না – ১৫

১৫

শ্যামলী সিনেমা হলের উত্তর পাশের রাস্তা ধরে পশ্চিমে অগ্রসর হচ্ছে গাড়ি। গাড়িতে বসে আছেন পরিচালক প্রশাসন, জাহেদ আকবর ও রুবা। রাস্তায় সাইনবোর্ডে লেখা আছে রিং রোড। রিং রোড ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে ডানে মোড় নেয় গাড়ি। ডানের ঢালু রাস্তায় নেমে ড্রাইভার বলে, এখানে পার্কিং করে রাখি গাড়ি। সামান্য পথ হেঁটে যেতে হবে, স্যার। পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে গাড়িটি ঘোরাতে অসুবিধা হয়।

জাহেদ আকবর বলেন, ঠিক আছে, রাখো। নেমে যাচ্ছি আমরা। হেঁটে যাব বাকি পথ।

ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দেয়। প্রথমে নামলেন জাহেদ আকবর, অপর পাশের দরজা খুলে নামে রুবা।

একই গাড়িতে ইমিডিয়েট বসের সঙ্গে অফিশিয়াল কাজে এসেছে রুবা। বস হিসেবে তিনি অসাধারণ। পুরুষ হিসেবেও বেশ ব্যক্তিত্ববান, কোনো অশোভন চাউনি কিংবা অশুভ মনোভাব দেখেনি এখনো রুবা। এটাই শান্তি। নিশ্চিন্তে এসেছে কাজে। তার পরও অনিশ্চিত গোপন ভয় কাজ করছে। সামাজিক চোখই সেই ভয় ঢুকিয়ে রেখেছে মনে। বিষয়টা কীভাবে দেখবে রবিন? বড় চোখে দেখবে তো? তিমুর ইস্যুটা পাত্তা দেয়নি রুবা। তার পরও দ্বিতীয় জন হিসেবে রবিনের আনন্দ-সংবাদ পেয়েছে তিমু! শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কেন? ঈর্ষা, না সন্দেহ? কী কাজ করেছে মনে? অতি তুচ্ছ ঘটনায়ও মন রি-অ্যাক্ট করে কেন? বুঝতে পারে না রুবা।

কেন্দ্রে ঢুকে মলিন হয়ে গেল রুবার মুখ।

জাহেদ আকবর বললেন, ব্যাপার কী? এমন ম্লান লাগছে কেন আপনাকে?

ম্লান দেখাচ্ছে? আমি এমনই স্যার।

নো। নেভার। এমন নন আপনি। কোনো কারণে মন খারাপ হয়েছে। নিশ্চয়।

মন খারাপ হওয়াটা অস্বাভাবিক না, স্যার। এখানে ঢুকে মনে হয়েছে, আমারও স্থান হতে পারত এ জায়গায়!

না। এমন ভাবা ঠিক নয়। ক্লায়েন্টের কোনো ইস্যুর সঙ্গে নিজেকে

কমপেয়ার করবেন না, পার্সোনালাইজ করা চলবে না। তবে ক্লায়েন্টের প্রতি আমাদের অ্যাপ্রোচ হবে এমপ্যাথেটিক। সমানুভূতি থাকবে, সহানুভূতি নয়।

এমপ্যাথি কিংবা সমানুভূতি শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটল রুবার। অর্থবোধ স্বচ্ছ নয় নিজের কাছে। প্রশ্নবোধক চোখে রুবা তাকাল বসের মুখের দিকে।

জাহেদ আকবর বোঝেন, ক্লায়েন্ট ডিলিংসের ক্ষেত্রে এমপ্যাথি একটা প্রফেশনাল শব্দ। শব্দটির ব্যাখ্যা দরকার। খোলাসা করে বলেন, এমপ্যাথি মানে ক্লায়েন্টের চোখ দিয়ে আমরা তার চারপাশের জগৎ মেপে দেখব। সমস্যাটি যেভাবে দেখছে তারা, আমরাও দেখব সেভাবে। অর্থাৎ ধরে নেব তাদের সমস্যা আমাদের সমস্যা, আমার নয়। আর একটা কথা মিস তাবাসসুম, মনে রাখবেন, ভিকটিমদের রোগী বলছি না আমরা, ভিকটিম বা নির্যাতিতা বলছি না–বলছি ক্লায়েন্ট।

জি স্যার। সেটা বুঝেছি ইতিমধ্যে।

থ্যাংকস। আর একটা কথা মনে রাখবেন, যাদের দেখভাল করবেন তাদের সামনে থাকতে হবে সেলফ কনফিডেন্ট। আত্মবিশ্বাসী।

থ্যাংক ইউ স্যার ফর ইওর ডিরেকশন। একটা প্রশ্ন এসেছে মনে, জিজ্ঞেস করব, স্যার? অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন।

ক্লায়েন্ট যদি কোনো ঘটনাকে ভুল বিশ্লেষণ করে, ভুল মূল্যায়ন করে কষ্ট পায়, আমরাও কি ভুলটা মেনে নেব?

ভুল করছে, সরাসরি বলে দেব না। আমাদের ডিলিংস এমন হবে, সে তার ভুল ধরতে পারবে, নিজের মূল্যায়নে তখন শুদ্ধ হয়ে যাবে। কাউন্সেলিং সেশনে ভুলের উত্তর পেয়ে যাবে সে।

তাহলে সমানুভূতির কথা আসে কেন?

সমানুভূতি থাকার অর্থ এই নয় ক্লায়েন্টের ভুল মেনে নিয়েছি। অর্থ এই যে, ওই মুহূর্তে ক্লায়েন্টের চোখেই ঘটনাটা দেখছি আমরা। সেভাবে দেখতে পেলে বোঝা সহজ হবে তাকে, স্বচ্ছ হবে।

প্রফেশনাল কথাবার্তায় রুবা একদম ইজি হয়ে গেল, জড়তা কেটে নিজস্ব চিন্তার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারল রুবা। নিজের ব্যক্তিত্বে এখন আসন গেড়ে বসেছে এই প্রতিষ্ঠানের একজন অফিসারের উজ্জ্বল প্রতিকৃতি। প্রত্যয়ী মন নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল কেন্দ্রের ভেতরে।

জাহেদ আকবরকে দেখে সাড়া পড়ে গেছে কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত স্টাফদের মধ্যে। এখানকার অফিসকক্ষে গিয়ে বসলেন তিনি। পাশের চেয়ারে বসতে বললেন রুবাকে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নতুন অফিস এক্সিকিউটিভকে।

জাহেদ আকবর বলেন, শিমুলকে নিয়ে আসুন। নতুন ম্যাডাম কথা বলবেন শিমুলের সঙ্গে।

অফিস সুপারভাইজার, মধ্যবয়সি এক নারী, উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, শিমুল ঘুমাচ্ছে।

এখনো ঘুমাচ্ছে? প্রশ্ন করল রুবা।

জি ম্যাডাম। মানসিক চিকিৎসা চলছে, রাতে ঘুম হয়েছে কম। ঘুমিয়েছে সকালের দিকে। এজন্য ওঠানো হয়নি তাকে।

জাহেদ আকবর প্রশ্ন করেন, তার সুইসাইডাল থটস কি আছে এখনো?

না স্যার। আত্মহত্যার কথা বলে না এখন। তবে মন খারাপ করে থাকে এখনো, কাঁদে মাঝে মাঝে।

আগের মতোই?

না, স্যার। আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে অনেক।

ঘুমাক শিমুল। নতুন যে মেয়েটি এসেছে, কী যেন নাম, ওকে নিয়ে আসুন।

ওর নাম ইরা।

ঠিক আছে মিস তাবাসসুম। আপনি কথা বলুন ইরার সঙ্গে। কাউন্সেলিং কক্ষে আছে পাশে। সুপারভাইজারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সেখানে নিয়ে বসান ম্যাডামকে।

উঠে দাঁড়ায় রুবা। সুপারভাইজারকে অনুসরণ করে গেল পাশের কক্ষে। মনের মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি টের পেতে থাকে। স্টাফদের সামনে বসের মুখে ম্যাডাম ডাক শুনতে ভালো লেগেছে। ভালো লাগল কেন? শুনেছে চেয়ার পেলে নিরীহ ব্যক্তিও ক্ষমতার দানবে পরিণত হয়, সেও কি তবে বদলে যাচ্ছে। মানবী থেকে দানবীতে?

ইরাকে দেখে অবাক হয়ে যায় রুবা। এত সুন্দর একটা মেয়ে তাদের ক্লায়েন্ট! ভাবা যায় না। মিষ্টি মুখ, অসাধারণ ফিগার, সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, জিনসের প্যান্ট পরনে, প্যান্টের নিচের অংশ ফোল্ডিং করা। ঘরে ব্যবহারের চটি স্যান্ডেল পায়ে পরেছে সে।

সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে এসে রুবার সামনে বসে ইরা।

বিস্ময়ের ঘোর ঠেলে নিজের মধ্যে ফেরে অফিস এক্সিকিউটিভ রুবা। নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করে আলাপ।

এ মুহূর্তে কী পেলে খুশি হবেন আপনি?

আমার ইচ্ছা পূরণ করলে খুশি হব।

ইচ্ছা পূরণে বাধা দিচ্ছে কে? কেন তা পূরণ হচ্ছে না?

যাকে ভালোবাসি সে হিন্দু। শুনে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন বন্দী করে রেখেছে আমাকে। সেখান থেকে পালিয়ে মানবাধিকারের সাহায্য নিয়ে এখানে উঠেছি আমি। আমার ইচ্ছা পূরণে বাধা দিচ্ছেন বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন।

ছেলেটি হিন্দু, সেটাই কি বড় কারণ? নাকি আরও কারণ আছে?

চুপ করে থাকে ইরা।

ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রুবা। কল্পনায় ওই মুখে ভেসে ওঠে নিজের ছোট বোন আনিকার ছবি। আনিকার মুখও এমন মায়াবী, এমন সুন্দর হয়ে উঠছে ত্বক, দৈহিক গড়ন। একটা মেয়ের মন যে কারও সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে, জড়িয়ে গেলে তার কিছু করার থাকে না আর। কমে যায় ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা। সেই অবস্থান থেকে ফেরানো কঠিন তাকে।

রুবার ভাবনা থেমে গেল। কিছু বলতে চাইছে ইরা। ও মনোযোগ দিল তার দিকে।

ইরা বলে আরও আছে কারণ–সে আমার গানের শিক্ষক। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। ম্যারেড।

জোরে একটা ধাক্কা খেল রুবা। বুঝতে পারে, কেন বাবা-মা বন্দী করেছিল তাকে।

এ বয়সি একটা মানুষের সঙ্গে ইচ্ছা পূরণের সম্পর্ক কী? কীভাবে ইচ্ছা পূরণ করতে চান?

থাকতে চাই ওর সঙ্গে।

সে ওর শব্দ দুটি স্কাড ছোড়ে। এমন বয়স্ক একজনকে কীভাবে ও সে বলে সম্বোধন করে এত অল্পবয়সি একটা মেয়ে?

থাকতে চাই মানে কী? মুখ ফুটে প্রশ্ন করে রুবা।

থাকতে চাই মানে একত্রে থাকব।

বিয়ে না করে একত্রে থাকবেন কীভাবে? সমাজ আছে না? সামাজিক রীতিনীতি আছে না?

রীতিনীতি মানি না। দরকার হলে বিয়ে করব তাকে।

সে কি রাজি আপনাকে বিয়ে করতে?

আমি যা চাইব তা-ই করবে সে।

আর ইউ কনফিডেন্ট?

শিওর।

স্বীকৃত বিয়ে মানে তো কেবল দুজনের সম্পর্ক না, দুটো পরিবারের, দুটো সামাজিকতারও সম্পর্ক, কিন্তু সম্পর্কটা একটা ধর্মের। একজনকে ধর্ম ত্যাগ করতে হয়। জানেন?

প্রয়োজনে ধর্ম ত্যাগ করবে সে।

শিওর?

হ্যাঁ। শিওর।

ওনার পরিবারের কী হবে? ছেলেমেয়ে?

তাও ত্যাগ করবে সে।

শিওর আপনি?

ডেফিনিটলি শিওর।

ইরার আত্মবিশ্বাস দেখে এত দিনে গড়ে ওঠা নিজের মূল্যবোধের শেকড়ে টান লাগল। অবাক হয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে থাকে রুবা। এমন একটি মেয়েকে কীভাবে হেলপ করবে ওদের প্রতিষ্ঠান! বুঝে উঠতে পারছে না। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসে–ইরা কি মানসিকভাবে সুস্থ? উত্তর নিয়ে না ভেবে ভাবে ইরার মা-বাবার অসহায়ত্বের কথা। বুঝতে পারে, জোর করে ইরাকে ফেরানো যাবে না। জোর করলে আরও তীব্র হবে এ বেমানান আকর্ষণ। যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দরকার ছিল সেভাবে হয়তো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অবস্থা টের পেয়ে প্রথম এপিসোডে বাবা-মা হার্ডলাইনে চলে গিয়েছিলেন। কীভাবে মেনে নেবে তারা ইরার এ ধরনের অসম ইচ্ছা।

গানের শিক্ষক প্ররোচিত করেছে তাকে? না বলতে পারেনি সে? নাকি শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে গলে গিয়েছে? কেন ঘটেছে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা? কীভাবে রোধ করা যাবে এই সংকট? ভেবে কোনো কূল-কিনারা পেল না রুবা। এই অসম অবাস্তব দাবি বুঝতে পারছে না কেন ইরা? ওকে মনোচিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করা দরকার। এ বোধটা শেয়ার করতে হবে বসের সঙ্গে। পরিকল্পনাটি সহজ করে দেয় রুবাকে।

ইরা আবার বলে, সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকব আমি। বাসায় যাব না।বাসায় যেতে বলবেন না আপনারা।

রুবা বলে, আপনার সমস্যা আমাদের সমস্যা। বলতে চেয়েছিল, আপনি যেভাবে মূল্যায়ন করছেন ঘটনাটি, সেভাবে মূল্যায়ন করছি আমরা, বলতে পারল না। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক চোখ বন্ধ করে দিয়েছে রুবার মুখের কথা।

ইরার অনড় অবস্থান দেখে আচমকা বুক টলে ওঠে–ইনটিউশন তেড়ে আসে মনে। রবিনের ছাত্রী তিমু এমন বেপরোয়া হবে না তো রবিনের প্রতি? কী ছিল এসএমএসে? কেন পড়তে দেয়নি রবিন? ভাবার সঙ্গে সঙ্গে অচেনা অনুভূতিতে ছেয়ে গেল মন। গোপন বিষের রেণু ছড়িয়ে যাচ্ছে দেহের প্রতিটি বিন্দুতে। এমন ভাবনা এল কেন মাথায়! হঠাৎ মনে পড়ে জাহেদ আকবরের কথা। অন্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না কোনো ইস্যু। কেন সে ইরাকে তুলনা করছে তিমুর সঙ্গে? কেন টেনে আনছে রবিনকে এই অসম ঘটনার ভেতর? মুখে হাসি টেনে ও উঠে দাঁড়াল চট করে, তার ভেতরটা হেসে না উঠলেও, ওর মুখের হাসি দেখে হাসল ইরাও। আশ্বস্ত করতে ইরাকে উদ্দেশ করে রুবা বলে, আমরা আছি আপনার পাশে।

চলে গেল ইরা। রুবাও ফিরে এল অফিস কক্ষে।

জাহেদ আকবর খেয়াল করলেন রুবাকে। বুঝতে পারেন, অবিশ্বাস্য ঘটনার মুখোমুখি হয়ে দিশেহারা হয়েছে সে।

রুবা কিছু বলার আগে জাহেদ আকবর বলেন, একজন মনোচিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে, ইরাকে দেখাতে হবে। ওকে নিয়ে ভাবলে টেনশন বাড়বে। ক্লায়েন্টের টেনশন বহন করা ঠিক হবে না কর্মকর্তা কর্মচারীদের।

মাথা নেড়ে রুবা সায় দেয়, জি।

একটা কেসের কথা শুনে মলিন হয়ে গেলেন মিস তাবাসসুম?

না স্যার, মলিন হইনি। চিন্তিত হয়েছি।

চিন্তিত হওয়া চলবে না। আগেই বলেছি।

বলে-কয়ে তো থামানো যায় না সব। আপনাআপনি চলে আসে চিন্তা। নিশ্চয় আরও অভিজ্ঞতা হবে কাজ করতে করতে। আরও শক্ত হবে মন। তখন হয়তো অন্যের বিষয়-আশয় নিজেকে আক্রান্ত করবে না। সময় যেতে দিন, স্যার। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঠিক হয়ে যাবে বললেও ঠিক হচ্ছে না মন। রুবার দেহের প্রতিটি অণুতে ঘুণপোকার মতো ঢুকে গেছে বিষের অণু। তিমু নামক একটা বিষ ক্রমাগত হেঁটে বেড়াচ্ছে কোষে-কোষে। আদরের বোন আনিকার জন্যও ভীত হয়ে ওঠে মন। অবুঝের মতো কোনো ঘটনা ঘটিয়ে বসবে না তো আনিকা?

জাহেদ আকবরের কথায় থেমে গেল চিন্তা। তিনি বলেন, শিমুলের আপিলের বিষয় দেখবেন আমাদের নির্দিষ্ট অ্যাডভভাকেট। এ ব্যাপারে আপনার কষ্ট করতে হবে না। আগে মানসিকভাবে সুস্থ হোক সে। আমাদের কাজ হবে শক্ত পায়ে তার পাশে দাঁড়ানো। এ দায়িত্বটা পালন করবেন আপনি। আরেক দিন এসে কথা বলবেন শিমুলের সঙ্গে।

যেভাবে বলবেন সেভাবে কাজ করব। নিশ্চিন্ত থাকুন।

একটা বিষয় কারেকশন করে নিন। আমার ডিরেকশন অনুযায়ী কাজ করবেন না আপনি। সমস্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে প্রস্তাব রাখবেন তা বাস্তবায়ন করব আমরা। দায়িত্ব আপনার। মাথা খাটাতে হবে আপনাকে।

দায়িত্ববোধের কথা শুনে মাথায় চেপে বসল দশমণ ওজনের ভারী বোঝা। সমস্যা সমাধানের মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা নেই তার। তবুও সাহস দেখিয়ে বলল, চেষ্টার ত্রুটি হবে না আমার। সবঘটনা কি একই ধরনের, স্যার?

না। একই ধরনের না। অবিশ্বাস্য, অচিন্তনীয় ঘটনা নিয়ে অনেক কেস আসবে। হিমশিম খেতে হবে আমাদের। তবুও হাল ছাড়ব না–ইমোশনাল সাপোর্টের পাশাপাশি সব ধরনের সাপোর্ট নিয়ে থাকব আমরা ক্লায়েন্টের পাশে।

অবিশ্বাস্য কেসের আর কোনো উদাহরণ পেতে পারি, স্যার?

চাকরি দেওয়ার নাম করে গ্রামগঞ্জের অনেক মেয়েকে পাচার করা হয়েছে বিদেশে। পরদেশে দেহব্যবসার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে তারা। সরকারি এজেন্সির মাধ্যমে দেশে ফিরে এসেছে অনেকে। একেকটা মর্মন্তুদ ইতিহাস।

দেশেও তো ফাঁদে পড়ছে অনেক মেয়ে। অসামাজিক, অনৈতিক কাজে জড়াতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের উদ্ধার করা যায় না, স্যার? রুবা প্রশ্ন করে তাকিয়ে থাকে জাহেদ আকবরের মুখের দিকে।

উদ্ধার করা আমাদের কাজ না। উদ্ধারের পর পুনর্বাসনের দায়িত্ব আমাদের।

উদ্ধার করবে কারা?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সি উদ্ধার করবে ভিকটিমদের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা ভিকটিমদের ধরে অপরাধী হিসেবে। কীভাবে অপরাধী হলো, কেন অপরাধ-জগতে ঢুকল, বিষয়টা তলিয়ে দেখেন কি তারা?

গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তুলেছেন আপনি। অবশ্যই বিষয়টা নিয়ে পরে আলাপ করব আমরা। তবে যতটুকু জানি, বিচারের মাধ্যমে সাজা পায় প্রকৃত অপরাধী। ছাড়া পায় নিরীহরা।

নিরীহ একজনও তো ফাঁদে পড়ে হয়ে যেতে পারে অপরাধী। তাকে পুনর্বাসন করবে কারা?

না। প্রকৃত অপরাধীদের সহযোগিতা করব না। সেই বিষয়টা দেখবে আদালত। সীমা টপকাতে পারব না আমরা।

কথা থেমে গেল রুবার।

জাহেদ আকবর বলেন, চলুন, হেড অফিসে ফিরে যাই।

কোনো জবাব না দিয়ে বসের সঙ্গে হেঁটে পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলো রুবা। মাথায় মধ্যে ঘুরতে থাকে রুমমেট সিমির কথা। গডমাদার আফরিনের কারণে অনৈতিক জগতে নেমে গেছে সিমি। সরল মেয়েটির জন্য মায়া হচ্ছে। কীভাবে উদ্ধার করবে তাকে বুঝে উঠতে পারছে না। এটা বুঝতে পারে, যারা সরল মেয়েদের ফাঁদে টেনে নিয়ে যায়, তাদের ছাড়া যাবে না। বিচার হতে হবে ওই চক্রের।

১৬

তিমুদের বাসায় ঢুকে সংকোচ বোধ করতে লাগল রবিন। এমন লাগেনি কখনো। আজ জড়তা চেপে ধরেছে ওকে। ইউ আর মাই ড্রিম মেসেজটা পাওয়ার পর থেকে পরিবর্তন হয়েছে অনুভবে। তিমুর কথায় কোনো পরিবর্তন টের পায়নি ও। চাকরির খবর যখন জানাল, তার কথায় তেমন উচ্ছ্বাস দেখেনি রবিন। স্বাভাবিক ঢঙে কথা বলেছে তিমু। পৃথিবীর কোথাও কোনো

পরিবর্তন হয়নি, এমন ভঙ্গিতে কনগ্রাচুলেট করেছে ওকে। আর দশজন যেভাবে সেলিব্রেট করে সেভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে চাকরির খবর শুনে। কথার ফাঁকে তিমু প্রশ্ন করেছিল, আমার নম্বরটা মুখস্থ করে রেখেছিলেন? সেদিন তো আপনার সেটে এন্ট্রি করতে দেখিনি নম্বরটা!

প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছিল রবিন।

এ প্রশ্ন কেন করেছিল তিমু? হঠাৎ কথাটা মনে জেগে উঠল। মেসেজ পাঠিয়েছিল তিমু, সেই সূত্রে নম্বরটা পাওয়া। এন্ট্রি করে রেখেছিল মেসেজ অপশন থেকে। এটা সহজ হিসাব। হিসাবটা ঢোকেনি কেন তিমুর মাথায়? তবে কি ওকে মেসেজটি তিমু পাঠায়নি? ভুল করে কি চলে এসেছে তার সেটে? এমন হওয়া অসম্ভব নয়। ভুল করেও আসতে পারে। ভাগ্যিস, উত্তর পাঠায়নি ও। উত্তর দিতে গিয়েও দেয়নি। মেসেজটা ডিলিট করে দিয়েছিল।

চট করে আর একটা প্রশ্ন উড়ে এল মাথায়। ওর সেট থেকে কি অন্য কেউ পাঠাতে পারে মেসেজটা? কেন পাঠাবে? নিজেকে প্রশ্ন করে। উত্তর পেয়ে যায় রবিন। ইয়েস! হতে পারে। ওর মা হয়তো পাঠিয়েছিলেন মেসেজটা। কী উত্তর যায় বোঝার চেষ্টা করেছিলেন হয়তো। এমন কঁচা কাজ করবেন কেন তিনি? তবে কি টিচারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন তিমুর মা? হতে পারে।

সম্ভাব্য উত্তর পেয়ে নিজেকে রবিন বোঝায়, তিমুর প্রতি অন্য কোনো ধরনের ফিলিংস নেই। চঞ্চল কিশোরীর প্রতি মায়া তৈরি হয়েছে, সেটা স্বচ্ছ মায়া, সুন্দর মায়া। ছাত্রীর প্রতি শিক্ষকের যতটুকু দরদ থাকা দরকার ততটুকু দরদ। ভেতর থেকে উত্তর পাওয়ায় কমে গেল চাপ। নিজেকে শুদ্ধ ভাবতে লাগল। রুবার সঙ্গে যতই প্রতিযোগী মনোভাব থাকুক না কেন, রুবাকে ও ভালোবাসে এক শত ভাগ। ভাবতে গিয়ে আরও কমে গেল মনের চাপ। বসার ঘরে এ সময় ঢোকেন তিমুর মা।

হাসিমুখে তিনি বলেন, কনগ্রাচুলেশন, রবিন সাহেব।

থ্যাংক ইউ, আপা।

তিমুর মুখে শুনেছি আপনার চাকরির খবর। তা কেমন চাকরি? চাকরিস্থল কোথায়?

একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সহকারী ম্যানেজার পদে অ্যাপয়নমেন্ট পেয়েছি। ঢাকায় অফিস।

ওহ্! ভালো। আপনার ভালো কিছু হলে খুশি হব আমরা।

দোয়া করবেন, আপা। ঢাকায় থেকে ইভনিং শিফটে এমবিএ কমপ্লিট করার ইচ্ছা আছে আমার।

চেষ্টা থাকলে অবশ্যই সফল হবেন আপনি।

কথার ফাঁকে রবিন প্রশ্ন করে, বাসায় নেই তিমু?

আছে ওর ঘরে। ইদানীং মোবাইল নিয়ে বেশি বিজি থাকছে। এত কথা কার সঙ্গে বলে বুঝতে পারছি না। চিন্তিত হয়ে যাচ্ছি ওকে নিয়ে।

চিন্তার কিছু নেই, আপা। একটু চঞ্চলতা বেড়েছে ওর। এটা বয়সের দোষ হতে পারে, গুণও হতে পারে। তিমু কিন্তু অসাধারণ মেধাবী। বুঝতে পেরেছি আমি। রেজাল্টও ভালো করছে। প্রমাণ রেখেছে তার মেধার।

হ্যাঁ। সেদিকে ঘাটতি নেই। ইদানীং ওর আচরণ নিয়ে শঙ্কিত আমি। ওর বাবা খোঁজ রাখতে পারে না মেয়ের। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসার ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে বলেন, বসেন আপনি। ডেকে দিচ্ছি তিমকে।

কথাবার্তা এবং গলার স্বরে খানিকটা শীতলতার আভাস পেল রবিন। আগে এমন মনে হয়নি এ বাসায়। সংসারে একজন আপন মানুষের মতো যাতায়াত করেছে ও। হঠাৎ ছোট হয়ে গেল মন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল গভীর নিঃশ্বাস।

তিমুর মা বেরিয়ে যাওয়ার একটু পর মুঠোফোন বেজে ওঠে। রুবার কল। ঠান্ডা গলায় রুবা প্রশ্ন করে, কেমন আছ?

ভালো। কোথায় তুমি এখন?

অফিসে বসে আছি নিজ কক্ষে। কাজের চাপ আছে। তবুও কল করতে ইচ্ছা হলো। কল করলাম। তুমি কোথায়?

এ মুহূর্তে এসেছি তিমুদের বাসায়। এখান থেকে যাব নিয়োগকর্তা হাবীব মোর্শেদ খানের সঙ্গে দেখা করতে।

উত্তর শুনে দপ করে নিভে গেল রুবার দ্বন্দ্বসংকুল মন। তার কথা থেমে গেল।

সাড়া না পেয়ে রবিন বলতে থাকে, হ্যালো…হ্যালো…হ্যালো…

সাড়া দিতে পারল না রুবা। লাইন কেটে দিল কিছুক্ষণ পর।

এ সময় বসার ঘরে ঢোকে তিমু।

হাসিমুখে জানতে চায়, এমন হ্যালো…হ্যালো করছেন কেন…এ ঘরে কি লাইন পাচ্ছেন না, স্যার? তাহলে বাইরে গিয়ে কথা বলুন।

তিমুর কথা শুনে দমে গেল রবিন। রুবাকে আবার কল করার পরিবর্তে সেট অফ করে বলে, বোসো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।

কী কথা, স্যার?

আগামীকাল থেকে তো চাকরিতে জয়েন করব। তোমাকে পড়ানোর সময়টা বদলাতে চাচ্ছি।

সেকি স্যার! কীভাবে পড়াবেন? সকাল-বিকেল পরিশ্রম করে কি আর পড়ানোর আগ্রহ পাবেন?

আমরা সংগ্রামী মানুষ। সংগ্রাম করে টিকে আছি ঢাকায়। পরিশ্রম করতে অসুবিধা হবে না। সামনের মাসটা সন্ধ্যার পর আসব ভাবছি। তুমি কী বলে?

আপনি পারলে আমার কোনো অসুবিধা নেই। গৃহশিক্ষক হিসেবে অনেক ভালো আপনি। নিশ্চয় এমন ভালো শিক্ষককে হারাতে চাইব না আমি।

নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হয় রবিন। কিছুটা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, কিছু দিন পর এমবিএ করার জন্য ভর্তি হব আমি। তখন হয়তো তোমাকে পড়ানো কষ্টকর হবে।

ওহ্। এজন্য বোধ হয় আরেকজন টিচারের খোঁজ শুরু করে দিয়েছেন আম্মু।

দপ করে নিভে গেল রবিন। তিমুর মাকে কিছুই বলেনি আগে। এ রকম একটা পদক্ষেপ নিতে পারলেন এত দ্রুত! গৃহশিক্ষকের আন্তরিকতার কোনো মূল্য নেই! সহজে বিদায় করে দেওয়া যায় একজন শিক্ষককে? বাড়ির বারান্দায় একটা কুকুর ঘোরাফেরা করলেও সেটার জন্য মায়া লাগে। রবিনের জন্য কি কোনো মায়া তৈরি হয়নি কারও? কেবল পেশাদার গৃহশিক্ষক ছিল ও? না। কেবল তা ছিল না। অনেক মমতা ঢেলে পড়িয়েছে তিমুকে। এ মমতার কোনো মূল্য হয় না। এখন এই পরিণতি!

স্যার, আপনার কি মন খারাপ হয়ে গেছে?

তিমুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে রবিন। কেবল মন খারাপ হয়নি, কান্নাও দাপিয়ে আসতে চাইছে। অথচ তিমুর মধ্যে তেমন কোনো অভিব্যক্তি নেই।

কিছুক্ষণ পর সহজ হয়ে রবিন জবাব দেয়, হ্যাঁ। খারাপ হয়েছে কিছুটা। মায়ার কাছে হেরে গেছি বলে খারাপ হয়েছে মন।

কোনো জবাব নেই তিমুর মুখে।

কিছুটা সময় চলে গেছে। কেউ কথা বলছে না। রবিন কথা বলতে পারছে না। আর নিজে থেকে কথা বলছে না তিমু। নিজের মুঠোফোনে টেপাটেপি করতে লাগল সে।

ইউ আর মাই ড্রিম-–কে দিয়েছিল মেসেজটা ওর সেট থেকে। জানা উচিত। বিষয়টা খোলাসা না হলে টেনশন থাকবে মনে। জ্বলবে মন। পুড়বে ও। মরিয়া হয়ে মুখ ফুটে প্রশ্ন করে, তোমার মোবাইল থেকে কোনো এসএমএস পাঠিয়েছিলে আমাকে?

না তো! তিমুর উত্তরের মধ্যে বিস্ময় ঝরে পড়ে।

আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না রবিন। তিমুর মা এসে ঢোকে বসার রুমে। হাতে একটা খাম। খাম বাড়িয়ে বলে, এই নিন আপনার এ মাসের অনারিয়াম। নতুন একজন টিচার ঠিক করেছি, মহিলা টিচার। তিমুর স্কুলের এক শিক্ষিকা।

চট করে তিমু প্রশ্ন করে, কই, আমাকে তো বলোনি, মামণি!

এই যে এখন বললাম।

এখন বললে হবে? একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে না?

তোমাদের টিচার। মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন কেন?

তবুও বলা উচিত ছিল আমাকে। আর স্যারকেও কিছু না বলে বিদায় করে দেওয়া ঠিক না মামণি।

একজন শিক্ষকের জন্য ছাত্রীর এটুকু মমতা যথেষ্ট। অল্পতে খুশি হয়ে গেল রবিনের মন। হাসি ফোটে ওর মুখে। সহজ হয়ে বলে, ঠিক আছে তিমু। স্কুলের শিক্ষক ভালো হবে তোমার জন্য। দোয়া করি, ভালো রেজাল্ট করো তুমি, অনেক বড় হও।

থ্যাংক ইউ, স্যার। বাট আই শ্যাল মিস ইউ।

ধন্যবাদ তোমাকে। আমাকে যেতেই হতো। এমবিএ কোর্সে ভর্তি হলে তোমাকে পড়ানোর সুযোগ পেতাম না। এ-ই ভালো হলো। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারা ভালো গুণ। তোমার মা, তোমার মঙ্গলের জন্য ভালো কাজ করবেন, এ বিশ্বাস রাখবে আজীবন। কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় রবিন। তিমুর মায়ের হাত থেকে খাম নিয়ে বেরিয়ে আসে।

.

বাইরে এসে ভাবে, ভালোই হলো। প্রথমে ভেবেছিল হেরে গেছে মায়ার কাছে। এখন ভাবছে হারেনি, দায়িত্ববোধ ও মায়ার জগতে জয়ী হয়েছে ও। ভাবতে পেরে স্বস্তি ফিরে এল মনে।

বাইরে এসে রবিন বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে বুক খালি করে ছেড়ে দেয় নিঃশ্বাস। ভারী বোঝাটা নেমে গেছে বুক থেকে। বুঝে গেছে, এসএমসটা তিমু দেয়নি। এটাই শান্তি। ছাত্রীর প্রতি শিক্ষকের মায়া দেখে মায়ের মন সন্দেহপ্রবণ হয়েছিল। প্রমাণিত হয়নি সন্দেহ। কোনো অন্যায় করেনি ও, দোষ করেনি। তিমুর মা সন্দেহের কারণে পুড়েছেন হয়তো, ভোগ করেছেন নিজের মনের দহন। এখানে কারও হাত নেই। না রবিনের, না তিমুর। তবু পুরো পরিবারটার জন্য মায়া লাগে। আপন করে মিশে গিয়েছিল রবিন। কোনো শিক্ষকের এত আপন হওয়া ঠিক নয়, দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। ঠেকে শিখল রবিন। এ শিক্ষা নিশ্চয় সহজ করবে সামনের দিন।

সুন্দর দিনের প্রত্যাশার ভিত তৈরি হলো মনে। প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল রুবা। সেট অন করে রুবাকে কল করে রবিন।

রুবার সেট বন্ধ। ওর মনেও অযথা সন্দেহ ঢুকেছে। তিমুদের বাসায় আছে জেনে গলা বসে গিয়েছিল রুবার। গলা বসে যাওয়ার অর্থ মনে চোট খেয়েছে। মান ভাঙাতে হবে তার। আবার কল করে..বারবার। না সেট বন্ধ রেখেছে রুবা। নিশ্চয় নতুন কাজের দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত সে। নিশ্চয় তিমুর তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বেশিক্ষণ ডুবে থাকবে না সে। কখন কথা হবে কে জানে। কথা না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি আসবে না। এখন যেতে হবে এমডি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। যত কষ্টই পাক না কেন, রুবাকে জয় করা কোনো ব্যাপার না। ভাবতে গিয়ে আবারও টেনশন কমে আসে। কমে আসলেও টেনশনমুক্ত হতে পারছে না। অজানা একটা শঙ্কা ঢুকে থাকে মনে।

আবারও কল করে। আবারও হতাশ হয় রবিন।

একটা মেসেজ লিখে পাঠালে কেমন হয়। সেট অন হলে কল ব্যাক কোরো লিখে রবিন তা সেন্ড করে দেয় রুবার নম্বরে। তারপর স্বস্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনে…

১৭

পৌষের শুরুতে কুয়াশা-ঢাকা ভোরের চাদর সরিয়ে কুষ্টিয়ার পথে এগিয়ে চলেছে কালো প্রাডো। কচি রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে উইন্ডশিল্ড। গ্লাসে চুমু দিয়ে ঝিকমিক করে ছিটকে যাচ্ছে নরম আলো। অসাধারণ দৃশ্যটি মনের নীল স্বপ্নের আকাশ রাঙিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার দুপাশের বিস্তীর্ণ সবুজ গাছগাছালির যৌবন মদমত্ত উদ্যত অথই ঢেউ ভেঙে দিচ্ছে নিজেকে, চূর্ণ করে দিচ্ছে আপন অস্তিত্বের ভিত। নতুন খোয়াবনামার খোঁজে ছুটছে মন চেনা পথে।

কান্ট্রি ডিরেক্টর জাফরিন নঈম হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, প্রজেক্ট ফাইলটি এনেছেন তো, জাহানারা তাবাসসুম রুবা?

ম্যাডামের প্রশ্ন শুনে কচি স্বপ্নের বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়ে ও চমকে ফিরে এল বাস্তবে। সহজ হয়ে রুবা বলে, জি ম্যাডাম। দুটো ফাইল এনেছি। একটা আছে আমার ব্যাগে, অন্যটা আকবর স্যারের ব্যাগে।

ড্রাইভারের পাশের সিটে সামনে বসেছেন জাহেদ আকবর। ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, জি ম্যাডাম আমার ব্যাগে আছে আরেকটা ফাইল।

ঠিক আছে। বলেই চুপ হয়ে যান জাফরিন নঈম।

রুবা নামে কখনো ডাকেননি ম্যাডাম। ডাকনামটা বলা হয়নি তাকে। জাহেদ স্যারও রুবা নাম জানেন না। জাহানার তাবাসসুম বলেই ডাকতেন দুজন। হঠাৎ রুবা বললেন কেন? ওঁনাদের কে জানিয়ে দিল ডাকনামটা? বুঝতে পারছে না রুবা। ম্যাডামের বা পাশে বসে ভালোই উপভোগ করছিল প্রকৃতির রমণীয় রূপ। আচমকা ধ্বংসের মহোৎসব শুরু হয়ে গেল মনের ঘরে। নীল স্বপ্নের আকাশে ঢুকে গেছে কালো মেঘের পাহাড়। পাহাড় বুকে নিয়ে চুপ করে থাকে ও। গাড়ি এগোচ্ছে নিয়ন্ত্রিত গতিতে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে। পূর্ব দিকের গাছগাছালির ফাঁকে। আড়াল থেকে হঠাৎ হঠাৎ পুরো সূর্য দ্রিম করে আছড়ে পড়ছে উইন্ডশিন্ডে। চকচক করে উঠছে গাড়ির ভেতর।

জাফরিন নঈমের কণ্ঠে আনন্দের প্লাবন জাগে–দেখেছেন রুবা! কী অসাধারণ ভোরের সূর্য! দেখেছেন, সবুজ পাতার ঝিলমিল রূপ!

জি ম্যাডাম। অসাধারণ সুন্দর! ভালো লাগছে।

শুধু ভালো লাগছে। আর কিছু না!

অন্য ধরনের আরও ফিলিংস আসছে মনে! ব্যাখ্যা করতে পারছি না, ম্যাডাম!

ঠিক বলেছেন, ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না! অতি ভোরে যাত্রা করে ভালোই হলো, মনের আলাদা খোরাক পেয়ে গেলাম আমরা।

মনের খোরাক শব্দটা নাড়িয়ে দিল রুবার কবিসত্তা। কবি নাসির আহমেদের বৃক্ষমঙ্গল উত্তরপর্ব : ১৬ কবিতাটির পঙক্তি জেগে উঠল মনে :

তুমি হবে বৃক্ষময়ী তোমার ভেতরে পাব নীল
স্বপ্নের আকাশ আর আরণ্যক পাতার ঝিলমিল।

দ্রুত মিলিয়ে গেল কবিসত্তার আলোড়িত অবস্থা। রুবা নামটা কোথায় পেলেন ম্যাডাম? প্রশ্নটি আবার জেগে উঠছে। চাচ্ছে তাড়াতে পারছে না। ম্যাডামকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রাধান্য দেওয়া ঠিক হবে না। দুই বসের সঙ্গে যাচ্ছে ও। বসদের ইচ্ছা, প্ল্যানিং নিয়ে চলতে হবে এখন। এটা অফিশিয়াল দায়িত্ব। এ দায়িত্বের বাইরে কথা বলা ঠিক হবে না ভেবে চুপ করে থাকে ও।

আবার মুখ খোলেন জাফরিন নঈম। জাহেদ আকবরকে উদ্দেশ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোর রিজার্ভেশন কনফার্ম করেছেন আবার?

জি ম্যাডাম। মাথা ঘুরিয়ে জবাব দিলেন জাহেদ আকবর।

এবার রুবার দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন বাংলোতে। রাজি?

জি ম্যাডাম।

শুধু জি ম্যাডাম জি ম্যাডাম করছেন। আর কোনো কথা জোটে না মুখে?

জি ম্যাডাম…

আবার?

ও হো…হেসে দেয় রুবা। হেসে হেসে বলে, আপনার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগবে আমার।

আপনাদের বাসায় থাকার সুযোগ পাবেন না বলে মন খারাপ হবে না?

না, জোরালোভাবে জবাব দিল রুবা।

সেকি! ছোট বোনের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা হবে না?

প্রশ্ন শুনে দুম করে নিভে গেল রুবা। কমে এল গলার উচ্ছ্বাস।

ছোট্ট করে বলে, মন খারাপ হবে ম্যাডাম।

ঠিক আছে। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যে কদিন কুষ্টিয়ায় থাকবেন। ছোট বোনকেও রাখবেন আপনার সঙ্গে।

আবার উচ্ছ্বাস ফিরে আসে, ঝলমল করে ওঠে রুবা।

দেখেছেন, কত সহজে খারাপ হয় মন? আবার ভালো হয়ে যায় কত সহজে?

জি, ম্যাডাম। বুঝেছি।

জীবনটা এ রকম। আনন্দ-বেদনায় ভরা। আনন্দের সময় পুরো উপভোগ করবেন, আর বেদনার সময় কষ্ট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন।

জি ম্যাডাম।

এটা ব্যক্তিগত কথা নয়। অফিশিয়াল কথা। মনে রাখবেন। দায়িত্ব পালন করতে গেলে কাজে লাগবে এই থিওরি। যাদের নিয়ে কাজ করি, সবাই আমাদের কাছে আসে বিশাল ক্ষত বুকে নিয়ে। যখন সমস্যার সমাধান হয়, তখন আনন্দে ভরে যায় কষ্টের ক্ষত। সেই আনন্দ আমার আনন্দ। তেমনটা হওয়া চাই আপনাদেরও।

রুবা বলে, জি ম্যাডাম।

ঘাড় ঘুরিয়ে জাহেদ আকবরও বলেন, জি ম্যাডাম।

আবার ব্রেনে প্রশ্ন ঢোকে রুবা নামটি নিয়ে। ম্যাডাম এখন আছেন। হ্যাপি মুডে। এ সময় জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। জিজ্ঞাসা না করলে ক্ষতি কী? ম্যাডাম ভালো চোখে দেখছেন। দ্বিতীয় সত্তা ভেতর থেকে থামিয়ে দিল তাকে। দমিয়ে দিল জানার আগ্রহ। সহজ হয়ে গেল রুবা। চলন্ত গাড়িতে নানা কথায় মেতে ওঠে তিনজন। গাড়ি ছুটছে সামনে। একাগ্র মনে নিয়ন্ত্রিত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার।

হঠাৎ ম্যাডাম বলেন, টি ব্রেকের জন্য ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে দাঁড়াবেন।

ড্রাইভার জবাব দেয়, ঠিক আছে ম্যাডাম।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। গাড়ি এখন উঠেছে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে। ব্রিজের ওপর দিয়ে যতবার পার হয়েছে, প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। একবার ও তাকাল দূরবর্তী নদীর দিকে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে দেখল ম্যাডামকে। জাফরিন নঈমও তাকিয়ে আছেন ব্রিজের ডান দিকে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রুবা বলে, দেখেছেন ম্যাডাম? কত সুন্দর!

মুখ ঘুরিয়ে জাফরিন নঈম তাকালেন রুবার দিকে। হাসিমুখে বলেন, নদীর মাঝে বালুচর দেখেছেন? এই চর জাগার অর্থ হচ্ছে কমে গেছে নদীর স্রোত, কমে গেছে পানির গতি। এ সৌন্দর্যের উল্টা পিঠে আছে থেমে যাওয়া। থেমে গেলে এমনিভাবে জমে ওঠে বালুচর। গতি হারিয়ে শুকিয়ে যায় নদী। নদীর সৌন্দর্য হচ্ছে স্রোতের গতিতে, থেমে থাকায় নয়। ভেতরের সৌন্দর্য দেখতে হবে। কেবল বাইরের সৌন্দর্য দেখে পটে গেলে কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কষ্ট পেতে হয় জীবনে। কথা বলার সময় তিনি তাকিয়ে থাকেন বালুচরে জেগে ওঠা হিজলগাছের ঝাড়ের দিকে। বাইরের সবুজ অনিন্দ্যসুন্দর হলেও তা নদীর জন্য ক্ষতিকর। এমনিভাবে জীবনেও আসতে পারে ক্ষতির উপহার।

মুগ্ধ হয়ে ম্যাডামের কথা শোনে রুবা।

জাফরিন নঈম আবার বলেন, আমাদের ক্লায়েন্টদের জীবননদীতেও তৈরি হয় এমন অনেক বালুচর। চর সরিয়ে তাদের জীবনে গতি আনা বড় দায়িত্ব আমাদের।

দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হয়ে রুবা বলে, আপনার পরামর্শ মনে থাকবে।

না, না। পরামর্শ না। এটা কর্তব্য। অফিশিয়াল রেসপনসিবিলিটি।

জি ম্যাডাম।

জাফরিন নঈম আবার তাকালেন ডানে। গাড়ি ততক্ষণে চলে এসেছে। ব্রিজের শেষ সীমানায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে পার হয়ে গেছে যমুনা সেতু। ছুটছে গাড়ি সামনে। উদাস হয়ে গেল ম্যাডামের মন। খেয়াল করে রুবা। দিনে দিনে জাফরিন নঈমের গুণে মুগ্ধ হয়ে ওঠা রুবার মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কোনো কষ্ট আছে ম্যাডামের মনে? কষ্টের কথা বলতে গিয়ে এমন করুণ অভিব্যক্তি ভেসেছে কেন ম্যাডামের মুখে?

কিছুটা পথ এগোনোর পর গাড়ি টার্নিং নেয় বাঁয়ে। অ্যারিসট্রোক্রেট রেস্টুরেন্টের সামনে খোলা স্পেসে এসে দাঁড়াল গাড়িটি। এখানে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাড়ি। খালি স্পেসে পার্কিং নেয় কালো প্রাডো। গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন জাহেদ আকবর। ড্রাইভার নেমে খুলে ধরে পেছনের দরজা। রুবা নামার পর নামলেন জাফরিন নঈম। নেমে হাত ধরলেন রুবার।

এ রেস্টুরেন্টে অনেকবার এসেছি। দিনে দিনে চেহারা বদলে যাচ্ছে অ্যারিসট্রোক্রেটের। ভালো লাগছে চারপাশ।

ম্যাডামের কথা শুনে রুবা বলে, জি। অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে। চারপাশের বাহারি সবুজ নার্সারির যত্ন দেখে মনে হচ্ছে, ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে রেস্টুরেন্টের। যাত্রীদের আকর্ষণ করার সব ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। কুষ্টিয়া যাওয়া-আসার পথে এ রেস্টুরেন্টে চা খেয়েছি অনেকবার। বেশি ভালো লাগছে আজ। বেশি সুন্দর লাগছে। চারপাশ বেশ পরিচ্ছন্ন।

দুজনে এগিয়ে যায় সামনে। জাহেদ আকবর ঢুকে গেছেন ভেতরে। দক্ষিণ-পূর্ব পাশের চার সিটের একটা টেবিল দখলে নিয়েছেন। ফ্রেশরুম থেকে ফিরে রুবা ও জাফরিন নঈম বসেছেন পাশাপাশি। দুই নারী সহকর্মী চেয়ারে বসার পর জাহেদ আকবর এগিয়ে গেলেন ফ্রেশরুমের দিকে।

অন্য রকম সুন্দর লাগছে ম্যাডামকে। সালোয়ার-কামিজ পরেছেন তিনি। গায়ে জড়িয়েছেন হালকা শীত তাড়ানোর জন্য নরম একটা শাল। সিম্পল সাজ। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। লুক ইজ ভেরি এলিগেন্ট!

ম্যাডাম তাকিয়ে আছে পূর্ব দিকে। মুখের পাশটা দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নীল হয়ে যাচ্ছে ওই মুখ! কেন? ব্যক্তিগত কোনো ঘটনা কি জড়িয়ে আছে ম্যাডামের এ কষ্টের সঙ্গে?

উত্তর পেতে দেরি হলো না। জাহেদ আকবর ফিরে এসে বলেন, আপনার প্রিয় টেবিলটা দখলে নিতে পেরেছি, ম্যাডাম!

হাসলেন জাফরিন নঈম। অভিব্যক্তিতে ফুটেছে হাসি। শব্দ করে হাসেননি তিনি। এ হাসি জানান দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ কোনো ঘটনা জড়িয়ে আছে টেবিলটার সঙ্গে।

রিং হচ্ছে রুবার মুঠোফোনে।

সবার কথা থেমে যায়। হ্যাঁন্ডব্যাগ থেকে সেট বের করে দেখে রবিনের কল। লাইন কেটে দেয় রুবা।

আবার বেজে ওঠে রিংটোন।

জাফরিন নঈম বলেন, ধরুন কলটা। কোনো অসুবিধা নেই।

আবারও কেটে দিতে চাইছিল কল। ম্যাডামের কথা শুনে নো থেকে সরে আসে আঙুল। ইয়েস বাটনে চাপ দিয়ে বলে, বলল, কী বলবে?

ফোন ধরো না কেন? কলও করো না। বিষয়টা কী?

এখন ট্যুরে যাচ্ছি কুষ্টিয়ায়।

দমে গেল রবিন। ট্যুরে যাচ্ছ, বলার প্রয়োজন হলো না আমাকে?

নরম গলায় রুবা বলে, না।

আবারও চোট খায় রবিন। ভারী গলায় বলে, কে আছে সঙ্গে?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রুবা ঘুরিয়ে জবাব দেয়, অফিশিয়াল ট্যুর।

আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে। কেটে দিল লাইন।

লাইন কেটে অবাক হয়ে যায় রুবা। এমন আচরণ করছে কেন ও? কেন কল করে না রবিনকে! কেন কল ধরে না রবিনের! অথচ ওর সঙ্গে কথা বলতে মুখিয়ে থাকে ভেতরটা। এভাবে অ্যাভয়েড করে কষ্ট দিয়ে তো আনন্দ হচ্ছে না। তবে কি ও জেদের বশে করছে এসব? অভিমানের ঘূর্ণিতে কি ডুবে আছে ও?

আবার রিংটোন বেজে ওঠে। এবার বেজেছে ম্যাডামের সেট। ম্যাডামের কথাগুলো চুপচাপ শুনতে থাকে রুবা।

ম্যাডাম বলছেন, হ্যাঁ মামণি। ভালো। এখন বসে আছি অ্যারিসট্রোক্রেট রেস্টুরেন্টে। নাশতা খেয়েছ তুমি?

মামণি শব্দটা বুঝিয়ে দিল মেয়ে ফোন করেছে। কথা বলছেন মেয়ের সঙ্গে, মুখটা ঝলমল করছে ম্যাডামের।

জাফরিন নঈমের আনন্দিত চোখ আড়ালে ছুঁয়ে যায় রুবার মন। রবিনকে নিয়ে টগবগিয়ে আসা প্রশ্নগুলো মিলিয়ে যায়। সহজ হয়ে ও তাকাল সামনের টেবিলের দিকে–দুজন নতুন পথযাত্রী এসে বসেছে। একজন ১৩-১৪ বছরের কিশোরী। আরেকজন প্রায় ৩০-৩২ বছরের পরিণত পুরুষ।

কিশোরীটি খলবল করছে। পুরুষটির হাত চেপে ধরে পাশে বসিয়ে বলে, তুমি বোসো। বয়রা আসবে অর্ডার নিতে।

রুবার মনে কৌতূহল জাগে। কী সম্পর্ক দুজনের?

ভাইবোন? দেখে মনে হচ্ছে না তেমনটি।

বাবা-মেয়ে? না, তাও না।

স্বামী-স্ত্রী? না, তা কী করে হয়! এত ছোট মেয়ে!

ফ্রেন্ড ওরা? না, তাও হতে পারে না। কী সম্পর্ক? আবার প্রশ্ন ঢোকে মনে। আচমকা তিমুর কথা মনে পড়ে। তিমুও তো এ বয়সি। কী মেসেজ দেয় রবিনকে? তিমু-রবিন সম্পর্কের মতো ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্ক ওদের? আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না ওদের সঙ্গে!

রবিন কেন এত ছাত্রী ঘেঁষা? তিমু কেন এত অনুরক্ত টিচারের প্রতি? রবিন কেন পরিবারের সদস্যের মতো মিশে গেছে ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে? প্রশ্ন আসছে, সমানতালে বাড়ছে মনের চাপ। জ্যাম হয়ে যাচ্ছে রুবার মাথা। কষ্ট বাড়ছে। মেয়েটির দিকে আবার তাকাল রুবা। আহা! কী লাবণ্য! কী ঝলমলে দ্যুতি ছড়াচ্ছে মেয়েটি! গালে টোল! কী মিষ্টি মুখ! তিমুও কি এমন? ওই টানেই কি রবিন কেবল ছুটে যায় ওদের বাসায়?

নাহ্! কী ভাবছে! রবিনকে ভালোবাসে ও। রবিনও ভালোবাসে ওকে। আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসছে কেন?

মোবাইল ফোনে রিংটোন হচ্ছে আবার। থেমে যায় চিন্তার স্রোত।

ফোন করেছে আনিকা।

আনিকার ফোন পেয়েও খুশি হলো না রুবার মন। রবিনের ফোন পেলে ভালো হতো। কোথায় আছে সে জানা যেত। ফোন করেছিল রবিন। ধরেছে ম্যাডামের কথায়। মন খুলে কথা বলেনি। এড়িয়ে গেছে প্রশ্নের জবাব। রবিনের মনে অভিমান জাগতে পারে না? জাগুক! কষ্ট পাক! কষ্টের বিনিময়ে কষ্টই পেতে হবে। আবার বাড়ে জেদ। আবার মলিন হতে থাকে মুখ।

আনিকা প্রশ্ন করে, কতদূর আপু?

অ্যারিসট্রোক্রেটে চা খাচ্ছি এখন।

তুমি কি বাসায় উঠবে না?

না।

কোথায় উঠবে?

ম্যাডামের সঙ্গে থাকব জি কে ঘাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোয়।

সেকি আপু! তোমাকে তো মিস করব।

না। মিস করবি না। যে কদিন কুষ্টিয়ায় থাকব তুইও থাকবি বাংলোয় আমার সঙ্গে।

ওয়াও! বলো কী আপু!

হ্যাঁ। সত্যি বলছি। এটা ম্যাডামের প্রপোজাল। কুষ্টিয়ায় ঢুকলে তুই হাজির থাকবি বাংলোয়। ফোন করে যোগাযোগ রাখব আমরা।

বাসায় কী বলবো?

কী বলব মানে?

বাবা জানতে চাইবে না, বাসায় কেন উঠবে না?

বাসায় যাব। এক বেলা থেকে আসব। অফিশিয়াল কাজে এসেছি আমি। ম্যাডামের সঙ্গে থাকব।

আচ্ছা। এসো, পরে দেখা যাবে।

কথা শেষ করে রুবা একবার তাকাল ম্যাডামের দিকে। তার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে। আবার তাকাল জাহেদ আকবরের দিকে। তিনিও হাসছেন। কিশোরীটির ওপর চোখ স্থির হয় এবার। কী উচ্ছ্বাস! চোখ হাসছে মেয়েটির মুখ হাসছে! হাসছে পুরো দেহ! খাবারের একটা টুকরো কাঁটা চামচে গেথে ঢুকিয়ে দিয়েছে সঙ্গীর মুখে।

এ যে দেখছি প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক! এত ছোট মেয়ের একি কাণ্ড! কল্পনার চোখে রবিনকে দেখতে পায় রুবা। মনে হচ্ছে তিমু খাইয়ে দিচ্ছে রবিনকে। ফোঁস করে বের হয় নিঃশ্বাস। ঘোরতর অভিমানের ঘূর্ণি তৈরি হয়, ঘূর্ণিতে ঝাপসা হতে থাকে রবিনের মুখ। কষ্ট জমা হতে থাকে মনে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুজনকে উদ্দেশ করে জাফরিন নঈম বলেন, একটু অফিশিয়াল কথা আলাপ করে নিই।

অ্যালার্ট হয়ে দুজন শুনতে থাকে ম্যাডামের কথা–আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকারি তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর মধ্যে ঝরে পড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ ছাত্রী। নবম থেকে দশম শ্রেণীর মধ্যে ঝরে পড়ার হার প্রায় ৭৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ হার কমপক্ষে ৮৩ শতাংশ।

জাহেদ আকবর বলেন, জি ম্যাডাম, বখাটেদের উৎপাত প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েদের শিক্ষায় বাধা সৃষ্টি করছে এখনো।

জাফরিন নঈম যোগ করেন, কেবল প্রত্যন্ত এলাকায় নয়, শহরেও মেয়েরা টিজের শিকার হচ্ছে, উত্ত্যক্ত হচ্ছে। কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্যও একটা বড় ফ্যাক্টর। এ ছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যা, পরিবার থেকে পড়াশোনায় নিরুৎসাহিত করা, দারিদ্র ও বাল্যবিবাহসহ নানা কারণে মেয়েরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না।

আলোচনায় অংশ নিয়ে রুবা বলে, মফস্বল শহর থেকে উঠে এসেছি ম্যাডাম। দেখেছি, মা-বাবারা নবম-দশম শ্রেণীতে কিংবা কলেজে ওঠার পর মেয়েদের ভালো পাত্রে দান করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এর বড় কারণ এ বয়সে মেয়েদের মুখে লাবণ্য থাকে বেশি। লাবণ্য কমে গেলে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না–এই শঙ্কা কাজ করে মা-বাবার মনে।

জাফরিন নঈম বলেন, এগুলো কুসংস্কার। কুসংস্কারে ডুবে আছে দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠী। কুসংস্কারের দেয়াল ভাঙতে হবে আমাদের। নির্যাতিত, নিপীড়িতদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর প্রকল্পও যুক্ত করতে হবে কুষ্টিয়ার প্রজেক্টে।

জাহেদ আকবর বলেন, ভালো উদ্যোগ হবে এটি। পাইলটিং এখান থেকে শুরু করতে পারি আমরা।

রুবা বলে, ম্যাডাম। কেবল গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েরা নিপীড়ন ভোগ করে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। টিচার দ্বারাও অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে! শুধু মফস্বলের দিকে তাকালে হবে না ম্যাডাম। সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে বিষয়গুলো। ইমোশনাল অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে শহুরে শিক্ষিত নারীরাও।

জাফরিন নঈম বলেন, ঠিক বলেছেন। পুনর্বাসনের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর আন্দোলনটা কুষ্টিয়া থেকে শুরু করতে চাই আমি।

জি ম্যাডাম। প্রজেক্ট প্রোফাইলে এ বিষয়গুলোও যোগ করে দেব।

থ্যাংকস আপনাদের। চলুন, রওনা দিই আবার। বললেন জাফরিন নাঈম।

অ্যারিসট্রাক্রেট থেকে বেরিয়ে আসে তিনজন। রুবা একবার পেছনে ফিরে তাকায়। টিনএজার মেয়েটিকে আবারও দেখে। সূক্ষ্ম পিন ঢুকে যাচ্ছে বুকে। চিনচিন করে ওঠে মন। রবিনের কথা মনে পড়ে। রবিনও ইমোশনাল অ্যাবিউজ করছে ওকে। বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করে আঘাত করেছে ওর কচি মন। নারী নিপীড়নের মতো বিশাল সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? তাদের পক্ষে কি সম্ভব এ বড় দায়িত্ব বহন করা? সম্ভব-অসম্ভবের বিষয় না। বিষয় হচ্ছে আন্দোলনের সূচনা করা। মানুষকে জাগিয়ে দেওয়া। একদিন নিশ্চয় পরিবর্তন হবে, বদলে যাবে চারপাশ। এ আশায় বুক বাঁধে রুবা।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আবার পেছনে তাকাল রুবা। দেখা যাচ্ছে। কিশোরীটিকে। এখনো হেসে কুটিকুটি হচ্ছে মেয়েটি। বাঁধভাঙা হাসির ঝলক বিনা কারণে রুবাকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে রবিনের ছাত্রী তিমুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। সরাসরি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়ে যাচ্ছে ব্রেনে। কেন এই স্নায়ুযুদ্ধ! একই সঙ্গে রবিনের দিকেও ছুটে যাচ্ছে। তির। কেন এমন যুদ্ধংদেহী রুঢ়তা, ঔদ্ধত্য? রবিন তো হৃদয়বান, উদার, দয়ালু ও বন্ধুবৎসল। তবুও তার দিকে ছুটে যাচ্ছে ক্রোধের তির। কেন হয়ে উঠছে নিজের মন এত নিষ্ঠুর! উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না রুবা। এগিয়ে যেতে থাকে কালো প্রাডোর দিকে।

১৮

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলো একতলা, বিশাল বাড়ি। চারদিকে উঁচু দেয়াল! গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পথের দুপাশে ফুলের সারি। ছোট ছোট গাছে ফুটে আছে লাল-সাদা-গোলাপি গোলাপ, গাঁদা ফুলের সারি। গেটের বাইরে বড় বড় দুটি বৃক্ষ–একটি লিচুগাছ, অন্যটি বেলগাছ, পুরোটা গাছ জুড়ে ঝুলে আছে কদবেল। বেলের ছড়াছড়ি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছেন কান্ট্রি ডিরেক্টর জাফরিন নঈম।

ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায়?

জাফরিন নঈমের মনে হলো, এমন সৌন্দর্য দেখতে হলে একবার নয়, বারবার আসতে হবে বেলতলায়। বেলতলা নিয়ে প্রবাদটি বদলাতে হবে, রুবা। বললেন জাফরিন নঈম।

অবাক হয়ে ম্যাডামের কথা শোনে রুবা।

কেন ম্যাডাম। প্রবাদ বদলানোর প্রয়োজন হলো কেন?

এ রকম প্রাকৃতিক শোভা একবার দেখলে কি প্রাণ জুড়াবে? বারবার দেখতে হবে না? আসতে হবে না বেলতলায়?

জি। একদম সত্যি কথা বলেছেন। এ রকম দৃশ্য ঢাকা শহরে বসে দেখার সুযোগ নেই।

শুনুন তাবাসসুম, কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতিকে বন্ধু বানিয়ে নেবেন, প্রকৃতির নির্মলতা সঙ্গে থাকলে কাজের উদ্যম বাড়বে, ক্ষণে-ক্ষণে আনন্দ জাগবে মনে।

থমকে যায় রুবা। ম্যাডাম আবার আগের টার্মে ফিরে এসেছেন, তাবাসসুম বলছেন, রুবা বলে ডাকছেন না। রুবা নামটি কোথায় শুনেছেন? সুযোগ পেলে জেনে নেবে ভেবেছিল। এখনই সময়। ফুর্তিতে আছে ম্যাডামের মন।

রুবা বিগলিত স্বরে বলে, ম্যাডাম একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে। জিজ্ঞেস করব?

হ্যাঁ। করতে পারেন। তবে ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাইবেন না। অফিশিয়াল বা অন্য বিষয়ে জানতে পারেন।

আজ রুবা নামে ডেকেছেন আমাকে। আমার ডাকনামটা কোথায় পেয়েছেন ম্যাডাম?

ওহ্! এই কৌতূহল? থাক। কৌতূহলটা ধরে রাখুন। ঢাকায় গেলে বলব। সব প্রশ্নের উত্তর সব জায়গায় জানতে চাওয়া উচিত না।

সরি ম্যাডাম। বিরক্ত করলাম আপনাকে।

নো প্রবলেম। সবকিছু মনে রাখলে আমাদের মূল মিশন সাকসেসফুল হবে না।

ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার পরপরই বাংলোর গেটে এসে দাঁড়াল একটা রিকশা। রিকশায় বসে আছে আনিকা, রুবার ছোট বোন। রিকশা থেকে নেমে ছুটে আসে আনিকা। জড়িয়ে ধরে রুবাকে। দুই বসের সঙ্গে রুবা পরিচয় করিয়ে দেয় আনিকাকে।

পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর বাংলোর ভেতরে ঢোকে সবাই।

ঢোকার মুখে এক লম্বা করিডর এমনভাবে সাজানো যে এটিকে বসার ঘর বলা চলে। ফ্লোরে লাল কার্পেট, চারপাশে রয়েছে অত্যাধুনিক সোফাসেট। এক কোণে টেলিভিশন। করিডরের বাইরের দিকটা টিনশেড গ্লাসের দেয়াল ঘেরা। দরজার দুটো পার্ট। এক পার্টে রয়েছে মসকিউটো নেট। বাঁ পাশের পশ্চিম দিকে রয়েছে একটা কক্ষ। দরজার ওপর নেমপ্লেটে লেখা ভিভিআইপি রুম। পূর্ব পাশে রয়েছে একটা ছোট কক্ষ। আর উত্তর প্রান্তের পশ্চিম পাশে আছে আর একটি ভিআইপি রুম। কে কোন রুমে থাকবে আগে থেকেই ছক কাটা ছিল। জাহেদ আকবরের নির্দেশে কেয়ারটেকার জব্বর আলী ভিভিআইপি রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছে জাফরিন নঈমের ব্যাগ। ভিআইপি রুমে ঢুকেছে জাহেদ আকবরের ব্যাগ। আর রুবার লাগেজ ঢুকেছে ম্যাডামের রুমের পাশের ছোট রুমে।

জাহেদ আকবরকে উদ্দেশ করে জাফরিন নঈম বলেন, সবাই ফ্রেশ হয়ে নিন। পরে একত্রে এসে লাঞ্চ করব। জব্বর আলীকে বলুন লাঞ্চ রেডি করতে। কথা শেষ করে ঢুকে যাচ্ছিলেন ভিভিআইপি রুমে। ফিরে তাকালেন আবার। আনিকাকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমার সঙ্গে পরে গল্প করব আনিকা। যাও, আপুর সঙ্গে থাকো এখন।

খুশিতে ঝিকমিক করে ওঠে আনিকার মুখ। ম্যাডাম কথা বলেছেন ও সঙ্গে। প্রাথমিক আনন্দের বড় কারণ। মনে হলো আপন করে নিয়েছেন আনিকাকে। এই ধারণা বদলে দিয়েছে আনিকার ভেতরের আবেগ ও বাইরে তার প্রকাশ। খুশিতে টুইটম্বুর হয়ে রুমে ঢুকে রুবার গলা জড়িয়ে ধরে। হু হু করে কান্না শুরু করে আনিকা। ওর কান্না ছুঁয়ে যায় রুবার মনও। দুজনেই কাঁদতে থাকে গলা জড়িয়ে।

স্বাভাবিক হওয়ার পর রুবা প্রশ্ন করে, কাঁদলি কেন আনিকা?

তোমাকে কাছে পেয়েছি অনেক দিন পর। আনন্দে কান্না চলে এসেছে। আমি কী করব? তুমিও তো কাঁদলে?

তুই কেঁদেছিস, তাই কান্না এসেছে আমারও। তবে কান্নার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ইমোশনালি আরও স্ট্রং হতে হবে আমাদের।

তুমি স্ট্রং হও। তারপর আমাকে বোলো শক্ত হতে।

কথার জবাব দিল না রুবা। বুঝতে পারছে আনিকা ঠিক কথা বলেছে। কিছু সময় পর প্রশ্ন করে, কেমন আছেন বাবা।

ভালো আছেন। মনে হয় তোমাকে ফিল করেন। তোমার জন্য কোনো দায়িত্ব পালন করেননি, বিষয়টা নিয়ে অপরাধবোধেও ভোগেন তিনি। মনে হয়েছে আমার।

মা কেমন আছেন?

ওই ডাইনির কথা বোলো না। একদম দেখতে পারে না আমাকে। সারা দিন জ্বালায়।

ছি! এমন করে বলতে নেই। সত্য হলেও তো মা। এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নাই।

দাপটের সঙ্গে আনিকা জবাব দেয়, না। মায়ের জায়গায় অন্য কোনো মহিলাকে জায়গা দেব না আমি। মা বলে ডাকব না।

ছি! এভাবে বলিস না। শ্রদ্ধার বিনিময়ে আদর পাওয়া যাবে। শ্রদ্ধা না। করলে আদরও পাবি না। সেজন্য সত্যকে দোষ দেওয়া যাবে না।

দোষ-নির্দোষের কথা না, আপু। স্পষ্ট কথা আমার। মায়ের স্থানে জায়গা নেই ওই মহিলার। বাবাকে পুরোপুরি দখল করে রেখেছে। আমার জন্য স্পেশাল কিছু করলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। কখনোই মা বলে মেনে নেব না তাকে।

কথাবার্তা ঝাঁঝালো হয়ে যাচ্ছে ভেবে প্রসঙ্গ পাল্টায় রুবা।

রেজাল্ট কেমন হচ্ছে? ঠিকমতো পড়াশোনা করছিস তো?

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আনিকা বলে, একটা গোয়েন্দা দল এসেছিল বাসায়। খোঁজ নিয়ে গেছে তোমার।

দ্রিম করে কেঁপে ওঠে বুক! মুহূর্তে উবে যায় মনের স্বস্তি। টেনশন চেপে ধরে বুক।

কী খোঁজ করেছে তারা?

বাবা কথা বলেছে।

কী বলেছে?

কী বলবে, ভালোই তো বলবে।

উদ্বিগ্ন হয়ে রুবা আবার প্রশ্ন করে, তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে?

হ্যাঁ। তোমার চাকরির কথা বলেছি আমি বাবাকে। বাবা ভেবেছে চাকরির পর পুলিশ ইনকোয়ারি এসেছিল।

ওহ! আর কিছু বলেছে?

না। আর কী বলবে। বাবাই বলল, চাকরির পর ইনকোয়ারি আসাটা স্বাভাবিক।

আর কথা না বলে ওয়াশরুমে ঢোকে রুবা। আয়নার সামনেদাঁড়িয়ে দেখে নিল নিজেকে। কপালে চিন্তারেখা ভেসে উঠেছে। বোঝার পর কোঁচকানো কপালটা ইজি করে নেয়। বোঝা যাচ্ছে গোয়েন্দা লেগে আছে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে। হঠাৎ ভয় ঢুকে যায়-ম্যাডামকেও কি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে? ভাবতে গিয়ে শিউরে ওঠে। রুবা নাম কি সেই সূত্রে জেনেছেন ম্যাডাম? কামড়ে ধরে বুক। এমন জিজ্ঞাসাবাদে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে ম্যাডামের? চাকরি কি চলে যাবে? না। ভাবতে পারছে না রুবা। অ্যানালাইসিস করতে থাকে আজকের সারা দিনে ম্যাডামের সঙ্গ। না। তেমন নেতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখেনি ও ম্যাডামের কথা বা আচরণে। এ ধরনের বাজে চিন্তা মাথ য় স্থান দেওয়া উচিত নয়। বাজে চিন্তা মাথায় থাকলে ধরে ফেলবে আনিকা। আনিকার মাথায় নিজের দুশ্চিন্তার বোঝা চাপানো ঠিক হবে না ভেবে নিজেকে সহজ করে নেয় ও। গোসল সেরে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে।

বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় খট করে শব্দ হয় দরজায়। শব্দটি ঢোকেনি আনিকার কানে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে চলেছে উচ্ছ্বসিত স্বরে। রুমে ঢুকেছে রুবা। টের পায়নি সে। এখন তার একশ ভাগ মনোযোগ মুঠোফোনে। আশপাশে কী ঘটছে দেখার বা শোনার কোনো লক্ষণ নেই। সে পুরোপুরি বিচরণ করছে অন্য জগতে!

মনোযাগ দিয়ে দেখে রুবা বুঝতে পারে মুঠোফোনে ডুবে গেছে আনিকা।

কার সঙ্গে কথা বলছে? এত নিমগ্ন কেন সে? ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে যায় অ্যারিসট্রোক্রেটে দেখা সেই অচেনা টিনএজ মেয়ের কথা। মনে পড়ে যায়। তিমুর কথা। ওদের মতো কি জড়িয়ে গেছে আনিকা কোনো বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে? ডিস্টার্ব না করে ওকে কথা বলার সুযোগ দেয় রুবা।

হঠাৎ গলার স্বর কমে যায় তার। দ্রুত লাইন কেটে আসে রুবার পাশে। সন্দেহের চোখে তাকাল সে রুবার দিকে। রুবার লুক দেখে ঘাবড়ে গেল আনিকা। নিজে থেকে বলে, এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বাথরুম থেকে কখন বেরোলে তুমি, আপু?

ফ্রেন্ড ছেলে, না মেয়ে?

থতোমতো খেয়ে আনিকা বলে, ছেলে।

কী করে ছেলেটি?

বিজনেস করে?

বিজনেস করে, অথচ বলছিস ছেলে, বিষয়টা কী?

বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাই না। এমনি এমনি কথা বলি আমি। অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।

এমনি এমনি বলিস ভালো কথা। সেও কি এমনি এমনি কথা বলে?

হ্যাঁ, আপু। ছেলেটা ভালো।

ভালো, কীভাবে বুঝলি?

পড়াশোনার জন্য উৎসাহ দেয় আমাকে। ভালো ভালো পরামর্শ দেয়। ভালো বলব না? ভালোটা বোঝা যায়।

বিজনেস করে ছেলেটা, পড়াশোনা করে না?

হ্যাঁ। পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে।

ওহ্! তাহলে তো বয়স বেশি।

বয়স নিয়ে ভেবে দেখিনি। জিজ্ঞাসাও করিনি।

যোগাযোগ হলো কীভাবে তোদের?

স্কুলের একটা প্রোগ্রামে এসেছিল গান গাইতে। তখন পরিচয় হয়েছিল।

গান গায় ছেলে, বেশ ভালো। বিজনেসও করে। বিষয়টা কেমন না?

কী কেমন, আপু?

মনে হয় কোথাও ঘাপলা আছে, তোর কথার সঙ্গে মিলছে না।

মিলুক, না মিলুক, ভাবার কী আছে? আমি তো কোনো সম্পর্ক করছি না তার সঙ্গে।

ওহ্! বলে থেমে গেল রুবা। সম্পর্ক করছি না বলছে সে। অথচ মুঠোফোন কথা বলার সময় অন্য জগতে চলে গিয়েছিল! কী সাংঘাতিক! ভাবতেই ভয়ে চুপ হয়ে গেল রুবা।

শোন আনিকা, টিনএজে থাকে দুর্বার কৌতূহল। নানা অনুভূতি আসতে থাকে, এসময় মন থাকে শুদ্ধ ও সুন্দর। সেই শুদ্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে চারপাশ বিচার করে টিনএজাররা। এ কারণে সবাইকেই ভালো মনে করে। ভালো ভেবে সবকিছু থেকে আনন্দ পেতে চায়।

তাতে অসুবিধা কী, আপু?

সুবিধা-অসুবিধার কথা না–কথা হচ্ছে, যে মিশছে তোর সঙ্গে, সে কী দৃষ্টিতে দেখছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তার চোখে ঘোর লেগে যেতে পারে, সে লোভী হয়ে উঠতে পারে। সেই লোভী চোখ চেনার ক্ষমতা তৈরি হয় না এ বয়সে। ফলে অনেক মেয়ে বিপদে পড়ে। বিপদে পড়া মেয়েদের পুনর্বাসনের কাজ করে আমাদের প্রতিষ্ঠান। ফাইল পড়ে দেখেছি কী ভয়াবহ ফাঁদ তৈরি হয়ে আছে চারপাশে। পড়াশোনার উৎসাহ দেওয়া, ভালো ভালো পরামর্শ দেওয়া, মেয়ে লোভীদের ফাঁদও হতে পারে। টিনএজ মন জয় করে দুষ্ট লোকেরা এভাবে, উদ্দেশ্য হাসিল করে। এজন্য এসব কথা বলছি।

কথা বলছ, নাকি ফ্রিডম কেড়ে নিতে চাচ্ছ?

টিনএজে সব বিষয়ে ফ্রিডম থাকা ভালো না। ঘরের পরিবেশ থেকে শিখে আসতে হয় এসব। তোর-আমার শেখা হয়নি কিছু। পেয়ে এসেছি কষ্ট, যাতনা। রাগ, জিদের মধ্যে থেকে বড় হচ্ছিস। সেই ধাপ পেরিয়ে এসেছি আমি। এখনো বিপদের সীমা অতিক্রম করিসনি তুই। তাই বলছি এসব কথা, সতর্কতা চাই তোর কাছ থেকে। ফ্রিডম হরণ করতে চাই না। রেজাল্ট ভালো হতে হবে, মনে রাখতে হবে তোকে।

আচ্ছা আপু, মানলাম তোমার কথা। ভয় পেয়ো না আমাকে নিয়ে। সতর্ক আছি নিজে। তোমার সঙ্গে থাকতে এসেছি। বাবাও রাজি হয়েছেন সহজে। লেকচার দিয়ে কানটা ঝালাপালা করে দিয়ো না। রেডিও হও। লাঞ্চের ডাক আসবে এখন।

রিং হচ্ছে রুবার সেলফোনে। এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে সেটটি নিয়ে আসে আনিকা। মণির ফোন, নাও আপু, কল ধরো।

হঠাৎ জিহ্বায় কামড় দেয় রুবা। ইস! রুমমেটদের পৌঁছানোর খবর জানানো হয়নি!

কল অ্যাটেন্ড করার সঙ্গে সঙ্গে মণি বলে, কতদূর আপু? পৌঁছালে?

হ্যাঁ। কিছুক্ষণ হলো পৌঁছেছি।

কোথায় উঠলে প্রথম?

অফিশিয়াল কাজ, সবাই রেস্টহাউসে উঠেছি। আর হ্যাঁ, আনিকাও এসেছে এখানে। সেও থাকবে আমার সঙ্গে। সানিয়া কোথায়? সবাই ভালো তোমরা?

হুম। আমরা ভালো। তুমি ভালো থেকো। ভালো ভালো ফিরে এসো।

হোস্টেলে নতুন কোনো সমস্যা হয়নি তো?

না। হোস্টেলে সমস্যা হয়নি। তবে রবিন ভাইয়া ফোন করেছিল। অভিযোগ করল তোমার বিরুদ্ধে!

কী অভিযোগ?

তুমি কল কর না, ফোনও নাকি ধর না। রাগ করেছ, আপু?

না। রাগ করব কেন? আর কী বলল সে?

জানতে চাইল, কে কে গেছে তোমার সঙ্গে?

কী বলেছ তুমি?

বলেছি, আমি জানি না।

ভালো করেছ।

মণি হঠাৎ বলে, পিএসসি থেকে তোমার একটা ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। রেখে দিয়েছি আমি।

রুবা বলে, রেখে দাও। ওটা দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ। ওই পদের জন্য ইন্টারভিউ দেব না, ঠিক করে রেখেছি।

কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল রুবা। দরজায় নক হচ্ছে। কেয়ারটেকার জব্বর আলী দাঁড়িয়েছে দরজায়।

খাওন দিছি টেবিলে। স্যারে খবর পাড়াইছে আপনাগো টেবিলে আসার।

আচ্ছা আসছি আমরা। জব্বর আলীর কথার জবাব দিয়ে আবার ফোনে। মন দেয় রুবা। মণিকে উদ্দেশ করে বলে, ভালো থেকো। এখন রাখি।

আনিকা এবার মুখ খোলে, অভিযোগ বিষয়ে প্রশ্ন করেছ মণিকে। কী অভিযোগ, আপু?

না। তেমন কিছু না।

তেমন কিছু না যেটা, সেটা তো কিছুই। বলল, কী অভিযোগ?

তোকে জানতে হবে না। এটা ব্যক্তিগত বিষয়।

ওহ্! নিজেদের বেলায় ব্যক্তিগত বিষয়! আর ছোটদের বেলায় সবকিছুর চুলচেরা হিসাব দিতে হবে, তাই না, আপু?

অবাক হয়ে রুবা তাকাল আনিকার চোখের দিকে।

আনিকা আবার বলল, এটা বড়দের দোষ–ছোটদের তুচ্ছ ভাবে, পাত্তা দিতে চায় না, অবহেলা করে। আর নিজেদের মনে করে অনেক বড়।

আনিকার ঝোড়ো কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় রুবা। কিছুটা সময় বিমূঢ় থেকে সহজ হয়ে বলে, বোনের মতো হয়েছিস দেখছি। কাটকাট কথা শিখেছিস!

বাহ্! তুমি পিন ছুঁড়ে মারবে? আর বুলেট ছুঁড়তে পারব না আমি?

ওরে বাবা! তোর সঙ্গে দেখি কথায় পেরে উঠছি না! বলেই হেসে ওঠে। বড় বোনের মুখে হাসি দেখে ছোট বোনও হাসে। দুজনে এল একসঙ্গে খাবার টেবিলে।

টেবিলে বসে আছেন জাহেদ আকবর।

বাহ! ইউ আর লুকিং ফ্রেশ! রুবাকে উদ্দেশ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন জাহেদ আকবর।

ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলেন না তিনি। বেশ সিরিয়াস ধরনের ব্যক্তিত্ববানের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে কিছুটা বিব্রত অবস্থা তৈরি হয়। চট করে রুবাও বলে, আপনাকেও ফ্রেশ লাগছে, স্যার।

লম্বা জার্নির পর গোসল করলে ক্লান্তি ঝরে যায়। গরম-ঠান্ডা পানির কারণে গোসলও ভালো লেগেছে। বললেন জাহেদ আকবর।

রুবা বলে, জি স্যার। এ কারণে ক্লান্তি ঝরে গেছে সহজে।

আনিকা মাঝখান থেকে কথা বলে ওঠে, কে বেশি ফ্রেশ? আমি, না আপু?

জাহেদ আকবর হেসে ওঠেন। হাসতে হাসতে বলেন, ওহ! ভুল হয়ে গেছে। তোমার কথা কিছু বলা হয়নি। তুমি কেবল ফ্রেশ না, সুইটও।

আমার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য থ্যাংকস আপনাকে। আনিকাও হেসে জবাব দেয়।

ওয়েলকাম আনিকা টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড।

আনিকা বলে, না। যেতে চাই না ওই ওয়ার্ল্ডে। শুধু মেয়েদের কষ্ট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন আপনারা। কষ্ট ভালো লাগে না। আনন্দ ভালো লাগে।

রুবা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আনিকার মুখের দিকে। বুঝতে পারে, অনেক চঞ্চল, ছটফটে ও বাকপটু হয়ে গেছে আনিকা। সংকোচ কিংবা লজ্জা নেই বললেই চলে। অপরিচিত একজন বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে দাপটের সঙ্গে। তার দেখা আনিকার সঙ্গে বর্তমান আনিকাকে মেলাতে পারছে না। এ বয়সের মেয়েরা লাজুক থাকে। জড়তার খোলস থেকে বেরোতে পারে না। আনিকাও ছিল লাজুক। চুপচাপ। তবে কি লজ্জাবতীর সিন্ধুকের তালা খুলে গেছে? উবে গেছে জড়তা-সংকোচ-লজ্জা?

জাফরিন নঈম এসেছেন ডাইনিং টেবিলে। তাঁকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সবাই। একনজর তাকিয়ে দেখে নিলেন তিনি খাবারের খোলা ডিশের দিকে। টেবিলে আছে বেগুনভর্তা, টাকি মাছের ভর্তা, কাজলি মাছের চচ্চড়ি, ডাল ও মুরগির গোশত। সাদা ভাত। ধোঁয়া উড়ছে প্রতিটি ডিশ থেকে।

বাংলোর কেয়ারটেকার জব্বর আলী দাঁড়িয়ে ছিল এক পাশে।

খাবারে মেনু দেখে খুশি হয়েছি, জব্বর আলী সাহেব। বললেন জাফরিন নঈম।

ম্যাডাম। সবাই আমারে ডাহে জব্বর আলী। আপনারাও হেই নামে ডাহেন। সাহেব কইয়েন না। লজ্জা লাগে।

আচ্ছা, বলেই ম্যাডাম সবার উদ্দেশে বলেন, আসুন শুরু করি।

প্রতিটি আইটেম মুখে দিয়ে দেখে নিলেন জাফরিন নঈম। তারপর উচ্চারণ করলেন একটি শব্দ-ওয়াও!

শব্দটির অর্থ বোঝেনি জব্বর আলী। তবে এক্সপ্রেশন দেখে বুঝেছে, খুশি হয়েছেন বড় ম্যাডাম।

আপনিই বেঁধেছেন?

না, ম্যাডাম। আমি না, মরিচা বেগম রানছে সবকিছু।

মরিচা বেগম কি বাবুর্চি?

না। তিনি মশালচি।

মশালচি কী?

মশলা বাটে, মরিচ বাটে। তয় অহন হে-ই বাবুর্চির কাজ করে।

ডাকো তাকে।

জব্বর আলী চলে যাওয়ার পর হেসে ওঠে আনিকা।

জাফরিন নঈম বলেন, হাসছ কেন আনিকা?

নাম শুনে হেসেছি। নাম মরিচা, মরিচা আবার মশালচি। নামের সঙ্গে কামের মিল আছে, ম্যাডাম।

কথা শুনে হেসে ওঠেন জাফরিন নঈম, জাহেদ আকবরও। রুবা হাসেনি। মুহূর্মুহূ অবাক হচ্ছে ও। কাম শব্দটির উচ্চারণ ভালো লাগেনি। শব্দটার সঙ্গে লেগে থাকে অশ্লীলতা। অথচ অবলীলায় উচ্চারণ করেছে আনিকা।

কিছুক্ষণ পর সামনে এসেছে মরিচা বেগম।

জাফরিন নঈম বলেন, খুব ভালো হয়েছে আপনার রান্না।

শুনে খুশি হয় মরিচা বেগম। দাঁত বের করে হাসে।

জাহেদ আকবর বলেন, আপনার নামটিও খুব সুন্দর!

আবার হাসে মরিচা বেগম!

জাফরিন নঈম জানতে চাইলেন, কে কে আছে সংসারে?

কেউ নাই মেদাম।

কেউ নাই মানে?

বাবা নাই। মা নাই। ভাই নাই। বোন নাই। স্বামী নাই। কেউ নাই মেদাম।

ওহ্! কিছুটা সময় চুপ থেকে জাফরিন নঈম বলেন, স্বামী নেই কেন?

হে ছাইড়া দিছে। দোষ দিচ্ছে আমারে। বাচ্চা হয় নাই আমার। হের লাইগা ছাইড়া দিয়া আবার বিয়া করছে।

সেই ঘরে বাচ্চা হয়েছে আপনার সাবেক স্বামীর?

না। হুনছি হেই ঘরেও বাচ্চা হয় নাই।

জাফরিন নঈমের মুখ মলিন হয়ে গেল। সবার দিকে মুখ তুলে বলেন, বাচ্চা না হওয়ার জন্য কেবল নারীরা দায়ী নয়। পুরুষেরাও দায়ী ৫০ শতাংশ। অথচ সব দোষ এসে পড়ে নারীদের ঘাড়ে। অবিচারের শিকার হয় নারীরা।

আর বিয়ে করেননি আপনি?

না। বাচ্চা হইব না ভাইববা বিয়া করি নাই আর।

এটাও একটা ভুল কাজ করেছে মরিচা বেগম। চোখ তুলে তাকালেন তার মুখের দিকে। অন্যঘরে বিয়ে হলে বুঝতেন, বাচ্চা না হওয়ার জন্য আপনি,

আপনার স্বামী দায়ী ছিল।

মরিচা বেগম পুরোনো কথা টানতে চাচ্ছে না। ভালো আছে নিজের মতো করে। বয়স এখন প্রায় পঞ্চাশের ঘরে। অথচ শরীর বেশ ভালো মনে হচ্ছে।

মরিচা বেগম চলে যাওয়ার পর জাফরিন নঈম বলেন, আমাদের ক্লায়েন্ট আশপাশে রয়েছে। দেখলেন, রুবা?

জি ম্যাডাম। ওনার কথা শুনে খারাপ হয়ে গেছে মন।

নো। মন খারাপ করা চলবে না। শক্ত থাকতে হবে। শক্ত না থাকলে সেবার ক্ষমতা কমে যাবে। মনে রাখতে হবে কথাটা।

জাহেদ আকবর এবার মুখ খোলেন। আগামী দিনের কর্মসূচি জেনে নিন–আগামীকাল সকাল ১০টায় ডিসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করব আমরা। পরদিন দেখা করব পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে।

আনিকা বলে, আমাদের বাসায় যাবেন না, ম্যাডাম?

রুবাকে উদ্দেশ করে বলে, এক ফাঁকে বাসা থেকে ঘুরে আসবেন আপনি। দুপুরের পর শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে বেড়ানোর ইচ্ছা আছে। আসা করি, সবাই যাব আমরা। ওটা রিক্রেয়েশন টুর। কাজের ফাঁকে আনন্দ না পেলে কাজ করার জোর আসবে না মনে। কী বলেন?

জাহেদ আকবর বলেন, জি ম্যাডাম।

আনিকা বলে, লালনের মাজারে যাবেন না? মীর মশাররফ হোসেনের বাবার ভিটা দেখবেন না? কুষ্টিয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ভূমি, লালনের আখড়া, মীর মশাররফের বাড়ি। শুধু কুঠিবাড়িতে গেলে চলবে, ম্যাডাম?

ম্যাডাম হেসে বলেন, ধীরে ধীরে যাব।

১৯

কুষ্টিয়ার ডিসির সঙ্গে মিটিং করে সন্তুষ্ট জাফরিন নঈম। জাহেদ আকবরও খুশি। সবার মনোভাব ইতিবাচক। ডিসি সাহেব অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন কান্ট্রি ডিরেক্টর জাফরিন নঈমের প্রপোজাল।

ভয় পাচ্ছিল রুবা। প্রথম মিটিংয়ে অংশ নিয়েছে ও। জেলার অনেক উচ্চ পর্যায়ের অফিসার ছিলেন মিটিংয়ে। নিজে প্রতিনিধিত্ব করেছে দুই বসের সঙ্গে। তুচ্ছ মনে হয়নি নিজেকে। সবাই বেশ সম্মান দিয়েছেন। আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে কয়েক গুণ বেশি। আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে রুবা বলল, ম্যাডাম আপনার প্রপোজাল শুনে ডিসি স্যার উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। নিজ হাতে ডায়েরিতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো টুকে নিয়েছেন।

জাহেদ আকবর বলেন, জি ম্যাডাম। আমিও লক্ষ করেছি। বেশ গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন আপনার কথা।

জাফরিন নঈম মৃদু হেসে বলেন, এমনি কি গুরুত্ব দিয়েছেন ডিসি সাহেব? একজন অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি ফোন করেছিলেন ওনাকে। এজন্য বেশি গুরুত্ব পেয়েছি আমরা।

ওহ্। ম্যাডাম! উনি কি আমাদের কর্মসূচিতে উৎসাহ দেবেন না? সহযোগিতা করবেন না আন্তরিকভাবে?

করবেন। ওপরের ফোন না পেলে এত গুরুত্ব দিতেন কি না সন্দেহ। এটা আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। দেখলেন না, উপস্থিত পুলিশ সুপার এবং সিভিল সার্জনকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন ডিসি সাহেব।

জি ম্যাডাম। এক ঢিলে তিন পাখি মেরেছি আমরা। সিভিল সার্জন ও পুলিশ সুপারও ডিসির ডাকে মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। ওনারা উপস্থিত থাকায় আলাদা মিটিংয়ের প্রয়োজন নেই এখন।

একটা কথা মনে রাখবেন, উপরের লেবেল থেকে সহযোগিতা না পেলে নিচের স্তর থেকে সহযোগিতা পেতে অসুবিধা হবে। বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। অসহযোগিতা কিংবা বাধা পেলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের যেকোনো পদক্ষেপ থেকে দমে যাবেন না। অন্যের মূল্য না পেলেও নিজের মনের শক্তিতে ঘাটতি তৈরি হতে দেবেন না। কাজ চালিয়ে যাবেন সততার সঙ্গে। সৎ কাজ ঠেকে থাকে না। এগিয়ে যাবেই। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সম্পৃক্ত করার আগে তাদের সঙ্গে ওপরের লেবেলের রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা সহযোগিতা করলে কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে।

মনোযোগ দিয়ে দুজনই শোনে ম্যাডামের কথা। প্রতিটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি শব্দের মধ্য দিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তিনি। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে ভবিষ্যতে।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জাফরিন নঈম আবার বললেন, জাহেদ সাহেব, একসঙ্গে তিন পাখি মারলেও সিভিল সার্জন ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে আলাদা দেখা করব আমরা। সৌজন্য সাক্ষাতের প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে তারা ভাববে, আমরা গুরুত্ব দিয়েছি তাদের স্ব স্ব ডিপার্টমেন্টকে। অন্যকে গুরুত্ব দিলে নিজেরাও মর্যাদা পাব। আপনার পরবর্তী কাজ হবে অফিস ভাড়া করা, পুনর্বাসনের জন্য আলাদা বাড়ি খোঁজা। জনবল নিয়োগের কাজ সেরে ফেলতে হবে দ্রুত।

জি ম্যাডাম। এ বিষয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে আছি আমরা। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী শহরসংলগ্ন মিলপাড়াতে একটা বড় বাড়ি দেখেছি–পুনর্বাসন সেন্টারটি মিলপাড়াতে করতে চাই। ভাড়া কম। পুরাতন একতলা বাড়ি। এই এলাকাতে রাস্তাঘাট ঘোঁট। গ্যাঞ্জাম কম। অনুন্নত এলাকা হলেও বাড়িগুলো গাছগাছালিতে ভরা।

গুড। এমনি জায়গা পছন্দ আমার। প্রকৃতির নির্মলতা দিয়ে ক্লায়েন্টদের সেবা করব আমরা। তবে অফিসটি মূল শহরে নেবেন। ভালোই হলো, মিলপাড়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আছেন আমার পরিচিত। প্রয়োজনে তার সহযোগিতা নিতে হবে। তাকে সম্পৃক্ত করতে হবে আমাদের পুনর্বাসনের কাজে।

উচ্ছ্বসিত হয়ে রুবা বলে, ম্যাডাম, আমি ওই স্কুলের ছাত্রী। আনিকাও সেখানে পড়ে। আর মিলপাড়াতে আমাদের বাসা। যাবেন? এলাকাটাও দেখে আসতে পারবেন? আমাদের গরিবের বাড়িটাও দেখে আসবেন।

হ্যাঁ যাব। একটা কথা শুনে রাখুন তাবাসসুম, নিজেকে হীন ভাববেন না, গরিব ভাববেন না। কনফিডেন্স ডেভেলপ করে প্রত্যয়ী হোন। ইউ আর দি অফিস এক্সিকিউটিভ অব আওয়ার ইনস্টিটিউট।

জি। মনে থাকবে আপনার কথা।

জাফরিন নঈম আবার বলেন, মিলপাড়াতে অবশ্যই যাব। তার আগে এখন চলুন ঘুরে আসি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যসাধনার তীর্থস্থান শিলাইদহ কুঠিবাড়ি।

ঘুরে আসার কথা শুনে খুশি হয় রুবা। একটা কথা আছে, মক্কার মানুষ হজ পায় না। কুষ্টিয়ায় বাড়ি হলেও স্কুলে পড়ার সময় মাত্র একবার গিয়েছিল রুবা কুঠিবাড়িতে। এ বয়সে আবার যাচ্ছে শুনে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মন।

মিটিংয়ের আগে আনিকা স্কুলে চলে গিয়েছিল। স্কুল ছুটি হয়েছে কি না কে জানে। আনিকাকে ফোন দেয় রুবা। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কল ধরে সে। জানাল স্কুল থেকে বেরিয়ে শহরে ঢুকেছে মাত্র।

তোমাদের মিটিং শেষ হয়েছে, আপু?

হ্যাঁ। তুই কোথায় এখন?

শহরে ঢুকেছি।

শহরে কোথায় আছিস?

এন এস রোডে প্রথম আলো, কুষ্টিয়া অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছি।

দাঁড়া ওখানে। কাছে আছি আমরা। তোকে তুলে নেব। কুঠিবাড়িতে যাব এখন। যাবি?

চিৎকার করে বলে আনিকা, যাব। আপু, নিয়ে যাও আমাকে।

.

আনিকাকে সঙ্গে নিয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। গাড়ি। শহর পেরিয়ে যত এগিয়ে যাচ্ছে মন তত খারাপ হতে থাকে জাফরিন নঈমের। রাস্তাঘাট এত অনুন্নত! বাংলার সাহিত্যসম্রাট রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকীর্তির বিশাল অঙ্গন জুড়ে রয়েছে শিলাইদহের নাম। কুঠিবাড়িতে বসে লিখেছিলেন তিনি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলির বড় অংশ–রচনা করেছিলেন সোনার তরীসহ অসংখ্য কবিতা, গীতিমালা ও গীতবিতানের উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত গান, গীতিনাট্য-চিত্রাঙ্গদা ও চোখের বালি, গোড়া, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ প্রভৃতি বিখ্যাত উপন্যাস, পত্রাবলী ও চিঠিপত্রের বিভিন্ন খণ্ড, জানেন তিনি।

আনিকা চিনিয়ে দিচ্ছে পথ। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ। সবুজে ঢাকা বাড়ি-ঘর। কিছুটা পথ বেশ এবড়োথেবড়ো, হেলেদুলে অগ্রসর হচ্ছে গাড়ি। রাস্তায় একসঙ্গে দুটো গাড়ি ক্রস করা ঝুঁকিপূর্ণ। মনটা হা হা করে করে ওঠে। কেন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় না রাস্তাগুলোর!

গাড়ি যত এগিয়ে যাচ্ছে অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে খুলে যাচ্ছে মনের দরজা-কাট, খুলে যাচ্ছে জানালা, গোপন সিন্ধুকের তালাও খুলে যাচ্ছে। ইহু করে ধেয়ে আসছে ভালো লাগা, ভালোবাসার গোপন বাতাস। গোপনে ভিজে ওঠে চোখ। রুবা খেয়াল করে ম্যাডামের চোখের জল। একি! ম্যাডামের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে কেন অশ্রুকণা? ম্যাডামের কান্না আড়ালে ভিজিয়ে দেয় নিজের মনও। এ মন খুঁজে ফিরে রবিনকে। সিমির জন্যও গোপন মায়ার জমাট চাকে নাড়া লাগে। কষ্ট হতে থাকে রুবার।

হঠাৎ চিৎকার করে আনিকা বলে, হ্যাঁ, ডানে… ওই যে দেখা যাচ্ছে কুঠিবাড়ি।

চোখ খোলেন ম্যাডাম। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকেন কুঠিবাড়ির দিকে। দূর থেকে মুগ্ধ চোখে তাকালেন জাফরিন নঈম। এই এলাকার বাতাস টেনে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নিচ্ছেন এখানকার অক্সিজেন এখন! আহ্! কী শান্তি!

কুঠিবাড়িতে ঢোকার দুপাশে জঞ্জাল দেখে মন খারাপ হয়ে গেল আবার। ছোট ছোট কটি স্টল, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ যেকোনো দর্শনার্থীকে আক্রান্ত করবে প্রথম। বামপাশে আছে গাড়ি পার্কিং এর স্পেস। গাড়ি থেকে নেমে অগ্রসর হচ্ছেন সবাই। মূল ভবনের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে আলোটুরিস্ট কমপ্লেক্স। এ ভবনটি মূলভবনে ঢোকার পথের সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে মনে হলো। জঞ্জাল পেরিয়ে এগোতে আবার অন্য ধরনের অনুভূতি আসতে লাগল মনে। কুঠিবাড়ির মূল ভবনের বাইরের দেয়াল ঢেউ খেলানো। পদ্মার ঢেউ আর বাড়ির চারপাশের দেয়াল-ঢেউ–এই প্রতাঁকের মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনসমুদ্রের ঢেউয়ের কথা। মূল ভবনের ঢোকার পথে রয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতিফলক। শ্মশ্রুমণ্ডিত কবিগুরুর ছবিটির মধ্যে লুকিয়ে আছে তারুণ্য। এসব দেখে খুলে গেল রুবার সব কটি জানালা। জাফরিন নঈমও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।

একজন গাইড নিজের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে এসে বলে, হেলপ করতে পারি?

শিওর। বললেন জাফরিন নঈম।

তের বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত এ বাড়ির মাঝামাঝি অংশের ছয় বিঘা জমি প্রাচীর ঘেরা। কেন্দ্রে রয়েছে আড়াই তলা মূলভবন। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০০ সালে নিলামে কিনেছিলেন জমিদারি। ১৮৯১ সালে জমিদারি পরিচালনার ভার নেন রবীন্দ্রনাথ। তখন রাজশাহী জেলার পতিসর, পাবনা জেলায় শাহজাদপুর, নদীয়া অর্থাৎ কুষ্টিয়া জেলার বিরাহিমপুর–এ তিন অংশে বিভক্ত ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি। বিস্তৃত এই জমিদারির মধ্যে পাকা কুঠিবাড়ি ছিল শিলাইদহে। জমিদারি দেখাশোনা করতে তিন জেলা ঘুরে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু পরিবার নিয়ে শুধু শিলাইদহেই থেকেছেন তিনি। হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলে গেল গাইড।

গাইডের কথার ফাঁকে তিনটি শিশু এসে সামনে দাঁড়াল। বাড়িয়ে ধরল বইচি বিচির মালা।

ছোট ছোট বিচি দিয়ে বানানো মালাগুলো আক্রান্ত করে জাফরিন নঈমের মন।

কত দাম? জিজ্ঞাসা করলেন জাফরিন নঈম।

দুই টেকা একটা।

কতগুলো আছে এখানে?

তিন শিশুর একজন বলে, ৫০টা আছে আমার কাছে। একজন বলে, আমার আছে ৩০টা। একজন বলে, ২০টা।

সব কটা দাও। সবাই একসঙ্গে সব মালা বিক্রি করে হইচই করে উঠল। কান্ট্রি ডিরেক্টর জাফরিন নঈম ব্যাগ থেকে বের করে দিলেন ১০০ টাকার দুটো নোট। যাও ভাগ করে নাও তোমরা।

একটা বিচির মালা দুহাতে ধরে গোল করে সামনে তুলে ধরেন তিনি। মালার ভেতর দিয়ে কল্পনার চোখে দেখে ফেললেন শৈশবের এক কিশোরের মুখ। কিশোরটি হাসছে, মায়ার জালে জড়িয়ে ডাকছে তাকে।

চট করে মালাগুলো একত্রে করে রুবার হাতে দিয়ে তিনি বলেন, এগুলো রাখুন। ঢাকায় গিয়ে সবাইকে গিফট দেব একটা করে।

আট বছরের একটা কিশোর বলে, আমার মালা নাই। আমারে কিছু দেবেন?

জাফরিন নঈম বলে, দেব। আগে তুমি বলো, এটা কার বাড়ি।

এটা রাজার বাড়ি।

রাজার নাম জানো?

না। তয় হে ছিল খারাপ লোক। আমাগো মতো শিশু দেয়ালের ভেতরে ঢুকলে হাত কাইটা নিত!

বলো কী!

হ। আমরা বেবাকে জানি।

উত্তর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন উপস্থিত সবাই। এ অঞ্চলের শিশুরা বলে কী? পাশ্চাত্য শিল্পবিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে, পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে দরিদ্র প্রজাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে কৃষকের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রজাদের জন্য স্থাপন করেছিলেন কৃষি ব্যাংক। জমিদারি চালাতে গিয়ে কর্মচারী ও প্রজাদের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সব সময় প্রজাদের সমর্থন করতেন তিনি। ১৯০৭ সালে শিলাইদহে কিশোরব্রতী-বালকদল নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন, কৃষি শিক্ষা ও আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি সদস্যদের। মানবদরদি, প্রজাবৎসল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ কথা এ অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি গাইডকে।

গাইড বলে, ম্যাডাম ওদের দোষ নাই। ১৯২২ সালে প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। তখন জমিদারির দায়িত্বে ছিলেন কবির ভ্রাতুস্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সময় কিছু অবিচার হয়েছিল। তা ছাড়া একসময় সেটি শেলি নামের অত্যাচারী এক নীলকর ছিল এই বাড়ির আদি মালিক। তাদের ইতিহাস জঘন্য। জঘন্য ইতিহাস বংশপরম্পরায় শুনেছে এ প্রজন্ম। রবীন্দ্রনাথের ভালো কাজের চেয়ে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি বেশি মনে রেখেছে এ অঞ্চলের পরবর্তীপ্রজন্ম। রাজা বলতে ওরা রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়ে বলেনি কিছু।

রবীন্দ্রনাথ অন্যায় করেননি। তাঁর সময় কোনো প্রজাবিদ্রোহ হয়নি। বরং সুরেন্দ্রনাথের সময়কার প্রজা বিদ্রোহ সামাল দিতে ১৯২২ সালে শিলাইদহে আবার এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলল রুবা।

জি। ম্যাডাম। আপনিও ঠিক বলেছেন। রুবাকে সাপোর্ট করল গাইড।

তাহলে এমন ভুল ধারণা কেন? কেন শিশুরা আলাদা করে রবীন্দ্রনাথকে জানবে না? জানবে না কেন রবীন্দ্রনাথের মহানুভবতার কথা?

প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না গাইড। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ম্যাডামের মুখের দিকে।

ছোটগল্প লেখার বেশি প্রেরণা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এ শিলাইদহে এসে। অধিকাংশ বিষয় গ্রহণ করেছিলেন এখনকার জীবনযাপনের ভেতর থেকে। এ ছাড়া বন্ধুদের উৎসাহ ছিল প্রবল। পরমবন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ঘনঘন শিলাইদহে আসতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কিছুকাল কুষ্টিয়া মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনিও রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গ দিতেন। এসব ইতিহাস তুলে ধরল রুবা।

জি ম্যাডাম। কাব্যচর্চার পাশাপাশি তিনি প্রজাদের পুনর্বাসনের কাজও করেছেন। কলের লাঙল প্রবর্তন করেছিলেন। ওই সময় এ অঞ্চলে কৃষিবিপ্লব হয়েছিল। এ ছাড়া আখমাড়াই কল স্থাপন করেছিলেন কৃষকের উন্নয়নের জন্য। বলল গাইড।

পুনর্বাসন শব্দটি লুফে নিলেন জাহেদ আকবর। এতক্ষণ চুপ করেছিলেন তিনি। নীরবতা ভেঙে বলেন, কৃষকদের উন্নতির জন্য যতটুকু জানি, আলু চাষেরও প্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এতে কৃষকের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছিল। আদর্শ গ্রাম তৈরির লক্ষে গ্রাম-সংস্কারের কাজও করেছিলেন তিনি। প্রথম। নিরক্ষর চাষিদের অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করতে প্রকল্প নিয়েছিলেন হাতে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও লড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঝাড়ফুঁক থেকে ফিরিয়ে প্রজাদের হোমিও চিকিৎসার দিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

জাফরিন নঈম যোগ করেন, আমাদের লড়তে হবে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও। নারীদের সচেতন করতে হলে এ দুটো বিষয়ের মূলোৎপাটন করতে হবে।

কথা থেমে গেল। মূল ভবনের ভেতরে হেঁটে-হেঁটে দেখেন নিচতলা, দোতলা এবং দোতলার বাইরের বারান্দা, আড়াই তলার শোবার ঘর। বর্তমানে এ বাড়িতে রয়েছে–শোয়ার খাট একটি, চেয়ার দুটি, গদি চেয়ার একটি, একটি ইজি চেয়ার, পালকি দুটি, খাজনা আদায় টেবিল, পড়ার টেবিল একটি, সোফা দুটি, সিন্দুক একটি, ওয়াটার ফিল্টার একটি, বুকশেলফ একটি, কাঠের আলমারি চারটি, স্পিড়বোড় একটি, বিভিন্ন প্রকারের ছবি রয়েছে ৭৬টি। প্রতিটি আসবাবপত্রের ওপর হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলেন জাফরিন নঈম। রুবাও হাত বুলিয়ে, পেতে চায় রবীন্দ্ৰস্পর্শ। ভেতরের চেতনা জুড়ে দখল করে আছে রবীন্দ্রনাথ। এ চেতনার নিবিড় স্তর থেকে বেরিয়ে আসে রবিন। রবীন্দ্ৰছোঁয়ার মধ্যে রবিন আসছে কেন? তবে কি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসার প্রতীক? বুকের ঘরের ভালোবাসার প্রতীকী দ্বার কি তিনি উন্মোচন করে দিয়েছেন?

জাফরিন নঈম বিমুগ্ধ চোখে ছুঁয়ে যাচ্ছেন শোয়র খাট। মনের ঘরে তৈরি হতে লাগল অসাধারণ ফিলিংস। ভাবতে লাগলেন, শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে না এসে যদি মরে যেতেন জীবনটা ষোল আনা বৃথা হয়ে যেত। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দিয়ে মনের পর্দায় ছুটে এল টিনএজে হারানো একটি প্রিয় মুখ। কল্পনার চোখে দেখতে লাগলেন সেই মুখটি।

গাইডের কথায় ধ্যান ভাঙে জাফরিন নঈমের। বাংলা ১৩৩৫ সালে শ্রাবণ মাসে শিলাইদহবাসী শচীন্দ্রনাথ অধিকারীকে চিঠি লেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ–মনে পড়ছে সেই শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, তেতলার নিভৃত ঘরটি, আমের বোলের গন্ধ আসছে বাতাসে–পশ্চিমের মাঠ পেরিয়ে বহুদূরে দেখা যাচ্ছে বালুচরের রেখা আর গুণটানা মাস্তুল…চিঠিটা পড়ে শোনালেন গাইড।

আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, জাতীয় সংগীতের এ অমর বাণীর। উত্স কি এই আমবাগান? আড়াই তলার শোবার ঘরে শুয়ে কি পেতেন তিনি উত্তর পাশের আমবাগানের আমের বোলের গন্ধ? বাগানের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি অনুভব করলেন জাফরিন নঈম।

নিজেকে শুদ্ধ করে ফিরে এলেন একতলা ঘরে।

রুবা দাঁড়িয়ে কথা বলছে জাহেদ আকবরের সঙ্গে। পুনর্বাসন নিয়ে রবীন্দ্র-ভাবনা মুগ্ধ করেছে জাহেদ আকবরকে। আলোড়িত করেছে রুবাকেও।

আনিকা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। এ সময় বেজে ওঠে আনিকার মুঠোফোন। সরে গিয়ে কল ধরে আনিকা।

রবিন ভাইয়া, আপনি?

হ্যাঁ। আমি তোমাকে ফোন করতে বাধ্য হলাম।

কেন? আপুকে করেন।

তোমার আপু ফোন ধরছে না। ধরে না। কলও করে না।

ফোন ধরার কি সময় আছে? বসের সঙ্গে কথা বলছে এখন। আপনি এলেন না কেন?

কোন বস?

পুরুষ বস। জাহেদ আকবর নাম।

ওহ্! বলে চুপ থাকে কিছু সময়।

সঙ্গে আছ তুমি?

আছি, আবার নাই।

সেটা কি?

মানে থেকেও নেই। ওনারা ওনাদের জগতে আছেন। মুগ্ধ হয়ে এখন দেখছেন শিলাইদহ কুঠিবাড়ি।

ওর নারী বস নেই সঙ্গে?

আছেন। উনি একাকী ঘুরে-ঘুরে দেখছেন। বিড়বিড় করছেন একাকী। ঘুরে-ঘুরে ছুঁয়ে দেখছেন রবীন্দ্রনাথের আসবাবপত্র। আপনি এলেন না কেন? আবার একই প্রশ্ন করল আনিকা।

রবিন জবাব দিল না এ প্রশ্নের।

চুপ করে আছে দেখে আনিকা আবার প্রশ্ন করে, কি, জেলাস হয়ে গেলেন নাকি? কথা বলছেন না কেন?

কথা বলতে পারছে না রবিন। তার বুকের ঘরে বসে গেছে দশমণ ওজনের বোঝ।

শোনেন; আপু হাসছে! জাহেদ আকবরও হাসছেন! আপনার জায়গা কি ওই বুড়ো লোকটা দখল করে নিচ্ছে?

রবিন চুপ।

কী! জ্বালা শুরু হয়েছে বুকে? আবারও খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করল আনিকা।

স্তব্ধ হয়ে গেছে রবিন।

এবার খলখল করে হেসে ওঠে আনিকা। বলে, মেপে দেখলাম আপনাকে। আপুকে কতটুকু ভালোবাসেন, কতটুকু বিশ্বাস করেন মেপে দেখলাম। হেরে গেছেন আপনি আমার পরীক্ষায়। বলেই লাইন কেটে দিল আনিকা।

বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে ঢোকার পর রুবা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, কার ফোন?

রবিন ভাইয়া ফোন করেছিল। তুমি নাকি তাকে অ্যাভয়েড করছ। আমিও রবিন ভাইয়ার মনে খোঁচা দিয়েছি। জাহেদ স্যারকে তোমার সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছি। কল ধরো না কেন, আপু?

প্রশ্নের জবাব দিল না রুবা। এগিয়ে গেল জাফরিন নঈমের সামনে। আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের।

আমরা আনিনি আপনাকে। আপনিই এনেছেন আমাদের। আজ নতুনভাবে উপলব্ধি করলাম রবীন্দ্রনাথকে। বোধে জেগে উঠেছে নতুন ঢেউ। নতুন উদ্দীপনা। এজন্য ধন্যবাদ আপনাকে ম্যাডাম।

হাসতে শুরু করেন জাফরিন নঈম। ম্যাডামের হাসির সঙ্গে মিলে যায় রুবার কণ্ঠ। দুজনে মুগ্ধ চোখে বেরিয়ে এলেন খোলা জায়গায়।

জাহেদ আকবরও বেরিয়ে এলেন নিচতলা থেকে।

আনিকার সামনে এসে বলেন, তুমি কি বহুবার এসেছ এখানে।

না। বহুবার বলা যাবে না। তবে আসা হয়েছে কয়েকবার।

প্রথমদিনের অনুভূতি আর আজকের অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য লাগছে?

অবশ্যই। আজ এসেছি আপনাদের সঙ্গে। আপনাদের সান্নিধ্যে বেশি ভালো লাগছে।

আর কী আছে দেখার এখানে?

ওই যে, ওই দিকে চলুন। পশ্চিমে পুকুরের পাড়ে আছে শানবাঁধানো ঘাট। ওইখানে লিচু গাছতলে বসে কবি লিখেছিলেন-যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…

চলো যাই।

আপু আর ম্যাডাম আসবেন না?

ম্যাডাম অতিশয় মুগ্ধ। ম্যাডামের ভালো লাগার অনুভূতি এখন হিমালয়চূড়ায় উঠে গেছে। ধীরে ধীরে নেমে আসবেন ওই চূড়া থেকে, তোমার আপুরও একই অবস্থা। রবীন্দ্র অনুভূতি নিয়ে চেতনা হারিয়ে ফেলেছেন তারা।

আপুকে আপনি করে সম্বোধন করেন আপনি?

হুঁ। আমার কলিগ না?

তাতে কি? সে তো আপনার চেয়ে অনেক ছোট।

ছোট হলেও সম্মান করতে হবে তাকে। মর্যাদা দিতে হবে।

আমাকেও সম্মান করবেন? মর্যাদা দেবেন?

হ্যাঁ। দেব।

না। আদর দেবেন আমাকে। সম্মান দেওয়ার দরকার নেই। আহ্লাদি গলায় বলল আনিকা।

হাঁটতে লাগল আনিকা। জাহেদ আকবর পাশাপাশি হেঁটে এসে বসলেন পুকুরঘাটে। আনিকার আহ্লাদ শুনে হঠাৎ চমকে উঠে চুপ করে থাকেন তিনি।

কী? বললেন না? আদর দেবেন?

জাহেদ আকবর জানেন, দুই বোনের কষ্টের কথা। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। বাবার আদর পায়নি ওরা। আদরের কাঙাল, আনিকাকে উদ্দেশ করে বলেন, হ্যাঁ দেব আদর। আমাকে প্রায়ই আসতে হবে কুষ্টিয়ায়। এখানে অফিস করব আমরা। তখন দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

খুশি হয়ে আনিকা বলে, তাহলে খুব ভালো হবে। আপনাদের সঙ্গ পাব ঘনঘন।

জাহেদ আকবর বলেন, দেখা করার ব্যাকুলতা, মনে রাখার আকুলতা সবার মধ্যে থাকে। এই ঘাটে বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার মতো বিশাল ব্যক্তিত্বও সংগীতে, কবিতায় রেখে গেছেন সেই আকুলতার কথা।

এ সময় একদল তরুণ কুঠিবাড়ি ঢোকার মুখ থেকে ঘুরে এদিকে আসতে থাকে। জাহেদ আকবর বলেন, ওই যে দেখো, প্রথম আলো কুষ্টিয়া বন্ধুসভার বন্ধুরা আসছে এদিকে।

আনিকা প্রশ্ন করে, কুষ্টিয়া বন্ধুসভার বন্ধুদের চিনলেন কীভাবে?

ওদের সঙ্গে যিনি আছেন, ফরসা করে, চুল কোঁকড়ানো মধ্যমণি, তিনি বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব, অণুকাব্যের জনক। শুনেছ তাঁর নাম? ওনাকে চিনি আমি। গতকাল ছিল কুষ্টিয়া বন্ধু-উৎসব। উৎসবে ঢাকা থেকে এসেছেন আরও অনেক গেস্ট।

ওনারা তো এদিকে আসছেন।

আসুক। রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ নিচ্ছেন ওরা। যে বাতাসে শ্বাস নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, সেই বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন কুষ্টিয়া ও ঢাকা থেকে আসা বন্ধুরা।

রবীন্দ্র-বাতাস এ এলাকাতে বসে নেই এখন। এটা অনুভবের ব্যাপার।

হ্যাঁ। সবাই মুগ্ধ-বিমুগ্ধ। সবাই মোহিত। চোখ দেখে বোঝা যায়, সবার অনুভবের কথা।

এ সময় আনিকার সেটে রিংটোন বেজে ওঠে।

আপু ফোন করেছে। খুঁজছে আমাকে।

জাহেদ আকবর বললেন, বলো, পশ্চিমে পুকুরের পাড়ে আসতে। ম্যাডামকে নিয়ে আসতে বলল।

আনিকা বলে, আপু, শুনেছ স্যারের কথা?

রুবা বলে, শুনেছি।

এসো এদিকে। ম্যাডামকে নিয়ে এসো।

জাফরিন নঈম, রুবা পাশাপাশি হেঁটে এগিয়ে আসছেন পুকুরঘাটের দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন তারা। অপূর্ব লাগছে দুই নারীকে। রবীন্দ্রগানের ভক্ত জাফরিন নঈম এ জগতে নেই। শতবর্ষ পিছিয়ে জীবন্ত রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পেয়ে হয়ে উঠেছেন কল্পনার নারী। কল্পনার নারীর পাশে রুবাকেও লাগছে অপ্সরীর মতো, অনিন্দ্যসুন্দর!

মনে মনে জাহেদ আকবর বলেন, রবীন্দ্রনাথ তুমি অমর। তুমি অম্লান। শতবর্ষ পরেও নারীকুল তোমার গানের জন্য ব্যাকুল–তুমি জেগে আছ মানুষের হৃৎস্পন্দনে। তোমার জন্য ভালোবাসা, ভালোবাসা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *