জ্যোৎস্নাময়ী

জ্যোৎস্নাময়ী

প্রিয়লাল মুস্তফির বাড়িতে যেন আনন্দের ঝড় বইতে লাগল। বস্তুত এ আনন্দের ঝড়ের সূচনা করেছিল মহীতোষের চিঠি, পাবার দিন থেকেই। এক মাস আগে মহীতোষ, তারিখ দিনক্ষণ জানিয়ে, হামবুর্গ থেকে, বাবা প্রিয়লালকে চিঠি লিখেছিল, ও কলকাতায় আসছে। সেই চিঠিতেই মহীতোষ ওর ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাভঙ্গের সংবাদটা জানিয়েছিল। লিখেছিল, ভেবে দেখলুম, মানব-জন্ম সত্যি দুর্লভ। কথাটা একদিন তোমার মুখ থেকেই শুনেছিলুম। তখন মনে মনে সত্যি হেসেছিলুম। বিশ্বে কয়েকশো কোটি মানুষ যদি সত্যি ভাবতে আরম্ভ করে, মানব জন্ম দুর্লভ, তা হলে তো সেটা একটা সমস্যা। আর মানব-জন্ম যদি দুর্লভই জ্ঞান করি, তার জন্যে বিয়ে করাটা কোনও অনিবার্য বিষয় নয়। তোমাদের–অর্থাৎ তোমার, মায়ের, অন্তু আর নীতুর মনে নানা রকম সন্দেহও ছিল, দীর্ঘকাল বিলেতে বাস করে আমি বোধ হয় কোনও শ্বেতাঙ্গিনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। কথাটা লিখলুম, কারণ তোমার আর মায়ের কোনও কোনও চিঠিতে সে আভাস ছিল। সে রকম ঘটলে তোমাদের জানাতুম নিশ্চয়ই। তোমরা আমাকে সে রকম শিক্ষা দাওনি। আসলে এত কাল আমার বোধ হয় সাহসের অভাব ছিল। আর সেটার কারণও বোধ হয় এই প্রবাসী জীবনযাপন। ভুলেই গিয়েছিলুম, আমাদের সমাজ পরিবার বিয়ে ব্যাপারটার সঙ্গে এ দেশের কোনও মিল নেই। জার্মানদের ওপর আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। কিন্তু এদের দাম্পত্য জীবন–বিশেষ করে এই জেনারেশনের যা চেহারা দেখছি, তাতে বীতশ্রদ্ধ বোধ। করছি। আমার মনের সেই বীতশ্রদ্ধ ভাবটাই আমার সাহসের অভাব কি না জানিনে। অথচ অন্তু আমার ছোট ভাই হয়েও, অনায়াসেই প্রেম করে সুনীতাকে বিয়ে করে নিয়ে এল। যাই হোক, অনেক আজেবাজে কথা লিখে ফেললুম। এ বার আসল কথাটা বলে ফেলি। আমি মন স্থির করে ফেলেছি, বিয়ে করব। যদিও চল্লিশ বছর পার করে দিয়েছি। তোমার মা’র অনেক অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও, প্রত্যাখ্যান করেছি। তোমাদের মনে কষ্ট দিয়েছি। তোমরা আমার বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছ। অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ করেছ। কলকাতায় গেলে অনেক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছ, ফটো দেখিয়েছ। উদ্দেশ্য গোপন করোনি। আমি এত কাল বাধা দিয়ে এসেছি। এ বার স্থির করেছি, বিয়ে করব। আমি দু মাসের ছুটি নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা প্রস্তুত হও। শুধু একটা অনুরোধ, যে-মেয়ের সঙ্গেই সম্বন্ধ কর, তার সঙ্গে আগে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়ো। বুঝতেই পারছ, বয়স হয়ে গিয়েছে। যে মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, সে যেন কোনও ক্রমেই নিজেকে বঞ্চিত না ভাবে, সে যেন আমাকে বুঝতে পারে, আমিও যেন তাকে খানিকটা বুঝতে পারি, যাকে বলে পরস্পরের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়, সেই জন্যই তার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় কথাবার্তা হওয়া উচিত। রূপের কথা তুলব না, কিন্তু বয়স যেন তিরিশের কম না হয়।

বাবা তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, হঠাৎ আমি কেন এ সিদ্ধান্ত নিলুম। হ্যাঁ, হঠাৎই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে আমার সহকর্মী ছিল একটি বাংলাদেশের ছেলে। নাম জাহাঙ্গীর। আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট। ভারী সুন্দর ছেলে, খাঁটি বাঙালি। জাহাঙ্গীর ছিল অত্যন্ত হাসি খুশি, দেখলেই মনে হত একটি তরতাজা ফুলের মতো ছেলে। বিয়ে করেনি। কিন্তু বিয়ের কথাবার্তা সব পাকা হয়ে গিয়েছিল। যার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল, সে মেয়েটি ওর চেনা। মেয়েটি থাকে ঢাকায়। নাম আয়েশা। জাহাঙ্গীর রোজ এক বার করে আমাকে ওর আয়েশার কথা শোনাত। আয়েশাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে, সেই সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখত ও। আমাকে বলত। আমাকে মহীদা বলে ডাকত। নেশা ভাং কিছুই করত, ধূমপান ছাড়া। এখানে মেয়েদের সঙ্গে ওকে কখনও তেমন মেলামেশা করতে দেখিনি। ও আয়েশার স্বপ্নেই ভোর হয়েছিল। হঠাৎ সেই জাহাঙ্গীর সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়ে মারা গেল। মৃত্যুর আগে জাহাঙ্গীর আমাকে একটা কথাই মাত্র বলেছিল, মহীদা, জীবনটা বড় ছোট।জাহাঙ্গীর আমার চোখের সামনে থেকে, আমার বুকের অন্ধকার থেকে যেন একটা কালো পরদা সরিয়ে দিয়ে গেল। জীবনকে আমি নতুন চোখে দেখলাম। অথচ এ কথাটা আগেও অনেক বার অনেক রকম করে শুনেছি। কিন্তু অনিবার্য মৃত্যুর গ্রাসে যে চলে যাচ্ছে, এমন মানুষের মুখ থেকে কখনও শুনিনি। সেই জন্যেই বোধ হয় কথাটা আমার জীবনে নতুন অর্থ বহন করে নিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীরের শেষ কথার মধ্যেই, তোমার সেই কথাটারই প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পেলাম, মানব জন্ম দুর্লভ। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি বিয়ে করব। মানুষের চিরকালের প্রার্থনা তো পূর্ণতা। বিয়ে সেই পূর্ণতারই একটি অংশ, জাহাঙ্গীর আমাকে সেটাও বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে…।

.

মহীতোষের রোজনামচা:

১৭ ডিসেম্বর: এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং বিমান উড়ে চলেছে অনেক ওপর দিয়ে। আর ঘণ্টা তিনেক পরেই দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাব। আশা করছি বাড়ির সবাইকেই সেখানে দেখতে পাব। আমাদের সংসার তেমন বড় নয়। বাবা, মা, ছোট ভাই অন্তু, অন্তুর স্ত্রী অনীতা আর একমাত্র বোন নীতু। ওর এখনও বিয়ে হয়নি।

মাসখানেক আগে বাবাকে যে চিঠি লিখেছিলুম, তার জবাবও পেয়ে গিয়েছি। বেশ অনুমান করতে পারছি, আমার বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানানোর চিঠি পেয়েই বাড়িতে একটা উৎসবের সাড়া পড়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক। আমার এখন চুয়াল্লিশ বছর বয়স চলছে। এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলুম ভাল ভাবে। কিছুকাল কলকাতায় একটা চাকরি করেছিলুম বছর দুয়েকের জন্য। মাইনে পেতুম সামান্য। বাবা একজন জাঁদরেল আইনজীবী। এখন আর তার জীবিকা অ্যাডভোকেটের নয়। হাইকোর্টের একজন জজ। এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে প্রথম চাকরি পাবার পরেই মা আমার বিয়ের কথা তুলেছিলেন। আমি তো আপত্তি করেছিলুমই, বাবাও আপত্তি করেছিলেন আমার বয়স আর অর্থোপার্জনের কথা ভেবে। তিনি ভেবেছিলেন, আমি চাকরিতে আরও উন্নতি করলে বিয়ে দেবেন। দু বছর চাকরির পরে, আমি যখন হামবুর্গে চাকরি নিয়ে চলে যাই, বাবা তখনই আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি নানান অছিলায় বিয়ে করিনি।

বিয়ে না করার কারণ আমাদের পরিবারে বরাবর অজ্ঞাত থেকে গিয়েছে। আমি একটি মেয়েকে ভালবাসতুম। যাকে বলে প্রেমে পড়া, তাই ঘটেছিল আমার জীবনে। কিন্তু জীবন বড় বিচিত্র। আমি প্রেমে পড়েছিলুম আমার এক বন্ধুপত্নীর সঙ্গে। যদি কোনও অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে প্রেম হত, তা হলে এত কালে আমার বিয়ে হয়ে যেত। ছেলেমেয়েও নিশ্চয়ই হত। তা হয়নি। আমার বন্ধু হীরক, একসঙ্গেই আমার সঙ্গে এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। পুরো নাম হীরক কুণ্ডু। ওদের আদি নিবাস ছিল যশোহরে। বৈষ্ণব পরিবার, পেশায় আত্যন্তিক ব্যবসায়ী। পরিবারটিকে ঠিক রক্ষণশীল বলা চলে না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের বিয়ে অল্প বয়সেই হত। হীরক এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার তিন মাসের মধ্যে ওর বিয়ে হয়েছিল। অর্থোপার্জনের জন্য ছেলের বিয়ে ওদের পরিবারে আটকায় না। ছেলে এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে, সেটাই যথেষ্ট। অর্থের অভাব ছিল না। ছেলে কবে চাকরি কিংবা ব্যবসা করবে, তার জন্যে বিয়ে মুলতুবি রাখার কোনও প্রশ্নই ছিল না। ওর বিয়ে হয়েছিল এক পাঁচ পুরুষের অবাঙালি শেঠ পরিবারে। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পুরোমাত্রায় বাঙালি হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসায়ী পরিবার বটে, কিন্তু শেঠ পরিবারটি ছিল শিক্ষিত, উদার। যথার্থ আধুনিকতা বলতে যা বোঝায়, পরিবারে ছিল সেই আবহাওয়া। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে গড়ে উঠেছিল অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। শিক্ষা সংগীত শিল্পচর্চা সবই ছিল সেই পরিবারে। সেই পরিবারের মেয়ে চন্দ্রা তখন সবে মাত্র ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করে কলকাতায় য়ুনিভার্সিটিতে ভরতি হয়েছিল। বিয়ে হয়ে গেল হীরকের সঙ্গে। হীরকদের বাড়ি থেকে বলা হয়েছিল, পুত্রবধূকে তার পড়া চালিয়ে যেতে দেওয়া হবে। চন্দ্রারও বিয়েতে সম্মতি দেবার এই একটাই শর্ত ছিল।

হীরকদের বাড়ির কোনও বউ কখনও কলেজে য়ুনিভার্সিটিতে পড়েনি। হীরকের মা চন্দ্রার য়ুনিভার্সিটিতে পড়তে যাওয়ায় আপত্তি তুলেছিলেন। সে আপত্তি তেঁকেনি। হীরকের বাবার পূর্ণ সম্মতি ছিল। হীরকও মোটে আপত্তি করেনি। আমি হীরকের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছিলুম। সন্ধ্যালয়ে বিয়ের পরে, আমি হীরকের বাসরঘরে গিয়েছিলুম। একলা না, গিয়েছিলুম কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে মিলেই। ছাদনাতলায় অন্যান্য ক্রিয়াকাণ্ড দেখিনি। চন্দ্রা ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসেছিল না। সেই ওকে আমার প্রথম দেখা। ওরও। কনের বেশে ওকে খুবই সুন্দরী দেখাচ্ছিল। এমনিতেও চন্দ্রা সুন্দরীই।

আমি নাস্তিক মানুষ। দেবদ্বিজে ভক্তি ছিল না। অতএব অলৌকিকতায় আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু আমি জীবন-রহস্যে বিশ্বাসী। জীবনের কোনও ছক নেই। আমাদের মনগড়া বিশ্বাস, সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি ব্যাপারগুলোতেও আমার কোনও বিশ্বাস নেই। কেন না, সেই সব বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রার কোনও মিল নেই। হীরকের বাসরঘরে, প্রথম যখন চন্দ্রার সঙ্গে আমার দৃষ্টিবিনিময় হয়েছিল, সেই মুহূর্তে কি অলক্ষ্যে থেকে কেউ হেসেছিল?

চন্দ্রার মুখে ছিল সলজ্জ শালীন হাসি। হীরক আমাদের সঙ্গে চন্দ্রার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এক বন্ধু বাধা দিয়ে বলেছিল, পরিচয়পর্বটা এখানেই সেরে ফেলছিস কেন হীরক। ওটা তোর বাড়িতে বউভাতের দিনে হবে। নাকি বউভাতে আমাদের ফাঁকি দিবি? হীরক বলেছিল, তা কেন? তোরা সামনে রয়েছিস, তাই পরিচয় করিয়ে দিলাম। চন্দ্রার বোন ও বান্ধবীরাও ছিল। চন্দ্রা তাদের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

সেই বাসরঘরে দেখার পরে, বউভাতের দিন আবার দেখেছিলুম। কিন্তু আমি চন্দ্রার সম্পর্কে কিছুই ভাবিনি। বন্ধুর স্ত্রী, এই পর্যন্ত। আমার তখন অল্প আয়। ভাল কিছু উপহার দেবার মতো সঙ্গতি ছিল না। আমার একটি প্রিয় বই, টমাস মানের হোলি সিনার। বইটি দুজনের নামে লিখে দিয়েছিলুম। হোলি সিনার আমার প্রিয় এই অর্থে নয় যে উপন্যাসটিতে ঐশ্বরিক ভাবনা আছে। জীবন যে আমাদের বাস্তবতা বোধ থেকে কত অপ্রাকৃত হতে পারে, এবং মানুষের পাপ ও আত্মত্যাগের গভীরতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, হোলি সিনার আমাকে সেই বোধ দিয়েছিল।

তারপরে তো সবই ভুলে গিয়েছিলুম। হীরক চন্দ্রাকে নিয়ে কাশ্মীর কোথায় গিয়েছিল, খেয়াল নেই। আমি আমার চাকরি, আড্ডা ইত্যাদি নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলুম। বেশির ভাগ দিনই, ছুটির পরে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর কফি হাউসে যেতুম। বন্ধুরাও আসত সেখানে। এমন কোনও বিষয় ছিল না, যা আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু আমার মনে থাকত একটা কথা। জীবনে উন্নতি।

কফি হাউসে একদিন হীরক এল। বিয়ের প্রায় দু মাস পরে ওর সঙ্গে দেখা। বন্ধুরা হইচই করল। হীরকের পকেট খসানো হল ভাল ভাবেই। কফি হাউস থেকে বেরিয়ে হীরক আমাকে বলল, চন্দ্রা তোকে যেতে বলেছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, হঠাৎ? হীরক একটু মুচকি হেসে বলেছিল, কী জানি। এখনই বাড়ি গিয়ে কী করবি? চল, আমাদের বাড়ি ঘুরে যাবি।’

বলতে গেলে দক্ষিণ কলকাতায় আমরা একই পাড়ার অধিবাসী।

এক কিলোমিটার দূরত্ব ওদের বাড়ি, আর আমাদের বাড়িতে। তা ছাড়া হীরকদের ব্যবসায়ের আইন উপদেষ্টা, মামলা মোকদ্দমার দায়িত্ব ছিল আমার বাবার। ওর বাবা প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমিও মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যেতুম। আমি হীরকের সঙ্গে ওদের বাড়ি গিয়েছিলুম। বিরাট ওদের বাড়ি, বাগান। হীরকের জন্য দোতলায় নির্দিষ্ট হয়েছিল নতুন ঘর। সামনে দক্ষিণ খোলা বড় ব্যালকনি। ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুম। ঘরটি সাজানো হয়েছিল সুন্দর। ঘন বুনটের সরু আর মিহি চটের ওপর রং করা পরদা। বড় ঘরের মাঝখানে ওদের ক্যাবিনেট করা খাটের ওপর পরিষ্কার বিছানা। ড্রেসিংটেবল, ওয়ারড্রব, স্টিলের আলমারি আর ওয়ারড্রব, সব সাদা সত্ত্বেও, বড় ঘরটাকে মোটেই জবরজং দেখাচ্ছিল না। এক পাশে দুটি সিঙ্গল সোফা আর সেন্টার টেবল। পাশেই আর একটি ছোট ঘর। চন্দ্রার পড়ার ঘর। একটি টেবিল একটি চেয়ার ছাড়া রয়েছে দুটি আলমারি ঠাসা বই।

চন্দ্রাকে দেখেছিলুম নতুন বেশে। একেবারেই আটপৌরে। প্রস্তুতও ছিল না, বাইরের কেউ আসতে পারে ভেবে। পরে আরও অনেক বার গিয়ে দেখেছি, ওর বেশভূষা খুবই সামান্য। ঠোঁটে রং, চোখে কাজল, সন্না দিয়ে ভুরু সরু করা, কখনও দেখিনি। ভুরু জোড়া ওর সরুই ছিল। এক হাতে সোনা দিয়ে বাঁধানো একটি লোহা, আর এক হাতে একটি সোনার বালা। ঘোমটা ছিল না মাথায়। সিঁথিতে সিঁদুরের রেখা। স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে লাবণ্যময়ী। রং ফরসা। টিকোলো নাক। চোখ দুটি ডাগর কালো, দৃষ্টি গভীর এবং ভুল দেখেছিলুম কি না জানিনে। মুখের হাসির কিরণের মধ্যেও, চোখের গভীরে যেন একটা বিষণ্ণতা। হীরক বলেছিল, তুমি বলেছিলে, মহীতোষকে ডেকে আনতে। এনেছি।

চন্দ্রা কেতামাফিক আমাকে নমস্কার করেনি। সোফা দেখিয়ে বলেছিল, বসুন’, হীরককে বলেছিল, ওঁকে ডেকে আনবার দরকার হল কেন? তোমার মুখে তো শুনেছি, উনি তোমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসেন। সেটা কি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে?

হীরক বলেছিল, সেই রকমই তো দেখছি। ও আজকাল আর আসছে না। তাই কফি হাউসে আমাদের পুরনো আড্ডা থেকে ওকে ধরে নিয়ে এলুম।’ চন্দ্রা আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিল। আমি হেসে বলেছিলুম, হীরক সবে বিয়ে করেছে। ওর নতুন দাম্পত্য জীবনে কোনও বাধা সৃষ্টি করতে চাইনি।’

চন্দ্রা অবাক হেসে বলেছিল, নতুন দাম্পত্য জীবন থেকে বন্ধুরা বিদায় নেবে, সে আবার কেমন কথা। দাম্পত্য জীবনের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবদের ত্যাগ করার কোনও প্রশ্ন নেই। চন্দ্রা হীরকের দিকে তাকিয়েছিল। হীরক বলেছিল, আমি মোটেই সে রকম ভাবিনে। তবে এটা বলতে পারো, আমি এখন তোমাকে নিয়ে মশগুল হয়ে আছি। আমি হীরক দুজনেই হেসে উঠেছিলুম। চন্দ্রা হেসে ওর পড়ার ঘরে গিয়েছিল। হাতে করে নিয়ে এসেছিল দুখানা বই। একই বই। একটির মলাট কিছু পুরনো বিবর্ণ। আর একটি বেশ ঝকঝকে। চন্দ্রা ঝকঝকে বইটি আগে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। দেখেছিলুম বিয়েতে উপহার দেওয়া আমারই বই হোলি সিনার। দ্বিতীয় বইটির পাতা খুলে বাড়িয়ে দিয়েছিল। দেখলাম, সেখানে ইংরেজিতে লেখা আছে, চন্দ্রা শেঠ। তার নীচে লেখা আছে, আমার অত্যন্ত প্রিয় উপন্যাস। তারিখ লেখা রয়েছে, বছর খানেক আগের। আমি অবাক চোখে চার দিকে তাকিয়েছিলুম। চন্দ্রা হেসে বলেছিল, বইটা পেয়ে মনে হয়েছিল, যেন আপনি জেনেশুনেই বইটি আমাদের উপহার দিয়েছেন। আমি উলটো বুঝে আফশোস করে বলেছিলুম, আপনার পড়া বইটাই আমি দিয়েছি? আগে জানতে পারলে, অন্য বই দিতুম। চন্দ্রা মাথা নেড়ে বলেছিল আমি মোটেই সে কথা বলতে চাইনি। তা হলে আর আমার বইটা আপনাকে দেখালুম কেন? আমার বইয়ে কী লেখা আছে, দেখলেন তো। বইটা পেয়ে তাই আমার খুব ভাল লেগেছিল। একই বই নিজের কেনা, আর তারপরে আর একজনের কাছ থেকে পাওয়া, অবাক করেছিল আমাকে। এ বইটা কি আপনার প্রিয়। নাকি?’ বলেছিলুম, খুবই৷’ সেই মুহূর্তে চন্দ্রা আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। আমিও। কেমন যেন মনে হয়েছিল, একটা উদগত দীর্ঘশ্বাস ও চেপেছিল। বলেছিল, আপনার আফশোসের কিছু নেই। এ বই দু কপি থাকলে ক্ষতি নেই।’

হীরক বই দুটো নেড়েচেড়ে দেখে বলেছিল, আমি তো এ বইয়ের পাতা উলটেই কোনও দিন দেখিনি। মহীতোষের খুব গল্প উপন্যাস পড়ার বাতিক আছে। আমি আবার সাহিত্যের ধারে কাছে নেই। আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রই পড়ে উঠতে পারলুম না। যা পড়েছি সেই স্কুলপাঠ্য বই থেকে।’হীরক যখন কথাগুলো বলছিল, চন্দ্রা আমার দিকে তাকিয়েছিল। ওর মুখে ছিল হাসি, চোখে বিষণ্ণতা। হীরকের হাত থেকে বই দুটো নিয়ে বলেছিল, সংসারে সবকিছু সকলের জন্য নয়। তা না হলে আর স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে কী করে। তবে কথা হল ওটা বাতিক নয়, মানসিকতা। বাতিকগ্রস্ত পাঠকদের জন্য অনেক আলাদা বই আছে। তারা সে সব গোগ্রাসে গেলে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসই বা কজন পড়ে? হালের লেখকদের মধ্যে যারা একটু আলাদা, ভাবনা চিন্তা করার মতো লেখা লেখেন, তাদের বইও খুব বেশি লোকে পড়ে না। যাকগে এ সব কথা। আপনি কী খাবেন বলুন।

আমি ব্যস্ত হয়ে বলেছিলুম, এখন কিছুই খাব না। হীরক আজ আমাদের প্রচুর খাইয়েছে। আর এক দিন এসে খাব। সেই সময়ে হীরকের মা এসেছিলেন। চন্দ্রা ছোট করে একটু ঘোমটা টেনেছিল। হীরকের মা আমাকে বলেছিলেন, মহীতোষের যে আর পাত্তাই নেই। হীরুর বিয়ের পরে এই প্রথম এলে। তিনিও আমাকে কিছু খেতে বলেছিলেন। জবাব সেই একই দিয়েছিলুম। চলে আসবার আগে তিনি বলেছিলেন, আমাদের হীরুর জন্য একটা চাকরি-বাকরি দেখো। বন্ধুকে বেকার করে রেখো না।’ চন্দ্রা বলেছিল, আবার আসবেন।কথাটা যে নিতান্ত ভদ্রতা নয়, একটা আন্তরিক আহ্বান ছিল, বুঝতে পেরেছিলুম। চন্দ্রা হীরকের দাম্পত্য জীবনটা কেমন, বুঝতে পারিনি। তবে কেন যেন মনে হয়েছিল, চন্দ্রা বোধ হয় সুখী নয়। নয় যে, সেটা কিছুকালের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলুম। ওর নিজের ভাষায়, আমি কক্ষচ্যুত হয়ে পড়েছি। সেটা ও হীরকের সামনে বলেনি।

ক্রমেই বুঝতে পারছিলুম, আমাদের পরস্পরের মধ্যে একটা নৈকট্য গড়ে উঠছিল। এবং সেটা মনে মনে। কেউ কারোর কাছে তা প্রকাশ করিনি। আমাদের ভাষা ছিল চোখে, বোঝাবুঝিটা ছিল মনে। একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝেছিলুম, ও ওর আবাল্যের জগৎ থেকে কেবল বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েনি। যে-জগতে এসেছিল, সেখানে ও একেবারে বেমানান। ও ছিল খুবই একা। হীরক ওকে বুঝতে পারেনি, বোঝবার চেষ্টাও করেনি। বিয়ের ছ’ মাসের মধ্যেও ওদের পরস্পরের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, মনের দিক থেকে কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ইতিমধ্যে হীরকের একটা ভাল চাকরি হয়েছিল। অর্থাভাব কোনও কালেই ওদের ছিল না। শেঠ পরিবারের সঙ্গে বিয়েটা ঘটেছিল নিতান্তই আর্থিক মর্যাদাকে কেন্দ্র করে। শেঠ পরিবারে সাহিত্য শিল্প ইত্যাদির চর্চা থাকলেও, মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করবে, সে আবহাওয়া ছিল না। বিয়ের পর মেয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে যে ভাবেই জীবন কাটাক, তাতেও আপত্তি ছিল না। যেমন চন্দ্রার দিদি স্বামীর সঙ্গে পার্টিতে যায়, মদ্যপান করে, পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে নাচে, এ সব নিয়ে শ্বশুর বা বাপের বাড়িতে কোনও আপত্তি দেখা যায়নি। চন্দ্রা ওর দিদির বিপরীত চরিত্রের মেয়ে। আর ওর ভগ্নিপতির তুলনায়, হীরক ছিল মধ্যপন্থী। মনে মনে রক্ষণশীল। হলেও, স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা থিয়েটারে যাওয়াটা দোষের ছিল না। কিন্তু সিনেমা থিয়েটারের বিষয়ে ওর ছিল না কোনও রুচির বালাই, ফলে চন্দ্রাকে সঙ্গিনী হিসাবে পেত না। আবার চন্দ্রা যে সব নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা চিত্রকলা প্রদর্শনীতে যেত, সে সবে হীরকের ছিল অতীব অনীহা। স্পষ্টই বলত, ও সবে ও কোনও আকর্ষণ বোধ করে না। চন্দ্রা এমন কোনও বিষয় খুঁজে পেত না, যা নিয়ে হীরকের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

হীরক চাকরি পাওয়ায়, ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত কমেছিল। হীরক কিছু অনুমান করতে পেরেছিল কি না, জানিনে। আমার সঙ্গে ওর মেলামেশা কমে এসেছিল। ও আমাকে আর আগের মতো বাড়িতে ডাকত না। অথচ আমি আর চন্দ্রা, এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছিলাম, মনে হয়েছিল, আমরা পরস্পরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি না। অথচ দুজনের কেউই এমন একটা পন্থা নিতে পারছিলাম না, সমাজের চোখে যেটা কলঙ্কজনক। কিন্তু শেষপর্যন্ত আবেগেরই জয় হয়েছিল। আর সেটা প্রতি দিনের বাঁচার প্রয়োজনেই। চন্দ্রাই প্রথম চিঠি লিখে জানিয়েছিল, অবশেষে মুখ খুলতেই হল। এটা পরাজয় বা বিকার, বুঝতে পারছি না। মনে একটা পাপ বোধও কাজ করছে। কিন্তু ভিতরের রুদ্ধ দুয়ারটা এমন সপাটে খুলে গিয়েছে, পাপ বোধটাকে ঝড়ের বেগে উড়িয়ে দিয়েছে। হীরকের প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। হীরক যে পরিবারে যে ভাবে মানুষ হয়েছে, ও আমার সঙ্গে সেইভাবেই আচরণ করছে। আমাকে বঞ্চিত করার বা দুঃখ দেবার কোনও ইচ্ছাকৃত ব্যাপার ওর মধ্যে নেই। আমারও একটা জীবন ছিল, আছে। হীরকের সংসারে এসে, আমি জীবনসঙ্গীর পরিবর্তে পেয়েছি এক কষ্টদায়ক একাকিত্ব। এর জন্য আমাকে কি দোষ দেওয়া যাবে? কিন্তু এ সব যুক্তি তর্কের অবকাশ আর নেই। আমি জানি, আপনার পক্ষে এ বাড়িতে আসা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। হীরক পুরুষ মানুষ। ওর চরিত্রে যত লঘু স্থূলতাই থাকুক, ওর পুরুষ-প্রবৃত্তিই ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে, আপনার আমার মধ্যে, একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। খুব সঙ্গত কারণেই ও ঈর্ষা বোধ করছে। ওকে দোষ দেব না। কিন্তু নিজে যে তিলে তিলে মরে যাচ্ছি। এভাবে মরতে পারছি না। জানিনে, হোলি সিনার-এর তাৎপর্য এতে কিছু আছে কি না। আমি আপনার সাহচর্য সঙ্গ চাই। এখনও আমার স্বাধীনতা আছে, বাইরে যাবার। য়ুনিভার্সিটিতে যাই। বাইরে ছাড়া আপনার সঙ্গে আর কোথায় দেখা করতে পারব? কোথাও নয়। আমার পিত্রালয়ে অথবা আপনাদের বাড়িতেও সম্ভব নয়। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আমার যাতায়াত আছে। কিন্তু সেখানেও বিস্তর পরিচিত মুখ। পরিচিত পরিবেশে দেখা সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। তা ছাড়া আছে সময়ের বিষয়। আপনার চাকরি, আমার ক্লাস। এ সবের সমন্বয় রক্ষা করে, কোথায় কীভাবে আপনার দেখা পাব, আপনিই স্থির করবেন। চিঠিটা খুব সহজে লিখতে পারছি না। হাত কাঁপছে, ঘামছি, নিশ্বাস দ্রুত। জীবনে এমন চিঠি লেখা এই প্রথম।’…

তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের দেখা সাক্ষাৎ। প্রায় একটা বছর কলকাতার নানা অজানা জায়গায় যে কীভাবে চন্দ্রার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি, এখন ভাবলে অবাক হয়ে যাই। আমার কাজ, ওর য়ুনিভার্সিটি ক্লাস, স্বভাবতই সে-সমন্বয় রক্ষা করা যায়নি। কলকাতাকে মাঝখানে রেখে, আমাদের গতিবিধি দক্ষিণে ডায়মন্ডহারবার থেকে উত্তরে কল্যাণী পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল। এমন মনে করার কোনও কারণ নেই, আমাদের সময় কাটত কেবল সাহিত্য কবিতা আলোচনা করে। চন্দ্রার একটা কথাই সব বিষয়টিকে বুঝিয়ে দেবার মতো যথেষ্ট। তা হল, শেষপর্যন্ত সমাজ সামাজিক ন্যায় অন্যায় বোধকে পায়ে দলেই, আমি আমার নারী জীবনের সার্থকতাকে খুঁজে পেলাম। কিন্তু মহী, পরিণতিহীন এ কোন পথে আমাদের যাত্রা? এ বার যে সে-সংকট ক্রমে আমার বুকের রক্ত শুষতে আরম্ভ করেছে। বিবাহ বিচ্ছেদ আমার দ্বারা সম্ভব নয়, সেই পরিণতি আমি মেনে নিতে পারব না। তাতে যে গোলমাল আর উৎপাতের সৃষ্টি হবে, তুমি সইতে পারলেও, আমি পারব না। অথচ তোমার স্পর্শ নিয়ে হীরকের সান্নিধ্য কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। তুমি আমাকে শক্তি দাও।’…

আমি কী শক্তি দেব চন্দ্রাকে? সে-ই তো আমার শক্তি। আমার পক্ষে যেটা সবথেকে সহজ ছিল, সেই বিবাহ বিচ্ছেদের প্রস্তাব ও নিজেই নাকচ করে দিয়েছিল? যাত্রার ইতি তো একমাত্র সেটাই ছিল। সে ইতি দিয়েই, নতুন জীবন শুরু করা। কী শক্তি ও আমার কাছে চেয়েছিল? ও চেয়েছিল, সেই শক্তি, ও যেন আমাকে ত্যাগ করতে পারে। আমার কাছ থেকে ফিরে যেতে পারে। কী মর্মান্তিক! সে তো বুকের পাঁজর নিজের হাতে খুলে দেবার মতো। ওকে ছেড়ে দেবার শক্তি আমার ছিল না।

সে শক্তি চন্দ্রারই ছিল। ওর শেষ চিঠিতে লিখেছিল, তোমার কাছ থেকে ফিরে, আবার হীরকের সঙ্গে জীবনযাপন, কোনওটাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বুঝেছি, যা আমার নয়, তা আমি চিরকাল ভোগ করতে পারিনে। সংকট মোচনের উপায় স্থির করেছি। নিজের কাছ থেকেই আমাকে বিদায় নিতে হবে। তোমার কাছে একটাই প্রার্থনা। আমাকে দিয়েই বুঝতে পেরেছ, জীবনের পূর্ণতার প্রয়োজনে বিয়ে একটা আবশ্যিক ব্যাপার। আমি যেন তোমার পথের বাধা না হই। ঠিক মেয়েটিকে খুঁজে নিয়ো?’..চন্দ্রা আত্মহত্যা করে সংকট মোচন করেছিল।

জানি না হীরক কিছু অনুমান করতে পেরেছিল কি না। বিষ খেয়ে আত্মহত্যার আগে, চন্দ্রা একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিল, এ আত্মনাশ আমার পরাজয়। দায়ী কেউ নয়। আমিই আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী।

তারপরেই আমি হামবুর্গে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলুম। তাও আজ ষোলো বছর আগের কথা। হীরক আবার বিয়ে করেছে। চন্দ্রা আমার সে পথ বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের কথা উঠলেই, চন্দ্রা আমার সামনে এসে দাঁড়াত। অথচ আমি নিতান্ত বেলকাঠ ব্রহ্মচারী মানুষ নই। পরস্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করেছি। কিন্তু ওকে পরস্ত্রী বলে ভাবতে পারিনি। একান্ত আমার বলেই ভেবেছি। হীরকের কিছু এল গেল না। আর আমি চিরকাল ধরেই ভেবে আসছি, অসাধারণ তো নই। বিয়ের ইচ্ছা আমার আছে। কিন্তু চন্দ্রার পরিপূরক কোনও মেয়েকে তো আজ অবধি খুঁজে পেলাম না।

তবে এখন কেন বিয়ে করার সম্মতি দিয়েছি? বাবাকে আমি মিথ্যে কথা লিখিনি, মানব জন্মকে আমি সত্যি দুর্লভ জ্ঞান করতে শিখেছি। আর একান্তভাবে অনুভব করছি, শেষ বারের জন্য চন্দ্রার পরিপূরক একটি মেয়েকে খুঁজে দেখব। পূর্ণতার স্বাদ গ্রহণ করব। দু মাস সময় হয়তো খুবই কম। কিন্তু ডাক্তার যে আমাকে নিদান দিয়েছেন মাত্র ছ’ মাসের জন্য। ছ’মাসের মধ্যে মৃত্যু আমাকে অনিবার্যভাবে গ্রাস করবে। বেদনাহীন দুরারোগ্য কর্কট রোগে আমি আক্রান্ত।…এয়ার হোস্টেসের ঘোষণা শুনতে পাচ্ছি, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করছি।…

২২ ডিসেম্বর: যা আশা করেছিলুম, তাই ঘটেছিল। দমদমে বাড়ির সকলের দেখা পেয়েছিলুম। প্রায় প্রতি বছরেই শীতকালে আমি কলকাতায় এসে থাকি। গতবছর আসিনি। গতবছরেই আমার কর্কট। রোগটি ধরা পড়ে। চিকিৎসা চলতে থাকে। ডাক্তারের বক্তব্য ছিল, বুকের বাঁ দিকে, বগল ঘেঁষে যে একটি টোপা কুলের মতো আব দেখা দিয়েছিল, সেটি জন্ম মাত্রই দেখানো উচিত ছিল। বেদনাহীন। বলেই আমি ব্যাপারটাকে আমল দিইনি। ডাক্তার দেখেই সন্দেহ করেছিলেন। বায়োপসি করেছিলেন, এবং সন্দেহ সত্যে পরিণত হয়েছিল। অপারেশনও করা হয়েছিল। ওষুধ-বিষুধ যা খাবার, সবই নিয়মিত চালিয়েও, আবার সেটি বগলের কাছ থেকে বুকের দিকে এগিয়ে দেখা দিয়েছিল। ডাক্তারের আশঙ্কা, ওই বেদনাহীন গ্রোথটি আবার অপারেশন করলেও, আবার হবে, এবং আমার হৃদযন্ত্রের গভীরে তা সে সময়ে অনুপ্রবেশ করেছিল। অপারেশন করলে, আমার হৃদযন্ত্র বাদ দিতে হবে। তাতেও নিশ্চয়তা ছিল না, গ্রোথটি আবার হবে না। বরং হবে, এটাই নিশ্চিত ছিল। অতএব মৃত্যু অনিবার্য। ডাক্তার বলেছিলেন, দুঃখিত মিঃ মুস্তফি, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। তোমরা ভারতীয়রা পূর্বজন্ম পরজন্ম বিশ্বাস কর। পরজন্মের কথা চিন্তা করে, তুমি এ জীবনের বাকি দিনগুলোতে যা করবার করে নাও।

এ জীবনে আমার আর কিছুই করার ছিল না, চন্দ্রার শেষ অনুরোধ রক্ষা করা ছাড়া। আর মানব-জন্ম। যে দুর্লভ, এমন করে কখনও অনুভব করিনি। আমি পূর্ব বা পরজন্মে বিশ্বাসী নই। জীবন একটাই। বাবা আমার চিঠি পাবার পরেই, বাড়ির সবাই আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করেছিল। বাবা মা তো বটেই। অন্তু অনীতা নীতুও, তবে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি।

মা বাবাকে দমদম বিমান বন্দরেই প্রণাম করেছিলুম। বাবার হাসিমুখে চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল। বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, দেরিতে হলেও তুই যে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিস, এ বয়সে এর থেকে বেশি সুখ আর আমি কিছুতে পাব না। মা বুকে চেপে ধরে, আমার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে, একটু উদ্বেগের সঙ্গে বলেছিলেন, তোর চেহারাটা এ বার একটু রোগা দেখছি। একটু যেন ফ্যাকাশেও। কেন রে? শরীরটা কি ভাল নেই? আমি হেসে বলেছিলুম, ভালই আছি। আসবার আগে কয়েকদিন ব্যস্ত ছিলুম, পথেরও ক্লান্তি আছে। সেইজন্যই বোধ হয় এ রকম দেখাচ্ছে। অন্তু অনীতা নীতুর চোখে-মুখে। আনন্দ ধরছিল না। অনীতা আমাকে প্রণাম করতে এসে, নিচু স্বরে হেসে বলেছিল, যা সব মেয়ে দেখে রেখেছি, চোখ ঝলসে যাবে। হেসে বলেছিলুম, সে কী অনীতা। চোখ ঝলসে গেলে দেখব কেমন করে? আমি তো বাবাকে লিখেইছি, রূপের কথা তুলব না। কেবল মেয়েটির বয়স যেন তিরিশের কম না হয়। অনীতা বলেছিল, দাদা, গোলমালটা ওখানেই৷ তিরিশ বছরের মেয়ে পাইনি একটিও। তবে আটাশ বছরের একটি মেয়ে পেয়েছি। নামটা একটু সেকেলে, জ্যোৎস্না। তবে সে জ্যোৎস্নার মতোই দেখতে, পূর্ণিমার চাঁদের মতোই রং। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পাশ করেছে। প্রথম শ্রেণীতে শুধু নয়, কলকাতা য়ুনিভারসিটিতে ও সেকেন্ড হয়েছিল। এখন বেথুন কলেজে ইংরেজির লেকচারার।

বিমান বন্দরে আর কথা বাড়াইনি। কিন্তু অনীতা আমার মনে একটা দাগ এঁকে দিয়েছিল। চন্দ্রার পরিবর্তে, জ্যোৎস্না। যেন একই অর্থ প্রায় বহন করছে। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পাশ। চন্দ্রা পাশ করার আগেই, নিজেকে শেষ করেছিল। কেবল বয়সটাই খটোমটো লেগেছিল। তা ছাড়া, আর একটা চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছিল। আটাশ-ত্রিশ বছরের মেয়েরা কি প্রেমে পড়ে না? আর যাই হোক, এমন কোনও মেয়েকে যেন বিয়ে করতে না হয়, যে তার বাবা মার অনুরোধ রাখতে গিয়ে, প্রেমিককে বঞ্চিত করবে। প্রেম করেছে, অথচ পরে সেই প্রেম ভেঙে গিয়েছে, এমন মেয়েতে আমার আপত্তি ছিল না। এমনকী, কোনও মেয়ে যদি তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে সহবাসও করে থাকে, তাতেও আমার আপত্তি নেই। বিধবা হলেও আপত্তি নেই। বাড়িতে সে কথা বলেছিলুম। সকলেরই আপত্তি।

গত চার দিন ধরে তিনটি পরিবার আমাদের বাড়িতে এসেছে, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। আমরাও গিয়েছি একটি পরিবারে। বাবা মা সকলেই গোড়ায় একটা গলদ করে রেখেছেন। সেরা সব সুন্দরীদের দেখে রেখেছেন। অনীতা মিথ্যে কিছু বলেনি, সকলেরই রূপের ঝলক বড় বেশি। আমি আপত্তি করেছি। তা ছাড়া চারটি মেয়েরই বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়। আর যাই হোক, আমার থেকে কুড়ি বছরের ছোট একটি রূপসী ফুলটুসি মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারব না।

গতকাল রাত্রে জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। জ্যোৎস্নারই শর্ত ছিল, আমরা কেউ কারোর পরিবারে যাব না। ও পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁর নাম করেছিল, এবং সময় জানিয়ে টেলিফোন করেছিল, সেই সময়ে ও একলা সেখানে থাকবে। মহীতোষও একলা যাবে। চেনাচিনি? মহীতোষ যে পোশাক পরেই আসুন, তার হাতে যেন একটি লাল গোলাপ থাকে। ব্যাপারটি বেশ অভিনব আর রোমান্টিক। বাড়ির সকলের সঙ্গেই জ্যোৎস্নার পরিচয় ছিল। বাবা মা আপত্তি করেননি! অনীতা ঠাট্টা করে বলেছিল, ঠিক আছে, আমরাও আজ রাত্রে রেস্তোরাঁয় খেতে যাব।

আমি পাজামা পাঞ্জাবির ওপরে একটা কাশ্মীরি শাল চাপিয়ে গিয়েছিলুম। হাতে একটি লাল গোলাপ। রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেখেছিলুম, এক কোণে একটি টেবিলে একটি মেয়ে একলা বসে আছে। টেবিলের ওপরে রাখা একটি লাল গোলাপে সে হাত বোলাচ্ছিল। রেস্তোরাঁ-কাম-বার নয়, তা হলে একলা একটি মেয়ের প্রবেশাধিকার থাকত না। আমাদের দেশে এখনও এই নিয়ম চালু আছে, পানশালায় একলা মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ।

রেস্তোরাঁটিতে ভিড় সে রকম ছিল না। খুব বড়ও না। একটু যেন নিরিবিলিই। পার্ক স্ট্রিটের মতো জায়গায় এ রকম রেস্তোরাঁ ফাঁকা থাকারই কথা। পরিচ্ছন্ন স্বল্পালোক, পরিবেশটা ভাল লেগেছিল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সেই কোণের টেবিলের দিকে তাকিয়েছিলুম। জ্যোৎস্নাও তাকিয়েছিল। হাতে ফুল তুলে নিয়েছিল। আমি ওর দিকে নিশ্চিত হয়েই পা বাড়িয়েছিলুম। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হেসেছিল, আমার নাম জ্যোৎস্নাময়ী ভট্টাচার্য। আমিও হেসে বলেছিলুম, আমার নাম মহীতোষ মুস্তফি। জ্যোৎস্না আর আমি পরস্পরকে নমস্কার বিনিময় করেছিলুম। বসেছিলুম মুখোমুখি। ওর সামনে ছিল কমলা লেবুর রসের গেলাস। ও উঠে দাঁড়াতেই বুঝে নিয়েছিলুম, অন্তত সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা। অনীতা মিথ্যা বলেনি, চাঁদের মতোই ওর রং কোমল, অনুগ্র ফরসা। বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল কালো চোখ টানা। ভুরু জোড়া কি প্লাক করা ছিল? বোধ হয় না। এমনিতেই সরু। টিকোলো নাক, ঠোঁট দুটি ঈষৎ পুষ্ট। কোনও প্রসাধনের প্রলেপ ছিল না। হাসিটি আড়ষ্ট, মিষ্টি। মাথার চুল বয়েজ কাট। মনে হয়েছিল পাড়হীন শাড়ি আর জামার রং যেন ওর গায়ের মতোই। বাঁ হাতের কবজিতে ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ওকে দেখাচ্ছিল তাজা, স্বাস্থ্যবতী একহারা।

আমিও খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করেছিলুম। কী দিয়ে কথা শুরু করব, ভেবে পাচ্ছিলুম না। জ্যোৎস্নার অবস্থাও অনেকটা আমার মতোই। ওর মুখে লজ্জার ছটা লেগে ছিল, এবং শেষপর্যন্ত ওই প্রথম বলেছিল, এভাবে দেখা করার আইডিয়াটা আপনার অপছন্দ হয়নি তো?’ বলেছিলুম, না। বরং বেশ ভালই লেগেছে। তারপরেই আবার চুপচাপ। এবং আবার জ্যোৎস্নাই জিজ্ঞেস করেছিল, আপনাকে। কী দিতে বলব? আমি একটু অরেঞ্জ স্কোয়াশ নিয়ে বসেছি। এখানে কোনও রকম অ্যালকোহল পাওয়া যায় না। আপনার কি তাতে অসুবিধে হবে?

বলেছিলুম, না, অ্যালকোহলে আমার কোনও আসক্তি নেই। নিইনে, সেটাও ঠিক নয়, নিই, মাঝে মধ্যে, কম। আজ এখন তার কোনও দরকার নেই। আমিও বরং একটু ঠাণ্ডা কমলালেবুর রসই নেব।’ জ্যোৎস্না হাত তুলে, বেয়ারাকে ডেকে, কমলালেবুর রস দিতে বলেছিল, এবং সেই সঙ্গে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আপনি কিন্তু আজ এখানে খেয়ে যাবেন। অবিশ্যি যদি সে রকম কোনও আপত্তি না থাকে। আমি বলেছিলুম, কোনও আপত্তি নেই। তবে আপনি আমার অতিথি হলে আমি খুশি হব।’

জ্যোৎস্না হেসে মাথা নেড়েছিল, তা কী করে হবে? আমিই তো আপনাকে ডেকেছি। আপনি আজ আমার অতিথি। আজকের পরেও যদি আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন আমি আপনার অতিথি হব।

কথাটা কিছু ভুল বলেনি। আপত্তি করতে পারিনি। কমলালেবুর রস এসেছিল। আমি জ্যোৎস্নার অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিলুম। ওকেও অফার করেছিলুম। ও দুঃখ ও ধন্যবাদ জানিয়েছিল। আমি আমার প্রথম প্রশ্ন তৈরি করে ফেলেছিলুম এবং দ্বিধা ত্যাগ করে জিজ্ঞেস করেছিলুম, আপনি কিছু মনে না করলে একটা কথা প্রথমেই জেনে নিতে চাই। ও বলেছিল, উচিত প্রশ্ন হলে নিশ্চয়ই জবাব দেব।’ বোঝা গিয়েছিল, জ্যোৎস্নাও দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, আমার প্রথমেই জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার সঙ্গে যদি আমার সম্পর্ক ঘটে ওঠে, তার জন্য কেউ বঞ্চিত হবেন না তো?

জ্যোৎস্নার চোখে ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি ফুটেছিল, তা হলে তো আমি আসতুমই না। আমার জীবনে এখনও সে রকম ঘটনা কিছু ঘটেনি। আর পালটা জিজ্ঞাসাটা আমারও। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি এক মুহূর্ত চুপ করে ছিলুম। তারপরে চন্দ্রার সংক্ষেপে কিন্তু বুঝিয়ে দেবার মতো সব কথা বলেছিলুম। এ কথাও বলেছিলুম, এ ঘটনার কথা আজ অবধি আমি কারোকে বলিনি। ওকেই প্রথম বললাম। জ্যোৎস্নার মুখে বেদনার ছায়া পড়েছিল। বলেছিল, শুনে কষ্ট পাচ্ছি, আর একটু ভয়ও। আমি কি আপনার সেই শূন্যতা পূর্ণ করতে পারব?’ বলেছিলুম, সে রকম প্রত্যাশা না করলে, ঘটনাটা আপনাকে বলতুম না। জীবনে আমার এই একটি ঘটনাই ছিল। আজ পর্যন্ত কারোকে বলতে পারিনি। জ্যোৎস্না বলেছিল, বলে ভালই করেছেন। আপনাকে বুঝতে আমার সুবিধে হবে। তবু একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারছিনে, ষোলো বছর পরে, মত বদলালেন কেন?’ বলেছিলুম, সে জবাব তো আপনাকে আগেই দিয়েছি। এত বছর পরে আমার মনে হয়েছে, আমি অপূর্ণ থেকে যাচ্ছি। আমি পূর্ণতা চাই।’

এ কথাটা বলার সময়ে, আমার হাত আপনিই চলে গিয়েছিল বুকের বাঁ দিকে। তিলে তিলে মৃত্যুর গ্রাসে এগিয়ে চলেছি। আর মুখে বলেছি, পূর্ণতা চাই। জ্যোৎস্নাময়ী আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। এবং চোখ নামিয়ে কয়েক মুহূর্ত কিছু ভেবেছিল। আমি আবার বলেছিলাম, অবিশ্যি আমার বিষয়ে আপনি ভাবুন। আমাদের পরিবার, আমার শিক্ষাদীক্ষা চাকরি, এ সবই আপনি আগে দেখেছেন শুনেছেন। আমাকে এই প্রথম দেখছেন। আপনার বয়স মাত্র আটাশ। আমার চুয়াল্লিশ। ষোলো বছরের তফাত। এ সবই আপনি ভেবে দেখবেন।

জ্যোৎস্না বলেছিল, সেটা তো আমারও কথা। আপনিও নিশ্চয় আমার কথা ভাববেন। আমরা কেউ কোনও দাবি নিয়ে এখানে দেখা করতে আসিনি। দুজনে একটু কথাবার্তা আলাপ আলোচনা করতে এসেছি। আমাকে অনীতা বলেছে, আপনি নিজে আপনার ভাবী স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান। সেটা আমিও চেয়েছি। আপনিও আমার কথা ভাবুন। আমি আত্মনির্ভরশীলতা পছন্দ করি। কোনও বিষয়েই আমার গোঁড়ামি নেই। কিন্তু রুচি আছে। আমি আবেগশূন্য নই। কিন্তু স্পষ্টবাদিতা ভালবাসি। গোঁড়ামি না থাকার অর্থ এই নয়, আমি সমস্ত বিষয়ে উদার। আমার উদারতারও একটা সীমা আছে। বড়লোক বলতে যা বোঝায়, আমরা তা নই, কিন্তু ও থেমে গিয়েছিল। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ও একটু হেসে বলেছিল, আমাদের পরিবারেও শিক্ষাদীক্ষা সংগীত শিল্প চর্চার আবহাওয়া আছে। কিন্তু ছেলে বা মেয়ের নিজের পছন্দমতো বিয়ে করার অধিকার সেখানে স্বীকৃত।

জ্যোৎস্না কথাটা বলেছিল, চন্দ্রার কথা ভেবে। চাঁদের পরিবারে, জ্যোৎস্নাদের পরিবারের মতোই শিক্ষা সংস্কৃতির আবহাওয়া, কিন্তু চন্দ্রাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিজেদের ইচ্ছা মতো বিয়ের অনুমতি ছিল না। স্বাভাবিক, অন্যথায় জ্যোৎস্না আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত না; বা আসার অনুমতিও মিলত না। অবিশ্যি জ্যোৎস্না নিজে চাকরি করে, আত্মনির্ভরশীল মেয়ে, ও ওর পছন্দ মতো বিয়ে করতেই পারে। আমি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলুম, একটু আশ্চর্য লাগছে, আপনার যা চেহারা আর গুণ, তাতে এ পর্যন্ত এখনও আপনাকে কেউ শরবিদ্ধ করতে পারেনি। জ্যোৎস্না শব্দ করে হেসে উঠেছিল, পারেনি, কিন্তু চেষ্টা তো অনেক হয়েছে। তবে শরগুলো ছিল বোধ হয় খুবই ভোতা, আমাকে বিধতে পারেনি। আর ও আবার থেমেছিল। আমি তাকিয়ে ছিলাম ওর চোখের দিকে। ও বলেছিল, ভাববেন না যে, আমিও কারোকে বিদ্ধ করতে চাইনি। সেক্ষেত্রে বোধ হয় আমারটাও ছিল। সেই রকম ভোঁতা। কিংবা বিদ্ধ করেই ফিরতে হয়েছে, কারণ লক্ষ্যবস্তুটি বিদ্ধ করার মতো ছিল না।’

আমরা দুজনেই হেসে উঠেছিলাম। জ্যোৎস্না মেনু কার্ড আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল, কী খাবেন বলুন।

বলেছিলুম, আপনি যা খাওয়াবেন, তাই খাব। খাবার ব্যাপারে আমার তেমন কোনও বাছাবাছি নেই। জ্যোৎস্না চায়নিজ স্যুপ আর খাবার অর্ডার দিয়েছিল। আহার-পর্ব শেষ হয়েছিল, আইসক্রিম দিয়ে। রাত্রি তখন সাড়ে ন’টা। দুজনের কারোরই গাড়ি ছিল না। ট্যাক্সিতে উঠে, আমি ওকে পৌঁছে। দিতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়নি। বলেছিল, পরে যদি আপনি আমাকে ডাকেন, তখন পৌঁছে দেবেন। সেটা তো একটা বড় কথা। এর পরে কে কাকে আগে ডাকবে? নিশ্চয়ই যে বেশি প্রয়োজন মনে করবে, বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। জ্যোৎস্না আমাকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে বলেছিল, আপনার আমার বাড়ির টেলিফোন নাম্বার জানাজানি আছে। আমি সাধারণত এগারোটা থেকে চারটে অবধি কলেজে থাকি। বিকেলে কোনও কোনওদিন হঠাৎ কোনও বন্ধুর বাড়ি চলে যাই, সিনেমা থিয়েটারে যাই। টেলিফোন বেলা এগারোটার মধ্যে হলেই সুবিধে হয়।

.

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

২৫ ডিসেম্বর, বড়দিন, রাত্রি দুটো: দুটো দিন ভাবলুম। তারপরে বাবা মাকে জানালুম। অনীতা হাততালি দিয়ে উঠল। সবাইকেই খুশি দেখলাম। জ্যোৎস্নাকে সকলেরই ভাল লেগেছে। বাবা তো বলেই ফেললেন, মহী, তোর পছন্দের সঙ্গে আমার একশো ভাগ মিলে গেছে। তা হলে আজই। আমি বাধা দিয়ে বললাম, না, তোমরা এখন কিছু বোলো না। আমি আগে জ্যোৎস্নার সঙ্গে কথা বলি। আমাকেও তো ওর মনের কথা জানতে হবে। সকলেই আমার কথায় রাজি।

আমি জানি, আজ জ্যোৎস্নার নিশ্চয়ই ছুটি। তবু সকাল দশটাতেই টেলিফোন করলুম। জবাব পেলুম পুরুষের ভারী গম্ভীর স্বরে, হ্যালো?’ জিজ্ঞেস করলুম, জ্যোৎস্নাময়ী আছেন?’ শুনলুম, আছেন, ধরুন ডেকে দিচ্ছি। প্রায় মিনিট খানেক পরে জ্যোৎস্নার গলা শুনলাম, হ্যাঁ, কে?’বললুম, আমি মহীতোষ। ব্যস্ত করলুম না তো?’ ঈষৎ হাসির সঙ্গে জবাব, না। আজ তো ছুটি। কিছু পরীক্ষার খাতা দেখা ছিল। শেষ করে ফেলেছি। জিজ্ঞেস করলুম, আজ কি আপনার সন্ধ্যা খালি আছে?’ শুনলুম, আছে। কিন্তু আজ তো বড়দিন। সবখানেই বড্ড ভিড় আর হইচই। কোথায় দেখা করতে পারি?’ বললুম, আজ হয় তো আমাদের বাড়িতেও কিছু কিঞ্চিৎ হইচই হতে পারে। তবে সেটা খুব অগ্রাহ্য হবে না। আমাদের বাড়ি আসবেন? জ্যোৎস্নার দিক থেকে একটু দ্বিধার স্বর শোনা গেল, আপনাদের বাড়ি?’ বললুম, আপনার সম্মতি থাকলে, আমি নিজে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসতে পারি। শুনলুম, সেটাই ভাল। তবে প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে আসবেন, একটু অস্বস্তি হতে পারে আপনার। সঙ্গে অনীতাকে নিয়ে আসুন। ওকে আমাদের বাড়ির সবাই খুব ভাল চেনে। বললুম, তা হলে বিকেল চারটা নাগাদ যাই? শুনলুম, হ্যাঁ, তাই আসুন।’ বললুম, আজ কিন্তু নিমন্ত্রণটা আমার। শুনলুম হাসি, এবং কথা, ঠিক আছে।

বাড়ির সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিলুম। শুরু হয়ে গেল হইচই। নীতু, আমার ছোট বোন কিছুতেই ছাড়তে চাইল না। আমার আর অনীতার সঙ্গ নিল। দুজনেই খুব সেজেছে, গন্ধ উড়িয়েছে। বাবার গাড়িটা পাওয়া গেল। জ্যোৎস্নাদের বাড়িতে গিয়ে দেখলুম, সকলেই আমাদের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত। জ্যোৎস্নার মা নেই। ওর বাবার সঙ্গে পরিচয় হল। সারা জীবন অধ্যাপনা করেছেন। মানুষটিকে দেখে কেমন ঋষিতুল্য মনে হল। আমি প্রণাম করলুম। তিনি বিব্রত হেসে বললন, থাক থাক, আসুন।

আসুন’ শুনে অস্বস্তি বোধ করলুম। জ্যোৎস্নার তিন দাদা দুই বউদির সঙ্গে পরিচয় হল। মনে হল আমাকে তাঁদের ভালই লেগেছে। যদিও আমরা জ্যোৎস্নাকে আনতে গিয়েছিলুম, তবু থাকতে হল ঘণ্টা খানেকের ওপর। কিছু খাবারও খেতে হল। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন জ্যোৎস্না। ওর তিন দাদারা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত চাকুরিজীবী। এক বউদি, একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ান, ভাল গান করেন। অন্য বউদি নাচে-গানে পারদর্শিনী, ক্লাসিক নাচের ওপর রিসার্চ করে ডক্টরেট করেছেন।

জ্যোৎস্না আগেও আমাদের বাড়ি এসেছে। অনীতা ওর পুরনো বন্ধু। আমাদের বাড়িতে হইচই লেগে গেল। মা বাবা দুজনেই খুশি! অন্তু তো বটেই। আমাদের বাড়ির মাপের তুলনায় তোক কম। দোতলায় গিয়ে প্রথমে আমার ঘরেই বসলুম। অনীতা বলল, এ বারে সাক্ষাৎটা যখন আমাদের বাড়িতে হচ্ছে, দুজনের নিভৃত আলাপের সময় এক-দেড় ঘণ্টার বেশি দেওয়া যাবে না। আমরা কি হা করে বসে। থাকব? জ্যোৎস্না হেসে বলল, এক-দেড় ঘণ্টাই বা দিবি কেন? নিভৃত আলাপ না হয় না-ই হল আজ? আয়, সবাই মিলে গল্প করি।’ অনীতা বলল, তোদের এতটা বঞ্চিত করতে চাই নে। একটু কথাবার্তা বলে নে, তারপর সবাই এসে জুটব।

আমি আর জ্যোৎস্না আমার ঘরে। ও আজ পরে এসেছে হালকা নীলের তসরের শাড়ি, পাড়ের রং গাঢ় নীল। বাসন্তী রঙের কাশ্মীরি লেডিজ শালে সূক্ষ্ম কাজ। নতুনত্বের মধ্যে দেখলুম, কপালে একটি সবুজ টিপ। আমার পাজামার ওপরে ছিল র সিল্কের মোটা পাঞ্জাবি। ঘরে ঢুকে শালটা বিছানায় রেখে দিলুম। আসবাবপত্রের মধ্যে খাট বিছানা, একটা ড্রেসিংটেবল। স্টিলের একটা আলমারি। বসবার জন্য মাত্র দুটো চেয়ার। এক পাশে আমার হামবুর্গ থেকে বয়ে আনা দুটো সুটকেস। বললুম, বসুন। জ্যোৎস্না বসল। আমি বিছানার ওপর অ্যাশট্রে রেখে, চেয়ার টেনে বসলুম। সিগারেট ধরালুম, জিজ্ঞেস করলুম, আপনি আজ এখানে না এলে, কী করতেন?’ ও হেসে বলল, বাড়িতেই একটু গান-বাজনার আসর বসত, বাড়িতেই থাকতুম। আপনি কী করতেন, আমি না এলে?

বললুম, সত্যি কথা যদি শুনতে চান তা হলে বলি, আপনার কথাই ভাবতুম। আমার কথা শুনে, জ্যোৎস্নার মুখে লাল ছটা লেগে গেল। চোখের পাতা নামিয়ে নিল এবং চোখ না তুলেই বলল, আমি অবিশ্যি কদিন ধরেই আপনার কথাই ভাবছি। আমার চোখে সাগ্রহ জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। কী ভেবেছে ও এ কদিন? ও মুখ না তুলেই আবার বলল, এখনও ভাবছি, এখন আমার লম্বা ছুটি পড়ে গেছে। ছুটি পড়লেই আমার বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে। অবিশ্যি খাতা কিছু জমে আছে এখনও। দেখে ফেলব সময় মতো। আমার কথার সোজা উত্তর ও এড়িয়ে গেল। আমার শেষ কথা আমি বলে ফেলেছি। এখন জ্যোৎস্নার পালা। সময় তো ওকে দিতেই হবে। জিজ্ঞেস করলুম, কোথাও যাবেন, ঠিক করেছেন?’ও মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকাল, না, ঠিক কিছুই করিনি। এমন নয় যে দূরেই কোথাও যেতে হবে। এমনও হয়, বন্ধুদের সঙ্গে ভোরবেলা বেরিয়ে গিয়ে সারা দিন কোনও একটা মনের মতো জায়গায় কাটিয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে এলুম। কাছে পিঠে বেড়াতে যাবার অনেক জায়গা আছে। তবে এ সময়টাই অন্য রকম। জ্যোৎস্না হাসল, শীতের দিনে ছুটি পেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া, বাঙালিদের মধ্যে একটা সংক্রামক ব্যাপার। যেখানেই যাব, সেখানেই ভিড়। অবিশ্যি সে সব ভিড় শনি-রবিতেই বেশি।

আমি বললুম, আপনার তো এখন শনি-রবি বলে কিছু নেই। জ্যোৎস্না মাথা নেড়ে বলল, না, তা নেই৷’ একটু নড়তে গিয়ে ওর শাল বুকের কাছ থেকে সরে গেল। ও নিজেই শালটা গা থেকে খুলে চেয়ারের হাতলে রাখল এবং তাকাল আমার চোখের দিকে। আমার চোখে কি আবেগ সঞ্চারিত হচ্ছিল। আয়না তো নেই, দেখতে পাচ্ছিনে। কিন্তু আমার সামনে আয়না হয়ে বসে আছে জ্যোৎস্না। ওর মুখে লজ্জার ছটা, চোখের পাতা নামাতে দেখেই বুঝলুম, আমার চোখ খুব সহজে ওর দিকে দেখছে না। আমি বললুম, আমার যা বলার, তা বোধ হয় বলা হয়ে গেছে। এখানে আসার পরে আমাকে যে কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করানো হয়েছিল, আমি বাবা মা সবাইকেই জানিয়ে দিয়েছি, আর কারোর। সঙ্গে আমার পরিচয়ের দরকার নেই।’

জ্যোৎস্না তাকাল আমার দিকে, এবং অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি সাঁতার জানেন?

সাঁতারের প্রসঙ্গ কেন এল, বুঝতে পারলুম না। বললুম, জানি৷’ ও জিজ্ঞেস করল, নৌকোয় বেড়াতে ভালবাসেন?’ উৎসাহ পেয়ে বললুম ভালবাসি। অনেক কাল বেড়াইনি। ও বলল, তা হলে চলুন, আগামীকাল সকালে আউটরাম ঘাট থেকে সারা দিনের জন্য নৌকো ভাড়া করে বেড়িয়ে আসি। ওতে ভিড় এড়ানো যায়। বেলা দশটায় বেরিয়ে আমরা বিকেলে ফিরতে পারি। দুপুরের জন্য কিছু শুকনো খাবার, আর জলের পাত্র নিয়ে গেলেই হবে। এ তো পরিষ্কার আমন্ত্রণ এবং একেবারে ভূমির ভিড় ছেড়ে দুজনের একান্তে ভেসে যাওয়া। আমি হেসে বললুম, অতি উত্তম প্রস্তাব। আমার মাথায় কিছুতেই আসত না। তা ছাড়া শীতের দিনে গঙ্গায় কোনও ভয়ও নেই। আপনি নিশ্চয়ই সাঁতার জানেন? বলল, তা জানি। তা হলে এ প্রস্তাবই বহাল রইল। আমরা নিশ্চয়ই দুজনে বাড়িতে বলে যাব?’ জ্যোৎস্নার কালো আয়ত চোখে বিস্মিত হাসি ফুটল, তা তো নিশ্চয়ই, আমরা তো লুকিয়ে অভিসার করতে যাচ্ছি নে?’ বলে ও ওর মিষ্টি হাসি হাসল, অবিশ্যি লুকিয়ে অভিসারে যাওয়াটা অনেক বেশি রোমান্টিক। আপনার সে অভিজ্ঞতাও আছে। জ্যোৎস্নার চোখ আমার চোখের ওপরে। ও চন্দ্রার কথা বলছে। বললুম, তা আছে। তবে পরস্ত্রী বলেই সেই অভিসারে একটা কেমন অপরাধবোধ ছিল। জ্যোৎস্না হেসেই বলল, বৈষ্ণব সাহিত্যে তো পরকীয় অভিসারেরই জয়গান। মন যেখানে অটল, সেখানে অপরাধবোধ একটা অকারণ বাড়তি জিনিষ। আমি কিন্তু কথাটা বিশেষ কিছু ভেবে বলিনি। পরস্ত্রীই হোক, আর পরের কন্যাই হোক, দুজনের মধ্যে যখন মেলামেশার আকাঙ্ক্ষা দুর্নিবার হয়ে ওঠে, তখন আর কোনও কিছুরই বাধা সেখানে থাকে না। বাধা সমাজ, পরিবার, কিন্তু অপরাধবোধ কীসের? অপরাধবোধ থাকতে পারে, যদি দুজনের মধ্যে ইচ্ছা অনিচ্ছার জোর খাটাবার ব্যাপার থাকে।

আমি জ্যোৎস্নার কথাগুলো পুরোপুরি মেনে নিতে পারলুম না। বললুম, বিষয়টা কি কেবলই দুজনের? সমাজ সংসার একেবারে বাদ? ব্যক্তিকে কি আমি সমাজের উর্ধ্বে রাখব? সমাজের কাছে তার কোনও দায় নেই?’–জ্যোৎস্না পরিষ্কার বলল, না ও দায়কে আমি স্বীকার করতে চাইনে। ব্যক্তির সংকটের মূলে সমাজ, কিন্তু যে সমাজ আজ আমাদের চারিদিকে দেখছি, ব্যক্তির বিকাশ বা সংকট-মোচনের পক্ষে তার দান কী আছে? আপনি ষোলো বছর হামবুর্গবাসী। এ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আমার থেকে বেশি আছে বলে মনে করি।’ বললুম, য়ুরোপের সমাজের চেহারা একেবারে আলাদা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পুরনো মূল্যবোধ সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। সমাজ পরিবারের কনসেপশানই বদলে গেছে। বিচ্ছিন্নতা, সর্বনাশা অস্থিরতায় মানুষ ভুগছে।’

জ্যোৎস্না বলল, আর আমাদের মূল্যবোধ বুঝি আগের মতোই থেকে গেছে? আমরা যুদ্ধ করিনি ঠিকই, কিন্তু হাজার হাজার পরিবার সকল লজ্জা ত্যাগ করে, এক মুঠো ভাতের জন্য রাস্তায় পড়ে মরেছে। মৃতদেহ তোলবার লোক ছিল না। অস্তিত্বের সংকটে মানুষ কোথায় নামতে পারে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আমাদের তাও দেখিয়ে দিয়েছে। তারপরে এই দেশ ভাগ। কোটি কোটি মানুষকে রাতারাতি ভিটে-ছাড়া হতে হয়েছে, স্বদেশ হয়ে গেছে বিদেশ। অথচ যেটাকে বলা হল তাদের স্বদেশ, সেখানে স্বদেশের স্বাদ তারা পায়নি। এপারের মানুষ তাদের অবাঞ্ছিত অনাহুত মনে করেছে। বিচ্ছিন্নতা অস্থিরতা থেকে কি আমাদের দেশ মুক্ত? সমাজ পরিবারের কনসেপশান এখানে কি বদলায়নি? আমি কী ভাবে বাঁচছি, আর আমার প্রতিবেশী কী ভাবে বাঁচছে, আমি কি এক বারও তা ভাবি? ভাবিনে। দুস্তর আমাদের ব্যবধান। সমাজ কোথায়। আমি তার কাছে কিছু প্রত্যাশা করিনে, সেও আমার কাছে। কিছু প্রত্যাশা করে না। মানুষ যদি তার দায়বোধ পালন করত, আপনার বন্ধু হীরকের তো উচিতই হয়নি চন্দ্রাকে বিয়ে করার। চন্দ্রারও কি উচিত ছিল, পারিবারিক সম্মানের কাছে নিজেকে বলি দেওয়া? কেন সে প্রতিবাদ করেনি? আত্মনাশ করে সে সমাজকে কী দিয়ে গেছে? পরিবারের কী সম্মান বেড়েছে? হীরকবাবু আবার বিয়ে করে দিব্যি জীবন কাটাচ্ছেন। কে কী দায় পালন করলেন? সমাজের কী উপকার হল? বিপন্ন ব্যক্তির সংকটের সঙ্গে সমাজের যোগাযোগ কোথায়?

জ্যোৎস্না কথাগুলো বলতে বলতে যেন লাল হয়ে উঠল। ও যে এই মুহূর্তে ভেবে কথাগুলো তৈরি করেছে, তা নয়। কথা শুনলেই বোঝা যায়, এ সব নিয়ে ও ভেবেছে। আমারও তো ভোলা উচিত নয়, বিশ্ব-চিন্তার থেকে ও বিচ্ছিন্ন নয়। ওর বিশ্বাস মতো, অন্যায় কিছু বলেনি। যে সমাজ পরিবার চন্দ্রাকে কিছু দেয়নি, সেখানে তো ওর প্রতিবাদই করা উচিত ছিল। তবু ব্যক্তি কি তার দায়বদ্ধতা থেকে নিরঙ্কুশ মুক্তি পেতে পারে? প্রশ্নটা তোলবার আগেই, দরজার কাছে টিং টিং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। অনীতা মায়ের পূজার ঘরের ঘণ্টাটা এনে বাজিয়ে দিয়ে বলল, এক ঘণ্টা হয়ে গেল। এটা ফার্স্ট বেল। আর দু বার।

জ্যোৎস্না হেসে উঠে বলল, একটা ওয়ার্নিং যথেষ্ট। আমাদের নিভৃত আলাপের আর কোনও প্রয়োজন নেই। ও আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। আমি অনীতাকে বললাম, তোমরা চলে এসো। আমাদের নিভৃত আলাপের ব্যবস্থা তো পাকা হয়ে গিয়েছে। অনীতা অন্তু নীতু হইহই করে এসে ঢুকল। অন্তু বলল, জ্যোৎস্না আজ আমরা একটু বড়দিন করব। আমার দাদা একেবারে বেরসিক। সবাই বাইরে থেকে কত হুইস্কি টুইস্কি নিয়ে আসে, দাদা ভাল এক কার্টন সিগারেট পর্যন্ত আনেনি। ক্যামেরা প্রোজেকটার টেপরেকর্ডার, গাদা গুচ্ছের অডিকলন সেন্ট–সে অনেক কিছু। আমি এক গরিব কোম্পানির সামান্য চিফ একজিকিউটিভ। আমার জোগাড়ে দু-চারটে স্কচ আর ব্র্যান্ডি, কোনিয়াক রেড ওয়াইন আছে। তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?’ জ্যোৎস্না হেসে বলল, আমার কেন আপত্তি থাকবে। তবে তুমি যদি আমাকে হুইস্কি খেতে বলল, আমি পারব না। জানি অনীতা আজকাল ও সবে খুব ধাতস্থ হয়েছে। আমি একটু রেড ওয়াইন নিয়ে তোমাদের সঙ্গে গল্প করব।’ অন্তু হেঁকে বলল, চমৎকার! নীতু, বাহাদুরকে বল ওপরে আমার ঘরে সব ব্যবস্থা করতে।’

অনীতার বন্ধু সমবয়সি জ্যোৎস্না। অতএব অন্তুরও বন্ধু। নীতু এখন য়ুনিভার্সিটিতে মডার্ন হিস্ট্রি নিয়ে পড়ছে। আমাদের আসরেও বেমানান নয়। আমিও একটু হুইস্কি খেলুম। দেখলুম, জ্যোৎস্না অনেক মজার গল্পও বলতে পারে। আমি আমার বুকের বাঁ দিকে এক বার হাত স্পর্শ করলুম।

.

৭ জানুয়ারি: পরের দিন নৌকাভ্রমণ দিয়ে আমাদের নিভৃত আলাপের শুরু। আমার আর জ্যোৎস্নার দূরত্বের ব্যবধান প্রতি দিনই কমে আসতে লাগল। জ্যোৎস্নার ভাবনা দ্বিধা ঘুচে গিয়েছে। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঠিক শর্ত বলতে যা বোঝায়, তা নয়। তবে ওর একটি বড় ইচ্ছে, আমার সঙ্গে যেখানেই যাক, একেবারে ডোমেস্টিক ওয়াইফ হয়ে থাকতে পারবে না। বাইরে কোথাও কাজ করবে। আমার কী আপত্তি থাকতে পারে? জার্মানিতে ভাষা একটা বাধা। ও জানে না। শিখে নেবে।

অনীতা জ্যোৎস্নার কাছ থেকে ওর মনের খবর নিয়ে নিয়েছে। বাড়িতেও আনন্দের সাড়া পড়ে গিয়েছে। বিয়ের আয়োজন আর কেনাকাটা শুরু হয়েছে। জ্যোৎস্নার বাবা এসেছেন আমাদের বাড়িতে। আমার বাবা মা গিয়েছেন ওদের বাড়িতে। সময় তো বিশেষ হাতে নেই। দুই পরিবারে চলেছে আয়োজন। আমরা দুজনে ক্রমে নিবিড় সান্নিধ্যে।

আমি যেন প্রতি দিন জ্যোৎস্নাকে নতুন করে আবিষ্কার করছি। জ্যোৎস্নাও। আমি ওকে তুমি সম্বোধন করছি। ও এখনও পারছে না। বলেছে, ওটা তো অনিবার্য, দু দিন আগে আর পরে। ঠিক সময় মতোই সব হবে। কিন্তু আমার ভিতরে যে একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে, সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। আমি যত জ্যোৎস্নাকে দেখছি, ততই মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা বাড়ছে।

আটাশ বছরের একটি স্বাস্থ্যবতী তাজা যুবতী। ওর চোখের আবেগ, অন্য কথা। ও নিজেকে এমন ভাবে সমর্পণ করতে চলেছে, যেখানে ও একান্তভাবেই রমণী। ওর শিক্ষা কালচার, সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে, নারী তার আটাশ বছর বয়সে, প্রথম একজন পুরুষের কাছে নিজেকে নিবেদনে উদ্যত। আর, যে আমি জীবনের পূর্ণতার কথা ভেবে, কলকাতায় ছুটে এসেছি, তার আয়ুষ্কাল আর মাত্র চার মাস। সেটাও অনিশ্চিত। ডাক্তারের নিদান মতে, ছ মাসের যে কোনও সময়ে। তার মধ্যে এক মাস হামবুর্গে কেটেছে। কলকাতায় এসে তিন সপ্তাহ কেটে গেল। আমি কোনও কালেই আস্তিক ছিলুম না। চন্দ্রার আত্মহত্যার পর পুরোপুরি নাস্তিক। এখন জ্যোৎস্নার মুখোমুখি হয়ে, আমার আর্তের মতো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, শুভ অশুভ যে কোনও শক্তির কাছে আমি আত্মসমর্পণে রাজি, আমাকে আর কয়েক বছরের আয়ু দাও। এ পৃথিবীতে তো কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। মহাভারতে পড়েছি, দৈব আর পুরষ্কারের মিলনই জীবনকে সার্থক করে তুলতে পারে। কী সেই দৈব? সেই দৈব আমার হোক। আমি আমার পুরুষকার দিয়ে, তা সার্থক করে তুলব। প্রাণ দাও আমাকে। আয়ু দাও আমাকে। জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমার নিরবচ্ছিন্ন মিলনের জীবন দাও। একদা চন্দ্রার কাছে আমি যা পেয়েছি, জ্যোৎস্না তার থেকেও গভীরতর এক জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে বঞ্চিত কোরো না। আমাকে মেরো না।

ডায়রিতে যখন এ সব কথা লিখছি, দেখছি, আমার দু চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। চন্দ্রার আত্মহত্যার পরেও, আমার চোখ থেকে জল পড়েনি। জ্ঞানত মনে করতে পারিনে, আমার চোখ জলে ভাসছে। চন্দ্রা সিনিক ছিল না। সেইজন্য ও আমাকে পূর্ণতার কথা লিখতে পেরেছিল। কিন্তু আমি সিনিক হয়ে গিয়েছিলাম। এখন আর আমার মধ্যে সেই সিনিসিজম নেই।

.

১৮ জানুয়ারি: মাঘ মাস পড়েছে। দুই পরিবারে কথা বলে, একুশে মাঘ বিয়ের দিন স্থির করেছে। তার আগেই আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হবে, তার জন্য ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন অফিসে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়ে গিয়েছে। স্থির হয়েছে, আমাদের আশীর্বাদ হবে বিয়ের পিড়িতেই। আজ ৩রা মাঘ। আর মাত্র আঠারো দিন বাকি।

গতকাল জ্যোৎস্নার এক নতুন রূপ দেখলুম আমি। ডায়মন্ডহারবারে গিয়েছিলুম আমরা। জ্যোৎস্না আগেই সেখানে টুরিস্ট লজে একটি ঘর বুক করে রেখেছিল। ছিলুম সকাল থেকে সারা দিন। ডায়মন্ডহারবারে পৌঁছে, জ্যোৎস্না বলল, আজ আমি সারা দিন ঘরের মধ্যে থাকব, বাইরে যাব না। ইচ্ছে হলে, ব্যালকনিতে রোদে বসে মোহনা দেখব। আমার যা ইচ্ছে করবে, তাই করব।কথাটা কেন বলেছিল, প্রথমে বুঝতে পারিনি। নীচের তলায় লজের এন্ট্রি বুকে, ও আমাদের পরিচয় লেখাল স্বামী স্ত্রী বলে। ওপরে ঘরে গিয়ে বলল, এবং আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়ে, মহী, আজ আমি ক্রাশড আইস দিয়ে একটু জিন খাব। তুমি কী খাবে?’ গতকাল ও আমাকে প্রথম তুমি এবং নাম ধরে ডাকল। দেখলুম, ও ওর সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব বিসর্জন দিয়ে, আবেগে যেন থরথর করে কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত অবাক চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। আমার বুকের ভিতর কাঁপছিল। নারীর এ অন্য রূপ। একটু অন্যভাবে হলেও, নিজেকে নিঃশেষ সঁপে দেবার এই রূপ আমার অচেনা নয়। কিন্তু জ্যোৎস্না কার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে? আমি যেন আমার পচে যাওয়া হৃৎপিণ্ডের দুর্গন্ধ পেলুম। মনে হয়েছিল, সেই মুহূর্তেই ওকে সব বলে ফেলব। আর তা মনস্থ করেই, ওকে আমি দু হাতে কাছে টেনে নিয়েছিলুম। ও ভুল বুঝেছিল। আমি কাছে টানতেই, ও আমার বুকে মুখ রেখে, দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরেছিল। দেখেছিলুম ওর তুলে ধরা মুখে ও চোখে অন্য এক প্রত্যাশা। খোলা ঠোঁটের ফাঁকে ওর ঝকঝকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছিল। আমি কথাটা বলতে পারলুম না। ওর প্রত্যাশা মেটাবার জন্য মুখ নামিয়েছিলুম, অশ্লেষ চুম্বনে পরস্পরের অমৃত পানে ডুবে গিয়েছিলুম। মনে মনে বলেছিলুম, মহীতোষ ঘণ্টা বাজছে। ঘণ্টা বাজছে! আর সে ঘণ্টা বাজিয়ে দিল জ্যোৎস্নাই। সময় আর নেই। শেষ সর্বনাশ ঘটবার আগেই, সময় এসেছে, তা রোধ করার। নিজের পাপ আর বাড়িও না।

তবু গতকাল জ্যোৎস্নাকে বলতে পারিনি। গতকাল ওর মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব ছিল। এবং আমি ওর প্রত্যাশা মেটাতে পারিনি। ও একটা মুহূর্ত আমার কাছ থেকে সরে থাকেনি। সর্বদা আমার ঘন সান্নিধ্যে কাটিয়েছে। আমার আড়ষ্টতা দ্বিধা ওকে অবাক করেছে। এমনকী, এ কথাও বলেছে, যত দূর জানি, তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছ আমার আগে। আমার সম্পর্কে কি তোমার মনে নতুন কোনও প্রশ্ন জেগেছে? …ওর পক্ষে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক, আমি ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলেছি, তোমার সম্পর্কে আমার মনে কোনও নতুন প্রশ্ন জাগেনি। যদি কিছু জেগে থাকে, তা আমার সম্পর্কেও জিজ্ঞাসু ব্যাকুল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছে। আমি বলেছি আজ সে কথা বলব না। তবে বলব–খুব শিগগিরই বলব।’…আমি স্থির করেছি, আজ বিকালে জ্যোৎস্নাদের বাড়ি গিয়ে, ওকে সব কথা বলব।

১৯ জানুয়ারি: জ্যোৎস্না আমার সমস্ত বিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়েছে। গতকাল ওদের বাড়ি গিয়ে, আমি আমার সব কথা বলেছি। বিশ্বাসঘাতকতার অপমান নিয়ে ফিরে আসব, এই বিশ্বাস নিয়েই আমি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলুম। সব কথা শোনার পরে, ও আমাকে জড়িয়ে ধরে উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছে, এ কথা আর কে জানে?’ বলেছি, তোমাকেই প্রথম বললুম। ও আমার হাত ধরে, নিজের বুকে চেপে ধরে বলেছে, তবে আর কারোকে বোলো না, এ বিয়ে হবে। আমি জানি, লোকে তোমাকে কী বলবে। কিন্তু আমি তা কখনও বলব না। তুমি কোনও অন্যায় আমার ওপর করোনি। তুমি যা চেয়েছিলে তা ঘটবে। তোমার ভাগ্যের সঙ্গে আমি এভাবেই জড়াব।’ আমি বাধা দিয়েছি, কিন্তু জ্যোৎস্না, আমি যা চাইনি, তাই করতে যাচ্ছিলুম। তুমি যা করতে যাচ্ছ, এ তো অন্তৰ্জলি যাত্রার মতো। জেনে শুনে এক আসন্ন-মৃত্যু মানুষকে কেন তুমি বিয়ে করবে? ও বলেছে, আমার মতো যুক্তিবাদী মেয়ের কোনও জবাব নেই এ বিষয়ে। তোমাকে বিয়ে করা, আমার কাছে সব যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে। আমার আটাশ বছরের দেহে মনে যা ঘটেনি, তুমি তাই ঘটিয়েছ। এটা একটা চূড়ান্ত ব্যাপার। তুমি যে কদিনই বাঁচ, আমি তোমার স্ত্রী। সংসারে মানুষ বাঁচে একান্তভাবে নিজের জন্য। আমিও আমার নিজের জন্যই বাচছি, সেজন্যই তোমাকে ছাড়ছিনে। তবে একটা কাজ করতে হবে। কাল সকালেই আমি তোমাদের বাড়ি যাব। তার আগে বাবা দাদার সঙ্গে কথা বলব। বিয়ের তারিখটা আরও যত সম্ভব এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমি জানি, এ মাসে অনেকগুলো বিয়ের দিন আছে।

আমি জ্যোৎস্নাকে কিছুই বোঝাতে পারিনি। আজ সকালে ও আমাদের বাড়ি এসেছিল। সঙ্গে ওর বাবা। বিয়ের তারিখও এগিয়ে আনা হয়েছে। আমাদের বাড়ির লোকের মনে বিস্ময়। একটা বিশ্বাসও বোধ হয় হয়েছে, গতকাল রাত্রে আমিই জ্যোৎস্নাদের বলে, বিয়ের দিন এগিয়ে এনেছি। এ নিয়েও অনেক হাসি ঠাট্টা হয়েছে। জ্যোৎস্না সারা দিন আমাদের বাড়ি ছিল। সন্ধ্যায় ফিরে গিয়েছে। যাবার আগে বলে গিয়েছে, উপায় থাকলে তোমাকে ছেড়ে যেতুম না। রাত্রিটা কোনও রকম আজেবাজে চিন্তা না করে ঘুমোও। আমি কাল সকালেই আসব। আমার মুখ চেয়ে অসুখের কথা চিন্তা কোরো না।

.

এখন রাত্রি প্রায় দুটো। আমার সামনে তীব্র বিষ। জিভে স্পর্শ মাত্রই জীবন শেষ। হাতের কাছে ডায়রি কম। এই পর্যন্ত লিখে চুপ করে আছি। বিষ আর জ্যোৎস্নার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আমি। আমি নিজেকে জানি! এই বিষের ছোবল কী, তার পরিণতি জানি। জানিনে কেবল জ্যোৎস্নাকে। জ্যোৎস্নাকে জানার অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছি।