আখড়াইয়ের দীঘি
কয়েক বৎসর পর পর অজন্মার উপর সে বৎসর নিদারুণ অনাবৃষ্টিতে দেশটা যেন জ্বলিয়া গেল। বৈশাখের প্রারম্ভেই অন্নাভাবে দেশময় হাহাকার উঠিল। রাজসরকার পর্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। সত্যই দুর্ভিক্ষ হইয়াছে কি না তদন্তের জন্য রাজকর্মচারী-মহলে ছুটাছুটি পড়িয়া গেল।
এই তদন্তে কান্দী সাব-ডিভিসনের কয়টা থানার ভার লইয়া ঘুরিতেছিলেন রজতবাবু ডি. এস. পি., সুরেশবাবু ডেপুটি, আর রমেন্দ্রবাবু কো-অপারেটিভ ইন্সপেক্টর। অতীতকালের সুপ্রশস্ত বাদশাহী সড়কটা ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া গো-পথের মতো মানুষের অব্যবহার্য হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপর ডিস্ট্রিক্ট-বোর্ডের ঠিকাদার মাটির ঢেলা বিছাইয়া পথটিকে আরও দুর্গম করিয়া তুলিয়াছে। কোনোরূপে তিনজনে এক পাশের পায়ে-চলা পথরেখার উপর দিয়া বাইসিক্ল ঠেলিয়া চলিয়া ছিলেন।
বৈশাখ মাসের অপরাহ্নবেলা। দগ্ধ আকাশখানা ধূলাচ্ছন্ন ধূসর হইয়া উঠিয়াছে। কোথাও কণামাত্র মেঘের লেশ নাই। হু-হু করিয়া গরম বাতাস পৃথিবীর বুকের রস পর্যন্ত শোষণ করিয়া লইতেছিল। একখানা গ্রাম পার হইয়া সম্মুখে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর আসিয়া পড়িল। ও-প্রান্তের গ্রামের চিহ্ন এ-প্রান্ত হইতে দৃষ্টিতে ধরা দেয় না। দক্ষিণে বামে শস্যহীন মাঠে ধু-ধু করিতেছে। গ্রামের চিহ্ন বহু দূরে দিগ্বলয়ে কালির ছাপের মতো বোধ হইতেছিল।
রজতবাবু চলিতেছিলেন সর্বাগ্রে। তিনি ডাকিয়া কহিলেন—নামছি আমি। আপনারা ঘাড়ের উপর এসে পড়বেন না যেন।
তিনজনেই বাইসিক্ল হইতে নামিয়া পড়িলেন। সঙ্গীরা কোনো প্রশ্ন করিবার পূর্বেই তিনি বলিলেন, কই মশাই, সামনে গ্রামের চিহ্ন যে দেখা যায় না। এদিকে দিবা যে অবসানপ্রায়।
রমেন্দ্রবাবু কোমরে ঝুলানো বাইনাকুলারটা চোখের উপর ধরিয়া কহিলেন, দেখা যাচ্ছে গ্রাম, কিন্তু অনেক দূরে। অন্তত পাঁচ-ছ মাইল হবে।
রজতবাবু রিস্টওয়াচটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন—পৌনে ছটা। এখনও আধ ঘণ্টা তিন কোয়ার্টার দিনের আলো পাওয়া যাবে। কিন্তু এদিকে যে বুক মরুভূমি হয়ে উঠল মশাই। আমার ওয়াটার ব্যাগে তো একবিন্দু জল নেই। আপনাদের অবস্থা কী?
রমেন্দ্রবাবু কহিলেন, আমারও তাই। সুরেশবাবু, আপনার অবস্থা কী? আপনি যে কথাও বলেন না, দৃষ্টিটাও বেশ বাস্তব জগতে আবদ্ধ নয় যেন। ব্যাপার কী বলুন তো?
সুরেশবাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, সত্যি বর্তমান জগতে ঠিক মনটা নিবদ্ধ ছিল না। অনেক দূর অতীতের কথা ভাবছিলাম আমি।
রজতবাবু সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন, অতীত যখন, তখন ইন্টারেস্টিং নিশ্চয়, চাই কি রোমান্টিকও হতে পারে। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য আর ভাবতে হবে না। উঠে পড়ুন গাড়িতে। গাড়িতে চলতে চলতেই আপনি গল্প বলতে শুরু করুন। আমরা শুনে যাই। কিন্তু এই চার-পাঁচ মাইল পথ কভার করবার মতো গল্পের খোরাক হওয়া চাই মশায়!
সুরেশবাবু আপনার জলাধারটি খুলিয়া আগাইয়া দিয়া বলিলেন, আমার জল এখনও আছে। জল পান করে একটু সুস্থ হন আগে।
জলপানান্তে সুরেশবাবুকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়া রজতবাবু বলিলেন, আপনি কথক। আপনাকে আগে যেতে হবে।
সকলে গাড়িতে চড়িয়া বসিলেন।
সুরেশবাবু বলিলেন, আমাদের জলের চিন্তার কথা শুনেই কথাটা আমার মনে পড়ল।
পিছন হইতে রমেন্দ্রবাবু হাঁকিলেন, দাঁড়ান মশায়, দাঁড়ান, বাঃ, আমাকে বাদ দিয়ে গল্প চলবে কী রকম? ……বেশ, এইবার কী বলছিলেন বলুন? একটু উচ্চকণ্ঠে কিন্তু।
সুরেশবাবু বলিলেন, যে রাস্তাটায় চলেছি আমরা এ রাস্তাটার নাম জানেন? এইটেই অতীতের বিখ্যাত বাদশাহী সড়ক। এ রাস্তায় কোনো পথিক কোনো দিন জলের জন্য চিন্তা করেনি। ক্রোশ-অন্তর দীঘি আর ডাক-অন্তর মসজিদ এ-পথের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল, দীঘিগুলি এখনও আছে—
বাধা দিয়া রজতবাবু প্রশ্ন করিলেন, ডাক-অন্তর মসজিদটা কী ব্যাপার?
—ডাক-অন্তর মসজিদের অর্থ হচ্ছে—এক মসজিদের আজানের শব্দ যত দূর পর্যন্ত যাবে, তত দূর বাদ দিয়ে আর একটি মসজিদ তৈরি হয়েছিল। এক মসজিদের আজান-ধ্বনি অপর এক মসজিদ থেকে শোনা যেত। একদিন ভাবুন—দেশদেশান্তরব্যাপী সুদীর্ঘ এই পথখানির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একসঙ্গে আজানধ্বনি ধ্বনিত হয়ে উঠত। ওই—ওই দেখুন, পাশের ওই যে ইটের স্তূপ—ওটি একটি মসজিদ ছিল। আর প্রতি ক্রোশে একটি দীঘি আছে। তাই বলছিলাম, এ-রাস্তায় কেউ কখনও জলের ভাবনা ভাবে নি।
রমেন্দ্রবাবু কহিলেন, বাদশাহী সড়ক যখন, তখন কোনো বাদশাহের কীর্তি নিশ্চয়। কোন বাদশাহের কীর্তি মশাই?
—ঠিক বুঝতে পারা যায় না। ঐতিহাসিকরা বলতে পারেন। তবে এ বিষয়ে সুন্দর একটি কিংবদন্তী এ দেশে প্রচলিত আছে। শোনা যায় নাকি কোনো বাদশাহ বা নবাব দিগ্বিজয়ে গিয়ে ফেরবার মুখে এক সিদ্ধ ফকিরের দর্শন পান। সেই ফকির তাঁর অদৃষ্ট গণনা করে বলেন—রাজধানী পৌঁছেই তুমি মারা যাবে। বাদশাহ ফকিরকে ধরলেন—এর প্রতিকার করে দিতে হবে। ফকির হেসে বললেন—প্রতিকার? মৃত্যুর গতি রোধ করা কি আমার ক্ষমতা? বাদশাহও ছাড়েন না। তখন ফকির বললেন—তুমি এক কাজ কর, তুমি এখান থেকে এক রাজপথ তৈরি করতে করতে যাও তোমার রাজধানী পর্যন্ত। তার পাশে ক্রোশ-অন্তর দীঘি আর ডাক-অন্তর মসজিদ তৈরি কর।
সুরেশবাবু নীরব হইলেন। রজতবাবু ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করিয়া উঠিলেন, তারপর মশাই, তারপর?
হাসিয়া সুরেশবাবু বলিলেন, তারপর বুঝুন না কী হল। আজকাল গল্প সাজেসটিভ হওয়াই ভালো। বাদশাহ রাজধানী পৌঁছেই মারা গেলেন। কিন্তু কত দিন তিনি বাঁচলেন অনুমান করুন। এই পথ, এই সব দীঘি, এতগুলি মসজিদ তৈরি করতে যতদিন লাগে, ততদিন তিনি বেঁচে ছিলেন।
রজতবাবু বলিলেন, হামবাগ—বাদশাহটি একটি ইডিয়ট ছিলেন বলতে হবে। তিনি তো পথটা শেষ না করলেই পারতেন—আজও তিনি বেঁচে থাকতে পারতেন।
রমেন্দ্রবাবু গাড়ি হইতে নামিবার উদ্যোগ করিয়া কহিলেন—দাঁড়ান মশাই, এ পথের ধুলো আমি খানিকটে নিয়ে যাব, আর মসজিদের একখানা ইট।
সুরেশবাবু কহিলেন, আর একটা কথা শুনে তারপর। পথ তো ফুরিয়ে যায়নি আপনার।
রজতবাবু তাগাদা দিলেন, সেটা আবার কী?
—এ দেশে একটা প্রবচন আছে, সেটার সঙ্গে আপনার পরিচয় থাকা সম্ভব। পুলিশ-রিপোর্টে সেটা আছে—
রমেন্দ্রবাবু অসহিষ্ণু হইয়া বলিলেন, চুলোয় যাক মশাই পুলিশ-রিপোর্ট। কথাটা বলুন তো আপনি।
—তাড়া দেবেন না মশাই। গল্পের রস নষ্ট হবে। কথাটা হচ্ছে, ‘আখড়াইয়ের দীঘির মাটি, বাহাদুরপুরের লাঠি, কুলীর ঘাঁটি।’—এই তিনের যোগাযোগে এখানে শত শত নরহত্যা হয়ে গেছে। রাত্রে এ পথে পথিক চলত না ভয়ে। বাহাদুরপুরে বিখ্যাত লাঠিয়ালের বাস। কুলীর ঘাঁটিতে তারা রাত্রে এই পথের উপর নরহত্যা করত। আর সেই সব মৃতদেহ গোপনে সমাহিত করত আখড়াইয়ের দীঘির গর্ভে।
রজতবাবু বলিয়া উঠিলেন, ও, তাই নাকি? এই সেই জায়গা?
সুরেশবাবু উত্তর দিলেন, তার কাছাকাছি এসেছি আমরা।
রজতবাবু কহিলেন, এখনও পুজোর আগে এখানে চৌকিদার রাখবার ব্যবস্থা আছে।
—আর তার দরকার নেই বোধহয়। এখন এরা শাসন মেনে নিয়েছে।
রমেন্দ্রবাবুর গাড়িখানি এই সময় একটা গর্তে পড়িয়া লাফাইয়া উঠিয়া পড়িয়া গেল। রমেন্দ্রবাবু লাফ দিয়া কোনোরূপে আত্মরক্ষা করিলেন। সকলেই গাড়ি হইতে নামিয়া আগাইয়া আসিলেন। গাড়িখানা তুলিয়া রমেন্দ্রবাবু বলিলেন, যন্ত্র বিকল। এখন ইনিই আমার ঘাড়ে চেপে যাবার মতলব করেছেন। একখানা চাকা ধাক্কায় বেঁকে টাল খেয়ে গেছে। আমাদের হাতের মেরামতের বাইরে।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া উঠিতেছিল। রজতবাবু অস্পষ্ট সম্মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এ যে মহাবিপদ হল সুরেশবাবু!
—কী করা যায়?
হাসিয়া সুরেশবাবু বলিলেন, পথপার্শ্বে বিশ্রাম। মালপত্র নিয়ে পেছনের গো-যান না এলে তো উপায় বিশেষ দেখছি নে।
আপনাকে বিপদের হেতু ভাবিয়া রমেন্দ্রবাবু একটু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি তখনও গাড়িখানা লইয়া মেরামতের চেষ্টা করিতেছিলেন। রজতবাবু কহিলেন, ঘাড়ে তুলুন মশাই বাহনকে। একটা বিশ্রামের উপযুক্ত স্থান নেওয়া যাক।
বাইসিক্লে ঝুলানো ব্যাগ হইতে টর্চটা বাহির করিয়া সুরেশবাবু সেটার চাবি টিপিলেন। তীব্র আলোক-রেখার সম্মুখের প্রান্তর আলোকিত হইয়া উঠিল। অদূরে একটা মাটির উঁচু স্তূপ দেখিয়া সুরেশবাবু কহিলেন, এই যে, সম্মুখেই বোধ হয় আখড়াইয়ের দীঘি। চলুন, ওরই বাঁধাঘাটে বাস যাবে।
রজতবাবু বলিলেন, হ্যাঁ, অতীত যুগের কত শত হতভাগ্য পথিকের প্রেতাত্মার সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথাবার্তা অতি উত্তমই হবে।
এতক্ষণে হাসিয়া রমেন্দ্রবাবু কথা কহিলেন, আর বাহাদুরপুরের দু-একখানা লাঠির সঙ্গে যদি সাক্ষাৎ হয়, সে উত্তমের পরে অযোগ্য মধ্যম হবে না। কী বলেন?
কোমরে বাঁধা পিস্তলটায় হাত দিয়া রজতবাবু কহিলেন, তাতে রাজি আছি।
প্রকাণ্ড দীঘিটা অন্ধকারের মধ্যে ডুবিয়া আছে। শুধু আকাশের তারার প্রতিবিম্বে জলতলটুকু অনুভব করা যাইতেছিল। চারি পাড় বেড়িয়া বন্য লতাজালে আচ্ছন্ন বড় বড় গাছগুলিকে বিকট দৈত্যের মতো মনে হইতেছিল। চারিদিক অন্ধকারে থম-থম করিতেছে। দীঘিটার দীর্ঘ দিকের মধ্যস্থলে সে আমলের প্রকাণ্ড বাঁধাঘাট। প্রথমেই সুপ্রশস্ত চত্বর। তাহারই কোল হইতে সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে জলগর্ভে। সিঁড়ির দুই পার্শ্বে দুইটি রানা। এক দিকের রানা ভাঙিয়া পাশেরই একটা সুগভীর খাদের মধ্যে নামিয়া গিয়াছে।
ঘাটের চত্বরটির মধ্যস্থলে তিনজনে আশ্রয় লইয়াছিলেন। এক পাশে সাইক্ল তিনখানা পড়িয়া আছে। ছোট একখানা শতরঞ্জি রমেন্দ্রবাবুর গাড়ির পিছনে গুটানো ছিল, সেইখানা পাতিয়া রমেন্দ্রবাবু বসিয়া ছিলেন। পাশেই সুরেশবাবু আকাশের দিকে চাহিয়া শুইয়া আছেন। রজতবাবু শুধু চত্বরটায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন।
সুরেশবাবু বলিলেন, সাবধানে পায়চারি করবেন রজতবাবু। অন্যমনস্কে খাদের ভেতরে গিয়ে পড়বেন না যেন। দেখছেন তো খাদটা?
হাতের টর্চটা টিপিয়া রজতবাবু বলিলেন, দেখছি।
আলোক-ধারাটা সেই গভীর গর্তে তিনি নিক্ষেপ করিলেন। সুগভীর খাদটার গর্ভদেশটা আলোকপাতে যেন হিংস্র হাসি হাসিয়া উঠিল। রজতবাবু কহিলেন, উঃ, এর মধ্যে পড়লে আর নিস্তার নেই। ভাঙা রানাটার ইটের ওপর পড়লে হাড় চুর হয়ে যাবে।
তিনি এদিকে সরিয়া আসিয়া নিরাপদ দূরত্ব বজায় করিলেন। আলোক নিবিবার পর অন্ধকারটা যেন নিবিড়তর হইয়া উঠিল। ওদিকে পশ্চিম দিকপ্রান্তে মধ্যে মধ্যে বিদ্যুদ্দীপ্তি চকিত হইয়া উঠিতেছিল। সুরেশবাবু নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কহিলেন, কে কী ভাবছেন বলুন তো?
রমেন্দ্রবাবু বাধা দিয়া বলিলেন, ওদিকে কী যেন একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে। কী বলুন তো?
সঙ্গে সঙ্গে দুইটা টর্চের শিখা দীঘির বুক উজ্জ্বল করিয়া তুলিল। রজতবাবু কহিলেন, কই?
রমেন্দ্রবাবু কহিলেন, ওপারে ঠিক জলের ধারে। লম্বা মতো—মানুষের মতো কী ঘুরে বেড়াচ্ছিল বোধ হল।
সুরেশবাবু হাসিয়া বলিলেন, দীঘির গর্ভের কোনো অশান্ত প্রেতাত্মা হয়তো।
—কিংবা বাহাদুরপুরের লাঠিয়াল কেউ।
রজতবাবু কহিলেন, সে হলে তো মন্দ হয় না, একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়, সময় কাটে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু হলেই যে বিপদ। যাদের সঙ্গে কথা চলে না মশাই—সাপ বা জানোয়ার? ওটা কী?
সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাঁ-হাতের টর্চটা জ্বলিয়া উঠিল। ডান হাত তখন পিস্তলের গোড়ায়। সচকিত আলোয় দেখা গেল সেটা একগাছা দড়ি।
সুরেশবাবু বলিলেন, গুড লাক! —রজ্জুতে সর্পভ্রমে লজ্জা আছে, বিপদ নেই। কিন্তু সর্পে রজ্জুভ্রম প্রাণান্তকর।
সকলেই হাসিলেন। কিন্তু সে হাসি মৃদুমন্থর। আনন্দ যেন জমাট বাঁধিতেছিল না।
আবার সকলেই নীরব।
অকস্মাৎ দীঘির ওদিকের কোণে জল আলোড়িত হইয়া উঠিল।
শব্দে মনে হয়, কেহ যেন জল ভাঙিয়া চলিয়াছে। টর্চের আলো অত দূর পর্যন্ত যায় না। আলোক-ধারার প্রান্তমুখে অন্ধকার সুনিবিড় হইয়া উঠে, কিছু দেখা গেল না।
রমেন্দ্রবাবু কহিলেন, এখনও বলবেন আমার ভ্রম!
সুরেশবাবু কথার উত্তর দিলেন না। তিনি নিবিষ্টচিত্তে শব্দটা লক্ষ্য করিতেছিলেন। শব্দটা নীরব হইয়া গেল।
সুরেশবাবু আরও কিছুক্ষণ পর বলিলেন, ভ্রমই বোধ হয়। জলচর কোনো জীবজন্তু হবে।
গরম বাতাসের প্রবাহটা ধীরে ধীরে বন্ধ হইয়া চারিদিকে একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতায় ভরিয়া উঠিয়াছে।
সুরেশবাবু আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া বলিয়া উঠিলেন—নাঃ, শুধু রমেন্দ্রবাবুকে দোষ দেব কেন—আমরা সকলেই ভয় পেয়েছি। সিগারেট খাওয়া পর্যন্ত ভুলে গেছি মশাই! নিন, একটা করে সিগারেট খাওয়া যাক।
রজতবাবু বলিলেন, না মশাই, একেই আমি অভ্যস্ত নই, তার ওপর খালিপেটে শুকনো গলায় সহ্য হবে না, থাক।
—আসুন তবে রমেনবাবু, আমরা দুজনেই—ও কী?
মানুষের মৃদু কণ্ঠস্বরে তিনজনেই চকিত হইয়া উঠিলেন।
কে যেন আত্মগত ভাবেই মৃদুস্বরে বলিতেছিল, তারা, তারাচরণ! এইখানেই তো ছিল। কোথা গেল?
রজতবাবুর হাতের টর্চটা প্রদীপ্ত রশ্মিরেখায় জ্বলিয়া উঠিল।
রমেনবাবু ত্রস্ত স্বরে বলিলেন, এদিকে, এদিকে, ভাঙা রানাটার পাশে জলের ধারে। ওই, ওই। কিন্তু দপ দপ করে জ্বলছে কী? চোখ কি? —ওই—ওই—
দীর্ঘ রশ্মিধারা ঘুরিল। সঙ্গে সঙ্গে সুরেশবাবুর টর্চটাও প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। জলের ধারে দীর্ঘাকৃতি মনুষ্যমূর্তি দাঁড়াইয়া ছিল। আলোকচ্ছটার আঘাতে চকিত হইয়া সে রশ্মির উৎস লক্ষ্য করিয়া মুখ ফিরাইল। রমেন্দ্রবাবু অস্ফুট চীৎকার করিয়া পড়িয়া গেলেন। সুরেশবাবুর হাতের টর্চটা নিবিয়া গিয়াছিল। অদ্ভুত অতি ভীতিপ্রদ সে মূর্তি!
দীর্ঘ বিবর্ণ চুল, দীর্ঘ দাড়িগোঁফে সমস্ত মুখখানা আচ্ছন্ন, অস্বাভাবিক দীর্ঘ কৃষ্ণবর্ণ দেহখানা কর্দমলিপ্ত। কোটরগত জ্বলন্ত চোখ দুইটিতে আলো পড়িয়া ঝকঝক করিতেছিল। সে মূর্তি ধরণীর সর্বমাধুর্য বর্জিত, মাটির জগতের বলিয়া বোধহয় না।
রজতবাবু স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তবুও তিনি কয়েকপদ অগ্রসর হইয়া প্রশ্ন করিলেন, কে? কে তুমি? উত্তর দাও! কে তুমি?
নিথর নিস্তব্ধ মূর্তির পেশীগুলি ঈষৎ চঞ্চল হইয়া উঠিল। একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে অধররেখা ভিন্ন হইয়া গেল। সে ভঙ্গিমা যেমন হিংস্র, তেমনি ভয়ঙ্কর।
রজতবাবু আকাশ লক্ষ্যে পিস্তলটার ঘোড়া টিপিলেন। সুগভীর গর্জনে নিবিড় অন্ধকার চমকিয়া উঠিল। বৃক্ষনীড়াশ্রয়ী পাখির দল কলরব করিয়া উঠিল।
সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত আর একটা গর্জনে চারিদিক কাঁপিয়া উঠিল। একটা বিকট হিংস্র গর্জন করিয়া সেই বিকট মূর্তি লাফ দিয়া ছুটিয়া আসিল। সে মূর্তি তখন জানোয়ারের চেয়ে হিংস্র—উন্মত্ত। রজতবাবুর বাঁ-হাতের টর্চটা হাত হইতে পড়িয়া গেল। ডান হাতে পিস্তলটা কাঁপিতেছিল। অন্ধকারের মধ্যে গুরুভার কিছু পতনের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আহত পশুর মতো একটা আর্তনাদ ধ্বনিয়া উঠিল।
রজতবাবু কহিলেন, সুরেশবাবু, শীগগীর টর্চটা জ্বালুন। আমারটা কোথায় পড়ে গেছে।
সুরেশবাবুর হাতের আলোটা জ্বলিয়া উঠিল।
রজতবাবু কহিলেন, এখানে আসুন—খাদের মধ্যে।
খাদের মধ্যে আলোকপাত করিতেই রজতবাবু বলিলেন, মানুষই, কিন্তু মরে গেছে বোধ হয়। ঘাড় নিচু করে পড়েছে, ঘাড় ভেঙ্গে গেছে।
সুরেশবাবু ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলেন—ভগ্ন ইষ্টকস্তূপের মধ্যে হতভাগ্যের মাথাটা অর্ধ-প্রাোথিত হইয়া গিয়াছে। যন্ত্রণার আক্ষেপে ঊর্ধ্বমুখে সমগ্র দেহখানা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল। উপর হইতে রমেন্দ্রবাবু সভয়ে কাহাকে প্রশ্ন করিলেন, কে? ও কী? কীসের শব্দ?
ক্ষণিক মনোযোগসহকারে শুনিয়া সুরেশবাবু কহিলেন—গাড়ি। গরুর গাড়ির শব্দ।
গন্তব্য থানায় পৌঁছিতে বাজিয়া গেল বারোটা।
তিনটি বন্ধুতেই নীরব। একটা বিষণ্ণ আচ্ছন্নতার মধ্যে যেন চলাফেরা করিতেছিলেন। শবদেহটা গাড়িতে বোঝাই হইয়া আসিয়াছে।
সেটা নামানো হইলে রজতবাবু সাব-ইন্সপেক্টরকে বলিলেন, লোকটাকে এখানকার কেউ চিনতে পারে কি না দেখুন তো?
মুখাবরণ মুক্ত করিয়া দারোগা চমকিয়া উঠিলেন।
রজতবাবু প্রশ্ন করিলেন, চেনেন আপনি?
—না। কিন্তু এ কি মানুষ?
জমাদার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, সে কহিল—আমি চিনি স্যার। এ একজন দ্বীপান্তরের আসামী। আজ দিন দশেক খালাস হয়ে বাড়ি এসেছে। সেদিন এসেছিল থানায় হাজিরা দিতে। বাহাদুরপুরের লোক, নাম কালী বাগদী।
—বেশ। তা হলে রিপোর্ট লেখ। একটা গামছায় বাঁধা কোমরে ওর কী কতকগুলো ছিল—দেখতো সেগুলো কী?
অনুসন্ধানে বাহির হইল একখানা কাপড়, ছোট ঘড়ি একটা, কয়খানি কাগজ। কাগজগুলি একটা মোকদ্দমার নথি ও রায়। নথিগুলিতে বহরমপুর জেলের ছাপ মারা—জেল-গেটে জমা ছিল। সঙ্গে একখানি চিঠি, হাইকোর্টের কোনো উকিলের লেখা—এরূপভাবে দণ্ডাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য আপীল করা অস্বাভাবিক ও আমাদের ব্যবসায়ের পক্ষে ক্ষতিজনক। সেইজন্য ফেরত পাঠানো হইল।
রজতবাবু নথিটা পড়িয়া গেলেন—
সেন্সর কোর্টের নথি। ১৯০৮ সালের ৫নং খুনী মামলার ইতিহাস। সম্রাটবাদী, আসামী কালীচরণ বাগদী—
অভিযোগ : আসামী তাহার পুত্র তারাচরণ বাগদীকে হত্যা করিয়াছে। সাক্ষী তিনজন।
প্রথম সাক্ষী মোবারক মোল্লা। এই ব্যক্তি বাহাদুরপুরের নানকাদার, অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। এই ব্যক্তিকে সরকার পক্ষের উকিল প্রশ্ন করেন—কালীচরণ বাগদীকে আপনি চেনেন?
উত্তর—হ্যাঁ। এই আসামী সেই লোক।
—কী প্রকৃতির লোক কালীচরণ?
—দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল।
—আপনার সঙ্গে কি কালীচরণের কোনো ঝগড়া আছে?
—না। সে আমার ওস্তাদ। আমি তার কাছে লাঠিখেলা শিখেছি।
—তারাচরণ বাগদীকে আপনি জানতেন?
—হ্যাঁ। ওস্তাদ কালীচরণেরই ছেলে সে।
—আচ্ছা, এটা কি ঠিক যে, কালীচরণ তারাচরণকে ভালো দেখতে পারত না?
—না। তবে ছেলেবেলায় তারাচরণ খুব রুগ্ন দুর্বল ছিল বলে ওস্তাদের ছেলেতে মন উঠত না। বলত, বেটাছেলে যদি বেটাছেলের মতো না হয়, তবে সে ছেলে নিয়ে করব কী?
—তারপর, বরাবরই তো সেই রকম ভাব ছিল?
—না। তারাচরণ বারো-তেরো বছর বয়স থেকে সেরে উঠে জোয়ান হতে আরম্ভ হলে ওস্তাদের চোখের মণি হয়ে উঠেছিল সে।
—কালীচরণ কি তারাচরণকে আখড়ায় মারত না?
—হ্যাঁ, ভুল করলে ওস্তাদের হাতে কারও রেহাই ছিল না, নিজের ছেলে বলে দাবির ওপর—
—থাক ও-কথা। আচ্ছা, আপনি কি জানেন, কুলীর ঘাঁটিতে রাত্রে পথিক খুন হয়?
—জানি। শুনেছি বহুকাল থেকে—বোধ হয় একশো বছর ধরে এ কাণ্ড ঘটে আসছে।
—কারা এ সব করে জানেন?
—না।
—শোনেননি?
—বহুজনের নাম শুনেছি।
—আপনাদের গ্রামের বাগদীদের নাম—এই কালীচরণ, তার পূর্বপুরষ—এদের নাম শুনেছেন কি?
—শুনেছি।
সরকারপক্ষের উকিল সাক্ষীকে আর জেরা করিতে ইচ্ছা করেন না।
দ্বিতীয় সাক্ষী এলোকেশী বাগদিনী। মৃত তারাচরণ বাগদীর স্ত্রী। বয়স আঠারো বৎসর।
প্রশ্ন—এই আসামী কালীচরণ তোমার শ্বশুর?
—হ্যাঁ।
—আচ্ছা বাপু, তোমার স্বামীর সঙ্গে কি তোমার শ্বশুরের ঝগড়া ছিল?
—না।
—কখনও ঝগড়া হত না?
—ঝগড়া হত বইকি! কতদিন টাকা-পয়সা নিয়ে ঝগড়া হত। কিন্তু তাকে ঝগড়া বলে না।
—কীসের টাকা-পয়সা নিয়ে ঝগড়া?
—খুনের, ডাকাতির। আমার শ্বশুর, আমার স্বামী মানুষ মারত। ডাকাতিও করত।
—কেমন করে জানলে তুমি?
—বাড়িতে শাশুড়ীর কাছে শুনেছি, আমার স্বামীর কাছে শুনেছি, এদের বাপ-বেটার কথাবার্তায় বুঝেছি। আর কতদিন রক্তমাখা টাকা-গয়না জলে ধুয়ে পরিষ্কার করেছি।
—তোমার স্বামী তারাচরণকে কে খুন করেছে জান?
—জানি। আমার শ্বশুর খুন করেছে। আমি নিজে চোখে দেখেছি।
বিচারক প্রশ্ন করেন—তুমি নিজের চোখে খুন করা দেখেছ?
—হ্যাঁ, হুজুর, সমস্ত দেখেছি।
বিচারক আদেশ করেন—কী দেখেছ তুমি? আগাগোড়া বল দেখি?
সরকার পক্ষের উকিলকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা বন্ধ করিতে আদেশ দেওয়া হইল।
সাক্ষীর উক্তি :
—হুজুর, শ্রাবণ মাসের প্রথমেই আমি বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। শ্রাবণের সাতাশে আমার ছোট বোনের বিয়ে ছিল। আমার স্বামী পঁচিশ তারিখে সেই বিয়ের নিমন্ত্রণে এখানে আমার বাপের বাড়িতে আসে। আরও অনেক কুটুম্ব সজ্জন এসেছিল। জাত-বাগদী আমরা হুজুর, সকলেই আমাদের লাঠিয়াল। আর ছোট জাতের আমোদ-আহ্লাদে মদই হল হুজুর প্রধান জিনিস। বড় বড় জোয়ান সব দিবারাত্র মদ খেয়েছে আর ঘাঁটি-খেলা খেলেছে!
বিচারক প্রশ্ন করেন—ঘাঁটি খেলা কী?
—হুজুর, ডাকাতি করতে গিয়ে যেমন লাঠি খেলে, গেরস্তর ঘর চড়াও করে বাইরের লোককে আটকে রাখে, সেই খেলার নাম ঘাঁটি-খেলা। সেই খেলা খেলতে গিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার দাদার ঝগড়া হয়। তিন তিন বার আমার দাদার ঘাঁটি ভেঙে দিয়ে বলেছিল—এ ছেলেখেলা ভালো লাগে না বাপু। মনের রাগে দাদা রাত্রে খাবার সময় আমার স্বামীর কুলের খোঁটা তুলে অপমান করে। আমার ননদ নীচ জাতের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই নিয়ে কুলের খোঁটা। স্বামী আমার তখনই উঠে পড়ে সেখান থেকে চলে আসে। আমার সঙ্গে দেখা করেনি হুজুর, তাহলে তাকে আমি সেই অন্ধকার বাদল রাতে বেরুতে দিতাম না। আমি যখন খবর পেলাম তখন সে বেরিয়ে চলে গেছে। আমি আর থাকতে পারলাম না—থাকতে ইচ্ছাও হল না। যে মরদ স্বামীর জন্য আমার সমবয়সীরা আমাকে হিংসে করত, তার অপমান আর সহ্য হল না। আর আমাকে সে যেমন ভালোবাসত—
সাক্ষী এই স্থলে কাঁদিয়া ফেলে। কিছুক্ষণ পর আত্মসম্বরণ করিয়া আবার বলিল, অন্ধকার বাদল রাত্রি সেদিন—কোলের মানুষ নজর হয় না এমনি অন্ধকার। পিছল পথ, বারবার পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম। গ্রামের বাইরে এসে আমি চিৎকার করে ডাকলাম—ওগো, ওগো! ঝিপ ঝিপ করে বৃষ্টির শব্দ আর বাতাসের গোঙানিতে সে শব্দ সে বোধ হয় শুনতে পায় নাই। শুনলে সে দাঁড়াত—নিশ্চয় দাঁড়াত হুজুর। তবে আমি তার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। বাতাসটা সামনে থেকে বইছিল। সে গান করতে করতে যাচ্ছিল, বাতাসে সে গান পিছু দিকে বেশ ভেসে আসছিল।
সাক্ষী আবার নীরব হইল।
কিছুক্ষণ পরে সাক্ষী আবার আরম্ভ করিল :
—আমি প্রাণপ্রণে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পিছিল পথ, তাড়াতাড়ি চলবার উপায় ছিল না। সামনে থেকে জলের ফোঁটা কাঁটার মতো মুখ চোখে বিঁধছিল। হঠাৎ একটা চিৎকারের শব্দ কানে পৌঁছল—বাবা, বাবা! শেষটা আর শুনতে পেলাম না। চিনতে পারলাম আমার স্বামীর গলা, ছুটে এগিয়ে যেতে গিয়ে পথে পড়ে গেলাম। উঠে একটু দূরে এগিয়ে যেতে দেখি, একজোড়া আঙরার মতো চোখ ধকধক করে জ্বলছে। এই চোখ দেখে চিনলাম, সে আমার শ্বশুর। আমার শ্বশুরের চোখের তারা বেড়ালের চোখের মতো খয়রা রঙের, সে চোখ আঁধারে জ্বলে। অন্ধকারের মধ্যে চলে চলে চোখে তখন অন্ধকার সয়ে গিয়েছিল, আমি তখন দেখতেও পাচ্ছিলাম। দেখলাম, আমার শ্বশুর একটা মানুষকে কাঁধে ফেলে আখড়াইয়ের দীঘির পাড় দিয়ে নেমে গেল। বুক ফেটে কান্না এল, কিন্তু কাঁদতে পারলাম না। গলা যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, চোখে যেন আগুন জ্বলছিল। আমিও তার পিছন নিলাম।
সাক্ষীকে বাধা দিয়ে বিচারক প্রশ্ন করিলেন, তোমার ভয় হল না?
সাক্ষী উত্তর দিল, আমরা বাগদীর মেয়ে। আমাদের মরদে খুন করে, আমরা লাস গায়েব করি হুজুর, আমরা লাস গায়েব করি। হুজুর, আমার হাতে যদি তখন কিছু থাকত তবে ঐ খুনেকে ছাড়তাম না।
সাক্ষী অকস্মাৎ উত্তেজিত হইয়া কাঠগড়া হইতে বাহির হইয়া পড়িয়া আসামীকে আক্রমণের চেষ্টা করে। তাহাকে ধরিয়া ফেলা হয় ও তাহার উত্তেজিত অবস্থা দেখিয়া সেদিনকার মতো বিচার স্থগিত রাখিতে আদেশ দেওয়া হয়। সাক্ষী কিন্তু বলে যে, সে বলিতে সমর্থ এবং আর সে এরূপ আচরণ করিবে না।
সে কহিল—তারপর দীঘির গর্ভে দেহটাও পুঁতে দিলে সে, আমি দেখলাম। তখন পশ্চিম আকাশে কাস্তের মতো এক ফালি চাঁদ মেঘের আড়ালে উঠেছিল। অন্ধকার অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে। সেই আলোতে পরিষ্কার চিনতে পারলাম, খুনী আমার শ্বশুর! সে বাড়ির দিকে হনহন করে চলে গেল। আমি পিছু ছাড়ি নাই।
বাড়িতে এসে লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে সে বাড়ি ঢুকল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অল্পক্ষণ পরেই কে বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠল, চিনলাম সে আমার শাশুড়ীর গলা, কিন্তু একবার কেঁদেই চুপ হয়ে গেল—
এই সময় আসামী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল—আমি তার মুখ চেপে ধরেছিলাম। হুজুর, আর সাক্ষী-সাবুদে দরকার নাই। আমি কবুল খাচ্ছি। আমিই আমার ছেলেকে খুন করেছি। হুকুম পেলে আমি সব বলে যাই।
বিচারক এরূপ ক্ষেত্রে বিবেচনা করিয়া আসামীকে স্বীকারোক্তি করিবার আদেশ দিলেন।
আসামী বলিয়া গেল, হুজুর, আমরা জাতে বাগদী, আমরা এককালে নবাবের পল্টনে কাজ করতাম। আজও আমাদের কুলের গরব—লাঠির ঘায়ে, বুকের ছাতিতে। কোম্পানির আমলে আমাদের পল্টনের কাজ যখন গেল, তখন থেকে এই আমাদের ব্যবসা। হুজুর, চাষ আমাদের ঘেন্নার কাজঃ; মাটির সঙ্গে কারবার করলে মানুষ মাটির মতোই হয়ে যায়। মাটি হল মেয়ের জাত। জমিদার লোকের বাড়িতে এককালে আমাদের আশ্রয় হত। কিন্তু কোম্পানির রাজত্বে থানা-পুলিশের জবরদস্তিতে তারাও সব একে একে গেল। যারা টিঁকে থাকল তারা শিং ভেঙে ভেড়া ভালোমানুষ হয়ে বেঁচে রইল। তাদের ঘরে চাকরি করতে গেলে এখন নীচ কাজ করতে হয়, গাড়ু বইতে হয়, মোট মাথায় করতে হয়, জুতো খুলিয়ে দিতেও হয় হুজুর। তাই আমরা এই পথ ধরি। আজ চার পুরুষ ধরে আমরা এই ব্যবসা চালিয়ে এসেছি। জমিদারের লগদীগিরি লোক দেখানো পেশা ছিল আমাদের। রাত্রির পর রাত্রি চামড়ার মতো পুরু অন্ধকারে গা ঢেকে কুলীর ঘাঁটিতে ওত পেতে বসে থেকেছি। মদের নেশায় মাথার ভেতরে আগুন ছুটত। সে নেশা ঝিমিয়ে আসতে পেত না। পাশেই থাকত মদের ভাঁড়। সেই ভাঁড়ে চুমুক দিতাম। অন্ধকারের মধ্যে পথিক দেখতে পেলে বাঘের মতো লাফ দিয়ে উঠতাম। হাতে থাকত ফাবড়া—শক্ত বাঁশের দু-হাত লম্বা লাঠি, সেই লাঠি ছুঁড়তাম মাটির কোল ঘেঁষে। সাপের মতো গোঙাতে গোঙাতে সে লাঠি ছুটে গিয়ে পথিকের পায়ে লাগলে আর তার নিস্তার ছিল না। তাকে পড়তেই হত। তারপর একখানা বড় লাঠি তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে চেপে দাঁড়াতাম, আর পা দুটো ধরে দেহটা উল্টে দিলেই ঘাড়টা ভেঙে যেত।—
এই সময় একজন জুরি অজ্ঞান হইয়া পড়ায় আদালত সেদিনকার মতো বিচার বন্ধ রাখিতে আদেশ দিলেন।
—পরদিন বিচারক ও জুরিগণ আসন গ্রহণ করিলে আসামী বলিতে আরম্ভ করিল—
কত মানুষ যে খুন করেছি তার হিসেব আমার নেই। সে-সময়ে কোনো কথা কানে আসে না হুজুর। তাদের কাতরানি যদি সব কানে আসত, মনে থাকত হুজুর, তাহলে সত্যি পাথর হয়ে যেতাম। মনে পড়ে শুধু দুটি দিনের কথা। যেদিন আমার বাপের কাছে আমি হাতেখড়ি নিই, আর আমি আমার ছেলে তারাচরণকে যেদিন হাতেখড়ি দিই, এই দুদিনের কথা মনে আছে। সরল বাঁশের কোঁড়ার মতো দীঘল কাঁচা জোয়ান তখন তারাচরণ। অন্ধকার রাত্রে শিকারের গলায় দাঁড়িয়ে বললাম, দে, পা-দুটো ধরে ধড়টা ঘুরিয়ে দে। সে থরথর করে কেঁপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি শিকার শেষ করলাম, কিন্তু মনটা কেমন সেদিন হিম হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, প্রথমদিন আমিও এমনি করে কেঁপেছিলাম। তারপর হুজুর, অভ্যাসে সব হয়—ক্রমে ক্রমে তারা আমার হয়ে উঠল গুলিবাঘ। পালকের মতো পাতলা গা—পাথরের মতো শক্ত ছাতি—শিকার পথের উপর পড়লে আমি যেতে না-যেতে সে গিয়ে কাজ শেষ করে রাখত। ঘটনার দিন হুজুর—
আসামী নীরব হইল। সে পানীয় জল প্রার্থনা করিল। জল পান করিয়া সে কহিল—সেদিনের সে ভুল তারাচরণের, আমার ভুল নয়। তবে সে আমার ভাগ্যের দোষ। আর নয়তো যাদের খুন করেছি, তাদের অভিসম্পাতের ফল। তবে এ যে হবে এ আমি জানতাম—আমার বাবা বলেছিল, আমাদের বংশ থাকবে না—নিব্বংশ হতেই হবে।
আবার আসামী নীরব হইল। আসামী কাতর হইয়া পড়িয়াছে বিবেচনা করিয়া আদালত কিছুক্ষণ সময় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু আসামী তাহা চাহে না। সে কহিল—আমার শেষ হয়েছে হুজুর। তবে আর একটু জল। পুনরায় জলপান করিয়া সে বলিয়া গেল—
—সেদিন তারার আসবার কথা নয়। কুটুম্ববাড়িতে বিয়ের নেমন্তন্নে গিয়ে বিয়ের রাত্রেই সে চলে আসবে এ ধারণা আমি করতে পারি নাই হুজুর। সেদিন অন্ধকার রাত্রি। ঝিপ ঝিপ করে বাদলও নেমেছিল। আমার বউমার কাছে শুনেছেন, আমার চোখ অন্ধকারে বেড়ালের মতো জ্বলে। আমার চোখেও আমি সেদিন ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না। সর্বাঙ্গ ভিজে হিম হয়ে যাচ্ছিল। আমি ঘন ঘন মদের ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। দু-পহর রাত পর্যন্ত শিকার না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠে আসছি—এমন সময় কার গানের খুব ঠাণ্ডা আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাতাস বইছিল আমার দিক থেকে। আওয়াজটা বাতাস ঠেলে উজানে ঠিক আসছিল না। সেদিন হাতে পয়সাকড়ি কিছু ছিল না। মানুষের সাড়া পেয়ে মদের ভাঁড়ে চুমুক মেরে অভ্যেসমতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে চলন্ত মানুষ নড়ছিল—মারলাম ফাবড়া। লাস পড়ল। চিৎকার করে সে কী বললে কানে এল না। ছুটে গিয়ে গলায় লাঠি দিয়ে উঠে দাঁড়াব, শুনলাম, বাবা—বাবা—আমি—
কথাটা কানেই এল, কিন্তু মনে গেল না, তার গলা আমি চিনতে পারলাম না। লাঠির ওপরে দাঁড়িয়ে বললাম—এ সময়ে বাবা সবাই বলে।
আসামী নীরব হইল। আবার সে বলিল—পেয়েছিলাম আনা-ছয়েক পয়সা আর তার কাপড়খানা।
আবার সে নীরব হইল। কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই সে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল।
রায়ে বিচারক দণ্ডাদেশের পূর্বে লিখিয়াছেন—যুগ-যুগান্তরের সাধনায় মানুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করিয়া ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখার নির্দেশ করিয়াছে। তাঁহার নামে সৃষ্টি ও সমাজের কল্যাণে অন্যায় ও পাপের রোধহেতু দণ্ডবিধির সৃষ্টি হইয়াছে। ঈশ্বরের প্রতিভূস্বরূপ বিচারক সেই বিধি অনুসারে অন্যায়ের শাস্তিবিধান করিয়া থাকেন। এই ব্যক্তির যে অপরাধ, বর্তমান রাষ্ট্রতন্ত্রের দণ্ডবিধিতে তাহার যোগ্য শাস্তি নাই। এ ক্ষেত্রে একমাত্র চরমদণ্ডই বিধি। আমার স্থির বিশ্বাস, সেইজন্যই সমগ্র বিশ্বের অদৃশ্য পরিচালক তাহার দণ্ডবিধান স্বয়ং করিয়াছেন; চরমদণ্ড এ ক্ষেত্রে সে গুরুদণ্ডকে লঘু করিয়া দিবে। ঈশ্বরের নামে বিচারকের আসনে বসিয়া তাঁহার অমোঘ বিধানকে লঙ্ঘন করিতে পারিলাম না। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাস ইহার শাস্তি বিহিত হইল।
রায় শেষ হইয়া গেল।
তিনজনেই নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিলেন। মনের বিচিত্র চিন্তাধারার পরিচয় বোধ হয় প্রকাশ করিবার শক্তি কাহারও ছিল না।
অকস্মাৎ রমেন্দ্রবাবু কহিলেন, একটা কথা বলব সুরেশবাবু?
মৃদুস্বরে সুরেশবাবু বলিলেন, বলুন।
—পুলিশ একজিকিউটিভ আপনারা দুজনেই তো এখানে রয়েছেন। দেহটা আর মর্গে পাঠাবেন না। ওই আখড়াইয়ের দীঘির গর্ভেই ওকে শুয়ে থাকতে দিন।