তারিণীখুড়ো ও বেতাল

তারিণীখুড়ো ও বেতাল

শ্রাবণ মাস, দিনটা ঘোলাটে, সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, তারই মধ্যে সন্ধ্যের দিকে তারিণীখুড়ো এসে হাজির। হাতের ভিজে জাপানী ছাতাটা সড়াৎ করে বন্ধ করে দরজার পাশটায় দাঁড় করিয়ে রেখে তক্তপোষে তাঁর জায়গাটায় বসে তাকিয়াটা টেনে নিয়ে খুড়ো বললেন, ‘কই, আর সবাইকে ডাক, আর নিকুঞ্জকে বল নতুন করে জল ফুটিয়ে এক কাপ চা করতে।’

লোড শেডিং, তাই বসবার ঘরে দুটো মোমবাতি জ্বলছে, তাতে থমথমে ভাবটা ত কমেইনি, বরং বেড়েছে।

নিকুঞ্জই জল চাপিয়ে পাড়ার এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে ন্যাপ্‌লা, ভুলু, চটপটি আর সুনন্দাকে ডেকে আনল। ন্যাপ্‌লা এসেই বলল, ‘এই বাদলা দিনে মোমবাতির আলোয় কিন্তু—’

‘ভূতের গল্প ত?’

‘মানে, যদি আপনার স্টকে আর থাকে। দুটো গল্প ত অলরেডি বলা হয়ে গেছে।’

‘আমার স্টক? আমার যা স্টক তাতে দুটো আরব্যোপন্যাস হয়ে যায়।’

‘তার মানে টু থাউজ্যাণ্ড অ্যাণ্ড টু নাইটস্‌?’

আমাদের মধ্যে ন্যাপ্‌লাই খুড়োর সঙ্গে তাল রেখে কথা বলতে পারে।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ বললেন খুড়ো। ‘তবে সব যে ভূতের গল্প তা নয় অবশ্যই।’

এখানে বলে রাখি যে তারিণীখুড়োর গল্পগুলো এত জমাটি হয় যে সেগুলো গুল না সত্যি সে কথাটা আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করি না। তবে এটা জানি যে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ঘোরার ফলে খুড়োর অভিজ্ঞতার স্টক অফুরন্ত।

‘আজকে কিসের গল্প বলবেন?’ জিগ্যেস করল ভুলু।

‘আজকেরটা ভূতেরও বলতে পারিস, কঙ্কালেরও বলতে পারিস।’

‘কঙ্কাল আর ভূত যে এক জিনিস সেটা ত জানতাম না,’ বলল ন্যাপ্‌লা।

‘তুই আর কী জানিস রে ছোকরা? এক জিনিস না হলেও একেক সময় এক হয়ে যায়। অন্তত আমি যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি তাতে তাই হয়েছিল। শোনার যদি সাহস থাকে তোদের ত বলতে পারি।’

আমরা পাঁচজনে একসঙ্গে পর পর তিনবার ‘আছে!’ বলার পর খুড়ো শুরু করলেন।

আমি তখন মালাবারে এলাচের ব্যবসা করে বেশ দু’ পয়সা কামিয়ে আবার ভবঘুরে। কোচিন থেকে গেলুম কোয়েম্বাটোর, সেখান থেকে ব্যাঙ্গালোর, ব্যাঙ্গালোর টু কুর্নুল, কুর্নুল টু হায়দ্রাবাদ। ফার্স্ট ক্লাস ছাড়া ট্রেনে চড়ি না, ভালো হোটেলে থাকি, শহরে ঘোরার ইচ্ছে হলে ট্যাক্সি ডাকি। হায়দ্রাবাদে যাবার ইচ্ছে ছিল সালার জাং মিউজিয়মটা দেখার জন্য। স্রেফ একজন লোকের সংগ্রহ থেকে একটা পুরো মিউজিয়ম হয়ে যায় সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মিউজিয়ম দেখে গোলকোণ্ডায় একটা ট্রিপ মেরে আবার বেরিয়ে পড়ব ভাবছি, এমন সময় লোকাল কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে মনটা চনমন করে উঠল। হায়দ্রাবাদেরই আর্টিস্ট ধনরাজ মার্তণ্ড একজন মডেল চাইছেন পৌরাণিক ছবি আঁকার জন্য। তোরা রবিবর্মার নাম শুনেছিস কিনা জানি না। রাজা রবিবর্মা। ট্রাভাঙ্কোরের এক রাজবংশের ছেলে ছিলেন। পৌরাণিক ছবি এঁকে খুব নাম করেছিলেন গত শতাব্দীর শেষ দিকটায়। ভারতবর্ষের বহু রাজারাজড়ার বাড়িতে দেখতে পাওয়া যায় তাঁর আঁকা সব অয়েল পেন্টিং। কতকটা রবিবর্মার স্টাইলের ছবি আঁকে এই ধনরাজ মার্তণ্ড, আর আমি যখনকার কথা বলছি, বছর পঁয়ত্রিশ আগে, তখন লোকটার খুব নাম, খুব পসার। তার এই বিজ্ঞাপনটা দেখে বেশ একটা জোরালো প্রতিক্রিয়া হল। পুরুষ মডেল চেয়েছে, চেহারা ভালো হওয়া চাই, রোজ সিটিং দিতে হবে, উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবে। তোদের ত বলেইছি, সে বয়েসে আমার চেহারা ছিল লাইক এ প্রিন্স। তার উপর ডন-বৈঠক দেওয়া শরীর। গায়ে জোব্বা, মাথায় মুকুট আর কোমরে তলোয়ার দিয়ে যে-কোনো নেটিভ স্টেটের সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া যায়। যাই হোক, অ্যাপ্লাই করে দিলুম, আর ডাকও এসে গেল সাতদিনের মধ্যে।

নতুন খুরে দাড়ি কামিয়ে ভালো পোশাক পরে দুর্গা বলে হাজির হলুম মার্তণ্ডের অ্যাড্রেসে। বাড়িটা দেখেই মনে হল এককালে কোনো নবাবের হাভেলি-টাভেলি ছিল। চারিদিকে মার্বেল মোজেইক নকসার ছড়াছড়ি। পৌরাণিক ছবিতে যে ভালো রোজগার হয় সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

উর্দিপরা বেয়ারা এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে বসাল একটা সারি সারি চেয়ার পাতা ঘরে। সেখানে জনা পাঁচেক ক্যানডিডেট অপেক্ষা করছে, যেন ডাক্তারের ওয়েটিং রুম। এদের মধ্যে একজনের চেহারাটা চেনা চেনা লাগলেও সে যে কে তা ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমি বসার মিনিট খানেকের মধ্যেই সে লোকের ডাক এল। বেয়ারা ঘরে ঢুকে ‘বিশ্বনাথ সোলাঙ্কি’ বলতেই চিনে ফেললুম লোকটাকে। ফিল্ম পত্রিকায় এঁর ছবি দেখেছি। কিন্তু তাহলে আবার চাকরির জন্য দরখাস্ত করা কেন?

কৌতূহল হওয়াতে আমার পাশে বসা ভদ্রলোকটিকে জিগ্যেস করলুম, ‘আচ্ছা, যিনি এক্ষুনি উঠে গেলেন, তিনি বোধহয় একজন ফিল্মস্টার, তাই না?’

ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, ‘স্টার হলে কি আর এখানে দেখতে পেতে? হতে চেয়েছিল স্টার, কিন্তু তিনটি ছবি পর পর মার খাওয়াতে এখন অন্য রাস্তা দেখছে।’

ভদ্রলোক আরো বললেন যে সোলাঙ্কি নাকি হায়দ্রাবাদেরই ছেলে। ধনী বাপের পয়সা উড়িয়েছে জুয়া খেলে আর ফুর্তি করে। তারপর বোম্বাই গিয়ে ফিল্মের হিরো হবার চেষ্টায় বিফল হয়ে আবার এখানে ফিরে এসেছে।

যিনি এসব খবর দিলেন তিনি নিজেও অবিশ্যি একজন ক্যানডিডেট। পাঁচজনের সকলেই মডেল হবার আশায় এসেছেন, তবে তার মধ্যে সোলাঙ্কির চেহারাটাই মোটের উপর ভালো, যদিও যাকে পৌরুষ বলে সে জিনিসটার একটু অভাব।

আমার ডাক পড়ল সবার শেষে। যে ঘরে ইন্টারভিউ হচ্ছে সেটাই দেখলাম স্টুডিও, কারণ একদিকে রয়েছে বেশ বড় একটা কাঁচের জানালা, ঘরের একপাশে একটা ইজেল আর তার পাশে একটা টেবিলের উপর আঁকার সরঞ্জাম। এইসবের মধ্যেই একটা ডেস্‌ক পাতা হয়েছে, আর তার দুদিকে দুটো চেয়ার। একটায় বসেছেন মার্তণ্ড সাহেব। সাহেব কথাটা ভুল হল না, কারণ ভদ্রলোকের ইংরিজিটা বেশ চোস্ত। শকুনিমার্কা নাক, ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি, মাথার লম্বা ঢেউ-খেলানো চুল নেমে এসেছে কাঁধ অবধি। পোশাক সম্ভবত নিজেরই ডিজাইন করা, কারণ জাপানী, সাহেবী আর মুসলমানী পোশাকের এমন খিচুড়ি আর দেখিনি। পাঁচ মিনিট কথা বলে আর জামা খুলিয়ে আমার বাইসেপ ট্রাইসেপ আর ছাতি দেখে ভদ্রলোক আমাকেই সিলেক্ট করে নিলেন। ডেইলি সিটিং-এ একশো টাকা। অর্থাৎ মাসে ত্রিশ দিন কাজ হলে তিন হাজার—আজকের দিনে প্রায় দশ-পনেরো হাজারের সামিল।

পরের দিন থেকেই কাজ শুরু হয়ে গেল। যে কোনো পৌরাণিক ঘটনাই হোক না কেন, তাতে প্রধান পুরুষ চরিত্র হব আমি। নারী চরিত্রের জন্য আছেন মিসেস্ মার্তণ্ড, আর ওদেরই ঊনিশ বছরের মেয়ে শকুন্তলা। খুচরো পুরুষের জন্য মডেলের অভাব নেই। মার্তণ্ডের পৌরাণিক পোশাকের স্টক বিরাট—পাগড়ি মুকুট ধুতি চাদর কোমরবন্ধ তাগা তাবিজ নেকলেস সবই আছে। অর্জুনের লক্ষ্যভেদ দিয়ে আঁকা শুরু হল, তার জন্য একটি জবরদস্ত ধনুকও তৈরী করিয়ে রেখেছেন আর্টিস্ট মশাই।

হুসেন সাগর লেক থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে দেড়শ টাকা ভাড়ার দুটি ঘর নিয়ে নিলাম আমি। বাড়িওয়ালা মোতালেফ হোসেন অতি সজ্জন ব্যক্তি, বাঙালীদের সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা। রোজ সকালে আণ্ডা-টোস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়ি, নটা থেকে একটা পর্যন্ত সিটিং, তার মধ্যে চা-পানের জন্য দশ মিনিটের বিরতি থাকে এগারোটায়। কাজের পর বাকি দিনটা ফ্রী থাকে, হায়দ্রাবাদ শহর ঘুরে দেখি, সন্ধ্যাবেলা লেকের ধারে একটু বেড়িয়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। এছাড়া আরেকটা কাজ আছে, সেটা হল পুরাণের গল্প পড়ে মার্তণ্ডর জন্য সুটেব্‌ল সাবজেক্ট খুঁজে রাখা। মার্তণ্ড নিজে শুধু রামায়ণ-মহাভারতটা পড়েছে, তাও তেমন খুঁটিয়ে নয়, তাই তার বিষয়গুলো একটু মামুলি হয়ে পড়ে।

আমিই মার্তণ্ডকে বলেছিলাম রাজা বিক্রমাদিত্যের কিছু ঘটনা, যেগুলো ওর মনে ধরেছিল। আমি জানতুম বিক্রমাদিত্যের পক্ষে আমার চেহারা খুব যুৎসই। কিন্তু কাজের বেলা গণ্ডগোলটা কোথায় হল আর কী ভাবে হল সেটাই বলি।

চার মাস একটানা সিটিং দিয়ে আটটা ছবি হয়ে হয়ে গেছে, এমন সময় একদিন সন্ধেবেলা লেকের ধারে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরছি, একটা পুরোন মসজিদের পাশ দিয়ে রাস্তা, জায়গাটা নিরিবিলি। মসজিদের উল্টো দিকে একটা তেঁতুল গাছের নিচে পৌঁছেছি, এমন সময় পিছন দিক থেকে মাথায় একটা বাড়ি খেয়ে চোখে ফুলঝুরি দেখলুম।

জ্ঞান হলে পর দেখি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি, মাথায় আর বাঁ হাতে বেদম পেন। রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে এক সহৃদয় ভদ্রলোক তাঁর গাড়িতে তুলে সোজা হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। হাতের ব্যথাটা আর কিছুই না—যখন পড়েছি তখন রাস্তায় একখণ্ড পাথরে লেগে কনুইটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। এখানে বলে রাখি যে অজ্ঞান অবস্থায় আমার বেশ কিছু লোকসান হয়ে গেছে: আমার ওয়ালেটে ছিল দেড়শো টাকা, সেটি গেছে, আর আমার সাতশো টাকা দামের সাধের ওমেগা ঘড়িটা। পুলিশে খবর দিয়ে কোনো ফল হয়নি, কারণ এ ধরনের অঘটন রাস্তাঘাটে নাকি প্রায়ই ঘটে।

হাত প্লাস্টার করে বিছানায় পড়ে থাকতে হল তিন হপ্তা। জখম হবার চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই আমি মার্তণ্ডকে একটা পোস্টকার্ড ছেড়ে দিয়েছিলুম আমার অবস্থা জানিয়ে। তিন দিনের মধ্যেই তার উত্তর এসে যায়। দুঃসংবাদ। মার্তণ্ড লিখেছে বিক্রমাদিত্য সিরিজের জন্য অর্ডার পেয়ে গেছে, অমুক তারিখের মধ্যে ছখানা ছবি দিতে হবে, তাই সে অন্য মডেল নিতে বাধ্য হয়েছে। আমার মতো কোয়ালিফিকেশন নাকি তার নেই, কিন্তু নিরুপায়। এ সিরিজ শেষ হলে পরে প্রয়োজন হলে আমায় আবার জানাবে, ইত্যাদি।

এ নিয়ে ত আর করার কিছু নেই, তাই অগত্যা সময় কাটানো এবং যা হোক কিছু রোজগারের জন্য অন্ধ হেরাল্ড পত্রিকায় একটু আধটু লিখতে শুরু করলুম। ছখানা ছবি আঁকতে মার্তণ্ডর লাগবে অন্তত তিনমাস। অর্থাৎ আমার প্রায় ন হাজার টাকা লোকসান করে দিয়েছে হায়দ্রাবাদের গুণ্ডা।

কিন্তু একমাস যেতে না যেতেই আমার বাড়িওয়ালার কাছে টেলিফোন এল মার্তণ্ড সাহেবের। আমায় নাকি তাঁর বিশেষ প্রয়োজন।

বেশ কৌতুহল নিয়ে হাজির হলুম মার্তণ্ডের স্টুডিওতে। ব্যাপারটা কী?

‘আমার একটা ভালো স্কেলিটন জোগাড় করে দিতে পার?’ বললেন মার্তণ্ড সাহেব। ‘দু-একজনকে বলে ফল হয়নি তাই তোমার কথা মনে হল। যদি পার ত ভালো কমিশন দেব। আমার বিশেষ দরকার।’

জিগ্যেস করলুম স্কেলিটনের প্রয়োজন হচ্ছে কেন। মার্তণ্ড বললেন বেতাল পঞ্চবিংশতির ছবি আঁকবেন। বিক্রমাদিত্যের কাঁধে বেতাল হবে ছবির সাবজেক্ট। বেতালের গল্প আজকালকার ছেলেমেয়েরা পড়ে কিনা জানি না; আমরা এককালে খুব উপভোগ করতুম। এক সন্ন্যাসী বিক্রমাদিত্যকে আদেশ করেছে—দু ক্রোশ দূরে শ্মশানে শিরীষ গাছে একটা মড়া ঝুলছে, সেইটে তুমি আমার কাছে এনে দাও। বিক্রমাদিত্য শ্মশানে গিয়ে ঝুলন্ত মড়ার গলার দড়ি তলোয়ারের এক কোপে কেটে ফেলতেই মড়া মাটিতে পড়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। ছেলেবেলায় জিন্দা লাশ বলে একটা হিন্দি ফিল্ম দেখেছিলুম; এও হল জিন্দা লাশ। এমন লাশ যার মধ্যে ভূত বাসা বেঁধেছে। এই ভূতে পাওয়া মড়াকেই বলে বেতাল। বিক্রমাদিত্য বেতালকে কাঁধে নিয়ে সন্ন্যাসীর কাছে চলেছেন, আর বেতাল তাঁকে হেঁয়ালি গল্প বলছে। রাজা যদি হেঁয়ালির ঠিক উত্তর দেন তাহলে মড়া আবার তাঁর কাঁধ থেকে শিরীষ গাছে ফিরে যাবে, আর যদি ভুল উত্তর দেন তাহলে রাজা বুক ফেটে মরে যাবেন।

যাই হোক, আমি মার্তণ্ডকে বললুম, ‘কিন্তু সাহেব, বেতাল ত কঙ্কাল নয়, সে ত শবদেহ।’

মার্তণ্ড বললে, ‘স্কেলিটন পেলে আমি ছবিতে তার গায়ে চামড়া বসিয়ে নিতে পারব, কিন্তু স্কেলিটন আমার চাই-ই।’

আমি বললুম, ‘তোমার মডেল কঙ্কালকে কাঁধে নিতে রাজি হবে ত?’

‘হবে বৈকি,’ বললে মার্তণ্ড। ‘আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলে তার কোনো ভয়ডর নেই। এখন তুমি বল তুমি জোগাড় করে দিতে পারবে কিনা।’

বললুম, ‘আই শ্যাল ট্রাই মাই বেস্ট। তবে এ কিন্তু অল্প খরচে হবে না। আর কাজ হয়ে গেলে সে কঙ্কাল ফেরত দিতে হতে পারে।’

মার্তণ্ড আমার হাতে দু হাজার টাকা দিয়ে বললে, ‘এই হল কঙ্কালের সাতদিনের ভাড়া, এটা দাম নয়। আর তোমায় আমি দেব টু হান্ড্রেড।’

॥ ২ ॥

স্কেলিটন পাওয়া আজকের দিনে খুবই কঠিন সেটা সকলেই জানে। যা পাওয়া যায় সবই প্রায় বিদেশে এক্সপোর্ট হয়ে যায়। কিন্তু তখনও যে সহজ ছিল তা নয়। বিশেষত হায়দ্রাবাদের মতো জায়গায়। আমি অনর্থক খোঁজাখুঁজি না করে সোজা আমার বাড়িওয়ালাকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। মোতালেফ সাহেব হায়দ্রাবাদে রয়েছেন বেয়াল্লিশ বছর। এখানকার নাড়ীনক্ষত্র জানেন। আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে বললেন, ‘একটা স্কেলিটনের কথা মনে পড়ছে বটে, তবে সেটা আসল কঙ্কাল না যন্ত্রপাতি লাগানো আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল সেটা বলতে পারব না। আর সেটা এখনো সে লোকের কাছে আছে কিনা তাও জানি না।’

‘কে লোক সে?’

‘এক ম্যাজিশিয়ান,’ বললেন হোসেন সাহেব। ‘আসল নাম কী জানি না, তবে ভোজরাজ নামে খেলা দেখাত। তার মধ্যে একটা ছিল কঙ্কালের খেলা। কঙ্কাল তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খেত, তাস খেলত, দুজনে পাশাপাশি হাঁটাচলা করত। সে এক তাজ্জব ব্যাপার। খুব নাম করেছিল লোকটা। তবে বছর পনের তার কোনো হদিস পাইনি। ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছে এটাই শুনেছিলাম।’

‘সে কি হায়দ্রাবাদেরই লোক?’

‘হ্যাঁ, তবে তার ঠিকানা জানি না। অন্ধ্র অ্যাসোসিয়েশনে জিগ্যেস করে দেখতে পার। তারা ফি বছর ভোজরাজের খেলার ব্যবস্থা করত।’

অন্ধ্র অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ভোজরাজের এককালের ঠিকানা পাওয়া গেল। আশ্চর্য! গিয়ে দেখি লোকটা এখনো সেইখানেই আছে। চক বাজারের মধ্যে একটা দোতলা বাড়িতে দুটি ঘর নিয়ে তিনি থাকেন। বয়স আশী-টাশী হবে, মুখ ভর্তি একরাশ খয়েরি রঙের দাড়ি, মাথায় চক্‌চকে টাক, গায়ের রং আবলুশ। আমায় দেখে হিন্দিতে প্রথম কথাই বললেন, ‘বাঙালী বাবুর নসীব খারাপ যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?’

লোকটা তাহলে বোধহয় গুণতে জানে। এবারে আর ভনিতা না করে আসল ব্যাপারটা তাঁর কাছে পেশ করলুম। বললুম, ‘যদি সে-কঙ্কাল এখনো আপনার কাছে থেকে থাকে আর যদি সেটাকে হপ্তা খানেকের জন্য ভাড়া দিতে পারেন তাহলে আমার নসীব কিছুট ইমপ্রুভ করতে পারে। যিনি ভাড়া নেবেন তিনি দু হাজার টাকা দিতে রাজী আছেন। সে কঙ্কাল এখনো আছে কি?’

‘একটা কেন—দুটো আছে—হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ।’

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলুম।

‘আরে কঙ্কাল ত তোমারও আছে!’ বললেন ভোজরাজ। ‘নেই কি? কঙ্কাল আছে বলেই ত চলে ফিরে বেড়াচ্ছ! তোমার কঙ্কাল ত আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কনুইয়ের কাছে হাড়ে চিড় ধরল, ডাক্তার আবার সেটাকে জুড়ে দিল। তুমি জোয়ান বলেই জোড়া লাগল! আমি যদি মাথায় বাড়ি খেয়ে পড়ে হাড় ভাঙতুম, আমাকে কি আর কোনোদিন উঠতে হত?’

এই সুযোগে একটা প্রশ্ন না করে পারলুম না।

‘আমায় কে জখম করল সেটা বলতে পারেন?’

‘এ ভেরি অর্ডিনারি গুণ্ডা,’ বললেন ভোজরাজ। ‘তবে তার পিছনে অন্য কেউ আছে কিনা জানি না। থাকতে পারে। সেটা জানতে পারে আমার কঙ্কাল। সেটা আমার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। তুমি চাইছ সে কঙ্কাল, আমি দিতেও প্রস্তুত আছি—অনেককাল রোজগার নেই, দেনা জমে গেছে বিস্তর, দু হাজার পেলে সব শোধ হয়ে যাবে, আমিও নিশ্চিন্তে মরতে পারি—কিন্তু একটা কথা বলি তোমায়। এ কঙ্কাল যে-সে কঙ্কাল নয়। যাঁর কঙ্কাল তিনি ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। মাটি থেকে পাঁচ হাত শূন্যে উঠে যোগ সাধনা করতেন। বায়ু থেকে আহার্য আহরণ করতেন, ফলমূলের দরকার হত না। তাঁর তেজ ছিল অসামান্য। একবার তাঁর সাধনার সময় এক চোর তাঁর কুটিরে ঢুকে ঘটিবাটি সরাতে গিয়েছিল। হাত বাড়ানো মাত্র আঙুলগুলো বেঁকে যায়। কুষ্ঠ। কেউটে ছোবল মারতে এলে সাপ ভস্ম হয়ে যেত, বাবাজীর কিছু হত না!’

আমি একটা কথা না বলে পারলুম না।

‘কিন্তু এই বাবাজীর কঙ্কালকেও ত আপনি বশে এনেছিলেন। একে দিয়ে ভেলকি দেখাতেন স্টেজে।’

‘তাহলে বলি শোন,’ বললেন ভোজরাজ। ‘কঙ্কালকে আমি কোনোদিন বশে আনিনি। এ সবই তাঁর খেলা। অন্য যা ম্যাজিক দেখাতুম সেগুলো কিছুই না—সব যন্ত্রপাতির কারসাজি। লোকে ভাবত কঙ্কালের মধ্যে বুঝি কলকব্জা আছে। আসলে কঙ্কালের যা কিছু ক্ষমতা সবই গুরুজীর কৃপায়। মনে মনে তাঁর শিষ্য হয়ে আমি একটানা দশ বছর তাঁর পদসেবা করি। তখন আমার তরুণ বয়স—ম্যাজিক সম্বন্ধে একটা কৌতুহল ছিল, এই পর্যন্ত। গুরুজী একবারও আমার কোনো নোটিস নেননি। তারপর একদিন হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘বেটা, তোর ওপর আমি খুশি হয়েছি। তবে তুই এখন সংসার ত্যাগ করতে যাস নি। তোর অনেক কাজ আছে। তুই হবি ভোজবাজির রাজা। তোর নাম হবে। যে কাজে নাম করবি সেই কাজেই আমি তোকে সাহায্য করব, তোর সেবার প্রতিদান দেব। তবে সেটা এখন নয়। আমি মরবার পর।’

আমি বললাম, ‘সেটা কি রকম করে হবে যদি বুঝিয়ে দেন।’

গুরুজী আমাকে সন তারিখ বলে দিয়ে বললেন, ‘এই দিনে যাবি তুই নর্মদার তীরে মান্ধাতা শহরে। সেখানে শ্মশানে গিয়ে দেখবি একটা বেল গাছ। সেই গাছ থেকে নদীর ধার ধরে পশ্চিমে চলে যাবি নশো নিরানবুই পা। সেখানে দেখবি বনের মধ্যে একটা তেঁতুল গাছ আর বাবুল গাছের মধ্যে আকন্দ ঝোপের পাশে একটা কঙ্কাল। সেটাই আমি। সেটাকে তুই নিয়ে যাস। সেটাই সাহায্য করবে তোর কাজে, তোর আদেশ মানবে, লোকে দেখে তোকে বাহবা দেবে। তারপর কাজ ফুরিয়ে গেলে সেটাকে নদীর জলে ফেলে দিবি। যদি তখনও কাজ বাকি থাকে তাহলে সেটা জলে ডুববে না। তখন আবার তুলে এনে তোর কাছে রেখে দিবি।’

তারিণীখুড়ো ও বেতাল

সব শুনেটুনে ভোজরাজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা জলে ফেলে দেবার সময় কি এখনো আসেনি?’

ভোজরাজ বললেন, ‘না, আসেনি। একবার মুসির জলে ফেলে দেখেছিলাম, ডোবেনি। এখন বুঝতে পারছি তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। তোমার কর্কট রাশিতে জন্ম ত?’

‘হ্যাঁ।’

‘পঞ্চমী তিথি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তবে তুমিই সেই লোক। অবিশ্যি রাশি আর তিথি না মিললেও, তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল তুমি সিধে লোক। বাবার কঙ্কালের হিল্লেটা তোমার হাত দিয়ে হলে ভালোই হবে। আমার বিশ্বাস বাবারও তোমাকে ভালো লাগত। তিনি সাচ্চা লোক পছন্দ করতেন।’

‘তাহলে এখন কী করতে হবে?’

‘আগে ওই বাক্সটা খোলো।’

ঘরের এক পাশে একটা বড় কাঠের সিন্দুকের দিকে দেখিয়েছেন ভোজরাজ। আমি গিয়ে ডালাটা তুললুম। ভেতরে কিংখাবের কাজ করা একটা গাঢ় লাল মখমলের ওপর হাঁটু ভাঁজ করে কঙ্কালটা শোয়ানো রয়েছে। ভোজরাজ বললেন, ‘ওটাকে তুলে বাইরে আন।’

দেখলাম, মিহি তামার তার দিয়ে সুন্দর করে কঙ্কালের হাড়গুলো পরস্পরের সঙ্গে প্যাঁচানো রয়েছে। পাঁজরাটা দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরে কঙ্কালটা বাইরে আনলুম। ভোজরাজ বললেন, ‘ওটাকে দাঁড় করাও।’

করালুম।

‘এবার হাত দুটো ছেড়ে দাও।’

হাত সরিয়ে আনলুম, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ টেরিয়ে গেল।

কঙ্কাল নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো সাপোর্ট নেই।

‘এবারে ওটাকে গড় কর। এই শেষ কাজের জন্য ওটা তোমারই সম্পত্তি।’

কাজটা যে কী জানি না, তবু রিস্ক না নিয়ে গড় না করে একেবারে সাষ্টাঙ্গ হয়ে শুয়ে পড়লুম স্কেলিটনের সামনে।

‘যা করছ তা বিশ্বাস করে করছ ত?’ জিগ্যেস করলেন ভোজরাজ। বললুম, ‘আমার মনের সব কপাট খোলা, ভোজরাজজী। আমি হাঁচি টিকটিকি ভূত-প্রেত দত্যি-দানা বেদ-বেদান্ত আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি।’

‘ভেরি গুড। এবার তুমি ওটাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। দেখো যেন গুরুজীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কাজ হয়ে গেলে ওটাকে মুসি নদীর জলে ফেলে দিও।’

কঙ্কাল পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে মার্তণ্ড আমাকে দুশোর জায়গায় পাঁচশো টাকা বকশিস দিয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘আজ সন্ধ্যায় কী করছ?’

‘কেন বলুন ত?’

‘আজ বিক্রমাদিত্যের ছবিটা আঁকা শুরু করব। তুমি এলে ভালো হয়।’

‘আমি ত জানতুম আপনি সকালে ছাড়া ছবি আঁকেন না।’

‘এটার জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা,’ বললেন মার্তণ্ড। ‘এ ছবির জন্য যে মুডটা চাই সেটা রাত্রেই ভালো আসবে। আর দৃশ্যটার জন্য আমি নিজে প্ল্যান করে একটা লাইটিং-এর ব্যবস্থা করেছি। আমি সেটা তোমাকে দেখাতে চাই।’

‘কিন্তু মডেল যদি আপত্তি করে?’

‘তুমি যে ঘরে আছ সেটা সে জানবেই না। তুমি ঠিক সাতটার সময় এসে স্টুডিওর এই কোণটাতে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আলোগুলো সব মডেলের উপর ফেলা থাকবে। তার পিছনে কী আছে সেটা সে দেখতেই পাবে না।’

এককালে অ্যামেচার থিয়েটার করেছি। জানতুম ফুটলাইটের পিছনে দর্শকদের প্রায় দেখাই যায় না। এও সেই ব্যাপার আর কি।

আমি রাজি হয়ে গেলাম।

একটা ধুকপুকুনির ভাব নিয়ে সাতটার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে হাজির হলুম মার্তণ্ডের বাড়ি। ওঁর মাদ্রাজী চাকর শিবশরণ আমাকে দরজা ফাঁক করে ঢুকিয়ে দিলে স্টুডিওতে।

মডেলের জায়গা এখনো খালি। তবে লাইটিং হয়ে গেছে এবং সত্যিই তারিফ করার মতো ব্যাপার সেটা। যে শ্মশানে ভূত পিশাচের নৃত্য হচ্ছে সেখানে এইরকম আলোরই দরকার।

মার্তণ্ড বসে আছে ক্যানভাসের সামনে, তার পাশে একটা জোরালো ল্যাম্প। সে আমাকে আড়চোখে দেখে একটা বিশেষ দিকে নির্দেশ করল। সেটা হল স্টুডিওর সঙ্গে লাগা একটা ঘরের দরজা। বুঝলাম সে ঘরে মডেল তৈরি হচ্ছেন।

এবারে আরেকটা জিনিসের দিকে দৃষ্টি গেল। সেটা হল কঙ্কাল। একটা হ্যাটস্ট্যাণ্ডের ডাঁটি থেকে সেটা ঝুলছে। তার গায়ে ভৌতিক আলো পড়ে সেটা আরো ভৌতিক দেখাচ্ছে। আর তার সঙ্গে ভৌতিক হাসি। তোরা লক্ষ করেছিস কিনা জানি না—বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে থাকে বলে যে-কোনো খুলির দিকে চাইলেই মনে হয় সেটা হাসছে।

একটা খুট্‌ শব্দ শুনে অন্য ঘরের দরজাটার দিকে চোখ গেল। তলোয়ার হাতে রাজপোশাক পরিহিত বিক্রমাদিত্য বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে। পাকানো গোঁফ, গালপাট্টা, লম্বা ঢেউ খেলানো চুল—কোনো ভুল নেই। মনটা হু হু করে উঠল, কারণ এই পার্টটা আমারই পাবার কথা, দৈব দুর্বিপাকে ফসকে গেল।

রাজা এসে স্টেজে আলো নিয়ে দাঁড়ালেন। মার্তণ্ড উঠে গিয়ে তার পোজ আর পোজিশনটা ঠিক করে দিয়ে চলে গেলেন হ্যাটস্ট্যাণ্ডের দিকে। কঙ্কালটাকে নামিয়ে নিয়ে সেটাকে মডেলের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটার হাত দুটোকে তোমার কাঁধের উপর দিয়ে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দাও, আর পা দুটো কোমরের দুপাশ দিয়ে নিয়ে এক করে তোমার বাঁ হাত দিয়ে চেপে থাক।’

দেখলুম মডেল দিব্যি মার্তণ্ডের ইনস্ট্রাকশন পালন করলে। লোকটার সাহসের প্রশংসা না করে উপায় নেই।

মার্তণ্ড ছবি আঁকা শুরু করে দিলেন। প্রথমে চারকোল দিয়ে স্কেচটা করে তারপর রং চাপানো হবে। এর আগে ত আমিই মডেল হতুম, তাই আঁকাটা কেমন হচ্ছে সেটা দেখার সুযোগ ছিল না। আজ দেখতে পেলুম মার্তণ্ডের নিপুণ হাতের কাজ।

মিনিট পাঁচেকও হয় নি, হঠাৎ মনে হল স্টেজের দিক থেকে একটা গোঙানির শব্দ পাচ্ছি। আর্টিস্ট এত মশগুল যে তার কানে শব্দটা যায়নি। সে খালি বললে, ‘স্টেডি, স্টেডি,’ কারণ রাজা অল্প অল্প হেলতে দুলতে শুরু করেছেন।

আর্টিস্টের আদেশ সত্ত্বেও দেখলাম মডেল স্টেডি থাকতে পারছে না; সে এপাশ ওপাশ করছে। আর তার মুখ দিয়ে যে শব্দটা বেরোচ্ছে সেটাকে গোঙানি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

‘হোয়াটস্ দ্য ম্যাটার?’ বেশ বিরক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করলেন মার্তণ্ড।

এদিকে আমি ম্যাটারটা বুঝে ফেলেছি। কারণ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কী ঘটছে।

কঙ্কালের হাত দুটো আর ঝোলানো নেই। সেটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে মডেলের থুতনির নিচে এসে ক্রমে একটা ভয়ংকর আলিঙ্গনে পরিণত হচ্ছে। সেই সঙ্গে পা দুটোও যেভাবে জড়িয়ে ফেলেছে কোমরটাকে, সেটা আর কোনোদিন খোলা যাবে বলে মনে হয় না।

মডেলের অবস্থা এখন শোচনীয়। তার গোঙানি ক্রমে পরিত্রাহি আর্তনাদে পরিণত হয়েছে, আর সে তলোয়ার মাটিতে ফেলে দিয়ে সমস্ত দেহটাকে ঝাঁকিয়ে দু’হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে কঙ্কালের হাত দুটোকে আলগা করার চেষ্টা করছে।

তারিণীখুড়ো ও বেতাল

মার্তণ্ড একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে গেছে মডেলের দিকে, কিন্তু দু’জনের কম্বাইন্‌ড চেষ্টা এবং শক্তিপ্রয়োগেও কোনই ফল হল না। মার্তণ্ড হাল ছেড়ে দিয়ে টলতে টলতে পিছিয়ে এসে ইজেলটাকে উল্টে ফেলে দিয়ে আমারই পাশে দেওয়ালের গায়ে এলিয়ে পড়ল।

আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা যদিও বেশিক্ষণ থাকেনি, কিন্তু তার মধ্যেই মডেল কাঁধে কঙ্কাল সমেত মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। এদিকে ঘড়ঘড়ে গলায় মার্তণ্ড বলছে, ‘ডু সামথিং!’

আমি এবার এগিয়ে গেলুম মঞ্চের দিকে। আমার কিন্তু ভয় কেটে গেছে এর মধ্যেই, কারণ মন বলছে কঙ্কাল আমার কোনো ক্ষতি করবে না, আমার চেষ্টায় কোনো বাধা দেবে না।

কাছে যেতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে মাথাটা ভোঁ করে উঠল। রাজার চুল গোঁফ গালপাট্টা পাগড়ি সবই আলগা হয়ে খসে পড়েছে, আর তার ফলে যে মুখটা বেরিয়ে পড়েছে সেটা আমার চেনা।

ইনি হলেন মার-খাওয়া ফিল্মের হিরো বিশ্বনাথ সোলাঙ্কি।

মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গিয়ে জাজ্জ্বল্যমান সত্যিটা বেরিয়ে পড়ল, আর সেই সঙ্গে মাথায় খেলে গেল এক পৈশাচিক বুদ্ধি।

আমি সোলাঙ্কির উপর ঝুঁকে পড়ে বললাম, ‘এবার বল ত দেখি, আমার জায়গাটা দখল করার জন্য আমার মাথায় বাড়ি তুমিই মারিয়েছিলে কিনা। না বললে কিন্তু কঙ্কালের হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই।’

সোলাঙ্কির চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে; সে সেই অবস্থাতেই দম বেরিয়ে আসা গলায় বলে উঠল, ‘ইয়েস ইয়েস ইয়েস—প্লীজ সেভ মি, প্লীজ!’

আমি মার্তণ্ডর দিকে ফিরে বললুম, ‘তুমি সাক্ষী। শুনলে ত?—কারণ এঁকে আমি পুলিশে দেব।’

মার্তণ্ড মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে দিলেন।

এবার কঙ্কালের কাঁধ ধরে মৃদু টান দিতেই সেটা রাজার কাঁধ ছেড়ে উঠে এল, সঙ্গে সঙ্গে কোমর ছেড়ে পা দুটোও।

এর পরে অবিশ্যি সোলাঙ্কি মশাইয়ের আর মডেল হওয়া হয়নি, কারণ তাঁকে বেশ কিছুদিন পুলিশের জিম্মায় থাকতে হয়েছিল। তার জায়গায় বিক্রমাদিত্য সিরিজের হিরো হলেন তারিণীচরণ বাঁড়ুজ্যে। ঘটনাটা মার্তণ্ডকেও কাবু করে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দিন সাতেকের মধ্যেই রিকাভার করে তিনি আবার পুরোদমে কাজে লেগে গেলেন।

বেতালের ছবি শেষ হবার পর দিনই মুসি নদীর জলে কঙ্কালটাকে ফেলে দিলাম। চোখের নিমেষে সেটা তলিয়ে গেল জলের তলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *