে কানে যেন কে বলল, এই জন্যে, এই জন্যেই সে দিন বুঝি চমকেছিলাম, ফটিকদার এমনি করে ছুটে আসা, এই চেহারা দেখব বলে?

ফটিকদার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ বুজে এল, কাঁদবে না মনে করে, তাকে রোধ করা গেল না। কিন্তু অশান্ত হল না আশা। ব্যাকুল হল না, ফোঁপাল না। ঘরের কোণে সরে গেল ও।

ফটিক কাছে এল, বোঝা গেল, তার গলার স্বর ফুটছে না। থেমে থেমে বলল, চাকরি নিয়ে নাকি চলে যেতে চাস?

আজ ফটিকদা তুমি’ বলে একটু ভনিতাও করল না।

 আশা বলল, হ্যাঁ।

-কেন?

আশা হাসতে চাইল। বলল, কেন আবার কী? দিন কি এক রকম যায়! খেয়ে পরে বাঁচতে হবে তো আমাকে।

ফটিকদার নিশ্বাস লাগল আশার গায়ে। বলল, তা হলে আমি কী করব?

আশা তাকাল ফটিকদার দিকে, কিন্তু সেই পুরনো দিনের মতো উচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল না। আশাকে, কোনও অভিমানের বাষ্প তাকে আবেগে কাঁপিয়ে দিল না। দেখল একদিন যে নদীর কূলে বর্ষায় প্লাবিত হয়েছিল, সামান্য বাতাসে ও দোলায় যা চলকে উঠেছে, ছলছলিয়েছে, আজ সেই জল নেমে গেছে। কঠিন ধূলিধূসর পাড় জেগেছে সেখানে, প্লাবন যখন হয়েছিল, তখনও ভবিষ্যৎ সময়ের বুকে ইশারা ছিল, এক দিন এ পাড় জাগবে। সে উত্তরঙ্গ উচ্ছ্বাস থাকবে না। কিন্তু নদীটি থাকবে, স্রোত থাকবে, গহীনও থাকবে। আছেও। তাই নিজের হাতে চোখের জল মুছে আশা স্নিগ্ধ চোখে তাকাল ফটিকদার দিকে, বলল, আমাকে কী করতে বলছ বলো?

ফটিকদার গলায় বুঝি আর স্বর ফুটতে চায় না, বলল, তোর সঙ্গে আমার যে কথা ছিল?

মনে আসে সে কথা, সংসার করার কথা। জবাবে অনেক কথা মনে এল আশার কিন্তু কী লাভ সে কথা বলে। আশা তো জানে, রাগে ফুলেছে ফটিকদা আশার স্ব-ইচ্ছায় কাজ করার জন্যে। তাতে নিজেই অনেক দুঃখে ভুগেছে, অনেক সন্দেহে ও সংশয়ে কষ্ট পেয়েছে। তারপর, শোধ তুলতে গিয়ে, সুখের ভান করে নিজেকেই মেরেছে নিষ্টেপিষ্টে, সে বিদ্রূপ করে লাভ কী? কারণ, আশার ভিতরের জটিল সর্পিল গতি সেই নদী তো কোনও দিন মজেনি। সে চিরপ্রবাহমান।

আশা বলল, কাজে যেতে চাই। ওটুকু নিয়েছি নাকি?

ফটিক আশার হাত ধরে বলল, তবে? চলে যেতে চাস যে?

আশা বলল, কাজে যেতে চাই। ওটুকু আমাকে যেতে দিয়ো ফটিকদা।

বলতে বলতে আশার গলা চেপে এল। একটু পরে পরিষ্কার গলায় বলল, তুমি সব নিয়ো, নিজের জন্য শুধু আমি ওই দায়টুকু নিলাম। নইলে আমাকে কবে এক দিন তোমার খাটো মনে হবে তখন আমার কষ্ট হবে।

ফটিকদা কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, শান্ত স্থির, কিন্তু এত খর বুঝি কোনও দিন মনে হয়নি আশাকে। চেনা জানাও ছিল না, কেন? তার কারণ কী? আশা এমনিই তো ছিল।

ফটিক আরও শক্ত করে আশার হাত ধরে বলল, কখন আসবি আবার?

আশা বলল, ছুটি পেলেই আসব। আর তুমি যখন ডাকবে, তখনই আসব।

ফটিকদার বিস্ময়ে ও বিচিত্র ব্যথায় সহসা কথা সরতে চায় না যেন। বলল, আজ আমি তা হলে তোকে চাকরির ওখানে রেখে আসব আশা।

আশা ঘাড় কাত করে বলল, আচ্ছা। কিন্তু ফটিকদা–

–কী?

–রাগ করলে না তো?

ফটিক বলল, না। কিন্তু তোকে না দেখে কষ্ট হবে। তবে সে তো দুজনেরই।

 বলেই ফটিকদা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপরই রুদ্ধ গলায় বলল, আমি ঘুরে আসি।

চলে গেল ফটিকদা। সে দিকে তাকিয়ে সহসা আশারও গলার কাছে যেন কিছু ঠেলে এল হু হু করে। ট্রাঙ্কের ওপর মুখ চেপে বসল সে।

একটু পরেই আশা মায়ের ডাক শুনতে পেল, খুকি।

মুখ না ফিরিয়ে আশা বলল, উঁ?

–ভাত বেড়েছি, খেতে আয়।

 মা চলে গেল।

চোখ মুছল আশা। মানুষ মনে মনে বারে বারে চমকায়। সে চমকটা ওপরের ঝলকানি। আসলে সেটা নিরন্তর জীবনের বাঁকে বাঁকে দূর-দুন্দুভির শব্দের দোলা। আশা বাইরে বেরিয়ে এল।