কালবৈশাখ
এরকম বিদঘুটে অন্ধকার জায়গা সে আগে কখনও দেখেনি। এটা কি তারই বাড়ি? তা হলে কি সে ঘুমিয়ে থাকাকালীন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেছে? আজকাল তো সেভাবে বিদ্যুৎ যায় না! যায়, সাতগেছেয় তার বাপের বাড়িতে যায় খুবই। অনেক সময়ে ভোল্টেজ খুব কমে থাকে।…কোথা থেকে একটা মৃদু আওয়াজ আসছে না? খট খট খটাখট খট খট। খট খট খটাখট খট খট! কে যেন অবিশ্রান্ত কড়া নেড়ে যাচ্ছে। জোরে নয়, আস্তে, খুব ধৈর্যে কিন্তু খুব গোপনে। এত গোপন যে প্রায় নৈঃশব্দ্যের কাছাকাছি, ইশারা, শুধু ইশারা আছে এই মৃদু কড়া নাড়ায়। যেন সবাইকে জাগাতে চায় না। সবাই ঘুমিয়ে থাক। একঘেঁয়ে আওয়াজের ঘুমপাড়ানিতে আরও গভীর হোক ঘুম। শুধু একজন, বিশেষ একজন, যার দায়িত্ব বেশি, যার কর্তব্যের কোনও মাপজোক নেই, সে এসে চুপচাপ দরজাটা খুলে দিক। দরজার ওদিকে কে? চোর নয়, অথচ চোরের মতো, চেনা অথচ চেনার মতো নয়! ভেতর থেকে একটা দুর্বার কাঁপুনি আসছে। শীত করে জ্বর আসছে যেন। জিভ শুকিয়ে কাঠ। জল, একটু জল দাও কেউ। চতুর্দিকে বাঘের গায়ের দুঃসহ গন্ধ। বুনো, বোঁটকা। এবার সে বুঝতে পারে ধূর্ত মানুষখেকোটা অনেকক্ষণ তার পিছু নিয়েছে। গুঁড়ি মেরে মেরে আসছে তাকে লক্ষ্য করে। বাঘের বাড়ি তো জঙ্গলে! এটা কি তা হলে জঙ্গল? না তো! অন্ধকারের মধ্যে কবরখানার ফলকের মতো ঘরবাড়ি সব আবছা হয়ে ভেসে আছে যেন! লোডশেডিং-এর ফাঁকেই কি বাঘটা লোকালয়ে চলে এসেছে? জনবহুল শহরের অলিগলি দিয়ে, লোকজন ট্রাম, বাস, রিকশা, ঠ্যালাগাড়ির পাশ কাটিয়ে ভয়াবহ দুলকি চালে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে বাঘটা। চোখের হাড় হিম-করা সবুজ আলো যেন জাহাজের সার্চলাইট, ঘুরছে চুনবালি খসা পাঁজরাসার বাড়িগুলোর গায়ে। হাত-পা সব কোলের মধ্যে টেনে নেয় সে, ছোট্ট একটা পুঁটলি হয়ে যায়, মালভর্তি ট্রাকের পাশে মাথা গুঁজে কুঁকড়ে থাকে, আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে আরও অন্ধকার কোণে, কানাচে। গলি পায়, পাথর পাতা সরু নোংরা, ঢিপি-ঢিপি আবর্জনা মাড়িয়ে মাড়িয়ে, ঘেন্নায় ভয়ে দিশেহারার মতো সে ছুটে চলে দু-পাশের পুরনো বাড়ির রোয়াকে রোয়াকে ধাক্কা খেতে খেতে। হুড়ুম করে একটা শব্দ। হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ছে বাঘটা। লাফিয়ে, লাফিয়ে, লাফিয়ে পড়ছে।
চিৎকার করে দিবানিদ্রা ভেঙে উঠে বসল সে। গোল গোল না-বোঝা চোখে বোবা আতঙ্ক। নড়ছে দরজা-জানলা, ঠাস করে জানলার পাট পড়ল কোথাও, সমস্ত ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। গড় গড় করে মেঘের ডাক। তীব্র বিদ্যুতের ঝলক বন্ধ খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঘরে দপ করে সাদা আলোর মশাল জ্বালিয়ে নিবে গেল। বাঘ নয়। ভূমিকম্প নয়, কালবৈশাখী। এ বছরের প্রথম। কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যেও দূর থেকে নির্ভুল ভেসে আসছে ধৈর্যশীল খট খট খটাখট খট খট খট খট…
সে বুঝতে পারছে অন্য ঘরগুলোয় কোথাও জানলা খুলে গেছে ঝড়ের দাপটে। বন্ধ করা দরকার। কিন্তু হাত-পাগুলো অবশ হয়ে আছে। এখনও পুরোপুরি না-ভাঙা ঘোরে, ভয়ে। নামতে গেলে যদি খাটের তলা থেকে দুটো লোমশ থাবা… খাট থেকে নিরাপদ দূরত্বে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল। ভীষণ লেগেছে। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে কোনওক্রমে খিল খুলে সে দালানের অপর প্রান্তের দরজাটায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। ‘জিনা! জিনা! জিনা!’ শেষের দিকে গলার স্বর আর্ত কান্নার মতো শোনাচ্ছিল।
খুলেছে। খুলেছে। ওই তো জিনা! খোলা দরজার ওপারে দীর্ঘ কাফতান, অভয়দাত্রী বরদা।
—এ কী! তুমি যে পড়ে যাচ্ছ? কী হয়েছে দিদিভাই?
দরজাটা কোনওমতে ধরে যেন ডুবন্ত মানুষের মতো হাঁকপাক করছে মল্লিকা।
—ভরদুপুরে কে দরজা নাড়ছে…
—এ তো ঝড়ের আওয়াজ…
—না… না… ওই শোন… ওই আবার…
—আমি দেখছি। তুমি ভেতরে এসে বসো তো… তারপরে সে বলল… দরজা নাড়লেই বা কী?
কী, তা জিনা বুঝবে না। জিনা কেন, কেউ বুঝবে না। কেউ না কেউ না। এতক্ষণ পরে আশ্বাস পেয়ে মল্লিকার চোখ দিয়ে গরম জল নামতে থাকে। ভয়ের অশ্রু। প্রায় ফুটছে এত গরম।
সত্যিই দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কেউ। ফুটো আছে একটা। কিন্তু ওপারে ঠিক জায়গায় না দাঁড়ালে কিচ্ছু দেখা যায় না। খুলতেই দমাস করে হাট হয়ে গেল পাল্লাদুটো। কোনওক্রমে দু হাত দিয়ে সেগুলো সামলাতে সামলাতে জিনা দেখল রোগামতো একটি লোক, কাঁধে ঝুলি, —ওহ্ ক্যুরিয়ার সার্ভিস। একটা কার্ড।
উলটো দিকে স্কটিশচার্চ কলেজ আর হেদুয়ার দক্ষিণে আকাশ নীলচে কালো, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ক্রমাগত নীচ থেকে ওপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। গরম হাওয়ার স্তর ভেদ করে একঝলক কনকনে এস্কিমো হাওয়া বরফজলের ঝাপটায় মুখের ওপর গলার ওপর আছড়ে পড়ল। নিখিল দে সরকারের নামে কার্ডটা। জনৈক ‘ল’ পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক নববর্ষে, ক্রিসমাসে আসে। লোকটি দরজা ভুল করেছে। ঠিক দুপুরবেলা লোকের বাড়ির দরজা ঠেঙিয়ে এভাবে কার্ড পাঠাবার মানেটা কী? সবাই জানে এসময়ে ঘুমন্ত গিন্নিবান্নি আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ থাকে না! লোকে দরজা খুলবেই বা কী ভরসায়? এইসব ক্যুরিয়ারদের কী নিয়ম সে জানে না। কিন্তু এরা তো সন্ধেবেলাতেও আসতে পারে! এসেও থাকে! বলতে গিয়ে দেখল লোকটি অনেক দূরে চলে গেছে। ঝড়ের মুখে একটা কুটোর মতো উড়ে গেছে বোধহয়।
দোতলায় উঠতে উঠতে বিস্ময়টা আবার ফিরে এল। ঠিক আছে। দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। তো ভয়ের কী আছে? এত ভয়? আঁচল লুটোচ্ছে, নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে, ঠোঁট শুকনো, চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেছে! এ কী!
—ক্যুরিয়ার, নিখিল দে সরকারের চিঠি। কার্ড একটা। ওর বন্ধু মিঃ ল’-এর কার্ড। দিদিভাই। স্বপ্ন দেখেছিলে, না?
মল্লিকা দরজার কাঠে ঠেস দিয়ে দু হাত পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই দিশেহারা আতঙ্কের ভাবটা এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু মুখটা সাদা হয়ে আছে। কেমন অবসন্ন।
—বেল তো ছিল। দরজা ঠক ঠক করছিল যে!—কোনওক্রমে শুকনো গলায় বলল মল্লিকা। অসংলগ্ন।
সত্যি তো! বেল না বাজিয়ে লোকটা ঠক ঠক করছিল কেন! আসলে বেলটা একটু ওপরে। ছোট ছেলেরা বাজিয়ে বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দেয়। সেই উৎপাত থেকে বাঁচতেই ওপরে লাগানো হয়েছে বেলটা। দেখতে পায়নি বোধহয়। সেই কথাই বলল জিনা।
—চলো তো। নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছিলে। চোরের না ডাকাতের?
চমকে উঠল মল্লিকা। জিনা ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে এসে বলল —খাও তো জলটা। সে মল্লিকার আঁচল গুছিয়ে তুলে দিল।
—তুমি ঝড় ভয় পাও দিদিভাই, না? অনেকে পায়। আমার ভাই ছোটবেলায় খাটের তলায় ঢুকে যেত দু কানে আঙুল দিয়ে। আমার কিন্তু ঝড় দুর্ধর্ষ লাগে। চলো প্লিজ। ছাতে চলো, তোমার ভয় আমি ভেঙে দেব।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই হিড়হিড় করে মল্লিকাকে টানতে থাকে সে।
মল্লিকা বলল, দাঁড়া, কোথায় জানলা পড়ছে, বন্ধ করে আসি।
—পারবে? না আমি যাব? ঘরে যদি ডাকাত লুকিয়ে থাকে?
জিনা হাসছে। শিউরে উঠল মল্লিকা, একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, তুই যা, আমি আসছি।
—ঠিক তো? আসবে তো? না এলে ভাল হবে না কিন্তু।
জিনা ভয়ের কী জানবে? জিনার চারপাশে কত অভিভাবক, কত রক্ষক, কত আলো, কত সঙ্গীসাথী! কত রকম সম্পর্ক থেকে জিনা তার অজস্র প্রাণশক্তি সঞ্চয় করেছে। টগবগ করছে যেন সব সময়ে। বিদ্যুৎহীন গ্রামাঞ্চলের ঝোপেঝাড়ে, গোয়ালে, উঠোনে, ঘরের কোণে, তক্তপোশের তলায় কীরকম ঝুঁঝকো আঁধার থাকে সে কি জানে? জানে মা না-থাকার ভয়, বাবা থেকেও না-থাকার ভয়, একমাত্র দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়? আরও কত, কত!
ইস, ঝুম্পা-মাম্পির ঘরখানা একেবারে হুলুট-থুলুট হয়ে গেছে। বালিশ থেকে ঢাকা উড়ে গেছে, টেবিলের ওপরে কাগজপত্র লুটোপুটি খাচ্ছে, ধুলোয় ঘরখানা বোঝাই। জানলাটা বোধহয় ভাল করে বন্ধ করে যায়নি ওরা। ছিটকিনিটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। ভাল করে জানলা বন্ধ করে ঝাঁটা আনতে যাচ্ছিল। নাঃ, এসব পরে হবে, এখন ছাতে না গেলে জিনা এক্ষুনি হুড়মুড় করে নেমে আসবে।
—কই, দিদিভাই? দু-তিন সিঁড়ি টপকে টপকে ঠিক নেমে আসছে।
—যাচ্ছি—
দুড়দাড় করে আবার উঠে গেল জিনা। পেছনে মল্লিকা। ছাতে দমকা হাওয়া। জিনা এখন আর ডাফ স্ট্রিটের বাড়ির ছোটবউ নেই। হয়ে গেছে আপাদমস্তক দমদম মতিঝিলের জিনপরি। ওর জ্যাঠামশাই ওকে ‘জিনপরি’ বলে ডাকেন। বোনেদের সঙ্গে পড়িমরি করে সে এখন ছাতে উঠছে। প্রকাশিত উদ্দেশ্য কাপড় তোলা, আসল উদ্দেশ্য ঝড়বৃষ্টিতে দাপাদাপি। সবাই মিলে হাসতে হাসতে ছুটোছুটি হবে এখন। এ ওর পেছনে। ও এর পেছনে। মেজজেঠুর ধুতিটা বাগানো গেল তো ঠাকুমার থান ওই উড়ে যায়। বেজায় মোটা সেজজেঠুর ফতুয়া হাত টান-টান করে শুকোতে দেওয়া, সেটা প্রবল বেগে দুলছে। যেন সেজজেঠু নিজেই ফতুয়ার মধ্যে গলে বসে আছে। ঝড়ে ফতুয়াও দুলছে। সেজজেঠুও দুলছে। এতোল বেতোল। কে কাকে বলল কথাটা। বাস, হাসির রোল উঠল। ছোট ছোট শার্ট, প্যান্ট, ফ্রকগুলো ক্লিপ খোলামাত্র লাট খেয়ে উড়ে পড়ছে পাঁচিলে। ওমা। সীতা যে লক্ষ্মণের গণ্ডি পেরিয়ে গেল— সেজদির চিৎকার। একটা প্যান্ট উড়ে চলে গেছে। ক্ষুরধার বৃষ্টিতে এবার সব ভিজে জাব। কাপড়ও, কাপড় তুলুনিরাও। যত বৃষ্টি তত হাসি। যত হাওয়া তত নাচ।
—ও মা গো! কাপড় তুলছে না আরও কিছু, ও বড়দি দেখে যাও, কাপড় তোলার নাম করে মেয়েগুলো কাকভেজা ভিজছে। কাপড়চোপড় সব ভিজে গোবো-ওর। কাকিমার তারস্বর নালিশ ডুবিয়ে দিয়ে আকাশচেরা বিদ্যুৎ ঝলসে বাজ পড়ল।
আকাশে গড়গড় করে রোলার গড়ানো শুরু হয়ে গেল। গম্ভীর আওয়াজে ভরে যাচ্ছে চরাচর। ছাতের পাঁচিলের নিচু ধাপে পা রেখে সে অবলীলায় শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে দেয়, তারপর মুখটাকে ওপরের দিকে হাসি হাসি করে তুলে ধরে, ঝড় খায়।
‘বেড়া ভাঙার মাতন নামে এ উদ্দাম উল্লাসে/আসে আসে’—গাইতে গাইতে লাফ দিয়ে নামে সে, ধাপ থেকে ছাদে।
—দিদি ভা-ই—দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে এরোপ্লেনের মতো সে ছুটে যায় ছাতের এক দিক থেকে আর এক দিকে।
—এবার জাগ রে হতাশ আয় রে
এবার জাগ রে হতাশ আয় রে ছুটে
অবসাদের বাঁধন টুটে
বুঝি এল এল তোমার পথের সাথী বিপুল অট্টহাসে
আসে আ-সে। গাইতে গাইতে সে ছুটে এসে দু হাত দিয়ে মল্লিকার গলা জড়িয়ে ধরল।
—দুর্ধর্ষ, না?
—কোনটা? —এতক্ষণে মল্লিকার মুখে কথা ফুটেছে!
—এই স-ব। হাত দিয়ে সমস্তটাকে সাপটে নিয়ে জিনা বলল এই ঝড়, গান, দুপুর, গরম, আমি, তুমি, তোমার স্বপ্ন, ভয়, সব… স…ব!
দূরের দিকে তাকিয়ে মল্লিকা দেখল দুটো নারকোল গাছ দক্ষিণ থেকে উত্তরে বেঁকছে, বেঁকছে, বেঁকছে। একেবারে এক গতিতে, পুরো একটা ঝাঁটা হয়ে গেছে। আবার উঠল, সোজা হল। ঝাঁকি দিয়ে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবার। ধুলোর ঘূর্ণি উঠছে। কুটোকাঠি, পাতাপুতি, সব পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরছে, সেই ঘুরনের কেন্দ্রে একটা মেয়ে। সে? জিনা? না ঝুম্পা? না মাম্পি? হতে পারে সবাই। কিন্তু তার এখন মনে পড়ছে বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ। সন্ধে করে বৃষ্টি থেমেছে। এবার হু-হু করে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে মেঘের দল, তলা থেকে বেরিয়ে পড়ছে, তকতকে করে মোছা নীল আকাশ। সন্ধে, তাই রংটা একটু গাঢ়, কালো মেশানো নীল, তারা ফুটে উঠছে, —যাক, এক পশলা হয়ে গরমটা একটু কমল…
রাস্তা দিয়ে পিছল বাঁচিয়ে পা টিপে টিপে চলতে চলতে কেউ বলল।
—এই শুরু হলও বলতে পার। এইবার চাল উড়বে, ঝড়ের এমন দাপট হলে আমার রান্নাঘরের দেওয়ালখানা নিয্যস পড়বে। তোমার আর কী! পাকা করে নিয়েচ।
—গরমটার কথা বলো, গরমটার কথা বলো… ঘামাচি হয়ে হয়ে, ঘামাচি হয়ে হয়ে…
বাইরে শুতেও আজকাল সাহস হয় না।
—শুনছ-ও, কে আছিস, মল্লি-ই ছাতাটা ধর দেখি।
কাকা আগড় খুলে ঢুকছেন। পা কাদায় কাদা। সে জল ঢেলে দিচ্ছে প্লাস্টিকের লাল মগে করে।
কাকিমা বেরিয়ে এল। হাতে শাঁখ। একটা দাঁত উঁচু। ওপরের দিকে মুখ করে শাঁখে ফুঁ দিল, তারপর বলল, বুঝলে? মল্লির হিল্লে হয়ে গেল।
—মল্লির? হিল্লে? কীরকম?
—ও বাড়ির আরতিদি এসেছিলেন আজ। গলা থেকে হার খুলে মল্লিকে পরিয়ে দিয়ে গেছেন।
—বল কী? তা ব্যাপারখানা…
—আরে আরতিদির বড় ছেলেটি তো চার্টার পাস করে চাকরিতে ঢুকেছে আর বছর। চাকরি পাকা হল। বুঝলে না? মল্লিকে বুক করে গেলেন।
—বলেছেন কিছু?
—বলেনি। বলবে, দুদিন যেতে দাও।
—তা না বলবার কারণটা কী?
—কে জানে! ঘোড়েল মহিলা। হয়তো আর পাঁচটা দেখছে।
—অন্য কোথাও পছন্দ হলে হারের কী হবে?
—কী আবার হবে? একখানা চিলতে সোনার হার আর ওদের গায়ে লাগে না।
মল্লি সরে যাচ্ছে ছায়া থেকে অন্ধকারের দিকে, অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার। নাকি আলো! কোনটা অন্ধকার কোনটা আলো সে জানে না। কলেজের বাইরে একটা মজা পুকুর। সারের লেকচার শুনতে শুনতে ওই মজা পুকুরের দিকে চোখ চলে যায়। একদলা কচুরিপানার ওপর একটা মাছরাঙা বসেই উড়ে গেল। কোঁচড়ে করে গুগলি তুলছে একটি বউ। একটা ছাগলি ভারী পালান নিয়ে পুকুরধারের আগাছা খেয়ে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনাটা তত ভাল লাগে না মল্লিকার। কলেজ ভাল লাগে। অন্য মেয়েদের সঙ্গে দেখাশোনা, কথাবার্তা। সার, ম্যাডাম। শুধুই তো সবসময়ে সংবিধান আর মার্কসীয় তত্ত্ব পড়াচ্ছেন না, অন্য গল্পও করছেন। কেউ কেউ বেশ মজার গল্প করতে পারেন। সারেদের সব্বাইকার মল্লিকার ওপর খুব ঝোঁক। যে সার গোমড়ামুখো, অন্য দিকে চেয়ে পড়ান সেই দীপ্তেন সারেরও। ওঁরা মল্লিকাকে বিদ্যাদিগ্গজ বিদ্যাধরী না করেই ছাড়বেন না।
—কালকে কী বলছিলাম? পয়েন্টসগুলো মল্লিকা বলো—
দুর বাবা, বলছিলেন তো আপনি, আমি কী করে জানব? মল্লিকা ভাবে।
অর্ধেক মনোযোগ দিয়ে এই মজা পুকুর, কচুরিপানা, গেঁড়িগুগলি, সংবিধান, সন্ধে হতে না-হতেই ওই আঁধার, এ আর কতদিন? হয়তো আরতিদি, ওপাড়ার আরতিদিই ভাল। ওই মাছরাঙাটার মতো তাকে ঠোঁটে করে উড়ে যাবেন। কোথায় যাবেন, সে তাঁর খাদ্য হবে না খেলা হবে এ প্রশ্ন বোধহয় অবান্তর। মায়েরা যে কেন মারা যান! বেশ তো ছিল তারা! হেলথ্ সেন্টারের কম্পাউন্ডার ছিলেন বাবা। তো অর্ধেক চিকিৎসা সেই আধা শহরে বাবাই করতেন। কত কল আসত। তারা বাবাকে ডাক্তার বলেই জানত। সবাই ডাক্তারবাবুই বলত। মাকে বলত ডাক্তার বউদি। স্বয়ং ডাক্তার বউদিরই কোনও চিকিৎসা হল না। একটি বারো, একটি আট, দুই মেয়েকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন অসহায় ডাক্তারবাবু। বছর চার-পাঁচ কোনওরকমে কাটালেন, তারপর নিজেও এসে গ্রামে বসে গেলেন। এখানেও রোগী হয়। চিকিৎসা করেন, কিন্তু কেমন আলাভোলা মতো হয়ে গেছেন। কাকা-কাকিমা বলে উদোমাদা।
কিন্তু এ কেমন আচরণ? সে জানল না, বুঝল না, দেখল না, মতামত দিল না, কেউ জিজ্ঞেসও করল না। একজন গিন্নিবান্নি মানুষ তাঁর ইচ্ছেমতো তাকে ‘বুক’ করে গেলেন? সত্যি বলছি জিনা ভেতর থেকে হু হু করে কান্না আসছিল। কিন্তু যার কান্না বোঝবার কেউ থাকে না, তার চোখের জল চোখেই শুকোয়।
—দিদিভাই। তোমার কারও সঙ্গে প্রেম হয়নি?
—ভ্যাট!
—অনেস্টলি দিদিভাই, যদি বল হয়নি, আমি এক কড়াও বিশ্বাস করব না। সব মেয়ের চোদ্দো-পনেরো থেকে প্রেম হতে শুরু করে, কেমন কিনা?
—তুই-ই বল আমি শুনি।
—শুনলে হবে না বলতে হবে। আচ্ছা, আমি কি দাদাকে বলে দিতে যাচ্ছি?
—বলে দিলে কী হবে? সে কি আমার হাতে মাথা কেটে নেবে?
—তবে? তবে বলবে না কেন?
—ঠিক আছে, বলব। তুই আগে বল, চোদ্দো-পনেরো কী সব বলছিলি?
—খুব মজা, না? আমারটা জেনে নেবে, তারপর নিজের বেলায় বলবে গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারিসনি। তোমাকে আমি চিনি না? হেভি চালাক!
—সত্যি সত্যি তিন সত্যি করছি, বলব।
—না, আমি বলছিলাম কি প্রথমে ভেতরে একটা প্রেম প্রেম ভাব হয়। নিজেকে নিয়ে নিজেই গদগদ। এই ধর পাড়ার দাদা, বন্ধুর দাদা, নিজের কাজিন-টাজিন, মল্লিকা মিটিমিটি হাসে— তারপর?
—তারপর ধর ফিলমের হিরো, গল্প-উপন্যাসের হিরো, বন্ধুর দাদাটা কনটিনিউ করতে থাকে, যদি না তার মাইনাস পয়েন্টগুলো একেবারে জ্বলজ্বলে হয়ে বেরিয়ে পড়ে।
—আর কাজিন?
—কাজিন আউট, ওরে ব্বাবা, অনেকে নিষিদ্ধের থ্রিল পেতে ঝুলে পড়ে বটে দিদিভাই, কিন্তু মোস্ট আনরিওয়ার্ডি।
—কেন?
—কেন আবার কী? নতুন তো কিছু নেই! পিসি-মাসি পিসে-মেসো এদের তো তুমি ইনসাইড আউট চেনো। নতুন বোতলে পুরাতন? কবি বলেছেন না? পুরানো জানিয়া চেয়ো না, চেয়ো না… আধেক আঁখির কোণে! জিনার গলায় উচ্ছ্বসিত হাসি। প্রেম নতুন কিছু চায়, বুঝলে দিদিভাই! দেশভ্রমণে যাওয়ার মতো! কিংবা একেবারে ভিন্নদেশে সেট্ল করার মতো। তবে সবচেয়ে কমন হল কলেজ য়ুনিভার্সিটি প্রেম। ব্যাচমেটকে আজকাল তা বলে হাফ পার্সেন্টও পাত্তা দেয় না, স্পোর্টস বা টেস্ট-ফেস্ট-এ এ প্লাস পেলে কটা দিন একটু স্বপ্নে আসা-যাওয়া করে বাস, ফুলস্টপ। এরা কতটুকু করে জান? একটা প্রেমের উপক্রমণিকা তৈরি করে দেয়। ঠিকঠাক একটা মেজাজ। তবে যদি হায়ার ক্লাসের হয় তো একটা বীভৎস ঝুলোঝুলি হয়। আচ্ছা এবার চালাকি ছেড়ে তোমার কেস বলো দিকি! ইয়ার্কি!
—আরে আমি গাঁয়ের মেয়ে। আমার আবার প্রেম কী?
—তবে রে? গাঁয়ে আর পাড়ার দাদা, বন্ধুর দাদা থাকে না? গাঁয়ের মেয়ের আর কাজিন নেই?
—কমন ক্যানডিডেট সব তো বলেই দিলি। ওইরকমই আমারও ঘটেছিল নিশ্চয়। কোনওটাই তেমন স্পষ্ট নয়। ওই তোর উপক্রমণিকাই।
—একদম বাজে কথা বলবে না দিদিভাই, তুমি হলে গিয়ে টিপিক্যাল ম্যান’স উয়োম্যান।
—মানে? তুই বাগে পেয়ে গুরুজনকে যা-তা বলছিস?
—এই তো! ‘গুরুজন’ তাসটা যে তুমি বেগতিক বুঝলেই খেলবে সেটা তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। তা খারাপ তো কিছু বলিনি দিদিভাই। তোমাকে বিধাতা খুব অ্যাট্রাকটিভ করে গড়েছেন। বাস।
—কেন? তুই অ্যাট্রাকটিভ নোস। যেখানে যাস, মুন্ডু তো সব তোর দিকে ঘুরে যায়।
—সত্যি সত্যি যায় কি না জানি না। তবে যতই সাজপোশাক করি, তোমার কাছে আমি কিছুই না। মানে ওই চার্ম-এর দিক থেকে। আমার হয়তো এক ফোঁটা ব্যক্তিত্ব, তোমার এক পুকুর চার্ম। —বুঝলে আর পুঙ্গবগুলো ব্যক্তিত্বফেক্তিত্ব দেখলে হেভি ঘাবড়ে যায়।
—একমাত্র নিখিলবিশ্ব দে সরকার ছাড়া।
দুজনে লুটোপুটি খেয়ে হাসে।
জিনার মতো সুখী জীবনের মেয়েকে বোঝানো শক্ত, কী কঠিন সংকট আর মনখারাপের মধ্যে তার কৈশোর কেটেছে। সেই দিগ্দিগন্ত অন্ধকার করা দিনগুলোতে… বাবা দিন দিন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছেন, খোঁজখবর পর্যন্ত নেন না মেয়েরা কোথায় আছে, কেমন আছে… কাকা-কাকিমার তাচ্ছিল্য বাবাকে এবং তাদের… দিদি ছিল আরও দুর্বল। ফাঁক পেলেই কাঁদত আর কথায় কথায় রেগে যেত, যত রাগ মল্লির ওপর। সেই সময়ে প্রেমট্রেমের বিলাসিতা যে একেবারে উদ্ভট চিন্তা ছাড়া আর কিছু না, তা কাউকে বোঝানো শক্ত। তবে কি অন্যদের নজর, অন্যদের কৌতূহল, ঘুরে ঘুরে কাছে আসা, বুড়োদের ছুঁকছুঁকুনি এসব বুঝতে পারেনি? কিন্তু সে তো প্রেম নয়! একমাত্র একটা ঘটনাই মনে আছে। অল্প বয়সি প্রোফেসর ছিলেন ইংরেজির। সলিল সেন। তিনিও ক্লাসে কারও দিকে চাইতেন না। দেয়ালের দিকে চেয়ে পড়াতেন। কিন্তু যখন-তখন শুধু মল্লিকার সঙ্গেই তাঁর চোখাচোখি হয়ে যেত। চোখের ভাষা শুধু। সলিল সেন কী একটা পড়াশোনার কাজ নিয়ে দিল্লি ইউনিভার্সিটি গেলেন। স্টাডি লিভ নিয়ে। একদিন কলেজের বেয়ারা এসে একটা মস্ত লেফাফা এনে দিল, বলল—সলিল সার দিয়ে গেলেন, দিদিমণি এর মধ্যে ইস্পেশ্যাল নোটস আছে। খুলে দেখে ওমা! গুচ্ছের সাদা কাগজ। তার মধ্যে একটায় বড় বড় করে লেখা—‘রিমেমবার মি।’ মানে কী এর? শুধু স্মৃতিতে আবছা ছবি হয়ে থাকতে চায়? না জ্বল-জ্বলন্ত হয়ে থাকতে চাইছে আবার ফিরে আসবে বলে! স্পষ্ট করে অপেক্ষা করার কথাও তো কিছু লেখেনি? এ কী রকমের কাপুরুষ, অপুরুষ ভালবাসা, যদি ভালবাসাই হয়? বিমানের মা যে হারছড়া দিয়ে তাকে ‘বুক’ করলেন সে মোটেই বুঝতে পারেনি। উনি বলেছিলেন—বা, বা, নরেনদার এমন মেয়ে? চমৎকার মেয়ে, গলা থেকে হারছড়া খুলে পরিয়ে দিলেন— এমন মেয়ের মুখ কি শুধু হাতে দেখতে আছে? কাকিমা চৌকাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বলছে— হিল্লে হয়ে গেল— কাকিমার সেই ঘাড় ফেরানোর ভঙ্গিটা, কানের তলায় গুঁড়ো চুল, একটা লাল পাথর চিকচিক করছে কানে— এখনও স্পষ্ট মনে আছে দৃশ্যটা।
কেন যে কান্না এসেছিল? হয়তো কান্নার মধ্যে ইংরেজির সার সলিল সেনও মিশে ছিলেন। কিন্তু আশা হয়ে নয়, বরং ক্রোধ হয়ে। আশাভঙ্গ হয়ে। মা-মরা, বাপের খোঁজ-না-নেওয়া একটা মেয়ে। তার আবার মতামত? এই তাচ্ছিল্যই আসলে তাকে অপমানের কান্না কাঁদিয়েছিল। আশ্চর্য, এখনও, এত দিনেও, বড় মেয়ে আঠারো পার হল, এখনও সেই অন্ধকার, অনিরাপদ, অপমানময় সন্ধ্যা তার অনুভূতিতে ফিরে ফিরে আসে। ফিরে আসে বিবাহোত্তর সেই বাড়ির দ্বিপ্রাহরিক নির্জনতাও। দুটি যুবক একটি তরুণী, এক প্রৌঢ় এক প্রৌঢ়া। সেই অস্বস্তি, অস্বাচ্ছন্দ্য, অসুবিধের কথা, আতঙ্কের কথা কাউকে না বলতে পারার অন্ধকার।
বৃষ্টিতে চুরচুর ভেজা হয়েছে। ভাগ্যিস মাম্পি বাড়ি নেই। থাকলে ভিজত। নির্ঘাত গ্ল্যান্ড ফুলত, জ্বর হত। পায়ের জলছাপ ফেলে ফেলে মল্লিকা কলঘরে গেল। বৃষ্টির জলের পর কলের জল গরম লাগে। কে জানে কেন, আজকের জলটা যথেষ্ট কনকনে। আরামে শিউরোচ্ছে গা। কেন যে দুপুরে ঘুমোতে গিয়েছিল। দুপুর-ঘুমেই এই বিশ্রী স্বপ্নগুলো আসে। বাঘ, চোর, মাঝে মাঝে ম্যমির স্বপ্ন আসে। একটা বিরাট দৈত্যের মতো লোক। মুখে মাথায় কোথাও কোনও চুল নেই। চোখদুটো কাচের মতো। চৌকো চোয়াল। বিরাট বিরাট থামের মতো পা ফেলে এগিয়ে আসছে। সে প্রাণপণে চিৎকার করছে কিন্তু আওয়াজ বেরোচ্ছে না। মাঠঘাট পেরিয়ে ছুটছে। কিন্তু দূরে যেতে পারছে না। এই লুটিয়ে পড়া আঁচল পায়ে বেধে বেধে যাচ্ছে।
—দিদিভাই দিদিভাই?
—আবার কী হল? —ভেতর থেকে সে সাড়া দিল।
—শিগগির বেরিয়ে এসো। আমার বন্ধু এসেছে। সেই মুকুট গো!
হঠাৎ যেন ভয়টা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে রাত শেষের বাদুড়ের মতো দূরে মিলিয়ে গেল। জিনার বন্ধু, মুকুট, বিদেশে থাকত, কাজ করে, একা একা, এসেছে। যেন বাইরের হাওয়া নিয়ে এসেছে। এই নির্জন দুপুরের ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা ভেঙে যাচ্ছে। দুপুরটা ভাল নয়, দুপুরটা অনিরাপদ, দুঃসহ, যত দুঃস্বপ্ন সে দুপুর-ঘুমেই দেখে। বিকেল হয়ে গেলে মেয়েরা ঘরে ফিরবে, শুধু তার ঘরে নয়, সব ঘরে। আর একটু পরে সন্ধে হবে, অফিস-ফেরত মানুষের ঢল নামবে মহানগরীর বুকে, এই বাড়ির অতীতভরা খাঁ খাঁ দুপুর তখন লেজ তুলে দে দৌড়। তাড়াহুড়ো করে সাবান মাখতে থাকে সে। কলঘর ভরে যায় ল্যাভেন্ডারের গন্ধে।