নিঃশব্দ চাল

নিঃশব্দ চাল

পজিশনাল : একটি চালের সাথে সম্পর্কিত, দক্ষতা অথবা ট্যাক্টিক্যালের তুলনায় স্ট্রাটেজি বিবেচনা করে খেলার ধরণ। এভাবে পজিশনাল চাল এক ধরণের নিঃশব্দ চাল হয়ে ওঠে।

নিঃশব্দ চাল : এমন একটি চাল যা চেক দেয় না, পাকড়াও করে না, এর মধ্যে সরাসরি কোনো হুমকিও থাকে না…এটা কালো চুঁটিগুলোকে বেশ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ এনে দেয়।

— ইলাস্ট্রেটেড ডিকশনারি অব চেস
এডওয়ার্ড আর. ব্রেস

.

কোথাও একটা ফোন বাজছে। ডেস্ক থেকে মাথা তুলে চারপাশে চেয়ে দেখলাম। আমি যে এখনও প্যান অ্যাম ডাটা সেন্টারেই আছি সেটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেলো। এখনও নিউইয়ার্স ইভ চলছে। দূরের দেয়ালে বিরাট ঘড়িটা বলছে রাত সোয়া এগারোটা বাজে। এখনও তুষার পড়ছে। আমি এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব অবাক হলাম কেউ ফোনটা তোলে নি বলে।

 ডাটা সেন্টারের দিকে তাকালাম। শত শত কেবল চলে গেছে সাপের মতো একেবেঁকে। এখানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কারোর চলাফেরার শব্দও কানে আসছে না। জায়গাটা একেবারে মর্গের মতো নিস্তব্ধ।

 তারপরই মনে পড়ে গেলো মেশিন অপারেটরদেরকে বলেছিলাম তারা একটু বিশ্রাম নিতে পারে, যতক্ষণ আছি আমিই নজরদারি করার কাজটা করবো। কিন্তু সেটা তো কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। সুইচবোর্ডের দিকে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম তাদের অনুরোধটা ছিলো একটু অদ্ভুত। “আমরা যদি টেপ ভল্টে গিয়ে একটু কাপড় বোনার কাজ করি তাহলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?” তারা আমাকে বলেছিলো। কাপড় বোনা?

সুইচবোর্ড আর মেশিন কনসোল চালায় যে কন্ট্রোল ডেস্ক সেটার কাছে গিয়ে যে ফোনটার বাতি বিন্ করছে সেটার বোতাম টিপলাম। আরো লক্ষ্য করলাম তেষট্টি নাম্বার ড্রাইভ-এর লাল বাতি জ্বলছে। এটাতে নতুন টেপ লাগাতে হবে। আমি বেল বাজিয়ে টেপ ভল্টের একজন অপারেটরকে ডাকলাম এখানে আসার জন্য, তারপর তুলে নিলামইরং হতে থাকা ফোনটা। আমার দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আছে।

“প্যান অ্যাম নাইট শিফট থেকে বলছি,” বললাম আমি।

“দেখলে তো?” উৎফুল্ল একটা কণ্ঠ বললো খাঁটি আপার-ক্লাস বৃটিশ টানে। “আমি তোমাকে বলেছিলাম না সে ওখানে কাজ করতে থাকবে! সে সব সময়ই কাজ করে। অন্যপ্রান্তে কারো সাথে কথা বলছে লোকটা। তারপর বললো, “ক্যাট ডার্লিং, তুমি দেরি করে ফেলছো! আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এগারোটারও বেশি বেজে গেছে। আজরাতটা কিসের রাত সেটা কি জানো না?”

“লিউলিন,” আমি বললাম। “আমি সত্যি আসতে পারছি না। আমাকে একটা কাজ করতে হবে। জানি আমি কথা দিয়েছিলাম কিন্তু-”

“কোনো কিন্তু-কিন্তু চলবে না। এই নিউইয়ার্স ইভের দিন আমরা সবাই জানতে চাই আমাদের ভাগ্যে কি আছে। আমাদের সবার ভাগ্য গণনা করা হয়ে গেছে, ব্যাপারটা খুবই মজার। এখন তোমার পালা। হ্যারি জোরাজুরি করছে তোমার সাথে কথা বলার জন্য।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বেল টিপলাম অপারেটরের জন্য। অপারেটররা গেলো কোথায়? আর কেনই বা তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিম-শীতল অন্ধকার টেপ ভল্টে গিয়ে কাপড় বুনে বুনে নিউইয়ার্স ইভ কাটাতে চাইছে?

 “ডার্লিং,” গমগমে কণ্ঠে হ্যারি বললো। আমি যখন টপল এম-এ কাজ করতাম তখন হ্যারি আমার ক্লায়েন্ট ছিলো। এখনও আমরা ভালো বন্ধু হিসেবে রয়ে গেছি। সে তার বাড়ির সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাকে তার বাড়িতে দাওয়াত করবেই। তার বউ ব্লাঁশে আর শ্যালক লিউলিনের সাথেও আমার ভালো সখ্যতা আছে। তবে হ্যারি মনেপ্রাণে চায় আমি তার বিরক্তিকর মেয়ে লিলির সাথে ভাব জমাই, যে আমারই সমবয়সী।

“ডার্লিং,” বললো হ্যারি। আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দেবে, আমি সলকে একটা গাড়ি দিয়ে তোমার কাছে পাঠিয়েছি।”

“গাড়ি পাঠানো ঠিক হয় নি, হ্যারি,” বললাম আমি। “এই তুষারপাতের মধ্যে সলকে গাড়িসহ পাঠানোর আগে আমাকে জানালে না কেন?”

“কারণ তুমি বারণ করতে,” হ্যারি সোজাসুজি বলে দিলো। কথাটা একদম সত্যি। তাছাড়া সল গাড়ি চালাতে খুব পছন্দও করে। এটাই তো তার কাজ, সে একজন শফার। যাইহোক না কেন, এটুকু করার জন্য তুমি আমার কাছে ঋণী থাকার কথা।”

“আমি তোমার কাছে মোটেও ঋণী নই, হ্যারি,” বললাম তাকে। “ভুলে যেও না কে কার জন্যে কি করেছে।”

দুই বছর আগে হ্যারির কোম্পানিতে আমি একটি ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম ইনস্টল করে দিয়েছিলাম, এরফলে তার কোম্পানিটা শুধুমাত্র নিউইয়র্কেই নয় বরং সমগ্র উত্তর-হ্যাম্পশায়ারে শীর্ষ ফারকোট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্বিভূত হয়। এখন ‘হ্যারিস কোয়ালিটি বৃটি ফার’ যেকোনো জায়গায় মাত্র। চব্বিশ ঘণ্টায় ডেলিভারি দিতে সক্ষম তারা। আমি আবারো টেপ ভল্টে বেল বাজালাম। অপারেটররা গেলো কোথায়?

“শোনো হ্যারি,” অধৈর্য হয়ে বললাম, “আমি জানি না তুমি কিভাবে জানতে পারলে আমি এখানে আছি, কিন্তু আমি এখানে এসেছি একদম একা থাকতে। কেন সেটা এখন বলতে পারছি না। তবে মনে রেখো আমি বিরাট সমস্যার মধ্যে আছি।”

“তোমার সমস্যা হলো তুমি সব সময় কাজ করো, আর সব সময়ই তুমি বড় একা।”

“আমার কোম্পানি সমস্যা করছে,” বললাম তাকে। তারা আমাকে এমন একটা ক্যারিয়ারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যার সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। তারা আমাকে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। আমার এখন ভাবার জন্য সময় দরকার। কি করবো না করবো সেটা ঠিক করতে হবে।”

“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম,” হ্যারি বললো, “ঐ ইহুদি নামধারী খৃস্টানগুলোকে কখনও বিশ্বাস কোরো না। লুথারান একাউন্টেন্টের দল! ঠিক আছে, জলদি কোটটা পরে ভালো মেয়ের মতো নীচে নেমে আসো। আমার এখানে এসে মদ খেতে খেতে এ নিয়ে কথা বলা যাবে। তাছাড়া তোমাকে কি আর বলবো, ঐ গণক মহিলা অসাধারণ, বুঝলে? অনেক বছর ধরে এখানে কাজ করে যাচ্ছে অথচ এর আগে আমি তার কথা শুনি নি। আমি আমার ব্রোকারকে বরখাস্ত করে তার শরণাপন্ন হয়েছি।”

 “তুমি সত্যি বলছো না তো!” অবাক হয়ে বললাম।

“আমি কি তোমার সাথে কখনও ঠাট্টা-তামাশা করেছি? শোনো, ঐ মহিলা জানে তুমি আজ রাতে ওখানে থাকবে। এখানে এসেই সে প্রথম যে কথাটা বলেছে সেটা হলো, আপনার কম্পিউটার বিশারদ বন্ধুটি কোথায়?’ তুমি বিশ্বাস করতে পারছো?”

“না, পারছি না,” বললাম আমি। “আচ্ছা, তুমি এখন কোথায়?”

“ডার্লিং, আমি তোমাকে বার বার বলছি এখানে চলে আসো। ঐ মহিলা এমন কি এটাও বলেছে তোমার আর আমার ভবিষ্যত কোনো না কোনোভাবে একসূত্রে গাঁথা। শুধু তাই না, লিলি যে এখানে থাকবে না সেটাও মহিলা জানতো।”

“লিলি আসতে পারছে না?” বললাম আমি। কথাটা শুনে দারুণ স্বস্তি পেলাম। তবে অবাক হলাম তাদের একমাত্র সন্তান নিউইয়ার্স ইভের সময় বাবা-মা’র সাথে থাকবে না বলে। মেয়েটার বোঝা উচিত এতে করে তার বাবা-মা কতোটা কষ্ট পাবে।

“মেয়ের কথা আর কী বলবো? এখানে আমার নৈতিক সাপোর্ট দরকার। আমি আমার শ্যালকের সাথে আজকের পার্টিতে আঁটকে আছি।”

“ঠিক আছে, আমি আসছি,” তাকে বললাম।

 “দারুণ। আমি জানতাম তুমি রাজি হবে। তাহলে নীচে নামলেই সলকে দেখতে পাবে। এখানে আসার পর বিশাল একটা অভ্যর্থনা পাবে, বুঝলে।”

ফোনটা রাখার পর আমি আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠলাম। আমার দরকার হ্যারির অর্থহীন প্রলাপ আর তার বিরক্তিকর পরিবারের সঙ্গ। তবে হ্যারি আমাকে সব সময়ই হাসাতে পারে। হয়তো এর ফলে আমার নিজের সমস্যা থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তও হতে পারবো।

টেপ ভল্টে ঢুকে দেখতে পেলাম অপারেটররা সেখানে বসে ছোট্ট গ্লাসের টিউবে সাদা পাউডার ভরে কী যেননা করছে। আমার দিকে অপরাধী চোখে তাকালো তারা। বোঝাই যাচ্ছে কাপড় বোনার কাজ না, কোকেন সেবন করার জন্য তারা এখানে এসেছে।

 “আমি চলে যাচ্ছি,” বললাম তাদেরকে। “তেষট্টি নাম্বার ড্রাইভে টেপ বসানোর মতো শক্তি কি আপনাদের আছে, নাকি আজকের রাতের জন্যে এয়ারলাইন বন্ধ করে দেবো আমরা?”

তারা একে অন্যের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। আমি আর কিছু না বলে আমার কোট আর ব্যাগ তুলে নিয়ে চলে এলাম লিফটের কাছে।

 নীচের তলায় এসে দেখি বিশাল কালো রঙের লিমোজিনটা অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। গাড়ির জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে সলকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে সে গাড়ি থেকে বের হয়ে বিশাল কাঁচের দরজাটা খুলে দিলো।

 সল লম্বায় ছ’ফুটের বেশি। হালকা-পাতলা গড়নের। দেখতে একেবারে হ্যারির মতো। শুধু ওজনে তার চেয়ে কম। সলের ইউনিফর্মে সাদা সাদা তুষার লেগে রয়েছে। চওড়া হাসি দিয়ে আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে বসতে দিলো সে।

“হ্যারির কথা না রেখে উপায় রইলো না তাহলে?” বললো সে। “তাকে না। বলাটা খুব কঠিন।”

“একেবারে নাছোরবান্দা,” আমি একমত পোষণ করলাম। “‘না’ শব্দটার মানে সে বোঝে কিনা বুঝতে পারছি না। তার এই আধ্যাত্মিক কাজকারবার কোথায় হচ্ছে?”

“ফিফথ এভিনু হোটেলে,” দরজা বন্ধ করতে করতে বললো সল। ড্রাইভিং সিটে বলে ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিলে আস্তে আস্তে আমাদের গাড়িটা জমে থাকা তুষার ভেদ করে এগোতে লাগলো।

নিউইয়ার্স ইভের দিন নিউইয়র্কের বড় বড় সব রাস্তাই কর্মব্যস্ত দিনের মতো জনাকীর্ণ থাকে। লোকজন এক বার থেকে আরেক বারে ছুটে যায়। আবর্জনা আর কনফেত্তিতে ভরে থাকে পথঘাট।

 আজ রাতটাও এর ব্যাতিক্রম নয়। কয়েকজন মাতাল পথচারি আরেকটু হলে সলের লিমোজিনের সামনে পড়ে যেতো। একটা গলি থেকে বালি শ্যাম্পেইনের বোতল উড়ে এসে পড়লো আমাদের গাড়ির ছাদে।

“এরকম পরিস্থিতিতে গাড়ি চালানো সহজ কাজ নয়,” সলকে বললাম।

“আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি,” জবাব দিলো সে। “আমি মি: র‍্যাড আর তার পরিবারকে প্রত্যেক নিউইয়ার্স ইভের দিন বাইরে ঘুরাতে নিয়ে যাই। এ সময়টাতে এমনটাই থাকে সব সময়। আমাকে ড্রাইভিংয়ের জন্যে পারিশ্রমিক না দিয়ে যুদ্ধ করার জন্য দেয়া উচিত।”

“হ্যারির সাথে কতো দিন ধরে আছো?”

“পঁচিশ বছর ধরে,” বললো সে। “লিলির জন্মের আগে থেকেই আমি মি: র‍্যাডের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। সত্যি বলতে কি তার বিয়েরও আগে থেকে।”

“তার সাথে কাজ করতে তুমি নিশ্চয় খুব পছন্দ করো,” আমি বললাম।

“এটাই তো আমার কাজ,” বললো সল। “মি: র‍্যাডকে শ্রদ্ধা করি। তার সাথে আমার কিছু বাজে সময়ও গেছে। এমনও সময় গেছে যখন আমাকে বেতনের টাকা দিতে পারতেন না। তারপরও যেভাবেই হোক জোগার করে দিতেন। তার কাছে একটা লিমোজিন আছে এটা ভাবতে তিনি খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই বলেন, একজন শফার থাকাটা নাকি স্ট্যাটাসের পরিচয় দেয়। এক সময় আমরা লিমোজিনে করেই ফারকোট ডেলিভারি দিতাম। নিউইয়র্কে আমরাই প্রথম এ কাজ করেছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “এখন বেশিরভাগ সময় আমি মিসেস র‍্যাড আর তার ভাইকে শপিংয়ে নিয়ে যাবার কাজ করি। মাঝেমাঝে লিলি যখন ম্যাচ খেলতে যায় তখন তাকেও নিয়ে যাই।”

এরপর ফিফথ এভিনু আসা পর্যন্ত আমাদের মধ্যে তেমন কোনো কথা হলো না।

“লিলি আজ রাতে আসছে না, তাই না?”

“হুম,” সল বললো।

“এজন্যেই আমি কাজ ছেড়ে আসতে রাজি হয়েছি। এমন কি জরুরি কাজ আছে যার জন্যে বাপ-মায়ের সাথে নিউইয়ার্স ইভের দিনও থাকা যাবে না?”

 “আপনি তো জানেনই সে কি করছে,” সল যখন এ কথা বললো তখন ফিফথ এভিনু হোটেলে ঢুকছে গাড়িটা। হয়তো আমার কল্পনা, তবে মনে হলো সলের কণ্ঠে ভিতর আভাস রয়েছে। তার যা করার সে তাই করছে। দাবা খেলছে।”

.

ওয়াশিংটন পার্কের পশ্চিম দিকে ফিফথ এভিনু হোটেলটা অবস্থিত। তার ঠিক পাশেই বিখ্যাত গ্রিনউইচ ভিলেজ। যেখানে কবি-সাহিত্যিক আর শিল্পীদের আচ্ছা চলে দিনরাত। ইদানিং অবশ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন আর নেশা করার জন্যে জায়গাটার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।

১৯৭২ সালে, তখনও পাবলিক বারগুলোর আধুনিকায়ন ঘটে নি। নিউইয়র্কের অনেক বার দেখতে সেই ওয়েস্টার্ন সিনেমার বারের মতোই রয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে বাইরে ঘোড়া রেখে আপনি ঢুকেছেন। পার্থক্য হলো, ঘোড়ার বদলে এখন আমি লিমোজিন নিয়ে এসেছি।

হোটেলের ভেতরে জানালার পাশে একটা রাউন্ড টেবিলে বসে আছে হ্যারি। আমাকে দেখেই হাত নাড়লো সে। লিউলিন আর ব্লাঁশে বসে আছে তার মুখোমুখি। একে অন্যের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে বত্তিচেল্লির এক জোড়া সোনালি চুলের অ্যাঞ্জেলদের মতো।

পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে। পোস্টকার্ডে দেখা কোনো দৃশ্য। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। লোকজনে ভর্তি একটা বার। কাঁচের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরই হ্যারি বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

 “ডার্লিং!” বিশাল দেহের হ্যারি লম্বায় ছ’ফুট চার-পাঁচ ইঞ্চির মতো হবে, মোটাসোটা হবার দরুণ দেখতে দৈত্যের মতো লাগে। লাল-সবুজ রঙের ডিনার জ্যাকেট পরে আছে বলে আরো বেশি দৈত্যাকার লাগছে তাকে।

“তুমি এসেছো বলে আমি খুব খুশি হয়েছি,” আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে লবিতে নিয়ে এলো এবার।

 “ডিয়ার, ডিয়ার ক্যাট,” বলেই লিউলিন নিজের আসন থেকে উঠে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো। “ব্লাঁশে আর আমি ভাবছিলাম তুমি আসলেই আসবে কিনা, তাই না ডিয়ারেস্ট?”

লিউলিন সব সময়ই ব্লাঁশেকে ডিয়ারেস্ট বলে ডাকে, এ নামে লিটল লর্ড ফন্টলিরয় তার মাকে ডাকতো।

 “সত্যি বলছি, ডার্লিং, তোমাকে কম্পিউটারের সামনে থেকে দূরে রাখাটা এ দুনিয়ার সবচাইতে কঠিনতম কাজ,” বললো সে। “কসম খেয়ে বলছি, হ্যারি আর তোমার যদি কোনো কাজ না থাকতো তাহলে তোমরা কী যে করতে প্রতিদিন!”

“হ্যালো, ডার্লিং,” ব্লাঁশে কথাটা বলেই আমাকে উপুড় হবার জন্য ইশারা করলো যাতে করে তার মসৃণ গালের সাথে আমার গালটা ছোঁয়া যায়। “সব সময়ের মতো আজকেও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। বসো। হ্যারি তোমার জন্য কি ড্রিং অর্ডার দেবে?”

“আমি তার জন্য এগনগ নিয়ে আসছি,” বললো হ্যারি। আমাদের দিকে এমন আমুদে ভঙ্গিতে তাকালো যে মনে হলো সে বুঝি জীবন্ত কোনো ক্রিসমাস ট্রি। “এখানে দারুণ এগনগ পাওয়া যায়। একটু খেয়ে দেখো, তারপর তোমার যা খুশি খেতে পারো।” কথাটা বলেই লোকজনের ভীড় ঠেলে চলে গেলো বারের দিকে।

 “হ্যারি বলছিলো তুমি নাকি ইউরোপে যাচ্ছো?” আমার পাশে বসতে বসতে লিউলিন বললো। ব্লাঁশেকে তার ড্রিং বাড়িয়ে দিলো সে। তারা দু’জনেই ম্যাচ করে পোশাক পরেছে। ব্রাশে পরেছে গাঢ় সবুজ রঙের সান্ধ্যকালীন গাউন আর লিউলিন পরেছে গাঢ় সবুজ রঙের ভেলভেটের জ্যাকেট। তারা দু’জনেই মধ্য চল্লিশের হলেও দেখতে একেবারে তরুণ দেখায়।

“ইউরোপে নয়,” জবাবে বললাম আমি। “আলজিয়ার্সে। এটা একধরণের শাস্তি। আলজিয়ার্স হলো আলজেরিয়ার”।

“আমি জানি সেটা কোথায়,” বললো লিউলিন। সে এবং ব্লাঁশে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কিন্তু কী দারুণ কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না, ডিয়ারেস্ট?

“তোমার জায়গায় আমি হলে এ কথাটা হ্যারিকে বলতাম না,” কানের দুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো ব্লাঁশে। “ও একেবারে আরববিদ্বেষী। তারপরও বলবে এগিয়ে যাও।”

“তুমি এটা উপভোগ করতে পারবে না,” বললো লিউলিন। “ভয়ঙ্কর একটি জায়গা। দারিদ্র, নোংরা, তেলাপোকা। খাবার-দাবারের অবস্থা আরো খারাপ।”

“তোমরা কি ওখানে গিয়েছিলে কখনও?” জানতে চাইলাম আমি, লিউলিন যে আমার আসন্ন নিবাসনস্থলের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে সেজন্যে কিছুটা খুশি হলাম।

 “আমি যাই নি,” বললো সে। “তবে আমার হয়ে ওখানে কেউ গিয়ে ঘুরে আসুক সেটা আমি চাচ্ছিলাম অনেক দিন ধরে। আমার এখন মনে হচ্ছে অবশেষে একজনকে পেয়ে গেছি। তুমি হয়তো জানো আমি মাঝেমধ্যেই আর্থিক ব্যাপারে হ্যারির উপর নির্ভর করি…”

হ্যারির কাছে লিউলিনের ঋণের বোঝা কতোটুকু সেটা আমার চেয়ে আর কেউ বেশি জানে না। যদিও হ্যারি এ নিয়ে খুব একটা মুখ খোলে না কখনই। তবে ম্যাডিসন এভিনুতে লিউলিনের অ্যান্টিকশপের করুণ অবস্থা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার শপটা দেখতে পুরনো-গাড়ি বিক্রির দোকান বলে মনে হয়।

“তবে এখন,” লিউলিন বললো, “আমি একজন কাস্টমার পেয়েছি যে দুর্লভ জিনিস সংগ্রহ করতে চায়। সে কি খুঁজছে সেটা যদি আমি জোগার করে দিতে পারি তাহলে স্বনির্ভরতার টিকেট হাতে পেয়ে যাবো।”

“তুমি বলতে চাচ্ছো ঐ লোক যা পেতে চাইছে সেটা আলজেরিয়াতে আছে?” ব্লাঁশের দিকে চেয়ে বললাম। একমনে শ্যাম্পেইনে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সে, মনে হয় না আমাদের কথাবার্তা তার কানে গেছে। “আমি যদি সেখানে যাইও তিনমাস পরে যাবো। ভালো কথা, তুমি নিজে কেন যাচ্ছে না, লিউলিন?”

“ব্যাপারটা অতো সহজ নয়,” বললো সে। “ওখানে আমার যে কন্ট্যাক্ট আছে সে একজন অ্যান্টিক ডিলার। সে জানে জিনিসটা কোথায় আছে, তবে সেটা কিনতে পারছে না। জিনিসটার মালিক নিভৃতচারি। এরজন্য একটু প্রচেষ্টা আর সময় দরকার। ওখানে বসবাস করছে এরকম কারো পক্ষেই কাজটা করা বেশি সহজ…”।

“তুমি তাকে ছবিটা দেখাচ্ছো না কেন, শান্তকণ্ঠে বললো ব্লাঁশে। লিউলিন রাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বুকপকেট থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো রঙ্গিন ছবি বের করলো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে ছেঁড়া হয়েছে। ছবিটা সমান করে টেবিলের উপর রাখলো সে।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাতির দাঁতে তৈরি অথবা রঙ্গিন কাঠ খোদাই করে করা একটি ভাস্কর্য-হাতির পিঠে সিংহাসনে বসা এক লোক। হাতির পেছনে বেশ কয়েকজন পদাতিক সৈন্য। হাতির পায়ের চারপাশে মধ্যযুগের অস্ত্র হাতে কয়েকজন অশ্বারোহী। খুবই সূক্ষ্ম নক্সা, অবশ্যই বেশ পুরনো। আমি জানি না এটার কী এমন গুরুত্ব আছে তবে ছবিটা দেখেই আমার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। টেবিলের পাশে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।

“এটার ব্যাপারে কি ভাবছো তুমি?” লিউলিন জানতে চাইলো। “জিনিসটা অসাধারণ না?”

“তোমার কি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে?” বললাম আমি। লিউলিন মাথা ঝাঁকালো শুধু। আমার দিকে চেয়ে আছে ব্লাঁশে।

লিউলিন বলতে লাগলো, “এটা হাতির দাঁতে তৈরি ভারতীয় একটি জিনিসের আরবীয় কপি। প্যারিসের ন্যাশনেইল বিবিলিওথেক-এ আছে এটা। ইউরোপে গেলে একবার দেখে আসতে পারো। তবে আমার বিশ্বাস অনেক পুরনো একটা খুঁটি থেকে এটা কপি করা হয়েছে। আসল জিনিসটা এখনও পাওয়া যায় নি। এটাকে বলে শার্লেমেইন কিং’।”

“শার্লেমেইন কি হাতির পিঠে চড়তো নাকি? আমি তো হ্যাঁনিবাল ভেবেছিলাম।”

“এটা শার্লেমেইনকে খোদাই করে করা হয় নি। এটা হলো শার্লেইেনের দাবাবোর্ডের রাজার দুটি। এটা কপি থেকে কপি করা। আসল দুটিটা কিংবদন্তীতুল্য। আমার জানামতে কেউ এটা চোখে দেখে নি।”

 “কিন্তু তুমি কি করে জানলে ওটা এখনও আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম কিছুটা।

“ওটা আছে,” বললো লিউলিন। “পুরো দাবাবোর্ডটিকে বলা হয় লিজেন্স অব শার্লেমেইন। আমার ঐ কাস্টমার ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পিস সংগ্রহ করেছে, সে চাইছে পুরো সেটটা কম্পিট করতে। এরজন্যে প্রচুর পরিমাণে টাকা খরচ করতেও রাজি আছে সে। তবে নিজের পরিচয় আড়ালে রাখতে চায় ভদ্রলোক। পুরো ব্যাপারটা খুবই গোপন রাখতে হবে, ডার্লিং। আমার বিশ্বাস আসল জিনিসটা চব্বিশ ক্যারেটের সোনা আর দামি দামি সব হীরা-জহরত দিয়ে তৈরি।”

 লিউলিনের দিকে তাকালাম, বুঝতে পারছি না ঠিকঠিক শুনছি কিনা। তারপরই বুঝতে পারলাম সে আমাকে দিয়ে এ কাজটা করাতে চাইছে।

“লিউলিন, কোনো দেশ থেকে স্বর্ণ আর হীরা-জহরত নিয়ে আসতে গেলে কিছু আইন-কানুন মেনে তা করতে হয়। আর ঐতিহাসিক বিরল কোনো বস্তুর বেলায় তো এইসব নিয়মকানুন আরো বেশি কড়া। তুমি কি আমাকে আরব দেশের কোনো জেলখানায় পচিয়ে মারতে চাও নাকি?”

“আহ্। হ্যারি আসছে,” শান্তকণ্ঠে বললো ব্লাঁশে। উঠে দাঁড়ালো সে যেনো হাত-পা ম্যাজ ম্যাজ করছে বসে থাকতে থাকতে। লিউলিন দ্রুত ছবিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো।

“আমার বোন জামাইকে এ ব্যাপারে কিছু বোলো না,” ফিসফিস করে সে বললো। “তুমি দেশ ছাড়ার আগে আমরা এ নিয়ে আবার কথা বলবো। তুমি যদি আগ্রহী হও তাহলে আমরা দুজনেই প্রচুর টাকা পাবো।”

 আমি মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম হ্যারির হাত থেকে খাবারের ট্রে’টা নেবার জন্য।

“আরে দেখো দেখো,” বললো, লিউলিন উচ্চস্বরে, “হ্যারি তো দেখছি। আমাদের সবার জন্যেই এগনগ নিয়ে এসেছে! দারুণ একটা লোক সে।” আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি এগনগ একদম পছন্দ করি না। শূয়োরের হাগু ছাড়া আর কিছু না।” কিন্তু হ্যারির কাছ থেকে ট্রেটা নিয়ে টেবিলে খাবার রাখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো সে।

“ডার্লিং,” হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললো ব্লাঁশে, “এখন আমরা সবাই একসাথে আছি। তুমি কেন ভাগ্য গণনা করছে না। এখন পৌনে বারোটা বাজে, নতুন বছর আসার আগেই ক্যাটের ভাগ্যটা জানা উচিত।” লিউলিন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো। এগনগ খাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেয়ে সে বরং খুশি।

তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো হ্যারি। “জানো,” ব্লাঁশেকে বললো সে, “আমাদের বিয়ে হয়েছে পঁচিশ বছর হলো, প্রত্যেক বছর আমি ভাবি ক্রিসমাস পার্টিতে কে গাছের গোড়ায় এগনগ ফেলে রাখে।”

“এগনগ আমার খুব ভালো লাগে,” বললাম তাকে। জিনিসটার স্বাদ আসলেই ভালো লাগে।

“কাজটা করে তোমার ঐ ভাই…” হ্যারি বললো। “এতগুলো বছর ধরে তাকে আমি সাপোর্ট দিয়ে আসছি আর সে কিনা আমার প্রিয় এগনগ গাছের গোড়ায় ফেলে দেয়! এই ভবিষ্যত গণনাকারীকে আবিষ্কার করাটাই হলো তার প্রথম ভালো কোনো কাজ।

“আসলে,” বললো ব্লাঁশে, “লিলিই ঐ গণকের কথা বলেছিলো, ঈশ্বরই জানে মেয়েটা কিভাবে জানতে পারলো ফিফথ এভিনু হোটেলে একজন হস্তরেখা বিশারদ কাজ করে। সম্ভবত এখানে সে দাবা খেলার কোনো প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছিলো, কাটাকাটাভাবে বললো। “আজকাল মনে হয় সবখানেই ঐ দাবা খেলা চলে।”

 লিলির দাবা খেলা নিয়ে চুড়ান্ত বিরক্তি প্রকাশ করে ব্লাঁশেকে দায়ি করলো হ্যারি। ব্লাঁশেও পাল্টা তাকে অভিযুক্ত করলো তাদের একমাত্র সন্তানকে এরকম একটি অসামাজিক আর বিরক্তিকর খেলায় আসক্ত করার জন্যে।

লিলি যে শুধু দাবাই খেলে তা নয়, বরং দাবা ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি মেয়েটার আগ্রহ নেই। ব্যবসা কিংবা বিয়েশাদি কোনোটাই না-হ্যারির জন্যে এটা দ্বিগুন আক্ষেপের বিষয়। ব্লাঁশে আর লিউলিনও লিলির আজেবাজে সব জায়গায় গিয়ে স্ট্যাটাসবিহীন লোকজনের সাথে মেলামেশা করাটা দারুণ অপছন্দ করে। সত্যি বলতে কি, এই খেলার প্রতি লিলির যে মোহগ্রস্ততা সেটা কোনোক্রমেই কাটানো যাচ্ছে না। মেয়েটা তার জীবনের সমস্ত মেধা আর সময় অপচয় করে যাচ্ছে একটা সাদা কালো চেক-চেক বোর্ডে কতোগুলো কাঠের টুকরো ঠেলে ঠেলে। তার পরিবারের লোকজনের প্রতি আমি সহমর্মি না হয়ে পারি না।

“লিলি সম্পর্কে গণক কি বলেছে তোমাকে বলছি,” ব্লাঁশেকে আমলে না। নিয়ে বললো হ্যারি। “ঐ মহিলা বলেছে আমার পরিবারের বাইরে এক তরুণী আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”

বুঝতেই পারছো, হ্যারি এটা খুব পছন্দ করেছে,” হেসে বললো ব্লাঁশে।

“মহিলা বলেছে জীবনের খেলায় সৈন্যরা হলো হৃদস্পন্দন, আর অন্য কোনো মহিলা যদি সাহায্য করে তাহলে রাজা তার চাল বদলাতে পারবে। আমার মনে হয় সে তোমার কথাই বলেছে-”

“মহিলা বলেছে ‘দাবার সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ,’” কথার মাঝখানে বললো ব্লাঁশে। “আমার ধারণা এটা একটা কোটেশন…”

“এটা তোমার মনে থাকলো কিভাবে?” বললো হ্যারি।

“কারণ লিউ এখানকার ককটেল রুমালে ঐ মহিলার সব কথা লিখে রেখেছে,” জবাব দিলো রাশে। “জীবনের বেলায় সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ। এমনকি তুচ্ছ কোনো সৈন্যও বিরাট পরবির্তন ঘটাতে সক্ষম। তুমি ভালোবাসো এম কেউ স্রোতের দিক বদলে দিতে পারে এবং সে-ই বয়ে আনবে সমাপ্তি। এটাই আগাম বলা হয়েছে।” ব্লাঁশে রুমালটা নামিয়ে রেখে এক চুমুক শ্যাম্পেইন পান করলো আমাদের দিকে না তাকিয়েই।

“বুঝলে তো? খুশি হয়ে বললো হ্যারি। “আমি এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছি-তুমি কোনো অলৌকিক কাজ করে দেখাবে-লিলি কিছু দিনের জন্যে দাবার নেশা থেকে দূরে থাকবে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।”

“তোমার জায়গায় আমি হলে নিঃশ্বাস আটকে রাখতাম না,” শীতল কণ্ঠে বললো ব্লাঁশে।

ঠিক তখনই গণককে নিয়ে হাজির হলো লিউলিন। হ্যারি উঠে সরে বসলো গণককে আমার পাশে বসতে দেয়ার জন্য। তাকে দেখে প্রথমেই মনে হলো আমার সাথে বুঝি তামাশা করা হচ্ছে। মহিলা আপাদমস্তক কিম্ভুতকিমাকার। একেবারে খাঁটি অ্যান্টিক সামগ্রী। কুজো হয়ে আছে। মাথার ফোলানো ফাপানো চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে উইগ, বাদুরের ডানার মতো দেখতে চশমা পরে আছে সে। চশমার ফ্রেমে ছোটো ছোটো পাথর বসানো। সেই চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকালো মহিলা। এম্ব্রয়ডারি করা গোলাপী রঙের উলের সোয়েটার পরে আছে, আর ট্রাউজার হিসেবে যে সবুজ রঙের জিনিসটা পরেছে সেটা একেবারে ঢিলেঢালা। মনে হয় না এটা তার সাইজের। সূতো দিয়ে ‘মিমসি’ লেখা এক জোড়া গোলাপী রঙের জুতো পরেছে মহিলা। তার হাতে একটা ক্লিপবোর্ড, মাঝেমধ্যেই ওটার দিকে তাকাচ্ছে। বিরামহীণভাবে চিবিয়ে যাচ্ছে চুইংগাম।

“এই আপনার বন্ধু?” বাজখাই চড়া গলায় বললো মহিলা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মহিলার হাতে কিছু টাকা তুলে দিলো হ্যারি। টাকাগুলো ক্লিপবোর্ডে আটকে রেখে আমার পাশে বসলো সে। হ্যারি তার বিপরীতে একটা সিটে গিয়ে বসলে আমার দিকে তাকালো মহিলা।

“ডার্লিং, উনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মাথা নেড়ে জানিও,” বললো হ্যারি। “তাহলে উনার পক্ষে তোমার…”

“আচ্ছা, ভাগ্য গণনাটা কে করবে?” বৃদ্ধমহিলা রেগেমেগে বললো। এখনও আমাকে চশমার উপর দিয়ে দেখে যাচ্ছে। আমার পাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো সে, কোনো ভাগ্য গণনা করলো না। তার মধ্যে কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর সবাই অধৈর্য হয়ে উঠলো।

“আপনার কি আমার হাত দেবার কথা না?” জানতে চাইলাম।

“তুমি কেনো কথা বলবে না!” হ্যারি আর লিউলিন একসাথে বললো।

“সবাই চুপ করুন!” বিরক্ত হয়ে বললো গণক। এটা খুব কঠন সাবজেক্ট। আমি মনোসংযোগ করার চেষ্টা করছি।

 আসলেই মহিলা মনোসংযোগ করছে, ভবলাম আমি। এখানে আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও আমার উপর থেকে চোখ সরায় নি। হ্যারির হাতঘড়ির দিকে চকিতে তাকালাম। বারোটা বাজতে আর সাত মিনিট বাকি। গণক একদম নড়ছে না। মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে।

বারোটা বাজতেই ক্ষেপে উঠলো ঘরের লোকজন। তাদের কণ্ঠস্বর চড়ে গেলো, শোনা যেতে লাগলো শ্যাম্পেইনের বোতল খোলার শব্দ। পকেট থেকে দেখতে হাস্যকর টুপি বের করে পরতে শুরু করলো একেকজন। মাথার উপর আছড়ে পড়তে লাগলো রঙ বেরঙের কনফেত্তি। পুরনো বছরের সমস্ত চাপ আর ক্লান্তি যেনো বিস্ফোরিত হয়ে ফুরিয়ে যেতে লাগলো এক লহমায়। মনে পড়ে গেলো কেন আমি নিউইয়ার্স ইভের সময় বাইরে যাওয়াটা সব সময় এড়িয়ে চলি। গণককে দেখে মনে হলো চারপাশের লোকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। চুপচাপ বসে একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে।

মুখ ফিরিয়ে মহিলার দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। হ্যারি আর লিউলিন উদগ্রীব হয়ে আছে। ব্লাঁশে মহিলার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর যখন মহিলার দিকে তাকালাম দেখতে পেলাম এখনও আমার দিকেই চেয়ে আছে। মনে হলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে সে। যেনো আমার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। এরপর আস্তে আস্তে আমার চোখের দিকে ফোকাস করলে সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি বয়ে গেলো, ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো একটু আগে। তবে এবার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আমার ভেতর থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

“কথা বলবেন না,” আচমকা ফিসফিস করে গণক মহিলা আমাকে বললো। কথাটা যে মহিলা বলেছে সেটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগে গেলো। হ্যারি আর লিউলিন আরো ঝুঁকে এলো মহিলার কথা ভালোমতো শোনার জন্য।

“আপনি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেছেন,” বললো গণক মহিলা। “আমি চারপাশে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।”

“বিপদ?” চমকে উঠে বললো হ্যারি। ঠিক এ সময় বরফ আর শ্যাম্পেইন নিয়ে এক ওয়েটার হাজির হলে সে বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে ওগুলো টেবিলে রেখে দ্রুত চলে যেতে বললো তাকে। “আপনি কিসের কথা বলছেন? এটা কি কোনো ঠাট্টা?”

গণক মহিলা এবার ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভেবে নিলো। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। এই ককটেল লাউঞ্জের ভবিষ্যদ্বক্তা আমাকে ভড়কে দেবার চেষ্টা করছে কেন? হঠাৎ করে মহিলা আমার দিকে তাকালো। আমার রাগ আর বিরক্তি টের পেয়েছে সে। এবার বেশ পেশাদারদের মতো আচরণ করলো।

“আপনি ডান-হাতি,” বললো মহিলা। “বাম হাতেই আপনার নিয়তি লেখা আছে। যে নিয়তি নিয়ে আপনি জন্মেছেন। ডান হাত বলছে নতুন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন। প্রথমে আপনার বাম হাতটা দিন।”

আমি স্বীকার করছি এটা অদ্ভুতই বটে, তবে সে যখন আমার বাম হাতের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলো তখন গা শিউড়ে ওঠার মতো অনুভূতি হলো, মনে হলো মহিলা আসলেই কিছু দেখতে পাচ্ছে। তার দূর্বল আর শুকনো হাতটা যখন আমার হাত ধরলো টের পেলাম বরফের মতোই শীতল সেটা।

“বাহবা,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললো সে। “একটা হাতই বটে, আপনার।”

আমার হাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো মহিলা, চশমার পেছনে তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো। তার হাত থেকে ক্লিপবোর্ডটা মেঝেতে পড়ে গেলেও কেউ সেটা তুললো না। আমাদের টেবিলে উত্তেজনা বিরাজ করলেও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। সবাই আমাকে দেখছে, আর ঘরের ভেতর আমাদের চারপাশে চলছে হৈহল্লা।

মহিলা গণক দু’হাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলে হাতে ব্যথা পেতে লাগলাম। হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেও পারলাম না। মহিলা যেনো লোহার আঙটা দিয়ে আটকে রেখেছে সেটা। কোনো এক কারণে অযৌক্তিকভাবেই আমি রেগে গেলাম। এগনগ আর ফলের জুস খেয়ে আমার একটু অস্বস্তিও লাগছিলো। ডান হাতটা ব্যবহার করে বাম হাতটা মহিলার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম।

“আমার কথা শুনুন,” একেবারে অন্য রকম এক কণ্ঠে কথাটা বললো মহিলা। এখানে আসার পর তার যে কণ্ঠ শুনেছি তার চেয়ে অনেক আলাদা। বুঝতে পারলাম তার বাচনভঙ্গি আমেরিকানদের মতো নয়, তবে ঠিক কোথাকার ধরতে পারলাম না। মাথার ধূসর চুল আর কুজো হবার কারণে মনে হয়েছিলো তার বয়স অনেক বেশি, তবে এখন মনে হচ্ছে মহিলা যথেষ্ট লম্বা আর গায়ের চামড়ায় কোনো ভাঁজ নেই। আমি আবারো কথা বলতে শুরু করতেই হ্যারি তার চেয়ার ছেড়ে বিশাল দেহটা নিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।

“এটা আমার জন্যে অনেক বেশি মেলোড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে, গণকের কাঁধে হাত রেখে বললো সে। অন্য হাতে পকেট থেকে আরো কিছু টাকা বের করে মহিলার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাই, কি বলেন?” গণক তাকে আমলেই নিলো না, আমার দিকে আরো ঝুঁকে এলো সে।

“আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে এসেছি,” ফিসফিসিয়ে বললো। মহিলা। “যেখানেই যান না কেন পেছনে তাকিয়ে দেখবেন। কাউকে বিশ্বাস করবেন না। সবাইকে সন্দেহ করবেন। আপনার হাতের রেখা বলছে…এই হাতটার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে।”

“কে করেছে?” জানতে চাইলাম আমি।

আমার হাতটা আবারো তুলে নিয়ে আলতো করে হাতে রেখায় পরশ বুলিয়ে গেলো চোখ বন্ধ করে। যেনো অন্ধ কেউ ব্রেইলি পড়ছে। এখনও ফিসফিসিয়ে কথা বলছে যেনো স্মরণ করছে বহু দিন আগে শোনা কোনো কবিতা।

“এই যে রেখাটা, যেটা চাবির মতো আকৃতি ধারণ করেছে, এটা হলো দাবার বর্গ, যখন চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন আসবে তখন রাজার চাল দিতে ঝুঁকি নেবেন না। একটা খেলা আসল, আর অন্যটা রূপকার্থে। অকথিত সময়, এই প্রজ্ঞা অনেক দেরি করে এসেছে। সাদার যুদ্ধ বিরামহীনভাবেই দামামা বাজাচ্ছে। সব জায়গায় কালোরা তার ভাগ্য চুরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তেত্রিশ আর তিনের খোঁজ অব্যাহত রাখুন। চিরন্তন আড়াল হলো গোপন দরজা।”

তার কথা যখন শেষ হলো তখন আমি নিশ্চুপ, হ্যারি পকেটে হাত ঢুকিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা কী বোঝাতে চাচ্ছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই-তবে ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে এখানে, এই বারে, এই কথাগুলো আগেও আমি শুনেছি। ব্যাপারটাকে দেজাভু মনে করে কাঁধ ঝাঁকালাম।

“আপনি কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না, খুব জোরেই বললাম কথাটা।

“আপনি বুঝতে পারছেন না?” মহিলা বললো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো সে। “তবে বুঝতে পারবেন,” জোর দিয়ে বললো গণক। “চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন? এটা কি আপনার কাছে কিছু ইঙ্গিত করছে না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু—”

মহিলা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে মাথা ঝাঁকালো। “এর মানে কি সেটা আপনি কাউকে বলবেন না। একদম না। বাকিটা খুব জলদিই বুঝতে পারবেন। যেহেতু এই হাতটাই ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছে। নিয়তির হাত। এটা লেখা হয়ে গেছে-চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন, তারপরই আসবে আট। “

“মানে কি?” লিউলিন আৎকে উঠে বললো। টেবিলের কাছে এসে মহিলার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে, কিন্তু মহিলা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিলো তার হাত।

ঠিক তখনই পুরো ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেলো। হৈহল্লা করতে থাকা লোকগুলো হর্ন বাজাতে শুরু করলো একসঙ্গে। শ্যাম্পেইনের বোতলের ছিপি খোলার শব্দ শুনতে পেলাম আমি। সবাই চিৎকার করছে সমস্বরে, “হ্যাপি নিউ ইয়ার!” রাস্তায় পটকা আর আতশবাজি ফুটতে শুরু করলো। নিভু নিভু ফায়ারপ্লেসের সামনে থাকা পার্টিবাজ লোকগুলোর কালচে অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে দান্তের দেখা নরকের কৃষ্ণ-প্রেতাত্মা। তাদের চিৎকার অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

 যখন আলো জ্বলে উঠলো দেখা গেলো মহিলা গণক আর নেই। হ্যারি তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত আগে মহিলা যেখানে বসেছিলো সে জায়গাটা এখন ফাঁকা। আমরা সবাই বিস্ময়ে একে অন্যের দিকে তাকালাম। হ্যারি অট্টহাসি হেসে উপুড় হয়ে আমার গালে চুমু খেলো।

“হ্যাপি নিউ ইয়ার, ডার্লিং,” আমাকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরে বললো সে। “দুবোধ্য ভাগ্যসহকারে। আমার মনে হয় আমার পুরো আইডিয়াটা মাঠে মারা গেছে। এজন্যে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

টেবিলের ওপর পাশে বসে থাকা ব্লাঁশে আর লিউলিন একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কথা বলছে।

“আরে আমো তো তোমরা,” হ্যারি বললো। “এই যে শ্যাম্পেইনগুলো পড়ে আছে টেবিলে এগুলোর সদ্ব্যবহার করি, নাকি? ক্যাট, তোমারও একটু পান করা দরকার।” লিউলিন উঠে এসে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো।

“ক্যাট ডিয়ার, আমিও হ্যারির সাথে একমত। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র যেনো ভুত দেখেছো।” আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।

“কী সাংঘাতিক মহিলা,” লিউলিন বললো। “আপদ-বিপদ নিয়ে আবোলতাবোল বলে গেলো। যদিও সে যা বলে গেলো তাতে মনে হয় তোমার কাছে কিছু একটা বোধগম্য হয়েছে। নাকি এটা আমার নিছক অনুমাণ?”

“আমার মনে হয় না,” বললাম তাকে। “দাবাবোর্ড আর সংখ্যাগুলো…আচ্ছা এই আট জিনিসটা কি? আমি তো এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।” হ্যারি আমাকে একগ্লাস শ্যাম্পেইন দিলো।

“সমস্যা নেই,” আমাকে একটা ককটেল রুমাল দিয়ে বললো ব্লাঁশে। রুমালটায় কিছু লেখা আছে। “লিউ সব লিখে রেখেছে তোমাকে দেবার জন্যে। হয়তো পরে কোনো এক সময় এটা তোমার কোনো স্মৃতি উসকে দিতে পারবে। তবে আশা করি সেটা না হলেই ভালো! পুরো ব্যাপারটাই হতাশাজনক।”

“আহা, এটা নিছক মজা,” বললো লিউলিন। “আমি দুঃখিত ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী রকম জানি হয়ে গেলো। তবে মহিলা দাবার কথা উল্লেখ করেছে, তাই

? মেটা অর্থাৎ রাজার চাল দেয়ার কথাও বলেছে। খুবই ভুতুরে ব্যাপার স্যাপার। মেট’ শব্দটার অর্থ তুমি কি জানো-চেকমেট,’ এটা এসেছে পারস্যের শাহমাত থেকে। এর মানে ‘রাজার মৃত্যু। মহিলা বলেছে তুমি বিপদে আছো তুমি কি নিশ্চিত এসবের কোনো মানে নেই তোমার কাছে?” লিউলিন জানতে চাইলো।

“আরে বাদ দাও তো এসব,” বললো হ্যারি। “লিলির সাথে তোমার ভাগ্য জড়িয়ে আছে এটা বলাটাই ভুল হয়ে গেছে। পুরো ব্যাপারটাই একেবারে অর্থহীন প্রলাপ। এটা ভুলে যাও, তা না হলে রাতের বেলায় দুঃস্বপ্ন দেখবে।”

“লিলি ছাড়াও আমার চেনাজানা আরো একজন আছে যে দাবা খেলে থাকে, তাকে আমি বললাম। “সত্যি বলতে কি, আমার এক বন্ধু প্রতিযোগীতামূলক দাবা খেলে থাকে…”

“তাই নাকি?” চট করে বললো লিউলিন। “আমি তাকে চিনি?”

মাথা ঝাঁকালাম। ব্লাঁশে কিছু একটা বলার আগেই হ্যারি তার হাতে শ্যাম্পেইনের গ্লাস ধরিয়ে দিলো। মুচকি হেসে চুমুক দিতে শুরু করলো সে।

“যথেষ্ট হয়েছে,” বললো হ্যারি। নতুন বছর যা-ই বয়ে আনুক না কেন। আসো সবাই মিলে টোস্ট করি।”

আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা শ্যাম্পেইনের বোতলগুলো শেষ করে ফেললাম। অবশেষে নিজেদের কোট গায়ে চাপিয়ে বাইরে এসে লিমোজিনে বসলাম সবাই। হ্যারি সলকে বললো সবার আগে আমাকে ইস্ট রিভারের অ্যাপার্টমেন্টে ড্রপ করে। দেবার জন্য। আমার বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়িটা আসতেই গাড়ি থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরলো হ্যারি।

 “আশা করি তোমার নতুন বছরটি চমৎকার কাটবে,” বললো সে। “হয়তো তুমি আমার নাছোরবান্দা মেয়েটার জন্য কিছু একটা করবে। সত্যি বলতে কি, আমি জানি তুমি তা করবে। এটা আমি আমার গ্রহ-নক্ষত্রে দেখেছি।”

 “দ্রুত বিছানায় না গেলে আমিও গ্রহ-নক্ষত্র দেখা শুরু করবো,” তাকে বললাম। “এগনগ আর শ্যাম্পেইনের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

হ্যারির সাথে করমর্দন করে অন্ধকারাচ্ছন্ন লবি দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। হ্যারি চেয়ে চেয়ে দেখলো। দরজার পাশে দারোয়ান নিজের চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। বিশাল ফয়ারের লিফটের কাছে যে চলে গেলাম সেটা টেরই পেলো না। সে। পুরো বিল্ডিংটা কবরের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে আছে।

বোতাম টিপলে ঘরঘর করে লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। লিফটা উপরে উঠতে শুরু করলে আমি কোটের পকেট থেকে রুমালটা বের করে আবারো পড়লাম। এবারো বুঝতে পারলাম না কিছু। ইতিমধ্যেই আমার অনেক সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে, নতুন কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। কিন্তু লিফট থেকে বের হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোর দিয়ে যেতে যেতে হুট করে মনে পড়ে গেলো, ঐ গণক মহিলা কি করে জানলে চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিনটি আমার জন্মদিন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *