দাবা খেলা

দাবা খেলা

তবুও আমরা দাবা খেলবো,
অলস চোখ জোর করে খুলে রেখে
দরজায় কড়াঘাতের অপেক্ষা করতে করতে।

–টি.এস এলিয়ট

.

নিউইয়র্ক সিটি
মার্চ ১৯৭৩

দরজায় টোকা পড়ছে। আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টের মাঝখানে কোমরে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। নতুন বছরের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। গণকের সাথে কাটানো অদ্ভুত সেই রাতটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।

দরজায় জোরে জোরে আঘাত করা হচ্ছে এখন। আমার সামনে থাকা বিশাল পেইন্টিংটায় প্রুশিয়ান বু রঙের আচর দিয়ে তুলিটা লিনসিড তেলে চুবিয়ে রাখলাম। জানালা খুলে রেখেছিলাম বাতাস চলাচলের জন্য, কিন্তু নীচের তলার অ্যালোটি মনে হয় গন্ধটা সহ্য করতে পারে নি।

দীর্ঘ প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেলাম, যদিও এ সময় কোনো অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর মুড নেই আমার। অবাক হলাম, নীচের ডেস্ক থেকে আমাকে ফোন করা হলো না কেন। আমার সাথে কেউ দেখা করতে এলে সেটাই তো করা উচিত ছিলো তাদের। পুরো সপ্তাহটি আমার খুব বাজে গেছে। কন এডিসনের সাথে আমি আমার কাজ গুটিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেইসাথে এই ভবনের ম্যানেজার আর বিভিন্ন স্টোরেজ কোম্পানির সাথে যুদ্ধ করেই ঘন্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। আলজেরিয়াতে চলে যাবার সময় এসে গেছে, আমিও সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।

কিছু দিন আগে আমার ভিসা এসে গেছে। সব বন্ধুবান্ধবকে ফোন করেছি। দেশ ছাড়ার পর এক বছরের মধ্যে তাদের কারো সাথে আমার দেখা হবে না। একজন বন্ধুর সাথে আমি যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদিও সে স্ফিংসের মতেই রহস্যময় আর দূর্লভ দর্শনের বস্তু হয়ে উঠেছে। কিছু দিনের মধ্যেই যে ঘটনা ঘটবে তাতে তার সাহায্য কতোটা জরুরি আমি তখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি।

দরজার কাছে পৌঁছানোর আগে দেয়াল আয়নায় নিজেকে দেখে চুলটা করে নিলাম। মুখে কিছু বুও লেগে আছে, সেটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিজেকে যথা সম্ভব ভদ্রস্থ করে দরজা খুলে দিলাম আমি।

দাড়োয়ান বাওয়েল দাঁড়িয়ে আছে, তার ক্ষুব্ধ মুষ্টিবদ্ধ একটা হাত আছে একবার দরজায় আঘাত করতে উদ্যত। নেভি-ব্লু ইউনিফর্ম পরে আছে সে। লম্বা নাকের লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

“ক্ষমা করবেন, ম্যাডম,” ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো সে, “আবারো প্রবেশপথ ব্লক করে রেখেছে ঐ নীল রঙের কর্নিশ গাড়িটা। আপনি তো জানেনই, গেস্টরা প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকে

“তাহলে তুমি আমাকে ফোন করলে না কেন?” আমিও রেগেমেগে জানতে চাইলাম। বেশ ভালো করেই জানি কার গাড়ির কথা সে বলছে।

“পুরো সপ্তাহটা জুড়েই আপনার হাউজ ফোনটা বিকল হয়ে আছে, ম্যাডাম…”।

“তাহলে তুমি সেটা ঠিক করো নি কেন, বসওয়েল?”

“আমি একজন দাড়োয়ান, ম্যাডাম। আমার কাজ এসব জিনিস ঠিক করা নয়। এটা করবে কাস্টোডিয়ান। দাড়োয়ান দেখবে কে ঢুকছে কে বের হচ্ছে

“ঠিক আছে। ঠিক আছে। মেয়েটাকে উপরে পাঠিয়ে দাও।” আমার জানামতে নিউইয়র্কে একজনই আছে যার নীল রঙের কর্নিশ রয়েছে। আর সেটা লিলি র‍্যাডের। আজ যেহেতু রবিবার তাই আমি নিশ্চিত সল তাকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা যখন আমার বিরক্তি উৎপাদন করতে থাকবে তখন সে গাড়িটা সরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বসওয়েল এখনও আমার দিকে রেগেমেগে চেয়ে। আছে।

“ছোট্ট একটা জন্তুর ব্যাপারও আছে, ম্যাডাম। আপনার গেস্ট ঐ জম্বুটা নিয়ে উপরে আসতে চাইছে, যদিও তাকে আমি বার বার বলেছি-”

তবে দেরি হয়ে গেছে। ঠিক তখনই করিডোরের লিফটটা থামলো। আমার অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক সামনেই সেটা। সাদা পশমের একটা ছোট্ট জিনিস সুরুৎ করে আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে। বসওয়েল ঘৃণাভরে তাকালো সেদিকে। তবে মুখে কিছু বললো না।

“ঠিক আছে, বসওয়েল,” কাঁধ তুলে বললাম আমি। “মনে করো আমরা কিছুই দেখি নি, বুঝলে? সে কোনো সমস্যা করবে না। তাকে খুব দ্রুত আমি এখান থেকে বিদায় করে দেবো।”

এমন সময় লিলিকে দেখা গেলো আমাদের দিকে আসতে। তার গায়ের স্লিভলেস জামাটার পেছন দিয়ে একটা লেজ ঝুলছে। সোনালি চুলগুলো তিন চারটা পনিটেইল করে মাথার চারপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে। বসওয়েল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

বসওয়েলকে কোনো রকম তোয়াক্কা না করে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো লিলি। বেশ মোটাসোটা হলেও লিলি খুব স্টাইল করে নিজের ওজনটাকে সামলে রাখে। অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময় খসখসে গলায় সে বললো, “এই দাড়োয়ানকে বলে দাও খুব বেশি হৈচৈ যেনো না করে। আমরা চলে যাবার আগপর্যন্ত সল এই বুকের আশেপাশেই থাকবে গাড়ি নিয়ে।”

বসওয়েল ঘোৎঘোৎ করতে করতে চলে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকলাম এই নিউইয়র্ক শহরে সবচাইতে কম প্রিয় মানুষটার সাথে আরেকটি রোববারের বিকেল নষ্ট করার জন্য। মনে মনে কসম পেলাম এবার খুব দ্রুত তাকে ভাগিয়ে দেবো।

 সুদীর্ঘ এন্ট্রান্স হলসহ আমার অ্যাপার্টমেন্টটায় রয়েছে বিশাল বড় একটা রুম, যার ছাদ বেশ উঁচুতে, বাথরুমটাও খুব সুন্দর। বিশাল রুমটায় তিনটি দরজা আর একটি ক্লোজেট আছে। বাটলারের প্যান্ট্রি আর দেয়ালঘেষা চমৎকার বিছানাও রয়েছে তাতে। পুরো রুমটায় বড় বড় গাছ আর লতাগুল্ম থাকার কারণে। জঙ্গলের মতো মনে হয়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বই-পত্র, মরোক্কান। বালিশ আর জাঙ্কশপ থেকে কেনা দোমড়ানো মোচড়ানো ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র। ভারতের তৈরি হাতে বানানো পার্চমেন্টের স্যাম্প, বেশ কয়েকটি মেক্সিকান। মাজোলিকা পিচার, এনামেলের তৈরি ফরাসি পাখি আর প্রাগ থেকে আনা একগাদা ক্রিস্টাল। দেয়াল জুড়ে আছে অর্ধসমাপ্ত পেইন্টিং, কিছু কিছুর তৈলরঙ এখনও শুকোয় নি, নক্সা করা ফ্রেমে পুরনো আমলের কিছু ছবি আর অ্যান্টিক আয়না। ছাদ থেকে ঝুলছে কতোগুলো চাইম, ঝুলন্ত ভাস্কর্য আর কাগজের তৈরি রঙবেরঙের মাছ। ঘরের একমাত্র আসবাব হলো জানালার কাছে রাখা বিশাল একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো।

 গাছপালা আর লতাগুল্মের মধ্য দিয়ে প্যান্থারের মতো এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছে লিলি। তার প্রিয় কুকরটাকে খুঁজছে। লেজওয়ালা স্লিভলেস জামাটা খুলে মেঝেতে রেখে দিলো সে। অবাক হয়ে দেখতে পেলাম ওই জামাটার নীচে সে কিছুই পরে নি। লিলি দেখতে ফরাসি নারী ভাস্কর্যের মতো, ছোটো ছোটো পা, ভারি নিতম্ব আর মাংসল দেহের অধিকারী। পা থেকে যতো উপরে উঠেছে তার শরীরে যেনো আরো বেশি মাংস যোগ হয়েছে। উরু থেকে এই বিশাল দেহটা সে চেপে রেখেছে বেগুনী রঙের আটোসাঁটো সিল্কের জামা পরে। নড়াচড়া করলে তার নাদুসনুদুস শরীরটা থলথল করে ওঠে।

 একটা বালিশ হাতে নিয়ে ছোটোখাটো পশমযুক্ত কুকুরটাকে ওটার উপরে বসিয়ে দিলো। এই জন্তুটা নিয়েই সে সবখানে ঘুরে বেড়ায়। বালিশসমেত কুকুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে নাকি নাকি কণ্ঠে, অনেকটা শিকারের মতো শব্দ করে আদর করতে শুরু করলো।

“এই তো আমার ডার্লিং ক্যারিওকা, চুমু খাওয়ার মতো করে চুচু শব্দ করলো সে। “খালি দুষ্টুমি করে। দুষ্টু কুকুর, কোথাকার।” আমি রীতিমতো অসুস্থ বোধ করতে শুরু করলাম।

“এক গ্লাস মদ চলবে?” লিলি কুকুরটাকে মেঝেতে নামিয়ে রাখলে তাতে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরে দৌড়াতে শুরু করলো ছোট্ট বদমাশটা। বাটলার প্যান্ট্রির ফ্রিজ থেকে এক বোতল মদ বের করে নিয়ে এলাম আমি।

“আমার মনে হয় এই জঘন্য হোয়াইট ওয়াইনটা তুমি লিউলিনের কাছ থেকে পেয়েছো, তীর্যক মন্তব্য করলো লিলি। “অনেক বছর ধরে সে এটা বাদ দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।”

গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলে সে। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একটু আগে যে পেইন্টিংটা নিয়ে কাজ করছিলাম সেটার সামনে এসে থেমে গেলো।

“তুমি কি এই লোকটাকে চেনো?” আচমকা পেইন্টিংয়ের লোকটাকে দেখিয়ে বললো লিলি। বাইসাইকেলের উপর এক লোক বসে আছে সাদা ধবধবে পোশাক পরে। “নীচের তলার ঐ লোকটাকে মডেল করে এঁকেছো নাকি?”

“নীচের তলায় কোন্ লোকের কথা বলছো?” পিয়ানোর বেঞ্চে বসে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম লিলিকে। তার নখ আর ঠোঁটে লাল টকটকে চায়নিজ রঙ লাগানো। ফ্যাকাশে সাদা গায়ের রঙের সাথে এটা একেবারে অন্য রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে গ্রিন নাইটদেরকে যে কামুক দেবী প্রলুব্ধ করেছিলো তাকে ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছে, কিংবা অর্ধমৃত এনসায়েন্ট মেরিনারের মতো।

“বাইসাইকেলের লোকটা,” বললো লিলি। “ঐ লোকটার মতোই পোশাক পরেছে। যদিও তাকে মাত্র একবারই দেখেছি, তাও আবার পেছন থেকে। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, আরেকটুর জন্যে হলে আমাদের গাড়ির নীচে পড়তে যাচ্ছিলো সে।”

“তাই নাকি?” অবাক হয়ে বললাম। “কিন্তু আমি তো এটা কল্পনা থেকে এঁকেছি।”

“এটা খুব ভীতিকর,” লিলি বললো। “যেনো কোনো মানুষ তার নিজের মৃত্যুর উপর সওয়ার হয়েছে। লোকটা যেভাবে তোমার বিল্ডিংয়ের দিকে তাকাচ্ছিলো তাতে খুব একটা ভালো ঠেকে নি আমার কাছে…”

“কি বললে তুমি?” আমার অবচেতনে কিছু একটা নাড়া খেলো যেনো। শ্বেতশুভ্র অশের পিঠে যে সওয়ার হয়েছে তার নাম মৃত্যু। এটা আমি কোথায় শুনেছিলাম?

ক্যারিওকা ছোটাছুটি বন্ধ করে সন্দেহজনক শব্দ করতে লাগলো এবার আমার একটা অর্কিডের টবের মাটি খুঁড়তে খুড়তে মেঝেতে ফেলে দিলো সে। তাকে তুলে নিয়ে ক্লোজেটের ভেতর রেখে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

“তুমি আমার কুকুরটাকে ক্লোজেটে আটকে রাখলে কোন সাহসে!” বললো লিলি।

“এই ভবনে কুকুর নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই, তবে বাক্সে বন্দী করে নিয়ে আসলে অনুমতি মেলে, তাকে বললাম। আমার কাছে তো কোনো বাক্স নেই তাই ওখানে রেখেছি। এবার বলো আমার কাছে কি উদ্দেশ্যে এসেছো? কয়েক মাস তো তোমার টিকিটাও আমি দেখি নি।” মনে মনে বললাম, সেটা আমার সৌভাগ্য।

“হ্যারি তোমার জন্য একটা ফেয়ারওয়েল ডিনারের আয়োজন করেছে, বললো সে। বাকি মদটুকুতে চুমুক দিতে দিতে পিয়ানো বেঞ্চে গিয়ে বসলো এবার। “সে বলেছে তারিখটা তুমিই ঠিক করে দিতে পারো। সব খাবার নাকি সে নিজের হাতে রান্না করবে।”

কুকুরটা ক্লোজেটের ভেতরে খামচাচ্ছে, তবে আমি সেটা আমলে নিলাম না।

“ডিনারে যেতে পারলে আমারও ভালো লাগবে,” বললাম তাকে। “এই বুধবারে করলে কেমন হয়? আমি সম্ভবত পরের উইকএন্ডে চলে যাবো।”

“দারুণ হয়,” বললো লিলি। এবার কুকুরটা নিজের শরীর দিয়ে ধাক্কা মারতে শুরু করলে লিলি উঠে দাঁড়ালো।

“আমি কি আমার কুকুরটা ক্লোজেট থেকে বের করতে পারি, প্লিজ?”

“তুমি কি চলে যাচ্ছো?” আশাবাদী হয়ে উঠলাম আমি।

তেলের ক্যান থেকে তুলিগুলো নিয়ে সিঙ্কের কাছে চলে গেলাম সেগুলো পরিস্কার করবো বলে, যেনো লিলি চলেই যাচ্ছে এরকম একটা ভঙ্গি করলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললো লিলি, “আমি ভাবছিলাম আজ বিকেলে তোমার কোনো প্ল্যান আছে কিনা?”

“আমার প্ল্যান আছে তবে সেটা আজকে বাস্তবায়ন করা যাবে বলে মনে হয়,” তুলিগুলো ধুতে ধুতে বললাম তাকে।

“আমি ভাবছিলাম তুমি আজ সোলারিনের খেলা দেখবে কিনা,” দূর্বলভাবে হেসে গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো সে।

তুলিগুলো সিঙ্কে রেখে তার দিকে তাকালাম। এটা তো দাবা খেলা দেখার আমন্ত্রণ ছাড়া আর কিছু না। কোনো দাবা টুর্নামেন্টে লিলি না খেললে সেটা দেখতে যাবার মেয়ে নয় সে।

“সোলারিনটা কে?” জিজ্ঞেস করলাম।

অবাক হয়ে তাকালো লিলি। যেনো আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি ইংল্যান্ডের রাণী কে। “তুমি যে পত্রপত্রিকা পড়ো না সেটা ভুলে গেছিলাম,” সে বললো। “সবাই এ নিয়ে কথা বলছে। এটা হলো এই দশকের সেরা রাজনৈতিক বিতর্ক। কাঁপাব্লাঙ্কার পর সে হলো সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়, বিগত তিন বছরে এই প্রথম সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বাইরে এলো সে…”

“আমি তো জানতাম ববি ফিশার হলো এ বিশ্বের সবচাইতে সেরা খেলোয়াড়,” তুলিগুলো উষ্ণ ফেনায় রাখতে রাখতে বললাম। “গত গ্রীষ্মে রেকিয়াভিকে এতো হৈচৈয়ের কারণ কি ছিলো?”

“যাক, তুমি অন্তত আইসল্যান্ডের নামটা শুনেছো,” উঠে এসে আমার সামনে ঝুঁকে দাঁড়ালো সে। “আসল কথা হলো তখন থেকে ফিশার আর খেলে নি। গুজব আছে সে নাকি তার শিরোপা ধরে রাখতে পারবে না, জনসম্মুখে আর কখনও খেলবেও না। রাশিয়ানরা তো দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছে। দাবা হলো। তাদের জাতীয় খেলা। শীর্ষস্থান পাবার জন্যে তারা মরিয়া। ফিশার যদি শিরোপা ধরে রাখতে না পারে তাহলে রাশিয়ার বাইরে আর কোনো প্রতিযোগী নেই সেটা করার মতো।”

“তাহলে রাশিয়া থেকে যে-ই আসুক না কেন সে-ই টাইটেলটা পাবে,” বললাম আমি। “তুমি মনে করছে এই লোকটা…”

“সোলারিন।”

“সোলারিন সেটা করতে পারবে?”

“হয়তো পারবে, আবার নাও পারতে পারে,” বললো লিলি। এটাই হলো দাবা খেলার সবচাইতে বিস্ময়কর আর মজার দিক। সবাই মনে করছে সে-ই সেরা তবে রাশিয়ান পলিটবুরোর কোনো সহায়তা সে পাচ্ছে না। কোনো রাশিয়ান খেলোয়াড়ের জন্যে এটা একদম জরুরি। সত্যি বলতে কি, বিগত কয়েক বছর ধরে রাশিয়ানরা তাকে খেলতেই দেয় নি!”

“কেন দেয় নি?” তুলিগুলো র‍্যাকে তুলে রেখে তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললাম। “তাদের জন্যে যদি দাবা খেলায় জেতাটা জীবন-মরণ ব্যাপার হয়ে থাকে তাহলে…”

 “বোঝাই যাচ্ছে সে সোভিয়েত ঘরানার লোক নয়,” ফ্রিজ থেকে আরেক বোতল মদ বের করে পান করতে আরম্ভ করলো সে। “তিন বছর আগে স্পেনের টুনামেন্টে খুবই হৈচৈ হয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে সোলারিনকে টুনামেন্ট থেকে তুলে মাদার রাশিয়ায় ফিরিয়ে নেয়া হয়। প্রথমে তারা বলেছিলো সে নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে, পরে বলতে শুরু করে সে নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছে-এ ধরণের গালগল্প ছড়ানোর পর এ নিয়ে আর কোনো কথা বলে নি। একদম চুপ মেরে যায় তারা। তারপর থেকে এই সপ্তাহের আগপর্যন্ত তার কোনো খোঁজই ছিলো না।”

“এই সপ্তাহে কি হয়েছে?”

“এই সপ্তাহে বলা নেই কওয়া নেই কেজিবির কয়েকজন ক্যাডারকে সঙ্গে নিয়ে সোলারিন এসে হাজির নিউইয়র্কে। সোজা ম্যানহাটন চেজ ক্লাবে গিয়ে বলে হারমানোন্ড ইনভাইটেশনালে প্রবেশ করতে চায় সে। এখন এ নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। ইনভাইটেশনাল মানে তোমাকে উপস্থিত থাকার জন্যে ইনভাইট করা হবে। সোলারিনকে তো ইনভাইট করা হয় নি। দ্বিতীয়ত, এটা পাঁচটা জোনে বিভক্ত হয়ে অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচ নাম্বার জোনটা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চার নাম্বার জোন সোভিয়েত রাশিয়া, তারা এর বিরোধিতা করেছে। তারা যখন দেখেছে সে কে তখন তাদের ভয়টা নিশ্চয় কল্পনা করতে পারছো।”

“তারা কেন তাকে প্রবেশ করতে দিলো?..না দিলেই তো পারতো।”

“কী যে বলো না!” বললো লিলি। “জন হারমানোল্ড হলো টুনামেন্টের স্পন্সর। আইসল্যান্ডে ফিশার উন্মাদনার পর থেকে দাবা খেলার জোয়ার বইছে সবখানে। এখন এই খেলায় প্রচুর টাকা। সোলারিনের মতো কাউকে টুর্নামেন্টে পাবার জন্য হারমানোন্ড খুনও করতে রাজি হবে।”

“আমি বুঝতে পারছি না সোভিয়েতরা যদি সোলারিনকে দিয়ে খেলাতে না-ই চাইবে তাহলে ওখান থেকে সোলারিন চলে এলো কিভাবে?”

“মাই ডার্লিং, এটাই হলো আসল কথা,” বললো লিলি। “তার সঙ্গে থাকা কেজিবি’র বডিগার্ড বলে দিচ্ছে সে তার নিজ দেশের সকারের আশীর্বাদ পেয়েই এখানে এসেছে, বুঝলে? তারপরও বলবো পুরো ব্যাপারটা দারুণ রহস্যময়। সেজন্যেই আমি ভাবলাম আজকে তোমার যাওয়া উচিত…” থামলো লিলি।

“কোথায় যাবো?” সে কোথায় যাবার কথা বলছে সেটা বুঝতে পারলেও মজা করে বললাম। তার ভুরু কোঁচকানোটা দেখতে আমার ভালোই লাগে। “আমি মানুষের সাথে খেলি না,” লিলি একজনের কথা উদ্ধৃত করলো, “আমি খেলি দাবাবোর্ডের সাথে।” কথাটা নির্বিকারভাবে বলেই চট করে বললো সে, “আজ বিকেলে সোলারিন খেলবে। স্পেনের ঐ ঘটনার পর এটা তার প্রথম প্রকাশ্য দাবা খেলা। আজকের খেলার সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। টিকেট পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। এক ঘণ্টার মধ্যেই খেলা শুরু হবে তবে আমার মনে হয় আমরা ভেতরে ঢুকতে পারবো-”

“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে,” তার কথার মাঝখানে বললাম। “আমি যাচ্ছি না। দাবা খেলা দেখা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে। তুমি নিজে কেন যাচ্ছো না?”

মদের গ্লাসটা শক্ত করে ধরে পিয়ানোর বেঞ্চে বসে পড়লো লিলি। যখন বলতে শুরু করলো খুব নাটকীয় শোনালো তার কথা।

“তুমি জানো আমি সেটা করতে পারবো না,” শান্তকণ্ঠেই বললো সে।

আমি বুঝতে পারলাম লিলি এই প্রথম কারো কাছ থেকে অনুগ্রহ চাইছে। আমি যদি তার সাথে খেলাটা দেখতে যাই তাহলে সে ভান করতে পারবে বন্ধুর কারণেই অনেকটা বাধ্য হয়ে এসেছে। লিলি যদি একা একা খেলা দেখতে যায় তাহলে সেটা দাবা অঙ্গনে গরম খবর হয়ে যাবে। সোলারিন হয়তো বড় কিন্তু নিউইয়র্কের দাবা অঙ্গনে লিলি র‍্যাডের উপস্থিতি তার চেয়ে কম বড় খবর হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা দাবাড়ু হিসেবে বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে সে।

“পরের সপ্তাহে, ঠোঁট চেপে বললো সে, “আজকের ম্যাচের বিজয়ীর সাথে আমি খেলবো।”

“আহ। এবার বুঝতে পেরেছি, তাকে বললাম। “সোলারিনই আজকে জয় লাভ করবে হয়তো। আর তুমি যেহেতু তার খেলার সাথে একদম পরিচিত নও সেজন্যে তার কৌশল সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই…”

ক্লোসেটের দরজা খুলে কুকুরটা বের করে দিতেই আমার পায়ের কাছে ঘোৎ ঘোৎ করতে লাগলো। আমি আস্তে করে লাথি মেরে মেঝেতে পড়ে থাকা বালিশের কাছে সেটাকে ঠেলে দিলাম। আনন্দে দাঁত বের করে গদগদ হয়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো কুকুরটা।

“আমার মাথায় ঢুকছে না তোমার প্রতি ও এতোটা অনুরক্ত হলো কি করে,” বললো লিলি।

“খুব সহজ জবাব, শক্তের ভক্ত নরমের যম,” লিলিকে বললাম, সে কিছু বললো না।

কুকুরটা বালিশে গড়াগড়ি খেতে লাগলে আমরা দু’জন সেটা দেখতে লাগলাম যেনো এটা অনেক মজার দৃশ্য।

“আমার সাথে তোমাকে যেতেই হবে,” অবশেষে বললো লিলি।

“আমার মনে হয় তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারে নি।”

লিলি উঠে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো, “তোমার কোনো ধারণাই নেই এই টুর্নামেন্টটা আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। হারমানোল্ড পাঁচটি জোনের প্রায় সব জি.এম আর আই.এম-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যাতে করে দাবা কমিশন এই টুর্নামেন্টটাকে র‍্যাঙ্ক দেয়। আমি যদি ভালো অবস্থানে থাকতাম, কিছু পয়েন্ট অর্জন করতে পারতাম তাহলে বড় লিগে চলে যেতাম। সোলারিন যদি এভাবে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে না বসততা আমি হয়তো সেটা জয়ও করতাম।”

আমি যতোটুকু জানি দাবা খেলোয়াড়দের র‍্যাঙ্কিংয়ের জটিলতাটি একেবারেই রহস্যময়। গ্র্যান্ড মাস্টার (জি.এম) এবং আন্তর্জাতিক মাস্টার (আই.এম)-এর অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটাও সেরকমই জটিল পদ্ধতি। দাবা খেলার কর্তাব্যক্তিরা হলো বুড়োদের একটি ক্লাব। লিলির ক্ষোভটা আমি বুঝি কিন্তু কিছু একটা আমাকে গোলোকধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে।

“তুমি যদি দ্বিতীয় হও তাহলে তাতে এমন কি সমস্যা হবে?” বললাম আমি। “তুমি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ মহিলা দাবাড়ু সেটার তো কোনো হেরফের হচ্ছে না—”

“শীর্ষ মহিলা দাবাড়ু! মহিলা?” লিলিকে দেখে মনে হলো আমার ঘরের মেঝেতে বুঝি থুতু ফেলে দেবে এক্ষুণি। মনে পড়ে গেলো একবার সে মহিলাদের সাথে কখনও দাবা না খেলার যুক্তি দিয়েছিলো। দাবা হলো পুরুষ মানুষের বেলা। আর সেটা জিততে হলে তোমাকে কোনো পুরুষ খেলোয়াড়কেই হারিয়ে জিততে হবে। লিলি ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হবার খেতাব অর্জন করার জন্য অনেক বছর ধরেই অপেক্ষা করে আসছে, তার ধারণা সে এরইমধ্যে সেটা পাবার যোগ্যতাও অর্জন করেছে। আমি এখন বুঝতে পারছি এই টুর্নামেন্টটা তার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সে যদি তারচেয়ে উপরের ব্যাঙ্কের খেলোয়াড়দের সাথে জিততে পারে তাহলে তারা তার খেতাব আটকে রাখতে পারবে না।

“তুমি কিছুই বুঝতে পারছে না,” বললো লিলি। “এটা হলো নকআউট টুর্নামেন্ট। সোলারিনের সাথে তার দ্বিতীয় খেলায় আমাকে লড়তে হবে। এভাবেই আয়োজকরা ঠিক করে রেখেছে। তারা ধরেই রেখেছে আমরা আমাদের প্রথম খেলায় জিতবো। তাদের ধারণা অবশ্য খুব একটা ভুলও নয়। আমি যদি তার সাথে খেলে হেরে যাই তাহলে টুনামেন্ট থেকে বের হয়ে যাবো। দ্বিতীয়। কোনো সুযোগ নেই।”

“তুমি মনে করছো না তুমি তাকে হারাতে পারবে?” বললাম আমি। সোলারিন অনেক বড় মাপের খেলোয়াড় হলেও আমি অবাক হবো সে যদি তার সাথে হেরে যাবার সম্ভাবনা আগে থেকেই মেনে নেয়।

“আমি জানি না, সততার সাথেই জবাব দিলো সে। “আমার কোচও মনে করে আমি জিততে পারবো না। তার ধারণা সোলারিন আমাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। আমার প্যান্ট খুলে দেবে। দাবা খেলায় হারলে কেমন লাগে সেটা তুমি বুঝতে পারবে না। হারতে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।” দাঁতে দাঁত চেপে বললো শেষ কথাটা।

“তারা কি তোমার সাথে তোমার সমপর্যায়ের খেলোয়াড়দের খেলার ব্যবস্থা করতে পারলো না?” জানতে চাইলাম। মনে হচ্ছে এরকম একটা নিয়মের কথা আমি পড়েছিলাম কোথাও।

 “আমেরিকায় হাতেগোনা কয়েকজন খেলোয়াড়ই আছে যাদের পয়েন্ট চব্বিশ শ’র মতো,” তিক্তকণ্ঠে বললো লিলি। “তাদের সবাইকে তো আর একটা টুর্নামেন্টে খেলানোও যায় না। সোলারিনের শেষ অর্জন ছিলো পঁচিশ শ’র মতো পয়েন্ট, কিন্তু তার আর আমার মাঝখানে মাত্র পাঁচ জন খেলোয়াড় আছে এখানে। তবে টুর্নামেন্টে এতো আগেভাগে তার মতো খেলোয়াড়ের সাথে খেলা মানে আমি অন্য খেলার জন্য ওয়ার্মআপ করার সুযোগও পাচ্ছি না।”

এবার বুঝতে পারলাম। টুনামেন্টের আয়োজকেরা লিলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার পাবলিসিটি মূল্যের জন্য। তারা টিকেট বিক্রি করতে চায়, আর লিলি হলো দাবার জোসেফাইন বেকার। সোলারিনের সাথে খেলায় লিলিকে বলি দেবার ব্যবস্থা আর কি। তাকে অনেক আগেভাগে সোলারিনের মতে খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে দিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিতারণের আয়োজন করা হয়েছে। অবশ্য এই টুর্নামেন্টটা তার খেতাব পাবার মাধ্যমও হতে পারে। আচমকা আমার মনে হলো দাবার ভুবনের সাথে সার্টিফায়েড পাবলিক একাউন্টেন্টদের খুব কমই পার্থক্য রয়েছে।

“ঠিক আছে, তুমি যা বলতে চেয়েছিলে আমি সেটা বুঝতে পেরেছি,” বললাম তাকে। আমি আমার বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” আৎকে উঠে বললো লিলি।

“গোসল করতে,” পেছন ফিরে বললাম।

“গোসল করতে?” উদভ্রান্তের মতো বললো লিলি। “কিন্তু কিসের জন্যে?”

“গোসল করে আমাকে কাপড় পাল্টাতে হবে, বাথরুমের দরজার কাছে এসে থেমে বললাম। “যদি এক ঘণ্টার মধ্যে শুরু হতে যাওয়া ঐ খেলাটা দেখতে যাই আমরা।” লিলি আমার দিকে চেয়ে রইলো। তার হাসিটা দারুণ। সুন্দর।

.

মার্চের তীব্র শীতের মধ্যে হুড খোলা গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছি ব্যাপারটা আমার কাছে বালখিল্য বলেই মনে হচ্ছে। লিলি একটা ফারকোট পরে আছে আর তার কুকুর ক্যারিওকা সিটের নীচে স্বল্প পরিসর জায়গায় নড়াচড়া করছে। মনের আনন্দে। আমার পরনে কেবল কালো রঙের উলের কোট। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।

“এই গাড়ির কি কোনো হুড নেই?” প্রবল বাতাসের মধ্যে জিজ্ঞেস করলাম।

“তুমি কেন হ্যারির কাছ থেকে একটা ফারকোট বানিয়ে নিচ্ছো না? তার ব্যবসাটাই তো ফারকোট নিয়ে, তাছাড়া তোমাকে সে ভীষণ পছন্দও করে।”

“এখন আর বলে কী লাভ,” বললাম আমি। “এবার বলো খেলাটা মেট্রোপলিটান ক্লাবে হচ্ছে কেন? কয়েক বছর পর সোলারিন খেলছে, তাও আবার আমাদের দেশের মাটিতে, স্পন্সর কি আরো বেশি প্রচারণা চায় না?”

 “তা ঠিক বলেছো,” লিলি একমত পোষণ করলো। কিন্তু আজ সোলারিন খেলবে ফিস্কের সাথে। ফিস্ক একটু প্রাইভেটলি খেলতে চাইছে। লোকটাকে পাগল বললেও কম বলা হয়।”

“ফিস্কটা আবার কে?”

“অ্যান্টনি ফিস্ক,” নিজের ফারকোটটা গায়ের সাথে আরো বেশি জড়িয়ে নিলো সে। “খুব বড় খেলোয়াড়। বৃটিশ গ্র্যান্ডমাস্টার হলেও সে রেজিস্টার করেছে পাঁচ নাম্বার জোন থেকে, কারণ খেলোয়াড়ি জীবনে যখন সক্রিয় ছিলো তখন বোস্টনে বসবাস করতো। অনেক বছর ধরেই সে খেলছে না, তাই সোলারিনের সাথে খেলতে রাজি হওয়ায় আমি অবাকই হয়েছি। শেষ যে টুনামেন্টটায় সে খেলেছে সেখানে ঘর থেকে সব দর্শককে বের করে দেয়া হয়েছিলো। তার ধারণা ঘরে আড়িপাতার যন্ত্র বসানো আছে, আর সেই যন্ত্রের ভাইব্রেশনে নাকি তার ব্রেনে প্রভাব ফেলছে। সব দাবাড়ুই বয়স বেড়ে গেলে এরকম পাগলামি আচরণ করে থাকে। তুমি জানো, প্রথম আমেরিকান দাবা চ্যাম্পিয়ন পল মরফি পরিপাটী জামা-কাপড় পরে বাথটাবে বসে মারা গেছে। তার বাথটাবে মেয়েদের এক জোড়া জুতো ভাসছিলো তখন। পাগল হয়ে যাওয়াটা হলো দাবা খেলোয়াড়দের পেশাগত ঝুঁকি। তবে তুমি আমার বেলায় এটা হতে দেখবে না। এটা শুধু পুরুষ মানুষের বেলায় ঘটে।”

“শুধু পুরুষ মানুষ কেন?”

“তার কারণ, মাই ডিয়ার, দাবা হলো ইডিপাল গেম। রাজাকে হত্যা করো, রাণীকে সম্ভোগ করো, এটাই হলো এই খেলাটার আসল কথা। মনোবিজ্ঞানীরা দাবাড়ুদের আচরণ বিশ্লেষণ করতে খুব পছন্দ করে। ঘন ঘন হাত ধোয়া, পুরনো স্নিকার জুতোর গন্ধ শোকা অথবা খেলার মাঝখানে বিরতিতে হস্তমৈথুন করে কিনা, এইসব। এরপর তারা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে জার্নাল অব দি এএমএ-তে সেসব প্রকাশ করে থাকে।”

 মেট্রোপলিটান ক্লাবের সামনে গাড়িটা থামলে সলের কাছে ক্যারিওকাকে রেখে লিলি আর আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। যাবার আগে সলের সাথে আমার শুধু চোখাচোখি হলো, এতোক্ষণ কোনো কথা বলে নি সে। সল আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলে আমি শুধু কাঁধ তুললাম।

 মেট্রোপলিটান ক্লাব ভবনটি পুরনো নিউইয়র্কের স্মৃতি ধরে রেখেছে। গত শতাব্দীর পর থেকে এই ভবনটির ভেতরের অবস্থা একচুলও পরির্বতন হয় নি। ফয়ারের বিবর্ণ লাল কার্পেট, ভেলভেট কাঠের ডেস্কটা পালিশ করা হয় নি বহুদিন ধরে। তবে মেইন লাউঞ্জটা দেখার পর ফয়ারের বিবর্ণতা আর মনে থাকলো না।

প্রথমেই আছে বিশাল একটা লবি, যার ছাদ ত্রিশ ফুট উঁচুতে, বিভিন্ন ধরণের স্বর্ণখচিত নক্সা করা তাতে। সেই ছাদ থেকে লম্বা লম্বা তারে ঝুলছে বিশাল বড় একটি ঝাঁঝর বাতি। দুই দিকের দেয়ালগুলোতে সারি সারি বেলকনি। সেইসব বেলকনির রেলিংগুলো অভিজাত নক্সায় সজ্জিত। দেখে ভেনিশিয়ান রাজপ্রাসাদ বলে মনে হতে পারে। তৃতীয় দেয়ালাটিতে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বড় বড় আয়না রয়েছে। চতুর্থ দেয়ালটিকে লবি থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে বিশাল বড় একটি ভেলভেটের পর্দা দিয়ে। মার্বেলের মেঝেটা ঠিক দাবাবোর্ডের মতো সাদা-কালো বর্গে সজ্জিত। সেখানে কয়েক ডজন ছোটো ছোটো টেবিল আর চামড়ার চেয়ার পাতা রয়েছে। এক কোণে রাখা আছে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো।

আমি যখন এসব দেখছি লিলি তখন আমাকে উপরের বেলকনি থেকে ডাক দিলো। ফারকোটটা খুলে কাঁধের উপর রেখে দিয়েছে সে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে আসতে ইশারা করলো আমাকে।

উপরে উঠতেই লিলি ছোট্ট একটা ঘরের দিকে চলে আসতে বললো আমাকে। ঘরটা একেবারে সবুজ রঙের, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বড় বড় ফ্রেঞ্চ জানালাগুলো দিয়ে ফিফথ এভিনু পার্ক দেখা যাচ্ছে। সেখানে টেবিল সরানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে কিছু শ্রমিক। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকালো তারা।

“এখানেই খেলাটা হবে,” লিলি আমাকে বললো। “তবে খেলোয়াড়েরা এখনও এসে গেছে কিনা বুঝতে পারছি না। হাতে এখনও আধঘণ্টার মতো সময় আছে।” এক শ্রমিকের কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি জানো জন হারমানোচ্ছ কোথায় আছে?”

“সম্ভবত ডাইনিং রুমে,” লোকটা বললো। “আপনি উপরে গিয়ে তাকে ফোন করতে পারেন।” লিলি তার ফারকোটটা অন্য কাঁধে সরিয়ে রাখলে আমিও আমার কোটটা খুলতে শুরু করলাম কিন্তু শ্রমিকদের একজন আমাকে বাধা দিলো।

“গেমরুমে মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি নেই,” কথাটা আমাকে বলেই লিলির দিকে ফিরলো সে, “ডাইনিং রুমেও। আপনি নীচে গিয়ে উনাকে ফোন করলেই ভালো হয়।”

 “আমি ঐ বানচোত হারমানোল্ডকে খুন করবো,” দাঁতে দাঁত চেপে বললো লিলি। “পুরুষদের ক্লাব, হা?” নীচের করিডোরে চলে গেলো সে তার শিকারের খোঁজে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। শ্রমিকগুলো আমার দিকে শত্রুভাবাপন্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বার বার। লিলি যেভাবে ছুটে গেলো তাতে করে এ মুহূর্তে হারমানোল্ডকে মোটেও ঈর্ষা করছি না।

গেমিংরুমে বসে জানালা দিয়ে সেন্ট্রাল পার্ক দেখতে লাগলাম।

“এক্সকিউজ মি,” বাজখাই গলায় পেছন থেকে কেউ একজন আমায় বললো। ঘুরে দেখতে পেলাম লম্বা আর দেখতে আকর্ষণীয় এক লোক, বয়স পঞ্চাশের মতো হবে। নেভি রেজার, সাদা রঙের টার্টলনেক সোয়েটার আর ধূসর রঙের ট্রাউজার পরে আছে সে।

“টুনামেন্ট শুরুর আগে এ ঘরে অন্য কারোর ঢোকার অনুমতি নেই, দৃঢ়ভাবে বললো সে। “আপনার কাছে যদি টিকেট থাকে তাহলে আমি আপনাকে নীচে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তা না হলে আপনাকে ক্লাব থেকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে।”

তার মধ্যে যে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা ছিলো সেটা তিরোহিত হয়ে গেলো। তাকে আমি বললাম, “আমি এখানেই থাকবো। যে আমার জন্য টিকেট আনতে গেছে তার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি—”

আস্তে করে আমার বাহুটা ধরে ভদ্রলোক বললো, “আমি এই ক্লাবের কর্মকর্তাদের কথা দিয়েছি, ক্লাবের নিজস্ব নিয়ম-কানুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। এর ব্যত্যয় ঘটলে সিকিউরিটি ডাকতে বাধ্য হবো আমি…”

আমার বাহু ধরে মৃদু টান দিলেও আমি বসে রইলাম। এখান থেকে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তার দিকে হেসে বললাম, “আমার বন্ধু লিলি র‍্যাডকে কথা দিয়েছি আমি তার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবো। সে আপনার খোঁজেই নীচে গেছে”।

“লিলি র‍্যাড!” যেনো গরম কোনো ছ্যাকা খেয়েছে, চট করে আমার হাতটা ছেড়ে দিলো ভদ্রলোক। তার দিকে মিষ্টি করে হাসলাম আবারো। “লিলি র‍্যাড। এখানে এসেছে?” আমি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। “তাহলে আমাকে আমার পরিচয় দিতে দিন, মিস…”

“ভেলিস,” বললাম তাকে, “ক্যাথারিন ভেলিস।”

“মিস ভেলিস, আমি জন হারমানোল্ড,” লোকটা বললো। “এই টুর্নামেন্টের স্পন্সর।” শক্ত করে আমার হাতটা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো সে। “আপনার কোনো ধারণাই নেই, লিলি এখানে আসার ফলে আমরা সবাই কতোটা গর্বিত বোধ করছি। আপনি কি জানেন তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

“আপনার খোঁজেই আছে,” বললাম তাকে। “শ্রমিকরা বললো আপনি নাকি ডাইনিংরুমে আছেন। সে হয়তো ওখানেই গেছে।”

“ডাইনিংরুমে,” নিশ্চিত হবার জন্য কথাটা পুণরাবৃত্তি করলো সে। “আমি তাহলে ওখানেই যাই, কী বলেন? তারপর আমরা একসাথে ড্রিঙ্ক করবো নীচে গিয়ে।” দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো হারমানোল্ড।

 টুনামেন্টের স্পন্সর আমাকে খাতির করার কারণে শ্রমিকেরা এখন সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম তাদের কাজ। তারা গেমিং টেবিলগুলো বসাচ্ছে। চেয়োরগুলো বসাচ্ছে জানালার দিকে মুখ করে। তারপর আমাকে অবাক করে মেঝেতে টেপ দিয়ে মাপজোখ করা শুরু করে দিলো। মাপা শেষ হলে ফার্নিচারগুলো আবার ঠিকঠাক করে নিলো তারা, যেনো অদৃশ্য একটা বর্গাকৃতিতে বসানো থাকে সেগুলো।

এসব যখন দেখছি তখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক লোক, আমার চেয়ারের খুব কাছে আসার আগর্যন্ত আমি অবশ্য টের পাই নি। লম্বা আর হালকা-পাতলা গড়নের, একেবারে ধবধবে সাদা চুল সুন্দর করে ব্যাব্রাশ করে রেখেছে। ধূসর রঙের প্যান্ট আর সাদা ঢিলেঢালা লিনেন শার্ট পরে আছে সে। উপরের দিকে কিছু বোতাম খোলা থাকার কারণে তার বুকটা দেখা যাচ্ছে। বেশ সুগঠিত আর ড্যান্সারদের মতোই শারিরীক গঠন। আস্তে করে শ্রমিকদের কাছে গিয়ে তাদের সাথে নীচু স্বরে কথা বলতে লাগলো সে। কিছু আসবাব সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলো। এক পর্যায়ে তার ভাবসাব দেখে বুঝতে পারলাম শ্রমিকদের কাছে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে ভদ্রলোক। আমার দিকে আঙুল তুলেও দেখালো, তারপর চলে এলো আমার কাছে। তার দিকে ভালো করে তাকাতেই আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে, যদিও আমি ধরতে পারছি না।

 গালের উঁচু হাড়, পাতলা-সরু নাক আর শক্ত চোয়াল। চোখ দুটো বিবর্ণ সবুজ, অনেকটা তরল পারদের মতো। রেনেসাঁ যুগের পাথরে খোদাই করা সুগঠিত আর সুন্দর ভাস্কর্যের মতোই তার অবয়ব। আর আমিও পাথর খুব ভালোবাসি। তার মধ্যে কেমন জানি অভেদ্য কঠিনশীতলতা রয়েছে। আমার কাছে চলে আসাতে একটু অবাকই হলাম।

কাছে এসেই আমার হাতটা ধরে টেনে তুললো আমাকে। বাহু ধরে দরজার কাছে নিয়ে যেতে শুরু করলো সে। আমি কী বলবো বুঝে ওঠার আগেই আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “তুমি এখানে কি করতে এসেছো? তোমার এখানে আসা উচিত হয় নি। তার বাচনভঙ্গি একটু অন্য রকম। আমি তার আচরণে যারপরনাই অবাক, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। লোকটাকে জীবনেও কখনও দেখি নি। এরকম অপরিচিত কেউ এমন করবে ভাবাই যায় না। আমি জোর করে থেমে গেলাম।

“আরে আপনি কে?” বললাম তাকে।

“আমি কে তাতে কিছুই যায় আসে না,” ফিসফিস করেই বললো কথাটা। সবুজ চোখে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো কোনো কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করছে। আমি যদি তোমাকে চিনি তাহলেই বা কি এসে যায়। তোমার এখানে আসাটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। তুমি ভয়ানক বিপদে আছো। চারপাশে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, এমনকি এখনও।”

এই কথাটা এর আগে কোথায় যেনো শুনেছিলাম?

আপনি এসব কী বলছেন?” বললাম তাকে। “আমি দাবা টুর্নামেন্ট দেখতে এনেছি লিলি র‍্যাডের সাথে। জন হারমানোল্ড আমাকে বলেছে-”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” অধৈর্য হয়ে বললো সে। “আমি সব জানি। কিন্তু তোমাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে এখান থেকে। কারণ জিজ্ঞেস কোরো না, প্লিজ। যতো দ্রুত সম্ভব এই ক্লাব থেকে চলে যাও…যা বললাম তাই করো।”

“হাস্যকর কথাবার্তা!” চড়া গলায় বললাম আমি। চট করে পেছন ফিরে শ্রমিকদের দিকে তাকালো সে। “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন সেটা পরিস্কার করে না বলা পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। আপনি কে তাও আমি জানি না। জীবনে আপনাকে দেখি নি। কোন অধিকারে আপনি আমাকে

“তুমি আমাকে দেখেছো,” শান্ত কণ্ঠে বললো সে। আলতো করে আমার কাঁধে হাত রাখলো। “আবারো আমাকে দেখবে। তবে এ মুহূর্তে এক্ষুণি। তোমাকে চলে যেতে হবে।”

কথাটা বলেই যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই নীরবে চলে গেলো ঘর থেকে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। বুঝতে পারলাম আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। শ্রমিকদের দিকে তাকালাম। আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে তারা। মনে হয় না কোনো কিছু শুনতে পেয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে যাবার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অদ্ভুত এই মোলাকাতের ঘটনাটি। এরপরই আমার মনে পড়ে গেলো। লোকটা আমাকে গণক মহিলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

নীচের লাউঞ্জ থেকে লিলি আর হারমানোল্ড আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকছে। তারা বসে আছে দাবাবোর্ডের মতো সাদা-কালো চেকচেক মেঝেতে রাখা একটি টেবিলে। তাদেরকে আমার দাবার খুঁটি বলে মনে হলো। তাদের আশেপাশে আরো কিছু গেস্টও আছে।

 ‘নীচে চলে আসুন,” হাক দিলো হারমানোল্ড। “আমি আপনাদের জন্যে। ড্রিঙ্ক নিয়ে আসছি।”

নীচে চলে এলাম আমি, এখনও পা দুটো দূর্বল বোধ করছি। লিলিকে একান্তে নিয়ে গিয়ে ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছে।

“আপনি কি নেবেন?” তাদের টেবিলের কাছে আসতেই বললো হারমানোল্ড। আমার জন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এলো কাছ থেকে। লিলি তার পাশেই বসে আছে। আমাদের শ্যাম্পেইন পান করা উচিত। লিলি তো আর প্রতিদিন অন্যদের খেলা দেখতে আসে না!”

“এটা সাধারণ কোনো দিন না,” চেয়ারের পেছনে ফারকোটটা রাখতে রাখতে বিড়বিড় করে বললো লিলি। হারমানোল্ড শ্যাম্পেইনের অর্ডার দিলো।

“টুর্নামেন্টটা বেশ ভালো মতোই চলছে। প্রতিদিন আমাদের এখানে হাউজফুল থাকবে। প্রচারণার জন্য অ্যাডভান্স টাকা-পয়সা দেয়া হয়ে গেছে। ব্যাপক প্রচারও পাচ্ছে টুনামেন্টটা। তবে যেসব রথিমহারথিরা আসছে তা আমিও আশা করি নি। প্রথমেই অবসর থেকে ফিরে এলো ফিস্ক, তারপরই ঐ ব্লকবাস্টার সোলারিন এসে হাজির! তোমার কথাও বলতে হয়, লিলির হাটুতে মৃদু চাপড় মারলো সে। আমি উপরের ঐ আগন্তুকের ঘটনাটা বলার জন্য উদগ্রীব থাকলেও বলার সুযোগ পাচ্ছি না।

“আজকের খেলাটার জন্য ম্যানহাটনে বড় কোনো হল পাই নি বলে খারাপই লাগছে,” শ্যাম্পেইন চলে এলে বললো সে। “একেবারে কানায় কানায় ভরে যেতো। তবে আমি ফিস্ককে নিয়ে একটু চিন্তার মধ্যে আছি, বুঝলে। সার্বক্ষণিক ডাক্তার রাখা আছে তার জন্য। আমার মনে হয়েছে তাকে আগেভাগে খেলিয়ে দ্রুত বিদায় করে দেয়াটাই ভালো। এই টুর্নামেন্টে তার সম্ভাবনা খুব ভালো তা বলা যাবে না। তবে তার জন্যে আমরা বেশ ভালো মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছি।”

“খুব কৌতূহল লাগছে আমার,” বললো লিলি। একসাথে দু’জন গ্র্যান্ডমাস্টার এবং নার্ভাস ব্রেকডাউন দেখাটা দারুণ হবে।” হারমানোল্ড নাভার্সভাবে তার দিকে তাকালে মদ ঢালতে ঢালতে, বুঝতে পারছে না লিলি ঠাট্টা করছে কিনা। তবে আমি বুঝতে পারছি। ফিস্ককে টুনামেন্টের শুরুতেই বিদায় করে দিলে তার নিজ দেশে বেশ হৈচৈ হবে।

“হয়তো পুরো খেলাটাই দেখবো,” শ্যাম্পেইনে চুমুক দিতে দিতে মিষ্টি করে বললো লিলি। “ক্যাটকে বসিয়ে দিয়ে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম আমি…”

“ওহ্, তুমি যেতেই পারো না!” আৎকে উঠে বললো হরমানোল্ড। “মানে তুমি এটা মিস করো তা আমি কোনোভাবেই চাই না। এটা হলো শতাব্দীর সেরা গেম।”

 “আর যেসব রিপোর্টারদেরকে তুমি ফোন করে আসতে বলেছে তারা এসে যদি আমাকে না দেখে তাহলে খুব হতাশ হবে, তাই না, ডার্লিং?” কথাটা শুনে। হারমানোন্ডের মুখ লাল হয়ে গেলো।

আমি দেখলাম আমার কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। “উপরতলায় যে লোকটাকে দেখলাম সে কি ফিস্ক?”

 “গেমিংরুমে?” একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললো হারমানোন্ড। “আশা করি সে ছিলো না। খেলা শুরুর আগে তার তো বিশ্রাম নেবার কথা।”

“সে যে-ই হোক না কেন খুবই অদ্ভুত আচরণ করেছে, তাকে আমি বললাম। “সে ঘরে ঢুকেই শ্রমিকদেরকে ফার্নিচারগুলো সরাতে বলেছে…”

 “ওহ্ ঈশ্বর,” হারমানোল্ড বললো। “তাহলে ওটা ফিস্কই ছিলো। “এর আগেও সে এরকম করেছে…এটা সরান, ওটা এখানে এনে রাখুন…এরকম বাতিক আছে তার। এটা নাকি তার মধ্যে একধরণের ভারসাম্য বোধ’ নিয়ে আসে, সে বলেছে আমায়। মহিলাদেরকেও একদম সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে খেলা চলাকালীন সময়ে…” হারমানোল্ড লিলির হাতে মৃদু চাপড় মারলে সে হাতটা সরিয়ে নিলো।

“হয়তো সেজন্যেই লোকটা আমাকে চলে যেতে বলেছিলো,” বললাম আমি।

“আপনাকে চলে যেতে বলেছে?” অবাক হলো হারমানোল্ড। “এটা তো ঠিক করে নি। খেলা শুরুর আগে এ নিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো। তার বোঝা উচিত, অনেক আগে সে যখন স্টার ছিলো তখনকার আচরণ বর্তমান সময়ে করা তার সাজে না। পনেরো বছর ধরে সে কোনো বড় টুনামেন্টে খেলে নি।

“পনেরো বছর?” আমি বললাম। “তাহলে তো সে বারো বছর বয়সে খেলা ছেড়েছে। উপরতলায় আমি যে লোকটাকে দেখেছি সে কিন্তু বয়সে বেশ তরুণ।”

“তাই নাকি?” একটু ধাঁধায় পড়ে গেলো হারমানোল্ড। “তাহলে কে হতে পারে?”

“লম্বা, হালকা-পাতলা, ধবধবে সাদা। আকর্ষণীয় দেখতে কিন্তু শীতল দৃষ্টি…”

“ওহ্, ওটা তাহলে অ্যালেক্সি,” হেসে বললো হারমানোল্ড।

“অ্যালেক্সি?”

“আলেক্সান্ডার সোলারিন,” বললো লিলি। “যাকে দেখার জন্যে তুমি ছটফট করছো, ডার্লিং। ব্লকবাস্টার মাল।”

“তার সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন তো,” বললাম আমি।

“আসলে খুব বেশি বলতে পারবো না,” হারমানোন্ড বললো। “এখানে এসে টুনামেন্টের জন্য রেজিস্টার করার আগে আমিও জানতাম না সে দেখতে কেমন। লোকটা খুব রহস্যময়। লোকজনের সাথে সাক্ষাৎ করে না, ছবি তুলতে দেয় না। গেমরুম থেকে আমাদেরকে সব ক্যামেরা বাইরে রাখতে হয়েছে। আমার চাপাচাপিতে অবশেষে একটা প্রেস ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছে সে। তার উপস্থিতিটা যদি সবাইকে না-ই জানাতে পারলাম তাহলে তাকে পেয়ে আমাদের লাভটা কি হবে, বলেন?”

তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো লিলি। “ড্রিঙ্কের জন্য ধন্যবাদ, জন,” ফারকোটটা কাঁধের উপর ফেলে বললো সে।

লিলি উঠে দাঁড়াতেই আমিও উঠে দাঁড়ালাম। উপরের তলায় চলে এলাম আমরা। “আমি হারমানোন্ডের সামনে কথাটা বলতে চাইছিলাম না,” বেলকনির দিকে যাবার সময় নীচুস্বরে বললাম তাকে। কিন্তু এই সোলারিন লোকটা…তার মধ্যে অদ্ভুত একটা জিনিস আছে!”

“আমি এটা সব সময়ই দেখে আসছি,” বললো লিলি। “দাবার ভুবনে হয় কোনো বিরক্তিকর লোক নয়তো বানচোত…এই দুই ধরণের লোকজনকেই দেখবে তুমি। আমি নিশ্চিত এই সোলারিন লোকটাও এর ব্যতিক্রম নয়। এই খেলায় তারা কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারে না।”

“আমি আসলে ঠিক এটা বলছি না,” বাধা দিয়ে বললাম তাকে। “সোলারিন খেলার সময় কোনো মেয়েমানুষ দেখতে পছন্দ করে না সেজন্যে কিন্তু আমাকে চলে যেতে বলে নি। সে বলেছে আমি নাকি মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছি!” তার হাতটা ধরে রেলিংয়ের সামনে দাঁড়ালাম। নীচে দেখতে পেলাম লোকজনের ভীড়টা ক্রমশ বাড়ছে।

“সে তোমাকে কি বলেছে?” বললো লিলি। “ঠাট্টা করছো না তো। বিপদ? দাবা খেলায়? এই খেলায় একমাত্র বিপদটা হলো খেলার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়া।”

“সে আমাকে বলছে আমি নাকি বিপদের মধ্যে আছি,” আবারো বললাম কথাটা। দেয়ালের কাছে নিয়ে গেলাম তাকে। কণ্ঠটা আরো নীচে নামিয়ে নিলাম। “নিউইয়ার্স ইভের দিন হ্যারির কাছে তুমি যে একজন গণক পাঠিয়েছিলে সেটা কি মনে আছে?”

“ওহ হো,” বললো লিলি। “এটা আবার বোলো না তুমি গুপ্তবিদ্যায় বিশ্বাস করো?” হেসে ফেললো সে।

 লোকজন গেমিংরুম আর বেলকনিগুলোতে আসতে শুরু করছে। আমরাও আমাদের সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। একেবারে সামনের একটা সারির এক পাশে। এতে করে খেলাটা যেমন ভালোভাবে দেখতে পাবো সেই সাথে একটু আড়ালেও থাকা যাবে। সিটে বসেই আমি নীচুস্বরে বললাম, “ঐ গণক মহিলা যা বলেছিলো সোলারিন ঠিক একই শব্দ ব্যবহার করেছে। গণক আমাকে কি বলেছে। হ্যারি কি তোমাকে সেটা বলে নি?”

“আমি ঐ মহিলাকে কখনও দেখি নি,” পকেট থেকে ছোট্ট একটা দাবাবোর্ড বের করে কোলের উপর রাখলো সে। “আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার খোঁজ পেয়েছিলাম। তবে আমি এইসব ফালতু জিনিসে বিশ্বাস করি না। সেজন্যেই

আমি যাই নি।”

লোকজন লিলির দিকে তাকাচ্ছে। একদল রিপোর্টার রুমে ঢুকলো, তাদের সাথে গলায় ক্যামেরা ঝোলানো একজন আছে, লিলিকে দেখতে পেয়েই আমাদের দিকে ছুটে আসতে লাগলো তারা। মাথা নীচু করে দাবাবোর্ডের দিকে মনোযোগ দিলো সে। খুব নীচু কণ্ঠে বললো, “আমরা দাবা নিয়ে সিরিয়াস কথাবার্তা বলছি। সবাই যেনো তাই বোঝে।”

জন হারমানোল্ড রুমে ঢুকেই দ্রুত ছুটে এসে রিপোর্টারদের সামনে দাঁড়ালো। গলায় ক্যামেরা আছে যে লোকটা তার কলার ধরে ফেললো আমাদের কাছে আসার আগেই।

 “এক্সকিউজ মি, ক্যামেরাটা আমার কাছে রেখে যেতে হবে,” রিপোর্টারকে বললো। “গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিন কোনো ক্যামেরা দেখতে চান না এই টুর্নামেন্ট হলের ভেতর। দয়া করে নিজেদের আসনে বসুন, খেলা উপভোগ করুন। খেলা শেষ হবার পর একটা ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করা হয়েছে।”

নিরস বদনে রিপোর্টার বেচারা তার ক্যামেরাটা হারমানোন্ডের হাতে তুলে দিলো। সে এবং তার সাথে বাকি সবাই নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পড়লো চুপচাপ।

 পুরো ঘরটা নীরব হয়ে গেলো, চলতে লাগলো নীচুস্বরে ফিসফাস। আরবিটার দু’জন নিজেদের টেবিলে গিয়ে বসে পড়লো। তাদের পর পরই একটু আগে দেখা সোলারিন আর বয়স্ক এক লোক ঢুকলো ঘরে। বুঝতে পারলাম এ হচ্ছে ফিস্ক।

ফিস্ককে দেখে নার্ভাস মনে হচ্ছে। তার এক চোখ কিছুটা নির্মিলিপ্ত, ধূসর গোঁফে বার বার হাত বুলাচ্ছে। মাথার চুল পাতলা হয়ে আসছে ক্রমশ। ব্যাব্রাশ করে রাখলেও কিছু চুল কপালের উপর এসে পড়েছে। মেরুন রঙের জ্যাকেট পরেছে সে। জ্যাকেটটা নিশ্চয় তার সোনালি দিনগুলোর সময়ের, ভালোভাবে ব্রাশ করা হয় নি। বিবর্ণ দেখাচ্ছে সেটা।

পরনের ব্যাগি প্যান্টটা দুমড়েমুচড়ে আছে। তাকে দেখে কোনোভাবেই হাল জমানার মনে হচ্ছে না। ভাবভঙ্গিতে একেবারে নৈরাশ্যবাদী বলেও মনে হচ্ছে।

তার পাশে সোলারিনকে দেখে মনে হচ্ছে ডিসকাস থ্রো খেলার একজন অ্যাথলেটের মূর্তি। ফিস্কের চেয়ে তার উচ্চতা কম করে হলেও একফুট বেশি। খেলার টেবিলে একটা চেয়ারের কাছে এসে অন্য একটা চেয়ার টেনে ফিস্ককে বসতে দিলো সে।

“বানচোত, লিলি ঘোঘোৎ করে বললো। “সে ফিস্কের আত্মবিশ্বাস জয় করতে চাচ্ছে, খেলা শুরু হবার আগেই এগিয়ে থাকতে চাইছে।”

“তোমার কি মনে হয় না তুমি একটু বেশি বলছো?” জোরেই বললাম কথাটা। পেছনের সারি থেকে কয়েকজন আমাদেরকে চুপ থাকতে বললো এ সময়।

একটা ছেলে খুঁটির বাক্স নিয়ে এসে বোর্ডে সাজাতে শুরু করলো। সাদা খুঁটি নিলো সোলারিন, কালোগুলো ফিস্ক। লিলি আমাকে জানালো এই খুঁটি নির্বাচনের যে ড্র সেটা আগেই হয়ে গেছে। আরো কয়েকজন চুপ থাকতে বললে আমরা আর কথা বললাম না।

আরবিটারদের একজন নিয়মকানুন পড়ে শোনানোর সময় সোলারিন দর্শকদের দিকে তাকালো। তার পুরো প্রোফাইলটা আমার সামনে, এখন তাকে ভালো করে দেখে নেবার সুযোগ আছে। আগের চেয়ে আরো বেশি রিল্যাক্স আর নিভার মনে হচ্ছে তাকে। খেলার শুরুর আগে তার বয়সটাও যেনো আরো কমে গেছে। কিন্তু লিলির পাশে আমাকে বসে থাকতে দেখেই তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে।

“উঁহু,” বললো লিলি। “এখন বুঝতে পারছি তার দৃষ্টিকে তুমি কঠিন-শীতল বলেছিলে কেন। দাবা খেলার আগে তার এই চাহনি দেখতে পেয়ে আমি বরং খুশি।”

 সোলারিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না আমি এখনও বসে আছি। যেনো এক্ষুণি আমাকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দিতে চাইছে এমনই তার চাহনি। হঠাৎ করে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো, মনে হতে লাগলো এখানে থেকে গিয়ে বোধহয় বিশাল কোনো ভুলই করে ফেলেছি। খুঁটি সাজানোর পর খেলা শুরু হয়ে গেলে তার চোখ আমার উপর থেকে দাবাবোর্ডের। উপর নিবদ্ধ হলো। প্রথমেই কিংস পন অর্থাৎ রাজার চতুর্থ সৈন্যটির সামনে বাড়ালো সে। খেয়াল করলাম লিলিও তার কোলে থাকা ছোট্ট দাবাবোর্ডে একই। কাজ করলো। বিশাল একটা বোর্ডে অল্পবয়সী এক ছেলে লিখে দিলো খেলার চাল : P-K4

কিছুক্ষণ ধরে, কোনো রকম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই খেলাটা এগিয়ে চললো। সোলারিন আর ফিরে একটা করে সৈন্য আর ঘোড়া মারা পড়েছে। সোলারিন তার বিশপ সামনে বাড়ালে দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ গুঞ্জন করতে শুরু করলো। দুয়েকজন উঠে বাইরে চলে গেলো কফি পান করার জন্য।

“মনে হচ্ছে গুইয়োকো পিয়ানো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো লিলি। “এই খেলাটা খুব দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। এরকম রক্ষণাত্মক কৌশল কোনো টুনামেন্টে ব্যবহার করা হয় না। এটা পাহাড়ের মতোই প্রাচীন একটি কৌশল। হায় ঈশ্বর, গটিনজেন ম্যানুস্ক্রিপ্টেও এটার উল্লেখ আছে।” দাবা খেলা সম্পর্কে যে কিছুই জানে না তার কাছে লিলির এসব কথাবার্তা খুবই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বলে মনে হতে পারে।

 “এটা কালো ঘুটিগুলোকে গুছিয়ে উঠতে সাহায্য করবে, তবে খুবই ধীরগতির, একদম ধীরগতির। সোলারিন এটা ফিস্কের জন্য সহজ করে দিচ্ছে। পরাজিত করার আগে তাকে কয়েকটা চাল দেবার সুযোগ করে দেয়া আর কি। পরবর্তী এক ঘণ্টায় কিছু ঘটলে আমাকে ডেকে দিও।”

“আরে আমি কি করে জানবো কিছু ঘটছে কিনা?” নীচুস্বরে বললাম তাকে।

ঠিক তখনই ফিস্ক একটা চাল দিয়েই ঘড়িটা বন্ধ করে দিলো। ফিসফাস শুরু হয়ে গেলো উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে। যারা চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলো তারাও ফিরে এলো নিজেদের সিটে। আমি দেখতে পেলাম সোলারিন হাসছে। তার হাসিটা খুবই অদ্ভুত।

“হয়েছেটা কি?” লিলির কাছে জানতে চাইলাম।

“আমি যতোটা ভেবেছিলাম ফিস্ক তারচেয়েও বেশি দুঃসাহসী। বিশপের চাল না দিয়ে সে দুই ঘোড়ার প্রতিরক্ষা নিয়েছে। রাশিয়ান খেলোয়াড় এটা দারুণ পছন্দ করেছে। এটা আরো বেশি বিপজ্জনক। আমি খুব অবাক হয়েছি সে এই চালটা সোলারিনের বিপক্ষে ব্যবহার করেছে, যে কিনা…” নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। হাজার হোক লিলি অন্য খেলোয়াড়দের স্টাইল নিয়ে খুব একটা রিসার্চ করে নি।

সোলারিন এবার তার ঘোড়ার চাল দিলো, আর ফিস্ক দিলো সৈন্যের। সোলারিন সেই সৈন্যটাকে খেয়ে ফেললো। এরপরই সোলারিনের একটা ঘোড়া খেয়ে ফেললো ফিস্ক। সুতরাং আবারও সমান হয়ে গেলো তারা। ভাবলাম আমি। আমার কাছে মনে হচ্ছে ফিস্কের অবস্থা ভালোর দিকে, কারণ তার খুঁটিগুলো বোর্ডের মাঝখানে চলে এসেছে, সেই তুলনায় সোলারিনেরগুলো অনেকটাই পেছনে রয়েছে। কিন্তু সোলারিন তার ঘোড়া দিয়ে ফিরে একটা কিস্তি খেয়ে ফেললো। ঘরের মধ্যে বেশ গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো এ সময়। কফি পান করতে যারা চলে গিয়েছিলো তারা সবাই ফিরে এলো খেলা দেখার জন্য। বোর্ডে থেলার চাল দেয়া হলো আবার।

“ফিগাতেল্লো!” অনেকটা আর্তনাদ করেই বলে উঠলো লিলি, তবে এবার কেউ তাকে চুপ থাকতে বললো না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।”

“ফিগাতেল্লো মানে কি?” মনে হচ্ছে ডাটা প্রসেসিং জগতের তুলনায় দাবা খেলায় অনেক বেশি দুর্বোধ্য শব্দ রয়েছে।

“এর মানে ‘যকৃৎ ভাজা।’ ফিস্কের যকৃৎ ভাজা হবে, যদি সে তার রাজা ব্যবহার করে ঘোড়াটা খেয়ে ফেলে।” আঙুল কামড়াতে কামড়াতে সে তার কোলে রাখা ছোট্ট দাবাবোর্ডের দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো খেলাটা ওখানেই হচ্ছে। “তাকে কিছু একটা হারাতে হবেই, এটা নিশ্চিত। তার কুইন আর রুক কচু কাটা হবে। সে নাইটের কাছে অন্য যেকোনো খুঁটি দিয়ে যেতে পারবে না।”

সোলারিন এরকম চাল দেবে সেটা আমার কাছে খুবই অযৌক্তিক বলে মনে হলো। বিশপের বদলে সে কি একটি ঘোড়া বলি দিচ্ছে রাজাকে এক ঘর সরানোর জন্য?

 “ফিস্ক একবার তার রাজার চাল দিলে সে আর কুইজলিং করতে পারবে না,” লিলি আপন মনে বলে গেলো কথাটা। “বোর্ডের মাঝখানে ঝুঁকির মধ্যে চলে আসবে রাজা আর বাকি খেলায় সেটা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকবে। তারচেয়ে ভালো সে যদি কুইন আর রুককে বিসর্জন দেয়।”

কিন্তু রাজা দিয়ে ঘোড়াকে খেয়ে ফেললো ফিস্ক। সোলারিন তার কুইনকে বের করে চেক দিলে ফিস্ক তার রাজাকে কয়েকটা সৈন্যের পেছনে নিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কুইন দিয়ে কালো নাইটকে হুমকি দিলো সোলারিন। এরপর তারা কি চাল দেবে বুঝতে পারছি না আমি। লিলির অবস্থাও আমার মতোই।

“এখানে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে,” আমার কানে কানে বললো সে। “এটা তো ফিস্কের খেলার স্টাইল নয়।”

আসলেই অদ্ভুত কিছু ঘটছে। ফিস্ককে দেখলাম, সে চাল দেবার পরও দাবাবোর্ড থেকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। তার নার্ভাসনেস যে বেড়ে গেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তার কপালে ঘাম দেখতে পাচ্ছি। তাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে, যদিও এখন চাল দেবার কথা সোলারিনের। ফিস্ক বোর্ডের দিকে চেয়ে আছে।

সোলারিনের ঘড়িটা এখন চলছে, তবে সেও ফিস্ককে লক্ষ্য করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে খেলছে, প্রতিপক্ষের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। অনেকক্ষণ পর সোলারিনের দিকে তাকালো ফিস্ক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিলো তার দৃষ্টি। আবারো মনোনিবেশ করলো দাবাবোর্ডের উপর। চোখ কুচকে ফেললো সোলারিন। একটা খুঁটি সামনে বাড়িয়ে দিলো সে।

আমি আর চালগুলোর দিকে মনোযোগ রাখতে পারলাম না। আমার দৃষ্টি দু’জন মানুষের দিকে। তাদের মধ্যে কী ঘটছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার পাশে বসা লিলি কোলের উপর রাখা ছোট্ট দাবাবোর্ডের দিকে হা করে তাকিয়ে কী যেনো ভাবছে। হঠাৎ সোলারিন উঠে দাঁড়ালে শুরু হয়ে গেলো লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন। টেবিলে রাখা দুটো ঘড়ির বোম টিপে বন্ধ করে দিলো সে, তারপর ঝুঁকে ফিস্ককে কী যেনো বললো। একজন আরবিটার। দৌড়ে এলো তাদের টেবিলের কাছে। সোলারিনের সাথে তার কিছু কথা হবার পর লোকটা মাথা ঝাঁকালো। ফিস্ক হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। তার চোখ দাবাবোর্ডের দিকে। তাকে কিছু একটা বললো সোলারিন। আরবিটার লোকটা ফিরে গেলো জাজ টেবিলের দিকে। সব জাজ মাথা নেড়ে সায় দেবার পর। সেন্টার জাজ উঠে দাঁড়ালো।

 লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন,” বললো সে। “গ্র্যান্ডমাস্টার ফিস্ক অসুস্থ বোধ করছেন। দয়াপরবশ হয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিন ঘড়ি বন্ধ করে দিয়ে ছোট্ট একটা বিরতি দেবার জন্য রাজি হয়েছেন, যাতে করে মি: ফিস্ক একটু বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ বোধ করতে পারেন। মি: ফিস্ক আপনি আপনার পরবর্তী চাল সিল করে আরবিটারদের কাছে দিয়ে দিন। ত্রিশ মিনিট পর আমরা খেলা শুরু করবো আবার।”

কাঁপা কাঁপা হাতে ফিস্ক তার চালটা লিখে একটা এনভেলপে ভরে সিল মেরে আরবিটারের কাছে দিয়ে দিলো। রিপোর্টাররা তাকে ঘেঁকে ধরার আগেই বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে হলের দিকে চলে গেলো সোলারিন। পুরো কক্ষে ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে লোকজন ফিসফাস করতে লাগলো। লিলির। দিকে ফিরলাম আমি।

“ঘটনা কি? কি হয়েছে?”

“এটা তো অবিশ্বাস্য,” বললো সে। “সোলারিন ঘড়িগুলো বন্ধ করতে পারে না। এটা করতে পারে শুধুমাত্র আরবিটাররা। এটা তো নিয়মবিরুদ্ধ কাজ হয়ে গেছে। তাদের উচিত ছিলো আরবিটারদের ডাকা, দু’পক্ষ রাজি থাকলে বিরতি নেয়া যায়। কিন্তু সেটা করা যেতো শুধুমাত্র ফিস্ক তার পরবর্তী চালটা সিল করার পরই।”

“সোলারিন ফিস্ককে কিছুটা সময় দিয়ে দিয়েছে,” বললাম আমি। “কিন্তু সে কেন এটা করলো?”

আমার দিকে তাকালো লিলি। তার চোখ দুটো একদম ফাঁকা। সে নিজেও দারুণ বিস্মিত। “সে জেনে গেছে এটা ফিস্কের খেলার স্টাইল নয়,” বললো আমায়। একটু ভেবে নিলো খেলাটার বিভিন্ন চাল স্মরণ করে। “সোলারিন ফিস্ককে কুইনদের এক্সচেঞ্জ অফার করেছিলো। খেলার যে অবস্থায় সে ছিলো তাতে এটা করার দরকার ছিলো না তার। সবাই জানে ফিস্ক তার কুইন হারানোটা দারুণ অপছন্দ করে।”

“তাহলে ফিস্ক অফারটা মেনে নিয়েছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না,” উদাস হয়েই বললো লিলি। “গ্রহণ করে নি। সে তার কুইন সরিয়ে ফেলেছে। সে বোঝাতে চেয়েছে এটা J’adoube।”

“ J’adoube মানে কি?”

“‘আমি স্পর্শ করি, আমি ঠিক করি।’ খেলার মাঝখানে কোনো ঘুঁটি এডজাস্ট করে নেয়াটা একদমই বৈধ।”

“তাহলে সমস্যাটা কি?” আমি বললাম।

“কোনো সমস্যা নেই,” বললো লিলি। “তবে খুঁটি স্পর্শ করার আগে তোমাকে অবশ্যই বলতে হবে Jadoube। চাল দেবার পরে বলা যাবে না।”

“হয়তো সে বুঝতে পারে নি…”

“ও একজন গ্র্যান্ডমাস্টার, লিলি বললো। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ। “ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে।”

কোলের উপর দাবাবোর্ডের দিকে চেয়ে রইলো লিলি। আমি তাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না কিন্তু সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে একে একে। আমরাই কেবল বসে আছি। আমি আমার সীমিত দাবাজ্ঞান ব্যবহার করে বোঝার চেষ্টা করছি এসবের মানে কি।

“তুমি কি জানতে চাও আমি কি ভাবছি?” অবশেষে বললো লিলি। “আমার মনে হচ্ছে গ্র্যান্ডমাস্টার ফিস্ক প্রতারণা করছে। আমার ধারণা তার শরীরের সাথে কোনো ট্রান্সমিটার লাগানো আছে।”

 আমি যদি সে মুহূর্তে জানতে পারতাম তার কথা কতোটা সত্যি তাহলে হয়তো এরপর যেসব ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো সেসব বদলে যেতো। কিন্তু সে সময় আমি কি করে বুঝবো আসলেই কী ঘটছে-আমার থেকে মাত্র দশ ফিট দূরে-দাবাবোর্ডের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে সোলারিন কি স্টাডি করেছে?

.

সোলারিন যখন প্রথম লক্ষ্য করতে পেরেছিলো তখন সে দাবাবোর্ডের দিকে চেয়ে থাকে। প্রথমে তার চোখের কোণে এক ঝলক ধরা পড়ে জিনিসটা। তবে কৌশলে তিন তিনটি চাল দেবার পর ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করে। সোলাবিন যতোবারই চাল দিয়ে ঘড়ি বন্ধ করেছে, ফিস্কের চাল দেবার সময় এসেছে তখনই সে তার দু’হাত কোলের উপর নিয়ে এসেছে। পরের বার সোণারিন চাল দিয়েই ফিস্কের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ধরে ফেলে। তার আঙটিটা। ফিস্ক এর আগে কখনও আঙটি পরে নি।

 খামখেয়ালিভাবে খেলে গেছে ফিস্ক। চান্স নিয়েছে সে। খুবই অভিনবভাবে খেলে গেছে ভদ্রলোক, তবে যখনই ঝুঁকি নিয়েছে সোলারিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। তার মুখে ঝুঁকি নেয়া লোকের অভিব্যক্তি ছিলো না। এরপর থেকেই তার হাতের আঙটিটার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে শুরু করে সোলারিন।

ফিস্কের শরীরে ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সোলারিন অন্য কারো সাথে, কিংবা অন্য কিছুর সাথে খেলছে। এই ঘরের কারো সাথে নয় সেটা। সে আসলে ফিস্কের সাথে খেলছে না। একটু দূরে, দেয়ালের কাছে কেজিবি’র লোকগুলোর দিকে তাকায় সোলারিন। সে যদি এই জুয়াটায় অংশ নিয়ে খেলে যায় তাহলে সে হেরে যাবে, টুনামেন্ট থেকে ছিটকে পড়বে। তবে তার জানা দরকার কে বা কারা ফিস্ককে এই ট্রান্সমিটার লাগিয়ে দিয়েছে। কেন দিয়েছে।

ফিস্ক কিভাবে জবাব দেয় সেটা দেখে একটা প্যাটার্ন বের করার জন্য সোলারিন বিপজ্জনকভাবে খেলতে শুরু করে। এরফলে ফিস্কের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। তখনই সোলারিনের মাথায় কুইনদের এক্সচেঞ্জ করার আইডিয়াটা আসে, যার সাথে খেলার কোনো সম্পর্কই ছিলো না। সে তার কুইনটাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসে, একেবারে অরক্ষিত করে ফেলে সেটাকে। ফিস্ককে তার নিজস্ব খেলাটা খেলতে বাধ্য করে সে, যাতে করে সে যে প্রতারণা করছে সেটা যেনো জানাজানি হয়ে যায়। ঠিক তখনই ফিস্ক ভেঙে পড়ে।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে ফিস্ককে দেখে মনে হয়েছিলো ফিস্ক হয়তো এক্সচেঞ্জটা গ্রহণ করবে, তার কুইনকে খেয়ে ফেলবে। তাহলে জাজদের ডেকে খেলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারতো সোলারিন। সে কোনো মেশিন কিংবা অন্য কারোর সাথে খেলবে না। কিন্তু ফিস্ক পিছিয়ে যায়, তার বদলে Jadobe চেয়ে বসে। লাফিয়ে উঠে ফিস্কের দিকে ঝুঁকে পড়ে সোলারিন।

“আপনি এসব কী করছেন?” ফিসফিসিয়ে বলেছিলো সে। “আপনার মাথা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিরতি নেবো। আপনি কি বুঝতে পারছেন না এখানে একজন কেজিবি আছে? আপনি যা করছেন তা যদি তাকে বলি তাহলে চিরজীবনের জন্য আপনার দাবা খেলা শেষ হয়ে যাবে।”

এক হাতে ঘড়ি দুটো বন্ধ করে অন্য হাতে আরবিটারদের ডাকে সোলারিন। তাদেরকে সে জানায় ফিস্ক অসুস্থ বোধ করছে, পরের চালটা সিল করে বিরতি নিতে চাইছে সে।

“আর সেটা অবশ্যই কুইন হতে হবে, স্যার,” ফিস্কের দিকে আরো ঝুঁকে বলেছিলো সোলারিন। ফিস্ক তার দিকে মুখ তুলে তাকায় নি। হাতের আঙটিটা মোচড়াতে শুরু করে সে, যেনো ওটা খুব টাইট হয়ে আছে। এরপরই সোলারিন ঘর থেকে ঝট করে বের হয়ে যায়।

হলের ভেতর খাটোমতো আর ভারি ভুরুর কেজিবি’র লোকটা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলো। তার নাম গোপোল।

“একটু স্লিভোভিজ পান করে আসুন,” বলেছিলো সোলারিন। “আমাকেই ব্যাপারটা সামলাতে দিন।”

“হয়েছেটা কি?” গোগে জানতে চায়। সে কেন Jadobe চাইলো? এটা তো বেআইনী। আপনারও ঘড়ি দুটো বন্ধ করা উচিত হয় নি। এজন্যে তারা আপনাকে ডিসকোয়ালিফাইড করতে পারতো।”

“ফিস্কের শরীরের সাথে ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। আমাকে জানতে হবে কে এটা করেছে, কেন করেছে। আপনি শুধু তাকে আরো বেশি ভয় পাইয়ে দেবেন। এখান থেকে চলে যান, ভান করেন যেনো কিছুই জানেন না। ব্যাপারটা আমি দেখছি।”

“কিন্তু ব্ৰদস্কি এখানে আছেন, নীচু কণ্ঠে বলে গোগোল। কেজিবি নামের সিক্রেট সার্ভিসে ব্ৰদস্কি খুবই উচ্চপর্যায়ের লোক। সোলারিনের সাথে যে বডিগার্ড আছে তার চেয়ে অনেক উঁচুপদমর্যাদার।

“তাহলে আপনার সাথে তাকে মদ্যপান করার জন্য আমন্ত্রণ জানান, চট করে বলে সোলারিন। “তাকে আমার কাছ থেকে আধ ঘণ্টার জন্য দূরে রাখুন। কোনো অ্যাকশনে যাওয়া যাবে না, বুঝতে পারছেন, গোগোল?”

বডিগার্ড কিছুটা ভড়কে গেলেও আর কোনো কথা না বলে চলে যায়। সোলারিন বেলকনির শেষমাথায় গিয়ে ফিস্কের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কখন সে গেমিংরুম থেকে বের হয়ে আসে।

.

বেলকনি দিয়ে দ্রুত হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নীচের ফয়ারে নেমে যাচ্ছে ফিস্ক। উপর থেকে যে সোলারিন তাকে দেখছে সেটা সে জানে না। ভবনের বাইরে এসে প্রাঙ্গণটা পেরিয়ে বিশাল বটআয়রনের গেটটা দিয়ে বের হয়ে গেলো। এই ক্লাবে ঢোকার পথেই একপাশে রয়েছে কানাডিয়ান ক্লাবে ঢোকার পথ। ফিস্ক সেখানে ঢুকে পড়লো।

সোলারিনও তাকে অনুসরণ করতে করতে চলে এলো সেখানে। ক্লাবের টয়লেট রুমে ঢুকে পড়লো ফিস্ক। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সারি সারি ইউরিনাল বেসিনের সামনে। তার অলক্ষ্যে সোলারিন তাকে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ফিস্ক হাটু গেড়ে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো ভদ্রলোক-শব্দহীন-অশ্রুহীন-তারপর আরো ঝুঁকে বেসিনের উপর বমি করে দিলো সে। বমি করা শেষ করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথাটা বোলের সাথে ঠেক দিয়ে রাখলো।

পানি পড়ার শব্দ শুনে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখতে পেলো বেসিনের ট্যাপ থেকে ঠাণ্ডা পানি পড়ছে। ফিস্ক একজন ইংরেজ, জনসম্মুখে বমি করাটাকে সে অসম্মানের বলে মনে করে।

“ওটা আপনার দরকার আছে,” নিজের সামনে থাকা বেসিন থেকে মুখ না সরিয়েই একটু জোরে বললো সোলারিন।

মুখ তুলে তাকালো ফিস্ক, তবে বুঝতে পারছে না কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে কিনা। অবশ্য টয়লেটের ভেতর তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। দ্বিধার সাথেই সে উঠে দাঁড়িয়ে সোলারিনের কাছে এগিয়ে গেলো। সে একটা পেপার টাওয়েল দুমড়ে মুচরে ফেলছে। সেটা থেকে ওটামিলের গন্ধ আসছে।

 ফিরে কপাল আর মাথাটা স্পঞ্জ করে দিলো সোলারিন। “আপনি যদি আপনার হাত দুটো পানিতে ডুবিয়ে রাখেন কিছুক্ষণ তাহলে আপনার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসবে,” ফিস্কের জামার হাত ধরে বললো সে। কাছের একটা ডাস্টবিনে পেপার টাওয়েলটা ফেলে দিলো সোলারিন। পানি ভর্তি বেসিনে নিজের দু’হাত ডুবিয়ে রাখলো ফিস্ক, সোলারিন লক্ষ্য করলো সে তার হাতের আঙুলগুলো ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করছে।

একটা শুকনো পেপার টাওয়েলের উপর পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখলো সোলারিন। ফিস্ক তার দিকে তাকালে লেখাটা তুলে ধরলো সে। এতে বলা আছে : “ট্রান্সমিটারটা কি একমুখি নাকি দ্বিমুখি?”

ফিস্কের চেহারা আরক্তিম হয়ে উঠলো। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কাগজটা ভাজ করে অন্য পিঠে আরো কিছু কথা লিখলো সোলারিন : “তারা কি

আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে?”

গভীর করে দম নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো ফিস্ক, তারপর নেতিবাচকভাবে মাথা নাড়লো। পানি থেকে হাত তুলে পেপার টাওয়েলটা নিতে উদ্যত হলে সোলারিন তার দিকে অন্য একটা পেপার টাওয়েল বাড়িয়ে দিলো।

“এই টাওয়েলটা না,” কথাটা বলেই পকেট থেকে লাইটার বের করে লেখা থাকা টাওয়েলটা আগুনে পুড়িয়ে ফেললো সোলারিন। আপনি নিশ্চিত?” ছাইগুলো বেসিনে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। “এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

“হ্যাঁ, অস্বস্তির সাথে বললো ফিস্ক। “আমাকে…তাই বলা হয়েছে।”

“বেশ, তাহলে আমরা কথা বলতে পারি। সোলারিনের হাতে এখনও লাইটারটা ধরা। “আপনার কোন্ কানে সেটা বসানো আছে? …ডান নাকি বামে?” ফিস্ক তার বাম কানে টোকা দিলে সোলারিন মাথা নেড়ে সায় দিলো কেবল। সাইটারের নীচ থেকে ছোট্ট একটা আঙটার মতো জিনিস বের করলো। সে। জিনিসটা আসলে ছোটোখাটো চিমটা।

“মেঝেতে শুইয়ে পড়ন, মাথাটা এমনভাবে রাখুন যাতে একদম না নড়ে। আপনার বাম কানটা উপরের দিকে রাখুন। হুট করে নড়াচড়া করবেন না। আপনার কানের পর্দা ছিঁড়ে ফেলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

কথামতোই কাজ করলো ফিস্ক। সোলারিনের হাতে নিজেকে সপে দিয়ে। মনে হচ্ছে বেশ স্বস্তি পাচ্ছে সে, কোনো রকম প্রশ্নই করছে না। হাটু গেড়ে বসে পড়লো সোলারিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিস্কের কান থেকে ছোট্ট একটি জিনিস বের করে আনলো সে। চিমটা দিয়ে জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখে নিলো। আলপিনের মাথার চেয়ে একটু বড়।

“আহ্,” বললো সোলারিন। “আমাদেরগুলোর মতো অতো ছোটো না। মাই ডিয়ার ফিস্ক, এখন বলুন কারা আপনাকে এটা দিয়েছে? এসবের পেছনে রয়েছে কারা?” হাতের তালুর উপর জিনিসটা রেখে দিলো সে।

ধপাস করে বসে পড়ে সোলারিনের দিকে তাকালো ফিস্ক। মনে হলো এই প্রথম সে বুঝতে পারছে সোলারিন আসলে কে : নিছক কোনো দাবা খেলোয়াড় নয়, বরং একজন রাশিয়ানও। তার সঙ্গে আছে কেজিবির একজন এসকর্ট। সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়লো সে।

 “আমাকে আপনার বলতে হবে। বুঝতে পারছেন, নাকি পারছেন না?” ফিস্কের আঙটিটার দিকে তাকালো সোলারিন। আঙটি পরা হাতটা তুলে নিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করলো জিনিসটা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো ফিস্ক।

আঙটিটার মাঝখানে বেশ বড়সড় একটা সিগনেট বসানো। দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণের তৈরি। সোলারিন সিগনেটটায় চাপ দিলে মৃদু শব্দে একটা ক্লিক করে আওয়াজ হলো। কানের কাছে নিয়ে খুব ভালো করে না শুনলে শব্দটা শোনা যেতো না। এভাবেই চেপে চেপে একটা কোডের মাধ্যমে দাবার চালগুলো বলে দিয়েছে ফিস্ক। এরপর তার সহযোগীরা তার কানে বসানো ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে কোন চালটা দিতে হবে।

“আপনাকে কি এই আঙটিটা না খোলার জন্যে সাবধান করে দেয়া হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো সোলানি। “এটার যে সাইজ তাতে মনে হয় অর কিছু এক্সপ্লোসিভ আর ডেটোনেটর থাকা সম্ভব।”

“ডেটোনেটর!” আর্তনাদ করে উঠলো ফিস্ক।

“এই ঘরটা উড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট,” মুচকি হেসে বললো সে। “নিদেনপক্ষে আমাদের দু’জনকে তো খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে পারে। আপনি কি আইরিশদের এজেন্ট? তারা ছোটোখাটো বোমার ব্যাপারে বেশ দক্ষ। যেমন ধরুন চিঠি বোমা, কলম বোমা। আমি জানি তার কারণ তাদের বেশিরভাগই রাশিয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।” ফিস্কের চেহারা সবুজ হয়ে গেলেও সোলারিন বলতে লাগলো, “আমার কোনো ধারণাই নেই আপনার বন্ধুরা কিসের পেছনে লেগেছে, মাই ডিয়ার ফিস্ক। কিন্তু কোনো এজেন্ট যদি আমাদের সরকারের সাথে বেঈমানি করে, যেমনটি আপনি করেছেন যারা আপনাকে পাঠিয়েছে তাদের সাথে, তবে তারা দ্রুত সেই এজেন্টকে সরিয়ে ফেলে।”

“কিন্তু…আমি তো কোনো এজেন্ট নই!” ফিস্ক চিৎকার করে বললো।

 তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললো সে। “না, আমিও মনে করি না আপনি কোনো এজেন্ট। হায় ঈশ্বর, তারা আপনাকে দিয়ে কতো বিপজ্জনক একটা কাজই না করিয়েছে!” সোলারিন কিছু একটা ভাবতে শুরু করলে ফিস্ক তার হাতটা মোচড়াতে লাগলো।

 “মাই ডিয়ার, ফিস্ক, দেখুন,” বললো সে, “আপনি একটা বিপজ্জনক খেলায় আছেন। যেকোনো সময় এখানে লোকজন চলে আসতে পারে, তখন আমাদের দু’জনের জীবনটাই বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে। আপনাকে দিয়ে যারা এ কাজ করাচ্ছে তারা খুব ভালো লোক নয়। বুঝতে পারছেন? তাদের সম্পর্কে যা জানেন আমাকে বলুন, দ্রত। তাহলেই কেবল আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারবো।” সোলারিন উঠে দাঁড়িয়ে ফিস্কের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে টেনে ওঠালো। ফিস্কের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে বুবি এখনই কেঁদে ফেলবে। বুড়ো লোকটার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো সে।

“কেউ আপনাকে এই ম্যাচটা জেতার জন্যে এরকম কাজ করতে রাজি করিয়েছে। আপনাকে বলতে হবে সে কে, কিংবা কারা। আর কেনই বা এটা চাচ্ছে।”

“ডিরেক্টর…” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো ফিস্ক। “অনেক বছর আগে, মানে আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, দাবা খেলতে পারতাম না তখন বৃটিশ সরকার আমাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে শিক্ষকের চাকরি জুটিয়ে দেয়। গত মাসে আমার ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর এসে আমাকে বললো কিছু লোক আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। তারা কারা আমি জানি না। তারাই আমাকে বললো, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এই টুর্নামেন্টে আমাকে খেলতে হবে। এজন্যে আমাকে তেমন কিছুই করতে হবে না…” হেসে ফেললো ফি, ঘরের চারপাটা দেখে নিলো সে। হাতের আংটিটা মোচড়াচ্ছে এখনও। তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো সোলাবিন।

“আপনাকে তেমন কিছুই করতে হবে না,” শান্তকণ্ঠে বললো সে, “তার কারণ আপনাকে সত্যিকার অর্থে কোনো খেলাই খেলতে হবে না। আপনাকে অন্য কেউ ইন্সট্রাকশন দেবে?”

ছলছল চোখে মাথা নেড়ে সায় দিলো ফিস্ক। সোলারিনের তীক্ষ্ণ চোখের সামনে সে ভেঙে পড়েছে। কথা বলার আগে বার কয়েক ঢোক গিলে নিলো।

“তাদেরকে আমি বলেছিলাম আমি এ কাজ করতে পারবো না, অন্য কাউকে বেছে নিতে, এবার তার কণ্ঠটা একটু চড়া হলো। আমাকে না খেলানোর জন্য অনেক অনুনয় করেছি কিন্তু তাদের কাছে আর কেউ ছিলো না। আমি পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাই। ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় তারা আমাকে চাকরি থেকে ছাটাই করে দিতে পারতো। তারা আমাকে বলেছে…” দম ফুরিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো সে। সতর্ক হয়ে উঠলো সোলারিন। ফিস্ক তার চিন্তাভাবনা গুছিয়ে উঠতে পারছে না। হাতের আঙটিটা মোচড়াচ্ছে বার বার, যেনো সেটা তার হাতে খোঁচাচ্ছে। একটু পর পর উদভ্রান্ত চোখে ঘরে আশেপাশে তাকালো সে।

“তারা আমার কথা শুনতো না। যেকোনো মূল্যেই হোক তারা ফর্মুলাটা চায়। তারা বলেছে

“ফর্মুলা!” ফিস্কের কাঁধটা শক্ত করে ধরে বললো সোলারিন। “তারা ফর্মুলার কথা বলেছে?”

“হ্যা! হ্যাঁ! ঐ বালের ফর্মুলা, সেটাই তারা চায়।”

ফিস্ক এবার ভয়ানকভাবে কাঁপতে শুরু করলো। সোলারিন বুড়ো লোকটার পিঠে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো তাকে শান্ত করার জন্য। “ফর্মুলার ব্যাপারে আমাকে বলুন, খুব সতর্কভাবে বললো সে। বলুন, মাই ডিয়ার ফিস্ক। এই ফর্মুলাটার জন্য তারা এতো মরিয়া কেন? আপনি এই টুর্নামেন্ট খেলে এটা কিভাবে পাবেন সেটা কি তারা বলেছে আপনাকে?”

“আপনার কাছ থেকে,” মেঝের দিকে চেয়ে দূর্বল কণ্ঠে বললো ফিস্ক। দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।

“আমার কাছ থেকে?” স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো সোলারিন। এরপর চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো সে। তার কাছে মনে হলো কেউ এদিকেই আসছে।

 “জলদি কথা বলুন,” নীচুকণ্ঠে বললো। “তারা কিভাবে জানতে পারলো আমি এই টুর্নামেন্টে খেলবো? আমি যে আসছি সেটা তো কেউ জানতো না।”

“তারা জানতো,” ফিস্ক উন্মাদগ্রস্তের মতো তাকালো সোলারিনের দিকে। হাতের আংটিটা এখনও মুচড়িয়ে যাচ্ছে। “হায় ঈশ্বর, আমাকে রক্ষা করে। আমি তাদেরকে বলেছিলাম আমি এ কাজ করতে পারবো না! বলেছিলাম ব্যর্থ হবে!”

“আঙটিটা খুলে ফেলুন, দৃঢ়কণ্ঠে বললো সোলারিন। ফিঙ্কের হাতটা ধরে মোচড় মারলো সে। “কিসের ফর্মুলা?”

“স্পেনে খেলার সময় যে ফর্মুলাটা নিয়ে আপনি বাজি ধরেছিলেন!” আর্তনাদ করে উঠলো ফিস্ক। “আপনি বলেছিলেন আপনাকে যে হারাবে তাকে ফর্মুলাটা দিয়ে দেবেন! এটাই আপনি বলেছিলেন। আমি জিতে গেলে আমাকে সেটা দিয়ে দিতেন।”

 অবিশ্বাস্য চোখে ফিস্কের দিকে চেয়ে রইলো সোলারিন। তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। উদভ্রান্তের মতো হাসতে লাগলো সে।

“আপনি এটা বলেছিলেন,” আঙটিটা খুলতে খুলতে বললো ফিস্ক।

“ওহ না,” বললো সোলারিন। পেছনে ফিরে দেখে নিলো সে, চোখে জল। আসা পর্যন্ত হাসতে লাগলো। “মাই ডিয়ার ফিস্ক,” হাসতে হাসতেই বললো সে। “ওটা কোনো ফর্মুলা না! ঐসব বোকাগুলো ভুল বুঝেছে। আপনি একদল বাজে। দাবা খেলোয়াড়, যাকে আমাদের ভাষায় বলে পাতজার, তাদের খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। আসুন বাইরে যাই…আপনি কি করছেন?!”

সে খেয়াল করে নি, আঙটিটা খুলতে গিয়ে ফিস্কের চেহারায় যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। কিন্তু এখন, ফিস্ক তার আঙটিটা এক ঝটকায় খুলে কাছের একটা বেসিনে ফেলে দিলো। চিৎকার করে বললো সে, “আমি এ কাজ করবো না! করবো না!”

আঙটিটা বেসিনে পড়তেই সোলারিন দরজার দিকে দৌড়ে গেলো, মনে মনে গুনতে আরম্ভ করলো সে। এক। দুই। টয়লেট থেকে বাইরে চলে এলো। তিন। চার। ছোট্ট ফয়ারটা অতিক্রম করতে শুরু করলো এবার। ছয়। সাত। ফয়ারের দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলে বাইরের প্রাঙ্গনে চলে এসে বড় বড় পা ফেলে ছকদম দূরে চলে গেলো। আট। নয়। লাফিয়ে কাকড় বিছানো পথের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো অবশেষে। দশ। দু’হাত দিয়ে কান দুটো ঢেকে ফেললো সোলারিন। অপেক্ষা করলো কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ হলো না।

 হাতটা সরিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেলো দুই জোড়া জুতো তার চোখের সামনে। আরো ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আরবিটার দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন। বিস্ময়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

“গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিন!” একজন জাজ বললো। “আপনি কি আঘাত পেয়েছেন?”

“না, আমি ঠিক আছি,” নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়ালো সে। পোশাক থেকে ঝুলো ঝেড়ে ফেললো। “গ্রাভমাস্টার ফিস্ক টয়লেটের ভেতরে আছেন, তিনি বেশ অসুস্থ। আমি তার জন্যে ডাক্তার ডাকাতে আসছিলাম, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। এই পাথর বিছানো পথটা বেশ পিচ্ছিল। সোলারিন ভাবতে লাগলো আঙটিটার ব্যাপারে সে ভুল করে ফেলেছে কিনা। হয়তো ওটা খুলে ফেললে কিছুই হবার কথা নয়।

“আমরা তাহলে গিয়ে দেখি তার জন্যে কিছু করা যায় কিনা,” বললো একজন জাজ। “উনি কেন কানাডিয়ান ক্লাবের টয়লেটে গেলেন? মেট্রোপলিটান ক্লাবের টয়লেটে গেলেন না কেন? কিংবা ফার্স্ট এইড স্টেশনে?”

“উনি খুব আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ,” জবাব দিলো সোলারিন। “নিজের অসুস্থতা অন্যকে দেখানোটা নিশ্চয় চাইবেন না।” জাজ দু’জন অবশ্য জিজ্ঞেস করলেন না সোলারিন কেন একই টয়লেটে গেছেন, তাও আবার নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে।

 “উনি কি খুব অসুস্থ?” প্রবেশপথের দিকে যেতে যেতে বললেন একজন জাজ।

“তেমন কিছু না, পেট খারাপ,” জবাব দিলো সোলারিন। সেখানে ফিরে গিয়ে দেখাটা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না তার কাছে কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই।

তারা তিনজন একসাথেই টয়লেটের কাছে চলে এলো, সামনে থাকা একজন জাজ দরজাটা টান মেরে খুলতেই আৎকে উঠে পিছিয়ে গেলেন।

 “দেখবেন না!” বললেন তিনি। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। জাজ দু’জনকে সরিয়ে দিয়ে টয়লেটের ভেতর ঢুকে পড়লো সোলারিন। টয়লেটের পার্টিশানের উপর থেকে নিজের টাই গলায় পেচিয়ে ঝুলে আছে ফিস্ক। কালচে হয়ে গেছে মুখটা। তার ঘাড়টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা ভেঙে গেছে।

 “আত্মহত্যা!” দরজা খুলেছিলেন যে জাজ তিনি বললেন। কিছুক্ষণ আগেও সেখানে দাঁড়িয়েছিলো ফিস্ক। একেবারে জ্বলজ্যান্ত।

“তিনিই প্রথম দাবামাস্টার নন যিনি এভাবে চলে গেলেন, অন্য জাজ জবাব দিলেন। সোলারিন তার দিকে ভুরু কুচকে তাকাতেই চুপ মেরে গেলেন তিনি।

“আমাদের ডাক্তার ডাকা দরকার,” অন্য এক জাজ দ্রুত বললেন।

ফিস্ক যে বেসিনটায় আঙটি ফেলেছিলো সেটার দিকে এগিয়ে গেলো সোলারিন। আঙটিটা আর সেখানে নেই। “হ্যাঁ, চলুন ডাক্তার ডাকা যাক, জবাবে বললো সে।

.

কিন্তু লাউঞ্জে বসে লিলির জন্য অপেক্ষা করতে করতে পর পর তিন কাপ কফি পান করার সময় আমি এসবের কিছুই জানতাম না। পর্দার আড়ালে কি ঘটে যাচ্ছে আমি যদি সেটা জানতে পারতাম তাহলে পরের ঘটনাগুলো হয়তো ঘটতোই না।

খেলার বিরতি প্রায় পাঁচচল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে, ভাবতে লাগলাম আসলে কী ঘটছে। আমার টেবিলের কাছে এসে লিলি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো।

“বলো তো কী হয়েছে,” চাপা কণ্ঠে জানতে চাইলো সে। “বারে আমার সাথে হারমানোন্ডের দেখা হয়েছে, তাকে দেখে মনে হলো হুট করেই দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে। টুর্নামেন্টের ফিজিশিয়ানের সাথে কথা বলছে সে! কফি খাওয়া শেষ হলেই আমরা আজকের খেলাটা বাতিল করে দিতে পারবো, ডার্লিং। আজকে আর কোনো খেলা হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘোষণা দেবে।”

“ফিস্ক কি আসলেই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? হয়তো সেজন্যেই খুব অদ্ভুতভাবে খেলছিলো আজ।”

“সে অসুস্থ নয়, ডার্লিং। সে খুব দ্রুতই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে বলতে পারো।”

“নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে?”

“এক দিক থেকে বলতে গেলে তাই। বিরতির পর পরই সে টয়লেটে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে।”

“ফাঁস দিয়েছে!” কথাটা বলতেই লিলি আমাকে চুপ করার জন্যে ইশারা করলো। আশেপাশে লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। “তুমি কী বলছো?”

“হারমানোন্ড বলছে ফিস্কের জন্যে নাকি একটু বেশিই চাপ হয়ে গেছে। তারদের অভিমত অবশ্য অন্যরকম। তারা বলছে, একশ’ চল্লিশ পাউন্ডের একজন লোকের পক্ষে ছয় ফুট উঁচু পার্টিশান দেয়ালে উঠে গলায় ফাঁস দেয়াটা সহজ কাজ নয়।”

“আমরা কি কফি খাওয়া রেখে বাইরে যেতে পারি?” সোলারিন তার গাঢ় সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কি বলেছিলো সেটা ভাবতে শুরু করলাম। অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম আমি। আমার দরকার মুক্ত বাতাস।

“বেশ,” জোরেই বললো লিলি। “তবে দ্রুত ফিরে আসবো। আমি এই ম্যাচট.র উত্তেজনা মিস করতে চাই না।” তড়িঘড়ি আমরা বের হয়ে লবিতে চলে এলাম। দু’জন রিপোর্টার হুমরি খেয়ে আমাদের সামনে চলে এলো।

“ওহ মিস র‍্যাড,” তাদের মধ্যে একজন বললো। “কি হচ্ছে সেটা কি আপনি জানেন? আজ কি খেলা শুরু হবে?”

“তারা যদি মি: ফিস্কের জায়গায় কোনো প্রশিক্ষিত বানর নিয়ে না আসে তাহলে শুরু করা সম্ভব হবে না।”

“আপনি তার খেলা নিয়ে খুব একটা ভাবেন না মনে হয়? নোটবুকে কিছু কথা টুকতে টুকতে রিপোর্টার বললো।

“আমি তার খেলা নিয়ে মোটেও ভাবি না,” ঠাট্টাচ্ছলে জবাব দিলো লিলি। “আপনারা তো জানেনই আমি শুধু আমার খেলা নিয়েই ভাবি।” লিলি রিপোর্টারদের ঠেলেঠুলে চলে গেলেও পেছন পেছন তারা আসতে লাগলো। “আর খেলার কথা যদি বলেন, আমি যতোটুকু দেখেছি তাতে এটা কিভাবে শেষ হবে তা জানি।” ডাবল-দরজাটা দিয়ে মেইন রোডে চলে এলাম আমরা দু’জন।

“সল গেলো কোথায়?” বললো লিলি। “গাড়িটা তো সামনেই পার্ক করার কথা ছিলো।”

রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি লিলির নীল রঙের কর্নিশ গাড়িটা বুকের শেষমাথায়, ফিফথ এভিনুর কাছে পার্ক করা আছে। তাকে দেখালাম সেটা।

 “দারুণ, আমার দরকার আরেকটা পার্কিং টিকেট,” সে বললো। “চলো। এখান থেকে, ভেতরে ঐ খবরটা ফাঁস হবার আগেই কেটে পড়া ভালো।” হাড়। কাঁপানো শীতের মধ্যে আমার হাতটা ধরে ছুটে চললো লিলি। গাড়ির কাছে আসতেই আমি বুঝতে পারলাম ভেতরে সল নেই। তাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

 রাস্তাটা পার হয়ে সলকে খুঁজলাম। গাড়ির কাছে আবার ফিরে এসে দেখি ইগনিশনে চাবিটা ঝুলছে। ক্যারিওকাও নেই ভেতরে।

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো লিলি। “সল জীবনেও এভাবে গাড়ি রেখে অন্য কোথাও যায় নি। সে গেছে কোথায়? আমার কুকুরটাই বা গেলো কোথায়?”

গাড়ির সিটের নীচ থেকে একটা গোঙানীর মতো শব্দ হলো। দরজা খুলে উপুড় হয়ে সিটের নীচে হাত দিতেই আমার হাতে একটা জিভ লাগলো। ক্যারিওকাকে ওখান থেকে টেনে বের করলাম আমি। উঠে দাঁড়াতেই এমন একটা জিনিস দেখতে পেলাম যে রক্ত হিম হয়ে গেলো। ড্রাইভারের সিটে একটা ফুটো।

“দেখো,” লিলিকে বললাম। “এই ফুটোটা কিসের?”

লিলি কাছে এসে উপুড় হয়ে সেটা দেখতে যাবে ঠিক তখনই ভোতা একটি শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে হালকা ঝাঁকি খেলো গাড়িটা। পেছন ফিরে তাকালাম, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম, ক্যারিওকাকে রেখে দিলাম পেছনের সিটে। গাড়ির একটা পাশে তাকালাম, সেটা মেট্রোপলিটান ক্লাবের দিক। সেখানে আরো একটা ফুটো দেখতে পেলাম, একটু আগেও সেটা ছিলো না। স্পর্শ করে দেখলাম বেশ উষ্ণ।

মেট্রোপলিটান ক্লাবের জানালাগুলোর দিকে তাকালাম আমি। বেলকনিগুলোর একটা ফ্রেঞ্চ জানালা খোলা, ঠিক তার উপরেই আমেরিকার জাতীয় পতাকা উড়ছে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। এটা গেমিংরুমের একটি জানালা, আরবিটারাদের টেবিলের পেছনে। আমি এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত।

“হায় জিশু, ফিসফিসিয়ে বললাম লিলিকে। “কেউ আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করছে!”

“কী যা তা বলছো,” বললো সে। কাছে এসে গাড়ির গায়ে বুলেটের ফুটোটা দেখলো। তারপর আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো ফ্রেঞ্চ জানালাটার দিকে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তোতা শব্দটা যখন শুনেছি তখন আমাদের পাশ দিয়ে কোনো গাড়িও চলে যায় নি।

“সোলারিন!” আমার হাতটা খপ করে ধরে বললো লিলি। “সে তোমাকে ক্লাব থেকে চলে যাওয়ার জন্যে বলেছিলো, তাই না? ঐ বানচোতটা আমাদেরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে!”

“সে আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো আমি যদি ক্লাবের ভেতরে থাকি তাহলে বিপদে পড়বো,” তাকে বললাম। “এখন তো আমি ক্লাবের বাইরে চলে এসেছি। তাছাড়া, কেউ যদি আমাদেরকে গুলি করতে চাইতো তাহলে এতো অল্প দূরত্ব থেকে সেটা লক্ষ্যচ্যুত হবার কথা নয়।”।

“সে আমাকে টুর্নামেন্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে!” লিলি জোর দিয়ে বললো কথাটা। “প্রথমে সে আমার ড্রাইভারকে অপহরণ করেছে, তারপর আমার গাড়িতে গুলি। আমি অবশ্য এতো সহজে ভয় পাবার মেয়ে নই।”

“তুমি না পাও, আমি পাচ্ছি। তাকে বললাম। “চলো এখান থেকে!”

দ্রুত ড্রাইভারের সিটে বসে পড়লো লিলি, তার মানে সে আমার সাথে। একমত। ফিফথ এভিনু ধরে গাড়িটা ছুটে চলতে লাগলো।

“ক্ষিদেয় পেট পুড়ে যাচ্ছে,” বাতাসের ঝাঁপটার মধ্যেই বললো সে।

“তুমি এখন খেতে চাচ্ছো?” আমি চিৎকার করে বললাম। “তোমার কি মাথা খারাপ? আমার মনে হচ্ছে সবার আগে আমাদের পুলিশের কাছে যাওয়া। উচিত।”

 “প্রশ্নই ওঠে না,” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “হ্যারি যদি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারে সে আমাকে বন্দী করে রাখবে, আমি আর এই টুর্নামেন্টে খেলতে পিরবো না। আমরা এখন কোথাও খেতে যাবো। খেতে খেতে ভাববো কি ঘটে গেছে। খাবার না পড়লে আমার মাথা কাজ করবে না।”

“পুলিশের কাছেই যদি না যাই তাহলে চলো আমার অ্যাপার্টমেন্টে।”

“তোমার ওখানে তো রান্নাঘরই নেই,” বললো লিলি। “আমার ব্রেন সেলগুলো কাজ করার জন্য গরুর মাংস দরকার।”

“আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলো। কয়েক ব্লক দূরে থার্ড এভিনুতে একটা স্টিক হাউজ আছে। তবে তোমাকে আগেই বলে রাখছি, খাওয়াদাওয়া করার পর কিন্তু পুলিশের কাছে যেতে হবে।”

লিলি গাড়িটা থামালো সেকেন্ড এভিনুতে অবস্থিত পাম রেস্টুরেন্টের সামনে। কাঁধের বিশাল ব্যাগ থেকে ছোট্ট দাবোর্ডটা বের করে আমার কোলের উপর রেখে দিলো সে, তারপর খালি ব্যাগের ভেতর রেখে দিলো ক্যারিওকাকে।

“তারা রেস্টুরেন্টের ভেতর কুকুর নিয়ে ঢুকতে দেয় না,” আমাকে বললো।

“আমি এটা নিয়ে কী করবো?” দাবাবোর্ডটার দিকে ইশারা করে বললাম।

“তোমার কাছে রাখো,” বললো সে। “তুমি হলে কম্পিউটার জিনিয়াস আর আমি হলাম দাবা বিশেষজ্ঞ। আমরা যদি আমাদের মাথাটা একসাথে ঠিকমতো খাটাতে পারি তাহলে নিশ্চিত পুরো বিষয়টা বুঝতে পারবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে দাবা খেলাটা শিখতে হবে। আর সেটা এখনই।”

একটু থেমে আবার বললো, “তুমি এ কথাটা শুনেছো, সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ’?”।

“হুমম। মনে হয় শুনেছি, তবে ধরতে পারছি না। কে বলেছে?”

“আঁদ্রে ফিলিদোর, আধুনিক দাবার পিতা বলা হয় তাকে। ফরাসি বিপ্লব সময়কালে দাবার উপর একটা বই লিখেছিলেন তিনি। ঐ বইতে ব্যাখ্যা করেছিলেন সৈন্যের দল একত্রে মিলে যেকোনো শক্তিশালী খুঁটির মতোই ক্ষমতাবান হতে পারে। তার আগে কেউ এটা ভাবে নি। শক্তিশালী খুঁটিগুলোর পথ করে দেয়ার জন্য সৈন্যদেরকে বলি দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো।

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো, আমরা দু’জন হলাম সেই সৈন্য, যারা একদিন এই রহস্যের সমাধান করবে?” এই আইডিয়াটা অদ্ভুত মনে হলেও আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো।

“না,” ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো লিলি। “আমি বলতে চাচ্ছি সৈন্যবাহিনীতে আমাদের যোগ দেবার সময় এসে গেছে এখন।”

আমরা একে অন্যের সাথে হাত মেলালাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *