চুলের আমি চুলের তুমি
—চুল তুমি কার?
—আগে ছিলাম মাথার, এখন মাটির।
পার্লারের মেঝেয় ছড়িয়ে থাকা অসহায় চুলের গোছাগুলোর দিকে চেয়ে জিনার বুক ঠেলে কান্না এল। সে বলল, প্লিজ, চুলগুলো আমাকে দিয়ে দিন।
—আগে বলবেন তো! মেঝেতে পড়ল! ঠিক আছে ওয়াশ করে দিচ্ছি।
গোছা করে চুলগুলো সযত্নে তুলল মেয়েটি। এলোমেলোগুলো বাদ দিয়ে দিল, তারপর শ্যাম্পু লাগিয়ে চড়া জলের ধারার তলায় ধুয়ে, ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে, রাবার ব্যান্ড আটকে ওর হাতে তুলে দিল। বলল, এত মন খারাপ তো কাটলেন কেন ম্যাডাম? আমাদের ব্যবসা, আমরা তো বলবই চুল কাটুন, ডাই করুন, ব্লিচ করুন…
জিনা হাসল, বলল, স্বীকার করছেন তা হলে!
মেয়েটি বলল, দুপুরবেলা, আর কাস্টমার নেই, আমাদের ম্যাডামও লাঞ্চে গেছেন তাই বলে ফেললাম। সাহেবের শখ, না?
জিনা চমকে উঠল, এ কথা কেন মনে হল আপনার?
—বা! সাহেবের শখেই তো বেশির ভাগ কাস্টমার চুল কাটে। আপনার মতো এমন সুন্দর ন্যাচারাল ওয়েভঅলা চুল যাদের, তারা বড় জোর একটু শেপ করে নিতে ভালবাসেন। আমাদের এমন কাস্টমারও আছে, জানেন, হাঁটু ছাড়িয়ে ঘন চুল। পার্লারে এসে শ্যাম্পু করাতে হয় এত। কিছুতেই চুল কাটবে না। চুল কাটে কারা? বয়স হয়েছে, চুল কমে বিশ্রী হয়ে গেছে, কী করলে ভাল লাগবে বুঝতে পারছে না… আপনার বয়সে আপনার মতো চুলে…ওসব সাহেবদের শখ।
জিনার হঠাৎ একটু স্বস্তি বোধ হল। যাক বাবা, আর পাঁচজনেরও তার মতো বর আছে। সে একলাই দুখিনী নয়।
টাকা মিটিয়ে সে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে এল। বর্ষার আকাশ থমথম করছে। যে কোনও মুহূর্তে ঢালতে পারে। ভিজে স্যাঁতসেঁতে দিন। চাবি দিয়ে নিঃশব্দে দরজাটা খুলল সে। দরজার কপাট, ভেতরের দেয়াল, পিয়ানো-রিড সিঁড়ি সব তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চিনতে পারছে না। ‘কে তুমি রঙ্গিণী, আগে তো দেখিনি’ গোছের ভাব। নিজের বাড়িতেই জিনা চোরের মতো পা টিপে টিপে চলাফেরা করছে। বাবা যদি উঠে পড়েন! এই সময়টায় উনি ওঁর আরামচেয়ারে পড়তে পড়তে টুক করে একটু ঘুমিয়ে পড়েন। পাতলা একটা ফুরফুরে নাক ডাকার শব্দে উঁকি মেরে সে দেখেছে দৃশ্যটা। কিন্তু খুব পাতলা ঘুম। এক্কেবারে বোনচায়নার মতো ভঙ্গুর। নিজের নাকের ডাকেই ভেঙে যায়। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল সে। বাথটবে জল ভরল, ও ডি কলোন দিল। তারপর পা খালি করে আস্তে আস্তে ছলাত ছলাত। এই ব্যাটা বাথটবই যত নষ্টের গোড়া।
বাবু বাথটব বসালেন, একসঙ্গে নাকি চান করবেন। এমা! ঠিক আছে বাবা তাই তা-ই। আয়না বসিয়েছে একখানা মানুষ-মাপের। টব থেকে উঠে তাকে যে এড়িয়ে যাবে তার উপায় নেই। একটা লেসের ঢাকা দিয়ে তাকে মোটামুটি ঘোমটা দিয়ে রাখা গেছে। তা এই টবে যুগল-স্নান করতে করতে গোছাসুদ্ধু তার চুলগুলো ধরে একদিন মারল এক টান। এই বাথটবে এরকম চুল মানাচ্ছে না যা-ই বলো! কেমন ঠাকুর ঠাকুর লাগছে। এখানে ঠাকুর নয়, মেমসাহেব দরকার। চুলগুলো কেটে ফেলো।
মানে? ভেরি অবজেকশনেব্ল্! তোমার বাথটবের সঙ্গে ম্যাচ করার জন্যে আমার চুল কাটতে হবে? সাব্বাস, কোনওদিন বলবে তোমার মুন্ডুটা বেডরুমের সঙ্গে যাচ্ছে না, তখন কি মুন্ডুটাও ঘ্যাঁচ করে…
—ঠিক আছে, আর বলব না। আমার ভাল লাগা না-লাগায় তোমার যদি কিছু এসে না যায়, কী আর করা যাবে!
অভিমান? বাব্বাঃ, নতুন জিনিস! জিনার গায়ে পুলক লাগে। গ্যাটম্যাট রাগ নয়, লাল-চোখ আদেশ নয়, মুখ-কুঁচকোনো ঘেন্না বা তাচ্ছিল্য নয়। তার বরের অভিমান হয়েছে। পুরনো ইয়ার্কিবিলাসী মন তাকে সুড়সুড়ি দেয়, সে মিটিমিটি হেসে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে—আমার ভাল লাগা না-লাগাতেও তো তোমার কিচ্ছু যায় আসে না। দাও না বাবা তোমার নেয়াপাতিটুকু স্লাইস করে কেটে। ভুঁড়িতে সে আচ্ছা করে কাতুকুতু দেয়।
এই কী হচ্ছে? কী হচ্ছে? নিখিল হাসতে হাসতে কেশে ফেলে। জলে খানিকটা খাবি খায়। জল গিলে ফেলে। জিনা বাথরোব গায়ে জড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পগার পার।
কিন্তু রোজ যদি একই ঘ্যানঘ্যান করে? ভাল লাগে? বিনুনি করা কি হাতখোঁপা করা বাঙালি মেয়ে রান্নাঘরে মানায়, ক্লাবে মানায় না। কেমন ভেতো ভেতো লাগে, কিছু না হোক চুলগুলো সোজা করে খুলে রাখো।
—আমার হালকা চুল বাবা, উড়বে, এলোমেলো হয়ে যাবে, চুল খুলে রাখলে আমার ভীষণ অস্বস্তি হয়। কেন? তোমাদের ওই মিসেস শিবদাসানি তো আমার খোঁপার কত প্রশংসা করলেন।
—বোঝে না। ওটা প্রশংসা নয়।
—ব্যাজস্তুতি?
—ইয়েস।
—জিনা কষে সাবানের ফেনা তোলে, বিজ্ঞাপনের মেয়েদের মতো। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে। নতুন জিনা আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাংচায়, বলে—তুই আর তুই নেই।
কত লোকেই তো চুল কাটে। ভালও দেখায়, নতুন দেখায়। নিজেকে নতুনরূপে দেখবার জন্যেই তো এত কাণ্ড! জিনার একারই কেন এমন স্যামসনের মতো অবস্থা! মাথাটা হালকা লাগছে, মান মর্যাদা গরিমা সব কিছুই কেন হালকা লাগছে? বাইবেলে গল্প আছে স্যামসনের চুল কাটলে শক্তি কমে যেত। তারও নিজেকে কেমন বলহীন, সত্যিকারের অবলা লাগছে। বিয়ের সময়ে শুনেছিল এই চুলই নাকি বিশেষ পছন্দ হয়েছিল নিখিলের। সে যখন খোলা চুলে পেছন ফিরে চলে যাচ্ছিল সেই দৃশ্য নাকি নিখিলের চোখে লেগে আছে, চিরকাল থাকবেও। জিনা এমনিতে নিজের কোনও বিশেষ অঙ্গের প্রশংসা শুনতে ভালবাসে না। তার কেমন অস্বস্তি হয়। কেউ যদি বলে—ইস জিনা তোর হাতগুলো কী সুন্দর!
—দেখিস আবার, হাতগুলোকেই আমি ভেবে বসিস না।
যখন ষোলো-সতেরো বছর বয়স কে এক বন্ধু হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
—কী রে, আমাকে দেখছিস?
—তোর স্কিন দেখছি। কী মাখিস রে?
—ব্রণ উঠলে ডাকব দেখে যাস—জিনা রাগ করে বলেছিল। এ এক অদ্ভুত বিদঘুটে ছেলেমানুষি, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা। কিন্তু নিখিল যখন প্রথম বিয়ের পর তার চুল নিয়ে আদিখ্যেতা করত, তার খারাপ লাগেনি। যেন গোড়ার থেকে জানাই ছিল, তার থেকে প্রায় বারো বছরের বড় এই লোকটা তাকে খণ্ডখণ্ডভাবে ছাড়া দেখতে পাবে না। হাত পা চুল চোখ নাক কান বুক—এ সবের ক্যালাইডোস্কোপ। কিন্তু সেই চুলই অমন নির্মমভাবে কেটে ফেলতে বলল? তার মানে কি ও খণ্ড থেকে শেষ পর্যন্ত জিনার সামগ্রিকতায় পৌঁছোল? নাকি সমগ্রকে দেখতে পেল না, আবার খণ্ডও গেল! এই জাতীয় কিছু অস্পষ্ট ভাবনা তার ভেতরে কাঁকরের মতো ফুটছিল। নতুন চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তার মনে হচ্ছিল—এই খুশি করার কি কোনও শেষ নেই? ‘খুশি থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো’ এই তো ছিল তার নিজের মনোভাব। মানুষটা রাগী, জটিল, খেয়ালী, দাম্ভিক, আত্মকেন্দ্রিক। ঘটনাচক্রে যদি এমন মানুষের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়তে হল তাকে, কুছ পরোয়া নেই, মতিঝিলের নাগিনী ওতে ঘাবড়ায় না। যাতে খুশি থাক, খুব অদেয় না হলে তাই-ই দিচ্ছি। বন্ধুদের আসরে যেতে হবে? ডাকতে হবে? বানাচ্ছি কাবাব, শিখে নিচ্ছি ককটেলের কায়দা। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। একদিন বাড়ি ফিরে নিখিলবাবুর ক্রুদ্ধ মন্তব্য— খুব যে। এবার কি ওই রণেনকে নিয়েই কাটবে না কি?
রণেন ওর এক নম্বরের বন্ধু। তার বাড়িতেই সবচেয়ে জমাটি আসরগুলো বসে।
—কাটতে হবে কেন? তোমার কি তা হলে ভাস্বতীকে নিয়ে কাটতে সুবিধে হয়?
ভাস্বতী রণেনের স্ত্রী। তার সঙ্গে নিখিলের ফস্টিনস্টি খুব জমে। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে নিখিল বলল—মেরে মুখ ভেঙে দেব একেবারে।
শুনে—জিনা হাঁ। নিজেকে চিমটি কেটে দেখে স্বপ্ন দেখছে কিনা। বলে কী রে লোকটা? সত্যি সত্যি মারবে না কি? তুমি ঢিল ছুড়েছ আমিও একটা ছোট্ট করে পাটকেল ছুড়ে দিয়েছি। এতে মারধরের কথা ওঠে কেন? নাগ-বাড়ির চৌহদ্দিতে কোনও মারধরের ব্যাপার নেই। জিনা যাকে বলে শক্ড্।
আর কিছুতেই সে যাবে না। কোনও বন্ধুবান্ধবের জমায়েতে সে যাবে না তো!
সাধাসাধি শুরু হল তখন।—প্রেসটিজ থাকছে না আমার। সব্বাই জিজ্ঞেস করছে তোর বউয়ের কী হল!
—বলোগে বউ ফিউজ হয়ে গেছে।
—ঠিক আছে বাবা, যত খুশি ঢলাঢলি করো, আর কিচ্ছু বলব না।
—ঢলাঢলি? মানে? যাব না, আমি কিছুতেই যাব না।
বললেই কি আর জেদ বজায় থাকে! বন্ধুরাই সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হয়। টুকটাক রাঁধতেও হয়, বোতলও খুলতে হয়, হাসি-ঠাট্টাতেও যোগ দিতে হয়। কিন্তু সে প্রবলভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ জারি রাখে। তার স্বাভাবিক দমদম-সুলভ ফুর্তিবাজ স্মার্টনেসকে, তার বর লাস্যফাস্য ভেবে খেপে ষাঁড় না হয়ে যায়। খুশি থাকো বাবা, খুশি থাকো।
কিন্তু এই সবটাই জিনার কাণ্ডজ্ঞান। তার আপসপ্রিয়তা, শান্তিপ্রিয়তা। এর চৌহদ্দিতে কোথাও ভয় নেই। নিখিলের বহু নির্দেশ সে পালন করে চলে। যেমন চায় তেমনই থাকে, সবই ঠিক, কিন্তু এ সবই তার অকৃপণ দান। সে ইচ্ছে করলেই না দিতে পারত। যেখানে দেবে না ঠিক করে, সেখানে সে অনায়াসে নিজের মতো চলে। যেমন, শ্বশুরমশাইকে সে তাঁর নিজের ঘর থেকে সরতে দেয়নি। তিনি বলেছিলেন আমি থাকলে তোমাদের ভাগে একটা ঘর কম পড়বে। শুধু ঘর কেন, শান্তির জন্য আমি আরও অনেক বেশি স্যাক্রিফাইস করতে পারি ছোট বউমা।
মনে মনে জিনা বলেছিল—আমিও।
কিন্তু কিছুতেই ওঁকে ঘর ছাড়তে দেয়নি। দিদিভাইদের পরিবারের সঙ্গে সে ঠিক আগেকার মতো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখনও গিয়ে সে দিদিভাইয়ের ভাঁড়ার গুছিয়ে দিয়ে আসে। ঝুম্পা-মাম্পিকে গান শেখাতে বসে। এখনও দাদার সঙ্গে ইয়ার্কি মারে। ভাল কিছু রাঁধলেই বাটি করে ওদের দিয়ে আসে। নিয়েও আসে। একেবারে শতকরা শতভাগ সহজ স্বচ্ছন্দ, যেন মাঝখানে কোনও পাঁচিল নেই। তোমার প্রয়োজনে তুমি পাঁচিল তুলেছ তোলো, আমার কাছে ওর অস্তিত্ব নেই। তোমার রাগারাগি করে নিজের গুরুত্ব জাহির করতে ইচ্ছে হয় করো, আমি দমছি না। ডিজাইনার ড্রেস এনে দিয়েছ? পরলে ভাল দেখাচ্ছে না। এটা আমার বিচার, তোমার চোখের বিচার বলছে ভাল। ঠিক আছে বাড়িতে পরলাম, নিভৃতে। এই জর্জেট কাপড়ের নদীস্রোতের মতো ড্রেস পরে আমি কোনও পার্টিতে যাচ্ছি না। চুল কাটতে বলেছিলে, ঘ্যানঘ্যান করে কানের পোকা বার করে দিচ্ছিলে, ঠিক আছে চুলগুলোও আমার শান্তিপ্রিয়তার আর তোমার খুশি থাকার বেদিমূলে নামিয়ে রাখলাম। কিন্তু এটা আমার পক্ষে বড্ড বেশি, মানে টু মাচ হয়ে যাচ্ছে, হয়ে গেল, এত বেশি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করলে একটা উলটো প্রতিক্রিয়া হয়। তুমি যদি একটা ভারী জিনিসকে ঘুসি মার, তোমার হাতে লাগবে, তখন তোমার মলম লাগবে। ব্যথাহারী মলম।
জিনা ফোনটা তুলে নিল।
—মুকুট? যাক বাবা ফিরেছিস। আমি জিনা বলছি বুঝতে পেরেছিস তো?
—বুঝতে পারব না, এমন ধারণা তোর হল কী করে? কেন?
—কী জানি বাবা, এক পৃথিবী লোকের সঙ্গে তোর ওঠা-বসা, গলা গুলিয়ে যাওয়া কোনও ব্যাপারই না।
—লোক যতই এক পৃথিবী হোক, ছোটবেলার বন্ধুর গলা একটাই হয়। যাক, কেমন আছিস?
—ভাল। শোন আমার দুপুরবেলা একদম সময় কাটে না। তুই কীসব সোশ্যাল ওয়ার্কটোয়ার্ক করিস, আমাকে একটু কাজে লাগা না।
—তোকে? সোশ্যাল ওয়ার্ক?
—কেন রে? আমি কি খুব আনসোশ্যাল, না কি অ্যানটিসোশ্যাল?
হাসির শব্দ শোনা গেল—তুই একদম একরকম আছিস।
—দু’রকম হবার চান্স আর পেলাম কই?
—জিনা তুই তো অনেক আগেই স্কুলে-কলেজে চেষ্টা করতে পারতিস!
—তোকে কি খুব বিপদে ফেললুম?
—মানে?
—যা আগে হয়ে গেছে, হতে পারত, সেসব নিয়ে কে ভাবে রে মুকুট? করিনি, করার ইচ্ছে হয়নি। এখনও করতে চাইব না। আমি একটু অন্য ধরনের কিছু চাইছি। পারিস যদি তো দেখ, তাড়া কিছু নেই।
—জিনা ফোনটা রেখে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে বাজল ফোনটা। মুকুট।
—কী রে? কী হয়েছে?
—কই? কিছু হয়নি তো!
—রাগ করলি কেন শুধু শুধু?
—অনুরাগের ভাগটা আমার দিক থেকে বোধহয় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। সব জায়গায়। জিনার চোখে জল আসছে। প্রাণপণে চাপল জল। গলায় আসতে দেওয়া হবে না। মুকুট বলল, কাল যাব। থাকবি তো?
—কোথায় আর যাব?
—ঠিক আছে। কাল কথা হবে।
ফোনটা রেখে দিলে মুকুট বারান্দায় এসে বসল। বৃষ্টি নেমেছে। ঝমঝম করে না হলেও ঝিরঝিরেও বলা যায় না। একটু একটু ছাট এসে গায়ে লাগছে। এইভাবে বৃষ্টি গায়ে লাগলে খুব আরাম লাগে। চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে রেখে বারান্দার গ্রিলে পাদুটো তুলে দিল সে। আজ মুকুট পৃথিবীর কাঁহা কাঁহা মুলুকে একলা একলা কাজ করছে। কত দায়িত্ব তার, কত গুরুত্ব। আর জিনা দুপুরে-কী-করবে-ভেবে-না-পাওয়া কর্মহীন অবলা। কিন্তু দমদমের যে স্কুলে পড়তে গিয়ে ওর সঙ্গে ভাব সেখানে ওদের ভূমিকা ঠিক উলটো ছিল। জিনা ঝকঝকে স্মার্ট করিৎকর্মা ক্লাস-মনিটর। আর মুকুট ভিন্ন স্কুল থেকে আসা ভ্যাবাচাকা একটা মোটাসোটা গোলগাপ্পা মেয়ে, যাকে সব্বাই মিলে উঠতে বসতে র্যাগিং করছে। বাবা তখন সবে কলকাতায় বদলি হয়েছেন। ওরা থাকে এয়ারপোর্টের কাছে। মুকুট ছিল ভীষণ লাজুক, নতুন স্কুলে তার একদম ছোট করে ছাঁটা চুল, ভালমানুষ ভালমানুষ গোল মুখ আর থতমত ভাব নিয়ে সবাই যত মজা পাচ্ছে, সে ততই গুটিয়ে যাচ্ছে। টিচাররা পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন এবং সে বলতে পারছে না। জিনা তার প্রতি যে কী শুভ দৃষ্টি দিল, ঈশ্বর জানেন। তার মধ্যস্থতায় পুরো ক্লাসের সঙ্গে মুকুটের সম্পর্ক সহজ হয়ে গেল।
জিনাদের সেই বিশাল বাড়ির কথা ভোলা যায় নাকি?
—বাবা এয়ারলাইনস-এ কাজ করেন? ও মা। ও দিদি দেখো জিনুর বন্ধু এসেছে-এ। এইটুকু বয়সেই এগারোবার প্লেনে চড়েছে-এ। জিনার এক কাকিমা চেঁচিয়ে ঘোষণা করলেন—আমি একবারও চড়িনি—তারপরেই তাঁর খেদোক্তি। সঙ্গে সঙ্গে লুচি রাবড়ি আলুভাজা এসে গেল। জিনার যেসব দিদি দাদা ভাইরা বাড়ি ছিল, সব্বাই ভাব করে গেল। মুকুট-জিনার এই জুটি গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত অটুট ছিল। তার পরেই দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেল। জিনা রয়ে গেল—আশুতোষ বিল্ডিং-এ, মুকুট চলে গেল রাজাবাজার। তখনও যোগাযোগ ছিল, কিন্তু মুকুট ক্রমশই জড়িয়ে পড়ছিল তার কাজে। চলে গেল প্রথমেই থাইল্যান্ড। সেখান থেকে মালয়েশিয়া নরওয়ে কত দ্রুত কত কী শিখল। তারপর গেল স্টেটস। তার মামা গ্যারান্টর ছিলেন, আরও সুবিধে। মাঝখানে লন্ডনে কনফারেন্সে যোগ দিয়েছে। স্টকহোলমে গেছে। সত্যি সত্যিই বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছে সে। জিনার বিয়ের সময়ে সে ছিল না। জিনা ফট করে বিয়ে বসে যাওয়ায় সে একটু অবাকই হয়েছিল। এমন নয় যে নিজে প্রেমট্রেম করে আহ্লাদে গলে গিয়ে জিনা বিয়েটা করছে। ঠিক এইরকম ব্যাপারটা মুকুটের বাড়িতে কেউ ভাবতে পারে না। গলদটা সম্ভবত জিনাদের বাড়ির মনোভাবে, পরিবেশে। ঋত্বিকের সেই ‘পরিবেশ’।
অনেককাল পরে কালবৈশাখীর মেঘ ঝড়বৃষ্টির মাঝখানে জিনাকে দেখল সে। চেহারায় খুব একটা বদল হয়নি। চোখা ভাবটা একটু ভোঁতা হয়ে গেছে। মোটা না হলেও একটু ভরা ভরা। খুব খাওয়াল, অনেক হাসল, ফাজলামি করল। কিন্তু কেন যেন মুকুটের ওর বাড়ির পরিবেশ ভাল লাগেনি। এমনিতেই উত্তর কলকাতার পুরনো বড় বড় বাড়িগুলোর মধ্যে কেমন একটা প্রাচীনতা গুমোট বেঁধে থাকে। তার মধ্যে অবশ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঘরের মধ্যে ঘোরানো সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। খুব কায়দা। জিনিসপত্র অনেক। কিন্তু তার মনে হল এই জিনিসগুলোই যেন এখানে মানুষদের ব্যবহার করে। জিনাকে ব্যবহার করে। এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না।
জিনার বরের সঙ্গে দেখা হয়নি। ছবি দেখল। বেশ নবকুমার নবকুমার চেহারা। মাংসল মুখ, চকচকে চুল। জিনার জা বললেন জিনাকে চক্ষে হারায় নাকি! ছ বছর বিয়ে হয়ে গেছে এখন জিনার একটা বাচ্চা হওয়ার কথা। প্রথম দিনেই এসব প্রশ্ন তো করা যায় না! যতই বন্ধু হোক! কিন্তু প্রশ্নটা তার মনে উঠেছে। দম্পতির উভয়েই চাকরি করলে, বাচ্চার জন্মটা অনেকেই পিছিয়ে দেয়। জিনার তো সেরকম কারণ নেই। এবং আজ যেভাবে ও কাজকর্ম চাইছে, দুপুর না কাটার কথা জানাচ্ছে, তাতে মুকুট প্রায় নিঃসন্দেহ বাচ্চা নিয়ে একটা কোনও সংকট এসেছে জিনার জীবনে।
তার কাজকর্ম নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে মুকুট ভাসা ভাসা উত্তর দিয়ে থাকে। তার কারণ সে দেখেছে এই সোশ্যাল ওয়ার্ক ব্যাপারটা এখানে বেশির ভাগ লোকই বোঝে না। অনেকে মনে করে এটা ভ্যারেন্ডা ভাজা, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো গোছের একটা ব্যাপার। অনেকে আবার ভাবে এটা একটা মহান কাজ। প্রচুর আত্মত্যাগ, স্বার্থত্যাগ আছে এর মধ্যে, আর বাকিরা ভাবে এটা একটা চালাকি। সোশ্যাল সার্ভিসের আড়ালে আবডালে অনেক কুকর্ম হচ্ছে, মুখোশের আড়ালে অনাচার। সবগুলোই হয়তো আংশিক সত্য, কিন্তু কোনওটাই যে পুরো সত্য নয়, এটা লোককে বোঝানো শক্ত। সোশ্যাল ওয়ার্ক যে রীতিমতো একটা উপার্জনের রাস্তা আজকাল, পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে উপযুক্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মীদের দিয়ে কাজটা চলে, এবং সেখানে আবেগতাড়িত নভেলি ব্যাপারস্যাপারের কোনও জায়গা যে নেই, সোশ্যাল ওয়ার্ক করা মানেই যে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী হয়ে যাওয়ার দরকার হয় না—এসব আমজনতাকে বোঝানো শক্ত। তার অনেক আত্মীয়ই সভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে থাকেন—বন্যাত্রাণে যাস? ভয় করে না? আমেরিকার জায়গায় জায়গায় তো ফ্ল্যাশ-ফ্ল্যাড হয় বলে শুনেছি। ভয়াবহ টর্নেডো হয় পশ্চিমে। বাপরে সেখানে যেতে হয় তো! এরা ভাবে সোশ্যাল সার্ভিস মানেই প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটলেই সেখানে ছুটে যাওয়া। যায়নি শুনে আবার অনেকের মুখে শ্লেষের হাসি খেলে যায়। ভাবটা—দিব্যি গা বাঁচিয়ে চলছ বাবা!
এর পরে নিজের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে কথা? ওরে বাবা! তা হলে আর দেখতে হবে না। তার অত আলোকপ্রাপ্ত বাবা মা? তাঁরাই কি খুব খুশি! ঋত্বিক বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করছে শুনে দুজনেই নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছে। —বুঝলি মুকু। তুইও আস্তে আস্তে ঋত্বিকের প্রজেক্টটাতে চলে যা। এটা অফ করে দে।
—কেন বাবা?
—না, বাবা ঢোঁক গেলে, ঋত্বিককে তো তোর সাহায্য করা দরকার।
—সে তো করছিই। এর চেয়ে বেশি সাহায্য ওর লাগবে না, ব্যাস। আমার কাজটা আলাদা, আলাদাই থাকবে।
মা বলবে, তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি। কেন, দুজনে মিলে একটা কী সুন্দর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবি, এটাই তো ভাল।
মুকুট হেসে ফেলে। বলে—এটাও ভাল। ওটাও ভাল মা, বুঝলে তো? কিন্তু সবার চাইতে ভাল নিজের কাজ আর নিজের সুখ।
এখন জিনা যে সোশ্যাল ওয়ার্ক করতে চাইছে সে ওই আত্মত্যাগের, সন্ন্যাসীর স্পেশ্যাল ওয়ার্ক নাকি স্রেফ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর সোশ্যাল ওয়ার্ক? সেটাই কথা।