কোরআনের আলোকে : মানব-সৃষ্টি

কোরআনের আলোকে : মানব-সৃষ্টি

মানব-সৃষ্টি সংক্রান্ত বিষয়ে বাইবেলের বক্তব্যের সাথে কোরআনের বক্তব্যের তুলনামূলক বিচার-পর্যালোচনা এবং তার ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা হয়নি বললেই চলে। ফলে, এ ব্যাপারে অনেকেরই তেমন কোন ধারণা গড়ে উঠতে পারেনি। পক্ষান্তরে, কোরআন কিভাবে অবতীর্ণ হয়েছিল, আর অবতীর্ণ সেই ওহী কিভাবে সংরক্ষিত হয় এ যাবতকাল আসমানী কিতাব হিসেবে চালু রয়েছে, পাশ্চাত্যের লোকজনের এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকের সে সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। এ ধরনের শিক্ষিত যে-কেউ মানব-সৃষ্টি মত বিজ্ঞানধর্মী আলোচনা-বিশ্লেষণে কোরআনের বক্তব্য নিয়ে সম্পূর্ণ একটি অধ্যায় ব্যয় করতে দেখে যে বিস্মিত হবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাদের এই বিস্ময় অবশ্য অকারণে নয়। কেননা, পাশ্চাত্য (এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোন কোন মহলে) ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে আগাগোড়া ভূল ধারণা বিদ্যমান। সত্যি বলতে কি, ইসলাম ও কোরআন-সম্পর্কিত এহেন ভুল ধারণার মধ্যেই বেশিরভাগ আধুনিক শিক্ষিত মানুষের বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা এবং এমনকি বসবাস পর্যন্ত সম্পন্ন হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের কথা বলতে গেলে নিজের কথাই বলতে হয়। ড. মরিস বুকাইলি জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন অনুরূপ ভুল ধারণার মধ্যে। ইসলাম সম্পর্কে আধুনিক শিক্ষিত মহলে ভুল ধারণা যে কি রকম, সে সম্পর্কে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে দু’একটা উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ড. মরিস বুকাইলি বলেন, লেখাপড়া শিখে আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখনকার কথা। গোড়া থেকেই আমাকে সবদিক দিয়ে একটি কথা শেখান হচ্ছিল, যে কোরআন হচ্ছে ‘মেহোমেটের’ রচিত একখানি ‘পুস্তক’। মেহোমেট’ অর্থাৎ মোহাম্মদ (দঃ) যে কোরআনের লেখক বা রচয়িতা, সেই কথাটা আমি কোরআনের এক ফরাসী অনুবাদের ভূমিকাতেও দেখেছি। শুধু তাই নয়, আমার শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বারবারই যে কথাটা আমার মনে গেঁথে দেয়ার প্রয়াস চলেছে, তাহল, কোরআনের লেখক (অর্থাৎ ‘মেহোমেট’) কোরআন রচনা করেছেন, আগাগোড়া বাইবেল নকল করেই। তবে সেই নকলের বেলায় তিনি কিছুটা ভিন্নধারা অবলম্বন করেছেন। যেমন, বাইবেলে বর্ণিত বিভিন্ন পবিত্র কাহিনী সংকলনের ক্ষেত্রে তিনি কোন কোন অনুচ্ছেদ কাটছাঁট করেছেন; কোন কোন স্থানে কিছুটা যোগ-সংযোগও করেছেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়েছেন যে ধর্মের তিনি প্রচারক বলে দাবি করেছেন সেই ইসলাম ধর্মের কিছু রীতি-নিয়ম আর কিছু নীতি-আদর্শের কথা!

এখন স্মরণযোগ্য যে, এই যুগেও ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্য জগতে এবং প্রাচ্যের আধুনিক শিক্ষিত মহলে ‘ইসলাম-বিশারদ’ হিসেবে খ্যাতিসম্পন্ন একধরনের ‘পণ্ডিত ব্যক্তি রয়েছেন। পেশায় এঁরা বেশিরভাগই শিক্ষক। এঁরা প্রায় সবাই ‘কোরআন’ ও ‘মেহোমেট’ সম্পর্কে কমবেশি উপরে যেভাবে বলা হয়েছে, তদনুরূপ ধারণাই পোষণ করেন। তবে, তাঁদের মধ্যে কারোকার প্রকাশভঙ্গি কিছুটা শালীন, কৌশলপূর্ণ ও সূক্ষ্ম।

কোরআনের মূলসূত্র সম্পর্কে এই যে প্রচারণ–যা শিক্ষা প্রদানের নাম করে প্রচার করা হয়ে থাকে, তা কিন্তু সত্যের ধারে-কাছেও কিছু নেই। তবুও, কোরআন সম্পর্কে এই অসত্য শিক্ষা কখনো সরাসরি, আবার কখনো সুকৌশলে সর্বত্র প্রচার করা হয়। আর এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা বড় হচ্ছেন, তারা যে দেশের বা যে ধর্মেরই হোন-না-কেন, তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন যে, বিজ্ঞান-সম্পর্কিত বিষয়ে বাইবেলে যে ধরনের ভুলের গোনজায়েশ রয়েছে, কোরআনও তা থেকে মুক্ত নয়।

প্রকৃতপক্ষে, কোরআন সম্পর্কে যে-সব শিক্ষা ও প্রচার সর্বত্র চালু রয়েছে, তাতে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সেই প্রচারণায় অনুপ্রাণিত যে-কারো পক্ষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুবই স্বাভাবিক। অথচ কে তাঁদের বুঝাবে যে, তাঁদের সেই সিদ্ধান্তটি তো বটেই, সেই সিদ্ধান্তের মূলে কার্যকর যে শিক্ষা ও প্রচারণা–তাও আগাগোড়া অসত্য, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।