দ্য এইট – ক্যাথারিন নেভিল
অনবাদ : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ২০১১
[হাজার বছর ধরে এক বিস্ময়কর সিক্রেট ফর্মুলা লুকিয়ে রাখা হয়েছে শার্লেমেইনের কিংবদন্তীতুল্য দাবাবোর্ডে। প্রকৃতির নিয়মকে পাল্টে দেবার ক্ষমতা রাখে এটি-যেমন শক্তিশালী তেমনি বিপজ্জনক। দার্শনিক রুশো, ভলতেয়ার, আইজ্যাক নিউটন, ক্যাথারিন দি গ্রেট, গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি, পিথাগোরাস, সঙ্গিতজ্ঞ বাখ, রিশেলু আর ফরাসি সম্রাট নেপোলিওন বোনাপার্তসহ ইতিহাসের অসংখ্য মহানব্যক্তিত্ব এই ফর্মলার খোঁজে ছিলেন। ফর্মুলাটি করায়ত্ত করতে ফরাসি বিপ্লব আর আধুনিক সময়কালে সমান্তরালভাবে ঘটে চলেছে দুটো ঘটনা। সেই দুটো ঘটনা একবিন্দুতে এসে মিলিত হয় অভাবনীয় রোমাঞ্চ আর গোলোকধাঁধাতুল্য অ্যাডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে। যারা ড্যান ব্রাউন-এর দুনিয়া কাঁপানো থৃলার ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছেন তাদের জন্যে ক্যাথারিন নেভিল-এর বহুস্তরবিশিষ্ট সিক্রেট আর পাজলের সমম্বয়ে গড়া বিশাল ক্যানভাসের ‘দ্য এইট’ অবশ্যইঠ্য।]
.
ক্যাথারিন নেভিল ১৯৪৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কলেজ শেষ করে নিউইয়র্কে চলে আসেন একজন কম্পিউটার এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করার জন্য। এছাড়াও পেইন্টার এবং ফটোগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। পরবর্তীকালে ‘দ্য এইট’ বইটি লিখে পরিণত হয়ে ওঠেন থৃলার সাহিত্যের অসাধারণ এক লেখকে। তার এই বইটি অন্যান্য থৃলার লেখকদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে। শুরু হয় পাজল-রহস্য আর সিক্রেট সোসাইটি নিয়ে থৃলার লেখার হিড়িক। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০০৮ সালে ‘দ্য এইট’-এর সিকুয়েল ‘ফায়ার’ বের করেন তিনি। প্রায় সমগ্র আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন, থেকেছেন বহু রাজ্যে। সত্তুরের দশকে আলজেরিয়ান সরকারের জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কনসালটেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। তবে আশির দশকে সানফ্রান্সিসকোতে ফিরে এসে ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটনের ভার্জিনিয়াতে বসবাস করছেন এবং শুরু করেছেন পেইন্টিংয়ের উপর একটি থৃলার লেখার কাজ।
.
দাবা হলো জীবন।–ববি ফিশার
জীবন এক ধরণের দাবা।–বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন
ডিফেন্স
দু’ধরণের চরিত্র আছে–একদল অম্বেষণপ্রিয় আরেকদল এর বিরুদ্ধে। যারা অম্বেষণপ্রিয় তারা অভাবনীয় কিছু লাভ করে; আর যারা এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা কাপুরুষ এবং খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এভাবে প্রতিটি সাধারণ মানুষই…দাবাখেলার সাদা-কালো খুঁটির মতো বিরুদ্ধ নৈতিকতার হয়ে থাকে।
–অ্যানাটমি অব ক্রিটিসিজম
নরথ্রোপ ফ্রাইয়ে
.
মন্তগ্লেইন অ্যাবি, ফ্রান্স
১৭৯০ সালের বসন্তকাল
একদল নান রাস্তা পার হচ্ছে, তাদের মাথার ঘোমটা গাংচিলের মতো উড়ছে প্রবল বাতাসে। শহরের বিশাল পাথুরে প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তাদের পথ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত মোরগ-মুরগি আর হাঁসের দল কাদার মধ্য দিয়ে যে যেদিকে পারলো সরে গেলো। প্রতি সকালে উপত্যকা ঢেকে দেয়া ঘন কুয়াশা ভেদ করে নিঃশব্দে চলে গেলো তারা। সামনে পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঘণ্টা ধ্বনি বাজছে নানের দলটি সেদিকেই এগিয়ে গেলো ধীরে ধীরে।
এই বসন্তকালকে তারা প্রিম্পটেস্পস স্যাঙ্গলান্ট বলে অভিহিত করছে, অর্থাৎ রক্তঝরা বসন্ত। পাহাড়ের চূড়া থেকে বরফ গলার অনেক আগেই এ বছর চেরি গাছে ফুল ধরে যায়। লাল টকটকে চেরির ভারে নাজুক ডালপালা মাটি ছুঁয়ে ফেলেছিলো। অনেকে বলছিলো, আগেভাগে চেরিফল আসা নাকি ভালো কিছু ঘটার লক্ষণ। দীর্ঘ আর অসহনীয় শীতের পরে পুণজন্মের একটি প্রতীক। কিন্তু তারপরই এলো সুতীব্র হিমশীতল বৃষ্টি, ডালে থাকা লাল চেরি ফল জমে বরফ হয়ে গেলো, অনেকটা ক্ষতস্থান থেকে বের হওয়া জমাটবাধা রক্তের মতো। এটাকেও আরেকটা ঘটনার অশনি সংকেত বলে ভাবা হলো তখন।
উপত্যকার উপরে মন্তগ্লেইন অ্যাবিটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দূর্গতুল্য স্থাপনাটি হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষা পেয়ে গেছে বহিশক্তির হাত থেকে। পর পর ছয় স্তরের দেয়ালের উপর ভিত্তি করে এটা গড়ে উঠেছে। পুরনো পাথরের দেয়াল শত শত বছর পর ক্ষয়ে গেলে তার উপর নতুন দেয়াল তৈরি করা হয়েছিলো। সেইসব দেয়াল ঠেকনা দেয়ার জন্যে বড় বড় পিলার নির্মাণ করা হয়। ফলে স্থাপনাটির যে দশা হয় সেটা অনেক গুজবের জন্ম দেয়। এই অ্যাবিটা ফ্রান্সের সবচাইতে পুরনো চার্চ যা একটি প্রাচীন অভিশাপ বহন করে যাচ্ছে আর সেই অভিশাপটি খুব শীঘ্রই জেগে উঠবে। বিশাল ঘণ্টা বাজছে, বাকি নানেরা একে অন্যের দিকে তাকালো, তারপর সারি সারি চেরিগাছের মাঝখান দিয়ে যে পথ চলে গেছে অ্যাবির দিকে সেটা ধরে এগোতে শুরু করলো তারা।
দীর্ঘ দলটির পেছনে আছে দু’জন শিক্ষানবীশ ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে, তারা হাতে হাত ধরে কর্দমাক্ত বুট জুতা পরে এগিয়ে যাচ্ছে। নানদের সুশৃঙ্খল সারিতে তারা দু’জন একেবারেই বেমানান। লম্বা, লালচুল, দীর্ঘ পদযুগল আর চওড়া কাঁধের মিরিয়েকে দেখে নান বলে মনে হয় না, মনে হয় কোনো কৃষককন্যা। নানের আলখেল্লার উপর বেশ ভারি একটা বুচার অ্যাপ্রোন পরে আছে সে, মাথায় যে টুপিটা পরেছে সেটার কানায় ঝুলছে লাল টকটকে লেস। তার পাশে থাকা ভ্যালেন্টাইন তার মতো লম্বা হলেও স্বাস্থ্য বেশ ভঙ্গুর। তার গায়ের চামড়া একেবারে ফ্যাকাশে সাদা, সেই ফ্যাকাশে রঙটা আরো বেশি প্রকট করে তুলেছে কাঁধ অবধি নেমে আসা ধবধবে সাদা চুল। মাথার টুপিটা সে আলখেল্লার পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। একান্ত অনিচ্ছায় মিরিয়ের পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, পায়ের বুট দিয়ে বার বার লাথি মারছে কাদায়।
অ্যাবির সবচাইতে অল্পবয়সী এই দুই নান একে অন্যের খালাতো বোন। তারা দুজনেই খুব অল্প বয়স থেকে এতিম, ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগের মহামারিতে ফ্রান্স যখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো তখন এদের বাপ-মা মারা যায়। তাদের বৃদ্ধ নানা কাউন্ট দ্য রেমি চার্চের হাতে এদেরকে তুলে দেন। তার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া এস্টেটের সহায়-সম্পত্তির আয় থেকে এ দু’জনের ভরণপোষণের ব্যয় মেটানো হয়।
দু’জনের এই অভিন্ন প্রেক্ষাপট তাদেরকে একে অন্যের কাছ থেকে অবিচ্ছেদ্য করে রেখেছে। যৌবনের সীমাহীন উদ্দামতায় তারা পরাভূত। অ্যাবিসের কাছে বৃদ্ধ নানেরা প্রায়শই অভিযোগ করে, দিনকে দিন এই মেয়ে দুটোর আচার আচরণ মঠ জীবনের সাথে বেখাপ্পা হয়ে উঠছে। কিন্তু অ্যাবিস নিজে একজন মেয়েমানুষ হিসেবে ভালো করেই জানেন, যৌবনের উদ্দামতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার চেয়ে এর লাগাম টেনে ধরাই বেশি ভালো।
তবে এটাও ঠিক, অ্যাবিস এই দুই এতিম তরুণীর প্রতি কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট, তার যে রকম ব্যক্তিত্ব তাতে করে এরকম আচরনকে ব্যতিক্রমই বলা যায়। বুড়ি নানেরা আরেকটা কথা জেনে অবাক হবে যে, অ্যাবিস নিজেও তার যৌবনে এক তরুণীর সাথে এরকম উজ্জ্বল বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু অনেক অনেক বছর আগেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে, বর্তমানে তারা দু’জন প্রায় হাজার মাইলের ব্যবধানে বসবাস করছে।
এখন, তার হাত ধরে অলসভঙ্গিতে হাঁটতে থাকা ভ্যালেন্টাইনকে আলস্য কতো বড় পাপ সে সম্পর্কে লেকচার দিয়ে যাচ্ছে মিরিয়ে।
“তুমি যদি এভাবে শ্লথ গতিতে হাঁটতে থাকে তাহলে রেভারেন্ড মাদার আমাদেরকে আবারো শাস্তি দেবেন,” বললো সে।
ভ্যালেন্টাইন চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো। “বসন্তে সব ভরে উঠেছে, চিৎকার করে কথাটা বলেই দু’হাত শূন্যে দোলাতে লাগলো সে। এটা করতে গিয়ে আরেকটুর জন্যে কাছের গিরিখাদে পড়ে যেতে উদ্যত হলো অবশ্য তার বোন তাকে ধরে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে। বাইরের দুনিয়া যখন ফুলেফলে নতুন জীবনস্পন্দে ভরে উঠছে তখন আমরা কেন ঐ অ্যাবিতে দরজা জানালা বন্ধ করে। থাকি?”
“কারণ আমরা নান,” ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললো মিরিয়ে। শক্ত করে ধরলো ভ্যালেন্টাইনের হাতটা। “আর আমাদের কাজ হলো মানুষের জন্য প্রার্থনা করা।” উপত্যকা থেকে যে উষ্ণ কুয়াশা উঠে আসছে তাতে মিশে আছে চেরি ফলের মিষ্টি ঘ্রাণ। মিরিয়ে এই ঘ্রাণকে আমলে না নেবার চেষ্টা করলো।
“আমরা এখনও নান হই নি, এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “শপথ নেবার আগপর্যন্ত আমরা কেবলই শিক্ষানবীশ। এ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে খুব বেশি দেরি হয়ে যায় নি। আমি বুড়ি নানদেরকে ফিসফাস করে বলতে শুনেছি, ফ্রান্সে নাকি সৈন্যের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব মনাস্টেরির সম্পদ লুট করে নিচ্ছে তারা, পাদ্রীদেরকে হাত বেধে মার্চ করাচ্ছে প্যারিসের পথেঘাটে। হয়তো এখানেও কিছু সৈন্য চলে আসবে, তারা আমাকেও প্যারিসে মার্চ করাবে ওভাবে। প্রতিরাতে অপেরা দেখাতে নিয়ে যাবে আমায়, তারা আমার পায়ের জুতায় করে শ্যাম্পেইন পান করবে!”
“তুমি যেরকম ভাবছো সৈন্যেরা কিন্তু সব সময় ওরকম চার্মিং হয় না, মিরিয়ে বললো। “তাদের কাজ হলো মানুষ হত্যা করা, অপেরায় নিয়ে যাওয়া নয়।”
“সবাই ওরকম হয় না,” ফিসফিস করে কণ্ঠটা নীচে নামিয়ে বললো ভ্যালেন্টাইন। তারা পর্বতের একেবারে শীর্ষে চলে এসেছে, এখানে পথ মোটেই ঢালু নয়, একদম সমতল। এই রাস্তাটি বেশ চওড়া, কাঁকর বিছানো পথ। বড় বড় শহরে যেমনটি দেখা যায়। পথের দু’ধারে বিশাল বিশাল সাইপ্রেস বৃক্ষ। চেরি আর অচাড় গাছ ছাড়িয়ে বহু উপরে উঠে গেছে সেগুলো। দেখতে যেনো নিষ্প্রাণ দৈত্যের মতো লাগছে, অ্যাবিটাও দেখতে অদ্ভুত।
“আমি শুনেছি,” বোনের কানে কানে ফিসফিস করে বললো ভ্যালেন্টাইন, “সৈন্যেরা নাকি নানদের সাথে ভয়ঙ্কর সব কাজ করে। কোনো সৈন্য যদি বনেবাদারে কোনো নানকে একা পেয়ে যায় তাহলে নাকি প্যান্ট খুলে কী একটা জিনিস বের করে নানের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য, এরপরই নানের পেটে বাচ্চা এসে যায়!”
“কী জঘন্য কথা! এটা তো রাসফেমি!” ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে বললো মিরিয়ে, তার ঠোঁটে যে চাপা হাসি ফুটে উঠেছে সেটা আড়াল করার চেষ্টা করলো সে। “তোমার এরকম সাহসী কথাবাতা নান হবার পক্ষে একদম বেমানান।”
“ঠিক বলেছো, এতোক্ষণ ধরে তো আমি এটাই বলে আসছিলাম,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “আমি জিওর বউ হবার চেয়ে একজন সৈন্যের বউ হতেই বেশি আগ্রহী।
অ্যাবির দিকে এগোতেই দুই বোনের চোখে পড়লো সারি সারি সাইপ্রেস বৃক্ষের মাধ্যমে তৈরি করা কুসিফিক্সের আদলটা। কালচে কুয়াশা ভেদ করে তারা অ্যাবির প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়লো। মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বিশাল কাঠের দরজার সামনে চলে এলো তারা, তখনও ঘণ্টা বেজে চলছে। যেনো ভারি ঘন কুয়াশ ভেদ করে মৃত্যুর বারতা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
তারা দু’জনেই দরজার কাছে এসে পায়ের বুট জুতা থেকে কাদা মুছে নিয়ে বুকে ক্রুস আঁকলো দ্রুত। তারপর প্রবেশদ্বারের উপরে যে খোদাই করা লেখাটা আছে সেটার দিকে না তাকিয়েই ঢুকে পড়লো ভেতরে। তবে তারা দুজনেই জানে সেই লেখাটা কী বলছে। এটা তাদের হৃদয়ে খোদাই করে লেখা হয়ে আছে যেনো :
এখানকার দেয়াল যারা মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দেবে তারা অভিশপ্ত হবে রাজা চেক হবে শুধুমাত্র ঈশ্বরের হাতে।
এই বাণীটার নীচে একটা নাম বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা আছে, কারোলাস ম্যাগনাস।
ইনি হলেন এই অ্যাবির স্থপতি, যারা এই স্থাপনা ধ্বংস করবে তাদের জন্যে সতর্কবার্তা এটি। প্রায় হাজার বছর আগে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যের মহান অধিপতি ছিলেন তিনি, শার্লেমেইন নামেই যিনি সবার কাছে পরিচিত।
.
অ্যাবির ভেতরকার দেয়ালগুলো কালো, শীতল আর আদ্র। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে ভেতরের স্যাঙ্কটাম থেকে শিক্ষানবীশ নানেরা প্রার্থনা করছে। মিরিয়ে এবং ভ্যালেন্টাইন দ্রুত নানদের দলের সাথে ঢুকে পড়লো বেদীর পেছনে থাকা ছোট্ট দরজা দিয়ে, এখানে রেভারেন্ড মাদারের স্টাডিরুম অবস্থিত। বয়স্ক এক নান সবার পেছনে থাকা দুই বোনের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকালেন। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো একসঙ্গে।
এভাবে অ্যাবির স্টাডিতে সবাইকে ডেকে আনাটা অদ্ভুতই বটে। খুব কম নানই এখানে ঢুকতে পারে, আর যারা ঢোকে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তি নেমে আসে। ভ্যালেন্টাইনকে বার কয়েক এই শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। তবে একটু আগে অ্যাবির ঘণ্টাধ্বনি সব নানকে এখানে ডেকে এনেছে জমায়েতের উদ্দেশ্যে। রেভারেন্ড মাদারের স্টাডিতে তাদের সবাইকে নিশ্চয় একসাথে ডেকে আনা হয় নি?
কিন্তু ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে যখন নীচু ছাদের বিশাল কক্ষটাতে প্রবেশ করলো দেখতে পেলো অ্যাবির সব নানই সেখানে উপস্থিত-তাদের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। অ্যাবিসের লেখার যে ডেস্কটা আছে সেটার সামনে কয়েক সারি কাঠের বেঞ্চ, নানেরা সবাই সেই বেঞ্চগুলোতে বসে আছে। এভাবে ডেকে আনার জন্যে নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছে তারা। দুই বোন ভেতরে ঢুকতেই যেসব নান তাদের দিকে তাকালো তাদের মুখে ভীতি ছড়িয়ে আছে। তারা দু’বোন বসলো সবার শেষ বেঞ্চে। ভ্যালেন্টাইন শক্ত করে মিরিয়ের হাতটা ধরে রাখলো।
“এসবের মানে কি?” সে জানতে চাইলো ফিসফিস করে।
“আমার তো ভালো ঠেকছে না,” জবাব দিলো মিরিয়ে। তার কণ্ঠ আরো নীচু। “রেভারেন্ড মাদারকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। তাছাড়া এখানে এমন দু’জন মহিলা আছে যাদেরকে আগে কখনও দেখি নি।”
কক্ষের শেষে অবস্থিত নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ালেন জরাজীর্ণ পার্চমেন্ট কাগজের মতো দেখতে বৃদ্ধ আর ভগ্ন স্বাস্থ্যের রেভারেন্ড মাদার। অবশ্য নিজের কর্তৃত্বের ব্যাপারে তিনি সচেতন। সেজন্যেই ভাবভঙ্গিতে বেশ দৃঢ়তা বজায় রেখে চলেছেন। তার মধ্যে এমন শান্ত আর ধীরস্থির একটা ব্যাপার আছে যে, মনে হতে পারে অনেক বছর আগেই তিনি আত্মার শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। তবে আজ একটু উদ্বিগ্নতা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। এরকমটি কোনো নান কোনোদিন দেখে নি।
তার দু’পাশে বেশ দীর্ঘাঙ্গি আর শক্তসামর্থ্য দুই তরুণী আজরাইলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। একজনের কালো চুল, ফ্যাকাশে গায়ের রঙ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অন্যজন দেখতে ঠিক মিরিয়ের মতো, ক্রিম রঙের গায়ের রঙ আর বাদামী রঙের চুল, মিরিয়ের চেয়ে কিছুটা গাঢ়। তারা দু’জন নান হলেও নানদের পোশাক পরে নেই। তারা পরে আছে সাধারণ কোনো ভ্রমণকারীদের পোশাক।
সব নান নিজেদের আসনে বসার পর দরজা বন্ধ করার আগপর্যন্ত অ্যাবিস কিছু বললেন না। পুরো কক্ষটায় নীরবতা নেমে এলে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন। তার কণ্ঠ শুনে ভ্যালেন্টাইনের কাছে সব সময়ই মনে হয় কোনো পাতার খসখসানি।
“আমার কন্যারা,” বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে বললেন অ্যাবিস। প্রায় হাজার বছর ধরে এই পর্বতের উপর অর্ডার অব মন্তগ্লেইন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মানুষ আর ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত আছে। যদিও আমরা বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি, তারপরেও বাইরের পৃথিবী যে অশান্ত হয়ে উঠছে সে খবর আমাদের অজানা নয়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, আমাদের এই ছোট্ট নিভৃতস্থানে সেই অশান্তির প্রভাব পড়ছে। সেজন্যে এতোদিন ধরে আমরা যে নিরাপত্তা ভোগ করে আসছিলাম তাতে বিরাট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এখন। আমার দু’পাশে যে দু’জন মহিলাকে দেখতে পাচ্ছো তারা এরকম খবরই নিয়ে এসেছে। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি সিস্টার আলেক্সান্দ্রিয়ে ফবোয়া”-কালো চুলের মহিলার দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন তিনি-”এবং ম্যারি-শালোত্তে দ্য কোরদে, তারা দু’জনেই উত্তর প্রভিন্সের কায়েন-এর অ্যাবি-অ-ড্যাম থেকে এসেছে। ফ্রান্সের বিশাল অঞ্চল ঘুরে এসে আমাদেরকে সতর্ক করতে এসেছে তারা। সেজন্যে আমি তোমাদেরকে বলবো তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে। এটা আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাবিস নিজের আসনে বসতেই আলেক্সান্দ্রিয়ে নামের মহিলা গলা খাকারি দিয়ে মৃদু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তার নীচুস্বরের কথা শুনতে নানদের বেগ পেতে হলো তবে মহিলার শব্দচয়ন একেবারেই স্পষ্ট।
“আমার ধর্মবোনেরা, যে গল্পটা এখন বলবো সেটা দূর্বলচিত্তের কারোর জন্যে না শোনাই ভালো। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা মানুষকে রক্ষা করার আশা নিয়ে খৃস্টের কাছে এসেছে, আবার অনেকে এ দুনিয়া থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই এসেছে নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে।” কথাটা বলেই মহিলা জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো ভ্যালেন্টাইনের দিকে,
সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্যাকাশে মুখটা লাল হয়ে গেলো।
“তোমাদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আজ থেকে সেটা বদলে গেছে। আমি আর সিস্টার শালোত্তে সমগ্র ফ্রান্স ঘুরে প্যারিস হয়ে এখানে এসেছি। আমরা দেখেছি ক্ষুধা আর দুর্ভিক্ষ। এক টুকরো রুটির জন্যে লোকজন একে অন্যের সাথে পথেঘাটে মারামারি করছে। রক্তারক্তি ব্যাপার। মহিলারা পাত্রে করে কর্তিত মস্তক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা পর্যন্ত খুনখারাবির হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। লোকজনকে রাস্তার মধ্যে ফেলে নির্যাতন করা হচ্ছে, হিংস্র দরদল তাদেরকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে পৈশাচিক উল্লাসে..” আলেক্সান্দ্রিয়েঁর কাছ থেকে এসব ভয়ঙ্কর গল্প শুনে নানরা আর চুপ থাকতে পারলো না।
মিরিয়ে ভাবলো ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত একজন নারী হিসেবে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কোনোরকম করুণ অভিব্যক্তি প্রকাশ না। করাটা অদ্ভুতই বটে। এটা ঠিক যে, বক্তার কণ্ঠে কোনোরকম কম্পন ছিলো না। ছিলো না কোনো আবেগের বহিপ্রকাশ। ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো মিরিয়ে, তার চোখ দুটোয় খুশির ঝিলিক উপচে পড়ছে। পুরো কক্ষটায় নীরবতা নেমে আসার আগপর্যন্ত আলেক্সান্দ্রিয়ে দ্য ফরবোয়া চুপ করে রইলো।
“এখন এপ্রিল মাস। গত অক্টোবরে এক হিংস্র দস্যু রাজা আর রাণীকে অপহরণ করে ভার্সাই থেকে, তাদেরকে বাধ্য করা হয় প্যারিসের তুইলেরিতে ফিরে যেতে। সেখানে তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রাজা বাধ্য হয়ে সকল মানুষের সম অধিকারের দলিল মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। বর্তমানে কার্যত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিই দেশ চালাচ্ছে। রাজার কোনো ক্ষমতাই নেই। আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা কোনো বিপ্লব নয়, এটা হলো অরাজকতা। অ্যাসেম্বলি জানতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো স্বর্ণ মজুদ নেই। রাজা পুরো দেশটাকে দেউলিয়া করে ফেলেছেন। প্যারিসের লোকজন বিশ্বাস করছে। তিনি আর বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবেন না।”
বেঞ্চে বসা নানেরা আৎকে উঠলো। শুরু হয়ে গেলো ফিসফিসানি। মিরিয়ে শক্ত করে ভ্যালেন্টাইনের হাতটা ধরে রাখলো। তাদের দুজনের চোখ সামনে থাকা বক্তার দিকে নিবদ্ধ। এ কক্ষের মহিলারা কখনও এরকম কথা কানে শোনে নি। এসব কথা তাদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। নির্যাতন, অরাজকতা, রাজা নিধন। এটা কিভাবে সম্ভব?
অ্যাবিস টেবিলের উপর হাত ঠুকে সবাইকে চুপ করতে নির্দেশ দিলে নানেরা চুপ মেরে গেলো। এবার আলেক্সান্দ্রিয়ে আসনে বসে পড়লে কেবল দাঁড়িয়ে রইলো সিস্টার শালোত্তে। তার কণ্ঠ খুবই দৃঢ় আর জোরালো।
“অ্যাসেম্বলিতে একটা শয়তান আছে। ক্ষমতার জন্যে সে লালায়িত, যদিও নিজেকে সে যাজকদের একজন বলেই দাবি করে থাকে। এই লোকটা হলো আঁতুয়ার বিশপ। রোমের চার্চ অবশ্য মনে করে লোকটা শয়তানের পুণর্জন্ম হওয়া পাপাত্মা। বলা হয়ে থাকে শয়তানের চিহ্ন হিসেবে পরিচিত অশ্বখুড় সদৃশ্য পা নিয়ে জন্মেছে লোকটা। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের রক্ত পান করে সে চিরযৌবন পাবার আশায়। ব্ল্যাক মাসের আয়োজন করে এই লোক। অক্টোবর মাসে এই বিশপ অ্যাসেম্বলিতে প্রস্তাব করে চার্চের সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। নভেম্বরের দুই তারিখে তার প্রস্তাবিত বিল অব সিজার অর্থাৎ ‘সম্পত্তি অধিগ্রহণ বিল’ মহান রাষ্ট্রনায়ক মিরাবিউ কর্তৃক সমর্থিত হলে অ্যাসেম্বলিতে পাস হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারির তেরো তারিখ থেকে এই অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। কোনো যাজক এর বিরোধীতা করলে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ষোলো তারিখে অ্যাসেম্বলির সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছে আঁতুয়ার বিশপ। তাকে এখন কেউ থামাতে পারবে না।”
নানের দল চরম উত্তেজনা আর ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। অনেকে প্রতিবাদও করলো এসব কথাবাতার কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো শালোত্তের দৃঢ় জোরালো কণ্ঠ।
“অধিগ্রহণ আইন পাস হবার অনেক আগেই আঁতুয়ার বিশপ ফ্রান্সের সমস্ত চার্চের সহায়-সম্পত্তি কোথায় কিভাবে আছে সেসবের একটি তালিকা তৈরি করে রেখেছিলো। যদিও বিলটাতে নির্দিষ্ট করে বলা আছে সর্বাগ্রে পতন ঘটাতে হবে যাজকদের, নানদেরকে এ ব্যাপারে রেহাই দেয়া হবে, কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি বিশপের কুনজর পড়েছে মন্তগ্লেইন অ্যাবির উপর। এজন্যেই আমরা আপনাদেরকে এসব জানাতে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছি। মন্তগ্লেইনের সম্পদ কোনোভাবেই যেনো ঐ বদমাশটার হাতে না পড়ে।”
অ্যাবিস উঠে দাঁড়িয়ে শালোত্তের কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন সামনে বসা কালো আলখেল্লা পরা নানদের দিকে। তাদের মাথার স্কা একটু দুলে উঠলো একসঙ্গে। অ্যাবিসের ঠোঁটে দেখা গেলো মুচকি হাসি। দীর্ঘদিন তিনি এদের রাখালের ভূমিকা পালন করে এসেছেন, এরা তার ভেড়ারপাল। এখন যে কথাটা তিনি বলবেন সেটা বলার পর তাদের সাথে আর এই জীবনে তার দেখা হবে না। চিরজীবনের জন্যে বিদায় জানাতে হবে সবাইকে।
“এখন তোমরা নিশ্চয় পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে,” বললেন অ্যাবিস। “অবশ্য এসব কথাবার্তা আমি কয়েক মাস আগেই জানতে পেরেছিলাম, তবে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমাদেরকে এ কথা বলে ঘাবড়ে দিতে চাই নি। আমার অনুরোধেই কায়েন-এর এই দুই সিস্টার আমাকে নিশ্চিত করেছে, আমার আশংকাই সত্যি।” নানের দল এবার মৃতলাশের মতো নিপ হয়ে পড়লো। অ্যাবিসের কণ্ঠ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না পুরো কক্ষে। “আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, হয়তো খুব শীঘ্রই ঈশ্বর আমাকে তার কাছে ডেকে নেবেন। এই কনভেন্টে প্রবেশ করার সময় আমি যে শপথ নিয়েছিলাম সেটা কেবল ঈশ্বরের প্রতি ছিলো না। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, এই কনভেন্টের অ্যাবিস হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সময় আমাকে আরেকটা শপথ নিতে হয়েছিলো-একটা সিক্রেট রক্ষা করার শপথ। নিজের জীবন দিয়ে হলেও সেটা রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। এখন সময় এসেছে সেই শপথ রক্ষা করার। তবে সেটা করার আগে আমি তোমাদের প্রত্যেককে সিক্রেটটার কিছু অংশ বলবো। সেইসাথে এও বলবো তোমরা জীবন দিয়ে হলেও এটা গোপন রাখবে। আমার গল্পটা অনেক দীর্ঘ, আশা করি ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না কারোর। গল্পটা বলা শেষ হলে তোমরা প্রত্যেকেই জেনে যাবে কেন আমাদের এ কাজটা করতে হবে।”
অ্যাবিস একটু থেমে টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক ঢোক পান করে নিলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন আবার।
“আজ ১৭৯০ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসের চার তারিখ। আমার গল্পটা অনেক অনেক বছর আগের এই এপ্রিলের চার তারিখেই শুরু হয়েছিলো। গল্পটা আমাকে পূর্বসূরীরা বলে গেছেন আমার অ্যাবিস হওয়ার প্রক্কালে, তাদেরকে আবার বলে গেছেন তাদের পূর্বসূরীরা। এভাবেই এটা চলে আসছে। এখন আমি তোমাদেরকে সেটা বলছি…”
অ্যাবিসের গল্প
৭৮২ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসের চার তারিখে আচেনের ওরিয়েন্টাল প্রাসাদে এক জমকালো উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মহান রাজা শার্লেমেইনের চল্লিশতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে। তিনি তার রাজ্যের সমস্ত গন্যমান্য আর জ্ঞানীদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেন্ট্রাল রাজসভা আর পেঁচানো সিঁড়িতে রঙবেরঙের ফেস্টুন আর ফুলে সাজানো হয়। স্বর্ণ-রূপার লণ্ঠনের আলোতে বাদকের দল বাজনা বাজাতে ব্যস্ত। উপস্থিত সভাসদেরা বাহারি পোশাকে সজ্জিত। পাপেট শোয়েরও ব্যবস্থা ছিলো সেখানে। বন্য ভালুক, সিংহ, জিরাফ আর খাঁচায় ভরে ঘুঘু আনা হয়। রাজসভায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজার জন্মদিন পালন করা হয় আনন্দমুখর পরিবেশে।
আসল উৎসবটি ছিলো রাজার জন্মদিনের দিন। সেদিন সকালে রাজা তার আঠারো জন সন্তানসন্ততি, রাণী আর সভাসদদের নিয়ে হাজির হন রাজসভায়। শার্লেমেইন বেশ লম্বা ছিলেন, অনেকটা অশ্বারোহী আর সাঁতারুদের মতো। হালকাঁপাতলা গড়নের অধিকারী। তার গায়ে রঙ ছিলো রোদে পোড়া, চুল সোনালী রঙের, চমৎকার গোঁফও ছিলো মুখে। এ বিশ্বের সবচাইতে বৃহৎ সাম্রাজ্যের যোগ্য রাজা আর মহান যোদ্ধার মতোই দেখাতো তাকে।
এই দিনটিতে রাজা বিশেষ এক আয়োজন রেখেছিলেন। রণকৌশলের একজন মাস্টার হিসেবে একটা খেলার প্রতি তার ছিলো প্রচণ্ড আসক্তি। যুদ্ধ আর রাজাদের খেলা হিসেবে সেটা পরিচিত, আর সেই খেলাটা হলো দাবা। নিজের চল্লিশতম জন্মদিনে তার রাজ্যের সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়ের সাথে খেলার আয়োজন করেন তিনি। সেই খেলোয়াড়টি ছিলো গরিয়াঁ দি ফ্রাঙ্ক নামের এক সৈনিক।
চারপাশে ট্রাম্পেটের বাজনার সাথে সাথে গরিয়াঁ প্রবেশ করে রাজসভায়। অ্যাক্রোবেটরা তার সামনে ডিগবাজি খেতে থাকে, মহিলারা তার পায়ের নীচে বিছিয়ে দেয় পাম গাছের পাতা আর গোলাপের পাপড়ি। গরিয়াঁ ছিলো বেশ শক্তসামর্থ, গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। বয়সে বেশ তরুণ। চোখ দুটো গভীর আর ধূসর বর্ণের। পশ্চিমাঞ্চলের সেনাবাহিনীতে ছিলো সে। রাজা যখন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উঠে দাঁড়ালেন তখন সেও হাটু মুড়ে রাজাকে সম্ভাষণ জানায়।
দাবার বোর্ডটি আটজন কৃষ্ণাঙ্গ মুর দাস কাঁধে করে বিশাল এক হলরুম। থেকে নিয়ে আসে। এইসব দাস আর দাবাবোর্ডটি চার বছর আগে পিরেনিজ বাস্কদের সাথে যুদ্ধের সময় সাহায্য করার জন্যে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন স্পেনের বার্সেলোনার মুসলিম শাসক ইবনে আল আরাবি। তবে এরপর রাজার প্রাণপ্রিয় সৈনিক, চাসোয়া দ্য রোল্যা নাভায়েরের যুদ্ধে নিহত হবার পর থেকে অসুখি শার্লেমেইন আর দাবা খেলেন নি, এমনকি জনসম্মুখে দাবাবোর্ডটিও প্রদর্শন করা হয় নি।
রাজসভার বিশাল টেবিলের উপর দাবাবোর্ডটি এনে রাখার পর উপস্থিত সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আরবিয় কারুশিল্পীরা এটা নির্মাণ করলেও দাবার খুঁটিগুলোতে ভারতীয় আর পারস্য ঐতিহ্য বহাল ছিলো। অনেকেই বিশ্বাস করে এই দাবা খেলাটি জিশুর জন্মেরও চারশ’ বছর আগে ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়। ভারতীয়দের কাছ থেকে পারস্যবাসীর কাছে খেলাটি প্রচলন হয়। আর আরবরা ৬৪০ খৃস্টাব্দে পারস্য জয় করলে তখন থেকে সেটা তাদের ঐতিহ্যে চলে আসে।
দাবাবোর্ডটি সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি করা, প্রতিটি দিক এক মিটার করে দীর্ঘ। দাবার ঘুটিগুলো মূল্যবান ধাতুতে তৈরি, আর তাতে খচিত মহামূল্যবান হীরা-জহরত। পালিশ করা রত্মগুলোর একেকটার আকার মুরগীর ডিমের মতো। রাজসভার উজ্জ্বল বাতির আলোয় ঝিকিমিকি করছিলো সেগুলো। মনে হচ্ছিলো ওগুলো ভেতর থেকে আলো উদগীরিত করছে আর মোহাবিষ্ট করে রেখেছে উপস্থিত সবাইকে।
দাবার যে খুঁটিটাকে শাহ্ অর্থাৎ রাজা বলে সেটা লম্বায় পনেরো সেন্টিমিটার, মাথায় মুকুট পরিহিত এক রাজা হাতির পিঠে সওয়ার হওয়ার একটি চমৎকার ভাস্কর্যের আকৃতির। ফার্জ অর্থাৎ রাণী খুঁটিটি সিংহাসনে বসা মুকুট পরা রাণী। বিশপগুলো হাতির অবয়বের। নাইটগুলো উদ্দাম আরবিয় ঘোড়া। রুকগুলো পিঠে আসন বসানো উটের আকৃতি। পন অর্থাৎ সৈন্যগুলো সাত সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পদাতিক সৈন্য। তাদের চোখ আর তলোয়াড় থেকে ছোটো ছোটো জহরত চিক চিক করছে।
দু’পাশ থেকে শার্লেমেইন আর গরিয়াঁ দাবাবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর রাজা হাত তুলে এমন একটা কথা উচ্চারণ করলেন যা শুনে বিস্মিত হলো উপস্থিত সভাসদেরা। তারা তাকে ভালো করেই চেনে, এরকম কথা বলার লোক তিনি নন।
“আমি একটা বাজি ধরতে চাই,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললেন তিনি। শার্ল জুয়া বেলার লোক ছিলেন না। সভাসদেরা একে অন্যের দিকে তাকাতে শুরু করলো।
“আমার সৈনিক গরিয়াঁ যদি আমার সাথে জিতে যায় তাহলে আমি তাকে আমার রাজ্যের আচেন আর বাস্ক পিরেনিজ অঞ্চলটি দান করে দেবো, সেই সাথে তার বিয়ে দেবো আমার বড় মেয়ের সাথে। আর সে যদি হেরে যায় তাহলে ভোরবেলায় তার গর্দান কাটা হবে এই রাজসভায়।
পুরো রাজসভায় ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। সবাই জানতো রাজা তার মেয়েদের এতোটাই ভালোবাসেন যে তিনি চান তারা যেন তার জীবিত অবস্থায় বিয়ে না করে।
রাজার সবচাইতে প্রিয়বন্ধু বারগুন্ডির ডিউক এগিয়ে এসে রাজার একহাত ধরে তাকে একটু পাশে নিয়ে গেলেন। “এটা কি ধরণের বাজি?” নীচুকণ্ঠে বললেন তিনি। “আপনি দেখছি মাতাল আর অসভ্য-বর্বরদের মতো বাজির কথা। বলছেন?”
শার্ল টেবিলে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হলো তিনি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছেন। ডিউকও মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলো না। গরিয়াঁ নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত। রাজা ডিউকের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর কোনো কথা না। বলেই খেলা শুরু করে দিলেন। গরিয়াঁ বেছে নিলো সাদা ঘুটি। প্রথম চাল দিলেন রাজা। শুরু হয়ে গেলো খেলা।
সম্ভবত পরিস্থিতির উত্তেজনার কারণেও হতে পারে, তবে খেলাটা যতোই এগোতে লাগলো মনে হলো দু’জন খেলোয়াড় যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে দাবার খুঁটি চাল দিচ্ছে, এক অদৃশ্য হাত যেনো ভেসে বেড়াচ্ছে বোর্ডের উপরে। একটা সময় এমনও মনে হলো দাবার খুঁটিগুলো যেনো নিজে থেকেই জায়গা বদল করছে। খেলোয়াড় দু’জন নিশ্চুপ আর ফ্যাকাশে হয়ে বসে রইলো, হতভম্ব হয়ে পড়লো সভাসদেরা।
এক ঘণ্টা খেলা চলার পর বারগুভির ডিউক লক্ষ্য করলেন রাজা অদ্ভুত আচরণ করছেন। তার ভুরু কুচকে আছে, দেখে মনে হচ্ছে একেবারেই উদভ্রান্ত। গরিয়াঁ নিজেও এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে আছে। চালচলনে অযথাই এক ধরণের অস্থিরতা আর কাঁপাকাপি দেখা গেলো। তার কপাল বেয়ে শীতল ঘাম ঝরে পড়ছে। দু’জন খেলোয়াড়ের চোখই দাবাবোর্ডে নিবদ্ধ, যেনো তারা অন্য দিকে তাকাতে পারছে না।
আচমকা চিৎকার করে রাজা উঠে দাঁড়ালেন, দাবাবোর্ডের খুঁটি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন মেঝেতে। বৃত্তাকারে ঘিরে থাকা সভাসদেরা রাজাকে পথ করে দেয়ার জন্যে একটু সরে গেলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের মাথার চুল হাত দিয়ে খামচে ধরে উন্মাদ কোনো পশুর মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেলেন তিনি। গরিয়াঁ আর বারগুন্ডির ডিউক রাজার কাছে ছুটে যেতেই তিনি ধাক্কা মেরে তাদের দুজনকে সরিয়ে দিলেন। ছয়জন সভাসদ ছুটে এসে রাজাকে নিবৃত্ত করলো অবশেষে। রাজা ধাতস্থ হবার পর এমনভাবে মুখ তুলে তাকালেন। যেনো এইমাত্র লম্বা একটা ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন।
“মাই লর্ড, নরম কণ্ঠে বললো গরিয়াঁ। মেঝে থেকে দাবার খুঁটিগুলো তুলে রাজার হাতে দিলো সে। “আমাদেরকে খেলা বাতিল করতে হবে মনে হচ্ছে। কোন্ খুঁটি কোথায় ছিলো সেটা তো আমার মনে নেই। আমি এই দাবার বোর্ডটাকে ভয় পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস এটার মধ্যে অশুভ শক্তি আছে, এজন্যেই। আপনি আমার জীবন নিয়ে এমন বাজি ধরতে বাধ্য হয়েছেন।”
শার্লেমেইন একটা চেয়ারে আরাম করে বসলেন, এক হাত কপালে রাখলেও কিছু বললেন না।
“গরিয়াঁ,” সতকর্তার সাথে বললেন বারগুডির ডিউক, “তুমি ভালো করেই জানো আমাদের রাজা এ ধরণের কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। উনার কাছে এগুলো প্যাগান আর বর্বরদের চিন্তাভাবনা। জাদুটোনা আর ভাগ্যগণনা এই রাজসভায় তিনিই নিষিদ্ধ করেছেন—”
কথার মাঝখানে শার্লেমেইন মুখ খুললেও তার কণ্ঠ ভঙ্গুর আর ক্লান্ত শোনালো। “আমার নিজের সৈনিকেরাই যেখানে এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করে সেখানে আমি কি করে খৃস্টিয় আলোকবর্তিকা ইউরোপে ছড়িয়ে দেবো?”
“প্রাচীনকাল হতেই এই জাদু আরব থেকে শুরু করে সমগ্র প্রাচ্যে চর্চা করা। হচ্ছে,” বললো গরিয়াঁ। “না আমি এসবে বিশ্বাস করি, না আমি নিজে এগুলো বুঝি। কিন্তু” গরিয়াঁ হাটু মুড়ে রাজার মুখের দিকে তাকালো। “-আপনি নিজে এটা অনুভব করেছেন।”
“আমাকে যেনো আগুনের হলকা গিলে ফেলেছিলো, শার্লেমেইন স্বীকার করলেন। “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করছে। আমি আসলে বোঝাতে পারবো না ব্যাপারটা।”
“কিন্তু স্বর্গ-মতের মধ্যে যা কিছু ঘটে তার একটা কারণ থাকে,” গরিয়াঁর পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো দাবাবোর্ড বয়ে আনা আটজন কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসদের একজনকে। মাথা নেড়ে কৃতদাসকে কথা বলতে ইশারা করলেন রাজা।
“আমাদের দেশে এক ধরণের লোক আছে, যাদেরকে আমরা বাদাওয়ি বলে ডাকি, মানে মরুভূমির বেদুইন। ঐসব লোকের মধ্যে রক্ত নিয়ে বাজি ধরাটাকে সবচাইতে সম্মানের বলে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে একমাত্র রক্ত-বাজিই মানবমনের কালো পর্দা হাব’ দূর করতে পারে। জিব্রাইল ফেরেশতা এই কালো পর্দাই মুহাম্মদের বুক থেকে অপসারিত করেছিলো। মহামান্য রাজা দাবা খেলায় একজন মানুষের জীবন নিয়ে রক্ত-বাজি ধরেছেন, এটা ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম প্রকাশ। মুহাম্মদ বলেছেন, কোনো সাম্রাজ্য কুফরি, নাস্তিকতা সহ্য করতে পারে কিন্তু জুলুম সহ্য করতে পারে না। এটা হলো অবিচার।”
“জীবন নিয়ে বাজি ধরাটা সব সময়ই শয়তানি কাজ, শার্লেমেইন বললেন। গরিয়াঁ এবং বারগুভির ডিউক অবাক হয়ে তাকালো রাজার দিকে। তিনি নিজেই
তো একটু আগে এ কাজ করেছেন, করেন নি?
“না!” কৃতদাস দৃঢ়তার সাথে বললো। “রক্ত-বাজির মাধ্যমেই বেহেস্ত লাভ করা সম্ভব। কেউ যদি শতরঞ্জ নিয়ে এরকম বাজি ধরে তাহলে শতরঞ্জ নিজেই সার’ বাস্তবায়ন করে!”
“দাবাকে এইসব আরবিয় কৃতদাস শতরঞ্জ বলে, মাই লর্ড,” গরিয়াঁ বললো।
“আর সার’?” শার্লেমেইন জানতে চাইলেন। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে ঘিরে থাকা সবার দিকে তাকালেন তিনি।
“এটা হলো প্রতিশোধ, নির্বিকারভাবে জবাব দিলো কৃতদাস। রাজাকে কুর্ণিশ করে পিছু হটলো সে।
“আমরা আবারো খেলবো,” রাজা ঘোষণা দিলেন। এবার কোনো বাজি ধরে খেলা হবে না। শুধুমাত্র খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে খেলবো। বর্বর আর ছেলেমানুষের মতো কোনো কুসংস্কারে বশবর্তী হয়ে খেলা হবে না।” সভাসদেরা পুণরায় দাবাবোর্ডে খুঁটি সাজাতে শুরু করলো। এক ধরণের স্বস্তি নেমে এলো পুরো কক্ষে। বারগুডির ডিউকের দিকে ফিরে তার হাতটা ধরলেন রাজা।
“আমি কি সত্যি ওরকম কোনো বাজি ধরেছিলাম?” আস্তে করে বললেন তিনি।
অবাক হলেন ডিউক। “হ্যাঁ, মাই লর্ড। আপনি কি মনে করতে পারছেন না?”
“না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দিলেন রাজা।
শার্লেমেইন আর গরিয়াঁ আবারো খেলতে বসলো। অসাধারণ এক যুদ্ধের পর বিজয়ী হলো গরিয়াঁ। রাজা বাস্ক-পিরেনিজের মন্তগ্লেইন রাজ্যটির মালিকানা দিয়ে গরিয়াঁ দ্য মন্তগ্লেইন উপাধিতে ভূষিত করলেন তাকে। দাবা খেলায় গরিয়াঁর অসাধারণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে তার সদ্য অর্জিত রাজ্য সুরক্ষিত করার জন্য একটি দূর্গ নির্মাণ করতে বললেন। অনেক বছর পর গরিয়াঁর কাছে রাজা মহামূল্যবান একটি উপহার পাঠান। যে দাবাবোর্ডে তারা বিখ্যাত খেলাটি
খেলেছিলো সেটি দিয়ে দেয়া হয় গরিয়াঁকে। এরপর থেকে এটাকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস নামে ডাকা হতে থাকে।
.
“এই হলো মন্তগ্লেইন অ্যাবির গল্প, নিজের গল্পটা শেষ করে অ্যাবিস বললেন। নিশ্চুপ বসে থাকা নানদের দিকে তাকালেন তিনি। “অনেক বছর পর গরিয়াঁ দ্য মন্তগ্লেইন যখন মৃত্যুশয্যায় উপনীত হলো তখন সে দূর্গসহ পুরো সম্পত্তিটা চার্চকে দান করে দেয়। এরফলে দূর্গটি হয়ে ওঠে একটি অ্যাবি, যা এখন আমরা ব্যবহার করছি। সেইসাথে চার্চের কাছে চলে আসে মন্তগ্লেইন সার্ভিস নামে পরিচিত দাবাবোর্ডটি।”
একটু থামলেন অ্যাবিস, যেনো এরপরের কথাগুলো কিভাবে বলবেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না। অবশেষে বলতে আরম্ভ করলেন তিনি।
“তবে গরিয়াঁ সব সময়ই বিশ্বাস করতো এই মন্তগ্লেইন সার্ভিসটায় রয়েছে ভয়ঙ্কর এক অভিশাপ। দাবাবোর্ডটি তার হাতে আসার অনেক আগে থেকেই। গুজব শুনেছিলো এটাতে নাকি শয়তানের আছর আছে। বলা হয়ে থাকে, চ্যারিয়ট নামের শার্লেমেইনের এক ভাতিজা এই দাবাবোর্ডে খেলার সময় নিহত হয়েছিলো। এই দাবাবোর্ডে খেলার সময় নাকি অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে-যুদ্ধ বিগ্রহ আর রক্তপাতের মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা।
“বার্সেলোনা থেকে শার্লেমেইনের কাছে এই দাবাবোর্ডটি যে আটজন কৃষ্ণাঙ্গ দাস বয়ে নিয়ে এসেছিলো তারা অনেক অনুনয় করেছিলো মন্তগ্লেইনে ওটা স্থানান্তরের সময় যেনো তাদেরকেও ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজা তাই। করেছিলেন। কিন্তু গরিয়াঁ কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারলো রাতের বেলায় দুর্গে। রহস্যময় আচার পালন করা হয়। আর কাজটি করে ঐসব কৃতদাসেরা। গরিয়াঁ তার উপহারটি নিয়ে ভয় পেতে শুরু করলো, যেনো এটা শয়তানের কোনো হাতিয়ার। দূর্গের ভেতরে সার্ভিসটাকে মাটি চাপা দিয়ে রেখে দিলো সে। শার্লেমেইনকে অনুরোধ করলো দেয়ালে যেনো একটা অভিশাপ বাণী লিখে রাখা। হয় যাতে করে জিনিসটা কেউ সরাতে না পারে। রাজার কাছে অনুরোধটি হাস্যকর শোনালেও তিনি গরিয়াঁর কথামতো কাজ করলেন। এভাবেই আমাদের। অ্যাবির দরজার উপরে যে বাণীটা আছে সেটা আমরা পেয়ে যাই।”
অ্যাবিস থেমে গেলে তাকে দেখে মনে হলো অনেক বেশি ক্লান্ত আর ফ্যাকাশে, নিজের চেয়ারে বসতে গেলে আলেক্সান্দ্রিয়ে উঠে তাকে সাহায্য করলেন।
“মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কি হবে, রেভারেন্ড মাদার?” সামনের বেঞ্চে বসা এক বৃদ্ধ নান জানতে চাইলো।
অ্যাবিস হেসে ফেললেন। “আমি তোমাদেরকে ইতিমধ্যেই বলেছি এই অ্যাবিতে থাকলে বিরাট বিপদে পড়তে হবে। ফ্রান্সের সৈন্যেরা চার্চের সম্পত্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। আমি তো বলেছিই, এখানে মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে মহামূল্যবান একটি জিনিস, সম্ভবত সেই জিনিসটা অশুভশক্তিও হতে পারে। এখানে অ্যাবিস হিসেবে ঢোকার সময় আমাকে জানানো হয়েছিলো ঠিক কোথায় দাবার প্রতিটি অংশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এখন শুধুমাত্র আমিই এই সিক্রেটটা জানি। আমাদের মিশন হলো শয়তানের অস্ত্রটা যথা সম্ভব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া যাতে করে পুরো জিনিসটা কখনও ক্ষমতালোভী কারোর হস্তগত না হয়। এই জিনিসটার রয়েছে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা, প্রকৃতির নিয়মকানুন এর কাছে অসহায়।
“তবে এই জিনিসগুলো ধ্বংস করার মতো সময় যদি আমাদের হাতে। থাকেও তারপরেও আমি সে কাজ করবো না। এরকম মহাক্ষমতাধর জিনিস ভালো কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। এজন্যে আমাকে শুধু মন্তগ্লেইন সার্ভিসের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যে শপথ করানো হয় নি, একে রক্ষা করার শপথও। করানো হয়েছিলো। সম্ভবত, ইতিহাসের কোনো এক সময়, যদি সব কিছু অনুকূলে থাকে, আমরা এর সবগুলো অংশ একত্রিত করে এর রহস্য উন্মোচন করবো।”
.
যদিও অ্যাবিস জানতেন মাটির নীচে ঠিক কোথায় মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন অংশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে তারপরও সব নানেরা মিলে সবগুলো অংশ মাটি খুড়ে বের করে ধুয়েমুছে সাফ করতে দুই সপ্তাহ লেগে গেলো। মেঝের পাথর থেকে বোর্ডটা সরাতে প্রয়োজন হলো চারজন নানের। প্রতিটি দাবাবোর্ডের বর্গের নীচে সিম্বল আঁকা। বিশাল ধাতব বাক্সে রাখা হলো একটা কাপড়। তারপর বাক্সের এককোণে মোম দিয়ে সীলগালা করা হলো যাতে করে ছত্রাক কিংবা আদ্রতায় নষ্ট
হয়ে যায়। কাপড়টা মিডনাইট ব্লু রঙের ভেলভেট, স্বর্ণের এম্ব্রয়ডারি করে রাশিচক্রের প্রতীক আঁকা আছে তাতে। কাপড়টার মাঝখানে সাপের আকৃতিতে দুটো পেঁচানো বৃত্ত অঙ্কিত থাকলো যা দেখতে অনেকটা ইংরেজি ৪ সংখ্যার মতো। অ্যাবিস বিশ্বাস করলেন এই কাপড়ে মোড়ানো থাকলে মন্তগ্লেইন সার্ভিস পরিবহনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে অ্যাবিস সব নানকে রওনা হবার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। প্রত্যেক নানকে একান্তে ডেকে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন ঠিক কোথায় তাকে পাঠানো হবে যাতে করে অন্যের অবস্থান কারো পক্ষে জানা না। যায়। এরফলে প্রত্যেকের ঝুঁকিও অনেকটা কমে আসবে। মন্তগ্লেইন সার্ভিসের অল্প সংখ্যক অংশ যখন বাকি তখন নানদের সংখ্যা তারচেয়ে বেশি রয়ে গেলো অ্যাবিতে, কিন্তু অ্যাবিস ছাড়া আর কেউ জানতো না কোন্ কোন্ নান সার্ভিসের অংশ বহন করবে আর কারা তা করবে না।
ভ্যালেন্টাইন এবং মিরিয়েকে অ্যাবিস তার স্টাডিতে ডেকে পাঠালেন। তারা কক্ষে ঢুকে দেখলো বিশাল ডেস্কে বসে আছেন তিনি। তাদেরকে সামনের চেয়ারে বসার আদেশ করলেন অ্যাবিস। ডেস্কের উপর মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কয়েকটি অংশ নীল ভেলভেট কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় আছে। কলমটা ডেস্কের উপর রেখে অ্যাবিস তাকালেন তাদের দিকে। মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইন একে অন্যের হাত ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে।
রেভারেন্ড মাদার, ভ্যালেন্টাইন মুখ ফসকে বলে ফেললো। আমি চাই আপনি জানুন, আমি আপনাকে খুব মিস্ করবো। আমি বুঝতে পারছি আমি আপনার কাঁধে বিরাট বোঝা হয়ে ছিলাম এতো দিন। আমি একজন ভালো নান। হতে পারলে আর আপনার জন্যে কম সমস্যা তৈরি করতে পারলে ভালো হতো
“ভ্যালেন্টাইন,” মিরিয়ে কঁনুই দিয়ে গুতো মেরে ভ্যালেন্টাইনকে চুপ করতে বললে অ্যাবিস মুচকি হেসে বললেন, “তুমি আসলে কি বলতে চাচ্ছো? তুমি আসলে ভয় পাচ্ছো তোমার খালাতো বোন মিরিয়ে থেকে আলাদা হয়ে যাবার-এই বিলম্ব উপলব্ধির উদ্রেক কি সেজন্যে হয়েছে?” ভ্যালেন্টাইন বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। অবাক হয়ে ভাবলো অ্যাবিস কি করে তার মনের কথা পড়ে ফেলতে পারলেন।
“এ নিয়ে আমিও চিন্তিত,” বলতে লাগলেন অ্যাবিস। মিরিয়ের কাছে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। এখানে তোমার তত্ত্বাবধান যিনি করবেন সেই গার্ডিয়ানের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। এর নীচে লেখা আছে তোমাদের দুজনের ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা।”
“আমাদের দুজনের!” ভ্যালেন্টাইন অনেকটা চিৎকার করে বললো। পারলে নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। “ওহ্, রেভারেন্ড মাদার, আপনি আমার কাঙ্খিত ইচ্ছেটা পূরণ করলেন!”
অ্যাবিস হেসে ফেললেন। “আমি ভালো করেই জানি তোমাদের দু’জনকে যদি একত্রে না পাঠাই তাহলে তোমরা আমার কথার অবাধ্য হয়ে আমার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে একত্রিত হয়ে যাবে কোনো না কোনোভাবে। তাছাড়া তোমাদের দুজনকে একত্রে পাঠানোর অন্য আরেকটা কারণও আছে। ভালো করে শোনো। এই অ্যাবির প্রত্যেক নানের জন্যেই টাকাপয়সা আসে। যেসব নানদেরকে তাদের পরিবার পুণরায় ফিরিয়ে নিয়েছে তারা চলে গেছে নিজেদের বাড়িতে। কিছু কিছু নানকে তাদের দূরসম্পর্কিয় আত্মীয়স্বজন আশয়। দিয়েছে। তারা যদি অ্যাবিতে ভরণপোষনের জন্যে টাকা-পয়সা নিয়ে আসে আমি সেসব টাকা তাদের কাছে পাঠিয়ে দেবো তাদের ভালোমতো থাকাখাওয়ার জন্য। আর যদি কোনো তহবিল না পাওয়া যায় তাহলে অন্য কোনো দেশে ভালো। কোনো অ্যাবিতে ঐসব তরুণীদের পাঠিয়ে দেবো। আশা করি সেখানে তারা নিরাপদেই থাকবে। আমার সব মেয়েদের নিরাপদ ভ্রমণ আর বেঁচে থাকার জন্যে। যা যা করা দরকার আমি তা করবো।” অ্যাবি তার হাত দুটো ভাঁজ করে আবার বলতে লাগলেন। “তবে অনেক দিক থেকেই তোমরা দু’জন বেশ ভাগ্যবতী, ভ্যালেন্টাইন। তোমার নানা তোমার জন্য বিশাল পরিমাণের সম্পদ রেখে গেছেন। তা থেকে বছরে যে আয় হয় সেই টাকা দিয়ে আমি তোমার এবং তোমার বোন মিরিয়ের ভরণপোষণ করি। আর যেহেতু তোমাদের কোনো পরিবার-পরিজন নেই তাই তোমাদের তত্ত্বাবধানের জন্য একজন গডফাদার আছেন। তিনিই তোমাদের সব কিছু দেখভাল করবেন। এই কাজ করতে তিনি রাজি হয়েছেন। আমার কাছে তার লিখিত সম্মতিপত্র রয়েছে। আর এটাই আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।”
অ্যাবিস যখন গডফাদারের কথা উল্লেখ করছিলেন তখন মিরিয়ে তাকিয়েছিলো ভ্যালেন্টাইনের দিকে, এখন সে হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকালো। সেখানে অ্যাবিস গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছেন : ‘এম জ্যাকলুই ডেভিড, চিত্রকর,’ এর নীচে প্যারিসের একটি ঠিকানা। ভ্যালেন্টাইনের যে একজন গডফাদার আছে এ কথা সে জানতো না।
“আমি বুঝতে পারছি,” অ্যাবিস আবার বলতে শুরু করলেন, “সবাই যখন। জানবে আমি অ্যাবিটা বন্ধ করে দিয়েছি তখন ফ্রান্সে অনেকেই বেজায় নাখোশ হবে। আমাদের অনেকেই তখন বিপদে পড়ে যাবে, বিশেষ করে আঁতুয়ার বিশপের মতোন লোকজনের কাছ থেকে। তিনি জানতে চাইবেন এখান থেকে। আমরা কি কি জিনিস সরিয়েছি। বুঝতেই পারছো, আমাদের কর্মকাণ্ডের খবর পুরোপুরি গোপন রাখা কিংবা আড়াল করা সম্ভব নয়। কিছু কিছু নানকে হয়তো খুঁজে বের করাও হবে। তাদের জন্যে হয়তো দেশ ছেড়ে পালানোরও প্রয়োজন পড়তে পারে। সেজন্যে আমি আমাদের মধ্য থেকে আটজনকে বেছে নিয়েছি, তাদের প্রত্যেকের কাছে সার্ভিসের কয়েকটি অংশ থাকবে তবে তারা সেইসাথে সম্মিলিতভাবে আরেকটা কাজও করবে, কেউ যদি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় তখন তার রেখে যাওয়া অংশটা কোথায় আছে সেটা তারা জানবে। অথবা কোথায় সেটা রাখা আছে সেটা খুঁজে বের করার ব্যাপারটা জানবে। ভ্যালেন্টাইন, তুমি এই আটজনের একজন।”
“আমি!” বললো ভ্যালেন্টাইন। ঢোক গিললো সে। তার গলা আচমকা শুকিয়ে গেলো। কিন্তু রেভারেন্ড মাদার, আমি…মানে আমি চাই না…”।
“তুমি বলতে চাচ্ছো এই গুরুদায়িত্ব নিতে তুমি অপারগ,” মুচকি হেসে বললেন অ্যাবিস। “আমি এ ব্যাপারে অবগত আছি। এই সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে আমি তোমার ভদ্র খালাতো বোনের উপর নির্ভরশীল।” মিরিয়ের দিকে তাকালেন তিনি। মাথা নেড়ে সায় জানালো সে। “আমি যে আটজনকে বাছাই করেছি তাদের শুধু এ কাজ করার সক্ষমতাই আছে তা নয়, বরং তাদের কৌশলগত অবস্থানও এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তোমার গডফাদার এম. ডেভিড থাকেন প্যারিসে, ফ্রান্সের দাবাবোর্ডের একেবারে কেন্দ্রে। একজন বিখ্যাত চিত্রকর তিনি, ফ্রান্সের উপরমহলে তাকে সম্মানিত ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। তিনি অ্যাসেম্বলির একজন সদস্যও বটে। ভদ্রলোক বিপ্লবীদের সমর্থক হিসেবেও পরিচিত। প্রয়োজন পড়লে তিনি তোমাদের দু’জনকে রক্ষা করতে পারবেন। তোমাদের ভরণপোষণের জন্যে তাকে আমি উপযুক্ত খরচাপাতিও দেবো।”
অ্যাবিস তার সামনে বসা দুই তরুণীর দিকে তাকালেন। “এটা কোনো অনুরোধ নয়, ভ্যালেন্টাইন,” দৃঢ়তার সাথে বললেন তিনি। “তোমার বোনেরা হয়তো বিপদে পড়তে পারে, তুমি তাদেরকে রক্ষা করার মতো অবস্থানে আছে। আমি তোমার নাম আর ঠিকানা এমন কিছু লোকের কাছে দিয়েছি যারা এরইমধ্যে নিজেদের বাড়ি ছেড়েছে। তুমি প্যারিসে যাবে, আমি যা বললাম ঠিক তাই করবে। তোমার বয়স পনেরো, তুমি ভালো করেই জানো জীবনে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার থাকে যা তাৎক্ষনিক চাওয়া-পাওয়া থেকে অনেক অনেক বেশি জরুরি।” অ্যাবিসের কণ্ঠটা রুক্ষ্ম হতেই আবার নরম হয়ে গেলো। ভ্যালেন্টাইনের সাথে কথা বলার সময় এরকমটিই হয়ে থাকে সব সময়। “তাছাড়া শাস্তি হিসেবে প্যারিস জায়গাটা মোটেও খারাপ না,” তিনি আরো বললেন।
অ্যাবিসের দিকে চেয়ে হেসে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। “হুম, রেভারেন্ড মাদার,” সে একমত পোষণ করে বললো। “ওখানে অপেরা আছে, বেশ পার্টি হয়, মেয়েরা সুন্দর সুন্দর গাউন পরে-” মিরিয়ে আবারো ভ্যালেন্টাইনের পাঁজরে কনুই দিয়ে গুতো মারলো এ সময়। “মানে আমি আন্তরিকভাবে রেভারেন্ড মাদারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তার একজন সেবিকাকে এরকম জায়গায় পাঠানোর জন্য।” এ কথা শুনে অ্যাবিস এমন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন যা তিনি অনেক যুগ ধরে করেন নি।
“খুব ভালো, ভ্যালেন্টাইন। তোমরা দু’জন এখন সব কিছু গোছগাছ করতে শুরু করে দাও। আগামীকাল ভোরে তোমরা রওনা দেবে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি কোরো না।” উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্ক থেকে ভারি দুটো দাবার ঘুটি তুলে তাদের দু’জনের হাতে দিয়ে দিলেন তিনি।
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে অ্যাবিসের হাতের আঙটিতে চুমু খেয়ে জিনিস দুটো সযত্নে তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলে গেলো। স্টাডি থেকে বের হবার ঠিক আগে মিরিয়ে পেছন ফিরে এই প্রথম মুখ খুললো।
“আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি, মাদার?” বললো সে। “আপনি কোথায় যাবেন? আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আমরা আপনার কথা মনে করবো, আপনার জন্যে প্রার্থনা করবো।”
“আমি এমন একটা ভ্রমনে যাচ্ছি যা বিগত চল্লিশ বছর ধরে মনে মনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গেছি,” অ্যাবিস জবাব দিলেন। “আমার এমন একজন বান্ধবি আছে যার সাথে আমার সেই শৈশব থেকে কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই। অনেক দিন আগের কথা-ভ্যালেন্টাইনকে দেখলে আমার সেই বান্ধবির কথা মনে পড়ে যায়। খুবই প্রাণবন্ত আর উচ্ছল এক মেয়ে ছিলো সে…” অ্যাবিস একটু থামলেন। মিরিয়ে অবাক হলো অ্যাবিসের মুখ থেকে এরকম কথা শুনে।
“আপনার সেই বান্ধবি কি ফ্রান্সে থাকে, মাদার?” সে জানতে চাইলো।
“না,” জবাব দিলো অ্যাবিস। “সে থাকে রাশিয়ায়।”
.
পরদিন খুব ভোরে, প্রায় অন্ধকারেই দুই তরুণী ভ্রমণের পোশাক পরে মন্তগ্লেইন অ্যাবি ছেড়ে একটা বড়ভর্তি ঘোড়াগাড়িতে গিয়ে উঠলো। বিশাল দরজা দিয়ে ঘোড়াগাড়িটা বের হয়ে পাহাড়ের ঢালুপথ বেয়ে নামতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। দূরের উপত্যকায় পৌঁছালে হালকা কুয়াশায় তাদের গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেলো।
তারা দু’জনেই ভয়ার্ত, নিজেদেরকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। অবশ্য ঈশ্বরের কাজে অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধন্যবাদ জানালো মনে মনে।
কিন্তু ঢালু পাহাড় বেয়ে তাদের ঘোড়াগাড়িটাকে নেমে যেতে দেখছে যে লোক সে কোনো ঈশ্বর নয়। অ্যাবির উপরে, বরফ ঢাকা পর্বতশীর্ষে ধবধবে সাদা ঘোড়ার উপর বসে আছে সে। ঘন কুয়াশায় ঘোড়াগাড়িটা চোখের আড়াল হওয়ার আগপর্যন্ত দেখে গেলো। তারপর ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে এগিয়ে চললো নিঃশব্দে।
The Eight by Catherine Nevil: Is the full book is translated in bengali. There is sequencing gap of the 9 parts of this translation