না – ৫

টিউশনির টাকা হাতে পাওয়ার পর কম দামের একটা নকিয়া সেট নিয়েছে রুবা। মুঠোফোন না থাকলে এখন কেমন শূন্য শূন্য লাগে। মুঠোফোনে ভরে আছে মুঠি, কিছুটা হলেও পূর্ণ লাগে নিজেকে এখন। পুরোপুরি পূর্ণ হতে হলে আর কী লাগবে? হ্যাঁ, চাকরি জরুরি। বিয়েও জরুরি। মাস্টার্স শেষ করে বিয়ে না করলে সামাজিক তির্যক চোখ উপেক্ষা করে চলা কঠিন। বাড়িতে গেলে এই কঠিন চোখটির ভয়াবহতা টের পায় রুবা। এজন্য বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে না। ঢাকা শহরে আত্মীয়স্বজন নেই, তাই রক্ষা। ইচ্ছা না করলেও যেতে হয় বাড়িতে। যেতে হয় আনিকার জন্য। ওকে ঢাকায় নিয়ে আসা গেলে ভালো হতো। এখন আনা সম্ভব না। এসএসসি শেষ করার পর নিশ্চয় নিয়ে আসবে তাকে। এমন একটা বিশ্বাস লালন করে রুবা।

সেট নাড়াচাড়া করতে করতে আনিকাকে কল করার ইচ্ছা হয়। ভাগ্যিস ওকে একটা সেলফোন কিনে দিয়েছিল। হাতে সেলফোন না থাকলে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয় নিজেকে। সেলফোন থাকলে মনে হয়, সবাই কত কাছাকাছি আছি! এ অনুভবটা ভালো। আনিকাকে কল করে ও। ফোনসেট কানে দিয়ে একটা ধাক্কা খায় রুবা। বিজি আছে ইউজার। ধক করে ওঠে বুক। টিনএজ আনিকার হাতে কি মোবাইল ফোন দেওয়া ঠিক হয়েছে? ভুল করেনি তো? কাছাকাছি থাকার জন্যই এই বাড়তি খরচটা চালাচ্ছে রুবা নিজে। খারাপ কিছু চিন্তা করতে পারছে না। নিশ্চয় কোনো বান্ধবী কল করেছে। নিশ্চয় সেলফোন ভালো কাজে ব্যবহার করছে আনিকা। কিছুক্ষণ পর আবার কল করে রুবা। এখনো ফ্রি হয়নি নম্বর। এখনো বিজি। শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। অস্থির অস্থির লাগছে। অস্থিরতা দূর করতে এবার কল করে সিমিকে। দুঃখিত, নম্বরটি বন্ধ আছে। একটু পর আবার ডায়াল করুন। একটা লম্বা শ্বাস বের হয়। কাছাকাছি থাকার ব্যাকুলতা আরও বেড়ে যায়। কতবার সিমিকে বলেছে, বাইরে থাকলে কখনো যেন সেট বন্ধ না থাকে। কথা রাখেনি সিমি। আগে কখনো সেট বন্ধ থাকত না। এখন কেন থাকে? দুশ্চিন্তা আঘাত হানে মাথায়। দুশ্চিন্তা নিয়ে এবার কল করে আফরিনকে। কল হচ্ছে। ওয়েলকামিং টিউন বেজে উঠেছে : বুঝিনি তো আমি…পৃথিবীতে ভালোবাসা সবচেয়ে দামি…

হ্যাঁ। ভালোবাসাটাই দামি। তবে সবচেয়ে দামি কি? যাদের চারপাশ জুড়ে দারিদ্র্য, তাদের কাছে কি বেশি দামি? মৌলিক সত্য কথা-ভালোবাসাই দামি। তবুও কখনো কখনো মনে হয়, ভালোবাসা না, আরও অনেক কিছু দামি। সবচেয়ে শব্দটাকে আপেক্ষিক মনে হয়। আবার খারাপ হয়ে যায় মন। ফোনসেটের মনিটরে ভেসে ওঠে নো আনসার। আফরিন ওর সঙ্গে আর তেমন যোগাযোগ করেনি। তবে মনে হচ্ছে, যোগাযোগ রাখছে সে সিমির সঙ্গে। সিমিকে বেশি পছন্দ করছে আফরিন। একটু কষ্ট হচ্ছে। জ্যাম লাগছে বুক। এমন লাগছে কেন? নিজে কি হিংসুটে? আফরিন কি মাইন্ড করেছে? ওর প্রপোজাল রাখেনি বলে মাইন্ড করতে পারে? নাকি হোস্টেলে আফরিনকে আনা ঠিক হয়নি? অনেকক্ষণ মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে রুবা ফিরতি কল পাওয়ার আশায়। না। কল আসছে না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আবার কল করতে ইচ্ছা করছে আফরিনকে। কল বাটনে চাপতে গিয়েও থেমে যায় রুবা। গোপন অভিমান ভর করে মনে। অভিমানের সংকেতে আটকে যায় আঙুল। থেমে গেছে রুবা। ভাবে, থাক, এখন আর কাউকে কল করবে না ও। বালিশের ওপরে রেখে দেয় ফোনসেট।

হোস্টেলে কেউ থাকে না এ সময়। প্রায় খালি থাকে হোস্টেল। রুমমেটরা কেউ নেই। বিকেলের দিকে সবাই টিউশনিতে যায়। রুবাও বেরোনোর প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় বেজে ওঠে সেলফোন। আফরিন কি? মনে ধক করে প্রশ্ন নিচ্ছে। মন আসলে অপেক্ষা করছিল আফরিনের কল পেতে। এত অপেক্ষা করে কেন মন আফরিনের জন্য? কেনর উত্তর জানা নেই। রবিনের কল পেতেও এত বেপরোয়া হয় না মন। আফরিনের বেলায় এমনটি ঘটে কেন? কী জাদু জানে মেয়েটি?

মনিটরে চোখ রেখে হতাশ হয় রুবা। আফরিনের কল না। কল করেছে আরিয়ানাদের বাসা থেকে। আরিয়ানা ওর ছাত্রী। পান্থপথে হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্টে ওদের বাসা।

কল রিসিভ করে রুবা বলে, স্লামুয়ালাইকুম।

আরিয়ানার আম্মু বলছি।

কী খবর, আপা? আরিয়ানার মাকে আপা বলে ডাকে রুবা। ভদ্রমহিলার বয়স ত্রিশের বেশি না। বেশ সুহৃদ। রুবার ব্যাপারে আন্তরিক।

একটা বার্থ ডে পার্টিতে যাবে আরিয়ানা। আজ পড়বে না সে। জানানোর জন্য ফোন করলাম।

রুবা জবাব দেয়, আচ্ছা।

লাইন কেটে গেছে। প্রস্তুতি থেমে গেছে বাইরে বেরোনোর। খারাপ মন আরও ডুবে যেতে থাকে খারাপের ভেতর। হঠাৎ তার চোখ গেল সিমির টেবিলের দিকে। টেবিলটা কি অগোছালো? একটু কি ময়লা জমেছে টেবিলে? কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে নিল রুবা। হ্যাঁ। যা ভেবেছে তা-ই সত্যি। মনে হচ্ছে, যত্ন নেই টেবিলের। বই-খাতাও সাজানো গোছানো না। মনে হচ্ছে, যথাযথ ব্যবহার কমে গেছে বা হচ্ছে না টেবিলটির। খেয়াল করে দেখা হয়নি অনেক দিন ধরে। এসব দেখতে দেখতে মন খারাপ হয়ে যায় এখন।

এমন কেন হচ্ছে? সিমি পড়ালেখার প্রতি ছিল ভীষণ সিরিয়াস। নিজেই বলতো, স্টাডি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। এই কি তবে বেস্ট ফ্রেন্ডশিপের নমুনা? টেবিল গুছিয়ে দেয় রুবা। একটা পুরোনো কাপড়ের টুকরো আছে টেবিল মোছার। ড্রয়ারে থাকার কথা কাপড়টা। ড্রয়ার লক করা। খুলতে গিয়ে থমকে যায় রুবা। সিমি ড্রয়ার লক করে না কখনো। তবে কি গোপন কিছু ঘটছে সিমির জীবনে। ঘটতে পারে। বয়সটা তো ঘটার। তবে কোনো খারাপ মানুষের পাল্লায় যেন না পড়ে, এটা চায় রুবা। নিজের টেবিল মোছার কাপড় নিয়ে সিমির টেবিলটা মুছে দেয় ও। মণি ও সানিয়ার টেবিলটাও একপলক দেখে নেয়। ওদের টেবিল বেশ গোছানো, পরিচ্ছন্ন। কোথাও কোনো পরিবর্তনের আলামত নেই। ছোট্ট রুমটা যেন নিজের সংসার। ওই যেন এ সংসারের কর্তী, আর সবাই সদস্য। সিনিয়র হিসেবে দায়িত্ববোধের প্রতি সচেতন রুবা নিজের খাটে এসে বসে।

আবার মুঠোফোন হাতে নিয়ে ও কল করে আনিকাকে। আনিকার নম্বর এখনো বিজি। প্রায় ২০ মিনিট পেরিয়ে গেছে, এখনো কথা বলছে? কার সঙ্গে এত কথা? আবার ধক করে ওঠে রুবার মন। আফরিনের নম্বরে কল করে আবার। দুঃখিত, নম্বরটি বন্ধ আছে…একটু পরে আবার কল করুন।

নিশ্চয় ব্যস্ত আছে আফরিন। এজন্য রিপ্লাই করেনি। ব্যস্ত থাকার জন্য ফোন বন্ধ রেখেছে। এমনি ইতিবাচক চিন্তা স্থান দেয় ও মনে। কিছুটা হালকা হয় মন। এবার কল করে সিমিকে। সিমির নম্বর এখনো বন্ধ। কেন বাপু? তোমার সেলফোন বন্ধ রাখার দরকার কী? মানুষের টেনশন বাড়িয়ে কী লাভ? মনে মনে ও শাসায় সিমিকে। ভাবে, আচ্ছা করে বকে দেবে রুমে এলে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল রুবা। কারও আসার শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাল দরজার দিকে। রুমে ঢুকছে সানিয়া। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ খাটে ছুঁড়ে দিয়ে সানিয়া বলে, কী খবর, আপু? সুসংবাদ, না দুঃসংবাদ?

কী বিষয় জানতে চাচ্ছ?

তোমার নামে দুটো খাম এসেছে–একটা ডাকে, আর একটা কুরিয়ারে। রিসিভ করে তোমার বালিশের তলে রেখেছি। দেখোনি?

না তো!

দেখো, বলতে বলতে বালিশ সরিয়ে নেয় সানিয়া। খাম তুলে দেয় রুবার হাতে।

একটা খাম এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। ইন্টারভিউ কার্ড। অন্যটি একটি এনজিও থেকে, সম্ভবত নিয়োগপত্র। খামটি খুলে বুঝতে পারে, হ্যাঁ। এনজিও থেকে তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে হবে।

নিয়োগপত্র পড়ে মনে পড়ে যায় আফরিনের কথা। জানানোর আগ্রহে কল করে সে আফরিনের নম্বরে। না। এখনো বন্ধ আছে মোবাইল ফোন।

দ্বন্দ্বে পড়ে যায় রুবা। খুশি হলেও এনজিওতে চাকরি নিয়ে শঙ্কা আছে ওর। তবুও একটু মাটি পাওয়া গেল ভেবে খুশিতে ও জড়িয়ে ধরল সানিয়াকে।

সানিয়া বলে, আপু, দুটো পাকা গাব কিনে এনেছি আমি। সবাই এলে মিষ্টি গাব খেয়ে তোমার আনন্দটা সেলিব্রেট করব আমরা।

সানিয়ার কথা শুনে হাসল রুবা। হাসতে হাসতে কল করে রবিনকে।

আশ্চর্য! রবিনের নম্বরও বন্ধ! কী হলো আজ! সব দিক থেকে এত বাধা পাচ্ছে কেন ও!

আনিকাকে কল দেয় আবার। হ্যাঁ। রিং হচ্ছে। আনিকার ওয়েলকামিং মিউজিক শুনে বুকে পানি আসে। বিষাদ ও আনন্দ মিলেমিশে মিশ্র এক আবেগ তৈরি করেছিল নিজের মনে। তেতে ছিল আনিকার ওপর। মুহূর্তের ব্যবধানে রাগ তরল হয়ে গেছে।

আপু, বলল, কী বলবে?

সুখবর আছে আনিকা।

সুখবর? তাড়াতাড়ি বলল।

একটা এনজিও থেকে নিয়োগপত্র পেয়েছি।

উফ! দারুণ খবর, আপু। পোস্টিং কোথায়?

সেটা জানি না। ইন্টারভিউর সময় জেনেছিলাম, ওটা ঢাকা-বেজড প্রতিষ্ঠান। মাঝে মাঝে ট্যুরে যেতে হবে জেলায় জেলায়।

বাবাকে জানাবে?

জানাতে হবে। এখন জানানোর দরকার নেই। আগে দেখি কী অবস্থা। চাকরির স্ট্যাটাস খারাপ হবে বলে মনে হয় না। তবুও এনজিওর চাকরি। বাবা বাধা দিতে পারেন।

বাবার বাধা মানবে কেন তুমি? জোরালোভাবে প্রশ্ন করে আনিকা।

মাথা ঠান্ডা রাখ। মনোযোগ দিয়ে পড়। বাবার ওপর তোকে বিদ্রোহী হতে হবে না। যা দেখার আমি দেখব।

চুপ করে থাকে আনিকা।

রুবা বলে, রাগ করলি।

আনিকা বলে, না।

মন খারাপ হয়েছে?

আনিকা বলে, হ্যাঁ।

শোন, এত আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। জীবনযুদ্ধের মাঠে আছি আমরা। শক্ত হতে হবে। আর হ্যাঁ, তোর ফোন প্রায় আধা ঘন্টা ধরে এনগেজড ছিল, বিষয়টা কী?

আনন্দের মাঝেও একটা ধাক্কা লাগে আনিকার বুকে। জানে সে, কাজটা ভালো হচ্ছে না। দীর্ঘক্ষণ মুঠোফোনে কথা বলছে সে। ধরা পড়ে গেছে আপুর হাতে। থতোমতো খেয়ে বলে, ফ্রেন্ডরা একের পর এক কল করেছে। এজন্য বোধ হয় টানা এনগেজড পেয়েছ তুমি।

সহজ ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হলো রুবা। তবুও বলে, আমাদের আরও সংযত হতে হবে, জীবনকে টেনে নিতে হবে ভালো পথে। এর জন্য প্রয়োজন ভালো করে পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট। ভালো রেজাল্টের কোনো বিকল্প নেই আনিকা।

তুমি ভেবো না। পড়াশোনায় গাফিলতি হচ্ছে না আমার। পড়াশোনার ব্যাপারে সিরিয়াস আছি আমি।

ওকে আনিকা, টেক কেয়ার।

লাইন কেটে সানিয়ার দিকে তাকাল রুবা। অন্য রকম উচ্ছ্বাস দেখতে পাচ্ছে ও সানিয়ার মুখে। যেন নিজেদের পরিবারের একজনের চাকরি হয়েছে, এই চাকরির অংশীদার ওরা সবাই।

সানিয়া বলে, দিনটা কীভাবে এনজয় করা যায়, বলো তো?

রুবা বলে, তোমরা মিলে ঠিক কোরো। সবাই যা বলবে, তা-ই করব আমরা। তবে ভুলে যাব না–আমাদের নিজেদের অবস্থান ও সামর্থ্যের কথা।

ঠিক আছে আপু, মণি ও সিমি আসুক।

কথা শেষ করার আগে দড়াম করে রুমে ঢোকে মণি। ব্যাগটা ছুঁড়ে দেয় নিজের খাটের ওপর। মুখ গম্ভীর। কালো একটা ছোপ বসে আছে মুখের উজ্জ্বল রঙে।

সানিয়া এগিয়ে যায় মণির দিকে। ডান হাতে ওর মুখটা টেনে বলে, সুসংবাদ আছে মণি।

সুসংবাদ তুলে রাখ। আগে কুসংবাদ শোন। আঁকি দিয়ে বলে মণি।

রুবা এগিয়ে গিয়ে বলে, কী বলছ? কুসংবাদ কী?

মণি ক্ষুব্ধ স্বরে বলে, গিয়েছিলাম আমার ছাত্রী রিমিকে পড়াতে। ওরা বেড়াতে গেছে। বাসায় গিয়ে দেখি, কেবল রিমির বাবা বাসায়। আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চাইল। পটাতে চাইল। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, গায়ে হাত দিতে চাইল।

সানিয়া বলে, তুই কী করলি?

মণি উদ্ধত স্বরে বলে, একটা চড় মেরে দিয়েছি।

রুবা বলে, ঠিক করেছিস। বজ্জাত লোকগুলোর চড়ই প্রাপ্য। সানিয়া বলে, এখন তোর কী হবে? কীভাবে চলবি? হোস্টেল রেন্ট কই পাবি? আবার কি যাবি রিমিকে পড়াতে?

মণি বলে, পড়ানোর প্রশ্নই আসে না। দরকার হলে না খেয়ে থাকব, হোস্টেল ছেড়ে দেব। তবুও নিজেকে হারতে দেব না।

ওয়েলকাম মণি। কনগ্র্যাচুলেশন ফর ইওর কনফিডেন্স। রুবা বাহবা দিয়ে আরও বলে, আমার একটা চাকরি হয়েছে। প্রয়োজনে আমার টিউশনি দিয়ে দেব তোমাকে। তবুও পরাজিত হব না আমরা।

ওয়াও! মণি লাফিয়ে জড়িয়ে ধরে রুবাকে। নিজের ভেতরের ক্ষুব্ধতা তরল হয়ে যায়, মুহূর্তে মনের মধ্যে জেগে ওঠে আনন্দধারা। চোখ-মুখ খুশিতে ভরে ওঠে।

সানিয়া বলে, রিমি তোর মতো টিচারকে হারাবে। বাবার দোষে মেয়ে শাস্তি পাবে কেন?

হ্যাঁ। এটা সমস্যা। রিমিকে আদর-মমতা দিয়ে পড়াতাম। সেও আমার খুব ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কষ্ট পাবে বেচারি। ওর জন্য খারাপ লাগবে আমার।

শোনো, বাবার কুকীর্তিটা মেয়ে যেন জানতে না পারে। জানলে নিরপরাধ রিমিকে কষ্ট দেওয়া হবে। বাবার শয়তানির বোঝা মেয়ের মনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

তাহলে কী বলব? কেন যাচ্ছি না, কী জবাব দেব?

কিছু একটা বানিয়ে বলা যাবে। রিমি ও ওর মা আসল কথাটা জানলে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। মা-মেয়েকে কষ্ট দেওয়াটা ঠিক হবে না।

মণি বলে, ঠিক আছে। তুমি পরামর্শ দিয়ে। কী করব, পরে ভেবে দেখা যাবে। এখন বলল, তোমার আনন্দ-খবর কীভাবে সেলিব্রেট করব?

সিমি আসুক। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

সানিয়া বলে, আজকাল সিমি কেমন হয়ে যাচ্ছে। কথা কম বলে, অল্পতে মেজাজ দেখায়, পড়াশোনাও ঠিকমতো করে না। পড়াতেও যায় না। মনে হয়, নতুন কোনো বন্ধু হয়েছে ওর। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, ফিরতেও অনেক রাত করে। প্রায়ই রাত নয়টার পর ফেরে। বিষয়টা ভাবনায় ফেলে দিয়েছে আমাকে।

মণি সায় দিয়ে বলে, ঠিক ধরেছিস তুই। আমারও মনে হয়েছে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে সিমি। দিনভর ঘুমায়। বিকেলের দিকে বের হয়। ফেরে দেরি করে।

ওদের কথা শুনতে শুনতে টেনশন ঢুকে যায় মনে। টেনশন নিয়ে সিমির মুঠোফোনে কানেক্ট করার চেষ্টা করে রুবা।

মোবাইল ফোন বন্ধ আছে। ধরা যাচ্ছে না।

রুবার মনে ইনটিউশন কাজ করে–আফরিনের সঙ্গে কি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিমি? ভাবতেই কেমন হয়ে যায় মনটা। একধরনের ঈর্ষাবোধ জেগে ওঠে মনে। ধিক্কার দেয় রুবা নিজেকে। ঈর্ষান্বিত হচ্ছি কেন? নারী চরিত্র কি এমন? ঈর্ষায় পুড়ে যায় অন্যের ভালো শুনলে? আফরিনের বন্ধুত্ব পেতে চেয়েছিল ও। আফরিনের মধ্যেও দেখেছিল একই রকম টান, একই রকম আকুলতা। সেই আফরিন মনে হচ্ছে অবহেলা করছে তাকে, যোগাযোগ করছে না। সেট কিনে দিতে চেয়েছিল আফরিন, ফাস্টফুড ক্যাফেতে নিমন্ত্রণ করেছিল। স্ট্রংলি না করে দিয়েছিল। এই নাই কি কাল হলো? মন ভেঙে দিয়েছে আফরিনের? এজন্য কি অবহেলা করছে আমাকে?

ভাবতে চায় না তেমন কিছু। ভাবতে চায়, ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে আফরিন। এজন্য বোধ হয় খবর নিচ্ছে না তার। সিমিকে সঙ্গী হিসেবে নিলে ক্ষতি কী, বরং লাভ হবে সিমির। ভালো বন্ধু পাবে। এটা ভালো দিক। সিমি কেন অন্য রকম হয়ে যাবে? কেন বদলে যাবে? সৎসঙ্গে সিমির উন্নতি হওয়ার কথা, মন ভালো থাকার কথা! সিমি কেন সহ্য করতে পারছে না রুমমেটদের? এ রুম তাদের ছোট্ট সংসার। আর্থিক দীনতা আছে সংসারে। মমতার ঘাটতি নেই, ভালোবাসার ঘাটতি নেই। কেন বদলে যাবে সিমি? মানতে পারছে না রুবা। ভাবতে ভাবতে কল করে বসে আফরিনকে। না, কানেক্ট করা যাচ্ছে। না। মোবাইল বন্ধ। আজকের আনন্দের মাঝেও মনটা অজানা এক বিষাদে ভরে গেল! কোত্থেকে আসছে এই বিষাদ? কেন বিষাদ এসে জড়ো হয় বুকে? কান্না পাচ্ছে ভেতর থেকে। দুজনের সামনে থেকে সরে যায় রুবা। এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে।

.

রাত ১০টা। হোস্টেল-জীবনের চার রুমমেটের মধ্যে একজন সিমি–এখনো ফেরেনি। মোবাইল ফোনও বন্ধ। তিন রুমমেট দিশেহারা। কর্মজীবী মেয়েরাও ১০টার আগে ফিরে আসে। সিমি কেন ফিরছে না? কোনো বিপদ হয়নি তো? কী করবে তারা? হোস্টেল কর্তৃপক্ষকে জানানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

হঠাৎ নিচে শোরগোল শুনতে পায় ওরা।

রুবা চমকে বলে, সিমি কি এসেছে? গার্ড কি ঢুকতে দিচ্ছে না ওকে? চলো, নিচে যাই।

তিনজন একসঙ্গে ছুটে গেল নিচে।

হ্যাঁ। যা ভেবেছিল, তা-ই সত্য। সিমি এসেছে ফিরে। তর্কাতর্কি করে গেট খুলেছে সে। গার্ডকে বলছে, নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে, পার্টটাইম জব। আজ আসতে ১০ মিনিট বেশি দেরি হয়েছে। এর জন্য বাধা কেন? হইচই কেন?

সিমিকে দেখে প্রাণে জোর ফিরে আসে তিন রুমমেটের।

রুবা বলে, ফোন বন্ধ রেখেছ কেন?

সিমি খেমটা মেরে উত্তর দেয়, সবকিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হবে নাকি?

মণি বলে, জবাবদিহিতার প্রশ্ন না সিমি, আমরা টেনশন করছিলাম, বিপদ-আপদ হতে পারে না?

আমাকে নিয়ে টেনশন করতে হবে না। আর আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে খোঁজখবর কিংবা টেনশন করার দরকার নেই তোমাদের। বলে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে উপরের দিকে। তিন রুমমেট অবাক চোখে দেখল সিমির কাণ্ড। বিমূঢ় হয়ে গেল ওরা।

জোট বাঁধার কথা বলেছিল আফরিন। ভালো লেগেছিল তার প্রস্তাব। যেখানে যাব সেখানে অন্যের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলব। জোট বেঁধে ফেলব। এই যে, এখন আমি আর আপনি একজোট। ঢাকায় এদিক-ওদিক চলতে গেলে মেয়েদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। গ্রুপ বেঁধে চললে এড়ানো যায় উটকো ঝামেলা। আফরিনের কথাগুলো এনজয় করেছিল। মনের শেকড়ে গেঁথে আছে প্রতিটি শব্দ। আফরিনকে ভুলতে পারছে না রুবা। এখন বসে আছে এনজিওর করপোরেট অফিসের লবিতে। কান্ট্রি ডিরেক্টর অফিসে ঢোকেননি এখনো। তিনি একজন মহিলা। বস মহিলা হওয়াতে সাহস আছে বুকে। তবুও ভয় কাটছে না। কিছুটা উদ্বেগ ঢুকে আছে মনে। উদ্বেগ নিয়ে স্মরণ করছে আফরিনকে। কাকে পাবে ও এখানে। কার সঙ্গে গড়ে তুলবে সখ্য? কয়েকজন পুরুষ কর্মকর্তা বার কয়েক হেঁটে গেছেন। ওর দিকে তাকিয়েছেন। হাই-হ্যালো বলেননি। রিসিপশন ডেস্কের মেয়েটি বেশ আন্তরিক। বসিয়ে রেখেছে ওকে লবিতে। পরিচিত হওয়ার সময় একটু হেসেছে। ভদ্রভাবে বলেছে বসার জন্য। ম্যাডাম এলে ওনার পারমিশন নিয়ে ঢুকতে দেবে রুমে। আর কোনো কথা বলেনি মেয়েটি। নিজের কাজে ব্যস্ত। হাতে কয়েকটি ফাইল। ফাইল দেখছে। কাগজপত্র গোছাচ্ছে। লবির উল্টা দিকের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে বিরাট এক তৈলচিত্র। সূর্যোদয়ের ছবি। লাঙল কাঁধে কৃষক যাচ্ছে মাঠে। দুটো গরু সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষকের হাতে একটা লাঠি। সবুজ গ্রামের ভেতর মেঠোপথ। মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে এক কিশোর। ছেলেটির হাতে গামছা মোড়ানো গামলা ও থালা। নিশ্চয় সকালের খাওয়া, পান্তা নিয়ে এগোচ্ছে ছেলেটি। এত সুন্দর অফিসে গ্রামের ছবি কেন? গ্রাম নিয়ে কি এই সংস্থার কাজ? ওকে কি গ্রামে যেতে হবে? কোন গ্রাম? নিজেদের জেলায় পোস্টিং দেবে? পোস্টিং কোথায় হবে বলেনি ওকে। হেড অফিসে হলে ভালোই হয়। এমন পরিবেশে চাকরি করার সুযোগ পেলে সরকারি চাকরির ধারেকাছে যাবে না ও।

ভাবনায় ছেদ পড়ে। মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে উঠেছে। দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে সেট বের করে দেখে মণি ফোন করেছে।

উদ্বিগ্ন স্বরে মণি বলে, আপু, কী করব, বলো? সিমি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এখন বাজে ১০টা। ওর ক্লাস আছে। জাগিয়ে দেব?

তুমি বুদ্ধি করে দেখো কী করা যায়? টেনশনে আছি আমি। বসের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছি।

দেখো, বসের হাতে ধরা খেয়ো না।

না, না। ভয় পাসনে। বস মহিলা।

যাক বাঁচালে, আপু। তবুও মনে করিয়ে দিলাম, যেখানে না বলার দরকার দাপটের সঙ্গে বলবে না। হ্যাঁ-এর জায়গায় না বোলা না আবার। এসব তোমার পরামর্শ। তোমাকেই স্মরণ করিয়ে দিলাম।

রুবা বলে, থ্যাংকস। এমন নার্ভাস হই না কখনো আমি। তোমার টেলিফোন না পেলে বোধ হয় টেনশন কাটত না।

আমার সঙ্গে কথা বলে কি এখন টেনশন কেটেছে তোমার?

হ্যাঁ, কেটেছে কিছুটা।

তাহলে বলল, সিমিকে নিয়ে কী করব। ওর ঘুমের ধরন অস্বাভাবিক। লাগছে। নাশতাও খায়নি সকালে। অসুস্থ কি না বুঝতে পারছি না। বাইরে গেছে সানিয়া। ওকে একা রেখে কি আমার ক্লাসে যাওয়া ঠিক হবে?

তোমার ক্লাস করতেই হবে তোমাকে। পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত না।

কাকে বলে যাব? ওকে এ অবস্থায় ফেলে যেতে ইচ্ছা করছে না।

আশপাশের রুমে কেউ নেই?

না। এ সময় কেউ থাকে না। সবাই যার যার কাজে বাইরে যায়।

তাহলে খালাকে বলে যাও। তুমি ক্লাস করো। ক্লাস মিস দেওয়া উচিত হবে না। পড়াশোনা আমাদের মতো সগ্রামী মেয়েদের বড় বন্ধু। ভুলে গেলে চলবে না।

কথা শেষ করে সামনে তাকায় রুবা। রিসিপশনের মেয়েটা ইশারায় ডাকছে। মুঠোফোনের লাইন কেটে দ্রুত উঠে যায় ও ডেস্কের কাছে।

আপনার নিয়োগপত্র জমা দিন।

ব্যাগ থেকে নিয়োগপত্র দ্রুত বের করে রুবা। তুলে দেয় মেয়েটির হাতে।

এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? সুস্থির হোন। ভয়ের কিছু নেই। আপনি এখন এ অফিসের একজন কর্মকর্তা। মনে রাখুন কথাটা।

হাসি ফোটে রুবার মুখে। ভয় কেটে যায়। সাহস জমা হয় বুকে। বিনয়ের সঙ্গে বলে, থ্যাংকস।

ওয়েলকাম, ম্যাডাম। বসুন আপনি। পরিচালক-প্রশাসন আপনাকে ডাকবেন। পাশের কক্ষে দেখা করবেন। আমি নিয়ে যাব। কান্ট্রি ডিরেক্টর ম্যাডাম আসতে দেরি হবে। তিনি বাইরে একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করে আসবেন।

পরিচালক পুরুষ, না মহিলা–জানে না রুবা। জিজ্ঞাসাও করা যাচ্ছে না।

আবার ভয় জাগতে থাকে মনে। নিজের অজান্তে আবার বাড়তে থাকে বুকের ঢিবঢ়িব। ভয় জাগছে, টের পাচ্ছে না ও। টেনশনের চিত্র ভেসে ওঠে চেহারায়।

রিসিপশনের মেয়েটি আবার বলে, ম্যাডাম আপনি ইজি হয়ে বসুন।

ইজি শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জগতে আবার ফিরে আসে রুবা। টেনেটুনে হাসি ফোঁটায় মুখে। ভাবে, ভয় পাচ্ছি কেন নিজে? পরিচালক পুরুষ হলে কী, মেয়ে হলেই বা কী, সবকিছু নিজের ওপর। নিজে কী ধরনের আচরণ করব, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ভাবতে গিয়ে আপন বৈশিষ্ট্যের কাঁপ খুলে যায়। সাহসী হয়ে বসে থাকে রুবা। মেয়েটির মুখে ম্যাডাম ডাক শুনতেও ভালো লেগেছে, চাকরিটার ওজন আছে বোধ হয়, স্ট্যাটাসফুল মনে হচ্ছে।

এ সময় আবার বেজে ওঠে রিংটোন।

দ্রুত দেখে নেয় মনিটর। রবিনের কল।

বিন বলে, কেমন আছেন, ম্যাডাম? দেখা হলো বসের সঙ্গে?

ফাজলামি রাখো, ওয়েট করছি বসের রুমে ঢোকার জন্য। পরে কথা বলব।

আচ্ছা, একটু বলুন, বস পুরুষ, না মহিলা?

রুবা লাইন কেটে দিচ্ছিল প্রায়। প্রশ্ন শুনে হাত থেমে যায়। লাইন না কেটে উত্তর দেয়, সবচেয়ে বড় বস মহিলা।

রবিন বলে, বাঁচালে!

কেন? বাঁচার কী হলো?

পুরুষগুলো মেয়ে কর্মীকে ফাঁদে ফেলে। এজন্য ভয় ছিল মনে। ভয় কেটে গেল। বাচলাম।

বাঁচার সুযোগ তৈরি হয়নি এখনো। এখন যে বসের সঙ্গে দেখা করব, তিনি হচ্ছেন পরিচালক-প্রশাসন। নারী, না পুরুষ–জানি না।

দরজার নেমপ্লেট দেখো।

লবিতে আছি আমি। এখনো বুঝতে পারছি না কোন রুমে ঢুকতে হবে।

কথা চলার সময় রিসিপশনের মেয়েটি বলে, আসুন, স্যার ডেকেছেন আপনাকে।

স্যার শব্দটি শুনে গুডম করে ওঠে আত্মা। বুঝতে পারে, পুরুষ বসের মখোমুখি হতে যাচ্ছে ও। তার পরও বুকে সাহস রেখে উঠে দাঁড়ায়। রিসিপশনিস্টের কথা লো ভলিউমে শুনতে পেয়েছে রবিন। কথা বলার সুযোগ পায়নি। লাইন কেটে দিয়েছে রুবা।

মেয়েটি আবার বলে, ম্যাডাম, রুমে ঢোকার আগে মোবাইল অফ করুন অথবা সাইলেন্ট রাখুন।

রুবা দ্রুত হাতে মোবাইল ফোন অফ করে দেয়।

ম্যাডাম, মনে হচ্ছে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন আপনি। নার্ভাস হবেন না। স্যার খুব ভালো, সজ্জন। আমাদের অফিসের সবাই ভদ্র, কর্মঠ ও সৎ।

অফিসের নারী সহকর্মীর এমন কথায় আবারও সাহস জাগে মনে। তবে পুরুষ নিয়ে ভীতি আছে ওর। সর্বশেষ ভীতির কারণ হয়েছে মণির ছাত্রী রিমির বাবার আচরণ। এ মুহূর্তে মনে পড়ে যায় মণির কথা। মেয়েটা কী করছে এখন কে জানে?

ভেতরে ঢুকে স্মার্ট হয়ে গেল রুবা।

স্লামুয়ালাইকুম। সহজ গলায় সালাম জানাল ও।

ওয়েলকাম, জাহানারা তাবাসসুম!

চমকে ওঠে রুবা। নিজের আসল নামটা শুনে ভালো লাগে। আসল নাম না শুনতে শুনতে কেমন অপরিচিত মনে হয়েছিল নিজেকে। সহজ হয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।

বসুন, প্লিজ। সজ্জন ব্যক্তির ভদ্র আহ্বান।

চেয়ার টেনে সামনে বসল রুবা। বাইরে চলে গেছে রিসিপশনের মেয়েটি।

আমি জাহেদ আকবর, এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক–প্রশাসন। মৌখিক পরীক্ষার দিন দেখেছিলাম আপনাকে। ভাইভা বোর্ডে বেশ সাহসের সঙ্গে কিছু সত্য কথা বলেছিলেন। মনে আছে সব?

কোন কথা, স্যার? আমি তো বুঝতে পারছি না।

বলেছিলেন, নিজের সংগ্রামের কথা। ছাত্রী হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছেন, টিউশনি করে নিজের খরচ বহন করেছেন।

ওহ!

ম্যাডাম জানতে চেয়েছিল, আপনার বাবার কথা। অপকটে বলেছিলেন, তিনি আপনার খরচ বহন করেন না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন?

বোল্ডলি উত্তর দিয়েছিলেন, সেকেন্ড ম্যারেজ করেছেন তিনি।

জি।

নির্মম সত্যটা বলার জন্য সৎ হিসেবে আপনাকে সিলেক্ট করেছি আমরা।

রুবা বলে, ওহ্।

অবশ্য আরও গুণাবলি আছে। পড়াশোনায়ও ফিট আপনি। তবে অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। সেটাও আশা করি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

আপনাদের আত্মবিশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ। অভিজ্ঞতার ঘাটতি নিয়ে সচেতন আমি। ঘাটতি পূরণ করতে এক শত ভাগ চেষ্টা করব।

সেই বিশ্বাসও আছে আমাদের।

নিশ্চয় আপনাদের বিশ্বাসের মর্যাদা দেব আমি। আত্মপ্রত্যয়ী রুবা আরও বলে, আমার কাজের ধরনটা কী হবে?

আপনি অফিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করবেন কেন্দ্রে। তবে মাঝেমধ্যে জেলা পর্যায়ে ট্যুরে যেতে হবে অফিস সুপারভিশনের কাজে।

কী ধরনের কাজ করছেন আপনারা?

মূলত নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করছি আমরা। তাদের চিকিৎসাসেবা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন নিয়ে আমাদের কর্মযজ্ঞ।

এ ধরনের কাজের জন্য তো আমি ফিট না।

অফিশিয়াল কাজ করবেন আপনি। সব সময় একই ধরনের কাজ করতে হবে, এক সপ্তাহের মধ্যে শিখে যাবেন সব।

ভরসা পায় রুবা। স্বস্তি নিয়ে বলে, সাহস পাচ্ছি এখন আপনার সঙ্গে কথা বলে। ভীত ছিলাম নতুন পরিবেশ এবং কাজের ধরন নিয়ে।

সাহস হারাবেন না। সংগ্রাম করতে জানেন। সাহস হারাবেন কেন? সাহস হারালে কি জয়ী হওয়া যায়?

মুগ্ধ হয়ে নতুন বসের কথা শোনে রুবা। বসে থাকে চুপ করে।

জাহেদ আকবর আবারও বলেন, যেকোনো সমস্যায় হেলপ চাইবেন। সহযোগিতা পাবেন আমার। বুঝেছেন?

রুবা বলে, আচ্ছা।

কান্ট্রি ডিরেক্টর খুব ভালো। তবে ডিস-অনেস্টি পছন্দ করেন না উনি। সব বিষয়ে ওনার সঙ্গে সৎ থাকতে হবে।

রুবা আবার বলে, আচ্ছা।

ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারলে প্রমোশন হবে, বেতনও বাড়বে। চাকরির নিশ্চয়তা আছে। আছে আর্থিক নিরাপত্তা।

রুবা খুশি হয় আবারও। বেতনের ওপর নির্ভর করে আনিকার জন্য ভালো ব্যবস্থা করতে হবে। মনে মনে ভাবে, শুরুতে বেতন কেমন হবে কে জানে।

জাহেদ আকবর বলেন, শুরুতে ভালো বেতন পাবেন। দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেতনও বাড়বে। সরকারি চাকরির চেয়ে হাজার গুণ ভালো হবে।

আবারও মুগ্ধ হয় রুবা। লোকটা কি ওর মন পড়তে পারছে?

মণির কথা মনে পড়ে। মণিকে নিজের টিউশনিটি দিয়ে দিতে হবে। সিমিকে বুঝতে হবে। কী হয়েছে ওর? কষ্ট দূর করতে হবে ওর। নিজের হোস্টেল নিজের বড় জগৎ। এ জগতে সবার সুখ চায় ও। সবাইকে সুখী দেখতে চায়। নিজের রুমের কেউ না আফরিন। সুখ চায় ও আফরিনেরও। উড়ে এসে মনজুড়ে বসেছে মেয়েটি। এখন অ্যাভয়েড করছে, তবুও ভালো চায় তার।

জাহেদ আকবর বলেন, ম্যাডাম এসেছেন। চলুন, ম্যাডামের সঙ্গে পরিচয় হোক। ভালো লাগবে।

মৌখিক পরীক্ষার সময় ম্যাডামকে চোখ তুলে ভালো করে দেখার সুযোগ পায়নি রুবা। রুমে ঢুকে হতবাক হয়ে যায় ও। জাফরিন নঈম, কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইয়াং লুকিং। সালোয়ার-কামিজ পরে বসে আছেন হেড চেয়ারে।

ওদেরকে দেখে হাতের ইশারায় বসতে বলেন।

দাঁড়িয়ে থাকে রুবা। জাহেদ আকবর চেয়ার টেনে বসেন পাশে।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনি? বসুন।

চেয়ারে বসে রুবা। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। অফিস-প্রধান একজন মহিলা। রুবা বসের কাজের দ্রুততা খেয়াল করে দেখল। হাতের কাজ এবং টেলিফোনে কথা শেষ করে তাকালেন তিনি রুবার দিকে।

হ্যাঁ, কী যেন নাম আপনার?

জাহানারা তাবাসসুম।

জাহানারা তাবাসসুম! সুন্দর নাম। আপনার নামের আদ্যাক্ষর আর আমার নামের আদ্যাক্ষর

জি!

তাই না? ভাইভা বোর্ডে বিষয়টি খেয়াল করেছিলাম।

জি।

হ্যাঁ। জাহানারা, কঠিন পরিশ্রম করতে হবে, প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের করে ভাবতে হবে। নিজের করে ভাবতে পারলে সংস্থার উন্নতির জন্য ভেতর থেকে ড্রাইভ টের পাবেন। আই নিড দিস ড্রাইভ ফ্রম উইদিন ইওরসেলফ। ওকে?

জি ম্যাডাম। চেষ্টা করব আমি।

গুড। আপনার দেশের বাড়ি কুষ্টিয়া, মিলপাড়ায়, তাই না?

জি।

কুষ্টিয়ায় একটা ব্রাঞ্চ খোলার ইচ্ছা আছে আমার। শিগগির ওখানে টুরে যাব আমরা। আপনিও যাবেন। ওকে?

জি। ম্যাডাম। মুখে জি বললেও মনে মনে ভয় পেয়ে যায় ও। কুষ্টিয়ায় পোস্টিং দিয়ে দেবে না তো ওকে? নিজের বাড়ি হলেও কুষ্টিয়ায় চাকরি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই ওর।

চিন্তিত মনে হচ্ছে আপনাকে। অফিস ভালো লাগেনি?

কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে রুবা। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, ভালো লেগেছে, ম্যাডাম।

ঠিক আছে। জয়েন করুন কাজে। টাকার প্রয়োজন আছে নিশ্চয়। এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। জাহেদ আকবরের দিকে তাকিয়ে অনেকটা নির্দেশের স্বরে বললেন জাফরিন নঈম।

জাহানারা তাবাসসুম, আপনি কি হোস্টেলেই থাকবেন, নাকি বাসা নেবেন?

হোস্টেল নিরাপদ। আপাতত হোস্টেলে থাকার পারমিশন পেলে খুশি হব।

না, না। সব কাজে পারমিশন নেবেন কেন? এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যেখানে নিরাপত্তা আছে, সেখানে থাকবেন। তবে বেতনের সঙ্গে বাসা ভাড়া ও যাতায়াত ভাড়া পেয়ে যাবেন।

মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রুবা।

ঠিক আছে। বেস্ট উইশেস ফর ইউ।

ম্যাডাম শেষ কথায় দর্শনার্থীকে উইশ করেন। এ উইশের অর্থ জানেন জাহেদ আকবর। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁকে অনুসরণ করে ওঠে রুবাও। বেরিয়ে আসে কান্ট্রি ডিরেক্টরের কক্ষ থেকে।

বেরিয়ে এসে জাহেদ আকবর বলেন, আপনার ওপর ম্যাডাম বেশ সন্তুষ্ট, বুঝতে পেরেছেন?

রুবা বলে, ভয়ে জড়ো হয়ে ছিলাম, ভেতরে টেনশন থাকলে কি সব বোঝা যায়?

নার্ভাস হবেন কেন? আজ থেকে এ প্রতিষ্ঠান আপনার প্রতিষ্ঠান। নিজের করে ভাবলে জড়তা থাকবে না। ভয় থাকবে না। পারফরমেন্স ভালো হবে।

প্রথমদিন তো! এজন্য বোধ হয় জড়তা কাজ করেছিল।

আমার সামনে আবার ভয় পাচ্ছেন না তো?

হেসে দেয় রুবা। সহজ হয়ে বলে, না এখন পাচ্ছি না। আপনার কক্ষে প্রথম ঢোকার সময় ভয় পেয়েছিলাম।

না, না। ভয় পেলে চলবে না। অবশ্য প্রথম দিনেরটা যৌক্তিক ভয়। যৌক্তিক ভয়ও জয় করতে হয়। অযৌক্তিক ভয়ও তাড়াতে হবে মন থেকে। অযৌক্তিক ভয় ও জড়তা পেছন থেকে টেনে রাখে মানুষকে।

আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে রুবা বলে, এত সুন্দর পরিবেশে ভয় পাব কেন? খুব ভালো লেগেছে অফিস। অফিসের সব স্টাফ ভালো।

পরিচালক-প্রশাসনের দুই কক্ষ পরে একটা বড় কক্ষ। রুমের কোণে গোছানো একটা বড় কিউবিকেলস। সিম্পল টেবিল, গর্জিয়াস লুক। সিম্পল চেয়ার। পাশে একটা সেলফ। টেবিলের এক পাশে কম্পিউটার। টেলিফোন সেট।

এটা আপনার অফিস ঘর। এই ঘরের অন্য খোপে আরও কয়েকজন বসেন। সবাই আপনার সহকর্মী, একেকজন একেক বিষয় দেখাশোনা করে থাকেন। এ ঘরের সবার পদবি সমান।

ভালো লাগল রুবার। নিজের বসার চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে দুরুদুরু করে ওঠে বুক। ভালো লাগায় জুড়িয়ে যায় মন। সামনে এগিয়ে টেবিলে হাত রাখে রুবা। যেন কোমল হাতে ছুঁয়ে দিয়েছে অতি আপন কাউকে। ভিন্ন রকম অনুভূতি। মনে হয়, নিজের এত দিনের শ্রম সফল হয়েছে। এমনি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি খুঁজছিল ও।

অফিসের নিজস্ব একটা প্রটোকল রয়েছে। ইউ হ্যাঁভ টু মেইনটেন দ্যাট আনসিন বাট সিন প্রটোকল।

কথাটার সঠিক অর্থ বুঝতে পারল রুবা। বুঝেও চুপ করে থাকে।

বিষয়টা নিয়ে আবার ঘাবড়াবেন না মিস তাবাসসুম। সব ইস্যতে সহযোগিতা পাবেন আমার। ম্যাডামও সহযোগিতা করবেন।

চুপ হয়ে থাকে রুবা। মিস তাবাসসুম শব্দটি নতুন সংযোজিত হয়েছে। শব্দটি শুনে কিছুটা ভড়কে যায় ও। তবুও চুপ করে থাকে। কোনো কথা বলছে না। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই অন্যদের সঙ্গে। বলেই পাশের কিউবিকেলসে আসেন তারা।

উনি ফারাহ আলম, আমাদের অ্যাকাউন্টস সেকশনটা দেখেন। মিস ফারাহ, ইনি হচ্ছেন মিস জাহানারা তাবাসসুম। আমাদের নতুন অফিস এক্সিকিউটিভ।

ফারাহ চেয়ার ছেড়ে ওঠে। হ্যাঁন্ডশেক করে রুবার সঙ্গে।

আরও মুগ্ধ হয়ে যায় রুবা। একই রুমের মধ্যে আছে একটি চৌকস মেয়ে। এবার ভেতর থেকে আলাদা একটা স্পিরিট টের পায় ও। ঝলমল করে ওঠে পুরো রুবা। রুবার টোটাল ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটতে থাকে। হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে সে ফারাহর দিকে।

ম্যাডাম বলেছেন, ওনার এক মাসের স্যালারি অগ্রিম দিতে। ব্যবস্থা করুন আপনি। ফারাহকে ইনস্ট্রাকশন দিলেন জাহেদ আকবর।

জাহেদ আকবর বলেন, একটা ফাইল আছে আপনার ড্রয়ারে, আপাতত ফাইলটি পড়ুন। আপনার জব জুরিডিকশন বুঝতে পারবেন। উইশ ইউ এ গুডলাক। বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে রুবা। ফাইলটি পড়তে থাকে। নিজের মধ্যে অন্য রকম জোশ জেগে ওঠে। বুঝতে পারে-হবে তাকে দিয়ে। ভয়। পাওয়ার কিছু নেই।

একটু পর রুমে এলেন ফারাহ আলম। হাসিমুখে বলে, ওয়েলকাম টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড।

রুবা হেসে বলে, থ্যাংকস।

ফারাহ আলম আবার বলে, আপনার বেসিক স্যালারি আছে এখানে। একটা সিগনেচার দিন, প্লিজ। রিসিভ করুন।

রুবা, স্ট্যাম্পের ওপর সিগনেচার করতে গিয়ে দেখে, বেসিক সেলারি ১০ হাজার টাকা। লাফিয়ে ওঠে বুক। এত টাকার খাম একসঙ্গে হাতে নিল জীবনে এই প্রথম।

ফারাহ আবার যোগ করে, হাউস রেন্ট ছয় হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা দুই হাজার এবং যাতায়াত ভাড়া দুই হাজার। টোটাল ২০ হাজার টাকা ড্র করবেন আপনি। এখন ১০ হাজার দেওয়ার ইনস্ট্রাকশন এসেছে আমার কাছে।

টাকা হাতে নিয়ে রুবা বলে, একই ঘরে আপনার মতো একজন সহকর্মী পেয়ে বেশ খুশি হয়েছি।

ফারাহ হাসে। হেসে বলে, আমিও খুশি। এ ঘরে পুরুষ সহকর্মী নেই। এটা হলো আমাদের বাড়তি সুবিধা। একসঙ্গে হেসে ওঠে দুজন।

.

ঘড়ির কাঁটা ধরে বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে বের হয় রুবা। এতক্ষণে মনে পড়ে মুঠোফোনের কথা। একটা উত্তেজনার মধ্যে পার করেছে পুরোটা সময়। জাহেদ আকবরের রুমে ঢোকার আগে ফোনসেট বন্ধ করে রেখেছিল, আর খোলা হয়নি। শেষ মুহূর্তে কথা হয়েছিল রবিনের সঙ্গে। না জানি কতবার কল দিয়েছে সে। নিশ্চয় উত্তপ্ত হয়ে আছে। থাকুক। ফোন অন করে কল করে তাকে।

গম্ভীর হয়ে কল রিসিভ করে রবিন। বলল, কী বলবে, বলো।

যা বলব, তা শুনে মাথা গরম হয়ে যাবে তোমার।

মাথা এমনিতেই হট আছে, আর গরম হওয়ার স্কোপ নেই। থমথমে গলা রবিনের।

শোনো, ১০ হাজার টাকা বেসিক স্যালারি। টোটাল ২০ হাজার। এখন অগ্রিম পেয়েছি ১০। উত্তপ্ত আছে আমার ব্যাগ।

বেতনের কথা শুনে প্রায় দম আটকে যাচ্ছিল রবিনের। উত্তপ্ত মন আচমকা শীতল হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় তার মুখের কথা।

রুবা চিৎকার করে বলে, কথা বলছ না কেন। হার্টবিট ঠিক আছে তো?

রবিন বলে, ঠিক আছে।

ঠিক থাকলে কথা বলো।

অফিস এনভায়রনমেন্ট কেমন?

চমৎকার। সবাই অসাধারণ।

পরিচালক-প্রশাসন তো পুরুষ, তাই না?

হ্যাঁ।

এজন্য এত উচ্ছ্বাস?

চড় খাবে। বলে লাইন কেটে দেয় রুবা। এত আনন্দের মধ্যে এমন নেগেটিভ খোঁচা সইবার শক্তি নেই। মোবাইল ফোন অফ করে রাস্তায় নেমে আসে রুবা। অফিস কাছে, খামারবাড়ির পেছনে শেলটেকের গলিতে, হেঁটে যাওয়া যাবে এখান থেকে। হোস্টেলে যেতে হবে প্রথমে। রুমমেটদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে আনন্দ। রবিনের সঙ্গে কথা বলে, মন তেতে উঠেছে এখন। ঠান্ডা হোক। ঠান্ডা হলে কথা বলবে আনিকার সঙ্গে। আফরিনের কথাও মনে পড়ে। কল করার ইচ্ছা হয় তাকেও। ইচ্ছা সামাল দিয়ে ও হাঁটতে থাকে হোস্টেলের দিকে।

ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের রাস্তার পশ্চিম পাশের ফুটপাথ দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রুবা। এ সময় বেশ ভিড় থাকে এখানে। জনারণ্যের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে ভালো লাগছে। জয়ী মনে হচ্ছে নিজেকে। ফুটপাথে পুরোনো কাপড় বিক্রেতা চিৎকার করে বলছে খালি দশ খালি দশ। কোথাও বলছে খালি এক শ খালি এক শ। সুর করে ডাকতে থাকে ওরা। এই ছন্দময় চিৎকার ভালো লাগে রুবার। বিক্রিও হয় প্রচুর। দরিদ্র মানুষের কেনাকাটার ভালো জায়গা এটি। রুবাও সব সময় কেনাকাটা করে এখান থেকে। পায়ের স্যান্ডেল থেকে শুরু করে সালোয়ার-কামিজও কিনেছে ও এখান থেকে। জায়গাটাকে বস্তি মনে হয় না। মনে দোল দিয়ে যায় এখানকার ছন্দময় ব্যস্ততা।

সামনে ফল বিক্রেতা। এক কেজি আঙুর নিল রুবা। পাশে আছে বনফুলের মিষ্টির দোকান। এক কেজি রসমালাইও নিল। এক কেজি সন্দেশও কিনতেও ভুলল না। সন্দেশ পছন্দ সিমির। রসমালাই পছন্দ মণির। আঙুর হচ্ছে সানিয়ার প্রিয় ফল। ওদের পছন্দের কথা ভোলেনি রুবা। আজ আনন্দের দিনে সবাইকে মনে পড়ছে। আফরিনকে পাচ্ছে না হাতের কাছে। পেলে ওর জন্য কেএফসি-কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন নেওয়া যেত। এটি আফরিনের প্রিয় খাবার। আফরিন সেদিন এ আইটেমটি খাওয়াতে চেয়েছিল। রাজি হয়নি রুবা কেন রাজি হয়নি জানে না ও। কেবল টের পেয়েছিল ভেতর থেকে ছুটে আসা এক অপ্রতিরোধ্য শব্দ না। এ না সর্বনাশ করেছে! মধুর বন্ধুত্বে ঢেলে দিয়েছে বিষ। নিজেকে দোষ দিল না রুবা। নিজের উপলব্ধিকে ও ছোট করে দেখে না কখনো। সব সময় বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থেকেছে। সেই স্বচ্ছতার স্থান অনেক উঁচুতে। নিচুতে নামতে চায় না ও উঁচু স্থান থেকে। তবে আফরিনের জন্য মনের মধ্যে যে মমতা ও টান টের পায় সেটা দিয়ে নিজের বিবেককে মাপতে পারে না। কখনো কখনো নিজের ভেতরের বোধ বাস্তবতা দিয়ে মাপা যায় না। মাপতে পারছে না রুবাও। এ অক্ষমতা মেনে নিয়েছে ও। আফরিনের জন্য কেমন যেন লাগে। এ অনুভূতির অর্থ খোলাসা হয়নি আজও। এর রহস্য জানা নেই নিজের কাছে।

গ্রীন রোড থেকে ডানে মোড় নেয় রুবা। হোস্টেলের গলিতে ঢোকে। গলিটাকে অনেক ঐশ্বর্যময় মনে হচ্ছে আজ। মনে হচ্ছে, বনেদি গলি এটি। নতুন জীবনের পথ খুলে দিয়েছে গলিটি। রাস্তার জরাজীর্ণ দশা, দোকানপাটের দারিদ্র্য, সব ছাপিয়ে বেড়ে উঠছে মনের প্রশস্ততা। এদিকে রয়েছে অনেক নাম করা কোচিং সেন্টার। পুরো দেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এইচএসসি পাস করার পর ছুটে আসে এখানে। ভর্তিযুদ্ধের তরী পার হওয়ার জন্য কোচিং করে। কেউ জয়ী হয়। কেউ হয় পরাজিত। কেউ ফাঁদে পড়ে ডুবে যায়। চোরাগলিতে। চোরাগলি টানতে পারেনি তাকে। টেনেছে পড়াশোনার নেশা। এ নেশা দিয়েছে তাকে স্বর্ণালি দিনের ঠিকানা। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে হোস্টেলের সামনে। একবার পেছন ফিরে তাকাল উল্টো দিকের বাসাটির দিকে। এ বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে একজন গৃহবধূ। রুবাকে দেখে। দেখে কী ভাবে? ভাবে, মেয়েটি নষ্ট? বাজে মেয়ে? আজ নেই কেন সে? দেখে যাও, নষ্ট মেয়ে বাজে মেয়ে নয়; সংগ্রামী মেয়ে, জয়ী মেয়ে ও। বলতে ইচ্ছা করে দেখে যাও–জয়ের উন্নত ঠিকানা।

পাড়ার গলিতে ওরা কারা? চার-পাঁচজনের একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে আছে মামা-ভাগ্নে রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা অশোভন। ওরা কী চায় এখানে? এখন সব মেয়ের হোস্টেলে ফেরার সময়। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাই কি ওদের উদ্দেশ্য?

উদ্ধত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে রুবা। ওদের কাছাকাছি আসার পর একজন বলে, যাইবেন?

ঘুরে দাঁড়াল রুবা। কঠিন গলায় শব্দ ছুঁড়ে দিল, আমাকে বলছেন?

হ। আফনারে বলতাছি।

কী বলছেন, আবার বলেন।

জিগাইছি, যাইবেন কি না?

যাইবেন মানে কী? কী বলতে চাচ্ছেন?

ছেলেটি এবার বিকৃত ভাষায় বলে, ভাড়া যাইবেন? রেট কত?

উদ্ধত ভঙ্গিতে সামনে রুখে দাঁড়ায় রুবা। তোদের বোনেরা কি ভাড়া খাটে? মায়েরাও ভাড়ায় যায়? প্রায় চিৎকার করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ও।

চিৎকার শুনে বেরিয়ে আসে আশপাশের দোকানের কর্মচারীরা। এমন তেজোদীপ্ত মেয়ে কম দেখেছে তারা। এমন প্রতিবাদ কম শুনেছে ছেলেরা। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত মাথা নত করে ভেতরে ঢুকে যায় মেয়েরা। প্রতিবাদ করে না। সাহস পেয়ে গিয়েছিল ছেলেগুলো। প্রতিবাদের ভাষা শুনে আজ পেছন হটে যায় ওরা। ওদের একজন বলে, এই হোস্টেলের মেয়েরা ভাড়া খাটে, জানি আমরা। এত তেজ ভালা না।

থরথর করে কাঁপতে থাকে রুবা। ক্রোধে ফেটে যাচ্ছে, হোস্টেল নিয়ে কোনো বদনাম শুনতে রাজি নয় ও। মানতে রাজি নয়।

ছেলেরা দূরে সরে যাওয়ার পর একজন বয়স্ক দোকানদার এগিয়ে এসে বলে, মা, ওরা ভালো না। এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। আমরা জানি, এই হোস্টেলে ভালো মেয়েরা থাকে। মেধাবী মেয়েরা থাকে। ওদের কথা কানে তুলো না, মা।

ফুঁসে ওঠা মন নরম হয়ে যায়। ঠান্ডা হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুবা হোস্টেলের দিকে। মনে মনে শ্রদ্ধা জানায় লোকটিকে।

রুমে ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে ধরে মণি-সানিয়া। ওদের উচ্ছ্বাসে সমান সাড়া দিতে পারল না রুবা।

মণি বলে, আপু, মন খারাপ কেন তোমার?

সানিয়া জানতে চায়, কী হয়েছে, আপু?

থমথমে গলায় রুবা বলে, বখাটেরা হোস্টেলে ঢোকার মুখে বাজে কথা বলেছে। চেঁচামেচি করেছি ওদের সঙ্গে।

কোনো অসুবিধা করেনি তো তোমার?

না। অসুবিধা কী। আমার প্রতিবাদ শুনে চলে গেছে লেজ গুটিয়ে।

কী বলেছে তোমাকে? মণি জানতে চায়।

পুরো ঘটনা খুলে বলে রুবা। সানিয়া, মণি দুজনই সব শুনে হতবাক হয়ে যায়।

সানিয়া বলে, বাইরের লোকদের হোস্টেল নিয়ে এমন ধারণা?

কারেকশন করে রুবা বলে, বাইরের লোকেরা না। বখাটেরা এমন বলেছে। মুরব্বিরা প্রশংসা করেছে হোস্টেলের ছাত্রীদের।

মণি বলে, মন খারাপের কিছু নেই। আমরা ভালো থাকলে পৃথিবী ভালো। কে কী বলল, শুনলে কি চলবে?

মণিকে সমর্থন দিয়ে রুবা বলে, এটা সত্যি কথা। আমরা আমাদের মতো নিজেদের গড়ে তুলব। অন্যদের বাজে কথায় কান দেব না, না বলব। আর ভালো কথায় বলব হ্যাঁ।

এবার বাস্তবে ফিরে এলো রুবা। সানিয়ার হাতে তুলে দিল আঙুরের প্যাকেট, মণির হাতে রসমালাই। আর সন্দেশের প্যাকেটটি রাখে সিমির টেবিলে।

মণি উচ্ছ্বসিত হয়ে যোগ করে, আপু আগামীকাল সিমির জন্মদিন। চলো, সবাই মিলে রুমে ওর জন্মদিনটা পালন করি। আজ ওকে কিছু বলার দরকার নেই। কাল ছুটির দিন। পুরো দিনটা এনজয় করব ঘরে। তোমার চাকরিটাও সেলিব্রেট করব আগামীকাল। একসঙ্গে দুই কাজ, কী বলে?

রাজি হয় সানিয়া। রুবাও প্রপোজালটা লুফে নিয়ে বলে, ঠিক আছে। সব রেডি করে ফেলব আজ। কেকের অর্ডার দেব আমি। আফরিন পছন্দ করে স্পেশাল আইটেম। স্পেশাল খাবার নিয়ে আসব ঘরে। সিমির জন্মদিনের কথা শুনলে নিশ্চয় আফরিন আসবে আগামীকাল। রুম ডেকোরেশনের বেলুন, হ্যাপি বার্থ ডে লেখা ব্যাকড্রপ নিয়ে এসো তোমরা।

কঠিন জীবনে এত আনন্দ বোধ হয় আসেনি আর। উৎসবের আয়োজনে সবার ভেতর নতুন প্রাণের জোয়ার আসে।

সানিয়া বলে, আপু, রুমে প্রোগ্রাম করলে রবিন ভাইয়া বাদ পড়ে যাবে।

মণি বলে, তাই তো!

ওদের প্রতিক্রিয়ার জবাবে রুবা বলে, ওর সঙ্গে আলাদা সময় কাটাব। ভাবার কিছু নেই।

আনিকার কথা মনে পড়ে। প্রাণঢালা এমন উৎসবে আনিকা থাকলে ভালো হতো। আনিকাকে ফোন করল রুবা। চাকরির খবর, বেতনের স্ট্যাটাস, জাফরিন নঈম ম্যাডামের প্রপোজালের কথা জানাল রুবা। আনন্দে আত্মহারা আনিকা বলে, তোমরা আনন্দ করো আপু। দূর থেকে পাশে থাকব আমি। মন খারাপ কোরো না আমার জন্য।

ওর কথার জবাব দিল না রুবা।

উদ্বেগ নিয়ে আনিকা জানতে চায়, কুষ্টিয়া ব্রাঞ্চে পোস্টিং দেবে না তো তোমাকে?

রুবা উত্তর দেয়, জানি না।

আনন্দের মাঝেও একটা শঙ্কা ঢুকে থাকে মনে। তবুও ভেঙে যাওয়ার মেয়ে নয় রুবা। ফিরিয়ে আনে নিজেকে শক্ত মাটিতে। কল করে আফরিনকে।

হ্যাঁ, ওয়েলকাম টিউন বাজছে…। বুক দুরুদুরু করে। ধরবে তো আফরিন?

ভাবনা থেমে যায়, কল ধরেছে আফরিন। বলে, কেমন আছ, রুবা?

তুমি আমার কল ধরেছ, এজন্য ভালো লাগছে এখন। তুমি ভালো আছ, আফরিন?

ভালো। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে জানতে চায়, কিছু বলবে?

তুমি কি বিজি আফরিন?

হ্যাঁ। ব্যস্ত। তবুও বলো। তোমার কথা শুনি।

কাল আমাদের রুমে একটা জন্মদিনের উৎসব হবে। তোমাকে ইনভাইট করতে চাই। আসবে দুপুরে?

কটায়?

দুটোয় এলে হবে। বেশি সময় নেব না তোমার।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফরিন বলে, কাল বোধ হয় চট্টগ্রাম যেতে হবে আমাকে। না গেলে আসব।

উত্তর শুনে উল্লসিত হয়নি রুবার মন। না আসার একটা সিগন্যাল থেকে গেছে। মন চাইছে আফরিন আসুক। ওকে রাজি করানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রুবা, কাল সিমির জন্মদিন। ওকে সারপ্রাইজ দেব আমরা রুমমেটরা। তুমি পাশে থাকলে খুশি হব।

সিমির জন্মদিনের কথা শুনেও খুশি হলোনা আফরিন। একটা রোবোটিক এক্সপ্রেশন শুনতে পায় রুবা। আফরিন বলল, দেখি।

আরও কথা বলতে ইচ্ছা করছে রুবার। ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে, এখন কি তোমার সঙ্গে আছে সিমি?

হ্যাঁ। ও বিজি এখন। এনগেজড আছে একটা কাজে।

এনগেজড শব্দটা শুনতে কেমন বেমানান লাগল। তবুও আফরিনের কথায় মাইন্ড করার কিছু নেই। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে রুবা, ওকে কিছু বোলো না তুমি। কাল সারপ্রাইজ দেব সবাই মিলে, ঠিক আছে?

আচ্ছা। রাখি এখন।

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না রুবা। ইচ্ছা হচ্ছিল নিজের চাকরির কথাটা বলতে। বলা হলো না। মন খারাপ হলেও নিজেকে শাসিয়ে দেয় রুবা। ব্যস্ত আছে আফরিন। এজন্য স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারেনি। এভাবে ভাবতে থাকে ও। বিষাদের আড়াল থেকে কুড়িয়ে নেয় আনন্দ। হেসে তাকায় সানিয়া আর মণির দিকে।

তোমরা তো শুনেছ আমার কথা, তাই না?

মণি বলে শুনেছি। অপর পক্ষের কথা শুনিনি। তবে তোমার এক্সপ্রেশন দেখেছি বেদনায় ভরা, কেন আপু?

রুবা থতোমতো খেয়ে বলে, ওর আসার চান্স ফিফটি পারসেন্ট। বোধ হয় এজন্য উল্লসিত হয়নি মন।

থাক। মন খারাপ কোরো না। উনি এলে আমরা খুশি হব, না এলেও খুশি থাকব। আমাদের উৎসবটা হয়ে থাকবে শুধু আমাদের। শক্ত গলায় বলল মণি।

আশঙ্কা নিয়ে সানিয়া বলে, উৎসবের মধ্যমণি সিমি অ্যাকসেপ্ট করবে আমাদের আয়োজন?

এ প্রশ্ন করলে কেন? ভুরু কুঁচকে জানতে চায় রুবা।

অনেক বদলে গেছে সিমি। মনে হচ্ছে, সিমির ভেতর অন্য একটা সিমি ঢুকে গেছে। সেই সিমি দখল করে নিয়েছে আমাদের লক্ষ্মী সিমির দেহ-মন। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা আমাদের রুমমেট সিমি নয়, অপরিচিত কেউ।

সানিয়ার কথার শুনে হাঁ হয়ে যায় রুবা। মণিও। অনিশ্চিত শঙ্কা ঢুকে যায় ওদের মনে। তবুও আশাবাদী রুবা বলে, জন্মদিন জন্মদিনই। গ্রহণ-বর্জন নিয়ে মাথা ঘামাব না। উৎসব আমাদের। থেমে থাকব কেন আমরা?

সানিয়া আবার বলে, মেজাজটা যেন কেমন হয়ে গেছে সিমির!

আমাদের সিমিকে আবার জাগিয়ে তুলব আমরা। শুনতে হবে ওর সমস্যার কথা। একটা পার্টটাইম জব করছে। বলেনি আমাদের কাউকে। আমরাও ওর এক্সপ্রেশন দেখে ব্যক্তিগত বিষয়টা জিজ্ঞাসা করিনি। নিশ্চয় কাজের চাপে থাকে। এজন্যই মেজাজ ভালো থাকে না তার। এ ভাবনা দিয়ে মণি ও সানিয়াকে প্রভাবিত করে রুবা। সবাই মেতে ওঠে আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়ে।

মণি ও সানিয়া নিয়েছে ঘর গোছানো ও সাজানোর দায়িত্ব। সকালে উঠে গুছিয়েছে মণি। ঝরঝরা লাগছে রুম। বেলুন ফুলিয়ে একসঙ্গে দুটো করে। বেঁধেছে সানিয়া–চারপাশের দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে স্কচটেপ দিয়ে। ফুলদানিতে কাঁচা ফুল রেখেছে প্রতিটি টেবিলে। রজনীগন্ধার সঙ্গে গোলাপের শোভা অসাধারণ। স্নিগ্ধ গন্ধে ভরে গেছে রুম। সিমির খাটের পাশে লাগিয়ে দিয়েছে হ্যাপি বার্থ ডে টু সিমি লেখা ব্যাকড্রপ। গতকাল বিকেলে কিনে এনেছিল তারা। এখনো ঘুমাচ্ছে সিমি। ওরা পরিকল্পনা করে রেখেছে, ঘুম থেকে সকালে জাগাবে না। সে দুপুরে ওঠে। ওঠুক। আজও দুপুর পর্যন্ত ঘুমাক।

নিঃশব্দে ঘরের ভেতর কাজ করছে মণি ও সানিয়া।

রুবা বলে, সানিয়া, তুমি চলো আমার সঙ্গে। কেক, গিফট ও খাবার নিয়ে ফিরব আমরা দুপুরের দিকে। রুমে থাকুক মণি। সিমি ঘুমাচ্ছে, ঘুমাতে দাও ওকে।

গতকাল সন্ধ্যায় কেকের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল রুবা। কেকের ব্যাপারে চিন্তা নেই। বারোটার দিকে সাপ্লাই দেবে। প্রথমে কিনতে হবে গিফট। সালোয়ার-কামিজই চয়েস।

সানিয়া বলে, আপু, আমার পক্ষ থেকে ওকে সুতার চুড়ি দেব আমি।

সায় দিল রুবা। ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু নেই আজ। সিমির জনাদিনটা আমাদের সবার আনন্দের দিন। চড়ি নাও। সবাই মিলে চুড়ি দেব, সালোয়ার-কামিজ দেব। তবে খরচ করব আজ আমি। কারণ একসঙ্গে চাকরিটাও সেলিব্রেট করছি আমরা।

ফার্মগেটে এসে চুড়ির দোকানে ঢুকেছে ওরা।

সানিয়া বলে, চলতি ফ্যাশন হচ্ছে সুতার চুড়ি। সুতার চুড়ি কিনতে চাই, তুমি কী বলে?

সানিয়ার কথার জবাব না দিয়ে ডিজাইন ও আকারে নতুনত্বে ভরা নানা রকম সুতোর চুড়ি দেখতে থাকে রুবা। মোটা চুড়িতে সুতা পেঁচিয়ে তৈরি করা হয়েছে রং-বেরঙের এই চুড়িগুলো। এক সেট সুতার চুড়ি কিনে তৃপ্ত হলো না রুবা। পাশে রয়েছে নারকেল মালার চুড়ি। প্রবর্তন এনেছে নতুন ডিজাইনের এ চুড়ি। ষড়ভূজ ডিজাইনে কাটা চুড়িতে বসানো আছে ঘুঙুর। প্রবর্তনার এ চুড়িও এক সেট কিনে নেয় রুবা।

চুড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে ওরা। পাশে রয়েছে মেয়েদের পোশাকের নানা ধরনের কালেকশন শপ।

শপে ঢোকার মুখে রয়েছে হাতের কাজের নকশা করা আকর্ষণীয় পোশাকের দৃষ্টিনন্দন ডিসপ্লে। বিবর্তন বুটিকসের হাতে করা পোশাক ভালো লাগল সানিয়ার। এক সেট সালোয়ার-কামিজ নিয়ে গৌরবদীপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসে দুজনে।

রুবা বলে, এবার একটু দূরে যেতে হবে। কেকের অর্ডার দিয়েছি।

সানিয়া প্রশ্ন করে, কোথায়?

বিজয় সরণির মোড়ে কুপারসে। ফেরার পথে সেটা কালেকশন করে নেব। স্পেশাল আইটেম কেএফসি-কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন নিতে হবে। সেটা পাওয়া যাবে গুলশানে। আরও কিছু আইটেম নেব ওই রেস্টুরেন্ট থেকে।

সানিয়া জানতে চায়, অনেক খরচ হয়ে যাবে না?

রুবা বলে, না। অনেক না। ভয় পেয়ো না। শখ পূরণ করতে হলে কৃপণ হওয়া চলবে না। আর এখন তো সামর্থ্য বেড়েছে, তাই না?

সিএনজি নিয়ে গুলশান কেএফসিতে এসে হাজির হয় দুজন।

ভেতরে ঢুকে পাঁচজনের হিসাব করে মেনু নম্বরগুলো টুকে দেয় রুবা পার্সেলের জন্য। কেএফসি-কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনের সঙ্গে স্টিমি রাইস, টুনা কর্ন সালাদ, স্পাইসি চিকেন এবং পাঁচটি সেভেন আপ ক্যানের অর্ডার দিয়ে এক কোণে বসে থাকে ওরা।

রুবা বলে, এখন কিছু খাবে?

মাথা নেড়ে সানিয়া বলে, না।

রুবা হেসে বলে, ভালো!

ভালো মানে?

মানে বোঝোনি? না বলতে শিখেছ!

তুমি বলো আপু, এ মুহূর্তে কি নাটা অযৌক্তিক?

তোমার চোখে যৌক্তিক। কারণ অন্যরা সঙ্গে নেই। তাই তোমার নাটাকে যৌক্তিক ভাবছি এখন আমি। তবুও অনুরোধ করছি আইসক্রিম খেতে। খাবে?

আইসক্রিমের কথা শুনে জিভে পানি চলে আসে। হেসে গড়াগড়ি খেয়ে সানিয়া বলে, এবার হা বলছি।

হেসে দেয় রুবাও। না ও হ্যাঁ শব্দ ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে দুজনে।

এখনো আইসক্রিম এসে পৌঁছেনি। বেজে ওঠে রুবার মোবাইল ফোন। কল করেছে রবিন।

ম্যাডাম, কেমন আছেন?

রুবা হেসে জবাব দেয়, খুব ভালো আছি।

খুব ভালো থাকার কারণ কী? চাকরি?

রুবা বলে, না। চাকরি না। আইসক্রিম খাব। খাবার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি খাবেন, স্যার? দুষ্টু সম্বোধনের জবাবে পাল্টা সম্বোধন করে রুবা।

রবিন বলে, একা? নাকি কেউ আছ সঙ্গে?

আইসক্রিম কি কেউ একা খায়?

ওহ! তাহলে আরও কেউ আছে?

হ্যাঁ, আছে।

কে?

এক ফ্রেন্ড। রহস্যময় জবাব রুবার।

ফ্রেন্ডটা কি ছেলে, না মেয়ে?

রুবা বলে, কী হলে খুশি হবেন আপনি?

গম্ভীর হয়ে রবিন জবাব দেয়, জানি না।

রুবা বলে, তাহলে শুনুন, ফ্রেন্ডটি ছেলে।

চুপ হয়ে যায় রবিন।

কি, কথা বলছ না কেন? হ্যালো। হ্যালো। হ্যালো..

চট করে সেলফোনটা রুবার হাত থেকে কেড়ে নেয় সানিয়া। বলে, রবিন ভাইয়া, আপনি এত সন্দেহপ্রবণ কেন? রুবাপুর মতো মেয়েকে সন্দেহ করা অন্যায়। বুঝেছেন? ধমক দিয়ে বলে, আমি সানিয়া, রুবাপুর সঙ্গে আইসক্রিম খাব বলে বসে আছি। বুঝেছেন?

লাইন কেটে সেটটি রুবার হাতে তুলে সানিয়া বলে, ঠিক বলেছি না, আপু।

রুবা জবাব দেয়, হ্যাঁ।

হ্যাঁ শুনে দুজনে হেসে ওঠে। আইসক্রিম চলে এসেছে সামনে…

.

পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে সবকিছু। রুমে এসে পৌঁছেছে রুবা, সানিয়া। এখনো ঘুমাচ্ছে সিমি। জন্মদিনের প্রস্তুতি শেষ। এখন প্রায় দুপুর দেড়টা। দুটোর দিকে আসার কথা আফরিনের। আবার কল দিয়ে কি স্মরণ করিয়ে দেবে ওকে? ইচ্ছা জাগে মনে। ইচ্ছাটা নিয়ন্ত্রণ করে নেয় আবার। থাক। সিমিকে দিয়ে কল করাবে। ওর কল শুনে নিশ্চয় চলে আসবে আফরিন।

সানিয়া বলে, আপু চলো, সিমিকে তুলে দিই ঘুম থেকে। চোখ মেললে একসঙ্গে বলব আমরা, হ্যাপি বার্থ ডে টু সিমি।

মণি বলে, ও রেসপন্স করবে তো? নাকি বিরক্ত হবে?

রুবা বলে, প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, আমরা সেলিব্রেট করব ওর জন্মদিন। কথা শেষ করে রুবা ওর খাটের ওপর বসে। সানিয়া ও মণিও দাঁড়িয়ে থাকে পাশে।

রুবা আদর করে ডাকে, চোখ খোলো সিমি। ওঠো ঘুম থেকে। দেখো, আজকের দিনটা কত সুন্দর! কত ঝলমলে! ওঠো। সিমি!

গভীর অন্ধকার থেকে জেগে ওঠে সিমি। চোখের পাতা খুলে আবছা দেখতে পায় তিনটি মুখ চেয়ে আছে ওর দিকে। চমকে ওঠে সে। কেঁপে কেঁপে সোজা হয়ে বসে। বড় বড় চোখ করে তাকায় তিনজনের দিকে।

তিনজন একসঙ্গে সুর করে গেয়ে ওঠে…হ্যাপি বার্থ ডে টু সিমি…হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ….

লাল হয়ে আছে সিমির দুচোখ। কিছু সময় হতবাক হয়ে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে তিনজন। তাকিয়ে থেকে আবার গেয়ে ওঠে…হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ…হ্যাপি বার্থ ডে টু সিমি…

সিমির বন্ধ চোখের পাতার ভেতর থেকে দরদর করে নেমে আসে অশ্রু। বুকটা কয়েকবার ওঠানামা করে। হু হু করে কেঁদে ওঠে তারপর।

ওর মাথাটা বুকের কাছে টেনে রুবা বলে, কাঁদছ কেন, সিমি? তোমার জন্মদিন আজ। হাসো। কান্না থামাও।

কান্না থামে না। কাঁদতে থাকে সিমি।

রুবাকে উদ্দেশ করে মণি বলে, ওকে কাঁদতে দাও, আপু।

অনেকক্ষণ কেঁদে চোখ খুলে চারপাশ দেখে সিমি। ফুল দেখে, বেলুন দেখে। ব্যাকড্রপে হ্যাপি বার্থ ডে টু সিমি লেখাটা পড়ে। আবার কেঁদে ওঠে হু হু করে। কান্নার সুযোগ দেয় ওরা সিমিকে।

রুবা বলে, সহজ হও সিমি। ওঠো। মুখ ধোও। গোসল করে নাও।

গোসল করে এই নতুন ড্রেসটা পররা, চুড়ি পররা। নতুনভাবে জেগে। ওঠো তুমি।

চুপ করে সিমি শোনে রুবার কথা।

ধীর পায়ে সে নেমে আসে খাট থেকে। টুথব্রাশ ও গোসলের কাপড় নিয়ে। এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে।

.

ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেছে সিমি। নতুন কাপড় পরেছে। চুড়িও পরেছে হাতে। বেশ শান্ত সে। বেশ প্রসন্ন। তবে চুপচাপ। কেমন যেন লাগছে ওকে। কী যেন ভাবছে মনে মনে।

রুবা কাছে এসে বলে, আফরিনকেও দাওয়াত করেছিলাম দুপুরে।

রুবার দিকে চোখ তুলে তাকাল সিমি। শীতল গলায় বলে, উনি কি আসবেন বলেছেন আজ?

নিশ্চয়তা দেয়নি। তুমি কল করো। আসতেও পারে।

সিমি আবার বলে, ওনার চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা আজ।

হা বলেছিল। না গেলে আসবে বলেছে। তুমি কল করো। ভালো হয়। এলে। বাইরে থেকে সবার জন্য স্পেশাল খাবার নিয়ে এসেছি আমরা।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল করে সিমি।

রিং হচ্ছে। রিং ধরছে না আফরিন। কানের কাছে সেটটি ধরে কক্ষটাকে এক চক্কর দেখে নেয় সিমি। টেবিলে সাজানো আকর্ষণীয় আইটেম সব দিকে চোখ যায় তার। কেকটাও দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, এত টাকা খরচ করেছ তোমরা? টাকা পেলে কোথায়?

রুবা হেসে বলে, আমার চাকরি হয়েছে। বেতনও পেয়েছি অগ্রিম।

মণি এর সঙ্গে যোগ দিয়ে বলে, আপুর চাকরিটাও সেলিব্রেট করছি আমরা।

একবার ভুরু কোঁচকায় সিমি। তারপর বলে, না। কল ধরছেন না উনি। মনে হয় কল ধরবেন না। ব্যস্ত আছেন চট্টগ্রামে।

সানিয়া বলে, অসুবিধা নেই। আমাদের মতো তোমার জন্মদিন উদযাপন করব আমরা।

মন খারাপ হয়ে যায় রুবার। আফরিন আসবে না। মানতে পারছে না। ও। নরম গলায় বলে, আড়াইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। কী বলো? আফরিন না করেনি। রেসপন্স করছে না। নিশ্চয় ব্যস্ত সে।

মণি বলে, ঠিক আছে। আড়াইটায় কেক কাটব আমরা। তারপর খাওয়াদাওয়া করব।

উল্লাসে ফেটে পড়ে মণি, সানিয়া। তাদের উল্লাসের প্রধান কারণ সিমি। রাগ করেনি সিমি, খেপে যায়নি। চুপচাপ আছে। গ্রহণ করেছে উৎসব আয়োজন।

সিমিকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল রুবা। থেমে যায়। কেক কাটার আগে প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। প্রীতিকর কিছু শুনলে তো ভালো, অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে নষ্ট হয়ে যাবে কেক কাটার মজা।

আংকেল ফোন করেছিল তোমাকে? ইউশ করেছে? জানতে চায় রুবা।

সিমি জবাব দেয়, জানি না, সেট বন্ধ ছিল। মাত্র তো উঠলাম ঘুম থেকে।

কল করবে তুমি?

আমি কেন কল করব?

তোমার জন্মদিনে তুমিই উইশ করো বাবাকে। স্মরণ করিয়ে দাও তার মেয়ে তুমি। না। জবাব দেয় সিমি। বেশ জোরেই বলে নাটা।

না শুনে মণি ও সানিয়া মনোযোগী হয় ওদের কথায়। বোঝার চেষ্টা করে, কেন উচ্চারিত হয়েছে শক্ত না। বুঝতে পারল না। সিমির জোরালো না শুনে দমে গেছে রুবাপু। বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাতে চাচ্ছে না ও।

রুবার হাত ধরে বসে থাকে সিমি। আচমকা আবার হু হু করে কেঁদে ওঠে। কোন সুদূর থেকে আসছে কান্নার প্লাবন বোঝে না রুবা।

আবারও কিছুক্ষণ কাঁদে সিমি। কাঁদতে সুযোগ দেয় রুবা। থামার পর আদর করে জানতে চায়, কিছু বলবে সিমি?

নরম হয়ে সিমি উত্তর দেয়, না।

রুবা বলে, আড়াইটা বেজেছে। চলো, কেক কাটি।

সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়, শিশুর মতো ছুরি নেয় হাতে, কেকের বুকে ছুরি চালায় সিমি। সবাই তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে–হ্যাপি বার্থ ডে টু সিমি…

জাস্ট টাইমের পাঁচ মিনিট আগে অফিসকক্ষে আসন নিয়েছে রুবা। এত ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। বিশ্বাস হতে চাইছে না।

ম্যাডাম, আসব? পিয়নের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকায় রুবা।

আসুন। আপনি করে সম্বোধন করে ও।

ম্যাডাম, এই নিন আজকের পেপার।

পত্রিকাটি হাতে নেয় রুবা। চোখ বোলায় হেডলাইনের ওপর।

ম্যাডাম, চা, না কফি দেব?

চা কফি এসবে অভ্যস্ত নয় রুবা। বুঝতে পারে অফিসের ডেকোরাম এটি। এ ডেকোরাম মেইনটেন করতে হবে। গম্ভীর হয়ে বলে, চা।

চলে গেছে পিয়ন। আবার পত্রিকায় চোখ বোলাতে থাকে রুবা।

শেষ পাতায় একটা ছবি দেখে থমকে যায়।

কে এই মেয়ে? চেনাচেনা লাগছে।

আচমকা লাফিয়ে ওঠে মন খুশিতে। আফরিনের ছবি না? হ্যাঁ। আফরিনকে দেখা যাচ্ছে।

ছবির নিচে ক্যাপশনের লেখা পড়ে আত্মা কেঁপে ওঠে। মনে হয় হিমালয় চূড়া থেকে এইমাত্র পতন হয়েছে তার। আফরিন ধরা পড়েছে র‍্যাবের হাতে। সে স্বাভাবিক কেউ নয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জড়িত মাদক ব্যবসায়ী। নানা অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত। চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে।

কাপন জাগে রুবার বুকে। দেহ কাঁপতে থাকে। মাথা ঘুরতে থাকে, ঘামতে থাকে। রত্নদ্বীপের মুক্তা আফরিন আসল মুক্তা নয়। নকল মুক্তা। মুক্তার মতো বুকে লালন করেছে তাকে। রাজসিকের রাজকন্যার মতো ভেবেছে তাকে। ভাবনার বুকে এসে পড়েছে কুড়াল।

নিজেকে বড় রিক্ত মনে হয়। শূন্য মনে হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে জোশ জেগে ওঠে মনে। না। শূন্য ভাববে কেন ও। পূর্ণ ভাবতে হবে। শক্তভাবে না বলতে পেরেছিল উপযুক্ত সময়ে। শূন্য হতে হতেও বৃত্ত থেকে ছিটকে বেরোতে পেরেছে। পূর্ণ মনে হচ্ছে নিজেকে। তবে কি শূন্য হয়ে গেছে সিমি? না বলতে পারেনি বলে কি ডুবে গেছে অন্ধকার জগতে। সিমির জন্য হাহা করে করে ওঠে রুবার মন।

পিয়নের উপস্থিতি টের পেয়ে কল্পনা থেকে ফিরে আসে রুবা।

কিছু বলবেন?

জি ম্যাডাম। চা নিয়ে এসেছি।

রাখুন টেবিলে।

কাপের দিকে তাকায় রুবা। স্ট্যান্ডার্ড কাপটির রং মিল্ক হোয়াইট–বেশ মোটা, বডিতে চিকনরেখায় আঁকা অর্কিড ফুল। ধোঁয়া উড়ছে কাপ থেকে।

কাপ রেখে চলে গিয়েছিল পিয়ন। কিউবিকেলসের বাইরে গিয়ে ফিরে এসেছে আবার।

মুখ তুলে রুবা বলে, আরও কিছু বলবেন?

জি।

বলুন।

ভয় পাচ্ছি, ম্যাডাম। অভয় দিলে বলতে পারি।

ভয় পাবেন কেন? স্মার্টলি বলুন। সাহস দেয় রুবা।

অফিসে ঢোকার সময় খোশ মেজাজে দেখেছি আপনাকে। তেমন দেখতে পাচ্ছি না এখন, মলিন লাগছে। কোনো বেয়াদপি হয়েছে, ম্যাডাম?

প্রশ্ন শুনে চট করে মনে পড়ে সিমির কথা, চোখের সামনে ভেসে ওঠে আফরিনের ভেতরের রূপটি। হাহাকার করে ওঠে বুকটা। আবারও মুখের রঙে বসে যায় গাঢ় কালো ছোপ। কথা বলার সুযোগ পেয়ে চাপ কমেছিল কিছুটা, প্রসঙ্গ ফিরে আসাতে কষ্ট বেড়ে গেল আবার শতগুণ হারে। কষ্ট বাড়লেও নিজেকে ভাঙতে না দিয়ে, উত্তর না দিয়ে পরিস্থিতি সামলে রুবা প্রশ্ন করে, কী নাম আপনার?

রাইয়ান নাবিল।

বাহ! নামটা তো সুন্দর! মডার্ন! প্রসঙ্গ ঘোরাতে চায় রুবা।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল।

রুবা আবার জিজ্ঞেস করে, কে রেখেছে এ নাম?

আমার আব্বা। গর্ব নিয়ে বলে নাবিল।

কী করেন তিনি?

আব্বা মারা গেছেন। সৌদি আরবে ছিলেন। রোড অ্যাকসিডেন্টে হারিয়েছি তাঁকে। বলতে বলতে বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায় নাবিলের মন। আরও খারাপ হয়ে যায় রুবার মন। বাবার মৃত্যু যেকোনো সন্তানের জন্য বেদনার। নিজেকে সহজ করতে গিয়ে অন্যের মনে বেদনার ছায়া ফেলেছে রুবা, ঠিক হয়নি বিষয়টা। বুঝতে পারলেও এখন করার কিছু নেই ওর। কালচারে এমনটিই ঘটে। পরিচয় হয় এমন আলাপ দিয়ে। সহজ আলাপের মাঝে চলে এসেছে বিষাদ। নিয়তির এই অসহায়ত্বের কাছে কারও রেহাই নেই।

রুবা বলে, আপনার মনটা খারাপ করে দিলাম।

না ম্যাডাম। আপনি খারাপ করেননি। নিয়তি খারাপ করেছে আমার ভাগ্য। এজন্য এখানে পিয়নের চাকরি করতে হচ্ছে।

কতটুকু পড়াশোনা করেছেন?

পড়াশোনা বেশি করতে পারিনি। মা স্বল্পশিক্ষিত। জমিজমা বিক্রি করে বাবা গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। নিজেকে দাঁড় করানোর আগে সব শেষ। তখন জন্ম হয় আমার।

ওহ্! বলে চুপ হয়ে যায় রুবা। কী বলবে, এ অবস্থায় আর কী বলা যায় বুঝতে পারে না ও। নিজের মন খারাপ, এর মধ্যে খারাপ হয়ে গেছে নাবিলের মনও। খারাপে খারাপে তো ভালো হওয়ার কথা মন। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস। অঙ্কের এই হিসাব খাটছে না এখানে। ক্রমেই খারাপ থেকে খারাপের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে ও।

ফিরে যাচ্ছিল নাবিল। আবার থমকে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে বলে, এ অফিসের সবাই আমাকে রাইয়ান বলে ডাকে। তুমি করে বলে। আপনিও তুমি করে ডাকলে খুশি হব।

রাইয়ানের মনের কথা বুঝতে পারে রুবা। স্নেহ-মমতা পেতে চায় ছেলেটি। বয়সেও তার চেয়ে ছোট। তুমি করে বলা যায় সহজে। তবুও অফিস-প্রটোকল বলে কথা! প্রটোকল বুঝতে সময় লাগবে, বুঝতে পারে। এবার একটু সহজ হয়ে রুবা বলে, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হবে, রাইয়ান?

রাইয়ান খুশি মনে বলে, অবশ্যই হবে। পুরো ঠান্ডা দেব, নাকি মিক্সড দেব?

মিক্সড দাও।

রাইয়ান চলে যাওয়ার পর কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে রুবা। ধোয়া বেরোচ্ছে না আর। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মনে প্রশ্ন আসার সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতে তুলে নিল কাপটি। চুমুক দিয়ে দেখে নেয় অবস্থা। না। ঠান্ডা হয়নি। অতি গরম ভাবটা কমে গেছে। এমন গরম চা খেয়ে অভ্যস্ত ও।

ফিরে এসেছে রাইয়ান। গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে পুরো গ্লাস খালি করে রুবা। টিস্যু দিয়ে মুখ মোছে নেয়। নীরবে এসেছে রাইয়ান। নীরবে চলে গেছে। পানি খাওয়ার পর ভেতরের অস্থিরতা কিছুটা কমেছে। অবিশ্বাস্য ঘটনাটা মন থেকে মুছে যাচ্ছে না, ক্রমশ শক্ত হয়ে বসছে মন জুড়ে। পরিণতি কী হতে পারে? আফরিনের সূত্র ধরে কি ওরাও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবে? আতঙ্ক জেগে ওঠে মনে। উড়িয়ে দেওয়া যায় না এমন সম্ভাবনা। ওদের ছাত্রীনিবাসে এসেছিল আফরিন। রেজিস্ট্রি বইতে কার নাম লিখেছিল সে! খেয়াল করেনি। ভাবতেই আরও বেড়ে যায় শঙ্কা। হোস্টেলে ঢোকার সময় সঙ্গে ছিল সিমি। তবে কি হোস্ট হিসেবে সিমির নাম লিখেছিল? দেখা হয়নি। বুকের মধ্যে ঢুকে গেল দুশ্চিন্তার কঠিন পেরেক।

আবার ফিরে এসেছে রাইয়ান। অবাক হয়ে যায় ম্যাডামের মুখের দিকে তাকিয়ে। বুঝতে পারে, ভালো নেই ম্যাডামের মন।

রাইয়ান প্রশ্ন করে, চা ভালো হয়নি, ম্যাডাম?

হুঁ। ভালো হয়েছে। নিজেকে সামলে ছোট্ট করে জবাব দেয় রুবা।

কান্ট্রি ম্যাডাম সালাম দিয়েছেন আপনাকে। কান্ট্রি ডিরেক্টর জাফরিন নঈমকে কান্ট্রি ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে অফিসের নিম্ন শ্রেণির স্টাফরা।

চা শেষ না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় রুবা। ভেতর থেকে সহজ হতে চেষ্টা করে, নিজেকে গুছিয়ে ম্যাডামের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জাফরিন নঈম হাসিমুখে মাথা তুলে তাকান। সংবাদপত্রে ডুবে ছিলেন তিনি। টেবিলে দুটো সংবাদপত্র থাকে নিয়মিত। একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ছিলেন, সাধারণত হেডলাইন পড়ার পর ভেতরে ঢুকতে পারেন না তিনি। আজও পারলেন না। ম্যাডামের হাতে। সংবাদপত্র দেখে ঘাবড়ে যায় রুবা। তবে কি আফরিনের নিউজটা পড়েছেন ম্যাডাম? জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই কি ডেকেছেন? প্রশ্ন এসেছিল মনে। ম্যাডামের হাসিমুখের সম্ভাষণ দেখে প্রশ্ন উবে যায়। কেটে যায় দুশ্চিন্তা। তবুও বদলাল না উদ্বেগের ছাপ।

এনিথিং রং জাহানারা তাবাসসুম? রুবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন ম্যাডাম। প্রশ্নের মধ্যে আছে আচমকা উকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ।

হাসার চেষ্টা করে রুবা। ভেতরের উদ্বেগ চাপা দিয়ে বাইরে হাসি টানা কষ্টকর। পাকা অভিনেত্রীরা হয়তো পারবে তেমনটি। রুবা পারল না। রুবার হাসির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এল আরও বেশি উৎকণ্ঠা।

জাফরিন নঈম আবার জিজ্ঞাসা করেন, মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। অফিসে?

থতমতো খেয়ে রুবা বলে, না ম্যাডাম। ভালো লাগছে অফিস। সমস্যা হচ্ছে না।

এমন লাগছে কেন আপনাকে? মনে হচ্ছে বড় বিপদে পড়েছেন?

বিপদ শব্দটা বুলেটের মতো আঘাত হানে। হ্যাঁ। বিপদই বলা চলে। মনে মনে ভাবলেও বাইরে হাসার চেষ্টা করে। আফরিনের মতো মেয়েকে বন্ধু ভেবেছে ও। আসলে একটা কালসাপ ও। ছোবল দিয়েছে তার রুমমেট সিমিকে। ভয়াবহ দুঃসংবাদটি মাথায় নিয়ে স্বাভাবিক থাকা অস্বাভাবিক। তবুও স্বাভাবিক থাকতে হবে। প্রথম দিন অফিসে এসে বসের সামনে ব্যক্তিগত সমস্যার কথা আলাপ করা উচিত না। ভেঙে পড়া চলবে না। বুঝতে পারে। ভেতর থেকে নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে, টেনশনমুক্ত হতে। ম্যাডামের দিকে মনোযোগ দিয়ে কথার প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য রুবা বলে, আমাকে বিশেষ কী কাজ করতে হবে এখন?

প্রথম সপ্তাহে কাজের ধরনগুলো বুঝে নিন আপনি। আজ কাজ নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আগে অফিসের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হোক। পরে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দেব আমি। সেসব কাজ জাহেদ সাহেব দেখিয়ে দিবেন আপনাকে।

মনোবল ফিরে আসে রুবার। বস এত ভালো হতে পারে, জানা ছিল না। জানা ছিল, বস মানে আতঙ্ক, বস মানে ভয়। বস ইজ অলওয়েজ রাইট। হ্যাঁ। শেষের কথাটা ঠিক। বস ইজ রাইট। বস মানে আতঙ্ক না। ভয় না। উল্কণ্ঠার আগুন নিভে যায়। বেশ ফিট মনে হচ্ছে, যোগ্য মনে হচ্ছে নিজেকে। আশাবাদী হয়ে ওঠে রুবা।

ম্যাডামের সঙ্গে আলাপচারিতায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে রুবা বলে, অ্যাসাইনমেন্টের ধরনটা কী, ম্যাডাম?

আপনি তো জেনেছেন, নির্যাতিত নিপীড়িত নারীদের নিয়ে কাজ করি আমরা। যারা রেপড হয়েছে, এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে, ফতোয়ার শিকার হয়েছে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে যাদের মানসিক যাতনায় ভুগে-বিয়ে হচ্ছে না, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করি। পুনর্বাসনসংক্রান্ত কাজে আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট আছে। এই প্রজেক্টগুলোর দেখভাল নিয়ে মূলত দায়িত্ব পালন করতে হবে আপনাকে।

নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করে রুবা। মানুষের সেবা করার গোপন একটা তাগিদ ছিল সব সময়। সময়টা হাতে এসে গেছে। সুযোগও এখন হাতের মুঠোয়। দৃঢ় হয় নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার সংকল্প। শক্ত একটা জোর টের পেতে থাকে। কমে আসে মুখের উদ্বেগের ছাপ। সহজ হতে থাকে। সাবলীল অভিব্যক্তি নিয়ে বলে, আমার সর্বোচ্চ ঢেলে কাজে মন দেব, ম্যাডাম। সেবামূলক কাজের প্রতি ছোটবেলা থেকে টান ছিল আমার।

ভেরি গুড। আজ থেকে জোর প্রস্তুতি শুরু করুন। আমাদের কাজের ধরন এবং আপনার দায়িত্ব বুঝে নিন জাহেদ সাহেবের কাছ থেকে। আর আমি পাশে আছি সব সময়।

কথা শেষ করে জাফরিন নঈম মন দিলেন ফাইলের দিকে। উঠে দাঁড়াল রুবা। অন্য ধরনের পরিবর্তন টের পেতে লাগল নিজের মধ্যে। বদলে গেছে সে মানসিকভাবে। বদলের হাওয়া অনেকটা উড়িয়ে নিয়ে আসে তাকে নিজের অফিসকক্ষে। চেয়ারে বসার পর আবার ঢেকে রাইয়ান। রাইয়ানের চোখেমুখে খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, ম্যাডামের মন ভালো দেখে তার মনও ভালো হয়ে গেছে। হাসিমুখে সামনে দাঁড়িয়ে বলে, চা খেতে পারেননি, ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ দেব, ম্যাডাম?

রাইয়ানের মনের খুশি টের পায় রুবা। ওর মনটা খারাপ করে দেওয়ার ইচ্ছা নেই। চা খাওয়া অসম্পূর্ণ ছিল ঠিক, আর খেতে ইচ্ছা করছে না এখন। তবুও বলে, যাও, নিয়ে এসো আরেক কাপ।

রুম থেকে বেরিয়ে গেছে রাইয়ান। কিছু কাগজপত্র দেখছে রুবা। প্রজেক্ট বিষয়ে একটা ফাইল আছে ড্রয়ারে। ফাইলটা বের করে পড়তে থাকে। অফিসের সবাই সিনসিয়ার। সময়মতো চলে এসেছে কাজে। যার যার চেয়ারে বসে প্রত্যেকে দায়িত্ব পালন করছে। কোনো হইচই নেই। চিৎকার নেই। আচ্ছা নেই। একটা ফাইলের ওপর লেখা–নারী পাচার। ফাঁদে পড়ছে নারীরা। ফাঁদ শব্দটি ঠাস করে বুকে আঘাত হানে। ফাঁদে আটকে গেছে সিমি! নিজেও প্রায় আটকে গিয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। আসলেই কি বেঁচে গেছে? নাকি মাকড়সার জালের মতো সুতা লেগে গেছে পায়ে? ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মুখের ছাচ বদলে যেতে থাকে। জমে যেতে থাকে। উদ্বেগ আবার চেপে ধরে মন।

কাপ হাতে খুশি মনে রুম ঢুকছিল রাইয়ান। ম্যাডামের মুখের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে উবে যায় খুশির ঝিলিক। থমকে যায় সে। দ্রুত রুম ঢুকতে যাচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোর জন্য কাপটা নড়ে ওঠে। এক ছলক চা ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। বিব্রত অবস্থা রাইয়ানের, সংকুচিত হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে।

কাপ-পিরিচের ঘর্ষণের শব্দ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় রুবা। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকা রাইয়ানকে কাছে ডাকে। টেবিলে রাখতে বলে কাপ।

কাপ রেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে রাইয়ান। ফিরে যাচ্ছিল সে। আবার ফিরে তাকাল ম্যাডামের মুখের দিকে। কাপের দিকে তাকিয়ে আছে রুবা। রাইয়ানের মনে হলো, কাপ দেখছেন না ম্যাডাম। পুরো শূন্যতা নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন কাপের দিকে। নিজেকে দোষী ভাবতে থাকে সে। ভাবছে, তাকে পছন্দ করছেন না ম্যাডাম। খারাপ হয়ে যায় তার মন। খারাপ মন নিয়ে নিজের জায়গায় এসে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে সে।

ভালোই ছিল অফিসের যাত্রাটা। শুভযাত্রায় শুরু হয়ে গেছে রাহুগ্রাস। কীভাবে মুক্তি ঘটবে এই রাহু থেকে? জানা নেই রুবার। ও মন বসানোর চেষ্টা চালাল ফাইলে। মন বসছে না। নানা রকম দুশ্চিন্তায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মন। চমকে ওঠে হঠাৎ। সেলফোন বাজছে। শব্দ শুনে কাঁপন ধরে গেছে শরীরে। মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখে মণির কল। দ্রুত অ্যাটেন্ড করে কলটি। মণির ভয়ার্ত কথা শুনে জমে যায় রুবা।

মণির স্বর অন্য রকম। কাঁপতে কাঁপতে বলে, আপু, তুমি যাওয়ার পর সিমির ফোন বাজতে থাকে বারবার। একসময় ঘুম ভেঙে যায় তার। কল অ্যাটেন্ড করে অনেকটা লাফিয়ে ওঠে বিছানা থেকে। দ্রুত হাতে ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। কথা বলেনি আমার সঙ্গে। সানিয়া জিজ্ঞাসা করেছিল, কী হয়েছে? জবাব দেয়নি। দেখে মনে হয়েছে, ভয়াবহ কোনো কিছু ঘটেছে। বুঝতে পারছিলাম না। এজন্য তোমাকে জানাইনি এতক্ষণ। তোমাকে টেনশনে ফেলতে চাইনি।

জবাব দিচ্ছে না রুবা। কথা বলছে না। বলতে পারছে না আফরিনের খবর। পত্রিকার খবর। রুমে পত্রিকা যায় না। পত্রিকা পড়ার সুযোগ পায়নি। মণি-সানিয়া। ওদের সব বলা উচিত হবে কি না, ভাবতে লাগল রুবা।

মণি আবার বলে, একটু আগে নিচ থেকে সিকিউরিটি গার্ডরা ডেকেছিল সিমিকে। সে কোনো এক ফাঁকে বেরিয়ে গেছে, টের পায়নি গার্ডরা।

ডেকেছিল কেন?

গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন নাকি এসেছিল হোস্টেলে। খোঁজখবর নিয়ে গেছে সিমির ব্যাপারে।

তোমাদের ডাকেনি? না। সিকিউরিটিরা সামাল দিয়েছে। ভালো রিপোর্ট দিয়েছে ওরা সিমির ব্যাপারে।

সিকিউরিটি গার্ড আর কিছু জানিয়েছে?

হ্যাঁ। আমাদের রেজিস্ট্রি খাতা নাকি চেক করেছে গোয়েন্দারা। কে কে এসেছে সিমির কাছে, খোঁজ নিয়েছে। বিশেষ করে, আফরিন আপা আসার ডেট নোট করে নিয়ে গেছে।

কার গেস্ট হিসেবে আফরিন সিগনেচার করেছিল, বলেছে গার্ড?

হ্যাঁ। সিমির নাম বলল। সিমির গেস্ট হিসেবে নাম লিখে দস্তখত করেছিলেন আফরিন আপা।

চট করে একটা বড় শ্বাস বেরিয়ে আসে। মাথার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল কিং কোবরার বিষ। ছোবল খেয়েছিল পত্রিকা পড়ে। বিষের নীলদংশন দুম করে উবে যায় মাথা থেকে। যেন আশি হাজার মণ ওজনের একটা বস্তা এইমাত্র ফেলে দিল ও মাটিতে। হালকা লাগছে। ভালো লাগছে। লাইন কেটে দিয়েছে। কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এবার তাকাল অফিস রুমের বাইরের গেটের দিকে। দেখল, একমনে তাকিয়ে আছে রাইয়ান।

এগিয়ে এসে রাইয়ান বলে, ডেকেছেন ম্যাডাম আমাকে?

না তো?

ওহ্। ঠিক আছে ম্যাডাম।

ডেকেছি মনে হলো কেন তোমার?

মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন। এতক্ষণ গম্ভীর ছিলেন। ভয় পাচ্ছিলাম।

এখন ভয় পাচ্ছ না?

না। এখন স্বাভাবিক লাগছে আপনাকে। মোবাইলে কথা বলার পর স্বাভাবিক হয়ে গেছেন আপনি।

ঠিক আছে। যাও তোমার কাজে। প্রয়োজনে ডাকব আমি। কথাটা হাসিমুখে বলতে পেরেছে রুবা। বুঝতে পারে, ওর ভালোমন্দের খোঁজ রাখবে রাইয়ান। বেশ সিরিয়াস সে এ ব্যাপারে। সবার জন্যই বোধ হয় এমন সে। তাকে ডাকেনি রুবা। তবুও নিজের এক্সপ্রেশনে কেন জেগে উঠেছে আহ্বান? বুঝতে পারে না রুবা। বোঝার চেষ্টা না করে মন বসাল ফাইলে। হ্যাঁ। এবার মন বসছে। পড়ছে। সচেতন হয়ে উঠছে নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে।

কতক্ষণ সময় গেছে টের পায়নি ও।

ম্যাডাম। শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকাল রুবা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ফুটে আছে বিনয়।

কিছু বলবে?

জি ম্যাডাম। জাহেদ আকবর স্যার সালাম দিয়েছেন আপনাকে।

নিজেকে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় রুবা। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে। পরিচালক-প্রশাসন নেমপ্লেটটা বেশ গর্জিয়াস। নেমপ্লেট দেখে যেকোনো অতিথি প্রথমে ঘাবড়ে যাবে। এর আগেও এসেছে রুবা। এখন ঢুকছে অফিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে। তবুও নড়ে উঠল, কিছুটা নার্ভাস ফিল করছে ও। কেঁপে কেঁপে বলে, স্লামুয়ালাইকুম!

জাহেদ আকবর বলেন, ওয়েলকাম তাবাসসুম। বসুন।

চেয়ার টেনে বসার পর জাহেদ সাহেব আবার বলেন, আপনার টেবিলের ইন্টারকমটা নষ্ট। কয়েকবার চেষ্টা করে কানেক্ট করতে পারিনি। সরি। প্রথম দিন ইন্টারকম ঠিক থাকা উচিত ছিল। ভাববেন না। ঠিক হয়ে যাবে। বলে দিয়েছি আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ শুরু করবে টেকনিশিয়ান।

বিষয়টা জানা ছিল না রুবার। নষ্ট শব্দ চট করে ধাক্কা দিয়েছে মগজে। অফিস শুরুতে এমন একটা শব্দ নানা ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে ব্রেনে। ঘটে গেছে ব্রেন স্টরমিং। বোকার মতো তাকিয়ে থেকে রুবা বলে, বুঝতে পারিনি আমি, ইন্টারকমটা ধরে দেখার প্রয়োজন হয়নি।

প্রয়োজন হবে। যেকোনো জরুরি বিষয়ে ম্যাডাম কথা বলবেন আপনার সঙ্গে। আমিও কল করব, পিয়ন দিয়ে ডেকে সব কাজ হয় না। টেবিলে বসে সেরে নিতে হয় অনেক কাজ। সব সময় কাছাকাছি থাকব আমরা। এতে সময় অপচয় কম হবে।

সহজ হয়ে রুবা বলে, ওহ। চট করে মনের মধ্যে আবার ঢুকে গেল কাছাকাছি শব্দটা। কাছাকাছি থাকার অর্থ কী? অফিসের বিষয়ে কাছাকাছি আছে সবাই। আলাদাভাবে আবার কাছাকাছি থাকার প্রয়োজন কেন? মনে প্রশ্ন এলেও তাড়িয়ে দিল অশুভ চিন্তা। চুপ করে বসে থাকে ও।

জাহেদ আকবর বলেন, আমাদের পুনর্বাসন সেন্টারে একটা নতুন মেয়ে এসেছে। মেয়েটা রেপড হয়েছে ওদের গ্রামের মেম্বার দ্বারা। কেস চলছিল। রায় হয়েছে বিচারের। খালাস পেয়ে গেছে ধর্ষক। মেয়েটি এখন সুইসাইড করার চেষ্টা করছে। আমাদের গ্রাম প্রতিনিধি তাকে নিয়ে এসেছে ঢাকায়।

ধর্ষক খালাস পেয়ে গেছে? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে রুবা।

হ্যাঁ। প্রমাণাদি ছিল না দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির হাতে। তা ছাড়া ধর্ষণ মামলার ফাঁকফোকর আছে অনেক। ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় আসামিরা।

বন্ধ করা যায় না ফাঁকফোকর?

যাবে না কেন? যাবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা, আইও কীভাবে চার্জশিট দিল, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণের মেডিকেল সার্টিফিকেটও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণের কতক্ষণ পর সার্টিফিকেটের জন্য হাসপাতালে গেল, সেই বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে বিচার পাবে না কেন বাদী?

বিচার পাবে না, ঠিক নয়। পাবে। নৈরাশ্যবাদী নই আমরা। এখন ওয়ান স্টপ সেন্টার চালু হয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়াতেও কি কাজ করব আমরা?

আমাদের কাজ অসহায় মেয়েটিকে সার্বিক সহায়তা করা। এ মুহূর্তে প্রধান কাজ হচ্ছে ওর প্রতি ইমোশনাল সাপোর্ট। এজন্য আছেন কাউন্সেলর। তারা তাদের কাজ করবে। আমাদের কাজ হচ্ছে ওর পাশে দাঁড়ানো। মেয়েটির পায়ের তলার মাটি সরে যায়নি, বুঝতে সুযোগ দিতে হবে তাকে। এ কেসটা আপনি ডিল করবেন। আমাদের আরও ম্যানপাওয়ার থাকবে আপনার সঙ্গে। তাদের কো-অর্ডিনেট করবেন, যেন কোনো সেন্টারে আমাদের নির্ধারিত কাজের ঘাপলা না হয়।

ওকে স্যার। এর মধ্যে কয়েকটি ফাইল পড়েছি আমি। নিজের কাজ বুঝতে পেরেছি। প্রথম কেস ডিল করতে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কনফিডেন্ট আমি। কোথাও ক্রটি হবে না আমাদের ব্যবস্থাপনায়, নিশ্চিত থাকুন আপনি।

থ্যাংকস ফর ইওর কনফিডেন্স। তবুও প্রথম কাজটির সঙ্গে জড়িত থাকব আমিও। আশা করি সমস্যা হবে না।

থ্যাংকস স্যার।

ওয়েলকাম তাবাসসুম! আপনি এখন যেতে পারেন নিজের ঘরে। পরিকল্পনা করে নিন নিজের মতো করে। রেপ কেস নিয়ে একটা ফাইল আছে, সেটাও পড়ে নেবেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিল রুবা। জাহেদ আকবর মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে বলেন, আর একটু বসুন, প্লিজ। আরেকটা কথা আছে আপনার সঙ্গে।

উঠতে গিয়েও বসে পড়ে রুবা।

আজ পত্রিকা পড়েছেন?

দুম করে মাথায় বাজ পড়ে। নড়ে উঠেও নিজেকে সামলে নেয় রুবা। মুখ তুলে তাকাল বসের দিকে। মাথা দুলিয়ে ছোট গলায় বলে, জি, পড়েছি।

ম্যাডাম বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছেন আমার সঙ্গে। যারা হোস্টেলে থাকে, বিশেষ করে আমাদের মেয়েরা, তাদের খোঁজ নিতে বলেছেন। তাদের সাবধানে থাকতে বলেছেন।

কোনো জবাব দিতে পারল না রুবা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কেবল।

জাহেদ আকবর আবার বলেন, ভয় পাবেন না। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, এই আর কি! আমরা চাই না, আমাদের কোনো সহকর্মী কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ক।

কথা নেই রুবার মুখে। আরও বেড়ে গেছে বোকাটে ভাব। মনে মনে ভাবে, বিষয়টা নিয়ে ম্যাডাম তাকে কিছুই বলেননি। ডিরেক্টর অ্যাডমিনকে দিয়ে বলাচ্ছেন কেন? কোনো ঝামেলার কথা কি টের পেয়ে গেছেন ম্যাডাম? এজন্য কি গোপনে খোঁজ নিতে বলেছেন পরিচালক-প্রশাসনকে?

জাহেদ আকবর নড়ে বসে আবারও বলেন, যেকোনো ঘটনা থেকে ভালো দিকটার শিক্ষা নিতে হয়। ঘটনায় জড়িয়ে গিয়েও শিক্ষা হয়, তবে নিজেকে না জড়িয়ে শিক্ষা পাওয়াটা বড় অর্জন।

রুবা বলে, জি স্যার। ঠিক বলেছেন। সতর্ক থাকব আমরা।

কথা শেষ করে রুবা ভালো করে পরখ করে নিল বসকে। না, বসের কথা ও এক্সপ্রেশনে কোনো জটিলতা নেই। যা জানেন তা-ই বলেছেন মনে হলো। প্রাণ খুলে কথা বলেছেন। লুকিয়ে রাখেননি কোনো কথা। দেখে বোঝা যাচ্ছে। অফিসের মুরুব্বি এবং বস হিসেবে সবার দেখভাল করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এজন্য বলেছেন কথাটা।

পুরো পরিস্থিতিকে ভালো চোখে মেপে নিয়ে স্বস্তি পেল রুবা। স্বস্তি নিয়ে বেরিয়ে এলো বসের চেম্বার থেকে। নিজের চেম্বারে ঢোকার আগে ভাবে ধর্ষিতার কথা। ধর্ষিত হয়েছে মেয়েটি। বিচার পায়নি। বিচার সঠিক না পেয়ে আর একবার ধর্ষিত হয়েছে মেয়েটি। পুরো শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে মেয়েটির পাশে। ভেবে ফিরে পায় মনের শক্তি। আফরিনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার জট থেকে নিজেকে বের করে নিতে পেরেছে এই মুহূর্তে।

.

অফিস থেকে ফেরার পথে দুটো দৈনিক পত্রিকা নিয়ে এসেছে রুবা। হোস্টেলে ঢুকতে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তাকাল ও। না। সকালের গার্ডরা বিকেলের শিফটে নেই। বিকেলের শিফটে এসেছে নতুন গার্ড। ওরা অন্য দিনের মতোই দায়িত্ব পালন করছে। কারও নতুন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে কি ওরা জানে না গোয়েন্দা আসার কথা?

স্বস্তি নিয়ে নিজের কক্ষে ঢেকে রুবা। রুমমেট মণি ও সানিয়া শুয়ে আছে। নিজেদের বেডে। সানিয়া তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। মণি আছে চোখ বন্ধ করে। নিশ্চুপ ভেতরে ঢুকে দেখল দুজনকে। একঝলক দেখে ও বসল নিজের খাটে। সিমির খাটের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতর। তার টেবিলটাকেও মনে হচ্ছে না কোনো ছাত্রীর টেবিল। দীর্ঘদিন পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করা হয়নি এ টেবিল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

রুবার উপস্থিতি টের পেতে সময় লাগে মণি ও সানিয়ার। আচমকা লাফিয়ে ওঠে সানিয়া। দুম করে এসে বসে রুবার শরীর ঘেঁষে। শব্দ শুনে চোখ খোলে মণি। সেও লাফ দিয়ে আসে রুবার পাশে।

প্রথম দিন আফরিনকে দেখে একটা খারাপ ইমপালস কাজ করেছিল সানিয়ার মনে। তখনই মনে প্রশ্ন হানা দিয়েছিল, ভালো তো মেয়েটি? জমে গিয়েছিল দেহ-মন। শক্ত হয়ে গিয়েছিল ওর অভিব্যক্তি। টের পেয়েছিল মণি। কেন এমনটি হয়েছিল সানিয়ার, জানা ছিল না তখন। কাকতালীয়ভাবে নয়, সরাসরি এখন ঘটনা বিশ্লেষণ করে মণি বুঝতে পারে, সানিয়ার ইনটিউশন ক্ষমতা অসাধারণ শার্প। ইনটিউশন মানে মন দ্বারা প্রত্যক্ষণ করা–অর্থাৎ পারসেপশন বাই মাইন্ড, জানে মণি। চোখ বড় বড় করে ও বলে, ওই দিন সানিয়ার চোখের ভাষা পড়ে দেখে মনে হয়েছিল, ঝামেলা আছে আফরিন আপার মধ্যে।

সানিয়া সায় দেয়। হ্যাঁ ঠিক বলেছিস তুই। প্রথম দিনই আমার ভালো লাগেনি। তবু ভদ্র আচরণ করেছি। মনের ভেতর থেকে গ্রহণ করিনি ওনাকে।

কথা নেই রুবার মুখে। পত্রিকা দুটি বাড়িয়ে দেয় দুজনের হাতে। পেপার পড়ে হতবাক হয়ে যায় দুজন। ভয় চেপে বসে তিনজনের মনে। তদন্ত হলে কি তাদের নিয়েও টানাটানি হবে? গাণিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে ভয়াল শঙ্কা।

উৎকণ্ঠা নিয়ে সানিয়া জিজ্ঞাসা করে, কী করব এখন আমরা?

মণির কণ্ঠেও একই ধরনের উদ্বেগ। একই প্রশ্ন।

শান্ত গলায় রুবা জবাব দেয়, কী করব, মানে? কী করার আছে আমাদের? কোনো অপরাধের সঙ্গে কেউ জড়িত নই, এ স্বচ্ছতা নিয়ে স্বাভাবিক থাকব আমরা।

সানিয়া পাল্টা প্রশ্ন করে, নিজেদেরকে নিজেরা স্বচ্ছ ভাবলেই হবে না, অন্যেরা যখন আঙুল দিয়ে দেখাবে আমাদের রুমমেটের কথা, তখন কি স্বচ্ছতা বজায় থাকবে?

মণি বলে, হ্যাঁ, তাই তো!

শান্ত গলায় আবার রুবা বলে, পাছে লোকে কিছু বলে নিয়ে ভয় পেলে চলবে না। স্পষ্ট করে জানি, আমরা প্রত্যেকে সগ্রামী মেয়ে। কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করে জীবন যাপন করছি, পড়াশোনা করেছি, তোমরাও পড়ছ। সৎ উপায়ে উপার্জন করছি। অসততা নেই, খারাপ কোনো কাজের সঙ্গেও জড়িত নই আমরা। ভয় পাব কেন? জোরালোভাবে বললেও গোপনে ভেতরে ভেতরে ভয়ের শেকড় গেড়ে বসছে, টের পেতে লাগল রুবা।

শান্ত হচ্ছে না সানিয়ার মন। নানা প্রশ্ন হানা দিচ্ছে মনে। বাইরে তাকাল রুবা। পড়ন্ত বিকেলের ছায়া বাড়ছে। ধীরে ধীরে নেমে আসছে গাঢ় ছায়া। মনে হচ্ছে, এগিয়ে আসছে রাহুগ্রাস, গিলে ফেলবে কি নিজেদের? ভয় নিয়ে সানিয়া বলে, জিজ্ঞাসাবাদে সিমির কথা বলতে বাধ্য হবে বা বলে দেবেন আফরিন আপু। তখন সিমিও অ্যারেস্ট হবে। কান টানলে মাথা আসে। সেই টানে গোয়েন্দারা আমাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করবে। করবে না?

মণি বলে, আফরিন আপু বলছিস কেন? বল আফরিন গুন্ডা।

আপু বা গুন্ডা, কোনোটা বলে লাভ নেই এখন। যা সত্য তা-ই বলব, সিমির ব্যাপারে কিছু জানি না আমরা। সুতরাং ভয় পাওয়ার কারণ নেই আমাদের। বলতে বলতে বাইরে তাকাল রুবা। ছায়া ঢেকে যাচ্ছে আঁধারে। ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। তিন রুমমেট তাকাচ্ছে একে অপরের দিকে। নির্ভরতা চায় ছোট দুজন রুবার কাছে। তিন কোমলমতি মেয়ের মনে ঢুকে গেছে ঝড়। বৈশাখীর মতো আচমকা শুরু হয়ে গেছে নির্মম ঝড়। এ ঝড়ের তাণ্ডবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জীবনতরী, জানা নেই এ মুহূর্তে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *