তিন শূন্য

তিন শূন্য

এক কঙ্কালসার মূর্তি, পাঁজরাগুলো শুধু চামড়ায় ঢাকা, ক্ষুধাতুর অগ্নিগর্ভ কোটরগত চোখ, পিঙ্গল রুক্ষ চুল, ক্রুদ্ধ কুকুরের মতো মুখভঙ্গি, বিস্ফারিত ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে তীক্ষ্ণ হিংস্র শ্বাদন্ত দুটো, হাতেও তেমনই হিংস্র বড় বড় নখ, গলায় হাড়ের মালা, নগ্ন দেহ, পরনে কোমরে শ্মশান থেকে কুড়িয়ে-নেওয়া রক্তচিহ্নময় এক টুকরো ন্যাকড়া, হা-হা করে হাসতে হাসতে এসে দেশটায় প্রবেশ করল।

দুর্ভিক্ষ সে। তার অট্টহাসিতে দেশটা শিউরে উঠল। তার নিশ্বাসে বাতাস হয়ে উঠল রসহীন, সে চোখের দৃষ্টিতে দেশের জল গেল শুকিয়ে, তার ক্ষুধার্ত উদর পরিপূর্ণ করতে ধরণী-জননীর প্রসাদ শস্যভাণ্ডার হয়ে গেল শূন্য; তারপর সে আরম্ভ করল মানুষের রক্ত-মাংসে আপনার উদর পরিপূর্ণ করতে।

ভয়ার্ত মানুষ উন্মত্ত পশুর মতো ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিল। সে হা হা করে হাসে আর চিৎকার করে, হা অন্ন, হা অন্ন! মানুষও ভয়ার্ত স্বরে কাঁদতে কাঁদতে প্রতিধ্বনি করে, হা অন্ন, হা অন্ন!

প্রকাণ্ড বড় ধনীর বাড়ি।

বাড়ির দোরে অন্নভিক্ষু কাঙালের ভিড় জমে গেছে। এক মুঠি ভাত, খানিকটা ডাল, শাকে-পাতে খানিকটা অখাদ্য, এই বরাদ্দ। সেই অপরাহ্নে, বেলা চারটের সময়!

এরা কিন্তু সকাল থেকেই বসে থাকে। পেট জ্বলে খাক হয়ে যায় তবু প্রত্যাশায় ওরা সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকে! কেউ কারও মাথার উকুন বাছে, কেউ তাকিয়ে থাকে নর্দমার দিকে—ওই দিকে ভাতের ফেন গড়িয়ে এসে পড়বে, ক্বচিৎ কেউ ব্যর্থ ভিক্ষায় গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি ফিরে ফিরে বেড়ায়।

—চারটি মুড়ি দেবা মা!

—কে লা, কে, কোন হতচ্ছাড়ি? মুড়ি দেবা মা, কেতাত্ত করে দিলে!

কোনো বাড়ির একটা চাকর কুয়ো থেকে জল তুলছিল, দুটো ছোট ছেলে একটা ভাঁড় হাতে এসে দাঁড়াল।

—একটুকু জল দাও গো?

—কাদের ছেলে বটিস?

—মুচিদের মশায়।

—কে কে আছে তোদের?

—মা আছে শুধু বাবু, আর কেউ নাই।

—হুঁ! কোনটো তোর মা? সেই গালকাটা মেয়েটা বুঝি?

—হ্যাঁ মশায়। একটুন জল দাও মশায়!

—ভাগ, হারামজাদা, ভাগ।

ছেলে দুটো ভয়ার্ত ভাবে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে।

চাকরটা ঘৃণা ভরে মাটিতে থুথু ফেলে বলে, হারামজাদীকে দেখলে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।—বেরো বেটার ছেলেরা!

ছেলে দুটো সভয়ে সরে আসে। চাকরটার কিন্তু মায়াও হয়, সে ডাকে, আয় আয়, নিয়ে যা!

ছেলে দুটো আবার সভয়েই এগিয়ে এসে ভাঁড়টা পেতে দাঁড়ায়। চাকরটা জল ঢেলে দেয়! কিন্তু তৃষ্ণা তো ওদের সহজ নয়, অগস্ত্ব্যের তৃষ্ণা, তা ছাড়া আছে ক্ষুধা, ঢক ঢক করে ভাঁড়ের পর ভাঁড় নিঃশেষিত করে শূন্য উদর পূর্ণ করে নিয়ে বলে, আঃ!

চাকরটা রসিকতা করে বলে, আয়, গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিই, কুয়োর ভেতর দিনরাত জল খাবি।

একটা ছেলে ছুটে খানিকটা এগিয়ে এসে বলে, পালিয়ে আয় রে, মারবে।

অপরটাও পালায়।

ওদিকে তখন কঙ্কালের দলের মধ্যে কলহ বেধে গেছে। নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে পড়া ফেনের ভাগ নিয়ে কলহ। তারস্বরে কদর্য অশ্লীল কুৎসিত বাক্য-বিনিময়ের বিরাম ছিল না।

একটা পুরুষ একটা মেয়ের টুঁটি টিপে ধরেছে। মেয়েটার তিনটি ছেলে, পুরুষটার অঙ্গে কেউ ধরেছে কামড়ে, একজন দুই হাতে তাকে খামচে ধরে আছে, আর একজন ইটভাঙা কুড়িয়ে নিয়ে তাই দিয়ে আঘাত করছে।

এ ছেলে দুটো সে দৃশ্য দেখে হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল।

ওদিকে এক বৃদ্ধ, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, বসে বসে আপন মনে বকছে, জনমে আমি এমন ছাইপাঁশ খাই নাই, খাব না, খেতে পারব না। শালারা ভাত দিচ্ছে, পুণ্যি হচ্ছে, না ছাই হচ্ছে!

এক অন্ধ বুড়ি গালাগালি দিচ্ছে ঈশ্বরকে। একেবারে ওদিকে দুটি যুবতী মেয়ে বটপাতার ঠোঙায় করে খাচ্ছে পাকা অশ্বত্থবীজ। সাঁওতালেরা খায়, খেতে দুর্গন্ধ তবু খাওয়া যায়। একটি মেয়ে বেশ সুশ্রী।

—এই এই, মারমারি করছ কেন? এই, ছাড় ছাড়। এই, হারামজাদা শুয়ার!—একটি ভদ্রলোক পথে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল। ধমক খেয়ে পুরুষটি মেয়েটির গলা ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল মেয়েটার দুর্বিনীত স্বার্থপর ব্যবহারের কথা।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটাও চিৎকার জুড়ে দিলে।

ভদ্রলোকটির কিন্তু সেদিকে মন ছিল না, দৃষ্টি ছিল না। সে দেখছিল ওই যুবতী মেয়ে দুটিকে।

মেয়ে দুটি সঙ্কোচে পেছন ফিরে বসল।

ভদ্রলোকটি ধমকে বলে উঠল, মারামারি করবি তো দোব সব তাড়িয়ে এখান থেকে।

অন্ধ বুড়ি বলে, তাই দাও বাবা, তাই দাও। আপদরা কোথা থেকে কোথা এসেছে তাই দেখ কেনে! দাও তাড়িয়ে।

ভদ্রলোক এইবার একে একে জিজ্ঞাসা করে, কার কোথায় বাড়ি।

—তোর? তোর? তোর?

—এই, তোদের দুজনের বাড়ি কোথা?

মেয়ে দুটি পেছন ফিরে তাকালে।

—কোথায় বাড়ি?

একজন বললে, আজ্ঞে, সাউগাঁ মশায়।

—হুঁ। এঃ তোদের কাপড়ের দশা যে দেখছি কিছু নেই রে।

এবার তারা দুজনেই সকরুণ দৃষ্টিতে তাকায়। ভদ্রলোকটি ইঙ্গিতময় হাসি হেসে মৃদুস্বরে বলে, দোব, কাপড় দোব।

তারা মুখ নামায়।

ভদ্রলোক পেছন ফিরে দেখলে, সকলে কুৎসিত হাসি হাসছে। সে চলে গেল।

অল্পক্ষণ পরেই তাকে আবার দেখা যায়। একটা অন্তরালময় স্থানে দাঁড়িয়ে সে ওই ওদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। হাতে তার কাপড় পুরোনো, কিন্তু সৌখিন-পাড় শাড়ি। অভাবপূরণই মনকে শুধু আকর্ষণ করে না, যেন তার সৌন্দর্যও মনকে বিভ্রান্ত করে, লোলুপ করে।

মেয়ে দুটির দৃষ্টিও সেদিকে পড়েছিল। কিন্তু সঙ্কোচে ভয়ে তাদের বুক দুর দুর করছিল। তারা মাঝে মাঝে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখেও অগ্রসর হতে পারে না। আঃ, কী কোমল মসৃণ কাপড় দুখানার জমি, আর কী সুন্দর ওর পাড়!

—এই, আয় না!

মৃদুস্বরে কথা বলে হাত নেড়ে ভদ্রালোক ডাকে।

ঝাঁ ঝাঁ করছে গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন, আকাশ থেকে অবিরাম আগুন বর্ষণ হচ্ছে। পায়ের তলায় ধরিত্রী যেন উত্তাপে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। কাঙালীর দল জটলা বেঁধে এক জায়গায় বসে নেই। এখানে ওখানে সামান্য সামান্য ছায়া বেছে নিয়ে শূন্য উদরেও উত্তাপের শ্রান্তিতে ঢুলছে।

বার বার এদিক ওদিক দেখে একটি মেয়ে এগিয়ে এল। অত্যন্ত নিম্নস্বরে কী বলে, ভদ্রলোক বললে, এই নে আবার নতুন দোব, টাকা দোব, বুঝলি?

মেয়েটা কিছুই বলতে পারে না।

আবার ভদ্রলোক বলে, বুঝলি?

মেয়েটা ঘাড় নাড়ে।

ওদিকে চিৎকার ধ্বনিত হয়ে উঠল, চিৎকার নয়, কোলাহল। উচ্ছিষ্ট বিতরণের সময় হয়েছে।

মেয়েটাও তাড়াতাড়ি চলে যায়।

অন্ধকার রাত্রি।

বনে বিচরণ করে শ্বাপদের দল, গলিতে ঘুঁজিতে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে নিঃশব্দে এঁকে বেঁকে ঘুরে বেড়ায় সরীসৃপ, সাপ, বিছে; কেঁচোগুলোও মাটি তোলে, গায়ে ঝরে লালা।

তার মাঝে মানুষও বেড়ায়, এমন নিঃশব্দে সন্তর্পণে। অন্ধকার, কোথায় অন্ধকার? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অন্ধকার ভেদ করে বহুদূর ঘুরে বেড়ায়। সেই ভদ্রলোকটি ঘুরে বেড়ায়, হাতে একটি ঠোঙা।

কই, কোথায়? এইখানেই তো থাকবার কথা! কই?

একটা ভাঙা ঘর, ঘরের সম্মুখে খানিকটা পরিষ্কার স্থান, তার পরই একটা বাঁধাঘাট। এই ঘাটেই তো থাকবার কথা!

ওখানে কে শুয়ে? পরিষ্কার উন্মুক্ত স্থানটায় শুয়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে কে?

তীব্র দৃষ্টি হেনে চেনা গেল, সেই কানা বুড়িটা।

ঘরে কাসছে কে?

কান পেতে শুনে বোঝা গেল, পুরুষ। তবুও ঘরে ঢুকে দেখলে, একটা পুরুষই, কিন্তু কে তা বোঝা গেল না, বোঝবার দরকারও নেই!

কোথায়, কোথায়?

উন্মত্ত লালসা বুকে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে। মাথার ওপর আকাশে অগণ্য নক্ষত্র ঝলমল করছে, মাঝে মাঝে দু-একটা খসেও যাচ্ছে।

ওই বেনেদের পড়ো বাড়িটায় নেই তো?

আবার সন্তর্পণে এগিয়ে চলে। হ্যাঁ, মানুষের নিঃশ্বাস পাওয়া যায়।

চোখের দৃষ্টি জলে ওঠে, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে ওঠে।

এই তো! হ্যাঁ!

না, এ নয়! এই, হ্যাঁ এই।

তারপর?

মেয়েটা সভয়ে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু মুহূর্তে সে চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়, মুখের উপর হাত চাপা পড়ে।

—চুপ!

মেয়েটা প্রাণপণে বাধা দিতে চায়, কিন্তু পারে না। নিস্তেজ, অসাড় হয়ে পড়ে ক্রমে।

মেয়েটা কাঁদে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কী সকরুণ কান্না! নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। আকাশে একটা উজ্জ্বল তারা খসে যায়।

—আঃ, কাঁদছিস কেন? এই নে, টাকা নে।

রাত্রির অন্ধকারের মধেও রজতপ্রভা ঢাকা পড়ে না। কিন্তু তবুও সে কাঁদে।

—ও, দাঁড়া দাঁড়া এক ঠোঙা খাবার এনেছি নে।

অদূরে ভাঙা প্রাচীরের উপর রক্ষিত ছিল ঠোঙাটা। সেটা এনে হাতে তুলে দিলে।

মেয়েটা হাত দিয়ে কী অনুভব করে, কী বস্তু।

লোকটি চলে যায়।

মেয়েটা বসে থাকতে থাকতে একটুকরো খাবার মুখে তোলে। অপূর্ব সুস্বাদু। আবার একটুকরো মুখে তোলে, আবার! তারপর সেই অন্ধকারে নিঃশব্দে সে নিঃশেষ করে খেয়ে ফেলে। সঙ্গী বোনটাকে পর্যন্ত জাগায় না। সে নিথর হয়ে ঘুমুচ্ছে।

সেই অন্ধকার রাত্রে সেই ভীষণ কুৎসিতমূর্তি দুর্ভিক্ষ বসে বসে মানুষের চামড়ার খাতায় হাড়ের কলম দিয়ে জমা-খরচ করছে। কালি নেই, লাল কালি ফুরিয়ে গেছে, যেটুকু অবশিষ্ট তার রঙ হয়ে গেছে জলের মতো। চামড়ার ওপর চিরে চিরে লেখে সে। বিধাতার হিসাব-নিকাশের খাতার ক-পাতা লেখবার ভার এখন তার ওপর পড়েছে। মুখে তার বীভৎস হাসি, হিংস্র আনন্দে ভীষণ দাঁতগুলি ঈষৎ বিস্ফারিত, সে বিস্ফারণের জন্য কদর্য নাকটা কুঁচকে উঠেছে।

হিসেব তার অনেক।

পরদিন প্রাতঃকালে দেখা যায়, একটা কঙ্কালসার জীর্ণ বৃদ্ধাকে জীবন্ত অবস্থাতেই টেনে নিয়ে গেছে শেয়ালে। প্রায় অর্ধেকটা তার ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। বক্ষপঞ্জরটাই আগে শেষ করেছে। বুড়ির চোখ দুটো মৃত্যুর পরও বিস্ফারিত হয়ে আছে। আতঙ্কিত বিস্ফারিত দৃষ্টি।

এদিকে সেই মেয়েটার এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

মাথার চুল রুক্ষ নয়, পরনে পরিছন্ন শৌখিন কাপড়, মুখেও তার অনাহারের ক্লেশের ছাপ আঁকা নেই, অতি সূক্ষ্ম তৃপ্তি হাসি ঠোঁটের কোণে প্রচ্ছন্নভাবে খেলা করে।

কিন্তু মাস খানেকের মধ্যেই তার শরীর কেমন অসুস্থ হয়ে উঠল। একটা জর্জর অবসাদময় ভাব, সর্বাঙ্গে বেদনা। কিছু ভালো লাগে না। আর কয়দিন পরই সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেল অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটকে।

মেয়েটা শঙ্কিত বিস্ময়ে আপন অঙ্গের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে। ঝর ঝর করে অবশেষে কেঁদে ফেলে।

রাত্রে সে আপনার জীবন-দেবতার কাছে করুণভাবে সব নিবেদন করে।

সে আশ্বাস দেয়, ভয় কি, ভালো হয়ে যাবে। ওষুধ এনে দোব।

পরম আশ্বাস নিয়ে মেয়েটি বসে থাকে। রোজ ভাবে, সে আজ আসবে ওষুধ নিয়ে; যাদুমন্ত্রের মতো একদিনে সমস্ত রোগ মুছে যাবে। প্রভাতে উঠে দেখবে, তার দেহ আবার পূর্বর মতো মসৃণ শ্রীময়ী হয়ে উঠেছে।

কিন্তু কোথায় কী? সে আর আসে না। তাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। আর পেলেই বা কী হবে? দিনের আলোতে কেমন করে জাগ্রত পৃথিবীর দৃষ্টির সম্মুখে তার কাছে দাবি জানাবে? সে দাবি কি তার আছে? কল্পনা মাত্রেই ভয়ে তার বুক গুরু গুরু করে ওঠে।

কয়দিন পর আর তাকে গ্রামে দেখা যায় না। সে পালায়, তাদের স্বজাতীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের উদ্দেশে চলে যায়।

বৎসর তিনেক পর আবার তাকে দেখা যায়, কিন্তু চেনা যায় না। দুর্ভিক্ষ নেই, কিন্তু তবুও তার কঙ্কালসার দেহ, সর্বাঙ্গে থকথকে ঘা। ক্ষতের দুর্গন্ধে মানুষ দূরের কথা, পশুরও বমি আসে।

মেয়েটার কোলে একটা শিশু।

দুর্ভিক্ষের বরলাভ করে এসেছে সে; তেমনই কদর্য চেহারা, তার ওপর পঙ্গু, পশুর মতো হাতে পায়ে ভর দিয়ে চলে। চোখে পিচুটি, অবিরাম বিন্দু বিন্দু জল ঝরছে; মুখে ভাষা নেই, রব আছে, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে লালা।

পশুর মতো চিৎকার করে সে মায়ের স্তনবৃন্ত দন্তাঘাতে রক্তাক্ত করে তাই লেহন করে। কেন, কেন সেখানে স্তন্য সঞ্চিত নেই? উদরে যে তার দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।

মাও দারুণ যন্ত্রণায় ছেলেটাকে নির্মমভাবে প্রহার করে।

—এই মাগী, এমন করে ছেলে মারছিস কেন?

মেয়েটা চমকে ওঠে, তার মুখ প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে মৃদুস্বরে বললে, বাবু!

—আঃ, সর সর সর। কী দুর্গন্ধ!

—আমাকে চিনতে লারছ বাবু? আমি—

—হারামজাদী, বেরো, বেরো বলছি।

ভদ্রলোক সত্যই তাকে চিনতে পারে না। চেনবার উপায়ও রাখে নি রোগে।

মেয়েটা শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। আর কিছু না, অভিসম্পাত দেবার মতনও মনের উগ্রতা নেই! একটা অত্যন্ত শিথিল হতাশায় জীবনের তারগুলো যেন ঝিমিয়ে নেতিয়ে পড়েছে। আঘাতের প্রতিঘাতে ধ্বনি তোলবার শক্তিও তাদের নাই!

আরও পনের বৎসর চলে গেছে।

রোগগ্রস্তা কুৎসিত মেয়েটা অনেক আগেই মরে খালাস পেয়েছে। কিন্তু বর্বর পশুর মতো ছেলেটা বেঁচে আছে। সে হাতে পায়ে হেঁটে বেড়ায়, এখনও মুখ দিয়ে লালা ঝরে, চোখে ঝরে জল।

বোধ করি, মায়ের বুকের বিষ সে উদগার করে, আর মায়ের শেষ-করতে-না-পারা কান্না কাঁদে।

তারই মধ্যে সে হাসে। হাতে পায়ে হেঁটে সে গিয়ে উপুড় হয়ে গৃহস্থের দোরে বসে, ‘আঁউ আঁউ’ করে চিৎকার করে।

গৃহস্থেরা হাসে, আবার করুণাও করে, উপবাসী তাকে একদিনও থাকতে হয় না।

ছেলেরা তাকে ডাকে, হনুমান।

বয়স্কেরা বলে, ল্যালা।

ল্যালা ঘুরে বেড়ায় আপন খেয়ালে। তার যত কৌতুক পশুর সঙ্গে, ছাগল ভেড়ার বাচ্চা ধরে তাদের অসহ্য যন্ত্রণা দেয়, তারা চিৎকার করে, ও হাসে। জঙ্গলে জঙ্গলে সে হনুমান ধরার জন্যে ছোটে।

ক্ষুধার উদ্রেক হলেই গ্রামের মধ্যে ছুটে আসে।

গৃহস্থের মেয়েরা বলে—এসেছিস?

সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হাসে।

—দে রে, ল্যালা এসেছে, এঁটোকাঁটাগুলো দে।

ল্যালা তাই পরম পরিতৃপ্তি সহকারে খায়! মাঝে মাঝে কোনো খাদ্য ভালো লাগলে চেঁচায়, আঁ—আঁ—আঁ।

সেই দ্রব্যটা তুলে দেখিয়ে চেঁচায়, পুনরায় না-পাওয়া পর্যন্ত থামে না।

সে জানে না, কতখানি তার দাবি। কিম্বা হয়তো মানে না।

মেয়েরা হেসে বলে, ল্যালা নাছোড়বান্দা।

এক একদিন রাত্রে অকস্মাৎ ক্ষুধা বোধ হলে সে লোকের গোশায়াল গরুর ডাবা খুঁজে বেড়ায়। সে জানে ওর মধ্যে পচা বাসি ভাত পাওয়া যায়!

অকস্মাৎ ল্যালা যেন কেমন হয়ে ওঠে। ক্ষুধার তাড়না বোধ হয় কমে গেছে। সে এখন বনে জঙ্গলেই বসে থাকে, যতক্ষণ দিবালোক থাকে ততক্ষণ সে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে পশুদের খেলা দেখে। মধ্যে মধ্যে আনন্দে করতালি দিয়ে ওঠে!

কখনও-কখনও নিদারুণ অস্থিরতায় প্রচণ্ড আবেগে সে মাটির বুকে গড়াগড়ি দেয়। কখনও বা শীতল জলে আকণ্ঠ ডুবিয়ে বসে থাকে।

রাত্রির অন্ধকারে যখন আর কিছু দেখা যায় না, তখনই সে গ্রামে এসে আহারের অন্বেষণ করে—গোশালায়, গৃহস্থের বহির্দ্বারে।

সেদিন অন্ধকারে সে আহার খুঁজছিল। কোথাও এক কণাও নেই। ল্যালা বসে ভাবে। মধ্যে মধ্যে আহারের চিন্তাও তার বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়।

আবার কতক্ষণ পর তার ক্ষুধার জ্বালা অনুভূত হয়। সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। লোকের বদ্ধদ্বারে আঘাত করে, আঁ—আঁ—আঁ।

কিন্তু গভীর ঘুমে নিস্তব্ধপুরী, সাড়া মেলে না। ল্যালা আবার চলে।

একটা নর্দমা। ল্যালা তারই সম্মুখে বসে ভাবে। তারপর সে ওই নর্দমা দিয়ে ভেতরে ঢোকবার চেষ্টা করে। সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, তবুও তার প্রচণ্ড চেষ্টা শিথিল হয় না। অবশেষে সে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। উঠানেই রাত্রের উচ্ছিষ্ট বাসন গাদা হয়ে আছে। ল্যালা পরমানন্দে সেইগুলো চাটে।

আর? আর কই? সে ঘরের বারান্দায় ওঠে! সম্মুখের ঘরে মৃদু আলোক জ্বলছে! ল্যালা দরজার সম্মুখে গিয়ে দরজাটা ঠেলে।

দরজা খোলে না।

এবার সে মাথা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে বদ্ধদ্বারটা ঠেলে। ঘরের খিলটা বোধ হয় শক্ত ছিল না, সেটা এবার ভেঙে খুলে যায়। ল্যালা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।

মৃদু আলোকে অস্পষ্ট দেখা যায় চোদ্দ-পনের বৎসরের একটি মেয়ে পরম নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন। পাশে তার দু-তিনটি ছোট ছেলে। নিশ্চিন্ত নিদ্রায় তার সর্বাঙ্গের আবরণ শিথিল হয়ে তার নগ্নরূপ মৃদু-আলোকচ্ছটায় অপরূপ লাবণ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

ল্যালার বুকের মধ্যে ক্ষুধার আবেগ মুহূর্তে লুপ্ত হয়ে যায়। জেগে ওঠে সেই প্রচণ্ড আবেগ—অদ্ভুত—দুর্নিবার। দেহে তার অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যায়।

তারপর?

ফুলের মতো নিষ্পাপ বালিকা, আর্ত চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু ল্যালার নিষ্পেষণে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নির্বাক হয়ে যায়। ল্যালা স্তব্ধ; তার রব পর্যন্ত নিঃশেষিত হয়ে গেছে।

অদৃশ্য লোকে, বিধাতার খাতার হিসেব-নিকেশ মুহূর্তের জন্য বন্ধ নেই। সেখানে জমা-খরচের একটি হিসেবে সেদিন দুই দিকেই দাঁড়িটানা হয়ে যায়। একটা হিসেব শেষ হল।

নীচে পড়ল তিনটে শূন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *