ধ্রুব

ধ্রুব

 সে যে কত কালের কথা, তাহা আমি জানি না। সেই অতি প্রাচীনকালে আমাদের দেশে উত্তানপাদ নামে এক রাজা ছিলেন। উত্তানপাদের দুই রাণী ছিলেন, একটির নাম সুনীতি, আর একটির নাম সুরুচি।

 সুনীতি বড় লক্ষ্মী মেয়ে ছিলেন, কিন্তু সুরুচি ছিলেন ঠিক তাহার উলটা। আর সুনীতিকে তিনি প্রাণ ভরিয়া হিংসা করিতেন। রাজা সেই সুরুচিকে এতই ভালোবাসিতেন, যে তাঁহার কথা না রাখিয়া থাকিতে পারিতেন না। সুরুচি তাঁহার নিকট সুনীতির নামে কত মিথ্যা কথাই বলিতেন, তিনি ভাবিতেন, তাহার সকলই বুঝি সত্য। শেষে রাজা একদিন সুরুচির কথায় সুনীতিকে রাজপুরী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।

 দুঃখিনী সুনীতি তখন আর কি করেন? মুনিদের তপোবনে গিয়া আশ্রয় লওয়া ভিন্ন তাঁহার আর উপায় রহিল না। সেইখানে কয়েকদিন পরেই তাঁহার একটি খোকা হইল, তাহার নাম হইল ধ্রুব। তখন হইতে ধ্রুবকে লইয়া তিনি মুনিদের আশ্রমেই থাকেন। খোকাটি ক্রমে বড় হইতে লাগিল। সে মুনিকুমারদের সঙ্গে খেলা করে, মুনিদের হোম তপস্যা দেখে আর তাঁহাদের মুখে ভগবানের নাম শুনে। এইরূপে শিশুকালেই তাহার প্রাণে ভগবানের প্রতি ভক্তি জন্মিল।

 এমনি করিয়া দিন যায়। ক্রমে ধ্রুবের বয়স চারি-পাঁচ বৎসর হইয়াছে। ইহার মধ্যে সে একদিন শুনিল যে সে রাজার পুত্র, মহারাজ উত্তানপাদ তাহার পিতা। এ কথা শুনিবামাত্র পিতাকে দেখিবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইল। সে ভাবিল আমি এখনই পিতাকে দেখিতে যাইব।’

 রাজা উত্তানপাদ সিংহাসনে বসিয়া আছেন, সুরুচি তাঁহার নিকটেই দাঁড়াইয়া, সুরুচির পুত্র উত্তম রাজার কোলে। এমন সময় ধ্রুব সেখানে আসিয়া তাঁহার কোলে উঠিবার জন্য তাহার ছোট হাত দুখানি বাড়াইয়া দিল। রাজার হয়তো তাহাকে কোলে লইতেন খুবই ইচ্ছা হইয়াছিল, কিন্তু সুরুচির বিষম ভ্রুকুটি করিয়া নিতান্ত কর্কশভাবে ধ্রুবকে বলিলেন, ‘‘ছেলের আস্পর্ধা দেখ। এত কষ্ট কেন করিতেছিস্ বাছা? জানিস না কি যে তুই সুনীতির ছেলে? উনি তোর পিতা হইলে কি হয়? আমি তো তোর মা নই। রাজাসনে বসা তোর কপালে নাই, সে শুধু আমার ছেলেরই জন্য।” ধ্রুবের প্রাণে এই নিষ্ঠুর কথাগুলি বড়ই লাগিল। সে আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব না করিয়া, ঠোঁট দুখানি ফুলাইয়া মার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। মা তাহার কাঁদ কাঁদ মুখ আর ছল ছল চোখ দুটি দেখিবামাত্র তাহাকে কোলে লইয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে বাবা? কেহ কি তোমাকে কিছু বলিয়াছে?”

 ধ্রুব কহিল, “মা আমি বাবার কোলে উঠিতে গিয়াছিলাম, সৎমা বলিলেন, আমি তোমার ছেলে বলিয়া নাকি তাঁহার কোলে উঠিতে পাইব না; আমার নাকি কপালে নাই।”

 ধ্রুব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে এই কথাগুলি বলিল; তাহা শুনিয়া সুনীতির যে কি কষ্ট হইল তাহা লিখিয়া বুঝাইবার সাধ্য নাই। তিনি কোনো মতে চোখের জল থামাইয়া ধ্রুবকে বলিলেন, “বাবা, সুরুচি সত্যই বলিয়াছে। তোমার কপাল মন্দ, তাই তুমি আমার মতো অভাগিনীর পুত্র হইয়াছ। তোমার কপাল ভালো হইলে কেহ তোমাকে এমন কথা বলিতে পারিত না। রাজার আসনে বসা, ভালো ভালো হাতি ঘোড়ায় চড়া, এ সকল যাহার পুণ্য আছে তাহার ভাগ্যেই জোটে। সুরুচির ছেলে উত্তম অন্যজন্মে অনেক পুণ্য করিয়াছিল, তাই এখন সে রাজার কোলে বসিতে পায়। তুমি কর নাই তাই তুমি তাঁহার কোলে বসিতে পাইলে না। সুরুচির কথায় যদি তোমার দুঃখ হইয়া থাকে, তবে যাহাতে তোমার খুব পুণ্য হয় সেইরূপ কাজ কর, তাহা হইলেই তোমার কপাল ভালো হইয়া যাইবে।”

 ধ্রুব কহিল, “মা আমার মনে যে বড়ই লাগিয়াছে তোমার কথায় তো আমার দুঃখ যাইতেছে না। আমি এমন কাজ করিব যাহাতে সকলের চেয়ে যে ভালো তাহার চেয়েও ভালো স্থান পাইতে পারি। তোমার ছেলে যে আমি, আমার তেজ তুমি দেখ। বাবার যাহা আছে সবই উত্তমের হউক, অন্যের দেওয়া আমি কিছু চাহি না। আমি নিজে এমন জায়গা দেখিয়া লইব যে বাবাও তাহা পান নাই।”

 এই বলিয়াই ধ্রুব ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, তারপর একমনে পথ চলিতে চলিতে সে বনের ভিতরে একস্থানে আসিয়া দেখিল যে সেখানে সাতজন মুনি কুশাসনে বসিয়া আছেন। সে তাঁহাদিগকে প্রণাম করিয়া বলিল, “আমি উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব, আমার মার নাম সুনীতি। আমি মনে বড় কষ্ট পাইয়া আপনাদের নিকটে আসিয়াছি’’ মুনিগণ বলিলেন, “বাছা, তুমি চারি-পাঁচ বৎসরের বালক, তোমার মনে আবার কি কষ্ট হইল।” ধ্রুব কহিল, “আমার বিমাতা আমাকে কটু কথা কহিয়াছেন, তাই আমার মনে কষ্ট হইয়াছে।”

 ধ্রুবের নিকট সকল কথা শুনিয়া মুনিরা বড়ই আশ্চর্যাম্বিত হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা বাছা, এখন তুমি কি চাহ? আমরা তোমার কি সাহায্য করিতে পারি?” ধ্রুব কহিল, “আমি সেই স্থান পাইতে চাহি, যাহা অন্য কেহ পায় নাই। সে স্থান কি করিয়া পাইব আপনারা তাহা আমাকে বলিয়া দিন।” মুনিগণ বলিলেন, “যিনি সকলের বড়, যাহা কিছু আছে সকলই যাঁহার, তুমি সেই হরিকে ডাক, তাহা হইলেই তুমি সে স্থান পাইবে।”

 ধ্রুব কহিল, “কি করিয়া তাঁহাকে ডাকিলে তিনি খুশি হইবেন তাহা তো আমি জানি না, তাহা আমাকে বলিয়া দিন।” মুনিরা বলিলেন, “আর কিছুরই কথা ভাবিবে না, কেবল তাঁহারই কথা ভাবিবে, আর শুধু বলিবে, ‘তুমি সকলের, তোমাকে কেহ জানিতে পারে না, তুমি সকলই জান, তোমাকে নমস্কার।’ ইহাতেই তিনি তুষ্ট হইবেন। তোমার পিতামহ মনু এইরূপেই তাঁহাকে তুষ্ট করিয়াছিলেন।”

 তখন ধ্রুব সেই মুনিদিগকে প্রণাম করিয়া মনের আনন্দে সেখান হইতে যমুনার তীরে মধুবন নামক বনে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া সে দিনরাত একমনে এমনি ব্যাকুলভাবে হরিনাম করিতে লাগিল যে, আর কেহ কখনো তেমন করিয়া তাঁহাকে ডাকিতে পারে নাই। সেই আশ্চর্য তপস্যা দেখিয়া দেবতারা ভয় পাইলেন, পৃথিবী কাঁপিল, সাগর উছলিয়া উঠিল।

 ইন্দ্র ভাবিলেন, না জানি এই বালক এমন তপস্যা করিয়া কি বিপদ ঘটাইবে। তখন তিনি আর কতগুলি দেবতার সহিত মিলিয়া ধ্রুবের তপস্যা ভাঙ্গিবার আয়োজন করিলেন। একজন দেবতা সুনীতির বেশে, ‘হায় বাছা’ ‘হায় বাছা’ বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গিয়া ধ্রুবকে বলিল, “বাবা, কত আশা করিয়া তোমাকে পাইয়াছি। দুঃখিনীর ধন, আমার যে বাছা আর কেহ নাই, আমাকে কি এমন করিয়া ফেলিয়া আসিতে হয়? তুমি যদি তপস্যা না ছাড়, তবে আমি তোমার সম্মুখেই মরিয়া যাইব।”

 কিন্তু ধ্রুরের মন তখন হরির ধ্যানেই মজিয়াছিল সে সকল কপট কান্না শুনিয়াও শুনিল না। তখন সেই দুষ্ট দেবতা “বাবা গো! কি ভয়ানক রাক্ষস আসিয়াছে। পালাও পালাও,” বলিতে বলিতে সেখান হইতে চলিয়া গেল।

 অমনি কোথা হইতে ভীষণ রাক্ষসগণ দলে দলে মার্‌-মার্‌ কাট-কাট শব্দে ধ্রুবকে খাইতে আসিল। সঙ্গে সঙ্গে শত শত শিয়াল ডাকিয়া উঠিল। রাক্ষসেরাও তাহাদের সিংহের মতো, উটের মতো, কুমিরের মতো মুখ দিয়া আগুন ফুঁকিতে ফুঁকিতে কতই গর্জন করিল, শেল, শূল, মুষল, মুদ্‌গর কতই ঘুরাইল, আর দাঁত খিচাইল! ধ্রুব তাহা টেরও পাইল না।

 এইরূপে যখন ধ্রুবের তপস্যা ভাঙ্গিবার সকল চেষ্টাই বিফল হইল, তখন দেবতারা ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে শ্রীহরির নিকটে আসিয়া বলিলেন, “হে প্রভু, আমাদিগকে রক্ষা করুন। উত্তনপাদের পুত্র অতি ভীষণ তপস্যা আরম্ভ করিয়াছে, না জানি আমাদের কাহার কাজটি কাড়িয়া নিবে। শীঘ্র উহার তপস্যা থামাইয়া দিন।”

 শ্রীহরি বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই। ধ্রুব কি চাহে, আমি তাহা জানি। তাহার বাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া আমি তাহার তপস্যা শেষ করিয়া দিতেছি।” তারপর তিনি সেই মধুবন আলো করিয়া ধ্রুবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “ধ্রুব! তোমার মঙ্গল হউক। আমি তোমার তপস্যায় তুষ্ট হইয়া বর দিতে আসিয়াছি; তুমি কি চাহ?” তখন ধ্রুব চক্ষু মেলিয়া সেই সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ দেবতাকে সম্মুখে দেখিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইল, ভয়ও পাইল। সে অমনি তাঁহার পায়ে লুটাইয়া বলিল, “আমি তো জানি না, কি করিয়া আপনার স্তব করিতে হয়; আমাকে তাহা শিখাইয়া দিন।” বলিতে বলিতে শ্রীহরির কৃপায় তাহার জ্ঞান হইল। তখন সে প্রাণ ভরিয়া অতি মধুর বাক্যে শ্রীহরির স্তব করিতে করিতে বলিল, “বিমাতা আমাকে ধমকাইয়া বলিয়াছেন, যে তাঁহার পুত্র নহি বলিয়া আমি রাজাসনে বসিতে পাইব না। হে প্রভু, আমি আপনার নিকট এমন স্থান চাই যে তাহা সংসারের সকল স্থানের চেয়ে ভালো।” শ্রীহরি বলিলেন, “ধ্রুব, তুমি তাহাই পাইবে। চন্দ্র, সূর্য, বুধ, বৃহস্পতি সকলের উপরে তোমার স্থান হইল। তোমার মাতাও তারা হইয়া তোমার নিকটে থাকিবেন।”

 সেই অবধি শ্রীহরির বরে ধ্রুব আকাশে ধ্রুবতারা হইয়া সংসারচক্র ঘুরাইতেছে এইরূপ আমাদের পুরাণে লেখা।

Leave a Reply to Aditi Biswas Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *