নরপশু ৪

৩১.

 মন্টানা, সিনেটর হেনরি শোফেল্ডের প্রাসাদোপম বাড়ি।

খ্যার-খ্যার আওয়াজ তুলল স্টিলের পুরু কেবল। নড়ে উঠে মসৃণভাবে চলল কেবল কার। হু-হু করে বইছে পাহাড়ি শীতল দমকা হাওয়া। থরথর করে কেঁপে সামান্য এদিক ওদিক দুলছে ক্যাপসুলের মত ধাতব কার। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক।

পাহাড়ের এত ওপর থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ভালবাসে রনসন থর্ন। ওই যে বহু নিচে উপত্যকা। মাইলের পর মাইল ঘন সবুজ অরণ্য। এখানে এলেই নিজেকে ঈশ্বরের মত মনে হয় তার। চাইলেও ছুঁতে পারবে না কেউ, পারবে নাক্ষতি করতে। সে যেন উড়ন্ত ঈগল, আকাশ থেকে দেখছে অসহায় শিকার। কারও সাধ্য নেই শুনবে গোপন কথা। তুমুল হাওয়ায় দুনিয়ার সেরা লিসেনিং ডিভাইসও কাজ করবে না। গোপন ইকুইপমেন্ট আছে কি না তা দেখতে প্রতি সপ্তাহে দুবার করে তল্লাসি করা হয় সিনেটরের বাড়ি। তবুও আকাশে ঝুলন্ত এই কেবল কার-এ নিজেকে বেশি নিরাপদ বোধ করে থর্ন। সেজন্যেই গোপন বিষয়ে আলাপ করতে হলে সবসময় চলে আসে এখানে।

পুরো পাঁচ শ গর্জ দৈর্ঘ্যের কেবল। পাহাড়ে সিনেটরের বাড়িতে বোর্ডিং প্ল্যাটফর্ম। রওনা হয়ে নামা যায় উপত্যকার আরেকপ্রান্তের প্ল্যাটফর্মে। কেবল কার থেকে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে যে-কোনও জায়গায় থামতে পারে থর্ন। জরুরি আলাপের জন্যে বেছে নেয় ঠিক মাঝের জায়গাটা। পুরো এক হাজার ফুট নিচে সবুজ অরণ্য।

অন্য কেউ আসে না এখানে। সেই আমলে কয়েক হাজার একরের রেঞ্জ কেনার পর, অনেক টাকা খরচ করে কেবল কার বসিয়ে নিয়েছিলেন সিনেটর শোফেন্ডের বাবা। ভেবেছিলেন, স্ত্রী ও ছেলে পছন্দ করবে রকি পর্বতের ওপর থেকে উপত্যকায় নেমে যেতে। কিন্তু তার স্ত্রী বা ছেলের ভাল লাগেনি খেলনাটা। বহু বছর হয়েছে কবরে গেছেন সিনেটরের বাবা। যখন বেঁচে ছিলেন, একমাত্র ছেলের নিরেট অযোগ্যতা দেখে অত্যন্ত হতাশ ছিলেন।

কন্ট্রোল বুথের দিকে রিমোট তাক করল রনসন থর্ন। টিপল মাঝের লাল বাটন। ছাতের ওপর থেকে এল ক্ল্যাং-ক্লাং আওয়াজ। কাজ শুরু করেছে পুলি। থরথর করে কেঁপে থেমে গেল কেবল কার। কোটের পকেটে রিমোট রেখে জানালা দিয়ে বিস্তৃত উপত্যকা দেখল থর্ন। কেবল কারের সঙ্গে দুলছে। মৃদু। এতটা ওপরে সাঁই-সাঁই বইছে পাহাড়ি হাওয়া।

উপত্যকার দিক থেকে ফিরে সঙ্গীকে দেখল রনসন থর্ন। দরদর করে ঘামছে তার সঙ্গীর মুখ। তোমার তো এতদিনে অভ্যেস হয়ে যাওয়ার কথা।

বুক কাঁপে। এত নিচে পড়লে…

হঠাৎ মিলিয়ে গেল থর্নের হাসিটা। কড়া গলায় বলল, নতুন রিপোের্ট দাও।

নার্ভাস হয়ে কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। এখনও তেমন কিছু বলেনি ক্যাথি হার্বার্ট। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

আগেও এই কথা বলেছ। আমরা ওকে বাঁচিয়ে রেখেছি কেন? আমার ভুল না হলে এখনও খুঁজে বের করতে পারোনি ওই উকিলকে।

পিছলা সিম্পসন?

অন্য কোনও উকিল ফস্কে গেছে হাত থেকে? আছে এমন কেউ, যার কাছে আছে ক্যাথি হার্বার্টের সংগ্রহ করা প্রমাণ? ওই লোক কিন্তু ডুবিয়ে দেবে আমাদেরকে।

আমরা খুঁজছি লোকটাকে।

কড়া চোখে সঙ্গীকে দেখল রন থর্ন। খেয়াল রেখো, যেন বেশি দেরি না হয়। সহজ কাজ। সেটাই পারছ না? ক্রিস্টিনা আর বয়েটারের কী খবর? কোথায় তারা? নতুন কোনও খবর দিয়ে অবাক করে দাও আমাকে। …পাওয়া গেছে ওদের লাশ?

না, এখনও পাইনি। তবে মনে হচ্ছে, ওরা আর কখনও ফিরবে না।

আপত্তি নিয়ে হাত নাড়ল থর্ন। চেয়ে আছে নিচের পাহাড়ি উপত্যকায়। তার মানে, তোমার কাছে ভাল কোনও সংবাদ নেই? কোটের পকেট থেকে চকোলেট নিয়ে মোড়ক খুলল সে। খাবে দুএকটা?

মাথা নাড়ল সিআইএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চেহারায় উদ্বেগ। কাশল খুকখুক করে। আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। পায়ের পাশ থেকে ব্রিফকেস তুলল সে। ডালা খুলে থর্নের হাতে দিল সরু কার্ড ফোল্ডার।

চকোলেট চিবুতে চিবুতে ফাইল খুলল থর্ন। প্রথমে তার চোখে পড়ল ব্লো-আপ করা পাসপোর্ট সাইযের ফোটো। কালো চুলের এক যুবক। এ কে?

নাম মাসুদ রানা। বাঙালি। দুর্ধর্ষ লোক। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেরা এজেন্ট। কয়েক দিন আগে আমাদের এজেন্টরা রিপোর্ট দিয়েছে, ওই লোক ছিল গ্রিসের কোর্ফিউ দ্বীপে। দেখা করেছিল জ্যা মউরোসের সঙ্গে। তুমি তো জানো, ওখানে ক্যাফেতে ছিল ওই ফরাসি…

ইতিহাসের প্রফেসরের মত লেকচার প্রয়োজন পড়বে না, তাকে থামিয়ে দিল থর্ন। ওই ফরাসি লোকটা খুঁজছিল ক্যাথি হার্বার্টকে। আলাপ করেছিল গাধা এক গ্রিক লোকের সঙ্গে। কিন্তু আমি তো ভেবেছি, চুকে গেছে ওসব ঝামেলা!

আমরাও তা-ই ভেবেছিলাম। থ্যানাটসকে মেরে ফেলার পর, ব্যবস্থা করা হয়, যাতে পুলিশ ধরে নেয় ড্রাগ লর্ডদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার। এরপর বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয় ফরাসি মার্সেনারি মউরোসকে। কিন্তু সেসময়ে বেঁচে যায় মাসুদ রানা। এটা আমরা জানতে পারি ক্রিস্টিনা আর বয়েটারের কাছ থেকে। তার দুএক দিনের ভেতর জেনে গেলাম, কে আসলে ওই মাসুদ রানা।

ফোটোর পাতা সরিয়ে পরের পৃষ্ঠায় চোখ ফেলল রনসন থর্ন। মউরোসের বিষয়ে তথ্য। ওটা বাদ দিয়ে পড়তে লাগল রানার ডোশিয়ে। ধীরে ধীরে কুঁচকে গেল দুই ভুরু। কমিয়ে দিয়েছে পড়ার গতি। টের পেল, বুক আঁকড়ে আসছে তার। দশ মিনিট পর পড়া শেষে মুখ তুলে তাকাল। পড়ে দেখেছ?

আস্তে করে মাথা দোলাল তার সঙ্গী।

অকল্পনীয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বয়সী মেজর। পদকের শেষ নেই। যোগ দিয়েছিল বিসিআই-এ। এমন কী সিআইএরও কোনও এজেন্ট নেই, যাকে তুলনা করা যাবে তার সঙ্গে। এ লোক তো অস্ত্র ভরা রোবট! এমন কী আমেরিকার প্রেসিডেন্টও নিরাপদ নয় তার কাছ থেকে! আমার দলে এর মত মানুষ থাকলে আর কিছুই চাইতাম না।

নীতি নিয়ে চলে, কারও কথায় নাচার লোক নয়, বলল সিআইএ কর্মকর্তা। নিজের আছে ডিটেকটিভ এজেন্সি। আছে সাগরগামী সব জাহাজের বহর। মেক্সিকো, উরুগুয়ে, পেরু এবং বহু দেশে গেছে অনেক অভিযানে। নামও করেছে শখের আর্কিওলজিস্ট হিসেবে। দুহাতে সাহায্য দেয় দুস্থদের সংস্থায়। কয়েকবার জঙ্গল-পাহাড়-মরুভূমি-সাগর কুঁড়ে খুঁজে বের করেছে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে। অনেকে বলে: দুঃসাহসী বাঙালি অভিযাত্রী। কিন্তু দুঃখের কথা: ওই হারামজাদা আমাদের দলে যোগ দেবে না কখনও।

ভাবছ, সে-ই শেষ করেছে ক্রিস্টিনা আর বয়েটারকে?

 তা ছাড়া আর কে?

ফাইল বন্ধ করল থর্ন। কী হচ্ছে আসলে? আর্কিওলজির অ্যাকাডেমিক এক মেয়ের সঙ্গে কীসের সম্পর্ক ওই লোকের? ওই মেয়ের পিছু নিয়েছে কেন সে?

জানি না। হয়তো কাজ করত ওই মেয়ের হয়ে।

ঝট করে সঙ্গীর চোখে তাকাল থর্ন। তা হলে সবই জানে মাসুদ রানা। গোপন নেই কিছুই।

হতে পারে।

তার মানে, আরও খারাপ হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, চোখ পাকিয়ে সঙ্গীকে দেখল থর্ন। একে একে খুন করবে মাসুদ রানা আমাদের এজেন্টদেরকে। তাদের পেট থেকে বের করবে নতুন তথ্য। এর অর্থ বুঝতে পারছ? নিরাপদ নই আমরা কেউ!

জানি, ঢোক গিলল সিআইএ কর্মকর্তা।

জানো, এখন কোথায় আছে ওই বাঙালি কুকুরটা?

ওই ব্যাপারেই এসেছি কথা বলতে। সে আছে এখন আমেরিকায়।

কী বলছ!

হ্যাঁ। গত দুদিন আগে আটলান্টার ইউএস ইমিগ্রেশন পেরিয়ে মিশে গেছে ভিড়ে।

হতাশায় মাথা ঝুলে গেল থর্নের। আর বলছ, ওকে খুঁজে বের করতে পারেনি সিআইএ?

দেরিতে এয়ারপোর্ট পৌঁছায় আমাদের লোক। তারপর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

চোখে রাগ নিয়ে সঙ্গীর দিকে চেয়ে রইল থর্ন। তিক্ত হয়ে গেছে মন।

সতর্ক থাকতে হবে, বলল তার সঙ্গী। আমাদের এটা কিন্তু অফিশিয়াল এজেন্সি বিযনেস নয়, থর্ন। এ-ও মাথায় রাখতে হবে, সাধারণ কেউ নয় মাসুদ রানা।

তোমার লোকের জন্যে লাখ লাখ ডলার খরচ করি, বলল থর্ন। ওদিকে মাসুদ রানা একা। মাত্র একজন সে। তোমার হাতে আছে অন্তত বিশজন এজেন্ট। দরকার হলে সাহায্য নিতে পারবে আরও এক শ এজেন্টের কাছ থেকে। মাসুদ রানা কি এতই বুদ্ধিমান, নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে তোমাদেরকে?

রেগে গেছে সিআইএ অফিসার। তোমার প্রতিটি কথা মেনে নিয়েছি আমরা। ধরে এনেছি ক্যাথি হার্বার্টকে। খতম করেছি থ্যানাটসকে। বোমা ফাটাতে ডেকেছি সলোমনকে। এসব সহজ কাজ নয়। এটা তো আর প্রেস কনফারেন্স করার মত কিছু না। মাত্র একটা ভুল হলেই ডুবে যাব সবাই।

নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল রন থর্ন। আমি যদি আগে বুঝতাম যে তোমার লোক এত গাধা, পুরো সমস্যা দূর করতে ভাড়া করতাম সলোমন রুশদিকে।

সলোমন মার্সেনারি, আপত্তির সুরে বলল সিআইএ কর্মকর্তা। কোনও নীতি নেই তার।

সে কী বিশ্বাস করে আর কী বিশ্বাস করে না, সেটা দিয়ে কী হবে? স্বয়ং শয়তান হোক না সে! কাজ হলেই হলো!

নীতি না থাকলে আমাদের চলবে না।

কড়া চোখে বন্ধুকে দেখল থর্ন। ও, তুমি ভাবছ, আমরা কাজ করছি ঈশ্বরের হয়ে? কান পেতে শোনো আমার কথা, আমরা করছি ব্যবসা। আর প্রথম কথা প্রচুর পরিমাণে মুনাফা করা, এবং শেষ কথাও মুনাফা। সলোমন রুশদি হলে শেষ করত তার কাজ। অন্ধ লোকও পিছু নিতে পারবে, এমন ছেঁড়া সুতো পেছনে ফেলে যেত না সে।

এর জবাবে কিছু বলতে গিয়ে হাঁ করল সিআইএর ঊর্ধ্বতন অফিসার। কিন্তু বেজে উঠল তার মোবাইল ফোন। কোটের পকেট থেকে ওটা নিয়ে থর্নের দিক থেকে ফিরে কল রিসিভ করল সে। কণ্ঠ মৃদু। কয়েক সেকেণ্ড পর কপালে উঠল ভুরু। ঠিক বলছ তো? ওকে! ভাল করেই জানো কী করতে হবে। ফোন রেখে থর্নের দিকে ফিরল সে। ঠোঁটে এখন বিজয়ীর চওড়া হাসি।

কী? জানতে চাইল থর্ন।

 ক্যাল অ্যামেট। ধরে ফেলেছে মাসুদ রানাকে।

প্রথমবারের মত হাসল থর্ন। গুড! ভেরি গুড! বাঙালি হারামিটাকে নিয়ে গিয়ে এখন বের করুক পেট থেকে সব।

তুমি তো জানো, আমি ওখানে থাকতে পারব না, বলল সিআইএ অফিসার, কেউ দেখে ফেললে তাকে খুন করতে হবে।

তা ঠিক আছে। তবে আমি যাব। দেখতে চাই কী ধাতু দিয়ে তৈরি ওই লোক।

আমার মনে হয় না তোমার ঝুঁকি নেয়া উচিত।

ঝুঁকিটা নেব, জোর দিয়ে বলল থর্ন। নিজ হাতে শেষ করব মাসুদ রানাকে।

.

৩২.

বিকট আওয়াজে বুম! করে উঠেছে প্রকাণ্ড রিভলভার। চারপাশে ছড়িয়ে গেল ওই ভয়ঙ্কর হুঙ্কার। লাল রঙ ভরা ভর্তায় পরিণত হলো তরুণ পুলিশ অফিসারের চেহারা। ভারী বুলেটের আঘাতে পিছিয়ে গিয়ে ধুলোয় ধপ করে পড়ল বেচারা। প্রাণটা যাওয়ার আগে বারকয়েক চুড়ল পা।

আবারও ৪৭৫ রিভলভার তাক করল অ্যামেট। পরের সেকেণ্ডে কিছু বোঝার আগেই খুন হলো দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার। প্রচণ্ড আঘাতে বিস্ফোরিত হয়েছে তার হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস। সব ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে ছিটকে বেরিয়ে গেছে বুলেট। পুলিশ ক্রুরের উইণ্ডশিল্ডে ছলাৎ করে লাগল একগাদা রক্ত। টু শব্দ না করে ধুলোয় আছড়ে পড়ল বয়স্ক পুলিশ অফিসার।

কয়েক সেকেণ্ড নড়ল না কেউ।

খোলা এলাকায় মিলিয়ে গেছে ভারী বুলেটের গর্জন। ধুলোর ভেতর নিথর পড়ে আছে দুই পুলিশ অফিসার। তাদের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট।

তার দিকে চেয়ে আছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর তাকাল অন্যান্য এজেন্টের দিকে। দাঁত বের করে হাসছে তাদের একজন। অন্য দুজন নিস্পৃহ। মহিলা এজেন্টের চোখে অনিশ্চয়তা। এ ধরনের খুনের জন্যে হয়তো তৈরি ছিল না।

দুর্দান্ত ঝাঁকি দেয়, খুশিমনে বলল অ্যামেট। এক হাতে বুঝতে চাইছে রিভলভারের ওজন। আরেক হাতে খুলে ফেলল সানগ্লাস। তিক্ত চোখে তাকাল রানার চোখে। তুমি তো দেখছি মস্ত বিপদে জড়িয়ে গেছ, মিস্টার রানা।

ক্রাইসলার গাড়ি থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে রানা। আঙুল তুলে লাশগুলো দেখাল। ওদেরকে খুন করলে কেন?

আমি তো খুন করিনি, সহজ সুরে বলল অ্যামেট। তুমি করেছ। নিজ চোখে দেখেছি আমরা সবাই। এটা তোমার রিভলভার। সবখানেই তোমার আঙুলের ছাপ রয়েছে।  

আমার কাছ থেকে কী চাও তোমরা?

হাঙুরে হাসি দিল অ্যামেট। জরুরি কিছু প্রশ্নের জবাব। এখান থেকে তোমাকে সরিয়ে নেয়ার পর জানতে চাইব সব।

রানার সামনে এসে দাঁড়াল সে। ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেছে হাসি। আবারও কক করল রিভলভার। নযল ঠেকাল রানার কপালে। আমরা তোমাকে গ্রেফতার করছি, মাসুদ রানা তুমি পুলিশ-হত্যাকারী বর্বর এক জানোয়ার!

অন্যান্য এজেন্টের দিকে তাকাল রানা। দলে তারা পাঁচজন। আরও অন্তত দুজন আছে টিনটেড কাঁচের ওদিকে। অ্যামেটের সঙ্গে ওর দূরত্ব আর অন্যদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখল রানা। চোখ ফিরল অস্ত্রের নলের ওপর। আবারও দেখল ক্যাল অ্যামেটকে। আজ দ্বিতীয়বারের মত ওর দিকে তাক করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। তরুণ অফিসারকে সহ্য করেছিল, কারণ সে ছিল আইনের ভেতর। কিন্তু কোনও কারণ নেই এই লোকটার বেআদবি সহ্য করার।

তা ছাড়া, লড়াইয়ের বড় একটা কৌশলে ভুল করেছে লোকটা। এতকাল শত্রুর মুখের কাছে ধরেছে খাটো নলের গ্লক বা সিগ সাওয়ার। এখন সে হয়তো অতিরিক্ত উত্তেজিত, অথবা অন্যদেরকে বোঝাতে চাইছে, যে-সে লোক নয় সে। এসব দেখানো হয় সিনেমায়। এই লোক ভুলে গেছে, হান্টিং রিভলভারের মাযল আপাতত আছে রানার মাথা থেকে মাত্র চার ইঞ্চি দূরে।

আর্মি বা বিসিআই-এ প্রথমেই শেখানো হয়: শত্রুর খুব কাছে নেবে না নিজের অস্ত্র। নইলে নিজেই খুন হবার সম্ভাবনা থাকে। ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে বেপরোয়া শত্রু, তাই দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বহুবার ট্রেনিঙে দেখানো হয়েছে, কীভাবে কেড়ে নিতে হবে অস্ত্র। ওই বিদ্যা বহুবার প্রাণরক্ষা করেছে রানার।

মাত্র এক সেকেণ্ড ভাবল রানা।

পারবে তো?

এরা সিআইএ এজেন্ট।

পাঁচজন।

ওর নিজের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

দ্বিধা এল একটু। পরক্ষণে ভাবল, আরে, গাধা, এই জীবনে দ্বিতীয়বার তো আর মরতে হবে না তোকে!

পরক্ষণে বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে। খ করে রিভলভারের নল ধরেই গায়ের জোরে ঠেলল ক্যাল অ্যামেটের মুখের দিকে। রিভলভারের খাজ কাটা কাঠের বাট কড়াৎ শব্দে ঢুকল স্পেশাল এজেন্টের মুখের গহ্বরে।

মার খাওয়া কুকুরের মত কেঁউ করে উঠল লোকটা। ফাটা ঠোঁট থেকে ঝরঝর করে নামল রক্তের স্রোত। আরেক টানে অ্যামেটের হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিয়ে কড়া একটা লাথি লাগাল রানা ওর হাঁটুর ওপর। ভারসাম্য হারিয়ে ধুলোয় পড়ল অ্যামেট। সাপের মত মুচড়ে উঠছে ব্যথায়। দুহাতে ধরেছে আহত মুখ। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরোল কয়েকটা ভাঙা দাঁত।

বসে নেই রানা। অন্যরা নড়ার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ধুলোয়। একটানে ব্যাগ নিয়ে পৌঁছে গেল ক্রাইসলারের দরজার হ্যাণ্ডেলের পাশে। পরক্ষণে দরজা খুলে সরে গেল ওটার আড়ালে। দরজাটাকে রেখেছে ঢালের মত করে। ওই একই সময়ে অস্ত্র বের করতে হোলস্টারে ছে দিল এজেন্টরা।  

গাড়ির ভারী দরজায় ঠকঠক শব্দে বিঁধল এক পশলা গুলি। রিভলভার কক করেই পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ল রানা। এরা সরকারী এজেন্ট, আমেরিকার বুকে দাঁড়িয়ে এদের বিরুদ্ধে গুলি করলে পড়বে মস্ত বিপদে।

হ্যাঁ, অনুচিত গুলি করা। নিতান্ত বাধ্য না হলে…

ওর অন্তর জানাল, উপায় নেই তোর খুন না করে।

সাইটে পেল এক এজেন্টকে। আহত করতে চাইলে ভাল। অস্ত্র নয় লাইনবাউ। কাঁধে বুলেট লাগলেও ছিঁড়ে নিয়ে যাবে কাঁধ থেকে গোটা হাত। অতিরিক্ত রক্ত হারিয়ে ও শকের কারণে মরবে লোকটা। এজেন্টের বুক লক্ষ্য করে গুলি করল রানা। বুম করে উঠে ওর হাতের ভেতর লাফ দিল দানবীয় রিভলভার। ওর টার্গেট মাটিতে পড়ল করাতে কাটা গাছের মত।

পাঁচ গুলির রিভলভার। এখন আছে দুটো বুলেট।

ক্রাইসলারের ভারী দেহে লাগছে একরাশ গুলি। ক্ষত বিক্ষত দরজার পেছনে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রানা। ওর দিকে পিস্তল তাক করেছে মেয়ে এজেন্ট। সরাসরি সাইটের মাঝ দিয়ে দেখছে। এবার ট্রিগার টিপলেই খুন হবে রানা।

কিন্তু কেন যেন রানার মনে হলো, ওকে গুলি করবে না ওই মেয়ে। কাজেই পাশের এজেন্টকে গুলি করল রানা। বুকে বুলেট বিধতেই কয়েক পাক খেয়ে কালো এক এসইউভির গায়ে গিয়ে পড়ল সে।

কালো শেভ্রোলে থেকে নেমে পড়ল আরও দুই এজেন্ট। টান দিয়ে হোলস্টার থেকে বের করে নিল পিস্তল।

এখান থেকে সরতে হবে, বুঝে গেল রানা। লাফিয়ে উঠল ক্রাইসলারের ড্রাইভিং সিটের সামনের গভীর অংশে। সিটে রিভলভার রেখে একহাতে মুচড়ে দিল চাবি। গিয়ার ফেলে অন্যহাতে ঘোরাল স্টিয়ারিং হুইল। হাত দিয়ে চাপ দিল অ্যাক্সেলারেটরে। হোঁচট খেয়ে রওনা হলো মস্ত গাড়ি। ধুলোয় বনবন করে ঘুরছে চাকা। পুরো খুলে গিয়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে দরজা। অন্ধের মত প্রায় বিশ গজ ড্রাইভ করল রানা। ভেতরে ঢুকছে অজস্র বুলেট। চুর-চুর হচ্ছে জানালার কাঁচ। রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে গাড়ি। তবে যথেষ্ট দূরত্ব তৈরি হয়েছে ভেবে এবার সিটে উঠে বসল রানা। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, নিজেদের গাড়ির দিকে ছুট দিয়েছে এজেন্টরা। অ্যামেটকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করছে সুন্দরী ওই এজেন্ট। চাকা পিছলে রানার পেছনে রওনা হলো দুই কালো এসইউভি।

আঁকাবাঁকা সরু ফাঁকা রাস্তায় ফুল স্পিড তুলতে চাইল রানা। ভারী গাড়ি নিয়ে চলেছে রাস্তার মাঝ বরাবর। পেছন থেকে ওভারটেক করতে এলে বাধা দেবে ডানে-বামে সরে। উইণ্ডশিল্ড এখন মাকড়সার জাল। রিভলভারের নল দিয়ে বাড়ি মেরে কাঁচ ঝরিয়ে দিল রানা। শোঁ-শোঁ করে ভেতরে ঢুকল তপ্ত হাওয়া। বহু দূর পর্যন্ত সরল রেখার মত গেছে। রাস্তা। ওপরে উঠছে স্পিডোমিটারের কাঁটা। গতি ঘণ্টায় আশি মাইল। তারপর নব্বই। পুরনো ক্রাইসুলারকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে রানা। তবে লেজের কাছেই আছে এজেন্টদের দুই গাড়ি। রানার রিভলভারে আছে মাত্র একটা বুলেট। লাইনবাউ এমনই অস্ত্র, গাড়ি চালাবার সময় আধুনিক অটোমেটিক পিস্তলের মত রিলোড করতে পারবে না। শিকারীদের অস্ত্র। ব্যবহার করে ধৈর্য আছে এমন মানুষ। একটা একটা করে বের করতে হবে বুলেটের খোসা। গুলিও ভরতে হবে একটা একটা করে। তাতে প্রয়োজন যথেষ্ট সময়।

পেছনে বুম! করে উঠল একটা অস্ত্র।

কুঁজো হয়ে গেল রানা। উড়ে গেল উইং মিরর এবং জানালার পিলারের একাংশ। নানাদিকে ছিটকে গেছে প্লাস্টিক ও ধাতব টুকরো। কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা।

এসইউভির জানালা দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ বের করেছে এক এজেন্ট। চুল ও পোশাক ধরে হ্যাচকা টান দিচ্ছে। দমকা হাওয়া। হাতে পেটমোটা শটগান। তাক করছে আবারও। বুম! করে উঠল অস্ত্রটা। ক্রাইসলারের ভেতরে ঢুকল সীসার অসংখ্য পেলেট। খুবলে গেল রানার পাশের সিটের চামড়া ও ফোম।

এঁকেবেঁকে যেতে যেতে হাত ঘুরিয়ে পেছনে রিভলভার নিল রানা। এটাই ওর শেষ গুলি। তাক না করেই টিপে দিল ট্রিগার। দানবীয় রিভলভারের প্রচণ্ড রিকয়েলে ওর মনে হলো ভেঙে গেছে কবজিটা। প্রায় কামানের গোলার মত বুলেট পেছনের জানালার অবশিষ্ট কাঁচ উড়িয়ে গিয়ে ঢুকেছে এসইউভির ভেতর। রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল, হঠাৎ করেই বাঁক নিল গাড়িটা। পরক্ষণে উল্টে পড়ল রাস্তার ধারে। জানালা থেকে পড়ে গাড়ির নিচে ঘেঁচে গেছে বন্দুকধারী এজেন্ট। কয়েক ডিগবাজি খেয়ে আরেকদিকে গিয়ে পড়ল গাড়িটা। রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে ভাঙাচোরা সব পার্টস্। ওসব এড়াতে একপাশে সরল দ্বিতীয় এসইউভি। নতুন করে গতি তুলছে ওটা।

পুরনো ক্রাইসলারটাকে ঝড়ের বেগে নিয়ে চলেছে রানা। বুম! বুম! শব্দে কান ফাটিয়ে দিচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র।

বামে বাঁক নিয়েছে সরু রাস্তা। দুপাশে ছোটবড় গাছ ও ঘন ঝোপ। সবচেয়ে কম ঘন দিকে ক্রাইসলার চালাল রানা। সামনেই পড়ল বৃদ্ধ এক লোক, পেছনে দড়িতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা খচ্চর। বৃদ্ধকে দেখে একেবারে শেষসময়ে বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাল রানা। রাস্তা থেকে ঝাঁপিয়ে গভীর ঝোঁপের মধ্যে পড়ল গাড়ি। ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকল অসংখ্য ডালপালা। এত জোরে ধুম করে নিচে পড়ল ক্রাইসলার, আরেকটু হলে সিট ছেড়ে উড়াল দিত রানা। ঝর্নার খাড়া তীর লক্ষ্য করে হুড়মুড় করে নামছে গাড়ি।

এক সেকেণ্ড রানার মনে হলো, সামনেই ঝর্না এড়াবার সোজা পথ। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে দেখল, একটু দূরে মস্ত এক গাছের গুঁড়ি। এখন আর এড়াতে পারবে না চাইলেও।

অন্তত পঞ্চাশ মাইল বেগে ছুটছে ক্রাইসলার। সাঁই করে গিয়ে লাগল গাছের কাণ্ডে। প্রচণ্ড বেগে সামনে হুমড়ি খেল রানা। ফটাস শব্দে খুলল এয়ারব্যাগ। আকাশে উঠেছে ক্রাইসলারের পৈছনদিক। বনবন ঘুরছে চাকা। গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন। নাকে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল ভারী গাড়ি, তারপর চিত হয়ে পড়ল বিকট শব্দে। ছাত এখন মেঝে।

কসেকেণ্ডের জন্যে হতচকিত হয়েছে রানা। কানে ঝনঝন শব্দ। ঠোঁটে রক্তের লবণ। তারপর টের পেল, উল্টে আছে ও। বুকের কাছে স্টিয়ারিং হুইল। উঠে এসে দুই কাঁধে চাপ দিচ্ছে ছাত।

দূরে ছুটন্ত পদশব্দ। মড়াৎ করে ভাঙল ডাল।। আওয়াজ। চিৎকার করে উঠল কেউঃ ওই যে! ওখানে!

ড্যাশবোর্ডে লাথি মেরে শরীর হিঁচড়ে ভাঙা জানালা দিয়ে বেরোতে চাইল রানা। দুহাতের জোরে ঘুরিয়ে নিল শরীর। ভাঙা গান্তি থেকে বেরোল প্রায় ক্রল করে। থামল ওখানে। হাত বাড়িয়ে ক্রাইসলারের ভেতর থেকে নিল ব্যাগ আর গুলিশূন্য লাইনবাউ। খালি হাতে লড়ার চেয়ে গুলিহীন অস্ত্রও অনেক ভাল।

রানা আছে ঘন ঝোপ ও গাছের জটলায়। জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে সব। তারকাঁটার বেড়ার মত হাত ও মুখে খচ খচ করে লাগছে কাটা। উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির কাছ থেকে সরে যেতে লাগল রানা। বাজে অ্যাক্সিডেন্টের ফলে কাজ করছে না মাথা। হাঁফাচ্ছে হাপরের মত। উত্তেজনায় লাফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড। একবার দেখল চারপাশ। প্রতিটি পদে বাধা দিচ্ছে গভীর কাঁটাঝোপ। পেছনে মানুষের কণ্ঠ। আসছে এজেন্টরা। যে-কোনও সময়ে ধরা পড়বে ও।

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঝোপ ভেঙে ছুটল দিগ্বিদিজ্ঞানশূন্য রানা। এড়িয়ে গেল নিচু এক ডাল। পরক্ষণে দেখল, কফুট দূরে এক এজেন্ট। অস্ত্র ওপরে তুলল সে। তবে মাটিতে দেহ পিছলে যেতে দিল রানা। তুলে রেখেছে ডান পা। ওর বুটের গোড়ালি সরাসরি লাগল এজেন্টের ঊরুর পাশে। ধুপ করে পড়ল লোকটা। টাশ শব্দে বেরিয়ে গেল হাতের নাইন এমএম পিস্তলের বুলেট। দূরের এক গাছে বিঁধল ওটা। উঠে বসেই লোকটার মাথায় গায়ের জোরে রিভলভারের বাঁট নামাল রানা। এতই জোরে, মুহূর্তে জ্ঞান হারাল এজেন্ট, হাতে এখনও পিস্তল। হান্টিং রিভলভারটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এজেন্টের নাইন এমএম পিস্তল নিয়ে নিল রানা। ম্যাগাযিন প্রায় ভরা। কালো অস্ত্রটা মনে দিল নিরাপত্তার অনুভূতি। কিন্তু গুলির শব্দ শুনেছে অন্য এজেন্টরা। ছুটে আসছে এদিকে। পেছনের ঝোপে কজনের চিৎকার ও পায়ের আওয়াজ। বেশি দূরে নেই তারা।

 উঠে দৌড় শুরু করল রানা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পায়ের নিচে লালচে মাটি হলো পিছলা জমি। সামনেই ঝর্না। ওটা পেরোতে চাইল রানা। ছুটছে পাথরের সব চাইয়ে পা ফেলে। ঝর্না পেরিয়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে যেতে লাগল খাড়া তীর বেয়ে। সামনের জঙ্গল আরও গভীর। জায়গায় জায়গায় পড়ে যাওয়া গাছ। জন্মেছে অসংখ্য কাঁটাঝোপ। খোঁচা খেতে খেতে কিছু দূর যাওয়ার পর ঘাস ভরা এক জায়গায় পৌঁছুল রানা। ওপরে গেছে ঢিবির মত জমিন। পেছনে শুনল চিৎকার। ঢিবি বেয়ে উঠে যেতে চাইল রানা। ভাবছে, সুযোগ আছে সরে যাওয়ার।

তখনই শুনল কপ্টারের জোরালো খ্যাট-খ্যাট আওয়াজ। ঘাসে ভরা ঢিবি পেরিয়ে কাত হয়ে এল যান্ত্রিক ফড়িং। উচ্চতা বড়জোর বিশ ফুট। আসছে ছে দেয়া বাজপাখির মত। নাক নিচু, লেজ আকাশে। রোটরের দমকা হাওয়া মাটিতে নুইয়ে দিল ঘাস ও ঝোপগুলোকে। প্রচণ্ড বাতাস ছিঁড়তে চাইছে রানার চুল ও পোশাক।

কপ্টারের দুই দরজায় দেখা দিয়েছে দুই এজেন্ট। হাতে অটোমেটিক রাইফেল। দুসেকেণ্ড পর রানার ওপর স্থির হলো অস্ত্রদুটোর মাযল। ঘুরেই দৌড় শুরু করল রানা। পেছনের জমিতে লাগল একরাশ গুলি। সামনে ধসে পড়া এক গাছ দেখে ওটার ওপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। পরক্ষণে হেলিকপ্টার ওপর দিয়ে যাচ্ছে দেখে গুলি পাঠাল। কালো ফিউজেলাজে লাগল বুলেট। তৈরি হলো একসারিতে তিনটে গর্ত। রোটরের ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে লালচে ধুলো, ছেঁড়া সবুজ পাতা ও ঘাস। নাকের কাছে গাছের সারি দেখে কাত হয়ে সরল হেলিকপ্টার। আবারও ঘুরে আসছে রানার দিকে।

এয়ারক্রাফট বা মিলিটারি রাইফেলের বিরুদ্ধে লড়তে তৈরি করা হয়নি নাইন এমএম পিস্তল। কিন্তু এ ছাড়া কোনও অস্ত্র নেই রানার কাছে। হেলিকপ্টারের দিকে পিস্তলটা তাক করে গুলি পাঠাল পর পর পাঁচবার। কিছুই হলো না শত্রুপক্ষের। ছুটে আসছে হেলিকপ্টার। রানার ওপর রাইফেল তাক করল এজেন্টরা। পায়ে লাল লেসারের আলো দেখে লাফিয়ে সরে গেল রানা। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, তার পেছনের গাছের কাণ্ডে বুলেট লেগে চারদিকে ছিটকে গেল স্পিন্টার। পরের সেকেণ্ডে গুলির আওয়াজ শুনল রানা। আগেই দৌড় দিয়েছে ঝোপে ঢুকতে। পেছনের মাটিতে ঠক ঠক শব্দে লাগছে বুলেট।

রানা ঝোপে ঢুকতেই ওপর দিয়ে গেল হেলিকপ্টার। ঘন ঝোপে প্রায় অন্ধের মত ছুটছে ও। টপকে যাচ্ছে বড় পাথর ও শেকড়। বারকয়েক সামলে নিল আছাড় খেতে গিয়ে। ঝোপঝাড় সরিয়ে দৌড়ে চলেছে। দুবাহুতে বিধছে ছোটবড় কাঁটা। কিছুক্ষণ ছোটার পর হঠাৎ করেই পেছনে পড়ল গাছের সারি। আবারও পৌঁছে গেছে ঘাস জমিতে।

কিন্তু ওখানে একা নয় রানা।

আগেই ঘাসজমিতে হাজির হয়েছে দুই এজেন্ট। অস্ত্র হতে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। যার হাতে শটগান, আগে তাকেই গুলি করা উচিত, ভাবল রানা। এত কম রেঞ্জে পিস্তলের গুলির চেয়ে বহুগুণ বিপজ্জনক নলকাটা বন্দুকের শতখানেক পেলেট। কিন্তু বন্দুকওয়ালাকে খতম করলে অন্য এজেন্টের পিস্তলের গুলিতে মরবে ও।

মাত্র এক সেকেণ্ড ভাবল রানা। পরের সেকেণ্ডে দেখল পেছনের ঝোপ ভেঙে পৌঁছে গেছে আরও কজন এজেন্ট। ডানে মেয়েটা। পেছনে স্পেশাল এজেন্ট অ্যামেট। প্রথম দুজনের পাশে আরও এক এজেন্ট।

শত্রু সবমিলে পাঁচজন, অস্ত্র হাতে ঘিরে ফেলেছে ওকে।

আপাতত কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। সহজ ভঙ্গিতে পিস্তলটা মাটিতে ফেলে মাথার ওপর হাত তুলল রানা।

অস্ত্র তাক করে ওকে দেখছে মেয়েটা, কুঁচকে গেছে ভুরু। চোখের দৃষ্টি পড়ল রানা। পালাতে গিয়ে মস্ত ভুল করেছে ও। তবে ওর খারাপ কিছু হোক, যেন চাইছে না সুন্দরী মেয়েটা। কেন চাইছে না, কে জানে! কালো চোখ বলছে, এখানে থাকতে না হলে খুশি হতো সে।

অগ্নিদৃষ্টিতে রানাকে দেখছে ক্যাল অ্যামেট। মুখে ধুলো কাদা আর থকথকে রক্ত। অর্ধেক গোঙানি আর অর্ধেক ধমকের সুরে নির্দেশ দিল লোকটা।

সামনে বেড়ে রানার দুহাত ধরল দুই এজেন্ট। পিঠে ধাক্কা দিয়ে উপুড় করে মাটিতে ফেলা হলো ওকে।

রানা টের পেল, প্লাস্টিকের কেবল টাই কামড়ে ধরেছে ওর দুই কবজি। কোমরে নামল কারও হাঁটু। ঠেকিয়ে দেয়া হলো মাথায় পিস্তলের নল। পরক্ষণে তীক্ষ্ণ ব্যথা পেল রানা। সজোরে পিঠে গেঁথে দেয়া হয়েছে ইঞ্জেকশনের সুঁই।

অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল অ্যামেট: বাঙালি কুত্তার বাচ্চা, তুই এখন মড়ার মত ঘুমাবি।

রানার মনে হলো কোথায় যেন হারিয়ে যেতে গিয়ে টুপ করে ডুব দিয়েছে কোনও কূপে। চারপাশে মানুষের কণ্ঠ। তবে কমছে আওয়াজ। তারপর ঘুটঘুটে কালো আঁধারে তলিয়ে গেল ও।

.

৩৩.

 ধূসর ধোয়াটে মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে আতঙ্ককর সব দুঃস্বপ্ন দেখছে রানা। হঠাৎ কাদের কথা শুনে ঘুম ভাঙল ওর। চোখের পাতা সামান্য খুলে দেখল চারপাশ। ছোট এক ঘরের কোণে কর্কশ এক ম্যাট্রেসে পড়ে আছে ও। দেয়ালের শেকলে আটকে রাখা হয়েছে হাতদুটো। চোখ আরও সামান্য খুলে কব্জি দেখল রানা। স্টিলের হ্যাণ্ডকাফ কামড়ে ধরেছে মাংস। বাম কবজির দীর্ঘ শিকল গেছে দেয়ালে গেঁথে রাখা ধাতব এক পাইপে। ওই একই শিকলে আটকা পড়েছে ডান কবজির হ্যাণ্ডকাফ।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর রানা বুঝল, অন্য কেউ নেই ঘরে। এবার হ্যাচকা টানে চাইল কবজি ছোটাতে। সম্ভব হলো না। দেয়ালে গভীরভাবে গেঁথে আছে পাইপ।

হাতঘড়ির দিকে তাকাল রানা।

 রাত আটটা আটত্রিশ মিনিট।

অর্থাৎ, ধরা পড়ার পর পেরিয়ে গেছে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। জানা নেই কোথায় আছে।

আবারও চারপাশ দেখল রানা।

ও আছে পুরনো আমলের কোনও মিট লকারে। জানালা নৈই। দরজা বলতে রিভেট করা অ্যালিউমিনিয়ামের পুরু কবাট। বহু দিন ব্যবহার করা হয় না এই গুদাম। মেঝেতে অন্তত এক ইঞ্চি পুরু ধুলো। দেয়ালে মাকড়সার ঝুল। বদ্ধ বাতাসে ইঁদুরের মলমূত্রের দুর্গন্ধ।

বাইরে কণ্ঠস্বর। পদশব্দ। ধাতব দরজার নিচের অংশ দিয়ে একচিলতে হলদে আলো দেখল রানা। খুট-খাট আওয়াজে খুলছে প্যাডলক তালা। কয়েক সেকেণ্ড পর ধুম করে সরে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল দুই লোক। তাদের একজন কাঠির মত চিকন। মুখে-হাতে ফোলা রগ। ঈগলের থাবার মত কুঁকড়ে আছে দুহাতের মুঠো। মাথার কুকাট চুল ধূসর। অন্যজন বোধহয় বড় কোনও প্রতিযোগিতায় হারা ওয়েইটলিটার। ব্যায়াম বাদ দিয়ে প্রতিদিন খেয়েছে প্রচুর ক্রাফট পনির, তাতেই হয়ে উঠেছে তিন শ পাউণ্ডের হাতি। নেড়া ছোট্ট মাথাটা মোটেও মানাচ্ছে না বিশাল দেহে। চিবুকে ছাগলের মত কালো চুটকি দাড়ি।

এদের পরনে কালো সুট, সাদা শার্ট ও চকোলেট টাই। ঝুঁকি নিচ্ছে না কোনও। কয়েক ফুট পেছনে রয়ে গেছে চিকন কাঠি। সরাসরি রানার মাথায় তাক করে রেখেছে পিস্তল। এগিয়ে এল মোটকু, সামান্য ঝুঁকে খুলল রানার বাম কবজির হ্যাণ্ডকাফ।

তোমাদের রুম সার্ভিস জঘন্য, মন্তব্য করল রানা।

খ্যাক-খ্যাক করে মিনিটখানেক হাসল ওয়েইটলিটার, তারপর সতর্ক না করেই হ্যাচকা টানে রানার দ্বিতীয় কবজি থেকে খুলল ব্রেসলেটের মত কাফ। দেয়াল ও পাইপের মাঝের জায়গা থেকে ছুটিয়ে এনে নিজের হাতে নিল শেকল।

চুপচাপ লোক দুজনকে দেখছে রানা।

এরা দ্রুত, অভ্যস্ত এবং পেশাদার।

হাতদুটো মুক্ত বলে সেকেণ্ডের জন্যে রানার মনে হলো: চেষ্টা করবে এদেরকে ঘায়েল করে বেরিয়ে যেতে?

পালোয়ান কাছেই, মুখে মদের গন্ধ। চার সেকেণ্ডে তাকে খুন করতে পারবে রানা।

কিন্তু সমস্যা চিকন পাটকাঠি। শকুনের দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। তাক করে রেখেছে পিস্তল।

না, তেড়িবেড়ি করলে সরুর হাতে খুন হবে ও।

 পালোয়ান খপ করে ধরল ওর কবজি, আবারও পরিয়ে দিল হ্যাণ্ডকাফ। জিনিসটা ছোট, কামড়ে ধরছে মাংস। সামনে ঝুঁকল ওয়েইটলিটার, রানার গলার কাছের শার্ট খামচে একটানে দাঁড় করিয়ে দিল ওকে। কর্কশ কণ্ঠে বলল, ঘঁটো।

তার চোখে চোখ রাখল রানা।

 লোকটার চোখে কোনও ভাব নেই।

হাঁটো, আবারও বলল পালোয়ান। ধাক্কা দিয়ে সামনে বাড়াল রানাকে।

প্রতিটা পদক্ষেপে অনুসরণ করছে চিকন পাটকাঠির পিস্তল। মিট লকার থেকে বেরোতেই সামনে পড়ল ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কিচেন। লকারের মতই পরিত্যক্ত। ধুলোভরা মেঝের টাইলের কোণে কিছু বস্তা। ভেতরের জিনিসপত্র গেছে ইঁদুর ও ছুঁচোর পেটে। ওঅর্ক টপ ও সিঙ্কে পাতিল ও নানান আকারের বাসন। বহু বছর পানির স্পর্শ পায়নি। শেলফের তৈজসপত্র আর কাঁচের জিনিস ঢেকে গেছে মাকড়সার জালে। চপিং বোর্ডে গাঁথা বড় একটা কিচেন ছুরি।

কোনও রেস্টুরেন্ট বা হোটেল এটা, ভাবল রানা।

অনেক বছর আগে বন্ধ হয়েছে ব্যবসা।

 বাতাস শীতল। ভেজা দেয়ালের জন্যে মনে হচ্ছে না এমন।

আসলে ও আছে কোথায়- ভাবছে রানা।

পিঠে ধাক্কা দিয়ে কিচেন পার করাল লোকদুজন। ডাবল ডোর পেরোবার পর শুরু হলো রঙচটা, দীর্ঘ এক করিডোর। কিছুদূর যাওয়ার পর স্টিলের এক দরজার সামনে থামানো হলো ওকে। ওদিকে বোধহয় পুরানো সার্ভিস লিফট। দেয়ালে স্টিলের প্লেটে বাটন। টিপ দিল পালোয়ান। সরসর শব্দে খুলল দুভাগের ধাতব কবাট। পিঠে পিস্তলের নলের খোঁচা খেয়ে এলিভেটরে উঠল রানা। ভেতরে কিচেনের মতই বাসি গন্ধ। ঘুরে দেয়ালে হেলান দিল ও। এবার ভেতরে ঢুকল চিকন কাঠি। পিস্তলের মাযল চেয়ে আছে রানার মাথার দিকে। সবার শেষে ঢুকল পালোয়ান। তার ভারী ওজনের জন্যে ক্যাট-ক্যাট শব্দে নড়েচড়ে উঠল এলিভেটরের মেঝে। বাটন টিপল সে। দরজা বন্ধ হতেই নানান আওয়াজ তুলে উঠতে লাগল এলিভেটর।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। গ্রাউণ্ড ফ্লোরে পৌঁছে খুলে গেল দরজা। ধাক্কা দিয়ে এলিভেটর থেকে রানাকে বের করল পালোয়ান। এগিয়ে চলল ওরা করিডোর ধরে। দেয়ালে নিচের দিকে কালো সব দাগ। তেলাপোকা, ইঁদুর ও ছুঁচোর গায়ের দুর্গন্ধ এখানে অনেক বেশি।

হাঁটতে থাকো, ধমকের সুরে বলল পালোয়ান। আগে আগে চলেছে সে। ধীর গতিতে হেঁটে চলেছে রানা। পিস্তলের নল দিয়ে পেছনে খোঁচা দিচ্ছে সরু কাঠি।

আরেকটা এলিভেটরে চেপে তৃতীয়তলায় উঠল ওরা। এবারের করিডোরও পরিত্যক্ত, দেয়াল রঙচটা। পাশ কাটিয়ে গেল কয়েকটা দরজা। পুরনো হোটেলের রুম, জায়গায় জায়গায় কালচে হয়েছে দরজার পিতলের প্লেট। ছত্রিশ নম্বর দরজার সামনে থামল পালোয়ান। নক করল তিনবার। ভেতর থেকে ঘোঁৎ করে উঠল কেউ। এগিয়ে এল পদশব্দ, তারপর খুলে গেল দরজা।

সামনে হিলহিলে এক লোক দেখল রানা। চুল তার ব্যাকব্রাশ করা।

চিনি তোমাকে, বলল রানা, দাঁতের ব্যথার কী অবস্থা?

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল ক্যাল অ্যামেট। ঠোঁট ফাঁক হতেই দেখা দিল ভেতরে কালো চৌকো গর্ত। ওকে ভেতরে নিয়ে এসো, দলের অন্য দুজনকে নির্দেশ দিল সে। ফোলা ঠোঁটের কারণে বিকৃত শোনাল কণ্ঠ।

পিঠে ধাক্কা খেয়ে ঘরে ঢুকল রানা। আরেক গুঁতো খেয়ে বসল সামনের চেয়ারে। ধৈর্যশীল লোকের মত কোলে রেখেছে শেকলে আটকানো হাতদুটো।

অফিস হিসেবে অযত্নের সঙ্গে ব্যবহার হচ্ছে এই ঘর। কয়েকটা চেয়ার, একটা কমদামি ডেস্ক, তার ওপর একটা ডিভিডি প্লেয়ার আর মনিটর ছাড়া আর কিছুই নেই। রানার মনে হলো না, এই জঘন্য হোটেল কক্ষে সিনেমা দেখাতে ধরে আনা হয়েছে ওকে।

দরজা বন্ধ করে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল ক্যাল অ্যামেট। আলতো করে স্পর্শ করল ফাটা ঠোঁট ও বেগুনি চোয়াল। তাকাল রানার দিকে। দৃষ্টিতে গোখরো সাপের বিষ।

ঘরের অন্য লোকটাকে চিনল না রানা। সে আছে ডেস্কের পেছনে। হাসতেই ঝিক করে উঠল সাদা দাঁত। আছে আনন্দে। বয়স বেশি হলে চল্লিশ। সুঠামদেহী। দীর্ঘ নয়, আবার খাটোও নয়। পরনে দামি কোট। মাথার চুল লালচে। কবজির ঘড়িটা নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি, হীরা খচিত। অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। কাউকে ভয় না দেখিয়েই অনায়াসে নেয় নেতৃত্ব। জন্মেছে নির্দেশ দিতে। সবসময় সব কাজে এগিয়ে থাকে বলে দেখতে পায় ভবিষ্যৎ সমস্যা। অত্যন্ত বিপজ্জনক।

ভাল জায়গা বেছে নিয়েছ, বলল রানা।

আবারও হাসল লোকটা। তা-ই ভাবছ তুমি? কণ্ঠটা বেশ নাকী। কথা বলার সময় অতিরিক্ত নাড়াচাড়া করে দুহাত। ভাল লেগেছে এই হোটেল? হাউ স্ট্রেঞ্জ! ভাল লাগতেই পারে, তোমরা বাঙালিরা তো ফকিরের জাত। আমার মনে হচ্ছে, এই হোটেল নোংরা, পরিত্যক্ত আস্তাবল। এটা চালু রাখতে গিয়ে কত খরচ হচ্ছে, ভাবতে গেলে খারাপই লাগে। কাজ শেষ হলে, এই নরক থেকে আশি মাইল দূরে সভ্য এলাকায় আমাকে নিয়ে যাবে পাইলট।  

তুমি বেশি কথা বলো, বলল রানা।

তুমিও তা-ই করবে, বলল লোকটা। একটু মলিন হলো হাসি।

মনে তো পড়ছে না আমাদের পরিচয় হয়েছে।

আমার নাম থর্ন। আর আগে থেকেই চেনো এজেন্ট ক্যাল অ্যামেটকে। পকেট থেকে সরু চকোলেট বার নিয়ে মোড়ক খুলল সে। চকোলেট পছন্দ করো, মিস্টার রানা?

করি, কিন্তু এখন চাই না, মাথা নাড়ল রানা। দাঁতের ডাক্তার অখুশি হবে, কাজেই অ্যামেটকে ওই জিনিস দেয়া ঠিক হবে না তোমার।

কঠোর চোখে রানাকে দেখল অ্যামেট।

হাসল থর্ন। রসিকতা মন্দ লাগে না। তবে হাসতে নয়, এখানে এসেছি জরুরি কাজে। তুমি ঝামেলা না বাড়ালে খুশি হব। তোমাকে ধরে আনা হয়েছে কিছু তথ্যের জন্যে।

কিছুই জানি না, কাজেই অনর্থক সময় নষ্ট করছ, বলল রানা।

তোমার পেট থেকে সবই বেরোবে, মাসুদ রানা, বলল থর্ন।

ভুল ভাবছ।

এতকাল কী করেছ, সেটাও জানি। সিআইএর প্রতিটা কমপিউটারে আছে তোমার ছবি।

তাই?

হ্যাঁ। ভুল করলে আমাদের পথে কাঁটা হয়ে। গম্ভীর হয়ে গেল থর্ন। ক্যাথি হার্বার্টের হয়ে কাজ করছিলে?

না, তবে খুঁজছি ওই মেয়েকে।

কেন?

আট দিন আগে ওই মেয়েকে চিনতাম না, ভাবল রানা। কোনও জবাব দিল না থর্নের প্রশ্নের।

কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। মার্সেনারি মউরোস আর বিসিআই এজেন্ট মাসুদ রানা গেল গ্রিসের এক দ্বীপে ক্যাথি হার্বার্টকে খুঁজতে। তা কি এমনি এমনিই? চিনত না তারা ওই মেয়েকে?

নিরেট সত্যি জানাল রানা, ওর বাবার অনুরোধে ঠিক করি খুঁজে দেব ওকে। কাজটা দিই আমার বন্ধু মউরোসকে।

ব্যস, এ-ই?

হ্যাঁ, আর কিছু বলার নেই। কড়া চোখে থর্নকে দেখল রানা। বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হলো মউরোসকে। ধারণা করলাম, ওই কাজ করেছে স্টিভ বার্কলে। পরে কথা বলেছি। ওর সঙ্গে। কিন্তু আমার ধারণা ছিল ভুল। এখন জানি, মউরোস, থ্যানাটস ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষের খুনের পেছনে আছ তুমি। জানতে চাইছ, কোথায় আছে ক্যাথির অবশিষ্ট ওস্ট্রাকা। ওসব দেখিয়েই বার্কলেকে ব্ল্যাকমেইল করছিল সে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর বলল রানা, জবাব পেলে তোমার প্রশ্নের। এবার জবাব দাও আমার প্রশ্নের: কী করবে ওসব ওস্ট্রাকা দিয়ে? কেন করছ এসব? হঠাৎ করে ধার্মিক হয়ে উঠেছে সিআইএ?

এসব তোমার না জানলেও হবে, বলল থর্ন।

ওস্ট্রাকা যদি এতই জরুরি, খুনের আগে ক্যাথির কাছ থেকে জেনে নিলে না কেন কোথায় রেখেছে ওগুলো?

ঠোঁট কামড়ে ধরল থর্ন। ভাবছ খুন করেছি ওকে?

ক্যাথি জীবিত থাকলে আমার কাছ থেকে এসব জানতে চাইতে না।

ক্যাথি জীবিত, বলল থর্ন, শুধু তা-ই নয়, আছেও এই হোটেলেই। একটু পর ওর সঙ্গে দেখা হবে তোমার।

বিস্মিত হয়ে ভাবল রানাঃ খুন হয়নি মেয়েটা! সেক্ষেত্রে, হয়তো কোনও সুযোগে ওকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। মুখে বলল, পুরো দুসপ্তাহ পেয়েও ওর মুখ থেকে কিছু বের করতে পারোনি? তোমরা তো জানতাম কঠোর মনের লোক।  

তর্জনী রানার বুকে তাক করল অ্যামেট। সব তোমার পেট থেকে বের করব, শালা!

তোমার ফোঁকলা মুখটা বন্ধ রাখাই ভাল, বলল রানা। চারকোনা, কালো ফাঁক দেখতে বড় বিশ্রী লাগছে। নকল দাঁত লাগিয়ে নিয়ে যত জলদি পার। থর্নের দিকে ফিরল। আমার ধারণা: ওই মেয়েও জানে না কোথায় আছে ওস্ট্রীকা, ঠিক?

নিস্পৃহ চেহারায় ওকে দেখল থর্ন। চিবিয়ে চলেছে চকোলেট।

কোর্ফিউ দ্বীপে ক্যাথির সঙ্গে একই সময়ে হারিয়ে গেছে ওর স্কুটার, বলল রানা, মেয়েটা যাচ্ছিল থ্যানাটসের পাহাড়ি বাংলোয়। কিন্তু ওকে কিডন্যাপ করল তোমার লোক। তারা অ্যামেটের মতই পেশাদার। ভয় লাগিয়ে দিল, ফলে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে ক্যাথি। ওকে হাতে পেয়েও জানতে পারোনি কিছু। চোট পেয়েছে মাথায়। হয়েছে অ্যামনেযিয়া। তোমরা ভাবতে লাগলে, আর কখনও স্মৃতি ফিরবে না ওর।

বুকে দুহাত ভাঁজ করে বলল থর্ন, চালাক লোক তুমি, রানা। দুর্ভাগ্য, তোমার মত লোক নিজের দলে পেলাম না।

সত্যিই, তোমার নোংরা, কাজে জুটল অ্যামেটের মত বাঁদর। তলিয়ে যাবে এ কারণেই।

তুমি তো বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই টের পাচ্ছ, রেগে গেছি তোমার ওপর? বলল থর্ন, প্রাণে বাঁচতে চাইলে মুখ খুলতে হবে তোমাকে।

কিছু জানলেও তোমাকে জানাতাম না।

আছ মস্ত বিপদে। দুই পুলিশ খুনের দায়ে পুঁতে ফেলবে সিআইএ এজেন্টরা তোমাকে।

অ্যামেট তাদের খুনি, বলল রানা। আমি নই।

সাক্ষ্য দেবে কয়েকজন। বলবে খুন করেছ তুমি। তার ওপর আছে গ্রিসের দুই এজেন্ট। ওদের খুনের সঙ্গেও জড়িয়ে যাবে। চাইলেও বাঁচবে না।

চুপ করে থাকল রানা।

হাসল থর্ন। দেখি একটু জাগিয়ে দিতে পারি কি না তোমার স্মৃতি। হাতের ইশারা করল অ্যামেটকে। ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভির দিকে রিমোট তাক করে বাটন টিপল সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট। দপ্ করে চালু হলো টিভি। এক সেকেণ্ড পর রানা বুঝল, দেখানো হচ্ছে কীসের দৃশ্য।

চমৎকার রঙিন ছায়াছবি।

ক্যাফের টেরেসে বসে আছে মউরোস।

মিউট করে রাখা হয়েছে আওয়াজ।

কয়েক সেকেণ্ড ছায়াছবি দেখল থর্ন।

এইমাত্র চেয়ারে মউরোসের মুখোমুখি বসল রানা।

কী যেন বলছে মউরোস।

বল নিয়ে হাজির হলো বাচ্চা ছেলেটা।

লাফ দিয়ে রাস্তায় চলে গেল বল।

পিছু নিল পিচ্চি।

 ছুটে আসছে ওর দিকে ভ্যান।

উঠে দাঁড়াচ্ছে মউরোস।

একটু পরেই ফাটবে বোমা।

কী দেখাবে? বলল রানা। বন্ধুর মৃত্যুদৃশ্য দেখতে হবে ভেবে গলা শুকিয়ে গেছে ওর।

ঠোঁট বাঁকিয়ে চোয়ালের হলদে দাঁত বের করে হাসল অ্যামেট। বসের নির্দেশ পেয়ে প্য করল দৃশ্যটা।

ছড়িয়ে যেতে গিয়েও মনিটরে থেমে গেছে শকওয়েভ। কিন্তু ততক্ষণে বিস্ফোরণের ধাক্কা লেগেছে মউরোসের দেহে। ছেঁড়া লাল কম্বলের মত ছিটকে পড়ছে রানার বন্ধু।

ওই দৃশ্য দেখে তৃপ্তির ছাপ পড়ল ক্যাল অ্যামেটের মুখে।

 স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে রানা। নতুন কিছু দেখছে।

বোমা ফাটার সময় ভ্যানের ওদিকে রাস্তায় বাচ্চাটাকে  আগলে রেখেছিল রানা। তখন প্রায় কিছুই দেখতে পায়নি।

এই ইমেজ তোলা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য অ্যাংগেল থেকে।

 ছড়িয়ে পড়ছে বিস্ফোরণ।

বোঝা যাচ্ছে কোথায় ছিল ওই বোমা।

তিক্ত সব স্মৃতি মনে পড়ল রানার।

বাচ্চাটা খেলছিল বল হাতে।

কাছের টেবিলে এক লোক, সঙ্গে ল্যাপটপ কমপিউটার। বাচ্চাটাকে ধমকে উঠেছিল সে।

পিচ্চিকে খুনির চোখে দেখেছিল বোমাবাজ।

এই ডিভিডি দেখার পর ওই দৃশ্য কখনও ভুলবে না রানা। মনে আছে ওই লোকের মুখটা।

মউরোস আর রানা, আলাপ করছে, তখন চলে গেছে ওই লোক। যে-কোনও ক্যাফেতে এটাই স্বাভাবিক, কফি ও নাস্তার পর চলে যাবে যে-যার পথে। কিন্তু চারপাশে আরও মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল রানার।

পয করা স্ক্রিনে লাল আগুন ও নানান কিছুর ভাঙা টুকরো। সেসবের মধ্যে আছে ভাঙা এক ল্যাপটপের কেসিং, টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে গিয়ে পড়বে দূরে।

টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে থর্নের দিকে তাকাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, তা হলে ভুল ভাবিনি। তোমরাই রেখেছিলে ওই বোমা।

বাতাসে হাত নাচাল থর্ন। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। বোমা পেতে রাখার কাজ আমার নয়। তবে যারা রাখে, তাদেরকে পয়সা দিই।

এই রেকর্ডিং আমাদের দুই এজেন্টের, তারপর হারিয়ে গেছে ওরা, বলল অ্যামেট। ওরা কোথায়, মাসুদ রানা?

সৈকতে, বলল রানা, কাঁকড়া খেয়ে শেষ করার আগেই হয়তো পাবে ওদের লাশ।

হাসল থর্ন। ও, তুমি চাও প্রতিশোধ নিতে?

মন দিয়ে শোনো। শীতল চোখে থর্নকে দেখছে রানা। মরতে হবে তোমাকে। আমার হাতে।

তাই?

হ্যাঁ, বাঁচবে না অ্যামেটও। খুঁড়ে নিয়েছ যে-যার কবর।

নীরবতা নেমেছে ঘরে।

ফ্যাকাসে হলো থর্নের চেহারা। নার্ভাস হাসল। ভেবেছি বুঝতে পারবে পরিস্থিতি। উল্টে হুমকি দিয়ে বিপদ বাড়াচ্ছ নিজের।

চিনে গেছি তোমাদের, বলল রানা, অর্থাৎ, তোমরা ঠিক করেছ, প্রাণে বাঁচতে দেবে না আমাকে। কাজেই কোথায় আছে ওসব ওস্ট্রাকা তা জানলেও মুখ খুলতাম না।

বাস্কেটে চকোলেটের মোড়ক ফেলল থর্ন। বুঝলাম। তবে সহজে মরার পথ আছে, আবার এমনও উপায় আছে যে অনেক বেশি কষ্ট পেয়ে মরবে।

ভেবে বের করব কোন্ পথে তোমাকে নরকে পাঠাব, বলল রানা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল থর্ন। তুমি সত্যিই বোকা। তা হলে দেখাচ্ছি একটা জিনিস। আবারও অ্যামেটের দিকে ইশারা করল সে। ডিভিডি প্লেয়ারের বাটন টিপল সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট। ডিস্ক চেঞ্জারের খর-খর আওয়াজ তুলে সরে গেল আগের ডিভিডি, সেটার জায়গায় এল আরেকটা।

কয়েক সেকেণ্ড কালো থাকল মনিটর। তারপর দেখা দিল ক্লো-আপ দৃশ্য। মোটা এক লোক। ঘর্মাক্ত। কাদামাখা। আছে নোংরা এক সেল বা খাঁচার ভেতর। দুহাতে ধরেছে পুরু শিক। উজ্জ্বল আলো পড়েছে তার মুখে। চোয়াল ও গালে তাজা ক্ষত। ফুলে আছে ডান চোখ।

দেখছ সিআইএ আর্কাইভের ক্লাসিফায়েড ডিভিডি, বলল থর্ন। তোমাকে জানতে হবে না কীজন্যে ওই লোকের এই হাল। শুধু মাথায় রাখো, ওর কাছে ছিল জরুরি তথ্য।  ওগুলো প্রয়োজন ছিল সিআইএর। খুব শক্ত মনের লোক ছিল। তোমার মত। সহ্য করেছে সব রকম নির্যাতন। ঠিক করেছিল হারবে না। …ক্যামেরা যুম হলে দেখতে পাবে তার পায়ের দগদগে ঘা। একটা একটা করে উপড়ে নেয়া হয়েছে প্রতিটা আঙুলের নখ। যে-কোনও সময়ে দেখবে দৃশ্যটা। …ওই যে।

ছায়াছবির দিকে মনোযোগ দিল রানা, ঘুরে অন্যদিকে সরে গেল থর্ন। দেখবে না বীভৎস দৃশ্য। বুঝতেই পারছ, আমি আমলা। মানুষ সত্য বললে খুশি হই। কিন্তু কাউকে নির্যাতন করলে তা দেখতে পারি না। রক্ত একেবারেই সহ্য হয় না আমার।

ফোনে হুকুম দিলে মানুষের খুনের দায় নিতে হয় না, তাই না? বলল রানা।

কথাটা পাত্তা দিল না থর্ন। আমি চাইলে পিটিয়ে ভর্তা করা হবে তোমাকে। উপড়ে নেয়া হবে হাত ও পায়ের নখ। ছিঁড়ে নেয়া হবে অণ্ডকোষ। দেয়া হবে বৈদ্যুতিক শক। বারবার চুবিয়ে তোলা হবে প্রায়-ফুটন্ত পানিতে। পায়ের বুড়ো আঙুলে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হবে ছাত থেকে। শুধু একবার নির্দেশ দিলেই এসব হবে। তোমার যা অতীত, ভাল করেই জানো কী ধরনের হয় নির্যাতন। কিন্তু এসব আমার ইচ্ছে নয়। অ্যামেটের ইচ্ছে তোমার ওপর নির্যাতন করা হোক, তা-ও চাইছি না। রক্ত ঝরানো বা হাত-পা ভাঙা আমার লাইন না। সবসময় পছন্দ করি পরিষ্কার ক্লিনিকাল কাজ। অবশ্য, কারও কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করতে হলে… হাসল থর্ন। নিজের চোখে দেখো কী হয়েছে ওই লোকের।

তার কথা শুনছে রানা। মন দিয়েছে মনিটরে। এইমাত্র চেয়ারে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে লোকটাকে। শক্ত করে ধরে রেখেছে দুজন গার্ড। ইউনিফর্মটা চেনার উপায় নেই। তৃতীয় এক লোক এসে নির্যাতিত লোকটার ঘাড়ে গেঁথে দিল সিরিঞ্জ। ডাবিয়ে দিল প্লাঞ্জার।

কোটের প্রকেট থেকে ছোট একটা বোতল বের করল থর্ন। বোতলে স্বচ্ছ কোনও তরল। ডেস্কে ঠক্ করে রাখল বোতলটা। কোটের অন্য পকেট থেকে নিল ছোট চামড়ার কেস। চেইন টেনে খুলে জিনিসটা রাখল বোতলের পাশে। কেসের ভেতরে সিরিঞ্জ। তুমি কি জানো, রানা, এই ভায়ালে কী আছে?

বোতলটা দেখল রানা। শুনেছি ওই জিনিস ব্যবহা করছে সিআইএর একদল হারামি লোক।

হাতের ইশারায় অ্যামেটকে পয করতে বলল থর্ন। তোমার জানার কথা, এটা কাজে সেরা। পাওয়া কঠিন। কপাল মন্দ, জোগাড় করেছে যে ডাক্তার, তাকে রাখতে পারিনি তামাদের মাঝে পৃথিবীতে। মনিটর দেখাল থর্ন। দেখো, ওই লোকটা ছিল কিন্তু তোমার মতই হাকড়া। বহুবার বলেছে, কিছুই জানে না সে। এত নির্যাতনেও পেট থেকে বেরোয়নি কিছু। কিন্তু ইঞ্জেক্ট করার পর মনের বাঁধ ভাঙল তার। বলতে লাগল সারাজীবনের সমস্ত অপকর্মের কথা। বাদ থাকল না কিছু। …এই তরলের ভাল দিক, সব জেনে নেয়ার পর খুন করতে হয় না কাউকে। …খেয়াল করো কী ঘটে।

আবার রিমোটের বাটন টিপল অ্যামেট।

নয়গুণ জোরে চলল ইমেজ। তারপর আবারও হলো স্বাভাবিক। এখন নতুন অ্যাংগেল থেকে দেখানো হচ্ছে। দৃশ্যটা। আলোও অন্যরকম। আছে ওই লোক, কিন্তু বদলে গেছে সে। মার-খাওয়া, ভয়-পাওয়া বন্দি এখন বদ্ধউন্মাদ। কর্কশ গলায় চিৎকার করছে প্রাণপণে। ঝাঁকি দিচ্ছে সেলের শিক ধরে। জলাতঙ্কে আক্রান্ত বাঁদরের মত বিস্ফারিত চোখে দেখছে এদিক-ওদিক। বেরিয়ে এসেছে দুই পাটি হলদে দাঁত। ফাটা ঠোঁটের কোণে সাদা পিচ্ছিল ফেনা। ওই লোক এখন আর মানুষ নয়, যেন আছে অন্য কোনও গ্রহে।

পুরো পাগল, বলল থর্ন, ওই একই লোক মাত্র ছয়। ঘন্টা আগে ছিল স্বাভাবিক মানুষ। আর কখনও সুস্থ হবে না। বেশিরভাগ সময় একঘণ্টা পর পাগল হয়। তবে কেউ কেউ দুঘণ্টাও টিকতে পেরেছে। ফলাফল সেই একই। দিনের পর দিন মানসিক রোগে ভুগে একসময় পাগলাগারদে অকাল মৃত্যু। বুঝতে পেরেছ, রানা, আমার কথা?

তৃপ্তির হাসি হাসল ক্যাল অ্যামেট। প্য করল ইমেজ। ডেস্কে নামিয়ে রাখল রিমোট। বুকে ভাঁজ করেছে দুই হাত।

ঢোক গিলতে গিয়েও জোর করে ঠেকাল রানা। বুঝতে পেরেছি।

গুড। এবার ভাবার জন্যে সময় দিচ্ছি তোমাকে।

চুপ করে আছে রানা।

সোনার হাতঘড়ি দেখল থর্ন। এখন বাজে সোয়া নয়টা। সময় পাচ্ছ দশটা পর্যন্ত। আবারও দেখা হবে দশটার পর। আশা করি এরপর সব খুলে বলবে। নইলে দেখবে সিরাম দেয়া হলে কী বলে ক্যাথি হার্বার্ট। হয়তো অনেক কথাই বলবে মেয়েটা। মজাই লাগবে শুনতে। তারপর ভোরে আবারও তোমাকে পাঠাব ওর ঘরে। নিজ চোখে দেখবে কী ধরনের জন্তু হয়েছে মেয়েটা। মৃদু হাসল থর্ন। ততক্ষণে বহু দূরে চলে গেছি। আরাম করে চুমুক দিচ্ছি ক্রুগের গ্লাসে। তৃপ্তির সঙ্গে স্ক্রিনে দেখছি কীভাবে ইঞ্জেকশন দেয়ার পর পাগল হয়ে উঠছ তুমি। তবে দুশ্চিন্তা কোরো না, নিজে আমি ব্যবস্থা করে তোমাকে পাঠাব আমেরিকার সেরা পাগলাগারদে। বাকি জীবন মাথা ঠুকবে ফোম লাগানো দেয়ালে।

যারা আয়কর দেয়, উচিত হবে তাদের টাকা এভাবে নষ্ট করা? আপত্তির সুরে বলল ক্যাল অ্যামেট। তার চেয়ে হাত পা ভেঙে বুকে একটা গুলি ঢুকিয়ে দিয়ে কোনও গলিতে ফেলে দিলেই তো হয়।

আমার মন্দ লাগবে না মাসুদ রানা বদ্ধউন্মাদ হলে, চিন্তার সুরে বলল থর্ন। ঠিক আছে, যথেষ্ট কথা হয়েছে। অ্যামেট, দলের লোকদের বলুন একে সরিয়ে নিতে।

দরজা খুলল অ্যামেট। করিডোরে অপেক্ষা করছে হাতি ও ঢ্যাঙা পাট কাঠি। যাও, গিয়ে মাসুদ রানাকে ভরে দাও মিট লকারে। মোটকুর দিকে আঙুল তুলল সে। জিমসন, দরজার বাইরে পাহারায় থাকবে। আর, ম্যাকার্থি, লোকটাকে রেখে এসে দেখা করবে আমার সঙ্গে।

হাতে পাচ্ছ মাত্র পৌনে একঘণ্টা, রানাকে বলল থর্ন।

খুদে মাথার হাতি ঘরে ঢুকে খপ্‌ করে ধরল রানার কনুই। চল, শালা!

চেয়ার ছেড়ে কনুই থেকে লোকটার হাত ঝেড়ে ফেলল রানা। চলেছে দরজার দিকে। তবে কবাটের সামনে থমকে গেল। ঘুরে তাকাল থর্নের চোখে। নরম সুরে বলল, একটু আগে কী বলেছি, ভুলে যেয়ো না, থর্ন। করিডোরে বেরিয়ে গেল রানা।

ঠোঁটে টিটকারির হাসি নিয়ে ওকে দেখল ক্যাল অ্যামেট। বন্দিকে নিয়ে করিডোের ধরে এলিভেটরের দিকে চলেছে তার দুই স্যাঙাৎ। থর্নের দিকে ফিরল সে। রানার কথায় একটু নড়ে গেছে আমলা।

মনে করুন, এরই ভেতর ইতিহাস হয়ে গেছে মাসুদ রানা, বলল ক্যাল অ্যামেট।

.

৩৪.

 পায়চারি করছে রনসন থর্ন। নীরবে সিগারেট ফুঁকছে ক্যাল অ্যামেট। পেরিয়ে গেল পাঁচ মিনিট। তারপর দশ।

দুশ্চিন্তা করবেন না, বলল অ্যামেট। রিল্যাক্স করুন।

আমি কখনও সময় নষ্ট করি না, হাতঘড়ি দেখল থর্ন। আপনার সিগারেটের ধোঁয়া বিরক্ত করছে আমাকে। …দেরি করছে কেন আপনার লোক ম্যাকার্থি? ওকে না বলেছিলেন চট করে ফিরে আসতে?

চলে আসবে, বলল অ্যামেট। আসার পথে হয়তো টয়লেটে গেছে।

বিরক্তি নিয়ে মাথা নাড়ল থর্ন। কঠোর হলো চোয়াল। হাত বোলাল চুলের ভেতর। কোনও গোলমাল হয়েছে। আমি টের পাচ্ছি, নিশ্চয়ই…

কী যে বলেন। বাঘের খাঁচার চেয়েও কঠিন ওই মিট লকার থেকে বেরোনো। ওখানে বসে প্রাণপণে ভাবছে মাসুদ রানা।

তাই? নিজের চোখে দেখতে চাই। খারাপ অনুভূতি হচ্ছে আমার।

কেন যে এত ঘাবড়ে যান, মাথা নাড়ল অ্যামেট। ঠিক আছে, চলুন, দেখিয়ে নিয়ে আসি।

শুধু আমরা নামব নিচে? না, ডাক দিন আপনার আরও কয়েকজনকে।

আমাকে ধরে এই দালানে আছে মোট বারোজন এজেন্ট। তবুও ভয় পাচ্ছেন? আসলে…

ভয় পাচ্ছি না। সতর্ক হচ্ছি। যা বলেছি, তা-ই করুন। ক্যাথি হার্বার্টকে যে দুজন পাহারা দিচ্ছে, তারা ছাড়া অন্যরা যেন যায় আমাদের সঙ্গে। আপত্তি তুলতে হাঁ করল ক্যাল অ্যামেট, কিন্তু কঠোর সুরে বলল থর্ন, যা বলছি, সেটা করুন।

ডেস্কের ড্রয়ার থেকে রেডিয়ো নিয়ে বলল অ্যামেট, ক্যাশকে নিয়ে মেয়েটার ঘরের বাইরে থাকো, রেবেকা। অন্যরা সবাই চলে এসো আমার অফিসে।

পেরিয়ে গেল আরও পাঁচ মিনিট, তারপর প্রায় একই সময়ে অফিসের সামনের করিডোরে জড় হলো সাতজন এজেন্ট। সাবধানে ঘর ছেড়ে করিডোরে বেরোল রন থর্ন। সবার আগে চলেছে অ্যামেট। চেহারায় বিরক্তি ও তিক্ততা।

এলিভেটর ব্যবহার করব না, বলল থর্ন। সিঁড়ি বেয়ে নামব।

ভয় পেয়েছেন রানার কথায়, টিটকারির সুরে বলল অ্যামেট। এতটা আশা করিনি।

সতর্ক থাকা ভাল, বলল থর্ন। বুদ্ধিমানরা তাই করে।

আরেকবার মাথা নাড়ল অ্যামেট। তাই বলে এত ভয় পেলে… কিছুক্ষণ পর ডাবল ডোর ঠেলে কিচেনে ঢুকল সে। পরক্ষণে হয়ে গেল পাথরের মূর্তি। ঝুলে পড়ল নিচের চোয়াল। হায়, ঈশ্বর!

এমনই কিছু হবে ভেবেছি, বিড়বিড় করল থর্ন।

কিন্তু হলো কী করে?

চট করে চারপাশ দেখল থর্ন। মাসুদ রানা সাধারণ কোনও এজেন্ট নয়। আগেই আপনার বোঝা উচিত ছিল।

মেঝেতে ভাঙাচোরা কাঁচ ও বাসন। সেসবের ভেতর পড়ে আছে ম্যাকার্থি ও জিমসন। টিউব লাইটের সাদা আলোয় মেঝেতে গড়িয়ে চলেছে রক্তের সরু দুটো খাল।  

জিমসনের মাথার তালুতে গেঁথে আছে বৃত্তাকার কী যেন। ঝুঁকে ওটা দেখল থর্ন। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, জিনিসটা ওয়াইন গ্লাসের ভাঙা অংশ। গভীরভাবে ঢুকেছে মগজে। জিমসনের একটু দূরে কাত হয়ে পড়ে আছে চিকন ম্যাকার্থি। নীল হয়ে গেছে চেহারা। চিবুকের কাছে ঝুলছে লম্বা জিভ। গলা কেটে গভীরে গেছে স্টিলের শিকল। মেঝেতে হ্যাণ্ডকাফ। পাশেই ছোট্ট চাবি। কোট পরা দুই এজেন্টের শোল্ডার হোলস্টার এখন খালি।

পরস্পরের দিকে তাকাল রনসন থর্ন ও ক্যাল অ্যামেট।

এই দালানে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাসুদ রানা, বলল সিআইএ এজেন্ট।

সন্দেহ নেই। এবার তাকে খুঁজে বের করুন।

 তা তো বটেই, বলল অ্যামেট।

নইলে সর্বনাশ হবে। খুন হব আমরাই। কথা বুঝতে পেরেছেন?

ভাববেন না, বলল অ্যামেট, অপেক্ষা করুন অফিসে।

জীবনেও না। আমি চলে যাচ্ছি। এই হোটেল এখন আমার জন্যে নিরাপদ নয়।

কারও জন্যেই নিরাপদ নয়।

দরকার হলে জান দেবেন, তেমনই কথা হয়েছে। তবে আমার কথা আলাদা। সর্বোচ্চ নেতার কিছু হলে সর্বনাশ হবে। আঙুল তুলে তিনজন এজেন্টকে দেখাল থর্ন! অ্যাই, তোমরা! আমাকে এস্কোর্ট করে নিয়ে যাবে। বিপদ হওয়ার আগেই সরিয়ে নেবে আমাকে। ঘুরে রওনা হলো থর্ন। কিন্তু কয়েক পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। অ্যামেট?

কী?

 জীবিত চাই মাসুদ রানাকে। বুঝতে পেরেছেন?

ধরে আনব, এই তো? ঠিক আছে।

 প্রায় দৌড়ে লবিতে পৌঁছুল থর্ন। পিস্তল হাতে পেছনে কাভার দিচ্ছে তিন এজেন্ট। হোটেল ভবনের দরজা খুলে ডানে ছুটল থর্ন। একটু দূরেই পার্কিং লটে চকচকে এক রুপালি বেল হেলিকপ্টার। থর্নকে ছুটে আসতে দেখেছে পাইলট। কফির ফ্লাস্ক রেখে মোটর চালু করল সে। ধীর গতি তুলে ঘুরতে লাগল রোটর। দৌড়ে এসে দরজা খুলে সিটে চাপল থর্ন। তিন মিনিট পর গাছের সারির ওপর দিয়ে বহু দূরে মিলিয়ে গেল হেলিকপ্টারটা।

 কাপুরুষ রনসন থর্ন বিদায় নিতেই নিজের এজেন্টদের জড় করল ক্যাল অ্যামেট। ঠিক আছে, মনে রেখো, ওই লোক একা। জিমসন আর ম্যাকার্থি নেই। কিন্তু আমরা এখনও দশজন। পালাতে পারবে না মাসুদ রানা। রেডিয়োতে বলল অ্যামেট, ক্যাশ, আগের জায়গায় আছ?

হ্যাঁ।

 ইয়ারফোনে কথাটা শুনে বলল অ্যামেট, সঙ্গে রেবেকা?

জী, স্যর।

মাথা দোলাল অ্যামেট। দলের উদ্দেশে দিল পিস্তলে ঝাঁকুনি। ম্যাকেঞ্জি, ব্রাঞ্চ, তোমরা দুজন ওপরতলায় গিয়ে মেয়েটাকে পাহারা দাও। ওখানেই যাবে মানা। নিষ্ঠুর হাসল অ্যামেট। ওই মেয়েকে চাই ওর। সবাইকে দেখল সে। ঠিক করে নিচ্ছে ট্যাকটিক। চার এজেন্টকে টপকে ক্যাথি হার্বার্ট পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না রানা। এদিকে দল তৈরি করে ছয়জন মিলে তাড়া করে কোণঠাসা করবে বাঙালি কুকুরটাকে। বেজো, মার্কো, তোমরা আমার সঙ্গে এসো। ক্লিভার, টনি আর ভাৰ্যানন, তোমরা সার্চ করবে হোটেলের বামদিক থেকে। রেডিয়োতে যোগাযোগ রাখবে। ওকে দেখলেই দেরি করবে না খুন করতে। জীবিত ধরার দরকার নেই, অনেক বেশি বিপজ্জনক ওই লোক।

রনসন থর্ন বলেছেন খুন না করতে, বলল ভার্ন্যানন।

ওই কাপুরুষের কথায় নাচলে বাঁচা কঠিন, জিভ দিয়ে দাঁতের পেছনে তালু স্পর্শ করল অ্যামেট। মনে পড়েছে, এখন নেই চারটে দাঁত। আমি চাই, আগামী দশ মিনিটের ভেতর ওই হারামজাদার লাশ ফেলে দেবে তোমরা। ঠিক আছে, চলো এবার।

.

৩৫.

 ধীরগতি ছিল সিআইএর দুই খুনি। তাদের প্রতি কোনও করুণা কাজ করছে না রানার মনে। কী ঘটছে তা ভাবতেও পারেনি লোকদুজন।

লাশ ফেলে দেয়ার পর মোটকু এজেন্টের কোটের পকেট থেকে পেয়েছে হ্যাণ্ডকাফের চাবি। দুজনের কাছেই ছিল সাইলেন্সরওয়ালা বেরেটা। গুলিভরা ম্যাগাযিন। ডান হিপ পকেটে রেখেছে একটা পিস্তল, পেছনের পকেটে অন্যটা। একবার দেখেছে কী আছে কিচেনে। চপিং বোর্ড থেকে খুলে নিয়েছে ছুরি। স্টেইনলেস স্টিলের করাতের মত দাঁতওয়ালা ফলা এখনও ধারালো। ওটা খুঁজে রেখেছে বেল্টে।

এরই মধ্যে ঠিক করেছে কীভাবে বেরোবে এখান থেকে। কিচেনে চারকোনা একটা হ্যাচ সরিয়ে দেখেছে পুরনো এক ডাম ওয়েটার। গর্তটা তিনফুট বর্গাকৃতির। দেয়ালের প্যানেলে প্লাস্টিকের তিনটে বাটন। দুটোর ওপর তীর আঁকা। একটা দেখাচ্ছে ওপরের দিক, অন্যটা নিচের দিকে। মাঝের বাটনের ওপর ঝাপসা লেখা: স্টপ।

ডাম ওয়েটার ওপরে পাঠাবার বাটন টিপল রানা। আশা করছে, এত বছর পরেও কাজ করবে কিচেন থেকে খাবার পাঠানো বা বাসন ফেরত আনার এলিভেটর। ভোঁতা দুম্প আওয়াজ শুনল রানা। ঝাঁকি খেয়ে এক ইঞ্চি ওপরে উঠল খুদে এলিভেটর।

স্টপ বাটন টিপে ওপরে ওঠা ঠেকাল রানা। চলবে। এঁটে যাবে ও। ভেতরে গ্রিস ও ইঁদুরের পয়মালের গন্ধ। ডাম ওয়েটারে চেপে বসল রানা। হাত বাড়িয়ে টিপে দিল ওপরের বাটন। আঁকি খেয়ে উঠতে লাগল ডাম ওয়েটার। পলকের জন্যে দেখল এবড়োখেবড়ো সিমেন্টের দেয়াল। ওটা নামছে নিচে, চট করে হাত ফেরত নিল রানা। কাঁপতে কাঁপতে উঠছে প্রাচীন এলিভেটর। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে পিস্তল পরীক্ষা করল রানা। জানা নেই ওপরে কী অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

ওপর থেকে এল কর্কশ আওয়াজ। যে-কোনও সময়ে ছিঁড়বে পুরনো কেবল। পতনের জন্যে তৈরি হলো রানা। এল নতুন কোনও আওয়াজ। কয়েক সেকেণ্ড পর আরেক ঝাঁকুনি দিয়ে থামল ডাম ওয়েটার। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে তিন ফুট বর্গাকৃতির ডাবল ডোর খুলল রানা। যা ভেবেছে। এটা হোটেলের বার। পৌঁছে গেছে কাউন্টারের পেছনে ছোেট এক সার্ভিং এরিয়ায়। হ্যাচ থেকে নেমে এল রানা। ওই বদ্ধ জায়গা থেকে বেরোতে পেরে খুশি। ধুলোভরা বার কাউন্টারের সঙ্গে প্রায় মিশে গেল ছায়ার মত।

রানার ধারণা: কিচেন থেকে উঠে এসেছে দোতলায়। এবার খুঁজে নিতে হবে ক্যাথিকে। বোধহয় ওপরের কোনও ঘরে আছে সে। কিন্তু এটা স্রেফ আন্দাজ। মেয়েটার কাছে পৌঁছাবার আগে বোধহয় বাধা হয়ে উঠবে অন্তত এক ডন এজেন্ট এবং তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। অবশ্য, আপাতত ভেবে লাভ নেই। পরের সমস্যার সমাধান পরেই খুঁজবে।

পিস্তলের সেফটি অফ করে নীরবে বাররুম থেকে বেরিয়ে এল রানা। ডান থেকে বামে ঘুরছে মাযল। প্রায়ান্ধকার করিডোরে চলেছে পায়ে পায়ে। সতর্ক চোখে এড়াচ্ছে না কিছুই। দেয়াল ঘেঁষে হাঁটছে ছায়ার ভেতর। মনোযোগ গভীর। সতর্ক হয়ে উঠেছে স্নায়ু। আওয়াজ করছে না হাঁটার সময়। দূর থেকে এল ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ। লবির কাছে। কথা বলল কেউ। ওকে খুন করতে ছড়িয়ে পড়েছে সিআইএ এজেন্টরা। একেকটা দলে থাকবে দুই থেকে তিনজন। অন্তত দুটো দল। তার মানে, ক্যাথি হার্বার্টকে পাহারা দিতে রয়ে গেছে দুএকজন। তারা থাকবে মেয়েটার ঘরে, বা বাইরের করিডোরে।

সামনের করিডোর L-এর মত। শুরু হয়েছে চওড়া এক হলওয়ে। দুপাশে একের পর এক রুম। একটা দরজা খানিকটা খোলা। ওখান থেকে আসছে ধুলোভরা আলো। ওই ঘর বোধহয় আগে ছিল টিভি রুম।

পাথরের মূর্তি হয়ে থামল রানা। উল্টো দিক থেকে দৌড়ে আসছে কারা যেন। তিনজন। ছায়ায় মিশে যেতে চাইল রানা। খোলা দরজা থেকে আসা আলোয় চট করে ওকে দেখবে না কেউ। দুই ফুট দূর দিয়ে গেল তারা। দুজনের কাঁধ চাপড়ে দিতে পারত রানা। নীরবে অফ করল পিস্তলের সেফটি।

তৃতীয় লোকটা দুই গজ যাওয়ার পর করিডোরে বেরোল রানা। কোনও সুযোগ না দিয়ে গুলি করল এজেন্টের মাথার পেছনে। দৌড়ের ভেতর খসে পড়ল লোকটা, লিনোলিয়াম মেঝেতে পিছলে গিয়ে থামল কয়েক ফুট দূরে। অন্যরা কী ঘটেছে বোঝার আগেই আরও দুবার গুলি করল রানা। কাশির রোগীর খুকখুক আওয়াজ তুলেছে সাইলেন্সর। ভীষণ দুই ঝাঁকি খেয়ে পরস্পর বাড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল দুই এজেন্ট। হাত থেকে ছুটে মেঝেতে গড়িয়ে দূরে গিয়ে থামল দুই পিস্তল।

তিন এজেন্টের তিন পিস্তল সগ্রহ করল রানা। ওগুলোও বেরেটা। একই মডেলের। পিস্তল থেকে বের করে নিয়ে পকেটে রাখল, ম্যাগাযিনগুলো। লাশ তিনটে টপকে দেখল লোকগুলোকে। অতি সতর্ক না হলে হেড-শট কখনও নেয় না কেউ। মনে তিক্ত অনুভূতি হলো রানার।

প্রাচীন আমলের মিলিটারি ট্যাকটিশিয়ানরা বলত, শত্রুকে পাল্টা হামলার সুযোগ দিতে না চাইলে, প্রথমেই উচিত মাথায় আঘাত করা। বুদ্ধিমানের কাজ প্রথম সুযোগে শত্রুকে খুন করা। যদিও তা কসাইয়ের মতই নিষ্ঠুর কাজ।

রানা ব্যবহার করেছে হাই পাওয়ারের হ্যাণ্ডগান। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে মাথায় গুলি করে তিন এজেন্টকে পাঠিয়ে দিয়েছে যমের বাড়িতে। ১৪৭-গ্রেইন সেমি-জ্যাকেটেড হলো-পয়েন্ট বুলেট চুরমার করেছে খুলি। দুপাশের দেয়ালে ও মেঝেতে মগজের টুকরো। আঠালো রক্তের আঁশটে গন্ধে ভরে গেছে করিডোর। সিনেমার দৃশ্যের মত সহজ নয় বিষয়টি। ছিটকে আসা রক্ত এড়াতে বাম হাতে মুখ আড়াল করে তিনটে দেহ সার্চ করল রানা। ও নিজে খুন হয়ে না গেলে আবারও এই হোটেলে আঘাত হানবে মৃত্যুদূত।

নিঃশব্দে হাঁটছে রানা।

.

৩৬.

করিডোর ধরে ছুটে চলেছে সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট। প্রতিবার বাঁক নেয়ার সময় সামনে বা দরজার দিকে তাক করছে পিস্তল। করিডোরের বেশিরভাগ বাতি নষ্ট, দপদপ করে আলোছায়া তৈরি করছে একটা টিউব লাইট।  জায়গায় জায়গায় ঘন ছায়া বা অন্ধকার। স্তূপ করে রাখা পুরনো কার্ডবোর্ডের কয়েকটা বাক্সে পা বেধে পড়তে গিয়েও সামলে নিল অ্যামেট। বিড়বিড় করে গালি দিল কপালকে। রেডিয়ো মুখের কাছে তুলে বলল, ক্লিভার? তুমি কোথায়?

ওদিক থেকে সাড়া নেই।

শালার কপাল, বিড়বিড় করল অ্যামেট, ক্যাশ। ওখানে আছ তো?

কপি। আমরা ওপরেই আছি। এদিকে আসেনি মাসুদ রানা। আপনি দেখতে পেয়েছেন?

না। হারামজাদা ভূতের মত। ঠিক আছে। আউট।

আরেকটা বাঁক নিয়েই বাতাসে ইঁদুরের মলমূত্রের সঙ্গে রক্তের আঁশটে গন্ধ পেল অ্যামেট। সামনে করিডোরের মেঝেতে তিনটে কালো স্তূপ। বেজো আর মার্কোকে হাতের ইশারায় থামতে বলল সে। থেমে গেল তারা। ঝুঁকে দেখল তিন মৃত এজেন্টকে।

পাঁচজনকে নিয়েছে, বলল বেজো। আমরা যেন উঁদুর, বিড়ালের মত আমাদের সঙ্গে খেলছে।

আলাদা হয়ে খুঁজতে যাওয়া উচিত হয়নি, বিড়বিড় করল এজেন্ট মার্কো।

রাগে দাঁতে দাঁত পিষল অ্যামেট। দাঁতের ব্যথায় আরেকটু হলে গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠত। ভুরু ও চোখ থেকে ঝেড়ে ফেলল ঘাম। আরও লোক লাগবে। চাই অন্তত আরও বিশজন।

আর কোনও লোক নেই, কাঁপা গলায় বলল বেজো।

 হারামজাদাকে ধরতে দরকার হলে ডেকে আনব এক শজনকে, মেঝেতে থুতু ফেলল অ্যামেট। একবার ফোন করলেই হবে। কী যেন ভাবল কয়েক মুহূর্ত। এই হোটেলে এজেন্টদের পৌঁছুতে লাগবে অন্তত কয়েক ঘণ্টা। ফোন করতে হবে উপকার পেয়েছে এমন সব এজেন্টকে। সবাইকে সংগঠিত করতে হলেও চাই সময়।

আরেকটা চিন্তা আসতেই বলল অ্যামেট, ঠিক আছে, মন দিয়ে শোনো। এখানে ঘুরঘুর না করে সোজা ওপরতলায় যাব আমরা। ওখানে সবাই আছে। সাতজন আমরা। ওই লোক ইবলিস হলেও আমাদেরকে টপকে যেতে পারবে না ক্যাথি পর্যন্ত। তিক্ত হাসল সে। এদিকে ওই বেশ্যাটাকে দেব ইঞ্জেকশন। দেরি করব না কাজটা করতে। অপেক্ষার খেলা এবার শেষ। জেনে নেব হারামজাদি কী জানে।

রনসন থর্ন কিন্তু খেপে যাবে, বলল বেজো।

মরুক শুয়োরের বাচ্চা, কাপুরুষ। লিডার হয়েছে! ওর তো উচিত ছিল আমাদের পাশে থাকা!

তিন লাশ টপকে করিডোর ধরে দৌড়ে চলল তারা। প্রথম এলিভেটরে উঠে বাটন টিপল অ্যামেট। প্রথমে উঠবে তৃতীয়তলায়। কথা বলছে না কেউ, মুখ ফ্যাকাসে। দুলতে দুলতে উঠছে এলিভেটর। থেমে গেল কয়েক সেকেণ্ড পর। খুলে গেল দরজা। নিজের অফিসের দিকে দৌড়ে গেল অ্যামেট।

দরজা সামান্য খোলা। ভেতরে আলো।

ভাবতে ভাবতে ছুটছে অ্যামেট। মনে পড়ল, দরজায় তালা মেরে তারপর গেছে সে।

পিস্তল বাগিয়ে ধরল অ্যামেট। ভীষণ ভয়ে পেটের ভেতর পাক খাচ্ছে নাড়িভুড়ি। থরথর করে কাঁপছে হাতের অস্ত্রটা। মনে মনে ধমক দিল নিজেকে শান্ত থাকু, শালা!

পিস্তল সামনে তাক করে বামহাতে কবাট ঠেলল অ্যামেট। ক্যাঁচ-ক্যাঁচ আওয়াজে খুলছে দরজা। আরও একটু ঠেলে দিল সে। ভেতরে ঢুকেই সিনেমার দৃশ্যের মত চারপাশে ঘুরিয়ে নিল পিস্তলের মাযল। ভীষণ কাঁপছে তার বুক।

অফিস ফাঁকা। ডেস্ক থেকে হাওয়া হয়েছে ক্যানভাসের ব্যাগ আর কেমিক্যালের বোতলটা।

রানা… চাপা শ্বাস ফেলল ক্যাল অ্যামেট, ওই শালা এসেছিল!

পেছন থেকে বড় বড় চোখে চেয়ে আছে মার্কো।

.

৩৭.

অফিসের বাইরে বিলাপ করে উঠল কেউ। আধ সেকেণ্ডের জন্যে পরস্পরকে দেখল অ্যামেট ও মার্কো। তারপর হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দরজা খুলে লাফিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এল অ্যামেট। পেছনে মার্কো।

বাইরে নামছে রাতের আঁধার। ছায়ায় কালচে হয়ে উঠেছে হোটেল ভবন। ঝট করে দেয়ালের বাতির সুইচ অন করল অ্যামেট। জ্বলল না আলো। অন্ধকারে চোখ চালিয়ে কাকে যেন অভিশাপ দিল সে। নরম সুরে ডাকল, বেজো।

জবাব দিল না কেউ।

প্রায়ান্ধকারে চকচক করছে মার্কোর চোখের সাদা অংশ।

 ও… কো… কোথায় যাবে…।

কথা শেষ করতে পারল না এজেন্ট মার্কো। অ্যামেটের মুখে ছলাৎ করে লাগল তপ্ত একরাশ রক্ত। খুক করে উঠেছে। সাইলেন্সড় পিস্তল। অ্যামেটের গায়ে ঢলে পড়ল মার্কো। গলা থেকে বেরোল গরগরার আওয়াজ। সে খামচে ধরতে চাইল বসের বাহু, তারপর পিছলে পড়ল করিডোরের মেঝেতে। বারকয়েক পা ছুঁড়ল, গলা থেকে বেরোচ্ছে বিশ্রী ঘড়ঘড় আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড পর থামল সব নড়াচড়া।

আমি খুন করব তোকেকুত্তার বাচ্চা! বেসুরো চিৎকার ছাড়ল ক্যাল অ্যামেট। সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে পিস্তল। টিপে দিল ট্রিগার। ম্যাগাযিন খালি না করে থামল না। ইজেক্ট করল ম্যাগাযিন। ভরে নিল নতুন একটা। করিডোরের সামনে ও পেছনে খরচ করল পনেরোটা গুলি। আগে কখনও এত দ্রুত ট্রিগারে টান দেয়নি।

গুলিশূন্য হতেই থামল গরম হয়ে ওঠা পিস্তল। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল অ্যামেট। হাঁফাচ্ছে ভয়ে। রাতের চাদর নেমে আসছে বলে আরও অন্ধকার হয়েছে করিডোর। মাকড়সার জালে ভরা এক জানালা থেকে এল ভোতা ধূসর আলো। নিজে অন্ধকারে আছে অ্যামেট। ঘুরে এগোতে লাগল আঁধারে। এখন চাই কাজ করে এমন একটা বাতির সুইচ। একটা সুইচ পেয়ে টিপে দিল। জ্বলল না বাতি।

তখনই অ্যামেটের গলায় চেপে বসল ছুরির শীতল ফলা। বরফের মূর্তি হলো স্পেশাল এজেন্ট। হাত এখনও বাতির সুইচের ওপর।

তার পেছন থেকে হিমশীতল ভরাট কণ্ঠ বলল, জানতাম ফিরবে। তাই সরিয়ে ফেলেছি করিডোরের সব বা।

ঢোক গিলতে চাইছে ক্যাল অ্যামেট, কিন্তু ছুরির ফলা ঠেকে আছে অ্যাডামস অ্যাপলে। কাটা পড়বে গলা। রানা? ফিসফিস করল সে।

জেনে নাও, কাউকে কিচেনে আটকাতে চাইলে ধারে কাছে রাখবে না ধারালো ছুরি, বলল রানা। কেউ আহত হতে পারে।

কী করতে চাও? কাঁপা গলায় জানতে চাইল অ্যামেট।

মাথাটা কেটে নেব।

প্রাণের ভয়ে থরথর করে কাঁপছে স্পেশাল এজেন্ট।

তবে ক্যাথির কাছে নিয়ে গেলে, আপাতত বাঁচবে, বলল রানা।  

ওকে পাহারা দিচ্ছে, রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল অ্যামেট।

নিজের নোক সরিয়ে দেবে, বলল রানা, সেক্ষেত্রে মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাব। সঙ্গে থাকবে তুমি। দেখিয়ে দেবে কোন্ পথে যাব। যাওয়ার পথে তোমার কাছ থেকে জেনে নেব, কী হচ্ছে আসলে।

কাঁপা গলায় বলল অ্যামেট, আমি শুধু নির্দেশ পালন করি। হুকুমের দাস। আসল লোক ওই থর্ন।

সঠিক সময়ে ওর সঙ্গে দেখা করব, বলল রানা। তবে আমার ধারণা, তুমি নিজেও কম জানো না। বলা যায় না, তোমার ওপর প্রয়োগ করতে পারি ওই সিরাম।

খুন হবে, মাসুদ রানা।

তোমার আগে না, অ্যামেটের গলায় ক্ষুরধার ছুরি ঠেকিয়ে বলল রানা, এগোও।

এলিভেটরে ঢুকে চতুর্থতলার বাটন টিপল অ্যামেট। ক্যানভাস ব্যাগে ছুরি রাখল রানা। অন্য হাতের বেরেটার মাযল চেয়ে থাকল সিআইএ এজেন্টের মাথা লক্ষ্য করে।

হুইস শব্দে খুলল এলিভেটরের দরজা। অ্যামেটের বামহাত পিঠের ওপরে ঠেলে করিডোরে তাকে বের করল রানা। আরেক হাতে তৈরি পিস্তল। রঙ করা হয়েছে করিডোরের দেয়াল। বাতাসে নতুন রঙের গন্ধ। সাজিয়ে নিয়েছে এই তলার সবকিছু। তবে সেটা করা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে।

এখানে কারা থাকে? জানতে চাইল রানা।

শুধু ওই মেয়ে, বলল অ্যামেট। আর বিশজন এজেন্ট। বাঁচার উপায় নেই তোমার।

ঝুঁকি নিতে আপত্তি নেই, বলল রানা। বকবক বন্ধ করে হাঁটো।

দরদর করে ঘামতে ঘামতে ধীর পায়ে হাঁটছে ক্যাল অ্যামেট। হাঁপিয়ে উঠছে ব্যথায়। বাহু মুচড়ে রেখেছে রানা। আরেকটু চাপ দিলেই মড়াৎ করে ভাঙবে সিআইএ এজেন্টের কাঁধের হাড়। সামনে বামে বাঁক নিয়েছে করিড়োর। প্রায় নিঃশব্দে পিস্তলের সেফটি ক্যাচ অফ করল রানা। হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সতর্ক। চোখ এড়াচ্ছে না কিছু। টের পেল, অ্যামেটের টানটান উত্তেজনা। যে-কোনও সময়ে মুখোমুখি হবে অন্য এজেন্টদের। অ্যামেটকে ছেড়ে সামান্য পিছিয়ে গেল রানা, হাতে উঠে এল দ্বিতীয় পিস্তল।

বাঁক ঘুরল ওরা। দশ গজ দূরে শেষ করিডোর। ওদিকে একটা দরজা। প্লেটে লেখা: রুম চার শ চৌত্রিশ। দরজা সামনে তিন এজেন্ট। তাদের দুজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। অ্যামেটের পেছনে পিস্তল হাতে রানাকে দেখে ঝট করে যার যার পিস্তল বের করেছে তারা। চিৎকার করে কী যেন বলল দুই পুরুষ এজেন্ট।

আগেও এই তিনজনকে দেখেছে রানা। বিশেষ করে মনে আছে সুন্দরী মেয়েটাকে। বেসবল ক্যাপের নিচে কালো বেণী মেয়েটার পেলর হাতে মানাচ্ছে না অতিরিক্ত বড় নাইন এমএম পিস্তল। অবশ্য, ভালই জানে নিজের কাজ। কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার চোখে। চেহারা দেখে মেয়েটার মনের কথা পড়তে ব্যর্থ হলো রানা।

বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে ক্যাল অ্যামেটের শরীরটাকে। বামহাতের পিস্তলের মাযল ঠেকিয়ে দিয়েছে এজেন্টের মাথার পাশে। করিডোরের তিন এজেন্টের দিকে তাক করেছে ডানহাতের পিস্তল। একই কাজ করছে তারাও।

আমি ক্যাথি হার্বাটকে চাই, বলল রানা, ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাব। বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে না। নইলে খুন হবে তোমাদের রস।

ক্যাল অ্যামেটকে সামনে রেখে এগোচ্ছে রানা। মাত্র পাঁচ গজ দূরে দরজা। টের পেল, দপদপ করে লাফ দিচ্ছে ওর কপালের পাশের শিরা। আড়ষ্ট চেহারায় ওকে দেখছে তিন এজেন্ট। সবার আঙুল ট্রিগারে। পিস্তলের মাযল নিষ্কম্প। যে কেউ আক্রমণে গেলেই বদ্ধ করিডোরে উঠবে গুলির ঝড়। সবাই এত কাছাকাছি, গুলি ফস্কে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

অ্যামেটের পিছন থেকে সরে মেঝেতে পিস্তল রাখো! চিৎকার করল ডানদিকের এজেন্ট।

তার চোখের মণির নড়াচড়া দেখল রানা। তখনই টের পেল, পেছনে পৌঁছে গেছে কেউ। সরে যেতে এক সেকেণ্ড দেরি করে ফেলেছে রানা। প্রায় একইসময়ে ঘটতে লাগল সব। শক্তিশালী একটা হাত খপ করে ধরল রানার বাম বাহু। ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল অ্যামেটের মাথায় ঠেকিয়ে রাখা ওর পিস্তল। পরক্ষণে রানার কানে নামল প্রচণ্ড এক ঘুষি। পলকে ওর ঘোলা চোখে ঝিলিক দিল অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো। লাফ দিয়ে রানার কাছ থেকে সরে গেল অ্যামেট। চারদিকে শুরু হলো সাইলেন্সরওয়ালা পিস্তলের গুলির খুকখুক আওয়াজ। বাম কাঁধে নাইন এমএম গুলি লাগতেই ডেলটয়েড পেশির ব্যথায় পাগল হয়ে উঠল রানা।

কিন্তু এখন সময় নেই ওদিকে মন দেয়ার। ঘুরেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে পেছনের হামলাকারী এজেন্টের গলায় গুলি করল রানা। কাটা কলা গাছের মত ধুপ করে মেঝেতে পড়ছে লোকটা। কিন্তু খপ করে তাকে ধরে নিজের সামনে আনল রানা। থ্যাপ-থ্যাপ আওয়াজে লোকটার দেহে ঢুকল অন্তত ছয়টা গুলি। কিন্তু তাকে গায়ের কাছে ধরে রাখতে গিয়ে পা পিছলে মেঝেতে পড়ল রানা। ওর ওপর চাপল ভারী লাশ। মেঝেতে কনুই লাগতেই ছুটে গেল রানার বামহাতের পিস্তল। লাথি মেরে লাশ সরিয়ে দেখল, প্রাণভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে দুঃসাহসী সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট। বাঁক ঘুরে হারিয়ে গেল করিডোরের ওদিকে। চলেছে বোধহয় এলিভেটরে চাপতে।

এগিয়ে এসেছে তিন এজেন্ট। বাড়িয়ে ধরেছে পিস্তল। সবার লক্ষ্য রানার বুক। লালচে পাথরের মত চেহারা করেছে মেয়েটা।

লড়াই করে জিতবে না, বুঝে গেল রানা।

তিনজনের পিস্তলের বিরুদ্ধে ওর মাত্র একটা অস্ত্র।

 তিন এজেন্টকে ফেলে দেয়া অসম্ভব।

চিত হয়ে পড়ে আছে রানা। গুলি পাঠাল শত্রুর উদ্দেশে। বেছে নিয়েছে বামদিকের লোকটাকে। পরক্ষণে মাযল সরিয়ে তাক করতে চাইল অন্য লোকটার দিকে।

কিন্তু… দেরি হয়ে গেছে অনেক!

রানা দেখল, ট্রিগারে চেপে বসেছে লোকটার আঙুল।

শূন্যে পাশ কাটাবে ওদের দুটো বুলেট।

 তুই খুন হয়ে গেলি, ভাবল রানা।

পরক্ষণে পাল্টে গেল পরিস্থিতি।

এক পা পিছিয়ে গেছে মেয়েটা, সরাসরি গুলি করল পুরুষ এজেন্টের শোল্ডার ব্লেডের মাঝে। বিস্ময়ে মস্ত হাঁ করল লোকটা। হাত থেকে মেঝেতে খটাং শব্দে পড়ল পিস্তল। এক সেকেণ্ড পর মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল এজেন্ট।

নীরবতা নামল করিডোরে। বেঁচে আছে মাত্র দুজন।

চোখে বিস্ময় নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। আগুন জ্বলছে কাঁধে। মস্ত সব লাফে বুকের পাঁজর ছিঁড়ে বেরোতে চাইছে হৃৎপিণ্ড। ভুরু থেকে টুপ করে দুফোঁটা ঘাম পড়ল মেঝেতে। মেয়েটার দিকে পিস্তল তুলল রানা। একই কাজ করেছে ওই মেয়ে।

কয়েক সেকেণ্ড পরস্পরের চোখে চেয়ে রইল ওরা।

চলছে নীরব চালমাত।

একটার সঙ্গে আরেকটা প্রায় ঠেকে আছে দুজনের পিস্তলের মাযল। রানা টের পেল, বাম বাহু বেয়ে কুলকুল করে নামছে গরম রক্ত। ভিজে গেল আঙুল। ধোয়াভরা করিডোরে নৈঃশব্দ্য ভাঙল মেঝেতে রক্তের ফোঁটার টুপটুপ শব্দ।

অস্ত্রটা নামিয়ে রাখো, বলল রানা।

নিজেরটা নামাও, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল মেয়েটা।

 আর সবাই মারা গেছে। রয়ে গেছ তুমি আর অ্যামেট।

তুমিই তা হলে বিসিআই-এর কিংবদন্তী সেই মাসুদ রানা?

তাই তো মনে হচ্ছে।

অনেক নাম শুনেছি তোমার। এখানে এসেছ কেন?

 ওর বাবা-মার কাছে ফেরত দেব ক্যাথিকে।

 ওকে সরিয়ে নিতে চাও? আমিও তা-ই চাই।

 প্রমাণ দাও তুমি মিথ্যা বলছ না।

ধীরে ধীরে ঝুঁকে মেঝেতে পিস্তল রাখল মেয়েটা। পিছিয়ে গেল কয়েক ফুট। সরাসরি তাকাল রানার চোখে। বুঝতেই পারছ, তোমার পক্ষে আছি। বিশ্বাস করতে পারো আমাকে।

অস্ত্র না নামিয়ে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল রানা। তুমি কে? খুন করলে কেন দলের লোকটাকে?

আমার নাম রেবেকা ট্রিপলার। সিআইএ এজেন্ট। তবে ওদের দলের কেউ নই।

এর কোনও প্রমাণ দিতে পারবে?

এরা সাধারণ এজেন্ট নয়। কাজ করেছে অন্য কারও হয়ে। জড়িয়ে গেছে বেআইনী সব কাজে।

কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল রানা, এখনও মেয়েটার বুকে তাক করে রেখেছে পিস্তল। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ক্যাথি কোথায়?

দরজাটা দেখাল রেবেকা। দরজার ওদিকে। এসো, দুজন মিলেই দরজা খুলি। অ্যামেট লোক জোগাড় করবে। হাতে বাড়তি সময় পাব না।

আসলে কী হচ্ছে, সেটা আমার জানা দরকার, বলল রানা।

যতটা জানি, বলতে আপত্তি নেই। তবে পরে শুনো।

কুঁজো হয়ে মেয়েটার পিস্তল তুলে নিল রানা। বাম কাঁধের ব্যথায় মনে হলো খুন হয়ে যাবে। কুঁচকে গেছে ভুরু।

রানা বেল্টে পিস্তল খুঁজতে বলল রেবেকা, বিশ্বাস করতে পারো আমাকে।

হয়তো… পরে, বলল রানা।খোলো ওই দরজা।

বামদিকের এজেন্টের ভারী লাশ চিত করতে গিয়ে মৃদু গুঙিয়ে উঠল মেয়েটা। মৃতদেহের প্যান্টের পকেট থেকে নিল চাবি। রক্তে ভিজে গেছে রেবেকার আঙুল। হাত মুছে নিল লাশের শার্টে। তিন পা ফেলে চলে গেল দরজার সামনে, দুসেকেণ্ড পর খুলে গেল তালা।

তুমি আগে ঢোকো, বলল রানা।

কবাট খুলে ঘরে পা রাখল রেবেকা। পিছু নিল রানা। হাতে তৈরি পিস্তল। ক্যাথির কারাগারের চারপাশে তাকাল

মেয়েটা নেই এই ঘরে!

.

৩৮.

 কয়েক সেকেণ্ড পর বিছানার তলা থেকে এল করুণ এক কো কোঁ আওয়াজ। রেবেকা সরে গেছে দেয়ালের কাছে। ওখানেই থাকো, বলে খাটের নিচে উঁকি দিল রানা।

বিশবছর পর আবারও ক্যাথি হার্বার্টের সঙ্গে দেখা হলো ওর। সে এখন হাসিমুখ ফোটোর মেয়েটা নয়। চেহারা ফ্যাকাসে। শুকিয়ে গেছে গত দুসপ্তাহের মানসিক চাপে।  

রানাকে দেখে ভীষণ ভয়ে কুঁকড়ে যেতে চাইল।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কড়া শোনাল রানার কণ্ঠ, ক্যাথি, আমি তোমার শত্রু নই। কাঁধের ব্যথায় পাগল হওয়ার দশা ওর। আমার নাম মাসুদ রানা। এসেছি তোমাকে সরিয়ে নিতে। তোমার বাবা পাঠিয়েছেন আমাকে।

কমল না ক্যাথির ভয়। সরে যেতে চাইল দেয়ালের দিকে।

বেরিয়ে এসো, বলল রানা। বাড়ি পৌঁছে দেব। আর ভয় নেই।

আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে মেয়েটার।

হাতে সময় নেই মিষ্টি কথা বলবে রানা। খপ করে স্টিলের বিছানার ফ্রেম একটানে সরাল ক্যাথির ওপর থেকে। এবার ধরল মেয়েটার কবজি। ভয়ের চোটে ফুঁপিয়ে উঠল ক্যাথি। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার চোখে।

জানি, অনেক কষ্টের মাঝ দিয়ে গেছ, বলল রানা, তবে আর ভয় নেই। আমার সঙ্গে এসো। টান দিয়ে মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে দিল ও।

তখনই ক্যাথির চোখ পড়ল রেবেকা ট্রিপলারের ওপর। ঝটকা দিয়ে হাত টেনে নিতে চাইল মেয়েটা। কাঁপা গলায় বলল, ওই মেয়ে ওদের দলের!

শান্ত হও, ক্যাথি, বলল রেবেকা, রানা আর আমি মিলে তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাব।

না-না! এ ওদের দলের! রানার হাত থেকে ছুটে যেতে চাইল ক্যাথি। চড়ে গেছে গলা।

এক মুহূর্ত ভাবল রানা, পরক্ষণে চোয়ালে জোরালো জ্যাব খেয়ে নীরবে জ্ঞান হারাল ক্যাথি। ওকে ডান কাঁধে তুলল রানা। ব্যথায় মনে হলো ছাত ছুঁড়ে স্বর্গে পৌঁছে যাবে।

এটা কোনও কাজ হলো? আপত্তির সুরে বলল রেবেকা।

কাঁধের ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল রানা, কাজের মত কাজ। দরজা পেরিয়ে করিডোরে রাখল ও। দেখা নেই ক্যাল অ্যামেটের।, সাবধানে এগিয়ে চলল রানা ও রেবেকা। টপকে গেল এজেন্টদের লাশ। রানার বাম বাহু বেয়ে দরদর করে পড়ছে রক্ত। পেছনের মেঝেতে লাল ফোঁটা। ভিজে গেছে শার্ট।

এলিভেটরের কাছে পৌঁছে ওরা দেখল, হাওয়া হয়েছে ওটা। রানা দেয়ালের বাটন টিপতেই নিচে শুনল রওনা হয়েছে লোহার পুরনো বাক্স।

পিছিয়ে যাও, দরজার দিকে পিস্তল তাক করল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দরজা খুলতে দেখল, ভেতরে কেউ নেই। নেমে এল ওরা একতলায়। লবি ফাঁকা। ক্যাথির অচেতন দেহ হাতির মত ভারী লাগছে রানার। ডানহাতে ঝেড়ে ফেলল কপালের ঘাম। থাকতে চাইছে সতর্ক। তবে কমে যাচ্ছে মনোযোগ।

ডানদিক দেখাল রেবেকা। ওদিক দিয়ে বেরোতে হবে।

দ্রুত পায়ে হেঁটে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

হঠাৎ ঘর্মাক্ত দেহে রাতের শীতল হাওয়ায় হাড় পর্যন্ত কাপ ধরল রানার। থমকে দাঁড়াল। প্রথমবারের মত দেখছে চারপাশ।

পাথুরে, উঁচু এক ঢিবির ওপর এই পরিত্যক্ত হোটেল। সরু রাস্তা গেছে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে। দূরে এবড়োখেবড়ো, আকাশছোঁয়া বিশাল পর্বতশ্রেণী। সূর্যের শেষ আলোয় লাল ও সোনালি হয়ে গেছে ওগুলো। দেখার মত দৃশ্য। নিজের ভেলা ভাসিয়ে পুবের কালো আকাশে উঠেছে মস্ত এক রুপালি চাঁদ। চারপাশে মাইলের পর মাইল জুড়ে গভীর সবুজ অরণ্য।

রেবেকার দিকে তাকাল রানা। আমরা কোথায় আছি?

মন্ট্যানার চিনুক থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে। একমাত্র রাস্তা ওটা। সরু, আঁকাবাঁকা পথ দেখাল মেয়েটা। চারপাশে লক্ষ লক্ষ একর জমি জুড়ে ঘন জঙ্গল।

আমরা মন্টানায় কেন?

সেটা আমি জানি না।

হোটেলের বাইরে রয়েছে কয়েকটা গাড়ি।

আমরা ওটা নেব, একটু দূরে জিএমসি ফোর-হুইল ড্রাইভ দেখাল রানা।

ওই জিপের পাশে গেল রেবেকা। ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে নামিয়ে দিল সান ভাইযর। ওটার ওপর ছিল চাবি। মেয়েটার হাতে টুপ করে পড়ল ওটা। আমি গাড়ি চালাব।

পেছনের দরজা খুলে আস্তে করে সিটে ক্যাথিকে শুইয়ে দিল রানা। গুঙিয়ে উঠে নড়ল মেয়েটা। ঘুষি মারতে হয়েছে বলে বেশ বিব্রত বোধ করছে রানা। তবে এখন এসব নিয়ে। ভাবার সময় নয়। রেবেকার পাশের সিটে চাপল রানা।

চালু করতেই গর্জে উঠল জিপের ইঞ্জিন। আওয়াজের ওপর দিয়ে বলল রেবেকা, সিটের নিচে ফার্স্ট-এইড কিট পাবে।

বাক্সটা সংগ্রহ করে ভেতরটা ঘটল রানা। আছে ব্যাণ্ডেজ, সার্জিকাল টেপ ও কাঁচি। একটা টিউবে কোডিন ট্যাবলেট। দুটো বড়ি গিলে আহত কাধ সিটের পেছনে চেপে ধরে রেখে। হেলান দিয়ে বসল রানা। হয়তো তাতে থামবে রক্তক্ষরণ।

হোটেল-প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলল জিপ। দুপাশ থেকে চেপে এসে পথরোধ করতে চাইছে জঙ্গল।

এই পথে বেশি দূর যেতে পারব না, ক্লান্ত সুরে বলল রানা। একটু পর হাজির হবে সিআইএ বা এফবিআই-এর অন্তত চল্লিশজন এজেন্ট। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কোনও ট্র্যাকে নেমে যেতে পারো কি না দেখো।

তুমি পাগল নাকি? জঙ্গলে হারিয়ে যাব।

ওটাই বাঁচার একমাত্র উপায়।

 ভাল ড্রাইভার রেবেকা ট্রিপলার। পিছলা; এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঝড়ের বেগে চলেছে বিশাল জিএমসি লিপ।

কয়েক মাইল যাওয়ার পর ডানে জঙ্গলের মাঝে ধুলোর সরু এক পথ দেখাল রানা। ওদিকে যাও।

পাকা রাস্তা ছেড়ে বাঁক নিয়ে অসমতল ধুলোর পথে পিছলে নামল জিপ। শুরু হলো বেদম ঝাঁকুনি। হেডলাইটের আলোয় ছিটকে পেছনে যাচ্ছে দুপাশের গাছের ডালপালা। সড়াৎ-সড়াৎ শব্দে লাগছে উইণ্ডশিল্ডে।

রক্তাক্ত শার্ট সরিয়ে কাঁধের ক্ষত দেখল রানা। মাংসল অংশে বিঁধেছে বুলেট। ওর মনে হলো না লেগেছে হাড়ে। এখনও রয়ে গেছে প্রায়-ভরা উইস্কির ফ্লাস্ক। ক্ষতের ওপর সোনালি তরল ঢালল রানা। মুখ কুঁচকে গেল ব্যথায়। ফার্স্ট এইড কিট থেকে ব্যাণ্ডেজ নিয়ে শক্ত করে বাঁধল আহত কাঁধের ক্ষত।

স্বাভাবিক গতির চেয়ে জোরে জিপ নিয়ে চলেছে রেবেকা। চট করে একবার রানাকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, বেশি খারাপ?

না, ভাল, বিড়বিড় করল রানা। কোডিন রক্তে মিশে যাওয়ায় ভোতা হয়েছে ব্যথা।

তা হলে খারাপ। রয়ে গেছে বুলেট। ওটা বের করতে হবে।

মন দিয়ে গাড়ি চালাও, বলল রানা।

নানান বাঁক নিয়ে জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকেছে ধুলোর পথ। তবে ছয় মাইল যাওয়ার পর চারপাশ থেকে চেপে ধরল জঙ্গল। প্রায় অন্ধের মত এগোতে হলো ঝোঁপের মাঝে। পেছনের সিটে টলমল করে উঠে বসল ক্যাথি। ডলতে লাগল। চোয়াল। আরেক হাতে ধরে রেখেছে দরজার হ্যাণ্ডেল। বারবার এদিক ওদিক কাত হয়ে বদ্ধ মাতালের মত চলেছে জিএমসি জিপ।

জঙ্গলে সতর্ক চোখ রেখেছে রেবেকা। দুই হাতে আঁকড়ে ধরেছে স্টিয়ারিং হুইল। আরও ক মাইল যাওয়ার পর গতি নেমে হলো কচ্ছপের সমান। তারপর হারিয়ে গেল পথের সামান্য আভাসটাও। কাঁটাঝোঁপের কালো মস্ত এক সাগরে নাক খুঁজে এগিয়ে চলল জিপ। শুরু হয়েছে প্ৰেয়ারি। ঝিকঝিক করছে অসংখ্য নক্ষত্র। আকাশের পটভূমিতে দূরে ভাঙা দাঁতের মত এবড়োখেবড়ো পাহাড়শ্রেণী।

মন্ট্যানার হাই লাইন, বলল রেবেকা। ওখানে মিলেছে। বিশাল বিস্তৃত জমি আর রকি পর্বতমালা। জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই এদিকে।

আরও বারো মাইল কোনওমতে এগোল ওরা, তারপর আরও রুক্ষ হলো জমি। এখানে-ওখানে পাথর ও মোটা গাছের শেকড়। বুনো পথে এগোতে হচ্ছে এঁকেবেঁকে। ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রেবেকা। মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকি দিয়ে ফিরিয়ে আনতে চাইছে মনোযোগ। কিন্তু একটু পর হঠাৎ করেই ভীষণভাবে বামে ঝুঁকে গেল জিএমসি জিপ। কাত হয়ে পড়তে গিয়েও যেন সামলে নিল ওটা। পিছলে পড়ে যাচ্ছিল, পায়ের জোরে পতন ঠেকাল রানা। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছে ক্যাথি। থেমে গেছে গাড়ি। বড় এক গর্তে আটকা পড়েছে। একদিকের চাকা। অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে উঠে যেতে চাইল রেবেকা। কিন্তু ওঠার নাম নেই, ধুলোর মধ্যে বনবন করে ঘুরল শুধু চাকা। কাকে যেন অভিশাপ দিল রেবেকা।

দরজা খুলে নামল রানা। ডানহাতে চেপে ধরেছে কাঁধের ক্ষত। রক্তক্ষরণ থামলেও ওর শার্ট ও প্যান্ট এখন কালো। অন্ধকারে টলে উঠল রানা। ভীষণ ব্যথায় ঘুরছে মাথা। ঠাণ্ডা ঘাম নামছে দুই জুলফি বেয়ে। ঝোঁপের ভেতর পাথুরে এক গভীর গর্তে আটকা পড়েছে জিপ।

এটা তুলতে হলে ট্র্যাক্টর লাগবে, বলল রানা। এখান থেকে হাঁটব আমরা।

কথা শুনে চোয়াল স্কুলে গেল ক্যাথির। মাই গড! আপনি ভেবেছেন হাঁটব? এটাই আপনার উদ্ধার করার আইডিয়া?

তা হলে হেঁটো না, বলল রানা, বসে থাকো। গল্প। করো র‍্যাটলকে আর গ্রিজলি ভালুকের সঙ্গে। রেবেকার দিকে ফিরল ও। আকাশ থেকে চট করে চোখে পড়বে। লুকিয়ে ফেলতে হবে গাড়িটা।

ভাবছ হেলিকপ্টারে চেপে আসবে?

ক্লান্ত হাসল রানা। তুমি হলে কী করতে?

গাড়ি থেকে সরিয়ে নেয়ার মত সব নামিয়ে ফেলল রানা ও রেবেকা। পেছনে ছিল কয়েকটা ব্ল্যাঙ্কেট, বোতলজাত পানি, একটা ম্যাগলাইট, কবাক্স ম্যাচ, বিনোকিউলার ইত্যাদি। নিজের ব্যাগে সব ভরল রানা। বাদ পড়ল না ফাস্ট-এইড কিট। কাজটা শেষ করে দেখতে বেরোল জঙ্গুলে উপত্যকার আশপাশ। ফেরার সময় সঙ্গে আনল ডালপালা ও ঝোপঝাড়। ওগুলো দিয়ে ঢেকে দিতে লাগল জিপ। রেবেকার পাশে কাজে হাত লাগিয়ে মনে অন্তত এক শটা প্রশ্ন জন্ম। নিল রানার। বুঝতে পেরেছে, বিশ্বাস করতে পারবে মেয়েটাকে। পরে জেনে নেবে সব। আগের কাজ আগে।

বারকয়েক ঝোপ-ঝাড় নিয়ে আসার পর উঁচু স্তূপের নিচে ঢাকা পড়ল গাড়িটা। চাঁদের রুপালি আলোয় দেখতে হলো মস্ত এক ঝোঁপের মত। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলাল রানা। তুলে নিল ডান কাঁধে ভারী ব্যাগ। লাইন তৈরি করে রওনা হলো তিনজন।

পাথুরে জমি। পথ দেখাল জ্যোৎস্নার আলো। বারবার পিছিয়ে পড়ছে ক্যাথি। বাধ্য হয়ে ওকে নিজের কাছাকাছি রাখল রানা। ধরে রেখেছে কনুই। রেগে আগুন হয়ে আছে মেয়েটা, অসমতল পাথর বা শেকড়ে হোঁচট খেলেই বারবার অভিযোগের আঙুল তুলছে রানার দিকে।

ক্যাথিকে পাত্তা দিল না রানা। মাঝে মাঝে কালো আকাশে চোখ রেখে দেখে নিচ্ছে নক্ষত্র। রেবেকা বলেছে, চিনুকের পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে ওই হোটেল। উত্তরদিকে নগর-সভ্যতা। হয়তো পাবে কোনও রাস্তা বা কোনও ফার্ম। বিশ্রাম নিয়ে তারপর ভাববে কোথায় যাবে। রানা বুঝে গেছে, আগে হোক বা পরে, সাহায্য নিতে হবে ডাক্তারের। দেরি করলে পচতে শুরু করবে বুলেটের ক্ষত। ভাগ্য ভাল, মাত্র কিছু দিন আগেই নিয়েছে টিটেনাস। তবে অনেক কম আঘাতেই কখনও কখনও শুরু হয়ে যায় গ্যাংগ্রিন।

বহুক্ষণ হাঁটছে রানা। বুঝতে পারছে, ফুরিয়ে এসেছে শক্তি। আবারও বেড়ে গেছে কাঁধের ব্যথা। আরেকবার পেইন কিলার নেয়ার ইচ্ছে জোর করে দমন করল রানা। বেহিসেবী হয়ে বড়ি খরচ করা উচিত হবে না। হাঁটতে হবে বহু দূরের পথ, সহ্য করতে হবে আরও অনেক ব্যথা।

.

৩৯.

 ক্রমেই খাড়া হয়েছে জঙ্গুলে, উপত্যকার জমিন। রানা, রেবেকা ও ক্যাথির কান-গাল-নাক প্রায় বরফ করে দিয়ে বইছে শোঁ-শোঁ ঠাণ্ডা হাওয়া। ক্লান্ত পায়ে নীরবে হাঁটছে ওরা। এতই পরিশ্রান্ত, এমন কী অভিযোগ করাও বাদ দিয়েছে ক্যাথি।

উপত্যকার মেঝে থেকে দেড় শ ফুট উঁচু লাইমস্টোনের পাহাড়ে উঠল ওরা। পাথরের চাতালে পেয়ে গেল মাঝারি একটা গুহা। ওটার মুখ অন্যদিকে, হু-হু করে ঢুকবে না শীতল হাওয়া। ভেতরে বুনো জন্তু আছে কি না ম্যাগলাইট জ্বেলে দেখে নিল রানা। বছরের এ সময়ে এসব গুহায় আস্তানা গাড়ে-গ্রিজলি ভালুক ও পাহাড়ি সিংহ। তবে গুহায় নেই শিকারের দেহাবশিষ্ট বা মলমূত্রের চিহ্ন।

আরামে শোয়ার জন্যে চারপাশ ঘুরে শুকনো পাতা ও ফার্ন জোগাড় করল রেবেকা ও অভিযোগবাজ ক্যাথি। ওই সময়ে ডালপালা সংগ্রহ করে গুহার ভেতর ছোট আগুন জ্বালল রানা। কাজটা করেছে এমনভাবে, সোজা ছাতে গিয়ে লাগবে ধোয়া, তারপর ধীরে ধীরে বেরোবে গুহামুখ দিয়ে। কিছুক্ষণ পর ভালভাবেই জ্বলে উঠল আগুন। আরও বাড়ছে কাঁধের টিসটিসে ব্যথা, ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে গেল রানা। শুয়ে পড়ল রেবেকার আনা পাতার বিছানায়। একটু পর ওর পাশে এসে বসল রেবেকা। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রানার ভেজা ভুরু ও চুলে হাত বুলিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল।

ওদের উল্টোদিকে বসল ক্যাথি। পাত্তা দিচ্ছে না রেবেকা বা রানাকে। ব্ল্যাঙ্কেট মুড়িয়ে ওটাকে বালিশ বানিয়ে শুল মেয়েটা। সময় লাগল না ঘুমিয়ে পড়তে।

একটা কাঠি দিয়ে আগুন উস্কে দিচ্ছে রানা। কিছুক্ষণ পর বলল, এবার আলাপ করা যাক।

যা জানি, খুলে বলছি, বলল রেবেকা। তবে অনেক কিছুই জানি না।

ক্যাল অ্যামেট সম্পর্কে বলল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেবেকা। আট মাস আগে আমাকে বলা হয় তার দলে যোগ দিতে। প্রথম থেকেই পছন্দ করতে পারিনি তাকে। ভীতিকর বাজে লোক। অন্য কোনও ইউনিটে ট্রান্সফারের জন্যে অনুরোধ করব, এমনসময় টের পেলাম, অস্বাভাবিক কিছু করছে এরা। স্টিভ বার্কলে নামের এক যাজকের ওপরে চোখ রাখার দায়িত্ব দেয়া হলো। ফোন ট্যাপ করলাম। ই-মেইল ঘাঁটলাম। চোখ রাখলাম লোকটার ওপর। কেন এসব কাজ করতে হবে, তার কোনও ব্যাখ্যা দিল না কেউ।

বলে যাও।

কখনও কখনও রহস্যময় অনেক কাজই করে সিআইএ। সবসময়ে সেজন্যে ফিল্ড এজেন্টকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়, তা-ও নয়। কিন্তু এরা ছিল অন্যরকম। ফোনের ট্রান্সক্রিপ্ট দেখত শুধু ক্যাল অ্যামেট। আমি ছিলাম অন্ধকারে। বাধ্য হয়ে কান। পাতলাম এদের দরজায়। তখনই জানলাম, গ্রিসে পাঠানো হয়েছে কয়েকজন এজেন্টকে।

তাদের একজন ক্রিস্টিনা পার্কার, বলল রানা। চিনতে তাকে?

না, চিনতাম না। তবে একটা ফাইলে পেলাম তার নাম। গোপনে ফাইল ঘাঁটছি জানাজানি হলে মস্ত বিপদে পড়ব। ক্রিস্টিনা প্রাক্তন সিআইএ এজেন্ট। এখন চাকরিতে নেই।

পৃথিবীতেই নেই, মনে মনে বলল রানা। চুপ করে আছে।

তারপর দশ দিন আগে, আবারও শুরু করল রেবেকা, হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। তাদের ভেতর সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা দেখাল ক্যাল অ্যামেট। হয়ে গেল খিটখিটে। প্রতিদিন ফোন করতে লাগল অন্তত এক শবার। কাকে ফোন করছে, জানতে পারলাম না। এর দুএক দিন পর দল গুছিয়ে নিয়ে। সোজা মন্টানায় ওই হোটেলে চলে এল সে।

সে সময়ে গ্রিস থেকে আনা হয়েছে ক্যাথিকে।

মাথা দোলাল রেবেকা। হেলেনা পর্যন্ত আনা হয়েছে প্রাইভেট জেটে করে। এরপর এসেছে হেলিকপ্টারে। আমাদের বলা হলো, গ্রিসের এক টেরোরিস্ট বমিঙের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সে। কথাটা মানতে পারলাম না। গালগল্প মনে হলো। এভাবে কাজে করে না সিআইএ। কখনও ওই হোটেলের মত হোল্ডিং ফ্যাসিলিটি আগে দেখিনি। বুঝলাম, এরা সরকারী খরচে নিজেদের বিশেষ কোনও কাজ করছে। ওপরের মহলে রিপোর্ট দেব ভাবছি, এমনসময় আরও সতর্ক হয়ে গেলাম।

ওপর মহলে রিপোর্ট পাঠালে না কেন?

কারণ, তখনই ঘটল বাজে একটা ব্যাপার। লোকটার নাম ছিল ডিক মান। ডাক্তার। ভাল করে চিনতাম না তাকে। তবে মনে হয়েছিল, মানুষ হিসেবে সে খারাপ নয়। মুখে গুলি করে তাকে মেরে ফেলল ক্যাল অ্যামেট।

মানুষের মুখে গুলি করতে ভালবাসে অ্যামেট, বলল রানা।

এত ভয় পেলাম, গুবলেট হয়ে গেল মগজ। বুঝলাম, ওই দলে আমি একা। পরে মনে হয়েছে, কিছু করা উচিত ছিল।

নিঃসঙ্গ হয়ে গেলে।

বুঝলাম না, কাকে বিশ্বাস করব। সেসময়ে হঠাৎ করে ফোনে নির্দেশ এল, আমাদেরকে যেতে হবে জর্জিয়ায়। এরপর ওখানে তোমাকে পেলাম আমরা। পরের কাহিনী তোমার জানা আছে।

প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, তুমি ওই দলে অন্যরকম, বলল রানা।

ওর চোখে তাকাল রেবেকা। তোমাকে গ্রেফতারের নামে কিডন্যাপ করছে, সেটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আমার উচিত ছিল তাদেরকে বাধা দেয়া। ক্ষমতা বা সাহস ছিল না বলে টু শব্দ করতে পারিনি।

তোমার কিছু করার ছিল না। বাধা দিলে ওই দুই পুলিশের মতই খুন হতে। নিজেদের পথে কাউকে বাধা বলে মনে হলে বিনা দ্বিধায় খুন করে এরা।

আগুনের লালচে আভার মাঝ দিয়ে ঘুমন্ত ক্যাথিকে দেখল রেবেকা। আমার জানা নেই, ওই মেয়ের কাছ থেকে কী চাইছে এরা। তবে ওটা খুব দরকার এদের।

এতই বেশি, ভাবতেও পারবে না, বলল রানা। পরের পনেরো মিনিটে প্রথম থেকে সব খুলে বলল ও।

দুচোখ বড় বড় হয়ে গেছে রেবেকার। বোমা বিস্ফোরণের বর্ণনার সময় হতবাক হয়ে রানার চোখে চেয়ে রইল। এক এক করে প্রতিটি জটিল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল রানা। বাদ পড়ল না কিছু। উকিল পিছলা সিম্পসন। স্টিভ বার্কলে। মেরিয়ান ট্রুলির এক শ মিলিয়ন ডলার। ক্যাথির আবিষ্কার। ব্ল্যাকমেইল।

রানার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ মন দিয়ে শুনল রেবেকা। ও থেমে যেতে নামল রাতের নীরবতা। বিস্ময় নিয়ে ওর চোখে চেয়ে আছে রেবেকা। থর্ন এবং তার দলের নিষ্ঠুরতা বুঝে হাঁফ ধরে গেছে ওর। বড় করে দম নিল। কী ভয়ানক! অথচ মনে হচ্ছে সব সিনেমার কাহিনী! …কিন্তু চাইছে কেন সামান্য পটারি? থিয়োলজির একটা জিনিস এত জরুরি কেন? কী করবে ওটা দিয়ে?

কত দিন তোমরা চোখ রেখেছ স্টিভ বার্কলের ওপর?

মাসের পর মাস।

এজন্যেই বুঝতে পেরেছে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ক্যাথি। মেয়েটা ব্ল্যাকমেইল করছিল স্টিভ বার্কলেকে। ফোনে কান পেতে সবই জেনেছে। এরপর বার্কলের অফিসে বাক্স নিয়ে উকিল পিছলা সিম্পসন গেলে খেয়াল করেছে সব। আরও তথ্য পাওয়ার জন্যে হামলা করেছে পরে উকিলের ওপর। লোকটার প্রাক্তন প্রেমিকা ওখানে হাজির না হলে মেরেই ফেলত নির্যাতন করে।

ভুরু কুঁচকে ভাবছে রেবেকা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, তার মানে, বলতে চাইছ দুর্ঘটনাবশত জালে জড়িয়ে গেছে ক্যাথি হার্বার্ট?

স্টিভ বার্কলে সবকিছুর চাবি, বলল রানা, তাকে ঘিরেই ঘুরছে সব। তবে সেটা সে জানেও না। বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে: কী কারণে বার্কলের ওপর চোখ রাখা হলো?

নীরবে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল ওরা। কারও কাছে কোনও জবাব নেই।

ভয়ানক কোনও পরিকল্পনা আছে, বলল রেবেকা। এটা বুঝতে পেরেছি।

কী ধরনের পরিকল্পনা?

 জানতে পারলে ভাল হতো।

কে এই থর্ন? জানতে চাইল রানা।

অবাক হয়েছে রেবেকা।

হোটেলে অ্যামেটের সঙ্গে ছিল সে। মাঝারি আকারে লোক। দামি কোট। দেখতে পুলিশ বা এজেন্টদের মত নয়। সবকিছুর মূলে আছে সে। তার কাছে জবাবদিহি করে ক্যাল অ্যামেট।

আগে কখনও শুনিনি থর্নের নাম, বলল রেবেকা।

বাড়ছে রানার কাঁধের ব্যথা। আরাম করে বসার জন্যে গুহার দেয়ালে হেলান দিল। তীরের মত খচখচ করে খুঁচিয়ে চলে হ ক্ষতটা। ব্যথা ও শীতে একবার শিউরে উঠল রানা। অত্যন্ত জটিল বিষয়ে অতিরিক্ত ভাবতে গিয়ে ক্লান্ত।

উদ্বিগ্ন চোখে ওকে দেখল রেবেকা। অনেক ব্যথা, তাই? রয়ে গেছে কিছু কোডিন পিল।

আগামী কালকের জন্যে রাখতে হবে, বিড়বিড় করল রানা।

বুলেটের জায়গাটা একবার দেখতে দাও।

একটু কেঁপে গেল রানার কণ্ঠ, আমি ঠিক আছি।

মরে গিয়ে আমাকে দায়ী করে যাবে, তা হবে না, বলল রেবেকা, আমাদের দুজনেরই দরকার পরস্পরের সাহায্য। এগিয়ে বসে রানার শার্টের বোতাম খুলতে লাগল মেয়েটা। বাধা দিতে গিয়েও থেমে গেল রানা। খুব সাবধানে শার্ট সরিয়ে ব্যাণ্ডেজ খুলল রেবেকা।

আগেও এ ধরনের কাজ করেছ, মৃদু কণ্ঠে বলল রানা।  

তিনবছর ছিলাম মেডিকেল স্কুলে। এরপর সিআইএতে যোগ দিয়েছি অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। এর চেয়ে বড় ভুল জীবনে আর করিনি। ম্যাগলাইটের আলো ফেলে রানার বুক ও কাঁধ দেখছে রেবেকা। ফ্যাকাসে কিছু দাগ দেখে বলল, আগেও গুলি লেগেছে।

কখনও কখনও।

বেশ কয়েকবার। ঝুঁকে রানার কাঁধের ক্ষত দেখছে। রেবেকা। ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, রানা। তবে বের করতে হবে বুলেট। উচিত হাসপাতালে যাওয়া।

প্রশ্নই ওঠে না, বিড়বিড় করল রানা। এতই দুর্বল, কমে গেছে আপত্তি তোলার সাধ্য।

ওর মাথার পেছনে ভাঁজ করে ব্ল্যাঙ্কেট রাখল রেবেকা। দক্ষ হাতে ড্রেসিং করে বেঁধে দিল নতুন ব্যাণ্ডেজ। সাহায্য করল শার্ট পরে নিতে। আরেকটা ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে ঢেকে দিল দেহ। প্রায় ফিসফিস করে বলল, এবার একটু ঘুমাতে চেষ্টা করো।

আগুনের টিমটিমে আলোয় ওকে দেখল রানা। নিজের জন্যে ফার্নের বিছানা তৈরি করে শুয়ে পড়ল রেবেকা। কয়েক মিনিট পর রানা বুঝল, ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে ধীরে ধীরে উঠছে নামছে মেয়েটার বুক। ঘুমিয়ে পড়েছে। বহুক্ষণ জেগে থাকল রানা। দূর থেকে এল কয়োটির ইয়াপ-ইয়াপ ডাক।

গভীর রাতে ঘুম ভাঙতে দেখল, নিভন্ত আগুনের কমলা আভায় মাথা উঁচু করে ওকে দেখছে রেবেকা। মুখে এলিয়ে পড়েছে কালো চুল। ফুরিয়ে আসা আগুনের ধিকিধিকি আলোয় চকচক করছে ওর মায়াবী দুচোখ।

ঘুমভরা স্বরে ফিসফিস করে বলল রেবেকা, তুমি স্বপ্ন দেখছিলে। ভালবেসেছিলে কাউকে। পাওনি বা নাওনি।

চুপ করে আছে রানা।

বিয়ে করলে না কেন ওকে? বিড়বিড় করল রেবেকা, হয়তো বাড়ি ফিরবে বলে তোমার জন্যে অপেক্ষা করত।

তেমন কেউ নেই, বলল রানা।

চলে গেল কেন?

চুপ করে থাকল রানা।

বলবে না?

তোমার কেউ নেই? পাল্টা জিজ্ঞেস করল রানা।

ছিল কেউ, বলল রেবেকা, নাম ছিল বব। ভার্জিনিয়ায় একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা। পরে বুঝলাম, অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশতে হবে ওকে। সরে গেলাম। বিষণ্ণ হাসল রেবেকা। মনটা দিয়েছি পরে সিআইএকে।

নীরব থাকল রানা।

ক্যাল অ্যামেট একটা কথা বলেছিল তোমার সম্পর্কে, নরম সুরে বলল রেবেকা।

কী বলেছে?

তুমি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক।

মৃদু মাথা নাড়ল রানা। ভুল বলেছে। ক্যাল অ্যামেটের মত লোক সত্যিকারের বিপজ্জনক জানোয়ার।

আমি কিন্তু তোমার ফাইল পড়েছি।

নীরবে রেবেকার চোখ দেখল রানা।

মুখ থেকে চুল সরাল মেয়েটা। সিআইএতে তোমার ফাইল পড়েছি অন্তত বিশবার। তুমি ছিলে আমার হিরো।

তোমার অন্তর থেকে পতন হলো কবে আমার? ক্লান্ত হাসল রানা।

আস্তে করে মাথা নাড়ল রেবেকা। না, স্থান আরও পরে গেছে। সিআইএ এজেন্টদের মত করে নিরীহ মানুষ নি করো না তুমি।

এসো, সেই খুশিতে ঘুমিয়ে পড়ি, বিড়বিড় করল রানা। চোখ বুজে চুপ করে শুয়ে থাকল ও।

.

৪০.

 মণ্ট্যানা।

পাহাড়ের ওপর সিনেটর হেনরি শোফেন্ডের প্রকাণ্ড বাড়ি।

রাত সাড়ে দশটার দিকে ফোনে কয়েকটা কথা শুনেই হতবাক হয়েছে রনসন থর্ন। পরিত্যক্ত হোটেল থেকে ফোন করে তার মাথায় বাজ ফেলেছে ক্যাল অ্যামেট।

প্রায় ডযনখানেক এজেন্টকে কাঁচ কলা দেখিয়ে ক্যাথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে মাসুদ রানা। সঙ্গে সম্ভবত বন্দি হিসেবে নিয়ে গেছে আরেক এজেন্ট রেবেকা ট্রিপলারকে।

কসেকেণ্ড পর ভাষা ফিরে পেয়েছে থর্ন। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফোনে গাল বকে ভূত ছাড়িয়ে দিয়েছে ক্যাল অ্যামেটের। হাতের কাছে পেলে হয়তো মেরেই বসত।

কিন্তু ওই দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর আগের চেয়ে ঠাণ্ডা হয়েছে থর্নের মগজ। তবে মন এত শান্ত হয়নি যে দানবীয় সোফায় বসে দেখবে নব্বই ইঞ্চি টিভির প্রোগ্রাম। পুরো ব্যাপারটা এখনও ঘোলাটে লাগছে তার কাছে।

অবশ্য, নিয়েছে জরুরি সিদ্ধান্ত। উচিত ছিল আগেই ওটা নিয়ে ভাবা। অনেক দেরি করে ফেলেছে সে।

ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল থর্ন। অপেক্ষা করছে সাড়া পাওয়ার জন্যে।

ওদিক থেকে রিসিভ করল এক লোক।

 হ্যাঁ, আমি বলছি, জানাল থর্ন।

এখন এত রাতে…

ওসব বাদ দাও। মন দিয়ে শোনো। হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে সব। বদলে গেছে প্ল্যান। এবার শত্রুদের বোকা বানাতে আগে থেকেই কাজে নামব আমরা।

ওদিক থেকে বড় করে শ্বাস নিল সিআইএর ঊর্ধ্বতন অফিসার। নিচু গলায় বলল, এখন কেন?

পাওয়া গেছে ভাল সুযোগ, বলল থর্ন, আমরা যে পরিবেশ চাইছি, ঠিক তেমনই ওটা। ব্যাখ্যা দিতে লাগল সে।

সবাই ওখানে থাকবে? তাদের প্রেসিডেন্ট আর সুপ্রিম কাউন্সিলের চার সদস্য?

হাসল রন থর্ন। একই গম্বুজের নিচে। সম্মানিত আরও অনেকে থাকছে। বলতে পারো, একহাতে সবার গালে চড় কষিয়ে দেব আমরা। কেমন মনে হচ্ছে?

কাজটা হলে তো খুব…

সলোমনকে ডাক দাও। তিন দিন পর ওই অনুষ্ঠান। ওকে বলবে, ঠিকভাবে কাজ হলে ও পাবে দ্বিগুণের বেশি টাকা।

ঠিক আছে। কিন্তু আমরা আবার বেশি তাড়াহুড়ো করছি না তো? মৃদু কাঁপছে সিআইএ কর্মকর্তার কণ্ঠ, অনেক বড় পদক্ষেপ।

সত্যিই বড়, সায় দিল থর্ন, কিন্তু সময় হয়েছে। হয় এখন কাজে নামতে হবে, নয়তো ভুলে যেতে হবে চিরকালের জন্যে। আর দেরি করা হবে না, বুক অভ রেভেলেশনের উক্তি। বুঝলে, আমিও বাইবেল পড়েছি। আরও দেরি হলে সর্বনাশ হবে আমাদের।

মানব-ইতিহাসে আমাদের এসব কথা এক সময়ে হয়ে উঠবে মূল্যবান, বিড়বিড় করল সিআইএর ঊর্ধ্বতন অফিসার। সিনেটর শোফেল্ড তৈরি তো?

তৈরি করে নেব। ও নিয়ে চিন্তা নেই। টানতে শুরু করো নিজের দিকের সুতো। আমার কাজ আমি করব।

কল কেটে খুশি হয়ে উঠল থর্ন। গিয়ে থামল ড্রিঙ্ক কেবিনেটের সামনে। বরফের কুচি ভরা বাকেট থেকে ক্রুগের বোতলটা নিয়ে গ্লাসে ঢালল পাঁচ ইঞ্চি সোনালি তরল। নীরবে টোস্ট করল নিজের উদ্দেশে। আজকের এই সিদ্ধান্তের কারণে কিছুদিনের ভেতর সে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পুরুষ। এক ঢোক শ্যাম্পেন গিলল সে। ধক-ধক করছে হৃৎপিণ্ড। শেষপর্যন্ত নিতে পেরেছে সিদ্ধান্ত। আর অপেক্ষা করবে না।

টেবিলে গ্লাস রেখে সোফায় শুল সে। চাপতে পারছে না উত্তেজনা। প্রকাণ্ড টিভির দিকে রিমোট তাক করে টিপল বাটন। স্ক্রিনে ভেসে উঠল তার সবচেয়ে প্রিয় স্যাটেলাইট পর্নো চ্যানেলের প্রচারিত নোংরা সব দৃশ্য।

কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখল থর্ন। তারপর আবারও বেজে উঠল টেলিফোন। অস্বাভাবিক সব গোঙানি ও শীকার মিউট করে কল রিসিভ করল সে।

আবারও ফোন করেছে সিআইএ কর্মকর্তা। সব ঠিক করা হয়েছে। তিন দিন পর।

সলোমন রুশদিকে বলে দিয়ো, ওর তুলনা হয় না।

 সেটা সে আগেই জানে, ফোন রেখে দিল লোকটা।

আবারও গ্লাসটা শ্যাম্পেনে ভরে নিল থর্ন। মিষ্টি তরল দুই ঢোক খেয়ে মুখ মুছল সিল্কের শার্টে। এবার ফোন করল অন্য এক নম্বরে।

তৃতীয় রিঙে ধরল ক্যাল অ্যামেট।

 আমি, বলল রনসন থর্ন।

এখনও খোঁজ নেই, বলল অ্যামেট। ভাল করেই জানত ফোন করবে থর্ন। আমরা সার্চ শুরু করেছি। হাতে পেয়ে যাব। সবই আছে নিয়ন্ত্রণের ভেতর।

আগেও ওই কথা শুনেছি। যখন ওদেরকে পাবেন, নিশ্চিত করবেন, যেন বেঁচে না থাকে।

সবাইকে মেরে ফেলব? ক্যাথি হার্বার্টও?

ওকে রেহাই দেয়ার কোনও দরকার নেই।

 কিন্তু ওস্ট্রাকা…

ওই পর্যায় পেরিয়ে এসেছি, বাধা দিল থর্ন। বদলে গেছে প্ল্যান। চালু করা হয়েছে জেরুযালেমের কাজ।

যিশু!

হ্যাঁ। এবার যিশুর মত কারও জন্যে অপেক্ষা করুন।

কবে শুরু হচ্ছে? জোরে শ্বাস ফেলল অ্যামেট।

তিন দিন পর, বলল থর্ন, কাজেই ওদেরকে খুঁজে কবর দিন।

আনন্দের সাথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *