কনওয়ে কাস্লের প্রেতাত্মা
তারিণীখুড়ো তাঁর এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়িতে দুটো টান দিয়ে বললেন, ‘ভূতের গল্প অনেকে বলতে পারে, তবে পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলা গল্পের জাতই আলাদা। সেটা আর কজন পারে বল।’
‘আপনি পারেন?’ প্রশ্ন করল ন্যাপলা।
‘হুঁঃ’, বলে খুড়ো অন্য দিকে চাইলেন।
তারিণীখুড়োর এক্সপিরিয়েন্সের স্টক যে অফুরন্ত সেটা আমরা জানি। এই সেদিন অবধি সারা দেশময় টোটো করে বেড়িয়েছেন। ভারতবর্ষের তেত্রিশটা শহরে ছাপ্পান্ন রকম কাজ করেছেন উপার্জনের জন্য। তবে এক বছরের বেশি কোনো কাজে টিঁকে থাকেননি—সে ব্যবসাই হোক আর চাকরিই হোক। এখন চৌষট্টি বছর বয়সে চরকিবাজি থামিয়ে কলকাতায় এসে রয়েছেন বেনেটোলা লেনে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। এখানে বলে রাখি, তারিণীখুড়ো সকলেরই খুড়ো। বাবাও খুড়ো বলেন, আমিও বলি। ন্যাপলা একবার ওঁকে দাদু বলেছিল, তাতে খুড়ো মহা ক্ষেপে বললেন, ‘এখনো বাস না পেলে অক্লেশে হেঁটে আসি বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ—দাদু আবার কি? খুড়ো বলবি।’
আমি আর পাড়ার পাঁচটি ছেলে মিলে আমাদের দল। আমাদের বাড়িতেই আসেন তারিণীখুড়ো; এলেই খবর চলে যায়, আর পাঁচজন তুরন্ত চলে আসে খুড়োর গল্পের লোভে। একটা গল্পে পুরো একটা সন্ধে কেটে যায়। খুড়ো বলেন আর্টের খাতিরে খানিকটা রং চড়ানো ছাড়া গল্পগুলো ষোল আনা সত্যি।
‘আমি তখন থাকি পুনায়,’ বললেন তারিণীখুড়ো।
‘পুনে’ বলল ন্যাপলা।
একটা গল্পের গন্ধ পাচ্ছি, ন্যাপলা যাতে বারবার ইনটারাপ্ট না করে তাই তার কোমরে একটা চিমটি কেটে দিলাম।
‘ওই হল’, বললেন তারিণীখুড়ো, ‘পুনে-পুনা, মুম্বাই-বোম্বাই, তিরুচিরপল্লী-ত্রিচিনপলি—যে-কোনো একটা বললেই হল। আর আমি যখনকার কথা বলছি তখন সবে স্বাধীনতা এসেছে; পুনার পুনে হতে অনেক দেরি। পল্টু একটা চা বলো।’
আমি লক্ষ্মণকে ডেকে চা অর্ডার দিলাম—দুধ-চিনি ছাড়া চা—আর খুড়ো তাঁর গল্প সুরু করলেন।
আমি রয়েছি আমার এক বন্ধু রাধানাথ চাটুজ্যের বাড়ি। সে ফার্গুসন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক। কোডার্মায় মাইকা মাইনসের কাজে ইস্তফা দিয়ে শিবাজীর দেশে এসেছি একটা হোটেলের ম্যানেজারি নিয়ে। আমার বয়স তখন চৌত্রিশ।
পৌঁছাবার দুদিনের মধ্যেই রাধানাথ নিয়ে গেল উকীল ঘনশ্যাম আপ্টের বাড়ি। সেখানে সন্ধ্যায় আড্ডা বসে, পাঁচ মেশালি আড্ডা, যাকে বলে মিক্স্ড ক্রাউড। আমরা তিনজন ছাড়া আসে মহারাষ্ট্র ব্যাঙ্কের এজেন্ট মিঃ যোশী, ম্যাকডারমট কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারী মিঃ হরিহরণ, পুলিশ ইন্স্পেকটর মিঃ আগাশে আর তরুণ সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি।
কুরেশির বয়স আমাদের মধ্যে সব চেয়ে কম, ত্রিশ পৌঁছায়নি। তুখোড় ছেলে, হ্যাণ্ডসাম চেহারা, চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। সে আসে হরিহরণের সঙ্গে দাবা খেলতে। তাঁরা ঘুটি এঘর ওঘর করেন, আর আমরা বাকি পাঁচজনে মারি আড্ডা। সবচেয়ে বেশি কথা বলেন বাড়ির কর্তা আপটে সাহেব নিজে। আমার বিশ্বাস তাঁর কথা বলার প্রয়োজনেই এই আড্ডার সৃষ্টি। কিছু লোক আছে যারা সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া বাঁচতে পারে না। এই সাঙ্গপাঙ্গ যদি তোষামুদে হয় তাহলে ত কথাই নেই। অবিশ্যি আড্ডার সকলে আপ্টেকে তোষামোদ করে বললে ভুল হবে, তবে ওঁর মতামতের প্রতিবাদ কেউ করে না।
আগাশের মতো খোশ মেজাজের দারোগা আমি আর দুটি দেখিনি। অবিশ্যি যখন প্রথম আলাপ তখন তিনি একটা ব্যাপারে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সম্প্রতি কিছু টাটকা জালনোট পাওয়া গেছে পুনাতে। জালিয়াত কারা এবং তাদের আস্তানাটা কোথায় তাই নিয়ে পুলিশ দপ্তরে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। আগাশেকে তাই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে দেখা যায়।
দলের মধ্যে স্বল্পভাষী হলেন মিঃ যোশী; তবে শ্রোতা হিসেবে তিনি চমৎকার। সব কথাই উদ্গ্রীব হয়ে শোনেন। হাসির কথায় ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করেন, দুঃখের কথায় তাঁর জিভ দিয়ে চুক্ চুক্ শব্দ শুনে আপ্টের পোষা ড্যালমেশিয়ন বারান্দা থেকে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে যোশীর কাছে চলে এসেছে, এ ঘটনা বহুবার ঘটেছে।
আমার স্টকে হাজার গল্প, বাংলার বাইরে বছরের পর বছর কাটিয়ে ইংরিজিটাও বেশ রপ্ত, তাই আমার একটা বেশ ভালো পোজিশন হয়ে গেল আপ্টের আড্ডায়।
কী প্রসঙ্গে মনে নেই, একদিন কথা উঠল অশরীরী আত্মার। দেখা গেল আপ্টে ছাড়া আর সকলেই ভূতে বিশ্বাস করে। আমি আপ্টেকে বোঝালুম যে পুরাণ, শেক্সপিয়র, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথ, দেশবিদেশের উপকথা, সবেতেই ভূতের উল্লেখ আছে, কাজেই ভূতে বিশ্বাস না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আপ্টে তবু মাথা নাড়ে। সে বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, যুক্তিবাদী মন তার, খালি বলে ভূত জিনিসটা ভুয়ো।
হঠাৎ কেন জানি রোখ চেপে গেল, ধাঁ করে হাজার টাকা বাজি ধরে ফেললুম। বললুম দুমাসের মধ্যে ভূত দেখিয়ে দেব তোমায়। আপ্টে হেসে উড়িয়ে দিলে। বললে—‘সাবধান। হাজার টাকা খোয়া যেতে চলেছে তোমার এটা তোমায় বলে দিলাম।’
অবিশ্যি আমার দিক থেকে ব্যাপারটা অতিমাত্রায় রিস্কি হয়ে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। রাধানাথের কাছে ভৎর্সনাও শুনতে হয়েছিল; কিন্তু বাজির ব্যাপারে দাবার মতোই চাল ফেরত নেওয়া যায় না। কাজেই ব্যাক-আউট করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এরই দিন সাতেক বাদে আমাদের আড্ডায় এলেন প্রোফেসর অটো হেলমার। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের বাসিন্দা। ভদ্রলোক পক্ষিবিদ্, ভারতবর্ষে এসেছেন ভারতীয় পাখির ডাক রেকর্ড করতে। টেপ রেকর্ডার জিনিসটা তখন সবে আবিষ্কার হয়েছে, সাহেবের কাছেই প্রথম দেখলুম সেই আশ্চর্য যন্ত্র। আমাদের নানারকম পাখির ডাক শুনিয়ে সাহেব বললেন পুনায় এক জায়গায় তিনি নাকি হুতোম প্যাঁচার ডাক শুনেছেন। সেইটে রেকর্ড করতে পারলেই নাকি তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। প্যাঁচার ডাকের ভালো রেকর্ডিং তিনি এখনো পাননি।
‘কোথায় শুনলে ডাক?’ প্রশ্ন করলেন আপ্টে।
তাতে হেলমার সাহেব একটা বাড়ির বর্ণনা দিলেন—দুর্গ প্যাটার্নের প্রাচীন পরিত্যক্ত সাহেব বাড়ি। সেন্ট মেরি গির্জার পুব পাশে। তারই কম্পাউণ্ডে নাকি দু’রাত আগে প্যাঁচাটা ডাকছিল। সাহেব ছিলেন গাড়িতে। সঙ্গে টেপরেকর্ডার। চলন্ত অবস্থাতেই ডাকটা শুনে গাড়ি থামিয়ে নেমে কম্পাউণ্ডের পাঁচিলের ধারে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো ফল হয়নি। প্যাঁচা আর ডাকেনি।
বাড়ির বর্ণনা এবং অবস্থান শুনে আমাদের অনেকেই বললেন যে সেটা কনওয়ে কাস্ল। এখানে বলা দরকার যে বৃটিশ আমলে পুনা ছিল সাহেবদের একটা বড় ঘাঁটি। মিলিটারি ত বটেই, সিভিলিয়ানও অনেক থাকতেন পুনা শহরে। তাঁরা অনেকেই রিটায়ার করার পর পুনাতে বাড়ি করে সারাজীবন সেখানেই কাটিয়ে দিতেন। ব্রিগেডিয়র কনওয়ে ছিলেন এই রকম একজন সাহেব। তাঁরই তৈরি বাড়ি এই কনওয়ে কাস্ল। কূরেশি বাড়িটা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানে, সেই বললে। বাড়িটা তৈরি হয় কুইন ভিক্টোরিয়া যে বছর ভারত-সাম্রাজ্ঞী হন সেই বছর। অর্থাৎ ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে। কনওয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করার ছ’মাসের মধ্যে নাকি তাঁর স্ত্রী ও দুটি ছেলে মারা যায়। ছেলেরা অবিশ্যি বাড়িতে মরেনি; তারা দুজনেই ছিল আর্মিতে, মরেছিল দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে। স্ত্রী মারা যায় যক্ষ্মারোগে। আর তার তিনমাসের মধ্যে কনওয়ে নিজেও মরে। কীভাবে মরে জানা যায়নি। তবে অনেকের ধারণা সে আত্মহত্যা করে।
মোট কথা সেই থেকে এই বাড়ি অভিশপ্ত বাড়ি বলে পরিচিত। কেউ আর সে বাড়িতে থাকেনি। সকলের পক্ষে সম্ভবও হত না, কারণ এত পেল্লায় বাড়ি মেনটেন করা মুখের কথা নয়। আসবাবপত্র যা ছিল সবই নাকি কনওয়ের এক আত্মীয় বিলেত থেকে এসে নিলামে বিক্রী করে দেয়।
রাধানাথ সব শুনে-টুনে বলল, ‘কনওয়ে কাস্ল সম্বন্ধে একটা ঘটনা শুনেছি সেটা স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।’
‘কোন স্বদেশী আন্দোলন?’ প্রশ্ন করলেন আপ্টে।
‘বালগঙ্গাধর তিলকের সময়কার’, বললে রাধানাথ। ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে। মেজর লেথব্রিজ বলে এক সাহেবকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এক সন্ত্রাসবাদী দল। তারা নাকি ওই কাস্লে তাদের গুপ্ত ডেরা করেছিল। পরে আত্মসমর্পণ করে। তবে তাদের লীডার আচরেকরকে নাকি ধরা যায়নি। সে বেপাত্তা হয়ে যায়।’
‘কনওয়ে কাস্লে খোঁজ করা হয়েছিল কি?’ আপ্টে প্রশ্ন করলেন।
আগাশে হো হো করে হেসে উঠলেন।
‘মিঃ আপ্টে—পুলিশও মানুষ। তাদেরও ভূতের ভয় আছে। ওই অভিশপ্ত বাড়ি রেড করতে গেলে রীতিমতো হিম্মৎ লাগে।’
এদিকে আমার কৌতুহল চাগিয়ে উঠেছে। ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটেমোর শখ। সেটা চৌত্রিশ বছরেও পুরোপুরি বজায় আছে। পর পর অতগুলো মৃত্যু যেখানে ঘটেছে, সেই বাড়ির ভেতরে দু-একটা প্রেতাত্মা বসবাস করবে না কি? বাজি জেতার পক্ষে এ যে একটা বড় সুযোগ!
এর কিছুদিন পরেই হেলমার সাহেব আবার এলেন আড্ডায় তাঁর টেলিফুংকেন টেপ রেকর্ডার নিয়ে। ভদ্রলোকের বাঁ কব্জিতে ব্যাণ্ডেজ। বললেন কাঁটা ঝোপে হাত কেটে গেছে। মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে না সুখবর না দুঃসংবাদ। তাঁকে বসতে দিয়ে সকলেই তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলুম। হুতোমের ডাক শোনা যাবে কি?
হেলমার কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘ডাক তুলতে পেরেছি, তবে পারফেক্ট হল না। রাত বারোটার পর প্যাঁচাটা ডাকল, সঙ্গে সঙ্গে মেশিন চালু করলাম। তখন শহরের অন্য শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। নিয়মমতো নিখুঁৎ রেকর্ডিং হবার কথা, কিন্তু দেখ কী হয়েছে।’
শুনলাম প্যাঁচার ডাক। ছেলেবেলা আমাদের বাদুড়বাগানের বাড়ির পাঁচিলের ওপারে পুকুরের ধারে শ্যাওড়া গাছে একটা হুতোম প্যাঁচা থাকত, তাই তার ডাক চেনা ছিল। ইনিও যে হুতোম তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ তাকে সত্যিই বড্ড ডিস্টার্ব করছে। সাহেবের এত মেহনৎ ষোল আনা সার্থক হল না জেনে তাঁর প্রতি মমতা হল।
‘বাট হোয়াট ইজ দ্যাট আদার সাউণ্ড?’ প্রশ্ন করল কুরেশি। সে দাবা ছেড়ে এগিয়ে এসেছে।
‘সেটাই ত বুঝতে পারছিনা,’ বললেন হেলমার। ‘মেশিনেই গণ্ডগোল বলে মনে হচ্ছে। এর আগে ত এ রকম হয়নি কখনো।’
শুনলে মনে হয় একটা যান্ত্রিক শব্দ। ঘটাং ঘটাং ঘটাং ঘটাং এই রকম। খুবই ক্ষীণ, কিন্তু জার্মান পক্ষিবিদ্-এর মন যে তাতে খঁৎ খুঁৎ করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
‘প্লে দ্যাট এগেন প্লীজ!’ হঠাৎ বলে উঠলেন ইন্স্পেক্টর আগাশে। তাঁর শরীরটা টান, আর চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ্ণ দৃষ্টি—শিকারের গন্ধ পেলে যেমন হয় হিংস্র জানোয়ারের।
হেলমার টেপটা ব্যাক করে আবার চালালেন। আগাশে কোমর থেকে শরীরটা ভাঁজ করে কানটা নিয়ে গেছেন একেবারে স্পীকারের সামনে।
ততক্ষণে অবিশ্যি আমিও বুঝে গেছি আগাশে কী ভাবছেন।
শব্দটা শুনে প্রিন্টিং মেশিনের কথা মনে হয়। ছোট, পায়ে-চালানোর কল। যাকে বলে ট্রেড্ল মেশিন।
এইরকম যন্ত্রই সাধারণত ব্যবহার হয়ে থাকে নোট জাল করার কাজে।
শব্দটা কাস্লের ভিতর থেকেই আসছে না অন্য কোথাও থেকে আসছে সেটা অবিশ্যি বোঝার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তাও আগাশে স্থির করলেন যে কনওয়ে কাস্লে পুলিশের রেড় হবে। আগাশের হুম্কিতে নাকি কিছু কন্স্টেবল রাজি হয়েছে অভিশপ্ত দুর্গে প্রবেশ করতে। এমনি খোশমেজাজ হলে কী হবে, অফিসার হিসেবে নাকি ভদ্রলোক অত্যন্ত কড়া।
আমি কিঞ্চিৎ নিরাশ বোধ করছি। জালিয়াতরা যেখানে আস্তানা গেড়েছে সেখানে ভূত থাকার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? মনে ত হয় না।
পরদিনই রাত্তিরে রেড, আড্ডার সকলে ফলাফলের জন্য উদ্গ্রীব, এমন সময় ইন্স্পেক্টর সাহেব এসে হাজির।
‘সেকি, তোমাদের ত আজই রেড হবার কথা!’
আমাদের হয়ে আপ্টেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
আগাশে একটা বোকা হাসি হেসে মাথা নেড়ে সোফায় বসে পড়লেন।
‘ভাবতে পার? আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সে গ্যাং ধরা পড়েছে।’
‘কোথায়?’ আমরা সমস্বরে জিগ্যেস করে উঠলাম।
‘নাসিক’, বললেন আগাশে।
‘তাহলে ওই শব্দটা…?’
‘টেপরেকর্ডারেই কোনো গণ্ডগোল হবে। ওটা বাইরের কোনো শব্দ না। কাল মাঝ রাত্তিরে আমি কাস্লের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে কোনো শব্দ পাইনি।’
আর কিছু বলার নেই। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা বেলুন চুপসোনো ভাব, অথচ তার কোনো কারণ নেই। জালিয়াতের দল ধরা পড়েছে এ তো ভালো কথা; শুধু পুনার কনওয়ে কাস্লে ধরা না পড়ে পড়েছে অন্য শহরের অন্য জায়গায়। কিন্তু তাও বলতে হবে যা ঘটেছে তার মধ্যে যেন নাটকের অভাব।
অবিশ্যি পরমুহূর্তেই মনে হল—জালিয়াত যখন নেই, তখন ভূত থাকতে বাধা কী? কনওয়ে কাস্লে একবার হানা দিলে দোষ কী?
চা-টা শেষ করে আমিই কথাটা পেড়ে বসলাম, ‘কে কে যেতে রাজি আছ বল।’
যোশী গোড়াতেই বললে তার ধুলোয় অ্যালার্জি, তাই ওই পোড়ো বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। হরিহরণ বললেন, ‘আমি যাবো, কিন্তু আপ্টে সাহেবেরও যাওয়া চাই। ভূত যদি থাকে ত সেটা ওঁর চাক্ষুষ দেখা উচিত। আমাদের কথা উনি মানতে নাও পারেন।
আপ্টে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি যাব। এবং আমি সঙ্গে ক্যাশ হাজার টাকা নিয়ে যাব। আমার কণ্ডিশন হল যে মিঃ ব্যানার্জিও যেন সঙ্গে টাকা রাখেন। বাজির টাকা ফেলে রাখা নিয়মবিরুদ্ধ।’
আমি বললুম, ‘তথাস্তু। তাহলে কালই হোক এক্সপিডিশন।’
এইখেনে কুরেশি বললে তাকে নাকি দুদিনের জন্য কোলাপুর যেতে হবে একটা রিপোর্টিং-এর ব্যাপারে; ফিরে এসে সে যেতে প্রস্তুত আছে। আমরাও তাতে রাজি হয়ে গেলুম।
আগাশে এতক্ষণ চুপ করে আমাদের কথা শুনছিলেন; এবার তিনি মুখ খুললেন।
‘জেন্টলমেন, তোমাদের একটা প্রশ্ন করতে চাই। কাস্লের সদর দরজা যদি তালা দিয়ে বন্ধ থাকে, তাহলে সেটা খোলার যন্ত্র, বা জানালা ভেঙে খোলার সরঞ্জাম—এসব তোমাদের আছে কি? কাজটি কিন্তু সহজ নয়।’
এ প্রশ্নের জবাব অবিশ্যি হ্যাঁ হতে পারে না। আমাদের যেটা আছে সেটা হল উৎসাহ আর উদ্যম। যন্ত্রপাতি থাকবে কোত্থেকে?
আমরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি দেখে আগাশে একটু হেসে বললেন, ‘কাজেই বুঝতেই পারছ, আমি ছাড়া তোমাদের গতি নেই।’
ভালোই হল। শুধু জানালা দরজা ভেঙে খোলার সরঞ্জাম নয়, একটি আগ্নেয়াস্ত্রও থাকবে সঙ্গে এটাও কম ভরসা নয়।
জুন মাস, দিনে বেজায় গরম, রাত্তিরের দিকটা তবু একটু ঝিরঝির হাওয়া দেয়। বন্দোবস্ত অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া সেরে ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় আমরা ছ’জন সেন্ট মেরি গির্জার সামনে জমায়েত হলাম। পাড়াটা নির্জন, গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। আমরা দল বেঁধে এগোলাম কনওয়ে কাস্লের দিকে।
ফটক থেকে কাস্লের দরজা অবধি লম্বা রাস্তা। এককালে বাহার ছিল রাস্তাটার সেটা আঁচ করা যায়, এখন পথ বলতে প্রায় কিছুই নেই, টর্চের আলোয় কোনোরকমে আগাছা বাঁচিয়ে পা ফেলতে হয়। বাড়িটা আমাদের সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে এক বিশাল প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, কেউ যে কস্মিনকালেও সেখানে ছিল সেটা এখন আর বিশ্বাস হয় না। দলে আছি বলে রক্ষে, নাহলে যতই ডানপিটে হই না কেন, আশি বছরের মধ্যে মানুষের পা পড়েনি এমন একটা থম্থমে অন্ধকার অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের মধ্যে যে একটা ট্রেড্ল মেশিন চলতে সুরু করেছে, সেটা ত অস্বীকার করা যায় না।
আগাশে সদর দরজায় ঠেলা দিতেই সেটা একটা জান্তব আর্তনাদ করে ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর সেই সঙ্গে ইঁদুর বাদুড় পায়রা চামচিকে গিরগিটি ছুঁচো মেশানো একটা গন্ধর ধাক্কায় আমরা সকলেই বেশ কয়েক হাত পিছিয়ে গেলুম।
তারপর দুরু দুরু বক্ষে সবাই মিলে ঢুকলুম ভেতরে। এটা ল্যাণ্ডিং, বাঁ দিকে চওড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। আগে একতলা সেরে তারপর দোতলায় যাব এটাই আমার ইচ্ছে ছিল, দেখলাম সকলেই তাতে সায় দিলে। আমরা সার বেঁধে গিয়ে ঢুকলুম একটা বিশাল ঘরে। সম্ভবত ডাইনিং রুম ছিল এটা। সারা ঘরে একটিও আসবাব নেই ঠিকই, কিন্তু দেয়ালে ধূলিমলিন ওয়ল পেপারের উপর বড় বড় ছবির ফ্রেমের দাগ রয়েছে, খান তিনেক দেয়ালবাতির মর্চে ধরা ব্রাকেট রয়েছে, আর সীলিং থেকে ঝুলে আছে ঝাড়-লণ্ঠন আর টানাপাখার হুক। এটার কড়িকাঠেই বাদুড় ঝোলার কথা, তবে তারা বোধহয় রাত্তিরে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে। এত বড় বাড়ির এতগুলো জানালার মধ্যে কয়েকটা কি আর খোলা নেই? বাদুড় না থাকলেও, ছোটখাটো চতুষ্পদ প্রাণী যে কিছু রয়েছে সেটা মেঝের এদিক ওদিক থেকে সড়াৎ সড়াৎ শব্দেই বুঝতে পারছি।
এতক্ষণ সবাই একটা জমাট দল বেঁধে চলাফেরা করছিলুম, বড় ঘর পেয়ে সেটা কিছুটা আলগা হল। কুরেশি দেখলুম একাই একটা টর্চ নিয়ে হল ঘরের পাশের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আপ্টেও খানিকটা এগিয়ে গেছে আমাদের ছেড়ে, তারও নিজস্ব একটি টর্চ আছে। ভূত এখনো চোখে পড়েনি ঠিকই, কিন্তু এর চেয়ে ভালো ভৌতিক পরিবেশ আর কি হতে পারে আমি জানি না।
হলঘরের একটা দরজা দিয়ে ডাইনে ঘুরে একটা প্যাসেজ পড়ল। সেটার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই ঘরের সারি। আগাশে তার পাঁচ-সেলের টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চলল প্যাসেজ ধরে। আমরা তার পিছনে। ঘর পড়লে দরজা দিয়ে আলো ফেলে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি।
এইভাবে পাঁচখানা ঘর দেখার পর একটা ঘটনা ঘটল যেটা ভাবতে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
একটা গোঙানির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্যাসেজের শেষ প্রান্তে বাঁয়ের একটা দরজা থেকে পিছন ফিরে টলতে টলতে বেরিয়ে এল কুরেশি। তার মুখ দেখতে না পেলেও, আতঙ্কের ছাপ রয়েছে সর্বাঙ্গে সেটা বুঝতে পারছি। ঘাড় কুঁজো, হাত দুটো পিছনে এবং কনুইএর কাছে ভাঙা, হাতের আঙুলগুলো ফাঁক।
আগাশের সঙ্গে আমরাও দৌড়ে গেলাম কুরেশির দিকে। আপ্টেও এখন আমাদেরই সঙ্গে রয়েছে।
‘কী হল? কী ব্যাপার? আগাশে ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করলে।
কুরেশি কাঁপা হাত দিয়ে খোলা দরজার দিকে দেখিয়ে দিলে।
ঘরের ভিতর আলকাতর অন্ধকার। আগাশে তার টর্চটা ফেলতে প্রথমে বিপরীত দিকের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তারপর টর্চটা একটু তুলতেই যা দেখলুম তাতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।
সীলিং থেকে ঝুলছে দড়ি, আর সেই দড়ি ফাঁস দিয়ে বাঁধা একটি আস্তো নরকঙ্কালের গলায়।
ধন্যি ইন্সপেক্টর আগাশে। এই চরম আতঙ্কের মুহূর্তেও সে দিব্যি ঠাণ্ডা গলায় বললে, ‘ইনিই সেই স্বদেশী গ্যাঙের লীডার আচরেকর বলে মনে হচ্ছে। এই কারণেই বেপাত্তা হয়ে গেছিলেন ভদ্রলোক।’
‘বাট এ স্কেলিটন ইজ নট এ গোস্ট।’
ঠিকই বলেছেন মিঃ আপ্টে। এবং তিনিও যেমন দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে বললেন কথাটা, তাতে তাঁর নার্ভের তারিফ না করে পারা যায় না।
‘সরি’ বললেন কুরেশি, ‘হঠাৎ সামনে কঙ্কালটা দেখে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম।’
‘কিন্তু ওটা কী?’
প্রশ্নটা করলেন আগাশে। তাঁর টর্চের আলো এখন সীলিং থেকে নিচের দিকে নেমেছে।
ঘরের কোণে ধুলো আর মাকড়সার জালে মুড়ি দেওয়া কিসের জানি একটা স্তূপ।
আলোটা ভালো করে ধরতে বুঝতে পারলুম জিনিসটা কী, আর পেরে একেবারে তাজ্জব বনে গেলুম।
এ যে দেখছি একটা ট্রেডল মেশিন! এখানে ছাপার যন্ত্র কী করছে?
আগাশে ব্যাপারটার একটু খুব সহজ এক্সপ্ল্যানেশন দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এটা যদি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি হয়ে থাকে তাহলে ছাপার কল থাকা অস্বাভাবিক নয়। এক নম্বর—তাদের মুখপত্র লুকিয়ে ছাপবার জন্যে কলের দরকার হত; দুই—সন্ত্রাসবাদীরা টাকার প্রয়োজনে নোট জাল করেছে এও অনেক শোনা গেছে।’
রাধানাথ এ কথায় সায় দিল।
মাথার উপর ঝুলন্ত কঙ্কাল আর তার নিচে নির্জীব যন্ত্রটা অদ্ভুত ভাবে যেন এক অতীত যুগের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
‘আরো অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে কি? প্রশ্ন করলেন মিঃ আপ্টে।
আমরা সকলেই বললাম যে যখন এসেছি তখন সারা বাড়িটা না দেখে ফিরব না। আমিই অবিশ্যি কথাটায় সবচেয়ে বেশি জোর দিলাম। কঙ্কাল হল মৃতব্যক্তির দেহের পরিণাম। তার আত্মা কী অবস্থায় আছে তা কে বলতে পারে?
প্যাসেজ দিয়ে যখন উল্টোমুখে অর্ধেক পথ এসেছি তখন শুনতে পেলাম সেন্ট মেরি চার্চের ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। ঘন্টার রেশ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ সুরু হল যেটা আমাদের হাঁটা বন্ধ করে দিল।
যে ঘর থেকে এলাম, সে ঘর থেকেই আসছে শব্দটা।
ট্রেড্ল মেশিন চলতে শুরু করেছে, আর তার শব্দে সারা কনওয়ে কাস্ল গম্ গম্ করছে। সেই সঙ্গে মাথার উপর ডানার ঝটপটানি সুরু হয়েছে, কারণ ঘুলঘুলির বাসিন্দা পায়রাগুলোর ঘুম ভেঙে গেছে প্রেসের শব্দে।
আমরা ছ’জনে রুদ্ধশ্বাসে শব্দটা শুনছি। দ্বিতীয়বার ওই ঘরের দিকে যাবার কোনো মানে নেই, কারণ জানি সে ঘরে যন্ত্র চালানোর মতো কোনো লোক নেই। হয়ত ওই আচরেকরই এককালে যন্ত্রটা চালিয়েছে। তারপর এক সময়ে বৃটিশ পুলিশের হাতে লাঞ্ছনা এড়াবার জন্য গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। আর সেই থেকে প্রতিদিন মাঝরাত্তিরে তার প্রেতাত্মা ওই ট্রেড্ল মেশিন চালিয়ে এসেছে। তার মানে হেলমারের রেকর্ডারে যে শব্দটা উঠেছিল সেটা এটারই শব্দ।
কনওয়ে কাস্লের বাইরে বেরোবার পর বেশ কিছুক্ষণ কারুর মুখে কথা নেই। হরিহরণ অসুস্থ বোধ করছে, সে গিয়ে তার গাড়িতে উঠে পড়ল। কথা ছিল আপ্টে তার গাড়িতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে। তার ডজ সিডানে ওঠার আগে সে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘টেন হানড্রেড-রুপী নোট্স—গুনে নাও।’
আমার তখন রীতিমতো অসোয়াস্তি লাগছে। তবে এ তো আর এলেবেলে খেলা নয়—এ বেট ইজ এ বেট।
খাম থেকে নোটের গোছাটা বার করে রাস্তার আলোতে একবার দেখে নিলুম। দশখানাই আছে।
তিনদিন পরে এক শনিবারের সন্ধ্যায় নেপিয়ার হোটেলে ডিনার হল। আমিই খাওয়ালুম। তখনকার সস্তাগণ্ডার দিনে সাত জনের বিল হল একশো নব্বই টাকা। আজ হলে বড় হোটেলে সাত জনের ফাইভ-কোর্স ডিনার হাজার টাকায় হত কিনা সন্দেহ।
গল্প শুনে ন্যাপলা বলল, ‘তাহলে খুব দাঁও মারলেন বলুন।’
খুড়ো উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন, কারণ সদ্য আনা তৃতীয় কাপ চা-যে গলা ভেজানো আছে, তারপর বিড়ি ধরানো আছে।
‘তা বটে,’ অবশেষে বললেন খুড়ো, ‘তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয়।’
‘আরো আছে?’ আমরা সকলেই প্রশ্ন করলাম। এর পরে আর কী থাকতে পারে সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তারিণীখুড়ো বলে চললেন—
ঘটনার কদিন পরে এক সকালে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো আমাদের আড্ডার সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি। বললে, ‘আমার গাড়ি আছে, তোমাদের একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। বিশ মিনিট স্পেয়ার করতে পারবে?’
কৌতূহল হল। রাধানাথ আর আমি গিয়ে উঠলুম তার গাড়িতে। কুরেশি নিজেই ড্রাইভ করে। কিছুদূর যেতেই বুঝলাম গাড়ি চলেছে আবার সেই কনওয়ে কাস্লের দিকে। কেন যাচ্ছে সে কথা বললে না ছোক্রা, খালি বললে এ কদিনে সে নাকি আরো তথ্য আবিষ্কার করেছে কনওয়ে সাহেব সম্বন্ধে।
একটি খবর নাকি বিলিতি কাগজে ছাপেনি, দিশি কাগজে পেয়েছে সেটা কুরেশি। ব্রিগেডিয়ার কনওয়ে তাঁর এক পাংখাবরদারকে বুট দিয়ে লাথিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। তাতে রাধানাথ বললে সেটা নাকি সে-যুগের একটা স্বাভাবিক ঘটনা। গরমকালে মাঝরাত্তিরে পাংখাবরদার পাখা টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়ত। মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে যেত সাহেবের। আর তখন রাগে দিক্বিদিক্জ্ঞান হারিয়ে এমন প্রহার করত ভৃত্যকে যে সে বেচারা অনেক সময় মরেই যেত।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গাড়ি গিয়ে থামল কনওয়ে কাস্লের গেটের সামনে।
কুরেশির পিছন পিছন আমরা গিয়ে ঢুকলাম কাস্লের ভেতর। দিনের বেলাও রীতিমতো অন্ধকার, ঢুকলে গা ছম্ছম্ করে।
‘আমরা কি আবার সেই ঘরেই যাচ্ছি?
রাধানাথের এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিলে না কুরেশি। তবে তার লক্ষ্য যে ওই একই ঘরের দিকে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কী দেখব কে জানে। শিরার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য অনুভব করছিলুম। কুরেশি ছোক্রা নির্বিকার।
আর তা হবে নাই বা কেন। সে ঘর যে খালি! দড়ি কঙ্কাল, ছাপার যন্ত্র, সব হাওয়া!
আমাদের হতভম্ব ভাব দেখে কুরেশি হো হো করে হেসে উঠলে। তারপর এক অদ্ভুত প্রশ্ন করলে।
‘আপ্টের বাড়িতে চা ছাড়া কিছু খেয়েছ কখনো?’
প্রশ্নটা অপ্রত্যাশিত হলেও বললুম, ‘কই, না ত!’
‘ওই ত! বললে কুরেশি। ‘লোকটা হাড় কঞ্জুশ। তাছাড়া ওর আত্মম্ভরি ভাবটাও মাঝে মাঝে ইরিটেট করে আমাকে। তুমি বাজিটা ফেলে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ করনি। তোমার নির্ঘাৎ হাজার টাকা খসত। তাই ভাবলাম কনওয়ে কাস্লে যদি ভূতের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে তোমারও লাভ, উনিও জব্দ। তাই দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। কঙ্কালটা আমার বন্ধু আর্টিস্ট কুলকার্নির বাড়ি থেকে আনা। ট্রেড্ল মেশিনটা শিবাজী জব প্রেসের। প্রোপ্রাইটার মধুকর ঢোন্ঢির ছেলে আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। ওটার জন্যে কিছু দক্ষিণা লাগবে; আর ওদেরই আপিসের এক ছোকরা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল; সে-ই কলটা চালায়। বেচারা অনেক মশার কামড় খেয়েছে। তাকে কিছু বকশিস দিয়েছি—’
আমি আর কথা বলতে দিলুম না কুরেশিকে। এক হিসেবে পুরো টাকাটাই ওর প্রাপ্য, কিন্তু পাঁচশোর বেশি কিছুতেই নিতে রাজি হল না।
প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে যখন ল্যাণ্ডিং-এ এসেছি, তখন কুরেশি বললে, ‘একবার দোতলায় যাবে নাকি? দেখবার জিনিস আছে কিন্তু। এলেই যখন…’
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে যুদ্ধের দামামার মতো শব্দ তুলে তিনজনে ওপরে হাজির হলুম। ল্যাণ্ডিং পেরিয়ে বৈঠকখানা। একটা শন্ শন্ মচ্ মচ্ শব্দ পাচ্ছিলুম, কিন্তু সেটা যে কী সেটা বুঝতে পারছিলুম না।
বৈঠকখানায় ঢুকে প্রচণ্ড চমক।
এ ঘর যে একেবারে আসবাবে ঠাসা! ভিক্টোরিয় যুগের সোফা, টেবিল, আয়না, মার্বেলের মূর্তি, দেয়ালের বাতি, কার্পেট, ঝাড়লণ্ঠন—কোনোটাই বাদ নেই। মনে হয় ঠিক যেমন ছিল তেমনিই আছে, তবে সব কিছুরই উপর আশি বছরের ধুলো জমে সেগুলোর আসল চেহারা বেমালুম ঢেকে দিয়েছে।
কিন্তু মোক্ষম চমকটা ঘরের মেঝে বা দেয়ালে নয়, সেটা হল সীলিং-এ।
সীলিং-এ দুলছে একটি বিশাল শতছিন্ন টানা পাখা, যার হাওয়া এই জুন মাসের ঘাম ছুটোনো গরমে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু এই পাখা টানছে কে? আর টানছে কী ভাবে? কারণ পাখার কোনো দড়ি নেই।
অর্থাৎ সেটাকে টানার কোনো উপায় নেই।
‘ভূতের উৎপাত বলে এ ঘরে কেউ প্রবেশ করেনি,’ বললে কুরেশি। ‘তাই জিনিসগুলোও নিলাম হয়নি। আমি ঘরটা আবিষ্কার করি ভূতের সব ব্যবস্থা করার পর। তারপর ভেবে মনে হল কঙ্কাল আর ট্রেড্ল মেশিনে ব্যাপারটা আরো জমবে।’
অবাক বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলুম অশরীরী পাংখাবরদারের অদৃশ্য হাতে টানা পাখার দিকে। ভূত বলেই তার ক্লান্তি নেই ঘুম নেই, সাহেবের লাথিতে মৃত্যু নেই।
আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছি তখনও বেশ কিছুক্ষণ ধরে শুনতে পেলুম ওই টানাপাখার শব্দ।
কঙ্কাল আর ছাপার কলের ব্যাপারটা কুরেশির কারসাজি জেনে মনে একটা খচখচে গিল্টি ভাব জেগে উঠেছিল; এখন বুঝতে পারলুম দিব্যি নিশ্চিন্ত লাগছে।