না – ১

রত্নদ্বীপের সামনে এসে আচমকা থেমে গেছে চলমান সিএনজি অটোরিকশা। পেছনে যাত্রীসিটে বসা রুবা ঝাঁকি খেয়ে ডানে তাকিয়ে দেখল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বায়ে রূপকথার রাজ্য-রত্নদ্বীপ। ভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য রত্নদ্বীপের ওপর চোখ পড়ায় মুগ্ধ হয়ে গেল ও। চালকের ওপর বিরক্ত হয়েছিল প্রথমে। বিরক্তি রূপ নিয়েছে আনন্দে। কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে গেছে ভাস্কর্যের নগরী ঢাকার এ কৃত্রিম রাজ্য। মনে হচ্ছে আলিফ লায়লার রূপকথার রত্নদ্বীপে ঢুকে পড়েছে ও। ভেতরে দেখছে–হাঁ করে আছে বড় বড় তিনটি ঝিনুক। ঝিনুকের খোলা মুখে জ্বলজ্বল করছে তিনটি মুক্তা। পাথরের ওপর বসানো আছে ঝিনুকগুলো, এর চারপাশেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাথর আর পাথর। মাঝে মাঝে তৈরি করা হয়েছে ফোয়ারা, পেছনে সাদা দেয়াল। মুক্তাগুলো রেজিনের আর ঝিনুকগুলো তৈরি স্টেইনলেস স্টিলের। ওর মনে হচ্ছে কৃত্রিম ভাস্কর্যের অংশটুকু প্রায় ২০০ ফুট লম্বা, চওড়া ৫০ ফুট। একটা বড় পাথরে খোদাই করে ছোট্ট করে লেখা রয়েছে মৃনাল হক। কে এই মৃনাল হক? তিনি কি তৈরি করেছেন ভাস্কর্যটি? মনে মনে মৃনাল হককে ধন্যবাদ দিয়ে অটো থেকে নেমে অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে লাগল রুবা। আর চালক তখন ইঞ্জিন খুলে মন দিয়েছে মেরামতের কাজে।

কিছুক্ষণ পরে আবার স্টার্ট নিয়েছে সিএনজি অটোরিকশা। চোখ তুলে অটোরিকশার দিকে তাকিয়ে রুবা দেখল ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ। এতক্ষণ প্রায় ঘোরের মধ্যে ছিল। দেখতে পায়নি ওই তরুণকে। মনে হচ্ছে, কিছু বলতে চায় সে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রুবা বলে, কিছু বলবেন আমাকে?

নরম হয়ে তরুণটি বলে, জি ম্যাডাম, বলতে চাই।

বলুন।

আপনার সিএনজি স্টার্ট নিয়েছে। নিরাপদে সিএনজিতে ওঠার আগে হাতের ব্যাগটা আমার হাতে দিন, ম্যাডাম। আর মোবাইল সেটটাও।

একটা ঝাঁকি খেল রুবা। ভীত চোখে তরুণের দিকে তাকিয়ে দেখল তার গায়ের রং তামাটে, ভেঁড়া জিনসের প্যান্টের সঙ্গে পরেছে টি-শার্ট। চোখ তার শান্ত অথচ ভয়াবহ। আতঙ্কে বুক জমে যায় রুবার, বড় বড় হয়ে যায় চোখ। রত্নদ্বীপের সৌন্দর্য উবে যায় চোখ থেকে। মনে হচ্ছে ফণা তুলে আছে বিষধর একটা সাপ, ছোবল বসাবে এখুনি। মুহূর্তেই বুকের ঢিবঢিব বেড়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। স্বর বেরোচ্ছে না আর কণ্ঠ থেকে।

ছেলেটা শান্ত স্বরে বলে, আমার ডান হাতটা দেখুন। দেখেছেন, ম্যাডাম?

ছেলেটার ডান হাতের দিকে তাকাল রুবা।

সে আবার বলে, এটা একটা স্বয়ংক্রিয় ছুরি। আর এই যে এটা হচ্ছে বাটন। এ বাটনে চাপ দিলে ছুটে যায় ছোট একটা ফলা। আপনার পেট বরাবর টিপলে, ঢুকে যাবে পেটে। বুক বরাবর টিপলে, ঢুকবে বুকে। শব্দ হবে না। ব্যথাও পাবেন না, ম্যাডাম। কেবল ফলাটা ঢুকে যাবে দেহে। সেটা কি চান আপনি? কণ্ঠস্বর একদম শান্ত। সহজ। সরল।

কাঁপতে থাকে রুবা। ছেলেটার শীতল কণ্ঠস্বর ভয় ঢুকিয়ে দেয় মনে।

ফলাটা আপনার দেহে ঢুকুক, চাই না আমি। বিশ্বাস করুন আমাকে।

রুবা এবার চোখ তুলে তাকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের গেটের দিকে। দেখল সিকিউরিটি ফোর্সের অনেক সদস্য দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

ছেলেটা বলে, লাভ নেই ওদের দিকে তাকিয়ে। ওরা ভাবছে আপনার অতি আপন কেউ আমি। দাঁড়িয়ে রত্নদ্বীপের সৌন্দর্য দেখছি আমরা।

স্বয়ংক্রিয় ছুরিটির দিকে আবার তাকাল রুবা।

মাথা নেড়ে তরুণ বলে, গুড। শান্তভাবে ব্যাগটি দিন, ম্যাডাম। সেলফোনটিও। চলুন, আপনাকে উঠিয়ে দিই সিএনজিতে।

ব্যাগটি বাড়িয়ে দেয় রুবা। এগিয়ে দেয় সেলফোনও।

তরুণটি বলে, ডান হাতে ওটা কিসের খাম?

ফ্যাসফ্যাস করে রুবা বলে, পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসে যাচ্ছিলাম। ওটা চাকরির দরখাস্ত।

আচ্ছা থাক। ওটা আপনার কাছে রাখুন। দরখাস্তটা জমা দিন। চাকরি হলে খুশি হব। আমার চাকরি হয়নি। আপনার হোক। চাই।

তরুণের দিকে তাকাল রুবা।

আসুন ম্যাডাম, চালক ডাকছে আপনাকে।

এগিয়ে যায় রুবা সিএনজির দিকে। দ্রুত গিয়ে বসে সিএনজির ভেতর।

তরুণটি আবার বলে, ম্যাডাম, এই নিন, একশ টাকা, আপনার সিএনজি ভাড়া। আর এই নিন আপনার ব্যাগ।

হাত বাড়িয়ে রুবা টাকা নেয়। ব্যাগ নেয়। ব্যাগের চেইন খোলা।

সিএনজি চলতে শুরু করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন দপ্তরের দিকে।

রহস্যময় দ্বীপ নিয়ে অনেক ছবি দেখেছে রুবা। আজ দেখল বাস্তব ছবি। অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছে ও, রোবটের মতো বসে আছে অটোরিকশার ভেতর।

এগিয়ে যাচ্ছে অটোরিকশা।

একবার মাথা বের করে পেছনে তাকাল রুবা। ওকে টা টা দিচ্ছে ছেলেটা। মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে ভোলা ব্যাগের ভেতরে চোখ রাখল এবার। ব্যাগ খালি। ব্যাগে হাজার দেড়েক টাকা ছিল। নেই এখন। নেই মোবাইল ফোনসেটটাও। হাহা করে ওঠে বুকটা।

চালককে উদ্দেশ করে রুবা বলে, ভাই, আপনি কি ওই ছেলেটার দলের লোক?

আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল চালক, স্টার্ট বন্ধ করেনি সে। চলন্ত অবস্থায় চালক প্রশ্ন করে, কিছু কইছেন আমারে?

জি। জানতে চাচ্ছি, ওই ছেলেটাকে চেনেন আপনি?

কী কন আফা? আমি তো ধইরাই নিছি উনি আফনার পরিচিত, আপন কেউ।

আপন কেউ মানে? রাস্তায় হঠাৎ আপন কেউ উড়ে আসবে কোত্থেকে?

তা কী করে কব, আফা। সে আপন মাইনষের মতো আফনার সঙ্গে কথা কইছে। টাহাও দিল দেখলাম আফনারে।

চুপ হয়ে গেল রুবা। ভয় কাটেনি। নিশ্চিত ও, চালক সেই ছেলেটির দলের কেউ। এদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। গন্তব্যে নামতে পারলেই রক্ষা।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসের সামনে বড় রাস্তার পাশে থামে অটোরিকশা।

রুবা বলে, ভেতরে চলেন।

চালক বলে, এহানে নামেন আফা।

কেন? পথে নামিয়ে দেবেন কেন?

পথে না, আফা। এইডা পাবলিক অফিস। এহানে নামেন।

রুখে দাঁড়াতে পারল না রুবা, প্রতিবাদ করতে পারল না অন্যায়ের। সেই ছেলেটির দলের একজন এই চালক। অথচ ওদের ধরিয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না ও। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। রাস্তার পাশে বাস থেকে নেমেছে কয়েকজন তরুণ। সবার হাতে খাম। বোঝা যাচ্ছে ওরাও চাকরিপ্রার্থী। ওদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। ধরা উচিত অটোরিকশাচালককে। সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে পারে না ও। অথচ দেখল চোখের পলকে উধাও হয়ে গেছে সিএনজিটি। অসহায় লাগছে। নিজের ওপর ঘটে গেছে চরম অবিচার। দ্র মুখোশ পরে এভাবে প্রতারণা করে গেল, কিছু করতে পারল না ও। বোকামির জন্য ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হচ্ছে নিজেকে। অটোরিকশার নম্বর টুকে রাখা উচিত ছিল। উচিত কাজটি করার তাগিদও ঠিক সময়ে মাথায় আসেনি। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে প্রবাদটি সত্য হয়েছে নিজের বেলায়। টুকে রাখলে কী লাভ হতো? র‍্যাব বা পুলিশকে কি দেওয়া যেত নম্বরটি? সেই সাহস কি আছে নিজের? ভাবতে ভাবতে পাবলিক সার্ভিস কমিশন দপ্তরে ঢুকে যায় রুবা।

আগেও এসেছিল। দরখাস্ত কোথায় জমা দিতে হয় জানা আছে তার। ভিড় নেই তেমন। তবুও দেখা যাচ্ছে ছোট লাইন। ১০-১২ জন দাঁড়িয়ে আছে সামনে। একে একে জমা দিচ্ছে দরখাস্ত। পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে রুবাও। সবকিছু চলছে ঠিকমতো। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে কোথাও পরিবর্তন ঘটেনি। কেবল নিজের মনে ঘটে গেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। হতাশ লাগছে। হাহাকার লাগছে। অস্বস্তিতে ডুবে যাচ্ছে ও।

নির্দিষ্ট বাক্সে খামটি ঢুকিয়ে ঘুরেই চমকে ওঠে রুবা। একটি মেয়ে পেছনে, একদম শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। চমকে উঠলেও দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যায় ও।

সরি, মেয়েটি বলে।

বিস্মিত হয়ে মেয়েটিকে দেখে রুবা প্রশ্ন ভরা চোখে জানতে চায়, সরি বলছেন কেন?

প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলাম আপনার শরীরে। তাই

সরি বললাম। ওহ্। ধাক্কা তো লাগেনি।

লাগতেও পারত। বলতে বলতে খামটি ভোলা বাক্সে ছেড়ে দিয়ে বলে, নিজেকে আপনার ওপর রাখলাম।

রুবা আবার বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে, মানে?

মানে, আপনার খামের ওপর জায়গা পেয়েছে আমার খামটি।

ওহ্! হাসে রুবা।

সরে আসে মেয়েটি, রুবার কাছাকাছি এসে বলে, এগিয়ে চলুন। আসল কথা বলছি।

আসল কথা কী?

আমার পেছনে একসঙ্গে তিনটি ছেলে ঢুকেছিল। একজন ছিল পেছনে, লাইনে। দুজন বাইরে থেকে গেছে। ওদের আচরণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই এমনভাব দেখাচ্ছিলাম যে আপনি আমার পরিচিত, আপন কেউ।

আপন কেউ আমার পরিচিত শব্দ দুটি চট করে ধাক্কা দেয়। কিছুটা স্থিত হয়ে রুবা বলে, এই অফিসের ভেতরেও কি নিরাপত্তা নেই?

না। না। অফিসে আছে। বাইরে নেই। এজন্য আপনার সঙ্গে জোট বাঁধলাম।

জোট বাঁধলাম, মানে?

মানে সহজ। একা চলা ঝামেলা। নানা ঝুট-ঝামেলায় পড়তে হয় পথে ঘাটে, উটকো লোকজন অযাচিত উপকার করতে চায়। জোট বেঁধে চললে রেহাই পাওয়া যায় সেই ঝামেলা থেকে।

জি। ঠিক বলেছেন।

মেয়েটি বলে, আমার নাম আফরিন। আপনার?

রুবা। সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় ও।

ওহ! আমার এক ফ্রেন্ডের নাম রুবা। ভালো হলো, মনে থাকবে আপনার নাম, ভুলব না।

আর কথা বাড়াল আফরিন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের চেইন খুলে বের করল সেলফোন। রিং হচ্ছে ফোনে।

সরি রুবা, এক মিনিট। মা ফোন করেছেন।

জি, আম্মা। কোনো অসুবিধা হয়নি। দরখাস্ত জমা দিয়েছি। আর হ্যাঁ চিন্তা কোরো না। এখানে আমার এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। কোনো ঝামেলা হয়নি। একনাগাড়ে কথা বলে লাইন কেটে দিল আফরিন। এবার রুবার দিকে তাকিয়ে, হড়বড়িয়ে বলল, কোথাও বেরোলে সব সময় পেছনে লেগে থাকেন মা। কোথায় আছি, কার সঙ্গে আছি ইত্যাদি জানাতে হবে তাঁকে। কতবার নিষেধ করেছি। শোনেন না। বিরক্ত লাগে মাঝে মাঝে।

রুবা বলে, আপনার ভাগ্য ভালো, মা আছে, খোঁজ নেন। আমার তো মা-ই নেই।

ওহ! সরি। কষ্ট দিয়ে ফেললাম আপনাকে।

কষ্ট পাব কেন? এটাই বাস্তব। মেনে নিয়েছি বাস্তবতা।

আফরিনের সেলফোনের দিকে তাকিয়ে কথা থেমে যায় রুবার। ছিনতাই হওয়া নিজের সেটের কথা ভেবে মনে জেগে ওঠে বিষাদ।

হঠাৎ থেমে গেলেন কেন? কী যেন বলতে চাচ্ছিলেন। বলুন, প্লিজ। আপনার মোবাইলটা দেবেন, আফরিন? একটা মিসকল দেব।

মিসকল কেন? কল করুন। কাকে করবেন? করুন। বলে সেটটি এগিয়ে দেয় আফরিন।

প্রয়োজনের তাগিদে সংকোচ ঝেড়ে সেট হাতে নেয় রুবা। কল করে রবিনকে।

অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর লাইন কেটে যায়। মনিটরে ভেসে ওঠে নো আনসার।

আবার কল দেয় ও।

হ্যাঁ। এবার কল রিসিভ করেছে রবিন।

শোনো, আমি রুবা বলছি…

গর্জন করে ওঠে রবিন। রুবাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রশ্ন করে, কোথায় তুমি? মোবাইল অফ কেন? কার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ?

আচমকা প্রশ্নের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায় রুবা। গরম হয়ে যায় ওর কান। প্রচণ্ড অভিমানে চিৎকার করতে ইচ্ছা করে। রাগে মুহূর্তে লাল হয়ে ওঠে চোখ-মুখ। কঠিন কথা মুখে চলে এসেছিল প্রায়। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আফরিন। তার সামনে দ্রুত গুটিয়ে নেয় নিজেকে। ঝোড়ো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে লাইন কেটে দেয় ও।

কোনো সমস্যা? আফরিন প্রশ্ন করে।

রুবা জবাব দেয়,না থাক। কথা বলব না এখন।

কথা বলতে পারেন আপনি, অসুবিধে নেই। দূরে সরে যাচ্ছি আমি। বলতে বলতে দূরে সরে যাচ্ছিল আফরিন।

কথা না বলে সেটটি ফিরিয়ে দিতে দিতে রুবা স্মরণ করিয়ে দেয়, জোট বাধার কথা বলেছিলেন।

হ্যাঁ। ঢাকায় এদিক-ওদিক চলতে গেলে নানা সমস্যায় পড়তে হয় মেয়েদের। দল বেঁধে থাকলে উটকো সমস্যা এড়ানো যায়।

সব সময় তো দল বাঁধা যায় না। এই যে এখানে একা এসেছেন আপনি, আমিও একা…জোট বাঁধব কীভাবে?

একা একা মিলেই দোকা হয়। যেখানে যাব সেখানে অন্যের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলব। জোট বেঁধে ফেলব। এই যে, এখন আমি আর আপনি একজোট। বলে হেসে দেয় আফরিন।

এ সময় আবার বেজে ওঠে আফরিনের ফোন।

হ্যালো। কে বলছেন, প্লিজ? ফোন রিসিভ করে প্রশ্ন করে আফরিন।

একটু আগে রুবা নামের এক মেয়ে এই নম্বর থেকে ফোন করেছিল আমাকে। আমি রবিন বলছি। রুবাকে চাচ্ছি।

ওহ্! আচ্ছা। আমার সামনে আছেন উনি। কথা বলুন।

প্রথম ইমপালসে না বলার চেষ্টা করে রুবা। তার পরও ফোন হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, কী বলবে, বলো।

সরি। সরি বলছি। আর কিছু বলবে?

দীর্ঘক্ষণ তোমাকে কানেক্ট করার চেষ্টা করেছি। ফোন বন্ধ রেখেছ, চিন্তায় পড়ে গেছি। রাগ হয়েছে। জিদ হয়েছে। রাগের মাথায় তোমার সঙ্গে কথা বলেছি। ঠিক হয়নি এভাবে বলা। সরি।

কার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ? এ প্রশ্ন করলে কেন? কোনো বিপদেও তোত পড়তে পারি, সেটা মনে আসেনি?

চুপ করে আছে রবিন।

এবার দৃঢ় ভাবে রুবা বলে, মনের মধ্যে সন্দেহ থাকলে কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ঠিক না। সন্দেহ ঝেড়ে সম্পর্ক রাখা উচিত। সন্দেহ থাকলে অ্যাফেয়ার টিকে না, বুঝেছ?

রবিন আবার বলে, সরি।

আর কথা বাড়াল রুবা। রবিনকেও সুযোগ দিল না কথা বলার। লাইন কেটে সেটটা ফিরিয়ে দিল আফরিনের হাতে। মেয়েটিকে খুব ভালো লেগেছে ওর। সহজে কারও আপন হতে পারে না ও। এইমুহূর্তে আপন হতে পেরেছে। আফরিনকে আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটি দীর্ঘদিনের পরিচিত, অতি আপনজন। এমন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে অসুবিধা নেই। সুবিধা বেশি। ভালো বন্ধু সঙ্গে থাকলে অনেক ধরনের চাপ মোকাবিলা করা সহজ হয়। মনের ওপর থেকেও চাপ কমে, বুঝতে পারে রুবা। আফরিনের হাত ধরে ও সহজ করে নেয় নিজেকে। হেসে বলে, চলুন, বাইরে যাই।

রুবার মনে হলো, আফরিন বেশ ফ্যাশন-সচেতন। ধুতি টাইপ সালোয়ার পরেছে। কামিজের ভি শেপ গলায় হালকা মেরুন রঙের ফুলেল বাউন্ডারির সঙ্গে টিয়া রং দারুণ লাগছে। তার ফিগারটাও দারুণ। চেহারা ও চোখে ফুটে আছে একটা মারকাট ভঙ্গি। একবার তাকালে আবার তাকাতে ইচ্ছা করে এমন মুখের দিকে। তবে চেহারায় মায়াটা কম। মায়া কম হলেও সব মিলিয়ে দারুণ স্মার্ট। নিজেকে ওর পাশে বেমানান লাগছে রুবার। তবুও পাশাপাশি এগিয়ে বাইরে এসে বলে, কই, কোনো ছেলে তো দেখছি না, কারা ফলো করল আপনাকে?

এদিক-ওদিক তাকাল আফরিন। তারপর সহজ গলায় বলে, তাই তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না এখন। ভেগে গেছে মনে হয়।

প্রসঙ্গ টেনে রুবা বলে, ভাগলেই ভালো। আপনার যা ফিগার! কৌতূহলী ছেলেরাও লাগতে পারে পেছনে।

আফরিন বলে, আপনি আপনি করছেন কেন? আমরা এখন ফ্রেন্ড, মনে হচ্ছে সমবয়সি আমরা, তুমি বলতে পারো।

বাপ রে! তুমি তো স্টার্ট করে দিয়েছ তুমি বলা। তোমার মতো অত স্মার্ট না। সহজ হতে সময় লাগে আমার। সহজে কারও সঙ্গে মিশতে পারি না, আপনও হতে পারি না সহজে।

কে বলে পার না? এই যে পারছ। আপন করে কাছে টেনে নিয়েছ আমাকে।

হাসতে হাসতে রুবা বলে, আমি না, আপন করে নিয়েছ তুমি। তুমিই কাছের মানুষ ভাবছ আমাকে।

ওহ্! তাহলে কি আমি আপন হতে পারিনি তোমার?

না। না। সেটা বলছি না। বলছি, তুমি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছ। অবশ্যই আপন হয়েছি আমরা।

যাক। তবু আপন বলে স্বীকার করেছ। ধন্যবাদ তোমাকে।

স্বীকার-অস্বীকারের বিষয়টা বড় না। আপন লাগার অনুভূতি মনের ভেতর থেকে আপনা-আপনি জেগে ওঠে। সেটা বড় বিষয়।

বাপ রে! তুমি দেখছি দার্শনিকের মতো কথা বলছ।

রুবা বলে, সহজ সত্য যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয় না। মনে ধরা দেয় আপনা-আপনি। আমাদের মনে ধরা দিয়েছে আপনকরে ভাবার তাগিদ। অনুভব করছি আমরা, দুজন কাছের মানুষ হয়েছি দুজনের। তাই না?

হাত বাড়িয়ে দেয় আফরিন। রুবাও হাত বাড়ায়। হ্যাঁন্ডশেক করে দুজন। বন্ধুত্বের যাত্রা শুরু হয় দুজনের মধ্যে। রুবা হাসে। আফরিন হাসে। হাসতে হাসতে বড় রাস্তার পাশে চলে আসে ওরা।

আফরিন হঠাৎ বলে, তোমার সেল নম্বরটা দাও।

সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে রুবা। খুলে বলে ছিনতাইয়ের পুরো ঘটনা।

ঘটনা শুনে কেঁপে ওঠে আফরিনও। আচমকা বলে বসে, বাসায় জানাতে পেরেছ?

না। জানানোর সুযোগ পেলাম কোথায়? আর আমি বাসায় থাকি না। হোস্টেলে থাকি।

হোস্টেলে থাকি মানে?

মানে, আমার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। ঢাকায় প্রাইভেট হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি। এখন চাকরি খুঁজছি।

তাই বলে তোমাকে কেউ খোঁজ করবে না? মোবাইল হারালে কেউ যোগাযোগ করতে পারবে না। আপনজনেরা অস্থির হয়ে যাবে চিন্তায়।

হুঁ। এক আপনজন ফোন করেছিল তোমার সেটে। বাবা ফোন করবে বলে মনে হয় না। ছোট বোন ফোন করতে পারে। স্টেপ মাদার আছেন। তিনি খোঁজ নেবেন না।

নাও তো। আমার সেলফোন থেকে ছোট বোনকে কল করো। মনে আছে ওর নম্বর?

আছে।

নম্বর বলল। আমি ধরিয়ে দিচ্ছি।

রুবা মুখস্থ বলে যায় ছোট বোন আনিকার নম্বর। লাইন কানেক্ট করে আফরিন বলে, নাও। কথা বলল। রিং হচ্ছে।

কল রিসিভ হওয়ামাত্র আনিকাকে উদ্দেশ করে রুবা বলে, আমি তোর রুবাপু!

আপু তুমি!

হ্যাঁ। অপরিচিত নম্বর দেখে ঘাবড়াসনি তো?

ঘাবড়াব না মানে? ঘণ্টা খানেক ধরে কল করছি তোমাকে। সেট অফ কেন তোমার? আতঙ্কে জমে যাচ্ছিলাম। তো, তোমার কাজ হয়েছে?

কাজ হয়েছে। আর শোন, মোবাইল ছিনতাই হয়েছে। ভয় পাসনে, আমার কোনো অসুবিধা হয়নি।

চিৎকার করে ওঠে আনিকা, ছিনতাই!

না। ঠিক ছিনতাইও বলা যায় না। আপন মানুষের ভান করে একজন। ভদ্রভাবে নিয়ে গেছে সব। কোনো অসুবিধা হয়নি। ভালো আছি আমি। পিএসসি অফিসে এক ফ্রেন্ডকে পেয়েছি। তার সঙ্গে আছি এখন। তার ফোন থেকে কল করেছি।

উহ্! বাঁচালে। বলে হাঁপ ছাড়ে আনিকা।

লাইন কেটে দেয় রুবা। সেটটা আফরিনের হাতে বাড়িয়ে বলে, তোমার আইকিউ দারুণ শার্প!

কেন? এ কথা বলছ কেন?

আনিকা আমাকে ঘণ্টা খানেক চেষ্টা করে পাচ্ছিল না। অস্থির হয়ে গিয়েছিল।

এটাই স্বাভাবিক। স্বজনেরা খোঁজ করবে, এটা মাথায় রাখা উচিত আমাদের। মোবাইল হারালে কাছাকাছি থাকার সুযোগ থাকে না। এখন। যেখানে যাই সেখানে মনে হয় স্বজনদের পাশে আছি। এজন্য মোবাইল কোম্পানিগুলোকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।

রুবা বলে, হ্যাঁ, কাছে থাকার টান চিরন্তন। এ দাবি অস্বীকার করা যায় না।

হঠাৎ মনে পড়েছে–এমন ভঙ্গিতে আফরিন বলে, আর একটা বিষয়ে দ্রুত সতর্ক হতে হবে।

কী বিষয়?

সিমটা বন্ধ করে দিতে হবে। তোমারটা কি গ্রামীণের?

রুবা বলে, হু।

তাহলে ফোন করে কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসে জানিয়ে দাও। নইলে সন্ত্রাসীরা ওই নম্বর থেকে ফোন করে নানা ক্রাইম করে ফেলতে পারে। শেষে আসল মালিক ফেঁসে যেতে পারে। নাও, আবার কল করো।

রুবা কল করার পরিবর্তে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আফরিনের দিকে। মনে মনে ভাবে, জীবনযুদ্ধে পথ চলতে গেলে ভালো বন্ধু কত প্রয়োজন। অথচ ওর তেমন বন্ধু নেই। রবিনের পজেসিভনেস বিরক্তি জাগায় মাঝে মাঝে। তার সন্দেহ প্রকাশও কষ্ট দেয় মনে। তবুও সে ফিয়ানসে। ফিয়ানসে হলেও কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়েছে। মনের মধ্যে পুরোপুরি নির্ভরতা জাগে না। কেন জাগে না, বুঝে না ও। বুঝতে পারে, দূর করতে হবে ফাঁক। বাড়াতে হবে ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা। কম্প্রোমাইজ করতে না পারলে জটিলতা বাড়বে নানা ইস্যুতে, সংঘাত বাড়বে, মমত্ব হারিয়ে যাবে। না। মন শক্ত করে ভাবে, হারানো যাবে না মমতা। ছোটখাটো সমস্যা তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে হবে জীবনযুদ্ধে।

আফরিন আবার বলে, আচ্ছা আমি কল করছি কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসে।

রুবা মুগ্ধ চোখে দেখছে আফরিনকে।

লাইন কানেক্ট করে আফরিন বলে, নাও। কথা বলল। কাস্টমার সার্ভিসের সবাই কাছের মানুষ।

রুবা সেটটা হাতে নেয়। বলুন, কী উপকার করতে পারি? অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে একটি মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠস্বর।

সমস্যা জানায় রুবা।

কয়েকটি প্রশ্ন করে উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে মেয়েটি বলে, ওকে ম্যাম। কোনো সমস্যা নেই। আপনার সিম অফ হয়ে যাবে। সুবিধামতো সময়ে নতুন সিম নিয়ে যাবেন কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস থেকে। আপনার পাশে আছি আমরা। প্রতি মঙ্গলবার মেয়েদের জন্য আছে আমাদের বিশেষ সেবা। কাল মঙ্গলবার। কাল আসুন।

পাশে আছি শব্দটা নতুনভাবে নাড়া দেয়। নৈরাশ্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে রুবার মন। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল মন। হতাশা জেগে উঠেছিল। হতাশা দূর হয়েছে, কেটে গেছে। বিষাদ। চারপাশ আবার ভরে উঠছে আলোয়। সেই আলোয় দেখছে ও নতুন এক আপনজনকে। নতুন এক বান্ধবী। অন্তরঙ্গ এ বান্ধবী আর কেউ নয়, সামনে দাঁড়ানো আফরিন।

আফরিন জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে এখন?

ভেবেছিলাম, জাতীয় জাদুঘরে যাব। যাব না এখন। হোস্টেলে ফিরতে হবে।

কী প্রোগ্রাম?

আমার এক ফ্রেন্ডের মা রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পী। আন্টির নতুন অ্যালবাম বের হচ্ছে। সেই উপল

ভালোই তো। চলো, তোমার সঙ্গে আমিও যাই।

না। থাক। তোমাকে যেতে হবে না। কষ্ট করতে হবে না।

কষ্টের কথা বলছ কেন? তোমার সান্নিধ্য ভালো লাগছে আমার। চলো, আমিও অনুষ্ঠানটা এনজয় করে আসি।

মুখ তুলে তাকায় রুবা। মনে হতাশা। তবুও চাউনিতে ভেসে ওঠে আনন্দ। হাতে টাকা নেই ভাবতেই আনন্দ আবার বিষাদে রূপ নেয়।

আফরিন বলে, তোমার হাতে টাকা নেই, আমি তো জেনেছি। এ অবস্থায় একা ছেড়ে দিতে পারি না তোমাকে। আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি একা ছেড়ে দিতে আমাকে?

আবারও অবাক হয় রুবা। ভাবে, মেয়েটি কি জাদু জানে? মনে মনে যা ভাবে, আগেই বলে দিচ্ছে তা।

কিছু বলার সুযোগ পেল না রুবা, হাত তুলে একটি সিএনজি অটোরিকশা দাঁড় করাল আফরিন। মুহূর্তের সুযোগ না দিয়ে অটোরিকশায় টেনে তোলে রুবাকে। ড্রাইভারকে বলে, চলুন ভাই, শাহবাগ জাদুঘর।

জাহাঙ্গীর গেটের দিকে খানিকটা সামনে এগিয়ে যায় অটোরিকশা। ডিভাইডার দিয়ে ঘুরে দক্ষিণমুখী চলতে থাকে আবার। অন্তরঙ্গভাবে বসেছে আফরিন। শরীরের সঙ্গে লেগে আছে শরীর। কেউ কথা বলছে না মুখে। অথচ তারা যেন অনর্গল বলে যাচ্ছে কতশত কথা।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে এসে থেমে যায় সিএনজি অটোরিকশা। ভেতর থেকে গাড়ির বহর বের হচ্ছে। আফরিন দেখছে চলমান গাড়ির সারি। সে দিকে চোখ নেই রুবার। তার চোখ স্থির হয় পশ্চিমে, রত্নদ্বীপে। এই ভাস্কর্য দেখতে গিয়ে খুইয়েছে ও প্রিয় মোবাইল ফোনসেট, হাত হয়েছে নিঃস্ব। একসময় মনে হয়েছিল, এটা একটা কফা দ্বীপ, নিঃস্ব দ্বীপ। মনের ওই অবস্থা বদলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে, এ দ্বীপে রয়েছে অনেক মুক্তা, অনেক হীরা। মনে হচ্ছে, এটা একটা ঐশ্বর্যময় দ্বীপ। এ দ্বীপ বুকের ঘরে ভরে দিয়েছে অন্য রকম সুখ, ভালো লাগা। এ দ্বীপ পাইয়ে দিয়েছে। মুক্তার মতো বন্ধু আফরিনকে। পাইয়ে দিয়েছে হীরার মতো উজ্জ্বল বন্ধুত্ব।

চলতে শুরু করেছে সিএনজি। চুপ করে আছে আফরিন, রুবাও।

ভিআইপি সড়ক জুড়ে কেবল গাড়ি আর গাড়ি। শাহবাগ পৌঁছাতে কত সময় লাগবে কে জানে। কেবল বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে গাড়ির সারি। র্যাংগস ভবনের সামনে বিরাট জটলা। সিগন্যালের জ্যাম, নাকি কোনো অ্যাকসিডেন্ট শিউরে ওঠে রুবা। অনুষ্ঠানের শিডিউল সময় এখনো প্রায় ৩০ মিনিট বাকি। সময়মতো পৌঁছানো যাবে তো?

আফরিন বলে, কী ভাবছ?

রুবা হাসে। জবাব না দিয়ে হাসতে থাকে।

হাসছ কেন?

রুবা এবার বলে, হাসছি মনের আনন্দে।

গুড। হতাশা কাটিয়ে উঠেছ। হাসতে পারছ তুমি। এমনটিই চাই। হতাশা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে নেই।

এ সময় পাশ থেকে হর্ন বেজে ওঠে। চার-পাঁচটা গাড়ি একসঙ্গে বাজাচ্ছে হর্ন।

বিরক্ত হয়ে আফরিন বলে, দেখেছ? শব্দদূষণ কাকে বলে, বুঝেছ?।

হর্ন বাজানো নিষেধ ভিআইপি রোডে। তবু হর্ন বাজবে। প্রতিকার নেই। এই অস্বাভাবিক জটের মধ্যেও চলতে হবে আমাদের। সহজ গতিতে চলার উপায় হচ্ছে মনের আনন্দ ধরে রাখা। বলল রুবা।

কথা শেষ হওয়ার আগে হো হো করে হেসে ওঠে আফরিন। রুবাও। আশপাশের গাড়ির যাত্রীরা মুখ বের করে দেখার চেষ্টা করে সিএনজিতে বসা দুই উচ্ছল তরুণীকে।

প্রায় ৩০ মিনিট পর শেরাটনের মোড়ে এসে দাঁড়ায় ওদের অটোরিকশা। এখানেও বিরাট জ্যাম।

রুবাকে সান্ত্বনা দিয়ে আফরিন বলে, স্ট্রেস নিয়ো না। অস্থির হয়ে না। অনুষ্ঠান ঠিক সময়ে শুরু হবে না। কেবল আমরা না, সবাই জ্যামে বসে থাকবে। কেউ জাস্ট টাইমে পৌঁছাতে পারবে না। তার চেয়ে বরং রাজসিককে দেখো। ভালো লাগবে। বলতে বলতে মাথা খানিকটা বের করে আফরিন, রুবার মাথাটা ধরেও টেনে আনে বাইরের দিকে।

শেরাটনের মোড়ে রাজসিক ভাস্কর্যের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। বারবার মাথা ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছা হয়। এটি শেরাটনের সৌন্দর্য ও মর্যাদা দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে। লোহার ফ্রেমের ওপর ফাইবার গ্লাসের অ্যান্টিক কালারের ভাস্কর্যটির উচ্চতা প্রায় ১৪ ফুট, ২২ ফুট দীর্ঘ এবং ছয় ফুট চওড়া হবে মনে হচ্ছে ওদের। নবাব সলিমুল্লাহ সপরিবারে গাড়িতে বসে আছেন, দুটো রাজকীয় ঘোড়া ছুটছে গাড়িটি নিয়ে–সামনে কোচোয়ান চাবুক পেটাচ্ছে। রাইফেল হাতে পেছনে বসে আছে একজন প্রহরী।

আফরিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, দেখেছ, কত সুন্দর!

রুবা সায় দেয়, হুঁ। নজরকাড়া অ্যান্টিক রংটা অসাধারণ। এ কারণে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে ভাস্কর্যটা।

কথা শেষ করার আগে বেজে ওঠে আফরিনের সেলফোন।

মনিটরের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে যায় সে। কল অ্যাটেন্ড করে চুপসে যায়। খানিকটা চমকে উঠে বলে, সরি রুবা। আমাকে নামতে হবে এখানে।

চট করে খারাপ হয়ে যায় রুবার মন। ভ্যাবাচ্যাকা চোখে ও তাকাল আফরিনের দিকে।

আফরিন বলে, কোনো সমস্যা নেই। ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি। ড্রাইভার তোমাকে নামিয়ে দেবে জাদুঘরে।

কথার জবাব দিতে পারল না রুবা।

আফরিন আবার বলে, তোমার সেল নম্বরটা দাও। আর আমারটাও নাও। যোগাযোগ কোরো নতুন সিম তুলে।

এবারও জবাব দিতে পারছে না রুবা। দ্রুত হাতে নিজের নম্বর একটা কাগজে টুকে দেয় আফরিন। রুবার নম্বরও তুলে নেয় নিজের সেটে। একশ টাকার একটা নোট সে গুঁজে দেয় রুবার হাতে। টাকা নিয়ে রোবটের মতো বসে থাকে রুবা। কোনো সময় না দিয়ে দ্রুত নেমে গেল আফরিন। সিগন্যালবার ক্রস করে সে এগিয়ে যেতে লাগল শেরাটন হোটেলের পশ্চিম পাশের ফুটপাতের দিকে।

রুবা তাকাতে পারছে না আফরিনের গমনপথের দিকে। চোখ যায় তার আবার

রাজসিক ভাস্কর্যের ওপর। ভাস্কর্যটিকে আর আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। না এখন। মনে হচ্ছে রাস্তার মোড়ে একটা জঞ্জাল গড়ে তুলেছেন শিল্পী মৃনাল হক। রত্নদ্বীপ তাকে শূন্য করেও পূর্ণ করেছিল। পূর্ণতা আবার শূন্য হয়ে গেছে। নিঃস্ব লাগছে নিজেকে। একই সঙ্গে মনে হচ্ছে রাজা হিসেবে নয়, নবাব সলিমুল্লাহ শূন্য হয়ে রাজ্য ছেড়ে সপরিবারে পালিয়ে যাচ্ছেন অজানা পথে।

অটোরিকশার ড্রাইভার একবার পেছনে তাকায়।

ছেদ পড়ে রুবার স্তব্ধতায়। সহজ হয়ে বলে, কিছু বলবেন?

বাঁয়ে কি ঘুরে যাব? সামনে জটলা। বড় কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে মনে হয়।

যা ভালো বোঝেন আপনি। বলে চমকে ওঠে রুবা। এ সিদ্ধান্ত ড্রাইভারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। অন্তত তার ব্যক্তিত্বে এটা মানায় না। নিজেকে সামলে আবার জবাব দেয়, না। অপেক্ষা করুন। ভিআইপি রোড এটা, এখানে জ্যাম বেশিক্ষণ থাকবে না।

স্টার্ট নিতে গিয়েও থেমে গেল ড্রাইভার। এ সৌজন্য ভালো লাগে রুবার। মনে মনে ড্রাইভারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় ও। কৃতজ্ঞ মনও স্বস্তি পাচ্ছে না। অসাধারণ ভালো লেগেছিল আফরিনের সান্নিধ্য। আচমকা এসেছে ভালোলাগা, চলেও গেছে আচমকা। এখনো সামাল দিতে পারছে না ভেতরের অস্থিরতা। দিশেহারা লাগছে। জাদুঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না আর। ইচ্ছা করছে হোস্টেলে ফিরতে।

রুবা বলে, ড্রাইভার সাহেব, জ্যাম চালু হলে কি এই মোড় থেকে ইউ টার্ন নিতে পারবেন? জাদুঘরে যেতে চাচ্ছি না আমি। গ্রীন রোডে গ্রীন সুপার মার্কেটের পাশের গলিতে যেতে চাই।

ড্রাইভার বলে, মনে হচ্ছে ইউ টার্ন নিতে দেবে না আজ। এখানে নেমে যেতে পারেন আপনি। রাস্তা পেরোলে ট্রেলপাম্পের উত্তর পাশের গলিতে রিকশা পাবেন। রিকশায় ফিরতে সহজ হবে।

কিছুটা সময় ভাবে রুবা। প্রপোজালটা মনে হয় ভালো। সিদ্ধান্ত নিয়ে বলে, ধন্যবাদ। ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। এখন বলুন, আপনাকে কত দিতে হবে?

ষাট টাকা দেখা যাচ্ছে মিটারে। ড্রাইভার মিটার দেখিয়ে বলে, ১০ টাকা বাড়িয়ে দিন, আপা।

রুবা কথা বাড়াল আর। একশ টাকার নোটটা টাকা দিয়ে বলে, নিন বাকি টাকা ফেরত দিন।

বাকি টাকা হাতে নিয়ে অটোরিকশা থেকে নামে রুবা। নিজের অজান্তে একবার তাকাল আফরিনের গমনপথের দিকে। খা খা শূন্যতা জেগে ওঠে আবার মনে। শূন্যতা নিয়ে হাঁটা দেয় সামনে। রাস্তা পারাপারের সময় বাধা পায় রুবা। তারকাঁটা দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া। এপারের পথচারীরা যেন হেঁটে ওপারে যেতে না পারে, পাকাপোক্ত করা আছে সেই ব্যবস্থা। এ রোডে কখনো হাঁটতে হয়নি, জানা ছিল না বিষয়টি। দুপাশে গাড়ির ভয়াবহ জ্যাম। কিছুদূর এগিয়ে যাত্রী পারাপারের স্পট দেখতে পায় ও। দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে থেমে থাকা গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে পেট্রলপাম্পের কাছে চলে আসে রুবা। নিরাপদ জায়গায় এসে আবার পেছন ফিরে তাকায়। অটোরিকশাটি দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না আফরিনের চলে যাওয়া পথটিও। কোথায় গেল মেয়েটি? সামনে শেরাটন হোটেল! এমন করে এত দ্রুত নেমে গেল কেন সে? খচ করে প্রশ্ন ঢোকে মনে। উত্তর খুঁজে পেল না। ব্রেন স্টরমিং করেও কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না রুবা। মনের বিষাদও কাটছে না তাই। চক্রবৃদ্ধি হারে বিষাদ চেপে বসছে। এ বোঝা সামাল দিবে কীভাবে ও! কী অদ্ভুত ব্যাপার! কাঁটাতারের বেড়ার মতো একটা বাঁধার প্রাচীর জেগে উঠেছে মনে। প্রাচীর ভেদ করে দেখা যাচ্ছে না রবিনকে। দেখা যাচ্ছে না আনিকাকেও। স্বজনেরা যেন চলে গেছে প্রাচীরের আড়ালে। চোখের সামনে এসে বারবার দাঁড়াচ্ছে আফরিন। মেয়েটা কি জাদু জানে? জাদুবলে কি দখল করে গেছে মনের সবটুকু স্থান? মনের মধ্যে তারের বেড়ার কাঁটার মতো বিঁধছে কষ্টের কাঁটা। কীভাবে ওপড়াবে ও এ যন্ত্রণা?

সামনে এগোনোর পর গলির মুখে পেয়ে গেল একটি খালি রিকশা। চালক তরুণ। বেশ চঞ্চল। ছটফটে।

যাবেন ভাই?

কই যাইবেন, আফা?

গ্রীন সুপার মার্কেট।

মার্কেটে নামবেন, না ভিতরে যাইবেন?

ভেতরের গলিতে যাব।

৩০ টাকা লাগব, আফা।

ফ্যালফ্যাল করে রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকে রুবা।

এমন করুণ চাউনিতে ভড়কে গিয়ে ছেলেটি বলে, ঠিক আছে। ২০ টাকা দিয়েন, আফা।

রিকশায় উঠে বসে রুবা।

চলতে শুরু করেছে রিকশা। নিজেকে অনেক বাস্তববাদী ভাবে রুবা। অনেক সংগ্রাম করে পার করছে জীবন। এখন মনে হচ্ছে ও আসলে এক ভাববাদী। ভাবনার কোনো শেষ নেই। ভালোই ছিল দিনের শুরুটা। ভালো যাবে সব সময়, এমন কোনো কথা নেই। পরিবর্তনটুকু মেনে নিতে পারছে, আবার পারছে না। অন্য রকম হয়ে গেছে ও।

ধীরে চলছিল রিকশা। থেমে গেল হঠাৎ। একটা মোটরসাইকেল শাঁই করে রিকশা ক্রস করে ঘুরে গেছে বাঁয়ে। কিছুক্ষণ থমকে ছিল মোটরসাইকেলটি। পেছনের সিটে বসা আরোহী পলকের জন্য তাকিয়েছে রিকশার দিকে। রুবাও এক ঝলক দেখার সুযোগ পেয়েছে ছেলেটিকে। অচেনা ছেলে। দেখতে বেশ স্মার্ট। তবে চাউনি কেমন যেন অন্য রকম–ভালো, না খারাপ, বোঝার আগেই মোটরসাইকেলটি বাঁক নিয়ে পেছনের দিকে চলে গেছে। ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে বুক। আবার সহজ হয়ে যায় ও।

রিকশাচালক বলে, মনে অয় ঠেকাবাজ, আফা। ভাগছে।

ঠেকাবাজ মানে?

মানে পেটে ছুরি ধইরে ব্যাগ-মোবাইল নিয়্যা যায়।

রুবা প্রশ্ন করে, একজনের থেকে কবার নেবে?

রিকশাচালক চলন্ত অবস্থায় পেছনে তাকায় একবার। রুবার মুখ দেখার চেষ্টা করে। আবার সামনে তাকিয়ে বলে, একবার নিছে সব?

কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবুও ও জোর করে উত্তর দেয়, হ্যাঁ। সব নিয়ে গেছে।

ভর করে নাই, আফা?

করেছে। সংক্ষিপ্ত উত্তর রুবার।

রিকশাচালক আবার পেছনে তাকানোর চেষ্টা করে। এবার ধমক দেয় রুবা। সামনে তাকান। মনোযোগ দিয়ে রিকশা চালান।

চালক চুপ হয়ে গেছে। বেচারাকে ধমক দেওয়া ঠিক হয়নি, বোঝে রুবা। তবুও উপায় নেই। এত কৌতূহল ভালো লাগছে না। রিকশাচালক ঘামছে। ঘামে ভেজা শরীরে লেপ্টে আছে ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি। ঠেকাবাজদের চেয়ে অনেক ভালো এ রিকশাচালক। শ্রমের বিনিময়ে টাকা রোজগার করে। সংসার চালায়। আর ঠেকাবাজরা! ভাবতেই শক্ত হয়ে ওঠে চোয়ালের পেশি। জেদ ওঠে মনে। জেদি মন নিয়ে তাকিয়ে থাকে সামনে। সবাই দেশ ছাড়তে চায়–কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের ইমিগ্র্যান্ট হতে চায়। কেন চায়, বুঝতে পারে রুবা। এমন নিরাপত্তাহীনতায় কি কেউ দেশে থাকতে চাইবে? চারপাশে ফাঁদ। চারপাশে ঝুঁকি। তার পরও পথচলা। কী করবে রুবা? অন্য অনেক বান্ধবীদের মতো কি কানাডার জন্য অ্যাপ্লাই করবে? হোঁচট খায় ও হঠাৎ। পেছন থেকে আর একটা রিকশা বেশ জোরে আঘাত করে ওর রিকশাটিকে। প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে রিকশাওয়ালার ভেজা শরীরের ওপর নিজেকে ঠেকা দেয় রুবা। অল্পতে রক্ষা পেয়েছে। আর একটু হলে পড়ে যেত!

সহজ হয়ে বসে পেছনের রিকশাচালককে দেখার চেষ্টা করে ও। ততক্ষণে দুই চালকে লেগে গেছে তুমুল ঝগড়া। পেছনের রিকশায় বসা যাত্রীর দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে হিম হয়ে যায় রুবার বুকের রক্ত। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা দেখেছে যাত্রীটিকে। তবে কি কোনো গোষ্ঠী ফলো করছে ওকে?

প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে ওঠে রুবা। বুকে সাহস জোগায়। মনে মনে ঠিক করে, সরাসরি হোস্টেলের সামনে নামবে না। গ্রীন রোডে নেমে যাবে। সুযোগ বুঝে ঢুকবে নিজেদের গলিতে।

গ্রীন সুপার মার্কেটের সামনে নেমে এদিক ওদিক হেঁটে পরিকল্পনা অনুযায়ী হোস্টেলের কলাপসিবল গেটের সামনে এসে একবার পেছন ফিরে তাকায় রুবা। গলির শেষ মোড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। না, গলিতে কোনো রিকশা নেই, সিএনজি নেই। অপরিচিত কোনো মানুষও দেখা যাচ্ছে না। কেউ অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে না এখন। গলির দৃশ্যপটে রয়েছে প্রতিদিনের চিত্র। রাস্তা এবড়োথেবড়ো। কোথাও কোথাও জমে আছে বৃষ্টির পানি। আশপাশের বাসার কাজের মেয়েরা পাশের দোকান থেকে সবজি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। হকার যাচ্ছে। চিৎকার করে ডাকছে মাছওয়ালা। প্রতিদিনের এ দৃশ্যের সঙ্গে অভ্যস্ত রুবা। ভেতরে ঢোকার আগে আবার মাথা বের করে যতদূর চোখ যায় দেখে নেয় রাস্তার শেষ সীমানা পর্যন্ত।

হোস্টেলে ঢোকার মুখে নিচতলায় রয়েছে ওয়েটিং রুম। বেশ কয়েকজন পুরুষ কথা বলছে হোস্টেলের অ্যাডমিন আপার সঙ্গে। কারা ওরা? হ্যাঁ, চিনতে পারে রুবা। একজন মালিকপক্ষের লোক। নিশ্চয় মালিকপক্ষ থেকে আজ হোস্টেল ভিজিট করছে। দেখেও না দেখার ভান করে রুবা সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে যায় তৃতীয় তলায়। ওখানে ওর সিট। উত্তরমুখী কক্ষের জানালার পাশে থাকে রুবা। খাটের তলে পেপার দিয়ে ঢাকা ছিল রাইসকুকার। রুমে ঢুকে প্রথমে চোখ যায় খাটের তলে। না, পেপারটি নেই। নেই রাইসকুকারটিও।

পাশের টেবিলে বসে পড়ছিল ওর রুমমেট সিমি।

সিমির দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় রুবা।

তাকানোর অর্থ বুঝতে পেরে সিমি বলে, অ্যাডমিন আপা ঘর তল্লাশি করেছেন আজ। রাইসকুকার নিয়ে গেছেন তিনি।

ওটা যে রাইসকুকার চিনলেন কীভাবে? অ্যাডমিন আপা তো বহুবার দেখেছেন ওটি, চিনতে পারেননি।

অন্য রুমের কেউ কমপ্লেইন করেছে মনে হয়। ওদের কী ক্ষতি করেছি আমরা? কমপ্লেইন করল কেন?

জানি না পু। ওদের পাকা ধানে মই দিইনি আমরা। তবে ওদের রুমে গ্যাঞ্জাম হয়েছে। চিল্লাচিল্লি হয়েছে। মালিকপক্ষের উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যাডমিন আপা বলেছেন, সামনের মাস থেকে সিট রেন্ট ৫০০ টাকা করে বাড়াবেন।

বলো কি! ঘোষণা দিয়েছেন?

হ্যাঁ। ঘোষণার পর প্রতিবাদও করেছে অন্যান্য রুমের মেয়েরা।

মালিকপক্ষ কী বলল?

ওরা বলেছে, আদেশ না মানলে সিট ছেড়ে দিতে হবে।

এমন অবিচার! এত কঠিন কথা বলতে পেরেছে?

বলেছে আপু। একা ছিলাম আমি ঘরে। প্রতিবাদ করতে পারিনি, ভয়ে চুপসে ছিলাম।

এটা জুলুম। আচমকা ৫০০ টাকা বাড়ালে অনেক মেয়ে বিপদে পড়বে। সামনে অনেকের পরীক্ষা। অন্য হোস্টেলেও এখন সিট পাওয়া যাবে না। এইচএসসি পরীক্ষার পর বহু মেয়ে ঢাকায় আসছে। কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছে। আশপাশের সব প্রাইভেট ছাত্রী হোস্টেলে হাউসফুল চলছে।

এ সুযোগটা কাজে লাগাতে চাচ্ছে মালিকপক্ষ! ঝঝের সঙ্গে বলল রুবা।

আশ্চর্য, এসব অনিয়ম দেখার কেউ নেই! কার কাছে যাব আমরা! কারা নিরীহ মেয়েদের উপকারে এগিয়ে আসবে সামনে? ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা জ্যাম হয়ে যায়। শরীরটা নিজের বিছানায় ছেড়ে দেয় রুবা। রেন্ট বাড়ানোর চিন্তার চেয়ে প্রিয় রাইসকুকারটির জন্য বেশি খারাপ লাগছে। চোখ বন্ধ রেখে কল্পনায় চারপাশ একবার ঘুরে আসে রুবা। আশপাশে ১৩ সংখ্যাটি খোঁজ করে দেখে ও। ১৩-র অশুভ সংকেত দেখছে। সকাল থেকে শুরু হয়েছে অশুভ সব ঘটনা। মন থেকে কুসংস্কার ঝেড়ে উঠে বসে রুবা। না। ১৩ নিয়ে কোনো কুসংস্কার মানে না ও। রবিন মানে। এ বিষয়টা নিয়ে রবিনের সঙ্গে মাঝে মাঝে ফাটাফাটি তর্ক বাধে। রাগ হয়। আজ ১৩ তারিখ হলে খবর ছিল। ভাগ্যিস আজ জুলাইয়ের ৬ তারিখ। আচমকা কেঁপে ওঠে রুবা। জুলাই মানে সাত। ছয় তারিখের ছয়। সাত আর ছয় যোগ করে হয় ১৩। ওরে বাপ রে! নিশ্চয় এমনি একটি ফর্মুলা বের করে সারা দিনের দুর্ঘটনাগুলোকে অ্যানালাইসিস করবে রবিন। থাক, সব বলা যাবে না রবিনকে। খাটে শুয়ে চোখ বুজে এসব ভাবছে রুবা। কিছু সময় পর বেজে ওঠে সিমির সেলফোনের রিংটোন।

ফোন অ্যাটেন্ড করে লাফিয়ে ওঠে সিমি। তাকায় রুবার খাটের দিকে। রুবাপু চোখ বুজে আছে দেখে সিমি বলে, আপু ক্লান্ত। বাইরে থেকে এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। ঘুমাচ্ছেন মনে হয়। জাগিয়ে দেব?

অপর পক্ষের কথা শুনতে না পেলেও মন জানান দেয়, ওটা রবিনের কল। ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে ও রবিনকে। সিমির সাহস হলো না রুবাকে জাগাতে। না ঘুমিয়েও ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকে রুবা।

টেবিল থেকে উঠে খাটের কাছে আসে সিমি। রুবাকে পরখ করে দেখে। মনে হলো আপার দেহে অনেক ক্লান্তি। ড্রেস না খুলে বাইরে থেকে ক্লান্ত শরীরে এভাবে বিছানায় বহুবার রেস্ট নিতে দেখেছে আপাকে। এখনো রেস্ট নিচ্ছে। অথচ আপার সঙ্গে বিশেষ কিছু কথা শেয়ার করা দরকার। সুযোগ না পেয়ে আবার গিয়ে বসে টেবিলে। সামনে পরীক্ষা। বই ধরতে ইচ্ছা হচ্ছে। জোর করে বহুবার চেষ্টা করেছে পড়তে। পড়া ঢুকছে না মাথায়। মাথা শূন্য শূন্য লাগছে। শূন্য মাথা পঠিত বিষয়-আশয় লুফে নিতে পারছে না।

একসময় শুরু হয় ঝিরঝির বৃষ্টি। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টির সরু রেখা। রুমেও ঢুকছে হালকা ঝাঁপটা। পা টিপে উঠে আসে সিমি। রুবার চৌকি পেরিয়ে আসে জানালার কাছে। জানালার কপাট লাগিয়ে দিয়ে। টু শব্দ না করে নরম পা ফেলে নেমে আসে চৌকি থেকে। প্রকৃতিতে ভাসমান ধূলিকণা ধুয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। গাছগাছালিতে জমে থাকা জঞ্জাল পরিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিধারায়। মনের কালিমাও ধুয়ে যাচ্ছে, কষ্ট মুছে যাচ্ছে বৃষ্টির পরশে। সাহিত্যের ভাষায় বিভিন্ন বইতে এসব লেখা হয়েছে। সিমির কষ্ট ধুয়ে যাচ্ছে না। আরও বাড়ছে। বারবার তাকাচ্ছে রুবাপার মুখের দিকে। রুবাপা উঠলে তাঁর কাছে গিয়ে বসবে। মুখ দেখে তিনি বুঝে যাবেন সিমির কষ্টের কথা। হাসতে হাসতে প্রায়ই বলেন, তোমার মন তো দেখা যাচ্ছে, সিমি। কী এত কষ্ট নিয়ে বসে আছ বুকে!

সিমি মনে মনে ভাবে, আরও বৃষ্টি ঝরুক, আরও নামুক মুষলধারা।

কিন্তু আর ভালো লাগছে না বৃষ্টিপাত। পড়ার প্রতি মন বসানোর চেষ্টা করে। বইয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটছে না। বুঝতে পারছে মনের মধ্যে তৈরি হয়েছে নিম্নচাপ। মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠছে মন। ইচ্ছা হচ্ছে কাঁদতে। মনের মধ্যে ধেয়ে আসছে উজান গাঙের জোয়ার। ধেয়ে আসছে উত্তাল ঢেউ। একসময় টপটপ করে চোখ দিয়ে পড়তে থাকে অশ্রুধারা। চোখ স্থির হয়ে আছে বইয়ের শৃঙ্খলে সাজানো কালো বর্ণের সারিতে। বর্ণগুলো ধরা পড়ছে। চোখে। অর্থ ঢুকছে না মাথায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কিছুটা বেড়েছে। ফোঁস ফোঁস করছে সিমি।

ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছিল রুবা। আকস্মিক ওর ঘুম কেটে যায়, চোখ তুলে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় টেবিলে বসা সিমির দিকে। রুমমেটের চোখে অশ্রুধারা দেখে দুম করে উঠে বসে রুবা।

কাঁদছ কেন, সিমি? রুবার কণ্ঠে আদুরে জিজ্ঞাসা।

চট করে থেমে যায় তার কান্নার শব্দ। চোখের পানি মুছে বলে, এক সপ্তাহ পর পরীক্ষা। অথচ পড়তে পারছি না।

পড়তে না পারলে কাঁদতে হবে? কাঁদছ কেন সেটা বলো।

সিমি এবার বলে কঠিন কথাটি–বাবা বিয়ে করতে চাচ্ছেন আবার।

বলো কি! তোমার মা চলে গেলেন ছয় মাসও হয়নি!

হ্যাঁ। পাঁচ মাস চলছে।

এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছেন তিনি?

চাচ্ছেন।

তোমার মতামত নিয়েছে?

আমার মত জানতে চেয়েছেন। আমি না বলে দিয়েছি।

তার পরও বিয়ে করতে চাচ্ছেন?

চাচ্ছেন। নানা জনকে দিয়ে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। শেষে বলেছি, আমার পরীক্ষার পর বিষয়টা নিয়ে ভাবব।

থামেননি তিনি?

না। বরঞ্চ কথা শুনিয়েছেন আমাকে।

কী কথা?

খবর পাঠিয়েছেন কনের বয়স আমার চেয়ে কম, আমার চেয়েও সুন্দরী। যেন বেশি দেমাক না দেখাই আমি।

কথা শেষ করে এবার হু হু করে কেঁদে ওঠে সিমি। এমন নির্মম কথা বলতে পারে কোনো বাবা! পৃথিবীটাকে মনে হয় বড় কঠিন। এমন নির্মমতার উত্তর কী হতে পারে, জানা নেই রুবার। চৌকি থেকে উঠে সিমির কাছে দাঁড়িয়ে, পরম মমতায় তার মাথা বুকের সঙ্গে চেপে রাখে ও।

হোস্টেলে গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে। কারও ইলেকট্রিক হিটার, কারও আয়রন নিয়ে গেছে মালিকপক্ষ। বিদ্যুৎবিল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আচমকা এ ধরনের ব্যবস্থা মেনে নিতে পারছে না অনেকে। পুরো হোস্টেলের আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের কক্ষের চাপের কোনো তুলনা চলে না। এখনকার বড় চাপের কারণে হোস্টেলের বিষয়গুলো তুচ্ছ মনে হচ্ছে। সিমির পাশে শক্ত থাকতে হবে, বুঝতে পারে রুবা। সঙ্গ দিতে হবে সিমিকে, পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে হবে সারাক্ষণ। বুঝে গেছে রুবা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে মেয়েদের। মানুষের সেরা বন্ধু হচ্ছে অর্জিত ডিগ্রি। সেরা বন্ধুটিকে মগজে স্থান দিতে হবে। অর্জন করতে হবে বড় ডিগ্রি। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। জাগতিক আবেগের ঘোড়ায় চড়ে কোনো মেয়ে যেন হেরে না যায় জীবনযুদ্ধে, এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে হবে সবাইকে।

রুবা বলে, চলো, বাইরে থেকে খেয়ে আসি আজ।

কান্না থামিয়ে সিমি বলে, খাবার আছে ডাইনিংয়ে। বাইরে যেতে হবে কেন?

না। হোস্টেলে বাজার হয়নি। ভাত, ডাল আর ডিম সেদ্ধ চলছে।

সিমি কথা বাড়ানোর সুযোগ পেল না। রুবা আবার বলে, হোস্টেলের ভাত এত মোটা যে খেতে অসুবিধা হয়। এজন্য কুষ্টিয়া থেকে চিকন চাল নিয়ে আসতাম, জানো তুমিও। মাঝে মাঝে বেঁধে সবাই মিলে খেতাম। পিকনিকের মতো আয়োজন করতাম রুমে। রাইস কুকার খোয়ানোর কারণে সে সুযোগও নেই এখন।

কথা শেষ করে নিজের লকার খোলে রুবা। অল্প কিছু জমানো টাকা আছে। টাকাগুলো হাতে নিয়ে বলে, রেডি হও। বাইরে যাব।

দূরে যাবে, আপু?

না। বেশি দূরে না, গলির ভেতর রেস্টুরেন্টে যাব।

রেস্টুরেন্টের খাবার কি ভালো হবে?

ভালো-খারাপ বুঝি না। একটু অন্য রকম হবে, একটু ব্যতিক্রম। খাবার পরিবেশটাও ভিন্ন রকম। তোমারও ভালো লাগবে। চলো।

রেডি হচ্ছে সিমি। হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পরে নেয় রুবাও। দেয়ালে ঝোলানো আছে ড্রেসিং আয়না। লাইট অন করে রুবা দাঁড়ায় আয়নার সামনে। এমন সময় চলে যায় ইলেকট্রিসিটি।

খারাপ হয়ে যায় মন। গরমের জন্য নয়। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে ডানে-বাঁয়ে দুই অ্যাপার্টমেন্টের নিজস্ব পাওয়ার জেনারেটরগুলো জেগে ওঠে। শুরু হয়ে যায় ভটভটানি। দুপাশ থেকে আসতে থাকে বিকট শব্দ। কালো ধোয়ারও উদ্‌গিরণ ঘটে। পুরো পরিবেশ হয়ে দাঁড়ায় অসহনীয়। ছাত্রীনিবাসে জেনারেটর নেই। থাকলে ভালো হতো। গরমের সময় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দাঁড়ায়। এখন মন তেতো হয়ে উঠছে। মুহূর্তে বদলে গেছে পরিস্থিতি।

রুবা বলে, বের হও। ভটভটানির অত্যাচার থেকে রেহাই পাব।

সিমি অনেক স্বাভাবিক এখন। দুজনে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ডানে একটু এগিয়ে গিয়ে মামা-ভাগ্নে রেস্টুরেন্টের মুখে দাঁড়ায়। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন অল্পবয়সি মহিলা। প্রায়ই ব্যালকনিতে আসেন তিনি। মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হয় রুবার সঙ্গে। কী দেখে মহিলা কে জানে, আজও তাকিয়ে দেখছেন দুজনকে।

কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রেস্টুরেন্টের সামনে। ওদের পাত্তা না দিয়ে সিমিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে রুবা বুঝতে পারে, ভুল হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরও বিদ্যুৎ নেই। কিছুটা অন্ধকার অথচ আলো আছে, এমন একটা টেবিল দখল করে বসল ওরা। এ পাড়ায় ছাত্রীনিবাস আছে, এখান থেকে খাবার নিয়ে যায় অনেক মেয়ে। সাধারণত ছাত্রীদের কেউ খায় না ভেতরে ঢুকে। ওদের দুজন এই গলিতে চেনা মুখ। চেনা আপাদের পেয়ে হোটেলের বয়রা ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। পাড়ার ছেলেরা রেস্টুরেন্টে ঢুকতে গিয়েও না ঢুকে, বেরিয়ে যায়। রুবা ও সিমি অনেক উদ্ধত ভঙ্গিতেই দখল করে নিয়েছে নিজেদের জায়গাটুকু। রেস্টুরেন্টের ভেতর একবার চোখ বোলায় রুবা। প্রায় টেবিলই ভরা। বয়দের মধ্যে ব্যস্ততা। তবে ভেতরে বেশ অপরিচ্ছন্ন, স্পেসও ঠাসা, প্রশস্ত নয়। বয়রা গ্লাসের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে একসঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে চার-পাঁচটা করে গ্লাস। কোনো কোনো টেবিলে গরম ধোয়া বেরোচ্ছে ভাতের প্লেট থেকে। বাটিতে নানা জাতের সবজি, মাছ, মুরগি। একেক টেবিলে একেক রকম খাবার। হোস্টেলে যারা থাকে তাদের জন্য এ খাবার লোভনীয় বলতে হয়। ভেতরের অপরিচ্ছন্নতার জন্য রি-রি করে ওদের মন। আবার জিভে পানিও চলে আসে রান্নার ঘ্রাণে।

আলাপ করে দুজনে একই খাবার অর্ডার দেয়।

দুটো ছেলে ঢোকে ভেতরে। বসার জায়গা পাচ্ছে না ওরা, এক চক্কর ঘুরে আবার বেরিয়ে যায়।

ফিসফিস করে সিমি বলে, আপা দেখেছ? মাস্তানি দেখিয়ে গেল।

রুবা বলে, ভয় পাসনে, এ পাড়ায় থাকি আমরা। আমরাও মেয়ে মাস্তান। নিজেদের হেয় ভাবার কারণ নেই।

নিজেদের মাস্তান বলছ কেন?

সাহসী অর্থে মাস্তান বলছি। আমাদের মাস্তানি হবে মাথা উঁচু করে চলার। অন্যের জন্য হুমকি হব না আমরা। নিজেদের রক্ষায় মাথা তুলে থাকব, অভদ্র হব না। ভদ্রভাবে সম্মানের সঙ্গে চলাও এক ধরনের মাস্তানি।

মুগ্ধ চোখে সিমি দেখে রুপাকে।

এ সময় খাবার আসে সামনে। দুজন ওঠে। হাত ধুতে যায় বেসিনে। হাত ধোয়ার জায়গাটুকু নোংরা। ট্যাপ খুলে পানি ছেড়ে ওরা হাত বাড়ায় সাবানের দিকে। সাবানে লেগে আছে ঝোল, কী বিশ্রী! সিমি প্রায় বমি করে। দিচ্ছিল। রুবা দম বন্ধ করে সাবান ছাড়াই হাত ধুয়ে ফিরে আসে টেবিলে।

কিছুটা গম্ভীর রুবা বলে, নাও শুরু করো।

সিমির হাত এগোয় না থালার দিকে। সহজ হতে পারছে না।

রুবা বলে, সব বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকা ভালো। আজ নতুন অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। ভবিষ্যতের জন্য এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। কোনো বিষয়ই তুচ্ছ না সিমি। এসো, হাত চালাও।

ওরা খেতে শুরু করে। খাবার সত্যিই সুস্বাদু। রান্নার স্বাদ আলাদা। অন্য রকম স্বাদ নিয়ে খাওয়া শেষ করে সিমি। এ সময় বেজে ওঠে মোবাইল ফোন। মনিটরে তাকিয়ে সিমি বলে, আপু, তোমার কল।

কে?

রবিন ভাইয়া। নাও, কথা বলো।

বাঁ হাতে সেটটি কানে ধরে রুবা।

কী করছ? রেস্ট হয়েছে? জানতে চায় রবিন।

হুঁ। হয়েছে। খাচ্ছি এখন।

রুমে খাচ্ছ? নাকি ডাইনিং হলে?

রুমে না। ডাইনিং হলেও না। ভাত খাচ্ছি গলির এক রেস্টুরেন্টে। ঠান্ডা গলায় বলল রুবা।

রেস্টুরেন্টে! ভদ্র মেয়েরা কি রেস্টুরেন্টে খেতে যায়? বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে রবিন।

আমরা তো অভদ্র, দ্ৰ না। আমাদের খেতে অসুবিধা কোথায়? প্রশ্ন করে লাইন কেটে দেয় রুবা। সেটটা অফ করে ফিরিয়ে দেয় সিমির হাতে।

এক পক্ষের কথা শুনলেও আলাপের বিষয় বুঝতে বাকি থাকে না সিমির। সেট ফেরত নিয়ে চুপ করে খেতে থাকে সে।

খাওয়া শেষ করে বিল দেয় রুবা। বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট থেকে।

গলিতে আনাগোনা বেড়েছে বখাটেদের। কেউ কোনো টিজ করছে না মুখের ভাষায়। ওদের আচরণই টিজ ছুঁড়ে দিচ্ছে। এসব পাত্তা না দিয়ে। দুজনে কথা বলতে বলতে দাপটের সঙ্গে এগিয়ে যায় হোস্টেলের দিকে।

আজ দিনটা আসলেই খারাপ যাচ্ছে। রবিনের সঙ্গে একবারও সহজ আলাপ হয়নি। আলাপের বিষয় তেতে উঠছে চট করে। বিষয়টা ভালো না। লক্ষণ খারাপ। অনুতাপ জাগে মনে। বোঝে, সংযত হতে হবে। সংযত হতে পারেনি ও। রবিনের কথায় বারবার উসকে উঠেছে রাগ। এমন হলে চলবে কেন? ভেতর থেকে শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে আদুরে কথা। আদর পেতে ইচ্ছা জাগছে। অথচ বাইরে থেকে তেতে উঠছে পরিবেশ। এমন হয় কেন মন!

হোস্টেলে ঢোকে দুজন। চারপাশের ভটভটানি এখনো কমেনি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ আসেনি এখনো। গরম রুমে ঢুকতে হবে আবার, ভাবতে গিয়ে শঙ্কিত হয় মন। শঙ্কা নিয়ে রুবা টান দিয়ে খোলে কলাপসিবল গেট।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস সেন্টারে এসেছে রুবা। সঙ্গে সিমি। দিনটি মহিলাদের জন্য স্পেশাল। অসংখ্য তরুণী এসেছে আজ। অনেকে এসেছে প্রয়োজনে, অনেকে এসেছে অপ্রয়োজনে। গমগম করছে চারপাশ। চাপ বেশি হলেও বিশৃঙ্খলা নেই। বাইরে থেকেও কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের সবাইকে আন্তরিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওরা কাছের মানুষ। ভেতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকল না রুবা।

সিমি প্রশ্ন করে, দাঁড়ালে কেন?

হাতের ইশারায় দেখিয়ে রুবা বলে, ওই যে রাস্তার উল্টা দিকে রয়েছে নন্দন শপিং সেন্টার, তার ওপর পারসোনা। ঢাকা শহরের বিত্তশালী রমণী-তরুণীরা এখানে আসে সৌন্দর্য বাড়াতে, সৌন্দর্য চর্চা করতে।

সিমি ছোট্ট করে বলে, ওহ!

রুবা বলে, ওহ্ আবার কী?

সিমি বলে, ওদিকে তাকিয়ে লাভ নেই। ওখানে আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় কেন?

সিমি উত্তরে বলে, আমরা হচ্ছি নারীশ্রমিক। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। ওই দিকে তাকানো অন্যায়, আপু। তাকিয়ো না।

এত নৈরাশ্যবাদী কেন তুমি? দেখো, একদিন আমরাও যাব ওখানে। জীবনের সঙ্গে লড়াই করছি বলেই একদিন বড় হব। কণ্ঠে প্রত্যয় ঝরে পড়ে রুবার।

সিমিকে ছুঁতে পারে না সেই কণ্ঠস্বর। নরম গলায় বলে, ভেতরে চলো, আপু। তোমার সিম তুলে নিই।

ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে যায় সিমি। রুবা প্রত্যয়ী। প্রত্যয়ী মন অনেক কিছু ভাবে। এত সুন্দর পরিবেশেও মুগ্ধ হয়নি রুবা। এমনটিই আশা করেছে ও। এমন না হলে হয়তো হতাশ হতো। হতাশ হয়নি। সহজে সিম তুলে একটু নিরিবিলিতে চলে আসে। ডিসপ্লেতে সাজানো সেটগুলো দেখছে। সেট কেনার সামর্থ্য নেই এখন। টিউশন ফি পেলে কম দামের একটা সেট কিনে নেবে। এমন আশা রেখে বলে, সিমি তোমার সিমটা খুলে সেটটা দাও।

নিজের সেট থেকে দ্রুত সিম খুলে সিমি সেটটা দেয় রুবার হাতে। নতুন সিমটা লোড করে রুবা স্বস্তি পায় মনে।

সিমি বলে, প্রথম কলটা কাকে করবে, আপু?

রুবা হাসে। মৃদু হাসিতে ছড়িয়ে যায় রহস্য।

রবিন ভাইকে? আবার প্রশ্ন করে সিমি।

রুবা আবারও হাসে। জবাব দেয় না।

ছোট বোন আনিকাকে?

চোখে মুখে অন্য ধরনের একটা রিফ্লেক্স বয়ে যায়। আঙুলের চাপে তখন নম্বর টিপছিল ও। ভুল হচ্ছে কি? ভেবে হ্যাঁন্ডব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা কাগজ বের করে। নম্বর মিলিয়ে দেখে। না, ভুল হয়নি। ঠিক আছে। একবার শুনে নম্বর মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। মনে মনে অনেকবার রিপিট করেছে এ নম্বর। মগজে ঠিক আসন ধরে রেখেছে নম্বরটি। কাগজ হারিয়ে যেতে পারে, হারিয়ে গেলে নম্বর খোয়া যেতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে বারবার মনে মনে মুখস্থ করেছে রুবা। নম্বরটি কিছুতেই হারাতে চায় না ও।

হ্যাঁ। রিং হচ্ছে। বুঝিনি তো আমি, পৃথিবীতে ভালোবাসা সবচেয়ে দামি ওয়েলকাম টিউনটি ছুঁয়ে যায় মন।

হাই রুবা! সিম তুলেছ? উল্লাস ঝরে পড়ে আফরিনের গলায়।

হ্যাঁ। সিম তুলেছি। তবে ফোনসেট কেনা হয়নি। রুমমেটের সেটে সিম ঢুকিয়ে প্রথমেই কল করলাম তোমাকে।

আফরিন বলে, দিস ইজ মাই প্লেজার! এখন কোথায় তুমি?

রুবা বলে, ধন্যবাদ। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস সেন্টারের ভেতরে আছি।

ওকে। অপেক্ষা করো তুমি, ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি আমি।

১০ মিনিটে আসবে? কোথায় আছ তুমি?

খুব কাছে আছি তোমার। আসছি। ওয়েট ফর মি, বলে লাইন কেটে দেয় আফরিন।

মুগ্ধ হয়ে শোনে সিমি সব কথা। তারপর চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, তোমাকে এত খুশি হতে কম দেখেছি আপু। কে? কার সঙ্গে কথা বললে?

ও আসছে। এলে দেখতে পাবে।

ওটা কে? ছেলে, না মেয়ে?

তোমার কী মনে হয়?

মনে করার রেঞ্জ ভোঁতা হয়ে গেছে আমার। বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে তোমার! রবিন ভাইয়ার সঙ্গে যেভাবে বিবাদ বেধে যাচ্ছে! না ভেবে পারলাম না, আপু।

রুবা হাসে। হাসিতে আবারও ছড়িয়ে যায় রহস্য। সার্ভিস সেন্টারের ডেকোরেশন মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে ও। জবাব দিল না সিমির কথার।

সিমি বলে, আপু দেখো, এখানকার মেয়েরা কী সুন্দর সেবা দিচ্ছে! কত স্মার্ট সবাই! কী সুন্দর ড্রেস! সবাই লম্বা! সুন্দরী! সুন্দর না হলে কি এখানে চাকরি জুটবে না?

কেন? ওদের প্রফেশন কি ভালো লাগছে তোমার? ওদের মতো হতে চাও?

হতে চাইলে কি পারব? আমি লম্বা না। সুন্দর না। অ্যাকাডেমিক যোগ্যতায় পেলেও দৈহিক যোগ্যতার অভাবে চাকরি পাব না।

তুমি সুন্দর না–কে বলেছে? এমন মিষ্টি মেয়েকে কেউ সুন্দর না বললে তার চোখই সুন্দর না, পচা। সান্ত্বনা দিচ্ছে না রুবা। সত্যটুকু জোরালোভাবে বলল।

এবার হেসে দেয় সিমি। বাবার চোখে আমি অসুন্দর, অন্যদের বলা না বলা দিয়ে কী আসে যায়!

চট করে চুপ হয়ে যায় রুবা। বিষয়টা বেশ সেনসিটিভ। সেনসিটিভ বিষয়ে কথা না বাড়ানো ভালো। জানে ও। তবুও চুপ থাকতে পারল না। মনে মনে ভেবে নেয়, সিমির এ কথাটা কাউন্টার দেওয়া উচিত। নইলে আরও বাড়বে ওর মনের ক্ষত। কিছুটা ক্রোধের সঙ্গে বলে, পচন ধরেছে তোমার বাবার চোখে। এজন্য এমন বাজে কথা বলেছেন তিনি। বাবার চোখে কখনো মেয়ে অসুন্দর হতে পারে না।

আর কথা বলার সুযোগ পেল না সিমি। এ সময় কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস সেন্টারে ঢোকে আফরিন। দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে ঝলসে ওঠে রুবা। সিমির হাত ধরে ছুটে যায় ওর কাছে।

এই আমার ফ্রেন্ড আফরিন, যাকে প্রথম কল করেছিলাম। সিমির সঙ্গে আফরিনকে পরিচয় করিয়ে দেয় রুবা।

খুশি হয় সিমি। মনে মনে ভাবে, কী স্মার্ট মেয়েটি! কী সুন্দর! কী লম্বা! এই মেয়ে রুবাপুর ফ্রেন্ড, ভাবতে ভালো লাগে।

উচ্ছ্বাস থামেনি রুবার। সিমিকে উদ্দেশ করে আফরিনকে বলে, ও আমার জুনিয়র। রুমমেট।

আফরিন হ্যাঁন্ডশেক করে সিমির সঙ্গে। তারপর রুবাকে উদ্দেশ করে বলে, ওর সেট দিয়ে কল করেছ?

রুবা জবাব দেয়, হ্যাঁ।

সেট কিনবে না?

কিনব। হাতে টিউশনির টাকা পেলে কিনব।

আফরিন এগিয়ে যায় ডিসপ্লেতে সাজানো সেটগুলোর দিকে। একটা সেট দেখিয়ে বলে, দেখো তো, কেমন এটা?

রুবা বলে, সুন্দর! কিনবে তুমি?

হ্যাঁ। তোমার জন্য কিনব।

ধাক্কা খেল রুবা। গতিময় আবেগ ঠাস করে আটকে গেল রুবার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের শেকলে। এবার মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে

না বলার শক্তি। স্থিত হয়ে দৃঢ় অথচ ভুদ্র গলায় রুবা বলতে পারল, আমার জন্য কিননা না।

কেন? এটা এখন প্রয়োজন তোমার।

হোক প্রয়োজন। তবুও বলছি। থামো তুমি। দৃঢ় গলায় বলল রুবা।

চট করে নিজেকে সামলে নেয় আফরিন। বিড়বিড় করে বলে, হাতে টাকা। এলে শোধ করে দিয়ো, ঋণ হিসেবে নাও।

ভাঙতে ভাঙতে দাঁড়িয়ে গেল রুবার ব্যক্তিত্ব। শক্ত হয়ে বলে, তোমার উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ। ভালো লেগেছে তোমার প্রস্তাব। প্রস্তাবটা রাখলাম না, এজন্য মনে কষ্ট নিয়ো না তুমি।

না না। কষ্ট পাইনি। পুরো পরিস্থিতি সামলে আফরিন আবার বলে, সিমি খুব সুইট মেয়ে।

দেখলে সিমি, আফরিনের চোখেও তুমি মিষ্টি মেয়ে। রুবা বলল।

প্রশংসা শুনে খুশি হয় সিমি। যেন কত আপন আফরিন, এমনি ভেবে হাত বাড়ায় আফরিনের দিকে। হাত ধরে খুব কাছে ঘেঁষে দাঁড়ায়। তারপর আফরিনকে বলে, আপু, যাবে তুমি আমাদের হোস্টেলে। রুবাপুর ফ্রেন্ড হিসেবে এখন আমারও ফ্রেন্ড তুমি।

রুবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চট করে আফরিনকে নিমন্ত্রণ করে বসেছে সিমি। বিষয়টা খচখচানি জাগিয়ে দেয় মনে। রুবা চাইছিল না, ওদের জীবনের কঠিন বাস্তবতাটুকু এত তাড়াতাড়ি দেখুক আফরিন। মন থেকে সাড়া না আসলেও সিমির আগ্রহে সাড়া দিতে হচ্ছে তাকেও। সিমির কথার সঙ্গে তাল রেখে বলে, চলো। যাবে আমাদের সঙ্গে?

আফরিন বলে, চলো। তোমাদের সঙ্গ ভালো লাগবে আমার।

আফরিনের কথা শেষ হওয়ার পর একসঙ্গে বেরিয়ে আসে তিনজন। বাইরে বেশ রোদ। কড়া রোদ মাথায় রাস্তার পাশে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে সিএনজির আশায়। ভিআইপি গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে যাচ্ছে হলুদ ক্যাব। ২৭ নম্বর একটা বনেদি এলাকা। বনেদি এলাকায় দামি গাড়ি চলবে–এটাই স্বাভাবিক। তবুও অস্থির হয়ে সিমি বলে, খালি সিএনজি পাব বলে মনে হচ্ছে না।

আফরিন বলে, ধৈর্য ধরো। পাবে।

আফরিনের কথায়ও ধৈর্য তৈরি হচ্ছে না মনে। পাওয়া যাচ্ছে না সিএনজি। অস্থিরতা বেড়ে চলেছে সিমির।

রুবা বলে, প্রয়োজনে হেঁটে যাব। এত অস্থির হচ্ছ কেন, সিমি?

সিমি বলে, তাহলে হেঁটে চলো। আফরিনকে উদ্দেশ করে বলে, আমাদের হাঁটার অভ্যাস আছে। তুমি হাঁটতে পারবে, আপু?

আফরিন বলে, কেন হাঁটতে পারব না, আমি কি পরীর দেশের মানুষ?

পরীর দেশের মানুষ কি পায়ে হাঁটে না? উড়ে উড়ে চলে?

রুবা হেসে বলে, আরে না, কথার কথা বলেছে আফরিন, তাই না?

আফরিন হেসে বলে, ঠিক বলেছ। কথা থেমে যায় আফরিনের। হঠাৎ সামনে এগিয়ে হাত তোলে সে। একটা হলুদ ক্যাব দাঁড়িয়ে গেল ওদের সামনে।

সিমি প্রশ্ন করে, হলুদ ক্যাবে যাবে?

আফরিন বলে, অসুবিধা কী?

রুবা বলে, হাতে টাকা কম আছে আমাদের। হলুদ ক্যাবে বেশি টাকা লাগবে। তা ছাড়া এত শর্ট ডিসটেন্স কি যাবে ড্রাইভার

কথার জবাব না দিয়ে দরজা খুলে আফরিন ভেতরে ঢুকে বসে। ওর দেখাদেখি ঢুকে যায় সিমিও। রুবা একটু থমকায়। কিছু বোঝার আগে আফরিন বলে, ওদিক থেকে ঢোকো তুমি।

না করার কোনো সুযোগ পেল না রুবা, গাড়ির অন্য পাশ দিয়ে ভেতরে ঢোকে। ঢুকতে বাধ্য হয় ও।

চলতে শুরু করেছে হলুদ ক্যাব।

সিমি বলে, ক্যাব যে খালি, বুঝলে কীভাবে? আমি তো টের পাইনি যে এটা খালি ছিল!

রুবার মনেও টোকা দেয় প্রশ্নটি। মুখ ফুটে বলল না কিছু। আরও অবাক হলো ও, কোনো ইনস্ট্রাকশন ছাড়া চলতে শুরু করেছে ক্যাবটি। ড্রাইভার এত ভদ্র! জানতেও চাইল না কোথায় যাবে ওরা!

আফরিন প্রপোজাল দেয়, তোমাদের আজকের দিনটা সেলিব্রেট করি আমি?

রুবা বলে, সেলিব্রেশন তো হয়ে গেল। তুমি যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে?

সিমি বলে, সেলিব্রেট বলতে কী বোঝাচ্ছ, আপু?

এই ধরো, তোমাদের নিয়ে একটা ফাস্টফুড ক্যাফেতে ঢুকব। একসঙ্গে খাব। এই আর কি।

লাফিয়ে প্রপোজাল লুফে নেয় সিমি।

রুবা কিছুটা স্থির গলায় বলে, আমাদের সঙ্গেই কাটাও আজ। আমাদের দরিদ্র জীবনের স্বাদ নাও। পরে না হয় ভেবে দেখা যাবে তোমার কথা।

আচমকা চুপ হয়ে যায় সিমি। কথা বাড়াল না আফরিনও। রুবা ড্রাইভারকে বলে, ভাই, রাসেল স্কয়ার হয়ে পান্থপথ দিয়ে গ্রীন সুপার মার্কেট চলুন। শর্ট ডিসটেন্স। যাবেন তো?

রুবার কথায় জবাব না দিয়ে ডিরেকশন অনুযায়ী গাড়ি চালাতে থাকে ড্রাইভার। ড্রাইভারের মুখ একবার দেখার চেষ্টা করে, দেখার সুযোগ পেল না ও। সরাসরি ড্রাইভারের পেছনে বসেছে রুবা। এজন্য মুখ দেখার সুযোগ নেই। পেছন থেকে বোঝা যাচ্ছে, বয়স খুব বেশি না ড্রাইভারের। অল্পবয়সি ভ্রাভাররা এমন ভদ্রতা দেখায় না। সে দেখাচ্ছে। একটা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা এবং আনন্দ হচ্ছে আফরিনে সঙ্গ। ভালো লাগছে সঙ্গসুখ।

রুবা জানতে চাইছিল, তোমার বাসা কোথায়? প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। মাঝপথে কথা লুফে নিয়ে আফরিন বলে, হোস্টেল লাইফ কেমন লাগছে? খুব ফ্রিডম থাকে তোমাদের, তাই না?

রুবা বলে, যারা বাসায় থাকে তারা এমন ভাবে। মনে করে, আমাদের ফ্রিডম খুব বেশি, ইচ্ছামতো চলাফেরা করতে পারি। ইচ্ছামতো বেড়াতে পারি।

সিমি যোগ করে, সবাই মনে করলেও আমি মনে করি না ফ্রিডম বেশি আমাদের। সন্ধ্যার আগে ইচ্ছামতো বেরোতে পারি। তবে ফিরতে হয় রাত আটটার মধ্যে। এ বিষয়ে হোস্টেলের নিয়ম খুব কড়া। সন্ধ্যারাতের কোনো ফাংশনে যেতে পারি না। গেলেও টেনশনে ভুগতে হয়। ঠিক সময়ে ফেরার টেনশনে এনজয় করা যায় না অনুষ্ঠান।

আফরিন বলে, ভার্সিটির হলের মতো নিয়ম দেখছি।

রুবা যোগ করে, না। ভার্সিটির হলে এখন এ নিয়ম নেই। সান্ধ্য আইন কার্যকর নয় এখন।

আফরিন বলে, ডিসিপ্লিন দেখে কে তোমাদের?

ওরে বাবা! সিমি বলে, ডিসিপ্লিন দেখার লোকের অভাব হয় না। উল্টাপাল্টা কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে যায় কর্তৃপক্ষের কাছে।

আফরিন বলে, তাহলে তো একধরনের শৃঙ্খলে বাঁধা তোমরা।

রুবা যোগ করে, প্রশাসনিক শৃঙ্খলার চেয়েও বড় বাধা হচ্ছে সামাজিক চোখ। সামাজিক মনোভাব। চারপাশের মানুষজনের চোখ গেঁথে থাকে আমাদের পিঠে। কখন বেরোচ্ছি, কখন ঢুকছি হোস্টেলে–অনেক লোক আছে দেখার। অনেকে ভেবে বসে থাকে, মা-বাবা ছাড়া থাকে মেয়েগুলো, নিশ্চয় বাজে মেয়ে সব। নষ্ট মেয়ে। বখে যাওয়া মেয়েরা হোস্টেলে থাকে, এমন কথাও বলতে শুনেছি আশপাশের গৃহিণীদের। বুড়োদেরও।

খারাপ লাগে না শুনতে? আফরিন শান্ত গলায় জানতে চায়।

না। এখন আর খারাপ লাগে না। গা-সওয়া হয়ে গেছে।

কী ধরনের মেয়েরা আসে এখানে?

অধিকাংশ মেয়ে আসে ঢাকা শহরের বাইরে থেকে। পড়াশোনায় মেধাবী অথচ নিজেদের জেলায় ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, এমন মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এরা পড়াশোনার জন্য জীবনসংগ্রামে ঢুকতে বাধ্য। মা-বাবা ছাড়া থাকতে বাধ্য হয়।

ওহ! আফরিন বলে, তাহলে অ্যাসোসিয়েশনটা ভালো।

রুবা বলে, কেন? আমাদের খারাপ ভেবেছিলে নাকি?

প্রশ্ন করে ঠেকে যায় আফরিন। জোরালোভাবে বলে, না, না। সেটা ভাবব কেন?

রুবা বলে, অনেকে তেমন ভাবে। এজন্য বললাম। অবশ্য অনেকের চেয়ে আলাদা তুমি। তুমি ওভাবে ভাববে না নিশ্চয়। তবে দু-চারটা ডেসপারেট মেয়ে যে আসে না, তা নয়। আসে। ওদের কারণে সবার কপালে বদনাম জোটে।

বদনামকে ভয় পাও? জিজ্ঞাসা করে আফরিন।

সিমি বলে, আগে কান্না পেত। ভয় পেতাম। এখন পাই না।

রুবা বলে, ভয় না পেলেও শৃঙ্খলা মেনে চলি আমরা।

কথা বলতে বলতে হলুদ ক্যাব চলে এসেছে গ্রীন সুপার মার্কেটে।

রুবা বলে, এসে গেছি আমরা। ক্যাব এখানে ছেড়ে দিই। বাকি পথ হেঁটে যাব।

সবাই নামে গাড়ি থেকে।

রুবা বলে, কত ভাড়া, ভাই?

আফরিন ড্রাইভারকে বলে, আপনি বসে থাকেন। আমি আবার ফিরব।

সিমি অবাক হয়ে বলে, বসে থাকবে মানে?

রুবাও প্রশ্ন করে, বেশিক্ষণ থাকবে না আমাদের সঙ্গে?

হ্যাঁ। থাকব। বসে থাকুক হলুদ ক্যাব।

এখানে তো ক্যাব পাওয়া যাবে, আপু। সিমি বোঝানোর চেষ্টা করে।

আফরিন বলে, থাকুক। ঘণ্টা অনুযায়ী ভাড়া দেব। বসুন ভাই। বলে সামনের দিকে এগোতে এগোতে বলে, চলো।

রুবা আবারও অবাক হয় ড্রাইভার কোনো কথা বলল না! আফরিনের প্রপোজাল সহজে মেনে নিল!

সিমি বলে, রুবাপু ফল নাও। আপুকে কী খাওয়াবে রুমে?

আফরিন বলে, তোমরা যা খাও, তা-ই খাব। নতুন কিছু নিতে হবে না। ভাবো, তোমাদের একজন আমি।

শুনে খুশি হয় রুবা। মুগ্ধ হয়ে যায় সিমিও। এমন আন্তরিকতার ছোঁয়া পায় না তারা। নিজেদের কঠিন জীবনের কঠিন পথে কেবল কষ্ট, বাধা, সমালোচনা। এর মধ্যে এমন নির্মোহ আন্তরিকতা! এমন মমত্ব!

কোনো কথা বলছে না সিমি। রুবাও চুপ।

আফরিন আবার বলে, তোমাদের সঙ্গ এনজয় করছি আমি।

সিমি কাছ ঘেঁষে হাঁটছে আফরিনের। রুবা হাঁটছে একটু এগিয়ে। এগিয়ে যাচ্ছে ওরা হোস্টেলের দিকে।

হাঁটার গতি স্লো করে সিমিকে আফরিন বলে, তোমাকে খুব ভালো লেগেছে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো।

সিমি বলে, অবশ্যই যোগাযোগ থাকবে, আপু। আমার আনন্দ যে আপনার মতো একজন ফ্রেন্ড পেয়েছি।

আফরিন বলে, তোমার সেল নম্বরটা দাও।

সিমি নম্বর বলে যায়। আফরিন তুলে নেয় ফোনসেটে।

.

দ্রুত হেঁটে সামনে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়ে রুবা বলে, তোমরা এসো। আমি আগে যাচ্ছি।

সিমি আরও অন্তরঙ্গভাবে হাত ধরে আফরিনের। অসাধারণ ভালো লাগতে থাকে তার। নিজের মধ্যে ভিন্ন ধরনের নির্ভরতা টের পেতে থাকে। নিজের কষ্টের নেপথ্যে যে মর্মভেদী ঘটনা আছে, ভুলে যায় তা এ মুহূর্তে। নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে। আফরিনের মুগ্ধ আচরণ সহজে আচ্ছন্ন করেছে তাকে, প্রভাবিত করেছে। এ আছন্নতায় এগিয়ে যায় ও আফরিনকে নিয়ে।

হোস্টেলের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি আছে মহিলা গেস্টের। তবে নাম লিখতে হয় রেজিস্ট্রি খাতায়। কটায় ঢুকল, কটায় বেরোল সিগনেচার করে যেতে হয়।

ভেতরে ঢোকার সময় সিকিউরিটি গার্ড অতিথির দিকে রেজিস্ট্রি খাতা বাড়িয়ে দেয়। প্রথমে থতমতো খায় আফরিন। পরে নিজ হাতে পূরণ করে রেজিস্ট্রি খাতার কলামগুলো। নিজের নাম লেখে আফরিন আদিবা। কার কাছে যাবেন? কলামটি পূরণ করতে গিয়ে থমকে যায়। সিমি বলে, আমার নাম লেখো। তুমি আজ আমার গেস্ট।

নিজ হাতে নাম লিখতে গিয়ে জড়তা বোধ করলেও সিমির নাম লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে আফরিন। সিগনেচার করে বলে, থ্যাংকস সিমি।

থ্যাংকস জানাচ্ছে কেন, আপু!

সে তুমি বুঝবে না।

বুঝব না?

না। হাসিমুখে জবাব দেয় আফরিন।

রুবাপুর ফ্রেন্ডকে কেড়ে নিলাম বলে হাসলে?

জবাব না দিয়ে আবারও হাসে আফরিন। রহস্যময়তায় ভরা হাসির অর্থ বুঝতে পারে না সিমি। তবে এটুকু বুঝতে পারে, আফরিন আপু তাকে খুব পছন্দ করেছে।

.

রুমে এসে হইচই বাধিয়ে দিয়েছে সিমি। ওদের অন্য দুই রুমমেট মণি ও সানিয়া বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আফরিনকে। সানিয়া কিছুটা চমকে যায়। এমন একটা অসাধারণ মেয়ে তাদের কক্ষে এসেছে, দেখে ভড়কে যায়। আনন্দের বদলে একধরনের জড়তা ও হীনম্মন্যতায় ডুবে যায় সে।

সানিয়ার মনে আচমকা প্রশ্ন ঢুকে গেছে–মেয়েটি ভালো তো? মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটি তাড়াতে চায়, পারে না ও। বারবার মনে আঘাত হানছে প্রশ্নটি।

মণি ফিসফিস করে বলে, সানিয়া, কী ভাবছিস? তোর ইনটিউশন তো অসাধারণ শার্প। কোনো চিন্তা এসেছে নতুন মেহমান নিয়ে?

শক্ত হয়ে গেছে সানিয়ার দেহ-মন। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের চৌকির ওপর গিয়ে বসে। বিছানার ওপর কয়েকটা বই এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বইগুলো গোছাতে গোছাতে কয়েকবার চোরা চোখে দেখে আফরিনকে। দেখে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। এমন লাগছে কেন, নিজেকে অ্যানালাইসিস করে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করে ও। উত্তর পেল না। ভেতর থেকে গুটিয়ে যেতে লাগল ও।

রুবা বলে, তোমরা আজ্ঞা দাও। আমি আসছি ডাইনিং হল থেকে। দুটো টিনের কৌটা, একটা বড় ধরনের বাটি নিয়ে বেরিয়ে যায় ও।

মণি বলে, আপু বাসা কোথায় তোমার?

উত্তর না দিয়ে প্রশ্নের মাঝখান থেকে কথা টেনে নিয়ে আফরিন বলে, তোমাদের ছোট্ট রুম। চারজন থাকো একসঙ্গে। জুনিয়র-সিনিয়রদের মধ্যে বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা দেখে ভালো লাগছে।

মণি বলে, সব সময় আন্তরিকতা কি থাকে, আপু? বিবাদও হয়। এই যে দেখেন, দিন নাই রাত নাই কুটকুট করে সারাক্ষণ সেলফোনে কথা বলে সানিয়া। কথা চলতে থাকলে কি ঘুমানো যায়? ও আমাদের ঘুম আর রেস্টের বারোটা বাজিয়ে দেয়।

ধমক দাও না?

দিই। রুবা আপু প্রায় ধমক দেয়। ধমক খেয়ে লো ভলিউমে কথা বলে। কিছুক্ষণ পর ধমকের কথা ভুলে যায় সে, আবার উঁচু টোনে কথা বলতে থাকে।

এই! তাহলে পড়ি কখন? সারাক্ষণ কথা বললে রেজাল্ট ভালো হয় কীভাবে আমার? সানিয়া পাল্টা যুক্তি দেখায়। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েও নীরব থাকতে পারে না। প্রতিবাদ করে।

মণি বলে, আরে না, আমি অভিযোগ করছি না। আমাদের রুমের একটা চিত্র তুলে ধরলাম আপনার সামনে।

এ সময়ে সিমি এসে রুমে ঢোকে। ফাঁক পেয়ে বাথরুমে গিয়েছিল। বাথরুম থেকে আসতে তেমন দেরি হয়নি। তবুও বলে, এই, তোরা ঝগড়া করছিস আফরিন আপুর সামনে? আমার একটু দেরি হয়েছে, এই সুযোগে বদনাম করছিস আমার?

আরে না, তোর বদনাম না। সরাসরি আমার বদনাম করছে মণি। সেলফোনে সবাই কথা বলে রাত জেগে, দোষ হয় শুধু আমার।

সিমি বলে, তাই নাকি, মণি? তুই নিজের দোষটা দেখবি না। টিউব লাইট ছাড়া পড়তে পারিস না, লাইটের জ্বালায় যে আমরা ঘুমাতে পারি না, তোর পরীক্ষার সময় নীরবে সব সয়ে যাই, যাতনা পাই, সে কথা বলবি না?

মণি হেসে বলে, বদলানোর চেষ্টা করছি অভ্যাসটা। চেষ্টা করছি টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পড়ার। জ্বালাতন থেকে তোদের মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি। কী করব বলল আপু, আফরিনকে উদ্দেশ করে বলে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ঘুম চলে আসে আমার। টিউব লাইট না জ্বালিয়ে পড়তে পারি না।

আফরিন বলে, তোমাদের দ্বন্দ্ব আর মনোমালিন্যের মধ্যেও একটা মমতা আছে, ভালোবাসা আছে–দেখে ভালো লাগছে আমার।

আপু, তিন দিন থাকো আমাদের সঙ্গে, ভালোলাগা দৌড়ে পালাবে জানালা দিয়ে। বলল সিমি।

কেন? এমন বলছ কেন?

এমন বলব না? আমার খুব শখ রিক্রিয়েশনের জন্য মাঝেমধ্যে বাইরে যাওয়ার, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অ্যাটেন্ড করার, ছাত্রী বলে আমাদের বেরোতে দেয় না সন্ধ্যার পর, যারা চাকরি করে তারা রাত ১০টায় ফিরলেও অসুবিধা নেই, আমাদের ফিরতে হয় আটটার মধ্যে। অনেক সময়, রুমমেটরা, একে অন্যের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াই আমরা।

আফরিন বলে, ভালো তো। তোমরা নিজেদের মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে নিয়েছ। বিবাদ করছ, আবার নিজেদের সমালোচনাও করছ। ভেরি গুড। আসলে সবাই তোমরা অসাধারণ ভালো।

পেঁয়াজ কেটে বাটিতে মুড়ি-চানাচুর তেল মেখে নিয়ে এসেছে রুবা। রুমে ঢুকতে ঢুকতে রুবা বলে, তুমিই অসাধারণ ভালো মেয়ে। এজন্য ভালো চোখে দেখছ সব। খারাপ কিছু ধরা পড়ছে না তোমার চোখে।

সবাই এবার একসঙ্গে হইচই করে ওঠে।

রুবা নিজের চৌকির মাঝখানে একটা তোয়ালে রেখে তার ওপর রাখে বাটিটা। মেহমান এলে এ কক্ষের এটা প্রধান খাবার। সবাই তুমুল উল্লাসের সঙ্গে বাটি শেষ করে।

আচমকা রুবা বলে, আল্লাহ! আফরিন, তুমি তো হলুদ ক্যাব বসিয়ে রেখেছ?

হ্যাঁ। বসিয়ে রেখেছি। থাকুক। ভাগিয়ে দিতে চাচ্ছ নাকি আমাকে?

আরে না। রুবা বলে, ক্যাবের বিল উঠছে না? আমরা টানাহেঁচড়ায় জীবন পার করি, বিলের বিষয়টা চট করে মাথায় চলে এসেছে।

ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমাদের মধ্যে আছি আমি। এটাই আনন্দ। বিলের চিন্তা করে মাটি করতে চাই না এমন অন্তরছোঁয়া পরিবেশ।

নিজেদের এমন দৈন্যদশার প্রশংসা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় ওরা। মুগ্ধ চোখে সবাই তাকিয়ে থাকে আফরিনের চোখের দিকে।

রবিন বলে, এবার চাকরিটা হবেই আমার।

চাকরি হলে কী হবে? রুবা প্রশ্ন করে।

মাকে তোমার কথা বলে রেখেছি। প্রথমে বিয়ে, তারপর যা হবার হবে।

বিয়ে করতে টাকা লাগবে না? খরচপাতি জোগাড় করতে পারবে?

চুপসে গেল রবিন। আশায় বুক বাঁধে। আশার মাঝে নিরাশা জাগলে কি আর আত্মবিশ্বাস থাকে?

রুবা আবার বলে, মন খারাপের কিছু নেই। বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে, কেবল আবেগ দিয়ে চললে হবে না।

রবিন কাউন্টার দিয়ে বলে, কেবল বাস্তবতা মেনেও জীবন চলে না, আবেগ না থাকলেও কোনো দাম নেই এ জীবনের।

এ কথাটা ভালো লাগে রুবার। শত ভুল বোঝাবুঝির মাঝেও বোঝে, তার জন্য রয়েছে রবিনের মৌলিক টান। এই টান ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই রবিনের। পড়াশোনায় তত উজ্জ্বল নয় সে, পারিবারিক দৈন্যও রয়েছে তাদের। কেবল মন ভরে ভালোবাসে রুবাকে। এমনি ভালোবাসার কাঙাল রুবা যেকোনো স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে। ভালোবাসার রসায়নে কোনো ছাড় দিতে পারবে না ও।

ঠান্ডা গলায় রুবা বলে, হ্যাঁ। বেশি বাস্তবতা দিয়েও জীবন চলে না। একমত তোমার সঙ্গে। এজন্য আশাবাদী হতে হয়। জয় আমাদের হবেই।

এবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে রবিন বলে, তোমার চাকরির খবর কী? কিছু হবে মনে হয়?

ক্লাস ওয়ান জবের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। চেষ্টা থেমে গেলে অবধারিত পতন হবে। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে একটা এনজিওতে চাকরি হতে পারে।

এনজিওতে হলে করবে চাকরিটা?

করব না কেন? পায়ের তলায় এখন মাটি নেই আমাদের। একটা প্লাটফর্ম পেলে দাঁড়াতে হবে প্রথমে। আমার কাঁধে রয়েছে ছোট বোন আনিকার দায়িত্ব। সেটা ভুলে গেলেও চলবে না।

রবিন বলে, দেখো, ঘুরতে এসেও জটিল কথাবার্তা বলছি আমরা। ভালো লাগার কথা বলছি না।

ভালো লাগার কথা কি মুখ ফুটে বলতে হয়? তোমার সঙ্গে আছি, এটাই ভালো লাগার বিষয়। অনুভব করছি সেটা।

তবুও ঝগড়া বেধে যায় কখনো-কখনো।

ঝগড়া বাঁধবেই। ঝগড়া বাঁধা মানে ভালোবাসাহীনতা নয়। স্বজনের সঙ্গেই খুনসুটি হবে, ঝগড়া হবে। রাস্তার ছমির উদ্দিনের সঙ্গে কি ঝগড়া করব?

এ কথাটা ভালো লাগে রবিনের। পাশ ঘেঁষে বসে রুবার। ওর বাঁ হাতটা তুলে নেয় নিজের ডান হাতে। বসে থাকে চুপচাপ। অন্য রকম ভালো লাগছে এখন। চারপাশে অনেক মানুষের হাঁটাচলা। সামনে ফুচকাওয়ালা, ঈগলু আইসক্রিম, বাদাম বিক্রেতা। আশপাশে বসে আছে অনেক জুটি। দামি গাড়ি থেকে নামছে কেউ কেউ। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছে বাঁ পাশের রাস্তা দিয়ে। একটা মেয়ে মাঠের দিকে ছুটতে গিয়ে উহ্ করে চিৎকার দেয়। বড় বড় ঘাসের আড়ালে জমে আছে বৃষ্টির পানি। পানিতে ডুবে গেছে তার পায়ের গোড়ালি। চিংড়ি মাছের মতো পা তুলে ফিরে আসছে সে আবার পাকা সিঁড়ির দিকে। মেয়েটার অবস্থা দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে সঙ্গের ছেলেটি। আরও অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে হাসিমুখে।

ফিরে এসে কিছুটা গম্ভীর হয়ে মেয়েটি বলে, হাসছ কেন? বাহ্! হাসি আসছে। এজন্য হাসছি।

আমার ভোগান্তি দেখে তোমার হাসি পেল? ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা এবার মেয়েটির।

ভোগান্তির কথা বলছ কেন? ঘটনাটা এনজয় করলাম।

এনজয়, নাকি হেসে সবার সামনে অপমান করছ আমাকে?

এখানে অপমানের কী আছে?

সবার সামনে হেনস্তা হলাম, সহমর্মিতা দেখাবে, সেটা না করে হাসাটা একধরনের ইনসালটেশন না?

ছেলেটি জোর দিয়ে বলে, মোটেই না। মজাদার ঘটনা ফুর্তি এনেছে মনে। এটা ইনসালটেশন না।

মেয়েটি ক্ষুব্ধ চোখে তাকায় ছেলেটির দিকে। চোখ নামিয়ে নেয় ছেলেটি। মেয়েটি এবার হনহন করে হাঁটতে থাকে রাস্তার পাশে পার্কিং করা ওদের গাড়ির দিকে। মাথা নত করে ছেলেটিও এগিয়ে যায় পেছন পেছন।

দৃশ্যটি দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়ায় রবিন।

রুবা প্রশ্ন করে, কোথায় যাচ্ছ?

কোথাও যাচ্ছি না। বাদাম খাব। বাদাম নিয়ে আসি।

বাধা দিল না রুবা। তাকিয়ে থাকে হনহন করে হেঁটে যাওয়া মেয়েটির দিকে। চারপাশের সবাই হতবাক। চুপ হয়ে দেখছে ঘটনাটা।

রবিন ফিরে আসে বাদাম নিয়ে। দুহাতে দুই প্যাকেট বাদাম।

রুবা বলে, দুই প্যাকেট কেন?

দুজনের জন্য। ১০০ গ্রামের প্যাকেট। এক প্যাকেটে কম হবে, তাই দুই প্যাকেট নিয়ে এসেছি। অ্যানি প্রবলেম?

না। প্রবলেম হবে কেন? হঠাৎ মনে হলো আমরা আলাদা। এক না। এজন্য দুই প্যাকেট।

তাহলে এক কাজ করি, তোমার রুমালটা রাখো এখানে। দুই প্যাকেটের বাদাম এক জায়গায় রাখি, মাখামাখি হয়ে যাক।

মাখামাখি শব্দটা শুনে হেসে দেয় রুবা। হাসতে হাসতে বলে, মাখামাখি করে নাও। একসঙ্গে খাব।

রবিন বলে, ভালো সিদ্ধান্ত। অনেক দিন পর রেগে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি।

আমি রেগে যাই?

হ্যাঁ, যাও তো।

তুমি রাগাও না?

জানি না।

জানো না, মানে? তুমিই তো রাগিয়ে দাও আমাকে।

রবিন বলে, একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দেখেছ?

দেখলাম।

কে কাকে রাগিয়েছে? ছেলেটা কি মেয়েটাকে রাগিয়েছে, না মেয়েটা ছেলেটাকে?

রুবা বলে, ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।

হ্যাঁ। এটা বলল, ভুল বুঝে তুমিও রেগে যাও। আমিও রাগ দেখাই। অধিকারে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে পারি না আমরা।

আমি অধিকার ছাড় দিতে রাজি নই। সাফ কথা।

এ ধরনের অনড় মনোভাব ভালো না। নমনীয়তা না থাকলে সম্পর্ক টেকে না। শীতল গলায় বলল রবিন।

না টিকলে না টিকবে। সব মানতে পারব, অধিকারে ছাড় দিতে পারব না। মেয়েটিকে দেখেছ? ভুল বুঝলেও ভালোবাসার মানুষের কাছে চাওয়াটা অনেক উঁচু। উঁচু থেকে নিচে পড়তে রাজি নয় সে। ছাড় দেয়নি। চলে গেছে। ছেলেটাও যেতে বাধ্য হয়েছে পেছন পেছন।

বাধ্য করে কিছু পাওয়ার মধ্যে আনন্দ থাকার কথা না। পাওয়া অর্জন করতে হয়। মেয়েটা ঠকেছে বাধ্য করে, হেরেছে। টের পায়নি সে। জোর দিয়ে কথাগুলো বলল রবিন।

বাদাম খাওয়া বন্ধ করে দেয় রুবা। রবিনের যুক্তি ভালো, বুঝতে পারে। তবুও মন মানে না অনেক কিছু। মন এমন কেন? মানে না কেন সব যৌক্তিক কথা?

সংসদ ভবন এলাকা জমে উঠেছে। মানুষের কমতি নেই, বর্ষাকালেও বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষ আসে এখানে। শিশুরা আসে মায়ের হাত ধরে। জুটিরা আসে। গাড়ি থেকে নেমে একটি শিশু হঠাৎ ছুটে আসে মাঠের দিকে। তার হাতে উড়ন্ত বেলুন। পেছনে আনাড়ি ভঙ্গিতে ছুটে আসছে শিশুটির মা। আচমকা হাত থেকে ছুটে যায় বেলুন। উড়ে গিয়ে পড়ে সবুজ ঘাসের মাঠে। কিছু না বুঝে শিশুটি ছুট দেয় মাঠের দিকে। ধপাস করে পড়ে যায় সে। কাদা-পানি একাকার হয়ে গেছে। কাছে বসা রবিন চট করে লাফ দিয়ে উঠে উদ্ধার করে শিশুটিকে–মুহূর্তে দুহাতে টেনে তোলে ঘাসের আড়ালে লুকানো কাদা-পানি থেকে। ততক্ষণে শিশুর মা কাছে এসে গেছে। বিপদাশঙ্কায় মা হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। একটু পর সহজ হয়ে কৃতজ্ঞতা জানায় রবিনকে। এই কৃতজ্ঞতাবোধের জবাব জানা নেই রবিনের। মৃদু হেসে ও ফিরে আসে রুবার কাছে।

রুবা বলে, দারুণ দেখালে!

দেখালাম মানে? দেখানোর কী আছে এখানে?

না। দেখানোর কিছু নেই। তবুও দেখিয়ে দিলে, তুমিও পারো। খোঁচা খেয়ে দমে যায় রবিন। হাত-পায়ে এখনো লেগে আছে ময়লা পানি। পরিষ্কার পানি দিয়ে বোয়া দরকার এসব নোংরা। পরিষ্কার পানি পাবে কোথায়? দেখে, সামনে ফুচকাওয়ালার কাছে পানির ড্রাম আছে। উঠে ফুচকাওলার কাছে যায় ও। অল্প পানি চেয়ে হাত-পা ধুয়ে ফিরে এসে গম্ভীর হয়ে বলে, কী বলছিলে, এবার বলো।

রুবা আবার বলে, ওই মহিলা বারবার তোমার দিকে তাকাচ্ছে। যাও কথা বলে এসো তার সঙ্গে।

বাহ্! উনি তাকাতে পারবেন না? ওনার ছেলেকে উদ্ধার করে দিলাম। আমার দিকে তাকানো কি তার অন্যায়?

না। অন্যায় হবে কেন? ন্যায়! একদম ন্যায় কাজ করেছ তুমি, তিনিও করছেন।

আরে বাবা, ন্যায়-অন্যায়ের কী হলো? সহজ হিসাব। একটা শিশু আচমকা…

থাক। আর বলতে হবে না। ওই রকম সুন্দরী মহিলা না থাকলে কাদা পানিতে কেবল শিশুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে না তুমি।

আহত চোখে রবিন এবার তাকাল রুবার দিকে। পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে চাচ্ছে না ও। কেবল এটুকু বোঝে, যা ঘটেছে আচমকা ঘটেছে। এখানে করার কিছু ছিল না তার, রিফ্লেক্সলি উঠে গেছে শিশুটি উদ্ধারের জন্য। মনে মনে ভাবে, মেয়েদের প্রতিই কেবল ছেলেদের পজেসিভনেস বা পার্টনারকে নিয়ে আশঙ্কা থাকে না, মেয়েরাও ছেলেদের প্রতি পজেসিভ হতে পারে। তার সর্বোত্তম প্রমাণ রুবার এখনকার প্রতিক্রিয়া।

মাথা ঠান্ডা করে রবিন বলে, আচ্ছা, আমি যদি না থাকতাম, তুমি একা থাকলে কি এ অবস্থায় বাচ্চাটাকে উদ্ধারের জন্য লাফ দিতে না?

দিতাম। সেটা হতো রিয়েল জাম্প। সেবার জন্য কাজ।

আর আমার জাম্পটা কি লোক দেখানো?

অ্যাকজ্যাক্টলি। আমি আগেও দেখেছি, সুন্দরী মেয়েদের সামনে তোমার মধ্যে বাহাদুর সাজার একটা প্রবণতা থাকে।

রবিন এবার হাসানোর জন্য বলে, তুমিও সুন্দরী, তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্যও আমাকে বাহাদুর সাজতে হবে!

নিজেকে সুন্দরী মনে হয় না। তবে আত্মবিশ্বাসী রুবা সুন্দরী শব্দটা শুনে গলে যায়। গলে গিয়ে বলে, ওই যে উনি আসছেন তোমার দিকে।

রবিন চোখ তুলে দেখে, মহিলাটি আসছে শিশুটিকে কোলে নিয়ে। উঠে দাঁড়ায় ও। সামনে এগিয়ে যায়।

নিজেকে বোঝার চেষ্টা করে রুবা। বোঝে, রবিনের কোনো দোষ নেই। ন্যায্য কাজ করেছে সে। যেকোনো মা-ই এমন কাজে কৃতার্থ হবেন। ওই মহিলাও হয়েছেন। তবুও পুরো ঘটনাটিকে এমন করে দেখছে কেন নিজে? সহজ বিষয়ে এমন পাক খেলে যায় কেন? অল্পতে কেন রাগ ওঠে? অল্পতে কেন খারাপ চিন্তার জালে জড়িয়ে যায় মন? নিজেদের গোপন হতাশা কি এর জন্য দায়ী? দারিদ্র্য কি গোপনে মনের কোমল জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছে? নিজের মনকেও দরিদ্র করে তুলেছে? জীবন নিয়ে অগ্রিম আশঙ্কা কি গোপনে ক্ষতিগ্রস্ত করছে প্রতিটি বর্তমান সময়? রবিনকে প্রাণ ঢেলে ভালোবাসে ও। তবুও কেন তিক্ত হয়ে যায় মন? তুচ্ছ ঘটনায় কেন বিক্ষিপ্ত হই নিজে? উত্তর জানা নেই রুবার। রুবা ভাবে, ও-ই কি ডমিনেট করার চেষ্টা করছে রবিনকে, নাকি রবিনই প্রতি কাজে ডমিনেট করতে চায় ওকে? নিজে ডমিনেট করতে চায় না, তবুও মনে হয়, মাঝে মাঝে চাপ তৈরি করে রবিনের ওপর। শক্ত হয়ে মনে মনে ভাবে, বুঝিয়ে দিতে হবে রবিনকে, তাকে যেন ডমিনেট করার চেষ্টা না করে।

অন্ধকার নেমে আসছে। তার পরও সংসদ এলাকা অন্ধকার নয়। চারপাশ আলোকিত। ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামছে। ভিজতে ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে। জগতের না পাওয়ার যাতনা থেকে মুক্তি চায় ও। বড় হতে চায়। প্রতিষ্ঠা পেতে চায় জীবনে। সঙ্গে আছে রবিন। বন্ধু হিসেবে আফরিন কি থাকবে তার পাশে? মাঝে মাঝে ঘাটতি হয় বিশ্বাসের। ঘাটতি পূরণ হবে কীভাবে? জানা নেই ওর। সামনে বিশাল রাস্তা, চলমান গাড়ির সারি, শত শত মানুষের মিছিল। এই মিছিলে তুচ্ছ মানুষ ও। পারবে কি ভরিয়ে তুলতে জীবন? আনন্দ কি ধরা দেবে এ জীবনে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *