২
সোমবার সকাল এগারোটার দিকে ফিরল হাসান, বাড়িতে তখন শান্তা ও আয়েশা বেগম যে যার কাজে ব্যস্ত। কাপড়চোপড় পাল্টেই লাইব্রেরিতে চলে এল সে, তার হাতে সিগারেট দেখে মনে মনে অবাক হলো শান্তা। কি ব্যাপার, আগে তো তাকে কখনও সিগারেট খেতে দেখা যায়নি। যে দুএকটা প্রশ্ন করল শান্তা, দায়সারা গোছের জবাব দিল সে।তারপর নিজে থেকেই বলল, শুক্রবারে বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করেছি; আজও করব—এত আগাছা জমেছে, আগে খেয়াল করিনি।
হ্যাঁ, বলল শান্তা। শনিবারে এসে দেখি আপনার বুটে কাদা লেগে রয়েছে। সাফ করার সময় গজগজ করছিলেন আয়েশা আন্টি।
কি দরকার ছিল সাফ করার, শুধু তো বাগানে কাজ করার সময় পরি। তোমার টাইপ কি রকম এগোচ্ছে, শান্তা?
প্রায় শেষ করে এনেছি। আপনার আর রিভাইজ না দিলেও চলবে বোধহয়।
সোফা ছেড়ে ডেস্কের সামনে চলে এল হাসান, টাইপ করা পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। পাতাগুলো উল্টে দেখছে, ট্রে-তে দুকাপ চা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন আয়েশা বেগম। আজ বিকেলে আমাকে ছুটি দিতে হবে, সন্ধে পর্যন্ত থাকতে পারব না–মীটিঙ আছে তো, বক্তৃতা দিতে হবে। তোমার বাবা কোন অসুবিধে হবে না তো? আমি অবশ্য তোমাদের দুজনের মত রান্না করে রেখেই যাব।
না, ঠিক আছে। রান্না…ঠিক আছে, আন্টি। ঝর্ণা কখন ফিরবে তা অবশ্য আমার জানা নেই। বোধহয় ফোন করবে।
আয়েশা বেগম কামরা থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল শান্তা, তারপর হাসানের হাতে তার চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিল, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। শনিবারে ফোন করেছিল ঝর্ণা, আপা। ভেবেছিল আপনি তখনও এখানে আছেন।
আচ্ছা! শান্তার দিকে সরাসরি তাকাল হার্সান। যে চোখ জোড়ায় স্বপ্নের ঘোর লেগে থাকতে দেখে শান্তা, এই মুহূর্তে সেখানে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, হুল ফোটাতে চাইবে বলে মনে হলো। আসলে আমিই ওকে বলেছিলাম, সিলেটে নাও যেতে পারি। তখন আমার মন-মেজাজ ভাল ছিল না।
আপা ফিরবে না বলেছে, স্পষ্ট করে বলল শান্তা।
আজ?
হাতের কাপটা নিচু তোপয়ের ওপর নামিয়ে রাখল শান্তা, খুব সাবধানে বলল, ঝর্ণা আপা কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করল। প্রথমে আমি তো তার গলা চিনতেই পারিনি। বলল, তার নাকি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই গলা ভেঙে গেছে।
গলা ব্যথা আর সর্দি তো সারা বছরই লেগে আছে তার। তা কবে ফিরবে, বলেছে কিছু?
না। মাথা নাড়ল শান্তা। শুধু বলল খবরটা যেন আমি আপনাকে জানাই। আবার টেলিফোন করবে কিনা জিজ্ঞেস করতে হাসল, তারপর বলল, তাকে শুধু বলবি আমি ফিরছি না। আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রেখে দিল রিসিভার।
কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকে হালকা লাগছে শান্তার। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল হাসান, যতক্ষণ না কেঁপে উঠল শান্তার চোখের পাতা। দৃষ্টি ফিরিয়ে ট্রের দিকে হাত বাড়াল শান্তা বিস্কিট নেয়ার জন্যে। তোমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয়েছে? জিজ্ঞেস করল হাসান।
হবে না! শুধু অদ্ভুত মনে হয়নি, আমার খুব দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। আসলে খবরটা দিতে ভুলে যাইনি, আপনাকে জানাতে ইচ্ছে করছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসান বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না ঝর্ণা সিরিয়াস কিছু মীন করেছে কিনা। শুক্রবারে তার সঙ্গে আমার। খুব এক চোট ঝগড়া হয়ে গেছে।
সিরিয়াস কিছু? মানে এত খারাপ যে…যে…।
কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছে সে-ই জানে। স্টেশনে পৌঁছে দেয়ার সময় আমার সঙ্গে কথা বলেনি।
খানিক ইতস্তত করে শান্তা বলল, আপনাদের ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিত নয়। তবু না বলে পারি না, আপনারা এভাবে ঝগড়া না করলে ভাল হত। দুজনেরই বোঝ উচিত, এতে আপনার কাজের ক্ষতি হয়। সবই আপনাদের ভাল, শুধু..।
সত্যি কি তাই? সবই আমাদের ভাল? মান হাসল হাসান। তুমি আসলে খুব সরল, শান্তা। তবে না, আমাদের ব্যাপার নিয়ে তুমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করবে না। বিবাহিত জীবন সবারই খুব জটিল, বুঝলে। যা-ই ঘটুক না কেন, আবার সব ঠিক হয়ে যায়।
এরকম ঝগড়া করতে দেখেছি আমার মা-বাবাকে। সব কিন্তু ঠিক হয়ে যায়নি, হাসান ভাই। দ্বিতীয় বিয়ে করে বাবা চলে গেলেন শহরে, দুবছর পর মারা গেলেন, অথচ আমরা খবর পেলাম এক হপ্তা পর। তখন আমার বয়েস মাত্র বারো কি তেরো।
সবার কেস এক রকম নয়, স্বীকার করছি। তবে আমার নার্ভ ইস্পাতের মত শক্ত। তুমি বিশ্বাস করো?
মাথা নাড়ল শান্তা। না, করি না। হাসছে সে।
অপেক্ষা করো, দেখে অবাক হয়ে যাবে। সে যাই হোক, একটা কথা জেনে রাখখা, তোমার আপা ফিরছে না জেনেও আজ অন্তত আমার নার্ভের কোন ক্ষতি হবে না। আরও কদিন দেখব, না ফিরলে টেলিফোন করা যাবে। সে না থাকায় শান্তিতে কাজ করার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে।
ব্যাপারটাকে হাসান হালকাভাবে নেয়ায় খুশি হলো শান্তা।
হাতঘড়ির ওপর চোখ রাখল হাসান। পাতা দুয়েক ডিকটেট করার সময় এখনও আছে। তারপর তোমার টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলো একবার রিভাইজও দেব। হেসে ফেলল সে। এমন নিখুঁত টাইপ করা লেখা কাটাকাটি করতে সত্যি খুব খারাপই লাগে আমার।
টাইপিস্টের টাইপিং সুন্দর বলে লেখক তাঁর লেখা কাটাকাটি করবেন না, লোকে শুনলে পাগল ভাববে। কিন্তু কাটাকাটি করতে হবে কেন বলুন তো?
তমার চরিত্রটা ঠিক ফুটছে না। মামুনের আচরণ যতই অদ্ভুত। বা অযৌক্তিক হোক, তার ওপর তমার বিশ্বাস থাকা দরকার।
হ্যাঁ, তাহলে আরও বাস্তব হবে চরিত্রটা।
তোমার প্রতিক্রিয়াও কি তাই হত, তুমি যদি কারও প্রেমে পড়তে?
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে শান্তা বলল, বোধহয়। হাসান ব্যক্তিগত উদাহরণ টানায় অস্বস্তিবোধ করছে সে।
তাহলে কিছু দূর অন্তত তোমাকেই মডেল ধরে লিখে যাই।
আমাকে মডেল ধরে? কিন্তু আপনি তো আমার চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
হাসান হাসল না। ঝর্ণাও বলছিল, মেয়েদের সম্পর্কে আমার নাকি কোন ধারণাই নেই। বিশেষ করে আধুনিক মেয়েদের সম্পর্কে। আমার একমাত্র অজুহাত হলো, বছরের পর বছর এমন মারাত্মক আর্থিক সংকট গেছে, সবচেয়ে কম আবদার করে এমন মেয়েকেও ভয় পেতাম আমি। তারপর লিখে টাকা কামাতে শুরু করলাম যখন, দেখা হলো ঝর্ণার সঙ্গে। আর তাকে বুঝতে পারাটা হিল, একটা হোল-টাইম জব। এমনকি এখনও আমি তার গভীরে পৌঁছুতে পারিনি।
আমরা, মেয়েরা, স্রেফ হিউম্যান বীংস, হাসান ভাই, নরম সুরে বলল শান্তা। পুরুষদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নই। বলতে চাচ্ছি, পুরুষরা আমাদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়।
জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোয় তা কিন্তু বলা হয় না। লেখকরা মেয়েদেরকে রহস্যময়ী দেখাতে পছন্দ করেন।
তা পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা সত্যি নয়।
তারমানে নিজেকে তুমি রহস্যময়ী বলে মনে করো না? অবশ্যই না।
খোলা একটা বই? তুমি যা ভাবো তাই বলো, আর তোমার ভাবনাগুলো স্বচ্ছ। তমার চরিত্র সম্পর্কে যা বলেছ, আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেছ। তুমি যদি কাউকে ভালবাস, তাকে তুমি বিশ্বাস করবে, তার পাশে দাঁড়াবে, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন?
হ্যাঁ, থাকব তার পাশে, যদি তাকে আমি ভালবাসি। ভালবাসার প্রশ্ন বাদ দিন, শুধু যদি তাকে পছন্দও করি, তবু তার ওপর আমার বিশ্বাস থাকবে।
তোমাকে পরীক্ষায় ফেলা গেলে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার হত।
কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল শান্তা। আমার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভুলে গিয়ে হাতের কাজটা শেষ করলে হত না?
তোমাকে আমি অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। কিংবা হয়তো বিরক্ত করছি-সেটা আরও খারাপ। টাইপ করা কাগজগুলো আবার ওল্টাতে শুরু করল হাসান। শোনো, বাহান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত ঠিক আছে সব, পরবর্তী পরিচ্ছেদে তমার চরিত্র খানিক বদলাতে হবে। তুমি তৈরি থাকলে আমি ডিকটেট করতে পারি।
শুরু করুন, বলে টাইপরাইটারের সামনে গিয়ে বসল শান্তা। গল্পগুজব বন্ধ হওয়ায় স্বস্তিবোধ করছে সে।
ধীরে ধীরে পার হয়ে যাচ্ছে হপ্তাটা। রোজই ডিকটেট করে হাসান, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টাইপ করে শান্তা, কাজ শেষে টাইপরাইটারে কাভার লাগিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
ঝর্ণার কথা প্রায় তোলেই না হাসান, তবে তার অনুপস্থিতিতে দিনে দিনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে শান্তা। এর আগেও ঢাকায় গিয়ে থেকেছে সে, এমনকি এবারের চেয়ে বেশি দিন, তবে প্রতিবারই জানা ছিল কবে সে ফিরে আসবে। এবারের ব্যাপারটা সেরকম নয়। হপ্তার শেষ দিকে একদিন আশা ভিলায় ঢুকে শান্তা দেখল, টেলিফোনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাসান। কথা শেষ করে রিসিভার রেখে দিল সে, ফিরল শান্তার দিকে। তার চেহারায় দুশ্চিন্তার রেখা দেখতে পেল শান্তা। এইমাত্র হাসি সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা হলো, বলল হাসান।
ঢাকায় ওঁদের বাড়িতেই তো উঠেছে আপা, তাই না?
আমি তাই ভেবেছিলাম, বলল হাসান। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমার ধারণা ভুল।
ভুল মানে? আপা ওখানে ওঠেনি? কিন্তু আমাকেও তো বলেছিল যে ঢাকায় গেলে ওখানে থাকবে!
যায়নি ওখানে। তারমানে সিদ্ধান্ত পাল্টেছে। হাসি সিদ্দিকী বলছেন, শুক্রবারে ঝর্ণা তাকে ফোন করেছিল, সন্ধের দিকে। ফোন করে বলে, তার ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই রওনা হতে পারছে না।
কোত্থেকে ফোন করেছিল? এখান থেকে? হাসি সিদ্দিকী তা জানেন না, ঝর্ণাকে তিনি জিজ্ঞেস করেননি। ধরে নিয়েছিলেন এখান থেকেই কথা বলছে সে। তবে বোধহয় ঢাকা থেকেই করেছিল। নিশ্চয় তাই।
কিন্তু কেন?
কি করে বলব বলো। ওখানে যায়নি শুনে বুকে রীতিমত একটা ধাক্কা খেলাম। হাসি সিদ্দিকী কি না কি ভেবে বসেন, তাড়াতাড়ি
একটা গল্প বানিয়ে বলতে হলো।
আপা ঢাকায় গেল অথচ হাসি সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করল না, এরকম তো হবার কথা নয়। আমাকে বলছিল, দুমাসের জন্যে স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় বেড়াতে চলে যাচ্ছে হাসি, যাই একবার দেখা করে আসি। উনিই তো আপার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, তাই না?
হ্যাঁ। খুবই আশ্চর্য লাগছে আমার। তবে কোন পরিস্থিতিতে কি ঘটেছে, জানি না আমরা। ঢাকায় তোমার আপার আরও তো বন্ধুবান্ধব আছে, হয়তো তাদের সঙ্গে ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে চলে গেছে। দেশের বাইরেও যেতে পারে।
দেশের বাইরে? আপা কি সঙ্গে করে পাসপোর্টও নিয়ে গেছেন?
কোথাও গেলে পাসপোর্ট সঙ্গেই রাখে সে। ওর একার পাসপোর্ট ওটা, বিয়ের আগে করা।
চুপ করে থাকল শান্তা। এই প্রথম ঝর্ণা আপার ওপর রাগ হচ্ছে তার। এক সময় মন্তব্য করল, কাজটা আপা ভাল করেননি। এর মানে হলো আপনাকে কষ্ট দেয়া।
ঠিক বলেছ। তবে তোমার আপা বরাবরই একটু নিষ্ঠুর ট্রাইপৈর। কথাটা এভাবে বলা যায়, সে সদয় হবার ভান কখনোই করে না। কোমলতা জিনিসটা তার দৃষ্টিতে দুর্বলতা।
কিন্তু আমার সঙ্গে সব সময় আপা নরম ব্যবহার করে, বলল শান্তা।
শান্তার দিকে ফিরল হাসান, তার চেহারায় মায়া মায়া ভাবটা হঠাৎ পুরোপুরি ফিরে এল। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমি এ-কথা বলিনি যে ঝর্ণা মানুষকে পছন্দ করে না। আর তোমাকে তো বিশেষভাবে পছন্দ করে। কেই-বা তোমাকে অপছন্দ করবে। তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।
লজ্জা পেল শান্তা, তাড়াতাড়ি বলল, সবাই আপনার সঙ্গে একমত হবে না। একটু থেমে আবার বলল, সত্যি আপনার জন্যে আমার খুব খারাপ লাগছে। আপাটা যে কি না, শুধু শুধু আপনাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে মজা পায়।
সে চাইছে বটে আমি দুশ্চিন্তা করি, তবে তার আশা আমি পূরণ করছি না, বলল হাসান। এসো, তার কথা আমরা বরং ভুলে থাকি। তুমি জানো না, কিছু দিন ধরে কি অশান্তির মধ্যে রেখেছিল আমাকে সে। বাড়িটা এখন শান্ত হয়েছে, আমিও শান্তিতে আছি। অনেক দিন পর কাজ করার একটা পরিবেশ পাওয়া গেছে। এবার বইটা ভালভাবে লেখা যাবে।
হ্যাঁ, আধুনিক প্রেমের ওপর এটাই আপনার প্রথম উপন্যাস। পটভূমিটা আমার খুব পছন্দ। কিন্তু, হাসান ভাই, আপার খোঁজখবর নেয়া দরকার না?
কি করার আছে আমার বলো? ঢাকার সবাইকে ফোন করে লোক হাসাক তার মানে হবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানো যে আমরা সুখী নই।
হ্যাঁ, কিন্তু…।
বলো তুমি কি ভাবছ। শান্তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল হাসান।
আমি ভাবছি…না, মানে, কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
সেরকম কিছু ঘটলে জানা যেত। ঢাকার কাগজ দিনেরটাই তো পাচ্ছি, হাসপাতাল থেকে ফোন আসতে পারত…।
হ্যাঁ, তা-ও ঠিক। হাসান ভাই…।
উঃ?
এসব হয়তো আমার ছেলেমানুষি, আমি হয়তো একটু বেশি রোমান্টিক, তবে যতই ঝগড়াঝাটি করুন আপনারা, আমার ভাবতে ইচ্ছে করে আপনারা পরস্পরকে প্রচণ্ড ভালবাসেন। জানি আপা খুব মেজাজী মানুষ, হার মানতে একদম রাজি নয়, কিন্তু তারপরও যত দেখি ততই মুগ্ধ হই, কি আছে বলতে পারব না অকালেই ভাল লাগে, কথা বললে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। আপনিও তো আপার সমস্ত জেদ বেশিরভাগ সময় মেনেই নেন। আপনি যে তাকে সত্যি ভালবাসেন…।
সব জিনিসেরই একটা সীমা আছে, শান্তা, মান গলায় বলল হাসান। ভালবাসা থাকলে অত্যাচার সহ্য করা যায় ঠিকই, কিন্তু কতদিন?
হ্যাঁ, তা ঠিক। যাই হোক, এ-সব আপনাকে আমার বলা উচিত হলো না। টাইপরাইটারের দিকে ঘুরল শান্তা, কিন্তু হঠাৎ অনুভব করল পিছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখল হাসান।
শান্তাকে নিজের দিকে ফেরাল সে। আজ লেখালেখি বাদ দিই এসো। আমার ভাল লাগছে না।
তাহলে বাগানে গিয়ে মাটি কোপান, কিংবা কোথাও থেকে খানিক হেঁটে আসুন।
না। তোমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি খুব বুদ্ধিমতী, তোমার পরিমিতি বোধও দারুণ। কেউ তোমাকে ব্যক্তিগত কোন কথা বললে সেটা গোপন থাকবে। তোমার আপার জীবনের কোন কথা বললে সেটা গোপন থাকবে। তোমার আপার জীবনের কোন কথা নয়, আমার নিজের কথা বলব তোমাকে। তাহলে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
কিন্তু…কিন্তু সেটা কি উচিত হবে? পরে হয়তো পস্তাবেন আপনি।
জানি কি বলতে চাইছ। মানুষ ঝোঁকের মাথায় এমন সব কথা বলে ফেলে যা বলা উচিত নয়। তবে আমার ব্যাপারটা অন্যরকম। গত আট-দশ মাসে আমাদের দুজনেরই খুব কাছাকাছি চলে এসেছ তুমি। যদিও তুমি ঝর্ণার বোন, তার সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক, তাসত্ত্বেও আমার ভাবতে ভাল লাগে তুমি তার চেয়ে আমারই বেশি আপন। তুমি আমার কাজের অংশীদার।
যদিও কোন অবদান রাখতে পারি না, বলল শান্তা।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছ। তোমার সাজেশনকে আমি মূল্য দিই। শান্তা, নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখতে চেয়ো না, আমার ওপর তাহলে অন্যায় করা হবে।
হাসান ভাই, এসব কি বলছেন আপনি! অস্থির, দিশেহারা বোধ করছে শান্তা। তার ভয় লাগছে, একটা যোতের মধ্যে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে সে-ও না ভেসে যায়। আবার নিরাপদ তীরে দাড়িয়ে থাকতে আরও বেশি ভয় পাচ্ছে, হাসান ভাই না তার কাছ থেকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যান। উনি কি বলতে চান শোনা দরকার তার।
বলার খুব বেশি কিছু নেই, বলল হাসান, সামান্য তিক্ত হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। ঝর্ণাকে আমি পাগলের মত ভালবেসেছিলাম, এখন তারই খেসারত দিতে হচ্ছে আমাকে। ভুলে গিয়েছিলাম আমি একজন লেখক, সেই সঙ্গে আমি একজন পুরুষও তো। নিজের অহম থেকে ভাল কিছু উদ্ধার করতে পারে শুধু একজন লেখক, তবে তার জন্যে সময় আর পরিবেশ থাকা চাই। ঝর্ণার সঙ্গে জীবন। কাটাতে হলে এ-সব আমি কোনদিনই পাব না। ইদানীং ব্যাপারটা সমস্ত সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। শুক্রবারে তাকে আমি বলেছি, আমি আর তার মেজাজ সহ্য করতে রাজি নই। অত্যাচার যদি করতেই চায়, অন্য কাউকে খুঁজে নিতে হবে।
হাসান ভাই, আপাকে আপনি ভুল বুঝছেন। প্রতিবাদ করল শান্তা। তার শুধু মেজাজটা দেখছেন আপনি, ভাল দিকগুলো…
ভাল দিক যদি কিছু থাকে তা সম্ভবত অন্য কোন লোকের জন্যে তুলে রেখেছে সে, আমার জন্যে নয়। এ-কথা বলাতেই। আমার ওপর খেপে দূরে সরে গেছে। এবার একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে, শান্তা। মনের গভীরে সত্যি যদি আমার প্রতি তার কোন টান থাকে, ফিরে আসবে সে, ফিরে আসবে সম্পূর্ণ নতুন একজন ঝর্ণা হয়ে।
মানুষ কি চাইলেই নিজেকে বদলাতে পারে?
চেষ্টা করতে পারে, প্রমাণ করতে পারে চেষ্টা করছে।
আর যদি আপনার ধারণা ভুল হয়, হাসান ভাই? ধরুন আপাকে আপনি যেমন চিনেছেন সেটাই তার আসল রূপ?
সেক্ষেত্রে তার আর ফিরে না আসাই ভাল। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
নিজেকে আমার অসুখী লাগছে, মনের অবস্থা সরল ভাষায়, প্রকাশ করল শান্তা। এত ভাল লাগত আপার প্রতি আপনার…নিষ্ঠা। ভাবতাম, এ-সব সহ্য করার ফল একদিন অবশ্যই আপনি পাবেন, আপা সুস্থ হয়ে গেলে ঠিকই আপনার দিকে খেয়াল দেবে।
সুস্থ হয়ে গেলে মানে? তার চোখে তো আসলে কিছুই হয়নি।
তা জানি। আপাও তা জানে। আমাকে বলেছে, রোগটা আসলে হয়েছে স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হাসান। তুমি আমাকে শুধু ঝর্ণার স্বামী হিসেবে না দেখলে খুশি হতাম, তার গলায় খানিকটা অসন্তোষ।
তা কেন দেখব। আপনি মানুষ হিসেবে আমার আদর্শ। আপনি খুব উঁচুদরের একজন লেখকও বটেন। আপাও তা জানে। তার মেজাজ বা অত্যাচার সম্পর্কে যা বললেন তা আংশিক সত্যি হতে পারে…।
শান্তাকে থামিয়ে দিয়ে হিসহিস করে উঠল হাসান, তাকে তুমি চেনো না তাই এ-কথা বলছ। তোমার আপা সাংঘাতিক আত্মসচেতন মেয়ে, শুধু নিজের কথা ভাবে। এমনকি…এমনকি আমাদের ঘনিষ্ঠ সময়গুলোয়ও নিজের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।
প্লীজ, চুপ করুন! নিজের অজান্তেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল শান্তা।
হাসানের হাত দুটো এখনও শান্তার কাঁধে। এবার একটা হাত অনাবৃত ঘাড়ের ওপর চলে এল। এক মুহূর্ত নরম নগ্ন চামড়ার ওপর স্থির হয়ে থাকল আঙুলগুলো, তারপর হাতটা তুলে নিল সে। স্বস্তিবোধ করল শান্তা; কিন্তু তার সঙ্গে যেন মিশে রয়েছে বঞ্চিত হবার একটা অস্পষ্ট বেদনা।
আমার ভুল হয়েছে, বিষন্ন সুরে বলল হাসান। বিশ্বাস করো, ঝর্ণার বিরুদ্ধে তোমার মনটাকে আমি বিষিয়ে তুলতে চাই না।
তোলেনওনি। আমি মেয়ে বলেই বোধহয় আপাকে বোঝ আমার পক্ষে সহজ। গোটা ব্যাপারটা অবশ্য খুবই দুঃখজনক।
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকায় হাসানের চোখের তারায় ঝিক করে ওঠা কৌতুক দেখতে পেল না শান্তা। তবে শুনতে পেল সে বলছে, আরও হপ্তাখানেক চুপ করে থেকে দেখি না কি করে। ফিরে যদি না-ও আসে, অন্তত একটা চিঠি তো লিখবে।
প্রায় এক মাস হতে চলল অথচ মেয়েটা ফিরছে না, গজ গজ করছেন আয়েশা বেগম। জিজ্ঞেস করলেই তোর দুলাভাই বলে কবে ফিরবে তার জানা নেই। কিন্তু এ তো আর মেনে নেয়া যায় না, শান্তা। তুই যা-ই বলিস বাপু, এর মধ্যে নিশ্চয়ই গভীর কোন ষড়যন্ত্র আছে। তার কিছু না হলে অন্তত একটা চিঠি তো লিখত!
আপনি জানলেন কিভাবে লিখেছে কিনা? জিজ্ঞেস করল শান্তা।
লিখলে তোর দুলাভাই তোকে অন্তত বলত। বলেছে কি?
না। কিন্তু আমাকে কেন বলতে যাবে?
শান্তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আয়েশা বেগম বললেন, এবাড়িতে মেয়েদের প্রতি যে গভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছে, তোকেও তাতে জড়ানো হবে বলে আমার ধারণা।
আপনার ধারণা নিয়ে থাকুন আপনি। শুধু দয়া করে এসব কথা হাসান ভাইয়ের সামনে বলবেন না। ঝর্ণা আপা এখান থেকে গিয়ে পরদিনই আমাকে টেলিফোন করেছিল, বলেছে ফিরতে তার দেরি হবে।
কিন্তু বেশিদিন থাকতে হলে তো সঙ্গে করে বেশি করে কাপড়চোপড় নিয়ে যাবে। তা তো নিয়ে যায়নি। আমি তাকে ছোট্ট একটা স্যুটকেস গোছাতে দেখেছি। শাড়ি নিয়ে গেছে মাত্র দুটো। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, অথচ গরম শাল বা কোট কিছুই তো নেয়নি।
ঢাকা থেকে হয়তো কিনে নেবে, বলল শান্তা।
বাড়িতে এ-সব থাকা সত্ত্বেও শুধু শুধু পয়সা খরচ করবে?
কিংবা হয়তো কিনবে না, বান্ধবীদের কাছ থেকে চেয়ে নেবে।
দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল হাসান। মাথায় ঘোমটা টেনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন আয়েশা বেগম। মনে হলো তোমরা
যেন গোপন কিছু আলাপ করছিলে? জিজ্ঞেস করল হাসান।
না, আন্টি বলছিলেন হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে, কোট বা শাল নেয়নি বলে আপা খুব কষ্ট পাবে।
দেখো দেখি কাণ্ড, কি ভুলো মন আমার! বাম হাতের তালুতে ডান হাত দিয়ে ঘুসি মারল হাসান। কাল সন্ধের দিকে ঝর্ণা ফোন করেছিল আমাকে, বলল তার কাপড়চোপড়গুলো যেন পাঠিয়ে দিই। বিশেষ করে নতুন ঘাগরা সেটটা।
খুশিতে নেচে উঠল শান্তার চোখ। সত্যি? আপা ফোন করেছিল? কি বলল? কেমন আছে আপা? ইস, আমার কি যে ভাল লাগছে! শান্তা অনুভব করল তার কাঁধ থেকে যেন ভারি একটা বোঝা নেমে গেছে।
ভাল লাগছে ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে বলে তো? আমারও। এরকম একটু কষ্ট পাওয়াই দরকার তার। হেসে উঠল হাসান।
হাসান ভাই, আপনি জানেন আমি তা বোঝাতে চাইনি। আমি খুশি হয়েছি আপা যোগাযোগ করায়। আপনিও নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কবে আসছে আপা?
কি জানি। এ-সব যখন পাঠাতে বলছে, তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে মনে হয় না। শান্তার দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকল হাসান, তারপর জানতে চাইল, তুমি কি সত্যি চাও তাড়াতাড়ি এখানে আবার ফিরে আসুক সে?
কি বলছেন! অবশ্যই চাই! হাসানের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে অন্য দিকে তাকাল শান্তা।
অথচ সে না থাকায় এখানে আমরা ভালই সময় কাটাচ্ছি, তাই? কাজও খুব ভাল এগোচ্ছে। বিলে পাখি শিকার করতে যাব আমি, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে বলে কথা দিয়েছ। নাকি ভুলে গেছ?
না, ভুলব কেন।তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান্তা, অনুভব করছে হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে পরিবেশটা। কি কি চেয়েছে আপা বলুন, স্যুটকেসে ভরে দিই, কিভাবে পাঠাবেন?
পাঠাব না, কাল আমি নিজেই ঢাকায় নিয়ে যাব। কথা হয়েছে, সালাম রোড ট্রান্সপোের্ট-এর অফিসে দেখা হবে আমাদের। তোমার আপা বোধহয় কোলকাতায় যাবে, তার কজন বন্ধুর সঙ্গে। ওদের কাউকে আমি চিনি না, তবে তার নাকি খুব ঘনিষ্ঠ তারা।
ও।
তারপর হাসান বলল, আমার আসলে সব কথা খুলে বলা দরকার। ঠিক কোথায় যাচ্ছে সে, আমি আসলে সঠিক জানি না, কোথায় আছে তা-ও জানি না। বলেছে ট্রান্সপোর্ট অফিসে দেখা করার চেষ্টা করবে, আবার এ-কথাও বলেছে যে দেখা না হলে আমি যেন স্যুটকেসটা ওই অফিসেই জমা রেখে আসি। টিকেটটা রমনা পোস্টাপিসের একটা পোস্ট-বক্সে পাঠিয়ে দিলেই হবে।
আশ্চর্য! এর মানে কি? হতভম্ব দেখাল শান্তাকে।
সে যদি দেখা করতে না চায়, ঠিকানা দিতে না চায়, আমি কি করতে পারি, বলো?।
তারমানে কি আপা আর…আপনাদের মধ্যে এ কি ঘটছে বলুন তো!।
কাঁধ ঝাকিয়ে অসহায় ভঙ্গি করল হাসান। তুমি যেখানে আমিও সেখানে। ফোনে ঝর্ণা আমার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি।
কিন্তু তাই বলে আপনি কিছু করবেন না? গত এক মাসে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাকে দেখেছে। সেই যে মেয়েটা, আপার ভক্ত, সব সময় যাকে সাহায্য করে.সোহানা। ফেরত পাবে না জেনেও প্রায়ই যাকে টাকা ধার দেয়। প্রতি হপ্তায় পরস্পরকে চিঠি লেখে ওরা। আপা ঢাকায় গেলে তার সঙ্গে তো যোগাযোগ করবেই।
মাথা ঝাঁকাল হাসান।
তার ঠিকানা তো আমাদের কাছে আছেই, বলল শান্তা।
তা আছে। বেশ, কাল তোমার আপার সঙ্গে দেখা না হলে সোহানার বাড়িতে যাব আমি। তুমি ঠিকই বলেছ, শান্তা। সত্যি এবার একটা কিছু করা দরকার আমার। ব্যাপারটা আর এভাবে পুলিয়ে রাখা যায় না।
শান্তা উপলব্ধি করল, বলার মত কিছু নেই তার। খুব ভয় করছে, মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের যে করুণ ঘণ্টা বাজছে, তার মধ্যে ওরও সূক্ষ্ম একটা ভূমিকা রয়েছে। সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাপার হলো, হাসান ভাইয়ের প্রতি নির্লিপ্ত থাকতে পারছে না সে। এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত আমার, ভাবল সে। আপা নেই, কাজেই হাসান ভাইয়ের কাছাকাছি আমারও থাকা উচিত নয়। কিন্তু কিভাবে সরব আমি? কোথায় যাব? শান্তা কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার খুব সকালে ঢাকায় চলে গেল হাসান। সন্ধের দিকে নিজেদের বাড়িতে রয়েছে শান্তা, কয়েকটা ব্লাউজের কাপড় নিয়ে হাজির হলেন ইসমত আরা, ফারুনী ইসলামকে, দিয়ে সেলাই করাবেন। মা ও মেয়ে, দুজনেই তখন রান্নাঘরে। ব্লাউজের মাপ দেয়ার সময় বক বক শুরু করলেন তিনি। এক মাসের বেশি হয়ে গেল ঝর্ণা নিখোঁজ। মেয়েটা মারা গেছে কিনা তাই বা কে বলবে?
পরশুদিন তো বেঁচে ছিল, ঠাণ্ডা সুরে বলল শান্তা। চুলোর দিকে পিছন ফিরে বসে চুল শুকাচ্ছে সে, অনেক দিন পর আজ শ্যাম্পু দিয়েছে মাথায়। ফোন করে কিছু কাপড়চোপড় চেয়েছে। বিশেষ করে লাল-সোনালি কাজ করা ঘাগরা সেটটা। কথাটা বলল শান্তা একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাওয়ায়। ঘাগরার ডিজাইন এত সুন্দর, যে দেখবে তারই লোভ হবে। ইসমত আরার বয়েস পঁয়ত্রিশের কম নয়, তিনিও ঝর্ণার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কোথেকে ওটা বানানো হয়েছে। কিন্তু মহিলাকে সম্ভবত পছন্দ করে না বলেই টেইলারিং শপের নামটা তাকে বলেনি ঝর্ণা। হাসান ভাই আজ সকালে ওগুলো নিয়ে গেছেন।
ইসমত আরা হতাশ হলেন। যা শুনছি সবই তাহলে গুজব? ওদের ছাড়াছাড়ি হচ্ছে না? আমি ভাবলাম আবার বোধহয় ভাঙল ঘর।
আবার ঘর ভাঙল মানে? জিজ্ঞেস করল শান্তা, এবার ফাল্গুনী ইসলামও হাতের কাজ বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন। হেসে, উঠলেন ইসমত আরা। আপনারা জানেন না? হঠাৎ ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। খালাম্মা, আপনার হাতে সুঁই নাকি? বিধছে তো!
ও, হ্যাঁ, ছি-ছি! দেখতে পাইনি, মা! বললেন বটে, তবে ফাল্গুনী ইসলামের চেহারায় সহানুভূতি ফোটেনি।
আপনাদের না জানাটা খুব অদ্ভুত, ইসমত আরা বললেন। ঝর্ণার প্রথম বিয়েটা হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। কিন্তু সে বিয়েও সুখের হয়নি। ছেলেটা টিভিতে অভিনয় করত, তবে নাম করতে পারেনি। কি কারণে জানি না, ঝর্ণাকে ছেড়ে চলে যায় সে। স্বামী ত্যাগ করায় সাংঘাতিক মুষড়ে পড়েছিল ঝর্ণা। এই ঘটনার কয়েক হপ্তা পর ভারত থেকে খবর আসে, পশ্চিমবঙ্গের দিঘা থেকে, সাগরে ডুবে মারা গেছে সে। সে-সময় একটা সিনেমায় কাজ করছিল ঝর্ণা, স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে, ফলে ছবিটা আর করতে পারেনি। বাপ টাকা রেখে গেছে, নাচ-গান জানা শিক্ষিত মেয়ে, ঢাকা ও কোলকাতার শিল্পীদের সঙ্গে খাতির আছে; ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে না পারলেও অসুবিধে হয়নি। আমার জানা মতে, কোলকাতায় বা দিঘায় এক বান্ধবীর বাড়িতে বেশ কয়েক মাস ছিল সে। আরও পরে আমাদের লেখক সাহেবের লেখা একটা নাটকে অভিনয় করার জন্যে ডাকা হয় তাকে অভিনয় খারাপ করেনি, তবে, আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে ঝর্ণা। তারপর কি হলো আমরা সবাই তা জানি।
কোন মন্তব্য না করে বিস্ময়কর খবরটা শুনে গেল মা ও মেয়ে। তবে প্রিয় লেখক সাঈদ হাসানের প্রতি শান্তার শ্রদ্ধা আরও যেন বেড়ে গেল। তার ঝর্ণা আপার প্রতি হাসান ভাই কতটা সদয়। ঝর্ণা আপার ক্ষতবিক্ষত জীবনটা মেরামত করার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন তিনি, সে যাতে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে পারে সুখের ঘর। অথচ বিনিময়ে ঝর্ণা আপা তার সঙ্গে কি আচরণটাই না করছে।
বিদায় নেয়ার আগে ইসমত আরা বললেন, হয়তো সত্যিই ঝর্ণা ফোন করেছে। হয়তো জামাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই ঢাকায় গেছে। তবে আবার এ-ও হতে পারে যে ঝর্ণা হয়তো তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, কিংবা তার মাথায় কোন গোলমাল দেখা দিয়েছে। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে গোটা ব্যাপারটাই তার স্বামীর একটা চাল। আজকাল কিছুই বলা যায় না।