দেবতার ব্যাধি

দেবতার ব্যাধি

দীর্ঘকাল পরে বুড়ো হেডমাস্টার চিঠি পেলেন—ডাক্তার গড়গড়ির কাছ থেকে। ডাক্তার গড়গড়ি। কতকাল আগের কথা! অনেক দিন আগের কথা। ঠিক কতদিন হল কারোরই মনে নেই। তব চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে, এতে আর ভুল নেই।

ছ ফুটের উপর লম্বা একটি মানুষ, পাতলা হিলহিলে কাঠামো, মাথাটি ছোট, টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো নাক, চোখ দুটিতে কোনো বিশেষত্ব না থাকলেও চোখের দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত রুক্ষ—তীব্র। এই ছিল গড়গড়ি ডাক্তারের চেহারা। ডাক্তার এসে উঠল—সন্ন্যাসীচরণ প্রধান মশায়ের নটকানের দোকানে। দোকানের পাশেই ছিল ছোট ছোট দুটি কুঠুরি—সেই কুঠুরি দুটি ভাড়া নিয়ে প্রথমেই টাঙিয়ে দিলে দুটি টিনের পাতে লেখা সাইনবোর্ড। একটায় ইংরেজিতে লেখা—Doctor Gargari, Experienced Physician. অপরটায় বাংলায় লেখা—ডাক্তার গড়গড়ি, সুবিজ্ঞ চিকিৎসক। লোকে ঠাট্টা করে নাম দিলে ডক্টর গ্রে-গ্ররি।

রাঢ়দেশের পল্লীগ্রাম—গণ্ডগ্রাম অবশ্য বলা চলে, সপ্তাহে দুদিন হাট বসে, ছোটখাট বাজারও আছে; মিষ্টির দোকান, নটকানের দোকান, কাপড়ের দোকান, মনিহারি দোকান, কাটা কাপড়ের দোকান না থাকলেও বৈরিগী খোঁড়া আর তিনু মিয়া, দুজনের দুটো সেলাইয়ের কল চলে—একটা বাজারের এ-মাথায় একটা ও-মাথায়। কিন্তু বাজার হাট—সব এই দিকে হওয়া সত্বেও গ্রামের যাকে বলে মুখপাত, সেটা এদিকে নয়। সেটা হল ভদ্রলোক-পল্লীতে। সে আমলের কথা। তখন টাকা-পয়সা যার যত থাক, জমিদারেরাই ছিল সমাজের প্রধান। গ্রামটির ভদ্রলোক-পল্লীটির চেহারা ছিল—বেঙাচি-ভরা খিড়কি ডোবার মতো। জমিদারে জমিদারে প্রায় শিবময় কাশীধামের মতো অবস্থা। বছরে পঞ্চাশ-একশ-দুশ, পাঁচশ-হাজার-দু হাজার আয়ের জমিদার সব। তিন-চারঘর চার-পাঁচ হাজারী, একঘর পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে ক্রমে ক্রমে বাড়ছেন দিন দিন শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো। ঘরে ঘরে মজলিশ বসে, কাছারি হয়, খানা-পিনা গীত-বাদ্য হয়, রাত্রি বারোটা-একটা পর্যন্ত আসর সরগরম থাকে।

ডাক্তার ঘাড় বেঁকিয়ে তির্যকভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্ন্যাসী প্রধান মশায়কে বললে, আই ডোন্ট কেয়ার। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মি মিঃ প্রডানা?

সন্ন্যাসীচরণ ইংরেজি বুঝত না। সে ডাক্তারের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, কী বলছেন ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার গড়গড়ি বললে, ওদের আমি গ্রাহ্যও করি না।—বলে হাসলে। বোধ হয় কথাটাকে একবার পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবার জন্যে বললে, আপনাদের ওই জমিদারদের।

তারপর ডাক্তার বের হল—সাজগোজ করে বিকেলবেলা বেড়াবার জন্যে। ডক্টর বলে, ইভনিং ওয়াক। মর্নিং ওয়াক অবশ্য সব চেয়ে ভালো; বাট, ইউ সি, ভোরে ঘুম আমার ভাঙে না। —আবার হেসে বলে, ইট ইজ এ ডক্টরস ডিজিজ। সব বড় ডাক্তারের ঘুম ভাঙে নটার পরে। —বলে সে ছড়ি ঘুরোতে ঘুরোতে বেরিয়ে পড়ল। ছ’ ফুট লম্বা ডাক্তারের মাথায় একটা গুজরাটী কালো টুপি, গায়ে হাঁটু পর্যন্ত ঝুল চায়না কোট, পরনে সাদা থান কাপড়, পায়ে সে আমলের হুডবার্নিশ, পাশে স্প্রিং দেওয়া জুতো। মুখে একটি সিগার। কড়া সিগারের গন্ধে রাস্তার লোক নাকে কাপড় দেয়। ডাক্তার তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, আনসিভিলাইজড ক্রিচার্স। ডাক্তার নাকে রুমাল দেয় বাড়ির পাশের ড্রেনগুলো দেখে! বলে, ডার্টি, নুইসেন্স! তার বেশভূষার দিকে হাঁ করে যারা চেয়ে থাকে, তাদের সে বলে—হামবাগ!

পশ্চিম রাঢ়ের পল্লী, লোকেদের কথায় বিচিত্র টান, ঐ-কার, এ-কার, চন্দ্রবিন্দু, ড-কারের ছড়াছড়ি; ‘গিয়েছে’ ‘হয়েছে’ স্থলে বলে—’গৈছে’ ‘হৈছে’; ‘কেন’কে বলে—’কেনে’, ‘খেয়েছি’কে বলে—’খেঁয়েছি’; ‘হার’কে—’হাড়’, ‘রাম’কে বলে—’ড়াম’। নিতান্ত নিম্নস্তরের লোকে আবার ‘রাম’কে বলে—’আম’ আর ‘আম’কে বলে—’ড়াম’। ডাক্তার শুনে বলে, বারবেরিয়ানস ব্রুটস! বাংলাতে বলে, অনার্য—বর্বরের দেশ।

বাজারের ভিতরের রাস্তাটা ধরে সে বরাবর চলে গেল ইস্কুলের দিকে। এখানে একটি এম. ই. ইস্কুল আছে। পথে থানা। সে আমলের থানা, খানকয়েক চেয়ার, দু’খানা টেবিল থাকলেও তক্তাপোশের আধিক্য ছিল বেশি; দারোগাবাবুরও ভুঁড়ি ছিল; তক্তাপোশের উপরে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে তিনি পান চিবুচ্ছিলেন আর গড়গড়ায় তামাক টানছিলেন। হঠাৎ এই এমন সজ্জায় সজ্জিত ডাক্তারকে দেখে তিনি ডাকলেন, চামারী সিং, দেখো তো—উ কৌন যাতা হ্যায়!

চামারী সিং পালোয়ান লোক, সে এসে গম্ভীরভাবে বললে, এ বাবু সাব!

মুখ থেকে চুরুটটা নামিয়ে ডাক্তার অল্প একটু ফিরে বললে, ইয়া-স?

‘ইয়েস’কে ডাক্তার বলে—’ইয়া-স’, লম্বা করে টেনে উচ্চারণ করে।

চামারী ইষৎ চকিত হয়ে গেল, বললে, আপকো দরৌগাবাবু বোলাতে হেঁ।

—হোয়া-ট? বোলাতে হেঁ? হোয়াই? কাহে? আই অ্যাম নট এ চোর, নট এ জুয়াচোর, নায়দার এ ডেকইট—নর এ ফেরারি আসাইমী। দেন, হোয়াই? থানামে কাহে যায়েগা?

চামারী উত্তরোত্তর ভড়কাচ্ছিল, তবুও সে থানার জমাদার লোক, বললে, কেয়া নাম আপকা? পাতা কেয়া? কাঁহা আয়ে হ্যায় হিঁয়া—বাতাইয়ে তো।

ডাক্তার পকেট থেকে একখানা কার্ড বের করে চামারীর হাতে দিয়ে বললে, সব লিখা হায় ইসমে। দে দেও তোমহারা দারোগাবাবুকো।—বলেই আবার চুরুটটা মুখে দিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে অগ্রসর হল।

পথে কয়েকটা কুকুর টুপি-পরা অপরিচিত এই মানুষটিকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল। ডাক্তার হাতের ছড়িটা তুললে বিরক্তি ভরে; দেখতে শৌখিন হলেও তার ছড়িটা বাবুছড়ি নয়—দস্তুরমতো যষ্টি। পাকা বেতের এবং মোটা, অর্থাৎ বেড়ে প্রায় সে আমলের ডবল পয়সার মতো, তার ওপর ডাক্তারের মতো লম্বা মানুষের উপযুক্ত লম্বা; দু-চার ঘা বেশ দেওয়া যায়। কিন্তু পরক্ষণেই হেসে ফেলে ডাক্তার ছড়ি নামিয়ে নিলে। কুকুরগুলোকেই বললে, দ্যাটস গুড। বিশ্বাসী গ্রামভক্ত কুকুর! এঁটো-কাঁটার নুন খেয়ে নিমকহালাল! অ্যাঁ! দ্যাটস গুড!—বলেই আবার অগ্রসর হল।

গ্রামের প্রান্তে এম. ই. ইস্কুল। খড়ো বাংলো-ধরনের লম্বা বাড়ি। পাশেই একটা কোঠাঘরে হেডমাস্টার থাকেন। প্রবীণ লোক। বাসার সামনে বেঞ্চি পেতে হুঁকোয় তামাক খাচ্ছিলেন, আর খবরের কাগজ পড়ছিলেন। সে আমলের কাগজ—সাপ্তাহিক সংবাদপত্র, অবশ্য ইংরেজি। ডাক্তার তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। —হ্যালো, আর ইউ দি ভেনারেবল হেডমাস্টার অব দি স্কুল?

হেডমাস্টার উঠে দাঁড়ালেন। —ইয়েস। —বলে সবিস্ময়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ডাক্তার বললে, গুড ইভনিং! —তারপর নিজের একখানি কার্ড বের করে হেডমাস্টারের হাতে দিয়ে বললে, এখানে প্র্যাকটিস করতে এসেছি আমি। বাট ইউ সি, জীবনে বন্ধুর প্রয়োজন। আই হ্যাভ কাম টু আস্ক ইউ টু বি এ ফ্রেন্ড অব মাইন।

হেডমাস্টার হেসে বললেন, বসুন—বসুন।

—লেট মি হ্যাভ ইওর হ্যাণ্ড ফার্স্ট। —মাস্টারের হাতখানি নিয়ে হ্যান্ডশেক করে ডাক্তার বসল।

মাস্টার মশায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় উঠেছেন? এখানে কেউ জানা-শোনা আছে কি না? দেশে কে কে আছে? কোথায় দেশ? কেমন অবস্থা—সে কথাও ইঙ্গিতে জানতে চাইলেন।

বেঞ্চের উপর বসে ডাক্তার তার লম্বা পা দুখানির একখানি নাচাতে নাচাতে উত্তর দিলে আর চুরুট টানলে। শেষের প্রশ্নের উত্তরে বললে, দেশ কলকাতার কাছেই। মা আছেন, তিনি থাকেন কাশীতে; স্ত্রী আছেন, পুত্র আছেন—কন্যাও আছে। গরিব মানুষ আমি, হেডমাস্টার—এ পুয়োর ম্যান।

মাস্টার প্রশ্ন করলেন, এইখানেই যখন থাকবেন, তখন নিয়ে আসবেন তো এখানে?

ডাক্তারের পা দুটো ঘন ঘন নাচতে আরম্ভ করলে। —না হেডমাস্টার, সে আইডিয়া আমার নাই।

—তাহলে? তাঁরা সেখানে থাকবেন কার কাছে?

—ও! —ডাক্তার বললে, তাদের আমি বাপের বাড়িতে, আই মিন, আমার আমার শ্বশুর-বাড়িতে রেখে এসেছি। সেখানেই তারা থাকবে। একটু চুপ করে থেকে অনেকটা যেন ভেবে হঠাৎ আবার বললে, ইয়া-স হেডমাস্টার, সেইখানেই তারা থাকবে। এখানে আনার কথা আমি ভাবতেও পারি না।

এর পরে সে প্রায় চুপ করেই গেল এবং অত্যন্ত দ্রুতভঙ্গিতে পা নাচাতে আরম্ভ করলে।

হেডমাস্টার বললেন, চলুন, আমি যাব গ্রামের দিকে। ভদ্রলোকদের সঙ্গে আলাপ হবে। চলুন।

ডাক্তারও উঠে দাঁড়াল—সন্ধ্যার আবছায়ার মধ্যে টুপি মাথায়, চায়না কোট পরা, লম্বা লোকটিকে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল, স্থির সুদীর্ঘ একটি রেখার মতো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সে বললে, গুড নাইট, হেডমাস্টার।

—সে কী? গ্রামের মধ্যে যাবেন না?

—নো। মাফ করবেন হেডমাস্টার। তাঁরা সব ধনী ব্যক্তি, পুরুষানুক্রমে জমিদার। আমি একজন গরিব মনুষ্য। খেটে খাই। ওয়াটার অ্যান্ড অয়েল, ইউ সি, হেডমাস্টার—কখনও মিশ খায় না। গুড নাইট!

কথাটা অজানা রইল না কারুর। জানাতে অবশ্য বারণ করেনি ডাক্তার কিন্তু ঢাক বাজিয়ে বলার মতো ইচ্ছেও তার ছিল না। ঢাক বাজিয়ে যে কথাই বলতে যাক, তাতে গলাই শুধু উঁচুতে চড়ে না, রঙ চড়ে, কথাও ফলাও হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। গাঁয়ের বাবুপাড়ায় কথাটা ঘোরালো এবং জোরালো হয়ে আলোচিত হতে আরম্ভ হল। কেউ বললেন, ডাক্তার বলেছে—গুণ্ডার দল সব। না-কামিয়ে দস্যি। বাপের পয়সায় খায় নিষ্কর্মার দল। মাতাল। লম্পট। অত্যাচারী।

ডাক্তারও শুনলে। শুনে হেসে বললে, ওরা নিজেরা নিজেদের সত্যি বিশেষণগুলো রাগের মাথায় আমার কথা বলে বলে ফেলেছে। ওর কোনোটা আমার কথা নয়।

কেউ বললে, ডাক্তার বলেছে—ইতর, ওদের আমি ঘেন্না করি। বলে থু থু করে থুথু ফেলেছে।

ডাক্তার গম্ভীর ভাবে বললে, না। এ কথা আমি বলতে পারি না।

বাবুরা বললে, দেখে নেব আমরা।

ডাক্তার এবারও কোনো জবাব দিলে না। শুধু হাসলে।

বাবুরা প্রায় হুকুম জানিয়েই প্রচার করে দিলে, ওকে বাবুরা কেউ ডাকবেই না। অন্য লোকেও যেন না ডাকে। দারোগাবাবুর সঙ্গে বাবুদের খুবই সদ্ভাব। দারোগাবাবুও সে মজলিশে ছিলেন।

সন্ন্যাসী প্রধান বললে, ডাক্তারবাবু, কাজটা ভালো হচ্ছে না। চলুন, একদিন বাবুদের ওখানে যাই। গেলেই ব্যাপারটা মিটে যাবে।

ডাক্তার নিবানো আধখানা চুরুটটা কামড়ে ধরে দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে ফেললে, বললে, বাবুরা আপনার যদি ক্ষতি করতে পারে বলে মনে করেন সন্ন্যাসীবাবু, বলবেন আমাকে, আমি তাহলে চলে যাব আপনার এখান থেকে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা ব্যাপার ঘটে গেল; বাবুদের টমটমে চামারী সিং ছাতা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল একটি ছেলেকে—দশ-বারো বছরের ছেলে। ছেলেটি চিৎকার করে উঠল, ও মাগো—ও বাবারে! প্রায় সে নেতিয়ে পড়ে গেল টমটমের উপর। চামারী সিং ব্যস্ত হয়ে উঠল, টমটমের কোচম্যানকে বললে, রোখো। গাড়িটা দাঁড়াল।

চামারী লাফ দিয়ে নেমে সন্ন্যাসীকে বললে, থোড়া পানি দেবেন তো প্রধান মাশা।

ডাক্তার উঠে এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে। ছেলেটি পেট ধরে কাতরাচ্ছে। চামারী জল আনতেই ডাক্তার প্রশ্ন করলে, কী হয়েছে এর?

চামারী বললে, দারোগাবাবুর লেড়কা।

—লেড়কা তো বটে। কী হয়েছে?

প্রধান বললে, ভারি দুঃখের কথা ডাক্তারবাবু, ছেলেটির এই বয়সেই অম্বলশূল হয়েছে।

—আই সি। তা, এই রোদ্দুরে এই অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে কোথায়?

—কালীতলা পাশের গাঁ দেবীপুরে ভারি জাগ্রত কালীমা আছেন, সেইখানে যাচ্ছে। ফি মাসে অমাবস্যেতে যেতে হয়। কালীমায়ের ওখানেই পড়েছে শেষ পর্যন্ত।

—হুঁ! কে বললে—শূলবেদনা?

—মা কালীর ভরণে বলেছে।

ডাক্তার বললে, হামবাগ।

চামারী বিব্রত হয়ে প্রধানকে বললে, কী করি হামি প্রধান মাশা?

ডাক্তার নিজেই ছেলেটিকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে এনে শোয়ালে। চামারীকে বললে, বোলাও তোমার দারোগাবাবুকে। যাও বলছি।

ডাক্তার দারোগাকে বললে, শূল-ফুল নয়। এ আপনাদের মা কালীর বাবারও সাধ্যি নাই যে ভালো করে দেয়। বুঝলেন?

দারোগা অবাক হয়ে গেলেন, বিশেষ করে ডাক্তার যখন মা কালীর বাবা তুলে জোর দিয়ে বললে, তখন আর তিনি কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না। কারণ কালীকেই তিনি ভালো করে জানেন না, কিন্তু ডাক্তার তার বাবার সংবাদ পর্যন্ত জানে। সে ক্ষেত্রে তিনি আর কী জবাব দেবেন।

ডাক্তার বললে, আমি ভালো করে দিতে পারি। কিন্তু ফি দু’ টাকা, ওষুধের দাম এক টাকা—তিন টাকা লাগবে। ভালো না হয় টাকা ফেরত দেব আমি।

দারোগা বললেন, ওষুধ দিন, আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

চুরুটে টান দিয়ে ডাক্তার হঠাৎ অত্যন্ত নিরাসক্ত হয়ে বললে, ধারে কারবার আমি করি না।

চামারী সিং দৌড়াল। সন্ন্যাসী ব্যস্ত হয়ে বললে, আমি টাকা দিচ্ছি ডাক্তারবাবু।

—দেবেন তাতে আমার আপত্তি কী আছে? কিন্তু আপনি ফের পাবেন তো?

ডাক্তার ওষুধ দিলে। একটা পুরিয়া আর এক দাগ ওষুধ। বললে, পায়খানা হবে। ভয় পাবেন না।

দারোগা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলেন। —পায়খানার সঙ্গে নাড়ির মতো লম্বা কী বেরিয়েছে! ডাক্তার বললে, শূল বেরুচ্ছে। কৃমি—কৃমি! ছেলের পেটে কৃমি ছিল।

—এত বড় কৃমি।

—হ্যাঁ ভালো হয়ে গেল শূলবেদনা। যান, বাড়ি যান।—তারপর আবার বললে, আপনার মাথাতেও দেখছি কৃমি আছে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন যে বড়!—হাসতে হাসতে আবার বললে, ওর ওষুধ আমার কাছে নাই। যান, বাড়ি যান। প্রধান মশাইয়ের টাকা তিনটে দিয়ে দেবেন। বুঝলেন?

এক চিকিৎসাতেই ডাক্তারের পসার জমে গেল। দারোগা প্রত্যেককে বললেন, ধন্বন্তরি—সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।

ডাক্তার এতেও হাসে। এ হাসি কিন্তু অন্য রকম। ডাক্তারের কথা যে একটা ধারালো ভাব আছে, সেটা নেই এ হাসিতে। সন্ন্যাসীচরণও একটু আশ্চর্য হয়ে যায়। ডাক্তার সন্ধ্যায় হেডমাস্টারের ওখানে যেতে হেডমাস্টার হেসে বলেন, যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, রাতারাতি বিখ্যাত ব্যক্তি।

ডাক্তার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে লম্বা ঘাড়টা একটু তুলে আপন মনে চুরুট টেনে যায়। আসর জমে না।

হেডমাস্টার জিজ্ঞাসা করেন, কী ব্যাপার ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেলে চুরুটটার দিকে তাকিয়ে বলে, নাথিং হেডমাস্টার।

—তবে?

ডাক্তার কোনো উত্তর না দিয়ে বসে থাকে চুপ করে। ক্রমে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে, আকাশে তারা ফুটে ওঠে; ডাক্তার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ বলে, হেডমাস্টার!

—বলুন।

—এগুলো ঠিক আমি পছন্দ করি না।

—কী? কী পছন্দ করেন না? ব্যাপারটা কী বলুন তো?

—ব্যাপার কিছু নয়। এই যে অনাবশ্যক—অনুচিত—অবাঞ্ছনীয় কৃতজ্ঞতা। দারোগার ছেলেটার কৃমি হয়েছিল পেটে, অত্যন্ত সাধারণ সোজা অসুখ—এক পুরিয়া স্যান্টোনাইন, এক ডোজ ক্যাস্টর অয়েলে ভালো হয়ে গেল; আমি তার জন্যে দু’ টাকা ফিজ—এক টাকা ওষুধের দাম নিয়েছি। তবুও দারোগা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেল। চারিদিকে বলে বেড়াচ্ছে, আমি ধন্বন্তরি। এগুলো অত্যন্ত—অত্যন্ত অবাঞ্ছনীয় মনে করি।

হেডমাস্টার অবাক হয়ে গেলেন। —কী বলছেন ডাক্তারবাবু? মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?

—না। —ডাক্তারের কণ্ঠস্বর যত রূঢ় তত দৃঢ়।

হেডমাস্টার খানিকটা আহত হলেন মনে মনে, ডাক্তারের কথা বলার এই ধরনের জন্য। তিনি একটু চুপ করে থেকে বেশ শক্তভাবেই জবাব দিলেন, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না আমি।

—ইউ আর এ ফু-ল।

—কী বলছেন আপনি?

—ইউ ডোন্ট নো হেডমাস্টার, ইউ ডোন্ট নো। এই ধরনের কৃতজ্ঞতা ব্যাড—ভেরি ব্যাড, অত্যন্ত খারাপ।

হেডমাস্টার দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ করে উঠলেন, কখনও না। এটা আপনার মনের দোষ।

ডাক্তার আবার বললে, ইউ আর এ ফু-ল।

এরপর ডাক্তারের সঙ্গে হেডমাস্টারের আরম্ভ হয় ঈষদুষ্ণ তর্ক। ক্রমশ সে উষ্ণতা বাড়তে লাগল। অন্ধকারের মধ্যে ডাক্তারের কণ্ঠস্বর—অত্যন্ত রূঢ় তীব্র উচ্চধ্বনিতে চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছিল। বলতে ভুলেছি, ডাক্তারের কণ্ঠস্বরটাই তীক্ষ্ণ, সরু আওয়াজ, কিন্তু ডাক্তারের আকৃতির মতোই প্রস্থে কম হলেও ছ ফুট উঁচু ডাক্তারের মতোই বর্শাফলকের মতো দীর্ঘ এবং ধারালো।

ইস্কুলের সঙ্গে সঙ্গে লাগাও একটা ছোট বোর্ডিং আছে,—এই বাদ-প্রতিবাদের উচ্চ কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে ছেলেরা অন্ধকারের মধ্যে অদূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই হেডমাস্টার চুপ করে গেলেন। তিনি আসন ছেড়ে উঠে স্থানত্যাগ করে এগিয়ে গেলেন ছেলেদের সঙ্গে।

ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপর উঠল এবং উচ্চস্বরে বললে, হেডমাস্টার, আমি চললাম। গুড নাইট!

কয়েক দিনের মধ্যেই ডাক্তারের খ্যাতি আরও বেড়ে গেল। খ্যাতি বইকি। সু কিংবা কু সম্বন্ধে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠা যে ডাক্তারের বাড়ল, তাতে আর সন্দেহ নেই। লোকে বলতে লাগল, ভারি তেজি ডাক্তার। আগুন একেবারে।

কেউ বললে, ডাক্তার ভালো হলে কী হবে, যেমন দুর্মুখ, তেমনই চামার।

কেউ বললে, পাষণ্ড।

দারোগা একদিন নিমন্ত্রণ করতে এসেছিলেন, ডাক্তার তাঁকে প্রায় হাঁকিয়ে দিয়েছে। —না না, না, ওসব আমার অভ্যেস নেই। রোগীর বাড়ি ফিজ নিই, চিকিৎসা করি। নেমন্তন্ন খাই না।

মানুষ মরছে, কি মরে গেছে—সেখানেও ডাক্তার ফিয়ের জন্যে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দয়ার জন্যে কেউ কাকুতি করলে বলে, দয়া করতে আমি আসিনি এখানে স্ত্রী-পুত্র ঘর-বাড়ি ছেড়ে। ফিজ ছাড়তে আমি পারব না। না দিতে পার, ডেক না আমাকে।

হেডমাস্টারকে বলে, হেডমাস্টারের সঙ্গে পরের দিনই আবার মিটে গেছে—বিনা বেতনে আগেকার গুরুদেবের মতো ছেলে পড়াতে পারেন আপনি?

হেডমাস্টার চুপ করে থাকেন। এই উগ্রমস্তিষ্ক লোকটির সঙ্গে কোনো মতামত নিয়ে আলোচনা করতে তিনি চান না। বিশেষ করে যেখানে সামান্য মত-বিরোধের সম্ভাবনা থাকে।

ডাক্তার পা নাচাতে শুরু করে। চুরুট টানতে টানতে বাঁকা সুরে বলে, অবশ্য এর চেয়ে তাতে লাভ বেশি, হেডমাস্টার।

হেডমাস্টার মৃদু হাসেন।

ডাক্তার বলে, আরুণি গুরুর আল বাঁধতে গিয়ে জল আটকে শুয়ে থাকে। উতঙ্ক দেবদুর্লভ কুণ্ডল এনে দেয় গুরুপত্নীর জন্য। গুঁড়ো থেকে, গরু থেকে ধন-রত্ন মণি-মাণিক্য সব পাওয়া যায়। এমন কি শিষ্যের জীবনও চাইলে পাওয়া যায়।

আবার একটু চুপ করে হেসে বলে, আমি ঠিক জানি না, তবে আমার মনে হয়, আরও বহুতর গুরুদক্ষিণার উপাখ্যান পুরাণে উল্লিখিত হয় নাই। আমি যদি ডাক্তার না হতাম হেডমাস্টার, তবে এগুলো নিয়ে রিসার্চ করতে পারতাম।

ব্যাপারটা চরমে উঠল। একটা সদনুষ্ঠানকে উপলক্ষ্য করে গ্রামের কয়েকজন উৎসাহী তরুণ অনেক জল্পনা-কল্পনা করে একটি সেবা-সমিতির প্রতিষ্ঠা করলে। দরিদ্র গৃহস্থকে সাহায্য, অনাথ-আতুরের সেবা করবে তারা। প্রত্যেক গৃহস্থ-বাড়িতে একটি করে ভাঁড় দিয়ে বলে গেল, দৈনন্দিন গৃহস্থের খোরাকির চাল থেকে এক মুঠো করে এই ভাঁড়ে তুলে রাখবেন। সাত দিনের সাত মুঠো চাল রবিবারে এসে নিয়ে যাব। —এছাড়া অবশ্য ভদ্রলোকদের, ব্যবসায়ীদের কাছে মাসিক চাঁদাও তারা পাবে।

তারা ডাক্তারকে এসে বললে, আপনার কাছে টাকা সাহায্য আমরা নেব না। আপনাকে আমাদের ডাক্তার হিসাবে সাহায্য করতে হবে।

ডাক্তার প্রায় ক্ষেপে গেল। সোজা বলে দিলে, থিয়েটার কর তো চাঁদা দেব। মদ খাও, গাঁজা খাও, তাতে কোনোদিন পয়সার অভাব হয়, আমার কাছে এস। কিন্তু এ সব চলবে না।

তারা অবাক হয়ে গেল।

ডাক্তার বললে, যাও যাও। ক্লিয়ার আউট, ক্লিয়ার আউট!

একজন রুখে উঠল, কী বললেন আপনি?

ডাক্তার বললে, আমি বলছি—গেট আউট। চলে যাও এখান থেকে।

গোটা গ্রাম জুড়ে এবার ডাক্তারের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন উঠল।

জনকতক ছেলে ডাক্তারকে প্রহার দেবার জন্য ষড়যন্ত্র করলে। জনকতক তাকে বয়কট করবার চেষ্টা করতে লাগল, অন্য ডাক্তার আনবার জন্য।

ডাক্তার কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। দাওয়ার উপর চেয়ারখানিতে বসে পা দোলাতে লাগল। প্রধান মশায় কিছু অস্বস্তি বোধ করছিল। অদ্ভুত মানুষ! লোকের অনুরাগে বিরাগে সমান নিস্পৃহ। নিঃসন্দেহে হৃদয়হীন নিষ্ঠুর। লোকটি গ্রামের লোকের প্রীতি অনুরাগ সব কিছুকে কর্কশভাবে উপেক্ষা করে অপমানিত করে তারই ঘরে রয়েছে, এতে তার মন খানিকটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে পারছিল না। কিন্তু উপায় নেই, ডাক্তার পুরো বছরের ভাড়া দিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া, তার ব্যবহারে রূঢ় কর্কশ যাই হোক, অন্যায্য কিছু নেই। সে তিক্ত অথচ শঙ্কিত দৃষ্টিতেই নিজের গদিতে বসে আড়চোখে ডাক্তারের দিকে প্রায় চেয়ে দেখে।

ডাক্তার শূন্যদৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে চুরুট টানে।

হঠাৎ যেন ডাক্তার উদাসীন হয়ে গেল। এটা নজরে পড়ল সর্বাগ্রে প্রধানের। সে কিন্তু কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে সাহস করলে না। তারপরই লক্ষ্য করলেন হেডমাস্টার। ডাক্তার যেন অতিরিক্ত মাত্রায় স্তব্ধ। তর্ক প্রসঙ্গে অত্যধিক উগ্র হয়ে ওঠার পর ডাক্তার অনেক সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে। হেডমাস্টার লোকটিকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তিনি তখন বলেন, কী মশাই? এখনও আপনার রাগ গেল না?

ডাক্তার তাতেও উত্তর না দিলে হেসে মাস্টার বলেন, অন্ধকারে কেউ দেখতে পাবে না, আমিও চিৎকার করব না; রাগ যদি না মিটে থাকে তো আমাকে নয় দু ঘা মেরেই রাগটা মিটিয়ে ফেলুন।

ডাক্তার তাতে হেসে ফেলে।

কিন্তু এবারে স্তব্ধতার সে রকম কোনো কারণই নেই। তা ছাড়া এ স্তব্ধতার ধরনটাও অন্য রকমের। ডাক্তার শুধু স্তব্ধই নয়, অত্যন্ত অন্যমনস্ক, চুরুট খাওয়ার মাত্রাও বেড়ে গেছে। তর্কে পর্যন্ত রুচি নেই।

হঠাৎ উঠে ডাক্তার চলে যায়; খানিকটা গিয়ে বোধহয় মনে পড়ে বিদায়-সম্ভাষণের কথা। থমকে দাঁড়িয়ে বলে, গুড নাইট, হেডমাস্টার!

হেডমাস্টার প্রশ্ন করেন নানাভাবে, কী হল ডাক্তার?

চুরুট টানতে টানতে ডাক্তার বলে, নাথিং হেডমাস্টার।

—বাড়ির খবর ভালো তো!

ভালো! হুঁ, ভালো। গুড নাইট, হেডমাস্টার।—ডাক্তার উঠে পড়ে।

হেডমাস্টার চিন্তিত হলেন। কয়েকদিনই ডাক্তার আসছেন না। নিজেই সেদিন গেলেন তিনি ডাক্তারের ওখানে। কিন্তু ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল না। ডাক্তার বেড়াতে বেরিয়েছে! প্রধান মশায় ছিলেন দোকানে। তিনি সসম্ভ্রমে মাস্টারকে বসতে দিলেন তাঁর দোকানের সবচেয়ে ভারি চেয়ারখানায়। ‘তামাক, তামাক’ করে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

মাস্টার বললেন, থাক। ব্যস্ত হবেন না প্রধান মশায়। আমি তো রয়েছি। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা না করে যাচ্ছি না। ধীরে-সুস্থে আনুক না তামাক।

প্রধান বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড হয়ে গেল মাস্টার মশায়। ডাক্তার হয় ক্ষেপে গেছে, নয় ছ মাসের বেশি বাঁচবে না। হঠাৎ আর এক রকম হয়ে গেল।

—বলেন কী!

—হ্যাঁ। গরিব-দুঃখীর কাছে ফিজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, ওষুধও অনেককে বিনা পয়সায় দিচ্ছে। আবার কাউকে কাউকে পথ্যের জন্যে পয়সাও দিচ্ছে।

হেডমাস্টার হাঁপ ছাড়লেন। বরাবরই তাঁর সন্দেহ ছিল। মনে হত, এ কঠোরতাটা তার অস্বাভাবিক, ধার করা, ছদ্মবেশের মতো। যাক, লোকটা তা হলে স্বাভাবিক হয়েছে।

ডাক্তার ফিরল প্রায় রাত্রি নটার সময়। নিস্তব্ধ পল্লীর পথ। ডাক্তার গান গাইতে গাইতে আসছিল; অবশ্য মৃদুস্বরে গান। হেডমাস্টারকে দেখে স্মিতহাস্যে সে বললে, হেডমাস্টার!

—হ্যাঁ।—হেডমাস্টার উঠে ডাক্তারের হাত চেপে ধরে বললেন, আই অ্যাম ভেরি গ্ল্যাড—আই অ্যাম ভেরি গ্ল্যাড ডক্টর। সব শুনলাম।

ডাক্তার একটু চুপ করে থেকে বললে, কী শুনলেন হেডমাস্টার।

হেসে হেডমাস্টার বললেন, আপনার গান তো নিজের কানেই শুনলাম। তারপর শুনলাম, আজকাল আপনার ছদ্মবেশে ফেলে দিয়েছেন। গরিব-দুঃখীদের বিনা পয়সায় দেখছেন, ওষুধও দিচ্ছেন অনেককে বিনা পয়সায়, কাউকে কাউকে পথ্যের পয়সাও দিচ্ছেন। আমার সন্দেহ বরাবরই ছিল ডাক্তার।

ডাক্তার একটু চুপ করে থেকে বললে, এক কালে—প্রথম যৌবনে মাস্টার মশাই—। আজ আর সে হেডমাস্টার বললে না, বললে, মাস্টার মশাই। —আমি সেবাধর্মকে গ্রহণ করেছিলাম জীবনের ব্রত হিসাবে। বিবাহ করিনি। সংকল্প ছিল এমনি ভাবেই জীবন কাটিয়ে দেব। সে কী আনন্দ, সে কী তৃপ্তি! কিন্তু—। ডাক্তার চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, কিন্তু উপকারের ঋণ বড় মারাত্মক ঋণ, মাস্টার মশাই। আর মানুষ বড় ভালো—অত্যন্ত ভালো, এ ঋণ শোধ করতে তারা—। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বললে, জীবনও দিতে পারে মানুষ। ডাক্তার আবার চুপ করে গেল। এবার বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, তারপর বললে, গুড নাইট হেডমাস্টার!

পরের দিন হেডমাস্টার প্রত্যাশা করেছিলেন—ডাক্তার আজ আসবে, কিন্তু ডাক্তার এল না। তার পরের দিন সকালেই প্রধান এসে সংবাদ দিলে, ডাক্তার চলে গেছে কাল রাত্রে।

—চলে গেছে!—হেডমাস্টার চমকে উঠলেন। চলে গেছে! ব্যাপার কী?

ঘাড় নেড়ে প্রধান বললে, জানি না। যাবার সময় শুধু বলে গেল—তক্তাপোশ চেয়ার এগুলো আপনি নেবেন প্রধান মশায়। ওষুধপত্রগুলো সদর শহরের ডাক্তারখানায় দিলাম। চিঠি লিখে দিলাম একটা—তাদের লোক এলে দিয়ে দিবেন। শেষ কথা বললে—দয়া ধর্ম একবার যখন করেছি, তখন আর এর জের মিটবে না। এ আর বন্ধ হবে না। সুতরাং এখানে আর থাকা চলবে না।

হেডমাস্টার স্তব্ধ হয়ে রইলেন।

দীর্ঘকাল পরে হেডমাস্টার একখানা চিঠি পেলেন। ডাক্তার লিখেছে। মৃত্যুশয্যায় লেখা চিঠি—ডাক্তারের মৃত্যুর পর একজন উকিল চিঠিখানা রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়েছে—ডাক্তারের অভিপ্রায় অনুযায়ী। বৃদ্ধ হেডমাস্টার পড়ে গেলেন। সুদীর্ঘ চিঠি। লিখেছে—মাস্টার মশাই, যে কথা আপনার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের দিনে শেষ করে বলে আসতে পারিনি, আজ সেই কথা সম্পূর্ণ অকপট চিত্তে জানালাম সুসমাপ্ত করে। কথাটা—মানুষের পুণ্যের, আমার পাপের। মনে আছে, আপনাকে বলেছিলাম উপকারের ঋণ মারাত্মক ঋণ, আর মানুষ বড় ভালো—এ ঋণ শোধ করতে জীবন পর্যন্ত দিতে পারে? এক বিন্দু অতিরঞ্জন করি নি।

মাস্টার মশাই, আমার তখন তরুণ বয়স, অফুরন্ত উদ্যম, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীন-দুঃখী অনাথ-আতুরের সেবা করে বেড়াতাম।

মানুষের দুঃখে সত্যই বুক ফেটে যেত, চোখে জল আসত। বিশ্বাস করুন, এক বিন্দু কপটতা ছিল না। প্রবলের অত্যাচার, জমিদারের জুলুম, পুলিশের অন্যায় শাসন, মহাজনের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করতাম তাদের। ভয় কাউকে করতাম না। তাদের স্নেহ করতাম সর্বান্তঃকরণে। মানুষেরও কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না, অকপট—অপরিমেয় কৃতজ্ঞতা। দেবতার মতো ভক্তি করত, আমার পায়ে কাঁটা ফুটলে তারা দাঁত দিয়ে তুলে দিত। ছেলেরা অসঙ্কোচে পরমাত্মীয়ের মতো আমার কাছে এসে দাঁড়াত। যুবকেরা ক্রীতদাসের আনুগত্য নিয়ে আমার মুখের কথার অপেক্ষা করত। বৃদ্ধেরা এসে বসত, বলত—আমার পায়ের ধুলো পেলে তাদের সর্বপাপ মোচন হবে, পরলোকে সদগতি হবে। পথ দিয়ে চলে যেতাম—কিশোরী, যুবতী, বৃদ্ধা, কন্যা, বধূরা শ্রদ্ধা-দীপ্ত অসঙ্কোচ দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে থাকত। আমার মনে হত মাস্টার মশাই, সত্যিই আমি নেমে এসেছি দেবলোক থেকে—তরুণ দেবতা আমি।

তারা অপরিসীম কৃতজ্ঞতায়—আমার কাছে নৈবদ্যের মতো নিয়ে আসত তাদের দৈনন্দিন জীবনের শ্রেষ্ঠ আহরণগুলি—ফুল-ফল, দুধ-মাছ। মাস্টার মশাই, শ্রেষ্ঠ বস্তু এনে তারা আমার দরজায় দাঁড়াত, দেবমন্দিরে যেমনভাবে তারা দিয়ে আসে তাদের সর্ব বস্তুর অগ্রভাগ।

মাস্টার মশাই, হঠাৎ সব বিষিয়ে উঠল। অনিবার্য পরিণতিই বলব একে! জীবন-সমুদ্র মন্থন করতে গেলে বিষ উঠবেই। আমার ছিল না নীলকণ্ঠের শক্তি। মাস্টার মশাই, এ ভাবে অমৃতের লোভে জীবন-সমুদ্র মন্থন করবার অধিকারী আমি ছিলাম না। যাক, যা ঘটেছিল তাই জানাই। সেবার রথযাত্রা উপলক্ষ্যে যাত্রীদল গিয়েছিল শ্রীক্ষেত্রে। তারা ফিরে এল কলেরা নিয়ে। একটি দরিদ্র পরিবার ছিল দলের মধ্যে। প্রৌঢ় বাপ, প্রৌঢ় মা আর বিধবা যুবতী কন্যা। বাপ পথে মারা গিয়েছিল, কন্যাটির রোগ সবে দেখা দিয়েছে, এমন সময় এসে পৌঁছল তারা গ্রামে। কন্যাটি যায় যায়, মা আক্রান্ত হল। দুটি রোগীর মাঝখানে বসে রাত কাটালাম আমি। এতটুকু ত্রুটি করলাম না। পরিশ্রম সম্পূর্ণ সার্থক হল না, মা-টি মারা গেল। মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এল কন্যাটি। অনাথা মেয়েটি রোগমুক্ত হয়ে, নিরুপায় হয়ে চলে গেল তার মামার বাড়ি। মাস কয়েক পরে একদিন পথে যেতে হঠাৎ দেখা হল মেয়েটির সঙ্গে। স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে, বৈধব্যের নিরাভরণতার মধ্যে তার সকরুণ মূর্তিখানি বড় ভালো লাগল আমার। বললাম, এই যে, চমৎকার শরীর সেরেছে তোমার! বাঃ ভারি আনন্দ হল। ভারি ভালো লাগছে তোমাকে দেখে।

পরদিন সে এল কয়েকটা গাছের ফল নিয়ে।

দু দিন পর সে আবার এল তার নিজের হাতের তৈরি মিষ্টান্ন নিয়ে।

আবার একদিন সে এল কিছু ফুল নিয়ে। কয়েকটি দুর্লভ ফুল—সে ফুলের গাছ ওদের বাড়িতে ছিল। আমি অন্য কোথাও দেখিনি। মাস্টার মশাই, ওই ফুলের রূপ এবং গন্ধের মধ্যে ছিল বিষ।

মন আমার বিষিয়ে উঠল। তার মনে কী ছিল জানি না। কিন্তু আমার মনে কামনার হলাহল যেন উথলে উঠল। সেই দিন রাত্রেই আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার জানালার নীচে। মৃদুস্বরে ডাকলাম। জানলা খুলে আমায় দেখে সে অবাক হয়ে গেল।

মাস্টার মশাই, সে প্রথমটা শিউরে উঠেছিল আমার প্রস্তাবে। কিন্তু আমার মধ্যে তখন প্রবৃত্তির আলোড়ন জেগে উঠেছে—কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো। আমি বললাম, এই তোমার কৃতজ্ঞতা! সে খাতকের মতোই দীনভাবে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে আমার বুভুক্ষিত প্রবৃত্তির কাছে। সেই যে জাগল ত্রূর প্রবৃত্তি, তার নিবৃত্তি আর হল না। শুধু আর আহুতি নিয়েই তৃপ্ত থাকতে পারলাম না। মানুষের সকৃতজ্ঞ চিত্তের আনুগত্যের সুযোগে বহুভোগের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। আমার কর্মের মর্মর খণ্ড থেকে এই মানুষগুলি তাদের কৃতজ্ঞতার পরিকল্পনায় গড়ে তুলেছিল যে দেবমূর্তি, আমার আত্মপ্রসাদের পূজায় সে দেবতা জাগল ক্ষুধা দিয়ে। মাস্টার মশাই, শয়তান ক্ষুধার্ত হয়ে মানুষকে আক্রমণ করলে—মানুষ তার সঙ্গে লড়াই করতে সাহস পায়, মানুষ বহু ক্ষেত্রে তাকে বধ করেছে, বহু দৃষ্টান্তই তার আছে। দেবতার ক্ষুধার্ত আক্রমণের মুখে মানুষ কিন্তু অসহায়। সেখানে তার কোনোক্রমেই নিস্তার নাই। আমার ক্ষুধার্ত দেবরূপ অবাধ গতিতে আদায় আরম্ভ করলে তার নৈবেদ্য—তার বলি।

আজ হয়তো আপনি মাস্টারি করেন নাঃ; যদি করেন, তবে অনুরোধ রইল—ছেলেদের দেবতা হবার উপদেশ দেবেন না। মানুষ—শুধু মানুষ হতে উপদেশ দেবেন। দেবতাকে পূজা করতেও উপদেশ দেবেন না। তার সঙ্গে লড়াই করবার মতো সাহস দেবেন তাদের। তারা যেন—। যাক এসব কথা।

এর পর নিজেকে সংযত করতে চাইলাম; রাত্রির পর রাত্রি কাঁদলাম, উপবাস করলাম, তবুও—তবুও সংযত হল না প্রবৃত্তি। অনুশোচনারও অন্ত ছিল না। একদা মনকে স্থির করে সেবাব্রত ত্যাগ করে দেশে ফিরে এসে বিবাহ করলাম। আমার স্ত্রী সুন্দরী, গুণবতী, কিন্তু আশ্চর্য মাস্টারমশাই, তাকে ভালোবাসতে পারলাম না। আমি জানি, তাকে আমি ভালোবাসিনি। তাই তাদের কাছেও থাকতে পারিনি। প্র্যাকটিসের অজুহাতে একখান থেকে অন্যখানে ঘুরেছি। জীবনে রূঢ় হতে চেয়েছি, মানুষকে দূরে রাখতে চেয়েছি। কটু বলেছি নিষ্ঠুরের মতো, কিছু আদায় করে পিশাচ হতে চেয়েছি—মানুষের কৃতজ্ঞতার ভয়ে। ক্রমে বহু পরিবর্তন হয়ে গেল জীবনে, আমার ভাষা ছিল মিষ্ট—হলাম রুক্ষভাষী, কথায় কথায় রাগ হতে আরম্ভ হল, তর্ক করা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু আসল পরিবর্তন হল না। সাপের বিষের থলি শূন্য করে দিলেও আবার সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে; দংশনের প্রবৃত্তিও তার যায় না মাস্টার মশাই। বার বার ঠকলাম। একবার কাউকে কৃতজ্ঞ হবার সুযোগ দিলে রক্ষা থাকত না। আমার অন্তরের সরীসৃপ জেগে উঠত। সেই সুযোগে সে প্রবেশ করতে চাইত তার ঘরে। তাই প্রাণপণে সংসারটাকে নিছক দেনা-পাওনার হিসেবের খতিয়ানের খাতায় পরিণত করতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। হঠাৎ একদা আর আত্মসম্বরণ করতে পারতাম না। সেদিন সত্যই সৎপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই করুণায়—কর্তব্যের প্রেরণাতেই মানুষের দুঃখের ভাগ নিতাম। তারপর আর রক্ষা থাকত না। আরম্ভ হয়ে যেত আমার জীবনের জটিল খেলার নূতন দান।

আপনাদের ওখানে হঠাৎ একদিন কল থেকে ফিরবার পথে দেখলাম একটি দরিদ্র তাঁতীর ঘরে একটি ছোট ছেলের তড়কা হয়েছে। প্রায় শেষ অবস্থা। কান্নাকাটি পড়ে গেছে। আত্মসম্বরণ করতে পারলাম না। অযাচিতভাবে গিয়ে শিশুটির আসন্ন বিপদ কাটিয়ে দিলাম। মন ভরে উঠল প্রসন্নতায়। সেদিন আপনি আমায় গান গাইতে শুনেছিলেন। আপনি বলার পূর্ব পর্যন্ত নিজে গান গেয়েও আমার সে সম্বন্ধে সচেতনতা ছিল না। আমি সেদিন গাইছিলাম—’বহু যুগের ওপার থেকে আষাঢ় এল আমার মনে।’ সেদিন হঠাৎ আপনার কথায় চেতনা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেয়েছিলাম আমার ভবিষ্যৎ। ছেলেটির মাকে মনে পড়ে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। মনে পড়ে গিয়েছিল, আসন্ন বিপদাশঙ্কায় বিহ্বল মায়ের অসম্বৃত বেশবাসের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিতে পড়া তার দেহের কথা।

মাস্টার মশায়, সমস্ত রাত্রি সমস্ত দিন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতেছিলাম। অজগরকে ঝাঁপিতে পুরে ওখান থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলাম।

মৃত্যুর পরপার যদি থাকে, তবে সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল ভাবে আপনি আমার সম্বন্ধে কী বলেন শোনবার প্রতীক্ষা করব। বলবেন।

মাস্টারমশাই দুটি হাত তুলে আপন মনে বললেন, নমস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *