৪
বিকেলে হাসান বাইরে বেরুতেই শান্তাকে ধরলেন আয়েশা বেগম। রসিদটা দেখিয়েছিস? কি বলল তোর দুলাভাই?
আপনাকে তো আগেই বলেছি, নিশ্চয়ই এর কোন ব্যাখ্যা আছে। ঝর্ণা আপা স্যুটকেস থেকে যা নেয়ার নিয়ে ট্রান্সপোর্ট অফিসেই রেখে গেছে ওটা। ওদেরকে বলা আছে, কোথাও পাঠাতে হবে না, পরে এক সময় রসিদ দেখিয়ে চেয়ে নেয়া হবে। ঠিক হয়েছে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে চার্জ করবে ওরা। অত বড় সুটকেস, কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রসিদটা আপা নিজের কাছে রাখেনি হারিয়ে ফেলার ভয়ে।
অবিশ্বাসে মাথায় হাত দিলেন আয়েশা বেগম। তুই এই গল্প বিশ্বাস করলি?
গল্প বলছেন কেন? যা সত্যি তাই বলেছেন হাসান ভাই।
মাথা নাড়লেন আয়েশা বেগম। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোর আসলে কি হয়েছে বল তো? তুই তো এত বোকা কখনও ছিলিস না!
বিশ্বাস না হয় আপনি নিজেই হাসান ভাইকে জিজ্ঞেস করুন। তার মন-মেজাজের যে অবস্থা, ধমক দিলে আমি কিছু জানি না।
কি যেন লুকাচ্ছিস তুই। কিছু একটা হয়েছে তোর! বলতে বলতে বিদায় নিলেন আয়েশা বেগম।
.
ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এল হাসান। এবার বাড়ি যাবে শান্তা। দরজা খুলে বাইরে বেরুবে, এই সময় নক হলো দরজায়। কবাট খুলে শান্তা দেখল, ছাই রঙের স্যুট পরা মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সে কিছু বলার আগে ভদ্রলোকই জিজ্ঞেস করলেন, হাসান সাহেব কি বাড়িতে আছেন?
আছেন, বলল শান্তা। কি বলব তাকে? আপনার পরিচয়?
আমি থানা থেকে এসেছি। বলুন ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী কথা বলতে চান। কিন্তু আপনার পরিচয়?
হাঁ হয়ে গেল শান্তা। বলল, আমি শান্তা ইসলাম, সাঈদ হাসান আমার দুলাভাই। ভদ্রলোককে বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে প্রায় ছুটে চলে এল লাইব্রেরিতে। হাসান ভাই, থানা থেকে সাদা পোশাকে একজন পুলিশ অফিসার এসেছেন। ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী, আপনাকে ডাকছেন।
পুলিশ কেন আসবে? কি চায়?
আমি কি করে বলব! আমার কেমন যেন লাগছে!
চলো তো দেখি, বলে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল হাসান।
বৈঠকখানায় ওরা ঢুকতেই সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী, হ্যাণ্ডসেকের জন্যে হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন হাতটা। আপনি বিখ্যাত লেখক, পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। বসুন, প্লীজ।
সিঙ্গেল একটা সোফায় বসল হাসান। সোফাটার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকল শান্তা, তার হাতের তালু এরইমধ্যে,ঘামতে শুরু করেছে। কি ব্যাপার বলুন তো, ইন্সপেক্টর সাহেব? জিজ্ঞেস করল হাসান।
না, তেমন কিছু না। প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছু গুজব ছড়িয়েছে..ইয়ে মানে, আপনার স্ত্রীকে নিয়ে। আমি শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে।
শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল হাসানের। কোন দুঃসংবাদ, ইন্সপেক্টর? তার কোন খারাপ খবর পেয়েছেন আপনারা?
না…না, আমি বরং এই প্রশ্নটাই আপনাকে করতে এসেছি, হাসান সাহেব। আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিলে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই মুহুর্তে কোথায় আছেন তিনি?
ঠিক এখনি যোগাযোগকরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, বলল হাসান। – আমার স্ত্রী তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে কোলকাতা গেছেন, ছয় থেকে আট হপ্তা থাকার কথা সেখানে। তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের নাম আমাকে বলেছিলেন বটে, তবে…, মাথায় একটা টোকা মারল সে, …একদম ভুলে গেছি। না, তাদের আমি চিনি না।
ও। তাহলে তো ব্যাপারটা জটিল হয়ে গেল, তাই না? তিনি আপনাকে কোন চিঠিও লেখেননি?
চিঠি লেখার অভ্যাস তার নেই। তবে ফোন করেছিলেন গত হপ্তায়, তারপর ঢাকায় আমি তার সঙ্গে দেখা করতেও যাই।
বলবেন কি, কোথায় আপনাদের দেখা হলো?
হেসে উঠল হাসান। দেখা হয়েছে আরমানিটোলায়, একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর অফিসে। কিন্তু, ইন্সপেক্টর, আমাকে এসব প্রশ্ন করার কারণটা কি বলুন তো?
কারণটা হলো, আপনার প্রতিবেশীদের কেউ কেউ মিসেস ঝর্ণার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। কাউকে কিছু না বলে এখান থেকে চলে গেছেন তিনি, যাবার সময় কেউ তাঁকে দেখেওনি, তারপর এক মাসের বেশি হয়ে গেল ফিরছেন না…।
বুঝেছি।আবার হাসল হাসান। তা এ-ব্যাপারে আমি কি করতে পারি?
সেটাই দেখতে হবে, হাসান সাহেব। আপনি কি তাঁর সঙ্গে একা দেখা করেছিলেন?
অবশ্যই। তখন মনে হয়নি দেখা করার সময় একজন সাক্ষী রাখা দরকার। ঝর্ণার, শুভানুধ্যায়ীরা ঠিক কি ভাবছেন আমাকে বলবেন, ইন্সপেক্টর? তারা কি ভাবছেন আমি ওকে খুন করে লাশটা লুকিয়ে রেখেছি?
হাসানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ইন্সপেক্টর। তারপর বললেন, কেন আপনার মনে হলো, তারা এরকম অস্বাভাবিক কিছু একটা ভাবতে পারেন?
বোঝাই যাচ্ছে আমাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। রেগে যাচ্ছে হাসান। এখানকার মানুষ কারও পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চায় না। গুজব ছড়াতে খুব ভালবাসে।
গুজব যখন একটা ছড়িয়েছে, আপনার স্বার্থেই প্রমাণ হওয়া দরকার সেটা মিথ্যে, বললেন ইন্সপেক্টর। অন্তত আমাদেরকে আপনি সাহায্য করতে পারেন। বলবেন কি, আপনার স্ত্রী যেদিন এখান থেকে রওনা হলেন, কেউ তাকে যেতে দেখেনি কেন? এখানে বা স্টেশনে?
এখানে কেউ দেখেনি কেন তা আমি বলতে পারব না, জানাল হাসান। সন্ধের একটু আগে ওকে নিয়ে বেরুই আমি। কেউ যদি না দেখে বা দেখেও অস্বীকার করে, আমার কিছু করার নেই। আর স্টেশনে অনেকে আমাদেরকে দেখলেও, ভাল করে হয়তো খেয়াল করেনি। তাছাড়া কজনই বা আমাদেরকে চেনে বলুন? খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, সালাম ট্রান্সপোর্ট অফিসে আমি একটা স্যুটকেস জমা রেখে এসেছি। আমার স্ত্রী ফোনে কিছু কাপড়-চোপড় চেয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম সুটকেসটায় ভরে। দুএকটা কাপড় বের করে নেন তিনি, স্যুটকেসটা ওখানেই রাখার সিদ্ধান্ত হয়। বলা যায় না, ওখানকার স্টাফরা ওঁকে হয়তো মনে রেখেছে।
নোটবুক বের করে কয়েকটা পয়েন্ট লিখে নিচ্ছেন ইন্সপেক্টর। তাঁকে দেখাবার জন্যে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর রসিদটাও দেরাজ থেকে বের করে আনতে হলো হাসানকে। রসিদটা নিজের কাছে দিন কয়েক রাখতে চাইলেন তিনি। তারপর বললেন, উনি যখন এখানে রয়েছেন, ওনাকেও দুএকটা প্রশ্ন করতে চাই। উনি কি এখানেই থাকেন? উনি কি আপনার স্ত্রীর আপন বোন?
শান্তা এখানে থাকে না, বলল হাসান। আমার স্ত্রীর খালাতো বোন ও। বলতে পারেন, এখানে আমার চাকরি করে সে। টাইপিস্ট।
টেলিফোনের ব্যাপারটা, মিস শান্তা, বললেন ইন্সপেক্টর। মিসেস ঝর্ণা ফোন করেছিলেন, রিসিভার তোলেন আপনি। সম্ভবত উনি যেদিন এখান থেকে গেলেন তার পরদিন, তাই না? মাথা ঝকাল শান্তা। আপনি কি তাঁর গলার আওয়াজ চিনতে পেরেছিলেন? মানে কোন সন্দেহ নেই তো যে মিসেস ঝর্ণাই ফোন করেছিলেন?
কোন সন্দেহ নেই, জোরের সঙ্গে জবাব দিল শান্তা। আপার সঙ্গে অনেক্ষণ কথা হয় আমার। একবারও কিছু সন্দেহ হয়নি। আমাকে বলল, তোর ভাইকে বলবি ফিরতে আমার দেরি হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে ফিরবে? আপা বলল, ঠিক বলতে পারছি না।
অবাক হননি আপনি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইন্সপেক্টর। .
না। এর আগেও আপা দুদিনের কথা বলে পাঁচ-সাতদিন থেকে গেছে।
হাসান সাহেব, স্ত্রীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে কি করলেন আপনি, বলবেন?
বাড়ি ফিরে আসি। সরাসরি সিলেট যাবার কথা ছিল, কিন্তু বাড়িতে কিছু কাজ থাকায়…।
যেমন? কি কাজ?
কিছু কাগজ-পত্র গোছগাছ করার দরকার ছিল।
আপনার তো বাগান করার শখ আছে, তাই না, হাসান সাহেব?
তা আছে। উপন্যাসের প্লট মাঝে মধ্যে জট পাকিয়ে যায়, তখন সমস্যাটা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকা দরকার হয় বাগানের আগাছা পরিষ্কার করলে বা শুধু মাটি কোপালে ভাল ফল পাই আমি।
কাজেই সেদিন বাড়ি ফিরে আপনি বাগানে মাটি কোপান, তারপর গাড়ি নিয়ে সিলেট রওনা হন। বাড়িতে আপনি কতক্ষণ ছিলেন?
ঘণ্টা দুয়েক হতে পারে।
তার মানে সিলেটে আপনি বেশ রাত করে পৌঁছান। তা ওখানে কোথায় উঠেছিলেন আপনি?
সিলেটের বিপিনবিহারী কলেজের কোয়ার্টার নম্বর আর অধ্যাপক বন্ধুর নাম বলল হাসান।
আর শুধু একটা প্রশ্ন, বললেন ইন্সপেক্টর। ইদানীং স্ত্রীর সঙ্গে আপনার বনিবনা কেমন? আপনি কি আশা করেন এখানে তিনি ফিরে আসবেন?
মাথার চুলে আঙুল চালাল হাসান, শান্তা জানে এটা তার অসহায় বোধ করার লক্ষণ। তার মানে আপনার কানে গেছে যে আমরা প্রায়ই ঝগড়াঝাটি করি, তাই না?
জ্বী, উল্লেখ করা হয়েছে।
দেখুন, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয়ই। সব মিলিয়ে আমি বলব, তবু আমরা সুখী। এ-কথা সত্যি যে আমার স্ত্রী এখানে বসবাস করতে চান না। তিনি ঢাকায় থাকার ব্যাপারে জেদ করছেন।
আপনার স্ত্রীর কোন খবর পেলে আমাদেরকে অবশ্যই জানাবেন, হাসান সাহেব, বলে সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী। আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম…।
দাঁড়াল হাসানও। জানাব না মানে? সঙ্গে সঙ্গে জানাব। আমার তো ভয় হচ্ছিল আপনি না আমাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যান। সঙ্গে করে আপনি সার্চ ওয়ারেন্ট আনেননি দেখে অবাকই হয়েছি। সে প্রশ্ন যদি ওঠে, বাড়ির সবখানে তল্লাশি চালাবার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে আপনাদের…মানে যদি চান আর কি।
আপাতত তার কোন দরকার নেই, ধন্যবাদ, ঠাণ্ডা সুরে বললেন ইন্সপেক্টর, ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালেন দরজার দিকে। তাকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল হাসান।
বৈঠকখানায় ফিরে নিঃশব্দে শান্তার দিকে তাকালসে। তারপর একটা সিগারেট ধরাল। শান্তা লক্ষ করল, হাসানের হাত দুটো কাঁপছে। টেলিফোনের ব্যাপারে তুমি যা বললে, শুনে নরম হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তা না হলে বোধহয় ঠিকই গোটা বাড়ি তল্লাশি করতেন।
আমি সত্যি কথা বলিনি, ফিসফিস করছে শান্তা। সত্যি কথাটা হলো, ঝর্ণা আপার গলা আমি চিনতে পারিনি।
এটাকে ঠিক মিথ্যে কথা বলে না।
বলার সময় এসব কিছু ভাবিনি আমি। আমার ধারণা, এসবের জন্যে দায়ী হলেন আয়েশা আন্টি। তিনি তো সবকিছুর মধ্যে শুধু ষড়যন্ত্র দেখতে পান। সন্দেহ নেই, প্রতিবেশীদের মাথা তিনিই গরম করেছেন।
যাক, ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক আপনার ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছে। বলেই মনে হলো। স্বস্তিবোধ করছে শান্তা, কারণ তার হাসান ভাই গোটা ব্যাপারটাকে হালকাভাবেই নিচ্ছেন।
তবে পুলিশ যদি বাগানটা খোঁড়াখুঁড়ি করে, একটুও আশ্চর্য হব আমি।
কি বলছেন! কেন?
তোমার ধারণা ঠিক নয়, শান্তা। ইন্সপেক্টর আমার ব্যাখ্যা পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। কারণটাও পরিষ্কার, আমি তাঁকে ঝর্ণার হদিস জানাতে ব্যর্থ হয়েছি। তাঁর চোখের সামনে আছেই মাত্র একটা জিনিস-বাড়ির পিছনের বাগানটা।
আপনার কথা শুনে আমার ভয় করছে।
কেন? ওরা বাগানটা খুঁড়লে আমার বরং মজাই লাগবে। ওখানে ওরা তাকে কোনদিনই পাবে না?
হাসান ভাই! শান্তার গলা চিরে প্রায় আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল হাসান, চেহারায় সম্পূর্ণ নিরীহ ভাব। কেন, কি বললাম আমি?
আপনার বলার ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো, আপা…আপা যেন মারা গেছে। আপনি য়েন বলতে চাইলেন-বাগানে আপা না থাকলেও অন্য কোথাও আছে।
অবশ্যই অন্য কোথাও আছে-কোলকাতায়। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে রীতিমত হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটাচ্ছে। অন্তত এ-ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
কি জানি…আমারই হয়তো বোঝার ভুল হয়েছে, কথা বলার সময় রীতিমত কাঁপছে শান্তা। হাসান ভাই, আমি এখন বাড়ি যাব।
তোমাকে অসুস্থ লাগছে, শান্তা। একটু বরং বিশ্রাম নিয়ে যাও। বললে আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
অসুস্থ যদি লাগে সেজন্যে আপনি দায়ী। আপনাকে আমি বুঝতে পারছি না। আপনি এত ভাল মানুষ, এত নরম…অথচ মাঝে মধ্যে এত নিষ্ঠুর মনে হয় যে…।
এর কারণ অমায়িক যে ভদ্রলোক তোমার পিছনে লেগেছেন তিনি তোমাকে বিরক্ত করেন না, কিন্তু আমি করি। ভদ্রলোক শিক্ষিত হলেও, খানিকটা সেকেলে, নিজের অধিকার কিভাবে আদায় করতে হয় জানেন না। আমি ঠিক তার উল্টো।
সাইফুল ভাই সেকেলে নন, কথাগুলো বলার সময় শান্তার চেহারায় অসহায় একটা ভাব ফুটে উঠল। অত্যন্ত ভদ্র তিনি, কিছু করার আগে প্রথমেই চিন্তা করেন আত্মসম্মানের কথা। সেদিন ওইসব করার সময় আমার উচিত ছিল আপনাকে বাধা দেয়া, যদিও এখন মনে হচ্ছে ঘটনাটার আসলে কোন গুরুত্ব নেই, কারণ আমার ধারণা আপনি মনে মনে হাসছিলেন…।
প্রেমে পড়লে মানুষ হাসবে না?
দ্রুত মাথা নাড়ল শান্তা। আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। আপনি আসলে সিরিয়াস হতে চান না। বাদ দিন এ-সর্ব, ভুলে যান। বলে আর দাঁড়াল না সে, গরম চাদরটা কাধে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
ভেবেছিলাম বাগানটা খোড়া হবে, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসে গোটা বাড়িতে তল্লাশি চালাবে পুলিশ, থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে আমাকে। কিন্তু কই! বাইরে বেরুলে লোকজন শুধু আড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। এমনকি আয়েশা আন্টিও নিয়মিত কাজে আসছেন। আশ্চর্যই বলতে হবে।
কেন, আন্টি কাজে আসবেন না কেন?
ওনার প্রতিক্রিয়া কি হবে আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি। যেখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেখানে তাঁর তো না মাসাই উচিত। তাঁর দৃষ্টিতে আমি তো একজন নিষ্ঠুর খুনী, তাই না?
এসব আপনার লেখক সুলভ কল্পনা, বলল শান্তা; সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনভাবে বিচলিত হবেন না।
আমার এসব কথাবার্তা তোমার ভাল লাগছে না, লাগছে। কি?
আপনার কোন কথাই আজকাল বিশেষ ভাল লাগে না আমার, বলল শান্তা। মানুষকে মুগ্ধ করতে পারেন আপনি, এই শক্তিটাকে বড় বেশি মূল্য দেন। কিন্তু একটা মেয়ে শুধু এই জিনিসটা দেখতে চায় না। সব মিলিয়ে একটা মানুষ যে চরিত্র, আমার কাছে সেটারই বেশি গুরুত্ব। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল শান্তা। হাসান ভাইয়ের প্রেমে পড়ার একটা ঝোক তাকে কাহিল করে রেখেছে, অস্বীকার করে লাভ নেই। গত কদিন ধরে মনের কোণে রঙিন একটা স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে বলেই বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে তাকে। হাসান ভাইয়ের সব ঠিক আছে, অথচ তারপরও কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি রয়ে গেছে। কি সেটা? শান্তা চায়, হাসান ভাই আরও একটু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন। গোটা ব্যাপারটাকে তিনি যেন বড় বেশি হালকাভাবে দেখছেন। যা-ই তিনি করছেন বা বলছেন সব কিছুর মধ্যে বিদ্বেষ ভরা একটা কৌতুকবোধ যেন থেকেই যাচ্ছে।
প্রিয় শান্তা, হেসে উঠে বলল হাসান, অন্তত কিছুটা সময় আমার অত্যাচার থেকে বাঁচবে তুমি। প্রকাশকের দেখা করার জন্যে ঢাকায় যাচ্ছি আমি, ফিরব হয়তো কাল সন্ধের দিকেএই সময়টা তোমাকে অবশ্য অনেক কাজ করতে হবে। আর মাত্র দুটো পরিচ্ছেদ লিখলেই বইটা শেষ হয়ে যাবে।
কাহিনী খুব দ্রুতই এগিয়েছে বলতে হবে, বলল শান্তা। শেষটা কি রকম হবে আমি আন্দাজও করতে পারছি না।
ফিরে এসে কাহিনী জোড়া লাগাবার কাজটা ধরব, দুই পরিচ্ছেদের মধ্যেই সারতে পারব বলে আশা করি। বইটা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে একরকম খারাপই লাগছে। তমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম তো। খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে সে।
এত বেশি মিষ্টি যে অবাস্তব বলে মনে হয়।
সত্যি বলছি, কিছুই তোমার মনমত হয় না। শুরুতে চরিত্রটা বদলেছিলাম শুধু তোমাকে খুশি করার জন্যে।
তা বোধহয় আপনার উচিত হয়নি। সমালোচনা করাটা আমার ভুল হয়েছে, তবে নিজের ধ্যান-ধারণার ওপর আপনার আস্থা থাকা উচিত ছিল।
সে সময়কার ধ্যানধারণা অন্য রকম ছিল আমার। তুমি আমাকে উপলব্ধি করাতে পেরেছিলে একটা মেয়ে কত সুন্দর হতে পারে; কি কোমল, বিশ্বস্ত আর প্রাণচঞ্চল হতে পারে; যখন সে একজন পুরুষকে ভালবাসে তখন নিজের বিশ্বাসে কেমন অটল থাকতে পারে।
আমি তার মত না-কখখনো নই। আপনার মুখে বারবার এই এক কথা শুনে আমার বিরক্ত ধরে গেছে। জঘন্য এই উপন্যাসটা শেষ হলে আমি বাঁচি।
শান্তা, তুমি খুব ভাল করেই জানো বইটা ভাল হয়েছে।
তারপরও ওটাকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করেছি।
কেন বলছ না আমাকেও তুমি ঘৃণা করতে শুরু করেছ? মনে যখন এত সন্দেহ আর ভয়, পুলিশের কাছেই বা যাচ্ছ না কেন? তুমি গেলে ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী সাংঘাতিক খুশি হবেন।
হাসান ভাই! কাতর গলায় বলল শান্তা। এসব কি বলছেন আপনি! এমনকি আমি যদি আপনাকে…যদিও আমি তা করি না…অবশ্যই আপনাকে আমি সন্দেহ করি না।
করো না? তবু তর্কের খাতিরে, মনে করো যে তুমি আমাকে সন্দেহ করো, তাহলে?
এ ধরনের কিছু আমি মনে করতে পারব না…।
পারবে না কেন, না পারার কি আছে। পরিস্থিতিটা কি? ভাব, ল্পনা করো। মনে করো…যেভাবেই হোক ঝর্ণাকে আমি সরিয়ে নিয়েছি, আমার এখন সাংঘাতিক বিপদ। এই পরিস্থিতিতে কি করবে
তুমি?
না, এ-সব আমি ভাবতে চাই না। হাসান ভাই, আমাকে আর কষ্ট দেবেন না। শান্তার দৃষ্টিতে কাতর অনুনয়।
শান্তার মাথায় একটা হাত রাখল হাসান, কোমল সহানুভূতির স্পর্শ। ঠিক আছে, দেব না। তুমি সত্যি খুব নরম…এত ভাল যে আমি তোমার উপযুক্ত নই, যদিও তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।
আশা ভিলায় একা থাকলে শান্তিতে কাজ করা যায়, কিন্তু শান্তাকে বিরক্ত করার কোন সুযোগই ছাড়তে রাজি নন আয়েশা বেগম। এবাড়িতে আর বেশিদিন কাজ করতে পারব বলে মনে হয় না, বিকেলের চা দিতে এসে বললেন তিনি। তুই কিছু বুঝতে পারছিস না? ঝড়ের আগে পরিবেশ যেমন থমথম করে, সেরকম লাগছে?
ইচ্ছে করেই ভুল বোঝার ভান করল শান্তা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, দেখুন বাতাসে কেমন দুলছে পিয়ারা গাছের পাতাগুলো।
খবরদার! হঠাৎ চোখ রাঙালেন আয়েশা বেগম। আর কক্ষনও তুই আমাকে বাগানের দিকে তাকাতে বলবি না। ওদিকে তাকালেই কেন যেন মনে হয় ওখানে কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। সেদিন দেখি খুব যত্ন করে তোর দুলাভাই গোলাপ চারা। পুঁতছে। দেখে মনে হলো, যেন একটা কবরের ওপর ফুলের চাষ করতে চায়। দেখ শান্তা, আমার দিকে ওভাবে তাকাবি না। কঠিন প্রহসন হলো, মেয়েদেরকেই বিশ্বাস করানো যায় না যে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রমাণের কথা যদি বলিস, বাগান খুঁড়লে তবে তো প্রমাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু পুলিশ তা খুঁড়বে কেন? তারাও তো পুরুষমানুষ।
আপনি চুপ করুন। এ-সব আমি শুনতে চাই না।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, জানতে পারি, কোথায় গেছে সে?
ঢাকায়। প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
হে-হে, হে-হে।
হাসছেন কেন?
আজ সকালে তোর দুলাভাই ব্যাংকে গিয়েছিল, সে খবর রাখিস? ফিরে এসে টেবিলের ওপর টাকার এই মোটা একটা বাণ্ডিল রাখল। আমার মনে বলছে, ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে ফেলেছে। পালাতে চাইলে সবাই তা-ই করে।
মানে? আপনার ধারণা হাসান ভাই পালিয়ে গেছেন?
তাহলে আমাকে বল, মাত্র এক রাত বাইরে থাকার জন্যে অত বড় একটা সুটকেস নিয়ে যাবে কেন সে?
ঢাকায় তার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছেন, নামী-দামী লোকজনের
সঙ্গে দেখা করতে হবে।
তাই বলে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন আয়েশা বেগম, চার চারটে আণ্ডারঅয়্যার নিয়ে যাবে?
শরীর রী রী করে উঠল শান্তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল সে, বলল, ও-সব আপনাকে দেখিয়ে সুটকেসে ভরার কারণটা কি জানেন? আপনি যাতে লোকজনকে বলতে পারেন।
কি বলতে পারি?
আন্টি, আপনি যে তার পিছনে লেগেছেন, তিনি তা জানেন। আপনার মুখ থেকে প্রতিবেশীরা জেনেছে, তাদের কাছ থেকে পুলিশ। হাসান ভাই বাগানে মাটি কোপান, ফুল গাছ লাগান, সবই আপনাকে দেখাবার জন্যে, কারণ তিনি জানেন আড়াল থেকে তাঁকে আপনি লক্ষ করেন।
কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন আয়েশা বেগম। তারপর বললেন, তা যদি সত্যি হয়, বলতে হবে তোর দুলাভাই খুব বাজে লোক। আমার মত একটা বুড়ি মানুষকে এভাবে ঠকাবার কোন মানে হয় না। এতে আমি তার কোন দোষ দেখি না, হেসে উঠে বলল শান্তা।
দেখা যাচ্ছে তোর চোখে ভালই ধুলো দিয়ে রেখেছে সে।
আন্টি শুনুন, ভাববেন না যে আপনার মত সবাই তাকে সন্দেহ করে। মার কথা ধরুন, সন্দেহ করলে এখানে আমাকে কাজ করতে দিত না। কিংবা সাইফুল ভাইয়ের কথা ধরুন।
এ-সবের সঙ্গে একজন অ্যাডভোকেটের কি সম্পর্ক? চেয়ারম্যান আমাকে গমচুরণী বলায় মানহানির মামলা করব বলে একজন অ্যাডভোকেটের কাছে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার কেস নিতে রাজি হয়নি সে।
রাজি হননি কেসে আপনি হেরে যাবেন, এই ভয়ে, বলল শান্তা। কারণ রিলিফের সের পাচেক গম সত্যি আপনি চুরি করেছিলেন। শুধু গম নয়, সরকারী হাসপাতাল থেকে ওষুধ আর তুলোও চুরি করেছিলেন।
কে বলল? থতমত খেয়ে গেলেন আয়েশা বেগম। তুই কি করে জানলি?
আমি একা না, সবাই জানে, আন্টি, বলল শান্তা, মায়ের মত শ্রদ্ধা করলেও মহিলার প্রতি আজ খেপে আছে সে।
সবাই জানে। কি জানে সবাই? আয়েশা বেগমকে বিচলিত দেখাল।
শুনুন, আন্টি, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে শান্তা, যে-বাড়িতেই আপনি কাজ করুন, তারা আপনাকে খেতে দেয়, কিন্তু আপনার মেয়েকে দেয় না। তারা আপনার মেয়ের ওষুধ কেনার পয়সাও দেয় না।
হঠাৎ এক পা পিছিয়ে গেলেন আয়েশা বেগম। বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন শান্তার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কি বলতে চাস তুই?
সবাই জানে, আন্টি। যে-বাড়িতেই আপনি কাজ করেন, সেখান থেকে কিছু না কিছু রোজই চুরি করেন-ভাত, তরকারি, রুটি-বিস্কিট, ওষুধ-পত্র, যখন যা হাতের কাছে পান। এ-সব আপনি আপনার মেয়ের কবরে, মাটির তলায় পুঁতে দিয়ে আসেন।
তোর মাথায় ঠাঠা পড়ুক। তুই মর মর মর। একটা মাত্র মেয়ে আমার, বিনা চিকিৎসায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, তা-ও তোরা হিংসা করবি? কেঁদে ফেললেন আয়েশা বেগম, ফোঁপাতে কোপাতে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
নিজের ওপর রাগ ও ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে শান্তা।
পরদিন আশা ভিলায় কাজ করতে এলেন ঠিকই, তবে শান্তার সঙ্গে কোন কথা বললেন না আয়েশা বেগম। তাঁর শান্ত স্বাভাবিক বিভাব লক্ষ করে শান্তার অপরাধ বোধ খানিকটা হালকা হলো। কিন্তু সে জানত না যে আজকের দিনটা তার জীবনে একটা অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে, শুরু হবে নরক যন্ত্রণায় দিন যাপন।
ঢাকা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ, বেলা দশটার দিকেই দৈনিকগুলো পৌঁছে যায়। প্রথম পৃষ্ঠার হেডিংগুলোয়-চোখ বুলিয়ে কাগজের মাঝখানের পাতাটা মেলে ধরল শান্তা। চলচ্চিত্র, থিয়েটার আর টিভি নাটকের খবর গোগ্রাসে গেলে সে। পাতা ওল্টাতেই রঙিন একটা ছবি তার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিল। একটা মেয়ের ছবি…মেয়েটাকে চেনে শান্তা…সোহানা। টিভির নাটকে ছোটখাট ভূমিকায় অভিনয় করে, ঝর্ণা আপার সাংঘাতিক ভক্ত। সোহানাকে নয়, শান্তার দম বন্ধ হয়ে এল তার পরনের ঘাগরা দেখে। এত সুন্দর সেট একটাই আছে, বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে তার ঝর্ণা আপা। যে ঘাগরা তার হাসান ভাই ঢাকায় গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন ঝর্ণা আপাকে। সেই ঘাগরা সৌহানা কোত্থেকে পেল?
খবরটাও রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলল শান্তা। টিভিতে নতুন একটা ধারাবাহিক নাটক শুরু হতে যাচ্ছে। মূল নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করার কথা শ্রাবণী আহমেদের। কিন্তু তিনি হঠাৎ গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট করায় অভিনয় করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন, তার বদলে চরিত্রটি করার জন্যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সোহানা চৌধুরীকে। এত বড় সুযোগ এই প্রথম পাচ্ছেন তিনি…
মাথাটা ঘুরছে শান্তার। ঝর্ণা আপা এই ঘাগরা তো কাউকে পরতে দেবে না! তাহলে?
চেয়ার ছেড়ে অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল সে। আসল সত্য তাকে জানতেই হবে। হাসান ভাই তাহলে ঢাকায় গিয়ে কাকে দিয়ে এলেন সুটকেসটা? ঘাগরাটা কোত্থেকে পেল সোহানা চৌধুরী?
তিন ঘণ্টার পথ, যেতে আসতে ছয় ঘণ্টা। কোচ ধরে এখুনি রওনা হলে সন্ধের আগে ফিরে আসতে পারবে সে। সোহানার ঠিকানা তার জানা আছে…না, হাসান ভাই বলেছেন সোহানা বাড়ি বদল করায় তার সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি। তাতে কি, রামপুরায় গেলে তার সঙ্গে ঠিকই দেখা করতে পারবে সে। খবরে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে শু্যটিং।
নিজেকে খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা করার সময় দিল না শান্তা, আয়েশা বেগমকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ল। বেরুবার আগে খবরের কাগজটা লুকিয়ে রাখল।
টিভি স্টেশনে পৌঁছে শান্তার মনে হলো, ঝোঁকের মাথায় বোধহয় ভুলই করে ফেলেছে সে। সিকিউরিটি গার্ডরা তাকে পাস খাড়া ভেতরে ঢুকতে দেবে না, একটা স্লিপ লিখে পাঠাতে হলো ভেতরে। আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, কিছু ঘটছে না। আজ হঠাৎ উপলব্ধি করল শান্তা, পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে অফিসাররা পর্যন্ত একা কোন মেয়েকে দেখলে এমন দৃষ্টিতে তাকায়, তাদের যেন কোন মা-বোন নেই। এই অমার্জিত অন্যায় মেনে নিতে কষ্ট হলো তার। মনে হলো, বাইরে না বেরুলে বোঝা যায় না নরকের চেয়েও খারাপ একটা জায়গায় বসবাস করতে হচ্ছে তাদেরকে। আয়েশা আন্টির কথা মনে পড়ল। ঠিকই বলেন তিনি, গাটা দেশে মেয়েদের বিরুদ্ধে নোংরা ষড়যন্ত্র চলছে। কুৎসিত মানুষে ভরে গেছে দেশ, আরেকটা যুদ্ধ কখনও যদি বাধে এরাই এখন রাজাকার হবে, যে রাজাকাররা আয়েশা আন্টির স্বামী ও একমাত্র কিশোরী মেয়েকে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
হাতে টেলিফোনের রিসিভার, গার্ডরুমের দরজা থেকে উঁকি দয়ে বাইরে তাকালেন একজন অফিসার। রুণই বলা যায়, চেহারায় মার্জিত ভাবটুকু সহজেই চোখে পড়ে, সরাসরি শান্তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি শান্তা ইসলাম, সোহানা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলবেন?
জ্বী, ছোট্ট করে জবাব দিল শান্তা।
প্লীজ, ভেতরে আসুন, বলে পথ ছেড়ে দিলেন অফিসার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল শান্তা। ওর হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিয়ে অফিসার বললেন, আপনি কথা বলুন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। শান্তা লক্ষ করল, বাইরে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের মত এই ভদ্রলোকের দৃষ্টি তার শরীরের ওপর হুল ফোটাল না। কামরা থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে কৃতজ্ঞবোধ করল সে। মনে মনে ভাবল এত হতাশ হবার সত্যি বোধহয় কোন কারণ নেই, সবাই কুৎসিত হয়ে যায়নি।
রিসিভারে সোহানার সাড়া পেয়ে শান্তা প্রথমে তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সে তাকে চিনতে পারছে কিনা। হেসে উঠে সোহানা বলল, ঝর্ণা আপার বোন তুমি, বেড়াতে গিয়ে তোমাদের বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, সেকি ভোলার কথা!
শান্তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আজকের কাগজে তোমায় ছবি দেখলাম…।
হ্যাঁ, পত্রিকায় ওই ছবি দেয়ার জন্যেই তো ঝর্ণা আপার ঘাগর সেটটা পরতে হলো আমাকে। আজ সময় পাইনি, ঝর্ণা আপাকে কথাটা জানাবার জন্যে কাল ফোন করব ভাবছি…।
কোন নম্বরে?
অপরপ্রান্তে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সোহানা, তারপর বলল, শু্যটিং নিয়ে এত ব্যস্ত আছি, কিছুই মনে থাকে না। ভুলে গেছি সে ঝর্ণা আপা দেশে নেই। এখনও নিশ্চয়ই ফেরেননি, ফিরলে শা আর ঘাগরাটা অবশ্যই ফেরত চাইতেন…।
শোনো, সোহানা, ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারছি না, তবে আমার জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণঝর্ণা আপার শাল আর ঘাগরা কে দিল তোমাকে?
দরকার হলেই ঝর্ণা আপার কাপড়চোপড় চেয়ে নিয়ে পরি আমি, বলল সোহানা। এত বড় সুযোগ পেয়েছি, পত্রিকায় ছবি দিতে হবে, ঝর্ণা আপার সেটটার কথা মনে পড়তে ময়মনসিংহে ফোন করলাম আমি। হাসান ভাই বললেন, উনি বাড়িতে নেই। তখন তাঁকেই আমি ঘাগরা আর শালটার কথা বললাম। উনি বললেন, আমি যেন পরদিন আরমানিটোলায় সালাম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীতে চলে আসি। কেন বলো তো, এ নিয়ে কিছু ঘটেছে নাকি? ঝর্ণা আপা বুঝি রাগ করেছেন হাসান ভাইকে?
আরে না, সে-সব কিছু না। হাসান ভাইও তো বাড়িতে নেই। পত্রিকায় তোমার ছবি দেখে ভাবলাম তাহলে কি ঝর্ণা আপা দেশে ফিরে এসেছে। আসলে আপার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা সাংঘাতিক জরুরী, বুঝলে। হাসান ভাই যদি আমাকে জানাতেন যে তিনিই তোমাকে ওটা দিয়েছেন তাহলে আমাকে আর ঢাকায় আসতে হত না…।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় চাইল শান্তা, রাস্তায় বেরিয়ে এসে কোচ ধরার জন্যে একটা রিকশা নিল। সাংঘাতিক একটা আতঙ্ক অসাড় করে ফেলছে তাকে। ভয় একটা সাপ, কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে তার বুকের ভেতর। ঝর্ণা আপার জন্যে এতদিন উদ্বিগ্ন ছিল সে। এখন উদ্বিগ্ন হয়ে কোন লাভ নেই। তার ঝর্ণা আপা মারা গেছে, মারা গেছে হিংস্র আক্রোশের শিকার হয়ে। ঠিক কিভাবে ঘটনাটা ঘটেছে তা জানার উপায় নেই। শুধু জানে যে ঘটেছে। কোচে চড়ে ফেরার পথে খুনটার চেয়ে শান্তাকে বেশি বিচলিত করল ঝর্ণা আপা নিখোঁজ হবার পর থেকে হাসান ভাইয়ের আচরণ। শোকে কাতর হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি ভয়ও পাননি তিনি, বরং হৃদয়হীন পাষাণের মত প্রেম-প্রেম খেলা। খেলেছেন তার সঙ্গে। একটা মানুষ নিজের স্ত্রীকে খুন করার পরপরই কিভাবে আরেকটা মেয়ের মন জয় করার জন্যে উঠেপড়ে লাগে? নির্লজ্জের মত হাত দিয়েছেন তার গায়ে, বোঝাতে চেয়েছেন তাকে তিনি কত ভালবাসেন।
তারপর নিজেকে যুক্তির পথে আনতে চেষ্টা করল শান্তা। এভাবে হাসান ভাইকে দোষী ভাবা কি ঠিক হচ্ছে তার? অন্তত আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ তাকে দেয়া উচিত। ঝর্ণা আপা। যেদিন খুন হন সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল তার জানা নেই, তবে সেই সঙ্গে যে তার হাসান ভাইও শেষ হয়ে গেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার প্রমাণ, নিজের সমস্ত সুন্দর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অন্য একটা মানুষে পরিণত হয়েছেন তিনি, যে মানুষটিকে শান্তা চেনে না বা শ্রদ্ধা করে না।
হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিল শান্তা। হাসান ভাই বলেছেন, তিনি তাকে বিশ্বাস করেন। সত্যি কিনা প্রমাণ হওয়া দরকার। সে যে তাঁর গোপন অপরাধের কথাটা জানে, এটা জানাবে.তাঁকে, একই সঙ্গে বলবে এখনও তাকে শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু বলে মনে করে। তারপর জিজ্ঞেস করবে, ঠিক কি ঘটেছিল সব আমাকে খুলে বলুন। সব। শোনার পর দুজন মিলে বুদ্ধি করা যাবে। হাসান ভাই যদি তাকে বিশ্বাস করে সব কথা স্বীকার করেন, তাহলে সে বিশ্বাসের মর্যাদা শান্তা রাখবে বৈকি। গোপন কথাটা কোনদিন কাউকে জানাবে না সে জানাবে তো নাই-ই, হাসান ভাই যাতে কোন বিপদে না পড়েন সেদিকটাও দেখবে।