২১.
রানাকে নিয়ে রাতের আঁধারে দক্ষিণের উপকূলীয় সড়ক ধরে জ্যাকসনভিলের দিকে চলেছে জলি। কিছুক্ষণ হলো টিপটিপ করে পড়ছিল বৃষ্টি, হঠাৎ করে গাড়ির ছাতে বাজতে লাগল অসংখ্য বেতালা ড্রাম। রাস্তা হয়ে গেল পিচ্ছিল।
নীরবে কয়েক মাইল যাওয়ার পর হঠাৎ করেই বলল জলি, উফ, একটা ড্রিঙ্ক পেলে বাঁচতাম। এখনও কাঁপছে হাত। রানার দিকে চেয়ে প্রথমবারের মত হাসল। আগে কখনও কারও দিকে অস্ত্র তাক করিনি।
ভালভাবেই দায়িত্ব পালন করেছ। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফ্লাস্ক বের করে জলির দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। স্নায়ু শান্ত রাখবে।
ছিপি খুলে এক, ঢোক আগুনে তরল গিলল জলি। দারুণ জিনিস তো! নাম কী?
ল্যাফ্রোএইগ সিঙ্গল মল্ট স্কর্চ, দশ বছর পুরনো।
ভাল জিনিস, আরেক ঢোক খেয়ে ফ্লাস্ক ফেরত দিল জলি। গ্লাভ কমপার্টমেন্টে সিগার আছে। একটা দেবে?
গ্লাভ কমপার্টমেন্ট খুলে অবাক হলো রানা। হাভানা সিগার?
বাবার কাছ থেকে শিখেছি। চাইলে নিজেও একটা নিতে পারো।
সিগার আছে রুপালি অ্যালিউমিনিয়াম টিউবে। দুটো সিগার বের করে আগুন ধরিয়ে একটা জলিকে দিল রানা, অন্যটা নিজের জন্যে।
কষে টান দিল মেয়েটা। মুখ থেকে বেরোল গলগল করে ধোয়া। তো, রানা, আসলে কে তুমি?
এমন এক লোক, যে কিনা সাহায্য করতে চায়।
মাথা দোলাল জলি। অস্ত্রের ব্যাপারে অনেক কিছু জানো। সাধারণ কেউ নও।
পিছলা সম্বন্ধে বলল, বলল রানা।
দেখা হয়েছিল ল স্কুলে।
তুমিও তা হলে উকিল?
মাথা নাড়ল জলি। পার হতে পারিনি বার একম। নার্ভাস হয়ে যেতাম। কয়েকবার চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিই। কিছু দিন কাজ করেছিলাম পিছলার হয়ে। তবে এখন কাজ করি শহরের এক ল ফার্মে।
নিজে না এসে তোমাকে পাঠাল কেন?
কারণ, কোথাও যেতে পারবে না। দেখলেই বুঝবে কারণ।
কী হয়েছে ওর?
স্টিভ বার্কলের লোক। ওকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। খুনই করত, কিন্তু সেসময়ে পুলিশে ফোন করি।
কে এই স্টিভ বার্কলে?
যা বলার নিজের মুখেই বলুক পিছলা।
এসবের ভেতর ক্যাথি হার্বার্ট জড়িয়ে গেল কীভাবে?
প্রায় দুবছর দুজন দুজনকে ভালবেসেছি পিছলা আর আমি, বলল জলি। কিন্তু তারপর আমাদের মাঝে কাবাবের হাড্ডির মত হাজির হলো ওই ক্যাথি হার্বার্ট।
শুনেছি কয়েকবার এই শহরে এসেছে ক্যাথি, বলল রানা। উঠত মিস মেরিয়ান ট্রুলির বাড়িতে।
মাথা দুলিয়ে সিগারে আরেক টান দিল জলি। শেষবার যখন এল, মাস ছয়েক আগে, একটা বার-এ বসে মাল টানছিল পিছলা। সবসময় কোনও না কোনও বার-এ ওকে পাওয়া যেতই। ওর সঙ্গে পরিচয় হলো সুন্দরী ইংরেজ মেয়েটার সঙ্গে। ওর আকর্ষণ এড়াতে পারল না পিছলা। ওই একই কথা খাটে ক্যাথির ব্যাপারেও। চার আনা পয়সাও নেই পিছলার। কিন্তু সবসময় হাসিখুশি। ওটাই ওর আকর্ষণ। গম্ভীর হয়ে গেল জলি। একটু পর মৃদু হাসল। পিছলার অফিসে একবার দেখা হলো ক্যাথির সঙ্গে। পিছলা বলল, মেয়েটা এসেছে ব্যবসায়িক চুক্তি করতে। বদমাশটা চেপে গেছে যে প্রতিদিন দুজন মিলে স্বর্গ থেকে ঘুরে আসছে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর বুঝে গেলাম সবই। প্রতি রাতে অনেক দেরি করে ফিরত পিছলা। জানালা নামিয়ে ছাই ঝাড়ল জলি। দোষ অস্বীকার করেনি পিছলা। তখনই ওকে ছেড়ে চলে গেলাম। জানিয়ে দিলাম, জীবনেও আর ওর মুখ দেখব না। চুকে গেছে সব। কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় ফোন দিল পিছলা। বলতে লাগল, আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। যদি সত্যি ওকে ছেড়ে চলে যাই, যে-কোনও দিন আত্মহত্যা করবে। ফোনে মেসেজ দিতে লাগল। কাঁদতে লাগল ল্যাংড়া কুকুরের মত।
আত্মহত্যা করবে ওর ওই মস্তবড় রিভলভার দিয়ে?
উড়ে যেত ওর অর্ধেক।
তা ঠিক।
যাই হোক, এক রাতে মুখোমুখি হতে গেলাম পিছলার অফিসে। সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, শুনতে পেলাম আর্তনাদ আর হাউমাউ কান্না। তারা তিনজন ছিল। পিটিয়ে পিছলার পিছলা হলুদ গু বের করে দিয়েছিল। কী করি, ফোন দিলাম পুলিশে। কাছেই ছিল একটা প্যাট্রল কার। মাত্র তিন মিনিটে পৌঁছে গেল দুই অফিসার। কিন্তু আগেই সাইরেন শুনেছে ওই তিন গুণ্ডা, পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে উধাও হলো তারা। বেদম পিট্টি দিয়ে বাজে অবস্থা করে ফেলেছিল পিছলার।
কবের কথা?
হবে দুসপ্তাহ, বলল জলি। পিছলা ভাবছে, আবারও ওকে খুঁজে বের করবে স্টিভ বার্কলে। তাই সাহস নেই যে কোনও হাসপাতালে যাবে। অথচ, খুব জরুরি ওর চিকিৎসা নেয়া।
পিছলার সেবা করছ, তাই না?
পাহারাদার কুত্তার মত চোখ রেখেছি। আবার বলতে পারো নার্স আর কাজের বুয়াও। সব মিলেই জলি।
তার মানে, ক্যাথি আর পিছলার মধ্যে চুক্তি হয়েছিল?
হ্যাঁ, চুক্তি হয়েছিল, গম্ভীর হয়ে গেল জলি। আর ওই জন্যেই আজ পিছলার এই হাল।
কীসের চুক্তি করেছিল?
যা বলার পিছলাই বলবে। গোপন করবে না কিছু। একটু পর ওখানে পৌঁছুব আমরা।
মাইল খানেক যাওয়ার পর হাইওয়ে ছেড়ে কাঁচা, সরু এক অন্ধকার রাস্তায় নামল জলি। অতিরিক্ত জোরে চালাচ্ছে গাড়ি। বামে গেল কাদামাখা পথ। সামনেই পড়ল মোটেলের প্রায় ধসে যাওয়া সাইনবোর্ড। বৃষ্টির পানিতে প্যাঁচ-প্যাঁচ করছে চারপাশ। গাড়ি ঢুকল মাটির উঁচু এক উঠানে। হেডলাইটের আলোয় রানা দেখল দীর্ঘ সব ঘাস। একপাশে উপচে যাওয়া গার্বেজ ব্যারেল, ভাঙা আসবাবপত্র ও চ্যাপ্টা অজস্ৰ বিয়ারের ক্যান। মোটেলের ছাত নিচু। মেরামত করা জরুরি। থেমে গেছে বৃষ্টি। উঁচু বারান্দার মাথায় পোকা ভরা হলদে নিয়ন বাতি।
বাঁক নিয়ে পুরনো এক পিকআপ ট্রাকের পাশে থেমে ইঞ্জিন বন্ধ করল জলি। ইশারা করে নেমে পড়ল।
তারের খাঁচা থেকে হুঙ্কার ছাড়ল বাঘের মত দুটো ডোবারম্যান কুকুর। পেছনের পায়ে ভর করে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে দরজার ওপর।
পিছলার নতুন বাড়ি, বলল জলি।
কয়েকটা ঘরের জানালায় জ্বলছে বাতি। কোথাও থেকে আসছে টিভির অস্পষ্ট আওয়াজ। প্রাণপণে ঘেউ-ঘেউ করছে কুকুরদুটো। ওই হুঙ্কার থামাতে দূর থেকে বাজখাই ধমক দিল মাতাল কেউ।
রানাকে পথ দেখিয়ে নয় নম্বর রুমের সামনে থামল জলি। পুরনো হার্ডবোর্ডের দরজা, উঠে আসছে চল্টা। জোরে নক করল জলি। আমি! জলি! ব্যাগ হাতড়ে বের করল দরজার চাবি, তালা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। ঘর অন্ধকার। বাতাসে ভাসছে অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ। জানালার পর্দা টেনে বাতি জ্বালল মেয়েটা।
ঘুমের ঘোরে পড়ে ছিল পিছলা সিম্পসন, ঝাঁকি খেয়ে মাথা তুলল। চোখ পিটপিট করছে আলোয়।
বয়স ত্রিশ, জলির চেয়ে দুতিন বছরের বড়। কিছু দিন আগেও সুদর্শন ছিল। মার খেয়ে এখন লাল, হলদে ও বেগুনি সব দাগ মুখে। ভুরুর সঙ্গে সেঁটে আছে নোংরা, ঘর্মাক্ত, কালো চুল। পরনে ডেনিম শার্ট, বগলে ঘামের হলদেটে দাগ। লোকটা বসে আছে আর্ম চেয়ারে। বেরিয়ে এসেছে। গদির বেশিরভাগ অংশ। পা-দুটো সোজা করে সামনের এক টুলের ওপর রেখেছে পিছলা। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্লাস্টার করা। চোখ রানার ওপর। দৃষ্টিতে ব্যথা ও ভয়। কোলে মসবার্গ পাম্প শটগান। নার্ভাস হয়ে ওটা ওপরে তুলতে গেল সে।
ভয় নেই, পিছলা, বলল জলি, বার্কলের লোক নয় এ।
চেয়ার টেনে বসুন, রানাকে বলল পিছলা। খুলে বলুন কী জানতে চান।
কয়েকটা বিয়ার নিয়ে আসছি, বলল জলি। তোমরা আলাপ করো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ও।
পুরো একমিনিট নীরবতায় বসে থাকল রানা ও পিছলা সিম্পসন। তারপর মুখ খুলল রানা, সরাসরি কাজের কথায় আসি। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ক্যাথি হার্বার্টকে। বারো দিন আগে হারিয়ে যায় গ্রিসের কোর্ফিউ দ্বীপ থেকে। ওকে খুঁজে বের করা আমার কাজ। ধারণা করছি, ওকে খোঁজার বিষয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন আপনি।
জানতাম, শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়বেই ও মেয়ে, বলল পিছলা। আমারও মুখ খুলিয়ে ছেড়েছে।
কারা তারা? জানতে চাইল রানা।
সর্বনাশ করে দিয়েছে আমার, গুঙিয়ে উঠল পিছলা। গুঁড়ো করে দিয়েছে হাড়। বুঝতেই তো পারছেন।
আমি হয়তো আপনার সাহায্যে আসতে পারব, বলল রানা।
তা জানি না। তবে যারা এই অবস্থা করেছে, তারা পেলে আপনার একটা হাড়ও আস্ত রাখবে না। চোয়াল ঘষল পিছলা। পুরো একমিনিট পর বলল, আপনি আসলে আমার কাছে কী জানতে চান?
প্রথম থেকে বললে সুবিধা হবে আমার, বলল রানা। ক্যাথি আর আপনার চুক্তি থেকে শুরু করুন। বাদ দেবেন না সিভ বার্কলের বিষয়ে কিছু। পরিচিত হয়ে উঠছে ওই নাম। কে তিনি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিছলা উকিল। দিন দেখি ওটা। টেবিলে রাখা জ্যাক ডেনিয়েলস্ বুর্বোনের বোতল তার দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। ওটা নিয়ে ছিপি খুলে ঢকঢক করে দুই ঢোক গিলল সিম্পসন। আস্তিনে মুছল মুখ। একেবারে প্রথম থেকে বলছি। আগে বলুন, আপনার জানা আছে মিস মেরিয়ান ট্রুলি কে?
মাথা দোলাল রানা।
তা হলে তো ভাল করেই জানেন, আমেরিকায় এলে ওই মহিলার বাড়িতেই ওঠে ক্যাথি। ওই এলাকার একটা বার-এ পরিচয় হয়েছিল ওর সঙ্গে আমার।
তা জেনেছি।
অস্বস্তি নিয়ে চেয়ারে নড়েচড়ে বসল পিছলা। পায়ের ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ। মিস ট্রুলি আর ক্যাথির সম্পর্ক খুব ভাল। অন্তত তাই মনে করেন মিস ট্রুলি। তবে মহিলার টাকার লোভেই তাঁর সঙ্গে মিশত ওই মেয়ে। বারবার বলত, টাকা থাকলে এটা কিনতাম, ওটা কিনতাম… ইত্যাদি। মনে মনে আশা করত, ওর কথা শুনে খুশিমনে চেক বইয়ের পাতায় বড় অঙ্কের টাকার অঙ্ক লিখবেন তিনি। আসলে সহজে এমন বান্ধবী পাওয়া কঠিন, যার কিনা আছে দুই বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি। চিরকাল চেয়েছেন কোল জুড়ে বাচ্চা আসুক। কিন্তু পছন্দমত কাউকে পাননি বলে জীবনটা পার করে দিয়েছেন একা। ক্যাথিকে পেয়ে ভাল লেগেছিল তাঁর। এদিকে ওই বিশাল অঙ্কের টাকা পাওয়ার নেশা পেয়ে বসেছিল ক্যাথিকে।
ঠিক ভালভাবে চিনি না ওকে, বলল রানা। শেষবার ওকে দেখেছি পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে।
আরেক ঢোক বুর্বোন নিল উকিল। ক্যাথির ধারণা হয়েছিল, মহিলার কাছ থেকে পাবে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু তখনই হঠাৎ করে কোথা থেকে হাজির হলো স্টিভ বার্কলে। গাল কুঁচকে ফেলল উকিল। রানার মনে হলো, এইমাত্র গাছ থেকে পেড়ে কাঁচা করলা চিবুতে শুরু করেছে পিছলা। আগে কখনও শোনেননি স্টিভ বার্কলের নাম?
আমার কি শ্রোনার কথা? কাঁধ ঝাঁকাল রানা।
বেস্টসেলার অঘোর। টেলিভেনজেলিস্ট। আগামী নির্বাচনে জিতলে হবে স্টেট গভর্নর। কিছু দিন হলো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মিস ট্রুলির। মহিলার ধারণা, স্টিভ বার্কলের পাছা থেকে ঝরে সূর্যের সোনালি রোদ। তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন ঈশ্বর আর যিশুর ওপর। ধর্মের সঙ্গে জড়িত দাঁতব্য সব প্রতিষ্ঠানে দেন মোটা অঙ্কের টাকা। তার মাথা মুড়িয়ে খাচ্ছে লোকটা। এমন ভাব নিচ্ছে, যেন সে বাস্তব এক সন্ত। তাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন মহিলা। ছয় মাস আগে মিস ট্রুলির বাড়িতে বেড়াতে এল ক্যাথি। তখনই মহিলা খুলে বললেন, কী পরিকল্পনা করেছেন তিনি। শত শত কোটি ডলার দেবেন স্টিভ বার্কলের সংগঠনকে। হাজার হাজার নয়, কোটি কোটি ডলার!
শুনে দেখি কত?
নয় অঙ্কের।
এক শ মিলিয়ন ডলার, বলল রানা।
মাথা দোলাল পিছলা। ঠিকই ধরেছেন। ওটা কিছুই না মিস ট্রুলির কাছে। ম্যাচিউর হবে বলেই বেশকিছু ইনভেস্টমেন্ট আর বণ্ড থেকে আসছে ওই টাকা। সেজন্যে ঘণ্টায় পাঁচ শ ডলার করে নেয় এমন কয়েকজন উকিল কাজ করছে মিস ট্রুলির হয়ে। যে-কোনও দিন ওই অঙ্কের নগদ টাকা পেতে পারেন মহিলা। এই মাসে বা আগামী মাসের শুরুর দিকেই সব চলে আসবে বার্কলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
ক্যাথি যখন এ খবর জানল, ভাল লাগল না ওর, মন্তব্য করল রানা।
তা তো বটেই, মাথা দোলাল পিছলা। বৃদ্ধা মহিলার বাড়িতে একবার দেখাও হলো ওর সঙ্গে বার্কলের। ক্যাথির মনে হয়েছে, ওই লোক ভীষণ চতুর এক বাটপার, ঠগ। ভাবতেও পারেনি ওকে না দিয়ে ওই বদমাশকে টাকা দেবেন মিস ট্রুলি। বারবার মহিলাকে সতর্ক করতে লাগল ক্যাথি। ভাবতে লাগল, ওর বিরুদ্ধে তাঁর কানে খারাপ কথা তুলেছে ওই লোক।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট ধরাল রানা। অপেক্ষা করছে চুপচাপ।
পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন? বলল পিছলা। বারবার স্টিভ বার্কলের প্রশংসা করেন মিস ট্রুলি, তাতে মাথা খারাপ হওয়ার দশা ক্যাথির। তিক্ত মনে ফিরল ইংল্যাণ্ডে। তারপর বেশকিছু দিন আমাদের যোগাযোগ ছিল না। নিজের ঝামেলায় বাঁচি না, ওর খোঁজ রাখা দূরের কথা। জলি বোধহয় খানিকটা বলেছে আপনাকে। যাই হোক, কয়েক সপ্তাহ আগে আবারও ফোন করল ক্যাথি। উঠান ভরা পাকা ফসল পাওয়া পায়রার মত উত্তেজিত হয়ে বাক-বাকুম করছিল। তুরস্কের এক খনন এলাকায় নাকি পেয়েছে দারুণ কী যেন। ওটার কারণে স্টিভ বার্কলের কাছ থেকে আদায় করবে লাখ লাখ ডলার। জানাল, ফাঁদে পড়ে গেছে লোকটা। ক্যাথি এমন ব্যবস্থা করবে, লেজ গুটিয়ে ওর কথা মত চলতে হবে তাকে। ওর দাবি অনুযায়ী সুড়সুড় করে দেবে টাকা। তাতে নেই কোনও ঝুঁকি। নাক দিয়ে বিদঘুটে ঘোৎ আওয়াজ বের করে, তিক্ত চোখে প্লাস্টার করা দুই ঠ্যাং দেখল পিছলা।
তার মানে, স্টিভ বার্কলেকে ব্ল্যাকমেইল করছিল ক্যাথি, বলল রানা। কিন্তু কীসের ভয় দেখিয়ে চাপ দিচ্ছিল?
আধখালি উইস্কির বোতল এদিক-ওদিক নাড়ছে পিছলা। সত্যি বলতে, তা আমি জানি না। বিস্তারিত কিছু বলেনি আমাকে ক্যাথি। নোংরা কিছু হবে। হয়তো যৌন কোনও বিষয়। কে জানে! ঘটনা যা-ই হোক, কাজে লেগেছিল। গ্রিস থেকে ফোন করে ক্যাথি। একটা প্রস্তাব দেয় বার্কলেকে। চেয়েছিল বেশ কিছু টাকা। ক্যাথি জানত, এখনও এক শ মিলিয়ন ডলার হাতে পায়নি বার্কলে। তাই সহজ কিস্তি দিতে বলে। আপাতত পঁচিশ হাজার ডলার দিলেই হবে। পাঁচ হাজার ছিল আমার ফি। সেজন্যে বার্কলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে একটা বাক্স।
বাক্স?
হ্যাঁ, বাক্স। ছোট। কার্ডবোর্ডের। আকারে এমন। ছয় ইঞ্চি চৌকো জায়গা দেখাল পিছলা। হালকা। জানি না ওটার ভেতরে কী ছিল। জানবই বা কী করে। তবে নাড়লে ভেতরে ঢব-ঢব আওয়াজ হয়েছিল।
তার মানে, ওটা ফোটোগ্রাফ নয়, ভাবল রানা। বোধহয় সেক্সের কোনও ব্যাপারে ব্ল্যাকমেইল করা হয়নি।
স্টিভ বার্কলে ওই বাক্স নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা ঘরে, বলল পিছলা। দাঁড়িয়ে থাকলাম বাইরে। ফড়-ফড় শব্দ করে ছিঁড়ে ভেতরের জিনিস বের করল লোকটা। খুব তাড়া ছিল তার। ভেতরে যা-ই থাকুক, ওটার কারণে কেমন দমে গেল সে। তিরিশ মাইল দৌড়ালে যেমন ঘাম হবে, সেভাবে এল ঘামতে ঘামতে। বলল, পরদিন যেন আবার তার অফিসে যাই। গেলাম পরদিন সকালেই। আমার হাতে তুলে দিল নগদ পঁচিশ হাজার ডলার। আমার ভাগ রেখে বাকিটা পাঠিয়ে দিলাম গ্রিসে ক্যাথির ঠিকানায়।
হঠাৎ দামি হোটেল বা ভিলাতে পার্টি দেয়ার টাকা কোথায় পেল মেয়েটা, বুঝতে পেরেছে রানা। আরও টাকা দাবি করল ক্যাথি, তাই না? জানতে চাইল।
ক্যাথি জানিয়ে দিয়েছিল, বার্কলে এক শ মিলিয়ন হাতে পেলেই দেরি না করে তাকে দিতে হবে দশ মিলিয়ন ডলার। নইলে ফাঁস করে দেবে সব। আমি পাব দশ পার্সেন্ট। সেজন্যে কিছুই করতে হবে না আমাকে। বলতে পারেন। হ্যাণ্ডলিং ফি। কথা থেকে মনে হয়েছিল, ওই চুক্তি মেনে নিয়েছে বার্কলে। নিজের কপাল দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আরে, ভাই, এটাই তো বেশিরভাগ উকিলের জীবনের স্বপ্ন। এমন এক দাও মারবে, পরের চোদ্দ গুষ্ঠির জন্যে আদায় করে নেবে কোটি কোটি টাকা। সব প্ল্যান করে ফেললাম। ইঁদুরের গর্তে আর থাকব না। অভিজাত এলাকায় অফিস নেব। বাকি জীবনে আর কোনও অন্যায় করব না। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিছলা উকিল। কিন্তু কথা পাল্টে ফেলল লোকটা।
সে রাতে পিটিয়ে আপনার নলি ভাঙতে এল তিন লোক।
দুঃখিত চেহারায় মাথা নাড়ল সিম্পসন। গত কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছিল, কে বা কারা যেন অনুসরণ করছে আমাকে। দেখিনি কাউকে। কেমন খারাপ অনুভূতি হতো। তখন থেকেই রিভলভার সঙ্গে রাখলাম। তারপর অফিসে গভীর এক রাতে ডেস্কে বসে কাজ করছি, জানতেও পারলাম ওরা গোপনে এসেছে। হঠাৎ চেয়ার থেকে টেনে মেঝেতে ফেলে দিল তারা। কানের ফুটোয় গুঁজে দিল পিস্তলের নল। আমার পাছায় কষে লাথি দিয়ে একজন বলল, ওটা কোথায়? কই! কী বলছে তাই তো বুঝতে পারলাম না। তারপর জানতে চাইল, কোথায় আছে ক্যাথি হার্বার্ট।
বলে দিলেন।
প্রথমে বলিনি, মাথা নাড়ল পিছলা। আগেও মাঝে মাঝে পিট্টি খেয়েছি বাজে মক্কেলের হাতে। আমি তো আর মুরগি না। সব মেনে নিয়েই বেশ স্বাভাবিকভাবে চুপচাপ পিটি খাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, একটু পর হাল ছেড়ে পোঁদে আরও দুটো লাথি দিয়ে বিদায় নেবে। কিন্তু… তখনই ব্যাগ থেকে বের করল ওগুলো। কী ভয়ানক দেখতে হাতুড়ি! তিন নম্বর লোকটা পিস্তল ধরল মাথার পাশে। অন্য দুজনের একজন চেপে ধরল ডান পা। অন্যজন পাগল হয়ে উঠল আমার পা ভাঙতে। গোটা কয়েক বাড়িতে দুই পা ভেঙে যেতে আমার আর উপায় থাকল না মুখ না খুলে। বলে দিলাম সব। আরে, ভাই, আমার বদলে আপনি হলেও একই কাজ করতেন।
আপনাকে কখনও কোনও ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে কিছু বলেছে ক্যাথি? জানতে চাইল রানা।
অবাক চোখে ওকে দেখল পিছলা। কী ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী? ওই যে যারা বাটপারি করছে নক্ষত্র দেখিয়ে?
ক্যাথি বিবলিকাল আর্কিওলজিস্ট, হয়তো বাইবেলের কোনও ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে, বলল রানা। একজনকে বলেছে, ওই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক টাকা।
আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না, মাথা নাড়ল পিছলা। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে কী করে টাকা পাবে? তবে এটা জানি, কোনওভাবে বাগে পেয়ে গিয়েছিল বার্কলেকে।
বাদ দিন, বলল রানা। বিষয়টা জরুরি না।
টোকা না দিয়েই দরজা খুলল কে যেন। আর্ম চেয়ারে প্রায় লাফিয়ে উঠল পিছলা। খপ করে তুলে নিয়ে দরজার দিকে তাক করল বন্দুক। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, বিপদ হবে না। বন্দুক রেখে আবারও এলিয়ে পড়ল চেয়ারের পিঠে।
দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকল জলি। ওর হাতে ছয় ক্যান বিয়ার। নামিয়ে রাখল বিছানায়। নরম সুরে পিছলাকে বলল, সময় হয়েছে বড়ি খাওয়ার।
দুঃখিত চেহারায় মাথা দোলাল উকিল। মিস্টার রানা, আমার আর কিছু বলার নেই। জলি যদি না থাকত, আজ আপনার সঙ্গে এসব কথাই হতো না।
চেয়ারের পাশে থেমে পিছলার কাঁধে আলতো করে হাত রাখল জলি। অন্যহাতে মুছল ওর চোখের অশ্রু। মেয়েটার বাহুতে মৃদু হাত বোলাচ্ছে ওর প্রেমিক। রানা টের পেল, দুজনের ভেতর রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ সবই আছে, কিন্তু সব ছাপিয়ে আছে গভীর ভালবাসা।
চাইনি আজ ওখানে গিয়ে বিপদে পড়ক জলি, বলল পিছলা। খুব জোর করল ও। খুব সাহসী মেয়ে।
এবার কী করবেন ভাবছেন? জানতে চাইল রানা।
ফকির এক পঙ্গু উকিল আর কী করবে? শেষ হয়ে গেছি আমি।
চিকিৎসা না করিয়ে পড়ে থাকতে পারবেন না এখানে।
আগে আমার কথা ভুলে যাক বার্কলে, নইলে বেরোতে পারব না। অথবা, পুঁকতে ধুঁকতে মরে যাব এখানেই। বাড়ি ফিরতে পারব না। কোথাও যাওয়ার নেই আমার। ওরা যদি খুঁজে পেয়ে যায়, খুন করবে আমাকে। তার চেয়ে মদ গিলে মরে যাওয়া অনেক ভাল। চট করে জলিকে দেখল পিছলা উকিল। ওর দিকে চেয়ে হাসছে মেয়েটা। চোখে অশ্রু। আমি আর কী বলব? করুণ হাসল পিছলা। যেদিন ক্যাথি হার্বার্টের সঙ্গে দেখা হলো, সেদিন থেকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছি কপাল। হারিয়ে বসেছি সব। সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানেন, দুনিয়ার সেরা মেয়েটাকেও হারিয়ে ফেলেছি আমি নিজের দোষে।
আমি তো মাফ করে দিয়েছি তোমাকে, ফিসফিস করে বলল জলি। চুমু দিল পিছলার ঘর্মাক্ত কপালে।
ঘুরে রানার দিকে তাকাল পিছলা। এবার কী করবেন?
দেখা করব মিস ট্রুলির সঙ্গে, বলল রানা।
তার ফোনের নম্বর আছে আমার কাছে, বলল পিছলা।
গুড। মহিলার সঙ্গে আলাপের পর কথা বলব স্টিভ বার্কলের সঙ্গে। ওয়ালেট বের করে একহাজার ডলার পিছলার হাতে দিল রানা। রাখুন।
এত টাকা কীসের জন্যে? জানতে চাইল জলি।
আমি নেব পিছলার রিভলভারটা। কেন যেন মনে হচ্ছে, কাজে লাগবে ওটা।
.
২২.
প্রায় মাঝরাতে গাড়িতে করে হাইন্সভিলে রানাকে পৌঁছে দিল জলি। হ্যাণ্ডশেক করে আন্তরিক হেসে বিদায় নিল। বৃষ্টির রাত, মেয়েটার গাড়ির ব্যাকলাইট দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেতে দেখল রানা, তারপর উঠে পড়ল ক্রাইসলার গাড়িতে। ফিরতি পথে রওনা হলো স্যাভানা লক্ষ্য করে। সিটের পেছনে ক্যানভাস ব্যাগে ঘুমিয়ে আছে পিছলার ফ্রিডম আর্মস্ ৪৭৫ লাইনবাউ হান্টিং রিভলভার ও এক বাক্স হলোপয়েন্ট কার্তুজ।
স্যাভানা শহরের কেন্দ্রে পৌঁছে সাধারণ মানের এক হোটেলে উঠল রানা। ডিনার সেরে নিজের ঘরে ফিরে বসল জানালার সামনে। একটু দূরে কুচকুচে কালো স্যাভানা নদী, তার বুকে নৌকায় জ্বলছে বাতি।
ভীষণ পরিশ্রান্ত রানা, অথচ ঘুম আসছে না। আনমনে ভাবছে গত কয়েক দিনের কথা।
গ্রিসে সব ছিল অস্পষ্ট। এখন তা হয়ে গেছে আরও ঘোলাটে। বেড়ে গেছে ঝুঁকির পরিমাণ। নোংরা হয়েছে। দৃশ্যপট। একেকটা টুকরো জোড়া দিতে গিয়ে বুঝতে পারছে, সম্ভাবনা খুব কম যে এখনও বেঁচে আছে ক্যাথি।
রানা এখন জানে সেই ক্ষমতাশালী লোকটার নাম, যে কিনা হুমকির মুখে পড়েছিল বলে নিয়েছে কঠোর ব্যবস্থা। এক শ মিলিয়ন বিশাল অঙ্কের অর্থ। তার ওপর জর্জিয়ার গভর্নর হলে আর কী চাই! এখানেই থামতে হবে, এমনও নয়। ভবিষ্যতে ওই লোক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে না, তাই বা কে বলতে পারে!
এখন পরিষ্কার, কেন ক্যাথির অ্যাড্রেস বুকে ছিল স্টিভ বার্কলের নাম। কীভাবে এবং কেন তাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল ক্যাথি, সে রহস্য এখনও জানা যায়নি। কিন্তু একটা কথা ঠিক: অনেক বেশি চেয়ে বসেছিল মেয়েটা। দশ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ইচ্ছে ছিল না লোকটার। কাজেই বেঁকে বসেছে। তার দিক থেকে দেখলে, বিশেষ কোনও কারণ নেই ক্যাথিকে বিশ্বাস করবার। হয়তো দিয়েই দিল দশ মিলিয়ন ডলার। তারপর? আবারও চাপ দেয়া হবে না, এমন কথা দিচ্ছে কে? হয়তো দশ বছর পর আরও দশ মিলিয়ন ডলার চাইবে ক্যাথি। ফতুর করে ছাড়বে তাকে। একবার মানুষের লবণাক্ত মাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘের মত মুখিয়ে থাকত ক্যাথি।
এই চরম হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়, চিরকালের জন্যে ক্যাথি হার্বার্টকে বিদায় করে দেয়া। চুকে যাবে সব ঝামেলা। স্বাভাবিকভাবেই ওর প্রাণের চেয়ে দশ মিলিয়ন ডলারকে অনেক বেশি মূল্যবান মনে করবে বার্কলে।
বাকি থাকে পিছলা উকিল। বার্কলে জানে, ছেঁড়া সুতোর আরেক প্রান্ত সে। প্রথমবার খতম করতে পারেনি তার লোক। কিন্তু আগে হোক বা পরে, পিছলাকে বাগে পাবে তারা। এ কথা পিছলাও জানে। যারা মুখ খুলতে পারে, এমন কাউকে বাঁচতে দেবে কেন বার্কলে? প্রথমে চিরকালের জন্যে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে ব্যানাটসের। তারপর মউরোসের।
সব পরিষ্কার হয়ে উঠছে রানার কাছে।
এখন স্টিভ বার্কলেকে শেষ না করলে, আসবে ওর ওপর হামলা। সেক্ষেত্রে প্রাণে বাঁচবে, এমনও নয়। এক শ মিলিয়ন ডলারের হাজারভাগের মাত্র এক ভাগ দিয়েই নামকরা সব খুনি ভাড়া করতে পারবে ওই লোক।
কালো নদীর দিকে চেয়ে চুপচাপ ভাবছে রানা।
ওর মনে পড়ল জন হার্বার্ট ও তাঁর স্ত্রীর কথা। তাঁদেরকে কোন্ মুখে বলবে, ধরে নিন, মারা গেছে আপনাদের মেয়ে!
চিন্তার জট দূরে সরাতে চাইল রানা। এসব ভাববে পরে। প্রথম কাজ হওয়া উচিত স্টিভ বার্কলের কাছে পৌঁছুনো।
.
পরদিন ভোর এল আগুনের মত তাপ ও আলো নিয়ে। নাস্তা সেরে সকাল নয়টায় পিছলা উকিলের দেয়া নম্বরে মিস ট্রুলির বাড়িতে ফোন দিল রানা।
কবরের গভীর থেকে যেন এল এক গম্ভীর কণ্ঠ: এটা মিস ট্রুলির বাড়ি।
রানা ব্যাখ্যা দিল: ও হার্বার্ট পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাওয়ার পথে স্যাভানা শহরে থেমেছে। একবার দেখা করবে মিস ট্রুলির সঙ্গে।
এই কথায় নরকের ফেরেশতার মত গমগমে কণ্ঠে রানাকে অপেক্ষা করতে বলল ওই লোক।
কিছুক্ষণ পর ফোনে এলেন মেরিয়ান ট্রুলি। তাঁর দুএক কথা শুনেই তাকে পছন্দ করে ফেলল রানা। শক্ত চিত্তের মানুষ তিনি। অথচ বুকে বইছে সবার জন্যে ভালবাসার ফল্গুধারা। জানালেন, খুব খুশি হয়েছেন যে হার্বার্ট পরিবারের এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, রানার কি সময় হবে তাঁর সঙ্গে একটু কফি খাওয়ার? খুব খুশি হবেন সকাল এগারোটার পর ট্রলি ভবনে এলে।
বাকি সময় পুরনো শহরটা ঘুরে দেখল রানা। কিনল সাধারণ কিন্তু রুচিশীল কিছু পোশাক। হোটেলে ফিরে পাল্টে নিল বাসি জামা। ওর পরনে থাকল কালো জিন্স, সাদা শার্ট ও কালো জ্যাকেট। ক্রাইসলার চালিয়ে হাজির হলো মিস ট্রুলির বাড়িতে।
সাধারণ বাড়ি নয়, রাস্তা থেকে দেখা যায় না কলোনিয়াল আমলের বিশাল ম্যানশন। চারপাশের বাগানে ফুটেছে হাজারো ফুল। ফলের গাছও কম নেই। গাড়ি রেখে ম্যানশনের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাল রানা। হাসি-হাসি মুখে দরজা খুলল এক লোক। তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে সে চড়ুই পাখির খালাত ভাই। কিন্তু গলা তার ভীষণ গম্ভীর। এই লোকই ধরেছিল রানার ফোন। হাতের ইশারায় ওকে বাড়িতে ঢুকতে বলল সে।
ছক কাটা মার্বেলের মেঝের চওড়া এক এন্ট্রান্স হলে পা রাখল রানা। দেয়ালে দেয়ালে সোনারঙ ফ্রেমে বাঁধানো সব পোট্রট।
আপনার ব্যাগটা সরিয়ে রাখতে পারি? জানতে চাইল ইংলিশ বাটলার।
আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গেই থাকুক, বলল রানা।
সকাল এগারোটা বাজে, ঢং-ঢং করে জানিয়ে দিল এক গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়ি। রানাকে ড্রইংরুমের দরজায় নিয়ে এল বাটলার। নক করল একবার। তারপর খুলল দরজা। সরে দাঁড়িয়ে বলল, ইনি মিস্টার রানা। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, ম্যাম।
চেয়ার ছেড়ে উঠে রানার দিকে এগিয়ে এলেন মিস মেরিয়ান ট্রুলি। চেহারায় আভিজাত্য। টানটান মেরুদণ্ড। বয়স পঁচাত্তর থেকে আশি। তবুও সুন্দরী। ত্বকে ভাঁজ পড়েনি। মিষ্টি হাসি। দাঁত নিখুঁত। মাথাভরা চুল রুপালি। পরনে নামকরা দর্জির তৈরি সিল্কের ব্লাউয ও কালো স্কার্ট। এখানে-ওখানে শোভা পাচ্ছে দামি মুক্তো। হাত বাড়িয়ে দিলেন রানার দিকে। জানালা দিয়ে আসা রোদে ঝিলিক দিল হীরার আঙটি। ওটার দাম কমপক্ষে দুই লাখ ডলার।
খুব খুশি হলাম পরিচিত হতে পারে, মিস্টার মাসুদ রানা।
দয়া করে আমাকে রানা বলেই ডাকবেন। রানা।
সুন্দর নাম।
ওই নামেই ডাকে পরিচিতরা।
হাতের ইশারায় রানাকে আরামদায়ক সোফা দেখালেন মিস ট্রুলি। একবার তাকালেন বাটলারের দিকে। চড়ুই পাখি চলে গেল কফি আনতে। নিজে মহিলা বসলেন ষোলোতম লুই-এর আমলের এক সেটিতে। ওটার নিচে শুয়ে আছে ছোট এক সাদা পিকিনিজ কুকুর। সন্দেহের চোখে রানাকে দেখে ঘড়-ঘড় আওয়াজ তুলল ওটা।
আপনার বাড়িটা চমৎকার, বলল রানা।
বলার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। এই বাড়ি আছে আমাদের পরিবারে স্বাধীনতার আগে থেকে। মিষ্টি হাসলেন মহিলা। তা হলে আপনি হার্বার্ট পরিবারের বন্ধু? তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন রানাকে।
মৃদু মাথা দোলাল ও। তারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আপনাকে।
ভাল মানুষ তাঁরা, বললেন মেরিয়ান ট্রুলি, অক্সফোর্ড শহরটাও চমৎকার। আগামী আগস্টে হয়তো আবারও ওখানে যাব গ্রীষ্মকালীন স্কুলে পড়াতে।
শুনেছি আর্কিওলজির বিষয়ে খুব আগ্রহ আপনার।
কথা ঠিক, বললেন মিস ট্রুলি। ওই জন্যেই পরিচয় হয় ক্যাথির সঙ্গে। খুব প্রতিভাশালী মেয়ে। বুদ্ধিও তেমন। তবে একটু মাথা গরম। এতটা পাগলামি না করাই ভাল।
প্রায় সবাই ওই একই কথা বলে ওর ব্যাপারে।
শেষ কবে দেখা হয়েছে আপনার সঙ্গে ওর?
যখন এতবড় ছিল, মেঝে থেকে তিন ফুট ওপরে হাত তুলে দেখাল রানা।
মুচকি হাসলেন মহিলা। তার মানে, আপনাকে কখনও প্রেমিক হিসেবে নেয়নি ক্যাথি?
না। পরে জেনেছি, দারুণ সুন্দরী হয়েছে ও।
চুপ হয়ে গেছেন মেরিয়ান ট্রুলি।
রানা টের পেল, মহিলার চোখে কীসের এক স্বস্তি।
কী পেশায় আছেন আপনি, মিস্টার রানা?
ছোটখাট একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাই।
বাহু, গুড! উপকার করছেন মানুষের। আবারও মিষ্টি হাসলেন মিস ট্রুলি। তো, উঠেছেন কোথায়?
হোটেলের নাম জানাল রানা।
তাতে মাথা নাড়লেন তিনি। না, ওখানে থাকবেন কেন? প্রিয, চলে আসুন আমার গেস্টহাউসে।
আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না, বলল রানা।
বিরক্ত হব কেন? অতিথিদের জন্যে এ বাড়ির পেছনে আছে গেস্টহাউস। কোনও সমস্যা হবে না আমার।
তিনি জোর করছেন দেখে বলল রানা, অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের কিছু নেই। আমার লোক গিয়ে নিয়ে আসবে হোটেল থেকে আপনার লাগেজ।
ক্যানভাস ব্যাগ দেখাল রানা। আর কিছু নেই।
হেসে ফেললেন মিস ট্রুলি। বেড়াতে যাওয়ার সময় একেবারেই মালপত্র নেন না দেখছি। লাঞ্চ আর ডিনার আজ আমাদের সঙ্গে করবেন। …ঠিক আছে?
আরও কেউ থাকবে?
শুধু আমি আর বার্কলে। এই বাড়িতে নিয়মিত আসে ও। আপনজন হয়ে গেছে।
ওঁর নাম স্টিভ বার্কলে? স্বাভাবিক সুরে বলল রানা।
হ্যাঁ। তা হলে আগেও শুনেছেন ওর নাম?
কে না শুনেছে তাঁর নাম।
তা হলে বোধহয় পড়েছেন ওর বই? জানতে চাইলেন মহিলা।
পড়ার সময় করে উঠতে পারিনি।
এক্ষুণি একটা দিচ্ছি। ছোট্ট রুপালি বেল বাজালেন মিস ট্রুলি। ঘরে ঢুকল সুন্দরী এক কৃষ্ণাঙ্গিনী। তার দিকে চেয়ে হাসলেন মহিলা। পরিচয় করিয়ে দিলেন রানা ও মেয়েটির। রানা, ও আমার হাঁউসকিপার, শেলি। মেয়েটার দিকে ফিরলেন তিনি। মিস্টার বার্কলের একটা বই এনে দেবে লাইব্রেরি থেকে?
জী, এক্ষুণি এনে দিচ্ছি, মাথা দুলিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল মেয়েটা।
চকচক করছে মিস ট্রুলির দুচোখ। উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন, পড়লেই বুঝবেন কত বড় লেখক। বদলে যারে আপনার জীবন। বোধহয় জানেনও না, গভীর এক রাতে ঘুমের ভেতর বার্কলেকে দেখা দিয়েছিলেন যিশুর শিষ্য, দূত ও বাইবেলের প্রচারক সন্ত জন।
আপনার কথায় এখন মনে হচ্ছে, অনেক আগেই বইটা পড়া উচিত ছিল, বলল রানা।
কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকল শেলি। হাতে বড়সড় একটা হার্ডব্যাব বই। ওটা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে মিস ট্রুলির হাতে দিল মেয়েট। মৃদু হেসে ওকে বিদায় করলেন মহিলা। রানার হাতে ছিলেন মহাভারতের মত মোটা বইটা।
মিস ট্রুলিকে ধন্যবাদ দিয়ে ওটা কোলে রাখল, রানা। প্রচ্ছদে সোনালি, পুরু অক্ষরে লেখা:
আমার সঙ্গে কথা বলেছেন সন্ত জন।
স্টিভ বার্কলে
দরিদ্র আর বঞ্চিত সব পরিবারকে বিনে পয়সায় এই বই দেয় বার্কলে, প্রশংসা করতে গিয়ে ঝিকমিক করছে মহিলার চোখ। সত্যিকারের ভালমানুষ।
কাভার উল্টে লেখকের ভূমিকায় চোখ রাখল রানা। পড়ছে ঝড়ের বেগে।
স্টিভ বার্কলে লিখেছে:
আজ থেকে দশ বছর আগে, শেষ করেছি এই পাণ্ডুলিপি। কখনও ভুলব না সেই স্বর্গীয় মুহূর্ত। একে একে এই পাণ্ডুলিপি দিয়েছি আমেরিকার সব প্রকাশকের কাছে। কিন্তু প্রকাশ করেনি তারা কেউ। জানতাম, এমনই হবে। আগেই এটা বলেন সন্ত জন। মন শক্ত করে নামতে হবে কাজে। হাল ছাড়লে চলবে না। প্রকাশ করতেই হবে এই বই। তাঁকে কথা দিয়েছি, তাই প্রথমে বিক্রি করেছি নিজের গাড়ি। এরপর বিক্রি করেছি বাড়ি। আর যা ছিল, বিক্রি করেছি সবই। রাত কাটত পুরনো এক ট্রেইলারে। প্রকাশনা সংগঠন গড়তে ব্যয় করেছি প্রতিটি সেন্ট। আর আজ, প্রিয় পাঠক, সন্ত জনের জ্ঞানের বইটি আপনার হাতে। তিনি যা বলেছেন, সত্য হয়েছে প্রতিটি কথা। বইটি বিক্রি হয়েছে লাখ লাখ কপি। পরের বছর প্রকাশকরা হাত-পা চেপে ধরল স্বত্ব পাওয়ার জন্যে। এই বইয়ের মাধ্যমে সন্ত জনের অমিয় বাণী ছড়িয়ে পড়েছে এ দেশের এক কোটি বিশ লাখ নাগরিকের মধ্যে। শুধু তা-ই নয়…
কী বুঝছেন, রানাঃ আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন মিস ট্রুলি।
বার্কলে মহা ধড়িবাজ, ভাবছে রানা। মুখে বলল, পড়ার মত একটা বই।
এটা আপনাকে দিলাম, খুশি হয়ে বললেন মিস ট্রুলি। অনেকগুলো আছে আমার কাছে।
অনেক ধন্যবাদ, ম্যাম। প্রতিটি অক্ষর পড়ব। আগ্রহী হয়ে উঠেছি লেখকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে।
ঝিলিক দিল মিস ট্রুলির চোখ। দেখা হওয়াটাই ছিল আপনাদের নিয়তির লিখন। বুঝতে পারছি, দারুণ সময় কাটবে বার্কলে আর আপনার।
পথ দেখিয়ে গেস্টহাউসে রানাকে নিয়ে এল শেলি। বাড়িটা ম্যানশনের পেছনে। একতলা কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট। প্রতিটাতে দুটো বেডরুম, কিচেন, বাথরুম, লিভিংরুম এবং একটি করে ডাইনিংরুম। আসবাবপত্র দেখার মত অভিজাত। একা হওয়ার পর ফোর-পোস্টার খাটে ব্যাগ রেখে লিভিংরুমে ফিরল রানা। ফ্রেঞ্চ জানালা দিয়ে দেখল প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বাগান। আরও সুন্দর লাগছে পাম গাছ ও স্প্যানিশ মসের উপস্থিতির কারণে। ফুলের সব বেডে নানান রঙের অসংখ্য গোলাপ।
রাজকীয় পরিবেশে ভাবল রানা, প্রতারক বার্কলের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হলো হাসিখুশি, অমায়িক, বিত্তশালিনী মেরিয়ান ট্রুলির?
লোকটা আসলে কেমন?
চট করে হাতঘড়ি দেখল রানা।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর জানবে লোকটা আসলে কেমন।
.
২৩.
বিছানায় উঠে বসেছে ক্যাথি হার্বার্ট। কোলে অলস দুই হাত। ছাত ভেদ করে বহু দূরে চোখ। খাটের পাশের প্লাস্টিক চেয়ারে বসে প্যাডে নোট নিচ্ছে ডাক্তার। বেশিরভাগ সময় এ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকে না অন্য কেউ। বরাবরের মতই নরম সুরে প্রশ্ন করছে লোকটা।
তোমার কবজিতে খুব সুন্দর ব্রেসলেট, ক্যাথি। ওটা কি আসল সোনার?
ডানহাত তুলে চকচকে ব্রেসলেট দেখল ক্যাথি। মনেই ছিল না ওটা ওর কাছে আছে। সোনার বলেই তো মনে হচ্ছে, সন্দেহ নিয়ে বিড়বিড় করল। কী ধরনের প্রশ্ন করবে ডাক্তার, সব মুখস্থ হয়ে গেছে ওর। কঠোর কোনও কথা বলবে না। সরাসরি কোনও প্রসঙ্গ তুলবে না। লোকটা যেন। ঘেঁটে দেখতে চায় ওর মগজ। মাঝে মাঝে মনে হয়, চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে যায় ও। মরুক ডাক্তার লোকটা। ঘৃণা জাগে অন্তরের গভীর থেকে। কিন্তু ডাক্তারের নরম কথা আর চোখ জানিয়ে দেয়, সে ওর শুভানুধ্যায়ী। মনটা চায় তাকে বিশ্বাস করতে। আবার মনের আরেক অংশ সতর্ক করে, ভুলেও একে বিশ্বাস কোরো না। তুমি এদের হাতে বন্দি। তোমাকে কিডন্যাপ করেছে এরা। যদিও মনে হয়, সত্যিই ওকে সাহায্য করতে চায় নোকটা।
অ্যান্টিক মনে হচ্ছে, বলল ডাক্তার। মনে আছে ওটা কোথা থেকে পেয়েছ?
না, জানা নেই কোথা থেকে পেয়েছি। কত দিন ধরে আমার কাছে আছে, তা-ও জানি না।
কাছের কেউ দিয়েছে হয়তো, বলল ডাক্তার, এমন কেউ, যে কিনা ভালবাসে তোমাকে। হয়তো আত্মীয় তিনি। বলো তো, তোমার পরিবারের কথা।
মনের আয়নায় দেখি কিছু মুখ। মনে হয় তারা আমার বাবা-মা।
মাথা দোলাল ডাক্তার। তা হলে তো বহু দূর এগোতে পেরেছ। এরপর দেখবে হঠাৎ অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে।
সবই মনে পড়বে?
তোমার যেটা হয়েছে, ওটাকে বলে পোস্ট-ট্রমাটিক রেট্রোগ্রেড অ্যামনেযিয়া, বলল ডাক্তার। অস্থায়ীভাবে হয় এসব স্মৃতিবিভ্রম। কত দ্রুত আরোগ্য হবে, সেটা নির্ভর করে আঘাতের ওপর। খুব জোরে মাথায় আঘাত লেগেছিল। তবে এর চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থাও দেখেছি, সেরে গেছে। ব্রিফকেস তুলে ওটা থেকে একটা বই বের করল সে। দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখাব তোমাকে।
বইটাকে পাত্তা না দিয়ে নিস্পৃহ সুরে বলল ক্যাথি, আমি কোথায় আছি? ডাক্তারকে কতবার এই একই কথা জিজ্ঞেস করেছে, ভাবতে গিয়ে হাঁফ লেগে উঠল ওর।
বরাবরের মত একই জবাব দিল ডাক্তার, এমন এক জায়গায়, যেখানে ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।
লোকটার অস্বস্তি টের পায় ক্যাথি। আমাকে নিয়ে কী করা হবে? চোখ রাখল সরাসরি ডাক্তারের চোখে। গাল বেয়ে নামল অশ্রু ধারা।
অন্যদিকে তাকাল ডাক্তার। আমরা ফিরিয়ে আনব তোমার স্মৃতি।
তারপর কী হবে? আমি স্মৃতি ফেরত পেলে, তখন?
আস্তে করে বইটা বিছানায় রাখল ডাক্তার। আগে এদিকে মন দাও, ঠিক আছে?
বইটার দিকে তাকাল ক্যাথি। নানান জাতের কুকুর নিয়ে লেখা। রঙিন ছবিও আছে ভেতরে। এটা দিয়ে কী হবে?
তুমি বলেছিলে, বাড়িতে তোমার একটা কুকুর ছিল। এসো, খুঁজে দেখি কোন্ জাতের কুকুর ওটা।
তাতে কী লাভ?
ছবি দেখতে গিয়ে হয়তো মনে পড়বে অন্য কোনও স্মৃতি। মগজ সবসময় কাজ করে অবচেতন মনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। একটা স্মৃতির লেজ ধরে আসে আরেকটা। যদি বের করতে পারো কোন্ জাতের কুকুর তোমার, হয়তো চট করে মনে পড়বে ওটার নাম। পরক্ষণে হয়তো আসবে সাগর সৈকতের কোনও স্মৃতি। ধরে নিতে পারো, চালু হয়ে গেছে মগজ। কে জানে, পরের দিন হয়তো আলোকিত হয়ে উঠবে মনের পর্দা। বুঝতে পেরেছ?
বুঝতে পেরেছি, প্রায় ফিসফিস করল ক্যাথি।
একটা একটা করে পাতা ওল্টাতে লাগল ডাক্তার। এবার দেখা যাক। তোমার কুকুরটা দেখতে এমন ছিল? ল্যাব্রাডর দেখাল সে।
ভুরু কুঁচকাল ক্যাথি। আমারটা এত বড় ছিল না।
ঠিক আছে, তা হলে দেখি ছোট কুকুরের ছবি। এই যে আরেকটা। কিংস চার্লস স্প্যানিয়েল। তোমারটা এমন?
মাথা নাড়ল ক্যাথি। না।
তা হলে এটা?
না, এটাও না।
আরেক পৃষ্ঠায় গেল ডাক্তার।
একমিনিট! বলে উঠল ক্যাথি। এইটাই!
এটা? আঙুল দিয়ে দেখাল ডাক্তার। ওয়েস্ট হাইল্যাণ্ড হোয়াইট টেরিয়ার।
ছবিটা পরিষ্কার চিনতে পেরেছে ক্যাথি। ছোট, সাদা কুকুর। ও-ই জিনিসই ছিল ওর। এটাই আমার কুকুর।
গুড, হাসল ডাক্তার, ভাল উন্নতি হয়েছে তোমার, ক্যাধি।
তা হলে এবার কি ছেড়ে দেবেন আমাকে?
কয়েক দিনের ভেতর, বলল ডাক্তার।
কত দিন?
এখনও বলতে পারছি না। সব নির্ভর করে তোমার উন্নতির ওপর।
আসলে কী মনে পড়তে হবে আমার? জানতে চাইল ক্যাথি। চড়ে যাচ্ছে কণ্ঠস্বর। এটা তো কোনও থেরাপি মনে হচ্ছে না। আটকে রাখা হয়েছে আমাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এতই গুরুত্বপূর্ণ কী থাকতে পারে, যে কারণে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে আমাকে বেআইনীভাবে?
এসব কথার জবাব নেই ডাক্তারের কাছে। এসো, এক ধাপ করে এগোতে শুরু করি আমরা, ঠিক আছে?
সেশন শেষ হওয়ার পর ক্যাথিকে ঘরে একা রেখে বেরিয়ে গেল ডাক্তার। পেছনে দরজায় তালা মেরে দিল গার্ড। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডাক্তার মাল্ডুন। ভাবছে: আমি ডাক্তার। আমার কাজ মানুষকে সাহায্য করা। অথচ, যা করছি, সেটা একদম ভুল কাজ। কোন্ আক্কেলে জড়িয়ে গেলাম এসবে?
মিস্টার অ্যামেট চাইছেন তাঁর অফিসে গিয়ে দেখা করবেন আপনি, জানাল গার্ড।
পরে, বলল ডাক্তার।
এখনই যেতে বলেছেন।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডাক্তার। ঝুঁকে গেল দুকাঁধ। তিন মিনিট পর হাজির হলো ওই লোকের অফিসে। দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকল ভেতরে। ঘরটা ছোট ও চৌকো। কংক্রিটের ন্যাড়া দেয়াল ও মেঝে। অ্যামেটের ডেস্কে একটা কমপিউটার ও ফোন ছাড়া আর কিছুই নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে লোকটা। ঠোঁটে টিটকারির বাঁকা হাসি।
দিন দিন তার প্রতি বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা বাড়ছে ডাক্তারের। সুযোগ পেলে এক ঘুষিতে বদমাশটার নাক-মুখ ভর্তা করে দিত। কিন্তু তারপর কী হতো, সেটাও ভাল করেই জানে। কী জন্যে ডেকেছেন?
ভাল কোনও খবর আছে? জানতে চাইল অ্যামেট।
দ্বিধায় পড়ল ডাক্তার। যা চান, তেমন কোনও তথ্য এখনও পাইনি।
হুম, মাথা দোলাল অ্যামেট। আমিও তা-ই ভেবেছি। মনে করি না আপনার এই থেরাপি দিয়ে কোনও কাজ হবে। আপনার কী মনে হয়?
কাজ হচ্ছে না, তা ঠিক বলা যায় না। তা ছাড়া, থেরাপি শুরু করেছি আমরা মাত্র কয়েক দিন আগে।
আপনি বোধহয় জানেন না, কী ধরনের ঝামেলায় আছি আমরা, ডক্টর মান। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মূল্যবান।
কিন্তু আপনি তুড়ি মারলেই তো আর সারবে না সিভিয়ার রেট্রোগ্রেড অ্যামনেযিয়া। ওর গোট রেযা আগের চেয়ে ভাল হচ্ছে।
গোট আবার কী? ধমকে উঠল অ্যামেট।
গ্যালভেস্টন ওরিয়েন্টেশন অ্যাণ্ড অ্যামনেযিয়া টেস্ট, নিজেকে শান্ত রাখতে গিয়ে হিমশিম খেল ডাক্তার।
মেডিকেল বিদ্যার নামে পাগলামি ঝাড়বেন না আমার ওপর। ওই মেয়ে ডাহা মিথ্যা বলছে।
পলিগ্রাফ রেযাল্ট আপনিও দেখেছেন।
সবসময় সঠিক হয় না লাই ডিটেক্টর। আপনি নিজেও এটা জানেন।
আমার কথা মন দিয়ে শুনুন, বিরক্তি চাপতে পারল না ডাক্তার। আমরা সফল হওয়ার খুব কাছে পৌঁছে গেছি। হয়তো আর কয়েক দিনে সুস্থ হয়ে উঠবে মেয়েটা। বড়জোর এক বা দুই সপ্তাহ। এরই ভেতর ফিরবে ওর সব স্মৃতি।
মাথা নাড়ল অ্যামেট। কেন যেন মনে হচ্ছে, ইচ্ছা করে দেরি করিয়ে দিচ্ছেন আপনি।
তা করছি না।
হ্যাঁ, তা-ই করছেন, ওই কুত্তীর প্রতি অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। সময় পাইয়ে দিচ্ছেন তাকে। একটা কথা মাথায় গেঁথে নেন, আপনাকে পয়সা দেয়া হচ্ছে সহানুভূতি দেখানোর জন্যে নয়। ফলাফল পাওয়ার জন্যেই দেয়া হচ্ছে কাড়ি-কাঁড়ি টাকা। অথচ, কোনও কাজেই আসছে না আপনার ফালতু বকবকানি চিকিৎসা। অনেক ধরনের সুবিধা করে দিয়েছি আপনাকে। কোনওদিকে কম দিইনি। আপনার কথায় রঙ করা হয়েছে ওপরের পুরো ফ্লোর, দিয়েছি হারামজাদীকে আরামদায়ক ঘর। আপনার কথায় নরম আচরণ করেছি আমরা। কোনও চাপ দেয়া হয়নি। কিন্তু ধৈর্যেরও সীমা আছে। সেটা মাথায় রাখবেন।
মাথা নিচু করে নিজের পায়ের দিকে চেয়ে আছে ডাক্তার ডিক মান। মুঠো করে ফেলেছে হাতদুটো। তা হলে কী করতে বলেন আপনি?
চাপ দিন কুত্তীটাকে। নানান উপায়ে।
কী ধরনের চাপ?
কাঁধ ঝাঁকাল অ্যামেট। যাতে কাজ হয়, সেই পথটা বের করুন। কী করবেন, সেটা নিয়ে আমার মাথা-ব্যথা নেই।
আপনি নির্যাতনের কথা বলছেন?
আবারও কাঁধ ঝাঁকাল অ্যামেট। আগেই বলেছি, কাজ হলো কি না, সেটাই বড় কথা।
অবাক চোখে তাকে দেখল ডাক্তার। আপনি সিরিয়াস? ওই মেয়ে কিন্তু রোগিণী।
চুপ করে শীতল চোখে ডাক্তারকে দেখছে অ্যামেট।
আপনারা এখন চাপ দিলে ওর স্মৃতি তলিয়ে যাবে আরও গভীরে, বলল ডাক্তার মাল্ডুন। মানসিক পতন হবে ওর। তা ছাড়া, আমার কাছে এমন কিছু নেই, যেটা দিয়ে ওর ওপর নির্যাতন চালাতে পারি। ওই জঘন্য কীর্তির জন্যে আমাকে ভাড়া করেননি আপনারা।
যা বলব, সেটাই করবেন, কঠোর সুরে বলল অ্যামেট। এবার দেখুন, কীভাবে ওই কুত্তীর কাছ থেকে বের করা যায় তথ্য। ডেস্ক থেকে একটা কাগজ নিয়ে ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিল সে।
দ্রুত পড়ল ডাক্তার। কাগজে লেখা মাত্র একটা নাম। এমন এক কেমিকেল, যেটা ব্যবহার করা হয় না মেডিকেল প্র্যাকটিসে। চমকে গেছে ডিক মাল্ডুন। আপনারা কি মেয়েটাকে ওই জিনিস দেবেন? কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন না ওটা দেয়ার। এক্সপেরিমেন্টাল কেমিকেল। সম্পূর্ণ বেআইনী।
প্রয়োজনে ব্যবহার করব ওর ওপর, নরম সুরে বলল অ্যামেট, মন দিয়ে শুনুন, সোডিয়াম পেন্টোখালের চেয়ে অনেক গভীরে গিয়ে কাজ করে এই জিনিস।
আমি এতে রাজি নই।
যা বলব, তাই করবেন, নইলে বিপদ হবে আপনার। কঠোর চোখে ডাক্তারকে দেখল অ্যামেট। এতে বেশি কাজ হবে, কথা কি ঠিক?
হায়ার কর্টিকাল ফাংশান দমিয়ে দিয়ে অসতর্ক করে, বিড়বিড় করল ডাক্তার। থিয়োরি অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টুথ সিরাম এটা। কিন্তু…
আমিও তা-ই শুনেছি।
তবে সন্ত্রাসী বা ভয়ঙ্কর হত্যাকারী ছাড়া কেউ ব্যবহার করে না এই কেমিকেল, বলল ডাক্তার। আমাদের মনে রাখা উচিত, এটা আমেরিকা, সিয়েরা লিয়োন নয়।
হলদে বড় বড় দাঁত বের করে হাসল অ্যামেট।
ওই কেমিকেলের সাইড এফেক্ট সম্পর্কে কিছু শুনেছেন?
জবাব দিল না অ্যামেট।
পঁচানব্বই ভাগ সম্ভাবনা, ওটা ব্যবহার করলে চিরকালের জন্যে বদ্ধ-উন্মাদ হবে যে-কেউ। ল্যাবে চিম্পাঞ্জির ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে। ভয়ানক কষ্ট পেয়ে পাগল হয়। আপনি চান ওই মেয়ের ওপর ওটা প্রয়োগ করতে? মগজটা হয়ে যাবে চিনাবাদামের সমান। বাকি জীবন পড়ে থাকবে মানসিক হাসপাতালে।
আস্তে করে মাথা দোলাল অ্যামেট। তাতে আপত্তি তুলব না, যদি আগে ওর পেট থেকে বের করতে পারি সব তথ্য।
তথ্য পাওয়ার জন্যে এত বড় ক্ষতি করবেন যুবতী একটা মেয়ের?
অবশ্যই। যাদের হয়ে কাজ করছি, ওই তথ্য তাদের কাছে খুবই জরুরি।
তা হলে অন্য কোনও ডাক্তারের সাহায্য নিন। আমি এসবে জড়াব না।
আপনার সেই সুযোগ আছে ভাবছেন?
এর জবাব দিতে তৈরি নই। ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াল ডাক্তার মাল্ডুন। কিন্তু পিছনে ধাতব ক্লিক আওয়াজে আবারও ঘুরল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুজন।
ডাক্তারের মাথায় পিস্তল তাক করেছে লোকটা। অন্য হাতে ফোনের রিসিভার। ফোন দেবেন, ডাক্তার। জোগাড় করবেন ওই সিরাম। ব্যবহার করবেন আপনার প্রিয় রোগিণীর ওপর। তারপর দেখব, কার কথা ঠিক।
মাথা নিচু করে নিল ডাক্তার। ক্ষমতা নেই বিদ্রোহ করবে। হাত-পা বাঁধা। ঠিক আছে, কাঁপা গলায় বলল, জোগাড় করতে পারব। কিন্তু প্রেসক্রিপশনে লেখার অধিকার নেই। ওই জিনিস হাতে পাওয়ার জন্যে লাগবে কয়েক দিন।
তাতে চলবে না, বলল অ্যামেট। অধৈর্য হয়ে উঠেছেন আমার এমপ্লয়ার। হাতঘড়ি দেখল সে। সিরাম হাজির করবেন আগামীকাল রাতেই।
আগামীকাল রাত!
না পারলে দেখবেন কীভাবে হাত-পা ভেঙে ওই মেয়ের পেট থেকে বের করি সব কথা। তারপর আপনার চোখে গেঁথে দেব একটা বুলেট। নিষ্ঠুর হাসল ক্যাল অ্যামেট। কী করবেন, সেটা ঠিক করবেন আপনিই।
.
২৪.
বিকেলটা মিস ট্রুলির গেস্টহাউসের ফোর-পোস্টার বেডে শুয়ে স্টিভ বার্কলের বই ঘাটল রানা। ওর কাছে পরিষ্কার হলো দুটো ব্যাপার।
প্রথম: বাইবেল প্রচারক সেন্ট জনের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। আলাবামার গরিব এক যাজক। এমনটা হয়েছে, কারণ কয়েক বছর আগে গভীর রাতে তাকে স্বপ্নে দেখা দেন যিশুর শিষ্য জন। জানান, সামনে ভয়ঙ্কর সময়। সতর্ক হতে হবে ধার্মিক মানুষকে। সহজভাবে লেখা হয়েছে বইটি, মুগ্ধ হবে সরল মনের যে-কেউ। বইয়ের শেষপাতায় একটা স্লিপ। বার্কলে ফাউণ্ডেশনে অনুদান দিতে পারবে যে-কেউ। এবং বইয়ের লেখক যেন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, সেজন্যে তৈরি করা হয়েছে ওই সংগঠন।
দ্বিতীয় কথা, বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট-এর বুক অভ রেভেলেশন-এর ওপর নির্ভর করে লেখা বার্কলের বই। বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে ধ্বংস হবে মানবজাতি। বহুবার এসেছে বাইবেলের ওই অংশের উদ্ধৃতি। বইটি লেখাই হয়েছে কোটি কোটি বিশ্বাসী খ্রিস্টানের জন্যে। বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছে আমেরিকার নাগরিকদের প্রতি। তাদের ধারণা, সময় এসেছে পৃথিবী ধ্বংসের। সামনেই মহাপ্রলয়।
বাইবেল ভেজে খেয়েছে স্টিভ বার্কলে।
লেখনিতে আন্তরিক একটা ভঙ্গি। বক্তব্য স্পষ্ট।
গোটা দুনিয়ায় চলছে অন্যায়। খুন হচ্ছে নিরীহ মানুষ। অথচ, সেটা আজ দোষের নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবেই তা করছে বহু দেশ। ধসে পড়ছে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। দেশে দেশে জেগে উঠেছে নৈরাজ্যবাদীরা। এমনই সময়ে আবির্ভাব হবে মহান যিশুর। বিশ্বাসীদের তিনি দেবেন নেতৃত্ব। হত্যা করবেন নিষ্ঠুর সব শত্রুদেরকে। শেষবারের মত দুনিয়ার বুকে নামবে শান্তি।
স্টিভ বার্কলে জোর দিয়ে লিখেছে, বাইবেলের বুক অভ রেভেলেশন লিখেছেন মাত্র একজন লেখক। তিনি যিশুর শিষ্য ও ধর্ম প্রচারক জন। তিনিই প্রথম বিশ্বাস করেন, নতুন করে প্রাণ পেয়েছেন যিশু। তবে বার্কলের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকে। তাঁরা লিখেছেন, রোমান কর্তৃপক্ষ যিশুকে ক্রুশে ঝুলিয়ে দেয়ার পর বহু দূরে চলে যান জন। প্রচার করেন খ্রিস্টান ধর্ম। সেসময় তাঁকে ফুটন্ত তেলে ফেলে দেয় রোমান শাসকরা। কিন্তু গায়ে ফোস্কা না পড়লে কর্তৃপক্ষ তাঁকে নির্বাসনে পাঠায় তুরস্কের তীরের কাছে গ্রিসের প্যাট দ্বীপে। ওখানে বসে লেখেন: বুক অভ রেভেলেশন। মানুষের ভবিষ্যৎ কী, তার ওপর লেখা বই। তাতে আছে ভয়াবহ বর্ণনা। চমকে গিয়েছিল সেসময়ের পাঠক সমাজ। পরেও বাইবেলের ওই অংশ নিয়ে হয়েছে প্রচুর বিতর্ক।
বার্কলের বইয়ের মূল কথা: ঘনিয়ে এসেছে মহাপ্রলয়। শেষদিকে ফাঁপিয়ে লিখেছে, কীভাবে স্বপ্নে এলেন সন্ত জন।
বর্তমান সময়ের স্কলাররা মনে করেন না গসপেলের সেন্ট জন ও বুক অভ রেভেলেশনের লেখক একই ব্যক্তি। প্যাটমস দ্বীপের জন যিশুর বারো শিষ্যের একজন কি না, তা নিয়েও আছে ঘোর সন্দেহ। বুক অভ রেভেলেশন নিউ টেস্টামেন্টের অংশ, তা-ও মনে করেন না অনেকে। আসলে কারও কাছেই প্রমাণ নেই বলে যে-যার মত ওই অংশের বিষয়ে লিখেছেন।
স্টিভ বার্কলে আঁকড়ে ধরেছে বাইবেলের ওই অংশ। মহাপ্রলয় না ঘটলে চলছে না তার। একেবারে শেষ কয়েকটা দিন পার করছে মানবসমাজ। কিন্তু সেসবের সঙ্গে ক্যাথি হার্বার্টের সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য, স্টিভ বার্কলেকে যেভাবেই হোক ব্ল্যাকমেইল করছিল মেয়েটা। বিষয়টি বাইবেলের কোনও ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কীভাবে জড়িত, তা জানে না রানা।
কোথাও কোনও সূত্র নেই বলে ভাবতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে ও। এসে চুপচাপ বসে থাকল লিভিংরুমে। পেরোল অনেকক্ষণ, তারপর বাজল সন্ধ্যা ছয়টা পঞ্চাশ।
পোশাক পাল্টে গেস্টহাউস থেকে বেরোল রানা। চলেছে ডিনারে। ওখানে দেখা হবে লোকটার সঙ্গে।
বাগানের মাঝের পথ পাড়ি দিয়ে ম্যানশনের দরজায় থামল রানা। কলিং বেল বাজাতেই হাসিমুখে কবাট খুলল হাউসকিপার শেলি। রানাকে নিয়ে এল গ্র্যাণ্ড হলওয়েতে। ড্রইংরুমে কার কথায় যেন হাসছেন মিস ট্রুলি। রানা ঘরে ঢুকতেই সোফা ছেড়ে হনহন করে হেঁটে ওর দিকে এগিয়ে এল এক লোক।
বয়স হবে পঞ্চান্ন মত। পরনে ভাল দর্জির তৈরি হালকা ধূসর কোট। মনে হলো ওটা ইতালিয়ান। স্কোয়াশ বা টেনিস খেলে লোকটা। শক্তপোক্ত দেহ। অবশ্য, পেট ও থুতনির নিচে আসছে চর্বির আভাস। দৈর্ঘ্যে রানার সমান। চুল কুচকুচে কালো। ব্যাকব্রাশ করা। এখানে-ওখানে সাদা রেখা। চওড়া হাসি নিয়ে রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।
বার্কলে, এই সুদর্শন যুবকের কথাই বলেছি, হাসিমুখে বললেন মেরিয়ান ট্রুলি। চকচক করছে চোখদুটো। রানা, আমার সৌভাগ্য যে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি তোমার সঙ্গে স্টিভ বার্কলেকে। বোধহয় বলা উচিত গভর্নর বার্কলে?
ঝিকঝিকে সাদা দাঁতের হাসি উপহার দিল লোকটা। ঈশ্বর চাইলে তবেই সেটা সম্ভব, মেরিয়ান। এখনও হতে পারিনি গভর্নর।
জর্জিয়ার নব্বইভাগ মানুষ তোমার পক্ষে, বললেন ভদ্রমহিলা। তোমাকে ঠেকাতে পারবে না কেউ।
শক্ত মুঠোয় রানার হাত নিয়ে ঝাঁকাতে শুরু করেছে বার্কলে। ভাব দেখে মনে হলো, বহু কাল পর আপন ভাইকে ফেরত পেয়ে খুশি। ভাল লাগল পরিচিত হয়ে, রানা। কথায় কোনও দ্বিধা নেই তার। দোষ করে ফেলছি না তো তোমাকে নাম ধরে ডেকে?
আমিও অধৈর্য ছিলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে, মিস্টার বার্কলে, বলল রানা।
প্লিজ, আমাকে ডাকবে স্টিভ বলে। মেরিয়ান বলেছেন, তুমিও আছ বিশ্বাসী মানুষের দলে। কথাটা শুনে খুব ভাল লেগেছে। আজকাল সত্য পথ থেকে সরে যাচ্ছে অনেকে।
ট্রে ভরা ক্যানাপে ও মার্টিনি ককটেইল দিয়ে গেল মেইড। চলছে টুকটাক কথা। গুরুত্ব পেল ইংল্যাণ্ড ও জর্জিয়ার পরিবেশ। তারপর মেরিয়ান ও বার্কলে জানাল, জর্জিয়ার কোথায় আছে দেখার মত জায়গা ও স্থাপত্য নিদর্শন। রানা যখন এ দেশে এসেই পড়েছে, উচিত হবে ওসব ঘুরে দেখা।
কিছুক্ষণ পর আলাপ ঝিমিয়ে আসছে দেখে জানতে চাইল বার্কলে, আসলে কোনদিকে বেশি আগ্রহ তোমার, রানা?
সত্যি বলতে, বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে আমার, স্বাভাবিক সুরে বলল রানা।
পরস্পরকে দেখল বার্কলে ও মেরিয়ান ট্রুলি। চোখে রানার প্রতি প্রশংসা।
জানতাম, এমন হবে, বললেন মহিলা, তো শোনো, রানা, দারুণ সুযোগ পেয়েছ। স্বয়ং বার্কলের মুখে…
পড়ছিলাম তাঁর বই, মেরিয়ানের কথা কেড়ে নিল রানা। শ্বাসরুদ্ধকর। রীতিমত কষ্ট হয়েছে ওটা রেখে আসতে।
অনেক ধন্যবাদ, রানা, লাজুক হাসি দিল বার্কলে। তুমি চাইলে তোমার জন্যে ওই বইয়ে সই করে দেব।
খুব খুশি হব তা হলে।
এমনসময় ঘরে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বাটলার জানিয়ে দিল, সার্ভ করা হয়েছে ডিনার। মেরিয়ান ট্রুলি ও স্টিভ বার্কলের পিছু নিয়ে দেখার মত সুন্দর এক ডাইনিংরুমে পৌঁছে গেল রানা। টেবিলটা দৈর্ঘ্যে পনেরো ফুটেরও বেশি। তৈজসপত্র রুপার তৈরি। মাথার ওপরে স্ফটিকের বিশাল এক ঝাড়বাতি। টেবিলের মাথায় বসলেন মিস ট্রুলি। বিশেষ অতিথি হিসেবে ডানদিকে রানা, বামে বার্কলে। টেবিলের মাঝে মস্ত এক রুপালি ডিশের ঢাকনি তুলল মেইড।
মিস ট্রুলির ফিশারি থেকে আসা স্যামন, বলল বার্কলে। স্মোকড়। আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে ওটাই সেরা।
খাওয়ার ফাঁকে শ্যাম্পেন দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে ওরা। রানার মনে হলো, এ বাড়িতে অতিথি নয় বার্কলে। লোকটা ঢুকে পড়েছে মিস ট্রুলির বুকের ভেতর।
স্যামন মাছের কাবাব খেতে খেতে বলল লোকটা, রানা, বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে কী যেন বলছিলে…
মনের যত প্রশ্ন, নির্দ্বিধায় বার্কলের কাছে জানতে চাও, খুশিমনে বললেন মেরিয়ান। এই যুগে বাইবেলের ওপরে ওর চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।
তুমি যুবক, নিশ্চয়ই বুঝছ, বাস করছ মানবজাতির সেরা উত্তেজনাময় সময়ে, বলল বার্কলে, কিন্তু সময় এখন সত্যিই খারাপ। আমরা সবাই রয়েছি ভয়ঙ্কর বিপদে।
আপনার বইয়ে পড়লাম, লিখেছেন ঘনিয়ে এসেছে মহাপ্রলয়।
সত্যিই পড়েছ আমার বই, বলল লোকটা। কী ঘটবে, সেটাও নিশ্চয়ই জেনেছ।
নানান স্কলার নানান মন্তব্য করেছেন, বলল রানা। যেমন কোনও কোনও থিয়োলজিয়ান বলেছেন, আসলে নিউ টেস্টামেন্টের অংশই নয় বুক অভ রেভেলেশন।
রাগে লাল হয়ে গেল বার্কলের দুই গাল। হারামজাদারা কিছুই জানে না। চট করে মেরিয়ান ট্রুলির দিকে তাকাল সে। সরি, গাল দেয়া অনুচিত হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের কথা শুনতে শুনতে এতই তিক্ত হয়েছে মন, সামলাতে পারিনি নিজেকে। এরা আসলে কোনও স্কলারই নয়! নইলে সব জেনেবুঝে চোখ বুজে থাকে? টেবিলে রাখা দুই হাত মুঠো করল সে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, রানা, কী ইঙ্গিত আসছে। ঈশ্বরের তরফ থেকে? ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্র। নিজেদের সামলাতে পারছে না সরকার। উধাও হচ্ছে আইনের বিচার। পঙ্গু হচ্ছে অর্থনীতি। নষ্ট হচ্ছে সংস্কৃতি। আসলে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা গভীর কূপে। নার্কের কাছে এসে হাজির হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের শুরু। আর সে কথাই এসেছে যিশুর বাইবেলে। কথায় জোর দিতে আঙুল নাড়ল বার্কলে। যার বোঝার, সে কিন্তু ঠিকই পাচ্ছে মহাপ্রলয়ের পরিষ্কার ইঙ্গিত। প্রভু যিশু তোমার হৃদয়ে থাকলে, তুমিও সব বুঝবে।-আমরা আছি মস্ত উঁচু খাদের কিনারায়। পতন হবে ভয়ঙ্কর। অথচ, ফালতু বিষয় নিয়ে তর্কে ব্যস্ত বুন্ধু সব স্কলার। ভাবছে: এটা ঠিক, না ওটা ঠিক। জানি না কীভাবে তাচ্ছিল্য করছে ঈশ্বরের বাণী! কান পেতে শুনছে না ধ্বংসের পদধ্বনি? শ্যাম্পেনে চুমুক দেয়ার জন্যে থামল বার্কলে।
নিজের বক্তব্য চমৎকারভাবে উপস্থাপন করছে সে। ভাল করত নাটক বা সিনেমায় অভিনয়ে নামলে। মুগ্ধ করেছে মিস ট্রুলিকে রানা বুঝতে পারছে, বার্কলের কথা শুনে মাতালের মত বুঁদ হয়েছেন মহিলা। বিনা দ্বিধায় দেবেন এক শ মিলি: ডলার। প্রবল আত্মবিশ্বাস, শেয়ালের চাতুরি ও ধর্ম প্রচার কর গাম্ভীর্য ব্যবহার করে ধর্মবিশ্বাসী মানুষটাকে জয় করে নিয়েছে বার্কলে।
হয়তো জানো, নতুন করে শুরু করল সে, দুহাজার দুই সালের একটা রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমেরিকার ষাট ভাগ মানুষ মনে করে, সন্ত জনের কথা সত্য। ষাট ভাগের কথা বাদ দাও, মাত্র বিশ ভাগ মানেই পাঁচ কোটি মানুষ। তাদের মতই একই কথা বলছি আমি। আমাদের এ জীবনেই আসবে মহাপ্রলয়। আর মাত্র অল্প কিছুদিনের ভেতর। তুমি ডিনার শেষ করে টিভি দেখতে গেলে, রুপালি পর্দায় দেখবে তারই লক্ষণ। গম্ভীর চোখে রানাকে দেখল বার্কলে। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর হাসল। গত বসন্তে কিছু খেয়াল করেছ, রানা?
ফসলের সব গাছ জন্মে গিয়েছিল সময়ের আগে।
এ থেকে কী বুঝলে? এমন হয়েছে প্রতিটা দেশে। শুধু ইংল্যাণ্ড বা আমেরিকায় নয়। বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর পরিবেশ। ঋতু আর নেই আগের মত। আসছে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প ও বন্যা। পরিবেশবাদীরা বলছে গ্লোবাল ওআর্মিং। আমি বলব গ্লোবাল সতর্কবাণী। সন্ত জনের বইয়ে লেখা আছে এসব। খুব খারাপ হবে পরিবেশ, মাটিতে মিশে যাবে মস্তবড় সব শহর। এত তাপ দেবে সূর্য, পুড়ে মরার দশা হবে আমাদের।
আকাশ থেকে পাথর পড়বে, সেটার কথা ভুলে যাবেন, সায় দেয়ার সুরে বলল রানা। স্বর্গ থেকে এমন পাথরের বৃষ্টি হবে, একেকটার ওজন হবে এমনই যে রক্ষা পাবে না কেউ।
ভালভাবেই পড়েছ বাইবেল। মাথা দোলাল বার্কলে। একেকটা পাথরের ওজন হবে প্রায় পঁয়ত্রিশ কেজি। তা ছাড়া, আছে মহামারী। হামলা করবে ভয়ঙ্কর সব পোকা। আসবে এমন সব রোগ, যার চিকিৎসা নেই। যেমন এভিয়েন ফুঁ বা নতুন দুরারোগ্য যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া। অলসভঙ্গিতে বাতাসে হাত দোলাল বার্কলে। নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাযিনে কী দেখছ, রানা? আফ্রিকার পঙ্গপাল যাচ্ছে ফ্রান্সের দক্ষিণ এলাকায়। ঠিক যেমন লেখা রয়েছে বাইবেলে। …তা হলে বলো, এবার কী ঘটবে, সে-কথা আমাদেরকে জানাবে কে? হঠাৎ টেবিলে চাপড় দিল বার্কলে। বিশ্বাস করো বা না করো, এসবই জানতেন সন্ত জ। আর তা-ই আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন স্বপ্নে।
শুনে দেখো, রানা, কীভাবে স্বপ্নে এসে বলে গেলেন সন্ত জন, বড় করে শ্বাস নিলেন মিস ট্রুলি। ভাবলে শিরশির করে ওঠে মেরুদণ্ড।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়, বলল বার্কলে। জন আমাকে আরও জানান: দুনিয়ার বুকে আসবে এমন এক সরকার, যারা কাজ করবে শয়তানের পক্ষে। যা খুশি করবে। বড়লোক বা গরিব… রক্ষা নেই কারও। সবার ডান হাতে বা কপালে মেরে দেয়া হবে সিল। কেউ কিনতে পারবে না কিছু। সবকিছুই ভোগ করবে সরকারী দলের লোক। কারও থাকবে না গবাদি পশু। নিজের নামও থাকবে না কারও। থাকবে শুধু সংখ্যা। তিক্ত হাসল বার্কলে। কাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, বুঝতে পারছ?
মাথা দোলাল রানা। বলতে চাইছেন, কমিউনিয়মের নামে যা খুশি করবে একদল লোক। ক্ষমতা থাকবে তাদের হাতে।
মৃদু হাসল বার্কলে। তুমি শিক্ষিত মানুষ। কী বুঝছ? এরাই হচ্ছে চিন, রাশা বা এ ধরনের দেশের সরকার। শয়তানের পক্ষে কাজ করছে তারা। মুক্ত থাকবে না মানুষ। দুনিয়া জুড়ে চলবে মাত্র একটা মুদ্রা। যেমন ইউরো। কিন্তু টিকবে না ওটা। থাকবে না ক্রেডিট কার্ড। তোমার কোনও ক্রেডিট কার্ড নেই, রানা?
আছে। ব্যবহার করি না পারতপক্ষে।
বুদ্ধিমানের কাজ করছ। বার কোডের কথাই ভাবো, এরই মধ্যে আমরা ব্যবহার করছি ৬৬৬ সংখ্যাটা। আধুনিক টেকনোলজি শেষ করবে আমাদেরকে। অথচ, গাট মেরে বসে দেখছে স্কলাররা। আসছে নতুন টেকনোলজি। তাতে ভাল না মন্দ হবে, বোঝার উপায় নেই কারও। প্লেটে আবারও খাবার তুলছে বার্কলে। তার ফাঁকে বলল, বুঝতেই পারছ মধ্যপ্রাচ্যের কী হবে। ওই রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরবেশের কারণে আরও বহু কিছুই বোঝা যায়। বাইবেলে তাগেই লেখা হয়েছে, ঈশ্বরের প্রিয় ইযরায়েলিরা পাবে কাঙ্ক্ষিত দেশ। উনিশ শ আটচল্লিশ সালে ইরায়েল রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই প্রমাণ হয়েছে, আছি আমরা শেষ সময়ে। সত্য হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছে। কাজেই তৈরি হতে হবে মন্দ সময়ের জন্যে।
কেমন হবে সেই সময়? জানতে চাইল রানা।
এ বিষয়ে বাইবেলের স্কলাররা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অন্তর্নিহিত খবর বুঝতে হলে যেতে হবে আরও গভীরে। যা ঘটার ঘটবে ইসরায়েলে। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, প্রথমে আগুন জ্বলবে ওই দেশে। কী ঘটবে, তা ঠিক করা হয়েছে হাজার বছর আগে। আক্রান্ত হবে পবিত্র ভূমি। সেটা পশ্চিম তীরে। হয়তো বোমায় খুন হবেন কূটনীতিকরা। ফলে শুরু হবে একের পর এক পারমাণবিক বোমার হামলা।
আপনি জানলেন কী করে? অবাক হয়ে গেছে রানা।
এমন হামলা হবে আমার প্রিয় ইযরায়েলিদের ওপর, যে ভয়ঙ্কর এক মেঘে ঢাকা পড়বে জমিন। আর ওটাই তোমাদের বলে দেবে, ফুরিয়ে এসেছে সময়। তিক্ত হাসল বার্কলে। হামলা করবে গগরা। প্রাচীন দেশ ম্যাগগের মানুষ তারা। ওটাই বর্তমান ইরান দেশ। মিসাইল ফেলবে ইযরায়েলের ওপর। ফলে পৃথিবী জুড়ে আরম্ভ হবে মহাযুদ্ধ।
সত্যিই বিশ্বাস করেন পবিত্র বাইবেলের এ ভবিষ্যদ্বাণী? জানতে চাইল রানা, ইহুদিদের ওপর হামলা করবে কোনও মুসলিম দেশ?
সন্দেহ নেই, বলল বার্কলে, তার ফল ভয়াবহ। এসবই লেখা হয়েছে বুক অভ রেভেলেশনে।
অর্থাৎ, ঈশ্বরের ইচ্ছেয় ধ্বংস হবে ইযরায়েল রাষ্ট্র?
ধ্বংস হতে দেবেন না ঈশ্বর, মাথা নাড়ল বার্কলে, ওই দেশে যতই মিসাইল পড়ক, ক্ষতি হবে না একটা ঘাসেরও। ইসরায়েল দেশের বিরুদ্ধে যা-ই করুক গগরা, আমার ক্রোধ ধ্বংস করবে তাদেরকে। …কী বুঝলে, রানা? খোদ ঈশ্বর রক্ষা করবেন ইসরায়েলিদেরকে। শেষ করবেন ওই জাতির শত্রুদের।
মৃদু হাসল রানা। চুপ করে আছে।
এদিকে পৃথিবী জুড়ে বেধে গেছে মারাত্মক যুদ্ধ, বলল বার্কলে। এমন এক যুদ্ধ, যেটার জন্যে মরবে শত শত কোটি মানুষ। শেষে চুক্তি করবে সবাই মিলে। প্রস্তাবটা আসবে ইউরোপের নেতাদের কাছ থেকে। তাদের একজনের থাকবে দুর্দান্ত কারিশমা। অথচ, সে মানবজাতির সত্যিকারের শত্রু।
বাইবেল অনুযায়ী যিশুর বিরুদ্ধে কাজ করবে সে, বলল রানা।
বারকয়েক মাথা দোলাল বার্কলে। চড়বে সাদা ঘোড়ায়। রেভেলেশন, চ্যাপ্টার সিক্স। ওই লোক জয় করবে গোটা পৃথিবী। আমরা হব তার দাস। নিজে সে শয়তানের পুত্র। কে জানে, হয়তো হবে কোনও ইংরেজ।
খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপারে আলাপ করছ তোমরা, শিউরে উঠলেন মেরিয়ান ট্রুলি।
ঠিকই বলেছেন, মেরিয়ান, বলল বার্কলে, চারপাশে নামবে ভয়ানক ঘুটঘুটে আঁধার। এতই শক্তিশালী হবে মহান যিশুর শত্রুরা, পৃথিবীর ক্ষমতা যাবে তাদের হাতে। কিছুই করতে পারবে না কেউ। বাধা দিলে জবাই হবে। হতাশ হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ। এসবই আছে জনের বইয়ে। আগুন দিয়ে, বা অন্যভাবে পুড়িয়ে দেবে কোটি কোটি গাছ। রক্তে লাল হবে সাগর। আসবে বিষাক্ত পঙ্গপাল। শেষ থাকবে না নির্যাতনের। নৃশংসভাবে খুন হবে কোটি কোটি মানুষ। শাসন ক্ষমতা তাদের কাছে, তাই যিশু বিরোধীদের হাতে খুন হবে বিশ্বাসীরা। নাযিদের অত্যাচারকে মনে হবে ছেলেখেলা।
তারপর একসময়ে এমনই ক্রুদ্ধ হবে সবাই, যেমন হয়নি আগে কখনও, বুক অভ রেভেলেশনের উদ্ধৃতি দিল রানা।
গম্ভীর চেহারায় মিস ট্রুলির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল বার্কলে। নিজের প্লেটের দিকে চেয়ে আছেন বয়স্কা মহিলা। ভীষণ অসহায় বোধ করছেন তিনি।
কিন্তু সবাই মেনে নেবে না নির্যাতন, নরম সুরে বলল বার্কলে, বাইবেল অনুযায়ী: হতাশা কাটিয়ে একসময়ে, কষ্ট ও নির্যাতন থেকে রক্ষা পাব আমরা।
যিশু নিজে নামবেন স্বর্গ থেকে, বাইবেলের উদ্ধৃতি দিল রানা। তখন বিকট এক আওয়াজ করবেন ঈশ্বরের দেবতা। ওটা ট্রাম্পেটের নিনাদের মত। ঘন মেঘে ঢাকা পড়ব আমরা। তারপর ঈশ্বরের সঙ্গেই থাকব চিরকালের জন্যে।
আমেন, ফিসফিস করলেন মেরিয়ান ট্ৰলি।
রানার দিকে চেয়ে হাসল বার্কলে। খুশি হয়েছি যে যিশুর সত্যিকারের বার্তা অন্তরে রেখেছ, রানা। তোমাকে ফেলে স্বর্গে গেলে কষ্ট পেতাম। আসলে মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পাবে না কেউ।
তারপর সাত বছর পর শেষ এক লড়াইয়ে নামবেন শত্রুদের বিরুদ্ধে যিশু, বলল রানা। সব ঝাড়ছে বার্কলের বই থেকেই।
কথা ঠিক, মাথা দোলাল বার্কলে, সত্যি আসবে এরপর সোনালি সময়। যারা বুকে রেখেছে পূর্ণ বিশ্বাস, পরকালে কষ্ট হবে না তাদের। পুরস্কার দেয়া হবে চিরকালের জন্যে।
.
ডিনার সেরে ওরা ফিরল ড্রইংরুমে। মেইড একটা ট্রেতে করে দিয়ে গেল ব্র্যাণ্ডির ডিক্যান্টার ও স্ফটিকের গ্লাস। কিছুক্ষণের জন্যে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মিস ট্রুলি।
আপনার কথা খুব মন দিয়ে শুনলাম, গ্লাস ভরা ব্র্যাণ্ডি নিয়ে আর্ম চেয়ারে বসল রানা। কিন্তু অন্য একটা বিষয়েও আপনার সঙ্গে সামান্য আলাপ করতে চাই।
দুদিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল বার্কলে। যা খুশি জানতে চাইতে পারো।
একজনের সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।
তাই? কে সেই মানুষ?
নামটা ক্যাথি হার্বার্ট, বার্কলের চোখ দেখছে রানা।
হাঁ করতে গিয়েও মুখ বুজে ফেলল লোকটা। মস্ত এক ঢোক গিলল। ওউ? ওহ্!
ভাল করেই জানেন, কার সম্পর্কে বলছি, বলল রানা।
হ্যাঁ, চিনি ওকে, শীতল কণ্ঠে বলল বার্কলে। দেখছে। নিজ হাতের আঙুলের নখ। সে মেরিয়ানের প্রিয় বান্ধবী।
আপনার সঙ্গে খাতির নেই ওর।
কঠোর চোখে রানাকে দেখল বার্কলে। এসব বলে কী বোঝাতে চাইছ?
জানি, আপনার কাছ থেকে পুরো পঁচিশ হাজার ডলার আদায় করে নিয়েছে, এখন চাইছে আরও দশ মিলিয়ন।
চুপ করে কী যেন ভাবছে বার্কলে। কিছুক্ষণ পর বলল, তুমি তা হলে এসব জানো?
এ-ও জানি, কী হয়েছে পিছলা সিম্পসনের। কিছু তথ্য বাদ পড়ে থাকতে পারে। খুলে বলুন, জ্ঞান বাড়বে আমার।
তুমি আসলে কে, মিস্টার রানা?
এমন একজন, যে কিনা খুঁজছে সঠিক উত্তর। এমন কেউ, যে থামবে না জবাব না পেলে।
মদের গ্লাস নাড়ছে, বার্কলে। মুখ ফ্যাকাসে। আমাকে চমকে দিয়েছ, রানা। এমন বিষয়ে জানতে চাইছ, যেটা বলতে হবে গোপনে।
তাতে আপত্তি নেই আমার, বলল রানা। প্রচুর টাকা পাওয়ার খুব কাছে পৌঁছে গেছেন, এখন নিশ্চয়ই চান না বিষয়টা উঠুক মিস ট্রুলির সামনে?
চুপ করে থাকল স্টিভ বার্কলে।
উত্তর না দিয়ে পার পাবেন না, বলল রানা। আমাকে সব না বলে উপায় নেই আপনার।
ড্রইংরুমে ঢুকলেন বয়স্কা মহিলা। পেছনে মেইড, হাতের ট্রেতে কফির জগ, সাদা পোর্সেলিন কাপ ও পিরিচ।
সোফায় বসে বললেন মিস ট্রুলি, ভাবছিলাম, আমাদের নতুন অতিথি খুশি হবে আগামী কালকের শুটিং দেখলে।
নার্ভাস হাসল স্টিভ বার্কলে। আবার কফি কেন?
মিষ্টি হাসলেন মহিলা। রানা, কখনও দেখেছ রাইফেল শুটিং? ভুরু কুঁচকে গেল তার। কী হলো, বার্কলে, শরীর খারাপ? চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে ফ্যাকাসে ভূত!
ভাল আছি, বলল বার্কলে, তবে খেয়ে ফেলেছি বেশি।
কী ধরনের টুর্নামেন্ট? জানতে চাইল রানা।
মেরিয়ান ট্রুলির সামনে স্বাভাবিক থাকতে চাইছে বার্কলে। আমার বাড়ির কাছে প্রতিবছর একবার আয়োজন করি ছোটখাটো একটা শুটিং প্রতিযোগিতা। তবে…।
হাসলেন মিস ট্রুলি। ছোটখাটো আয়োজন? ছোট করে দেখাচ্ছ নিজেকে। জর্জিয়া, আলাবামা আর মিসিসিপির সেরা সব শুটার আসে ওই প্রতিযোগিতায়। একেকটা টিকেট বিশ ডলার। জড় হবে কমপক্ষে দুই হাজার মানুষ।
দাতব্য সংস্থার জন্যে তোলা হবে টাকা, হাসি-হাসি চেহারা করল বার্কলে, তাকে দেখাল ভেঙচি-কাটা বাদরের মত।
তাই নাকি! লোকটার দিকে চেয়ে হাসল রানা।
মিস ট্রুলি ট্রাস্ট চ্যারিটি হসপিটালের জন্যে পয়সা তুলব আমরা, বললেন মহিলা। এমন বেশ কয়েকটি সংস্থা আছে। আমাদের। বার্কলের চোখ দেখছে রানা। জর্জিয়া ও আলাবামার যেসব গরিব পরিবারের সাধ্য নেই হেল্থ ইস্যুরেন্স করার, তাদের চিকিৎসা-ব্যয় তুলতে আয়োজন হয়েছে ওই রাইফেল শুটিং। দুঃখিত মুখে হাসলেন মিস ট্রুলি। গত গ্রীষ্মে ফ্রি চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে খুলেছি নতুন উইং। ভর্তি করা হচ্ছে ক্যান্সারে আক্রান্ত বাচ্চাদের। এত ভাল কাজ হচ্ছে দেখে ভেবেছি, আরও বড় করব ওই উইং। এ বছরের রাইফেল প্রতিযোগিতা থেকে যে টাকা আসবে, সেসব খুব কাজে লাগবে। আমার আমন্ত্রণে সাড়াও দিয়েছেন কয়েকজন স্পন্সর।
সত্যিই ভাল কাজে ব্যয় হবে টাকা, মিস ট্রুলি, বলল রানা। ওর চোখ সরল না বার্কলের চোখ থেকে।
আমার সঙ্গে কিন্তু যাবে, রানা, বললেন মেরিয়ান। দেখো, দারুণ কাটবে সময়।
লালচে হয়ে গেছে বার্কলের দুই গাল। গলা পরিষ্কার করে বলল, আমার মনে হয়, বিরক্ত হবে রানা। কী দরকার ওকে কষ্ট দেয়ার? তাই বলছি, মিস ট্রুলি…
ওখানে সত্যিই দারুণ লাগবে আমার, এক কথায় সুদক্ষ বক্তা স্টিভ বার্কলের জবান বন্ধ করে দিল রানা।
.
২৫.
স্যাভানা শহর থেকে দশ মাইল পশ্চিমে যাজক স্টিভ বার্কলের বাড়ি। ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলেছে সকাল। জর্জিয়া উপকূলের ভেজা জলবায়ুর জন্যে হাঁফ লেগে যাচ্ছে সবার। সমতল জমিতে আকাশছোঁয়া সারি সারি ওক গাছ। হাইওয়ে থেকে যত দূর চোখ যায়, ঘন সবুজ অরণ্য।
বড় রাস্তার পাশে শুটিং টুর্নামেন্ট লেখা ব্যানার দেখে হাইওয়ে থেকে সরু এক ব্যক্তিগত রাস্তায় নামল রানা। চলেছে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে। সামনে ও পেছনে কিছু গাড়ি। দুমাইল যাওয়ার পর বাঁক নিয়ে রানা পৌঁছে গেল বিশাল এক সবুজ ঘাসের মাঠের প্রান্তে। একদিকে রাখা অন্তত তিন শ গাড়ি। ওটাই পার্কিং লট। ওখানে গিয়ে গাড়ি রাখল রানা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নেমে পড়েই ঝাপটা খেল কড়া রোদের।
শোফার চালিত লিমো নিয়ে ভোরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন মহা উৎসাহী মিস ট্রুলি। আশা করছেন কয়েক লাখ ডলার পাবেন দাঁতব্য সংস্থার জন্যে। একের পর এক ফোন এসেছে বলে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করেনি রানা, কারা স্পন্সর করছে শুটিং প্রতিযোগিতা। চারপাশ দেখল রানা। পার্কিং লটের একদিকে মিস ট্রুলির রাজকীয় সাদা লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল লিমাযিন।
মাইলের পর মাইল জুড়ে স্টিভ বার্কলের ব্যক্তিগত জমি। শুধু সামনের মাঠ কমপক্ষে চার একর। আরও কয়েক একরের হবে আশপাশের অন্যান্য মাঠ। ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে দর্শকরা। কোথাও কোথাও জটলা। ছোট কিছু স্টল ও তাবু থেকে বিক্রি হচ্ছে খাবার ও সফ্ট ড্রিঙ্ক। সবমিলে জড় হয়েছে অন্তত তিন হাজার মানুষ। ভাপসা গরমেও হাসিখুশি সবাই। পরিবেশ পিকনিকের মত। ছোটাছুটি করে খেলছে বাচ্চারা। পেছনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে একদল মা।
সুষ্ঠুভাবেই আয়োজন করা হয়েছে এই অনুষ্ঠান। খবর দেয়া হয়েছে টিভি চ্যানেলে। তাদের লোক আছে প্রধান মাঠের ফটকের পাশে। ব্যস্ত হয়ে ভিডিয়ো তুলছে। ক্যামেরাম্যান। মাইক বা প্যাড হাতে এদিক-ওদিক ঘুরছে সাংবাদিকরা।
মস্তবড় মাঠের মাঝে বিশাল রঙিন তাঁবু। চারদিকে লেখা: মেরিয়ান ট্রুলি ট্রাস্ট। একটু দূরে কাগজের প্লেটে খদ্দেরদেরকে ভাজা মুরগির মাংস, মাখন মেশানো পোড়া ভুট্টা, কয়েক ধরনের বার্গার ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পরিবেশন করছে একদল ব্যস্ত তরুণ। আরেক দিকে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের স্টল। আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে যেন দুর্ঘটনা না ঘটে, তাই ওখান থেকে বিলি হচ্ছে গান সেফটি লিফলেট। পাশেই বিক্রি করা হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, বই, পত্রিকা, ইয়ার ডিফেণ্ডার, হান্টিং গিয়ার ও শুটিঙের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র।
রোদ থেকে বাঁচতে বেড়ার আড়াল নিয়ে শুটিং রেঞ্জে চোখ বোলাল রানা। চমৎকার সেটআপ। দুসারি গাছের মাঝে টার্গেট। প্রথমটা এক শ গজ দূরে, তারপর পাঁচ শ এবং শেষে এক হাজার গজ দূরে কাগজের টার্গেট। আরও পেছনে মাটির টিলা। ওটা ঠেকাবে বুলেট। নইলে গুলি যেত পরের স্টেট-এ। শুটিং দেখতে আসা দর্শকদের জন্যে দড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা প্রাঙ্গণ। শুটারদের জন্যে মাটিতে পাশাপাশি পেতে দেয়া হয়েছে ম্যাট ও রাইফেল রেস্ট। প্রধান শুটিং রেঞ্জের সামান্য দূরে চলছে ছোট সব প্রতিযোগিতা। ছোটদেরও আছে রেঞ্জ। সেখানে কীভাবে নিরাপদে গুলি করা যায়, বাচ্চাদেরকে শেখাচ্ছে এনআরএ-র লোক। ব্যবহার করা হচ্ছে ছোট ক্যালিবারের অস্ত্র।
বিচারকের তাঁবুর পাশের খুঁটিতে বোর্ডে সেঁটে দেয়া হয়েছে মূল প্রতিযোগিতার সঠিক সময় লেখা কাগজ। আজ সকালে শেষ হয়েছে ছোট বোরের অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। একপাশে ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা হয়েছে বিজয়ীদের নাম। অবশ্য, দিনের সেরা আকর্ষণ হচ্ছে ওপেন ক্লাস ফুলববার রাইফেল শুটিং। ওটা দেখতেই জড় হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এরই ভেতর ফায়ারিং পয়েন্ট-এ পৌঁছে গেছে শুটাররা। যে যার মত কিট বক্স খুলে ব্যস্ত হয়ে প্রস্তুত করছে ইকুইপমেন্ট।
শুটিঙের ব্যাপারে আগ্রহ নেই রানার। এখানে এসেছে। বার্কলেকে বাগে পেতে। আড়ালে সরিয়ে নেবে লোকটাকে, তারপর তার পেট থেকে বের করবে সব কথা।
কী করবে মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছে রানা। সহজ পরিকল্পনা। বার্কলে নিজের দোষ স্বীকার না করলে, পিটিয়ে হাড় ভাঙবে তার। জেনে নেবে কোথায় রেখেছে ক্যাথি হার্বার্টকে। মেয়েটা বেঁচে আছে না খুন হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করছে না বার্কলের ভবিষ্যৎ। ওই লোককে মরতেই হবে মউরোসের অকাল মৃত্যুর জন্যে। সরিয়ে নিয়ে তার মগজে বুলেট গেঁথে দেবে রানা। এবং কাজটা করবে ঠাণ্ডা মাথায়। এরপর সোজা ফিরবে বাংলাদেশে।
বার্কলে এই মুহূর্তে কোথায়, তা নিয়ে ভাবছে রানা। দূরে দেখল বিশাল ম্যানশন। চওড়া বারান্দার বাইরের দিকে সাদা সব পিলার। ওদিকে চেয়ে নিজেকে সামলে নিল রানা। মন চাইছে, এখনই ওখানে গিয়ে লোকটাকে ধরে।
বাড়িটার ওপর থেকে চোখ সরাতেই একটু দূরে দেখল স্টিভ বার্কলেকে। তিক্ত হয়ে গেল রানার মন। লোকটা ভিড় বা ক্যামেরা থেকে সরবে না, সেটা ভুলে গিয়েছিল। মেরিয়ান ট্রুলি ট্রাস্টের বড় তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দৈনিক পত্রিকার ফোটোগ্রাফাররা প্রায় ঘিরে রেখেছে তাকে। ঠোঁটে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে নিয়েছে বার্কলে। থামছে না নকল ওই হাসি। ওখানেই আছেন মেরিয়ান ট্ৰলি। রাজকীয় পোশাক। আজ কাজের শেষ নেই ভদ্রমহিলার। সঙ্গে একদল সহকারী। রানা ওদিকে পা বাড়াতেই ওকে দেখলেন মিস ট্রুলি। হাত নাড়লেন হাসিমুখে। পাল্টা হেসে হাত নাড়ল রানা।
ভদ্রমহিলার কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই রানার চোখে চোখ পড়ল স্টিভ বার্কলের। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল লোকটা। ভাব দেখে মনে হলো, তার জরুরি কোনও কাজ পড়ে গেছে। হনহন করে হেঁটে মিলিয়ে গেল ভিড়ের ভেতর।
পরে দেখা হবে, বিড়বিড় করল রানা।
মিস ট্রুলির কাছে পৌঁছে যেতেই ওর বাহুতে হাত রাখলেন তিনি। দারুণ, তাই না? হাজার হাজার দর্শক এসেছে শুটিং দেখতে! ঝলমল করছে তার চোখ-মুখ। এসো, পরিচয় করিয়ে দিই বিশেষ একজনের সঙ্গে। লালচে-হলুদ চুলের মোটা এক মহিলার দিকে ফিরলেন তিনি। পঁচিশ বছর বয়সী দারুণ আকর্ষণীয় চেহারার এক জাপানি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন মহিলা।
মিনা, আমাদের ববি কই? ব্যস্ত সুরে জানতে চাইলেন মিস ট্রুলি।
ওই যে, বোধহয় পৌঁছে গেছে, বলল মহিলা।
অনেক দেরি করে এসেছে, বললেন মিস ট্রুলি। বকা না দিয়ে উপায় নেই।
রানার চোখে চোখ রেখে হাসল জাপানি মেয়েটি।
ভদ্রতা করে মৃদু নড করল রানা।
রানা, এসো, ওর বাহু ধরে রওনা হলেন মেরিয়ান।
পার্কিং লটের দিকে চলল ওরা। গভীর আলাপে তলিয়ে গেলেন মিনা ক্র্যানডন ও মেরিয়ান ট্ৰলি। একটু পিছিয়ে পড়েছে রানা। ওর পাশে হাঁটছে জাপানি মেয়েটা।
আমার নাম তাকিয়োনা মুতিয়ামি, ফাঁসফেঁসে কণ্ঠে বলল মেয়েটা, আপনি…?
রানা, মাসুদ রানা, বলল রানা। মেরিয়ান ট্রুলি ট্রাস্টে কাজ করেন?
মাথা দোলাল সুন্দরী। একটু আগে আপনার কথাই বলছিলেন মিস ট্রুলি।
তাই? …নিশ্চয়ই জানেন ববি কে?
মিস ট্রুলির প্রটেজিদের একজন, বলল তাকিয়োনা। পয়সা নেই এমন শত শত গরিব ছেলে-মেয়েকে স্কুল ও কলেজে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন তিনি। তাদেরই একজন ববি বোবাক। বয়স মাত্র উনিশ, অথচ এরই ভেতর হয়ে উঠেছে জর্জিয়ার সেরা চ্যাম্পিয়ন রাইফেল মার্কম্যান। ওর ট্রেনিঙের সমস্ত খরচ দেয়া হয় ট্রাস্ট থেকে। মিস ট্রুলির আশা, একদিন হয়তো পুরো আমেরিকার হয়ে অলিম্পিকে অংশ নেবে ববি।
বাহ, গুড! বলল রানা।
এবারের শুটিঙে বিশেষ বাড়তি আকর্ষণ রেখেছেন মিস ট্রুলি। বাজির পটে নিজে থেকে দিয়েছেন এক লাখ ডলার। একই কাজ করতে অনুরোধ করেছেন বড়লোক বন্ধু ও বান্ধবীদেরও। আশা করছেন, ওসব টাকা জিতে নেবে ববি বোবাক। সেক্ষেত্রে পাবে সে অন্তত পাঁচ লাখ ডলার। সব দিয়ে দেবে শিশু হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে। তবে বোবাকের বিরুদ্ধে লড়বে অন্তত পাঁচটা স্টেট-এর চ্যাম্পিয়নরা। এটা ভাবতে গিয়ে বুক কাঁপছে আমাদের।
শিশুদের জন্যে উইঙের কথা আমাকে বলেছেন মিস ট্রুলি, বলল রানা।
বিমর্ষ চেহারায় মাথা দোলাল তাকিয়োনা মুতিয়ামি। খুব খারাপ লাগে বাচ্চাদের এত কষ্ট দেখলে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই কি কেউ আছে আকাশে?
পার্কিং লটে পৌঁছে গেছে ওরা। পোঁতা খুঁটিতে বাঁধা দড়ি দিয়ে সাধারণের গাড়ি থেকে আলাদা করা হয়েছে শুটারদের গাড়ি রাখার জায়গা। খুব কাছে শুটিং রেঞ্জ।
ওই যে বোবাক, আঙুল তাক করল তাকিয়োনা।
ওদিকে তাকাল রানা। মার খাওয়া চেহারার পুরনো এক পণ্টিয়াক গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণ। পাশেই ওর বন্ধু। সে শ্বেতাঙ্গ। সমানই হবে বয়স। পরনে টি-শার্ট ও হাঁটুর কাছে ঘেঁড়া জিন্সের প্যান্ট। নাকের ওপর পুরু কাঁচের চশমা। দেখে রানার মনে হলো, সে যেন গভীর চিন্তায় ডুবে যাওয়া হতাশ বিজ্ঞানী। পেছনের ডালা থেকে বের করেছে রাইফেলের কালো কেস।
ববি বোবাক আবার চশমাওয়ালা নয় তো? জানতে চাইল রানা।
ফিক করে হেসে ফেলল তাকিয়োনা মুতিয়ামি। না। ওর নাম মিক্কো গোযি। গোলাগুলি ওর কাজ নয়। তবে গিটার পেলে জাদু দেখিয়ে দেয়।
রানাদের দিকে খেয়াল নেই ওদের। বন্ধুর কথা শোনায় সমস্ত মনোযোগ ববি বোবাকের। ডানহাত রেখেছে গাড়ির পেছন ডালার ভেতর। ঘাসের মধ্যে রাইফেলের কেস নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মিক্কো গোযি। বোধহয় কৌতুক বলছে সে। হঠাৎ মাথা পিছিয়ে নিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল ববি। হাসছে মিক্কোও। পুরু লেন্সের ওদিকে বুজে গেছে দুই চোখ। হাসতে হাসতে হঠাৎ গাড়ির পেছনের ডালাটা ধুম্ করে বন্ধ করল ও। লোহার ভারী ঢাকনি ভয়ঙ্করভাবে চেপে বসল বোবাকের ডানহাতের চার আঙুলে।
হাসতে হাসতেই খেঁক-শেয়ালের মত করুণ এক আর্তনাদ ছাড়ল ছেলেটা। ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে গুঁজে দিল দুই উরুর মাঝে। নাচতে শুরু করেছে ঘুরে ঘুরে।
প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলেন মেরিয়ান ট্রুলি। হায় ঈশ্বর! দেখি তো, বাছা, কী হয়েছে?
সর্বনাশ! কী হয়েছে? ওদিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠেছে। তাকিয়োনা।
প্রচণ্ড ব্যথায় নরকে পৌঁছে গেছে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ। বেচারার আঙুলের কী অবস্থা দেখল রানা। একেবারে থেঁতলে গেছে মাংস। চোট পেয়েছে আঙুলের হাড়। দরদর করে পড়ছে। রক্ত।
আঙুল নাড়তে পারবে? জানতে চাইল রানা।
সে-চেষ্টা করতে গিয়ে জোরেশোরে বোবার মত গুঙিয়ে উঠল বোবাক।
বোধহয় ভেঙে গেছে দুএকটা হাড়, বলল রানা।
একটু দূরেই ফার্স্ট-এইড তাঁবু, বললেন মিস ট্রুলি। কড়া চোখে দেখলেন হতবাক মিক্কো গোযিকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, মুখ ফ্যাকাসে। ওরা একবার দেখুক, তবে আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত ডাক্তারের কাছে।
মিস ট্রুলি ঠিকই বলেছেন, বলল রানা।
তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে গিয়ে গাল কুঁচকে ফেলেছে ববি। হতাশ সুরে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমার যে আজ এখানে শুটিং করার কথা?
ওর কথা শেষ হতে না হতেই লাউডস্পিকারে ঘোষণা দেয়া হলো: একটু পরেই শুরু হতে যাচ্ছে ভারী ক্যালিবারের রাইফেল শুটিং। শুটাররা, দয়া করে যে-যার মত চলে যান ফায়ারিং লাইনে।
সময় নষ্ট না করে ফাস্ট-এইড তাঁবুতে ঢুকল ওরা। বোবাকের থেঁতলে যাওয়া আঙুল দেখল নার্স। ব্যাণ্ডেজ করে দিয়ে জানাল, দেরি না করে যেতে হবে হাসপাতালে। ওখানে হাতের এক্সরে করাতে হবে বোবককে।
আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়, তর্ক করতে চাইল ববি।
তুমি কি বামহাতি? জানতে চাইল বয়স্কা নার্স। মাথা নাড়ল তরুণ। তা হলে এই আঙুল দিয়ে ট্রিগার টিপতে পারবে না। শুটিঙের কথা ভুলে যাও।
প্রায় কাঁদতে কাঁদতে তবু ছেড়ে বেরিয়ে এল ছেলেটা। ব্যথা ও হতাশায় ভেঙে পড়েছে। ওর গাড়ির দিকে চলেছে সবাই। পায়ে পায়ে পেছনে চলেছে মিক্কো গোযি। বন্ধুর সর্বনাশ করে দিয়েছে বলে বুক ভেঙে গেছে ওর। এই দুঃখজনক দুর্ঘটনার পরেও খুব শান্ত আছেন মিস ট্রুলি। অবশ্য রানা দেখল, তার চোখে হতাশার ছায়া। নরম সুরে বললেন, জরুরি এখন তোমার হাসপাতালে যাওয়া। চিকিৎসা নিতে হবে।
কিন্তু লাখ লাখ ডলার ক্ষতি হয়ে গেল আপনার, বলল বোবাক। বাচ্চাদের জন্যে খুলতে পারব না আমরা নতুন উইং।
তোমার কিচ্ছু করার নেই, বাছা, মাথা নাড়লেন মেরিয়ান, পরের বছর হয়তো সুযোগ পাব আমরা।
বোবাকের জায়গায় অন্য কাউকে প্রতিযোগিতায় নামানো যায় না? জানতে চাইল তাকিয়োনা মুতিয়ামি। ওর কোনও বন্ধু?
বন্ধু বলতে মাত্র একজন, বিড়বিড় করল ববি, কিন্তু মিক্কো তো সামনের দেয়ালেও গুলি লাগাতে পারে না। চরম হতাশায় মাটিতে পড়ে থাকা ছোট এক পাথর লাথি মেরে দূরে পাঠিয়ে দিল সে।
রেঞ্জ থেকে শুরু হয়েছে রাইফেলের গর্জন। শুটাররা গরম করছে নল। শেষসময়ে আরও নিখুঁত করতে চাইছে নিশানা।
এখুনি শুরু হবে শুটিং, অথচ বাতিল মাল হয়ে গেলাম, আফসোস করল ববি বোক।
আমি কি কোনও সাহায্যে আসতে পারি? আমতা আমতা করে বলল রানা।
ঝট করে ঘুরে ওকে দেখল তরুণ শুটার।
তুমি, রানা? বিস্ময় নিয়ে বললেন মেরিয়ান, গুলি করতে জানো?
একটু-আধটু তো জানিই, বলল রানা।
পটিয়াক গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। এখনও ঘাসের ওপর রাইফেলের কেস। ওটার পাশে চলে গেল রানা।
শেষ রেঞ্জ এক হাজার গজ দূরে, বলল ববি। আলতো করে ধরে রেখেছে আহত হাত। কুঁচকে গেছে ভুরু। আপনার কি জানা আছে, অত দূরে কতটা ছোট দেখায় টার্গেট?
খুব ছোট, মাথা দোলাল রানা।
আপনি যদি চেষ্টা করেন, আমার কোনও আপত্তি নেই, বলল ববি। ব্যবহার করতে পারেন আমার রাইফেল। কিন্তু মনে রাখবেন, দাঁড়াতে হবে আর্ভিন ক্রাযের মত পেশাদার শুটারের বিরুদ্ধে। আরও আছেন আলাবামার জন বেঞ্জামিন। উনি ছিলেন মেরিন সার্জেন্ট। স্নাইপারদের ইনস্ট্রাকটার। এঁরা আছেন দুনিয়ার সেরাদের মধ্যে। ভেবে দেখুন, লজ্জার ভেতর পড়বেন কি না।
কাঁধ থেকে থলির মত ব্যাগ ঘাসে নামিয়ে রাইফেলের কেসের পাশে বসল রানা। খুলে ফেলল ক্যাচ। সহজ সুরে বলল, দেখা যাক কী রেখেছ ভেতরে।
.
২৬.
কেস খুলে ভেতরে স্কোপ লাগানো রাইফেল দেখল রানা। ধরে দেখব তোমার রাইফেলটা, ববি?
ধরুন না, বলল বোবাক।
সাবধানে ফোম থেকে রাইফেল নিল রানা। দ্রুত হাতে পরীক্ষা করল অস্ত্রটা। বোল্ট অ্যাকশন উইনচেস্টার মডেল ৭০। চেম্বার ৩০০ এইচ-অ্যাণ্ড-এইচ ম্যাগনাম। অত্যন্ত শক্তিশালী। বাধা না পেলে সরু বুলেট প্রতি সেকেণ্ডে পৌঁছে যাবে দুহাজার ফুট। এমন এক রাইফেল, বহু দূরের টার্গেটে জাদু দেখিয়ে দিতে পারে দক্ষ শুটারের হাতে। সেরা আগ্নেয়াস্ত্রের একটা। যন্ত্রটা প্রায় নিখুঁত করতে গিয়ে শত শত ঘণ্টা খাটতে হয়েছে গানস্মিথকে। কম্পিটিশন গ্রেড ব্যারেল। দেখার মত অ্যাকশন। যে স্কোপ আছে, ওটার দাম রানার ভাড়া করা পুরনো ক্রাইসলার গাড়ি দ্বিগুণ হবে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও ম্যাচ বের করে একটা শলা ঠোঁটে ঝুলিয়েই আবার রেখে দিল রানা যথাস্থানে। হয়ে উঠেছে পেশাদার স্নাইপার। রাইফেলের ব্যাপারে আমার জানা দরকার, এমন কোনও তথ্য, বোক?
পালকের মত হালকা হেয়ার ট্রিগার, বলল ববি। সাবধানে ছুঁতে হবে।
ঠিক আছে। যিরো করা হয়েছে কতটা দূরে? পয়েন্ট অভ এইম তিন শ গজ, বলল তরুণ।
মাথা দোলাল রানা। রাইফেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে চোখ রাখল স্কোপে। সন্তুষ্ট হয়ে কেসে রেখে দিল রাইফেল। এবার খুলল ববির অ্যামিউনিশন বাক্স। তুলে নিল দীর্ঘ একটা কার্তুজ। নিজের হাতে অ্যামিউনিশন তৈরি করো?
মাথা দোলাল বোবাক।
ওর চোখে নিজের তৈরি কার্তুজের প্রতি ভালবাসা দেখল রানা। টার্গেট শুটাররা নিজ হাতে নিখুঁত অ্যামিউনিশন তৈরি করতে গিয়ে ব্যয় করে দিনের পর দিন। ব্যবহার করে সেরা খোল, বুলেট ও গান পাউডার, প্রাইমার। পাকা হাতে কাজটা হলে ওই বুলেট হবে নির্ঘাত লক্ষ্যভেদী। অবশ্য শুটারকেও হতে হবে দক্ষ। সাদা কাগজের মধ্যে কালো বৃত্তে ছোট্ট গর্ত তৈরি করবে বুলেট, তাই পরিশ্রম করে শুটার। যার গুলি অন্যদের তুলনায় কালো বৃত্তের যত বেশি কেন্দ্রে থাকবে, সে-ই হবে প্রথম।
একহাজার গজ দূরের মানুষকে গুলি করতে হলে লক্ষ্যস্থির করতে হয় ওপরে। একবার কঙ্গোয় বারো শ গজ দূরে ভয়ানক বদ এক ড্রাগ-লর্ডের মাথায় তাক করেছিল একজন .৫০ ক্যালিবারের স্নাইপার রাইফেল। অনেকটা উঁচুতে তাক করতে হয়েছিল। ফলে গুলিটা নেমেছিল ওপর থেকে লোকটার চাঁদিতে। ছিঁড়েখুঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল লোকটা। হাইড্রোস্ট্যাটিক শকের ফলে এক শ গজ দূরে গিয়ে পড়েছিল তার একটা বিচ্ছিন্ন হাত। ওর জন্যে ঘণ্টার পর ঘন্টা টিলার ওপরে অপেক্ষা করেছিল সেই স্নাইপার। নমটা ছিল তার মাসুদ রানা।
অস্ত্রটা দিয়ে আজ মানুষ খুন করতে হবে না। সঠিকভাবে কালো কাগজ ফুটো করলেই হবে। কেমন হালকা মনে হলো রানার এই ফুর্তিভরা পরিবেশ।
পারবে ভাবছ, রানা, দুশ্চিন্তা নিয়ে জানতে চাইলেন মেরিয়ান ট্রুলি।
চেষ্টা করব, বলল রানা। অনেক দিন হাতে রাইফেল নিই না।
আমরা তোমার জন্যে প্রার্থনা করব, রানা। ববি, সোজা চলে যাও হাসপাতালে। মিক্কো, গাড়ি চালাতে পারবে, না ড্রাইভারের ব্যবস্থা করব?
শুটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাব না, বলল ববি। নিজ চোখে দেখতে চাই কী হয়।
লাউড স্পিকারে এল ম্যাচ রেফারির কণ্ঠ: এবার শুরু হবে ফুল বোর রাইফেলের প্রতিযোগিতা।
জলদি চলো, বললেন মিস ট্রুলি।
রাইফেলের কেস আর ওর ব্যাগ তুলে নিল রানা। চলল প্রতিযোগীদের সারির দিকে। রানার পিছু নিয়ে এল ববি বোবাক। ব্যথায় লালচে হয়ে গেছে চোখ। বামহাতে চেপে ধরেছে আহত আঙুল। ম্যাচ রেফারির সঙ্গে কথা বলতে গেলেন মিস ট্রুলি। বুঝিয়ে বলার পর নতুন শুটারকে প্রতিযোগিতায় নামতে দিতে রাজি হয়ে গেলেন ম্যাচ রেফারি।
ফায়ারিং লাইনে হাজির তিরিশজন শুটার। দড়ি দিয়ে ঘেরা এলাকায় ঢুকে নিজের জায়গায় পৌঁছে গেছে রানা। শুটিং ম্যাটের একপাশে নামিয়ে রাখল ব্যাগ, অন্যপাশে রাইফেলের কেস। বের করে নিল উইনচেস্টার রাইফেল। হাতে সময় নেই যে দুচারটা গুলি করবে, বা গরম করে নেবে ব্যারেল। প্র্যাকটিসের টার্গেট সরিয়ে নিয়ে এক শ গজ দূরে নতুন কাগজ লাগিয়ে দিচ্ছে রেঞ্জ অফিসাররা।
কানে ববি বোবাকের ইলেকট্রনিক ইয়ার ডিফেণ্ডার পরে নিল রানা। ম্যাটে শুয়ে তৈরি হলো গুলি করতে। টের পেল, লাফ দিচ্ছে ওর বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড। অনেক দিন হলো হাতে নেয়নি রাইফেল। বড় করে তিনটে দম নিতেই শান্ত হয়ে এল ওর হার্ট বিট। এ
পাশের ম্যাটের শুটারের দিকে তাকাল রানা। ওই লোকের পাশে সেনাবাহিনীর সবুজ, ধাতব অ্যামিউনিশন বাক্সে লেখা: জন বেঞ্জামিন।
এ লোকই মেরিন ফোর্সের স্নাইপার ট্রেইনার সার্জেন্ট। কয়েক মুহূর্তের জন্যে চোখে চোখ পড়ল দুজনের। জন বেঞ্জামিনের চোখ বলে দিল, এতকাল শুধু যে কাগজে গুলি করেছে, তা নয়। হাসল লোকটা। তবে ওই হাসি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। স্রেফ ভদ্রতা দেখিয়ে হেসেছে সে। ভাল করেই জানে, জিতে নেবে বাজির কয়েক লাখ ডলার। মন দিল নিজের রাইফেলের দিকে।
মুহূর্তের জন্যে অনিশ্চয়তা বোধ করল রানা। স্কোপের মাঝ দিয়ে দেখল টার্গেট। মাত্র এক শ গজ দূরেই প্রথম কাগজ। ডিনারের প্লেটের মত। ভেতরে কালো পিরিচে বৃত্তাকার সব রিং। একদম মধ্যে কালো ছোট্ট রিং। শুটাররা বলে এক্স-রিং। বড়জোর কয়েনের সমান। ওখানে লাগলে শুটার পাবে দশ পয়েন্ট। তার পাশের রিঙে লাগলে নয় পয়েন্ট। আরও দূরের সব রিঙে গুলি লাগলে কমতে থাকবে পয়েন্ট।
সহজ আইন মেনে করা হয় রাইফেল প্রতিযোগিতা। প্রথমে এক শ গজ দূরের টার্গেটে গুলি করবে শুটাররা। তারপর পাঁচ শ গজে, শেষে এক হাজার গজ দূরে। প্রতিটি টার্গেটে দশটা করে গুলি করবে। নব্বইয়ের নিচে নম্বর পেলে বাদ দেয়া হবে যে-কাউকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। একবার শ্বাস নিয়ে রাইফেলে ম্যাগাযিন ভরল রানা। টেনে নিল উইনচেস্টারের বোল্ট।
চুপ করে অপেক্ষা করছে।
নীরব হয়ে গেছে দর্শকরা।
কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। ফায়ারিং লাইনের বিশ গজ দূরে দড়ির ওদিকে রয়ে গেছেন মেরিয়ান ট্রুলি, তাকিয়োনা মুতিয়ামি, তাদের সহকারীরা, ববি বোবাক আর মিক্কো গোযি। মিস ট্রুলির কনুইয়ের কাছে স্টিভ বার্কলে। শীতল চোখে দেখছে রানাকে।
গুলি শুরু করতে নির্দেশ দিলেন রেফারি।
সেফটি ক্যাচ অফ করল রানা। চট করে কষল ব্যালিস্টিক অঙ্ক। টার্গেটের কয়েক ইঞ্চি নিচে তাক করল ক্রসহেয়ার। লক্ষ্যভেদ করতে হবে তিন শ গজ দূরে জিরো করা রাইফেল দিয়ে।
ওর বামে বুম্! করে উঠল জন বেঞ্জামিনের রাইফেল। মাযলের কাছে লাফিয়ে উঠল কিছুটা ধুলো।
দম নিয়ন্ত্রণ করল রানা। টার্গেটের ওপর সামান্য উঠছে নামছে সাইটের ক্রসহেয়ার। একটু সরছে এদিকে বা ওদিকে। ভুরু থেকে রানার চোখে নামতে চায় লোনা জল। মৃদু মাথা নেড়ে ঘাম সরিয়ে দিল চোখ থেকে।
মনের আয়নায় ভেসে এল মউরোসের মুখ। পেভমেন্টে বোমা বিস্ফোরণে ক্ষত-বিক্ষত কিছু লাশ। দুটো ছবি। ওরা অ্যাবেলিনো থ্যানাটস ও ক্যাথি। নরক ভোগ করছেন হার্বার্ট দম্পতি। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা জোয়ি। ওর সন্তান কখনও পাবে না বাবার আদর। এসব হয়েছে মাত্র একজন লোভী, ভণ্ড লোকের কারণে। সে স্টিভ বার্কলে। তার দৃষ্টি নিজের ওপর টের পেল রানা।
প্রচণ্ড রাগের প্রতিক্রিয়া নানানভাবে দেখায় মানুষ। কারও নষ্ট হয় মনোযোগ, ভোতা হয় চিন্তা, এসব বহুবার দেখেছে রানা। কিন্তু ওর নিজের তা নয় না। রাগের স্রোত অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে জানে ও। বহুগুণ মনোযোগ আসে নিজের কাজে। রাইফেলের প্রতিটি কৌশল মাথায় রেখে শক্ত হাতে অস্ত্রটা ধরেছে ও। তাকাল স্কোপের ভেতর দিয়ে। সাইটের দৃশ্যটা এখন একদম পাথরের মত স্থির। পরিষ্কার দেখল টার্গেট। রাইফেল মনে মনে তাক করল স্টিভ বার্কলের কপালে।
ট্রিগারটাকে মৃদু স্পর্শ করল রানার তর্জনীর শেষ কড়া। কট শব্দে ডেবে গেল বাকা, পুরু পাত। রানার কাঁধে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল রাইফেল। ঝাঁকি খেয়ে স্কোপ থেকে সরে গেল ওর চোখ। নতুন করে কালো বৃত্তে ফিরিয়ে আনল নিশানা। স্কোপের মাঝ দিয়ে পরিষ্কার দেখল, কালো কাগজে তৈরি হয়েছে খুব ছোট একটা গর্ত। ওর প্রথম গুলি কেটে দিয়েছে এক্স-রিঙের কিনারা।
একেবারে খারাপ নয়, ভাবল রানা।
অল্পক্ষণেই বুঝল, অনভ্যাসে হারিয়ে যায়নি দক্ষতা।
প্রথম দশটা গুলির পর ত্রিশজন শুটারের মাঝ থেকে বাদ পড়ল সাতজন। বিরতি দেয়া হলো বিশ মিনিটের। এই সময়ে পুরনো কাগজ সরিয়ে পাঁচ শ গজ দূরে টাঙিয়ে দেয়া হলো নতুন টার্গেট। প্রথম টার্গেটের চেয়ে একটু ছোট দেখাচ্ছে ওটা। তবুও সাইটের মাঝ দিয়ে দেখা গেল ভালভাবেই।
আরম্ভ হলো দ্বিতীয় রাউণ্ড। রানা জানে, পাঁচ শ গজ দূরে বুলেট লাগাতে হলে বাদ পড়বে অনেকেই। তাই হলো, রয়ে গেল মাত্র নয়জন শুটার। তাদের একজন রানা। ওর মতই টিকে গেছে এক্স-মেরিন স্নাইপার সার্জেন্ট জন বেঞ্জামিন এবং আরও কজন নাম করা শুটার। আবারও রানার দিকে তাকাল সে, এখন আর মুখে হাসি নেই।
জন বেঞ্জামিনের দিকে মনোযোগ নেই রানার। চোখ স্টিভ বার্কলের ওপর। শুটিং দেখতে রয়ে গেছে লোকটা। চেহারায় এখন চাপা ভয়। নীরব ভয়ঙ্কর এক বার্তা দিচ্ছে রানার জ্বলন্ত চোখ। মন থেকে চাইছে, ওকে ভয় পেতে শুরু করুক লোকটা। বুঝেও গেছে, ওর নীরব উপস্থিতি কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাকে।
পাঁচ শ গজের টার্গেট নামিয়ে নেয়ার পর টিকেছে মাত্র কয়েকজন। এবার শুরু হবে সত্যিকারের পরীক্ষা। এমন কী শক্তিশালী স্কোপের ম্যাগনিফায়িং লেন্স দিয়েও খুব ছোট দেখাল এক হাজার গজ দূরের টার্গেট। সাবধানে রাইফেল স্থির রেখে ট্রিগার টিপলেই হবে না, বহু দূরের রেঞ্জে হিসেব কষতে হবে এক শ রকমের। বাতাস ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে বুলেট, সেটা মাথায় রাখতে হবে। ভুললে চলবে না বুলেটের গতিপথ ও মাধ্যাকর্ষণের টান। দূরে গুলি লাগাতে চাইলে বেশ কয়েক ফুট ওপরে তাক করতে হবে রাইফেলের নল। ওখানেই দক্ষ স্নাইপারের কৃতিত্ব।
গুলি শুরু করার নির্দেশ দিলেন রেফারি। বোল্ট টেনে স্কোপের ভেতর দিয়ে তাকাল রানা। প্রায় দেখাই যাচ্ছে না ছোট্ট টার্গেট। ওটা ছাড়া দুনিয়ার আর সব কথা ভুলে গেছে ও। মনের চোখে দেখছে পয়সার মত কালো কিছু। ওখানে। লাগাতে হবে বুলেট।
ট্রিগার স্পর্শ করল রানা। টানল বোল্ট। ছিটকে বেরিয়ে গেল খরচ করা খোল। ঠেলে দিল বোল্ট। চেম্বারে ঢুকেছে নতুন বুলেট। টার্গেটে গুলি পাঠাল রানা। হাতের ভেতর জীবন্ত প্রাণীর মত লাফিয়ে উঠছে রাইফেল। আবারও টেনে নিল বোল্ট। হারিয়ে গেছে ও নিজের গভীর কোনও জগতে। রাইফেল, টার্গেট আর ও ছাড়া যেন কিছুই নেই পৃথিবীতে। ফুটো করতে হবে কাগজের ওই ছোট্ট গোল দাগ। রাইফেল যেন ওর হাতের বাড়তি অংশ। এখন এমন কী অস্তিত্ব নেই স্টিভ বার্কলেরও। এক এক করে গুলি করছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর টের পেল, ফুরিয়ে গেছে গুলি। স্কোপ দিয়ে দেখল কেমন হয়েছে ফলাফল।
আস্তে করে চাপা শ্বাস ফেলল। টার্গেটে মাত্র একটা ফুটো, এবড়োখেবড়ো। ওর দশটা গুলি ভেদ করেছে এক্স রিং। পারফেক্ট স্কোর জিতে গেছে ও।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দূর থেকে গফ কার্টে চেপে ছুটে এল রেঞ্জ অফিসাররা। তাদের নেতা ফলাফল ঘোষণা দিতেই হৈ-হৈ করে উঠল দর্শকরা। সমান রেযান্ট করেছে দুজন শুটার। একজন রানা, অন্যজন জন বেঞ্জামিন।
রানার দিকে এগিয়ে এল এক্স-মেরিন। হাত বাড়িয়ে দিল। দারুণ শুটিং, দোস্ত। কোথা থেকে শিখলে?
হ্যাণ্ডশেক করল রানা। বাংলাদেশ আর্মি। কমাণ্ডো ট্রেইনিং।
আপনারা সমান পয়েন্ট পেয়েছেন, বললেন রেফারি। এবার কী করতে চান?
রানার দিকে চেয়ে হাসল জন বেঞ্জামিন। কী করবে ভাবছ, দোস্ত?
আমি যা করতে চাইব, মেনে নেবে? জানতে চাইল রানা।
মাথা দোলাল লোকটা।
তা হলে এক শ গজ দূরে রাখা হোক আমার পছন্দের টার্গেট, বলল রানা। গুলি করা হবে মাত্র একবার। যে জিতবে, তাকে বিজয়ী হিসেবে মেনে নেবে অপরজন।
মাত্র এক শ গজ? ঠাট্টা করছ?
জবাব দিল না রানা।
ঠিক আছে, রেফারির দিকে চেয়ে চোখ টিপল বেঞ্জামিন।
বেশ, কাঁধ ঝাঁকালেন রেফারি।
এক শ গজ দূরে থাকবে টার্গেট। দুই শুটার ও রেফারির সঙ্গে চলল কর্তৃপক্ষের কয়েকজন।
এক শ গজ গিয়ে হঠাৎ ঘাসে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রানা। একমিনিট। জুতোর ফিতে ঠিক করে নিচ্ছে ও। অন্যরা ব্যস্ত দুটো স্ট্যাণ্ডে কাগজের টার্গেট টাঙাবার কাজে।
কাজ শেষ হলে আবারও ফায়ারিং লাইনের দিকে চলল সবাই। রানাও ফিরল নিজের রাইফেলের পাশে। উৎসুক চোখে ওকে দেখছে দর্শকরা। অবাক হয়ে চেয়ে আছেন মিস ট্রুলি। এখনও তার কনুইয়ের কাছে স্টিভ বার্কলে। চোখে শীতল দৃষ্টি। বরফঠাণ্ডা চাহনি ফেরত দিল রানা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভণ্ড যাজক। চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকাল নিজের পায়ের দিকে।
ম্যাটে শুয়ে পড়ল রানা। চোখ পড়ল এক শ গজ দূরের টার্গেটে। ঘাড়ে তপ্ত রোদ। গরমে ভেজা দর্শকদের গুঞ্জন ছাপিয়ে তুমুল উৎসাহে চিচিচিকচিক শব্দে ডাকছে ঘুঘুরে পোকা। রানাকেই প্রথমে গুলি করতে বলা হলো।
ঝাড়া তিন মিনিট লক্ষ্যস্থির করার পর ওর তর্জনীর মৃদু স্পর্শে দেবে গেল ট্রিগার। বুম! শব্দে লাফিয়ে উঠল রাইফেল। টার্গেটের ওপর থেকে সরে গেল স্কোপ।
কসেকেণ্ড পর জোর গুঞ্জন তুলল দর্শকরা। অনেকের হাতে বিনকিউলার ও স্পটিং স্কোপ। কিন্তু অবাক কাণ্ড! টার্গেটে রানার গুলির কোনও ফুটোই নেই!
মিস হয়ে গেছে, দোস্ত, চওড়া হাসি দিল জন বেঞ্জামিন। অনেক দূর দিয়ে গেছে বুলেট।
স্কোপের ভেতর দিয়ে দেখল রানা। মৃদু হাসল। বলল, আমার পছন্দের টার্গেটটা দেখো।
একমিনিট! হঠাৎ বলে উঠল এক স্পটার, নিচের দিকে দেখো, নিচের দিকে! কাগজের টার্গেটে গুলি করেনি মিস্টার রানা।
এবার দেখতে পেয়েছে জন বেঞ্জামিন। ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা।
টার্গেটের সামনে হেঁটে রাখা খাটো ঘাস। ওগুলো ছাপিয়ে উঁকি দিচ্ছে মাটিতে পুঁতে রাখা দুটো ম্যাচের কাঠি। একটা থেকে আরেকটা তিন ইঞ্চি দূরে। মৃদু হাওয়ায় ওই দুটোর একটা শলা থেকে জ্বলছে কমলা শিখা।
গুলি করে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে দিয়েছে বিদেশি শুটার, চিৎকার করে উঠল এক মধ্যবয়স্ক লোক।
সবই দেখেছে ববি বোবাক। দড়ি সরিয়ে ছুটে এল রানার দিকে। চোখদুটো বিস্ফারিত। বেসুরো হয়ে গেল কণ্ঠ: হোলি শিট! আপনি কি মানুষ না অপদেবতা? হাঁ করে রানাকে দেখছে। দুই সেকেণ্ড পর ঝুপ করে বসে ওর পা স্পর্শ করে কপালে হাত ঠেকাল। ওরে বাবা! আপনি আমার চিরকালের ওস্তাদ!
বেড়ে উঠেছে দর্শকদের গুঞ্জন। হতবাক হয়ে রানাকে দেখছে অনেকে। বুড়ো হয়েছি প্রতিযোগিতায় রেফারিং করতে করতে, কিন্তু এর চেয়ে ভাল শুটিং আর দেখিনি, বললেন রেফারি। চাপড়ে দিলেন রানার কাধ। এক কোটিবারেও কঠিন একবার এমন শুটিং করা।
এটা সম্ভব? বলল বেঞ্জামিন। ওখানে যখন ছিল, তখন বোধহয় আগুন জ্বেলে এসেছে।
মাথা নাড়লেন রেফারি। উপায় ছিল না। এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত কাঠি। এ কারণেই এবারের শুটিঙে বাড়তি সময় নিয়েছিলে, তাই না, মিস্টার?
মৃদু হাসল রানা।
এক শ গজ দূর থেকে গুলি করে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে দেয়া? বিড়বিড় করল ববি বোবাক। চোখ পিটপিট করতে করতে উঠে দাঁড়াল। ব্যথা ভুলে মুখে এখন চওড়া হাসি।
এবার তোমার পালা, বেঞ্জামিনকে বলল রানা। এখনও রয়ে গেছে দ্বিতীয় ম্যাচের কাঠি।
কোত্থেকে শিখলে এমন দুর্দান্ত শুটিং? শ্বাস ফেলল এক্স-মেরিন সার্জেন্ট।
বাংলাদেশ আর্মি, একই জবাব দিল রানা, কমাণ্ডে ট্রেনিঙে।
ইউএস আর্মিতে এসব শেখায় না। আফসোস করে মাথা নাড়ল জন বেঞ্জামিন। নামিয়ে ফেলল মেরিন স্নাইপার রাইফেল। আমার সাধ্য নেই শুট করব তোমার মত। চেষ্টাই করব না। ভাল করেই জানি কখন হার মেনে নিতে হয় সত্যিকারের ওস্তাদের কাছে। রানার হাত ধরে জোরেশোরে ঝাঁকাতে লাগল সে।
এই বেচারার মাত্র একটাই ডানহাত, ওটা আস্ত রাখো, দোস্ত, কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা।
লজ্জা পেয়ে ওর হাত ছাড়ল প্রাক্তন মেরিন।
প্রতিযোগিতা শেষ।
রাইফেলটা কেসে রাখল রানা। ল্যাচ লাগিয়ে ববির কাছে ফেরত দিল কালো কেস। বামহাতে ওটা ধরেছে তরুণ। বেদম ব্যথা সহ্য করেও হাসছে খুশিমনে।
কর্তৃপক্ষের জটলার কাছে রানা যেতেই এগিয়ে এলেন মিস ট্রুলি। জড়িয়ে ধরলেন ওকে। কানে ফিসফিস করে বললেন, রানা, এতই ভয়ে ভয়ে ছিলাম, আরেকটু হলে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতাম।
এবার ববিকে পাঠাতে হবে হাসপাতালে, মনে করিয়ে দিল রানা। টের পেল, পাশেই কে যেন। ঘুরে দেখল সুন্দরী তাকিয়োনা মুতিয়ামি, চোখে তার অকুণ্ঠ প্রশংসা।
ওকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাব হাসপাতালে, বলল মেয়েটা। লজ্জায় পালিয়ে গেছে মিক্কো গোযি। আপাতত ওর দেখা পাব না।
মৃদু নড করল রানা। থ্যাঙ্ক ইউ। ববি বোবাকের দিকে তাকাল ও। আঙুলের যত্ন নিয়ো।
নেব। তবে একটা কথা, যা দেখালেন, এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বোবাকের বাহু ধরে পার্কিং লটের দিকে রওনা হয়ে গেল মুতিয়ামি, এখনও রানার বিজয়ে হাসছে খুশিতে।
রানার বাহু আঁকড়ে ধরে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন মিস ট্রুলি। এমনসময় হাজির হলেন ম্যাচ রেফারি। রানাকে বললেন, চলুন, বুঝে নেবেন পুরস্কার। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে সাংবাদিকরা।
পরে, বলল রানা। ভিড়ের মাঝে কাকে যেন খুঁজছে ওর চোখ। একটু আগে যেখানে ছিল স্টিভ বার্কলে, ওই জায়গায় কেউ নেই। বার্কলে কোথায় গেলেন? মিস ট্রুলির কাছে জানতে চাইল ও।
বাড়িতে। বলল, ফোন এসেছে। কিন্তু… তুমি, রানা… পুরস্কার ফেলে চললে কোথায়?
জরুরি একটা ব্যাপারে আলাপ আছে মিস্টার বার্কলের সঙ্গে। এখুনি না গেলেই নয়।
.
২৭.
দূর থেকে রাজকীয় মনে হয় স্টিভ বার্কলের প্রাসাদ। সামনে নিয়ো-ক্লাসিক ফ্যাসেড ও পাথরের দীর্ঘ সাদা সব কলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠে সদর দরজা পেরিয়ে গেল রানা। সামনেই পড়ল হলওয়ে। ঠিকভাবে মেরামত হয়নি পুরনো বাড়ি, নইলে থাকত মিস ট্রুলির ম্যানশনের মতই রাজসিক।
সামনের একটা দরজা পেরিয়ে এল এক মেয়ে। বোধহয় স্টাফ, হাউসকিপার অথবা পিএ। রানাকে দেখে বড় বড় হয়ে গেল ওর চোখ।
বার্কলে কোথায়? জানতে চাইল রানা।
আপনি কে?
গেছে কোথায়?
জানি না, মাথা নাড়ল মেয়েটা। তবে ওর নার্ভাস চোখ গেল একটু দূরের পেঁচানো সিঁড়ির ওপর। আর কিছু জানার দরকার নেই রানার। মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে একেকবারে টপকাতে লাগল দুটো করে সিঁড়ির ধাপ। পেছনে আপত্তি তুলছে মেয়েটা। ওকে পাত্তা না দিয়ে ওপরতলায় উঠে এল রানা। সামনেই গ্যালারি। দুপাশে সারি সারি ঘরের দরজা। প্রথমটা খুলে দেখল রানা। ভেতরে কেউ নেই। দরজা খুলতে খুলতে এগোল ও।
চতুর্থ দরজা খুলতেই মস্ত ঘরের পেছনে এক ডেস্কে স্টিভ বার্কলেকে পেল রানা। দড়াম করে কবাট বন্ধ করে চলল ডেস্কের দিকে। বুঝে গেছে, এটা লোকটার স্টাডিরুম। নেই পর্যাপ্ত আসবাবপত্র। দেয়ালে কিছু দাগ আছে শুধু ওখানে আগে ঝুলত বড় পেইন্টিং। দারিদ্র্যের ছাপ সব কিছুতে। এখনও মেরিয়ান ট্রুলির কাছ থেকে এক শ মিলিয়ন ডলার পায়নি লোকটা।
রানাকে দেখে উঠে দাঁড়াল স্টিভ বার্কলে। একটু কাঁপছে সে। ডেস্কে আধখালি বুর্বোনের বোতল আর একটা গ্লাস।
আমাদের ভেতর কথা আছে, তা ভুলে গেছ? বলল রানা।
চামড়া মোড়া চেয়ারে বসে পড়ল বার্কলে। ডেস্কের কোণে বসল রানা। দুফুট দূরে যাজক।
ধুম্ করে খুলে গেল ঘরের দরজা। প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকল প্রকাণ্ড দুই লোক। পরনে সুট। রানাকে দেখে গম্ভীর হলো চেহারা। বাদামি লোকটা ঝামেলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। স্যর, কোনও সমস্যা?
ওদের ফেরত পাঠাও, বলল গম্ভীর রানা। নইলে ওদের হাত-পা ভাঙার দায় তোমাকেই নিতে হবে।
হাতের ইশারা করল বার্কলে। সব ঠিক আছে। তোমরা যাও।
রানাকে একবার দেখে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল লোকদুজন। পেছনে বন্ধ করে দিল দরজা।
তুমি বাইবেলের ব্যাপারে আলাপ করতে আসোনি, বলল বার্কলে।
না, জানতে এসেছি তোমার পেটের কথা। গোপন করবে না কিছুই।
না হলে?
ক্যানভাস ব্যাগ থেকে ৪৭৫ লাইনবাউ রিভলভার বের করল রানা। সরাসরি তাক করল বার্কলের বুকে। আগেই দেখেছ, এক হাজার গজ দূরের টার্গেটে লাগাতে পারি বুলেট। এই দূরত্বেও তোমাকে লাগাতে পারব।
বুঝলাম, দীর্ঘশ্বাস ফেলল বার্কলে। এসো, আলাপ করা যাক।
ক্যাথি হার্বার্ট কোথায়?
চাইলেও এর জবাব দিতে পারব না।
ভালভাবে ভাবো, নইলে প্রথমে যাবে তোমার পা দুটো।
আগেই বলেছি, জবাব দিতে পারব না। জানিই তো না ওই বদমাশ মেয়ে কোথায় গেছে।
আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে যেয়ো না, বলল রানা।
ভাবলে কী করে যে আমি কিছু করেছি?
ওই মেয়ে ব্ল্যাকমেইল করছিল তোমাকে। ঠিক করেছিলে আর টাকা দেবে না।
দিয়েছি তো, প্রতিবাদের সুরে বলল বার্কলে, দ্বিধা করিনি। ক্যাশ টাকা পেলে বাকিটাও দেব। আগেই বলেছি, দেব। আমি এককথার মানুষ।
নল উঁচু করে বার্কলের মাথায় রিভলভার তাক করল রানা। নীরব ঘরে ক্লিক্ আওয়াজে কক হলো হ্যামার।
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে বার্কলের ভুরুতে। ভয় নিয়ে চেয়ে আছে রিভলভারের মাযলের দিকে। মস্তবড় কোনও বিপদে পড়েছে মেয়েটা, তাই না? কী করেছে?
আমার কাছে জানতে চাইছ?
ওর কোনও ক্ষতি করিনি, বলল বার্কলে। কাঁপা কণ্ঠে ভয়। শুধু অনুসরণ করতে পাঠিয়েছি দুজনকে।
গ্রিস পর্যন্ত গেছে তারা। পরের ঘটনা আমার জানা আছে।
ভুরু কুঁচকে ফেলল বার্কলে। বুঝলাম না তোমার কথা।
খেলা বন্ধ করো, বার্কলে।
তুমি বললে গ্রিসের কথা। এসবের ভেতর গ্রিস এল কোত্থেকে?
গ্রিসে বোমা রেখেছিলে বলে খুন হয়েছে আমার বন্ধু জঁা মউরোস, গুড়গুড় করে উঠল রানার কণ্ঠ। লোক দিয়ে খুন করিয়েছ অ্যাবেলিনো থ্যানাটসকে। কিডন্যাপ করেছ ক্যাথি হার্বার্টকে। কান পেতে শোনো, মারা পড়েছে তোমার পাঠানো দুই খুনি ক্রিস্টিনা পার্কার আর বয়েটার ব্ল্যাকউড।
উদ্ভ্রান্ত চেহারা হয়েছে হতবাক স্টিভ বার্কলের।
ভাল করেই জানি, তোমার লোক ভেঙে দিয়েছে পিছলা সিম্পসনের পাদুটো, বলল রানা।
ডানহাত ওপরে তুলল বার্কলে। একমিনিট! মস্ত কোনও ভুল করছ, রানা। ক্রিস্টিনা আর ব্ল্যাকউডের নাম বাপের জন্মেও শুনিনি। এ-ও জানি না, মউরোস আর থ্যানাটস কে। তবে ওই পিছলা সিম্পসন ওকে চিনি। কিন্তু ওর ঠ্যাং ভাঙতে লোক পাঠাব কেন? ওকে তো নগদ টাকা দিয়েই দিয়েছি। আমি শুধু মিস ট্রুলির ম্যানশনে আমার ছেলেদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে চোখ রাখতে পারে ওই বেশ্যা মেয়েটার ওপর।
প্রথমবারের মত দ্বিধায় পড়ল রানা। বুকের দিকে অস্ত্র ধরলে ঘাবড়ে যায় সাধারণ মানুষ। গুলি করা হবে জানলে দেরি করে না পেটের সব উগরে দিতে। বার্কলেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। সত্য বলছে প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু তা হলে এর কথা সত্যি হয় কীভাবে! মিথ্যা বলছ, বার্কলে!
মাথা নাড়ল ভণ্ড যাজক। একফোঁটা মিথ্যা বলছি না। হাত তুলে মাফ চাওয়ার ভঙ্গি করল। যা জানি, সবই বলব। তবে আগে সরাও ওই কামান। যখন-তখন আমার ইয়ে বেরিয়ে যাবে।
হ্যামার নামিয়ে রিভলভার সামান্য নিচু করল রানা।
খুকখুক করে কেশে নিল বার্কলে, বুর্বোনের বোতল তুলে ঢকঢক করে গিলল মদ। বোতল নামিয়ে বামহাতে মুছল ভুরুর ঘাম।
একদম প্রথম থেকে শুরু করো, বলল রানা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্টিভ বার্কলে। তুমি তো জানো, মিস ট্রুলির গাছ থেকে পুরো এক শ মিলিয়ন ডলার আসছে আমার কাছে। জানা নেই আমার, কীভাবে জানলে। জানতে চাইও।
মাথা দোলাল রানা। বলতে থাকো।
টাকার অভাব নেই মিস ট্রুলির। টাকার কুমির বললেও ভুল হবে, উনি হাজার হাজার কোটি টাকার নীল ড্রাগন। অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন ঈশ্বর, যিশু আর বাইবেলকে। সত্যিকারের ভাল ক্রিশ্চিয়ান। মেরিয়ান যখন বললেন, আমার সংগঠনে এক শ মিলিয়ন ডলার দেবেন, খুব খুশি হলাম। তুমিও খুশি হতে হঠাৎ আকাশ থেকে এত টাকা পড়লে। কিন্তু একটু পর মহিলা বললেন, তার ইচ্ছে সত্ত্বেও আপাতত দিতে পারবেন না এক পয়সাও। সব টাকা আটকে আছে নানান হোল্ডিং, ট্রাস্ট আর রিয়াল এস্টেটের ব্যবসায়। এমন নয় যে চাইলেই যে কাউকে লাখ লাখ ডলার দিতে পারবেন। এসব শুনে একদম দমে গেলাম।
আর তারপর উদয় হলো ক্যাথি হার্বার্ট, বলল রানা। ঘাবড়ে গেলে, মেরিয়ান ট্রুলির কান ভাঙাবে ওই মেয়ে। পরে আর পাবে না ওই এক শ মিলিয়ন ডলার।
হ্যাঁ, ভয় পেলাম, রেগে গেছে বার্কলে। ক্যাথির মত শয়তান ডাইনী জীবনেও আর দেখিনি। কখন যে কী করে বসবে, তার ঠিক নেই। টাকা পাব ভাবছি, এমনসময় ইংল্যাণ্ড থেকে এসে মেরিয়ানের কোল জুড়ে বসল বদমাইশ বেটি। বলতে লাগল, দুর্দান্ত এক প্রজেক্টে কাজ করতে চায়। সেজন্যে চাই বড় ফাণ্ড। কোটি কোটি টাকা লাগবে। এসব শুনে পাথর হয়ে গেলাম। এমনিতেই মেরিয়ানের স্বামী, ছেলে-মেয়ে নেই। এখন যদি সব দিয়ে দেয় ওই বেশ্যাকে, ঠেকাতে পারব? ওদের সম্পর্কও মা-মেয়ের মত। এ অবস্থায় তুমিও আমার মতই হিসাব কষতে, রানা। বুঝে গেলাম, ওই বেশ্যার কাছে হেরে যাব। আরেক ঢোক বুর্বোন গিলল বার্কলে। তারপর যখন সত্যিই দেখলাম ওই বেশ্যাকে, বুঝে গেলাম- মহিলাকে নয়, তার কোটি কোটি টাকা ভালবাসে সে। বড় বড় কথা বললে হবে কী, সব আসলে মিথ্যা। বেশ্যাটা চায় দামি দামি মদ গিলবে আর যার-তার সঙ্গে শোবে। ওকে তুলনা করা যায় লোভী স্বর্ণসন্ধানীর সঙ্গে।
ওকে চিনতে পেরেছ, কারণ তুমি নিজেও তা-ই, বলল রানা।
রাগের আগুন জ্বলে উঠল বার্কলের দুচোখে। বলো, কী করা উচিত ছিল আমার? দিতে চাইছে নিজে থেকে অত টাকা, মানা করে দেব? দশ বছর হলো প্রকাশ করেছি আমার বইযা পেয়েছি, সব শেষ। ধার নিয়েছি অনেকের কাছ থেকে। ভীষণ চাপ আসছে আমার ওপর। কীভাবে সংগঠন চালাব ভাবতে গিয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। এর ভেতর কোত্থেকে এসে হাজির হয়েছে বেশ্যা ইংরেজ মেয়েটা।
বাড়ির আসবাবপত্র আর পেইন্টিং বিক্রি করছ অনেক দিন ধরে, বলল রানা।
উপায় নেই। ফকির হওয়ার দশা আমার। মিস ট্রুলি ওই টাকা দেবেন, সেই আশায় বসে আছি। টাকা না পেলে সব বিক্রি করে ভিক্ষার থালা হাতে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।
ফালতু পেঁচাল বাদ দিয়ে মূল কথায় এসো, বলল রানা।
ঠিক আছে। মিস ট্রুলির সামনে ধার্মিক হয়ে ওঠে মিস হার্বার্ট। ওর চেয়ে ভাল মেয়ে নেই। পরনে লম্বা স্কার্ট, ফুল হাতা ব্লাউয। যাচ্ছে খ্রিস্টানদের সব ধর্মানুষ্ঠানে। কিন্তু জেনে গেলাম, শহরের শতখানেক যুবকের চাহিদা মিটিয়েও ওর নিজের খাই মেটে না।
এসব জেনেছ তোমার লোকদের কাছ থেকে?
মাথা দোলাল বার্কলে। কপাল থেকে মুছল ঘাম। ক্যাথি হার্বার্টের পিছু নিল আমার দুজন লোক। জানলাম সব। বুঝে গেলাম, পচাতে হবে মেয়েটাকে। কাদা ঘাটতেই বেরিয়ে এল সব। মিস ট্রুলির আড়ালে তাঁরই গেস্টহাউসে চলত রাতের পর রাত যৌনানুষ্ঠান। একইসঙ্গে মিলিত হতো দুই থেকে তিনজন যুবকের সঙ্গে। তাদেরই একজন পিছলা সিম্পসন। এতজন, নাম মনে রাখা যায় না। সাড়া ফেলে দিয়েছিল স্যাভানা শহরের যুব সমাজে।
এরপর কী বলবে বার্কলে, বুঝে গেছে রানা। তাই লোক দিয়ে ক্যাথির কীর্তি ভিডিয়ো করালে। ওসব দৃশ্য দেখিয়ে তিক্ত করে দিলে মিস ট্রুলির মন।
জানতে পারেননি, কে পাঠিয়ে দিয়েছে ওই ভিডিয়ো, বাল বার্কলে। চিঠিতে লেখা হয়েছিল: আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, মিস ট্রুলি। কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু পরেরবার ডিনারে গিয়ে টের পেলাম, পরিবেশটা ঝড়ের আগের মুহূর্তের মত থমথমে। বুঝলাম; রেগে গেছেন তিনি। আমার লোকের করা ভিডিয়ো কাজ করেছে ঠিকভাবে। আবারও আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন মিস ট্রুলি। ওই এক শ মিলিয়ন ডলার পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
কিন্তু তোমার ওপর খেপে গেল ক্যাথি, বলল রানা।
বুঝল, যেভাবেই হোক মিস ট্রুলিকে বিগড়ে দিয়েছি। এর কদিন পর আমেরিকা ছেড়ে চলে গেল মেয়েটা। ভাবলাম, এ জীবনে আর নাম শুনব না বেশ্যাটার। কিন্তু কয়েক দিন পরেই ফোন করল মড়াখেকো কুত্তীটা।
জানি। পঁচিশ হাজার ডলার চেয়ে বসল। পরে নেবে দশ মিলিয়ন।
তা হলে তো সবই জানো, বলল বার্কলে। দিয়ে দিলাম পঁচিশ হাজার ডলার। বলে দিলাম, টাকা পেলে তখন বাকি অংশও দেব। কোনও সমস্যা নেই।
এত সহজে দিয়ে দেবে? কেন?
জানতে চাইছ কেন? মিথ্যা তো বলিনি। দেব বলেছি, তাই দেব। কিন্তু এরপর যা হয়েছে, সেসবের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। এবার, তুমি কিছু না মনে করলে বিদায় নাও। অনেক কাজ পড়ে আছে। উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছে লোকটা।
বসো, কথা আছে, আবার রিভলভার তুলল রানা।
বিশ্বাস করছ না আমার কথা?
পরের সব জানাও। কী ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীর জন্যে এত টাকা দিতে রাজি হলে?
ধপ করে চেয়ারে বসল বার্কলে। ও; এজন্যেই গতকাল রাতে ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে এত কথা বলেছিলে?
উকিল পিছলা সিম্পসন যে বাক্স এনেছিল, ওটার ভেতর কী ছিল?
একটা হাঁড়ির টুকরো। আর কিছু না।
রানার মনে পড়ল, অক্সফোর্ডের সামারটাউনে লাঞ্চের সময় প্রফেসর হার্বার্ট বলেছিলেন, প্রাচীন কিছু পটারি খুঁজে পেয়েছে ক্যাথি।
দশ মিলিয়ন ডলার কেন দিতে হবে মৃৎশিল্পের ভাঙা টুকরোর জন্যে? জানতে চাইল রানা।
জানি না, বলল বার্কলে।
ফাজলামো করছ? কঠোর হলো রানার চোখ। হাঁড়ির টুকরো দেখাল, আর পঁচিশ হাজার ডলার দিয়ে দিলে এর কী ব্যাখ্যা? আবারও হ্যামার ওপরে তুলল। ঝেড়ে কাশো।
কার্বন ডেট করিয়ে দেখেছি আমি ওটা, বিমর্ষ মুখে বলল বার্কলে। ওটা ওই সময়ের।
কোন সময়ের?
মুখ নিচু করল বার্কলে। ওই হাঁড়ির টুকরো বুক অভ রেভেলেশন লেখার আমলের।
তো?
ওই টুকরো দেখিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ওই সময়ের অনেক কিছুই আছে ওর কাছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল বার্কলে।
কী আছে?
প্রমাণ। বেশ্যাটা হুমকি দিয়েছে, তার কাছে আছে প্রাচীন গ্রিসের সব মৃৎশিল্প। ওখানে লেখা আছে বিবলিকাল সব তথ্য। প্রমাণ করে দেবে, সেন্ট জন কখনও বুক অভ রেভেলেশনের লেখক ছিলেন না।
তো?
তাতেই তো সব। আমার মাথায় বাজ ফেলেছে ওই হারামজাদী। বাড়তি আর কিছু জানা নেই। বেটির কথা অবিশ্বাস করে মরতে চাই না। সত্যিই যদি ফাঁস করে দেয় বুক অভ রেভেলেশন ভুয়া, আমি শালা শেষ।
মিথ্যা প্রমাণিত হবে, সন্ত জনের সঙ্গে স্বপ্নে কথা হয়নি। তোমার।
চোর-চোর চেহারা করে মাথা নাড়াল বার্কলে।
মৃদু হাসল রানা। তা হলে বলছ, আসলে সন্ত জনের সঙ্গে কথা হয়নি তোমার?
পুরনো আমলের লোক… বিড়বিড় করল বার্কলে, মরেছে দুহাজার বছর আগে। কথা বলব কী করে?
হুম।
বইয়ে নিজের কথায় জোর দিতে তাকে টেনে এনেছি, কাতর সুরে বলল বার্কলে। নইলে আমার কথা শুনত না কেউ। মানত না আমি শেষ সময়ের সেরা বাইবেল প্রচারক।
তাই মিথ্যা লিখলে? বোকা বানাতে চাইলে সবাইকে?
বুক অভ রেভেলেশনের ওপর ভর করে লিখেছি ওই বই। সব ভেস্তে যেত ওই বেশ্যার মাত্র এক তুড়িতে। উদাস হয়ে জানালা দিয়ে দূরে তাকাল বার্কলে। আমেরিকার অন্তত দশ লাখ মানুষ মনে করে, সন্ত জনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে আমার। নিজে বলেছে: সে-ই লিখেছে প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী। এদিকে শত শত বছর ধরে থিয়োলজির স্কলাররা প্রমাণ খুঁজছে, ওটা লিখেছে অন্য কেউ। এখন কোথা থেকে এসে মাটি খুঁচিয়ে একগাদা হাঁড়ি বের করে আমার পোঁদে বাঁশ দিতে চাইছে ওই শয়তান বেশ্যা বেটি।
বাহ্, মুখটাকে তো পালিশ করে ফার্স্টক্লাস বানিয়েছ! প্রশংসা ঝরল রানার কণ্ঠে। তাহলে সব গোপন রাখবে ও দশ মিলিয়ন ডলার পেলে?
অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল বার্কলে। আমাকে তা-ই বলেছে। ঝুঁকি নেয়ার সাহস নেই। দুই পয়সার ছাত্রী নয়, নামকরা স্কলার। নিজে লিখেছে অ্যাকাডেমিক বই। তার কথা বিশ্বাস করবে না, এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। যদি টিভিতে বলে, ওর কাছে প্রমাণ আছে? আর তারপর সত্যিই যদি প্রমাণ করে দেয়? তখন? ওর এককথায় মাটিতে মিশে যাব আমি। শেষ হবে আমার রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার সব আশা।
হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এক শ মিলিয়ন ডলার।
দুঃখিত চেহারায় মাথা দোলাল বার্কলে। ফোনে আমাকে বলেছিল, সব বলে দেবে মিস ট্রুলিকে। প্রমাণ করে দেবে, আমি আসলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ঠকবাজ।
কথা মিথ্যা নয়, বলল রানা, নিজেই স্বীকার করেছ।
জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে রইল বার্কলে। কিছুক্ষণ পর ঘুরে তাকাল রানার চোখে। ঠিকই বলেছ। আমি ঠকবাজ। প্রতারক। কিন্তু এর বেশি কিছু নই। কারও ক্ষতি করিনি। কাউকে পাঠাইনি গ্রিসে। বোমা ফাটানো আর পা ভাঙার ব্যাপারে জড়িত নই। মাত্র দুবার দেখেছি উকিল পিছলা সিম্পসনকে। যখন বাক্সটা নিয়ে এল, আর আরেকবার টাকা দেয়ার সময়। ব্যস।টাকা দেয়ার পর চলে যায় সে। লালচে হয়ে গেল বার্কলের গাল। ডেস্কের পেছন থেকে উঠে দাঁড়াল। আমি বাইরে যাব। চাইলে গুলি করো, আপত্তি নেই। তবে গুলি করলে মনে রেখো, নিরপরাধ লোককে খুন করেছ।
পরে যদি বুঝি মিথ্যা বলেছ, আবারও ফিরব আমি, বলল রানা, সেক্ষেত্রে খুন হবে। এক হাজার গজ দূর থেকে মরবে, না কাছ থেকে গুলি খেয়ে, টেরও পাবে না। কথাটা মাথায় রেখো।
স্টিভ বার্কলেকে দরজার দিকে যেতে দেখল রানা। বুঝে গেছে, একটা কথাও মিথ্যা বলেনি আতঙ্কিত ওই লোক। মস্ত ভুল ভেবেছে ও।
.
২৮.
প্রথম যখন রাজনীতির কর্দমাক্ত মাঠে হাঁটতে থাকেন সিনেটর হেনরি শোফেল্ড, তিনি ছিলেন অতি বড়লোক বাবার নির্বোধ, উচ্ছল সন্তান। মনে আশা, হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাঁর বাবা মণ্ট্যানার কাঠুরে, প্রচণ্ড পরিশ্রম করে হয়েছিলেন কোটিপতি ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। তবে তাঁর ছেলে হেনরি জীবনেও কোনও পরিশ্রম করেননি। ব্যবসায় মন দেয়ার চেয়ে তাঁর কাছে অনেক জরুরি ছিল ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দেয়া। সময় কাটিয়েছেন গলফ বল গর্তে ফেলা বা শতখানেক বান্ধবী নিয়ে তুমুল আড্ডায়। এ ছাড়া আছে মাছ ধরা ও প্রিয় পোর্শে ৯৫৯ নিয়ে ঝড়ের বেগে বহু দূরে চলে যাওয়া।
গত দুবছর আগের কথা। হেনরি শোফেন্ডের চিফ অভ স্টাফ, পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও তার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার রনসন থর্ন ভাবছিল, তার বয়স মাত্র সাঁইত্রিশ বছর, তাই এখনও সুযোগ আছে নতুন ক্যারিয়ার গড়ে নেয়ার। যে রাজনীতিকে মজার খেলা, মনে করে, তার কাছ থেকে দূরে থাকাই উচিত। চরম বোকামি হচ্ছে আস্ত গাধা হেনরি শোফেন্ডের পেছনে পরিশ্রম দিয়ে।
হতাশ হয়ে পদত্যাগ করবে ঠিক করেছে, এমনসময় ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। বলা উচিত, আসলে দুটো ঘটনা। তাতেই পাল্টে গেলেন হেনরি শোফেল্ড। আর এ কারণেই জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ পেয়ে গেল রনসন থর্ন।
হেনরি শোফেল্ডের পঞ্চাশতম জন্মদিনের মাত্র কদিন পর ঘটল প্রথম ঘটনা। ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে মন্টানায় বাড়ি ফিরবেন বলে এয়ারপোর্টে বিমানে উঠবেন হেনরি, এমনসময় হঠাৎ করেই তাঁর মনে হলো: উচিত হবে না বিমানে ওঠা। মাথার ভেতর কে যেন বলে উঠল: প্রাণে বাঁচতে চাইলে ভুলেও উঠবে না ওই বিমানে। খুব অস্বস্তি বোধ করলেন তিনি। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেন, উঠছেন না বিমানে। পরের বিমানে ফিরবেন বাড়ি। পনেরো মিনিট পর রানওয়ে থেকে আকাশে উঠতে গিয়ে ক্র্যাশ করল ওই বিমান। বাঁচল মাত্র কয়েকজন। তাঁর জীবনে যে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে, তা দশ মুখে বলতে লাগলেন তিনি।
দ্বিতীয় ঘটনা তার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন তিনি। গতি তুমুল। উড়ে চলেছে পোর্শে গাড়ি। সামনেই একটু দূরে বাঁক। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, ব্রেক কষে থেমে যেতে হবে। দেখবেন সূর্যাস্ত আর সোনালি-নীল আকাশ। গাড়ি থামিয়ে পুরো দশ মিনিট প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলেন তিনি। তারপর পোর্শে নিয়ে ছুটে চললেন বাড়ির দিকে। এক মাইল যাওয়ার পর চমকে গেলেন চ্যাপ্টা হওয়া এক বাস দেখে। পাহাড়ি ভূমিধস প্রায় পিষে দিয়েছে বাসটাকে। ঊনচল্লিশজন যাত্রীর মধ্যে বাঁচল মাত্র তিনজন। হিসেব কষে সিনেটর শোফেল্ড দেখলেন, ঠিক যে সময়ে বাসটাকে চাপা দিয়েছে ভূমিধস, ওই একই সময়ে ওখানে থাকার কথা ছিল তাঁরও। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে থেমে গিয়েছিলেন বলে বেঁচে গেছেন তিনি।
এর শুধু একটা কারণই খুঁজে পেলেন সিনেটর। দুবার তাঁর প্রাণ রক্ষা করেন ঈশ্বর। তার কারণ, আরও জরুরি কোনও কাজে হেনরিকে দরকার তার। এসব ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। দ্বিতীয়বারের মত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে বদলে গেল সিনেটরের চিন্তা-ভাবনা। পরের আঠারো মাসে নাটকীয়ভাবে পাল্টে নিলেন রাজনৈতিক দর্শন। প্রথমবারের মত নিজে থেকে কাজ করতে শুরু করলেন তিনি। মানসিকভাবে হয়ে উঠলেন প্রাপ্ত-বয়স্ক। অন্তর থেকে তাকে ভালবেসে ফেলল তাঁর অনুসারীরা। দুই-দুইবার প্রাণে বেঁচে জীবনের মূল্য বুঝে গেছেন তিনি। সময় নষ্ট না করে নামলেন মানুষের সেবায়। তখনই টের পেলেন, সমাজের বিশেষ একাংশ থেকে পাচ্ছেন বুক ঢালা সমর্থন। আগে ওসব মানুষ পাত্তাও দিত না তাকে। এদেরকে কখনও হিসেবের ভেতরেই রাখেনি রনসন থর্ন। যিশু ফিরবেন, আর ফুরিয়ে এসেছে পৃথিবী, এটা মেনে নিয়েই জীবন পার করছে আমেরিকার বহু মানুষ। তাদের সংখ্যা পাঁচ কোটিরও বেশি। দুর্ঘটনার কবল থেকে বেঁচে এদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছেন হেনরি শোফেল্ড। এর ভাল দিক ঠিকই বুবলি রনসন থর্ন। পাঁচ কোটি ভোটারের সমর্থন মানেই হোয়াইট হাউসে বসবাসের অনেকটা কাছে পৌঁছে যাওয়া।
নিজের কপাল দেখে অবাক হয়েছিল থর্ন। চিরকালের হারামজাদাটা খাটছে প্রেসিডেন্ট হতে! কাকতালীয় হোক বা অলৌকিক কিছু, জনগণের তৈরি মস্ত এক ঢেউয়ের মাথায় চেপে বসেছেন হেনরি। এখন থর্নের কাজ ওই ঢেউ থিতিয়ে যাওয়ার আগেই সাগর পার করে তাঁকে সৈকতে তুলে দেয়া। ঠেলে তুলতে হবে জগদ্দল শোফেল্ডকে হোয়াইট হাউসে।
হঠাৎ বাইবেলে নাক খুঁজে নানানদিক বুঝতে চাইল থর্ন। বসের অনড় বিশ্বাস: ফুরিয়ে এসেছে পৃথিবীর সময়। বুক অভ রেভেলেশনে আগেই লেখা হয়েছে এসব। প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্লেষণ করল থর্ন। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয়ে আমেরিকার মানুষের গভীর বিশ্বাস হতবাক করল তাকে। এরা ধরে নিয়েছে, যেহেতু মিথ্যা নয় বাইবেল, কাজেই যে কোনও সময়ে নরকের মত হয়ে উঠবে এই বিশ্ব। এ থেকে দুটো দিক বুঝল থর্ন। প্রথমটা কাউকে বলবে না, নইলে শয়তানের পুত্র ভাববে ওকে লোকে। দ্বিতীয় দিক: এতদিন ধর্মের নাম ভাঙিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা চায়নি কেউ। অথচ, সোনার ওই মস্তবড় খনি পেয়েছে সে। আমেরিকায় কখনও ওই খনি থেকে সোনা তোলেনি কেউ।
চুপচাপ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়তে লাগল থর্ন। প্রবল স্রোতের মত জনগণের সমর্থন পেলেন শোফেল্ড। আমেরিকার যেখানেই গেছেন, শুধু একবার তাকে দেখতে ছুটে এসেছে লাখ লাখ ভোটার। বক্তৃতা দিতে গেলে উপচে পড়েছে অডিটোরিয়াম। টিভি ও রেডিয়োতে বক্তৃতা দিলে কান পেতে শুনেছে অন্তত কয়েক কোটি মানুষ। মাত্র কয়েক মাসে সিনেটর শোফেল্ড হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্টের চেয়েও জনপ্রিয়। হুড়মুড় করে আসছে তার ফাণ্ডে ডোনেশন।
থর্ন বুঝে গেল, এই সবে শুরু।
বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর পূর্ণবিশ্বাস রেখেছে কোটি কোটি আমেরিকান নাগরিক। চাইছে সত্যি হোক সব। মিথ্যা যেন না হয় ঈশ্বরের ইচ্ছে। এরফলে দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ হলে মরবে শত শত কোটি মানুষ তাতে কী, ভবিষ্যদ্বাণী তো ফলবে! ম্যাড়মেড়ে জীবনে কম কথা নয় ওটা পাওয়া। ঝরবে কোটি মানুষের রক্ত, ধ্বংস হবে পৃথিবী, কিন্তু তারপর বিশ্বাসীদেরকে রক্ষা করবেন ঈশ্বর। কে না চাইবে স্বর্গে যেতে?
কিন্তু বাইবেলে লেখা আছে: ঈশ্বর সবাইকে স্বর্গে নেয়ার আগে পৃথিবী জুড়ে আসবে ভীষণ কষ্টের সময়। সেসব সহ্য করতে হবে ধার্মিক মানুষকেও। কিন্তু সে সময়ে কোটি কোটি মানুষকে পথ দেখাবার জন্যে লাগবে সত্যিকারের নেতা। এমন একজন, যে কিনা হবে নবী মুসার মত, বা যিশুর মত। যে কিনা প্রতিটি পদে দেখাবে পথ।
সিনেটর শোফেল্ডকে নিয়ে দিনের পর দিন ভেবেছে রনসন থর্ন। নিরেট বোকাসোকা লোক হেনরি শোফেল্ড। তিনি মস্ত এক নেতা হলে, কেমন হবে তাঁর আচরণ? বাইবেল বিশ্বাসীদের ভোটে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পা রাখলে, পেছন থেকে গোটা দেশটাকে, শুধু এই দেশ কেন, গোটা পৃথিবীকে চালাতে পারবে থর্ন।
কিন্তু সফলতা চাইলে আগে লাগবে প্রাকৃতিক সহায়তা। ঘটতে হবে বাইবেলের সব ঘটনা। সেটা প্রায় অসম্ভব। তবে একদল যোগ্য লোক সঙ্গে থাকলে, হয়তো সম্ভব প্রেসিডেন্ট হিসেবে হেনরি শোফেল্ডকে হোয়াইট হাউসে বসিয়ে দেয়া।
এসব নিয়ে ভাবছে রনসন থর্ন, এমনসময় সামাজিক এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক লোকের। সে বিশ্বাস করে ফুরিয়ে গেছে পৃথিবীর আয়ু। মাত্র কয়েক দিন আলাপে থর্ন জেনে গেল, ওই লোক কাজ করে ইউএস ইন্টেলিজেন্সে। ছোটখাটো অফিসার নয়। তার কাছ থেকেই থর্ন জানল, আমেরিকার সরকারের লাখ লাখ কর্মচারী ও কর্মকর্তা মনে করে, সময় হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের।
এ তথ্য পেয়ে গতি এল থর্নের পরিকল্পনায়। পরিচিত লোকটার মাধ্যমে জোগাড় করল সমমনা অনেককে। প্রত্যেকে সিআইএ বা এধরনের সংগঠনে চাকরি করছে বা করেছে। তাদেরই একজন সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট। দুনিয়ার কী হলো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই তার। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অঢেল টাকা পেলেই খুশি। ওই লোক এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল থর্ন। এ দলে ভিড়ে গেল অ্যামেটের পরিচিত অসুস্থমস্তিষ্ক অনেকে। মাঝখানে হেনরি শোফেল্ডকে রেখে, তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে গোটা দেশ শাসন করবে তারা। দলের প্রধান হবে রনসন থর্ন।
দেখতে না দেখতে মাত্র কয়েক দিনে তারা গড়ল গোপন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। বহু হিসাব কষে স্থির হলো, কীভাবে পৃথিবীর বুকে আনা হবে মহাপ্রলয়।
বিশাল পরিকল্পনা তাদের। তবে ওটা সহজ-সরল।
প্রথমে বাধাতে হবে যুদ্ধ।
এমন এক যুদ্ধ, বিশ্বাসীরা ভাববে: ফলতে শুরু করেছে বুক অভ রেভেলেশনে লেখা বাইবেলের বাণী।
কাজটা কঠিন হবে না।
ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যুদ্ধ বাধবে মধ্যপ্রাচ্যে।
ওটা পাকিয়ে তোলা খুব সহজ।
বাইবেল অনুযায়ী, যুদ্ধ হবে সেটা তো ঈশ্বরেরই ইচ্ছে!
তাঁকে সন্তুষ্ট করতে যুদ্ধে একটু শুধু হাত লাগাবে থর্নরা।
ডিনামাইটের পাহাড়ে এক ফুলকি আগুন ফেলার মত হবে ব্যাপারটা।
রাগে-দুঃখে পাগল হয়ে উঠবে সাধারণ মুসলিমরা।
কীভাবে তাদেরকে উস্কে দেবে, আগেই স্থির করেছে থর্ন ও তার দলের নেতারা।
এখন রয়ে গেছে শুধু সবুজ সঙ্কেত দেয়া।
সব দোষ চাপবে ইসলামের পুরনো শত্রু ইহুদি জাতির ঘাড়ে। নানান দেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে গেলে, মুসলিমদের তরফ থেকে ইহুদিদের ওপর আসবে চরম হামলা।
আগুন ও পাথরের কথা তো আগেই আছে বাইবেলে। সবাই ধরে নেবে, বলা হয়েছে পারমাণবিক বোমার কথা।
যত বাড়বে যুদ্ধের উন্মাদনা, আমেরিকার কোটি কোটি ভোটার ভাববে: শেষ হচ্ছে পৃথিবী! তারা সত্যিকারের কোনও ভাল নেতার ওপর রাখতে চাইবে বিশ্বাস। আর সেক্ষেত্রে কে ঠেকাবে হেনরি শোফেল্ডকে!
মনে হতে পারে, খামোকা নিরীহ মানুষের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া চরম নিষ্ঠুরতা। খুন হবে কোটি কোটি ইহুদি ও মুসলিম। মরবে কিছু আমেরিকান নাগরিকও। তবে তাতে কিছুই যাবে আসবে না রনসন থর্নের। তার যুক্তি পাক্কা, সহজ, সুন্দর ও কাজের। ক্ষমতা পেতে ব্যবহার করবে মহাপ্রলয়ের বুলি। ধীরে ধীরে গড়ছে সে হেনরি শোফেল্ডকে। গড়ছে নিজ ভবিষ্যৎ। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস আছে, এমন এক নেতাকে সামনে রেখে প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করবে সে।
কিন্তু হেনরি শোফেল্ডের আছে এক প্রতিযোগী। এখনও অত শক্তিশালী নয় সে। বহু দিন ধরেই বাজাচ্ছে মহাপ্রলয়ের ঢাক। থর্নের কথায় তার ওপর চোখ রাখছে একদল সিআইএ এজেন্ট। সত্যি বলতে, চোখ রাখা হয়েছে ধর্মীয় সব সংগঠনের বড় নেতাদের ওপরেই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক যাজক স্টিভ বার্কলে। জর্জিয়া থেকে দাঁড়াতে চাইছে গভর্নর পদে।
আপাতত প্রেস কনফারেন্সের জন্যে হেনরি শোফেন্ডের সঙ্গে লিমোতে চেপে চলেছে রনসন থর্ন। উথাল-পাতাল করছে মন। রওনা হওয়ার আগে খারাপ খবর শুনে বাজ পড়েছে মাথায়। নতুন করে গণ্ডগোল বেধেছে ক্যাথি হার্বার্টের কারণে।
.
হাজারো একর জুড়ে সিনেটর শোফেল্ডের এলাকা। বিশাল প্রাসাদের মত বাড়িটাও দেখার মত সুন্দর। নিজের প্রকাণ্ড অফিসে পায়চারি করছে রন থর্ন। গত মাসে যা ঘটেছে, অস্থির লাগছে তার। মস্ত জানালা দিয়ে দেখল অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য।
পায়চারি থামিয়ে ডেস্ক থেকে নিল দুধের বোতল। বসে পড়ল আরামকেদারায়। রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে চালু করল দেয়ালে ঝুলন্ত বিশাল টিভি।
গত তিনমাসে যত অনুষ্ঠানে গেছেন হেনরি শোফেল্ড, সেগুলোর ডিভিডি করিয়ে নিয়েছে সে। নিয়মিত দেখছে এসব প্রোগ্রাম। ভবিষতে আরও ভাল কিছু করা যায় কি না, সেসব নিয়ে ভাবছে। নানাদিক থেকে আগলে রেখেছে শোফেল্ডকে। সেজন্যে মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে নিল থর্ন। নিরেট গাধাটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ নয়। ও নিজে লিখে দিয়েছে প্রতিটি বক্তৃতার বক্তব্য। ফলে সাধারণ ভোটারদেরকে মাতিয়ে তুলছে সিনেটর।
আজ অনুষ্ঠান থেকে ফিরবে, এমনসময় অডিটোরিয়ামের পেছন থেকে উঠে দাঁড়াল লম্বা চুলের এক ছাত্র। জিজ্ঞেস করল ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক একটা বিষয়ে।
টিভি স্ক্রিনে মন দিল থর্ন। রিমোট টিপে গেল ডিভিডির নির্দিষ্ট অংশে। হাত তুলেছে ছাত্র। তার দিকে ঘুরে গেছে ক্যামেরা। সিনেটর, অনেক স্কলার মনে করেন বুক অভ রেভেলেশন আসলে বাইবেলের অংশই নয়। এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য?
টিভিতে দুজনকে দেখাল দুটো ক্যামেরা।
হাসলেন শোফেল্ড। কণ্ঠ শান্ত, এ বিষয়ে সবই পড়েছি, কিন্তু টলিয়ে দিতে পারেনি কেউ আমার বিশ্বাস।
ছাত্র এবার বলল, কিন্তু যদি প্রমাণ হয় বুক অভ রেভেলেশনের লেখক নন সেন্ট জন, ওসব বক্তব্য ঈশ্বরের নয়- তখন? তাতে কি নষ্ট হবে আপনার বিশ্বাস, স্যর?
লাইভ টিভিতে অনুষ্ঠানের সময় চেয়ারের হাতল খামচে ধরেছিল রনসন থর্ন।
এক সেকেণ্ড দ্বিধা করেছেন শোফেল্ড, তারপর আস্তে করে মাথা দুলিয়ে বলেছেন, সত্যি যদি দেখা যায় কোনও স্কলার প্রমাণ করে দিলেন, সেন্ট জন ওই বই লেখেননি… নাটকীয়তার জন্যে থেমে গেলেন তিনি। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, তো ধরে নেব নতুন করে ভাবতে হবে আমাকে। তবে, সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের কাছ থেকে নিশ্চয়ই পাব নতুন ইঙ্গিত। তখন এগোব নতুন বিশ্বাস বুকে নিয়ে। চওড়া হেসেছেন সিনেটর। খুশি হব এই ভেবে যে আমাদের মত অসংখ্য মানুষকে অত কষ্টের মাঝ দিয়ে যেতে হবে না।
কথাগুলো শুনে খুশি মনে হেসেছে দর্শকরা।
সে সময়ে ওই বিষয়ে কিছু ভাবেনি থর্ন। কিন্তু পরে এখন মনে হচ্ছে, সবাইকে নিয়ে বিপদেই আছে সে।
জর্জিয়ার স্টিভ বার্কলের ওপর যারা চোখ রেখেছিল, আগেই জানিয়ে দিয়েছে, বুক অভ রেভেলেশনের কোনও ব্যাপারে বার্কলেকে ব্ল্যাকমেইল করছে কেউ। এর আরেক অর্থ, ব্ল্যাকমেইলারের হাতে আছে জোরালো প্রমাণ। হয়তো তার কারণে অদূর ভবিষ্যতে বাতিল হবে বাইবেলের ওই অংশ। কথাটা ভাল লাগেনি থর্নের। লাগার কথাও নয়।
খোঁজখবর নিতেই জানল, ব্ল্যাকমেইলার এক যুবতী। আগে ক্যাথি হার্বার্ট নামটা শোনেনি থর্ন। কিন্তু গুগল ঘাঁটতে গিয়েই বাড়ল দুশ্চিন্তা। স্কলার মেয়ে। সে যদি প্রমাণ করে দেয় নিউ টেস্টামেন্টের ওই অংশ বানোয়াট, স্রেফ মাঠে মারা পড়বে ওদের সমস্ত পরিকল্পনা!
শুধু তা-ই নয়, বাতিল অংশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে খ্রিস্টান ধর্মের গুরুরা। হেনরি নিজে বলেছেন, বুক অভ রেভেলেশন ভুয়া প্রমাণ হলে, খুশি মনে মেনে নেবেন স্কলারদের কথা। সেক্ষেত্রে মহাপ্রলয় হবে বলে যে কোটি কোটি আমেরিকান নাগরিক বসে আছে, তারাও ভাববে নতুন করে। তখন আর হেনরি পাবেন না তাদের ভোট। অর্থাৎ, যতই স্বপ্ন দেখুক থর্ন, ঠেলেও আর হোয়াইট হাউসে তুলতে পারবে না হেনরি শোফেল্ডকে।
ব্যবসায়ী মানুষ থর্ন, মগজও চলে যৌক্তিকভাবে। এই অবস্থায় কী করা উচিত, সেটা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগেনি তার।
প্রথমে ভেবেছিল, পয়সা ঢেলে বন্ধ করে দেবে ক্যাথি হার্বার্টের মুখ। স্টিভ বার্কলের কাছ থেকে দশ মিলিয়ন ডলার চাইছে মেয়েটা। কার কাছ থেকে ওই টাকা আসছে, তা তার মাথার ব্যথা নয়। দরকার হলে বিশ মিলিয়ন দেবে থর্ন। কিন্তু এরপর কিছু দিন যেতে না যেতেই যদি আরও টাকা দাবি করে ওই মেয়ে? যদি টাকা নেয়ার পরেও ফাস করে সব? উপায় আছে ব্ল্যাকমেইলারকে বিশ্বাস করবার?
এরপর দ্বিতীয় চিন্তা যেটা এল, ওটা অনেক যৌক্তিক। গায়েব করে দিতে হবে ওই মেয়েকে। তার পেট থেকে বের করতে হবে কোথায় রেখেছে সে-সব প্রমাণ। ওগুলো ধ্বংস হলে, এবং মেয়েটাকে গায়েব করে ফেললে, প্রমাণ বলতে কিছুই থাকবে না।
দলের ওপরের দিকের একজনের সঙ্গে কথা বলল থর্ন। সিআইএর ওই লোক কাজটা দিল ক্যাল অ্যামেটকে। ওই লোক আবার কাজ দিল জুনিয়র অফিসার ও প্রাক্তন কজন অফিসারকে। কোর্ফিউ দ্বীপে গিয়ে মেয়েটাকে কিডন্যাপ করল তারা। ঠিকই বন্দি হলো ক্যাথি, কেউ জানল না কোথায় আছে সে। কিন্তু গজিয়ে গেল নানান সমস্যা। এদিকে বাড়তি সময় নেই থনের হাতে। যা করার করতে হবে দ্রুত।
ডিভিডি মেশিন বন্ধ করে আরামদায়ক চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল থর্ন। টিপছে মাথার তালু। পাশে ছোট এক টেবিলে কাঠের বউলে অসংখ্য চকলেট। ওখান থেকে তিনটে নিয়ে : খাসা ছাড়িয়ে মুখে পুরল সে। খাওয়া শেষ করে তুলে নিল ফোনের রিসিভার। টিপতে লাগল বাটন।
দ্বিতীয়বারের মত ডায়াল হওয়ার পর কল রিসিভ করল সিআইএ এজেন্ট।
জরুরি কথা আছে, বলল থর্ন। চুপচাপ শুনল ওদিকের বক্তব্য। তারপর বলল, না। তুমি এসো। আমি একা। কয়েক দিনের জন্যে গাধাটাকে পাঠিয়ে দিয়েছি ছুটিতে।
তিন ঘণ্টা লাগবে পৌঁছুতে, বলল সিনিয়র সিআইএ এজেন্ট।
দুঘণ্টার ভেতর হাজির হবে, নির্দেশ জারি করল থর্ন।
.
২৯.
হাইওয়ে থেকে নেমে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টের সামনের পার্কিং লটে থামাল ডক্টর মান ভাড়া করা হোণ্ডা গাড়ি। ব্রিফকেস নিয়ে গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়ল। একবার গুঙিয়ে উঠল শরীরের ব্যথায়। গাড়ি চালিয়ে আসতে হয়েছে বহু দূর। আড়মোড়া ভেঙে ডলে নিল দুই চোখ।
ধুলো ভরা উত্তপ্ত বাতাস ও কালো ধোঁয়া নাকে-মুখে ছুঁড়ে সাঁই করে পাশ কাটিয়ে গেল বড় একটা ট্রাক। আড়ষ্ট পায়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকল ডাক্তার মান। ভেতরে খদ্দের নেই বললেই চলে। কোণের বুথে গিয়ে বসল সে। অর্ডার দিল কফির। কিছুক্ষণ পর লালচে যে জিনিস এল, ওটাকে আর যাই হোক, কফি বলা যেতে পারে না। নাক-মুখ কুঁচকে ওই জিনিসই দুই ঢেকে গিলে ফেলল ডাক্তার।
নিজের হাতের দিকে চেয়ে পার করে দিল পুরো ত্রিশ মিনিট। সময় থাকতে ড্রাগটা নিয়ে রওনা হওয়া উচিত। অন্তত আরও দুঘণ্টা লাগবে ওই ফ্যাসিলিটিতে ফিরতে।
তিক্ত হাসল ডাক্তার মান।
এরা ওটাকে আবার বলে ফ্যাসিলিটি!
নির্জন এলাকায় প্রায় পরিত্যক্ত একটা হোটেলে বেআইনী সব কাজে জড়িয়ে গেছে সে। নির্যাতন করছে কিডন্যাপ করা নিরীহ এক নিরপরাধ মেয়েকে।
পাশের চেয়ারে রাখা ব্রিফকেস দেখল ডাক্তার মান। ওটা টেবিলে তুলে খুলল ডালা। ভেতর থেকে বের করে নিল ছোট একটা বোতল। টেবিলে নামিয়ে রাখল ওটা। পানির মত স্বচ্ছ এক শ মিলি লিটারের ড্রাগ। মনে হচ্ছে সাধারণ হার্বাল ওষুধ। কিন্তু ওটা আসলে কী, ভালভাবেই জানে মান। রেস্টুরেন্টের কফির পটে ওই জিনিস ঢাললে, অন্তত ত্রিশজন সুস্থ লোক একদিনে চিরকালের জন্যে বদ্ধউন্মাদ হয়ে যাবে।
প্রথমে বকবক করবে তারা, বাদ রাখবে না পেটের কোনও কথা বলতে। বেরিয়ে আসবে তাদের যত ভয়, রাগ, নোংরামি, তিক্ততা, আবেগ ও হিংস্র সব চিন্তা। পুরো অতীত মনে পড়বে হুড়মুড় করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলবে এমন। এত মানসিক অত্যাচারে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মানুষটা হবে উন্মাদ। এই ড্রাগের কোনও অ্যান্টিডোট নেই।
ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল ডাক্তার মাল্ডুন। এমন ভয়ঙ্কর ড্রাগ তুলে দিচ্ছে সে ক্যাল অ্যামেটের হাতে।
কেন?
যাতে এই ড্রাগ প্রয়োগ করা যায় মেয়েটার ওপর।
সারাজীবনের জন্যে শেষ হয়ে যাবে বেচারি।
দুহাতে মাথা চেপে ধরল মান। ভাবছে: কী করে এসবের ভেতর নাক গুঁজে দিলাম?
কেন আজ তার এ অবস্থা, ভাল করেই জানে সে।
ছোট্ট একটা ভুল করেছিল অতীতে। ভেবেছিল ওটার কথা ভুলে গেছে সবাই। কিন্তু তা নয়। ওই ছোট্ট ভুল আজ শেষ করে দিচ্ছে তাকে।
গরীব পরিবার থেকে এসেছে ডিক মাল্ডুন। প্রাণপণ চেষ্টা করেছে সমাজে সম্মানের অবস্থানে পৌঁছুতে। তার বাবা ছিল ডেট্রয়েটের এক ফ্যাক্টরির মজুর। মা ঝাড় দিত কয়েকটা অফিসে। বাবা-মা প্রাণপণ পরিশ্রম করেছিল ওকে কলেজে পড়াবার জন্যে। মানও গর্বিত করেছিল তাদেরকে।
গ্র্যাজুয়েশন করেছে মেডিসিনের ওপর। এরপর বেছে নিয়েছে নিউরোলজি ও সাইকিয়াট্রি। চব্বিশ বছর বয়সেই হয়ে উঠেছে স্পেশালিস্ট ডাক্তার। তেতাল্লিশ বছর বয়সে একজন সফল মানুষ। নিউ ইয়র্কে নিজের প্রাইভেট প্র্যাকটিস তো ছিলই, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পেল শিক্ষকতার সুযোগ, সেই সুবাদে নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান। হাম্পটনে পুরো দুই একর জমিতে বাগান, সুইমিং পুল, স্টেবল ও বিশাল বাড়ি। কী নেই তার। সুন্দরী প্রিয় স্ত্রী আর দুই মেয়ে। ওরা ঘুরে বেড়ায় এস্টেটে আরবি ঘোড়ায় চড়ে। বিলাসিতার জীবন। রাজা-রানির মত আরামে আছেন মানের বাবা-মা। সবই ছিল ঠিক।
অতীতের ভূত যে আবারও চেপে বসবে মাল্ডুনেরর ঘাড়ে, কখনও ভাবতে পারেনি। প্রথম বছরে বাড়ি থেকে কলেজে এসে ঘাবড়ে গিয়েছিল আঠারো বছরের মাল্ডুন। হোস্টেলের রুমে ওর সঙ্গে থাকত রজার হোগার্থ।
কখনও ছেলেটাকে ভুলতে পারবে না মান। ওই ছেলে ছিল নামকরা এক উকিলের সন্তান। পড়ত দুক্লাস ওপরে। মাঝে মাঝেই বেড়াতে যেত ফ্রান্স ও ইতালিতে। মানের মনে হতো ওসব চাঁদে যাওয়ার মত। ওর তুলনায় দুনিয়া সম্পর্কে অনেক বেশি বুঝত ওই ছেলে। ফুকত হাভানা সিগার। চিনত কোন্ ওয়াইন ভাল। পড়ত টলস্টয়ের বই। পুরো ছয় মাস দূর থেকে দেবতার মত তাকে দেখল মাদ্ভুন। ভাবল, সামলে নিতে পারবে বুকের লালসা।
না, বুঝতে দেবে না সে কাউকে।
কিন্তু যে রাতে রজার ওকে দিল শ্যাম্পেন, তখন এক পর্যায়ে মাতাল হয়ে তাকে চুমু দিতে চাইল মাল্ডুন।
শেষমেশ চুমু আর দেয়া হয়নি, কিন্তু তার পরদিন ঘর বদল করে অন্য কোনও রুমে চলে গেল ছেলেটা।
এর কমাস পর জেসির সঙ্গে পরিচয় হলো মানের। ভুলে গেল অতীতের ওই পীড়াদায়ক স্মৃতি। এরপর পেরিয়ে গেল বছরের পর বছর।
কিন্তু আজ থেকে চোদ্দ মাস আগে, কী যেন হলো ওর মনে। চমকে গেল ওই নতুন সুন্দর ছাত্রকে দেখে। কোঁকড়ানো কালো চুল, চকচকে জলপাইয়ের মত মসৃণ ত্বক, বড় বড় বাদামি দুই চোখ। হঠাৎ করেই আবারও আগের সেই অনুভূতি ফিরল মানের বুকে। অধৈর্য হয়ে উঠল বুক। মনে হলো, বাঁচবে না ওই ছেলেকে কাছে না পেলে। ওই একই অবস্থা বোধহয় ওই সুন্দর ছেলেরও। মধ্যবয়স্ক মোটা ধরনের এক লেকচারারকে কেন ওর ভাল লাগছে, জানতেও চাইল না মান। তবে প্রথমে ছেলেটাকে এড়াতে চাইল। রাজি হলো ছেলেটার আমন্ত্রণে। না, ছেলেটার কথায় নির্জন ক্যাফেতে বসে কফি পান করবে না সে।
তারপর একদিন চমকে গেল।
মাল্ডুনের স্ত্রী জেসি জানাল, প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে ডিনারের দাওয়াত দেবে বাড়িতে। ঠেকানো গেল না ওর স্ত্রীকে। প্রতিবাদ করতে গেলে সেটা অযৌক্তিক দেখাত।
সে-রাত ছিল ঝড়বৃষ্টির।
কিচেন থেকে ড্রিঙ্ক নিয়ে ড্রইংরুমে যাবে মাল্ডুন, এমনসময় তার বাহু স্পর্শ করল কেউ। দুসেকেণ্ড পর বুঝল, স্ত্রী নয়, ওর পেছনে সেই ছেলে!
আকাশের বিজলির আলোয় হঠাৎ চমকে উঠে পরস্পরকে চুমু দিল ওরা। এরপর ভেঙে গেল মাল্ডুনেরর সব বাঁধ। কলেজের পার্কিং লটে নিয়মিত গাড়ির ভেতর ব্যস্ত হয়ে উঠল ওরা দুজন। তবে মাল্ডুনকে প্রতিবার ঝুলিয়ে রাখল ছেলেটা। একটা না একটা কারণে তার সঙ্গে মিলিত হতে পারল না মাল্ডুন। কামনার কারণে হয়ে গেল পাগল। প্রিয় ছাত্রের হোস্টেল ঘরের বাইরে জানালায় হানা দিতে লাগল রাতে।
যদি একবার দেখতে পায় ওই ছেলেকে?
স্ত্রীকে বলত, জরুরি কাজে ব্যস্ত সে।
তারপর একদিন হঠাৎ করেই কলেজ পাল্টে ফেলল ওই ছেলে। খোঁজ নিয়ে মাল্ডুন জানল, ট্রান্সফার হয়ে চলে গেছে সে ইউসিএলএ-য়।
কিন্তু মন ভেঙে যাওয়ার চেয়েও বড় সমস্যা এল মাল্ডুনেরর সামনে। ছেলেটা চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর এল ডাকে বড় একটা প্যাকেট। সব ছবির। দেখলে যে-কেউ বুঝবে, কারা চুমু দিচ্ছে পরস্পরকে।
একটা চিরকুটে পেল মাল্ডুন ছোট একটা চিঠি: নিচের ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। আপনার সহায়তা আমাদের দরকার।
প্রথমে মাল্ডুন ভেবেছিল, সব খুলে বলবে স্ত্রীকে। কিন্তু পরে ভাবল: খেপে যাবে জেসি, বুঝতে চাইবে না কিছুই। চলে যাবে মেয়েদুটোকে নিয়ে বহু দূরে। মামলায় হেরে খুইয়ে বসবে বাড়ি এবং প্রায় সব। শোকে পাথর হবে ওর বাবা-মা। শুধু তাই নয়, কলেজ কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় তুলে ধরা হবে নোংরা ছবি। চাকরি তো যাবেই, ছড়িয়ে পড়বে স্ক্যাণ্ডাল। বন্ধ হবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস।
কসপ্তাহ পেরোবার পর, যোগাযোগ করা হলো মাল্ডুনের সঙ্গে। পুরো বিশ মিনিট কথা বলল ওদিকের লোকটা। বক্তব্য তার সোজা। এদিক-ওদিক হলে মস্ত বিপদে পড়বে সে। জেসিকে বলতে হবে, নামকরা এক ডাক্তার যেতে পারছেন না বলে জরুরি এক সেমিনারে যোগ দিতে হচ্ছে মাল্ডুনকে।
এরপর থেকে এমন সেমিনারে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকতে হলো তাকে। জানল না, কাজ করিয়ে নিচ্ছে কারা। সবসময় দিয়েছে যথেষ্ট টাকা। বারবার ভেবেছে। সে, বাধ্য হয়ে দিচ্ছে চিকিৎসা-সেবা। এ ছাড়া উপায়ও নেই। তার।
এরা গাড়িতে করে পৌঁছে দেয় এয়ারপোর্টে। বিমান থেকে নামার পর আরেক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ধূসর সব দালানে। ওখানে থাকতে হয় দিনের পর দিন। জানার উপায় নেই কোথায় আছে।
ধূসর রঙের ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় রোগীকে। বন্দি তারা। তাদের ওপর প্রয়োগ করতে হয় অস্বাভাবিক ওষুধ। কখনও ভুলিয়ে দেয় কারও কারও স্মৃতি। জানতে হয়েছে রোগীর মানসিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা। অথচ, ওর জানা নেই, এরা কেন রোগী। তবুও করেছে নানান পরীক্ষা। সেগুলো এমন সব চিকিৎসা, যেগুলো আছে বলেই জানত না।
প্রতিরাতে ঘুম ভেঙে দরদর করে ঘেমে ওঠে মান। ভয়ানক সব ঘটনার সাক্ষী সে। অথচ, মানুষের ওপর ওসব এক্সপেরিমেন্ট করা ভীষণ অনুচিত। গর্হিত অপরাধ।
দুএকবার কালো সুট পরা লোকদের অবাধ্য হয়েছে সে। তখন আবারও এসেছে ওসব ছবি, সঙ্গে হুমকি।
কিন্তু এবারের ব্যাপারটা বেশি অস্বাভাবিক। অন্য এক দলের মাধ্যমে এসেছে অনুরোধ ও হুমকি। যেতে হয়েছে মন্ট্যানার প্রত্যন্ত, বুনো এক এলাকায়। যে পুরনো বাড়িতে উঠেছে, ওটা অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে পরিত্যক্ত। সিআইএ বা অন্য কোনও ইন্টেলিজেন্সের তরফ থেকে ওখানে ডাকা হয়নি মানকে। যে রোগী, সে-ও বিপজ্জনক নয়। মনে করার কোনও কারণ নেই, মেয়েটি দেশের জন্যে ক্ষতিকর। সহজ সরল রূপসী যুবতী, অ্যাক্সিডেন্টে হারিয়ে ফেলেছে স্মৃতি। আর তাকেই ওই ভয়ঙ্কর ড্রাগ ব্যবহার করে চিরকালের জন্যে বদ্ধউন্মাদ করতে চলেছে সে!
মাল্ডুনকে খুন করবে বলে ভয় দেখিয়েছে ক্যাল অ্যামেট। কম নয় তার দলের অন্য এজেন্টরাও। একমাত্র নারী এজেন্ট ওই কালো চুলের সুন্দরী মেয়েটা শুধু ব্যতিক্রম। আচরণও মানুষের মত। কিন্তু প্রয়োজনে যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তা বোঝা যায় চোখ দেখে।
টেবিলে রাখা স্বচ্ছ তরল ভরা ছোট্ট বোতল আবারও দেখল মাল্ডুন। অন্তরের গভীরে বুঝল, চাইলেও ড্রাগ দিতে পারবে না নিরীহ ওই মেয়েটাকে। ঠিক করে ফেলল, প্রথম সুযোগেই বেচারিকে সরিয়ে নেবে ওই অবৈধ কারাগার থেকে। এরপর সোজা ফিরবে নিউ ইয়র্কে, সব খুলে বলবে জেসিকে। তাতে সর্বনাশ হলে, তা-ই হোক। আর সহ্য করতে পারছে না সে এই প্রচণ্ড মানসিক চাপ।
.
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ফিরতি পথে চলল মাল্ডুন। ভাবছে কীভাবে সরাবে মেয়েটাকে। ঘোট এক শহরে থেমে জেনারেল স্টোর থেকে কিনল টুকিটাকি জিনিস। গাড়ির পেছনের বুটে লুকিয়ে ফেলল ওসব। তারপর চলল আঁকাবাঁকা, জঙ্গুলে পথে পরিত্যক্ত হোটেলের উদ্দেশে।
অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে পৌঁছুল হোটেলের কাছে। গাড়ি থেকে নেমে দরকারি জিনিসটা নিয়ে রাখল ওভারকোটের ভেতর-পকেটে। নতুন করে আটকে নিল বোতাম। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠল কাঁচের দরজার সামনে। পাশেই দেয়ালে সিকিউরিটি প্যানেল। ওখানে কোড দিতেই ক্লিক আওয়াজ তুলল দরজা। খুলে গেছে লক। কাঁচের কবাট ঠেলে হোটেলে ঢুকল সে।
নাকে লাগল তেলাপোকা ও ইঁদুরের মলমূত্রের দুর্গন্ধ। বদ্ধ পরিবেশ। রঙচটা করিডোর ধরে হেঁটে চলল মান। কেউ নেই আশপাশে। চট করে দেখল হাতঘড়ি। গুমট বাতাস। ঘেমে উঠছে ভুরু। দুরুদুরু করছে বুক।
এলিভেটরে চেপে উঠে এল ওপরতলায়। বরাবরের মতই করিডোরে শেষমাথায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালো সুট পরা এক এজেন্ট। কড়া চোখে এগিয়ে আসতে দেখছে ডাক্তার মানকে।
এত ভারী কোট কেন, ডক? জানতে চাইল সে।
ঠাণ্ডা লেগেছে, বলল মাল্ডুন। কথা ঠিক, তা প্রমাণ করতে নাক টানল বারকয়েক।
আপনি তো দরদর করে ঘামছেন।
ফ্লু ধরেছে বলেই তো এই অবস্থা দরজা দেখাল মান। ভেতরে যেতে চাই।
আপনার তো এখন ওই মেয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা নয়, বলল এজেন্ট।
জরুরি বলেই ফিরেছি, একটু থমকে গিয়ে বলল ডাক্তার। আমার ব্ল্যাকবেরি ওই ঘরে।
এই এলাকায় কোনও সিগনাল নেই, ডক।
কথা ঠিক। কিন্তু ফোনটা লাগবে। দরকারি অনেক তথ্য আছে ওটার ভেতর।
আপনার সাবধান হওয়া উচিত, বলল এজেন্ট।
কথা ঠিক। সরি।
একমিনিটের বেশি থাকবেন না, বলে দিল লোকটা।
থ্যাঙ্কস্, দুর্বল হাসি দিয়ে দরজার কবাট ঠেলে ভেতরে ঢুকল মান। পেছনে বন্ধ করে দিল দরজা। শুনল, ক্লিক আওয়াজে আটকে গেছে লক।
ঘুমিয়ে ছিল ক্যাথি হার্বার্ট, পায়ের আওয়াজ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল খাটে। বিস্ফারিত চোখে তাকাল মানের দিকে। বরাবরের মত সাদা কোট নেই ডাক্তারের পরনে। চুল সব এলোমেলো।
আমার এখানে থাকার কথা নয়, ফিসফিস করে বলল মান। যা বলব, মন দিয়ে শুনবে। কোনও প্রশ্ন তুলবে না। তোমাকে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাব আমি।
.
এজেন্ট ভাবছে, সময় হয়েছে কফি ব্রেকের, এমনসময় ঘর থেকে এল ধুপ-ধাপ আওয়াজ। মারামারি করছে দুজন? ঘাড় কাত করে আরও মনোযোগ দিল এজেন্ট। পরক্ষণে লক খুলে দরজা ঠেলে ঢুকল ভেতরে।
মেয়েটা চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে বিছানার পাশে। বুকের কাছে দুই হাঁটু। কাঁপছে থরথর করে।
অবাক চোখে তাকে দেখল এজেন্ট।
মেয়েটার পাশে হাটু গেড়ে বসেছে ডাক্তার মাল্ডুন। মুখ তুলে তাকাল সে। চরমভাবে অসুস্থ। এখন চাই আধুনিক চিকিৎসা।
কী হয়েছে এর? চমকে গিয়ে জানতে চাইল এজেন্ট।
অজানা এপিসোড, বলল ডাক্তার মাল্ডুন। আমি ভেতরে ঢুকতেই জেগে গেল। পরক্ষণেই শুরু হলো কাঁপুনি। একমিনিট… আমার গাড়িতে এ রোগের ওষুধ আছে। মেঝে ছেড়ে উঠে দরজার দিকে রওনা হলো মাল্ডুন।
আমার কী করা উচিত?
কিছুই করবেন না। স্পর্শ করবেন না ওকে। আপাতত পাশে থাকুন।
ক্যাথির দিকে পাথরের মূর্তির মত চেয়ে রইল সচকিত এজেন্ট। প্রবল ঝড়ে পড়া পাতার মত কাঁপছে মেয়েটা। ভিজে গেছে মাথার চুল। দুঠোঁটের কোণে সাদা ফেনা। আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার দশা হলো এজেন্টের। ভাল করেই জানে, ওর পাহারার সময়ে মেয়েটার কিছু হলে প্রাণে বাঁচতে দেয়া হবে না ওকে। তবে কপাল ভাল, ঠিক সময়ে এসেছে ডাক্তার নোকটা।
ওটাই ছিল এজেন্টের শেষ চিন্তা।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে মাল্ডুন। ওভারকোটের ফ্ল্যাপ খুলে বেল্ট থেকে নিয়েছে বেসবল ব্যাট। আবার ফিরেছে ঘরে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কলেজে ভাল বেসবল খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু এখন লোকটার মাথা চুরমার করতে গিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। অথচ, ব্যাট না চালিয়ে উপায় নেই। আরও শক্ত হাতে ধরল ব্যাট। পরের সেকেণ্ডে নামাল এজেন্টের মাথার ওপর। ব্যাটের আঘাতে থরথর করে কেঁপে উঠল মাল্ডুনের দুই বাহু। মাথার তালু ডেবে গেছে মগজের ভেতর, হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল এজেন্ট। স্থির হয়ে গেল কয়েকটা খিচুনি দিয়ে। নিথর লাশ।
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল ক্যাথি। মুখ থেকে থুথু করে ফেলল অ্যালকা-সেন্টারের গুড়ো। একহাতে মুছল ঠোঁটের কোণে জমা ফেনা। চোখে আতঙ্ক নিয়ে দেখল এজেন্টের রক্তাক্ত মাথা।
চলো, প্রায় ফিসফিস করল মাল্ডুন। হাত থেকে ফেলে দিল ব্যাট। ওভারকোট খুলে পরিয়ে দিল মেয়েটাকে। হাত ধরে বেরিয়ে এল করিডোরে। পেছনে আটকে দিল দরজা।
এদিক-ওদিক দেখছে ক্যাথি। ডাক্তারের পিছু নিয়ে এল হোটেলের পেছনদিকের ফায়ার একযিটের কাছে। এদিকটা ব্যবহার করে না এজেন্টরা। এতদিন শুয়ে-বসে কাটিয়ে এখন হাঁটতে গিয়ে বড় দুর্বল লাগছে ক্যাথির। তবুও ডাক্তারের তাড়া খেয়ে প্রায় দৌড়ে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে।
পাঁচতলা নেমে চারপাশ দেখে নিল ডাক্তার। বেরিয়ে এল ফায়ার ডোর পেরিয়ে। সামনেই করিডোর ফাঁকা। ক্যাথির বাহু ধরে দৌড় দিল মান। কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেয়েটা। থেমে ওকে টেনে তুলল ডাক্তার।
আস্তে হাঁটুন, চাপা স্বরে বলল ক্যাথি।
দেরি করা যাবে না। বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। একটু দূরেই আমার গাড়ি।
সামনের দরজা খুলেই চমকে গেল মান। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ওই মেয়ে এজেন্ট। পরস্পরের চোখে চোখ রেখে পাথর হয়েছে ওরা।
নড়ল না মেয়েটা। মুখে টু শব্দ নেই।
অন্তর থেকে তাগিদ পেল মাল্ডুন: দৌড়ে বেরিয়ে যাও এখান থেকে! বাহু ধরে ক্যাথিকে টেনে নিয়ে চলল সে।
আমাদেরকে দেখেছে, আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল ক্যাথি।
জবাব দিল না মাল্ডুন। সামনেই একটু দূরে বেরোবার ফয়ে। ক্যাথিকে বাধ্য করছে দৌড়াতে।
দশ গজ দূরেই সামনের ফয়ে।
পাঁচ গজ।
কয়েক সেকেণ্ড পর সদর দরজার শীতল হ্যাণ্ডেল আঁকড়ে ধরল মাল্ডুন। আর তখনই নির্জন করিডোরে ভেসে এল কর্কশ কণ্ঠ: কোথায় যাবে ভেবেছ, আঁ?।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল মাল্ডুন। করিডোরে মাত্র কয়েক গজ দূরে ক্যাল অ্যামেট! পাশেই মহিলা এজেন্ট রেবেকা ট্রিপলার। পেছন থেকে ছুটে আসছে আরও দুই এজেন্ট, হাতে পিস্তল!
কোট থেকে গাড়ির চাবি নিয়েই ক্যাথির হাতে গুঁজে দিল মাল্ডুন। এতটা দৌড়ে এসে হাঁফিয়ে গেছে। চাপা স্বরে বলল, নীল গাড়ি। বেরিয়ে যাও। দেরি কোরো না। সে ভাল করেই জানে, মেয়েটাকে গুলি করবে না এরা। এখন আর নিজের কথা ভাবছে না ডাক্তার মাল্ডুন।
সামনে বাড়ল অ্যামেট। ঊরুর পাশে ঝুলছে পিস্তল।
দ্বিধায় পড়ে গেছে ক্যাথি।
যাও! চিৎকার করল মাল্ডুন।
কোথাও যাওয়ার উপায় নেই, ক্যাথি, শান্ত স্বরে বলল অ্যামেট। মৃদু হাসছে। চলে গেল মেয়েটার কাছে। বাইরে গহীন জঙ্গল। এখানে আমাদের সঙ্গে নিরাপদে আছ তুমি।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথি। অসহায় চোখে দেখল ডাক্তার মানকে। ওর চোখ গেল এজেন্টদের দিকে। চোখ সরিয়ে নিল মহিলা এজেন্ট।
তিন পা ফেলে ক্যাথির কবজি শক্ত হাতে ধরল অ্যামেট। একটানে সরিয়ে নিল দরজার কাছ থেকে। ঘাড়ে এক ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলল অন্য দুই এজেন্টের বাড়িয়ে দেয়া হাতে। সরে যেতে চাইল ক্যাথি। চেষ্টা করল লাথি মারতে। কিন্তু গত কদিন নিয়মিত খাবার খায়নি, দুর্বল। অনায়াসেই ওকে আটকে রাখল দুই এজেন্ট। ঘুরে ডাক্তারের দিকে চলল ক্যাল অ্যামেট।
দয়া করে ওঁকে মারবেন না, কাতর সুরে বলল ক্যাথি, ওঁকে…
আরেক টানে ওকে করিডোর ধরে নিয়ে চলল দুই এজেন্ট। বদ্ধ করিডোরে বিকট আওয়াজে গুড়! করে উঠল পিস্তল। কাঁধের ওপর দিয়ে দেখল ক্যাথি।
কাঁচের দেয়ালে ছিটকে লেগেছে টকটকে লাল রক্ত। পিছলে অ্যামেটের পায়ের কাছে পড়ল ডাক্তারের লাশ।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল ক্যাথি। ওকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওপরের ঘরে।
.
৩০.
দুপুর দেড়টা। এইমাত্র স্টিভ বার্কলের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে রানা। শুটিং রেঞ্জে এখনও চলছে ছোটখাটো কিছু প্রতিযোগিতা। দূরে ঝলমলে তাঁবুর কাছে মিস ট্রুলিকে দেখল রানা। তাঁকে ঘিরে রেখেছে একদল সাংবাদিক। মহিলা জানলেন না, বিদায় না নিয়েই ভিড়ের মাঝ দিয়ে পথ করে গাড়ির কাছে চলে এসেছে রানা। একা কোথাও বসে ভাবতে হবে ওকে।
ক্রাইসলার গাড়িতে চেপে ফিরতি পথ ধরল রানা। কিছুক্ষণ পর হাইওয়েতে উঠে লক্ষ্যহীনভাবে চলল দক্ষিণ পশ্চিমে। পেরোল আল্টামাহা নদীর সেতু। দুপাশে সবুজ ফসলে ভরা দিগন্তজোড়া লালচে মাটির খেত। তারই মাঝে দূরে দূরে একটা-দুটো কাঠের কুটির।
সোনালি আগুন ঢালছে গনগনে সূর্য।
কটা ট্রেইলার পাশ কাটাল রানা। ভিক্ষা পাবে ভেবে ওর গাড়ির দিকে এসেছিল জনাকয়েক কিশোর-কিশোরী। এদেরকে দেখলে বোঝা যায়, এখন আর সেই স্বপ্নের দেশ নেই আমেরিকা। ঘণ্টাখানেক চলার পর পেছনে পড়ল সব লোকালয়, চারপাশে থাকল বিরান, নির্জন এলাকা।
নিজেকে চরম ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে রানার।
জীবনে নানান ভুল করেছে, কিন্তু আগে কখনও এভাবে বোকা বনতে হয়নি ওকে। ধরে নিয়েছিল বার্কলে দোষী। সে তো নয়ই, অন্য কাউকে সন্দেহ করবে, তেমন কেউ নেই।
সত্যিকারের সুযোগ-সন্ধানী লোক বার্কলে। বাটপার, কিন্তু কিডন্যাপ বা খুন করেনি।
তিক্ত চেহারায় মগজ খেলাচ্ছে রানা।
মনে গাদাগাদা প্রশ্ন।
অথচ হাতে নেই জরুরি কোনও সূত্র।
হয়তো আর বেঁচেই নেই ক্যাথি মেয়েটা?
হয়তো আছে কোর্ফিউ দ্বীপেই?
কী কারণে ওকে আমেরিকায় আনবে কেউ?
ক্রিস্টিনা মেয়েটার মুখের কথা বিশ্বাস করেছিল ও।
হয়তো তাকে জানানো হয়েছিল ভুল তথ্য।
পুরনো মৃৎশিল্প পেয়েছে বলে বার্কলেকে ব্ল্যাকমেইল করছিল ক্যাথি। পিছলা সিম্পসনকে বলেছিল, ভবিষ্যদ্বাণীর জন্যে বড়লোক হবে ও। বাস্তবে কী পেয়েছিল মেয়েটা?
প্রমাণ দিলে সত্যিই হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়বে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের একাংশ।
ঠিক কথাই বলেছে বার্কলে: একদল স্কলার বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন হাতে বারুদ পাওয়ার জন্যে। ওটা পেলেই দমাদম গুলি ছুঁড়বেন তাঁরা। সেক্ষেত্রে সরিয়ে ফেলা হবে বাইবেল থেকে বুক অভ রেভেলেশন। চিরকালের জন্যে সর্বনাশ হবে বার্কলের। ধুলায় মিশে যাবে তার সুনাম।
ওই ধরনের প্রমাণ মিললে সেটা ডেড সি স্ক্রল বা টুরিন শ্রাউডের চেয়ে কম আলোড়ন তুলবে না। হয়তো আরও বেশি কিছু হবে, পাল্টে যাবে বাইবেল।
কিছু প্রশ্ন বারবার জাগছে রানার মনে।
ক্যাথি প্রমাণ করে দিলে আসলে মস্ত ক্ষতিটা কার?
কে সে?
নিশ্চয়ই কেউ আছে, যে চাইছে সব গোপন করতে?
হয়তো ওসব প্রাচীন পটারির আছে অন্য কোনও মূল্য? আর সেজন্যে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা নেই ওই লোকের।
এসবই ওর ধারণা বা আন্দাজ।
হাজারো সম্ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে রানা।
কিছু করতে হবে ওকে।
কিন্তু কী করবে, সেটাই তো ওর জানা নেই!
তা হলে কি গ্রিসে ফিরে নতুন করে খুঁজবে সূত্র? বাগে পেলে ঝামেলা করবে পুলিশ ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো।
নাকি ফিরে যাবে অক্সফোর্ড শহরে?
হাল ছেড়ে স্বীকার করে নেবে পরাজয়?
প্রফেসরকে বলবে, সরি, ফিরিয়ে আনতে পারলাম না আপনাদের মেয়েকে।
একদম ভেঙে পড়বেন প্রবীণ দম্পতি।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজে চটকা ভাঙল রানার। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল পেছনে আসছে পুলিশের ক্রুর। ছাতে জ্বলছে লাল-নীল আলো। কর্কশ আওয়াজে আবারও বেজে উঠল সাইরেন। রানাকে রাস্তার পাশে থামতে নির্দেশ দিচ্ছে ইণ্ডিকেটর বাতি। রাস্তা থেকে সরে নুড়িপাথরে খড়মড় আওয়াজ তুলে কিছু দূর গিয়ে থামল রানা।
পেছনে এসে হাজির হলো পুলিশের কুর। দুই গাড়ির ওড়ানো ধুলো ঘিরে ফেলল চারপাশ। আয়নায় রানা দেখল, পেছনের গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে দুই পুলিশ অফিসার। একজন হেঁটে আসছে ওর দিকে, অন্যজন ক্রাইসলারের পেছনের দিকে।
এটা রুটিন চেক নয় বা স্পিডিং টিকেটের জন্যে থামানো হয়নি, বুঝে গেল রানা। বামদিকের পুলিশ বেল্ট থেকে বের করেছে রিভলভার। ডানদিকের লোকটার হাতে খাটো নলের পাম্প শটগান। ওকে থামানো হয়েছে অন্য কোনও গুরুতর অভিযোগে। দুই পুলিশ অফিসারকে লেলিয়ে দিয়েছে যে লোক, আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে সে এদের।
হুইলে দুহাত রেখে চুপ করে অপেক্ষা করছে রানা। অফিসারদের দিকে চেয়ে ভাবছে: আমাকে বেছে নিল কেন? আমার সম্বন্ধে কী জানে এরা?
উদ্যত রিভলভার হাতে ওর জানালায় থামল অফিসার। তর্জনীর ইশারা দিল কাঁচ নামাতে। পুরনো গাড়ি, হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ নামাল রানা। পুলিশের বয়স হবে বড়জোর চব্বিশ। বিস্ফারিত হয়েছে চোখদুটো। নার্ভাস।
ইঞ্জিন বন্ধ করুন, নির্দেশ দিল সে।
সাবধানে হাত সরিয়ে চাবি মুচড়ে দিল রানা। ইঞ্জিনের গর্জন থামতেই চারপাশে শোনা গেল ঝিঁঝিপোকার টানা আওয়াজ।
লাইসেন্স, বলল অফিসার। হাত সাবধানে নাড়বেন।
কচ্ছপের গতি তুলে প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে লাইসেন্স বাড়িয়ে দিল রানা। প্রায় ছোঁ দিয়ে ওটা নিল অফিসার। কয়েক সেকেণ্ড দেখল লাইসেন্স, তারপর মাথা দোলাল সঙ্গীর উদ্দেশে। ভাব দেখে মনে হলো, নীরবে যেন বলছে, হ্যাঁ, এ-ই সে লোক! আরও নার্ভাস হয়ে গেছে সে।
গাড়ি থেকে নামুন, চড়া গলায় নির্দেশ দিল। হাত এমন জায়গায় রাখবেন, যেন চোখের সামনে দেখি।
গাড়ির দরজা খুলে ধীরেসুস্থে নামল রানা। হাত রেখেছে মাথার ওপর। চোখ পুলিশের চোখে। অ্যাড্রেনালিনের কারণে উত্তেজিত যুবক অফিসার। মৃদু নড়ছে রিভলভারের নল। ওটা তাক করা সরাসরি রানার বুকে।
রিভলভারটা মাত্র দুফুট দূরে। স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন মডেল নাইন্টিন। দুভাবে গুলি করা যায়। অ্যাকশন কক করা থাকলে আঙুলের স্পর্শে ফেলা যায় হ্যামার। অথবা, ব্যবহার করতে হবে ডাবল অ্যাকশন মোড। ট্রিগার টিপলেই ঘুরবে সিলিণ্ডার, উঠে এসে বুলেটের পেছনে আঘাত হানবে হ্যামার। তাতে জোরে টানতে হবে ট্রিগার। কাজটা যেমন কঠিন, লক্ষ্যভেদ হওয়ার সম্ভাবনাও কম। অবশ্য, ভাল গানস্মিথ ওটার ওপর কাজ করলে, পাখির পালকের স্পর্শেও বেরোবে গুলি।
করা করা নয় রিভলভার। আধসেকেণ্ড বাড়তি পাবে রানা। সামনে বেড়ে তরুণ পুলিশকে বেসামাল করে কেড়ে নেবে মস্ত্র। পরের আধসেকেণ্ডে ঘুরেই রিভলভার তাক করবে শটগানধারী পুলিশের দিকে। গুরুতর আহত করবে না এদেরকে। স্রেফ অচেতন করে ফেলে যাবে।
কিন্তু এর ফলে শুরু হবে বাজে ঝামেলা। সেটা চাইছে না রানা। কী কারণে আমাকে থামানো হলো? শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল ও।
অস্ত্র দিয়ে ক্রাইসলার গাড়ি দেখাল অফিসার। হাত হুডের ওপর রাখুন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে ইঞ্জিনের তাপে গরম হুডে হাত রাখল রানা। তিন গজ দূর থেকে ওকে কাভার করল শটগানধারী পুলিশ। অন্যজন ফিরল পুলিশ রে। কথা বলছে রেডিয়োতে। গলার আওয়াজ শুনে রানা বুঝল, আরও নার্ভাস হয়ে উঠেছে যুবক।
কয়েক সেকেণ্ড পর ধুলোর মাঝে ভারী চাকার আওয়াজ শুনল রানা। নিচু গর্জন ছাড়ছে ভি-এইট ইঞ্জিন। গাড়ির হুড থেকে হাত না সরিয়ে ঘাড় কাত করে তাকাল ও। এইমাত্র পুলিশ ক্রুযারের পেছনে থেমেছে দুটো কালো এসইউভি শেভ্রেলো। নতুন করে আকাশে উড়ল ধুলো। একটু পর নেমে গেল। দুই গাড়ির টিনটেড কাঁচ থেকে প্রতিফলিত হলো সূর্যের সোনালি আলো।
খুলে গেল কয়েকটা দরজা। দুই গাড়ি থেকে নামল পাঁচজন। প্রথম গাড়ির আরোহী দুজন পুরুষ ও এক সুন্দরী মেয়ে। অন্য গাড়ির যাত্রী দুজন। এদের পরনে চমৎকার কালো সুট। বয়স্কজনের মুখে অসংখ্য ভাজ। চুল ব্যাকব্রাশ করা। চোখে কালো সানগ্লাস। বয়স হবে পঞ্চাশ। শরীর চিকন। তানপুরার তারের মত টানটান। আসছে রানার দিকে। মুখে কুৎসিত হাসি। হাঙরের অসমান ও চোখা দাঁতের কথা মনে পড়ল রানার। দলে সবচেয়ে কম বয়স মেয়েটার। বড়জোর পঁচিশ। রূপসী, কুঁচকে রেখেছে ভুরু। ঝিরঝিরে তপ্ত হাওয়ায় দুলছে কালো চুলের পুরু বেণী।
দুই পুলিশ অফিসারকে ব্যাজ দেখাল বয়স্ক লোকটা। স্পেশাল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট। বাকি কাজ করব আমরা, অফিসার্স।
জীবনে দেখেনি, এমন চেহারায় ব্যাজ দেখল দুই পুলিশ অফিসার। কয়েক সেকেণ্ড পর নামিয়ে ফেলল অস্ত্র।
দলের এক এজেন্টের উদ্দেশে মাথা দোলাল অ্যামেট। ওই লোক গেল রানার গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজায়। ঝটকা দিয়ে ওটা খুলে সিট থেকে নিল ক্যানভাসের ব্যাগ। কোটের পকেট থেকে রাবারের দুটো সার্জিকাল গ্লাভ বের করে হাতে পরল ক্যাল অ্যামেট। অন্য এজেন্টের হাত থেকে। নিল রানার ব্যাগ। হাতড়াতে লাগল ভেতরে।
হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে বের করল .৪৭৫ লাইনবাউ রিভলভার। যা ভেবেছি! দেখেছ ভেতরে কী? হাত থেকে ফেলে দিল ক্যানভাসের ব্যাগ। ওটা পড়ল ধুলোর মধ্যে তার পায়ের পাশে। গ্লাভ পরা দুহাতে ধরেছে বিশাল রিভলভারটা, দেখছে প্রশংসার দৃষ্টিতে। খুলল ললাডিং পোর্ট। বারকয়েক ঘুরিয়ে নিল সিলিণ্ডার। তারপর কাউবয়ের মত ট্রিগার-গার্ডে আঙুল ভরে চরকির মত ঘোরাল রিভলভার। তার হাসিতে যোগ দিল আরেক এজেন্ট। ঘুরে রানার দিকে তাকাল অ্যামেট। মুখে বেপরোয়া হাসি। দারুণ অস্ত্র!
কোনও জবাব দিল না রানা। ভাবছে, এরা কী চায়, বা কী করবে?
ওর কাছে ঘেঁষে এল এজেন্টরা।
রানার চোখে তাকাল মেয়েটা।
সুন্দরীর চোখে ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধা দেখল রানা। এখন আর কুঁচকে নেই ধনুক ভুরু।
মোবাইল ফোন বের করে কল দিল ক্যাল অ্যামেট। হ্যাঁ, বলছি। ভাল খবর। পেয়ে গেছি মিস্টার মাসুদ রানাকে। …ওকে।
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। এরা এজেন্ট কি না সন্দেহ আছে। হাবভাব অস্বাভাবিক।
পকেটে ফোন রেখে দুই পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাল অ্যামেট। তোমাদের আর লাগবে না। মাছি তাড়াবার মত করে হাতের ইশারা করল সে।
পরস্পরের দিকে তাকাল দুই অফিসার, তারপর তিক্ত চেহারায় চলল কুমারের দিকে। গাড়ির দরজার হ্যাণ্ডেল ধরেছে, এবার উঠে পড়বে সিটে, এমনসময় পেছন থেকে ডাক দিল অ্যামেট: একমিনিট! একটা কথা জানাতে চাই।
চোখ সরু করে তার দিকে তাকাল তরুণ অফিসার। কী বলবেন?
আবারও হাঙুরে হাসি দিল ক্যাল অ্যামেট। ভাব দেখে রানার মনে হলো, লোকটা বলবে, বুঝতেই পারছ কী বলব, আবার জানতে চাও কেন, দোস্ত?
চোখ সরু করে ভারী রিভলভার দেখল অ্যামেট, পরক্ষণে হ্যামার তুলে অস্ত্রটা তাক করল তরুণ অফিসারের মুখ লক্ষ্য করে। বেচারা আছে মাত্র দশ ফুট দূরে!