ধর্ম ও বিজ্ঞান : উপসংহার

ধর্ম ও বিজ্ঞান

পৃথিবীর বুকে অস্তিত্ব সম্পর্কে যে দুটি প্রশ্ন প্রায়ই বড় হয়ে দেখা দেয়–এর একটি হল, আমাদের শেষ পরিণতি কোথায়? এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে ও যে মানবজাতির আমরা সদস্য, সেই মানুষের আদি উৎস কি? সবিনয়ে স্বীকার করতে হচ্ছে, এই পর্যায়ে ডঃ মরিস বুকাইলি যে-সব বক্তব্য রেখেছেন, বাংলাভাষায় রূপান্তরের সময় কোন কোন ক্ষেত্রে তা সংক্ষেপে করতে হয়েছে; এবং বহুক্ষেত্রেই বিশদব্যাখ্যা সংযোজন করতে হয়েছে, পাঠক-সাধারণের বুঝার সুবিধার জন্য।

প্রথম প্রশ্নের জবাবে আধুনিক সেকুলার-নলেজ বা ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, মানবজাতির শেষ পরিণতি হচ্ছে, ধ্বংস বা বিলুপ্তি এবং মানবজাতি মূলত সেই ধ্বংস তথা বিলুপ্তিরদিকেই অগ্রসরমান। পদার্থগত দিকথেকে মানবদেহের ভবিষ্যৎ পরিণতি ধূলি কিংবা তদনুরূপ কিছু। এই একই কথা অবশ্য একত্ববাদী সব ধর্মগ্রন্থেও স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। সব মানুষের দেহই আজ হোক বা কাল হোক, পরিবর্তিত হয়ে ধূলিতে পরিণত হবে। আগেই বলেছি, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞানের কথাও একই। শুধু তাই নয়, আধুনিক বিজ্ঞান এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে নিতে গিয়ে অপরাপর গ্রহ-উপগ্রহের দিকেও নজর দিয়েছে। এ বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নিমরূপ :

এই যে আমাদের সৌরজগৎ, পৃথিবী যার একটি গ্রহমাত্র, সেই গোটা সৌরজগতেরও শেষপর্যন্ত একই পরিণতি ঘটবে। অর্থাৎ, গোটা সৌরজগাই একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

বস্তুগত দিকথেকে বিচার করেও নির্দ্বিধায় এই ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করা চলে যে, এই ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় মানুষেরা বড়জোর পরিবর্তিত কোন পদার্থে পরিণত হবে। আর সেই পরিবর্তনের কারণে গোটা মানবজাতির দেহাবশেষ পরিণত হবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অতি তুচ্ছ অতি নগণ্য কিছুতে। এদিকে মানবজাতির সেই শেষপরিণতি ঘনিয়ে আসার আগেই মানুষের দেহাবশেষ সমেত পৃথিবী নামক গোটা এই গ্রহটি পরিণত হবে মহাশূন্যের এক প্রাণহীন বস্তুতে। অর্থাৎ, পৃথিবী পরিণত হবে একটি মৃত গ্রহে অনেকটা ঠিক চাঁদের মতই। উল্লেখ্য, আইনস্টাইনের মত বরেণ্য মহাবিজ্ঞানী মানুষের এই ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে এই বলে আর্তনাদ করেছেন যে, শেষপর্যন্ত মানবজাতি তার সকল জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতাসমেত নিক্ষিপ্ত হবে মহাশূন্যের আস্তাকুঁড়ে।

কিন্তু মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য সম্পূর্ণ আলাদা। একত্ববাদী ধর্মগ্রন্থগুলোতে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মৃত্যুই মানুষের পরিণতি বটে কিন্তু মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। আমরা মানুষেরা পুনর্বার জীবন ফিরে পাব; এবং এই মৃত্তিকার ধূলি থেকে পুনরুত্থিত হয়ে হাজির হবো শেষ বিচারের জন্য।

দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে ইতিমধ্যে দেখা গেছে, আধুনিক সেকুলার জ্ঞান বিজ্ঞানের মানুষ এমনসব বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত উপহার পেয়েছে যা থেকে এখন অনায়াসেই মানুষ তথা জীবনের উদ্ভব তথা প্রাণের আদি উৎস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

মানুষের আদি উৎস সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য ও ধর্মীয়গ্রন্থের বক্তব্যের এই যে বিচার-বিশ্লেষণ, এবং তার ভিত্তিতে এই যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ–এরমধ্যে সুবিধা-অসুবিধা কতটুকু তারও বিশদ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

কোন কোন চিন্তাবিদ সম্ভবত বলবেন, এরকম একটি তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত টেনে আনাতে সুবিধা অনেক। আবার কেউ সম্ভবত এর বিপরীত অভিমতই প্রকাশ করবেন। আবার কেউ হয়তোবা বলতে চাইবেন, সুদীর্ঘ সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা ও বিশ্লেষণের ধারায় সুপ্রতিষ্ঠিত একটি তথ্যের নতুন করে আলোচনার উপযোগিতাই-বা কি? আবার এমন লোকেরও অভাব হবে না যিনি মনে করবেন, এরকম আলোচনা এ ধরনের বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণকে নতুন একমাত্রা প্রদান করতে পারে।

পক্ষান্তরে, ধর্মে যারা বিশ্বাসী, এই প্রশ্নের জবাবে তাঁদের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। অবশ্য, এ কথা ঠিক যে, ধর্মবিশ্বাসীদের অনেকে এ ধরনের গবেষণামূলক বিশ্লেষণে ধর্মগ্রন্থের বক্তব্যকে সবার উপরে স্থান দিতে চাইবেন। পক্ষান্তরে, ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও কোন কোন বিজ্ঞানী চাইবেন, ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান বিজ্ঞান ও তথ্য-উপাত্তের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে। এই অবস্থায় যা সবচেয়ে সঠিক ও ন্যায্য বলে আমরা মনে করি, তা হল, ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত এবং ধর্মগ্রন্থের বক্তব্যকে সম-গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা এবং উভয়ধরনের তথ্য ও বক্তব্যের উপর সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ পরিচালনা করা।

আমাদের এই বক্তব্যের পেছনে যুক্তি একটিই। আর তা হল, বিজ্ঞানের তথ্য ও ধর্মগ্রন্থের বক্তব্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ বিদ্যমান বলে যা-কিছু প্রচার করা হয় তা যেমন সত্য নয়; তেমনি ধর্ম ও বিজ্ঞান পরস্পর-বিরোধী বলে শিক্ষিত সমাজে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ইতিপূর্বে তার পরিচয়ও পেয়েছি।

অনেকেরই অজানা নয় যে, কেউ কেউ এমনও আছে, যারা তাদের নিজস্ব রীতি অনুযায়ী আল্লাহ্ কিংবা তার অস্তিত্বের ধারণা বাদ দিতে প্রস্তুত। তাদের কথা, এক্ষেত্রে যদি আমরা নাও ধরি, তবুও দেখতে পাই যে, মানব-সৃষ্টির রহস্যের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য কোন জবাব শুধু বিশ্বাসের জোরে প্রদান করা অসম্ভব ও বিশ্বাসের সাথে সাথে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।

যদিও অনেকে মনে করেন, এরকম আধুনিক তথ্যজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণ ধর্মীয়-বিশ্বাস তথা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধর জন্য ক্ষতিকর বা তার পরিপন্থী; তথাপি, যিনি যাই বলুন, এই জটিল প্রশ্নের জবাব খুঁজতে এটাই একমাত্র সঠিক, যুক্তিযুক্ত ও যথার্থ পন্থা বলে আমরা মনে করি।

মূলত, সবযুগে সবদেশেই ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ ধরনের লোক থাকে। ‘জ্ঞানপাপী’ বা ‘পণ্ডিতমূর্খ’ বলে পরিচিত লোকদেরও সমাজে সদম্ভে বিচরণ করতে দেখা যায়। কিন্তু মুষ্ঠিমেয়সংখ্যক ওই ধরনের লোক যাই বলুন বা যাই ভাবুন, আধুনিক যুগের তথ্য-উপাত্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে এমন যুক্তি প্রমাণই প্রদান করছে যা মানুষকে অবিশ্বাসী করা তো দূরে থাক বরং আল্লাহর প্রতি অধিকতর বিশ্বাসী হওয়ারই শিক্ষা দিচ্ছে। এটি আরও বেশি সম্ভব হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নবনব গবেষণা ও আবিষ্কারের দরুন।

এই গবেষণা-বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানব-সৃষ্টি-সম্পর্কিত তথ্যানুসন্ধান এখন আমাদের সবাইকে এক পরম বিস্ময়কর সাংগঠনিক ক্ষমতার মুখোমুখি করছে। সেই মহাক্ষমতার অদৃশ্য ইঙ্গিতেই জারি রয়েছে জীবনের ধারাপ্রবাহ অব্যাহত গতিতে। সেই বিস্ময়কর সংগঠন ও জীবনের অব্যাহতধারার মুখোমুখি হয়ে বিজ্ঞানীমাত্রেরই এখন স্বীকার না করে উপায় থাকছে না যে, সবকিছুর মূলে রয়েছেন একজন মহান কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, সকল ধরনের জটিল বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ের অনুসন্ধান, পর্যালোচনা ও গবেষণা বিশ্লেষণে এটাও এখন সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে যে, সেই মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব এখন আর শুধু ‘সম্ভাবনার’ কোন বিষয় নয়, বরং তা একান্ত ‘বাস্তব’ এবং সম্পূর্ণভাবে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ একটি বিষয়।

অবশ্য, সমাজে এমন লোকেরও অভাব নেই যারা পারলে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের যেকোন আবিষ্কার-গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তকে তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দেন। তাঁদের ধারণা, এসব গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত পরম স্রষ্টার মহান অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ক্ষেত্র ও অবকাশ সৃষ্টি করে দেয়; মানুষকে মহান স্রষ্টার পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মধ্যযুগের ধর্মীয় গোঁড়ামির দরুন বিজ্ঞানে প্রতিক্রিয়া, এবং বিজ্ঞানের ধর্ম-বিরোধিতার বাড়াবাড়ির দরুন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া একটি ঐতিহাসিক বিষয়। তাছাড়াও, নিছক অজ্ঞতার কারণে বিজ্ঞানের প্রাথমিক জয়যাত্রাকালে এমনটি যে ঘটেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ইতিহাস অন্যকথা বলছে।

এই গ্রন্থের ইতিপূর্বেকার অধ্যায়সমূহের পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে প্রমাণ করছে যে, পরবর্তী পর্যায়ে আধুনিক বিজ্ঞান তার প্রাথমিক পর্যায়ের সেই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্যানুসন্ধান, আবিষ্কার ও গবেষণার ফলাফল আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণকেই সুদৃঢ় করছে : সকল সৃষ্টির পেছনে এক মহান স্রষ্টার সৃষ্টিকুশলতার প্রমাণকে করছে অনেক বেশি স্পষ্ট।

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার গোড়ার দিকে কিছুসংখ্যক বিজ্ঞানী নাস্তিক্যধারার বস্তুবাদী-তত্ত্বকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে ভালবাসতেন। বিজ্ঞানের অব্যাহত জয়যাত্রার দরুন বিশেষত নবনব আবিষ্কার ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উদ্ভাবনার ফলে তাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। কারণটি সত্যিই বিচিত্র। এসব বিজ্ঞানী প্রথমত বস্তুবাদী তত্ত্বকেই গুরুত্ব দিতেন এবং বস্তুই ছিল তাদের নিকট শেষ সত্য। বেশকিছুকাল এইধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু বস্তুকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা প্রায় সবাই এমন এক পর্যায়ে উপনীত হন, যেখানে বস্তু আর বস্তু থাকে না। বস্তুর অতীত এমনকিছু হিসেবে প্রতিভাত হতে শুরু করে যে, তারা প্রায় সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় না হয়ে পারেন না।

অধুনা, বস্তুবাদী গবেষণার ধারায় এভাবে বস্তুনিরপেক্ষ সত্যকে তো বটেই; সেই সাথে বস্তুর অতীত সত্যকে পাওয়ার ঘটনাই ঘটে চলেছে এন্তার। এজন্য, বস্তুবাদী তত্ত্ব অবশ্যই কৃতিত্বের হকদার। পক্ষান্তরে, হাতে গোনা যে দু’চারজন বিজ্ঞানী বস্তুর অতীত সত্যকে পেয়েও অস্বীকার করতে চেয়েছেন বা এখনো নাস্তিক্যবাদীধারায় পরম স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন, তাঁরা শুধু যে বস্তুর পক্ষেই নিমজ্জিত হয়ে রয়েছেন, তাই নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের এই সর্বাধুনিক অগ্রযাত্রার কাফেলা থেকেও তারা নিজেদের করেছেন বিচ্ছিন্ন।

অবশ্য, বস্তুবাদী বিজ্ঞানীদেরও অনেকে ইতিমধ্যে নিজেদের বস্তুতন্ত্রের মোহমুক্তি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তারা এখন উপলব্ধি করেছেন যে, বিজ্ঞানীমাত্রেরই উচিত, বস্তুর অতীত বস্তুর সাংগঠনিক রূপকারের অস্তিত্ব স্বীকার করা। কেননা, বিজ্ঞানের নবনব গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই ধারায় একটি সত্যই এখন তাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে যে, শুধু এই পন্থায় আরেকটি এবং এই পদ্ধতিতেই যেকোন জটিল গবেষণার শেষ-প্রশ্নের জবাবপ্রাপ্তি সম্ভব। অনেকে, ইতিমধ্যে তা পেয়েও গেছেন এবং জবাব একান্ত স্পষ্ট।

মানুষের তথা জীবনের সৃষ্টি-সংক্রান্ত রহস্যের গবেষণায় আরেকটি ধারা বা পস্থার কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাহল, জীবকোষ পর্যায়ে জীবনের-প্রক্রিয়া সম্পর্কে সর্বাধুনিক বিশ্লেষণ ও আবিষ্কার। মলিকুলার বায়োলজি এবং বংশগতি-সম্পর্কিত সর্বশেষ কয়েকযুগের গবেষণায় দেখা গেছে, কোন কোন বিজ্ঞানী মনে করতেন, এই বিষয়ে আরও গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে এ অবকাশ রয়েছে। তারা এর যৌক্তিকতা স্বীকার করতেন এবং শুধু মনে করা নয়, মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতেন যে, এই ধারার গবেষণায় জীবনের সূচনা সম্পর্কিত সব রহস্যের সন্ধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

কিন্তু, তাঁদের সেই গবেষণার ফলাফল শেষপর্যন্ত কি দাঁড়িয়েছে? তাঁদের সেই গবেষণার সেই ফলাফলের কথা এভাবে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করা হলে অনেকে হয়তোবা আহত বোধ করবেন।

কিন্তু তবুও সত্যের খাতিরে বলতে হয় যে, যে দু’চারজন বিজ্ঞানী এ বিষয়ে শেষপর্যায় পর্যন্ত গবেষণাকর্মে লিপ্ত ছিলেন, তাঁরাও সর্বশেষ একপর্যায়ে পৌঁছে থেমে যেতে বাধ্য হন। ঠিক থেমে-যাওয়া নয়, বরং বলা ভালো, থমকে যাওয়া। বিস্ময়ে হতবাক হয়েই তাঁরা দেখেছেন, গবেষণার শেষপর্যায়ে গিয়ে জীবনের মানব-সৃষ্টি-সংক্রান্ত জটিল প্রশ্নের সমাধানের আলোক উদ্ভাসিত হয়েছে বটে; কিন্তু সে আলোক জাগতিক নয় বরং অতীন্দ্রিয়!

উদাহরণস্বরূপ, জীববিজ্ঞানী জিন রোস্ট্যান্ড (জা রোস্তা) মৃত্যুর মাত্র দিন কয়েক আগে ফরাসী টেলিভিশনে যে সাক্ষাৎকার দেন–এক্ষেত্রে তার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জিন রোস্ট্যান্ডকে সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে ‘আল্লাহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। এ যুগের এই সেরা বায়োলজিস্ট জবাবে বলেন যে, এতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু গবেষণার শেষপর্যায়ে পৌঁছে এখন একজন বিজ্ঞানী হিসেবেই তিনি স্বীকার না করে পারছেন না যে, সবকিছুর পেছনে নিশ্চয়ই একজন মহাপরিচালকের অস্তিত্ব রয়েছে। কারণ, জীব-বিজ্ঞানের গবেষণার শেষপর্যায়ে উপনীত হয়ে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখেছেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অর্থাৎ ধারণাতীত ক্ষুদ্র অথচ জীবন্ত কিছুরমধ্যেও সৃষ্টিশীল কার্যকারণের ধারা রয়েছে অব্যাহত। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সেই কার্যকারণের (প্রায় অতীন্দ্রিয়) ধারা অনুধাবন করতে পারেন; কিন্তু সেই সৃষ্টিশীল কার্যকারণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতির বর্ণনার বা বিবরণ প্রকাশের কোন ভাষা তিনি খুঁজে পান না।

সত্য কথা বলতে কি, এখন সকলেরই একটা বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করার সময় এসেছে। তাহল, যেকোন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ধারায় এমন একটা পর্যায় এসে হাজির হয় যখন সে বিষয়ে নতুন কোন তথ্য আবিষ্কারের আর কোন অবকাশ থাকে না। শুধু তাই নয়, সেই একই বিষয়ের উপর গবেষণা পরিচালনা করার তেমন আর কোন ক্ষেত্রেও বাকি থাকে না। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী-গবেষককে এই পর্যায়ে এসে থেমে যেতে হয় এবং তখনই সেই গবেষক-বিজ্ঞানীর দৃষ্টি নিপতিত হয় একই বিষয়ের সম্পূর্ণ নতুন কোন তত্ত্ব বা তথ্যের উপর।

যাহোক, ‘মানুষের সৃষ্টি রহস্য’-সম্পর্কিত ধর্মীয় বক্তব্য কি, এবং সে-সব বক্তব্যের ওপর কিভাবে গবেষণা ও বিশ্লেষণ পরিচালনা করা যায়, বেশ কয়েকবছর ধরেই ড. মরিস বুকাইলি তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে আসছিলেন। দুনিয়াতে বহু ধর্ম রয়েছে; ধর্মগ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে তার ধারণা জন্মেছে অন্যসব ধর্ম বাদ দিয়ে তিনটি একত্ববাদী ধর্ম এবং সেই তিন ধর্মের ধর্মীয়গ্রন্থে সন্নিবেশিত ‘মানব-সৃষ্টির আদি রহস্য’-সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে পর্যালোচনা করাটাই হবে সর্বোত্তম।

মূলত, কোন ইহুদী কিংবা কোন খ্রিস্টান অথবা কোন মুসলমান কিভাবে একইসঙ্গে নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষাকে ধারণ করেও ‘মানব-সৃষ্টির আদি রহস্য’ সম্পর্কিত আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্তকে গ্রহণ করতে পারেন, তাই

ছিল ড. মরিস বুকাইলির চিন্তা-ভাবনার বিষয়। প্রকৃতপক্ষে কি একজন বিশ্বাসী মানুষের পক্ষে একই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য উপাত্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলা সম্ভব? আর চলা যদি সম্ভব হয়, তবে সেই বিষয়টিকে জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাশীল মানুষের নিকট কিভাবে তুলে ধরা যেতে পারে?

উপায় অবশ্য একটি রয়েছে, আর তা হল, বিজ্ঞানের কোন-একটা বিষয়ে আধুনিক গবেষণা ও আবিষ্কারের যে ফলাফল, তারমধ্য থেকে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সত্যগুলো বেছে নিতে হবে; এবং তারপর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিন ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোতে যা কিছু আছে তার ওপরে পরিচালনা করতে হবে এমন তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ,–যা হবে একইসঙ্গে নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক।

সেই পথেই এগিয়ে যেতে হবে; এবং এই নগণ্য পুস্তকটি হচ্ছে, মানব সৃষ্টির আদি রহস্য-সম্পর্কিত সেই তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়াস মাত্র। অতএব, সেই তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণে এ যাবত যা-কিছু পাওয়া গেছে তার ফলাফল একনজরে কি দাঁড়ায়, এবারে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

.

উপসংহার

উপসংহারের এই বক্তব্য নিজস্ব। বলা চলে, মূল লেখকের সকল বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ।

মোটকথাটা তাহলে শেষপর্যন্ত এই দাঁড়াচ্ছে যে, মানুষের আদি উৎস তথা পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমাণ একদিকে যেমন ডারউইনের বানর-তত্ত্বকে বাতিল করে দিচ্ছে। তেমনি অন্যদিকে তা সর্বশেষ একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের তথ্য ও বক্তব্যকে করছে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, ডারউইনের বিবর্তনেরধারায়। ধাপে ধাপে-পর্যায়ক্রমে সেই মানুষকে তিনিই পরিগঠিত করেছেন এবং কোরআনের বর্ণনানুসারে তিনিই ঐশীজ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে তারমধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে সেই মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ও গৌরবে ভূষিত করেছেন। মানুষের আদি উৎস, মানুষের সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণা-আবিষ্কারের সারকথা এটাই।

বিজ্ঞানের ‘শেষ কথা’ বলে কোন কিছু নেই। কিন্তু সর্বশেষ ধর্ম (ইসলাম) শেষ নবীর (সঃ) মাধ্যমে সর্বশেষ আসমানী কিতাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সারকথাকে শেষ কথার আদলে পেশ করেছে এভাবে:

“তিনিই আল্লাহ্, তিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নাই। তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুর পরিজ্ঞাতা। তিনি পরম করুণাময় ও দয়াশীল।

তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নাই। তিনি সবকিছুর মালিক, তিনিই পবিত্রতম, তিনিই শক্তিদাতা, তিনিই নিরাপত্তাবিধানকারী, তিনিই সকল কিছুর সংরক্ষক, তিনিই সর্বজয়ী, তিনিই প্রবল, তিনিই মহামহিমান্বিত। আরোপিত সকল শরিক থেকে আল্লাহ পবিত্র।–

তিনিই আল্লাহ্, যিনি সৃষ্টির পরিকল্পনা রচনাকারী, উহার বাস্তবায়নকারী, সেই অনুসারে আকার-আকৃতি প্রদানকারী। সকল উত্তম নামের অধিকারী তিনি। আসমান ও জমীনের সকলকিছুই তাহার পবিত্রতা ঘোষণাকারী এবং তিনি। মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞানী।”–সূরা ৫৯ (হাশর), আয়াত ২২, ২৩ ও ২৪