৫১.
রাত দশটার পর কনফারেন্স রুম ছেড়ে বেরোল রানা ও রেবেকা। আগের মতই ব্যস্ত অপারেশন্স অফিস। ওদেরকে পথ দেখিয়ে দুদফা কাঁচের দরজা পেরোলেন চিফ ডালটন। এসে ঢুকলেন কমপিউটার ল্যাববারেটরিতে। ভেতরে গিজগিজ করছে নানান ইকুইপমেন্ট। গম্ভীর চেহারায় কাজ করছে ছয়জন স্টাফ।
টেকনিশিয়ানদের ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে একটা টার্মিনালে চোখ রেখেছে স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। চিফ ঘরে ঢুকতেই তার দিকে এগিয়ে এল সে। সব মিলে ইউএসএতে আছে প্রায় ছয় হাজার থর্ন। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ।
কমপিউটার ডেস্কের দিকে তাকালেন ডালটন। চুলের রঙ, উচ্চতা, শরীরের গঠন, পেশা এসব থেকে পরিসর ছোট করে আনতে পারবেন না?
সময় লাগবে, তিক্ত কণ্ঠে জানাল স্পেশাল এজেন্ট।
বেশি সময় নেবেন না। সময় সংক্ষিপ্ত।
কয়েক মিনিটের জন্যে লবিতে রানা ও রেবেকাকে রেখে ফোন করতে গেলেন জেরাল্ড ডালটন।
উপকার করলে বলে আমি কৃতজ্ঞ, বলল রেবেকা, নইলে চাকরি তো যেতই, জেলের রুটিও খেতাম।
তুমিও আমার জন্যে কম করোনি, নরম সুরে বলল রানা। জানতে চাইল, দুটো বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করবে?
মাথা দোলাল রেবেকা। বলল।
প্রথম কথা, নজর রাখবে, যেন ইংল্যাণ্ডে বাবা-মার কাছে ফিরতে পারে ক্যাথি।
অবশ্যই। দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা কীসের?
নিজের যত্ন নেবে। অপেক্ষা করবে। দেখবে তোমার জীবনে আসবে উপযুক্ত কেউ।
রানার চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে ফেলল রেবেকা। ঠোঁটে ফুটে উঠল অনিশ্চিত হাসি। তুমি কি আমাকে টা-টা দিচ্ছ?
ঠিক তা নয়। তবে ভবিষ্যতে কী হবে জানি না।
কাতর চোখে ওর দিকে তাকাল রেবেকা। ফোন করতে অনুমতি দেবে? মাঝে মাঝে?
খুশি হব যোগাযোগ থাকলে। নিজের মোবাইল ফোন ও রানা এজেন্সির নিউ ইয়র্কের ফোন নম্বর জানাল রানা। মাত্র দ্বিতীয়বারে সব মুখস্থ হয়ে গেল রেবেকার।
লবিতে খুলে গেল একটা দরজা, আবার উপস্থিত হলেন। ডালটন। কাজ শেষ। মাঝরাতে ইযরায়েলের উদ্দেশে রওনা হবে আপনার বিমান, মিস্টার এমআরনাইন।
তারপর ওখানে নেমে? জানতে চাইল রানা।
ভুরু কুঁচকে ফেললেন সিআইএ চিফ। জাল ছড়াতে শুরু করেছি আমরা। ধরে নিন, আপনি ওখানে পৌঁছুবার আগেই পাব নতুন তথ্য। জেরুযালেমে আমাদের এজেন্টরা খুঁজে বের করবে আসল টার্গেট। সেক্ষেত্রে যোগাযোগ করব আপনার সঙ্গে। হাতঘড়ি দেখে চোখ কুঁচকে ফেললেন তিনি। আপনার পাশে কাজ করবেন স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। রেবেকার দিকে তাকালেন তিনি। মিস্টার রানার কথায় তোমার ওপর দায়িত্ব দিচ্ছি, এখন থেকে দেখভাল করবে ক্যাথি হার্বার্টের। চেনে, তাই নিজেকে নিরাপদ ভাববে তোমার সান্নিধ্যে। খুব উত্তেজিত। হয়তো বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করতে পারবে ওকে।
আমার সাধ্যমত করব, কথা দিল রেবেকা। আজকের মত উঠুক আমার বাড়িতে।
সন্তুষ্ট হাসলেন সিআইএ চিফ জেরাল্ড ডালটন। তাঁর চোখে রেবেকার জন্যে প্রশংসা দেখল রানা। থ্যাঙ্ক ইউ, রেবেকা। তোমার বাড়ির বাইরে থাকবে তিনজন এজেন্ট। যদিও মনে করি না বিপদ হবে ওই মেয়ের। একটা দরজা দেখালেন তিনি। ওই ঘরে আছে।
দ্বিধা নিয়ে রানার দিকে তাকাল রেবেকা।
তা হলে আপাতত বিদায়, বলল রানা।
পরে দেখা হবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেবেকা।
আমেরিকায় ফিরলে যোগাযোগ করব তোমার সঙ্গে, বলল রানা।
ওর বাহু স্পর্শ করল রেবেকা। পরক্ষণে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ওরা। রানার ঠোঁট নামল রেবেকার নরম ঠোঁটে। উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকালেন সিআইএ চিফ।
সাবধান, ফিসফিস করে রানাকে বলল রেবেকা।
তুমিও, সরে এক পা পিছিয়ে গেল রানা।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বামের ঘরে গিয়ে ঢুকল রেবেকা।
এবার চলুন, দেখা যাক হ্যামারস্টাইন খুঁজে বের করতে পেরেছেন কি না আপনার সেই লোককে, বললেন ডালটন।
.
পরের সত্তর মিনিট প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইনের সঙ্গে সময় ব্যয় করল রানা। কমপিউটারের স্ক্রিনে দেখল শত শত ফোটো। হাজার হাজার লোকের ভেতর থেকে খুঁজে পাওয়া গেল, না থর্নকে। বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল রানা। এদের মধ্যে নেই সে।
চোখ সরু করে ওকে দেখল হ্যামারস্টাইন। ভুল হচ্ছে না তো? সিআইএর সেরা সুপার কমপিউটারের ডেটা পাচ্ছেন আপনি।
আমার কোনও ভুল হচ্ছে না, বলল রানা, কখনও কারও চেহারা ভুলি না।
তা হলে হয়তো নকল নাম ব্যবহার করেছে ওই লোক, বলল হ্যামারস্টাইন। এমনই কিছু হবে, জানতাম। অবাক লাগছে এটা বুঝতে পারেননি ডালটন। এত খেটেও ফলাফল শূন্য। সময় নষ্ট কাকে বলে!
চুপ করে থাকল রানা।
ডান আস্তিন গুটিয়ে হাতঘড়ি দেখল হ্যামারস্টাইন। চলুন, যেতে হবে এয়ারফিল্ডে। হাতে বেশি সময় নেই।
.
৫২.
ভার্জিনিয়া।
ল্যাংলিতে সিআইএর হেডকোয়ার্টার থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরেই ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টির ঘুমন্ত শেডি ওক পল্লী।
রাত সাড়ে এগারোটা।
নির্জন রাস্তার পাশেই রেবেকার কাঠের ছোট সাদা বাড়ি। ওটার সামনে থামল সিআইএর স্টাফ ভেহিকেল। পেছনের দরজা খুলে নেমে পড়ল রেবেকা ও ক্যাথি। ছোট্ট বাগান পেরিয়ে পৌঁছে গেল সদর দরজার সামনে। পুরো বাড়ি সার্চ করেও কোনও ছারপোকা পায়নি সিআইএ এজেন্টরা। দরজা খুলে ভেতরে রেবেকা ও ক্যাথিকে ঢুকতে দেখে আবারও গাড়ির কাছে ফিরল তিন এজেন্ট। কয়েক ঘণ্টা পর তাদের বদলে নতুন আরেক দল আসবে পাহারা দিতে।
খোলামেলা লিভিংরুমে বাতি জ্বেলে সহজ সুরে বলল রেবেকা, মনে করো এটা তোমার নিজের বাড়ি। পরিবেশ বেশ শীতল। ইমিটেশন ফায়ারপ্লেসে জ্বালল গ্যাসের নীল আগুন। পরখ করে দেখল, নতুন মেসেজ এসেছে কি না অ্যান্সার-ফোনে। না, কল করেনি কেউ।
চামড়ার সাদা সোফায় বসে চোখ ডলছে ক্যাথি।
ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, বলল রেবেকা। কোনও ড্রিঙ্ক নেবে? কিচেনের র্যাক থেকে লাল ওয়াইনের বোতল এনে টেবিলে রাখল ও। দুজনের জন্যে ঢেলে নিল বড় দুই গ্লাসে ওয়াইন। খুশি হয়ে গ্লাসটা নিল ক্যাথি।
আপাতত এই বাড়িতেই থাকছি, বলল রেবেকা।
আগামীকাল হয়তো তুলে দেবে বিমানে, মৃদু হেসে জানাল ক্যাথি।
সময়টা খুব খারাপ কেটেছে, তাই না? বলল রেবেকা।
মাথা দোলাল ক্যাথি। মনে আনতে চাই না ওসব। ভাবলে ভয় লাগে। বাড়ি ফিরলে একমাসেও বেরোব না।
তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবেন তোমার বাবা-মা।
ল্যাংলি থেকে ফোন করেছিলাম।
কী বললেন তারা?
খুব কাঁদলেন।
বাড়ি ফিরলে নতুন করে আবারও কাঁদবেন, তবে সেটা আনন্দের কান্না।
হয়তো।
ডিনারে পিৎযা পছন্দ করো?
একটা কিছু হলেই হয়।
বলেছিলে তুমি ভেজিটারিয়ান। পিত্যায় পেপেরোনি আর অ্যানকোভি আছে, তোমারটা থেকে চেঁছে দেব?
থাকুক, বলল ক্যাথি, যা খিদে লেগেছে, কাঁটাওয়ালা গাধাও আস্ত খেয়ে ফেলব।
বেজে উঠল ল্যাণ্ড ফোন। স্পিকার অন করে কল রিসিভ করল রেবেকা।
সব ঠিক করা হয়েছে, ভারী গলায় বললেন জেরাল্ড ডালটন। সকালে আর্লিংটন এয়ারপোর্ট থেকে কমার্শিয়াল ফ্লাইটে লণ্ডনে যাচ্ছে মিস হার্বার্ট। সকাল দশটার পর তোমার বাড়িতে যাবেন হ্যামারস্টাইন, এস্কোর্ট করে মেয়েটাকে নিয়ে তুলে দেবেন বিমানে।
জী, বলল রেবেকা।
গত বেশ কিছু দিন মানসিক কষ্টে ছিলে, তোমাকে এক মাসের ছুটি দিয়েছি, বললেন ডালটন।
ধন্যবাদ দিল রেবেকা।
ফোন রেখে দিলেন সিআইএ চিফ।
ফায়ারপ্লেসের আগুনের তাপে স্বাভাবিক হয়েছে ক্যাথি। খুলে ফেলল জাম্পার। পাশে ওটা রেখে বলল, ছুটি পেয়ে গেলে?
মাথা দোলাল রেবেকা। চলে গেল কিচেনে। বের করল ফ্রি থেকে পিত্যা। দুমিনিট গরম করল মাইক্রোওয়েভ আভেনে, তারপর ডাইনিং টেবিলে ডাকল ক্যাথিকে। পিত্যা ও ওয়াইন নিয়ে মুখোমুখি বসল ওরা।
ছোট হলেও সুন্দর বাড়ি, মুখ ভরা খাবার নিয়ে মন্তব্য করল ক্যাথি।
চলে। বেশিরভাগ সময় ফিরতে পারি না।
তা হলে এখানে একাই থাকো?
হ্যাঁ।
বয়ফ্রেণ্ড নেই?
নাহ।
ওয়াইন শেষ করে টেবিলে গ্লাস রাখল ক্যাথি। ঠোঁটে ফুটে উঠল দুষ্টুমির হাসি। তুমি মাসুদ রানাকে পছন্দ করো।
ওয়াইনের বোতল নিতে গিয়েও থেমে গেল রেবেকা। এত সহজেই বোঝা যায়?
তা যায়।
ভুরু ওপরে তুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেবেকা। তা হলে অন্যদের কাছ থেকেও লুকাতে পারব না। ক্যাথির গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে দিল ও।
তোমাকেও খুব পছন্দ করে রানা।
চুপ করে থাকল রেবেকা।
তবে আমাকে একেবারেই অপছন্দ করে, ভুরু কুঁচকে গ্লাসে চুমুক দিল ক্যাথি।
কখনও তেমন কিছু বলেনি আমাকে, মিথ্যা বলল রেবেকা।
দোষ দেব না ওকে। অন্যায় করেছি ওর ওপর। আসলে, অনেক মানুষের ক্ষতি করে ফেলেছি।
নিজেও তুমি অনেক চাপে ছিলে।
মাথা নাড়ল ক্যাথি। মাফ পাব এমন মুখ আমার নেই। তবে বলব, রেবেকা, যত খারাপ কাজ করেছি, সেজন্যে আমি সত্যিই অন্তর থেকে দুঃখিত এবং লজ্জিত।
ক্যাথির বাহুতে হালকা চাপড় দিল রেবেকা, ঠোঁটে মৃদু হাসি। অতীত নিয়ে আলাপ আমরা না-ই বা করলাম? মনে মনে বলল, সামনে কঠিন সময়। যে-কোনও মুহূর্তে শুরু হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মস্তবড় বিপদে আছে রানা। অথচ, ওকে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারবে না ও।
নিশ্চয়ই আবার রানার সঙ্গে দেখা হবে তোমার? জানতে চাইল ক্যাথি।
জানি না। তবে আশা করি। দেখা যাক।
ওর সঙ্গে দেখা হলে আমার হয়ে একটা কথা বলবে?
বলব। কী বলতে হবে?
ওকে বলবে, আমি জানতাম না আমার জন্যে খুন হবে ওর বন্ধু। কারও ক্ষতি করতে চাইনি। ভেবেছিলাম, মিথ্যা বলে পাব অনেক টাকা। বুঝিনি, সেজন্যে এত ক্ষতি হবে অনেকের। আমি সত্যিই দুঃখিত।
বলব ওকে, ভেবো না, বলল রেবেকা।
নীল আগুনের দিকে চেয়ে রইল ক্যাথি। চোখ চলে গেছে বহু দূরে। ফিসফিস করে বলল, থ্যাটসের জন্যে মনটা খুব পুড়ছে। মারা গেছে। এক ফোঁটা অশ্রু নামল গালে। পিছলা সিম্পসনের জন্যেও খারাপ লাগছে। পা ভেঙে দিয়েছে বেচারার। কোথাও যাওয়ার নেই। ওর এত বড় ক্ষতি হবে, ভাবতেও পারিনি।
যা হওয়ার হয়েছে, অতীত ভুলে গুছিয়ে নিয়ে জীবনটা, বলল রেবেকা।
দেখো, একদম বদলে যাব, বলল ক্যাথি। অনেক আগেই ছেলেমি বাদ দিয়ে বড় হয়ে ওঠা উচিত ছিল আমার।
সান্ত্বনা দেয়ার কিছু নেই। জানতে চাইল রেবেকা, খুলব ওয়াইনের আরেকটা বোতল?
মাথা দোলাল ক্যাথি।
.
৫৩.
জেরুযালেম শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে বেন গুরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
ইযরায়েলি সময় বিকেল পৌনে চারটা।
সাদা আগুনের মত দাউদাউ করে জ্বলছে মধ্যপ্রাচ্যের সূর্য। বিমান থেকে নেমেই নাকে-মুখে গরমের ঝাপটা খেল মাসুদ রানা। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই নিল ট্যাক্সি। প্লাস্টিকের সিটের গনগনে তাপে ওর মনে হলো ছারখার হয়ে গেল নিতম্ব। তুমুল বেগে গন্তব্যের দিকে চলেছে তুবড়ে যাওয়া মার্সিডিয।
তালমুদের বর্ণনা অনুযায়ী, ঈশ্বর জেরুযালেম শহরকে দিয়েছেন দুনিয়ার নয়টি দিকের সব সৌন্দর্য। ওখানে লেখা নেই, দুনিয়ার এক শ নয়টা সমস্যার মূল কারণ ওই শহর।
মেঘহীন নীলাকাশের সাদা দিগন্ত পর্যন্ত জ্বলছে সূর্যের আগুন। তাপ এতই বেশি, মন চায় ছুটে পালিয়ে যেতে। এই একই অবস্থা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার সব শহরে। চারপাশে কালচে ধোঁয়া আর বিকট সব আওয়াজ। অনেকটা হাজার কোটি পিঁপড়ের ঢিবির মত। ভ্যাঁ-পোঁ হর্ন বাজিয়ে অন্যসব গাড়ি পেছনে ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। মাত্র কয়েক মাইল এলাকায় গিজগিজ করছে লাখ লাখ স্থানীয় লোজন ও হাজারো টুরিস্ট। নানাদিকে ছুটছে যে-যার কাজে। দুহাজার বছরেরও বেশি পুরনো বাড়ির পাশেই হয়তো আকাশচুম্বী সব আধুনিক দালান। একটু দূরেই ধর্মীয় প্রাচীন স্থাপনা। একেকটা এলাকার নাম অদ্ভুত: অ্যামিউনিশন হিল বা প্যারাট্রুপার্স রোড। মনে করিয়ে দেয় শহরের রক্তাক্ত সব ইতিহাস।
পৃথিবীর অন্য কোনও শহর জেরু্যালেমের মত এভাবে এতবার হাত বদল হয়নি। কখনও দখল করেছে খ্রিস্টানরা, ইহুদিরা আবার কখনও মুসলিমরা। তিন ধর্মের আর্কিটেক্টদের চিন্তাভাবনার ছাপ আছে এসব দালানে। জেরুযালেমের দিকে যেতে যেতে ভাবছে রানা, ক্যাল অ্যামেটের কথা মিথ্যা না হলে, এ শহরের রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণেই যখন তখন আগুনের ফুলকি পড়বে ডিনামাইটের স্তূপে।
বিকেল সাড়ে চারটেয় ওর জন্যে নির্ধারিত হোটেলে উঠল রানা। শহরের প্রান্তে প্রায় ঘুমন্ত হোটেল। একটু দূর থেকে এল প্রচণ্ড আওয়াজে আযান। ওকে দেয়া হয়েছে খুব সাধারণ ঘর। তাতে কিছু যায় আসে না ওর। লাখখানেক তেলাপোকা থাকলেও আপত্তি তুলত না।
বিরক্ত বোধ করছে। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, কীরে, ব্যাটা, তুই এখানে কী করছিস? সিআইএ সাহায্য চেয়েছে, কিন্তু তোর কী করতে হবে সেটাই তো তুই জানিস না!
তিলতিল করে ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা। কিছুই করার নেই রানার। কিছুক্ষণ পর শাওয়ার সেরে পরে নিল নতুন পোশাক। আরেকবার দেখল জেরুযালেম শহরের ম্যাপ। কিছুক্ষণ পায়চারি করল ঘরের ভেতর। অপেক্ষা করছে ফোনে জরুরি কোনও তথ্য দেবেন সিআইএ চিফ ডালটন।
আরও কিছুক্ষণ পর মহাবিরক্ত হয়ে হোটেলের বার-এ এল রানা। ফাঁকা ঘর। মানুষ বলতে ও ছাড়া বুড়ো এক বারম্যান। স্টুলে বসে সিগারেট ধরাল ও। অর্ডার দিল। বৃদ্ধ বারম্যান ওর সামনে রাখল বরফের মত ঠাণ্ডা এক গ্লাস বিয়ার। সোনালি তরলে মাঝে মাঝে চুমুক দিতে দিতে ছাতের দিকে উঠে যাওয়া সিগারেটের ধোঁয়া দেখছে রানা। আধঘণ্টা পর নিল আরেকটা বিয়ার। চুপ করে বসে থেকে হয়ে উঠছে অধৈর্য।
বিকেল পাঁচটা তিন মিনিটে বেজে উঠল ওর মোবাইল ফোন। কল রিসিভ করল রানা।
মিস্টার রানা, হ্যামারস্টাইন বলছি। লিখে নিন ঠিকানা।
পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুক ও কলম নিল রানা। বলুন।
ঠিকানা জানানোর পর বলল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন, জেরুযালেমের পুরনো অংশে ওটা। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ইহুদি কোয়ার্টারে। সাড়ে ছয়টায় ওখানে উপস্থিত হবেন।
কে ওই লোক?
কিছু তথ্য দেবে। পেয়ে যাবেন দরকারি সব কিছু।
আপনাদের লোক?
ওটা আমাদের অপারেশনাল হাউস।
স্লিপার এজেন্ট?
ওকে একটা রত্নও বলতে পারেন।
কী দেবে সে?
আপনার কথাই ঠিক, ঘনিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর বিপদ, বলল হ্যামারস্টাইন, আমার ধারণা, ওটাই মোসাদ এজেন্টের টার্গেট। আমাদের ওই লোকের কাছে পাবেন জরুরি তথ্য। সব ভালভাবে শুনে নেবেন তার কাছ থেকে।
নাম কী তার? জানতে চাইল রানা।
নাম জানা দরকারি নয়, বলল অধৈর্য হ্যামারস্টাইন, আমরা কৃতজ্ঞ, ঠিক ইনফর্মেশনই দিয়েছিলেন আপনি। বাধ্য হয়েই নিয়ম ভেঙে ফোন করতে হলো। সময় খুব সংক্ষিপ্ত। ওখানে পৌঁছে যেতে দেরি করবেন না। আপনার ওপর নির্ভর করছি আমরা।
থর্ন সম্পর্কে কিছু জানলেন?
এখনও না। ঠিকই খুঁজে পাব। আপনি চিন্তা করবেন। জরুরি কাজটা শেষ করুন, ঠিক আছে?
আর ক্যাথি?
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী একটু পর মেয়েটাকে পৌঁছে দেব এয়ারপোর্টে। ইংল্যাণ্ডে ফিরছে সে।
বাড়ি ফিরল কি না, সেটা দেখব, বলল রানা।
তাই করবেন। আরেকটা কথা, মিস্টার রানা… চুপ হয়ে গেল হ্যামারস্টাইন।
কী?
গুড লাক, ফোন রেখে দিল সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট।
মোবাইল ফোন রেখে কয়েক ঢোকে বিয়ার শেষ করল রানা, চিন্তিত। এবার ঘটবে নতুন কিছু। হ্যামারস্টাইনের লোক জানাবে কী করতে হবে। তার তথ্য ভুয়া না সঠিক, সেটা বুঝতে হলেও ওকে যেতে হবে ওই ঠিকানা অনুযায়ী।
হোটেল থেকে বেরিয়ে আগুনের মত গরম রোদে পড়ল রানা। প্রথম সুযোগে ট্যাক্সি-ক্যাব ডেকে চেপে বসল। পুরনো জেরুযালেমের উদ্দেশে ঝড়ের বেগে চলেছে গাড়ি। রানা ভাবছে, লোকটা জরুরি তথ্য দিলে তখন কী করতে হবে ওকে?
দামাস্কাস গেট দিয়ে পুরনো শহরে ঢুকল ট্যাক্সি।
চারপাশে ভিড়। নানান দোকান থেকে হাজারো জিনিস কিনছে অজস্র লোক। তাদের মাঝে আছে টুরিস্ট, রাস্তার হকার, মানি চেঞ্জার, ঠেলাগাড়িসহ ছেলেরা আর ভিক্ষুকের দল। ট্যাক্সি যানজটে এগোবে না বুঝে নেমে পড়ল রানা। চলেছে ফুটপাথের দোকান এড়িয়ে। খাবার, খবরের কাগজ, নকল লিভাইস জিন্স, ইলেকট্রিকাল সামগ্রী থেকে শুরু করে ইযরায়েলি কোলা সবই পাওয়া যায় এসব দোকানে। ভিড়ের মাঝে হাঁটছে একদল ইযরায়েলি সৈনিক। গলার কাছে খোলা খাকি ইউনিফর্ম। চোখে কালো সানগ্লাস। হাতে গ্রেনেড লঞ্চারসহ গ্যালিল অ্যাসল্ট রাইফেল। প্রতিটি অস্ত্র কক করা। প্রয়োজনে গুলি চালাতে দেরি করবে না সৈনিকরা।
দ্রুত হাঁটছে রানা। পুরনো শহরে পৌঁছে গেছে প্রায়। জায়গাটা গোলকধাঁধার মত। ছায়াময় সব পেঁচানো রাস্তা। হাজারো বছরের আলোড়ন-সৃষ্টি করা ইতিহাস রয়েছে এদের একেকটার।
একটু পর রানা পৌঁছে গেল ডোলোলরাসায়। এখানে প্রতি বছর আসে দশ লাখ খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী। এ পথেই একসময়ে কুশ বহন করে মৃত্যুর দিকে হেঁটে গিয়েছিলেন যিশু। কয়েক মিনিট পর পুরনো শহরের খ্রিস্টান কোয়ার্টারে হাজির হলো রানা। ওখানে থেমে কপালে হাত রেখে কড়া রোদ এড়িয়ে দেখল বিশাল দালান।
আগেও এ ভবন দেখেছে রানা।
দ্য চার্চ অভ দ্য হোলি সেপুলকার। খ্রিস্টানদের জন্যে অত্যন্ত পবিত্র। এখানেই কবর দেয়া হয়েছিল যিশুকে। পরে পুনরুত্থান হয় তাঁর। শত শত বছর ধরে ধার্মিকরা পাথরে খোদাই করেছেন যিশুর সেসব দৃশ্য। দুনিয়ার দূরপ্রান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা আসে প্রার্থনার জন্যে। ধরে নেয়া হয়, তাতেই পাবে স্বর্গে যাওয়ার টিকেট।
আজও বহু মানুষের ভিড় ওই চার্চে। আর্চ করা ফটক দিয়ে ঢুকছে-বেরোচ্ছে পশ্চিমা টুরিস্ট ও তীর্থযাত্রী। অসংখ্য মানুষের পরনে টি-শার্ট ও শর্টস। প্রায় সবার হাতে গাইডবুক, ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন। অবাক হয়ে দেখছে দুহাজার বছর আগের আর্কিটেকচার। চারপাশে প্রচুর মানুষের চিৎকার ও জোর গুঞ্জন।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবল রানা, এরা সাধারণ মানুষ। কিন্তু এদেরই ভেতর আছে নিষ্ঠুর এক আততায়ী। তাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা চাইছে কেউ। যে-কোনও সময়ে হবে হামলা। সাধারণ মানুষ চাইবে না পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ হোক। অথচ বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা চাইছে স্টিভ বার্কলের মত আর একজন লোভী লোক।
অবশ্য, সভ্যতার প্রথম আলো থেকেই প্রতিটি ধর্মের সাধারণ ধার্মিক মানুষের মাথায় কাঁচা কাঁঠাল ভেঙেই ক্ষমতায় গেছে অতিবুদ্ধিমান লোকেরা। প্রয়োজনে নিজেই ভূমিকা নিয়েছে ঈশ্বরের। স্থির করে দিয়েছে, কে বাঁচবে, আর কাকে মরতে হবে।
হাতঘড়ি দেখল রানা।
ছয়টা চোদ্দ।
পকেট থেকে বের করে দেখল ঠিকানা লেখা কাগজ। কাছের রাস্তায় পৌঁছে অন্য কেউ দখল করার আগেই নিল তুবড়ে যাওয়া আরেকটা সাদা মার্সিডিয ট্যাক্সি। ঠিকানা জানাতেই মাথা দোলাল নাভি পর্যন্ত লম্বা দাড়িওয়ালা ড্রাইভার। কোথায় যেতে হবে জানে সে।
সিটের পিঠে হেলান দিয়ে বসল রানা। একটু পর জানবে কী হতে চলেছে জেরুযালেমে। ওর কাজ হবে ওই দুর্ঘটনা ঠেকিয়ে দেয়া।
.
৫৪.
ভার্জিনিয়ার শেডি ওক কাউন্টি।
ইউএস সময় অনুযায়ী এখন বাজে সকাল দশটা পাঁচ।
কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলল রেবেকা।
কাঁচা সোনার মত রোদে দাঁড়িয়ে আছে স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারটাইন। পেছনে আরও দুই এজেন্ট। রেবেকা দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই ভেতরে ঢুকল তারা। মেয়েটা তৈরি? জানতে চাইল হ্যামারস্টাইন।
নিচে আওয়াজ শুনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ক্যাথি। আমি রেডি।
দরকারি সব নিয়েছ? জানতে চাইল রেবেকা।
তেমন কিছু আনিইনি, হাসল ক্যাথি, ঠিক আছে, রেবেকা, আশা করি আবারও দেখা হবে। কখনও ইংল্যাণ্ডে এলে তোমার জন্যে সবসময় খোলা থাকবে আমার দরজা।
ভদ্রতা করে মাথা দোলাল রেবেকা। সুযোগ পেলে চলে এসো তুমিও।
আমার জন্যে যা করেছ, কোনদিন ভুলব না, বলল ক্যাথি। শক্ত হাতে রেবেকার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল ও।
তিন এজেন্টের পিছু নিয়ে কালো জিএমসি জিপে উঠল ক্যাথি। দুপাশে বসল দুই এজেন্ট। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে চাপল হ্যামারস্টাইন।
ক্যাথির উদ্দেশে হাত নাড়ল রেবেকা, তারপর দরজা বন্ধ করে ফিরল লিভিংরুমে। এবার কী করবে ভাবতে গিয়ে বসল সোফায়। ওর চোখের কোণে ঝিকিয়ে উঠল কী যেন। কফি টেবিলের পাশে কাঠের মেঝেতে ক্যাথির পুরনো আমলের সেই ব্রেসলেট। জাম্পার খোলার সময় পড়ে গিয়েছিল।
যাহ্, বিড়বিড় করল রেবেকা। জিনিসটা বোধহয় ক্যাথির খুব প্রিয়, নইলে সবসময় পরত না। দুসেকেণ্ড পর রেবেকা বুঝল, কী করতে হবে ওকে। তাকাল জানালা দিয়ে। এরই ভেতর অনেকটা দূরে চলে গেছে কালো জিএমসি জিপ। জ্বলে উঠল লাল ব্রেক লাইট, তারপর বামে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেল ওটা।
কী করবে ঠিক করে ফেলল রেবেকা। মাত্র কয়েক মাইল দূরেই এয়ারপোর্ট। এখনও সময় আছে মেয়েটাকে ব্রেসলেট ফেরত দেয়ার। বাড়ির পাশেই আছে ওর ভিডাব্লিউ বিটল। দরজার হুক থেকে ওটার চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রেবেকা।
আধমিনিট পর রওনা হলো গাড়ি নিয়ে। কয়েক শ গজ যেতেই মনে পড়ল, ফোন করে গাড়ি থামাতে বলতে পারে হ্যামারস্টাইনকে। চট করে ফেরত দিতে পারবে ক্যাথির ব্রেসলেট। তখনই মনে পড়ল, ফোন রেখে এসেছে বাড়িতে। এখন আবার ফিরলে সময় নষ্ট হবে। অ্যাক্সেলারেটরে পায়ের চাপ বাড়াল রেবেকা।
দুপাশে শহরতলীর নীরব ছোট-বড় বাড়ি। বামে বাঁক নিয়ে হাইওয়েতে পড়ল রেবেকা। চলেছে সারি সারি গাড়ি। দূরে কালো জিএমসি জিপ। ওটার ওপর চোখ রেখে চেনা পথে ষাট মাইল বেগে চলেছে রেবেকা। সিডিতে ছাড়ল ওর প্রিয় মোযার্টের সিম্ফনি।
কয়েক মিনিট পর জিপ পৌঁছে গেল এয়ারপোর্টে যাওয়ার টার্নঅফ-এ। রেবেকাও চট করে দেখে নিল রিয়ার ভিউ মিরর। এবার ইণ্ডিকেটর দেখিয়ে সরে যাবে অন্য লেন-এ।
কিন্তু লেন বদল করল না জিএমসি, সোজা চলেছে হাইওয়ে ধরে।
ভুরু কুঁচকে গেল রেবেকার। সাঁই করে পেছনে পড়ল এয়ারপোর্টের সাইনবোর্ড। বিস্মিত হয়েছে ও। চিফ ডালটন বলেছিলেন, সোজা ক্যাথিকে তুলে দেয়া হবে বিমানে। তা হলে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটাকে?
গতি না বাড়িয়ে একই বেগে এগিয়ে চলল রেবেকা। বোধ করছে কেমন এক অস্বস্তি। পেরিয়ে গেল অনেকটা সময়। ফুরিয়ে গেল সিম্ফনি। ওটার দিকে খেয়াল নেই ওর। মাথার ওপর জমেছে ভারী কালো মেঘ। একটু পর নামল বৃষ্টি। টা-টাশ আওয়াজে পড়ছে গাড়ির ছাতে।
হাইওয়ে ছেড়ে অপেক্ষাকৃত সরু এক রাস্তায় চলেছে জিএমসি। এখন আর আশপাশে গাড়ি নেই। শুরু হয়েছে দুপাশে ঘন জঙ্গল। ল্যাংলি ও ওয়াশিংটন ডি.সি. পেছনে পড়েছে অনেক আগে। রেবেকা ভাবল, ঈশ্বর জানেন কোথায় যাচ্ছে এরা! গতি কমিয়ে আরও পিছিয়ে পড়ল। অনুসরণ করছে দূর থেকে।
জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকছে জিপ। রেবেকার গাড়ির উইণ্ডশিল্ড বেয়ে ঝরঝর করে নামছে বৃষ্টির ধারা। দ্বিগুণ জোরে কাজ করছে ওয়াইপার। সামনের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলা কালো সাপের মত। দূরে থেকে জিপের ওপর চোখ রাখল রেবেকা।
দুশ্চিন্তা কুরে খাচ্ছে ওকে।
কী করছেন হ্যামারস্টাইন?
এখন খুব ভাল হতো সিআইএ চিফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে। মস্ত ভুল করেছে ফোন না এনে।
ফোক্সভাগেনের ড্যাশবোর্ডের ঘড়ি দেখাচ্ছে সকাল প্রায় এগারোটা। নেমে এসে লাল দাগের কাছে পৌঁছে গেছে। ফিউয়েল গজের কাঁটা। একটু পর তেল ফুরিয়ে গেলে নির্জন এলাকায় আটকা পড়বে ও। তবে আরও পাঁচ মিনিট পর সরু রাস্তা থেকে নেমে গেল জিএমসি জিপ। ষাট গজ পেছনে চলেছে রেবেকা। পরিষ্কার দেখল, জ্বলে উঠল ব্রেক লাইট। নেমে পড়েছে গাড়িটা জলে এক পথে। ছলাৎ ছলাৎ করে ছিটিয়ে দিচ্ছে অগভীর ডোবার পানি। সাবধানে পিছু নিল রেবেকা।
এদিক-ওদিক দুলতে দুলতে চলেছে জিএমসি জিপ। একটু পর থামল ফার্নে প্রায় অর্ধেক ঢাকা এক উঁচু গেটের সামনে। এখন তুমুল বেগে নেমেছে বৃষ্টি।
আরও কয়েক গজ যাওয়ার পর ফোক্সভাগেনের ইঞ্জিন বন্ধ করল রেবেকা। গাড়ি রাখল কয়েকটা ঝোঁপের আড়ালে। নেমে পড়ল বৃষ্টির ভেতর। ঝোপঝাড়ের আড়াল নিয়ে চোখ রাখল সামনে। জিপ থেকে নেমে পড়েছে এক এজেন্ট। খুলে ফেলল গেটের তালা। ঠেলা দিতেই কাঁচ-কোচ আওয়াজে সরে গেল দুই কবাট। গাড়ি ঢুকে পড়ল ভেতরে।
কয়েক মুহূর্ত পর ক্যাথির আর্তচিৎকার শুনল রেবেকা।
ওর কাছে ফোন বা অস্ত্র নেই। মনে হলো কষে চড়িয়ে দেয়া উচিত নিজেকে। আগে কখনও এত অসহায় বোধ করেনি। সামান্য দ্বিধা নিয়ে এগোেল ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে। সতর্ক, যেন পায়ের নিচে মটু করে না ভাঙে কোনও ডাল। কিছুক্ষণের ভেতর ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। গেটের কাছে পৌঁছে চোখ রাখল ওদিকে। একটু দূরেই বিশাল এক বাড়ি। বড়লোকের নির্জন কোনও বিলাসবহুল হান্টিং লজ। অবশ্য, আগাছায় ভরে গেছে বাগান। হয়তো বছরে দুবছরে আসে মালিক।
হ্যামারস্টাইনের দুই লোক জিএমসি জিপ থেকে টেনে নামিয়েছে ক্যাথিকে। ঠেলে নিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। সবার আগে হ্যামারস্টাইন। খুলে ফেলল বাড়ির সদর দরজা। ঠেলে ভেতরে নেয়া হলো ক্যাথিকে। পাগলের মত লাথি ছুঁড়ছে মেয়েটা। সেই সঙ্গে করুণ আর্তচিৎকার। ধুপ করে বন্ধ হলো দরজা।
বুকের ভেতর লাফাচ্ছে রেবেকার হৃৎপিণ্ড। চট করে দেখল হাতঘড়ি। সকাল এগারোটা বারো। আন্দাজ করতে চাইল, আসলে কোথায় আছে ওরা।
চোরের মত খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল রেবেকা। সরে গেল বাগানের ঝোপঝাড়ের আড়ালে। মনে হলো না নজর রেখেছে কেউ। বাড়ির জানালার সব কবাট বন্ধ। খুব সাবধানে বাড়িটার দিকে এগোল রেবেকা। গলার কাছে উঠে এসেছে হৃৎপিণ্ড। থেমে গিয়ে কান পাতল। কিন্তু ভেতরে কোনও আওয়াজ নেই।
কিন্তু তিন সেকেণ্ড পর পিস্তলের হ্যামার কক করার ধাতব ক্লিক শব্দ পেল রেবেকা। ওর মাথার পেছনে ঠেসে ধরা হয়েছে শক্ত একটা মাল।
তোমার মত বোকা মেয়ে দেখিনি, অচেনা এক লোকের কণ্ঠ শুনল রেবেকা। ওদের পিছু নিয়েছিলে। আর আমি যে তোমার পেছনে সেদিকে কোনও খেয়াল নেই।
ঝুঁকি নিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রেবেকা।
পেছনের লোকটা হালকা-পাতলা। পরনের দামি কোটের ওপরে লম্বা রেইন কোট। চুল লালচে। চোখে কৌতুক। একহাতে পিস্তল, অন্য হাতে ছাতা থেকে ছিটকে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা।
তুমিই থর্ন, শুকনো গলায় বলল রেবেকা।
আর তুমি এজেন্ট ট্রিপলার। সুন্দরী, বিদূষী। অনেক নাম শুনেছি তোমার।
চমকে গেছে রেবেকা। ভাবতেও পারেনি, একই দলের লোক হ্যামারস্টাইন ও থর্ন!
পিস্তলের নল দিয়ে বাড়ির দিকে ইশারা করল লোকটা। সামনে বাড়ো। মাথার ওপর রাখবে হাত। খুন হবে ও-দুটো নামালেই।
হাঁটতে লাগল রেবেকা। পেছনে থর্ন। ঢুকে পড়ল ওরা বাড়িতে। প্রথম ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র অভিজাত। প্রায়ান্ধকারে চকচক করছে কালচে কাঠের প্যানেল। একটু দূরে পাথরের ফায়ারপ্লেস। ওখানে পড়ে আছে পুরনো ধূসর ছাই ও পোড়া, কালো চ্যালা কাঠ। দেয়াল থেকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বড় সব শিকারের ট্রফি। হরিণের মস্ত শিং তৈরি করেছে বিদঘুটে ছায়া। শীতে কাঁপছে রেবেকা। ওর শরীরের পানি টপটপ করে পড়ছে ফ্ল্যাগস্টোনে।
পায়ের প্রতিধ্বনি উঠল হলওয়েতে। দড়াম করে খুলল একটা দরজা। ভেতরে ঢুকল হ্যামারস্টাইন। রাগে বিকৃত চেহারা। পেছনে আরও তিন এজেন্ট। সবার হাতে পিস্তল।
আমাদের নতুন অতিথি, রেবেকাকে দেখাল থর্ন।
কড়া চোখে ওকে দেখল হ্যামারস্টাইন। নিজেকে খুব চালাক ভাবো, তাই না, রেবেকা ট্রিপলার? চালাকি করতে গিয়ে করেছ বোকামি। দলের অন্যদের দিকে ইশারা করল সে। সার্চ করো ওকে।
মুখ থেকে ভেজা চুল সরিয়ে জানতে চাইল রেবেকা, ক্যাথি কোথায়? কী করেছ ওর?
হাসল হ্যামারস্টাইন। দেখা করবে? এসো!
সার্চ করার পর পিস্তলের মুখে নিরস্ত্র রেবেকাকে নেয়া হলো বেসমেন্টের আঁকাবাঁকা ছায়াময় এক করিডোরে। আগে চলেছে হ্যামারস্টাইন ও থর্ন। প্যাসেজের শেষে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নামল তারা। থামল লোহার পেরেক দিয়ে পোক্ত করা এক পুরু কাঠের দরজার সামনে। লোহার বড় চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলল হ্যামারস্টাইন। ধাক্কা দিয়ে খুলল কবাট। পিঠে ঠেলা খেয়ে সামনে বাড়ল রেবেকা। নিচে নেমেছে পাথরের কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে নিচের কংক্রিট সেলারে পড়ল বেচারি। ঠোঁটের রক্তের লবণ টের পেল জিভে। উঠে দাঁড়াল টলমল করে।
সাবধানে তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে থামল রনসন থর্ন। খুশিতে চকচক করছে চোখ। রেলিঙে হাত রেখে নরম সুরে বলল, কী লজ্জা! লোভী চোখে দেখছে রেবেকার ভেজা দেহ। সেঁটে থাকা পোশাক ফুটিয়ে তুলেছে কমনীয় অঙ্গ। শরীরটা কিন্তু সত্যিই দারুণ!
পেছনে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনল রেবেকা। ঘুরে দাঁড়াল। পেছনের দেয়ালের ছায়ায় আছে ক্যাথি। গাল ভিজে গেছে অশ্রুর ধারায়। চোখের একটু ওপরে কাটাচিহ্ন।
মেয়েটার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরল রেবেকা। চাপা স্বরে বলল, একেকটা জানোয়ার তোমরা!
থর্নের পাশে থামল হ্যামারস্টাইন। কোটের ল্যাপেল সরিয়ে বের করল গ্লক নাইন এমএম পিস্তল। ঠিক আছে, এখানেই চিরবিদায়। সরাসরি ক্যাথির মাথার দিকে পিস্তল তাক করল সে, পরক্ষণে রেবেকার মাথায়।
নিষ্পলক চোখে তাকে দেখছে রেবেকা। মরতে রাজি, কিন্তু প্রকাশ করবে না ভয়।
রেবেকার হাত খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ক্যাথি।
নরকের কীট তোমরা, ওখানেই যাবে, বলল রেবেকা।
দারুণ! আবারও বলে উঠল থর্ন। এই মেয়েকে ভাল না বেসে পারছি না। লোভনীয় শরীর। তেমনি তেজ। কিন্তু আপাতত উপায় নেই ওকে ঠাণ্ডা করব।
ওর মত শয়তান মেয়ে হয় না, বলল হ্যামারস্টাইন। মেরে ফেলাই ভাল। ভুরু কুঁচকে সাইটের মাঝ দিয়ে রেবেকাকে দেখল সে। যে-কোনও সময়ে গুলি করবে।
একমিনিট, বলে উঠল থর্ন।
অধৈর্য হয়ে পিস্তল নামাল হ্যামারস্টাইন। কী?
খুন করার দরকার নেই।
তো কী করব?
আরও ভাল বুদ্ধি আছে, মুচকি হাসল রনসন থর্ন। কত দিন পর পর আসো এই বাড়িতে?
সময় পাই না বলে দেরি হয়, বলল হ্যামারস্টাইন, কেন?
তা হলে চার বা পাঁচ মাস পর পর?
কাজ কম থাকলে।
এ বছর কাজ বেশি না কম?
কাজের চোটে মরার দশা!
তা হলে, আটকে রেখে যাব আমরা। আবার ফিরব ছয় মাস পর। দেখা যাক কী অবস্থা হয় ওদের?
আপত্তি নিয়ে থর্নকে দেখল হ্যামারস্টাইন। তাতে এ ঘরে হবে ভয়ানক বাজে দুর্গন্ধ।
মাথা নাড়ল থর্ন। কখনও বলেছি আমার কুকুরের কাহিনী? ছোটবেলায় ছিল। রিট্রিভার। ভালই ছিল, কিন্তু এক সময়ে খুব বিরক্ত হলাম ওটার ওপর। তাই কী হয় দেখতে আটকে রাখলাম বেসমেন্টে। মরতে অনেক সময় নিল ওটা। কিছু দিনের মধ্যেই ওটার মাংস খেয়ে ফেলল ইঁদুরের পাল। মিলিয়ে গেল দুর্গন্ধ। কাজে এসেছিল পোকামাকড়ও। পড়ে থাকল শুকিয়ে যাওয়া একটা কংকাল।
তোমার মত নোংরা ঘেয়ো কুকুর আর দেখিনি, বলল রেবেকা।
ভাবতে ভাল লাগছে রেবেকা পাবে অমন সাদা হাড়, বলল হ্যামারস্টাইন, পরে ফিরে দেখব কেমন হয়েছে দেখতে। মরার আগে চাইবে মাটি খুঁড়ে বেরোতে। কিন্তু, খুব গভীর এই বাড়ির ভিত্তি। নিরেট পাথরের ওপর তৈরি।
মরতে রেখে যাওয়ার আগে দিই একটা তথ্য, বলল থর্ন। পৃথিবীর সেরা মঞ্চের পর্দা তুলছি আমরা। অবশ্য সে নাটক দেখতে পাবে না তোমরা। শুধু শুনে রাখো, এবার যা হবে, কোর্ফিউয়ের বোমাকে মনে হবে বড়জোর বাজিপটকা।
রেবেকা বিড়বিড় করল, তোমরা বদ্ধ উন্মাদ!
বাইবেল সত্য করতে কাজে নেমেছি, এজেন্ট ট্রিপলার, বলল হ্যামারস্টাইন। আমাদের কিছু করার নেই। এসব ঈশ্বরের ইচ্ছে। সত্যি যুদ্ধ বাধবে তো তারই খায়েসে। দোষ দিলে তাকেই দিয়ো।
ঈশ্বরের গালগপ্পে বিশ্বাস করি না, বলল থর্ন। তবে আমাদের হ্যামারস্টাইন আবার খুব ধার্মিক।
কড়া চোখে তাকে দেখল স্পেশাল এজেন্ট।
যা খুশি করে পার পাবে না, জোর দিয়ে বলল রেবেকা। ওরা ইংল্যাণ্ডে অপেক্ষা করছে ক্যাথির জন্যে। ওখানে না গেলেই সতর্ক হবে সবাই।
মাথা নেড়ে হাসল হ্যামারস্টাইন। ভুল। ওর জন্যে আর অপেক্ষা করছে না তারা।
গাড়িতে করে আসার সময় আমাকে বাধ্য করেছে বাবা মাকে ফোন দিতে, সড়াৎ শব্দে নাক টানল ক্যাথি। বলতে হয়েছে এক বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছি। আপাতত দেশে ফিরব না।
ওরা এসবে অভ্যস্ত, তাই না? হাসল হ্যামারস্টাইন।
সিআইএ চিফ খেয়াল করবেন হারিয়ে গেছি, বলল রেবেকা। খোঁজ নিলেই ধরা পড়বে তুমি।
না, বলল থর্ন, কেউ বোঝার আগেই এ দুনিয়া হবে অন্যরকম। তখন তোমাদের খোঁজার চেয়ে বহু গুণ বেশি জরুরি কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠবে সিআইএ।
তোমরা হয়তো আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারবে, কিন্তু রক্ষা পাবে না রানার হাত থেকে, বলল রেবেকা।
হাসিমুখে পরস্পরকে দেখল থর্ন ও হ্যামারস্টাইন।
ভাল কথা, ট্রিপলার, হাতঘড়ি দেখল হ্যামারস্টাইন। এখন এগারোটা পঁচিশ। জেরুযালেমে সন্ধ্যা ছয়টা পঁচিশ। ফাঁদে পা দিতে চলেছে তোমার মাসুদ রানা। খুন হবে ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে।
চওড়া হাসল থর্ন। চমৎকার সময় কাটল তোমাদের সঙ্গে। এবার বিদায় নিতে হয়।
সেলারের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল হ্যামারস্টাইন ও থর্ন। পেছনে ধুম শব্দে বন্ধ হলো পুরু কাঠের দরজা। নীররতা ভেঙে ক্লিক শব্দে আটকে গেল তালা।
ঘুটঘুটে আঁধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রেবেকা ও ক্যাথি।
.
৫৫.
জেরুযালেম শহরের পুরনো এলাকা।
ইহুদি কোয়ার্টার।
সন্ধ্যা ছয়টা আটাশ মিনিট।
কোবল পাথরের, সরু গলি পেরিয়ে প্রায় ধসে পড়া, পুরনো অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছে গেছে রানা। রাস্তা নির্জন। ওকে দেখে চট করে একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ইযরায়েলের ঐতিহ্যবাহী হেডড্রেস পরা এক মহিলা।
হাতঘড়ি দেখল রানা। এসেছে একদম ঠিক সময়ে। আবারও দেখল নোটবুক, তারপর চলে গেল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ছায়ায়। পাথুরে মেঝেতে উঠছে ওর পায়ের খট-খট আওয়াজ। পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনি।
সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল রানা। একের পর এক দরজার বুকে নেমপ্লেট ও সংখ্যা।
পুরনো অ্যাপার্টমেন্টে থাকে সিআইএর স্লিপার। মিশে আছে সাধারণ মানুষের মাঝে। কারও সাধ্য নেই সন্দেহ করবে। এরা কখনও কখনও আঁধারে রাখে স্ত্রী বা স্বামীকেও। দৃষ্টি আকর্ষণ করে না পুলিশ বা কর্তৃপক্ষের। নতুন তথ্য পেলে পাঠিয়ে দেয়। নিজ এলাকায় কাজ করে সিনিয়র কোনও এজেন্টের বার্তাবাহক হিসেবে। রানার মনে পড়ল, কিছু দিন আগে ঢাকায় পর পর দুদিনে গ্রেফতার হয়েছিল এক পাকিস্তানি ও এক ভারতীয় স্লিপার। বিপদ বুঝে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে গিয়ে গুলিতে খুন। হয়েছিল ওই দুই দেশের সিনিয়র দুই এজেন্ট।
নম্বর দেখে দরজায় টোকা দিল রানা।
থমথম করছে চারপাশ।
ভেতর থেকে এল না কোনও আওয়াজ।
ঘড়ি দেখল ও।
ঠিক সময়েই এসেছে।
নক করল আবারও।
কয়েক সেকেণ্ড পর খুলল দরজা।
রানা দেখল, বাজপাখির চঞ্চুর মত বাঁকা নাকের এক হালকা লোক। ছোট করে ছাঁটা কালো চুল। গালে ঘন দাড়ি। পরনে জিন্স প্যান্ট ও সাদা শার্ট। জ্বলজ্বলে চোখদুটো কালো। মিস্টার রানা?
মাথা দোলাল রানা।
আসুন, সরে গেল লোকটা। তার পিছু নিয়ে এক লিভিংরুমে পা রাখল রানা। এই অ্যাপার্টমেন্ট বেশ ছোট। আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। সাদা দেয়ালে মাত্র দুএকটা ছবি বা তৈলচিত্র। এরা অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। টেবিলে সরু কার্ড ফাইল। ভেতরে কিছু কাগজ। ফাইলের পাশেই হেকলার অ্যাণ্ড কচ নাইন এমএম পিস্তল ও ম্যাগাযিন। একটু দূরে কাউচে যন্ত্র খোলা এক স্নাইপার রাইফেল, সাইলেন্সার ও স্কোপ।
রানার মনে পড়ল ডালটনের কথা: স্নাইপার কাউন্টার স্নাইপারের লড়াই হলে, আপনার চেয়ে দক্ষ কাউকে দুনিয়ায় পাব না।
হ্যামারস্টাইন বলেছে একটা জিনিস দেবেন, বলল রানা।
কথা ঠিক, রহস্যপূর্ণ হাসি হাসল লোকটা। ওটা খুব জরুরি। তবে আসুন, আগে একটু কফি খেয়ে নিই?
মাথা নাড়ল রানা। কফি খাওয়ার সময় নেই। আমার তাড়া আছে।
আবারও হাসল লোকটা। কথা ঠিক, আপনার হাতে সময় নেই।
এক সেকেণ্ড পর রানা টের পেল, দমকা হাওয়ার মত পেছনে হাজির হয়েছে কেউ!
সতর্ক হওয়ার সুযোগ পেল না ও। চোখের সামনে দেখল সাদা ঝিলিক। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করছে বলে নিজেকে রক্ষা করতে হাতদুটো ওপরে তুলল রানা। ওর আঙুলে চেপে বসল তারের ফাঁস। ঝটকা দিয়ে ওটা সরাতে চাইল রানা। কিন্তু গায়ে প্রচণ্ড শক্তি পেছনের লোকটার। পেছনে টেনে নিল ওকে। আরেকটু হলে মেঝে ছাড়ত পা-দুটো। আঙুলে টানটান হয়ে চেপে বসেছে তারের ফাস। পেছনে লাথি মেরে নিজেকে ছোটাতে চাইল রানা। টলমল করছে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে।
মুচকি হাসছে দাড়িওয়ালা। খুব ধীর ভঙ্গিতে হাত বাড়াল টেবিলে রাখা পিস্তলের দিকে।
প্রাণ বাঁচাতে লড়ছে রানা। এদিক-ওদিক মুচড়ে ওর গলায় ফাঁস বসাতে চাইছে পেছনের লোকটা। চোখের কোণে রানা দেখল, খুলে গেল একটা দরজা। ঘরে ঢুকল তৃতীয় একজন। তার হাতে বাঁকা করাতের মত দীর্ঘ এক ছোরা।
খুন করবে বলে ফাঁদ পেতেছে সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। মরতেই যদি হয়, না লড়ে হারবে না, মেঝেতে ঝাঁপ দিল রানা। ওর সঙ্গে হুড়মুড় করে পড়ল পেছনের লোকটা। আরও জোরে টান দিল তারের ফাঁসে। দম আটকে গেছে রানার। ঝটকা দিয়ে কাত হয়েই প্রাণপণে লাথি মারল ও। বুটের ডগা লাগল লোকটার থুতনির ওপর। হঠাৎ করেই ঢিল হলো ফাঁস।
এদিকে কাছে চলে এসেছে ছোরাওয়ালা।
শরীর গড়িয়ে একপাশ থেকে তার হাঁটুতে লাথি ঝাড়ল রানা। কড়াৎ শব্দে ভাঙল হাঁটুর বাটি। আউ-উ-উ করে করুণ আর্তনাদ ছাড়ল লোকটা আহত কুকুরের মত। হাত থেকে মেঝেতে পড়েছে ছোরা।
এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ফাঁসওয়ালার নাকমুখ সই করে পেনাল্টি কিক ঝেড়ে দিল রানা। পরের সেকেণ্ডে ঘুরেই কারাতে চপ মারল ছোরাওয়ালার গলায়। ক শব্দে ভাঙল শ্বাসনালী। ওদিকে ভীষণ ব্যথায় জবাই করা মোরগের মত ছটফট করছে ফসওয়ালা। বদমাসটার মুখ থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে রক্ত, সঙ্গে দাঁতও পড়ল কয়েকটা।
তাড়াহুড়ো করে পিস্তল নিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। দাড়িওয়ালা। অন্য হাতে কটাৎ শব্দে আটকে নিল ম্যাগাযিন। স্লাইড টেনে নেয়ায় ঝটাং আওয়াজে চেম্বারে গেল প্রথম বুলেট। দেরি হলো না গুলি ছুঁড়তে। ছোট্ট ঘরে বিকট আওয়াজ। রানা টের পেল মাথার পাশে শকওয়েভ। ছয় ইঞ্চি দূরের দেয়াল থেকে ওর গালে ছিটকে লাগল প্লাস্টারের ধারালো টুকরো। পাশের দেয়াল থেকে একটা ছবির ফ্রেম খুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল রানা ফ্রিসবির মত। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে লোকটার কবজিতে লাগল ফ্রেম। টাশ শব্দে ভাঙল কাঁচ। কবজির মাংস কেটে যেতেই চমকে গেছে লোকটা। হাত থেকে মেঝেতে পড়েছে পিস্তল। তিন লাফে দাড়িওয়ালার সামনে পৌঁছেই মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি ছুঁড়ল রানা। কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত ওই লোক। খপ করে কবজি ধরে টেনে নিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে রানাকে থ্রো করল সে। উড়ে গিয়ে কফি টেবিলের কাঁচে আছড়ে নামল রানা। হুড়মুড় করে সব ভেঙে পড়ল মেঝেতে। এদিকে পাশে পৌঁছে গেছে ক্ষিপ্ত দাড়িওয়ালা। বসার সময় ধুপ করে হাঁটুর গুতো দিল রানার বুকে। পটাপট কয়েকটা ঘুষি বসাল মুখে। এক সেকেণ্ড পর পা টেনে লোকটার সোলার প্লেক্সাসে লাথি মারল রানা। ছিটকে পড়তে গিয়েও শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে আবারও দাঁড়িয়ে গেল দাড়িওয়ালা। দৌড়ে এল রানাকে শেষ করতে।
একই সময়ে উঠে দাঁড়াল রানাও।
এবারের মুখোমুখি লড়াই হলো প্রচণ্ড এবং তীব্র।
সুযোগ পেলেই পরস্পরকে আক্রমণ করছে দুজন।
একই ধরনের ট্রেনিং পেয়েছে ওরা।
ঠেকিয়ে দিচ্ছে হামলা।
ঝড়ের বেগে চলছে দুজনের দুই হাত।
সুযোগ করে নিয়ে গায়ের জোরে দাড়িওয়ালার গালে ঘুষি বসাল রানা। টলমল করে এক পা পিছিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু লোহার আঁকশির মত শক্ত হাতে ধরে রেখেছে রানার বাহু। টান দিয়ে চরকির মত ঘুরিয়ে ওকে ফেলল ঘরের কোণে বুকশেলফের ওপর। কাত হয়ে হুড়মুড় করে ওর ওপর নামল আলমিরা। চারপাশে ছড়িয়ে গেল বই ও ভাঙা কাঁচ।
মোটা এক শক্ত মলাটের বই হাতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। খেপা ষাঁড়ের মত ছুটে আসছে দাড়িওয়ালা, এখন আর থামতে পারবে না। বইটা তুলে গায়ের জোরে ওটার চোখা দিক লোকটার মুখে নামাল রানা। ফাটা ঠোঁট থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। একমুহূর্ত পর রানার কনুই লাগল দাড়িওয়ালার নাকে-মুখে। আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ। ধুপ করে মেঝেতে পড়ল সে। পরক্ষণে তার বুকে চেপে বসল রানা। দুইহাতে খামচে ধরল চুল, পরক্ষণে মেঝেতে ঠুকল মাথাটা। পরের সেকেণ্ডে আবারও। তারপর আবারও।
তখনই টের পেল রানা, প্যান্টের পকেটে কাঁপছে ফোন। কল করেছে কেউ। মাত্র আধ সেকেণ্ডের জন্যে সরিয়ে নিয়েছে মনোযাগ, সেই সুযোগে শরীর মুচড়ে সরল দাড়িওয়ালা। পরমুহূর্তে হিংস্র জানোয়ারের মত ঝাঁপ দিল রানার ওপর। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে গড়াচ্ছে ওরা। কিন্তু তখনই দাড়িওয়ালার হাত পড়ল মেঝেতে পিস্তলের বাঁটের ওপর। কাত হয়ে উঠে এল কালো চোখের মত মাযল, সরাসরি তাকাল রানার চোখে। শীতল নল খামচে ধরল বেপরোয়া রানা। তাতে কাত হয়ে সরল মাযল। শুরু হলো দুজনের গায়ের জোরের প্রতিযোগিতা। পিস্তলের দখল চাইছে দুজনই।
দুই সেকেণ্ড পর ছোট্ট, এলোমেলো ঘরে বিকট বুম! শব্দে গর্জে উঠল পিস্তল!
.
৫৬.
বেরোবার পথ খুঁজতে গিয়ে পুরো সেলার ঘুরে দেখেছে রেবেকা। দরজা পাথরের দেয়ালের মতই নিরেট। মাকড়সার জালে ভরা একটা তাকে ছোট টর্চ পেয়েছে ও। সেই হলদে দুর্বল আলোয় দেখছে ঘরের প্রতিটি কোনা। ভেবেছিল কোনও ট্র্যাপ ডোর বা কয়লা রাখার ঢালু কোনও সরু পথ পাবে।
কিচ্ছু নেই!
বেরোবার কোনও উপায় নেই ওদের!
পাথরের সিঁড়ির ধাপে বসল রেবেকা। মাথার পেছনে রেখেছে দুহাত। ভাবছে রানার কথা।
হ্যামারস্টাইন মৃত্যু-ফাঁদে ফেলেছে বিসিআই এজেন্টকে! যদি সাধ্য থাকত, উড়ে গিয়ে শত্রুর সামনে বুক পেতে দিত রেবেকা। মারা পড়বে রানা, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না ও। রানার যে রেকর্ড, ঝুঁকি নেবে না সিআইএর আততায়ী। রেবেকার দুচোখ বেয়ে দরদর করে নামল অশ্রু।
ফিসফিস করে ছায়া থেকে বলল ক্যাথি, রেবেকা? এতক্ষণে চলে গেছে না লোকগুলো? এবার চলো বেরিয়ে যাই।
ঠাট্টা করছ?
না। বেরিয়ে যেতে পারব আমরা।
কী করে, ক্যাথি? আটকা পড়েছি মাটির নিচে পাথরের ঘরে। চাইলেও বেরোতে পারব না। ছায়ায় ক্যাথিকে দেখল রেবেকা।
মেয়েটার হাতে জ্বলে উঠল অপার্থিব এক আলো!
একটা হৃৎস্পন্দন মিস করল রেবেকা।
ক্যাথির হাতে মোবাইল ফোন!
টর্চের আলো ওদিকে ফেলল রেবেকা। কোত্থেকে পেলে মোবাইল ফোন?
গাড়িতে আমার পাশে যে নিয়ানডারথালটা ছিল, তার পকেট থেকে নিয়েছি। টের পায়নি।
হেসে ফেলল রেবেকা। কাজের কাজ করেছ!
পনেরো বছর বয়সে মাঝে মাঝেই সুযোগ বুঝে মানুষের পকেট মারতাম, বলল ক্যাথি। এ-বিদ্যা কখনও ভোলা যায় না। তা ছাড়া, গাড়িতে করে আসার সময় যত কথা বলেছে হারামজাদারা, সব রেকর্ড করেছি। মনে হয়েছিল পরে কাজে আসবে।
ফোনটা দাও তো, বলল রেবেকা।
উঠে দাঁড়াল ক্যাথি। রিসেপশন দুর্বল। একমিনিট। একটা ফোঁটা আছে। এদেশের পুলিশকে ডাকতে হলে যেন কত লিখতে হয়? নাইন-ওয়ান-ওয়ান?
পুলিশে ফোন কোরো না, ফোনটা আমাকে দাও, সিঁড়ি থেকে নেমে ক্যাথির হাত থেকে ওটা নিল রেবেকা। সত্যিই খুব দুর্বল সিগনাল। কখনও থাকছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাতে বাটন টিপে রেকর্ডিং শুনতে লাগল রেবেকা। হতবাক হয়ে গেল চার এজেন্টের কথা শুনে। চুপচাপ কী যেন ভাবল, মনে করতে চাইল রানার ফোন নম্বর। সংখ্যাগুলো মনে পড়ল দুসেকেণ্ড পর। ব্যস্ত হাতে বাটন টিপতে লাগল রেবেকা। কয়েক সেকেণ্ড পর এল ডায়াল টোন। কান পেতে থাকল ও। রিং হচ্ছে আর হচ্ছে! বিড়বিড় করল রেবেকা, হায়, ঈশ্বর, বোধহয় সর্বনাশ হয়েই গেল!
.
হাজার হাজার মাইল দূরে মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। পায়ের কাছে পড়ে আছে দাড়িওয়ালার লাশ। উড়ে গেছে অর্ধেক মুখ। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জের গুলি মেঝেতে ছিটিয়ে দিয়েছে রক্ত, সেই সঙ্গে মাংস, খুলি ও চোয়ালের অংশ।
হাপরের মত হাঁফিয়ে চলেছে রানা। অ্যাড্রেনালিনের প্রভাবে থরথর করে কাঁপছে শরীর। নিজের রক্ত আর অন্য তিনজনের রক্তে লাল ওর মুখ। তচনচ হয়েছে অ্যাপার্টমেন্টের এ ঘর।
এখনও প্যান্টের পকেটে কাঁপছে মোবাইল ফোন।
কল রিসিভ করবে কি না ভাবল রানা। এক সেকেণ্ড পর রক্তলাল আঙুলে যন্ত্রটা বের করে স্ক্রিন দেখল। দেরি হলো না রিপ্লাই বাটন টিপে কানে ঠেকাতে।
রানা? তুমি ঠিক আছ?
রেবেকা? চেনা কণ্ঠ শুনে অবাক হয়েছে রানা। গলার আওয়াজে ওর মনে হলো খারাপ কিছু হয়েছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি ঠিক আছ।
আমার মনে হয় না তোমার ঈশ্বর খুব সাহায্য করেছে।
শয়তানদের দলের একজন হ্যামারস্টাইন, বলল রেবেকা।
তা জানতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাকে, বলল রানা। তুমি এখন কোথায়?
আমার সঙ্গেই আছে ক্যাথি। আছি হ্যামারস্টাইনের হান্টিং লজের বেসমেন্টে। সংক্ষেপে সব খুলে জানাল রেবেকা। অনুসরণ করেছিল সিআইএ স্পেশাল এজেন্টের গাড়ি। পরে বাড়ির কাছে বন্দি হলো থর্নের হাতে। ক্ষমতাশালী সিনেটর হেনরি শোফেন্ডের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট আর তাঁর কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ওই লোক। তবে আমার মনে হয়নি সিনেটর কিছু জানেন। তাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে এরা।
কসেকেণ্ড ভেবে বলল রানা, ভুলেও পুলিশ ডাকবে না, রেবেকা। আশপাশের স্টেট-এ আছে তোমার কোনও আপন ভাই?
আছে।
তাকে ডেকে নাও। বুঝিয়ে দিতে পারবে না কোথায় আছ?
পারব।
তুমি, ক্যাথি বা তোমার ভাই বন্ধ রেখো মুখ। আপাতত লুকিয়ে থাকতে হবে। পরে যোগাযোগ করব।
আরও কিছু কথা আছে, বলল রেবেকা, থর্ন সম্পর্কে আলাপ করছিল হ্যামারস্টাইন ও তিন এজেন্ট। ওদেরই একজনের মোবাইল ফোন চুরি করে সব রেকর্ড করেছে ক্যাথি। জেরু্যালেমের নামকরা এক মসজিদে নামাজের সময় গুরুত্বপূর্ণ কজন মুসলিম নেতাকে খুন করবে। তাদের ভেতর আছেন প্যালেস্তাইনি প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিলের চার সদস্য। ওঁদের উড়িয়ে দেয়া হবে বোমা মেরে।
ধক্ করে উঠল রানার বুক। কোন্ মসজিদ?
ওটা টেম্পল মাউন্ট-এর কাছে, বলল রেবেকা।
কখন ফাটাবে বোমা?
ইসরায়েলি সময় আজ সন্ধ্যা সাতটায়।
ঘড়ি দেখল রানা। কিন্তু সাতটা বাজতে তো আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি!
জানি, রানা। যেভাবে পারো ঠেকাও!
সেলারে দুর্বল সিগনাল বলেই হয়তো কেটে গেল কল। মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে রানা। শুকিয়ে গেছে গলা। হাজার খানেক চিন্তা ভিড় করল ওর মনে।
নিজেকে বোকা বলে মনে হচ্ছে। উচিত ছিল আগেই বোঝ। শক্তিশালী বোমার হামলা হবে বিশাল ওই মসজিদে। ফলাফল ভয়ঙ্কর।
পুরনো শহরের টেম্পল মাউন্ট এলাকায় ওটা বিতর্ক সৃষ্টি করা মসজিদ। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাস জটিল। খ্রিস্টানরা মনে করে প্রথমে ওখান থেকেই পৃথিবী তৈরি করেন ঈশ্বর। শেষ বিচারে ওই জায়গায় জড় হবে সবাই। আবার মুসলিমরা বিশ্বাস করে, স্বর্গ থেকে ফেরার সময় ওই মসজিদে প্রথমে নামেন শেষ নবী (সাঃ)। একসময়ে ওটাই ছিল ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির। তাদের শায়েস্তা করতে যিশুর প্রস্থানের সত্তর বছর পর মসজিদ ধ্বংস করে রোমানরা।
মক্কা ও মদিনার পর মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে প্রখ্যাত মসজিদ ওটা। কুব্বত আল-সখরা। অষ্টকোণী মসজিদের ওপরে রয়েছে পাথরের তৈরি প্রকাণ্ড, সোনালি গম্বুজ। শহরের বহু দূর থেকে দেখা যায় ওটাকে। ওখানে জড়িয়ে আছে দুই হাজার বছরের ইহুদি ধর্মের ইতিহাস। বেশ কয়েকটা দেশ হামলা করেছে ওই মসজিদ দখলে নেয়ার জন্যে। অবশ্য, উনিশ শ সাতষট্টি সালে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইহুদিরা ওটা তুলে দেয় মুসলিমদের হাতে। দুই জাতির মাঝের টানাপড়েনের প্রতীক ওই মসজিদ।
কুব্বত আল-সখরার মত পবিত্র মসজিদ ধ্বংস হলে সব দোষ পড়বে ইহুদিদের ওপর। তাতে আরেকটা কাজ হবে, দ্রুত জ্বলে উঠবে বোমার বিপজ্জনক সলতে। প্রমাণ হবে ঠিকই লেখা হয়েছে বাইবেলে: মানবজাতি পৌঁছে গেছে ধ্বংসের প্রান্তে। যুদ্ধ শুরু হবে ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে। ইহুদিদের পক্ষ নেবে আমেরিকা। একই সময়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে মুসলিম প্রতিটি দেশ। অন্ধবিশ্বাসী মুসলিমরা ধরে নেবে সত্যিই পৃথিবীর বুকে এটাই সবচেয়ে বড় জিহাদ। যুদ্ধের আগুন জ্বলবে পুরো পৃথিবী জুড়ে। দেরি হবে না পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে। এ সুযোগে আমেরিকান কোটি কোটি খ্রিস্টানের ভোট চাইবে স্টিভ বার্কলের মত ভণ্ড নেতারা।
এগিয়ে চলেছে ঘড়ির কাঁটা। একটু পর সত্যিই ধ্বংসের পথে যাত্রা করবে পৃথিবী। যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে সেটা। অন্তত চেষ্টা তো করতেই হবে।
.
৫৭.
একেকবারে কয়েক ধাপ ভেঙে সিঁড়ি বেয়ে নামল রানা। ছিটকে বেরোল সূর্যের সোনালি আলোয়। সরু গলিতে উঠছে ওর বুটের ভারী শব্দ। না থেমেই চট করে দেখল হাতঘড়ি।
বাজে ছয়টা বেয়াল্লিশ।
হাতে আর মাত্র আঠারো মিনিট!
উত্তরদিকের গলিতে রক্তমাখা রানাকে ছুটতে দেখে উন্মাদ ভেবে চমকে উঠছে মানুষজন। সামনে কেউ পড়লে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে ও। বাঁক ঘুরেই দেখল, সামনে গিজগিজ করছে দোকান। জমজমাট বাজারে দরদামে ব্যস্ত স্থানীয় খদ্দের ও টুরিস্টরা। তাদেরকে সরাতে ভেঁপু দিচ্ছে প্রাইভেট গাড়ি ও ট্যাক্সি। গিজগিজ করা টুরিস্টদের ওপর রেগে গিয়ে এক বিএমডাব্লিউ ট্রেইল বাইকের ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ তুলছে এক মোটর সাইক্লিস্ট।
দৌড়ে যুবকের পেছনে হাজির হলো রানা। রাইডারের পিঠে স্ট্যাপ দিয়ে বাঁধা ব্যাকপ্যাক। একদিকের স্ট্র্যাপ ধরে তাকে সিট থেকে তুলে ফেলল রানা, এক ধাক্কায় ফেলল একটু দূরের রাস্তায়। বিএমডাব্লিউ কাত হওয়ার আগেই ওটার সিটে চেপে বসল রানা। হ্যাণ্ডেল ধরে মুচড়ে দিল থ্রটল। ভয়ানক এক গর্জন ছেড়ে লাফিয়ে এগোল মোটরসাইকেল। প্রাণের ভয়ে ছিটকে সরে গেল আশপাশের সবাই। দোকানগুলোর মাঝ দিয়ে দুলতে দুলতে চলেছে তুমুল বেগী বিএমডাব্লিউ মোটরসাইকেল। কখনও চলে যাচ্ছে এদিকের দোকানের খুব কাছে, আবার ওদিকের দোকানের দিকে। আত্মা খাঁচাছাড়া করে দিয়েছে সবার।
প্রতি সেকেণ্ড গুনছে রানা।
আর কতটা দূরে গন্তব্য?
মস্তবড় জেরুযালেম শহরের ছোট্ট অংশ প্রাচীন নগর। সবচেয়ে চওড়া অংশ বড়জোর দৈর্ঘ্যে দু কিলোমিটার। আগে যে দ্য চার্চ অভ দ্য হোলি সেপুলকার পেরিয়ে এসেছে রানা, সেটা থেকে মাত্র পাঁচ শ গজ দূরে কুব্বত আল-সখরা মসজিদ।
মার্কেট ও গাড়ির মাঝ দিয়ে ছুটছে মোটরসাইকেল। হঠাৎ পেছনে কেঁদে উঠল, পুলিশের ওঁয়া-ওঁয়া সাইরেন। আয়নায় গাড়িটার জ্বলজ্বলে আলো দেখল রানা। ডানে উঁচু দেয়াল। দুপাশে প্রাচীন আমলের বাড়ি। মাঝে একটা ফাঁক। ওই পথে নেমেছে পাথরের সিঁড়ি। ছুটতে ছুটতে স্কিড করে ঘুরল রানা, থ্রটল মুচড়ে উঠে যেতে চাইল সিঁড়ি বেয়ে। সামনের চাকা প্রথম ধাপে লাগতেই আরেকটু হলে ছিটকে পড়ত ও, সামলে নিল কোনওমতে। কর্কশ আওয়াজে আপত্তি তুলছে ইঞ্জিন, ধুপ-ধুপ আওয়াজে উঠতে লাগল সিঁড়ির ধাপ বেয়ে।
আয়নায় আর পুলিশের গাড়িটা দেখল না রানা। দূরে চলে যাচ্ছে সাইরেন। তবে এখন পিছু নিয়েছে অন্তত তিনটে স্কোয়াড কার। ঘুরে এসে ধরতে চাইবে ওকে।
ঝড়ের বেগে সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরের রাস্তায় উঠল রানা। সামনেই দেখল বাতেই মাহাসে স্ট্রিটের সাইনবোর্ড। ঠিক পথেই যাচ্ছে। দুটো পুলিশের গাড়ির ঝলমলে আলো দেখল পেছমে। অনেক কাছে চলে এসেছে তারা।
হঠাৎ করেই সামনের একটা বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল একদল বাচ্চা।
স্কুল ছুটি!
তাদেরকে বাঁচাতে কাত হয়ে সরে গেল রানা। সরসর করে পিছলে গেল মোটরসাইকেলের পেছনের চাকা। ধুম করে গিয়ে লাগল একটা দোকানের দরজার পাশে। দুই সেকেণ্ড পর হুঁশ ফিরতেই রানা দেখল, চিৎপাত হয়ে দেখছে নীলাকাশ। একটু দূরে এসে থামল পুলিশের গাড়ি। লাফিয়ে নেমে এল দুই পুলিশ। দৌড়ে এল রানার দিকে। টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়াল রানা, পরক্ষণে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল কাছের পুলিশের চোয়ালে। প্রায় উড়ে গিয়ে কাত হয়ে রাস্তায় পড়ল লোকটা। দ্বিতীয় পুলিশ খামচে ধরেছে রানার বাহু। পেটে হাঁটুর জোর এক গুঁতো খেয়ে হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ল সে। তার আর্তচিৎকার শুরু হওয়ার আগেই ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে রানা।
বাজে ছয়টা ঊনপঞ্চাশ।
সময় মাত্র এগারো মিনিট!
অবশ্য, গন্তব্যের কাছে চলে এসেছে রানা। একটু দূরে ইহুদি কোয়ার্টারের কাছে উঁচু দেয়াল। ওদিকে জ্বলজ্বল করছে। কুব্বত আল-সখরা মসজিদের সোনালি গম্বুজ।
পেছনে চিৎকার শুনছে ও। হাহাকার করছে সাইরেন। ছুটতে ছুটতে একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। পিছু নিয়েছে একদল পুলিশ। ইহুদিদের দেয়ালের কাছে পৌঁছে. ওটার পাশ দিয়ে উড়ে চলল ও। আলখেল্লা পরা লোকজন ঠেলে সরিয়ে দৌড়ে চলেছে।
সামনেই মুর গেট। একমাত্র ওই পথেই মসজিদে ঢুকতে পারবে অন্য ধর্মের লোক। দুপাশে ছোট ছোট দোকান। ভিড় করে নানাকিছু কিনছে টুরিস্টরা। তাদের ভেতর দিয়ে তীরের বেগে ছুটছে রানা। ধমকে উঠছে কেউ কেউ, তারপর রক্তাক্ত লোকটাকে দেখে চুপ হয়ে যাচ্ছে। টেম্পল মাউন্টের বিস্তৃত এসপ্লেনেড মাড়িয়ে কুব্বত আল-সখরা মসজিদ লক্ষ্য করে ছুটছে রানা। দাউদাউ আগুনের মত জ্বলছে ফুসফুস। আর চলতে চাইছে না পা। মানসিক জোরে ছুটছে রানা।
সামনেই নীল মার্বেল পাথর দিয়ে নকশা করা অষ্টকোণী দেয়াল, দারুণ কারুকাজ করে লেখা আল-কোরআনের সব আয়াত। দেয়ালের ওদিকেই প্রকাণ্ড দালান। মসজিদের বাইরে জড় হয়েছে শত শত মুসলিম। বাতাসে গুঞ্জন।
পেছনে চিৎকার শুনল রানা। ভিড়ের ভেতর দিয়ে তেড়ে আসছে পুলিশ। ধার্মিকদের মাঝে হারিয়ে যেতে চাইল ও। আর চলছে না শরীর। দৌড়ে ঢুকল মসজিদে। সামনেই থাকবেন প্যালেস্তাইনি প্রেসিডেন্ট ও মুসলিম কাউন্সেলাররা।
হাতে আছে মাত্র চার মিনিট!
থমকে গিয়ে পাগলের মত এদিক-ওদিক দেখল রানা। যে কোথাও থাকতে পারে বোমা। হয়তো আছে আত্মঘাতী কারও শরীরে, বোঝার উপায় নেই। হাজার হাজার মানুষের ভেতর তাকে খুঁজবে কী করে রানা!
হয়তো বোমা রেখেছে কয়েক সপ্তাহ আগে।
দূর থেকে রিমোট দিয়ে ফাটিয়ে দেয়া হবে।
হঠাৎ করেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চুরমার হবে অপূর্ব সুন্দর মসজিদ।
আগুনের হলকার মাঝে ধসে পড়বে সোনালি গম্বুজ।
জেরুযালেমের আকাশে উঠবে কমলা আগুন ও ধোঁয়ার বিশাল স্তম্ভ। ওটার মাধ্যমেই শুরু হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড়।
সাতটা বাজতে তিন মিনিট!
এখন আর কিছুই করতে পারবে না রানা।
হঠাই চোখের কোণে দেখল অস্বাভাবিক দ্রুত নড়াচড়া। ঝট করে তাকাল রানা। পিলারের ওদিকে গেল কে যেন! চেহারাটা চেনা চেনা। পরনে ছিল হালকা জ্যাকেট ও নীল প্যান্ট। কাঁধে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা চামড়ার ব্যাগ। লাখ লাখ টুরিস্টের একজন হতে পারে সে।
কিন্তু একবার কারও চেহারা দেখলে কখনও ভোলে না রানা। ওই লোক কোর্ফিউ দ্বীপের সেই বোমাবাজ আততায়ী না?
চোখা চেহারা।
অলস চোখে বিষ।
মউরোসের খুনি!
ওদিকের পিলারের দিকে দৌড় দিল রানা। বিশ গজ পেছনে ছুটে আসছে পুলিশের লোক। দৌড়ের গতি আরও বাড়াল রানা। ওর রক্তাক্ত চেহারা দেখে প্রাণভয়ে আর্তনাদ ছাড়লেন এক মহিলা।
রানাকে দেখেছে বোমাবাজ। সরু হলো দুচোখ। কী যেন ভাবছে সে। পরক্ষণে ঘুরেই দৌড় দিল ভিড়ের ভেতর।
সাতটা বাজতে মাত্র দুই মিনিট!
আগে কখনও এত জোরে দৌড়ায়নি রানা। ছুটছে চিতার বেগে। বোমাবাজের পিছু নিয়ে পেরোল ছোট গম্বুজওয়ালা এক প্রাচীন দালান। প্রায় লাফিয়ে নামতে লাগল অসমতল পাথরের সরু সিঁড়ি বেয়ে। চারপাশে বিশাল পিলার ও উঁচু খিলান। নানা উঁচু-নিচু ফটকের মাঝ দিয়ে ছুটে একটা গলিতে নামল বোমাবাজ। বাঁক নিল বামে। সামনের লোকদের ধাক্কা দিয়ে পথ করে ছুটছে।
খুব ধীর হলেও দূরত্ব কমিয়ে আনছে রানা। প্রাচীন পাথরের বুকে উঠছে ওদের দুজনের ছুটন্ত পদশব্দ।
সাতটা বাজতে মাত্র এক মিনিট বাকি!
ছুটতে ছুটতে পিঠের চামড়ার ব্যাগে হাত ভরল লোকটা। হাতে তুলে নিল কী যেন। কালো রঙের দেখতে ছোট মোবাইল ফোনের মত। দৌড় না থামিয়ে কী সব বাটন টিপছে সলোমন রুশদি।
তারই সেট করা কোড!
ভয়ে বরফের মত জমাট বাঁধতে চাইছে রানার হৃৎপিণ্ড। রক্তাক্ত শার্টের কোমর থেকে নিল দাড়িওয়ালার পিস্তল। দেরি হলো না গুলি করতে। মাথা নিচু করে নিল সলোমন রুশদি। পেছনের দেয়ালে বিঁধল রানার বুলেট। বিকট আওয়াজ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে সরে যেতে লাগল লোকজন।
আবার বাঁক নিয়ে খিলান করা আরেক চওড়া দরজা দিয়ে পরের গলিতে ঢুকল বোমাবাজ। পেছনে ছুটছে রানা। লোকটা পালিয়ে গেলে চলবে না ওর। প্রথম সুযোগে শেষ করতে হবে তাকে। কোড পূরণ হলে খেলা শেষ। এরপর স্রেফ টিপে দেবে সেণ্ড কি।
বোমার বিস্ফোরণে মরবে শত শত মুসলিম।
আর তারপর শুরু হবে সত্যিকারের কেয়ামত।
ছুটতে ছুটতে হাতঘড়ি দেখল রানা।
সময় এখন সন্ধ্যা সাতটা!
.
হাজার হাজার মাইল দূরে দ্রুতগামী কালো লিমোর পেছন সিটে বসে আছে রনসন থর্ন। সোনার ঘড়িতে দেখছে শেষ কসেকেণ্ড। একটু পরেই সূচনা হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের!
মৃদু মৃদু হাসছে থর্ন। আরাম করে হেলান দিল চামড়ার সিটের পিঠে। বিড়বিড় করে বলল, সময় এখন ফুর্তির!
.
৫৮.
ভাঙা খিলানের ভেতর দিয়ে ওদিকে বেরিয়ে গেল সলোমন রুশদি। লোকটার হাতে কালো ওই রিমোট।
আবারও গুলি করতে পিস্তল তুলেছে রানা, এমনসময় হঠাৎ করেই আকাশে উঠল লোকটা। ধুম করে গিয়ে পড়ল একটু দূরের পাথরের স্ল্যাবে। বাঁক নিয়েই তার ওপর চড়াও হয়েছে পুরনো একটা মোপেট। আপাতত ভূমিশয্যা নিয়েছেন। ভীষণ মোটা আরোহিনী। মহিলার ভারী পেট সলোমনের পিঠের ওপর। তলা থেকে বেরোতে চাইছে লোকটা।
ব্রেক কষে থামল রানা। সলোমনের হাত থেকে দুফুট দূরে পড়েছে রিমোট। আছাড় খেয়ে গাল-কপাল কেটে গেছে। তার। দাঁত খিঁচিয়ে কী যেন বলল মহিলাকে। পিঠে ভারী ওজন নিয়েও তিলতিল করে এগোল রিমোটের দিকে।
দশ গজ দূরে রানা। নতুন করে শুরু করল দৌড়। চোখে আতঙ্ক নিয়ে দেখল, মহিলা সলোমনের পিঠ থেকে গড়িয়ে নেমে পড়তেই খপ করে রিমোট ধরল লোকটা।
রানা শেষ দুই গজ পেরোবার আগেই বাটন টিপবে সে!
ডাইভ দিয়ে তার পাশে পড়েই ঘুরল রানা। গায়ের জোরে ঘুষি মারল হালকা-পাতলা লোকটার মাথায়। পরক্ষণে ওর বামহাতি ঘুষি পড়ল বোমাবাজের চোয়ালে। লোকটার মুখ থেকে ছিটকে বেরোল ভাঙা দাঁত ও রক্ত। হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিতে চাইল রানা।
তখনই পেছনে শুনল কর্কশ ধমক। ঘুরে তাকাল রানা। তিন গজ দূরে তরুণ পুলিশ অফিসার, হাঁফিয়ে চলেছে। হাপরের মত। হাতে পিস্তল তাক করেছে রানার বুকে। তরুণের চোখে ভয়, তবে গুলি করবে প্রয়োজনে। হিব্রু ভাষায় আবারও নির্দেশ দিল সে। এক পা এক পা করে এগোচ্ছে।
ধীরে ধীরে মাথার ওপর হাত তুলল রানা। উঠে দাঁড়াল।
বোমাবাজের দিকে পিস্তল তাক করল পুলিশ অফিসার।
ভাঙা দাঁতের হাসি হাসল সলোমন রুশদি। উঠে বসল ধুলোর ভেতর। বুড়ো আঙুল রাখল সেণ্ড বাটনে।
কমপ্লিট হয়েছে সিকোয়েন্স। এবার চাপ দিলেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে পারবে না কেউ!
আগে কখনও এত দ্রুত নড়েনি রানা। ওর কনুই নামল তরুণ পুলিশ অফিসারের মুখের ওপর, একইসময়ে কেড়ে নিল পিস্তল। তাকও করল না, ঘুরেই গুলি করল সলোমন রুশদির হাতে। লাল কুয়াশা তৈরি করে উধাও হলো লোকটার বুড়ো আঙুলের অর্ধেক অংশ। খটাৎ শব্দে পাথুরে স্ল্যাবে পড়ল প্লাস্টিকের রিমোট।
হাঁটু গেড়ে বসে আহত আঙুল চেপে ধরেছে সলোমন। অবাক চোখে দেখছে রানাকে। ভাঙা গলায় জানতে চাইল, তুমি আসলে কে?
কেউ না, শান্ত স্বরে বলল রানা। পরক্ষণে গুলি করল লোকটার মাথায়।
.
যার শেষ ভাল, তার সবই ভাল, বললেন সিআইএ চিফ জেরাল্ড ডালটন। আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, মিস্টার রানা। একটু আগে পৌঁছেছেন এ শহরে।
জেরুযালেমে নিজের হোটেল কক্ষে বসে আছে রানা। নড়বড়ে খাটের কিনারায় ডালটন। সারাশরীরের প্রতিটি হাড় চুর-চুর হয়ে ভেঙে গেছে, মনে হচ্ছে রানার।
আপনার বিরুদ্ধে আমাদের আর কোনও অভিযোগ নেই, বললেন ডালটন। আপনি আসলে আসেনইনি এখানে। জীবনেও কখনও দেখা হয়নি আমাদের। এবার সিআইএর বিমানে চেপে সোজা চলে যেতে পারেন যেখানে খুশি। হাসলেন তিনি, জেনে সুখী হবেন, মসজিদে পাওয়া গেছে শক্তিশালী বোমাটা, ফাটলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আবারও ধন্যবাদ।
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন জেরাল্ড ডালটন।
একটু পর রেবেকার কাছে কল দিল রানা। ভাবছে, এই নম্বরে কি পাব ওকে?
পাঁচ সেকেণ্ড পর কল রিসিভ করল কেউ। ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আমি ফিরছি, বলল রানা। আগামীকাল দুপুর একটায় দেখা কোরো ওয়াশিংটন ডি.সি.-র লিঙ্কন মেমোরিয়ালে।
ফোন রেখে অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিল রানা। ধুয়ে গেল সব রক্ত, কিন্তু মিলিয়ে গেল না অন্তরের তিক্ত স্মৃতি। চল্লিশ মিনিট পর পৌঁছে গেল রানা এয়ারপোর্টে। এখনও রয়ে গেছে অনেক কাজ।
.
৫৯.
লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে পাথুরে সিঁড়ির ধাপে বসে আছে রেবেকা। পিছনে ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল আর ক্যাপিটোল ডোম। ওখানেই বসে ইউএস সিনেট। ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে রানাকে হেঁটে আসতে দেখল ও। দশ লক্ষ ওয়াটের বাতির মত ঝলমল করে উঠেছে ওর মুখ।
যাক, সত্যিই এলে, রানা এসে থামতেই উঠে ওকে জড়িয়ে ধরল রেবেকা। ভেবেছিলাম আসবেই না।
আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে জানতে চাইল রানা, তোমার ভাই বের করেছিল সেলার থেকে?
মাথা দোলাল রেবেকা। আমরা আছি ওর বাড়িতেই। এখনও ওখানেই আছে ক্যাথি।
গুড, বলল রানা। আপাতত লুকিয়ে থাকাই ভাল। থর্ন আর হ্যামারস্টাইনের সঙ্গে বোঝাঁপড়া সব শেষ হয়নি। এখনও বিপদে আছে মেয়েটা। একই কথা খাটে তোমার বেলাতেও। থর্ন আর হ্যামারস্টাইন চাইবে না তোমরা মুখ খোলো।
উদ্বেগের ছাপ পড়ল রেবেকার মুখে। তা হলে কী করা উচিত?
সিনেটর শোফেন্ডের সঙ্গে দেখা করব, বলল রানা। তারপর দেখা যাক, কী বলেন তিনি।
আমিও যাব?
একা লাগবে না তুমি সঙ্গে গেলে।
মন্ট্যানা তা হলে?
হ্যাঁ, ওখানে।
পার্কিং লটের দিকে চলল ওরা।
.
পরদিন।
মণ্ট্যানা।
সকাল দশটা।
পাহাড়ি সড়কে ছুটে চলেছে পোর্শে নাইন ফাইভ নাইন। চওড়া চাকা আঁকড়ে রেখেছে অ্যাসফল্ট। গতি প্রায় না কমিয়েই বাঁক নিলেন সিনেটর হেনরি শোফেল্ড।
সামনের দৃশ্য দেখে চেপে ধরলেন ব্রেক প্যাডেল। তিরিশ গজ দূরে আড়াআড়িভাবে রাখা পুরনো এক ফোর্ড পিকআপ। খোলা ওটার হুড। ঝুঁকে কী যেন দেখছে সুন্দরী এক মেয়ে।
পোর্শে থেকে নেমে এলেন সিনেটর। হুডের সামনে পৌঁছে হাসলেন সুন্দরীর দিকে চেয়ে। মেয়েটার হাতে চটচট করছে কাদার মত তেল। অসহায় দৃষ্টিতে দেখল হেনরির চোখে।
সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সিনেটর। আমি কি কোনও সাহায্যে আসতে পারি, ম্যাম?
রাস্তার পাশের এক বোল্ডারের পেছন থেকে বেরিয়ে সিনেটরের চার ফুট দূরে থামল রানা। হ্যাঁ, সাহায্য করতে পারেন, স্যর। ওর হাতের পিস্তলের নল সোজা ভদ্রলোকের মাথার দিকে তাক করা।
ধুম করে বনেট বন্ধ করল রেবেকা।
কী চাই তোমাদের? আড়ষ্ট কণ্ঠে জানতে চাইলেন শোফেল্ড।
আলাপ করতে চাই রনসন থর্নের বিষয়ে, বলল রানা। চলুন, একটু ঘুরে আসি।
পিকআপের পেছনে বসে আছেন হেনরি শোফেল্ড। ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর থর্নের বিষয়ে সব কথা শেষ করল রানা। ও থেমে যাওয়ার পর ক্যাথি আর ওকে কীভাবে মেরে ফেলতে চেয়েছে থর্ন, খুলে বলল রেবেকা।
সব শোনার পর দুর্বল সুরে বললেন শোফেল্ড, যা বললেন, সব শুনেও মনে হচ্ছে ভুল শুনেছি।
আপনি থর্নের প্ল্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বলল রানা। প্রথম থেকেই আপনাকে ব্যবহার করছে সে।
মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগত ওর আচরণ, বললেন শোফেল্ড, কেবল কার-এ উঠে গোপনে মিটিং করত। বুঝতাম না কীসের অত ফুসুর-ফাসুর।
এখন সবই জানেন, বলল রানা।
দুমুঠো পাকিয়ে ফেললেন শোফেল্ড। জানতাম খুব চতুর লোক থর্ন। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত পেছনে। তবে ভাবতেও পারিনি এত বড় নরপশু। রাগে থরথর করে কেঁপে গেল তাঁর কণ্ঠ: ঈশ্বর মাফ করবেন না আমাকে, এত বড় খুনিকে পুষে রেখেছি! শয়তানও বোধহয় এত খারাপ হয় না। মুখ তুলে রানাকে দেখলেন তিনি। বলতে পারেন, আমি হতভম্ব। কী করব বুঝতে পারছি না। বিচার হওয়া উচিত লোকটার। রেবেকাকে দেখলেন শোফেল্ড। আপনি জানাননি আপনার সুপিরিয়র অফিসারকে?
আমরা দুজন ছাড়া কেউ জানে না, বলল রেবেকা।
ওপরের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন শোফেল্ড। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, হ্যামারস্টাইন আর থর্নের বিচার করতে হবে। দেরি না করে এবার ফোন দেব সঠিক জায়গায়।
মাথা নাড়ল রানা। সেটা চাই না।
দ্বিধান্বিত হয়ে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখলেন শোফেল্ড। তা হলে কী করতে চান?
বলুন আপনার কেবল কারের কথা, বলল রানা।
.
৬০.
দ্য বেলাজিয়ো হোটেল।
লাস ভেগাস।
কুব্বত আল-সখরা মসজিদ এখনও অক্ষত শুনেই ছুটি নিয়েছে রনসন থর্ন। এখন বসে আছে নিজের সুইটে। দমে গেছে মন। একটু পর পর গিলছে ব্র্যাণ্ডি। কয়েকটা চকোলেট খাওয়ার পর ঠিক করল ফোন দেবে তার ব্রোকারের কাছে। নামকরা কিছু কোম্পানির শেয়ার কিনেছিল, এখন মুনাফা তো হবেই না, গচ্চা দিতে হবে কয়েক লাখ ডলার। শুধু তা-ই নয়, যখন-তখন চিরকালের জন্যে ছেড়ে যেতে হবে এ দেশ।
অবশ্য এখন মনে হচ্ছে, লুকিয়ে পড়তে হবে না অন্য দেশে। খবরের কাগজ বা টিভি কিছুই বলেনি ওর সম্পর্কে। প্রকাশ পায়নি কিছু। মন্ট্যানার ওই হোটেলে কেউ বেঁচে নেই যে, সাক্ষ্য দেবে ওর বিরুদ্ধে। ভালভাবেই নিজের পদচিহ্ন লুকিয়ে ফেলেছে হ্যামারস্টাইন।
জেরুযালেম থেকে ফিরে সিআইএ চিফকে হয়তো জানাবে মাসুদ রানা, ফাঁদে ফেলা হয়েছিল তাকে। কিন্তু প্রমাণ করতে পারবে না কিছুই। প্রমাণ শুধু দিতে পারত হ্যামারস্টাইনের বেসমেন্টের দুই কুত্তী। কিন্তু মুখ খোলার উপায় নেই তাদের।
কাজেই চিন্তার কী আছে?
দুপুরের আগে ফোন করলেন সিনেটর শোফেল্ড। খুশি খুশি কণ্ঠে জানালেন, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় বিষয়ে আলাপ করতে ডাক এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। তাতে নিজেকে। অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছেন তিনি। বক্তৃতা তৈরি করে দিতে হবে। সে কারণে বাধ্য হয়েই থর্নের ছুটি বাতিল করছেন তিনি।
চলে এসো, বললেন শোফেল্ড। দেখা করবে আটটায় স্কি শ্যালেতে।
ঘড়ি দেখল থর্ন। কুঁচকে গেল ভুরু। এখন রওনা হলে হয়তো ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারব। তবে স্কি শ্যালেতে কেন?
বাড়িতে ছারপোকা আছে, বললেন সিনেটর। আমার অফিসও বাদ পড়েনি। সার্চ করা হচ্ছে পুরো বাড়ি। আমরা আলাপ সারব স্কি শ্যালেতে।
এই তথ্য শুনে অবাক হয়েছে থর্ন। সিনেটর ফোন রাখার পর আরেক ঢোক ব্র্যাণ্ডি নিল সে। ভাবছে, কারা রেখেছে ওই লিসেনিং ডিভাইস?
যাক গে!
ব্যাগেজ গুছিয়ে রওনা হতে হবে তাকে।
.
বিমান থেকে নেমে লিমোতে চেপেছে রনসন থর্ন। তিক্ত মনে ফিরল সিনেটরের প্রাসাদে। দরদর করে ঘামছে গরমে। শাওয়ার নেয়া জরুরি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে এখন টেইল-বোন ব্যথা করছে তার।
সিনেটরের বাড়ির উল্টো দিকে উপত্যকার শেষমাথায় পাহাড়ি শ্যালে। ওখানে পৌঁছুতে হলে ব্যবহার করতে হবে কেবল কার। সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাড়ির পাশের কাঠের কন্ট্রোল রুমে ঢুকল থর্ন। চেপে বসল কেবল কার-এ। কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাক করল রিমোট। যন্ত্র অ্যাকটিভেট করবে, এমনসময় শুনল পরিচিত কণ্ঠ: একমিনিট!
ক্লান্ত পায়ে কেবল কারে এসে উঠল হ্যামারস্টাইন।
অবাক চোখে ওকে দেখল থর্ন। তুমি এখানে কী করছ?
মিটিঙে ডেকেছে শোফেল্ড। কী যেন বলবে হোয়াইট হাউসের বিষয়ে।
তোমার সঙ্গে শোফেন্ডের কী?
জানি না। জানাল খুব জরুরি। লোকটা কোথায়?
উপত্যকার আরেক প্রান্তে কেবল কার শ্যালেতে, বলল থর্ন। ওটা ওদিকে। হাত তুলে উপত্যকা দেখাল সে।
ফ্যাকাসে হলো হ্যামারস্টাইনের মুখ। বাড়িতে মিটিং করলে ভাল হতো না?
বাড়িতে ছারপোকা পাওয়া গেছে।
অবাক কাণ্ড, বলল হ্যামারস্টাইন, ঠিক আছে, চলো। কথা বলে দেখি লোকটার সঙ্গে।
রিমোট তুলে বাটন টিপল থর্ন। তাতে কিছুই হলো না। আবার রিমোটের বাটন টিপে দিল সে। এবার ক্লং-ক্ল্যাং আওয়াজে নড়ে উঠল কেবল কার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলেছে মসৃণভাবে। বহু নিচে উপত্যকার মেঝে।
মাঝামাঝি যাওয়ার পর হঠাৎ থামল কেবল কার। আর এগোচ্ছে না।
আরে, কী ব্যাপার! রিমোট তুলে নির্দিষ্ট বাটন টিপল থর্ন। নড়ল না কেবল কার। বিড়বিড় করে বলল সে, বোধহয় ব্যাটারি শেষ।
কিন্তু ঠিকই জ্বলছে সবুজ লেড বাতি।
বুকটা ধক্ করে উঠল থর্নের।
তোমার রিমোট কাজ না করলে ফিরব কী করে? আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল হ্যামারস্টাইন।
থর্ন কিছু বলার আগেই তার পকেটে বাজল মোবাইল ফোন।
.
পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে রানা। দেখছে তিন শ গজ দূরে, শূন্যে ভাসছে কেবল কারটা। একহাজার ফুট নিচে গভীর জঙ্গল। পকেটে রেখে দিল আসল রিমোটটা। থর্নের কাছে আছে নকল একটা। ওটা দিয়ে কিছুই করতে পারবে না সে।
কল রিসিভ করল থর্ন। উত্তেজনা আর ভয় নিয়ে জানতে চাইল, সিনেটর, ফোন কি আপনি করেছেন?
ভুল বললে, থর্ন, ব্লুটুথ হেডসেট-এ জবাব দিল রানা।
চুপ হয়ে গেল থর্ন। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, কে? কে আপনি?
তোমার বামে তাকাও, বলল রানা। চোখ ভাল থাকলে দেখবে আমি পাহাড়ের ওপর।
রানা?
হয়তো ভাবছ, হঠাৎ এখানে কেন, বলল রানা। কিন্তু এর কোনও ব্যাখ্যা দেব না। জেনেই বা কী করবে? মৃত লোকের কোনও তথ্য দরকার হয় না।
শোনো… রানা… তোতলামি পেয়ে বসল থর্নকে, রানা… আমার… অনেক টাকা। বড়লোক করে দেব। তোমাকে। বুঝলে…।
ভালই প্ল্যান করেছিলে, বলল রানা। চালাক লোক। হ্যামারস্টাইনও কম নয়। সহজেই সিআইএ ডেটা বেস থেকে সরিয়ে দিয়েছে তোমার সব ডেটা। কথা বলতে বলতে প্যাড দেয়া রাইফেল কেসের স্ট্র্যাপ খুলছে রানা। বের করল রেমিংটন রাইফেল। দারুণ জিনিস। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের এক বন্ধু যত্নের সঙ্গে জিরো করেছেন এটাকে। আনযিপ করে অ্যামিউনিশন কম্পার্টমেন্ট থেকে পাঁচটা লম্বা পয়েন্ট থ্রিযিরোএইট বুলেট নিল রানা। এক এক করে ভরল ম্যাগাযিনে। ধীরেসুস্থে শুয়ে পড়ল পাহাড়ের কিনারায়। স্কোপের মাঝ দিয়ে পরিষ্কার দেখল, কেবল কার এর ছাতে পুলি ও পুরু তার।
ফোনে ধাতব আওয়াজ শুনেছে থর্ন। ভীতকণ্ঠে প্রতিবাদের সুরে বলল, আমি কাজ করি ইউএস সিনেটরের হয়ে। বুঝতে চেষ্টা করো, রানা, আমাকে খুন করলে রক্ষা পাবে না।
তা হলে শোনো, তোমার জন্যে একটা মেসেজ আছে, বলল রানা।
কীসের মেসেজ? কী বলতে চাও…
চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে তোমাকে। সেফটি অফ করল রানা। হ্যামারস্টাইনকেও জানাতে পার, ওকেও বের করে দেয়া হয়েছে সিআইএ থেকে। হেডসেটে শুনল রানা, তীব্র আতঙ্কে কী যেন বলছে থর্ন। পাত্তা দিল না ও। আঙুল আস্তে করে ডেবে গেছে ট্রিগারে। ওর কাঁধে ধাক্কা দিল রেমিংটন।
তিনশ গজ দূরে ছিঁড়ল একটা কেবল। সড়াৎ করে পুলি থেকে বেরোতে লাগল ওটা। বনবন করে ঘুরছে পুলি। হোঁচট খেল কেবল কার। সাঁই করে নামল দশ ফুট নিচে। কেবল আটকে গেছে বলে থামল পতন।
ভীষণ করুণ চিৎকার জুড়েছে রনসন থর্ন ও হ্যামারস্টাইন। পাগল হয়ে গেছে তারা। কাত হয়ে যাওয়া মেঝেতে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে থাবা মারছে জানালার কাঁচে।
শান্ত হাতে রাইফেলের বোল্ট টানল রানা। আবারও তাক করল রেমিংটন। টিপল ট্রিগার। পাহাড়ি উপত্যকায় ছড়িয়ে গেল বুলেটের প্রচণ্ড আওয়াজ। |||||||||| রানার মনে হলো চিরকাল শূন্যে ঝুলে আছে কেবল কার, তারপর হঠাৎ করে সাই করে রওনা হলো একহাজার ফুট নিচে পাথুরে জমি লক্ষ্য করে। থর্ন ও হ্যামারস্টাইনের বেসুরো চিৎকার শুনল রানা। নেমে চলেছে তারা তীর বেগে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর পাহাড়ের পায়ের কাছে ড্রপ খেল কেবল কার। লাফ দিয়ে উঠে বিস্ফোরিত হলো তরমুজের মত। ভাঙা সব টুকরো ডিগবাজি খেতে খেতে গিয়ে থামল নিচের জঙ্গলে।
ততক্ষণে কেসের ভেতর রাইফেল রেখে দিয়েছে রানা। সব গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল কেস হাতে পাহাড় থেকে নামতে লাগল রানা। নিচে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে রেবেকা। এবার সোজা ফিরবে ওরা ভার্জিনিয়ায়।
.
৬১.
ভার্জিনিয়া।
রেবেকার বাড়ি।
সোনালি রোদ চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙল রানার। এখনও ঘুমিয়ে আছে রেবেকা। পরীর মত লাগছে মেয়েটাকে। শুভ্র বুক থেকে চাদর সরে গেছে। কয়েক সেকেণ্ড ওকে দেখল রানা, তারপর বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল নিঃশব্দে। দুটো ফোন কল করতে হবে। জরুরি।
ড্রইংরুমে চলে এল রানা। প্রথমে কল দিল মিস মেরিয়ান ট্রুলির ফোনে।
রিসিভার তুলল একটা মেয়ে। রানা মিস ট্রুলিকে চাইছে শুনে জানাল, ডেকে দিচ্ছি তাঁকে।
দুমিনিট পর লাইনে এলেন বৃদ্ধা মহিলা।
রানা জানে, তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন। নরম সুরে বলল ও, সরি। বাধ্য হয়ে জরুরি কাজে যেতে হয়েছিল।
এখনও যোগাযোগ করছে সাংবাদিকরা, বললেন মিস ট্রুলি। সবার কৌতূহল, কোথায় গেল রহস্যময় ওই শুটার। আর পুরস্কারই বা নিল না কেন?
আপনার আতিথেয়তার কথা সবসময় মনে থাকবে, বলল রানা।
ওটা কিছু না, রানা। স্যাভানায় এলে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করবে। আমার বাড়ির দরজা সবসময় তোমার জন্যে খোলা। …এবার আরেকটা কথা, কোথায় পাঠাব আমরা তোমার পুরস্কারের ছয় লাখ ডলার?
ওটা আমাকে দিতে হবে না, ম্যাডাম, বলল রানা, আপনার ট্রাস্টের ফাণ্ডে জমা করে নিলে খুব খুশি হব।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকলেন মিস ট্রুলি, তারপর বললেন, সত্যি? এত টাকা দিয়ে দেবে তুমি?
এ বিষয়ে টুঁ শব্দ করল না রানা, সরে গেল অন্য প্রসঙ্গে: তবে একটা সাহায্য চাই। আপনার কাছে কি রেভারেণ্ড স্টিভ বার্কলের ফোন নম্বর আছে? তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু বই কিনব। দারুণ লিখেছেন ভদ্রলোক।
খুব খুশি হবে, বললেন মিস ট্রুলি। মুখস্থ করে ফেলেছেন বাটপার যাজকের ফোন নম্বর। সংখ্যাগুলো বলে গেলেন তিনি।
বিদায় নিয়ে কল কেটে দিল রানা। এবার কল করল বার্কলের ফোনে। হ্যালো, কেমন আছেন, বার্কলে?
রানার কণ্ঠ শুনে চুপ থাকল লোকটা। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আছি।
তা হলে পেয়ে গেছেন এক শ মিলিয়ন ডলার?
দুদিন আগে, বিস্মিত সুরে বলল বার্কলে। আপনি জানলেন কী করে?
আন্দাজ, বলল রানা, ফোন করেছি জরুরি এক চুক্তি করতে।
বড় একটা ঢোক গিলল বার্কলে। চুক্তি? কীসের চুক্তি?
ভয় পাবেন না। আপনার টাকা কেড়ে নেব না। অন্তত সব নয়।
আপনার অনেক দয়া, শুকনো গলায় বলল যাজক।
তা ঠিক, হাসল রানা। এবার শুনুন আপনার ভাঁওতাবাজি গোপন রাখার ব্যাপারে আমার শর্ত। কোনও এদিক-ওদিক চলবে না। আপনি শুনতে তৈরি তো?
শুনছি।
প্রথম কথা, দেরি না করে মিস ট্রুলির ট্রাস্টে জমা দেবেন ওই এক শ মিলিয়নের পঁচিশ পার্সেন্ট। ওটা দিচ্ছেন শিশুদের চিকিৎসার জন্যে।
কান্না কান্না হয়ে গেল বার্কলের কণ্ঠ, ঠিক আছে। আমিও ভাবছিলাম… কিন্তু একেবারে পঁচিশ ভাগ?
চুক্তির প্রথম অংশ, বলল রানা। এবার পরের অংশ। যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছেন, সব শোধ করার পর আপনার মনে হবে বাড়িটা নতুন করে সাজিয়ে নেয়া উচিত। এখনও তো আপনার বাড়ির দেয়াল একদম ফাঁকা, ঠিক?
ই… ইয়ে, তুতলে উঠল বার্কলে। কিন্তু…।
অক্সফোর্ডে প্রতিভাময়ী এক পেইন্টার আছে, নাম লিলি রিভার্স। আমি চাই আপনি তার ওয়েব সাইট দেখবেন।
ওটা দেখে কী হবে?
আজ থেকে শিল্পী-বান্ধব হয়ে উঠছেন, বার্কলে। ওর সব ছবি উপযুক্ত দামে কিনে নেবেন। দামটা উপযুক্ত কি না, সেটা আমি পরে খোঁজ নেব। ঠকাতে যাবেন না ভুলেও।
এটা তো অত্যাচার, প্রতিবাদ করল বার্কলে। আমি আধুনিক আর্ট পছন্দ করি না।
অভ্যেস তৈরি করুন, বলল রানা। এবার চুক্তির তৃতীয় অংশ। মন্টানার এক খামারের বয়স্ক মালিকের দরকার কিছু টাকা। কে বা কারা যেন গোলাগুলি করে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ওই খামারের। নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে সব। দরকার একটা-দুটো নতুন পিকআপ ট্রাক। সঠিক সময়ে পেয়ে যাবেন তার ঠিকানা আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর। দেরি করবেন না টাকা পাঠিয়ে দিতে।
কত দিতে হবে? সন্দেহের সুরে জানতে চাইল বার্কলে।
রাউণ্ড ফিগার দেয়াই ভাল, বলল রানা। ধরুন, এক মিলিয়ন ডলার।
ওদিক থেকে এল দীর্ঘশ্বাসের ফেস আওয়াজ। আপনি খুন করে ফেলছেন আমাকে, রানা!
আপনাকে খুন করব বলেই ভাবছিলাম, বলল রানা। পরে ভাবলাম, শেষ করে না দেয়াই ভাল। …এবার শুনবেন চুক্তির পরের অংশ?
হঠাৎ ভীষণ ক্লান্ত মনে হলো বার্কলের কণ্ঠ, বলুন।
ঠিক আছে, তা হলে শুনুন, জর্জিয়ায় আছে এক উকিল। তার পা-দুটো অপারেশন করে ঠিক করতে হবে।
পিছলা সিম্পসন? কাতরে উঠল বার্কলে। আপনি চান। ওই হারামজাদাকে টাকা দেব আমি?
ধরেছেন ঠিক, বলল রানা। এ ছাড়া, তাকে বাড়তি কিছু টাকা দেয়াও খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে না। নতুন করে শুরু করতে পারবে প্র্যাকটিস। ধরুন, তিন লাখ ডলার দিলেই চলবে। ..:না, না, পাঁচ লাখ দেয়াই ভাল।
পাথর হয়ে গেছে স্টিভ বার্কলে।
আরেকটা কথা, মন দিয়ে শুনবেন, বলল রানা। চুপ হয়ে গেল। এবার যে বিষয়ে বলবে, ওটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওর কাছে। তৈরি করবেন একটা ট্রাস্ট। সব মিলে দশ লাখ ডলার।
কার জন্যে? নাক টানল বার্কলে। আপনার?
অনাগত এক শিশুর জন্যে, বলল রানা। ওকে অন্তর থেকে ভালবাসি। আঠারো বছর হওয়ার পর ও ওই টাকা পাবে। ততদিনে বাড়বে টাকা। কদিনের ভেতর লণ্ডনের এক উকিল যোগাযোগ করবে আপনার সঙ্গে। তার কাছে থাকবে দরকারি সব কাগজ। সই করে দেবেন।
রানা ভেবে দেখেছে, যা ঘটে গেছে, এরপর কখনও ওকে মাফ করবে না মউরোসের স্ত্রী জোয়ি। মুখে বলে বোঝাতে পারবে না ও, দোষ ছিল না ওর। তবে যদি টাকার ব্যবস্থা করে, তা পরে কাজে আসবে মউরোসের সন্তানের।
আমি কি বুঝিয়ে বলতে পেরেছি, আপনাকে কী কী করতে হবে? জানতে চাইল রানা।
বুঝেছি, বিড়বিড় করল স্টিভ বার্কলে। কিন্তু চুক্তির এসব ভাল দিক যদি মেনে নিতে না চাই?
আমার চোখ থাকবে আপনার ওপর, বার্কলে। তেড়িবেড়ি করলে বুঝবেন, ধার দেয়া লোকদের মত অতটা নরম মনের মানুষ আমি নই। আপনার প্রতি যে শ্রদ্ধা আছে মিস ট্রুলির, সব শেষ হয়ে যাবে তাঁর। জানিয়ে দেব আপনার মত ঠগ লোক কমই হয়। শুধু তা-ই নয়, প্রথম ফ্লাইটে চেপে হাজির হব জর্জিয়ায়। পরে লোকে বলবে, কী ভয়ঙ্কর করুণ ভাবেই না মরল স্টিভ বার্কলে! জানেন তো, আমি আবার এককথার মানুষ।
আপনি তো এরপর বলবেন, আরও দশ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে ওই বেশ্যা বেটি ক্যাথি হার্বার্টকে, গুঙিয়ে উঠল ভণ্ড যাজক।
না, ওই টাকা রেখে দিন নিজের কাছে। আপনার কাছ থেকে আর একটা ফুটো পয়সাও প্রাপ্য নেই ওই মেয়ের।
চুপ হয়ে গেল দুজন। হিসাব কষছে বার্কলে। কিছুক্ষণ পর বলল, তার মানে, আমার আর কোনও উপায় নেই?
আসলেই নেই, বলল রানা।
গভীর আরেক গোঙানি ছাড়ল যাজক। ঠিক আছে। আপনি জিতে গেলেন, রানা। রাজি আছি এই চুক্তিতে।
রানা ফোন রেখে দেখল, কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে রেবেকা। রানা কিছু বলার আগেই হাসল মেয়েটা। চুক্তি তো শেষ, নাস্তা রেডি। এসো।
ডাইনিং রুমে পা রেখে রানা বুঝল, আজ টেবিলে অন্তত আট-দশটা সুস্বাদু খাবার। খুশি হয়ে উঠল রানার অন্তরটা। ভাল খাবার কার না পছন্দ? যদি সে খাবার এমন মমতার সঙ্গে পরিবেশন করা হয়?
টুক করে একটা চুমু দিল ও রেবেকার গালে।