খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো
ডিসেম্বরের ঊনত্রিশে, শীতটা পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। সন্ধেবেলা তারিণীখুড়ো এলেন গলায় আর মাথায় মাফলার জড়িয়ে। ‘তোরা মাঠে যাচ্ছিস না খেলা দেখতে?’ তক্তপোষে বসেই প্রশ্ন করলেন খুড়ো, ‘নাকি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার তাল করছিস?’
‘তার মানে?’ জিগ্যেস করলাম আমি।
‘ওই টেলিভিশন আর কি,’ বললেন, খুড়ো। ‘লোককে ঘরকুনো করার জন্যে অমন জিনিস আর দ্বিতীয় নেই। আমাদের সময়ে খেলা দেখতে হলে টিকিট কেটে মাঠে যেতে হত, আর তার মজাটাই ছিল আলাদা। শীতকালের মিঠে রোদে সবুজ রঙের খোলা বেঞ্চেতে বসে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে সাদা পোশাক পরা লোকগুলোর কাণ্ড দেখে দিব্যি সময় কেটে যেত। তার মধ্যে দুটো একটা বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি হলে ত কথাই নেই। মনে আছে দিলওয়ার হোসেনের খেলা জার্ডিনের এম সি সি টীমের এগেনস্টে। মাথায় পট্টি—বল লেগে মাথা ফেটে গেছে—তাই নিয়ে খেলছে দিলাওয়ার। স্টাইল-ফাইলের বালাই নেই, ব্যাট ধরেছে যেন কোলা ব্যাঙ ওৎ পেতেছে, কিন্তু কী খেলা খেললে লোকটা! চৌষট্টি না পঁয়ষট্টি রান, কিন্তু প্রত্যেকটি রানের দাম লাখ টাকা।’
‘সে ত হল, কিন্তু খেলা যদি না জমে?’ বলল সুনন্দ।
‘তাতে কী হল? চার পাশে লোক রয়েছে, তাদের সঙ্গে খোশ গল্প করো; লাঞ্চ টাইমে মুরগীর কাটলেট আর হ্যাপি বয় আইস ক্রীম। বিকেল যত বাড়ছে সূর্যি তত হেলছে পশ্চিমে, আর গাছের ছায়া লম্বা হয়ে মাঠটাকে ছেয়ে ফেলছে, উত্তরে হাইকোর্ট। ব্যাটে বলে খুটখুটের ফাঁকে ফাঁকে গঙ্গা থেকে স্টীমারের ভোঁ…..আর কত বলব? সাহেবরা বলে গেছে ইডেনের মতো ক্রিকেটের মাঠ দুনিয়ায় দুটি নেই।
‘আপনার যে ক্রিকেটে এত শখ সে ত অ্যাদ্দিন বলেননি,’ বলল ন্যাপলা।
‘বলিস কী! আমার হিরো ছিল রণজি। জামসাহেব অফ নওয়ানগর মহারাজা রণজিৎ সিংজী। নওয়ানগরের রাজা, ক্রিকেটেরও রাজা। সাহেবদের চোখ টেরিয়ে যেত কালা আদমির খেলা দেখে। যে সব ভারতীয় বিদেশে গিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে তার মধ্যে রণজিই বোধহয় প্রথম।…তবে, শুধু ক্রিকেট কেন? এই পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে কোনো খেলাই বাদ দেয়নি এ শর্মা—ডাংগুলি হাডুডু থেকে শুরু করে ব্রিজ-পোকার-দাবা-বিলিয়ার্ড পর্যন্ত। ইস্কুল কলেজে হকি ক্রিকেট ফুটবল রেগুলার খেলতুম। ত্রিশ বছর বয়সে একবার এক সাহেব টীমের এগেনস্টে ক্রিকেট খেলতে হয়েছিল।’
‘এম সি সি?’ ন্যাপলা জিগ্যেস করল।
‘ঠিকই বলেছিস্’ বললেন তারিণী খুড়ো, ‘তবে এম সি সি-র বিরুদ্ধে নয়, এম সি সি-র পক্ষে। মেরিলিবোন নয়, মার্তন্ডপুর ক্রিকেট ক্লাব, আর বিপক্ষদলের সাহেবরা প্লান্টার্স ক্লাব।’
‘কত রান করেছিলেন আপনি?’
‘সে বললে তা পুরো গল্পটাই বলতে হয়।’
‘তাই বলুন না’ বলল ন্যাপলা। ‘ভূতের গল্প ত অনেক হল; আজ খেলার গল্পই হোক।’
‘ভূত যে এ গল্পে একেবারেই নেই সেটা অবিশ্যি বললে ভুল হবে।’
‘আরেব্বাস!’ চোখ গোল গোল করে বলল ন্যাপলা, ‘ভূত আর ক্রিকেট—দারুণ কম্বিনেশন!’
চিনি-দুধ ছাড়া চায়ে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে গলার মাফলারটা আরেকটু ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে তারিণীখুড়ো আরম্ভ করলেন তাঁর গল্প।
উত্তর প্রদেশের উত্তরে হিমালয়ের গায়ে সাড়ে তিন হাজার ফুট এলিভেশনে হল মার্তন্ডপুর শহর। নেটিভ স্টেট্, রাজার বয়স বাহান্ন, নাম বীরেন্দ্রপ্রতাপ সিং। এই রাজার সেক্রেটারির চাকরি আমি পেলুম ভগবানগড়ের রাজার রেকমেন্ডেশনে। রাজাদের সম্বন্ধে যে যাই বলুক না কেন, আমি তাদের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছি তাতে আমি অন্তত তাদের বদনাম করতে পারব না। হতে পারে যে আমার কপাল ছিল ভালো, তেমন বিচ্ছু রাজার সংস্পর্শে আমি আসিনি। সে যাই হোক, মার্তণ্ডপুরের রাজা আমাকে যে ভাবে খাতির করলেন তাতে খুশি না হয়ে উপায় নেই। সেক্রেটারির যাবতীয় কাজ ছাড়াও একটা জরুরী কাজ আমার ছিল সেটা হল এই—বীরেন্দ্রপ্রতাপ তাঁর বাপ রাজেন্দ্রপ্রতাপের জীবনী লিখবেন, সেই কাজে তাঁকে সাহায্য করা। রাজেন্দ্রপ্রতাপ ছাত্র-জীবন থেকেই ডায়রি লিখতেন। সেই সব ডায়রি পড়ে তাঁর জীবনের নানান তথ্য বার করে একটা খাতায় নোট করে রাখতে হবে আমাকে। ঘটনাবহুল জীবন, তাই কাজটা করতে ভালই লাগছিল। এই ডায়রি থেকেই আমি জানতে পারি যে রাজেন্দ্রপ্রতাপের জীবনে ক্রিকেট একটা খুব বড় স্থান অধিকার করেছিল। রাজবাড়ির বিশাল কম্পাউন্ডে একটা ক্রিকেট মাঠ রয়েছে সেটা এসেই দেখেছিলাম। কম্পাউন্ডের অধিকাংশটাই পাহাড় চেঁছে সমতল করে ফেলা হয়েছে। তাতে ফুলের বাগান, ফলের বাগান, তিরতির করে বয়ে যাওয়া সরু নদী, চিড়িয়াখানা, মন্দির, সবই রয়েছে। আর আছে ক্লাব বিল্ডিং সমেত ক্রিকেট গ্রাউন্ড। রাজাকে জিগ্যেস করাতে উনি বলেছিলেন সে মাঠে খেলা হয় শরৎকালে। বড় খেলা একটাই হয়, সেটা হল মার্তন্ডপুর ক্রিকেট ক্লাব ভারসাস প্লান্টার্স ক্লাব। সে খেলা দেখতে নাকি সমতলভূমি থেকেও লোক উঠে আসে। আমি যখন গেছি—নাইনটিন ফর্টি নাইনে—তখনও অনেক সাহেব প্লান্টার থাকে ওই অঞ্চলে। তারা সব স্থানীয় চা বাগানের মালিক। তার মধ্যে নাকি জনাচারেক ডাকসাইটে প্লেয়ার আছে যারা তরুণ বয়সে দেশে থাকতে কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছে, তারপর ভারতবর্ষে চলে এসেছে ব্যবসা করতে। রাজার টীম নাকি রাজেন্দ্রপ্রতাপের আমলে খুবই ভালো ছিল, কিন্তু এখন আর তেমন নেই। তাই গত দশবছরে একবারও মার্তন্ডপুর জিততে পারেনি। চারদিন ধরে খেলা চলে, মার্তন্ডপুরের পক্ষে রান ওঠে না বলে প্রতিবারই নাকি ইনিংস ডিফিট হয়, তাই সহেবদের এক ইনিংসের বেশি ব্যাটই করতে হয় না।
আমি আসার হপ্তা তিনেকের মধ্যেই রাজা একদিন আমাকে এই বাৎসরিক ম্যাচের কথা বলে বললেন, ‘তোমার ত বেশ জোয়ান ছিমছাম সুপুরুষ চেহারা, খেলাধুলোর শখ আছে নাকি?’
আমি বললাম, ‘আউটডোর গেমস এককালে খেলেছি; আজকাল তাস, দাবা, বিলিয়ার্ড, এই সব খেলি সুযোগ পেলে।’
তারপরেই রাজা এম সি সি আর প্লান্টার্স ক্লাবের কথাটা বললেন। ‘এখানে ভালো ক্রিকেটারের খুব অভাব’, বললেন রাজা। ‘এককালে এমন ছিল না। আমি নিজে অবশ্য কোনোদিন ক্রিকেট খেলিনি, বাবাই খেলতেন, কিন্তু তখন আমাদের দলকে সাহেবরা রীতিমতো ভয় পেতো। এখন ব্যাপারটা উল্টে গেছে। অথচ এমনই ট্র্যাডিশনের জোর যে বাৎসরিক ম্যাচটা না খেললেই নয়। আর ত একমাস আছে; এবার তুমিও লেগে পড়।’
আমি বাধ্য হয়ে বললাম যে আমার প্র্যাকটিস নেই; কিন্তু রাজা কথাটা কানেই নিলেন না। বললেন, ‘এই একমাসে প্র্যাকটিসের ঢের সুযোগ পাবে। তোমাকে গান্ অ্যান্ড মূর কোম্পানির একটা ভালো বিলিতি ব্যাট দিচ্ছি, বাবা এনেছিলেন বিলেত থেকে, তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু হাত চালিয়ে নাও। তোমার কি বোলিং আসে নাকি?’
বাধ্য হয়ে বললুম যে ওদিকে আমার কোনোদিনও ঝোঁক ছিল না। ফাইভ ডাউন, সিক্স ডাউন নামতুম আর ব্যাটিং-ই করতুম। তবে ইয়াং বয়সের সে ফর্ম ফিরে পাবার আশা বৃথা। সেটাও জানিয়ে দিলুম। রাজা অবিশ্যি একথাতেও কান দিলেন না। বললেন, ‘আমার সঙ্গে এস, তোমাকে ব্যাটটা দিয়ে দিই।’
প্রাসাদের দক্ষিণভাগে একটা বিশেষ ঘরে গেলুম রাজার সঙ্গে। এই ঘরটা হল যাকে বলে ট্রোফি রুম। বীরেন্দ্রপ্রতাপ ভালো শিকারি, তাঁর মারা বাঘ ভাল্লুক বাইসন হরিণের স্টাফ করা দেহ আর মাথা রয়েছে এই ঘরে। এছাড়া রয়েছে এক আলমারি বোঝাই কাপ আর মেডেল, তার মধ্যে বেশির ভাগই রাজেন্দ্রপ্রতাপের পাওয়া, আর বাকি পেয়েছেন বর্তমান রাজা তাঁর স্কোয়াশ খেলায় কৃতিত্বের জন্য।
এরই পাশে একটা আলমারিতে রয়েছে কিছু টেনিস র্যাকেট, স্কোয়াশ র্যাকেট, মাছ ধরার ছিপ, আর বিভিন্ন খেলার সময় পরার জন্য রকমারি ক্যাপ। কিন্তু ক্রিকেট ব্যাট ত কোথাও দেখছি না। রাজাকে জিগ্যেস করাতে বললেন, ‘ওটা ছিল রাজার খুব সাধের সম্পত্তি, তাই যেমন-তেমন ভাবে রাখা নেই।’
এই বলে একটা আলমারির তলার দিকের দেরাজ খুলে তার থেকে টেনে বার করলেন খবরের কাগজে মোড়া ব্যাটটা। সেটা দিয়ে অনেক খেলা হলেও এখনো বেশ ব্যবহার্য অবস্থায় রয়েছে।
‘হাতে নিয়ে দেখ।’
নিলুম, আর নিতেই কেমন যেন ম্যাজিকের মতো বয়সটা দশবছর কমে গেল। মনে পড়ল যত খেলা আমি খেলেছি তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল ক্রিকেট। বার চারেক হাঁকড়াবার ভঙ্গিতে হাত চালিয়ে ফস করে বলে দিলুম আমি রাজার দলের হয়ে সাহেবদের বিরুদ্ধে খেলতে রাজি আছি। রাজা হ্যান্ডশেকের জন্য তাঁর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
* * * * *
দিন তিনেকের মধ্যে এম সি সি টীমের সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ক্যাপটেন হচ্ছেন সুন্দরলাল গুপ্তে, দিল্লীর লোক, বয়স আমারই মতো। অন্য খেলোয়াড়দের কাউকেই দেখে বিশেষ ভরসা হয় না। এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি যে আমার চেহারা এবং স্বাস্থ্য এদের সকলের চাইতে ভালো।
দুদিন মাঠে নেমে ঠুকঠাক করলুম, দেখলুম দিব্যি হাত চলছে, দৃষ্টি পরিষ্কার, মাথা ঠান্ডা। সুন্দরলাল খুব খুশি হলেন।
কিন্তু তিনদিনের দিন বিধি বাদ সাধলেন। সকালে উঠে দু চারটে হাঁচি হল, আর দুপুর হতে না হতে তেড়ে জ্বর। ইন্ফ্লুয়েঞ্জা। তখন মিক্সচারের যুগ, ডাক্তার পান্ডে এসে প্রেস্ক্রিপশন লিখে দিলেন, তাও সাতদিনের আগে জ্বর ছাড়ল না। আট দিনের দিন বিছানা ছেড়ে উঠে বুঝতে পারলুম দেহের শক্তি অর্ধেক হয়ে গেছে। আগেও ফ্লু হয়েছে, জানি দুর্বল করে দেয়, কিন্তু কথা হচ্ছে—পনের দিন বাদে ম্যাচ, খেলব কি করে? রাজা কিন্তু নির্বিকার। বললেন, ‘পনের দিন ঢের সময়; খেলার আগে ঠিক চাঙা হয়ে উঠবে, দেখে নিও। ম্যাচের আগের দিন একটু ব্যাট চালিয়ে নিতে পারলে আর কোনো ভাবনা নেই।’
কী আর করি; খেলার চিন্তা আপাততঃ স্থগিত রেখে কাজে মন দিলাম।
এখানে রাজেন্দ্রপ্রতাপের ডায়রির কথাটা বলা দরকার। চামড়া দিয়ে বাঁধানো তেত্রিশটা ভল্যুম। ষোল বছর বয়স থেকে লেখা শুরু, আগাগোড়াই ইংরিজিতে। গোড়ার দিকে ভাষায় গন্ডগোল, ব্যাকরণে ভুল ইত্যাদি রয়েছে, কিন্তু একুশ বছর বয়সে বিলেত যাবার ছ মাসের মধ্যে ভাষা হয়ে গেছে চোস্ত। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোট করে যেতে হচ্ছে বলে এই দেড়মাসে বেশি এগোতে পারিনি, কিন্তু এর মধ্যেই রাজার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি। বীরেন্দ্রপ্রতাপ অবিশ্যি তেত্রিশ খন্ডের সবকটাই পড়েছেন। তাঁর মতে রাজেন্দ্রপ্রতাপের ডায়রি হল একমেবাদ্বিতীয়ম্। ভারতবর্ষের কোনো রাজ্যের কোনো রাজাই এরকম ডায়রি লিখেছেন বলে জানা যায়নি। একটা কথা অবিশ্যি এর মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছি; সেটা হল এই যে রাজেন্দ্রপ্রতাপ ছিলেন ক্রিকেটের পোকা। তিনি বিলেত পৌঁছেছিলেন ১৯০১ সালে। যেদিন পৌঁছালেন সেদিনই ডায়রিতে লিখছেন, ‘অ্যাট লাস্ট আই ক্যান ওয়চ রণ্জি প্লে!’
বিলেত থেকে ফিরে এসেই রাজেন্দ্রপ্রতাপ মার্তণ্ডপুর ক্রিকেট ক্লাবের পত্তন করেন। প্লান্টার্স ক্লাব অবিশ্যি তার আগে থেকেই ছিল। দুই ক্লাবের মধ্যে বাৎসরিক ম্যাচের পরিকল্পনাও রাজেন্দ্রপ্রতাপের। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর বয়স অবধি তিনি ছিলেন এম সি সি-র ক্যাপ্টেন। তাঁর আমলে সাহেবরা নাকি মোটেই যুৎ করতে পারেননি। তার প্রধান কারণ—অধিনায়ক নিজে ছিলেন ডাক-সাইটে ব্যাট্স্ম্যান। বীরেন্দ্রপ্রতাপের মতে তাঁর বাবার উচিত ছিল কোমর বেঁধে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে নেমে যাওয়া—যেমন নেমেছিলেন রণ্জি, দিলীপ সিংজী, পাতৌদির নবাব, পাতিয়ালার মহারাজা। কিন্তু ক্রিকেটের চেয়েও বেশি টান ছিল তাঁর সাহিত্যের প্রতি। আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিপ্পান্ন বছর বয়সে হঠাৎ হার্টফেল করে চলে গেলেন। বীরেন্দ্রপ্রতাপের বয়স তখন বাইশ। যে কাজ বাপ করে যেতে পারেননি, সে কাজ এখন তিনি করবেন বলে মনস্থ করেছেন।
দেখতে দেখতে ম্যাচের দিন এল। তার আগে দুদিন মাত্র প্র্যাকটিস করেছি। দুর্বলতা যে পুরোপুরি গেছে তাও বলতে পারব না। তা সত্ত্বেও যে একটা উদ্দীপনা অনুভব করছিলুম এটা বলতেই হবে। মন বলছিল যে এ-খেলা আমাকে খেলতে হবে।
ইতিমধ্যে প্লান্টার্সের টীম সম্বন্ধেও জেনেছি। তিনজন ভালো ব্যাট্স্ম্যান আছে তাদের মধ্যে—বোল্টন, ম্যানারস আর উইলকক্স। এছাড়া ভালো বোলার আছে দুজন—মার্টিন আর ফুলারটন। তার মধ্যে প্রথমটির বলে নাকি বেশ তেজ।
খেলার দিন দেখি সকাল থেকে মাঠে দর্শক জমায়েৎ হচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে খেলার আগ্রহটাও বাড়ছে। ক্যাপ্টেনকে বললাম যে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রভাব যেহেতু সম্পূর্ণ কাটেনি, ফীল্ডিং-এ যেন আমাকে এমন জায়গায় রাখা হয় যাতে বেশি দৌড়াতে না হয়। গুপ্তে বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই, তোমাকে স্লিপে দেব।’
দশটায় ম্যাচ শুরু, মাঠের চতুর্দিকে লোক গিজগিজ করছে, নীল আকাশে শরতের তুলো-প্যাঁজা মেঘ, দুই ক্যাপ্টেন আম্পায়ারের সঙ্গে মাঠে নামলেন, আর আমিও চোখ বুজে বার চারেক দুর্গা নাম জপে নিলুম। ওদিকের অধিনায়ক জন উইলকক্স, সেই টস্ জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলে, আর আমি টাটকা নতুন সাদা প্যান্ট, সার্ট, জুতো আর নীল ক্যাপ পরে দলের সঙ্গে মাঠে নেমে সেকেন্ড স্লিপে গিয়ে দাঁড়ালুম। যাবার আগে অবিশ্যি রাজার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলুম। রাজা আমার হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বললেন, ‘কোনো ভাবনা নেই, তোমার ব্যাটে জাদু আছে।’ কথাটার আসল মানে অবশ্য পরে বুঝেছিলুম।
পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা, তাই খুব ডিটেলে মনে নেই, তবে এটা মনে আছে যে সাহেবরা তিনশো বাইশ রান্ তুলে দ্বিতীয় দিন টী-এর আগে সবাই আউট হয়ে গেলেন। আমি একটা ক্যাচ লুফে কিছুটা মান রক্ষা করলুম, কিন্তু মন বলতে লাগল যে এবারও সাহেবদের হারানো গেল না, সাড়ে তিনশো রান তোলার মতো ব্যাটসম্যান আমাদের দলে নেই। পর পর দশবার হেরেছে মার্তন্ডপুর ক্লাব, এবার নিয়ে হবে এগারোবার।
এম্ সি সি চায়ের পর ব্যাট করতে নামল; ওপনিং ব্যাট ক্যাপ্টেন গুপ্তে আর সুন্দরম বলে একটি মাদ্রাজি। আমি পাঁচ উইকেট গেলে নামব এটা আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে।
গুপ্তে টুক্টুক্ করে তেইশ রান তুলে কট আউট হয়ে গেল, তার জায়গায় এল সলামৎ হোসেন। বললে বিশ্বাস করবি না, পৌনে পাঁচটার মধ্যে পাঁচটা উইকেট ধড়াধ্ধড় কচুকাটা—তখন রান উঠেছে মাত্র বিরানব্বই! চারটে যখন পড়েছে তখনই আমি প্যাড পরে রেডি। পাঁচ নম্বর যখন শূন্যি করে মুখ কালি করে ফিরছে, আমি নেমে পড়লুম মাঠে। কেউ তালি দিলে না। আমাকে কেউ চেনে না, শুনেছে ইনি বাঙালীবাবু, কাজেই আমার উপর কেউই বিশেষ ভরসা করছে না।
তখনও ওভারের তিন বল বাকি, বোলিং করছে ওদের ফাস্ট বোলার ক্লিফ মার্টিন। আমি গিয়ে জায়গায় দাঁড়ালুম। তখনকার মনের অবস্থা বলে বোঝানো খুব মুশকিল। সকাল অবধি মনে হচ্ছিল যে অসুখের দরুণ যে এনার্জিটা হারিয়ে ছিলাম, তার সবটুকুই এ কদিনে আবার ফিরে পেয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা আবার লোপ পেয়েছে। ব্যাটটা হাতে ভারী লাগছে, পায়ের প্যাড যেন একটা দুর্বিষহ বোঝা, তাই নিয়ে ছুটে রান করা যেন একটা অসম্ভব ব্যাপার।
ওদিকে মার্টিন হেঁটে গিয়ে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে বলটা প্যান্টের পাশে ঘষে নিচ্ছে, মন বলছে প্রথম বলেই আমার স্টাম্প হবে চিচিংফাঁক! তাও কোনোরকমে মনটাকে শক্ত করে মাথা ঘুরিয়ে ফীল্ডটা দেখে নিয়ে ব্যাট পাতলুম ঘাসের ওপর। তারপর ভুরু কুঁচকে চাইলুম মার্টিনের দিকে। সব তৈরি বুঝে সে দিলে স্টার্ট। চোদ্দ পা দৌড়ে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে যে বলটা সে দাগলে আমার দিকে সেটা শর্ট পিচ। কোত্থেকে মুহুর্তের মধ্যে যে মনে সাহসটা এল জানি না। শুধু সাহস না—সেই সঙ্গে চোখের দৃষ্টি, নার্ভের উপর দখল, কবজির জোর আর হাঁকড়াবার গোঁ। সব মিলে ব্যাটচালানোর সঙ্গে সঙ্গে বলবাবাজী উল্টো মুখে আকাশে উঠে চোখের পলকে ক্লাব ঘরের পেছনে শিরীষ গাছের পাতা ভেদ করে একটা কান ফাটানো খটাং শব্দ করে পড়ল একটা অদৃশ্য টিনের চালের উপর। খেলায় এই প্রথম ছক্কা, আর তাই না দেখে হাজার পায়রা এক সঙ্গে টেক অফ্ করলে যেমন শব্দ হয়, দর্শকদের মধ্যে থেকে উঠল তেমনি একটা শব্দ। এমন হাততালি ক্রিকেটের মাঠে বড় একটা শোনা যায় না। আর এই হাততালিতেই যেন নদীতে বান ডাকার মতো হুড়মুড় করে আমার সমস্ত উৎসাহ আর কনফিডেন্স ফিরে এল। এটা ঠিক যে সেদিন নিজের খেলায় আমি নিজেই হকচকিয়ে যাচ্ছিলুম। এ যেন আমি নয়; আমার ভেতর ঢুকে আমার হয়ে অন্য কোন ক্ষণজন্মা ক্রিকেটর যেন খেলাটা খেলে দিচ্ছে, সব কৃতিত্ব তারই, আমি নিমিত্ত মাত্র।
আমার স্কোর হয়েছিল দুশো তেতাল্লিশ নট আউট, তার মধ্যে এগারোটা ছক্কা আর একত্রিশটা বাউন্ডারি। অন্য ব্যাটসম্যানের উপর ভরসা নেই বলে ওভারে শেষ বলে শর্ট রান নিয়ে ব্যাটিং-এর পুরো দায়িত্বটা নিজের ঘাড়েই নিয়ে নিয়েছিলাম। ড্রাইভ, হুক, গ্লান্স, কাট, ওভার দি বোলার—কোনো স্ট্রোকই আমার খেলা থেকে বাদ পড়েনি। আশ্চর্য এই যে, এককালে যখন ক্রিকেট খেলেছি তখন এর অনেক স্ট্রোকই আমার হাত দিয়ে বেরোয়নি। একশো করার সঙ্গে সঙ্গে সাহেবরা এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল, কিন্তু দুশোর বেলায় দেখলুম তাদের সকলের মুখ ফ্যাকাশে মেরে গেছে, পিঠ চাপড়ানোর সামর্থ্যও যেন আর নেই।
আমার এমন খেলার পরে সাহেবরা এমন মুসড়ে পড়েছিল যে দ্বিতীয় ইনিংসে সাতাত্তরের মাথায় তাদের শেষ উইকেট পড়ে গেল। ইনিংস ডিফীট, কারণ আমাদের টোটাল হয়েছিল চারশো ছত্রিশ।
চারদিনের দিন আড়াইটেয় খেলা শেষ হয়ে গেল।
সেদিনই সন্ধ্যায় আমার ঘরে খাটে শুয়ে ভরদ্বাজ বেয়ারাকে দিয়ে একটু দলাই মলাই করিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় রাজার খাশ বেয়ারা এসে জানালে যে আমার তলব পড়েছে।
গেলুম বেয়ারার সঙ্গে। তাঁর ঘরে ঢুকতেই রাজা আমার দিকে চেয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘ওয়েল ব্যানার্জি, হাউ ডু ইউ ফীল?’
আমি অকপটে বললুম, ‘দেখ রাজা, আমি একেবারে বোকা বনে গেছি। সত্যি বলছি আমি এমন খেলা কখনো খেলিনি, কারণ এমন খেলা আমার পক্ষে সম্ভবই নয়। এর রহস্য ভেদ করার শক্তি আমার নেই।’ রাজার মুখে এখনো মেলায়েম হাসি। সামনের চেয়ারের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘বোস।’
আমি বসলুম। রাজা তাঁর সামনে টেবিলের উপর থেকে একটা বই তুলে নিলেন। দেখে চিনতে পারলুম; এটা রাজেন্দ্রপ্রতাপের ডায়রির একটা খণ্ড।
একটা বিশেষ জায়গায় ডায়রিটা খুলে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বীরেন্দ্রপ্রতাপ বললেন, ‘এইখানটা পড়ে দেখ।’
পড়ার আগে ওপরে সন তারিখ দেখে নিলুম। তেসরা নভেম্বর ১৯০৩। অর্ত্থাৎ বিলেত যাবার আড়াই বছর পর।
এবার লেখাটায় চোখ গেল। যা পড়লুম তার বাংলা করলে এইরকম দাঁড়ায়—‘আজ রণজি তার বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ তার নিজের একটা ব্যাট আমাকে দিল। এই ব্যাট নিয়েই সে সাসেক্সের হয়ে মিড্লসেক্সের বিরুদ্ধে ২০২ রান করেছিল। আমার মতো ভাগ্যবান পৃথিবীতে আর কেউ আছে কি?
এতোদিন রণ্জির শুধু নামই শুনেছিলুম। আজ তাঁর মৃত্যুর ষোল বছর পরে, নিজের খেলা থেকে আঁচ করলুম তিনি কেমন খেলতেন।